(বই#৯৮৬) [*মানুষকে রসূল করে পাঠানাের রহস্য :] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৮৬)
[*মানুষকে রসূল করে পাঠানাের রহস্য :]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৮
০৭-১০ নং আয়াত:-
২৫:৭
وَ قَالُوۡا مَالِ ہٰذَا الرَّسُوۡلِ یَاۡکُلُ الطَّعَامَ وَ یَمۡشِیۡ فِی الۡاَسۡوَاقِ ؕ لَوۡ لَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡہِ مَلَکٌ فَیَکُوۡنَ مَعَہٗ نَذِیۡرًا ۙ﴿۷﴾
তার বলে, “এ কেমন রসূল, যে খাবার খায় এবং হাটে বাজারে ঘুরে বেড়ায়? কেন তার কাছে কোন ফেরেশতা পাঠানো হয়নি, যে তার সাথে থাকতো এবং (অস্বীকারকারীদেরকে) ধমক দিতো?
২৫:৮
اَوۡ یُلۡقٰۤی اِلَیۡہِ کَنۡزٌ اَوۡ تَکُوۡنُ لَہٗ جَنَّۃٌ یَّاۡکُلُ مِنۡہَا ؕ وَ قَالَ الظّٰلِمُوۡنَ اِنۡ تَتَّبِعُوۡنَ اِلَّا رَجُلًا مَّسۡحُوۡرًا ﴿۸﴾
অথবা আর কিছু না হলেও তাঁর জন্য অন্তত কিছু ধন-সম্পদ অবতীর্ণ করা হতো অথবা তাঁর কাছে থাকতো অন্তত কোন বাগান, যা থেকে সে (নিশ্চিন্তে) রুজি সংগ্রহ করতো?” আর জালেমরা বলে, “তোমরা তো একজন যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছো।”
২৫:৯
اُنۡظُرۡ کَیۡفَ ضَرَبُوۡا لَکَ الۡاَمۡثَالَ فَضَلُّوۡا فَلَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ سَبِیۡلًا ﴿٪۹﴾
দেখো, কেমন সব উদ্ভট ধরনের যুক্তি তারা তোমার সামনে খাড়া করেছে, তারা এমন বিভ্রান্ত হয়েছে যে, কোন কাজের কথাই তাদের মাথায় আসছে না।
২৫:১০
تَبٰرَکَ الَّذِیۡۤ اِنۡ شَآءَ جَعَلَ لَکَ خَیۡرًا مِّنۡ ذٰلِکَ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ۙ وَ یَجۡعَلۡ لَّکَ قُصُوۡرًا ﴿۱۰﴾
কত প্রাচুর্যময় তিনি, যিনি ইচ্ছা করলে তোমাকে এ অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর বস্তু দান করতে পারেন — উদ্যানসমূহ; যার নিম্নদেশে নদীমালা প্রবাহিত এবং দিতে পারেন প্রাসাদসমূহ।

তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন:

*মানুষকে রসূল করে পাঠানাের রহস্য : রসূলুল্লাহ(স.) সম্পর্কে ওরা যা কিছু মনগড়া মিথ্যা ও বানোয়াট কথা বলছে, তার মানুষ হওয়া সম্পর্কেও যে সব জাহেলী কথাবার্তা বলছে এবং তার রেসালাত সম্পর্কে তারা যেসব মিথ্যা আরােপ করছে সেসব কিছু রদ করতে গিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের কথাগুলাের উদ্ধৃতি পেশ করছেন। ওরা বললাে, এ আবার কেমন রসূল! খানা-দানা খায়, বাজার-ঘাটে বেড়ায়… আল্লাহ তায়ালা রাসূল যদি বানাতে চেয়েছিলেন তাে এমন এতিম অনাথ ব্যক্তিকে কেন বানাবেন? তিনি কি রসূল বানানাের জন্যে আর মানুষ পাননি। তিনি চাইলে তাে তােমাকে, যে অবস্থায় তুমি আছাে, এর থেকে ভালাে অবস্থা দান করতে পারতেন, দিতে পারতেন এমন জান্নাত, যার নীচু দিয়ে ছোট ছােট নদী প্রবাহিত হয়, আর তােমার জন্যে বড়াে বড়ো বালাখানা বানিয়ে দিতেন। অর্থাৎ, কি হলাে এ রসূলের, খানা-দানা খায়, বাজার ঘাটে চলে ফিরে বেড়ায়? তার কি এমন কেউ নেই যে তার মানবীয় প্রয়ােজনগুলাে মেটাতে পারে? এই হচ্ছে সেই প্রশ্ন যা সকল যামানার মানুষ নিজ নিজ এলাকার রসূলদেরকে জিজ্ঞাসা করেছে। অমুকের বেটা অমুক যাকে তারা চেনে, সে আবার রসূল হয় কেমন করে? যে লােক তদের জীবনের সাথে বেশ জড়িত, যে তাদেরই মতাে খায় দায় এবং তাদেরই মতাে জীবন যাপন করে …..সে কেমন করে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন রসূল নিযুক্ত হবে যার কাছে ওহী নাযিল হয়? কেমন করে এজগতের বাইরের আর এক জগতের সাথে তার সম্পর্ক স্থাপিত হবে? অথচ তাকে তারা তাদেরই মতাে একজন রক্ত মাংসের মানুষ বলে জানে! তাদের কাছে ওহী না আসলে, ওর কাছে ওহী আসে কেমন করে, যে জগত থেকে ওহী। আসছে বলে সে দাবী করে, সে জগত সম্পর্কে তারা তো কেউ কোনাে খবর রাখে না, তাদের থেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এমন কিছু তাে সে নয়! এহেন বিভিন্ন প্রশ্ন সকল যামানার মানুষই রসূলদের সম্পর্কে বরাবর করেছে। এমনই সব আজব আজব ও অস্বাভাবিক প্রশ্ন সকল যামানার রসূলদের প্রতি করা হয়েছে, তাদের কাছে স্বভাবতই আর একটা কথাও গ্রহণযােগ্য মনে হয়নি… হা আল্লাহ তায়ালা এই মাটির মানুষের মধ্যেই তাে এক সময় রূহ ফুকে দিয়েছিলেন! মাটির ধড়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রেরিত রূহ প্রবেশ করাতেই তাে এই জড় পদার্থ এমন সচল ও জ্ঞানী-গুণী হয়ে গিয়েছিলাে এবং পৃথিবীর বুকে আল্লাহর খলীফা নিযুক্ত হয়েছিলাে! এই মানুষ, সে হতে পারে খুবই অল্প জ্ঞানের অধিকারী, সীমিত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, দুর্বল উপায় উপকরণের মালিক- এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা তার সাহায্য ছাড়া তাকে তাে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেননি, তাকে সেই সুস্পষ্ট সমুজ্জ্বল হেদায়াতের আলাে থেকে বঞ্চিত মানুষ হিসেবে ছেড়ে দেননি, যা তাকে পৃথিবীর ঘনান্ধকারের মধ্যে তাকে পথ দেখাতে পারে! অবশ্যই আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা তাকে তার মহান সত্ত্বার সাথে মিলিত হওয়ার এবং সম্পর্কিত হওয়ার যােগ্যতা দান করেছেন, আর সে যােগ্যতা এসেছে তার মধ্যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অকল্পনীয় শক্তি সম্পন্ন রূহের আগমনে। যা তাকে অন্যান্য সকল প্রাণী থেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও পৃথক করেছে। সুতরাং তাদের মধ্যে কাউকে যদি তিনি তার রসূলরূপে বাছাই করে নিয়ে থাকেন তাতে আশ্বর্য্য হওয়ার কী আছে! সে তাে সে শক্তি সম্পন্ন রূহের অধিকারী। যখনই তিনি চেয়েছেন, তখনই তাদের মধ্যে কাউকে তিনি তার ওহীর ধারক বাহক বানিয়ে নিয়েছেন আর যখনই তাদের জীবন পথ জটিলতা ও ব্যথা বেদনায় ভরে গেছে এবং তারা সাহায্যের জন্যে আবেদন জানিয়েছে, তখনই তিনি তাদেরকে সাহায্য করেছেন। আল্লাহ তাবারকা ওয়া তায়ালা মানুষকে যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন তার কিছু অংশ এই নবুওত রূপে চমৎকার পদ্ধতিতে প্রকাশ পায়। সমগ্র মানবমন্ডলীর মধ্য থেকে কারাে কারাে প্রকৃতির মধ্যে এই মর্যাদা লাভের যােগ্যতা দান করা হয়েছে, কিন্তু বহু মানুষ তাদেরকে দেয়া এই সম্মানের মর্যাদা বুঝে না, উপলব্ধি করতে পারে না তাদেরকে প্রদত্ত ও মান-সম্ভ্রমের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কি! এজন্যেই ওহী নাযিলের মাধ্যমে যাদেরকে সম্মানিত করা হয়েছে তাদেরকে, যাদের মান-মর্যাদাকে তারা অস্বীকার করে, তারা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের মধ্যে কেউ একজন রসূল হয়ে আসতে পারে। তারা মনে করে, মানুষ রসূল হওয়া থেকে ফেরেশতাদের রসূল হওয়া বেশী ভাল এবং অধিক গ্রহণযােগ্য। তাই এ বিষয়ে তাদের কথার উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, তার কাছে কোনাে ফেরেশতা কেন নাযিল হয় না, যে তার সাথে একজন (সহকারী নবী) বা সতর্ককারী হিসেবে যােগ দিত। অথচ, তাদের একথা হিসাব করা উচিত ছিলাে যে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা দ্বারা মানুষকেই তাে সিজদা করিয়েছেন, এর কারণ আল্লাহ জাল্লা শানুহু মাটির পুতুলের মধ্যে মহান রূহ ফুকে দিয়ে তাকে মর্যাদাবান বানিয়েছেন এবং তারপর ভালাে মন্দের জ্ঞান দান করে তাকে বানিয়েছেন আরাে বেশী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, আর এর ফলে তার স্থান সৃষ্টির সকল কিছুর ওপর নিরূপিত হয়েছে। এটা আল্লাহ রব্দুল আলামীনের হেকমতের বিশেষ নিদর্শন যে তিনি বিশ্ব মানবতার দরবারে একই রিসালাতের পয়গামকে কালান্তরে অনেক অনেক মানুষের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। মানুষের মধ্যে রিসালাতপ্রাপ্ত এক মানুষ বাকি মানুষের অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করে, বুঝে যে এসব অনুভূতির উৎসগুলাে কি কি তাদের অভিজ্ঞতাসমূহের প্রতিনিধি হিসাবে সে মানুষকে সাহায্য করে, তাদের ব্যথা-বেদনা ও আশা-আকাংখাকে সে বুঝতে পারে, সে জানতে পারে তাদের মনের কষ্ট কি এবং কি তাদের মনের চাহিদা, সে জানে তাদের প্রয়ােজনসমূহ ও জীবনের বােঝাগুলাে কি…. আর এই কারণেই তাদের দুর্বলতা ও ক্ষতিগুলাে যখন সে দেখে তখন দয়া সহানুভূতিতে তার মন ভরে যায়, কাজেই তখন তাদের সেসব পুঞ্জীভূত দুঃখ-বেদনা নিরসনে তৎপর হয়ে ওঠে এবং এজন্যে তাদের সমস্ত শক্তি ও বড়ত্বকে উপেক্ষা করে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত বলে বলীয়ান হয়ে কাজ করে, আর এই জন্যে পা পা করে সাফল্য ও বিজয়ের পথে সে এগিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা কোথায়, তাদের মনের প্রতিক্রিয়া ও তাদের গ্রহণ যােগ্যতা সম্পর্কেও জানতে পারে, একথা অবশ্য সত্য যে, সে তাে তাদেরই একজন, তাদেরকে নিয়ে সে আল্লাহর পথেই চলতে চায়, তার কাছে ওহী আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং জীবনের কন্টকাকীর্ণ পথ পরিক্রমায় সে আল্লাহর সাহায্য লাভ করে! দুনিয়ার মানুষ এই প্রেরিত পুরুষ- আল্লাহর রসূলের মধ্যে অনুকরণীয় এক চমকপ্রদ আদর্শ দেখতে পায়, কারণ তারা তাঁকে তাদেরই একজন হিসেবে দেখতে পায়। তিনি যদি শত দুঃখ জ্বালা সয়েও এই সত্য সুন্দর পথে চলতে পারেন তাহলে তারা কেন এ দুর্গম পথে পাড়ি জমাতে পারবে না? এজন্যে মানুষ ধীরে ধীরে হলেও আদর্শ মানুষটির অনুকরণ ও অনুসরণের মাধ্যমে অবশেষে এই উত্তম আদর্শকে গ্রহণ করে, এর ফলে এই উত্তম মানুষটি আজও অসংখ্য নিগৃহীত নিপীড়িত মানুষের অন্তরের মাঝে বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকবে আবহমানকাল ধরে, বেঁচে থাকবে তাদের মধ্যে তার নৈতিক চরিত্র, সুমধুর ব্যবহার, উত্তম কার্যাবলী এবং যেসব দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা তাকে দিয়েছেন ও চেয়েছেন যে তার পয়গাম্বর নিজে সেগুলাে যথাযথভাবে এগুলাে পালনের মাধ্যমে অনুশীলন করে দেখাক। প্রকৃতপক্ষে এভাবে আল্লাহর রসূল তার আনীত আকীদা। বিশ্বাসকে তার নিজের জীবনের মাধ্যমে বাস্তব রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার জীবন, তার ব্যবহার এবং তার কর্মসমূহকে এক উন্মুক্ত গ্রন্থরূপে তিনি বিশ্ববাসীর সামনে রেখে গেছেন, যার জীবন গ্রন্থের প্রতিটি লাইন মানুষরা স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে গেছে এবং কার্যত পৃথিবীর বহু স্থানে বাস্তবায়িত করে চলেছে। মানুষ রসূলুল্লাহ(স.)-কে তার শিক্ষা ও কাজের মাধ্যমে আজও জীবন্ত দেখতে পাচ্ছে, যার কারণে তাঁর অনুকরণ ও অনুসরণ করাটা তেমন কোনাে দূরূহ ব্যাপার বলে মনে হয় না, কারণ এই উন্নত আদর্শ তাে পৃথিবীতে শুধু কথা আকারে নেই, আছে এ আদর্শ বাস্তবায়নের সােনালী নযির। কিন্তু আজ আমরা সেই আদর্শের বাস্তব রূপ কোথাও ফুটিয়ে তুলতে পারায় অনেকাংশে হতাশ হয়ে পড়েছি। আজ যদি সেই সুমহান আদর্শ তার সম্মােহনী রূপ নিয়ে জেগে উঠতাে, যদি পৃথিবীর কোনাে প্রান্তরে কোনাে একটু ভূখন্ডেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম পরিপূর্ণভাবে জীবনের সকল দিক ও বিভাগে কায়েম হয়ে যেতাে, যদি কাজে, কথায় চিন্তায় ও ব্যবহারে মানুষ ইসলামের পুরােপুরি অনুসারী হয়ে যেতাে তাহলে মানুষ তা দেখে এ শারাবান তহুরা আকণ্ঠ পান করার জন্যে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়তাে। আর আল্লাহর নবী মানুষ না হয়ে যদি ফেরেশতা হতেন তাহলে তার কাজ সম্পর্কে তারা কোনাে চিন্তাই করতাে না, আর তাকে অনুসরণ করারও কোনাে চেষ্টা করতাে না, কারণ শুরুতেই তারা বুঝতাে যে ওদের প্রকৃতি থেকে তার প্রকৃতি ভিন্ন, অতএব তার ব্যবহার অবশ্য অবশ্যই তাদের ব্যবহার থেকে ভিন্ন হবে, কাজেই তার বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার ষড়যন্ত্রের প্রশ্নই আসে না। তার জন্যে কারাে কোনাে উপায় বের করারও প্রয়ােজন নেই। এটাই আল্লাহর কর্মকৌশলের এক বিশেষ রহস্য যে, তিনি সব কিছুকে সৃষ্টি করে তাদের প্রত্যেকের কাজ কি হবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার তাৎপর্যবহ কাজগুলাের মধ্যে এটা এক বিশেষ জ্ঞানপূর্ণ কাজ যে তিনি তার বার্তা মানুষ পর্যন্ত পৌছে দেয়ার জন্যে মানুষ-দূতকেই নিয়োগ দিয়েছেন, যাতে এই মানুষের নেতৃত্বেই আল্লাহর বিধানকে মানুষের বাস্তব জীবনে কার্যকর করতে পারে। যারা মানুষকে রসূল বানানাের ওপর প্রশ্ন তােলে, তারা খুব যে একটা চিন্তা ভাবনা করে কথা বলে, তা নয়। এর প্রথম কারণ হচ্ছে মানুষকে কতােটা সম্মান দেয়া হয়েছে তা ওরা বুঝে না। দ্বিতীয় কারণ, আল্লাহর হুকুম মানুষ কিভাবে পালন করবে তা একজন মানুষই আরেকজন মানুষকে দেখাতে পারে।   *রাসূলের ব্যাপারে কাফেরদের অবান্তর মন্তব্য : ওদের নির্বুদ্ধিতার আর এক নযির হচ্ছে, তারা যেসব প্রশ্ন করতে সেগুলাের মধ্যে একথাও ছিলাে, ‘এ আবার কেমন রাসূল, সে হাটে বাজারে রুজি রােজগারের জন্যে যাতায়াত করে!’ রসূল ও আল্লাহর খাস ব্যক্তি এবং তার নিজস্ব দূত, কাজেই কেন তিনি তার রুজি রােজগারের ব্যবস্থা করে দেন না? কেনই বা তাকে বিনা কষ্ট ও বিনা পরিশ্রমে বিত্তশালী বানিয়ে দেন না? তাদের কথাগুলােকে এইভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তার কাছে গুপ্ত ভান্ডারের চাবিকাঠি কেন দিয়ে দেয়া হয় না, অথবা ফুলে ফলে সুশােভিত কোনাে বাগিচার মালিকই বা তাকে বানিয়ে দেয়া হয় না, যাতে করে নিশ্চিন্তে সেখান থেকে সে তার খাদ্য খাবার পেতে পারে।’ আপাত দৃষ্টিতে এসব আপত্তি বেশ যুক্তিসংগত মনে হয়, কিন্তু মুক্ত মন নিয়ে কেউ যদি বুঝতে চেষ্টা করতাে তাহলে এসব কথার জওয়াব তারা নিজেদের মধ্যেই পেয়ে যেতাে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চাননি যে তার রসূল কোনাে গুপ্ত ভান্ডারের অধিকারী বা কোনাে বাগ-বাগিচার মালিক হয়ে যাক, কারণ তার রসূলকে তিনি তার উম্মতের জন্যে পরিপূর্ণ এক আদর্শ মানুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, তার উম্মতের যে কোনাে এক ব্যক্তির মতাে নিজের খাদ্য খাবার, কষ্ট পরিশ্রম করে সে নিজেই যােগাড় করে নিক, যেন তার উম্মতের মধ্য থেকে কোনাে শ্রমিক আল্লাহর হুকুম পালন করার ব্যাপারে এ ওজুহাত পেশ করতে না পারে যে, তিনি তাে রসুল ছিলেন, তার কোনাে কাজ করা লাগে না, রুজি-রােজগারের তালাশে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় না। তাই তার পক্ষে এসব হুকুম পালন করা সম্ভব হয়েছে, তার পক্ষে আকীদা বিস্তারের কাজ ও রিসালাতের দায়িত্ব আনজাম দেয়া সম্ভব হয়েছে। তাকে তাে জীবন পথে কোনাে বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি, যার জন্যে তাঁর পক্ষে এসব কিছু সম্ভব হয়েছে এগুলাে আমাদের জন্যে নয়। তাই, রসূল(স.)-কেও, তার প্রতি অর্পিত সকল দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে সাথে জীবিকা অর্জনের জন্যেও যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা অন্য কারাে থেকে কোনাে অংশে কম নয়। এভাবেই তার আদর্শকে তিনি সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য পরবর্তীতে তাকে জীবিকা আহরণের কাজ থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে, যাতে করে তিনি, অন্যদিক থেকে আগত পরীক্ষার সঠিক মােকাবেলা করতে পারেন এবং তার মিশনকে পূর্ণতা দান করতে পারেন। সাহাবায়ে কেরামরা প্রাণপ্রিয় নবীর পদপ্রান্তে হাদিয়া স্বরূপ যে ধন সম্পদ এনে দিতেন তা তিনি দুহাত দিয়ে ঝড়াে হাওয়ার মতাে বিলিয়ে দিতেন। এভাবে তিনি সম্পদের মহব্বতের ওপর জয়লাভ করতেন এবং অন্তরের মধ্যে সম্পদের কোনাে মূল্য অনুভূত হতে দিতেন না, যাতে করে এরপর একথা আর কেউ বলতে না পারে, মােহাম্মদ তার রিসালাতের কারণে এতাে এতাে অর্থ সম্পদ গড়ে তুলেছিলাে।’ তিনি অভাব অভিযােগের মধ্যেই জীবন অতিবাহিত করতেন, কোনাে সম্পদ তাঁকে বিলাসিতায় মগ্ন করে দিতে সক্ষম হতাে না। তিনি বলতেন, আল ফাকরু ফাখরী আমার দৈন্যই আমার গৌরব। হাঁ, অবশ্যই তিনি সম্পদশালী ছিলেন, ধন সম্পদ আসতাে এবং অল্পস্বল্প নয় প্রচুরই আসতাে, কিন্তু এসব সম্পদ তিনি অকাতরে দাওয়াতী কাজের জন্যে ব্যয় করে ফেলতেন। এতাে সম্পদ তার কাছে আসা সত্তেও তিনি যেমন দরিদ্র ছিলেন, তেমনি দরিদ্রই থেকে যেতেন। ধন সম্পদ, পুঞ্জীকৃত অর্থ এসবের কী মূল্য আছে, কী স্থায়িত্ব আছে। নশ্বর দেহসর্বস্ব এই মানুষের দু চোখ যখন বুঁজে যাবে, যখন এই দুর্বল মানুষ চিরস্থায়ী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে মিলিত হবে সে অবস্থা স্মরণ করলে মানুষ বুঝতে পারে এ জীবনের কী দাম আছে। পৃথিবী ও এর মধ্যস্থিত বিষয়াদিরই বা কী মূল্য আছে। এই বিশ্ব জগত গােটা এ সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার পর এসবের আর কীইবা মূল্য থাকবে। তিনিই তাে দেনেওয়ালা, কিন্তু হতভাগা সে জাতি এসব কিছুই হিসাব করতাে না! এরশাদ হচ্ছে, যালেমরা বলতাে, তােমরা একজন যাদু স্পর্শিত ব্যক্তির অনুসরণ করছ মাত্র! ছিঃ, এ হচ্ছে সৃষ্টি ছাড়া, সীমাবহির্ভূত এক চরম নির্লজ্জ কথা, যার বর্ণনা এখানে এবং সূরায়ে বনি ইসরাঈল এ (বা ইসরাতে) প্রায় একই ভাষায় এসেছে এবং এখানে এবং ওখানে জওয়াবও একই ভাষায় দেয়া হয়েছে, ‘দেখাে, ওরা তােমার কেমন উদাহরণ দিলাে, অতপর তারা গােমরাহ হয়ে গেলাে, ফলে আর কোনাে পথ তারা পাবে না।’ দুটি সূরাতে প্রায় একই বিষয় বর্ণিত হয়েছে, বর্ণনাকালে এ দুটির পরিবেশও প্রায় একই ছিলাে। এসব সূরার মধ্যে রসূলুল্লাহ(স.)-এর জন্যে অপমানজনক যেসব কথা উচ্চারিত হয়েছে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। যেসব কথা দ্বারা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে সেগুলাে এ দুটি সূরার মধ্যে সমানভাবে পাওয়া যায়। আল আমীন মােহাম্মদ, বিশ্বস্ত সবার প্রিয় মােহাম্মদ, আজ নবুওতের দায়িত্ব ঘাড়ে আসাতে কতাে হীন, কতাে অপমানজনক নামে তাকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, যাদুকরদের সাথে তাকে তুলনা করা হচ্ছে, তুলনা করা হচ্ছে এমন এক ব্যক্তির সাথে যাদুর আছর হওয়ার কারণে যার আকল বুদ্ধি শেষ হয়ে গেছে। যাদুর কথা বলা হচ্ছে- এজন্যেই তাে সে এমন আজব আজব কথা বলছে যা স্বাভাবিক মানুষরা বলে না, বলতে পারে না। আসলে এসব অস্বাভাবিক কথা যখন সে মূর্খের দল উচ্চারণ করছে তখন ওদের আভ্যন্তরীণ অবস্থা এমন ভোতা হয়ে গেছে যে তাদেরকে সে চেতনা আর সঠিক দিকনির্দেশ দিতে পারছে না। তাদের কাছে মনে হচ্ছে নবী(স.) অস্বাভাবিক কথা বলছেন, এমন কিছু তিনি বলছেন যার সাথে মানুষ পরিচিত নয়, বলছেন তাই যা মানুষের স্বভাব বিরুদ্ধ এবং মানুষের জন্যে কল্যাণকর নয়… এর জওয়াবে বিস্ময় প্রকাশ করে আল্লাহর তরফ থেকে ওহী নাযিল হলাে, দেখাে তােমার জন্যে ওরা কেমন ধরনের উদাহরণ পেশ করছে।’ কখনাে ওরা তােমার তুলনা করছে যাদুকরদের সাথে, কখনাে বলছে মিথ্যাবাদী, কখনাে বা তােমাকে দোষারােপ করছে পুরাতন কালের অলীক কাহিনী বর্ণনাকারী হিসাবে, অথচ এসব কিছু চরম ভ্রান্তি, বরং তারা সত্যই বুঝছে যে, এটা অবশ্যই সত্য কথা, সত্য কথা জানতে বুঝতে পারার পরও তারা নিছক দুনিয়াবী সাময়িক স্বার্থের কারণে এ মহা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এজন্যে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ফয়সালা শােনাচ্ছেন, ওরা আর কখনাে সঠিক পথ পাবে এ কথার সাথে ওদের হঠকারিতাপূর্ণ বিতর্কের অবসান ঘটানাে হচ্ছে যে, যা কিছু ওরা বলাবলি করছে এবং দুনিয়ার এ জীবন সম্পর্কে যতাে যা কিছু ধারণা কল্পনা করছে সবই বে-ফায়দা হয়ে যাবে, তা ওরা যতােই এ দুনিয়াকে মূল্যবান বলে বুঝুক না কেন। আর দুনিয়া কেন্দ্রিক জীবন হওয়ার কারণে ওদের চিন্তা যে, সত্যিকার রসূলই যদি তিনি হবেন তাহলে তার কাছে প্রচুর সম্পদ থাকা উচিত ছিলাে, এমন ফুলের বাগ-বাগিচা থাকা প্রয়ােজন ছিলাে, যার থেকে নিশ্চিন্তে তার খােরপােষের ব্যবস্থা হতাে। হাঁ, আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান, তিনি চাইলে অবশ্যই যা ওরা ধারণা করছে তার থেকেও অনেক বেশী দিতে পারতেন। তাই তিনি জানাচ্ছেন, ‘মহা কল্যাণময় সেই সত্ত্বা যিনি চাইলে দিতে পারতেন, যা ওরা ধারণা করছে, তার থেকেও বেশী তােমাকে দিতে পারতেন, দিতে পারতেন তােমাকে এমন বাগ-বাগিচায় ভরা বাসস্থান যার নীচু দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকত ছােট ছােট নদী, তােমার জনে বহু বালাখানাও বানিয়ে দিতে পারবেন।’ কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে ওদের কল্পনার অতীত, আরাে আরাে অনেক বেশী সুন্দর বাগ বাগিচা ও বাসস্থান বানাতে চেয়েছেন, আরাে অনেক বেশী আরামদায়ক প্রাসাদ তাকে দিতে চেয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে তার নিজের সাথে মহা মিলনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। যিনি সকল সহায় সম্পদ অট্টালিকা ও সকল ক্ষমতার মালিক তার সান্নিধ্য পাওয়া কি সকল পাওয়ার বড়াে পাওয়া নয়। এর সাথে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাকে পরম পুলকিত ও পরিতৃপ্ত হৃদয় দিয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত যে তার মালিক নিজেই তাকে চালাচ্ছেন এবং সদা সর্বদা তাকে তিনি নিজের হেফাযতে রেখেছেন, সর্বক্ষণ তাঁর প্রতি মালিকের মনােযােগ রয়েছে এবং তিনিই তাকে সর্বপ্রকার যােগ্যতা দিচ্ছেন যার কারণে শত চেষ্টা করেও বিরােধিরা তাকে তার মিশনকে স্তব্ধ করে দিতে পারছে না, আর এসব কিছুর সাথে পরম প্রেমাস্পদের সাথে মহা মিলনের স্বাদ তাকে সারাক্ষণ বিমােহিত করে রেখেছে। এ স্বাদের অনুভূতি তাকে দান করছে এমন আরাম যা সকল নেয়ামতের বড়াে নেয়ামত। মানুষের জন্যে এর থেকে বড়াে অন্য সম্পদ হতে পারে না। হায়, ওরা যদি সময় ফুরানাের আগেই বুঝতাে, যদি ওরা স্বাদ পেতাে সেই মহা নেয়ামতের।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# প্রথমত মানুষের রসূল হওয়াটাই তো অদ্ভূত ব্যাপার। আল্লাহর পয়গাম নিয়ে যদি কোন ফেরেশতা আসতো তাহলে না হয় বুঝতাম। কিন্তু একজন রক্ত-মাংসের মানুষ জীবিত থাকার জন্য যে খাদ্যের মুখাপেক্ষী সে কেমন করে আল্লাহর পয়গাম নিয়ে আসে! যাহোক তবুও যদি মানুষকেই রসূল করা হয়ে থাকে তবে তাকে তো অন্তত বাদশাহ ও দুনিয়ার বড় লোকদের মতো উন্নত পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব হওয়া উচিত ছিল। তাকে দেখার জন্য চোখ উন্মুখ হয়ে থাকতো এবং তার দরবারে হাজির হবার সৌভাগ্য হতো অনেক দেন-দরবার ও সাধ্য-সাধনার পর। কিন্তু তা না হয়ে এমন একজন সাধারণ লোককে কিভাবে পয়গম্বর করে দেয়া হয়, যে বাজারের মধ্যে ঘুরে ঘুরে জুতোর তলা ক্ষয় করতে থাকে? পথ চলতে মানুষ যাকে প্রতিদিন দেখে এবং কোন দিক দিয়েই যার মধ্যে কোন অসাধারণত্বের সন্ধান পায় না, কে তাকে গ্রাহ্য করবে? অন্য কথায় রসুলের প্রয়োজন থাকলে তা সাধারণ মানুষকে পথনির্দেশনা দেবার জন্য ছিল না বরং ছিল বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটাবার এবং ঠাটবাট দেখাবার ও ভীতি প্রদর্শন করার জন্য। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন, আল মু’মিনূন ২৬ টীকা )
# যদি মানুষকেই নবী করা হয়ে থাকে তাহলে একজন ফেরেশতাকে তার সঙ্গে দেয়া হতো। তিনি সব সময় একটি চাবুক হাতে নিয়ে ঘুরতেন এবং লোকদের বলতেন “এ ব্যক্তির কথা মেনে নাও, নয়তো এখনই আল্লাহর আযাব বর্ষণ করার ব্যবস্থা করছি।” বিশ্ব-জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এক ব্যক্তিকে নবুওয়াতের মহান মর্যাদাসম্পন্ন দায়িত্ব প্রদান করে এমনি একাকী ছেড়ে দেবেন লোকদের গালিগালাজ ও দ্বারে দ্বারে ধাক্কা খাবার এটা তো বড়ই অদ্ভূত ব্যাপার।

# এটা যেন ছিল তাদের শেষ দাবী। অর্থাৎ আল্লাহ‌ অন্তত এতটুকুই করতেন যে, নিজের রসূলের গ্রাসাচ্ছাদনের কোন ভালো ব্যবস্থা করে দিতেন। এ কেমন ব্যাপার, আল্লাহর রসূল আমাদের একজন সাধারণ পর্যায়ের ধনী লোকের চেয়েও খারাপ অবস্থায় থাকেন! নিজের খরচ চালাবার মতো ধন-সম্পদ নেই, ফল-ফলারি খাবার মতো বাগান নেই একটিও, আবার দাবী করেন তিনি রব্বুল আলামীন, আল্লাহর নবী।
# পাগল। আরবদের দৃষ্টিতে পাগলামির কারণ ছিল দুটো। কারো উপর জ্বীনের ছায়া পড়লে সে পাগল হয়ে যেতো অথবা যাদু করে কাউকে পাগল করা হতো। তাদের দৃষ্টিতে তৃতীয় আরো একটি কারণও ছিল। সেটি ছিল এই যে, কোন দেবদেবীর বিরুদ্ধে কেউ বেআদবী করলে তার অভিশাপ তার উপর পড়তো এবং তার ফলে সে পাগল হয়ে যেতো। মক্কার কাফেররা প্রায়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে এ কারণগুলো বর্ণনা করতো। কখনো বলতো, এ ব্যক্তির উপর কোন জিন চেপে বসেছে। কখনো বলতো, বেচারার উপর কোন দুশমন যাদু করে দিয়েছে। আবার কখনো বলতো, আমাদের কোন দেবতার সাথে বেআদবী করার খেসারতে বেচারা ভুগছে। কিন্তু এই সঙ্গে তাঁকে আবার এতটা বুদ্ধিমান ও ধীশক্তি সম্পন্নও মনে করতো যে, এ ব্যক্তি একটি অনুবাদ ভবন কায়েম করেছে এবং সেখানে পুরাতন সব গ্রন্থাদি সংগ্রহ করে তার অংশ বিশেষ বাছাই করে করে মুখস্থ করছে। এছাড়া তারা তাঁকে যাদুকরও বলতো। অর্থাৎ তিনি নিজে যাদুকরও ছিলেন আবার অন্যের যাদুতে প্রভাবিতও ছিলেন। এরপর আর একটি বাড়তি দোষারোপ এও ছিল যে, তিনি কবিও ছিলেন।
# এ আপত্তি ও অভিযোগগুলোও এখানে মূলত জবাব দেবার জন্য নয় বরং অভিযোগকারীরা হিংসা ও বিদ্বেষে কি পরিমাণ অন্ধ হয়ে গেছে তা বুঝবার জন্য উদ্ধৃত করা হয়েছে। উপরে তাদের যেসব কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে তার মধ্যে কোন একটিও গুরুত্বসহকারে আলোচনা করার মতো নয়। তাদের শুধুমাত্র উল্লেখ করাই একথা বলার জন্য যথেষ্ট যে, বিরোধীদের কাছে ন্যায়সঙ্গত যুক্তির অভাব অত্যন্ত প্রকট এবং নেহাতই বাজে ও বস্তাপঁচা কথার সাহায্যে তার একটি যুক্তি সিদ্ধ ও নীতিগত দাওয়াতের মোকাবিলা করছে। এক ব্যক্তি বলছেন, হে লোকেরা! এই যে শিরকের ওপর তোমরা নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি-সভ্যতার বুনিয়াদ কায়েম করে রেখেছো এ তো একটি মিথ্যা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং এর মিথ্যা ও ভ্রান্ত হবার পেছনে এ যুক্তি কাজ করছে। জবাবে শিরকের সত্যতার সপক্ষে কোন যুক্তি পেশ করা হয় না বরং শুধুমাত্র এভাবে একটি বিরূপ ধ্বনি উঠানো হয় যে, আরে এ লোকের ওপর তো যাদু করা হয়েছে। তিনি বলছেন, বিশ্ব-জাহানের সমগ্র ব্যবস্থা চলতে তাওহীদের ভিত্তিতে এবং এইসব বিভিন্ন সত্য এর সাক্ষ্য দিচ্ছে। জবাবে বড় গলায় ধ্বনিত হচ্ছে—এ ব্যক্তি যাদুকর। তিনি বলছেন, দুনিয়ায় তোমাদের লাগামহীন উটের মতো ছেড়ে দেয়া হয়নি বরং তোমাদের রবের কাছে তোমাদের ফিরে যেতে হবে এবং এসব বিবিধ নৈতিক, ঐতিহাসিক এবং যুক্তি ও তথ্যগত বিষয় এ সত্যটি প্রমাণ করছে। জবাবে বলা হচ্ছে, আরে এতো একজন কবি। তিনি বলছেন, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছি সত্যের শিক্ষা নিয়ে এবং সে শিক্ষাটি হচ্ছে এই। জবাবে এ শিক্ষার ওপর কোন আলোচনা সমালোচনা করা হয় না বরং প্রমাণ ছাড়াই একটি দোষারোপ করা হয় এই মর্মে যে, এসব কিছুই কোথাও থেকে নকল করা হয়েছে। নিজের জীবন ও নিজের চরিত্র ও কার্যাবলী পেশ করছেন এবং তার প্রভাবে তার অনুসারীদের জীবনে যে নৈতিক বিপ্লবের সূচনা হচ্ছিল তাও পেশ করছেন। কিন্তু বিরোধিতাকারীরা এর কোনটিও দেখে না। তারা কেবল জিজ্ঞেস করছে, তুমি খাও কেন? বাজারে চলাফেরা করো কেন? কোন ফেরেশতাকে তোমার আরদালী হিসেবে দেয়া হয়নি কেন? তোমার কাছে কোন অর্থভাণ্ডার বা বাগান নেই কেন? এ পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং কে এর মোকাবিলায় অক্ষম হয়ে আজেবাজে ও উদ্ভট কথা বলে চলছে এসব কথা আপনা-আপনিই তা প্রমাণ করে দিচ্ছিল।

# এখানে আবার সেই একই تَبَارَكَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং পরবর্তী বিষয়বস্তু থেকে একথা জানা যাচ্ছে যে, এখানে এর মানে হচ্ছে “বিপুল সম্পদ ও উপকরণাদির অধিকারী,” “সীমাহীন শক্তিধর” এবং “কারো কোন কল্যাণ করতে চাইলে করতে পারেন না, এর অনেক উর্ধ্বে।”

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

অত্র আয়াতগুলোতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাতকে অস্বীকারকারী কাফিরদের একটি ভ্রান্ত ধারণার খণ্ডন করা হয়েছে। তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলতন এটা কেমন রাসূল যে খাওয়া দাওয়া করে, বাজারে যায়, আমাদের মতই সাধারণ মানুষ। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, রাসূল হবেন ফেরেশতা বা যিনি রাসূল হবেন তার সাথে একজন ফেরেশতা থাকবেন, অথবা তার অনেক ধন-ভাণ্ডার থাকবে বা বিশাল বাগান থাকবে ফলে মানুষ তা থেকে খেতে পারবে। এ সম্পর্কে সূরা মু’মিনূনের ৩৩-৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আলোচনা করেছেন। সুতরাং যখন মুহাম্মাদের এসব কিছুই নেই, তাই তা জানা সত্ত্বেও যে মুহাম্মাদের অনুসরণ করবে সে জাদুগ্রস্ত ব্যক্তি, মুহাম্মাদ তাকে জাদু করেছে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ বিশ্বাসকে খণ্ডন করে বলেন: শুধু মুহাম্মাদ নয় বরং তার পূর্বে যত রাসূল প্রেরণ করেছি সবাই মানুষ ছিল এবং খাবার খেত ও বাজারে যেত। অত্র সূরার ২০ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَآ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ إِلَّآ إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُوْنَ الطَّعَامَ وَيَمْشُوْنَ فِي الْأَسْوَاقِ ط وَجَعَلْنَا بَعْضَكُمْ لِبَعْضٍ فِتْنَةً ط أَتَصْبِرُوْنَ ج وَكَانَ رَبُّكَ بَصِيْرًا)

“তোমার পূর্বে আমি যে সকল রাসূল প্রেরণ করেছি তারা সকলেই তো আহার করত ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করত। হে মানুষ! আমি তোমাদের মধ্যে পরস্পরকে পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে কি? আর তোমার প্রতিপালক সমস্ত‎ কিছু দেখেন।”

এরূপ অসংখ্য আয়াত রয়েছে যা প্রমাণ করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন মানুষ, অন্যান্য মানুষের মত খাবার ও প্রয়োজন পূরণের জন্য তাঁকেও বাজারে গমন করতে হত। সুতরাং নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাটির তৈরি একজন মানুষ, পার্থক্য হল তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা রিসালাত দান করেছেন, তাঁর কাছে ওয়াহী আসে; আমাদের কাছে আসে না।

অর্থাৎ তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য তারা কিরূপ উদারহণ পেশ করে থাকে! নাবী এরূপ হবে না, এরূপ হবে না, এরূপ হবে ইত্যাদি। আল্লাহ বলছেন, তাদের এসব কথার জন্য তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তারা নাজাতের কোন পথ পাবে না। তারা যে বাগানের কথা বলে আল্লাহ তা‘আলা চাইলে তোমাকে এর চেয়ে উত্তম বাগান দিতে পারেন, যার তলদেশ দিয়ে নাদী-নালা প্রবাহিত হবে এবং বিশাল অট্টালিকা দিতে পারেন। এরপর আল্লাহ বলছেন, তারা এসব কথা বলে সত্য অনুসন্ধানের জন্য নয় এবং সত্যের অনুসরণ করার জন্যও নয় বরং তা প্রকাশ পায় হিংসার কারণে এবং সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য। এমনকি তারা কিয়ামত দিবসকেও অস্বীকার করে বসেছে। তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি এদের জন্যই জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছি।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. প্রত্যেক যুগেই মানুষের মধ্য হতেই রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে, কোন ফেরেশতা বা জিনকে নয়। সুতরাং খাদ্য খাওয়া ও বাজারে গমন করাটা রাসূল না হওয়ার জন্য কোন দলীল হতে পারে না।
২. একই কথার ওপর অটল না থাকলে তার ওপর বিশ্বাস আসে না বা এ কথা মিথ্যা বলে গৃহিত হয়। যেমন কাফিররা রাসূলকে কখনো কবি, কখনো জাদুকর, কখনো পাগল বলত তাদের এসব কথা প্রমাণ করে যে, তারা ছিল মিথ্যুক।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলেই যাকে যা কিছু খুশি দিতে পারেন। এতে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, আল্লাহ তা‘আলাই সকল ক্ষমতার অধিকারী, অন্য কেউ নয়।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের আরো বোকামির বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর রিসালাতের অস্বীকার করার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলে তিনি পানাহারের মুখাপেক্ষী কেন? কেনই বা তিনি ব্যবসা ও লেনদেনের জন্যে বাজারে গমনাগমন করেন? তার সাথে কোন ফেরেশতাকে কেন অবতীর্ণ করা হয়নি? তাহলে তিনি তাঁকে সত্যায়িত করতেন, জনগণকে তার দ্বীনের দিকে আহ্বান করতেন এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে সতর্ক করতেন? ফিরাউনও একথাই বলেছিলঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তার উপর সোনার কংকন কেন নিক্ষেপ করা হয়নি কিংবা তার সাহায্যের জন্যে আকাশ থেকে কেন ফেরেশতা অবতীর্ণ করা হয়নি?” (৪৩:৫৩)

সমস্ত কাফিরের অন্তর একই বলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগের কাফিররাও বলেছিল- তাকে ধন-ভাণ্ডার দেয়া হয় না কেন অথবা তার একটি বাগান নেই। কেন যা হতে সে আহার সংগ্রহ করতে পারে? নিশ্চয়ই এ সবকিছু প্রদান করা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ। কিন্তু সাথে সাথে এগুলো না দেয়ার মধ্যে নিপুণতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে।

এই যালিমরা মুসলমানদেরকেও বিভ্রান্ত করতো। তারা তাদেরকে বলতো: ‘তোমরা এমন একজন লোকের অনুসরণ করছো যার উপর কেউ যাদু করেছে। তারা কতই না ভিত্তিহীন কথা বলছে! কোন একটি কথার উপর তারা স্থির থাকতে পারছে না। তারা কথাকে এদিক-ওদিক নিয়ে যাচ্ছে। কখনো বলছে যে, কেউ তার উপর যাদু করেছে, কখনো তাকে যাদুকর বলছে, কখনো বলছে যে, তিনি একজন কবি, কখনো বলছে যে, তার উপর জ্বিনের আসর হয়েছে, কখনো তাকে মিথ্যাবাদী বলছে, আবার কখনো বলছে যে, তিনি একজন পাগল। অথচ তাদের এসবই বাজে ও ভিত্তিহীন কথা। আর তারা যে ভুল কথা বলছে এটা এর দ্বারাও প্রকাশমান যে, স্বয়ং তাদের মধ্যেই পরস্পর বিরোধী কথা রয়েছে। কোন একটি কথার উপর মুশরিকদের আস্থা নেই। তারা একবার একটি কথা বানিয়ে বলছে, তারপর ওটাকে ছেড়ে দিয়ে আর একটি কথা বানাচ্ছে এবং আবার ওটাকেও ছাড়ছে। একটি কথার উপর তারা অটল থাকতে পারছে না। সঠিক ও সত্য তো এটাই হয় যে, এ ব্যাপারে কোন দ্বন্দ্ব ও বিরোধ থাকবে না। মহান আল্লাহ বলেন যে, তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা পথ পাবে না।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কত মহান তিনি যিনি ইচ্ছা করলে তোমাকে দিতে পারেন এটা অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর বস্তু উদ্যানসমূহ যার নিম্নদেশে নদী-নালা প্রবাহিত এবং দিতে পারেন প্রাসাদসমূহ।

পাথর দ্বারা নির্মিত ঘরকে আরবের লোকেরা (আরবি) বলে থাকে, তা বড়ই হোক বা ছোটই হোক।

আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলা হয়েছিলঃ “তুমি যদি চাও তবে যমীনের ধন-ভাণ্ডার এবং এর চাবী আমি তোমাকে দিয়ে দিই। আর তোমাকে দুনিয়ার এত বড় মালিক করে দিই যে, এত বড় মালিকানা আমি তোমার পূর্বে কোন নবীকে দিইনি এবং তোমার পরে আর কাউকেও প্রদান করবো না। সাথে সাথে তোমার পারলৌকিক সমস্ত নিয়ামত ঠিকমতই থাকবে।” কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “সব কিছু আমার জন্যে আখিরাতেই জমা করা হোক (দুনিয়ায় আমার এগুলোর দরকার নেই)।” (এ হাদীসটি সুফিয়ান সাওরী (রঃ) হাবীব ইবনে আবি সাবিত (রঃ) হতে এবং তিনি খাইসুমা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন

Leave a Reply