أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৮৭)
[ *জাহান্নামের কিছু ভয়াবহ চিত্র :]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৮
১১-১৬ নং আয়াত:-
২৫:১১
بَلۡ کَذَّبُوۡا بِالسَّاعَۃِ ۟ وَ اَعۡتَدۡنَا لِمَنۡ کَذَّبَ بِالسَّاعَۃِ سَعِیۡرًا ﴿ۚ۱۱﴾
বরং ওরা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে। আর যারা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে, তাদের জন্য আমি জ্বলন্ত জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছি।
২৫:১২
اِذَا رَاَتۡہُمۡ مِّنۡ مَّکَانٍۭ بَعِیۡدٍ سَمِعُوۡا لَہَا تَغَیُّظًا وَّ زَفِیۡرًا ﴿۱۲﴾
দূর থেকে আগুন যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে এর ক্রুদ্ধ গর্জন ও হুঙ্কার।
২৫:১৩
وَ اِذَاۤ اُلۡقُوۡا مِنۡہَا مَکَانًا ضَیِّقًا مُّقَرَّنِیۡنَ دَعَوۡا ہُنَالِکَ ثُبُوۡرًا ﴿ؕ۱۳﴾
আর যখন এরা শৃংখলিত অবস্থায় তার মধ্যে একটি সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষিপ্ত হবে তখন নিজেদের মৃত্যুকে ডাকতে থাকবে।
২৫:১৪
لَا تَدۡعُوا الۡیَوۡمَ ثُبُوۡرًا وَّاحِدًا وَّ ادۡعُوۡا ثُبُوۡرًا کَثِیۡرًا ﴿۱۴﴾
আজ তোমরা একবারের জন্য ধ্বংস কামনা করো না; বরং বহুবার ধ্বংস কামনা করতে থাক।
২৫:১৫
قُلۡ اَذٰلِکَ خَیۡرٌ اَمۡ جَنَّۃُ الۡخُلۡدِ الَّتِیۡ وُعِدَ الۡمُتَّقُوۡنَ ؕ کَانَتۡ لَہُمۡ جَزَآءً وَّ مَصِیۡرًا ﴿۱۵﴾
বলুন, ‘এটাই শ্রেয়, না স্থায়ী জান্নাত, যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে মুত্তাকীদেরকে?’ তা হবে তাদের প্রতিদান ও প্রত্যাবর্তনস্থল।
২৫:১৬
لَہُمۡ فِیۡہَا مَا یَشَآءُوۡنَ خٰلِدِیۡنَ ؕ کَانَ عَلٰی رَبِّکَ وَعۡدًا مَّسۡـُٔوۡلًا ﴿۱۶﴾
সেখানে তারা স্থায়ী হয়ে যা কামনা করবে তাই পাবে; এ প্রতিশ্রুতি পূরণ তোমার প্রতিপালকেরই দায়িত্ব।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*জাহান্নামের কিছু ভয়াবহ চিত্র : আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ও রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিরুদ্ধে কাফের মােশরেকদের সীমাহীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা এ পর্যন্ত যা পেশ করা হলাে, তার সাথে তাদের অপর যে কঠিন সত্য বিরােধী চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা হচ্ছে আখেরাত ও আখেরাতের অনন্ত জীবনকে অস্বীকার করা। তারা বিশ্বাস করতাে না যে, মৃত্যুর পর আবার একসময় তাদেরকে যিন্দা করে তােলা হবে এবং দুনিয়ার জীবনের যাবতীয় কার্যকলাপ ও ব্যবহারের হিসাব নেয়া হবে, আর এজন্যেই তারা এতাে বে-পরওয়া ছিলাে। তাদের এই যুলুম নির্যাতনের কারণে একদিন তাদের শাস্তি পেতেই হবে, তাদের উপহাস-বিদ্রুপ ও নবীর সাথে দুর্ব্যবহারের জন্যে কারাে কাছে কোনাে দিন তাদের জওয়াবদিহি করতে হবে এবং কোনাে দিন কারাে কাছে তাদের হিসাব দিতে হবে। এসব বিশ্বাসের অভাবে তারা কোনাে অন্যায় কাজ বা খারাপ আচরণ করতে কুন্ঠিত হতাে না। তাদের অত্যাচারের কোনাে সীমা থাকতাে না এবং তাদের আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনাে কিছুই ছিলাে না। এজন্যে এখানে তাদের সামনে অত্যন্ত তেজোদ্দীপ্ত ও মর্মস্পর্শী ভাষায় কেয়ামতের দৃশ্যাবলীর মধ্য থেকে এমন একটি কঠিন দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে, যা তাদের প্রস্তর কঠিন হৃদয়কে বিগলিত করছে, তাদের সুপ্ত চেতনাকে, প্রচন্ডভাবে নাড়িয়ে তুলছে তাদের অবচেতন মনকে ভীষণভাবে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলছে এবং একদিন তাদের মন্দ কাজ ও দুর্ব্যবহারের জন্যে অতি কঠিন পরিণতি ভােগ করতে হবে বলে তাদের মনে প্রত্যয় জাগিয়ে দিচ্ছে। এ পর্যায়ে মহা প্রলয়ংকর কেয়ামত সম্পর্কে আল কোরআনের সম্মােহনী বাণী মােমেনদেরকে যেমন করে আতংকিত করছে, তেমনি কাফেরদেরকেও ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলছে। দেখুন, একবার আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালার সেই ভীতি সৃষ্টিকারী বাণীর দিকে। ‘বরং ওরা কেয়ামতের বর্ণনাকে মিথ্যা বলে দাবী করলাে এবং আমি, তাদের জন্যে দোযখের দগদগে… একটি ধ্বংসকে ডেকো না, বরং বহু বহু ধ্বংসকে ডাকো।'(আয়াত ১১-১৪) ‘বলাে, সে (পরিণতি)টিই ভালাে, না চিরস্থায়ী সেই জান্নাত ভালাে- যার ওয়াদা করা হয়েছে মুত্তাকী (আল্লাহভীরু) লোকদের সাথে, এটাই হবে তাদের… এক ওয়াদা- শুধু তার জন্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর এ মহান ওয়াদা লাভের জন্য আকাংখী থাকে!’ (আয়াত ১৫-১৬) ওরা কেয়ামত সম্পর্কিত কথাগুলােকে মিথ্যা কথা বলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। সত্যকে অস্বীকার করা এবং ভুল পথে দৃঢ়ভাবে টিকে থাকার জিদ তাদেরকে সত্য থেকে এতাে বেশী দূরে পৌছে দিয়েছে, যেখান থেকে ফিরে আসা বড়ােই কঠিন। এর ফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, সত্য সমাগত হওয়ার পর তাকে প্রত্যাখ্যান করায় তাদের অবস্থা পূর্বের যে কোনাে সময়ের তুলনায় আরাে বেশী কঠিন আরাে বেশী কষ্টকর হয়ে গেছে এবং সে কঠিন অবস্থা যেন এ আয়াতের মাধ্যমে আজ মূর্ত হয়ে উঠছে তাদের সামনে। এরশাদ হচ্ছে, ‘বরং ওরা কেয়ামতের কথাকে মিথ্যা বলে দাবী করলাে।’ আর এই ঘৃণ্য ব্যবহার ও হঠকারিতার জন্যে তাদের সামনে সেই ভয়ানক আযাবের দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে যা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সে ভয়ানক শাস্তি আসবে দগদগে আগুন আকারে, যা পূর্ব থেকেই তাদেরকে গ্রাসের জন্যে প্রস্তুত থাকবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ, অস্বীকারকারী যে কোনাে ব্যক্তির জন্য টগবগে আগুনের শাস্তি ঠিক করে রেখেছি।’ সুনির্দিষ্ট করে কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, আমরা জীবনকে অন্যায় অবিচার ও যাবতীয় আবিলতা থেকে মুক্ত করতে চাই এবং মনের মধ্যে যেসব দুশ্চিন্তা, কুপ্ররােচনা ও অন্যায়ের প্রতি আকর্ষণ এবং রয়েছে অন্যায়ের প্রতি যেসব ঝোক প্রবণতা রয়েছে তার থেকে আমরা আমাদের গােটা সত্ত্বাকে পবিত্র করতে চাই। আল কোরআন এর মধ্যে যে বিজ্ঞান রয়েছে, তা বিভিন্ন উপায়ে এবং বিভিন্ন দৃশ্যের মধ্য দিয়ে এমনভাবে এখানে ফুটে ওঠে যা দেখে বিস্ময়ে আমরা হতবাক হয়ে যাই। সমগ্র জীবনটাই তো এক বিস্ময়, সুতরাং এ জীবন নিয়ে আল কোরআন যা কিছু বলেছে তা অবশ্যই তাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হবে যারা এ মহাগ্রন্থকে গবেষণা করে এবং অন্তর প্রাণ দিয়ে এ পাক কালামকে বুঝার চেষ্টা করে। আলোচ্য সূরার এই পর্যায়ে এসে আমরা উপনীত হয়েছি দোযখের আগুনের সামনে। এমন মর্মস্পশী বর্ণনার অবতারণা এখানে করা হয়েছে যে, আমাদের কল্পনা নেত্রে সে কঠিন আগুনের দৃশ্য ভেসে উঠছে। কতাে কঠিন এ আগুন! এর বর্ণনা দিতে গিয়ে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে (মরুভূমির বুকে) দুপুরের সময়ে যে উত্তপ্ত হাওয়া চলে, যার তাপে যে কোনাে মানুষের শরীর ঝলসে যায়, সেই উত্তপ্ততা আসে জাহান্নামের তাপ থেকে। সে কঠিন আগুনের মধ্যে সাঁতার কেটে বেড়াবে মানুষ। (হে রসূল) তুমি এ ভয়ানক দৃশ্য অনেক অনেক দূর থেকে দেখবে। সে আগুন প্রচন্ড আক্রোশে গর্জন করতে থাকবে এবং প্রলয়ংকরী ঢেউ তুলে তুলে জ্বলতে থাকবে। সে আগুনের শা শা শব্দ ও ক্রোধোমত্ত ধ্বনি সে পাপাচারীরা শুনতে থাকবে। সে আগুন তাদের দারুণ আক্রোশে পােড়াতে থাকবে এবং তার লেলিহান শিখা গােল্লা মেরে মেরে তাদের ওপর উঠতে থাকবে- আর ওরা হবে সে আগুনের জ্বালানী, তাদেরকে কঠিন আগুনের দিকে এগিয়ে দেয়া হবে। কল্পনা নেত্রে একবার সে দৃশ্যটি রাখুন এবং চিন্তা করুন কী ভয়ানক হবে সে দৃশ্য। বিশ্বাস হতে চায় না? দুনিয়ার বুকে কোনাে অগ্নিকান্ডের দৃশ্য যদি দেখে থাকেন এবং যদি সেই লেলিহান শিখার মধ্যে কারাে জ্বলতে থাকা নযরে পড়ে থাকে তাহলেই কখন বুঝবেন, সেখানে সেভাবে পাপাচারী কেউ জ্বলতে পারে কিনা। কিন্তু সে দিন তাে আজকের মতাে মৃত্যু থাকবে না। জ্বলবে, চীৎকার করবে, জীবন বেরুবে না, জ্বলে পুড়ে একেবারে নিশেষও হয়ে যাবে না, যেমন করে পেটের ব্যথার রুগী ছটফট করে যন্ত্রণায়, তবু মরে না পৃথিবীতে এ দৃশ্য তাে অনেকের চোখেই পড়ে। এসব ভয়ানক দৃশ্য চিন্তাশীল যে কোনাে ব্যক্তিকে প্রকম্পিত করে, এমন কঠিন ব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ছটফট করতে থাকে এবং থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার দেহ মন এবং মুহুর্মুহু সে শিউরে উঠতে থাকে কেয়ামতের দিনে যালেম ও সত্যকে প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্যে যে আগুন নির্ধারিত রয়েছে তার বর্ণনা এখানে পেশ করা হয়েছে সে কঠিন আগুনের ভয় যখন মনের ওপর ছেয়ে যায়, তখন পায়ে বল থাকে না, হাঁটতে গেলে নড়বড় করে! এরপর সত্য বিরােধী ও সত্যকে উপেক্ষাকারী প্রত্যেকটি ব্যক্তির জন্যে রয়েছে এ সম্বােধন, পাপাচারীরা সে ভয়ানক আগুনের মধ্যে পৌছে যাবে। সে ধ্বংসের গহ্বরে তাদেরকে একেবারে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হবে না যে, সে কঠিন আগুন থেকে পালিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। যখন বিদ্রোহী ও পাপাচারী ব্যক্তিদেরকে হাঁকিয়ে আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে, তখন তারা বাঁচার চেষ্টা করতে থাকবে কিন্তু কিছুতেই বাঁচতে পারবে না, বরং ধাক্কা মেরে ওই কুন্ডলি পাকিয়ে জ্বলতে থাকা আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে তাদেরকে ফেলে দেয়া হবে, তাদেরকে জিঞ্জিরে আবদ্ধ অবস্থায় এই ভীষণ আগুনে ফেলে দেয়া। তাদের হাতগুলাে পায়ের সাথে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকবে এবং ছুঁড়ে ফেলা হবে আগুন ভর্তি কোনাে সংকীর্ণ স্থানে। যারা বেড়ি পরা কয়েদীদের দেখেছেন, যারা দেখেছেন ফাঁসির আসামীকে মৃত্যু দন্ড প্রাপ্তির পর মৃত্যু শেলে থাকতে, যারা দেখেছেন ষ্টীল মিলের ষ্টীল গালানাে আগুনকে, যারা কল্পনা করতে পারেন আমাদের দেখা আগুন থেকে হাজার গুণ শক্তিশালী এটম বােমার আগুন সম্পর্কে তাদের পক্ষে যালেমদের অবস্থা বুঝা সহজ হবে। যারা আল্লাহর রাজ্যে বাস করে তাকে মানতে চায় না, তাঁর বান্দাদের প্রতি নিজ স্বার্থের জন্যে অকথ্য নির্যাতন চালায়, যারা মানুষকে শেয়াল কুকুরের মতাে আছড়ে আছড়ে মারে, চরম নিষ্ঠুরতার সাথে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে, পানিতে ডুবিয়ে মারে, পশু পাখীর মতাে যবাই করে, যারা বুঝতে চায় না তাদের শক্তি ক্ষমতার ওপর আরাে কারাে ক্ষমতা আছে এবং যারা মানতে চায় না যে তাদের এই দাপটের একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে, তাদের জন্যেই সে লেলিহান শিখা বিশ্ব সম্রাটের হুকুমে অপেক্ষা করছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলা হবে, শিকল দ্বারা হাত পা বাঁধা অবস্থায় সংকীর্ণ এক স্থানে, তখন (কষ্টের চোটে) তারা চূড়ান্ত ধ্বংসকে ডাকতে থাকবে (যেন এ আগুনের কষ্ট পরিসমাপ্তি ঘটে কিন্তু এ কষ্ট অবসানের জন্যে মৃত্যু (আসবে না), এজন্যে তারা বহু বহু মৃত্যুকে ডাকতে থাকবে।’ সে সময়ে মৃত্যু বড়াই কাম্য বস্তু হবে, যেহেতু মনে করা হবে অসহ্য সে যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্যে মৃত্যুই একমাত্র উপায়, কিন্তু মৃত্যুকে ডাকতে থাকার জওয়াবে তারা শুনতে থাকবে তীব্র উপহাস-বিদ্রুপ ও ভীষণ ঘৃণা ব্যঞ্জক কথা, এজন্যে বলা হয়েছে, ‘একটি মৃত্যুকে ডেকো না, বরং বহু মৃত্যুকে ডাকো’ তোমরা- দেখাে, কোনাে মৃত্যু তােমাদের এই কষ্টের অবসান ঘটাতে পারে কিনা! সেদিন মৃত্যু না থাকলেও মৃত্যু যাতনা তাে থাকবেই, কাজেই বহু মৃত্যু যাতনা এসে দেখাে না তােমাদের আগুনের কষ্ট লাঘব করাতে পারে কিনা (আসলে এটা বড়াে কঠিন বিদ্রুপ, যেহেতু মৃত্যু না আসলে যাতনা তাে আর বাড়তেই থাকেবে। এমনই কঠিন যাতনার পাশাপাশি মােত্তাকীদের জন্যে ওয়াদাকৃত সাফল্যের অবস্থাকে পেশ করা হচ্ছে। সেই সকল মােত্তাকীদের জন্যে রয়েছে ওয়াদা যারা তাদের মালিককে ভয় করে চলেছে। তার ভয়েতেই কোনাে সীমালংঘন করেনি। কারাে ওপর যুলুম, অত্যাচার করেনি এবং তার সাথে মােলাকাতের আশা পােষণ করতে থেকেছে, কেয়ামতকে বিশ্বাস করেছে। তাদের পুরস্কারপ্রাপ্তি ও শান্তির অবস্থাকে সামনে রেখে আবারও পাপাচারীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। বলো, সে অবস্থাটাই ভালাে, না চিরস্থায়ী জান্নাত, মুত্তাকীদের সাথে যার ওয়াদা করা হয়েছে সেটা ভালাে। তাদের জন্যে রয়েছে সে মহাপুরস্কার সে সুন্দর বাসস্থান। সেখানে তারা তাই পাবে যা তাদের মন চাইবে। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। তাদের রবের কাছে এটা হবে তাদের বড়াে পাওনা- এটা হবে তাদের বাঞ্ছিত দাবী, যা হবে বড়ােই আশা-আকাংখা করা ও চাওয়ার বস্তু, হাঁ, চাওয়ার বস্তুই বটে। এখন হিসাব করে দেখাে, হে পাপাচারীরা সে ঘৃণা ও দুঃখজনক অবস্থা ভালাে? না চিরস্থায়ী জান্নাত ভালাে? যার ওয়াদা আল্লাহ তায়ালা মােত্তাকীদের সাথে করেছেন? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চেয়েছেন, তারা জান্নাত সম্পর্কে চিন্তা করুক এবং আরও চেয়েছেন যে তারা আল্লাহর কাছে তার সেই ওয়াদা পূরণ করার জন্যে দোয়া করতে থাকুক, যার খেলায় তিনি করেন না, তিনি তাদের এ অধিকারও মঞ্জুর করেছেন যে, তারা সে জান্নাতে যা চাইবে তাই পাবে। এ অবস্থায় জান্নাতী ও দোযখী অবস্থার মধ্যে কোনাে তুলনা করা চলে কি? তবুও কেয়ামতের দিনে সেসব ব্যক্তির প্রতি যে বিদ্রুপবাণ নিক্ষেপ করা হবে সেই বিষয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন যারা আজ রসূলে করীম(স.)-এর সাথে ঠাট্টা মস্কারি করছে, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মূলে الْسَّاعَة শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ساعة মানে মুহূর্ত ও সময় এবং তার সাথে ال সংযোগ করার ফলে এর অর্থ হয়, সেই নির্দিষ্ট সময় যা আসবে এবং যে সম্পর্কে আমি পূর্বাহ্ণেই তোমাকে খবর দিয়েছি। কুরআনে বিভিন্ন স্থানে এ শব্দটি একটি পারিভাষিক অর্থে এমন একটি বিশেষ সময়ের জন্য বলা হয়েছে যখন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, পূর্বের ও পরের সবাইকে নতুন করে জীবিত করে উঠানো হবে, সবাইকে একত্র করে আল্লাহ হিসেব নেবেন এবং সবাইকে তার বিশ্বাস ও কর্ম অনুযায়ী পুরস্কার ও শাস্তি দেবেন।
# তারা যেসব কথা বলছে তার কারণ এ নয় যে, সত্যি সত্যিই কোন সঙ্গত ভিত্তিতে তাদের মনে এ সন্দেহ জেগেছে যে, কুরআন অন্য কোথাও থেকে নকল করা বাণীর সমষ্টি অথবা যথার্থই ধারণা করে যেসব আজাদ করা গোলামের নাম তারা রটিয়ে থাকে তারাই তোমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেয় কিংবা তুমি আহার করো ও বাজারে চলাফেরা করো কেবলমাত্র এ জিনিসটিই তোমার রিসালাত মেনে নেবার ব্যাপারে তাদের জন্য বাঁধার সৃষ্টি করছে অথবা তোমার সত্যের শিক্ষা মেনে নিতে তারা তৈরিই ছিল কিন্তু তোমার সাথে আরদালী, হিসেবে কোন ফেরেশতা ছিল না এবং তোমার জন্য কোন অর্থভাণ্ডারও অবতীর্ণ করা হয়নি শুধুমাত্র এজন্যই তারা পিছিয়ে গিয়েছে। এগুলোর কোনটিই আসল কারণ নয়। বরং আখেরাত অস্বীকারই হচ্ছে এর আসল কারণ, যা হক ও বাতিলের ব্যাপারে তাদেরকে একেবারেই দায়িত্বহীন বানিয়ে দিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে তারা আদতে কোন গভীর চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা অনুসন্ধানের প্রয়োজনই অনুভব করে না এবং তোমার যুক্তিসঙ্গত দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার জন্য এমনই সব হাস্যকর যুক্তি পেশ করতে উদ্যত হয়েছে। এ জীবনের পরে আর একটি জীবনও আছে যেখানে আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে তাদের সমস্ত কার্যকলাপের জবাবহিতি করতে হবে, এ চিন্তা তাদের মাথায় আসেই না। তারা মনে করে, এ দুদিনের জীবনের পরে সবাইকে মরে গিয়ে মাটিতে মিশে যেতে হবে। মূর্তি পূজারীও যেমন মাটিতে মিশে যাবে, তেমনি আল্লাহতে বিশ্বাসী এবং আল্লাহতে অবিশ্বাসীও। কোন জিনিসেরও কোন পরিণাম ফল নেই। তাহলে মুশরিক হিসেবে মরা এবং তাওহীদবাদী বা নাস্তিক হিসেবে মরার মধ্যে ফারাক কোথায়? তাদের দৃষ্টিতে সত্য ও অসত্যের মধ্যকার ফারাকের যদি কোন প্রয়োজন থেকে থাকে তাহলে তা থাকে এ দুনিয়ার সাফল্য ও ব্যর্থতার দিক দিয়ে, অন্য কোন দিক দিয়ে নয়। এখানে তারা দেখে, কোন বিশ্বাস বা নৈতিক মূলনীতিরও কোন নির্ধারিত ফলাফল নেই। প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রতিটি মনোভাব ও কর্মনীতির ব্যাপারে পূর্ণ সমতা সহকারে এ ফলাফল প্রকাশিত হয় না। নাস্তিক, অগ্নি উপাসক, খৃস্টান, ইয়াহূদী ও নক্ষত্র পূজারী সবাই ভাল ও মন্দ উভয় ধরনের অবস্থার মুখোমুখী হয়। এমন কোন একটি বিশ্বাস নেই যে সম্পর্কে অভিজ্ঞতা এ কথা বলে যে, এ বিশ্বাস অবলম্বনকারী অথবা তা প্রত্যাখ্যানকারী এ জগতে চিরকাল নিশ্চিত সচ্ছল বা নিশ্চিত অসচ্ছল অবস্থায় থাকে। অসৎকর্মশীল এবং সৎকর্মশীলও এখানে চিরকাল নিজের কর্মকাণ্ডের একই নির্ধারিত ফল ভোগ করে না। একজন অসৎকর্মশীল আরাম-আয়েশ করে যাচ্ছে এবং অন্যজন শাস্তি পাচ্ছে। একজন সৎকর্মশীল বিপদ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে এবং অন্যজন সম্মানীয় ও মর্যাদাশালী হয়ে বসে আছে। কাজেই পার্থিব ফলাফলের দিক দিয়ে কোন বিশেষ নৈতিক মনোভাব ও কর্মনীতি সম্পর্কেও আখেরাত অস্বীকারকারীরা তার কল্যাণ বা অকল্যাণ হবার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না। এহেন পরিস্থিতিতে যখন কোন ব্যক্তি তাদেরকে একটি বিশ্বাস ও একটি নৈতিক নিয়ম-শৃংখলার দিকে আহ্বান জানায় তখন সে যতই গুরুগম্ভীর ও ন্যায়সঙ্গত যুক্তির সাহায্যে নিজের দাওয়াত পেশ করুক না কেন একজন আখেরাত অস্বীকারকারী কখনো গুরুত্ব সহকারে তা বিবেচনা করবে না বরং বালকসুলভ ওজর-আপত্তি জানিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করবে।
# আগুন কাউকে দেখবে-একথাটা সম্ভবত রূপক অর্থে বলা হয়েছে। যেমন আমরা বলি, ঐ জামে মসজিদের মিনার তোমাকে দেখছে। আবার এটা প্রকৃত অর্থেও হতে পারে। অর্থাৎ জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের মতো চেতনাহীন হবে না বরং ভালোভাবে দেখে শুনে জ্বালাবে।
# মূল শব্দ হচ্ছে وَعْدًا مَسْئُولًا অর্থাৎ এমন প্রতিশ্রতি যা পূর্ণ করার দাবী করা যেতে পারে। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারে, জান্নাতের এ প্রতিশ্রুতি ও জাহান্নামের এ ভীতি প্রদর্শন এমন এক ব্যক্তির ওপর কি প্রভাব ফেলতে পারে যে পূর্ব থেকেই কিয়ামত, শেষ বিচারের দিন এবং জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ্বাস করে না? এদিক দিয়ে বিচার করলে বাহ্যত এটি পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে অসঙ্গতিশীল একটি বাণী বলে মনে হবে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে একথাটা সহজেই বোধগম্য হবে। ব্যাপার যদি এমন হয় যে, আমি একটি কথা স্বীকার করাতে চাই এবং অন্যজন তা স্বীকার করতে চায় না, তাহলে এক্ষেত্রে আলোচনা ও বিতর্কের ধরন হবে এক রকম। কিন্তু যদি আমি নিজের শ্রোতার সাথে এমনভাবে আলাপ করতে থাকি যে, আমার কথা মানা না মানার ব্যাপারটা আলোচ্য নয় বরং শ্রোতার স্বার্থ ও লাভ-ক্ষতিই হচ্ছে আলোচ্য বিষয়, তাহলে এক্ষেত্রে শ্রোতা যতই হঠকারী হোক না কেন একবার অবশ্যই চিন্তা করতে বাধ্য হবে। এখানে কথা বলার ও বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য এ দ্বিতীয় ভংগীটিই অবলম্বিত হয়েছে। এ অবস্থায় শ্রোতাকে তার নিজের কল্যাণের জন্য একথা ভাবতে হয় যে, পরকালীন জীবন অনুষ্ঠিত হবার প্রমাণ যদি নাই বা থাকে তাহলে তার অনুষ্ঠিত না হবারও তো কোন প্রমাণ নেই। আর সম্ভাবনা উভয়টিরই আছে। এখন যদি পরকালীন জীবন না থেকে থাকে, যেমনটি আমরা মনে করছি, তাহলে আমাদেরও মরে মাটির সাথে মিশে যেতে হবে এবং পরকালীন জীবন স্বীকারকারীদেরও। এ অবস্থায় উভয়ে সমান পর্যায়ে অবস্থান করবে। কিন্তু যদি এ ব্যক্তি যে কথা বলছে তা-ই সত্য হয়ে যায় তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমাদের বাঁচোয়া নেই। এভাবে এ বাচনভংগী শ্রোতার হঠকারিতার দেয়ালে ফাটল ধরিয়ে দেয়। এ ফাটল আরো বেশী বেড়ে যায় যখন কিয়ামত, শেষ বিচার, হিসেব-নিকেশ, দোজখ ও বেহেশতের এমন বিস্তারিত নকশা পেশ করা হয় যেমন কেউ সেখানকার স্বচক্ষে দেখা ঘটনাবলী বর্ণনা করছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য। এমনকি তারা কিয়ামত দিবসকেও অস্বীকার করে বসেছে। তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি এদের জন্যই জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“যখন বলা হয়: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলার প্রতিশ্র“তি সত্য এবং কিয়ামত এতে কোন সন্দেহ নেই, তখন তোমরা বলে থাক: আমরা জানি না কিয়ামত কী; আমরা মনে করি এটি একটি ধারণা মাত্র এবং আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত নই। তাদের মন্দ কর্মগুলো তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করত তা তাদেরকে পরিবেষ্টন করবে। আর বলা হবে: আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে যাব যেমন তোমরা এই দিবসের সাক্ষাতকে ভুলে গিয়েছিলে। তোমাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।” (সূরা জাসিয়া ৪৫:৩২-৩৪)
এ সমস্ত লোকেদেরকে জাহান্নাম যখন দেখতে পাবে তখন সে চিৎকার ও গর্জন করতে থাকবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِذَآ أُلْقُوْا فِيْهَا سَمِعُوْا لَهَا شَهِيْقًا وَّهِيَ تَفُوْرُ لا – تَكَادُ تَمَيَّزُ مِنَ الْغَيْظِ ط كُلَّمَآ أُلْقِيَ فِيْهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَآ أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيْرٌ)
“যখন তারা তাতে (জাহান্নামে) নিক্ষিপ্ত হবে তখন তারা তার গর্জনের শব্দ শুনতে পাবে, আর তা টগবগ করে ফুটবে। অত্যধিক ক্রোধে তা ফেটে পড়ার উপক্রম হবে।” (সূরা মুলক ৬৭:৭-৮)
অতঃপর যখন তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে তখন তারা শুধু মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু তখন তাদেরকে বলা হবে আজ এক মৃত্যুকে ডেকে কোন লাভ নেই বরং বহু মৃত্যুকে ডাক অর্থাৎ তারা সেখানে শুধু শাস্তি ভোগ করবে আর কখনো মৃত্যুবরণ করবে না।
# পৃথিবীর সকল কাফির মুশরিদেরকে বিশেষ করে যারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রমাণস্বরূপ জান্নাত তথা বাগানের দাবী করছিল তাদেরকে বলে দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন যে, দুনিয়ার বাগান উত্তম নাকি আখিরাতের বাগান উত্তম। দুনিয়ার বাগান শেষ হয়ে যাবে, নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আখিরাতের বাগান তথা জান্নাত কোনদিন শেষ হবে না। এ নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে প্রবেশ করবে একমাত্র ঐ সকল লোকেরা যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে। আর সেখানে তাদের জন্য তাই থাকবে যা তারা কামনা করবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
* কিয়ামত সংঘটিত হবেই।
* জান্নাত, জাহান্নাম বিদ্যমান রয়েছে।
* জাহান্নামের চিৎকার ও গর্জন থাকবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# মহান আল্লাহ বলেনঃ বরং তারা কিয়ামতকে অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ এরা এসব যা কিছু বলছে তা শুধু গর্ব, অবাধ্যতা, জিদ ও হঠকারিতার বশবর্তী হয়েই বলছে। এ নয় যে, তারা যা কিছু বলছে তা হয়ে গেলে তারা মুসলমান হয়ে যাবে। বরং এরপরেও তারা কোন কৌশল বের করবে। তাদের অন্তরে তো এটা বদ্ধমূল রয়েছে যে, কিয়ামত সংঘটিত হবেই না। আর এরূপ লোকদের জন্যেই আমি জ্বলন্ত অগ্নি প্রস্তুত রেখেছি। এটা তাদের সহ্যের বাইরে। দূর হতে অগ্নি যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে এর ক্রুদ্ধ গর্জন ও চীকার। জাহান্নাম ঐ দুষ্ট লোকদেরকে দেখে ক্রোধে দাঁতে আঙ্গুন কাটবে এবং ভীষণ গর্জন ও চীৎকার করবে যে, কখন সে ঐ কাফিরদেরকে গ্রাস করবে। আর কখন সে ঐ যালিমদের নিকট হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যখন তারা ওর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে তখন তারা জাহান্নামের শব্দ শুনবে, আর তা হবে উদ্বেলিত। ক্রোধে জাহান্নাম যেন ফেটে পড়বে।” (৬৭:৭-৮),
নবী (সঃ)-এর সাহাবীদের এক ব্যক্তি হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আমার নাম দিয়ে এমন কথা বলে যা আমি বলিনি, যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতাকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে নিজের পিতা-মাতা বলে, যে গোলাম নিজের মনিবকে বাদ দিয়ে অন্যকে নিজের মনিব বলে পরিচয় দেয় তারা যেন জাহান্নামের দুই চক্ষুর মাঝে নিজেদের বাসস্থান ঠিক করে নেয়।” জিজ্ঞেস করা হলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জাহান্নামেরও কি দুই চক্ষু রয়েছে?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “তুমি কি আল্লাহর কালামের নিম্নের আয়াতটি শুননি?” (আরবি)
অর্থাৎ “যখন ওটা (জাহান্নাম) তাদেরকে দূর স্থান হতে দেখবে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু ওয়ায়েল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা আমরা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর সাথে বের হই। আমাদের সাথে হযরত রাবী ইবনে খাইমও (রাঃ) ছিলেন। পথে একটি কামারের দোকান দেখা যায়। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) সেখানে দাড়িয়ে যান। সেখানে লোহাকে আগুনে গরম করা হচ্ছিল তাই তিনি দেখতে ছিলেন। হযরত রাবী (রাঃ)-এর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আল্লাহর শাস্তির ছবি তার চোখের সামনে প্রকাশিত হলো। তাঁর অবস্থা এমনই হলো যে, যেন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। এরপর হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) ফুরাতের তীরে গেলেন। সেখানে তিনি একটি চুল্লী দেখলেন যার মধ্যে অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হচ্ছিল। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে (আরবি) (অর্থাৎ দূর হতে অগ্নি যখন তাদেরকে দেখবে তখন তারা শুনতে পাবে এর ক্রুদ্ধ গর্জন ও চীৎকার)। এটা শশানামাত্রই হযরত রাবী (রাঃ) অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। খাটের উপর উঠিয়ে নিয়ে তাঁকে তাঁর বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তার পার্শ্বে বসে থাকেন এবং তাঁকে দেখা শোনা করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর আর জ্ঞান ফিরেনি।” (এটা ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, জাহান্নামীকে যখন জাহান্নামের দিকে হেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে তখন জাহান্নাম ভীষণ চীৎকার করবে এবং ক্রোধে এমনভাবে ফেটে পড়বে যে হাশরের মাঠে উপস্থিত জনতা সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, কোন কোন লোককে যখন জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে তখন জাহান্নাম জড়সড় ও সংকুচিত হয়ে যাবে। তখন রহমান (দয়ালু আল্লাহ) জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করবেনঃ “তোমার কি হলো?” উত্তরে জাহান্নাম বলবেঃ “হে আমার প্রতিপালক! এ তো দুআয় আপনার নিকট জাহান্নাম হতে আশ্রয় প্রার্থনা করতো এবং আজও সে আশ্রয় প্রার্থনা করতে রয়েছে।” একথা শুনে তার প্রতি আল্লাহর দয়া হবে এবং তিনি নির্দেশ দিবেনঃ “তাকে ছেড়ে দাও।” আরও কতক লোককে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তারা বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার সম্পর্কে তো এরূপ ধারণা আমাদের ছিল না।” আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞেস করবেনঃ “তোমাদের কিরূপ ধারণা ছিল?” তারা উত্তরে বলবেঃ “আমাদের ধারণা এটাই ছিল যে, আপনার রহমত আমাদেরকে ঢেকে নেবে, আপনার করুণা আমাদের অবস্থার অনুকূলে হবে এবং আপনার প্রশস্ত রহমত আমাদেরকে স্বীয় আঁচলে জড়িয়ে ফেলবে।” আল্লাহ তা’আলা তাদের আশাও পুরো করবেন এবং (ফেরেশতাদেরকে) নির্দেশ দিবেনঃ “আমার এই বান্দাদেরকেও ছেড়ে দাও।”
আরো কিছু লোককে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসা হবে। তাদেরকে দেখা মাত্রই জাহান্নাম ক্রোধে চীৎকার করতে করতে এগিয়ে আসবে এবং এমনভাবে ক্রোধে ফেটে পড়বে যে, হাশরের মাঠে উপস্থিত জনতা ভীষণভাবে আতংকিত হবে।
হযরত উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রাঃ) বলেন যে, জাহান্নাম যখন ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে থাকবে এবং ভীষণ চীৎকার শুরু করে দেবে ও কঠিন উত্তেজিত হয়ে উঠবে তখন সমস্ত নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতা এবং মর্যাদা সম্পন্ন। নবীগণ কম্পিত হবেন। এমনকি হযরত ইবরাহীম খলীলও (আঃ) হাঁটুর ভরে পড়ে যাবেন এবং বলতে থাকবেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আজ আমি আপনার কাছে শুধু নিজের প্রাণ রক্ষার জন্যে প্রার্থনা করছি। আর কিছুই চাচ্ছি না।”
এই লোকদেরকে জাহান্নামের অত্যন্ত সংকীর্ণ স্থান দিয়ে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হবে যেমনভাবে বর্শাকে ছিদ্রে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। অন্য রিওয়াইয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করা এবং তার নিম্নরূপ কথা বলা বর্ণিত আছেঃ “যেমনভাবে পেরেককে দেয়ালে অতি কষ্টে গেড়ে দেয়া হয় তেমনিভাবে জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামের মধ্যে ঠুসিয়ে দেয়া হবে।” ঐ সময় তারা শৃংখলিত অবস্থায় থাকবে এবং ধ্বংস ও মৃত্যু কামনা করবে। তাদেরকে তখন বলা হবে। আজ তোমরা একবারের জন্যে ধ্বংস কামনা করো না, বরং বহুবার ধ্বংস হবার কামনা করতে থাকো।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সর্বপ্রথম ইবলীসকে জাহান্নামের পোশাক পরানো হবে। সে ওটা তার কপালের উপর রাখবে এবং পিছন হতে তার সন্তানদেরকে টানতে টানতে নিয়ে চলবে, আর মৃত্যু ও ধ্বংস কামনা করতঃ ফিরতে থাকবে। তার সাথে সাথে তার সন্তানরাও হায়! হায়! করবে এবং ধ্বংস ও মৃত্যুকে ডাকতে থাকবে। ঐ সময় তাদেরকে বলা হবে- “আজ তোমরা একবারের জন্যে ধ্বংস কামনা করো না, বরং বহুবার ধ্বংস হবার কামনা করতে থাকো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
(আরবি) শব্দের ভাবার্থ হলো মৃত্যু, ধ্বংস, ক্ষতি, দুর্ভাগ্য ইত্যাদি। যেমন হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউনকে বলেছিলেনঃ অর্থাঃ “হে ফিরাউন! আমি তো মনে করি যে, তুমি ধ্বংসপ্রাপ্তই হবে।” (১৭:১০২)
# ১৫-১৬ নং আয়াতের তাফসীর
পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে ঐ দুষ্ট ও পাপীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে যাদেরকে অত্যন্ত লাঞ্ছিত অবস্থায় উল্টোমুখে জাহান্নামের দিকে টেনে আনা হবে এবং মাথার ভরে জাহান্নামে প্রবিষ্ট করা হবে। ঐ সময় তারা শৃংখলিত থাকবে। তারা থাকবে অত্যন্ত সংকীর্ণ স্থানে, যেখান থেকে না তারা ছুটতে পারবে, নড়তে পারবে, না পালাতে পারবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি কাফির ও মুশরিকদেরকে জিজ্ঞেস কর- এটাই কি শ্রেয়, না স্থায়ী জান্নাত শ্রেয়, যার প্রতিশ্রুতি মুত্তাকীদেরকে দেয়া হয়েছে? অর্থাৎ দুনিয়ায় যারা পাপকর্ম হতে বেঁচে থেকেছে এবং আল্লাহর ভয় অন্তরে রেখেছে, আজ তারা ওর বিনিময়ে প্রকৃত বাসস্থানে পৌঁছে গেছে, অর্থাৎ জান্নাতে। সেখানে রয়েছে তাদের চাহিদামত নিয়ামতরাজি, চিরস্থায়ী ভোগ্যবস্তু এবং এমন আনন্দের জিনিস যা কখনো শেষ হবার নয়। তথায় আছে সুস্বাদু ও উপাদেয় খাদ্য, উত্তম বিছানাপত্র, ভাল ভাল যানবাহন, সুন্দর সুন্দর পোশাক, চমৎকার বাসস্থান, সুন্দর সুন্দর সাজে সজ্জিতা সুলোচনা হুরগণ এবং আরাম ও শান্তিদায়ক দৃশ্য। এগুলো চোখে দেখা তো দূরের কথা, কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারে না। এগুলো কমে যাবার, খারাপ হওয়ার, ভেঙ্গে যাবার এবং শেষ হয়ে যাওয়ার কোনই আশংকা নেই। তার। সেখান হতে কখনো বহিষ্কৃত হবে না। তারা সেখানে চিরন্তন উত্তম জীবন, সীমাহীন রহমত এবং চিরস্থায়ী সম্পদ লাভ করবে। এ সবগুলো হলো প্রতিপালকের ইহসান ও ইনআম, যা তারা লাভ করেছে এবং যেগুলো তাদের প্রাপ্য ছিল। এটা হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার প্রতিশ্রুতি যা তিনি নিজের দায়িত্বে গ্রহণ করেছেন। এটা পূর্ণ হবেই। এটা পূর্ণ না হওয়া অসম্ভব এবং এটা ভুল হওয়াও সম্ভব নয়। তাঁর কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্যে প্রার্থনা কর। তার কাছে জান্নাত চাও এবং তাঁকে তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দাও। এটাও তাঁর অনুগ্রহ যে, ফেরেশতারা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করবেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার মুমিন বান্দাদের সাথে আপনি যে ওয়াদা করেছেন তা পূরণ করুন এবং তাদেরকে জান্নাতে আদনে প্রবেশ করিয়ে দিন।” আিমতের দিন মুমিন বান্দারা বলবেনঃ “হে বিশ্বপ্রতিপালক! আমরা আপনার কিতিকে সামনে রেখে আমল করেছিলাম। আজ আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি পূরণ করুন।”
এখানে প্রথমে জাহান্নামীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অতঃপর প্রার্থনার পরে অতীদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সূরায়ে সফফাতে জান্নাতীদের সম্পর্কে আলোচনা করতঃ প্রার্থনার পরে জাহান্নামীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেছেনঃ “আপ্যায়নের জন্যে এটাই শ্রেয়, না যাককূম বৃক্ষ? যালিমদের জন্যে আমি এটা সৃষ্টি করেছি পরীক্ষা স্বরূপ। এই বৃক্ষ উপাত হয় জাহান্নামের তলদেশ হতে। এর মোচা যেন শয়তানের মাথা। তারা এটা হতে ভক্ষণ করবে এবং উদর পূর্ণ করবে এটা দ্বারা। তদুপরি তাদের জন্যে থাকবে ফুটন্ত পানির মিশ্রণ। আর তাদের গন্তব্য হবে অবশ্যই প্রজ্বলিত অগ্নির দিকে। তারা তাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছিল বিপথগামী এবং তারা তাদের পদাংক অনুসরণে ধাবিত হয়েছিল।