(বই#৯৯৫) [আমি তো তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি ।] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯৫)
[আমি তো তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি ।]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৯
৫৬-৬২ নং আয়াত:-
২৫:৫৬
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا ﴿۵۶﴾
আমি তো তোমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি ।
২৫:৫৭
قُلۡ مَاۤ اَسۡـَٔلُکُمۡ عَلَیۡہِ مِنۡ اَجۡرٍ اِلَّا مَنۡ شَآءَ اَنۡ یَّتَّخِذَ اِلٰی رَبِّہٖ سَبِیۡلًا ﴿۵۷﴾
এদের বলে দাও “এ কাজের জন্য আমি তোমাদের কাছ থেকে কোন প্রতিদান চাই না, যে চায় সে তার নিজের রবের পথ অবলম্বন করুক, এটিই আমার প্রতিদান।
২৫:৫৮
وَ تَوَکَّلۡ عَلَی الۡحَیِّ الَّذِیۡ لَا یَمُوۡتُ وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِہٖ ؕ وَ کَفٰی بِہٖ بِذُنُوۡبِ عِبَادِہٖ خَبِیۡرَا ﴿ۚۛۙ۵۸﴾
তুমি তাঁর উপর নির্ভর কর যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই এবং তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর, তিনি তাঁর দাসদের পাপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত।
২৫:৫৯
ۣالَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَا فِیۡ سِتَّۃِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسۡتَوٰی عَلَی الۡعَرۡشِ ۚۛ اَلرَّحۡمٰنُ فَسۡـَٔلۡ بِہٖ خَبِیۡرًا ﴿۵۹﴾
তিনি আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেন; তারপর তিনি ‘আরশের উপর উঠলেন। তিনিই ‘রাহমান’, সুতরাং তাঁর সম্বন্ধে যে অবহিত তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
২৫:৬০
وَ اِذَا قِیۡلَ لَہُمُ اسۡجُدُوۡا لِلرَّحۡمٰنِ قَالُوۡا وَ مَا الرَّحۡمٰنُ ٭ اَنَسۡجُدُ لِمَا تَاۡمُرُنَا وَ زَادَہُمۡ نُفُوۡرًا ﴿٪ٛ۶۰﴾
যখন ওদেরকে বলা হয়, ‘পরম দয়াময়ের প্রতি তোমরা সিজদাবনত হও।’ তখন ওরা বলে, ‘পরম দয়াময় আবার কে? তুমি কাউকেও সিজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সিজদা করব?’ আর এতে ওদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়। (সাজদাহ-৭)
২৫:৬১
تَبٰرَکَ الَّذِیۡ جَعَلَ فِی السَّمَآءِ بُرُوۡجًا وَّ جَعَلَ فِیۡہَا سِرٰجًا وَّ قَمَرًا مُّنِیۡرًا ﴿۶۱﴾
অসীম বরকত সম্পন্ন তিনি যিনি আকাশে বুরুজ নির্মাণ করেছেন এবং তার মধ্যে একটি প্রদীপ ও একটি আলোকময় চাঁদ উজ্জ্বল করেছেন।
২৫:৬২
وَ ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ الَّیۡلَ وَ النَّہَارَ خِلۡفَۃً لِّمَنۡ اَرَادَ اَنۡ یَّذَّکَّرَ اَوۡ اَرَادَ شُکُوۡرًا ﴿۶۲﴾
তিনিই রাত ও দিনকে পরস্পরের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে শিক্ষা গ্রহণ করতে অথবা কৃতজ্ঞ হতে চায়।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*নবীর দায়িত্ব ও কর্তব্য : এরপর আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে প্রবােধ ও আশ্বাস দিচ্ছেন পরবর্তী আয়াতে। তাঁর বােঝা হালকা করে দিচ্ছেন এই বলে যে, তিনি যখন সুসংবাদ দান ও সতর্কীকরণের মাধ্যমে এবং কোরআনের সাহায্যে কাফেরদের সাথে সংগ্রাম করার মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে কাফেরদের শত্রুতায় তার উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই। কেননা তার শত্রুদের সাথে তার পক্ষ হয়ে লড়াই করার দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। অতএব তার উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা করা। তিনিই তাঁর বান্দাদের গুনাহ সম্পর্কে অবহিত। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আমি তােমাকে কেবল সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি…'(আয়াত ৫৬-৫৮) এভাবে রসূল(স.) এর দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। সেটা হলাে সুসংবাদ দান ও সতর্কীকরণ। মক্কায় থাকাকালে মােশরেকদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ তখনাে তাকে দেয়া হয়নি। বরং সুসংবাদ দান ও সতর্কীকরণের মধ্যেই দাওয়াতী কাজ সীমাবদ্ধ করা হয়েছিলাে। যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে মদীনায় যাওয়ার পর। এর পেছনে যে কী মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। আমার ধারণা, ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারীরা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে একটা স্থীতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলতে পারে, তারা এমন খুনের প্রতিশােধের চক্রে জড়িয়ে না পড়ে, যা কোরায়শদেরকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘস্থায়ী বিদ্বেষ সৃষ্টি না করে, সে জন্যেই মক্কায় জেহাদ ফরয করা হয়নি। বিশেষত আল্লাহ তায়ালা তাে জানেন, কুরাইশদের অনেকেই হিজরতের আগে এবং তাদের সবাই মক্কা বিজয়ের পরে ইসলামে প্রবেশ করবে। আর তখন আল্লাহর ইচ্ছায় তারাই হবে ইসলামের শাশ্বত আকীদা বিশ্বাসের রক্ষক ও অভিভাবক। তবে রেসলাতের মূল কাজ মদিনায় যথারীতি বহাল ছিলাে। সেই মূল কাজ হলাে সুসংবাদ দান ও সতর্কীকরণ। যুদ্ধের অনুমতি শুধু দাওয়াতের বাধা অপসারণের, দাওয়াতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ও মুসলমানদেরকে তাদের শত্রুদের পক্ষ থেকে সৃষ্টি করা যাবতীয় বাধাবিপত্তি থেকে মুক্ত করার জন্যেই দেয়া হয়েছিল। সুতরাং, ‘তোমাকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসাবেই পাঠিয়েছি’ এই কথাটা মক্কা ও মদীনা উভয় জায়গাতেই সমভাবে প্রযােজ্য ও কার্যকর। তুমি বলাে, আমি এ কাজের জন্যে তোমাদের কাছে কোনাে পারিশ্রমিক চাই না, তবে যে ইচ্ছা করে, সে তার প্রভুর পথ অবলম্বন করুক।(আয়াত ৫৭) অর্থাৎ ইসলামের পথ অবলম্বনকারীদের কাছ থেকে কোনাে পারিশ্রমিক বা পার্থিব স্বার্থ অর্জনের মােহে রসূল আক্রান্ত নন। একজন মুসলমানকে ইসলামের কালেমা উচ্চারণ ও তাতে বিশ্বাস স্থাপনের জন্যে কোনাে নযর নেয়ায, কোরবানী বা ভেট দিতে হয় না। এটাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য। এখানে কোনাে ব্রাহ্মণ বা পুরােহিত নেই, যে তার পৌরহিত্যের মজুরি আদায় করবে। এখানে কোনাে ভর্তি ফি নেই, যা কোনাে বরকত বা ফায়েয লাভের জন্যে দেয়া লাগে। মনমগজ যখন ঈমান আনতে প্রস্তুত, তখন ঈমান আনার পথে কোনাে বাধা থাকে না- এটাই ইসলামের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর বান্দার মাঝে কোনাে পীর পুরােহিত আড় হয়ে দাঁড়াতে পারে না। রসূল(স.) কেবল একটা মজুরীই পান। সেটা হলাে, একজন মানুষের আল্লাহর পথ অবলম্বন তথা ইসলাম গ্রহণ ও স্বতস্ফূর্তভাবে তাঁর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট হওয়া। তবে যে ইচ্ছা করে, সে আপন প্রভুর পথ অবলম্বন করুক।’ এটাই তার একমাত্র পারিশ্রমিক। তাঁর পবিত্র মন এতেই সন্তুষ্ট এবং তার মহানুভব হৃদয় এতেই খুশী যে, আল্লাহর একজন বান্দাকে তিনি হেদায়াত লাভ করতে দেখেন, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হতে দেখেন এবং তাঁর পথ অবলম্বন করতে দেখেন। ‘আর সেই চিরঞ্জীব সত্ত্বার ওপর নির্ভর করাে, যিনি কখনাে মারা যান না এবং তার প্রশংসা সহকারে তাসবীহ করাে।'(আয়াত ৫৮) বস্তুত আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর সব কিছুই মৃত, কেননা সবাই মরণশীল ও ধ্বংসশীল। একমাত্র তিনিই চিরঞ্জীব, অমর ও অক্ষয়। তিনি ছাড়া আর কেউ বা কিছুই টিকে থাকবে না। কোনাে মরণশীল চাই সে দীর্ঘজীবী হােক বা ক্ষণজীবী হােক তার ওপর নির্ভর করা একটা ভংগুর খুঁটির ওপর ভর দেয়ারই শামিল। নির্ভর করা যায় শুধু চিরঞ্জীব মাবুদের ওপর। এবং তার প্রশংসা সহকারে তাসবীহ করাে। কেননা তিনিই সীমাহীন নেয়ামত দাতা। আর সেই সব কাফেরকে চিরঞ্জীব আল্লাহর হাতে সমর্পণ কর, যাদেরকে সতর্কীকরণ ও সুসংবাদ দানে কোনাে লাভ হবে না। কেননা তিনিই তাদের পাপের খবর রাখেন। ‘তিনিই তার বান্দাদের গুণাহ সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত।’

*ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারী : বর্তমান আলােচনার মধ্যে ওদের হঠকারিতা, জেদ এবং নিজেদের স্বার্থের জন্যে নির্লজ্জ বিরােধিতার যে উপমা তুলে ধরা হয়েছে তা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। এ উদাহরণগুলাে পেশ করার পর যে কোনাে বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে ওদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ঘৃণার সঞ্চার হবে। ওদের সত্যবিরােধী জেদী মনোভাব বুঝাতে গিয়ে আকাশের দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, গােটা সৃষ্টিজগতকেই ব্যবহার করা হয়েছে এই সব মানুষকে জ্ঞান দানের পুস্তক হিসাবে এবং এ ব্যাপারে শুরু করা হয়েছে আকাশের রহস্যপূর্ণ দৃশ্যাবলীর উল্লেখ দ্বারা, তারপর পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তুর নযির তুলে ধরা হয়েছে, যেমন পানি ভর্তি বায়ু, জীবন মৃত্যু, মরণের পর পুনরায় জীবিত হয়ে ওঠা ও আল্লাহর দরবারে সবার হাযির হওয়া ইত্যাদি, কিন্তু এসব উদাহরণ দ্বারাও যাদের বিবেকে সাড়া জাগে না, তাদের হঠকারিতা বুঝানাের জন্যে চূড়ান্ত এই উপমা তুলে ধরা হয়েছে যে তারা এতাে বেশী সত্যবিরােধী এবং নিজেদের স্বার্থের ব্যাপারে এতাে বেশী অন্ধ যে তাদের সামনে যদি আকাশে ওঠে যাওয়ার জন্যে কোনাে দরজাও খুলে দেয়া হতাে এবং আল্লাহর রহস্য ভান্ডার অবলােকন করতে করতে সম্মুখ পানে এগিয়ে গিয়ে তারা আল্লাহর ক্ষমতাসমূহ প্রত্যক্ষ করতাে তবুও তারা নবী(স.)-এর কথা ও কোরআনের বাণীকে সত্য বলে মেনে নিতে না। বরং তারা বলতো, আমাদেরকে নযরবন্দী করে ফেলা হয়েছে। এতেও তৃপ্ত না হয়ে তারা আরাে বলে উঠতাে, আমরা গােটা জাতি এই মারাত্মক যাদুর স্পর্শে হয়ে গিয়েছি মন্ত্রমুগ্ধ। সে আমাদেরকে যা দেখাচ্ছে ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, বাধ্য হয়ে আমরা তাই দেখছি। এ অবস্থাটাকে তুলে ধরার জন্যে আরাে বলা হচ্ছে, ‘আর অবশ্যই আমি, বানিয়েছি আকাশের মধ্যে সুউচ্চ গম্বুজ বিশিষ্ট কেল্লাসমূহ… তাকে তাড়া করে নিয়ে যায় উজ্জল উল্কা পিন্ড।’ এটাই হচ্ছে সুপ্রশস্ত ও চিরস্থায়ী সুরক্ষিত ফলকের মধ্যে লিখিত প্রথম অংশ। অবশ্যই এটা মহান আল্লাহর অদৃশ্য হাতের ইশারায় অংকিত রহস্যে ভরা সেই চিরস্থায়ী ফলকের লিখন। আর আল কোরআন এর ভাষাই এমন এক মােজযা যা ফেরেশতাদের আগমন থেকেও অনেক বেশী আশ্চর্যজনকভাবে আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূল সম্পর্কে সাক্ষ্য বহন করছে এবং বিশ্ব সৃষ্টির পরিকল্পনা ও পরিচালনার জটিলতা সম্পর্কেও আমাদেরকে অবহিত করছে এবং এ মহা সৃষ্টির বিশালত্ব সম্পর্কে জানাচ্ছে। এখানে বুরূজ বা কেল্লাসমূহের যে উল্লেখ হয়েছে তার দ্বারা তারকারাজি ও সুবিশাল ছায়ালােককে বুঝানাে হয়েছে । এটাও জানানাে হয়েছে যে, এসব গ্রহ-নক্ষত্র এক মুহূর্তের জন্যেও স্থির হয়না, বরং প্রত্যেকটি নিজ নিজ গতি পথে সদা সর্বদা পরিভ্রমণ করছে, কিন্তু গতিহীন বা গতিপূর্ণ যাই হােক না কেন, উভয় অবস্থাতেই এ মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়কর প্রতিটি সৃষ্টি স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে সর্বদাই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আরাে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালাই এসব কিছুর মধ্যে অপরূপ সৌন্দর্য বিধান করেছেন, যে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলছেন,  ‘আর অবশ্য অবশ্যই আমি এগুলােকে সুন্দর করেছি দর্শকদের জন্যে।’ সৃষ্টির অনুপম সৌন্দর্যের বর্ণনায় এ হচ্ছে একটি চমৎকার ঝলক, বিশেষ করে এর দ্বারা অতি উজ্জ্বল ও চরম সুন্দর উর্ধাকাশের দিকে ইংগিত করা হয়েছে। এই বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি লগ্ন থেকেই তাঁর এই প্রিয়তম সৃষ্টিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করতে চেয়েছেন এবং সবকিছুকে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের রশিতে আবদ্ধ করেছেন। এসব কিছুর বর্ণনায় দেখা যায় মানুষের দৃষ্টি ও মনমগযে গােটা সৃষ্টি সম্পর্কে বিরাজমান নিয়ম শৃংখলা, এর বিশালত্ব, ব্যাপকত্ব ও সূক্ষতার ধারণা দেয়ার মাধ্যমে তাদের কাছে এর রূপ মাধুৰ্য্য ও সৌন্দর্যের দৃশ্যাবলীই তুলে ধরা হয়েছে। আহ্, বিদগ্ধ চিত্তে এই মহা সৃষ্টির রাশি-রাশি সৌন্দর্য যখন দোলা দিতে থাকে তখন খুশীতে সে আত্মহারা হয়ে যায় এবং উদাত্ত কষ্ঠে সে গেয়ে ওঠে পরম করুণাময় আল্লাহর জয়গান। তাই তাে দেখা যায় অন্ধকার রাত্রির পর্দাকে ছিন্ন করে আল্লাহ প্রেমিক যখন আরামের বিছানা পরিত্যাগ করে পরম প্রেমময়ের দরবারে হাযির হয়, যখন তার নযর নিবদ্ধ হয় ঘনান্ধকারে ছাওয়া বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে কোটি কোটি প্রদীপ-সাজানাে উর্ধাকাশের দিকে, তখন রাশি রাশি ফুল সম ওই গ্রহ-নক্ষত্র তারকারাজি যেন হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে থেকে আরাে কাছে টেনে নিতে চায় । তখন এসব কিছুর মধ্যে আল্লাহর নূরের জ্যোতি তাকে মনমুগ্ধ করে ফেলে, আর তখন তার অন্তরাত্মা তার পরম প্রেমময় প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করার জন্যে পাগলপারা হয়ে ওঠে এবং তখন সে যেন আল্লাহর মহব্বত ভরা আহ্বান তার হৃদয়ের গভীরে অনুভব করে। আবার, চাঁদনী রাতের রূপালী-রূপ এমনইভাবে তার হৃদয়কে উদ্বেলিত করে, বিশেষ করে পূর্ণিমা রাতের স্বর্ণালী সন্ধ্যার আগমনে তার হৃদয় যেন ময়ুরের মতাে নেচে ওঠে, তারপর রাত যত গভীর হয়, ধীরে ধীরে জাগ্রত ধরা ঢলে পড়ে নিদ্রার প্রশান্ত কোলের মাঝে তখন আল্লাহপ্রেমিক ব্যক্তিরা যেন পদার্পন করে এক স্বর্নালী রাজ্যে আর তখনই তারা এক অনির্বচনীয় সুখ স্বপ্নে মেতে ওঠে। এমনই এক মােহময় মুহূর্তে আল্লাহ প্রেমিক হৃদয় গভীরভাবে অনুভব করে মহিমাময় মালিকের প্রাণস্পর্শী ও মধুময় বাণীর তাৎপর্য, আর অবশ্যই আমি বড় সুন্দর করে সাজিয়েছি…

 

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# কোন ঈমানদারকে পুরস্কার এবং কোন অস্বীকারকারীকে শাস্তি দেয়া আপনার কাজ নয়। কাউকে জোর করে ঈমানের দিকে টেনে আনা এবং কাউকে জবরদস্তি অস্বীকার করা থেকে দূরে রাখার কাজেও আপনি নিযুক্ত হননি। যে ব্যক্তি সত্য-সঠিক পথ গ্রহণ করবে তাকে শুভ পরিণামের সুসংবাদ দেবে এবং যে ব্যক্তি নিজের কু পথে অবিচল থাকবে তাকে আল্লাহর পাকড়াও ও শাস্তির ভয় দেখাবে, তোমার দায়িত্ব এতটুকুই, এর বেশী নয়।

কুরআন মজীদের যেখানেই এ ধরনের উক্তি এসেছে সেখানেই তার বক্তব্যের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কাফের সমাজ। সেখানে এ কথা বলাই তাদের উদ্দেশ্য যে, নবী হচ্ছেন একজন নিঃস্বার্থ সংস্কারক, যিনি আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণার্থে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়ে থাকেন এবং তাদের শুভ ও অশুভ পরিণাম সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন। তিনি জোরপূর্বক তোমাদের এ পয়গাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেন না। এভাবে বাধ্য করলে তোমরা অনর্থক বিক্ষুব্ধ হয়ে সংঘাত সংঘর্ষে লিপ্ত হতে। তোমরা যদি মেনে নাও তা হলে এতে তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণ হবে, তাঁর দুপয়সা লাভ হবে নয়া। আর যদি না মানো তাহলে নিজেদেরই ক্ষতি হবে, তাঁর কোন ক্ষতি হবে না। পয়গাম পৌঁছিয়ে দিয়েই তাঁর দায়িত্ব শেষ, এখন আমার সাথে তোমাদের ব্যাপার জড়িত হয়ে পড়েছে। —একথা না বুঝার কারণে অনেক সময় লোকেরা এ বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়ে যে, মুসলমানদের ব্যাপারেও বুঝি নবীর কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া এবং শুভ পরিণামের সুসংবাদ শুনিয়ে দিয়েই শেষ। অথচ কুরআন বিভিন্ন স্থানে বার বার সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছে যে, মুসলমানদের জন্য নবী কেবল সুসংবাদদাতাই নন বরং শিক্ষক, পরিশুদ্ধকারী এবং কর্মের আদর্শও। মুসলমানদের জন্য তিনি শাসক, বিচারক এবং এমন আমীরও যার আনুগত্য করতে হবে। তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে আসা প্রতিটি ফরমান তাদের জন্য আইনের মর্যাদা রাখে। সর্বান্তকরণে তাদের এ আইন মেনে চলতে হবে। কাজেই যার

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا مُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ও وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ

এবং এ ধরনের বিষযবস্তু সম্বলিত অন্যান্য আয়াতকে নবী ও মূ’মিনদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেন তারা বিরাট ভুল করে যাচ্ছেন।

# এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের পক্ষে আর একটি প্রমাণ। অর্থাৎ নিজের এ কাজে আপনি পুরোপুরি নিস্বার্থ। কোন ব্যক্তি সততার সাথে এ দোষারোপ করতে পারেনা যে, নিজের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য আপনার সামনে রয়েছে তাই আপনি এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে আপনার ভালোই উন্নতি হচ্ছিল। এখন দারিদ্রও অর্থসংকটের সম্মুখীন হলেন। জাতির মধ্যে আপনাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো। লোকেরা মাথায় করে রাখতো। এখন গালাগালি ও মার খাচ্ছেন বরং প্রাণ নাশের পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। নিজের পরিবার –পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে সুখে জীবন যাপন করছিলেন। এখন এমন একটি কঠিন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে পড়ে গেছেন যার ফলে এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না। এর ওপর আরো সমস্যা হলো এমন বিষয় নিয়ে সামনে এসেছেন যারফলে সারা দেশের লোক শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এমনকি নিজের জ্ঞাতি ভাইরা আপনাকে হত্যা করার জন্য পাগলপারা হয়ে উঠেছে। কে বলতে পারে, এটা একজন স্বার্থবাদী লোকের কাজ? স্বার্থবাদী লোক তো নিজের জাতি ও গোত্রপ্রীতির ঝান্ডা উঁচিয়ে নিজের যোগ্যতা ও যোগসাজশের মাধ্যমে নেতৃত্ব লাভ করার প্রচেষ্টা চালাতেন। তিনি কখনো এমন কোন বিষয় নিয়ে আবির্ভূত হতেন না যা কেবলমাত্র সমগ্র জাতীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থপ্রীতির বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জই নয় বরং আরবের মুশরিকদের মধ্যে তার গোত্রের সরদারী যে জিনিসের বদৌলতে প্রতিষ্ঠিত আছে তার শিকড়ও কেটে দেয়। এটি এমন একটি যুক্তি যা কুরআনে শুধুমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই নয় বরং সাধারণভাবে সকল নবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে বারবার পেশ করা হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আল আন’আম ৯০ , ইউনুস ৭২ , হুদ ২৯ ও ৫১ , ইউসুফ ১০৪ , আল ফুরকান ৫৭ , আশ শু’আরা ১০৯ , ১২৭ , ১৪৫ , ১৬৪ ও ১৮০ , সাবা ৪৭, ইয়াসীন ২১ , সাদ ৮৬ , আশশূরা ২৩ ও আন-নাজম ৪০ আয়াত এবং এই সঙ্গে টীকাগুলোও দেখুন।

# মহান আল্লাহর আরশের ওপর সমাসীন হবার বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আরাফ ৪১ ও ৪২ , ইউনূস ৪ এবং হূদ ৭ টীকা। পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলী ছ’দিনে তৈরি করার বিষয়টি মুতাশাবিহাতের অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ নির্ধারণ করা কঠিন। হতে পারে একদিন অর্থ একটি যুগ, আবার এও হতে পারে, দুনিয়ায় আমরা একদিন বলতে যে সময়টুকু বুঝি একদিন অর্থ সেই পরিমাণ সময়। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা হা-মীম-আস্ সাজদাহ ১১-১৫ টীকা )।
# একথা তারা বলতো আসলে নিছক কাফের সুলভ ঔদ্ধত্য ও গোয়ার্তুমির বশে। যেমন ফেরাউন মূসাকে বলেছিল وَمَا رَبِّ الْعَالَمِينَ “রব্বুল আলামীন আবার কি?” অথচ মক্কার কাফেররা রহমান তথা দয়াময় আল্লাহ‌ সম্পর্কে বেখবর ছিল না এবং ফেরাউনও রব্বুল আলামীন সম্পর্কে অনবহিত ছিল না। কোন কোন মুফাসসির এর ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, আরবদের মধ্যে আল্লাহর “রহমান” নামটি বেশী প্রচলিত ছিল না, তাই তারা এ আপত্তি করেছে। কিন্তু আয়াতের প্রকাশ ভংগী থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, না জানার কারণে এ আপত্তি করা হয়নি বরং করা হয়েছিল জাহেলীয়াতের প্রাবল্যের কারণে। নয়তো এজন্য পাকড়াও করার পরিবর্তে আল্লাহ‌ নরমভাবে তাদের বুঝিয়ে দিতেন যে, এটাও আমারই একটি নাম, এতে অবাক হবার কিছু নেই। তাছাড়া একথা ঐতিহাসিকভাবেও প্রমাণিত যে, আরবে প্রাচীনকাল থেকে রহমান শব্দটি আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এটা বহুল প্রচলিত ও পরিচিত শব্দ ছিল। দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আস সাজদাহ-৫ ও সাবা ৩৫ টীকা ।

# এখানে তেলাওয়াতের সিজদা করার ব্যাপারে সকল আলেম একমত। প্রত্যেক কুরআন পাঠক ও শ্রোতার এ জায়গায় সিজদা করা উচিত। তাছাড়া যখনই কেউ এ আয়াতটি শুনবে জবাবে বলবে, زَادَنَا اللهُ خُضُوعًا مَا زَادَ لِلْاعْدَاءِ نُفُورًا ا “আল্লাহ করুন, ইসলামের দুশমনদের ঘৃণা যত বাড়ে আমাদের আনুগত্য ও বিনয় যেন ততই বাড়ে।” এটি একটি সুন্নাত।

# আরবী ভাষায় দূর্গ, প্রাসাদ ও মজবুত ইমারতকে বুরুজ বলা হয়। প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যায় সূর্যের পরিভ্রমণ পথকে যে বারটি স্তরে বা রাশিচক্রে বিভক্ত করা হয়েছিল ‘বুরুজ’ শব্দটিকে পারিভাষিক অর্থে সেই বারটি স্তরের জন্য ব্যবহার করা হতো। এ কারণে কুরআন ঐ বুরুজগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছে বলে কোন কোন মুফাস্সির মনে করেছেন। আবার কোন কোন মুফাস্সির এটিকে গ্রহ অর্থে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তী বক্তব্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে মনে হবে, এর অর্থ সম্ভবত উর্ধ্বজগতের এমন সব অংশ যার মধ্যকার প্রত্যেকটি অংশকে অত্যন্ত শক্তিশালী সীমান্ত অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করে রেখেছে। যদিও এ সীমান্তরেখা মহাশূন্যে অদৃশ্যভাবে অঙ্কিত হয়ে আছে তবুও সেগুলো অতিক্রম করে কোন জিনিসের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাওয়া খুবই কঠিন। এ অর্থের প্রেক্ষিতে আমি বুরুজ শব্দটিকে সংরক্ষিত অঞ্চলসমূহ (Fortified spheres) অর্থে গ্রহণ করা অধিকতর নির্ভুল বলে মনে করি।
# প্রত্যেক অঞ্চলে কোন না কোন উজ্জ্বল গ্রহ বা তারকা রেখে দিয়েছেন এবং এভাবে সমগ্র জগত ঝলমলিয়ে উঠেছে। অন্যকথায়, আমি দৃশ্যত কুলকিনারাহীন এ বিশ্ব জগতকে একটি বিশাল পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়ি বানিয়ে রেখে দেইনি। বরং তাকে এমন একটি সুন্দর সুসজ্জিত জগৎ বানিয়ে রেখেছি যার মধ্যে সর্বত্র সবদিকে নয়নাভিরাম দীপ্তি ছাড়িয়ে রয়েছে। এ শিল্পকর্মে শুধুমাত্র একজন মহান কারিগরের অতুলনীয় শিল্প নৈপুণ্য এবং একজন মহাবিজ্ঞানীর অনুপম বৈজ্ঞানিক কুশলতাই দৃষ্টিগোচর হয় না বরং এই সঙ্গে একজন অতীব পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রুচির অধিকারী শিল্পীর শিল্পও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ বিষয়বস্তুটিই অন্য এক স্থানে এভাবে বলা হয়েছেঃ الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ (আল্লাহ, যে জিনিসই বানিয়েছেন, চমৎকার বানিয়েছেন।) আস-সাজদাহঃ ৭
# এ দু’টি ভিন্ন ধরনের মর্যাদা কিন্তু স্বভাবের দিক দিয়ে এরা পরস্পরের জন্য অপরিহার্য। দিন-রাত্রির আবর্তন ব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করার ফলে মানুষ প্রথমে এ থেকে তাওহীদের শিক্ষা লাভ করে এবং আল্লাহ‌ থেকে গাফেল হয়ে গিয়ে থাকলে সঙ্গে সঙ্গেই সজাগ হয়ে যায়। এর দ্বিতীয় ফল হয়, আল্লাহর রবুবীয়াতের অনুভূতি জাগ্রত হয়ে মানুষ আল্লাহর সমীপে মাথা নত করে এবং কৃতজ্ঞতার প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)‎-কে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছেন। অর্থাৎ মু’মিনদের জন্য সুসংবাদদাতা ও কাফিরদের জন্য সতর্ককারী, যারা আনুগত্য করবে তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ আর যারা অস্বীকার করবে তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির ব্যাপারে সতর্ককারী রূপে এবং তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)‎-কে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি যেন বলেন, হে মানুষ! আমি তোমাদের নিকট ঈমানের দাওয়াত ও আল্লাহ তা‘আলার বিধি-বিধান পৌঁছে দেয়ার জন্য কোন পারিশ্রমিক চাই না। যার মন চায় , সে আল্লাহ তা‘আলার পথ অবলম্বন করবে। এতে তারই উপকার হবে। এ সম্পর্কে সূরা হূদ-এ আলোচনা করা হয়েছে।

(وَتَوَكَّلْ عَلَي الْحَيِّ….)

‘তুমি নির্ভর কর সেই চিরঞ্জীবের ওপর, যিনি মরবেন না’ যিনি চিরঞ্জীব কখনো মারা যাবেন না তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা। সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা কর। এখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে সকল মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। ভরসা করা দু’প্রকার-(১) এমন বিষয়ে ভরসা করা যা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কেউ দিতে পারে না, যেমন সন্তান দেয়া, বিপদ থেকে মুক্তি দেয়া ইত্যাদি যা আল্লাহ তা‘আলা কোন বান্দার হাতে সাময়িকের জন্যও দেননি। এরূপ ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করতে হবে, অন্য কারো ওপর ভরসা করলে শির্ক হবে। (২) এমন বিষয়ে ভরসা করা যা সাময়িকভাবে বান্দাকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যেমন টাকা-পয়সার সহযোগিতা দেয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভরসা করা যাবে।

(عَلَي الْعَرْشِ…. الَّذِيْ خَلَقَ)

‘তিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও তাদের উভয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত‎ কিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন’ এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৫৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যখন তাদেরকে বলা হয় তোমরা রহমানকে সিজদা কর, তখন তারা তা অস্বীকার করেন যেমন হাদীসে এসেছে:

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় আলী (رضي الله عنه)-কে বললেন, লেখন

(بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ)

দয়াময় ও দয়ালু আল্লাহ তা‘আলার নামে শুরু করছি। তখন তারা (কাফিররা) বলল, আমরা রহমান ও রাহিমকে চিনি না। বরং তুমি ঐভাবে লেখ যে, হে আল্লাহ তা‘আলা! তোমার নামে।

সুতরাং তারা দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাজদাহ করত না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِذَا قُرِئَ عَلَيْهِمُ الْقُرْاٰنُ لَا يَسْجُدُوْنَ)

“এবং যখন তাদের নিকট কুর’আন পাঠ করা হয় তখন তারা সিজদা করে না?” (সূরা ইনশিকাক ৮৪:২১)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ ارْكَعُوْا لَا يَرْكَعُوْنَ)‏

“যখন তাদেরকে বলা হয়ঃ তোমরা রুকূ কর (সালাত আদায় কর) তখন তারা রুকূ করে না।” (সূরা মুরসালাত ৭৭:৪৮)

বরং তারা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত এবং আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. দাওয়াতী কাজ করে বিনিময় গ্রহণ করার চেয়ে না করাই উত্তম।
২. আল্লাহ তা‘আলা চিরস্থায়ী, চিরজীবী, তাঁর কোন মৃত্যু নেই এবং তিনি আরশের ওপর সমুন্নত।

৬১-৬২ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে পুনরায় আল্লাহ তা‘আলা আরো কিছু ক্ষমতার কথা বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা নভোমণ্ডলের নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন। এখানে নক্ষত্ররাজি দ্বারা উদ্দেশ্য হল (বড় বড় তারকারাজি)।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَا۬ءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيْحَ)

“আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা (তারকারাজি) দ্বারা।” (সূরা মূলক ৬৭:৫)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَالسَّمَا۬ءِ ذَاتِ الْبُرُوْجِ)

“শপথ বুরূজ (প্রকাশ্য তারকারাজি)-বিশিষ্ট আকাশের।” (সূরা বুরূজ ৮৫:১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَا۬ءِ بُرُوْجًا وَّزَيَّنّٰهَا لِلنّٰظِرِيْنَ)

“আমি আকাশে গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টি করেছি এবং তা সুশোভিত করেছি দর্শকদের জন্য।” (সূরা হিজর ১৫:১৬)

আর তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপময় সূর্য ও জ্যোতিময় চন্দ্র। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(أَلَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللّٰهُ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا لا – ‏ وَّجَعَلَ الْقَمَرَ فِيْهِنَّ نُوْرًا وَّجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا)‏

“তোমরা কি লক্ষ্য করনি, আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে সাত আসমানকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন? এবং সেখানে চাঁদকে আলো ও সূর্যকে প্রদীপরূপে স্থাপন করেছেন?” (সূরা নূহ ৭১:১৫-১৬)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَا۬ءً وَّالْقَمَرَ نُوْرًا)

“তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন।” (সূরা ইউনুস ১০:৫)

অতঃপর তিনি বলেন, তিনি দিবা ও রাত্রিকে করেছেন একটি আরেকটির অনুগামী। অর্থাৎ দিন যায় রাত্রি আসে, আবার রাত্রি যায় দিন আসে। একটি অপরটির নাগাল পায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَا۬ئِبَيْنِ ج وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ)

“তিনি তোমাদের (কল্যাণে) নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে, যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুগামী এবং তোমাদের (কল্যাণে) নিয়োজিত করেছেন রাত্রি ও দিবসকে।” (সূরা ইবরাহীম ১৪:৩৩)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لَا الشَّمْسُ يَنْۭـبَغِيْ لَهَآ أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ ط وَكُلٌّ فِيْ فَلَكٍ يَّسْبَحُوْنَ)

“সূর্যের সাধ্য নেই যে, সে চন্দ্রকে ধরে ফেলে এবং রাতও দিনের পূর্বে আসতে পারে না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষে চলছে।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৪০)

আর এগুলো কোন মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়, এগুলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই করে থাকেন।

সুতরাং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে। তাঁকেই উপাস্য হিসেবে মানতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না।
২. সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
৩. বেশি বেশি করে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করতে হবে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলছেনঃ আমি তো তোমাকে শুধু সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই প্রেরণ করেছি। যারা আল্লাহর আনুগত্যকারী তাদেরকে তুমি জান্নাতের সুসংবাদ দেবে এবং যারা তাঁর অবাধ্য তাদেরকে তার কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করবে। জনগণের মধ্যে তুমি সাধারণভাবে ঘোষণা করে দেবে- আমি তোমাদের কাছে আমার এই প্রচারকার্যের জন্যে কোন প্রতিদান চাই না। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ছাড়া আমার উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়। আমি শুধু এটাই চাই যে, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সঠিক পথে আসতে চায় তার সামনে সঠিক রাস্তা প্রকাশ করে দেবো।

মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল (সঃ)-কে সম্বোধন করে আরো বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি প্রতিটি কাজে ঐ আল্লাহর উপর নির্ভর করবে যিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই। যিনি আদি ও অন্ত, প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কিছুরই পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। যিনি চিরজীবিত ও চির বিরাজমান। যিনি প্রত্যেক জিনিসেরই মালিক ও প্রতিপালক। তাঁকেই তুমি তোমার প্রকৃত আশ্রয়স্থল মনে করবে। তার সত্তা এমনই যে, তারই উপর ভরসা করা উচিত এবং ভীতি-বিহ্বলতার সময় তাঁরই দিকে ঝুঁকে পড়া কর্তব্য। সাহায্যকারী ও আশ্রয়দাতা হিসেবে তিনিই যথেষ্ট। মানুষের উচিত তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করা। তিনি তাঁর বান্দাদের পাপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ ঘোষণা করেছেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে রাসূল (সঃ)! তোমার নিকট তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তুমি (জনগণের নিকট) পৌছিয়ে দাও। যদি তুমি এটা না কর তবে তুমি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করলে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, আল্লাহ তোমাকে লোকদের (অনিষ্ট) থেকে রক্ষা করবেন।” (৫: ৬৭)।

শহর ইবনে হাওশিব (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, একদা কোন এক গলিতে নবী (সঃ)-এর সাথে হযরত সালমান (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ হলে তিনি তাঁকে সিজদা করতে উদ্যত হন। তখন নবী (সঃ) তাকে বলেনঃ “হে সালমান (রাঃ)! তুমি আমাকে সিজদা করো না, বরং সিজদা করো সেই সত্তাকে যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি মুরসাল)

আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেনঃ ‘তুমি আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) মহান আল্লাহর এ নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছিলেন। তিনি বলতেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “হে আল্লাহ! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি।” মহান আল্লাহর এই উক্তির ভাবার্থ হচ্ছে ? ইবাদত শুধু আল্লাহরই করবে এবং শুধু তাঁর সত্তার উপরই ভরসা করবে। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিপালক তিনিই, তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। সুতরাং তাকেই কর্মবিধায়ক বানিয়ে নাও।” (৭৩;৯) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “সুতরাং তাঁরই ইবাদত করো এবং তাঁরই উপর নির্ভর করো।” (১১:১২৩) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তুমি বলে দাও- তিনিই রহমান (পরম দয়ালু), আমরা তার উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁরই উপর ভরসা করেছি।” (৬৭:২৯)

মহান আল্লাহর উক্তিঃ তিনি তাঁর বান্দাদের পাপ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। অর্থাৎ বান্দাদের সমস্ত কার্যকলাপ তার সামনে প্রকাশমান। অণু পরিমাণ কাজও তার কাছে গোপন নয়।

তিনিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি। তিনিই সব কিছুর আহার্যদাতা। তিনি স্বীয় ক্ষমতাবলে আসমান যমীনের ন্যায় বিরাট মাখলুককে মাত্র ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। কার্যাবলীর তদবীর ও ফলাফল তারই পক্ষ হতে এবং তাঁরই হুকুম ও তদবীরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাঁর ফায়সালা সত্য, সঠিক ও উত্তমই হয়। তাঁর সত্তা ও গুণাবলী সম্বন্ধে যে অবগত আছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখো।

এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, আল্লাহর সত্তা সম্বন্ধে পূর্ণ অবগতি একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এরই ছিল যিনি দুনিয়া ও আখিরাতে সাধারণভাবে সমস্ত আদম সন্তানের নেতা ছিলেন। একটি কথাও তিনি নিজের পক্ষ থেকে বানিয়ে বলেননি। বরং তিনি যা কিছু বলতেন আল্লাহর পক্ষ হতে আদিষ্ট হয়েই বলতেন। তিনি আল্লাহ তা’আলার যে গুণাবলীর বর্ণনা দিয়েছেন সেগুলোর সবই সত্য। তিনি যা কিছু সংবাদ দিয়েছেন তার সবই সঠিক। প্রকৃত ও সত্য ইমাম তিনিই। সমস্ত বিবাদের মীমাংসা তাঁরই নির্দেশক্রমে করা যেতে পারে। যে তার কথা বলে সে সত্যবাদী। আর যে তাঁর বিপরীত কথা বলে সে মিথ্যাবাদী এবং তার কথা প্রত্যাখ্যাত হবে। সে যে কেউই হোক না কেন। আল্লাহর ফরমান অবশ্যই পালনীয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “কোন বিষয়ে যদি তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় তবে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর দিকে ফিরিয়ে দাও।” (৪:৫৯) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “যে ব্যাপারেই তোমরা মতানৈক্য কর, ওর ফায়সালা আল্লাহর নিকট রয়েছে।” (৪২:১০) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালকের কথা যা খবরের ব্যাপারে সত্য ও ফায়সালা হিসেবে ন্যায়, পূর্ণ হয়ে গেছে।” (৬:১১৬) এটাও বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে।

মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে সিজদা করতো। তাদেরকে যখন ‘রহমানকে সিজদা করার কথা বলা হতো তখন তারা বলতো: আমরা রহমানকে চিনি না। আল্লাহর নাম যে রহমান’ এটা তারা অস্বীকার করতো। যেমন হুদায়বিয়ার সন্ধির বছর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) লেখককে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ লিখতে বলেন তখন মুশরিকরা বলে ওঠেঃ “আমরা রহমানকে চিনি না এবং রহীমকেও না। বরং আমাদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ‘বিইসমিকা আল্লাহুম্মা’ লিখুন।” তাদের এই কথার উত্তরে আল্লাহ তা’আলা নিম্নলিখিত আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ(আরবি)

অর্থাৎ “তুমি বলে দাও- তোমরা আল্লাহকে ডাকো অথবা রহমানকে ডাকো, যে নামেই ইচ্ছা তাকে ডাকো, তাঁর বহু উত্তম নাম রয়েছে।” (১৭:১১০) অর্থাৎ তিনিই আল্লাহ এবং তিনিই রহমান।

কাফিররা বলতো: তুমি কাউকেও সিজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সিজদা করবো? মোটকথা, এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে মুমিনরা আল্লাহর ইবাদত করে যিনি রহমান এবং রাহীম। তাঁরা তাঁকেই ইবাদতের যোগ্য মনে করে এবং তার উদ্দেশ্যেই সিজদা করে।
আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, সূরায়ে ফুরকানের এই আয়াতটির পাঠক ও শ্রোতার উপর সিজদা ওয়াজিব হওয়া শরীয়তের বিধান। যেমন ওর স্থলে ওর ব্যাখ্যা বিদ্যমান। এসব ব্যাপারে মহামহিমান্বিত আল্লাহই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

৬১-৬২ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তাআলা স্বীয় বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, ব্যাপক ক্ষমতা এবং উচ্চ মর্যাদার কথা বলছেন যে, তিনি আকাশে রাশিচক্র বানিয়েছেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য বড় বড় তারকাও হতে পারে, আবার পাহারা দেয়ার বুরূজও হতে পারে। প্রথম উক্তিটিই বেশী প্রকাশমান। বড় বড় তারকা দ্বারাও এই বুজই উদ্দেশ্য হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা।” (৬৭: ৫) (আরবি) দ্বারা সূর্যকে বুঝানো হয়েছে যা ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করতে থাকে। এটা প্রদীপের মত। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি উজ্জ্বল প্রদীপ বানিয়েছি।” (৭৮:১৩) এর দ্বারা সূর্যকেই বুঝানো হয়েছে।

আল্লাহ পাক বলেনঃ আর আমি সৃষ্টি করেছি জ্যোতির্ময় চন্দ্র। অর্থাৎ উজ্জ্বল ও আলোকময় করেছি সূর্যের আলো ছাড়া অন্যের আলো দ্বারা। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তিনি এমনই যিনি সূর্যকে উজ্জ্বল বানিয়েছেন এবং চন্দ্রকে বানিয়েছেন জ্যোতির্ময়।” (১০:৫) আল্লাহ তা’আলা হযরত নূহ (আঃ) সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেন যে, তিনি স্বীয় কওমকে বলেছিলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমরা কি লক্ষ্য করনি? আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টি করেছেন সপ্তস্তরে বিন্যস্ত আকাশমণ্ডলী? এবং সেখানে চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে।” (৭১:১৫-১৬) যারা উপদেশ গ্রহণ করতে ও কৃতজ্ঞ হতে চায় তাদের জন্যে তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি এবং দিবসকে পরস্পরের অনুগামীরূপে। এটা আল্লাহ তা’আলার সু ব্যবস্থাপনা যে, দিবস ও রজনী একের পরে এক আসছে ও যাচ্ছে। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তিনি তোমাদের জন্যে সূর্য ও চন্দ্রকে একে অপরের অনুগামীরূপে বানিয়েছেন।” (১৪:৩৩) আরো বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “রাত দিনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তাড়াতাড়ি ওকে কামনা করে।” (৭:৫৪) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া এবং রজনীর পক্ষে সম্ভব নয় দিবসকে অতিক্রম করা।” (৩৬:৪০)

এর মাধ্যমেই আল্লাহর বান্দারা তাঁর ইবাদতের সময় জানতে পারে এবং রাত্রির ছুটে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ দিনে সমাপ্ত করতে ও দিনের অসমাপ্ত কাজ রাত্রে সমাপ্ত করতে পারে। সহীহ হাদীসে আছে যে, আল্লাহ তা’আলা রাত্রে স্বীয় হস্ত সম্প্রসারিত করেন যাতে দিনের পাপীরা তাওবা করতে পারে এবং দিনে তিনি স্বীয় হস্ত সম্প্রসারিত করেন যাতে রাত্রের পাপীরা তাওবা করার সুযোগ পায়।

হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) চাশতের নামাযে খুবই বিলম্ব করেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “রাত্রের কিছু অযীফা আমার বাকী থেকে গিয়েছিল, ওটাই এখন আদায় করলাম।” অতঃপর(আরবি) এ আয়াতটি তিনি পাঠ করেন। (এটা আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

(আরবি)-এর অর্থ কেউ(আরবি) ও করেছেন। অর্থাৎ দিন উজ্জ্বল ও রাত্রি অন্ধকার। এতে ঔজ্জ্বল্য এবং ওতে অন্ধকার। এটা আলোকময় এবং ওটা অন্ধকারাচ্ছন্ন।

Leave a Reply