أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯৬)
[এখানে আল্লাহর মুমিন বান্দাদের গুণাবলীর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে:-]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৯
৬৩-৭৭ নং আয়াত:-
২৫:৬৩
وَ عِبَادُ الرَّحۡمٰنِ الَّذِیۡنَ یَمۡشُوۡنَ عَلَی الۡاَرۡضِ ہَوۡنًا وَّ اِذَا خَاطَبَہُمُ الۡجٰہِلُوۡنَ قَالُوۡا سَلٰمًا ﴿۶۳﴾
রহমানের (আসল) বান্দা তারাই যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে৭৯ এবং মূর্খরা তাদের সাথে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়, তোমাদের সালাম।
২৫:৬৪
وَ الَّذِیۡنَ یَبِیۡتُوۡنَ لِرَبِّہِمۡ سُجَّدًا وَّ قِیَامًا ﴿۶۴﴾
তারা নিজেদের রবের সামনে সিজদায় অবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়ে দেয়।
২৫:৬৫
وَ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَا اصۡرِفۡ عَنَّا عَذَابَ جَہَنَّمَ ٭ۖ اِنَّ عَذَابَہَا کَانَ غَرَامًا ﴿٭ۖ۶۵﴾
তারা দোয়া করতে থাকেঃ “হে আমাদের রব! জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদের বাঁচাও, তার আযাব তো সর্বনাশা।
২৫:৬৬
اِنَّہَا سَآءَتۡ مُسۡتَقَرًّا وَّ مُقَامًا ﴿۶۶﴾
আশ্রয়স্থল ও আবাস হিসেবে তা বড়ই নিকৃষ্ট জায়গা।
২৫:৬৭
وَ الَّذِیۡنَ اِذَاۤ اَنۡفَقُوۡا لَمۡ یُسۡرِفُوۡا وَ لَمۡ یَقۡتُرُوۡا وَ کَانَ بَیۡنَ ذٰلِکَ قَوَامًا ﴿۶۷﴾
তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না বরং উভয় প্রান্তিকের মাঝামাঝি তাদের ব্যয় ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে।
২৫:৬৮
وَ الَّذِیۡنَ لَا یَدۡعُوۡنَ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ وَ لَا یَقۡتُلُوۡنَ النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ وَ لَا یَزۡنُوۡنَ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ یَلۡقَ اَثَامًا ﴿ۙ۶۸﴾
তারা আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্যকে ডাকে না, আল্লাহ যে প্রাণকে হারাম করেছেন কোন সঙ্গত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। এসব যে-ই করে সে তার গোনাহের শাস্তি ভোগ করবে।
২৫:৬৯
یُّضٰعَفۡ لَہُ الۡعَذَابُ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ وَ یَخۡلُدۡ فِیۡہٖ مُہَانًا ﴿٭ۖ۶۹﴾
কিয়ামতের দিন তাকে উপর্যুপরি শাস্তি দেয়া হবে এবং সেখানেই সে পড়ে থাকবে চিরকাল লাঞ্ছিত অবস্থায়।
২৫:৭০
اِلَّا مَنۡ تَابَ وَ اٰمَنَ وَ عَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَاُولٰٓئِکَ یُبَدِّلُ اللّٰہُ سَیِّاٰتِہِمۡ حَسَنٰتٍ ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۷۰﴾
তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ্ তাদের গুণাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
২৫:৭১
وَ مَنۡ تَابَ وَ عَمِلَ صَالِحًا فَاِنَّہٗ یَتُوۡبُ اِلَی اللّٰہِ مَتَابًا ﴿۷۱﴾
যে ব্যক্তি তাওবা করে সৎকাজের পথ অবলম্বন করে, সে তো আল্লাহর দিকে ফিরে আসার মতই ফিরে আসে।
২৫:৭২
وَ الَّذِیۡنَ لَا یَشۡہَدُوۡنَ الزُّوۡرَ ۙ وَ اِذَا مَرُّوۡا بِاللَّغۡوِ مَرُّوۡا کِرَامًا ﴿۷۲﴾
—(আর রহমানের বান্দা হচ্ছে তারা) যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং কোন বাজে জিনিসের কাছ দিয়ে পথ অতিক্রম করতে থাকলে ভদ্রলোকের মত অতিক্রম করে যায়।
২৫:৭৩
وَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِّرُوۡا بِاٰیٰتِ رَبِّہِمۡ لَمۡ یَخِرُّوۡا عَلَیۡہَا صُمًّا وَّ عُمۡیَانًا ﴿۷۳﴾
এবং যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াত স্মরণ করিয়ে দিলে অন্ধ এবং বধির সদৃশ আচরণ করে না।
২৫:৭৪
وَ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَا ہَبۡ لَنَا مِنۡ اَزۡوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعۡیُنٍ وَّ اجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِیۡنَ اِمَامًا ﴿۷۴﴾
তারা প্রার্থনা করে থাকে, “হে আমাদের রব! আমাদের নিজেদের স্ত্রীদের ও নিজেদের সন্তানদেরকে নয়ন শীতলকারী বানাও এবং আমাদের করে দাও মুত্তাকীদের ইমাম।”
২৫:৭৫
اُولٰٓئِکَ یُجۡزَوۡنَ الۡغُرۡفَۃَ بِمَا صَبَرُوۡا وَ یُلَقَّوۡنَ فِیۡہَا تَحِیَّۃً وَّ سَلٰمًا ﴿ۙ۷۵﴾
তাদেরকে ধৈর্যাবম্বনের প্রতিদান স্বরূপ (বেহেশ্তের) কক্ষ দেওয়া হবে এবং তাদেরকে সেখানে অভিবাদন ও সালাম সহকারে অভ্যর্থনা জানানো হবে ।
২৫:৭৬
خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ حَسُنَتۡ مُسۡتَقَرًّا وَّ مُقَامًا ﴿۷۶﴾
তারা সেখানে থাকবে চিরকাল। কী চমৎকার সেই আশ্রয় এবং সেই আবাস!
২৫:৭৭
قُلۡ مَا یَعۡبَؤُا بِکُمۡ رَبِّیۡ لَوۡ لَا دُعَآؤُکُمۡ ۚ فَقَدۡ کَذَّبۡتُمۡ فَسَوۡفَ یَکُوۡنُ لِزَامًا ﴿٪۷۷﴾
লোকদের বলো, “আমার রবের তোমাদের কি প্রয়োজন, যদি তোমারা তাঁকে না ডাকো। এখন যে তোমরা মিথ্যা আরোপ করেছো, শিগগীর এমন শাস্তি পাবে যে, তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হবে না।”
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৬৩-৭৪ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতগুলোতে দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা যারা শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করে তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও আলামত উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিশ্বাসগত, দৈহিক ও আর্থিক যাবতীয় ব্যক্তিগত কর্মে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিধান অনুসরণ, অপর মানুষের সাথে সামাজিকতা ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রকারভেদ, দিবারাত্রি ইবাদতের মাধ্যমে সাথে আল্লাহ তা‘আলা-ভীতি, যাবতীয় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার প্রয়াস, নিজের সাথে সাথে সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রীদের সংশোধন চিন্তা ইত্যাদি বিষয়বস্তু শামিল রয়েছে। সেগুলো হল:
প্রথম গুণ:
عِبَادُ হওয়া। عِبَادُ শব্দটি عبد এর বহুবচন, অর্থন বান্দা, দাস, গোলাম, যে তার প্রভুর মালিকানাধীন এবং যার সমস্ত ইচ্ছা ও ক্রিয়াকর্ম প্রভুর আদেশ ও মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তা‘আলার আবদ বা দাস হতে পারা সৌভাগ্যের ও মর্যাদার ব্যাপার, সবাই আল্লাহ তা‘আলার আবদ হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনেক স্থানে আবদ বা দাস বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার দাসত্ব দু’প্রকারন (১) عبودية لربوبيته বা আল্লাহ তা‘আলা প্রতিপালন করেন সে জন্য তাঁর দাসত্ব করা, এতে কাফির মুশরিক, মুসলিম সবাই শামিল। কেননা পৃথিবীর সবাই আল্লাহ তা‘আলার প্রতিপালন বা রুবুবিয়াহ স্বীকার করে। (২) عبودية لألوهيته বা আল্লাহ তা‘আলা মা‘বূদ বা তিনি ইবাদত পাওয়ার যোগ্য তাই তাঁর ইবাদত করা। এ প্রকার ইবাদত একমাত্র মুসলিমরাই করে থাকে, এখানে এ প্রকার ইবাদতকারী বান্দাদের আলোচনা করা হয়েছে। (তাফসীর সাদী)
দ্বিতীয় গুণ:
(يَمْشُوْنَ عَلَي الْأَرْضِ هَوْنًا)
‘যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে’ هَوْنً শব্দের অর্থ স্থিরতা, গাম্ভীর্য, বিনয়। অর্থাৎ গর্বভরে চলে না, অহংকারীর ন্যায় পা ফেলে না। আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে খুব বিনয়-নম্রতার সাথে চলে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেনন
(وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ط إِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرٍ)
“এবং পৃথিবীতে গর্বভরে বিচরণ কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কোন দাম্ভিক, অহংকারকারীকে ভালোবাসেন না।” (সূরা লুকমান ৩১:১৮)
তৃতীয় গুণ:
(وَّإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلَامًا)
‘এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে, ‘সালাম’; الْجٰهِلُوْنَ এখানে এই শব্দের অনুবাদ অজ্ঞ ব্যক্তিরা করা হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ বিদ্যাহীন ব্যক্তি নয় বরং যারা মূর্খতাপূর্ণ কথাবার্তা বলে ও কাজ করে যদিও বাস্তবে বিদ্বান হয়। ‘সালাম’ শব্দ বলে এখানে প্রচলিত সালাম বুঝানো হয়নি। বরং নিরাপত্তার কথাবার্তা বুঝানো হয়েছে। ইমাম কুরতুবী নাহহাস থেকে বর্ণনা করেন যে, سلام শব্দটি تسليم থেকে নয় বরং تسلم থেকে উদ্ভুত যার অর্থ নিরাপদ থাকা। উদ্দেশ্য হলন মূর্খদের জবাবে তারা নিরাপত্তার কথাবার্তা বলে, যাতে অন্যরা কষ্ট না পায় এবং কোন বিশৃংখলা না হয় সে জন্য তাদের থেকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوْا عَنْهُ وَقَالُوْا لَنَآ أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ ز سَلٰمٌ عَلَيْكُمْ ز لَا نَبْتَغِي الْجٰهِلِيْنَ
“তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন তারা তা উপেক্ষা করে চলে এবং বলে: ‘আমাদের কাজের ফল আমাদের জন্য এবং তোমাদের কাজের ফল তোমাদের জন্য এবং তোমাদের প্রতি ‘সালাম’। আমরা অজ্ঞদের সঙ্গ চাই না।’’ (সূরা কাসাস ২৮:৫৫)
চতুর্থ গুণ:
(وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَّقِيَامًا)
‘তারা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য ও ইবাদতের মধ্যে রাত্রি অতিবাহিত করে।’ মানুষ যখন ঘুমিয়ে যায় তখন ইবাদতের কথা বলার কারণ হলন এ সময়টি হল নিদ্রা ও আরামের সময়, এ সময় সালাতের জন্য জাগ্রত হওয়া যেমন কষ্টকর ব্যাপার তেমনি এতে লোক দেখানোর কোন আশংকা থাকে না, ইবাদতে একাগ্রতা আসে। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(كَانُوْا قَلِيْلًا مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُوْنَ - وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ)
“তারা রাত্রির সামান্য অংশই নিদ্রাবস্থায় অতিবাহিত করত। রাত্রির শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত।” (সূরা যারিয়াত ৫১:১৭-১৮)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، أَفْشُوا السَّلَامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوا وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُونَ الجَنَّةَ بِسَلَامٍ
হে মানুষ সকল! সালামের প্রসার কর, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ, মানুষকে খাদ্য খাওয়াও, রাতে সালাত আদায় কর যখন মানুষ ঘুমিয়ে যায়, তাহলে শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী হা: ২৪৮৫, সহীহ)
পঞ্চম গুণ:
(وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ)
‘তারা জাহান্নামের শাস্তি থেকে দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে।’ অর্থাৎ রাতে ইবাদত করার পরেও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকে না বরং জাহান্নামের ভয়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। কেননা তারা জানে যে, এ জাহান্নামের শাস্তি চিরস্থায়ী। এর থেকে আল্লাহ তা‘আলা মুক্তি না দিলে মুক্তি পাওয়ার কোন রাস্তা নেই। তারা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির ব্যাপারে ভয় করে। যেমন জাহান্নামের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمْ مِّنْ عَذَابِهَا ط كَذٰلِكَ نَجْزِيْ كُلَّ كَفُوْرٍ)
“তাদের থেকে জাহান্নামের আযাবও হালকা করা হবে না। আমি এরূপই শাস্তি দিয়ে থাকি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে।” (সূরা ফাতির ৩৫:৩৬)
ষষ্ঠ গুণ:
(وَالَّذِيْنَ إِذَآ أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا)
‘তারা খরচ করার সময় কৃপণতা করে না, আবার অপচয়ও করে না; বরং তারা এ ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে।’ ইবনু আব্বাস প্রমুখ বলেন: আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজে ব্যয় করাকে اسراف বলা হয়, যদিও তা এক পয়সা হয়। কেউ বলেছেন, বৈধ ও অনুমোদিত কাজে প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করাকেও اسراف বলা হয়। আর তারা তাক্বওয়া ও ভাল কাজে ব্যয় করতে কুন্ঠাবোধ করে না, যথাসম্ভব ব্যয় করার চেষ্টা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاٰتِ ذَا الْقُرْبٰي حَقَّه۫ وَالْمِسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيْرًا)
“আত্মীয়-স্বজনকে তার প্রাপ্য অধিকার দাও এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও; আর কিছুতেই অপব্যয় কর না।” (বানী ইসরাঈল ১৭:২৬) অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْمُبَذِّرِيْنَ كَانُوْآ إِخْوَانَ الشَّيَاطِيْنِ ط وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهٰ كَفُوْرًا)
“যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” (সূরা ইসরা ১৭:২৭)
সপ্তম গুণ:
(وَالَّذِيْنَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللّٰهِ إلٰهًا اٰخَرَ)
‘তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে ইলাহ হিসেবে আহ্বান করে না।’ অর্থাৎ তারা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে, অন্য কাউকে তাঁর সাথে মা‘বূদ হিসেবে আহ্বান করে না। যেমন হাদীসে এসেছে: আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করা হলন সবচেয়ে বড় পাপ কোন্টি? তিনি বলেন: আল্লাহর সাথে শির্ক করা যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ৬০০১-৪৪৭৭, সহীহ মুসলিম হা: ৮৬)
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّه۫ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللّٰهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللّٰهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوٰهُ النَّارُ ط وَمَا لِلظّٰلِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ)
“কেউ আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। জালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৭২)
অষ্টম গুণ:
(وَلَا يَقْتُلُوْنَ النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللّٰهُ إِلَّا بِالْحَقِّ)
‘তারা অন্যায়ভাবে কোন মানুষকে হত্যা করে না।’ তবে যথাযথ কারণ পাওয়া গেলে ভিন্ন কথা, যথাযথ কারণ বলতে যে বিষয়টি বুঝনো হয়েছে তা হল: মুসলিম হওয়ার পর ধর্ম ত্যাগ করে মুর্তাদ হওয়া, এমতাবস্থায় তাকে হত্যা করা বৈধ। বিবাহের পর ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাকে হত্যা করা বৈধ। কাউকে হত্যা করলে কিসাসস্বরূপ তাকে হত্যা করা বৈধ।
নবম গুণ:
(وَلَا يَزْنُوْنَ)
‘তারা যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না।’ বরং নিজেদের সতীত্বকে হেফাযত করে। নিজ স্ত্রী বা দাসী ছাড়া অন্য কারো সাথে এ অপকর্মে লিপ্ত হয় না।
অতঃপর যারা এ সকল অপকর্মে বিশেষ করে উক্ত তিনটি যথা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক, হত্যা ও ব্যভিচারে লিপ্ত হবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তির কথা বর্ণনা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন এদের শাস্তি দ্বিগুণ করে দেয়া হবে। আর তারা সেখানে চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। তবে যদি কেউ এগুলো করার পর অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসে, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান রাখে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তার গুনাহগুলো আল্লাহ তা‘আলা নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন।
দশম গুণ:
(وَالَّذِيْنَ لَا يَشْهَدُوْنَ الزُّوْرَ)
‘তারা কোন ব্যাপারে কোন মিথ্যা সাক্ষী দেয় না।’ মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া অন্যতম একটি কবীরা গুনাহ, যা ব্যক্তিকে ও সমাজকে নষ্ট করে। হাদীসে এসেছে, আবূ বকর
(رضي الله عنه)
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সচেতন করব না? এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন, বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমরা বললাম, হ্যাঁ। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। এ কথটি তিনি বার বার বলতে থাকলেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৬৬৪, সহীহ মুসলিম হা: ৮৭)
একাদশ গুণ:
(وَإِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا)
‘এবং অসার ক্রিয়াকলাপের সম্মুখীন হলে স্বীয় মর্যাদার সাথে সেটা পরিহার করে চলে।’ অর্থাৎ এমন মাজলিস বা আলোচনা সভা যেখানে এমন কথা-বার্তা হয় যা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য উপকারী নয়, তাহলে তারা সে সব মাজলিস ও বৈঠক বর্জন করে। এতে সকল প্রকার অসার কথা, গান-বাজনা ও অনর্থক কথা চলে আসে।
দ্বাদশ গুণ:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا ذُكِّرُوْا بِاٰيٰتِ رَبِّهِمْ)
‘যাদের সম্মুখে তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহ পাঠ করা হলে তারা অন্ধ ও বধিরসদৃশ আচরণ করে না।’ বরং এতে তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায় ও তার যথার্থ মূল্যায়ন করে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য সিজদাবনত হয়, তাঁর প্রশংসা করে এবং অহংকার করে না।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِاٰيٰتِنَا الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِّرُوْا بِهَا خَرُّوْا سُجَّدًا وَّسَبَّحُوْا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُوْنَ)
“কেবল তারাই আমার নিদর্শনগুলোর প্রতি ঈমান রাখে, যাদেরকে আমার আয়াতসমূহ যখন স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং স্বীয় প্রতিপালকের প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, আর তারা অহঙ্কার করে না।” (সূরা সিজদাহ ৩২:১৫)
ত্রয়োদশ গুণ:
(وَالَّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا)
‘এবং তারা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদেরকে আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ কর।’ সুতরাং আমরা যারা আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা হতে চাই তাদের উচিত উপরোল্লিখিত এ সকল বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করা।
৭৫-৭৭ নং আয়াতের তাফসীর:
দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা যারা উপর্যুক্ত গুণে গুণান্বিত হবে তাদের প্রতিদানের কথা এ আয়াতগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহ তা‘আলার বান্দার পরিচয় দিতে গিয়ে যে ধৈর্য ধারণ করেছে তার প্রতিফলস্বরূপ জান্নাতে একটি কক্ষ দেয়া হবে।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَهُمْ فِي الْغُرُفٰتِ اٰمِنُوْنَ)
“আর তারা প্রাসাদসমূহে নিরাপদে থাকবে।” (সূরা সাবা ৩৪:৩৭)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الَّذِيْنَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ لَهُمْ غُرَفٌ مِّنْ فَوْقِهَا غُرَفٌ مَّبْنِيَّةٌ لا تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ ط৫ وَعْدَ اللّٰهِ ط لَا يُخْلِفُ اللّٰهُ الْمِيْعَادَ)
“যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য জান্নাতে এমন সব প্রাসাদ রয়েছে যার ওপর আরও প্রাসাদ নির্মিত আছে, যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদীসমূহ। আল্লাহ তা‘আলা এ ওয়াদা দিয়েছেন; আল্লাহ তা‘আলা কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।” (সূরা যুমার ৩৯:২০)
আর তারা তথায় কোন বেহুদা কথাবার্তা শুনবে না। তারা শুধু শান্তিপূর্ণ কথাবার্তা শুনবে। যেমনটি সূরা ইউনুসে আলোচনা করা হয়েছে। আর তারা তথায় চিরকাল থাকবে। সে সম্পর্কে সূরা কাহফে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন যে, তিনি মানুষের সকল বিষয় থেকে বেপরোয়া। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। কিন্তু যদি কেউ তাঁর ইবাদত না করে তাতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। শুধুমাত্র তিনি এ ইবাদতের দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَهُوَ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ فِيْ سِتَّةِ أَيَّامٍ وَّكَانَ عَرْشُه۫ عَلَي الْمَا۬ءِ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا)
“আর তিনিই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, তখন তাঁর ‘র্আশ ছিল পানির ওপর, (সৃষ্টি করেছেন) তোমাদের মধ্যে কে কর্মে শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করার জন্য।” (সূরা হূদ ১১:৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না।
২. কোন প্রকার গর্ব অহঙ্কার করা যাবে না।
৩. কোন প্রকার কৃপণতা ও অপচয় করা যাবে না।
৫. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যাবে না।
৫. অশ্লীল কার্যকলাপ করা যাবে না।
৬. ভুলবশত পাপ কাজ হয়ে গেলেও সাথে সাথে তাওবাহ করে নিতে হবে।
৭. মিথ্যা কথা বলা যাবে না ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া যাবে না।
৮.যারা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে কেবল তারাই চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করবে আর বাকীরা সব জাহান্নামী।
৯. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সকল জিনিস থেকে বেপরোয়া।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# যে রহমানকে সিজদা করার জন্য তোমাদের বলা হচ্ছে এবং তোমরা তা অস্বীকার করছো, সবাই তো তাঁর জন্মগত বান্দা কিন্তু সচেতনতা সহকারে বন্দেগীর পথ অবলম্বন করে যারা এসব বিশেষ গুণাবলী নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করে তারাই তাঁর প্রিয় ও পছন্দনীয় বান্দা। তাছাড়া তোমাদের যে সিজদা করার দাওয়াত দেয়া হচ্ছে তার ফলাফল তার বন্দেগীর পথ অবলম্বনকারীদের জীবনে দেখা যাচ্ছে এবং তা অস্বীকার করার ফলাফল তোমাদের নিজেদের জীবন থেকে পরিস্ফূট হচ্ছে। এখানে আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্র নৈতিকতার দু’টি আদর্শের তুলনা করা। একটি আদর্শ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছিল এবং দ্বিতীয় আদর্শটি জাহেলীয়াতের অনুসারী লোকদের মধ্যে সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু এ তুলনামূলক আলোচনার জন্য শুধুমাত্র প্রথম আদর্শ চরিত্রের সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো সামনে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় আদর্শকে প্রত্যেক চক্ষুষ্মান ও চিন্তাশীল ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে সে নিজেই প্রতিপক্ষের ছবি দেখে নেয় এবং নিজেই উভয়ের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে। তার চিত্র পৃথকভাবে পেশ করার প্রয়োজন ছিল না। কারণ চারপাশের সকল সমাজে তার সোচ্চার উপস্থিতি ছিল।
# অহংকারের সাথে বুক ফুলিয়ে চলে না। গর্বিত স্বৈরাচারী ও বিপর্যয়কারীর মতো নিজের চলার মাধ্যমে নিজের শক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করে না। বরং তাদের চালচলন হয় একজন ভদ্র, মার্জিত ও সৎস্বভাব সম্পন্ন ব্যক্তির মতো। নম্রভাবে চলার মানে দুর্বল ও রুগীর মতো চলা নয় এবং একজন প্রদর্শন অভিলাষী নিজের বিনয় প্রদর্শন করার বা নিজের আল্লাহ ভীতি দেখাবার জন্য যে ধরনের কৃত্রিম চলার ভংগী সৃষ্টি করে সে ধরনের কোন চলাও নয়। নবী ﷺ নিজে চলার সময় এমন শক্তভাবে পা ফেলতেন যেন মনে হতো উপর থেকে ঢালুর দিকে নেমে যাচ্ছেন। উমরের ব্যাপারে হাদীসে বলা হয়েছে, তিনি এক যুবককে দুর্বলভাবে হেঁটে যেতে দেখে তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি অসুস্থ? সে বলে, না। তিনি ছড়ি উঠিয়ে তাকে ধমক দিয়ে বলেন, শক্ত হয়ে সবল ব্যক্তির মতো চলো। এ থেকে জানা যায়, নম্রভাবে চলা মানে, একজন ভালো মানুষের স্বাভাবিকভাবে চলা। কৃত্রিম বিনয়ের সাহায্যে যে চলার ভংগী সৃষ্টি করা হয় অথবা যে চলার মধ্য দিয়ে বানোয়াট দ্বীনতা ও দুর্বলতার প্রকাশ ঘটানো হয় তাকে নম্রভাবে চলা বলে না।
কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মানুষের চলার মধ্যে এমন কি গুরুত্ব আছে যে কারণে আল্লাহর সৎ বান্দাদের বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম এর কথা বলা হয়েছে? এ প্রশ্নটিকে যদি একটু গভীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে বুঝা যায় যে, মানুষের চলা শুধুমাত্র তার হাঁটার একটি ভংগীর নাম নয় বরং আসলে এটি হয় তার মন-মানস, চরিত্র ও নৈতিক কার্যাবলীর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির চলা, একজন গুণ্ডা ও বদমায়েশের চলা, একজন স্বৈরাচারী ও জালেমের চলা, একজন আত্মম্ভরী অহংকারীর চলা, একজন সভ্য-ভব্য ব্যক্তির চলা, একজন দরিদ্র-দ্বীনহীনের চলা এবং এভাবে অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের লোকদের চলা পরস্পর থেকে এত বেশী বিভিন্ন হয় যে, তাদের প্রত্যেককে দেখে কোন্ ধরনের চলার পেছনে কোন্ ধরনের ব্যক্তিত্ব কাজ করছে তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। কাজেই আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে, রহমানের বান্দাদের তোমরা সাধারণ লোকদের মধ্যে চলাফেরা করতে দেখেই তারা কোন্ ধরনের লোক পূর্ব পরিচিত ছাড়াই আলাদাভাবে তা চিহ্নিত করতে পারবে। এ বন্দেগী তাদের মানসিকতা ও চরিত্র যেভাবে তৈরী করে দিয়েছে তার প্রভাব তাদের চালচলনেও সুস্পষ্ট হয়। এক ব্যক্তি তাদের দেখে প্রথম দৃষ্টিতে জানতে পারে, তারা ভদ্র, ধৈর্যশীল ও সহানুভূতিশীল হৃদয়বৃত্তির অধিকারী, তাদের দিক থেকে কোন প্রকার অনিষ্টের আশঙ্কা করা যেতে পারে না। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা বনি ইসরাঈল ৪৩ , সুরা লোকমান ৩৩ টীকা )
# মূর্খ মানে অশিক্ষিত বা লেখাপড়া না জানা লোক নয় বরং এমন লোক যারা জাহেলী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবার উদ্যোগ নিয়েছে এবং কোন ভদ্রলোকের সাথে অশালীন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। রহমানের বান্দাদের পদ্ধতি হচ্ছে, তারা গালির জবাবে গালি এবং দোষারোপের জবাবে দোষারোপ করে না। এভাবে প্রত্যেক বেহুদাপনার জবাবে তারাও সমানে বেহুদাপনা করে না। বরং যারাই তাদের সাথে এহেন আচরণ করে তাদের সালাম দিয়ে তারা অগ্রসর হয়ে যায়, যেমন কুরআনের অন্য জায়গায় বলা হয়েছেঃ
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
“আর যখন তারা কোন বেহুদা কথা শোনে, তা উপেক্ষা করে যায়। বলে, আরে ভাই, আমাদের কাজের ফল আমরা পাবো এবং তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে। সালাম তোমাদের, আমরা জাহেলদের সাথে কথা বলি না।” (আল কাসাসঃ ৫৫) ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল কাসাস ৭২ ও ৭৮ টীকা
# ওটা ছিল তাদের দিনের জীবন এবং এটা হচ্ছে রাতের জীবন। তাদের রাত আরাম-আয়েশে, নাচ-গানে, খেলা-তামাশায়, গপ-সপে এবং আড্ডাবাজী ও চুরি-চামারিতে অতিবাহিত হয় না। জাহেলীয়াতের এসব পরিচিত বদ কাজগুলোর পরিবর্তে তারা এ সমাজে এমন সব সৎকর্ম সম্পাদনকারী যাদের রাত কেটে যায় আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে, বসে শুয়ে দোয়া ও ইবাদাত করার মধ্য দিয়ে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাদের জীবনের এ দিকগুলো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন সূরা সাজদায় বলা হয়েছেঃ
تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا
“তাদের পিঠ বিছানা থেকে আলাদা থাকে, নিজেদের রবকে ডাকতে থাকে আশায় ও আশঙ্কায়।” ( ১৬ আয়াত )
সূরা যারিয়াতে বলা হয়েছেঃ
كَانُوا قَلِيلًا مِنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ – وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
“এ সকল জান্নাতবাসী ছিল এমন সব লোক যারা রাতে সামান্যই ঘুমাতো এবং ভোর রাতে মাগফিরাতের দোয়া করতো।” ( ১৭-১৮ আয়াত)
সূরা যুমারে বলা হয়েছেঃ
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ
“যে ব্যক্তি হয় আল্লাহর হুকুম পালনকারী, রাতের বেলা সিজদা করে ও দাঁড়িয়ে থাকে, আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজের রবের রহমতের প্রত্যাশা করে তার পরিণাম কি মুশরিকের মতো হতে পারে?” ( ৯ আয়াত )
# এ ইবাদাত তাদের মধ্যে কোন অহংকারের জন্ম দেয় না। আমরা তো আল্লাহর প্রিয়, কাজেই আগুন আমাদের কেমন করে স্পর্শ করতে পারে, এ ধরনের আত্মগর্বও তাদের মনে সৃষ্টি হয় না। বরং নিজেদের সমস্ত সৎকাজ ও ইবাদাত-বন্দেগী সত্ত্বেও তারা এ ভয়ে কাঁপতে থাকে যে, তাদের কাজের ভুল-ত্রুটিগুলো বুঝি তাদের আযাবের সম্মুখীন করলো। নিজেদের তাকওয়ার জোরে জান্নাত জয় করে নেবার অহংকার তারা করে না। বরং নিজেদের মানবিক দুর্বলতাগুলো মনে করে এবং এজন্যও নিজেদের কার্যাবলীর উপর নয় বরং আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের উপর থাকে তাদের ভরসা।
# তাদের অবস্থা এমন নয় যে, আরাম-আয়েশ, বিলাসব্যসন, মদ-জুয়া, ইয়ার-বন্ধু, মেলা-পার্বন ও বিয়ে-শাদীর পেছনে অঢেল পয়সা খরচ করছে এবং নিজের সামর্থ্যের চেয়ে অনেক বেশী করে নিজেকে দেখাবার জন্য খাবার-দাবার, পোষাক-পরিচ্ছদ, বাড়ি-গাড়ি, সাজগোজ ইত্যাদির পেছনে নিজের টাকা-পয়সা ছড়িয়ে চলছে। আবার তারা একজন অর্থলোভীর মতো নয় যে এক একটা একটা পয়সা গুণে রাখে। এমন অবস্থাও তাদের নয় যে, নিজেও খায় না, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের ছেলেমেয়ে ও পরিবারের লোকজনদের প্রয়োজনও পূর্ণ করে না এবং প্রাণ খুলে কোন ভালো কাজে কিছু ব্যয়ও করে না। আরবে এ দুধরনের লোক বিপুল সংখ্যায় পাওয়া যেতো। একদিকে ছিল একদল লোক যারা প্রাণ খুলে খরচ করতো। কিন্তু প্রত্যেকটি খরচের উদ্দেশ্য হতো ব্যক্তিগত বিলাসিতা ও আরাম-আয়েশ অথবা গোষ্ঠির মধ্যে নিজেকে উঁচু মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং নিজের দানশীলতা ও ধনাঢ্যতার ডংকা বাজানো। অন্যদিকে ছিল সর্বজন পরিচিত কৃপণের দল। ভারসাম্যপূর্ণ নীতি খুব কম লোকের মধ্যে পাওয়া যেতো। আর এই কম লোকদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণ।
এ প্রসঙ্গে অমিতব্যয়িতা ও কার্পণ্য কি জিনিস তা জানা উচিত। ইসলামের দৃষ্টিতে তিনটি জিনিসকে অমিতব্যয়িতা বলা হয়। এক, অবৈধ কাজে অর্থ ব্যয় করা, তা একটি পয়সা হলেও। দুই, বৈধ কাজে ব্যয় করতে গিয়ে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে সে নিজের সামর্থ্যের চাইতে বেশী ব্যয় করে অথবা নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী যে অর্থসম্পদ সে লাভ করেছে তা নিজেরই বিলাসব্যসনে ও বাহ্যিক আড়ম্বর অনুষ্ঠানে ব্যয় করতে পারে। তিন, সৎকাজে ব্যয় করা। কিন্তু আল্লাহর জন্য নয় বরং অন্য মানুষকে দেখাবার জন্য। পক্ষান্তরে কার্পণ্য বলে বিবেচিত হয় দু’টি জিনিস। এক, মানুষ নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজনদের প্রয়োজন পূরণের জন্য নিজের সামর্থ্য ও মর্যাদা অনুযায়ী ব্যয় করে না। দুই, ভালো ও সৎকাজে তার পকেট থেকে পয়সা বের হয় না। এ দু’টি প্রান্তিকতার মাঝে ইসলামই হচ্ছে ভারসাম্যের পথ। এ সম্পর্কে নবী ﷺ বলেনঃ
مِنْ فِقْهِ الرَّجُلِ قصده فِى مَعِيشَتِهِ
“নিজের অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা মানুষের ফকীহ (জ্ঞানবান) হবার অন্যতম আলামত।” (আহমদ ও তাবারানী, বর্ণনাকারী আবুদ দারদা)
# “অর্থাৎ আরববাসীরা যে তিনটি বড় গোনাহের সাথে বেশী করে জড়িত থাকে সেগুলো থেকে তারা দূরে থাকে। একটি হলো শিরক, দ্বিতীয়টি অন্যায়ভাবে হত্যা করা এবং তৃতীয়টি যিনা। এ বিষয়বস্তুটিই নবী ﷺ বিপুল সংখ্যক হাদীসে বর্ণনা করেছেন। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদীস। তাতে বলা হয়েছেঃ একবার নবীকে ﷺ জিজ্ঞেস করা হলো, সবচেয়ে বড় গোনাহ কি? তিনি বললেনঃ
أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ
“তুমি যদি কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দী দাঁড় করাও। অথচ আল্লাহই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর? বললেনঃ
َ أَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ خَشْيَةَ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ
“তুমি যদি তোমার সন্তানকে হত্যা কর এই ভয়ে যে সে তোমার সাথে আহারে অংশ নেবে।” জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর? বললেনঃ
أَنْ تُزَانِيَ حَلِيلَةَ جَارِكَ
“তুমি যদি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে যিনা কর।” (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, আহমদ)
যদিও আরো অনেক কবীরা গোনাহ আছে কিন্তু সেকালের আরব সমাজে এ তিনটি গোনাহই সবচেয়ে বেশী জেঁকে বসেছিল। তাই এক্ষেত্রে মুসলমানদের এ বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছিল যে, সমগ্র আরব সমাজে মাত্র এ গুটিকয় লোকই এ পাপগুলো থেকে মুক্ত আছে।
এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে, মুশরিকদের দৃষ্টিতে তো শিরক থেকে দূরে থাকা ছিল একটি মস্ত বড় দোষ, এক্ষেত্রে একে মুসলমানদের একটি প্রধান গুণ হিসেবে তাদের সামনে তুলে ধরার যৌক্তিকতা কি ছিল? এর জবাব হচ্ছে আরববাসীরা যদিও শিরকে লিপ্ত ছিল এবং এ ব্যাপারে তারা অত্যন্ত বিদ্বিষ্ট মনোভাবের অধিকারী ছিল কিন্তু আসলে এর শিকড় উপরিভাগেই সীমাবদ্ধ ছিল, গভীর তলদেশে পৌঁছেনি। দুনিয়ার কোথাও কখনো শিরকের শিকড় মানব প্রকৃতির গভীরে প্রবিষ্ট থাকে না। বরঞ্চ নির্ভেজাল আল্লাহ বিশ্বাসের মহত্ব তাদের মনের গভীরে শিকড় গেড়ে বসেছিল। তাকে উদ্দীপিত করার জন্য শুধুমাত্র উপরিভাগে একটুখানি আঁচড় কাটার প্রয়োজন ছিল। জাহেলিয়াতের ইতিহাসের বহুতর ঘটনাবলী এ দু’টি কথার সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। যেমন আবরাহার হামলার সময় কুরাইশদের প্রত্যেকটি শিশুও জানতো যে, কাবাগৃহে রক্ষিত মূর্তিগুলো এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না বরং একমাত্র এ গৃহের মালিক আল্লাহই এ বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন। হাতি সেনাদের ধ্বংসের পর সমকালীন কবিরা যে সব কবিতা ও কাসীদা পাঠ করেছিলেন এখনো সেগুলো সংরক্ষিত আছে। সেগুলোর প্রতিটি শব্দ সাক্ষ্য দিচ্ছে, তারা এ ঘটনাকে নিছক মহান আল্লাহর শক্তির প্রকাশ মনে করতো এবং এতে তাদের উপাস্যদের কোন কৃতিত্ব আছে বলে ভুলেও মনে করতো না। এ সময় কুরাইশ ও আরবের সমগ্র মুশরিক সমাজের সামনে শিরকের নিকৃষ্টতম পরাকাষ্ঠাও প্রদর্শিত হয়েছিল। আবরাহা মক্কা যাওয়ার পথে তায়েফের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে তায়েফবাসীরা আবরাহা কর্তৃক তাদের “লাত” দেবতার মন্দির বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তাকে কাবা ধ্বংসের কাজে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিল এবং পার্বত্য পথে তার সৈন্যদের নিরাপদে মক্কায় পৌঁছিয়ে দেবার জন্য পথ প্রদর্শকও দিয়েছিল। এ ঘটনার তিক্ত স্মৃতি কুরাইশদেরকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মানসিকভাবে পীড়ন করতে থাকে এবং বছরের পর বছর তারা তায়েফের পথ প্রদর্শকের কবরে প্রস্তর নিক্ষেপ করতে থাকে। তাছাড়া কুরাইশ ও অন্যান্য আরববাসীরা নিজেদের দ্বীনকে হযরত ইবরাহীমের আনীত দ্বীন মনে করতো। নিজেদের বহু ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি এবং বিশেষ করে হজ্জ্বের নিয়ম-কানুন ও রসম-রেওয়াজকে ইবরাহীমের দ্বীনের অংশ গণ্য করতো। তারা একথাও মানতো যে, হযরত ইবরাহীম একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করতেন এবং তিনি কখনো মূর্তিপূজা করেননি। তাদের মধ্যে যেসব কথা ও কাহিনী প্রচলিত ছিল তাতে মূর্তি পূজার প্রচলন তাদের দেশে কবে থেকে শুরু হয়েছিল এবং কোন্ মূর্তিটি কে কবে কোথায় থেকে এনেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ সংরক্ষিত ছিল। একজন সাধারণ আরবের মনে নিজের উপাস্য দেবতাদের প্রতি যে ধরনের ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল তা এভাবে অনুমান করা যেতে পারে যে, কখনো তার প্রার্থনা ও আশা-আকাংখা বিরোধী কোন ঘটনা ঘটে গেলে অনেক সময় নিজের উপাস্য দেবতাদেরকেই সে তিরষ্কার করতো, তাদেরকে অপমান করতো এবং তাদের সামনে নযরানা পেশ করতো না। একজন আরব নিজের পিতার হত্যাকারী থেকে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিল। ‘যুল খালাসাহ’ নামক ঠাকুরের আস্তানায় গিয়ে সে ধর্না দেয় এবং এ ব্যাপারে তার ভবিষ্যত কর্মপন্থা জানতে চায়। সেখান থেকে এ ধরনের কাজ না করার জবাব আসে। এতে আরবটি ক্রুব্ধ হয়ে বলতে থাকেঃ
لو كنت يا ذا الخلص الموتورا مثلى وكان شيخك المقبورا لم تنه عن قتل العداة زورا
অর্থাৎ “হে যুল খালাস! তুমি যদি হতে আমার জায়গায়
নিহত হতো যদি তোমার পিতা
তাহলে কখনো তুমি মিথ্যাচারী হতে না
বলতে না প্রতিশোধ নিয়ো না জালেমদের থেকে।”
অন্য একজন আরব তার উটের পাল নিয়ে যায় সা’দ নামক দেবতার আস্তানায় তাদের জন্য বরকত লাভ করার উদ্দেশ্যে। এটি ছিল একটি লম্বা ও দীর্ঘ মূর্তি। বলির পশুর ছোপ ছোপ রক্ত তার গায়ে লেপ্টেছিল। উটেরা তা দেখে লাফিয়ে ওঠে এবং চারিদিকে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। আরবটি তার উটগুলো এভাবে চারিদিকে বিশৃংখলভাবে ছুটে যেতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে মূর্তিটির গায়ে পাথর মারতে মারতে বলতে থাকেঃ “আল্লাহ তোর সর্বনাশ করুক। আমি এসেছিলাম বরকত নেবার জন্য কিন্তু তুই তো আমার এই বাকি উটগুলোকেও ভাগিয়ে দিয়েছিস।” অনেক মূর্তি ছিল যেগুলো সম্পর্কে বহু ন্যাক্কারজনক গল্প প্রচলিত ছিল। যেমন ছিল আসাফ ও নায়েলার ব্যাপার। এ দু’টি মূর্তি রক্ষিত ছিল সাফা ও মারওয়াও ওপর। এদের সম্পর্কে প্রচলিত ছিল যে, এরা দু’জন ছিল মূলত একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোক। এরা কাবাঘরের মধ্যে যিনা করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে পাথরে পরিণত করে দেন। যেসব দেবতার এ হচ্ছে আসল রূপ, তাদের পূজারী ও ভক্তদের মনে তাদের কোন যথার্থ মর্যাদা থাকতে পারে না। এসব দিক সামনে রাখলে এ কথা সহজে অনুধাবন করা যায় যে, আল্লাহর প্রতি নির্ভেজাল আনুগত্যের একটি সুগভীর মূল্যবোধ তাদের অন্তরের অন্তস্থলে বিরাজিত ছিল। কিন্তু একদিকে অন্ধ রক্ষণশীলতা তাকে দমিয়ে রেখেছিল এবং অন্যদিকে কুরাইশ পুরোহিতরা এর বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ উদ্দীপিত করে তুলছিল। কারণ তারা আশঙ্কা করছিল দেবতাদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা খতম হয়ে গেলে আরবে তাদের যে কেন্দ্রীয় প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তা খতম হয়ে যাবে এবং তাদের অর্থোপার্জনও বাধাগ্রস্থ হবে। এসব উপাদানের ভিত্তিতে যে মুশরিকী প্রতিষ্ঠিত ছিল তা তাওহীদের দাওয়াতের মোকাবিলায় কোন গুরুত্ব ও মর্যাদা সহকারে দাঁড়াতে পারতো না। তাই কুরআন নিজেই মুশরিদেরকে সম্বোধন করে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেঃ তোমাদের সমাজে যেসব কারণে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, তারা শিরকমুক্ত এবং নির্ভেজাল আল্লাহর বন্দেগী ও আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এদিক থেকে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বকে মুশরিকরা মুখে মেনে নিতে না চাইলেও মনে মনে তারা এর ভারীত্ব অনুভব করতো।”
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, এ শান্তির ধারা খতম হবে না বরং একের পর এক জারী থাকবে। দুই, যে ব্যক্তি কুফরী, শিরক বা নাস্তিক্যবাদের সাথে হত্যা ও অন্যান্য গোনাহের বোঝা মাথায় নিয়ে যাবে সে বিদ্রোহের শাস্তি আলাদাভাবে ভোগ করবে এবং অন্যান্য প্রত্যেকটি অপরাধের শাস্তি ভোগ করবে আলাদা আলাদাভাবে। তার ছোট বড় প্রত্যেকটি অপরাধ শুমার করা হবে। কোন একটি ভুলও ক্ষমা করা হবে না। হত্যার জন্য একটি শাস্তি দেয়া হবে না বরং হত্যার প্রত্যেকটি কর্মের জন্য পৃথক পৃথক শাস্তি দেয়া হবে। যিনার শাস্তিও একবার হবে না বরং যতবারই সে এ অপরাধটি করবে প্রত্যেকবারের জন্য পৃথক পৃথক শাস্তি পাবে। তার অন্যান্য অপরাধ ও গোনাহের শাস্তিও এ রকমই হবে।
# যারা ইতিপূর্বে নানা ধরনের অপরাধ করেছে এবং এখন সংশোধন প্রয়াসী হয়েছে তাদের জন্য এটি একটি সুসংবাদ। এটি ছিল সাধারণ ক্ষমার (General Amnesty) একটি ঘোষণা। এ ঘোষণাটিই সেকালের বিকৃত সমাজের লাখো লাখো লোককে স্থায়ী বিকৃতি থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। এটিই তাদেরকে আশার আলো দেখায় এবং অবস্থা সংশোধনে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যথায় যদি তাদেরকে বলা হতো, তোমরা যে পাপ করেছো তার শাস্তি থেকে এখন কোন প্রকারেই নিষ্কৃতি পেতে পারো না, তাহলে এটি তাদেরকে হতাশ করে চিরকালের জন্য পাপ সাগরে ডুবিয়ে দিতো এবং তাদের সংশোধনের আর কোন সম্ভাবনাই থাকতো না। অপরাধীকে একমাত্র ক্ষমার আশাই অপরাধের শৃংখল থেকে মুক্ত করতে পারে। নিরাশ হবার পর সে ইবলিসে পরিণত হয়। তাওবার এ নিয়ামতটি আরবের বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট লোকদেরকে কিভাবে সঠিক পথে এনেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা থেকে তা অনুমান করা যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইবনে জারীর ও তাবারানী এ ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, একদিন আমি মসজিদে নববী থেকে এশার নামায পড়ে ফিরছি এমন সময় দেখি এক ভদ্রমহিলা আমার দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি তাকে সালাম দিয়ে আমার কামরায় চলে গেলাম এবং দরজা বন্ধ করে নফল নামাজ পড়তে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর সে দরজার কড়া নাড়লো। আমি উঠে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি চাও? সে বলতে লাগলো, আমি আপনার কাছে একটি প্রশ্ন করতে এসেছি। আমি যিনা করেছি। আমার পেটে অবৈধ সন্তান ছিল। সন্তান ভূমিষ্ট হবার পরে আমি তাকে মেরে ফেলেছি। এখন আমি জানতে চাই আমার গোনাহ মাফ হবার কোন পথ আছে কি না? আমি বললাম, না কোনক্রমেই মাফ হবে না। সে বড়ই আক্ষেপ সহকারে হা-হুতাশ করতে করতে চলে গেলো। সে বলতে থাকলোঃ “হায়! এ সৌন্দর্য আগুনের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল।” সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে নামায শেষ করার পর আমি তাঁকে রাতের ঘটনা শুনালাম। তিনি বললেনঃ আবু হুরাইরা, তুমি বড়ই ভুল জবাব দিয়েছো। তুমি কি কুরআনে এ আয়াত পড়নি-
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ………………………. إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ জবাব শুনে আমি সঙ্গে সঙ্গেই বের হয়ে পড়লাম। মহিলাটিকে খুঁজতে লাগলাম। রাতে এশার সময়ই তাকে পেলাম। আমি তাকে সুখবর দিলাম। তাকে বললাম, নবী করীম ﷺ তোমার প্রশ্নের এ জওয়াব দিয়েছেন। শোনার সাথে সাথেই সে সিজদাবনত হলো এবং বলতে থাকলো, সেই আল্লাহর শোকর যিনি আমার জন্য ক্ষমার দরজা খুলে দিয়েছেন। তারপর সে গোনাহ থেকে তাওবা করলো এবং নিজের বাঁদীকে তার পুত্রসহ মুক্ত করে দিল। হাদীসে প্রায় একই ধরনের অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেটি একটি বৃদ্ধের ঘটনা। তিনি এসে রসূলুল্লাহর ﷺ কাছে আরজ করছিলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! সারা জীবন গোনাহের মধ্যে কেটে গেলো। এমন কোন গোনাহ নেই যা করিনি। নিজের গোনাহ যদি দুনিয়ার সমস্ত লোকদের মধ্যে ভাগ করে দেই তাহলে সবাইকে গোনাহের সাগরে ডুবিয়ে দেবে। এখনো কি আমার ক্ষমার পথ আছে।? জবাব দিলেনঃ তুমি কি ইসলাম গ্রহণ করেছো? বৃদ্ধ বললেনঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রসূল। রসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ যাও, আল্লাহ গোনাহ মাফ করবেন এবং তোমার গোনাহগুলোকে নেকীতে পরিণত করে দেবেন। বৃদ্ধ বললেনঃ আমার সমস্ত অপরাধ ও পাপ কি ক্ষমা করবেন? জবাব দিলেনঃ হ্যাঁ, তোমার সমস্ত অপরাধ ও পাপ ক্ষমা করে দেবেন। (ইবনে কাসীর, ইবনে আবী হাতেমের বরাত দিয়ে)
# এর দু’টি অর্থ হয়। এক, যখন তারা তাওবা করবে তখন ইতিপূর্বে কুফরী জীবনে তারা যে সমস্ত খারাপ কাজ করতো তার জায়গায় এখন ঈমান আনুগত্যের জীবনে মহান আল্লাহ তাদের সৎকাজ করার সুযোগ দেবেন এবং তারা সৎকাজ করতে থাকবে। ফলে সৎকাজ তাদের অসৎ কাজের জায়গা দখল করে নেবে। দুই, তাওবার ফলে কেবল তাদের আমলনামা থেকে তারা কুফরী ও গোনাহগারির জীবনে যেসব অপরাধ করেছিল সেগুলো কেটে দেয়া হবে না বরং তার পরিবর্তে প্রত্যেকের আমলনামায় এ নেকী লেখা হবে যে, এ হচ্ছে সেই বান্দা যে বিদ্রোহ ও নাফরমানির পথ পরিহার করে আনুগত্য ও হুকুম মেনে চলার পথ অবলম্বন করেছে। তারপর যতবারই সে নিজের পূর্ববর্তী জীবনের খারাপ কাজগুলো স্মরণ করে লজ্জিত হয়ে থাকবে এবং নিজের প্রভু রব্বুল আলামীনের কাছে তাওবা করে থাকবে ততটাই নেকী তার ভাগ্যে লিখে দেয়া হবে। কারণ ভুলের জন্য লজ্জিত হওয়া ও ক্ষমা চাওয়াই একটি নেকীর কাজ। এভাবে তার আমলনামায় পূর্বেকার সমস্ত পাপের জায়গা দখল করে নেবে পরবর্তীকালের নেকীসমূহ এবং কেবলমাত্র শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার মধ্যেই তার পরিণাম সীমিত থাকবে না বরং উল্টো তাকে পুরস্কৃতও করা হবে।
# প্রকৃতিগতভাবে তাঁর দরবারই বান্দার আসল ফিরে আসার জায়গা এবং নৈতিক দিক দিয়েও তাঁর দরবারই এমন একটি জায়গা যেদিকে তার ফিরে আসা উচিত। আবার ফলাফলের দিক দিয়েও তাঁর দরবারের দিকে ফিরে আসা লাভজনক। নয়তো দ্বিতীয় এমন কোন জায়গা নেই যেখানে এসে মানুষ শাস্তি থেকে বাঁচতে পারে অথবা পুরস্কার পেতে পারে। এছাড়া এর অর্থ এও হয় যে, এমন একটি দরবারের দিকে ফিরে যায় যেখানে সত্যি ফিরে যাওয়া যেতে পারে, যেটি সর্বোত্তম দরবার, সমস্ত কল্যাণ যেখান থেকে উৎসারিত হয়, যেখান থেকে লজ্জিত অপরাধীকে খেদিয়ে দেওয়া হয় না বরং ক্ষমা ও পুরস্কৃত করা হয়, যেখানে ক্ষমা প্রার্থনাকারীর অপরাধ গণনা করা হয় না বরং দেখা হয় সে তাওবা করে নিজের কতটুকু সংশোধন করে নিয়েছে এবং যেখানে বান্দা এমন প্রভুর সাক্ষাত পায় যিনি প্রতিশোধ নেবার জন্য উঠেপড়ে লাগেন না বরং নিজের লজ্জাবনত গোলামের জন্য রহমতের দরজা খুলে দেন।
# এরও দু’টি অর্থ হয়। এক, তারা কোন মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং এমন কোন জিনিসকে প্রকৃত ঘটনা ও সত্য হিসেবে গণ্য করে না যাকে প্রকৃত ঘটনা ও সত্য বলে তারা জানে না। অথবা তারা যাকে প্রকৃত ঘটনা ও সত্যের বিরোধী ও বিপরীত বলে নিশ্চিতভাবে জানে। দুই, তারা মিথ্যা প্রত্যক্ষ করে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার দেখে না এবং তা দেখার সংকল্প করে না। এ দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে মিথ্যা শব্দটি বাতিল ও অকল্যাণের সমার্থক। খারাপ কাজের গায়ে শয়তান যে বাহ্যিক স্বাদ চাকচিক্য ও লাভের প্রলেপ লাগিয়ে রেখেছে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই মানুষ সেদিকে যায়। এ প্রলেপ অপসৃত হলে প্রত্যেকটি অসৎ কাজ মিথ্যা ও কৃত্রিমতায় পরিপূর্ণ দেখা যায়। এ ধরনের মিথ্যার জন্য মানুষ কখনো প্রাণপাত করতে পারে না। কাজেই প্রত্যেকটি বাতিল, গোনাহ ও খারাপ কাজ এদিক দিয়ে মিথ্যা যে, তা মিথ্যা চাকচিক্যের কারণে মানুষকে নিজের দিকে টেনে নেয়। মুমিন যেহেতু সত্যের পরিচয় লাভ করে তাই এ মিথ্যা যতই হৃদয়গ্রাহী যুক্তি অথবা দৃষ্টিনন্দন শিল্পকারিতা কিংবা শ্রুতিমধুর সুকণ্ঠের পোষাক পরিহিত হয়ে আসুক না কেন এসব যে তার নকল রূপ, তা সে চিনে ফেলে।
# এখানে মূলে لغو শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। উপরে যে মিথ্যার ব্যাখ্যা করা হয়েছে لغو শব্দটি তার উপরও প্রযুক্ত হয় এবং এই সঙ্গে সমস্ত অর্থহীন, আজেবাজে ফালতু কথাবার্তা ও কাজও এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর সৎ বান্দাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা জেনে শুনে এ ধরনের কথা ও কাজ দেখতে বা শুনতে অথবা তাতে অংশ গ্রহণ করতে যায় না। আর যদি কখনো তাদের পথে এমন কোন জিনিস এসে যায়, তাহলে তার প্রতি একটা উড়ো নজর না দিয়েও তারা এভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে যেমন একজন অত্যন্ত সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তি কোন ময়লার স্তুপ অতিক্রম করে চলে যায়। ময়লা ও পচা দুর্গন্ধের ব্যাপারে একজন কুরুচিসম্পন্ন ও নোংরা ব্যক্তিই আগ্রহ পোষণ করতে পারে কিন্তু একজন সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রলোক বাধ্যতামূলক পরিস্থিতির শিকার হওয়া ছাড়া কখনো তার ধারে কাছে যাওয়াও বরদাশত করতে পারে না। দুর্গন্ধের স্তুপের কাছে বসে আনন্দ পাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল মূ’মিনূন ৪ টীকা। )
# মূল শব্দগুলো হচ্ছে لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا এর শাব্দিক তরজমা হচ্ছে, “তারা তার ওপর অন্ধ ও বোবা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। কিন্তু এখানে “ঝাঁপিয়ে পড়া আভিধানিক অর্থে নয় বরং পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আমরা কথায় বলি, “জিহাদের হুকুম শুনে বসে রইলো।” এখানে বসে থাকা শব্দটি আভিধানিক অর্থে নয় বরং জিহাদের জন্য না ওঠা ও নড়াচড়া না করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তারা এমন লোক নয় যারা আল্লাহর আয়াত শুনে একটুও নড়ে না বরং তারা তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলোতে যেসব নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা সেগুলো মেনে চলে। যেটি ফরয করা হয়েছে তা অবশ্য পালন করে। যে কাজের নিন্দা করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকে। যে আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে তার কল্পনা করতেই তাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে।
# তাদেরকে ঈমান ও সংকাজের তাওফীক দান করো এবং পবিত্র-পরিচ্ছন্ন চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী করো কারণ একজন মু’মিন তার স্ত্রী ও সন্তানদের দৈহিক সৌন্দর্য ও আয়েশ-আরাম থেকে নয় বরং সদাচার ও সচ্চরিত্রতা থেকেই মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। দুনিয়ায় যারা তার সবচেয়ে প্রিয় তাদেরকে দোযখের ইন্ধনে পরিণত হতে দেখার চাইতে বেশী কষ্টকর জিনিস তার কাছে আর কিছুই নেই। এ অবস্থায় স্ত্রীর সৌন্দর্য ও সন্তানদের যৌবন ও প্রতিভা তার জন্য আরো বেশী মর্মজ্বালার কারণ হবে। কারণ সে সব সময় এ মর্মে দুঃখ করতে থাকবে যে, এরা সবাই নিজেদের এসব যোগ্যতা ও গুণাবলী সত্ত্বেও আল্লাহর আযাবের শিকার হবে। এখানে বিশেষ করে এ বিষয়টি দৃষ্টি সম্মুখে রাখা উচিত যে, এ আয়াতটি যখন নাযিল হয় তখন মক্কার মুসলমানদের মধ্যে এমন একজনও ছিলেন না যার প্রিয়তম আত্মীয় কুফরী ও জাহেলিয়াতের মধ্যে অবস্থান করছিল না। কোন স্বামী ঈমান এনে থাকলে তার স্ত্রী তখনো কাফের ছিল। কোন স্ত্রী ঈমান এনে থাকলে তার স্বামী তখনো কাফের ছিল। কোন যুবক ঈমান এনে থাকলে তার মা-বাপ, ভাই, বোন সবাই তখনো কাফের ছিল। আর কোন বাপ ঈমান এনে থাকলে তার যুবক পুত্ররা কুফরীর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ অবস্থায় প্রত্যেকটি মুসলমান একটি কঠিন আত্মিক যন্ত্রণা ভোগ করছিল এবং তার অন্তর থেকে যে দোয়া বের হচ্ছিল তার সর্বোত্তম প্রকাশ এ আয়াতে করা হয়েছে। “চোখের শীতলতা” শব্দ দু’টি এমন একটি অবস্থার চিত্র অংকন করেছে যা থেকে বুঝা যায়, নিজের প্রিয়জনদেরকে কুফরী ও জাহেলিয়াতের মধ্যে ডুবে থাকতে দেখে এক ব্যক্তি এতই কষ্ট অনুভব করছে যেন তার চোখ ব্যথায় টনটন করছে এবং সেখানে খচখচ করে কাঁটার মতো বিঁধছে। দ্বীনের প্রতি তারা যে ঈমান এনেছে তা যে পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারেই এনেছে-একথাই এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের অবস্থা এমন লোকদের মতো নয় যাদের পরিবারের লোকেরা বিভিন্ন ধর্মীয় দল ও উপদলে যোগ দেয় এবং সব ব্যাংকে আমাদের কিছু না কিছু পুঁজি আছে এই ভেবে সবাই নিশ্চিন্ত থাকে।
# তাকওয়া-আল্লাহভীতি ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে আমরা সবার চেয়ে এগিয়ে যাবো। কল্যাণ ও সৎকর্মশীলতার ক্ষেত্রে সবার অগ্রগামী হবো। নিছক সৎকর্মশীলই হবো না বরং সৎকর্মশীলদের নেতা হবো এবং আমাদের বদৌলতে সারা দুনিয়ায় কল্যাণ ও সৎকর্মশীলতা প্রসারিত হবে। একথার মর্মার্থ এই যে, এরা এমন লোক যারা ধন-দৌলত ও গৌরব-মাহাত্মের ক্ষেত্রে নয় বরং আল্লাহভীতি ও সৎকর্মশীলতার ক্ষেত্রে পরস্পরের অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের যুগে কিছু লোক এ আয়াতটিকেও নেতৃত্ব লাভের জন্য প্রার্থী হওয়া ও রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের জন্য অগ্রবর্তী হওয়ার বৈধতার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের মতে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, “হে আল্লাহ! মুত্তাকীদেরকে আমাদের প্রজা এবং আমাদেরকে তাদের শাসকে পরিণত করো।” বস্তুত, ক্ষমতা ও পদের প্রার্থীরা ছাড়া আর কারো কাছে এ ধরনের ব্যাখ্যা প্রশংসনীয় হতে পারে না।
# সবর শব্দটি এখানে ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সত্যের শত্রুদের জুলুম-নির্যাতনের মোকাবিলা সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তার সাথে করা। সত্য দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত ও তার মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা ও সংগ্রামে সব ধরনের বিপদ-আপদ ও কষ্ট বরদাশত করা। সব রকমের ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবিলায় সঠিক পথে দৃঢ়পদ থাকা। শয়তানের সমস্ত প্ররোচনা ও প্রবৃত্তির যাবতীয় কামনা সত্ত্বেও কর্তব্য সম্পাদন করা। হারাম থেকে দূরে থাকা এবং আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থান করা। গোনাহের যাবতীয় স্বাদ ও লাভ প্রত্যাখ্যান করা এবং সৎকাজে ও সঠিক পথে অবস্থানের প্রত্যেকটি ক্ষতি ও তার বদৌলতে অর্জিত প্রতিটি বঞ্চনা মেনে নেওয়া। মোটকথা এ একটি শব্দের মধ্যে দ্বীন এবং দ্বীনী মনোভাব, কর্মনীতি ও নৈতিকতার একটি বিশাল জগত আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
# মূলে ْغٌرْفَه শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মানে উঁচু দালান। সাধারণত এর অনুবাদে “বালাখানা” শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এ থেকে একতলা বা দোতলা কক্ষের ধারণা মনের পাতায় ভেসে ওঠে। অথচ সত্য বলতে কি দুনিয়ায় মানুষ যতই বৃহদাকার ও উচ্চতম ইমারত তৈরি করুক না কেন এমন কি মানুষের অবচেতন মনে জান্নাতের ইমারতের যেসব নকশা সংরক্ষিত আছে ভারতের তাজমহল ও আমেরিকার আকাশচুম্বী ইমারতগুলোও (Sky-scrapers) তার কাছে নিছক কতিপয় কদাকার কাঠামো ছাড়া আর কিছুই নয়।
# যদি তোমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা না করো, তাঁর ইবাদাত না করো এবং নিজেদের প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য তাঁকে সাহায্যের জন্য না ডাকো, তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের কোন গুরুত্বই নেই। এ কারণে তিনি নগণ্য তৃণ-খণ্ডের সমানও তোমাদের পরোয়া করবেন না। নিছক সৃষ্টি হবার দিক দিয়ে তোমাদের ও পাথরের মধ্যে কোন ফারাক নেই। আল্লাহর কোন প্রয়োজন পূরণ করতে হলে তোমাদের উপর নির্ভর করতে হয় না। তোমরা বন্দেগী না করলে তাঁর কোন কাজ ব্যাহত হবে না। তোমাদের তাঁর সামনে হাত পাতা এবং তাঁর কাছে প্রার্থনা করাই তাঁর দৃষ্টিকে তোমাদের প্রতি আকৃষ্ট করে। এ কাজ না করলে তোমরা নিক্ষিপ্ত হবে ময়লা আবর্জনার মতো।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
‘রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে সালাম…'(আয়াত ৬৩) আলােচ্য সূরার শেষ পর্বে ‘আল্লাহর বান্দাদের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হচ্ছে। কারণ, এই বান্দারাই হচ্ছে সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার দীর্ঘ লড়াইয়ের পরবর্তী মানবতার সারবত্তা, হেদায়াত ও গােমরাহীর মধ্যকার কঠিন জিহাদের ফলাফল। এই বান্দারাই হচ্ছে হেদায়াতের সেসব মশাল বরদারদের জন্যে সান্তনান্বরূপ যারা আল্লাহদ্রোহী গােষ্ঠীর নানা ধরনের অবজ্ঞা, অবহেলা ও অগ্রাহ্যতার শিকার হয়েছেন। আগের আয়াতে সেই সব লােকদের কথা বলা হয়েছিলাে, যারা দয়াময় আল্লাহকে চিনেনা বলে জানিয়েছিলাে। আর এখন বলা হচ্ছে সেসব লােকদের কথা যারা দয়াময় আল্লাহর বান্দা এবং যারা দয়াময় আল্লাহকে চিনে ও জানে। কাজেই তাদেরকে আল্লাহর বান্দা বলেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই বিশেষণে বিশেষিত হওয়ার উপযুক্তই তারা। এখানে তাদের আচার আচরণ ও স্বভাব-চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হচ্ছে। তাদেরকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। কারণ, তাদের মতে লোকজন হচ্ছে ইসলামের কাম্য, এরাই হচ্ছে ইসলামী নৈতিকতার মানদন্ড। পৃথিবীর বুকে একমাত্র এরাই আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও নেকদৃষ্টির উপযুক্ত। পৃথিবীর বুকে এরা যদি না থাকতাে, এরা যদি আল্লাহকে না ডাকতাে তাহলে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর কারাে প্রতি দৃষ্টিপাত করতেন না। *আল্লাহর নেক বান্দাদের গুণাবলী : দয়াময় আল্লাহর বান্দাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে ও বিনয়ীভাবে চলাফেরা করে। তাদের চলাফেরায় কোনাে অহঙ্কার নেই, নাস্তিকতা নেই, উন্নাসিকতা নেই, কৃত্রিমতা নেই, জড়তা নেই, ভনিতা নেই এবং নেই কোনাে শিথিলতা। কারণ, হাটা-চলার মধ্যেও মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়, তার মন-মানসিকতা প্রকাশ পায়। কাজেই সহজ, সরল, শান্ত, প্রত্যয়ী ও প্রত্যাশী মনের অধিকারী ব্যক্তির হাটা-চলার মাঝে এসব গুণের বহিপ্রকাশ ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই তার চলাফেরার মাঝে থাকে গাম্ভীর্য ও ধীরস্থিরতা। তার মাঝে থাকে প্রত্যয় ও শক্তি। নম্রভাবে চলার অর্থ এই নয় যে, মাথা নুইয়ে, শরীর ঢিলেঢালা করে রােগীর মতাে করে হাঁটতে হবে। অনেকেই তাকওয়া পরহেযগারী দেখাতে গিয়ে এভাবে হাঁটেন। অথচ এটা ঠিক নয়। কারণ, খােদ রসূলুল্লাহ(স.) এভাবে হাঁটতেন না। তিনি বেশ দ্রুত হাঁটতেন। কিন্তু তারপরও তার চলার ভংগি ছিলাে শান্ত ও সুন্দর। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহাবী আবু হােরায়রা(রা.) বলেন, ‘আমি রসূলুল্লাহ(স.)-এর তুলনায় সুন্দরতম কোনাে কিছু দেখিনি। মনে হতাে যেন সূর্যটা তার চেহারার মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি রসূলুল্লাহ(স.)-এর চেয়ে দ্রুত কাউকে হাঁটতে দেখিনি। মনে হতাে যেন জমিটা তার জন্যে ভাজ হয়ে আসতাে। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়তাম অথচ তাঁর কোনাে কষ্টই হতাে না। হযরত আলী(রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ(স.) যখন হাঁটতেন তখন বীরদর্পে হাঁটতেন। মনে হতাে যেন তিনি কোনাে উচু জায়গা থেকে নামছেন। এই বর্ণনার ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট মােহাদ্দেস আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল জাউযিয়া(র.) বলেন, অর্থাৎ রসূলুল্লাহ(স.)-এর চলা ফেরার মাঝে শৌর্য বীর্য ও বীরত্বের ভাব প্রকাশ পেতো।(যাদুল মা’আদ) দয়াময় আল্লাহর বান্দারা যখন চলাফেরা করে তখন তাদের মনযােগ নিবন্ধ থাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির প্রতি। তাই চলার পথে নির্বোধ ও মূর্খরা কী বললাে বা কী মন্তব্য ছুঁড়ে দিলাে সে দিকে তাকাবার মত সময় ও সুযােগ তাদের থাকে না। তারা কখনাে এসব মূৰ্খদের সাথে অহেতুক তর্ক বিতর্ক ও ঝগড়া-ঝাটিতে লিপ্ত হয় না। এদের খপ্পর থেকে বাঁচার জন্যে ‘সালাম’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তবে এ পাশ কাটিয়ে যাওয়া দুর্বলতার কারণে নয়, অক্ষমতার কারণে নয়, বরং অনর্থক ঝগড়া ফ্যাসাদ থেকে বাঁচার জন্যে এবং মূল্যবান সময়ের অপচয় রােধ করার জন্যে। কারণ একজন ভদ্র ও দায়িত্বশীল লােক কখনাে অনর্থক ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়ে নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষতি করতে পারে না। দিনের বেলায় মানুষের সাথে তাদের আচরণ ও চলাফেরা থাকে এ রকমই। আর রাতের বেলায় তাদের আচরণ কি হয়, সে সম্পর্কে নিচের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে…'(আয়াত ৬৪-৬৬) মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকে তখন আল্লাহর বান্দারা নিজেদের মালিক ও প্রভুর এবাদতে একান্তভাবে মগ্ন থাকে। একমাত্র তার প্রতিই মনােনিবেশ করে, তার উদ্দেশেই দাঁড়ায় এবং তার উদ্দেশেই মাথা নত করে। আরামদায়ক বিছানা আর সুখকর দ্রিার তুলনায় গভীর রাতের এবাদাতই তাদের জন্যে অধিক সুখের ও আরামদায়ক। নিজেদের প্রভুর প্রতি দেহ-মন সহ সর্বাংগ সপে দিয়েই তারা অনাবিল সুখ পায়, শান্তি পায়। মানুষ সহ গােটা প্রকৃতি যখন নিন্দ্রায় বিভাের, তখন তারা নীরবে ও একাকী এবাদাতে মশগুল থাকে। মানুষ যখন মাটিকেই আপন করে নেয়, তখন তারা পরম দয়ালুর মহান আরশের প্রতি মনােনিবেশ করে। দাড়িয়ে হােক বা সেজদায় হােক, ধ্যানে হােক বা যিকিরে হােক সর্ব অবস্থায় এদের মন থাকে আল্লাহভীতিতে পরিপূর্ণ এবং জাহান্নামের আযাবের ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত। সে কারণেই তারা বলে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের কাছ থেকে জাহান্নামের শাস্তি হটিয়ে দাও।'(আয়াত ৬৫-৬৬) অথচ এরা কখনাে জাহান্নাম দেখেনি, কিন্তু এর অস্তিত্বে তারা দৃঢ় বিশ্বাসী। কারণ, তারা এর বর্ণনা পবিত্র কোরআনে পেয়েছে, রাসূলের মুখনিসৃত বাণীতে পেয়েছে। কাজেই তাদের এই ভয় তাদের গভীর ঈমান ও বিশ্বাসেরই পরিচয় ও ফলস্বরূপ। এবাদাত বন্দেগীতে লিপ্ত থেকেও তারা জাহান্নামের শাস্তির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারা নিজেদের এবাদাত বন্দেগীকেই যথেষ্ট মনে করে না এবং এটাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও রেহাই পাওয়ার গ্যারান্টি হিসেবেও দেখে না। তাদের বিশ্বাস যে, আল্লাহর রহমত, দয়া, ক্ষমা ও করুণা ব্যতীত জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা অত্যন্ত ভয় ও ভক্তি নিয়ে আল্লাহর দরবারে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে কাকুতি মিনতি জানায়। জাহান্নামের বর্ণনা এমনভাবে দেয়া হয়েছে যা পড়লে মনে হয় যেন জাহান্নামের লেলিহান অগ্নি শিখা প্রতিটি মানুষকে গ্রাস করার জন্যে ধেয়ে আসছে। এমতাবস্থায় আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে ও সেজদায় পড়ে কান্নাকাটি করছে, ফরিয়াদ জানাচ্ছে যেন এই জাহান্নামের আযাব তাদের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। এর লেলিহান শিখার ছােবল থেকে সবাইকে রক্ষা করা হয় । তারা যে ভাষায় জাহান্নামের বর্ণনা দিচ্ছে তা পড়লে ভয়ে শরীর কেঁপে উঠে। কারণ তাদের বর্ণনায় জাহান্নাম হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই এর শাস্তি নিশ্চিন্ত বিনাশ’ অর্থাৎ এর ছােবলে কেউ আক্রান্ত হলে তার আর রক্ষা নেই। তার ধ্বংস অনিবার্য। আর সে কারণেই আল্লাহর নেক বান্দারা এর ভয়ে এতাে সন্ত্রস্ত ও আতংকিত। আর সে কারণেই তারা বলে, ‘নিশ্চয়ই বসবাস ও অবস্থানস্থল হিসেবে তা অতি নিকৃষ্ট জায়গা’ তারা যথার্থই বলে। কারণ, অগ্নিকুন্ডে বসবাস কি মানুষের জন্যে কামা হতে পারে? জাহান্নামের লেলিহান অগ্নি শিখার মাঝে অবস্থান করা কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? প্রতি মুহূর্তে তপ্ত অঙ্গারে গড়াগড়ি খেয়ে টিকে থাকা কি কারাে পক্ষে সম্ভব? আল্লাহর নেক বান্দাদের জীবনে কোনাে বাড়াবাড়ি নেই, কোনাে অসঙ্গতি নেই এবং কোনাে অতিরঞ্জন নেই। তাদের জীবন হয় ভারসাম্যপূর্ণ, সংগতিপূর্ণ ও মধ্যপন্থী। এ কথাই নিচের আয়াতে বলা হয়েছে। ‘এবং তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এই দুয়ের মধ্যবর্তী।'(আয়াত ৬৭) এটাই হচ্ছে ইসলামী আদর্শের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও গুণ। এই গুণই ইসলাম তার অনুসারীদের ব্যক্তি জীবনে ও সমাজ জীবনে সৃষ্টি করতে চার। এই গুণের ওপরই প্রতিষ্ঠিত ইসলামের শিক্ষা নীতি ও বিচারনীতি। বস্তুত ইসলামী আদর্শের গােটা ভিত্তিই হচ্ছে এই মধ্যমপন্থা ও ভারসাম্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি মালিকানা ইসলাম স্বীকার করলেও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ন্যায় অথবা মানব রচিত আইন দ্বারা পরিচালিত কোনাে সমাজ ব্যবস্থার ন্যায় ইসলাম কখনাে তার কোনাে অনুসারীকে নিজ মালিকানাধীন সম্পদ ব্যবহারে অবাধ স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছাচারিতার অনুমতি দেয় না। বরং ইসলাম তার সকল অনুসারীকে নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপচয় ও কৃপণতার মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করতে উৎসাহিত করে থাকে। কারণ, অপচয় ব্যক্তির জন্যে ক্ষতিকর, সম্পদের জন্যে ক্ষতিকর এবং সমাজের জন্যেও ক্ষতিকর। অপরদিকে কার্পণ্যও ব্যক্তি ও সমাজের জন্যে ক্ষতিকর। কারণ, এর ফলে সম্পদের সদ্ব্যবহার থেকে ব্যক্তি ও সমাজ বঞ্চিত হয়। অথচ সম্পদ হচ্ছে সামাজিক উপকরণ যা সমাজের সেবা ও উপকারেই ব্যবহৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। মােটকথা, অপচয় ও কৃপণতা দুটোই সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় । তাছাড়া এর ফলে ব্যক্তির নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে। এই অবস্থার সংশোধন করতে গিয়ে ইসলাম প্রথমেই ব্যক্তিগত জীবনকে বেছে নেয় এবং মধ্যমপন্থা ঈমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করে। আল্লাহর নেক বান্দাদের আর এক গুণ হচ্ছে, তারা কখনাে আল্লাহর সাথে শিরক করে না, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না এবং ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় না। কারণ, এসব হচ্ছে গুরুতর পাপের কাজ যা কঠিন শান্তিযােগ্য। একথাই নিচের আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোনাে ইলাহকে ডাকে না, আল্লাহ তায়ালা যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারণ ব্যতীত তাকে হত্যা করে না'(আয়াত ৬৮) বলাবাহুল্য, তাওহীদ হচ্ছে ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তি। এই তাওহীদ হচ্ছে আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কতােটুকু তার অধিকারী, সততার অধিকারী ও সরলতার অধিকারী, তা জানার মাপকাঠি। এর মাধ্যমেই ধরা পড়ে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তির অস্বচ্ছতা, বক্রতা ও দুর্বোদ্ধতা যা একটি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল জীবন গঠনে কখনাে সহায়ক হতে পারে না। ন্যায়সংগত কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করাকে পাপ মনে করাও এমন একটি গুণ যা নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক জীবনের জন্যে অপরিহার্য কেননা এই সমাজে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা থাকবে, মানুষের জীবনের মূল্য থাকবে। এই জীবন বন্য জীবন ও গুহার জীবন থেকে সমূর্ণরূপে ডিন্ন, যে জীবনে মানুষের জানমাল ও ইযযত আবরুর কোনো নিরাপত্তা থাকে না। ব্যাভিচারকে পাপ মনে করার অর্থ হচ্ছে একটি নিস্কলুষ ও নির্মল জীবনকে বেছে নেয়া যে জীবনের অধিকারী ব্যক্তিরা স্থূল পাশবিক কামনা-বাসনার অনেক উর্ধে অবস্থান করে এবং বিপরীত লিঙ্গের সাথে দৈহিক মিলনের মাঝে একটা উচ্চ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে বলে তারা বিশ্বাস করে। এই উদ্দেশ্য অবশ্যই স্থূল উপায়ে ও পাশবিক পন্থায় যৌন পিপাসা নিবারণের চেয়ে অনেক উর্ধে। এই তিনটি গুণ দ্বারা যেহেতু সুন্দর ও সুস্থ মানবিক জীবন এবং পশুর স্তরে নেমে যাওয়া স্থূল জীবনের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করে, এই কারণেই আল্লাহ তায়ালা সেগুলােকে তার নেক বান্দাদের গুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই গুণের অধিকারী হওয়ার ফলেই তারা আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান ও সম্মানিত বান্দা হিসেবে গণ্য। এসব গুণাবলী বর্ণনা করার পর এর বিপরীত গুণের অধিকারীদের জন্যে কঠিন হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করে বলা হচ্ছে, ‘যারা এ কাজ করে তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শান্তি দ্বিগুণ হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে অর্থাৎ নিছক শাস্তিই নয়, বরং দ্বিগুণ শাস্তি। আবার নিছক দ্বিগুণ শাস্তিই নয়, বরং শাস্তির সাথে সাথে চিরকাল লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে যা দ্বিগুণ শান্তির চেয়েও কঠিন। তবে যারা এই মর্মান্তিক পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে চায় তাদের জন্যে তাওবার দরজা খােলা রাখা হচ্ছে। ইচ্ছা করলে তারা সঠিক ঈমান, নেক আমল ও তাওবার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তাই বলা হচ্ছে, ‘কিন্তু যারা তাওবা করে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের গােনাহকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন'(আয়াত ৭০) তাওবা করার ফলে আল্লাহ তায়ালা বান্দার অতীতের পাপ কাজগুলাে সৎ কাজে রূপান্তরিত করে দেন। এই যে বিরাট প্রতিদান যার কোনাে তুলনা হয় না এটা কেবল তখনই আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে দান করেন যখন সে ভুল পথ থেকে সরে এসে সঠিক পথে পা বাড়ায় এবং তাঁরই দরবারে আশ্রয় নেয়। কারণ, ‘আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল দয়ালু, তাওবার দরজা সব সময়ই খােলা আছে। কারাে বিবেক যদি জাগ্রত হয় এবং পুনরায় সঠিক পথে ফিরে আসতে চায় তাহলে তার পথে কেউ বাধার সৃষ্টি করবে না তার গােনাহ যাই হােক না কেন এবং তার পরিচয়ও যাই থাকুক না কেন? তাবরানী কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, আবু ফারওয়াহ নামক জনৈক সাহাবী রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি কী বলেন সে সৰ রকমের গােনাহর কাজেই লিপ্ত হয়েছে, তার জন্যে কি কোনাে তাওবার বিধান আছে?’ রসূল বললেন, ‘তুমি কি ইসলাম গ্রহণ করেছো?’ সে উত্তরে বললাে, জী। তিনি বললেন, তাহলে ভালাে কাজ করবে আর মন্দ কাজ ছাড়ে দেবে, এর ফলে আল্লাহ তায়ালা ওই সব গােনাহগুলােকে তােমার জন্যে সৎ কাজে পরিণত করে দেবেন। সে বললাে, আমার বিশ্বাসঘাতকতা ও অপকর্মগুলােকেও’ তিনি বললেন, হা’, তখন লােকটি ‘আল্লাহ আকবার’ বলতে বলতে চলে গেলাে। তবে এই তাওবার কিছু নিয়ম আছে, কিছু শর্ত আছে। এ সম্পর্কে আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সে তাওবা করে ও সৎ কর্ম করে'(আয়াত-৭১) অর্থাৎ তাওবার প্রথম শর্ত হলাে, অনুশােচনা এবং গােনাহর কাজ পরিহার করা। এর দ্বিতীয় শর্ত হলাে, সৎ কাজে আত্মনিয়ােগ করা, যখন কোনাে ব্যক্তি গােনাহর কাজ ত্যাগ করে সৎকাজে আত্মনিয়ােগ করবে তখনই বুঝা যাবে, লোকটি সত্যিকার অর্থে তাওবা করেছে। ফলে এই সং কাজগুলাে তার পাপাচারের ইতিবাচক বিকল্প হিসেবে তার সামনে প্রকাশ পাবে। এটা সকলেরই জানা যে, গােনাহ বা পাপাচার মানুষের এক প্রকারের কর্মকান্ড যা তার দৈনন্দিন জীবনের একটা অনুষঙ্গ। যদি কেউ এসৰ নেতিবাচক কর্মকান্ড ত্যাগ করার পর ইতিবাচক কোনাে কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হতে না পারে তাহলে অবসর মুহূর্তগুলো তার জন্যে অস্বস্তিকর ও পীড়াদায়ক হয়ে উঠবে। ফলে এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সে পুনরায় গােনাহর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে। তাই, একথা বলা যায় যে, তাওবার পর সৎ কাজের নির্দেশ যে পবিত্র কোরআনে এসেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। এই নির্দেশ কেবল সেই মহান সত্ত্বাই দিতে পারেন যিনি মানব চরিত্র ও মানসিকতা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেফহাল। স্রষ্টা অপেক্ষা সৃষ্টি সম্পর্কে অধিক ওয়াকেফহাল আর কে হতে পারে? তিনি কতােই না মহান! আল্লাহর নেক বান্দাদের আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে বলা হচ্ছে, আর তাহলাে, ‘এবং যারা মিথ্যা কাজে যােগদান করে না'(আয়াত ৭২) মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান না করার দুটো অর্থ হতে পারে, এক, সরাসরি কোনাে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান না করা। কারণ এর দ্বারা অন্যের অধিকার খর্ব হয় এবং অন্যায় কাজে সহযােগিতা করা হয়। দুই, যে বৈঠকে কোনাে মিথ্যা কথা বলা হয় অথবা মিথ্যা কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তা থেকে দূরে সরে থাকা। এই শেষােক্ত অর্থই হচ্ছে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। মিথ্যা কর্মকান্ড থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার সাথে সাথে তারা বেহুদা ও অনর্থক কাজ কাম ও কথাবার্তা থেকেও নিজেদেরকে রক্ষা করে থাকে। তাই বলা হয়েছে, ‘এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলে যায়’ অর্থাৎ বেহুদা কথাবার্তা ও কাজ-কাম নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না, নিজের কানকে কলুষিত করে না, বরং এর অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্যে নীরবে পাশ কেটে চলে যায়। কারণ একজন মােমেনের এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানাের সময়ই বা কোথায়? তার তাে নিজের কাজ থেকেই ফুরসত নেই। তার গােটা জীবনটাই তাে ঈমান, আমল ও দাওয়াতী কাজ নিয়ে ব্যস্ত। সে অন্য সব ফালতু কাজ নিয়ে মাথা ঘামাবে কখন? আল্লাহর নেক বান্দাদের আর একটি গুণ হচ্ছে, তারা দ্রুত উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। তারা আল্লাহর আয়াত দ্রুত বােঝার চেষ্টা করে। তাদের হৃদয় মন এ ব্যাপারে পুরােপুরি উন্মুক্ত। সে কথাই নিচের আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘এবং যাদেরকে তাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহ বােঝানাে হলে তাতে অন্ধ ও বধির সদৃশ আচরণ করে না'(আয়াত ৭৩) আলােচ্য আয়াতের বর্ণনাভংগির মাঝে মােশরেকদের আচরণের প্রতি ইংগিত রয়েছে। কারণ, ওরা চোখ, কান বন্ধ করে নিজেদের ভ্রান্ত ও অলীক বিশ্বাসকে নিয়েই আঁকড়ে পড়ে থাকে। তাদের গুরুদের বানানাে আইন কানুন ও মতবাদ নিয়ে পড়ে থাকে কিংবা মনগড়া দেব-দেবীদের চরণেই মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকে । ওরা কিছু শুনতেও চায় না এবং দেখতেও চায় না। ওরা সত্যের আলাের দিকেও যেতে চায় না। নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মতবাদের ব্যাপারে এভাবে চোখ-কান বন্ধ করে পড়ে থাকাটা গােড়ামী, মূর্খতা ও অন্ধ বিশ্বাস নয় তাে কি? কিন্তু আল্লাহর নেক বান্দাদের মাঝে সে জাতীয় স্বভাব নেই। কারণ, তারা নিজেদের আকীদা বিশ্বাসের সত্যতার ব্যাপারে এবং আল্লাহর আয়াতের যথার্থতার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। তারা জেনে-বুঝেই ঈমান গ্রহণ করে। তাদের মাঝে অন্ধ বিশ্বাসের কোনাে অবকাশ নেই। নিজেদের আদর্শের ব্যাপারে আবেগ উচ্ছাস প্রকাশ করলে তা যুক্তিসংগতভাবেই করে এবং জেনে-শুনেই করে।
*আল্লাহর বান্দাদের দোয়া ও তাদের সফলতা : মােটকথা, যারা প্রকৃত আল্লাহর নেক বান্দা তারা কেবল নফল নামাযেই রাত কাটায় না। বরং তাদের মাঝে ওপরে বর্ণিত সবগুলাে গুণই বিদ্যমান থাকে। শুধু তাই নয়, বরং তারা একান্তভাবে কামনা করে যেন তাদের সন্তানরাও তাদের পদাংক অনুসরণ করে, তাদের স্ত্রীরাও যেন তাদের অনুরূপ আদর্শের অনুসারী হয়। এর ফলে যেন তাদের চক্ষু শীতল হয়, তাদের মন শান্ত হয় এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। তারা আরাে কামনা করে যেন আল্লাহভীরু লােকদের জন্যে তাদেরকে আদর্শরূপে গ্রহণ করা হয়। সে কথাই নিচের আয়াতে বলা হয়েছে। ‘এবং যারা বলে, হে আমাদের মালিক, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান করাে'(আয়াত ৭৪) এটাই হচ্ছে স্বভাবজাত অনুভূতি যা গভীর ঈমান থেকে উৎসারিত। একজন প্রকৃত মােমেন স্বভাবতই কামনা করবে যেন আল্লাহর পথের পথিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। আর এই পথিকদের প্রথম সারিতে তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি থাকুক। কারণ তারা হচ্ছে তার একান্ত আপনজন ও আমানতস্বরূপ। তাদের ব্যাপারে তার কাছ থেকে অবশ্যই কৈফিয়ত তলব করা হবে। একজন প্রকৃত ও খাটি মােমেন এটাও কামনা করবে সে যেন সত্য ও মঙ্গলের দিশারী হতে পারে এবং আল্লাহর পথের পথিকদের নেতৃত্ব দান করতে পারে। এই কামনার মাঝে নিজেকে বড়াে মনে করার কিছুই নেই এবং এতে আত্মগরিমারও কিছুই নেই। কারণ তারা সবাই তাে একই কাফেলার লােক। তারা সবাই আল্লাহর পথেরই যাত্রী। এখন আলােচনা করা হচ্ছে আল্লাহর নেক বান্দাদের উত্তম পরিণতির ব্যাপারে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাদেরকে তাদের সবরের প্রতিদানে জান্নাতে কক্ষ দেয়া হবে এবং তাদেরকে সেখানে দোয়া ও সালাম সহকারে অভ্যর্থনা জানানাে হবে'(আয়াত ৭৫-৭৬) কক্ষ বলতে এখানে খুব সম্ভবত জান্নাতই বুঝানাে হয়েছে অথবা জান্নাতে অবস্থিত বিশেষ কোনাে স্থানকে বুঝানাে হয়েছে। পৃথিবীর নিয়ম অনুসারে গুরুত্বপূর্ণ মেহমানদেরকে মানুষ বাড়ীর আংগিনার পরিবর্তে অন্দর মহলের খাস কামরায় নিয়েই বসায়। আল্লাহ তায়ালাও তার নেক বান্দাদেরকে তাদের ধৈর্য ও সহ্যের বিনিময়ে এবং তাদের সৎ গুণাবলীর পুরস্কারস্বরূপ জান্নাতের বিশেষ কক্ষে সালাম সহকারে অভ্যর্থনা জানাবেন, সাদর সম্ভাষণ জানাবেন। এই বর্ণনাভংগি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ। এর দ্বারা এ কথাই বুঝা যায় যে, ওইসব উচ্চাংগের সৎ গুণাবলী অর্জন করতে গিয়ে আল্লাহর নেক বান্দাদেরকে অনেক কামনা বাসনা বিসর্জন দিতে হয়েছে, জীবনের অনেক ভোগ বিলাসিতা ত্যাগ করতে হয়েছে এবং নিজেদেরকে পতনের কারণ থেকে রক্ষা করতে হয়েছে। সৎ জীবন সাধনা ব্যতীত লাভ করা যায় না। আর এই সাধনার জন্যে প্রয়ােজন হয় পরম ধৈর্য ও সহ্য। এমন ধৈর্য যা পবিত্র কোরআনে স্থান পাওয়ার মতাে উপযুক্ত আর সে কারণেই তাদের স্থান হবে জাহান্নামের পরিবর্তে জান্নাতে। যে জান্নাত হচ্ছে বসবাসের জন্যে সুন্দরতম স্থান, চিরস্থায়ী স্থান। এখান থেকে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কেউ তাদেরকে বের করতে পারবে না। এখানে তারা স্থায়ীভাবে এবং পরম শান্তিতে বসবাস করতে থাকবে। আল্লাহর বান্দাদের সকল গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পর আলােচ্য সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিচ্ছেন গােটা মানব জাতি তার সামনে কিছুই নয়। তিনি ইচ্ছা করলে সবাইকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। তবে নেক বান্দাদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে বলে তিনি তা করেন না। তবে যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের জন্যে কঠিন শাস্তি অনিবার্য। সে কথাই নিচের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘বলো, আমার পালনকর্তা তােমাদের পরওয়া করেন না।'(আয়াত-৭৭)। সূরার শেষের এই বক্তব্যটি বিষয়বস্তুর সাথে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। এর দ্বারা রসূলুল্লাহ(স.)-কে সান্তনা দেয়া হয়েছে। তাঁকে সমবেদনা জানানাে হয়েছে, তিনি যেন কাফের মােশরেকদের কঠোর ও নিষ্ঠুর আচরণে ব্যথিত না হন। অথচ এসব কাফের মােশরেকলের দল রসূলুল্লাহ(স.)-এর মান-মর্যাদার কথা ভালােভাবেই জানে। তা সত্ত্বেও কেবল গােড়ামী ও গােয়ার্তুমীর বশবর্তী হয়ে তারা এ ধরনের আচরণ করে থাকে। তাদের জানা উচিত, আল্লাহর সামনে শুধু তারাই নয়, বরং গােটা মানব জাতিই কিছুই নয়। যদি এই অল্পসংখ্যক ঈমানদার বান্দাদের দোয়া-দরূদ ও কান্নাকাটি না হতাে তাহলে পৃথিবীর বুকে ওদের কি কোনাে অস্তিত্ব থাকতাে? এই যে পৃথিবী- এরই বা কী মূল্য আছে? এই বিশাল সৃষ্টিজগতে পৃথিবী একটা ছােট্ট কনা বৈ আর কি? আর মানব জাতি? সেও তাে পৃথিবীর বুকে বিচরণকারী অসংখ্য প্রাণী জগতেরই একটা ক্ষুদ্র অংশ এবং এক বিশাল গ্রন্থের অসংখ্য পৃষ্ঠার মাঝে একটি পৃষ্ঠা মাত্র। এরপরেও মানুষ আত্মগর্বে ফুলে-ফেঁপে উঠে। দাম্ভিকতা দেখাতে দেখাতে সে এক সময় নিজ স্রষ্টার ওপরও বাহাদুরী ফলাতে আরম্ভ করে। অথচ একটা নগন্য, দুর্বল ও অক্ষম জীব ব্যতীত মানুষের আর কী পরিচয় আছে স্রষ্টার সামনে। এই স্রষ্টার কাছ থেকেই সে শক্তি অর্জন করে, সঠিক পথের সন্ধান পায়। আর তখনই নিজ স্রষ্টার কাছে তার একটা মূল্য হয়। এমন কি সে এক্ষেত্রে ফেরেশতাদেরকেও ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে। এটা আল্লাহরই অশেষ মেহেরবানী যে, তিনি এই মানুষ নামী প্রাণীকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এবং ফেরেশতাদের দ্বারা তাদেরকে সেজদা করিয়েছেন, উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, তারা যেন সেই মহান স্রষ্টাকে চিনতে পারে, জানতে পারে এবং তারই এবাদাত বন্দেগী করতে পারে। এর ফলে তারা নিজেদের সেই সকল বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীগুলাে রক্ষা করতে সক্ষম হবে যার কারণে ফেরেশতারা তাদেরকে সম্মানার্থে সেজদা করেছিলাে। অন্যথায় তার কোনােই মূল্য নেই। এমনকি গােটা মানব জাতিকেও যদি এক পাল্লায় রাখা হয় তাতেও পাল্লা ভারী হবে না। ‘বলো আমার প্রভূ তোমাদের পরোয়া করেন না’ এই বর্ণনাভংগি রসূলকে উৎসাহিত করে এবং তার মাঝে শক্তি যােগায়, মনােবল যােগায়। এর অর্থ হচ্ছে, রসূল(স.) ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দেবেন, আমি আমার প্রভুর সান্নিধ্যে আছি, তাঁর হেফাযতে আছি। তিনিই আমার পালনকর্তা ও রক্ষক, আর আমি তাঁর বান্দা। তােমরা হচ্ছো, বেঈমানদের দল, তােমরা তাঁর নেক বান্দাদের দলে নও। কাজেই তােমরা হচ্ছাে জাহান্নামের ইন্ধন, তােমাদের জন্যে জাহান্নামের আযাব অনিবার্য।