(বই#৯৯৭) [ *আল কুরআন এক জীবন্ত নিদর্শন :-] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯৭)
[ *আল কুরআন এক জীবন্ত নিদর্শন :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৬:শুআরা
পারা:১৯
১-৯ নং আয়াত:-
২৬:১
طٰسٓمّٓ ﴿۱﴾
ত্বা-সীন-মীম।
২৬:২
تِلۡکَ اٰیٰتُ الۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ ﴿۲﴾
এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত।
২৬:৩
لَعَلَّکَ بَاخِعٌ نَّفۡسَکَ اَلَّا یَکُوۡنُوۡا مُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۳﴾
তারা মুমিন হচ্ছে না বলে আপনি হয়ত মনোকষ্টে আত্মঘাতী হয়ে পড়বেন!
২৬:৪
اِنۡ نَّشَاۡ نُنَزِّلۡ عَلَیۡہِمۡ مِّنَ السَّمَآءِ اٰیَۃً فَظَلَّتۡ اَعۡنَاقُہُمۡ لَہَا خٰضِعِیۡنَ ﴿۴﴾
আমি চাইলে আকাশ থেকে এমন নিদর্শন অবতীর্ণ করতে পারতাম যার ফলে তাদের ঘাড় তার সামনে নত হয়ে যেতো।
২৬:৫
وَ مَا یَاۡتِیۡہِمۡ مِّنۡ ذِکۡرٍ مِّنَ الرَّحۡمٰنِ مُحۡدَثٍ اِلَّا کَانُوۡا عَنۡہُ مُعۡرِضِیۡنَ ﴿۵﴾
তাদের কাছে দয়াময়ের পক্ষ থেকে যে নতুন নসীহতই আসে, তা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।
২৬:৬
فَقَدۡ کَذَّبُوۡا فَسَیَاۡتِیۡہِمۡ اَنۡۢبٰٓؤُا مَا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿۶﴾
অতএব তারা তো মিথ্যারোপ করেছে। কাজেই তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত তার প্রকৃত বার্তা তাদের কাছে শীঘ্রই এসে পড়বে।
২৬:৭
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اِلَی الۡاَرۡضِ کَمۡ اَنۡۢبَتۡنَا فِیۡہَا مِنۡ کُلِّ زَوۡجٍ کَرِیۡمٍ ﴿۷﴾
আর তারা কি কখনো পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেনি? আমি কত রকমের কত বিপুল পরিমাণ উৎকৃষ্ট উদ্ভিদ তার মধ্যে সৃষ্টি করেছি?
২৬:৮
اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً ؕوَ مَا کَانَ اَکۡثَرُ ہُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸﴾
নিশ্চয় এতে আছে নিদর্শন, আর তাদের অধিকাংশই মুমিন নয়।
২৬:৯
وَ اِنَّ رَبَّکَ لَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ﴿٪۹﴾
আর যথার্থই তোমার রব পরাক্রান্ত এবং অনুগ্রহশীলও।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : তা-সীন-মীম, এগুলাে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী আয়াতসমূহ… আর অবশ্যই তােমার রব বড়ই শক্তিমান মেহেরবান। এই মৌলিক সূরাটির আলােচ্য বিষয় সবটুকুই হচ্ছে মক্কী যিন্দেগী কেন্দ্রিক, অর্থাৎ সূরাটিতে আকীদা সম্পর্কেই আলােচনা এসেছে। আকীদা বা অন্তরের মধ্যে আগত মৌলিক গভীর বিশ্বাসের প্রধান কথা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা একা এবং একাই তিনি সকল ক্ষমতার মালিক, ‘অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শক্তি ক্ষমতার মালিক (ইলাহ) রূপে ডেকো না, তাহলে তুমি শাস্তি প্রাপ্তদের মধ্যে একজন হয়ে যাবে।'(আয়াত ২১৩) এরপর আলােচনা এসেছে আখেরাতের ভয় সম্পর্কে, হে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন আমাকে অপমান করাে না, যেদিন সম্পদ সন্তানাদি কোনাে কিছুই কোনাে কাজে লাগবে না, তবে সেই ব্যক্তিই নাজাত পাবে যে সেদিন শিরক মুক্ত মন নিয়ে আসবে। আকীদার অন্তর্গত তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর ওপর যে ওহী নাযিল হয়েছে একথাকে বিশ্বাস করা, এরশাদ হচ্ছে, ‘এ পবিত্র ওহী নাযিল হয়েছে রব্বুল আলামীনের কাছ থেকে। এ পাক পবিত্র বাণী নিয়ে রুহুল আমীন (বিশ্বস্ত ঐশী দূত) জিবরাঈল(আ.) নাযিল হয়েছেন।’ আকীদার মধ্যে চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার পরিণতি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করা, কেননা সত্য বিরােধীরা হয় দুনিয়াতে আযাবে পতিত হয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হবে, নতুবা আখেরাতের আযাবে পতিত হবে, যা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা (সত্যকে) প্রত্যাখ্যান করলাে, অতপর ওরা সত্য সম্পর্কে যেসব উপহাস বিদ্রুপ করলাে, সে পরিণতির সংবাদ শীঘ্রই তাদের কাছে পৌছে যাবে।’

*আল কুরআন এক জীবন্ত নিদর্শন : ‘শীঘ্রই জানতে পারবে তারা যারা যুলুম করেছে- কোন পরিণতির দিকে তারা ফিরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে (ওদের সম্পর্কে চিন্তা করতে করতে) তুমি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে। এজন্যে যে ওরা ঈমান আনছে না। যদি আমি চাইতাম তাহলে আকাশ থেকে এমন কোনাে নিদর্শন নাযিল করতাম, যার কারণে বিনয়াবনতভাবে তাদের গর্দান ঝুঁকে পড়ে।'(আয়াত ৩-৪) এ আয়াতের ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, কাফেরদের না-ফরমানীর কারণে রসূলুল্লাহ(স.) খুব বেশী কষ্ট বােধ করতেন, দুঃখে তাঁর মন ফেটে চৌচির হয়ে যেতাে। এ কথাটাই এখানে বলা হচ্ছে, ‘বােধ হয় ওরা ঈমান না আনার কারণে (চিন্তা করতে করতে) তুমি নিজেকে হালাক করে ফেলবে।’ ‘বাখেউন্নাফসা’ অর্থ নাফসকে হত্যা করা। এই জন্যে রসূল(স.)-এর এই অবস্থা এমন হতাে যে, যারা এতােদিন ‘আল আমীন’ (একান্ত বিশ্বস্ত মানুষ) বলে তাকে ডেকেছে, তারাই তার আহবানকে মিথ্যা কথা বলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। তাদের এই কঠিন আচরণের কারণে অবশ্যই তাদের ওপর আল্লাহর আক্রোশ এসে পড়বে বলে তার নিশ্চিত বিশ্বাস। আর এই কারণেই তিনি পেরেশান হয়ে যাচ্ছেন। তারা তাে তাঁরই দেশবাসী, তারই পরিবার, গােত্রের লােক ও তাঁরই জাতি। এজন্যে তার বুকটা সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে তাদের ওপর নিশ্চিত বিপদ আসার আশংকায়। এজন্যে তার প্রতি স্নেহমাখা ভাষায় মহান আল্লাহ কথা বলছেন এবং তাকে এত বেশী দুঃখ করতে মানা করছেন যা তার জন্যে চরম ক্ষতিকর হয়ে যাবে, বরং তিনি ধ্বংস হওয়ার পর্যায়ে পৌছে যাচ্ছেন। তাই তিনি তাঁকে জানাচ্ছেন তারা ঈমান আনুক আর না আনুক তাকে তাে সেজন্যে দায়ী করা হবে না, আল্লাহ তায়ালা চাইলে তাদেরকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে পারতেন, কিন্তু তিনি বলছেন, ‘আর যদি আমি তাদেরকে ঈমান আনার জন্যে বাধ্য করতে চাইতাম তাহলে অবশ্যই বাধ্য করতে পারতাম এবং অবশ্যই আকাশ থেকে এমন কিছু নিদর্শন নাযিল করতে পারতাম যা দেখে তারা ঈমান আনতে বাধ্য হয়ে যেতাে এবং কোনাে টাল বাহানা করার সুযােগ পেতাে না, ঈমান আনা থেকে মুখ ফিরিয়েও চলে যেতে পারতাে না। এরপর তারা এই আয়াতের প্রতি বা সে নিদর্শনের প্রতি এতােই দুর্বল হয়ে পড়তাে যে, তাদের অন্তর গলে যেতো; ফলে বিনয়ের কারণে তাদের ঘাড় ঝুঁকে পড়তো।’ অর্থাৎ, আমি চাইলে সত্যকে তাদের কাছে এতােই গ্রহণ যােগ্য করে তুলতে পারতাম যে সত্য থেকে তারা দূরে সরে যেতে পারতাে না এবং অবশ্যই তারা এর ওপর কায়েম হয়ে যেতাে। কিন্তু পাক পরওয়ারদেগার এই শেষ রেসালাতের সাথে এমন কোনাে নিদর্শন পাঠাতে চাননি যার কারণে মানুষ সত্যকে গ্রহণ করার ব্যাপারে মজবুর হয়ে যায়। হাঁ, সত্যকে জানা ও বুঝার জন্যে আল্লাহ রুবুল আলামীন আল কোরআনকে জীবন্ত নিদর্শন বানিয়ে পাঠিয়েছেন, যা গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে যে কোনাে মানুষের মন সত্য সচেতন হয়ে যাবে, সত্যের দিকে আকৃষ্ট হবে এবং তার মনের মধ্যে সত্যকে গ্রহণ করার জন্যে একটি প্রবল প্রেরণা অনুভব করবে, অর্থাৎ এ পাক কালামের মধ্যে অবর্ণনীয় এক সৌন্দর্য আছে। ভাষার এমন আকর্ষণ, এমন গাঁথুনি, অনস্বীকার্য যুক্তি, অভাবনীয় তথ্য ও তত্ত্ব যা মানুষকে সত্য থেকে আর দূরে সরে যেতে দেয় না এবং সকল দিক থেকে তাদের মনকে সরিয়ে এনে সত্যকে গ্রহণ করতে বাধ্য করে ফেলে। প্রিয় পাঠক পাঠিকা, দিল ও দেমাগ দিয়ে আল কোরআন বুঝার চেষ্টা করুন, দেখতে পাবেন ওপরের এ কথাটা কতটা সত্য, দেখবেন এর বৈচিত্র্যময় বর্ণনাভংগী এবং আলােচ্য বিষয়াবলীর মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সংগতিপূর্ণ তত্ত্ব ও তথ্যের অবতারণা আপনাকে মুগ্ধ করবে। দেখবেন এর মধ্যে একটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি মনকে কেন্দ্রীভূত করার মতাে প্রবল শক্তি রয়েছে, যার মধ্যে কোনাে বিভিন্নতা নেই, নেই পারস্পরিক কোনাে বিরােধ এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলাের মধ্যে একের সাথে অন্যের কোনাে পার্থক্য নেই। আরাে দেখতে পাবেন এর মধ্যে উপস্থাপিত মানুষের জন্যে কল্যাণকর কাজগুলাের মধ্যেও কোনাে বৈপরীত্য নেই। আল কোরআনের এসব বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে তখনই মানুষের কাছে ধরা পড়ে, যখন সে কোনাে এক ব্যক্তির কাজকে পর্যবেক্ষণ করে এবং তার কাজের মধ্যে এসব কিছু দেখতে পায়। অগ্রগতি, অধগতি, মজবুরী ও দুর্বলতা সবই সে দেখে এবং তার মধ্যে বিভিন্ন অবস্থাও লক্ষ্য করে। এমনই এক ব্যক্তির জীবন ও তার সকল কাজের মধ্যে আল কোরআন সামঞ্জস্য, ভারসাম্য এবং সুনির্দিষ্ট এক শৃংখলা এনে দেয়; তাকে এমন নীতির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। যার মধ্যে কোনাে ভাংগন বা বিভিন্নতা থাকে না, তা তাকে এমন এক উৎসের দিকে এগিয়ে দেয়, যার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন হয় না। আল কোরআন এর আয়াতগুলাে বা এ পাক কালামের মধ্যে উপস্থাপিত নিদর্শনগুলাের সংস্পর্শে যখন মানুষ আসে তখন তার চিন্তার মধ্যে এক অভাবিত বিপ্লব সৃষ্টি হয়, কিন্তু লক্ষ্য করলে এখানেও দেখবেন এ বিপ্লবের ধারা উপধারার মধ্যে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে। আরোও দেখতে পাবেন, আল কোরআনে পেশকৃত চিন্তাধারার মধ্যে কোনাে শূন্যতা দিশেহারা ভাব নেই, অথবা প্রথম দিককার চিন্তার সাথে পরবর্তী চিন্তার কোনাে অসংগতি বা অসামঞ্জস্যতা নেই। মানুষকে আল কোরআন যতাে প্রকার চিন্তার দিকেই এগিয়ে দিয়েছে, দিয়েছে যতাে প্রকার নিয়ম ও বিধানের দিকে, তার প্রত্যেকটির মধ্যে দেখতে পাবেন পারস্পরিক এক অবিচ্ছেদ্য যােগসূত্র, যা একটা আরেকটার পরিপূরক ও সম্পূরক হিসাবে কাজ করে, এতে বুঝা যায় যে, গােটা সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকটি বস্তু অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। আর এর ব্যাপ্তি গােটা মানব জীবনকে ঘিরে রেখেছে, যতো প্রকার বস্তু বিশ্ব জগতে ছড়িয়ে আছে, তার প্রত্যেকটির সাথে প্রত্যেকটিরই ঘনিষ্ঠ একটা যােগাযােগ রয়েছে। একটি আর একটির জন্যে সহায়ক এবং একটি আর একটির ওপর নির্ভরশীল; একটি আর একটির সাথে কোনােভাবেই এবং কোনাে দিক দিয়েই সংঘর্ষশীল নয়। আপনি দেখতে পাবেন, এ বিশাল সৃষ্টির সবাই সবার সাথে এক অমােঘ নিয়মে বাঁধা রয়েছে। বিশ্ব জগতের সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষও একটি সৃষ্টি, যে বৃহত্তর সৃষ্টির নিয়মের মধ্যে সে গড়ে উঠেছে এবং নিত্য এখানে প্রতিপালিত হচ্ছে। আর সুবিশাল এ সৃষ্টিরাজ্যের সব কিছুই একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুর সাথে আবদ্ধ হয়ে আছে, সবাই মিলেও একটি মাত্র সুদৃঢ় ও অভংগুর রশি ধরে আছে যতাে দিন মানবজাতির অস্তিত্ব এই সীমাবদ্ধ জগতে বর্তমান রয়েছে ততােদিন সব কিছুর সাথে তার এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছেই, এ সম্পর্ক কিছুতেই ছিন্ন হবার নয়। এসব কিছুর পেছনে এমন অসীম জ্ঞান ভান্ডার থাকতে হবে যে, যার বাইরে কিছু থাকবে না এবং এসব কিছুকে পরিচালনার জন্যেও নিশ্ছিদ্র এক শৃংখলা বা পূর্ণাংগ ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। অন্তরসমূহে নিহিত চিন্তাধারা ও মানুষের বাহ্যিক মনের মধ্যে যেসব কথা নিশিদিন আনাগােনা করে সেগুলাে অতি সহজভাবে আল কোরআন পেশ করেছে। এটা এ অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। মানুষের জন্যে এসব রহস্য ভান্ডারের সন্ধান রয়েছে সেগুলােকে মানুষের জন্যে খুলে দেয়া হচ্ছে। বিষয়গুলােকে খুঁজে বের করা, এ সবের জট ও জটিলতাগুলােকে খুলে দেয়া এবং সাধারণ মানুষের জন্যে সব কিছুকে বােধগম্য করে দেয়া- এসবই আল কোরআনের মােজেযা। জ্ঞানান্বেষণের জন্যে আল কোরআন যেভাবে মানুষকে উৎসাহিত করেছে এবং যতাে কিছুর তথ্য সরবরাহ করেছে ইতিপূর্বে কখনও কোনো গ্রন্থ তা করেনি। পৃথিবীর রহস্য ভান্ডারের দরজা মানুষের জন্যে খুলে দেয়ার জন্যে আল কোরআন সম্ভাব্য সকল খেদমত আনজাম দিয়েছে, যা এর আগে কোনাে দিন সম্ভব হয়নি। শেষ রসূল(স.)-কে মােজেজা হিসাবে আল্লাহ তায়ালা আল কোরআন দান করেছেন। যা চির দিন দুনিয়ার সকল মানুষের জন্যে মােজেযা হিসাবে থাকবে। এ গ্রন্থের ওপর মানুষ যতাে বেশী গবেষণা চালাতে থাকবে তত বেশী এর থেকে নতুন নতুন তথ্য তারা পেতে থাকবে এবং দিনে দিনে এ পবিত্র গ্রন্থ মানুষের জীবনকে আরাে সহজ এবং আরাে সুন্দর করতে সাহায্য করতে থাকবে। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে এই যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন এমন কোনাে আয়াত নাযিল করেননি যা বস্তুগত কোনাে জিনিস ব্যবহার করার জন্যে মানুষকে বাধ্য করবে এবং জোর করে কোনাে কিছু গ্রহণ করবে অথবা কোনাে কিছু মেনে নেয়ার জন্যে তাকে মজবুর করে ফেলবে। এটা এজন্যে যে রেসালাতে মােহাম্মাদী হচ্ছে বিশ্ব মানবের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত শেষ পয়গাম। এ পয়গাম সবার জন্যে। এ মহাগ্রন্থকে কুক্ষিগত করে রাখার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি, সকল যামানার সকল মানুষের জন্যে এ কেতাব অধ্যয়ন করা, এর ওপর গবেষণা করা এবং এ কেতাব থেকে জীবন পথের নির্দেশনা লাভ করার অধিকার রয়েছে। কোনাে বিশেষ যামানা বা বিশেষ এলাকায় এ কেতাবকে সীমাবদ্ধ করে রাখার জন্যে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কখনও বলা হয়নি। আল্লাহ তায়ালা দূর ও নিকটের সকল মানুষের জন্যে এ কেতাবের মােজেযা বুঝবার পথকে সুগম করেছেন, প্রত্যেক যুগের সকল মানুষের জন্যেই রয়েছে এ মহাগ্রন্থের দ্বার অবারিত ও উন্মুক্ত। এসব অলৌকিক ও অত্যাশ্চর্য ঘটনাবলী তাদের মনকে আল্লাহর দিকে ঝুঁকিয়ে দেয় যারা সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে এগুলাের দিকে তাকায়; এর ফলে এসব দৃশ্য তাদের অন্তরে এত গভীরভাবে রেখাপাত করে যার তুলনা অন্য কোনাে জিনিসের সাথে হয় না। অবশ্যই এই মহা গ্রন্থ আল কোরআন চৌদ্দশত বছরের বেশী সময় ধরে বিশ্ববাসী সবার জন্যে উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে, এর বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং এর মধ্যে বর্ণিত তথ্যসমূহ সবার অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্যে অবারিত রয়েছে। এর মধ্যে মানুষের বাস্তব জীবনকে পরিচালনার জন্যে যে জীবন ব্যবস্থা পেশ করা হয়েছে তা কতােটুকু বাস্তবসম্মত এবং মানব জীবনের জন্য তা কতােখানি কল্যাণকর, সকল শ্রেণীর বিদগ্ধ মানুষই তা দেখতে পারছে। যদি সত্যিকারে তারা মানবজাতির কল্যাণকামী হয় এবং তারা এ পাক কালাম থেকে পথ পেতে চায় তাহলে অবশ্যই এর থেকে তারা সকল বিষয়েই দিক-নির্দেশনা লাভ করবে, উন্নততর পৃথিবী গড়তে পারবে। সুন্দরতর জীবন, মনােরম পরিমন্ডল এবং আদর্শ ও সুন্দরতম পরিণতি অর্জিত হবে। আল কোরআনের অধ্যয়ন ও অনুসরণের মাধ্যমে হয়তাে আগামী প্রজন্ম আমাদের পরে এমন বহু কিছু গড়ে তুলতে সক্ষম হবে যার আমরা কিছুই কল্পনা করতে পারি না। যেসব তত্ত্ব ও তথ্যের সন্ধান আমরা এ পর্যন্ত পেয়েছি তার থেকেও বেশী দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যখন মানুষ এ গ্রন্থ অধ্যয়ন করবে এবং আরাে গভীর গবেষণায় আত্মনিয়ােগ করবে তখন এ পাক কালাম তাদের সামনে অনাগত ভবিষ্যতের নবতর দিগন্ত খুলে দেবে।

*কোরআনের নির্দেশনা থেকে সরে যাওয়ার পরিণতি : আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিয়ম হচ্ছে, যারা প্রকৃতপক্ষে এ মহা ভান্ডারের কাছে প্রার্থী হয়ে যথাযােগ্য সাধনা করে তিনি তাদেরকে তারা যতােটা চায়, ততােটা তাে দেনই- বরং তার থেকেও অনেক বেশী দান করেন এবং তার প্রাপ্তিযোগ এমনভাবে ঘটে যা কখনাে ফুরাতে চায় না, আল্লাহর অসীম ভান্ডারের নতুন নতুন দ্বার তাদের সামনে তখন উন্মোচিত হতেই থাকে। এরশাদ হচ্ছে, যারা সাধনা করে অসীম ভান্ডারের মালিকের কাছে কিছু পাওয়ার জন্যে তাদের জন্যে আমার ওয়াদা, অবশ্যই আমি তাদের আমার বহুতর পথ দেখাবাে। কিন্তু, আফসােস, আজকের মুসলমানেরা এই মহা জ্ঞান ভান্ডারের সন্ধান করার সময় যখন কোনাে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয় তখন হাল ছেড়ে দেয়; আল কোরআন পর্যায়ক্রমে তাদেরকে যেসব কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যখনই তারা কোনাে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে, তখনই তারা পিছপা হয়ে গেছে। তাই এরশাদ হয়েছে, ‘আর যখনই মহা দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নতুন কোনাে নির্দেশ বা উপদেশ আসে তখন তারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর এই উপদেশমালা নাযিল করার সময় তাঁর বান্দার প্রতি কতােবড় রহমত বর্ষণ করেছেন এখানে তাঁর ‘রহমান’ নামটি ব্যবহার করে সেই দিকেই ইংগিত করেছেন। একথাটি বলতে গিয়ে প্রথমেই তিনি তাদের ঘৃণাভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কথা উল্লেখ করছেন। এতে ক্ষতি তাে তাদেরই হচ্ছে, তারা দূরে সরে যাচ্ছে, আল্লাহর অপার রহমতের বারিধারা থেকে যা তিনি বড় মেহেরবানী করে তাঁর বান্দাদের জন্যে বর্ষণ করেছেন। এ রহমতকে তারা অস্বীকার করছে এবং তাদের অবজ্ঞার কারণে তারা নিজেদেরকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করছে, অথচ তাদের জীবনের এই কঠিন অবস্থায় আল্লাহর রহমতের প্রয়ােজন তাদেরই বড় বেশী। এভাবে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় এবং তাঁর রহমতকে উপেক্ষা করার কারণে সে হতভাগাদেরকে এর কঠিন পরিণতি ও ভীষণ শাস্তি ভােগ করতে হবে বলে ও তাদের ধমক দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, হাঁ, ওরা প্রত্যাখ্যান করলাে অতএব তাদের কাছে তাদের উপহাস বিদ্রুপ দরুণ কঠিন পরিণতির খবর শীঘ্রই আসছে। এ আয়াতের মধ্যে ইংগিতের মাধ্যমে তাদের জন্যে ভয়ানক আযাবের ধমকি দেয়া হয়েছে। আয়াতাংশটি ব্যাখ্যা করলে একথাটা আসে যে, ওরা যেমন সত্যকে উপেক্ষা করার সাথে সাথে সত্য খবর দাতার সাথে ঠাটা মঙ্কারি করছে, তার জওয়াবে ওদেরকেও বিদ্রুপাত্মক ভাষায় আযাবের খবর দেয়া হচ্ছে, ‘শীঘ্রই আসছে ওদের কাছে, তার সাথে ওদের বিদ্রুপের কারণে, ওদের জন্যে যথােপযুক্ত খবর’ অর্থাৎ, তার সাথে ওদের উপহাস বিদ্রুপের শাস্তি স্বরূপ শীঘ্রই ওরা আযাবের খবর পাবে। আসলে কথা আকারে তাদের কাছে কোনাে খবর আসবে না, হাযির হবে সে খবর বাস্তব আযাবের রূপ নিয়ে, যার কঠিন স্বাদ তারা ভোগ করবে! তারপর তাদের অধস্তন প্রজন্মে তা পরিণত হবে এক করুন খবর হিসাবে- যা মানুষ বংশ পরম্পরায় বর্ণনা করতে থাকবে। ওরা সত্যকে বিদ্রুপ করছে, ফলে আল্লাহ তায়ালাও ভয়ানক আযাবের ‘সুসংবাদ'(?) দিয়ে তাদেরকে বিদ্রুপ করছেন!!

*চোখ থাকলে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যায় : ওরা আল্লাহর নবীর কাছে মােজেযা দেখানাের জন্য বারবার দাবী করছে, অথচ ওদের আশে পাশে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শক্তি ক্ষমতা বুঝার জন্যে হাজারাে দৃষ্টান্ত যে ছড়িয়ে রয়েছে সেদিকে ওরা তাকায় না। একবার যদি ওরা ওদের হৃদয়ের দ্বার খুলে দিতে এবং বিশ্ব প্রকৃতির দিকে ভােলা চোখ দিয়ে তাকাতাে, তাহলে দেখতে পেতাে চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নিদর্শনগুলাে যেন এক একটি উন্মুক্ত কেতাব, যার প্রত্যেকটি পাতা তাদের সামনে আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার অসংখ্য নিদর্শন। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা কি তাকিয়ে দেখছে না পৃথিবীর দিকে, সেখানে কতাে রকমের জোড়া জোড়া মনােরম গাছপালা ও ফলমূল, আমি (ওদের জন্যে) উৎপাদন করেছি? অবশ্যই এর মধ্যে (আল্লাহকে জানার জন্যে) সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু এসব দেখেও ওদের অধিকাংশই বিশ্বাস স্থাপনকারী হয়নি।’ জীবন্ত গাছপালা, টাটকা ফলমূল ও শাক সজি এসব কিছু (মৃত) থেকে উৎপন্ন হওয়া এবং এদের প্রত্যেকটির মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী জাতীয় অস্তিত্ব থাকা- এটা কি অলৌকিক ব্যাপার নয়? পর্যবেক্ষণ দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়েছে, এদের মধ্যে কোনাে কোনাে প্রজাতি তাে এমনও আছে যাদের মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী জাতীয় সত্ত্বা পৃথক পৃথকভাবে থাকতে দেখা যায়, আর কোনাে কোনােটার মধ্যে একের মধ্যে দুইয়ের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। এক স্রষ্টার সৃষ্টি সবাই- এই এক নিয়মের অধীনে গােটা বিশ্বের বুকে বিরাজ করছে। প্রতি মুহুর্তেই আমরা এটা দেখছি, এর মধ্যে কোনাে ব্যতিক্রম কেউ দেখাতে পারে না, এ সত্য কি বিশ্বস্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আশ্চর্যজনক নিদর্শন হিসাবে আমাদের মধ্যে বিশ্ব সৃষ্টি করে না? এটা কি আল কোরআনে বর্ণিত এক বিশেষ মােজেযা নয়? সাধারণভাবে মানুষ এগুলোর দিকে তাকায় না বলেই তাদের কাছে এগুলাে কোনাে বিস্ময়কর ব্যাপার বলে মনে হয় না। এজন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এগুলাের দিকে খেয়াল করে তাকানাের আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘ওরা কি দেখছে না?’ এই দেখার জন্যে আহ্বান জানানােতে বুঝা যাচ্ছে, এটা এমন কোনাে সুক্ষ্ম বিষয় বা বস্তু নয় যে, খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শুধুমাত্র নযর ফেললেই তারা দেখতে পাবে প্রতিটি জিনিসের মধ্যে রয়েছে পুরুষ ও স্ত্রী জাতীয় অস্তিত্ব ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তির সময়। এজন্যে দেখার থেকে বেশী কিছু করার নেই বলে আলােচ্য আয়াতে শুধু ‘দেখা’র কথাই বলা হয়েছে। মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে আল কোরআনের মধ্যে অবলম্বিত পদ্ধতি মানুষের অন্তর ও সৃষ্টি রাজ্যের দৃশ্যাবলীর মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা জানাচ্ছে। অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলছে, মানুষের সুপ্ত চেতনাকে উজ্জীবিত করছে। ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে থাকা চিন্তাধারাকে আবিলতামুক্ত করছে, তার হৃদয়ের বন্ধ দুয়ারকে খুলে দিচ্ছে, যাতে করে সে সারা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে থাকা এবং তার চতুর্দিকে সবখানে অবস্থিত আশ্চর্যজনক বিষয়াদির দিকে মুদ্ধ নয়নে তাকায় এবং তার জাগ্রত হৃদয় দিয়ে জীবন্ত এ বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারে, তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বিস্ময়কর কীর্তিসমূহ দেখতে পায়; যতােবারই দেখে ততােবারই যেন সে তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে, যতােবার তাঁর বিস্ময়কর সৃষ্টিসমূহের দিকে তার নযর পড়ে, সে যেন তার সাথে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, দিবারাত্রির মধ্যে যে কোনাে মুহুর্তে সে যেন একান্তভাবে মশগুল হয়ে যেতে পারে। তার ধ্যানে সেই মুহূর্তেই যেন তাকে সে তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখতে পায়, সে যেন এসব কিছুর মাধ্যমে বুঝতে পারে যে, তিনি এক ও একমাত্র শক্তিমান এবং সকল ক্ষমতার মালিক। আল্লাহ তায়ালা চান যে মানুষ যেন অনুভব করে যে তিনি বান্দাদের মধ্যে এক ও একক শক্তি হিসাবে সদা-সর্বদা বর্তমান রয়েছেন, তিনি ওৎপ্রােতভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন তার সৃষ্টির সাথে, তিনি বিরাজ করছেন সারা বিশ্ব জুড়ে পরিব্যাপ্ত তাঁর বিধানাবলীর মধ্যে, যার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা কারাে নেই। পাঠক-পাঠিকাকে বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান সে আবর্তন ধারার দিকে একবার গভীরভাবে তাকাতে, যা তাঁরই হুকুমে এক বিশেষ নিয়মে সদা-সর্বদা চলছে এবং যে আবর্তন ধারা বিশ্বের সব কিছুকে পরস্পর সংঘবদ্ধ করে রেখেছে। তার দিকে গভীরভাবে তাকাতে বিশেষভাবে আমরা অনুরােধ করবাে। তাহলে গভীরভাবে অনুভব করতে পারবাে যে মহাবিশ্বের সব কিছুর সাথে এ পৃথিবী নামক গ্রহটিও একান্তভাবে সম্পৃক্ত এবং এর মধ্যে প্রাণ প্রবাহ ও সজীবতা বর্তমান থাকার পেছনে চাঁদ সূর্য ও গ্রহ নক্ষত্রাদির আবর্তন ধারার এক অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা কি তাকিয়ে দেখছে না এই পৃথিবীর দিকে, আমি এদের সবাইকে জোড়া জোড়া অবস্থায় সৃষ্টি করেছি কত রকমের উৎকৃষ্ট জিনিষ সৃষ্টি করেছি!’ এসবের মধ্যে জীবনের স্পন্দন থাকাতে এগুলাে সজীব মনােরম ও সুদৃশ্য হয়ে উঠেছে। এরা পরম মর্যাদাবান আল্লাহ রব্বুল আলামীন থেকে তাদের অনাবিল সুষমা পেয়েছে। এই কারীম শব্দটি সেই ব্যক্তি বা বস্তুর জন্যে যথাযযাগ্য শব্দ হিসাবে আল্লাহ তায়ালা এখানে বর্ণনা করেছেন যে, মহান স্রষ্টার সৃষ্টিরাজিকে তারই মহাদান হিসেবে সে বুঝতে পেরেছে এবং পরওয়ারদেগারে হাকীমের এসব নেয়ামত লাভে নিজেদেরকে ধন্য জ্ঞান করেছে সে বুঝতে পারবে, যে সে এসব কিছুর কোনােটিকে অবহেলা করেনি, তুচ্ছ জ্ঞান করেনি; এগুলাে ব্যবহারের সময় এদের প্রতি কোনাে অবজ্ঞা-ভাব প্রদর্শন করেনি এবং এগুলাে থেকে উদাসীনও হয়ে যায়নি এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই এর মধ্যে (আল্লাহকে চেনার জন্যে) নিদর্শন রয়েছে।’ ওরা চাচ্ছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দেখতে, ওরা দাবী করছে (পূর্ববর্তী নবীদের প্রদত্ত মােজেযাসমূহের মতােই) বিভিন্ন মােজেযা দেখাতে, অথচ আল কোরআনে উল্লেখিত সৃষ্টির বুকে ছড়িয়ে থাকা এসব রহস্যরাজির দিকে তারা তাকায় না। এজন্যেই তাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘ওদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়।’ আলােচ্য সুরার ভূমিকাটিতে আল্লাহর সেই মহিমা ব্যঞ্জক আয়াতাংশটি তুলে ধরে কথাগুলাে শেষ করা হচ্ছে যা এই সূরায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে, ‘তােমার রব অবশ্যই মহাশক্তিমান, বড়ই করুণাময়।’ ‘আল আযীয’ বলতে বুঝায় একমাত্র শক্তিমান তিনি, তিনিই কোনাে নিদর্শন বা মােজেজা প্রদর্শন করার অধিকারী, যখনই তিনি চেয়েছেন তখনই তিনি কোনাে নবীর হাত দিয়ে বিশেষ কোনাে শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং তিনিই মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে পাকড়াও করেছেন। আর রহীম মহা দয়াবান করুণাময়, যিনি তাঁর নিদর্শনগুলাের প্রতি দয়া প্রকাশ করেন। অতপর যার অন্তর হেদায়াতকে গ্রহণ করবে তিনি মেহেরবানী করে তাকে এসব মােজেযার মাধ্যমে তাকে নিরাপত্তা দান করবেন এবং প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে শােধরানাের জন্যে সুযােগ ও সময় দেবেন। কাজেই তাদের কাছে সতর্ককারী কোনাে ব্যক্তি না আসা পর্যন্ত তিনি তাদেরকে আযাব দেবেন না। আর এটাও খেয়াল করুন, সৃষ্টিজগতের মধ্যে বিদ্যমান নিদর্শনাবলীর মধ্যে মানুষের সচ্ছলতা লাভ এবং প্রাচুর্যের অধিকারী হওয়া আল্লাহর শক্তি ক্ষমতারই বিশেষ নিদর্শন, কিন্তু সত্যকে ভাস্বর ও সমুজ্জ্বল করার জন্যে রসূলদেরকে প্রেরণ করা এটা তাঁর রহমতেরই দাবী। এই রসূলদের মাধ্যমেই তিনি মানুষকে তার নেয়ামতের সুসংবাদ দেন এবং তার আযাবের ব্যাপারে সতর্ক করেন।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(২৬-শুআরা) : নামকরণ:

২২৪ আয়াতের وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ থেকে সূরার নামটি গৃহীত হয়েছে।

(২৬-শুআরা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভংগী থেকে বুঝা যাচ্ছে এবং হাদীস থেকে এর সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে যে, এ সূরাটির নাযিলের সময়-কাল হচ্ছে মক্কার মধ্যবর্তীকালীন যুগ। ইবনে আব্বাসের (রা.) বর্ণনা মতে প্রথমে সূরা তা-হা নাযিল হয়, তারপর ওয়াকি’আহ এবং এরপর সূরা আশ্ শু’আরা। (রূহুল মাআনী, ১৯ খণ্ড, ৬৪ পৃষ্ঠা) আর সূরা তা-হা সম্পর্কে জানা আছে, এটি হযরত উমরের (আ) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে নাযিল হয়েছিল।
(২৬-শুআরা) : নাযিলের প্রেক্ষাপট :

ভাষণের পটভূমি হচ্ছে, মক্কার কাফেররা লাগাতার অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও তাবলীগের মোকাবিলা করছিল। এজন্য তারা বিভিন্ন রকমের বাহানাবাজীর আশ্রয় নিচ্ছিল। কখনো বলতো, তুমি তো আমাদের কোন চিহ্ন দেখালে না, তাহলে আমরা কেমন করে তোমাকে নবী বলে মেনে নেবো। কখনো তাঁকে কবি ও গণক আখ্যা দিয়ে তাঁর শিক্ষা ও উপদেশাবলীকে কথার মারপ্যাঁচে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতো। আবার কখনো তাঁর মিশনকে হালকা ও গুরুত্বহীন করে দেবার জন্য বলতো, কয়েকজন মূর্খ ও অর্বাচীন যুবক অথবা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোক তাঁর অনুসারী হয়েছে, অথচ এ শিক্ষা যদি তেমন প্রেরণাদায়ক ও প্রাণপ্রবাহে পূর্ণ হতো তাহলে জাতির শ্রেষ্ঠ লোকেরা, পণ্ডিত, জ্ঞানী-গুণী ও সরদাররা একে গ্রহণ করে নিতো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বলিষ্ঠ যুক্তি সহকারে তাদের আকীদা-বিশ্বাসের ভ্রান্তি এবং তাওহীদ ও আখেরাতের সত্যতা বুঝাবার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু তারা হঠকারিতার নিত্য নতুন পথ অবলম্বন করতে কখনোই ক্লান্ত হতো না। এ জিনিসটি রসূলুল্লাহর (সা.) জন্য অসহ্য মর্মযাতনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এ দুঃখে তিনি চরম মানসিক পীড়ন অনুভব করছিলেন। এহেন অবস্থায় এ সূরাটি নাযিল হয়।

(২৬-শুআরা) : বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়:

বক্তব্যের সূচনা এভাবে হয়ঃ তুমি এদের জন্য ভাবতে ভাবতে নিজের প্রাণ শক্তি ধ্বংস করে দিচ্ছো কেন? এরা কোন নিদর্শন দেখেনি, এটাই এদের ঈমান না আনার কারণ নয়। বরং এর কারণ হচ্ছে, এরা একগুয়ে ও হঠকারী। এরা বুঝালেও বুঝে না। এরা এমন কোন নিদর্শনের প্রত্যাশী, যা জোরপূর্বক এদের মাথা নুইয়ে দেবে। আর এ নিদর্শন যথাসময়ে যখন এসে যাবে তখন তারা নিজেরাই জানতে পারবে, যে কথা তাদেরকে বুঝানো হচ্ছিল তা একেবারেই সঠিক ও সত্য ছিল। এ ভূমিকার পর দশ রুকূ’ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে যে বিষয়বস্তুটি বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, সত্য প্রত্যাশীদের জন্য আল্লাহর সর্বত্র নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। সেগুলো দেখে তারা সত্যকে চিনতে পারে। কিন্তু হঠকারীরা কখনো বিশ্ব-জগতের নিদর্শনাদি এবং নবীদের মু’জিযাসমূহ তথা কোন জিনিস দেখেও ঈমান আনেনি। যতক্ষণ না আল্লাহর আযাব এসে তাদেরকে পাকড়াও করেছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের গোমরাহীর ওপর অবিচল থেকেছে। এ সম্বন্ধের প্রেক্ষিতে এখানে ইতিহাসের সাতটি জাতির অবস্থা পেশ করা হয়েছে। মক্কার কাফেররা এ সময় যে হঠকারী নীতি অবলম্বন করে চলছিল ইতিহাসের এ সাতটি জাতিও সেকালে সেই একই নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। এ ঐতিহাসিক বর্ণনার আওতাধীনে কতিপয় কথা মানস পটে অংকিত করে দেয়া হয়েছে।

। একঃ নিদর্শন দু’ধরনের। এক ধরনের নিদর্শন আল্লাহর যমীনে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। সেগুলো দেখে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি নবী যে জিনিসের দিকে আহবান জানাচ্ছেন সেটি সত্য হতে পারে কিনা সে সম্পর্কে অনুসন্ধান ও গবেষণা করতে পারে। দ্বিতীয় ধরনের নিদর্শন ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় দেখেছে, নূহের সম্প্রদায় দেখেছে, আদ ও সামূদ দেখেছে, লূতের সম্প্রদায় ও আইকাবাসীরাও দেখেছে। এখন কাফেররা কোন্ ধরনের নিদর্শন দেখতে চায় এটা তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

। দুইঃ সকল যুগে কাফেরদের মনোভাব একই রকম ছিল। তাদের যুক্তি ছিল একই প্রকার। তাদের আপত্তি ছিল একই। ঈমান না আনার জন্য তারা একই বাহানাবাজীর আশ্রয় নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা একই পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক নবীর শিক্ষা একই ছিল। তাদের চরিত্র ও জীবননীতি একই রঙে রঞ্জিত ছিল। নিজেদের বিরোধীদের মোকাবিলায় তাঁদের যুক্তি-প্রমাণের ধরণ ছিল একই। আর তাঁদের সবার সাথে আল্লাহর রহমতও ছিল একই ধরনের। এ দু’টি আদর্শের উপস্থিতি ইতিহাসের পাতায় রয়েছে। কাফেররা নিজেরাই দেখতে পারে তাদের নিজেদের কোন ধরনের ছবি পাওয়া যায় এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিসত্তায় কোন্ ধরনের আদর্শের নিদর্শন পাওয়া যায়।

। তৃতীয় যে কথাটির বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে সেটি হচ্ছে আল্লাহ একদিকে যেমন অজেয় শক্তি, পরাক্রম ও ক্ষমতার অধিকারী অপরদিকে তেমনি পরম করুণাময়ও। ইতিহাসে একদিকে রয়েছে তাঁর ক্রোধের দৃষ্টান্ত এবং অন্যদিকে রহমতেরও। এখন লোকদের নিজেদেরকেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা নিজেদের তাঁর রহমতের যোগ্য বানাবে না ক্রোধের।

। শেষ রুকূ’তে এ আলোচনাটির উপসংহার টানতে গিয়ে বলা হয়েছে, তোমরা যদি নিদর্শনই দেখতে চাও, তাহলে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলো যেসব ভয়াবহ নিদর্শন দেখেছিল সেগুলো দেখতে চাও কেন? এ কুরআনকে দেখো। এটি তোমাদের নিজেদের ভাষায় রয়েছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখো। তাঁর সাথীদেরকে দেখো। এটা কি কোন শয়তান বা জিনের বাণী হতে পারে? এ বাণীর উপস্থাপককে কি তোমাদের গণৎকার বলে মনে হচ্ছে? মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদেরকে কি তোমরা কবি ও তাদের সহযোগী ও সমমনারা যেমন হয় তেমনি ধরনের দেখেছো? জিদ ও হঠকারিতার কথা আলাদা। কিন্তু নিজেদের অন্তরের অন্তস্থলে উঁকি দিয়ে দেখো সেখানে কি এর সমর্থন পাওয়া যায়? যদি মনে মনে তোমরা নিজেরাই জানো গণকবৃত্তি ও কাব্যচর্চার সাথে তাঁর দূরতম কোন সম্পর্ক নেই, তাহলে এই সাথে একথাও জেনে নাও, তোমরা জুলুম করছো, কাজেই জালেমের পরিণামই তোমাদের ভোগ করতে হবে।

# এ সূরার যে আয়াতগুলো পেশ করা হচ্ছে এগুলো এমন একটি কিতাবের আয়াত যা তার বক্তব্য পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বর্ণনা করেছে। এগুলো পড়ে বা শুনে যে কোন ব্যক্তি বুঝতে পারে এগুলো কোন্ জিনিসের দিকে আহ্বান জানাচ্ছে, কোন্ জিনিস থেকে বিরত রাখছে, কাকে সত্য বলছে এবং কাকে মিথ্যা গণ্য করছে। মেনে নেয়া বা না মেনে নেয়া আলাদা কথা কিন্তু এর শিক্ষা বুঝা যায়নি এবং এ কিতাব কি ত্যাগ করার এবং কি গ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছে এ থেকে তা জানতেই পারা যায়নি এমন কথা বলার অবকাশ কোন ব্যক্তির নেই।

কুরআনকে “আল কিতাবুল মুবীন” বা সুস্পষ্ট কিতাব বলার আরো একটি অর্থও আছে। সেটি হচ্ছে, এটি যে আল্লাহর কিতাব সে ব্যাপারটি সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত। এর ভাষা, বর্ণনা, বিষয়বস্তু এবং এর উপস্থাপিত সত্য ও এর নাযিল হবার অবস্থা সবকিছু পরিষ্কার বলে দিচ্ছে— এটি বিশ্ব-জগতের প্রভুরই কিতাব। এদিক দিয়ে বিচার করলে এ কিতাবের প্রত্যেকটি বাক্যই একটি নিদর্শন ও মুজিযা। কোন ব্যক্তি নিজের বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহার করলে তার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য পৃথক কোন নিদর্শনের প্রয়োজনই হয় না। সুস্পষ্ট কিতাবের এ “আয়াত” তথা নিদর্শন তাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য যথেষ্ট।

সামনের দিকে এ সূরায় যে বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে এ ছোট্ট প্রারম্ভিক বাক্যটি নিজের দ্বিবিধ অর্থের দৃষ্টিতে তার সাথে পুরোপুরি সম্পর্ক রাখে। মক্কার কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মু’জিযার দাবী জানাচ্ছিল। তাদের বক্তব্য ছিল, এ মু’জিযা দেখে তিনি যে সত্যিই আল্লাহর পক্ষ থেকে এ পয়গাম এনেছেন সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারবে। বলা হয়েছে, সত্যিই যদি ঈমান আনার জন্য কেউ নিদর্শনের দাবী করে থাকে, তাহলে তো “কিতাবুল মুবীন” তথা সুস্পষ্ট কিতাবের এ আয়াতগুলোই সেজন্য যথেষ্ট। অনুরূপভাবে কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে দোষারোপ করতো এ মর্মে যে, তিনি কবি বা গণক। বলা হয়েছে, এ কিতাবটি তো কোন হেঁয়ালী বা ধাঁধাঁ নয়। কিতাবটি পরিষ্কারভাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজের শিক্ষা পেশ করছে। নিজেই দেখে নাও, এ শিক্ষা কি কোন কবি বা গণকের হতে পারে? (তারা তো সচরাচর হেঁয়ালীপূর্ণ কথা বলতে অভ্যস্ত)

# কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ অবস্থার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সূরা কাহফে বলা হয়েছেঃ

فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا

“এরা এ শিক্ষার প্রতি ঈমান না আনলে সম্ভবত তুমি এদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ও আক্ষেপ করতে করতে মারা যাবে।” ( ৬ আয়াত )

আবার সূরা ফাতের-এ বলা হয়েছেঃ

فَلَا تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَاتٍ

-“তাদের অবস্থার প্রতি দুঃখ ও আক্ষেপ করে যেন তোমার প্রাণ ধ্বংস না হয়ে যায়।” ( ৮ আয়াত)

এ থেকে সে যুগে নিজের জাতির পথভ্রষ্টতা, তার নৈতিক অবক্ষয় ও গোয়ার্তুমি শুধরানোর জন্য তাঁর সকল প্রচেষ্টার প্রবল বিরোধিতা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন হৃদয় বিদারক ও কষ্টকর অবস্থায় তাঁর দিবা-রাত্র অতিবাহিত করতেন তা আন্দাজ করা যায়। بخع শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, পুরোপুরি জবেহ করা। بَاخِعُ نِفْسُكَ এর আভিধানিক অর্থ হয়, তুমি নিজেই নিজেকে হত্যা করে ফেলছো।

# এমন কোন নিদর্শন অবতীর্ণ করা যার ফলে সমগ্র কাফেরকুল ঈমান ও আনুগত্যের নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়, এটা আল্লাহর জন্য কোন কঠিন ব্যাপার ছিল না। যদি তিনি এমনটি না করে থাকেন তাহলে তার কারণ এ নয় যে, এ কাজটি তাঁর শক্তির বাইরে বরং এর কারণ হচ্ছে, এভাবে জোরপূর্বক ঈমান আদায় করে নিতে তিনি চান না। তিনি চান লোকেরা বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহার করে এমন সব আয়াতের মাধ্যমে সত্যকে চিনে নিক, যেগুলো আল্লাহর কিতাবে পেশ করা হয়েছে, যেগুলো সমগ্র বিশ্ব-জগতে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং যেগুলো তাদের নিজেদের সত্তার মধ্যেই বিরাজিত রয়েছে। তারপর যখন তাদের অন্তর এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, নবীগণ যা পেশ করেছেন তাই যথার্থ সত্য এবং তার বিরুদ্ধে যেসব আকীদা-বিশ্বাস ও পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে তা মিথ্যা, তখন তারা জেনে বুঝে মিথ্যা ত্যাগ করে সত্যকে গ্রহণ করবে। আল্লাহ‌ মানুষের কাছ থেকে এ স্বেচ্ছাকৃত ঈমান, মিথ্যা পরিহার ও সত্য অনুসৃতিই চান। এজন্য তিনি মানুষকে ইচ্ছা ও সংকল্পের স্বাধীনতা দান করেছেন। এজন্যই তিনি মানুষকে সঠিক-বেঠিক যে পথেই সে যেতে চায় সে পথে চলার স্বাধীনতা দিয়েছেন। এজন্যই তিনি মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ উভয় প্রবণতাই রেখে দিয়েছেন। অশ্লীলতা ও তাকওয়া উভয় পথই তার সামনে খুলে দিয়েছেন। শয়তানকে পথভ্রষ্ট করার স্বাধীনতা দান করেছেন। সঠিক পথ দেখাবার জন্য নবুওয়াত, অহী ও কল্যাণের প্রতি আহ্বানের ধারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পথ বাছাই করে নেবার জন্য মানুষকে সময়োপযোগী যাবতীয় যোগ্যতা দিয়ে তাকে পরীক্ষার স্থলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, সে চাইলে কুফরী ও ফাসেকীর পথ অথবা ঈমান ও আনুগত্যের পথ অবলম্বন করতে পারে। যদি আল্লাহ‌ এমন কোন কৌশল ও ব্যবস্থা অবলম্বন করেন যা মানুষকে ঈমান আনতে ও আনুগত্য করতে বাধ্য করে দেয়, তাহলে এ পরীক্ষার সমস্ত উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। বাধ্যতামূলক ঈমানই যদি কাংখিত হতো, তাহলে নিদর্শন অবতীর্ণ করার কি প্রয়োজন ছিল? আল্লাহ‌ মানুষকে এমন প্রকৃতি ও কাঠামোয় সৃষ্টি করতে পারতেন যেখানে কুফরী, নাফরমানী ও অসৎকর্মের কোন সম্ভাবনাই থাকতো না। বরং ফেরেশতাদের মতো মানুষও জন্মগত বিশ্বস্ত ও অনুগত হতো। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ সত্যটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ

وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّى يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ

“যদি তোমার রব চাইতেন, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ ঈমান আনতো। এখন তুমি কি লোকদের ঈমান আনতে বাধ্য করবে?” ( ইউনুস ৯৯ আয়াত)

আরো বলা হয়েছেঃ

وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ – إِلَّا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ

“যদি তোমার রব চাইতেন, তাহলে সমস্ত মানুষকে একই উম্মতে পরিণত করে দিতে পারতেন। তারা তো বিভিন্ন পথেই চলতে থাকবে এবং একমাত্র তারাই পথভ্রষ্ট হবে না যাদের প্রতি রয়েছে তোমার রবের অনুগ্রহ, এজন্যই তো তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন। (হূদ ১১৮ ও ১১৯ আয়াত) (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনুস ১০১ ও ১০২ এবং সূরা হূদ ১১৬ টীকা )

# যাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, যুক্তি সহকারে তাদেরকে কিছু বুঝাবার ও সঠিক পথ দেখাবার যে কোন চেষ্টাই করা হলে তারা প্রত্যাখ্যান ও অনাগ্রহের মাধ্যমে তার জবাব দেয়, তাদের অন্তরে জোরপূর্বক ঈমান স্থাপন করার জন্য আকাশ থেকে নিদর্শন অবতীর্ণ করে তাদের চিকিৎসা করানো যায় না বরং এ ধরণের লোকদের যখন একদিকে পুরোপুরি বুঝানো হয়ে গিয়ে থাকে এবং অন্যদিকে তারা প্রত্যাখ্যানের পর্যায় অতিক্রম করে চূড়ান্ত ও প্রকাশ্য মিথ্যা আরোপ করতে এবং সেখান থেকেও অগ্রসর হয়ে প্রকৃত সত্যের প্রতি বিদ্রূপ করতে শুরু করে তখন তাদের পরিণাম দেখিয়ে দেয়াই উচিত। এ অশুভ পরিণাম তাদেরকে এভাবেও দেখানো যেতে পারে যে, তাদের ওপর একটি যন্ত্রণাদায়ক আযাব নাযিল হবে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। এ পরিণাম এভাবেও তাদের সামনে আসতে পারে যে, কয়েক বছর নিজেদের ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত থাকার পর তারা অনিবার্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে এবং অবশেষে তাদের কাছে এ কথা প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, যে পথে তারা নিজেদের জীবনের সমস্ত পুঁজি নিয়োগ করেছিল সেটি ছিল পুরোপুরি মিথ্যা এবং নবীগণ যে পথ পেশ করতেন এবং যার প্রতি তারা সারা জীবন ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে এসেছে সেটিই ছিল সত্য। এ অশুভ পরিণাম সামনে আসার যেহেতু অনেকগুলো পথ ছিল এবং বিভিন্ন লোকের সামনে তা বিভিন্ন আকারে আসতে পারে এবং চিরকালই এসেছে। তাই আয়াতে একবচনে نباء এর পরিবর্তে বহুবচনে انباء শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ যে জিনিসের প্রতি এরা বিদ্রূপ করছে তার প্রকৃত অবস্থা বিভিন্ন আকারে তারা জানতে পারবে।

# সত্যের অনুসন্ধানের জন্য কারো নিদর্শনের প্রয়োজন হলে তার দূরে যাবার প্রয়োজন নেই। এ পৃথিবীর শ্যামল প্রকৃতির প্রতি একবার চোখ মেলে দেখুক। সে জানতে পারবে, বিশ্ব ব্যবস্থার যে স্বরূপ নবীগণ পেশ করেন (অর্থাৎ আল্লাহর একত্ব) এবং মুশরিক বা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারকারীরা যে মতবাদ পেশ করে তার মধ্যে কোনটি সঠিক। পৃথিবীর মাটিতে যেসব রকমারি জিনিস যে বিপুল পরিমাণে উৎপন্ন হচ্ছে, যেসব উপাদান ও শক্তির বদৌলতে উৎপন্ন হচ্ছে, যেসব নিয়মের আওতায় উৎপাদিত হচ্ছে, তারপর তাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীতে এবং অসংখ্য সৃষ্টির অসংখ্য প্রয়োজনের মধ্যে যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান, সেসব জিনিস দেখে কেবলমাত্র একজন নির্বোধই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে যে, এসব কিছু কোন মহাকৌশলীর কৌশল, কোন জ্ঞানীর জ্ঞান, কোন শক্তিমানের শক্তি এবং কোন স্রষ্টার সৃষ্টি পরিকল্পনা ছাড়া শুধুমাত্র এমনিই আপনা-আপনি হচ্ছে অথবা কোন একজন খোদা এ সমগ্র পরিকল্পনা প্রণয়ন ও পরিচালনা করছেন না বরং বহু খোদার কৌশল ও ব্যবস্থাপনাই পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র এবং বায়ু ও পানির মধ্যে এ সামঞ্জস্য এবং এসব উপাদান থেকে সৃষ্ট উদ্ভিদ ও বিভিন্ন শ্রেণীর অসংখ্য প্রাণীর প্রয়োজনের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি করে রেখেছে। একজন বিবেক-বুদ্ধিমান মানুষ, সে যদি কোন প্রকার হঠকারী ও পূর্ব-বিদ্বেষ পোষণকারী না হয়ে থাকে, তাহলে এ দৃশ্য দেখে স্বতস্ফূর্তভাবে এই বলে চিৎকার করে উঠবে, নিশ্চয়ই এগুলো আল্লাহর অস্তিত্বের এবং এক ও একক আল্লাহর অস্তিত্বের সুস্পষ্ট আলামত। এসব নিদর্শন থাকতে আবার কোন্ ধরনের মু’জিযার প্রয়োজন, যা না দেখলে মানুষ তাওহীদের সত্যতায় বিশ্বাস করতে পারে না?

# তিনি এমন শক্তিধর যে, যদি কাউকে শাস্তি দিতে চান, তাহলে মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস করে দেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও শাস্তি দেবার ব্যাপারে তিনি কখনো তাড়াহুড়ো করেন না, এটা তাঁর দয়ার মূর্ত প্রকাশ। বছরের পর বছর এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল ধরে ঢিল দিতে থাকেন। চিন্তা করার, বুঝার ও সামলে নেবার সুযোগ দিয়ে যেতে থাকেন। সারা জীবনের সমস্ত নাফরমানী একটিমাত্র তাওবায় মাফ করে দেবার জন্য প্রস্তুত থাকেন।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

নামকরণ:

الشُّعَرَا۬ءُ শব্দটি شاعر এর বহুবচন, অর্থ হচ্ছে কবিগণ। এ সূরার ২২৪ নং আয়াতে الشُّعَرَا۬ءُ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, সেখান থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।

সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কাফিররা ঈমান আনবে না তাতে আফসোস করা ও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তারপর মূসা ও হারূন (عليهم السلام)-এর ফির‘আউনের কাছে তাওহীদের দাওয়াত, দাওয়াত পেয়ে ফির‘আউনের অবস্থান, জাদুকরদের সামনে মূসা (عليه السلام)-এর সাপের মু‘জিযাহ প্রদর্শন ও জাদুকরদের ঈমান আনয়ন, ঈমানদারদের সাথে নিয়ে সমুদ্র পারাপার, ইবরাহীম (عليه السلام) ও তাঁর মূর্তিপূজক জাতির বর্ণনা, কিয়ামতের দিন বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারীদের সফলতা, নূহ (عليه السلام) ও তাঁর জাতির কাছে তাওহীদের দাওয়াত, হূদ (عليه السلام), সালেহ (عليه السلام), লূত (عليه السلام), শু‘আইব (عليه السلام) ও তাঁদের জাতির বর্ণনা দিয়ে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর নিকটাত্মীয়দের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার আযাবের ভয় প্রদর্শন করার নির্দেশ দিয়েছেন, তারপর কবিদের অবস্থা তুলে ধরেছেন।

১-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

طٰسٓمّ (ত্বা-সীন-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর আসল উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, এগুলো সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াত অর্থাৎ এতে হালাল-হারাম, হক-বাতিল সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেগুলোর ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। যাতে মানুষ কোন সংশয় ও সন্দেহে না থাকে।

بَاخِعٌ শব্দটি بخع থেকে উদ্ভূত, এর অর্থ যবেহ করতে গিয়ে গর্দানের শিরা পর্যন্ত পৌঁছা। এখানে অর্থ নিজেকে কষ্ট ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া। অর্থাৎ কাফিররা ঈমান আনছে না এজন্য আফসোস ও চিন্তিত হয়ে নিজেকে হয়তো ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছো। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, এমন করার কোনই প্রয়োজন নেই। হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, দাওয়াতি কাজ যা করার তুমি তা করে যাচ্ছ, এটাই তোমার কাজ। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, ‘আমি ইচ্ছা করলে আকাশ হতে তাদের নিকট এক নিদর্শন প্রেরণ করতাম’ অর্থাৎ প্রকাশ্য মু‘জিযাহ প্রদান করতেন, ফলে তাদের মাথা বিনয়ের সাথে নত হয়ে যেত।

আল্লাহ বলেন:

(وَلَوْ شَا۬ءَ رَبُّكَ لَاٰمَنَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيْعًا ط أَفَأَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتّٰي يَكُوْنُوْا مُؤْمِنِيْنَ)

“তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সকলেই ঈমান আনত; তবে কি তুমি মু’মিন হবার জন্য মানুষের ওপর জবরদস্তি করবে?” (সূরা ইউনুস ১০:৯৯) যেহেতু যখনই তাদের কাছে কোন উপদেশ বাণী এসেছে তখনই তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সুতরাং তারা শাস্তির হকদার। তাদের ভাগ্যে ঈমান নেই। তারা আমার নিদর্শন নিয়ে যে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেছে তার ফলাফল অচিরেই পাবে। এ সম্পর্কে সূরা কাহফের ৬ নং ও সূরা হিজরের ৮৮ ও ৯৭ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কাউকে কোন কিছু করতে বাধ্য করেন না। যার ইচ্ছা হয় ঈমান আনবে আবার যার ইচ্ছা হয় ঈমান আনবে না। এটা মানুষের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। যে ঈমান নিয়ে আসবে সে তার প্রতিদানস্বরূপ জান্নাত লাভ করবে। আর যে ঈমান আনবে না বরং কুফরী করবে তারা তাদের কুফরীর প্রতিদান অচিরেই বুঝতে পারবে। সুতরাং ঈমান আনা না আনা একান্তই মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। কোন জোর-জবরদস্তির বিষয় নয়।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর একটি ক্ষমতার কথা বর্ণনা করেছেন, তিনি জমিন হতে মানুষের জন্য সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছেন। এ সম্পর্কে সূরা নাহলের ১০ ও ১১ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

সুতরাং আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। আর তিনিই একমাত্র ইবাদতের হকদার।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. যারা ঈমান আনবে তারা জান্নাতে যাবে আর যারা ঈমান আনবে না তারা জাহান্নামে যাবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা কাউকে কোন কাজ করার জন্য বাধ্য করেন না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

মালিক (রঃ)-এর রিওয়াইয়াতকৃত তাফসীরে এই সূরার নাম দেয়া হয়েছে সূরায়ে জামেআহ’।

১-৯ নং আয়াতের তাফসীর

হুরূফে মুকাত্তাআতের আলোচনা সূরায়ে বাকারার তাফসীরের শুরুতে গত হয়েছে। অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ এগুলো হলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত, যা খুবই স্পষ্ট, সম্পূর্ণ পরিষ্কার এবং হক ও বাতিল, ভাল ও মন্দের মধ্যে ফায়সালা ও পার্থক্যকারী।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ তারা ঈমান আনয়ন করছে না বলে তুমি দুঃখ করো না এবং নিজেকে ধ্বংস করে ফেলো না। এভাবে তিনি স্বীয় নবী (সঃ)-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। যেমন অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তারা ঈমান আনয়ন করছে না বলে তুমি দুঃখ করে নিজেকে ধ্বংস করো না।” (৩৫: ৮) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হয়তো তাদের পিছনে পড়ে তুমি আত্মবিনাশী হয়ে পড়বে।” (১৮৪৬)

মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি ইচ্ছা করলে আকাশ হতে তাদের নিকট এক নিদর্শন প্রেরণ করতাম, ফলে তাদের গ্রীবা বিনত হয়ে পড়তো ওর প্রতি। অর্থাৎ তাদেরকে ঈমান আনয়নে বাধ্য করার ইচ্ছা করলে আমি এমন জিনিস আকাশ হতে অবতীর্ণ করতাম যে, তা দেখে তারা ঈমান আনতে বাধ্য হতো। কিন্তু আমি তো তাদের ঈমান আনা বা না আনা তাদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছি। অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সবাই অবশ্যই ঈমান আনয়ন করতো। তুমি কি লোকদেরকে বাধ্য করবে যে পর্যন্ত না তারা মুমিন হয়?” (১০: ৯৯) আর এক জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালক যদি ইচ্ছা করতেন তবে তিনি সমস্ত মানুষকে একই উম্মত (দল) করতে পারতেন।” (১১:১১৮) দ্বীন ও মাযহাবের এই বিভিন্নতাও আল্লাহ তা’আলারই নির্ধারণকৃত এবং এটা তার নিপুণতা প্রকাশকারী। তিনি রাসূল পাঠিয়েছেন, কিতাবসমূহ অবতীর্ণ করেছেন, দলীল-প্রমাণাদি কায়েম করেছেন, অতঃপর তিনি মানুষকে ঈমান আনয়ন করা বা করার ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছেন। এখন যে পথে ইচ্ছা সে চলতে থাকুক।

মহান আল্লাহ বলেনঃ যখনই তাদের কাছে দয়াময়ের নিকট হতে নতুন। উপদেশ আসে তখনই তারা তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অর্থাৎ যখনই আকাশ হতে তাদের নিকট কোন কিতাব আসে তখনই অধিকাংশ লোক মুখ ফিরিয়ে নেয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তুমি লালসা করলেও অধিকাংশ লোক মুমিন নয়।” (১২:১০৩)। তিনি আরো বলেনঃ
অর্থাৎ “পরিতাপ বান্দাদের জন্যে; তাদের নিকট যখনই কোন রাসূল এসেছে। তখনই তারা তাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছে।” (৩৬:৩০) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “অতঃপর আমি পর্যায়ক্রমে রাসূল পাঠিয়েছি, কিন্তু যখনই কোন উম্মতের কাছে তাদের রাসূল এসেছে, তারা তাকে অবিশ্বাসই করেছে।” (২৩:৪৪) এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেনঃ “তারা তো অস্বীকার করেছে; সুতরাং তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতো তার প্রকৃত বার্তা তাদের নিকট শীঘ্রই এসে পড়বে।” যালিমরা অতিসত্বরই জানতে পারবে যে, তাদেরকে কোন পথে নিক্ষেপ করা হয়েছে।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ নিজের শান-শওকত, ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান ও উচ্চ মর্যাদার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ যার কথা এবং যার দূতকে তোমরা অবিশ্বাস করছে তিনি এতো বড় ক্ষমতাবান ও চির বিরাজমান যে, তিনি একাই সারা যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে প্রাণী ও নিষ্প্রাণ বস্তু সৃষ্টি করেছেন। ক্ষেত, ফলমূল, বাগ-বাগিচা ইত্যাদি সবই তাঁর সৃষ্ট।

হযরত শা’বী (রঃ) বলেন যে, মানুষ যমীনের উৎপন্নদ্রব্য স্বরূপ। তাদের মধ্যে যারা জান্নাতী তারা শরীফ ও ভদ্র এবং যারা জাহান্নামী তারা ইতর ও ছোটলোক। এতে সৃষ্টিকর্তার বিরাট ক্ষমতার বহু নিদর্শনাবলী রয়েছে যে, তিনি বিস্তৃত যমীন ও উঁচু আসমান সৃষ্টি করেছেন। এতদসত্ত্বেও অধিকাংশ লোক। ঈমান আনে না। বরং উল্টো তারা নবীদেরকে প্রতারক বলে থাকে। আল্লাহর কিতাবসমূহকে তারা স্বীকার করে না, তার হুকুমের তারা বিরোধিতা করে এবং তার নিষেধকৃত কাজ করে থাকে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতিপালক তো পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। তিনি সবকিছুর উপরই পূর্ণ ক্ষমতাবান। তার সামনে তাঁর সৃষ্টজীব সম্পূর্ণ অপারগ ও অক্ষম। সাথে সাথে তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি বড়ই করুণাময় ও অনুগ্রহশীল। তার অবাধ্য বান্দাদেরকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে তিনি তাড়াতাড়ি করেন না, বরং শাস্তি দিতে তিনি বিলম্ব করেন, যাতে তারা সৎ পথে ফিরে আসে। কিন্তু তবুও তারা সৎ পথে ফিরে আসে না। তখন তিনি তাদেরকে অতি শক্তভাবে পাকড়াও করেন এবং তাদের থেকে পুরোপুরিভাবে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। তবে যারা তাওবা করতঃ তার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার অনুগত হয়ে যায়, তাদের প্রতি তিনি তাদের পিতা-মাতার চেয়েও বেশী দয়া করে থাকেন।

Leave a Reply