أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯৮)
[ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, শাসক শ্রেণিকে দাওয়াত দিতে হবে:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৬:শুআরা
পারা:১৯
১০-৬৮ নং আয়াত:-
২৬:১০
وَ اِذۡ نَادٰی رَبُّکَ مُوۡسٰۤی اَنِ ائۡتِ الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾
আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব মূসাকে ডেকে বললেন, ‘আপনি যালিম সম্পপ্রদায়ের কাছে যান,
২৬:১১
قَوۡمَ فِرۡعَوۡنَ ؕ اَلَا یَتَّقُوۡنَ ﴿۱۱﴾
‘ফির‘আউনের সম্পপ্রদায়ের কাছে; তারা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না?’
২৬:১২
قَالَ رَبِّ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اَنۡ یُّکَذِّبُوۡنِ ﴿ؕ۱۲﴾
তখন সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি আশংকা করি যে, ওরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে।
২৬:১৩
وَ یَضِیۡقُ صَدۡرِیۡ وَ لَا یَنۡطَلِقُ لِسَانِیۡ فَاَرۡسِلۡ اِلٰی ہٰرُوۡنَ ﴿۱۳﴾
‘এবং আমার বক্ষ সংকুচিত হয়ে পড়ছে, আর আমার জিহ্বা তো সাবলীল নেই। কাজেই হারূনের প্রতিও ওহী পাঠান।
২৬:১৪
وَ لَہُمۡ عَلَیَّ ذَنۡۢبٌ فَاَخَافُ اَنۡ یَّقۡتُلُوۡنِ ﴿ۚ۱۴﴾
আমার বিরুদ্ধে ওদের এক অভিযোগ আছে, আমি আশংকা করি, ওরা আমাকে হত্যা করবে।
২৬:১৫
قَالَ کَلَّا ۚ فَاذۡہَبَا بِاٰیٰتِنَاۤ اِنَّا مَعَکُمۡ مُّسۡتَمِعُوۡنَ ﴿۱۵﴾
আল্লাহ্ বললেন, ‘না, কখনই নয়, অতএব আপনারা উভয়ে আমাদের নিদর্শনসহ যান, আমরা তো আপনাদের সাথেই আছি, শ্রবণকারী।
২৬:১৬
فَاۡتِیَا فِرۡعَوۡنَ فَقُوۡلَاۤ اِنَّا رَسُوۡلُ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۱۶﴾
অতএব তোমরা ফিরআউনের নিকট যাও এবং বল, আমরা তো বিশ্বজগতের প্রতিপালকের রসূল।
২৬:১৭
اَنۡ اَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ۱۷﴾
সুতরাং আমাদের সঙ্গে বনী-ইস্রাঈলকে যেতে দাও।’
২৬:১৮
قَالَ اَلَمۡ نُرَبِّکَ فِیۡنَا وَلِیۡدًا وَّ لَبِثۡتَ فِیۡنَا مِنۡ عُمُرِکَ سِنِیۡنَ ﴿ۙ۱۸﴾
ফির‘আউন বলল, ‘আমরা কি তোমাকে শৈশবে আমাদের মধ্যে লালন-পালন করিনি? আর তুমি তো তোমার জীবনের বহু বছর আমাদের মধ্যে কাটিয়েছ,
২৬:১৯
وَ فَعَلۡتَ فَعۡلَتَکَ الَّتِیۡ فَعَلۡتَ وَ اَنۡتَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۱۹﴾
তুমি তো যা অপরাধ করার তা করেছ, আর তুমি হলে অকৃতজ্ঞ।’
২৬:২০
قَالَ فَعَلۡتُہَاۤ اِذًا وَّ اَنَا مِنَ الضَّآلِّیۡنَ ﴿ؕ۲۰﴾
মূসা বললেন, ‘আমি তো এটা করেছিলাম তখন, যখন আমি ছিলাম বিভ্ৰান্ত’
২৬:২১
فَفَرَرۡتُ مِنۡکُمۡ لَمَّا خِفۡتُکُمۡ فَوَہَبَ لِیۡ رَبِّیۡ حُکۡمًا وَّ جَعَلَنِیۡ مِنَ الۡمُرۡسَلِیۡنَ ﴿۲۱﴾
অতঃপর আমি যখন তোমাদের ভয়ে ভীত হলাম, তখন আমি তোমাদের নিকট থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আমার প্রতিপালক আমাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন এবং আমাকে রসূল করেছেন।
২৬:২২
وَ تِلۡکَ نِعۡمَۃٌ تَمُنُّہَا عَلَیَّ اَنۡ عَبَّدۡتَّ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ۲۲﴾
আমার প্রতি তোমার যে অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করেছ, তা তো এ যে, তুমি বনী ইস্রাঈলকে দাসে পরিণত করেছ।’
২৬:২৩
قَالَ فِرۡعَوۡنُ وَ مَا رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ؕ۲۳﴾
ফিরআউন বলল, ‘বিশ্বজগতের প্রতিপালক আবার কি?’
২৬:২৪
قَالَ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّوۡقِنِیۡنَ ﴿۲۴﴾
মূসা বললেন, ‘তিনি আসমানসমূহ ও যমীন এবং তাদের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।’
২৬:২৫
قَالَ لِمَنۡ حَوۡلَہٗۤ اَلَا تَسۡتَمِعُوۡنَ ﴿۲۵﴾
ফিরআউন তার পারিষদবর্গকে লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা শুনছ তো!’
২৬:২৬
قَالَ رَبُّکُمۡ وَ رَبُّ اٰبَآئِکُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۲۶﴾
মূসা বলল, ‘তিনি তোমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদের পূর্বপুরুষগণেরও প্রতিপালক।’
২৬:২৭
قَالَ اِنَّ رَسُوۡلَکُمُ الَّذِیۡۤ اُرۡسِلَ اِلَیۡکُمۡ لَمَجۡنُوۡنٌ ﴿۲۷﴾
ফিরআউন বলল, ‘তোমাদের প্রতি প্রেরিত তোমাদের রসূলটি তো এক বদ্ধ পাগল।’
২৬:২৮
قَالَ رَبُّ الۡمَشۡرِقِ وَ الۡمَغۡرِبِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا ؕ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۲۸﴾
মূসা বললেন, ‘তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের এবং তাদের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব; যদি তোমরা বুঝে থাক!’
২৬:২৯
قَالَ لَئِنِ اتَّخَذۡتَ اِلٰـہًا غَیۡرِیۡ لَاَجۡعَلَنَّکَ مِنَ الۡمَسۡجُوۡنِیۡنَ ﴿۲۹﴾
ফির‘আউন বলল, ‘তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে ইলাহরূপে গ্ৰহণ কর আমি তোমাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করব’।
২৬:৩০
قَالَ اَوَ لَوۡ جِئۡتُکَ بِشَیۡءٍ مُّبِیۡنٍ ﴿ۚ۳۰﴾
মূসা বলল, ‘আমি তোমার নিকট স্পষ্ট কোন (নিদর্শন) আনয়ন করলেও কি?’
২৬:৩১
قَالَ فَاۡتِ بِہٖۤ اِنۡ کُنۡتَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۳۱﴾
ফির‘আউন বলল, ‘তুমি যদি সত্যবাদী হও তবে তা উপস্থিত কর।’
২৬:৩২
فَاَلۡقٰی عَصَاہُ فَاِذَا ہِیَ ثُعۡبَانٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۚۖ۳۲﴾
সুতরাং মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল, আর তৎক্ষণাৎ তা এক সাক্ষাৎ অজগরে পরিণত হল।
২৬:৩৩
وَّ نَزَعَ یَدَہٗ فَاِذَا ہِیَ بَیۡضَآءُ لِلنّٰظِرِیۡنَ ﴿٪۳۳﴾
আর মূসা তার হাত বের করলে তৎক্ষনাৎ তা দর্শকদের দৃষ্টিতে শুভ্র উজ্জ্বল প্রতিভাত হল।
২৬:৩৪
قَالَ لِلۡمَلَاِ حَوۡلَہٗۤ اِنَّ ہٰذَا لَسٰحِرٌ عَلِیۡمٌ ﴿ۙ۳۴﴾
ফিরআউন তার পারিষদবর্গকে বলল, ‘এ তো এক সুদক্ষ যাদুকর।
২৬:৩৫
یُّرِیۡدُ اَنۡ یُّخۡرِجَکُمۡ مِّنۡ اَرۡضِکُمۡ بِسِحۡرِہٖ ٭ۖ فَمَا ذَا تَاۡمُرُوۡنَ ﴿۳۵﴾
এ দেশ হতে তার যাদুবলে তোমাদেরকে বহিষ্কৃত করতে চায়! এখন তোমরা কি করবে বল?’
২৬:৩৬
قَالُوۡۤا اَرۡجِہۡ وَ اَخَاہُ وَ ابۡعَثۡ فِی الۡمَدَآئِنِ حٰشِرِیۡنَ ﴿ۙ۳۶﴾
তারা বলল, ‘তাকে ও তার ভাইকে কিছু অবকাশ দাও এবং নগরে নগরে সংগ্রাহকদেরকে পাঠাও,
২৬:৩৭
یَاۡتُوۡکَ بِکُلِّ سَحَّارٍ عَلِیۡمٍ ﴿۳۷﴾
যেন তারা আপনার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ যাদুকর উপস্থিত করে।’
২৬:৩৮
فَجُمِعَ السَّحَرَۃُ لِمِیۡقَاتِ یَوۡمٍ مَّعۡلُوۡمٍ ﴿ۙ۳۸﴾
অতঃপর এক নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট সময়ে জাদুকরদেরকে একত্র করা হল,
২৬:৩৯
وَّ قِیۡلَ لِلنَّاسِ ہَلۡ اَنۡتُمۡ مُّجۡتَمِعُوۡنَ ﴿ۙ۳۹﴾
এবং লোকদের বলা হল, ‘তোমরাও একত্র হও।
২৬:৪০
لَعَلَّنَا نَتَّبِعُ السَّحَرَۃَ اِنۡ کَانُوۡا ہُمُ الۡغٰلِبِیۡنَ ﴿۴۰﴾
‘যেন আমরা জাদুকরদের অনুসরণ করতে পারি, যদি তারা বিজয়ী হয়।’
২৬:৪১
فَلَمَّا جَآءَ السَّحَرَۃُ قَالُوۡا لِفِرۡعَوۡنَ اَئِنَّ لَنَا لَاَجۡرًا اِنۡ کُنَّا نَحۡنُ الۡغٰلِبِیۡنَ ﴿۴۱﴾
যাদুকরেরা ফিরআউনের নিকট এসে বলল, ‘আমরা যদি বিজয়ী হই, তাহলে আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো?’
২৬:৪২
قَالَ نَعَمۡ وَ اِنَّکُمۡ اِذًا لَّمِنَ الۡمُقَرَّبِیۡنَ ﴿۴۲﴾
ফির‘আউন বলল, ‘হ্যাঁ, তখন তো তোমরা অবশ্যই আমার ঘনিষ্ঠদের শামিল হবে।’
২৬:৪৩
قَالَ لَہُمۡ مُّوۡسٰۤی اَلۡقُوۡا مَاۤ اَنۡتُمۡ مُّلۡقُوۡنَ ﴿۴۳﴾
মূসা ওদেরকে বলল, ‘তোমাদের যা নিক্ষেপ করার, তা নিক্ষেপ কর।’
২৬:৪৪
فَاَلۡقَوۡا حِبَالَہُمۡ وَ عِصِیَّہُمۡ وَ قَالُوۡا بِعِزَّۃِ فِرۡعَوۡنَ اِنَّا لَنَحۡنُ الۡغٰلِبُوۡنَ ﴿۴۴﴾
অতঃপর তারা তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল এবং তারা বলল, ‘ফির‘আউনের ইযযতের শপথ! আমরাই তো বিজয়ী হব।’
২৬:৪৫
فَاَلۡقٰی مُوۡسٰی عَصَاہُ فَاِذَا ہِیَ تَلۡقَفُ مَا یَاۡفِکُوۡنَ ﴿ۚۖ۴۵﴾
অতঃপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল; সহসা তা ওদের অলীক সৃষ্টিগুলিকে গ্রাস করতে লাগল।
২৬:৪৬
فَاُلۡقِیَ السَّحَرَۃُ سٰجِدِیۡنَ ﴿ۙ۴۶﴾
তখন জাদুকরেরা সিজদাবনত হয়ে পড়ল।
২৬:৪৭
قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۴۷﴾
তারা বলল, ‘আমরা ঈমান আনলাম সৃষ্টিকুলের রব-এর প্রতি—
২৬:৪৮
رَبِّ مُوۡسٰی وَ ہٰرُوۡنَ ﴿۴۸﴾
যিনি মূসা এবং হারূনেরও প্রতিপালক।’
২৬:৪৯
قَالَ اٰمَنۡتُمۡ لَہٗ قَبۡلَ اَنۡ اٰذَنَ لَکُمۡ ۚ اِنَّہٗ لَکَبِیۡرُکُمُ الَّذِیۡ عَلَّمَکُمُ السِّحۡرَ ۚ فَلَسَوۡفَ تَعۡلَمُوۡنَ ۬ؕ لَاُقَطِّعَنَّ اَیۡدِیَکُمۡ وَ اَرۡجُلَکُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ وَّ لَاُوصَلِّبَنَّکُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿ۚ۴۹﴾
ফির‘আউন বলল, ‘কী! আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার আগেই তোমরা তার প্রতি বিশ্বাস করলে? সে-ই তো তোমাদের প্রধান যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে। সুতরাং শীঘ্রই তোমরা এর পরিণাম জানবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত এবং তোমাদের পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলবিদ্ধ করবই।’
২৬:৫০
قَالُوۡا لَا ضَیۡرَ ۫ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا مُنۡقَلِبُوۡنَ ﴿ۚ۵۰﴾
ওরা বলল, ‘কোন ক্ষতি নেই, নিশ্চয় আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করব।
২৬:৫১
اِنَّا نَطۡمَعُ اَنۡ یَّغۡفِرَ لَنَا رَبُّنَا خَطٰیٰنَاۤ اَنۡ کُنَّاۤ اَوَّلَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿ؕ٪۵۱﴾
আমরা আশা করি যে, আমাদের রব আমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন, কারণ আমরা মুমিনদের মধ্যে অগ্রণী।’
২৬:৫২
وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسٰۤی اَنۡ اَسۡرِ بِعِبَادِیۡۤ اِنَّکُمۡ مُّتَّبَعُوۡنَ ﴿۵۲﴾
আমি মূসার কাছে ওহী পাঠিয়েছি এই মর্মেঃ “রাতারাতি আমার বান্দাদের নিয়ে বের হয়ে যাও, তোমাদের পিছু নেয়া হবে।”
২৬:৫৩
فَاَرۡسَلَ فِرۡعَوۡنُ فِی الۡمَدَآئِنِ حٰشِرِیۡنَ ﴿ۚ۵۳﴾
এর ফলে ফেরাউন (সৈন্য একত্র করার জন্য) নগরে নগরে নকীব পাঠালো,
২৬:৫৪
اِنَّ ہٰۤؤُلَآءِ لَشِرۡ ذِمَۃٌ قَلِیۡلُوۡنَ ﴿ۙ۵۴﴾
এরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক,
২৬:৫৫
وَ اِنَّہُمۡ لَنَا لَغَآئِظُوۡنَ ﴿ۙ۵۵﴾
ওরা তো আমাদের ক্রোধ উদ্রেক করেছে।
২৬:৫৬
وَ اِنَّا لَجَمِیۡعٌ حٰذِرُوۡنَ ﴿ؕ۵۶﴾
আর আমরা তো সবাই সদা সতর্ক।’
২৬:৫৭
فَاَخۡرَجۡنٰہُمۡ مِّنۡ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوۡنٍ ﴿ۙ۵۷﴾
এভাবে আমি তাদেরকে বের করে এনেছি তাদের বাগ-বাগীচা, নদী-নির্ঝরিনী,
২৬:৫৮
وَّ کُنُوۡزٍ وَّ مَقَامٍ کَرِیۡمٍ ﴿ۙ۵۸﴾
ধন-ভাণ্ডার ও সুরম্য আবাসগৃহসমূহ থেকে।
২৬:৫৯
کَذٰلِکَ ؕ وَ اَوۡرَثۡنٰہَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ﴿ؕ۵۹﴾
এরূপই ঘটল এবং বনী-ইস্রাঈলকে এ সমুদয়ের অধিকারী করলাম।
২৬:৬০
فَاَتۡبَعُوۡہُمۡ مُّشۡرِقِیۡنَ ﴿۶۰﴾
ওরা সূর্যোদয়কালে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল।
২৬:৬১
فَلَمَّا تَرَآءَ الۡجَمۡعٰنِ قَالَ اَصۡحٰبُ مُوۡسٰۤی اِنَّا لَمُدۡرَکُوۡنَ ﴿ۚ۶۱﴾
অতঃপর যখন দু’দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা বলল, ‘আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম।
২৬:৬২
قَالَ کَلَّا ۚ اِنَّ مَعِیَ رَبِّیۡ سَیَہۡدِیۡنِ ﴿۶۲﴾
মূসা বলল, ‘কিছুতেই নয়! আমার সঙ্গে আছেন আমার প্রতিপালক; তিনি আমাকে পথনির্দেশ করবেন।’
২৬:৬৩
فَاَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسٰۤی اَنِ اضۡرِبۡ بِّعَصَاکَ الۡبَحۡرَ ؕ فَانۡفَلَقَ فَکَانَ کُلُّ فِرۡقٍ کَالطَّوۡدِ الۡعَظِیۡمِ ﴿ۚ۶۳﴾
অতঃপর মূসার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, ‘তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর।’ ফলে তা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতসদৃশ হয়ে গেল।
২৬:৬৪
وَ اَزۡلَفۡنَا ثَمَّ الۡاٰخَرِیۡنَ ﴿ۚ۶۴﴾
আর আমরা সেখানে কাছে নিয়ে এলাম অন্য দলটিকে,
২৬:৬৫
وَ اَنۡجَیۡنَا مُوۡسٰی وَ مَنۡ مَّعَہٗۤ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿ۚ۶۵﴾
মূসা ও তাঁর সমস্ত লোককে যারা তার সঙ্গে ছিল আমি উদ্ধার করলাম।
২৬:৬৬
ثُمَّ اَغۡرَقۡنَا الۡاٰخَرِیۡنَ ﴿ؕ۶۶﴾
তারপর নিমজ্জিত করলাম অন্য দলটিকে।
২৬:৬৭
اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً ؕ وَ مَا کَانَ اَکۡثَرُہُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۶۷﴾
এতে তো অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই মুমিন নয়।
২৬:৬৮
وَ اِنَّ رَبَّکَ لَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ﴿٪۶۸﴾
আর প্রকৃতপক্ষে তোমার রব পরাক্রমশালীও আবার দয়াময়ও।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মুসার দাওয়াতের প্রস্তাব পর্ব : এরশাদ হচ্ছে, ‘আর স্মরণ করে দেখাে সেই সময়ের কথা, যখন তােমার রব মূসা-কে ডেকে বললেন, যালেম জাতির কাছে যাও… যাও তােমরা দু’জনা ফেরাউনের কাছে এবং বলাে, আমরা রব্বুল আলামীনের প্রেরিত দূত (রাসূল), যেন তুমি আমাদের সাথে বনী ইসরাঈল জাতিকে পাঠিয়ে দাও।'(আয়াত ১১-১৭) এখানে আল্লাহর রসুল মােহাম্মদ(স.)-কে সম্বাধন করে বলা হয়েছে। ইতিপূর্বে সূরার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘সম্ভবত ওরা ঈমান আনছে না বলে তুমি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে… ওরা অবশ্যই তােমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছে। যার কারণে যে উপহাস বিদ্রুপ ওরা করছে তার ফলস্বরূপ শীঘ্রই ওদের উপযুক্ত খবর আসবে। এরপর আল্লাহ তায়ালা মিথ্যা সাব্যস্তকারী, অস্বীকারকারী ও বিদ্রূপকারীদের পরিণতি কী হবে, সে খবর বলতে শুরু করেছেন, শুরু করেছেন সেই আযাবের খবর দিতে যা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করে দেখাে, যখন তােমার রব মূসাকে ডেকে বললেন, যাও যালেম জাতির কাছে, তারা হচ্ছে ফেরাউনের জাতি, ওরা কি ভয় করে চলবে না (আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে- এই ভয়ে কি তারা জীবনে বাছ বিচার করে চলবে না?)’ এটা হচ্ছে এ ভাষণটির মধ্যে প্রথম কথা, অর্থাৎ মূসা (আ.)-কে রেসালাতের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এটাই তার প্রথম কথা। এখানে আল্লাহ তায়ালা সে জাতির প্রথম গুণটির ঘােষণা দ্বারা তার বক্তব্য শুরু করছেন, আর তা হচ্ছে, যালেম জাতি’ যারা নীতি-নৈতিকতা ও মানবতার কোনাে সীমা মেনে চলেনা এবং নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে যারা অপরকে কষ্ট দিতে কোনাে প্রকার দ্বিধা করে না, এমনকি বিচার ফয়সালার ব্যাপারেও তারা নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে সঠিক ফয়সালা করে না, এরা সত্যকে অস্বীকার করা ও ভুল পথে চলার দ্বারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে, এভাবে যুলুম করেছে বনী ইসরাঈল জাতির ওপর যে তারা তাদের ছেলেদেরকে হত্যা করছে এবং মেয়েদেরকে অব্যাহতি দিচ্ছে মৌখিক ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও শারীরিক নির্যাতন-দ্বারা তাদেরকে কষ্ট দিচ্ছে… এজন্যে তাদের এই অত্যাচারী স্বভাবের কথাটাকেই প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে এবং তারপরই নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে ওরা হচ্ছে, ‘ফেরাউনের জাতি।’ তারপর তাদের এসব কাজ কারবারের ওপর মুসা বিস্ময় প্রকাশ করছেন এবং যে কোনাে মানুষ এগুলাে প্রত্যক্ষ করছে তাদের কাছেও তাদের এসব আচরণ আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে, এজন্যে আল্লাহ তায়ালা উচ্চারণ করছেন, ‘তারা কি পরহেয করবে না?’ অর্থাৎ ওর কি ভয় করবে না তাদের রবকে? ভয় কি করবে না ওরা তাদের অত্যাচারের পরিণতিকে ভ্রান্তি থেকে কি ওরা ফিরে আসবে না? শােনাে, ওদের বিষয়টা বড়ই অদ্ভুত, পদে পদে ওদের ব্যবহারগুলাে বিস্ময় জাগায়। আর এমনি করে বিস্ময় জাগায় সেসব অত্যাচারী লােকের ব্যবহারও, যারা ওদেরই মতাে যুলুম অত্যাচার দ্বারা নিজেদের জীবনকে ভরে রেখেছে। এবং তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থানমূহকে দুর্বিষহ করে ফেলেছে। ফেরাউন ও তার সভাসদবর্গ বিষয়টি মূসা(আ.)-এর জন্যে কোনাে নতুন জিনিস ছিলাে না, তিনি ওদের সব কিছু জানতেন! তিনি ফেরাউনের যুলুম সম্পর্কে ভালােভাবে ওয়াকেফহাল ছিলেন এবং ভালােভাবেই জানতেন যে, সে নিজের প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব কায়েম রাখার জন্যে যে কোনাে অত্যাচার করতে কুন্ঠিত হয় না। তিনি গভীরভাবে অনুভব করেন যে এই অহংকারী, বলদর্পী ও সীমাহীন উদ্ধত ব্যক্তির কাছে সঠিক কথা বলা কতাে ঝুঁকিপূর্ণ, কতাে বিপজ্জনক এবং কতাে বড় বিরাট কাজ, আর এই কারণেই তিনি তার রবের কাছে নিজের সকল-ব্যথা-বেদনা পেশ করে তার কাছেই সাহায্যের জন্যে আবেদন জানাচ্ছেন, তার দুর্বলতার কথা জানিয়ে তার কাছেই শক্তি-সাহস ও সকল দুরূহতা অতিক্রম করার সক্ষমতা কামনা করছেন। আলােচ্য অধ্যায়ে মূসা(আ.)-এর সেই আবেদনকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে, ‘সে বলল, হে আমার রব, আমার ভয় হয় যে ওরা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবে, আমার বুক সংকুচিত হয়ে আসছে এবং আমার জিহ্বা যেন আর চলছে না। হারুনের কাছেও রেসালাত প্রেরণ করাে, আমার বিরুদ্ধে তাদের একটি অপরাধ করার অভিযােগ আছে, এজন্যে আমার ভয় হয় যে, ওরা আমাকে হত্যা করবে।’ মূসা(আ.)-এর এ কথাটিতে বাহ্যত বুঝা যায় যে, তার ভয় শুধু এটাই ছিলাে না যে ওরা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করবে, এ ভয়ও তার হচ্ছিলাে যে, অনিচ্ছাসত্তেও যে একটি অপরাধ তার দ্বারা অতীতে হয়ে গিয়েছিলাে, এজন্যে তারা তাকে হত্যা করবে। অবশ্য এ আশংকা তার হচ্ছিল বিশেষ করে এ জন্যেও বটে যে তার জিহ্বা-তে কিছু দুর্বলতা থাকায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তার মুখ দিয়ে তার কথা স্পষ্টভাবে বেরুবে না। তিনি তােতলা ছিলেন, নিজের কথা পরিস্কার করে বলতে তার কষ্ট হতাে, একথা সূরায়ে ত্ব-হা-তেও বলা হয়েছে আমার জিহ্বা থেকে জড়তাকে দূর করাে যেন ওরা আমার কথা বুঝতে পারে। জিহ্বার এই আড়ষ্টতার কারণে বুক সংকীর্ণ হওয়াটা স্বাভাবিক, যেহেতু নিজের কথাটি যুক্তিসহকারে এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে তুলে ধরতে না পারলে অবশ্যই তার মনটা ছােট হয়ে যাবে, হৃদয় দুর্বল হয়ে পড়বে, এটা সবাই সহজে বুঝতে পারে। এই কারণে অত্যাচারী ও অহংকারী এক শাসকের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে কিছু দ্বিধা-সংকটের সৃষ্টি হয়েছিলাে। এজন্যে তিনি তার রবের কাছেই তার দুর্বলতা দূর করে দেয়ার জন্যে আবেদন জানাচ্ছিলেন, তার রেসালাত পেশ করার দুরূহতাকে পেশ করছিলেন এবং আবেদন জানাচ্ছিলেন যেন, তার ভাই হারুনের কাছে রেসালাত পাঠিয়ে তাকে তার সহযােগী বানিয়ে দেয়া হয়, যাতে করে রেসালাতের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তিনি তাকে সহায়তা করতে পারেন। এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, তার আবেদন-নিবেদন এজন্যে ছিলােনা যে তিনি দায়িত্ব পালনে গড়িমসি করছিলেন অথবা পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। হারুন(আ.)-এর ভাষা ছিলাে অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং তার উচ্চারণ ছিলাে পরিস্কার, যে কারণে সহজে তিনি উত্তেজিত হতেন না। যেখানে মূসা(আ.)-এর কণ্ঠ থেমে যেতাে বা তােতলা ভাব এসে যেতাে সেখানেই হারুন(আ.) এগিয়ে এসে কথাটিকে পরিষ্কার করে দিতেন এবং যুক্তিপূর্ণ কথা দ্বারা পুরাে বক্তব্যকে জোরালােভাবে তুলে ধরতেন। এজন্যেই মূসা(আ.) হারুন(আ.)-কে তার সংগী ও সহকারী হিসাবে পাওয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, যার বিস্তারিত বর্ণনা সূরায়ে ত্ব-হা-তে পাওয়া যায়। এই দোয়াতে তার জিহ্বার জড়তা দূর করার জন্যে তিনি আল্লাহর সাহায্য চেয়েছিলেন এবং হারুন(আ.)-কে তার বিশ্বস্ত সহকারী হিসাবে পেতে চেয়েছিলেন, আরও তিনি চেয়েছিলেন, যেন ভাই হারুন তার পাশে প্রধান মন্ত্রণাদাতা ও উযির হিসাবে সদাসর্বদা উপস্থিত থাকেন এবং সকল কাজে তাকে সাহায্য করেন। এইডাবে তার এ কথায় আর একটি অবস্থা সামনে আসছে; আমার একটি অপরাধ তাদের কাছে ধরার মত রয়েছে, এজন্যে আমার ভয় হয় যে, তারা আমাকে হত্যা করবে।’ একথা দ্বারা বুঝা গেলাে যে মূসা(আ.) তাদের সাথে মুখােমুখী হতে অথবা দায়িত্ব পালনের তকলীফ স্বীকার করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন- তা নয়, বরং তিনি চাইছিলেন যে রেসালাতের দায়িত্ব পালনে হারুন তার সাথে শরীক হােক, যাতে করে যদি তারা তাকে কতল করে ফেলে, সে অবস্থায়ও যেন রেসালাতের কাজ বন্ধ না হয়, তার কাজটা যেন হারুন চালিয়ে যেতে পারে এবং যে গুরুদায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে সে কাজটা যেন অব্যাহতভাবে চলতে পারে। দাওয়াতী-কাজের প্রয়ােজনে এটা ছিলাে সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদ- দাওয়াত দানকারীর জীবন বাচানাের প্রয়ােজনে তার এটা কোনাে অজুহাত ছিলাে না; ছিলাে না এটা আত্মরক্ষার কোনাে প্রচেষ্টা, বরং তিনি চাইছিলেন, তার জিহ্বাতে জড়তা থাকার কারণে দাওয়াতী কাজের অসুবিধাটা হারুণের দ্বারা পূরণ হয়ে যাক এবং তার বক্তব্য পেশ করার ত্রুটির কারণে আল্লাহর বাণী যেন দুর্বল বলে মনে না হয়। তিনি চাইছিলেন, যদি তিনি নিহত হন সে অবস্থাতেও যেন মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকার কাজটি থেমে না যায় এবং আল্লাহর বাণী প্রচারের কাজ যেন অবিরতভাবে চলতে থাকে, এটাই ছিলাে তার কামনা। এটাই ছিলাে মূসা(আ.)-এর আসল ভূমিকা, যাকে আল্লাহ তায়ালা তার নিজ তত্ত্বাবধানে লালন পালনের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং যাকে আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাঁর নিজের কাজে নিয়ােজিত করেছিলেন।
*ফেরাউনের মুখােমুখি : এখানে কোন সে শক্তি কথা বলছে ? কোন ক্ষমতাবান সম্রাট? আর কোন সাহায্য, কোন পরিচালনা এবং কোন মহা ক্ষমতাবানের পক্ষ থেকে আসছে এ নিরাপত্তার আশ্বাস? হাঁ অবশ্যই আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা রয়েছেন তাদের সাথে এবং সকল সত্যনিষ্ঠ মানুষের সাথে, প্রতিটি মুহূর্তে ও প্রতিটি স্থানে, কিন্তু এই সাথে থাকার উদ্দেশ্য হচ্ছে সমর্থন করা ও সর্বোতভাবে সাহায্য দান। আল্লাহ তায়ালা শােনেন- এ কথার মাধ্যমেই বুঝা যায় তিনি বান্দার সাহায্যে তখনই এগিয়ে আসেন যখন সে কায়মনােবাক্যে তাঁকে ডাকতে থাকে। একথা থেকে আরাে বুঝা যায় যে, তিনিই তাঁর বান্দাকে পরিচালনা করেন এবং সদা-সর্বদা তিনি সাহায্যের জন্যে প্রস্তুত রয়েছেন। আর এ সাহায্য তখনই আসবে যখন সে আল কোরআন-প্রদর্শিত পথে পুরােপুরিভাবে অবস্থান করতে থাকবে। এজন্যে আল্লাহ তায়ালা তার মনােনীত ও অনুগত বান্দাদ্বয়কে বললেন ‘তোমরা দু’জন ফেরাউনের কাছে যাও’ অতপর তাকে তােমরা নির্দ্বিধায় ও নির্ভিক চিত্তে তােমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানাও। তাদেরকে বলাে, ‘আমরা রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে দূত হয়ে এসেছি।’ তারা দু’জন মানুষ মাত্র, কিন্তু একই দায়িত্ব নিয়ে তারা উভয়ে আল্লাহর দূত হিসাবে ফেরাউনের দরবারে যাচ্ছেন। দু’জন হলেও তাদের মনের মধ্যে একথা দৃঢ়বদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, বিশ্বজগতের মালিক স্বয়ং আল্লাহর প্রতিনিধি তাঁরা, তাঁরা দাঁড়াচ্ছেন সেই বলদর্পী অহংকারী ফেরাউনের সামনে যে নিজেকে সর্বশক্তিমান বলে দাবী করছে, সে তার জাতিকে বলছে, আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বলে জানি না। কাজেই ফেরাউনের সাথে তার সংঘর্ষ শুরু হয় সাক্ষাতের প্রথম মুহূর্ত থেকেই, যেহেতু তাকে সর্বশক্তিমান মানা তাে দূরে থাকুক, মুসা(আ.) তাকে সামান্যতম কোনাে ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দিতেও প্রস্তুত নন। যেহেতু সকল শক্তি-ক্ষমতার মালিকের প্রতিনিধি হিসাবে এখানে তার আগমন, এজন্যে কারও কোনাে পরওয়া না করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে তিনি ফেরাউনের সামনে তার কথা পেশ করছেন, বিশ্বপ্রভুর আহ্বানকে সে বলদর্পী সম্রাটের কাছে এবং তার সভাসদ ও সারাদেশের মানুষের কাছে পৌছে দিচ্ছেন। তার কথাটা উদ্ধৃত করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন। ‘আমরা রব্বুল আলামীনের রসূল, তােমার কাছে এসেছি আমরা, যেন আমাদের সাথে তুমি বনী ইসরাঈল জাতিকে যেতে দাও।’ এখানে এসব কথা থেকে এবং কোরআন মজীদের মধ্যে উল্লেখিত আরও বহু আলােচনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, মূসা ও হারুন(আ.) ফেরাউন ও তার জাতিকে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার জন্যে যেমনি প্রেরিত হয়েছিলেন তেমনি বনী ইসরাঈল জাতিকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করে তাদেরকে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর বান্দা বানানােও ছিলাে তাদের দায়িত্ব, যাতে তারা পুরােপুরিভাবে আল্লাহর দাসত্ব করতে পারে। তারা এতাে দিন থেকে তাদের পূর্বপুরুষ ইউসুফ(আ.)-এর পিতা ইয়াকুব(আ.)-এর প্রদর্শিত জীবন ব্যবস্থার ওপর টিকে ছিলাে। ইয়াকুব(আ.)-এর এক নামই ছিলাে ইসরাঈল, যার কারণে তার বংশধরদেরকে বনী ইসরাঈল বলা হয়ে থাকে। তাদের এই পৈত্রিক জীবন পদ্ধতি তাদের প্রাণে খােদিত ছিলাে; কিন্তু পরবর্তীতে তাদের বিশ্বাস বা আকীদার মধ্যে কিছুটা বিশৃঙ্খলা এসে গিয়েছিলাে। একারণেই আল্লাহ তায়ালা তাদের কাছে মূসা(আ.)-কে তাঁর রসূল বানিয়ে পাঠালেন, যেন তিনি তাদেরকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথে নিয়ে আসেন এবং তাদেরকে ফেরাউনের অত্যাচার ও দাসত্বের নিগড় থেকে মুক্ত করেন, অতপর তাদেরকে তাওহীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এর ভিত্তিতে গঠিত জীবন ব্যবস্থার দিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনেন। এ পর্যন্ত এসে আমরা তিনটি জিনিস দেখতে পাচ্ছি, নবুওত লাভ, ওহীর আগমন এবং দায়িত্ব পালন, কিন্তু এতােটুকু বলার পর প্রসংগ পরিবর্তন করা হচ্ছে যে, আমরা ফেরাউনের সাথে মােকাবেলার দৃশ্যটি ভালোভাবে অবলােকন করতে পারি । নবুওত লাভের আগের ও নবুওত প্রাপ্তির পরের অবস্থাকে আল কোরআন তার নিজস্ব বর্ণনা ভংগীতে সংক্ষেপে পেশ করতে গিয়ে বলছে, ‘সে বললাে, আমরা কি তােমাকে বাচ্চা বয়সে আমাদের মধ্যে লালন পালন করিনি এবং তােমার জীবনের অনেকগুলাে বছর কি তুমি আমাদের মধ্যে কাটাওনি? আর তুমি আমাদের এসব উপকারের কথা ভুলে গিয়ে যা করার তা করেছে (এটা কি)- ঠিক না?’ হাঁ, হাঁ, ওইসব উপকারের কথা বলে তুমি আমার প্রতি এহসান প্রদর্শন করছে, এই কারণেই তুমি গোটা বনী ইসরাঈল জাতিকে গোলাম বানিয়ে রেখেছো। ফেরাউন আশ্চর্য হয়ে দেখছে, মূসা কেমন করে তার মুখােমুখি দাঁড়িয়ে এমন বিরাট দাবী করে কথা বলছে। সে কতাে বড়ো সাংঘাতিক দাবী করছে, আমি তাঁর রসূল, যিনি সমগ্র বিশ্ব জগতের মালিক। এই সেই মূসা যাকে নদী থেকে তুলে আনার পর থেকে সে তারই প্রাসাদে তার পালক ছেলে হিসাবে লালিত-পালিত হয়েছে। একজন ইসরাঈলীর সাথে জনৈক কিবতীর ঝগড়া বাঁধলে সেখানে মূসা হাযির হন এবং মীমাংসা করতে গিয়ে তার আক্রমণে কিবতী ব্যক্তিটি নিহত হলে তিনি মিসর ছেড়ে পালিয়ে যান।(বিস্তারিত জানার জন্য ‘ফী যিলালিল কোরআন’ এ সূরায়ে ‘তা-হা’-র তাফসীরে দেখুন) নিহত সে ব্যক্তি ফেরাউনের সেনাবাহিনীর একজন সদস্য ছিলাে বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। ফেরাউনের সাথে তার বাড়ীতে মূসার শেষ সাক্ষাত ও বারাে বছর পর মূসা(আ.)-এর এখানে আগমন ও তার মুখােমুখি হওয়ার মধ্যে সময়ের খুব বেশী ব্যবধান ছিলাে না! এই কারণেই ফেরাউন বড়ই বিস্মিত হচ্ছিলাে এবং সে হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছিলাে তার সেই আদরের মুসা আজকে তার সাথে কি উদ্ধতভাবে কথা বলছে; কিভাবে অস্বীকার করছে তার ক্ষমতাকে এবং কেমন করেই বা সে তার ক্ষমতার ওপর অন্য কারাে ক্ষমতার প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই সে মহা বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করছে, তােমাকে কি আমরা বাল্যাবস্থায় লালন পালন করিনি, তুমি কি তােমার জীবনের বেশ কয়েকটি বছর আমাদের মধ্যে কাটাওনি? আর তাই করেছ তুমি যা করতে চেয়েছিলে। এ কথার দ্বারা ফেরাউন বলতে চাচ্ছে যে তােমার এই আচরণ দ্বারা তুমি প্রমাণ করেছ যে, তুমি আমার উপকারকে অস্বীকার করেছে; তাই না? অর্থাৎ তােমার শিশু থাকা অবস্থায় আমাদের কাছে থাকাকালীন আমরা যে তােমাদের আদর মহব্বতের সাথে লালন পালন করেছিলাম- এটাই কি তার পুরস্কার? আমাদের স্নেহ মহব্বতের প্রতিদান কি তুমি এইভাবে দিচ্ছ যে আমরা যে জীবন ব্যবস্থার ওপর আছি, আজকে তুমি তার বিরােধিতা করছো। আর সেই বাদশাহকেই তুমি উৎখাত করতে চাইছে যার ঘরে তুমি লালিত পালিত হয়েছো? আর তাকে ছাড়া অন্য কাউকে সর্বময় ক্ষমতার মালিক বলে দাবী করছো এবং তার দিকে আমাদেরকেও আহবান জানাচ্ছে। তােমার কী হয়েছে বলাে দেখি, অথচ তুমি তাে তােমার জীবনের বেশ কয়েকটি বছর আমাদের মধ্যে কাটিয়েছাে। যে কথা আজকে তুমি বলছো, কই সে সময় তাে এর কোানাে কিছু বলােনি, আর এত বড় এক বিরাট ব্যাপার সামান্যতম পূর্বাভাসও তাে তখন তুমি দাওনি? এতােগুলো বছর পরও ফেরাউন মূসা(আ.)-এর অনিচ্ছাকৃত সেই অপরাধের কথা ভুলতে পারেনি; তাই সেই নিহত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে সে বলছে, তুমি সেই (মারাত্মক) কাজটি করেছো, যা তুমি করতে চেয়েছিলে অর্থাৎ এতােবড় জঘন্য অন্যায় কাজ তুমি করেছো যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার শক্তি ক্ষমতাকে অস্বীকারকারী হওয়ার কারণে এবং আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ার ফলেই তাে আজকে তুমি এই কথাগুলাে বলতে পারছাে। আজকে রব্বুল আলামীন সম্পর্কে তুমি যে সব কথা শােনা, কই আগে তো এসব কথা কখনও বলোনি! এইভাবে, ফেরাউন, যতাে কথা তার পেট ছিলাে সবই সে বললাে এবং সেসব কথা সে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাে যার কোনাে জবাব মূসা(আ.)-এর কাছে ছিলাে না, বিশেষ করে কিবতিকে হত্যা করার কথা; এসব কথার মধ্যে তার ধমক ও প্রচ্ছন্ন ছিলাে যে কিবতীর হত্যার দায়ে তাকে এখনও পাকড়াও করা হয়নি, কিন্তু এখনও তাে তাকে শাস্তি নিতে হতে পারে। কিন্তু এসময়ে যে মূসা(আ.)-এর দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করে নিয়েছিলেন, তার তোতলা অবস্থাটা তিনি ভালাে করে দিয়েছিলেন, যার কারণে তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তার কথার জবাব দিলেন। দেখুন কি জবাব তিনি দিলেন, ‘সে বললাে হাঁ, যখন আমি একাজ করেছিলো তখন আমি সঠিক পথ পাওয়া থেকে দূরে ছিলাম, এজন্যেই যখন তােমাদের ভয় আমাকে পেয়ে বসলাে তখন আমি পালিয়ে গেলাম, তারপর আল্লাহ তায়ালা আমাকে জ্ঞান দান করলেন এবং একজন রসূল বানালেন।’ অর্থাৎ যখন আমি সে কাজটা করেছিলাম তখন আমি সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত ছিলাম, তখন আমার মধ্যে ছিলাে অন্ধ একটি আবেগ। আজকে যে সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের সন্ধান আমি পেয়েছি এবং আমার জাতির জন্যে আমার রব আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন তাতে আমি এখন বুঝতে পারছি, সে সময়ে আমার দ্বারা মারাত্মক এক অন্যায় কাজ সংঘটিত হয়ে গিয়েছিলাে। এজন্যে আজ আমি অবশ্যই অনুতপ্ত। অবশ্য সে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরপরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার দ্বারা একটা সাংঘাতিক অন্যায় কাজ হয়ে গেছে এবং এজন্যে আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম যে ধরা পড়ে গেলে আমার কোনাে ওযর কবুল করা হবে না, তাই আমি পালিয়ে তারপর আল্লাহ তায়ালা আমাকে কল্যাণ দান করবেন বলে তার শপথ বাণী শােনালেন এবং আমাকে জ্ঞান দান করলেন। তার কথাটা উদ্বৃত করতে গিয়ে এরশাদ হয়েছে, ‘তিনি আমাকে একজন রসূল বানালেন।’ সুতরাং আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি যে, আজ আমি যা কিছু বলছি তা আমি নিজে উদ্ভাবন করিনি। অবশ্যই আমি রসূলদের মধ্যে একজন ‘প্রেরিতদের অন্যতম’ অর্থাৎ মানবমন্ডলীকে জীবন পথে পরিচালনা করার জন্যে যাদের আল্লাহ তায়ালা পথ প্রদর্শক হিসাবে পাঠিয়েছেন সেই রসূলদের বাহিনীর আমি একজন সদস্য। [এ কথার ব্যাখ্যার জন্যে সূরার মধ্যে চূড়ান্ত যে কথাটি বলা হয়েছে তা হচ্ছে, মীম ও নূন এ অক্ষরগুলাের পূর্বে রয়েছে মন্দ; যেমন বলা হয়েছে মিনাল মূরসালীন (প্রেরিত রসূলদের অন্যতম) এতে সুরের যে ঝংকার উঠেছে তা জালানী রসূলান আমাকে তিনি রসূল বানিয়েছেন, বলাতে আসতাে না; কিন্তু এ ছাড়াও অন্য আরও যে অর্থ উপরােক্ত কথায় বেরিয়ে আসে তা হচ্ছে, তিনি বলতে চেয়েছেন এ কাজটি কোন এক ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন কোনাে কাজ নয় বা এটা অভিনব কোনা কাজও নয়। যারা এ দায়িত্ব নিয়ে দুনিয়ায় প্রেরিত হয়েছেন তিনি সেই দলেরই একজন সদস্য] তারপর তির্যকভাবে তার জওয়াব দিতে গিয়ে মূসা(আ.) সঠিক কথাটি বলছেন, আর সেই সব উপকারের প্রতিদানেই কি তাহলে তুমি বনী ইসরাঈল জাতিকে এমনি করে গােলাম বানিয়ে রেখেছিলে? তাহলে এটাই কি সত্য, যে বনী ইসরাইল জাতিকে তুমি গােলাম বানিয়ে রেখেছিলে বলেই কি তার প্রতিদান দিতে গিয়ে তুমি আমাকে ছােট বেলায় লালন করেছিলে! শােন, হে মিসর অধিপতি, এটা কি সত্য নয় যে, তুমি বনী ইসরাঈল জাতির ছেলেদেরকে হত্যা করে চলেছিলে বলেই তাে আমার মা তােমার এ চরম নিষ্ঠুর আচরণে ঘাবড়ে যান এবং আমাকে একটি বাক্সের মধ্যে রেখে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেন; তারপর আমাকে সেখান থেকে তুলে আনার কারণে আমার পিতামাতার মায়া মমতাপূর্ণ বাড়ীতে না হয়ে তােমার বাড়ীতে আমি লালিত-পালিত হই, তাই তাে আজকে তুমি আমাকে তােমার এই এহসানটাই প্রদর্শন করছো। এটা কি তােমার আসলেই মেহেরবানী! এসব কথা শােনার পর কোনাে জওয়াব দিতে না পেরে ফেরাউন ভিন্ন প্রসংগ তুললাে এবং তাঁর দাওয়াতের মূল কথা কি সে বিষয়ে নির্বোধের মতাে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতেই তার মূৰ্খতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে তাচ্ছিল্য ভরে সে স্বয়ং মহান আল্লাহ সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করে বসল, এরশাদ হচ্ছে, ‘ফেরাউন বললাে, রব্বুল আলামীন আবার কি জিনিস? এমন তাচ্ছিল্যের সাথে জিজ্ঞাসা করায় সে আল্লাহকে তুচ্ছ জ্ঞান করলাে। দেখুন তার প্রশ্নের ধরনটা কি? সে বলছে, তুমি যে রব্বুল আলামীন এর কথা বলছে তা কেমন জিনিস? তুমি আবার কার কাছ থেকে রসূল হয়ে এসেছো? মূলত এ প্রশ্নের মধ্যে চরম ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ পাচ্ছে। এ কথাটি দ্বারা যে বলছে এবং যা বলছে আসলে তার প্রতি টিটকারীই করা হচ্ছে। এ প্রশ্নগুলাে করতে গিয়ে এমন অট্টহাসি সে হাসছিলাে যে তাতে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছিলাে যে তার কাছে এটা একটা অকল্পনীয় কথা বলেই মনে হচ্ছিলাে, সে মনে করছিলাে যে এটা একটা মনগড়া কথা মাত্র; কাজেই এটা মােটেই গ্রহণযােগ্য নয়। তাই দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিভিন্ন গুণাবলীর উল্লেখ করে মূসা(আ.) তার জবাব দিচ্ছেন যে, তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সবকিছুর মালিক ও পরওয়ারদেগার। সবাইকে পয়দা করা, বাঁচিয়ে রাখা এবং তাদেরকে লালন পালন করা-এসব কিছু কাজ একা মহান আল্লাহ তায়ালাই করেন। এসব কাজে অন্য কারাে কোনাে হাত নেই। তার কথার উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে আল কোরআন জানাচ্ছে, ‘সে বললাে, আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে এবং এ দু’য়ের মধ্যখানে যা কিছু আছে, সে সব কিছুর প্রতিপালক তিনি, তােমরা বুঝতে পারবে তখন যখন এ কথাগুলাের প্রতি তােমাদের দৃঢ় বিশ্বাস পয়দা হবে।’ যে মূর্খতাপূর্ণ প্রশ্ন ফেরাউন করছিলাে এই ছিলাে তার উপযুক্ত জবাব। আল্লাহ তায়ালা এ বিশাল সৃষ্টিজগতের মালিক ও প্রতিপালক। তার রাজ্যের পরিমাপ করার ক্ষমতা তােমার নেই। হে ফেরাউন, তার রাজ্যের পরিধি সম্পর্কেও তুমি কোনাে জ্ঞান রাখাে না, আর বাস্তবে ফেরাউন সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছিলাে তার জাতির দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসে থাকতে এবং নীল উপত্যকার সকল অধিবাসীকে তার দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ করে রাখতে, কিন্তু এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারেনি যে সে ছােট্ট এবং তুচ্ছ একটি রাষ্ট্রের কর্তা মাত্র, যা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী জুড়ে যে মহাবিশ্ব রয়েছে এবং এ দুই এর মাঝে যা কিছু রয়েছে তার তুলনায় একটি ক্ষুদ্র বালুকণা অথবা একটি বিন্দুসমও নয়। মূসা(আ.) ও তার জবাবে তাকে অত্যন্ত তুচ্ছ জ্ঞান করে কথা বলছিলেন, যাতে সে নির্বোধ ফেরাউন তার দুর্বলতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারে এবং তার দাবীর অসারতা বুঝতে পেরে সে তাকাতে বাধ্য হয় এ মহাবিশ্বের দিকে এবং চিন্তা করে যে তার রবের অবস্থান কোথায় থাকতে পারে? হাঁ এ অকল্পনীয় বিশাল জগৎ, যার পরিমাপ করা কোনাে মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, রব্বুল আলামীন তারই তাে সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা! এরপর এ ব্যাখ্যার পেছনে যে মূল কথাটি রয়েছে সেইদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। যদি তােমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হতে পারো। আসলে এই একটি ঘটনাই নিশ্চিত বিশ্বাস ও সত্যকে গ্রহণ করার যােগ্যতা গড়ে তােলার জন্যে যথেষ্ট। এখানে প্রণিধানযােগ্য যে, মূসা(আ.) নির্ভিক চিত্তে ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে এবং অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় যেসব তথ্যের দিকে ফেরাউনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তার ফলে সে নিজের অজান্তে চতুর্দিকের পারিপার্শিক অবস্থার দিকে তাকাতে শুরু করল। আসলে মূসা(আ.)-এর এসব কথায় সে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাে অথবা এমনও হতে পারে, যেমন করে চিরদিন শক্তি-দর্পী অহংকারী ব্যক্তিরা সত্যকে দেখেও দেখে না এবং বিশ্বরহস্য তাদের হৃদয়ে কোনাে আলােড়ন সৃষ্টি করে না, তাদের মতােই ফেরাউন সাময়িকভাবে প্রভাবিত হলেও তার সেই মনােভাবটাকে সে বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। তাই সে তার আশে পাশের লােকদেরকে বললাে, ‘তােমরা কি শুনছাে না?’ অর্থাৎ, এই অদ্ভুত ও অভিনব কথাগুলাে কি তােমরা শুনছে না! এমন কিছু করতে হবে বলে তাে কারাে সাথে আমাদের ইতিপূর্বে কোনাে কথা হয়নি, অথবা কেউ তাে আমাদেরকে এসব কথা ইতিপূর্বে বলেনি যে আমরা ওর কথাগুলাে সঠিক বলে বুঝবে! এরপর, রব্বুল আলামীনের অন্যান্য গুণাবলী সম্পর্কে আলােচনা বাড়ানাে এবং পরস্পরের ওপর পুনরায় চাপ সৃষ্টি করার জন্যে এ বিষয় নিয়ে মূসা(আ.) আর কোনাে বাদানুবাদ করলেন না বরং তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বললেন। ‘তিনি তােমাদের রব এবং তােমাদের পূর্ববর্তী বাপ-দাদাদেরও রব।’ ওপরের এ কথাটি এমন এক শক্ত ও হৃদয়গ্রাহী কথা যা ফেরাউনের মনের ওপর ও তার হৃদয়ের গভীর অনুভূতির ওপর ভীষণ এক চাপ সৃষ্টি করলাে। তার সামনে এ সত্যটা জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে যে, হা সারা বিশ্বের যিনি রব-প্রতিপালক-মালিক-মনিব ও পরিচালক, অবশ্য অবশ্যই তার রবও তিনিই; অতএব, তার অন্যান্য গোলামদের মতাে সেও তাে একজন সাধারণ গােলাম আসলে, তারই ঘরে লালিত-পালিত তার পালক ছেলের মুখে এমন বলিষ্ঠ কথা শােনার সাথে সাথে তার মধ্যে এক প্রচন্ড কম্পন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলাে, এক এক করে তার মনে পড়তে লাগলো, বিভিন্ন সময়ে আগত তার মধ্যে নানাপ্রকার দুর্বলতার কথা এবং তখন সে বুঝতে পারছিলাে যে সে নিজে নিজের মালিক নয়। অবশ্যই তার মালিক সেই মহান সত্ত্বা যার নিয়ন্ত্রণে একই নিয়মে গােটা বিশ্ব সাম্রাজ্য পরিচালিত হচ্ছে- যেখানে অন্য কারাে কোনাে ক্ষমতা চলে না। তার হৃদয় তাকে বলতে শুরু করেছিলাে। সে যে তার জাতির সর্বময় কর্তা ও মালিক হওয়ার দাবী করে, বাস্তবে এটা তাে মােটেই সঠিক নয়। কারণ তাহলে তার পূর্ববর্তী বাপ-দাদাদের রব কে ছিলাে? নিশ্চয়ই সে ছিলাে না, কারণ তখন তাে তার অস্তিত্বই ছিলাে না। তাহলে ছিলো অন্য কেউ, কে সে? অবশ্যই তারই মতাে আর কোনাে একজন হবে? তার পূর্বে না, না, সবার রব তাে তিনি যিনি চিরদিন আছেন, চিরদিন থাকবেন, যার কর্তৃত্ব সবার ওপর সব সময় একইভাবে ছেয়ে রয়েছে। হাঁ, তাহলে সেই মহান সত্ত্বাই বুল আলামীন-তিনিই কি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা? তিনিই কি বিশ্বসমূহের প্রতিপালক। এটা ছিলাে ফেরাউনের জন্যে এক মারাত্মক আঘাত, যার কারণে সে আর চুপ থাকতে পারেনি, চারপাশে অপেক্ষমান তার পরিষদদের সম্বােধন করে সে বলে উঠলাে তােমরা কি শুনছে না? হাঁ ওরা তাে এসব আলাপ-আলােচনা শুনছিলােই। এ জন্যে তাদের সামনে নবী মূসাকে হেয় করার উদ্দেশ্যে ফেরাউন তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলো। দেখুন এখানে তার কথার উদ্ধৃতিটি; ‘সে বললাে, তােমাদের যে রসূলটিকে তােমাদের কাছে পাঠানাে হয়েছে সে অবশ্যই একজন বদ্ধ পাগল। ওপরের কথাটির মধ্যে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলাের দিকে একবার খেয়াল করে দেখুন। বলা হচ্ছে, ‘অবশ্যই তােমাদের যে রসূলটিকে তােমাদের কাছে পাঠানাে হয়েছে সে একটি বদ্ধ পাগল’ এ কথার মধ্যে এক দারুণ কটাক্ষ রয়েছে, মূল রেসালাতের প্রশ্নেই সমালােচনা করতে চেয়েছে সে হতভাগা আল্লাহর দুশমন। অতপর এই বিদ্রুপের দ্বারাতেই সে মানুষের অন্তরকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চেয়েছে, অস্বীকার করেছে এর সত্যতাকে-সত্যকে মানা তাে দূরের কথা, একথা সত্য হতে পারে বলে অনুমান করতেও প্রস্তুত নয়। মূসা(আ.)-কে পাগল বলে আখ্যায়িত করছে, যেন তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কথার যুক্তি কারাে হৃদয়ে রেখাপাত করতে না পারে এবং মানুষকে যেন তাদের ও তাদের বাপ দাদাদের আসল প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু তার এই উপহাস বিদ্রুপ ও দোষারােপ মূসা(আ.)-এর মনােবলকে এতােটুকু ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। বরং তিনি অবিরাম আল্লাহর সেই মহা বাণী প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। এরপরও মূসা(আ.)-এর বলিষ্ট দাওয়াত সে বিদ্রোহী, অহংকারী ও অত্যাচারী বাদশাহকে প্রকম্পিত করে চলেছিলাে। আল কোরআন বলছে, ‘(মূসা) বললাে, মাশরিক মাগরিব এবং এ দুইয়ের মাঝে যা কিছু আছে সে সবের রব একমাত্র তিনি, তােমরা যদি তোমাদের বুদ্ধি কে কাজে লাগাও তবে এই মহাসত্যটিকে তােমরাও বুঝবে।’ পূর্ব ও পশ্চিম দুটি নিদর্শন প্রতিদিনই মানুষের সামনে হাযির হচ্ছে, কিন্তু পাগল মানুষ এগুলাের দিকে দেখে না এবং চিন্তাও করে না, যেহেতু এগুলাে সব সময় এবং বার বার ঘুরে ঘুরে মানুষের সামনে আসছে এবং দুনিয়ার জীবন এবং পৃথিবীর নানা প্রকার জীবন সামগ্রী নিয়ে মানুষ সব সময়ই ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। এখানে ব্যবহৃত শব্দগুলােতে পূর্ব ও পশ্চিম দিক বুঝালেও আসলে শব্দদ্বয় দ্বারা পূর্ব পশ্চিমের সমুদয় এলাকা ও বস্তুগুলােকে বুঝানাে হয়েছে, আর উল্লেখিত এ দুটি নিদর্শন এমন উজ্জ্বল যার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন আনার সাধ্য বলদর্পী-অহংকারী ফেরাউন ও তার আমীর ওমরাদের নাই। এ দুটি জিনিসের দিকে ফেরাউনের মনােযােগ আকর্ষণ করে তার মধ্যে এ চিন্তা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে যে, এতাে শক্তি-ক্ষমতার দাবীদার হওয়া সত্তেও সত্যিই তাে এগুলাের ওপর তার কোনাে নিয়ন্ত্রণ নাই। আর তার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে অন্য আর কার নিয়ন্ত্রণ থাকবে? অবশ্যই এটা সত্য যে এগুলাের গতিকে থামিয়ে রাখা বা এগুলাের গতির মধ্যে কোনাে পরিবর্তন আনাও কারাে পক্ষে সম্ভব নয়। এই দৃষ্টিআকর্ষণীয় কথাগুলাে নির্বোধ অন্তরসমূহকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয় এবং গাফলতির নিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকা যে কোনাে বুদ্ধিকে জাগিয়ে তােলে। অন্যদিকে মূসা(আ.) এসব কথা উত্থাপন করে তাদের মধ্যে এক প্রচন্ড বিপ্লব সৃষ্টি করে দিচ্ছেন এবং তাদেরকে গভীরভাবে এসবের ওপর চিন্তা ভাবনা করতে আহ্বান জানাচ্ছেন। বলা হচ্ছে, ‘যদি তােমরা বুদ্ধিকে কাজে লাগাও- তাহলে বুঝবে।’ অহংকারীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা যতােদিন সুস্থ ও সবল থাকে, ততােদিন নিজেকে নিয়ে ও নিজের গৌরব প্রচারে এতােই ব্যস্ত থাকে যে অন্য কারাে সম্পর্কে তারা এতােটুকু মাথা ঘামাতে পারে না বা অন্য কারাে কোনাে ক্ষমতা থাকতে পারে, এসব বিষয়ে চিন্তা করার মতাে কোনাে অবসর বা খেয়াল তাদের থাকে না; বরং তারা ভয় করে তাদেরকে যারা জাগ্রত হৃদয় এবং যারা যুক্তি দিয়ে কথা বলার সাহস রাখে আর যারা তাদেরকে চিন্তা করতে আহবান জানায় বা তাদেরকে ঘুম থেকে জাগাতে চায়, তাদেরকে তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। এজন্যে যখনই কেউ তাদের বিবেককে জাগাতে চায়, খুশী হওয়ার পরিবর্তে তারা এ কল্যাণকামীর ওপর মারমুখী হয়ে ওঠে। দেখুন, এই একই কারণে ফেরাউন ক্ষেপে যাচ্ছে মূসা(আ.)-এর ওপর এবং যখনই মূসা(আ.) তাকে চিন্তা করতে আহ্বান জানাচ্ছেন তখনই তার ওপর সে চড়াও হওয়ার ভাব দেখাচ্ছে। আবার যখন তার মধ্যে কিছু সাড়া জাগাতে চাইছে এবং মূসা(আ.)-এর বলিষ্ঠ কথায় তার অন্তরের জট খুলে যেতে চাইছে, তখনই পাশের মােসাহেব বা উপস্থিত উযির নাযির তাকে এই সাধারণ একজন মানুষের(?) কাছে নতি স্বীকার করতে বাধা দিচ্ছে। দুনিয়ার এটাও এক চিরাচরিত নিয়ম, যখনই কোনাে এলাকায় কেউ প্রভাবশালী বা ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে, তখনই তার আশপাশে, বসন্তের কোকিলের মতাে কিছু মােসাহেব জুটে যায়। এরা নিজেদের আখের গুছানাের ও তার নেক দৃষ্টি হাসিল করার মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সদা সর্বদা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। এরা তাকে তার দুর্বলতার দিক বুঝতে দেয় না এবং তার সামনে কখনাে তার দোষ-ক্রটি তুলে ধরে না বরং কেউ তুলে ধরতে চাইলে তাকে সর্ব প্রযত্নে বাধা দেয়; এদের প্রশংসায় মুগ্ধ হয়ে ওই ক্ষমতাধর ব্যক্তি তাদেরকেই একান্ত আপনজন ও কল্যাণকামী মনে করে বিভ্রান্ত হতে থাকে ও তাদের ওপর নির্ভর করে ধীরে ধীরে নেমে যায় চরম রসাতলে- এমনই এক পর্যায়ে এসে সত্যের পক্ষে সকল যুক্তি প্রমাণ সবই ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই দেখা যায়, মূসা(আ.) এর শাণিত যুক্তির সামনে মনটা নুয়ে পড়তে চাইলেও শেষ পর্যন্ত ফেরাউন বলে উঠলাে, ‘সে বললাে, (শােন হে যুবক) যদি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করতে চাও, তাহলে অবশ্য অবশ্যই আমি তােমাকে কয়েদীদের অন্তর্ভুক্ত করে দেবে।’ (ইতিপূর্বে যেমন বলা হয়েছিল, ‘মিনাল মুরসালীন’, এখানেও উপরে বর্ণিত একই উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে ‘মিনাল মাসজুনীন’) এটাই হচ্ছে সেই হৃদয়গ্রাহী যুক্তি যার কোনাে জবাব দেয়ার ক্ষমতা কারাে থাকে না এবং এটাই সেই অকাট্য প্রমাণ যাকে উপেক্ষাও কেউ করতে পারে না। এমনই অবস্থায় অহংকারী ও বলদর্পীরা জেল-জরিমানার ভয় দেখায় ও শারীরিক নির্যাতনের হুমকি দেয়। আসলে জেলখানা বা বন্দীদশা থেকে মূসা(আ.) খুব বেশী দূরেও ছিলেন না, অর্থাৎ মােটেই তিনি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছিলেন না, কিন্তু এটাও সত্য, মূসা(আ.) তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অঘােষিত এই বন্দিদশা স্বেচ্ছায় কবুল করে নিয়েছিলেন। ক্ষমতাগর্বীদের পক্ষ থেকে এই অত্যাচার-যুলুম- এটাই হচ্ছে সত্যপন্থীদের কথার জবাব দেয়ার ব্যাপারে তাদের অক্ষমতার প্রমাণ এবং এই যে প্রতিক্রিয়া এটাই হচ্ছে সক্রিয় শক্তির সামনে মিথ্যার দুর্বলতা ও পরাজয়ের লক্ষণ। অতীত ও বর্তমানের বিদ্রোহী ও অন্যায়কারীদের গতি-প্রকৃতি ও কার্যধারার এটা একটা সুস্পষ্ট দিক। কিন্তু এটাও আমরা দেখতে পাচ্ছি, এসব ফোস ফাঁস ও জেল-জরিমানার ধমক-কোনােটাই মূসা(আ.)-কে তাঁর বিজয়াভিযানের পথে বাধা হয়ে দাড়াতে পারছে না। কে আছে এমন যে, রুখবে তারে, তিনি যে স্বয়ং আল্লাহর রসূল-বিশ্ব সম্রাটের রাষ্ট্রদূত, কেমনে তার গতি কেউ রােধ করতে পারে, যখন তার ও তার ভাইয়ের পাশে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা রয়েছেন? তার আগমন ও সত্য জ্ঞানের সেই পাতাটি খুলে দেয়ার জন্যে যা চিরদিনের জন্যে বন্ধ করে দিয়ে ফেরাউন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে চেয়েছিলাে। তিনি নতুন এক কথা ও সম্পূর্ণ অভিনব এক প্রমাণ দ্বারা সে পাতা খুলে দিচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘আমি কি তােমার কাছে সুস্পষ্ট এক জিনিস নিয়ে আসিনি?” অর্থাৎ আমার রেসালাতের সপক্ষে আমি কি সুস্পষ্ট এক দলীল প্রমাণ নিয়ে তােমার সামনে হাযির হইনি? এরপরেও তুমি আমাকে কারারুদ্ধ করতে চাও? এই বলিষ্ঠ যুক্তি পেশ করে এ কথা দ্বারা উপস্থিত শ্রোতাদের সামনে ফেরাউনের সেই আসল (যুক্তিহীন ও অত্যাচারী) চেহারাকে প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে যা মূসা(আ.)-এর কথায় ইতিপূর্বে জানা গিয়েছিলাে। এরপরও যদি এসব সুস্পষ্ট প্রমাণের দিকে খেয়াল দিতে সে অস্বীকার করে তাহলে তার এই অস্বীকৃতিই তার মধ্যে শাস্তির ভয় গড়ে তুলবে, যদিও মূসা(আ.)-কে সে পাগল সাজাচ্ছিলাে এবং এরপর এমন পেরেশানী তাকে ঘিরে রাখবে যা তার সকল শান্তি নষ্ট করে দেবে। আর তাই বাস্তবে ঘটেছিলো, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার এ কথায়, ‘সে বললাে, বেশ তাে নিয়ে এসাে না, তামার সেই নিদর্শন যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো!’ অর্থাৎ তােমার (নবী হওয়ার) দাবীতে যদি তুমি সত্যবাদীই হয়ে থাকো তাহলে, অথবা তােমার কাছে কিছু আছে-এ কথায় যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তা নিয়ে এসাে না। এ কথা দ্বারা বুঝা যায় যে মূসা(আ.) সম্পর্কে ফেরাউন বেশ দ্বিধা-দ্বন্দবের মধ্যে ছিলাে, বার বার তার এ ভয় হচ্ছিলাে যে তার এ সব তর্ক বিতর্কের কারণে তার জাতির মধ্যে নানা সংশয় সৃষ্টি হতে পারে এবং তার ওপর তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধাতেও ক্রমান্তয়ে ভাটা পড়ে যেতে পারে। এমনই এক পর্যায়ে এসে মূসা(আ.) তার সামনে দুটি বস্তুগত অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন তুলে ধরছেন। মূসা(আ.) এই মােজেযা দুটি দেখাতে বিলম্ব করছিলেন। যাতে করে ফেরাউনের হঠকারিতা তার জাতির কাছে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং তাকে সমর্থন দেয়ার মতো মনােবল তাদের শেষ হয়ে যায়। অবশেষে, মূসা তার লাঠি ফেলে দিলাে, সাথে সাথে এটা রূপান্তরিত হয়ে গেলাে বিরাট এক অজগর সাপে এবং সে তার হাতকে বের করলাে তার বগল থেকে আর তৎক্ষণাত তা দর্শকদের নযরে প্রতিভাত হলাে শুভ্র-সমুজ্জ্বল রূপে। এ আয়াতের দ্বারা বুঝা যাচ্ছে লাঠিটা এমন এক বিরাট অজগর সাপে পরিণত হলাে যার মধ্যে প্রাণ প্রবাহ বর্তমান ছিলাে এবং যখন (বগল থেকে) তিনি হাত বের করলেন তখন বাস্তবে এর থেকে স্বচ্ছ শুভ্রতা ঝলমল করে উঠলো। এ সত্যটিই তার কথা ‘ফা-ইযা’-তে (আর অমনি হয়ে গেলাে এই কথাতে) প্রকাশ পেলাে। এটা যাদুর মতাে নিছক ধারণা-দান বা মনে হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করা নয়। যাদুতে বাস্তবে কোনাে জিনিসের পরিবর্তন হয় না বরং তাতে দর্শকদের নযরবন্দী করা হয় মাত্র, যার ফলে তারা যাদুকরের ইচ্ছামতাে কোনাে জিনিস নেহাৎ-সাময়িকভাবে দেখে। কিন্তু জীবনের মােজেযা আসে এমন এক মহা শক্তির কাছ থেকে যা মানুষ বুঝে না। এ মােজেযা প্রতি মুহূর্তে মানুষ দেখে এবং এ মােজেযা কখনাে শেষ হয়ে যায় না। যেমন ছিলো সাপের মােজেযা, এটা না ধরা পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়নি। এইভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে অসংখ্য নেয়ামত আমাদের জন্যে বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে রেখেছেন তার দিকে আমরা খেয়াল করে তাকাই না বলেই সেগুলাের অলৌকিকতা বুঝে উঠতে পারি না। আমরা তাকাই না এই জন্যে দৈনিক এসব দৃশ্য আমাদের সামনে ঘুরে ঘুরে বারবার আসছে। অথবা এ বিষয়ে কেউ জোর দিয়ে বলার কারণে এগুলাের দিকে সাধারণভাবে মানুষের মনােযােগ আকৃষ্ট হয় না এবং এগুলাের মধ্যে নিরন্তর সংঘটিত পরিবর্তনের দিকে মানুষের নযর পড়ে না। এই ধরনের এক চমৎকার দৃশ্য সামনে আসছে এবং দেখা যাচ্ছে মূসা(আ.)-এর সামনে উপরােক্ত মােজেযা দুটিকে হাযির করে ফেরাউনকে সত্য গ্রহণের জন্যে নৈতিক দিক দিয়ে চাপ দেয়া হচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিষয়টি ফেরাউনের অন্তরে এক প্রচন্ড নাড়া দিচ্ছে এবং তার মধ্যে এক দারুণ ভয় জাগিয়ে দিচ্ছে। অবশ্যই ফেরাউন মােজেযা দুটির শক্তি ও ব্যাপকতা অনুভব করেছে। এ কারণেই সে ব্যস্ত হয়ে এগুলাের মােকাবেলা ও প্রতিরােধ করার জন্যে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিচ্ছে, যেহেতু সে জানে তার দুর্বলতা কোথায়। সে এও জানে এবং বুঝে যে আশেপাশে তার জাতির লােকেরা, তাকে সমর্থনদানকারী যাদেরকে দেখা যাচ্ছে তারা সবাই তাকে নিজেদের স্বার্থের কারণেই তােষামােদ করে মাত্র, অন্তর দিয়ে তাকে সমর্থন করে অথবা সঠিক পরামর্শ দেয়, এ রকম লােক খুব কমই আছে। সেসব লােকদেরকে মূসা ও তার জাতির ভয় প্রচন্ডভাবে প্রকম্পিত করে ফেলেছে, যেহেতু যে মােযেজা তারা দেখেছে, তার শক্তিকে তারা মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলতে পারছে না। তারা দেখে নিয়েছে দেশের সকল নাম করা ও প্রবীণ যাদুকরদের সকল জারিজুরি খতম হয়ে গেলাে এমন একজন তরুণ মানুষের কাছে যাকে তারা জানে ও চিনে এবং তার কাজ তাে কোনাে সাময়িক নরবন্দী নয়, বরং ফেরাউনের দাপট ও তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্থায়ীভাবেই তাে সকল যাদুকর তার কাছে আত্মসমর্পণ করলাে-এটা কোনাে সাধারণ ব্যাপার নয়, অবশ্যই এ কাজের পেছনে এমন কেউ আছে যার শক্তি-ক্ষমতা অফুরন্ত, যার কাছে সবাই পরাজিত হতে বাধ্য। তাদের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে বলা হচ্ছে, তার আশেপাশে অপেক্ষমান জনতাকে সে বললাে, ‘অবশ্যই এ একজন পন্ডিত যাদুকর, সে তার যাদুর দ্বারা, তােমাদেরকে তােমাদের দেশ থেকে বের করে দিতে চায় অতএব, তােমরা আমাকে কী করতে বলাে?'(আয়াত ৩৫) ওপরে বর্ণিত ফেরাউনের এ কথাটিতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে সে মূসা(আ.)-এর মােজেযাকে যাদু বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও এর বিরাট শক্তির কথা সে অকপটে স্বীকার করছে। আরও দেখুন, সে মূসা(আ.)-কে যাদুকর বললেও সাথে সাথে তাকে জ্ঞানী (আলীম) বলেও সে অভিহিত করছে এবং তার কথায়, তার অন্তরের মধ্যে গভীর ভীতির সঞ্চার হয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে, কারণ সে দেখতে পাচ্ছে যে মূসা(আ.) তার অলৌকিক কাজগুলাে দ্বারা এমনভাবে সবাইকে প্রভাবিত করে ফেলেছে যে তারা অনেকেই এখন তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ জন্যেই সে বলে উঠেছে, সে তার যাদু দ্বারা তােমাদেরকে তােমাদের দেশ থেকে বের করে দিতে চায়। সুতরাং, বলল তােমাদের পরামর্শ কি? যখন এ কথাগুলাে সে বলছিলাে তখন তার শরীর থেকেই তার দুর্বলতা এবং হৃদয়ের প্রকম্পন ফুটে ফুটে বেরুচ্ছিলাে, যাদের সামনে নিজেকে সে সর্বশক্তিমান বানিয়ে রেখেছিলাে তাদের কাছে পরামর্শ চাওয়ার মাধ্যমে তার চরম দুর্বলতার বহিপ্রকাশ ঘটছিলাে এবং এ দুর্বলতার অনুভূতি তাকে যেন মাটির মধ্যে ধসিয়ে দিচ্ছিলো। দেখুন না, কিভাবে সে জিজ্ঞাসা করছে, ‘তোমরা আমাকে কী পরামর্শ দিচ্ছো।’ এখানে সহজেই আন্দাজ করা হচ্ছে যে নরপতির ইচ্ছার বাইরে সে রাজ্যে কিছুই হতাে না, সে দেখছে তার সামনে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে কথা বলছে সেই যুবককে যাকে এতােদিন ধরে তার লােকজন খুনের অপরাধের কারণে তালাশ করে ফিরছিলাে, উপরন্তু সে চ্যালেঞ্জ করছে তার শক্তি-ক্ষমতাকে- সে অবস্থায় তাকে ধরা তাে দূরের কথা, তার ব্যাপারে কী করবে সে বিষয়ে পরামর্শ চাইছে সেই সব মানুষের কাছে যাদের এতােদিন ধরে নিরংকুশ আনুগত্য ও পুজা সে পেয়ে এসেছে। তার মনের অবস্থা কী হলে এই অবস্থাটা হতে পারে! সহজেই অনুমেয় যে সে শত চেষ্টা করেও তার হৃদয়ের কম্পন ও দুর্বলতাকে চেপে রাখতে পারছিলাে না। পৃথিবীর বিদ্রোহী ও অহংকারী ব্যক্তিদের প্রকৃতিই হচ্ছে এই যে, যখন তারা দেখে, তাদের পায়ের নীচের যমীন কাঁপছে, তখন তারা ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং তার সামনে সামান্যতম ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যেইই থাকুক না কেন তাদের কাছেই সে সংকট থেকে বাঁচার জন্যে পরামর্শ চাইতে থাকে, মতামত চায় তাদের কাছে, পরামর্শ তাদের কাছে চায় যাদেরকে এতোদিন সে পদদলিত করেছে, আজ তাদেরকে নিয়ে সে গােল টেবিল বেঠক করতে চায়, এ এমন এক অবস্থা যে এ সময়ে তার বুদ্ধি কাজ করে না, মাথা বেঠিক হয়ে যায়, ভয়ের চোটে তার দাপট-দম্ভ সব বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর তখন সে ডুবন্ত সমুদ্রযাত্রীর মতাে সামান্যতম খর-কুটো ধরেও বাঁচতে আশা করে। চিরদিনই যালেমদের দশা এইভাবে একই হয়ে থাকে। ইতিহাসের ধারাবিবরণী চিরদিন এই একই সাক্ষ্য বহন করে এসেছে যে এসব অহংকারী মানুষ বিপদে পড়লেই চিৎকার করতে থাকে, আর ছেড়ে দিলে মনে করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেলাে, অর্থাৎ তাদের এসব পরামর্শ চাওয়াটা শুধু বিপদ কাটা পর্যন্তই টিকে থাকে, বিপদ কাটার সাথে সাথে তারা পূর্বের মতাে একইভাবে অত্যাচারী ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই কঠিন ব্রিতকর অবস্থায় ফেরাউনের আমীর ওমরারা তার দুর্বলতার কথাটা তাকে ইংগীতে জানিয়ে দিলাে, যদিও তার এই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের কাজে ওরা, নিজেদের স্বার্থের কারণে বরাবরই তাকে সহায়তা করে এসেছে। কিন্তু আজ তাদের আশংকা দেখা দিলাে যে মূসা(আ.) অচিরেই তাদের ওপর বিজয়ী হয়ে উঠবে এবং তারা প্রমাদ গুণলাে যে মূসার হাতেই ফেরাউন ও তাদের পতন আসন্ন হয়ে গেছে এবং খুব শীঘ্রই বনি ইসরাঈলরা মুক্তিলাভ করে তাদেরকে পদানত করবে। যখন তারা সে মােজেযাগুলাে দেখলাে তখন তারা ঠিকই বুঝলাে এবং তাদের অন্তর সাক্ষ্য দিলাে যে, এগুলাে মােটেই যাদু নয়, অবশ্যই এগুলাে রব্বুল আলামীন (সমগ্র বিশ্বের মালিক) এর দেয়া ক্ষমতার নিদর্শন। তবুও তারা শেষ ও চূড়ান্ত চেষ্টা হিসাবে পরামর্শ দিলাে, দেশের ওস্তাদ যাদুকরদের একত্রিত করে অনুরূপ কিছু শক্তি দেখাতে যেন মূসা(আ.)-কে অবিলম্বে দমন করা যায় । তাদের বুঝতে বাকি ছিলাে না যে, মূসা(আ.)-কে ফেরাউনের মিথ্যা দম্ভ ও দাপট দিয়ে পর্যদুস্ত করা যাবে না। যেহেতু মূসা(আ.)-এর বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও তার উপস্থাপিত অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন দুটো ফেরাউনের সকল আত্মম্ভরিতার ওপর ছিলাে মুহুর্মুহু প্রকম্পিত হচ্ছে এবং মূসা ও হারুন আলাইহিস সালামকে ধরা বা তাদেরকে শাস্তি দেয়ার কথা চিন্তাই সে করতে পারছিলাে না। দেখুন, তার এই অবস্থার সাথে তাল রেখেই ফেরাউনের পরিষদবর্গ তাকে পরামর্শ দিচ্ছে, ‘তাকে ও তার ভাইকে (এখনই পাকড়াও করবেন না, বরং) তাদেরকে কিছু সময় দিন, আর দেশের চতুর্দিকে খবর দিয়ে সকল দক্ষ ও ওস্তাদ যাদুকরদেরকে জড় করুন।’ অর্থাৎ তাকে ও তার ভাইকে একটু সুযােগ দিন এবং আপনার দূতদেরকে এই বিশাল সাম্রাজ্যের দিকে পাঠিয়ে দিন, যাতে করে তারা দক্ষ যাদুকরদেরকে একত্রিত করে নিয়ে আসতে পারে এবং একটা চূড়ান্ত ফয়সালায় পৌছানাের জন্যে তাদের ও মূসা(আ.)-এর মধ্যে এক বিরাট প্রতিযােগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
*মুসা(আ.)-এর সফলতা যাদুকরদের ব্যর্থতা : এই বিয়ােগান্ত নাটকের এ দৃশ্যের ওপর আবার পর্দা পড়ছে এবং ভেসে উঠছে আর একটি দৃশ্য। এখানে দেখা যাচ্ছে যাদুকররা দলে দলে এসে জড় হচ্ছে, অসংখ্য মানুষ হক ও বাতিলের মধ্যে এই সিদ্ধান্তকর প্রতিযােগিতা দেখার উদ্দেশ্যে একত্রিত হচ্ছে। সারা রাজ্যের যতাে মানুষ জড় হয়েছে, সবাই চায় যাদুকররা বিজয়ী হােক। এ প্রতিযােগিতা দেখার জন্যে সবার উৎসাহ উদ্দীপনা যেন উপচে পড়ছে এবং হক ও বাতিলের মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা দেখা অথবা ঈমান ও আল্লাহদ্রোহী শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার ফল দখার জন্যে সবাই উদগ্রীব। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর যাদুকরদেরকে এক নির্দিষ্ট দিনে, একত্রিত করা হলাে আর (এক ঘোষণার মাধ্যমে) লােকদেরকে বলা হলাে তােমরা একত্রিত হবে তাে?’ হয়তাে, আমাদেরকে যাদুকরদেরই অনুসরণ করতে হবে যদি তারা জয়ী হয়ে যায় ওপরের আয়াতের ব্যাখ্যায় বুঝা যাচ্ছে যে, এক মহা উৎসবের দিনে এই প্রতিযােগিতা অনুষ্ঠিত হবে বলে যখন ঘােষণা দেয়া হলাে তখন সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হলাে। এই অবস্থাই প্রকাশ পাচ্ছে, এ আয়াতে, সবাই তােমরা একত্রিত হবে তা হয়তো আমাদের পক্ষে যাদুকরদেরই অনুসরণ করা লাগবে? অর্থাৎ প্রতিযােগিতার জন্যে নির্দিষ্ট দিনে একত্রিত হওয়া এবং কেউ অনুপস্থিত না থাকা অবস্থায় তােমাদের কিছু প্রাপ্য হবে কি? ঘােষণায় একথাটাও এসেছে, প্রতিযােগিতাকালে আমাদের এ জন্যেও সমবেত হওয়া প্রয়ােজন যেন আমরা যাদুকর কে উৎসাহ যােগাতে পারি এবং ইসরাঈলী বংশের লােক মূসা(আ.)-এর ওপর তাদের বিজয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে পারি। সাধারণ মানুষ বড়ই হুজুগ প্রিয় হয়ে থাকে এবং এ ধরনের কোনাে প্রতিযােগিতা দেখার জন্যে। দলে দলে তারা একত্রিত হয়। তারা এটা হিসেব করে না বা করতে পারে না যে তাদের শাসকবর্ণ কোনাে অন্যায় ও নিরর্থক কাজের অনুষ্ঠান করছে কি না, ভালাে মন্দ পরখ করে দেখার মতো যােগ্যতা সাধারণ মানুষের থাকে না বলে যখনই এ রকম কোনাে মেলার অনুষ্ঠান দেখা বা প্রতিযােগিতা দেখার আমন্ত্রণ জনগণ পায়, তখন তারা মহাসমারােহে একত্রিত হয়ে যায় এবং উল্লাসে ফেটে পড়তে চায়। এই কারণেই মিসরবাসী মূসা(আ.) ও যাদুকরদের প্রতিযােগিতা দেখার জন্যে বিপুলসংখ্যায় হাযির হয়ে গেলাে। এতে কারাে প্রতি যুলুম বা অন্যায় হচ্ছে কি না সে বিষয়ে তাদের তেমন কোনাে মাথা ব্যথা থাকে না। এরপর দেখা যাচ্ছে আর একটি দৃশ্য। বাস্তবে প্রতিযােগিতায় নামার পূর্বে যাদুকররা ফেরাউনের দরবারে ভীড় করে আছে, তারা নিশ্চিন্ত হতে চাইছে যে, প্রতিযােগিতায় বিজয়ী হলে তারা যেন রাজকীয় পুরস্কার থেকে কোনােক্রমেই বঞ্চিত না হয়; ফেরাউনও তাদেরকে তার পাকা ওয়াদা দানের মাধ্যমে নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে আজকের এই মহা প্রতিযোগিতায় তারা বিজয়ী হলে তাদেরকে শুধু পুরস্কারই দেয়া হবে না, বরং তাদেরকে রাজকীয় মেহমান হিসেবে তার দরবারে রেখে দেয়া হবে এবং সম্রাট ফেরাউন তাদেরকে তার অত্যন্ত আপনজন হিসেবে গণ্য করবে। দেখুন এ বিষয়ে আল কোরআনের ভাষ্য, অতঃপর যখন যাদুকররা এলাে, তারা ফেরাউনকে বললাে, আমরা বিজয়ী হলে আমরা পুরস্কার পাবে তাে? সে বললাে, হাঁ বরং তখন তােমরা আমার একান্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে গণ্য হবে।’ এইভাবে বিদ্রোহী, অহংকারী ফেরাউন যাদের কাছে সাহায্য প্রার্থী হচ্ছে তারা এমন একদল লােক যারা তার কাছে পুরস্কার পাওয়ার জন্যে লালায়িত। এরা তাদের জারিজুরি দেখিয়ে দু’পয়সা কামানের চিন্তায় অধীর। তারা অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে-কতাে তাড়াতাড়ি এই মহাপুরস্কার ও রাজকীয় নেক নযরের মহাদান হাতিয়ে নেয়া যায় । আকীদা বিশ্বাস বা মানুষের কল্যাণ অকল্যাণ, ব্যাপারে এদের কোনাে মাথা ব্যথা নেই। এরা তাদের স্বার্থ, পুরস্কার এবং নিজেদের কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। আর এরাই হচ্ছে তারা যারা প্রত্যেক যামানায় ও প্রত্যেক দেশে ক্ষমতাশীনদের চাটুকারিতা ও গােলামী করে দেশ, জাতি ও জনগণের ভাগ্যে অকল্যান বয়ে আনে। হাঁ, দেখুন, এগিয়ে আসছে অগাধ পুরস্কারের আশায় বুক বেঁধে সাম্রাজ্যের প্রবীণতম যাদুকররা। তাদের সাথে তারা নিয়ে এসেছে মানুষের নযরবন্দী করার মতো তাদের নানা উপকরণাদি, এরা পরম পুলকিত বিজয়ের আশায় এবং পুরস্কার ছাড়াও বাড়তি মর্যাদা-প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতিতে, কেননা খােদ সম্রাট ওয়াদা করেছে যে, তাদেরকে সে তার একান্ত কাছের লােক বানিয়ে নেবে, আর অবশ্যই সে এটা মনে মনে স্থিরও করে রেখেছিলাে। এবারে দেখুন বাস্তবে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার বর্ণনা। মুসা তাদেরকে বললাে তােমরা যা কিছু নিক্ষেপ করতে চাও নিক্ষেপ করাে… অবশ্যই আমরা আশা করি যে আমাদেরকে আমাদের প্রতিপালক আমাদের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। কারণ আমরা বিশ্বাস স্থাপনকারীদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা অবলম্বন করেছি।’ (আয়াত ৪৩-৫১) দেখা যাচ্ছে, এ দৃশ্যটি, সাধারণভাবে এবং বেশ ধীর ধীরে সামনে আসছে, অপরদিকে মূসা(আ.) শুরু থেকেই সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও নিখাদ সত্যের ওপর তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, এ বিষয়ে তিনি দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন। শহর, নগর বন্দর থেকে এবং সারাদেশের সকল নগরী থেকে দলে দলে যাদুকররা এসে জমা হচ্ছে- এসব দেখে তার মধ্যে এতােটুকু ভাবান্তর সৃষ্টি হয়নি, মােটেই তিনি ঘাবড়ে যাননি। নানা সাজে সজ্জিত হয়েও দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে প্রবীণতম যাদুকররা এসেছে। তাদের পাশে সকল সাহায্যের হাত প্রসারিত করে ফেরাউন ও তার আমীর ওমরারা দন্ডায়মান, এতদসত্তেও মূসা(আ.) সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত চিত্তে বলছেন, ছুঁড়ে মারা যা কিছু তােমরা ছাড়তে চাইছে। এর দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, ওই যাদুকরদের যােগাড় জৌলুস ও যােগাড়যন্ত্রকে মূসা(আ.) তুচ্ছ জ্ঞান করে নিশ্চিন্ত মনে ও বিজয়ের প্রতীক্ষায় বলছেন, ‘ফেলাে না, কি ফেলতে চাইছাে… তাঁর অন্তরে ওদের কোনাে জিনিসের প্রতি কোনাে গুরুত্ব নেই, তার ভেতর কোনাে সীমাবদ্ধতার অনুভূতি নেই, নেই কোনাে সংকট-সমস্যার ভাবনা, আর এ জন্যে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বনের কোনাে চিন্তা তিনি করেননি। অপরদিকে, দেখুন যাদুকরদের অবস্থা তারা ফেরাউন ও তার মান-সম্ভ্রমের নাম নিয়ে প্রযত্নে গৃহীত তাদের সকল প্রকার সতর্কতা ও সরঞ্জামকে কাজে লাগাচ্ছে। আল কোরআন সে দৃশ্যটি পেশ করতে গিয়ে বলছে, অতঃপর তারা তাদের দড়ি খড়ি ও লাঠি-ঠ্যাংগা ছুঁড়ে মারলাে এবং বললাে, ফেরাউনের ইযযতের কসম, আমরাই আজকে বিজয়ী হবো। বর্তমান আলােচনার মধ্যে এ কথার কোনাে বিস্তারিত বিবরণ আসেনি যে ওরা দড়ি খড়ি ও লাঠি-ঠাংগা ফেলায় সেগুলাে কিরূপ ধারণ করলাে । বরং সূরায়ে আ’রাফ ও তা-হা-তে এর থেকে আরও অনেক বেশী বিবরণ পাওয়া যায়। যার কারণে সত্যের বিজয়ের ব্যাপারে যে কোনাে মুসলমানের হৃদয়ে প্রতীতি জেগে উঠবে এবং প্রতিযোগিতার পরিণতিতে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সংঘর্ষের অবসান হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়, আর এইটিই আলােচ্য সূরার লক্ষ্য। এরশাদ হচ্ছে, অতপর মূসা তার লাঠিটি নিক্ষেপ করলাে, ফলে যা কিছু মিথ্যা ওরা বানিয়ে রেখেছিলাে তা গিলে খেয়ে ফেলতে শুরু করলো। এ সময়ে হঠাৎ করে সেই অকল্পনীয় ও অপমানজনক ঘটনাটি ঘটে গেলাে যা সারাদেশের ওস্তাদ যাদুকররা কিছুতেই আশা করতে পারেনি। আসলে ওরা তাে ওদের যাদুবিদ্যার মধ্যে সব থেকে বড় যা শিখেছিলাে তাইই প্রয়ােগ করেছিলাে। তাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস ছিলাে যে গােটা সাম্রাজ্যের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তাদের এ বিদ্যার ওপর কোনাে কারসাজি দেখাতে পারে। এ জন্যে তারা একেবারে প্রথমেই সেই বিদ্যা প্রয়ােগ করলাে যা তাদের ভান্ডারে সর্বাপেক্ষা বড় বলে তারা জানতো এবং সংখ্যায়ও ছিলাে তারা অনেক, সকল এলাকা থেকে বাছাই করা দক্ষ যাদুকররাই সেখানে একত্রিত হয়েছিলাে। অপরদিকে মূসা একা মাত্র। তার সংগী বলতে ছিলাে একমাত্র তার লাঠিটি। এরপরও দেখা গেলাে সেই এক লাঠিই ওদের নযরবন্দী করা সকল কিছুকে গিলে খেয়ে ফেললাে। দ্রুততার সাথে খাওয়ার জন্যে গিলে ফেলাই হচ্ছে সর্বোত্তমপন্থা এবং তারা যাদুর দ্বারা যা কিছু বানিয়েছিলাে তা আসলে ছিলাে সব খেয়ালী জিনিস, এমনভাবে মানুষকে নযরবন্দী করা হয়েছিলাে যে তাদের দড়ি খড়ি ও লাঠি ঠ্যাংগা সব সচল জিনিস বলে মনে হয়েছিলাে, কিন্তু তারা দেখলাে ওদের ছুঁড়ে ফেলা কোনাে কিছুকে মূসা(আ.)-এর লঠি আর অবশিষ্ট ছাড়েনি। যদি মূসা(আ.) আনীত জিনিসও যাদু হতাে তাহলে তা ওদের দড়ি খড়িগুলােকে নিঃশেষে গিলে ফেলতে পারতাে না। সাময়িকভাবে গিলতে দেখলেও লােকদের সামনে অবশেষে দড়ি-লাঠি হিসেবে বাকি থেকে যেতাে। কিন্তু বাস্তবে পরে তারা ওইসব দড়ি-লাঠি আর খুঁজে পেলাে না। এ অবস্থাটা বাস্তবে যখন যাদুকররা দেখে তখন তাদের তর্ক-বিতর্ক করার আর কোনাে সুযোগ রইলাে না এবং তারা ভালােভাবেই বুঝে গেলাে যে মূসা হচ্ছেন একজন সত্য-নবী। এই কারণেই তারা যা করলাে আল কোরআন তা উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলছে, অতপর যাদুকররা সেজদায় পড়ে গেলাে। তারা বলে উঠলাে, ‘আমরা ঈমান আনলাম রব্বুল আলামীনের ওপর, ঈমান আনলাম সেই মহান সত্ত্বার ওপর যিনি মূসা ও হারুনের রব-প্রতিপালক।’ এরা তাে ছিলাে সব ভাড়াটে যাদুকর- যাদুবিদ্যা প্রদর্শনে জয়ী হলে তারা বিরাট মজুরী পাবে বলে আশায় বুক বেঁধে এসেছিলাে। তাদের সম্পর্ক ছিলাে মজুরী ও পুরস্কারের সাথে, কোনাে আকীদার ধারক-বাহক তারা ছিলাে না এবং কোনাে বিষয়ের সাথে তাদের আন্তরিক কোনাে যােগও ছিলাে না। কিন্তু মূসা(আ.)-এর সাথে প্রতিযােগিতায় নেমে তারা যে মহাসত্যের সন্ধান পেলাে তা তাদের অন্তরের চোখ খুলে দিলাে এবং তাদের পরাজয়ের মাধ্যমে সত্যকে বাস্তব চোখে দেখে তারা অভিভূত হয়ে ছিলাে। বাস্তবে সত্যের সংস্পর্শে এসে তাদের হৃদয়ে বিরাট এক পরিবর্তন এসে গেলাে । যারা কোনাে দিন সত্যের সন্ধান পায়নি, আজকে তারা সত্যের ছোঁয়া পেয়ে বিগলিত হয়ে গেলাে, আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রতি ভক্তি-বিশ্বাস ও ভয় তাদেরকে প্রচন্ডভাবে প্রকম্পিত করলাে এবং ক্ষণস্থায়ী এ জীবন শেষে সব কিছুর ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে হিসেব দিতে হবে তাদেরকে এ চিন্তা গভীরভাবে পেয়ে বসলাে, যখন তাদেরকে এ গভীর চিন্তা পেয়ে বসলাে তখন তাদের অন্তরের পুঞ্জীভূত জাহেলিয়াতের অন্ধকার ধীরে ধীরে অপসারিত হতে শুরু করলাে । অনতিকালের মধ্যেই তাদের মরিচাধরা কলিজার ওপর থেকে কলুষ-কালিমার আবরণ পরিষ্কার হয়ে গিয়ে সত্যের সামনে তারা সর্বান্তকরণে ঝুঁকে ছিলাে এবং দেখতে দেখতে ঈমানের মহাশক্তি তাদেরকে এমনভাবে বশীভূত করে ফেললাে যে তারা নিজেদের অজান্তেই সেজদায় পড়ে গেল, অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তাদের কণ্ঠ থেকে ঈমানের তেজোদ্দীপ্ত বাণী বেরিয়ে এলাে, ‘আমরা সর্বশক্তিমান রব্বুল আলামীনের ওপর ঈমান এনেছি, সেই মহা পরওয়ারদেগারের ওপর যিনি মূসা ও হারুনের রব।’ মানুষের অন্তর এক আশ্চর্য বস্তু-এমনই আজব তার গতিবিধি যা নিরূপণ করা কোনাে মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোনাে সময় এমনও হয়, যখন হঠাৎ করে এতে সত্যের জীয়ন-কাঠির ছোঁয়া লেগে যায়, তখন দেখা যায়, সকল বাধার পর্দা তার সামনে থেকে দূরে সরে গেছে এবং হঠাৎ করে সে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে, প্রচন্ড এক ঝাপটা এসে তাকে পরিবর্তিত এক মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। হাঁ, মহানবী(স.) সত্যই বলেছেন, যতাে অন্তর তিনি সৃষ্টি করেছেন তার প্রত্যেকটিই পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আংগুলগুলাের যে কোনাে দুটি আংগুলের মাঝে অবস্থিত রয়েছে, যখন তিনি চান তাকে সােজাপথে চালিত করেন। আবার যখন তিনি চান তার গতি ফিরিয়ে দেন মন্দের দিকে (ইমাম বুখারী তার বুখারী শরীফের মধ্যে হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন)। এইভাবেই ভাড়াটে সে যাদুকরদের হৃদয়ের মধ্যে হঠাৎ করে বিপ্লবী এক পরিবর্তন এসে গেলাে। তারা এমনভাবে বলিষ্ঠ হৃদয়ের মােমেন দলে পরিণত হয়ে গেলেন যে তারা ফেরাউন ও তার আমীর-ওমরাসহ সমবেত সকল জামায়েতের সামনে তাদের ঈমান আনার কথা সুউচ্চ কণ্ঠে ঘােষণা করে দিলেন। সে বিদ্রোহী অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারী বাদশার সামনে এইভাবে ঈমান আনার ঘােষণা দেয়ার পরিণাম কত ভয়ংকর হতে পারে তার কিছুমাত্র পরওয়াও তারা করলেন না। কে কী ভাববে, আর কে কী বলবে- এসবের কোনাে চিন্তাই তাদেরকে সত্যের কাছে নতি স্বীকার করা এবং সত্যের নিশান বরদার হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারলাে না। অপরদিকে ফেরাউন ও তার পারিষদদলের কাছে অবশ্যই যাদুকরদের ঈমানের এই বিপ্লবাত্মক ঘােষণা এক প্রচন্ড বজ্রপাতের মতাে মনে হলাে। একি মহা বিস্ময় তারা দেখছে। দেশের আপামর জনতার বিশাল এই সমাবেশ। সেখানে উপস্থিত রয়েছে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দ ও ফেরাউনের সকল শ্রেণীর অফিসাররা, যারা এই মহা প্রতিযোগিতার তামাশা দেখতে হাযির হয়েছিলাে। কিন্তু তারা এখন কী দেখছে, যাদেরকে নিয়ে তারা আশায় বুক বেঁধেছিলাে, যারা ছিলাে তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। যাদের বলে বলীয়ান হয়ে তারা ভেবেছিলাে মূসা ও তার বংশদেরকে চিরদিনের মতাে শেষ করে দেবে, যাদের বিজয়কে তারা তাদের বিজয় হিসেবে দেখবে, ফেরাউন ও গােটা দেশের বিজয় হিসেবে দেখবে, তারাই কিনা শুধু আত্মসমর্পণ করেই ক্ষান্ত হলাে না, বরং সকল ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে প্রবল প্রতাপান্বিত অহংকারী, দাম্ভিক, অত্যাচারী সম্রাট ফেরাউনের রক্ত চক্ষুর সামনেই দাঁড়িয়ে গেলাে তার বিরুদ্ধে! একি বাস্তব? না এ এক দিবা স্বপ্ন। তাদের মনের মধ্যে যে কথাটা বদ্ধমূল হয়েছিলাে তা হচ্ছে মূসা ইসরাঈলী একজন (অপরাধী) ব্যক্তি, সে একজন যাদুকর, তার যাদুর সাহায্যে সে চায় গােটা মিসরকে দখল করে ফেরাউন ও তার জাতিকে উৎখাত করে দিতে, সে চায় শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়ে তাদেরকে পদানত করতে এবং তার জাতিকে সর্বস্তরে ক্ষমতায় বসাতে। এ জন্যেই তারা আশায় বুক বেঁধে বসেছিলাে সারাদেশ থেকে দক্ষ সকল যাদুকর এসে মূসার এ আশা ধূলিসাৎ করে দেবে। কিন্তু হায়! একি হলাে। তাদের সকল আশাই ছাই হয়ে গেলাে, যাদেরকে নিয়ে তারা তাদের স্বপ্নসাধ গড়েছিলাে তারাই কিনা নিজেরাই মূসার অনুসারী হয়ে গেলাে! এরা তো সেই যাদুকররা যারা ফেরাউনের নাম নিয়ে ময়দানে নেমেছিলাে, যারা ফেরাউনের ইযযতের দোহাই দিয়ে তাদের উপকরণাদি ছুঁড়ে মেরেছিলাে, তারাই এমনভাবে প্রথম আঘাতেই পরাজিত হয়ে গেলাে আর এতাে সহজে তারা তাদের পরাজয়কে মেনে নিলাে, তারা মূসার রেসালাতকে স্বীকৃতি দিয়ে দিলাে আর তারা তাদের স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রমাণ করে দিলাে যে মূসা আল্লাহর কাছ থেকেই প্রেরিত হয়েছে। তারা আল্লাহ রবদুল আলামীনের ওপর ঈমান আনলাে। যিনি মূসা(আ.)-কে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন তারা ফেরাউনের আনুগত্য করা প্রত্যাহার করলাে, অথচ এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তারাই তাে ছিলাে ফেরাউনের সেই দুরন্ত ও দুর্জয় বাহিনী- যারা তারই খেদমত করার জন্যে এখানে সমাগত হয়েছিলাে এবং এই খেদমতের বিনিময় পাওয়ার জন্যে তারা কতাে দারুণভাবে প্রত্যাশী ছিলাে- কতাে হৃদয়াবেগ সহকারে এবং চূড়ান্ত বিজয় লাভের আকাংখায় তারা ফেরাউনের ইযযতের দোহাই পেরেছিলে। প্রকৃতপক্ষে মূসা ফেরাউনকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপােক্ত করার জন্যে চেষ্টা করছে ফেরাউন সারাদেশব্যাপী যেসব মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে রেখেছিলাে তার ওপরই তিনি আঘাতের ওপর আঘাত হেনেছেন। তিনি ফেরাউন কর্তৃক চালু করা জনগণের এই ধারণাকে ভেংগে দিতে চেয়েছেন যে দেব-দেবীরা আল্লাহর সন্তান এবং দেশ পরিচালনা কর জন্যে তার আইনই চলবে। প্রকৃতপক্ষে সকল যামানায় ও সকল ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপােক্ত করার জন্যে দেশে এই রকম বহু অলীক ধারণা চালু করে রাখে। এসব কাজে যাদুকরদের খেদমতকে কাজে লাগানাে হয়েছে। আসলে যাদুবিদ্যাকে সেসব জাহেলরা বরাবরই এক পবিত্র কৌশল হিসেবে গণ্য করতাে। আর এদেরকে অনুসরণ করেই গীর্জার পাদ্রীরা জ্যোতির্বিদ বা গনকরা নানা প্রকার মিথ্যার জালে জনগণকে আবদ্ধ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছে। হাঁ, সেই সব যাদুকরই আজ রব্বুল আলামীনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে বসলাে। তারা ঈমান আনলাে মূসা ও হারুনের রবের ওপর। সাধারণত জনগণ বিশ্বাসের ব্যাপারসমূহের (আকীদা-বিশ্বাসের) প্রশ্নে ধর্মযাযকদের কথা মতাে চলে। যেহেতু তারাই এসব বিষয়ে পারদর্শী। এবং তারাই এসব কিছুর পুরােধা। ফেরাউনের সিংহাসন কেমন করে টিকবে শক্তিছাড়া? আর সে শক্তি তাে আসবে জনগণের বিশ্বাসের ভিত্তিতে। অর্থাৎ ফেরাউনের প্রচারিত সেই অলীক বিশ্বাসই যদি জনগণ হারিয়ে ফেলে তাহলে কোত্থেকে সে শক্তি পাবে। কাজেই যাদুকরদের আত্মসমর্পণ ও রব্বুল আলামীনের ওপর ঈমান আনার ঘােষণায় ফেরাউনের তখতে তাউস এর ভিত্তি টলমল করে উঠলাে। অকস্মাৎ এই ঘটনা ঘটায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ফেরাউন ও তার দল-বলের মধ্যে একটা তীব্র আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। এতে আমরা আন্দায করতে পারি ওই সব ধর্মগুরু ও যাদুকরদের ঈমান আনাটা এমন ছিলাে না যে তারা ঈমান না আনলেও পারতাে। আসলে তাদের সব থেকে বড় বিদ্যা যখন খতম হয়ে গেলাে তখন তারা বুঝলাে মূসা(আ.) প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর রাসূল। অতএব ফেরাউনের সাথে থেকে এ পর্যন্তকার সকল পাপের শাস্তি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে তওবা করা ও রব্বুল আলামীনের কাছে আত্মসমর্পণ করা এটা তারা বুঝতে পেরেছিলাে। তাই তারা আনুগত্য ভরা হৃদয় নিয়ে সেজদায় পড়ে গেলাে। এমন সময় আবার ফেরাউনের মাথায় পাগলামি চেপে উঠলাে এবং সে যাদুকরদেরকে পয়লা এই বলে দোষারােপ করলাে যে ওরা মূসার সাথে গােপনে পরামর্শ করে একসাথে মিলে ফেরাউন ও তার সভাসদদের উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ফেরাউন চরম শাস্তি দেবে বলে ঘােষণা দিলাে । দেখুন এ সময়ে ফেরাউন কি বললাে, কী! আমি তােমাদেরকে অনুমতি দেয়ার আগেই তােমরা ঈমান আনলে। এ কথা সে বলেনি, ‘আমানতুম বিহী’ (তার ওপর তােমরা ঈমান এনেছো) তার ভাষায় বুঝা যাচ্ছে, সে বলতে চেয়েছে, ঈমান আনবে এতে আমার আপত্তি ছিলাে না, কিন্তু আমার অনুমতি না নিয়েই কিভাবে তােমরা ঈমান এনে ফেললে। এর অর্থ দাঁড়ায়, আমি তােমাদের দন্ডমুন্ডের মালিক, যে কোনাে কাজ করবে আমার হুকুমেই করবে। তােমরা মূসার কাছে পরাজিত হয়েছো এবং আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন দেখে তার ওপর ঈমান এনেছে, এতে কোনাে আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু আমার খেয়ে এবং আমার পরে এতােবড়াে অকৃতজ্ঞ ও অবাধ্য হলে কেমন করে যে আমার অনুমতি ছাড়াই ঈমান এনে ফেললে। তােমরা একটুও চিন্তা করলে না যে আমি তােমাদের ওপর রাগ করতে পারি এবং তােমাদেরকে চরম সাজা দিতে পারি। স্বৈরাচারী এ বাদশাহ বলতে চেয়েছে যে সেই-ই তার অধীনস্থ সবার ইচ্ছাশক্তির মালিক, সেইই জানবে তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে। কিন্তু মূর্খটা এটা টের পেলাে না, সে যাদুকরদের সারা জীবনের সাধনার ধন ছিলাে তাদের যাদু বিদ্যাটুকুই! যার ওপর কেউ কোনাে দিন কোনাে কথা বলতে পারেনি এবং কেউ তাদেরকে পরাস্ত করতে পারেনি, অথচ আজ যখন তাদের সকল বিদ্যাবুদ্ধিকে ব্যর্থ করে দেয়া হলাে তখন বুঝা গেলাে, অবশ্যই এটা কোনাে মানুষের শক্তি বলে সম্ভব হয়নি। এর পেছনে অবশ্যই সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতা এবং যার অধীনে চলছে সারা বিশ্বের সব কয়জন মানুষ। তারা এ পর্যন্ত রয়েছে তাদের প্রকৃত মালিককে চেনেনি, তাঁর হুকুম মতাে জীবন যাপন করেনি । অজান্তে যে ভুল তারা করেছে, আজকে তাদের জ্ঞান-চোখ খুলে যাওয়ার পর তারা আর কেমন করে আর পিছিয়ে থাকবে? যিনি প্রকৃত মালিক, যিনি তাদের, ফেরাউনের এবং সমগ্র বিশ্বের সবার জীবন মৃত্যুর কর্তা-প্রতিপালক, তাঁর পরিচয় জানার পর আর এক মুহূর্ত বিলম্ব নয়, তাদের চেতনায় উন্নত এসব অনুভূতি কি করে সে অহংকারী বলদর্পী শাসক টের পাবে? এর পর দেখুন স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী সম্রাট আর কাল বিলম্ব না করে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার দাপট প্রদর্শন করছে এবং তাদেরকে দোষারােপ করতে গিয়ে বলছে, ‘হাঁ, বুঝেছি, তােমাদের (এসব যাদু বিদ্যার) নেতা তাে সেই, সেই তােমাদেরকে এসব যাদুবিদ্যা শিখিয়েছে এ এক আজব দোষারােপ, লােকজন তার, সেই-ই তার অফিসারদের দ্বারা খবর দিয়ে তার দরবারে তাদেরকে জড় করেছে, কতাে বয়স্ক ও প্রবীণ লােক তারা, যারা একটু আগ পর্যন্ত ফেরাউনের কাছ থেকে পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় সর্বোতভাবে তার মনােরঞ্জন করার চেষ্টা করেছে, যাদের সাথে মূসার পরিচয়ের কোনাে সুযােগ ছিলাে না, মূসা তাে ছিলাে পলাতক এক আসামী, ধরা পড়ার ভয়ে নিরুদ্দেশে কাটিয়েছে সে দীর্ঘ বারােটি বছর, সে-ই নাকি সে মহা-মহা পন্ডিত যাদুকরদের নেতা। পাগলের প্রলাপ আর কি! সুতরাং এ কথার কোনাে ব্যাখ্যা করা চলে না। শুধু এতােটুকু জানা যায় এবং বলা যায় যে মূসা ফেরাউনের পালক ছেলে থাকাকালে সে সব ধর্ম যাজকদের কেউ কেউ ফেরাউনের প্রাসাদে আসতাে এবং তাকে লালন পালনের ব্যাপারে কিছু সহায়তা করতাে, মৃসাও হয়তাে কখনাে কখনাে তাদের গীর্জা বা এবাদতখানাগুলােতে যাতায়াত করতাে, সম্ভবত ফেরাউন এই সব কথাই বলতে চেয়েছিলাে। কিন্তু ব্যাপারটাকে অন্যভাবে চিত্রিত করলাে এবং আসল কথা সে তােমাদের ছাত্র-এ কথাটার বিপরীত বলে বসলাে সেই তােমাদের ওস্তাদ। আসলে ফেরাউন এই জন্যেই সত্যকে চাপা দিয়ে এক ডাহা মিথ্যার আশ্রয় নিতে চেয়েছিলাে যেন জনতার চোখে ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় এবং সে নব দীক্ষিত মােমেনদের ঈমান আনাটা সবার কাছে মারাত্মক এক অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। আসলে তার পায়ের নীচের যমীন সরে যাচ্ছিলাে এবং যখন ওদের ঈমান আনার কারণে সকল মানুষের সমর্থন থেকে ওরা বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তেই এই দোষারােপটা ছিলাে তার তার এক কূটনৈতিক চাল। এরপর সেসব লােকদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে শেষ চেষ্টা হিসেবে নব্য ঈমানদার যাদুকরদেরকে সে ভীষণ শাস্তির ভয় দেখাতে শুরু করলাে। কিন্তু নব দীক্ষিত এই মােমেনদল ইতিমধ্যেই আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনে মুক্তি লাভের আশায় পরম পুলকিত মনে দুনিয়ার যে কোনাে শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। দেখুন ফেরাউনের শাস্তির হুমকির ও ভীতি প্রদর্শনের ভাষা, ‘শীঘ্রই তােমরা জানতে পারবে (তােমাদের পরিণতি)। অবশ্য অবশ্যই আমি তােমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেবো এবং তােমাদের সবাইকে শুলিতে চড়াবাে। অন্যায়কারী শক্তিদ্পী ও বিদ্রোহীরা এই বেওকুফীটাই চিরদিন করে থাকে। যখনই তাদের ক্ষমতার আসন টলটলায়মান হয়ে যায় এবং নিজেদের জীবনকে বিপন্ন দেখে, তখনই তারা এই ধরনের জঘন্য পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে দেয়, চরম নিষ্ঠুর ও ঘৃণ্য অত্যাচারের পন্থা উদ্ভাবন করে… হৃদয় বা বিবেকের সকল বাধাকে উপেক্ষা করে তারা হিংস্র জন্তু-জানােয়ারের ভূমিকায় নেমে আসে। আর এটাই ছিলাে বিদ্রোহী-অহংকারী-শক্তিদর্পী সেই যালিম ফেরাউনের ঘােষণা, যে তার হুকুমকে কার্যকর করার ক্ষমতা রাখে বলে মনে করতাে এমতাবস্থায় ওইসব মােমেনদের সিদ্ধান্তকর কথা কী হতে পারে, যারা ঈমানের আলাে দেখে নিয়েছে। এসব কথা তাে সেসব জাগ্রত হৃদয় থেকে বেরিয়ে আসে যারা আল্লাহ রব্বুল ইযযতকে সত্যিকার অর্থে ভয় করে এবং তার সম্তুষ্টি কামনা করে, যারা কখনাে এমন দিকে যেতে পারে না বা এমন কিছু করতে পারে না, যা তাদের এই পরম প্রাপ্তিকে কেড়ে নেবে, কেননা তাদের হৃদয় মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেছে, অতপর তারা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে সম্মানিত হওয়ার মধুর স্বাদ যখন পেয়ে গেছে, তারা আর কখনাে তাগূতের সাথে দল বাঁধতে পারে না। এরা এমনই আত্ম মর্যাদাবােধ সম্পন্ন হয়ে যায় যে দুনিয়ার তুচ্ছ ও ক্ষণস্থায়ী জীবনের আর কোনাে পরওয়াই তারা করে না। কম পেলো না বেশী পেলো তারা এসব চিন্তার উর্ধে উঠে যায় তাদের সকল ধ্যান জ্ঞান হয়ে যায় আখেরাত কেন্দ্রিক। তাই দেখুন এই মুখগুলাে থেকে কী বলিষ্ঠ কথা বেরিয়ে আসছে, ওরা বলে উঠলাে, কোনাে অসুবিধে নেই, আমরা আমাদের রবের দিকে প্রত্যবর্তন করেছি। আমাদের কামনা-বাসনা মাত্র এতােটুকু, যেন আমাদের রব আমাদের শুণাহ খাতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেন, যাতে করে আমরা প্রথম ঈমান আনয়নকারী বলে গণ্য হতে পারি। অর্থাৎ কোনাে ক্ষতি নেই, কোনাে পরওয়া নেই আমাদের ফেরাউন আজ আমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়ার ভয় দেখাচ্ছে?(অর্থাৎ ডান হাত বাম পা এবং বাম হাত ডান পা-এক জনের এক এক রকম) এসব চিন্তা আর আমাদের কাছে কোনাে মুখ্য বিষয় নয়। শুলে চড়ানােতে বা সাজা দেওয়াতে আমাদের কোনােই পরােয়া নেই । মৃত্যু আসায় বা শাহাদাত লাভ করায় কোনাে পরওয়া নেই আমাদের কোনাে কিছুই আর আমাদেরকে ঘায়েল করতে পারবে না। আমরা আমাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি, এখন এ পৃথিবীতে আমাদের অবস্থা যা হবে হােক। আমাদের আসল চাহিদা, যার সাথে আমাদের মন-মগয এখন বিজড়িত এবং যা আমাদের একমাত্র কাম্য তা হচ্ছে, ‘যেন আমাদের রব আমাদের গুনাহখাতা মাফ করে দেন আমাদের এই পুরস্কারই যথেষ্ট যে আমরা সর্বাগ্রে মােমেন হতে পেরেছি।’ অর্থাৎ ঈমান আনার প্রতিযােগিতায় আমরা প্রথম স্থান অধিকার করেছি। ইয়া আল্লাহ, যখন কোনাে ব্যক্তির বিবেকের মধ্যে ঈমানের আগমন ঘটে তখন সে কতাে সুন্দর হয় এবং তার রূহের ওপর এর ছাপ পড়ে তখন সে কতাে মধুর চরিত্রের অধিকারী হয়ে যায়, তখন এই ঈমানের কারণেই কতাে ধীর-স্থির এবং প্রশান্ত বদনে দুনিয়ার নানা প্রকার দুঃখ-কষ্ট জ্বালাকে সে সহ্য করে নেয়; যখন পচা চটকানাে মাটির এ পুতুলটিকে ইল্লিয়ীনে তােলা হবে, যখন জীবন শেষে আল্লাহর দরবারে সে অভাবহীন ও প্রাচুর্য নিয়ে পৌছে যাবে তখন তার চোহারা কতাে মনােরম হবে; তখন পৃথিবীতে যা কিছু স্বার্থ সে ত্যাগ করে এসেছে এবং লােভ-লালসা ও আকাংখার বস্তু যা কিছু সে আখেরাতের জীবনে শান্তি পাওয়ার আশায় ছেড়ে এসেছে- সে সব কিছু তার কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হবে। এখানে এ পৃথিবীর প্রচুর সুন্দর বস্তুর ওপর পর্দা নিক্ষেপ করা হচ্ছে, কারণ এসব সৌন্দর্য ইচ্ছা করলেই বাড়ানাে যায় না। আসুন আমরা এগুলাের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পরিবর্তে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে যা সুন্দর বলে বিবেচিত হবে তাই বাড়ানাের চেষ্টা করি এবং সেই সকল কাজ করি যা গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। এভাবে আমরা দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে চেষ্টা করলে মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের মনকে তৃপ্তিতে ভরে দেবেন। মক্কায় থাকাকালে সাহাবায়ে কেরামকে তাদের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতনের মধ্যেও আল্লাহ তায়ালাই সাস্তুনা দিয়েছেন। এতে সংকট, এতাে দুঃখ ও কাফেরদের এতাে অত্যাচার সত্তেও তাদের মধ্যে কেউ ঈমান পরিত্যাগ করেননি, এমনি করে সর্বকালে ও সর্বদেশে আল্লাহ রব্বুল আলামীনই ঈমানের পথে চলতে গিয়ে মােমেনদেরকে পাথেয় যােগাড় করে দেন। তাদের দৃঢ়তা অবলম্বনের শক্তি যোগান এবং শত প্রকার যুলুম নির্যাতন সহ্য করার তাওফিক তাদের দেন।
*ফেরাউনের সলীল সমাধি : ঈমানের রাস্তায় এ সকল পরীক্ষায় মােমেনরা যখন দৃঢ়তা অবলম্বন করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজের শক্তি ক্ষমতা দ্বারা সাহায্য করেন। তিনি নিজেই তাদেরকে পরিচালনা করেন। তাই একদিকে যেমন দেখা যায় মূসা (আ.)-এর ওপর যারা বিশ্বাস স্থাপন করলেন তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নিজে পরিচালনা করে এগিয়ে নিয়ে গেলেন সাগরের দিকে, অপরদিকে ফেরাউন ও সকল প্রকার সাজ সজ্জাসহ তার সময় সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলাে বনি ইসরাঈল জাতির পশ্চাদ্ধাবন করতে। এর বর্ণনা আসছে, ‘আমি মূসাকে নির্দেশ দিলাম, আমার অনুগত বান্দাদের সাথে করে নিয়ে এগিয়ে যাও, (সাবধান থেকো) তােমাদেরকে পেছন দিক থেকে ধাওয়া করা হবে’ তখন ফেরাউন সকল শহর নগর বন্দরগুলােতে ঘােষণা করার ব্যবস্থা করলাে যেন সকল এলাকা থেকে সেনাবাহিনীতে আরও মানুষ এসে যােগ দেয়। সে তাদেরকে অভয় দিলাে যে মূসা ও তার লােকজন সব মিলেও তা সামান্য কিছুসংখ্যক লােক মাত্র সুতরাং ভয়ের কিছু নেই ওরা আমাদেরকে রাগান্বিত করে তুলেছে। আর আমরা সবাই ওদের কাছে সতর্ককারী আতংক সৃষ্টিকারী হয়ে দেখা দেবাে। এখানে বুঝা যাচ্ছে, মিসর পরিত্যাগ করার পূর্বে বনি ইসরাঈলদের আরও কিছুকাল সেখানে থাকতে হয়েছিলাে এবং আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিলাে যার বর্ণনা এখানে আসেনি, অর্থাৎ প্রতিযােগিতা শেষে বনি ইসরাঈল জাতিকে নিয়ে মূসা(আ.) আরও বেশ কিছু সময় মিসরে বাস করেছিলেন এবং তার জাতিকে নিয়ে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছিলাে, যার কিছু বিবরণ সূরায়ে আ’রাফে এসেছে। কিন্তু বর্তমান এই সূরাটিতে এ প্রসংগের আলােচনাকে সংক্ষেপ করা হয়েছে। যাতে করে এখানে মূল যে বিষয়টিকে তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছে সেটাকে পরিষ্কার করা যায়। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে মূসা(আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তিনি আল্লাহর বান্দাদেরকে নিয়ে এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং রাত্রিতেই যেন আসবাবপত্র গােছগাছ করে শৃংখলার সাথে রওনা করেন। মূসা(আ.) সবাইকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে অবশ্যই ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে পেছন থেকে তাদের ধাওয়া করবে। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সাগরের কিনারায় পৌছে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন (সম্ভবত এটা ছিলাে সেই এলাকা যেখানে বর্তমানের সুয়েজখাল মূল হ্রদের অঞ্চলে গিয়ে মিশেছে)। ইতিমধ্যে ফেরাউন জানতে পারলাে যে বনি ইসরাঈলরা অতি সংগােপনে পালিয়ে যাবে, এ জন্যে সে সাধারণভাবে সবাইকে ওদের ধরার জন্যে হুকুম জারি করে দিলাে এবং বিভিন্ন শহর থেকে লােক পাঠিয়ে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার নির্দেশ দিল, যাতে মূসা ও তার জাতিকে যথাসময়ে পাকড়াও করা যায় এবং তাদের গােপনে বেরিয়ে যাওয়ার সব পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়া যায়। কিন্তু সে হতভাগা তাে এটা জানতােনা যে নবীর পরিকল্পনা তাে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্মিত হয়, কে আছে এমন যে তাকে ব্যর্থ করতে পারে। ফেরাউনের কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীকে বর্ধিত করতে এবং সংঘবদ্ধ করে পরিচালনা করতে শুরু করলাে; কিন্তু এই বৃহৎ জমায়েতকে নিয়ন্ত্রণ করা ও খাওয়া থাকার ব্যবস্থা আনজাম দেয়ার কাজটা ফেরাউনের জন্যে ভীষণ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ালাে। কেননা ইতিপূর্বে প্রতিযােগিতায় ফেরাউনের পরাজয় এবং মূসা(আ.) ও তার জনগণের শক্তির কাহিনী, যার কারণে স্বতস্ফূর্তভাবে কেউই মূসা(আ.) ও তার জাতির মুখােমুখি হওয়ার জন্যে এগিয়ে আসছিলাে না, অর্থের লােভ ও নির্দেশ অমান্য করার জন্যে শাস্তির হুমকি- কানােটাই ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। অবশেষে এ প্রবল প্রভাবশালী বাদশাহ যে তার ধারণায় সে সর্বশক্তিমান ও পূজনীয় (ইলাহ) মূসা(আ.) ও তার জনগণের পেছনে ধাওয়া করার জন্য সাধারণকে নির্দেশ দিলাে। অন্যদিকে সে মােমেনদেরকে তুচ্ছ করতে গিয়ে বললাে, ওরা অবশ্যই ছােট্ট একটি দল মাত্র আবার দেখা যাচ্ছে তাদের ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করার জন্যে এই বিপুল আয়ােজন এসব অবস্থা সামনে রাখলে যে কোনাে ব্যক্তি বুঝবে কতাে গভীরভাবে মােমেনদের ভীতি তার অন্তরে জেঁকে বসেছে। মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ক্রোধের সঞ্চার করার জন্যে আবারও সে পাগলের মতাে বললাে, ওরা আমাদেরকে রাগিয়ে তুলেছে।’ হাঁ, ওরা কাজ ও কথা দ্বারা এমন কিছু করছিলাে যার দ্বারা মানুষের মধ্যে অসন্তোষ, রাগ ও ভাবের আবেগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, একই সাথে তাদের মধ্যে দুটি অবস্থা বিরাজ করছিলাে। একদিকে নিজেদের সংখ্যা ও সরঞ্জামের আধিক্য তাদেরকে উৎসাহ যােগাচ্ছিলাে, অপরদিকে মূসা(আ.)-এর মােজেযার কথা ও মােমেনদের আক্রমণ করার ব্যাপারে নানাপ্রকার বাধা-বিপত্তির কথা স্মরণ করে তারা সাহসহারা হয়ে যাচ্ছিল। তবুও তাদের কর্মকতারা বলছিলাে, ওদেরকে ধরা এটা কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, সর্বত্রই আমরা ওৎ পেতে বসে থাকবাে, যেন ওরা পালানাের কোনাে সুযােগ। পায়। আবার তারা বলছিলাে, অবশ্যই আমরা সুসংগঠিত এক সতর্ককারী ও আতংক সৃষ্টিকারী দল অর্থাৎ, আমাদের তৎপরতা ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা তাদেরকে ও নানা প্রকার কলা কৌশল অবলম্বনের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, তারা আমাদের ভয়ে এতােই ভীত যে আমাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তারা নানা প্রকার ফন্দী-ফিকির আঁটছে, তাদের সকল কাজে সতর্কতা অবলম্বন করছে এবং বেশ সুশৃংখলভাবে তাদের কাজকে গুছিয়ে নিচ্ছে! বাতিল শক্তি ও তার ধারক বাহকরা প্রকাশ্যে সত্যের প্রতি যতােই উন্নাসিক হােক এবং যতােই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করুক না কেন, তাদের অন্তরের গভীরে সত্যের শক্তির ব্যাপারে সদা-সর্বদা এক বিরাট আতংক বিরাজ করতে থাকে এবং মােমেনদের আকীদার মােকাবেলা করার জন্যে সকল সময়েই তারা অস্থিরতার মধ্যে কাটায়। একদম শেষের অবস্থায় পেশ করার পূর্বে প্রসংগক্রমে ফেরাউন ও তার আমীর-ওমরাদের নিজ নিজ বাসস্থান ও সুযোগ-সুবিধার সকল ক্ষেত্র পরিত্যাগ করে বেরিয়ে আসা, ডুবে মরা ও পরিশেষে আমাদের সকল কিছুর মালিকানা বনি ইসরাঈলীদের হাতে চলে যাওয়ার করুণ ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদেরকে তাদের বাগ-বাগিচা, ঝর্ণাধারা, অর্থ-সম্পদ, ও জাক-জমকপূর্ণ বাসস্থানগুলাে থেকে বের করে নিলাম। এমনি করে বনি ইসরাঈলদেরকে সব কিছুর ওয়ারিশ বানালাম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অহংকারী ও বিদ্রোহী রাজা ফেরাউন ও তার জাতিকে এইভাবে শাস্তি দিলেন যে, তারা মূসা(আ.) ও তার জাতিকে ধরার উদ্দেশ্যে অনুসরণ করার জন্যে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাে। আর এই বেরিয়ে আসাটাই তাদের শেষবারের মতাে বেরিয়ে আসায় পরিণত হলাে। বরং তারা ডেকে আনলাে তাদের শেষ ও চূড়ান্ত পরিণতি। হায় আফসােস, সে জাতির জন্যে, যারা আরাম আয়েশের সকল উপকরণাদির মালিক ছিলাে! বাগ-বাগিচা, ঝর্ণাধারা, সহায়-সম্পদ ও সম্পত্তি কতাে উন্নতমানের বাসস্থান, কিন্তু প্রতিহিংসা পরায়নতা তাদেরকে এসব কিছু পেছনে ফেলে রেখে এসে অজানা ও অকল্পনীয় পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলাে। আসলে আগ্রাসী নীতি, ক্রোধ, লােভ ও জিদ বরাবরই মানুষকে চরম ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই, এই বের হওয়াই তাদের শেষ বের হওয়া হলাে, পুনরায় আর কোনাে দিন তারা তাদের সেসব পরিত্যক্ত বিষয় আসয় ফিরে পাওয়ার জন্যে যেতে পারেনি। এই জন্যেই বলা হয়েছে মােমেন মুসলমানদের পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে তাদের এই বের হওয়াই ছিলাে শেষ বের হওয়া। এ জন্যে ওদের বেরিয়ে যাওয়ার পর সেসব দ্রব্য সম্ভার ও এলাকা সবই মােমেনদের হস্তগত হয়ে গেলাে। যুলুম, অহংকার, বিদ্রোহ ও বিপজ্জনক যেসব কাজ তারা করেছিলাে এই চরম বিপর্যয় তারই পরিণতিস্বরূপ তাদের ওপর নেমে এলাে। তাই আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলছেন, ‘আমি এমন করেই বনী ইসরাঈলদেরকে এগুলাের ওয়ারিশ বানালাম। অবশ্য মিসর থেকে বেরিয়ে পবিত্র ভূমি বায়তুল মাকদাসের দেশ ফিলিস্তিনে চলে যাওয়ার। পর পুনরায় মিসরে তারা ফিরে এসেছিলাে কিনা তা জানা যায় না, তবে ফেরাউনের দেশ ধন সম্পদ এবং তার বাসস্থান সব কিছুর উত্তরাধিকারী হয়েছিলাে বনি ইসরাঈলরাই। এই জন্যেই মােফাসসেররা বলেছেন, ফেরাউন ও আমীর-ওমরাহরা যে সব জিনিসের অধিকারী ছিলাে ওরা ওয়ারিশ হয়েছে। এসব ঘটনা পেশ করার পর আসছে শেষ এবং চূড়ান্ত দৃশ্য অতপর ওরা একদিন সূর্যোদয়ের সময়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাে। ‘যখন তারা পরস্পরকে দেখলাে তখন মূসার সংগীরা বললাে, আমরা তাে সত্যিই পড়ে যাচ্ছি। তারপর আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম।'(আয়াত ৬০-৬৫) উপরের আয়াতগুলাে থেকে জানা গেলাে যে মূসা(আ.) আল্লাহর হুকুমে এবং তারই নির্দেশিত পন্থায় আল্লাহর অনুগত বান্দা, অর্থাৎ বনি ইসরাঈলদেরকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। অতপর ভাের বেলায় পরিপূর্ণ শক্তি ও সাজ-সজ্জাসহ ফেরাউনের লােক লস্কর তাদেরকে ধাওয়া করলাে। এরপরই এগিয়ে এলাে সেই বিয়োগান্ত নাটকের শেষ পালা। আর যুদ্ধাভিযান চূড়ান্ত রূপের দিকে এগিয়ে গেলাে। দেখুন, একদিকে মূসা, তার জাতির লােকদেরকে নিয়ে সমুদ্রের সামনে দাড়িয়ে, তাদের কাছে কোনাে নৌবহর নেই, যাতে আরােহন করে পার হওয়ার চিন্তা করা যায়, তারা কী করবে কিছুই স্থির করতে পারছে না এবং তাদের কাছে কোনাে অস্ত্র শস্ত্রও নেই, যার দ্বারা ফেরাউনের মােকাবেলা করা যায়। ওদিকে তাদের একেবারে কাছাকাছি পৌছে গেছে ফেরাউনও তার সেনাবাহিনী, ওরা সর্বপ্রকার অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের পেছনে ধাওয়া করে আসছে। আজ তারা কানাে দয়া করবে না। পরিস্থিতি এমনই সংগীন যে সামনে রয়েছে বিশাল সমুদ্র এবং পেছনে রয়েছে চরম হিংস্র দুশমন, এমতাবস্থায় বাঁচার কোন উপায় আছে বলে মনে হচ্ছে না। এমন অবস্থায় মূসা(আ.)-এর সংগীরা চরম হতাশার সাথে চীৎকার করে বলে উঠছে, ‘আমরা তাে ধরাই পড়ে যাচ্ছি ।’ হাঁ, সংকট চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে যাবে। যখন বাঁচার আর কোনাে উপায়ই থাকবে না, থাকবে না তাদেরকে সাহায্য করার আর কেউ। কিন্তু মূসা তাে সেই ব্যক্তি যিনি তার রবের কাছ থেকে ওহী পেয়ে থাকেন, দেখা যাচ্ছে, তিনি নির্লিপ্ত নিঃশংক, তার রবের সাহায্য প্রাপ্তির ব্যাপারে তার মধ্যে কোনােপ্রকার সন্দেহ বা সংশয় নেই, তিনি তার রবের ওয়াদার ব্যাপারে পুরােপুরি আস্থাবান, তাঁর সাহায্য অবশ্যম্ভাবী-এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আজ মুক্তি সুনিশ্চিত, যদিও বুঝা যাচ্ছে না তা কেমন করে সম্ভব, কিন্তু শত্রুদের কল থেকে আজ তারা সবাই মুক্তি লাভ করবেনই এ বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত। আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাে তাদেরকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাকে পরিচালনা করছেন তাই, ‘তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে বলছেন, না, কিছুতেই না, অবশ্যই আমার রব আমার সাথে আছেন। শীঘ্রই তিনি আমাকে পথ দেখাবেন জানাবেন এই ক্রান্তিকালে কি আমার করণীয়। কাল্লা শব্দটি ব্যবহৃত হয় কোনাে বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দান করতে গিয়ে এবং কোনাে কথাকে নাকচ করার উদ্দেশ্যে যেমন না, কখনাে আমরা ধূর্ত হবাে না, না, কিছুতেই আমরা ধ্বংস হবাে না, না, কিছুতেই আমরা বিপদাপন্ন হবাে না, না, কোনােভাবেই আমরা ব্যর্থ হবাে না, না, কিছুতে (আমরা ধ্বংস হব) না, নিশ্চয়ই আমাদের সাথে আমাদের রব বর্তমান আছেন, তিনি আমাদেরকে পথ দেখাবেন।’ এমনি দৃঢ়তা নিয়ে এবং গুরুত্ব ও নিশ্চয়তা দিয়ে কথা বলার জন্যে কাল্লা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এমনই এক কঠিন মুহূর্ত যখন সমাগত, তবুও মূসা(আ.) নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ত, এতােটুকু বিচলিতভাব তার মধ্যে নেই, আল্লাহর সাহায্য আসার ব্যাপারে তিনি এতােটুকু সন্দিহান নন, নিরাশার ঘাের আঁধার রাতে অবশেষে শুভ্র সমুজ্জ্বল আশার বাতি ফুটে উঠছে এবং মুক্তির পথ খুলে যাচ্ছে- এমন এক পন্থায় যা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। এরশাদ হচ্ছে, ওহী নাযিল করে জানালাম মূসাকে যে তােমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রের (বুকের) ওপর আঘাত করাে। এ প্রসংগে, মূসা (আ.) সমুদ্রবক্ষে লাঠি মারলেন এ কথাটা আর পরিষ্কার করে বলা হয়নি, কারণ এটা এমনিই বুঝা যাচ্ছে যে তিনি লাঠি মারলেন, এ কাজের ফলে সংগে সংগে, সমুদ্রের পানি ভাগ হয়ে গেলাে এবং দুটো টুকরা দুই দিকে পর্বত খন্ডের মতাে উঁচু হয়ে দাড়িয়ে গেলাে। এইভাবে এক অভাবনীয় এক মহা মােজেযা (অলৌকিক ঘটনা) ঘটে গেলাে, অবর্ণনীয় ও অচিন্তনীয় সেই সত্য বাস্তবায়িত হলাে যার সম্পর্কে মানুষ বলে, ‘অসম্ভব’, কারণ মানুষের সীমিত জ্ঞানে এর কোনো সম্ভাব্যতা বের করা অসম্ভব। সাধারণভাবে তারা প্রতিনিয়ত যা দেখে চলেছে, সেইটার ওপরই তারা কোনাে ধারণা করে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাে সেই মহান সত্ত্বা যিনি দুনিয়া জাহানের জন্যে সকল নিয়ম তৈরী করেছেন (যা সাধারণত, আমরা দেখে থাকি), কিন্তু এ সব কিছুর বাইরে তিনি আরও অনেক কিছু সংঘটিত করতে পারেন এবং যখনই যা কিছু করতে চান তা সম্পন্ন করেন। এ ব্যাপারে তার কোনাে সংকট বা সীমাবদ্ধতা নেই। মােজেযা সংঘটিত হলাে এবং পানি দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুই দিকে সরে গেলাে এবং মাঝখান থেকে সুপ্রশস্ত একটি রাস্তা বেরিয়ে এলাে এ রাস্তার দুই দিকে বিরাট পর্বতের মতাে উঁচু হয়ে পানি দাড়িয়ে গেলাে এবং বনী ইসরাঈলরা এই রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাে ইতিমধ্যে ফেরাউন তার লােক লস্কর সহ সেই মহা সাগরের কিনারায় পৌছে গেলাে এবং এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে ফেরাউন ও সেনাবাহিনী চরম বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লাে; অতপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা এই আজব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইলাে এবং দেখতে থাকলাে যে মূসা(আ.) তার জাতিকে নিয়ে সে মহাসাগর পার হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পরে বিস্ময়ের ঘাের একটু কেটে গেলে সে হুকুম দিলাে তার সেনাদলকে সে বিস্ময়কর রাস্তা ধরে ওদের পশ্চাদ্ধাবন করার জন্যে। এইভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মহা পরিকল্পনা পূর্ণতা লাভ করলাে। বনী ইসরাঈল অপর কিনারায় পৌছে গেলাে। কিন্তু তখন ফেরাউন ও তার সকল লােক লস্কর পর্বতসম ওই দুই পানির ভাগের মধ্যে দিয়ে মহা বিক্রমে অগ্রসরমান। এইভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাদের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে দিলেন। সে অবস্থার চিত্র আঁকতে গিয়ে আল কোরআন জানাচ্ছে, আমি অপর দলটিকে অগ্রসর করে দিলাম এবং মূসা ও তার সাথীদের সবাইকে মুক্তি দিলাম। তারপর আমি অন্যদেরকে ডুবিয়ে দিলাম। এভাবে তাদের এ ঘটনাটি পৃথিবীর বুকে বহুকাল ধরে এক পরম দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে গেলাে। যুগ যুগ ধরে যা মানুষ স্মরণ করতে থাকলাে এবং এ ঘটনাটি অসংখ্য মানুষের আলােচনার বিষয়ে পরিণত হলাে, কিন্তু এতদসত্তেও অধিকাংশ লােক কি ঈমান এনেছিলাে? এই জন্যেই আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘অবশ্যই এই ঘটনার (বর্ণনার) মধ্যে রয়েছে এক উজ্জ্বল নিদর্শন, কিন্তু তা সত্তেও ওদের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাসী নয়।’ সুতরাং, এটা প্রমাণিত হলাে যে অলৌকিক ঘটনাবলী সব সময় ঈমান আনার ব্যাপারে চূড়ান্ত নিশ্চয়তা দিতে পারে না, যদিও মােজেযা দেখে মানুষ নরম হয়ে পড়ে এবং ঈমান আনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু আসলে ঈমান তাে হচ্ছে অন্তরের মধ্যে আগত হেদায়াতের এক মহান আলাে। ‘আর তােমার প্রতিপালকই মহাপ্রতাপশালী করুণাময়।’ ইতিপূর্বে বর্ণিত নিদর্শনাবলী ও কাফেরদের পক্ষ থেকে নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানের উল্লেখের পর এই মন্তব্য করা হলাে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১০-৬৮ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূন (عليهم السلام)-এর দাওয়াতী পদ্ধতি, বানী ইসরাঈলকে ফির‘আউনের দাসে পরিণত করা ও ফির‘আউনের সীমালঙ্ঘন করার কথা আলোচনা করেছেন।
মূসা ও হারূন (عليهم السلام)-এর ফিরআনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ আল্লাহ তা‘আলা একাধিক স্থানে উল্লখ করেছেন। কারণ এদের ঘটনার মাঝে অনেক শিক্ষা ও উপদেশ রয়েছে। তাই বলা হয় “যেখানেই ফির‘আউন সেখানেই মূসা”
আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে
الْقَوْمَ الظّٰلِمِيْنَ
তথা ফির‘আউনের কাছে তাক্বওয়ার দাওয়াত দিয়ে প্রেরণ করলেন। ফির‘আউন ছিল সে দেশের তৎকালীন শাসক, মূসা (عليه السلام) সাধারণ একজন নাগরিক। তাই তিনি ভয় পেলে আল্লাহ তা‘আলাকে বললেন: আমি ভয় করছি যে, তারা আমাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করবে। ভয়ে অন্তর সংকীর্ণ হয়ে আসছে, পূর্ব থেকে তো মুখে জড়তা ছিলই। তাই তিনি সহযোগী হিসেবে ভাই হারূনকে নাবী হিসেবে প্রেরণ করার প্রার্থনা করলেন। অর্থাৎ কিবতী ব্যক্তিকে হত্যা করে আমি তাদের কাছে অপরাধী হয়ে আছি তা তো তাদের জানা। সুতরাং আমি ভয় করছি, তারা আমাকে পেলে হত্যা করে ফেলবে। “আল্লাহ তা‘আলা বললেন: ‘কখনই নয়, অতএব তোমরা উভয়ে আমার নিদর্শনসহ যাও, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, শ্রবণকারী হিসেবে।” এখান থেকে জানা গেলন দাওয়াতী কাজ রাষ্ট্রের শাসক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। আরো জানা গেল, কেউ আল্লাহ তা‘আলার পথে সঠিক দাওয়াতী কাজ করলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন।
(إِنَّا مَعَكُمْ مُّسْتَمِعُوْنَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ক্ষমতা, দর্শন, শ্রবণ দ্বারা মূসা (عليه السلام)-এর সাথে ছিলেন। যা পরের শব্দ مُّسْتَمِعُوْنَ তাফসীর করে দিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু দেখছেন শুনছেন। মূসা (عليه السلام)-কে সহযোগিতা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলাকে মূসার সাথে যেতে হবে না, আরশের ওপর থেকেই যথেষ্ট।
মূসা (عليه السلام) ফির‘আউনের কাছে গেলেন। বানী ইসরাঈলকে সাথে দিয়ে দেয়ার জন্য আবেদন করলেন। তখন ফির‘আউন মূসা (عليه السلام)-এর শৈশবকাল থেকে যতদূর লালন-পালন করেছে তার ইতিবৃত্ত তুলে ধরল। মূসা (عليه السلام) বললেন: ‘‘আমি তো এটা করেছিলাম তখন যখন ছিলাম অজ্ঞ।”
অজ্ঞ এর অর্থ হলন অনিচ্ছাকৃতভাবে অজ্ঞতাবশত হত্যা করেছি। হত্যা করা বৈধ মনে করিনি যে কারণে আমি কুফরী পর্যায়ে চলে যাব। আমি বুঝতে পারিনি যে, ঘুষি মারলে মারা যাবে। ফলে আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা চেয়েছি, তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন।
তোমরা যখন হত্যার প্রতিশোধ নিতে এসেছিলে তখন আমি পলায়ন করে মাদইয়ান চলে যাই। পরে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে নবুওয়াত দান করেন।
মূসা (عليه السلام) যখন ফির‘আউনের কাছে রবের দাওয়াত দিলেন তখন “ফির‘আউন বলল: ‘জগতসমূহের প্রতিপালক আবার কী?’ মূসা বলল: ‘তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালক, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও।’’ এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে অমুসলিমকে প্রথমে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের দাওয়াত দিতে হবে। যেমন মুআয (رضي الله عنه)-কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ইয়ামানে প্রেরণ করেন তখন সর্বপ্রথম তাকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে বলেন। (সহীহ বুখারী হা: ১৩৯৫)
অতঃপর ফির‘আউনের দাবী অনুযায়ী মূসা (عليه السلام) মু‘জিযাহ প্রকাশার্থে সাপ দেখালে সেখানে উপস্থিত সকল জাদুকর ঈমান আনে এবং তারা বুঝতে পারে এটা কোন জাদু নয়। পরে এসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
(إِنَّا لَمُدْرَكُوْنَ)
অর্থাৎ যখন মূসা (عليه السلام) বানী ইসরাঈলকে নিয়ে রওনা দিয়ে সাগর পাড়ে চলে আসেন তখন পিছন দিক থেকে ফির‘আউনের বাহিনী চলে আসে, যখন একদল অপরদলকে দেখতে পেতে লাগল তখন মূসা (عليه السلام)-এর কাছে অভিযোগ করে বানী ইসরাঈল বলল: ‘আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম!’ মূসা (عليه السلام) বললেন: ‘কখনই নয়! আমার সঙ্গে আছেন আমার প্রতিপালক; সত্বর তিনি আমাকে পথনির্দেশ করবেন।’ অতঃপর মূসা (عليه السلام)-সহ বানী ইসরাঈলকে নাজাত দেন আর ফির‘আউন ও তার দলবলকে সাগরে ডুবিয়ে মারেন। এ সম্পর্কে ইতোপূর্বে সূরা ত্বা-হা-সহ আরো অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ঈমান আনলে অধীনস্থরা এমনিতেই ঈমান আনবে। তাই প্রথমে শাসক শ্রেণিকে ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে।
২. অমুসলিমদেরকে প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দিতে হবে।
৩. ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণ করলে বাধা দিতে হবে।
৪. কোন ব্যক্তির ভয় ঈমানদারকে তার ঈমান থেকে সরাতে পারে না, যেমন ফির‘আউনের জাদুকরেরা ঈমান আনার পর তাদেরকে ভয় দেখানো হলেও তারা ঈমান বর্জন করেনি।
৫. যারা সত্যের অনুসরণ করে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সহযোগিতা দিয়ে থাকেন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# ভূমিকার আকারে ওপরের সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর এবার ঐতিহাসিক বর্ণনার সূচনা হচ্ছে। হযরত মূসা ও ফেরাউনের কাহিনী দিয়ে এ বর্ণনার শুরু। এর মাধ্যমে বিশেষভাবে যে শিক্ষা দেয়া উদ্দেশ্য তা নিম্নরূপঃ
প্রথমত হযরত মূসাকে যেসব অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব অবস্থার মুখোমুখি ছিলেন তার তুলনায় ছিল অনেক বেশী কঠিন। হযরত মূসা ছিলেন একটি দাস জাতির সদস্য। ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় এ জাতিকে মারাত্মকভাবে দাবিয়ে রেখেছিল। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কুরাইশ সম্প্রদায়ের সদস্য। তাঁর বংশ ও পরিবার কুরাইশদের অন্যান্য বংশ ও পরিবারের সাথে পুরোপুরি সমান মর্যাদায় অবস্থান করছিল। হযরত মূসা নিজেই সেই ফেরাউনের গৃহে প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং একটি হত্যা অভিযোগে দশ বছর আত্মগোপন করে থাকার পর তাঁকে আবার সেই বাদশাহর দরবারে গিয়ে দাঁড়াবার হুকুম দেয়া হয়েছিল যার কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরণের কোন নাজুক অবস্থার মুখোমুখি হননি। তাছাড়া ফেরাউনের সাম্রাজ্য ছিল সে সময় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তিশালী সাম্রাজ্য। তার সাথে কুরাইশদের শক্তির কোন তুলনায় ছিল না। এ সত্ত্বেও ফেরাউন হযরত মূসার কোন ক্ষতিই করতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর সাথে সংঘর্ষ বাধিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এ থেকে আল্লাহ কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের এ শিক্ষা দিতে চান যে, আল্লাহ যার পৃষ্ঠপোষক থাকেন তার সাথে মোকাবেলা করে কেউ জিততে পারে না। ফেরাউনই যখন মূসার মোকাবিলায় কিছুই করতে পারেনি তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মোকাবিলায় তোমাদের জয়লাভের কথা কল্পনাই করা যায় না।
দ্বিতীয়ত হযরত মূসার মাধ্যমে ফেরাউনকে যেসব নিদর্শন দেখানো হয়েছে তার চেয়ে বেশী সুস্পষ্ট নিদর্শন আর কি হতে পারে? তারপর হাজার হাজার লোকের সমাবেশে ফেরাউনেরই চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে যাদুকরদের সাথে মোকাবিলা করে এ কথা প্রমাণও করে দেয়া হয়েছে যে, হযরত মূসা যা কিছু দেখাচ্ছেন তা যাদু নয়। যেসব যাদুশিল্প বিশেষজ্ঞগণ ফেরাউনের নিজের সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল এবং যাদেরকে ফেরাউন নিজেই ডেকেছিল, তারা নিজেরাই এ সত্য স্বীকার করে নিয়েছে যে, হযরত মূসার লাঠি যে অজগরে পরিণত হয়েছিল, সে ব্যাপারটি ছিল যথার্থ ও অকৃত্রিম এবং শুধুমাত্র আল্লাহর মু’জিযার মাধ্যমেই এমনটি হতে পারে, যাদুর সাহায্যে এমনটি হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। যাদুকররা ঈমান এনে এবং নিজেদের প্রাণকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশই রাখেননি যে, হযরত মূসার পেশকৃত নিদর্শন সত্যিই মু’জিযা, যাদু নয়। কিন্তু এ ব্যাপারেও যারা হঠকারিতায় লিপ্ত ছিল তারা নবীর সত্যতা স্বীকার করেনি। এখন তোমরা কেমন করে এমন কথা বলতে পারো যে, তোমাদের ঈমান আনা আসলে কোন ইন্দ্রিয়ানুভূত মু’জিযা ও বস্তুগত নিদর্শন দেখার ওপর নির্ভরশীল? জাতীয় ও বংশগত স্বার্থ, জাহেলী বিদ্বেষ ও স্বার্থপূজার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ খোলা মনে হক ও বাতিলের পার্থক্য অনুধাবন করে অসত্য কথা পরিহার করে সত্য ও সঠিক কথা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হলে এ কিতাবে, এ কিতাব উপস্থাপনকারীর জীবনে এবং আল্লাহর বিশাল বিশ্ব-জগতে প্রত্যেক চাক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ যেসব নিদর্শন দেখতে পারে তার জন্য যথেষ্ট হয়। নয়তো এমন একজন হঠকারী ব্যক্তি যে সত্যের সন্ধান করে না এবং প্রবৃত্তির স্বার্থ পূজায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যে তার স্বার্থে আঘাত লাগে এমন কোন সত্য গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে যতই নিদর্শন দেখুক না কেন তার সামনে আকাশ ও পৃথিবী উল্টে দিলেও সে ঈমান আনবে না।
তৃতীয়ত এ হঠকারিতার যে পরিণাম ফেরাউন দেখেছে তা এমন কোন পরিণাম নয় যা দেখার জন্য অন্য লোকেরা পাগল হয়ে গেছে। নিজের চোখে আল্লাহর শক্তিমত্তার নিদর্শন দেখে নেবার পর যে তা মানে না সে এমনি ধরণের পরিণতিরই সম্মুখীন হয়। এখন তোমরা কি এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার পরিবর্তে এর স্বাদ আস্বাদন করা পছন্দ করছো?
# এ বর্ণনাভংগী ফেরাউন এর সম্প্রদায়ের চরম নির্যাতনের কথা প্রকাশ করছে। “জালেম সম্প্রদায়” হিসেবে তাদেরকে পরিচিত করানো হচ্ছে। যেন তাদের আসল নামই হচ্ছে জালেম সম্প্রদায় এবং ফেরাউন এর সম্প্রদায় হচ্ছে তার তরজমা ও ব্যাখ্যা।
# হে মুসা! দেখ কেমন অদ্ভূত ব্যাপার, এরা নিজেদেরকে সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন মনে করে দুনিয়ায় জুলুম-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে এবং উপরে আল্লাহ আছেন, তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, এ ভয় তাদের নেই।
# সূরা তা-হা এর ২ এবং সূরা কাসাস-এর ৪ রুকু’তে এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সেই আলোচনাগুলোকে এর সাথে মিলিয়ে দেখলে জানা যায়, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম প্রথমত এত বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজে একাকী যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। (আমার বক্ষ সংকুচিত হচ্ছে এ বাক্যটি এ কথাই প্রকাশ করছে) দ্বিতীয়ত তাঁর মধ্যে এ অনুভূতি ছিল, তিনি বাকপটু নন এবং অনর্গল ও দ্রুত কথা বলার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই। তাই তিনি হযরত হারুনকে সাহায্যকারী হিসেবে নবী বানিয়ে তাঁর সাথে পাঠাবার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানান। কারণ, হযরত হারুন অত্যন্ত বাকপটু, প্রয়োজনে তিনি হযরত মূসাকে সমর্থন দেবেন এবং তাঁর বক্তব্যকে সত্য প্রমাণ করে তাঁর হাতকে শক্তিশালী করবেন। হতে পারে, প্রথম দিকে হযরত মূসা তাঁর পরিবর্তে হযরত হারুনকে এ দায়িত্বে নিযুক্ত করার আবেদন জানান, কিন্তু পরে যখন তিনি অনুভব করেন আল্লাহ তাঁকেই নিযুক্ত করতে চান তখন আবার তাঁকে নিজের সাহায্যকারী করার আবেদন জানান। এ সন্দেহ হবার কারণ হচ্ছে, হযরত মূসা এখানে তাঁকে সাহায্যকারী করার আবেদন জানাচ্ছেন না বরং বলছেনঃ
فَأَرْسِلْ إِلَى هَارُونَ
“আপনি হারুনের কাছে রিসালত পাঠান।” আর সূরা তা-হা-এ তিনি আবেদন জানানঃ
وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي – هَارُونَ أَخِي
“আমার জন্য আমার পরিবার থেকে একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন, আমার ভাই হারুনকে।”
এছাড়া সূরা কাসাসে তিনি আবেদন জানানঃ وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي
“আর আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে বেশী বাকপটু, কাজেই আপনি তাঁকে সাহায্যকারী হিসেবে আমার সাথে পাঠিয়ে দিন, যাতে সে আমার সত্যতা প্রমাণ করে।”
এ থেকে মনে হয়, সম্ভবত এই পরবর্তী আবেদন দু’টি পরে করা হয়েছিল এবং এ সূরায় হযরত মূসা থেকে যে কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে সেটিই ছিল প্রথম কথা। বাইবেলের বর্ণনা এ থেকে ভিন্ন। বাইবেল বলছে, ফেরাউনের জাতি তাঁকে মিথ্যুক বলে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এ ভয়ে এবং নিজের কন্ঠের জড়তার ওজর পেশ করে হযরত মূসা এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে পুরোপুরি অস্বীকারই করে বলেছিলেনঃ “হে প্রভু, বিনয় করি, অন্য যাহার হাতে পাঠাইতে চাও, এ বার্তা পাঠাও।” তারপর আল্লাহ নিজেই হযরত হারুনকে তাঁর জন্য সাহায্যকারী নিযুক্ত করে তাঁকে এ মর্মে রাজী করান যে, তারা দু’ভাই মিলে ফেরাউনের কাছে যাবেন। (যাত্রা পুস্তক ৪: ১-১৭) ,
# সূরা কাসাসের ২ রুকু’তে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। হযরত মূসা ফেরাউনের সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে একজন ইসরাঈলীর সাথে লড়তে দেখে একটি ঘুঁষি মেরেছিলেন। এতে সে মারা গিয়েছিল। তারপর হযরত মূসা যখন জানতে পারলেন, এ ঘটনার খবর ফেরাউনের লোকেরা জানতে পেরেছে এবং তারা প্রতিশোধ নেবার প্রস্তুতি চালাচ্ছে তখন তিনি দেশ ছেড়ে মাদয়ানের দিকে পালিয়ে গেলেন। এখানে আট-দশ বছর আত্মগোপন করে থাকার পর যখন তাঁকে হুকুম দেয়া হলো তুমি রিসালাতের বার্তা নিয়ে সেই ফেরাউনের দরবারে চলে যাও, যার ওখানে আগে থেকেই তোমার বিরুদ্ধে হত্যার মামলা ঝুলছে, তখন যথার্থই হযরত মূসা আশঙ্কা করলেন, বার্তা শুনাবার সুযোগ আসার আগেই তারা তাঁকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করে ফেলবে।
# হযরত মূসা ও হারুনের দাওয়াতের দু’টি অংশ ছিল। একটি ছিল ফেরাউনকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে আহ্বান করা। সকল নবীর দাওয়াতের আসল উদ্দেশ্য ছিল এটিই। দ্বিতীয়টি ছিল বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের গোলামীর বন্ধন মুক্ত করা। এটি ছিল বিশেষভাবে কেবলমাত্র তাঁদের দু’জনেরই আল্লাহর পক্ষ হতে অর্পিত দায়িত্ব। কুরআন মজীদে কোথাও শুধুমাত্র প্রথম অংশটির উল্লেখ করা হয়েছে (যেমন সূরা নাযি’আতে) আবার কোথাও শুধুমাত্র দ্বিতীয় অংশটির।
# এ থেকে মূসা যে ফেরাউনের গৃহে লালিত পালিত হয়েছিলেন, এ ফেরাউন যে সে ব্যক্তি নয়, এ চিন্তার প্রতি সমর্থন মেলে। বরং এ ফেরাউন ছিল তার পুত্র। এ যদি সে ফেরাউন হতো, তাহলে বলতো, আমি তোমাকে লালন-পালন করেছিলাম। কিন্তু এ বলছে, আমাদের এখানে তুমি ছিলে। আমরা তোমাকে লালন-পালন করেছিলাম। (এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ ৮৫-৯৩ টীকা)
# মূলে وَأَنَا مِنَ الضَّالِّينَ বলা হয়েছে। অর্থাৎ “আমি তখন গোমরাহীর মধ্যে অবস্থান করছিলাম।” অথবা “আমি সে সময় এ কাজ করেছিলাম পথভ্রষ্ট থাকা অবস্থায়।” এ ضلالت শব্দটি অবশ্যই গোমরাহী বা পথভ্রষ্ট তারই সমার্থক। বরং আরবী ভাষায় এ শব্দটি অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা, ভুল, ভ্রান্তি, বিস্মৃতি ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। সূরা কাসাসে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে এখানে ضلالت শব্দটিকে অজ্ঞতা অর্থে গ্রহণ করাই বেশী সঠিক হবে। হযরত মূসা সেই কিবতীকে একজন ইসরাঈলীর উপর জুলুম করতে দেখে শুধুমাত্র একটি ঘুঁষি মেরেছিলেন। সবাই জানে, ঘুঁষিতে সাধারণত মানুষ মরে না। আর তিনি হত্যা করার উদ্দেশ্যেও ঘুঁষি মারেননি। ঘটনাক্রমে এতেই সে মরে গিয়েছিল। তাই সঠিক এ ছিল যে, এটি ইচ্ছাকৃত হত্যা ছিল না বরং ছিল ভুলক্রমে হত্যা। হত্যা নিশ্চয়ই হয়েছে কিন্তু ইচ্ছা করে হত্যা করার সংকল্প করে হত্যা করা হয়নি। হত্যা করার জন্য যেসব অস্ত্র বা উপায় কায়দা ব্যবহার করা হয় অথবা যেগুলোর সাহায্যে হত্যাকার্য সংঘটিত হতে পারে তেমন কোন অস্ত্র, উপায় বা কায়দাও ব্যবহার করা হয়নি।
# জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং নবুওয়াতের পরোয়ানা। “হুকুম” অর্থ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হয় আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীকে কর্তৃত্ব করার অনুমতিও (Authority) হয়। এরই ভিত্তিতে তিনি ক্ষমতা সহকারে কথা বলেন।
# তোমরা যদি বনী ইসরাঈলের প্রতি জুলুম-নিপীড়ন না চালাতে তাহলে আমি প্রতিপালিত হবার জন্য তোমাদের গৃহে কেন আসতাম? তোমাদের জুলুমের কারণেই তো আমার মা আমাকে ঝুড়িতে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। নয়তো আমার লালন-পালনের জন্য কি আমার নিজের গৃহ ছিল না? তাই এ লালন-পালনের জন্য অনুগৃহীত করার খোটা দেয়া তোমার মুখে শোভা পায় না।
# হযরত মূসাকে ফেরাউনের কাছে যে বাণী পৌঁছাবার জন্য পাঠানো হয়েছিল তিনি নিজেকে রব্বুল আলামীনের রসূল হিসেবে পেশ করে তা তাকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন, এ বিস্তারিত বিবরণটি এখানে বাদ দেয়া হয়েছে। একথা স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রকাশিত যে, যে বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য নবীকে নিযুক্ত করা হয়েছিল তিনি নিশ্চয় তা পৌঁছিয়ে দিয়ে থাকবেন। তাই তা উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। সেটি বাদ দিয়ে এবার এমন সংলাপ উদ্ধৃত করা হয়েছে যা এ বাণী প্রচারের পর ফেরাউন ও মূসার মধ্যে হয়েছিল।
# এ প্রশ্নটি করা হয় হযরত মূসার উক্তির ওপর ভিত্তি করে। তিনি বলেন, আমি রব্বুল আলামীনের (সমস্ত বিশ্ব-জাহানের মালিক, প্রভু ও শাসকের) পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছি এবং এজন্য প্রেরিত হয়েছি যে, তুমি বনী ইসরাঈলকে আমার সাথে যেতে দেবে। এটি ছিল সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য। এর পরিষ্কার অর্থ ছিল, হযরত মূসা যার প্রতিনিধিত্বের দাবীদার তিনি সারা বিশ্ব-জাহানের সকল সৃষ্টির ওপর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও শাসনের অধিকারী এবং তিনি ফেরাউনকে নিজের অনুগত গণ্য করে তার শাসন কর্তৃত্বের পরিসরে একজন ঊর্ধ্বতন শাসনকর্তা হিসেবে কেবল হস্তক্ষেপই করছেন না বরং তার নামে এ ফরমানও পাঠাচ্ছেন যে, তোমার প্রজাদের একটি অংশকে আমার মনোনীত প্রতিনিধির হাতে সোপর্দ করো, যাতে সে তাদেরকে তোমার রাষ্ট্রসীমার বাইরে বের করে আনতে পারে। এ কথায় ফেরাউন জিজ্ঞেস করছে, এ সারা বিশ্ব-জাহানের মালিক ও শাসনকর্তাটি কে? যিনি মিসরের বাঁদশাহকে তার প্রজাকূলের অর্ন্তভুক্ত সামান্য এক ব্যক্তির মাধ্যমে এ ফরমান পাঠাচ্ছেন?
# আমি পৃথিবীতে বসবাসকারী কোন সৃষ্টি ও ধ্বংসশীল শাসন কর্তৃত্বের দাবীদারের পক্ষ থেকে আসিনি বরং এসেছি আকাশ ও পৃথিবীর মালিকের পক্ষ থেকে। যদি তোমরা বিশ্বাস করো এ বিশ্ব-জাহানের কোন স্রষ্টা-মালিক ও শাসনকর্তা আছেন তাহলে বিশ্বাবাসীর রব কে একথা বুঝা তোমাদের পক্ষে কঠিন হবার কথা নয়।
# হযরত মূসা (আ) ফেরাউনের দাবীদারদেরকে সম্বোধন করে এ ভাষণ দিচ্ছিলেন। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে ফেরাউন বলেছিল, তোমরা শুনছো? হযরত মূসা তাদেরকে বলেন, আমি এমন সব মিথ্যা রবের প্রবক্তা নই যারা আজ আছে, কাল ছিল না এবং কাল ছিল কিন্তু আজ নেই। তোমাদের এ ফেরাউন যে আজ তোমাদের রবে পরিণত হয়েছে সে কাল ছিল না এবং কাল তোমাদের বাপ-দাদারা যেসব ফেরাউনকে রবে পরিণত করেছিল তারা আজ নেই। আমি কেবলমাত্র সেই রবের সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও শাসনাধিকার স্বীকার করি যিনি আজও তোমাদের এবং এই ফেরাউনের রব এবং এরপূর্বে তোমাদের ও এর যে বাপ-দাদারা চলে গেছেন তাদের সবারও রব ছিলেন।
# আমাকে পাগল গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু আপনারা যদি বুদ্ধিমান হয়ে থাকেন, তাহলে নিজেরাই ভেবে দেখুন, প্রকৃতপক্ষে কি এ বেচারা ফেরাউন যে পৃথিবীর সামান্য একটু ভূখণ্ডের বাদশাহ হয়ে বসেছে সে রব? অথবা পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক এবং মিসরসহ পূর্ব ও পশ্চিম দ্বারা পরিব্যাপ্ত প্রত্যেকটি জিনিসের মালিক যিনি তিনি রব? আমি তো তাঁরই শাসন কর্তৃত্ব মানি এবং তাঁরই পক্ষ থেকে এ হুকুম তাঁর এক বান্দার কাছে পৌঁছিয়ে দিচ্ছি।
# এ কথোপকথনটি বুঝতে হলে এ বিষয়টি সামনে থাকতে হবে যে, আজকের মতো প্রাচীন যুগেও “উপাস্য”-এর ধারণা কেবলমাত্র ধর্মীয় অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ পূজা, আরাধনা, মানত ও নজরানা লাভের অধিকারী। তার অতি প্রাকৃতিক প্রাধান্য ও কর্তৃত্বের কারণে মানুষ নিজের ব্যবহারিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছে সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের জন্য প্রার্থনা করবে, এ মর্যাদাও তার আছে। কিন্তু কোন উপাস্য আইনগত ও রাজনৈতিক দিক দিয়েও প্রাধান্য বিস্তার করার এবং পার্থিব বিষয়াদিতে তার ইচ্ছামত যে কোন হুকুম দেবে আর তার সামনে মানুষকে মাথা নত করতে হবে। এ কথা পৃথিবীর ভূয়া শাসনকর্তারা আগেও কখনো মেনে নেয়নি এবং আজও মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা সব সময় একথা বলে এসেছে, দুনিয়ার বিভিন্ন ব্যাপারে আমরা পূর্ণ স্বাধীন। কোন উপাস্যের আমাদের রাজনীতিতে ও আইনে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নেই। এটিই ছিল পার্থিব রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যসমূহের সাথে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ও তাঁদের অনুসারী সংস্কারকদের সংঘাতের আসল কারণ। তাঁরা এদের কাছ থেকে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করার চেষ্টা করেছেন এবং এরা এর জবাবে যে কেবলমাত্র নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের দাবী পেশ করতে থেকেছে তাই নয় বরং এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে অপরাধী ও বিদ্রোহী গণ্য করেছে, যে তাদের ছাড়া অন্য কাউকে আইন ও রাজনীতির ময়দানে উপাস্য হিসেবে মেনে নিয়েছে। এ ব্যাখ্যা থেকে ফেরাউনের এ কথাবার্তার সঠিক মর্ম উপলব্ধি করা যেতে পারে। যদি কেবলমাত্র পূজা-অর্চনা ও নজরানা-মানত পেশ করার ব্যাপার হতো, তাহলে হযরত মূসা অন্য দেবতাদের বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে এর একমাত্র হকদার মনে করেন এটা তার কাছে কোন আলোচনার বিষয় হতো না। যদি কেবলমাত্র এ অর্থেই মূসা আলাইহিস সালাম তাকে ইবাদতের ক্ষেত্রে তাওহীদমুখী হবার দাওয়াত দিতেন তাহলে তার ক্রোধান্মত্ত হবার কোন কারণই ছিল না। বড়জোর সে যদি কিছু করতো তাহলে নিজের পিতৃপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করতো অথবা হযরত মূসাকে বলতো, আমার ধর্মের পণ্ডিতদের সাথে বিতর্ক করে নাও। কিন্তু যে জিনিসটি তাকে ক্রোধান্মত্ত করে দিয়েছে সেটি ছিল এই যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম রব্বুল আলামীনের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে পেশ করে তাকে এমনভাবে একটি রাজনৈতিক হুকুম পৌঁছিয়ে দিয়েছেন যেন সে একজন অধীনস্ত শাসক এবং একজন ঊর্ধ্বতন শাসনকর্তার দূত এসে তার কাছে এ হুকুমের প্রতি আনুগত্য করার দাবী করছেন। এ অর্থে সে নিজের ওপর কোন রাজনৈতিক ও আইনগত প্রাধান্য মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। বরং তার কোন প্রজা তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ঊর্ধ্বতন শাসনকর্তা হিসেবে মেনে নেবে, এটাও সে বরদাশত করতে পারতো না। তাই সে প্রথমে চ্যালেঞ্জ করলো “রব্বুল আলামীন”-এর পরিভাষাকে। কারণ, তাঁর পক্ষ থেকে যে বার্তা নিয়ে আসা হয়েছিল তার মধ্যে শুধুমাত্র ধর্মীয় উপসনার নয় বরং সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ভাবধারা সুস্পষ্ট ছিল। তারপর হযরত মূসা যখন বারবার ব্যাখ্যা করে বললেন— তিনি যে রব্বুল আলামীনের বার্তা এনেছেন তিনি কে? তখন সে পরিষ্কার হুমকি দিল, মিসর দেশে তুমি যদি আমার ছাড়া অন্য কারো সার্বভৌম কর্তৃত্বের নাম উচ্চারণ করবে তাহলে তোমাকে জেলখানার ভাত খেতে হবে।
# যদি আমি সত্যিই সমগ্র বিশ্ব-জাহানের, আকাশ ও পৃথিবীর এবং পূর্ব ও পশ্চিমের রবের পক্ষ থেকে যে আমাকে পাঠানো হয়েছে এর সপক্ষে সুস্পষ্ট আলামত পেশ করি, তাহলে এ অবস্থায়ও কি আমার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করা হবে এবং আমাকে কারাগারে পাঠানো হবে?
# হযরত মূসার প্রশ্নের জবাবে ফেরাউনের এ উক্তি স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করে যে, প্রাচীন ও আধুনিক কালের মুশরিকদের থেকে তার অবস্থা ভিন্নতর ছিল না। অন্য সব মুশরিকদের মতোই সে আল্লাহকে অতিপ্রাকৃত অর্থে সকল উপাস্যের উপাস্য বলে বিশ্বাস করতো এবং তাদের মতো একথাও স্বীকার করতো যে, বিশ্ব-জাহানের সকল দেবতার চাইতে তাঁর শক্তি বেশী। তাই মূসা তাঁকে বলেন, যদি তুমি আমাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত বলে বিশ্বাস না করো, তাহলে আমি এমন সব নিদর্শন পেশ করবো যা থেকে আমি যে তাঁর প্রেরিত তা প্রমাণ হয়ে যাবে। আর এ কারণে সে-ও জবাব দেয়, ঠিক আছে যদি তোমার দাবী সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আনো তোমার নিদর্শন। অন্যথায় সোজা কথা, যদি সে আল্লাহর অস্তিত্ব অথবা তাঁর বিশ্ব-জাহানের মালিক হবার ব্যাপারেই সন্দিহান হতো, তাহলে নিদর্শনের প্রশ্নই উঠতে পারতো না। নিদর্শনের প্রশ্ন তো তখনই সামনে আসতে পারে যখন আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হওয়া স্বীকৃত হয় কিন্তু মূসা তাঁর প্রেরিত কি না এ ব্যাপারে প্রশ্ন দেখা দেয়।
# কুরআন মজীদে কোন জায়গায় এজন্য حَيَّةً (সাপ) আবার কোথাও جان (সাধারণত ছোট ছোট সাপকে বলা হয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর এখানে বলা হচ্ছে ثعبان (অজগর)। এর ব্যাখ্যা এভাবে করা যায় যে حية আরবী ভাষায় সর্প জাতির সাধারণ নাম। তা ছোট সাপও হতে পারে আবার বড় সাপও হতে পারে। আর ثعبان শব্দ ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, দৈহিক আয়তন ও স্থূলতার দিক দিয়ে তা ছিল অজগরের মতো। অন্যদিকে جان শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ছোট সাপের মতো তার ক্ষীপ্রতা ও তেজস্বীতার জন্য।
# কোন কোন তাফসীরকারক ইহুদীদের বর্ণনায় প্রভাবিত হয়ে بيضاء এর অর্থ করেছেন “সাদা” এবং এর অর্থ এভাবে নিয়েছেন, বগল থেকে বের হতেই স্বাভাবিক রোগমুক্ত হাত ধবল কুষ্ঠরোগীর মত সাদা হয়ে গেলো? কিন্তু ইবনে জারীর, ইবনে কাসীর, যামাখশারী, রাযী, আবুস সাউদ ঈমাদী, আলূসী ও অন্যান্য বড় বড় মুফাসসিরগণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এখানে بيضاء মানে হচ্ছে, উজ্জ্বল ও চাকচিক্যময়। যখনই হযরত মূসা বগল থেকে হাত বের করলেন তখনই আকস্মাত সমগ্র পরিবেশ আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠলো এবং অনুভূত হতে লাগলো যেন সূর্য উদিত হয়েছে।
# মু’জিযা দু’টির শ্রেষ্ঠত্ব এ থেকেই অনুমান করা যেতে পারে। মাত্র এক মূহুর্ত আগে নিজের এক সাধারণ প্রজাকে দরবারের মধ্যে রিসালাতের কথাবার্তা ও বনী ইসরাঈলের মুক্তির দাবী করতে দেখে ফেরাউন তাকে পাগল ঠাউরিয়েছিল। (কারণ, তার দৃষ্টিতে একটি গোলাম জাতির কোন ব্যক্তির পক্ষে তার মতো পরাক্রমশালী বাদশাহর সামনে এ ধরণের দুঃসাহস করা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।) এবং এই বলে ধমক দিচ্ছিল, তুমি যদি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য বলে মেনে নাও, তাহলে তোমাকে কারাগারে আটকে মারবো। আর এখন মাত্র এক মূহুর্ত পরে এ নিদর্শনগুলো দেখার সাথে সাথেই তার মধ্যে এমন ভীতির সঞ্চার হলো যে, নিজের বাদশাহী ও রাজ্য হারাবার ভয়ে সে ভীত হয়ে পড়লো এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রকাশ্য দরবারে নিজের অধস্তন কর্মচারীদের সামনে সে যে কেমন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে চলছে সে অনুভূতিই সে হারিয়ে ফেললো। বনী ইসরাঈলের মতো একটি নির্যাতিত-নিপীড়িত জাতির দু’টি লোক যুগের সবচেয়ে বড় শক্তিশালী বাদশাহর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের সাথে কোন লোক-লস্কর ছিলো না। তাদের জাতির মধ্যে কোন সক্রিয়তা ও প্রাণশক্তি ছিলো না। দেশের কোথাও বিদ্রোহের সামান্যতম আলামতও ছিলো না। দেশের বাইরে অন্য কোন রাষ্ট্রীয় শক্তিও তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিল না। এ অবস্থায় শুধুমাত্র একটি লাঠিকে সর্পে পরিণত হতে ও একটি হাতকে ঔজ্জ্বল্য বিকীরণ করতে দেখে অকস্মাৎ তার এই বলে চিৎকার করে ওঠা যে, এ দু’টি সহায়-সম্বলহীন লোক আমাকে সিংহাসনচ্যুত করবে এবং সমগ্র শাসক শ্রেণীকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বেদখল করে দেবে— একথার কি অর্থ হতে পারে? এ ব্যক্তি যাদুবলে এসব করে ফেলবে— একথা বলাও তার অত্যধিক হতবুদ্ধি হওয়ারই প্রমাণ। যাদুবলে দুনিয়ায় কখনো কোথাও কোন রাজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়নি, কোন দেশ বিজিত হয়নি, কোন যুদ্ধ জয়ও হয়নি। যাদুকররা তো তার নিজের দেশেই ছিল এবং তারা বড় বড় তেলেসমাতি দেখাতে পারতো। কিন্তু সে নিজে জানতো, ভেল্কিবাজীর খেলা দেখিয়ে পুরস্কার নেয়া ছাড়া তাদের আর কোন কৃতিত্ব নেই। রাজ্য তো দূরের কথা, সে বেচারারা তো রাজ্যের একজন সামান্য পুলিশ কনস্টেবলকেও চ্যালেঞ্জ করার হিম্মত রাখতো না।
# ফেরাউন যে অত্যধিক হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল, এ বাক্যাংশটি সে কথাই প্রকাশ করে। সে নিজেকে উপাস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিল এবং এদের সবাইকে করে রেখেছিল নিজের গোলাম। কিন্তু এখন উপাস্য সাহেব ভয়ের চোটে অস্থির হয়ে বান্দাদের কাছেই জিজ্ঞেস করছে তোমরা কি হুকুম দাও। অন্য কথায় বলা যায়, সে যেন বলতে চাচ্ছে, আমার বুদ্ধি তো এখন বিকল হয়ে গেছে, তোমরাই বলো আমি কিভাবে এ বিপদের মোকাবিলা করতে পারি।
# সূরা তা-হা-এ উল্লেখিত হয়েছে, কিবতীদের জাতীয় ঈদের দিনকে (يَوْمُ الزِّينَةِ) এ প্রতিদ্বন্দ্বীতার দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উৎসব ও মেলা উপলক্ষ্যে আগত সমস্ত লোকেরা এ বিরাট প্রতিযোগিতা দেখতে পাবে এটাই ছিল উদ্দেশ্য। এজন্য সময় নির্ধারিত করা হয়েছিল সূর্য আকাশে উঠে চারদিকে আলো ছড়িয়ে পড়ার পর। এভাবে প্রকাশ্যে দিবালোকে সবার চোখের সামনে উভয় পক্ষের শক্তির প্রদর্শনী হবে এবং আলোর অভাবে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হবার অবকাশ থাকবে না।
#শুধুমাত্র ঘোষণা ও বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করা হয়নি বরং জনগণকে উদ্দীপিত ও উত্তেজিত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখার জন্য ময়দানে হাজির করার উদ্দেশ্যে লোকও নিয়োগ করা হয়। এ থেকে জানা যায়, প্রকাশ্য দরবারে মূসা যেসব মু’জিযা দেখিয়েছিলেন সেগুলোর খবর সাধারণ লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং দেশের লোকেরা এতে প্রভাবিত হতে চলেছে বলে ফেরউনের মনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তাই সে চাচ্ছিল বেশী বেশী জনসমাগম হোক এবং লোকেরা দেখে নিক লাঠির সাপে পরিণত হওয়া কোন বড় কথা নয়, আমাদের দেশের প্রত্যেক যাদুকরও এ ভেল্কিবাজী দেখাতে পারে।
# এ বাক্যাংশটি প্রমাণ করছে যে, ফেরাউনের দরবারের যেসব লোক মূসার মু’জিযা দেখেছিল এবং দরবারের বাইরের যেসব লোকের কাছে এর নির্ভরযোগ্য খবর পৌঁছে গিয়েছিল, নিজেদের পিতৃপুরুষের ধর্মের উপর তাদের বিশ্বাসের ভিত নড়ে যাচ্ছিল এবং এখন মূসা আলাইহিস সালাম যে কাজ করেছেন তাদের যাদুকররাও কোনক্রমে তা করিয়ে দেখিয়ে দিক, এরই উপর তাদের ধর্মের টিকে থাকা নির্ভর করছিল। ফেরাউন ও তার রাজ্যের কর্মকর্তাগণ একে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকর মোকাবিলা মনে করছিল। তাদের প্রেরিত লোকেরা সাধারণ মানুষের মগজে এ চিন্তা প্রবেশ করাবার চেষ্টা করছিল যে, যাদুকররা যদি কামিয়াব হয়ে যায়, তাহলে মূসার ধর্ম গ্রহণ করার হাত থেকে আমরা বেঁচে যাবো, অন্যথায় আমাদের ধর্ম ও বিশ্বাসের অপমৃত্যু ঘটবে।
# এ ছিল মুশরিকী ধর্মের রক্ষকদের অবস্থা। মূসা আলাইহিস সালামের হামলা থেকে তারা নিজেদের ধর্মকে বাঁচাতে চাচ্ছিল। এজন্য চূড়ান্ত মোকাবিলার সময় তাদের মধ্যে যে পবিত্র আবেগের সঞ্চার হয়েছিল তা ছিল এই যে, তারা বাজী জিততে পারলে সরকার বাহাদুর থেকে কিছু পুরস্কার পাওয়া যাবে।
# আর এ ছিল সমকালীন বাদশাহর পক্ষ থেকে ধর্ম ও জাতির খিদমতগারদেরকে প্রদান করার মতো সবচেয়ে বড় ইনাম। অর্থাৎ কেবল টাকা পয়সাই পাওয়া যাবে না, দরবারে আসনও পাওয়া যাবে। এভাবে ফেরাউন ও তার যাদুকররা প্রথম পর্যায়েই নবী ও যাদুকরের বিরাট নৈতিক পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। একদিকে ছিল উন্নত মনোবল। বনী ইসরাঈলের মতো একটি নিগৃহীত জাতির এক ব্যক্তি দশ বছর যাবত নরহত্যার অভিযোগে আত্মগোপন করে থাকার পর ফেরাউনের দরবারে বুক টান করে এসে দাঁড়াচ্ছেন। নির্ভীক কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন, আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাকে পাঠিয়েছেন, বনী ইসরাঈলকে আমার হাতে সোপর্দ করে দাও। ফেরাউনের সাথে মুখোমুখি বিতর্ক করতে তিনি সামান্যতম সংকোচ অনুভব করছেন না। তার হুমকি ধমকিকে তিলার্ধও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। অন্যদিকে হীন মনোবলের প্রকাশ। বাপ-দাদার ধর্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে যাদুকরদেরকে ফেরাউনের দরবারেই ডেকে পাঠানো হচ্ছে। এরপরও হাত জোড় করে তারা বলছে, জনাব! কিছু ইনাম তো মিলবে? আর জবাবে অর্থ পুরস্কার ছাড়াও রাজ নৈকট্যও লাভ করা যাবে শুনে খুশীতে বাগেবাগ। নবী কোন্ প্রকৃতির মানুষ এবং তাঁর মোকাবিলায় যাদুকররা কেমন ধরনের লোক, এ দু’টি বিপরীত চরিত্র আপনা-আপনি একথা প্রকাশ করে দিচ্ছে। কোন ব্যক্তি নির্লজ্জতার সকল সীমালঙ্ঘন না করলে নবীকে যাদুকর বলার দুঃসাহস দেখাতে পারে না।
# এখানে এ আলোচনা বাদ দেয়া হয়েছে যে, হযরত মূসার মুখে এ ধরণের বাক্য উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই যখন যাদুকররা নিজেদের দড়িদড়া ও লাঠিসোঁটা ছুঁড়ে দিল তখন অকস্মাৎ সেগুলোকে বহু সাপের আকারে কিলবিল করতে করতে হযরত মূসার দিকে দৌঁড়ে যেতে দেখা গেলো। কুরআন মজীদের অন্যান্য স্থানে এর বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। সূরা আ’রাফে বলা হয়েছেঃ
فَلَمَّا أَلْقَوْا سَحَرُوا أَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ وَجَاءُوا بِسِحْرٍ عَظِيمٍ
“যখন তারা নিজেদের মন্ত্র নিক্ষেপ করলো তখন লোকদের দৃষ্টিকে যাদুগ্রস্থ করে দিল, সবাইকে আতংকিত করে ফেললো এবং বিরাট যাদু বানিয়ে নিল।”
সূরা তা-হা-এ এমন এক সময়ের চিত্র আঁকা হয়েছে যখনঃ
قَالَ بَلْ أَلْقُوا فَإِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى – فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُوسَى
“সহসা তাদের যাদুর ফলে হযরত মূসার মনে হলো যেন তাদের রশি ও লাঠিগুলো দৌঁড়ে চলে আসছে। এতে মূসা মনে মনে ভয় পেয়ে গেলো।”
# এটা হযরত মূসার মোকাবিলায় তাদের পক্ষ থেকে নিছক পরাজয়ের স্বীকৃতি ছিল না। ব্যাপারটা এমন ছিল না যে, কেউ বলতো, আরে ছেড়ে দাও, একজন বড় যাদুকর ছোট যাদুকরদেরকে হারিয়ে দিয়েছে। বরং তাদের সিজদাবনত হয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান আনা যেন প্রকাশ্যে সর্ব সম্মুখে হাজার হাজার মিসরবাসীর সামনে একথার স্বীকৃতি ও ঘোষণা দিয়ে দেয়া যে, যা কিছু এনেছেন তা আমাদের যাদু শিল্পের অন্তর্গত নয়, এ কাজ তো একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কুদরতেই হতে পারে।
# এখানে যেহেতু বক্তব্য পরম্পরার সাথে সম্পর্ক রেখে কেবলমাত্র এতটুকু দেখানো উদ্দেশ্য যে, কোন জেদী ও হঠকারী ব্যক্তি একটি সুস্পষ্ট মু’জিযা দেখার এবং তার মু’জিযা হবার সপক্ষে স্বয়ং যাদুকরদের সাক্ষ্য শুনার পরও কিভাবে তাঁকে যাদুকর আখ্যা দিয়ে যেতে থাকে, তাই ফেরাউনের শুধুমাত্র এতটুকু উক্তি এখানে উদ্ধৃত করাই যথেষ্ট বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু সূরা আ’রাফে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
إِنَّ هَذَا لَمَكْرٌ مَكَرْتُمُوهُ فِي الْمَدِينَةِ لِتُخْرِجُوا مِنْهَا أَهْلَهَا
“এ একটি ষড়যন্ত্র, যা তোমরা সবাই মিলে এ রাজধানী নগরে তৈরী করছো, যাতে এর মালিকদেরকে কর্তৃত্ব থেকে বেদখল করে দাও।”
এভাবে ফেরাউন সাধারণ জনতাকে একথা বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করে যে, যাদুকরদের এ ঈমান মু’জিযার কারণে নয় বরং এটি নিছক একটি যোগসাজশ। এখানে আসার আগে মূসার সাথে এদের এ মর্মে সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল যে, এখানে এসে এরা মূসার মোকাবিলায় পরাজয় বরণ করে নেবে এবং এর ফলে যে রাজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হবে তার সুফল এরা উভয় গোষ্ঠী মিলে ভোগ করবে।
# যাদুকররা আসলে মূসা আলাইহিস সালামের সাথে যোগসাজশ করে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল, নিজের এ অভিমতকে সফল করে তোলার জন্য ফেরাউন এ ভয়ংকর হুমকি দিয়েছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে এরা প্রাণ বাঁচাবার জন্য ষড়যন্ত্র স্বীকার করে নেবে এবং এর ফলে পরাজিত হবার সাথে সাথে তাদের সিজদাবনত হয়ে ঈমান আনার ফলে হাজার হাজার দর্শকের উপর যে নাটকীয় প্রভাব পড়েছিল তা নির্মূল হয়ে যাবে। এ দর্শকবৃন্দ স্বয়ং ফেরাউনের আমন্ত্রণে এ চূড়ান্ত মোকাবিলা উপভোগ করার জন্য সমবেত হয়েছিল। তার প্রেরিত লোকেরাই তাদেরকে এ ধারণা দিয়েছিল যে, মিসরীয় জাতির ধর্ম বিশ্বাস এখন এ যাদুকরদের সহায়তার উপর নির্ভরশীল রয়েছে। এরা সফলকাম হলে জাতি তার পূর্বপুরুষের ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবে, অন্যথায় মূসার দাওয়াতের সয়লাব তাকে ও তার সাথে ফেরাউনের রাজত্বকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
# আমাদের একদিন তো আমাদের রবের কাছে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। এখন যদি তুমি আমাদের হত্যা করো, তাহলে এর ফলে যেদিনটি আসবার ছিল সেটি আজ এসে যাবে, এর বেশী কিছু হবে না। এ অবস্থায় ভয় পাওয়ার প্রশ্ন কেন উঠবে? বরং উল্টো আমাদের তো মাগফেরাত পাওয়ার ও গোনাহ মাফের আশা আছে। কারণ আজ এখানে সত্য প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই আমরা তা মেনে নেবার ক্ষেত্রে এক মূহুর্তও দেরি করিনি এবং এ বিশাল সমাবেশে আমরাই প্রথমে অগ্রবর্তী হয়ে ঈমান এনেছি।
ফেরাউন ঢেঁড়া পিটিয়ে যে জনগোষ্ঠীকে সমবেত করেছিল তাদের সবার সামনে যাদুকরদের এ জবাব দু’টি কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেঃ
একঃ ফেরাউন একজন মহা মিথ্যুক, হটকারী ও প্রতারক। সে নিজে ফায়সালা করার জন্য যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলো তাতে মূসা আলাইহিস সালামের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বিজয়কে সোজাভাবে মেনে নেবার পরিবর্তে এখন সে সহসা একটি মিথ্যা ষড়যন্ত্রের গল্প ফেঁদে বসেছে এবং হত্যা ও শাস্তির হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক তার স্বীকৃতি আদায় করার চেষ্টা করছে। এ গল্প যদি সামান্যও সত্য হতো, তাহলে যাদুকররা হাত-পা কাটাবার ও শূলবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেবার জন্য এতো হন্যে হয়ে যেতো না। এ ধরণের কোন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যদি কোন রাজত্ব লাভের লোভ থেকে থাকতো, তাহলে এখন তো আর তার কোন অবকাশ নেই। কারণ রাজত্ব এখন যাদের ভাগ্যে আছে তারাই তা ভোগ করবে, এ ভাগ্যাহতরা এখন শুধুমাত্র নিহত হওয়া ও শাস্তি লাভ করার জন্য রয়ে গেছে। এ ভয়াবহ বিপদ মাথায় নিয়েও এ যাদুকরদের নিজেদের ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা পরিষ্কারভাবে একথা প্রমাণ করে যে, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সবৈর্ব মিথ্যা। বরং এক্ষেত্রে সত্য কথা হচ্ছে, যাদুকররা নিজেদের যাদুবিদ্যায় পারদর্শী হবার কারণে যথার্থই জানতে পেরেছে যে, মূসা আলাইহিস সালাম যা কিছু দেখিয়েছেন তা কোনক্রমেই যাদু নয় বরং প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কুদরতের প্রকাশ।
দুইঃ এ সময় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজার হাজার জনতার সামনে যে কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সেটি ছিল এই যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথেই এ যাদুকরদের চরিত্রে কেমন নৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়ে গেলো। ইতিপূর্বে তাদের অবস্থা ছিলঃ তারা পূর্বপুরুষদের ধর্মকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিল এবং এজন্য ফেরাউনের সামনে হাত জোড় করে ইনাম চাইছিল। আর এখন মুহূর্তের মধ্যে তাদের হিম্মত ও সংকল্পের বলিষ্ঠতা এমনি উন্নত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যার ফলে সেই ফেরাউন তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল, তার সমগ্র রাজশক্তিকে তারা হেয় প্রতিপন্ন করেছিল এবং নিজেদের ঈমানের খাতিরে মৃত্যু ও নিকৃষ্টতম শারীরিক শাস্তি বরদাশত করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। এ নাজুক মনস্তাত্বিক পরিবেশে মিসরীয়দের মুশরীকি ধর্মের লাঞ্ছনা এবং মূসা আলাইহিস সালাম প্রচারিত সত্য দ্বীনের বলিষ্ঠ প্রচারণা সম্ভবত এর চাইতে বেশী আর হতে পারতো না।
# ওপরে বর্ণিত ঘটনার পর হিজরতের কথা শুরু করার কারণে কারোর মনে এ ভুল ধারণা সৃষ্টি হওয়া উচিত নয় যে, এর পর পরই হযরত মূসাকে বনী ইসরাঈল শহর মিসর থেকে বের হয়ে আসার হুকুম দেওয়া হয়। আসলে এখানে মাঝখানে কয়েক বছরের ইতিহাস আলোচনা করা হয়নি। সূরা আ’রাফের ১৫-১৬ এবং সূরা ইউনুসের ৯ রুকু’ তে এ আলোচনা এসেছে। এর একটি অংশ সামনের দিকে সূরা মু’মিনের ২ থেকে ৫ ও সূরা যুখরুফের ৫ রুকু’তেও আসছে। এখানে যেহেতু বক্তব্য পরম্পরার সাথে সম্পর্ক রেখে সুস্পষ্ট নিদর্শনাসমূহ দেখে নেবার পরও যে ফেরাউন হঠকারিতার পথ অবলম্বন করেছিল তার পরিণতি কি হয়েছিল? এবং যে দাওয়াতের পেছনে আল্লাহর শক্তি নিয়োজিত ছিল তা কিভাবে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল সে কথা বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য, তাই ফেরাউন ও হযরত মূসা সংঘাতের প্রাথমিক পর্যায় বর্ণনা করার পর এখন ঘটনা সংক্ষেপ করে এর শুধুমাত্র শেষ দৃশ্য দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
# উল্লেখ্য, বনী ইসরাঈলের জনবসতি মিসরের কোন এক জায়গায় একসাথে ছিল না। বরং দেশের সমস্ত শহরে ও পল্লীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। বিশেষ করে মামফিস (MAMPHIS) থেকে রামসীস পর্যন্ত এলাকায় তাদের বৃহত্তর অংশ বাস করতো। এ এলাকা জুশান নামে পরিচিত ছিল। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আ’রাফ, বনী ইসরাঈলের নির্গমন পথের নকশা) কাজেই হযরত মূসাকে যখন হুকুম দেওয়া হয়েছিল যে, তোমাকে এবার বনী ইসরাঈলকে নিয়ে মিসর থেকে বের হয়ে যেতে হবে, তখন সম্ভবত তিনি দেশের সমস্ত বনী ইসরাঈলী বসতিতে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে হিজরত করার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য হয়তো একটি রাত নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। সে রাতে প্রত্যেক জনপদের মুহাজিরদের বের হয়ে পড়তে হবে। রাতের বেলা হিজরত করার জন্য বের হবার নির্দেশ কেন দেয়া হয়েছিল “তোমাদের পিছু নেয়া হবে” উক্তি থেকে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অর্থাৎ ফেরাউনের সেনাবাহিনী তোমাদের পিছনে ধাওয়া করার আগে রাতের মধ্যে তোমরা নিজেদের পথে অন্তত এতদূর অগ্রসর হয়ে যাওয়ার ফলে তারা অনেক পিছনে পড়ে যায়।
# একথাগুলো ফেরাউনের মনের গোপন ভীতি প্রকাশ করে। লোক দেখানো নির্ভীকতার মোড়কে সেই ভীতিকে সে ঢেকে রেখেছিল। একদিকে তাৎক্ষণিক সাহায্যের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে সে সৈন্য তলব করছিল। এ থেকে মনে হয় যে, সে বনী ইসরাঈলের দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা করছিল। অন্যদিকে আবার একথাটিও গোপন করতে চাচ্ছিল যে, একটি দীর্ঘকালের নিগৃহীত-নিষ্পেষিত এবং চরম লাঞ্ছনা ও দাসত্বের জীবন যাপনকারী জাতির দিক থেকে ফেরাউনের মতো মহাশক্তিধর শাসক কোন আশঙ্কা অনুভব করছে, এমনকি ত্বরিত সাহায্যের জন্য সেনাবাহিনী তলব করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই নিজের বার্তা সে এমনভাবে পাঠাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে, বেচারা বনী ইসরাঈল তো সামান্য ব্যাপার মাত্র, মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক, তারা আমাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না কিন্তু তারা এমন সব কাজ করেছে যা আমাদের ক্রোধ উৎপাদন করেছে। তাই আমরা তাদেরকে শাস্তি দিতে চাই। কোন আশঙ্কার কারণে আমরা সেনা সমাবেশ করছি না। বরং এটি নিছক একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ মাত্র। বিপদের কোন দূরতম সম্ভাবনা হলেও যথাসময়ে তার মূলোৎপাটনে প্রস্তুত থাকাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
# ফেরাউনের মতে দূরতম এলাকা থেকে সেনাবাহিনী তলব করে বনী ইসরাঈলকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করে সে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। কিন্তু আল্লাহ এমন ব্যবস্থা অবলম্বন করলেন যার ফলে তার নিজের কৌশলে সে নিজেই ফেঁসে গেলো। অর্থাৎ ফেরাউনী রাজ্যের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তারা নিজ নিজ জায়গা ছেড়ে এমন এক জায়গায় সমবেত হলো যেখানে তাদের সবাইকে এক সাথে সলিল সমাধি লাভ করতে হবে। যদি তারা বনী ইসরাঈলের পিছু না নিতো, তাহলে এর ফল কেবল এতটুকুই হতো যে, একটি জাতি দেশ ত্যাগ করে চলে যেতো। এর চেয়ে বেশী তাদের আর কোন ক্ষতি হতো না, ফলে তারা আগের মতো বিলাস কুঞ্জে বসে আয়েশী জীবন যাপন করতো। কিন্তু তারা বুদ্ধিমত্তার পরম পরাকাষ্ঠা দেখানোর জন্য বনী ইসরাঈলকে নিরাপদে চলে না যেতে দেবার ফায়সালা করলো। শুধু তাই নয়, মুহাজির কাফেলাগুলোর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে চিরকালের জন্য তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইলো। এ উদ্দেশ্যে তাদের শাহজাদাবৃন্দ, বড় বড় সরদার ও রাজকর্মচারীরা তাদের শক্তিমদমত্ত বাদশাহকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের প্রাসাদসমূহ থেকে বের হয়ে পড়লো। তাদের এহেন বুদ্ধিমত্তার এ দ্বিবিধ ফলও দেখা গেলো যে, বনী ইসরাঈল মিসর থেকে বের হয়েও গেলো আবার মিসরের জালেম ফেরাউনী সাম্রাজ্যের প্রধান জনশক্তি (cream) সাগরে বিসর্জিত হলো।
# কোন কোন তাফসীরকার এ আয়াতের অর্থ এভাবে গ্রহণ করেছেনঃ যেসব উদ্যান, নদী, ধনভাণ্ডার ও উন্নত আবাসগৃহ ত্যাগ করে এ জালেমরা বের হয়েছিল মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে সেগুলোরই ওয়ারিশ বানিয়ে দেন। এ অর্থ যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, ফেরাউনের ডুবে মরার পর বনী ইসরাঈল আবার মিসরে পৌঁছে যাবে এবং ফেরাউনের বংশধরদের সমস্ত ধন-দৌলত এবং শক্তি, পরাক্রম ও গৌরবের অধিকারী হবে। কিন্তু এ জিনিসটি প্রথমত ইতিহাস থেকেও প্রমাণিত নয় এবং দ্বিতীয়ত কুরআনের অন্যান্য জায়গায় বিস্তারিত বিবরণও আয়াতের এ অর্থ গ্রহণের অনুকূল নয়। সূরা বাকারাহ, মায়েদাহ, আ’রাফ ও তা-হা-তে যে ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা হয়েছে তা থেকে পরিষ্কার জানা যায়, ফেরাউনের ডুবে মরার পর বনী ইসরাঈল মিসরে ফিরে আসার পরিবর্তে নিজেদের অভীষ্ট মনজিলের (ফিলিস্তীন) দিকেই এগিয়ে যেতে থাকে। তারপর থেকে দাউদের আমল (খৃঃ পূঃ ৯০৩-১০১৩) পর্যন্ত তাদের ইতিহাসের সব ঘটনাই আজকের পৃথিবীতে সিনাই উপদ্বীপ, উত্তর আরব, পূর্ব জর্দান (ট্রান্সজর্ডান) ও ফিলিস্তীন নামে পরিচিত এলাকায় ঘটেছে। তাই এর সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহ একদিকে ফেরাউনের বংশধরদেরকে এসব নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করেন এবং অন্যদিকে বনী ইসরাঈলকে এসব নিয়ামতই দান করেন। অর্থাৎ তারা ফিলিস্তীন ভূখণ্ডে বাগ-বাগীচা, নদ-নদী, ধনভাণ্ডার ও উত্তম আবাসিক ভবন সমূহের অধিকারী হয়। সূরা আরাফের নিন্মোক্ত আয়াতে এ ব্যাখ্যার প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়ঃ
فَانْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ فِي الْيَمِّ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَكَانُوا عَنْهَا غَافِلِينَ – وَأَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِينَ كَانُوا يُسْتَضْعَفُونَ مَشَارِقَ الْأَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا
“তখন আমি তাদের থেকে প্রতিশোধ নিলাম এবং তাদেরকে সাগরে ডুবিয়ে দিলাম। কারণ তারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা আখ্যায়িত করেছিল এবং তা থেকে বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। আর তাদের পরিবর্তে আমি যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তাদেরকে এমন একটি দেশের পূর্ব ও পশ্চিমের ওয়ারিস বানিয়ে দিলাম যাকে আমি সমৃদ্ধিতে ভরে দিয়েছিলাম।” ( ১৩৬-১৩৭ আয়াত )
এ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ দেশের উপমা কুরআন মজীদে সাধারণত ফিলিস্তীনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যখন কোন এলাকার নাম না নিয়ে এ গুণটি বর্ণনা করা হয় তখন এ থেকে এ এলাকার কথা বলা হয়েছে বলে মনে করা হয়। যেমন সূরা বনী ইসরাঈলে বলা হয়েছেঃ إِلَىالْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ এবং সূরা আম্বিয়ায়ে বলা হয়েছেঃ
وَنَجَّيْنَاهُ وَلُوطًا إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا لِلْعَالَمِينَ
আরো বলা হয়েছেঃ
وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ عَاصِفَةً تَجْرِي بِأَمْرِهِ إِلَى الْأَرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا এভাবে সূরা সাবা-এ বলা হয়েছে الْقُرَى الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا
এ সবগুলো আয়াতে বরকত শব্দ ফিলিস্তীনের জনপদগুলোর সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়েছে।
# মূলে كَالطَّوْدِ الْعَظِيمِ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় বড় পাহাড়কে طود বলা হয়। লিসানুল আরব গ্রন্থে বলা হয়েছে الطود – الجبل العظيم অর্থাৎ ‘তওদ’ মানে বিশাল পাহাড়। কাজেই এর পরে আবার عظيم গুণবাচক শব্দটি ব্যবহার করার অর্থ দাঁড়ায়— পানি উভয় দিকে খুব উঁচু উঁচু পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর আমরা এ বিষয়টিও চিন্তা করি যে, মূসার লাঠির আঘাতে সমুদ্রে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। এ কাজটি একদিকে বনী ইসরাঈলের সমগ্র কাফেলাটির সাগর অতিক্রম করার জন্য করা হয়েছিল এবং অন্যদিকে এর উদ্দেশ্য ছিল ফেরাউনের সমস্ত সৈন্য সামন্তকে ডুবিয়ে দেয়া। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, লাঠির আঘাতে পানি বিশাল উঁচু পাহাড়ের আকারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এবং এতটা সময় পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল, যতটা সময় লেগেছিল হাজার হাজার লাখো লাখো বনী ইসরাঈল তার মধ্য দিয়ে সাগর অতিক্রম করতে। তারপর ফেরাউনের সমগ্র সেনাবাহিনী তার মাঝখানে পৌঁছে গিয়েছিল। একথা সুস্পষ্ট, সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মে যে ঝড়ো বাতাস প্রবাহিত হয় তা যতই তীব্র ও বেগবান হোক না কেন তার প্রভাবে কখনো সাগরের পানি এভাবে বিশাল পাহাড়ের মতো এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকে না। এরপর আরো সূরা তা-হা-এ বলা হয়েছেঃ
فَاضْرِبْ لَهُمْ طَرِيقًا فِي الْبَحْرِ يَبَسًا
“তাদের জন্য সমুদ্রের বুকে শুকনো পথ তৈরী করে দাও।”
এর অর্থ দাঁড়ায়, সাগরের উপর লাঠির আঘাত করার কারণে কেবল সাগরের পানি ফাঁক হয়ে গিয়ে দু’দিকে পাহাড় সমান উঁচু হয়ে যায়নি বরং মাঝখানে যে পথ বের হয় তা শুকনো খটখটেও হয়ে যায় এবং কোথাও এমন কোন কাদা থাকেনি যার উপর দিয়ে হেঁটে চলা সম্ভব নয়। এ সঙ্গে সূরা দু’খানের ২৪ আয়াতের এ শব্দগুলোও প্রণিধানযোগ্য যেখানে আল্লাহ মূসাকে নির্দেশ দেন, সমুদ্র অতিক্রম করার পর “তাকে এ অবস্থার উপর ছেড়ে দাও, ফেরাউনের সেনাদল এখানে নিমজ্জিত হবে।” এ থেকে বুঝা যায় যে, মূসা সমুদ্রের অপর পাড়ে উঠে যদি সমুদ্রের উপর লাঠির আঘাত করতেন, তাহলে উভয় দিকে খাড়া পানির দেয়াল ভেঙ্গে পড়তো এবং সাগর সমান হয়ে যেতো। তাই আল্লাহ তাঁকে এরূপ করতে নিষেধ করেন, যাতে ফেরাউনের সেনাদল এ পথে নেমে আসে এবং তারপর পানি দু’দিক থেকে এসে তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়। এটি একটি সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন মু’জিযার বর্ণনা। যারা সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মের আওতায় এ ঘটনাটির ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন তাদের চিন্তার গলদ এ থেকে একেবারেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়।