أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯৯)
[মুশরিকদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে যদিও নিকটাত্মীয় হয়।]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৬:শুআরা
পারা:১৯
৬৯-১০৪ নং আয়াত:-
২৬:৬৯
وَ اتۡلُ عَلَیۡہِمۡ نَبَاَ اِبۡرٰہِیۡمَ ﴿ۘ۶۹﴾
ওদের নিকট ইব্রাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর।
২৬:৭০
اِذۡ قَالَ لِاَبِیۡہِ وَ قَوۡمِہٖ مَا تَعۡبُدُوۡنَ ﴿۷۰﴾
যখন তিনি তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, ‘তোমরা কিসের ইবাদাত করা?’
২৬:৭১
قَالُوۡا نَعۡبُدُ اَصۡنَامًا فَنَظَلُّ لَہَا عٰکِفِیۡنَ ﴿۷۱﴾
ওরা বলল, ‘আমরা প্রতিমার পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে ওদের পূজায় নিরত থাকি।’
২৬:৭২
قَالَ ہَلۡ یَسۡمَعُوۡنَکُمۡ اِذۡ تَدۡعُوۡنَ ﴿ۙ۷۲﴾
সে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা যখন তাদেরকে ডাকো তখন কি তারা তোমাদের কথা শোনে?
২৬:৭৩
اَوۡ یَنۡفَعُوۡنَکُمۡ اَوۡ یَضُرُّوۡنَ ﴿۷۳﴾
অথবা ওরা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে?’
২৬:৭৪
قَالُوۡا بَلۡ وَجَدۡنَاۤ اٰبَآءَنَا کَذٰلِکَ یَفۡعَلُوۡنَ ﴿۷۴﴾
তারা জবাব দিল, “না, বরং আমরা নিজেদের বাপ-দাদাকে এমনটিই করতে দেখেছি।”
২৬:৭৫
قَالَ اَفَرَءَیۡتُمۡ مَّا کُنۡتُمۡ تَعۡبُدُوۡنَ ﴿ۙ۷۵﴾
ইবরাহীম বললেন, ‘তোমরা কি ভাবে দেখেছ, যাদের ‘ইবাদাত তোমরা করে থাক,
২৬:৭৬
اَنۡتُمۡ وَ اٰبَآؤُکُمُ الۡاَقۡدَمُوۡنَ ﴿۫ۖ۷۶﴾
তোমরা এবং তোমাদের অতীতের পিতৃপুরুষেরা?
২৬:৭৭
فَاِنَّہُمۡ عَدُوٌّ لِّیۡۤ اِلَّا رَبَّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۷۷﴾
বিশ্বজগতের প্রতিপালক ব্যতীত তারা সকলেই আমার শত্রু।
২৬:৭৮
الَّذِیۡ خَلَقَنِیۡ فَہُوَ یَہۡدِیۡنِ ﴿ۙ۷۸﴾
যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাকে পথপ্রদর্শন করেন।
২৬:৭৯
وَ الَّذِیۡ ہُوَ یُطۡعِمُنِیۡ وَ یَسۡقِیۡنِ ﴿ۙ۷۹﴾
তিনিই আমাকে খাওয়ান এবং তিনিই আমাকে পান করান।
২৬:৮০
وَ اِذَا مَرِضۡتُ فَہُوَ یَشۡفِیۡنِ ﴿۪ۙ۸۰﴾
এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন;
২৬:৮১
وَ الَّذِیۡ یُمِیۡتُنِیۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡنِ ﴿ۙ۸۱﴾
তিনি আমাকে মৃত্যু দান করবেন এবং পুনর্বার আমাকে জীবন দান করবেন।
২৬:৮২
وَ الَّذِیۡۤ اَطۡمَعُ اَنۡ یَّغۡفِرَ لِیۡ خَطِیۡٓئَتِیۡ یَوۡمَ الدِّیۡنِ ﴿ؕ۸۲﴾
তাঁর কাছে আমি আশা করি, প্রতিদান দিবসে তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন।”
২৬:৮৩
رَبِّ ہَبۡ لِیۡ حُکۡمًا وَّ اَلۡحِقۡنِیۡ بِالصّٰلِحِیۡنَ ﴿ۙ۸۳﴾
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত কর।
২৬:৮৪
وَ اجۡعَلۡ لِّیۡ لِسَانَ صِدۡقٍ فِی الۡاٰخِرِیۡنَ ﴿ۙ۸۴﴾
আর পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আমার সত্যিকার খ্যাতি ছড়িয়ে দিও।
২৬:৮৫
وَ اجۡعَلۡنِیۡ مِنۡ وَّرَثَۃِ جَنَّۃِ النَّعِیۡمِ ﴿ۙ۸۵﴾
এবং আমাকে নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো।
২৬:৮৬
وَ اغۡفِرۡ لِاَبِیۡۤ اِنَّہٗ کَانَ مِنَ الضَّآلِّیۡنَ ﴿ۙ۸۶﴾
‘আর আমার পিতাকে ক্ষমা করুন, তিনি তো পথভ্রষ্টদের শামিল ছিলেন।
২৬:৮৭
وَ لَا تُخۡزِنِیۡ یَوۡمَ یُبۡعَثُوۡنَ ﴿ۙ۸۷﴾
এবং সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না যেদিন সবাইকে জীবিত করে উঠানো হবে,
২৬:৮৮
یَوۡمَ لَا یَنۡفَعُ مَالٌ وَّ لَا بَنُوۡنَ ﴿ۙ۸۸﴾
‘যে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না;
২৬:৮৯
اِلَّا مَنۡ اَتَی اللّٰہَ بِقَلۡبٍ سَلِیۡمٍ ﴿ؕ۸۹﴾
‘সে দিন উপকৃত হবে শুধু সে, যে আল্লাহ্র কাছে আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে।’
২৬:৯০
وَ اُزۡلِفَتِ الۡجَنَّۃُ لِلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿ۙ۹۰﴾
–(সেদিন) জান্নাত মুত্তাকীদের কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে।
২৬:৯১
وَ بُرِّزَتِ الۡجَحِیۡمُ لِلۡغٰوِیۡنَ ﴿ۙ۹۱﴾
এবং জাহান্নাম পথভ্রষ্টদের সামনে খুলে দেয়া হবে।
২৬:৯২
وَ قِیۡلَ لَہُمۡ اَیۡنَمَا کُنۡتُمۡ تَعۡبُدُوۡنَ ﴿ۙ۹۲﴾
আর তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা যাদের ইবাদাত করতে তারা এখন কোথায়?
২৬:৯৩
مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ؕ ہَلۡ یَنۡصُرُوۡنَکُمۡ اَوۡ یَنۡتَصِرُوۡنَ ﴿ؕ۹۳﴾
আল্লাহর পরিবর্তে? ওরা কি তোমাদের সাহায্য করতে আসবে? না ওরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম?’
২৬:৯৪
فَکُبۡکِبُوۡا فِیۡہَا ہُمۡ وَ الۡغَاوٗنَ ﴿ۙ۹۴﴾
অতঃপর ওদের এবং পথভ্রষ্টদের অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে,
২৬:৯৫
وَ جُنُوۡدُ اِبۡلِیۡسَ اَجۡمَعُوۡنَ ﴿ؕ۹۵﴾
আর ইবলীসের বাহিনীর সবাইকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে।
২৬:৯৬
قَالُوۡا وَ ہُمۡ فِیۡہَا یَخۡتَصِمُوۡنَ ﴿ۙ۹۶﴾
তারা সেখানে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে বলবে,
২৬:৯৭
تَاللّٰہِ اِنۡ کُنَّا لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿ۙ۹۷﴾
‘আল্লাহর শপথ! আমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিলাম,
২৬:৯৮
اِذۡ نُسَوِّیۡکُمۡ بِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۹۸﴾
যখন তোমাদের দিচ্ছিলাম রব্বুল আলামীনের সমকক্ষের মর্যাদা।
২৬:৯৯
وَ مَاۤ اَضَلَّنَاۤ اِلَّا الۡمُجۡرِمُوۡنَ ﴿۹۹﴾
আর এ অপরাধীরাই আমাদেরকে ভ্রষ্টতায় লিপ্ত করেছে।
২৬:১০০
فَمَا لَنَا مِنۡ شَافِعِیۡنَ ﴿۱۰۰﴾ۙ
এখন আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই!
২৬:১০১
وَ لَا صَدِیۡقٍ حَمِیۡمٍ ﴿۱۰۱﴾
এবং কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুও নেই।
২৬:১০২
فَلَوۡ اَنَّ لَنَا کَرَّۃً فَنَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۰۲﴾
হায় যদি আমাদের আবার একবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ মিলতো, তাহলে আমরা মু’মিন হয়ে যেতাম।”
২৬:১০৩
اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً ؕ وَ مَا کَانَ اَکۡثَرُہُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۰۳﴾
নিঃসন্দেহে এর মধ্যে একটি বড় নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু এদের অধিকাংশ মুমিন নয়।
২৬:১০৪
وَ اِنَّ رَبَّکَ لَہُوَ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ﴿۱۰۴﴾٪
আর প্রকৃতপক্ষে তোমার রব পরাক্রমশালীও এবং করুণাময়ও।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলোচনা (৬৯-১০৪) : ফেরাউন, তার দলবল ও হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনী ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। সেই কাহিনীতে ফেরাউনের চরম পরিণতির উল্লেখ রয়েছে। তাতে দুর্বল মােমনদের জন্যে সুসংবাদ হয়েছে। মক্কায় রাসূল(স.)-এর আমলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অবস্থা তাদের মতােই ছিলাে। মক্কার যেসব অত্যাচারী ফ্যাসিবাদী মােশরেকরা ফেরাউনের মতাে আচরণ করে, তাদের ধ্বংসের বার্তাও সে কাহিনীতে ঘােষিত হয়েছে। এবার সে কাহিনীর পর আসছে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনী। রসুল(স.)-কে আদেশ দেয়া হচ্ছে যেন এই কাহিনী মােশরেকদেরকে শােনান। কেননা তারা দাবী করে থাকে যে, তারা হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর উত্তরাধিকারী ও তার আনীত আদি ও আসল ধর্মের অনুসারী। অথচ তারা আল্লাহর সাথে শরীক করে এবং যে পবিত্র ঘর হযরত ইবরাহীম(আ.) একমাত্র আল্লাহর এবাদাতের জন্যে নির্মাণ করেছেন, সেই ঘরের ভেতরে তারা পূজা করার উদ্দেশ্যে মূর্তি স্থাপন করে। আয়াতে বলা হয়েছে, তাদেরকে হযরত ইবরাহীমের কাহিনী জানিয়ে দাও’, যাতে তাদের দাবীর অসারতা প্রমাণিত হয়। এই সূরার কাহিনীগুলােতে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়নি। কেননা এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলাে শিক্ষা। তবে সূরা আ’রাফ প্রভৃতিতে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য, যাতে হযরত আদম(আ.)-এর সময় থেকে পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ ও নবীদের আগমনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরা যায়। এ জন্যে সেসব সূরায় হযরত আদম(আ.)-এর বেহেশত থেকে অবতরণ ও পৃথিবীতে মানব জীবনের সূচনা থেকে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনীর যে অংশটা আলােচিত হয়েছে, তা হলাে তার জাতির কাছে তার রসূল হিসাবে আর্বিভূত হওয়া, তাদের সাথে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস নিয়ে তার আলােচনা, তথাকথিত দেব-দেবীর উপাসনাকে তার প্রত্যাখ্যান, একমাত্র আল্লাহর এবাদাত করার ওপর তার গুরুত্ব আরােপ ও আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া সংক্রান্ত। এরপরই তুলে ধরা হয়েছে কেয়ামতের পূর্ণাংগ চিত্র। এই চিত্রে দেখানাে হয়েছে যে, দেব-দেবীর পূজারীরা তাদেরকে সেদিন অস্বীকার করবে এবং যে শিরকের কারণে তাদের অমন শোচনীয় পরিণতি হয়েছে তার জন্যে তারা অনুশােচনা করবে। মােশরেকদের জন্যে এ কাহিনীতে যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে তা এখানে আলােচিত হয়েছে। এ জন্যে তাওহীদ বিশ্বাসের যথার্থতা, শিরকের অসারতা এবং কেয়ামতের দিন মােশরেকদের শােচনীয় পরিণতি বিশদভাবে আলােচনা করা হয়েছে। কেননা এগুলােই এর কেন্দ্রীয় আলােচ্য বিষয়। এ ছাড়া অন্য যেসব বিষয় আনুষংগিকভাবে এসেছে, তা এখানে সংক্ষেপে ও অন্যান্য সুরায় বিস্তারিতভাবে এসেছে। হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনীর কিছু কিছু অংশ সূরা বাকারায়, আনয়ামে, হুদে, ইবরাহীম, হিজরে, মারিয়ামে, আম্বিয়ায়, ও হজ্জে আলােচিত হয়েছে। প্রত্যেক সূরায় সে সূরার সাধারণ আলােচনার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই আলােচ্যসূচী স্থির করা হয়েছে এবং সূরার বক্তব্য, প্রেক্ষাপট ও শিক্ষার সাথে সংগতিশীল বিষয়ই তুলে ধরা হয়েছে। সূরা বাকারায় এসেছে তিনি ও তার পুত্র ইসমাঈল কর্তৃক কাবা শরীফের নির্মাণের কথা, পবিত্র মক্কা নগরীকে নিরাপদ ও শান্তি পূর্ণ নগরীতে পরিণত করার জন্যে আল্লাহর কাছে তার দোয়ার বিবরণ এবং এই মর্মে তার ঘােষণা যে, কা’বা শরীফ ও তার নির্মাতার উত্তরাধিকার একমাত্র তার আনীত ধর্মের অনুসারী মুসলমানদের জন্যেই নির্দিষ্ট- যারা কেবল তার বংশধর হওয়ার সুবাদে তার উত্তরাধিকারী হওয়ার দাবী করে তাদের জন্যে নয়। বনী ইসরাঈলের পথভ্রষ্টতা, তাদের অভিশপ্ত ও বিতাড়িত হওয়া এবং হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর আনীত ধর্ম ও তার নির্মিত ঘরকে মুসলমানদের উত্তরাধিকাররূপে চিহ্নিত করার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি সে ঘােষণা দিয়েছিলেন। সুরা বাকারায় কাহিনীর এ অংশটাও আলােচিত হয়েছে যে, তার সমসাময়িক কাফের বাদশার সাথে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তার বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। মহান আল্লাহ তায়ালা যে জীবিতকে মৃত ও মৃতকে জীবিত করতে পারেন, সে সম্পর্কে সে বাদশাহ বিতর্ক তুললে তিনি তাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা পূর্বদিক থেকে সূর্য উদিত করেন, তুমি ওটা পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও। এই চ্যালেঞ্জে কাফের বাদশাহ পরাজিত ও হতবাক হয়ে গিয়েছিলাে। সূরা বাকারায় আরাে আলােচিত হয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যে, তিনি কিভাবে মৃতকে জীবন দান করেন, এটা যেন তিনি তাকে দেখান। আল্লাহ তায়ালা এই আবেদনের জবাবে তাকে চারটি পাখী যবাই করা এবং সে চারটে পাখীর দেহের বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার আদেশ দেন। তারপর সেগুলােকে তার সামনেই জীবিত করেন এবং জীবিত হয়ে পাখীগুলাে তার কাছে ছুটে আসে। সে সূরায় এই উভয় কাহিনীই আল্লাহর নিদর্শনাবলী এবং তার জীবিতকে মৃত করা ও মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা সংক্রান্ত আলােচনা প্রসংগেই বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে সূরা আনয়াম এসেছে তার আল্লাহ তায়ালা সংক্রান্ত তত্ত্বানুসন্ধান এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ও প্রকৃতির নিদর্শনাবলী সম্পর্কে তার গভীর চিন্তা গবেষণার পর অবশেষে আল্লাহর সন্ধান লাভের কাহিনী। সমগ্র সূরাটা ইসলামের শাশ্বত আকীদা বিশ্বাস, বিশ্ব প্রকৃতিতে বিরাজমান আল্লাহর নিদর্শনাবলী এবং এসবগুলাে দ্বারা সারা বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়া সংক্রান্ত আলােচনায় ভরপুর। সূরা হুদে এসেছে হযরত ইবরাহীম(আ.)-কে ইসহাক নামক পুত্রের সুসংবাদ দানের কাহিনী। আর এটা লূত(আ.)-এর কাহিনী প্রসংগে এবং হযরত লূত(আ.)-এর জনপদ ধ্বংস করার আদেশপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সংঘটিত হয়েছিলাে। এতে দেখানাে হয়েছে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে কতো সাহায্য করেন এবং পাপিষ্ঠদেরকে কিভাবে ও কোন পর্যায়ে গিয়ে ধ্বংস করেন। সূরা ইবরাহীমে দেখানাে হয়েছে, হযরত ইবরাহীম আল্লাহর পবিত্র ঘরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে সেই উষর মরুভূমিতে নিজের যে বংশধর ও পরিবারকে তিনি সে দেশের অধিবাসী করেছেন তাদের জন্যে দোয়া করছেন। বুড়াে বয়সে তাকে ইসহাক ও ইসমাঈল(আ.)-এর ন্যায় সন্তান দানের জন্যে আল্লাহর প্রশংসা করছেন, নিজেকে ও নিজের বংশধরকে নামায কায়েমকারী বানানাের জন্যে তার দোয়া কবুল করার জন্যে এবং কেয়ামতের দিন তাকে ও তার পিতামাতাকে ক্ষমা করার জন্যে কাকুতি মিনতি করে আবেদন জানাচ্ছেন। সমগ্র সূরায় সকল নবীর উম্মতকে একই আদর্শ তাওহীদের পতাকাবাহী হিসেবে এবং নবীদেরকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের সকলকে একই কাতারে দেখানাে হয়েছে। যে নবুয়ত ও রিসালাত হচ্ছে কুফরের উষর মরুতে একমাত্র ছায়াদানকারী বৃক্ষ। সূরা আল হিজরে সূরা হুদে বর্ণিত অংশটাই কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। সেই সাথে আল্লাহর মােমেন বান্দাদের প্রতি তার রহমত ও অবাধ্য বান্দাদের প্রতি তার গযব ও শাস্তির বিবরণ দেয়া হয়েছে। সূরা মারিয়ামে এসেছে বিনয়ের সাথে হযরত ইবরাহীম(আ.) কর্তৃক পিতাকে ইসলামের দাওয়াত দান, পিতা কর্তৃক কঠোরভাবে তা প্রত্যাখ্যান, অতপর তার পক্ষ থেকে পিতা ও সমগ্র জাতির সংশ্রব বর্জন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে ইসমাঈল ও ইসহাকের ন্যায় সুপুত্র দানের বিবরণ। এই সূরায় দেখানাে হয়েছে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের প্রতি কতাে স্নেহ মমতা ও দয়ার আচরণ করেন। সমগ্র সূরায় দয়া, মমত্ব ও প্রীতির ভাবধারা ফুটে উঠেছে। সূরা আম্বিয়ায় পেশ করা হয়েছে তার পক্ষ থেকে তার পিতা ও জাতিকে তাওহীদের দাওয়াত দান, মূর্তিপূজার সমালােচনা, মূর্তিগুলাে ভেঙ্গে ফেলা, তাকে আগুনে নিক্ষেপ করণ, আল্লাহর আদেশে আগুন ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ও শান্তির উপকরণে পরিণত হওয়া, তার ও তার ভাইয়ের ছেলে লূতের আল্লাহর আযাব থেকে অব্যাহতি লাভ এবং উভয়ের কল্যাণময় ভূখন্ডে হিজরতের বিবরণ। সেই সাথে সঠিক আলােচনা এসেছে সকল নবীর উম্মতদের তাওহীদের অনুসারী হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে এক আল্লাহর এবাদাতের প্রেরণা দান প্রসংগে। আর সূরা হজ্জে এসেছে তাওয়াফ কারী ও এতেকাফকারীদের জন্যে আল্লাহর ঘরকে পবিত্র করার জন্যে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর প্রতি আল্লাহর আদেশের বিবরণ।
*মােশরেকদের সাথে ইব্রাহীম(আ.)-এর কথপােকথন : তাদেরকে ইবরাহীমের কাহিনী শুনিয়ে দাও। ‘ইবরাহীম যখন তার পিতা ও জাতিকে বললাে, তােমরা কিসের এবাদাত করছ?’ আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূল মােহাম্মদ(স.) কে আদশে দিচ্ছেন যে, মক্কার মােশরেকদের সামনে সেই ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনী পাঠ করে শােনাও, যার উত্তরাধিকারী বলে ও তার আনীত ধর্মের অনুসারী বলে তারা নিজেদেরকে দাবী করে থাকে। অথচ ইবরাহীম(আ.) তার জাতির মূর্তি পূজার ঘাের বিরােধী ও কঠোর সমালােচক ছিলেন। আর আজকের মক্কার মােশরেকরা যে ধরনের মূর্তি পূজা করে থাকে, ইবরাহীমের পিতা ও জাতিও ঠিক তদ্রুপ মূর্তি পূজা করতাে। তিনি প্রচন্ড ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সাথে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তােমরা কিসের পূজা করো। তারা বললাে, ‘আমরা কতকগুলাে মূর্তির পূজা করি এবং তাদের পাশে অবস্থান করি।’ তারা তাদের মূর্তিগুলােকে ইলাহ বা মাবুদ নামে আখ্যায়িত করতাে। কিন্তু তাদের মুখ দিয়ে ওগুলােকে মূর্তি বলা দ্বারা বুঝা যায়, তারা এ কথা অস্বীকার করার ক্ষমতা রাখতাে না যে, ওগুলাে তাদেরই হাতের তৈরী পাথরের মূর্তি। তথাপি তারা ওগুলাের সামনে ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকে এবং ওগুলাের পূজো করতে অভ্যন্তত হয়ে গেছে। এটা চরম নির্বুদ্ধিতা কিন্তু বিশ্বাস যখন বিকৃত হয়ে গেলাে, তখন সে বিশ্বাসের ধারকদের বুঝবার ক্ষমতাই রইল না যে, তাদের পূজো উপাসনা, ধ্যান-ধারণা ও কথাবার্তা কত নিচের স্তরে নেমে গেছে। এদিকে ইবরাহীম(আ.) তাদের সুপ্ত বিবেক ও বিভ্রান্ত মনকে জাগ্রত করা ও কোনাে চিন্তা ভাবনা ছাড়াই যে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় তারা দিচ্ছে, সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করা শুরু করে দিলেন। ‘সে বললাে, ওই সব মূর্তিকে যখন তােমরা ডাক, তখন ওরা কি শুনতে পায়? কিংবা ওরা কি তােমার কোনাে ক্ষতি বা উপকার করতে পারে?’ বস্তুত যে মাবুদের পূজা উপাসনা করা হয়, অন্তত পক্ষে তার বিনীত পূজারীর ন্যায় শ্রবণ শক্তি তাে থাকা চাই। অথচ এই মূর্তিগুলো এমনই যে, তাদের উপাসকরা যখন তাদের উপাসনা করে এবং ক্ষতি থেকে নিস্তার লাভ ও উপকার প্রাপ্তির জন্যে সকাতর প্রার্থনা করে, তখন তা শুনবার ক্ষমতাও রাখে না। এখন তারা যদি বধির হয়ে থাকে এবং শুনতেই না পায়, তাহলে ওর লাভ বা ক্ষতি সাধনের ক্ষমতা কোত্থেকে পাবে? এ দুটোর কোনােটাই মোশরেকরা দাবী করতেপারে না। ইবরাহীম(আ.)-এর জাতি এ প্রশ্ন ক’টার কোনােটাই জবাব দেয়নি। কেননা ইব্রাহীম(আ.) যে তাদের প্রতি বিদ্রুপ করছেন এবং তাদের কঠোর নিন্দা করছেন, সে সম্পর্কে তাদের কোনােই সন্দেহ ছিলাে না। ইবরাহীম যা বলছেন, তা খন্ডন করার কোনাে যুক্তি প্রমাণও তাদের কাছে ছিলাে না। তাই তারা যখন কথা বললো, তখন কোনাে যুক্তি প্রমাণের পরিবর্তে নিজেদের হঠকারিতা ও গােয়ার্তুমির পরিচয়ই প্রকটভাবে তুলে ধরলাে, যা বিনা চিন্তা-ভাবনায় ও না জেনে না বুঝে অন্যের পদানুসারীদের চিরাচরিত স্বভাব। তারা বললাে, আমরা বরং আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এ রকমই করতে দেখেছি।’ অর্থাৎ এই মূর্তিগুলাে কোনাে কথাও শুনতে পায় না, কারাে কোনাে লাভ ক্ষতিও করতে পারে না। তবে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এগুলাের সামনে ধর্ণা দিয়ে থাকতে দেখেছি। তাই আমরাও ওগুলাের সামনে ধর্ণা দেই এবং পূজো উপাসনা করি। এ জবাব যদিও অপমানজনক ও লজ্জাকর। কিন্তু হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সময়কার মােশরেকরা এ কথা বলতে কোনাে লজ্জা বা অপমান বােধ করেনি। যেমন মক্কায় মােশরেকরাও করেনি। বাপ-দাদাদের করা যে কোনাে কাজ কোনাে রকম চিন্তা-গবেষণা ছাড়াই অনুকরণীয় ছিলাে। শুধু তাই নয়, বরং প্রকৃত ব্যাপার হলাে, ইসলাম গ্রহণের একটা অন্যতম বাধাই ছিলাে এই যে, মােশরেকরা তাদের বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করতে পারতাে না, বাপদাদাকে অন্ধভাবে অনুকরণ করে পারতাে না এবং তাদেরকে বিপথগামী বলে স্বীকার করতে পারতাে না। এভাবে এ ধরনের বিভিন্ন অন্ধ অনুকরণ সত্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন সময়ে মানুষের গুণগত ও মানসিক একগুয়েমি ও বিপথগামিতায় আক্রান্ত থাকাকালে এসব অন্ধ অনুকরণ সত্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ফলে আক্রান্ত লােকদেরকে স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার দিকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে প্রয়ােজন হয় জোরদার কাপুনি দেয়ার। হযরত ইবরাহীম(আ.) অত্যন্ত উদার ও সহিষ্ণু মানুষ হওয়া সত্তেও তাদের এধরনের গােয়ার্তুমি ও একগুয়েমি দেখে তাদেরকে সজোরে ঝাকুনি দেয়া এবং মূর্তিপূজা ও শিরকী আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিজের শক্রতা ঘােষণা করা ছাড়া আর কোনাে উপায়ান্তর খুঁজে পাননি। তিনি বললেন, তোমরা কি ভেবে দেখেছাে তােমরা ও তােমাদের প্রাচীন বাপ-দাদারা এ কিসের এবাদাত করছাে? ওরা সবাই আমার শত্রু। কিন্তু বিশ্বজগতের প্রতিপালক শত্রু নন। এভাবে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর পিতা ও তার স্বজাতি মূর্তি পূজায় লিপ্ত থাকলেও তিনি নিজের আকীদা-বিশ্বাসকে অটুট ও অম্লান রেখে তাদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেছেন এবং তাদের ও তাদের প্রাচীন পূর্ব-পুরুষদের আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি নিজের শত্রুতার মনােভাব ব্যক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোনাে বাধাই মানেননি এবং কোনাে শক্তিকেই ভয় পাননি। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এই উক্তি উদ্ধৃত করে কোরআন শিক্ষা দিচ্ছে যে, আকীদা বিশ্বাস, নীতি ও আদর্শের ব্যাপারে কারাে সাথে আপােষ হতে পারে না- এমনকি প্রতিপক্ষ যদি নিজের পিতাও হয় কিংবা সমগ্র জাতিও হয়, তবে তাদের সাথেও নয়। মানুষের সাথে মানুষের যতো রকমের সম্পর্ক ও বন্ধন থাকতে পারে, তার মধ্যে প্রথম বন্ধন হলো আকীদা বিশ্বাস ও নীতি-আদর্শের বন্ধন। আর মানব সমাজে যতাে রকমের মূল্যবােধই থাক না কেন, তন্মধ্যে ঈমানী মূল্যবােধই হলাে সর্বপ্রথম ও সর্বোচ্চ মূল্যবোধ । এ ছাড়া আর যা কিছুই থাক এবং যেখানেই থাক, তার ঈমানের অধীন এবং তারই শাখা-প্রশাখা। এখানে লক্ষণীয় যে, হযরত ইবরাহীম(আ.) তার স্বজাতি ও তাদের পূর্ব পুরুষদের পূজ্য-উপাস্যদের সবার প্রতি শক্রতা প্রকাশ করলেও ‘বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে সেগুলাে থেকে বাদ রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একমাত্র বিশ্ব প্রভু ছাড়া ওরা সবাই আমার শক্র। কেননা তাদের প্রাচীন পূর্ব-পুরুষদের মধ্যে এমনও কেউ থাকতে পারে, যে আল্লাহর এবাদাত করতাে। জাতির ঈমান আকীদা নষ্ট ও বিকৃত হবার আগে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদাতকারী মানুষ থাকা বিচিত্র নয়। আবার এমন কেউও থাকতে পারে যে আল্লাহর এবাদাত করেছে। কিন্তু সেই সাথে কিছু তথাকথিত দেব-দেবীকেও শরীক করেছে। সুতরাং এ উক্তিকে বলা যেতে পারে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সতর্কতাও প্রজ্ঞার সাক্ষর। ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ও তার সুক্ষ্ম বিষয়গুলােকে তুলে ধরার সময় তিনি এই সতর্কতা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাতেন। এ প্রজ্ঞা ও সতর্কতা ছিলাে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য।
*আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে একজন মােমেনের অভিব্যক্তি : পরবর্তী ক’টা আয়াতে হযরত ইবরাহীম বিশ্ব প্রভুর গুণাবলী এবং সর্বাবস্থায় ও সকল সময় তাঁর সাথে তার সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন। এ থেকে আমরা আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এবং প্রতিটা কর্মকান্ডে ও প্রত্যেক প্রয়ােজনে আল্লাহর সক্রিয় হাতের উপস্থিতি অনুভব করি, ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তিনিই আমাকে সুপথ দেখান। আর যিনি আমাকে পানাহার করান। আর যখন আমি রােগাক্রান্ত হই, তখন আমাকে আরােগ্য দান করেন, যিনি আমাকে মৃত্যু দেবেন এবং পুনরায় জীবিত করবেন, আর যার সম্পর্কে আমি আশা করি যে, কেয়ামতের দিন আমার গুনাহ মাফ করবেন।’ এখানে হযরত ইবরাহীম(আ.) যেভাবে আল্লাহর কতিপয় গুণাবলীর বিবরণ দিয়েছেন, যেভাবে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরেছেন, তা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি তার সমগ্র সত্ত্বাকে নিয়েই তার প্রতিপালকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থান করছেন, পরিপূর্ণ আস্থার সাথে তার প্রতি নির্ভরশীল রয়েছেন এবং তার প্রেমে মাতােয়ারা রয়েছেন। এখানে তিনি তাঁর গুণাবলীর বর্ণনা এমনভাবে দিচ্ছেন যে, মনে হয়, তিনি তাকে সচোক্ষে দেখতে পাচ্ছেন এবং নিজের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া নেমে আসাকে যেন তার সমগ্র হৃদয়, চেতনা ও অংগপ্রত্যংগ দিয়ে অনুভব করছেন। হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কথাগুলোকে কুরআন যেরূপ সুমধুর সূরে উদ্ধৃত করেছে, তা এই দয়া ও অনুগ্রহপূর্ণ পরিবেশকে আরাে সম্প্রসারিত করতে ও এই ভাবধারার বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করেছে। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তিনিই আমাকে সুপথ দেখান। অর্থাৎ যিনি আমাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরী করেছেন এবং তৈরী করার পদ্ধতি ও কৌশল তিনিই জানেন আমি জানি না আমার জন্মতত্ত্ব আমার গঠন প্রক্রিয়া, আমার কর্মকান্ড, আমার আবেগ অনুভূতি এবং আমার বর্তমান সম্পর্কে একমাত্র তিনিই অবগত। অতপর তিনিই আমাকে সুপথ দেখান। অর্থাৎ যে পথ দিয়ে আল্লাহর কাছে পৌছতে পারবাে। যে পথ দিয়ে আমি চলছি, চলবাে এবং চলা উচিত, তা তিনিই দেখান। এ কথার মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম(আ.) এরূপ মনােভাব প্রকাশ করছেন যেন তিনি মহান স্রষ্টার হাতে নির্মিয়মান একটা কাদার পুতুল। একে তিনি যেভাবে খুশী আকৃতি দেবেন। এ মনােভাব দ্বিধাহীন চিত্তে ও শর্তহীনভাবে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের শামিল। আর যিনি আমাকে খাওয়ান ও পান করান এবং যখন আমি রােগাক্রান্ত হই, আরোগ্য দান করেন, এ বক্তব্যের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম নিজের এই অনুভূতি প্রকাশ করছেন যেন রােগে ও সুস্থাবস্থায় তিনি আল্লাহর স্নেহ মমতাপূর্ণ অভিভাবকত্বে অবস্থান করেন। তিনি নবীসুলভ আদব ও ভক্তিশ্রদ্ধার এমন সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন যে, তিনি রােগাবস্থা ও সুস্থাবস্থা- উভয় অবস্থাই আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে সংঘটিত হয় এ কথা জেনেও রােগাবস্থার জন্যে আল্লাহকে দায়ী করেননি, বরং আল্লাহকে কেবল রােগ নিরাময়কারী ও পানাহার করানেওয়ালা হিসাবে তুলে ধরেছেন। যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাকে কোনাে পরীক্ষা বা দুর্যোগের সম্মুখীন করেছেন, সেখানে সেই দুর্যোগের উল্লেখই তিনি করেননি। ‘যিনি আমাকে মারেন ও পুনরায় জীবিত করেন।’ এ থেকে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর ঈমানের প্রকৃত রূপ তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই মৃত্যুর ফায়সালা করে থাকেন। আর এরই মধ্য দিয়ে একথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মৃত্যু সংক্রান্ত ঈমান আসলে আখেরাতের পুনরুজ্জীবনে নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপনেরই শামিল। ‘যার সম্পর্কে আমি আশা করি যে, তিনি কেয়ামতের দিন আমার গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ এর অর্থ দাঁড়ালাে, হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর মতাে নবীও আল্লাহর কাছে এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করেন না যে, কেয়ামতের দিন তিনি তার গুনাহ মাফ করে দেবেন। অর্থাৎ তিনি নিজেকে নিষ্পাপ মনে করেন না, বরং নিজের ঘাড়ে প্রচুর গুনাহ রয়েছে ভেবে তিনি শংকিত ও চিন্তিত। তিনি নিজের সৎ কাজের ওপর নির্ভর করেন না এবং তার বিনিময়ে তিনি নিজেকে কোনাে কিছু পাওয়ার যােগ্য বলে বিবেচনা করেন না। তবে তিনি আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পা আশা করেন বলেই তার গুনাহ মাফ হবার ব্যাপারে আস্থাশীল। এ কথার মাধ্যমে তিনি আসলে আল্লাহভীতি, আদব ও সাবধানতার মনােভাবই প্রকাশ করেন। এটাই সঠিক মনােভাব, আল্লাহর নেয়ামত সম্পর্কে এটাই সঠিক অনুভূতি ও মূল্যায়ন। কেননা আল্লাহর নেয়ামত অত্যন্ত বড় ও বিশাল, আর বান্দার সৎ কাজের পরিমাণ খুবই সামান্য ও নগণ্য। এভাবে হযরত ইবরাহীম(আ.) বিশ্ব প্রভু আল্লাহ সংক্রান্ত বিশুদ্ধ আকীদাসমূহকে একত্রিত করেছেন। সেগুলাে হচ্ছে, আল্লাহর একত্ব, পৃথিবীর জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও মানুষের ওপর আল্লাহর প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব, মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন ও হিসাব নিকাশ আল্লাহর অনুগ্রহ ও বদান্যতা এবং বান্দার ত্রুটি-বিচ্যুতি। এ বিষয়গুলাে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর জাতিও অস্বীকার করতাে, অন্যান্য পৌত্তলিকদের অস্বীকার করে। এর ইবরাহীম(আ.) আল্লাহর কাছে আরাে কয়েকটা সকাতর প্রার্থনা করেন, যেমন, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দান করুন এবং আমাকে সৎ লােকদের সাথে যুক্ত রাখুন, পরবর্তীদের মধ্যে আমার সত্য ভাষণ চালু রাখুন, আমাকে নেয়ামতে পরিপূর্ণ বেহেস্তের উত্তরাধিকারী করুন, আমার পথভ্রষ্ট পিতাকে ক্ষমা করুন, আমাকে কেয়ামতের দিন অপমানিত করবেন না, যেদিন সম্পদ ও সন্তান মানুষের কোনাে উপকারে আসবে না। তবে আল্লাহর কাছে যে ব্যক্তি পবিত্র অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে, তার কথা আলাদা।’ এই সমগ্র দোয়ার মধ্যে পার্থিব স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছুই চাওয়া হয়নি, এমনকি শারীরিক সুস্থতাও নয়, এ দোয়া দ্বারা শুধু উচ্চতর মার্গে উন্নীত হওয়ার অভিলাষ প্রকাশ করা হয়েছে। এ দোয়ার চালিকা শক্তি ছিলাে পবিত্র আবেগ ও নির্মল প্রেরণা। এ দোয়া উঠে এসেছিলাে এমন এক হৃদয় থেকে, যা আল্লাহকে চেনার পর অন্যসব কিছুকে তুচ্ছ করতে শেখায়। সে হৃদয়ের কাছে একবার যা মজা লাগে, তা আরাে পেতে চায়। সে হৃদয় যা কিছু আশা করে নিজের ইচ্ছা ও অভিরুচির সীমার মধ্যেই আশা করে, আর যা কিছুকে ভয় পায়, নিজের ইচ্ছা ও অভিরুচি অনুসারেই ভয় পায়। আমাকে প্রজ্ঞা দান করো অর্থাৎ সেই সুক্ষ্ম ও নির্ভুল জ্ঞান দান করাে, যা দ্বারা কোনটা ভাল ও কোনটা মন্দ, কোনােটা ন্যায় ও কোনােটা অন্যায়, আমি তা চিনতে পারি, অতপর যা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী, তার সাথে যুক্ত থাকার পথ যেন গ্রহণ করতে ও তাতেই বহাল থাকতে পারি। ‘আমাকে সৎ লােকদের সাথে যুক্ত রাখাে।’ লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই দোয়া করছেন সেই মহান নবী ইবরাহীম, যার পুণ্যময়তা, মহত্ব, মহানুভবতা, ও ধৈর্যশীলতা সর্বজন বিদিত। কী বিস্ময়কর বিনয়, কী অপূর্ব সতর্কতা, গুনাহে জড়িয়ে পড়ার কতাে ভয়, মনের বিপথগামিতা সম্পর্কে কত শংকা এবং সৎ লােকদের সাথে নিছক সংশ্রব ও সংযােগ বজায় রাখার কী তীব্র বাসনা! আর এই সংযােগ বজায় রাখার একমাত্র যােগসূত্র হিসেবে সৎ কর্মের প্রেরণা লাভের জন্যে আল্লাহর কাছে কী সকাতর মিনতি। ‘পরবর্তীদের মধ্যে আমার সত্যভাষণ চালু রাখো।’ বংশ বিস্তারের মাধ্যমে নয়, বরং আদর্শের বিস্তারের মাধ্যমে ইসলামী সমাজের সম্প্রসারণ ঘটুক এরূপ আকাংখা থেকেই তার এই দোয়ার উদ্ভব। তিনি চেয়েছেন, তার পরবর্তী বংশধরের কাছে যেন তার দেয়া সত্যের দাওয়াত পৌছে, সে দাওয়াত যেন তাদের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয় এবং তাদেরকে ইবরাহীমের আনীত সত্য দ্বীন ইসলামে দীক্ষিত করে। সম্ভবত এটা তার সেই দোয়ারই ভিন্ন রূপ, যা তিনি নিজ পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের সময় করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের উভয়কে তােমার কাছে আত্মসমর্পণকারী বানাও, আর আমাদের বংশধরদের মধ্যে থেকেও তােমার কাছে আত্মসমর্পণকারী একটা উম্মত গঠন করাে। আর আমাদেরকে আমাদের জীবন বিধান শিখিয়ে দাও এবং আমাদেরকে ক্ষমা করো। নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াময় । হে আমাদের প্রতিপালক। আমার বংশধরদের মধ্যে তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রসূল পাঠাও, যিনি তােমার আয়াতসমূহ তাদেরকে পড়ে শোনাবে, তাদেরকে কেতাব ও হেকমত শেখাবে এবং তাদেরকে বিশুদ্ধ করবে। নিশ্চয়ই তুমি মহা প্রতাপশালী ও পরম প্রজ্ঞাময়।’ আল্লাহ তায়ালা তার এ দোয়া কবুল ও কার্যকর করেছিলেন, ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দাওয়াত ও আন্দোলনের যে ধারার সূচনা তিনি করেছিলেন, তাকে পরবর্তীদের মধ্যে অব্যাহত রেখেছিলেন এবং তাদের মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচারকারী, আল্লাহর কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দানকারী ও মানুষের চরিত্র সংশােধনকারী একজন রাসূল পাঠিয়েছিলেন। এই দোয়া কবুল হয়েছিলাে কয়েক হাজার বছর পরে। এটা সাধারণ মানুষের কাছে দীর্ঘ সময়, কিন্তু আল্লাহর কাছে এটা একটা নির্দিষ্ট সময় যার মধ্যে কবুলকৃত দোয়া বাস্তবায়িত হওয়া উচিত বলে তার প্রজ্ঞার দাবী। আর আমাকে নেয়ামতে পরিপূর্ণ বেহেশতের অধিকারী করাে। ইতিপূর্বে তিনি যে দোয়া করেছেন, তার সাথে এ দোয়া সংগতিপূর্ণ। তিনি দোয়া করেছেন আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে সৎ কাজে নিয়ােজিত থাকার প্রেরণা দেয়ার মাধ্যমে সৎ লােকদের সাথে যুক্ত রাখেন। কেননা সৎ কাজ ও সৎ চরিত্রই মানুষকে সৎ লােকদের অন্তর্ভুক্ত রাখে। আর সেই সৎ লােকদের জন্যেই নির্ধারিত রয়েছে নেয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত। আমরা পথভ্রষ্ট পিতাকে ক্ষমা করাে। পিতার পক্ষ থেকে অত্যন্ত নির্দয় ও নিষ্ঠুর বাক্যবাণ ও প্রচন্ড ধমকে জর্জরিত হয়েও হযরত ইবরাহীম তার জন্যে এ দোয়া করলেন কেবল সেই ওয়াদা পূরণের জন্যে, যা তিনি ইতিপূর্বে তার পিতার সাথে করেছিলেন। অবশ্য কোরআনে সূরা তাওবায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেও মােশরেকদের জন্যে ক্ষমা চাওয়া জায়েয নয়। সেইসাথে এ কথাও পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম(আ.) কর্তৃক তার পিতার ক্ষমার জন্যে দোয়া করার একমাত্র কারণ ছিলাে ইতিপূর্বে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি। পরে তার কাছে যখন একথা স্পষ্ট হয়ে গেলাে যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। তিনি তখন বুঝলেন যে, রক্তের আত্মীয়তা নয়, আদর্শ ও নীতির আত্মীয়তা আসল আত্মীয়তা। এটাই ইসলামী শিক্ষার অন্যতম সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষে মানুষে সম্পর্কের প্রথম যােগসূত্র হলাে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। এই যোগসূত্র বাদ দিয়ে দু’জন মানুষের মধ্যে কোনাে সম্পর্কই গড়ে উঠতে পারে না। এই যােগসূত্র ছিন্ন হলে অন্য সকল যােগসূত্রই ছিন্ন হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে কোনাে সম্পর্কই আর অবশিষ্ট থাকে না। ‘আর কেয়ামতের দিন আমাকে অপমানিত করাে না। যেদিন কোনাে ধন সম্পদ এবং কোনাে সন্তান-সন্ততি কোনাে উপকারে আসবে না। তবে যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ মন নিয়ে উপস্থিত হবে সে মুক্তি পাবে।’ হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর এ উক্তি দ্বারা আমরা বুঝতে পারি একজন সম্মানিত নবী হয়েও তিনি কেয়ামতের ভয়াবহতাকে কতাে গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন, আল্লাহর সামনে তিনি কতাে বিনয়ী ছিলেন, তার সামনে অপমানিত হবার ভয়ে তিনি কতাে শংকিত ছিলেন এবং নিজের ভুলত্রুটি সম্পর্কে তিনি কতাে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার এ কথা থেকে আরাে বুঝা যায়, তিনি কেয়ামতের দিনের প্রকৃত স্বরূপ নির্ভুলভাবে হৃদয়ংগম করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, সেদিন আল্লাহর জন্যে মনের পরিপূর্ণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা ছাড়া এবং সব রকমের স্বার্থপরতা, পার্থিব মােহ, বিকৃতি ও আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে বা অন্য কিছুর প্রতি আসক্তি থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকা ছাড়া কারাে কোনাে সৎ কাজ গৃহীত হবে না। মনের এই পবিত্রতা ও এই সমস্ত কলুষতা থেকে মুক্ত হওয়াই সেদিন প্রত্যেক বান্দার উপকারে আসবে। এ ছাড়া পার্থিব স্বার্থের মােহান্ধ লােকেরা অন্য যেসব জিনিসকে পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যবান মনে করে, আখেরাতের বিচারে তার কোনােই মূল্য নেই। এরপর কেয়ামতের একটা ভয়ংকর দৃশ্য এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যেন, তা এখনই উপস্থিত এবং যেন তা তিনি সাক্ষাত দেখতে পাচ্ছেন। এ দৃশ্যই কেয়ামতকে সেই বিশিষ্টতা দান করছে, যার জন্যে তিনি কেয়ামতকে নিয়ে এত শংকিত।
*জাহান্নামে বসে পাপিষ্ঠদের আক্ষেপ : ‘আল্লাহভীরুদের জন্যে বেহেশতকে নিকটবর্তী করা হয়েছে আর বিপথগামীদের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে জাহান্নামকে।…'(আয়াত ৯০-১০২) এ আয়াতগুলােতে যে দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে তা এই যে, আল্লাহভীরুদের সামনে উপস্থিত করা হয়েছে এবং তাদের নিকটে আনা হয়েছে। এই আল্লাহভীরুরা পার্থিব জীবনে আল্লাহর আযাবের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতাে। অপরদিকে বিপথগামী পাপীদের সামনে জাহান্নামকে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এরা আখেরাতকে অস্বীকার করতাে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথ এড়িয়ে চলতাে। তারা আজ কেয়ামতের দিন জাহান্নামের কাছে এক ভয়াবহ পরিবেশে অবস্থান করছে। তাদেরকে অধােমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপের আগে তারা নানারকমের তিরস্কার ও ধমক শুনতে পাচ্ছে। তারা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোন কোন উপাস্যের পূজা করতাে, কোনাে কোন ব্যক্তি বা মতাদর্শের আনুগত্য করতাে তা তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। আর এই জিজ্ঞাসার সাথে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সাথে তার জাতির লােকদের কথােপকথনের মিল রয়েছে। তিনিও জানতে চেয়েছিলেন যে, তােমরা কিসের পূজা করছে? আজ কেয়ামতের দিন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তোমরা যার যার পূজো করতে, তারা এখন কোথায়? তারা কি তােমাদেরকে সাহায্য করতে বা সাহায্য গ্রহণ করতে পারছে? এ প্রশ্নের কোনাে জবাব শােনা যাচ্ছে না। জবাবের আশাও করা যায় না। কেননা এ প্রশ্ন কেবল ধমক ও তিরস্কারের জন্যেই করা হচ্ছে। অতঃপর তাদেরকে ও পথভ্রষ্টদেরকে অধােমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে। সেই সাথে ইবলীসের সকল বাহিনীকেও। তাদেরকে অধােমুখে নিক্ষেপ করা হলো। তাদেরকে এলােপাতাড়িভাবে ও নিষ্ঠুরভাবে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে নিক্ষেপ করার শব্দ যেন আমরা শুনতে পাচ্ছি। এই কুবকিবু শব্দটার ঝংকার থেকেই এর অর্থের ছবি ফুটে উঠছে। একটা গর্তের পতনােন্মুখ ঢালু কিনারা থেকে ধাক্কা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পর্যায়ক্রমে নিচে নিক্ষেপ করা থেকে যে শব্দের সৃষ্টি হয়, সেই শব্দ যেন আমাদের কানে আসছে। যারা এভাবে ধাক্কা খেয়ে জাহান্নামের অতল গহবরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তারা সবাই বিপথগামী পাপিষ্ঠ। এই পাপিষ্ঠরা নিক্ষিপ্ত হবার সাথে সাথে ইবলীসের সাংগ-পাংগরাও সবাই নিক্ষিপ্ত হবে, কেউ বাদ যাবে না এবং কেউ রেহাই পাবে না। এরপর জাহান্নামের ভেতর থেকেও তাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি। তারা তাদের উপাসিত দেবদেবীকে বলছে, তােমাদেরকে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সমান গণ্য করার সময় আমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিলাম।’ অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সাথে তােমাদেরও অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তােমাদের আনুগত্য করা আমাদের চরম ভ্রান্তি ছিলাে। আজ সময় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর তারা এ কথা বলছে। আজ যখন অপরাধীরা নিজ নিজ অপরাধের ফল ভোগ করছে, তখন তাদের মধ্যে এই চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু আজ এই চেতনা ও উপলব্ধি নিস্ফল। আমাদের আর কোনাে সুপারিশকারী নেই, নেই কোনাে অন্তরংগ বন্ধু। না কোনাে দেব-দেবী বা বা মানবরচিত মতবাদের ধারক বাহক নেতা নেতৃরা আজ সুপারিশ করবে, না কারাে বন্ধুত্ব কোনাে কাজে লাগবে। অতীতের কৃতকর্মে কোনাে সুপারিশের অবকাশ যখন নেই, তখন দেখা যাক অতীতের সেই জীবনটায় আবার ফিরে যাওয়ার কোনাে সুযােগ আছে কিনা। না, তাও নেই। ‘আহা আমাদের যদি আর একবার সুযােগ দেয়া হতাে, তাহলে আমরা ঈমানদার হয়ে যেতাম।’ কিন্তু এটা কেবল আক্ষেপের আকারেই থেকে যাবে। পৃথিবীতে ফিরেও যাওয়া যাবে না, সুপারিশও পাওয়া যাবে না। কেননা আজ হলাে কর্মফল পাওয়ার দিন। এরপর আসছে প্রত্যাশিত মন্তব্য, ‘নিশ্চয়ই এতে রয়েছে নিদর্শন। তাদের বেশীর ভাগ লােকই ঈমান আনেনি। আর তােমার প্রভু মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। এই একই মন্তব্য এসেছে আদ, সামুদ ও হযরত লুতের জাতির ধ্বংসের কাহিনীর উপসংহারে । আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যানকারী প্রত্যেক জাতির ক্ষেত্রেই এরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। নবীদের দাওয়াত ও আল্লাহর নিদর্শনকে মিথ্যা সাব্যস্তকারী অন্যান্য জাতির ওপর যে। পার্থিব আযাব ও ধ্বংস নেমে এসেছে, হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর জাতি তেমন কোনাে আযাব ও ধ্বংসের শিকার হয়েছে বলে এখানে কোনাে বিবরণ দেয়া হয়নি। তবে তার পরিবর্তে এখানে কেয়ামতের আযাবের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমেই হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর জাতির ও শিরকের অবসান দেখানাে হয়েছে। সমগ্র সূরার শিক্ষার বিষয় এটাই। আর কোরআনে কেয়ামতের ঘটনাবলীকে এমনভাবে দেখানাে হয়- যেন তা এখনই ঘটছে, লােকেরা তা যেন সচক্ষেই দেখতে পাচ্ছে, তা দেখে তারা যেন আবেগে উদ্বেলিত হচ্ছে এবং তাদের স্নায়ুমন্ডল যেন রােমাঞ্চিত হচ্ছে, ঠিক যেমনটি ঘটে থাকে প্রকাশ্যে আসমানী আযাবে সংঘটিত ধ্বংসযজ্ঞসমূহের পরিণামে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৬৯-১০৪ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন ও তার জন্য নিজের নিকটাত্মীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে দ্বিধাবোধ করেনি এমন নাবী খলীলুল্লাহ ইবরাহীম (عليه السلام) সম্পর্কে ও তার সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যখন ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতা ও স্ব-জাতির কাছে মূর্তি মা‘বূদ হতে পারেনা, তারা মা‘বূদ হতে অপারগ এসব বিষয় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন তখন তারা বলল: ‘না, বরং আমরা আমাদের পিতৃপুুরুষদেরকে এরূপই করতে দেখেছি।’ সুতরাং তারা যখন বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কথা বর্জন করল তখন তিনি বললেন: ‘তারা সকলেই আমার শত্র“, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত; ‘যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন।”
(وَلَا تُخْزِنِيْ يَوْمَ يُبْعَثُوْنَ)
আবূ হুরাইরাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: হাশরের ময়দানে ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতার সাক্ষাত পেয়ে বলবেন: হে আল্লাহ তা‘আলা ! আপনি আমাকে ওয়াদা দিয়েছিলেন, কিয়ামতের দিন আমাকে অপমানিত করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: আমি কাফিরদের ওপর জান্নাত হারাম করে দিলাম। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৬৯)
(وَاغْفِرْ لِأَبِيْ)
‘আর আমার পিতাকে ক্ষমা কর, প্রশ্ন হতে পারে ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পিতা মুশরিক হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে ক্ষমা চাইলেন? উত্তরঃ পূর্বে ওয়াদা দিয়েছিলেন সে প্রেক্ষিতে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু যখন প্রমাণিত হল যে, তাঁর পিতা আল্লাহর শত্র“ তখন ক্ষমা চাওয়া বাদ দিলেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ أَنْ يَّسْتَغْفِرُوْا لِلْمُشْرِكِيْنَ وَلَوْ كَانُوْا أُولِيْ قُرْبٰي مِنْۭ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحٰبُ الْجَحِيْمِ)
“আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নাবী এবং মু’মিনদের জন্য সঙ্গত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিশ্চিতই তারা জাহান্নামী।” (সূরা তাওবাহ ৯:১১৪)
(إِلَّا مَنْ أَتَي اللّٰهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ)
‘সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহ তা‘আলার নিকট আসবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে।’
(قَلْبٍ سَلِيْمٍ)
অর্থ এমন অন্তর যা শিরক ও সংশয় থেকে ম্ক্তু। যে অন্তরে পাপ কাজের প্রতি ভালবাসা থাকে না, বারবার বিদ‘আত ও অন্যায় কাজে লিপ্ত হয় না। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন সম্পদ ও সন্তান কোন উপকারে আসবে না যদি উল্লিখিত গুণাবলী সম্বলিত অন্তর নিয়ে উপস্থিত না হয়। প্রশ্ন হতে পারে সম্পদ ও সন্তান কিভাবে উপকারে আসবে? সম্পদ ও সন্তান উপকারে আসবে যদি সম্পদ সৎপথে উপার্জন ও ব্যয় করা হয় আর সন্তানকে যদি দীনদার বানিয়ে রেখে যাওয়া হয়।
(إِذْ نُسَوِّيْكُمْ) – سوي يسوي
অর্থ বরাবর করে দেয়া, সমান করে দেয়া অর্থাৎ যে সকল পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে তাদেরকে আমরা আল্লাহ তা‘আলার সমান করে দিয়েছিলাম। এসকল পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরা আল্লাহর ইবাদতের নামে নিজেদের ইবাদতের দিকে আহ্বান করেছে। সুতরাং ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের ধর্মযাজক আহ্বার ও রুহবানদের ন্যায় একশ্রেণির মানুষ দাড়ি-টুপি পরে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের নামে নিজেদের ইবাদতের দিকে আহ্বান করে; তাদের থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
ইবরাহীম (عليه السلام) ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনা ইতোপূর্বে সূরা আম্বিয়াসহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মুশরিকদের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে যদিও নিকটাত্মীয় হয়।
২. মুশরিকদের কাছে দাওয়াত দেয়ার অন্যতম মূলনীতি হল তাদের মা‘বূদের অক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে, তাহলে দাওয়াত সহজেই ফলপ্রসূ হতে পারে।
৩. মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা বৈধ নয়।
৪. কিছু মানুষ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের নামে নিজেদের ইবাদতের দিকে আহ্বান করে, তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে।।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এখানে হযরত ইব্রাহীমের পবিত্র জীবনের এক যুগের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে যখন নবুওয়াত লাভ করার পর শিরক ও তাওহীদের বিষয় নিয়ে তাঁর নিজের পরিবার ও নিজের সম্প্রদায়ের সাথে সংঘাত শুরু হয়েছিল। সে যুগের ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত সূরাগুলোতে বর্ণিত হয়েছেঃ সূরা আল বাকারাহ ৩৫ রুকু’ , আল আন’আম ৯ রুকু’ , মারয়াম ৩ রুকু’ , আল আম্বিয়া ৫ রুকু’ , আস্ সাফফাত ১৩ রুকু’ এবং আল মুমতাহিনাহ ১ রুকু’।
হযরত ইব্রাহীমের জীবনের এ যুগের ইতিহাস কুরআন মজীদ বিশেষভাবে বারবার সামনে এনেছে। এর কারণ হচ্ছে, আরবের লোকেরা সাধারণভাবে এবং কুরাইশরা বিশেষভাবে নিজেদেরকে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের অনুসারী মনে করতো। এজন্য কুরআন মজীদ বিভিন্ন জায়গায় তাদেরকে এ মর্মে সতর্ক করেছে যে, ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যে দ্বীন নিয়ে এসেছিলেন তা ছিল সেই একই নির্ভেজাল দ্বীন যা আরবীয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ এনেছেন এবং যার সাথে তোমরা সংঘাতে লিপ্ত হয়েছো। তিনি মুশরিক ছিলেন না। বরং শিরকের বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর সংগ্রাম এবং এ সংগ্রামের কারণে তাঁকে নিজের বাপ, পরিবার, জাতি ও দেশ সবকিছু ত্যাগ করে সিরিয়া, ফিলিস্তিন এবং হিজাযে প্রবাসীর জীবন যাপন করতে হয়েছিল। অনুরূপভাবে তিনি ইহুদী ও খ্রিস্টানও ছিলেন না। বরং ইহুদীবাদ ও খৃস্টবাদ তো তাঁর বহু শতাব্দী পরে জন্ম নিয়েছিল। এ ঐতিহাসিক যুক্তির কোন জবাব মুশরিক, ইহুদী ও খৃস্টান কারো কাছে ছিল না। কারণ মুশরিকরাও স্বীকার করতো, আরবের মূর্তি পূজার প্রচলন হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের কয়েক শত বছর পরে। অন্যদিকে ইহুদীবাদ ও খৃস্টবাদের জন্মের বহু পূর্বে হযরত ইব্রাহীমের যুগ অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল, একথা ইহুদী ও খৃস্টানরা অস্বীকার করতো না। এর স্বতস্ফূর্ত ফল স্বরূপ বলা যায়, যেসব বিশেষ আকীদা বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের ওপর তারা বিশ্বাস স্থাপন করে তা প্রথম থেকে প্রচলিত প্রাচীন দ্বীনের অংশ নয় এবং এসব মিশ্রণমুক্ত নির্ভেজাল আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত দ্বীনই সঠিক দ্বীন। এরই ভিত্তিতে কুরআন বলছেঃ مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ – إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آمَنُوا “ইব্রাহীম ইহুদীও ছিল না এবং খৃস্টানও ছিল না বরং সে একজন একনিষ্ট মুসলিম ছিল। আর সে মুশরিকও ছিল না। আসলে ইব্রাহীমের সাথে সম্পর্ক রাখার সবচেয়ে বেশী অধিকার তাদের, যারা তাঁর পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং (এখন এ অধিকার) এ নবীর এবং এর সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদের।” (আলে ইমরানঃ ৬৭-৬৮)
# তারা কিসের পূজা করছে তা জানা ইবরাহীমের প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ সেখানে তারা যেসব মূর্তির পূজা করতো তা তিনি নিজে দেখতেন। কাজেই তাঁর প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তিনি তাদের দৃষ্টি ও চিন্তা এদিকে আকৃষ্ট করতে চাচ্ছিলেন যে, তোমরা যেসব উপাস্যের সামনে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত করছো তাদের স্বরূপ কি? সূরা আম্বিয়াতে এ প্রশ্নটিকে এভাবে করা হয়েছেঃ “এসব কেমন প্রতিমা যেগুলোর প্রতি ভক্তিতে তোমরা গদগদ হচ্ছো?”
# আমরা কিছু মূর্তির পূজা করি, এ জবাবও নিছক একটা সংবাদ জানিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। কারণ প্রশ্নকর্তা ও জবাবদাতা উভয়ের সামনে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট ছিল। নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি তাদের অবিচলতাই ছিল এ জবাবের আসল প্রাণসত্তা। অর্থাৎ তারা আসলে বলতে চাচ্ছিল, হ্যাঁ, আমরাও জানি এগুলো কাঠ ও পাথরের তৈরী প্রতিমা। আমরা এগুলোর পূজা করি। কিন্তু আমরা এগুলোরই পূজা ও সেবা করে যাবো, এটিই আমাদের ধর্ম ও বিশ্বাস।
# এরা আমাদের প্রার্থনা, মুনাজাত ও ফরিয়াদ শোনে অথবা আমাদের উপকার বা ক্ষতি করে মনে করে আমরা এদের পূজা করতে শুরু করেছি তা নয়। আমাদের এ পূজা-অর্চনার কারণ এটা নয়। বরং আমাদের এ পূজা-অর্চনার আসল কারণ হচ্ছে, আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে তা এভাবেই চলে আসছে। এভাবে তারা নিজেরাই একথা স্বীকার করে নিয়েছে যে, তাদের ধর্মের পেছনে তাদের পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া আর কোন প্রমাণ নেই। অন্য কথায় তারা যেন বলছিল, তুমি আমাদের কি এমন নতুন কথা বলবে? আমরা নিজেরা দেখছি না এগুলো কাঠ ও পাথরের মূর্তি? আমরা কি জানি না, কাঠ শোনে না এবং পাথর কারো ইচ্ছা পূর্ণ করতে বা ব্যর্থ করে দিতে পারে না? কিন্তু আমাদের শ্রদ্ধেয় পূবপুরুষরা শত শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এদের পূজা করে আসছে। তোমার মতে তারা সবাই কি বোকা ছিল? তারা এসব নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলোর পূজা করতো, নিশ্চয়ই এর কোন কারণ থাকবে। কাজেই আমরাও তাদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে এ কাজ করছি।
#ব্যস, স্রেফ বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসছে বলেই তাকে সত্য ধর্ম বলে মেনে নিতে হবে, একটি ধর্মের সত্যতার জন্য শুধুমাত্র এতটুকু যুক্তিই যথেষ্ট? চোখ বন্ধ করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাবে এবং কেউ একবার চোখ খুলে দেখবেও না যাদের বন্দেগী-পূজা-অর্চনা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে সত্যিই আল্লাহর গুণাবলী পাওয়া যায় কি না এবং আমাদের ভাগ্যের ভাংগা-গড়ার ক্ষেত্রে তারা কোন ক্ষমতা রাখে কি না?
# চিন্তা করলে আমি দেখতে পাই, যদি আমি এদের পূজা করি তাহলে আমার দুনিয়া ও আখেরাত দু’টোই বরবাদ হয়ে যাবে। আমি এদের ইবাদাত করাকে শুধুমাত্র অলাভজনক ও অক্ষতিকর মনে করি না বরং উল্টো ক্ষতিকর মনে করি। তাই আমার মতে তাদেরকে পূজা করা এবং শত্রুকে পূজা করা এক কথা। তাছাড়া হযরত ইব্রাহীমের এ উক্তির মধ্যে সূরা মারয়ামে যে কথা বলা হয়েছে সেদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। সূরা মারয়ামে বলা হয়েছেঃ
وَاتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ آلِهَةً لِيَكُونُوا لَهُمْ عِزًّا -كَلَّا سَيَكْفُرُونَ بِعِبَادَتِهِمْ وَيَكُونُونَ عَلَيْهِمْ ضِدًّا
“তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে, যাতে তারা তাদের জন্য শক্তির মাধ্যম হয়। কখখনো না, শিগগির সে সময় আসবে যখন তারা তাদের পূজা-ইবাদাত অস্বীকার করবে এবং উল্টো তাদের বিরোধী হয়ে যাবে।” (৮১-৮২ আয়াত)
অর্থ্যাৎ কিয়ামতের দিন তারা তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এবং পরিষ্কার বলে দেবে, আমরা কখনো তাদেরকে আমাদের পূজা করতে বলিনি এবং তারা আমাদের পূজা করতো এ কথা আমরা জানিও না। এখানে প্রচারের কৌশলের একটি বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য। হযরত ইব্রাহীম এ কথা বলেননি যে, এরা তোমাদের শত্রু বরং বলেছেন এরা আমার শত্রু। যদি তিনি বলতেন এরা তোমাদের শত্রু, তাহলে প্রতিপক্ষের হঠকারী হয়ে ওঠার বেশী সুযোগ থাকতো। তারা তখন বিতর্ক শুরু করতো এরা কেমন করে আমাদের শত্রু হয় বলো। পক্ষান্তরে যখন তিনি বললেন তারা আমার শত্রু তখন প্রতিপক্ষের জন্যও চিন্তা করার সুযোগ হলো। তারাও ভাবতে পারলো, ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম যেমন নিজের ভাল-মন্দের চিন্তা করছেন তেমনি আমাদের নিজেদের ভাল-মন্দের চিন্তা করা উচিত। এভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ.) যেন প্রত্যেক ব্যক্তির স্বভাবজাত আবেগ-অনুভূতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন, যার ভিত্তিতে তারা নিজেরাই হয় নিজেদের শুভাকাঙ্খী এবং জেনে শুনে কখনো নিজেদের মন্দ চায় না। তিনি তাদেরকে বললেন, আমি তো এদের ইবাদাত করার মধ্যে আগাগোড়াই ক্ষতি দেখি এবং জেনে বুঝে আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারতে পারি না। কাজেই দেখে নাও আমি নিজে তাদের ইবাদাত-পূজা-অর্চনা থেকে পুরোপুরি দূরে থাকছি। এরপর প্রতিপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই একথা চিন্তা করতে বাধ্য ছিল যে, তাদের লাভ কিসে এবং জেনে বুঝে তারা নিজেদের অমঙ্গল চাচ্ছে না তো।
# পৃথিবীতে যেসব উপাস্যের বন্দেগী ও পূজা করা হয় তাদের মধ্যে একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনই আছেন যাঁর বন্দেগীর মধ্যে আমি নিজের কল্যাণ দেখতে পাই এবং যাঁর ইবাদাত আমার কাছে শত্রুর নয় বরং একজন প্রকৃত পৃষ্ঠপোষকের ইবাদাত বলে বিবেচিত হয়। এরপর হযরত ইব্রাহীম একমাত্র রব্বুল আলামীনই ইবাদাতের হকদার কেন, এর কারণগুলো কয়েকটি বাক্যে বর্ণনা করেছেন। এভাবে তিনি নিজের প্রতিপক্ষের মনে এ অনুভূতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন যে, তোমাদের কাছে তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যান্য উপাস্যদের পূজা করার স্বপক্ষে বাপ-দাদার অনুকরণ ছাড়া বর্ণনা করার মতো আর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই কিন্তু আমার কাছে একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করার জন্য অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে, যা তোমরাও অস্বীকার করতে পারো না।
# এটি প্রথম কারণ, যার ভিত্তিতে আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহই ইবাদাতের হকদার। প্রতিপক্ষও এ সত্যটি জানতো এবং মেনেও নিয়েছিল যে, আল্লাহ তাদের সৃষ্টিকর্তা। তাঁর সৃষ্টিতে অন্য কারো কোন অংশ নেই, একথাও তারা স্বীকার করতো। এমন কি তাদের উপাস্যরা নিজেরাও যে আল্লাহর সৃষ্টি এ ব্যাপারে ইবরাহীমের জাতিসহ সকল মুশরিকদের বিশ্বাস ছিল। নাস্তিকরা ছাড়া বাকি দুনিয়ার আর কোথাও কেউ একথা অস্বীকার করেনি। আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা তাই হযরত ইবরাহীমের প্রথম যুক্তি ছিল, আমি একমাত্র তাঁর ইবাদাতকে সঠিক ও যথার্থ মনে করি যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অন্য কোন সত্তা কেমন করে আমার ইবাদাতের হকদার হতে পারে, যেহেতু আমাকে সৃষ্টি করার ব্যাপারে তার কোন অংশ নেই। প্রত্যেক সৃষ্টি অবশ্যি তার নিজের স্রষ্টার বন্দেগী করবে। যে তার স্রষ্টা নয়, তার বন্দেগী করবে কেন?
# একমাত্র আল্লাহর বন্দেগী করার স্বপক্ষে এটি হচ্ছে দ্বিতীয় যুক্তি। যদি তিনি মানুষকে কেবল সৃষ্টি করেই ছেড়ে দিতেন এবং সামনের দিকে তার দুনিয়ার জীবন যাপনের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক না রাখতেন তাহলেও মানুষের তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো সহায়তা চাওয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতো। কিন্তু তিনি তো সৃষ্টি করার সাথে সাথে পথনির্দেশনা, প্রতিপালন, দেখাশুনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। যে মুহূর্তে মানুষ দুনিয়ায় পদার্পণ করে তখনই তার মায়ের বুকে দুধের ধারা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে স্তন চোষার ও গলা দিয়ে দুধ নিচের দিকে নামিয়ে নেবার কায়দা শিখিয়ে দেয়। তারপর এ প্রতিপালন, প্রশিক্ষণ ও পথ প্রদর্শনের কাজ প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বরাবর চালু থাকে। জীবনের প্রতি পর্যায়ে মানুষের নিজের অস্তিত্ব, বিকাশ, উন্নয়ন ও স্থায়িত্বের জন্য যেসব ধরনের সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় তা সবই তার স্রষ্ট পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সর্বত্রই সঠিকভাবে যোগান দিয়ে রেখেছেন। এ সাজ-সরঞ্জাম থেকে লাভবান হবার এবং একে কাজে লাগাবার জন্য তার যে ধরনের শক্তি ও যোগ্যতার প্রয়োজন তা সবও তার আপন সত্তায় সমাহিত রাখা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি বিভাগে তার যে ধরনের পথনির্দেশনার প্রয়োজন হয় তা দেবার পূর্ণ ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছেন। এ সঙ্গে তিনি মানবিক অস্তিত্বের সংরক্ষণের এবং তাকে বিপদ-আপদ, রোগ-শোক, ধ্বংসকর জীবাণু ও বিষাক্ত প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য তার নিজের শরীরের মধ্যে এমন শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন মানুষের জ্ঞান এখনো যার পুরোপুরি সন্ধান লাভ করতে পারেনি। আল্লাহর এ শক্তিশালী প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যদি না থাকতো, তাহলে সামান্য একটি কাঁটা শরীরের কোন অংশে ফুটে যাওয়াও মানুষের জন্য ধ্বংসকর প্রমাণিত হতো এবং নিজের চিকিৎসার জন্য মানুষের কোন প্রচেষ্টাই সফল হতো না। স্রষ্টার এ সর্বব্যাপী অনুগ্রহ ও প্রতিপালন কর্মকাণ্ড যখন প্রতি মুহূর্তে সকল দিক থেকে মানুষকে সাহায্য করছে তখন মানুষ তাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন সত্তার সামনে মাথা নত করবে এবং প্রয়োজন পূরণ ও সংকট উত্তরণের জন্য অন্য কারো আশ্রয় গ্রহণ করবে, এর চেয়ে বড় মূর্খতা ও বোকামী এবং এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে?
# আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত যে ঠিক নয় এ হচ্ছে তার তৃতীয় কারণ। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক কেবলমাত্র এ দুনিয়া এবং এখানে সে যে জীবন যাপন করে তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অস্তিত্বের সীমানায় পা রাখার পর থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সাথে সাথেই তা খতম হয়ে যায় না। বরং এরপর তার পরিণামও পুরোপুরি আল্লাহরই হাতে আছে। আল্লাহই তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সবশেষে তিনি তাকে দুনিয়া থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। দুনিয়ায় এমন কোন শক্তি নেই যা মানুষের এ ফিরে যাওয়ার পথ রোধ করতে পারে। যে হাতটি মানুষকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যায় আজ পর্যন্ত কোন ঔষধ, চিকিৎসক দেব-দেবীর হস্তক্ষেপ তাকে পাকড়াও করতে পারেনি। এমন কি মানুষেরা যে একদল মানুষকে উপাস্য বানিয়ে পূজা-আরাধনা করেছে তারা নিজেরাও নিজেদের মৃত্যুকে এড়াতে পারেনি। একমাত্র আল্লাহই ফায়সালা করেন, কোন ব্যক্তিকে কখন এ দুনিয়া থেকে ফিরিয়ে নেবেন এবং যখন যার তাঁর কাছ থেকে চলে যাবার সমন এসে যায় তখন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় তাকে চলে যেতেই হয়। তারপর আল্লাহ একাই ফায়সালা করেন, দুনিয়ায় যেসব মানুষ জন্ম নিয়েছিল তাদের সবাইকে কখন পূর্ণবার জীবন দান করবেন এবং তাদের পৃথিবীর জীবনের কাজ-কারবারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। তখনো মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন থেকে কাউকে রেহাই দেয়া বা নিজে রেহাই পাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রত্যেককে তাঁর হুকুমে উঠতেই হবে এবং তাঁর আদালতে হাজির হতেই হবে। তারপর সেই আল্লাহ একাই সেই আদালতের বিচারপতি হবেন। তাঁর ক্ষমতায় কেউ সামান্যতমও শরীক হবে না। শাস্তি দেয়া বা মাফ করা উভয়টিই হবে সম্পূর্ণ তাঁর ইখতিয়ারভুক্ত। তিনি যাকে শাস্তি দিতে চান কেউ তাকে ক্ষমা করার ক্ষমতা রাখে না। অথবা তিনি কাউকে ক্ষমা করতে চাইলে কেউ তাকে শাস্তি দিতে পারবে না। দুনিয়ায় যাদেরকে ক্ষমা করিয়ে নেবার ইখতিয়ার আছে বলে মনে করা হয় তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষমার জন্য তাঁরই অনুগ্রহ ও দয়ার দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে বসে থাকবে। এসব জাজ্বল্যমান সত্যের উপস্থিতিতে যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী করে সে নিজেই নিজের অশুভ পরিণামের ব্যবস্থা করে। দুনিয়া থেকে নিয়ে আখেরাত পর্যন্ত মানুষের ভাগ্য পুরোপুরি ন্যস্ত থাকে আল্লাহর হাতে। আর সেই ভাগ্য গড়ার জন্য মানুষ এমন সব সত্তার আশ্রয় নেবে যাদের হাতে কিছুই নেই, এর চেয়ে বড় ভাগ্য বিপর্যয় আর কী হতে পারে?
# “হুকুম” অর্থ এখানে নবুওয়াত গ্রহণ করা সঠিক হবে না। কারণ এটা যে সময়ের দোয়া সে সময় হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে নবুওয়াত দান করা হয়ে গিয়েছিল। আর ধরে নেয়া যাক যদি এ দোয়া তার আগেরও হয়ে থাকে, তাহলে নবুওয়াত কেউ চাইলে তাকে দান করা হয় না বরং এটি এমন একটি দান যা আল্লাহ নিজেই যাকে চান তাকে দান করেন। তাই এখানে ‘হুকুম’ অর্থ জ্ঞান, হিকমত, প্রজ্ঞা, সঠিক বুঝ-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত করার শক্তি গ্রহণ করাই সঠিক অর্থ হবে। হযরত ইব্রাহীমের (আ) দোয়াটি প্রায় সেই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যে অর্থে নবী ﷺ থেকে এ দোয়া উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ارَنَا الْأَشْيَاءِكَمَاهى অর্থাৎ আমাদের এমন যোগ্যতা দাও যাতে আমরা প্রত্যেকটি জিনিসকে তার যথার্থ স্বরূপে দেখতে পারি এবং প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি যা তার প্রকৃত স্বরূপের প্রেক্ষিতে গ্রহণ করা উচিত।
# দুনিয়ায় আমাকে সৎ সমাজ-সংসর্গ দান করো এবং আখেরাতের ময়দানে সৎলোকদের সাথে আমাকে সমবেত করো। আখেরাতের ময়দানে সৎ লোকদের সাথে কারো সমবেত হওয়া তার মুক্তি লাভ করার সমার্থক হয়ে থাকে। তাই মৃত্যু পরের জীবন ও কিয়ামতের ময়দানে কর্মের প্রতিফল দানের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিরই এ দোয়া করা উচিত। কিন্তু দুনিয়াতেও পবিত্র জীবনের অধিকারী সৎকর্মশীল ব্যক্তির অন্তরের আকাংখাই এই হয়ে থাকে যে, আল্লাহ যেন তাকে একটি ফাসেক, নোংরা ও অসুস্থ সমাজে জীবন যাপন করার বিপদ থেকে নিষ্কৃতি দেন এবং সৎলোকদের সাথে উঠা-বসা ও চলা-ফেরা করার সুযোগ দান করেন। সামাজিক বিকৃতি ও অসুস্থতা যেখানে চারদিকে বিস্তার লাভ করে সেখানে কেবল মাত্র এটাই সর্বক্ষণ একজন লোককে মানসিক পীড়া দেয় না যে, তার চারদিকে সে কেবল নোংরামীই নোংরামী দেখছে বরং তার নিজের পবিত্র জীবন যাপন করা এবং দূষিত আবর্জনার ছিঁটা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলাও তার পক্ষে কঠিন হয়ে থাকে। তাই একজন সৎ লোক ততক্ষণ পর্যন্ত অস্থির থাকে যতক্ষণ না তার নিজের সমাজ পবিত্র ও সুস্থ হয়ে যায় অথবা সে এ সমাজ থেকে বের হয়ে সত্য ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত অন্য একটি সমাজের সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়।
# ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন মর্যাদা ও শুভেচ্ছা সহকারে আমার নাম স্মরণ করে। দুনিয়ায় যেন আমি এমন কাজ না করে যাই যার ফলে ভবিষ্যত বংশধররা আমার পরে আমাকে এমন সব জালেমদের দলভুক্ত করে যারা নিজেরাও ছিল অসৎ ও বিকৃত চরিত্রের অধিকারী এবং দুনিয়াকেও অসৎ ও বিকৃতির পথে চালিয়ে গেছে। বরং আমি যেন এমন সব কাজ করে যাই যার ফলে কিয়ামত পর্যন্ত আমার জীবন মানুষের জন্য আলোকবর্তিকার কাজ করে এবং আমাকে মানব হিতৈষী ও মানবজাতির সেবক গণ্য করা হয়। এটি নিছক লোক দেখানো খ্যাতি ও সুনাম অর্জনের দোয়া নয় বরং প্রকৃত সুখ্যাতি ও যথার্থ সুনাম অর্জনের দোয়া। নিশ্চিত খাঁটি জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম ও সেবাকর্মের ফলে এ সুখ্যাতি অর্জিত হয়। কোন ব্যক্তির এ জিনিস অর্জিত হলে দু’টো লাভ ও উপকার হয়। দুনিয়ায় এর ফলে মানবজাতির ভবিষ্যত বংশধররা খারাপ আদর্শের পরিবর্তে একটি ভালো আদর্শ পেয়ে যায়। এ থেকে তারা ভালো দৃষ্টান্ত লাভ করে এবং ভালো দৃষ্টান্ত থেকে পায় ভালো হবার শিক্ষা। প্রত্যেক সৎব্যক্তি এর মাধ্যমে সত্য-সঠিক পথে চলার প্রেরণা লাভ করে। আর আখেরাতে এর ফলে এক ব্যক্তির ভালো কর্মকাণ্ড অনুসরণ করে যত জন লোকই সৎপথের সন্ধান লাভ করে তাদের সওয়াব সেও লাভ করবে এবং কিয়ামতের দিন তার নিজের কর্মকাণ্ডের সাথে সাথে কোটি কোটি মানুষের সাক্ষ্যও তার স্বপক্ষে উপস্থিত থাকবে যাতে বলা হবে, সে দুনিয়ায় কল্যাণ ও সৎকর্মের এমন স্রোতধারা প্রবাহিত করে এসেছিল যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুগ যুগ ধরে সে ধারায় অবগাহন করেছে।
# কোন কোন মুফাসসির হযরত ইব্রাহীমের মাগফেরাতের দোয়ার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, তাঁর এ মাগফেরাত কামনা ছিল ইসলামের শর্ত সাপেক্ষ। কাজেই তাঁর নিজের পিতার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করাটা ছিল যেন আল্লাহ তাঁকে ইসলাম গ্রহণ করার তাওফীক দান করেন, এ ধরণের একটি দোয়া। কিন্তু কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তা সংশ্লিষ্ট মুফাসসিরগণের এ ব্যাখ্যার সাথে মেলে না। কুরআন বলছে, হযরত ইব্রাহীম নিজের পিতার জুলুম সইতে না পেরে যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিলেন তখন বলেনঃ
سَلَامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا
“আপনাকে সালাম, আমি আপনাকে ক্ষমা করার জন্য নিজের রবের কাছে দোয়া করবো। তিনি আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান।” ( মারয়াম, ৪৭ আয়াত) এ প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তিনি এ মাগফেরাতের দোয়া করেন কেবলমাত্র নিজের পিতার জন্য নয় বরং অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে মাতা ও পিতা উভয়ের জন্য করেনঃ
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ
“হে আমাদের রব! আমার গোনাহ মাফ করো এবং আমার মাতা-পিতারও।” (ইবরাহীম, ৪১ আয়াত )
কিন্তু পরে তিনি নিজেই অনুভব করেন যে, একজন সত্যের দুশমন একজন মু’মিনের পিতা হলেও মাগফেরাতের দোয়ার হকদার হয় না।
وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ
“ইব্রাহীমের নিজের পিতার জন্য মাগফেরাতের দোয়া করা নিছক তাঁর প্রতিশ্রুতির কারণে ছিল, যা সে করেছিল। কিন্তু সে যে আল্লাহর দুশমন, একথা যখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল তখন সে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করলো।” (আত্ তাওবা, ১১৪ আয়াত)
# কিয়ামতের দিন আমাকে এমন অপমানকর অবস্থার সম্মুখীন করো না যেখানে হাশরের ময়দানে পূর্বের ও পরের সমগ্র জনগোষ্ঠী একত্র হবে সেখানে তাদের সবার সামনে ইব্রাহীমের পিতা শাস্তি পেতে থাকবে এবং ইব্রাহীম তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে।
# এ বাক্যাংশ দু’টি কি হযরত ইব্রাহীমের (আ.) দোয়ার অংশ অথবা আল্লাহ তাঁর বক্তব্যের সাথে নিজে এটুকু বাড়িয়ে যোগ করে দিয়েছেন, একথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। যদি প্রথম কথাটি মেনে নেয়া হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, হযরত ইব্রাহীম (আ.) নিজের পিতার জন্য এ দোয়া করার সময় নিজেই এ সত্য সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। আর দ্বিতীয় কথাটি মেনে নেয়া হলে এর অর্থ হবে, তাঁর দোয়ার ওপর মন্তব্য প্রসঙ্গে আল্লাহ এ কথা বলেছেন যে, কিয়ামতের দিন যদি কোন জিনিস মানুষের কাজে লাগতে পারে, তাহলে তা তার ধন-দৌলত ও সন্তান-সন্ততি নয় বরং একমাত্র প্রশান্ত চিত্ত এমন একটি অন্তর যা কুফুরী, শিরক, নাফরমানী, ফাসেকী ও অশ্লীল কার্যকলাপ মুক্ত। ধন-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততিও প্রশান্ত ও নির্মল অন্তরের সাথেই উপকারী হতে পারে। প্রশান্ত অন্তরকে বাদ দিয়ে এদের কোন উপকারিতা নেই। ধন সেখানে কেবলমাত্র এমন অবস্থায় উপকারী হবে যখন মানুষ দুনিয়ায় ঈমান ও আন্তরিকতা সহকারে তা আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। নয়তো কোটিপতি ও বিলিয়ন সম্পদের মালিকরাও সেখানে পথের ভিখারীই হবে। সন্তানদেরও দুনিয়ায় মানুষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ঈমান ও সৎকর্মের শিক্ষা দিলে তবেই তারা সেখানে কাজে লাগাতে পারে। অন্যথায় পুত্র যদি নবীও হয়ে থাকেন, তাহলে যে পিতা কুফুরী ও গোনাহের মধ্যে নিজের জীবনকাল শেষ করেছে এবং সন্তানের সৎকাজে যার কোন অংশ নেই তার শাস্তি পাওয়া থেকে কোন নিষ্কৃতি নেই।
# এখান থেকে শেষ প্যারাগ্রাফ পর্যন্ত সমস্ত বাক্য হযরত ইব্রাহীমের (আ) উক্তির অংশ মনে হয় না। বরং এর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার মনে হয় যে, এগুলো আল্লাহর উক্তি।
# একদিকে মুত্তাকিরা জান্নাতে প্রবেশ করার আগেই দেখতে থাকবে, আল্লাহর মেহেরবানীতে কেমন নিয়ামতে পরিপূর্ণ জায়গায় তারা যাবে। অন্যদিকে পথভ্রষ্টরা তখনো হাশরের ময়দানেই অবস্থান করবে। যে জাহান্নামে তাদের গিয়ে থাকতে হবে তার ভয়াবহ দৃশ্য তাদের সামনে উপস্থাপিত করা হবে।
# মূলে كُبْكِبُوا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি অর্থ নিহিত। এক, একজনের উপর অন্য একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে। দুই, তারা জাহান্নামের গর্তের তলদেশ পর্যন্ত গড়িয়ে যেতে থাকবে।
# ভক্ত-অনুরক্তদের পক্ষ থেকে এভাবে তাদের খাতির তোয়াজ করা হবে। অথচ এ ভক্ত-অনুরক্তরাই দুনিয়ায় এদেরকে বুজর্গ, গুরু ও নেতা বলে মেনে নিয়েছিল। এদের হাতে-পায়ে চুমো দেয়া হতো। এদের কথা ও কাজকে প্রমাণ্য ও আদর্শ বলে স্বীকার করা হতো। এদের সমীপে নজরানা ও মানত পেশ করা হতো। পরকালে গিয়ে যখন সত্য প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং অনুসারীবৃন্দ জানতে পারবে অগ্রবর্তীরা কোথায় চলে এসেছে এবং তাদেরকে কোথায় নিয়ে এসেছে তখন এ ভক্ত-অনুরক্তের দল তাদেরকে অপরাধী গণ্য করবে এবং অভিশাপ দেবে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে পরকালীন জগতের এ শিক্ষণীয় চিত্র অংকন করা হয়েছে, যাতে দুনিয়ায় অন্ধ অনুসারীদের চোখ খুলে যায় এবং কারো পেছনে চলার আগে তারা দেখে নিতে পারে অগ্রবর্তীরা সঠিক পথে যাচ্ছে কিনা। সূরা আ’রাফে বলা হয়েছেঃ
كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَعَنَتْ أُخْتَهَا حَتَّى إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِنَ النَّارِ قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَكِنْ لَا تَعْلَمُونَ
“প্রত্যেকটি দল যখন জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন তার নিজের সাথী দলের উপর অভিশাপ দিতে দিতে যাবে। এমনকি যখন সবাই সেখানে একত্র হয়ে যাবে তখন প্রত্যেক পরবর্তী দল পূর্ববর্তী দল সম্পর্কে বলবে, হে আমাদের রব! এরাই আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল, এখন এদেরকে দ্বিগুণ আগুনের শাস্তি দাও। রব বলবেন, সবার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ শাস্তি কিন্তু তোমরা জানো না।” ( ৩৮ আয়াত )
সূরা হা-মীম আস্ সাজদায় বলা হয়েছেঃ وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا رَبَّنَا أَرِنَا اللَّذَيْنِ أَضَلَّانَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ الْأَسْفَلِينَ “আর কাফেররা সে সময় বলবে, হে আমাদের রব! জিন ও মানুষদের মধ্য থেকে তাদেরকে আমাদের সামনে নিয়ে আসেন যারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল, যাতে আমরা তাদেরকে পায়ের তলায় পিষে ফেলতে পারি এবং তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়।” ( আয়াত ২৯ ) এ বিষয়বস্তুটিই সূরা আহযাবে বলা হয়েছেঃ
وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا – رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا
“আর তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের সরদারদের ও বড়দের আনুগত্য করেছি এবং তারা আমাদের সোজা পথ থেকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। হে আমাদের রব! তাদেরকে দ্বিগুণ আযাব দাও এবং তাদের প্রতি কঠোর লানত বর্ষণ করো।” (৬৭-৬৮ আয়াত)
# যাদেরকে আমরা দুনিয়ায় সুপারিশকারী মনে করতাম এবং যাদের সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস ছিল যে, তাদের পক্ষপুটে যে আশ্রয় নিয়েছে, সে বেঁচে গেছে। তাদের কেউ সুপারিশ করার জন্য মুখ খুলবে না।
# এমন কেউ নেই, যে আমাদের দুঃখে দুঃখ অনুভব করে এবং আমাদের ব্যথায় সমব্যথী হয়। অন্তত আমাদের ছাড়িয়ে নিতে না পারলেও আমাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করবে এমনও কেউ নেই। কুরআন মজীদ বলছে, আখেরাতে একমাত্র মু’মিনদের মধ্যে বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে পথভ্রষ্টরা দুনিয়ায় যতই গভীর ও আন্তরিক বন্ধুত্ব সূত্রে আবদ্ধ থেকে থাক না কেন সেখানে পৌঁছে তারা পরস্পরের প্রাণের শত্রুতে পরিণত হবে। তারা পরস্পরকে অপরাধী গণ্য করবে এবং পরস্পরকে পরস্পরের ধ্বংস ও সর্বনাশের জন্য দায়ী করে একে অন্যকে বেশী শাস্তি দান করাবার চেষ্টা করবে।
الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ
“বন্ধুরা সেদিন হবে একে অন্যের শত্রু কিন্তু মুত্তাকীদের বন্ধুত্ব অপরিবর্তিত থাকবে।” ( আয্ যুখরুফঃ ৬৭ আয়াত)
# এ আকাংখার জবাবও কুরআনে দেয়া হয়েছেঃ
وَلَوْ رُدُّوا لَعَادُوا لِمَا نُهُوا عَنْهُ
“যদি তাদেরকে পূর্ববর্তী জীবনে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাহলে তারা তাই করতে থাকবে যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে।” ( আন’আমঃ ২৮ আয়াত ) যে সব কারণে তাদেরকে ফিরে যাবার সুযোগ দেয়া হবে না এর আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা মু’মিনুনের ৯০-৯২ টীকায়।
# হযরত ইব্রাহীমের এ কাহিনীতে নিদর্শনের তথা শিক্ষার দু’টি দিক রয়েছে। একটি দিক হচ্ছে, আরবের মুশরিকরা একদিকে হযরত ইব্রাহীমের (আ) অনুসারী হবার দাবী করতো এবং তাঁর সাথে নিজেদের সম্পর্ক দেখিয়ে গর্ব করতো। কিন্তু অন্যদিকে তারা সেই একই শিরকে লিপ্ত রয়েছে যার বিরুদ্ধে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন এবং তিনি যে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন আজ যে নবী তা পেশ করছেন তাঁর বিরুদ্ধে তারা ঠিক তাই করছে যা হযরত ইব্রাহীমের জাতি তাঁর সাথে করেছিল। তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, হযরত ইব্রাহীম তো ছিলেন শিরকের শত্রু ও তাওহীদের দাওয়াতের পতাকাবাহী। তোমরা নিজেরাও জানো, হযরত ইব্রাহীম মুশরিক ছিলেন না। কিন্তু এরপরও তোমরা নিজেদের জিদ বজায় রেখে চলছো। এ কাহিনীতে নিদর্শনের দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, ইব্রাহীমের জাতি দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে যে, কোথাও তাদের নাম নিশানাও নেই। তাদের মধ্যে থেকে যদি কারো বেঁচে থাকার সৌভাগ্য হয়ে থাকে তাহলে তারা হচ্ছেন কেবলমাত্র হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ও তাঁর দুই ছেলের (ইসমাইল ও ইসহাক) বংশধরগণ। হযরত ইব্রাহীম তাঁর জাতির মধ্য থেকে বের হয়ে যাবার পর তাদের ওপর যে আযাব আসে কুরআন মজীদে যদিও তার উল্লেখ নেই কিন্তু আযাব প্রাপ্ত জাতিদের মধ্যে তাদেরকে গণনা করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ
لَمْ يَأْتِهِمْ نَبَأُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ قَوْمِ نُوحٍ وَعَادٍ وَثَمُودَ وَقَوْمِ إِبْرَاهِيمَ وَأَصْحَابِ مَدْيَنَ وَالْمُؤْتَفِكَاتِ (التوبة: 70)