( বই # ১১৭৫/ এবং কাফের-রা বলে:-২১) [* *শত্রুদের ধন সম্পদ দেখে প্রতারিত হয়ো না :- **কাফেরদের করুন পরিনতি :- **কাফেরদের জন্যে চরম হুমকি :- **ইসলাম বিরােধীদের চরিত্র :- *আর কাফিররা যখন কুরআন শোনে এবং বলে, ‘এ তো এক পাগল।’:-} www.motaher21.net সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম। পারা:২৯ ১৭- ৫২ নং আয়াত:-

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
( বই # ১১৭৫/ এবং কাফের-রা বলে:-২১)
[* *শত্রুদের ধন সম্পদ দেখে প্রতারিত হয়ো না :-
**কাফেরদের করুন পরিনতি :-
**কাফেরদের জন্যে চরম হুমকি :-
**ইসলাম বিরােধীদের চরিত্র :-
*আর কাফিররা যখন কুরআন শোনে এবং বলে, ‘এ তো এক পাগল।’:-}
www.motaher21.net
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম।
পারা:২৯
১৭- ৫২ নং আয়াত:-
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১৭
اِنَّا بَلَوۡنٰہُمۡ کَمَا بَلَوۡنَاۤ اَصۡحٰبَ الۡجَنَّۃِ ۚ اِذۡ اَقۡسَمُوۡا لَیَصۡرِمُنَّہَا مُصۡبِحِیۡنَ ﴿ۙ۱۷﴾
আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি,যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম বাগানের মালিকদেরকে, যখন তারা শপথ করল যে, তারা ভোর-সকালে তুলে আনবে বাগানের ফল,
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১৮
وَ لَا یَسۡتَثۡنُوۡنَ ﴿۱۸﴾
এবং তারা ‘ইন শাআল্লাহ’ বলল না।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-১৯
فَطَافَ عَلَیۡہَا طَآئِفٌ مِّنۡ رَّبِّکَ وَ ہُمۡ نَآئِمُوۡنَ ﴿۱۹﴾
অতঃপর তোমার রবের পক্ষ থেকে একটি বিপর্যয় এসে সে বাগানে চড়াও হলো। তখন তারা ছিলো নিদ্রিত।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২০
فَاَصۡبَحَتۡ کَالصَّرِیۡمِ ﴿ۙ۲۰﴾
ফলে তা পুড়ে গিয়ে কালোবর্ণ ধারণ করল।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২১
فَتَنَادَوۡا مُصۡبِحِیۡنَ ﴿ۙ۲۱﴾
ভোর-সকালে তারা একে অপরকে ডাকাডাকি করে বলল,
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২২
اَنِ اغۡدُوۡا عَلٰی حَرۡثِکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰرِمِیۡنَ ﴿۲۲﴾
‘তোমরা যদি ফল তুলতে চাও, তাহলে সকাল সকাল বাগানে চল।’
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২৩
فَانۡطَلَقُوۡا وَ ہُمۡ یَتَخَافَتُوۡنَ ﴿ۙ۲۳﴾
তারপর তারা চলল নিম্নস্বরে কথা বলতে বলতে,
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২৪
اَنۡ لَّا یَدۡخُلَنَّہَا الۡیَوۡمَ عَلَیۡکُمۡ مِّسۡکِیۡنٌ ﴿ۙ۲۴﴾
‘আজ সেখানে যেন তোমাদের কাছে কোন মিসকীন প্ৰবেশ করতে না পারে।’
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২৫
وَّ غَدَوۡا عَلٰی حَرۡدٍ قٰدِرِیۡنَ ﴿۲۵﴾
তারা কিছুই না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভোরে এমনভাবে দ্রুত সেখানে গেল যেন তারা (ফল আহরণ করতে) সক্ষম হয়।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২৬
فَلَمَّا رَاَوۡہَا قَالُوۡۤا اِنَّا لَضَآلُّوۡنَ ﴿ۙ۲۶﴾
কিন্তু বাগানের অবস্থা দেখার পর বলে উঠলোঃ আমরা রাস্তা ভুলে গিয়েছি।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২৭
بَلۡ نَحۡنُ مَحۡرُوۡمُوۡنَ ﴿۲۷﴾
বরং আমরা তো বঞ্চিত!’
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২৮
قَالَ اَوۡسَطُہُمۡ اَلَمۡ اَقُلۡ لَّکُمۡ لَوۡ لَا تُسَبِّحُوۡنَ ﴿۲۸﴾
তাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলল, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি, এখনো তোমরা আল্লাহ্র পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছনা কেন ?’
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-২৯
قَالُوۡا سُبۡحٰنَ رَبِّنَاۤ اِنَّا کُنَّا ظٰلِمِیۡنَ ﴿۲۹﴾
তখন তারা বলে উঠলোঃ আমাদের রব অতি পবিত্র। বাস্তবিকই আমরা গোনাহগার ছিলাম।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩০
فَاَقۡبَلَ بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ یَّتَلَاوَمُوۡنَ ﴿۳۰﴾
অতঃপর তারা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করতে লাগল।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩১
قَالُوۡا یٰوَیۡلَنَاۤ اِنَّا کُنَّا طٰغِیۡنَ ﴿۳۱﴾
তারা বলল, ‘হায় দুর্ভোগ আমাদের! নিশ্চয় আমরা সীমালংঘনকারী ছিলাম।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩২
عَسٰی رَبُّنَاۤ اَنۡ یُّبۡدِلَنَا خَیۡرًا مِّنۡہَاۤ اِنَّاۤ اِلٰی رَبِّنَا رٰغِبُوۡنَ ﴿۳۲﴾
বিনিময়ে আমাদের রব হয়তো এর চেয়েও ভাল বাগান আমাদের দান করবেন। আমরা আমাদের রবের দিকে রুজু করছি ।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩৩
کَذٰلِکَ الۡعَذَابُ ؕ وَ لَعَذَابُ الۡاٰخِرَۃِ اَکۡبَرُ ۘ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿٪۳۳﴾
শাস্তি এরূপই হয়ে থাকে এবং আখিরাতের শাস্তি কঠিনতর। যদি তারা জানত !
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩৪
اِنَّ لِلۡمُتَّقِیۡنَ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ جَنّٰتِ النَّعِیۡمِ ﴿۳۴﴾
নিশ্চয় মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত তাদের রবের কাছে।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩৫
اَفَنَجۡعَلُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ کَالۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿ؕ۳۵﴾
আমি কি অনুগতদের অবস্থা অপরাধীদের মতো করবো?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩৬
مَا لَکُمۡ ٝ کَیۡفَ تَحۡکُمُوۡنَ ﴿ۚ۳۶﴾
তোমাদের কি হয়েছে? তোমাদের এ কেমন সিদ্ধান্ত?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩৭
اَمۡ لَکُمۡ کِتٰبٌ فِیۡہِ تَدۡرُسُوۡنَ ﴿ۙ۳۷﴾
তোমাদের নিকট কি কোন কিতাব আছে, যা তোমরা অধ্যয়ন কর?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩৮
اِنَّ لَکُمۡ فِیۡہِ لَمَا تَخَیَّرُوۡنَ ﴿ۚ۳۸﴾
নিশ্চয় তোমাদের জন্য ওতে রয়েছে, যা তোমরা পছন্দ কর?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৩৯
اَمۡ لَکُمۡ اَیۡمَانٌ عَلَیۡنَا بَالِغَۃٌ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ ۙ اِنَّ لَکُمۡ لَمَا تَحۡکُمُوۡنَ ﴿ۚ۳۹﴾
আমি কি তোমাদের সাথে কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ এমন কোন প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ আছি যে, তোমরা নিজেদের জন্য যা স্থির করবে তাই পাবে?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪০
سَلۡہُمۡ اَیُّہُمۡ بِذٰلِکَ زَعِیۡمٌ ﴿ۚۛ۴۰﴾
আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন তাদের মধ্যে এ দাবির যিম্মাদার কে?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪১
اَمۡ لَہُمۡ شُرَکَآءُ ۚۛ فَلۡیَاۡتُوۡا بِشُرَکَآئِہِمۡ اِنۡ کَانُوۡا صٰدِقِیۡنَ ﴿۴۱﴾
তাদের কি কোন শরীক উপাস্য আছে? থাকলে তারা তাদের শরীক উপাস্যগুলোকে উপস্থিত করুক; যদি তারা সত্যবাদী হয়।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪২
یَوۡمَ یُکۡشَفُ عَنۡ سَاقٍ وَّ یُدۡعَوۡنَ اِلَی السُّجُوۡدِ فَلَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ ﴿ۙ۴۲﴾
যেদিন কঠিন সময় এসে পড়বে এবং সিজদা করার জন্য লোকদেরকে ডাকা হবে। কিন্তু তারা সিজদা করতে সক্ষম হবেনা।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪৩
خَاشِعَۃً اَبۡصَارُہُمۡ تَرۡہَقُہُمۡ ذِلَّۃٌ ؕ وَ قَدۡ کَانُوۡا یُدۡعَوۡنَ اِلَی السُّجُوۡدِ وَ ہُمۡ سٰلِمُوۡنَ ﴿۴۳﴾
তাদের দৃষ্টি অবনত হবে, হীনতা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে অথচ যখন তারা সুস্থ ছিল, তখন তো তাদেরকে সিজদা করতে আহবান করা হত।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪৪
فَذَرۡنِیۡ وَ مَنۡ یُّکَذِّبُ بِہٰذَا الۡحَدِیۡثِ ؕ سَنَسۡتَدۡرِجُہُمۡ مِّنۡ حَیۡثُ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿ۙ۴۴﴾
তাই হে নবী! এ বাণী অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমি ধীরে ধীরে এমনভাবে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবো যে, তারা বুঝতেই পারবে না।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪৫
وَ اُمۡلِیۡ لَہُمۡ ؕ اِنَّ کَیۡدِیۡ مَتِیۡنٌ ﴿۴۵﴾
আর আমি তাদেরকে ঢিল দিয়ে থাকি, আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪৬
اَمۡ تَسۡـَٔلُہُمۡ اَجۡرًا فَہُمۡ مِّنۡ مَّغۡرَمٍ مُّثۡقَلُوۡنَ ﴿ۚ۴۶﴾
তুমি কি তাদের নিকট পারিশ্রমিক চাচ্ছ যে, তারা একে একটি দুর্বহ দন্ড মনে করবে?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪৭
اَمۡ عِنۡدَہُمُ الۡغَیۡبُ فَہُمۡ یَکۡتُبُوۡنَ ﴿۴۷﴾
তাদের কি অদৃশ্যের জ্ঞান আছে যে, তারা লিখে রাখে?
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪৮
فَاصۡبِرۡ لِحُکۡمِ رَبِّکَ وَ لَا تَکُنۡ کَصَاحِبِ الۡحُوۡتِ ۘ اِذۡ نَادٰی وَ ہُوَ مَکۡظُوۡمٌ ﴿ؕ۴۸﴾
অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর তোমার প্রতিপালকের নির্দেশের অপেক্ষায়, তুমি তিমি-ওয়ালা (ইউনুস)এর মত অধৈর্য হয়ো না, যখন সে বিষাদ আচ্ছন্ন অবস্থায় কাতর প্রার্থনা করেছিল।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৪৯
لَوۡ لَاۤ اَنۡ تَدٰرَکَہٗ نِعۡمَۃٌ مِّنۡ رَّبِّہٖ لَنُبِذَ بِالۡعَرَآءِ وَ ہُوَ مَذۡمُوۡمٌ ﴿۴۹﴾
যদি তার রবের অনুগ্রহ তার কাছে না পৌঁছত তবে তিনি লাঞ্ছিত অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হতেন উন্মুক্ত প্ৰান্তরে।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৫০
فَاجۡتَبٰہُ رَبُّہٗ فَجَعَلَہٗ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۵۰﴾
অবশেষে তার রব তাকে বেছে নিলেন এবং নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করলেন।
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৫১
وَ اِنۡ یَّکَادُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَیُزۡلِقُوۡنَکَ بِاَبۡصَارِہِمۡ لَمَّا سَمِعُوا الذِّکۡرَ وَ یَقُوۡلُوۡنَ اِنَّہٗ لَمَجۡنُوۡنٌ ﴿ۘ۵۱﴾
আর কাফিররা যখন কুরআন শোনে তখন তারা যেন তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা আপনাকে আছড়ে ফেলবে এবং বলে, ‘এ তো এক পাগল।’
সুরা: ৬৮: আল্-ক্বলম:-৫২
وَ مَا ہُوَ اِلَّا ذِکۡرٌ لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿٪۵۲﴾
অথচ তা সারা বিশ্ব-জাহানের জন্য উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

১৭-৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
ফী সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-33

كَذٰلِكَ الْعَذَابُ١ؕ وَ لَعَذَابُ الْاٰخِرَةِ اَكْبَرُ١ۘ لَوْ كَانُوْا یَعْلَمُوْنَ۠

আযাব এরূপই হয়ে থাকে। আখেরাতের আযাব এর চেয়েও বড়। হায়! যদি তারা জানতো।

তাফসীর :
তাফহীমুল কুরআন:

তাফসীরের জন্য পরবর্তী আয়াত দেখুন।।

ফী জিলালিল কুরআন:

*একটি বিখ্যাত ঘটনা ও তার ব্যাখ্যা : এরশাদ হয়েছে, ‘আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি, যেমন করেছিলাম বাগিচার মালিকদেরকে। তারা কসম খেয়েছিলাে যে, সকাল হতে না হতেই বাগানের ফল পেড়ে ফেলবাে, তারা কিন্তু ইনশাআল্লাহ বলেনি। ফলে সেই বাগানের ওপর দিয়ে তােমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটা প্রলয়ংকরী ঝড় বয়ে গেলাে। তখন তারা ঘুমিয়েছিলাে। ব্যাস, আর যায় কোথায়। সকালে দেখা গেলাে গােটা বাগান যেন ফসল তুলে নেয়া মাঠে পরিণত হয়ে গেছে। এদিকে ভোর বেলায় তারা পরস্পরকে ডাকাডাকি করতে লাগলাে যে, ফল পাড়তে হলে তােমরা বাগানে সকালে সকালে চলো। তারা গোপনে এরূপ সলাপরামর্শ করতে করতে গেলে যে, আজ যেন কোনাে অভাবী মানুষ বাগানে ঢুকতে না পারে। এখন তারা হকদারদেরকে বঞ্চিত করাতে সক্ষম ছিলাে। কিন্তু যখন তারা বাগানটি দেখলাে তখন বললাে যে, আমরা পথ ভুলে এসেছি। (পরক্ষণেই বললাে) না, বরং আমরা বঞ্চিত হয়ে গেছি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিটি বললো, আমি তােমাদের বলেছিলাম না যে, তােমরা কেন আল্লাহর গুণগান করাে না? তারা বললো, আমরা আল্লাহর গুণগান করছি। আমরা তাে যুলুম করে ফেলেছি। অতপর একে অপরকে ভৎর্সনা করতে লাগলাে। তারা বললাে, ‘হায় আফসােস, আমরা সীমা অতিক্রম করেছিলাম। আশাকরি আমাদের প্রভু আমাদেরকে এই বাগানের পরিবর্তে আরাে ভালো কিছু দেবেন। আমরা আমাদের প্রতিপালকের প্রতি অনুরক্ত। এরশাদ হয়েছে, ‘এভাবেই আযাব এসে থাকে, আর আখেরাতের আযাব সবচেয়ে বড়, যদি তারা জানে।’ এ ঘটনাটা হয়ত তৎকালের একটা বিখ্যাত ঘটনা ছিলাে। তবে কোরআন শুধু গল্প বলার জন্যে এর অবতারণা করেনি। কোরআন শুধু আল্লাহর কাজ ও ক্ষমতা এবং তার কোনাে কোনাে বান্দাকে তিনি কিভাবে পরীক্ষা করেন তা বুঝানাের জন্যে এ ঘটনা বর্ণনা করেছে। এ বিবরণের নেপথ্যে একটা গ্রামের সহজ সরল অধিবাসীদের ছবি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত এ ঘটনা যাদেরকে শুনানাে হচ্ছে, সেই আরববাসীর জন্যে এটা অধিকতর উপযােগী ছিলাে। তারা আল্লাহর বিধানকে অমান্যকারী হঠকারী লােক ছিলাে বটে, তবে তাদের মগজ অপেক্ষাকৃত সরল ছিলাে, পেঁচানাে বা জটিল ছিলাে না। কোরআন যে ভংগীতে ও যে উদ্দেশ্যে কিচ্ছা কাহিনী বলে, আলােচ্য ঘটনা সেই উদ্দেশ্যের দিকেই পথ নির্দেশ করছে। এ ঘটনা এমন নাটকীয়ভাবে ও আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছে যে, শ্রোতার মনে তা জানার প্রচন্ড কৌতুহল সৃষ্টি হয়। এতে মানুষের চেষ্টা তদবীর ও চক্রান্তকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এবং আল্লাহর ব্যবস্থাপনার সামনে তা কতাে অক্ষম ও অসহায় তা দেখানাে হয়েছে। ঘটনাটি বর্ণনা করার জন্যে এমন প্রাঞ্জল ও জীবন্ত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যে, শ্রোতা বা পাঠকের কাছে তা এই মুহূর্তের একটি ঘটনা বলে মনে হয়। এবার আসুন কোরআনের ভাষায় ঘটনাটি যেভাবে এসেছে, আমরা সেভাবে তার ওপর দৃষ্টি দিতে চেষ্টা করি। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, কোনাে এক সময়ে একজন পুণ্যবান ব্যক্তির একটি ফলের বাগান ছিল। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, সে ফলের বাগানের ফলের একটা অংশ দরিদ্র লােকেরা নিয়মিত পেতাে। কিন্তু তাঁর তিরোধানের পর উত্তরাধিকারীরা দরিদ্র লােকদেরকে কোনাে অংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে ঘটনার বিবরণটি শুনুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মক্কার কাফেরদেরকে অবিকল সেইভাবে পরীক্ষা করেছি যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম বাগানের মালিকদেরকে। তারা কসম খেয়েছিলাে যে, সকাল বেলায় তারা ফল পাড়বেই এবং কোনাে দরিদ্র ব্যক্তিকে কিছুই দেবে না। তারা জানত যে, ফল পাড়ার খবর শুনে দরিদ্র লােকেরা অবশ্যই আসবে। তাই তারা গভীর রাতে পরামর্শ করলাে যে, তারা সকাল সকালে ও দ্রুতগতিতে ফল পাড়তে হবে যেন কেউ জানতেই না পারে এবং কাউকে কিছু দিতে না হয়। কিন্তু সেই রাতের অন্ধকারে তাদের অজ্ঞাতসারে ঘটে গেলাে অন্য এক ঘটনা। আল্লাহ তায়ালা তাে চিরজাগ্রত। তিনি কখনাে ঘুমান না, তিনি তাদের অসদুদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্যে গভীর কৌশল খাটালেন। এটা ছিলাে তাদের অকৃতজ্ঞতার শাস্তি। কেননা তারা আল্লাহর নেয়ামতের না-শােকরি করেছিলাে, কল্যাণমূলক কাজ থেকে বিরত থেকেছিলাে এবং দরিদ্র লােকদের নির্দিষ্ট প্রাপ্য দিতে কার্পণ্য করেছিলাে। তাই সবাই যখন গভীর ঘুমে অচেতন তখন অতর্কিতে অতি সংগােপনে এক সুক্ষ্ম ঘটনাটি সংঘটিত হলাে। কোরআনের ভাষায়, তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে এক ঘূর্ণায়মান বস্তু (ঘূণিৰায়ু) সে বাগানের ওপর চক্র দিলাে। তখন তারা ঘুমন্ত ছিলাে। ফলে সকাল বেলায় সে বাগান এমন একটা মাঠের রূপ ধারণ করলাে যেখানে থেকে ফসল কেটে নেয়া হয়েছে সেই ঘূর্ণিবায়ু বা আল্লাহর আযাব তার ফসলাদিকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে! অতি প্রত্যুষে সেই কুচক্রী বাগান মালিকেরা তাদের পরিকল্পনা মােতাবেক পরস্পরকে ডাকাডাকি করতে লাগলাে যে, ‘তােমরা তােমাদের খামারের দিকে সকাল সকাল চলাে- যদি তােমাদের ফসল কাটার ইচ্ছা থেকে থাকে!’ অর্থাৎ সবাই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে দিতে, উৎসাহ দিতে দিতে এবং পরামর্শ দিতে দিতে চলল। এরপর কোরআন তাদেরকে নিয়ে কিভাবে উপহাস করছে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদেরকে ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে চলমান দেখানাে হচ্ছে। ভাবখানা এই যে, তারা তাদের কৌশলটাকে একেবারেই অব্যর্থ বানিয়ে ফেলেছে এবং তারা যেন নির্ঘাত গরীব দুঃখীদের বঞ্চিত করে সকল ফল কেটে না এনে আর ছাড়ছেই না! তারা চললাে ফিসফিস করে এ কথা বলতে বলতে যে, আজ আর কোনাে দরিদ্র যেন কিছুতেই বাগানে ঢুকতে না পারে। পরবর্তী আয়াতেও তাদের প্রতি উপহাস অব্যাহত রয়েছে। যেন আমরা কোরআনের পাঠক শ্রোতারা সে বাগানের ওপর কি ঘটেছিলাে তা জানি, অথচ বাগানের মালিকরা জানেনা। আসলেও আমরা মােমেন পাঠক-পাঠিকারা বাগানের দিকে অগ্রসরমান গােপন ও সূক্ষ্ম হাতটিকে দেখেছি। দেখেছি তা কিভাবে তার সমস্ত ফসল নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সেই ভয়ংকর গােপন ঘূর্ণিবায়ু সংঘটিত হবার পর দেখলাম, ক্ষেতটি এমন বিরাণ হয়ে আছে যেমনটি ফসল কেটে নেয়ার পর হয়ে থাকে । আল্লাহ তায়ালা যথারীতি উপহাসের সুরে বলছেন, তারা বঞ্চিত করার ক্ষমতা হাতে নিয়ে সকাল সকাল ছুটে গেলাে।’ বস্তুত বঞ্চিত করার ক্ষমতা তাদের ছিলাে বৈ কি? অন্যকে না হােক, অন্তত নিজেদের বঞ্চিত করার ক্ষমতা তাে তাদের ছিলােই। তারা এরপর অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে ভড়কে যাচ্ছে। আয়াতের বক্তব্যের সাথে সাথে আমরাও যেন উপহাস করতে করতে চলেছি এবং তাদেরকে দেখছি হতবুদ্ধি হয়ে যেতে। অতপর তারা যখন বাগানটি দেখলাে, বললাে অর্থাৎ এতে আমাদের সেই আপাদমস্তক ফলে টইটম্বুর বাগান নয়! আমরা নিশ্চয়ই সে পথ হারিয়ে অন্য কোথাও এসে পড়েছি। কিন্তু ক্ষণেক পরেই তারা সম্বিত ফিরে পায় এবং নিশ্চিত হয়ে বলে, বরঞ্চ আমরাই বঞ্চিত হয়ে গেছি। বস্তুত এটাই হলাে সুনিশ্চিত সংবাদ। আমরা পথ ভুলে এসেছি। এখন তারা যখন তাদের রাতের বেলার সলাপরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের পরিণাম ভােগ করছে এবং অকৃতজ্ঞতা ও কৃপণতার শাস্তি হাতে হাতে পেয়ে গেছে। এখন তাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে মধ্যমপন্থী এবং সবচেয়ে সৎ ব্যক্তিটি এগিয়ে এলাে। দেখে মনে হয় সে এদের থেকে ভিন্ন মত পােষণ করতাে। তবে নিজের ভিন্ন ও একক মত অন্যদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর সেও তাদের অনুসরণ করে। যে সত্য সে সুনিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলাে তার ওপর সে দৃঢ়তা দেখায়নি। ফলে অন্যদের মতাে তাকেও গ্রাস করলাে বঞ্চনা। কিন্তু ঘটনার পর সে তাদেরকে তার পূর্বেকার সদুপদেশের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সে বলে, আমি কি তােমাদেরকে বলিনি যে, তােমরা আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করাে না কেন? আর সময় ও সুযােগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর এখন তারা তাদের সদুপদেশদাতার কথা মান্য করল। তারা বললাে, ‘আমরা আমাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘােষণা করছি, নিশ্চয় আমরা অপরাধী।’ যখন একটি দল কোনাে খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হয়, তখন তাদের একে অপরকে দোষারােপ করা একটি স্বাভাবিক রীতি। এই বাগানের মালিকরাও তাই করলাে, তারা একে অপরকে দোষারােপ করতে লাগলাে। শােচনীয় পরিণতির সম্মুখীন হয়ে পরক্ষণেই তারা পারস্পরিক দোষারােপ বন্ধ করে সকলেই। নিজ নিজ ভুল স্বীকার করলাে, যাতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ক্ষমা করেন এবং তাদের অকৃতজ্ঞতা, কৃপণতা ও চক্রান্তের দায়ে যে বাগান ধ্বংস হয়েছে যেন তার কিছুটা ক্ষতিপূরণ হয়। তারা বললাে, “হায় পােড়া কপাল! আমরা সীমা অতিক্রমকারী ছিলাম। আশা করা যায়, অচিরেই আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে এর চেয়ে ভালাে কোনাে বিকল্প দেবেন। আমরা আমাদের প্রতিপালকের প্রতি আগ্রহী।’ সর্বশেষ দৃশ্যের যাবনিকাপাতের আগে আমরা মন্তব্য শুনতে পাই এ রকমই হয়ে থাকে আযাব, আর আখেরাতের আযাব আরাে বড়, যদি তারা জানতো! অনুরূপভাবে নেয়ামত দিয়েও মাঝে মাঝে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। কাজেই মক্কার মােশরেকদের জানা উচিত যে, আমি সে বাগানওয়ালাদের মতাে তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি। পরীক্ষার ফল কি হয় তার দিকে যেন তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। আর দুনিয়ার পরীক্ষা ও আযাবের চেয়েও ভয়াবহ যে আযাব, তা থেকে সতর্ক হওয়া উচিত, সেটি হচ্ছে আখেরাতের আযাব। কোরআন এভাবে কোরায়শ জনগােষ্ঠীকে এই বাস্তব অভিজ্ঞতাটি অবহিত করে। এটি গল্পাকারে তাদের মধ্যেও প্রচলিত ছিলাে। তাই কোরআন অতীত ও বর্তমান কালের মানুষের মধ্যে আল্লাহর যে চিরাচরিত নীতি রয়েছে তার মধ্যে সংযােগ স্থাপন করে। আর তাদের মনে এই শিক্ষা বদ্ধমূল করে যে, আল্লাহর সেই নীতি এখনাে তাদের বাস্তব জীবনে কার্যকর রয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন:   *শত্রুদের ধন সম্পদ দেখে প্রতারিত হয়ো না : সংগে সংগে মােমেনদের মনে এই চেতনা সৃষ্টি করে যে, বড় বড় পৌত্তলিক নেতার বিশেষত কোরায়শ নেতাদের জীবনে জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসবহুল জীবনের যে লক্ষণ দেখা যায় তা আসলে আল্লাহর পরীক্ষা। এর ফলাফল আছে এবং পরিণতি আছে। আর আল্লাহর রীতি এই যে, তিনি দুঃখ কষ্ট দিয়ে যেমন পরীক্ষা করেন, তেমনি সুখ সম্ভোগ দিয়েও পরীক্ষা করেন। যারা অঢেল সুখ সমৃদ্ধি পেয়ে পরিণাম ভুলে যায় এবং কৃপণতা ও অকৃতজ্ঞতার প্রদর্শন করে, তাদের পরিণতির জন্যে এ ঘটনা একটা নমুনা। আখেরাতে তাদের জন্যে এর চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। আর মোত্তাকী পরহেযগার ব্যক্তি যারা সংহত জীবন যাপন করেছেন, তাদের জন্যে রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে নেয়ামতে পরিপূর্ণ বেহেশত। ‘নিশ্চয় সংযত আল্লাহভীরুদের জন্যে রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে নেয়ামতে পরিপূর্ণ অনেক বেহেশত।’ এ হলাে তুলনামূলক পরিণতির ঘােষণা। একই সাথে এ আয়াতে মত, পথ ও আচরণের তুলনা করা হয়েছে। পরস্পর বিরােধী দুই আচরণের পথও ভিন্ন, গন্তব্যও ভিন্ন। এখানে এসে কোরআন একটা বিতর্ক উপস্থাপিত করে। এ এক সহজ ও সরল বিতর্ক। মানুষকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে কোরআন চ্যালেঞ্জ দেয়। সে প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের একটিমাত্রই জবাব রয়েছে। এ জবাবের মধ্যে রয়েছে আখেরাতে ভয়াবহ দৃশ্যের হুমকি, আর দুনিয়াতে সর্বশক্তিমান। আল্লাহর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার হুঁশিয়ারী। ‘আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের সমপর্যায়ে রাখব? তােমাদের কি হয়েছে?…’ এর জবাব স্পষ্টতই নেতিবাচক। এর জবাব এই যে-না, তা হতেপারে না। যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি অবিচল আস্থাশীল। তারা কখনাে অপরাধীদের মতাে হতে পারে না। কারণ অপরাধীরা স্বেচ্ছায় অপরাধের ভেতরে ডুবে থাকে। তাই বুদ্ধি ও ন্যায়নীতি উভয়ের বিচারেই মুসলিম-অমুসলিম নির্দোষ ও অপরাধীরা কখনাে প্রতিদানের বেলায় একসমান হতে পারে না। এজন্যে পরবর্তী আয়াতে আর একটি প্রশ্ন করা হচ্ছে, তোমাদের কি হলাে? তােমরা কি ধরনের বিচার বিবেচনা কর? অর্থাৎ কিসের ভিত্তিতে তােমরা বিচার বিবেচনা ও মতামত প্রতিষ্ঠা করে থাকো? কোন কষ্টিপাথরে তােমরা বিভিন্ন মূল্যবােধ যাচাই করাে যে, তােমাদের দাঁড়িপাল্লায় ইসলাম গ্রহণকারীরা অপরাধীর সমপর্যায়ে পরিগনিত হয়? এরপর কিছুটা বিদ্রুপের ভংগীতে বলা হয়, ‘তবে কি তােমাদের কাছে কোনাে গ্রন্থ আছে যা তােমরা পাঠ করে থাক এবং সেই মতে তােমরা যা খুশী মত পােষণ করে থাকো।’ বস্তুত এটা সুস্পষ্ট বিদ্রুপ যে, মােশরেকদের কাছে কিতাব আছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হয়েছে এবং সেই কিতাব এমন যে, আগে কোনাে বুদ্ধি বিবেক বা ন্যায়নীতি দ্বারা সমর্থিত নয় এমন মতামতও তা সমর্থন করে এবং তা ইসলাম গ্রহণকারী ও অপরাধীকে এক কাতারে দাঁড় করানাে হয়। ওটাতাে একখানা হাস্যকর পুস্তক, যা তাদের প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনাকে সমর্থন ও সহযােগিতা দেয়। যেমন ধরনের আইন বিধি তারা পছন্দ করে তা বানিয়ে নেয়ার অনুমতি দেয়। তা কোনাে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ নেয়না এবং ভালাে ও যুক্তি সম্মত জিনিসের প্রতি সমর্থন দেয় না। তাদের কি আমার ওপর কেয়ামত পর্যন্ত এই মর্মে শপথ ছিলাে যে, তােমরা যেমন খুশী সিদ্ধান্ত নিতে পারাে? অর্থাৎ তাদের কাছে যদি সে ধরনের কোনাে কিতাব না থেকে থাকে, তবে আল্লাহর নামে কিছু শপথ রয়েছে কিনা যা কেয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে এবং যা তাদেরকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দিয়েছে? জানা কথা যে, এ ধরনের কিছুই নেই। কাজেই আল্লাহর কাছে তাদের জন্যে কোনাে ওয়াদা নেই এবং অংগীকারও নেই। তাদেরকে তুমি জিজ্ঞাসা করলে, তাদের মধ্যে কে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল। অর্থাৎ কে তাদেরকে এ ধরনের অংগীকার দিয়েছে কে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, আল্লাহর কাছে তারা যা চাইবে তাই পাবে এবং তাদের জন্যে কেয়ামত অবধি কার্যকর প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, তারা যা খুশী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আসলে এ হচ্ছে তাদের প্রতি কোরআনের এক গভীর ও নির্মম পরিহাস। অথবা তাদের কি কিছু অংশীদার রয়েছে? থাকলে তাদেরকে নিয়ে আসুক, যদি তারা সত্যবাদী হয়ে থাকে । আল্লাহ তায়ালা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন যে, যাদেরকে তারা আল্লাহর অংশীদার ভেবে পূজা করছে তাদেরকে নিয়ে আসুক।
ফী জিলালিল কুরআন:   *কাফেরদের করুন পরিনতি : ‘যেদিন পায়ের নলা নগ্ন হবে এবং তাদেরকে সাজদা করতে বলা হবে কিন্তু তা করতে পারবে না।’ এখানে কোরআন কাফেরদেরকে এমনভাবে কেয়ামতের দৃশ্যের মুখােমুখী দাঁড় করায় যেন সে দৃশ্য এই মুহূর্তেই উপনীত। যেন তাদেরকে চ্যালেঞ্জ দেয়া হচ্ছে যে, তারা তাদের কল্পিত উপাস্যদেরকে ডেকে আনুক। শ্রোতাদের সামনে তাকে এভাবে তুলে ধরা কোরআনের চিরাচরিত রীতি এবং তা অত্যন্ত প্রভাবশালী ও উদ্দীপক। আয়াতটিতে যে পায়ের নলা নগ্ন হওয়ার কথাটা বলা হয়েছে, প্রচলিত আরবীতে তার অর্থ হলাে কঠিন বিপদ মুসিবত আপতিত হওয়া। তাই কেয়ামতের দিনের পরিচয় দাঁড়ালাে এই যে, যেদিন কঠিন বিপদ মুসিবত আপতিত হবে এবং দিনটির ভয়াবহতা এতাে বেশী হবে যে, মানুষ পায়ের নলার ওপর কাপড় তুলে ছুটোছুটি করবে। সেদিন এইসব অংহকারী মানুষকে সাজদা করতে ডাকা হবে কিন্তু তারা সাজদা করতে পারবে না। এর কারণ এও হতে পারে যে, তার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। কেননা সিজদার স্বাভাবিক সময় ছিলাে কেয়ামতের আগে ও মৃত্যুর আগে । অথবা এও হতে পারে যে, কোরআনের অন্যত্র যেমন বলা হয়েছে, কাফেররা সেদিন ঘাড় ঝুঁকিয়ে চোখ নামিয়ে থাকবে। তাদের দেহ ও দেহের রগসমূহ প্রচন্ড ভয়ে বাঁধা থাকবে এবং অনিচ্ছা সত্তেও তাদের দেহ এমনভাবে আড়ষ্ট থাকবে যে, কিছুতেই তা সাজদা দেয়ার জন্যে ঝুঁকতে পারবে না। মােটকথা, এ বিবরণ দ্বারা কেয়ামতের ভয়াবহ কষ্টদায়ক পরিস্থিতিকেই এখানে বুঝানাে হয়েছে। এরপর তাদের আকৃতির চিত্র অংকন সম্পূর্ণ করা হয়েছে এই বলে, তাদের দৃষ্টি থাকবে অবনমিত এবং তারা আপাদমস্তক লাঞ্ছনা গঞ্জনায় জর্জরিত থাকবে।’ এইসব অহংকারী সমাজপতিদের গর্বস্ফীত ঘাড় ঝুঁকে যাবে, তাদের চোখ নত হবে এবং অপমানে জর্জরিত হবে এটা বিস্ময়কর বৈ কি। সূরার শুরুতে ‘অচিরেই তার শুঁড়ে দাগ দেবাে’ যে হুমকি দেয়া হয়েছে এ আয়াত সেই হুমকি ও হুঁশিয়ারীকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বস্তুত এ আয়াতে চরম লাঞ্ছনা ও অবমাননাকর অবস্থা দৃশ্যমান। আর এ অবমাননাকর অবস্থা দেখা দেওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে আয়াতের শেষাংশে, ‘অথচ ইতিপূর্বে যখন তাদেরকে সিজদা করার আহবান জানানাে হতাে, তখন তারা সুস্থ ছিলো।’ অর্থাৎ সিজদা করার ক্ষমতা তাদের ছিলাে, কিন্তু তারা সিজদা করতে অস্বীকার করতাে। কারণেই কেয়ামতের দিন তাদের অমন শােচনীয় অবস্থা হবে।

ফী জিলালিল কুরআন:   *কাফেরদের জন্যে চরম হুমকি : এর পরবর্তী আয়াতেও রয়েছে মনে আতংক সৃষ্টিকারী আরাে একটি হুমকি, ‘আমাকে ও আমার এই বাণীকে যে প্রত্যাখ্যান করে তাকে একলা ছেড়ে দাও।’ হৃদয় কাঁপানাে এই হুমকিতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রসূলকে(স.) বলছেন যে, এই বাণীকে কে প্রত্যাখ্যান করে তার সাথে আমাকেই লড়তে দাও, তাকে শায়েস্তা করতে আমি একাই যথেষ্ট। এই প্রত্যাখ্যানকারী কে? সে হচ্ছে এই তুচ্ছ, ক্ষুদ্র ও দুর্বল মানুষ। পিপড়ের মতাে ক্ষুদ্র, তুলাের মতাে হালকা, এমনকি বলতে গেলে মহা পরাক্রান্ত আল্লাহর দোর্দন্ড প্রতাপের সামনে সে একেবারেই অস্তিত্বহীন একটি ক্ষুদ্র মানুষ। তাই হে মােহাম্মদ! এই সৃষ্টিকে ও আমাকে একলা ছেড়ে দাও! তুমি ও তােমার সাথী মােমেনরা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করাে। কারণ ওদের যুদ্ধ তাে আমার সাথে । তােমার সাথেও নয়, মােমেনদের সাথেও নয়। যুদ্ধ আমারই সাথে, আর এই সৃষ্টি আমার দুশমন। তার দায়িত্ব আমিই নিচ্ছি। ওর সাথে বােঝাপড়ার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তােমরা বিশ্রাম নাও। অবিশ্বাসীদের জন্যে কি সাংঘাতিক শাসানি! আর মােমেনদের জন্যে কি চমৎকার প্রশান্তি! এরপর মহা প্রতাপশালী আল্লাহ তায়ালা তার এই ক্ষুদ্র ও দুর্বল সৃষ্টির সাথে যুদ্ধের পরিকল্পনা পেশ করছেন! ‘তারা টেরও পাবে না এমনভাবে আমি তাদেরকে ধাপে ধাপে চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যাবাে। আমি তাদেরকে সময় দিচ্ছি। আমার কৌশল অতীব সূক্ষ্ম।। অবিশ্বাসীরা এবং সমগ্র বিশ্ববাসীরা একত্রিত হলেও আল্লাহর সামনে এতাে ক্ষুদ্র ও দুর্বল যে, তাদেরকে জন্দ করতে আল্লাহর এতসব কৌশল অবলম্বন করতে হয় না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সতর্ক করে দেন যেন সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে তারা নিজেদেরকে সামাল দিতে পারে। তাদেরকে জানিয়ে দিতে চান যে, যে বাহ্যিক নিরাপত্তাটুকু তারা ভােগ করছে, তা আসলে একটা ফাঁদ মাত্র। অচিরেই তারা দিকভ্রান্ত অবস্থায় সে ফাঁদে আটকা পড়বে। যুলুম, অত্যাচার, গোমরাহী, অবাধ্যতা ইত্যাদি সত্ত্বেও তাদেরকে যেটুকু সময় দেয়া হচ্ছে তা আসলে নিকৃষ্টতম পরিণতিতে উপনীত হওয়ার জন্যে তাদের ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ারই অবকাশ মাত্র। ওটা আল্লাহর পক্ষ থেকে গৃহীত একটি ব্যবস্থা ও কৌশল-যার উদ্দেশ্য হলাে, কাফেরদের অপরাধ ও পাপাচার যেন ষোলকলায় পূর্ণ হয় এবং তারা চরম অবমাননাকর আযাব ভােগ করার যােগ্য হয়ে যায়। এই সতর্কীকরণ এবং এই ধাপে ধাপে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা সংক্রান্ত এই হুশিয়ারী প্রদানের চেয়ে বড় ন্যায়বিচার ও অনুকম্পা আর কিছুই হতে পারে না। এই সতর্কীকরণের মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের, তার দ্বীনের এবং তাঁর নবীর দুশমনদেরকেও ন্যায়বিচার ও দয়া ভিক্ষা দিচ্ছেন। এর পরে তারা সৎ পথে ফিরে আসার এই শেষ সুযােগ গ্রহণ করে কিনা, সেটা তাদের ব্যাপার। প্রয়ােজনীয় তথ্য সব জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং প্রকৃত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অবকাশ দিয়ে থাকেন, কিন্তু তার কোনাে কিছুই তিনি উপেক্ষা করেন না। যালেমকে তিনি সময় দেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন আর ছাড়েন না। তার স্বেচ্ছায় গৃহীত ও অনুসৃত এই কর্মপন্থা তিনি এখানে মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালা তার রাসূল কে বলছেন, আমাকে ও আমার বাণী অস্বীকারকারীকে একলা ছেড়ে দাও। ধন সম্পদ, সন্তান সন্তুতি ও প্রভাব প্রতিপত্তির অহংকারে যারা মত্ত, তাদেরকে আমি দেখে নেবাে। তাদেরকে আমি অবকাশ দেবাে এবং এই নেয়ামতকে তাদের জন্যে ফাদে পরিণত করবাে।’ এভাবে রসূলকে(স.) সান্ত্রনা ও আশ্বাস দেয়ার পর স্বীয় শত্রুকে সতর্ক করার জন্যে তাদেরকে উপরােক্ত কঠোর হুমকি দেয়া হচ্ছে।
ফী জিলালিল কুরআন:   *নবীদের দাওয়াত নিঃস্বার্থ : কেয়ামতের দৃশ্যাবলীর বর্ণনা দান এবং এই হুমকি প্রদানের পর আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ এবং তাদের আচরণে বিস্ময় প্রকাশের উপসংহার টানছেন এই বলে, ‘তবে কি তুমি তাদের কাছে কোনাে প্রতিদান চাইছো, যার ফলে তারা দায়ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে?’ অর্থাৎ তাদেরকে হেদায়াত করার জন্যে তুমি তাদের কাছে যে পারিশ্রমিক চাইছো, সেই পারিশ্রমিক দেয়ার ভয়েই কি তারা তােমাকে এড়িয়ে চলছে এবং তােমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে! এর কারণেই কি তারা সেই শােচনীয় পরিণামকে বেছে নিয়েছে, নাকি তাদের কাছে অদৃশ্যের তথ্য রয়েছে যে, তারা (তা) লিখে রাখছে। অর্থাৎ এই অদৃশ্য তথ্য জানার কারণে কি তাদের আত্মবিশ্বাস আছে এবং তাদের কোনা ভয় নাই। তারা আখেরাতে কার কি পরিণাম হবে তা কি জেনে ফেলেছে অথবা তারাই কি তা লিখেছে? এরা নিজেরা যা পছন্দ করে তা নিজেদের জন্যে নিশ্চিত করেই লিখে নিয়েছে। এর কোনটাই তো হয়নি। তাহলে কোন ভরসায় তারা এরূপ অদ্ভুত আচরণে লিপ্ত? একদিকে এক চমকপ্রদ ও ভয়ংকর ভংগীতে আল্লাহ তায়ালা আমাকে ও আমার বাণী অস্বীকারকারীকে একলা ছেড়ে দাও’ এ কথা বলে কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেই যুদ্ধ ঘােষণা করেছেন। অপরদিকে এ কথাও বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা ও তার শত্রুদের মাঝে এ যুদ্ধ আল্লাহর চিরাচরিত ও শাশ্বত নীতি। এ দুটো কথার মাধ্যমে আসলে আল্লাহ তায়ালা মােহাম্মদ(স.) ও তাঁর সাথী মােমেনদেরকে যুদ্ধের ময়দান থেকে এই বলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন যে, এখন তােমরা পেছনে সরে যাও, হক ও বাতিল এবং ঈমান ও কুফরের লড়াই আসলে আমার নিজের লড়াই এবং আমি নিজেই কাফেরদের সাথে বােঝাপড়া করবাে।  *এ যুদ্ধ স্বয়ং আল্লাহর : বাহ্যত যদিও মনে হয় যে, হক ও বাতিলের লড়াইয়ে মােহাম্মদ(স.) ও তার সহচর মােমেনদের ভূমিকাই প্রধান, কিন্তু আসল ব্যাপার এই যে, রসূল(স.) ও মােমেনদের ভূমিকা এ লড়াইতে খুবই সীমিত। আল্লাহর অদৃশ্য পরিকল্পনায় তারা শুধু বাহ্যিক উপকরণ বা লড়াই এর হাতিয়ার মাত্র। এর পেছনে আসল কার্যসম্পাদনকারী হাত হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহর। তিনি কখনাে চাইলে তাদেরকে কাজে লাগাবেন, নচেৎ লাগাবেন না। উভয় অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বয়ংক্রিয়। এ সব আয়াত যখন নাযিল হয় তখন রসূল(স.) মক্কায় ছিলেন। আর তার সহচর মােমেনরা সংখ্যায় এতাে কম ছিলেন যে, তারা কিছুই করতে সক্ষম ছিলেন না। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে এ আয়াত কয়টিতে দুর্বল মােমেনদের জন্যে যেমন সান্ত্বনা ও উৎসাহের বাণী রয়েছে, তেমনি ধনবল, জনবল ও প্রভাব প্রতিপত্তির বলে গর্বিত কাফেরদের জন্যে এতে ছিলাে ভয়াল হুমকি ও আতংক। এরপর মদীনায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সে সময়ে আল্লাহ তায়ালা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, হক ও বাতিলের যুদ্ধে রাসূল(স.) এর মক্কী জীবনে মােমেনদের সংখ্যা স্বল্পতাজনিত দুর্বলতার সময়ে তাদেরকে যে আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন, মদীনাতে একটু ভিন্ন আংগিকে তারই পুনরাবৃত্তি করলেন। বদরের রণাঙ্গনে অর্জিত ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘ওদের সাথে তাে তােমরা লড়াই করােনি, লড়েছেন এবং ওদেরে হত্যা করেছেন আল্লাহ তায়ালা । তুমি যখন তীর বর্শা নিক্ষেপ করেছিল, তখন সে বর্শা আসলে তুমি নিক্ষেপ করােনি, নিক্ষেপ করেছেন আল্লাহ তায়ালা; যেন আল্লাহ তায়ালা এ দ্বারা মােমেনদের একটি সুষ্ঠু পরীক্ষা নিতে পারেন। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা শ্রোতা ও জ্ঞানী।’ এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের মনে এ সত্য বদ্ধমূল করে দিতে চান যে, হক ও বাতিলের যুদ্ধ আসলে আল্লাহর যুদ্ধ। এ লড়াই আল্লাহর লড়াই। এ সমস্যা আল্লাহরই সমস্যা। আল্লাহ তায়ালা যদি মােমেনদেরকে এ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করান তবে সেটা তাদের জন্যে একটা উত্তম পরীক্ষা। এ দ্বারা তিনি তাদের নামে সওয়াব লিখবেন। আসল যুদ্ধ আল্লাহ তায়ালা নিজেই পরিচালনা করেন। আর আসল বিজয়ও আল্লাহ তায়ালা নিজেই দেন। এ যুদ্ধ আল্লাহ তায়ালা একাও চালাতে পারেন, মােমেনদেরকেও এতে কাজে লাগাতে পারেন। তারা যখন যুদ্ধে অংশ নেন তখন তারা আল্লাহর অস্ত্র ও সরঞ্জাম হিসাবে অংশ নেন, তবে তারা আল্লাহর একমাত্র অস্ত্র নয়। পবিত্র কোরআনে এ সত্যকে একাধিকবার স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ সত্য আল্লাহর শক্তি ও পরিকল্পনা সংক্রান্ত ঈমান ও বিশ্বাসের সাথেও সংগতিপূর্ণ। আল্লাহর শাশ্বত নীতি ও তার ইচ্ছার সাথে মানানসই। আর আল্লাহর পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে সক্রিয় মানবীয় শক্তি সামর্থ্যের সাথেও এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানুষের যা কিছুর শক্তি সামর্থ্য আছে, তাতে সে এ লড়াইয়ে শুধু অস্ত্র হিসাবেই ব্যবহৃত হতে পারে তার বেশী কিছু নয়। এ সত্য মােমেনকে সর্বাবস্থায় আশ্বস্ত করে-চাই সে সবল হােক কিংবা দুর্বল। মােমেন যদি আল্লাহর জন্যে একনিষ্ঠ হয় এবং জিহাদে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে ঈমান ও কুফরের লড়াইতে এবং হক ও বাতিলের সংগ্রামে শুধুমাত্র তার শক্তিই তাকে বিজয় এনে দিতে পারে না-বিজয় শুধু আল্লাহ তায়ালাই এনে দিতে পারেন এবং দিয়েও থাকেন, আর তার দুর্বলতাও তাকে পরাজিত করতে পারেনা। কেননা তার নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে আল্লাহর শক্তি। তিনিই যুদ্ধ চালান এবং তিনিই জয় পরাজয়ের নিয়ন্তা। কাফেরদেরকে সময় দেয়া, ধাপে ধাপে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া এবং নির্ধারিত সময়ে ঘটনাবলী ঘটানাে আল্লাহর চিরন্তন নীতির অন্তর্ভুক্ত। এ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাঁর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত, বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা, দয়া ও ন্যায়বিচারের নীতিমালা দ্বারা। যুদ্ধের আসল পরিচালক যে আল্লাহ তায়ালা, সে সত্যটি মােমেনদের জন্যে যেমন সান্তনাদায়ক, কাফেরের জন্যে তেমনি ত্রাস সঞ্চারক। চাই সে সময় মােমেন সবল অবস্থায় থাকুক বা দুর্বল অবস্থায়। কেননা কাফেরের সাথে মোমেন লড়ছে না বরং লড়ছেন আল্লাহ তায়ালাই, তিনি লড়ছেন তার সমস্ত শক্তি ও প্রতাপ নিয়ে । আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে বলেন, ‘আমাকে ও আমার বাণী প্রত্যাখানকারীকে একা ছেড়ে দাও।’ আল্লাহ তায়ালা তার এ শত্রুকে সময় দেন এবং ধাপে ধাপে ঠেলে দেন ভয়াবহ ফাঁদের মুখে। সে যতই শক্তিমান হােক এবং তার যত সাজ সরঞ্জাম থাকুক, তাতে কিছু এসে যায় না। তার শক্তিই তার জন্যে ফাঁদ আর তার সাজ সরঞ্জামই তার জন্যে বধ্যভূমি । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকি। আমার কৌশল অত্যন্ত সুক্ষ্ম।’ এখন সেই অবকাশ কখন শেষ হবে এবং কখন সে ফাঁদে আটকা পড়বে সে কথা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। সেই অজানা অদৃশ্য ও অনিশ্চিত বিষয় একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জানা। ভয়াল পরিণতি সম্পর্কে বেপরােয়া হওয়া কিভাবে সমীচীন হতে পারে? কখন যে আল্লাহর সেই ভয়াবহ আযাব এসে পড়ে তা কে জানে? সেটা হিসাবে না রেখে কাজ করা তাে একমাত্র নাফরমান বান্দাদের পক্ষেই সম্ভব। এই সত্যের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে উপদেশ দিয়েছেন ধৈর্যধারণের।

ফী জিলালিল কুরআন:   *ইউনুস (আ.)-এর ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ : নবুওতের দায়িত্ব পালনে সুদৃঢ় ও অবিচল সংকল্প গ্রহণ, বিভিন্ন মানুষের স্বভাবের বক্রতা সহ্য করা, অনেকের প্রত্যাখ্যান, অশালীন ও কটুবাক্য বর্ষণ বরদাশত করা এবং আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালার সময় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা এ সবই ধৈর্যের আওতাভুক্ত। এই প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে তার পূর্বতন এক ভাইয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, যিনি এতােসব কষ্টকর। পরিস্থিতি সহ্য করতে পারেননি। আল্লাহ তায়ালা বিশেষ অনুগ্রহ দ্বারা তাকে সাহায্য না করলে তিনি আল্লাহর রােষের শিকার হতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি স্বীয় প্রতিপালকের ফয়সালা পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করাে এবং মাছ সম্পর্কিত ঘটনার ব্যক্তিটির মতাে হয়াে না। তাকে গিলে ফেলার পর সে আল্লাহ তায়ালাকে ডেকেছিলাে। আল্লাহর অনুগ্রহ তাকে সাহায্য না করলে সে উষর প্রান্তরে নিক্ষিপ্ত হতাে নিন্দিতভাবে। তখন তার প্রভু তাকে বাছাই করে নিলেন এবং তাকে সৎ লােকদের অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন।’ এই মাছের ঘটনার ব্যক্তি হচ্ছেন হযরত ইউনুছ আলাইহিস সালাম। সূরা ‘আস্ সাফাত’-এও এ কথাই বলা হয়েছে। এখানে তার অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্তসার হযরত মােহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে এটা তার পাথেয় হয়। কারণ তিনি শেষ নবী। নবুওতের দায়িত্ব পালনে তাঁর পূর্ববর্তী সকল নবীর অভিজ্ঞতা তার জানা দরকার। তাকে হতে হবে সকল অভিজ্ঞতার, সকল পাথেয় ও সকল কীর্তির সর্বশেষ মালিক। এটা তার এই বিরাট গুরুদায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে। গুরুদায়িত্বই বটে, একটি গােত্রের নয়, একটি গ্রামের নয় একটি জাতির নয়; বরং সমগ্র মানব জাতির হেদায়াতের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। একটি প্রজন্মের দায়িত্ব নয়, একটি শতাব্দীর দায়িত্বও নয়- যেমনটি ছিলাে পূর্ববর্তী নবীদের দায়িত্ব। বরং তার পরবর্তী সর্বকালের সকল প্রজন্মের সমগ্র বিশ্ববাসীকে হেদায়াত করা তার দায়িত্ব। মানব জাতি তার সমগ্র জীবনে যত রকমের অবস্থার সম্মুখীন হয়, যত রকমের অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং প্রতিদিন যত রকমের সমস্যায় জর্জরিত হয়, তার সব কিছুর সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারে এমন একটি সুষ্ঠু ও চিরস্থায়ী বিধান দিয়ে মানবজাতির নেতৃত্ব দান করা তাঁর দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব তাকে সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হলে পূর্ববর্তী নবীদের অভিজ্ঞতা তাঁর জানা প্রয়ােজন। সেই প্রেক্ষাপটেই এখানে একজন পূর্বতন নবীর অভিজ্ঞতার বিবরণ দেয়া হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্তসার এই যে, হযরত ইউনুস ইবনে মাত্তা(আ.)-কে আল্লাহ তায়ালা ‘নিনােয়া’ নামক একটি শহরে পাঠিয়েছিলেন। এই শহরটি ইরাকের মু’সল অঞ্চলে অবস্থিত ছিলাে। সেখানকার অধিবাসীরা তার ওপর ঈমনি আনতে বড় বেশী বিলম্ব করে ফেলে। এতে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তাদের ওপর বিরক্ত হয়ে তিনি তাদেরকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মনে মনে বললেন, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই আমাকে এইসব একুগুঁয়ে হঠকারী লােকদের মধ্যে পড়ে থাকার জন্যে আটকে রাখবেন না। তিনি তাে আমাকে অন্য কোনাে জাতির কাছেও পাঠাতে পারেন।’ বিরক্তি ও রাগের বশে তিনি সমুদ্রের কিনারে চলে গেলেন। সেখানে তিনি নৌকায় উঠলেন। নৌকা অতিমাত্রায় বােঝাই হওয়ায় সমুদ্রের মাঝখানে গিয়ে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলাে। বােঝা হালকা করার জন্যে একজন যাত্রীকে সমুদ্রে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলাে। এ জন্যে লটারি করা হলাে। লটারি উঠলাে হযরত ইউনুসের নামে। তাকে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হলাে। সমুদ্রে পড়া মাত্রই তাকে একটা মাছে গিলে ফেললাে। সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে মাছের পেটের গভীর অন্ধকারে বসে নিদারুণ উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের মধ্যে তিনি আল্লাহ তায়ালাকে সম্বােধন করে বললেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সােবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যোয়ালিমিন। (তুমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, তুমি পবিত্র, অবশ্যই আমি অপরাধীদের একজন।) এর ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সাহায্য এলাে। মাছটি তাকে সমুদ্রের কিনারে উগড়ে ফেললাে। তার গায়ে তখন চামড়া ছিলাে না। চামড়া মাছের পেটে গলে গিয়েছিলো। আল্লাহ তায়ালা তার অসীম ক্ষমতা বলে তার জীবন রক্ষা করলেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর এই অনুগ্রহ যদি না হতাে, তবে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিন্দিত ও ধিকৃত অবস্থায় মাছের পেট থেকে নিক্ষিপ্ত হতেন, নিন্দিত হতেন তার ধৈর্যের স্বল্পতার জন্যে, আল্লাহর অনুমতি লাভের আগে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে।’ আল্লাহ তায়ালা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ওপর অনুগ্রহ করলেন। তার তাসবীহ, ত্রুটির স্বীকারােক্তি ও অনুশােচনাকে তিনি গ্রহণ করলেন এবং এটাকে তার অনুগ্রহ লাভ ও মনােনীত ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার যােগ্যতা হিসাবে গ্রহণ করলেন। তাই নিন্দিত ও ধিকৃত হওয়ার পরিবর্তে তিনি আল্লাহর অনুগ্রহে তাঁর মনােনীত ব্যক্তিরূপে পরিগণিত এবং সৎ লােকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন। মাছের গ্রাসে পরিণত নবী ইউনুস(আ.)-এর এই ছিলাে অভিজ্ঞতা। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রসূল মােহাম্মদ(স.) কে সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কেননা তিনিও ছিলেন একই রকমের একগুয়েমী, হঠকারিতা ও প্রত্যাখ্যানের শিকার । ইতিপূর্বে তিনি তাকে লড়াইয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। যুদ্ধের ভার আল্লাহর ওপর সােপর্দ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি যেমন ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। আল্লাহর সেই যুদ্ধের সময় নির্ধারিত সময় সমাগত হওয়া পর্যন্ত যত বিপদ মুসিবত আসুক, ধৈর্য ধারণ করে যেতে হবে। এই হলাে রসূল(স.)-এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ।   *ইসলামী আন্দোলনের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য : বস্তুত ইসলাম প্রচার ও ইসলামী আন্দোলনের আসল কষ্টটা হলাে, আল্লাহর স্বীয় প্রজ্ঞা, সুক্ষ্মদর্শিতা ও দূরদর্শিতা মােতাবেক যখন কাফেরদের দমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করবেন, তখন পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করা। এই পথে অনেক বাধা বিপত্তি ও দুঃখকষ্ট রয়েছে। কাফেররা শুধু ইসলামের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানই করেনা বরং মােমেনদের ওপর নির্যাতন চালায়। এসব ইসলামের পথে বাধা সৃষ্টি করে। বাধা সৃষ্টি করে কাফেরদের একগুয়েমি এবং বুদ্ধির বক্রতাও। তাছাড়া বাতিলের বিকাশ, বৃদ্ধি ও প্রতাপ এবং বাতিলের আপাত দৃশ্যমান সাময়িক বিজয় দ্বারা সাধারণ মানুষের ভড়কে যাওয়া ও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাওয়াও মােমেনের জন্যে মানসিক ও দৈহিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই সমস্ত দুঃখ কষ্ট ও বাধাবিপত্তির মুখে মনকে প্রবােধ দিয়ে আল্লাহর সত্য ওয়াদা বাস্তবায়িত হবার সময় পর্যন্ত সকল সন্দেহ-সংশয় থেকে মুক্ত হয়ে শান্ত মনে অপেক্ষা ও ধৈর্য ধারণ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়। এটা অত্যন্ত কঠিন জিহাদ, যা আল্লাহর সাহায্য ও তাওফীক ছাড়া সম্ভব হয় না। বাতিল শক্তির সাথে যে আসল লড়াই, সেটা তাে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং করবেন বলে আগেই স্থির করে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা এটা তাে স্থির করেই রেখেছেন যে, তিনি বাতিল শক্তিকে আত্মশুদ্ধির জন্যে সময় দেবেন, আর যদি তার সংশােধনের সম্ভাবনা না থাকে তাহলেও তাকে এক নিমেষে শেষ করে দেয়ার পরিবর্তে ধাপে ধাপে ও তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেবেন। এটা তার বৃহত্তর কল্যাণ চিন্তা এবং প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতা থেকে উদ্ভূত সিদ্ধান্ত। তিনি রসূল(স.)-কেও বিজয় দানের ওয়াদা করেছেন এবং সে ওয়াদা একটা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হবার পরই পূরণ করেছেন।

সুরা: আল-ক্বলম
আয়াত নং :-৫২

وَ مَا هُوَ اِلَّا ذِكْرٌ لِّلْعٰلَمِیْنَ۠

অথচ তা সারা বিশ্ব-জাহানের জন্য উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

ফী জিলালিল কুরআন:

*ইসলাম বিরােধীদের চরিত্র : সর্বশেষ আল্লাহ তায়ালা ধর্মদ্রোহী বাতিল শক্তির চরিত্রের একটা দিক তুলে ধরেছেন। একপর্যায়ে তারা রসূল(স.)-এর কাছ থেকে দাওয়াত পাওয়ার সময় প্রচন্ড ক্রোধে ও গভীর ঘৃণা ও বিদ্বেষে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়। সে সময় তাদের রােষ কষায়িত চোখ থেকে এমন বিষাক্ত দৃষ্টি রসূল(স.)-এর দিকে নিক্ষিপ্ত হয় যেন তা তাকে হত্যা করে ফেলবে। কোরআন এই দৃশ্যটাকে এমন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে, যার তুলনা সত্যিই বিরল, ‘কাফেররা যখন স্মরণিকা (কোরআন) শ্রবণ করে, তখন তাদের দৃষ্টি দিয়েই তােমাকে পদদলিত ও পথচ্যুত করে দিতে উদ্যত হয়, আর তারা বলে যে, সে তাে একটা পাগল।’ বস্তুত এই দৃষ্টি রসূল(স.)-এর ওপর এতটা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে যেন তার পা ডগমগ করে, পিছলে যায় ও মাটির ওপর তারা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কাফেরদের এই দৃষ্টিতে কত আক্রোশ, কত হিংস্রতা, কত বিদ্বেষ, কত জিঘাংসা, কত বিষ এবং কত হিংসা মিশ্রিত থাকে, তা এ বর্ণনায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। আর এই হিংসার আগুন ঝরা ও বিষ মাখা দৃষ্টি যখন অশ্রাব্য ও অকথ্য গালির সাথে যুক্ত হয় এবং সেই সাথে রসূল(স.)-কে ‘পাগল’ বলার জঘন্য মিথ্যাচারও চলে, তখন বাতিল শক্তির আসল কদাকার চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। নিসন্দেহে এটি মক্কার মুক্তাংগনে দেয়া সাধারণ দাওয়াতী কার্যক্রমেরই একটি দৃশ্য। এ ধরনের রক্তচক্ষু প্রদর্শন যে বড় বড় কোরায়শ নেতাদের দ্বারাই সম্ভব, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের মন থেকেই এতাে হিংসা উদগীরণ হওয়া এবং তাদের চোখ থেকেই এতাে বিদ্বেষ ভরা ভ্রুকুটি নিক্ষিপ্ত হওয়া সম্ভব। সর্বশেষে যে মন্তব্যটি দিয়ে সূরার সমাপ্তি টানা হয়েছে তা হলাে, ‘এটা সমগ্র বিশ্বাসীর জন্যে স্মরণিকা ছাড়া কিছু নয়।’ বস্তুত স্মরণিকা বহন ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার কাজ কোনাে পাগলের কাজ হতে পারে না। তাই অকাট্যভাবে বলা যায়, আল্লাহর কথাই সত্য আর সেসব অপপ্রচারকদের কথা মিথ্যা। শেষ করার আগে ‘সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যে’ এ কথাটার বিশ্লেষণ দরকার। ইসলাম প্রচারের কাজ যখন মক্কায় প্রচন্ড বিরােধিতা ও প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন, রসূল(স.) যখন রক্তচক্ষুর বিষময় ভ্রুকুটি হজম করে চলেছেন, আর মােশরেকরা যখন ইসলামী আন্দোলনের মােকাবেলা করার জন্যে নিজেদের যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের সংর্কীণ পরিসরে এবং অত আগাম মুহূর্তে ঘােষণা করা হচ্ছে যে, এ দাওয়াত ও আন্দোলন একটা বিশ্বজোড়া আন্দোলন। ইসলাম তার স্বভাব প্রকৃতি অনুসারে যেমন আন্তর্জাতিক, তেমনি বাস্তবেও তাই। এ যুগের কোনাে কোনাে মিথ্যাচারী বলে থাকে যে, ইসলাম মদীনায় গিয়ে সার্বিক বিজয় ও সাফল্য লাভ করার পরই শুধু আন্তর্জাতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু এ কথা আদৌ ঠিক নয়। ইসলাম মক্কায় তার সূচনাকালীন মুহূর্তেও একটা বিশ্বজোড়া ও আন্তর্জাতিক দাওয়াত ছিলাে। কেননা তার প্রাথমিক ভাষণগুলােতেও তার আন্তর্জাতিক আবেদন ও চরিত্র সুস্পষ্ট ছিলাে। আল্লাহ তায়ালা এভাবেই ইসলামকে তৈরী করেছেন এবং শুরু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত তা এ রকমই থাকবে। আল্লাহ তায়ালাই ইসলামের মালিক ও রক্ষক। ইসলামের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার দায়িত্ব তিনিই গ্রহণ করেছেন। ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের নিশানবাহীদের কাজ আল্লাহর ফয়সালা পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।

১৭-৫২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা:-
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ:-
১৭-৩৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতের প্রথমটিতে আল্লাহ তা‘আলা একজন বাগানের মালিকের সন্তানদের ঘটনা উল্লেখ করছেন। কৃপণতার জন্য যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তি দিয়েছেন তেমন মক্কাবাসী কাফিরদেরও শাস্তি প্রদান করেছেন।

ঘটনার সারসংক্ষেপ হল : বাগানের মালিক ইয়ামানের একটি গ্রাম জরওয়ান (ضروان) এর অধিবাসী। তা সানআ থেকে ৬ মাইল দূরে। আবার বলা হয় তারা হাবশাবাসী। এ বাগানের মালিক আহলে কিতাব ছিলেন। তিনি বাগান থেকে যা পেতেন তার এক ভাগ নিজ পরিবারের সারা বছরের খরচ হিসাবে রাখতেন, আরেক ভাগ পরবর্তী রছর ফসল উৎপাদনের জন্য রাখতেন, অন্য ভাগ গরীব মিসকীনদের দান করতেন। মালিক মারা গেলে তার সন্তানেরা নীতি বহির্ভূত কাজ করতে লাগল। বলল : আমাদের পিতা একজন বোকা লোক ছিলেন। আমরা গরীর মিসকীনদের কিছুই দেব না, সব জমা করব। তাই তাদের পরিকল্পনা ছিল : সকাল সকাল বাগানে চলে যাবে যাতে কোন মিসকীন না দেখে। তারা তাই করল, তারা সকাল সকাল রওনা দিল কিন্তু তাদের এসব কথাবার্তার পূর্বে ইনশা-আল্লাহ বলেনি। ফলে বাগানে যেয়ে দেখে সব ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা বলাবলি করতে লাগল : আমরা মনে হয় পথ ভুল করে এসেছি। তাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠ ছিল সে বলল : আমি কি বলিনি যে তোমরা ইনশা-আল্লাহ বলোনি। তারা মাহরুম হল। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বঞ্চিত করলেন। তাদের এ পরিণতির কারণ হচ্ছে : তারা ফসলের যাকাত তথা উশর আদায় করেনি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَاٰتُوْا حَقَّه۫ يَوْمَ حَصَادِه)

“আর ফসল তোলার দিনে তার হক প্রদান করবে” (সূরা আন‘আম ৬ : ১৪১)।
এ আয়াতগুলো প্রমাণ করছে যে, মানুষ কোন অন্যায় কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলে সেজন্য তাকে পাকড়াও করা হবে। যেমন এরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিল, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

وَمَنْ يُّرِدْ فِيْهِ بِإِلْحَادٍمبِظُلْمٍ نُّذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ

“আর যে ইচ্ছা করে পাপ কাজে সীমালঙ্ঘন করে, তাকে আমি আস্বাদন করাব যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি‎।” (সূরা হাজ্জ ২২ : ২৫)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : যখন দু’জন মুসলিম তরবারী নিয়ে মুখোমুখি হয়ে একজন অন্যজনকে হত্যা করে তখন হত্যাকারী ও নিহত উভয় জাহান্নামী। বলা হল : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! এ শাস্তি তো হত্যাকারীর জন্য কিন্তু নিহত ব্যক্তির কী হল? তিনি বললেন : সে তার সাথী (হত্যাকারীকে) হত্যা করার জন্য উৎসাহী ছিল (তাই উভয় সমান শাস্তি পাবে)। (সহীহ বুখারী হা. ৩১, সহীহ মুসলিম হা. ২৮৮৮)

لَا يَسْتَثْنُوْنَ
অর্থ : ইনশা-আল্লাহ বলেনি। طائفة অর্থ : آفة سماوية আসমানী বালা মসিবত। صريم অর্থ : ফসল কাটা বা ফসল তোলা। صرد শব্দের অর্থ : শক্তি, কঠোরতা করা। কেউ অর্থ করেছেন ।

৩৪-৪১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

দুনিয়ার বাগানের মালিকের অবস্থা বর্ণনা এবং তাদের অবাধ্যতার কারণে যে শাস্তি আপতিত হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরার পর আল্লাহভীরু লোকদের অবস্থা বর্ণনা করছেন। তারা আখেরাতে এমন জান্নাত লাভ করবে যার নেয়ামত শেষ হবে না এবং হ্্রাস পাবে না। আর তা নষ্টও হবে না। মুুমিন-মুসলিমকে আল্লাহ তা‘আলা অপরাধীর মত অপমানিত করবেন না।

(كِتٰبٌ فِيْهِ تَدْرُسُوْنَ)

অর্থাৎ তোমাদের নিকট কি এমন কিতাব আছে যাতে বলা হয়েছে- তোমরা যা চাইবে তাই পাবে? নাকি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন প্রতিশ্র“তি আছে যা কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। অর্থাৎ এ সবের কিছ্ইু নেই।

(بَالِغَةٌ إِلٰي يَوْمِ الْقِيٰمَةِ)

অর্থাৎ তোমাদের কি আল্লাহ তা‘আলার সাথে এমন কোন প্রতিশ্র“তি আছে যে, তা তোমাদেরকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে।
زعيم অর্থাৎ তারা যে এসব দাবী করছে সেজন্য কে দায়িত্বভার নেবে? নাকি এ বিষয়ে তাদের কোন শরীক আছে? যদি থাকে তাহলে তা নিয়ে আসতে বল। না, তারা কখনো পারবে না এবং কেউ দায়িত্বও নেবে না। অতএব আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. অপরাধীরা কখনো মু’মিনদের সমান হতে পারে না।
২. মু’মিনরা এমন জান্নাত পাবে যা কখনো শেষ হবে না।
৪২-৪৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

কিয়ামতের দিন যখন চরম সংকটপূর্ণ, ভয়াবহ ও কম্পনযুক্ত অবস্থা সৃষ্টি হবে এবং সকলে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বে তখন আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের মাঝে ফায়সালা করার জন্য আসবেন এবং নিজের পদনালী খুলে দেবেন-যে পদনালী কোন কিছুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। তখন মানুষকে সিজদা দিতে বলা হবে। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পদনালী খুলে দেবেন ফলে মু’মিনরা তাঁকে সিজদা করবে, আর যারা দুনিয়াতে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং প্রশংসা পাওয়ার জন্য সিজদা করত তারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। যখন সিজদা করতে যাবে তখন পিঠ তক্তার মত হয়ে যাবে। ফলে তারা সিজদা দিতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯১৯)

(خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ)

অর্থাৎ কিয়ামতের দিন অপমানের কারণে দৃষ্টি অবনত করে রাখবে। কেননা দুনিয়াতে তাদেরকে সালাতের দিকে আহ্বান করা হয়েছিল কিন্তু তারা সেই ডাকে সাড়া দেয়নি, অথচ তারা সুস্থ সবল ছিল, গ্রহণযোগ্য কোন ওজর ছিল না। তাই আখিরাতে এর শাস্তিস্বরূপ তারা সিজদা দিতে পারবে না।

(فَذَرْنِيْ وَمَنْ يُّكَذِّبُ)

অর্থাৎ যারা কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতঃ এড়িয়ে চলে তাদের ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও, আমিই তাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা এদেরকে এমনভাবে অবকাশ দেন যে, এরা বুঝতেও পারে না।

(أَمْ تَسْأَلُهُمْ أَجْرًا)

অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বান কর অথচ তাদের নিকট কোন প্রতিদান চাওনা, তারপরেও তারা তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। এটা তাদের মূর্খতার পরিচয়।

সুতরাং দুনিয়াতে যারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য সালাত আদায় করে না তারা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার জন্য সিজদা দিতে পারবে না। তাই আমাদের নিয়মিত সালাত আদায় করা উচিত এবং তা করা উচিত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলার পদনালী রয়েছে তার প্রমাণ পেলাম। কিন্তু কেমন তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না।
২. কিয়ামত দিবসে অপরাধীরা অপমানে দৃষ্টি অবনত করে রাখবে।
৩. যারা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলার জন্য সিজদা করেনি তারা আখিরাতে সিজদা করতে পারবে না।
৪. আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদেরকে পার্থিব সম্পদ দ্বারা অবকাশ প্রদান করেন।
৪৮-৫২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কাফিরদের অত্যাচার, মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি সকল কষ্টের ওপর ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দিয়ে বলছেন : মাছওয়ালা তথা ইউনূস (আঃ)-এর মত ধৈর্যহারা হয়ো না। ইউনুস (আঃ) জাতির প্রতি রাগান্বিত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়াই বের হয়ে চলে গিয়েছিলেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাস্তিস্বরূপ মাছের পেটে নিয়ে যান।

(وَهُوَ مَكْظُوْمٌ)

তিনি বিষণœ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করলেন যে,

(أَنْ لَّآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنْتَ سُبْحٰنَكَ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِيْنَ)

‘তুমি ব্যতীত কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; তুমি পবিত্র, মহান! আমি তো সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আম্বিয়াহ ২১ : ৮৭)

আল্লাহ তা‘আলা তার দু‘আ কবূল করে বললেন :

(فَاسْتَجَبْنَا لَه۫ لا وَنَجَّيْنٰهُ مِنَ الْغَمِّ ط وَكَذٰلِكَ نُنْجِي الْمُؤْمِنِيْنَ)

“তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং মুক্তি দিয়েছিলাম দুশ্চিন্ত‎া থেকে আর এভাবেই আমি মু’মিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি।” (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৮৭-৮৮)

(لَوْلَآ أَنْ تَدٰرَكَه۫ نِعْمَةٌ مِّنْ رَّبِّه)

অর্থাৎ যদি আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নেয়ামত তথা ক্ষমা দ্বারা আচ্ছাদিত না করে নিতেন তাহলে (لَنُبِذَ بِالْعَرَا۬ءِ…..) বা গাছ পালাহীন তীরে নিক্ষেপ করতেন অথবা মাছের পেটেই রেখে দিতেন। সেখানেই তাঁর কবর হতো এবং সেখান থেকেই পুনরুত্থিত হতেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার দয়া যে, ইউনুস (আঃ) সেখানে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করে রাখেননি বরং সুস্থ ও নিরাপদ অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছেন।

(فَاجْتَبَاهُ) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সুস্থ ও নিরাপদ অবস্থায় পুনরায় রিসালাতের দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন। সূরা সাফফাতের ১৩৯-১৪৮ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

(لَيُزْلِقُوْنَكَ بِأَبْصَارِهِمْ)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করে ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : যদি তোমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার প্রতিরোধ ও প্রতিরক্ষামূলক হেফাযত না হত তাহলে কাফিরদের হিংসাত্মক দৃষ্টির কারণে তুমি বদনজরের শিকার হয়ে পড়তে। অর্থাৎ তাদের কুদৃষ্টি তোমার প্রতি লেগে যেত। মানুষের বদনজর সত্য এবং তা লেগে যাওয়ার অনেক প্রমাণ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন : العين حق তথা বদনজর সত্য। (ইবনু মাযাহ হা. ৩৫০৭, সনদ সহীহ )।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন : বদনজর সত্য। যদি কোন কিছু তাকদীর অতিক্রম করে চলে যাওয়ার থাকত তাহলে বদনজর চলে যেত। কেউ যদি তোমাদেরকে গোসল করিয়ে পানি নিতে চায় তাহলে গোসল করে পানি দিও। বদনজরের ঔষধ হিসাবে। (সহীহ মুসলিম হা. ২১৮৮)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করা ও ধৈর্য ধারণ করা খুব প্রশংসনীয়।
২. ইউনূস (আঃ)-এর শাস্তির কারণ জানলাম যে, তিনি আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়াই অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন।
৩. বড় মানুষের ছোট অপরাধও বড় বলে গণ্য হয়।
৪. বদনজর সত্য। বদনজরের চিকিৎসা হল বদনজরদাতা ব্যক্তির গোসল করা পানি দ্বারা যার বদনজর লেগেছে তাকে গোসল দিয়ে দেওয়া।
৫. বদনজর থেকে বাঁচার জন্য সূরা ইখলাস, নাস ও ফালাক পড়া মুস্তাহাব।

Leave a Reply