أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٥٣)-২৫৫
www.motaher21.net
قُلْ يٰٓأَهْلَ الْكِتٰبِ تَعَالَوْا إِلٰى كَلِمَةٍ سَوَآءٍۭ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ
বল, ‘হে আহলে কিতাব! এমন এক কথার দিকে আসো, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই,
Say”O people of the Scripture: Come to a word that is just between us and you.”
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-৬৪
قُلْ يَٰٓأَهْلَ ٱلْكِتَٰبِ تَعَالَوْا۟ إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَآءٍۭ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِۦ شَيْـًٔا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ ٱللَّهِۚ فَإِن تَوَلَّوْا۟ فَقُولُوا۟ ٱشْهَدُوا۟ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ
বল, ‘হে আহলে কিতাব! এমন এক কথার দিকে আসো, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই, তা এই যে, আমরা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো ‘ইবাদাত করব না এবং কোন কিছুকে তাঁর শরীক করব না এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের মধ্যে কেউ কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব না। তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও, তোমরা এ বিষয়ে সাক্ষী থাক যে, আমরা আত্মসমর্পণকারী।
৬৪ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
ইয়াহুদী, খ্রীষ্টান এবং ঐ প্রকারের লোকদেরকে এখানে সম্বোধন করা হয়েছে। (আরবী) ‘শব্দের প্রয়োগ (আরবী)-এর উপর হয়ে থাকে। যেমন এখানে (আরবী) বলার পর (আরবী) বলে ওর বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে। শব্দের অর্থ হচ্ছে সমান। অর্থাৎ যাতে মুসলমান ও ইয়াহূদ-খ্রীষ্টান সবাই সমান। অতঃপর ওর তাফসীর করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওটা এই যে, মানুষ এক আল্লাহরই ইবাদত করবে, তার সাথে না কোন প্রতিমার উপাসনা করবে, না ক্রুশের পূজো করবে, না পূজো করবে কোন ছবির। না আল্লাহ ছাড়া আগুনের পূজো করবে, না অন্য কোন জিনিসের উপাসনা করবে। বরং তারা এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহরই ইবাদত করবে। সমস্ত নবী (আঃ) মানুষকে এ আহ্বানই জানিয়েছিলেন। ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ তোমার পূর্বে আমি যত রাসূল পাঠিয়েছি সবারই নিকট এই অহীই করেছি যে, আমি ছাড়া কেউ ইবাদতের যোগ্য নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর।’ (২১:২৫) অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ (আরবী) অর্থাৎ আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল পাঠিয়ে এই বলিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং দেবতাদের উপাসনা হতে বিরত থাক। (১৬:৩৬)
অতঃপর বলা হচ্ছে- আল্লাহকে ছেড়ে পরস্পর আমরা একে অপরকে প্রভু বানিয়ে নেবো না। ইবনে জুরায়েজ (রঃ)-এর মতে এর ভাবার্থ হচ্ছে‘আল্লাহর অবাধ্যতায় আমরা একে অপরের অনুসরণ করবো না।’ ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে-‘আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও সিজদা করবো না। অতঃপর তারা যদি এ ন্যায় ভিত্তিক আহ্বানে সাড়া না দেয় তবে- “হে মুসলমানগণ, তোমরা যে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করছো ঐ লোকদেরকে তার সাক্ষী বানিয়ে নাও। আমি সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যায় এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। ওর মধ্যে রয়েছে যে, আবু সুফইয়ান (রাঃ) যখন রোম সম্রাট কায়সারের দরবারে আহুত হন এবং সম্রাট তাঁকে রাসূলুল্লাহ। (সঃ)-এর বংশের অবস্থা জিজ্ঞেস করেন, সে সময় তিনি অমুসলিম ও তাঁর চরম শত্রু হওয়া সত্ত্বেও তার বংশের আভিজাত্যের কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। অনুরূপভাবে তিনি প্রত্যেক প্রশ্নেরই স্পষ্ট ও সঠিক উত্তর দেন। এটি হোদায়বিয়ার সন্ধির পরের ও মক্কা বিজয়ের পূর্বের ঘটনা। এ কারণেই নবী (সঃ) সম্বন্ধে কায়সারের ‘তিনি কি চুক্তি ভঙ্গ করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আবূ সুফইয়ান (রাঃ) বলেছিলেনঃ “তিনি চুক্তি ভঙ্গ করেন না, তবে এখন আমাদের ও তার মধ্যে একটি চুক্তি রয়েছে, না জানি তিনি এতে কি করেন। এখানে। উদ্দেশ্য এটাই যে, এ সমস্ত কথা বার্তার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পবিত্র চিঠি পেশ করা হয়, যাতে ‘বিসমিল্লাহ’-এর পরে রয়েছেঃ ‘এ পত্রটি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সঃ)-এর পক্ষ হতে রোমের বাদশাহ কায়সারের নিকট। হিদায়াতের অনুসারীদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ কর তবে শান্তি লাভ করবে এবং আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ পুণ্য দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে সমস্ত প্রজাদের পাপ তোমার উপর বর্তিত হবে। অতঃপর এ আয়াতটিই লিখেছিলেন। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রঃ) প্রমুখ মনীষী। লিখেছেন যে, এ সূরা অর্থাৎ সূরা-ই-আলে-ইমরানের প্রথম হতে নিয়ে কিছু কম বেশী আশি পর্যন্ত আয়াতগুলো নাজরানের প্রতিনিধিদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ইমাম যুহরী (রঃ) বলেন যে, সর্বপ্রথম এ লোকগুলোই জিযিয়া কর প্রদান করে এবং এ বিষয়ে মোটেই মতবিরোধ নেই যে, জিযিয়ার আয়াতটি মক্কা বিজয়ের পরে অবতীর্ণ হয়। এখন প্রশ্ন উঠে যে, এ আয়াতটি মক্কা বিজয়ের পর অবতীর্ণ হয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) কি করে এ আয়াতটি হিরাক্লিয়াসের পত্রে। লিখলেন? এর উত্তর কয়েক প্রকারের দেয়া যেতে পারে। প্রথম এই যে, সম্ভবতঃ এ আয়াতটি দু’বার অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ একবার হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে এবং দ্বিতীয়বার মক্কা বিজয়ের পর। দ্বিতীয় উত্তর এই যে, হয়তো সূরার প্রথম হতে এ আয়াতের পূর্ব পর্যন্ত আয়াতগুলো নাজরানের প্রতিনিধিদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় এবং এ আয়াতটি পূর্বেই অবতীর্ণ হয়েছিল। এ অবস্থায় ইবনে ইসহাক (রঃ)-এর ‘আশির উপর আরও কিছু আয়াত’ -এ উক্তি রক্ষিত হয় না। কেননা, আবু সুফইয়ান (রাঃ) বর্ণিত ঘটনাটি এর সম্পূর্ণ উল্টো। তৃতীয় উত্তর এই যে, সম্ভবতঃ নাজরানের প্রতিনিধিদল হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে এসেছিল এবং তারা যা কিছু দিতে সম্মত হয়েছিল তা হয়তো মুবাহালা হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সন্ধি হিসেবেই দিয়েছিল, জিযিয়া হিসেবে নয়। আর এটাইতো সর্বসম্মত কথা যে, জিযিয়ার আয়াত এ ঘটনার পরে অবতীর্ণ হয় যার মধ্যে ওর সাদৃশ্য এসে যায়। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ (রাঃ) বদরের পূর্বেকার যুদ্ধে যুদ্ধলব্ধ মালকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেন এবং এক পঞ্চমাংশ রেখে বাকীগুলো সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দেন। অতঃপর গনীমতের মাল বন্টনের আয়াতগুলোও ওর অনুরূপই অবতীর্ণ হয় এবং এ নির্দেশই দেয়া হয়। চতুর্থ উত্তর এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে পত্র হিরাক্লিয়াসকে পাঠিয়েছিলেন তাতে তিনি এ কথাগুলো নিজের পক্ষ হতেই লিখেছিলেন, অতঃপর তাঁর ভাষাতেই অহী অবতীর্ণ হয়। যেমন হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর পর্দার নির্দেশের ব্যাপারে ঐ রকমই আয়াত অবতীর্ণ হয়। বদরের যুদ্ধে যেসব কাফির বন্দী হয়েছিল তাদের ব্যাপারেও হযরত উমার (রাঃ)-এর মতের অনুরূপই আয়াত নাযিল হয়। মুনাফিকদের জানাযার নামায না পড়ার ব্যাপারেও তার মতের অনুরূপ নির্দেশ জারী করা হয়। মাকাম-ই-ইবরাহীম (আঃ)-কে নামাযের স্থান বানানোর ব্যাপারেও এরূপই অহী অবতীর্ণ হয়। (আরবী) (৬৬:৫) -এ আয়াতটিও তার কথারই সাদৃশ্যে অবতীর্ণ হয়। সুতরাং এ আয়াতটিও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘোষণার সাদৃশ্যে নাযিল হয়। এটাই খুব সম্ভব।
তাফসীরে তাফহীমুল। কুরআন বলেছেন:-
এখান থেকে তৃতীয় ভাষণ শুরু হচ্ছে। এর বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে মনে হয় এটা বদর ও ওহোদ যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে নাযিল হয়েছিল। কিন্তু এ তিনটি ভাষণের মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক পাওয়া যায়। যার ফলে সুরার শুরু থেকে নিয়ে এখান পর্যন্ত কোথাও বক্তব্যের মধ্যে কোন সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেনি। এ জন্য কোন কোন তাফসীরকার সন্দেহ করেছেন যে, এই পরবর্তী আয়াতগুলোও নাজরানের প্রতিনিধিদলের সাথে সম্পর্কিত ভাষণেরই অংশবিশেষ। কিন্তু এখান থেকে যে ভাষণ শুরু হচ্ছে তার ধরন দেখে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে ইহুদীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে।
অর্থাৎ এমন একটি বিশ্বাসের প্রশ্নে একমত হয়ে যাও, যার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি এবং তোমরাও যার নির্ভুলতা অস্বীকার করতে পারো না। তোমাদের নবীদের এ বিশ্বাসের কথাই প্রচারিত হয়েছে। তোমাদের পবিত্র কিতাবগুলোতে এরই শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
এ আয়াত থেকে দ্বীনের প্রতি আমন্ত্রণ জানানোর একটি মূলনীতি জানা যায়। তা এই যে, ভিন্ন মতাবলম্বী কোন দলকে দ্বীনের প্রতি আমন্ত্রণ জানাতে হলে প্রথমে তাকে শুধু এমন বিষয়ের প্রতিই আহবান জানানো উচিত, যে বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রোম সম্রাটকে ইসলামের দাওয়াত দেন, তখন এমন বিষয়ের প্রতি আহবান জানান, যাতে উভয়েই একমত ছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার একত্ববাদ। আমন্ত্রণ লিপিতে লিখা হয়েছিলঃ ‘আমি আল্লাহ্র নামে আরম্ভ করছি- যিনি পরম করুণাময় ও দয়ালু। এ পত্র আল্লাহ্র বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। যে হেদায়াতের পথ অনুসরণ করে, তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর আমি আপনাকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। মুসলিম হয়ে যান; শান্তি লাভ করবেন। আল্লাহ্ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। আর যদি বিমুখ হন, তবে আপনার প্রজা সাধারণের গোনাহ আপনার উপর পতিত হবে। “হে আহলে কিতাবগণ! এমন এক বিষয়ের দিকে আস, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে অভিন্ন। তা এই যে, আমরা আল্লাহ্ ছাড়া কারো ইবাদাত করব না। তার সাথে অংশীদার করব না এবং আল্লাহ্কে ছেড়ে অন্যকে পালনকর্তা সাব্যস্ত করব না। ” [বুখারীঃ ৭]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] না কোন মূর্তিকে, না ক্রুশকে, না আগুনকে এবং না অন্য কোন কিছুকে। বরং কেবলমাত্র এক আল্লাহরই ইবাদত করব। আর এটাই ছিল প্রত্যেক নবীর দাওয়াত।
[২] প্রথম যে জিনিসটির প্রতি এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হল, তোমরা ঈসা এবং উযায়ের (আলাইহিমাস্ সালাম)-এর রব্ব বা প্রতিপালক হওয়ার যে মনগড়া বিশ্বাস রাখ, তা সম্পূর্ণ ভুল। তাঁরা রব্ব ছিলেন না, বরং মানুষ ছিলেন। আর দ্বিতীয় যে জিনিসটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা হল, তোমরা যে তোমাদের পন্ডিত ও সংসার-বিরাগীদেরকে হালাল ও হারাম করার অধিকার দিয়ে রেখেছ, তা তাদেরকে রব্ব মনে করারই অন্তর্ভুক্ত। যেমন, [اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ] আয়াতও এ কথার সাক্ষ্য দেয়। তাদের এ কাজও সঠিক নয়। কারণ, হালাল ও হারাম করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল ক্বাদীর)
[৩] বুখারী শরীফের বর্ণনায় এসেছে যে, কুরআন কারীমের এই নির্দেশ অনুযায়ী রসূল (সাঃ) রোমক বাদশাহ হিরাকলের নিকটে পত্র প্রেরণ করেন এবং পত্রের মাধ্যমে এই আয়াতের দাবী অনুযায়ী তাকে ইসলাম কবুল করার প্রতি আহবান জানান।
‘ فَأَسْلِمْ تَسْلَمْ، أَسلِمْ يُؤْتِكَ اللهُ أَجْرَكَ مَرَّتَيْنِ فَإِنْ تَوَلَّيْتَ فَإِنَّ عَلَيْكَ إِثْمَ الْأَرِيسِيِّينَ’ “ইসলাম কবুল করে নাও, নিরাপত্তা পাবে। মুসলিম হয়ে যাও, তাহলে মহান আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ নেকী দিবেন। কিন্তু যদি তুমি ইসলাম স্বীকার না কর, তাহলে প্রজাদের পাপও তোমার উপর চাপবে।” (বুখারী ৭নং) কেননা, প্রজাদের ইসলাম স্বীকার না করার কারণই হবে তুমি। আলোচ্য আয়াতে তিনটি মৌলিক বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, (ক) কেবলমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করা, (খ) তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং (গ) কাউকে শরীয়তী বিধান প্রণয়নের ইলাহী মর্যাদা না দেওয়া। এটাই সেই ‘অভিন্ন বাক্য’ যার উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতি আহলে-কিতাবদেরকে আহবান জানানো হয়েছে। সুতরাং এই শতধা-বিচ্ছিন্ন উম্মতকেও ঐক্যবদ্ধ করতে উক্ত তিনটি বিষয়কে এবং এই ‘অভিন্ন বাক্য’কে অধিকরূপে মূল ভিত্তি ও বুনিয়াদ হিসাবে গ্রহণ করা উচিত।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
এ আয়াতের সম্বোধনে ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানসহ সকল অমুসলিম অন্তর্ভুক্ত। সবাইকে দু’টি বিষয়ের দিকে আহ্বান করা হয়েছে:
১. আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করব না এবং কাউকে তাঁর সাথে শরীক করব না।
২. আমাদের মধ্য থেকে কেউ কাউকে রব বানিয়ে নেব না।
এখানে যে বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হলো, সবাই এক আল্লাহর ইবাদত করব, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করব না। আল্লাহর এ এককত্বের বাণী গ্রহণের জন্য আহলে কিতাবসহ সকল ধর্মের লোককে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাই বলা হয়েছে, ‘আস এমন একটি কালেমার দিকে যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে সমান’। আর আমাদের মধ্য হতে কোন পণ্ডিত, ধর্মযাজক, ইমাম, সংসার বিরাগী, ওলী, গাউস-কুতুব ও রাজনৈতিক নেতার হালাল-হারাম বিধান দেয়ার অধিকার নেই। তারা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত হালালকে হারাম করবে আর হারামকে হালাল করবে এ অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়নি। যারা তাদেরকে এক্ষেত্রে মান্য করে তারা তাদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করে।
সাহাবী ‘আদী বিন হাতিম (রাঃ) বলেন: একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসলাম এমতাবস্থায় যে, আমার গর্দানে স্বর্ণের ক্রুশ ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: হে ‘আদী! তোমার থেকে এ মূর্তিটা সরিয়ে ফেল। ‘আদী (রাঃ) বলেন: এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূরা তাওবার এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন,
(اِتَّخَذُوْٓا اَحْبَارَھُمْ وَرُھْبَانَھُمْ اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللہِ)
‘তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগিদেরকে প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে।’ (সূরা তাওবা ৯:৩১)
‘আদী (রাঃ) বললেন: আমরা (ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরা) তো তাদের ইবাদত করি না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন, আল্লাহ তা‘আলা হারাম করে দিয়েছেন এমন বিধানকে তারা হালাল বললে তোমরা কি তা হালাল হিসেবে গ্রহণ করে নাও না? আবার আল্লাহ তা‘আলা হালাল করে দিয়েছেন এমন বিধানকে তারা হারাম বললে তোমরা কি তা হারাম হিসেবে গ্রহণ করে নাও না? ‘আদি বলল: হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটাই তাদের ইবাদত করা। (তিরমিযী হা: ৩০৯৫) সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার বিধানের বিপরীত বিধান চালু করা এবং তা গ্রহণ করা সবই শির্ক। এ অপরাধ স্বেচ্ছায় বুঝে-শুনে করলে মু’মিন থাকা যাবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর এ আয়াত অবতীর্ণ হলে রোম ও পারস্যসহ বিভিন্ন বাদশার প্রতি তিনি দাওয়াতনামা লিখে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানান এবং সে দাওয়াতনামায় এ আয়াত উল্লেখ করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৭)
অমুসলিমদের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে এ আয়াত একটি মূলনীতি। এ আয়াতের সমর্থক মুয়ায (রাঃ)-এর হাদীস। যখন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইয়ামানের আহলে কিতাবদের নিকট দাওয়াতের জন্য প্রেরণ করেছিলেন তখন সেখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: হে মুয়ায! তুমি এমন একটি সম্প্রদায়ের নিকট যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। অতএব তুমি সর্বপ্রথম যে দাওয়াত দেবে তা হল, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত রাসূল। (সহীহ বুখারী হা: ১৩৩১)
সুতরাং অমুসলিমদেরকে প্রথম যে দাওয়াত দিতে হবে তা হল তাওহীদের দাওয়াত।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইসলামের মূল ভত্তি হল তাওহীদ।
২. অমুসলিমদের সর্বপ্রথম তাওহীদের দিকে আহ্বান করতে হবে।
৩. অমুসলিমদের থেকে সর্ব প্রথম শির্ক দূর করার ব্যাপারে চেষ্টা করতে হবে।