أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٧٦)-২৭৯
www.motaher21.net
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِّن دُونِكُمْ
হে মু’মিনগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদের লোক ছেড়ে অন্য কাউকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না,
O you who believe! Yake not as Bitanah,
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-১১৮-১১৯
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا بِطَانَةً مِّنْ دُوْنِكُمْ لَا یَاْلُوْنَكُمْ خَبَالًاؕ وَدُّوْا مَا عَنِتُّمْۚ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَآءُ مِنْ اَفْوَاهِهِمْ ﭕ وَ مَا تُخْفِیْ صُدُوْرُهُمْ اَكْبَرُؕ قَدْ بَیَّنَّا لَكُمُ الْاٰیٰتِ اِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُوْنَ
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের নিজেদের জামায়াতের লোকদের ছাড়া অন্য কাউকে তোমাদের গোপন কথার সাক্ষী করো না। তারা তোমাদের দুঃসময়ের সুযোগ গ্রহণ করতে কুন্ঠিত হয় না। যা তোমাদের ক্ষতি করে তাই তাদের কাছে প্রিয়। তাদের মনের হিংসা ও বিদ্বেষ তাদের মুখ থেকে ঝরে পড়ে এবং যা কিছু তারা নিজেদের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে তা এর চাইতেও মারাত্মক। আমি তোমাদের পরিষ্কার হিদায়াত দান করেছি। তবে যদি তোমরা বুদ্ধিমান হও (তাহলে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার সতর্কতা অবলম্বন করবে) ।
هٰۤاَنْتُمْ اُولَآءِ تُحِبُّوْنَهُمْ وَ لَا یُحِبُّوْنَكُمْ وَ تُؤْمِنُوْنَ بِالْكِتٰبِ كُلِّهٖۚ وَ اِذَا لَقُوْكُمْ قَالُوْۤا اٰمَنَّا وَ اِذَا خَلَوْا عَضُّوْا عَلَیْكُمُ الْاَنَامِلَ مِنَ الْغَیْظِؕ قُلْ مُوْتُوْا بِغَیْظِكُمْؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیْمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ
তোমরা তাদেরকে ভালোবাসো কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালোবাসে না অথচ তোমরা সমস্ত আসমানী কিতাবকে মানো। তারা তোমাদের সাথে মিলিত হলে বলে, আমরাও(তোমাদের রসূল ও কিতাবকে) মেনে নিয়েছি। কিন্তু তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ ও আক্রোশ এতবেশী বেড়ে যায় যে, তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে থাকে। তাদেরকে বলে দাও, নিজেদের ক্রোধ ও আক্রোশে তোমরা নিজেরাই জ্বলে পুড়ে মরো। আল্লাহ মনের গোপন কথাও জানেন।
إِن تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِن تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا۟ بِهَاۖ وَإِن تَصْبِرُوا۟ وَتَتَّقُوا۟ لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْـًٔاۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ
যদি তোমাদের কল্যাণ হয়, তা তাদেরকে দুঃখ দেয়, আর যদি তোমাদের অকল্যাণ হয়, তাতে তারা আনন্দিত হয়, যদি তোমরা ধৈর্যশীল হও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না, নিশ্চয় তারা যা কিছু করছে, আল্লাহ তা পরিবেষ্টন করে আছেন।
১১৮-১২০ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
এখানে আল্লাহ পাক মুমিনদেরকে কাফির ও মুনাফিকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করছেন। তিনি বলছেন- এরা তো তোমাদের শত্রু। সুতরাং তোমরা তাদের বাহ্যিক মিষ্ট কথায় ভুলে যেও না এবং তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ো না। নতুবা তারা সুযোগ পেয়ে তোমাদেরকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং তদের ভেতরের শত্রুতা তখন প্রকাশ পেয়ে যাবে। তোমরা তাদের নিকট তোমাদের গুপ্ত কথা কখনও প্রকাশ করো না। (আরবী) বলা হয় মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধুকে এবং (আরবী) দ্বারা ইসলাম ছাড়া অন্যান্য সমস্ত দলকে বুঝানো হয়েছে। সহীহ বুখারী প্রভৃতির মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলা যে নবীকেই প্রেরণ করেছেন এবং যে প্রতিনিধিকেই নিযুক্ত করেছেন, তাঁর জন্যে তিনি দু’জন বন্ধু নির্ধারিত করেছেন। একজন তাকে ভাল কথা বুঝিয়ে থাকেন ও ভালকার্যে উৎসাহ দিয়ে থাকেন এবং অপরজন তাকে মন্দকার্যের পথ-প্রদর্শন করে ও সেই কার্যে উত্তেজিত করে। সুতরাং আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন সেই রক্ষা পেতে পারে।’ হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-কে বলা হয়ঃ ‘এখানে ‘হীরার’ একজন লোক রয়েছে, খুব ভাল লিখতে পরে এবং তার স্মরণশক্তি খুব ভাল সুতরাং আপনি তাকে আপনার লিখক নিযুক্ত করুন।’ একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ তাহলে তো আমি একজন অমুসলিমকে আমার বন্ধু বানিয়ে নেবো যা আল্লাহ তা’আলা নিষেধ করেছেন’! এ ঘটনাটিও এ আয়াতটিকে সামনে রেখে চিন্তা করলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে, যিম্মী কাফিরদেরকেও এরূপ কার্যে নিয়োগ করা উচিত নয়। কেননা, হতে পারে যে, তারা শত্রুপক্ষকে মুসলমানদের গোপনীয় কথা ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত করবে এবং তাদেরকে সতর্ক করে দেবে। কারণ, মুসলমানদের পতনই তাদের কাম্য। হযরত আযহার ইবনে রাশেদ (রঃ) বলেন যে, মানুষ হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ)-এর নিকট হাদীস শুনতেন। কোন হাদীসের ভাবার্থ বোধগম্য না হলে তারা হযরত হাসান বসরী (রঃ)-এর নিকট তা বুঝে নিতেন। একদা হযরত আনাস (রাঃ) নিম্নের হাদীসটি বর্ণনা করেনঃ “তোমরা অংশীবাদীদের অগ্নি হতে আলোক গ্রহণ। করো না এবং স্বীয় আংটিতে আরবী অংকন করো না। তারা এসে খাজা সাহেবকে এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ দ্বিতীয় বাক্যটির ভাবার্থ হচ্ছে- “তোমরা আংটিতে মুহাম্মদ (সঃ)-এর নাম খোদাই করো না এবং প্রথম বাক্যটির ভাবার্থ হচ্ছেঃ ‘তোমরা নিজেদের কার্যের ব্যাপারে মুশরিকদের পরামর্শ গ্রহণ করো না।’ দেখুন, আল্লাহ তা’আলাও স্বীয় গ্রন্থে বলেনঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্যদের বিশ্বস্ত বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না’। (আবু ইয়ালা) কিন্তু খাজা সাহেবের এ ব্যাখ্যাটি একটি বিবেচ্য বিষয়। সম্ভবতঃ হাদীসটির সঠিক ভাবার্থ হবেঃ (আরবী) (৪৯:২৯) আরবী অক্ষরে আংটির উপর খোদাই করো না। যেমন অন্য হাদীসে এর নিষিদ্ধতা পরিষ্কারভাবে বিদ্যমান রয়েছে। এর কারণ এই যে, এর ফলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মোহরের সঙ্গে সাদৃশ্য এসে যাবে। আর প্রথম বাক্যটির ভাবার্থ হবেঃ “তোমরা মুশরিকদের গ্রামের পার্শ্বে থেকো না, তাদের প্রতিবেশী হয়ো না এবং তাদের শহর হতে হিজরত কর।’ যেমন সুনান-ই-আবু দাউদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ মুসলমান ও মুশরিকদের মধ্যকার যুদ্ধ কি তোমরা দেখ না? অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যারা মুশরিকদের সাথে মেলামেশা করে, তাদের সাথে বসবাস করে, তারা তাদের মতই।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তাদের কথাতেও শুক্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের চেহারা দেখেই শুভাশুভ নিরূপকগণ তাদের ভেতরের দুষ্টামির কথা জানতে পারে। তাদের অন্তরে যে ধ্বংসাত্মক মনোভাব রয়েছে তা তোমাদের জানা নেই। কিন্তু আমি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিলাম। সুতরাং জ্ঞানীরা কখনও তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়বে না।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “দেখ, এটা কত বড় দুর্বলতার কথা যে, তোমরা তাদেরকে ভালবাসছো, অথচ তারা তোমাদেরকে চায় না। তোমরা সমস্ত গ্রন্থকে স্বীকার করে থাক বটে, কিন্তু তারা সন্দেহের মধ্যেই পড়ে রয়েছে। তোমরা তাদের গ্রন্থে বিশ্বাস কর বটে, কিন্তু তারা তোমাদের গ্রন্থে বিশ্বাস করে না। অতএব, উচিত তো ছিল যে, তোমরা তাদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে দেখতে। পক্ষান্তরে তারা কিন্তু তোমাদের প্রতি শত্রুতাই পোষণ করছে।
তারা মুসলমানদের মুখোমুখি হলে নিজেদের ঈমানদারীর কাহিনী বলতে আরম্ভ করে। কিন্তু যখনই তাদের হতে পৃথক হয় তখনই হিংসা ও ক্রোধে নিজেদের অঙ্গুলি কামড়াতে থাকে। সুতরাং মুসলমানদের উচিত যে, তারা যেন মুনাফিকদের বাহ্যিক ভাব দেখেই তাদেরকে বন্ধু মনে না করে। এ মুনাফিকরা মুসলমানদের উন্নতি দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরলেও আল্লাহ তা’আলা ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নতি সাধন করতেই থাকবেন। মুসলমানরা সর্বদিক দিয়ে বেড়েই চলবে, যদিও মুশরিক ও মুনাফিকরা হিংসা ও ক্রোধে জ্বলে পুড়ে মরে যায়। আল্লাহ পাক তাদের অন্তরের কথা খুব ভাল করেই জানেন। তাদের সমুদয় ষড়যন্ত্রের উপর মাটি পড়ে যাবে এবং তারা তাদের জঘন্য কার্যে কৃতকার্য হবে না। তারা মুসলমানদের উন্নতি চায় না তথাপি মুসলমানেরা দিন দিন উন্নতি লাভ করতেই থাকবে এবং পরকালেও তাদেরকে সুখময় জান্নাতে দেখতে পাবে। পক্ষান্তরে এ মুশরিক ও মুনাফিকরা ইহজগতেও লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে এবং পরকালেও তারা জাহান্নামের জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত হবে। তারা যে তোমাদের চরমশ তার বড় প্রমাণ এই যে, যখন তোমাদের কোন মঙ্গল সাধিত হয় তখন তারা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়। আর যদি তোমাদের কোন ক্ষতি সাধিত হয় তখন তারা তাতে আনন্দ লাভ করে। অর্থাৎ যখন আল্লাহ পাক মুমিনদেরকে সাহায্য করেন এবং তারা কাফিরদের উপর বিজয় লাভ করতঃ যুদ্ধলব্ধ দ্রব্য প্রাপ্ত হয় তখন ঐ মুনাফিকরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়। আর যখন মুমিনগণ পরাজয় বরণ করে তখন তারা কাফিরদের সাথে মিলিত হয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। এখন মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা তাদের দুষ্টামি হতে মুক্তি পেতে চাও তবে ধৈর্যধারণ কর, সংযমী হও এবং আমার উপর নির্ভর কর, আমি তোমাদের শত্রুদেরকে ঘিরে নেবো। কোন মঙ্গল লাভ করা এবং কোন অমঙ্গল হতে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। আল্লাহ তা’আলা যা চান তাই হয় এবং যা চান না তা হতে পারে না। তোমরা যদি আল্লাহর উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর কর তবে তিনিই তোমাদের জন্যে যথেষ্ট।’ এ সম্পর্কেই এখন উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা শুরু হচ্ছে, যার মধ্যে মুসলমানদের ধৈর্য ও সহনশীলতার বর্ণনা রয়েছে এবং যার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ তা’আলার পরীক্ষার পূর্ণচিত্র ও যদ্দ্বারা মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে প্রভেদ প্রকাশ পেয়েছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
মদীনার আশেপাশে যেসব ইহুদী বাস করতো আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের সাথে প্রাচীন কাল থেকে তাদের বন্ধুত্ব চলে আসছিল। এ দুই গোত্রের লোকেরা ব্যক্তিগতভাবেও বিভিন্ন ইহুদীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতো এবং গোত্রীয়ভাবেও তারা ছিল পরস্পরের প্রতিবেশী ও সহযোগী। আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা মুসলমান হয়ে যাবার পরও ইহুদীদের সাথে তাদের সেই পুরাতন সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। ব্যক্তিগতভাবেও তারা তাদের পুরাতন ইহুদী বন্ধুদের সাথে আগের মতই প্রীতি ও আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করতো। কিন্তু নবী ﷺ ও তাঁর মিশনের বিরুদ্ধে ইহুদীদের মধ্যে যে শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তার ফলে তারা এই নতুন আন্দোলনে যোগদানকারীকোন ব্যক্তির সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে প্রস্তুত ছিল না। আনসারদের সাথে তারা বাহ্যত আগের সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। কিন্তু মনে মনে তারা হয়ে গিয়েছিল তাদের চরম শত্রু। ইহুদীরা তাদের এই বাহ্যিক বন্ধুত্বকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে মুসলমানদের জামায়াতে অভ্যন্তরীণ ফিত্না ও ফাসাদ সৃষ্টি করার এবং তাদের জামায়াতের গোপন বিষয়গুলোর খবর সংগ্রহ করে শত্রুদের হাতে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য সর্বক্ষণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মহান আল্লাহ এখানে তাদের এই মুনাফেকী কর্মনীতি থেকে মুসলমানদের সাবধান থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
অর্থাৎ এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপারই বলতে হবে, কোথায় তোমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, তা নয় বরং তারা তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। তোমরা তো কুরআনের সাথে তাওরাতকেও মানো, তাই তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযোগ থাকতে পারতো। কারণ তারা কুরআনকে মানে না।
[১] অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ মিত্ররূপে গ্রহণ করো না। (بِطَانَةً) শব্দের অর্থ অভিভাবক, বন্ধু, বিশ্বস্ত, রহস্যবিদ। কাপড়ের অভ্যন্তর ভাগকেও (بِطَانَةً) বলা হয়, যা শরীরের সাথে মিশে থাকে। ‘কোন ব্যক্তির অভিভাবক, বিশ্বস্ত বন্ধু এবং যার সাথে পরামর্শ করে কাজ করা হয়, এরূপ ব্যক্তিকে তার (بِطَانَةً) বলা হয়’। এখানে (بِطَانَةً) বলে বন্ধু, বিশ্বস্ত, গোপন তথ্যের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য লোককে বোঝানো হয়েছে। অতএব আলোচ্য আয়াতে মুসলিমদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, নিজেদের দ্বীনের লোকদের ছাড়া অন্য কাউকে মুরুব্বী ও উপদেষ্টারূপে গ্রহণ করে তাদের কাছে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য প্রকাশ করতে যেও না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তাআলা যখনই কোন নবী পাঠিয়েছেন বা কোন খলীফা বা রাষ্ট্রনায়ককে ক্ষমতা প্রদান করেছেন, তখনই তার দু’ধরনের মিত্রের সমাহার ঘটে। এক ধরনের মিত্র তাকে সৎকাজের আদেশ দেয় এবং সেটার উপর উৎসাহ যোগায়। অপর ধরনের মিত্র তাকে খারাপ কাজের নির্দেশ দেয় এবং সেটার উপর উদ্দীপনা দিতে থাকে। আল্লাহ যাকে হেফাযত করতে ইচ্ছা করেন তিনি ব্যতীত সে মিত্রের অকল্যাণ থেকে বাঁচার কোন পথ থাকে না”। [বুখারী: ৭১৯৮]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, অন্ধকার যুগে কোন কোন মুসলিমের সাথে কোন কোন ইয়াহুদীর সন্ধিচুক্তি ছিল। সে চুক্তির কারণে ইসলাম গ্রহণের পরও মুসলিমরা তাদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রাখত। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে ইয়াহুদী-নাসারা তথা অমুসলিমদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশ দেন। [ইবন আবী হাতেম, আততাফসীরুস সহীহ]
[২] অর্থাৎ তারা তোমাদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি করতে কসুর করবে না। তারা তোমাদের বিপদ কামনা করে। এ ধরনের কিছু বিষয় স্বয়ং তাদের মুখেও প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু অন্তরে যে শক্রতা গোপন রাখে, তা আরও মারাত্মক। আমি তোমাদেরকে সামনে সব আলামত প্রকাশ করে দিয়েছি; এখন তোমরা যদি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পার তবে তা থেকে উপকার পেতে পার।
উদ্দেশ্য এই যে, ইয়াহুদী হোক কিংবা নাসারা, কপট বিশ্বাসী মুনাফেক হোক কিংবা মুশরেক -কেউ তোমাদের সত্যিকার হিতাকাঙ্ক্ষী নয়। তারা সর্বদাই তোমাদের বোকা বানিয়ে তোমাদের ক্ষতি সাধনে ব্যাপৃত এবং ধর্মীয় ও পার্থিব অনিষ্ট সাধনে সচেষ্ট থাকে। তোমরা কষ্টে থাক এবং কোন না কোন উপায়ে তোমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি হোক, এটাই হলো তাদের কাম্য। তাদের অন্তরে যে শক্রতা লুক্কায়িত রয়েছে, তা খুবই মারাত্মক। কিন্তু মাঝে মাঝে দুর্দমনীয় জিঘাংসায় উত্তেজিত হয়ে এমন সব কথাবার্তা বলে ফেলে, যা তাদের গভীর শক্রতার পরিচায়ক। শক্রতা ও প্রতিহিংসায় তাদের মুখ থেকে অসংলগ্ন কথা বের হয়ে পড়ে। সুতরাং এহেন শক্রদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আল্লাহ তা’আলা শক্ৰ-মিত্রের পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপনের বিধান বলে দিয়েছেন, সুতরাং মুসলিমদের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া খুবই সমীচীন।
[৩] ইসলাম বিশ্বব্যাপী করুণার ছায়াতলে মুসলিমগণকে অমুসলিমদের সাথে সহানুভূতি, শুভেচ্ছা, মানবতা ও উদারতার অসাধারণ নির্দেশ দিয়েছে। এটা শুধু মৌখিক নির্দেশই নয়; বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ একে কার্যে পরিণত করেও দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মুসলিমদের নিজস্ব রাষ্ট্র ও তার বৈশিষ্ট্যপুর্ণ কাযাবলী সংরক্ষণের স্বার্থে ইসলাম এ নির্দেশও দিয়েছে যে, ইসলামী আইনে অবিশ্বাসী ও বিদ্রোহীদের সাথে সম্পর্ক একটি বিশেষ সীমার বাইরে এগিয়ে নেয়ার অনুমতি মুসলিমদের দেয়া যায় না। কারণ, এতে ব্যক্তি ও জাতি উভয়েরই সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি যুক্তিপুর্ণ, সঙ্গত ও জরুরী ব্যবস্থা। এতে ব্যক্তি ও জাতি উভয়েরই হেফাজত হয়। যে সব অমুসলিম মুসলিম রাষ্ট্রের বাসিন্দা কিংবা মুসলিমদের সাথে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ, তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে জোরদার নির্দেশাবলী ইসলামী আইনের গুরুত্বপুর্ণ অংশ। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘সাবধান! যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের প্রতি অত্যাচার করে কিংবা তার প্রাপ্য হ্রাস করে কিংবা তার উপর সামর্থ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেয় অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছ থেকে কোন জিনিস গ্রহণ করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি তার পক্ষ থেকে উকিল হবো। [আবু দাউদঃ ৩০৫২]
কিন্তু এসব উদারতার সাথে সাথে মুসলিমদের নিজস্ব সত্তার হেফাযতের স্বার্থে এ নির্দেশও দেয়া হয়েছে যে, ইসলাম ও মুসলিমদের শক্রদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু কিংবা বিশ্বস্ত মুরুববীরূপে গ্রহণ করো না। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলা হলো যে, এখানে একজন হস্তলিপিতে সুদক্ষ অমুসলিম বালক রয়েছে। আপনি তাকে ব্যক্তিগত মুনশী হিসাবে গ্রহণ করে নিলে ভালই হবে। উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু উত্তরে বলেনঃ এরূপ করলে মুসলিমদের ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিশ্বস্তরূপে গ্রহণ করা হবে, যা কুরআনে নির্দেশের পরিপন্থী।’ [ইবন আবী হাতেম; আত-তাফসীরুস সহীহ]
ইমাম কুরতুবী হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর বিখ্যাত আলেম ও তফসীরবিদ। তিনি অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে মুসলিমদের মধ্যে এ শিক্ষার বিরুদ্ধাচরন ও তার অশুভ পরিণাম এভাবে বর্ণনা করেনঃ “আজকাল অবস্থা এমন পাল্টে গেছে যে, ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্যরূপে গ্রহণ করা হচ্ছে এবং এভাবে ওরা মুর্খ বিত্তশালী ও শাসকদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।” আধুনিক সভ্যতার যুগেও বিশেষ মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে সংশ্লিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়- এমন কোন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা ও মুরুব্বীরূপে গ্রহণ করা হয় না। তাই মুসলিম শাসকগণেরও এ ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত।
[৪] অর্থাৎ তাদের কাফেরসুলভ মনোভাবের আরো প্রমাণ হলো, তাদের অবস্থা এই যে, তোমরা কোন সুখকর অবস্থার সম্মুখীন হলে তারা দুঃখিত হয়, আর তোমরা কোন বিপদে পতিত হলে তারা আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে। অতঃপর আয়াতে এ ধরনের লোকদের চক্রান্ত এবং শক্রতার অশুভ পরিণাম থেকে নিরাপদ থাকার জন্যে একটি সহজ সুন্দর ব্যবস্থা বাতলে দেয়া হচ্ছেঃ “তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে এবং তাকওয়া অবলম্বন করলে ওদের চক্রান্ত তোমাদের বিন্দুমাত্রও অনিষ্ট করতে পারবে না”। কাতাদা বলেন, আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যখন তারা মুসলিমদের মধ্যে পরস্পর বন্ধুত্ব ও ঐক্যবদ্ধতা দেখে এবং শক্রদের উপর মুসলিমদের বিজয় প্রত্যক্ষ করে, তখন তারা কষ্ট পায়। আর যখন মুসলিমদের মধ্যে দলাদলি ও মতবিরোধ হয়েছে দেখতে পায়, অথবা মুসলিমদের কোন পরাজয় লক্ষ্য করে, তখনি তারা খুশীতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। যখনি তাদের এ ধরনের লোকের আবির্ভাব হবে, তখনি আল্লাহ্ তাআলা তাদের গোপন অবস্থা প্রকাশ করে দিবেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের এ অবস্থা চলতে থাকবে। [তাবারী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এই বিষয়টা পূর্বেও আলোচিত হয়েছে। বিষয়টা যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ তাই এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। بِطَانَة বলা হয় অন্তরঙ্গ ও বিশ্বস্ত বন্ধু এবং রহস্যবিদকে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফের ও মুশরিকরা যে সব অসদিচ্ছা ও দুরভিসন্ধি রাখে এবং তার মধ্যে যা তারা প্রকাশ করে আর যা নিজেদের অন্তরে গোপন রাখে, তার সব কিছুকেই মহান আল্লাহ (কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে) চিহ্নিত করে দিয়েছেন। এই আয়াত এবং এই ধরনের অন্য আয়াতসমূহের ভিত্তিতে উলামা ও ফক্বীহগণ লিখেছেন যে, কোন ইসলামী দেশে অমুসলিমদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কোন (নেতৃত্ব) পদে নিযুক্ত করা জায়েয নয়। বর্ণিত হয়েছে যে, আবূ মুসা আশআরী (রাঃ) একজন অমুসলিমকে সেক্রেটারী (কর্মসচিব) নিযুক্ত করেন। উমার (রাঃ) এ ব্যাপার জানতে পারলে তাঁকে কঠোর ধমক দিয়ে বলেন, ‘তুমি ওদেরকে তোমার কাছে টেনে নিও না, যখন আল্লাহ ওদেরকে দূর করে দিয়েছেন। তুমি ওদের সম্মান দান করো না, যখন আল্লাহ ওদেরকে লাঞ্ছিত করেছেন। আর তুমি ওদেরকে বিশ্বস্ত ও গোপন তথ্যের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য মনে করো না, কারণ আল্লাহ ওদেরকে বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করেছেন।’ উমার (রাঃ) এই আয়াতের ভিত্তিতেই এই ধরনের কথা বলেছেন। ইমাম ক্বুরত্বুবী বলেন, ‘এই যুগে আহলে-কিতাবকে সেক্রেটারী নিযুক্ত এবং বিশ্বস্ত মনে করার কারণে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই কারণেই নির্বোধ ও বোকা প্রকৃতির লোকেরা নেতা ও আমীর হয়ে বসে আছে।’ (তাফসীর ক্বুরত্বুবী) দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমানে বহু মুসলিম দেশেও কুরআন কারীমের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই নির্দেশের কোনই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাই তো অমুসলিমরা মুসলিম দেশেও বড় বড় পদে এবং বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে বহাল রয়েছে। আর এর অনিষ্টকারিতা যে কত বড় তা সকলের কাছে পরিষ্কার। যদি মুসলিম দেশগুলো স্বীয় দেশের সবরাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রীয় নীতির ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশকে গুরুত্ব দিত, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা বহু ফিতনা-ফাসাদ ও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেত।
[২]لاَ يَألُوْنَ ত্রুটি ও কসুর করবে না। خَبَالًا এর অর্থঃ বিশৃঙ্খলা, অনিষ্ট ও কষ্ট। مَا عَنِتُّمْ (যাতে তোমরা বিপন্ন হও, কষ্টে পতিত হও) عَنَتٌ মানে কষ্ট, বিপদ।
[৩] অর্থাৎ, তোমরা ঐ মুনাফিকদের নামায এবং (মৌখিকভাবে) তাদের ঈমান প্রকাশ করার কারণে ধোঁকায় পড়ে তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন কর।
[৪] عَضَّ يَعُضُّ এর অর্থ হল দাঁত দিয়ে কাটা। এই শব্দ দ্বারা তাদের রোষ ও ক্রোধের ভীষণতা বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন পরের [اِنْ تَمْسَسْكُمْ] আয়াতেও তাদের ক্রোধের ধরন প্রকাশ করা হয়েছে।
[৫] মুনাফিকরা মু’মিনদের সাথে যে কঠোর শত্রুতা পোষণ করত, সে কথা এখানে তুলে ধরে বলা হচ্ছে যে, যখন মুসলিমরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করত, আল্লাহর পক্ষ হতে যখন তারা সমর্থন ও সাহায্য পেত এবং তাদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি লাভ করত, তখন মুনাফিকদেরকে বড়ই খারাপ লাগত। আর যখন মুসলিমরা অনাবৃষ্টি ও সংকীর্ণতার শিকার হত অথবা আল্লাহর ইচ্ছা ও কৌশলের ভিত্তিতে শত্রু সাময়িকভাবে তাদের উপর জয়লাভ করত (যেমন উহুদ যুদ্ধে হয়েছিল), তখন এরা বড়ই খুশী হত। বলার উদ্দেশ্য হল, যাদের অবস্থা হল এই, তারা কি এই যোগ্যতার অধিকারী যে, মুসলিমরা তাদের প্রতি সম্প্রীতির হাত বাড়াবে এবং তাদেরকে রহস্যবিদ্ ও অন্তরঙ্গ বন্ধু বানিয়ে নেবে? এই কারণেই মহান আল্লাহ ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের সাথেও বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করেছেন (যেমন কুরআনের অন্যত্র এসেছে)। কেননা, তারাও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করে। মুসলিমদের সফলতায় তারা নিরানন্দ এবং তাদের অসফলতায় তারা আনন্দ বোধ করে।
[৬] এটা হল তাদের প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা থেকে বাঁচার পথ ও চিকিৎসা। অর্থাৎ, মুনাফিক এবং ইসলাম ও মুসলিমদের অন্যান্য সকল শক্রর চক্রান্ত থেকে বাঁচার জন্য ধৈর্য ও আল্লাহভীরুতার প্রয়োজন অত্যধিক। মুসলিমদের মাঝে এই ধৈর্য ও তাকওয়া না থাকার ফলেই অমুসলিমদের যাবতীয় চক্রান্ত সাফল্যমন্ডিত হয়েছে। মানুষ মনে করে যে, কাফেরদের সফলতার কারণ হল, আর্থিক উপায়-উপকরণের প্রাচুর্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় তাদের উন্নতি। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হল, মুসলিমদের অবনতির মূল কারণ তাদের দ্বীনের উপর ধৈর্যের সাথে প্রতিষ্ঠিত না থাকা এবং তাকওয়া-শূন্যতা। পক্ষান্তরে এই দু’টি জিনিসই হল মুসলিমদের উন্নতির চাবিকাঠি এবং আল্লাহর বিজয় লাভের অসীলা।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
মু’মিনগণ কেবল মু’মিনদেরকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে, অন্য কাউকে না। এ সম্পর্কে সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আল্লাহ তা‘আলা আরো কঠোরভাবে ধমক দিয়ে কাফির-মুশরিকসহ অন্যান্যদেরকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করছেন। যদিও আয়াতে মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, তবে মুনাফিকসহ সকল কাফির এতে শামিল; কারণ তারা তোমাদের ভাল চায় না, সুযোগ পেলেই তোমাদের ক্ষতি করবে। মুখে বাহ্যিকভাবে খুব সুসম্পর্কের কথা বলবে, এমনকি অনেক কিছু আদান-প্রদান করবে। মাঝে মাঝে বিদ্বেষমূলক কথা বের হয়ে যাবে। কিন্তু অন্তরে যে বিদ্বেষ গোপন করে আছে তা আরো ভয়ংকর। আমরা মুসলিমরা তাদের প্রতি ভালবাসা দেখালে কি হবে, তারা মূলত আমাদের ভালবাসে না, তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষণিকের সম্পর্ক রাখে; কিন্তু সুযোগ পেলেই তাদের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়ে যাবে। সুতরাং তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই। যদি মুসলিমরা তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে কখনো পূর্ণ ঈমানের ওপর টিকে থাকতে পারবে না এবং দুনিয়াতে তাদের ওপর বিজয়ী হতে পারবে না। আরবিতে একটি প্রবাদ রয়েছে যার অর্থ হলো: কোন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না; বরং ব্যক্তির বন্ধু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর। কারণ ব্যক্তি তার বন্ধুর অনুসরণ করে চলে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: একজন ব্যক্তি তার বন্ধুর ধর্ম অনুরসণ করে থাকে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকে যেন লক্ষ রাখে সে কাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করছে। (সিলসিলা সহীহাহ হা: ৯২৭)
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন নাবী প্রেরণ ও খলীফা নির্ধারণ করেননি যার জন্য দু’জন অন্তরঙ্গ বন্ধু দেননি। একজন বন্ধু তাকে ভাল কাজের পরামর্শ দেয় ও ভাল কাজে উৎসাহ দেয় অপর জন খারাপ কাজের পরামর্শ দেয় ও খারাপ কাজের ইন্ধন যোগায়। আল্লাহ তা‘আলা যাকে রক্ষা করেন সেই কেবল রক্ষা পায়। (সহীহ বুখারী হা: ৬৬১১, ৭১৯৬)
সুতরাং রাষ্ট্র প্রধানদেরও লক্ষ রাখা দরকার কাদের সাথে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক করছেন।
بِطَانَةً এমন অন্তরঙ্গ বন্ধু যার নিকট গোপন তথ্য বলা হয়।
لَا يَأْلُوْنَكُمْ
তোমাদের ক্ষতি করতে ত্র“টি করে না।
خَبَالًا যা তোমাদের দীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্য অনিষ্টকর।
تُحِبُّوْنَهُمْ তোমরা মুনাফিকদের বাহ্যিক সালাত এবং ঈমানের ধোঁকায় তাদের বন্ধু বানিয়ে নাও। জেনে রেখ! তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা কাফির-মুনাফিকদের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্র“তা পোষণ করার কথা তুলে ধরছেন। যদি মুসলিমদের কোন বিজয়, গনীমত ও সাহায্য আসে তা হলে তারা ব্যথিত হয়। পক্ষান্তরে মুসমিদের পরাজয় হলে অথবা জানমালের কোন ক্ষতি হলে তারা খুব খুশি হয়। তাই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক রাখাই আমাদের অধঃপতনের অন্যতম কারণ।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কাফির-মুশরিকদের সাথে বন্ধুত্ব হারাম। তবে কোন ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে অন্তরে ঘৃণা রেখে বাহ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা যেতে পারে।
২. কাফিরদের প্রতি মুসলিমরা সহানুভূতি দেখালেও তারা মূলত মুসলিমদেরকে ভালবাসে না।
৩. মুসলিমদের প্রতি কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের হিংসার দাবানল সর্বদা জ্বলতে থাকে।