أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٨٩)-২৯১
www.motaher21.net
أَصٰبَتْكُم مُّصِيبَةٌ ؟
‘এটা কোত্থেকে আসলো?’
” Whence is this?”
সুরা: আলে-ইমরান
- আয়াত নং ১৬৫-১৬৮
اَوَ لَمَّاۤ اَصَابَتْكُمْ مُّصِیْبَةٌ قَدْ اَصَبْتُمْ مِّثْلَیْهَاۙ قُلْتُمْ اَنّٰى هٰذَاؕ قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ اَنْفُسِكُمْؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلٰى كُلِّ شَیْءٍ قَدِیْرٌ
তোমাদের ওপর যখন বিপদ এসে পড়লো তোমরা বলতে লাগলে, এ আবার কোথায় থেকে এলো? তোমাদের এ অবস্থা কেন? অথচ (বদরের যুদ্ধে) এর দ্বিগুণ বিপদ তোমাদের মাধ্যমে তোমাদের বিরোধী পক্ষের ওপর পড়েছিল।হে নবী! ওদের বলে দাও, তোমরা নিজেরাই এ বিপদ এনেছো। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের ওপর শক্তিমান।
وَمَآ أَصٰبَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ
দু’দল পরস্পরের সম্মুখীন হওয়ার দিন যে বিপদ পৌঁছেছিল, তা আল্লাহর হুকুমে ঘটেছিল, এর উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত মু’মিনদেরকে জেনে নেয়া।
وَ لِیَعْلَمَ الَّذِیْنَ نَافَقُوْا ۚۖ وَ قِیْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ اَوِ ادْفَعُوْاؕ قَالُوْا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَّا اتَّبَعْنٰكُمْؕ هُمْ لِلْكُفْرِ یَوْمَئِذٍ اَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلْاِیْمَانِۚ یَقُوْلُوْنَ بِاَفْوَاهِهِمْ مَّا لَیْسَ فِیْ قُلُوْبِهِمْؕ وَ اللّٰهُ اَعْلَمُ بِمَا یَكْتُمُوْنَۚ
এবং কে মুনাফিক। এ মুনাফিকদের যখন বলা হলো, এসো আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো অথবা (কমপক্ষে) নিজের শহরের প্রতিরক্ষা করো, তারা বলতে লাগলোঃ যদি আমরা জানতাম আজ যুদ্ধ হবে, তাহলে আমরা অবশ্যি তোমাদের সাথে চলতাম।যখন তারা একথা বলছিল তখন তারা ঈমানের তুলনায় কুফরীর অনেক বেশী কাছে অবস্থান করছিল। তারা নিজেদের মুখে এমন সব কথা বলে, যা তাদের মনের মধ্যে নেই এবং যা কিছু তারা মনের মধ্যে গোপন করে আল্লাহ তা খুব ভালো করেই জানেন।
ٱلَّذِينَ قَالُوا۟ لِإِخْوَٰنِهِمْ وَقَعَدُوا۟ لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا۟ۗ قُلْ فَٱدْرَءُوا۟ عَنْ أَنفُسِكُمُ ٱلْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَٰدِقِينَ
যারা বসে থেকে নিজেদের ভাইদের সম্বন্ধে বলতে লাগল, আমাদের কথামত চললে তারা নিহত হত না। বল, তোমরা সত্যবাদী হলে তোমাদের নিজেদের উপর থেকে মরণকে হটিয়ে দাও।
১৬৫-১৬৮ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
এখানে যে বিপদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে উহুদ যুদ্ধের বিপদ। এ যুদ্ধে সত্তরজন সাহাবী শহীদ হন। কিন্তু মুসলমানগণ এর দ্বিগুণ বিপদ কাফিরদেরকে পৌছিয়ে ছিলেন। অর্থাৎ বদরের যুদ্ধে সত্তরজন কাফির নিহত হয়েছিল এবং সত্তরজন বন্দী হয়েছিল। মুসলমানগণ পরস্পর বলাবলি করেন যে, এ বিপদ কি করে আসলো? আল্লাহ তাআলা উত্তরে বলেন-এ বিপদ তোমাদের নিজেদের পক্ষ হতেই এসেছে। হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বর্ণনা করেন, “বদরের যুদ্ধে মুসলমানগণ মুক্তিপণ নিয়ে যেসব কাফিরকে মুক্তি দিয়েছিলেন তারই শাস্তি স্বরূপ উহুদের যুদ্ধে সত্তরজন সাহাবীকে শহীদ করা হয়, তাদের মধ্যে পলায়নের হিড়িক পড়ে যায়, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সম্মুখের চারটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। তার মাথার পাগড়ী পড়ে যায় এবং চেহারা মুবারক রক্তাক্ত হয়ে যায়। উক্ত আয়াতে এরই বর্ণনা রয়েছে। (মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিম ও মুসনাদ-ই-আহমাদ) হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন এবং বলেনঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আপনার গোত্রের লোক যে কাফিরদেরকে বন্দী করেছে এটা আল্লাহ পাকের নিকট পছন্দীয় নয়। এখন দু’টি সিদ্ধান্তের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণের নির্দেশ দিন। হয় তারা বন্দীদেরকে হত্যা করে ফেলবে না হয় মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু পরে এ সংখ্যক মুসলমানও শহীদ হয়ে যাবে।’ রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুসলমানদেরকে একত্রিত করে এ দুটি সিদ্ধান্তই পেশ করেন। তাঁরা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এরা আমাদের গোত্রীয় লোক এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন। সুতরাং মুক্তিপণ আদায় করে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হোক। আর এ অর্থ দ্বারা আমরা শক্তি অর্জন করতঃ অন্যান্য শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো এবং আমাদের মধ্য হতে যে এতজন লোক শহীদ হবেন তাতে আমাদের ক্ষতি কি? এরূপে ক্ষতিপূরণ আদায় করে সত্তরজন বন্দীকে ছেড়ে দেয়া হয়। উহুদ যুদ্ধে ঠিক সত্তরজন মুসলমানই শহীদ হন। (জামেউত তিরমিযী ও সুনান-ই-নাসাঈ) সুতরাং এক ভাবার্থতো এই হলো যে, এটা স্বয়ং মুসলমানদের পক্ষ হতেই হয়েছে। অর্থাৎ তারা এই শর্তে বন্দীদেরকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন যে, তাদের মধ্য হতেও এ সংখ্যক মুসলমান শহীদ হবেন এবং ঘটেছিলও তাই। দ্বিতীয় ভাবার্থ হচ্ছে“তোমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অবাধ্য হয়েছিলে বলেই তোমাদেরকে এ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।’ তীরন্দাজগণকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের স্থান হতে সরতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু ঐ নিষেধ সত্ত্বেও তারা উক্ত স্থান হতে সরে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক জিনিসের উপর সক্ষম। তিনি যা চান তাই করেন, যা ইচ্ছে করেন তাই নির্দেশ দেন। কেউ তার নির্দেশের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পরে না। দু’টি দলের মুখখামুখী হওয়ার দিন (হে মুমিনগণ!) তোমাদের যে ক্ষতি হয়েছিল, যেমন তোমরা শত্রুদের মোকাবিলা করতে গিয়ে পলায়ন করেছিলে, তোমাদের কতক লোক শহীদ হয়েছিল এবং কিছু আহতও হয়েছিল, এ সবকিছু আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছাক্রমেই হয়েছিল। এর একটি কারণ ছিল এই যে, এর মাধ্যমে অটল ও দৃঢ় ঈমানের লোক এবং মুনাফিকদের মধ্যে পার্থক্য আনয়ন করা হয়। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল এবং তার সঙ্গীরা যারা রাস্তা হতে ফিরে এসেছিল। একজন মুসলমান তাদেরকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘এসো, আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর কিংবা কমপক্ষে ঐ আক্রমণকারীদেরকে পিছনে সরিয়ে দাও।’ কিন্তু তারা কৌশল করে বলে, ‘আমরা যুদ্ধবিদ্যায় মোটেই পারদর্শী নই। আমরা যুদ্ধবিদ্যা জানলে অবশ্যই তোমাদের অনুসরণ করতাম। ওরা যদি কমপক্ষে মুসলমানদের সঙ্গেও থাকতে তাহলেও কাফিরদের আক্রমণ প্রতিহত করা যেতো। কেননা এর ফলে মুসলমানদের সংখ্যা বেশী দেখানো হতো বা তারা দু’আ করতো, কিংবা প্রস্তুতি গ্রহণ করতো। তাদের উপরের কথার ভাবার্থ নিম্নরূপও বর্ণনা করা হয়েছেঃ ‘আমরা যদি জানতে পারতাম যে, সত্য সত্যই তোমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তবে অবশ্যই আমরা তোমাদের সহযোগিতা করতাম। কিন্তু আমরা জানি যে, যুদ্ধ হবেই না। সীরাত-ই-মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক হাজার লোক নিয়ে উহুদের প্রান্তরের দিকে অগ্রসর হন। পথে গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল বিদ্রোহী হয়ে যায় এবং বলে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) অন্যদের কথা শুনে মদীনার বাইরে চলে আসলেন এবং আমার কথা শুনলেন না। আল্লাহর শপথ! কোন্ উপকারকে লক্ষ্য করে যে আমরা প্রাণ বিসর্জন দেবো তা আমাদের মোটেই জানা নেই। হে লোক সকল! কেন তোমরা জীবন হারাতে যাচ্ছ? কপট ও সন্দেহ পোষণকারী যত লোক। সবাই তার কথা মেনে নেয় এবং এক তৃতীয়াংশ সৈন্য নিয়ে সে দুষ্ট ফিরে আসে। বানূ সালমার ভাই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম (রাঃ) তাদেরকে বুঝিয়ে বলেন, হে আমার গোত্র! স্বীয় নবী (সঃ)-কে ও স্বীয় সম্প্রদায়কে অপদস্থ করো না। তাদেরকে শত্রুর সম্মুকে নিক্ষেপ করে তোমরা পলায়ন করো না। কিন্তু তারা কৌশল অবলম্বন করে বলে, আমরা জানি যে যুদ্ধ হবেই না।’ মুসলমানগণ তাদেরকে বুঝতে অসমর্থ হয়ে অবশেষে বলেন, “হে আল্লাহর শত্রুর দল! যাও আল্লাহ তোমাদেরকে ধ্বংস করুন! তোমাদের কোনই প্রয়োজন নেই। আল্লাহ পাক স্বীয় নবী (সঃ)-এর সাহায্যকারী। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে ছেড়ে সম্মুখে অগ্রসর হন। ইরশাদ হচ্ছে-‘সে দিন তারা বিশ্বাস অপেক্ষা অবিশ্বাসের বেশী নিকটবর্তী ছিল।’ এর দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, মানুষের অবস্থা বিভিন্ন প্রকারের। কখনও সে কুফরীর নিকটবর্তী হয় এবং কখনও ঈমানের নিকটবর্তী। এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তাদের অন্তরে যা নেই তা তারা মুখে বলে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে-“আমরা যদি যুদ্ধ হওয়ার কথা জানতাম তবে অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে থাকতাম। অথচ তারা নিশ্চিতরূপে জানতো যে, মুশরিকরা মুসলমানদের উপর ভীষণ আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে দুনিয়ার বুক হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কেননা, ইতিপূর্বে বদরের যুদ্ধে তাদের বড় বড় নেতারা নিহত হয়েছিল। কাজেই তারা এখন দুর্বল মুমিনদের উপর ভীষণ আক্রমণ চালিয়েছে। সুতরাং এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হতে যাচ্ছে। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘তাদের অন্তরের গোপনীয় কথা আমি খুব ভালভাবেই জানি।’ এ লোকগুলো ওরাই যারা তাদের ভাইদের সম্বন্ধে বলেছিল, ‘যদি এরা আমাদের পরামর্শ মত কাজ করতো এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করতো তবে কখনও নিহত হতো না। এর উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যদি তোমাদের এ কথা সঠিক হয় যে, মানুষ যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত না হলে মৃত্যু হতে রক্ষা পেয়ে যাবে তবে তো তোমাদের না মরাই উচিত, কেননা তোমরা তো বাড়ীতেই বসে রয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট কথা যে, একদিন তোমরাও মৃত্যুবরণ করবে, যদিও সুদৃঢ় ও সুউচ্চ অট্টালিকায় আশ্রয় গ্রহণ কর। আমি তোমাদেরকে তখনই সত্যবাদী মনে করতে পারি যখন তোমরা নিজেরেদকে মৃত্যু হতে রক্ষা করতে পারবে।’ হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, “এ আয়াতটি আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল এবং তার সঙ্গীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
নেতৃস্থানীয় সাহাবীগণ অবশ্যি যথার্থ সত্য অবগত ছিলেন এবং তাঁদের কোনো প্রকার বিভ্রান্তির শিকার হবার সম্ভাবনা ছিল না। তবে সাধারণ মুসলমানরা মনে করছিলেন, আল্লাহর রসূল যখন আমাদের সঙ্গে আছেন এবং আল্লাহ আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা দান করছেন তখন কোন অবস্থাতেই কাফেররা আমাদের ওপর বিজয় লাভ করতে পারে না। তাই ওহোদ পরাজিত হবার পর তারা ভীষণভাবে আশাহত হয়েছেন। তারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছেন, এ কি হলো? আমরা আল্লাহর দ্বীনের জন্য লড়তে গিয়েছিলাম। তাঁর প্রতিশ্রুতি ও সাহায্য আমাদের সঙ্গে ছিল। তাঁর রসূল সশরীরে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন। এরপরও আমরা হেরে গেলাম? এমন লোকদের হাতে হেরে গেলাম, যারা আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য এসেছিল? মুসলমানদের এই বিস্ময় পেরেশানী ও হতাশা দূর করার জন্য এ আয়াত নাযিল হয়।
ওহোদের যুদ্ধে মুসলমানদের সত্তর জন লোক শহীদ হয়। অন্যদিকে ইতিপূর্বে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে সত্তর জন্য কাফের নিহত এবং সত্তর জন বন্দী হয়েছিল।
অর্থাৎ এটা তোমাদের নিজেদের দুর্বলতা ও ভুলের ফসল। তোমরা সবর করোনি। তোমাদের কোন কোন কাজ হয়েছে তাকওয়া বিরোধী। তোমরা নির্দেশ অমান্য করেছো। অর্থ-সম্পদের লোভে আত্মহারা হয়েছো। পরস্পরের মধ্যে বিবাধ ও মতবিরোধ করেছো। এতো সব করার পর আবার জিজ্ঞেস করছো, বিপদ এলো কোথা থেকে?
অর্থাৎ আল্লাহ যদি তোমাদের বিজয় দান করার শক্তি রাখেন তাহলে পরাজয় দান করার শক্তিও রাখেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যখন তিন’শো মুনাফিক নিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে যেতে লাগলো তখন কোন কোন মুসলমান গিয়ে তাকে বুঝাবার চেষ্টা করলো এবং মুসলিম সেনাদলে ফিরে আসার জন্য রাজী করতে চাইলো। কিন্তু সে জবাব দিল, “আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আজ যুদ্ধ হবে না, তাই আমরা চলে যাচ্ছি। নয়তো আজও যুদ্ধ হবার আশা থাকলে আমরা অবশ্যি তোমাদের সাথে চলে যেতাম।”
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] এক হাদীসে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বদরের ঘটনা বর্ণনার পর উহুদের যুদ্ধের বিপর্যয়ের কারণ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, এটার কারণ হলোঃ বদরের যুদ্ধের বন্দীদের থেকে ফিদিয়া নেয়া। [দেখুনঃ মুসনাদে আহমাদঃ ১/২০৭]
[২] সহীহ আকীদা বিশ্বাস হলো, কোন খারাপের সম্পর্ক আল্লাহ্র দিকে করা জায়েয নেই। আল্লাহ তা’আলার দিকে সব সময় ভাল ফলাফলের সম্পর্ক করতে হয় । খারাপ ফলের বাহ্যিক কারণ সৃষ্ট জীব। খারাপ তাদেরই অর্জন করা। আর এজন্যই সূরা আল-জ্বিনে আল্লাহ্ তা’আলা জ্বিনদের কথা উল্লেখ করে বলছেন যে, তারা বলেছিল “আর আমরা জানিনা যমীনের অধিবাসীদের জন্য খারাপ কিছুর ইচ্ছা করা হয়েছে নাকি তাদের প্রভূ তাদের জন্য সঠিক পথ দেয়ার ইচ্ছা করেছেন”। [সূরা জ্বিনঃ ১০]
অন্য হাদীসে এসেছে, ‘আর খারাপ কিছু আপনার থেকে হয় না’ [মুসলিমঃ ৭৭১]
[৩] এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এসব যা কিছু হয়েছে, সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা ও সমর্থনে হয়েছে। মনে রাখা দরকার যে, আল্লাহ্র ইচ্ছা বা অনুমতি দু’প্রকার। এক, ইযনে শারয়ী’ বা শরীআতগত অনুমোদন বা ইচ্ছা। এ অনুমোদনের সাথে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক কাউকে সালাত আদায় করতে দেয়ার ইচ্ছা, কাউকে হক পথে চলতে দেয়ার ইচ্ছা ইত্যাদি। এ ধরনের অনুমোদন বা ইচ্ছা সংঘটিত হওয়া বাধ্যতামূলক নয়। দুই. ‘ইযনে কাওনী’ বা প্রকৃতিগত অনুমোদন বা ইচ্ছা। এ অনুমোদনের সাথে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি নেই। তবে তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। যেমন এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ্র অনুমোদন বা ইচ্ছা। [তাফসীরে সা’দী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ, উহুদ যুদ্ধে যেমন তোমাদের ৭০ জন লোক শহীদ হয়েছে, তেমনি বদর যুদ্ধে তোমরাও ৭০ জন কাফেরকে হত্যা এবং ৭০ জনকে বন্দী করেছিলে।
[২] অর্থাৎ, তোমাদের নিজেদেরই সেই ভুলের কারণে যা তোমরা রসূল (সাঃ)-এর পাহাড়ের ঘাঁটি ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তা ত্যাগ করার মাধ্যমে করেছিলে। যার বিস্তারিত আলোচনা পূর্বেই হয়েছে। এই ভুলের কারণে কাফেরদের একটি দল সে ঘাঁটি হয়ে পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায়।
[৩] অর্থাৎ, উহুদে তোমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা আল্লাহরই নির্দেশে হয়েছে। (যাতে তোমরা আগামীতে রসূল (সাঃ)-এর আনুগত্যের প্রতি যথাযথ যত্ন নাও।) এ ছাড়া এর আরো একটি উদ্দেশ্য হল, মু’মিন ও মুনাফিকদেরকে একে অপর থেকে পৃথক করা হল।
[৪] যুদ্ধ জানার অর্থ হল, যদি বাস্তবিকই তুমি যুদ্ধ করতে যেতে, তাহলে আমরাও তোমার সাথে থাকতাম। কিন্তু তুমি তো নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দিতে যাচ্ছ, অতএব এ রকম ভুল কাজে আমরা তোমার সাথে কিভাবে থাকতে পারি? এই ধরনের কথা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সাথীরা এই জন্যই বলেছিল যে, তাদের মত গ্রহণ করা হয়নি। আর এ কথা তারা তখন বলেছিল, যখন ‘শাউত্ব’ নামক স্থানে পৌঁছে তারা (যুদ্ধ না করে) প্রত্যাবর্তন করছিল এবং আব্দুল্লাহ ইবনে হারাম আনসারী তাদেরকে বুঝিয়ে যুদ্ধে শরীক করার প্রচেষ্টা করছিলেন। (এর কিছু বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে হয়েছে।)
[৫] নিজেদের মুনাফিক্বী এবং এমন কথা-বার্তার কারণে যা তারা বলেছে।
[৬] অর্থাৎ, যুদ্ধ ত্যাগ করার যে কারণ মৌখিকভাবে তারা প্রকাশ করেছে, সেটা প্রকৃত কারণ নয়, বরং তাদের অন্তরে লুক্কায়িত যে কারণ ছিল তা হল, প্রথমতঃ আমাদের পৃথক হওয়ায় মুসলিমদের অন্তরে দুর্বলতার সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়তঃ কাফেরদের লাভ হবে। অর্থাৎ, আসল উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম, মুসলিম এবং নবী করীম (সাঃ)-এর ক্ষতি করা।
[৭] এখানে মুনাফিকদের কথা ‘তারা আমাদের কথা মত চললে নিহত হতো না’ এর প্রতিবাদ করে মহান আল্লাহ বলছেন, “যদি তোমরা তোমাদের কথায় সত্যবাদী হও, তাহলে নিজেদের উপর থেকে মৃত্যুকে সরিয়ে দাও তো দেখি।” অর্থাৎ, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্য থেকে পালানোর কোন উপায় নেই। মৃত্যুও যেখানে এবং যেভাবে নির্ধারিত আছে, সেখানে এবং সেইভাবেই আসবে। সুতরাং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হতে পলায়ন কাউকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের যেমন সত্তরজন সাহাবী শহীদ হয়েছিল, তেমনি বদর যুদ্ধে মুসলিমরাও সত্তরজন কাফিরকে হত্যা এবং সত্তরজন বন্দী করেছিলেন।
(هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ)
‘ওটা তোমাদের নিজেদের নিকট থেকেই এসেছে’ অর্থাৎ তোমাদের নিজেদের ভুলের কারণে এ বিপদ এসেছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাদেরকে পাহাড়ের গিরিপথ ত্যাগ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন; কিন্তু তোমরা নির্দেশ ভঙ্গ করে সেখান থেকে চলে এসেছিলে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, মুসলিমরা যদি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ মোতাবেক না চলে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণ না করে তা হলে তারা কোন দিন সফলকাম হতে পারবে না।
(يَوْمَ الْتَقَي)
সম্মুখীন হবার দিন বলতে উহুদের দিনকে বুঝানো হয়েছে। এ দিন মুসলিম ও কাফির দু’দল মুখোমুখি হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।
(وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُوْا)
অর্থাৎ উহুদে তোমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা আল্লাহ তা‘আলারই নির্দেশে হয়েছে। (যাতে তোমরা আগামীতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্যের প্রতি যতœবান হও) এ ছাড়াও এর আরো একটি উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলা জানতে চান কারা প্রকৃত মু’মিন আর কারা মুনাফিক।
(لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا)
‘আমরা যদি যুদ্ধ হবে জানতাম’ এর অর্থ হল, যদি বাস্তবিকই তুমি যুদ্ধ করতে যেতে, তাহলে আমরাও তোমার সাথে থাকতাম। কিন্তু তুমি তো নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দিতে যাচ্ছ, অতএব এ রকম ভুল কাজে আমরা তোমার সাথে কিভাবে থাকতে পারি? এ ধরণের কথা আবদুল্লাহ বিন উবাই ও তার সাথী মুনাফিকরা বলেছিল। কারণ যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। তারা মুখে যা বলে অন্তরে তা নেই। যেমন আমরা যুদ্ধ জানলে তোমাদের অনুসরণ করতাম।
এ সকল মুনাফিকরাই তাদের সঙ্গীদের বলে, তারা যদি আমাদের কথা শুনত তাহলে মারা যেত না। এসকল মুনাফিকদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. দুনিয়ার অনেক বিপদ-আপদ মানুষের পাপের কারণেই আসে, অধিকাংশই আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দেন।
২. পৃথিবীতে যা কিছু হয় সবকিছু আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত।
৩. মুনাফিকরা মু’মিনদের জন্য কাফিরদের থেকে ভয়ানক।