أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٩٨)-৩০০
www.motaher21.net
لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِى الْبِلٰدِ
দেশে দেশে কাফিরদের সদম্ভ পদচারণা তোমাকে যেন বিভ্রান্ত না করে।
Let not the strutting about of the Unbelievers through the land I deceive you.
সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং ১৯৬-১৯৮
لَا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِى الْبِلٰدِ
দেশে দেশে কাফিরদের সদম্ভ পদচারণা তোমাকে যেন বিভ্রান্ত না করে।
(১৯৭)
مَتٰعٌ قَلِيلٌ ثُمَّ مَأْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ ۚ وَبِئْسَ الْمِهَادُ
সামান্য ভোগ, তারপর জাহান্নাম তাদের আবাস, আর তা কতই না নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল!
(১৯৮)
لَٰكِنِ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَوْا۟ رَبَّهُمْ لَهُمْ جَنَّٰتٌ تَجْرِى مِن تَحْتِهَا ٱلْأَنْهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَا نُزُلًا مِّنْ عِندِ ٱللَّهِۗ وَمَا عِندَ ٱللَّهِ خَيْرٌ لِّلْأَبْرَارِ
কিন্তু যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্য আছে জান্নাত যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তারা তাতে চিরকাল থাকবে, এ হল আল্লাহর নিকট হতে আতিথ্য আর আল্লাহর নিকট যা আছে, তা সৎকর্মপরায়ণদের জন্য অতি উত্তম।
১৯৬-১৯৮ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেন-“হে নবী (সঃ)! তুমি কাফিরদের মাতালতা, আনন্দ-বিহ্বলতা, সুখ সম্ভোগ এবং আঁকজমকের প্রতি দৃষ্টিপাত করো না। অতিসত্বরই এসব কিছু বিনষ্ট ও বিলীন হয়ে যাবে এবং শুধু তাদের দুষ্কাৰ্যসমূহ শাস্তির আকারে তাদের উপর অবশিষ্ট থাকবে। তাদের এ সব সুখের সামগ্রী পরকালের তুলনায় অতি নগণ্য। এ বিষয়েরই বহু আয়াত কুরআন কারীমের মধ্যে রয়েছে। যেমন এক জায়গায় রয়েছে- (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ তা’আলার আয়াতসমূহের ব্যাপারে শুধুমাত্র কাফিরেরাই ঝগড়া করে থাকে, সুতরাং তাদের নগরসমূহে প্রত্যাগমন যেন তোমাকে প্রতারিত না করে।” (৪০:৪) অন্য জায়গায় রয়েছে- “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়, তারা মুক্তি পায় না; তারা দুনিয়ায় কিছুদিন উপকৃত হবে, কিন্তু পরকালে তো তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট; আমি তাদেরকে তাদের কুফরীর প্রতিশোধরূপে কঠিন শাস্তি প্রদান করবো।” আর এক স্থানে রয়েছে-“আমি তাদেরকে অল্পদিন উপকার পৌছাবো, অতঃপর তাদেরকে পুরু শাস্তির দিকে আকৃষ্ট করবো।” আর এক জায়গায় রয়েছে-“আমি কাফিরদেরকে কিছু অবকাশ দিয়ে থাকি।” অন্য জায়গায় রয়েছে-“যে ব্যক্তি আমার উত্তম অঙ্গীকার পেয়ে গেছে, আর যে ব্যক্তি দুনিয়ায় আরাম উপভোগ করছে, কিন্তু কিয়ামতের দিন শাস্তির সম্মুখীন হবে তারা কি সমান হতে পারে?” যেহেতু কাফিরদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক অবস্থা বর্ণিত হলো, কাজেই সাথে সাথে মুমিনদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে- এ মুত্তাকী দলটি কিয়ামতের দিন এমন জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে যার পার্শ্ব দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হবে।’ তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তাদেরকে পুণ্যবান বলার কারণ এই যে, তারা পিতা-মাতার সাথে ও সন্তানাদির সাথে সৎ ব্যবহার। করে থাকে। যেমন তোমার উপর তোমার পিতা-মাতার অধিকার রয়েছে, দ্রুপ তোমার উপর তোমার সন্তান-সন্ততির অধিকার রয়েছে।” এ বর্ণনাটিই হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে মাওকুফরূপেও বর্ণিত আছে এবং এর মাওকুফ হওয়াই অধিকতর সঠিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। হযরত হাসান বসরী (রঃ)বলেন, “পুণ্যবান ঐ ব্যক্তি যে কাউকেও কষ্ট দেয় না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রঃ) বলেনঃ প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যেই মৃত্যু উত্তম। সে ব্যক্তি ভালই হোক আর মন্দই হোক। যদি সে সৎ হয় তবে তার জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট যা কিছু। রয়েছে তা খুবই উত্তম। আর যদি সে অসৎ হয় তবে আল্লাহ তা’আলার শাস্তি ও তার পাপরাশি যা তার ইহলৌকিক জীবনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল সেই বৃদ্ধি এখান হতেই শেষ হয়ে যাবে। প্রথমটির দলীল হচ্ছে- (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ তাআলার নিকট যা রয়েছে তা পুণ্যবানদের জন্যে উত্তম।” দ্বিতীয়টির দলীল হচ্ছে- (আরবী) অর্থাৎ “অবিশ্বাসকারীরা যেন ধারণা না করে যে, আমি যে তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি তা তাদের জন্যে উত্তম। আমি তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছি যেন তাদের পাপ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। (৩:১৭৮) হযরত আবৃদ্দারদা (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এখানে সম্বোধন নবী করীম (সাঃ)-কে করা হলেও এই সম্বোধনের লক্ষ্য সমস্ত উম্মত। ‘দেশ-বিদেশে তাদের অবাধ বিচরণ’ বলতে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এক নগরী থেকে আর এক নগরীতে বা এক দেশ থেকে আর এক দেশে যাওয়া-আসা। এই বাণিজ্য সফর পার্থিব ভোগ্যসামগ্রীর প্রাচুর্য এবং ব্যবসার প্রসারতারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাই মহান আল্লাহ বলছেন, এগুলো আসলে কিছু দিনের জন্য ক্ষণস্থায়ী লাভের সামগ্রী। এ ব্যাপারে ঈমানদারদেরকে ধোঁকায় পতিত না হয়ে শেষ পরিণামের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। আর সেই পরিণাম হল, ঈমান থেকে বঞ্চিত হলে জাহান্নামের চিরস্থায়ী আযাব। দুনিয়ার ধন-সম্পদের প্রাচুর্যের অধিকারী কাফেররা এই আযাবে পতিত হবে। এই বিষয়টা কুরআনের আরো বিভিন্ন স্থানে আলোচিত হয়েছে। যেমন, [مَا يُجَادِلُ فِي آيَاتِ اللهِ إِلَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَلا يَغْرُرْكَ تَقَلُّبُهُمْ فِي الْبِلادِ] “কাফেররাই কেবল আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে। কাজেই নগরীসমূহে তাদের বিচরণ যেন তোমাকে বিভ্রান্তিতে না ফেলে।” (সূরা মু’মিন ৪০:৪) [قُلْ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لا يُفْلِحُونَ، مَتَاعٌ فِي الدُّنْيَا ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ] “বলে দাও, যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তারা অব্যাহতি পাবে না। পার্থিব জীবনে সামান্যই লাভ, অতঃপর আমার নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” (সূরা ইউনুস ১০:৬৯-৭০) [نُمَتِّعُهُمْ قَلِيلًا ثُمَّ نَضْطَرُّهُمْ إِلَى عَذَابٍ غَلِيظٍ] “আমি তাদেরকে স্বল্পকালের জন্যে ভোগবিলাস করতে দেব, অতঃপর তাদেরকে বাধ্য করবো গুরুতর শাস্তি ভোগ করতে।” (সূরা লুকমান ৩১:২৪)
[২] অর্থাৎ, পার্থিব উপকরণাদি এবং ভোগবিলাসের সামগ্রী বাহ্যদৃষ্টিতে যতই বেশী হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তা সামান্যই। কেননা, তার তো শেষ পরিণতি ধ্বংসই। আর এগুলো ধ্বংস হওয়ার পূর্বে স্বয়ং তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে, যারা এগুলো অর্জন করার প্রচেষ্টায় আল্লাহকে ভুলে থাকে এবং সর্বপ্রকার নৈতিকতা ও আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে।
[৩] ওদের বিপরীত যাঁরা প্রতিপালককে ভয় করে পরহেযগারী এবং আল্লাহভীরুতার জীবন যাপন করে তাঁর সমীপে উপস্থিত হবেন, যদিও দুনিয়াতে তাঁদের কাছে আল্লাহ ভুলানোর মত ধন-সম্পদের প্রাচুর্য এবং অঢেল রুযী ছিল না, তবুও তাঁরা সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা এবং তার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহর মেহমান হবেন এবং সেখানে এই সৎলোকরা যে প্রতিদান পাবেন, তা দুনিয়াতে কাফেররা ক্ষণস্থায়ীভাবে যা পেয়েছে, তা থেকে বহুগুণে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
এ আয়াতগুলোতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলা হলেও উম্মাতের সকলেই এতে শামিল।
“দেশে-বিদেশে তাদের (কাফিরদের) অবাধ বিচরণ।” বলতে ব্যবসা-বাণিজ্যর জন্য এক নগরী থেকে অন্য নগরীতে বা এক দেশ হতে অন্য দেশে যাতায়াত করা। এ বাণিজ্য সফর পার্থিব ভোগ্যসামাগ্রী এবং ব্যবসায় প্রসারতার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এগুলো আসলে কিছু দিনের ক্ষণস্থায়ী লাভের সামগ্রী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: পরকালের তুলনায় দুনিয়া তেমন যেমন তোমাদের কারো আঙ্গুল সাগরে প্রবেশ করালে যতটুকু পরিমাণ পানি আঙ্গুলের মাথায় উঠে, সুতরাং সে কী নিয়ে আসল তা যেন লক্ষ করে। (তিরমিযী হা: ২৩২৩, ইবনু মাযাহ হা: ৪১০৮, সহীহ)
সুতরাং এ ব্যাপারে ঈমানদারদেরকে ধোঁকায় পতিত না হয়ে শেষ পরিণতির প্রতি লক্ষ রাখা উচিত। সে পরিণতি হল ঈমান থেকে বঞ্চিত হলে জাহান্নামের চিরস্থায়ী আযাব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَا يُجَادِلُ فِيْٓ اٰيٰتِ اللّٰهِ إِلَّا الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَلَا يَغْرُرْكَ تَقَلُّبُهُمْ فِي الْبِلَادِ)
“শুধু কাফিররাই আল্লাহর নিদর্শন সম্বন্ধে ঝগড়া করে; সুতরাং শহরগুলোতে তাদের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে।” (সূরা মু’মিন ৪০:৪)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(قُلْ إِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَي اللّٰهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُوْنَ – مَتَاعٌ فِي الدُّنْيَا ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ)
“বল: ‘যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তারা সফলকাম হবে না।’ পৃথিবীতে তাদের জন্য আছে কিছু সুখ-সম্ভোগ; পরে আমারই নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন।” (সূরা ইউনুস ১০:৬৯-৭০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(نُمَتِّعُهُمْ قَلِيْلًا ثُمَّ نَضْطَرُّهُمْ إِلٰي عَذَابٍ غَلِيْظٍ)
“আমি অল্প সময়ের জন্য তাদেরকে সুখ-সম্ভোগ দেব, পুনরায় তাদেরকে বাধ্য করব কঠিন শাস্তি ভোগ করতে।” (সূরা লুকমান ৩১:২৪)
(الَّذِيْنَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ)
“যারা স্বীয় প্রতিপালককে ভয় করে” কাফিরদের বিপরীতে যদি মু’মিনরা প্রতিপালককে ভয় করে, পরহেযগারী এবং আল্লাহভীরু জীবন যাপন করে, তাঁর সমীপে উপস্থিত হবে- এ বিশ্বাস রাখে, যদিও দুনিয়াতে তাদের কাছে ধন-সম্পদের প্রাচুর্য এবং অঢেল রুযী ছিল না, তবুও তারা সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা এবং তার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলার মেহমান হবেন এবং যেখানে এ সৎ লোকেরা যে প্রতিদান পাবেন, দুনিয়াতে কাফিররা ক্ষণস্থায়ীভাবে যা পেয়েছে, তাত্থেকে বহুগুণে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ হবে।
‘لِّلْأَبْرَارِ’
বা পুণ্যবানদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِيْ نَعِيْمٍ)
“নিশ্চয়ই পুণ্যবানগণ নেয়ামতসমূহে অবস্থান করবে” (সূরা ইনফিতার ৮২:১৩)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الْأَبْرَارَ يَشْرَبُوْنَ مِنْ كَأْسٍ كَانَ مِزَاجُهَا كَافُوْرًا)
“নিশ্চয়ই সৎকর্মশীলরা পান করবে এমন পানীয় যার মিশ্রণ হবে কাফূর (কর্পুর)” (সূরা দাহার ৭৬:৫)
অতএব আমাদের এ গুণে গুণান্বিত হয়ে পরকালীন সফলতা অর্জন করা একান্ত কর্তব্য।
যারা তাদের প্রতিপালককে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সর্বাবস্থায় ভয় করতঃ আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকবে তাদের জন্য মেহমানদারীস্বরূপ পরকালে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ বহমান থাকবে।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কাফিররা যে সুখ ও সাচ্ছন্দে আছে তাতে মু’মিনদের ধোঁকায় পড়া উচিত নয়।
২. আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের জন্য যা তৈরি করে রেখেছেন তা দুনিয়া ও তার মধ্যবর্তী যা কিছু আছে সে সব থেকে উত্তম।