أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٣٦)-৩৩৮
www.motaher21.net
كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ
তাদের উপর যখন লড়াই ফরয করা হল,
When the fighting was ordained for them,
সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-৭৭-৭৯
اَلَمْ تَرَ اِلَى الَّذِیْنَ قِیْلَ لَهُمْ كُفُّوْۤا اَیْدِیَكُمْ وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَۚ فَلَمَّا كُتِبَ عَلَیْهِمُ الْقِتَالُ اِذَا فَرِیْقٌ مِّنْهُمْ یَخْشَوْنَ النَّاسَ كَخَشْیَةِ اللّٰهِ اَوْ اَشَدَّ خَشْیَةًۚ وَ قَالُوْا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَیْنَا الْقِتَالَۚ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنَاۤ اِلٰۤى اَجَلٍ قَرِیْبٍؕ قُلْ مَتَاعُ الدُّنْیَا قَلِیْلٌۚ وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ لِّمَنِ اتَّقٰى وَ لَا تُظْلَمُوْنَ فَتِیْلًا
তোমরা কি তাদেরকেও দেখেছো, যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমাদের হাত গুটিয়ে রাখো এবং নামায কায়েম করো ও যাকাত দাও? এখন তাদেরকে যুদ্ধের হুকুম দেয়ায় তাদের একটি দলের অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, তারা মানুষকে এমন ভয় করেছে যেমন আল্লাহকে ভয় করা উচিত অথবা তার চেয়েও বেশী। তারা বলছেঃ হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এই যুদ্ধের হুকুমনামা কেন লিখে দিলে? আমাদের আরো কিছু সময় অবকাশ দিলে না কেন? তাদেরকে বলোঃ দুনিয়ার জীবন ও সম্পদ অতি সামান্য এবং একজন আল্লাহর ভয়ে ভীত মানুষের জন্য আখেরাতই উত্তম। আর তোমাদের ওপর এক চুল পরিমাণও জুলুম করা হবে না।
আয়াত নং :-৭৮
اَیْنَ مَا تَكُوْنُوْا یُدْرِكْكُّمُ الْمَوْتُ وَ لَوْ كُنْتُمْ فِیْ بُرُوْجٍ مُّشَیَّدَةٍؕ وَ اِنْ تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ یَّقُوْلُوْا هٰذِهٖ مِنْ عِنْدِ اللّٰهِۚ وَ اِنْ تُصِبْهُمْ سَیِّئَةٌ یَّقُوْلُوْا هٰذِهٖ مِنْ عِنْدِكَؕ قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِؕ فَمَالِ هٰۤؤُلَآءِ الْقَوْمِ لَا یَكَادُوْنَ یَفْقَهُوْنَ حَدِیْثًا
আর মৃত্যু, সে তোমরা যেখানেই থাকো না কেন সেখানে তোমাদের নাগাল পাবেই, তোমরা কোন মজবুত প্রাসাদে অবস্থান করলেও। যদি তাদের কোন কল্যাণ হয় তাহলে তারা বলে, এতো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে। আর কোন ক্ষতি হলে বলে, এটা হয়েছে তোমার বদৌলতে। বলে দাও, সবকিছুই হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। লোকদের কী হয়েছে, কোন কথাই তারা বোঝে না।
(আয়াত:-৭৯)
مَّآ أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ ۖ وَمَآ أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ ۚ وَأَرْسَلْنٰكَ لِلنَّاسِ رَسُولًا ۚ وَكَفٰى بِاللَّهِ شَهِيدًا
তোমার কাছে যে কল্যাণ পৌঁছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যে অকল্যাণ তোমার কাছে পৌঁছে তা তোমার নিজের পক্ষ থেকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ যথেষ্ট।
৭৭-৭৯ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে যখন মুসলমানরা মক্কায় অবস্থান করছিল তখন তারা ছিল দুর্বল। তারা মর্যাদাসম্পন্ন শহরে বাস করছিল। তথায় কাফিরদেরই প্রাধান্য বজায় ছিল। মুসলমানরা তাদেরই শহরে ছিল।
কাফিরেরা সংখ্যায় খুব বেশী ছিল এবং যুদ্ধের অস্ত্র-শস্ত্রও ছিল তাদের অধিক। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে জিহাদের নির্দেশ দেননি। বরং তাদেরকে কাফিরদের অত্যাচার সহ্য করারই নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে আরও আদেশ করেছিলেন যে, তিনি যেসব হুকুম আহকাম অবতীর্ণ করেছেন ঐগুলোর উপর যেন তারা আমল করে। যেমন তারা যেন নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত আদায় করে। সাধারণতঃ যদিও তখন তাদের মালের আধিক্য ছিল না তথাপি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদেরকে সাহায্য করা ও তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করার নির্দেশ দেন।
আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জন্যে এটাই যুক্তিযুক্ত মনে করেন যে, তারা যেন এখানে কাফিরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করে বরং সবর ও ধৈর্যের দ্বারাই যেন কাজ নেয়। আর ওদিকে কাফিররা ভীষণ বীরত্বের সাথে মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও উৎপীড়নের পাহাড় চাপিয়ে দেয়। তারা ছোট-বড় প্রত্যেককেই কঠিন হতে কঠিনতম শাস্তি দিতে থাকে। কাজেই মুসলমানগণ অত্যন্ত সংকীর্ণতার মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করছিল। মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে যেতো এবং তারা কামনা করতো যে, যদি আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ দিতেন।
অবশেষে যখন তাদেরকে মদীনায় হিজরত করার অনুমিত দেয়া হয় তখন মুসলমানরা স্বীয় মাতৃভূমি, আত্মীয়-স্বজন সবকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে মদীনায় হিজরত করে। তথায় আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে সর্বপ্রকারের সুবিধা ও নিরাপত্তা দান করেন। সাহায্যকারী হিসেবে তারা মদীনার আনসারদেরকে পেয়ে যায় এবং তাদের সংখ্যাও বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া তারা যথেষ্ট শক্তিও অর্জন করে।
তখন আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তারা যেন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে যুদ্ধ করে। জিহাদের হুকুম অবতীর্ণ হওয়া মাত্রই কতক লোক ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। জিহাদের কথা চিন্তা করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত এবং স্ত্রীদের বিধবা হওয়া ও শিশুদের পিতৃহীন হওয়ার দৃশ্য তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। ভয় পেয়ে তারা বলে উঠে- “হে আমাদের প্রভু! এখনই কেন আমাদের উপর যুদ্ধ বিধিবদ্ধ করলেন? আমাদেরকে আরও কিছুদিন অবসর দিতেন!’ এ বিষয়কেই অন্য আয়াতে নিম্নরূপে বর্ণনা করা হয়েছেঃ (আরবী) (৪৭:২০) এর সংক্ষিপ্ত ভাবৰ্থ এই যে, মুমিনগণ বলে-(যুদ্ধের) কোন সূরা অবতীর্ণ হয় না কেন? অতঃপর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ করা হয় এবং তাতে জিহাদের বর্ণনা দেয়া হয় তখন রুগ্ন অন্তরবিশিষ্ট লোকেরা চীৎকার করে উঠে এবং ভ্রুকুঞ্চিত করে তোমার দিকে তাকায় এবং ঐ ব্যক্তির মত চক্ষু বন্ধ করে নেয় যে মৃত্যুর পূর্বক্ষণে অচৈতন্য হয়ে থাকে। তাদের জন্যে আফসোস!
মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মক্কায় হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) এবং আরও কয়েকজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলেন, “হে আল্লাহর নবী (সঃ)! কুফরীর অবস্থায় আমরা সম্মানিত ছিলাম, আর আজ ইসলামের অবস্থায় আমাদের লাঞ্ছিত মনে করা হচ্ছে।’ তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ আমার উপর আল্লাহ পাকের এ নির্দেশই রয়েছে যে, আমি যেন ক্ষমা করে দেই। সাবধান কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করো না।’
অতঃপর মদীনায় হিজরতের পর এখানে যখন জিহাদের আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন লোকেরা বিরত থাকে। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। ইমাম নাসাঈ (রঃ), ইমাম হাকিম (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ)ও এটা বর্ণনা করেছেন।
হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, তাদের উপর নামায ও যাকাত ফরয ছিল। তখন তারা আকাঙক্ষা করে যে, জিহাদও যদি ফরয করা হতো!
অতঃপর যখন জিহাদের হুকুম অবতীর্ণ হয় তখন দুর্বল ঈমানের লোকেরা মানুষকে ঐরূপ ভয় করতে লাগে যেমন আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা উচিত; বরং তার চেয়েও বেশী ভয় করতে থাকে এবং বলে-“হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদের উপর জিহাদ কেন ফরয করলেন? স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত আমাদেরকে দুনিয়ায় সুখ ভোগ করতে দিলেন না কেন?’ তখন তাদেরকে উত্তর দেয়া হয় যে, দুনিয়ার সুখ ভোগ খুবই অস্থায়ী এবং জান্নাতের তুলনায় খুবই নগণ্যও বটে। আর আখিরাত আল্লাহ ভীরুদের জন্য দুনিয়া হতে বহুগুণ উত্তম ও পবিত্র।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি ইয়াহুদীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। তাদেরকে উত্তরে বলা হয়-“আল্লাহভীরুদের পরিণাম সূচনা হতে বহুগুণে উত্তম। তোমাদেরকে তোমাদের কার্যের পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। তোমাদের একটি সৎ আমলও বিনষ্ট হবে না। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে কারও উপর এক চুল পরিমাণ ও অত্যাচার হওয়া অসম্ভব। এ বাক্যে দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহ উৎপাদন করে পরকালের প্রতি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে জিহাদের উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, হযরত হাসান বসরী (রঃ)। (আরবী) -এ আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা ঐ ব্যক্তির উপর সদয় হোন যে দুনিয়ায় এভাবেই থাকে। দুনিয়ার প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত এ রকমই অবস্থা যেমন একজন নিদ্রিত ব্যক্তি স্বপ্নে নিজের কোন পছন্দনীয় জিনিস দেখতে পায় কিন্তু চক্ষু খোলা মাত্রই জানতে পারে যে, মূলে কিছুই ছিল না। হযরত আবু মুসহির (রঃ)-এর নিম্নের কবিতাংশটি কতই না সুন্দরঃ (আরবী) অর্থাৎ দুনিয়ায় ঐ ব্যক্তির জন্য কোনই মঙ্গল নেই, যার জন্যে আখিরাতে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে কোনই অংশ নেই, যদিও দুনিয়া কতক লোককে বিস্ময় বিমুগ্ধ করে, কিন্তু এটা খুব অল্পই সুখ এবং এর ধ্বংস খুব নিকটবর্তী।
এরপর বলা হচ্ছে-‘তোমরা যেখানেই থাকনা কেন মৃত্যু তোমাদেরকে ধরবেই যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর।’ কোন মধ্যস্থতা কাউকেও এটা হতে বাঁচাতে পারবে না। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘এর উপর যত কিছু রয়েছে সবই ধ্বংসশীল।'(৫৫:২৬) আর এক আয়াতে আছেঃ (আরবী) আর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী’। (৩:১৮৫) অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তোমার পূর্বেও আমি কোন মানুষের জন্য চিরস্থায়ী জীবন নির্ধারণ করিনি।'(২১:৩৪) এগুলো বলার উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ জিহাদ করুক আর নাই করুক একমাত্র আল্লাহ পাকের সত্তা ছাড়া সকলকেই একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। প্রত্যেকের জন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে এবং প্রত্যেকের মুত্যুর স্থানও নির্দিষ্ট রয়েছে।
হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) স্বীয় মরণ শয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেনঃ ‘আল্লাহর শপথ! আমি বহু বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতঃ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছি। তোমরা এসে দেখ যে, আমার শরীরের এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে বলুম, বর্শা, তীর, তরবারী বা অন্য কোন অস্ত্রের চিহ্ন দেখা যায় না। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে আমার ভাগ্যে মৃত্যু লিখা ছিল না বলে আজ তোমরা দেখ যে আমি গৃহ শয্যায় মৃত্যুবরণ করছি। সুতরাং কাপুরুষের দল আমার জীবন হতে যেন শিক্ষা গ্রহণ করে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন- মৃত্যুর থাবা হতে উচ্চতম, সুদৃঢ় এবং সংরক্ষিত দুর্গ ও অট্টালিকাও রক্ষা করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেন যে শব্দের ভাবার্থ হচ্ছে আকাশের বুরুজ। কিন্তু এটা দুর্বল উক্তি। সঠিক কথা এই যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে সুরক্ষিত প্রাসাদাসমূহ। অর্থাৎ মৃত্যু হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে যে কোন সুব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক না কেন ওটা নির্ধারিত সময়েই আসবে, একটুও আগে পিছে হবে না। যুহাইর ইবনে আবি সালমা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ যে ব্যক্তি মৃত্যুর কারণে পলায়ন করে তাকে মুত্যু পেয়ে বসবেই, যদিও সে সোপানের সাহায্যে আকাশ মার্গেও আরোহণ করে।
(আরবী) শব্দটিকে কেউ কেউ তাশদীদ সহ বলেছেন এবং কেউ কেউ ‘তাশদীদ’ ছাড়াই বলেছেন। দুটোরই একই অর্থ। কিন্তু কারও কারও মতে আবার এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মুশাইয়্যাদাহ্ পড়লে অর্থ হবে সুদীর্ঘ এবং মুশায়াদাহ পড়লে অর্থ হবে চুন দ্বারা সুশোভিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাফসীর -ই-ইবনে জারীর এবং মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে একটি সুদীর্ঘ গল্প হযরত মুজাহিদ (রঃ)-এর ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন যে, পূর্ব যুগে একটি স্ত্রীলোক গর্ভবতী ছিল। তার প্রসব বেদনা উঠে এবং সে একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে। সে তখন তার পরিচারককে বলে, “যাও কোন জায়গা হতে আগুন নিয়ে এসো। পরিচারক বাইরে গিয়ে দেখে যে, দরজার উপর একটি লোক দাড়িয়ে রয়েছে। লোকটি পরিচারককে জিজ্ঞেস করে, “স্ত্রী লোকটি কি সন্তান প্রসব করেছেন? সে বলে, ‘কন্যা সন্তান।
লোকটি তখন বলে, ‘জেনে রেখ যে, এ মেয়েটি একশ জন পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচার করবে এবং এখন স্ত্রীলোকটির যে পরিচারক রয়েছে শেষে তার সাথে এ মেয়েটির বিয়ে হবে। আর একটি মাকড়সা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এ কথা শুনে চাকরটি সেখান হতে ফিরে যায় এবং ঐ মেয়েটির পেট ফেড়ে দেয়। অতঃপর তাকে মৃতা মনে করে তথা হতে পলায়ন করে। এ অবস্থা দেখে তার মা তার পেট সেলাই করে দেয় এবং চিকিৎসা করতে আরম্ভ করে। অবশেষে মেয়েটির ক্ষতস্থান ভাল হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এক যুগ অতিবাহিত হয়। মেয়েটি যৌবনে পদার্পণ করে। সে খুব সুন্দরী ছিল।
তখন সে ব্যভিচারের কাজ শুরু করে দেয়। আর ওদিকে ঐ চাকরটি সমুদ্র পথে পালিয়ে গিয়ে কাজ-কাম আরম্ভ করে দেয় এবং বহু অর্থ উপার্জন করে। দীর্ঘদিন পর প্রচুর ধন-সম্পদসহ সে তার সেই গ্রামে ফিরে আসে। তারপর সে একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোককে ডেকে পাঠিয়ে বলেঃ আমি বিয়ে করতে চাই। এ গ্রামের যে খুব সুশ্রী মেয়ে তার সঙ্গে আমার বিয়ে দাও।’
বৃদ্ধা তথা হতে বিদায় নেয়। ঐ গ্রামের ঐ মেয়েটি অপেক্ষা সুশ্রী মেয়ে আর একটিও ছিল না বলে সে তাকেই বিয়ের প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি প্রস্তাব সমর্থন করে এবং বিয়ে হয়ে যায়। সে সব কিছু ত্যাগ করে লোকটির নিকট চলেও আসে। তার ঐ স্বামীকে জিজ্ঞেস করেঃ আচ্ছা বলুনতো, আপনি কে? কোথা হতে এসেছেন এবং কিভাবেই বা এখানে এসেছেন?’ লোকটি তখন সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে বলেঃ এখানে আমি একটি স্ত্রীলোকের পরিচারক ছিলাম। তার মেয়ের সঙ্গে এরূপ কাজ করে এখান হতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। বহু বছর পরে এসেছি।’
তখন মেয়েটি বলে, যে মেয়েটির পেট ফেড়ে আপনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সেই মেয়ে।’ এ বলে সে তাকে তার ক্ষত স্থানের দাগও দেখিয়ে দেয়। তখন লোকটির বিশ্বাস হয়ে যায় এবং মেয়েটিকে বলে, তুমি যখন ঐ মেয়ে তখন তোমার সম্বন্ধে আমার আর একটি কথা জানা আছে। তা এই যে, তুমি আমার পূর্বে একশ জন লোকের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। মেয়েটি তখন বলে, কথা তো ঠিকই, কিন্তু আমার গণনা মনে নেই।
লোকটি বলে তোমার সম্বন্ধে আমার আরও একটি কথা জানা আছে। তা এই যে, একটি মাকড়সা তোমার মুত্যুর কারণ হবে। যা হোক, তোমার প্রতি আমার খুবই ভালবাসা রয়েছে। কাজেই আমি তোমাকে একটি সুউচ্চ ও সুদৃঢ় প্রাসাদ নির্মাণ করে দিচ্ছি। তুমি সেখানে অবস্থান করবে। তাহলে সেখানে কোন পোকা-মাকড়ও প্রবেশ করতে পারবে না।
সে তাই করে। মেয়েটির জন্যে এরূপই একটি প্রাসাদ নির্মিত হয় এবং সে সেখানেই বাস করতে থাকে, কিছুদিন পর একদা তারা স্বামী-স্ত্রী ঐ প্রাসাদের মধ্যে বসে রয়েছে, এমন সময় হঠাৎ ছাদের উপর একটি মাকড়সা দেখা যায়। ঐ লোক তখন তার স্ত্রীকে বলে, “দেখ, আজ এখানে মাকড়সা দেখা গেছে। ওটা দেখা মাত্রই মেয়েটি বলে, আচ্ছা, এটা আমার প্রাণ নেয় নেবেই কিন্তু আমিই এর প্রাণ নেব।’
অতঃপর সে চাকরকে বলেঃ মাকড়সাটিকে আমার নিকট জ্যান্ত ধরে আন। চারকটি ধরে আনে। সে তখন মাকড়সাটিকে স্বীয় পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে দলিত করে। ফলে মাকড়সাটির প্রাণ বায়ু নির্গত হয়। ওর দেহের যে রস বের হয় ওরই এক আধ ফোটা তার বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ ও মাংসের মধ্যস্থলে প্রবেশ করে। ফলে বিষক্রিয়া আরম্ভ হয় এবং পা কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। তাতেই তার জীবনলীলা শেষ হয়ে যায়।
হযরত উসমান (রাঃ)-এর উপর বিদ্রোহীগণ যখন আক্রমণ চালায় তখন তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ করুন। অতঃপর তিনি নিম্নের ছন্দ দু’টি পাঠ করেনঃ (আরবী) হাযরের বাদশাহ সাতেরূনকে পারস্য সমাট সাবুর যুল আলতাফ যে হত্যা করেছিল সে ঘটনাটিও আমরা এখানে বর্ণনা করছি। ইবনে হিশাম বলেছেন যে, সাকূর যখন ইরাকে অবস্থান করছিল সে সময় তার এলাকার উপর সাতেরূন আক্রমণ চালিয়েছিল। এর প্রতিশোধ স্বরূপ সাকূর যখন তার উপর আক্রমণ চালায় তখন সে দুর্গের দরজা বন্ধ করে তাতে আশ্রয় গ্রহণ করে। দু’বছর পর্যন্ত দুর্গ অবরোধ করে রাখা হয় কিন্তু কোনক্রমেই দুর্গ বিজিত হয় না।
একদা সাতেরূনের নাযীরা নাম্নী এক কন্যা তার পিতার দুর্গে টহল দিচ্ছিল। এমন সময় সায়ূরের উপর তার দৃষ্টি যায়। সে সময় সাকূর শাহী রেশমী পোশাক পরিহিত ছিল এবং তার মস্তকে ছিল রাজমুকুট। নাযীরা মনে মনে বলে-তোর সাথে আমার বিয়ে হলে কতইনা উত্তম হতো! সুতরাং গোপনে তার নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে আরম্ভ করে এবং সাকূর ওয়াদা করে যে, যদি এ মেয়েটি তাকে দুর্গ দখল করিয়ে দিতে পারে তবে সে তাকে বিয়ে করবে।
সাতেরূন ছিল বড়ই মদ্যপায়ী। সারারাত তার মদ্যের নেশাতেই কেটে যেতো। মেয়েটি এ সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করে। রাতে স্বীয় পিতাকে মদমত্ত অবস্থায় দেখে চুপে চুপে তার শিয়র হতে দুর্গের দরজার চাবিটি বের করে নেয় এবং তার নির্ভরযোগ্য ক্রীতদাসের মাধ্যমে সানূরের নিকট পৌছিয়ে দেয়। সাবুর তখন ঐ চাবি দিয়ে দুর্গের দরজা খুলে দেয় এবং ভেতরে প্রবেশ করে সাধারণভাবে হত্যাকার্য চালিয়ে যায়।
অবশেষে দুর্গ তার দখলে এসে যায়। এও বলা হয়েছে যে, ঐ দুর্গে একটি যাদুযুক্ত জিনিস ছিল। ওটা ভাঙ্গতে না পারলে এ দুর্গ জয় করা সম্ভব ছিল না। ঐ মেয়েটিই ওটা ভাঙ্গবার পদ্ধতি বলে দেয় যে, একটি সাদাকালো মিশ্রিত রঙের কবুতর এনে তার পা কোন কুমারী মেয়ের প্রথম ঋতুর রক্ত দ্বারা রঞ্জিত করতে হবে, তারপর কবুতরটিকে ছেড়ে দিলেই ওটা উড়ে গিয়ে ঐ দুর্গের দেয়ালে বসবে। আর তেমনি যাদুযুক্ত জিনিসটি পড়ে যাবে এবং দুর্গের সিংহদ্বার খুলে যাবে।
অতএব সাকূর তাই করে এবং দুর্গ জয় করতঃ সাতেরূনকে হত্যা করে। অতঃপর সমস্ত লোককে তরবারীর নীচে নিক্ষেপ করে এবং সারা শহর ধ্বংস। করে দেয়। তারপর সাতেরূনের কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে স্বীয় রাজ্যে ফিরে আসে এবং তাকে বিয়ে করে নেয়। একদা রাত্রে মেয়েটি স্বীয় শয্যায় শুয়ে আছে কিন্তু তার ঘুম আসছে না। সে অস্থিরতা প্রকাশ করছে। তার এ অবস্থা দেখে সাবুর তাকে জিজ্ঞেস করেঃ ব্যাপার কি?’ সে বলে, সম্ভবতঃ বিছানায় কিছু রয়েছে যে কারণে আমার ঘুমে ধরছে না। প্রদীপ জ্বালিয়ে বিছানায় অনুসন্ধান চালানো হলো। অবশেষে তৃণ জাতীয় গাছের ছোট একটি পাতা পাওয়া গেল।
তার এ চরম বিলাসিতা দেখে সানূর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো যে, ছোট একটি পাতা বিছানায় থাকার কারণে তার ঘুম আসছে না! তাই তাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার পিতার নিকট তোমার জন্যে কি কি থাকতো’? সে বললোঃ ‘আমার জন্যে থাকতো নরম রেশমের বিছানা এবং পাতলা নরম রেশমের পোশাক। আর আমি আহার করতাম পায়ের অস্থির মজ্জা এবং পান করতাম। খাটি সুরা। এ ব্যবস্থাই আমার আব্বা আমার জন্যে রেখেছিলেন। মেয়েটি এরূপ ছিল যে, বাহির হতে তার পায়ের গোছর গোড়ালির) মজ্জা পর্যন্তও দেখা যেতো।
একথাগুলো সায়ূরের মনে অন্য এক উত্তেজনার সৃষ্টি করে এবং মেয়েটিকে বলেঃ ‘যে পিতা তোমাকে এভাবে লালন পালন করেছে, তুমি তোমার সে পিতার সাথে এ ব্যবহার করেছে যে, আমার দ্বারা তাকে হত্যা করিয়েছে এবং তার রাজ্যকে ছারখার করিয়েছে। কাজেই আমার সঙ্গেও যে তুমি এরূপ ব্যবহার করবে না তা আমি কিরূপে বিশ্বাস করতে পারি’? তৎক্ষণাৎ সে নির্দেশ দেয় যে, তার চুলকে ঘোড়ার লেজের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে ঘোড়াকে লাগামহীন ছেড়ে দেয়া হোক। তাই করা হয়। ঘোড়া নাচতে লাফাতে আরম্ভ করে এবং এভাবে তাকে এ নশ্বর জগৎ হতে চির বিদায় গ্রহণ করতে হয়।
আল্লাহপাক বলেন-যদি তাদের উপর কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হয় অর্থাৎ যদি তারা খাদ্যশস্য, ফল, সন্তানাদি ইত্যাদি লাভ করে তবে তারা বলে- এটা আল্লাহ তা’আলার নিকট হতে এসেছে। আর যদি তাদের উপর কোন অমঙ্গল নিপতিত হয় অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু, মাল ও সন্তানের স্বল্পতা এবং ক্ষেত্র ও বাগানের ক্ষতি ইত্যাদি পৌছে যায় তখন তারা বলে-“হে নবী (সঃ)! এটা আপনার কারণেই হয়েছে। অর্থাৎ এটা নবী (সঃ)-এর অনুসরণ এবং মুসলমান হওয়ার কারণেই হয়েছে। ফিরাউনের অনুসারীরাও অমঙ্গলের বেলায় হযরত মূসা (আঃ) এবং তাঁর অনুসারীদেরকে কু-লক্ষণ বলে অভিহিত করতো। যেমন। কুরআন কারীমের এক জায়গায় বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ যখন তাদের নিকট কোন মঙ্গল পৌছে তখন তারা বলে- এটা আমাদের জন্যই হয়েছে এবং যখন তাদের নিকট কোন অমঙ্গল পৌছে তখন তারা মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে কুলক্ষণে বলে থাকে।’(৭:১৩১)
আর এক জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ কতক লোক এমন রয়েছে যারা এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে থাকে।'(২২:১১) অতএব এখানেও এ মুনাফিকরা যারা বাহ্যিক মুসলমান কিন্তু অন্তরে ইসলামকে ঘৃণা করে তাদের নিকট যখন কোন অমঙ্গল পৌছে তখন তারা ঝট করে বলে ফেলে যে, এ ক্ষতি ইসলাম গ্রহণের কারণেই হয়েছে। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এখানে (আরবী) শব্দের ভাবার্থ বৃষ্টিপাত হওয়া, গৃহপালিত পশুর আধিক্য হওয়া, ছেলেমেয়ে বেশী হওয়া এবং স্বচ্ছলতা আসা। এসব হলে তারা বলতো-“এটা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতেই হয়েছে। আর যদি এর বিপরীত হতো তবে তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কেই এ জন্যে দায়ী করতো এবং তাঁকে বলতো-এটা আপনার কারণেই হয়েছে। অর্থাৎ আমরা আমাদের বড়দের আনুগত্য ছেড়ে এ নবী (সঃ)-এর আনুগত্য স্বীকার করেছি বলেই আমরা এ বিপদে পড়েছি।
তাই আল্লাহ পাক তাদের এ অপবিত্র কথা ও জঘন্য বিশ্বাসের খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন- সবই আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে। তার ফায়সালা ও ভাগ্যলিখন প্রত্যেক ভাল-মন্দ, ফাসিক, ফাজির, মুমিন এবং কাফির সবারই উপরেই জারী রয়েছে। ভাল ও মন্দ সবই তার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে।
অতঃপর তিনি তাদের সে উক্তি খণ্ডন করছেন যা তারা শুধুমাত্র সন্দেহ, অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা এবং অত্যাচারের বশবর্তী হয়েই বলে থাকে। তিনি বলেনতাদের কি হয়েছে যে, কোন কথা বুঝবার যোগ্যতা তাদের মধ্য হতে লোপ পাচ্ছে? (আরবী) সম্পর্কে যে একটি গারীব হাদীস রয়েছে তারও এখানে বর্ণনা দেয়া হচ্ছে।
মুসনাদ-ই-বাযে ‘ হযরত আমর ইবনে শুয়াইব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন- তাঁর দাদা বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট বসেছিলাম, এমন সময় কতগুলো লোককে সঙ্গে নিয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ) আগমন করেন। তাঁরা উচ্চেঃস্বরে কথা বলছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে তাঁরা দুজন বসে পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “উচ্চৈঃস্বরে কিসের আলোচনা চলছিল?’ এক ব্যক্তি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হযরত আবু বকর (রাঃ) বলছিলেন যে, পুণ্য এবং মঙ্গল আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে হয়ে থাকে এবং মন্দ ও অমঙ্গল আমাদের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কি বলছিলে’? হযরত উমার (রাঃ) বলেন, আমি বলছিলাম যে, দু’টোই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ ‘এ তর্ক প্রথম প্রথম হযরত জিবরাঈল (আঃ) ও হযরত মিকাইল (আঃ)-এর মধ্যেও হয়েছিল। হযরত মিকাঈল (আঃ) ঐ কথাই বলেছিলেন যা হযরত আবু বকর (রাঃ) বলছিল এবং হযরত জিবরাঈল (আঃ) ঐ কথাই বলেছিলেন যা তুমি (হযরত উমার রাঃ) বলছিলে। তাহলে আকাশবাসীদের মধ্যে যখন মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে তখন পৃথিবীবাসীদের মধ্যে এটা হওয়া তো স্বাভাবিক’।
অতঃপর ইসরাফীল (আঃ)-এর উপর এর মীমাংসার ভার পড়ে যায়। তিনি মীমাংসা করেন যে, ভাল ও মন্দ দু’টোই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতেই হয়ে থাকে। অতঃপর তিনি তাঁদের দুজনকে সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমরা আমার সিদ্ধান্ত শুনে নাও এবং স্মরণ রেখো আল্লাহ তাআলা যদি স্বীয় অবাধ্যাচরণ না চাইতেন তবে তিনি ইবলিশকে সৃষ্টি করতেন না।
কিন্তু শায়খুল ইসলাম ইমাম তাকিয়ুদ্দীন আবূ আব্বাস হযরত ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন যে, এ হাদীসটি মাও’ এবং যেসব মুহাদ্দিস হাদীস পরীক্ষা করে থাকেন তাঁরা সবাই একমত যে, এ হাদীসটি তৈরী করে নেয়া হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলছেনঃ অতঃপর এ সম্বোধন সাধারণ হয়ে গেছে, অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা সকলকেই সম্বোধন করে বলছেন- “তোমাদের নিকট যে কল্যাণ উপস্থিত হয় তা আল্লাহ তাআলারই অনুগ্রহ, দয়া ও করুণা। আর তোমাদের উপর যে অমঙ্গল নিপতিত হয় তা তোমাদের স্বীয় কর্মেরই প্রতিফল।’ যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ তোমাদের উপর যে বিপদ পৌছে তা তোমাদের হাত যা অর্জন করেছে তারই কিছুটা প্রতিফল এবং তিনি তোমাদের অধিকাংশ পাপই ক্ষমা করে দেন। (৪২:৩০) এর ভাবার্থ হচ্ছে- “তোমার পাপের কারণে। অর্থাৎ কার্যেরই প্রতিফল।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তির শরীরের সামান্য ছাল উঠে যায় বা তার পদস্খলন ঘটে কিংবা তাকে কিছু কাজ করতে হয়, ফলে শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়, ওটাও কোন না কোন পাপের কারণেই হয়ে থাকে। আর আল্লাহ তা’আলা যে পাপগুলো দেখেও দেখেন না এবং ক্ষমা করে থাকেন সেগুলো তো অনেক রয়েছে।” এ মুরসাল হাদীসটির বিষয়বস্তু একটি মুত্তাসিল সহীহ হাদীসেও রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! মুমিনকে যে দুঃখকষ্ট পৌছে, এমনকি তার পায়ে যে কাঁটা ফুটে সে কারণেও আল্লাহ তা’আলা তার পাপ মার্জনা করে থাকেন। হযরত আবু সালিহ (রঃ) বলেন (আরবী)-এর ভাবার্থ এই যে, যে অমঙ্গল তোমার উপর নিপতিত হয় তার কারণ হচ্ছে তোমার পাপ। হ্যা, তবে ওটাও ভাগ্যে আল্লাহ তা’আলাই লিখেছেন।
হযরত মুতরাফ ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, তোমরা তকদীর সম্বন্ধে কি জিজ্ঞেস করছো? তোমাদের জন্যে কি সূরা-ই-নিসার (আরবী)-এ আয়াতটি যথেষ্ট নয়? আল্লাহর শপথ! মানুষকে আল্লাহ তাআলার নিকট সমর্পণ করা হয়নি বরং তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং তাঁরই নিকট তারা ফিরে যাবে। এ উক্তিটি খুবই দৃঢ় ও মজবুত এবং এটা কাদরিয়্যাহ্ এবং জাবরিয়্যাহ সম্প্রদায়ের উক্তিকে চরমভাবে খণ্ডন করেছে। এ তর্ক-বিতর্কের জায়গা তাফসীর নয়।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলেন- “হে নবী (সঃ)! তোমার কাজ হচ্ছে শুধু শরীয়তকে প্রচার করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির কাজকে, তার আদেশ ও নিষেধকে মানুষের নিকট পৌছিয়ে দেয়া। আল্লাহ তা’আলার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। তিনি তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন। অনুরূপভাবে তাঁরই সাক্ষ্য এ ব্যাপারেও যথেষ্ট যে, তুমি প্রচারকার্য চালিয়েছো। তোমার ও তাদের মধ্যে যা কিছু হচ্ছে তিনি সব কিছুই দেখছেন। তারা তোমার সাথে যে অবাধ্যাচরণ ও অহংকার করছে তাও তিনি দেখতে রয়েছেন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:১:-
এই আয়াতটির তিনটি অর্থ হয়। এই তিনটি অর্থই তাদের নিজস্ব পরিসরে যথার্থ ও নির্ভুলঃ
এর একটি অর্থ হচ্ছে, প্রথমে লোকেরা নিজেরাই যুদ্ধ করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। বারবার বলতোঃ আমাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে। নিপীড়ন নির্যাতন চালানো হচ্ছে। মারপিট করা হচ্ছে। গালি গালাজ করা হচ্ছে। আমরা আর কতদিন সবর করবো? আমাদের মোকাবিলা করার অনুমতি দেয়া হোক। সে সময় তাদেরকে বলা হতো, সবর করো এবং নামায ও যাকাতের মাধ্যমে নিজেদের সংশোধন করতে থাকো। তখন এই সবর ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করার হুকুম পালন করা তাদের জন্য বড়ই কষ্টকর হতো। কিন্তু এখন লড়াই করার হুকুম দেবার পর সেই লড়াইয়ের দাবীদারদের একটি দল শত্রুদের সংখ্যা ও যুদ্ধের বিপদ দেখে আতংকিত হয়ে পড়েছিল।
দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, যতদিন নামায, রোযা এবং এই ধরনের নির্ঝনঝাট ও ঝুঁকিহীন কাজের হুকুম ছিল এবং যুদ্ধ করে প্রাণ দান করার প্রশ্ন সামনে আসেনি ততদিন এরা খাঁটি দ্বীনদার ও ঈমানদার ছিল। কিন্তু এখন সত্যের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার কাজ শুরু হতেই এরা ভীত ও আতংকিত হয়ে পড়েছে।
এর তৃতীয় অর্থটি হচ্ছে, প্রথমে তো লুটপাট করার ও নিজের স্বার্থোদ্ধারের লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য তাদের তরবারী সবসময় কোষমুক্ত থাকতো এবং রাতদিন যুদ্ধ-বিগ্রহই ছিল তাদের কাজ। সে সময় তাদেরকে রক্তপাত থেকে বিরত রাখার জন্য নামায ও যাকাতের মাধ্যমে নফসের সংশোধন করার হুকুম দেয়া হয়েছিল। আর এখন আল্লাহর জন্য তলোয়ার ওঠাবার হুকুম দেবার পর দেখা যাচ্ছে, যারা স্বার্থোদ্ধারের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সিংহ ছিল আল্লাহর জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তারা হয়ে গেছে বুজদিল কাপুরুষ। নফ্স ও শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে হাতে ইতিপূর্বে তরবারী ঝল্সে উঠেছিল, আল্লাহর পথে তরবারী চালাবার প্রশ্নে সে হাত নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।
এ তিনটি অর্থই বিভিন্ন ধরনের লোকদের আচরণের সাথে খাপ খেয়ে যায়। এখানে আয়াতের মধ্যে এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা একই সাথে এই তিনটি অর্থই প্রকাশ করতে সক্ষম।
টিকা: ২:-
অর্থাৎ যখন তোমরা আল্লাহর দ্বীনের খেদমত করবে এবং তার পথে প্রাণপাত পরিশ্রম করতে থাকবে তখন আল্লাহর কাছে তোমাদের প্রতিদান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই।
টিকা: ৩:-
অর্থাৎ যখন বিজয় ও সাফল্য আসে তখন তাকে আল্লাহর অনুগ্রহ গণ্য করে থাকো এবং একথা ভুলে যাও যে, আল্লাহ তাঁর নবীর মাধ্যমেই এই অনুগ্রহ করেছেন। কিন্তু নিজেদের দুর্বলতা ও ভুলের জন্য কোথাও পরাজয় বরণ করে থাকলে এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া পা পিছিয়ে আসতে থাকলে তখন নবীর ঘাড়েই সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা দায়মুক্ত হতে চাও।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
এগারতম রুকূ‘
[১] ইমাম যুহরী বলেন, সালাত কায়েম করার অর্থ, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রত্যেকটিকে তার নির্ধারিত সময়ে আদায় করা। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
[২] আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আব্দুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তার কয়েকজন সাথী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা যখন মুশরিক ছিলাম তখন আমরা সম্মানিত ছিলাম। কিন্তু যখন ঈমান আনলাম তখন আমাদেরকে অসম্মানিত হতে হচ্ছে। একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘আমি ক্ষমা করতে নির্দেশিত হয়েছি, সুতরাং তোমরা যুদ্ধ করো না। তারপর যখন আল্লাহ তাকে মদীনায় হিজরত করালেন এবং যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হল তখন তাদের কেউ কেউ যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকল। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [নাসায়ী: ৩০৮৬; মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ২/৬৭, ৩০৬]
[৩] সুদ্দী বলেন, তারা ‘কিছুদিনের অবকাশ’ বলে মৃত্যু পর্যন্ত সময় চাচ্ছিল। অর্থাৎ তারা যেন বলছে যে, তাদের মৃত্যু হয়ে গেলে তারপর এ আয়াত নাযিল হওয়ার দরকার ছিল। [আত-তাফসীরুস সহীহ]
[৪] হাসান বসরী এ আয়াত পাঠ করে বলেন, ঐ বান্দাকে আল্লাহ রহমত করুন, যে দুনিয়াকে এ আয়াত অনুযায়ী সঙ্গী বানিয়েছে। দুনিয়ার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উদাহরণ হচ্ছে, সে ব্যক্তির ন্যায়, যে একটি ঘুম দিল, ঘুমের মধ্যে সে কিছু ভাল স্বপ্ন দেখল, তারপর তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আত-তাফসীরুস সহীহ]
[৫] আয়াতে দুনিয়ার নেয়ামতের তুলনায় আখেরাতের নেয়ামতসমূহকে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার কয়েকটি কারণ রয়েছে:
দুনিয়ার নেয়ামত অল্প এবং আখেরাতের নেয়ামত অধিক।
দুনিয়ার নেয়ামত ক্ষণস্থায়ী এবং আখেরাতের নেয়ামত অনন্ত-অফুরন্ত।
দুনিয়ার নেয়ামতসমূহের সাথে নানা রকম অস্থিরতাও রয়েছে, কিন্তু আখেরাতের নেয়ামত এ সমস্ত জঞ্জালমুক্ত।
দুনিয়ার নেয়ামত লাভ অনিশ্চিত, কিন্তু আখেলাতের নেয়ামত প্রত্যেক মুত্তাকী ব্যক্তির জন্য একান্ত নিশ্চিত। [তাফসীরে কাবীর]
[৬] আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা সুদৃঢ় প্রাসাদে হলেও মৃত্যু তোমাদেরকে বরণ করতেই হবে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বসবাস করার জন্য কিংবা ধন-সম্পদের হেফাজতের উদ্দেশ্যে সুদৃঢ় ও উত্তম গৃহ নিৰ্মাণ করা তাওয়াক্কুল বা ভরসার পরিপন্থী কিংবা শরী’আত বিরুদ্ধ নয়। [কুরতুবী]
[৭] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এখানে কল্যাণ দ্বারা বদরের যুদ্ধে বিজয় ও গনীমত লাভ বোঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে অকল্যাণ দ্বারা ওহুদের যুদ্ধে যে বিপদ সংঘটিত হয়েছিল, যাতে রাসূলের চেহারা মুবারকে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল তা বোঝানো হয়েছে। [তাবারী]
[৮] এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় । কিন্তু এর পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, ভাল কাজ হলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর মন্দ কাজ হলে তা বান্দার পক্ষ থেকে। এর কারণ হলো আল্লাহর ইচ্ছা দু’প্রকার, (এক) সৃষ্টিগত সাধারণ ইচ্ছা, যার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা বাধ্যতামূলক নয়। (দুই) শরীআতগত বিশেষ ইচ্ছা, যার সাথে সন্তুষ্ট থাকা অবশ্য জরুরী। আলোচ্য এ আয়াতে আল্লাহর সাধারণ ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিতে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কিছুই হয় না। কিন্তু খারাপ কিছুর ব্যাপারে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে না। তিনি শুধু ভাল কাজেই সন্তুষ্ট হন। খারাপ পরিণতি বান্দার কর্মকাণ্ডের ফল। বান্দা যখন খারাপ কাজ করে তখন আল্লাহ তা হতে দেন যদিও তাতে তিনি সন্তুষ্ট হন না। এর বিপরীতে বান্দা যখন ভাল কাজ করেন তখন আল্লাহ তা’আলা তা হতে দেয়ার পাশাপাশি তাতে সন্তুষ্টও হন। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে খারাপ পরিণতির দায়-দায়ীত্ব কেবল বান্দার দিকেই সম্পর্কযুক্ত করা যাবে, আল্লাহর দিকে সম্পর্কযুক্ত করা জায়েয নেই। [মাজমু ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়্যাহ]
[৯] আয়াতে ‘হাসানাহ’-এর দ্বারা নেয়ামতকে বোঝানো হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মানুষ যে সমস্ত নেয়ামত লাভ করে তা তাদের প্রাপ্য নয়, বরং একান্ত আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহেই প্রাপ্ত হয়। মানুষ যত ইবাদাত-বন্দেগীই করুক না কেন, তাতে সে কোন নেয়ামত লাভের অধিকারী হতে পারে না। কারণ, ইবাদাত করার যে সামর্থ্য, তাও আল্লাহর পক্ষ থেকেই লাভ হয়। তদুপরি আল্লাহ তা’আলার অসংখ্য নেয়ামত তো রয়েছেই। এ সমস্ত নেয়ামত সীমিত ‘ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে কেমন করে সম্ভব? বিশেষ করে আমাদের ‘ইবাদাত-বন্দেগী যদি আল্লাহ তা’আলার শান মোতাবেক না হয়? অতএব, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলার রহমত ব্যতীত কোন একটি লোকও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ বলা হল, ‘আপনিও কি যেতে পারবেন না’? তিনি বললেন, ‘না আমিও না’। [বুখারীঃ ৫৩৪৯, মুসলিমঃ ২৮১৬]
[১০] বিপদাপদ যদিও আল্লাহ তা’আলাই সৃষ্টি করেন, কিন্তু তার কারণ হয় মানুষের কৃত অসৎকর্ম। মানুষটি যদি কাফের হয়ে থাকে, তবে তার উপর আপতিত বিপদাপদ তার জন্য সে সমস্ত আযাবের একটা সামান্য নমুনা হয়ে থাকে যা আখেরাতে তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। বস্তুতঃ আখেরাতের আযাব এর চাইতেও বহুগুণ বেশী। আর যদি লোকটি ঈমানদার হয়, তবে তার উপর আপতিত বিপদাপদ হয় তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত, যা আখেরাতে তার মুক্তির কারণ। অথবা তার জন্য পদমর্যাদা বৃদ্ধির সোপান। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মুসলিমের উপর যে বিপদই আপতিত হোক না কেন, এর দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা তার গোনাহের কাফফারা করে দেন। এমনকি যে কাটাটি পায়ে ফোটে তাও। [বুখারীঃ ৫৩২৪, মুসলিমঃ ২৫৭২]
[১১] আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য রাসূল বানিয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি শুধু আরবদের জন্যই রাসূল ছিলেন না, বরং তার রেসালাত ছিল সমগ্র বিশ্বমানবের জন্য ব্যাপক। তারা তখন উপস্থিত থাকুক বা না-ই থাকুক। কিয়ামত পর্যন্ত আগত সমস্ত মানুষই এর আওতাভুক্ত।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] মক্কায় মুসলিমদের সংখ্যা ও যুদ্ধসামগ্রীর স্বল্পতার কারণে যুদ্ধ করার মত যোগ্যতা ছিল না। তাই তাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে তা থেকে বিরত রাখা হয় এবং দু’টি বিষয়ের প্রতি তাদেরকে তাকীদ করা হয়। প্রথমঃ কাফেরদের অত্যাচারমূলক আচরণকে ধৈর্য ও হিম্মতের সাথে সহ্য করে তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন কর। আর দ্বিতীয়টি হল নামায, যাকাত সহ অন্যান্য ইসলামী নির্দেশাবলীর উপর আমল করার প্রতি যত্ন নাও। যাতে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর আল্লাহর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে হিজরতের পর মদীনায় যখন মুসলিমদের সম্মিলিত শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাঁদেরকে জিহাদ করার অনুমতি দেওয়া হয়। আর এই অনুমতি পাওয়ার পর কেউ কেউ দুর্বলতা ও উদ্যমহীনতা প্রকাশ করে। তাই আয়াতে তাদেরকে তাদের মক্কী জীবনের আকাঙ্ক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে বলা হচ্ছে যে, এখন এই মুসলিমরা জিহাদের নির্দেশ শুনে ভীত-সন্ত্রস্ত কেন অথচ জিহাদের এই নির্দেশ তো তাদের ইচ্ছানুযায়ী দেওয়া হয়েছে?
কুরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যাঃ আয়াতের প্রথম অংশ যাতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর এবং যথাযথভাবে নামায পড়।’ কেউ কেউ এটাকে দলীল বানিয়ে বলে যে, নামাযে রুকূ থেকে উঠার সময় হাত দু’টিকে (কাঁধ বা কান পর্যন্ত) উঠানো নিষেধ। কেননা, মহান আল্লাহ কুরআনে নামাযের অবস্থায় হাতকে সংযত রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা সীমাহীন বিভ্রান্তিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক অন্তঃসারশূন্য প্রতিপাদন। এতে তারা আয়াতের শাব্দিক এবং আর্থিক উভয় প্রকারের পরিবর্তনও ঘটিয়েছে! নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।
[২] এই আয়াতের দ্বিতীয় আর এক অর্থ হল, কেন এই নির্দেশকে আরো কিছু দিনের জন্য বিলম্ব করা হল না। অর্থাৎ, اَجَلٍ قَرِيْبٍ এর অর্থ মৃত্যু অথবা জিহাদ ফরয হওয়ার সময়কাল। (তাফসীর ইবনে কাসীর)
[৩] দুর্বল মুসলিমদেরকে বুঝানো হচ্ছে যে, প্রথমতঃ যে দুনিয়ার জন্য তোমরা অবকাশ কামনা করছ, সে দুনিয়া হল ধ্বংসশীল এবং তার ভোগ-সামগ্রী ক্ষণস্থায়ী। এর তুলনায় আখেরাত অতি উত্তম এবং চিরস্থায়ী। আল্লাহর আনুগত্য না করে থাকলে সেখানে তোমাদেরকে শাস্তি পেতে হবে। দ্বিতীয়তঃ জিহাদ কর আর না কর, মৃত্যু তো তার নির্ধারিত সময়েই আসবে; যদিও তোমরা কোন সুদৃঢ় দুর্গের মধ্যে অবস্থান কর তবুও। অতএব জিহাদ থেকে পশ্চাৎপদ হওয়ার লাভ কি?
জ্ঞাতব্যঃ কোন কোন মুসলিমের এই ভয় যেহেতু প্রকৃতিগত ছিল, অনুরূপ যুদ্ধ বিলম্ব হওয়ার আশা প্রকাশ প্রতিবাদ ও অস্বীকৃতিমূলক ছিল না, বরং তাও ছিল প্রকৃতিগত ভয় থেকে সৃষ্ট ফল। এই জন্য মহান আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং বলিষ্ঠ দলীলাদির মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য ও উৎসাহিত করেছেন।
[৪] এখান থেকে পুনরায় মুনাফিকদের আলোচনা শুরু হচ্ছে। পূর্ববর্তী উম্মতের অস্বীকারকারীদের মত এরাও বলল যে, কল্যাণ (সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ভাল ফলনের ফসলাদি এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য ইত্যাদি) আল্লাহর পক্ষ হতে এবং অকল্যাণ (অনাবৃষ্টি এবং ধন-সম্পদের হ্রাস ইত্যাদি) হে মুহাম্মাদ! এগুলো তোমার পক্ষ হতে। অর্থাৎ, তোমার দ্বীন অবলম্বন করার ফল স্বরূপ এ বিপদ এসেছে। যেমন মূসা (আঃ) এবং ফিরআউন ও তার লোক-জনদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, “যখন তাদের কোন কল্যাণ হত, তখন তারা বলত, ‘এতো আমাদের প্রাপ্য।’ আর যখন কোন অকল্যাণ হত, তখন তা মূসা ও তার সঙ্গীদেরকে অশুভ কারণরূপে মনে করত।” (আ’রাফঃ ১৩১) (অর্থাৎ –নাঊযু বিল্লাহ– এ সব তাঁদের কুলক্ষণের কুফল মনে করে।)
[৫] অর্থাৎ, কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ হতে। কিন্তু এরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির স্বল্পতা এবং মূর্খতা ও যুলুম-অত্যাচারের আধিক্যের কারণে তা বোঝে না।
[৬] অর্থাৎ, তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ স্বরূপ। কোন নেকী অথবা আনুগত্যের প্রতিদান স্বরূপ নয়। কেননা, নেকী করার তওফীকদাতাও মহান আল্লাহ। তাছাড়া তাঁর নিয়ামত ও অনুদান এত বেশী যে, কোন মানুষের ইবাদত-আনুগত্য তার তুলনায় কিছুই নয়। এই জন্য একটি হাদীসে রসূল (সাঃ) বলেছেন, “জান্নাতে যে-ই যাবে, সে আল্লাহর রহমতে যাবে (অর্থাৎ, নিজের আমলের বিনিময়ে নয়)।” জিজ্ঞাসা করা হল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনিও কি আল্লাহর রহমত ব্যতীত জান্নাতে যেতে পারবেন না?’ তিনি (সাঃ) বললেন, “হ্যাঁ, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না তাঁর রহমতের আঁচল আমাকে আবৃত করে নেবে।” (বুখারী ৫৬৭৩নং)
[৭] এই অকল্যাণ ও অনিষ্ট যদিও আল্লাহর পক্ষ হতেই আসে যেমন كُلٌّ مِنْ عِنْدِ اللهِ বাক্যের দ্বারা তা পরিষ্কার, কিন্তু যেহেতু এই অকল্যাণ কোন পাপের শাস্তি অথবা তার বদলা হয়, তাই বলা হল, এটা তোমাদের পক্ষ হতে। অর্থাৎ, এটা তোমাদের ভুল, অবহেলা এবং পাপের ফল। যেমন, অন্যত্র বলেছেন, [وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ] “তোমাদের যেসব বিপদ-আপদ আপতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।” (শূরাঃ ৩০)
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
মুসলিমরা মক্কায় থাকা অবস্থায় সালাত আদায়, দরিদ্র অসহায়দের প্রতি সহানুভূতি ও মুশরিকদের উদ্ধত আচরণের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সেখানে যাকাত, জিহাদ ও অন্যান্য শরীয়তের নির্দেশাবলী ফরয করা হয়নি।
এর কয়েকটি কারণ রয়েছে:
১. আল্লাহ তা‘আলা চান শরীয়তের বিধি-বিধান এমনভাবে ও পর্যায়ক্রমে দেবেন যাতে বান্দাদের পালন করতে কষ্ট না হয়। ২. মুসলিমদের সংখ্যা কম ও শত্র“দের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও যদি তাদের ওপর জিহাদ ফরয করা হয় তাহলে আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ার শামিল হবে।
এ ছাড়াও অনেক বিষয়ের প্রতি খেয়াল করে মক্কায় মুসলিমদের ওপর জিহাদ ফরয করা হয়নি।
এতদসত্ত্বেও অনেক মুসলিমরা চাচ্ছিল যে, এ অবস্থাতেই জিহাদ করার অনুমতি প্রদান করা হোক। কিন্তু মদীনায় যখন উপযুক্ত পরিবেশে ও উপযুক্ত স্থানে জিহাদ ফরয করা হল তখন ঐ শ্রেণির মুসলিম জিহাদ থেকে পিছপা হল যারা মক্কায় জিহাদ করার কামনা করেছিল। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَوْ أَنَّهُمْ فَعَلُوْا مَا يُوْعَظُوْنَ بِه۪ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُمْ وَأَشَدَّ تَثْبِيْتًا)
“যা করতে তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যদি তা করত তাহলে তাদের ভাল হত এবং অধিকতর সুপ্রতিষ্ঠিত হত।” (সূরা নিসা ৪:৬৬)
আয়াতে তাদের মাক্কী জীবন স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, এখন জিহাদের কথা শুনে এত ভয় করে কেন অথচ তারা তো ইতোপূর্বে জিহাদ কামনা করেছিল।
তারপর বলা হচ্ছে মৃত্যুর ভয়ে জিহাদে না গিয়ে যদি সীসাঢালা দুর্গে অবস্থান করে তবু মৃত্যু সঠিক সময়ে আসবেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ)
প্রতিটি আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবেই। (সূরা আলি-ইমারান ৩:১৮৫)
(وَإِنْ تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ)
‘যদি তাদের কোন কল্যাণ হয়’ এখানে মুনাফিকদের আলোচনা করা হচ্ছে। পূববর্তী উম্মাতের অস্বীকারকারীদের মত এরাও বলে যে, কল্যাণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আসে এবং অকল্যাণ মুহাম্মাদের কারণে হয়। যেমন ফিরআউনের সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বলছেন:
(فَإِذَا جَا۬ءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوْا لَنَا هٰذِه۪ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَّطَّيَّرُوْا بِمُوْسٰي وَمَنْ مَّعَه۫)
“যখন তাদের কোন কল্যাণ হত, তারা বলত, ‘এটা আমাদের প্রাপ্য’। আর যখন কোন অকল্যাণ তাদের গ্রাস করত তখন তারা মূসা ও তার সংগীদেরকে অলক্ষুণে গণ্য করত।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৩১)
আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, হে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি বলে দাও কল্যাণ-অকল্যাণ সবই আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। এদের বিবেক বুদ্ধি কম থাকার কারণে এরা বুঝে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ، وَأَنَّ مَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَكَ
তোমাকে যে বিপদ-আপদ পেয়েছে মনে করো না তা ভুল করে এসেছে আর যে বিপদ থেকে বেঁচে গেলে মনে করো না ভুল করে তোমার ভাগ্য থেকে সরে গেছে। এর সবই তোমার ভাগ্যে ছিল বলেই হয়েছে। (আবূ দাঊদ হা: ৪৬৯৯, সহীহ)
কল্যাণকর যা কিছু আসে সব আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আর অকল্যাণকর সব নিজের হাতের অর্জন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَصَابَكُمْ مِّنْ مُّصِيْبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيْكُمْ وَيَعْفُوْا عَنْ كَثِيْرٍ)
“তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তা তো তোমাদেরই হাতের উপার্জনের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন।” (সূরা শুরা ৪২:৩০)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কোন কিছু দ্রুত চাওয়া ও কাপুরুষতা প্রকাশ করা নিন্দনীয়।
২. মুত্তাকীদের জন্য আখিরাত দুনিয়া থেকে উত্তম।
৩. মৃত্যু থেকে পলায়নের কোন পথ নেই।
৪. ভাল-মন্দ সব আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত।
৫. ভাল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আসে আর খারাপ নিজের কর্মের কারণে আল্লাহ তা‘আলা দেন।