أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٧٤)-৩৭৬
www.motaher21.net
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ أَوْفُواْ بِالْعُقُودِ
হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর।
O you who believe! Fulfill (your) obligations.
সুরা: আল্ মায়িদাহ
আয়াত নং :-১
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(০৫-মায়েদা) : নামকরণ: এ সূরার ১৫ রুকূ’র هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ আয়াতে উল্লেখিত “মায়েদাহ” শব্দ থেকে এ নামকরণ করা হয়েছে। কুরআনের অধিকাংশ সূরার নামের মতো এ সূরার নামের সাথেও এর আলোচ্য বিষয়বস্তুর তেমন কোন সম্পর্ক নেই। নিছক অন্যান্য সূরা থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্যই একে এ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
(০৫-মায়েদা) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
হোদাইবিয়ার সন্ধির পর ৬ হিজরীর শেষের দিকে অথবা ৭ হিজরীর প্রথম দিকে এ সূরাটি নাযিল হয়। সূরায় আলোচ্য বিষয় থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় এবং হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনাও এর সত্যতা প্রমাণ করে। ষষ্ঠ হিজরীর যিলকাদ মাসের ঘটনা। চৌদ্দশ’ মুসলমানকে সাথে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমরাহ সম্পন্ন করার জন্য মক্কায় উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু কুরাইশ কাফেররা শত্রুতার বশবর্তী হয়ে আরবের প্রাচীনতম ধর্মীয় ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করে তাঁকে উমরাহ করতে দিল না। অনেক তর্ক বিতর্ক ও বাদানুবাদের পর তারা এতটুকু মেনে নিল যে, আগামী বছর আপনারা আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার জন্য আসতে পারেন। এ সময় একদিকে মুসলমানদেরকে কাবাঘর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করার নিয়ম কানুন বাতলে দেবার প্রয়োজন ছিল, যাতে পরবর্তী বছর পূর্ণ ইসলামী শান শওকতের সাথে উমরাহর সফর করা যায় এবং অন্য দিকে তাদেরকে এ মর্মে ভালভাবে তাকীদ করারও প্রয়োজন ছিল যে, কাফের শত্রু দল তাদের উমরাহ করতে না দিয়ে যে বাড়াবাড়ি করেছে তার জবাবে তারা নিজেরা অগ্রবর্তী হয়ে যেন আবার কাফেরদের ওপর কোন অন্যায় বাড়াবাড়ি ও জুলুম না করে বসে। কারণ অনেক কাফের গোত্রকে হজ্ব সফরের জন্য মুসলিম অধিকারভুক্ত এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া আসা করতে হতো। মুসলমানদেরকে যেভাবে কাবা যিয়ারত করতে দেয়া হয়নি সেভাবে তারাও এ ক্ষেত্রে জোর পূর্বক এসব কাফের গোত্রের কাবা যিয়ারতের পথ বন্ধ করে দিতে পারতো। এ সূরার শুরুতে ভূমিকাস্বরূপ যে ভাষণটির অবতারণা করা হয়েছে সেখানে এ প্রসংগই আলোচিত হয়েছে। সামনের দিকে তের রুকূ’তে আবার এ প্রসংগটি উত্থাপিত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, প্রথম রুকূ’ থেকে নিয়ে চৌদ্দ রুকূ’ পর্যন্ত একই ভাষণের ধারাবাহিকতা চলছে। এ ছাড়াও এ সূরার মধ্যে আর যে সমস্ত বিষয়বস্তু আমরা পাই তা সবই একই সময়কার বলে মনে হয়। বর্ণনার ধারাবাহিকতা দেখে মনে হয় এ সমগ্র সূরাটি একটি মাত্র ভাষণের অন্তর্ভুক্ত এবং সম্ভবত এটি একই সঙ্গে নাযিল হয়েছে। আবার এর কোন কোন আয়াত পরবর্তীকালে পৃথক পৃথকভাবে নাযিল হতেও পারে এবং বিষয়বস্তুর একাত্মতার কারণে সেগুলোকে এ সূরার বিভিন্ন স্থানে জায়গা মতো জুড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্ণনার ধারাবাহিকতার মধ্যে কোথাও সামান্যতম শূন্যতাও অনুভূত হয় না। ফলে একে দু’টি বা তিনটি ভাষণের সমষ্টি মনে করার কোন অবকাশ নেই।
(০৫-মায়েদা) : নাযিলের উপলক্ষ / প্রেক্ষাপট :
আলে ইমরান ও আন্ নিসা সূরা দু’টি যে যুগে নাযিল হয় সে যুগ থেকে এ সূরাটির নাযিলের যুগে পৌঁছতে পৌঁছতে বিরাজমান পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে অনেক বড় রকমের পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। ওহোদ যুদ্ধের বিপর্যয় যেখানে মদীনার নিকটতম পরিবেশও মুসলমানদের জন্য বিপদসংকুল করে তুলেছিল। সেখানে এখন সম্পূর্ণ ভিন্নতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আরবে ইসলাম এখন একটি অজেয় ও অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র একদিকে নজ্দ থেকে সিরিয়া সীমান্ত এবং অন্যদিকে লোহিত সাগর থেকে মক্কার নিকট এলাকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। ওহোদে মুসলমানরা যে আঘাত পেয়েছিল তা তাদের হিম্মত ও সাহসকে দমিত এবং মনোবলকে নিস্তেজ করার পরিবর্তে তাদের সংকল্প ও কর্মোন্মদানার জন্য চাবুকের কাজ করেছিল। তারা আহত সিংহের মতো গর্জে ওঠে এবং তিন বছরের মধ্যে সমগ্র পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। তাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও আত্মদানের ফলে মদীনার চারদিকে দেড়শ’, দুশ’ মাইলের মধ্যে সমস্ত বিরোধী গোত্রের শক্তির দর্প চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মদীনার ওপর সবসময় যে ইহুদী বিপদ শকুনির মতো ডানা বিস্তার করে রেখেছিল তার অশুভ পাঁয়তারার অবসান ঘটেছিল চিরকালের জন্য। আর হিজাযের অন্যান্য যেসব জায়গায় ইহুদী জনবসতি ছিল সেসব এলাকা মদীনার ইসলামী শাসনের অধীনে এসে গিয়েছিল। ইসলামের শক্তিকে দমন করার জন্য কুরাইশরা সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল খন্দকের যুদ্ধে। এতেও তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। এরপর আরববাসীদের মনে এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহই রইলো না যে, ইসলামের এ আন্দোলনকে খতম করার সাধ্য দুনিয়ার আর কোন শক্তির নেই। ইসলাম এখন আর নিছক একটি আকীদা-বিশ্বাস ও আদর্শের পর্যায় সীমিত নয়। নিছক মন ও মস্তিষ্কের ওপরই তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত নয়। বরং ইসলাম এখন একটি পরাক্রান্ত রাষ্ট্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের সীমানায় বসবাসকারী সমস্ত অধিবাসীর জীবনের ওপর তার কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত। এখন মুসলমানরা এতটা শক্তির অধিকারী যে, যে চিন্তা ও ভাবধারার ওপর তারা ঈমান এনেছিল সে অনুযায়ী স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলার এবং সে চিন্তা ও ভাবধারা ছাড়া অন্য কোন আকীদা-বিশ্বাস, ভাবধারা, কর্মনীতি অথবা আইন-বিধানকে নিজেদের জীবন ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করতে না দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার তারা লাভ করেছিল। তাছাড়া এ কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামী মূলনীতি ও দৃষ্টিভংগী অনুযায়ী মুসলমানদের নিজস্ব একটি কৃষ্টি ও সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছিল। এ সংস্কৃতি জীবনের যাবতীয় বিস্তারিত বিষয়ে অন্যদের থেকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তির অধিকারী ছিল। নৈতিকতা, স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, জীবন যাপন প্রণালী, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি যাবতীয় ক্ষেত্রে মুসলমানরা এখন অমুসলিমদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামী রাষ্ট্রের সমস্ত মুসলিম অধ্যুষিত জনপদে মসজিদ ও জামায়াতে সাথে নামায পড়ার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক জনবসতিতে ও প্রত্যেক গোত্রে একজন ইমাম নিযুক্ত রয়েছে। ইসলামের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন-কানুন অনেকটা বিস্তারিত আকারে প্রণীত হয়ে গেছে এবং মুসলমানদের নিজস্ব আদালতের মাধ্যমে সর্বত্র সেগুলো প্রবর্তিত হচ্ছে। লেনদেন ও কেনা–বেচা ব্যবসায় বাণিজ্যের পুরাতন রীতি ও নিয়ম রহিত করে নতুন সংশোধিত পদ্ধতির প্রচলন চলছে। সম্পত্তি উত্তরাধিকারের স্বতন্ত্র বিধান তৈরী হয়ে গেছে। বিয়ে ও তালাকের আইন, শ’রয়ী পর্দা ও অনুমতি নিয়ে অন্যের গৃহে প্রবেশের বিধান এবং যিনা ও মিথ্যা অপবাদের শাস্তি বিধান জারি হয়ে গেছে। এর ফলে মুসলমানদের সমাজ জীবন একটি বিশেষ ছাঁচে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। মুসলমানদের ওঠা বসা, কথাবার্তা, পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবন যাপন ও বসবাস করার পদ্ধতিও একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল হয়ে উঠেছে। এভাবে ইসলামী জীবন একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করার এবং মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও তামাদ্দুন গড়ে ওঠার পর, তারা যে আবার কোন দিন অমুসলিম সমাজের সাথে মিলে একাত্ম হয়ে যেতে পারে। তেমনটি আশা করা তৎকালীন অমুসলিম বিশ্বের পক্ষে আর সম্ভবপর ছিল না।হোদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদিত হবার পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধক ছিল এই যে, কুরাইশ কাফেরদের সাথে তাদের ক্রমাগত যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও সংঘাত লেগেই ছিল। নিজেদের ইসলামী দাওয়াতে সীমানা বৃদ্ধি ও এর পরিসর প্রশস্ত করার জন্য অবকাশই তারা পাইনি। হোদাইবিয়ার বাহ্যিক পরাজয় ও প্রকৃত বিজয় এ বাধা দূর করে দিয়েছিল। এর ফলে কেবল নিজেদের রাষ্ট্রীয় সীমায়ই তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে পায়নি বরং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের দাওয়াত বিস্তৃত করার সুযোগ এবং অবকাশও লাভ করেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজটিরই উদ্ধোধন করলেন ইরান, রোম মিসর ও আরবের বাদশাহ ও রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে পত্র লেখার মাধ্যমে। এ সাথে ইসলাম প্রচারকবৃন্দ মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহবান জানাবার জন্য বিভিন্ন গোত্র ও কওমের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেন। এ ছিল সূরা মা-য়েদাহ নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট।
(০৫-মায়েদা) : আলোচ্য বিষয়সমূহ:
নিম্নলিখিত তিনটি বড় বড় বিষয় এ সূরাটির অন্তর্ভুক্তঃ
একঃ মুসলমানদের ধর্মীয়, তামাদ্দুনিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আরো কিছু বিধি নির্দেশ। এ প্রসংগে হজ্ব সফরের রীতি-পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। ইসলামী নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং কাবা যিয়ারতকারীদেরকে কোন প্রকার বাধা না দেবার হুকুম দেয়া হয়। পানাহার দ্রব্য সামগ্রীর মধ্যে হালাল ও হারামের চূড়ান্ত সীমা প্রবর্তিত হয়। জাহেলী যুগের মনগড়া বাধা নিষেধগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়। আহলী কিতাবদের সাথে পানাহার ও তাদের মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়। অযু, গোসল ও তায়াম্মুম করার রীতি পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। বিদ্রোহ ও অরাজকতা সৃষ্টি এবং চুরি-ডাকাতির শাস্তি প্রবর্তিত হয়। মদ ও জুয়াকে চূড়ান্তভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়। কসম ভাঙার কাফ্ফারা নির্ধারিত হয়। সাক্ষ্য প্রদান আইনের আরো কয়েকটি ধারা প্রবর্তন করা হয়।
দুইঃ মুসলমানদেরকে উপদেশ প্রদান। এখন মুসলমানরা একটি শাসক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে যাওয়ায় তাদের হাতে ছিল শাসন শক্তি। এর নেশায় বহু জাতি পথভ্রষ্ট হয়। মজলুমীর যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছিল এবং তার চাইতে অনেকে বেশী কঠিন পরীক্ষার যুগে মুসলমানরা পদার্পণ করেছিল। তাই তাদেরকে সম্বোধন করে বারবার উপদেশ দেয়া হয়েছেঃ ন্যায়, ইনসাফ ও ভারসাম্যের নীতি অবলম্বন করো। তোমাদের পূর্ববর্তী আহ্লী কিতাবদের মনোভাব ও নীতি পরিহার করো। আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর হুকুম ও আইন কানুন মেনে চলার যে অঙ্গীকার তোমরা করেছো তার ওপর অবিচল থাকো। ইহুদী ও খৃস্টানদের মতো তাঁর সীমালংঘন করে তাদের মতো একই পরিণতির শিকার হয়ো না। নিজেদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালার জন্য কিতাবের অনুসরণ করো। মুনাফিকী নীতি পরিহার করো।
তিনঃ ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে উপদেশ প্রদান। এ সময় ইহুদীদের শক্তি খর্ব হয়ে গেছে। উত্তর আরবের প্রায় সমস্ত ইহুদী জনপদ মুসলমানদের পদানত। এ অবস্থায় তাদের অনুসৃত ভ্রান্ত নীতি সম্পর্কে তাদেরকে আর একবার সর্তক করে দেয়া হয়। তাদেরকে সত্য-সঠিক পথে আসার দাওয়াত দেয়া হয়। এ ছাড়া যেহেতু হোদায়বিয়ার চুক্তির কারণে সমগ্র আরবে ও আশপাশের দেশগুলোয় ইসলামের দাওয়াত প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তাই খৃস্টানদেরকেও ব্যাপকভাবে সম্বোধন করে তাদের বিশ্বাসের ভ্রান্তিগুলো জানিয়ে দেয়া হয় এবং শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনার জন্য তাদেরকে আহবান জানানো হয়। যেসব প্রতিবেশী দেশে মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসক জাতির বসবাস ছিল সেসব দেশের অধিবাসীদেরকে সরাসরি সম্বোধন করা হয়নি। কারণ ইতিপূর্বে তাদের সমমনা আরবের মুশরিকদেরকে সম্বোধন করে মক্কায় যে হেদায়াত নাযিল হয়েছিল তা-ই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল।
সুরা: আল-মায়িদাহ
আয়াত নং :-১
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ۬ؕ اُحِلَّتْ لَكُمْ بَهِیْمَةُ الْاَنْعَامِ اِلَّا مَا یُتْلٰى عَلَیْكُمْ غَیْرَ مُحِلِّی الصَّیْدِ وَ اَنْتُمْ حُرُمٌؕ اِنَّ اللّٰهَ یَحْكُمُ مَا یُرِیْدُ
হে ঈমানদারগণ! বন্ধনগুলো পুরোপুরি মেনে চলো। তোমাদের জন্য চতুষ্পদ গৃহপালিত পশু জাতীয় সব পশুই হালাল করা হয়েছে তবে সামনে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের জানানো হবে সেগুলো ছাড়া। কিন্তু ইহ্রাম বাঁধা অবস্থায় শিকার করা নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন।
১ নং আয়াতের তাফসীর:
টিকা:১) অর্থাৎ এ সূরায় তোমাদের প্রতি যে সমস্ত নীতি-নিয়ম ও বিধি-বিধান আরোপ করা হচ্ছে এবং সাধারণভাবে আল্লাহর শরীয়াত যেগুলো তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, সেগুলো মেনে চলো। ভূমিকা স্বরূপ এ ছোট্ট একটি বাক্যের অবতারণা করার পর এবার সে বাঁধনগুলোর বর্ণনা শুরু হচ্ছে যেগুলো মেনে নেবার হুকুম দেয়া হয়েছে।
টিকা:২) মূল শব্দ হচ্ছে, “বাহীমাতুল আন’আম”। “আন’আম” শব্দটি বললে আরবী ভাষায় উট, গরু, ছাগল ও ভেড়া বুঝায়। আর “বাহীমা” বলতে প্রত্যেক বিচরণশীল চতুষ্পদ জন্তু বুঝানো হয়। যদি আল্লাহ বলতেন, “আন’আম” তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে, তাহলে এর ফলে কেবলমাত্র আরবীতে যে চারটি জন্তকে “আন’আম” বলা হয় সে চারটি জন্তুই হালাল হতো। কিন্তু আল্লাহ বলেছেনঃ গৃহপালিত পশু পর্যায়ের বিচরণশীল চতুষ্পদ প্রাণী তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। এর ফলে নির্দেশটি ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং গৃহপালিত গবাদি পশু পর্যায়ের সমস্ত বিচরণশীল চতুষ্পদ প্রাণী এর আওতায় এসে গেছে। অর্থাৎ যাদের শিকারী দাঁত নেই, যারা জান্তব খাদ্যের পরিবর্তে উদ্ভিজ্জ খাদ্য খায় এবং অন্যান্য প্রাণীগত বিশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে আরবের ‘আন’আম’-এর সাথে সাদৃশ্য রাখে। এ সঙ্গে এখানে এ ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, গৃহপালিত চতুষ্পদ পশুর বিপরীত ধর্মী যে সমস্ত পশুর শিকারী দাঁত আছে এবং অন্য প্রাণী শিকার করে খায়, সেসব পশু হালাল নয়। এ ইঙ্গিতটিকে সুস্পষ্ট করে হাদীসে নবী ﷺ পরিষ্কারভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, শিকারী হিংস্র প্রাণী হারাম। অনুরূপভাবে নবী ﷺ এমন সব পাখিকেও হারাম গণ্য করেছেন যাদের শিকারী পাঞ্জা আছে, অন্য প্রাণী শিকার করে খায় বা মৃত খায়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেনঃ
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ كُلِّ ذِى نَابٍ مِنَ السِّبَاعِ و كُلِّ ذِى مِخْلَبٍ مِنَ الطَّيْرِ
“নবী ﷺ শিকারী দাঁত সম্পন্ন প্রত্যেকটি পশু এবং নখরধারী ও শিকারী পাঞ্জা সম্পন্ন প্রত্যেকটি পাখি আহার করতে নিষেধ করেছেন।” এর সমর্থনে অন্যান্য বহু সংখ্যক সাহাবীর হাদীসও বর্ণিত হয়েছে।
টিকা:৩) কাবাঘর যিয়ারত করার জন্য যে ফকিরী পোশাক পরা হয় তাকে বলা হয় “ইহরাম।” কাবার চারদিকে কয়েক মনযিল দূরত্বে একটি করে সীমানা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। কোন যিয়ারতকারীর নিজের সাধারণ পোশাক বদলে ইহরামের পোশাক পরিধান না করে এ সীমানাগুলো পার হয়ে এগিয়ে আসার অনুমতি নেই। এ পোশাকের মধ্যে থাকে কেবল মাত্র একটি সেলাইবিহীন লুংগী ও একটি চাদর। চাদরটি দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ ঢাকা হয়। একে ইহরাম বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এ পোশাক পরিধান করার সাথে সাথে মানুষের জন্য এমন অনেক কাজ হারাম হয়ে যায় যেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় তার জন্য হালাল ছিল। যেমন ক্ষৌরকার্য করা, সুগন্ধি ব্যবহার, সবধরনের সাজসজ্জা, সৌন্দর্য চর্চা, যৌনাচার ইত্যাদি। এ অবস্থায় কোন প্রাণী হত্যা করা যাবে না, শিকার করা যাবে না এবং শিকারের খোঁজও দেয়া যাবে না। এগুলোও এ বিধিনিষেধের অন্তর্ভুক্ত।
টিকা:৪) অর্থাৎ আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছেমতো যে কোন হুকুম দেবার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। তাঁর নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে কোন প্রকার উচ্চবাচ্য করার বা আপত্তি জানানোর কোন অধিকার মানুষের নেই। তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়নীতি ও কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার মুসলিম যুক্তিসঙ্গত, ন্যায়ানুগ ও কল্যাণকর বলেই তার আনুগত্য করে না বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর হুকুম বলেই তার আনুগত্য করে। যে জিনিসটি তিনি হারাম করে দিয়েছেন তা কেবল তাঁর হারাম করে দেবার কারণেই হারাম হিসেবে গণ্য। আর ঠিক তেমনিভাবে যে জিনিসটি তিনি হালাল করে দিয়েছেন সেটির হালাল হবার পেছনে অন্য কোন কারণ নেই বরং যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ এসব জিনিসের মালিক তিনি নিজের দাসদের জন্য এ জিনিসটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলে এটি হালাল। তাই কুরআন মজীদ সর্বোচ্চ বলিষ্ঠতা সহকারে এ মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কোন বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর অনুমোদন ও অননুমোদন ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন ভিত্তির আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। অনুরূপভাবে আল্লাহ যে কাজটিকে বৈধ গণ্য করেছেন সেটি বৈধ এবং যেটিকে অবৈধ গণ্য করেছেন সেটি অবৈধ, এছাড়া মানুষের জন্য কোন কাজের বৈধ ও অবৈধ হবার দ্বিতীয় কোন মানদণ্ড নেই।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
5:1
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوٓا أَوْفُوا بِالْعُقُودِ ۚ أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الْأَنْعٰمِ إِلَّا مَا يُتْلٰى عَلَيْكُمْ غَيْرَ مُحِلِّى الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ ۗ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ
হে মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর। তোমাদের জন্য গৃহপালিত চতুস্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে, তোমাদের নিকট যা বর্ণনা করা হচ্ছে তা ছাড়া। তবে ইহরাম অবস্থায় শিকারকে হালাল করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা বিধান দেন।
নামকরণ ও অবতীর্ণের সময়কাল:
الْمَائِدَةُ (আল মায়িদাহ) শব্দের অর্থ: দস্তরখানা, খাদ্য ইত্যাদি। অত্র সূরার ১১৪ নং আয়াতে আল মায়িদাহ (الْمَائِدَةُ) শব্দটি থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। তাছাড়া এ সূরাতে খাদ্য হিসেবে কোন্ প্রাণী ও বস্তু খাওয়া হালাল বা হারাম সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
সূরা আল-মায়িদাহ সম্পূর্ণ মদীনায় অবতীর্ণ হয়। মদীনায় অবতীর্ণ হওয়া সূরাসমূহের মধ্যে এটি শেষ দিকের সূরা। এমনকি কেউ কেউ এটাকে কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা বলেও আখ্যায়িত করেছেন। (আল মাবাহিস ফী উলুমুল কুরআন, মান্নাউল কাত্তান পৃঃ ৬৬)।
শানে নুযূল ও ফযীলত:
আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাহনের ওপর আরোহী অবস্থায় সূরা মায়িদাহ অবতীর্ণ হয়। তখন বাহন তাঁকে বহন করতে অক্ষম হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাহন হতে নেমে পড়লেন। (মুসনাদ আহমাদ হা: ৬৬৪৩, সনদ হাসান, ইবনে কাসীর ৩/৫)
যুবাইর বিন নুফাইর (রাঃ) বলেন: একদা আমি হজ্জ আদায়ের জন্য গমন করি। অতঃপর আমি আয়িশাহ (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করার জন্য তার কাছে প্রবেশ করি। তখন আয়িশাহ (রাঃ) বললেন: হে যুবাইর! তুমি কি সূরা মায়িদাহ তেলাওয়াত কর? উত্তরে বললাম: হ্যাঁ। তখন বললেন: এটা সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। সুতরাং এতে যা কিছু হালাল হিসেবে পাও তা হালাল হিসেবে গ্রহণ কর আর যা হারাম হিসেবে পাও তা হারাম হিসেবেই গ্রহণ কর। (হাকিম: ২/৩১১, ইমাম হাকিম বলেন: এ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুপাতে কিন্তু তারা নিয়ে আসেননি)
রূহুল মা‘আনী গ্রন্থকার- আতিয়্যা বিন কায়েস থেকে এর সমর্থনে একটি বর্ণনা নিয়ে এসেছেন:
المائدة من آخر القرآن نزولا فأحلوا حلالها وحرموا حرامها
সূরা আল-মায়িদাহ কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর হালালগুলোকে হালাল হিসেবে ও হারামগুলোকে হারাম হিসেবে গ্রহণ করে নাও। (আহকামূল কুরআন ৪/১৬১)
সূরা আল-মায়িদাহ সূরা নিসার মত বিধি-বিধান সম্বলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এ কারণেই রূহুল মা‘আনীর গ্রন্থকার বলেন: বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে যেমন সূরা আল-বাক্বারাহ ও সূরা আলি-ইমরান এক ও অভিন্ন তেমনি সূরা নিসা ও সূরা মায়িদাহ বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন; কেননা এ দু’টি সূরায় প্রধানত বিভিন্ন বিধি-বিধান বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে এবং মৌলিক বিধান প্রসঙ্গক্রমে বর্ণিত হয়েছে।
এ সূরায় যে সকল জীব-জন্তু খাওয়া হালাল ও যেগুলো হারাম, শত্রু“ হলেও তার প্রতি ন্যায় বিচার করা, ভাল কাজে সহযোগিতা করা ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা না করা, ওযূ ও তায়াম্মুমের পদ্ধতি, বানী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ, ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র হওয়ার দাবী, চোরের বিধান, ইসলামদ্রোহীদের বিধান, কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য বিধান দ্বারা বিচার-ফায়সালা করার হুকুম, দীনের কোন বিধান নিয়ে ঠাট্টা না করে বরং তার প্রতি আনুগত্য করা এবং যারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী তাদের বিধানসহ আরো অনেক মাসআলাহ বর্ণনা করা হয়েছে।
১ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র সূরার প্রথমেই আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। عقود শব্দটি عقد এর বহুবচন। অর্থ হল عهد বা চুক্তি, অঙ্গীকার, ইত্যাদি।
ইমাম জাসসাস (রহঃ) বলেন: দু’জন ব্যক্তি যদি ভবিষ্যতে কোন কাজ করা অথবা না করার ওপর একমত হয় তবে তাকেই عقد , عهد ও معاهدة বলে। আমরা যাকে চুক্তি বলি।
ইবুন আব্বাস (রাঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যা কিছু হালাল, হারাম, ফরয ও সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সবই এ অঙ্গীকারের অন্তভুর্ক্ত। অতএব তা ভঙ্গ ও খেলাফ কর না। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা কঠিনভাবে হুশিয়ার করে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ يَنْقُضُوْنَ عَهْدَ اللّٰهِ مِنْۭ بَعْدِ مِيْثَاقِه۪ وَيَقْطَعُوْنَ مَآ أَمَرَ اللّٰهُ بِه۪ٓ أَنْ يُّوْصَلَ وَيُفْسِدُوْنَ فِي الْأَرْضِ ج أُولٰ۬ئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوْءُ الدَّارِ)
“যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর সেটা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণœ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য লা‘নত এবং তাদের জন্য আছে মন্দ আবাস।”(সূরা রা‘দ ১৩:২৫)
যহহাক (রহঃ)
(أَوْفُوْا بِالْعُقُوْدِ)
‘তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ কর’এর ব্যাখ্যায় বলেন: আল্লাহ তা‘আলা যেসব বিষয় বৈধ ও অবৈধ করেছেন এবং তার কিতাব ও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর বিশ্বাস সংক্রান্ত আবশ্যকীয় যে কাজগুলো করার ওয়াদা নিয়েছেন عقود দ্বারা সেগুলো বুঝানো হয়েছে। এছাড়াও এ সম্পর্কে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। (ইবনে কাসীর, ৩/৯)
আল্লাহ তা‘আলা ও বান্দার মাঝে যে অঙ্গীকার- বান্দা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, তাঁর সকল হক আদায় করবে; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর উম্মাতের মাঝে যে অঙ্গীকার- উম্মাতেরা রাসূলের আনুগত্য করবে; সন্তান তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরস্পরের মাঝে যে অঙ্গীকার- তারা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। এছাড়াও মানুষ তার অন্যান্য সঙ্গী সাথীদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনের বৈষয়িক বিষয়ে যত অঙ্গীকার করে সব এতে শামিল। (তাফসীর সা‘দী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
এ কারণেই ইমাম রাগেব (রহঃ) বলেন: যত প্রকার চুক্তি রয়েছে, সবই এর অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর তিনি বলেন: প্রধানত চুক্তি তিন প্রকার: (১) আল্লাহ তা‘আলার সাথে মানুষের অঙ্গীকার, যেমন ঈমান ও ইবাদতের অঙ্গীকার অথবা হালাল-হারাম মেনে চলার অঙ্গীকার। (২) নিজের সাথে মানুষের অঙ্গীকার। (৩) মানুষের সাথে মানুষের সম্পাদিত চুক্তি, বিবাহ, ব্যবসায়, লেন-দেন ইত্যাদি।
(بَهِيْمَةُ الْأَنْعَامِ)
‘চতুষ্পদ জন্তু’ নর ও মাদী মিলে চতুষ্পদ জন্তু আট প্রকার। সূরা আন‘আমের ১৪৩ ও ১৪৪ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো: গরু, উট, ছাগল, মেষ এদের নর ও মাদী। এ ছাড়াও আরো অনেক প্রাণী রয়েছে যা খাওয়া হালাল। এক্ষেত্রে সূত্র হল: কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ যা হারাম করেছে তা হারাম, বাকি সব হালাল। কতক সাহাবী এ আয়াত দ্বারা মাদী পশু জবাই করার পর গর্ভে ভ্রুণ পাওয়া গেলে তা হালাল বলেছেন। এ সম্পর্কে সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা বললাম; হে আল্লাহর রাসূল! আমরা উটনী ও গাভী অথবা ছাগল জবাই করি আর তাদের পেটে ভ্রুণ পাই, আমরা কি ফেলে দেব, না খাব? তিনি বললেন: তোমাদের ইচ্ছা হলে খাও; কেননা তার মাকে জবাই করাই হল তাকে জবাই করা। (আবূ দাঊদ হা: ২৮২৭, তিরমিযী হা: ৩১৯৯, সহীহ)
(إِلَّا مَا يُتْلٰي عَلَيْكُمْ)
‘যা তোমাদের নিকট বর্ণিত হয়েছে তা ব্যতীত’ অর্থাৎ যা তেলাওয়াত করে শুনানো হবে তা ব্যতীত সব হালাল। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: অর্থাৎ মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত। কাতাদাহ বলেন: রক্ত ও যে পশু যবাই করার সময় আল্লাহ তা‘আলার নাম নেয়া হয় না। এ অংশটুকুর তাফসীর ৩ নং আয়াতে উল্লেখ করা হবে ইনশা-আল্লাহ।
(غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ)
‘তবে ইহরাম অবস্থায় শিকার করা অবৈধ’অর্থাৎ হজ্জের ইহরাম অবস্থায় এসব প্রাণী শিকার করা বা হত্যা করা হারাম। তবে ইহরাম অবস্থাতেও যেসব প্রাণী হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা ব্যতীত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: পাঁচটি প্রাণী মুহরিম ব্যক্তি হত্যা করলে কোন অপরাধ হবে না। কাক, চিল, ইঁদুর, বিচ্চু ও কালো কুকুর। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩১৫)
(إِنَّ اللّٰهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيْدُ)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যা ইচ্ছা হুকুম করেন।’অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যে কোন বিধান দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, তাঁর ইচ্ছার কোন প্রতিরোধকারী নেই এবং কারো কাছে তাঁর জবাবদিহিও করতে হয় না। তবে তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ সত্য ও ন্যায়সঙ্গত এবং সৃষ্টির জন্য কল্যাণকর ও উপকারী।
(شَعَا۬ئِرَ اللّٰهِ) ‘আল্লাহর নিদর্শন’ শব্দটি شعيرة এর বহুবচন। অর্থ হল চিহ্ন, নিদর্শন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: এখানে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন বলতে হাজ্জের নিদর্শনাবলীকে বুঝানো হয়েছে। মুজাহিদ বলেন: এর দ্বারা সাফা ও মারওয়াকে বুঝানো হয়েছে।
মোটকথা হল, এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ও সম্মানীত সকল বস্তু শামিল যা আল্লাহ তা‘আলা পালন করার ও সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং লংঘন করতে নিষেধ করেছেন। (তাফসীরে সা‘দী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
الشَّهْرَ الْحَرَامَ
‘হারাম মাস’অর্থাৎ হারাম মাসের সম্মান নষ্ট করতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيْهِ ط قُلْ قِتَالٌ فِيْهِ كَبِيْرٌ)
“তারা আপনাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে প্রশ্ন করে; আপনি বলুন, তাতে যুদ্ধ করা বড় অপরাধ।”(সূরা বাকারাহ ২:২১৭)
হারাম মাসসমূহ হল: যুলকাদা, যুলহাজ্জ, মুহাররম ও রজব। (সহীহ বুখারী হা: ৩১৯৭)
(وَلَا الْهَدْيَ وَلَا الْقَلَا۬ئِدَ)
‘কুরবানীর জন্য কা‘বায় প্রেরিত পশু, গলায় পরিহিত চিহ্নবিশিষ্ট পশু’হাদী ঐ পশুকে বলা হয়, যা কুরবানী দেয়ার জন্য হাজীগণ সঙ্গে করে হারামে নিয়ে আসেন।
قلائد শব্দটি قلادة এর বহুবচন। যার অর্থ গলায় ঝুলানো হয় এমন হার, মালা ও সুতা। এখানে হজ্জ ও উমরায় কুরবানীর জন্য নিয়ে আসা পশুকে বুঝানো হয়েছে, যাদের গলায় আলামত বা চিহ্ন স্বরূপ জুতা বা ফিতা বেধে দেয়া হয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ঐ সমস্ত পশুকে কেউ যেন ছিনতাই না করে এবং মাসজিদুল হারাম পর্যন্ত পৌঁছার ব্যাপারে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে।
এসব হাদী ও চিহ্নিত পশুকে হালাল মনে করে তার ওপর আক্রমণ বা হস্তক্ষেপ করো না; বরং তাদের সম্মান রক্ষা করবে, এসব নিদর্শনকে সম্মান দেখানো তাক্বওয়ার পরিচায়ক।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা ও মানুষের মাঝে পরস্পর অঙ্গীকার ও চুক্তি পূর্ণ করা ওয়াজিব।
২. আল্লাহ তা‘আলা কিছু চতুষ্পদ জন্তু হালাল করে দিয়েছেন, তবে তা আল্লাহ তা‘আলার নামে ও তাঁর উদ্দেশ্যে জবাই করতে হবে।
৩. ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম। তবে ইহরামের পরে বৈধ।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
সূরা সংক্রান্ত আলোচনাঃ
আয়াত সংখ্যাঃ ১২০
নামকরণঃ এ সূরারই ১১২ ও ১১৬ নং আয়াতদ্বয়ে উল্লেখিত “মায়েদাহ” শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। মায়েদা শব্দের অর্থঃ খাবারপূর্ণ পাত্র।
সূরা নাযিলের প্রেক্ষাপটঃ সূরা আল-মায়েদাহ সর্বসম্মত মতে মাদানী সূরা। মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের মধ্যেও এটি শেষ দিকের সূরা। এমনকি, কেউ কেউ একে কুরআন মজীদের সর্বশেষ সূরাও বলেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ও আসমা বিনতে ইয়াযীদ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত আছে, সূরা আল-মায়েদাহ যে সময় নাযিল হয়, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে ‘আদ্ববা’ নামীয় উষ্ট্রীর পিঠে সওয়ার ছিলেন। সাধারণতঃ ওহী অবতরণের সময় যেরূপ অসাধারণ ওজন ও বোঝা অনুভূত হতো, তখনও যথারীতি তা অনুভূত হয়েছিল। এমনকি ওজনের চাপে উষ্ট্রী অক্ষম হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীচে নেমে আসেন। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/৪৫৫] কোন কোন বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, এটি ছিল বিদায় হজ্জের সফর। বিদায় হজ্জ নবম হিজরীর ঘটনা। এ হজ্জ থেকে ফিরে আসার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় আশি দিন জীবিত ছিলেন। আবু হাইয়ান বলেনঃ সূরা মায়েদার কিয়দাংশ হোদায়বিয়ার সফরে, কিয়দাংশ মক্কা বিজয়ের সফরে এবং কিয়দাংশ বিদায় হজ্জের সফরে নাযিল হয়। এতে বোঝা যায় যে, এ সূরাটি সর্বশেষ সূরা না হলেও শেষ পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েছে। [বাহরে মুহীত]
জুবায়ের ইবনে নুফায়ের থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একবার হজ্জের পর আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে উপস্থিত হলে তিনি বললেনঃ জুবায়ের, তুমি কি সূরা মায়েদাহ পাঠ কর? তিনি আরয করলেন, জী-হ্যাঁ, পাঠ করি। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এটি কুরআনুল কারীমের সর্বশেষ সূরা। এতে হালাল ও হারামের যেসব বিধি-বিধান বর্ণিত আছে, তা অটল। এগুলো রহিত হওয়ার নয়। কাজেই এগুলোর প্রতি বিশেষ যত্নবান থেকো। [দেখুনঃ মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩১১]
রহমান, রহীম আল্লাহর নামে
[১] আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন শুনবে যে, আল্লাহ্ তা’আলা ‘ইয়া আইয়ুহাল্লায়ীনা আমানু’ বা ‘হে ঈমানদারগণ’ বলছে তখন সেটাকে কান লাগিয়ে শুন। কেননা, এর মাধ্যমে কোন কল্যানের নির্দেশ আসবে বা অকল্যাণ থেকে নিষেধ করা হবে। [ইবন কাসীর]
[২] আয়াতে মুমিনগণকে ওয়াদা-অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ কারণেই সূরা মায়েদার অপর নাম সূরা ‘উকুদ তথা ওয়াদা- অঙ্গীকারের সূরা। চুক্তি-অঙ্গীকার ও লেন-দেনের ক্ষেত্রে এ সূরাটি বিশেষ করে এর প্রথম আয়াতটি সবিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমর ইবন হায্মকে ঐ আমলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন এবং একটি ফরমান লিখে তাঁর হাতে অর্পণ করেন, তখন এ ফরমানের শিরোনামে উল্লেখিত আয়াতটিও লিপিবদ্ধ করে দেন। [দেখুন, নাসায়ী: ৪৮৫৬; আল খাতীবুল বাগদাদী, আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাককিহ হাদীস নং ৩১৮ (হাদীসটির সনদ হাসান); দেখুন, ‘আদেল ইউসুফ আল-‘আয্যাযীর টিকা এবং ইরউয়াউল গালীল ১ম খণ্ড: পৃষ্ঠা নং ১৫৮-১৬১]
[৩] (عُقُوْدٌ) শব্দটি (عقد) শব্দের বহুবচন। এর শাব্দিক অর্থ বাঁধা, আবদ্ধ করা। চুক্তিতে যেহেতু দুই ব্যক্তি অথবা দুই দল আবদ্ধ হয়, এজন্য এটাকেও (عقد) বলা হয়েছে। এভাবে (عُقُوْدٌ) এর অর্থ হয়-(عهود) অর্থাৎ চুক্তি ও অঙ্গীকার। [তাবারী] বস্তুত: দুই পক্ষ যদি ভবিষ্যতে কোন কাজ করা অথবা না করার বাধ্য-বাধকতায় একমত হয়ে যায়, তবে তাকেই আমরা আমাদের পরিভাষায় চুক্তি বলে অভিহিত করে থাকি। অতএব, উপরোক্ত বাক্যের সারমর্ম এই যে, পারস্পরিক চুক্তি পূর্ণ করাকে জরুরী ও অপরিহার্য মনে কর। [আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস]
তবে এ আয়াতে চুক্তি বলে কোন্ ধরনের চুক্তিকে বুঝানো হয়েছে এ ব্যাপারে তফসীরবিদগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের কাছ থেকে ঈমান ও ইবাদত সম্পর্কিত যে সব অঙ্গীকার নিয়েছেন অথবা আল্লাহ তা’আলা বান্দাদের কাছ থেকে স্বীয় নাযিলকৃত বিধি-বিধান হালাল ও হারাম সম্পর্কিত যেসব অঙ্গীকার নিয়েছেন, আয়াতে সেগুলোকেই বুঝানো হয়েছে। তাফসীরকার যায়দ ইবনে আসলাম বলেনঃ এখানে ঐসব চুক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যা মানুষ পরস্পরে একে অন্যের সাথে সম্পাদন করে। যেমন, বিবাহ-শাদী ও ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি ইত্যাদি। মুজাহিদ, রবী, কাতাদা প্রমুখ বলেনঃ এখানে ঐসব শপথ ও অঙ্গীকারকে বুঝানো হয়েছে যা জাহেলিয়াত যুগে একজন অন্যজনের কাছ থেকে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার ক্ষেত্রে সম্পাদন করতো। [বাগভী]
প্রকৃতপক্ষে এ সব উক্তির মধ্যে কোন বিরোধিতা নাই। কারণ, উপরোক্ত সব চুক্তি ও অঙ্গীকারই (عُقُوْدٌ) শব্দের অন্তর্ভুক্ত এবং কুরআন সবগুলোই পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইমাম আবুল লাইস আস-সামরিকান্দী বলেনঃ চুক্তির যত প্রকার রয়েছে, সবই এ শব্দের অন্তর্ভুক্ত। তিনি আরো বলেনঃ এর প্রাথমিক প্রকার তিনটি। (এক) পালনকর্তার সাথে মানুষের অঙ্গীকার। উদাহরণতঃ ঈমান ও ইবাদতের অঙ্গীকার অথবা হারাম ও হালাল মেনে চলার অঙ্গীকার। (দুই) নিজের সাথে মানুষের অঙ্গীকার। যেমন, নিজ যিম্মায় কোন বস্তুর মান্নত মানা অথবা শপথ করে কোন কাজ নিজের উপর জরুরী করে নেওয়া। (তিন) মানুষের সাথে মানুষের সম্পাদিত চুক্তি। এছাড়া সে সব চুক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত, যা দুই ব্যক্তি, দুই দল বা দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত হয়। বিভিন্ন সরকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি অথবা পারস্পরিক সমঝোতা, বিভিন্ন দলের পারস্পরিক অঙ্গীকার এবং দুই ব্যক্তির মধ্যকার সর্বপ্রকার লেন-দেন,বিবাহ, ব্যবসা, শেয়ার, ইজারা ইত্যাদিতে পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যে সব বৈধ শর্ত স্থির করা হয়, আলোচ্য আয়াতদৃষ্টে তা মেনে চলা প্রত্যেক পক্ষের অবশ্য কর্তব্য। তবে শরী’আত বিরোধী শর্ত আরোপ করা এবং তা গ্রহণ করা কারও জন্যে বৈধ নয়। [তাফসীর আবুল লাইস আস-সামারকান্দী]
[৪] ‘যা বর্ণিত হচ্ছে’ বলে যা বোঝানো হয়েছে, তা এখানে বর্ণিত হয় নি। পরবর্তী ৩ নং আয়াতে সেটার বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। [আদওয়াউল বায়ান]
[৫] আয়াতে বর্ণিত (انعام) শব্দটি (نعم) -এর বহুবচন। এর অর্থ পালিত পশু। যেমন- উট, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি। সূরা আল-আন’আমে এদের আটটি প্রকার বর্ণনা করা হয়েছে। এদের সবাইকে (نعم) বলা হয়। এখন আয়াতের অর্থ দাঁড়িয়েছে এই যে, গৃহপালিত পশু আট প্রকার তোমাদের জন্যে হালাল করা হয়েছে। পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, (عقود) শব্দ বলে যাবতীয় চুক্তি-অঙ্গীকার বুঝানো হয়েছে। তন্মধ্যে একটি ছিল ঐ অঙ্গীকার, যা আল্লাহ তা’আলা হালাল ও হারাম মেনে চলার ব্যাপারে বান্দার কাছ থেকে নিয়েছেন। আলোচ্য বাক্যে এই বিশেষ অঙ্গীকারটিই বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্যে উট, ছাগল ,গরু, মহিষ ইত্যাদিকে হালাল করে দিয়েছেন। শরীআতের নিয়ম অনুযায়ী তোমরা এগুলোকে যবেহ করে খেতে পার। [কুরতুবী]
[৬] এখানে সব ধরনের জন্তু বুঝানো হয়নি। বরং সুনির্দিষ্ট কিছু জন্তু বোঝানো হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে (بَهِيْمَةٌ) যেসব জীব-জন্তুকে সাধারণভাবে নিবোধ মনে করা হয়, সেগুলোকে (بَهِيْمَةٌ) বলা হয়। কেননা, মানুষ অভ্যাসগতভাবে তাদের ভাষা বুঝে না। ফলে তাদের বক্তব্য (مُبْهَم) তথা অস্পষ্ট থেকে যায়। এখানে ‘বাহীমা’ বলে কোন কোন সাহাবীর মতে, জবাইকৃত প্রাণীর উদরে যে বাচ্ছা পাওয়া যায় সেটাকে বোঝানো হয়েছে। [তাফসীরে কুরতুবী; সাদী, বাগভী; ফাতহুল কাদীর]
[৭] ইহরাম অবস্থায় শিকার করতে নিষেধ করার মাধ্যমে এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, পূর্বে বর্ণিত ‘বাহীমাতুল আন’আম’ বলতে সে সমস্ত প্রাণীকেও বোঝাবে, যেগুলোকে সাধারণত শিকার করা হয়। যেমন, হরিণ, বন্য গরু, খরগোশ ইত্যাদি। কারণ, ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম হওয়ার অর্থ স্বাভাবিক অবস্থায় হালাল হওয়া। [সা’দী]
[৮] আল্লাহ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছেমত যেকোন হুকুম দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। কাতাদা বলেন, তিনি তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে যা ইচ্ছে বিধান প্রদানের অধিকারী। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য যা ইচ্ছা তা বর্ণনা করেন, ফরয নির্ধারিত করেন, সীমা ঠিক করে দেন। আনুগত্যের নির্দেশ দেন ও অবাধ্যতা থেকে নিষেধ করেন। [আত-তাফসীরুস সহীহ] তাঁর সমস্ত বিধান জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যুক্তি, ন্যায়-নীতি ও কল্যাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঈমানদার শুধু এ জন্যই তার আনুগত্য করে না; বরং একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রভু আল্লাহর হুকুম বলেই তাঁর আনুগত্য করে। তাই কোন বস্তুর হালাল ও হারাম হবার জন্য আল্লাহর অনুমোদন ও অননুমোদন ছাড়া আর দ্বিতীয় ভিত্তির আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। তারপরও সেগুলোতে অনেক হেকমত নিহিত থাকে। যেমন তোমাদেরকে তিনি অঙ্গীকার পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছেন, কারণ, এতে রয়েছে তোমাদের স্বার্থ। আর এর বিপরীত হলে, তোমাদের স্বার্থহানী হবে। তোমাদের জন্য কিছু প্রাণী হালাল করেছেন সম্পূর্ণ দয়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। আবার কিছু প্রাণী থেকে নিষেধ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে মুক্ত রাখার জন্য। অনুরূপভাবে তোমাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় শিকার করা নিষেধ করেছেন, তার সম্মান রক্ষার্থে। [সা’দী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] ‘عقود’ এটা ‘عقد’ এর বহুবচন। যার আভিধানিক অর্থ গিরা লাগানো। এ শব্দ কোন বস্তু (দড়ি, সূতা, চুল ইত্যাদি)-তে গিরা বাঁধার অর্থেও ব্যবহার হয়; যেমন অঙ্গীকার ও চুক্তি করার অর্থেও ব্যবহার হয়। এখানে এর অর্থ, আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান যা মানুষের উপর আরোপ করা হয়েছে। অনুরূপ লোকেরা ব্যবহারিক জীবনে নিজেদের মধ্যে যে অঙ্গীকার ও চুক্তি করে, তাকেও বুঝানো হয়েছে। উভয়ই পালন ও পূর্ণ করা আবশ্যিক।
[২] بهيمة চতুষ্পদ জন্তুকে বলা হয়। بهم ـ إبهام ধাতু থেকে এর উৎপত্তি। কেউ কেউ বলেন, এদের বাকশক্তি, জ্ঞান ও বোধশক্তিতে যেহেতু إبهام (রুদ্ধতা) আছে, তার জন্য এদেরকে بهيمة বলা হয়েছে। أَنْعاَمٌ উট, গরু, ছাগল ও ভেঁড়া বা দুম্বাকে বলা হয়। কেননা এদের গতি ও চালচলনে نعومة (নম্রতা) থাকে। بهيمة الأنعام (চতুষ্পদ জন্তু) নর ও মাদী মিলে আট প্রকার; যা সূরা আনআম ৬:১৪৩ নং আয়াতে বিস্তারিত আকারে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া যে সব পশুকে অহ্শী, জংলী, বন্য বা বুনো বলা হয়; যেমন হরিণ, নীল গাই ইত্যাদি, যেগুলো সাধারণতঃ শিকার করা হয়, সেগুলোও বৈধ। কিন্তু ইহরাম অবস্থায় এগুলো ও অন্যান্য পাখী শিকার করা নিষেধ। সুন্নাহতে বর্ণিত নীতি অনুসারে যে পশু শিকারী দাঁতবিশিষ্ট এবং যে পাখী শিকারী নখবিশিষ্ট নয় তা হালাল। যেমন সূরা বাক্বারার ২:১৭৩ নং আয়াতের টীকায় এর বিস্তারিত বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে। শিকারী দাঁতবিশিষ্ট পশু বলতে সেই পশু উদ্দিষ্ট, যে তার শিকারী বা ছেদক দাঁত দ্বারা শিকার ধরে ও ফেড়ে খায়; যেমন বাঘ (সিংহ, চিতা, নেকড়ে), কুকুর প্রভৃতি। আর শিকারী নখবিশিষ্ট পাখী বলতে সেই পাখী উদ্দিষ্ট, যে তার ধারালো নখর দ্বারা শিকার ধরে; যেমন শকুনি, বাজ, ঈগল, চিল, কাক ইত্যাদি।
[৩] এর বিস্তারিত বিবরণ ৫:৩ নং আয়াতে আসছে।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল একটি হাদীসের উল্লেখ করে বলেছেন যে, আসমা বিনতে ইয়াযীদ বর্ণনা করেছেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আযরা নাম্নী উন্ত্রীর লাগাম ধারণ করেছিলাম। তখন হঠাৎ তার উপর সম্পূর্ণ সূরা মায়িদাহ্অবতীর্ণ হয়। এ সূরার ভারে তখন উন্ত্রীর পায়ের উপরিভাগ ভেঙ্গে চুরমার হবার উপক্রম হয়। আসেম আল আইওয়াল বর্ণনা করেন যে, আমর তাঁর চাচার নিকট থেকে তাঁর নিকট একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, তাঁর চাচা একদা রাসূলল্লাহ (সঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলেন। সে সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর সূরা মায়িদাহ অবতীর্ণ হয়। সূরা মায়িদাহর। ভারে তাঁর বাহনের ঘাড় ভেঙ্গে চুরমার হবার উপক্রম হয়। আবার আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলে কারীম (সঃ) যখন তাঁর বাহনের উপর উপবিষ্ট ছিলেন তখন তার উপর সূরা মায়িদাহ্ অবতীর্ণ হয়, এর ফলে বাহনটি তাকে বহন করতে অসমর্থ হয়ে পড়ে। তখন তিনি তাঁর বাহন হতে অবতরণ করেন। এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল একাই বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে একটু অন্যভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ সূরাগুলোর মধ্যে সূরা মায়িদাহ’ ও সূরা আল-ফাতহ সর্বশেষ সূরা। এরপর ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এটা একটা গারীব’ ও ‘হাসান হাদীস। তিনি ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ সর্বশেষ সূরা হলোঃ (আরবী) (১১০:১)
হাকিম তার মুসতাদরিক’ গ্রন্থে তিরমিযীর বর্ণনার ন্যায় আবদুল্লাহ ইবনে ওয়াহাবের সনদের মাধ্যমে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এরপর তিনি হাদীসটি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, এটা ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) কর্তৃক আরোপিত শর্তানুযায়ী একটি সহীহ হাদীস। কিন্তু ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) কেউই এ হাদীসটিকে তাদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেননি। হাকিম আরও বর্ণনা করেন যে, যুবাইর ইবনে নুফাইর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, আমি একদা হজ্বে গমন করি। এরপর আমি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে দেখা করি। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে যুবাইর (রাঃ)! তুমি কি সূরা মায়িদাহ্ পড়?’ আমি উত্তরে বললামঃ হ্যা। তখন তিনি বললেনঃ “এটাই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ শেষ সূরা। সুতরাং তোমরা তার মাধ্যমে যেসব বিষয় বৈধ হিসেবে পাও সেগুলোকে বৈধ হিসেবে গ্রহণ কর। আর যেগুলোকে অবৈধ হিসেবে পাও সেগুলোকে অবৈধ হিসেবে গ্রহণ কর।” অতঃপর হাকিম এ হাদীসটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, এটা ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) কর্তৃক আরোপিত শর্তানুযায়ী একটি সহীহ হাদীস। কিন্তু হাদীসটিকে তারা তাদের গ্রন্থে স্থান দেননি।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল আবদুর রহমান ইবনে মাহদীর সনদের মাধ্যমে মুআবিয়া ইবনে সালেহ হতে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং কিছু বেশী অংশ যোগ করেন। এ বেশী অংশটুকু নিম্নরূপঃ
যুবাইর ইবনে নুফাইর (রাঃ) বলেনঃ “আমি একদা হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তখন তিনি বলেন যে, পবিত্র কুরআনই তাঁর চরিত্র।” ইমাম নাসাঈও (রঃ) এ হাদীসটিকে আবদুর রহমান ইবনে মাহ্দীর সনদের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন।
১-২ নং আয়াতের তাফসীর:
মা’আন অথবা আউফ হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট আগমন করেন এবং তাঁকে কিছু উপদেশ দিতে অনুরোধ করেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “যখন তুমি (আরবী) কথাটি শ্রবণ কর তখন তার জন্যে তোমার কানকে সতর্ক করে দিও। কারণ, হয়তো তা দ্বারা আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে কোন ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করছেন। আবার যুহরী হতে বর্ণিত আছে যে, যখন আল্লাহ (আরবী) বলে কোন কাজের নির্দেশ দেন তখন তোমরা ঐ কাজ কর। কারণ, উক্ত সম্বোধনের মধ্যে যারা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে আল্লাহর নবীও (সঃ) আছেন। আবার খাইসুমা হতে বর্ণিত আছে যে, পবিত্র কুরআনে যে অবস্থায় (আরবী) বলে সম্বোধন করা হয়েছে সেই অবস্থায় পবিত্র তাওরাত গ্রন্থে (আরবী) বলে সম্বোধন করা হয়েছে। যায়েদ ইবনে ইসমাঈল তাঁর সনদের মাধ্যমে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির মূল রাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত (আরবী) দ্বারা যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে, হযরত আলী (রাঃ) তাঁদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ও সম্মানিত। কারণ, পবিত্র কুরআনে একমাত্র হযরত আলী (রাঃ) ছাড়া অন্যান্য সকল সাহাবীকে ভৎসনা করা হয়েছে। হযরত আলী (রাঃ)-কে কুরআনের কোথাও ভর্সনা করা হয়নি।” তাফসীরকারক ইবনে কাসীর মন্তব্য করেন যে, হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এ হাদীসটি গারীব’। এ হাদীসের মধ্যে কতগুলো অশোভনীয় শব্দ রয়েছে এবং এর সনদ সম্পর্কেও মন্তব্য করার অবকাশ আছে। এ হাদীসের একজন রাবী ঈসা ইবনে রাশেদ সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রঃ) মন্তব্য করেছেন যে, তিনি একজন অপরিচিত ব্যক্তি এবং হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী তাঁর হাদীস মুনকার’। ইবনে কাসীর (রঃ) উক্ত হাদীসের একজন রাবী আলী ইবনে বুজাইমা সম্পর্কে বলেন যে, যদিও তিনি একজন বিশ্বস্ত রাবী, কিন্তু তিনি শিয়া মতাবলম্বী। তার থেকে বর্ণিত এ ধরনের হাদীসের মধ্যে সন্দেহের অবকাশ থাকায় এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ হাদীসে উল্লেখ আছে যে, পবিত্র কুরআনে আলী (রাঃ) ছাড়া আর সকল সাহাবীকে ভৎসনা করা হয়েছে। অবশ্য এর দ্বারা পবিত্র কুরআনের ঐ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে আয়াতে সাহাবীদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে আলাপ করার পূর্বে সাদকা’ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। একাধিক ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন যে, একমাত্র আলী (রাঃ) ছাড়া আর কেউই এ আয়াত অনুযায়ী কাজ করেননি। আর এ সাদকা দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ পাক পরবর্তীতে এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন“তোমরা কি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে আলোচনা করার পূর্বে সাদকা দিতে ভয় পাও? যখন তোমরা তা করনি তখন আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।”
এ আয়াতের দ্বারা যে ভৎর্সনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে সে সম্পর্কেও মন্তব্যের অবকাশ আছে। কেননা, কেউ কেউ বলেছেন যে, সাদকা দেয়ার নির্দেশটি মুস্তাহাব ছিল, ওয়াজিব ছিল না। আর তাছাড়া কার্যকরী করার পূর্বেই ততা আয়াতের নির্দেশকে তাদের জন্যে মওকুফ করা হয়েছে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, সাহাবীদের কারও নিকট থেকেই এ আয়াতের নির্দেশের বিপরীত কোন কাজ প্রকাশ পায়নি। আর এ ছাড়া পবিত্র কুরআনে হযরত আলী (রাঃ)-কে কখনই ভৎসনা করা হয়নি বলে রাবী যে মন্তব্য করেছেন সে সম্পর্কেও মন্তব্যের অবকাশ আছে। কেননা, যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিয়ে মুক্তিপণ গ্রহণের ব্যাপারে সূরা আনফালে যে আয়াতটি আছে তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, যারা মুক্তিপণ গ্রহণের ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন তাদের সকলের ক্ষেত্রেই এ আয়াতটি প্রযোজ্য। হযরত উমার (রাঃ) ছাড়া আর কেউই এ তিরস্কার হতে মুক্ত নন। অতএব, পূর্বাপর ঘটনা হতে বুঝা যায় যে, উক্ত হাদীসটি দুর্বল। তবে আল্লাহ পাকই ভাল জানেন।
মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমর ইবনে হাকামকে যখন নাজরানে পাঠিয়েছিলেন তখন তিনি তাঁকে যে চিঠিটি দিয়েছিলেন সেই চিঠিটি আমি পড়েছি। উক্ত চিঠিটি পরবর্তীকালে আবু বকর ইবনে হাযমের নিকট ছিল। চিঠির প্রথমাংশ নিম্নরূপঃ
এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর নিকট হতে বর্ণনা-হে ঈমানদারগণ! তোমরা ওয়াদাগুলো পূরণ কর।’ এরপর তিনি সূরা মায়িদাহ’র (আরবী) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর’ (৫৪ ৪) পর্যন্ত লিখেন। আবদুল্লাহ তার পিতা আবু বকর থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সেই চিঠি যা তিনি আমর ইবনে হাযমকে দিয়েছিলেন। যখন তিনি তাঁকে ইয়ামান বাসীদেরকে জ্ঞান দান, তার শিক্ষাদান এবং সাদকা আদায়ের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। তখন তিনি এ চিঠিটি লিখে দিয়েছিলেন। উক্ত চিঠিতে তিনি তাঁকে কতগুলো উপদেশ এবং তাঁর কার্যাবলী সম্বন্ধে কতগুলো নির্দেশ দিয়েছিলেন। চিঠির শুরুতে তিনি লিখেনঃ দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর পক্ষ হতে চিঠি।’ অতঃপর তিনি সূরা মায়িদাহ্র নিম্নের আয়াত দ্বারা শুরু করেনঃ
“হে মুমিনগণ! তোমরা প্রতিজ্ঞাগুলো পূরণ কর। যখন তিনি আমর ইবনে • হাযমকে ইয়ামানে পাঠান তখন তিনি তাকে একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করেন। উক্ত অঙ্গীকারনামায় তিনি তাঁকে তাঁর প্রতিটি কাজে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দেন। কারণ আল্লাহ পরহেযগার ও সৎকর্মশীলদের সাথে থাকেন।
(আরবী) তাফসীরকারক এ অংশের ব্যাখ্যায় বলেন যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ), মুজাহিদ (রাঃ) এবং আরও অনেকে বলেছেন – শব্দের দ্বারা অঙ্গীকারকে বুঝানো হয়েছে। ইবনে জাবির (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে -এর অর্থের ব্যাপারে তাফসীরকারকগণ একমত। তিনি বলেন যে, কোন কিছুর ব্যাপারে পরস্পরের শপথ বা অঙ্গীকারকে (আরবী) বলা হয়ে থাকে। আলী ইবনে আবু তালহা (রঃ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন যে, (আরবী)-এর দ্বারা (আরবী) বা অঙ্গীকারকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ পাক যেসব বিষয় বৈধ ও অবৈধ ঘোষণা করেছেন, যেসব বিষয় অবশ্যকরণীয় করেছেন এবং যেসব বিষয় সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে। (আরবী) বলে সাবধান করেছেন, (আরবী) দ্বারা সেসব বিষয়কে বুঝানো হয়েছে। এরপর আল্লাহ এ সম্পর্কে আরও কঠোর ভাষায় বলেনঃ “আল্লাহর সাথে ওয়াদা করার পর যারা উক্ত ওয়াদা ভঙ্গ করে এবং তিনি যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে বলেছেন তা ছিন্ন করে……….তাদের জন্যে জঘন্য আবাসস্থল রয়েছে। আবার যহহাক (রঃ) (আরবী)-এর ব্যাখ্যায় বলেন যে, আল্লাহ পাক যেসব বিষয় বৈধ ও অবৈধ করেছেন এবং তাঁর কিতাব ও নবী (সঃ)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারীদের নিকট হতে তিনি বৈধ ও অবৈধ সংক্রান্ত বিভিন্ন আবশ্যকীয় যে কাজগুলো করার ওয়াদা নিয়েছেন (আরবী) দ্বারা সেগুলোকে বুঝায়। যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ)-এর ব্যাখ্যায় বলেন যে, (আরবী) দ্বারা ছয়টি বস্তুকে বুঝানো হয়েছে। (ক) আল্লাহর সাথে ওয়াদা, (খ) শপথ করা, চুক্তি করা, (গ) অংশীদারী সংক্রান্ত ওয়াদা, (ঘ) ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত ওয়াদা, (ঙ) বিবাহ বন্ধন এবং (চ) কসম খাওয়া। মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব (রঃ) বলেন যে, (আরবী) বলতে পাঁচটি বস্তুকে বুঝানো হয়েছে। ওগুলোর একটি হচ্ছে অজ্ঞতার যুগে কৃত চুক্তিনামা। আর অন্যটি হচ্ছে অংশীদারী সংক্রান্ত চুক্তি। ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর উক্ত স্থানে অবস্থানকালেও উক্ত বস্তু গ্রহণ করা বা না করার কোন ইখতিয়ার ক্রেতা বা বিক্রেতার থাকে না। এ মতে যারা বিশ্বাসী তারা (আরবী) দ্বারা তাঁদের পক্ষে দলীল গ্রহণ করেছেন। তাঁরা বলেন যে, এ আয়াতটি উক্ত স্থানে থাকা অবস্থায়ও চুক্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত ও অবশ্যপালনীয় করার প্রতি ইঙ্গিত করে এবং উক্ত স্থানে থাকা অবস্থায়ও বস্তু গ্রহণ করা না করার ইখতিয়ারকে অস্বীকার করে। এটাই ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ও ইমাম মালিক (রঃ)-এর মত। কিন্তু ইমাম শাফিঈ (রঃ), ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এবং অধিকাংশ আলেম এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁরা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে গৃহীত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-এর একটি হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। হাদীসটি নিম্নরূপঃ
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “বিক্রয়স্থল ত্যাগ করার পূর্বপর্যন্ত ক্রেতা ও বিক্রেতার বস্তু গ্রহণ করা বা না করার ইখতিয়ার আছে।” সহীহ বুখারীতে অন্যভাবেও হাদীসটি এসেছে। তা নিম্নরূপঃ
“যখন দু’জন লোক ক্রয়-বিক্রয় করে তখন বিক্রয়স্থল ত্যাগ করার পূর্বপর্যন্ত ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের বস্তুটি গ্রহণ করা বা না করার ইখতিয়ার আছে।” তাফসীরকারক ইবনে কাসীর (রঃ) মন্তব্য করেন যে, এ হাদীসটি ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি সম্পাদনের পরেও উক্ত স্থানে থাকা অবস্থায় বস্তুটি গ্রহণ করা বা না করার ইখতিয়ারকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে প্রকাশ্য দলীল। উক্ত ইখতিয়ারের প্রশ্নটি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরে আসে। অতএব এই ইখতিয়ার চুক্তি সম্পাদিত হওয়াকে অস্বীকার করে না, বরং চুক্তিকে আইনগতভাবে কার্যকরী করে। অতএব চুক্তিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থই হচ্ছে অঙ্গীকারকে পূর্ণ করা। (আরবী) -এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারক বলেন যে, চতুষ্পদ জন্তু বলতে এখানে উট, গরু ও বকরীকে বুঝানো হয়েছে। আবুল হাসান, কাতাদা এবং আরও অনেকের এটাই মত। ইবনে জারীর (রঃ) বলেন। যে, আরবদের ভাষা অনুযায়ী চতুষ্পদ জন্তু বলতে এটাই বুঝানো হয়। ইবনে উমার (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং আরও অনেকে এ আয়াত হতে দলীল গ্রহণ করেছেন যে, যবেহকৃত গাভীর পেটে যদি মৃত বাচ্চা পাওয়া যায় তাহলে ঐ মৃত বাচ্চার গোশত খাওয়া মুবাহ। এ প্রসঙ্গে হাদীসের সুনান গ্রন্থসমূহে বহু হাদীস এসেছে। যেমন আবু দাউদ (রঃ), তিরমিযী (রঃ) এবং ইবনে মাজাহ (রঃ) আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা উট, গাভী এবং বকরী যবেহ করি। ওগুলোর পেটের মধ্যে কখনও কখনও বাচ্চা পাই। আমরা কি তা ফেলে দেবো, না ভক্ষণ করবো? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তোমরা ইচ্ছে করলে তা খেতে পার। কেননা, তার মাকে যবেহ করাই হচ্ছে তাকেও যবেহ করা।” ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এটি একটি হাসান হাদীস। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মাকে যবেহ করাই হচ্ছে বাচ্চাকেও যবেহ করা।” এ হাদীসটিকে ইমাম আবু দাউদ (রঃ) একাই তাঁর হাদীস গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন।
(আরবী) আলী ইবনে আবি তালহা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন যে, এর দ্বারা মৃত পশু, রক্ত এবং শূকরের মাংসকে বুঝানো হয়েছে। কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা মৃত পশু এবং যে পশুকে যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি তাকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহই এর সঠিক অর্থ সম্পর্কে সমধিক জ্ঞাত। তবে প্রকাশ্যভাবে বুঝা যায় যে, এর দ্বারা (আরবী) (৫:৩)-এ আয়াতের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ “তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে , মৃত পশু, রক্ত, শূকরের মাংস, আল্লাহ ছাড়া অপরের নামে উৎসর্গীকৃত পশু, গলা টিপে মারা পশু, প্রহারে মৃত পশু, শিং-এর আঘাতে মৃত পশু এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তু”। যদিও এগুলো চতুষ্পদ জন্তুর অন্তর্ভুক্ত তবুও উল্লিখিত কারণে সেগুলোকে হারাম করা হয়েছে। এ জন্যে আল্লাহ বলেছেনঃ “তবে তোমরা যেগুলোকে যবেহ দ্বারা পবিত্র করেছ সেগুলো হালাল এবং যেগুলোকে মূর্তিপূজার বেদীর উপর বলি দেয়া হয়েছে সেগুলোও হারাম।” অর্থাৎ উক্ত পশুগুলোকে এজন্যে হারাম করা হয়েছে যে, তাদেরকে আর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না এবং হালাল পশুর সাথে আর যুক্ত করা যাবে না। আর এ কারণেই আল্লাহ পাক বলেছেনঃ “তোমদের জন্যে চতুষ্পদ জন্তুকে হালাল করা হয়েছে। তবে যেগুলো হারাম হওয়া সম্পর্কে তোমাদের উপর কুরআনের আয়াত নাযিল হয়েছে সেগুলো হারাম।” অর্থাৎ এসব পশুর মধ্য হতে বিশেষ অবস্থায় কোন কোন পশুর হারাম হওয়া সংক্রান্ত আয়াত অতিসত্বর তোমাদের উপর অবতীর্ণ হবে।
(আরবী) কোন কোন ব্যাকরণবিদের মতে এ বাক্যটি (আরবী) হওয়ার কারণে হালাতে নাসাবীতে আছে। আনআম বলতে উট, গরু, ছাগল প্রভৃতি গৃহপালিত পশু এবং হরিণ, গাভী, গাধা প্রভৃতি বন্য পশুকে বুঝানো হয়। আর গৃহপালিত হালাল পশুগুলোর মধ্যে উক্ত পশুগুলোকে এবং বন্য হালাল পশুগুলোর মধ্য হতে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শিকার করা পশুগুলোকে হারাম বলে পৃথক করা হয়েছে। কোন কোন তাফসীরকারক বলেছেন যে, এর অর্থ হচ্ছে-আমরা তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুকে হালাল করেছি। তবে জন্তুগুলো হতে যেগুলোকে হারাম বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেগুলো হালাল নয়। আর এ নির্দেশ ঐ ব্যক্তির জন্যেই প্রযোজ্য যে ইহরাম অবস্থায় শিকার করাকে হারাম বলে গ্রহণ করেছে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেছেনঃ “তবে যে মৃতপ্রায় অথচ অন্যায়কারী ও সীমালংঘনকারী নয়, তার জন্যে অবৈধ জানোয়ার খাওয়া হালাল। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু”। অর্থাৎ উক্ত আয়াতের ন্যায় এখানেও আল্লাহ বলেনঃ আমরা যেভাবে সর্বাবস্থায় চতুষ্পদ জন্তুকে হালাল করেছি, ঠিক সেভাবে ইহরাম অবস্থায় শিকার করাকে হারাম মনে কর। কারণ আল্লাহ পাকই এ নির্দেশ দিয়েছেন। আর তিনি যা করা বা না করার নির্দেশ দেন সেগুলোর সবকিছুই হিকমতে পরিপূর্ণ। এজন্যেই তিনি বলেছেন যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর ইচ্ছামত হুকুম করেন।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Al Mayadah
Verse:- 1
Allah says;
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ أَوْفُواْ بِالْعُقُودِ
O you who believe! Fulfill (your) obligations.
Ibn Abi Hatim recorded that;
a man came to Abdullah bin Mas`ud and said to him, “Advise me.”
He said, “When you hear Allah’s statement,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ
(O you who believe!) then pay full attention, for it is a righteous matter that He is ordaining or an evil thing that He is forbidding.”
Khaythamah said,
“Everything in the Qur’an that reads,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ
(O you who believe), reads in the Tawrah, `O you who are in need.”‘
Allah said,
أَوْفُواْ بِالْعُقُودِ
(Fulfill (your) obligations).
Ibn Abbas, Mujahid and others said that;
`obligations’ here means treaties.
Ibn Jarir mentioned that there is a consensus for this view.
Ibn Jarir also said that;
it means treaties, such as the alliances that they used to conduct.
Ali bin Abi Talhah reported that Ibn Abbas commented:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ أَوْفُواْ بِالْعُقُودِ
(O you who believe! Fulfill (your) obligations),
“Refers to the covenants, meaning, what Allah permitted, prohibited, ordained and set limits for in the Qur’an. Therefore, do not commit treachery or break the covenants. Allah emphasized this command when He said,
وَالَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهْدَ اللّهِ مِن بَعْدِ مِيثَاقِهِ
وَيَقْطَعُونَ مَأ أَمَرَ اللّهُ بِهِ أَن يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الَارْضِ
أُوْلَيِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ
And those who break the covenant of Allah, after its ratification, and sever that which Allah has commanded to be joined, and work mischief in the land, on them is the curse, and for them is the unhappy (evil) home (i.e. Hell). (13:25)”
Ad-Dahhak said that,
أَوْفُواْ بِالْعُقُودِ
(Fulfill your obligations),
“Refers to what Allah has permitted and what He has prohibited. Allah has taken the covenant from those who proclaim their faith in the Prophet and the Book to fulfill the obligations that He has ordered for them in the permissible and the impermissible.”
Explaining the Lawful and the Unlawful Beasts
Allah said,
أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الَانْعَامِ
Lawful to you (for food) are all the beasts of cattle,
camels, cows and sheep, as Al-Hasan, Qatadah and several others stated.
Ibn Jarir said that this Tafsir conforms to the meaning of (`beasts of cattle’) that the Arabs had.
We should mention that Ibn Umar, Ibn Abbas and others relied on this Ayah as evidence to allow eating the meat of the fetus if it is found dead in the belly of its slaughtered mother.
There is a Hadith to the same effect collected in the Sunan of Abu Dawud, At-Tirmidhi and Ibn Majah and narrated by Abu Sa`id who said,
“We asked, `O Messenger of Allah! When we slaughter a camel, cow or sheep, we sometimes find a fetus in its belly, should we discard it or eat its meat?’
He said,
كُلُوهُ إِنْ شِيْتُمْ فَإِنَّ ذَكَاتَهُ ذَكَاةُ أُمِّه
Eat it if you want, because its slaughter was fulfilled when its mother was slaughtered.”
At-Tirmidhi said, “This Hadith is Hasan.”
Abu Dawud recorded that Jabir bin Abdullah said that the Messenger of Allah said,
ذَكَاةُ الْجَنِينِ ذَكَاةُ أُمِّه
Proper slaughter of the fetus is fulfilled with the slaughter of its mother.
Only Abu Dawud collected this narration.
Allah’s statement,
إِلاَّ مَا يُتْلَى عَلَيْكُمْ
except that which will be announced to you (herein),
Ali bin Abi Talhah reported that Ibn Abbas said that it refers to,
“The flesh of dead animals, blood and the meat of swine.”
Qatadah said,
“The meat of dead animals and animals slaughtered without Allah’s Name being pronounced at the time of slaughtering.”
It appears, and Allah knows best, that the Ayah refers to Allah’s other statement,
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالْدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ
Forbidden to you (for food) are:
Al-Maytah (the dead animals),
blood,
the flesh of swine, and
what has been slaughtered as a sacrifice for others than Allah, and
that which has been killed by strangling, or by a violent blow, or by a headlong fall, or by the goring of horns – and
that which has been (partly) eaten by a wild animal. (5:3),
for although the animals mentioned in this Ayah are types of permissible cattle (except for swine), they become impermissible under the circumstances that the Ayah (5:3) specifies.
This is why Allah said afterwards,
إِلاَّ مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ
(Unless you are able to slaughter it (before its death), (5:3) and that which is sacrificed (slaughtered) on An-Nusub (stone altars)) as the latter type is not permissible, because it can no longer be slaughtered properly.
Hence, Allah’s statement,
أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الَانْعَامِ إِلاَّ مَا يُتْلَى عَلَيْكُمْ
(Lawful to you are all the beasts of cattle except that which will be announced to you), means,
except the specific circumstances that prohibit some of these which will be announced to you.
Allah said,
غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ
game (also) being unlawful when you assume Ihram.
Some scholars said that;
the general meaning of `cattle’ includes domesticated cattle, such as camels, cows and sheep, and wild cattle, such as gazelle, wild cattle and wild donkeys.
Allah made the exceptions mentioned above (dead animals blood, flesh of swine etc.), and prohibited hunting wild beasts while in the state of Ihram.
It was also reported that the meaning here is,
“We have allowed for you all types of cattle in all circumstances, except what We excluded herewith for the one hunting game while in the state of Ihram.”
Allah said,
فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ
فَإِنَّ اللّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
But if one is forced by necessity, without willful disobedience, and not transgressing, then, Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful. (16:115)
This Ayah means, “We allowed eating the meat of dead animals, when one is forced by necessity, under the condition that one is not transgressing the limits or overstepping them.”
Here, Allah states, “Just as We allowed the meat of cattle in all conditions and circumstances, then do not hunt game when in the state of Ihram, for this is the decision of Allah, Who is the Most Wise in all that He commands and forbids.”
So Allah said;
إِنَّ اللّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ
Verily, Allah commands that which He wills.
The Necessity of Observing the Sanctity of the Sacred Area and the Sacred Months .