أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/١٧٦)-৩৭৮
www.motaher21.net
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الاِسْلَمَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।
This day, I have perfected your religion for you, completed My favor upon you, and have chosen for you Islam as your religion.
সুরা: আল্ মায়িদাহ
আয়াত নং :-৩
5:3
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَآ أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِۦ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَآ أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلٰمِ ۚ ذٰلِكُمْ فِسْقٌ ۗ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ ۚ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِى وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلٰمَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِى مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত ও শূকরের গোশত এবং যা আল্লাহ ভিন্ন কারো নামে যবেহ করা হয়েছে; গলা চিপে মারা জন্তু, প্রহারে মরা জন্তু, উঁচু থেকে পড়ে মরা জন্তু অন্য প্রাণীর শিঙের আঘাতে মরা জন্তু এবং যে জন্তুকে হিংস্র প্রাণী খেয়েছে- তবে যা তোমরা যবেহ করে নিয়েছ তা ছাড়া, আর যা মূর্তি পূঁজার বেদিতে বলি দেয়া হয়েছে এবং জুয়ার তীর দ্বারা বণ্টন করা হয়, এগুলো গুনাহ। যারা কুফরী করেছে, আজ তারা তোমাদের দীনের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, বরং আমাকে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিআমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে। তবে যে তীব্র ক্ষুধায় বাধ্য হবে, কোন পাপের প্রতি ঝুঁকে নয় (তাকে ক্ষমা করা হবে), নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
৩ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
১ নং আয়াতে বলা হয়েছে
(إِلَّا مَا يُتْلٰي عَلَيْكُمْ)
অর্থাৎ তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু হালাল করা হল তবে যা তেলাওয়াত করে শুনানো হবে তা ব্যতীত। সে অংশটুকুর ব্যাখ্যা হল এ আয়াত। অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সেসব প্রাণীর বর্ণনা দিয়েছেন যার কতকগুলো সর্বাবস্থায় সম্পূর্ণ হারাম, আর কতকগুলো জন্তু খাওয়া হালাল কিন্তু কারণবশত তা হারাম।
الْمَیْتَةُ বা মৃত বলতে সেসব জীবিত স্থলচর চতুষ্পদ জন্তুকে বুঝানো হয়েছে যা যবাই করে খাওয়া হালাল, কিন্তু যদি অস্বাভাবিক অবস্থায় যবাই বা শিকার বিহীন অবস্থায় মারা যায় তাহলে তা হারাম।
তবে জলচল মৃত প্রাণী হালাল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সাগরের পানি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: তার পানি পবিত্র ও তার মৃত হালাল।
الدَّمُ বা রক্ত বলতে, পশু জবেহ করার সময় যে রক্ত দ্রুত গতিতে বের হয় তা হারাম। আর গোস্তের সাথে যে রক্ত মিশ্রিত থাকে তা হালাল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আমাদের জন্য দুটি মৃত ও দুটি রক্ত হালাল করে দেয়া হয়েছে। মৃত দুটি হল- মাছ ও টিড্ডি, আর রক্ত হল কলিজা ও প্লীহা। (ইবনু মাযাহ হা: ৩২১৮, সহীহ)
(وَمَآ أُهِلَّ لِغَيْرِ اللّٰهِ بِه۪)
‘আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে জবেহকৃত পশু’ অর্থাৎ যা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের নাম নিয়ে জবেহ করা হয় তা হারাম। আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে যদি কোন দরগাহ, মাজার বা খানকাতে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোন ব্যক্তির সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য জবেহ করা হয় তাও হারাম। এটা
(وَمَا ذُبِحَ عَلَي النُّصُبِ)
বা মূর্তিপূজার বেদীর ওপর বলি দেয়ার শামিল।
সাবেত বিন যহহাক (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি ‘বাওয়ানা’ নামক স্থানে একটি উট জবাই করার নযর করে। এ বিষয়ে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: সেখানে এমন কোন প্রতিমা আছে কি যার ইবাদত করা হয়? তারা বললেন: না। তিনি বললেন: সেখানে কি জাহিলী যুগের কোন অনুষ্ঠান পালন করা হয়? তারা বললেন: না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমার নযর পূর্ণ কর। (আবূ দাঊদ হা: ৩৩১৫, সহীহ) এ হাদীস প্রমাণ করে, যেসব ওরস ও দরগায় গাইরুল্লাহর ইবাদত করা হয় সেখানে কোন নযর-মানত করা হারাম এবং তা খাওয়াও হারাম।
الْمُنْخَنِقَةُ হল, যেকোনভাবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া প্রাণী।
الْمَوْقُوْذَةُ হল, যে প্রাণী আঘাতে মারা যায়। الْمُتَرَدِّیَةُ ওপর থেকে পড়ে মরে যাওয়া প্রাণী। النَّطِيحَةُ অন্য প্রাণীর দ্বারা ক্ষত হয়ে মারা যাওয়া প্রাণী।
وَمَآ اَکَلَ السَّبُعُ
হিংস্র প্রাণী যে জন্তু খেয়েছে। তবে এসব প্রাণী মারা যাবার পূর্বে মুমূর্ষু অবস্থায় যদি আল্লাহ তা‘আলার নামে যবেহ করা যায় তবে হালাল। (তাফসীরে সা‘দী, পৃঃ ২৭)
অনুরূপভাবে যেসব জন্তু খাওয়া হালাল তা যদি কোন হিংস্র প্রাণী আক্রমণ করে, আর সে অবস্থায় মারা যায় তাহলে তা হারাম, তবে যদি মারা যাওয়ার পূর্বে জবেহ করা সম্ভব হয় তাহলে তা খাওয়া বৈধ।
(وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوْا بِالْأَزْلَامِ)
‘জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা হয়’ অর্থাৎ তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা হারাম। এর দু’টি অর্থ: ১. তীরের মাধ্যমে বণ্টন করা। ২. তীরের মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করা।
প্রথম অর্থের ব্যাপারে বলা হয়, জুয়া ইত্যাদিতে জবেহকৃত পশুর মাংস বণ্টনের ক্ষেত্রে উক্ত তীর ব্যবহার করা হত। ফলে কেউ প্রাপ্য অংশের চেয়ে বেশি পেত, আবার কেউ বঞ্চিত হত।
দ্বিতীয় অর্থের ব্যাপারে বলা হয়েছে- কোন কর্মের শুরুতে বিশেষ তীরের মাধ্যমে লোকেরা ভাগ্য পরীক্ষা করত, যদি হ্যাঁ লেখা উঠত তাহলে কাজ করত, আর না লেখা উঠলে কাজ করত না, আর হ্যাঁ বা না কোন লেখা না উঠলে পুনরায় পরীক্ষা করত। আল্লাহ তা‘আলা এসব কাজ হারাম করেছেন। এবং তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করে অর্জিত সম্পদ খাওয়াও হারাম করেছেন। এসব পাপ কাজ শয়তানের আনুগত্যের নামান্তর।
(اَلْيَوْمَ يَئِسَ…..وَاخْشَوْنِ)
‘আজ কাফিররা তোমাদের দীনের বিরুদ্ধাচরণে হতাশ হয়েছে…’ আজ বলতে আরাফা দিবসকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আরাফা দিবসে কাফিররা তোমাদের দীনের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে যে, তারা কোনদিন তোমাদেরকে শির্কের দিকে নিয়ে যেতে পারবে না, তাদের দীনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। অতএব তাদেরকে ভয় না করে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
”إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ أَنْ يَعْبُدَهُ الْمُصَلُّونَ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَلَكِنْ فِي التَّحْرِيشِ بَيْنَهُمْ”.
আরব ভূখণ্ডে মুসল্লীগণ শয়তানের উপাসনা করবে, এ বিষয়ে শয়তান নিরাশ হয়ে পড়েছে। তবে তাদের একজনকে অন্যের বিরুদ্ধে উস্কিয়ে দেয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়নি। (সহীহ মুসলিম হা: ৬৯৯৬)
(اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ)
‘আজ (আরাফা দিবসে) তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম’ এটা হল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ উম্মাতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। আল্লাহ তা‘আলা ইসলাম দিয়ে আদম (আঃ)-সহ অসংখ্য নাবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, সে ইসলামকে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এ উম্মাত অন্য কোন দীন বা নাবীর প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। এ নাবী শেষ নাবী, তাকে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মানব ও জিন জাতির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। অতএব যা ইসলামে হালাল হওয়ার মত তা হালাল করে দেয়া হয়েছে, আর যা হারাম হওয়ার মত তা হারাম করে দেয়া হয়েছে। এরপর হালাল বা হারাম করার কিছুই নেই। আল্লাহ তা‘আলা যা দিয়েছেন সবই সত্য এবং পরিপূর্ণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلًا)
“সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে তোমার প্রতিপালকের বাণী পরিপূর্ণ।”(সূরা আনআম ৬:১১৫)
তাই নতুন করে দীন ইসলামে কোন কিছু প্রবেশ করানোর সুযোগ নেই। ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করল আর তা ভাল মনে করল সে ব্যক্তির বিশ্বাস হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দীন প্রচারে খিয়ানত করেছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
(اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِيْنًا)
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।”যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জীবদ্দশায় পূর্ণ ইসলাম পেয়েছেন এবং প্রচার করেছেন, অতএব নতুন কোন সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই।
তারেক বিন শিহাব বলেন: এক ইয়াহূদী উমার (রাঃ)-এর নিকট আগমন করে বলল: হে আমীরুল মু’মিনীন, আপনাদের কিতাবের এমন একটি আয়াত তেলাওয়াত করেন যদি তা আমাদের ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের ওপর অবতীর্ণ হত তাহলে আমরা সে দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করে নিতাম। তিনি বললেন: তা কোন্ দিন? সে বলল:
(اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ…… )।
উমার (রাঃ) বললেন: আল্লাহর শপথ যেদিন এ আয়াত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং কোন্ সময়ে হয়েছে সে সম্পর্কে আমি অধিক জানি। আরাফায় জুমার দিন বিকালে অবতীর্ণ হয়েছে। (মুসনাদ আহমাদ: ১/২৮, সহীহ) সহীহ বুখারীতে ৪৬০৬ নং হাদীসেও এরূপ বর্ণনা রয়েছে।
(فَمَنِ اضْطُرَّ فِيْ مَخْمَصَةٍ… )
‘তবে কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় (উল্লিখিত নিষিদ্ধ বস্তু খেতে) বাধ্য হলে’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি এসব হারাম খাদ্য খেতে বাধ্য হবে তার জন্য খাওয়া হালাল। তবে যেন আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যাচরণ উদ্দেশ্য না হয় এবং সীমালঙ্ঘন করা না হয়। অর্থাৎ প্রাণ বাঁচানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন শুধু ততটুকু ছাড়া বেশি যেন না খায়।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যেসকল পশু খাওয়া হারাম তা জানতে পারলাম।
২. তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা হারাম এবং এ জাতীয় কাজ করে অর্জিত সম্পদও হারাম।
৩. মাজার, কবর, দরগাহ ও খানকাতে জবেহ করা হারাম এবং তা শির্কে আকবার।
৪. হিংস্র প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত জন্তু জবেহ করা সম্ভব হলে তা খাওয়া হালাল।
৫. ইসলামে নতুন কিছু সংযোজন করা হারাম; কেননা দীন পরিপূর্ণ।
৬. যখন মানুষ খাবারের অভাবে মৃত্যুর আশঙ্কা করবে তখন প্রাণ রক্ষার্থে হারাম বা মৃত জন্তু খাওয়া হালাল।
৭. ইসলামের দু’টি ঈদ-উৎসব (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) ছাড়া বার্ষিক পালনীয় অন্য কোন বাৎসরিক ঈদ-উৎসব নেই।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:৯) অর্থাৎ যে পশুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
টিকা:১০) অর্থাৎ যাকে যবেহ করার সময় আল্লাহর ছাড়া আর কারোর নাম নেয়া হয়। অথবা যাকে যবেহ করার আগে এ মর্মে নিয়ত করা হয় যে, অমুক মহাপুরুষ অথবা অমুক দেবী বা দেবতার নামে উৎসর্গীত।
সূরা বাকারার ১৭১ টীকা :-
এই নিষেধাজ্ঞাটি এমন সব প্রাণীর গোশতের ওপর আরোপিত হয় যাদেরকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নামে যবেহ করা হয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নামে নজরানা হিসেবে যে খাদ্য তৈরী করা হয় তার ওপরও আরোপিত হয়। আসলে প্রাণী, শস্য, ফলমূল বা অন্য যে কোন খাদ্যের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনিই ঐ জিনিসগুলো আমাদের দান করেছেন। কাজেই সেগুলোর ওপর অনুগ্রহের স্বীকৃতি, সাদকাহ বা নজরানা হিসেবে একমাত্র আল্লাহরই নাম নেয়া যেতে পারে। আর কারোর নয়। এগুলোর ওপর আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নাম নেয়ার অর্থ হবে, আল্লাহর পরিবর্তে অথবা আল্লাহর সাথে সাথে তার প্রাধান্যও স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে এবং তাকেও অনুগ্রহকারী ও নিয়ামত দানকারী মনে করা হচ্ছে।
টিকা:১১) অর্থাৎ যে প্রাণীটি উপরোক্ত দুর্ঘটনাগুলোর শিকার হবার পরও মরেনি। বরং তার মধ্যে জীবনের কিছু আলামত পাওয়া যায়। তাকে যবেহ করলে তার গোশ্ত খাওয়া যেতে পারে। এ থেকে এ কথাও জানা যায় যে, হালাল প্রাণীর গোশ্ত একমাত্র যবেহর মাধ্যমে হালাল হয়। একে হালাল করার আর দ্বিতীয় কোন সঠিক পথ নেই। এ ‘যবেহ’ ও ‘যাকাত’ ইসলামের একটি বিশেষ পরিভাষা। এর অর্থ হচ্ছে, গলার এতখানি অংশ কেটে দেয়া যার ফলে শরীরের সমস্ত রক্ত ভালভাবে বের হয়ে যেতে পারে। এক কোপে কেটে বা গলায় ফাঁস দিয়ে অথবা অন্য কোনভাবে প্রাণী হত্যা করলে যে ক্ষতিটা হয় তা হচ্ছে এই যে, এর ফলে রক্তের বেশীর ভাগ অংশ তার শরীরের মধ্যে আটকে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমে গিয়ে তা গোশ্তের সাথে মিশে যায়। অন্য দিকে যবেহ করলে মস্তিকের সাথে শরীরের সম্পর্ক দীর্ঘ সময় বজায় থাকে। এর ফলে প্রতিটি শিরা উপশিরা থেকে রক্ত নিংড়ে বেরিয়ে আসে। এভাবে সারা দেহের গোশ্ত রক্তশূন্য হয়ে যায়। রক্ত হারাম একথা আগেই বলা হয়েছে। কাজেই গোশ্তের পাক ও হালাল হবার জন্য অবশ্যি তার পুরোপুরি রক্তশূন্য হওয়া অপরিহার্য।
টিকা:১২) আসলে ‘নুসুব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে এমন সব স্থান বুঝায় যেগুলোকে লোকেরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর উদ্দেশ্যে বলিদান ও নজরানা পেশ করার জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। সেখানে কোন পাথর বা কাঠের মূর্তি থাক বা না থাক তাতে কিছু আসে যায় না। আমাদের ভাষায় এরই সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে বেদী বা ‘আস্তানা’। কোন মহাপুরুষ, কোন দেবতা বা মুশরিকী আকীদার সাথে এ স্থানটি জড়িত থাকে।
টিকা:১৩) এখানে একথাটি ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, পানাহারযোগ্য দ্রব্যাদির মধ্যে শরীয়াত যেগুলোকে হালাল ও হারাম বলে দিয়েছে সেগুলোর হালাল ও হারাম হবার মূল ভিত্তি তাদের ভেষজ উপকারিতা ও অনুপকারিতা নয়। বরং তাদের নৈতিক লাভ ও ক্ষতিই এর ভিত্তি। প্রাকৃতিক বিষয়গুলোকে আল্লাহ মানুষের নিজের প্রচেষ্টা, সাধনা, অনুসন্ধান ও গবেষণার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। জীব ও জড় পদার্থগুলোর মধ্যে কোনটি মানুষের দেহে সুখাদ্যের যোগান দিতে পারে এবং কোনটি খাদ্য হিসেবে তার জন্য ক্ষতিকর ও অনুপকারীর তা উদ্ভাবন ও নির্ণয় করার দায়িত্ব মানুষের নিজের ওপর বর্তায়। এসব বিষয়ে তাকে পথনির্দেশ দেবার দায়িত্ব শরীয়াত নিজের কাঁধে তুলে নেয়নি। এ দায়িত্ব যদি শরীয়াত নিজের কাঁধে তুলে নিতো তাহলে সর্বপ্রথম ‘বিষ’ হারাম বলে ঘোষণা করতো। কিন্তু আমরা দেখি কুরআন ও হাদীসের কোথাও এর অথবা মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর অন্যান্য মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের আদৌ কোন উল্লেখই নেই। শরীয়াত খাদ্যের ব্যাপারে যে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে তা হচ্ছে এই যে, কোন্ খাদ্যটি মানুষের নৈতিকতার ওপর কি প্রভাব বিস্তার করে, আত্মার পবিত্রতার জন্য কোন্ খাদ্যটি কোন্ পর্যায়ভুক্ত এবং খাদ্য সংগ্রহের পদ্ধতিগুলো মধ্য থেকে কোন্ পদ্ধতিটি বিশ্বাস ও প্রকৃতিগত দিক দিয়ে ভুল বা নির্ভুল? যেহেতু এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাবার সাধ্য মানুষের নেই এবং এ অনুসন্ধান চালাবার জন্য যে উপায় উপকরণের প্রয়োজন তাও মানুষের আয়ত্বের বাইরে, আর এ জন্য এসব ব্যাপারে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল করে বসেছে, তাই শরীয়াত কেবলমাত্র এসব বিষয়েই তাকে পথনির্দেশ দেয়। যেগুলোকে সে হারাম গণ্য করেছে, সেগুলোকে হারাম করার কারণ হচ্ছে এই যে, মানুষের নৈতিক বৃত্তির ওপর সেগুলোর খারাপ প্রভাব পড়ে বা সেগুলো তাহারাত ও পবিত্রতা বিরোধী অথবা কোন খারাপ আকীদার সাথে সেগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। পক্ষান্তরে যে জিনিসগুলোকে শরীয়াত হালাল গণ্য করেছে সেগুলোর হালাল হবার কারণ হচ্ছে এই যে, উপরোল্লিখিত দোষগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি দোষেও সেগুলো দুষ্ট নয়। প্রশ্ন করা যেতে পারে, এ জিনিসগুলোর হারাম হবার কারণ আল্লাহ আমাদের বুঝাননি কেন? কারণ বুঝিয়ে দিলে তো আমরা যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারতাম। এর জবাব হচ্ছে, আমাদের পক্ষে ঐ কারণগুলো অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যেমন রক্ত, শূকরের গোশ্ত বা মৃত জীব খেলে আমাদের নৈতিক বৃত্তিতে কোন্ ধরনের দোষ, কতটুকু এবং কি পরিমাণে দেখা দেয়, সে সম্পর্কে কোন প্রকার অনুসন্ধান চালাবার কোন ক্ষমতাই আমাদের নেই। কারণ নৈতিকতা পরিমাপ করার কোন উপকরণ আমাদের আয়ত্বাধীন নয়। ধরুন যদি এদের খারাপ প্রভাব বর্ণনা করে দেয়াও হতো, তাহলেও সংশয় পোষণকারীরা প্রায় সে একই জায়গায় থাকতেন যেখানে বর্তমানে অবস্থান করছেন। কারণ এ বর্ণনা ভুল না নির্ভুল, তা সে পরিমাপ করবে কিসের সাহায্যে? তাই মহান আল্লাহ হালাল ও হারামের সীমানা মেনে চলাকে ঈমানের ওপর নির্ভরশীল করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি মেনে নেবে যে, কুরআন আল্লাহরই কিতাব, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লারই রসূল এবং আল্লাহকে সর্বজ্ঞ ও সবচেয়ে জ্ঞানী ও কুশলী বলে স্বীকার করবে সে তার নির্ধারিত সীমানা অবশ্যই মেনে চলবে। এর কারণ বোধগম্য হোক বা না হোক তার পরোয়া সে করবে না। আর যে ব্যক্তি এ মৌলিক আকীদাটির ব্যাপারেই নিসংশয় নয় তার জন্য যেসব জিনিসের ক্ষতিকর বিষয় মানুষের জ্ঞানে ধরা পড়েছে কেবল মাত্র সেগুলো থেকে দূরে থাকা এবং যেগুলোর ক্ষতিকর বিষয় মানুষের জ্ঞানে ধরা পড়তে পারেনি সেগুলোর ক্ষতি দুর্ভোগ পোহাতে থাকা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন পথ নেই।
টিকা:১৪) এ আয়াতে যে জিনিসটি হারাম করা হয়েছে দুনিয়ায় তার তিনটি সংস্করণ প্রচলিত আছে। আয়াতে ঐ তিনটিকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
একঃ মুশরিকদের মতো করে ‘ফাল’ গ্রহণ করা। এতে কোন বিষয়ে দেব-দেবীর কাছে ভাগ্যের ফয়সালা জানার জন্য জিজ্ঞেস করা হয় অথবা গায়েবের-অজানার ও অদৃশ্যের খবর জিজ্ঞেস করা হয় বা পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসা করে নেয়া হয়। মক্কার মুশরিকরা কাবা ঘরে রক্ষিত ‘হুবল’ দেবতার মূর্তিকে এ কাজের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিল। তার দেবীমূলে সাতটি তীর রাখা হয়েছিল। সেগুলোর গায়ে বিভিন্ন শব্দ ও বাক্য খোদাই করা ছিল। কোন কাজ করার বা না করার প্রশ্নে দোদুল্যমানতা দেখা দিলে, হারানো জিনিসের সন্ধান লাভ করতে চাইলে বা হত্যা মামলার ফয়সালা জানতে চাইলে, মোট কথা যেকোনো কাজের জন্যই হুবল-এর তীর রক্ষকের কাছে যেতে হতো, সেখানে নজরানা পেশ করতে হতো এবং হুবল-এর কাছে এ মর্মে প্রার্থনা করা হতো, “আমাদের এ ব্যাপারটির ফয়সালা করে দিন।” এরপর তীর রক্ষক তার কাছে রক্ষিত তীরগুলোর সাহায্যে ‘ফাল’ বের করতো। এতে যে তীরটিই বের হয়ে আসতো, তার গায়ে লিখিত শব্দকেই হুবল-এর ফয়সালা মনে করা হতো।
দুইঃ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ফাল গ্রহণ। এক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা ও জ্ঞান-বুদ্ধির সাহায্যে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের মীমাংসার পরিবর্তে কোন প্রকার কুসংস্কার ও অমূলক ধারণা-কল্পনা বা কোন আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে কোন বিষয়ের মীমাংসা করা হয়। অথবা এমন সব উপায়ে ভাগ্যের অবস্থা জানবার চেষ্টা করা হয়, যেগুলো গায়েব জানার উপায় হিসেবে কোন তাত্বিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত নয়। হস্তরেখা গণনা, নক্ষত্র গণনা, রমল করা, বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার এবং নানা ধরনের ফাল বের করা এর অন্তর্ভুক্ত।
তিনঃ জুয়া ধরনের যাবতীয় খেলা ও কাজ। যেখানে অধিকার, কর্মমূলক অবদান ও বুদ্ধিবৃত্তিক ফায়সালার মাধ্যমে বস্তু বন্টনের পদ্ধতি গ্রহণ না করে নিছক কোন ঘটনা-ক্রমিক কার্যক্রমের ভিত্তিতে বস্তু বণ্টন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যেমন, লটারীতে ঘটনাক্রমে অমুক ব্যক্তির নাম উঠেছে, কাজেই হাজার হাজার ব্যক্তির পকেট থেকে বের হয়ে আসা টাকা তার একার পকেটে চলে যাবে। অথবা তাত্বিক দিক দিয়ে কোন একটি ধাঁধাঁর একাধিক উত্তর হতে পারে কিন্তু পুরস্কারটি পাবে একমাত্র সেই ব্যক্তি যার উত্তর কোন যুক্তিসঙ্গত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নয় বরং নিছক ঘটনাক্রমে ধাঁধাঁ প্রতিযোগিতা পরিচালকের সিন্ধুকে রক্ষিত উত্তরটির সাথে মিলে যাবে।
এ তিন ধরনের ফাল গ্রহণ ও অনুমানভিত্তিক লটারী করাকে হারাম ঘোষণা করার পর ইসলাম ‘কুরআ’ নিক্ষেপ বা লটারী করার একমাত্র সহজ-সরল পদ্ধতিটিকেই বৈধ গণ্য করেছে। এ পদ্ধতিতে দু’টি সমান বৈধ কাজের বা দু’টি সমপর্যায়ের অধিকারের মধ্যে ফয়সালা করার প্রশ্ন দেখা দেয়। যেমন, একটি জিনিসের ওপর দু’ব্যক্তির অধিকার সবদিক দিয়ে একদম সমান এবং ফায়সালাকারীর জন্য দু’জনের কাউকে অগ্রাধিকার দেবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই আর তাদের দু’জনের মধ্য থেকে কোন একজন নিজের অধিকার প্রত্যাহার করতেও প্রস্তুত নয়। এ অবস্থায় তাদের সম্মতিক্রমে লটারীর মাধ্যমে ফয়সালা করা যেতে পারে অথবা দু’টি একই ধরনের সঠিক ও জায়েয কাজ। যুক্তির মাধ্যমে তাদের কোন একটিকে অগ্রাধিকার দেবার ব্যাপারে এক ব্যক্তি দোটানায় পেড়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন হলে লটারী করা যেতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে যখন দু’জন সমান হকদারের মধ্যে একজনকে প্রাধান্য দেবার প্রশ্ন দেখা দিতো এবং তাঁর আশংকা হতো যে, তিনি একজনকে প্রাধান্য দিলে তা অন্যজনের মনোকষ্টের কারণ হবে তখন তিনি সাধারণত এ পদ্ধতিটি অবলম্বন করতেন।
টিকা:১৫) ‘আজ’ বলতে কোন বিশেষ দিন, ক্ষণ বা তারিখ বুঝানো হয়নি বরং যে যুগে ও সময়ে এ আয়াত নাযিল হয় সেই সময়কালকে বুঝানো হয়েছে। আমাদের ভাষায়ও ‘আজ’ শব্দটি একইভাবে সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
“তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কাফেররা পুরোপুরি নিরাশ হয়ে পড়েছে।”-অর্থাৎ তোমাদের দ্বীন এখন একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে এবং সে তার নিজস্ব শাসন ও কর্তৃত্ব ক্ষমতার জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কাফেররা এতদিন তার পথে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল। কিন্তু এখন তারা এ দ্বীনকে ধ্বংস করার এবং তোমাদেরকে আবার জাহেলিয়াতের অন্ধকার গর্ভে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েছে। “কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো।” অর্থাৎ এ দ্বীনের বিধান এবং এর হেদায়াত কার্যকর করার ব্যাপারে এখন তোমাদের আর কোন কাফের শক্তির প্রভাব, পরাক্রম, প্রতিবন্ধকতা, প্রাধান্য ও হস্তক্ষেপের সম্মুখীন হতে হবে না। এখন আর মানুষকে ভয় করার কোন কারণ নেই। তোমাদের এখন আল্লাহকে ভয় করা উচিত। আল্লাহর বিধান কার্যকর করার ব্যাপারে এখন যদি তোমরা কোন ত্রুটি করো তাহলে এ জন্য তোমাদের কাছে এমন কোন ওজর থাকবে না যার ভিত্তিতে তোমাদের সাথে কোমল ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন আর শরীয়াতের বিরুদ্ধাচরণের অর্থ এ হবে না যে, এ ব্যাপারে তোমরা অন্যদের প্রভাবে বাধ্য হয়ে এমনটি করেছো। বরং এর পরিষ্কার অর্থ হবে, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করতে চাও না।
টিকা:১৬) দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেবার অর্থই হচ্ছে তাকে একটি স্বতন্ত্র চিন্তা ও কর্ম ব্যবস্থা এবং একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়েছে। তার মধ্যে জীবনের সমস্ত প্রশ্নের নীতিগত বা বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায়। হেদায়াত ও পথনির্দেশ লাভ করার জন্য এখন আর কোন অবস্থায়ই তার বাইরে যাবার প্রয়োজন নেই। নিয়ামত সম্পূর্ণ করে দেবার অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমরা আমার আনুগত্য ও বন্দেগী করার যে অঙ্গীকার করেছিল তাকে যেহেতু তোমরা নিজেদের প্রচেষ্টা ও কর্মের মাধ্যমে সত্য ও আন্তরিক অঙ্গীকার হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছো, তাই আমি তাকে গ্রহণ করে নিয়েছি এবং তোমাদেরকে কার্যত এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছি যে, এখন তোমাদের গলায় প্রকৃতপক্ষে আমার ছাড়া আর কারোর আনুগত্য ও বন্দেগীর শৃংখল নেই। এখন আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যেমন তোমরা আমার মুসলিম (আনুগত্যকারী) ঠিক তেমনি কর্মজীবনেও আমার ছাড়া আর কারোর মুসলিম (আনুগত্যকারী) হয়ে থাকতে তোমরা কোনত্রুমেই বাধ্য নও। এ অনুগ্রহগুলোর কথা উচ্চারণ করার পর মহান আল্লাহ নীরবতা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু এ বাক পদ্ধতি থেকে একথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে ওঠে, যেন এখানে আল্লাহ বলতে চাচ্ছেন, আমি যখন তোমাদের ওপর এ অনুগ্রহগুলো করেছি তখন এর দাবী হচ্ছে, এখন আমার আইনের সীমার মধ্যে অবস্থান করার ব্যাপারে তোমাদের পক্ষ থেকে যেন আর কোন ত্রুটি দেখা না দেয়।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, এ আয়াতটি বিদায় হজ্জের সময় ১০ হিজরীতে নাযিল হয়েছিল। কিন্তু যে বক্তব্যের ধারাবাহিকতার সাথে এর সম্পর্ক তা ৬ হিজরীতে হোদাইবিয়া চুক্তির সমসাময়িক কালের। বর্ণনা রীতির কারণে বাক্য দু’টি পরস্পর এমনভাবে মিশে গেছে যার ফলে কোন ক্রমেই ধারণা করা যাবে না যে, শুরুতে এ বাক্যগুলো ছাড়াই এ ধারবাহিক বক্তব্যটি নাযিল হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এ বাক্যগুলো নাযিল হবার পর তা এখানে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য প্রকৃত ব্যাপার একমাত্র আল্লাহই জানেন, তবে আমার অনুমান, প্রথম এ আয়াতটি এ একই প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছিল। তাই লোকেরা তখন এর আসল গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। পরে যখন সমগ্র আরব ভূখণ্ড বিজিত হল এবং ইসলাম শক্তি অর্জন করে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেলো তখন মহান আল্লাহ পুনর্বার এ বাক্য তাঁর নবীর প্রতি নাযিল করেন এবং এটি ঘোষণা করে দেবার নির্দেশ জারি করেন।
টিকা:১৭) সূরা বাকারার ১৭২ টীকা :- এই আয়াতে তিনটি শর্ত সাপেক্ষে হারাম জিনিস ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এক যথার্থ অক্ষমতার মুখোমুখি হলে, যেমন ক্ষুধা বা পিপাসা প্রাণ সংহারক প্রমাণিত হতে থাকলে, অথবা রোগের কারণে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকলে এবং এ অবস্থায় হারাম জিনিস ছাড়া আর কিছু না পাওয়া গেলে। দুই, মনের মধ্যে আল্লাহর আইন ভঙ্গ করার ইচ্ছা পোষণ না করলে। তিন, প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম না করলে যেমন কোন হারাম পানীয়ের কয়েক ফোঁটা বা কয়েক ঢোক পান করলে অথবা হারাম খাদ্যের কয়েক মুঠো খেলে যদি প্রাণ বাঁচে তাহলে বেশী ব্যবহার না করা।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Al Mayadah
Verse:- 3
This day, I have perfected your religion for you, completed My favor upon you, and have chosen for you Islam as your religion.
Tafsir Ibn Kathir:-
The Animals that are Unlawful to Eat
Allah says;
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ
Forbidden to you (for food) are:Al-Maytah (the dead animals), blood,
Allah informs His servants that He forbids consuming the mentioned types of foods, such as the Maytah, which is the animal that dies before being properly slaughtered or hunted. Allah forbids this type of food due to the harm it causes, because of the blood that becomes clogged in the veins of the dead animal. Therefore, the Maytah is harmful, religiously and physically, and this is why Allah has prohibited it.
The only exception to this ruling is fish, for fish is allowed, even when dead, by slaughtering or otherwise.
Malik in his Muwatta, also Abu Dawud, At-Tirmidhi, An-Nasa’i and Ibn Majah in their Sunan, Ibn Khuzaymah and Ibn Hibban in their Sahihs, all recorded that Abu Hurayrah said that the Messenger of Allah was asked about seawater.
He said,
هُوَ الطَّهُورُ مَاوُهُ الْحِلُّ مَيْتَتُه
Its water is pure and its dead are permissible.
The same ruling applies to locusts, as proven in a Hadith that we will mention later.
Allah’s statement,
وَالْدَّمُ
blood…,
This refers to flowing blood, according to Ibn Abbas and Sa`id bin Jubayr, and it is similar to Allah’s other statement,
دَمًا مَّسْفُوحًا
(Blood poured forth…). (6:145)
Ibn Abi Hatim recorded that Ibn Abbas was asked about the spleen and he said,
“Eat it.”
They said, “It is blood.”
He said, “You are only prohibited blood that was poured forth.”
Abu Abdullah, Muhammad bin Idris Ash-Shafii recorded that Ibn Umar said that the Messenger of Allah said,
أُحِلَّ لَنَا مَيْتَتَانِ وَدَمَانِ
فَأَمَّا الْمَيْتَتَانِ فَالسَّمَكُ وَالْجَرَادُ
وَأَمَّا الدَّمَانِ فَالْكَبِدُ وَالِّطَحال
We were allowed two dead animals and two (kinds of) blood.
As for the two dead animals, they are fish and locust.
As for the two bloods, they are liver and spleen.
Imam Ahmad bin Hanbal, Ibn Majah, Ad-Daraqutni and Al-Bayhaqi also recorded this Hadith through Abdur-Rahman bin Zayd bin Aslam, who is a weak narrator.
Allah’s statement,
وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ
the flesh of swine…
includes domesticated and wild swine, and also refers to the whole animal, including its fat, for this is what the Arabs mean by Lahm or `flesh’.
Muslim recorded that Buraydah bin Al-Husayb Al-Aslami said that the Messenger of Allah said,
مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدَشِيرِ فَكَأَنَّمَا صَبَغَ يَدَهُ فِي لَحْمِ الْخِنْزِيرِ وَدَمِه
He who plays Nardshir (a game with dice that involves gambling) is just like the one who puts his hand in the flesh and blood of swine.
If this is the case with merely touching the flesh and blood of swine, so what about eating and feeding on it! This Hadith is a proof that Lahm means the entire body of the animal, including its fat.
It is recorded in the Two Sahihs that the Messenger of Allah said,
إِنَّ اللهَ حَرَّمَ بَيْعَ الْخَمْرِ وَالْمَيْتَةِ وَالْخِنْزِيرِ وَالاَْصْنَام
Allah made the trade of alcohol, dead animals, pigs and idols illegal.
The people asked, “O Allah’s Messenger! What about the fat of dead animals, for it was used for greasing the boats and the hides; and people use it for lanterns?”
He said,
لَاا هُوَ حَرَام
No, it is illegal.
In the Sahih of Al-Bukhari, Abu Sufyan narrated that he said to Heraclius, Emperor of Rome,
“He (Muhammad) prohibited us from eating dead animals and blood.”
Allah said,
وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللّهِ بِهِ
And that which has been slaughtered as a sacrifice for other than Allah.
Therefore, the animals on which a name other than Allah was mentioned upon slaughtering it, is impermissible, because Allah made it necessary to mention His Glorious Name upon slaughtering the animals, which He created. Whoever does not do so, mentioning other than Allah’s Name, such as the name of an idol, a false deity or a monument, when slaughtering, he makes this meat unlawful, according to the consensus.
Allah’s statement,
وَالْمُنْخَنِقَةُ
and that which has been killed by strangling…,
either intentionally or by mistake, such as when an animal moves while restrained and dies by strangulation because of its struggling, this animal is also unlawful to eat.
وَالْمَوْقُوذَةُ
or by a violent blow…,
This refers to the animal that is hit with a heavy object until it dies.
Ibn Abbas and several others said;
it is the animal that is hit with a staff until it dies.
Qatadah said,
“The people of Jahiliyyah used to strike the animal with sticks and when it died, they would eat it.”
It is recorded in the Sahih that `Adi bin Hatim said,
“I asked, `O Allah’s Messenger! I use the Mi`rad for hunting and catch game with it.’ He replied,
إِذَا رَمَيْتَ بِالْمِعْرَاضِ فَخَزَق فَكُلْهُ وَإِنْ أصَابَ بَعَرْضِهِ فَإنَّمَا هُوَ وَقِيذٌ فَلَ تَأْكُلْه
If the game is hit by its sharp edge, eat it. But, if it is hit by its broad side, do not eat it, for it has been beaten to death.
Therefore, the Prophet made a distinction between killing the animal with the sharp edge of an arrow or a hunting stick, and rendered it lawful, and what is killed by the broad side of an object, and rendered it unlawful because it was beaten to death.
There is a consensus among the scholars of Fiqh on this subject.
وَالْمُتَرَدِّيَةُ
or by a headlong fall,
the animal that falls headlong from a high place and dies as a result, it is also prohibited.
Ali bin Abi Talhah reported that Ibn Abbas said that;
an animal that dies by a headlong fall, “Is that which falls from a mountain.”
Qatadah said that;
it is the animal that falls in a well.
As-Suddi said that;
it is the animal that falls from a mountain or in a well.
وَالنَّطِيحَةُ
or by the goring of horns,
the animal that dies by being gorged by another animal, it is also prohibited, even if the horn opens a flesh wound and it bleeds to death from its neck.
Allah’s statement,
وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ
and that which has been (partly) eaten by a wild animal,
refers to the animal that was attacked by a lion, leopard, tiger, wolf or dog, then the wild beast eats a part of it and it dies because of that. This type is also prohibited, even if the animal bled to death from its neck. There is also a consensus on this ruling.
During the time of Jahiliyyah, the people used to eat the sheep, camel, or cow that were partly eaten by a wild animal. Allah prohibited this practice for the believers.
Allah’s statement,
إِلاَّ مَا ذَكَّيْتُمْ
unless you are able to slaughter it,
before it dies, due to the causes mentioned above. This part of the Ayah is connected to,
وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ
and that which has been killed by strangling, or by a violent blow, or by a headlong fall, or by the goring of horns – and that which has been (partly) eaten by a wild animal.
Ali bin Abi Talhah reported that Ibn Abbas commented on Allah’s statement,
إِلاَّ مَا ذَكَّيْتُمْ
(unless you are able to slaughter it),
“Unless you are able to slaughter the animal in the cases mentioned in the Ayah while it is still alive, then eat it, for it was properly slaughtered.”
Similar was reported from Sa`id bin Jubayr, Al-Hasan Al-Basri and As-Suddi.
Ibn Jarir recorded that Ali, may Allah be pleased with him, said,
“If you are able to slaughter the animal that has been hit by a violent blow, or by a headlong fall, or by the gorging of horns while it still moves a foot or a leg, then eat from its meat.”
Similar was reported from Tawus, Al-Hasan, Qatadah, Ubayd bin Umayr, Ad-Dahhak and several others, that;
if the animal that is being slaughtered still moves, thus demonstrating that it is still alive while slaughtering, then it is lawful.
The Two Sahihs recorded that Rafi` bin Khadij said,
“I asked, `O Allah’s Messenger! We fear that we may meet our enemy tomorrow and we have no knives, could we slaughter the animals with reeds?’
The Prophet said,
مَا أَنْهَرَ الدَّمَ وَذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ فَكُلُوهُ لَيْسَ السِّنَّ وَالظُّفُرَ وَسَأُحَدِّثُكُمْ عَنْ ذلِكَ أَمَّا السِّنُّ فَعَظْمٌ وَأَمَّا الظُّفُرُ فَمُدَى الْحَبَشَة
You can use what makes blood flow and you can eat what is slaughtered with the Name of Allah. But do not use teeth or claws (in slaughtering). I will tell you why, as for teeth, they are bones, and claws are used by Ethiopians for slaughtering.”
Allah said next,
وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ
and that which is sacrificed on An-Nusub.
Nusub were stone altars that were erected around the Ka`bah, as Mujahid and Ibn Jurayj stated.
Ibn Jurayj said,
“There were three hundred and sixty Nusub (around the Ka`bah) that the Arabs used to slaughter in front of, during the time of Jahiliyyah. They used to sprinkle the animals that came to the Ka`bah with the blood of slaughtered animals, whose meat they cut to pieces and placed on the altars.”
Allah forbade this practice for the believers. He also forbade them from eating the meat of animals that were slaughtered in the vicinity of the Nusub, even if Allah’s Name was mentioned on these animals when they were slaughtered, because it is a type of Shirk that Allah and His Messenger have forbidden.
The Prohibition of Using Al-Azlam for Decision Making
Allah said,
وَأَن تَسْتَقْسِمُواْ بِالَازْلَامِ
(Forbidden) also is to make decisions with Al-Azlam,
The Ayah commands, “O believers! You are forbidden to use Al-Azlam (arrows) for decision making,” which was a practice of the Arabs during the time of Jahiliyyah.
They would use three arrows, one with the word `Do’ written on it, another that says `Do not’, while the third does not say anything. Some of them would write on the first arrow, `My Lord commanded me,’ and, `My Lord forbade me,’ on the second arrow and they would not write anything on the third arrow. If the blank arrow was picked, the person would keep trying until the arrow that says do or do not was picked, and the person would implement the command that he picked.
Ibn Abbas said that;
the Azlam were arrows that they used to seek decisions through.
Muhammad bin Ishaq and others said that;
the major idol of the tribe of Quraysh was Hubal, which was erected on the tip of a well inside the Ka`bah, where gifts were presented and where the treasure of the Ka`bah was kept. There, they also had seven arrows that they would use to seek a decision concerning matters of dispute. Whatever the chosen arrow would tell them, they would abide by it!
Al-Bukhari recorded that;
when the Prophet entered Al-Ka`bah (after Makkah was conquered), he found pictures of Ibrahim and Ismail in it holding the Azlam in their hands. The Prophet commented,
قَاتَلَهُمُ اللهُ لَقَدْ عَلِمُوا أَنَّهُمَا لَمْ يَسْتَقْسِمَا بِهَا أَبَدًا
May Allah fight them (the idolaters)! They know that they never used the Azlam to make decisions.
Mujahid commented on Allah’s statement,
وَأَن تَسْتَقْسِمُواْ بِالَازْلَامِ
((Forbidden) also is to make decisions with Al-Azlam),
“These were arrows that the Arabs used, and dice that the Persians and Romans used in gambling.”
This statement by Mujahid, that these arrows were used in gambling, is doubtful unless we say that they used the arrows for gambling sometimes and for decisions other times, and Allah knows best.
We should also state that Allah mentioned Azlam and gambling in His statement before the end of the Surah (5:90-91),
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالَانصَابُ وَالَازْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاء فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللّهِ وَعَنِ الصَّلَةِ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ
O you who believe! Intoxicants (all kinds of alcoholic drinks), and gambling, and Al-Ansab, and Al-Azlam are an abomination of Shaytan’s handiwork. So avoid that in order that you may be successful. Shaytan wants only to excite enmity and hatred between you with intoxicants (alcoholic drinks) and gambling, and hinder you from the remembrance of Allah and from the Salah (the prayer). So, will you not then abstain!
In this Ayah, Allah said,
وَأَن تَسْتَقْسِمُواْ بِالَازْلَامِ
ذَلِكُمْ فِسْقٌ
(Forbidden) also is to make decisions with Al-Azlam, (all) that is Fisq.
meaning, all these practices constitute disobedience, sin, misguidance, ignorance and, above all, Shirk. Allah has commanded the believers to seek decisions from Him when they want to do something, by first worshipping Him and then asking Him for the best decision concerning the matter they seek.
Imam Ahmad, Al-Bukhari and the collectors of Sunan recorded that Jabir bin Abdullah said,
“The Prophet used to teach us how to make Istikharah (asking Allah to guide one to the right action), in all matters, as he taught us the Surahs of the Qur’an. He said,
إِذَا هَمَّ أَحَدُكُمْ بِالاَْمْرِ فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ مِنْ غَيْرِ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ لْيَقُلْ
If anyone of you thinks of doing any matter, he should offer a two Rak’ah prayer, other than the compulsory, and say (after the prayer)
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّمُ الْغُيُوبِ
`O Allah! I ask guidance from Your knowledge, from Your ability and I ask for Your great bounty, for You are capable and I am not, You know and I do not, and You know the Unseen.
اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الاَْمُرَ ويسميه باسمه خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَمَعَاشِي وعَاقِبَةِ أَمْرِي أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَاجِلِهِ فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ
O Allah! If You know that this matter (and one should mention the matter or deed here) is good for my religion, my livelihood and the Hereafter (or he said, `for my present and later needs’) then ordain it for me, make it easy for me to have, and then bless it for me.
اللَّهُمَّ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّهُ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ رَضِّنِي بِه
O Allah! And if You know that this is harmful to me in my religion and livelihood and for the Hereafter then keep it away from me and let me be away from it. And ordain whatever is good for me, and make me satisfied with it.’
This is the wording collected by Ahmad, and At-Tirmidhi said, “Hasan Sahih Gharib.”
Shaytan and the Disbelievers Do Not Hope that Muslims Will Ever Follow Them
Allah said,
الْيَوْمَ يَيِسَ الَّذِينَ كَفَرُواْ مِن دِينِكُمْ
This day, those who disbelieved have given up all hope of your religion;
Ali bin Abi Talhah reported that Ibn Abbas said that the Ayah means,
“They gave up hope that Muslims would revert to their religion.”
This is similar to the saying of Ata bin Abi Rabah, As-Suddi and Muqatil bin Hayyan.
This meaning is supported by a Hadith recorded in the Sahih that states,
إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ يَيِسَ أَنْ يَعْبُدَهُ الْمُصَلُّونَ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَلكِنْ بِالتَّحْرِيشِ بَيْنَهُم
Verily, Shaytan has given up hope that those who pray in the Arabian Peninsula, will worship him. But he will still stir trouble among them.
It is also possible that;
the Ayah negates the possibility that the disbelievers and Shaytan will ever be like Muslims, since Muslims have various qualities that contradict Shirk and its people. This is why Allah commanded His believing servants to observe patience, to be steadfast in defying and contradicting the disbelievers, and to fear none but Allah.
Allah said,
فَلَ تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ
So fear them not, but fear Me.
meaning, `do not fear them when you contradict them. Rather, fear Me and I will give you victory over them, I will eradicate them, and make you prevail over them, I will please your hearts and raise you above them in this life and the Hereafter.’
Islam Has Been Perfected For Muslims
Allah said,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الاِسْلَمَ دِينًا
This day, I have perfected your religion for you, completed My favor upon you, and have chosen for you Islam as your religion.
This, indeed, is the biggest favor from Allah to this Ummah, for He has completed their religion for them, and they, thus, do not need any other religion or any other Prophet except Muhammad. This is why Allah made Muhammad the Final Prophet and sent him to all humans and Jinn. Therefore, the permissible is what he allows, the impermissible is what he prohibits, the Law is what he legislates and everything that he conveys is true and authentic and does not contain lies or contradictions.
Allah said;
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلاً
(And the Word of your Lord has been fulfilled in truth and in justice), (6:115) meaning, it is true in what it conveys and just in what it commands and forbids. When Allah completed the religion for Muslims, His favor became complete for them as well.
Allah said,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الاِسْلَمَ دِينًا
This day, I have perfected your religion for you, completed My favor upon you, and have chosen for you Islam as your religion.
meaning, accept Islam for yourselves, for it is the religion that Allah likes and which He chose for you, and it is that with which He sent the best of the honorable Messengers and the most glorious of His Books.
Ibn Jarir recorded that Harun bin Antarah said that his father said,
“When the Ayah,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ
(This day, I have perfected your religion for you…) was revealed, during the great day of Hajj (the Day of Arafah, the ninth day of Dhul-Hijjah) Umar cried.
The Prophet said, `What makes you cry?’
He said, `What made me cry is that our religion is being perfected for us. Now it is perfect, nothing is perfect, but it is bound to deteriorate.’
The Prophet said,
صَدَقْت
(You have said the truth).”
What supports the meaning of this Hadith is the authentic Hadith,
إِنَّ الاِْسْلَمَ بَدَأَ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاء
Islam was strange in its beginning and will return strange once more. Therefore, Tuba for the strangers.
Imam Ahmad recorded that Tariq bin Shihab said,
“A Jewish man said to Umar bin Al-Khattab, `O Leader of the Believers! There is a verse in your Book, which is read by all of you (Muslims), and had it been revealed to us, we would have taken that day (on which it was revealed) as a day of celebration.’
Umar bin Al-Khattab asked, `Which is that verse!’
The Jew replied,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي
(This day, I have perfected your religion for you, completed My favor upon you…).
Umar replied, `By Allah! I know when and where this verse was revealed to Allah’s Messenger. It was the evening on the Day of Arafah on a Friday.”‘
Al-Bukhari recorded this Hadith through Al-Hasan bin As-Sabbah from Jafar bin `Awn. Muslim, At-Tirmidhi and An-Nasa’i also recorded this Hadith.
In the narration collected by Al-Bukhari in the book of Tafsir, through Tariq, he said,
“The Jews said to Umar, `By Allah! There is a verse that is read by all of you (Muslims), and had it been revealed to us, we would have taken that day (on which it was revealed) as a day of celebration.’
Umar said, `By Allah! I know when and where this verse was revealed and where the Messenger of Allah was at that time. It was the day of Arafah, and I was at Arafah, by Allah.”
Sufyan (one of the narrators) doubted if Friday was mentioned in this narration. Sufyan’s confusion was either because he was unsure if his teacher included this statement in the Hadith or not. Otherwise, if it was because he doubted that the particular day during the Farewell Hajj was a Friday, it would be a mistake that could not and should not have come from someone like Sufyan Ath-Thawri.
The fact that it was a Friday, is agreed on by the scholars of Sirah and Fiqh. There are numerous Hadiths that support this fact that are definitely authentic and of the Mutawatir type. This Hadith was also reported from Umar through various chains of narration.
Permitting the Dead Animals in Conditions of Necessity
Allah said,
فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لاِِّثْمٍ فَإِنَّ اللّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
But as for him who is forced by severe hunger, with no inclination to sin (such can eat these above mentioned animals), then surely, Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful.
Therefore, when one is forced to take any of the impermissible things that Allah mentioned to meet a necessity, he is allowed and Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful with him. Allah is well aware of His servant’s needs during dire straits, and He will forgive and pardon His servant in this case.
In the Musnad and the Sahih of Ibn Hibban, it is recorded that Ibn Umar said that Messenger of Allah said,
إنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ تُوْتَى رُخْصَتُهُ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ تُوْتَى مَعْصِيَتُه
Allah likes that His Rukhsah (allowance) be used, just as He dislikes that disobedience to Him is committed.
We should mention here that it is not necessary for one to wait three days before eating the meat of dead animals, as many unlettered Muslims mistakenly think. Rather, one can eat such meat when the dire need arises.
Imam Ahmad recorded that;
Abu Waqid Al-Laythi said that the Companions asked, “O Messenger of Allah! We live in a land where famine often strikes us. Therefore, when are we allowed to eat the meat of dead animals?”
The Prophet replied,
إِذَا لَمْ تَصْطَبِحُوا وَلَمْ تَغْتَبِقُوا وَلَمْ تَخْتَفِيُوا بَقْلً فَشَأْنُكُمْ بِهَا
When you neither find food for lunch and dinner nor have any produce to eat, then eat from it.
Only Imam Ahmad collected this narration and its chain meets the criteria of the Two Sahihs.
Allah said,
غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لاِِّثْمٍ
(with no inclination to sin),
meaning, one does not incline to commit what Allah has prohibited. Allah has allowed one when necessity arises to eat from what He otherwise prohibits, under the condition that his heart does not incline to eat what Allah prohibited.
Allah said in Surah Al-Baqarah,
فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَل إِثْمَ عَلَيْهِ إِنَّ اللّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
But if one is forced by necessity without willful disobedience nor transgressing due limits, then there is no sin on him. Truly, Allah is Oft-Forgiving, Most Merciful. (2:173)
Some scholars used this Ayah as evidence that those who travel for the purpose of committing an act of disobedience are not allowed to use any of the legal concessions of travel, because these concessions are not earned through sin, and Allah knows best.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
আল্লাহ পাক উল্লিখিত আয়াতে যে সমস্ত বস্তু খাওয়া অবৈধ তার বর্ণনা দিয়েছেন। মৃত ঐ জানোয়ারকে বলা হয়, যে জানোয়ার যবেহ অথবা শিকার ব্যতীত নিজেই মৃত্যুবরণ করে। মৃত পশু খাওয়া এ জন্যেই নিষিদ্ধ যে, তাতে। শরীর ও দ্বীনের জন্যে ক্ষতিকর রক্ত থেকে যায়। তবে মৃত মাছ খাওয়া হালাল। কারণ মুআত্তায়ে মালিক, মুসনাদে শাফিঈ, মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবি দাউদ, জামেউত তিরমিযী, সুনানে নাসাঈ, সুনানে ইবনে মাজাহ, সহীহ ইবনে খুযাইমা এবং সহীহ ইবনে হাব্বানে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সমুদ্রের পানি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। তখন তিনি বলেন যে, ওর পানি পবিত্র এবং ওর মধ্যেকার মৃত হালাল। এ সম্পর্কীয় একটি হাদীস সামনে রয়েছে।
(আরবী) শব্দ দ্বারা প্রবাহিত রক্তকে বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেছেনঃ (আরবী) (৬:১৪৬)-এর দ্বারাও প্রবাহিত রক্তকে বুঝানো হয়েছে। এটাই আব্বাস (রাঃ) ও সাঈদ ইবনে যুবাইর (রঃ)-এর মত। ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাসকে প্লীহা ও কলিজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেনঃ “তোমরা তা খাও।” তখন লোকেরা বললোঃ “ওটা তো রক্ত।’ তিনি বললেনঃ “তোমাদের উপর শুধুমাত্র প্রবাহিত রক্তকেই হারাম করা হয়েছে।” হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ ‘শুধু প্রবাহিত রক্তকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইমাম শাফিঈ (রঃ) ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাদের জন্যে দু’টি মৃত জন্তু ও দু’প্রকারের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত জন্তু দু’টি হলো মাছ ও ফড়িং এবং দু’প্রকার রক্ত হলো কলিজা ও প্লীহা।” এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, দারেকুতনী এবং বায়হাকীতেও বর্ণনাকারী আবদুর রহমান ইবনে আসলামের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে। অথচ আবদুর রহমান একজন দুর্বল রাবী। হাফিয বায়হাকী বলেন যে, এ হাদীসটিকে ইসমাঈল ইবনে ইদরীস এবং আবদুল্লাহও বর্ণনা করেছেন। ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন যে, এ দু’জনও দুর্বল রাবী। তবে তাদের দুর্বলতার মধ্যে কিছু কম বেশী আছে। সুলাইমান ইবনে বিলালও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। যদিও তিনি একজন বিশ্বস্ত রাবী তবুও কারও কারও মতে এটি একটি মওকুফ হাদীস। এর বর্ণনাকারী হচ্ছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)। হাফিয আবু জার আরাফীর মতে এ হাদীসটি মওকুফ হওয়া সঠিক। ইবনে আবি হাতিম সুদ্দী ইবনে আজলান হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে আমার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর প্রতি আহ্বান করার জন্যে প্রেরণ করেন এবং ইসলামের আহ্বানগুলো তাদের নিকট ব্যক্ত করার নির্দেশ দেন। আমি তাদের মধ্যে আমার কাজ করছিলাম। হঠাৎ একদিন তারা আমার নিকট এক পেয়ালা রক্ত নিয়ে উপস্থিত হলো এবং তারা সবাই মিলে ঐ রক্ত পান করার জন্যে প্রস্তুতি নিলো। তারা আমাকেও ঐ রক্ত পান করার জন্যে অনুরোধ করলো। তখন আমি তাদেরকে বললাম, তোমাদের জন্যে আফসোস! আমি তোমাদের কাছে এমন এক ব্যক্তির নিকট হতে এসেছি যিনি তোমাদের জন্য এ রক্তকে হারাম করেছেন। তখন তারা সকলে আমাকে সেই হুকুমটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। তখন আমি তাদেরকে এ আয়াতটি পড়ে শুনালাম। হাফিয আবু বকর তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সুদ্দী বলেন, আমি তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করতে থাকি। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। একদিন আমি তাদেরকে আমাকে এক গ্লাস পানি পান করাতে বলি। কারণ আমি সে সময় অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত ছিলাম। তখন তারা বললোঃ “না, আমরা তোমাকে মৃত্যু পর্যন্তও পানি পান করাবো না। আমি তখন চিন্তিত অবস্থায় ভীষণ গরমের মধ্যে উত্তপ্ত পাথরের উপর আবা’ মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমন্ত অবস্থায় আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, এক ব্যক্তি অতি সুন্দর একটি কাচের পেয়ালায় উত্তম সুমিষ্ট পানীয় নিয়ে আমার নিকট উপস্থিত হলো এবং আমাকে পেয়ালাটি দিলো। আমি তখন তা হতে পান করলাম এবং সাথে সাথেই জেগে উঠলাম। জেগে দেখলাম যে, আমার কোন পিপাসা নেই, বরং এরপর আজ পর্যন্ত আমি কখনও পিপাসার্ত হইনি। হাকিম তার মুসতাদরিক গ্রন্থে এ অংশটি বেশী বর্ণনা করেন। সুদ্দী (রঃ) বলেন, এরপর আমি আমার সম্প্রদায়ের লোককে বলাবলি করতে শুনলামঃ “তোমাদের নিকট তোমাদের সম্প্রদায় হতে একজন সর্দার এসেছেন; অথচ তোমরা তাকে এক ঢাক পানিও প্রদান করলে না!” এরপর তারা আমার নিকট পানীয় দ্রব্য নিয়ে আসলো। তখন আমি বললাম, এখন আমার এর প্রয়োজন নেই। কারণ, আল্লাহ আমাকে খাইয়েছেন এবং পানও করিয়েছেন। আমি তাদেরকে আমার খাবারপূর্ণ পেট দেখালাম। তারপর তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করলো। কবি আশা তাঁর কবিতায় কত সুন্দরই না বর্ণনা করেছেনঃ “এবং তুমি কখনও ভক্ষণ করার উদ্দেশ্যে মৃত জন্তুর নিকট যেওনা এবং পশুর শরীরে আঘাত করে তা হতে নির্গত রক্ত পান করার উদ্দেশ্যে ধারাল অস্ত্র গ্রহণ করো না। আর তোমরা পূজার বেদীর উপর স্থাপিত কোন জন্তুকে খেওনা, মূর্তিপূজা করো না, বরং আল্লাহর ইবাদত কর।” কাসীদার এ অংশটি প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
(আরবী) তাফসীরকারক এর ব্যাখ্যায় বলেন যে, গৃহপালিত এবং বন্য শূকর উভয়ই হারাম। শূকরের মাংস বলতে চর্বি এবং তার অন্যান্য অংশকে বুঝায়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, (আরবী) শব্দের দ্বারা মাংসকে বুঝানো হয়। শূকরের চর্বি বা অন্যান্য অংশ কি করে গ্রহণ করা যেতে পারে? এর উত্তরে যাহেরী সম্প্রদায় বলেন যে, কুরআন মাজীদের অন্য একটি আয়াতে আছে-(আরবী) (৬:১৪৬)।
এখানে (আরবী)-এর (আরবী) এর দ্বারা (আরবী) কে বুঝানো হয়েছে। আর (আরবী) বলতে তার যাবতীয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গকেই বুঝায়। কিন্তু এটা আরবী ভাষার রীতি অনুযায়ী সঠিক। নয়। কারণ, (আরবী) আরবীতে বা সর্বনাম সব সময়ই (আরবী) -এর দিকে ফিরে, কখনও (আরবী)-এর দিকে না। আর এখানে (আরবী) হলো (আরবী) শব্দটি। আসলে এর সঠিক উত্তর হলো এই যে, (আরবী) বা গোশত বলতে আরবরা উক্ত জন্তুর প্রতিটি অঙ্গকেই গ্রহণ করে থাকে। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি খেলায় অংশগ্রহণ করে সে যেন তার হস্তকে শূকরের গোশত ও তার রক্তে রঞ্জিত করলো। এখানে শূকরের গোশত ও রক্ত স্পর্শ করার প্রতি ঘৃণা পোষণ করা হয়েছে। অতএব ওটা ভক্ষণ করা নিঃসন্দেহে নিষিদ্ধ। এ হাদীস শূকরের গোশত ও রক্তসহ যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবৈধ হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আরও উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ পাক মদ, মৃত, শূকর এবং মূর্তির ব্যবসাকে হারাম করেছেন।” তখন রাসুলুল্লাহ (সঃ)-কে প্রশ্ন করা হয়ঃ মৃতের চর্বি সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? কারণ মানুষ তা দ্বারা নৌকায় প্রলেপ দেয়, চামড়াতে মালিশ করে এবং প্রদীপ জ্বালায়। তিনি উত্তরে বললেনঃ “ওগুলোও হারাম।” সহীহ বুখারীতে আবু সুফিয়ানের হাদীসে উল্লেখ আছে যে, একদা রোম সম্রাট আবু সুফিয়ানের নিকট জানতে চেয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে কোন্ কোন্ বিষয়ে নিষেধ করেছেন? তদুত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে মৃত ও রক্ত খেতে নিষেধ করেছেন।’
(আরবী)-এর ব্যাখ্যায় তাফসীরকারক বলেন যে, এর দ্বারা যে জন্তুকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে যবেহ করা হয় তাকে বুঝানো হয়েছে। কারণ, আল্লাহ তার সৃষ্টজীবকে তাঁর মহান নামের উপর যবেহ্ করা ওয়াজিব করেছেন। অতএব যখন তার নির্দেশকে লংঘন করে মূর্তি বা অন্য কোন সৃষ্টজীবের নামে যবেহ করা হয় তখন তা হারাম হবে। এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত। তবে যদি কোন পশু যবেহ করার সময় ভুলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ পড়া না হয় তবে উক্ত পশু হারাম বা হালাল হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। এ বিষয়ে সূরা আন-আমের ব্যাখ্যায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ইবনে আবি হাতিম আবু তোফাইল হতে বর্ণনা করেন যে, যখন হযরত আদম (আঃ) পৃথিবীতে অবতরণ করেন তখন তার উপর চারটি বস্তু হারাম করা হয়েছিল। সেগুলো হলো মৃত পশু, রক্ত, শূকরের মাংস এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গিত পশু। এ চারটি বস্তুকে কখনও হালাল করা হয়নি। বরং আসমান ও যমীনকে সৃষ্টি করার পর হতেই এগুলো হারাম ছিল। ইসরাঈলীদের পাপের কারণে আল্লাহ পাক তাদের জন্যে কিছু কিছু হালাল বস্তুকে হারাম করে দিয়েছিলেন। এরপর হযরত ঈসা (আঃ)-এর যুগে হযরত আদম (আঃ)-এর যুগের ন্যায় নির্দেশ আসে এবং উল্লিখিতি চারটি বস্তু ছাড়া সবকিছুই হালাল হয়ে যায়। কিন্তু তারা হযরত ঈসা (আঃ)-কে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করে এবং তার নির্দেশ অমান্য করে।
হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এ হাদীসটি ‘গারীব’। ইবনে আবি হাতিম বর্ণনা করেন যে, বান্ রেবা গোত্রের ইবনে ওয়ায়েল নামে এক ব্যক্তি এবং ফারাজদাকের পিতা গালিব উভয়েই একশটি করে উটের পা কাটার জন্যে বাজি ধরে। কুফা শহরের উপকণ্ঠে একটি ঝর্ণার ধারে তারা তাদের উটগুলোর পা কাটা শুরু করে। তখন জনসাধারণ তাদের গাধা ও খচ্চরের পিঠে চড়ে উটের গোশত নেয়ার জন্যে তথায় গমন করে। এ দেখে হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একটি সাদা খচ্চরের পিঠে চড়ে বলতে শুরু করেনঃ “হে জনমণ্ডলী! তোমরা এ উটগুলোর গোশত খেওনা। কেননা, এগুলোকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।” হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এটিও একটি ‘গারীব’ হাদীস। তবে আবু দাঊদের সুনানে বর্ণিত একটি হাদীস দ্বারা এ হাদীসের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়। হাদীসটি নিম্নরূপঃ
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরব বেদুঈনদের মত পরস্পর বাজি রেখে উটের পা কাটতে নিষেধ করেছেন। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) আরও বলেন যে, মুহাম্মাদ ইবনে জাফর এ হাদীসটিকে একটি মওকুফ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের বর্ণনাকারী হচ্ছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)। ইমাম আবূ দাউদ ইকরামা হতে আরও বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত খাবার খেতে নিষেধ করেছেন।
(আরবী)-এ শব্দের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারক বলেন যে, ইচ্ছাকৃতভাবে যে জন্তুকে গলাটিপে মারা হয় অথবা যে জন্তু আকস্মিকভাবে দম বন্ধ হয়ে মারা যায় তাকে বলা হয়। যেমন কোন পশুকে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখলে ছুটাছুটি করার ফলে গলায় দডির ফাঁস লেগে যদি দম বন্ধ হয়ে মারা যায় তবে তা খাওয়া হারাম। আর (আরবী) শব্দের দ্বারা ঐ মৃত জন্তুকে বুঝানো হয়েছে। যাকে ভারী অথচ ধারাল নয় এমন অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে মারা হয়েছে। যেমন ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যে জন্তুকে লাঠি দ্বারা আঘাত করে মারা হয় তাকে (আরবী) বলা হয়। কাতাদা বলেন যে, জাহেলি যুগের লোকেরা লাঠি দ্বারা আঘাত করে পশু মেরে খেতো। হাদীসের সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, আদি ইবনে হাতিম (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি এক পার্শ্বে ধারাল এবং অপর পার্শ্বে ধারহীন এ জাতীয় এক প্রকার প্রশস্ত অস্ত্র দ্বারা শিকার করি। এ শিকার খাওয়া কি জায়েয?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “যদি ওটা ধারাল পার্শ্ব দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয় তবে তা খাওয়া জায়েয। আর যদি ওটা ধারহীন অংশ দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মারা যায় তবে তা অপবিত্র এবং তা খাওয়া জায়েয নয়।”এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ধারহীন অস্ত্র এবং ধারাল অস্ত্রের দ্বারা শিকার করা জন্তুর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি ধারাল অংশের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত জন্তুকে খাওয়া জায়েয করেছেন এবং ধারহীন অংশ দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত জন্তুকে খাওয়া নাজায়েয করেছেন। ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ এ ব্যাপারে একমত। তবে যদি ক্ষত না করে শুধু অস্ত্রের ভারত্বের দ্বারা কোন জন্তু নিহত হয় তবে তা হারাম বা হালাল হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। ইমাম শাফিঈ উভয় মতই পোষণ করেন। তাঁর এক মতানুযায়ী উল্লিখিত হাদীসের আলোকে এ জন্তুটি হালাল নয়। অন্য মতানুযায়ী কুকুর দ্বারা শিকার করা জন্তু খাওয়া যেহেতু হালাল, সেহেত ভারী অস্ত্র দ্বারা শিকার করা জন্তুকে খাওয়াও হালাল। এ বিষয়টি নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলোঃ
যদি শিকারী কুকুরকে শিকারের জন্যে পাঠানো হয় এবং সে ক্ষত না করে ভারত্বের দ্বারা অথবা আঘাতের দ্বারা তাকে হত্যা করে তবে তা হালাল ও হারাম হওয়ার ব্যাপার আলেমদের দুটি মত আছে। এক মতানুসারে তা খাওয়া হালাল। কারণ কুরআন মাজীদে উল্লেখ আছে- “কুকুর তোমাদের জন্যে যা শিকার করে আনে তোমরা তা খাও।” এ আয়াতটি ক্ষত করা বা না করা উভয় ধরনের শিকারকেই বুঝিয়েছে। ঠিক একইভাবে আদি ইবনে হাতিমের হাদীসেও এ জাতীয় নির্দেশের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। এটা ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর মত। ইমাম নববী ও ইমাম রাফেয়ী প্রমুখ আলেমগণও ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর এ মতকে সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন। তাফসীরকারক ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন যে, ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর (আরবী) -এবং (আরবী) নামক গ্রন্থে বর্ণিত তাঁর কথা হতে এ জাতীয় নির্দেশের প্রতি ইঙ্গিত বুঝায় না। উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণিত তাঁর বক্তব্য দ্ব্যর্থবোধক। তাঁর অনুসারীগণ এ ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন এবং উভয় দলই তাঁর বক্তব্যকে নিজ নিজ দলের পক্ষে ব্যবহার করেছেন। অবশ্য আল্লাহ পাকই এ বিষয়ে সম্যক অবগত। তবে তার এ বক্তব্যে উক্ত পশু হালাল হওয়ার প্রতি অতি সামান্য ইঙ্গিতই পাওয়া যায়। আসলে এ জাতীয় পশু হালাল না হারাম এ প্রসঙ্গে তিনি খোলাখুলি কোন মন্তব্য করেননি। ইবনে সাব্বাগ হাসান ইবনে যিয়াদের বর্ণনানুযায়ী ইমাম আবু হানীফা (রঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, এ জাতীয় পশু হালাল। ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, সালমান ফারসী (রাঃ), আবূ হুরাইরা (রাঃ), সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং ইবনে উমার (রাঃ)-এর মতে এ জাতীয় পশু হালাল। কিন্তু হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এ হাদীসটি গারীব। কারণ তাদের পক্ষ হতে এ জাতীয় কোন প্রকাশ্য বক্তব্য নেই। ইবনে কাসীর ইবনে জারীরের এ রিওয়ায়াত সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেন।
শিকারী কুকুর কর্তৃক ভার বা আঘাত দ্বারা নিহত পশু খাওয়া হালাল কি হারাম এ ব্যাপারে আলেমদের দ্বিতীয় মত হলো এই যে, ঐ পশু খাওয়া হালাল নয়। আর এটাই ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর আর একটি মত। ইমাম মুযানীও তার এ মতকে সমর্থন করেন। ইবনে সাব্বাগও ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর এ দ্বিতীয় মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) ইমাম আবু হানীফা (রঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এ জাতীয় পশু হালাল নয়। আর এটাই ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)-এর প্রসিদ্ধ মত। ইবনে কাসীর (রঃ)-এর মতে এ মতটি সঠিক হওয়ারই সম্ভাবনা বেশী। কারণ এটাই ইসলামী আইনের নীতিমালার সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইবনে সাব্বাগ এ মতের পক্ষে রাফে ইবনে খুদাইজের হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন। হাদীসটি নিম্নরূপঃ
রাফে ইবনে খুদাইজ (রাঃ) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা আগামীকাল শত্রুর সম্মুখীন হবো। তখন কাছে কোন ছুরি থাকবে না। আমরা কি বাশের ধারাল অংশ দ্বারা কোন শিকারকে যবেহ করতে পারি? তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যে অস্ত্র রক্ত প্রবাহিত করে এবং যে জন্তুকে যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেয়া হয় তোমরা তা খেতে পার।” এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম উভয় গ্রন্থেই রয়েছে। ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন যে, যদিও এ হাদীসটি একটি বিশেষ কারণে বর্ণনা করা হয়েছে, তবুও অধিকাংশ উসুলবিদ ও আইনবিদ হাদীসটিকে সাধারণভাবে গ্রহণ করেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে একদা মধুর তৈরী নাবীজ জাতীয় পানীয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “যে সমস্ত পানীয় মানুষের মধ্যে মাতলামি এনে দেয় সেগুলো হারাম।” এ হাদীটি সম্পর্কে কোন কোন ফিকাহবিদ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) খাস করে মধুর তৈরী পানীয় সম্পর্কেই এ মন্তব্য করেছেন। ঠিক এমনিভাবে উল্লিখিত হাদীসটিতে যদিও একটি বিশেষ যবেহ্ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল তথাপি এর জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এমন একটি মন্তব্য করেন যা উক্ত বিশেষ যবেহ্ এবং এর সাথে সংযুক্ত অন্যান্য যবেহূকে শামিল করে। কারণ আল্লাহ পাক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবোধক বক্তব্য রাখার ক্ষমতা দান করেছিলেন। অতএব দেখা যাচ্ছে। যে, যদি শিকারী কুকুর আঘাত বা তার ভারত্বের দ্বারা কোন পশুকে হত্যা করে অথচ এতে রক্ত প্রবাহিত না হয় তাহলে উক্ত পশু খাওয়া হালাল নয়। কারণ উপরোক্ত হাদীসে যে অবস্থায় পশুকে হালাল করা হয়েছে তার বিপরীত অবস্থায় তা নিশ্চয়ই হারাম হবে। এ হাদীস হতে কুকুরের শিকার করা পশু সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে সে সম্পর্কে কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে যবেহ করার অস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তাকে যবেহ করা পশু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এজন্যে দেখা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) অন্য এক হাদীসে দাত ও নখের দ্বারা কোন পশু যবেহ করতে নিষেধ করেছেন। আর এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন যে, দাঁত হাড়ের অনুরূপ এবং নখ দ্বারা অমুসলিম হাবসীরা যবেহ করতো। এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে দু’টি বস্তু দ্বারা পশু যবেহ করতে নিষেধ করেছেন। সে বস্তু দু’টো যবেহের অস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। ওটা নিশ্চয়ই যবেহকৃত পশুর প্রতি কোন ইঙ্গিত বহন করে না। অতএব পূর্ববর্তী হাদীসে কুকুরের শিকার পশু সম্পর্কে কোন ইঙ্গিত নেই। ইবনে কাসীর (রঃ) এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে বস্তু রক্ত প্রবাহিত করে এবং যে জন্তু আল্লাহর নামে যবেহ করা হয় তা খাওয়া তোমাদের জন্যে হালাল। এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে বস্তু রক্ত প্রবাহিত করে সেই অস্ত্র দ্বারাই তোমরা পশুকে যবেহ কর’একথা বলেননি। অতএব এ হাদীসটি হতে একই সাথে দু’টি নির্দেশ পাওয়া যায়। একটি অস্ত্র সম্পর্কিত এবং অপরটি যবেহকৃত পশু সম্পর্কিত। অর্থাৎ পশুকে এমন অস্ত্র দ্বারা যবেহ করতে হবে যা রক্ত প্রবাহিত করে। কিন্তু তা দাঁত বা হাড় হওয়া চলবে না। উল্লিখিত হাদীস হতে কুকুরের শিকার সম্পর্কে ইমাম মুযানী এভাবে দলীল গ্রহণ করে থাকেন যে, হাদীসটিতে তীর দ্বারা শিকার করা পশু সম্পর্কে বলা হয়েছে-‘যদি অস্ত্রের ধারহীন অংশের আঘাত দ্বারা শিকার করা পশু মারা যায় তবে তা খেয়ো না। আর যদি ধারাল অংশের আঘাতে মারা যায় তবে তা খাও।’ কিন্তু কুকুর সম্পর্কে সাধারণ মন্তব্য করা হয়েছে। এখানে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ সাধারণ মন্তব্যকে বিশেষ অর্থে গ্রহণ করতে হবে। কারণ দু’টি ভিন্ন জাতীয় বস্তু দ্বারা শিকার করা হলেও নির্দেশটি শিকার করা পশু সম্পর্কিত। যেমন পবিত্র কুরআনে অন্যায়ভাবে হত্যাকারীকে একটি মুমিন গেলাম আযাদ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহার’ সম্পর্কিত নির্দেশে শুধু গোলাম আযাদ করার কথাই বলা হয়েছে। এখানে যদিও এক জায়গায় মুমিন গোলামের কথা বলা হয়েছে এবং অন্য জায়গায় শুধু গোলামের কথা বলা হয়েছে, তবুও উভয় ক্ষেত্রেই মুমিন গোলাম আযাদ করার অর্থই গ্রহণ করতে হবে। ইবনে কাসীর (রঃ)-এর মতে ইমাম মুযানীর এ মতটি সঠিক। বিশেষভাবে যারা এ মতবাদের মূলনীতিকে গ্রহণ করেন তাঁদের জন্যে এ যুক্তিটি উত্তম বলে মনে হবে। সুতরাং যারা এর বিরোধিতা করে থাকেন তাদের পক্ষে এ ব্যাপারে সঠিক ও যুক্তিসম্মত মত পেশ করা উচিত। ইবনে কাসীর (রঃ) ইমাম মুযানীর (রঃ) পক্ষে বলেনঃ আমরা জানি যে, হাদীসে এসেছে-‘অস্ত্রের ধারহীন অংশের আঘাত দ্বারা মৃত শিকার খাওয়া হালাল নয়।’ এ হাদীসের উপর কিয়াস করেও আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কুকুর তার ভারত্বের দ্বারা কোন শিকারকে হত্যা করলে তা খাওয়া হালাল হবে না। কারণ এ দু’টোই শিকারের অস্ত্র স্বরূপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উল্লিখিত আয়াতটিতে (আরবী) (৫:৪) কুকুরের শিকার সম্পর্কে একটি সাধারণ নির্দেশ আছে। এখানে কোন শর্তের পশুর উল্লেখ করা হয়নি। আমরা কিয়াসের দ্বারা কুকুরের শিকারের প্রতি বিশেষ শর্ত আরোপ করছি। কারণ, এ জাতীয় অবস্থায় সাধারণ নির্দেশের পরিবর্তে কিয়াসের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এটাই চার ইমাম এবং অধিকাংশ আলেমের মত। ইবনে কাসীর (রঃ)-এর মতেও এটা উত্তম মতবাদ। দ্বিতীয় কথা হলো এই যে, (আরবী) (৫:৪) আয়াতটিতে একটি সাধারণ নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু উপরে আলোচিত মৃত শিকার শিং বা এ জাতীয় কোন বস্তু দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত অথবা দম বন্ধ হয়ে বা এ জাতীয় অন্য কোনভাবে মৃত জন্তু নির্দেশিত হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। তবে যে কোন অবস্থায় (আরবী) (৫:৪) নির্দেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ শরীয়ত এ আয়াতের নির্দেশকে শিকারের ব্যাপারেই গ্রহণ করেছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আদি ইবনে হাতিম (রাঃ)-কে বলেছিলেনঃ যদি শিকার তীরের ধারহীন অংশের আঘাতে মারা যায় তবে তা অপবিত্র। কাজেই তোমরা তা খেয়ো না।’ ইবনে কাসীর (রঃ) বলেনঃ আমাদের জানামতে এমন কোন আলেম নেই যিনি কুরআন ও হাদীসের নির্দেশের মধ্যে পার্থক্য করে একথা বলেছেন যে, শুধু অস্ত্রের ধারহীন অংশ দ্বারা শিকার করা জন্তুই শিকারের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং শিং- এর আঘাতে মৃত জন্তু শিকারের নির্দেশের আওতায় পড়ে না। সুতরাং আলোচ্য মৃত শিকারকে যদি হালাল বলা হয় তবে এর দ্বারা সমস্ত আলেমের ইজমার বিরোধিতা করা হবে। অথচ ইজমার বিরোধিতা করা কারো মতেই জায়েয নয়, বরং অধিকাংশ আলেম এ ধরনের কাজকেই বিধি বহির্ভূত বলেছেন।
দ্বিতীয়তঃ (আরবী) (৫:৪) -এ আয়াতটি আলেমদের ইজমা অনুযায়ী সাধারণ নির্দেশ বহন করে না। বরং এ আয়াতের দ্বারা শুধুমাত্র ঐ ধরনের জ্যুকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে হালাল। সুতরাং এর সাধারণ নির্দেশ হতে হারাম জন্তুগুলো বাদ পড়ে যায়। কেননা, শরীয়তের সাধারণ নির্দেশের দুটি স্তর আছে, একটিতে সীমা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে এবং অন্যটিতে কোন সীমা নির্ধারণ করা থাকে না। আর এ জাতীয় সাধারণ নির্দেশের বেলায় সীমা নির্ধারিত নির্দেশকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। অন্য আর একটি মতে বলা হয়েছে যে, এ ধরনের শিকার মৃত জন্তুর হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। কারণ এ ধরনের শিকারের মধ্যে রক্ত ও যাবতীয় রস ওর ভেতরেই থেকে যায়। আর মৃত জন্তুও এ কারণেই হারাম হয়ে থাকে। সুতরাং কিয়াস অনুযায়ী উপরোক্ত শিকারও হালাল নয়। অন্য আর একটি মত এই যে, পবিত্র কুরআনের (আরবী) আয়াতটি হারাম জন্তুর বর্ণনায় একটি মুহকাম আয়াত। এর কোন হুকুম অন্য কোন আয়াতের হুকুম দ্বারা বাতিল হয় না। ঠিক এমনিভাবেই পবিত্র কুরআনের (আরবী) (৫:৪)-এ আয়াতটি হালাল জন্তুর বর্ণনায় একটি মুহকাম আয়াত। মূলতঃ এ ধরনের আয়াতের নির্দেশের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। আর এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা হাদীস শরীফে রয়েছে। যেমন তীর দ্বারা শিকার করা জন্তু সম্পর্কিত। হাদীসটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এ হাদীসে যে জন্তু হালাল সম্পর্কিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত তার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অস্ত্রের ধারাল অংশ দ্বারা যা শিকার করা হয় তা হালাল। কারণ তা পবিত্র বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে যে জন্তু হারাম সম্পর্কিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ অস্ত্রের ধারহীন অংশ দ্বারা যে জন্তুকে শিকার করা হয়েছে তা হারাম। কারণ তা অপবিত্র। আর এটা অপবিত্র বস্তু হারাম সম্পর্কিত আয়াতের নির্দেশের একটি অঙ্গও বটে। অতএব কুকুর যে শিকারকে ক্ষত করে মেরে ফেলে তা হালাল সম্পর্কিত আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। আর কুকুর যে শিকারকে আঘাতে বা ভারের দ্বারা মেরেছে তা শিং বা ঐ জাতীয় বস্তু দ্বারা মৃত জন্তু সম্পর্কিত নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা হালাল নয়। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, কুকুরের শিকার সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কেন নির্দেশ দেয়া হয়নি? যেমন যদি কুকুর শিকারকে ক্ষত করে মেরে ফেলে তবে তা হালাল। আর যদি ক্ষত না করে মেরে ফেলে তবে তা হালাল নয়। তাফসীরকারক এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, ভার বা আঘাতের দ্বারা শিকারকে মেরে ফেলার উদাহরণ বিরল।
কারণ কুকুর সাধারণতঃ নখ বা থাবা অথবা এ দু’টো দ্বারাই শিকারকে হত্যা করে থাকে। সুতরাং কুকুরের শিকার সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন হুকুম দেয়ার কোন প্রশ্ন উঠে না। অথবা যদি কুকুর ভার বা আঘাতের দ্বারা শিকারকে হত্যা করে তবে এর হুকুম ঐ ব্যক্তির নিকট স্পষ্ট। কারণ সে জানে যে, এর হুকুম মৃতজন্তু, দম আটকিয়ে মৃতজন্তু, প্রহারে মৃতজন্তু, পতনে মৃতজস্তু এবং শিং-এর আঘাতে মৃত্যুর হুকুমেরই মত। তবে শিকারী কোন কোন সময় তীর বা ধারহীন অস্ত্রকে (আরবী) ভুল বশতঃ বা খেলাচ্ছলে শিকারের গায়ে ঠিকমত লাগাতে পারে না। বরং অধিকাংশ সময়েই ঠিকভাবে শিকারের গায়ে লাগাতে ব্যর্থ হয়ে থাকে। শিকার ক্ষত না হয়ে অস্ত্রের চাপ বা আঘাতের ফলে মারা যায়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এ দু’ব্যাপারে বিস্তারিত হুকুম দান করেছেন। অবশ্য আল্লাহই এ ব্যাপারে সম্যক অবগত আছেন। ঠিক এমনিভাবে কুকুর তার অভ্যাস বশতঃ কখনো কখনো শিকারকৃত জন্তুকে খেয়ে ফেলে। এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওর সম্পর্কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেনঃ “যদি কুকুর শিকারকে খেয়ে ফেলে তবে তোমরা তা খেয়ো না। কারণ আমি ভয় করি যে, কুকুর তার নিজের জন্যেই ঐ জন্তুকে রেখে দিয়েছে। হাদীসের এ বর্ণনাটি সঠিক। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম উভয় গ্রন্থে হাদীসটি স্থান পেয়েছে। অধিকাংশ আলেমের মতে কুকুরের শিকার সম্পর্কে এ নির্দেশটিকে কুকুরের শিকার হালাল হওয়া সম্পর্কিত আয়াতের নির্দেশ হতে পৃথক করে বলা হয়েছে যে, কুকুর যদি তার শিকারের কোন অংশ খেয়ে ফেলে তবে তা হালাল নয়। হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এরূপ বর্ণিত হয়েছে। হাসান (রঃ), শাবী (রঃ) এবং নাখঈরও (রঃ) এ অভিমত। ইমাম আবু হানীফা (রঃ), ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ), ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃ), ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এবং ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর একটি প্রসিদ্ধ অভিমতও এটাই। ইবনে জারীর (রঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে আলী (রাঃ), সাঈদ (রঃ), সালমান (রঃ), আবূ হুরাইরা (রাঃ), ইবনে উমার (রাঃ) এবং ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, কুকুরের শিকার খাওয়া যাবে যদিও সে শিকারের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে। এমন কি সাঈদ (রঃ), সালমান (রঃ), আবু হুরাইরা (রাঃ) ও অন্যান্যদের মতে যদি কুকুর শিকারের এক টুকরা গোশত ব্যতীত সবটুকু খেয়ে ফেলে তবুও ঐ গোশতের টুকরাটি খাওয়া যাবে। ইমাম মালিক (রঃ) এবং ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর পূর্ব মতও এটাই। ইমাম শাফিঈ (রঃ) তাঁর পরবর্তী নতুন অভিমতে কুকুরের শিকার সম্পর্কিত দু’টি অভিমতের প্রতিই ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আবু মনসুর ইবনে সাব্বাগ ও অন্যান্য শাফিঈ মতাবলম্বী ইমামগণ ইমাম শাফিঈ (রঃ) হতে তার এ অভিমত বর্ণনা করেন। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) উত্তম ও জোরালো সনদ দ্বারা আবু সা’লাবা আল খুশানী হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুকুরের শিকার সম্পর্কে বলেছেনঃ “যদি তুমি কুকুরকে শিকারের জন্যে পাঠাবার সময় আল্লাহর নাম উল্লেখ করে থাক তবে তুমি শিকারকে খাও, যদিও কুকুর তার কিছু অংশ খেয়ে ফেলে এবং তোমার হস্ত তোমার প্রতি যা ফিরিয়ে দেয় তা খাও।” ইমাম নাসাঈ (রঃ) এ হাদীসটি আমর ইবনে শশাআইবের সনদের দ্বারা তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হচ্ছে নিম্নরূপঃ
আবু সা’লাবা নামক এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেছিলঃ “হে আল্লাহর রাসূল!…….” ইমাম নাসাঈ (রঃ) হাদীসটির পরবর্তী অংশটুকু আবু দাউদ (রঃ)-এর রিওয়ায়াতের মতই বর্ণনা করেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে জারীর (রঃ) তার তাফসীর গ্রন্থে সালমান ফারসী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন কোন লোক তার কুকুরকে শিকারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে এবং কুকুর শিকারকৃত জন্তুর কিছু অংশ খেয়ে নেয় তবে বাকী অংশ সে খেতে পারে।” ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ হাদীসটিকে হযরত সালমান (রাঃ) হতে মাওকুফ হাদীস বলে অভিমত প্রকাশ করেন। অধিকাংশ আলেম কুকুরের শিকার সম্পর্কিত নির্দেশের ক্ষেত্রে আদি কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন এবং আবু সা’লাবা প্রমুখের বর্ণিত হাদীসকে দুর্বল বলে অভিমত প্রকাশ করেন। কোন কোন আলেম আবু সা’লাবা বর্ণিত হাদীসকে এ অর্থে গ্রহণ করেছেন যে, কুকুর শিকার করার পর যদি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মালিকের অপেক্ষা করার পর ক্ষুধার তাড়নায় বা এ জাতীয় কোন কারণে শিকারের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে তবে বাকী অংশটুকু খেতে কোন দোষ নেই। কেননা, এ অবস্থায় এ আশংকা করা যায় না যে, কুকুর শিকারকে তার নিজের জন্যেই গ্রহণ করেছে। তবে কুকুর যদি শিকার করা মাত্রই তা ভক্ষণ করতে শুরু করে তবে এ অবস্থায় বুঝা যাবে যে, সে শিকারকে তার নিজের জন্যেই গ্রহণ করেছে। অবশ্য এ ব্যাপারে মহান আল্লাহই সম্যক অবগত।
শিকারী পাখী সম্পর্কে ইমাম শাফিঈ (রঃ) বলেন যে, এর শিকারের হুকুমও কুকুরের শিকারের ন্যায়। অধিকাংশ আলেমের মতে যদি শিকারী পাখী শিকার করে তার কিছু অংশ খেয়ে ফেলে তবে তা খাওয়া হারাম। কিন্তু অপর একদল আলেমের মতে তা খাওয়া হারাম নয়। শাফিঈ মতাবলম্বী ইমাম মুযানী পাখীর শিকার সম্পর্কে এ অভিমত পোষণ করেন যে, শিকারী পাখী যদি শিকার করার পর শিকারের কোন অংশ খেয়ে ফেলে তবে তা খাওয়া হারাম নয়। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)-এর মতও এটাই। তারা এর কারণ প্রসঙ্গে বলেন যে, কুকুরকে যেমন মারপিট করে শিকার করা শিক্ষা দেয়া যায়, পাখীকে সেরূপভাবে শিকার করা শিখানো যায় না। আর তা ছাড়া শিকার খাওয়া ব্যতীত পাখীকে শিকার করা শিক্ষা দেয়া সম্ভবপর নয়। সুতরাং এটা ধর্তব্য নয়। এ ছাড়া কুকুরের শিকার সম্পর্কে শরীয়তের নির্দেশ এসেছে। কিন্তু পাখীর শিকার সম্পর্কে শরীয়তে কোন নির্দেশ আসেনি। শেখ আবু আলী তার ‘ইফসাহ্’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ যেহেতু আমরা শিকারী কুকুর কর্তৃক শিকারের কিছু অংশ খেয়ে ফেলার পরে ঐ শিকারকে হারাম বলে গণ্য করি, সেহেতু শিকারী পাখী কর্তৃক শিকারের কিছু অংশ খাওয়া হলে উক্ত শিকার হারাম হওয়ার ব্যাপারে দুটি দিক রয়েছে। কিন্তু কাযী আবু তাইয়্যেব আবু আলী কর্তৃক এ বিশ্লেষণকে অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন যে, ইমাম শাফিঈ (রঃ) কুকুরের ও পাখীর শিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে আল্লাহই সম্যক জ্ঞান রাখেন।
(আরবী) ঐ মৃত জন্তুকে বলা হয় যা পাহাড় বা কোন উঁচু স্থান হতে পড়ে মৃত্যুবরণ করে। এ ধরনের জন্তু খাওয়া হালাল নয়। আলী ইবনে আবি তালহা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, (আরবী) ঐ জন্তুকে বলা হয়, যে পাহাড় হতে পড়ে মারা যায়। কাতাদার মতে এটা ঐ ধরনের জন্তু যা কূপে পড়ে মারা যায়। সুদী বলেন যে, যে জন্তু পাহাড় হতে পড়ে অথবা কূপে পড়ে মারা যায় তাকেই (আরবী) বলা হয়।
(আরবী) ঐ জন্তুকে বলা হয় যা অন্য জন্তুর শিং-এর আঘাতে মারা যায়। যদি ওটা শিং দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং তা হতে রক্ত প্রবাহিত হয় এবং ঐ আঘাত যদি যবেহ করার স্থানেও লাগে তবুও ঐ ধরনের জন্তু খাওয়া হারাম। আরবী ভাষায় (আরবী) শব্দটি (আরবী) অর্থাৎ (আরবী) -এর অর্থে ব্যবহৃত হয়। আরবী ভাষায় এ ধরনের শব্দ অধিকাংশ সময় ব্যতীতই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা (আরবী) অর্থাৎ সুরমা লাগান চোখ এবং (আরবী) অর্থাৎ খেযাব লাগান হস্ততালু। আরবী ভাষায় এটা কখনও (আরবী) এবং (আরবী) হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু উক্ত আয়াতের শব্দগুলোতে ব্যবহৃত হওয়া সম্পর্কে কোন কোন ব্যাকরণবিদ বলেন যে, উক্ত শব্দগুলো (আরবী)-এর স্থানে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে ওর শেষে (আরবী)-এর ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আরবরা বলে থাকে (আরবী) কিন্তু কেউ কেউ বলে থাকেন যে, উক্ত শব্দগুলোতে এ জন্যেই ব্যবহার করা হয়েছে যাতে দেখা মাত্রই বুঝা যায় যে, এ শব্দগুলো (আরবী) বা স্ত্রীলিঙ্গ। ত (আরবী) ও (আরবী) ‘-এর বেলায় প্রথম দৃষ্টেই ওটা (আরবী) বলে মনে হয়।
(আরবী) -এ অংশের ব্যাখ্যায় তাফসীরকারক বলেন যে, সিংহ, নেকড়ে বাঘ, চিতা বাঘ বা কুকুর যে জন্তুকে আক্রমণ করে এবং ওর কিছু অংশ খেয়ে ফেলার কারণে ওটা মারা যায় তা খাওয়া হারাম। যদিও আঘাতের কারণে রক্ত প্রবাহিত হয় এবং উক্ত আঘাত জন্তু যবেহ্ করার স্থানে লাগে তবুও আলেমদের ইজমা অনুযায়ী উক্ত জন্তু খাওয়া হালাল নয়। যদি হিংস্র জন্তু ছাগল, উট, গরু বা এ জাতীয় কোন জন্তুকে মেরে কিছু অংশ খেয়ে ফেলতো তবুও অজ্ঞতার যুগের লোকেরা উক্ত জন্তুর বাকী অংশ খেতো। কিন্তু আল্লাহ পাক মুমিনদের জন্যে ওটা হারাম করে দেন।
(আরবী) অর্থাৎ দম আটকিয়ে পড়া, প্রহারে আহত, পতনে ও শিং-এর আঘাতে এবং জন্তুর আক্রমণে মৃতপ্রায় জন্তুকে যদি জীবিতাবস্থায় পাওয়া যায় ও তাকে যবেহ করা যায় তবে তা খাওয়া হালাল। ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ “যদি এ ধরনের জন্তুগুলোকে তোমরা প্রাণ থাকা অবস্থায় যবেহ করতে সক্ষম হও তবে তোমরা সেগুলো খাও। কারণ ওগুলো পবিত্র।” সাঈদ ইবনে যুবাইর (রঃ), হাসান বসরী (রঃ) এবং সুদ্দীও (রঃ) এ অভিমত পোষণ করেন। হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যদি এ ধরনের জন্তুগুলোকে যবেহ করার পর ওগুলো লেজ, গাখা ও চোখ নাড়ে তবে সেগুলো খাওয়া হালাল। ইবনে জারীর (রঃ) হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যদি তোমরা প্রহারে, পতনে বা শিং-এর আঘাতে মৃতপ্রায় জন্তুকে হাত বা পা নাড়া অবস্থায় পাও তবে ওকে যবেহ করে খাও। তাউস, হাসান, কাতাদা, উবাইদ ইবনে উমাইর, যহহাক এবং আরও অনেকের মতে যদি যবেহ করার পর জন্তু তার কোন অংশকে নাড়ে এবং যবেহ করার পরও বুঝা যায় যে, ওর প্রাণ আছে তবে তা খাওয়া হালাল। এটাই অধিকাংশ ফিকাহবিদের মত। ইমাম আবু হানীফা (রঃ), ইমাম শাফিঈ (রঃ) এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলও (রঃ) এ অভিমতই পোষণ করেন। ইবনে ওয়াহ্হাব (রঃ) বলেন যে, একদা ইমাম মালিক (রঃ)-কে এমন বকরী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যাকে কোন হিংস্র জন্তু আঘাত করার ফলে নাড়ি ভুড়ি বেরিয়ে পড়ে। তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমার মতে ওকে যবেহ করার প্রয়োজন নেই।” আশহাব বলেন যে, ইমাম মালিক (রঃ)-কে আরও জিজ্ঞেস করা হয়, যদি হিংস্র জন্তু কোন বকরীকে আঘাত করে তার পিঠকে ভেঙ্গে দেয় তবে ওটা মারা যাওয়ার পূর্বে কি ওকে যবেহ করা যাবে? তিনি উত্তরে বলেনঃ “যদি আঘাত ওর গলা পর্যন্ত পৌঁছে যায় তবে আমার মতে ওটা খাওয়া ঠিক নয়। তবে যদি ওর দেহের কোন একাংশে আঘাত লেগে থাকে তাহলে আমার মতে ওটা খেতে কোন অসুবিধা নেই। তাকে আরো প্রশ্ন করা হয়, কোন হিংস্র জন্তু যদি বকরীর উপর লাফিয়ে পড়ে তার পিঠ ভেঙ্গে ফেলে তবে ওটা খাওয়া কি হালাল? তিনি জবাবে বলেনঃ “আমার মতে ওটা খাওয়া ঠিক নয়। কারণ এত বড় আঘাতের পরে ওটা জীবিত থাকতে পারে না। তাকে আরও জিজ্ঞেস করা হয়, যদি হিংস্র জন্তু উক্ত বকরীর পেটকে চিরে ফেলে অথচ ওর নাড়ি ভুড়ি বের না হয় তবে কি ওটা খাওয়া হালাল হবে? তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমার মতে ওটা খাওয়া যাবে না। আর এটাই ইমাম মালিক (রঃ)-এর মাযহাবপন্থীদের মত। ইবনে কাসীর (রঃ) ইমাম মালিক (রঃ)-এর উল্লিখিত মতামত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, উক্ত আয়াতটি একটি সাধারণ নির্দেশ বহন করে। ইমাম মালিক (রঃ) এ সাধারণ নির্দেশ হতে যে বিশেষ নির্দেশগুলো বের করেছেন। এর পক্ষে বিশেষ দলীল প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে। অবশ্য আল্লাহ পাকই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্থেই রাফে ইবনে খুদাইজ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ আমরা আগামীকাল শক্রর সম্মুখীন হবো। এমতাবস্থায় আমাদের সাথে যদি কোন ছুরি না থাকে তবে বাঁশের ধারাল অংশ দ্বারা আমরা যবেহ করতে পারব কি? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ যদি রক্ত প্রবাহিত করে এবং যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেয়া হয় তবে তোমরা ঐ জন্তু খাও। কিন্তু দাঁত না নখ দ্বারা কোন জন্তু যবেহ করা যাবে না। আর এর কারণ সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে এই বলি যে, দাঁত হচ্ছে হাড় স্বরূপ, আর নখ হচ্ছে আবিসিনিয়ার অমুসলিমদের অস্ত্র। দারেকুতনী (রঃ) যে হাদীসকে মারফু হাদীস হিসেবে বর্ণনা করেছেন সে সম্পর্কে মন্তব্যের অবকাশ আছে। হযরত উমার (রাঃ) হতে যে মওকুফ হাদীসটি বর্ণিত আছে ওটাই অধিক বিশুদ্ধ। হাদীসটি নিম্নরূপঃ কণ্ঠ ও লুব্বা যবেহ করার প্রকৃত স্থান এবং তোমরা প্রাণ বের হওয়ার জন্যে তাড়াহুড়া করো না।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মুসনাদে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ কণ্ঠ ও লুব্বর মধ্যে যবেহ করাই কি সঠিক? তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ ‘তার রানে আঘাত করলেও তোমার জন্যে যথেষ্ট হবে।’ সনদের দিক থেকে এটা একটা বিশুদ্ধ হাদীস। তবে হাদীসের নির্দেশটি ঐ বিশেষ অবস্থায় প্রযোজ্য হবে যখন জন্তুটির কণ্ঠ বা লুব্বাতে যবেহ করা সম্ভবপর হবে না।
(আরবী) মুজাহিদ এবং ইবনে জুরাইদ বলেন যে, কাবা শরীফের এলাকায় অবস্থিত একটি পাথরকে (আরবী) বলা হয়। ইবনে জুরাইদ আরও বলেন যে, সেখানে ৩৬০টি পূজার বেদী ছিল। জাহেলিয়াত যুগের লোকেরা এ বেদীগুলোর নিকটে পশু বলি দিত এবং তারা পবিত্র কা’বা গৃহের নিকটবর্তী বেদীগুলোতে বলি দেয়া পশুগুলোর রক্ত ছিটিয়ে দিতো। তারা উক্ত পশুগুলোর গোশত বেদীতে রেখে দিতো। আরও অনেক তাফসীরকারকও এ বর্ণনা দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করেন এবং পূজার বেদীর বলি দেয়া পশুগুলোকে খাওয়া হারাম করে দেন। এমনকি পূজার বেদীর উপর বলিদানকৃত পশুগুলোকে হত্যা করার সময় আল্লাহর নাম নিলেও তা খাওয়া হারাম। কারণ এটা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। কেননা, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) এ জাতীয় শিরককে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছেন। আর এটা হারাম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে যবেহ করা জন্তুর হারাম হওয়া সম্পর্কিত নির্দেশ ইতিপূর্বেই দেয়া হয়েছে।
(আরবী) অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তীরের সাহায্যে অংশ বণ্টন করাও তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে। (আরবী) শব্দের একবচন (আরবী) যুলাম। শব্দটি। কখনো কখনো একে যালামও পড়া হয়। অজ্ঞতার যুগে আরবরা এ তীরের সাহায্যে ভাগ্য নির্ধারণ করতো। সেখানে তিনটি তীর থাকতো। একটিতে লিখা থাকতো (আরবী) বা কর। দ্বিতীয়টিতে লিখা থাকতো বা (আরবী) করো না। আর তৃতীয়টিতে কিছুই লিখা থাকতো না। কারো কারো বর্ণনানুযায়ী প্রথমটিতে লিখা থাকতো (আরবী) অর্থাৎ আমার প্রভু আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। দ্বিতীয়টিতে লিখা থাকতো (আরবী) অর্থাৎ আমার প্রভু আমাকে নিষেধ করেছেন। আর তৃতীয়টিতে কিছুই লিখা থাকতো না। যখন তাদের কোন কাজে দ্বিধা-সংকোচ আসতো তখন তারা এ তীর নিক্ষেপ করতো। যদি নির্দেশসূচক তীরটি উঠতো তখন তারা ঐ কাজটি করতো।
নিষেধসূচক তীরটি উঠলে তারা ঐ কাজটি থেকে বিরত থাকতো। আর শূন্য তীরটি উঠলে তারা পুনরায় তীর নিক্ষেপ করতো। (আরবী) শব্দটি আরবী ভাষায় তীরের দ্বারা অংশ অন্বেষণ করার অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটাই আবু জাফর ইবনে জারীরের অভিমত। ইবনে আবি হাতিম (রঃ) ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, (আরবী) এমন ধরনের তীরকে বলা হতো যদ্বারা তারা তাদের বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। মুজাহিদ, ইবরাহীম নাখঈ, হাসান বসরী এবং মুকাতিল ইবনে হাইয়ান থেকেও এই ধরনের বর্ণনা রয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক এবং অন্যান্যদের মতে কুরাইশদের সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মূর্তিটির নাম ছিল হুবল। ওটা পবিত্র কাবা গৃহের ভেতরের কূপের মধ্যে পোঁতা ছিল। কাবা শরীফের জন্যে যে সমস্ত উপঢৌকন ও অন্যান্য দ্রব্যাদি আসতো তা উক্ত কূপে সংরক্ষিত রাখা হতো। হুবলের নিকট সাতটি তীর রাখা হতো, এ তীরগুলোতে কিছু লিখা থাকতো। তাদের বিভিন্ন কাজে যখন দ্বিধা-সংকোচের সৃষ্টি হতো তখন তারা এ তীরগুলো নিক্ষেপ করতো এবং তীরের নির্দেশানুযায়ী কাজ করতো। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফের হাদীসে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন কা’বা গৃহে প্রবেশ করেন তখন তিনি তথায় হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর পূর্ণ মূর্তি দেখতে পান। তাদের দু’হাতে তীর রাখা ছিল। নবী করীম (সঃ) তখন বলেনঃ “আল্লাহ তাদেরকে (অজ্ঞতা যুগের আরবদেরকে) ধ্বংস করুন। কারণ তারা জানতো যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাঈল (আঃ) কখনও ভাগ্য নির্ধারণে এ তীর ব্যবহার করতেন না।” সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আরও বর্ণিত আছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং আবু বকর (রাঃ) মদীনায় হিজরতের জন্যে রওয়ানা হন তখন। সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জাশাম তাদেরকে ধরে জীবিতাবস্থায় মক্কায় ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সুরাকা বলেন যে, তিনি তাঁরেদকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবেন কি না তা বের হওয়ার পূর্বেই তীর নিক্ষেপ করে জানবার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেখা গেল যে, তীর টানার ফলে তার অপছন্দনীয় বস্তুটি প্রকাশ পেয়েছে। অর্থাৎ তিনি তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারবেন না। এরপর তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারও তীর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর অপছন্দনীয় বস্তুটি প্রকাশ পেতে থাকে। এতদ্সত্ত্বেও তিনি তাঁদের অন্বেষণে বের হন। অবশ্য তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবনে মিরদুওয়াই হযরত আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ভবিষ্যদ্বাণী করে অথবা তীরের দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করে এবং কোন বিশেষ ঘটনাকে অশুভ মনে করে সফর হতে বিরতণ থাকে, সে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।’ হযরত মুজাহিদ (রহঃ) (আরবী) এর ব্যাখ্যায় আরও বলেন যে, (আরবী) বলতে আরবদের জুয়াখেলার তীর এবং পারস্য ও রোমবাসীদের -কে বুঝানো হতো। তাফসীরকারক বলেন যে, মুজাহিদের এ মত সম্পর্কে মন্তব্যের অবকাশ আছে। তবে এটা বলা যেতে পারে যে, আরবরা তীর দ্বারা জুয়া খেলতো এবং ইস্তাখারা করতো। আল্লাহই এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জানেন।
মহান আল্লাহ তীর এবং জুয়াখেলা এ দু’টিকে একই সাথে বর্ণনা করেছেন। যেমন এ সূরার শেষাংশে আল্লাহ পাক বলেনঃ “হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী এবং ভাগ্য নির্ধারক তীর ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা ওটা বর্জন কর। যেন তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ-জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায হতে বাধা দিতে চায়। তবুও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না” ঠিক এমনিভাবে এখানেও আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করা জঘন্যতা, ভ্রষ্টতা, মূখতা এবং একটি শিরকী কাজ। আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তারা যখন তাদের কোন কাজে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয় তখন যেন তারা আল্লাহর ইবাদত করে, তাদের বাঞ্ছিত কাজের জন্যে ইসতাখারা করে এবং আল্লাহর কাছে তাদের কাজের জন্যে মঙ্গল কামনা করে। মুসনাদে আহমাদ, সহীহ বুখারী এবং সুনান গ্রন্থসমূহে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে যাবতীয় কাজে পবিত্র কুরআনের শিখানোর মত করে ইসতাখারা করা শিক্ষা দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ যখন তোমাদের কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ এসে পড়বে তখন তোমরা দু’রাকআত নফল নামায পড়ে নিয়ে নিম্নের দু’আটি পড়বেঃ (আরবী) অনুবাদঃ “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আপনার জ্ঞানের মাধ্যমে মঙ্গল কামনা করছি এবং আপনার ক্ষমতার ওসিলায় আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি। আপনার নিকট আপনার মহান দান যাজ্ঞা করছি। কারণ আপনি ক্ষমতাবান আর আমি অক্ষম। আপনি জানেন আর আমি কিছুই জানি না। আপনি অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে সম্যক অবগত। হে আল্লাহ! আপনি যদি জানেন যে, এ কাজে (কাজের নাম বলতে হবে) আমার দ্বীন, দুনিয়া, ইহজীবন ও পরজীবন অথবা বর্তমান বা ভবিষ্যতের জন্যে কোন মঙ্গল নিহিত রয়েছে, তবে আপনি তা আমার জন্যে নির্ধারিত করে দিন এবং সহজ করে দিন, অতঃপর তাতে বরকত দান করুন। হে আল্লাহ! যদি আপনি জানেন যে, আমার এ কাজে আমার দ্বীন, দুনিয়া, ইহজীবন ও পরজীবনে কোন অমঙ্গল রয়েছে, তবে আমাকে তা হতে বিরত রাখুন এবং উক্ত কাজকেও আমা হতে দূরে রাখুন। আর যে কাজে আমার জন্যে মঙ্গল রয়েছে তা আমার জন্যে নির্ধারিত করে দিন। এবং ঐ কাজে আমার সন্তুষ্টি দান করুন।” উক্ত দু’আয় বর্ণিত শব্দগুলো মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ “হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এ হাদীসটি একটি হাসান সহীহ এবং গারীব হাদীস। এ হাদীসটিকে আমরা শুধু আবুল মাওয়ালীর সনদের মাধ্যমে পাই।”
(আরবী) আলী ইবনে আবি তালহা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন যে, কাফিররা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেছে। অর্থাৎ তারা তোমাদের ধর্মের সাথে তাদের ধর্মকে মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে। আতা ইবনে আবি রাবাহ, সুদ্দী ও মুকাতিল ইবনে হাইয়ান হতেও এ ধরনের বর্ণনা রয়েছে। আয়াতের এ অর্থ বহনকারী একটি সহীহ হাদীস পাওয়া যায়। হাদীসটি নিম্নরূপঃ
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আরব উপদ্বীপের নামাযীগণ শয়তানের পূজা করবে, শয়তান এটা থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। তবে সে তাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে থাকবে।” উক্ত আয়াতটির অর্থ এটাও হতে পারে যে, মক্কার মুশরিকগণ মুসলমানদের মত রূপ ধারণ করার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে। কারণ, ইসলামের নির্দেশাবলী এ দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে বহু পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। এ জন্যেই তো আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তারা ধৈর্য ধারণ করে, কাফিরদের বিরোধিতায় দৃঢ় তাকে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় না করে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলেছেনঃ “কাফিরগণ কর্তৃক তোমাদের বিরোধিতা করা হলে তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, বরং তোমরা আমাকে ভয় কর। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করবো, তাদের উপর বিজয় দান করবো এবং তোমাদেরকে হিফাজত করবো যেন তারা তোমাদের ক্ষতি করতে না পারে। আর সর্বোপরি দুনিয়া ও আখিরাতে আমি তোমাদেরকে তাদের উপর বিজয় দান করবো।”
(আরবী) এটা উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার প্রতি আল্লাহর মহান দান। কারণ, তিনি এ উম্মতের জীবন বিধানকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন, যার ফলে তারা অন্য বিধানের মুখাপেক্ষী নয়। এমনিভাবে তিনি তাদের নবী (সঃ)-কে ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ বা সর্বশেষ নবী করেছেন এবং অন্য কোন নবীর মুখাপেক্ষী করেননি। আর তাদের নবীকে সমগ্র মানব জাতির ও বিশ্ববাসীর নবী করে পাঠিয়েছেন। তিনি যে বস্তুকে হালাল করেছেন সেটাই হালাল এবং যেই বস্তুকে হারাম করেছেন সেটাই হারাম। তিনি যে দ্বীনকে প্রবর্তন করেছেন ওটাই একমাত্র দ্বীন এবং তিনি যে সংবাদ প্রদান করেছেন ওটা ন্যায় ও সত্য তাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা বা বৈপরিত্য নেই। যেমন আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেছেনঃ “(হে। নবী!) তুমি যে সমস্ত সংবাদ দিয়েছ সেগুলো সত্য এবং যে সমস্ত আদেশ ও নিষেধ করেছ সেগুলো ন্যায় নীতি ভিত্তিক।” আল্লাহ এ উম্মতের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করার মাধ্যমে তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছেন। আর এজন্যেই তিনি বলেছেনঃ “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছি এবং তোমাদের জন্যে আমার দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছি। আর ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছি। সুতরাং তোমরা ওটাকে তোমাদের নিজেদের জন্যে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হও। কেননা, ওটা সেই দ্বীন যাকে আল্লাহ ভালবাসেন ও পছন্দ করেন। আর এ দ্বীনসহ তিনি তাঁর সম্মানিত রাসূলদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসূল (সঃ)-কে পাঠিয়েছেন। এ দ্বীনসহ তিনি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থকে অবতীর্ণ করেছেন। হযরত আলী ইবনে তালহা ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন যে, দ্বীনের দ্বারা ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাঁর নবী ও মুমিনদেরকে এ আয়াতের দ্বারা এ সংবাদ প্রদান করেন যে, তিনি তাদের ঈমানকে পরিপূর্ণ করেছেন। সুতরাং তারা আর কখনও এর চেয়ে অধিক বস্তুর মুখাপেক্ষী হবে না। আর আল্লাহ যখন এ দ্বীনকে একবার পরিপূর্ণতা দান করেছেন তখন তিনি আর কখনও তাকে অসম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাবেন না। আল্লাহ একবার যখন ওর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন তখন আর কখনও ওর প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন না। আসবাত সুদ্দী হতে বর্ণনা করেন যে, এ আয়াত আরাফার দিনে অবতীর্ণ হয়। এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর হালাল এবং হারাম সম্পর্কিত আর কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়নি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ হজ্ব হতে প্রত্যাবর্তনের পরই ইন্তেকাল করেন। আসমা বিনতে উমাইস বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে হজ্ব করেছিলাম। যখন আমরা সফরের অবস্থায় ছিলাম তখন একদিন হঠাৎ জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর বাহনের উপর উপবিষ্ট অবস্থায় একটু নীচের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বাহনটি তখন অহীর ভার সহ্য করতে না পারায় বসে পড়ে। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর শরীরের উপর আমার চাদরটি বিছিয়ে দিলাম।” ইবনে জারীর এবং আরও অনেকের মতে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ আরাফাত দিবসের ৮১ দিন পরে ইন্তেকাল করেন। ইবনে জারীর আনতারার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলেন যে, উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার দিনটি ছিল হজ্বে আকবরের দিন। এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত উমার (রাঃ) কাঁদতে লাগলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করেন। উমার (রাঃ) বলেনঃ “আমরা এ দ্বীন সম্পর্কে আরও বেশী কিছু আশা করছিলাম। কিন্তু এটা যখন পূর্ণতা লাভ করেছে, তখন সাধারণ নিয়মানুযায়ী এখন তা অবনতির দিকে যেতে পারে।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তুমি সত্য কথাই বলেছো।” এ হাদীসের অর্থের স্বপক্ষে অন্য একটি সহীহ হাদীস এসেছে, হাদীসটি নিম্নরূপঃ
“ইসলাম স্বল্প সংখ্যক লোক নিয়ে শুরু হয়েছিল এবং অতিসত্বরই তা স্বল্প সংখ্যার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। অতএব এ স্বল্প সংখ্যক লোকের জন্যে সুসংবাদ।” ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) তারিক ইবনে শিহাব হতে বর্ণনা করেন যে, একজন ইয়াহূদী হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট এসে বলেনঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! আপনাদের ধর্মীয় গ্রন্থে একটি আয়াত আছে, তা যদি ইয়াহুদীদের উপর অবতীর্ণ হতো তবে আমরা ঐ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিনটিকে একটি ঈদের দিন হিসেবে গণ্য করতাম।” তখন হযরত উমার (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আয়াতটি কি?” উত্তরে ইয়াহূদী বলেঃ (আরবী)-এ আয়াতটি। হযরত উমার (রাঃ) তখন বললেনঃ “আল্লাহর শপথ! যে দিনে ও যে সময়ে উক্ত আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল আমি উক্ত দিন ও সময় সম্পর্কে অবগত আছি। ওটা ছিল আরাফার দিন শুক্রবার সন্ধ্যার সময়।” ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) এ হাদীসটিকে তাদের গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। ইমাম বুখারী (রঃ) তাঁর সহীহ গ্রন্থের কিতাবুত তাফসীরে এ হাদীসটি তারিক হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন যে, ইয়াহুদীগণ হযরত উমার (রাঃ) বললোঃ “আপনারা আপনাদের পবিত্র কুরআনের এমন একটি আয়াত পাঠ করে থাকেন যে, যদি ঐ আয়াতটি আমাদের ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের উপর অবতীর্ণ হতো তবে আমরা ঐ দিনকেই ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতাম।” তখন হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আমি এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় ও স্থান সম্পর্কে ভালভাবে অবগত আছি। আর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন কোথায় ছিলেন সেটাও জানি। উক্ত দিনটি ছিল আরাফার দিন এবং আল্লাহর শপথ! আমিও সে সময় আরাফায় ছিলাম।” সুফিয়ান বলেনঃ “আরাফার দিনটি শুক্রবার ছিল কি-না এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে।” ইবনে কাসীর (রঃ) বলেনঃ সুফিয়ান যদি এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে থাকেন যে, শুক্রবারের কথাটি হাদীসের বর্ণনার মধ্যে রয়েছে কি-না, তবে এটা হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে তাঁর অসতর্কতা। কারণ, তিনি সন্দেহ করেছেন যে, তাঁর শায়েখ তাঁকে শুক্রবারের কথা বলেছেন কি বলেননি। আর যদি তার এ ব্যাপারে সন্দেহ হয়ে থাকে যে, বিদায় হজ্বের বছর আরাফায় অবস্থান শুক্রবার দিন হয়েছিল কি-না? তবে আমার ধারণায় এ সন্দেহ সুফিয়ান সওরী কর্তৃক হতে পারে না। কারণ, এটা এমন একটি জানা ও প্রসিদ্ধ ঘটনা যাতে মাগাযী’ ও ‘সিয়র লেখক এবং ফকীহগণ একমত। এ ব্যাপারে এতো অধিকসংখ্যক প্রসিদ্ধ হাদীস বর্ণিত রয়েছে যে, এতে সন্দেহের কোন অবকাশই থাকতে পারে না। অবশ্য আল্লাহই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন।
হযরত উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি বহু সনদের মাধ্যমেও বর্ণিত হয়েছে। ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত কা’ব (রঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে বলেনঃ “যদি অন্য কোন উম্মতের উপর এ আয়াতটি অবতীর্ণ হতো তবে তারা ঐ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিনটিকে একটি ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতো এবং সেই দিনে তারা সকলেই একত্রিত হতো।”তখন হযরত উমার (রাঃ) হযরত কা’ব (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ওটা কোন, আয়াত?” তিনি উত্তরে বললেনঃ (আরবী)-এ আয়াতটি। তখন হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আমি এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিন ও সময় সম্পর্কে জানি। ওটা ছিল জুমআ ও আরাফার দিন। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, এ দু’দিনই আমাদের ঈদের দিন।” ইবনে জারীর (রঃ) আম্মারা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, একদা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)। আয়াতটি পাঠ করেন। তখন একজন ইয়াহূদী তাঁকে বলেনঃ “যদি এ আয়াতটি আমাদের উপর অবতীর্ণ হতো তবে আমরা ওর অবতীর্ণ হওয়ার দিনকেই ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতাম।” উত্তরে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “ওটা দু’টি ঈদের দিনে অবতীর্ণ হয়েছে। একটি ঈদের দিন এবং অপরটি জুম’আর দিন।” হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, .. (আরবী) আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর আরাফার দিন সন্ধ্যার সময় অবতীর্ণ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) দণ্ডায়মান অবস্থায় ছিলেন। আমর ইবনে কায়েস আসসাকুনী বলেন যে, তিনি মু’আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাঃ)-কে মিম্বরের উপর দণ্ডায়মান অবস্থায় … (আরবী) পূর্ণ আয়াতটি তিলাওয়াত করতে শুনেন। অতঃপর মুআবিয়া (রাঃ) বলেনঃ “এ আয়াতটি আরাফার দিন অবতীর্ণ হয়। নবী করীম (সঃ) সে সময় মাওকাফে অবস্থান করছিলেন। ইবনে জারীর (রঃ), ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) এবং তিবরানী (রঃ) তাঁদের সনদের মাধ্যমে হযরত আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সঃ) সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেন, সোমবার দিন তিনি মক্কা হতে হিজরত করেন, সোমবার দিন তিনি মদীনায় প্রবেশ করেন এবং সোমবার দিন তিনি বদরের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এ সোমবার দিন সূরা মায়িদাহ্ তথা … (আরবী) আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং সোমবারের যিকরের (ইবাদতের) অধিক মূল্য দেয়া হয়েছে। ইবনে কাসীর (রঃ) এ হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ হাদীসের সংজ্ঞানুযায়ী এটি একটি ‘গারীব হাদীস এবং এর সনদ দুর্বল। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) তার সনদের মাধ্যমে ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সঃ) সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেছেন, সোমবার দিন তাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে, সোমবার দিন তিনি মক্কা হতে মদীনার দিকে হিজরত করেছেন এবং সোমবার দিন হাজরে আসওয়াদকে স্থাপন করা হয়েছে। তাফসীরকারক বলেনঃ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)-এর এ বর্ণনায় সোমবার দিন সূরা মায়েদাহ অবতীর্ণ হওয়ার উল্লেখ নেই। আল্লাহ পাক এ বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত।
ইবনে কাসীর (রঃ) আরও বলেনঃ সম্ভবতঃ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলতে চেয়েছিলেন যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার দিন তিন প্রকারের ঈদের দিন ছিল। কিন্তু বর্ণনাকারী ভুল বশতঃ (আরবী) শব্দের দ্বারা সোমবারের অর্থ করেছেন। আল্লাহই এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী জানেন।
ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার সময় সম্পর্কে আরও দু’টি অভিমত রয়েছে। একটি অভিমত হলো এই যে, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার দিন কারও জানা নেই। ইবনে জারীর এ অভিমতের স্বপক্ষে ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে একটি হাদীসের উল্লেখ করেছেন। আর একটি মতানুযায়ী বলা হয়েছে যে, এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিদায় হজ্বের সফরে অবতীর্ণ হয়েছে। ইবনে জারীর এ হাদীসটি তার সনদের মাধ্যমে রাবী ইবনে আসাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। ইবনে কাসীর (রঃ) বলেনঃ ইবনে মিরদুওয়াই তাঁর সনদের মাধ্যমে আবু সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর গাদিরে জুমের দিন অবতীর্ণ হয়েছে এবং ঐদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বলেছিলেনঃ “আমি যার নেতা আলীও তার নেতা।” ইবনে মিরদুওয়াই এ হাদীসটি হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতেও বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনায় দেখা যায় যে, ঐদিনটি ছিল ১৮ই যিলহজ্ব। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিদায় হজ্ব থেকে প্রবর্তনের দিন। ইবনে কাসীর (রঃ) উপরোক্ত মতগুলোর কোনটিই শুদ্ধ নয় বলে মন্তব্য করেছেন। বরং সঠিক ও সন্দেহাতীত অভিমত এই যে, আয়াতটি আরাফার দিন অবতীর্ণ হয়েছে। আর সেদিন ছিল জুম’আর দিন। হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ), আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ), ইসলামের প্রথম বাদশাহ্ মু’আবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রাঃ), কুরআনের ভাষ্যকার আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ) হতেও বর্ণনা করা হয়েছে যে, আরাফার দিনটি ছিল জুম’আর দিন। শা’বী, কাতাদাহ ইবনে দিমাআহ, শাহর ইবনে হাওশাব এবং বহু ইমাম ও আলেমেরও অভিমত এটাই। ইবনে জারীর তাবারীও এ মতটিই গ্রহণ করেছেন।
(আরবী) অর্থাৎ আল্লাহ যে সমস্ত বস্তুকে হারাম করেছেন, প্রয়োজনের তাকিদে যদি কোন লোক ওগুলো খেতে বাধ্য হয় তবে সেগুলো খেতে পারে। আল্লাহ এ ব্যাপারে তার প্রতি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। কেননা, আল্লাহ জানেন যে, সে অপারগ ও অক্ষম হয়ে হারাম বস্তুকে গ্রহণ করেছে। সুতরাং তিনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। ইবনে হিব্বানের সহীহ গ্রন্থে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে যে কাজ করার অনুমতি প্রদান করেছেন তা পালন করাকে তিনি ঐরকম পছন্দ করেন যেমন তিনি তার অবাধ্য না হওয়াকে পছন্দ করে থাকেন।
আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)-এর মুসনাদে হাদীসটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুমতিকে গ্রহণ করলো না সে যেন আরাফার পাহাড় সমূহের সমান গুনাহ্ করলো। এজন্যেই ফিকাহূবিদগণের মতে কখনও মৃত জন্তু খাওয়া ওয়াজিব এবং ওটা ঐ সময়, যখন হালাল বস্তু পাওয়া যায় না, আর ক্ষুধার কারণে মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। আবার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কখনও মৃত জন্তু খাওয়া মুস্তাহাব এবং কখনও মুবাহ্। অবশ্য প্রয়োজনের তাকিদে হারাম বস্তু কি পরিমাণ গ্রহণ করা যাবে এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারও মতে যে পরিমাণ খেলে জান বাঁচে তার বেশী নয়। কারও মতে পেট ভরেও খাওয়া যাবে। আবার কারো কারো মতে পেট ভরে খাওয়াও যাবে এবং ভবিষ্যতের জন্যে রেখেও দেয়া যাবে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আহকাম সম্পর্কিত কিতাবে পাওয়া যাবে।
যদি কোন ব্যক্তি ক্ষুধার তাড়নায় বিব্রত হয়ে পড়ে, এমতাবস্থায় মৃত জন্তু পেলে বা ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শিকার পেলে সে কি মৃত জন্তু বা শিকারকৃত জন্তু খেয়ে নেবে না অন্যের খাদ্য তার বিনানুমতিতেই খেয়ে নেবে এবং পরে মালিককে সেই পরিমাণ খাদ্য দিয়ে দেবে, এ ব্যাপারে আলেমদের দু’ধরনের অভিমত রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (রঃ) হতে দু’ধরনের অভিমতই বর্ণিত হয়েছে। অধিকাংশ সাধারণ লোকের মধ্যে ধারণা প্রচলিত আছে যে, মৃতজন্তু হালাল হওয়ার জন্যে তিন দিন পর্যন্ত ক্ষুধার্ত থাকা শর্ত। ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন। যে, এ শর্ত ঠিক নয়, বরং যখনই কোন ব্যক্তি ক্ষুধার তাড়নায় মৃত খেতে বাধ্য ও মজবুর হয়ে পড়বে তখনই তার জন্যে তা খাওয়া জায়েয। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) তার সনদের মাধ্যমে আবু ওয়াকিদ আল লায়সী হতে বর্ণনা করেন যে, একদা সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ আমরা কখনও কখনও এমন স্থানে উপস্থিত হই সেখানে আমরা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি। তখন কোন্ কোন্ অবস্থায় আমাদের জন্যে মৃত জন্তু খাওয়া হালাল হবে? রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “যখন তোমরা সকাল ও সন্ধ্যায় কোন খাদ্য বা তরিতরকারী না পাও তখন তোমরা তা (মৃত জন্তু) খেতে পার।” হাদীসে উল্লিখিত সনদটি ইমাম আহমাদ একাই তাঁর গ্রন্থে এনেছেন। অবশ্য সনদটি সহীহ। কারণ, ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) সনদ সহীহ হওয়ার জন্যে যেসব শর্ত আরোপ করেছেন তা উক্ত শর্তগুলো পূরণ করে। এ হাদীসটি ইবনে জারীরও তার সনদের মাধ্যমে ইমাম আওযায়ী হতে বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ এ হাদীসটিকে “মুরসাল” সনদের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। উল্লেখ্য যে, যে সনদে কোন সাহাবীর নাম উল্লেখ থাকে না তাকে মুরসাল সনদ বলে। ইবনে জারীর তার সনদের মাধ্যমে ইবনে আউন হতে বর্ণনা করেন, আমি হাসানের নিকট সামুরার কিতাব দেখতে পাই এবং তার সম্মুখে ওটা পাঠ করি। তাতে লিপিবদ্ধ ছিল যে, সকাল বা সন্ধ্যায় খাদ্য পাওয়া না গেলে ঐ অবস্থাকে ক্ষুধার চরম অবস্থা বলে বিবেচনা করা যাবে। (আর এ অবস্থায় মৃত জন্তু খাওয়া যেতে পারে) হাসান বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ কোন অবস্থায় হারাম বস্তু খাওয়া যায়? তিনি উত্তরে বলেনঃ “যখন তুমি তোমার পরিবারবর্গের জন্যে দুধ অথবা অন্য খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করতে না পার তখন হারাম বস্তু (মৃত জন্তু) খেতে পার।” অপর একটি হাদীসে উল্লেখ আছে যে, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হালাল ও হারাম বস্তু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। উত্তরে তিনি বলেনঃ “তোমার জন্যে পবিত্র বস্তু খাওয়া হালাল এবং অপবিত্র বস্তু খাওয়া হারাম। তবে যদি তুমি কখনো কোন খাদ্য খেতে বাধ্য হও তাহলে হালাল বা হারাম বিবেচনা না করে খেতে পার। কিন্তু যে অবস্থায় তুমি তা পরিহার করে চলতে পার সে অবস্থায় তা খাওয়া হারাম।” ঐ ব্যক্তি তখন তাকে আবার জিজ্ঞেস করলো, উক্ত অনন্যোপায় অবস্থাটা কি? যে অবস্থায় আমার জন্যে হারাম খাওয়া সিদ্ধ এবং ঐ অবস্থাই বা কি, যে অবস্থা আমাকে হারাম বস্তু খাওয়া থেকে নিবৃত্ত রাখবে? রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “ঐ অবস্থাকে অনন্যোপায় অবস্থা বলা হয়, যে অবস্থায় তুমি কোন হালাল বস্তু না পাও অথচ তোমার আকাক্ষিত বস্তুগুলো হারাম বস্তু হিসেবে পেয়ে থাক। ঐ সময় তুমি ওগুলো দ্বারা প্রয়োজনমত তোমার পরিবার পরিজনকে খাওয়াও। তবে যখন ওগুলো পরিহার করে চলার অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন সেগুলো খাওয়া বন্ধ কর। আর অনুকূল অবস্থা বলতে ঐ অবস্থাকে বুঝায়, যে অবস্থায় তুমি তোমার পরিজনকে শুধুমাত্র রাতের বেলায় সামান্য পরিমাণ পানীয় বস্তু দিতে পার। এ অবস্থায় তুমি হারাম বস্তু পরিহার কর। কারণ এটা তোমার জন্যে অনুকূল অবস্থা। তাই এ অবস্থায় কোন হারাম খাওয়া জায়েয নয়।” ইমাম আবু দাউদ (রঃ) তাঁর সনদের মাধ্যমে নুয়ায়ী আল-আমেরীর মাধ্যমে বর্ণনা করেন যে, একদা তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ কোন অবস্থায় আমাদের জন্যে মৃত জন্তু খাওয়া হালাল? রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমাদের খাদ্য কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ আমরা সকালে এক পেয়ালা এবং বিকালে এক পেয়ালা দুধ পান করে থাকি। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এ অবস্থাকে ক্ষুধার্ত অবস্থা বলা যায়।” তিনি এ অবস্থায় তাঁদেরকে মৃত জন্তু খেতে অনুমতি দেন। ইমাম আবু দাঊদ (রঃ) এ হাদীসটিকে একাই তাঁর গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। ইবনে কাসীর (রঃ) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তারা সকাল ও বিকাল বেলায় যা খেতো তা তাদের জন্যে যথেষ্ট ছিলনা বলেই তাদের প্রয়োজন মিটানোর জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে মৃতজন্তু খেতে অনুমতি দিয়েছেন। ফিকাহবিদদের একটি দল এ হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করে বলেন যে, এ জাতীয় লোকদের জন্যে পেট ভরেও হারাম বস্তু খাওয়া জায়েয। শুধুমাত্র জীবন বাঁচানোর জন্যে খাওয়া যেতে পারে, এরূপ শর্ত তারা আরোপ করেননি। অবশ্য আল্লাহই এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী জানেন।
ইমাম আবু দাউদ (রঃ) তাঁর সনদের মাধ্যমে সামুরা হতে, আর একটি হাদীস বর্ণনা করেন যে, একটি লোক তাঁর পরিবার পরিজনসহ হাররা নামক স্থানে অবতরণ করে। তথায় এক ব্যক্তি তার উষ্ট্রীকে হারিয়েছিল। সে এ লোকটিকে বললোঃ ‘যদি তুমি আমার হারানো উটটি পাও তবে তোমার কাছে রেখে দিও।’ এরপর সে উষ্ট্ৰীটি পেল এবং বহু খোজাখুজির পরেও মালিকের কোন সন্ধান পেলো না। ইত্যবসরে এ উষ্ট্ৰীটি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লো। তখন তার স্ত্রী তাকে বললোঃ তুমি উষ্ট্রীটিকে যবেহ কর। কিন্তু সে যবেহ করতে অস্বীকার করলো এবং পরে উষ্ট্ৰীটি মারা গেল। মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী তাকে উষ্ট্রীটির চামড়া ছাড়াতে এবং ওর গোশত ও চর্বি শুকিয়ে নিতে বললো, যেন তারা তা খেতে পারে। তখন সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস না করে তা করতে অস্বীকার করলো। এর পর সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার কাছে কি এ পরিমাণ খাদ্য আছে যে, ওর ফলে তুমি এ মৃত উস্ত্রীর গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পার?” উত্তরে লোকটি বললোঃ না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাদেরকে তা খেতে অনুমতি দিলেন। বর্ণনাকারী বলেন যে, এরপর উষ্ট্রীর মালিক ফিরে আসে এবং লোকটি তাকে সমস্ত খবর খুলে বলে। উষ্ট্রীর মালিক তাকে বলে, তুমি প্রথমেই কেন উষ্ট্রীকে যবেহ করে খাওনি? সে উত্তরে বলেঃ আমি তোমার সামনে লজ্জিত হবো বলেই যবেহ করিনি।’ এ হাদীসটিও ইমাম আবূ দাউদ (রঃ) একাই বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসের আলোকে ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের অপর একটি দল দলীল গ্রহণ করেন যে, এ প্রকার লোকদের জন্যে হারাম বস্তু পেট ভরে খাওয়া, প্রয়োজনবোধে কিছু সময়ের জন্যে সঞ্চিত করা উভয়ই জায়েয। তবে আল্লাহ পাকই সবচেয়ে ভাল জানেন।
(আরবী) অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর নাফরমানীমূলক কাজে লিপ্ত না হয় তার জন্যেই এ প্রকারের হারাম বস্তু ভক্ষণ করা বৈধ। ইবনে কাসীর (রঃ) বলেনঃ মহান আল্লাহ সূরা মায়িদাহর এ আয়াতে শুধুমাত্র পাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের জন্যে হারাম বস্তু ভক্ষণ নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু সীমালংঘনকারীদের জন্যেও যে তা ভক্ষণ করা হারাম তার কোন উল্লেখ নেই। যেমন সূরা বাকারার আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। আয়াতটি নিম্নরূপঃ
“যারা অনন্যোপায় অবস্থায় অন্যায়কারী, কিন্তু সীমালংঘনকারী নয় তাদের কোন পাপ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” এ আয়াত হতে ফিকাহবিদগণের একটি দল প্রমাণ গ্রহণ করেন যে, যে ব্যক্তি সফরে নাফরমানীমূলক কাজে লিপ্ত থাকে, সে সফর সংক্রান্ত ব্যাপারে শরীয়তের শিথিলতা পাওয়ার যোগ্য নয়। কেননা, পাপ কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিদের জন্যে শিথিলতা প্রযোজ্য নয়। তবে আল্লাহ পাকই সবচেয়ে ভাল জানেন।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি জিনিস হারাম করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম হারাম বস্তু হিসেবে বলা হয়েছে, মৃত জিনিস। এখানে ‘মৃত’ বলে ঐ জন্তু বুঝানো হয়েছে, যা যবেহ্ ব্যতীত কোন রোগে অথবা স্বাভাবিকভাবে মরে যায়। এধরনের মৃত জন্তুর গোস্ত চিকিৎসা-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও মানুষের জন্যে ক্ষতিকর। তবে হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই প্রকার মৃতকে এ বিধানের বাইরে রেখেছেন, একটি মৃত মাছ ও অপরটি মৃত টিড্ডী। [মুসনাদে আহমদঃ ২/৯৭, ইবন মাজাহঃ ৩৩১৪]
[২] আয়াতে বর্ণিত দ্বিতীয় হারাম বস্তু হচ্ছে রক্ত কুরআনের অন্য আয়াতে (اَوْ دَمًا مَّسْفُوْحًا) বা ‘প্রবাহিত রক্ত’ [সূরা আল-আন’আম: ১৪৫] বলায় বুঝা যায় যে, যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তাই হারাম। সুতরাং কলিজা ও প্লীহা রক্ত হওয়া সত্ত্বেও হারাম নয়। পূর্বোক্ত যে হাদীসে মাছ ও টিভভীর কথা বলা হয়েছে, তাতেই কলিজা ও প্লীহা হালাল হওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
[৩] আয়াতে বর্ণিত তৃতীয় হারাম বস্তু হচ্ছে, শুকরের গোস্ত। গোস্ত বলে তার সম্পূর্ণ দেহ বুঝানো হয়েছে। চর্বি ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। [ইবন কাসীর]
[৪] আয়াতে বর্ণিত চতুর্থ হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু যা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। যদি যবেহ্ করার সময়ও অন্যের নাম নেয়া হয়, তবে তা খোলাখুলি শির্ক। এরূপ জন্তু সর্বসম্মতভাবে মৃতের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আরবের মুশরেকরা মূর্তিদের নামে যবেহ করত। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে কোন কোন মুর্খ লোক পীর-ফকীরের নামে যবেহ করে। যদিও যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে; কিন্তু জন্তুটি যেহেতু অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে জবেহ বা কুরবানী করা হয়, তাই এ সব জন্তুও আয়াত দৃষ্টে হারাম।
[৫] আয়াতে বর্ণিত পঞ্চম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু যাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে অথবা নিজেই কোন জাল ইত্যাদিতে আবদ্ধ অবস্থায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে গেছে। [ইবন কাসীর]
[৬] আয়াতে বর্ণিত ষষ্ঠ হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যা লাঠি অথবা পাথর ইত্যাদির প্রচন্ড আঘাতে নিহত হয়। যদি নিক্ষিপ্ত তীরের ধারাল অংশ শিকারের গায়ে না লাগে এবং তীরের আঘাতে শিকার নিহত হয়, তবে সে শিকারও এর অন্তর্ভুক্ত এবং হারাম। [ইবন কাসীর]
[৭] আয়াতে বর্ণিত সপ্তম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যা কোন পাহাড়, টিলা, উচু দালানের উপর থেকে অথবা কুপে পড়ে মরে যায়। এমনিভাবে কোন পাখিকে তীর নিক্ষেপ করার পর যদি সেটি পানিতে পড়ে যায়, তবে তা খাওয়াও নিষিদ্ধ। কারণ, এখানেও পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। [ইবন কাসীর]
[৮] আয়াতে বর্ণিত অষ্টম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যা কোন সংঘর্ষে নিহত হয়। যেমন রেলগাড়ী, মোটর ইত্যাদির নীচে এসে মরে যায় অথবা কোন জন্তুর শিং-এর আঘাতে মরে যায়। [ইবন কাসীর]
[৯] আয়াতে বর্ণিত নবম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যেটি কোন হিংস জন্তুর কামড়ে মরে যায়। [ইবন কাসীর] এগুলো ছাড়াও হাদীসে অন্যান্য আরো কয়েক ধরনের প্রাণী হারাম করা হয়েছে।
[১০] উপরোক্ত নয় প্রকার হারাম জন্তুর বর্ণনা করার পর একটি ব্যতিক্রম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, (اِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ) অর্থাৎ এসব জন্তুর মধ্যে কোনটিকে জীবিত অবস্থায় পাওয়ার পর যবেহ করতে পারলে হালাল হয়ে যাবে। এ ব্যতিক্রম প্রথমোক্ত চার প্রকার জন্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত হতে পারে না। কেননা, মৃত ও রক্তকে যবেহ্ করার সম্ভাবনা নাই এবং শূকর এবং আল্লাহ ব্যতিত অন্যের নামে উৎসর্গীকৃত জন্তু সত্তার দিক দিয়েই হারাম। এ দুটোকে যাবেহ্ করা না করা উভয়ই সমান। এ কারণে আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে, এ ব্যতিক্রম প্রথমোক্ত চারটি পরবতী পাঁচটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। অতএব আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, শেষোক্ত এ পাঁচ প্রকার জন্তুর মধ্যে যদি জীবনের স্পন্দন অনুভব করা যায় এবং তদবস্থায়ই বিসমিল্লাহ বলে যবেহ করে দেয়া হয়, তবে এগুলো খাওয়া হালাল হবে। [ইবনে কাসীর]
[১১] আয়াতে বর্ণিত দশম হারাম বস্তু হচ্ছে, ঐ জন্তু, যাকে নুছুবের উপর যবেহ্ করা হয়। নুছুব ঐ প্রস্তর বা বেদীকে বলা হয়, যা কাবা গৃহের আশেপাশে স্থাপিত ছিল। জাহেলিয়াত যুগে আরবরা এদের উপাসনা করত এবং এদের উদ্দেশ্যে জন্তু কোরবানী করত। একে তারা ইবাদত বলে গণ্য করত। জাহেলিয়াত যুগের আরবরা উপরোক্ত সব প্রকার জন্তুর গোস্ত ভক্ষণে অভ্যস্ত ছিল। আল্লাহ তা’আলা এগুলোকে হারাম করেছেন। [ইবন কাসীর] বর্তমানেও যদি কোথাও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও জন্য উৎসর্গ করার কোন বেদী বা কবর অথবা এ জাতীয় কিছু থাকে এবং সেখানে কেউ কোন কিছু যবেহ করে, তবে তাও হারাম হবে।
[১২] আয়াতে উল্লেখিত একাদশ হারাম বস্তুটি হচ্ছে, ইস্তেকসাম বিল আযলাম । যার অর্থ তীরের দ্বারা বন্টণকৃত বস্তু। (اَزْلَامٌ) শব্দটি (زَلَمٌ) এর বহুবচন। এর অর্থ ঐ তীর, যা জাহেলিয়াত যুগে ভাগ্য পরীক্ষার জন্যে নির্ধারিত ছিল। এ কাজের জন্যে সাতটি তীর ছিল। তন্মধ্যে একটিতে (نعم) (হ্যাঁ), একটিতে (لا) (না) এবং অন্যগুলোতে অন্য শব্দ লিখিত ছিল। এ তীরগুলো কা’বাগৃহের খাদেমের কাছে থাকত। কেউ নিজ ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলে অথবা কোন কাজ করার পূর্বে তা উপকারী হবে না অপকারী, তা জানতে চাইলে সে কাবার খাদেমের কাছে পৌঁছে একশত মুদ্রা উপটৌকন দিত। খাদেম তুন থেকে একটি একটি করে তীর বের করত। ‘হ্যাঁ’ শব্দ বিশিষ্ট তীর বের হয়ে আসলে মনে করা হত যে, কাজটি উপকারী। পক্ষান্তরে ‘না’ শব্দ বিশিষ্ট তীর বের হলে তারা বুঝে নিত যে, কাজটি করা ঠিক হবে না। হারাম জন্তুসমূহের বর্ণনা প্রসঙ্গে এ বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ এই যে, তারা এ তীরগুলো জন্তুসমূহের গোস্ত বন্টনেও ব্যবহার করত। কয়েকজন শরীক হয়ে উট ইত্যাদি যবেহ করে তা গোস্ত প্রাপ্য অংশ অনুযায়ী বন্টন না করে এসব জুয়ার তীরের সাহায্যে বন্টন করত। ফলে কেউ সম্পূর্ণ বঞ্চিত, কেউ প্রাপ্য অংশের চাইতে কম এবং কেউ অনেক বেশী গোস্ত পেয়ে যেত। এ কারণে হারাম জন্তুর বর্ণনা প্রসঙ্গে এ হারাম বন্টন পদ্ধতিও বর্ণনা করা হয়েছে। [ইবন কাসীর] আলেমগণ বলেন, ভবিষ্যৎ অবস্থা এবং অদৃশ্য বিষয় জানার যেসব পস্থা প্রচলিত আছে; যেমন ভবিষ্যৎ কথন বিদ্যা, হস্তরেখা বিদ্যা, ইত্যাদি সব (اسْتِقْسَام بِالْاَزْلَامِ) এর অন্তর্ভুক্ত এবং হারাম। (اسْتِقْسَام بِالْاَزْلَامِ) শব্দটি কখনও জুয়া অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যাতে গুটিকা নিক্ষেপ অথবা লটারীর নিয়মে অধিকার নির্ধারণ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা একে (مَيْسر) নাম দিয়ে হারাম ও নিষিদ্ধ করেছে। মোটকথা এ জাতীয় বস্তু দ্বারা কোন কিছু নির্ধারণ করা হারাম। [ফাতহুল কাদীর]
[১৩] অর্থাৎ অদ্য কাফেররা তোমাদের দ্বীনকে পরাভূত করার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে। কাজেই তোমরা তাদেরকে আর ভয় করো না। তবে আল্লাহকে ভয় কর। এ আয়াতাংশ যখন নাযিল হয়, তখন মক্কা এবং প্রায় সমগ্র আরব মুসলিমদের করতলগত ছিল। সমগ্র আরব উপত্যকায় ইসলামী বিধি-বিধান প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। তাই বলা হয়েছেঃ ইতিপূর্বে কাফেররা মুসলিমদের সংখ্যা ও শক্তি অপেক্ষাকৃত কম দেখে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার পরিকল্পনা করতো। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে এরূপ দুঃসাহস ও বল-ভরসা নাই। এ কারণে মুসলিমরা তাদের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হয়ে স্বীয় রবের আনুগত্য ও ইবাদতে মনোনিবেশ করুক। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আরব উপদ্বীপে মুসল্লীরা শয়তানের ইবাদত করবে এ ব্যাপারে সে নিরাশ হয়েছে, তবে সে তাদের মধ্যে গণ্ডগোল লাগিয়ে রাখতে পারবে”। [বুখারী: ১১৬২; আবু দাউদ: ১৫৩৮; তিরমিযী ৪৮০; ইবন মাজাহঃ ১৩৮৩] কোন কোন মুফাসসির বলেন, কাফেরদের নিরাশ হওয়ার অর্থ, তারা তোমাদের মত হবে এবং তোমাদের কর্মকাণ্ড তাদের মত হবে এ ব্যাপারে তারা নিরাশ হয়েছে, কারণ, তোমাদের গুণাগুণ তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। [ইবনে কাসীর]
[১৪] দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দেবার অর্থই হচ্ছে এর মধ্যে জীবনের সমস্ত প্রশ্নের নীতিগত ও বিস্তারিত জবাব পাওয়া যায়। হেদায়াত ও পথনির্দেশ লাভ করার জন্য এখন আর কোন অবস্থায়ই তার বাইরে যাবার প্রয়োজন নাই। সুতরাং এ নবীর পরে কোন নবী নেই। এ শরীআতের পরে কোন শরীআত নেই। এ শরীআতে যা যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে সত্য ও ইনসাফপূর্ণ। আল্লাহ বলেন, “সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ। তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই”। [সূরা আল-আন’আম: ১১৫] [ইবন কাসীর]
[১৫] আয়াতের এ অংশটি নাযিলের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। আরাফার দিন। এ দিনটি পূর্ণ বৎসরের মধ্যে সর্বোত্তম দিন। ঘটনাক্রমে এ দিনটি পড়েছিল শুক্রবারে। এর শ্ৰেষ্ঠত্বও সর্বজনবিদিত। স্থানটি হচ্ছে ময়দানে-আরাফাত। এ স্থানটিই আরাফার দিনে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত নাযিল হওয়ার বিশেষ স্থান। সময় আছরের পর-যা সাধারণ দিনগুলোতেও বরকতময় সময়। বিশেষতঃ শুক্রবার দিনে। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, এ দিনের এ সময়েই দো’আ কবুলের মূহুর্তটি ঘনিয়ে আসে। আরাফার দিনে আরও বেশী বৈশিষ্ট্য সহকারে দোআ কবুলের সময়। হজ্জের জন্যে মুসলিমদের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক সমাবেশ। প্রায় দেড় লক্ষ সাহাবায়ে-কেরাম উপস্থিত। রাহমাতুল্লিল-আলামীন সাহাবায়ে-কেরামের সাথে আরাফার সে বিখ্যাত পাহাড়ের নীচে স্বীয় উষ্ট্রী আদ্ববার পিঠে সওয়ার। সবাই হজ্জের প্রধান রোকন অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানরত। এসব শ্রেষ্ঠত্ব, বরকত ও রহমতের ছত্রছায়ায় উল্লেখিত পবিত্র আয়াতটি নাযিল হয়। [দেখুন, তিরমিযীঃ ৩০৪৪]
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ এ আয়াত কুরআনের শেষ দিকের আয়াত। এরপর বিধি-বিধান সম্পর্কিত আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। বলা হয় যে, শুধু উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শনমূলক কয়েকখানি আয়াত-এর পর নাযিল হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র একাশি দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন। কেননা, দশম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ তারিখে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং একাদশ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাত পান। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] এখান থেকে ঐ সমস্ত নিষিদ্ধ বা হারামকৃত (পশুর) ব্যাপারে আলোচনা শুরু হচ্ছে, যার ইঙ্গিত সূরার প্রারম্ভে দেওয়া হয়েছে। আয়াতের এই অংশটুকু সূরা বাক্বারাতে উল্লেখ হয়েছে। (দেখুন আয়াত নং ২:১৭৩)
[২] যাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে অথবা নিজেই কোনভাবে ফাঁস লাগা অবস্থায় শবাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে, উভয় অবস্থায় এই মৃত (পশু ভক্ষণ) করা হারাম।
[৩] অর্থাৎ, পাথর অথবা লাঠি অথবা অন্য কোন জিনিস দ্বারা আঘাত করার কারণে বিনা যবেহতে মারা গেছে। জাহেলী যুগে এই সমস্ত পশুকে (হালাল মনে করে) ভক্ষণ করা হত। ইসলামী শরীয়তে তা নিষেধ করে দেওয়া হয়ছে। বন্দুকের শিকার; বন্দুক দ্বারা শিকার করা হয়েছে এমন পশুর ব্যাপারে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাওকানী (রঃ) বন্দুক দ্বারা শিকার করা পশুর ব্যাপারে একটি হাদীস থেকে প্রমাণ উল্লেখ করে তা হালাল বলেছেন। অর্থাৎ (শিকারী) যদি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে গুলি ছুঁড়ে এবং যবেহ করার পূর্বেই শিকার মারা যায়, তাহলে তাঁর মতানুসারে তা ভক্ষণ করা বৈধ। (ফাতহুল ক্বাদীর) (অন্য মতে, যে বন্দুকের গুলি শিকারের দেহ ভেদ করে যায়, চামড়া কেটে ফেলে রক্তপাত ঘটায় সে বন্দুকের শিকার হালাল। পক্ষান্তরে ভেদ না করে কেবল আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেলে তা খাওয়া বৈধ নয়।) (সিলসিলাহ সহীহাহ ৫/৫১১)
[৪] (ঐ পশু) যে কোনভাবে পড়ে অথবা কেউ পাহাড় বা অন্য কোন উঁচু জায়গা থেকে ধাক্কা মারার কারণে পড়ে গিয়ে মারা যায়।
[৫] نطيحة , منطوحة ঐ পশুকে বলা হয়; যাকে অন্য পশু শিং দ্বারা ধাক্কা মেরেছে বা শিং-লড়ায়ে বিনা যবাইয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।
[৬] অর্থাৎ সিংহ, চিতা ও নেকড়ে বাঘ ইত্যাদি (শিকারী বা ছেদক দাঁতবিশিষ্ট) হিংস্রজন্তু যদি কোন শিকারকে নিজে খাওয়ার উদ্দেশ্যে ধরার ফলে মৃত্যু হয়েছে (এমন পশু)। জাহেলী যুগে এই ধরণের মৃত জানোয়ার খাওয়া হত। (কিন্ত ইসলাম এই ধরণের মৃত পশু খাওয়া হারাম করে দিয়েছে।)
[৭] অধিকাংশ মুফাসসিরগণের নিকটে এই ব্যতিক্রম পূর্বে উল্লিখিত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত জন্তু, ধারবিহীন কিছু দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত জন্তু, পতনে মৃত জন্তু, শৃঙ্গাঘাতে মৃত জন্তু এবং হিংস্র পশুর খাওয়া জন্তুর ব্যাপারে। অর্থাৎ, ব্যতিক্রম হল, যদি ঐ সকল পশুকে তোমরা এমন অবস্থায় পাও যে, তার মৃত্যু হয়নি; এখনো জীবিত আছে, তারপর তাকে শরয়ী পদ্ধতিতে যবেহ কর, তাহলে তোমাদের জন্য (ঐ পশু) খাওয়া বৈধ হবে। জীবিত থাকার চিহ্ন হল, যবেহ করার সময় যেন তার হাত-পা নড়ে ওঠে। কিন্তু ছুরি চালানোর সময় যদি এই অবস্থা না হয়, তাহলে জানতে হবে সে পশুটি মৃত। যবেহর শরয়ী পদ্ধতি হল, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ধারালো ছুরি দ্বারা এমনভাবে তার গলায় পেঁচাতে হবে যেন তার সমস্ত মোটা শিরাগুলি কেটে যায়। যবেহ ছাড়াও শরীয়তে ‘নহর’ করা বৈধ; যার পদ্ধতি হল, পশু দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সিনায় ছুরি (বা বর্শা) দ্বারা আঘাত করতে হবে; যাতে তার কণ্ঠনালী ও রক্তবাহী বিশেষ শিরা কেটে যায় এবং সমস্ত রক্ত প্রবাহিত হয়ে যায়।
[৮] মুশরিকগণ তাদের পূজ্যপ্রতিমার নিকটে পাথর বা অন্য কিছু স্থাপন করে একটি নির্দিষ্ট জায়গা বানিয়ে নিত; যাকে نصب (বেদী, থান বা আস্তানা) বলা হত। আর সেই স্থানে মানত ও নযর মানা পশু ঐ পূজ্যপ্রতিমার নামে বলি দিত। অর্থাৎ, এটি {وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللهِ} (গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ) এরই একটি ধরন। সুতরাং এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আস্তানা, কবরস্থান ও দর্গায় গিয়ে লোকেরা নিজের মনষ্কামনা পূরণ করার জন্য এবং কবরস্থ বুযুর্গের সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য যে পশু (মুরগী, ছাগল ইত্যাদি) যবেহ বা উৎসর্গ করে কিংবা পোলাও বা (সিন্নি, মিঠাই) খাবার বণ্টন করে, তা ভক্ষণ করা হারাম। আর এ সব আল্লাহর বাণীঃ {وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ} এর শামিল।
[৯] {وَأَن تَسْتَقْسِمُواْ بِالأَزْلاَمِ} এই অংশের দুটি অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে ; (ক) তীরের মাধ্যমে বণ্টন করা (খ) তীরের মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করা। প্রথম অর্থের ব্যাপারে বলা হয় যে, জুয়া ইত্যাদিতে যবেহকৃত পশুর গোশত বণ্টনের ক্ষেত্রে উক্ত তীর (লটারী হিসাবে) ব্যবহার করা হত। যার ফলে কেউ প্রাপ্য অংশের চাইতে বেশী পেত, আবার কেউ সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হত। দ্বিতীয় অর্থের ব্যাপারে বলা হয় যে, বিশেষ তীর হত, তারা কোন কর্মের প্রারম্ভে তার মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষা করত। তারা তিন ধরণের তীর তৈরী করে রেখেছিল। তার মধ্যে একটিতে (افْعَلْ ) অর্থাৎ ‘কর’ এবং দ্বিতীয়টিতে (لاَ تَفْعَلْ ) অর্থাৎ ‘করো না’ লিখা থাকত। আর তৃতীয়টিতে কোন কিছু লেখা থাকত না। ভাগ্য পরীক্ষার সময় যদি প্রথম তীরটি (যাতে ‘কর’ লেখা আছে) বের হত, তাহলে তারা সে কর্মটি সম্পাদন করত, যদি দ্বিতীয় তীরটি (যাতে ‘করো না’ লেখা আছে) বের হত, তাহলে তারা সে কর্মটি সম্পাদন করত না, আর যদি তৃতীয় তীরটি (যাতে কোন কিছু লেখা থাকত না) বের হত, তাহলে তারা পুনরায় ভাগ্য পরীক্ষা করত। আর এটাও এক ধরণের গণকের কাজ এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট সাহায্য প্রার্থনারই একটি চিত্র মাত্র। এই জন্য (ইসলামে) একে হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। استقسام এর অর্থ হল, ভাগ্য পরীক্ষা করা।
[১০] এখানে ক্ষুধার শেষ পর্যায়ের অবস্থায় উল্লিখিত হারাম খাদ্য ভক্ষণ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, তবে তাতে যেন আল্লাহর অবাধ্যাচরণ উদ্দেশ্য না হয় এবং সীমালঙ্ঘন করা না হয়। অর্থাৎ প্রাণ বাঁচানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন শুধুমাত্র ততটুকু ছাড়া বেশী যেন ভক্ষণ করা না হয়।