أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 114/٢٤٤)-৪৪৬
www.motaher21.net
সুরা: আল-আনয়াম
৭১-৭৩ নং আয়াত:-
قُلْ أَنَدْعُو مِن دُونِ اللّه
তুমি বলে দাওঃ আমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করব?
Say:”Shall we invoke others besides Allah?
قُلۡ اَنَدۡعُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مَا لَا یَنۡفَعُنَا وَ لَا یَضُرُّنَا وَ نُرَدُّ عَلٰۤی اَعۡقَابِنَا بَعۡدَ اِذۡ ہَدٰىنَا اللّٰہُ کَالَّذِی اسۡتَہۡوَتۡہُ الشَّیٰطِیۡنُ فِی الۡاَرۡضِ حَیۡرَانَ ۪ لَہٗۤ اَصۡحٰبٌ یَّدۡعُوۡنَہٗۤ اِلَی الۡہُدَی ائۡتِنَا ؕ قُلۡ اِنَّ ہُدَی اللّٰہِ ہُوَ الۡہُدٰی ؕ وَ اُمِرۡنَا لِنُسۡلِمَ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ۷۱﴾
তুমি বলে দাওঃ আমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করব, যারা আমাদের কোন উপকার করতে পারবেনা এবং আমাদের কোন ক্ষতিও করতে পারবেনা? অধিকন্তু আমাদেরকে সুপথ প্রদর্শনের পর আমরা কি উল্টা পথে ফিরে যাব? আমরা কি ঐ ব্যক্তির ন্যায় হব যাকে শাইতান মরুভূমির মধ্যে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে এবং যে দিশেহারা-লক্ষ্যহারা হয়ে ঘুরে মরছে? তার সহচরেরা তাকে হিদায়াতের দিকে ডেকে বলছে – তুমি আমাদের সঙ্গে এসো। তুমি বলঃ আল্লাহর হিদায়াতই হচ্ছে সত্যিকারের সঠিক হিদায়াত, আর আমাকে সারা জাহানের রবের সামনে মাথা নত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
وَ اَنۡ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اتَّقُوۡہُ ؕ وَ ہُوَ الَّذِیۡۤ اِلَیۡہِ تُحۡشَرُوۡنَ ﴿۷۲﴾
আর তুমি নিয়মিতভাবে সালাত কায়েম কর এবং সেই রাব্বকে ভয় করে চল যাঁর নিকট তোমাদের সকলকে সমবেত করা হবে।
وَ ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ ؕ وَ یَوۡمَ یَقُوۡلُ کُنۡ فَیَکُوۡنُ ۬ؕ قَوۡلُہُ الۡحَقُّ ؕ وَ لَہُ الۡمُلۡکُ یَوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ ؕ عٰلِمُ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ ؕ وَ ہُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡخَبِیۡرُ ﴿۷۳﴾
সেই সত্তা আকাশমন্ডল ও ভূ-মন্ডলকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। যেদিন তিনি বলবেনঃ ‘হাশর হও‘ সেদিন হাশর হয়ে যাবে। তাঁর কথা খুবই যথার্থ বাস্তবানুগ। যেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে সেদিন একমাত্র তাঁরই হবে বাদশাহী ও রাজত্ব। গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু তাঁর জ্ঞানায়ত্বে। তিনি হচ্ছেন প্রজ্ঞাময়, সর্ববিদিত।
৭১-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
যারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য মা‘বূদদেরকে আহ্বান করে তারা কোন প্রকার উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখে না। সকল ভাল-মন্দের ক্ষমতার উৎস একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, যা তাঁর রুবুবিয়্যাহ বা প্রভুত্যের প্রমাণ বহন করে।
যারা ঈমান আনার পর আবার মুশরিক বা কাফির হয়ে যায় তাদের উদাহরণ হল- এক ব্যক্তি তার সেই সাথীদের সঙ্গ ছাড়া হয়ে যায় যারা সোজা ও সঠিক পথে যাচ্ছিল। আর সঙ্গচ্যুত হয়ে এই ব্যক্তি বনে জঙ্গলে চঞ্চল ও অস্থির অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। এদিকে তার সাথীরা তাকে ডাকে, কিন্তু চাঞ্চল্যের কারণে সে কিছুই শুনতে পায় না। অথবা শয়তান জিনদের বেড়াজালে পড়ার কারণে পথের দিকে ফিরে আসা তার পক্ষে সম্ভব হয় না।
(إِنَّ هُدَي اللّٰهِ هُوَ الْهُدٰي)
‘আল্লাহর হিদায়াতই হচ্ছে সত্যিকার হিদায়াত’অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জবানে আল্লাহ তা‘আলা যে শরীয়ত প্রদান করেছেন তা ব্যতীত হিদায়াতের অন্য কোন সঠিক পথ নেই।
(وَأُمِرْنَا لِنُسْلِمَ لِرَبِّ الْعٰلَمِيْنَ)
‘আমরা আদিষ্ট হয়েছি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করতে।’অর্থাৎ আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যেন আমরা আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও আদেশ-নিষেধের সামনে আত্মসমর্পণ করি। (তাফসীর সা‘দী পৃঃ ২৫৫)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় নিজের রুবুবিয়্যাতের কথা বলেন যে, তিনিই আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন আবার তিনি সব ধ্বংস করে কিয়ামতের দিন বলবেন ‘হয়ে যাও’সাথে সাথে হয়ে যাবে। যে দিনের কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার হাতে থাকবে। তিনি বলেন:
(اَلْمُلْكُ يَوْمَئِذِ نِالْحَقُّ لِلرَّحْمٰنِ ط وَكَانَ يَوْمًا عَلَي الْكٰفِرِيْنَ عَسِيْرًا)
“সে দিন প্রকৃত কর্তৃত্ব হবে দয়াময়ের এবং কাফিরদের জন্য সে দিন হবে কঠিন।”(সূরা ফুরকান ২৫:২৬)
(يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّوْرِ)
‘যেদিন শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে’ ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: এ আয়াতের ব্যাপারে মুফাসসিরগণের মতানৈক্য বিদ্যমান। তবে সঠিক কথা হল صور দ্বারা উদ্দেশ্য قرن বা শিং যাতে ইসরাফিল (আঃ) কিয়ামত সংঘঠিত হবার জন্য ফুঁ দেবেন। (ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩১৮)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
إن إسرافيل قد التقم الصور وحني جبهته ينتظر متي يؤمر فينفخ
ইসরাফিল (আঃ) শিঙ্গা মুখে লাগিয়ে রয়েছেন। তিনি মাথা নীচু করে অপেক্ষমান রয়েছেন যে, কখন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার হুকুম হয় তখন তিনি ফুঁ দেবেন। (তিরমিযী হা: ২৪৩১, আহমাদ ৩/৭২, ৭৩, হাসান)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যদের আহ্বান করে তাদের অবস্থা জানা গেল।
২. যারা মুশরিক ও কাফির তাদের পরিচয় জানতে পারলাম।
৩. কিয়ামতের পূর্বে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার জন্য ইসরাফিল (আঃ) প্রস্তুত হয়ে আছেন।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Anam
Verses :- 71-73
قُلْ أَنَدْعُو مِن دُونِ اللّه
Say:”Shall we invoke others besides Allah?
The Parable of Those Who Revert to Disbelief After Faith and Good Deeds
As-Suddi said,
“Some idolators said to some Muslims, `Follow us and abandon the religion of Muhammad.’ Allah sent down the revelation,
قُلْ أَنَدْعُو مِن دُونِ اللّهِ مَا لَا يَنفَعُنَا وَلَا يَضُرُّنَا وَنُرَدُّ عَلَى أَعْقَابِنَا
Say:”Shall we invoke others besides Allah, that can do us neither good nor harm, and shall we turn on our heels…”
by reverting to disbelief,
بَعْدَ إِذْ هَدَانَا اللّهُ
“…after Allah has guided us.”
for if we do this, our example will be like he whom the devils have caused to wander in confusion throughout the land.
Allah says here, your example, if you revert to disbelief after you believed, is that of a man who went with some people on a road, but he lost his way and the devils led him to wander in confusion over the land. Meanwhile, his companions on the road were calling him to come to them saying, `Come back to us, for we are on the path.’ But, he refused to go back to them. This is the example of he who follows the devil after recognizing Muhammad, and Muhammad is the person who is calling the people to the path, and the path is Islam.”
Ibn Jarir recorded this statement.
Allah’s statement,
كَالَّذِي اسْتَهْوَتْهُ الشَّيَاطِينُ فِي الَارْضِ
حَيْرَانَ
Like one whom the Shayatin (devils) have made to go astray confused (wandering) through the land,
refers to ghouls,
لَهُ أَصْحَابٌ يَدْعُونَهُ إِلَى الْهُدَى ايْتِنَا
his companions calling him to guidance (saying):`Come to us.”‘
(calling him) by his name, his father’s and his grandfather’s names. So he follows the devils’ call thinking that it is a path of guidance, but by the morning he will find himself destroyed and perhaps they eat him. The Jinns will then let him wander in a wasteland where he will die of thirst.
This is the example of those who follow the false gods that are being worshipped instead of Allah, Most Honored.
Ibn Jarir also recorded this.
Allah said,
قُلْ إِنَّ هُدَى اللّهِ هُوَ الْهُدَىَ
Say:”Verily, Allah’s guidance is the only guidance,”
Allah said in other instances,
وَمَن يَهْدِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّضِلٍّ
And whomsoever Allah guides, for him there will be none to misguide him. (39:37)
and,
إِن تَحْرِصْ عَلَى هُدَاهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِى مَن يُضِلُّ وَمَا لَهُمْ مِّن نَّـصِرِينَ
If you covet for their guidance, then verily Allah guides not those whom He makes to go astray. And they will have no helpers. (17:37)
Allah’s statement,
وَأُمِرْنَا لِنُسْلِمَ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
and we have been commanded to submit to the Lord of all that exists.
means, we were commanded to worship Allah in sincerity to Him alone, without partners.
وَأَنْ أَقِيمُواْ الصَّلةَ وَاتَّقُوهُ
And to perform the Salah, and have Taqwa of Him.
meaning, we were commanded to perform the prayer and to fear Allah in all circumstances,
وَهُوَ الَّذِيَ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ
and it is He to Whom you shall be gathered.
on the Day of Resurrection.
وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالَارْضَ بِالْحَقِّ
It is He Who has created the heavens and the earth in truth.
meaning, in justice, and He is their Originator and Owner Who governs their affairs and the affairs of their inhabitants.
Allah said,
وَيَوْمَ يَقُولُ كُن فَيَكُونُ
and on the Day He will say:”Be!” it shall become.
Referring to the Day of Resurrection, which will come faster than the blink of an eye, when Allah says to it, `Be.’
قَوْلُهُ الْحَقُّ
His Word is the truth.
As-Sur; The Trumpet
Allah’s statement,
وَلَهُ الْمُلْكُ يَوْمَ يُنفَخُ فِي الصُّوَرِ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ
His will be the dominion on the Day when the Sur will be blown. All-Knower of the unseen and the seen. He is the All-Wise, Well-Aware.
يَوْمَ يُنفَخُ فِي الصُّوَرِ
(on the Day when the Sur will be blown…),
refers to His statement,
وَيَوْمَ يَقُولُ كُن فَيَكُونُ
(and on the Day He will say:”Be!” it shall become). as we stated above.
Or, it means,
وَلَهُ الْمُلْكُ يَوْمَ يُنفَخُ فِي الصُّوَرِ
(His will be the dominion on the Day when the Sur will be blown).
Allah said in other Ayat,
لِّمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ لِلَّهِ الْوَحِدِ الْقَهَّارِ
Whose is the kingdom this Day It is Allah’s, the One, the Irresistible! (40:16)
and,
الْمُلْكُ يَوْمَيِذٍ الْحَقُّ لِلرَّحْمَـنِ وَكَانَ يَوْماً عَلَى الْكَـفِرِينَ عَسِيراً
The sovereignty on that Day will be the true (sovereignty), belonging to the Most Beneficent (Allah), and it will be a hard Day for the disbelievers. (25:26)
The Sur is the Trumpet into which the angel Israfil, peace be upon him, will blow.
The Messenger of Allah said,
إِنَّ إِسْرَافِيلَ قَدِ الْتَقَمَ الصُّورَ وَحَنَى جَبْهَتَهُ يَنْتَظِرُ مَتَى يُوْمَر فَيَنْفُخ
Israfil has held the Sur in his mouth and lowered his forehead, awaiting the command to blow in it.
Muslim recorded this Hadith in his Sahih.
Imam Ahmad recorded that Abdullah bin `Amr said,
“A Bedouin man said, `O Allah’s Messenger! What is the Sur?’
He said,
قَرْنٌ يُنْفَخُ فِيه
A Trumpet which will be blown.
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
৭১-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:
মুশরিকরা মুসলমানদেরকে বলেছিল-তোমরা মুহাম্মাদের দ্বীনকে পরিত্যাগ কর। তখন আল্লাহ তাআলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেন। তিনি বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি মুশরিকদেরকে বলে দাও-আমরা কি আল্লাহকে ছেড়ে ঐ সব মূর্তির পূজা করবো যারা আমাদের কোন উপকারও করতে পারবে না এবং কোন ক্ষতি করারও শক্তি তাদের নেই? কুফরী অবলম্বন করে কি আমরা উল্টো পথে ফিরে যাবো? অথচ আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে আলো দান করেছেন? তাহলে তো শয়তান যাকে পথভ্রষ্ট করেছে আমাদের দৃষ্টান্ত তার মতই হবে। অর্থাৎ ঈমান আনয়নের পর কুফরী অবলম্বন করা এরূপই যেমন একটি লোক সফররত অবস্থায় পথ ভুলে গেল এবং শয়তানরা তাকে পথভ্রষ্ট করলো। আর তার সঙ্গী সরল পথে রইলো এবং তাকে ডেকে বললোঃ আমাদের কাছে এসো। আমরা সরল সোজা পথে রয়েছি। সে কিন্তু যেতে অস্বীকার করলো। এটা ঐ ব্যক্তি যে নবী (সঃ)-কে ভালভাবে জানা সত্ত্বেও পথভ্রষ্টদের অনুসরণ করে কাফের হয়ে যাচ্ছে এবং নবী (সঃ) তাকে সোজা পথে আসার জন্যে ডাক দিচ্ছেন। এই পথ হচ্ছে ইসলামের পথ।
(আরবী) এতে মূর্তি ও মূর্তিপূজকদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে এবং ঐ লোকদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে যারা তাদেরকে আল্লাহর হিদায়াতের দিকে ডাকতে রয়েছে। যেমন কেউ পথ ভুলে গেছে। অতঃপর কোন আহ্বানকারী তাকে ডাক দিয়ে বলছে- হে অমুক! তুমি পথের দিকে এসো। আর তার অন্য সাথী বলছে- তুমি বিভ্রান্ত হয়ো না, আমাদের সোজা পথের দিকে এসো। এখন সে যদি পূর্ববর্তী আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেয় তবে সে তাকে নিয়ে গিয়ে ধ্বংসের গর্তে ফেলে দেবে। কিন্তু যদি অন্য সঙ্গীর কথা মেনে নেয় তবে সে তাকে সোজা ও হিদায়াতের পথে নিয়ে আসবে। প্রথম আহ্বানকারী হচ্ছে জঙ্গলের শয়তানের অন্তর্ভুক্ত। এটা হচ্ছে ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত, যে আল্লাহর নিকট থেকে সরে গিয়ে মূর্তিপূজা করতে শুরু করে দেয় এবং ওর মধ্যেই মঙ্গল নিহিত আছে বলে মনে করে। আর যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে তখন লজ্জিত হতে হবে। এটা হচ্ছে পথভ্রষ্টকারী শয়তান যে তাকে তার বাপ-দাদার নাম নিয়ে এবং তার নাম নিয়ে ডাক দেয়। তখন সে তার অনুসরণ করতে শুরু করে দেয় এবং ওটাকেই কল্যাণকর বলে মনে করে। তখন শয়তান তাকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করে। তাকে সে ক্ষুধা পিপাসায় কাতর করে জংগলে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়, যাতে সে ধ্বংস হয়ে যায়।
(আরবী) শব্দ দ্বারা হতবুদ্ধি লোককে বুঝানো হয়েছে। যেমন কোন লোক পথ ভুলে হতবুদ্ধি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যে ব্যক্তি আল্লাহর হিদায়াত কবুল না করে শয়তানের অনুসরণ ও পাপের কাজ করে থাকে। অথচ তার সাথী তাকে হিদায়াতের দিকে আহ্বান করতে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন যে, সে শয়তান কর্তৃক পথভ্রষ্ট ব্যক্তি যার ওলী হচ্ছে মানুষ। আল্লাহর হিদায়াতই হচ্ছে প্রকৃত হিদায়াত এবং পথভ্রষ্টতা হচ্ছে ওটাই যার দিকে শয়তান ডেকে থাকে। এটা ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ সে এরই উপযোগী। যে, তার সাথী তাকে পথভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করছে। আর সে ধারণা করছে। যে ওটাই হচ্ছে সঠিক পথ । হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এটা প্রকাশ্য আয়াতের উল্টো। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ তার সফরের সঙ্গী তাকে হিদায়াতের দিকে আহ্বান করছে। সুতরাং এটা জায়েয নয় যে, ওটাকে পথভ্রষ্টতা বলা হবে, অথচ আল্লাহ তো ওটাকে হিদায়াত বলে খবর দিয়েছেন। আর ইবনে জারীর (রঃ) যা বলেছেন রচনাভঙ্গী ওরই দাবীদার। তা এই যে, (আরবী) এটা (আরবী) হওয়ার কারণে (আরবী) -এর স্থানে রয়েছে। অর্থাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা, পথভ্রষ্টতা এবং অজ্ঞতা ও মূর্খতার অবস্থায়, আর তার সঙ্গী সাথীরা ঐ পথেই চলছে এবং ঐ পথেই তাদেরকে আসতে বলছে, যেটাকে আল্লাহ পাক দৃষ্টান্তস্বরূপ বর্ণনা করেছেন। তখন এই বাক্যের অর্থ হবে-সে তাকে আহ্বানকৃত পথে যেতে অস্বীকার করছে এবং ওর দিকে মনোনিবেশ করছে না। যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন তবে তাকে হিদায়াত করতেন এবং সোজা-সঠিক পথে পরিচালিত করতেন। এই জন্যেই তিনি বলেছেন-আল্লাহর হিদায়াতই হচ্ছে সঠিক হিদায়াত। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেছেনঃ “যাকে আল্লাহ হিদায়াত করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না।” তিনি আর এক জায়গায় বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে হিদায়াতের উপর আনবার লোভ করলেও আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কে হিদায়াতের উপর আনতে পারে? এবং তাদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই।” (১৬:৩৭) ইরশাদ হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ আমাদেরকে সারা জাহানের প্রতিপালকের সামনে মাথা নত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ভাবার্থ হচ্ছে-আমাদের প্রতি এই নির্দেশ রয়েছে যে, আমরা যেন আন্তরিকতার সাথে তাঁর ইবাদত করি, নামায সুপ্রতিষ্ঠিত করি, আল্লাহকে ভয় করি এবং সর্বাবস্থায় তাকওয়া অবলম্বন করি। কিয়ামতের দিন তাঁরই কাছে সকলকে সমবেত করা হবে। তিনিই আকাশ ও যমীনকে ভারসাম্য রক্ষা করে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই এ দু’টির মালিক। কিয়ামতের দিন তিনি শুধু বা হও’ বলবেন আর তখনি চোখের পলকে সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব পুনরায় এসে যাবে। এখানে (আরবী) এই বাক্যে (আরবী) শব্দকে হয়তো বা (আরবী)-এর উপর বা সংযোগের কারণে (আরবী) দেয়া হয়েছে। সেই সময় বাক্যের রূপ হবে (আরবী)।
(আরবী) এইরূপ। অথবা (আরবী) শব্দকে এর উপর ভিত্তি করে (আরবী) দেয়া হয়েছে যে, ওর সংযোগ হয়েছে (আরবী) -এর উপর। যেহেতু সৃষ্টির সূচনা ও সৃষ্টির পুনরাবৃত্তির উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটাই বেশী যুক্তিসঙ্গতও বটে। কিংবা এখানে উহ্য রাখা হয়েছে এর উপর ভিত্তি করেই শব্দকে দেয়া হয়েছে। তখন বাক্যের রূপ হবে (আরবী) এইরূপ।
ইরশাদ হচ্ছে- (আরবী) এখানে রয়েছে দুটি বাক্য। এই উভয় বাক্যের (আরবী) হচ্ছে (আরবী) এটা এর উপর ভিত্তি করে হয়েছে যে, এ দু’টোই (আরবী)-এর বা বিশেষণ হয়েছে। আর আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ (আরবী) এটা (আরবী)-এর (আরবী) হতে পারে। আবার এরও সম্ভাবনা রয়েছে যে, (আরবী) -এর ওটা (আরবী) হবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ আজ রাজত্ব কার? আজ প্রবল পরাক্রমশালী একক আল্লাহরই রাজত্ব সত্য।” (৪০:১৬) যেমন মহান আল্লাহ এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই দিন পরম দাতা ও দয়ালুর রাজত্ব সত্য এবং ঐ দিন কাফিরদের উপর অত্যন্ত কঠিন হবে।” (২৫:২৬)
মুফাসসিরগণ (আরবী) এই ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, (আরবী) শব্দটি হচ্ছে (আরবী) শব্দের বহুবচন। ইবনে জারীর (রঃ) বলেন, যেমন বলা হয় প্রাচীর বেষ্টিত শহরকে এবং এটা হচ্ছে (আরবী)-এর বহুবচন, দ্রুপ এটাও। সঠিক কথা হচ্ছে এটাই যে, (আরবী)-এর অর্থ হচ্ছে সেই শিঙ্গা যার মধ্যে হযরত ইসরাফীল (আঃ) ফু দেবেন। ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, সঠিক ওটাই যার উপর হাদীসে রাসূল (সঃ) দ্বারা আলোকপাত করা হয়েছে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত ইসরাফীল (আঃ) শিঙ্গা মুখে লাগিয়ে রয়েছেন। তিনি মাথা নীচু করে অপেক্ষমান রয়েছেন যে, কখন শিঙ্গায় ফুঙ্কার দেয়ার হুকুম হয়!” একজন গ্রাম্য লোকও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে সিজ্ঞেস করেছিলঃ (আরবী) কি জিনিস? তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “এটা হচ্ছে শিঙ্গা, যাতে ফুৎকার দিয়ে বাজানো হয়।”
একদা নবী (সঃ) সাহাবীদের সাথে বসেছিলেন। সেই সময় তিনি বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার পর (আরবী) বা শিঙ্গাকে সৃষ্টি করেন। এবং তা তিনি হযরত ইসরাফীল (আঃ)-কে প্রদান করেন। ওটাতে তিনি মুখ লাগিয়ে রয়েছেন। তিনি আরশের দিকে তাকিয়ে আছেন। কখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়ার হুকুম হয় তার তিনি অপেক্ষায় রয়েছেন। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! (আরবী) কি জিনিস? তিনি উত্তরে বললেনঃ “ওটা হচ্ছে শিঙ্গা।” তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ “ওটা কিরূপ?” তিনি জবাব দিলেন, ওটা খুবই বড়। যে আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ! ওর প্রস্থ হচ্ছে আকাশ ও পৃথিবীর প্রস্থের সমান। ওতে তিনবার ফুস্কার দেয়া হবে। প্রথম ফুকার হবে ভয় ও সন্ত্রাস সৃষ্টির ফুকার। দ্বিতীয় ফুঙ্কার সবাইকে বেহুঁশ করে ফেলবে এবং তৃতীয় ফুঙ্কারের সময় সবাই আল্লাহর সামনে এসে হাযির হয়ে যাবে। আল্লাহ তা’আলা যখন প্রথম ফুকারের নির্দেশ দিবেন তখন সারা দুনিয়ার লোক হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে, তবে তিনি যাকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখবেন তার অবস্থা ঠিকই থাকবে। দ্বিতীয় ফুকারের হুকুম হওয়া পর্যন্ত প্রথম ফুকার চলতেই থাকবে, থামবে না। যেমন আল্লাহ তাআলা এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আর এরা শুধু একটি ভীষণ ধ্বনির প্রতিক্ষায় রয়েছে, যাতে শ্বাস গ্রহণেরও অবকাশ হবে না।” (৩৮:১৫) ওটা একটা ভীষণ ও উচ্চ শব্দ হবে, যার ফলে পাহাড় মেঘের মত উড়তে থাকবে এবং যমীন হেলতে দুলতে থাকবে। যেমন নড়বড়ে নৌকাকে সমুদ্রের তরঙ্গ চারদিকে হেলাতে দুলাতে থাকে এবং যেমন ছাদে লটকান লণ্ঠনকে বাতাস দোল দিতে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) (৭৯:৬) অর্থাৎ “যেই দিন কম্পনকারী বস্তু প্রকম্পিত করবে। যার পর আর এক পশ্চাদগামী বস্তু এসে পড়বে। সেই দিন সবাই ভীষণ আতংকিত হবে। লোকেরা পড়ে যাবে। মায়েরা দুগ্ধপোষ্য শিশুদেরকে ভুলে যাবে। গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের গর্ভপাত হয়ে যাবে। ভয়ে ছেলেদের উপর বার্ধক্য এসে পড়বে। শয়তানরা প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে যমীনের প্রান্তে প্রান্তে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ফেরেশতাগণ তাদেরকে মেরে মেরে ফিরিয়ে আনবেন। একে অপরকে ডাকতে থাকবে, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া কেউ কাউকেও আশ্রয় দিতে পারবে না। মানুষ এরূপ ভয় ও সন্ত্রাসের মধ্যে থাকবে এমন সময় যমীন প্রত্যেক কোণ থেকে ফাটতে শুরু করবে। সেই সময় এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে যা পূর্বে কখনও দেখা যায়নি। এমন ব্যাকুলতা ও সন্ত্রাস দেখা দেবে যা একমাত্র আল্লাহই জানেন। তারপর মানুষ আকাশের দিকে তাকাতে থাকবে। তখন তারা দেখতে পাবে যে, ওর টুকরাগুলো উড়তে রয়েছে। তারকাগুলো নিক্ষিপ্ত হবে। চন্দ্র ও সূর্য কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, মৃত লোকেরা এর কোন সংবাদই রাখবেন না। হযরত আবু হুরাইরী (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ তাআলা তো বলেছেন- (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ যাদেরকে চাইবেন তারা ছাড়া আকাশ ও পৃথিবীতে যারা রয়েছে তারা সবাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে।” (২৭:৮৭) তাহলে তিনি সেই দিন কাদেরকে হতবুদ্ধি হওয়া থেকে মুক্ত রাখবেন? রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ তারা হচ্ছে শহীদ। হতবুদ্ধি এবং ভীত সন্ত্রস্ত তো হয় জীবিত লোকেরা। আর শীদেরা জীবিত বটে, কিন্তু তারা অবস্থান করছে আল্লাহ তা’আলার নিকট, আল্লাহ তাদেরকে জীবিকা দান করছেন। তিনি সেই দিনের সন্ত্রাস থেকে তাদেরকে রক্ষা করবেন। কেননা, ওটা তো হচ্ছে আল্লাহর আযাব। আর তাঁর আযাব তো বর্ষিত হবে অসৎ লোকদের উপর। এটাকেই আল্লাহ (আরবী) (২২:২) -এই আয়াতে বর্ণনা করেছেন যে, সেই দিন প্রত্যেক দুগ্ধবতী স্ত্রী লোক তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। আল্লাহ যতদিন চাইবেন ততদিন তারা এই আযাবে ডুবে থাকবে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই অবস্থা থাকবে। তারপর আল্লাহ পাক হযরত ইসরাফীল (আঃ)-কে জ্ঞান লোপকারী ফুকার দেয়ার নির্দেশ দিবেন। ফলে সমস্ত আকাশবাসী ও যমীনবাসী অজ্ঞান হয়ে পড়বে। তবে আল্লাহ যাকে চাইবেন তার জ্ঞান ঠিকই থাকবে। মৃত্যুর ফেরেশতা আল্লাহ তা’আলার নিকট এসে বলবেনঃ “হে আল্লাহ! সবাই মরে গেছে।” আল্লাহ তো জানেনই।
তবু তিনি জিজ্ঞেস করবেনঃ “অবশিষ্ট কে আছে?” তিনি বলবেনঃ “অবশিষ্ট একমাত্র আপনি আছেন। আপনার তো কখনও মৃত্যু হবে না। তা ছাড়া আরশ। বহনকারী ফেরেশতাগণও বাকী রয়েছেন। আর বাকী রয়েছেন জিবরাঈল এবং মিকাঈলও। বাকী আমিও রয়েছি।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “জিবরাঈল ও মীকাঈলের তো মৃত্যু হওয়া উচিত।” তখন আরশ বলে উঠবেঃ “হে আমার প্রভু! জিবরাঈল এবং মীকাঈলও মরে যাবেন?” আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বলবেনঃ “কথা বলো না। আরশের নীচে যত কিছু আছে সবাইকেই মরতে হবে।” মৃত্যুর ফেরেস্তা পুনরায় আরয করবেন- “হে প্রভু! জিবরাঈল এবং মীকাঈলও মরে গেছেন।” আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেনঃ “এখন আর কে বাকী আছে?” তিনি উত্তরে বলবেনঃ “বাকী আছেন আপনি, আপনার তো মৃত্যু নেই। এখন আমি বাকী আছি এবং বাকী আছেন আরশ বহনকারী ফেরেশতাগণ।” তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “আরশ বহনকারীদেরকেও তো মরতে হবে।” তারাও মরে যাবে। আল্লাহ পাক জিজ্ঞেস করবেনঃ “এখন বাকী আছে কে?” আরাঈল (মৃত্যুর ফেরেশতা) তখন বলবেনঃ “মৃত্যুবরণ না কারী আপনি বাকী আছেন, আর বাকী আছি আমি।” আল্লাহ তা’আলা তখন ইসরাফীলের নিকট থেকে শিঙ্গা নিয়ে নেয়ার জন্যে আরশকে হুকুম করবেন এবং ইসরাফীল (আঃ)-কে তিনি বলবেনঃ “তুমিও আমার মাখলূক, সুতরাং তুমিও মরে যাও।” তিনি তৎক্ষণাৎ মরে যাবেন এবং একমাত্র আল্লাহই অবশিষ্ট থাকবেন যিনি এক, অমুখাপেক্ষী, তার কোন সন্তান নেই এবং তিনিও কারও সন্তান নন। তারপর আসমান ও যমীনকে জড়িয়ে নেয়া হবে যেমনভাবে মার’কে জড়িয়ে নেয়া হয়। ও দু’টোকে তিনবার খুলে দেয়া হবে এবং তিনবার জড়িয়ে নেয়া হবে। তারপর মহান আল্লাহ বলবেনঃ “আমি জাব্বার (সর্ব শক্তিমান ও বিজয়ী), আমি জাব্বার, আমি জাব্বার।” এরপর তিনবার তিনি উচ্চস্বরে বলবেনঃ “আজকের দিন রাজত্ব কার?” উত্তর দেবে কে? সুতরাং স্বয়ং তিনিই বলবেনঃ “আজকের দিন আল্লাহরই রাজত্ব যিনি একক ও প্রবল পরাক্রান্ত।”
অতঃপর তিনি দ্বিতীয় যমীন ও আসমান সৃষ্টি করবেন, ও দু’টো ছড়িয়ে দিবেন এবং দীর্ঘ করবেন। ও দু’টোর মধ্যে কোন বক্রতা ও ত্রুটি থাকবে না। তারপর আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে মাখলুকের প্রতি এক ভীষণ শব্দ হবে। তখন নতুনভাবে সৃষ্ট যমীনে সবাই পূর্বের মত হয়ে যাবে। যারা যমীনের মধ্যে ছিল তারা যমীনের মধ্যেই হবে এবং যারা বাইরে ছিল তারা বাইরেই হবে। অতঃপর আরশের নীচ থেকে আল্লাহ পানি বর্ষণ করবেন। আকাশকে তিনি পানি বর্ষণের নির্দেশ দিবেন। চল্লিশ দিন পর্যন্ত বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকবে। তারপর তিনি দেহগুলোকে নির্দেশ দিবেন যে, ওগুলো যেন যমীন থেকে এমনভাবে প্রকাশিত হয় যেমনভাবে ঘাসপাতা ও শাক-শজী অঙ্কুরিত হয়। যখন দেহগুলো পূর্বের ন্যায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে তখন সর্বপ্রথম আরশের ফেরেশতাদেরকে জীবিত করা হবে। আল্লাহ ইসরাফীল (আঃ)-কে শিঙ্গা গ্রহণ করতে বলবেন। তিনি তা গ্রহণ করবেন। তারপর মহান আল্লাহ জিবরাঈল (আঃ) ও মীকাঈল (আ)-কে জীবিত করবেন। এরপর আত্মাগুলোকে ডাক দেয়া হবে। মুসলমানদের আত্মা আলোর মত চমকিতে থাকবে। আর কাফিরদের আত্মা অন্ধকারের ন্যায় থাকবে। এই সবকে নিয়ে শিঙ্গার মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ তা’আলা হযরত ইসরাফীল (আঃ)-কে হুকুম করবেন যে, পুনর্জীবনের জন্যে যেন শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হয়। সুতরাং শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, ফলে রূহগুলো মৌমাছির মত তীব্র বেগে বেরিয়ে আসবে। তাদের দ্বারা যমীন ও আসমান ভরে যাবে। এরপর আল্লাহ তাআলা রূহগুলোকে দেহের ভিতর প্রবেশ করার নির্দেশ দিবেন। তখন দুনিয়ার সমস্ত রূহ নিজ নিজ দেহের মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করবে এবং দেহগুলোর মধ্যে নাকের ছিদ্রের পথ হয়ে যাবে, যেমন কোন সর্পদষ্ট ব্যক্তির দেহের মধ্যে বিষ অনুপ্রবেশ করে থাকে। তারপর যমীন ফাটতে শুরু করবে এবং মানুষেরা উঠে উঠে নিজেদের প্রতিপালকের দিকে মুখ করবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, সর্বপ্রথম আমার কবর খুলে যাবে। মহান আল্লাহর দিকে চলে যাব। কাফিররা বলবেঃ ‘এদিন তো বড় কঠিন বলে মনে হচ্ছে।’ লোকেরা সব উলঙ্গ হয়ে থাকবে। তারা সবাই একই জায়গায় দণ্ডায়মান হবে। সত্তর বছর পর্যন্ত এই অবস্থাই থাকবে। আল্লাহ তা’আলা তাদের দিকে দেখবেনও না এবং কোন ফায়সালাও করবেন না। লোকেরা ক্রন্দন এবং বিলাপ করতে থাকবে। তাদের অশ্রু শেষ হয়ে যাবে। তখন তাদের চক্ষু দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে। নিজেদের শরীরের ঘামে তারা ভিজে যাবে। ঘাম এতো বেশী ঝরবে যে, সেই ঘামের পানিতে তাদের গুতনী পর্যন্ত ডুবে যাবে । ললাকেরা পরস্পর বলাবলি করবে যে, আল্লাহর নিকট সুপারিশের জন্যে কাউকে পাঠানো হাক, যেন তিনি কোন মীমাংসা করে দেন। তারা তখন পরস্পর মন্তব্য করবে যে, পিতা আদম (আঃ) ছাড়া কে এমন আছেন যিনি আল্লাহর সামনে কথা বলার সাহস রাখেন? আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর মধ্যে রূহ ফুকেছেন। আর সর্বপ্রথম তিনি তাঁর সাথে কথা বলেছেন। অতঃপর তারা হযরত আদম (আঃ)-এর কাছে যাবে এবং নিজেদের উদ্দেশ্য পেশ করবে। তিনি সুপারিশ করতে অস্বীকৃতি জানাবেন এবং বলবেনঃ “আমি এর যোগ্য নই।” অতঃপর তারা পৃথক পৃথকভাবে এক একজন নবীর কাছে যাবে। যার কাছেই যাবে তিনিই অস্বীকার করবেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, এরপর তারা আমার কাছে আসবে। আমি তখন যাবো এবং ফাহস’ -এর উপর সিজদায় পড়ে যাবো। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ফাহস’ কি জিনিস?” তিনি উত্তরে বলেন, ওটা হচ্ছে আরশের সামনের অংশ। তখন আল্লাহ তাআলা একজন ফেরেশতা পাঠাবেন। তিনি আমাকে আমার বাহু ধরে উঠাবেন। মহামহিমান্বিত আল্লাহ আমাকে সম্বোধন করে বলবেনঃ “তুমি কি বলতে চাও?” আমি আরয করবো- হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে সুপারিশ করার অধিকার দানের ওয়াদা করেছেন। অতএব এই অধিকার আমাকে দান করুন এবং লোকদের মধ্যে ফায়সালা করুন। আল্লাহ পাক তখন বলবেনঃ “আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি সুপারিশ করতে পার এবং আমি লোকদের মধ্যে ফায়সালা করবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ আমি তখন ফিরে এসে লোকদের সাথে দাড়িয়ে যাবো। আমরা সব দাঁড়িয়েই থাকবো এমন সময় হঠাৎ আকাশ থেকে এক ভীষণ শব্দ আসবে। আমরা চিন্তান্বিত হয়ে পড়বো। পৃথিবীবাসী দানব ও মানবের দ্বিগুণ সংখ্যক ফেরেশতা আকাশ থেকে অবতরণ করবেন। তারা যমীনের নিকটবর্তী হবেন। যমীন তাঁদের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাবেন। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবোআপনাদের মধ্যে কি মহান আল্লাহ রয়েছেন? তারা উত্তরে বলবেনঃ “না, তবে তিনি অবশ্যই আসবেন।” দ্বিতীয়বার আকাশ থেকে ফেরেশতাগণ অবতরণ করবেন। তাদের সংখ্যা পূর্বের অবতারিত ফেরেশতাদের সংখ্যার দ্বিগুণ এবং দানব ও মানবের সংখ্যার দ্বিগুণ হবে। যমীন তাঁদের আলোকে চমকিত হয়ে উঠবে। তারা দাঁড়িয়ে যাবেন। আমরা জিজ্ঞেস করবো- আল্লাহ কি আপনাদের মধ্যে রয়েছেন? তাঁরা জবাবে বলবেনঃ ‘না, তবে তিনি অবশ্যই এসে পড়বেন!” তারপর তৃতীয়বার ওর চেয়েও দ্বিগুণ সংখ্যক ফেরেশতা অবতরণ করবেন। তখন মহাপ্রতাপান্বিত ও মহামহিমান্বিত আল্লাহ মেঘের ছত্র লাগিয়ে আটজন ফেরেশতা দ্বারা স্বীয় তখৃত বহন করিয়ে নিয়ে তাশরিফ আনবেন, অথচ এখন তো তাঁর তখৃত চারজন ফেরেশতা বহন করতে রয়েছেন। তাঁদের পা যমীনের সর্বশেষ স্তরের তলায় রয়েছে। আসমান ও যমীন হচ্ছে তাদের দেহের অর্ধাংশের সমান। আল্লাহ তা’আলার আরশ তাঁদের স্কন্ধের উপর রয়েছে। তাদের মুখে তাসবীহ ও তাহমীদ উচ্চারিত হতে থাকবে। তারা বলতে থাকবেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমরা তাঁরই পবিত্রতা বর্ণনা করছি যিনি আশ ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আমরা পবিত্রতা বর্ণনা করছি তারই যিনি রাজ্য, রাজত্ব ও আধ্যাত্মিক জগতের মালিক। আমরা তাঁরই পবিত্রতা বর্ণনা করছি যিনি মৃত্যুবরণ করেন না। আমরা তাঁরই পবিত্রতা ঘোষণা করছি যিনি সমস্ত মাখলুকের মৃত্যু ঘটিয়ে থাকেন কিন্তু নিজে মৃত্যুবরণ করেন না। আমরা তারই তসবীহ পাঠ করছি। তিনি পবিত্র, তিনি পবিত্র, তিনি পবিত্র। আমরা আমাদের মহান প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি যিনি ফেরেশতামণ্ডলী ও রূহের (জিবরাঈল আঃ-এর) প্রভু। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা করছি যিনি সারা মাখলুকের মৃত্যু ঘটিয়ে থাকেন কিন্তু নিজে মৃত্যুবরণ করবেন না। তারপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় কুরসীর উপর উপবেশন করবেন। একটা শব্দ হবে- “হে দানব ও মানবের দল! তোমাদেরকে সৃষ্টি করার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি নীরব ছিলাম। তোমাদের কথা শুনে এসেছি এবং তোমাদের কাজকর্ম দেখে এসেছি। এখন তোমরা নীরব থাক। তোমাদের আমলের সহীফা তোমাদেরকে পাঠ করে শুনানো হবে। যদি ওটা ভাল সাব্যস্ত হয় তবে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। আর যদি মন্দ হয় তবে নিজেদেরকেই তিরস্কার করবে।” অতঃপর আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামকে নির্দেশ দিবেন, তখন ওর মধ্যে ভীষণ কৃষ্ণকায় এক আকৃতি দেখা দেবে। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, তোমরা শয়তানের উপাসনা করবে না। কারণ, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এটা সেই জাহান্নাম যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল এবং যাকে তোমরা অবিশ্বাস করতে। সুতরাং হে পাপীর দল! সৎ লোকদের থেকে এখন তোমরা পৃথক হয়ে যাও।” একথা বলে আল্লাহ তা’আলা উম্মতদেরকে পৃথক করে দিবেন। এরশাদ হচ্ছে- “হে নবী (সঃ)! তুমি প্রত্যেক উম্মতকে জানুর ভরে পতিত দেখতে পাবে। প্রত্যেক উম্মতের পাশে তার আমলনামা থাকবে এবং স্বীয় কৃতকর্মের প্রতিফল পাবে। এরপর আল্লাহ স্বীয় মাখলুকের মধ্যে ফায়সালার কাজ শুরু করবেন। কিন্তু জ্বীন ও মানুষের বিচার তখনও শুরু হবে না।
প্রথমে আল্লাহ হিংস্র ও চতুষ্পদ জন্তুর বিচার শুরু করবেন। এমন কি এক অত্যাচারী শিং বিশিষ্ট ছাগলের অত্যাচারের প্রতিশোধও অন্য ছাগলের দ্বারা গ্রহণ করাবেন। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি জন্তুগুলোকে সম্বোধন করে বললেনঃ “তোমরা মাটি হয়ে যাও।” এ দেখে কাফিররা বলবেঃ “হায়! আমরাও যদি মাটি হয়ে যেতাম তবে এই শাস্তি থেকে বাঁচতে পারতাম। অতঃপর বান্দাদের বিচারকার্য শুরু হবে। সর্বপ্রথম হত্যা ও খুনের মাকদ্দমা পেশ করা হবে। তখন এমন। প্রত্যেক নিহত ব্যক্তি আসবে যাকে আল্লাহর পথে হত্যাকারী হত্যা করেছিল; আল্লাহ তাআলা হত্যাকারীকে হুকুম করবেন তখন সে ঐ নিহত ব্যক্তির মাথা উঠিয়ে নেবে। ঐ মাথা তখন বলবেঃ “হে আল্লাহ! একে জিজ্ঞেস করুন, কেন সে আমাকে হত্যা করেছিল?” আল্লাহ তখন তাকে জিজ্ঞেস করবেন (অথচ আল্লাহ নিজেই জানেন)ঃ “কেন তাকে হত্যা করেছিলে?” সেই গাযী তখন বলবেঃ “হে আল্লাহ! আপনার মর্যাদা ও আপনারই নামের জন্যে।” তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “তুমি সত্য বলেছো।” সেই সময় তার মুখমণ্ডল সূর্যের আলোকের মত চমকাতে থাকবে। ফেরেশতাগণ তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবেন। অনুরূপভাবে অন্যান্য নিহতগণ নিজ নিজ নাড়ি ভূড়ি মাথায় নিয়ে আসবে। আল্লাহ পাক ওদের হত্যাকারীদের জিজ্ঞেস করবেন- “কেন হত্যা করেছিলে?” তারা উত্তরে বলতে বাধ্য হবে যে, নিজের নাম ও খ্যাতির উদ্দেশ্যে। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “ধ্বংস হয়ে যাও।” মোটকথা, প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির মাকদ্দমা পেশ করা হবে এবং বিচার হবে। প্রত্যেক অত্যাচারের প্রতিশোধ অত্যাচারী থেকে নেয়া হবে। যে অত্যাচারীকে আল্লাহ ইচ্ছা করবেন শাস্তি দেবেন এবং যার উপর ইচ্ছা রহমত বর্ষণ করবেন। তারপর সারা মাখলুকের বিচার করা হবে এবং এমন কোন অত্যাচারী অবশিষ্ট থাকবে না যে, সে অত্যাচারী থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেনি। এমন কি যে ব্যক্তি দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করতো এবং বলতো যে, দুধ খাটি, তাকেও শাস্তি দেয়া হবে। আর ক্রেতাকে তার পুণ্য দেয়া হবে। এই কার্য সমাপ্তির পর এক আহ্বানকারী আহ্বান করবে যা সারা মাখলুক শুনতে পাবে। সেই আহ্বান হবে নিম্নরূপঃ
“প্রত্যেক দল যেন নিজ নিজ মা’রূদের কাছে চলে যায় এবং তার অঞ্চল চেপে ধরে।” তখন এমন কোন মূর্তিপূজক থাকবে না যার সামনে তার মূর্তি লাঞ্ছিত অবস্থায় পড়ে না থাকবে। ঐদিন একজন ফেরেশতা হযরত উযায়ের (আঃ)-এর রূপ ধরে আসবেন এবং আর একজন ফেরেশতা হযরত ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ)-এর রূপ ধরে আগমন করবেন। তখন ইয়াহূদীরা হযরত উযায়ের (আঃ)-এর পিছনে চলে আসবে এবং খ্রীষ্টানেরা আসবে হযরত ঈসা (আঃ)-এর পিছনে। অতঃপর তাদের এই কল্পিত মা’বৃদ তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে। তখন তারা বলবে যে, যদি ওরা তাদের প্রকৃত মা’রূদ হতো তবে তাদেরকে কখনও জাহান্নামে নিয়ে যেতো না। তারা জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করবে। এখন শুধু মুমিনরাই বাকী থাকবে এবং তাদের মধ্যে মুনাফিকরাও থাকবে। আল্লাহ তা’আলা নিজের ইচ্ছামত পরিবর্তিত আকৃতিতে তাদের কাছে আসবেন এবং বলবেনঃ “হে লোক সকল! সবাই নিজ নিজ মাবুদের সাথে মিলিত হয়েছে। সুতরাং তোমরাও যাদের ইবাদত করতে তাদের সাথে মিলিত হও।” তখন মুনাফিক মিশ্রিত মুমিনরা বলবেঃ “আল্লাহর শপথ! আমাদের মাবুদ তো আপনিই ছিলেন। আপনাকে ছাড়া আমরা আর কাউকেও মানতাম না।” এরপর আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট থেকে সরে যাবেন। অতঃপর তিনি নিজেই প্রকৃত দীপ্তি ও আঁকজমকের সাথে আসবেন এবং যতক্ষণ চাইবেন ততক্ষণ তাদের থেকে সরে থাকবেন। তারপর তিনি তাদের সামনে আসবেন এবং পুনরায় বলবেনঃ “হে লোকেরা! সবাই নিজ নিজ মাবুদের সাথে মিলিত হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মা’ৰূদের সাথে মিলিত হও।” তারা বলবেঃ “আল্লাহর শপথ! আপনি ছাড়া আমাদের অন্য কোন মা’বুদ নেই। আমরা একমাত্র আপনারই ইবাদত করতাম। তখন আল্লাহ পাক তাদের পায়ের গোছা খুলে দেবেন। এবং মর্যাদা গুণে তাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তার মা’বুদ তিনিই। তারপর সবাই মাথার ভরে সিজদায় পড়ে যাবে। কিন্তু মুনাফিকরা পিঠের ভরে পড়বে। সিজদার জন্যে তারা ঝুঁকে পড়তে পারবে না। তাদের পিঠ গাভীর পিঠের মত সোজা হয়ে থাকবে। যখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুকুম করবেন। তখন তাদের সামনে পুলসিরাত এসে পড়বে। ওটা তরবারীর ধারের চেয়ে তীক্ষ্ণ হবে। ওর স্থানে স্থানে আঁকড়া ও কাঁটা থাকবে এবং অত্যন্ত পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক হবে। ওর নীচে আরও একটি পিচ্ছিল সেতু থাকবে। ভাল লোকেরা চক্ষের পলকে দ্রুত গতিতে ওটা পার হয়ে যাবে। যেমন বিদ্যুৎ চমকিত হয় বা প্রবল বেগে বায়ু প্রবাহিত হয় অথবা দ্রুতগামী ঘোড়া কিংবা দ্রুত দৌড়ালু মানুষ চলে থাকে। কতগুলো লোক তো সম্পূর্ণরূপে অক্ষত থাকবে ও পরিত্রাণ পেয়ে যাবে। কতগুলো লোক আহত হবে এবং বহু লোক কেটে জাহান্নামে পড়ে যাবে। অতঃপর জান্নাতীদেরকে যখন জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে তখন তারা বলবেঃ “আমাদের জন্যে আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে কে?” তারা হযরত আদম (আঃ)-এর নিকট গিয়ে সুপারিশের আবেদন জানাবে। তখন তিনি নিজের পাপের কথা উল্লেখ করে বলবেনঃ “আমার এর যোগ্যতা নেই। তোমরা হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকট যাও। তাঁকে আল্লাহর প্রথম রাসূল বলা হয়। লোকেরা তখন হযরত নূহ (আঃ)-এর কাছে যাবে। তিনিও নিজের অপরাধের কথা উল্লেখ করে বলবেনঃ “আমার তো এই কাজের যোগ্যতা নেই। তোমরা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর কাছে যাও। আল্লাহ তা’আলা তাকে নিজের বন্ধু বলেছেন। তারা তাঁর কাছে যাবে। তিনিও নিজের দোষের কথা উল্লেখ করে বলবেনঃ “তোমরা হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে যাও। আল্লাহ তাআলা তার সাথে কথা বলেছেন এবং তাঁর উপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন। তারা তখন হযরত মূসা (আঃ)-এর কাছে যাবে এবং সুপারিশের জন্যে আবেদন করবে। তিনি নিজের হত্যার পাপের কথা উল্লেখ করে বলবেনঃ “আমি এই কাজের যোগ্য নই। তোমরা বরং হযরত ঈসা রূহুল্লার (আঃ) কাছে যাও। তিনি আল্লাহর রূহ ও তাঁর কালেমা।” হযরত ঈসাও (আঃ) বলবেনঃ “না, আমি এ কাজের যোগ্য নই। তোমরা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কাছে যাও।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন- তখন লোকেরা আমার কাছে আসবে। আল্লাহ তা’আলা আমাকে শাফাআতের অধিকার দিয়েছেন এবং ওয়াদা করেছেন। আমি জান্নাতের দিকে যাবো এবং জান্নাতের দরজায় করাঘাত করবো। জান্নাতের দরজা খুলে যাবে এবং আমাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে। জান্নাতে প্রবেশ করে আমি আল্লাহ পাকের দিকে দৃষ্টিপাত করবো এবং সিজদায় পড়ে যাবো। আল্লাহ তা’আলা আমাকে এমন তাহমীদ ও তামজীদের অধিকার দান করবেন যা তিনি অন্য কাউকেও শিখিয়ে দেননি। অতঃপর তিনি বলবেনঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! মাথা উঠাও। সুপারিশ করতে হয় কর। তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে এবং তোমার আবেদন মঞ্জুর করা হবে।” আমি তখন আমার মাথা উঠাবো। আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেনঃ “কি বলতে চাও?” আমি বলবো, হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে সুপারিশ করার অধিকার দিয়েছেন। জান্নাতীদের ব্যাপারে আমার শাফাআত কক্ল করুন! তারা যেন জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে। তখন তিনি বলবেনঃ “ঠিক আছে, আমি অনুমতি দিলাম। এই লোকগুলো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে।” নবী (সঃ) বলেনঃ আল্লাহর শপথ! দুনিয়ায় তোমরা তোমাদের বাসস্থান ও স্ত্রীদেরকে যেমন চিনতে পার তার চেয়ে তাড়াতাড়ি তোমরা তোমাদের জান্নাতের বাসস্থান ও স্ত্রীদেরকে চিনতে পারবে। প্রত্যেক লোককে বাহাত্তরটি স্ত্রী দেয়া হবে। তারা আদম সন্তানদের মধ্য থেকে হবে দু’জন এবং হ্রদের থেকে হবে সত্তরজন। ঐ সত্তরজনের উপর এই দু’জনের মর্যাদা, দান করা হবে। কেননা, এই সতী সাধ্বী মহিলারা দুনিয়ায় খুব বেশী বেশী করে আল্লাহর ইবাদত করতো। জান্নাতবাসী যখন একজনের কাছে যাবে তখন দেখতে পাবে যে, সে ইয়াকূতের ঘরে মণিমুক্তা দ্বারা সজ্জিতা হয়ে সোনার সিংহাসনে বসে আছে। সে মিহীন সবুজ রেশমের সত্তরটি জান্নাতী হুল্লা পরিধান করে রয়েছে। সে যখন তার কাঁধের উপর হাত দেবে তখন তার বক্ষের উপর কাপড়, দেহ, মাংস ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ওগুলো ভেদ করে বক্ষের অপর দিকে তার হাতের প্রতিবিম্ব দেখা যাবে। তার দেহ এত স্বচ্ছ হবে যে, তার পায়ের গোছার মজ্জা পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাবে। মনে হবে যে, তোমরা যেন ইয়াকৃতের ছুরি দেখতে রয়েছে। তার অন্তর এর জন্যে এবং এর অন্তর তার জন্যে আয়না বানানো হবে। না এ ওর থেকে ক্লান্ত হবে এবং না ও এর থেকে ক্লান্ত হবে। সে যখন কখনো কোন মহিলার কাছে আসবে তখন সে তাকে কুমারী রূপেই পাবে। না স্বামী স্ত্রীর ক্লান্তির অভিযোগ করবে এবং না স্ত্রী স্বামীর ক্লান্তির অভিযোগ করবে। এমনই অবস্থায় শব্দ শোনা যাবেঃ “তোমাদের কারো প্রাণ ভরবে না এটা তো আমার জানা আছে। কিন্তু অন্যান্য স্ত্রীরাও তো রয়েছে।” সুতরাং সে পালাক্রমে তাদের কাছে যাবে। যার কাছেই সে যাবে সে-ই বলবেঃ “আল্লাহর কসম! জান্নাতে তোমার চেয়ে সুন্দর আর কেউ নেই এবং আমার কাছে তোমার চেয়ে প্রিয়তম কেউই নেই। কিন্তু জাহান্নামীদেরকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে তখন আগুন কারও পা পর্যন্ত পৌঁছবে কারও পায়ের গোছার অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছবে, কারও পৌছবে জানু পর্যন্ত, কারও কোমর পর্যন্ত এবং কারও শুধু মুখমণ্ডল বাদ দিয়ে সমস্ত দেহ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। কেননা, মুখমণ্ডলের উপর আগুনকে হারাম করে দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ আমি আল্লাহ তাআলাকে বলবো- হে আমার প্রভু! আমার উম্মতের জাহান্নামবাসীদের ব্যাপারে আমার শাফা’আত কবুল করুন। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “তুমি তোমার উম্মতের যাদেরকে চিননা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে নাও।” সুতরাং কোন উম্মতই অবশিষ্ট থাকবে না। তারপর সাধারণ শাফাআতের অনুমতি দেয়া হবে। তখন প্রত্যেক নবী ও প্রত্যেক শহীদ নিজ নিজ শাফা’আত পেশ করবে। আল্লাহ পাক তখন বলবেনঃ “যার অন্তরে এক দীনারের ওজন পরিমাণও ঈমান রয়েছে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে নাও।” তারপর বলবেনঃ “এক দীনারের এক তৃতীয়াংশ ঈমান থাকলেও তাকে বের কর।” এরপর বলবেনঃ “এক দীনারের দুই তৃতীয়াংশ ঈমান থাকলেও তাকে বের কর। এক চতুর্থাংশ হলেও বের কর। এক কীরাত বরাবর হলেও বের করে নাও। এমন কি কারও অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে তাকেও বের করে নাও। তারপর যারা আল্লাহর জন্যে কোন একটি ভাল কাজও করেছে তাকেও বের কর।” তখন আর এমন কেউই বাকী থাকবে না যে শাফাআতের যোগ্য। এমন কি আল্লাহ তা’আলার এই সাধারণ রহমত দেখে শয়তানের লোভ হবে যে, যদি কেউ তার জন্যেও সুপারিশ করতেন। আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “আমি তো হচ্ছি সবচেয়ে বড় দয়ালু।” অতঃপর তিনি জাহান্নামে স্বীয় হাতটি রাখবেন এবং এতো অসংখ্য জাহান্নামীকে বের করবেন যারা পুড়ে কয়লার মত হয়ে যাবে। তাদেরকে জান্নাতের নাহরে হায়ওয়ান’ নামক একটি নদীতে নিক্ষেপ করা হবে। তারা এমনভাবে নব জীবন লাভ করবে যেমনভাবে কোন জলাশয়ের ধারে উদ্ভিদ অংকুরিত হয় এবং রোদের আলোতে সবুজ আকার ধারণ করে। আবার ছায়ায় থাকলে ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। ঐ জাহান্নামীরা জান্নাতের ঐ নদীতে গোসল করার পর শ্যামল সবুজ উদ্ভিদের মত সুন্দর আকার ধারণ করবে। তাদের কপালে লিখা থাকবে ‘আল্লাহর আযাদকৃত জাহান্নামী। তাদের এই চিহ্ন দেখে জান্নাতবাসীরা তাদেরকে চিনতে পারবে যে, তারা কিছু ভাল কাজ করেছিল। কিছুকাল তারা এইভাবেই জান্নাতে অবস্থান করবে। তারপর তারা মহান আল্লাহর নিকট আবেদন করবে যে, তাদের ঐ কপালের লিখাটা যেন মিটিয়ে দেয়া হয়। তখন তা মিটিয়ে দেয়া হবে।”
এটি একটি মাশহুর ও দীর্ঘ হাদীস। হাদীসটি অত্যন্ত গারীব এবং বিভিন্ন হাদীসের বিভিন্ন অংশ বিশেষ। এর কতগুলো কথা তো একেবারে অস্বীকারযোগ্য। মদীনার কাযী ইসমাঈল ইবনে রাফে একাই এর বর্ণনাকারী। এর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ এটাকে বিশ্বাসযোগ্য বলেছেন এবং কেউ কেউ একে দুর্বল বলেছেন। আবার কেউ কেউ সম্পূর্ণরূপেই অস্বীকার করেছেন। যেমন আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ), আবু হাতিম রাযী (রঃ) এবং উমার ইবনে ফালাস (রঃ)। কেউ কেউ বলেছেন যে, এই হাদীসটি সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। ইবনে আদী (রঃ) বলেন যে, এই হাদীসটির ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এর বর্ণনাকারীরা সবাই দুর্বল। আমি বলি যে, কয়েকটি কারণে এর ইসনাদে মতভেদ রয়েছে। আমি এটাকে পৃথক একটি খণ্ডে বর্ণনা করেছি। এর বর্ণনাভঙ্গীও বিস্ময়কর। বহু হাদীস মিলিয়ে একটি হাদীস বানিয়ে নেয়া হয়েছে। এজন্যেই এটা অস্বীকারযোগ্য হয়ে গেছে। আমি আমার শিক্ষক হাফিয আবুল হাজ্জাজ আল মুযী (রঃ)-এর কাছে শুনেছি যে, এটা ওয়ালীদ ইবনে মুসলিমের একটি রচনা, যা তিনি জমা করেছেন। এটা যেন। কতগুলো পৃথক পৃথক হাদীসের সাক্ষ্য বহনকারী। আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
টিকা:৪৬) কুরআনের বিভিন্ন স্থানে একথা বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ আকাশ ও পৃথিবীকে যথাযথ ভাবে বা হকের সাথে সৃষ্টি করেছেন। এ বাণীটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ।
এর একটি অর্থ হচ্ছে, পৃথিবী ও আকাশসমূহের সৃষ্টি নিছক খেলাচ্ছলে সাধিত হয়নি। এটি ঈশ্বরের বা ভগবানের লীলা নয়। এটি কোন শিশুর হাতের খেলনাও নয়। নিছক মন ভুলাবার জন্য কিছুক্ষণ খেলার পর শিশু অকস্মাৎ একে ভেঙ্গে চুরে শেষ করে ফেলে দেবে এমনও নয়। আসলে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ। অত্যন্ত গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের ভিত্তিতে এ কাজটি করা হয়েছে। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি বিরাট উদ্দেশ্য। এর একটি পর্যায় অতিক্রান্ত হবার পর এ পর্যায়ে যে সমস্ত কাজ হয়েছে তার হিসেবে নেয়া এবং এই পর্যায়ের কাজের ফলাফলের ওপর পরবর্তী পর্যায়ের বুনিয়াদ রাখা স্রষ্টার জন্য একান্ত অপরিহার্য।
এ কথাটিকেই অন্যান্য জায়গায় এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا “হে আমাদের রব! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করোনি।”
مَا خَلَقْنَا السَّمَاء وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لعِبِينَ “আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মাঝখানে যা কিছু আছে সেগুলোকে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।”
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ
“তোমরা কি ভেবেছো, আমি তোমাদেরকে এমনি অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার দিকে ফিরিয়ে আনা হবে না।”
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছেঃ আল্লাহ্ তা’আলা বিশ্ব-জাহানের গোটা ব্যবস্থা ও অবকাঠামোকে নিরেট ও নির্ভেজাল সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ন্যায়নীতি, সূক্ষ্মদর্শীতা ও বিচক্ষণতা এবং সততার বিধান এর প্রতিটি জিনিসের পেছনে ক্রিয়াশীল। বাতিল ও অসত্যের জন্য শেকড় গাড়া ও ফলপ্রসূ হবার কোন অবকাশই এ অবকাঠামোতে নেই। অবশ্য বাতিলপন্থীরা যদি তাদের মিথ্যা, অন্যায় ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে চায় তবে তাদেরকে সেজন্য চেষ্টা-সাধনা চালানোর কিছু সুযোগ আল্লাহ দিতেও পারেন-সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে বাতিলের প্রতিটি বীজকে পৃথিবী উগরে ফেলে দেবে এবং শেষ হিসেব-নিকেশ প্রত্যেক বাতিলপন্থী দেখতে পাবে যে, এ নোংরা ও অবাঞ্ছিত বৃক্ষের চাষ করতে সে যত চেষ্টা চালিয়েছে, তার সবই বৃথা ও নিষ্ফল হয়ে গেছে।
তৃতীয় অর্থ হচ্ছেঃ মহান আল্লাহ্ বিশ্ব-জাহানের এ সমগ্র ব্যবস্থাপনাটি হকের তথা নিরেট ও নির্ভেজাল সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাঁর নিজস্ব হক ও অধিকারের ভিত্তিতে তার ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালাচ্ছেন। তাঁর হুকুম এ জন্য চলে যে, তিনিই তাঁর সৃষ্ট এ বিশ্ব-জাহানের ওপর রাজত্ব করার অধিকার রাখেন। আপাত দৃষ্টিতে যদি অন্যদের রাজত্বও এখানে চলতে দেখা যায় তাহলে তাতে প্রতারিত হয়ো না। প্রকৃতপক্ষে তাদের হুকুম চলে না, চলতে পারেও না। কারণ এ বিশ্ব-জাহানের কোন জিনিসের ওপর তাদের কর্তৃত্ব চালাবার কোন অধিকারই নেই।
টিকা:৪৭) শিংগায় ফূঁক দেবার সঠিক স্বরূপ ও ধরনটা কি হবে তার বিস্তারতি চেহারা আমাদের বুদ্ধির অগম্য। কুরআন থেকে আমরা যা কিছু জানতে পেরেছি তা কেবল এতটুকু যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর হুকুমে একবার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে এবং তাতে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর না জানি কত সময় কত বছর চলে যাবে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন, দ্বিতীয়বার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। এর ফলে পূর্বের ও পরের এবং প্রথমের ও শেষের সবাই পুনর্বার জীবিত হয়ে নিজেদেরকে হাশরের ময়দানে উপস্থিত দেখতে পাবে। প্রথম ফুঁকে বিশ্ব-জাহানের সমস্ত ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়বে, সবকিছু ওলট পালট ও লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে এবং দ্বিতীয় ফুঁকে নতুন প্রকৃতি ও নতুন আইন কানুন নিয়ে আর একটি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হবে।
টিকা:৪৮) এর অর্থ এ নয় যে, সেদিন রাজত্ব তাঁর হবে আর আজকে রাজত্ব তাঁর নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সেদিন যখন পর্দা উঠে যাবে, অন্তরাল সরে যাবে এবং প্রকৃত অবস্থা একবারে সামনে এসে যাবে, তখন জানা যাবে, যাদেরকে দুনিয়ায় ক্ষমতাশালী দেখা যেতো, তারা সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন এবং যে আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহান সৃষ্টি করেছেন রাজত্ব করার সমস্ত ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের একমাত্র ও একচ্ছত্রভাবে তিনিই অধিকারী।
টিকা:৪৯) সৃষ্টির দৃষ্টি থেকে যা কিছু গোপন আছে তাই অদৃশ্য। সৃষ্টি সামনে যা কিছু প্রকাশিত ও তার গোচরীভূত, তাই দৃশ্য।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] অর্থাৎ ঈমানদার হওয়ার পরে কি আমরা কুফরীতে ফিরে যাব? [আইসারুত তাফসীর]
[২] কিন্তু সে ঈমানদার বন্ধুদের এ আহবানে সাড়া দেয় না। [মুয়াসসার]
[৩] এ আয়াত দ্বারা আরো জানা গেল যে, যারা আখেরাতের প্রতি অমনোযোগী হয়ে শুধু
পার্থিব জীবন নিয়ে মগ্ন, তাদের সংসৰ্গও অপরের জন্য মারাত্মক। তাদের সংসর্গে উঠা-বসাকারীরাও পরিণামে তাদের অনুরূপ আযাবে পতিত হবে। পূর্ববতী তিনটি আয়াতের সারমর্ম মুসলিমদেরকে অশুভ পরিবেশ ও খারাপ সংসর্গ থেকে বাচিয়ে রাখা। এটি যে কোন মানুষের জন্যই বিষতৃল্য। কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য উক্তি ছাড়াও চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, অসৎ সমাজ ও মন্দ পরিবেশই মানুষকে কুকর্ম ও অপরাধে লিপ্ত করে। এ পরিবেশে জড়িয়ে পড়ার পর মানুষ প্রথমতঃ বিবেক ও মনের বিরুদ্ধে কুকর্মে লিপ্ত হয়। এরপর আস্তে আস্তে কুকর্ম যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন মন্দের অনুভূতিও লোপ পায়, বরং মন্দকে ভাল এবং ভালকে মন্দ মনে করতে থাকে। যেমন এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘যখন কোন ব্যক্তি প্রথমবার গোনাহ করে, তখন তার কলবে একটি কাল দাগ পড়ে। তারপর যখন তাওবা করে গোনাহের কাজ থেকে বিরত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন তার কলব আবার পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু যদি গোনাহ বাড়িয়ে দেয়, তখন একের পর এক কালো দাগ বাড়াতে থাকে। কুরআনুল কারমে (رَانَ) শব্দ দ্বারা এ অবস্থাকেই ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “কুকর্মের কারণে তাদের অন্তরে মরিচা পড়ে গেছে।” [সূরা আল-মুতাফফিফীন:১৪] [ইবনে মাজাহঃ ৪২৪৪, তিরমিযীঃ ৩৩৩৪, ইমাম আহমাদ, মুসনাদঃ ২/২৯৭] অর্থাৎ ভাল-মন্দ পার্থক্য করার যোগ্যতাই লোপ পেয়ে বসে। চিন্তা করলে বুঝা যায়, অধিকাংশ ভ্রান্ত পরিবেশ ও অসৎ সঙ্গই মানুষকে এ অবস্থায় পৌছায়। এ কারণেই অভিভাবকদের কর্তব্য ছেলে-সন্তানদেরকে এ ধরণের পরিবেশ থেকে বাচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করা।