(Book# 114/٢٨٩)-৪৯১ www.motaher21.net সুরা: আল-আরাফ সুরা:৭ ১-৩ নং আয়াত:- قَلِيلً مَّا تَذَكَّرُونَ তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো। Little do you remember!

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/٢٨٩)-৪৯১
www.motaher21.net
সুরা: আল-আরাফ
সুরা:৭
১-৩ নং আয়াত:-
قَلِيلً مَّا تَذَكَّرُونَ
তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো।
Little do you remember!

الٓـمّٓصٓ ۚ﴿۱﴾
আলিফ লাম-মিম-সাদ।

کِتٰبٌ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ فَلَا یَکُنۡ فِیۡ صَدۡرِکَ حَرَجٌ مِّنۡہُ لِتُنۡذِرَ بِہٖ وَ ذِکۡرٰی لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲﴾
এ একটি কিতাব যা তোমার উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, সুতরাং তোমার অন্তরে যেন মোটেই সংকীর্ণতা না আসে। আর মু’মিনদের জন্য এটা উপদেশ।

اِتَّبِعُوۡا مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکُمۡ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءَ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ ﴿۳﴾
তোমার রবের পক্ষ থেকে যা তোমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে তুমি তা অনুসরণ কর এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে অভিভাবক অথবা সাহায্যকারী হিসাবে গ্রহণ করনা। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো।

১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
নামকরণ ও বিষয় সংক্ষেপ:

জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম আ‘রাফ। জান্নাতীগণ জান্নাতে আর জাহান্নামীগণ জাহান্নামে প্রবেশ করার পূর্বে এ আ‘রাফ নামক স্থানে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের মাঝে কথোপকথন হবে। এ সূরার ৪৬ ও ৪৮ নং আয়াতে আ‘রাফ শব্দটি উল্লেখ আছে বিধায় উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ, তবে আটটি আয়াত ব্যতীত। এ আটটি আয়াত হল-

(وَاسْأَلْهُمْ عَنِ الْقَرْيَةِ………… إِنَّا لَا نُضِيْعُ أَجْرَ الْمُصْلِحِيْنَ)

১৬৩ থেকে ১৭০ আয়াত।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: সূরা আ‘রাফ মক্কায় অবতীর্ণ। (ফাতহুল কাদীর, ২/২৩৯)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাগরিবের সালাতে দু’ ভাগে ভাগ করে এ সূরা তেলাওয়াত করতেন। (সহীহ নাসাঈ হা: ৯৪৫, আবূ দাঊদ হা: ৮১৬)

সূরাটির প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায় যে, এ সূরার অধিকাংশ বিষয়বস্তু আখিরাত ও রিসালাতের সাথে সম্পৃক্ত। সূরার প্রথম দিকে নবুওয়াত ও পরকালের সত্যতা, তারপর আদম (আঃ)-কে শয়তানের বিপদগামীকরণ, অতঃপর অন্যান্য নাবী ও তাদের জাতির আলোচনা এবং যারা অবিশ্বাসী ছিল তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি, আবার পরকালের পুনঃ আলোচনাপূর্বক তাওহীদের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে সূরা শেষ করা হয়েছে।

১-৩ নং আয়াতের তাফসীরঃ

ال۬ـمـّٓـص۬ ‘আলিফ, লাম, মীম, সোয়াদ’ এগুলোকে “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর বলা হয়। এ সম্পর্কে সূরা বাক্বারার শুরুতে আলোচনা রয়েছে, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

حَرَجٌ শব্দটির দু’টি অর্থ পাওয়া যায়- ১. কাতাদাহ, মুজাহিদ ও সুদ্দী (রাঃ) বলেন:

حَرَجٌ أيْ شَكٌ

অর্থাৎ সন্দেহ। অর্থ হল: এ কুরআনের সত্যতার ব্যাপারে তোমার মনে যেন কোন সন্দেহ না থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(اَلْحَقُّ مِنْ رَّبِّكَ فَلَا تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِيْنَ) ‏

“সত্য তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসেছে; সুতরাং তুমি সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (সূরা বাক্বারাহ ২:১৪৭)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَإِنْ كُنْتَ فِيْ شَكٍّ مِّمَّآ أَنْزَلْنَآ إِلَيْكَ فَسْأَلِ الَّذِيْنَ يَقْرَأُوْنَ الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلِكَ ج لَقَدْ جَا۬ءَكَ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكَ فَلَا تَكُوْنَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِيْنَ)‏

“আমি তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে যদি তুমি সন্দেহ করে থাক তবে তোমার পূর্বের কিতাব যারা পাঠ করে তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর‎; তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার নিকট সত্য অবশ্যই এসেছে। সুতরাং তুমি কখনও সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (সূরা ইউনুস ১০:৯৪)

২. অধিকাংশ আলেম বলেন: حَرَجٌ দ্বারা উদ্দেশ্য হল: সংকীর্ণতা। অর্থাৎ এ কুরআনের তাবলীগ করতে তোমার মনে যেন কোন সংকীর্ণতা না আসে। হয়তো কাফিররা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলবে, তোমাকে কষ্ট দেবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَلَعَلَّکَ تَارِکٌۭ بَعْضَ مَا یُوْحٰٓی اِلَیْکَ وَضَا۬ئِقٌۭ بِھ۪ صَدْرُکَ اَنْ یَّقُوْلُوْا لَوْلَآ اُنْزِلَ عَلَیْھِ کَنْزٌ اَوْ جَا۬ئَ مَعَھ۫ مَلَکٌﺚ اِنَّمَآ اَنْتَ نَذِیْرٌﺚ وَاللہُ عَلٰی کُلِّ شَیْءٍ وَّکِیْلٌ)‏

“তবে কি তোমার প্রতি যা ওয়াহী করা হয়েছে তার কিছু তুমি বর্জন করবে এবং এতে তোমার মন সংকুচিত হবে এজন্য যে, তারা বলে, ‘তার নিকট ধন-ভাণ্ডার প্রেরিত হয় না কেন অথবা তার সাথে ফেরেশতা আসে না কেন?’ তুমি কেবল সতর্ককারী এবং আল্লাহ সর্ব বিষয়ের কর্মবিধায়ক।” (সূরা হুদ ১১:১২)

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيْقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُوْلُوْنَ )‏

“আমি অবশ্যই জানি, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্ত‎র সংকুচিত হয়।” (সূরা হিজর ১৫:৯৭)

তবে দ্বিতীয় উক্তিটিই সঠিক। (আযউয়াউল বায়ান, ২/১৯০) অর্থাৎ এ কুরআন দ্বারা ভীতি প্রদর্শন করতে তোমার মনে যেন কোন সংকীর্ণতা না আসে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لِتُنْذِرَ قَوْمًا مَّآ أُنْذِرَ اٰبَا۬ٓؤُهُمْ فَهُمْ غَافِلُوْنَ)‏

“যাতে তুমি সতর্ক করতে পার এমন এক জাতিকে যাদের পূর্বপুরুষদেরকে সতর্ক করা হয়নি, ফলে তারা গাফিল রয়ে গেছে।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৬) কেননা কুরআনের ব্যাপারে নাবী (সাঃ) এর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

তারপর আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম জাতিকে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন: “তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে তোমাদের নিকট যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর” আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَآ اٰتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ ج وَمَا نَهٰكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا)

“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।” (সূরা হাশর ৫৯:৭) সেই সাথে আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করছেন কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ ব্যতীত অন্য কোন বন্ধু বা ওলী তথা দল, মত, তরীকা ইত্যাদি যারা প্রবৃত্তির অনুকরণ করে চলে তাদের অনুসরণ করো না। কেননা তাদের অনুসরণ করলে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ط إِنْ يَّتَّبِعُوْنَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُوْنَ)‏

“যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথামত চল তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। তারা তো শুধু অনুমানের অনুসরণ করে; আর তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে।” (সূরা আনআম ৬:১১৬) সুতরাং সর্বদা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মেনে চললে সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকা সম্ভব, অন্যথায় পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হতে হবে।

(قَلِيْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ)

‘তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর।’ অর্থাৎ সত্য বিষয় তোমরা খুব কমই অনুধাবন কর, যার কারণে তোমাদের অধিকাংশই কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ ছেড়ে দিয়ে এদিক সেদিক থেকে দীন গ্রহণ করতে দৌড়াচ্ছ।

(وَكَمْ مِّنْ قَرْيَةٍ)

‘কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি!’ অর্থাৎ ইতোপূর্বে আল্লাহ তা‘আলা যত জাতিকে ধ্বংস করেছেন সবাই রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ ও তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِّنْ قَبْلِكَ فَحَاقَ بِالَّذِيْنَ سَخِرُوْا مِنْهُمْ مَّا كَانُوْا بِه۪ يَسْتَهْزِءُوْنَ)‏

“তোমার পূর্বেও অনেক রাসূলকেই ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা হয়েছে। তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করছিল পরিণামে তা-ই বিদ্রƒপকারীদেরকে পরিবেষ্টন করেছে।” (সূরা আন‘আম ৬:১০)

(فَجَا۬ءَهَا بَأْسُنَا…..)

‘আমার শাস্তি তাদের ওপর পতিত হয়েছিল’ অর্থাৎ যাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার আযাব এসেছে তারা সে সময় হয় রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় অথবা দিনের বেলা বিশ্রামরত অবস্থায় ছিল।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর দাওয়াতের মূল সিলেবাস ছিল কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ।
২. আল্লাহ তা‘আলা যা অবতীর্ণ করেছেন তথা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ এর অনুসরণেই ইসলাম মেনে চলা ওয়াজিব।
৩. ইসলাম বিদ্বেষী ও অস্বীকারকারী পূর্ববর্তী উম্মাতের ধ্বংসের কারণ অবগত হলাম।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

(০৭-আরাফ) : নামকরণ:

এ সূরার ৪৬ ও ৪৭নং আয়াতে (পঞ্চম রুকূ’তে) “আসহাবে আরাফ” বা আরাফবাসীদের উল্লেখ করা হয়েছে। সেই জন্য এর নামকরণ করা হয়েছে “আল আরাফ।” অন্য কথায় বলা যায়, এ সূরাকে সূরা আল আরাফ বলার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, যে সূরার মধ্যে আ’রাফের কথা বলা হয়েছে, এটা সেই সূরা।

(০৭-আরাফ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

এ সূরার আলোচ্য বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, এ সূরাটি সূরা আন’আমের প্রায় সমসময়ে নাযিল হয়। অবশ্য এটি আগে না আন’আম আগে নাযিল হয় তা নিশ্চয়তার সাথে চিহ্নিত করা যাবে না। তবে এ সূরায় প্রদত্ত ভাষণের বাচনভংগী থেকে এটি যে ঐ সময়ের সাথে সম্পর্কিত তা পরিষ্কার বুঝা যায়। কাজেই এর ঐতিহাসিক পটভূমি অনুধাবন করার জন্য সূরা আন’আমের শুরুতে যে ভূমিকা লেখা হয়েছে তার ওপর একবার নজর বুলিয়ে নেয়া যথেষ্ট হবে।

(০৭-আরাফ) : আলোচ্য বিষয় :

এ সূরার ভাষণের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হচ্ছে রিসালাতের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত। আল্লাহ প্রেরিত রসূলের আনুগত্য করার জন্য শ্রোতাদেরকে উদ্বুদ্ধ করাই এর সমগ্র আলোচনার মৌল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কিন্তু এ দাওয়াত সতর্ক করার ও ভয় দেখানোর ভাবধারাই ফুটে উঠেছে বেশী করে। কারণ এখানে যাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে (অর্থাৎ মক্কাবাসী) তাদেরকে বুঝাতে বুঝাতে দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। তাদের স্থুল শ্রবণ ও অনুধাবন শক্তি, হঠকারিতা, গোয়ার্তুমী ও একগুঁয়ে মনোভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। যার ফলে রসূলের প্রতি তাদেরকে সম্বোধন করা বন্ধ করে দিয়ে অন্যদেরকে সম্বোধন করার হুকুম অচিরেই নাযিল হতে যাচ্ছিল। তাই বুঝাবার ভংগীতে নবুয়াত ও রিসালাতের দাওয়াত পেশ করার সাথে সাথে তাদেরকে একথাও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, নবীর মোকাবিলায় তোমরা যে কর্মনীতি অবলম্বন করেছো তোমাদের আগের বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ও নিজেদের নবীদের সাথে অনুরূপ আচরণ অবলম্বন করে অত্যন্ত মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল। তারপর বর্তমানে যেহেতু তাদেরকে যুক্তি প্রমাণ সহকারে দাওয়াত দেবার প্রচেষ্টা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হতে চলেছে। তাই ভাষণের শেষ অংশে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আহলি কিতাবদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এক জায়গায় সারা দুনিয়ার মানুষকে সাধারণভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। এ থেকে এরূপ আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, এখন হিজরত নিকটবর্তী এবং নবীর জন্য তার নিটকতর লোকদেরকে সম্বোধন করার যুগ শেষ হয়ে আসছে। এ ভাষণের এক পর্যায়ে ইহুদিদেরকেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাই এই সাথে রিসালাত ও নবুয়াতের দাওয়াতের আর একটি দিকও সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। নবীর প্রতি ঈমান আনার পর তাঁর সাথে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করার, আনুগত্য ও অনুসৃতির অঙ্গীকার করার পর তা ভংগ করার এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে যাওয়ার পর মিথ্যার প্রতি সাহায্য সহযোগিতা দানের কাজে আপাদমস্তক ডুবে থাকার পরিনাম কি, তাও এতে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

টিকা:১) কিতাব বলতে এখানে এই সূরা আরাফকেই বুঝোনো হয়েছে।

টিকা:২) অর্থাৎ কোন প্রকার সংকোচ, ইতস্ততভাব ও ভীতি ছাড়াই একে মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দাও। বিরুদ্ধবাদীরা একে কিভাবে গ্রহণ করবে তার কোন পরোয়া করবে না। তারা ক্ষেপে যায় যাক, বিদ্রূপ করে করুক, নানান আজেবাজে কথা বলে বলুক এবং তাদের শত্রুতা আরো বেড়ে যায় যাক। তোমরা নিশ্চিন্তে ও নিসংকোচে তাদের কাছে এ পয়গাম পৌঁছিয়ে দাও। এর প্রচারে একটুও গড়িমসি করো না।

এখানে যে অর্থে আমরা সংকোচ শব্দটি ব্যবহার করেছি, মূল ইবারতে তার জন্য حَرَجٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘হারজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, এমন একটি ঘন ঝোপঝাড়, যার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা কঠিন। মনে ‘হারজ’ হবার মানে হচ্ছে এই যে, বিরোধিতা ও বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার না দেখে মানুষের মন সামনে এগিয়ে চলতে পারে না, থেমে যায়। কুরআন মজীদেضِيقُ صَدْرُ র বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়বস্তুকে শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ

وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّكَ يَضِيقُ صَدْرُكَ بِمَا يَقُولُونَ

“হে মুহাম্মাদ! আমি জানি এরা যেসব কথা বলে বেড়াচ্ছে তাতে তোমার মন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।” অর্থাৎ যারা জিদ, হঠকারিতা ও সত্য বিরোধিতায় এ পর্যায়ে নেমে এসেছে যে, তাদেরকে কিভাবে সোজা পথে আনা যাবে, এ চিন্তায় তুমি পেরেশান হয়ে পড়েছো। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

فَلَعَلَّكَ تَارِكٌ بَعْضَ مَا يُوحَى إِلَيْكَ وَضَائِقٌ بِهِ صَدْرُكَ أَنْ يَقُولُوا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ كَنْزٌ أَوْ جَاءَ مَعَهُ مَلَكٌ (سورة هود-12)

“এমন যেন না হয় যে, তোমার দাওয়াতের জবাবে তোমার ওপর কোন ধনভাণ্ডার অবতীর্ণ হয়নি কেন? তোমার সাথে কোন ফেরেশতা আসেনি কেন? একথা বলবে ভেবে তুমি তোমার প্রতি নাযিল করা কোন কোন অহী প্রচার করা বাদ দিয়ে দেবে এবং বিব্রত বোধ করবে।”

টিকা:৩) এর অর্থ হচ্ছে, এ সূরার আসল উদ্দেশ্য তো ভয় দেখানো। অর্থাৎ রসূলের দাওয়াত গ্রহণ না করার পরিণাম সম্পর্কে লোকদেরকে সতর্ক করা ও ভয় দেখানো এবং গাফেলদেরকে সজাগ করা। তবে এটি যে মু’মিনদের জন্য স্মারকও, (অর্থাৎ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়) সেটি এর একটি আনুসঙ্গিক লাভ, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে এটি আপনা আপনিই অর্জিত হয়ে যায়।

টিকা:৪) এটি হচ্ছে এ সূরার কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়। এ ভাষণটিতে যে আসল দাওয়াত দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছেঃ দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের জন্য যে হেদায়াত ও পথ-নির্দেশনার প্রয়োজন, নিজের ও বিশ্বজাহানের স্বরূপ এবং নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুধাবন করার জন্য তার যে জ্ঞানের প্রয়োজন এবং নিজের আচার-আচারণ, চরিত্র, নৈতিকতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারাকে সঠিক ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সে যেসব মূলনীতির মুখাপেক্ষী সেগুলোর জন্য তাকে একমাত্র আল্লাহ‌ রাব্বুল আলামীনকেই নিজের পথপদর্শক হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং আল্লাহ‌ তার রসূলদের মাধ্যমে যে হেদায়াত ও পথ-নির্দেশনা দিয়েছেন একমাত্র তারই অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারোর দিকে পথ-নির্দেশনা লাভ করার জন্য মুখ ফিরানো এবং তার নেতৃত্বের আওতায় নিজেকে সমর্পণ করা মানুষের একটি মৌলিক ভ্রান্ত কর্মপদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর পরিণামে মানুষকে সব সময় ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তাকে সবসময় এই একই পরিণামের সম্মুখীন হতে হবে।

এখানে “আউলিয়া” (অভিভাবকগণ) শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যে, মানুষ সাধারণত যার নির্দেশে ও নেতৃত্বে চলে তাকে আসলে নিজের ‘ওলি’ তথা অভিভাবকে পরিণত করে। মুখে সে তার প্রশংসা করতে পারে বা তার প্রতি অভিশাপও বর্ষণ করতে পারে, আবার তার অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি দিতে পারে বা কঠোরভাবে তা অস্বীকারও করতে পারে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আশশূরা, টীকা নং ৬)

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir
Sura : Al-Araf
Sura:7
Verses :- 1-3
قَلِيلً مَّا تَذَكَّرُونَ

Little do you remember!
Allah says;

المص

Alif-Lam-Mim-Sad.

We mentioned before the explanation of the letters (such as, Alif-Lam, that are in the beginning of some Surahs in the Qur’an)

كِتَابٌ أُنزِلَ إِلَيْكَ

(This is the) Book (the Qur’an) sent down unto you (O Muhammad),

from your Lord,

فَلَ يَكُن فِي صَدْرِكَ حَرَجٌ مِّنْهُ

so let not your breast be narrow therefrom,

According to Mujahid, Qatadah and As-Suddi,

meaning, having doubt about it.

It was also said that the meaning here is:

`do not hesitate to convey the Qur’an and warn with it,’

فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُواْ الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ

Therefore be patient as did the Messengers of strong will. (46:35)

Allah said here,

لِتُنذِرَ بِهِ

that you warn thereby,

meaning, `We sent down the Qur’an so that you may warn the disbelievers with it,’

وَذِكْرَى لِلْمُوْمِنِينَ

and a reminder unto the believers.

Allah then said to the world.

اتَّبِعُواْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ

Follow what has been sent down unto you from your Lord,

meaning, follow and imitate the unlettered Prophet, who brought you a Book that was revealed for you, from the Lord and master of everything.

وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِ أَوْلِيَاء

and follow not any Awliya’, besides Him (Allah),

meaning, do not disregard what the Messenger brought you and follow something else, for in this case, you will be deviating from Allah’s judgment to the decision of someone else.

Allah’s statement,

قَلِيلً مَّا تَذَكَّرُونَ

Little do you remember!

is similar to,

وَمَأ أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُوْمِنِينَ

And most of mankind will not believe even if you desire it eagerly. (12:103)

and;

وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِى الاٌّرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ

And if you obey most of those on the earth, they will mislead you far away from Allah’s path. (6:116)

and,

وَمَا يُوْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلاَّ وَهُمْ مُّشْرِكُونَ

And most of them believe not in Allah except that they attribute partners unto Him. (12:106)

তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:

(আরবী) এবং এগুলোর অর্থ ও এগুলো সম্পর্কে যেসব মতবিরোধ রয়েছে এ সবকিছু সূরায়ে বাকারায় আলোচিত হয়েছে। (আরবী) অর্থাৎ (আরবী)-এর অর্থ হচ্ছে আমি আল্লাহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে থাকি। (হে নবী সঃ!) এই কিতাব (কুরআন) তোমার প্রতি তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এখন এর প্রচার এবং এর দ্বারা মানুষকে ভয় প্রদর্শনের ব্যাপারে তোমার মনে যেন কোন সংকীর্ণতা না আসে এবং এমন ধৈর্য অবলম্বন কর যেমন দুঃসাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নবীরা অবলম্বন করেছিল। এটা অবতরণের উদ্দেশ্য এই যে, তুমি এর মাধ্যমে কাফিরদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে। আর মুমিনদের জন্যে তো এ কুরআন উপদেশবাণী। এই মুমিনরা তো কুরআনে অবতীর্ণ বিষয়ের অনুসরণ করেছে এবং উম্মী নবী (সঃ) যে কিতাব তাদের সামনে পেশ করেছেন তার তারা পদাংক অনুসরণ করেছে। এখন একে ছেড়ে অন্যের পিছনে পড়ো না এবং আল্লাহর হুকুমের সীমা ছাড়িয়ে অপরের হুকুমের উপর চলো না। কিন্তু উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা খুবই কম হয়ে থাকে। হে নবী (সঃ)! তুমি যতই বাসনা, কামনা, লোভ ও চেষ্টা কর না কেন এদের সকলকে উপদেশ ও শিক্ষা লাভ করাতে পারবে না।

আল্লাহ পাক বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি যদি সকলকেই সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা কর তবে এই লোকেরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে দেবে এবং তুমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে। অধিকাংশ লোকই ঈমান আনয়ন করে না, বরং মুশরিকই থেকে যায়।

তাফসীরে আবুবকর ‌যাকারিয়া‌ বলেছেন:-

সূরা সংক্রান্ত আলোচনাঃ

আয়াত সংখ্যাঃ ২০৬ আয়াত।

নাযিল হওয়ার স্থানঃ এ সূরা সর্বসম্মতভাবে মক্কী সূরা।

সূরার ফযীলতঃ হাদীসে এসেছে ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ প্রথম সাতটি সূরা গ্রহণ করবে সে আলেম হিসেবে গণ্য হবে”। [মুসনাদে আহমাদ: ৬/৮৫, ৬/৯৬]

সূরার নামকরণঃ এ সূরার নাম আল-আ’রাফ। এ নামকরণ এ জন্যই করা হয়েছে যে, এ সূরার ৪৬ ও ৪৮ নং আয়াতদ্বয়ে আল-আ’রাফ শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। এরূপ নামকরণের অর্থঃ এটা এমন একটি সূরা যাতে আ’রাফবাসীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

—————-

এ হরফগুলোকে ‘হুরুফে মুকাত্তা’আত’ বলে। এ সম্পর্কে সূরা আল-বাকারার প্রথমে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

কিতাব বলতে এখানে কি বোঝানো হয়েছে এ ব্যাপারে সবচেয়ে স্বচ্ছ মত হল- পবিত্র কুরআনকেই বুঝানো হয়েছে। [বাগভী] কারো কারো মতে এখানে শুধু এ সূরার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

‘হারাজ’ হবার মানে হচ্ছে এই যে, বিরোধিতা ও বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে নিজের পথ পরিষ্কার না দেখে মানুষের মন সামনে এগিয়ে চলতে পারে না; থেমে যায়। তাই মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানে ‘হারাজ’ বলে ‘সন্দেহ’ বুঝানো হয়েছে। [আততাফসীরুস সহীহ] কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়বস্তুকে ‘দাইকে সদর’ শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল-হিজরঃ ৯৭, সূরা আন-নাহলঃ ১২৭, সূরা আন-নামলঃ ৭০, সূরা হুদঃ ১২।

এ আয়াতে কাদেরকে সতর্ক করতে হবে তা বলা হয়নি। অন্য আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ বলেন, “এবং বিতণ্ডাপ্রিয় সম্প্রদায়কে তা দ্বারা সতর্ক করতে পারেন ” [মারইয়াম: ৯৭] আরও বলেন, “বস্তুত এটা আপনার রব-এর কাছ থেকে দয়াস্বরূপ, যাতে আপনি এমন এক কওমকে সতর্ক করতে পারেন, যাদের কাছে আপনার আগে কোন সতর্ককারী আসেনি, যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে;” [আল-কাসাস:৪৬] আরও বলেন, “বরং তা আপনার রব হতে আগত সত্য, যাতে আপনি এমন এক সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারেন, যাদের কাছে আপনার আগে কোন সতর্ককার আসেনি, হয়তো তারা হিদায়াত লাভ করবে।” [ সূরা আস-সাজদাহ: ৩] অনুরূপভাবে এ আয়াতে কিসের থেকে সতর্ক করতে হবে তাও বলা হয়নি। অন্যত্র তা বলে দেয়া হয়েছে, যেমন, “তার কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য” [সূরা আল-কাহাফ:২] “অতঃপর আমি তোমাদেরকে লেলিহান আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি।” [সূরা আল-লাইল: ১৪] এ আয়াতে ভীতিপ্রদর্শন এবং সুসংবাদ প্রদান একসাথে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ভীতিপ্রদর্শন কাফেরদের জন্য আর সুসংবাদ মুমিনদের জন্য। [আদওয়াউল বায়ান]

অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনকেই নিজের পথ প্রদর্শক হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলদের মাধ্যমে যে হিদায়াত ও পথ-নির্দেশনা দিয়েছেন একমাত্র তারই অনুসরণ করতে হবে। যারাই আল্লাহকে বাদ দিয়ে এবং আল্লাহর পাঠানো নবীর আদর্শ অনুসরণ না করে অন্যের কাছ থেকে কিছু নিতে চেষ্টা করবে, তারাই আল্লাহর হুকুমকে বাদ দিয়ে অন্যের হুকুম গ্রহণ করল। [ইবন কাসীর]

Leave a Reply