Book#539

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ

(Book# 114/٣٣٦) -৫৩৯
www.motaher21.net
সুরা: আল্‌ আরাফ
সুরা:৭
১৬০-১৬২ নং আয়াত:-
وَقَطَّعْنَاهُمُ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أَسْبَاطًا أُمَمًا

আর তাদেরকে আমি বারটি গোত্রে তথা দলে বিভক্ত করেছিলাম।[
And We divided them into twelve tribes (as distinct) nations.
وَ قَطَّعۡنٰہُمُ اثۡنَتَیۡ عَشۡرَۃَ اَسۡبَاطًا اُمَمًا ؕ وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسٰۤی اِذِ اسۡتَسۡقٰىہُ قَوۡمُہٗۤ اَنِ اضۡرِبۡ بِّعَصَاکَ الۡحَجَرَ ۚ فَانۡۢبَجَسَتۡ مِنۡہُ اثۡنَتَا عَشۡرَۃَ عَیۡنًا ؕ قَدۡ عَلِمَ کُلُّ اُنَاسٍ مَّشۡرَبَہُمۡ ؕ وَ ظَلَّلۡنَا عَلَیۡہِمُ الۡغَمَامَ وَ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡہِمُ الۡمَنَّ وَ السَّلۡوٰی ؕ کُلُوۡا مِنۡ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقۡنٰکُمۡ ؕ وَ مَا ظَلَمُوۡنَا وَ لٰکِنۡ کَانُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ یَظۡلِمُوۡنَ ﴿۱۶۰﴾
আর তাদেরকে আমি বারটি গোত্রে তথা দলে বিভক্ত করেছিলাম। মূসার সম্প্রদায় যখন তার নিকট পানি প্রার্থনা করল, তখন তার প্রতি প্রত্যাদেশ করলাম, ‘তোমার লাঠি দ্বারা পাথরে আঘাত কর।’ ফলে তা থেকে বারটি প্রস্রবণ উৎসারিত হল, প্রত্যেক গোত্র নিজ নিজ পানস্থান চিনে নিল। এবং মেঘ দ্বারা তাদের উপর ছায়া বিস্তার করলাম, তাদের নিকট ‘মান্ন্’ ও ‘সালওয়া’ পাঠালাম; (বললাম,) ‘তোমাদের যা পবিত্র রুযী দিয়েছি তা আহার কর।’ (কিন্তু তারা নির্দেশ অমান্য করল। আর তাতে) তারা আমার প্রতি কোন অত্যাচার করেনি; আসলে তারা নিজেদের প্রতিই অত্যাচার করেছিল।
وَ اِذۡ قِیۡلَ لَہُمُ اسۡکُنُوۡا ہٰذِہِ الۡقَرۡیَۃَ وَ کُلُوۡا مِنۡہَا حَیۡثُ شِئۡتُمۡ وَ قُوۡلُوۡا حِطَّۃٌ وَّ ادۡخُلُوا الۡبَابَ سُجَّدًا نَّغۡفِرۡ لَکُمۡ خَطِیۡٓـٰٔتِکُمۡ ؕ سَنَزِیۡدُ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۶۱﴾
আর স্মরণ কর, যখন তাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘এ জনপদে বাস কর ও যেখানে ইচ্ছা আহার কর এবং বল, ‘‘হিত্ত্বাহ’’ (ক্ষমা চাই) এবং নতশিরে (শহর)দ্বার প্রবেশ কর, আমি তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করব। আমি শীঘ্রই সৎকর্মশীলদের জন্য আমার দান বৃদ্ধি করব।’
فَبَدَّلَ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡہُمۡ قَوۡلًا غَیۡرَ الَّذِیۡ قِیۡلَ لَہُمۡ فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ رِجۡزًا مِّنَ السَّمَآءِ بِمَا کَانُوۡا یَظۡلِمُوۡنَ ﴿۱۶۲﴾٪
কিন্তু তাদের মধ্যে যারা সীমালংঘনকারী ছিল, তারা তাদেরকে যা বলা হয়েছিল তার পরিবর্তে অন্য কথা বলল। সুতরাং তাদের সীমালংঘনের ফলে আমি আকাশ হতে তাদের প্রতি শাস্তি প্রেরণ করলাম।
১৬০-১৬২ নং আয়াতের তাফসীর:-
তাফসীরে ইবনে ‌কাসীর বলেছেন:-
উপরে বর্ণিত হয়েছিল যে, আল্লাহ তাদেরকে অমুক অমুক বিপদ হতে রক্ষা করেছিলেন। এখানে বর্ণিত হচ্ছে যে, মহান আল্লাহ তাদেরকে অমুক অমুক সুখ সম্ভোগ দান করেছেন।

(আরবি) শব্দটি (আরবি)শব্দের বহুবচন। এটা আকাশকে ঢেকে রাখে বলে একে (আরবি) বলা হয়ে থাকে। এটা একটা সাদা রঙ্গের মেঘ ছিল যা তীহের মাঠে তাদের উপর ছায়া করেছিল। যেমন সুনান-ই-নাসাঈ ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থের মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি সুদীর্ঘ হাদীসে রয়েছে। ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বলেন যে, হযরত ইবনে উমার (রাঃ), রাবী’ বিন আনাস (রঃ), আবু মুযলিজ (রঃ), যহহাক (রঃ) এবং সুদ্দী (রঃ) এটাই বলেছেন। হাসান (রঃ) এবং কাতাদাও (রঃ) এ কথাই বলেন। অন্যান্য লোক বলেন যে, এ মেঘ সাধারণ মেঘ হতে বেশী ঠাণ্ডা ও উত্তম ছিল। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা ঐ মেঘ ছিল যার মধ্যে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন আগমন করবেন। আবূ হুযাইফার (রঃ) এটাই উক্তি।

এ আয়াতটির মধ্যে এর বর্ণনা রয়েছেঃ ‘এসব লোক কি এরই অপেক্ষা করছে যে, আল্লাহ তাআলা মেঘের মধ্যে আসবেন এবং তার ফেরেশতামণ্ডলী?’ এটা ঐ মেঘ যার মধ্যে বদরের যুদ্ধে ফেরেশতাগণ অবতরণ করেছিলেন।

‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’

যে মান্না, তাদেরকে দেয়া হতো তা গাছের উপর অবতারণ করা হতো। তারা সকালে গিয়ে তা জমা করতো এবং ইচ্ছে মত খেয়ে নিতো। ওটা আঠা জাতীয় জিনিস ছিল। কেউ কেউ বলেন যে, শিশিরের সঙ্গে ওর সাদৃশ্য ছিল। কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, শিলার মত মান্না তাদের ঘরে নেমে আসতো, যা দুধের চেয়ে সাদা ও মধু অপেক্ষা বেশী মিষ্ট ছিল। সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবতারিত হতে থাকতো। প্রত্যেক লোক তার বাড়ীর জন্যে ঐ পরিমাণ নিয়ে নিতো যা ঐ দিনের জন্যে যথেষ্ট হতো। কেউ বেশী নিলে তা পচে যেতো। শুক্রবারে তারা শুক্র ও শনি এ দু’দিনের জন্যে গ্রহণ করতো। কেননা, শনিবার ছিল তাদের জন্যে সাপ্তাহিক খুশীর দিন। সে দিন তারা জীবিকা অন্বেষণ করতো। রাবী’ বিন আনাস (রঃ) বলেন যে, মান্না’ ছিল মধু জাতীয় জিনিস যা তারা পানি দিয়ে মিশিয়ে পান করতো।

শাবঈ (রঃ) বলেনঃ “তোমাদের এ মধু ঐ মান্না’ -এর সত্তর ভাগের একভাগ। মাত্র। কবিতাতেও মান্না মধু অর্থে এসেছে। মোটকথা এই যে, তা একটি জিনিস ছিল যা তারা বিনা পরিশ্রমে লাভ করতো। শুধু ওটাকেই খেলে ওটা ছিল খাওয়ার জিনিস, পানির সাথে মিশ্রিত করলে তা ছিল পানের জিনিস এবং অন্য কিছুর সঙ্গে মিশ্রিত করলে তা অন্য জিনিস হয়ে যেতো। কিন্তু এখানে মান্নার ভাবার্থ এটা নয়, বরং ভাবার্থ হচ্ছে পৃথক একটা খাওয়ার জিনিস।

সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন মান্না ব্যাঙ-এর ছাতার অন্তর্গত এবং ওর পানি চক্ষু রোগের ঔষধ। ইমাম তিরমিযী (রঃ) একে হাসান বলেছেন।

জামেউত তিরমিযীর মধ্যে আছেঃ “আজওয়াহ নামক মদীনার এক প্রকার খেজুর হচ্ছে বেহেশতী খাদ্য ও বিষক্রিয়া নষ্টকারী এবং ব্যাঙের ছাতা মান্না এর অন্তর্গত ও চক্ষুরোগে আরোগ্যদানকারী।” এ হাদীসটি হাসান গারীব। আরও বহু পন্থায় এটা বর্ণিত আছে। তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে, ঐ গাছের ব্যাপারে সাহাবীগণের (রাঃ) মধ্যে মতভেদ রয়েছে যা মাটির উপরে হয় এবং যার মূল শক্ত হয় না। কেউ বললেন যে, ওটা ব্যাঙের ছাতা। তখন তিনি বললেন যে, ব্যাঙের ছাতা তো মান্না’-এর অন্তর্ভুক্ত এবং ওর পানি চক্ষু রোগের ঔষধ।’

সালওয়া এক প্রকার পাখী, চড়ুই পাখি হতে কিছু বড়, বরং অনেকটা লাল। দক্ষিণা বায়ু প্রবাহিত হতো এবং ঐ পাখিগুলোকে জমা করে দিতো। বানী ইসরাঈল নিজেদের প্রয়োজন মত ওগুলো ধরতো এবং যবাহ করে খেতো। একদিন খেয়ে বেশী হলে তা শড়ে যেতো। শুক্রবারে তারা দুই দিনের জন্যে জমা করতো। কেননা, শনিবার তাদের জন্যে সাপ্তাহিক খুশীর দিন ছিল। সেই দিন তারা ইবাদতে মশগুল থাকতত এবং ঐদিন শিকার করা তাদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল। কোন কোন লোক বলেছেন যে, ঐ পাখিগুলো কবুতরের সমান ছিল। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে এক মাইল জায়গা ব্যাপী ঐ পাখিগুলোর বর্শা পরিমাণ উঁচু স্থূপ জমে যেতো। ঐ তীহের মাঠে ঐ দু’টো জিনিস তাদের খাদ্যরূপে প্রেরিত হতো, যেখানে তারা তাদের নবীকে বলেছিলঃ ‘এ জঙ্গলে আমাদের আহারের ব্যবস্থা কিরূপে হবে?’ তখন তাদের উপর ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’ অবতারিত হয়েছিল। হযরত মূসাকে (আঃ) পানির জন্যে আবেদন জানানো হলে বিশ্বপ্রভু তাঁকে একটি পাথরের উপর লাঠি মারতে বলেন। লাঠি মারতেই ওটা হতে বারোটি ঝরণা প্রবাহিত হয়। বানী ইসরাঈলের বারোটি দল ছিল। প্রত্যেক দল নিজের জন্যে একটি করে ঝরণা ভাগ করে নেয়। সেই মরুময় প্রান্তরে ছায়া ছাড়া চলা কঠিন বলে তারা ছায়ার জন্যে প্রার্থনা জানায়। তখন মহান আল্লাহ তুর পাহাড় দ্বারা তাদের উপর ছায়া করে দেন। এখন বাকী থাকে বস্ত্র। আল্লাহর হুকুমে যে কাপড় তারা পরেছিল, তাদের দেহ বাড়ার সাথে সাথে কাপড়ও বাড়তে থাকলো। এক বছরের শিশুর কাপড় তার দেহ বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বেড়ে যেতো। সেই কাপড় ছিড়তেও না ময়লাও হতো না। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় এসব নিয়ামতের বর্ণনা রয়েছে।

হাজলী (রঃ) বলেন যে, সালওয়া’ মধুকে বলা হয়। কিন্তু এটা তার ভুল কথা। সাওরাজ (রঃ) এবং জাওহারী (রঃ) এই দু’জনও একথাই বলেছেন এবং এর প্রমাণরূপে আরব কবিদের কবিতা ও কতকগুলো আরবী বাকরীতি পেশ করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এটা একটা ঔষধের নাম। কাসাঈ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) শব্দটি এক বচন এবং এর বহু বচন (আরবি) এসে থাকে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, এর এক বচন ও বহু বচনের একই রূপ। অর্থাৎ- (আরবি) শব্দটি। মোট কথা এই দু’টি আল্লাহ তা’আলার নিয়ামত ছিল, যা খাওয়া তাদের জন্যে বৈধ ছিল। কিন্তু ঐ লোকগুলো তার ঐ সব নিয়ামতের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি এবং ওটাই ছিল তাদের নাসের উপর অত্যাচার।

সাহাবীদের (রাঃ) বৈশিষ্ট্য এবং তাদের মর্যাদা

বানী ইসরাঈলের এ নক্সাকে সামনে রেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহাবীদের (রাঃ) অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তাঁরা কঠিন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েও এবং সীমাহীন দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও রাসূলুল্লাহর (সঃ) আনুগত্যের উপর ও আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের উপর অটল ছিলেন। না তাঁরা মুজিযা দেখতে চেয়েছিলেন, না দুনিয়ার কোন আরাম চেয়েছিলেন। তাকের যুদ্ধে তারা ক্ষুধার জ্বালায় যখন কাতর হয়ে পড়েন, তখন যার কাছে যেটুকু খাবার ছিল সবকে জমা করে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট হাজির করে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের এ খাবারে বরকতের জন্য প্রার্থনা করুন।” আল্লাহর রাসূল (সঃ) প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তা’আলা সে প্রার্থনা মঞ্জুর করতঃ তাতে বরকত দান করেন। তাঁরা খেয়ে পরিতৃপ্ত হন এবং খাবারের পাত্র ভর্তি করে নেন। পিপাসায় তাদের প্রাণ শুকিয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দু’আর বরকতে এক খণ্ড মেঘ এসে পানি বর্ষিয়ে দেয়। তারা নিজেরা পান করেন পশুকে পান করান এবং মশক, কলস ইত্যাদি ভর্তি করে নেন। সুতরাং সাহাবীদের এই অটলতা, দৃঢ়তা, পূর্ণ আনুগত্য এবং খাটি একত্ববাদীতা তাদেরকে হযরত মূসা (আঃ)-এর সহচরদের উপর নিশ্চিতরূপে মর্যাদা দান করেছে।

 

জিহাদের নির্দেশ ও তা অমান্য করণ

হযরত মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলকে নিয়ে যখন মিসরে আসেন এবং তাদেরকে পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, যা ছিল তাদের পৈত্রিক ভূমি ও তথায় তাদেরকে আমালুকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তারা কাপুরুষতা প্রদর্শন করে, যার শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে তীহের মাঠ নিক্ষেপ করা হয়। যেমন সূরা-ই- মায়েদায় বর্ণিত হয়েছে। (আরবি)-এর ভাবার্থ হচ্ছে বায়তুল মুকাদ্দাস। সুদ্দী (রঃ), রাবী (রঃ), কাতাদাহ্ (রঃ) এবং আবু মুসলিম (রঃ) প্রভৃতি মনীষীগণ এটাই বলেছেন। কুরআন মাজীদের মধ্যে রয়েছে যে, হযরত মূসা (আঃ) স্বীয় সম্প্রদায়কে বলেনঃ “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা পবিত্র ভূমিতে গমন কর যা তোমাদের ভাগ্যে লিখে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা ‘আরীহা’ নামক জায়গাকে বুঝান হয়েছে। আবার কেউ কেউ মিসরের কথা বলেছেন। কিন্তু এর ভাবার্থ “বায়তুল মুকাদ্দাস’ হওয়াই সঠিক কথা। এটা তীহ’ হতে বের হওয়ার পরের ঘটনা। শুক্রবার সন্ধ্যার সময় আল্লাহ তা’আলা স্থানটি মুসলমানদের দ্বারা বিজিত করান। এমন কি তাদের জন্যে সূর্যকে কিছুক্ষণের তরে থামিয়ে দিয়েছিলেন, যেন তাদের বিজয় লাভ সম্ভব হয়ে যায়।

বিজয়ের পর কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে নতশিরে উক্ত শহরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) সিজদার অর্থ রুকু নিয়েছেন। বর্ণনাকারী বলেন যে, এখানে সিজদার অর্থ বিনয় ও নম্রতা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দরজাটি ছিল কিবলার দিকে। ওর নাম ছিল বাবুল হিত্তাহ। ইমাম রাযী (রঃ) একথাও বলেছেন যে, দরজার অর্থ হচ্ছে এখানে কিবলার দিক।

সিজদার পরিবর্তে তারা জানুর ভরে যেতে আরম্ভ করে এবং পার্শ্বদেশের ভরে প্রবেশ করতে থাকে। মস্তক নত করার পরিবর্তে উচু করে। (আরবি)শব্দের অর্থ হচ্ছে ক্ষমা। কেউ কেউ বলেন যে, এটা সত্যের নির্দেশ। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এতে পাপের স্বীকারোক্তি রয়েছে। হাসান (রঃ) এবং কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, এটার অর্থ হচ্ছেঃ “হে আল্লাহ! আমাদের ভুল ত্রুটিগুলো দূর করে দিন।”

অতঃপর তাদের সাথে ওয়াদা করা হচ্ছে যে, যদি তারা এটাই বলতে বলতে শহরে প্রবেশ করে এবং বিজয়ের সময়েও বিনয় প্রকাশ করতঃ আল্লাহর নিয়ামত ও নিজেদের পাপের কথা স্বীকার করে এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে এটা তাঁর নিকট খুবই প্রিয় বলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে সূরা-ই- (আরবি) অবতীর্ণ হয়। এর মধ্যেই এ নির্দেশ দেয়া হয়ঃ “যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং তুমি জনগণকে দেখবে যে তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করছে, তখন তুমি তোমার প্রভুর তাসবীহ পাঠ ও প্রশংসা কীর্তন করবে এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, নিশ্চয় তিনি তাওবা কবূলকারী।” এ সূরার মধ্যে যেন যিক্র ও ক্ষমা প্রার্থনার বর্ণনা রয়েছে, তেমনই রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নশ্বর জগত হতে বিদায় গ্রহণের ইঙ্গিত রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত উমারের (রাঃ) সামনে এ ভাবার্থও বর্ণনা করেছিলেন এবং তা তিনি খুব পছন্দ করেছিলেন।

মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন শহরে প্রবেশ করেন, তখন অত্যন্ত বিনয় ও দারিদ্র তার উপর বিরাজ করছিল। তিনি স্বীয় মস্তক এত নীচু করেছিলেন যে, তার উন্ত্রীর জিনে ঠেকে গিয়েছিল। শহরে প্রবেশ করেই তিনি প্রথম প্রহরের আট রাকআত নামায আদায় করেন। ওটা ‘যুহা’র নামায ছিল এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশক নামাযও বটে। দুটোই মুহাদ্দিসগণের কথা।

হযরত সা’দ বিন আবি ওক্কাস (রাঃ) ইরান দেশ বিজয়ের পর যখন কিসরার শাহী প্রাসাদে পৌছেন, তখন তিনিও সেই সুন্নাত অনুযায়ী আট রাকআত নামায আদায় করেন। এক সালামে দুই রাকআত করে পড়া কারও কারও মাযহাবে আছে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, একই সালামে আট রাকআত পড়তে হবে। আল্লাহ্ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

সহীহ বুখারী শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “বানী ইসরাঈলকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তারা যেন সিজদা করা অবস্থায় ও (আরবি) বলতে বলতে দরজায় প্রবেশ করে। কিন্তু তারা তা পরিবর্তন করে ফেলে এবং জানু ভরে ও (আরবি)বলতে বলতে চলতে থাকে। সুনান-ই-নাসাঈ, মুসনাদ-ই-আবদুর রাযযাক, সুনান-ই-আবি দাউদ, সহীহ মুসলিম এবং জামেউত ক্রিমিযীর মধ্যেও শব্দের বিভিন্নতার সঙ্গে এ হাদীসটি বর্ণিত আছে। এর সনদ বিশুদ্ধ।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেনঃ “আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে চলছিলাম। যাতল হানযাল’ নামক ঘাঁটির নিকটবর্তী হলে রাসুলুল্লাহ বলেনঃ “এ ঘাঁটির দৃষ্টান্ত বানী ইসরাঈলের সেই দরজার মত যেখান দিয়ে তাদেরকে নতশিরে এবং (আরবি) বলতে বলতে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ও তাদেরকে তাদের পাপ ক্ষমা করে দেয়ার ওয়াদা দেয়া হয়েছিল।”

হযরত বারআ’ (রঃ) বলেন যে, (আরবি) (২:১৪২) নির্বোধ ইয়াহুদীগণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর কথা পরিবর্তন করেছিল। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর পরিবর্তে তারা (আরবি) বলেছিল। তাদের নিজের ভাষায় ওটা ছিল (আরবি) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাদের এ পরিবর্তনকে বর্ণনা করেন যে, নতশিরে চলার পরিবর্তে তারা জানুর ভরে এবং (আরবি)এর পরিবর্তে (আরবি) (গম) বলতে বলতে চলছিল। হযরত আতা’ (রঃ), মুজাহিদ (রঃ), ইকরামা (রঃ), যহহাক (রঃ), হাসান বসরী (রঃ), রাবী’ বিন আনাস (রঃ), কাতাদাহ (রঃ) এবং ইয়াহইয়াও (রঃ) এটাই বর্ণনা করেছেন। ভাবার্থ এই যে, তাদেরকে যে কথা ও কাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তারা তা উপহাস করে উড়িয়ে দিয়েছিল, যা ছিল প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ। এ জন্যেই আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি শাস্তি অবতীর্ণ করেন। তিনি বলেনঃ “আমি অত্যাচারীদের উপর তাদের পাপের কারণে আসমানী শাস্তি অবতীর্ণ করেছি।” কেউ বলেছেন অভিশাপ, আবার কেউ বলেছেন মহামারী।

একটি মারফু হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মহামারী একটি শান্তি। ওটা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছিল। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা শুনবে যে, অমুক জায়গায় মহামারী আছে তখন তোমরা তথায় যেয়ো না।” তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এটা দুঃখ, রোগ এবং শাস্তি, যা দ্বারা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল।”

আর একটি পুরস্কারঃ

এখানে বানী ইসরাঈলকে আর একটি নিয়ামতের কথা স্মরণ করানো হচ্ছে যে, যখন তাদের নবী হযরত মূসা (আঃ) তাদের জন্যে মহান আল্লাহ নিকট পানির প্রার্থনা জানালেন, তখন আল্লাহ তা’আলা বারটি প্রস্রবণ সেই পাথর হতে বের করলেন যা তাদের সাথে থাকতো এবং তাদের প্রত্যেক গোত্রের জন্য তিনি এক একটি ঝর্ণা প্রবাহিত করে দেন যা প্রত্যেক গোত্র জেনে নেয়। অতঃপর আল্লাহ পাক তাদেরকে বলেন যে, তারা যেন মান্না ও সালওয়া’ খেতে থাকে এবং ঐ ঝর্ণার পানি পান করতে থাকে, আর বিনা পরিশ্রমে প্রাপ্ত ঐ আহার্য ও পানীয় খেয়ে ও পান করে যেন তারা তাঁর ইবাদত করতে থাকে, কিন্তু তারা যেন তাঁর অবাধ্য হয়ে দুনিয়ার বুকে ফাসাদ সৃষ্টি না করে, নচেৎ সেই নিয়ামত তাদের নিকট হতে কেড়ে নেয়া হবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ওটা একটা চার কোণ বিশিষ্ট পাথর ছিল যা তাদের সাথেই থাকতো। আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত মূসা (আঃ) ওর উপর লাঠি দ্বারা আঘাত করলে চার কোণা হতে তিনটি করে বারোটি ঝর্ণা বেরিয়ে আসে। পাথরটি বলদের মাথার মত ছিল যা বলদের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো। তারা যেখানে যেখানে অবতরণ করতো, ওটা নামিয়ে রাখতে এবং লাঠির আঘাত করতেই ওটা হতে ঝর্ণা বেরিয়ে আসতো। আবার যখন যাত্রা আরম্ভ করতো তখন ঝর্ণা বন্ধ হয়ে যেতো। এবং তারা তা উঠিয়ে নিতো। ঐ পাথরটি ছিল তূর পাহাড়ের। ওটা ছিল এক হাত লম্বা ও এক হাত চওড়া। কেউ কেউ বলেন যে, ওটা ছিল বেহেশতী পাথর, যা দশ হাত লম্বা ও দশ হাত চওড়া ছিল। ওর দু’টি শাখা ছিল যা ঝলমল করতো। অন্য একটি মত এই যে, ঐ পাথরটি হযরত আদম (আঃ)-এর সাথে বেহেশত হতে এসেছিল এবং এভাবে হস্তান্তর হতে হতে হযরত শুআইব (আঃ) ওটা প্রাপ্ত হন এবং তিনি লাঠি ও পাথরটি হযরত মূসা (আঃ) কে প্রদান করেন।

কেউ কেউ বলেন যে, ওটা ছিল সেই পাথর যার উপর হযরত মূসা (আঃ) তার কাপড় রেখে গোসল করছিলেন এবং আল্লাহর নির্দেশক্রমে পাথরটি তার কাপড় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর পরামর্শক্রমে তিনি পাথরটি উঠিয়ে নিয়েছিলেন এবং ওটা হতেই তার মুজিযা প্রকাশ পায়।

ইমাম যামাখশারী (রঃ) বলেন যে, ওটা কোন নির্দিষ্ট পাথর ছিল না, বরং তাকে যে কোন একটি পাথরে আঘাত করতে বলা হয়েছিল। হযরত হাসান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে এবং এর দ্বারাই মুজিযার পূর্ণতা প্রকাশ পায়। তার লাঠিটা দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হলেই তা বইতে থাকতো, অন্য লাঠি দ্বারা আঘাত করলেই তা শুকিয়ে যেতো। বানী ইসরাঈল পরস্পর বলাবলি করতে থাকে যে, ঐ পাথরটি হারিয়ে গেলেই তারা পিপাসায় মরে যাবে। তখন আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা (আঃ) কে বলেনঃ “তুমি লাঠি দ্বারা আঘাত করো না, শুধু মুখেই উচ্চারণ কর, তাহলে তাদের বিশ্বাস হবে।” আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। প্রত্যেক গোত্র আপন আপন ঝরণা এভাবে চিনতো যে, প্রত্যেক গোত্রের এক একটি লোক পাথরের পার্শ্বে দাড়িয়ে যেতো এবং লাঠির আঘাত দেয়া মাত্রই ওটা হতে ঝরণা বেরিয়ে আসত। যে ব্যক্তির দিকে যে ঝরণা বয়ে আসতো সে, তখন তার গোত্রকে ডেকে বলতোঃ “এই ঝরণা তোমাদের।” এটা তীহ’ প্রান্তরের ঘটনা। সূরা-ই-আ’রাফের মধ্যেও এ ঘটনা বর্ণিত আছে। কিন্তু ঐ সূরাটি মাক্কী’ বলে তথায় ওটার বর্ণনা নাম পুরুষের সর্বনাম দ্বারা করা হয়েছে এবং আল্লাহ তা’আলা যেসব অনুগ্রহ তাদের উপর করেছিলেন, স্বীয় রাসূলের (সঃ) সামনে তিনি তার পুনরাবৃত্তি করেছেন।

আর এই সূরাটি ‘মাদানী’ বলে এখানে স্বয়ং তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। সূরা-ই-আ’রাফের মধ্যে (আরবি) বলেছেন এবং এখানে (আরবি) বলেছেন। কেননা, সেখানে প্রথম প্রথম জারী হওয়ার অর্থ এবং এখানে শেষ অবস্থার বর্ণনা রয়েছে। আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। এই দু’জায়গায় দশটি যুক্তিতে পার্থক্য রয়েছে এবং এ পার্থক্য শব্দ ও অর্থ উভয় হিসেবেই। ইমাম যামাখশারী (রঃ) এসব যুক্তি বর্ণনা করেছেন,এবং প্রকৃতভাব প্রায় একই।

English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Al-Araf
Sura:7
Verses :- 160-162

وَقَطَّعْنَاهُمُ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أَسْبَاطًا أُمَمًا
And We divided them into twelve tribes (as distinct) nations.

Allah says;

وَقَطَّعْنَاهُمُ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أَسْبَاطًا أُمَمًا وَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى إِذِ اسْتَسْقَاهُ قَوْمُهُ أَنِ اضْرِب بِّعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانبَجَسَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْنًا قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَّشْرَبَهُمْ وَظَلَّلْنَا عَلَيْهِمُ الْغَمَامَ وَأَنزَلْنَا عَلَيْهِمُ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُواْ مِن طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ

وَمَا ظَلَمُونَا وَلَـكِن كَانُواْ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

And We divided them into twelve tribes (as distinct) nations. We revealed to Musa when his people asked him for water (saying):”Strike the stone with your stick,” and there gushed forth out of it twelve springs, each group knew its own place for water. We shaded them with the clouds and sent down upon them the manna and the quail (saying):”Eat of the good things with which We have provided you.” They harmed Us not but they used to harm themselves.

وَإِذْ قِيلَ لَهُمُ اسْكُنُواْ هَـذِهِ الْقَرْيَةَ وَكُلُواْ مِنْهَا حَيْثُ شِيْتُمْ وَقُولُواْ حِطَّةٌ وَادْخُلُواْ الْبَابَ سُجَّدًا نَّغْفِرْ لَكُمْ خَطِييَاتِكُمْ

سَنَزِيدُ الْمُحْسِنِينَ
And (remember) when it was said to them:”Dwell in this town (Jerusalem) and eat therefrom wherever you wish, and say, `(O Allah) forgive our sins’; and enter the gate prostrating (bowing with humility). We shall forgive you your wrongdoings. We shall increase (the reward) for the good-doers.”

فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنْهُمْ قَوْلاً غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ

فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِجْزًا مِّنَ السَّمَاء بِمَا كَانُواْ يَظْلِمُونَ
But those among them who did wrong, changed the word that had been told to them. So We sent on them a torment from the heaven in return for their wrongdoings.)

We discussed these Ayat in Surah Al-Baqarah, which was revealed in Al-Madinah, while these Ayat were revealed in Makkah.

We also mentioned the difference between the two narrations, and thus we do not need to repeat it here, all thanks are due to Allah and all the favors are from Him.

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
* সূরা মায়েদার ১২ আয়াতে বনী ইসরাঈলের সমাজ কাঠামো পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রসঙ্গে যে কথা বলা হয়েছে এবং বাইবেলের গণনা পুস্তকে যে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেদিকেই এ আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহর আদেশে হযরত মূসা সিনাই পাহাড়ের জনবসতিহীন এলাকায় অবস্থানকালে বনী ইসরাঈল জাতির আদমশুমারী সম্পন্ন করেন। হযরত ইয়াকূবের দশ ছেলে এবং হযরত ইউসুফের দুই ছেলের বংশের ভিত্তিতে ১২ টি পরিবারকে পৃথকভাবে ১২টি গোত্র বা গোষ্ঠীতে বিন্যস্ত ও সংগঠিত করেন। প্রত্যেকটি দলে একজন সরদার নিযুক্ত করেন। তাদের দায়িত্ব ছিল, নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক দিক দিয়ে দলের মধ্যে নিয়ম-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং তাদের মধ্যে শরীয়াতের বিধান জারী করা। এছাড়া হযরত ইয়াকুবের যে দ্বাদশতম পুত্র লাবীর বংশে হযরত মূসা ও হযরত হারুনের জন্ম হয়েছিল, সেই শাখাটিকে বাদবাকী সব কটি গোত্রের মধ্যে সত্যের আলোক শিখা সমুজ্জ্বল রাখার দায়িত্ব পালনের জন্য একটি পৃথক দলের আকারে সংগঠিত করেন।

* ওপরে যে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছে, সেটি ছিল মহান আল্লাহ‌ বনী ইসরাঈলীদের ওপর যেসব অনুগ্রহ করেছিলেন তার অন্যতম। এরপর এখানে আরো তিনটি অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

একঃ সিনাই উপদ্বীপের জনমানবহীন এলাকায় তাদের জন্য অলৌকিক উপায়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।

দুই, রৌদ্র তাপ থেকে বাঁচাবার জন্য তাদের ওপর আকাশে মেঘমালার ছায়া রচনা করা হয়।

তিন, মান্না ও সালওয়ার আকারে তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহের অস্বাভাবিক ব্যবস্থা করা হয়। তাদের জীবন ধারণের জন্য এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা না করা হলে কয়েক লাখ জনসংখ্যা সম্বলিত এ জাতিটি এ খাদ্য-পানীয় বিহীন পাহাড়-মরু-প্রান্তরে ক্ষুধা পিপাসায় একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। আজো কোন ব্যক্তি সেই এলাকায় গেলে সেখানকার পরিবেশ দেখে অবাক হয়ে যাবে। অকস্মাৎ পনের-বিশ লাখ মানুষ যদি সেই এলাকায় গিয়ে ওঠে তাহলে তাদের জন্য খাদ্য পানীয় ও ছায়াদানের কি ব্যবস্থা করা যেতে পারে, তা তার মাথায়ই আসবে না। বর্তমানে সমগ্র সিনাই উপদ্বীপের জনসংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশী নয়। আর আজ এই বিশ শতকেও যদি কোন দেশের শাসক সেখানে ৫ লাখ সৈন্য নিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাদের জন্য খাদ্য পানীয় সরবরাহের ব্যবস্থাপনা তার বিশেষজ্ঞদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ কারণে আল্লাহর কিতাব অমান্যকারী ও মুজিযা অস্বীকারকারী বহু আধুনিক পুরাতত্ত্ববিদ ও গবেষকগণ একথা মানতেই চান না যে, বনী ইসরাঈলীরা সিনাই উপদ্বীপের কুরআনে ও বাইবেলে উল্লেখিত অংশ অতিক্রম করেছিল। তাদের ধারণা, সম্ভবত এ ঘটনাগুলো ফিলিস্তিনের দক্ষিণে ও আরবের উত্তরের এলাকায় কোথাও সংঘটিত হয়ে থাকবে। সিনাই উপদ্বীপের প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগলিক পরিবেশ যে রকম, তা দেখে তারা কল্পনাও করতে পারেন না যে এত বড় একটা জাতির পক্ষে এখানে বছরের পর বছর এক একটি এলাকায় তাঁবু খাঁটিয়ে অবস্থান করতে করতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বিশেষ করে যখন মিসরের দিক থেকেও তাদের খাদ্য সরবরাহের পথ রুদ্ধ ছিল এবং অন্যদিকে পূর্ব ও উত্তরে আমালিকা গোত্রগুলো তাদের বিরোধিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এসব বিষয় বিবেচনা করলে সঠিকভাবে অনুমান করা যেতে পারে যে, এ কয়েকটি সংক্ষিপ্ত আয়াতে মহান আল্লাহ‌ বনি ইসরাঈলীদের প্রতি নিজের যে সমস্ত অনুগ্রহের কথা বর্ণনা করেছেন, তা আসলে কত বড় অনুগ্রহ ছিল। এরপর আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের এ ধরনের সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নিদর্শনাবলী দেখার পরও আল্লাহর সাথে এ জাতির নাফরমানী ও বিশ্বাসঘাতকতার যে ধারাবাহিক ঘটনাবলীতে ইতিহাসের পাতা পরিপূর্ণ, তা থেকে বুঝা যায় যে তারা কত বড় অকৃতজ্ঞ ছিল। (তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য দেখুন সূরা বাকারা ৭২ , ৭৩ ও ৭৬ টীকা)

* টিকা: 72
অর্থাৎ প্রখর রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য যেখানে সিনাই উপদ্বীপে তোমাদের জন্য কোন আশ্রয়স্থল ছিল না সেখানে আমরা মেঘমালার ছায়া দান করে তোমাদের বাঁচার উপায় করে দিয়েছি। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, লক্ষ লক্ষ বনী ইসরাঈর মিসর থেকে বের হয়ে এসেছিল। আর সিনাই উপত্যকায় গৃহ তো দূরের কথা সামান্য একটু মাথা গোঁজার মতো তাঁবুও তাদের কাছে ছিল না। সে সময় যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ সময়ের জন্য আকাশকে মেঘাবৃত করে রাখা না হতো, তাহলে খর-রৌদ্র –তাপে বনী ইসরাঈলী জাতি সেখানেই ধ্বংস হয়ে যেতো।
* টিকা: 73
মান্না ও সালওয়া ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক প্রকার প্রাকৃতিক খাদ্য। বনী ইসরাঈররা তাদের বাস্তুহারা জীবনের সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে এই খাদ্য লাভ করতে থেকেছে। মান্না ছিল ধনিয়ার ধানার মতো ক্ষুদ্রাকৃতির এক ধরনের খাদ্য। সেগুলোর বর্ষণ হতো কুয়াসার মতো। জমিতে পড়ার পর জমে যেতো। আর সালওয়া ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির কবুতরের মতো এক প্রকার পাখি। আল্লাহর অসীম অনুগ্রহে এই খাদ্যের বিপুল প্রাচুর্য ছিল। বিপুল জনসংখ্যার অধিকারী একটি জাতি দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই খাদ্যের ওপর জীবন নির্বাহ করেছে। তাদের কাউকে কোনদিন অনাহারে থাকতে হয়নি। অথচ আজকের উন্নত বিশ্বের কোন দেশে যদি হঠাৎ কয়েক লাখ শরণার্থী প্রবেশ করে তাহলে তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করা একটি প্রাণান্তকর সমস্যায় পরিণত হয়। (মান্না ও সালওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে বাইবেলের নির্গমন পুস্তকঃ ১৬ অনুচ্ছেদ, গণনাঃ ১১ অনুচ্ছেদ, ৭-৯ ও ৩১-৩৬ শ্লোক এবং ঈশুঃ ৫ অনুচ্ছেদ, ১২ শ্লোক)
* টিকা: 76
সে পাথরটি এখনো সিনাই উপদ্বীপে রয়েছে। পর্যটকরা এখনো গিয়ে সেটি দেখেন। পাথরের গায়ে এখনো ঝর্ণার উৎস মুখের গর্তগুলো দেখা যায়। ১২টি ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করার কারণ ছিল এই যে, বনী ইসরাঈলদেরও ১২টি গোত্র ছিল। প্রত্যেক গোত্রের জন্য আল্লাহ‌ একটি করে ঝর্ণা প্রবাহিত করেন। তাদের মধ্যে পানি নিয়ে কলহ সৃষ্টি না হয়, এ জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছিল।
** মহান আল্লাহর উপরোল্লিখিত অনুগ্রহসমূহের জবাবে বনী ইসরাঈল কি ধরনের অপরাধমূলক ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্য দেখাতে থাকে এবং কিভাবে ক্রমাগত ধ্বংসের আবর্তে নেমে যেতে থাকে, তা তুলে ধরার জন্য এখানে এ জাতির সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বর্ণনা করা হচ্ছে।

* টিকা: 74
এখনো পর্যন্ত যথার্থ অনুসন্ধানের মাধ্যমে এ জনপদটিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে যে ঘটনা পরস্পরায় এর উল্লেখ হয়েছে তা এমন এক যুগের সাথে সম্পর্কিত যখন বনী ইসরাঈল সাইনা উপদ্বীপেই অবস্থান করছিল। তাতেই মনে হয়, উল্লেখিত জনপদটির অবস্থান এ উপদ্বীপের কোথাও হবে। কিন্তু এ জনপদটি ‘সিত্তীম’ও হতে পারে। সিত্তীম শহরটি ‘ইয়ারীহো’ –এর ঠিক বিপরীত দিকে জর্দান নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত ছিল। বাইবেলে উল্লেখিত হয়েছে, বনী ইসরাঈলরা মূসার (আ) জীবনের শেষ অধ্যায়ে এ শহরটি জয় করেছিল। সেখানে তারা ব্যাপক ব্যভিচার করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ভয়াবহ মহামারীর শিকারে পরিণত করেন এবং এতে চব্বিশ হাজার লোকের মৃত্যু হয়। (গণনা, ২৫ অনুচ্ছেদ, ১-৮ শ্লোক)
* টিকা: 75
অর্থাৎ তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল। স্বেচ্ছাচারী যালেম বিজয়ীদের মতো অহংকার মদমত্ত হয়ে প্রবেশ করো না। বরং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও তাঁর ভয়ে ভীত বান্দাদের মতো বিনম্রভাবে প্রবেশ করো। যেমন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় বিনয়াবনত হয়ে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। ‘হিত্তাতুন’ শব্দটির দুই অর্থ হতে পারে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কাছে নিজের গোনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে প্রবেশ করো। আর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, ব্যাপক গণহত্যা ও লুটতরাজ করতে করতে প্রবেশ না করে বরং জনপদের অধিবাসীদের ভুল-ত্রুটি উপেক্ষা করে তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে করতে শহরে প্রবেশ করো।

Leave a Reply