أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
(Book# 604)
www.motaher21.net
সুরা: আত্ তাওবাহ
সুরা:০৯
২৮-২৯ নং আয়াত:-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡمُشۡرِکُوۡنَ نَجَسٌ
হে বিশ্বাসিগণ! অংশীবাদীরা তো অপবিত্র।
O you who have believed, indeed the polytheists are unclean,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡمُشۡرِکُوۡنَ نَجَسٌ فَلَا یَقۡرَبُوا الۡمَسۡجِدَ الۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِہِمۡ ہٰذَا ۚ وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ عَیۡلَۃً فَسَوۡفَ یُغۡنِیۡکُمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖۤ اِنۡ شَآءَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۲۸﴾
হে বিশ্বাসিগণ! অংশীবাদীরা তো অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মাসজিদুল হারামের নিকট না আসে। যদি তোমরা দারিদ্রে্র আশঙ্কা কর, তাহলে জেনে রাখ, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাঁর নিজ করুণায় তিনি তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
قَاتِلُوا الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ لَا بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ لَا یُحَرِّمُوۡنَ مَا حَرَّمَ اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗ وَ لَا یَدِیۡنُوۡنَ دِیۡنَ الۡحَقِّ مِنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ حَتّٰی یُعۡطُوا الۡجِزۡیَۃَ عَنۡ یَّدٍ وَّ ہُمۡ صٰغِرُوۡنَ ﴿٪۲۹﴾
যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না ও পরকালেও নয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা নিষিদ্ধ মনে করে না এবং সত্য ধর্ম অনুসরণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে নিজ হাতে জিযিয়া আদায় করে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ বলেছেন:-
২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: মুশরিকরা হাজ্জ করতে বাইতুল্লায় আসত এবং ব্যবসা করার জন্য সাথে খাদ্য নিয়ে আসত। যখন বাইতুল্লায় আসতে নিষেধ করা হল তখন শয়তান মুসলিমদের মনে ভয় সৃষ্টি করে দিয়ে বলতে লাগল: তাহলে তোমরা কিভাবে বাঁচবে, তোমাদের খাবার কোথা থেকে আসবে? তখন আল্লাহ তা‘আলা
(وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللّٰهُ مِنْ فَضْلِه۪)
আয়াতটি নাযিল করেন। (লুবানুল নুকুল, পৃঃ ১৪০, কুরতুবী, অত্র আয়াতের তাফসীর, সফওয়াতুত্ তাফাসীর ১/৪৯৩)
মুশরিকরা অপবিত্র এর অর্থ: তারা আকীদা বিশ্বাস ও আমলগত অপবিত্র। কারো কারো নিকট মুশরিকরা বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয়ভাবে অপবিত্র। কেননা, তারা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে সেরূপ খেয়াল রাখেনা যেরূপ শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে।
মুশরিকরা শুধু মাসজিদে হারামেই প্রবেশ করতে পারবে না। প্রয়োজনে অন্য কোন মাসজিদে প্রবেশ করতে পারে। যেমন সুমামাহ বিন উসালকে মাসজিদে নববীতে বেঁধে রাখা হয়েছিল। অথচ সে ছিল মুশরিক। অধিকাংশ আলিমের মতে মাসজিদে হারাম বলতে সম্পূর্ণ হারাম এলাকা এতে শামিল। সুতরাং সম্পূর্ণ হারাম এলাকায় মুশরিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
তবে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এ বিষয়ে পাঁচটি মত নিয়ে এসেছেন। মদীনাবাসীদের মতে মাসজিদে হারামসহ কোন মাসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না। এ নির্দেশ দিয়ে উমার বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) গভর্নরদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। এ মতকে কুরআনের অন্য আয়াত সমর্থন করে।
(فِيْ بُيُوْتٍ أَذِنَ اللّٰهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيْهَا اسْمُه۫ لا يُسَبِّحُ لَه۫ فِيْهَا بِالْغُدُوِّ وَالْاٰصَالِ)
“সে-সকল ঘরকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে”(সূরা নূর ২৪: ৩৬)
নাবী (সাঃ) বলেন: মাসজিদে প্রসাব ও ময়লা ফেলা উচিত নয়। (সহীহ মুসলিম হা: ২৮৫) কাফিররা ময়লা থেকে খালি নয়। তবে সঠিক কথা প্রথমটিই, কারণ কুরআনে সরাসরি মাসজিদে হারামের কথা উল্লেখ রয়েছে।
(بَعْدَ عَامِهِمْ هٰذَا)
‘এ বৎসরের পর’এ বছর বলতে যে বছর সূরা তাওবাহ নাযিল হয়েছে তথা নবম হিজরী, কেউ বলেছেন দশম হিজরী।
إِنْ شَا۬ءَ ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ অর্থাৎ রিযিক সম্পূর্ণ আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন, আল্লাহ তা‘আলা যাকে যতটুকু ইচ্ছা রিযিক দান করেন এবং তিনিই বণ্টন করে দেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَهُمْ يَقْسِمُوْنَ رَحْمَتَ رَبِّكَ ط نَحْنُ قَسَمْنَا بَيْنَهُمْ مَّعِيْشَتَهُمْ فِي الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجٰتٍ لِّيَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِيًّا ط وَرَحْمَتُ رَبِّكَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ)
“তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বন্টন করে? আমিই তাদের মধ্যে জীবিকা বণ্টন করি তাদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের ওপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে একে অপরের দ্বারা খেদমত লাভ করতে পারে এবং তারা যা জমা করে তা হতে তোমার প্রতিপালকের রহমত উৎকৃষ্টতর।”(সূরা যুখরুফ ৪৩: ৩২)
(قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُوْنَ)
‘যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে যারা আল্লাহতে ঈমান আনে না ও শেষদিনেও নয়’মুশরিকদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে যুদ্ধের আদেশের পর এ আয়াতে ইয়াহূদী খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার আদেশ করা হচ্ছে। (যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তারা জিযিয়া দিয়ে মুসলিমদের অধীনে বসবাস করবে। জিযিয়া হল নির্ধারিত কিছু অর্থ। মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করতে চায় এমন অমুসলিমদের থেকে বাৎসরিক যে চাঁদা আদায় করা হয় তাকে জিযিয়া বলা হয়। এ জিযিয়া প্রত্যেকে স্বহস্তে নত স্বীকার করে প্রদান করবে। এর বিনিময়ে তাদের জান মাল ও মান-ইজ্জতের হিফাযতের দায়িত্ব মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর বর্তাবে। জিযিয়া কেবল স্বাধীন পুরুষ ও যোদ্ধাদের থেকে নেয়া হবে। কুরআনে সে নির্দেশই দেয়া হয়েছে এবং আলেম সমাজ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরা আল্লাহ তা‘আলা এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখত, তা সত্ত্বেও তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলা এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে না। এ থেকে এটা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সেভাবে ঈমান না আনবে যেভাবে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়।
অধিকাংশ আলিম এ আয়াতের ভিত্তিতে বলেছেন: জিযিয়া কেবল আহলে কিতাবের থেকে নেয়া হবে। কেননা তাদের ছাড়া অন্যের কাছ থেকে জিযিয়া নেয়ার কথা বলা হয়নি। অন্যরা হয় ইসলাম গ্রহণ করবে নতুবা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। (তাফসীরে সা‘দী, পৃঃ ৩৪১)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মক্কার হারাম এলাকায় মুশরিকদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ সে যে কেউ হোক না কেন।
২. দরিদ্রতার ভয় যেন কোন মু’মিনকে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বাস্তবায়ন করতে বাধা না দেয়।
৩. আহলে কিতাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব যতক্ষণ না ইসলাম গ্রহণ করে অথবা জিযিয়া দেয়।
৪. শির্ক মিশ্রিত ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
আগামীতে শুধু তাদের হজ্জ ও যিয়ারতই বন্ধ নয় বরং মসজিদে হারামের সীমানায় তাদের প্রবেশই নিষিদ্ধ। এভাবে শিরক ও জাহেলিয়াতের পুনরাবর্তনের কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।
অপবিত্র, কথাটির মানে এই নয় যে, তারা নিজেরাই অপবিত্র বা নাপাক। বরং এর মানে হচ্ছে, তাদের আকীদা,-বিশ্বাস, নৈতিক, চরিত্র, কাজকর্ম এবং তাদের জাহেলী চালচলন ও সমাজ ব্যবস্থা অপবিত্র। আর এ অপবিত্রতার কারণে হারাম শরীফের চতুঃসীমায় তাদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইমাম আবু হানিফার মতে এর অর্থ শুধু এতটুকুই যে, হজ্জ ও উমরাহ এবং জাহেলী অনুষ্ঠানাদি পালন করার জন্য তারা হারাম শরীফের সীমানায় প্রবেশ করতে পারবে না। ইমাম শাফেয়ীর মতে এ হুকুমের অর্থ হচ্ছে, তারা (যে কোন অবস্থায়ই) মসজিদে হারামে প্রবেশ করতে পারবে না। ইমাম মালেক বলেন, শুধু মসজিদে হারামেই নয়, দুনিয়ার অন্য কোন মসজিদেও তাদের প্রবেশ জায়েজ নয়। তবে এ শেষোক্ত মতটি সঠিক নয়। কারণ নবী (সা.) নিজেই তাদের মসজিদে নববীতে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন।
যদিও আহলি কিতাবরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখার দাবীদার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা না আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, না আখেরাতের প্রতি। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অর্থ শুধুমাত্র আল্লাহ আছে একথা মেনে নেয়া নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে, মানুষ আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ ও একমাত্র রব বলে মেনে নেবে এবং তাঁর সত্তা, গুণাবলী, অধিকার ও ক্ষমতায় নিজেকে বা অন্য কাউকে শরীক করবেনা। কিন্তু খৃস্টান ও ইহুদীরা এ অপরাধে লিপ্ত। পরবর্তী পর্যায়ের আয়াতগুলোতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই তাদের আল্লাহকে মেনে নেয়ার কথাটা অর্থহীন। একে কোন ক্রমেই ঈমান বিল্লাহ বলা যেতে পারে না। অনুরূপভাবে আখেরাতকে মানার অর্থ মরে যাওয়ার পর আমাদের আবার উঠানো হবে, শুধু এতটুকু কথার স্বীকৃতি দেয়া নয় বরং এ সঙ্গে এ কথা মেনে নেয়াও অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, সেখানে কোন চেষ্টা-তদবীর ও সুপারিশ করা, জরিমানা দেয়া এবং কোন বুজর্গ ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক ও বন্ধন কোন কাজে লাগবে না। কেউ কারোর পাপের কাফফারা হবে না। আল্লাহর আদালতে ইনসাফ হবে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন এবং মানুষের ঈমান ও আমল ছাড়া আর কোন জিনিসকে মোটেই মূল্য দেয়া হবে না। এরূপ বিশ্বাস ছাড়া আখেরাতকে মেনে নেয়া অর্থহীন। কিন্তু ইহুদী ও খৃস্টানরা এ দিক দিয়েই নিজেদের ঈমান আকিদা নষ্ট করে ফেলেছে। কাজেই তাদের আখেরাতের প্রতি ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়।
* আল্লাহ তার রসূলের মাধ্যমে যে শরীয়াত নাযিল করেছেন তাকে নিজেদের জীবন বিধান হিসেবে গ্রহণ করে না।
* তারা ঈমান আনবে ও আল্লাহর সত্য দ্বীনের অনুসারী হয়ে যাবে, যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তা নয়। বরং যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছেঃ তাদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য খতম হয়ে যাবে। তারা পৃথিবীতে শাসন ও কর্তৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবে না। বরং পৃথিবীতে মানুষের জীবন ব্যবস্থা লাগাম এবং মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করা ও তাদের নেতৃত্ব দান করার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সত্যের অনুসারীদের হাতে থাকবে এবং তারা এ সত্যের অনুসারীদের অধীনে অনুগত জীবন যাপন করবে।
জিম্মিদেরকে ইসলামী শাসনের আওতায় যে নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ দান করা হবে তার বিনিময়কে জিযিয়া বলা হয়। তাছাড়া তারা যে হুকুম মেনে চলতে এবং ইসলামী শাসনের আওতাধীনে বসবাস করতে রাজী হয়েছে, এটা তার একটি আলামত হিসেবেও চিহ্নিত হবে। নিজের হাতে জিযিয়া দেয় এর অর্থ হচ্ছে, সহজ, সরল আনুগত্যের ভঙ্গিতে জিযিয়া আদায় করা। আর পদানত হয়ে থাকে এর অর্থ, পৃথিবীতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের নয় বরং যে মু’মিন ও মুসলিমরা আল্লাহর খিলাফত ও প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করছে তাদের হাতে থাকবে।
প্রথমদিকে ইহুদী ও খ্রিষ্টানের কাছ থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নবী (সা.) নিজে মাজুসীদের (অগ্নি উপাসক) থেকে জিযিয়া আদায় করে তাদেরকে যিম্মী করেন। এরপর সাহাবায়ে কেরাম সর্বসম্মতিক্রমে আরবের বাইরের সব জাতির ওপর সাধারণভাবে এ আদেশ প্রয়োগ করেন।
ঊনিশ শতকে মুসলিম মিল্লাতের পতন ও অবনতির যুগে এ জিযিয়া সম্পর্কে মুসলমানদের পক্ষ থেকে বড় বড় সাফাই পেশ করা হতো। সেই পদাঙ্ক অনুসারী কিছু লোক এখনো রয়েছে এবং তারা এখনো এ ব্যাপারে সাফাই গেয়ে চলেছে। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন এসবের অনেক ঊর্ধ্বে।
আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহের ভূমিকায় অবতীর্ণ, তাদের কাছে কৈফিয়ত দান ও ওযর পেশ করার তার কোন প্রয়োজন নেই। পরিষ্কার ও সোজা কথায়, যারা আল্লাহর দ্বীনকে গ্রহণ করে না এবং নিজেদের বা অন্যের উদ্ভাবিত ভুল পথে চলে, তারা বড় জোর এতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রাখে যে, নিজেরা ভুল পথে চলতে চাইলে চলতে পারে, কিন্তু আল্লাহর যমীনে কোন একটি জায়গায়ও মানুষের ওপর শাসন চালাবার এবং নিজেদের ভ্রান্তি নীতি অনুযায়ী মানুষের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা পরিচালনা করার আদৌ কোন অধিকার তাদের নেই। দুনিয়ার যেখানেই তারা এ জিনিসটি লাভ করবে সেখানেই বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। তাদেরকে এ অবস্থান থেকে সরিয়ে দিয়ে সৎ ও সত্যনিষ্ঠা জীবন বিধানের অনুগত করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোই হবে মু’মিনদের কর্তব্য।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, এ জিযিয়া কিসের বিনিময়ে দেয়? এর জবাব হচ্ছে, ইসলামী শাসন কর্তৃত্বের আওতাধিনে নিজেদের গোমরাহীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য অমুসলিমদের যে স্বাধীনতা দান করা হয় এটা তারই মূল্য। আর যে সৎ ও সত্যনিষ্ঠা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তাদের এ স্বাধীনতাকে কাজে লাগাবার অনুমতি দেয় এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণ করে তার শাসন ও আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পরিচালনায় এ অর্থ ব্যয়িত হওয়া উচিত। এর সবচেয়ে বড় ফায়দা হচ্ছে এই যে, জিযিয়া আদায় করার সময় প্রতি বছর জিম্মিদের মধ্যে একটা অনুভূতি জাগতে থাকবে। প্রতি বছর তারা মনে করতে থাকবে, তারা আল্লাহর পথে যাকাত দেবার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত আর এর পরিবর্তে গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য তাদের মূল্য দিতে হচ্ছে। এটা তাদের কত বড় দুর্ভাগ্য। এ দুর্ভাগ্যের কারাগারে তারা বন্দী।
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura Tawbah
Sura:09
Verses :- 28-29
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡمُشۡرِکُوۡنَ نَجَسٌ
O you who have believed, indeed the polytheists are unclean,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡمُشۡرِکُوۡنَ نَجَسٌ فَلَا یَقۡرَبُوا الۡمَسۡجِدَ الۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِہِمۡ ہٰذَا ۚ وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ عَیۡلَۃً فَسَوۡفَ یُغۡنِیۡکُمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖۤ اِنۡ شَآءَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۲۸﴾
O you who have believed, indeed the polytheists are unclean, so let them not approach al-Masjid al-Haram after this, their [final] year. And if you fear privation, Allah will enrich you from His bounty if He wills. Indeed, Allah is Knowing and Wise.
قَاتِلُوا الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ لَا بِالۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ لَا یُحَرِّمُوۡنَ مَا حَرَّمَ اللّٰہُ وَ رَسُوۡلُہٗ وَ لَا یَدِیۡنُوۡنَ دِیۡنَ الۡحَقِّ مِنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ حَتّٰی یُعۡطُوا الۡجِزۡیَۃَ عَنۡ یَّدٍ وَّ ہُمۡ صٰغِرُوۡنَ ﴿٪۲۹﴾
Fight those who do not believe in Allah or in the Last Day and who do not consider unlawful what Allah and His Messenger have made unlawful and who do not adopt the religion of truth from those who were given the Scripture – [fight] until they give the jizyah willingly while they are humbled.
Idolators are no longer allowed into Al-Masjid Al-Haram
Allah says;
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلَ يَقْرَبُواْ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَـذَا
O you who believe! Verily, the Mushrikin are impure. So let them not come near Al-Masjid Al-Haram after this year;
Allah commands His believing servants, who are pure in religion and person, to expel the idolators who are filthy in the religious sense, from Al-Masjid Al-Haram.
After the revelation of this Ayah, idolators were no longer allowed to go near the Masjid.
This Ayah was revealed in the ninth year of Hijrah. The Messenger of Allah sent Ali in the company of Abu Bakr that year to publicize to the idolators that no Mushrik will be allowed to perform Hajj after that year, nor a naked person allowed to perform Tawaf around the House.
Allah completed this decree, made it a legislative ruling, as well as, a fact of reality.
Abdur-Razzaq recorded that Jabir bin Abdullah commented on the Ayah,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ امَنُواْ إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلَ يَقْرَبُواْ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَـذَا
(O you who believe! Verily, the Mushrikin are impure. So let them not come near Al-Masjid Al-Haram after this year),
“Unless it was a servant or one of the people of Dhimmah.”
Imam Abu Amr Al-Awza’i said,
“Umar bin Abdul-Aziz wrote (to his governors) to prevent Jews and Christians from entering the Masjids of Muslims, and he followed his order with Allah’s statement,
إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ
(Verily, the Mushrikin are impure).
Ata said,
“All of the Sacred Area (the Haram) is considered a Masjid, for Allah said,
فَلَ يَقْرَبُواْ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَـذَا
(So let them not come near Al-Masjid Al-Haram (at Makkah) after this year).”
This Ayah indicates that idolators are impure and that the believers are pure. In the Sahih is the following,
الْمُوْمِنُ لَا يَنْجُس
The believer does not become impure.
Allah said,
وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ
and if you fear poverty, Allah will enrich you, out of His bounty.
Muhammad bin Ishaq commented,
“The people said, `Our markets will be closed, our commerce disrupted, and what we earned will vanish.’
So Allah revealed this verse,
وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ
(and if you fear poverty, Allah will enrich you, out of His bounty), from other resources,
إِن شَاء
(if He wills), until,
وَهُمْ صَاغِرُونَ
(… and feel themselves subdued).
This Ayah means, `this will be your compensation for the closed markets that you feared would result.’
Therefore, Allah compensated them for the losses they incurred because they severed ties with idolators, by the Jizyah they earned from the People of the Book.”
Similar statements were reported from Ibn Abbas, Mujahid, Ikrimah, Sa`id bin Jubayr, Qatadah and Ad-Dahhak and others.
Allah said,
إِنَّ اللّهَ عَلِيمٌ
Surely, Allah is All-Knowing, (in what benefits you),
حَكِيمٌ
All-Wise,
in His orders and prohibitions, for He is All-Perfect in His actions and statements, All-Just in His creations and decisions, Blessed and Hallowed be He. This is why Allah compensated Muslims for their losses by the amount of Jizyah that they took from the people of Dhimmah.
The Order to fight People of the Scriptures until They give the Jizyah
Allah said
قَاتِلُواْ الَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ بِاللّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الاخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ
Fight against those who believe not in Allah, nor in the Last Day, nor forbid that which has been forbidden by Allah and His Messenger, and those who acknowledge not the religion of truth among the People of the Scripture, until they pay the Jizyah with willing submission, and feel themselves subdued.
Therefore, when People of the Scriptures disbelieved in Muhammad, they had no beneficial faith in any Messenger or what the Messengers brought. Rather, they followed their religions because this conformed with their ideas, lusts and the ways of their forefathers, not because they are Allah’s Law and religion. Had they been true believers in their religions, that faith would have directed them to believe in Muhammad, because all Prophets gave the good news of Muhammad’s advent and commanded them to obey and follow him. Yet when he was sent, they disbelieved in him, even though he is the mightiest of all Messengers. Therefore, they do not follow the religion of earlier Prophets because these religions came from Allah, but because these suit their desires and lusts. Therefore, their claimed faith in an earlier Prophet will not benefit them because they disbelieved in the master, the mightiest, the last and most perfect of all Prophets . Hence Allah’s statement,
قَاتِلُواْ الَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ بِاللّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الاخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ
Fight against those who believe not in Allah, nor in the Last Day, nor forbid that which has been forbidden by Allah and His Messenger, and those who acknowledge not the religion of truth among the People of the Scripture,
This honorable Ayah was revealed with the order to fight the People of the Book, after the pagans were defeated, the people entered Allah’s religion in large numbers, and the Arabian Peninsula was secured under the Muslims’ control. Allah commanded His Messenger to fight the People of the Scriptures, Jews and Christians, on the ninth year of Hijrah, and he prepared his army to fight the Romans and called the people to Jihad announcing his intent and destination.
The Messenger sent his intent to various Arab areas around Al-Madinah to gather forces, and he collected an army of thirty thousand. Some people from Al-Madinah and some hypocrites, in and around it, lagged behind, for that year was a year of drought and intense heat.
The Messenger of Allah marched, heading towards Ash-Sham to fight the Romans until he reached Tabuk, where he set camp for about twenty days next to its water resources. He then prayed to Allah for a decision and went back to Al-Madinah because it was a hard year and the people were weak, as we will mention, Allah willing.
Paying Jizyah is a Sign of Kufr and Disgrace
Allah said,
حَتَّى يُعْطُواْ الْجِزْيَةَ
until they pay the Jizyah,
if they do not choose to embrace Islam,
عَن يَدٍ
with willing submission,
in defeat and subservience,
وَهُمْ صَاغِرُونَ
and feel themselves subdued.
disgraced, humiliated and belittled. Therefore, Muslims are not allowed to honor the people of Dhimmah or elevate them above Muslims, for they are miserable, disgraced and humiliated.
Muslim recorded from Abu Hurayrah that the Prophet said,
لَاا تَبْدَءُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى بِالسَّلَامِ وَإِذَا لَقِيتُمْ أَحَدَهُمْ فِي طَرِيقٍ فَاضْطَرُّوهُ إِلَى أَضْيَقِه
Do not initiate the Salam to the Jews and Christians, and if you meet any of them in a road, force them to its narrowest alley.
This is why the Leader of the faithful Umar bin Al-Khattab, may Allah be pleased with him, demanded his well-known conditions be met by the Christians, these conditions that ensured their continued humiliation, degradation and disgrace.
The scholars of Hadith narrated from Abdur-Rahman bin Ghanm Al-Ashari that he said,
“I recorded for Umar bin Al-Khattab, may Allah be pleased with him, the terms of the treaty of peace he conducted with the Christians of Ash-Sham:
`In the Name of Allah, Most Gracious, Most Merciful.
This is a document to the servant of Allah Umar, the Leader of the faithful, from the Christians of such and such city.
When you (Muslims) came to us we requested safety for ourselves, children, property and followers of our religion.
We made a condition on ourselves that we will neither erect in our areas a monastery, church, or a sanctuary for a monk, nor restore any place of worship that needs restoration nor use any of them for the purpose of enmity against Muslims.
We will not prevent any Muslim from resting in our churches whether they come by day or night, and we will open the doors (of our houses of worship) for the wayfarer and passerby.
Those Muslims who come as guests, will enjoy boarding and food for three days.
We will not allow a spy against Muslims into our churches and homes or hide deceit (or betrayal) against Muslims.
We will not teach our children the Qur’an, publicize practices of Shirk, invite anyone to Shirk or prevent any of our fellows from embracing Islam, if they choose to do so.
We will respect Muslims, move from the places we sit in if they choose to sit in them.
We will not imitate their clothing, caps, turbans, sandals, hairstyles, speech, nicknames and title names, or ride on saddles, hang swords on the shoulders, collect weapons of any kind or carry these weapons.
We will not encrypt our stamps in Arabic, or sell liquor.
We will have the front of our hair cut, wear our customary clothes wherever we are, wear belts around our waist, refrain from erecting crosses on the outside of our churches and demonstrating them and our books in public in Muslim fairways and markets.
We will not sound the bells in our churches, except discretely, or raise our voices while reciting our holy books inside our churches in the presence of Muslims, nor raise our voices (with prayer) at our funerals, or light torches in funeral processions in the fairways of Muslims, or their markets.
We will not bury our dead next to Muslim dead, or buy servants who were captured by Muslims.
We will be guides for Muslims and refrain from breaching their privacy in their homes.’
When I gave this document to Umar, he added to it,
We will not beat any Muslim.
These are the conditions that we set against ourselves and followers of our religion in return for safety and protection. If we break any of these promises that we set for your benefit against ourselves, then our Dhimmah (promise of protection) is broken and you are allowed to do with us what you are allowed of people of defiance and rebellion.”‘
তাফসীরে ইবনে কাসীর বলেছেন:-
২৮-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র দ্বীনের অনুসারী এবং পাক পবিত্র মুসলিম বান্দাদেরকে হুকুম করছেন যে, তারা যেন ধর্মের দিক থেকে অপবিত্র মুশরিকদেরকে বায়তুল্লাহর পাশে আসতে না দেয়। এই আয়াতটি নবম হিজরীতে অবতীর্ণ হয়। ঐ বছরই রাসূলুল্লাহ (সঃ) আলী (রাঃ)-কে আবু বকর (রাঃ) -এর সাথে প্রেরণ করেন এবং নির্দেশ দেনঃ “হজ্বের সমাবেশে ঘোষণা করে দাও যে, এ বছরের পরে কোন মুশরিক যেন হজ্ব করতে না আসে এবং কেউ যেন উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ না করে। শরীয়তের এই হুকুমকে আল্লাহ তা’আলা এমনিতেই পূর্ণ করে দেন। সেখানে আর মুশরিকদের প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য হয়নি এবং এরপরে উলঙ্গ অবস্থায় কেউ আল্লাহর ঘরের তাওয়াফও করেনি। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) গোলাম ও যিম্মী ব্যক্তিকে এই হুকুমের বহির্ভূত বলেছেন। মুসনাদে আহমাদে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এ বছরের পরে চুক্তিকৃতগণ ছাড়া এবং তাদের গোলামরা ছাড়া আর কেউই যেন আমাদের মসজিদে প্রবেশ না করে। কিন্তু এই মারফু হাদীস অপেক্ষা বেশী সহীহ সনদযুক্ত মাওকুফ রিওয়ায়াত রয়েছে।
মুসলিমদের খলীফা উমার ইবনে আবদুল আযীয (রঃ) ফরমান জারী করেছিলেনঃ “ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে মুসলমানদের মসজিদে আসতে দিবে না।” এই আয়াতকে কেন্দ্র করেই তিনি এই নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন। আতা (রঃ) বলেন যে, সম্পূর্ণ হারাম শরীফই মসজিদুল হারামের অন্তর্ভুক্ত। মুশরিকরা যে অপবিত্র, এই আয়াতটিই এর দলীল। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, মুমিন অপবিত্র হয় না। বাকী থাকলো এই কথাটি যে মুশরিকদের দেহ ও সত্তাও কি অপবিত্র? এ ব্যাপারে জমহরের উক্তি এই যে, তাদের দেহ অপবিত্র নয়। কেননা আল্লাহ তা’আলা আহলে কিতাবের যবেহকৃত জন্তু হালাল করেছেন। যাহেরিয়া মাযহাবের কোন কোন লোক মুশরিকদের দেহকে অপবিত্র বলেছে। হাসান (রঃ) বলেন যে, যে ব্যক্তি মুশরিকদের সাথে মুসাফাহা করবে সে যেন তার হাতটি ধুয়ে নেয়। এ হুকুম হলে লোকদের কেউ কেউ বললোঃ “তাহলে তো আমাদের বাজার মন্দা হয়ে যাবে এবং ব্যবসার জাঁকজমক নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে আমাদের বহুবিধ ক্ষতি সাধিত হবে। (লুবাব গ্রন্থে ইবনে আবি হাতিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন যে, মুশরিকরা বায়তুল্লাহতে খাদ্য সম্ভার নিয়ে আসতো এবং এর মধ্যে ওরা ব্যবসা করতো। অতঃপর যখন তাদেরকে বায়তুল্লাহতে আসতে নিষেধ করে দেয়া হলো তখন মুসলমানরা বললোঃ “আমাদের জন্যে খাদ্য কোথায়?” তখন আল্লাহ তাআলা (আরবী) এ আয়াত অবতীর্ণ করেন) তাদের এ কথার জবাবে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তোমরা এ ব্যাপারে কোনই ভয় করো না। আল্লাহ তোমাদের আরো বহু পন্থায় দান করবেন। আহলে কিতাবের নিকট থেকে তোমাদের জন্যে তিনি জিযিয়া আদায় করিয়ে দিবেন এবং তোমাদেরকে সম্পদশালী করবেন । তোমাদের জন্যে কোটা বেশী কল্যাণকর তা তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন। তাঁর নির্দেশ এবং নিষেধাজ্ঞা সবটাই নিপুণতাপূর্ণ। এ ব্যবসা তোমাদের জন্যে ততোটা লাভজনক নয় যতোটা লাভজনক তোমাদের জিযিয়া প্রাপ্তি ঐ আহলে কিতাবের নিকট থেকে যারা আল্লাহ, তাঁর রাসূল (সঃ) এবং কিয়ামতকে অস্বীকারকারী। প্রকৃত অর্থে তারা যখন মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর ঈমান আনলো না তখন কোন নবীর উপরই তাদের ঈমান রইলো না। বরং তারা নিজেদের প্রবৃত্তির ও তাদের বড়দের অন্ধ বিশ্বাসের পিছনে পড়ে রয়েছে। যদি তাদের নিজেদের নবীর উপর এবং নিজেদের শরীয়তের উপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকতো তবে তারা আমাদের এই নবী (সঃ)-এর উপরে অবশ্যই ঈমান আনতো। তাঁর শুভাগমনের সুসংবাদ তো প্রত্যেক নবীই দিয়ে গেছেন এবং তার অনুসরণ করার হুকুমও সব নবীই প্রদান করেছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা এই সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (সঃ)-কে অস্বীকার করছে। সুতরাং পূর্ববর্তী নবীদের শরীয়তের সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এ কারণেই ঐ নবীদেরকে মুখে স্বীকার করার কোনই মূল্য নেই। কেননা মুহাম্মাদ (সঃ) হলেন নবীদের নেতা সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, সর্বশেষ নবী এবং রাসূলদের পূর্ণকারী। অথচ তারা তাঁকেই অস্বীকার করছে। সুতরাং তাদের সাথেও জিহাদ করতে হবে।
তাদের সাথে জিহাদের হুকুম হওয়ার এটাই প্রথম আয়াত। ঐ সময় পর্যন্ত আশে পাশের মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তাদের অধিকাংশই তাওহীদের পতাকা তলে আশ্রয় নিয়েছিল। আরব উপদ্বীপে ইসলাম স্বীয় জায়গা করে নিয়েছিল। এখন ইয়াহদী ও খ্রীষ্টানদের সংবাদ নেয়ার এবং তাদেরকে সত্য পথ দেখাবার নির্দেশ দেয়া হয়। এ হুকুম অবতীর্ণ হয় হিজরী নবম সনে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। জনগণকে তিনি স্বীয় সংকল্পের কথা অবহিত করেন। মদীনার চতুম্পার্শ্বের আরবীয়দেরকে যুদ্ধের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন এবং প্রায় ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে রোম সাম্রাজ্য অভিমুখে রওয়ানা হন। এই যুদ্ধ থেকে বিমুখ থাকলো মুনাফিকরা এবং আরো কিছু সংখ্যক লোক। গরমের মৌসুম ছিল এবং গাছের ফল পেকে গিয়েছিল। রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে সিরিয়ার পথ ছিল বহু দূরের পথ এবং ঐ সফর ছিল খুবই কঠিন সফর। তারা তাবূক পর্যন্ত পৌঁছে যান। সেখানে প্রায় বিশ দিন অবস্থান করেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলার নিকট ইসতিখারা করে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। কেননা, তাঁদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সঙ্গীন এবং তারা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। ইনশাআল্লাহ সত্বরই এর বর্ণনা আসছে। এই আয়াতকেই দলীল হিসেবে গ্রহণ করে কেউ কেউ বলেছেন যে, জিযিয়া শুধু আহলে কিতাবের নিকট থেকে এবং তাদের সাথে সাদৃশ্যযুক্ত লোকদের নিকট থেকে নেয়া যাবে, যেমন মাজুসীদের নিকট থেকে । রাসূলুল্লাহ (সঃ) হিজরের মাজুসদের নিকট থেকে জিযিয়া আদায় করেছিলেন। ইমাম শাফিঈ (রঃ)-এর এটাই মাযহাব। ইমাম আহমাদ (রঃ)-এরও প্রসিদ্ধ মাযহাব এটাই। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) বলেন যে, সমস্ত আজমীর নিকট থেকে জিযিয়া আদায় করা হবে, তারা আহলে কিতাবই হাক অথবা মুশরিকই হাক। হ্যাঁ, তবে আরবের লোকদের মধ্যে শুধুমাত্র আহলে কিতাবের নিকট থেকে জিযিয়া আদায় করা হবে। ইমাম মালিক (রঃ) বলেন যে, সমস্ত কাফিরের নিকট থেকেই জিযিয়া আদায় করা জায়েয। তারা আহলে কিতাবই হাক বা মাজুসীই হাক অথবা মূর্তিপূজক প্রভৃতিই হাক। তাদের মাযহাবের দলীলগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার এখানে তেমন কোন সুযোগ নেই। এসব ব্যাপার আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
আল্লাহ পাক বলেনঃ যে পর্যন্ত না তারা অধীনতা স্বীকার করে প্রজারূপে জিযিয়া দিতে স্বীকৃত হয়, তাদেরকে ছেড়ে দিয়ো না। সুতরাং মুসলিমদের উপর যিম্মীদের মর্যাদা দেয়া বৈধ নয়। সহীহ মুসলিমে আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে প্রথমে সালাম দিয়ো না এবং যদি পথে তোমাদের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায় তবে তাদেরকে সংকীর্ণ পথে যেতে বাধ্য করো।” এ কারণেই উমার (রাঃ) তাদের সাথে এরূপই শর্ত করেছিলেন।
আব্দুর রহমান ইবনে গানাম আশআরী (রাঃ) বলেন, আমি নিজের হাতে চুক্তিনামা লিখে উমার (রাঃ)-এর নিকট পাঠিয়েছিলাম যে, সিরিয়াবাসী অমুক অমুক শহুরে খ্রীষ্টানদের পক্ষ হতে এই চুক্তিনামা আল্লাহর বান্দা আমীরুল মুমিনীন উমার (রাঃ) -এর নিকট। চুক্তিপত্রের বিষয় বস্তু হচ্ছে- “যখন আপনারা আমাদের উপর এসে পড়লেন, আমরা আপনাদের নিকট আমাদের জান, মাল ও সন্তান-সন্ততির জন্যে নিরাপত্তার প্রার্থনা জানাচ্ছি। আমরা এ নিরাপত্তা চাচ্ছি এ শর্তাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে যে, আমরা এই শহরগুলোতে এবং এগুলোর আশে পাশে নতুন কোন মন্দির, গির্জা এবং খানকা নির্মাণ করবো না। এরূপ কোন নষ্ট ঘরের মেরামত ও সংস্কারও করবো না। এসব ঘরে যদি কোন মুসলিম মুসাফির অবস্থানের ইচ্ছা করেন তবে আমরা তাদেরকে বাধা দেবো না। তারা রাত্রেই অবস্থান করুন অথবা দিনেই অবস্থান করুন। আমরা পথিক ও মুসাফিরদের জন্যে ওগুলোর দরজা সব সময় খুলে রাখবো । যেসব মুসলিম আগমন করবেন আমরা তিন দিন পর্যন্ত তাঁদের মেহমানদারী করবো। আমরা ঐসব ঘরে বা বাসভূমি প্রভৃতিতে কোন গুপ্তচর লুকিয়ে রাখবো না। মুসলিমদের সাথে কোন প্রতারণা করবো না। নিজেদের সন্তানদেরকে কুরআন শিক্ষা দেবো না। নিজেরা শিরক করবো না এবং অন্য কাউকেও শিকের দিকে আহ্বান করবো না। আমাদের মধ্যে কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করার ইচ্ছা করে তবে আমরা তাদেরকে মোটেও বাধা দেবো না। মুসলিমদেরকে আমরা সম্মান করবো। যদি তাঁরা আমাদের কাছে বসার ইচ্ছা করেন তবে আমরা তাদের জন্যে জায়গা ছেড়ে দেবো। কোন কিছুতেই আমরা নিজেদেরকে মুসলিমদের সমান মনে করবো না। পোশাক পরিচ্ছদেও না, আমরা তাদের কথার উপর কথা বলবো না। আমরা তাঁদের পিতৃপদবী যুক্ত নামে নামকরণ করবো না। জিন বিশিষ্ট ঘোড়ার উপর আমরা সওয়ার হবো না। আমরা তরবারী লটকাবো না এবং নিজেদের সাথেও তরবারী রাখবো না। অঙ্গুরীর উপর আরবী নকশা অংকন করাবো না এবং মাথার অগ্রভাগের চুল কেটে ফেলবো না। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, পৈতা অবশ্য অবশ্যই ফেলে রাখবো। আমাদের গির্জাসমূহের উপর ক্রুশচিহ্ন প্রকাশ করবো , আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো মুসলিমদের যাতায়াত স্থানে এবং বাজারসমূহে প্রকাশিত হতে দেবো না। গীর্জায় উচ্চৈঃস্বরে শংখ বাজাবো না, মুসলিমদের উপস্থিতিতে আমাদের ধর্মীয় পুস্তকগুলো জোরে জোরে পাঠ করবো না, রাস্তাঘাটে নিজেদের চাল চলন ও রীতি নীতি প্রকাশ করবো না, নিজেদের মৃতদের উপর হায়! হায়!! করে উচ্চৈঃস্বরে শাক প্রকাশ করবে না এবং মুসলিমদের চলার পথে মৃতদেহের সাথে আগুন নিয়ে যাবো না। যেসব গোলাম মুসলিমদের অংশে পড়বে তা আমরা গ্রহণ করবো না। আমরা অবশ্যই মুসলিমদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকবো। মুসলিমদের ঘরে আমরা উঁকি মারবো না।” যখন এই চুক্তি পত্র উমার (রাঃ)-এর সামনে পেশ করা হলো তখন তিনি তাতে আরো একটি শর্ত বাড়িয়ে নিলেন। তা হচ্ছে- “আমরা কখনো কোন মুসলিমকে প্রহার করবো না।” অতঃপর তারা বললোঃ “এসব শর্ত আমরা মেনে নিলাম। আমাদের ধর্মাবলম্বী সমস্ত লোকই এসব শর্তের উপর নিরাপত্তা লাভ করলো। এগুলোর কোন একটি যদি আমরা ভঙ্গ করি তবে আমাদেরকে নিরাপত্তা দানের ব্যাপারে আপনার কোন দায়িত্ব থাকবে না এবং আপনি আপনার শত্রুদের সাথে যা কিছু করেন, আমরাও ওরই যোগ্য ও উপযুক্ত হয়ে যাবো।”
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] অংশীবাদী বা মুশরিকরা অপবিত্র কথার অর্থ হল, আকীদা-বিশ্বাস ও আমল হিসাবে তারা (অভ্যন্তরীণভাবে) অপবিত্র। কারো কারো নিকটে মুশরিক বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিক উভয়ভাবে অপবিত্র। কেননা, তারা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সেইরূপ খেয়াল রাখে না, যেরূপ শরীয়ত নির্দেশ করেছে।
[২] এটা সেই হুকুম যা সন ৯ হিজরীতে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণার সাথে করা হয়েছিল। যার বিস্তারিত বর্ণনা পূর্বে (১-২নং আয়াতে) উল্লেখ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা কেবল মাসজিদুল হারামের জন্য। নচেৎ প্রয়োজন মোতাবেক মুশরিকরা অন্যান্য মসজিদে প্রবেশ করতে পারে। যেমন নবী (সাঃ) সুমামাহ বিন উসালকে মসজিদে নববীর থামে বেঁধে রেখেছিলেন। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁর হৃদয়ে ইসলাম ও নবীর মহব্বত সৃষ্টি করেন এবং তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। পরন্তু অধিকাংশ উলামাগণের নিকট এখানে ‘মাসজিদুল হারাম’ থেকে উদ্দেশ্য পূর্ণ হারাম এলাকা। অর্থাৎ, হারাম-সীমানার ভিতর মুশরিকদের প্রবেশ নিষেধ। কিছু আসার (সাহাবার উক্তি ও কর্ম) অনুসারে এই হুকুম থেকে যিম্মী ও খাদেমদেরকে পৃথক করা হয়েছে। উমার বিন আব্দুল আযীয (রঃ) আলোচ্য আয়াতের ভিত্তিতে নিজ রাজত্বকালে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদেরকেও মুসলিমদের মসজিদে প্রবেশ না করার আদেশ জারী করেছিলেন। (ইবনে কাসীর)
[৩] মুশরিকদের উপর হারাম প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারী হওয়ার কারণে কিছু মুসলিমদের মনে চিন্তা হল যে, হজ্জের মৌসুমে অধিকাধিক লোক জমা হওয়ার কারণে যে ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে, তাতে প্রভাব পড়তে পারে। আল্লাহ তাআলা বললেন, দারিদ্রে্র ভয় করো না। তিনি অতিসত্বর নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে ধনবান বানিয়ে দেবেন। সুতরাং বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ফলে বহু গনীমতের মাল মুসলিমদের হস্তগত হল। অতঃপর ধীরে ধীরে সারা আরববাসী মুসলমান হয়ে গেল। পরিণামে হজ্জের মৌসুমে হাজীদের গমনাগমন ঠিক সেইরূপ হয়ে গেল যেমন পূর্বে ছিল; বরং তার থেকেও বেশী হল। আর সেই সংখ্যাবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত।
* মুশরিকদের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে যুদ্ধের আদেশের পর এই আয়াতে ইয়াহুদী-নাসারাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার আদেশ করা হচ্ছে। (যদি তারা ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে) তারা জিযিয়া-কর দিয়ে মুসলিমদের অধীনে বসবাস-অধিকার গ্রহণ করে নিক। জিযিয়া হল, নির্ধারিত কিছু অর্থ; যা বাৎসরিকভাবে সেই অমুসলিমদের নিকট থেকে আদায় করা হয়, যারা কোন মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করতে চায়। এর বিনিময়ে তাদের জান-মাল ও মান-ইজ্জতের হিফাযতের দায়িত্ব মুসলিম রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখত, তা সত্ত্বেও তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে না। এ থেকে এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি সেইভাবে ঈমান না রাখবে যেভাবে আল্লাহ নিজ পয়গম্বরদের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। আর এটাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের আল্লাহর প্রতি ঈমানকে এই জন্য সঠিক বলা হয়নি যে, ইয়াহুদী-নাসারা উযাইর এবং ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর বেটা ও উপাস্য বলে বিশ্বাস করে। যেমন পরবর্তী আয়াতে এ ব্যাপারে তাদের আকীদার কথা প্রকাশ করা হয়েছে।
তাফসীরে আবুবকর যাকারিয়া বলেছেন:-
[১] কোন কোন মুফাসসির বলেন, কাফেরগণ ব্যহ্যিক ও আত্মিক সর্ব দিক থেকেই অপবিত্র। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] তবে অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ এখানে নাপাক বলতে তাদের দেহ সত্তা বুঝানো হয়নি, বরং দ্বীনী বিষয়াদিতে তাদের অপবিত্রতা বোঝানো হয়েছে। সে হিসেবে এর অর্থ, তাদের আকীদাহ-বিশ্বাস, আখলাক-চরিত্র, আমল ও কাজ, তাদের জীবন – এসবই নাপাক। [ইবন কাসীর; সা’দী]; আর এ সবের নাপাকির কারণেই হারাম শরীফের চৌহদির মধ্যে তাদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
[২] এ বছর বলতে অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের মতে ৯ম হিজরী বুঝানো হয়েছে। কাতাদা বলেন, এটা ছিল সে বছর যে বছর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু লোকদের নিয়ে হজ করেছেন। তখন আলী এ বিষয়টির ঘোষণা লোকদের মধ্যে দিয়েছিলেন। তখন হিজরতের পর নবম বছর পার হচ্ছিল। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরবর্তী বছর হজ করেছিলেন। তিনি এর আগেও হজ করেন নি, পরেও করেন নি। [তাবারী]
[৩] এখানে “মাসজিদুল হারাম” বলতে সাধারণতঃ বুঝায় বায়তুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকের আঙ্গিনাকে যা দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। তবে কুরআন ও সুন্নার কোন কোন স্থানে তা মক্কার পূর্ণ হারাম শরীফ অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। যা কয়েক বর্গমাইল এলাকব্যাপী। যার সীমানা চিহ্নিত করেছেন ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম। যেমন, মে’রাজের ঘটনায় মাসজিদুল হারামের উল্লেখ রয়েছে। ইমামগণের ঐক্যমতে এখানে “মাসজিদুল হারাম অর্থ বায়তুল্লাহর আঙ্গিনা নয়। কারণ, মে’রাজের শুরু হয় উম্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘর থেকে, যা বায়তুল্লাহর আঙ্গিনার বাইরে। অনুরূপ সূরা তাওবার শুরুতে ৭ নং আয়াতে যে মসজিদুল হারামের উল্লেখ রয়েছে, তার অর্থও পূর্ণ হারাম শরীফ। কারণ, এখানে উল্লেখিত সন্ধির স্থান হলো হুদায়বিয়া’ যা হারাম শরীফের সীমানার বাইরে তার অতি সন্নিকটে অবস্থিত। [আল-বালাদুল হারাম: আহকাম ওয়া আদাব]
[৪] ইবনে আব্বাস বলেন, যখন আল্লাহ তা’আলা মুশরিকদেরকে মাসজিদুল হারামে যাওয়া থেকে নিষেধ করলেন, তখন শয়তান মুমিনদের অন্তরে চিন্তার উদ্রেক ঘটাল যে, তারা কোথেকে খাবে? মুশরিকদেরকে তো বের করে দেয়া হয়েছে, তাদের বানিজ্য কাফেলা তো আর আসবে না। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করলেন। যাতে তিনি তাদেরকে আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দিলেন। আর এর মাধ্যমে তিনি তাদেরকে অমুখাপেক্ষী করে দিলেন। [তাবারী; কুরতুবী ইবন কাসীর]
***
[১] যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে বলে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে এসেছে তারা হলোঃ ইয়াহুদী ও নাসারা সম্প্রদায়। আল্লাহ তা’আলা আরবের মুশরিক সম্পপ্রদায়ের ওজর বন্ধ করার জন্য বলেনঃ “তোমরা হয়তো বলতে পার যে, কিতাব তো শুধু আমাদের পূর্বে দু’সমপ্রদায়ের প্রতিই নাযিল হয়েছে, আর আমরা তো এর পঠন ও পাঠন থেকে সম্পূর্ণ বেখবর ছিলাম। [আল-আনআমঃ ১৫৬]
এ আয়াতে আহলে কিতাব তথা যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে। তাবুকে আহলে কিতাবদের সাথে মুসলিমদের যে যুদ্ধ অভিযান সংঘটিত হয়েছিল, আয়াত দুটি তারই পটভূমি। বাগভী; ইবন কাসীর আহলে কিতাবের উল্লেখ করে এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে তাদের সাথে যে যুদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে, তা শুধু আহলে কিতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ আদেশ রয়েছে সকল কাফের সম্প্রদায়ের জন্যই। কারণ, যুদ্ধ করার যে সকল হেতু বর্ণিত হয়েছে, তা সকল কাফেরদের মধ্যে সমভাবে বিদ্যমান। সুতরাং এ আদেশ সকলের জন্যই প্রযোজ্য। [বগভী; কুরতুবী; সাদী] তবে বিশেষভাবে আহলে কিতাবের উল্লেখ করা হয়, কারণ এদের কাছে রয়েছে তাওরাত ইঞ্জীলের জ্ঞান, যে তাওরাত ও ইঞ্জলে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী। তা সত্বেও তারা ঈমান আনছে না। [ফাতহুল কাদীর]
[২] এ আয়াতে যুদ্ধের চারটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, প্রথমতঃ তারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে না। দ্বিতীয়তঃ আখেরাতের প্রতিও তাদের বিশ্বাস নেই। তৃতীয়তঃ আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে তার হারাম মনে করে না। চতুর্থতঃ সত্য দ্বীন গ্রহণে তারা অনিচ্ছুক | [কুরতুবী] ইয়াহুদী-নাসারাগণ যদিও প্রকাশ্যে আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করে না, কিন্তু পরবর্তী আয়াতের বর্ণনা মতে ইয়াহুদীগণ উযায়ের আর নাসারাগণ ঈসাকে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করে প্রকারান্তরে শির্ক তথা অংশীবাদকেই সাব্যস্ত করছে। [বাগভী] অনুরূপভাবে আখেরাতের প্রতি যে ঈমান রাখা দরকার তা আহলে কিতাবের অধিকাংশের মধ্যে নেই। তাদের অনেকের ধারণা হল, কিয়ামতে মানুষ দেহ নিয়ে উঠবে না; বরং তা হবে মানুষের এক ধরনের রূহানী জিন্দেগী। তারা এ ধারণাও পোষণ করে যে, জান্নাত ও জাহান্নাম বিশেষ কোন স্থানের নাম নয়; বরং আত্মার শান্তি হল জান্নাত আর অশান্তি হল জাহান্নাম। তাদের এ বিশ্বাস কুরআনে পেশকৃত ধ্যান ধারণার বিপরীত। সুতরাং আখেরাতের প্রতি ঈমানও তাদের যথাযোগ্য নয়। তৃতীয় কারণ বলা হয়েছে যে, ইয়াহুদী-নাসারাগণ আল্লাহর হারামকৃত বস্তুকে হারাম মনে করে না। এ কথার অর্থ হল তাওরাত ও ইঞ্জীলে যে সকল বস্তুকে হারাম করে দেয়া হয়েছে, তা তারা হারাম বলে গণ্য করে না। সেটা অনুসরণ করে না। [সা’দী] যেমন, সুদ ও কতিপয় খাদ্যদ্রব্য- যা তাওরাত ও ইঞ্জলে হারাম ছিল, তারা সেগুলোকে হারাম মনে করত না। এ থেকে এ মাস’আলা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তুকে হালাল মনে করা যে শুধু পাপ তা নয়, বরং কুফরীও বটে। অনুরূপ কোন হালাল বস্তুকে হারাম সাব্যস্ত করাও কুফরী। চুতর্থত: তারা সত্য দ্বীনের অনুসরণ করে না। যদিও তারা মনে করে থাকে যে, তারা একটি দ্বীনের উপর আছে। কিন্তু তাদের দ্বীন সঠিক নয়। আল্লাহ সেটা কখনো অনুমোদন করেননি। অথবা এমন শরীআত যেটা আল্লাহ রহিত করেছেন। তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরীআত দিয়ে সেটা পরিবর্তন করেছেন। সুতরাং রহিত করার পর সেটা পাকড়ে থাকা জায়েয নয়। [সা’দী]
[৩] জিযইয়ার শাব্দিক অর্থঃ বিনিময়ে প্রদত্ত পুরস্কার। [ফাতহুল কাদীর] শরীআতের পরিভাষায় জিযইয়া বলা হয় কাফেরদেরকে হত্যা থেকে মুক্তি এবং তাদেরকে মুসলিমদের মাঝে নিরাপত্তার সাথে অবস্থান করার বিনিময়ে গৃহীত সম্পদকে। যা প্রতি বছরই গ্রহণ করা হবে। ধনী, দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত প্রত্যেকে তার অবস্থানুযায়ী সেটা প্রদান করবে। যেমনটি উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তার পরবর্তী খলীফাগ গ্রহণ করেছিলেন। [সা’দী]
সঠিক মত হচ্ছে যে, দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে জিযইয়ার যে হার ধার্য হবে তাতে শরীআতের পক্ষ থেকে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ধার্যকৃত হারে জিযইয়া নেয়া হবে। যেমন, নাজরানের নাসারাদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুক্তি হয় যে, তারা সকলের পক্ষ থেকে বার্ষিক দু’হাজার জোড়া বস্ত্র প্রদান করবে। [আস-সুনানুস সগীর লিল বাইহাকী] প্রতি জোড়ায় থাকবে একটা লুঙ্গি ও একটা চাদর। প্রতি জোড়ার মূল্যও ধার্য হয়। অর্থাৎ এক উকিয়া রুপার সমমূল্য। চল্লিশ দিরহামে হয় এক উকিয়া। যা আমাদের দেশের প্রায় সাড়ে এগার তোলা রুপার সমপরিমাণ। অনুরূপ তাগলিব গোত্রীয় নাসারাদের সাথে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর চুক্তি হয় যে, তারা যাকাতের নেসাবের দ্বিগুণ পরিমাণে যিয্ইয়া প্রদান করবে [মুয়াত্তা, ইমাম মুহাম্মাদের বর্ণনায়]। তাই মুসলিমগণ যদি কোন দেশ যুদ্ধ করে জয় করে নেয় এবং সে দেশের অধিবাসিগণকে তাদের সহায় সম্পত্তির মালিকানা স্বত্বের উপর বহাল রাখে এবং তারাও ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত নাগরিক হিসাবে থাকতে চায়, তবে তাদের জিযিয়ার হার তা হবে যা উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আপন শাসনকালে ধার্য করেছিলেন। তাহলো উচ্চবিত্তের জন্যে মাসিক চার দিরহাম, মধ্যবিত্তের জন্যে দু’ দিরহাম এবং স্বাস্থ্যবান শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রভৃতি নিন্মবিত্তের জন্য মাত্র এক দিরহাম। [আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস] বিকলাঙ্গ, মহিলা শিশু, বৃদ্ধ এবং সংসারত্যাগী ধর্মজাযক এই জিযিরা কর থেকে অব্যাহতি পায়। [আহকামুল কুরআন লিল জাসসাস]| কিন্তু এই স্বল্প পরিমাণ জিযইয়া আদায়ের বেলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাগিদ ছিল যে, কারো সাধ্যের বাইরে যেন কোনরূপ জোর জবরদস্তি করা না হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, “যে ব্যক্তি কোন অমুসলিম নাগরিকের উপর যুলুম চালাবে, [আবুদাউদঃ ৩০৫২]।
উপরোক্ত বর্ণনার প্রেক্ষিতে কতিপয় ইমাম এক মত পোষণ করেন যে, শরীআত জিযইয়ার বিশেষ কোন হার নির্দিষ্ট করে দেয়নি, বরং তা ইসলামী শাসকের সুবিবেচনার উপর নির্ভরশীল। তিনি অমুসলিমদের অবস্থা পর্যালোচনা করে যা সঙ্গত মনে হয়, ধার্য করবেন।
জিযইয়া প্রদানে স্বীকৃত হলে ওদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করার যে আদেশ আয়াতে হয়েছে তা অধিকাংশ ইমামের মতে সকল অমুসলিমের বেলায় প্রযোজ্য। তারা আহলে কিতাব হোক বা অন্য কেউ। [কুরতুবী] আর এ জন্যই উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মাজুসীদের থেকেও জিযইয়া নিয়েছিলেন। [দেখুন, বুখারী: ৩১৫৬] আলোচ্য আয়াতে يد শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ নির্ধারণ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। স্বাভাবিক অর্থ হচ্ছে, নিজেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রদান করা। কারও কারও মতে এর অর্থ, স্বহস্তে প্রদান করা। কারও কারও মতে, নগদ প্রদান করা, বাকী না করা। কারও কারও মতে, জোর করে নেয়া। কারও কারও মতে, এটা বুঝিয়ে নেয়া যে, তাদেরকে হত্যা না করে এ অর্থ নেয়ার দ্বারা তাদের উপর দয়া করা হচ্ছে। কার কারও মতে, ধিকৃত। [ফাতহুল কাদীর] তাই জিযইয়া যেন খয়রাতি চাঁদা প্রদানের মত না হয়, বরং তা হবে ইসলামের বিজয়কে মেনে নিয়ে একান্ত অনুগত নাগরিক হিসেবে।
[৪] আয়াতে বলা হয়েছেঃ “যতক্ষণ না তারা বিনীত হয়ে জিযইয়া প্রদান করে”। এ বাক্য দ্বারা যুদ্ধ-বিগ্রহের একটি সীমা ঠিক করে দেয়া হয়। অর্থাৎ তাবেদার প্রজারূপে জিযইয়া কর প্রদান না করা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। [সা’দী]