أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 651)[اِنَّ فِی اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ
নিঃসন্দেহে রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তনের মধ্যে…
Indeed, in the alternation of the night and the day…]
www.motaher21.net
সুরা: ইউনুস
সুরা:১০
০৫-০৬ নং আয়াত:-
اِنَّ فِی اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ
নিঃসন্দেহে রাত্রি ও দিবসের পরিবর্তনের মধ্যে….
Indeed, in the alternation of the night and the day..
ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ الشَّمۡسَ ضِیَآءً وَّ الۡقَمَرَ نُوۡرًا وَّ قَدَّرَہٗ مَنَازِلَ لِتَعۡلَمُوۡا عَدَدَ السِّنِیۡنَ وَ الۡحِسَابَ ؕ مَا خَلَقَ اللّٰہُ ذٰلِکَ اِلَّا بِالۡحَقِّ ۚ یُفَصِّلُ الۡاٰیٰتِ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ﴿۵﴾
তিনি সূর্যকে দীপ্তিময় ও চঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ্ এগুলোকে যথাযথ ভাবেই সৃষ্টি করেছেন । তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বর্ণনা করেন এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা জানে।
It is He who made the sun a shining light and the moon a derived light and determined for it phases – that you may know the number of years and account [of time]. Allah has not created this except in truth. He details the signs for a people who know.
اِنَّ فِی اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ وَ مَا خَلَقَ اللّٰہُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَّقُوۡنَ ﴿۶﴾
নিশ্চয় দিন ও রাতের পরিবর্তনে এবং আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনে যা সৃষ্টি করেছেন তাতে নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে।
Indeed, in the alternation of the night and the day and [in] what Allah has created in the heavens and the earth are signs for a people who fear Allah.
৫-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ক্ষমতার পূর্ণতা ও সাম্রাজ্যের প্রমাণস্বরূপ বহু নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন সে সংবাদ দিচ্ছেন। আল্লাহ তা‘আলা মহান স্রষ্টা তার প্রমাণ বহন করে এমন অনেক নিদর্শন তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল চন্দ্র ও সূর্য। আল্লাহ তা‘আলা সূর্যকে করেছেন দীপ্তিময় এবং চন্দ্রকে করেছেন আলোকময়। কুরআনে সূর্যকে বুঝাতে الشَّمْسَ (শামস) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আবার السراج (সিরাজ) শব্দটি দ্বারাও সূর্যকে বুঝানো হয়ে থাকে, যার অর্থ বাতি বা মশাল। অন্যত্র সূর্যকে الشَّمْسَ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো প্রজ্জ্বলিত বাতি। এখানে একই অর্থ বুঝানোর জন্য ضِيَا۬ءً শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে উজ্জ্বল জ্যোতি। তিনটি বর্ণনার সবই সূর্যের জন্য উপযোগী। কারণ, সূর্য নিজ দহনক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচণ্ড তাপ ও আলো উৎপন্ন করে। আর চাঁদকে বলা হয়েছে الْقَمَرَ (কামার), একে منير (মুনির) ও বলা হয়েছে। যার অর্থ স্নিগ্ধ আলো দানকারী। তাছাড়া চাঁদ হচ্ছে একটি নিষ্ক্রিয় জিনিস, যা সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে, চাঁদের এ বৈশিষ্ট্যের সাথে কুরআনের বর্ণনা হুবহু মিলে যায়। কুরআনে একবারের জন্যও চাঁদকে السراج (সিরাজ) وهاج (ওয়াহহাজ) বা ضِيَا۬ءً (জিয়া) হিসেবে এবং সূর্যকে نُوْرً (নূর) منير (মুনীর) হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কুরআন সূর্যের আলো এবং চন্দ্রের আলোর পার্থক্যকে স্বীকার করে। এরূপ আয়াত সূরা ফুরকানের ৬১ নং এবং সূরা নূহের ১৬ নং এ উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং চাঁদের আলো প্রতিফলিত আলো, যা বর্তমান বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অথচ কুরআন তা ১৪০০ বছর পূর্বে প্রমাণ করেছে।
(وَّقَدَّرَه۫ مَنَازِلَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা চন্দ্র পরিভ্রমণের কক্ষপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কক্ষপথ বলতে তার ঐ পরিভ্রমণ পথকে বুঝায় যা চাঁদ এক দিন ও এক রাতে তার বিশেষ পরিক্রমণ দ্বারা অতিক্রম করে। উক্ত কক্ষ হল আশিটি। প্রত্যেক রাতে একটি কক্ষ সমাপ্ত করে, তাতে কখনো কোন ব্যতিক্রম হয় না। প্রথম কক্ষগুলোতে চাঁদকে ছোট ও সরু দেখা যায়। তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এমন কি চৌদ্দ রাত্রি বা চৌদ্দতম কক্ষে গিয়ে তা পূর্ণ (পূর্ণিমার) চন্দ্র রূপে প্রকাশ হয়। তার পর পুনরায় ছোট ও সরু হতে আরম্ভ করে, এমনকি শেষে এক বা দুই রাত্রি লুক্কায়িত থাকে এবং পরে প্রথম দিনের ক্ষীণ চন্দ্ররূপে উদিত হয়। চন্দ্রের উপকারিতা এ কারণে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসেব করতে পার। অর্থাৎ চন্দ্রের সে কক্ষপথ ও গতি দ্বারাই মাস ও বছর গণনা হয়, যার দিনের, দিবারাত্রি চব্বিশ ঘন্টার সমান সমান দিন হলে বার ঘন্টা করে এবং শীত ও গ্রীষ্মকালে কমবেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া পার্থিব উপকার ও কাজ কারবার শুধু সেই চন্দ্রের কক্ষপথের সাথে সম্পৃক্ত নয় বরং তাতে দীনি লাভও অর্জন হয়। নতুন চাঁদ দ্বারা হজ্জ, রমাযানের রোযা, নিষিদ্ধ মাস এবং অন্যান্য ইবাদতের সময়কাল নির্দিষ্ট করা হয়, প্রত্যেক মু’মিন তাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা এ সমস্ত বস্তু সৃষ্টি করেছেন যাতে করে জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে। এগুলোকে অযথা সৃষ্টি করেননি। দিন-রাতের আবর্তন ও আকাশ-জমিন যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার মাঝে মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে নিদর্শন। সূর্য উঠছে, অস্ত যাচ্ছে, দিন-রাত এক এক করে আসছে আর চলে যাচ্ছে। এভাবে একদিন একদিন করে সপ্তাহ, মাস, বছর অতীত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অনুধাবন করতে পারছে না, এর মধ্যে তার জীবনটা অতীত হয়ে যাচ্ছে। একদিন দেখা যাবে সূর্য উঠছে কিন্তু সে মানুষ আর নেই। অর্থাৎ পৃথিবী তার আপন গতিতে চলবে কিন্তু মানুষ একদিন বিদায় নেবে।
আয়াত হতে শিক্ষনীয় বিষয়:
১. চন্দ্র, সূর্য সৃষ্টি করার হিকমত জানতে পারলাম।
২. প্রত্যেক জিনিসের সৃষ্টিতে মানুষের জন্য উপকার রয়েছে।
৩. জ্ঞানীদের মর্যাদা জানতে পারলাম।
৪. দিন-রাতের পরিবর্তনের মাঝে ইঙ্গিত রয়েছে পৃথিবী একদিন শেষ হয়ে যাবে এবং প্রত্যেকেই একদিন বিদায় নেবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি তার ক্ষমতার পূর্ণতা এবং তার সাম্রাজ্যের বিরাটত্বের প্রমাণস্বরূপ বহু নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন। সূর্যের কিরণ হতে বিচ্ছুরিত আলোকমালাকে তিনি তোমাদের জন্যে দীপ্তি বানিয়েছেন। আর চন্দ্রের কিরণকে তোমাদের জন্যে নূর বানিয়েছেন। সূর্যের কিরণ এক রকম এবং চন্দ্রের কিরণ অন্য রকম। একই আলো, অথচ দুটোর মধ্যে বিরাট পার্থক্য। একটির কিরণ অপরটির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না বা একটির কিরণের সাথে অপরটির কিরণ মিলিত হয় না। দিবসে সূর্যের রাজত্ব আর রাত্রে চন্দ্রের কর্তৃত্ব। দুটোই আসমানী আলোকবর্তিকা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা সূর্যের মঞ্জিল নির্ধারণ করেননি, অথচ চন্দ্রের মঞ্জিল তিনি নির্ধারণ করেছেন। প্রথম তারিখের চাঁদ অতি ক্ষুদ্ররূপে প্রকাশিত হয়। তারপর ওর কিরণও বাড়ে এবং আয়তনও বেড়ে যায় ।
শেষ পর্যন্ত ওটা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং গোল বৃত্তের আকার ধারণ করে। এরপর আবার কমতে শুরু করে এবং পূর্ণ একমাস পর প্রথম অবস্থায় এসে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি চন্দ্রের জন্যে মঞ্জিলসমূহ নির্ণিত করে রেখেছি (এবং ওটা তা অতিক্রম করছে), এমন কি ওটা (অতিক্রম শেষে ক্ষীণ হয়ে) এইরূপ হয়ে যায়, যেন খেজুরের পুরাতন শাখা । সূর্যের সাধ্য নেই যে চন্দ্রকে গিয়ে ধরবে, আর না রাত্রি দিবসের পূর্বে আসতে পারবে; এবং উভয়ে এক একটি চক্রের মধ্যে সন্তরণ করছে। আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ “সূর্য ও চন্দ্রের নিজ নিজ হিসাব রয়েছে। এই আয়াতে কারীমায় বলা হয়েছে যে, সূর্যের মাধ্যমে দিনের পরিচয় পাওয়া যায়, আর চন্দ্রের আবর্তনের মাধ্যমে পাওয়া যায় মাস ও বছরের হিসাব। আল্লাহ এগুলো বৃথা সৃষ্টি করেননি। বরং জগত সৃষ্টি মহান আল্লাহর বিরাট নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করে এবং এটা তার ব্যাপক ক্ষমতার যে স্পষ্ট প্রমাণ এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আকাশ, পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে এগুলোকে বৃথা সৃষ্টি করিনি, এটা হচ্ছে কাফিরদের ধারণা, সুতরাং কাফিরদের জন্যে রয়েছে (জাহান্নামের আগুনের শাস্তি।” (৩৮:২৭) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তবে কি তোমরা এই ধারণা করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি। আর এটাও (ধারণা করেছিলে) যে, তোমাদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে না? অতএব আল্লাহ অতি উচ্চ মর্যাদাবান, তিনি প্রকৃত বাদশাহ, তিনি ছাড়া কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়, তিনি মহান আরশের মালিক।” (২৩:১১৫-১১৬) আয়াতগুলোর ভাবার্থ হচ্ছে- আমি দলীল প্রমাণাদি খুলে খুলে বর্ণনা করছি যাতে অনুধাবনকারীরা অনুধাবন করতে পারে।
(আরবী) এর ভাবার্থ এই যে, দিন গেলে রাত্রি আসে এবং রাত্রি গেলে দিনের আগমন ঘটে। একে অপরের উপর জয়যুক্ত হয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ “রাত দিনের উপর ছেয়ে যায় এবং দিন রাতের উপর ছেয়ে যায়, কিন্তু এটা সম্ভব নয় যে, সূর্য চন্দ্রের সাথে টক্কর খায়।” মহান আল্লাহ বলেনঃ “সকাল হয়ে যায় এবং রাত্রি নির্বিঘ্নে অতিক্রান্ত হয়।
আল্লাহ আসমান ও যমীনে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সেগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, তার ক্ষমতা কতই না ব্যাপক। যেমন তিনি বলেনঃ “আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে আল্লাহর কতই না নিদর্শন রয়েছে।” আর এক জায়গায় তিনি বলেনঃ “তুমি বলে দাও- তোমরা লক্ষ্য কর যে, আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে কতই না নিদর্শন রয়েছে এবং যারা ঈমানদার নয় তাদেরকে সতর্ককারী নিদর্শনের কোনই অভাব নেই। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ “তারা কি আকাশ ও পৃথিবীতে তাদের সামনে ও পিছনে দৃষ্টিপাত করে না?” আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ “নিঃসন্দেহে আসমানসমূহ ও যমীনের সৃজনে এবং পর্যায়ক্রমে দিবা ও রাত্রির গমনাগমনে নিদর্শনসমূহ রয়েছে জ্ঞানীদের জন্যে। আর এখানে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অবশ্যই নিদর্শনসমূহ রয়েছে ঐ লোকদের জন্যে যারা (আল্লাহর শাস্তির) ভয় করে।”
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
এটি আখেরাত বিশ্বাসের পক্ষে তৃতীয় যুক্তি। এ বিশ্ব-জাহানের চারদিকে মহান আল্লাহর যেসব কীর্তি দেখা যাচ্ছে, যার বড় বড় নিদর্শন সূর্য, চন্দ্র, দিন ও রাত্রির আবর্তনের আকারে মানুষের সামনে রয়েছে, এগুলো থেকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, কোন একটি ছোট্ট শিশু এ সৃষ্টি জগতের বিশাল কারখানার স্রষ্টা নয়। সে কোন শিশুর মত নিছক খেলা করার জন্য এসব কিছু তৈরী করেনি আবার খেলা করে মন ভরে যাওয়ার পর এসব কিছু ভেঙে চুরে ফেলে দেবে না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তাঁর সব কাজে রয়েছে শৃঙ্খলা, বিচক্ষণতা, নৈপুণ্য ও কলা কৌশল। প্রতিটি অণুপরমাণু সৃষ্টির পেছনে পাওয়া যায় একটি লক্ষ্যভিসারী উদ্যোগ। কাজেই তিনি যখন মহাজ্ঞানী এবং তাঁর জ্ঞানের লক্ষণ ও আলামত গুলো তোমাদের সামনে প্রকাশ্যে মওজুদ রয়েছে, তখন তোমরা তাঁর থেকে কেমন করে আশা করতে পারো যে, তিনি মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তি, নৈতিক অনুভূতি এবং স্বাধীন দায়িত্বও এ সব কিছু ব্যবহারের ক্ষমতা দান করার পর তার জীবনের কার্যক্রম হিসেব কখনো নেবেন না এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিক দায়িত্বের কারণে পুরস্কার ও শাস্তি লাভের যে যোগ্যতা অনিবার্যভাবে সৃষ্টি হয়ে যায় তাকে অনর্থক এমনিই ছেড়ে দেবেন?
অনুরূপভাবে এ আয়াতগুলোতে আখেরাত বিশ্বাস পেশ করার সাথে সাথে তার স্বপক্ষে যৌক্তিক ধারাবাহিকতা সহকারে তিনটি যুক্তি পেশ করা হয়েছেঃ
একঃ দ্বিতীয় জীবন অর্থাৎ পরকালীন জীবন সম্ভব। কারণ, প্রথম অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের সম্ভাবনা জাজ্বল্যমান ঘটনার আকারে বিরাজমান।
দুইঃ পরকালীন জীবনের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, বর্তমান জীবনে মানুষ নিজের নৈতিক দায়িত্ব সঠিক বা বেঠিক যেভাবে পালন করে এবং তা থেকে পুরস্কার ও শাস্তি লাভের যে অবশ্যম্ভাবী যোগ্যতা সৃষ্টি হয় তার ভিত্তিতে বুদ্ধি ও ইনসাফ আর একটি জীবনের দাবী করে। সেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নৈতিক কার্যক্রমের উপযুক্ত ফল প্রত্যক্ষ করবে।
তিনঃ বুদ্ধি ও ইনসাফের দৃষ্টিতে যখন পরকালীন জীবনের প্রয়োজন তখন এ প্রয়োজন অবশ্যই পূর্ণ করা হবে। কারণ, মানুষ ও বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা হচ্ছেন মহাজ্ঞানী। আর মহাজ্ঞানীর কাছে আশা করা যেতে পারে না যে, জ্ঞান ও ইনসাফ যা দাবী করে তিনি তা কার্যকর করবেন না।
গভীরভাবে চিন্তা করলে জানা যাবে, মৃত্যুর পরের জীবনকে যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করতে হলে, এ তিনটি যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনই সম্ভব এবং এক্ষেত্রে এগুলো যথেষ্টও। এ যুক্তি-প্রমাণগুলোর পরে যদি আর কিছু অপূর্ণতা থেকে যায় তাহলে তা হচ্ছে মানুষকে চর্ম চোখে দেখিয়ে দেয়া যে, যে জিনিসটি সম্ভব, যার অস্তিত্বশীল হওয়ার প্রয়োজনও আছে এবং যাকে অস্তিত্বশীল করা আল্লাহর জ্ঞানের দাবীও, তাকে মানুষের চোখের সামনে হাযির করে দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান দুনিয়াবী জীবনে এ শূন্যতা পূর্ণ করা হবে না। কারণ, চোখে দেখে ঈমান আনার কোন অর্থই হয় না। মহান আল্লাহ মানুষের পরীক্ষা নিতে চান। ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ঊর্ধ্বে উঠে নিছক চিন্তা-ভাবনা ও সঠিক যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহকে মেনে নেয় কিনা, এটিই এ পরীক্ষা।
এ প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বর্ণনা করা হয়েছে। সেটি গভীর মনোযোগের দাবী রাখে। বলা হয়েছে, “আল্লাহ তার নিশানী গুলোকে উন্মুক্ত করে পেশ করেছেন তাদের জন্য, যারা জ্ঞানের অধিকারী।” “আর আল্লাহর সৃষ্ট প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে নিশানী রয়েছে তাদের জন্য যারা ভুল দেখা ও ভুল পথে চলা থেকে বাচতে চায়।” এর মানে হচ্ছে, আল্লাহ অত্যন্ত বিজ্ঞ জনোচিত পদ্ধতিতে জীবনের নিদর্শনাবলীর মধ্যে চতুর্দিকে এমন সব চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন যা ঐ নিদর্শনগুলোর পেছনে আত্মগোপন করে থাকা সত্য গুলোকে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করছে। কিন্তু এ নিদর্শন গুলোর সাহায্য নিগূঢ় সত্যে একমাত্র তারাই উপনীত হতে পারে যাদের মধ্যে নিম্নোক্ত গুণ দু’টি আছেঃ
একঃ তারা মূর্খতা ও অজ্ঞতাপ্রসূত একগুয়েমী বিদ্বেষ ও স্বার্থ প্রীতি থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞান অর্জন করার এমন সব মাধ্যম ব্যবহার করে যেগুলো আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন।
দুইঃ তারা ভুল থেকে আত্মরক্ষা ও সঠিক পথ অবলম্বন করার ইচ্ছা নিজেদের অন্তরে পোষণ করে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
* [১] ضِيَآءٌ , ضُوْءٌ সমার্থবোধক শব্দ। এখানে ‘মুযাফ’ (সম্বন্ধপদের প্রথমাংশ) উহ্য আছে; অর্থাৎ, ذات ضياء والقمر ذا نور “সূর্যকে দীপ্তিমান এবং চন্দ্রকে আলোময় বানিয়েছেন।” অথবা তাকে অতিশয়োক্তি বলে ধরা হবে; অর্থাৎ ঠিক যেন তা নিজেই প্রদীপ্ত ও আলো। আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তার পরিচালনার কথা বর্ণনার পর উদাহরণ স্বরূপ আরো কিছু বস্তুর বর্ণনা করা হচ্ছে, যা বিশ্ব-পরিচালনার অন্তর্ভুক্ত। তার মধ্যে সূর্য ও চন্দ্র অধিক গুরুতত্ত্বপূর্ণ। সূর্যের তাপ ও তার আলোর প্রয়োজনীয়তা প্রত্যেকেই জানে। অনুরূপ চন্দ্রের মৃদু জ্যোৎস্নালোকের যে মধুরতা ও উপকারিতা আছে, তাও বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। বৈজ্ঞানিকদের মতে সূর্যের নিজস্ব আলো আছে আর চন্দ্রের নিজস্ব আলো নেই বরং সূর্যের আলো থেকে আলো গ্রহণ করে থাকে। (ফাতহুল কাদীর) والله أعلم بالصواب
[২] অর্থাৎ আমি চন্দ্র পরিভ্রমণের কক্ষপথ নির্ধারণ করে দিয়েছি। কক্ষপথ বলতে তার ঐ পরিভ্রমণপথকে বুঝায়, যা চাঁদ এক দিন ও এক রাত্রে তার বিশেষ পরিক্রমণ দ্বারা অতিক্রম করে। উক্ত কক্ষ হল আটাশটি। প্রত্যেক রাত্রে একটি কক্ষ সমাপ্ত করে, তাতে কখনো কোন ব্যতিক্রম হয় না। প্রথম কক্ষগুলিতে চাঁদকে ছোট ও সরু দেখা যায়। তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এমন কি চৌদ্দ রাত্রি বা চৌদ্দতম কক্ষে গিয়ে তা পূর্ণ (পূর্ণিমার) চন্দ্র রূপে প্রকাশ হয়। তার পর পুনরায় ছোট ও সরু হতে আরম্ভ করে, এমনকি শেষে এক বা দুই রাত্রি লুক্কায়িত থাকে এবং পরে প্রথম দিনের ক্ষীণচন্দ্র রূপে উদিত হয়। চন্দ্রের উপকারিতা এই বর্ণনা করা হয়েছে যে, “যাতে তোমরা বছরের গণনা ও সময়ের হিসাব করতে পার।” অর্থাৎ চন্দ্রের সেই কক্ষপথ ও গতি দ্বারাই মাস ও বছর গণনা হয়, যার দ্বারা তোমাদের সকল বস্তুর হিসাব রাখা সহজ হয়। অর্থাৎ বছর বার মাসের, মাস উনত্রিশ বা ত্রিশ দিনের, দিবারাত্রি চবিবশ ঘণ্টার, সমান সমান দিন হলে বার ঘণ্টা করে এবং শীত ও গ্রীষ্মকালে কমবেশি হয়ে থাকে। তাছাড়া পার্থিব উপকার ও কাজ-কারবার শুধু সেই চন্দ্রের কক্ষপথের সাথে সম্পৃক্ত নয়; বরং তাতে দ্বীনী লাভও অর্জন হয়। নতুন চাঁদ দ্বারা হজ্জ, রমযানের রোযা, নিষিদ্ধ মাস এবং অন্যান্য ইবাদতের সময়কাল নির্দিষ্ট করা হয়, প্রত্যেক মু’মিন তার গুরুতত্ত্ব দিয়ে থাকে।
তাফসীরে আবুবকর জাকারিয়া বলেছেন:-
তিনি এগুলো অনাহুত সৃষ্টি করেননি। বরং তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞাময়, তাঁর প্রত্যেকটি কাজই প্রজ্ঞায় পূর্ণ। আসমান ও যমীন সৃষ্টির মাঝে কোন হেকমত নেই এমন কথা শুধুমাত্র কাফেররাই বলতে পারে। [এ ব্যাপারে আরো দেখুন, সূরা সোয়াদঃ ২৭, সূরা আল-মূমিনূনঃ ১১৫-১১৬]
আসমান ও যমীনে আল্লাহ্ তা’আলা যা সৃষ্টি করেছেন তাতে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, সেগুলো আল্লাহরই মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছে। কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা’আলা এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন, সূরা ইউসুফঃ ১০৫, সূরা ইউনুসঃ ১০১, সূরা সাবাঃ ৯, সূরা আলে ইমরানঃ ১৯০। এগুলোর পরিবর্তনের অর্থ, একটির পর অপরটি এমনভাবে আসা তাদের সুনির্দিষ্ট নিয়মের কোন ব্যঘাত ঘটে না। [ইবন কাসীর] এ ব্যাপারে সূরা আল-আরাফ এর ৫৪, সূরা ইয়াসীন এর ৪০ নং এবং সূরা আল-আন’আমের ৯৬ নং আয়াতেও চাঁদ ও সূর্যের নিয়মানুবর্তিতার কথা বর্ণিত হয়েছে। [ইবন কাসীর]
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Yunus
Sura: 10
Verses :- 05-06
اِنَّ فِی اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّہَارِ
Indeed, in the alternation of the night and the day…
Everything is a Witness to the Power of Allah
Allah tells;
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاء وَالْقَمَرَ نُورًا
It is He Who made the sun a shining thing and the moon as a light,
Allah tells us about the signs He created that are indicative of His complete power and great might. He made the rays that come forth from the bright sun as the source of light, and made the beams that come forth from the moon as light. He made them of two different natures so they would not be confused with one another. Allah made the dominion of the sun in the daytime and the moon in the night. He ordained phases for the moon, where it starts small then its light increases until it completes a full moon. Then it begins to decrease until it returns to its first phase at the conclusion of the month.
Allah said:
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَـهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالعُرجُونِ الْقَدِيمِ
لَا الشَّمْسُ يَنبَغِى لَهَأ أَن تدْرِكَ القَمَرَ وَلَا الَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِى فَلَكٍ يَسْبَحُونَ
And the moon, We have measured for it mansions (to traverse) till it returns like the old dried curved date stalk. It is not for the sun to overtake the moon, nor does the night outstrip the day. They all float, each in an orbit. (36:39-40)
And He said:
وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَاناً
And the sun and the moon for counting. (6:96)
And in this Ayah He said:
وَقَدَّرَهُ
and measured,
that is the moon,
Allah said:
وَقَدَّرَهُ
مَنَازِلَ لِتَعْلَمُواْ عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ
And measured out for it stages that you might know the number of years and the reckoning.
The days are revealed by the action of the sun, and the months and the years by the moon.
Allah then stated
مَا خَلَقَ اللّهُ ذَلِكَ إِلاَّ بِالْحَقِّ
..
Allah did not create this but in truth.
He didn’t create that for amusement but with great wisdom and perfect reasoning.
With a similar meaning, Allah said:
وَمَا خَلَقْنَا السَّمَأءَ وَالاٌّرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا بَـطِلً ذَلِكَ ظَنُّ الَّذِينَ كَفَرُواْ فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنَ النَّارِ
And We created not the heaven and the earth and all that is between them without purpose! That is the consideration of those who disbelieve! Then woe to those who disbelieve from the Fire! (38:27)
He also said:
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَـكُمْ عَبَثاً وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ
فَتَعَـلَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ لَا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ
“Did you think that We had created you in play (without any purpose), and that you would not be brought back to Us!”
So Exalted be Allah, the True King:None has the right to be worshipped but He, the Lord of the Supreme Throne! (23:115-116)
Allah said:
.
يُفَصِّلُ الايَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
He explains the Ayat in detail for people who have knowledge.
In other words, He explained the signs and proofs for people who know.
Allah further stated
إِنَّ فِي اخْتِلَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ
Verily, in the alternation of the night and the day,
The day and the night alternate, when one arrives, the other goes, and so on, with no errors.
This is similar to the meaning indicated in the following Ayat:
يُغْشِى الَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا
He brings the night as a cover over the day, seeking it rapidly….
لَا الشَّمْسُ يَنبَغِى لَهَأ أَن تدْرِكَ القَمَرَ
It is not for the sun to overtake the moon. (36:40)
and,
فَالِقُ الاِصْبَاحِ وَجَعَلَ الَّيْلَ سَكَناً
(He is the) Cleaver of the daybreak. He has appointed the night for resting. (6:96)
Allah continued:
وَمَا خَلَقَ اللّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالَارْضِ
and in all that Allah has created in the heavens and the earth,
meaning the signs that indicate His greatness.
This is similar to Allah’s statements:
وَكَأَيِّن مِّن ءَايَةٍ فِى السَّمَـوَتِ وَالاٌّرْضِ
And how many a sign in the heavens and the earth… (12:105)
قُلِ انظُرُواْ مَاذَا فِى السَّمَـوَتِ وَالاٌّرْضِ وَمَا تُغْنِى الايَـتُ وَالنُّذُرُ عَن قَوْمٍ لاَّ يُوْمِنُونَ
“Say:”Behold all that is in the heavens and the earth,” but neither Ayat nor warners benefit those who believe not. (10:101)
أَفَلَمْ يَرَوْاْ إِلَى مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ مِّنَ السَّمَأءِ وَالاٌّرْضِ
See they not what is before them and what is behind them, of the heaven and the earth. (34:9)
إِنَّ فِى خَلْقِ السَّمَـوَتِ وَالاٌّرْضِ وَاخْتِلَـفِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ لاّيَـتٍ لاٌّوْلِى الاٌّلْبَـبِ
Verily, in the creation of the heavens and the earth, and in the alternation of night and day, there are indeed signs for men of understanding. (3:190)
means intelligent men.
Allah said here,
لاايَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَّقُونَ
Ayat for those who have Taqwa.
meaning fear Allah’s punishment, wrath and torment.