أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 671)
[ وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ
ও অন্তরের রোগের নিরাময়,
And a cure for that which is in your breasts,]
www.motaher21.net
اَلَاۤ اِنَّ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ وَّ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۵۵﴾
Unquestionably, to Allah belongs whatever is in the heavens and the earth. Unquestionably, the promise of Allah is truth, but most of them do not know
ہُوَ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ وَ اِلَیۡہِ تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۵۶﴾
He gives life and causes death, and to Him you will be returned.
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡکُمۡ مَّوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوۡرِ ۬ۙ وَ ہُدًی وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۵۷﴾
O mankind, there has to come to you instruction from your Lord and healing for what is in the breasts and guidance and mercy for the believers.
قُلۡ بِفَضۡلِ اللّٰہِ وَ بِرَحۡمَتِہٖ فَبِذٰلِکَ فَلۡیَفۡرَحُوۡا ؕ ہُوَ خَیۡرٌ مِّمَّا یَجۡمَعُوۡنَ ﴿۵۸﴾
Say, “In the bounty of Allah and in His mercy – in that let them rejoice; it is better than what they accumulate.”
সুরা: ইউনুস
সুরা:১০
৫৫-৫৮ নং আয়াত:-
وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ
ও অন্তরের রোগের নিরাময়,
And a cure for that which is in your breasts,
৫৫-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৫৫-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা খবর দিচ্ছেন যে, আকাশ ও জমিন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তার প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে তাঁর সাথে আর কেউ শরীক নেই। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তার রাজত্বের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করেন। তিনি কাউকে শাস্তি দেন আবার কারো প্রতি রহম করেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা সত্য। তা অবশ্য অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কক্ষনো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيْعَادَ)
“নিশ্চয়ই আপনি ওয়াদা খেলাফ করেন না।” (সূরা আলি ইমরান ৩:১৯৪)
কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। যদি তারা এই শাস্তি সম্পর্কে জানত তাহলে তারা জেনে শুনে কুফরী করত না।
অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা জীবন ও মৃত্যুর মালিক। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেউ জীবন দিতেও সক্ষম নয় আবার মৃত্যু দিতেও সক্ষম নয়। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই পারেন, অন্য কেউ নয়। এ আয়াত দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, মানুষের এ কথা বলা সমীচীন নয় যে, যদি এই কাজটি করতাম তাহলে এই লোকটি মারা যেত না বা আরো কিছুদিন জীবিত থাকত বা অমুক লোকটি অকাল মৃত্যুবরণ করেছে। এরূপ বলা ঠিক নয়, কারণ প্রত্যেকে তার নির্ধারিত সময়েই মৃত্যুবরণ করে। এ রকম করলে এরূপ হত, এরূপ না করলে এরূপ হতো না ইত্যাদি বলা নিষেধ। এসব কথা শয়তানের পথ খুলে দেয় এবং আফসোস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল কিছুর প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওয়াদাকে বাস্তবায়িত করবেন।
৩. মানুষকে জীবন ও মৃত্যু একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই দান করেন।
৪. তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে এবং ‘যদি’ কথা বলে শয়তানের পথ খুলে দেয়া যাবে না।
৫৭-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি নিজ অনুগ্রহ ও দয়া এবং কুরআনের দিকে ধাবিত হবার প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেন, হে মানুষ সকল! তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি উপদেশ বাণী এসেছে। এ উপদেশ বাণী হল কুরআন। সুতরাং কুরআন থেকে উপদেশ ও নসীহত গ্রহণ করে নিজেদের ঈমান ও আমলকে সংশোধন করে নাও। প্রকৃতপক্ষে তারাই এ কুরআন থেকে উপদেশ নিতে পারবে যারা উপদেশ নেয়ার মানসিকতা নিয়ে তা পাঠ করবে এবং বুঝে শুনে পাঠ করবে, আর কুরআন যে দিকনির্দেশনা প্রদান করে তা মেনে চলবে। সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করতে হবে তিনি যেন হিদায়াত দান করেন এবং তার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন। আর এ কুরআন হল অন্তরের রোগের আরোগ্য। অন্তরের রোগ দু’ ধরণের-
(১) কুপ্রবৃত্তির রোগ, মন চায় অন্যায় ও খারাপ কাজ করতে।
(২) সংশয় ও সন্দেহের রোগ।
কুরআন এ দু’ প্রকার রোগেরই চিকিৎসা দিয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَا۬ءٌ وَّرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ لا وَلَا يَزِيْدُ الظَّالِمِيْنَ إِلَّا خَسَارًا)
“আমি কুরআনের এমন আয়াত অবতীর্ণ করি, যা মু’মিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু সেটা জালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।” (সূরা ইসরা ১৭:৮২)
এরূপ সূরা হা-মীম-সিজদাহর ৪৪ নং আয়াতেও বলা হয়েছে। তবে কুপ্রবৃত্তি রোগের চিকিৎসা- উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই সমাধান হয় কিন্তু সংশয় ও সন্দেহের চিকিৎসা সবাই পায় না। যাদের অন্তরে তাওহীদ ও রিসালাতের এবং সঠিক ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয়ের রোগ রয়েছে, তাদের অন্তরে যদি আল্লাহ তা‘আলা সচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার মনোভাব দেখতে পান তাহলেই তাদের অন্তরে এ কুরআন বদ্ধমূল হয়ে যায় এবং তা পাপকে দূরীভূত করে এবং হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করে দেয়। আর এই কুরআন সকল মানুষের জন্য রহমত কিন্তু যেহেতু মু’মিনরা এর দ্বারা উপদেশ গ্রহণ করে তাই এখানে মু’মিনদের কথাই বলা হয়েছে।
পক্ষান্তরে মু’মিনদেরকে বলা হচ্ছে যে, এই কুরআন আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত, এ অনুগ্রহ লাভ করে মু’মিনদের আনন্দিত হওয়া উচিত। এর অর্থ এই নয় যে, আনন্দ করার জন্য জশনে জুলুস করে, আলোকসজ্জা বা অন্য কোনরূপ অপচয়ের অনুষ্ঠান উদ্যাপন করবে। যেমন বর্তমানের বিদআতীরা উক্ত আয়াত দ্বারা ‘নাবীদিবস’ এই ধরনের অভিনব বিদআতী অনুষ্ঠান বৈধ হবার কথা প্রমাণ করতে চায়। যা আদৌ ঠিক নয়, বরং আনন্দ প্রকাশ করতে হবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও শুকরিয়া আদায় করার মাধ্যমে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যে ব্যক্তি কুরআন ভালভাবে ধারণ করবে তাকে কুরআন উপদেশ দেবে, রোগ থেকে মুক্তি দেবে এবং আলো দান করবে।
২. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত পেয়ে মু’মিনরা আনন্দিত হবে তবে তা অবশ্যই শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায়।
৩. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি খুবই অনুগ্রহপরায়ণ, তাই তিনি হিদায়াতের জন্য কিতাব দিয়েছেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫৫-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনিই আকাশসমূহের ও পৃথিবীর মালিক। তার অঙ্গীকার অবশ্য অবশ্যই পূর্ণ হবে। তিনিই জীবন দান করে থাকেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটিয়ে থাকেন। তারই কাছে সকলকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তিনি এর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান যে, সমুদ্রে, প্রান্তরে এবং বিশ্বের সর্বত্র তাদের মাটি হয়ে যাওয়া দেহের প্রতিটি অণু পরমাণুকে পুনরায় একত্রিত করবেন এবং জীবিত দেহ তৈরী করবেন।
৫৭-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
বান্দার উপর স্বীয় ইহসানের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন- হে লোক সকল! তোমাদেরকে যে পবিত্র গ্রন্থটি (কুরআন কারীম) দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে নসীহতের একটি দফতর, যা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়েছে। এটা তোমাদের অন্তরের সমস্ত রোগের আরোগ্যদানকারী। অর্থাৎ এটা তোমাদের অন্তরের সন্দেহ, সংশয়, কালিমা ও অপবিত্রতা দূরকারী। এর মাধ্যমে তোমরা মহান আল্লাহর হিদায়াত ও রহমত লাভ করতে পারবে । কিন্তু এটা লাভ করবে একমাত্র তারাই যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস রাখে। কুরআনকে আমি মুমিনদের জন্যে শিফা ও রহমতরূপে অবতীর্ণ করেছি। কিন্তু পাপীদের জন্যে এটা ধ্বংস ও ক্ষতি আনয়নকারী। হে নবী (সঃ)! তুমি জনগণকে বলে দাও- এই কুরআন হচ্ছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও অনুকম্পা । সুতরাং এটা নিয়ে তোমরা খুশী হয়ে যাও। আর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী যেসব ভোগ্য বস্তু তোমরা লাভ করেছে, সেগুলো অপেক্ষা কুরআনই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম ও উৎকৃষ্টতম বস্তু।
উমার (রাঃ)-এর নিকট ইরাকের খেরাজ আসলে তিনি তা দেখার জন্যে বেরিয়ে আসেন। তাঁর সাথে তার খাদেমও ছিল। উমার (রাঃ) খেরাজে আগত উটগুলো গণনা করতে শুরু করেন। কিন্তু শেষে গণনায় অপারগ হয়ে বলে ওঠেনঃ “আমি মহান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।” এ দেখে তার খাদেমটি বলেঃ “আল্লাহর কসম! এটাও আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত।” তখন। উমার (রাঃ) বলেনঃ “না, এটা নয়। বরং আল্লাহ তা’আলা (আরবী) বলে কুরআন ও ওর দ্বারা উপকার গ্রহণ বুঝিয়েছেন। সুতরাং এই খেরাজের সম্পদগুলোকে আল্লাহর ফযল ও রহমত মনে না করে বরং এটাকে (আরবী) মনে করাই উচিত। কেননা, এগুলো তো হচ্ছে আমাদের জমাকৃত সম্পদ। ফযল’ ও ‘রহমত’ তো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাহাত্ম্য অত্যন্ত বেশী।” (ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এই আয়াতের তাফসীরে এটা বর্ণনা করেছেন)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
* উক্ত আয়াতে আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তুর উপর আল্লাহর পূর্ণ মালিকানা, আল্লাহর ওয়াদার সত্যতা, জীবন ও মরণ তাঁর ইচ্ছায় সংঘটন এবং তাঁর দরবারে সকলের উপস্থিতির বর্ণনা আছে। যার উদ্দেশ্য পূর্বোক্ত আলোচনাকে পরিষ্ফুটিত ও সমর্থন করা। আর তা এই যে, যে সত্তা এত বিশাল ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা পেয়ে মানুষ কোথায় যেতে পারে? এবং হিসাব-নিকাশ নেওয়ার জন্য তিনি যে একটি দিন নির্ধারিত করে রেখেছেন, সে দিন থেকে কে রেহাই পাবে? আল্লাহর ওয়াদা অবশ্যই সত্য, কিয়ামত অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে এবং সকল ভাল ও মন্দ লোকদেরকে তাদের নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী প্রতিদান ও প্রতিফল দেওয়া হবে।
* [১] যে ব্যক্তি মন দিয়ে কুরআন পাঠ করবে এবং তার অর্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, কুরআন তার জন্য উপদেশ। ওয়াযের প্রকৃত অর্থ হল পরিণাম ও ফলাফল স্মরণ করিয়ে দেওয়া; চাহে তা উৎসাহ দানের মাধ্যমে হোক বা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে। আর একজন উপদেষ্টা (বক্তা) একজন ডাক্তারের মত, তিনি রোগীকে ঐ সকল বস্তু থেকে বিরত থাকতে বলেন, যা রোগীর শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনুরূপ কুরআনও উৎসাহদান ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে ওয়ায-নসীহত করে এবং ঐ সকল পরিণাম ও ফলাফল সম্পর্কে সতর্ক করে, যা আল্লাহর অবাধ্যাচরণের কারণে ভোগ করতে হবে। আর ঐ সকল কর্ম থেকে নিষেধ করে যে কর্ম দ্বারা মানুষের আখেরাত বরবাদ হয়।
[২] অর্থাৎ, অন্তরে তাওহীদ ও রিসালাত এবং সঠিক ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে যে সন্দেহ ও সংশয়ের রোগ সৃষ্টি হয়, তা দূরীভূত করে এবং কুফরী ও মুনাফিকীর পঙ্কিলতা ও আবর্জনা থেকে হৃদয়কে পরিষ্কার করে দেয়।
[৩] এই কুরআন মু’মিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত (সুপথ ও করুণা) লাভের অসীলা। প্রকৃতপক্ষে কুরআন পৃথিবীর সকলের জন্য হিদায়াত ও রহমত লাভের কারণ। কিন্তু যেহেতু মু’মিনগণই তার দ্বারা উপকৃত হয়, ফলে এখানে শুধু তাদের জন্যই হিদায়াত ও রহমত বলা হয়েছে। এই বিষয়টি কুরআন কারীমের সূরা বানী ইস্রাঈলের ১৭:৮২ নং আয়াত ও সূরা হা-মীম সাজদাহর ৪১:৪৪ নং আয়াতে আলোচিত হয়েছে। এ ছাড়া (هدًى للمُتَّقِين) এর টীকা দ্রষ্টব্য।
* আনন্দ’ বা ‘খুশি’ বলা হয় ঐ অবস্থাকে যা কোন আকাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জনের ফলে মানুষ নিজ মনে অনুভব করে। মু’মিনগণকে বলা হচ্ছে যে, এই কুরআন আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, এ অনুগ্রহ লাভ করে মু’মিনগণের আনন্দিত হওয়া উচিত। এর অর্থ এই নয় যে, আনন্দ প্রকাশ করার জন্য জালসা-জলুস করে, আলোকসজ্জা বা অন্য কোনরূপ অপচয়ের অনুষ্ঠান উদ্যাপন করবে। যেমন বর্তমানের বিদআতীরা উক্ত আয়াত দ্বারা ‘নবীদিবস’ ইত্যাদি অভিনব বিদআতী অনুষ্ঠান বৈধ হওয়ার কথা প্রমাণ করতে চায়।
তাফসীরে আবুবকর জাকারিয়া বলেছেন:-
* এখানে কুরআনুল কারীমের চারটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে- এক.
( مَّوۡعِظَةٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ) – (مَوْعِظَةٌ) ও (وَعَظٌ)
এর প্রকৃত অর্থ হলো উৎসাহ কিংবা ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে পরিণাম সম্পর্কে স্মরণ করে দেয়া। [ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ এমন বিষয় বর্ণনা করা, যা শুনে মানুষের অন্তর কোমল হয় এবং আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়ে। পার্থিব গাফলতীর পর্দা ছিন্ন হয়ে মনে আখেরাতের ভাবনা উদয় হয়। যাবতীয় অন্যায় ও অশ্লিলতা থেকে বিরত করে। [ইবন কাসীর] কুরআনুল কারীমের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই ‘মাওয়ায়েযে হাসানাহ’-এর অত্যন্ত সালঙ্কার প্রচারক। এর প্রতিটি জায়গায় ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির সাথে সাথে ভীতি-প্রদর্শন, সওয়াবের সাথে সাথে আযাব, পার্থিব জীবনের কল্যাণ ও কৃতকার্যতার সাথে সাথে ব্যর্থতা ও পথভ্রষ্টতা প্রভৃতির এমন সংমিশ্রিত আলোচনা করা হয়েছে, যা শোনার পর পাথরও পানি হয়ে যেতে পারে।
দুই. কুরআনুল কারীমের দ্বিতীয় গুণ
(وَ شِفَآءٌ لِّمَا فِی الصُّدُوۡرِ)
বাক্যে বর্ণিত হয়েছে। (شِفَاءٌ) অর্থ রোগ নিরাময় হওয়া আর (صُدُوْرٌ) হলো (صَدْرٌ) এর বহুবচন, যার অর্থ বুক। আর এর মর্মার্থ অন্তর। সারার্থ হচ্ছে যে, কুরআনুল কারাম অন্তরের ব্যাধিসমূহ যেমন সন্দেহ, সংশয়, নিফাক, মতবিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদির জন্য একান্ত সফল চিকিৎসা ও সুস্থতা এবং রোগ নিরাময়ের অব্যৰ্থ ব্যবস্থাপত্র। [কুরতুবী] অনুরূপভাবে অন্তরে যে সমস্ত পাপ পঙ্কিলতা রয়েছে সেগুলোর জন্যও মহৌষধ। [ইবন কাসীর] সঠিক আকীদা বিশ্বাস বিরোধী যাবতীয় সন্দেহ কুরআনের মাধ্যমে দূর হতে পারে। [ফাতহুল কাদীর] হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন যে, কুরআনের এই বৈশিষ্ট্যের দ্বারা বোঝা যায় যে, এটি বিশেষতঃ অন্তরের রোগের শিফা: দৈহিক রোগের চিকিৎসা নয়। কিন্তু অন্যান্য মনীষীবৃন্দ বলেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে কুরআন সর্ব রোগের নিরাময়, তা অন্তরের রোগই হোক কিংবা দেহেরই হোক। [আদ-দুররুল মানসূর]। তবে আত্মিক রোগের ধ্বংসকারিতা মানুষের দৈহিক রোগ অপেক্ষা বেশী মারাত্মক এবং এর চিকিৎসাও যে কারো সাধ্যের ব্যাপার নয়। সে কারণেই এখানে শুধু আন্তরিক ও আধ্যাত্মিক রোগের উল্লেখ করা হয়েছে। এতে একথা প্রতীয়মান হয় না যে, দৈহিক রোগের জন্য এটি চিকিৎসা নয়। হাদীসের বর্ণনা ও উম্মতের আলেম সম্প্রদায়ের অসংখ্য অভিজ্ঞতাই এর প্রমাণ যে, কুরআনুল কারাম যেমন আন্তরিক ব্যাধির জন্য অব্যর্থ মহৌষধ, তেমনি দৈহিক রোগ-ব্যাধির জন্যও উত্তম চিকিৎসা। তিন. কুরআনুল কারীমের তৃতীয় গুণ হচ্ছেঃ কুরআন হলো হেদায়াত। অর্থাৎ যে তার অনুসরণ করবে তার জন্য সঠিক পথের দিশা প্রদানকারী [কুরতুবী] আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে কুরআনকে হেদায়াত বলে অভিহিত করেছেন। যেমন সূরা আল-বাকারার ২য় আয়াত, সূরা আল ইসরার নবম আয়াত, সূরা আল-বাকারাহঃ ৯৭, ১৮৫, সূরা আলে-ইমরানঃ ১৩৮, সূরা আল-আনআমঃ ১৫৭, সূরা আল-আরাফঃ ৫২, ২০৩, সূরা ইউসুফঃ ১১১, সূরা আন-নাহলঃ ৬৪, ৮৯, ১০২, সূরা আয-যুমারঃ ২৩, সূরা ফুসসিলাতঃ ৪৪, সূরা আল-জাসিয়াহঃ ২০। চার. কুরআনুল কারীমের চতুর্থ গুণ হচ্ছেঃ কুরআন হলো রহমত। যার এক অর্থ হচ্ছে নে’আমত। [কুরতুবী] অনুরূপভাবে সূরা আল-ইসরার ৮২, সূরা আল-আনআমঃ ১৫৭, সূরা আল-আরাফঃ ১৫২, ২০৩, সূরা ইউসুফঃ ১১১, সূরা আন-নাহলঃ ৬৪, ৮৯, সূরা আল-ইসরাঃ ৮২, সূরা আন-নামলঃ ৭৭, সুরা লুকমানঃ ৩, সূরা আল-জাসিয়াহঃ ২০, সূরা আল-কাসাসঃ ৮৬ নং আয়াতেও কুরআনকে রহমত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসবই কিন্তু মুমিনদের জন্য কারণ তারাই এর দ্বারা উপকৃত হয়, কাফেররা এর দ্বারা উপকৃত হয় না, কারণ তারা এ ব্যাপারে অন্ধ। [মুয়াসসার]।
* মানুষের কর্তব্য হলো আল্লাহ তা’আলার রহমত ও অনুগ্রহকেই প্রকৃত আনন্দের বিষয় মনে করা এবং একমাত্র তাতেই আনন্দিত হওয়া দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশ ও মান-সন্ত্রম কোনটাই প্রকৃতপক্ষে আনন্দের বিষয় নয়। কারণ, একে তো কেউ যত অধিক পরিমাণেই তা অর্জন করুক না কেন, সবই অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে; পরিপূর্ণ হয় না। দ্বিতীয়তঃ সর্বদাই তার পতনাশঙ্কা লেগেই থাকে। তাই আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে-
(هُوَ خَیۡرٌ مِّمَّا یَجۡمَعُوۡنَ)
অর্থাৎ আল্লাহর করুণা-অনুগ্রহ সে সমস্ত ধন-সম্পদ ও সম্মান-সাম্রাজ্য অপেক্ষা উত্তম, যেগুলোকে মানুষ নিজেদের সমগ্র জীবনের ভরসা বিবেচনা করে সংগ্রহ করে। এ আয়াতে দুটি বিষয়কে আনন্দ-হর্ষের বিষয় সাব্যস্ত করা হয়েছে। একটি হলো (فضل) ‘ফদল’, অপরটি হলো –( رحمة) ‘রহমত’। আবু সাঈদ খুদরী ও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাসহ অনেক মুফাসসির বলেছেন যে, ‘ফদল’ অর্থ কুরআন; আর রহমত অর্থ ইসলাম। [কুরতুবী] অন্য বর্ণনায় ইবন আব্বাস বলেন, ‘ফদল’ হচ্ছে, কুরআন, আর তার রহমত হচ্ছে এই যে, তিনি আমাদেরকে কুরআনের অনুসারী করেছেন। হাসান, দাহহাক, মুজাহিদ, কাতাদা বলেন, এখানে ‘ফদল’ হচ্ছে ঈমান, আর তার রহমত হচ্ছে, কুরআন। [তাবারী; কুরতুবী] বস্তুতঃ রহমতের মর্ম এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে কুরআনের শিক্ষা দান করেছেন এবং এর উপর আমল করার সামর্থ্য দিয়েছেন। কারণ, ইসলামও এ তথ্যেরই শিরোনাম। যখন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট ইরাকের খারাজ নিয়ে আসা হলো তখন তিনি তা গুনছিলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেন। তখন তার এক কর্মচারী বললঃ এগুলো আল্লাহর দান ও রহমত। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ তোমার উদ্দেশ্য সঠিক নয়। আল্লাহর কুরআনে যে কথা বলা হয়েছে যে, “বল তোমরা আল্লাহর দান ও রহমত পেয়ে খুশী হও যা তোমরা যা জমা করছ তার থেকে উত্তম” এ আয়াত দ্বারা দুনিয়ার কোন ধন-সম্পদ বুঝানো হয়নি। কারণ আল্লাহ তা’আলা জমা করা যায় এমন সম্পদ থেকে অন্য বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তা উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদই জমা করা যায়। সুতরাং আয়াত দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। [ইবনে আবী হাতিম] বরং ঈমান, ইসলাম ও কুরআনই এখানে উদ্দেশ্য। আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক দ্বারাও এ অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। সুতরাং এ জাতীয় দ্বীনী কোন সুসংবাদ যদি কারো হাসিল হয় তিনিও এ আয়াতের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত হবেন। আব্দুর রহমান ইবনে আবযা তার পিতা থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি উবাই ইবনে কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেনঃ “আমার উপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে এবং আমাকে তা তোমাকে পড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে”। তিনি বললেন, আমি বললামঃ আমার নাম নেয়া হয়েছে? রাসূল বললেনঃ হ্যা। বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি আমার পিতা (উবাই রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে বললামঃ হে আবুল মুনযির! আপনি কি তাতে খুশী হয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমাকে খুশী হতে কিসে নিষেধ করল অথচ আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ “বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তারই রহমতের উপর তোমরা খুশী হও” [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৩/৩০৪, আবুদাউদঃ ৩৯৮০]
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Yunus
Sura: 10
Verses :- 55-58
وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ
And a cure for that which is in your breasts,
Allah says;
أَلا إِنَّ لِلّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالَارْضِ أَلَا إِنَّ وَعْدَ اللّهِ حَقٌّ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ هُوَ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ
No doubt, surely, all that is in the heavens and the earth belongs to Allah. No doubt, surely, Allah’s promise is true. But most of them know not. It is He Who gives life, and causes death, and to Him you (all) shall return.
Allah is the Owner of the heavens and earth. His promise is true and is indeed going to be fulfilled. He is the One Who gives life and causes death. To Him is the return of everyone, and He is the One who has the power over that, and the One Who knows everything about every creature; its deterioration, and where every speck of it has gone, be it land, oceans or otherwise.
The Qur’an is an Admonition, Cure, Mercy and Guidance
Allah confers a great favor on His creatures in what He has sent down of the Gracious Qur’an to His Noble Messenger. He said:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ
O mankind! There has come to you good advice from your Lord.
A warning and a shield from shameful deeds.
وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ
and a cure for that which is in your breasts,
A cure from suspicion and doubts. The Qur’an removes all the filth and Shirk from the hearts.
وَهُدًى وَرَحْمَةٌ
a guidance and a mercy,
The guidance and the mercy from Allah are attained through it.
لِّلْمُوْمِنِينَ
for the believers.
This is only for those who believe in it and have firm faith in what it contains. As Allah said:
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْءَانِ مَا هُوَ شِفَأءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُوْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّـلِمِينَ إَلاَّ خَسَارًا
And We send down of the Qur’an that which is a cure and a mercy to those who believe, and it increases the wrongdoers nothing but loss. (17:82)
and;
قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْ هُدًى وَشِفَأءٌ
Say:”It is for those who believe, a guide and a cure.” (41:44)
Allah then said.
قُلْ بِفَضْلِ اللّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُواْ
Say:”In the bounty of Allah, and in His mercy; therein let them rejoice.”
rejoice in what has come from Allah. Let them rejoice in the guidance and the religion of the truth. It is better than anything they might rejoice in,
هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ
That is better than what (the wealth) they amass.
from the ruins of the world and its vanishing bloom undoubtedly.