أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 718)
[ وَيَا قَوْمِ لَا يَجْرِمَنَّكُمْ شِقَاقِي
আর হে আমার সম্প্রদায়! আমার প্রতি তোমাদের বিরুদ্ধাচরণ যেন,
And O my people! Let not my Shiqaq cause you,]
www.motaher21.net
قَالُوۡا یٰشُعَیۡبُ اَصَلٰوتُکَ تَاۡمُرُکَ اَنۡ نَّتۡرُکَ مَا یَعۡبُدُ اٰبَآؤُنَاۤ اَوۡ اَنۡ نَّفۡعَلَ فِیۡۤ اَمۡوَالِنَا مَا نَشٰٓؤُاؕ اِنَّکَ لَاَنۡتَ الۡحَلِیۡمُ الرَّشِیۡدُ ﴿۸۷﴾
তারা বলল, ‘হে শু’আইব ! তোমার সালাত কি তোমাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা যারা ‘ইবাদত করত আমাদেরকে তা বর্জন করতে হবে অথবা আমরা আমাদের ধন-সম্পদ সম্পর্কে যা করি তাও ? তুমি তো বেশ সহিষ্ণু, সুবোধ !’
They said, “O Shu’ayb, does your prayer command you that we should leave what our fathers worship or not do with our wealth what we please? Indeed, you are the forbearing, the discerning!”
قَالَ یٰقَوۡمِ اَرَءَیۡتُمۡ اِنۡ کُنۡتُ عَلٰی بَیِّنَۃٍ مِّنۡ رَّبِّیۡ وَ رَزَقَنِیۡ مِنۡہُ رِزۡقًا حَسَنًا ؕ وَ مَاۤ اُرِیۡدُ اَنۡ اُخَالِفَکُمۡ اِلٰی مَاۤ اَنۡہٰکُمۡ عَنۡہُ ؕ اِنۡ اُرِیۡدُ اِلَّا الۡاِصۡلَاحَ مَا اسۡتَطَعۡتُ ؕ وَ مَا تَوۡفِیۡقِیۡۤ اِلَّا بِاللّٰہِ ؕعَلَیۡہِ تَوَکَّلۡتُ وَ اِلَیۡہِ اُنِیۡبُ ﴿۸۸﴾
তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায় ! তোমরা ভেবে দেখেছ কি , আমি যদি আমার রব প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি তাঁর কাছ থেকে আমাকে উৎকৃষ্ট রিযক দান করে থাকেন ( তবে কি করে আমি আমার কর্তব্য হতে বিরত থাকব? ) আর আমি তোমাদেরকে যা নিষেধ করি আমি নিজে তার বিপরীত করতে ইচ্ছে করি না আমি তো আমার সাধ্যমত সংস্কারই করতে চাই। আমার কার্যসাধন তো আল্লাহরই সাহায্যে ; আমি তাঁরই উপর নির্ভর করি এবং তাঁরই অভিমুখী।
He said, “O my people, have you considered: if I am upon clear evidence from my Lord and He has provided me with a good provision from Him… ? And I do not intend to differ from you in that which I have forbidden you; I only intend reform as much as I am able. And my success is not but through Allah . Upon him I have relied, and to Him I return.
وَ یٰقَوۡمِ لَا یَجۡرِمَنَّکُمۡ شِقَاقِیۡۤ اَنۡ یُّصِیۡبَکُمۡ مِّثۡلُ مَاۤ اَصَابَ قَوۡمَ نُوۡحٍ اَوۡ قَوۡمَ ہُوۡدٍ اَوۡ قَوۡمَ صٰلِحٍ ؕ وَ مَا قَوۡمُ لُوۡطٍ مِّنۡکُمۡ بِبَعِیۡدٍ ﴿۸۹﴾
আর হে আমার সম্প্রদায়! আমার প্রতি তোমাদের বিরুদ্ধাচরণ যেন তোমাদেরকে এমন কাজে উদ্বুদ্ধ না করে, যাতে তোমাদের উপর সেইরূপ (আযাব) এসে পতিত হয়, যেরূপ নূহের সম্প্রদায় অথবা হূদের সম্প্রদায় অথবা সালেহর সম্প্রদায়ের উপর পতিত হয়েছিল। আর লূতের সম্প্রদায় তো তোমাদের হতে দূরে নয়।
And O my people, let not [your] dissension from me cause you to be struck by that similar to what struck the people of Noah or the people of Hud or the people of Salih. And the people of Lot are not from you far away.
وَ اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ثُمَّ تُوۡبُوۡۤا اِلَیۡہِ ؕ اِنَّ رَبِّیۡ رَحِیۡمٌ وَّدُوۡدٌ ﴿۹۰﴾
আর তোমরা তোমাদের পাপের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন কর; নিশ্চয় আমার প্রতিপালক পরম দয়ালু, অতি প্রেমময়।’
And ask forgiveness of your Lord and then repent to Him. Indeed, my Lord is Merciful and Affectionate.”
সুরা: হুদ।
সুরা:১১
৮৭-৯০ নং আয়াত:-
وَيَا قَوْمِ لَا يَجْرِمَنَّكُمْ شِقَاقِي
আর হে আমার সম্প্রদায়! আমার প্রতি তোমাদের বিরুদ্ধাচরণ যেন,
And O my people! Let not my Shiqaq cause you,
৮৭-৯০ নং আয়াতের তাফসীর :-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এটি আসলে একটি তিরস্কারসূচক বাক্য। যে সমাজ আল্লাহকে ভুলে গেছে এবং ফাসেকী, অশ্লীলতা ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে ডুবে গেছে এমন প্রত্যেকটি সমাজেই এ ভাবধারা আজো মূর্ত দেখা যাবে। যেহেতু নামায দ্বীনদারীর সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে সুস্পষ্ট চিহ্ন এবং ফাসেক ও ব্যভিচারী লোকেরা নামাযকে একটি ভয়ংকর বরং সবচেয়ে মারাত্মক রোগ মনে করে থাকে তাই এ ধরনের লোকদের সমাজে নামায ইবাদাতের পরিবর্তে রোগের চিহ্ন হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে কোন ব্যক্তিকে নামায পড়তে দেখলে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মনে এ অনুভূতি জাগে যে, এ ব্যক্তির ওপর “দ্বীনদারীর আক্রমণ” ঘটেছে। তারপর এরা দ্বীনদারীর এ বৈশিষ্ট্যও ভালোভাবে জানে যে, এ জিনিসটি যার মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায় সে কেবল নিজের সৎ ও পরিচ্ছন্ন কর্মধারার ওপরই সন্তুষ্ট থাকে না বরং অন্যদেরকেও সংশোধন করার চেষ্টা করে এবং বে-দ্বীনী ও নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সমালোচনা না করে সে স্থির থাকতে পারে না। তাই নামাযের বিরুদ্ধে এদের অস্থিরতা শুধুমাত্র এ আকারে দেখা দেয় না যে, এদের এক ভাই দ্বীনদারীর মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে বরং এ সঙ্গে এদের মনে সন্দেহ জাগে যে, এবার খুব শিগগির চরিত্র, নৈতিকতা ও দ্বীনদারীর ওয়াজ-নসীহত শুরু হয়ে যাবে আর এ সাথে সমাজ জীবনের প্রত্যেকটি দিকে খুঁত বের করার একটি দীর্ঘ সিলসিলার সূচনা হবে। এ কারণেই এ ধরনের সমাজে নামায সবচেয়ে বেশী ভর্ৎসনা, তিরস্কার, নিন্দা ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। আর নামাযী সম্পর্কে পূর্বাহ্ণে যে ধরনের আশঙ্কা করা হয়েছিল কোন নামাযী যদি ঠিক সেই পর্যায়েই অসৎকাজের সমালোচনা ও ভালো কাজ করার উপদেশ দিতে শুরু করে দেয় তাহলে তো নামাযীকে এমনভাবে দোষারোপ করা শুরু হয়ে যায় যেন সে-ই এসব আপদের উৎস।
# এ বক্তব্যটি ইসলামের মোকাবিলায় জাহেলী মতবাদের পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরছে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, আল্লাহর বন্দেগী ছাড়া বাকি অন্যান্য যাবতীয় পদ্ধতিই ভুল। এগুলো অনুসরণ করা উচিত নয়। কারণ অন্য কোন পদ্ধতির পক্ষে বুদ্ধি, জ্ঞান ও আসমানী কিতাবসমূহে কোন যুক্তি-প্রমাণ নেই। আর তাছাড়া শুধুমাত্র একটি সীমিত ধর্মীয় গণ্ডীর মধ্যে আল্লাহর বন্দেগী হওয়া উচিত নয় বরং তামাদ্দুনিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা জীবনের সকল বিভাগেই হওয়া উচিত। কারণ দুনিয়ায় মানুষের কাছে যা কিছু আছে সব আল্লাহর মালিকানাধীন। আল্লাহর ইচ্ছার গণ্ডী ভেদ করে স্বাধীনভাবে কোন একটি জিনিসও মানুষ ব্যবহার করার অধিকার রাখে না। এর মোকাবিলায় জাহেলী মতবাদ হচ্ছে, বাপ-দাদা থেকে যে পদ্ধতি চলে আসছে মানুষের তারই অনুসারী হওয়া উচিত। এর অনুসরণের জন্য এছাড়া আর অতিরিক্ত কোন যুক্তি প্রমাণের প্রয়োজন নেই যে, এটা বাপ-দাদাদের পদ্ধতি। তাছাড়া শুধুমাত্র পূজা-অর্চনার সাথে দ্বীন ও ধর্মের সম্পর্ক রয়েছে। আর আমাদের জীবনের সাধারণ পার্থিব বিষয়াবলীর ব্যাপারে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা দরকার, যেভাবে ইচ্ছা আমরা সেভাবে কাজ করতে পারি।
এ থেকে একথাও আন্দাজ করা যেতে পারে যে, জীবনকে ধর্মীয় ও পার্থিব এ দু’ভাগে ভাগ করার চিন্তা আজকের কোন নতুন চিন্তা নয় বরং আজ থেকে তিন সাড়ে তিন হাজার বছর আগে হযরত শো’আয়েব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ও এ বিভক্তির ওপর ঠিক তেমনিই জোর দিয়েছিল যেমন আজকের যুগে পাশ্চাত্যবাসীরা এবং তাদের পাচ্য দেশীয় শাগরিদবৃন্দ জোর দিচ্ছেন। এটা আসলে কোন “নতুন আলো” বা “প্রগতি” নয় যা “মানসিক উন্নয়নে”র কারণে মানুষ আজ লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। বরং এটা সেই একই পুরাতন অন্ধকার ও পশ্চাৎপদ চিন্তা যা হাজার হাজার বছর আগের জাহেলিয়াতের মধ্যেও আজকের মতো একই আকারে বিরাজমান ছিল। এর সাথে ইসলামের সংঘাত আজকের নয়, অনেক পুরাতন।
# রিজিক শব্দটি এখানে দ্বিবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, সত্য-সঠিক জ্ঞান, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে, আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এ শব্দটি থেকে সাধারণত যে অর্থ বুঝা যায় সেটি অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জীবন যাপন করার জন্য যে জীবন সামগ্রী দান করে থাকেন। প্রথম অর্থটির প্রেক্ষিতে এ আয়াত থেকে এমন একটি বিষয়বস্তুর প্রকাশ ঘটে, যা এ সূরায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, নূহ (আ) ও সালেহ আলাইহিস সালামের মুখ থেকে প্রকাশ হয়ে এসেছে। অর্থাৎ নবুওয়াতের আগেও আমি নিজের রবের পক্ষ থেকে সত্যের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য নিজের মনের মধ্যে ও বিশ্ব-জগতের সমস্ত নিদর্শনের মধ্যে পাচ্ছিলাম এবং এরপর আমার রব আমাকে সরাসরিভাবেও সত্য-জ্ঞান দান করেছেন। এখন তোমরা যেসব গোমরাহী ও নৈতিকতা বিরোধী কাজে লিপ্ত রয়েছো তাতে আমার পক্ষে জেনে বুঝে লিপ্ত হওয়া কেমন করে সম্ভবপর হতে পারে? আর দ্বিতীয় অর্থের প্রেক্ষিতে হযরত শো’আয়েবকে তারা ভর্ৎসনা করেছিল এ আয়াতটিকে তার জওয়াব বলা যায়। হযরত শো’আয়বকে তারা ভর্ৎসনা করে বলেছিলঃ “ব্যস শুধু তুমিই রয়ে গেছো একজন উদারমনা ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি। এ কড়া ও তিক্ত আক্রমণের জবাব এভাবে দেয়া হয়েছেঃ “ভাইয়েরা! যদি আমার রব সত্যকে চিনবার মতো অন্তরদৃষ্টি এবং হালাল রিযিক আমাকে দিয়ে থাকেন তাহলে তোমাদের নিন্দাবাদের কারণে এ অনুগ্রহ কি করে বিগ্রহে পরিণত হবে? আল্লাহ যখন আমর প্রতি মেহেরবানী করেছেন তখন তোমাদের ভ্রষ্টতা ও হারাম খাওয়াকে আমি সত্য ও হালাল গণ্য করে তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হই কেমন করে?
# একথা থেকেই তোমরা আমার সত্যতা আন্দাজ করে নিতে পারো যে, অন্যদের আমি যা কিছু বলি আমি নিজেও তা করি। যদি আমি তোমাদের আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহর পূজা বেদীতে যেতে নিষেধ করতাম এবং নিজে কোন বেদীর সেবক হয়ে বসতাম তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরা বলতে পারতে, নিজের পীরগিরির ব্যবসায়ের প্রসারের জন্য অন্য দোকানগুলোর সুনাম নষ্ট করতে চাচ্ছি। যদি আমি তোমাদের হারাম জিনিস খেতে নিষেধ করতাম এবং নিজের কারবারে বেঈমানী করতে থাকতাম তাহলে তোমরা অবশ্যই এ সন্দেহ পোষণ করতে পারতে যে, আমি নিজের সুনাম প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঈমানদারীর ঢাক পিটাচ্ছি। কিন্তু তোমরা দেখছো, যেসব অসৎকাজ থেকে আমি তোমাদের নিষেধ করছি, আমি নিজেও সেগুলো থেকে দূরে থাকছি। যেসব কলঙ্ক থেকে আমি তোমাদের মুক্ত দেখতে চাচ্ছি আমার নিজের জীবনও তা থেকে মুক্ত। তোমাদের আমি যে পথের দিকে আহবান জানাচ্ছি আমার নিজের জন্যও আমি সেই পথটিই পছন্দ করেছি। এসব জিনিস একথা প্রমাণ করে যে, আমি যে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছি সে ব্যাপারে আমি সত্যবাদী ও একনিষ্ঠ।
# লূতের সম্প্রদায়ের ঘটনা তো খুব বেশী দিনের কথা নয়। তোমাদের সামনে এ ঘটনা এখনো তরতাজা আছে। তোমাদের কাছাকাছি এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত লূতের কওমের ধ্বংসের পর তখন ছ’ সাতশো বছরের বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়নি। আর ভৌগোলিক দিক দিয়েও লূতের কওম যেখানে বসবাস করতো শো’আয়েবের কওমের এলাকাও ছিল একেবারে তার লাগোয়া।
# মহান আল্লাহ পাষাণ হৃদয় ও নির্দয় নন। নিজের সৃষ্টির সাথে তাঁর কোন শত্রুতা নেই। তাদেরকে অযথা শাস্তি দিতে তিনি চান না। নিজের বান্দাদেরকে মারপিট করে তিনি খুশী হন না। তোমরা যখন নিজেদের বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপে সীমা অতিক্রম করে যাও এবং কোন প্রকারেই বিপর্যয় সৃষ্টিতে বিরত হও না তখন তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাদের শাস্তি দেন। নয়তো তাঁর অবস্থা হচ্ছে এই যে, তোমরা যতই দোষ কর না কেন যখনই তোমরা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে লজ্জিত হয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসবে তখনই তাঁর হৃদয়কে নিজেদের জন্য প্রশস্ততর পাবে। কারণ নিজের সৃষ্ট জীবের প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসার অন্ত নেই।
এ বিষয়বস্তুটিকে নবী ﷺ দু’টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টান্ত দিয়ে সুস্পষ্ট করেছেন। তিনি একটি দৃষ্টান্ত এভাবে দিয়েছেন যে, তোমাদের কোন ব্যক্তির উট যদি কোন বিশুষ্ক তৃণ-পানিহীন এলাকায় হারিয়ে গিয়ে থাকে, তার পিঠে তার পানাহারের সামগ্রীও থাকে এবং সে ব্যক্তি তার খোঁজ করতে করতে নিরাশ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের নীচে শুয়ে পড়ে। ঠিক এমনি অবস্থায় সে দেখে তার উটটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় সে যে পরিমাণ খুশী হবে আল্লাহর পথভ্রষ্ট বান্দা সঠিক পথে ফিরে আসার ফলে আল্লাহ তার চেয়ে অনেক বেশী খুশী হন। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি এর চেয়ে আরো বেশী মর্মস্পর্শী। হযরত উমর (রা.) বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিছু যুদ্ধবন্দী এলো। এদের মধ্যে একজন মহিলাও ছিল। তার দুগ্ধপোষ্য শিশুটি হারিয়ে গিয়েছিল। মাতৃস্নেহে সে এতই অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, কোন বাচ্চা সামনে দেখলেই তাকে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরতো এবং নিজের বুকের দুধ তাকে পান করাতে থাকতো। তার এ অবস্থা দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মনে করো এ মা তার নিজের বাচ্চাকে নিজের হাতে আগুনে ছুঁড়ে ফেলতে পারে? আমরা জবাব দিলামঃ কখনোই নয়, তার নিজের ছুঁড়ে দেবার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না, বাচ্চা নিজেই যদি আগুনে পড়ে যায় তাহলে সে তাকে বাঁচাবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। তিনি বলেনঃ
اللَّهُ أَرْحَمُ بِعِبَادِهِ مِنْ هَذِهِ بِوَلَدِهَا
“এ মহিলা তার বাচ্চার প্রতি যে পরিমাণ অনুগ্রহশীল আল্লাহর অনুগ্রহ তাঁর বান্দার প্রতি তার চেয়ে অনেক বেশী।”
আর এমনি চিন্তা-ভাবনা করলে একথা সহজেই বুঝা যায়। আল্লাহই তো বাচ্চার লালন-পালনের জন্য মা-বাপের মনে স্নেহ-প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। নয়তো আল্লাহ যদি এ স্নেহ-প্রীতি সৃষ্টি না করে দিতেন তাহলে বাচ্চাদের মা-বাপের চেয়ে বড় শত্রু আর হতো না। কারণ তারা মা-বাপের জন্য হয় সবচেয়ে বেশী কষ্টদায়ক। এখন যে আল্লাহ মাতৃ-পিতৃ স্নেহের স্রষ্টা তাঁর নিজের মধ্যে নিজের সৃষ্টির জন্য কি পরিমাণ স্নেহ-প্রীতি-ভালোবাসা থাকবে— একথা প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই আন্দাজ করতে পারে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# হযরত আ’মাশ (রঃ) বলেন যে, এখানে (আরবি) দ্বারা (আরবি) উদ্দেশ্য। হযরত শুআ’ইবের (আঃ) কওম তাঁকে ঠাট্টা করে বললো: “ওহে, তুমি খুব ভাল কথাই বলছো! তোমার পঠন তোমাকে এটাই হুকুম করছে যে, আমরা আমাদের পুর্ব পুরুষদের রীতিনীতি পরিত্যাগ করতঃ আমাদের পুরাতন উপাস্যদের উপাসনা ছেড়ে দেই! আর এটাও খুব মজার কথা যে, আমরা আমাদের নিজেদের মালেরও মালিক থাকবো না, সুতরাং এ ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই করতেও পারবো না। কাউকে মাপে ও ওজনে কমও দিতে পারবো না।” হযরত হাসান (রাঃ) বলেনঃ আল্লাহর কসম! হযরত শুআ’ইবের (আঃ) নামাযের হুকুম এটাই ছিল যে, তিনি তাদেরকে গায়রুল্লাহর ইবাদত ও মাখলুকের হক বিনষ্ট করা হতে বিরত রাখবেন। সাওরী (রঃ) বলেনঃ “আমরা নিজেদের মালে নিজেদের ইচ্ছানুসারে ব্যবস্থা অবলম্বন করি’ তাদের এই উক্তি দ্বারা তারা বুঝাতে চেয়েছেঃ ‘আমরা যাকাত কেন দেবো?’ তারা শুধু বিদ্রুপ করেই হযরত শুআ’ইবকে (আঃ) জ্ঞানবান ও ধর্মপরায়ণ বলেছিল।
# হযরত শুআ’ইব (আঃ) স্বীয় কওমকে বলতে লাগলেনঃ “দেখো, আমি আমার প্রতিপালকের তরফ হতে দলীল প্রমাণের উপর প্রতিষ্টিত রয়েছি। এবং সেই দিকেই তোমাদেরকে আহবান করছি। আমার প্রতিপালক আমাকে অনুগ্রহ পূর্বক উত্তম রিযক দান করেছেন।” কেউ কেউ বলেছেন যে, এখানে উত্তম রিয্ক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে নুবওয়াত। আবার কেউ কেউ হালাল জীবিকা অর্থ নিয়েছেন। দু’টোই হতে পারে। তিনি বলেনঃ হে আমার কওম! তোমরা আমার নীতি এরূপ পাবে না যে, আমি তোমাদেরকে ভাল কাজের হুকুম করব এবং নিজে গোপনে এর বিপরীত কাজ করবো। আমার তো একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার সাধ্য অনুযায়ী সংশোধন করা। হা, তবে আমার উদ্দেশ্যের সফলতা আল্লাহ তাআ’লার হাতেই রয়েছে। তারই উপর আমি ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি ও ঝুঁকে পড়ি।
হাকীম ইবনু মুআ’বিয়া তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর (মুআ’বিয়ার) ভাই মালিক তাঁকে বলেনঃ “হে মুআ’বিয়া! রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার প্রতিবেশীদেরকে বন্দী করে রেখেছেন। তুমি তাঁর নিকট গমন কর। তাঁর সাথে তোমার আলাপ আলোচনা হয়ে থাকে এবং তিনি তোমাকে চিনেন।” (মুআ’বিয়া বলেনঃ) আমি তখন তার সাথে গমন করলাম। সে (মালিক) বললো: “আমার প্রতিবেশীদেরকে ছেড়ে দিন। তারা মুসলমান হয়েছিল। তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুখ ফিরিয়ে নেন। সে তখন রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বলেঃ “আল্লাহর কসম! যদি আপনি এটা করেন তবে লোকেরা বলাবলি করবেঃ আপনি আমাদেরকে কোন কাজের আদেশ করেন, অথচ নিজে ওর বিপরীত কাজ করে থাকেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তুমি কি বলছো?” সে উত্তরে বললো: আল্লাহর কসম! যদি আপনি এটা করেন তবে অবশ্যই লোকেরা ধারণা করবে যে, আপনি কোন কাজের আদেশ করেন, আর নিজেই ওটার বিপরীত কাজ করে থাকেন।” বর্ণনাকারী বলেন যে, তার একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “লোকেরা কি এ কথা সত্যিই বলেছে? অবশ্যই যদি আমি এরূপ করি তবে নিশ্চয় এর শাস্তি আমাকেই ভোগ করতে হবে, তাদেরকে নয়। তোমরা তার প্রতিবেশীদেরকে ছেড়ে দাও। (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
বাহায ইবনু হাকীম হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (তাঁর দাদা) বলেনঃ “আমার কওমের কতকগুলি লোককে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সন্দেহ বশতঃ পাকড়াও করে বন্দী করেন। তখন আমার কওমের একজন লোক আল্লাহর রাসূলের (সঃ) নিকট আগমন করে। ঐ সময় তিনি খুৎবা দিচ্ছিলেন। লোকটি ঐ অবস্থাতেই তাঁকে বললো: “হে মুহাম্মদ (সঃ)! আমার প্রতিবেশীদেরকে আপনি কি কারণে বন্দী করেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) নীরব থাকেন। তখন সে বলে, নিশ্চয় লোকেরা বলাবলি করছে, আপনি কোন কিছু থেকে নিষেধ করছেন, অথচ নিজেই তা করছেন। তার এ কথা শুনে নবী (সঃ) বলেনঃ “তুমি কি বলছো?” বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি মাঝখানে বলতে শুরু করলামঃ এ কথা শুনার আপনার কোনই প্রয়োজন নেই, আমি এই ভয়েই একথা বললাম যে, যদি তিনি এটা শুনতে পান, অতঃপর আমার কওমের উপর বদ দুআ’ করেন তবে এর পরে কখনো তারা মুক্তি পাবে না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) বরাবর এর পিছনে লেগেই থাকলেন এবং শেষে তার কথা বুঝেই ফেললেন।
অতঃপর তিনি বললেনঃ “তাদের কেউ এ কথা মুখ দিয়ে বের করেছে? আল্লাহর শপথ! আমি যদি এরূপ করি তবে এর পাপের বোঝা আমাকেই বহন করতে হবে, তাদেরকে নয়। তার প্রতিবেশীদেরকে ছেড়ে দাও। (এ হাদীসটিও ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এই প্রসঙ্গেই আবু হুমায়েদ (রাঃ) ও আবু উসায়েদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা আমার পক্ষ থেকে এমন কোন হাদীস শুনবে যা তোমাদের অন্তর অস্বীকার করে এবং তোমাদের দেহ ও চুল তার থেকে পৃথক থাকে এবং তোমরা পার যে, তোমরা ওর থেকে দূরে রয়েছে, তখন জানবে যে, তোমাদের চেয়ে এটা হতে আমি আরো বহু দূরে রয়েছি।” (ইমাম আহমদই (রঃ) এ হাদীসটিকেও স্বীয় হাদীস গ্রন্থ ‘মুসনাদ’ এ বর্ণনা করেছেন। এর সনদ বিশুদ্ধ)
ইমাম মুসলিম (রঃ) এই সনদে নিম্নের হাদীসটি তাখরীজ করেছেনঃ “যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে তখন যেন সে বলেঃ (আরবি) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ্! আপনি আমার জন্যে আপনার রহমতের দরজাগুলি খুলে দিন।‘ আর যখন বের হবে তখন যেন বলেঃ (আরবি) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ্! আমি আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি।‘ এর অর্থ হচ্ছে (আল্লাহ তাআ’লাই খুব ভাল জানেন): যখনই আমার পক্ষ হতে তোমাদের কাছে কোন ভাল কথা পৌঁছে তখন জেনে রাখবে আমি তোমাদের অপেক্ষা ওর বেশী নিকটবতী। আর যখনই তোমাদের কাছে কোন খারাপ কথা পৌঁছবে তখন জানবে যে, আমি তোমাদের অপেক্ষা এর থেকে বহু দূরে।”
হযরত মাসরূফ (রাঃ) বলেন যে, একজন স্ত্রীলোক হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদের (রাঃ) নিকট এসে বলেঃ “আপনি কি চুলে চুল মিলাতে নিষেধ করে থাকেন?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “হা।” তখন মহিলাটি তাঁকে বলেঃ “আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকদের কেউ কেউ এটা করে থাকে।” একথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “যদি তা-ই হয় তবে তো আমি সৎ বান্দার অসিয়তের হিফাযত করি নাই। আমি চাই না যে, তোমাদেরকে আমি যা থেকে নিষেধ করি তা নিজেই করি।”
হযরত আবু সুলাইমান (রঃ) বলেনঃ “আমাদের কাছে হযরত উমার ইবনু আবদিল আযীযের (রঃ) নিকট থেকে চিঠিপত্র আসতো, যাতে হুকুম আহ্কাম এবং নিষেধাজ্ঞা থাকতো। শেষে তিনি লিখতেনঃ “আমি ঐ কথাই বলছি, যে কথা সৎ বান্দা বলেছিলেন। তা হচ্ছেঃ আমার যা কিছু তাওফীক হয় তা শুধু আল্লাহরই সাহায্যে হয়ে থাকে। আমি তাঁরই উপর ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি।”
# ৮৯-৯০ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত শুআ’ইব (আঃ) তাঁর কওমকে বলেনঃ “হে আমার কওম! তোমরা আমার প্রতি শত্রুতা ও হিংসায় পড়ে কুফরী ও পাপ কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ো না; নচেৎ তোমাদের উপর ঐ শাস্তিই এসে পড়বে যা তোমাদের পূর্বে তোমাদের ন্যায় আমলকারীদের উপর এসেছিল। বিশেষ করে হযরত লূতের (আঃ) কওম তো তোমাদের অদূর যুগেই ছিল। তাদের যুগ তোমাদের থেকে বেশী দূরে নয় এবং তাদের বাসস্থানও তোমাদের বাসভূমির অতি নিকটবর্তী। তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী পাপরাশির জন্যে মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। আমার প্রতিপালক এইরূপ লোকদের উপর অত্যন্ত দয়ালু হয়ে যান এবং তাদেরকে নিজের প্রিয় বান্দা বানিয়ে নেন যারা এইভাবে নিজেদের পাপের জন্যে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাঁরই দিকে ফিরে যায়।
ইবনু আবি লায়লা আল-কিনদী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “আমি আমার মনিবের জন্তুটি ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। জনগণ হযরত উসমানের (রাঃ) বাড়ী অবরোধ করেছিল। তিনি বাড়ীর ভিতর হতে মাথা উঁচু করে আমাদেরকে উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করে শুনিয়ে দেন। অতঃপর তিনি বলেন, “হে আমার কওম! তোমরা আমাকে হত্যা করো না। তোমরা তো এইরূপ ছিলে।” এ কথা বলার সময় তিনি স্বীয় অঙ্গুলীর মধ্যে অঙ্গুলী প্রবেশ করিয়ে দেন অর্থাৎ এক হাতের অঙ্গুলীর মধ্যে আর এক হাতের অঙ্গুলী প্রবেশ করান।” (এটা ইবনু আবি হা’তিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। হযরত উসমানের (রাঃ) অঙ্গুলীর মধ্যে অঙ্গুলী প্রবেশ করিয়ে দেখানোর তাৎপর্য এই যে, সাহাবীগণ তো একে অপরের ভাইরুপে কালাতিপাত করতেন। কিন্তু হযরত উসমানের (রাঃ) যুগে ভুল বুঝাবুঝির কারণে তাঁরা তাঁর শক্ত হয়ে যান। তাই, তিনি তাদেরকে পূর্বাবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দেন)
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
কোন কোন মুফাসসির বলেছেন: সকল জাতির ধর্মেই যাকাত, ফিতরা এবং সাদকা ইত্যাদি আবশ্যক ছিল। সম্পদ উপার্জনের কিছু নিয়মাবলী ছিল। তাদের কথা শুনে শু‘আইব (عليه السلام) বললেন: যদি আমি আমার প্রভুর পক্ষ থেকে হকের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকি আর তিনি আমাকে উত্তম রিযিক দান করেন তবুও কি আমি তোমাদের কথা মত তোমাদেরকে যেদিকে আহ্বান করছি তার বিপরীত আমল করব। এটা হতে পারে না। আমি তো শুধু আমার সাধ্যমত তোমাদের কল্যাণ করারই ইচ্ছা পোষণ করি। আর তাও আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য ব্যতীত সম্ভব নয়। সুতরাং আমি আমার প্রভুর ওপরই ভরসা করলাম। তিনি তাদেরকে আরো সতর্ক করলেন যে, হে আমার সম্প্রদায়! আমার বিরুদ্ধে তামরা এমন কাজ করে বস না যার ফলে তোমাদের ওপর পূর্ববর্তী জাতির মত শাস্তি নেমে আসে, যেমন শাস্তি এসেছিল নূহ, হূদ, সালেহ ও লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায়ের ওপর। আর তোমরা লূত (عليه السلام)-এর সম্প্রদায় থেকে বেশি দূরেও নও। সুতরাং তোমরা তোমাদের পাপের কারণে আল্লাহ তা‘আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁরই দিকে ফিরে যাও।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান বলেছেন:-
[১] صلوةٌ শব্দের অর্থ হল, ইবাদত, ধর্মনিষ্ঠা অথবা তেলাঅত।
[২] কোন কোন মুফাসসিরের নিকট এর অর্থ যাকাত ও সাদকা, সকল আসমানী কিতাবে তার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর আদেশকৃত যাকাত বের করা, আল্লাহর অবাধ্যদের উপর বড় কঠিন হয় এবং তারা ভাবে যে, যেখানে আমরা নিজ পরিশ্রম ও ক্ষমতাবলে সম্পদ উপার্জন করি, সেখানে তা খরচ করা বা না করাতে আমাদের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে কেন? এবং তার কিছু অংশ নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী বের করার জন্য আমাদেরকে কেন বাধ্য করা হবে? অনুরূপ ইনকাম ও ব্যবসা ইত্যাদিতে হালাল-হারাম ও বৈধ-অবৈধতার নিষেধাজ্ঞাও এ সকল লোকদের উপর বড় কষ্টকর হয়। সম্ভবত ওজনে ও পরিমাপে কম দেওয়া থেকে নিষেধ করাকেও তারা নিজ সম্পদের ব্যাপারে অনুচিত হস্তক্ষেপ ভেবেছে এবং এই শব্দে তা অস্বীকার করেছে। এর উভয় ভাবার্থই সঠিক।
[৩] শুআইব (আঃ)-কে তারা বিদ্রূপ স্বরূপ উক্ত ব্যাক্য বলেছিল।
# [১] ‘উত্তম সম্পদ’এর দ্বিতীয় অর্থ নবুঅতও করা হয়েছে। (ইবনে কাসীর)
[২] অর্থাৎ, আমি তোমাদেরকে যে কর্ম থেকে বিরত থাকতে বলব, তার বিপরীত সে কর্ম আমি নিজে করব, তা হতে পারে না।
[৩] আমি তোমাদেরকে যে কর্ম করার বা না করার আদেশ দিই, তাতে আমার উদ্দেশ্য, সাধ্যমত তোমাদের সংশোধন।
[৪] অর্থাৎ, সত্য পর্যন্ত পৌঁছনোর আমার যে প্রবল ইচ্ছা, তা একমাত্র আল্লাহর তওফীক বা সাহায্যেই সম্ভব। এই জন্য প্রত্যেক কাজে আমি আল্লাহরই উপর ভরসা রাখি এবং তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করি।
# তাদের অবস্থানক্ষেত্র তোমাদের থেকে দূরে নয়, অথবা সেই কারণ তোমাদের থেকে দূরে নয় যে কারণে তারা আযাবে পতিত হয়েছিল।
তাফসীরে আবুবকর জাকারিয়া বলেছেন:-
# এত কিছু শোনার পরেও তার কওমের লোকেরা পূর্ববতী বর্বর পাপিষ্ঠদের ন্যায় একই জবাব দিল। তারা নবীর আহবানকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর নবীকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করে বললঃ আপনার নামায কি আপনাকে শিখায় যে, আমরা আমাদের ঐসব উপাস্যের পুজা ছেড়ে দেই, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যার পুজা করে আসছে। আর আমাদের ধন-সম্পদকে নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করার অধিকারী না থাকি? কোনটা হালাল কোনটা হারাম তা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে করে সব কাজ করতে হবে? শু’আইব আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সারাদেশে প্রসিদ্ধ ছিল যে, তিনি অধিকাংশ সময় নামায ও নফল এবাদতে মগ্ন থাকেন। [কুরতুবী] তাই তারা তার মূল্যবান নীতি বাক্যসমূহকে বিদ্রুপ করে বলতো- আপনার নামায কি আপনাকে এসব কথাবার্তা শিক্ষা দিচ্ছে? হাসান বসরী বলেন, অবশ্যই তার সালাত তাকে আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে নিষেধ করছে। [ইবন কাসীর] তাদের এসব মন্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, এরা দ্বীনকে শুধু কতিপয় আচার-আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করতো। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ধর্মকে কোন দখল দিত না। তারা মনে করত, প্রত্যেকে নিজ নিজ ধন-সম্পদ যেমন খুশী তেমন ভোগ দখল করতে পারে, এ ক্ষেত্রে কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করা ধর্মের কাজ নয়। [মুহাম্মাদ আল-মাক্কী: আত- তাইসীর ফী আহাদীসিত তাফসীর ৩/১৩৯] সুফিয়ান আস-সাওরী বলেন, তারা এটা বলেছিল যাকাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে। [ইবন কাসীর]
এ থেকে একথাও আন্দাজ করা যেতে পারে যে, জীবনকে ধর্মীয় ও পার্থিব এ দু’ভাগে ভাগ করার চিন্তা আজকের কোন নতুন চিন্তা নয় বরং আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে শু’আইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ও এ বিভক্তির উপর ঠিক তেমনিই জোর দিয়েছিল যেমন আজকের যুগে পাশ্চাত্যবাসীরা এবং তাদের প্রাচ্যদেশীয় শিষ্যবৃন্দ জোর দিচ্ছেন।
# [১] রিযক শব্দটি এখানে দ্বিবিধ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, সত্যসঠিক জ্ঞান, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে, আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এ শব্দটি থেকে সাধারণত যে অর্থ বুঝা যায় সেটি অর্থাৎ আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে জীবন যাপন করার জন্য যে জীবন সামগ্ৰী দান করে থাকেন। প্রথম অর্থটির প্রেক্ষিতে এর অর্থ হচ্ছে নবুওয়াত ও রিসালত। [ইবন কাসীর] আর দ্বিতীয় অর্থের প্রেক্ষিতে এর অর্থ হবে, হালাল রিযক। [ইবন কাসীর] অর্থাৎ শু’আইব আলাইহিস সালাম বলছেন যে, আমার আল্লাহ যদি আমাকে হালাল রিযিক দিয়ে থাকেন তাহলে তোমাদের নিন্দাবাদের কারণে এ অনুগ্রহ কি করে বিগ্রহে পরিণত হবে? আল্লাহ যখন আমার প্রতি মেহেরবানী করেছেন তখন তোমাদের ভ্রষ্টতা ও হারাম খাওয়াকে আমি সত্য ও হালাল গণ্য করে তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হই কেমন করে?
[২] অর্থাৎ একথা থেকেই তোমরা আমার সত্যতা আন্দাজ করে নিতে পারো যে, অন্যদের আমি যা কিছু বলি আমি নিজেও তা করি। এমন নয় যে, তোমাদেরকে যা থেকে নিষেধ করছি আমি নিজে তার বিরোধিতা করে তা গোপনে করে যাচ্ছি। [ইবন কাসীর] অর্থাৎ যদি আমি তোমাদের আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহর পূজা বেদীতে যেতে নিষেধ করতাম এবং নিজে কোন বেদীর সেবক হয়ে বসতাম তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরা আমার কথার বাইরে চলার মত দলীল-প্রমাণাদি পেয়ে যেতে। যদি আমি তোমাদের হারাম জিনিস খেতে নিষেধ করতাম এবং নিজের কারবারে বেঈমানী করতে থাকতাম তাহলে তোমরা অবশ্যি এ সন্দেহ পোষণ করতে পারতে যে, আমি নিজের সুনাম প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ঈমান্দারীর দাবী করছি। কিন্তু তোমরা দেখছো, যেসব অসৎকাজ থেকে আমি তোমাদের নিষেধ করছি। আমি নিজেও সেগুলো থেকে দূরে থাকছি। যেসব কলংক থেকে আমি তোমাদের মুক্ত দেখতে চাচ্ছি আমার নিজের জীবনও তা থেকে মুক্ত। তোমাদের আমি যে পথের দিকে আহবান জানাচ্ছি আমার নিজের জন্যও আমি সেই পথটিই পছন্দ করেছি। এসব জিনিস একথা প্রমাণ করে যে, আমি যে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছি সে ব্যাপারে আমি সত্যবাদী ও একনিষ্ঠ।
# তোমরা ইস্তেগফার ও তাওবা কর। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। মহান আল্লাহ্ নির্দয় নন। নিজের সৃষ্টির সাথে তাঁর কোন শক্রতা নেই। তোমরা যতই দোষ করো না কেন যখনই তোমরা নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে লজ্জিত হয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসবে তখনই তাঁর হৃদয়কে নিজেদের জন্য প্রশস্ততর পাবে। কারণ নিজের সৃষ্ট জীবের প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসার অন্ত নেই। এ বিষয়বস্তুটিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সূক্ষ্ম দৃষ্টান্ত দিয়ে সুস্পষ্ট করেছেন। তিনি একটি দৃষ্টান্ত এভাবে দিয়েছেন যে, তোমাদের কোন ব্যক্তির উট যদি কোন বিশুষ্ক তৃণপানিহীন এলাকায় হারিয়ে গিয়ে থাকে, তার পিঠে তার পানাহারের সামগ্ৰীও থাকে এবং সে ব্যক্তি তার খোঁজ করতে করতে নিরাশ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের নীচে শুয়ে পড়ে। ঠিক এমনি অবস্থায় সে দেখে তার উটটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় সে যে পরিমাণ খুশি হবে আল্লাহর পথভ্রষ্ট বান্দা সঠিক পথে ফিরে আসার ফলে আল্লাহ তার চেয়ে অনেক বেশী খুশী হন। [ দেখুন, বুখারী: ৬৩০৮; মুসলিম: ২৭88]
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- HUD.
Sura: 11
Verses :- 87-90
وَيَا قَوْمِ لَا يَجْرِمَنَّكُمْ شِقَاقِي
And O my people! Let not my Shiqaq cause you,
The Response of Shu`ayb’s People
Allah tells;
قَالُواْ يَا شُعَيْبُ
They said:”O Shu`ayb!
They said to Shu`ayb, in mockery,
أَصَلَتُكَ
Does your Salah,
Al-A`mash said,
“This means your reading.”
تَأْمُرُكَ أَن نَّتْرُكَ مَا يَعْبُدُ ابَاوُنَا
command you that we give up what our fathers used to worship,
meaning the idols and statues.
أَوْ أَن نَّفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَ
وُ
ا
or that we give up doing what we like with our property,
This means, “Should we abandon our practice of lightening the scales because of your statement This is our wealth and we will do with it as we please.”
Al-Hasan said concerning Allah’s statement,
أَصَلَتُكَ
تَأْمُرُكَ أَن نَّتْرُكَ مَا يَعْبُدُ ابَاوُنَا
(Does your Salah command you that we give up what our fathers used to worship)
“By Allah, this means that his prayer commanded them to abandon what their fathers used to worship.”
At-Thawri said concerning Allah’s statement,
أَوْ أَن نَّفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَ
وُ
ا
(or that we give up doing what we like with our property),
“They were speaking in reference to the paying of Zakah (charity).”
إِنَّكَ لَاَنتَ الْحَلِيمُ الرَّشِيدُ
Verily, you are the forbearer right-minded!
Ibn Abbas, Maymun bin Mihran, Ibn Jurayj, Ibn Aslam, and Ibn Jarir all said,
“These enemies of Allah were only saying this in mockery.
May Allah disfigure them and curse them from ever receiving His mercy. And verily, He did so.
Shu`ayb’s Refutation of His People
Allah tells;
قَالَ يَا قَوْمِ أَرَأَيْتُمْ إِن كُنتُ عَلَىَ بَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّي
He said:”O my people! Tell me if I, have a clear evidence from my Lord,
meaning, upon clear guidance in that which I am calling to.
وَرَزَقَنِي مِنْهُ رِزْقًا حَسَنًا
and He has given me a good sustenance from Himself.
It has been said that he meant the Prophethood.
It has also been said that he meant the lawful provisions.
It seems that the verse carries both meanings.
وَمَا أُرِيدُ أَنْ أُخَالِفَكُمْ إِلَى مَا أَنْهَاكُمْ عَنْهُ
I wish not, in contradiction to you, to do that which I forbid you.
Ath-Thawri said,
meaning, `do not forbid you from something and at the same time I contradict my prohibitions in secret behind your backs, doing what I have forbidden.’
This is similar to what Qatadah said concerning Allah’s statement,
“He is saying, `I do not forbid you all from something while I do it myself.”‘
إِنْ أُرِيدُ إِلاَّ الاِصْلَحَ مَا اسْتَطَعْتُ
I only desire reform to the best of my power.
This means, “In that which I command and forbid you, I only want to correct your affair as much as I am able.”
وَمَا تَوْفِيقِي
And my guidance cannot come,
This means, “In whatever I intend that agrees with the truth.”
إِلاَّ بِاللّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ
except from Allah, in Him I put my trust,
This means in all of my affairs.
وَإِلَيْهِ أُنِيبُ
and unto Him I repent.
meaning; “I return.”
This has been said by Mujahid and others.
He (Shu`ayb) said to them,
وَيَا قَوْمِ لَا يَجْرِمَنَّكُمْ شِقَاقِي
And O my people! Let not my Shiqaq cause you,
This means, “Do not let your hatred and enmity of me cause you to persist in your corruption and disbelief. If you continue this way, you will suffer the same vengeance and torment that overcame Nuh’s people, Hud’s people, Salih’s people and Lut’s people.”
Qatadah said,
وَيَا قَوْمِ لَا يَجْرِمَنَّكُمْ شِقَاقِي
(And O my people! Let not my Shiqaq cause you),
“He is saying, `Do not be influenced by your differing with me.”‘
As-Suddi said,
“This means your enmity of me should not lead you to continue in misguidance and disbelief, or else you will be afflicted by what afflicted them.”
أَن يُصِيبَكُم مِّثْلُ مَا أَصَابَ قَوْمَ نُوحٍ أَوْ قَوْمَ هُودٍ أَوْ قَوْمَ صَالِحٍ
to suffer the fate similar to that of the people of Nuh or of Hud or of Salih,
and the people of Lut are not far off from you!”
Concerning His statement,
وَمَا قَوْمُ لُوطٍ مِّنكُم بِبَعِيدٍ
and the people of Lut are not far off from you!
It has been said that this refers to the period of time.
Qatadah said,
“This means that they were only destroyed before you yesterday.”
It has also been said that it refers to place. Actually, the verse carries both meanings.
وَاسْتَغْفِرُواْ رَبَّكُمْ
And ask forgiveness of your Lord,
from the previous sins.
ثُمَّ تُوبُواْ إِلَيْهِ
and turn unto Him in repentance.
In whatever evil actions you may encounter in the future.
Concerning his statement,
إِنَّ رَبِّي رَحِيمٌ وَدُودٌ
Verily, my Lord is Most Merciful, Most Loving.
to those who repent.