أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই নং # ৮২৪)
বাংলা তাপসীর:-
সুরা: আন- নহল
সুরা:১৬
১০৪-১০৯ নং আয়াত:-
[ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۰۵﴾
তারাই মিথ্যাবাদী।
It is those who are the liars.]
www.motaher21.net
اِنَّ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ۙ لَا یَہۡدِیۡہِمُ اللّٰہُ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱۰۴﴾
যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না, তাদেরকে আল্লাহ পথনির্দেশ করেন না এবং তাদের জন্য আছে বেদনাদায়ক শাস্তি।
Indeed, those who do not believe in the verses of Allah – Allah will not guide them, and for them is a painful punishment.
اِنَّمَا یَفۡتَرِی الۡکَذِبَ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۰۵﴾
যারা আল্লাহর নিদর্শনে বিশ্বাস করে না, তারাই শুধু মিথ্যা উদ্ভাবন করে এবং তারাই মিথ্যাবাদী।
They only invent falsehood who do not believe in the verses of Allah, and it is those who are the liars.
مَنۡ کَفَرَ بِاللّٰہِ مِنۡۢ بَعۡدِ اِیۡمَانِہٖۤ اِلَّا مَنۡ اُکۡرِہَ وَ قَلۡبُہٗ مُطۡمَئِنٌّۢ بِالۡاِیۡمَانِ وَ لٰکِنۡ مَّنۡ شَرَحَ بِالۡکُفۡرِ صَدۡرًا فَعَلَیۡہِمۡ غَضَبٌ مِّنَ اللّٰہِ ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۰۶﴾
কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহ্র সাথে কুফরী করলে এবং কুফরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহ্র গযব এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি ; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরীর জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত।
Whoever disbelieves in Allah after his belief… except for one who is forced [to renounce his religion] while his heart is secure in faith. But those who [willingly] open their breasts to disbelief, upon them is wrath from Allah, and for them is a great punishment;
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمُ اسۡتَحَبُّوا الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا عَلَی الۡاٰخِرَۃِ ۙ وَ اَنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۱۰۷﴾
এটা এ জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং এই জন্য যে, আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।
That is because they preferred the worldly life over the Hereafter and that Allah does not guide the disbelieving people.
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ طَبَعَ اللّٰہُ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ وَ سَمۡعِہِمۡ وَ اَبۡصَارِہِمۡ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ ﴿۱۰۸﴾
ওরাই তারা; আল্লাহ যাদের অন্তর, কর্ণ ও চক্ষু মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই উদাসীন।
Those are the ones over whose hearts and hearing and vision Allah has sealed, and it is those who are the heedless.
لَاجَرَمَ اَنَّہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۱۰۹﴾
নিঃসন্দেহে তারা পরকালে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
Assuredly, it is they, in the Hereafter, who will be the losers.
১০৪-১০৯ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনি শুধু ঈমানদারদেরকেই হিদায়াত দান করেন। কোন কাফির-মুশরিককে নয়। তারা তো শুধু মিথ্যা ও বানোয়াট কথাই বলে বেড়ায়। তারা কখনো সুপথ লাভ করবে না। প্রশ্ন হতে পারে ঈমানদাররা তো সঠিক পথে রয়েছে, তাদের হিদায়াতের প্রয়োজন নেই, হিদায়াত তো দরকার হল কাফির-মুশরিকদের। উত্তর হল কাফির-মুশরিকরা হিদায়াত গ্রহণ করতে উৎসাহী নয় এবং হিদায়াতের প্রয়োজনও মনে করে না, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে হিদায়াত দেন না। আর মু’মিনদেরকে হিদায়াত দান করেন এর অর্থ তাদেরকে হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন।
(مَنْ كَفَرَ بِاللّٰهِ….)
আয়াতের শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস (রা:) বলেন, এ আয়াতটি আম্মার ইবনু ইয়াসিরের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ঘটনা হল মুশরিকরা তাকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকে যে পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অস্বীকার করেন। তখন তিনি অত্যন্ত নিরূপায় ও বাধ্য হয়ে তাদেরকে সমর্থন করেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট গমন করে ওযর পেশ করেন। ঐ সময় আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। (ইবনে কাসীর ১/৬১১, মুসতাদরাক হাকেম ২/৩৫৭, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুপাতে সহীহ)
আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেন, যদি কেউ ঈমান আনার পর মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। দুনিয়াতে মুরতাদের শাস্তি হিসেবে হত্যা করা হবে। আর আখিরাতে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে থাকবে। কারণ হল তারা আখিরাতের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করেছে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে, শ্রবণশক্তিতে এবং দর্শনশক্তিতে মোহর মেরে দিয়েছেন যার কারণে তারা ঈমান থেকে গাফেল হয়ে গেছে।
তবে যদি কেউ জীবন নাশের আশঙ্কা থেকে বাঁচার জন্য শুধু মুখে কুফরী বাক্য উচ্চারণ করে কিন্তু তার অন্তর ঈমানে পরিপূর্ণ তাহলে সে মুরতাদ বলে গণ্য হবে না এবং তার ওপর মুরতাদের বিধান কার্যকর হবে না।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আমার উম্মতের তিনটি বিষয় থেকে কলম তুলে নেয়া হয়েছে
১. ভুল করে কোন কাজ করলে,
২. কোন কাজ করতে ভুলে গেলে
৩. কোন কিছু করতে বা না করতে বাধ্য করা হলে।
(ইরওয়ারুল গালীল হা: ২৫৬৬, সহীহুল জামে হা: ৩৫১৫)
এ সুবিধা অনেকে অনাকাক্সিক্ষত স্থানে ব্যবহার করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। এটা মোটেও ঠিক নয়। বরং ঈমান নিয়ে মারা গেলে সেটাই উত্তম, যেমন কেউ দুনিয়ার স্বার্থে ঈমান ছেড়ে দিয়ে বলে কুফরী করতে বাধ্য হয়েছি। এ সম্পর্কে সূরা বাকারায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ঈমান আনার পর কুফরী করা যাবে না।
২. কেউ জীবন বাঁচানোর জন্য কুফরী কথা বললে মুরতাদ হবে না, তবে অন্তরে ঈমান দৃঢ়ভাবে থাকতে হবে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ আয়াতের দ্বিতীয় অনুবাদ এও হতে পারে “মিথ্যা তো তারাই তৈরী করে যারা আল্লাহর আয়াতের প্রতি ঈমান আনে না।”
# এ আয়াতে এমন সব মুসলমানদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যাদের ওপর সে সময় কঠোর নির্যাতন চালানো হচ্ছিল এবং যাদেরকে অসহনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণা দিয়ে কুফরী করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা যদি কখনো জুলুম-নিপীড়নের চাপে বাধ্য হয়ে নিছক প্রাণ বাঁচাবার জন্য কুফরী কথা মুখে উচ্চারণ করো এবং তোমাদের অন্তর কুফরী আকীদা মুক্ত থাকে তাহলে তোমাদের মাফ করে দেয়া হবে। কিন্তু যদি অন্তরে তোমরা কুফরী গ্রহণ করে নিয়ে থাকো তাহলে দুনিয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলেও আখেরাতে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে পারবে না।
এর অর্থ এ নয় যে, প্রাণ বাঁচাবার জন্য কুফরী কথা বলা বাঞ্ছনীয়। বরং এটি নিছক একটি “রুখসাত” তথা সুবিধা দান ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি অন্তরে ঈমান অক্ষুণ্ণ রেখে মানুষ বাধ্য হয়ে এ ধরনের কথা বলে তাহলে তাকে কোন জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে না। অন্যথায় ‘আযীমাত’ তথা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ঈমানের পরিচয়ই হচ্ছে এই যে, মানুষের এ রক্তমাংসের শরীরটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললেও সে যেন সত্যের বাণীরই ঘোষণা দিয়ে যেতে থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারক যুগে এ উভয় ধরনের ঘটনার নজির পাওয়া যায়। একদিকে আছেন খাব্বাব ইবনে আরত (রা.) তাঁকে জ্বলন্ত আংগারের ওপর শোয়ানো হয়। এমনকি তাঁর শরীরের চর্বি গলে পড়ার ফলে আগুন নিভে যায়। কিন্তু এরপরও তিনি দৃঢ়ভাবে ঈমানের ওপর অটল থাকেন। বিলাল হাবশীকে (রা.) লোহার বর্ম পরিয়ে দিয়ে কাঠফাটা রোধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। তারপর উত্তপ্ত বালুকা প্রান্তরে দিয়ে তার ওপর দিয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তিনি ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ শব্দ উচ্চারণ করে যেতেই থাকেন। আর একজন সাহাবী ছিলেন হাবীব ইবনে যায়েদ ইবনে আসেম (রা.)। মুসাইলামা কাযযাবের হুকুমে তাঁর শরীরের প্রত্যেকটি অংগ-প্রত্যংগ কাটা হচ্ছিল এবং সেই সাথে মুসাইলামাকে নবী বলে মেনে নেবার জন্য দাবী করা হচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যেক বারই তিনি তার নবুওয়াত দাবী মেনে নিতে অস্বীকার করছিলেন। এভাবে ক্রমাগত অংগ-প্রত্যংগ কাটা হতে হতেই তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। অন্যদিকে আছেন আম্মার (রা.), ইবনে ইয়াসির (রা.)। আম্মারের (রা.) চোখের সামনে তাঁর পিতা ও মাতাকে কঠিন শাস্তি দিয়ে দিয়ে শহীদ করা হয়। তারপর তাঁকে এমন কঠিন অসহনীয় শাস্তি দেয়া হয় যে, শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য তিনি কাফেরদের চাহিদা মত সবকিছু বলেন। এরপর তিনি কাঁদতে কাঁদতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হন এবং আরয করেনঃ
يَا رَسُولَ اللهِ مَا تُرِكتُ حَتَّى سَبَبتُكَ وَذَكَرتُ اَلِهَتَهُم بِخَيرٍ
“হে আল্লাহর রসূল! আমি আপনাকে মন্দ এবং তাদের উপাস্যদেরকে ভাল না বলা পর্যন্ত তারা আমাকে ছেড়ে দেয়নি।”
রসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, كَيفَ تَجِدُ قُلبَكَ ؟ “তোমার মনের অবস্থা কি?” জবাব দিলেন, مُطمَئِنَّا بِالِايمَانِ “ঈমানের ওপর পরিপূর্ণ নিশ্চিন্তে।” একথায় নবী ﷺ বললেনঃ اِن عَادُوا فَعُد “যদি তারা আবারো এ ধরনের জুলুম করে তাহলে তুমি তাদেরকে আবারো এসব কথা বলে দিয়ো।”
# যারা সত্যের পথ কঠিন করে দেখে ঈমান থেকে ফিরে গিয়েছিল এবং তারপর নিজেদের কাফের ও মুশরিক জাতির সাথে মিশে গিয়েছিল তাদের জন্য এ বাক্যাংশটি বলা হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*ঈমান আনার পর কুফরীর পরিণতি : এরপর আলােচ্য প্ৰসংগ পরিবর্তিত হয়ে তাদের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান জানাচ্ছে, যারা ঈমান আনার পর কুুফরী করে; এরশাদ হচ্ছে, যে ঈমান আনার পর কুফুরী করবে তাদের ওপর নেমে আসবে আল্লাহর পক্ষ থেকে মারাত্মক গযব, তবে কাউকে যদি ঈমান আনার কারণে কষ্ট দেয়া হয় এবং কষ্ট সহ্য করতে না পেরে যদি সে কুফুরী কথা উচ্চারণ করে বা কোনাে কুফুরী কাজ করতে বাধ্য হয়, অথচ অন্তর তার সত্য বিশ্বাসে পরিপূর্ণ-ও ঈমানী শক্তিতে পরিতৃপ্ত তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যে তার অন্তরকে কুফরীর জন্যে উন্মুক্ত করে রাখে, অন্তরে কুফরীর আগ্রহ থাকে, তাদের ওপর আল্লাহর গযব। তাদের জন্যেই রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। ঈমান আনার কারণে প্রথম দিককার মুসলমানরা বহু কষ্ট পেয়েছেন। আল্লাহর একত্বের প্রতি সাক্ষ্য দেয়ার নিয়ম ছাড়া, এতাে কষ্ট করে ঈমানের পথে টিকে থাকা তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিলাে না। আখেরাতের জীবনকে যারা গুরুত্ব দিয়েছে, তারা এ জীবনে শত কষ্ট সহ্য করেও ঈমানের পথে দৃঢ় হয়ে থেকেছে। তারা কুফুরী ও গােমরাহীর দিকে ফিরে যাওয়ার থেকে দুনিয়ার কষ্ট পাওয়াকে শ্রেয় মনে করেছে। বর্তমান আয়াতগুলােতে জানা যাচ্ছে ঈমান আনার পর কুফুরী যিন্দেগীতে ফিরে যাওয়াটা আরও বড় অপরাধ, কারণ ঈমান যখন সে এনেছে, অবশ্য বুঝে সুঝে এবং সত্যের পরশ পেয়েই এনেছে। ঈমান আনার অর্থ বাপ-দাদার প্রচলিত ব্যবস্থাকে ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর মােহব্বতে ও সত্যকে চিনতে পারার কারনেই ঈমান আনা, এরপর কুফুরীর পথে ফিরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনটাকেই বড় মনে করা এবং আখেরাতের অনন্ত শান্তিপূর্ণ যিন্দেগীর তুলনায় দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী যিন্দেগীর আরাম-আয়েশকে প্রাধান্য দান-এইভাবে ঈমান আনার পর কুফুরী করে, নিজেদেরকে আল্লাহর আক্রোশের দিকে নিক্ষেপ করা হয়, এগিয়ে দেয়া হয় নিজেদেরকে চিরন্তন ও মহা আযাবের দিকে এবং হারাম করে নেয়া হয় নিজেদের ওপর হেদায়াতকে। এ নশ্বর দুনিয়ার জীবনের জন্যে নিজেদের সােপর্দ করা হয় এবং কান-চোখ ও অন্তরের ওপর কালিমা লেপে দেয়া হয়। এমন ব্যক্তিদের জন্যে অবশ্যই আখেরাতের শান্তির ফয়সালা হয়ে আছে এবং তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একথা চূড়ান্তভাবে সত্য যে, যখন কোনাে অন্তর আল্লাহর ওপর ঈমান আনে তখন তার ওপর এ জগতের কোনাে কিছুর প্রভাব পড়া না জায়েয হয়ে যায়। অবশ্যই পৃথিবীর জীবনের একটা মূল্য আছে, তেমনি মুল্য আছে আখেরাতের যিন্দেগীর। এই উভয় জীবনের মূল্য একটা আর একটার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না; অর্থাৎ যে যেটাকে প্রাধান্য দেয়, তাকে সেটা নিয়েই থাকতে হয়। দুনিয়ার জীবনকে যে মূখ্য মনে করে তার জন্যে আখেরাতে কিছুই থাকে না। আখেরাতকে যে মূখ্য বানায়, দুনিয়ায় তাকে অবশ্যই কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, জীবন হয়ে যায় তার জন্যে অনেক সময় কষ্টকর, কিন্তু দুনিয়ার জীবনে সে একবারে কিছু পায় না এটা ঠিক নয়। (এ বিষয়ে সূরায়ে শূরা-তে বলা হয়েছে, ‘যে প্রধানত আখেরাতের ফসল চায়, আমি মহান আল্লাহ তার ফসলকে আরও বাড়িয়ে দেব, আর যে প্রধানত দুনিয়ার ফসল চায় আমি তাকে এর থেকে কিছু দেব; কিন্তু আখেরাতে তার জন্যে কোনাে অংশই থাকবে না)।’ আকীদা কোনাে খেলার বস্তু নয়, নয় এটা কোনাে তুচ্ছ সওদা-যে ইচ্ছা হল গ্রহণ করলাম, আর ইচ্ছা হল ত্যাগ করলাম-এই গ্রহণ বর্জনের সাধারণ নিয়ম ও সাধারণ চিন্তা থেকে এ বিষয়টি আরও বহু বহু উর্ধের মর্যাদা পাওয়ার দাবীদার। এই কারণেই এ বিষয়ে সঠিক ফয়সালা নিতে না পারার অপরাধ বড়, তেমনি এর শাস্তিও অত্যন্ত কঠিন বর্ণিত বিধানের আওতা থেকে কেবল তাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে যাদেরকে কুফুরী কালাম মুখে উচ্চারণ করতে বাধ্য করা হলেও তাদের অস্তর কখনও তাতে সায় দেয় না, বরং তাদের মন আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাসের ওপরই অটল থাকে। ধ্বংস বা মৃত্যুর হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কখনও মৌখিকভাবে আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করলেও তাদের মন কিন্তু ঈমানের ওপরই অবিচল থাকে এবং সন্তুষ্ট থাকে। আলােচ্য আয়াতটি বিশিষ্ট সাহাবী আম্মার ইবনে ইয়াসিরের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। *ঈমান রক্ষায় সাহাবায়ে কেরামদের আত্মত্যাগ : ইবনে জারীর নিজস্ব সূত্রের বরাত দিয়ে আবু উবাইদা মােহাম্মদ বিন আম্মার বিন ইয়াসির থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, একবার মােশরেকরা আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে পাকড়াও করে নিয়ে গিয়ে তার ওপর কঠিন নির্যাতন চালাতে থাকলে এক পর্যায়ে এসে আম্মার ইবনে ইয়াসির ওই মােশরেকদের কথা মতাে কাজ করতে রাযী হয়ে যান। তিনি ঘটনাটি রসূল(স.)-কে জানান। রাসূল(স.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার মনের অবস্থা কী?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘ঈমানের ওপর অটল আছে’ এর পর রসূল(স.) তাকে বললেন, ‘তারা যদি পুনরায় তােমার ওপর আক্রমণ করে তাহলে তুমি তাদের কথা মতাে কাজ করবে।’ অর্থাৎ এ ধরনের পরিস্থিতিতে কুফুরী কালাম মৌখিকভাবে উচ্চারণ করার অনুমতি আছে। কিন্তু অনেক মােমেন বান্দা এমনও আছে যারা জীবন দিতে রাযী, কিন্তু কখনও কুফুরী কালাম মুখে আনতে রাযী নয়। এর নযীর বিশিষ্ট মহিলা সাহাবী হযরত সুমাইয়া। তাকে তার লজ্জাস্থানে বর্ষার আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তবুও তিনি আল্লাহর সাথে কুফরী করতে রাজি হননি। ঠিক এরূপ ঘটনাই বিশিষ্ট সাহাবী ইয়াসির(রা.)-এর সাথেও ঘটেছে। হযরত বেলাল(রা.)-এর নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা সকলেরই জানা আছে। তাকে উত্তপ্ত বালুর ওপর ফেলে রেখে তার বুকের ওপর বড় বড় পাথর চাপা দেয়া হতাে এবং তাকে আল্লাহর সাথে শিরক করতে বলা হতাে। কিন্তু তিনি মােশরেকদের নির্দেশ অমান্য করে বলতে থাকতেন, “আহাদ, আহাদ” অর্থাৎ লা শরীক আল্লাহ, লা শরীক আল্লাহ। তিনি আরও বলছেন, ‘তােমাদের মনে হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার মতাে এর চেয়েও যদি মারাত্মক কোনাে শব্দ আমার জানা থাকতাে সেটাও আমি এই মুহূর্তে উচ্চারণ করতাম।’ হযরত হুবায়র ইবনে যায়েদ আল আনসারীর সাথেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিলাে। ভন্ড নবী মুসায়লামা আল কাযযাব তাকে বলেছিলাে, মােহাম্মদ আল্লাহর রসূল-এ কথা কি তুমি বিশ্বাস করো? তিনি বললেন, হাঁ। তারপর সে পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি যে, আল্লাহর রসূল এ কথা কি তুমি বিশ্বাস করাে? উত্তরে তিনি বললেন, আমি শুনতে পাচ্ছি না। এই কথা শুনার পর ওই ভণ্ড ও মিথ্যুক তাকে টুকরাে টুকরাে করে কেটে ফেললো। কিন্তু তা সত্তেও তিনি ওকে নবী বলে স্বীকার করেননি। বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ ইবনে আসাকের হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হােযায়ফা আস-সাহমী(রা.)-এর জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনা প্রসংগে লিখেছেন যে, এক বার তাকে রােমান সৈন্যরা পাকড়াও করে তাদের বাদশার কাছে উপস্থিত করলাে। বাদশা তাকে বললাে, তুমি যদি খৃষ্টান হয়ে যাও তাহলে তােমাকে আমি আমার রাজত্বে অংশীদার করবাে এবং আমার কন্যাকে তােমার সাথে বিবাহ দিয়ে দেবাে। তিনি উত্তরে বললেন, তুমি যদি তােমার গােটা রাজত্ব, এমন কি গােটা আরববাসীদের সম্পদও দান করাে এবং বিনিময়ে আমাকে ক্ষণিকের জন্যে মােহাম্মদ(স.)-এর ধর্ম থেকে সরে আসতে বলো, তাহলে আমি এমন কাজ কখনও করবাে না। এর পর বাদশা তাকে বললাে, তাহলে তাে আমি তােমাকে হত্যা করবাে। উত্তরে তিনি বললেন, সেটা তােমার ইচ্ছা। এ কথা শুনে অত্যাচারী বাদশাহ তাকে শূলীতে উঠানাের নির্দেশ দিলাে এবং কাছে থেকে তার হাতে ও পায়ে তীরের আঘাত করতে বললাে। যখন তাকে তীরের আঘাত করা হচ্ছিলাে তখনও তিনি খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করছিলেন। এর পর তাকে শূলী থেকে নিচে নামিয়ে তার সামনে একটি ডেকচী, অন্য বর্ণনায় পিতলের একটি গাভী, রাখা হলাে এবং সেটাতে আগুন রেখে উত্তপ্ত করা হলাে। মুসলমান কয়েদীদেরকে একজন একজন করে তাঁর চোখের সামনেই নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। উত্তপ্ত লােহার তাপে তাদের দেহ জ্বলন্ত হাড়ে রূপান্তরিত হচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে পুনরায় একই প্রস্তাব করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন। এর পর তাকে ওই উত্তপ্ত ডেকচীতে ফেলে দিতে নির্দেশ দেয়া হলাে। যখন তাকে ডেকচীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলাে তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। বাদশা মনে মনে ভাবলাে এই বার বুঝি কাজ হবে। তাই তাকে কাছে ডাকলাে। তিনি বাদশাহকে বললেন, আমি কাঁদছি এ জন্যে যে, আমার মাত্র একটাই প্রাণ। আর একটা প্রাণই ঘন্টা খানেকের জন্যে আল্লাহর জন্যে শাস্তি ভােগ করবে। আমার ইচ্ছা হয় যদি আমার দেহের প্রতিটি লােমে একটি করে প্রাণ থাকতাে এবং এই সব কটি আল্লাহর জন্যে শাস্তি ভােগ করতাে। অন্য বর্ণনা অনুযায়ী উক্ত সাহাবীকে জেলে আটক করে তাকে কয়েক দিন পর্যন্ত অভুক্ত রাখা হয়েছিলাে। এরপর তাঁর কাছে মদ ও শুকরের মাংস পাঠানাে হলাে। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে দিলেন। এরপর তাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করা হলাে, তুমি খাচ্ছাে না কেন? তিনি উত্তরে বললেন, প্রাণ রক্ষার জন্যে ওগুলাে খাওয়া আমার জন্যে বৈধ ছিলাে। কিন্তু আমি চাই না যে, এর ফলে আমার প্রতি করুণা প্রদর্শনের একটা সুযােগ আপনার ঘটুক। বাদশা তাকে বললাে, ঠিক আছে তুমি আমার মাথায় চুমাে খাও, তাহলে তােমাকে আমি ছেড়ে দেবাে। তিনি বললেন, আমি চুমু খাবাে যদি আমার সাথে সাথে সকল মুসলমান বন্দীদেরকে আপনি ছেড়ে দেন। বাদশাহ বললাে, ঠিক আছে। তিনি তার মাথায় চুমু খেলেন। ফলে বাদশা তাকে এবং তার সাথে সাথে অন্যান্য সকল বন্দীদেরকেও মুক্ত করে দিলাে। তিনি যখন ফিরে আসলেন তখন আমীরুল মােমেনীন হযরত ওমর(রা.) বললেন, আবদুল্লাহ ইবনে হােযাইফার মাথায় চুমু খাওয়া প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে উচিত। আমিই এ কাজটি প্রথমে করছি। এরপর তিনি নিজের আসন থেকে উঠে গিয়ে তার মাথায় চুমু খেলেন। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার। এখানে আপােষের কোনাে সুযােগ নেই, শৈথিল্যের কোনাে সুযােগ নেই। এই আকীদা-বিশ্বাসকে রক্ষা করতে গিয়ে চড়া মূল্য দিতে হয়। তা সত্তেও মােমেনের এর স্থান অনেক বড়, আল্লাহর কাছেও এর প্রতিদান অনেক বড়, এই আকীদা-বিশ্বাস হচ্ছে একটা পবিত্র আমানত। এই আমানত কেবল সেই মহাপ্রাণ ব্যক্তিরাই রক্ষা করতে পারে যারা জীবন উৎসর্গ করতে রাযী, যাদের কাছে ওই আমানতের তুলনায় তাদের জীবন-যৌবন ও আরাম-আয়েশের সকল সামগ্রীই তুচ্ছ এবং নগণ্য।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১০৪-১০৯ নং আয়াতের তাফসীর
# আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, যারা আল্লাহর যিকর হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং তাঁর কিতাবের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করে ও তাঁর কথার উপর বিশ্বাসই রাখে না, এইরূপ লোকদেরকে আল্লাহ তাআলাও দূরে নিক্ষেপ করে থাকেন। তারা সত্য দ্বীনের উপর আসার তাওফীক লাভ করে না। পরকালে তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেন যে, এই রাসূল (সঃ) আল্লাহ তাআলার উপর মিথ্যা আরোপ করতে পারেন না। এই কাজ তো হচ্ছে নিকৃষ্টতম মাখলুকের। যারা ধর্মত্যাগী ও কাফির তাদের মিথ্যা কথা লোকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হয়ে থাকে। হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) তো সমস্ত মাখলুকের মধ্যে সবচেয়ে বেশী উত্তম দ্বীনদার, খোদাভীরু এবং সত্যবাদী। তিনি সর্বাপেক্ষা বেশী জ্ঞানী, ঈমানদার এবং পূণ্যবান। সত্যবাদীতায়, কল্যাণ সাধনে, বিশ্বাসে এবং মারেফাতে তিনি অদ্বিতীয়। কাফিরদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারাও তাঁর সত্যবাদীতার কথা অকপটে স্বীকার করবে। তারা তাঁর বিশ্বস্ততার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের মধ্যেই তিনি ‘আমীন’ বা আমানতদার উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। রোমক সম্রাট হিরাক্লিয়াস যখন আবু সুফিয়ানকে (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পর্কে অনেকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন তখন একটি প্রশ্ন এটাও ছিলঃ “নুবওয়তের পূর্বে তোমরা তাঁকে কোন দিন মিথ্যা বলতে শুনেছো কি?” উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ “না, কখনো নয়। এ সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেনঃ “যে ব্যক্তি পার্থিব ব্যাপারে কখনো মিথ্যা কথা বলেন নাই, তিনি আল্লাহ তাআলার উপর কি করে মিথ্যা আরোপ করতে পারেন?”
# মহান আল্লাহ বর্ণনা করছেন যে, যারা ঈমান এবং কুফরীর জন্যে হৃদয় উন্মুক্ত রাখে, তাদের উপর আল্লাহর গজব আপতিত হবে। কারণ এই যে, ঈমানের জ্ঞান লাভ করার পর তা থেকে তারা ফিরে গেছে। আর আখেরাতে তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। কারণ, তারা আখেরাত নষ্ট করে দুনিয়ার প্রেমে পড়ে গেছে এবং ইসলামের উপর ধর্মত্যাগী হওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছে, একমাত্র দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণে।
তাদের অন্তর হিদায়াত হতে শূন্য ছিল বলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক তারা লাভ করে নি।
তাদের অন্তরে মোহর লেগে গেছে, তাই উপকারী কোন কথা তারা বুঝতে পারে না। তাদের চক্ষু ও কর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। না তারা হক দেখতে পায়, না শুনতে পায়। সুতরাং কোন জিনিসই তাদের কোন উপকার করে নাই এবং তারা নিজেদের পরিণাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন রয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, তারা নিজেদেরও ক্ষতি করছে এবং পরিবারেরও ক্ষতি করছে।
প্রথম আয়াতের মাঝে যাদেরকে স্বতন্ত্র করা হয়েছে, অর্থাৎ ওরাই, যাদের উপর জোর-জবরদস্তি করা হয়েছে, অথচ তাদের অন্তরে পূর্ণ ঈমান রয়েছে, তাদের দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা মারপিট ও অসহনীয় উৎপীড়নের কারণে বাধ্য হয়ে মৌখিক ভাবে মুশরিকদেরকে সমর্থন করে থাকে। কিন্তু তাদের অন্তর তাদেরকে মোটেই সমর্থন করে না। বরং অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সঃ) প্রতি পূর্ণ ঈমান বিদ্যমান থাকে।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি হযরত আম্মার ইবনু ইয়াসিরের (রাঃ) ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ঘটনা এই যে, মুশরিকরা তাঁকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকে, যে পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহকে (সঃ) অস্বীকার করেন। তখন তিনি অত্যন্ত নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে তাদেরকে সমর্থন করেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট গমন করে ওজর পেশ করেন। এ সময় আল্লাহ তাআলার এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। শাবী (রঃ) কাতাদা (রঃ) এবং আবু মালিকও এ কথাই বলেন।
তাফসীরে ইবনু জারীরে রয়েছে যে, মুশরিকরা হযরত আম্মার ইবনু ইয়াসিরকে (রাঃ) ধরে ফেলে। অতঃপর তারা তাঁকে কষ্ট দিতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের কথাকে সমর্থন করে নেন। তারপর তিনি রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট এসে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার অন্তরকে তুমি কিরূপ পাচ্ছ?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “অন্তর তো ঈমানে পরিপূর্ণ রয়েছে। তিনি তখন বলেনঃ “তারা যদি তাদের কাজের পুনরাবৃত্তি করে তবে তুমিও তোমার একথার পুনরাবৃত্তি করবে।”
ইমাম বায়হাকী (রঃ) এ ঘটনাটিকে আরো বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত আম্মার তাদের সামনে নবীকে (সঃ) গালমন্দ দেন এবং তাদের মা’বুদ সম্পর্কে ভাল মন্তব্য করেন। অতঃপর তিনি নবীর (সঃ) কাছে নিজের দুঃখের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি মুশরিকদের সামনে আপনাকে গাল-মন্দ দেয়া এবং তাদের মা’বৃদের সুনাম করার পূর্ব পর্যন্ত তারা আমাকে শাস্তি দেয়া হতে রেহাই দেয় নাই।” তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার অন্তরকে তুমি কেমন পাচ্ছ।” উত্তরে তিনি বললেনঃ “আমার অন্তরকে আমি ঈমানে অবিচলিত পেয়েছি।” তাঁর একথা শুনে তিনি তাঁকে বললেনঃ “তারা যদি পুনরায় তোমার সাথে এরূপ ব্যবহার করে, তবে তুমিও আবার এই ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে।” এ ব্যাপারেই এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
উলামায়ে কিরাম এ বিষয়ে একমত যে, যার উপর জোর-যবরদস্তি করাহবে, প্রাণ বাঁচানোর জন্যে কাফিরদের পক্ষ সমর্থন করা তার জন্যে জায়েয। আবার এরূপ পরিস্থিতিতেও তাদের কথা অমান্য করা জায়েয। যেমন হযরত বিলাল (রাঃ) এরূপ করে দেখিয়েছেন। তিনি কোন অবস্থাতেই মুশরিকদের কথা মান্য করেন নাই। এমনকি কঠিন গরমের দিনে প্রখর রৌদ্রের সময় তারা তাকে মাটির উপর শুয়ে যেতে বাধ্য করেছিল এবং ঐ অবস্থায় তার বক্ষের উপর একটা ভারী ওজনের পাথর চাপিয়ে দিয়েছিল এবং বলেছিলঃ “এখনও যদি তুমি শিরক কর তবে তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে।” কিন্তু তখনও তিনি পরিষ্কার ভাষায় তাদের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ‘আহাদ’ ‘আহাদ’(একক, একক) বলে আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি ঐ অবস্থাতেও তাদেরকে বলেছিলেনঃ “দেখো, তোমাদের ক্রোধ উদ্রেককারী এর চেয়ে বড় কথা যদি আমার জানা থাকতো তবে আল্লাহর কসম! আমি ঐ কথাই বলতাম।” আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং চিরদিনের জন্যে তাকেও সন্তুষ্ট রাখুন।
অনুরূপভাবে হযরত খুবাইব ইবনু যায়েদ আনসারী (রাঃ) -এরও ঘটনা রয়েছে যে, যখন মুসাইলামা কায্যাব তাকে জিজ্ঞেস করেঃ “তুমি কি মুহাম্মদের (সঃ) রিসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করছো?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হা”। সে আবার তাকে জিজ্ঞেস করেঃ “তুমি আমার রিসালাতেরও সাক্ষ্য দিচ্ছ কি?” জবাবে তিনি বলেনঃ “না, আমি তোমাকে রাসূল বলে মানি না।” তখন ঐ ভণ্ড নবী তাঁর দেহের একটি অঙ্গকে কেটে নেয়ার নির্দেশ দেয়। পুনরায় অনুরূপ প্রশ্ন ও উত্তরের আদান প্রদান হয়। তখন তার আর একটি অঙ্গ কেটে নেয়া হয়। এই অবস্থা চলতেই থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর এ কথার উপরই অটল থাকেন। আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন এবং তাঁকেও খুশী রাখুন!
হযরত ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কতকগুলি লোক মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যায়। তখন হযরত আলী (রাঃ) তাদেরকে আগুন দ্বারা জালিয়ে দেন। এ খবর হযরত ইবনু আব্বাসের (রাঃ) কানে পৌছলে তিনি বলেনঃ “আমি তো তাদেরকে আগুন দ্বারা পোড়াতাম না। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর আযাব দ্বারা তোমরা আযাব করো না।” আমি বরং তাদেরকে হত্যা করতাম। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার দ্বীন পরিবর্তন করবে তোমরা তাকে হত্যা করবে।” এ খবর হযরত আলীর (রাঃ) কাছে পৌছলে তিনি বলেনঃ “ হযরত ইবনু আব্বাসের (রাঃ) মাতার উপর আফসোস।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন । ইমাম বুখারীও (রঃ) এটা রিওয়াইয়াত করেছেন)
হযরত আবু বুরদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত মুআহ্ ইবনু জাবাল (রাঃ) হযরত আবু মূসার (রাঃ) নিকট আগমন করে দেখেন যে, তার পাশে একটি লোক অবস্থান করছে। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এটা কে?” হযরত আবু মূসা (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “এ লোকটি ইয়াহুদী ছিল। পরে মুসলমান হয়। এখন আবার ইয়াহূদী হয়ে গেছে। আমি প্রায় দু’মাস ধরে ইসলামের উপর আনার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।” তাঁর এ কথা শুনে হযরত মুআয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি এখানে বসবো না, যে পর্যন্ত না তুমি এর গর্দান উড়িয়ে দাও। যে ব্যক্তি তার দ্বীন থেকে ফিরে যায় তার ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সঃ) ফায়সালা এটাই।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এ ঘটনাটি উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু শব্দগত পার্থক্য রয়েছে)
সুতরাং উত্তম এটাই যে, মুসলমান তার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ও অটল থাকবে যদিও তাকে হত্যা করে দেয়া হয়। যেমন হাফিয ইবনু আসাকির (রঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনু হুযাফা (রাঃ) নামক একজন সাহাবীর জীবনীতে লিখেছেন যে, তাঁকে রোমক কাফিররা বন্দী করে তাদের সম্রাটের নিকট পৌছিয়ে দেয়। সম্রাট তাঁকে বলেঃ “তুমি খৃষ্টান হয়ে গেলে আমি তোমাকে আমার রাজপাটে অংশীদার করে নেবো। আমার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দেবো।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “এটা তো নগণ্য! তুমি যদি আমাকে তোমার সমস্ত রাজত্ব দিয়ে দাও এবং সারা আরবের রাজপাটও আমার হাতে সমর্পণ কর, আর চাও যে, ক্ষণিকের জন্যে আমি হযরত মুহাম্মদের (সঃ) দ্বীন হতে ফিরে যাই, তথাপিও এটা অসম্ভব।” বাদশাহ তখন বললো, “তা হলে আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলবো।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বললেনঃ “হাঁ, এটা তোমার ইচ্ছাধীন।” সুতরাং তৎক্ষণাৎ সম্রাটের নির্দেশ ক্রমে তাঁকে শূলের উপর চড়িয়ে দেয়া হলো এবং তীরন্দাযরা নিকট থেকে তীর মেরে মেরে তার হাত, পা ও দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকলো। ঐ অবস্থায় বারবার তাঁকে বলা হচ্ছিল “এখনও খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে নাও।” কিন্তু তখন তিনি পূর্ণ স্থিরতা ও ধৈর্যের সাথে বলতে ছিলেন “কখনো নয়।” তখন বাদশাহ হুকুম করলোঃ “তাকে শূলের উপর থেকে নামিয়ে নাও।” তারপর সে হুকুম করলো যে, তার কাছে যেন তামার একটা ডেগচি অথবা তামা দ্বারা নির্মিত একটি গাভী আগুন দ্বারা অত্যন্ত গরম করে পেশ করা হয়। তার এই নির্দেশ মতো তার সামনে তা পেশ করা হলো। সেই বাদশাহ তখন অন্য একজন বন্দী মুসলমানের ব্যাপারে হুকুম করলো যে, তাকে যেন ঐ ডেগচির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়। তৎক্ষণাৎ হযরত আবদুল্লাহর (রাঃ) উপস্থিতিতে তাঁর চোখের সামনে ঐ অসহায় মুসলমানটির দেহের গোশত পুড়ে ভষ্ম হয়ে গেল এবং অস্থিগুলি চমকাতে থাকলো। অতঃপর বাদশাহ হযরত আবদুল্লাহকে (রাঃ) বললোঃ “দেখো, এখনো আমার কথা মেনে নাও এবং আমার ধর্ম ককূল কর। অন্যথায় তোমাকেও এই আগুনের ডেগচিতে ফেলে দিয়ে এরই মত করে জ্বালিয়ে দেয়া হবে।” তখনো তিনি ঈমানী বলে বলিয়ান হয়ে বাদশাহকে উত্তর দিলেনঃ “আমি আল্লাহর দ্বীনকে ছেড়ে দিতে পারি না। এটা আমার দ্বারা কখনই সম্ভব নয়।” তৎক্ষণাৎ বাদশাহ হুকুম করলোঃ “তাকে চরকার উপর চড়িয়ে তাতে নিক্ষেপ কর। যখন তাঁকে ঐ আগুনের ডেগচিতে। নিক্ষপ করার জন্যে চরকার উপর উঠানো হলো তখন বাদশাহ লক্ষ্য করলো যে, তাঁর চক্ষু দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। তখনই সে তাঁকে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিলো। অতঃপর তাঁকে নিজের কাছে ডাকিয়ে নিলো। সে আশা করেছিল যে, হয়তো ঐ শাস্তি দেখে তিনি ভয় পেয়েছেন, কাজেই এখন তাঁর মত পালটে গেছে। সুতরাং তিনি এখন তার কথামতই কাজ করবেন এবং তার ধর্ম গ্রহণ করবেন। আর এরপর তার জামাতা হয়ে তার রাজত্বের অংশীদার হয়ে যাবেন। কিন্তু তার এই আশায় গুড়ে বালি পড়ে যায়। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) তাকে বলেনঃ “আমার ক্রন্দনের একমাত্র কারণ ছিল এই যে, আজ আমার একটি মাত্র প্রাণ রয়েছে যা আমি এই শাস্তির মাধ্যমে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতে যাচ্ছি। হায়! যদি আমার প্রতিটি লোমের মধ্যে একটি করে প্রাণ থাকতো তবে আজ আমি সমস্ত প্রাণকে এক এক করে এই ভাবে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করতাম।”
অন্যান্য রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহকে (রাঃ) কয়েদ খানায় রাখা হয়েছিল এবং পানাহার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কয়েকদিন পরে তাঁর কাছে মদ ও শূকরের গোশত পাঠান হয়। কিন্তু তিনি এ চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও এ খাদ্যের প্রতি ভ্রক্ষেপ মাত্র করেন নাই। বাদশাহ তাকে ডেকে পাঠিয়ে ওগুলো না খাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি উত্তরে বলেনঃ “এই অবস্থায় আমার জন্যে এই খাদ্য হালাল তো হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তোমার মত শত্রুকে আমার ব্যাপারে খুশী হওয়ার সুযোগ দিতেই চাই না।” অবশেষে বাদশাহ তাঁকে বললোঃ “আচ্ছা, তুমি যদি আমার মাথা চুম্বন কর তবে আমি তোমাকে ও তোমার সঙ্গী সমস্ত মুসলমানকে মুক্তি দিয়ে দেবো।” হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) এটা কবুল করে নেন এবং তার মাথা চুম্বন করেন। সম্রাটও তার ওয়াদা পালন করে এবং তাঁকে ও তার সাথের সমস্ত মুসলমানকে ছেড়ে দেয়। যখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনু হুযাফা’ (রাঃ) এখান থেকে মুক্তি পেয়ে হযরত উমর ফারুকের (রাঃ) নিকট উপস্থিত হন তখন তিনি বলেনঃ “প্রত্যেক মুসলমানের উপর হক রয়েছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু হুযাফার (রাঃ) চুম্বন করা এবং আমিই প্রথম এর সূচনা করছি।” একথা বলে হযরত উমার ফারুক (রাঃ) সর্বপ্রথম তার মস্তক চুম্বন করেন।
(Book# 824)
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- An-Nahl
Sura: 16
Verses :- 104-109
[ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۰۵﴾
Tt is those who are the liars.]
www.motaher21.net
اِنَّ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ۙ لَا یَہۡدِیۡہِمُ اللّٰہُ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱۰۴﴾
Indeed, those who do not believe in the verses of Allah – Allah will not guide them, and for them is a painful punishment.
اِنَّمَا یَفۡتَرِی الۡکَذِبَ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۰۵﴾
They only invent falsehood who do not believe in the verses of Allah, and it is those who are the liars.
مَنۡ کَفَرَ بِاللّٰہِ مِنۡۢ بَعۡدِ اِیۡمَانِہٖۤ اِلَّا مَنۡ اُکۡرِہَ وَ قَلۡبُہٗ مُطۡمَئِنٌّۢ بِالۡاِیۡمَانِ وَ لٰکِنۡ مَّنۡ شَرَحَ بِالۡکُفۡرِ صَدۡرًا فَعَلَیۡہِمۡ غَضَبٌ مِّنَ اللّٰہِ ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۰۶﴾
Whoever disbelieves in Allah after his belief… except for one who is forced [to renounce his religion] while his heart is secure in faith. But those who [willingly] open their breasts to disbelief, upon them is wrath from Allah, and for them is a great punishment;
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمُ اسۡتَحَبُّوا الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا عَلَی الۡاٰخِرَۃِ ۙ وَ اَنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۱۰۷﴾
That is because they preferred the worldly life over the Hereafter and that Allah does not guide the disbelieving people.
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ طَبَعَ اللّٰہُ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ وَ سَمۡعِہِمۡ وَ اَبۡصَارِہِمۡ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ ﴿۱۰۸﴾
Those are the ones over whose hearts and hearing and vision Allah has sealed, and it is those who are the heedless.
لَاجَرَمَ اَنَّہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۱۰۹﴾
Assuredly, it is they, in the Hereafter, who will be the losers.
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- An-Nahl
Sura: 16
Verses :- 104-109
[ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۰۵﴾
Tt is those who are the liars.]
www.motaher21.net
Allah says:
إِنَّ الَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ بِأيَاتِ اللّهِ لَا يَهْدِيهِمُ اللّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
Verily, those who do not believe in Allah’s Ayat (signs, or revelation), Allah will not guide them, and theirs will be a painful punishment.
Allah tells that He does not guide those who turn away from remembering Him and who are heedless of that which He revealed to His Messenger, those who have no intention of believing in that which he has brought from Allah. This kind of people will never be guided to faith by the signs of Allah and the Message which He sent His Messengers in this world, and they will suffer a painful and severe punishment in the Hereafter.
إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ بِأيَاتِ اللّهِ وَأُوْلـيِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ
It is only those who do not believe in Allah’s Ayat who fabricate the falsehood, and it is they who are liars.
Then Allah informs that His Messenger is not a forger nor a liar, because the one who fabricates falsehood about Allah and His Messenger is the most evil of creatures.
الَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ بِأيَاتِ اللّهِ
Verily, those who do not believe in Allah’s Ayat,
Allah will not guide them, and theirs will be a painful punishment, meaning, the disbelievers and heretics who are known to the people as liars.
The Messenger Muhammad, on the other hand, was the most honest and righteous of people, the most perfect in knowledge, deeds, faith and conviction. He was known among his people for his truthfulness and no one among them had any doubts about that – to such an extent that they always addressed him as Al-Amin (the Trustworthy) Muhammad.
Thus when Heraclius, the king of the Romans, asked Abu Sufyan about the attributes of the Messenger of Allah, one of the things he said to him was, “Did you ever accuse him of lying before he made his claim?”
Abu Sufyan said, “No”.
Heraclius said,
“He would refrain from lying about people and then go and fabricate lies about Allah.
Allah’s Wrath against the Apostate, except for the One Who is forced into Disbelief
Allah says:
مَن كَفَرَ بِاللّهِ مِن بَعْدِ إيمَانِهِ إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَيِنٌّ بِالاِيمَانِ وَلَـكِن مَّن شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِّنَ اللّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
Whoever disbelieves in Allah after his belief – except one who was forced while his heart is at peace with the faith – but whoever opens their breasts to disbelief, on them is wrath from Allah, and theirs will be a terrible torment.
Allah tells that He is angry with them who willingly disbelieve in Him after clearly believing in Him, who open their hearts to disbelief finding peace in that, because they understood the faith yet they still turned away from it.
ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّواْ الْحَيَاةَ الْدُّنْيَا عَلَى الاخِرَةِ وَأَنَّ اللّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
That is because they preferred the life of this world over that of the Hereafter. And Allah does not guide the people who disbelieve.
They will suffer severe punishment in the Hereafter, because they preferred this life to the Hereafter, and they left the faith for the sake of this world and Allah did not guide their hearts and help them to stand firm in the true religion.
أُولَـيِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ وَأُولَـيِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ
They are those upon whose hearts, hearing (ears) and sight (eyes) Allah has set a seal over. And they are the heedless!
He put a seal on their hearts so that they would not be able to understand what is beneficial for them, and He sealed their ears and eyes so that they would not benefit from them. Their faculties did not help them at all, so they are unaware of what is going to happen to them.
لَا جَرَمَ
No doubt,
means, it is inevitable, and no wonder that those who are like this –
أَنَّهُمْ فِي الاخِرَةِ هُمُ الْخَاسِرونَ
in the Hereafter, they will be the losers.
meaning, they will lose themselves and their families on the Day of Resurrection.
إِلاَّ مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَيِنٌّ بِالاِيمَانِ
except one who was forced while his heart is at peace with the faith,
This is an exception in the case of one who utters statements of disbelief and verbally agrees with the Mushrikin because he is forced to do so by the beatings and abuse to which he is subjected, but his heart refuses to accept what he is saying, and he is, in reality, at peace with his faith in Allah and His Messenger.
The scholars agreed that if a person is forced into disbelief, it is permissible for him to either go along with them in the interests of self-preservation, or to refuse, as Bilal did when they were inflicting all sorts of torture on him, even placing a huge rock on his chest in the intense heat and telling him to admit others as partners with Allah.
He refused, saying, “Alone, Alone.”
And he said, “By Allah, if I knew any word more annoying to you than this, I would say it.”
May Allah be pleased with him.
Similarly, when the Liar Musaylimah asked Habib bin Zayd Al-Ansari, “Do you bear witness that Muhammad is the Messenger of Allah!”
He said, “Yes.”
Then Musaylimah asked, “Do you bear witness that I am the messenger of Allah!”
Habib said, “I do not hear you.”
Musaylimah kept cutting him, piece by piece, but he remained steadfast insisting on his words.
It is better and preferable for the Muslim to remain steadfast in his religion, even if that leads to him being killed, as was mentioned by Al-Hafiz Ibn Asakir in his biography of Abdullah bin Hudhafah Al-Sahmi, one of the Companions. He said that;
he was taken prisoner by the Romans, who brought him to their king. The king said, “Become a Christian, and I will give you a share of my kingdom and my daughter in marriage.”
Abdullah said:”If you were to give me all that you possess and all that Arabs possess to make me give up the religion of Muhammad even for an instant, I would not do it.”
The king said, “Then I will kill you.”
Abdullah said, “It is up to you.”
The king gave orders that he should be crucified, and commanded his archers to shoot near his hands and feet while ordering him to become a Christian, but he still refused. Then the king gave orders that he should be brought down, and that a big vessel made of copper be brought and heated up. Then, while Abdullah was watching, one of the Muslim prisoners was brought out and thrown into it, until all that was left of him was scorched bones.
The king ordered him to become a Christian, but he still refused. Then he ordered that Abdullah be thrown into the vessel, and he was brought back to the pulley to be thrown in.
Abdullah wept, and the king hoped that he would respond to him, so he called him, but Abdullah said,
“I only weep because I have only one soul with which to be thrown into this vessel at this moment for the sake of Allah; I wish that I had as many souls as there are hairs on my body with which I could undergo this torture for the sake of Allah.”
According to some reports, the king imprisoned him and deprived him of food and drink for several days, then he sent him wine and pork, and he did not come near them. Then the king called him and asked him, “What stopped you from eating”
Abdullah said,
“It is permissible for me (under these circumstances), but I did not want to give you the opportunity to gloat.”
The king said to him, “Kiss my head and I will let you go.”
Abdullah said, “And will you release all the Muslim prisoners with me!”
The king said, “Yes.”
So Abdullah kissed his head and he released him and all the other Muslim prisoners he was holding.
When he came back, Umar bin Al-Khattab said,
“Every Muslim should kiss the head of Abdullah bin Hudhafah, and I will be the first to do so.”
And he stood up and kissed his head. May Allah be pleased with them both.