(বই#৮৪৪) [তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন =:-৭ وَ لَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না;] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৪৪) [তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন =:-৭
وَ لَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ
আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না;]
www.motaher21.net
وَ لَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ وَ مَنۡ قُتِلَ مَظۡلُوۡمًا فَقَدۡ جَعَلۡنَا لِوَلِیِّہٖ سُلۡطٰنًا فَلَا یُسۡرِفۡ فِّی الۡقَتۡلِ ؕ اِنَّہٗ کَانَ مَنۡصُوۡرًا ﴿۳۳﴾
আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না; কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি। সুতরাং হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে; নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।

৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-
#“যাকে হত্যা” মানে কেবলমাত্রে অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করাই নয়, নিজেকে হত্যা করাও এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ মানুষকে মহান আল্লাহ মর্যাদা সম্পন্ন করেছেন। অন্যের প্রাণের সাথে সাথে মানুষের নিজের প্রাণও এ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। কাজেই মানুষ হত্যা যত বড় গুনাহ ও অপরাধ, আত্মহত্যা করাও ঠিক তত বড় অপরাধ ও গুনাহ। মানুষ নিজেকে নিজের প্রাণের মালিক এবং এ মালিকানাকে নিজ ক্ষমতায় খতম করে দেবার অধিকার রাখে বলে মনে করে, এটা তার একটা বিরাট ভুল ধারণা। অথচ তার এ প্রাণ আল্লাহর মালিকানাধীন এবং সে একে খতম করে দেয়া তো দূরের কথা একে কোন অনুপযোগী কাজে ব্যবহার করার অধিকারও রাখে না। দুনিয়ার এ পরীক্ষাগৃহে আল্লাহ যেভাবেই আমাদের পরীক্ষা নেন না কেন, পরীক্ষার অবস্থা ভাল হোক বা মন্দ হোক, সেভাবেই শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের পরীক্ষা দিতে থাকা উচিত। আল্লাহর দেয়া সময়কে ইচ্ছা করে খতম করে দিয়ে পরীক্ষাগৃহ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার এ পালিয়ে যাবার কাজটিও এমন এক অপরাধের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাকে আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় হারাম গণ্য করেছেন, এটা তো কোনক্রমেই গ্রহণীয় হতে পারে না। অন্য কথায় বলা যায়, দুনিয়ার ছোট ছোট কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মানুষ বৃহত্তর ও চিরন্তন কষ্ট ও লাঞ্ছনার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।

# পরবর্তীকালে ইসলামী আইন ‘সত্য সহকারে হত্যা’ কে শুধুমাত্র পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এক, জেনে বুঝে হত্যাকারী থেকে কিসাস নেয়া। দুই, আল্লাহর সত্যদ্বীনের পথে বাধাদানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। তিন, ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করার প্রচেষ্টাকারীদের শাস্তি দেয়া, চার, বিবাহিত পুরুষ ও নারীকে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার শাস্তি দেয়া। পাঁচ, মুরতাদকে শাস্তি দেয়া। শুধুমাত্র এ পাঁচটি ক্ষেত্রে মানুষের প্রাণের মর্যাদা তিরোহিত হয় এবং তাকে হত্যা করা বৈধ গণ্য হয়।

# মূল শব্দ হচ্ছে, “তার অভিভাবককে আমি সুলতান দান করেছি।” এখানে সুলতান অর্থ হচ্ছে “প্রমাণ” যার ভিত্তিতে সে কিসাস দাবী করতে পারে। এ থেকে ইসলামী আ‌ইনের এ মূলনীতি বের হয় যে, হত্যা মোকদ্দমার আসল বাদী সরকার নয়। বরং নিহত ব্যক্তির অভিভাবকগণই এর মূল বাদীপক্ষ। তারা হত্যাকারীকে মাফ করে দিতে এবং কিসাসের পরিবর্তে রক্তপণ গ্রহণ করতে সম্মত হতে পারে।

# হত্যার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে সীমা অতিক্রম করা যেতে পারে। এগুলো সবই নিষিদ্ধ। যেমন প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে উন্মত্তের মতো অপরাধী ছাড়া অন্যদেরকেও হত্যা করা। অথবা অপরাধীকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা। কিংবা মেরে ফেলার পর তার লাশের ওপর মনের ঝাল মেটানো। অথবা রক্তপণ নেবার পর আবার তাকে হত্যা করা ইত্যাদি।

# যেহেতু সে সময় পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই কে তাকে সাহায্য করবে, একথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। পরে যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন ফায়সালা করে দেয়া হয় যে, তাকে সাহায্য করা তার গোত্র বা সহযোগী বন্ধু দলের কাজ নয় বরং এটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র এবং তার বিচার ব্যবস্থার কাজ। কোন ব্যক্তি বা দল নিজস্বভাবে হত্যার প্রতিশোধ নেবার অধিকার রাখে না। বরং এটা ইসলামী সরকারের দায়িত্ব। ন্যায় বিচার লাভ করার জন্য তার কাছে সাহায্য চাওয়া হবে।

 

 

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
#.   *জীবনের নিরাপত্তাদানে ইসলাম : সন্তান হত্যার নিষেধাজ্ঞা ও ব্যাভিচারের নিষেধাজ্ঞার পর সে নরহত্যার নিষেধাজ্ঞা উচ্চারণ সংগত কারণ ব্যতীত আল্লাহর নিষিদ্ধকৃত প্রাণ বধ করাে না। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়, তার অভিভাবককে আমি ক্ষমতা দিয়েছি। সুতরাং সে যেন হত্যার প্রতিশােধ নেয়ার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে। তাকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে।’ ইসলাম হচ্ছে বেঁচে থাকার বিধান এবং শান্তির বিধান। সুতরাং তার কাছে নরহত্যা আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করার পর সবচাইতে বড় গুনাহ। জীবনদাতা হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে অধিকার নেই যে, তার অনুমতি ছাড়া এবং তারই নির্ধারিত সীমার মধ্যে ছাড়া কারাে প্রাণ সংহার করে। প্রত্যেক প্রাণই পবিত্র। তাকে সংগত কারণ ছাড়া স্পর্শ করা যাবে এবং বৈধ উপায় ছাড়া হত্যা করা যাবে না। আর এই বৈধ ও সংগত সীমার কোনাে অস্বচ্ছতা নেই, বরং তা হচ্ছে সুস্পষ্ট। এটা কারাে খেয়ালখুশী বা মনগড়া মতামতের ওপর ন্যস্ত করে রাখা হয়নি। রসূল(স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই এবং মােহাম্মদ আল্লাহর রসূল-এই মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছে এমন কোনাে মুসলমানকে হত্যা করা তিনটি ক্ষেত্রে ছাড়া বৈধ হবে । যদি সে কাউকে হত্যা করে থাকে তবে তার বদলা হিসাবে, যদি সে বিবাহিত হয়েও ব্যাভিচার করে এবং যদি সে ইসলাম ত্যাগ করে ও মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। (বােখারী ও মুসলিম)।  *কেসাস ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে : এর মধ্যে প্রথমটা হলাে কিসাস যা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এবং সমগ্র মানবজাতির প্রাণের নিরাপত্তা দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কিসাসে তােমাদের জীবন রয়েছে।'(আল-বাকারা) যারা অন্যদের ওপর আগ্রাসন চালাতে ইচ্ছুক, তাদের হাতকে এটা থামিয়ে দেয়। কেননা তারা জানে যে, কিসাস তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। তাই এ জঘন্য অপরাধে অগ্রসর হবার আগেই কিসাস-ভীতি তাদের ইচ্ছাকে দমন করে। অনুরূপভাবে, এটা নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী ও অভিভাবকদের বাড়াবাড়ি থেকেও খুনীর নিরাপরাধ আত্মীয়দেরকে রক্ষা করে। প্রতিশােধের মাত্রাতিরিক্ত আক্রোশে অধীর হয়ে যখন তারা হত্যাকারীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকতে চায় না, বরং অধিকতর প্রাণ নাশ করতে চায়। যেন বদলার পর বদলা এবং রক্তের হােলিখেলা চলতেই থাকে-এমতাবস্থায় কিসাসের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা খুনীর পরিবার ও আত্মীয়দের জীবনের নিরাপত্তা দেয়। কসাস ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকে। ফলে সবাই নিশ্চিন্তে চলাফেরা করে কাজ করে, উৎপাদনের চাকা সচল রাখে! এভাবে গােটা জাতির জীবনে অব্যাহত থাকে শান্তি ও প্রাণচাঞ্চল্য। দ্বিতীয়টা হলাে অশ্লীলতার বিস্তার ঘটার মাধ্যমে যে সর্বনাশা বিপর্যয় ও নৈরাজ্য দেখা দেয়, তার বিরুদ্ধে সফল প্রতিরােধ। আমি আগেই ব্যাখ্যা করে এসেছি যে, অশ্লীলতাও এক ধরনের হত্যাকান্ড। তৃতীয়টা হলাে আধ্যাত্মিক বিপর্যয় ও বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ, যা মুসলিম সমাজে নৈরাজ্য ছড়ায় এবং তার শাস্তি ও শৃংখলাকে হুমকির মুখে নিক্ষেপ করে। ইসলাম ত্যাগকারীকে হত্যা করা হবে এ জন্যে যে, সে ইসলামকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলাে, কেউ তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। সে মুসলমানদের সমাজদেহে লীন হয়ে গিয়েছিলাে এবং তার যাবতীয় গােপন তথ্য জেনে ফেলেছিলাে। এমতাবস্থায় তার ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ও মুসলিম সমাজ থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে হুমকিস্বরূপ। সে যদি অমুসলিম থাকতাে, কেউ তাকে মুসলমান হতে বাধ্য করতাে না, বরঞ্চ সে ইহুদী বা খৃষ্টান হলে ইসলাম তার জানমাল রক্ষার দায়িত্ব নিতাে। মােশরেক হলে তাকে নিরাপত্তা দান ও নিরাপদ জায়গায় পৌছে দেয়ার দায়িত্ব নিত। ধর্ম বিরােধীদের প্রতি এর চেয়ে বেশী উদারতা আর কিছুই থাকতে পারে না। ‘সংগত কারণ ছাড়া আল্লাহর নিষিদ্ধকৃত প্রাণ বধ করাে না…'(আয়াত ৩৩) উপরােক্ত তিনটি কারণই নরহত্যাকে বৈধতা দান করে। ওই তিনটি কারণের কোনাে একটিও যেখানে উপস্থিত নেই, সেখানে হত্যাকান্ড অবৈধ, অন্যায় ও যুলুমের পর্যায়ভুক্ত। আর এরূপ অবৈধভাবে ও অত্যাচারিত হয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়, আল্লাহ তায়ালা তার অভিভাবককে হত্যাকারীর ওপর এতােটা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দান করেছেন যে, সে ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা করতে পারে। ইচ্ছা করলে তার কাছ থেকে দিয়াত তথা রক্তপণ নিয়ে ক্ষমা করে দিতে পারে, ইচ্ছা করলে তাকে দিয়াত ছাড়াও সে ক্ষমা করে দিতে পারে। এভাবে হত্যাকারীর ব্যাপারে সে ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী। কেননা হত্যাকারীর রক্ত তারই প্রাপ্য। ইসলাম একদিকে তাকে দিচ্ছে এই ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী ক্ষমতা। অপরদিকে সে তাকে প্রতিশােধের সীমা অতিক্রম থেকে নিষেধ করছে। তাকে যে প্রতিশােধ গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তার অপব্যবহার রােধ করাই ইসলামের উদ্দেশ্য। প্রতিশােধের সীমা অতিক্রম নানাভাবে করা যেতে পারে। যথা শুধু হত্যাকারীকে নয়, বরং অন্যান্য নিরীহ নিরপরাধ ব্যক্তিদেরকেও হত্যা করা। জাহেলী যুগে এভাবেই প্রতিশােধ নেয়া হতাে। হত্যাকারীর পিতা, ভাই, সন্তান ও আত্মীয় স্বজনকেও হত্যা করা হতাে। অথচ হত্যাকারীর পরিবারভুক্ত হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনাে অপরাধ থাকতাে না। অনুরূপভাবে, হত্যাকারীকে হত্যা করে তার মুখমন্ডল বিকৃত করা এবং অংগ প্রত্যংগ টুকরাে টুকরাে করাও এক ধরনের বাড়াবাড়ি। নিহত ব্যক্তির অভিভাবক বা উত্তরাধিকারীকে শুধু প্রতিশােধ গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, মুখমন্ডল বা অংগ প্রত্যংগ বিকৃত করার অধিকার দেয়া হয়নি। আল্লাহ তায়ালা এটা অপছন্দ করেন, আর রসূল(স.) এটা নিষিদ্ধ করেছেন। ‘অতএব, সে যেন হত্যার প্রতিশােধে বাড়াবাড়ি না করে। তাকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তাঁর পক্ষে ফয়সালা করবেন, শরীয়তের বিধি তাকে সমর্থন করবে এবং শাসকরাও তাকে সাহায্য করবে। এভাবে সবাই যখন তাকে সাহায্য করবে এবং তার অধিকার আদায়ে সহযােগিতা করবে তখন তার উচিত প্রতিশােধ গ্রহণে ন্যায়-পরায়ন হওয়া। খুনের বদলা গ্রহণের জন্যে অভিভাবক, আইন আদালত ও শাসককে এভাবে ক্ষমতা দিয়ে আসলে মানুষের স্বভাবসুলভ দাবী ও চাহিদা পূরণ করা হয়েছে এবং উত্তরাধিকারীর মনের আবেগ উচ্ছাসকে দমন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নচেত এই আবেগ ও উচ্ছাস হয়তাে উত্তরাধিকারীকে ক্রোধােম্মত্ত করে বাড়াবাড়ির পথে ঠেলে দিতাে। কিন্তু সে যখন উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে খুনের বদলা গ্রহণের ক্ষমতা দিয়েছেন এবং শাসক তাকে বদলা নিতে সাহায্য করে, তখন তার উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং সে ন্যায়সংগত পন্থায়ই খুনের বদলা নিয়ে ক্ষান্ত হবে। আপনজনের খুনের বদলা গ্রহণ মানুষের স্বভাবসুলভ ও মজ্জাগত চাহিদা। ইসলাম মানুষের এ চাহিদাকে অস্বীকার করে না। এ চাহিদাকে সে স্বীকার করে এবং নিরাপদ সীমার ভেতরে তা পূরণ করে। এ চাহিদাকে সে অবজ্ঞা করে না এবং খুনীকে ক্ষমা করতে বাধ্য করে না। তবে ক্ষমা করার জন্যে উপদেশ দেয়, উদ্বুদ্ধ করে এবং ক্ষমাকারীকে পুরস্কৃত করে। কিন্তু এসব কিছুই করে উত্তরাধিকারীকে খুনের বদলা নেয়ার অধিকার দেয়ার পর। উত্তরাধিকারী তাকে ক্ষমা করতে পারে, প্রতিশােধও নিতে পারে। তার যে এই উভয় ক্ষমতা রয়েছে, সেটা উপলব্ধি করার পর সে হয়তাে ক্ষমা করার দিকেই ঝুঁকতে পারে। কিন্তু তাকে যদি ক্ষমা করতে বাধ্য করা হতাে, তাহলে সে উত্তেজিত হয়ে বাড়াবাড়ির দিকে ঝুঁকতে পারতাে।

 

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
#আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করছেন ইসলামী শরীয়তের বৈধ পন্থা ব্যতীত কাউকে হত্যা করতে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করল সে সারা পৃথিবীর মানুষকে হত্যা করল। (সূরা মায়িদাহ ৫:৩২)

আর যদি মু’মিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তাহলে তার ঠিকানা জাহান্নাম। (সূরা নিসা ৪:৯৩)

কাউকে হত্যা করার বৈধ পন্থাগুলো হল হত্যার বদলে হত্যা করা, বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করলে তাকে হত্যা করা এবং কেউ ইসলাম বর্জন করে মুরতাদ হলে তাকে হত্যা করা। সেটাও রাষ্ট্রপ্রধনের দায়িত্বে। উল্লিখিত বিধি-বিধানগুলো সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ১৫১ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُوْمًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّه۪ سُلْطَانًا)

-এখানে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করছেন যে, যদি কোন ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয় তাহলে তার যে অভিভাবক রয়েছে তারা দায়িত্বশীল হবে। অর্থাৎ ইসলামী সরকারের ব্যবস্থাপনায় নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণ হত্যা করলে হত্যাকারীকে হত্যা করতে পারবে, ইচ্ছা করলে দিয়াত গ্রহণ করতে পারবে অথবা সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দিতে পারবে। তিনটি বিধানেই তাদের স্বাধীনতা রয়েছে, তবে বাড়াবাড়ি যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাড়াবাড়ি বলতে হত্যাও করবে আবার দিয়াতও নেবে, বা ক্ষমা করে আবার হত্যা করল বা কিসাস গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি যেমন

(১) একজনকে হত্যা করার ফলে দুইজন বা একের অধিক জনকে হত্যা করা, যদি তারা জড়িত না থাকে।
(২) একজনকে হত্যা করার ফলে একজনকেই হত্যা করা, কিন্তু যে হত্যা করেছে তার পরিবর্তে অন্যকে হত্যা করা।
(৩) একজনকে এবং যে হত্যা করেছে তাকেই হত্যা করা কিন্তু তার সাথে অতিরিক্ত আঘাত করা। এগুলো হল হত্যা করার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
#১)বৈধ কারণ ব্যতীত মানুষকে হত্যা করা যাবে না।
২) অন্যায়ভাবে নিহত হলে কিসাস গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে।
৩) কিসাস আদায়ের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা যাবে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# আল্লাহ তাআলা বলেন যে, শরীয়তের কোন হক ছাড়া কাউকেও হত্যা করা হারাম। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ এক হওয়া এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর রাসূল হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করেছে তাকে তিনটি কারণের কোন একটি ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয়। কারণগুলি হচ্ছেঃ হয়তো সে কাউকেও হত্যা করেছে অথবা বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যভিচার করেছে কিংবা দ্বীন হতে ফিরে গিয়ে জমাআতকে পরিত্যাগ করেছে।

সুনানে রয়েছে যে, সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহ তাআলার নিকট একজন মুমিনের হত্যা অপেক্ষা বেশী হাকা। যদি কোন লোক কারো হাতে অন্যায়ভাবে নিহত হয়, তবে আল্লাহ তাআলা তার উত্তরাধিকারীদেরকে হত্যাকারীর উপর অধিকার দান করেছেন। তার উপর কিসাস (হত্যার বিনিময়ে হত্যা) লওয়া বা রক্তপণ গ্রহণ করা অথবা সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দেয়া তাদের ইখতিয়ার রয়েছে।

একটি বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের হুকুম কে সাধারণ হিসেবে ধরে নিয়ে হযরত মুআবিয়ার (রাঃ) রাজত্বের উপর এটাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন যে, তিনি বাদশাহ হয়ে যাবেন। কেননা, হযরত উছমানের (রাঃ) ওয়ালী তিনিই ছিলেন। আর হযরত উছমান (রাঃ) শেষ পর্যায়ের জুলুমের সাথে শহীদ হয়েছিলেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) , হযরত আলীর (রাঃ) নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন যে, হযরত উছমানের (রাঃ) হত্যাকারীদের উপর যেন কিসাস নেয়া হয়। কেননা, হযরত মুআবিয়াও (রাঃ) উমাইয়া বংশীয় ছিলেন। হযরত আলী (রাঃ) এ ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা করছিলেন। এদিকে তিনি হযরত মুআবিয়ার (রাঃ) । নিকটে আবেদন করেছিলেন যে, তিনি যেন সিরিয়াকে তাঁর হাতে সমর্পণ করেন। হযরত মুআবিয়া (রাঃ) হযরত আলীকে (রাঃ) পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছিলেনঃ “যে পর্যন্ত না আপনি হযরত উছমানের (রাঃ) হত্যাকারীদেরকে আমার হাতে সমর্পণ করবেন, আমি সিরিয়াকে আপনার শাসনাধীন করবো ।” সুতরাং তিনি সমস্ত সিরিয়াবাসীসহ হযরত আলীর (রাঃ) হাতে বায়আত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী কলহ শুরু হয়ে যায় এবং হযরত মুআবিয়া (রাঃ) সিরিয়ার শাসনকর্তা হয়ে যান।

মু’জিমে তিবরানীতে এই রিওয়াইয়াত রয়েছে যে, হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) রাত্রির কথোপকথনে একবার বলেনঃ “আজ আমি তোমাদেরকে একটি কথা শুনাচ্ছি যা এমন কোন গোপনীয় কথাও নয় এবং তেমন প্রকাশ্য কথাও নয়। হযরত উছমানের (রাঃ) যা কিছু করা হয়েছে, ঐ সময় আমি তাকে নিরপেক্ষ থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং বলেছিলামঃ আল্লাহর শপথ! যদি আপনি কোন পাথরের মধ্যেও লুকিয়ে থাকেন তবুও আপনাকে বের করা হবে। কিন্তু তিনি আমার পরামর্শ গ্রহণ করেন নাই। আর একটি কথা জেনে নাও যে, আল্লাহর কসম! মুআবিয়া (রাঃ) তোমাদের উপর বাদশাহ হয়ে যাবেন। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ “যে অত্যাচারিত ব্যক্তি নিহত হবে, আমি তার ওয়ারিছদেরকে তার উপর প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি। এখন তারা যে হত্যার বিনিময়ে হত্যা করবে, এ ব্যাপারে তারা যেন বাড়াবাড়ি না করে (শেষ পর্যন্ত)। আরো জেনে রেখো যে, এই কুরায়েশী তোমাদেরকে পারস্য ও রোমের পন্থায় উত্তেজিত করবে এবং তোমাদের উপর খৃস্টান, ইয়াহুদী ও মাজুসী দাঁড়িয়ে যাবে। ঐ সময় যে ব্যক্তি ওটা ধারণ করবে যা সুপরিচিত, সে মুক্তি পেয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি ওটা ছেড়ে দেবে এবং বড়ই আফসোস যে, তোমরা ছেড়েই দেবে, তবে তোমরা এ যুগের লোকদের মত হয়ে যাবে যে, যারা ধ্বংস প্রাপ্তদের সাথে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।” এখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ওয়ারিছদের জন্যে এটা উচিত নয় যে, হত্যার বদলে হত্যার ব্যাপারে তারা সীমালংঘন করে। যেমন তার মৃতদেহকে নাক, কান কেটে বিকৃত করা বা হত্যাকারী ছাড়া অন্যের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা ইত্যাদি। শরীয়তে নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছকে অধিকার ও ক্ষমা প্রদানের দিক দিয়ে সর্বপ্রকার সাহায্য দান করা হয়েছে।

Leave a Reply