أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৫৪)
সুরা: আল্ বনি ইসরাইল
সুরা:১৭
৫৩-৫৫ নং আয়াত:-
[ وَ قُلۡ لِّعِبَادِیۡ یَقُوۡلُوا الَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ ؕ
আমার বান্দাদেরকে বলুন, তারা যেন এমন কথা বলে যা উত্তম। ]
www.motaher21.net
وَ قُلۡ لِّعِبَادِیۡ یَقُوۡلُوا الَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ ؕ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ یَنۡزَغُ بَیۡنَہُمۡ ؕ اِنَّ الشَّیۡطٰنَ کَانَ لِلۡاِنۡسَانِ عَدُوًّا مُّبِیۡنًا ﴿۵۳﴾
আর আমার বান্দাদেরকে বলুন, তারা যেন এমন কথা বলে যা উত্তম। নিশ্চয় শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়; নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।
رَبُّکُمۡ اَعۡلَمُ بِکُمۡ ؕ اِنۡ یَّشَاۡ یَرۡحَمۡکُمۡ اَوۡ اِنۡ یَّشَاۡ یُعَذِّبۡکُمۡ ؕ وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ عَلَیۡہِمۡ وَکِیۡلًا ﴿۵۴﴾
তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে ভালোভাবে জানেন; ইচ্ছা করলে তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন এবং ইচ্ছা করলে তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দেবেন। আর আমি তোমাকে তাদের উপর দায়িত্বশীল করে পাঠাইনি।
وَ رَبُّکَ اَعۡلَمُ بِمَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ لَقَدۡ فَضَّلۡنَا بَعۡضَ النَّبِیّٖنَ عَلٰی بَعۡضٍ وَّ اٰتَیۡنَا دَاوٗدَ زَبُوۡرًا ﴿۵۵﴾
যারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে আছে তাদেরকে তোমার প্রতিপালক ভালভাবে জানেন। আমি তো নবীদের কতককে কতকের উপর মর্যাদা দিয়েছি। আর দাঊদকে আমি যাবূর দিয়েছি।
৫৩-৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে উত্তম চরিত্র, আমল ও কথা বলার নির্দেশনা দিয়ে বলেন: যখন তোমরা কথা বলবে তখন যা ভাল সে কথা বলবে। মন্দ কথা বলা থেকে বিরত থাকবে, তা দীনের ব্যাপারে হোক আর দুনিয়ার ব্যাপারে হোক।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও আখিরাতে বিশ্বাসী সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (সহীহ বুখারী হা: ৬০১৮)
সুতরাং কথা বলার সময় খেয়াল করা উচিত, আমি যা বলছি তা কি দীন ও দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর, মানুষের উপকারে আসবে, না কারো ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে। এসব খেয়াল করে চললে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে না, হানাহানি মারামারি হবে না, বরং সকলে ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করা যাবে। তার পরেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, শয়তান চায় তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কিছু কথা বের করতে যার দ্বারা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করবে, কারণ তার কাজই হল তোমাদের অকল্যাণ করা, সে তোমাদের কল্যাণ দেখতে পারে না। কেননা সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“। তার ব্যাপারে সাবধান থাকবে।
এজন্যই হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দিকে অস্ত্র দ্বারা ইশারা না করে। কেননা তার অজান্তে হয়তবা শয়তান ওটা তার ভাইয়ের গায়ে লাগিয়ে দেবে। আর এর ফলে সে জাহান্নামী হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী হা: ৭০৭২, সহীহ মুসলিম হা: ১২৬)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনি সমস্ত বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন, আকাশে ও জমিনে যারা অবস্থান করে তাদের সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত। তিনি চাইলে সকল মানুষের প্রতি দয়া করতে পারেন আবার ইচ্ছা করলে শাস্তিও দিতে পারেন। এতে বুঝা যায় যে, সকল ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলারই হাতে। অন্য কারো হাতে নয়।
(وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ…. )
এখানে নাবীদের মর্যাদার তারতম্যের কথা বলা হয়েছে। কিছু কিছু নাবীর মর্যাদা কিছু কিছু নাবীদের থেকে বেশি। এ মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন। যেমন আদম (عليه السلام)-কে নিজ হাতে সৃষ্টি করে মর্যাদা দিয়েছেন যা অন্য কোন নাবীর নেই, নূহ (عليه السلام)-কে প্রথম রাসূল হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন যা অন্য নাবীদের নেই, ইবরাহীম (عليه السلام)-কে খলীল বা অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে মর্যাদা দিয়েছেন যা অন্য কোন নাবীকে দেননি, মূসা (عليه السلام)-এর সাথে সরাসরি কথা বলে কালিমুল্লাহর মর্যাদা দিয়েছেন যা অন্য কাউকে দেননি, আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে শেষ নাবী হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন যা অন্যদের থেকে পৃথক।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلٰي بَعْضٍۭ مِنْهُمْ مَّنْ كَلَّمَ اللّٰهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجٰتٍ)
“এ সকল রাসূল যাদের কারো উপর আমি কাউকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি, তাদের মধ্যে কারও সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং কারও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন।” (সূরা বাক্বারাহ ২:২৫৩)
অতএব মর্যাদার দিক দিয়ে নাবীদের মধ্যে কম-বেশি রয়েছে, তবে নির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না, কারণ নির্দিষ্টভাবে বলা নিষেধ রয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩৯৫)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কোন মন্দ কথা বলব না, কারণ মুখ শয়তানের অন্যতম একটি হাতিয়ার।
২. আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও ক্রোধ নামে দুটি সিফাত রয়েছে।
৩. মর্যাদাগত দিক থেকে নাবীদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে তবে তা ব্যাপকভাবে, নির্দিষ্টভাবে নয়।
৪. দাঊদ (عليه السلام)-এর মর্যাদার কথা জানা গেল।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# কাফের ও মুশরিক এবং ইসলাম বিরোধীদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক করার সময় কড়া কথা, বাড়াবাড়ি ও বাহুল্য বর্জন করবে। বিরোধী পক্ষ যতই অপ্রীতিকর কথা বলুক না কেন মুসলামানদের মুখ থেকে কোন ন্যায় ও সত্য বিরোধী কথা বের হওয়া উচিত নয়। ক্রোধে আত্মহারা হয়ে তাদের আজে বাজে বথা বলা শোভা পায় না। ঠাণ্ডা মাথায় তাদের এমন সব কথা বলতে হবে, যা যাচাই বাছাই করা, মাপাজোকা, ওজন করা, সত্য এবং তাদের দাওয়াতের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিশীল।
# যখনই তোমরা বিরোধীদের কথার জবাব দিতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠছে বলে মনে করবে এবং মন-মেজাজ আকস্মিকভাবে আবেগ-উত্তেজনায় ভরে যেতে দেখতে পাবে তখনই তোমাদের বুঝতে হবে, তোমাদের বুঝতে হবে, তোমাদের দ্বীনের দাওয়াতের কাজ নষ্ট করার জন্য এটা শয়তানের উস্কানী ছাড়া আর কিছুই নয়। তার চেষ্টা হচ্ছে, তোমরাও নিজেদের বিরোধীদের মতো সংস্কারের কাজ ত্যাগ করে সে যেভাবে মানব গোষ্ঠীকে বিতর্ক-কলহ ও ফিতনা-ফাসাদে মশগুল করে রাখতে চায় সেভাবে তোমরাও তার মধ্যে মশগুল হয়ে যাও।
# আমরা জান্নাতী এবং অমুক ব্যক্তি বা দল জাহান্নামী এ ধরনের দাবী কখনো ঈমানদারদের মুখে উচ্চারিত হওয়া উচিত নয়। এ বিষয়টির ফায়সালা একমাত্র আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। তিনিই সকল মানুষের ভিতর-বাইর এবং বর্তমান-ভবিষ্যত জানেন। কার প্রতি অনুগ্রহ করতে হবে এবং কাকে শাস্তি দিতে হবে— এ ফায়সালা তিনিই করবেন। আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে কোন্ ধরনের মানুষ রহমত লাভের অধিকার রাখে এবং কোন্ ধরনের মানুষ শাস্তি লাভের অধিকারী নীতিগত দিক দিয়ে মানুষ অবশ্যি একথা বলার অধিকার রাখে। কিন্তু অমুক ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হবে এবং অমুককে মাফ করে দেয়া হবে, একথা বলার অধিকার কারোর নেই। সম্ভবত এ উপদেশ বাণী এজন্য করা হয়েছে যে, কখনো কখনো কাফেরদের জুলুম ও বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলমানদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা বের হয়ে যেতো যে, তোমরা জাহান্নামে যাবে অথবা আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দেবেন।
# নবীর কাজ হচ্ছে দাওয়াত দেয়া। লোকদের ভাগ্য নবীর হাতে দিয়ে দেয়া হয়নি যে, তিনি কারোর ভাগ্যে রহমত এবং কারোর ভাগ্যে শাস্তির ফায়সালা দিয়ে যেতে থাকবেন। এর অর্থ এ নয় যে, নবী ﷺ এ ধরনের কোন ভুল করেছিলেন এবং সে কারণে আল্লাহ তাঁকে এভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বরং এর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দেয়াই আসল উদ্দেশ্য। তাদেরকে বলা হচ্ছে, নবীই যখন এ মর্যাদার অধিকারী নন তখন তোমরা কিভাবে জান্নাত ও জাহান্নামের ঠিকেদার হয়ে গেলে?
# এ বাক্যটি আসলে মক্কার কাফেরদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, যদিও আপাতদৃষ্টিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন সমকালীন লোকদের সাধারণ নিয়ম হয়ে থাকে ঠিক সেই একই নিয়মে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমকালীন ও সমগোত্রীয় লোকেরা তাঁর মধ্যে কোন শ্রেষ্টত্ব ও মহত্ব দেখতে পাচ্ছিল না। তারা তাঁকে নিজেদের জনপদের একজন সাধারণ মানুষ মনে করছিল। আর যেসব খ্যাতনামা ব্যক্তি কয়েক শতাব্দী আগে অতীত হয়ে গিয়েছিলেন তাদের সম্পর্কে মনে করতো যে, শ্রেষ্টত্ব ও মহত্ব কেবল তাদের মধ্যেই ছিল। তাই তাঁর মুখে নবুওয়াতের দাবী শুনে তারা এ বলে আপত্তি জানাতো যে, এ লোকাটি তো বেশ লম্ফ ঝম্প মারছে। না জানি নিজেকে কী মনে করে বসেছে। বড় বড় পয়গম্বররা, যাদের শ্রেষ্ঠত্ব সারা দুনিয়ার লোকেরা মানে, তাদের সাথে এ ব্যক্তির কি কোন তুলানাই করা যেতে পারে? আল্লাহ এর সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে বলছেনঃ পৃথিবী ও আকাশের সমস্ত সৃষ্টি আমার চোখের সামনে আছে। তোমরা জানো না তাদেরকে কোন্ পর্যায়ের এবং কে কোন্ ধরনের মর্যাদার অধিকারী। নিজের শ্রেষ্ঠত্বের মালিক আমি নিজেই এবং ইতিপূর্বেও আমি বহু নবী পয়দা করেছি যাদের একজন অন্যজনের চাইতে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা সম্পন্ন।
# এখানে বিশেষভাবে দাউদ আলাইহিস সালামকে যাবুর দান করার কথা সম্ভবত এজন্য উল্লেখ করা হয়েছে যে, দাউদ আলাইহিস সালাম বাদশাহ ছিলেন এবং বাদশাহ সাধারণত আল্লাহর কাছ থেকে বেশী দূরে অবস্থান করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমকালীন লোকেরা যে কারণে তাঁর পয়গম্বরী ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার বিষয়টি মেনে নিতে অস্বীকার করতো তা তাদের নিজেদের বর্ণনা অনুযায়ী এ ছিল যে, সাধারণ মানুষের মতো তাঁর স্ত্রী-সন্তান ছিল, তিনি পানাহার করতেন, হাটে বাজারে চলাফেরা করে কেনাবেচা করতেন এবং একজন দুনিয়াদার ব্যক্তি নিজের দুনিয়াবী প্রয়োজনাদি পূরণ করার জন্য যেসব কাজ করতো তিনি তা সব করতেন। মক্কার কাফেরদের বক্তব্য ছিল, তুমি একজন দুনিয়াদার ব্যক্তি, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার সাথে তোমার কি সম্পর্ক? আল্লাহর নৈকট্য লাভকারীরা তো হচ্ছে এমন সব লোক, নিজেদের দৈহিক ও মানসিক চাহিদার ব্যাপারে যাদের কোন জ্ঞান থাকে না। তারা তো একটি নির্জন জায়গায় বসে দিনরাত আল্লাহর ধ্যানে ও স্মরণে মশগুল থাকে। ঘর সংসারের চাল-ডালের কথা ভাববার সময় ও মানসিকতা তাদের কোথায়! এর জবাবে বলা হচ্ছে, পুরোপুরি একটি রাজ্যের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করার চাইতে বড় দুনিয়াদারী আর কি হতে পারে, কিন্তু এরপরও হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে নবুওয়াত ও কিতাবের নিয়ামত দান করা হয়েছিল।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*দাওয়াতের কাজে মার্জিত ভাষার গুরুত্ব : এরপর আলােচনা ধারা এগিয়ে চলেছে ওই সব মিথ্যা সাব্যস্তকারী ও হঠকারী ব্যক্তিদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন ও হাশরের ময়দানের অবস্থাকে কেন্দ্র করে। যারা আল্লাহর ওয়াদা ও রসূল(স.)-এর কথাকে ঠাট্টা বিদ্রুপের বিষয় মনে করতাে সত্য সঠিক বিষয়গুলাে বুঝার পরও তারা মুখ ফিরিয়ে চলে যেতাে, উপহাস বিদ্রুপ করে রসূলুল্লাহ(স.)-কে কষ্ট দিতাে, এদের থেকে আলােচনার গতি সরিয়ে নিয়ে আল্লাহর মােমেন বান্দাদের দিকে ইংগিত করে রসূলুল্লাহ(স.)-কে বলা হচ্ছে যেন তিনি এদেরকে উন্নতমানের আদব কায়দা শিক্ষা দেন, সুন্দরতম মানুষ হিসাবে গড়ে তােলেন এবং তাদেরকে পবিত্র কথা ও মিষ্টি মধুর আচরণ শেখান, যেন সদা সর্বদা তারা ভাল ও কল্যাণকর কথা বলেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর বলাে আমার বান্দাহদেরকে যেন তারা সেই কথাই বলে যা সর্বাধিক ভালাে। নিশ্চয়ই শয়তান তাদের মধ্যে কুপ্ররােচনা দান করে চলেছে। অবশ্যই সে মানুষের জন্য প্রকাশ্য দুশমন। আর বলো আমার বান্দাদেরকে তারা যেন সর্বোত্তম কথা বলে।’ অর্থাৎ তারা যেন পুরােপুরি ও সাধারণভাবে সবখানেই উত্তম কথা বলে। এমন সুন্দর কথা যেন বলে যা মানুষের কাছে শুনতে ভাল লাগে, মনের ওপর দাগ কেটে যায় এবং হৃদয়ের ওপর মধুর পরশ বুলিয়ে দেয়। এমন কথাকেই শয়তান ভয় পায় এবং সে শক্ত কথা ও কষ্টদায়ক ব্যবহার করতে মানুষকে প্ররােচনা দেয় যেন মানুষের পারস্পরিক মােহব্বত নষ্ট হয়ে যায়, ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি হয় এবং পরস্পর শত্রুতা করতে উদ্বুদ্ধ হয়, আর ভ্রাতৃত্ববোেধ পারস্পরিক দরদ সহানুভূতির মনােভাব পরিবর্তিত হয়ে শত্রুতাপূর্ণ মনােভাব গড়ে ওঠে। অবশ্যই একথা সত্য যে মিষ্টি-মধুর কথা হৃদয়ের মলিনতাকে দূর করে দেয় অন্তরের ব্যধিকে নিরাময় করে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করে এবং পরস্পরকে ভালবাসতে শেখায় এবং মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগায়। এরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন।’ এ মরদূদ শয়তান মানুষের মুখে মন্দ কথা যুগিয়ে দেয় এবং জিহ্বাকে সঠিক কথা উচ্চারণ করা থেকে সরিয়ে দেয়। যার ফলে মানুষে মানুষে ও ভাইয়ে ভাইয়ে জাগে দুশমনি ও ঘৃণা বিদ্বেষ। অপরদিকে সুন্দর সুমিষ্ট কথা মানুষের সম্পর্কের দূরত্বকে কাছে টেনে নিয়ে আসে, ব্যবধান কমিয়ে দেয় এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে মযবুত বানায়, আর ভাই-এর অপরাধকে মার্জনা করে তাদের পরস্পরের মধ্যে নিরাপত্তাবােধ সৃষ্টি করে। শয়তানের উস্কানিতে তাদের মধ্যে যে সব দূরত্ব আসতে চায় ভ্রাতৃত্ববােধ সেগুলােকে রােধ করে। কেয়ামতের অবস্থার এ ছবি তুলে ধরার পর আলােচনার প্রসংগ আবার ফিরে যাচ্ছে ওই হঠকারী জাতির শেষ পরিণতির কথার দিকে-সেদিন তাদেরকে যখন ডাকা হবে তখন তারা আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে জওয়াব দেবে। সেদিন সবার পরিণতি একমাত্র আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ থাকবে। যাকে তিনি চাইবেন রহম করবেন, আর যাকে চাইবেন শাস্তি দেবেন। তাদের সবাইকে সেদিন আল্লাহর ফয়সালার ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। সেদিন রসূলও কারাে জন্যে দায়ী থাকবেন না। আজ তিনি তাে শুধু বার্তা বাহকই মাত্র, এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমাদের রব ভাল করেই জানেন তােমাদের সম্পর্কে, তিনি চাইলে তােমাদের প্রতি রহম করবেন, আর চাইলে শাস্তি দেবেন। আর তােমাকে তাে আমি, কারাে জন্যে জামিন বা অভিভাবক বানিয়ে পাঠাইনি। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর যেখানে যা আছে সে সম্পর্কে তােমার রব ভাল করেই জানেন।’ অতপর, অবশ্যই এটা সত্য যে যাবতীয় জ্ঞানের আধার একমাত্র আল্লাহ। তার পূর্ণাংগ জ্ঞান দ্বারা তিনি সব কিছুর ব্যবস্থা করে থাকেন। তার রহমত দ্বারাই তিনি ঠিক করেন কাকে আযাব দেবেন এবং কাকে করবেন পুরস্কৃত। অবশেষে বলা হচ্ছে, ‘রসূলের কাজ পৌছে দেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ’ অর্থাৎ পৌছে দেয়া পর্যন্তই তার কাজ শেষ হয়ে যায়, কারণ তিনি তাে মাত্র একজন রসূল (বার্তাবাহক মাত্র) আল্লাহ তায়ালা তার পূর্ণাংগ জ্ঞানের দ্বারা সব কিছুর ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেন, এই রহমত ও করুণার কারণেই কারাে প্রতি রহম করেন আর কাউকে শাস্তি দেন। পৌছে দেয়া পর্যন্তই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পূর্ণাংগ জ্ঞানের মধ্যেই রয়েছে আসমান যমীনের সমস্ত জ্ঞান ভান্ডার-ফেরেশতা, রসূলরা, মানুষ জ্বিন এবং গােটা সৃষ্টিকুল, এসব কিছুর খবর তিনি ছাড়া আর কেউ রাখে না-রাখতে পারে না। কেউ জানেনা কার মূল্য কতটুকু কার মর্যাদা কতটুকু। আর তার এই সর্বব্যাপী জ্ঞানের দ্বারাই তিনি গােটা সৃষ্টি জগতের কাউকে কারাে ওপর মর্যাদা দিয়েছেন-মর্যাদা দিয়েছেন কোনাে নবীকে কোনাে নবীর ওপর। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর আমি নবীদের মধ্যে কাউকে অন্য কারাে ওপর মর্যাদাবান বানিয়েছি।’ এই যে শ্রেষ্ঠত্ব এর কারণ কি? এর কারণ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কেউ জানেনা এ মর্যাদা দান সম্পর্কে কিছু কথা ইতিমধ্যে ‘ফী যিলালিল কোরআন’ এর দ্বিতীয় খন্ডে বর্ণিত হয়েছে। সেখানেও আল্লাহর বাণী সকল রসূলদের মধ্যে আমি মহান আল্লাহ, কাউকে কারাে ওপর মর্যাদাবান বানিয়েছি…’ এখানে আবারও সে কথার উল্লেখ করা হচ্ছে, ‘আর আমি, দাউদকে যাবুর (কিতাব) দিয়েছি…’ এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনাে নবীর জন্যে এক নিদর্শন এবং অবশ্যই মর্যাদার এক চিহ্নও বটে, কারণ মানুষ তাে নির্দিষ্ট একটি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর দুনিয়া ছেড়ে যায়, কিন্তু পৃথিবীর গ্রন্থাগারে রক্ষিত জ্ঞান ভান্ডারের আধার কিতাব থেকে যায় অগণিত মানুষের জন্য জ্ঞানের উৎস হিসাবে, যা থেকে পরবর্তী লােকেরা উপকৃত হয়।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) সম্বোধন করে বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি আমার মুমিন বান্দাদেরকে বলে দাও যে, তারা যেন উত্তম ভাষায়, সুবাক্যে এবং ভদ্রতার সাথে কথা বলে। অন্যথায় শয়তান তাদের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি ও ফাটল ধরাবার চেষ্টা করবে। ফলে তাদের পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়ে যাবে। এজন্যেই হাদীসে রয়েছে যে, মুসলমান ভাই এর দিকে। কোন অস্ত্রের দ্বারা ইশারা করাও হারাম। কেননা, হয়তো, শয়তান ওটা তার গায়ে লাগিয়ে দেবে এবং এর ফলে সে জাহান্নামী হয়ে যাবে। (এ হাদীস মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে)
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক সমাবেশে জনগণকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ “সমস্ত মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। কেউ কারো উপর জুলুম করবে না এবং কেউ কারো মর্যাদার হানি করবে না।” অতঃপর তিনি স্বীয় বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেনঃ “তাকওয়া এখানে।” একথা তিনি তিনবার বলেন। তারপর তিনি বলেনঃ “যে দুই ব্যক্তি পরস্পর দ্বীনী বন্ধু হিসেবে রয়েছে, অতঃপর তাদের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি হয়ে যায়, এখন তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই প্রভেদের কথা বর্ণনা করবে সে মন্দ, বদতর এবং চরম দুষ্ট।” (এ হাদীসটি ‘মুসনাদ গ্রন্থে রয়েছে)।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ) ও মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ তোমাদের মধ্যে কারা হিদায়াত লাভের যোগ্য তা তোমাদের প্রতিপালক ভালভাবেই জানেন। তিনি যার উপর চান দয়া করে থাকেন, নিজের আনুগত্যের তাওফীক দেন এবং নিজের দিকে আকৃষ্ট করেন। পক্ষান্তরে যাকে চান দুষ্কর্যের উপর পাকড়াও করেন এবং শাস্তি দেন। হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতিপালক তোমাকে তাদের উপর দায়িত্বশীল করেন নাই। তোমার কাজ হচ্ছে শুধু তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া। যারা তোমাকে মেনে চলবে তারা। জান্নাতে যাবে এবং যারা মানবে না তারা জাহান্নামী হবে। তোমার প্রতিপালক যমীন ও আসমানের সমস্ত দানব, মানব ও ফেরেশতার খবর রাখেন এবং প্রত্যেকের মর্যাদা সম্পর্কেও তিনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তিনি একজনকে অপরজনের উপর মর্যাদা দান করেছেন। মর্যাদার দিক দিয়ে নবীদের মধ্যে শ্রেণী বিন্যাস রয়েছে। কেউ আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন এবং কারো অন্য দিক দিয়ে মর্যাদা রয়েছে। একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আমাকে নবীদের উপর ফযীলত দিয়ো না।” এর উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ শুধু গোড়ামীর কারণে ফযীলত কায়েম করা। এর দ্বারা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ফযীলত অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়। যে নবীর যে মর্যাদা দলীলের দ্বারা প্রমাণিত তা মেনে নেয়া ওয়াজিব। সমস্ত নবীর উপর যে রাসূলুল্লাহর (সঃ) মর্যাদা রয়েছে এটা অনস্বীকার্য। আবার রাসূলদের মধ্যে স্থির প্রতিজ্ঞা পাঁচজন রাসূল বেশী মর্যাদাবান। তাঁরা হলেনঃ হযরত মুহাম্মদ (সঃ), হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত ঈসা (আঃ)। এই পাঁচজন রাসূলের নাম সূরায়ে আহযাবে বর্ণিত আছে। সুরায়ে শুরা (আরবি) এর এই আয়াতেও এই পাঁচজন রাসূলের নাম বিদ্যমান রয়েছে। এটাও যেমন সমস্ত উম্মত মেনে থাকে, অনুরূপভাবে এটাও সর্বজন স্বীকৃত যে, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তার পর হলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) এঁর পর হলেন হযরত মূসা (আঃ), যেমন এটা প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। আমরা এর দলীল গুলো অন্য জায়গায় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীক প্রদানকারী।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি দাউদকে (আঃ) যবুর প্রদান করেছিলাম। এটাও তার মর্যাদা ও আভিজাত্যের দলীল। সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত দাউদের (আঃ) উপর কুরআনকে (যনূরকে) এতো সহজ করে দেয়া হয়েছিল যে, জন্তুর উপর জিন কষতে যেটুকু সময় লাগে ঐটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি কুরআন (যনূর) পড়ে নিতেন।”