أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৬০)
সুরা:- আল্ জুমআ।
সুরা:৬২
০১-০৪ নং আয়াত:-
[ وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ
তাদের মধ্য হতে অন্যান্যদের জন্যও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি।]
www.motaher21.net
یُسَبِّحُ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ الۡمَلِکِ الۡقُدُّوۡسِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَکِیۡمِ ﴿۱﴾
আসমানসমূহে যা আছে এবং যমীনে যা আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে, যিনি অধিপতি, মহাপবিত্র, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
ہُوَ الَّذِیۡ بَعَثَ فِی الۡاُمِّیّٖنَ رَسُوۡلًا مِّنۡہُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُزَکِّیۡہِمۡ وَ یُعَلِّمُہُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ٭ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ۙ﴿۲﴾
তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যিনি তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন তাঁর আয়াতসমূহঃ তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমত ; যদিও ইতোপূর্বে তারা ছিল ঘোর বিভ্ৰান্তিতে;
وَّ اٰخَرِیۡنَ مِنۡہُمۡ لَمَّا یَلۡحَقُوۡا بِہِمۡ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۳﴾
আর তাদের অন্যান্যদের জন্যও (রসূল পাঠিয়েছেন), যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰہِ یُؤۡتِیۡہِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۴﴾
এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে তিনি এটা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী।
০১-০৪ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
(৬২-জুমুয়া) : নামকরণ:
৯ নং আয়াতের إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ আয়াতাংশ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ সূরার মধ্যে যদিও জুম’আর নামাযের আহকাম বা বিধি-বিধানও বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু জুম’আ সামগ্রিকভাবে এর বিষয়বস্তুর শিরোনাম নয়। বরং অন্যান্য সূরার নামের মত এটিও এ সূরার প্রতীকী বা পরিচায়মূলক নাম।
(৬২-জুমুয়া) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
প্রথম রুকূ’র আয়াতসমূহ ৭ হিজরীতে সম্ভবত খায়বার বিজয়ের সময় অথবা তার নিকটবর্তী সময়ে নাযিল হয়েছে। বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী এবং ইবনে জারীর হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সাল্লামের খেদমতে বসে থাকা অবস্থায় এ আয়াতটি নাযিল হয়। হযরত আবু হুরাইরা সম্পর্কে এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে এবং খায়বার বিজয়ের পূর্বে ঈমান এনেছিলেন। ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুসারে ৭ হিজরীর মুহাররাম মাসে আর ইবনে সা’দের বর্ণনা অনুসারে জমাদিউল উলা মাসে খায়বার বিজিত হয়েছিল। অতএব যুক্তির দাবি হলো, ইহুদীদের এই সর্বশেষ দুর্গটি বিজিত হওয়ার পর আল্লাহ তা’আলা তাদের সম্বোধন করে এ আয়াতগুলো নাযিল করে থাকবেন কিংবা খায়বারের পরিণাম দেখে উত্তর হিজাযের সমস্ত ইহুদী জনপদ যখন ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত হয়ে গিয়েছিল তখন হয়তো এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল। ।। । দ্বিতীয় রুকূ’র আয়াতগুলো হিজরতের পরে অল্পদিনের মধ্যে নাযিল হয়েছিল। কেননা নবী(সা.) মদীনা পৌছার পর পঞ্চম দিনেই জুম’আর নামায কায়েম করেছিলেন। এই রুকূ’র শেষ আয়াতটিতে যে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, আয়াতটি জুম’আর নামায আদায় করার ব্যবস্থা হওয়ার পর এমন এক সময়ে নাযিল হয়ে থাকবে যখন মানুষ দ্বীনী উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত সমাবেশের আদব-কায়দা ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে তখনও পুরো প্রশিক্ষণ লাভ করেনি।
(৬২-জুমুয়া) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
ওপরে আমরা একথা বলেছি যে, এ সূরার দুটি রুকূ’ দুটি ভিন্ন সময়ে নাযিল হয়েছে। অতএব এর বিষয়বস্তু যেমন আলাদা তেমনি যাদের সম্বোধন করে নাযিল করা হয়েছে সে লোকজনও আলাদা। তবে এ দুটি রুকূর আয়াতসমূহের মধ্যে এক প্রকার সাদৃশ্য আছে এবং এ জন্য তা একই সূরাতে সন্নিবেশিত হয়েছে। সাদৃশ্য কি তা বুঝার আগে রুকূ’ দুটির বিষয়বস্তু আলাদাভাবে আমাদের বুঝে নেয়া উচিত।
ইসলামী আন্দোলনের পথ রোধ করার জন্য বিগত ছয় বছরে ইহুদীরা যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছে তা ব্যর্থতায় পর্যবসতি হয়েছে এমনি এক সময় প্রথম রুকূ’র আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল। প্রথমত মদীনায় তাদের তিন তিনটি শক্তিশালী গোত্র রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লামকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। তারা এর ফল দেখতে পেল এই যে, একটি গোত্র সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল এবং অপর দুটি গোত্রকে দেশান্তরিত হতে হলো। অতপর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা আরবের বহুসংখ্যক গোত্রকে মদীনার ওপর আক্রমণের জন্য নিয়ে আসল কিন্তু আহযাব যুদ্ধে তারা সবাই চপেটাঘাত খেল। এরপর তাদের সবচেয়ে বড় দুর্গ বা আখড়া রয়ে গিয়েছিল খায়বারে। মদীনা ত্যাগকারী ইহুদীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাও সেখানে সমবেত হয়েছিল। এসব আয়াত নাযিল হওয়ার সময় সেটিও অস্বাভাবিক রকমের কোন সংঘর্ষ ছাড়াই বিজিত হয় এবং মুসমানদের ভূমি কর্ষণকারী হিসেবে থাকতে খোদ ইহুদীরাই আবেদন জানায়। সর্বশেষ এই পরাজয়ের পর আরবে ইহুদীদের শক্তি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ওয়াদিউল কুরা, ফাদাক, তায়ামা, তাবুক সব একের পর এক আত্মসমর্পণ করতে থাকে। ইসলামের অস্তিত্ব বরদাশত করা তো দূরের কথা তার নাম শুনতেও যারা পছন্দ করত না, আরবের সেইসব ইহুদীই শেষ পর্যন্ত সেই ইসলামের প্রজায় পরিণত হয়। এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলা এই সূরার মধ্যে আরো একবার তাদেরকে সম্বোধন করলেন। তাদের উদ্দেশ্যে কুরআন মজীদে উল্লেখিত এটাই সম্ভবত সর্বশেষ বক্তব্য। এতে তাদের উদ্দেশ্য করে তিনটি কথা বলা হয়েছে:
এক: তোমরা এ রসূলকে মানতে অস্বীকার করছো এই কারণে যে, তিনি এমন এক কওমের মধ্যে প্রেরিত হয়েছেন যাদেরকে অবজ্ঞা ভরে তোমরা ‘উম্মী’ বলে থাক। তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, রসূলকে অবশ্যই তোমাদের নিজেদের কওমের মধ্যে থেকে হতে হবে। তোমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে ছিলে যে, তোমাদের কওমের বাইরে যে ব্যক্তিই রিসালাতের দাবি করবে সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী। কারণ এই পদমর্যাদা তোমাদের বংশের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং ‘উম্মী’ দের মধ্যে কখনো কোন রসূল আসতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সেই উম্মীদের মধ্যেই একজন রসূল সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের চোখের সামনেই যিনি তাঁর কিতাব শুনাচ্ছেন, মানুষকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সেই মানুষকে হিদায়াত দান করেছেন তোমরা নিজেরাও যাদের গোমরাহীর অবস্থা জান। এটা আল্লাহর করুণা ও মেহেরবানী, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। তাঁর করুণা ও মেহেরবানীর ওপর তোমাদের কোন ইজারাদারী নেই যে, তোমরা যাকে তা দেয়াতে চাও তাকেই তিনি দিবেন আর তোমরা যাকে বঞ্চিত করতে চাও, তাকে তিনি বঞ্চিত করবেন।
দুই: তোমাদের তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল। কিন্তু তোমরা এর গুরুদায়িত্ব উপলদ্ধিও করোনি, পালনও করোনি। তোমাদের অবস্থা সেই গাধার মত যার পিঠে বই পুস্তকের বোঝা চাপানো আছে কিন্তু সে কি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তা জানে না। তোমাদের অবস্থা বরং ঐ গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট। গাধার তো কোন প্রকার-বুদ্ধি-বিবেক নেই, কিন্তু তোমাদের বুদ্ধি-বিবেক আছে। তাছাড়া, তোমরা আল্লাহর কিতাবের বাহক হওয়ার গুরুদায়িত্ব শুধু এড়িয়েই চলছো না, জেনে বুঝে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলা থেকেও বিরত থাকছো না। এসব সত্ত্বেও তোমাদের ধারণা এই যে, তোমরা আল্লাহর অতি প্রিয় এবং রিসালাতের নিয়ামত চিরদিনের জন্য তোমাদের নামে লিখে দেয়া হয়েছে। তোমরা যেন মনে করে নিয়েছ, তোমরা আল্লাহর বাণীর হক আদায় করো আর না করো কোন অবস্থায়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ছাড়া আর কাউকে তাঁর বাণীর বাহক বানাবেন না।
তিন সত্যিই যদি তোমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে এবং এ বিশ্বাসও তোমাদের থাকতো যে, তাঁর কাছে তোমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থান সংরক্ষিত আছে তাহলে মৃত্যুর এমন ভীতি তোমাদের মধ্যে থাকতো না যে, অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন গ্রহণীয় কিন্তু কোন অবস্থায়ই মৃত্যু গ্রহণীয় নয়। আর মৃত্যুর এই ভয়ের কারণেই তো বিগত কয়েক বছরে তোমরা পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছো। তোমাদের এই অবস্থা-ই প্রমাণ করে যে, তোমাদের অপকর্মসমূহ সম্পর্কে তোমরা নিজেরাই অবহিত। তোমাদের বিবেক ভাল করেই জানে যে, এসব অপকর্ম নিয়ে যদি মারা যাও তাহলে পৃথিবীতে যতটা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছো আল্লাহর কাছে তার চেয়ে অধিক লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে।
এ হচ্ছে প্রথম রুকূ’র বিষয়বস্তু। দ্বিতীয় রুকূ’টি এর কয়েক বছর আগে নাযিল হয়েছিল। দ্বিতীয় রকূ’র আয়াতগুলো এ সূরার অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হলো, আল্লাহ তা’আলা ইহুদীদের ‘সাবত’ বা শনিবারের পরিবর্তে মুসলমানদের ‘জুম’আ’ দান করেছেন। তাই তিনি মুসলমানদের সাবধান করে দিতে চান যে, ইহুদীরা, ‘সাবতে’র সাথে যে আচরণ করেছে তারা যেন জুম’আর সাথে সেই আচরণ না করে। একদিন ঠিক জুম’আর নামাযের সময় একটি বাণিজ্য কাফেলা আসলে তাদের ঢোল ও বাদ্যের শব্দ শুনে বারজন ছাড়া উপস্থিত সবাই মসজিদে নববী থেকে বেরিয়ে দৌড়িয়ে কাফেলার কাছে গিয়ে হাজির হয়। অথচ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন খোতবা দিচ্ছিলেন। তাই নির্দেশ দেয়া হয় যে, জুম’আর আযান হওয়ার পর সব রকম কেনাবেচা এবং অন্য সব রকম ব্যস্ততা হারাম। ঈমানদারদের কাজ হলো, এ সময় সব কাজ বন্ধ রেখে আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হবে। তবে নামায শেষ হওয়ার পর নিজেদের কারবার চালানোর জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার অধিকার অবশ্যই তাদের আছে। জুম’আর হুকুম আহকাম সম্পর্কিত এ রুকূটিতে একটি স্বতন্ত্র সূরাও বানানো যেত কিংবা অন্য কোন সূরার অন্তর্ভুক্ত ও করা যেতে পারত। কিন্তু তা না করে এখানে যেসব আয়াতে ইহুদীদেরকে তাদের মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে বিশেষভাবে সেই সব আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য তাই যা আমরা ওপরে বর্ণনা করেছি।
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা হাদীদের ১ ও ২ নং টীকা, আল হাশরের ৩৬, ৩৭ ও ৪১ টীকা। পরবর্তী বিষয়ের সাথে এই প্রারম্ভিক কথাটির গভীর সম্পর্কে বিদ্যমান। আরবের ইহুদীরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যক্তিসত্তা, গুণাবলী ও কার্যকলাপে রিসালাতের স্পষ্ট নিদর্শন চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও এবং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর সম্পর্কে তাওরাতে স্পষ্ট ভাষায় যে সুসংবাদ দিয়েছিলেন তা যে তাঁর ছাড়া আর কারো জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না তা উপলব্ধি করা সত্ত্বেও শুধু এজন্য তাঁকে অস্বীকার করেছিল যে, নিজ জাতি ও বংশের বাইরের আর করো রিসালাত মেনে নেয়া তাদের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় ব্যাপার ছিল। তারা পরিষ্কার বলতো, আমাদের কাছে যা কিছু এসেছে আমরা কেবল তাই মানবো। কোনো অইসরাঈলী নবীর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকেও কোনো শিক্ষা এসে থাকলে তো মেনে নিতে তারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। এই আচরণের কারণে পরবর্তী আয়াতগুলোতে তাদেরকে তিরষ্কার করা হচ্ছে। তাই এই প্রারম্ভিক আয়াতাংশ দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে। এতে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো, বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি বন্তু আল্লাহর তাসবীহ করছে। অর্থাৎ গোটা বিশ্ব-জাহান একথার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যেসব অপূর্ণতা ও দুর্বলতার ভিত্তিতে ইহুদীরা তাদের বংশীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা কায়েম ও বদ্ধমূল করে রেখেছে আল্লাহ তা’আলা তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি কারো আত্মীয় নন। তাঁর কাছে পক্ষপাতিত্বমূলক () কোন কাজ নেই। তিনি নিজের সমন্ত সৃষ্টির সাথে সমানভাবে ইনসাফ, রহমত ও প্রতিপালক সুলভ আচরণ করেন। কোনো বিশেষ বংশধারা বা কওম তাঁর প্রিয় নয় যে, তারা যাই করুক না কেন সর্বাবস্থায় তাঁর অনুগ্রহ তার জন্য নির্দিষ্ট থাকবে এবং অন্য কোনো জাতি গোষ্ঠী বা কওমের সাথে তাঁর কোন শত্রুতা নেই যে, তাদের মধ্যে সদগুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তাঁর দান ও করুণা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। এরপর বলা হয়েছে তিনি বাদশাহ। অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের কোন শক্তিই তার ক্ষমতা ও ইখতিয়ারকে সীমিত করতে পারে না। তোমরা তাঁর দাস এবং প্রজা। তোমাদের হিদায়াতের জন্য তিনি কাকে পয়গাম্বর বানাবেন আর কাকে বানাবেন না, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত পদমর্যাদা তোমরা কবে থেকে লাভ করছে? তারপর বলা হয়েছে, তিনিقدوس মহা পবিত্র। অর্থাৎ তাঁর সিদ্ধান্তে ভুল-ত্রুটির কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে না। তিনি ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। তোমাদের বুঝ ও উপলব্ধিতে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু তার সিদ্ধান্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে না। শেষ দিকে আল্লাহ তা’আলার আরো দু’টি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে একটি হলো, তিনি অত্যন্ত পরাক্রমশারী। অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ জয়লাভ করতে পারে না। অপরটি হলো তিনি জ্ঞানময়, অর্থাৎ যা কিছু করেন, বুদ্ধি, বিবেক ও প্রজ্ঞার দাবীও হুবহু তাই। আর তাঁর কৌশল ও ব্যবস্থাপনা এতই সুদৃঢ় হয়ে থাকে যে, বিশ্ব-জাহানের কেউই তা ব্যর্থ করতে পারে না।
# এখানে ‘উম্মী’ শব্দটি ইহুদীদের পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বিদ্রূপ বা তিরষ্কার প্রচ্ছন্ন আছে। অর্থাৎ ইহুদীরা যাদেরকে অবজ্ঞা করে ‘উম্মী’ বলে থাকে এবং নিজেদের তুলনায় নগণ্য ও নীচু বলে মনে করে পরাক্রমশালী ও জ্ঞানময় আল্লাহ তাদের মধ্যেই একজন রসূল সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজে রসূল হয়ে বসেননি, বরং তাঁকে পাঠিয়েছেন তিনিই যিনি সমগ্র বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ, মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। তাঁর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে এরা নিজেদেরই ক্ষতি করবে তাঁর কোনো ক্ষতি করতে এরা আদৌ সক্ষম নয়।
জেনে রাখা দরকার যে, কুরআন মজীদে, ‘উম্মী’ শব্দটি বেশ কটি স্থানে এসেছে। তবে সব জায়গায় শব্দটি একই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও যাদের কাছে অনুসরণ করার জন্য কোন আসমানী কিতাব নেই আহলে কিতাবেরদের বিপরীতে তাদেরকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ
قُلْ لِلَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْأُمِّيِّينَ أَأَسْلَمْتُمْ (ال عمران : 20)
আহলে কিতাব ও উম্মীদের জিজ্ঞেস করঃ তোমরা কি ইসলাম গ্রহণ করেছ? ”-(সূরা আলে ইমরানঃ ২০) এখানে উম্মী বলতে আরবের মুশরিকদের বুঝানো হয়েছে এবং তাদেরকে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদী ও খৃস্টানদের থেকে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কোথাও এ শব্দটি আহলে কিতাবদেরই নিরক্ষর ও আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অজ্ঞ ও অনবহিত লোকদের সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ
وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لَا يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلَّا أَمَانِيَّ (البقرة : 78) “এই ইহুদীদের কিছু লোক আছে ‘উম্মী’ কিতাবের কোন জ্ঞান তাদের নেই। তারা কেবল নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনাকেই চিনে। “-(সূরা বাকারাঃ ৭৮)
আবার কোথাও এ শব্দটি নিরেট ইহুদী পরিভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘উম্মী’ বলতে অ-ইহুদী সবাইকে বুঝানো হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছেঃ
ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ (ال عمران : 75)
“তাদের মধ্যে এ অসাধুতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো, তারা বলেঃ ‘উম্মীদের অর্থ-সম্পদ লুটেপুটে ও মেরে খাওয়ার কোন দোষ নেই। “-(সূরা আলে ইমরানঃ ৭৫ )
আলোচ্য আয়াতে এই তৃতীয় অর্থটিই গ্রহণ করা হয়েছে। এ শব্দটি ইব্রিয় ভাষায় “গোয়েম” শব্দের সমার্থক। ইংরেজী বাইবেলে এর অনুবাদ করা হয়েছে Gentiles এবং এর দ্বারা সমস্ত অ-ইহুদী বা-ইসরাঈলী লোককে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু শুধু এতটুকু ব্যাখ্যার, সাহায্য এ ইহুদী পরিভাষাটির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝা সম্ভব নয়। ইবরানী বা ইব্রিয় ভাষায় ‘গোয়েম’ শব্দটি প্রথমত কেবল জাতি বা কওমসমূহ অর্থে বলা হতো। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ইহুদীরা এটিকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করতে শুরু করে। প্রথমে তারা এটিকে নিজেদের ছাড়া অন্যসব কওমের জন্য নির্দিষ্ট করে। পরে এ শব্দটির অর্থে এ ভাবধারাও সৃষ্টি করে যে, ইহুদীরা ছাড়া অন্য সব জাতিই অসভ্য ও অভদ্র, ধর্মের দিক থেকে নিকৃষ্ট, অপবিত্র এবং নীচ ও হীন। শেষ পর্যন্ত অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা ও ঘৃণা-বিদ্ধেষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এ শব্দটি উদ্দেশ্যে অগ্রীকদের জন্য গ্রীকদের ব্যবহৃত পরিভাষা Barbarian শব্দটিকেও ছাড়িয়ে যায়। রিব্বীদের সাহিত্যে ‘গোয়েম’রা এমনই ঘৃণ্য মানুষ যে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে ভাই বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না এবং তাদের সাথে সফরও করা যেতে পারেনা। বরং তাদের কেউ যদি পানিতে ডুবে মারতে থাকে তাহলে তাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টাও করা যেতে পারে না। ইহুদীরা বিশ্বাস করতো, মাসীহ এসে সমস্ত গোয়েমকে ধ্বংস করে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলবেন।-(আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আলে ইমরান টীকা ৬৪ )।
# কুরআন মজীদের চারটি স্থানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করা হয়েছে এবং প্রত্যেক স্থানই বর্ণনা করার ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। সূরা বাকারার ১২৯ আয়াতে এসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী উল্লেখিত হয়েছ আরববাসীদের একথা বলার জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী হয়েছে আসাকে তারা যে নিজেদের জন্য দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-মুসিবত বলে মনে করছে, তা ঠিক নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে তা তাদের জন্য একটি বড় নিয়ামত। এটি লাভের জন্য হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম তাদের সন্তানদের জন্য দোয়া করতেন। সূরা বাকারার ১৫১ আয়াতে এসব গুণাবলী বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানরা যেন নবীর ﷺ মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নবী বানানোর মাধ্যমে যে নিয়ামত তাদের দিয়েছেন তা থেকে পুরোপুরি উপকৃত হতে পারে। সূরা আলে ইমরানের ১৬৪ আয়াতে আবার এসব গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানের মানুষগুলোকে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের কাছে তাঁর রসূল পাঠিয়ে কত বড় ইহসান করেছেন। কিন্তু তারা এমনই অপদার্থ যে, তাঁকে কোনো মর্যাদাই দিচ্ছে না। চতুর্থবারের মত এ সূরাতে ঐসব গুণাবলী পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ইহুদীদের একথা জানিয়ে দেয়া যে, মুহাম্মাদ ﷺ তোমাদের চোখের সামনে যেসব কাজ করেছেন, তা স্পষ্টত একজন রসূলের কাজ। তিনি আল্লাহর আয়াত শুনাচ্ছেন। এসব আয়াতের ভাষা, বিষয়বস্তু, বর্ণনাভঙ্গি সবকিছুই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তা প্রকৃতই আল্লাহর আয়াত। তা মানুষের জীবনকে সুন্দর, পরিপাটি ও সুবিন্যস্ত করছে, তাদের নৈতিক চরিত্র, অভ্যাস ও রীতিনীতি এবং লেনদেন ও জীবনচারণকে সব রকমের কলূষ-কালিমা থেকে পবিত্র করছে এবং উন্নতমানের নৈতিক মর্যাদায় ভূষিত করছে। এটা ঠিক সেই কাজ যা ইতিপূর্বে সমস্ত নবী-রসূলও করেছেন। তাছাড়া তিনি শুধু আয়াতসমূহ শুনানোকেই যথেষ্ট মনে করেন না, বরং সবসময় নিজের কথা ও কাজ দ্বারা নিজের বাস্তব জীবনের উদাহরণ দ্বারা মানুষকে আল্লাহর কিতাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝাচ্ছেন। তিনি তাদের এমন যুক্তি, বুদ্ধি ও জ্ঞানের শিক্ষা দিচ্ছেন যা কেবল নবী-রসূলগণ ছাড়া আর কেউ-ই শিক্ষা দেয়নি। এ ধরনের চরিত্র ও কাজ নবী-রসূলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণ। এর সাহায্যেই তাদের চেনা যায়। সত্যিকার অর্থে নিজের কর্মকাণ্ড থেকে যার রসূল হওয়া প্রমাণিত হচ্ছে তাঁকে তোমরা কেবল এজন্য অস্বীকার করছো, যে তাঁকে তোমাদের কওমের মধ্য থেকে না পাঠিয়ে এমন এক কওমের মধ্য থেকে পাঠানো হয়েছে যাদেরকে তোমরা ‘উম্মী’ বলে অবজ্ঞা করে থাকেন।
# এটা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের আরো একটি প্রাণ। ইহুদীদের সত্যোপলদ্ধির জন্য এ প্রমাণটি পেশ করা হয়েছে। তারা শত শত বছর পূর্বে থেকে আরব ভূমিতে বসবাস করে আসছিল। আরবের অজানা ছিল না। তাদের পূর্বতন এ অবস্থার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলা হচ্ছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে এ জাতির চেহারা যেভাবে আমূল পরিবর্তিত হয়েছে তা তোমরা নিজ চোখে দেখেছ। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে এমন লোক যে অবস্থার মধ্যে ডুবে ছিল তা তোমাদের জানা আছে। ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদের অবস্থা কি হয়েছে তাও তোমরা নিজ চোখে দেখছ। আর এ জাতির যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের অবস্থাও কি তোমরা দেখতে পাচ্ছ। একজন অন্ধও এই স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে ও বুঝতে পারে। এটা কি তোমাদেরকে একথা বিশ্বাস করানোর জন্য যথেষ্ট নয় যে, একজন নবী ছাড়া এটা আর কারো কীর্তি হতে পারে না? বরং এর তুলনায় পূর্ববর্তী নবী-রসূলদের কীর্তিও ম্লান হয়ে গিয়েছে।
# মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত শুধু আরব জাতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। তা সারা দুনিয়ার সেইসব জাতি ও বংশ-গোষ্ঠীর জন্য যারা এখনো ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়নি, বরং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। মূল আয়াতাংশ হলোঃ وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ তাদের মধ্য থেকে আরো কিছু লোক যারা এখনো তাদের সাথে শামিল হয়নি। এ আয়াতের مِنْهُمْ (তাদের মধ্য থেকে) শব্দটির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সেই অন্যান্য লোকগুলো উম্মীদের মধ্যে থেকে অর্থাৎ তারা হবে দুনিয়ার সেইসব জাতি ও বংশ-গোষ্ঠীর জন্য যারা এখনো ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হয়নি, বরং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে। মূল আয়াতাংশ হলোঃ () তাদের মধ্য থেকে আরো কিছু লোক যারা এখনো তাদের সাথে শামিল হয়নি। এ আয়াতের———(তাদের মধ্য থেকে, ) শব্দটির দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সেই অন্যান্য লোকগুলো উম্মীদের মধ্যে থেকে, অর্থাৎ তারা হবে দুনিয়ার অ-ইসরাঈলী জাতি-গোষ্ঠীর লোক। দুই, তারা হবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণকারী। তবে এখনো ঈমানদারদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কিন্তু পরে এসে শামিল হবে। এভাবে এ আয়াতটিও সেই সব আয়াতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত যাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত সমগ্র মানব জাতির জন্য এবং চিরদিনের জন্য। কুরআন মজীদের আর যেসব স্থানে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সূরা আল আনআম আয়াত ১৯ , আল আরাফ ১৫৮ , আল আম্বিয়া ১০৭ , আল ফুরকান ১ , সাবা ২৮ ; (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাবা টীকা ৪৭ )।
# এটি তাঁর শক্তি-সমর্থ ও জ্ঞানের বিস্ময়কর দিক যে, তিনি এ ধরনের এক অশিষ্ট উম্মী কওমের মধ্য থেকে এমন মহান নবী সৃষ্টি করেছেন যার শিক্ষা ও হিদায়াত এতটা বিপ্লবাত্মাক ও এমন বিশ্বজনীন স্থায়ী নীতিমালার ধারক, যার ওপর ভিত্তি করে গোটা মানব জাতি একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হতে পারে এবং এ নীতিমালা থেকে চিরদিন দিকনির্দেশনা লাভ করতে পারে। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে কোনো মানুষই এই স্থান ও মর্যাদা লাভ করতে পারতো না। আরবদের মত পশ্চাদপদ জাতি তো দূরের কথা, দুনিয়ার কোন বড় জাতির সর্বাধিক মেধা-সম্পন্ন ব্যক্তিও এভাবে কোন জাতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে দিতে এবং গোটা মানব জাতিকে চিরদিনের জন্য একটি আদর্শ এবং একটি সংস্কৃতির বিশ্বজনীন ও সর্বাত্মক আদর্শ পরিচালনার যোগ্য হওয়ার মত একটা ব্যাপক নীতিমালা গোটা বিশ্বকে উপহার দিতে পারতো না। এটি আল্লাহর কুদরাতে সংঘটিত একটি মু’জিযা। আল্লাহ তাঁর কৌশল অনুসারে যে ব্যক্তি, যে দেশ এবং যে জাতিকে চেয়েছেন। এ উদ্দেশ্যে বাছাই করে নিয়েছেন। এতে কোন নির্বোধ যদি মনে কষ্ট পায় তাহলে পেতে থাকুক।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
# সংক্ষিপ্ত আলােচনা : মদীনায় অবতীর্ণ এ সূরাটি ‘সূরা সফ’-এর পরেই অবতীর্ণ হয়েছে। ‘সুরা সফ’-এর মধ্যে যে বিষয়ের ওপরে আলােচনা এসেছে এ সূরার মধ্যে আলােচনার বিষয়ও প্রায় সেই একই প্রকার, তবে ভিন্ন এক পদ্ধতিতে সে বিষয়টিকে এ সূরার মধ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই এর প্রভাবও নতুন এবং আর একভাবে মানুষের মনে দাগ কাটে। এ সূরা মদীনার মুসলিম জনগােষ্ঠীর মনে ঈমানের আকীদা-বিশ্বাস অত্যন্ত গভীরভাবে প্রােথিত করতে চেয়েছে। রসূল(স.)-এর যমানায় বিভিন্ন গােষ্ঠীভুক্ত মুসলমানরা ঈমানের সম্পদ হাসিল করায় যে অভংগুর একতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাে, তা একমাত্র আল্লাহর মেহেরবানীতেই সম্ভব হয়েছিলাে। নিরক্ষর আরববাসীদের মধ্যে পাঠানাে হয়েছে শেষ রসূলকে, এটা আরবদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যই এক বিরাট এহসান, যার জন্যে আরববাসীদের অবশ্যই আকাশ থেকে অবতীর্ণ এ আমানতের প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান ও মনােযােগী হওয়া দরকার এবং বিশেষভাবে আল্লাহর শােকরগােযারী করা দরকার। একই ভাবে যে জনগাষ্ঠী রসূল(স.)-এর ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং ঈমানের আমানত বহন করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে তাদের ওপর কিছু দায়িত্বও বর্তায় এবং এই একই দায়িত্ব ভবিষ্যতেও যুগের পর যুগ ধরে মুসলমানদের ওপর আসতে থাকবে। আল্লাহর নেয়ামতের শােকরগােযারী স্বরূপ তাদের আল্লাহ রসূলের বিধানমতাে জীবন যাপন করতে হবে এবং অপরের কাছেও এই আমানত পৌছে দিতে হবে। এ দায়িত্ব কোনাে সময়েই শেষ হয়ে যাবে না; বরং হেদায়াতের যে বীজ রসূল(স.) বপন করে গিয়েছেন তার বৃক্ষকে লালন পালন করতে হবে এবং বাড়াতে হবে। চার হাজার বছর ধরে এই দায়িত্ব বনী ইসরাঈল জাতির হাতে ছিলাে, কিন্তু এর হক আদায় না করার কারণে তারা আকাশ থেকে আসা আমানত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাে এবং তাদের থেকে এ দায়িত্ব কেড়ে নিয়ে উম্মতে মােহাম্মদীকে দেয়া হলো। তাওরাত ছিলাে মূসা(আ.)-এর কাছে প্রেরিত আল্লাহরই কিতাব, বনী ইসরাঈল জাতি গাধার মতাে এই কিতাবের বােঝা বহন করেছে বটে, কিন্তু এর থেকে কোনাে ফায়দা নিতে পারেনি। গাধা তাে বােঝা বহন করে খাদ্যস্বরূপ কিছু মজুরি পায়, কিন্তু বনী ইসরাঈলরা সে মজুরিও পায়নি এবং বােঝা বহন করার সময় তাদের কেউ সাহায্যও করেনি। মুসলমানদের অন্তরের মধ্যে এই মূল সত্যই আলােচ্য সূরাটি বদ্ধমূল করে দিতে চায়। বিশেষ করে মদীনাবাসী তৎকালীন মুসলমানদের মধ্যে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যেহেতু আল্লাহ তায়ালা তাদের দ্বারাই ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এভাবে তাদের পরে যারা এসেছেন- তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, পর্যায়ক্রমে সবার ওপরেই পর্যায়ক্রমে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব এসেছে। এখন আমরা দেখতে পাই ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানদের এমন কিছু বাস্তব অবস্থা এই সূরার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে, যা ওই কঠিন সময়ে ব্যক্তি চরিত্র গড়ে তােলার ব্যাপারে দীর্ঘ দিন ধরে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে কাজ করেছে এবং ধীরে ধীরে মানুষকে লােভ লালসা ও পার্থিব ফায়দা হাসিলের আকাংখা, পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলার মনােবৃত্তি এবং সুনাম অর্জন করার বাসনা থেকে মুক্ত করেছে, বিশেষ করে মুক্ত করেছে ধন দৌলতের আসক্তি থেকে এবং সেই খেল তামাশার আকর্ষণ থেকে যা মানুষকে প্রদত্ত আমানতের মহান দায়িত্ব পালন থেকে গাফিল করে দেয়, দূরে সরিয়ে দেয় খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে ব্যক্তিগত যােগ্যতা প্রদর্শন করা থেকে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্যে সূরাটি ইশারা করেছে বিশেষ একটি ঘটনার দিকে। ঘটনাটি হচ্ছে, এক জুময়ার নামাযে মসজিদে রসূলুল্লাহ(স.) খোতবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় এক বাণিজ্য কাফেলা ব্যবসা-দ্রব্য নিয়ে দেশে ফিরলাে এবং শহরে এসে হাযির হলাে। তাদের আগমন সংবাদ জানার সাথে সাথে যারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর খােতবা শুনছিলাে, সেই শ্রোতারা হঠাৎ করে সেই কাফেলার দিকে ছুটে গেলাে। কাফেলার আগমন সংবাদ ঘােষণাকারী বাদ্যধ্বনি তাদের আবেগমুগ্ধ করে ফেললাে। অবশ্য এভাবেই আরব বাসীরা (ইসলাম-পূর্ব) জাহেলী যুগে বাণিজ্য ফিরত কাফেলাকে অভিনন্দন জানাত। কাফেলার মধ্য থেকে দফ নামক বাদ্যযন্ত্র (তবলা) সহ উট-হাঁকানাে গান ও সম্মিলিত কলরব ভেসে আসছিল। এতদ শ্রবণে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রসূলুল্লাহকে দন্ডায়মান অবস্থায় পরিত্যাগ করে চলে আসে। এদের মধ্যে বারাে জন ব্যক্তি ছিলেন ব্যতিক্রম। এরা ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত সাহাবা, ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব, যারা সর্বাবস্থায় রসূলুল্লাহ(স.)-কে ঘিরে থাকতেন। সুতরাং তারা স্থান ত্যাগ না করে মনােযােগ দিয়ে শুনতে লাগলেন। বিভিন্ন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায়, এদের মধ্যে আবু বকর ও ওমর(রা.)-ও ছিলেন। যদিও সংখ্যার দিক দিয়ে এরা একেবারে নগণ্য ছিলেন না, কিন্তু কোরআনুল করীমে আসা সতর্কবাণী থেকে জানা যায়, উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এক উল্লেখযােগ্য সংখ্যক লােক ওঠে চলে গিয়েছিলাে। এ ঘটনাটি বিশেষভাবে পীড়াদায়ক ছিলাে এজন্যে যে, যে প্রথম ইসলামী দলটিকে এতাে কষ্ট করে ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে গড়ে তােলা হয়েছিলাে, তার এমন দশা হলাে। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি, ইসলামের ইতিহাসে এটা একটা বিশেষ ঘটনা এবং গােটা মানব জীবনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এ ঘটনা থেকে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, যে কোনাে সময়ে এবং যে কোনাে কঠিন অবস্থাতে আমাদের সবর করতেই হবে। আসলে যে মুসলিম জামায়াত ইসলামের এই মহামূল্যবান আকীদার প্রচার প্রসারের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিয়েছে, তাকে সঠিকভাবে গড়ে তােলার জন্যে প্রয়ােজন অবিচল দৃঢ়তার। এই সবর দ্বারাই পরবর্তী কালের মুসলমানরা ইসলামকে বাস্তব জগতে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে, যেভাবে প্রথম যুগের ইসলামী জামায়াত এই আকীদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আলােচ্য সূরাটিতে ইহুদীদের সাথে মােবাহালা করার দৃশ্যও দেখা যায়, অর্থাৎ কারা সত্য পথে আছে তার জন্যে প্রতিযােগিতা করতে গিয়ে উভয় পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে এই বলে দোয়া করা, ‘হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যে ভুল পথে আছে তার প্রতি তােমার লানত বর্ষণ করাে এবং সে ধ্বংস হয়ে যাক।’ ইহুদীদের সাথে যে প্রতিযােগিতার কথাও এ সূরার মধ্যে ফুটে ওঠেছে, তা ছিলাে উভয় পক্ষ থেকে মিথ্যাপন্থীদের জন্যে মৃত্যু কামনা করা, আর ইহুদীরা অন্যান্য যে কোনাে জাতির তুলনায় নিজেদের আল্লাহর বন্ধু ও অধিক প্রিয়পাত্র বলে দাবী করত, আর বলত যে, অন্য কোন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে রাসূলের আগমন ঘটবে না- সেই দাবী প্রতিহত করার উদ্দেশ্যেই এই মোবাহালা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এইভাবে আল কোরআনও চূড়ান্ত ভাবে দাবী করেছে যে, ওদের মােবাহালার জন্যে ডাকলে এই প্রতিযােগিতায় ওরা কিছুতেই সাড়া দেবে না, যেহেতু তাদের চেতনার মধ্যে গভীরভাবে একথা রয়েছে যে, তারা অবশ্যই মিথ্যাপন্থী এবং তাদের দাবী মিথ্যা। এর পর আল কোরআন মৃত্যুর তাৎপর্য জানাতে গিয়ে বলছে, এমন ভয়ানক বিপদ যার থেকে বাচার জন্যে ওরা সব সময়েই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়; কিন্তু সে মৃত্যু অবশ্যই ওদের সাথে সাক্ষাত করবে তা ওরা যখানেই থাকুক না কেন। অবশেষে তাদের অনুপস্থিত ও উপস্থিত সব কিছুর জাননেওয়ালা যে আল্লাহ তায়ালা, তার কাছে হাযির করা হবে। আর তখন তিনি তাদের সেই সকল বিষয়ে অবগত করবেন, যা অতীতে তারা করতে থেকেছে। এ কথাগুলাে শুধু ইহুদীদের জন্যেই নয় বরং সবার জন্যে, কেননা এ কথাগুলাে খাস করে ইহুদীদের নাম নিয়ে বলা হয়নি। কাজেই মােমেনদের ওপরেও কথাগুলাে সমানভাবে প্রযােজ্য। যেহেতু ঈমান আকীদার আমানত বহন করার প্রশ্নেই এ কথাগুলাে এসেছে, এজন্যে যারাই এ আমানতের হক আদায় না করবে, তাদের ওপরেই কথাগুলাে প্রযােজ্য হবে। কারণ, তারা এ আমানত সম্পর্কে জানে ও তার গুরুত্বও যথাযথভাবে বুঝে। তবু নিছক পার্থিব স্বার্থের কারণে তারা সে দায়িত্ব পালন করা থেকে পিছিয়ে থাকে। এই হচ্ছে সূরার মুখ্য আলােচ্য বিষয়। ইতিপূর্বে সূরা সফ-এ যে বিষয়টি আলােচনা করা হয়েছে, তা এখানে আলােচিত বিষয়ের খুবই কাছাকাছি। তবে প্রত্যেক সূরার বর্ণনাভংগি পৃথক এবং প্রতিটি সূরা ভিন্ন ভিন্নভাবে হৃদয়কে আকর্ষণ করে। যদিও উদ্দেশ্য তাদের এক অভিন্ন। সুতরাং এখন আমরা দেখি এ সূরার মাধ্যমে কোরআনুল কারীম কি পদ্ধতি পেশ করেছে।
# আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবই নিরংকুশ আনুগত্য দান করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা করে চলেছে। বিশ্বলােকে তিনি একচ্ছত্র অধিপতি, তিনি সকল প্রকার দুর্বলতা ও অক্ষমতার উর্ধ্বে, তিনি মহা শক্তিমান, মহা বিজ্ঞানময়।’ আলােচ্য আয়াতটি এখানে স্পষ্টভাবে এই সত্য তুলে ধরেছে যে, সৃষ্টিলােকে যা কিছু আছে তা সর্বক্ষণ আল্লাহর প্রশংসায় রত রয়েছে, অর্থাৎ নিরন্তর তার নির্দেশমতাে চলার মাধ্যমে এ কথার সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে যে, সকল শক্তি ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, আর এই সূরার মধ্যে আলােচ্য বিষয়বস্তু হিসাবে অতি সূক্ষ্মভাবে এই কথাই আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করছেন। তিনি সুরাটির নাম বেখেছেন আল জুমুয়া। এখানে জুমআর নামায সম্পর্কে কিছু শিক্ষাও রয়েছে, সময় হওয়ার সাথে সাথে এ নামাযে শরীক হওয়ার জন্যে সকল কাজকর্ম পরিত্যাগ করে ছুটে আসতে বলা হয়েছে। পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে সকল প্রকার বে-ফায়দা কাজ ও ব্যবহার এবং যাবতীয় ব্যবসা বাণিজ্য। আর সেই মহামূল্যবান নেয়ামত চাইতে বলা হয়েছে যা একমাত্র আল্লাহর কাছেই বিদ্যমান। তাদের একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, হৃদয় মনকে প্রলুব্ধকারী এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীন ব্যস্ততা এবং ব্যবসা বাণিজ্য ও ব্যবসায়ের ধন সম্পদের তুলনায় আল্লাহর কাছে অবস্থিত নেয়ামত অতি উত্তম। এই জন্যেই তিনি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনিই বাদশা ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি, তিনিই সব কিছুর মালিক। এমনকি ব্যবসা বাণিজ্য করে মানুষ যা কিছু উপার্জন করে সে সকল পণদ্রব্যের মালিকও তিনি। তিনি আরও স্মরণ করাচ্ছেন যে, তিনি সকল প্রকারের দুর্বলতার উর্ধে এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যে সকল জিনিস মানুষের নিকট গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এবং যেসব জিনিসের প্রতি মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সেসব কিছু থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। একথাগুলাে বিশেষভাবে এই জন্যেই বলার প্রয়ােজন হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ(স.) যখন খোতবা দিচ্ছিলেন, তখন কাফেলার আগমনবার্তা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে খােতবা শােনার গুরুত্ব তাদের মনে কমে গেলাে এবং অহেতুক খুশীতে অস্থির হয়ে তারা মসজিদ ত্যাগ করে চলে গেলাে। সাময়িকভাবে হলেও তারা একথা ভুলে গেলাে যে, এ সব কিছুর ব্যাপারে একদিন তাদের আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে।
# *নিরক্ষর জনগােষ্ঠীর মাঝে নবী প্রেরণ : ইহুদীদের দাবী যে তারাই আল্লাহর নিকবর্তী লােক, সেই কথার প্রেক্ষাপটে মহাশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের সাথে মােবাহালা করার জন্যে নবী(স.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন। এই মােবাহালার মধ্যে আরও একটি কথা রয়েছে, বেশ তাে, তােমরা যদি আল্লাহর বিশেষ প্রিয়পাত্রই হয়ে থাকো তাহলে আসন্ন মৃত্যু কামনা করাে, যেহেতু মৃত্যুর পরেই তােমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হিসেবে তাঁর কাছে হাযির হতে পারবে এবং হিসাব নিকাশের পর মহা পুরস্কার লাভ করতে পারবে, কিন্তু এ কপট আহলে কিতাবরা জানতাে যে, প্রকৃতপক্ষে তারা সঠিক কাজ ও ব্যবহার করছে না, এজন্যে তারা এইভাবে মােবাহালা করতে রাযি হতে পারেনি। অপরদিকে মহাবিজ্ঞানময় আল্লাহ তায়ালা উম্মী (নিরক্ষর) লোকদের মধ্য থেকে রাসূল পাঠাতে চাইলেন যাতে করে সেই রাসূল তার আয়াতগুলাে তাদের পড়ে শােনাতে পারেন, তাদের নিস্কলুষ চরিত্রের অধিকারী বানাতে পারেন এবং কিতাব ও বুদ্ধিমত্তার কথা তাদের শিক্ষা দিতে পারেন। এসব উপযুক্ত ও সূক্ষ্ম কথা তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যেন তারা ইসলাম গ্রহণ করতে পারে এবং মুসলমানদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়। তারপর এ সূরার মধ্যে যে মূল বিষয়বস্তুর আলােচনা করতে চাওয়া হয়েছে তা শুরু হচ্ছে। আল্লাহ তাে সেই মহান সত্ত্বা, যিনি পাঠিয়েছেন তার রাসূল কে নিরক্ষর লােকদের মধ্যে রসূল বানিয়ে যেন তিনি তাদের আল্লাহর আয়াতগুলাে তেলাওয়াত করে শুনান, কলুষ-কালিমা ও নৈতিক অপরাধসমূহ থেকে তাদের মুক্ত করেন, তাদের আল-কোরআনের কথাগুলাে এবং বুদ্ধিমত্তাভরা বিদ্যা শেখান, যদিও এর পূর্বে তারা ছিলাে স্পষ্ট গােমরাহীর মধ্যে। তিনি রসূল হয়ে এসেছেন অন্যদের জন্যও, যারা এখন ও মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়নি। আর তিনিই মহা শক্তিমান, বিজ্ঞানময়। কথিত আছে, আরবদের উম্মি বলা হতাে। তাদের এই জন্যে নিরক্ষর বলে অভিহিত করা হতাে যে, সাধারণভাবে তারা পড়ালেখা করতাে না। নবী(স.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে জানা যায়, তিনি একদিন বললেন, মাস এই রকম, এই রকম এবং এই রকম। কথাগুলাে বলার সময় তিনি তার আংগুলগুলাে দ্বারা ইশারা করে দেখাচ্ছিলেন। তারপর বললেন, আমরা তাে এক নিরক্ষর (উম্মী) জাতি, আমরা হিসাবও করতে পারি না, গুনতেও পারি না (আহকামুল কোরআন প্রণেতা ইমাম জাসসাস এ কথাটি উল্লেখ করেছেন, তবে তিনি কোনাে হাদীসের কিতাবের বরাত দেননি) আরও একটি কথা বলা হয়েছে, তাঁকে উম্মী এ জন্যেই বলা হয়েছে যে, তিনি জন্মগ্রহণ করার পর লেখাপড়া শিখতে পারেননি এবং তার মায়ের কাছ থেকেই তার অবস্থা সম্পর্কে জানা গেছে, এ জন্যেও তাকে উম্মী বলা হতে পারে। লেখাপড়া জানতে হলে তাকে অবশ্যই কারাে কাছে শিখতে হয় এবং কারাে সাহায্য নিতে হয়। এই সুযােগ তিনি পাননি। নবী(স.)-কে লােকেরা উম্মী হয়তাে এ জন্যেও বলে থাকবে যে, ইহুদীরা নিজেদের ছাড়া অন্য সবাইকে উম্মী বলতাে। তারা অন্যদের সম্পর্কে বলতাে, ওরা হচ্ছে, ‘জুওয়াইয়েম।’ এই শব্দটি ইবরানী ভাষা থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক’ একথা দ্বারা ‘জাতিসমূহ’ অর্থও বুঝায়। একথা দ্বারা তারা বলতে চাইতাে যে, তারাই আল্লাহর গােত্র, বাকি সবাই সাধারণ জাতি। আর আরবি ভাষায় উম্মী’ একবচন, এর বহুবচন ‘উম্মিউন’। সম্ভবত এই উম্মিউন (বহুবচন) শব্দটি সূরাটির মধ্যে আলােচিত বিষয় বস্তুর সাথে বেশী সংশ্লিষ্ট, এই জন্যে এই শব্দটিই এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। ইহুদীরা অপেক্ষায় ছিলাে যে, শেষ রসূল তাদের থেকেই প্রেরিত হবেন এবং তিনি আগমন করে তাদের মধ্যে বিরাজমান দল, উপদলের যে কোন্দল রয়েছে, সেগুলাে দূর করে দেবেন এবং তাদের পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্ত করে সম্মানের আসনে সমাসীন করবেন। তারা বলতাে, শীঘ্রই শেষ যমানার নবী আসবেন এবং তার সাহায্যে আরবদের ওপর তারা জয় লাভ করবে, অর্থাৎ শেষ নবীর সাহায্য তারা সবাই কামনা করতাে। কিন্তু আল্লাহর প্রজ্ঞার দাবী ছিলাে যে, এই নবীকে আরব দেশে পাঠানাে হােক এবং উম্মীদের মধ্যেই পাঠানাে হােক, ইহুদীদের মধ্য থেকে নয়। কারণ, আল্লাহর জানা হয়ে গিয়েছিলাে যে, ইহুদীরা নবুওতের বোঝা বহন করতে অক্ষম হয়ে গেছে এবং গােটা মানব জাতিকে পরিচালনার যে নতুন দায়িত্ব আসছে, তা পালন করার যােগ্যতা ওদের নেই। এ বিষয়ে আলােচ্য সূরার দ্বিতীয় বর্ণনা আসছে। সে জাতি সত্য সঠিক পথ থেকে সরে গেছে এবং সূরা ‘সফ’-এর বর্ণনামতে তারা গোমরাহ হয়ে গেছে। এ জাতির দীর্ঘ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ওদের এতাে বড়ো আমানতের বােঝা বহন করার দায়িত্ব আর দেয়া ঠিক হবে না। অপরদিকে রয়েছে আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়া। সে দোয়া অনুযায়ী জানা যায়, এই পবিত্র ঘরের ছায়াতলে থেকে যিনি এর কার্যক্রম পরিচালনা করবেন, তিনি হবেন ইসমাঈল(আ.)। ‘যখন এ ঘরটির ভিত্তি রচনা করলাে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (বাপ-বেটা) দু’জনে মিলে (এবং তারা বললো), হে আমাদের রব, আপনি আমাদের নিকট থেকে এ কাজ কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই, আপনি দোয়া শুননেওয়ালা, জাননেওয়ালা। হে আমাদের রব, আমাদের দুজনকে মুসলমান (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) বানিয়ে দিন এবং বানিয়ে দিন আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও মুসলিম উম্মত, দেখিয়ে দিন আমাদের হজ্জের কার্যক্রম পদ্ধতি এবং আমাদের তাওবা কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী, মেহেরবান। হে আমাদের রব, ওদের (আমাদের বংশধরদের) মধ্য থেকেই পাঠান এমন একজন রসূল, যে তাদের আপনার আয়াতসমূহ পড়ে শােনাবে, তাদের কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শিক্ষা দান করবে এবং তাদের পবিত্র (কলুষমুক্ত) করবে। অবশ্যই তুমি মহাশক্তিমান, বিজ্ঞানময়।’ অদৃশ্য মহাশক্তিমান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে এ দোয়া পৌছে গিয়েছিলো এবং যুগ যুগ ধরে এ দোয়া প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলাে আকাশে-বাতাসে অন্তরালে। এ দোয়া অবিস্মরণীয় এবং এমনভাবে আল্লাহর দরবারে সুরক্ষিত ছিলাে, যা কোনাে দিন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না এবং কেয়ামত পর্যন্ত তার ফয়সালা এ দোয়া আল্লাহর জ্ঞানভান্ডারের মধ্যে ধ্বনিত হতে থাকবে, তারপর সঠিক ও উপযুক্ত সময়ে এ দোয়া অনুযায়ী কাজ হবে- এটাই আল্লাহর ফয়সালা এবং যথাযােগ্য ব্যবস্থা এবং অবশেষে সৃষ্টিজগতে নবুওতের দায়িত্ব পালনের কাজ নির্ধারিত ও সঠিক সময়ে আল্লাহর মর্জিমতােই গৃহীত হবে, তার আগেও নয়, পরেও নয়। তাই দেখা যায়, আল্লাহর নিজ কুদরত ও পরিচর্যায় এ দোয়ার বিকাশ ঘটেছে, বাস্তবায়িত হয়েছে মহান দুই নবীর আকুল আবেদন। কি চমৎকারভাবে এই সূরার মধ্যে ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, তাদের মধ্য থেকে যেন আগমন করেন এমন একজন রসূল, যিনি তাদেরকে তার আয়াতগুলাে পড়ে শোনাবেন, পবিত্র করবেন তাদের এবং শেখাবেন তাদের কিতাব ও হিকমত। এটা আল্লাহরই দান, যেমন ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়াতেই আল্লাহর এই ক্ষমতার কথা ধ্বনিত হয়েছে। অবশ্য তুমিই মহাশক্তিমান প্রজ্ঞাময়। আর রসূলুল্লাহ(স.)-কে তার নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, আমি তাে আব্বা ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়ার বাস্তব রূপ এবং ঈসা(আ.)-এর সুসংবাদের বাস্তবায়ন। আমি ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই আমার আম্মা দেখেছিলেন এমন এক জ্যোতি, যার আলােতে সিরিয়ার রাজধানী বসরা শহর উদ্ভাসিত হয়ে গিয়েছিলাে (ইবনে ইসহাকের রেওয়ায়াত অনুযায়ী জানা যায়, তিনি বলেন, আমাকে এ হাদীসটি সওর ইবনে যায়দ উর্ধ্বতন বিভিন্ন রেওয়ায়াতকারীর বর্ণনা ধারা ও রসূল(স.)-এর সাহাবাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন। ইবনে কাসীর বলেন, এ হাদীসটির বর্ণনাধারা সঠিক ও সুন্দর। আরও বিভিন্ন উপায়ে হাদীসটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জানা গেছে) অন্ধকার পেরিয়ে আলাের জগতে মানব জাতির অগ্রযাত্রা।
# *অন্ধকার পেরিয়ে আলোর জগতে মানব জাতির অগ্রযাত্রা : ‘তিনিই তাে সেই মহান সত্ত্বা, যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদের থেকেই একজন রসূল পাঠাবেন। তার দায়িত্ব হবে, সে তার আয়াতগুলাে ওদের পড়ে শোনাবে, তাদের পবিত্র করবে এবং তাদের আল্লাহর কিতাব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা শিখাবে। যদিও এর পূর্বে তারা খােলাখুলি ভুল পথের মধােই ছিলাে।’ এখানে উম্মীদের আল্লাহর কিতাবের ধারক বাহক বানানাের উদ্দেশ্যেই তাদের প্রতি আল্লাহর ইহসানের কথা প্রকাশ করেছেন। এ ইহসান প্রদর্শন এজন্যেও বটে যে, তাদের মধ্য থেকেই তিনি এমন একজন রসূল পাঠিয়েছেন যাকে তারা আল্লাহরই ইচ্ছাতে সুমহান মর্যাদার আসনে বসিয়েছে এবং তিনি তাদের নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে বের করে এনেছেন, অথবা তাদের কাছে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাদের সাধারণ উম্মতের মধ্য থেকে মর্যাদাশীল উম্মতের পরিণত করেছেন, তাদের সাবেক অবস্থা থেকে উন্নীত করেছেন এবং সারা জগতে তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বানিয়েছেন। এবং পবিত্র করেছেন’। এর দ্বারা মনের পবিত্রতা বুঝায় এবং রসূল(স.)-এর শেখানাে পাক সাফ থাকাও বুঝায়। এ পবিত্রকরণ দ্বারা যেমন বিবেক বুদ্ধি, চেতনা, কাজ ও ব্যবহার বুঝায়, তেমনি বুঝায় দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা ও সামাজিক জীবনের মধ্যে বসবাসকালীন আদান-প্রদানের পরিচ্ছন্নতাকেও। এ পবিত্রকরণ দ্বারা মানুষের মন মগয শিরকের কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে তাওহীদী বিশ্বাসকে ধারণ করে এবং ভুল চিন্তা চেতনা থেকে মুক্তি লাভ করে সঠিক বিশ্বাসের দিকে মানুষ এগিয়ে যায়। এই পবিত্রকরণ দ্বারা সমস্ত প্রকারের সন্দেহ পূর্ণ কাহিনী ও মনগড়া কথা থেকেও পবিত্র করা এবং নিশ্চিত ও সন্দেহমুক্ত বিশ্বাসের দিকে এগিয়ে দেয়াও বুঝায়। প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মনে যেসব খারাপ কথার উদয় হয় এবং চারিত্রিক দুর্বলতা সৃষ্টি হয়, সেসব থেকে পবিত্র করে ঈমানী চরিত্র গড়ে তোলার দ্বারা পরিশুদ্ধকরণের কথা বলা হয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করার পর সূদ ও অন্যান্য হারাম পদ্ধতির মাধ্যমে রোজগার বন্ধ করে মুসলমানদের হালাল রুযি খেতে শিখানাে হয়েছে। এভাবে ব্যক্তি ও দলীয় জীবনে, কল্পনা ও বাস্তবতার ক্ষেত্রে সবখানেই যেন মুসলমানরা পবিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর হতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পবিত্রকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে মানবতাবােধ সৃষ্টি করা হয়েছে, জীবন সম্পর্কে সুস্থ সঠিক চিন্তা চেতনা পয়দা করা হয়েছে এবং মন-মগযকে এমনভাবে উন্নত করতে চাওয়া হয়েছে, যেন এ সুন্দর মন নিয়ে মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে এবং পৃথিবীর সংকীর্ণতার গন্ডি থেকে মুক্ত হয়ে মহান আল্লাহর মহব্বত হাসিল করার জন্যে এগিয়ে যেতে পারে এবং মহান রব্বুল আলামীনের কাছে জওয়াবদিহি করার জন্যে তার মন-মানসিকতা সৃষ্টি হয় ও প্রত্যেকটি কাজ সেভাবে পরিচালিত হয়। (এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে হলে দেখুন, মােহাম্মদ কুতুব রচিত ‘আল ইনসানু বাইনাল মাদ্দিয়াতে অল ইসলাম) এবং তাদের তিনি কিতাব ও হিকমত (বুদ্ধিপূর্ণ কথা) শিক্ষা দিচ্ছেন। কিতাব শিক্ষা দেয়ার কারণে তারা আহলে কিতাব বা কিতাবের অধিকারী হচ্ছে এবং হিকমত শিক্ষা দেয়ায় তারা বস্তুজগতের বিভিন্ন তথ্য জানতে পারছে ও সেগুলাে যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছে। এভাবে তারা তাদের ভাগ্য উন্নয়ন করতে পারছে, উন্নত হচ্ছে তাদের মন ও জীবন যাপনের মান। এসব কিছু মিলেই ইসলাম গ্রহণ করার মাধ্যমে মানুষ সার্বিক কল্যাণের অধিকারী হয়েছে। যদিও এর পূর্বে তারা ছিলাে স্পষ্ট ভুল পথে। এই ভুল পথ বা গােমরাহী ছিলাে অজ্ঞানতার (জাহেলিয়াতের) গােমরাহী। হযরত জাফর ইবনে আবু তালেবের ব্যাখ্যায় এ কথা জানা যায়। মুসলমানরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করে নাজ্জাশীর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যে কুরাইশরা আমর ইবনুল আস ও আবদুল্লাহ ইবনে রবীয়াকে সেখানে পাঠায়। এই কোরায়শ প্রতিনিধিরা যখন মুসলমান মােহাজেরদের সম্পর্কে নানা প্রকার ভুল কথা বলে তাদের ফেরত দেয়ার অনুরােধ করলাে, তখন নাজ্জাশী মুসলমানদের কাছে সঠিক অবস্থা জানতে চাইলেন। জওয়াবে মুসলমানদের পক্ষ থেকে জাফর বললেন, ‘হে বাদশাহ, আমরা জাহেলিয়াতবাসী ছিলাম (অর্থাৎ অজ্ঞানতার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম)। বিভিন্ন পুতুলের পূজা করতাম, মৃত জীবজন্তু খেতাম, নানা প্রকার লজ্জাকর কাজে ছিলাম, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীদের কষ্ট দিতাম এবং আমাদের সমাজের শক্তিশালী লােকেরা গরীবের ধন সম্পদ কেড়ে খেতাে, দীর্ঘকাল ধরে আমরা এই অবস্থার মধ্যে থেকে কষ্ট পাওয়ার পর আমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল এলেন, যার বংশ-পরিচয় ও সত্যবাদিতা সম্পর্কে আমরা জানতাম, জানতাম তার আমানতদারী ও চারিত্রিক পবিত্রতা সম্পর্ক। তিনি আমাদের এক আল্লাহ হুকুমদাতা ও মালিক বলে মানতে শেখালেন এবং একমাত্র তাঁরই হুকুম পালনের আহবান জানালেন। আমরা এবং আমাদের বাপ দাদারা আল্লাহ ব্যতীত যে সব জড় পাথর ও দেব দেবীর পূজা করতাম, সেগুলাে তিনি পরিত্যাগ করতে বললেন। তিনি আমাদের সত্য কথা বলার নির্দেশ দিলেন, আমানতের হক আদায় করতে বললেন এবং আত্মীয়স্বজনের প্রতি সদয় হতে বললেন, প্রতিবেশীর সাথে সুন্দর ব্যবহার করতে শেখালেন, সম্মানী লােকদের বেইযযত করতে মানা করলেন এবং খুন খারাবী করা থেকে আমাদেরকে বিরত করলেন এবং নিষেধ করলেন লজ্জাকর কাজ করতে, মিথ্যা কথা বলতে, এতীমের সম্পদ ভক্ষণ করতে এবং পাক সাফ মহিলাদের বদনাম করতে। তিনি আমাদের একমাত্র আল্লাহর নিরংকুশ আনুগত্য ও পরিপূর্ণ দাসত্ব করতে নির্দেশ দিলেন এবং তার সাথে শক্তি ক্ষমতায় অন্য কাউকে অংশীদার করতে মানা করলেন, আর তিনি আমাদের নামায পড়তে, যাকাত আদায় করতে এবং রােযা রাখতে আদেশ করলেন। জাহেলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে তারা গােমরাহীর মধ্যে ডুবে থাকা সত্তেও আল্লাহ তায়ালা জানতেন, ভুল আকীদা বিশ্বাসের কারণেই তারা ওই ভুল পথে চলছিলাে। তার জানা ছিলাে যে, তাদের অন্তরের মধ্যে কল্যাণ ও সংশােধনী গ্রহণ করার শক্তি রয়েছে, যদি যুক্তি সহকারে তাদের সত্য সঠিক পথের দিকে দাওয়াত দেয়া হয় তাহলে তা গ্রহণ করার মতাে যােগ্যতা তাদের মধ্যে আছে। ইতিপূর্বে মিসরে ইহুদীদের অপমানজনক জীবন যাপন তারা দেখেছে, ভুল আকীদা গ্রহণ ও সত্য পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কারণে তাদের অধােপতন এবং কিছুতেই দুনিয়ার কোনো জায়গাতেই এই অভিশপ্ত ইহুদী জাতির স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে না পারার করুণ অবস্থাও তারা প্রত্যক্ষ করেছে। এমনকি আল্লাহর নবী মূসা(আ.)-এর জীবদ্দশায় তাঁর উম্মত ও অনুসারী হওয়া সত্তেও তাদের নাফরমানীর কারণে কোথাও তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেনি এবং পরবর্তীকালেও কোনাে দেশে তাদের স্থায়ী ঠিকানা ছিলাে না। অবশেষে তাদের অভিশপ্ত ও শাস্তিপ্রাপ্ত জাতি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের দায়িত্বও কেড়ে নেয়া হয়েছে, যা কেয়ামত পর্যন্ত আর তাদের ফেরত দেয়া হবে না। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জ্ঞানভান্ডারে একথা ছিলাে যে, এই সময়ে জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে পৃথিবীবাসীকে মুক্ত করার জন্যে এবং তৎকালীন বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী রাজ্যসমূহের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যে দাওয়াতী কাজের কেন্দ্রভূমি হবে এই আরব উপদ্বীপ। তৎকালীন ওই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে ছােট খাটো গােত্রীয় শক্তিগুলাে তেমনি করে মিশে গিয়েছিলো যেমন করে প্রদীপের মধ্যে পতংগরা ঝাপ দিয়ে আত্মােৎসর্গ করে, এমনকি মানুষের সাধারণ বুদ্ধিও তখন অকেজো হয়ে গিয়েছিলাে। তৎকালীন এই অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে জনৈক ইউরোপীয় লেখক বলছেন, পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে গােটা পৃথিবী এতাে বেশী বস্তুবাদী হয়ে পড়েছিলাে যে, বস্তুর মহব্বতের কারণে ও আধিপত্য লাভের প্রতিযােগিতায় মানুষ চরম নীতি বিবর্জিত হয়ে গিয়েছিলাে। কারণ, যে আখেরাতকেন্দ্রিক আকীদা বিশ্বাসের কারণে মানুষ নীতিবান হয়, তা নিশেষ হয়ে যাওয়ার ফলে মানবতার চরম অধপতন হয় এবং মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে ধস নেমে আসে। এ কারণেই বনী ইসরাঈলদের হাতে চার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সভ্যতার প্রাসাদে ধসের সূচনা শুরু হয়ে যায়। তাদের সীমা লংঘন ও যুলুমের কারণে সাধারণভাবে মানুষ তাদের নাগপাশ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মনে প্রাণে কামনা করতে থাকে এবং গােটা মানব জাতি পুনরায় বর্বরতার দিকে ফিরে যেতে উদ্যত হয়। গোত্রে গোত্রে মারামারি, কাটাকাটি, রাহাজানি, খুনখারাবী নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আইন কানুন ও সুষ্ঠু কোনাে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সর্বত্র স্বৈরাচার, স্বেচ্ছাচার ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। খৃষ্ট ধর্মের প্রচার প্রসারে যে শাসন ব্যবস্থা ও শৃংখলা গড়ে ওঠেছিলাে, তার বুনিয়াদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা ভেংগে পড়ে এবং গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গােত্রীয় শাসন ব্যবস্থা। অথচ ইতিপূর্বে গড়ে ওঠা শাখা-প্রশাখা-পল্লবিত মহা বৃক্ষের ন্যায় নগর-সভ্যতা সারা পৃথিবীর বুকে প্রভাবশীল অবস্থায় বিরাজ করতাে। এই কেন্দ্রীয় রাজ্য থেকে বিচ্ছুরিত হত চতুর্দিকে জ্ঞান বিজ্ঞানের আলাে, কিন্তু জাহেলিয়াতের যুগে কেন্দ্রীয় কোনাে শাসন ব্যবস্থা না থাকায় সামাজিক সংহতি বলতে কোনাে কিছু থাকে না এবং সর্বত্র ধ্বংস ও বিপর্যয় নেমে আসে, এমনকি মানুষের সাধারণ বিবেক বুদ্ধি পর্যন্ত বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। এমন কঠিন যুগসন্ধিক্ষণে জন্মগ্রহণ করেন এমন এক মহাপুরুষ যিনি (তাওহীদের) এক পতাকাতলে সমবেত করেন গােটা পৃথিবীর মানুষকে।(Dinesan রচিত গ্রন্থ ‘আল আওয়াতিফু কাআসানুন লিল হাজারাহ। এই পুস্তকটি মৌলবী মােহাম্মদ আলী রচিত আল ইসলাম ওয়ান্নিজামুল আলামুল জাদীদ এবং এর অনুবাদক অধ্যাপক আহমাদ জুদাত আস সাহ্হার অবলম্বনে লিখিত) এই হচ্ছে আরব দেশের তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে ইসলামের চরম বিরােধী ইউরােপীয় লেখকের কলমের আঁকা ছবি। অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন আরব মরুর বুকে বিচরণরত সেই বেদুইন জাতিকে আল্লাহ তায়ালা বেছে নিলেন এই বিশ্বপ্লাবী দ্বীনের পতাকা সমুন্নত করার জন্যে। এই মহান সংশোধনী কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজেরা সংশােধিত হওয়ার ও অপরের কাছে এই আহ্বান পৌছে দেয়ার যােগ্যতা ও সক্ষমতা তাদের মধ্যে কতটুকু ছিলাে ও আছে তা আল্লাহ তায়ালা ভাল জানেন। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে তার রসূল পাঠালেন। তিনি তাদের তার আয়াতগুলাে তেলাওয়াত করে শােনালেন, তাদের যাবতীয় অসৎ ব্যবহার, বদঅভ্যাস ও খারাপ কাজ থেকে পবিত্র করলেন এবং তাদের মহান এ কিতাব ও যুক্তি-বুদ্ধিপূর্ণ কথা শেখালেন, যদিও এর পূর্বে তারা স্পষ্ট গােমরাহীর মধ্যে নিমজ্জমান ছিলাে। এ সংশোধনী প্রচেষ্টা ও এ শিক্ষা ছিলাে পরবর্তী সেসব লােকের জন্যেও, যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি। আর তিনিই মহাশক্তিমান মহা বিজ্ঞানময়। মরুবাসী এ বেদুইনদের সম্পর্কে ইতিহাস ও অন্যান্য বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ইমাম বোখারী(র.) আবু হােরায়রা(রা.)-এর হাদীস রেওয়ায়াত করতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা বলেন, ‘আমরা একদিন নবী(স.)-এর কাছে বসে ছিলাম, তখন তাঁর কাছে সূরা জুমুয়া নাযিল হলাে, যার মধ্যে ‘ওয়া আখারীনা মিনহুম লাম্মা ইয়ালহাকু বিহিম’ অর্থাৎ এরা বাদে অন্যান্য আরও ব্যক্তিদেরও পবিত্র করতে চাইলেন, যারা এখনও তাদের সাথে মিলিত হয়নি আয়াতটিও রয়েছে। আয়াতটি শােনার সাথে সাথে সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা ইয়া রসূলাল্লাহ? কথাটির উত্তর দেয়ার পূর্বে তারা তিন বার কথাটি জিজ্ঞেস করলেন। তখন আমাদের সাথে সালমান ফারসীও উপস্থিত ছিলেন। অতপর রসূলুল্লাহ(স.) সালমান ফারেসী(রা.)-এর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঈমান যদি সুরাইয়া তারকার কাছেও থাকে, তাহলে অবশ্যই সেখান থেকেও এ সকল ব্যক্তি অথবা ওদের মধ্যে কোনাে ব্যক্তি তা পেয়ে যাবে। রসূলুল্লাহ(স.)-এর এই আচরণ এবং এই কথায় ইশারা পাওয়া গেলাে, অন্যান্য লােক বলতে পারস্যের লােকদের বুঝানাে হয়েছে, যেহেতু সালমান ফারসী ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। আর প্রখ্যাত আলেম মােজাহেদ এই আয়াত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এ আয়াতে আরব দেশের বাইরের যারাই নবীকে সত্য বলে জেনেছে ও মেনে নিয়েছে, তাদের সবাইকে বুঝানাে হয়েছে।’ ইবনে আবী হাতেম সাহল ইবনে সাদের বরাত দিয়ে রসূলুল্লাহ(স.)-এর হাদীস উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, আমার উম্মতের আওলাদ, তাদের আওলাদ, তাদের আওলাদের মধ্য থেকে বহু পুরুষ ও নারী বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ এরপর তিনি পাঠ করলেন, ‘ওয়া আখারীনা মিনহুম লাম্মা ইয়ালহা বিহিম’, অর্থাৎ উম্মতে মােহাম্মদীর (উপস্থিত এই ব্যক্তিরা ছাড়া) অবশিষ্ট অংশ সবাই এই আয়াতের অন্তর্গত। এই আয়াত সম্পর্কে রসূল(স.)-এর উল্লিখিত দুটি কথাতেই উভয় শ্রেণীর লােকদের বুঝায়, অর্থাৎ অনারব ও রাসূল(স.)-এর যমানার পরবর্তী সকল উম্মত। এ কথাগুলাে থেকে এও বুঝা যায় যে, পৃথিবীর সকল এলাকায় সকল যমানায় যারাই এই ঈমান ও ইসলামের আমানত বহন করতে থাকবে এবং এই দ্বীন (ইসলামী জীবন ব্যবস্থা) অনুযায়ী জীবন যাপন করবে, তারা সবাই এই আয়াতের লক্ষ্য। আর তিনিই মহাশক্তিমান মহাবিজ্ঞানময়। তিনিই সকল শক্তির মালিক, সব কিছু করতে সক্ষম ও সকল কিছুর ওপর একমাত্র তারই অধিকার বিদ্যমান। তিনিই জ্ঞানী ও সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনিই সবখান থেকে তার পছন্দমতাে লােক বাছাই করে তাদের দায়িত্ব দান করেন। তার মেহেরবানী ও সম্মান তিনি পূর্ববর্তী পরবর্তী সবাইকে দান করেছেন ও করেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, এই হচ্ছে আল্লাহর সেই মেহেরবানী, যা তিনি দান করেন যাকে ইচ্ছা তাকে। তার বাণী ও শিক্ষা বহন করার দায়িত্ব যে কোনাে উম্মত, দল বা ব্যক্তি, যাকে ইচ্ছা তাকেই তিনি দেন। আল্লাহর এ বাতি কার হাতে দিতে হবে, কার হাতে রাখা হবে, কার হাতে সােপর্দ করা হবে এ গুরুদায়িত্ব, আর কোন্ কেন্দ্রে এবং কোন্ স্থানে আসমান ও যমীনের মিলন হবে তা সবই তার জানা। এ দায়িত্বের বােঝা বহন করা এমন এক মর্যাদা যার কোনাে তুলনা নেই। এ মহান মর্যাদাবােধ গড়ে ওঠে একজন মােমেনের মধ্যে তার নিজের অন্তর থেকে, তার বিষয়-আশয় এবং জীবনের সব কিছু থেকে সে এ মর্যাদা পেতে থাকে। এমনকি জীবন পথে চলতে গিয়ে মানুষকে যেসব অসুবিধার মােকাবেলা করতে হয়, দুঃখ সংকট ও সংসারের নানা প্রকার জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয় এবং সত্য পথে থাকতে গিয়ে যে কঠিন সংগ্রাম করতে হয় এসব কিছুর মধ্যে সে এই মর্যাদা অনুভব করতে থাকে। মদীনার মুসলমান জামায়াত, আশেপাশের লােক ও অনাগত ভবিষ্যতের সকল মানুষকে আল্লাহ তায়ালা একথা জানাচ্ছেন, স্মরণ করাচ্ছেন যে, তার এই কিতাব তিলাওয়াত করে শােনানাে, মানুষকে দোষত্রুটি মুক্ত করার কাজ এবং আল কোরআন ও এর সংশ্লিষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাদানের এই আমানত যারাই বহন করবে, তারাই এই মহান মর্যাদার অধিকারী হবে। রসূলকে অবশ্যই এই একই উদ্দেশ্যে পাঠানাে হয়েছিলাে। তাঁর প্রশিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তিনি আল্লাহর কিতাব পড়ে শােনাতেন, তার নিজের মহান ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তাদের যাবতীয় দোষ, ত্রুটি ও কদর্য খাসলত থেকে পবিত্র করার কাজ করতেন এবং তাঁর সাহাবাদের যুক্তি-বুদ্ধিপূর্ণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শেখাতেন। অনাগত ভবিষ্যতের সকল মানুষের জন্যে এই দুটি আয়াত আল্লাহর এমন মহান নেয়ামতভরা ভান্ডারের দরজা খােলা রেখে দিয়েছে, যেখানে যে কোনাে মানুষ প্রবেশ করে এ মহামূল্যবান সম্পদ হাসিল করতে পারে। এর সাথে আরও রয়েছে প্রথম যুগের ইসলামী দলের লােকদের বাস্তব জীবনের কর্মধারা। আল্লাহ তায়ালা তাদের এই মহান নেয়ামতের কথা স্মরণ করাতে গিয়ে জানাচ্ছেন যে, তার দেয়া এই নেয়ামতের পাশাপাশি মানুষের তৈরী যতো প্রকার মূল্যবোধ ও নেয়ামত লাভ করার জন্যে যতাে ত্যাগই স্বীকার হােক এবং যতাে দুঃখ-বেদনাই ভােগ করা হােক না কেন, সে নেয়ামতের মর্যাদার তুলনায় তা একেবারেই তুচ্ছ।
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ ও গুরুত্ব :
الجمعة জুমু‘আহ অর্থ : একত্রিত করা, সমবেত হওয়া ইত্যাদি। জুমু‘আহ বলতে জুমু‘আর সালাত উদ্দেশ্য। জুমু‘আর সালাতকে এজন্য জুমু‘আহ বলা হয় এ সালাতের জন্য মুসলিমরা দূর দূরান্ত থেকে সপ্তাহে একদিন সমবেত হয়। এ দিনে সমস্ত মাখলুকের সৃষ্টি পরিপূর্ণ করা হয়েছে, কারণ যে ছয় দিনে আকাশ-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে তার ৬ষ্ঠ দিন ছিল জুমু‘আর দিন। এ দিন আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং জান্নাত থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এ দিনই কিয়ামত সংঘঠিত হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ১০৪৬)
এ দিনে এমন একটি সময় রয়েছে যদি কোন মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার কাছে কল্যাণকর কিছু চায় আল্লাহ তা‘আলা তা দান করেন। (সহীহ বুখারী হা. ৯৩৫)
الجمعة শব্দটি অত্র সুরার ৯ নম্বর আয়াতে উল্লেখ হয়েছে। সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর সালাতে সূরা জুমু‘আহ ও সূরা মুনাফিকূন পাঠ করতেন। (সহীহ মুসলিম হা. ৮৭৭)
১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা বলছেন; আকাশে ও জমিনে এবং এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে। অর্থাৎ জীবজন্তু ও জড় পদার্থ যা কিছু আছে সবই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِنْ مِّنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِه۪ وَلٰكِنْ لَّا تَفْقَهُوْنَ تَسْبِيْحَهُمْ ط إِنَّه۫ كَانَ حَلِيْمًا غَفُوْرًا)
“এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না; কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না; নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” (সূরা ইসরা ১৭ : ৪৪)
الْقُدُّوْسِ অর্থ হল : সকল অপূর্ণাঙ্গ গুণাবলী থেকে পবিত্র, সকল পূর্ণাঙ্গ গুণে গুণান্বিত।
(هُوَ الَّذِيْ بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّيْنَ) – اميين
(নিরক্ষর) বলতে যাদের কোন আসমানী কিতাব নেই এবং রিসালাতের চিহ্নও নেই। তারা আরব হোক কিম্বা অনারব হোক। (তাফসীর সা‘দী)।
হাফেয ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : اميين (নিরক্ষর) বলা হয় আরবদেরকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَقُلْ لِّلَّذِيْنَ أُوْتُوا الْكِتٰبَ وَالْأُمِّيِّيْنَ أَأَسْلَمْتُمْ ط فَإِنْ أَسْلَمُوْا فَقَدِ اهْتَدَوْ)
“আর কিতাবধারী এবং নিরক্ষরদেরকে বল : তোমরা কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তাহলে তারা হিদায়াত পাবে।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ২০)
এখানে বিশেষ করে اميين (নিরক্ষর) উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত অন্যদের জন্য ছিল না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিরক্ষরদের মাঝে প্রেরণ করে তাদের ওপর যে অনুগ্রহ করেছেন সে জন্য তাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত সারা জাহানের জন্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(قُلْ يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللّٰهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعَا)
“বল ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৫৮)
এ সম্পর্কে সূরা আনআমে আলোচনা করা হয়েছে। এ আয়াতটি ইবরাহীম (আঃ)-এর দু‘আর প্রমাণ। ইবরাহীম (আঃ) মক্কাবাসীর মাঝে রাসূল প্রেরণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করে বলেছিলেন :
(رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ ط إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ)
“হে আমাদের রব! সে দলে তাদেরই মধ্য হতে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন যিনি তাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দান করবেন ও তাদেরকে পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা বাকারাহ ২ : ১২৯)
(وَّاٰخَرِيْنَ مِنْهُمْ)
অর্থাৎ যারা এখনো নিরক্ষরদের সাথে মিলিত হয়নি সে সকল মানুষের জন্যও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাসূল।
اٰخَرِيْنَ দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে মুফাসসিরগণের অভিমত :
(১) ইকরিমা (রহঃ) বলেন : তারা হল তাবেয়ী,
(২) ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন : সাহাবীদের পর কিয়ামত দিবস পর্যন্ত যত মানুষ আসবে সবাই শামিল।
(৩) ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন : আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা আমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বসে ছিলাম। এমন সময় সূরা জুমু‘আহ অবতীর্ণ হল। সাহাবীগণ বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! اٰخَرِيْنَ তথা অন্যান্য এরা কারা? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের কোন জবাব দিলেন না। এমনকি তিনবার জিজ্ঞাসা করা হল। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলছেন, আমাদের মাঝে সালমান ফারেসী (রাঃ) ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালমান ফারেসীর গায়ে হাত রেখে বললেন :
لَوْ كَانَ الإِيمَانُ عِنْدَ الثُّرَيَّا، لَنَالَهُ رِجَالٌ مِنْ هَؤُلاَءِ
ঈমান যদি সুরাইয়া নামক তারকাতেও থাকে তাহলে এ সকল লোক নিয়ে আসবে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৯৭)
এজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রুম ও পারস্যসহ অন্যান্য জাতির নিকট বিভিন্ন চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন। মুজাহিদ (রহঃ)-সহ অনেকে বলেছেন : اٰخَرِیْنَ বা অন্যান্যদের দ্বারা উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক অনারবরা যারাই নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনবে। আল্লামা জাবের আল জাযায়েরী (রহঃ) বলেন : আরব ও অনারব প্রত্যেক সে সকল লোক যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় উপস্থিত হয়নি। (আয়সারুত তাফাসীর)
অতএব বুঝা গেল اٰخَرِيْنَ দ্বারা উদ্দেশ্য হল অনারবের সকল মু’মিন মুসলিমরা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
إِنَّ فِي أَصْلَابِ أَصْلَابِ أَصْلَابِ رِجَالٍ مِنْ أَصْحَابِي، رِجَالًا وَنِسَاءً يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ
আমার সাহাবী হতে বংশানুক্রমে তিন পুরুষ পর্যন্ত আগমনকারী আমার উম্মাতের নারী ও পুরুষরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। (মাযমাউজ জাওয়ায়েদ ১০/৪০৮ সনদ ভাল)।
(ذٰلِكَ فَضْلُ اللّٰهِ)
অর্থাৎ যে নবুওয়াত নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রদান করেছেন তা বিশেষ অনুগ্রহ, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করে থাকেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. জুমু‘আর সালাতে এ সূরা পড়া সুন্নাত।
২. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত সারা জাহানের জন্য।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মী ছিলেন। লিখতে-পড়তে জানতেন না।
৪. আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কেউ দেখুক আর না দেখুক যারাই ঈমান আনবে তাদের ফযীলত জানতে পারলাম।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) জুমআর নামাযে সূরায়ে জুমআহ ও সূরায়ে মুনাফিকূন পাঠ করতেন।
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, সৃষ্ট সব কিছু বাকশক্তি সম্পন্ন হোক বা নির্বাক হোক, সদা-সর্বদা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণায় মগ্ন রয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এমন কোন জিনিস নেই যে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করে না।” (১৭:৪৪) সমস্ত মাখলুক, আসমানেরই হোক বা যমীনেরই হোক, তাঁর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনায় মশগুল রয়েছে। তিনি আকাশ ও পৃথিবীর বাদশাহ্ এবং এ দু’টির মধ্যে তিনি পূর্ণভাবে স্বীয় ব্যবস্থাপনা ও হুকুম জারীকারী। তিনি সর্ব প্রকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি দোষ মুক্ত এবং সমস্ত উত্তম গুণাবলী ও বিশেষণের সাথে বিশেষিত। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞানময়। এর তাফসীর কয়েক জায়গায় গত হয়েছে।
উম্মী দ্বারা আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে বলঃ তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছো? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয়ই তারা পথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তোমার কর্তব্য শুধু প্রচার করা। আল্লাহ্ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” (৩:২০)
এখানে আরবের উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, অনারব এর অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং কারণ শুধু এটাই যে, তাদের উপর অন্যদের তুলনায় ইহ্সান ও ইকরাম বহুগুণে বেশী রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)
অথাৎ “নিশ্চয়ই এটা তোমার জন্যে ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্যে উপদেশ।” (৪৩:৪৪) এখানেও কওমকে খাস করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, কুরআন সারা দুনিয়াবাসীর জন্যে উপদেশ। অনুরূপভাবে আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী)
অর্থাৎ “তুমি তোমার নিকটতম আত্মীয়দেরকে ভীতি প্রদর্শন কর।” (২৬:২১৪) এখানেও উদ্দেশ্য এটা কখনই নয় যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ভীতি প্রদর্শন শুধুমাত্র তাঁর আত্মীয়-স্বজনের জন্যেই খাস, বরং তাঁর সতর্ককরণ তো সাধারণভাবে সবারই জন্যে। মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “ (হে নবী সঃ!) তুমি বলঃ হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবারই নিকট আল্লাহর রাসূল (রূপে এসেছি)।” (৭:১৫৮) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এর মাধ্যমে আমি তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে এবং তাদেরকেও, যাদের কাছে পৌঁছবে।” (৬:১৯) অনুরূপভাবে কুরআন সম্পর্কে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “সমস্ত দলের মধ্যে যে কেউই এটাকে অস্বীকার করবে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।” (১১:১৭) এই ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে যেগুলো দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সারা বিশ্ববাসীর জন্যে রাসূল। সমস্ত মাখলুকের তিনি নবী, তারা লাল হোক না কালোই হোক। সূরায়ে আনআমের তাফসীরে আমরা এটা পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছি এবং বহু আয়াত ও হাদীসও আনয়ন করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই জন্যে।
এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, ঐ নিরক্ষর অর্থাৎ আরবদের মধ্যে তিনি স্বীয় রাসূল (সাঃ)-কে প্রেরণ করেন। এটা এই জন্যে যে, যেন হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দু’আ কবূল হওয়া জানা যায়। তিনি মক্কাবাসীর জন্যে আল্লাহ্ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেছিলেন যে, তিনি যেন তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে পাপ হতে পবিত্র করবেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন। আল্লাহ্ তা’আলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর এ দু’আ কবূল করেন।
ঐ সময় সমস্ত মাখলুকের জন্যে আল্লাহর নবীর কঠিন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আহলে কিতাবের শুধুমাত্র কতক লোক হযরত ঈসা (আঃ)-এর সত্য দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁরা ইফরাত ও তাফরীত হতে বেঁচে ছিলেন। তাঁরা ছাড়া দুনিয়ার সমস্ত মানুষ সত্য দ্বীনকে ভুলে বসেছিল এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টির কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় রাসূল (সাঃ)-কে প্রেরণ করলেন। তিনি ঐ নিরক্ষরদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনালেন, তাদেরকে পাপ হতে পবিত্র করলেন এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিলেন। অথচ ইতিপূর্বে তারা ঘোর বিভ্রান্তিতে ছিল।
আরবরা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের দাবীদার ছিল বটে, কিন্তু অবস্থা এই ছিল যে, তারা ঐ দ্বীনকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বদল করে ফেলেছিল। তারা ঐ দ্বীনের মধ্যে এতো বেশী পরিবর্তন আনয়ন করেছিল যে, তাওহীদ শিরকে এবং বিশ্বাস সন্দেহে পরিবর্তিত হয়েছিল। তারা নিজেরাই বহু কিছু বিদআত আবিষ্কার করে নিয়ে আল্লাহর দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছিল। অনুরূপভাবে আহলে কিতাবও তাদের কিতাবগুলো বদলিয়ে দিয়েছিল, সাথে সাথে অর্থেরও পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা হয়রত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে আযীমুশ শান শরীয়ত এবং পরিপূর্ণ দ্বীনসহ দুনিয়াবাসীর নিকট প্রেরণ করেন, যেন তিনি এই গোলযোগ মিটিয়ে দিতে পারেন। যেন তিনি আহলে কিতাবের নিকট মহান আল্লাহর আসল আহকাম পৌঁছিয়ে দেন, তাঁর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির আহকাম জনগণকে জানিয়ে দেন, এমন আমল তাদেরকে বাতলিয়ে দেন যা তাদেরকে জানাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ লাভ করাবে, তিনি সমস্ত মাখলুকের জন্যে পথ প্রদর্শক হন, শরীয়তের মূল ও শাখা সবই শিক্ষা দেন, ছোট বড় কোন কথা ও কাজ না ছাড়েন, সবারই সমস্ত শক-সন্দেহ দূর করে দেন এবং জনগণকে এমন দ্বীনের উপর আনয়ন করেন যার মধ্যে সর্বপ্রকারের মঙ্গল বিদ্যমান রয়েছে।
এসব মহান দায়িত্ব পালনের জন্যে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মধ্যে এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও বুযুর্গী একত্রিত করেন যা না তার পূর্বে কারো মধ্যে ছিল এবং না তার পরে কারো মধ্যে থাকতে পারে। মহান আল্লাহ সদা-সর্বদা তার উপর দুরূদ ও সালাম বর্ষণ করতে থাকুন!
(আরবী)-এ আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পার্শ্বে বসেছিলাম এমন সময় তার উপর সূরায়ে জুমআহ অবতীর্ণ হয়। জনগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! (আরবী)দ্বারা কাদেরকে বুঝানো হয়েছে?” কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিলেন না। তিনবার এই প্রশ্ন করা হয়। আমাদের মধ্যে হযরত সালমান ফারসীও (রঃ) ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর হাতখানা হযরত সালমান ফারসীর (রাঃ) উপর রেখে বললেনঃ “ঈমান যদি সারিয়্যা নক্ষত্রের নিকট হতো তাহলেও এই লোকগুলোর মধ্যে এক বা কয়েক ব্যক্তি এটা পেয়ে যেতো।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু আবদিল্লাহ বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এ রিওয়াইয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এটা মাদানী সূরা এবং এটাও প্রমাণিত হচ্ছে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সারা দুনিয়াবাসীর জন্যে নবী, শুধু আরববাসীদের জন্যে নয়। কেননা, তিনি এই আয়াতের তাফসীরে পারস্যবাসীদের সম্পর্কে উপরোক্তে মন্তব্য করেন। এ জন্যেই তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) পারস্য ও রোমের সম্রাটদের নিকট ইসলামের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেছিলেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও বলেন যে, এর দ্বারা অনারবদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে এবং তাঁর অহীর সত্যতা স্বীকার করেছে।
হযরত সাহল ইবনে সা’দ সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ “এখন হতে নিয়ে বংশানুক্রমে তিন পুরুষ (পিড়ী) পর্যন্ত আগমনকারী আমার উম্মতের নারী ও পুরুষরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” অতঃপর তিনি ….(আরবী) এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
‘তিনি (আল্লাহ) পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ অর্থাৎ তিনি স্বীয় শরীয়ত ও তকদীর নির্ধারণে প্রবল পরাক্রম ও মহাবিজ্ঞানময়।
মহান আল্লাহর উক্তিঃ এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা এটা তিনি দান করেন। আল্লাহ তো বড় অনুগ্রহশীল।’ অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে এরূপ আযীমুশ শান নবুওয়াত দান করা এবং এই মহান অনুগ্রহে অনুগৃহীত করা আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি তাঁর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা দান করে থাকেন। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল।