: أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৮৩) [গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা বিস্ময়কর! ]
সূরা:- আল-কাহাফা।
সুরা:১৮
০৯-২৬ নং আয়াত:-
[ اَمۡ حَسِبۡتَ اَنَّ اَصۡحٰبَ الۡکَہۡفِ وَ الرَّقِیۡمِ ۙ
গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা বিস্ময়কর! ]
www.motaher21.net
اَمۡ حَسِبۡتَ اَنَّ اَصۡحٰبَ الۡکَہۡفِ وَ الرَّقِیۡمِ ۙ کَانُوۡا مِنۡ اٰیٰتِنَا عَجَبًا ﴿۹﴾
তুমি কি মনে কর যে, গুহা ও রাকীমের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর?
18:10
اِذۡ اَوَی الۡفِتۡیَۃُ اِلَی الۡکَہۡفِ فَقَالُوۡا رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ رَحۡمَۃً وَّ ہَیِّیٴۡ لَنَا مِنۡ اَمۡرِنَا رَشَدًا ﴿۱۰﴾
যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল, তখন তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিজের তরফ থেকে আমাদেরকে করুণা দান কর এবং আমাদের কাজ-কর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা কর।’
فَضَرَبۡنَا عَلٰۤی اٰذَانِہِمۡ فِی الۡکَہۡفِ سِنِیۡنَ عَدَدًا ﴿ۙ۱۱﴾
অতঃপর আমরা তাদেরকে গুহায় কয়েক বছর ঘুমন্ত অবস্থায় রাখলাম ।
ثُمَّ بَعَثۡنٰہُمۡ لِنَعۡلَمَ اَیُّ الۡحِزۡبَیۡنِ اَحۡصٰی لِمَا لَبِثُوۡۤا اَمَدًا ﴿٪۱۲﴾
পড়ে আমরা তাদেরকে জাগিয়ে দিলাম জানার জন্য যে, দু’দলের মধ্যে কোনটি? তাদের অবস্থিতিকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে।
نَحۡنُ نَقُصُّ عَلَیۡکَ نَبَاَہُمۡ بِالۡحَقِّ ؕ اِنَّہُمۡ فِتۡیَۃٌ اٰمَنُوۡا بِرَبِّہِمۡ وَ زِدۡنٰہُمۡ ہُدًی ﴿٭ۖ۱۳﴾
আমি তোমার কাছে তাদের সঠিক বৃত্তান্ত বর্ণনা করছিঃ তারা ছিল কয়েকজন যুবক, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম ।
وَّ رَبَطۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ اِذۡ قَامُوۡا فَقَالُوۡا رَبُّنَا رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ لَنۡ نَّدۡعُوَا۠ مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اِلٰـہًا لَّقَدۡ قُلۡنَاۤ اِذًا شَطَطًا ﴿۱۴﴾
আর আমরা তাদের চিত্ত দৃঢ় করে দিলাম; তারা যখন উঠে দাঁড়াল তখন বলল, ‘আমাদের রব। আসমানসমূহ ও যমীনের রব। আমরা কখনই তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহকে ডাকব না; যদি ডাকি, তবে তা হবে খুবই গর্হিত কথা।
ہٰۤؤُلَآءِ قَوۡمُنَا اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اٰلِہَۃً ؕ لَوۡ لَا یَاۡتُوۡنَ عَلَیۡہِمۡ بِسُلۡطٰنٍۭ بَیِّنٍ ؕ فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا ﴿ؕ۱۵﴾
আমাদেরই এই স্বজাতিরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এসব উপাস্য সম্বন্ধে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তার চেয়ে অধিক সীমালংঘনকারী আর কে?
وَ اِذِ اعۡتَزَلۡتُمُوۡہُمۡ وَمَا یَعۡبُدُوۡنَ اِلَّا اللّٰہَ فَاۡ وٗۤا اِلَی الۡکَہۡفِ یَنۡشُرۡ لَکُمۡ رَبُّکُمۡ مِّنۡ رَّحۡمَتِہٖ وَیُہَیِّیٴۡ لَکُمۡ مِّنۡ اَمۡرِکُمۡ مِّرۡفَقًا ﴿۱۶﴾
তোমরা যখন তাদের ও তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা করে তাদের সংস্পর্শ হতে বিচ্ছিন্ন হলে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর; তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করবার ব্যবস্থা করবেন।’
وَ تَرَی الشَّمۡسَ اِذَا طَلَعَتۡ تَّزٰوَرُ عَنۡ کَہۡفِہِمۡ ذَاتَ الۡیَمِیۡنِ وَ اِذَا غَرَبَتۡ تَّقۡرِضُہُمۡ ذَاتَ الشِّمَالِ وَ ہُمۡ فِیۡ فَجۡوَۃٍ مِّنۡہُ ؕ ذٰلِکَ مِنۡ اٰیٰتِ اللّٰہِ ؕ مَنۡ یَّہۡدِ اللّٰہُ فَہُوَ الۡمُہۡتَدِ ۚ وَ مَنۡ یُّضۡلِلۡ فَلَنۡ تَجِدَ لَہٗ وَلِیًّا مُّرۡشِدًا ﴿٪۱۷﴾
আর আপনি দেখতে পেতেন- সূর্য উদয়ের সময় তাদের গুহার ডান পাশে হেলে যায় এবং অস্ত যাওয়ার সময় তাদেরকে অতিক্রম করে বাম পাশ দিয়ে , অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে, এ সবই আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম। আল্লাহ্ যাকে সৎপথে পরিচালিত করেন , সে সৎপথপ্রাপ্ত এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি কখনো তার জন্য কোন পথনির্দেশকারী অভিভাবক পাবেন না।
وَ تَحۡسَبُہُمۡ اَیۡقَاظًا وَّ ہُمۡ رُقُوۡدٌ ٭ۖ وَّ نُقَلِّبُہُمۡ ذَاتَ الۡیَمِیۡنِ وَ ذَاتَ الشِّمَالِ ٭ۖ وَ کَلۡبُہُمۡ بَاسِطٌ ذِرَاعَیۡہِ بِالۡوَصِیۡدِ ؕ لَوِ اطَّلَعۡتَ عَلَیۡہِمۡ لَوَلَّیۡتَ مِنۡہُمۡ فِرَارًا وَّ لَمُلِئۡتَ مِنۡہُمۡ رُعۡبًا ﴿۱۸﴾
তুমি মনে করতে, তারা জাগ্রত; কিন্তু আসলে তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম ডানে ও বামে এবং তাদের কুকুর ছিল সম্মুখের পা দুটি গুহার দ্বারে প্রসারিত করে; তাকিয়ে তাদেরকে দেখলে তুমি পিছনে ফিরে পালিয়ে যেতে ও তাদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে।
وَ کَذٰلِکَ بَعَثۡنٰہُمۡ لِیَتَسَآءَلُوۡا بَیۡنَہُمۡ ؕ قَالَ قَآئِلٌ مِّنۡہُمۡ کَمۡ لَبِثۡتُمۡ ؕ قَالُوۡا لَبِثۡنَا یَوۡمًا اَوۡ بَعۡضَ یَوۡمٍ ؕ قَالُوۡا رَبُّکُمۡ اَعۡلَمُ بِمَا لَبِثۡتُمۡ ؕ فَابۡعَثُوۡۤا اَحَدَکُمۡ بِوَرِقِکُمۡ ہٰذِہٖۤ اِلَی الۡمَدِیۡنَۃِ فَلۡیَنۡظُرۡ اَیُّہَاۤ اَزۡکٰی طَعَامًا فَلۡیَاۡتِکُمۡ بِرِزۡقٍ مِّنۡہُ وَ لۡـیَؔتَلَطَّفۡ وَ لَا یُشۡعِرَنَّ بِکُمۡ اَحَدًا ﴿۱۹﴾
এভাবেই আমি তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করে; তাদের একজন বলল, ‘তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ?’ তাদের কেউ কেউ বলল, ‘একদিন অথবা একদিনের কিছু অংশ।’ তাদের কেউ কেউ বলল, ‘তোমরা কতকাল অবস্থান করেছ, তা তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর; সে যেন দেখে কোন খাদ্য উত্তম ও তা হতে যেন কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য; সে যেন সতর্কতা ও নম্রতার সাথে কাজ করে এবং কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকেও কিছু জানতে না দেয়।
اِنَّہُمۡ اِنۡ یَّظۡہَرُوۡا عَلَیۡکُمۡ یَرۡجُمُوۡکُمۡ اَوۡ یُعِیۡدُوۡکُمۡ فِیۡ مِلَّتِہِمۡ وَ لَنۡ تُفۡلِحُوۡۤا اِذًا اَبَدًا ﴿۲۰﴾
তারা যদি তোমাদের বিষয় জানতে পারে, তবে তোমাদেরকে প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। আর সে ক্ষেত্রে তোমরা কখনই সাফল্য লাভ করবে না।
وَ کَذٰلِکَ اَعۡثَرۡنَا عَلَیۡہِمۡ لِیَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ وَّ اَنَّ السَّاعَۃَ لَا رَیۡبَ فِیۡہَا ۚ٭ اِذۡ یَتَنَازَعُوۡنَ بَیۡنَہُمۡ اَمۡرَہُمۡ فَقَالُوا ابۡنُوۡا عَلَیۡہِمۡ بُنۡیَانًا ؕ رَبُّہُمۡ اَعۡلَمُ بِہِمۡ ؕ قَالَ الَّذِیۡنَ غَلَبُوۡا عَلٰۤی اَمۡرِہِمۡ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَیۡہِمۡ مَّسۡجِدًا ﴿۲۱﴾
এভাবে আমি লোকেদেরকে তাদের বিষয় জানিয়ে দিলাম, যাতে তারা জ্ঞাত হয় যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই। যখন তারা তাদের কর্তব্য বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করছিল তখন অনেকে বলল, ‘তাদের উপর সৌধ নির্মাণ কর।’ তাদের প্রতিপালক তাদের বিষয়ে ভাল জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হল, তারা বলল, ‘আমরা তো নিশ্চয়ই তাদের উপর মসজিদ নির্মাণ করব।
سَیَقُوۡلُوۡنَ ثَلٰثَۃٌ رَّابِعُہُمۡ کَلۡبُہُمۡ ۚ وَ یَقُوۡلُوۡنَ خَمۡسَۃٌ سَادِسُہُمۡ کَلۡبُہُمۡ رَجۡمًۢا بِالۡغَیۡبِ ۚ وَ یَقُوۡلُوۡنَ سَبۡعَۃٌ وَّ ثَامِنُہُمۡ کَلۡبُہُمۡ ؕ قُلۡ رَّبِّیۡۤ اَعۡلَمُ بِعِدَّتِہِمۡ مَّا یَعۡلَمُہُمۡ اِلَّا قَلِیۡلٌ ۬۟ فَلَا تُمَارِ فِیۡہِمۡ اِلَّا مِرَآءً ظَاہِرًا ۪ وَّ لَا تَسۡتَفۡتِ فِیۡہِمۡ مِّنۡہُمۡ اَحَدًا ﴿٪۲۲﴾
কেউ কেউ বলবে, ‘তারা ছিল তিনজন , তাদের চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর এবং কেউ কেউ বলবে, তারা ছিল পাঁচজন, তাদের ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর, গায়েবী বিষয়ে অনুমানের উপর নির্ভর করে। আবার কেউ কেউ বলবে , ‘তারা ছিল সাতজন, তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর।’ বলুন, ‘আমার রবই তাদের সংখ্যা ভালো জানেন; তাদের সংখ্যা কম সংখ্যক লোকই জানে । সুতরাং সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের বিষয়ে বিতর্ক করবেন না এবং এদের কাউকেও তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন না।
وَ لَا تَقُوۡلَنَّ لِشَایۡءٍ اِنِّیۡ فَاعِلٌ ذٰلِکَ غَدًا ﴿ۙ۲۳﴾
কখনই তুমি কোন বিষয়ে বলো না যে, ‘আমি ওটা আগামীকাল করব’–
اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ اللّٰہُ ۫ وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ اِذَا نَسِیۡتَ وَ قُلۡ عَسٰۤی اَنۡ یَّہۡدِیَنِ رَبِّیۡ لِاَقۡرَبَ مِنۡ ہٰذَا رَشَدًا ﴿۲۴﴾
ইন শাআল্লাহ (আল্লাহ ইচ্ছা করলে) এই কথা না বলে; যদি ভুলে যাও, তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করো ও বলো, ‘সম্ভবতঃ আমার প্রতিপালক আমাকে এ অপেক্ষা সত্যের নিকটতম পথ নির্দেশ করবেন।’
وَ لَبِثُوۡا فِیۡ کَہۡفِہِمۡ ثَلٰثَ مِائَۃٍ سِنِیۡنَ وَ ازۡدَادُوۡا تِسۡعًا ﴿۲۵﴾
তারা তাদের গুহায় ছিল তিনশ’ বছর, অতিরিক্ত আরো নয় বছর।
قُلِ اللّٰہُ اَعۡلَمُ بِمَا لَبِثُوۡا ۚ لَہٗ غَیۡبُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَبۡصِرۡ بِہٖ وَ اَسۡمِعۡ ؕ مَا لَہُمۡ مِّنۡ دُوۡنِہٖ مِنۡ وَّلِیٍّ ۫ وَّ لَا یُشۡرِکُ فِیۡ حُکۡمِہٖۤ اَحَدًا ﴿۲۶﴾
তুমি বল, ‘তারা কত কাল ছিল, তা আল্লাহই ভাল জানেন। আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই; তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা! তিনি ছাড়া তাদের অন্য কোন অভিভাবক নেই; তিনি কাউকেও নিজ কর্তৃত্বের শরীক করেন না।’
০৯-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৯-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা “আসহাবে কাহ্ফের” ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এটা ছিল একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। কাহফ বলা হয় পাহাড়ের গুহাকে। সেখানে এই যুবকরা লুকিয়ে গিয়েছিল।
আর “রকীম” দ্বারা উদ্দেশ্য কী এ নিয়ে অনেক মতামত পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন, কুকুরের নাম রকীম।
যহ’হাক (রহঃ) বলেন: “রকীম” হল ঐ উপত্যকার নাম যেখানে আসহাবে কাহ্ফরা ছিল।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: “রকীম” একটা অট্টালিকার নাম।
ইমাম শানকিতী (রহঃ) বলেন: ভাষা ও কুরআনের অন্যান্য আয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার কাছে সঠিক মনে হয় রকীম একটি কিতাবের নাম যা তাদের কাছে ছিল। এ কিতাবে তাদের শরয়ী বিধি-বিধান লেখা ছিল তারা যার অনুসরণ করত।
অথবা স্বর্ণের ফলক তাতে তাদের নাম, নসবনামা ও ঘটনা এবং গুহায় চলে যাওয়ার কারণ উল্লেখ ছিল। তবে সঠিক জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলার কাছে।
আসহাবে কাহফ ও রকীম কি একই দলের নাম, না তারা আলাদা দুটি দল, নাকি অন্য কিছু এ ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই। তবে ইমাম বুখারী আসহাবে কাহফ ও আসহাবে রকীমের দুটি আলাদা আলাদা শিরোনাম রেখেছেন। অতঃপর আসহাবে রকীম শিরোনামের অধীনে বানী ইসরাঈলের সে তিন ব্যক্তির ঘটনা নিয়ে এসেছেন যারা ঝড়ের কারণে গুহায় আশ্রয় নেয়, পরে গুহার মুখে পাথর পড়ার কারণে আটকে যায়। ইবনু হাজার আসকালানীসহ অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে কুরআনের পূর্বাপর বর্ণনা অনুযায়ী আসহাবে কাহফ ও রকীম একই দল।
“সংক্ষিপ্ত ঘটনা”
গুহায় আশ্রয় গ্রহণকারীরা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা সত্য দীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিদায়াত লাভ করে। এই যুবকরা তাঁদের দীনকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের কওমের নিকট থেকে পালিয়ে গিয়ে গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এই ভয়ে যে, না জানি তাঁদের কওমের লোকেরা তাঁদেরকে তাঁদের দীন থেকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। সেখানে তাঁরা প্রার্থনা করেছিল যে, হে আল্লাহ তা‘আলা! আপনার পক্ষ থেকে আমাদের ওপর রহমত অবতীর্ণ করুন। আমাদেরকে আমাদের কওম হতে লুকিয়ে রাখুন এবং আমাদের এই কাজের পরিণতি ভাল করুন। অতঃপর তাঁরা সেখানে ঘুমিয়ে পড়ে আর এই ঘুমন্ত অবস্থায়ই বহু বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জাগ্রত করেন। আর তখন তাদের মধ্যে কোন প্রকারের পরিবর্তন সাধিত হয়নি। তারা ঘুমানোর সময় তাদের দেহ, চুল, চামড়া যেরূপ ছিল ঘুম থেকে ওঠার পরও সেরূপই রয়েছে। তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল। আচ্ছা বলত, আমরা কত সময় ঘুমিয়ে ছিলাম? উত্তরে বলা হয়: একদিন বা একদিনেরও কিছু কম। কেননা, সকালে তারা ঘুমিয়ে গিয়েছিল, আর যখন জেগে ওঠে তখন ছিল সন্ধ্যা। তাই তারা সূর্যের ওপর অনুমান করে এ কথা বলেছে। অবশেষে এর সঠিক সিদ্ধান্ত আল্লাহ তা‘আলার দিকে ন্যস্ত করে।
অতঃপর তারা তাদের ক্ষুধা মিটানোর জন্য তাদের মধ্য থেকে একজনকে মুদ্রাসহ বাজারে পাঠায় কিছু খাদ্য ক্রয় করে আনার জন্য এবং তাকে বলে দেয়, সে যেন খুব সতর্কতার সাথে কাজ করে। যতদূর সম্ভব জনগণের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হবে, যাতে কেউ আমাদের খবর জানতে না পারে। কারণ যদি তারা আমাদের খবর জানতে পারে তাহলে কঠিন শাস্তি প্রদান করবে আর আমাদের দীনের ব্যাপারে বিভ্রান্ত করে ফেলবে। কারণ বাদশা দাকইয়ানুস, সে ছিল শির্কী মনোভাবাপন্ন এবং সে মূর্তিপূজা করত। আর তাঁরা এই মূর্তিপূজোকে মানতে পারেনি বলেই তাদের দীন রক্ষার জন্য গুহায় আশ্রয় নেয়, যাতে তাদের দ্বারা কোন শির্ক না হয়ে যায়। আর আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়ে তাদের মনকে আরো দৃঢ় চিত্ত করে দিলেন যাতে তারা ভয় না পায়। আল্লাহ তাদের এ গুহায় সূর্যের মাধ্যমে আলো প্রবেশ করাতেন।
মানুষেরা মনে করত যে, তারা জাগ্রত; মূলত তারা জাগ্রত ছিল না, তারা ছিল ঘুমন্ত। আর আল্লাহ এ অবস্থায়ই তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করাতেন ডানে ও বামে। আর তাদের সাথে একটি কুকুর ছিল। ঐ কুকুরটি তার সম্মুখের পা দু‘টি গুহার দ্বারে প্রসারিত করে রেখেছিল। মানুষেরা এই দৃশ্য দেখলে ভয় পেত। এটি ছিল একটি ভয়ানক দৃশ্য। তারা সে গুহায় ঐ ঘুমন্ত অবস্থায় তিনশত নয় বছর ছিল। আর তাদের সংখ্যা ছিল প্রথমে বলা হয় তিনজন ও চতুর্থজন ছিল তাদের কুকুর। পরবর্তীতে তা খণ্ডন করে বলা হয় পাঁচজন ষষ্ঠজন ছিল তাঁদের কুকুর। তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ই ভাল জানেন এবং তারা কত বছর ঐ ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন তা-ও একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। এভাবেই আল্লাহ স্বীয় ক্ষমতার বলে মানুষকে গুহাবাসীদের অবস্থা অবহিত করালেন। যাতে তারা আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা ও কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সত্যতার জ্ঞান লাভ করে।
এ কাহিনীর দুটি অংশ:
১. এ কাহিনীর আসল উদ্দেশ্য হল ইয়াহূদীদের প্রশ্নের জবাব দেয়া ও মুসলিমদেরকে তাওহীদ শিক্ষা দেয়া।
২. কাহিনীর ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক পটভূমি উক্ত ঘটনাটি কোন্ কালে, কোন্ স্থানে ও জনপদে ঘটেছিল, কাফির বাদশাটি কে ছিল, তাদের সংখ্যা কত ছিল, তারা কতকাল ঘুমিয়েছিল, তারা কি এখনো জীবিত আছে, না মারা গেছে ইত্যাদি।
কুরআনুল কারীমে একজন নাবীর ঘটনা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তিনি হলেন ইউসুফ (عليه السلام), সে সাথে মূসা (عليه السلام)-এর অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ নয় যেমন ইউসুফ (عليه السلام)-এর ঘটনা এসেছে। এ ছাড়া কোন ঘটনার বিশদ বর্ণনা কুরআনে আসেনি। প্রত্যেক কাহিনীর ঐ অংশটুকুই বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে যা মানবীয় হিদায়াত ও শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা অনর্থক, কোন প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন থাকলে আল্লাহ তা‘আলা নিজে অথবা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা বলে দিতেন।
সংক্ষিপ্ত তাফসীর:
(أَمْ حَسِبْتَ) অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি কি মনে করেছ আসহাবে কাহফ ও রকীমের ঘটনা আশ্চর্য ধরণের কোন নিদর্শন? না, বরং আকাশ-জমিন, চন্দ্র-সূর্য ও অন্যান্য বিশাল বিশাল মাখলূক সবই আল্লাহ তা‘আলার বড় বড় নিদর্শন যা আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মহত্বের ওপর প্রমাণ বহন করে। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন, তাঁেক কোন জিনিস অক্ষম করতে পারে না।
(وَّهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا)
অর্থাৎ নিজেদের দীন রক্ষার্থে গুহায় আশ্রয় নেয়া যুবকরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু’আ করে বলেছিল: সঠিক পথে পৌঁছার উপকরণ সহজ করে দিন এবং উভয় জগতের সফলতা দান করুন। এ অর্থও হতে পারে যে, আমাদের পরিণতি ভাল করে দিন।
(فَضَرَبْنَا عَلٰٓي اٰذَانِهِمْ)
অর্থাৎ কানে পর্দা সৃষ্টি করে দিলেন, যাতে বাইরের আওয়াজ তাদের কানে গিয়ে ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। কয়েক বছর বলতে ৩০৯ বছর। (তাফসীর সা‘দী)
এ দুটি দল বলতে তাদের মধ্যে যে দুটি দল মত বিরোধ করেছিল। যেমন ১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
(وَزِدْنٰهُمْ هُدًي)
অর্থাৎ তারা যখন নিজেদের ঈমান রক্ষা করার জন্য গুহায় চলে গেল তাদেরকে দীনের ওপর অটল রাখার জন্য ঈমান বাড়িয়ে দিলাম।
(وَّرَبَطْنَا عَلٰي قُلُوْبِهِمْ)
যেহেতু আত্মীয়-স্বজন, সব কিছু বর্জন করে দেশের বাদশার বিরুদ্ধাচরণ করে চলে যেতে হচ্ছে, তাই জীবন নাশের আশঙ্কা অন্তরে প্রবেশ করতে পারে, তাই তাদের অন্তরকে ঈমানের সাথে বেঁধে দিলাম।
(إِذْ قَامُوْا)
অর্থাৎ এ দাঁড়ানো অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে বাদশার নিকট ছিল। তারা রাজ দরবারে দাঁড়িয়ে তাওহীদের ওয়াজ করছিল। কেউ কেউ বলেছেন, শহর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে একে অপরকে তাওহীদের সে কথা শোনাতে লাগল যা এক এক করে প্রত্যেকের অন্তরে প্রবেশ করে দেয়া হয়েছিল এবং তারা সকলে একত্রিত হয়ে বেরিয়ে আসে।
(تَّزَاوَرُ عَنْ كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِيْنِ)
অর্থাৎ সূর্য ওঠার সময় ডান দিকে এবং অস্ত যাবার সময় বাম দিকে পাশ কেটে চলে যায়। আর এভাবে উভয় সময়ে তাদের ওপর সূর্যের আলো পড়ত না। অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে আরামে অবস্থান করছিল। فَجْوَةٍ অর্থ প্রশস্ত স্থান।
أَيْقَاظًا শব্দটি يقظ এর বহুবচন, অর্থ জাগ্রত। رُقُوْدٌ শব্দটি راقد এর বহুবচন অর্থ ঘুমন্ত। অর্থাৎ তাদেরকে এ জন্য জাগ্রত মনে হচ্ছিল যে, তাদের চোখগুলো জাগ্রত ব্যক্তির মত খোলা ছিল। কেউ বলেছেন: খুব বেশি পার্শ্ব পরিবর্তন করার কারণে তাদরেকে জাগ্রত মনে হচ্ছিল।
(وَكَذٰلِكَ بَعَثْنٰهُمْ)
অর্থাৎ তাদেরকে যেভাবে আমি নিজ কুদরতে ৩০৯ বছর ঘুমের মধ্যে রেখেছিলাম তেমনি কত কাল অবস্থান করেছে তা জিজ্ঞেস করার জন্য জাগ্রত করেছি।
(لِيَعْلَمُوْآ أَنَّ وَعْدَ اللّٰهِ حَقٌ)
অর্থাৎ তাদেরকে আমি যেভাবে ৩০৯ বছর ঘুম পাড়ানোর পর জাগ্রত করেছি তেমনি দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করার পর মৃত্যুর পরে হাজার হাজার বছর অতিত হয়ে গেলেও হিসাব-নিকাশের জন্য পুনরুত্থিত করতে সক্ষম।
(إِذْ يَتَنَازَعُوْنَ بَيْنَهُمْ)
অর্থাৎ তাদের সম্পর্কে সে সময় অবগত করালেন যখন তারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আপোসে বিতর্কে লিপ্ত ছিল।
(فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا)
‘তাদের ওপর সৌধ নির্মাণ কর।’ এ কথা কে বলেছিল? কেউ বলেছেন, সে যুগের ঈমানদারগণ। কেউ বলেছেন; বাদশা ও তার সাথের লোকেরা যখন সেখানে গিয়ে তাদের সাথে সাক্ষাত করল এবং এরপর আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। তখন বাদশা ও তার সাথীরা বলল: এদের হেফাযত করার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ কর।
(الَّذِيْنَ غَلَبُوْا عَلٰٓي أَمْرِهِمْ)
এ প্রবল দলটি ঈমানদার ছিল, না কাফির মুশরিক ছিল? ইমাম শাওকানী প্রথম মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবনু কাসীর দ্বিতীয় মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ কবরকে মাসজিদে পরিণত করা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত, তারা তাদের নাবীদের কবরকে মাসজিদ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৩৫) সুতরাং ঈমানদাররা এ কাজ করতে পারে না।
(سَيَقُوْلُوْنَ)
অর্থাৎ আসহাবে কাহফের সংখ্যা সম্পর্কে মতানৈক্য করেছিল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যুগের আহলে কিতাবরা। তাই আয়াতের শেষের দিকে তাদের সংখ্যা সম্পর্কে আহলে কিতাবদেরকে জিজ্ঞেস করতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিষেধ করা হয়েছে।
(وَلَا تَقُوْلَنَّ لِشَیْءٍ)
এখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিয়ে উম্মাতের সকলকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতের কোন কাজ করতে হলে এ কথা বলা যাবে না: আগামী কাল আমি এ কাজ করব। বরং বলবে: ইনশা-আল্লাহ তা‘আলা আগামীকাল এ কাজ করব। কারণ হতে পারে আগামী কাল সে উক্ত কাজ নাও করতে পারে।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: সুলাইমান ইবনু দাউদ (عليه السلام) বলেছেন: অবশ্যই আমি আজ রাতে (আমার) সত্তরজন স্ত্রীর সাথে সহবাস করব। প্রত্যেক স্ত্রী একজন করে অশ্বারোহী মুজাহিদ গর্ভ ধারণ করবে। এরা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদ করবে। সুলাইমান (عليه السلام)-এর এক সাথী বলল: ইনশা-আল্লাহ বলেন। সুলাইমান (عليه السلام) তা বললেন না। অতঃপর একজন স্ত্রী ছাড়া বাকী আর কেউ গর্ভ ধারণ করেনি। সে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল এবং তারও একটি অঙ্গ ছিল না। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যদি তিনি ইনশা-আল্লাহ বলতেন তাহলে সব স্ত্রীর গর্ভেই সন্তান জন্ম নিত এবং আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদ করতো। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪২৪, সহীহ মুসলিম হা: ১৬৫৪)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যদি জনসমাজে থাকার ফলে ঈমান হারানোর আশঙ্কা থাকে তাহলে তা প্রত্যাখ্যান করা জায়েয।
২. আকাশ ও জমিনের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
৩. হিদায়াত আল্লাহ তা‘আলার হাতে অন্য কেউ হিদায়াতের মালিক নয়।
৪. যা না জানলে দীনের কোন ক্ষতি হবে না তা জানা আবশ্যক নয়।
৫. কিয়ামত অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।
৬. কবরের ওপর মাসজিদ বা সৌধ নির্মাণ করা যাবে না।
৭. কোন অনিশ্চিত বিষয় সম্পর্কে তর্ক বিতর্ক না করে আল্লাহ তা‘আলার দিকে ন্যস্ত করতে হবে।
৮. ভবিষ্যতের কোন কাজের ব্যাপারে অবশ্যই ইনশা-আল্লাহ তা‘আলা বলতে হবে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
#আরবী ভাষায় বড় ও বিস্তৃত গুহাকে ‘কাহফ’ বলা হয় এবং সংকীর্ণ গহ্বরকে বলা হয় “গার।”
# মূল শব্দ হচ্ছে “আর রকীম।” এর বিভিন্ন অর্থ করা হয়েছে। কোন কোন সাহাবী ও তাবেঈর বর্ণনা মতে আসহাবে কাহফের ঘটনাটি যে জনপদে সংঘটিত হয়েছিল সেই জনপদটির নাম ছিল আর রকীম। এটি “আইলাহ” (অর্থাৎ আকাবাহ) ও ফিলিস্তীনের মাঝামাঝি একটি স্থানে অবস্থিত ছিল। আবার অনেক পুরাতন মুফাস্সির বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, এ নাম দিয়ে গুহা মুখে আসহাবে কাহফের স্মৃতি রক্ষার্থে সে ফলক বা শিলালিপিটি লাগানো হয়েছিল। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ তাঁর ‘তরজমানুল কুরআন’ তাফসীর গ্রন্থে প্রথম অর্থটিকে প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন, এ স্থানটিকে বাইবেলের যিহোশূয় পুস্তকের ১৮: ২৬ শ্লোকে রেকম বা রাকম বলা হয়েছে। এরপর তিনি একে ফিলিস্তীনের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কেন্দ্র পেট্টা —এর প্রাচীন নাম হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু তিনি একথা চিন্তা করেননি যে, যিহোশূয় পুস্তকে রেকম বা রাকমের আলোচনা এসেছে বনী বিন ইয়ামীনের (বিন্যামীন সন্তান) মীরাস প্রসঙ্গে। এ সংশ্লিষ্ট পুস্তকের নিজের বর্ণনামতে এ গোত্রের মীরাসের এলাকা জর্দান নদী ও লূত সাগরের ( dead sea ) পশ্চিম দিকে অবস্থিত ছিল। সেখানে পেট্টার অবস্থানের কোন সম্ভাবনাই নেই। পেট্টার ধ্বংসাবশেষ যে এলাকায় পাওয়া গেছে তার ও বনী বিন ইয়ামীনের মীরাসের এলাকার মধ্যে ইয়াহুদা (যিহোদ) ও আদুমীয়ার পুরো এলাকা অবস্থিত ছিল। এ কারণে আধুনিক যুগের প্রত্নত্ববিদগণ পেট্টা ও রেকম একই জায়গার নাম এ ধারণার কঠোর বিরোধিতা করেছেন। (দেখুন ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ১৯৪৬ সালে মুদ্রিত, ১৭ খণ্ড, ৬৫৮ পৃষ্ঠা) আমি মনে করি “আর রকীম” মানে ফলক বা শিলালিপি, এ মতটিই সঠিক।
# যে আল্লাহ এ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তাঁর শক্তিমত্তার পক্ষে কয়েকজন লোককে দু’তিন শো বছর পর্যন্ত ঘুম পাড়িয়ে রাখা এবং তারপর তাদেরকে ঘুমাবার আগে তারা যেমন তরুণ তাজা ও সুস্থ-সবল ছিল ঠিক তেমনি অবস্থায় জাগিয়ে তোলা কি তুমি কিছু অসম্ভব বলে মনে করো? যদি চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে তুমি কখনো চিন্তা-ভাবনা করতে তাহলে তুমি একথা মনে করতে না যে, আল্লাহর জন্য এটা কোন কঠিন কাজ।
#এ কাহিনীর প্রাচীনতম বিবরণ পাওয়া গেছে জেম্স সারোজি নামক সিরিয়ার একজন খৃস্টান পাদরীর বক্তৃতামালায়। তার এ বক্তৃতা ও উপদেশ বাণী সুরিয়ানী ভাষায় লিখিত। আসহাবে কাহফের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ৪৫২ খৃস্টাব্দে তার জন্ম হয়। ৪৭৪ খৃস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে তিনি নিজের এ বক্তৃতামালা সংকলন করেন। এ বক্তৃতামালায় তিনি আসহাবে কাহফের ঘটনাবলী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। আমাদের প্রথম যুগের মুফাসসিরগণ এ সুরিয়ানী বর্ণনার সন্ধান পান। ইবনে জারীর তাবারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থের বিভিন্ন সূত্র মাধ্যমে এ কাহিনী উদ্ধৃত করেছেন। অন্যদিকে এগুলো ইউরোপেও পৌঁছে যায়। সেখানে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় তার অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত সার প্রকাশিত হয়। গিবন তার “রোম সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস” গ্রন্থের ৩৩ অধ্যায়ে ঘুমন্ত সাতজন (Seven sleepers) শিরোনামে ঐসব উৎস থেকে এ কাহিনীর যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন তা আমাদের মুফাসসিরগণের বর্ণনার সাথে এত বেশী মিলে যায় যে, উভয় বর্ণনা একই উৎস থেকে গৃহীত বলে মনে হয়। যেমন যে বাদশাহর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আসহাবে কাহ্ফ গুহাভ্যন্তরে আশ্রয় নেন আমাদের মুফাসসিরগণ তাঁর নাম লিখেছেন ‘দাকায়ানুস’ বা ‘দাকিয়ানুস’ এবং গিবন বলেন, সে ছিল কাইজার ‘ডিসিয়াস’ (decious) এ বাদশাহ ২৪৯ থেকে ২৫১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত রোম সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে এবং ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালাবার ব্যাপারে তার আমলই সবচেয়ে বেশী দুর্নাম কুড়িয়েছে। যে নগরীতে এ ঘটনাটি ঘটে আমাদের মুফাসসিরগণ তার নাম লিখেছেন ‘আফ্সুস’ বা ‘আসসোস’। অন্যদিকে গিবন তার নাম লিখেছেন ‘এফিসুস’ (Ephesus) এ নগরীটি এশিয়া মাইনরের পশ্চিম তীরে রোমীয়দের সবচেয়ে বড় শহর ও বন্দর নগরী ছিল। এর ধ্বংসাবশেষ বর্তমান তুরস্কের ‘ইজমীর’ (স্মার্ণা) নগরী থেকে ২০-২৫ মাইল দক্ষিণে পাওয়া যায়। (দেখুন ২২২ পৃষ্ঠায়)। তারপর যে বাদশাহর শাসনামলে আসহাবে কাহ্ফ জেগে উঠেন আমাদের মুফাসসিরগণ তার নাম লিখেছেন ‘তেযোসিস’ এবং গিবন বলেন, তাদের নিদ্রাভংগের ঘটনাটি কাইজার দ্বিতীয় থিয়োডোসিস (theoosius) এর আমলে ঘটে। রোম সাম্রাজ্য খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে নেয়ার পর ৪০৮ থেকে ৪৫০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রোমের কাইজার ছিলেন। উভয় বর্ণনার সাদৃশ্য এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে আসহাবে কাহ্ফ ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর তাদের যে সাথীকে খাবার আনার জন্য শহরে পাঠান তার নাম আমাদের মুফাসসিরগণ লিখেছেন ‘ইয়াম্লিখা’ এবং গিবন লিখেছেন ‘ইয়াম্লিখুস’ (lamblchus) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণের ক্ষেত্রে উভয় বর্ণনা একই রকমের। এর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, কাইজার ডিসিয়াসের আমলে যখন ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের ওপর চরম নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছিল তখন এ সাতজন যুবক একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর কাইজার থিযোডোসিসের রাজত্বের ৩৮ তম বছরে অর্থাৎ প্রায় ৪৪৫ বা ৪৪৬ খৃস্টাব্দে তারা জেগে উঠেছিলেন। এ সময় সমগ্র রোম সাম্রাজ্য ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বীনের অনুসারী। ঐ হিসেবে গুহায় তাদের ঘুমানোর সময় ধরা যায় প্রায় ১৯৬ বছর।
কোন কোন প্রাচ্যবিদ এ কাহিনীটিকে আসহাবে কাহফের কাহিনী বলে মেনে নিতে এজন্য অস্বীকার করেছেন যে, সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে কুরআন তাদের গুহায় অবস্থানের সময় ৩০৯ বছর বলে বর্ণনা করছে। কিন্তু ২৫ টীকায় আমি এ জবাব দিয়েছি।
এ সুরিয়ানী বর্ণনা ও কুরআনের বিবৃত্তির মধ্যে সামান্য বিরোধও রয়েছে। এরই ভিত্তিতে গিবন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে “অজ্ঞতা”র অভিযোগ এনেছেন। অথচ যে বর্ণনার ভিত্তিতে তিনি এতবড় দুঃসাহস করছেন তার সম্পর্কে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে, সেটি এ ঘটনার তিরিশ চল্লিশ বছর পর সিরিয়ার এক ব্যক্তি লেখেন। আর এত বছর পর নিছক জনশ্রুতির মাধ্যমে একটি ঘটনার বর্ণনা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছতে পৌঁছতে কিছু না কিছু বদলে যায়। এ ধরনের একটি ঘটনার বর্ণনাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য মনে করা এবং তার কোন অংশের সাথে বিরোধ হওয়াকে নিশ্চিতভাবে কুরআনের ভ্রান্তি বলে মনে করা কেবলমাত্র এমনসব হঠকারী লোকের পক্ষেই শোভা পায় যারা ধর্মীয় বিদ্বেষ বশে বুদ্ধিমত্তার সামান্যতম দাবীও উপেক্ষা করে যায়।
আসহাবে কাহফের ঘটনাটি ঘটে আফসোস (Ephesus) নগরীতে। খৃস্টপূর্ব প্রায় এগারো শতকে এ নগরীটির পত্তন হয়। পরবর্তীকালে এটি মূর্তিপূজার বিরাট কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানকার লোকেরা চাঁদ বিবির পূজা করতো। তাকে বলা হতো ডায়না (diana)। এর সুবিশাল মন্দিরটি প্রাচীন যুগের দুনিয়ার অত্যাশ্চর্য বিষয় বলে গণ্য হতো। এশিয়া মাইনরের লোকেরা তার পূজা করতো। রোমান সাম্রাজ্যেও তাকে উপাস্যদের মধ্যে শামিল করে নেয়া হয়।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পর যখন তাঁর দাওয়াত রোম সাম্রাজ্যে পৌঁছতে শুরু করে তখন এ শহরের কয়েকজন যুবকও শিরক থেকে তাওবা করে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে। খৃস্টীয় বর্ণনাবলী একত্র করে তাদের ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ গ্রেগরী অব টুরস ((Gregory of tours) তার গ্রন্থে (Meraculorum liber) বর্ণনা করেছেন তার সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপঃ
“তারা ছিলেন সাতজন যুবক। তাদের ধর্মান্তরের কথা শুনে কাইজার ডিসিয়াস তাদের নিজের কাছে ডেকে পাঠান। তাদের জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের ধর্ম কি? তারা জানতেন, কাইজার ঈসার অনুসারীদের রক্তের পিপাসু। কিন্তু তারা কোন প্রকার শংকা না করে পরিষ্কার বলে দেন, আমাদের রব তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব। তিনি ছাড়া অন্য কোন মাবুদকে আমরা ডাকি না। যদি আমরা এমনটি করি তাহলে অনেক বড় গুনাহ করবো। কাইজার প্রথমে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, তোমাদের মুখ বন্ধ করো, নয়তো আমি এখানেই তোমাদের হত্যা করার ব্যবস্থা করবো। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন, তোমরা এখনো শিশু। তাই তোমাদের তিনদিন সময় দিলাম। ইতিমধ্যে যদি তোমরা নিজেদের মত বদলে ফেলো এবং জাতির ধর্মের দিকে ফিরে আসো তাহলে তো ভাল, নয়তো তোমাদের শিরশ্ছেদ করা হবে।”
“এ তিন দিনের অবকাশের সুযোগে এ সাতজন যুবক শহর ত্যাগ করেন। তারা কোন গুহায় লুকাবার জন্য পাহাড়ের পথ ধরেন। পথে একটি কুকুর তাদের সাথে চলতে থাকে। তারা কুকুরটাকে তাদের পিছু নেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু সে কিছুতেই তাদের সঙ্গ ত্যাগ করতে রাযী হয়নি। শেষে একটি বড় গভীর বিস্তৃত গুহাকে ভাল আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়ে তারা তার মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। কুকুরটি গুহার মুখে বসে পড়ে। দারুন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত থাকার কারণে তারা সবাই সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েন। এটি ২৫০ খৃস্টাব্দের ঘটনা। ১৯৭ বছর পর ৪৪৭ খৃস্টাব্দে তারা হঠাৎ জেগে উঠেন। তখন ছিল কাইজার দ্বিতীয় থিয়োডোসিসের শাসনামল। রোম সাম্রাজ্য তখন খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং আফসোস শহরের লোকেরাও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেছিল।”
“এটা ছিল এমন এক সময় যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে মৃত্যু পরের জীবন এবং কিয়ামতের দিন হাশরের মাঠে জমায়েত ও হিসেব-নিকেশ হওয়া সম্পর্কে প্রচণ্ড মতবিরোধ চলছিল। আখেরাত অস্বীকাররের ধারণা লোকদের মন থেকে কিভাবে নির্মূল করা যায় এ ব্যাপারটা নিয়ে কাইজার নিজে বেশ চিন্তিত ছিলেন। একদিন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যেন তিনি এমন কোন নিদর্শন দেখিয়ে দেন যার মাধ্যমে লোকেরা আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। ঘটনাক্রমে ঠিক এ সময়েই এ যুবকরা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।”
“জেগে ওঠেই তারা পরস্পরকে জিজ্ঞস করেন, আমরা কতক্ষণ ঘুমিয়েছি? কেউ বলেন একদিন, কেউ বলেন দিনের কিছু অংশ। তারপর আবার একথা বলে সবাই নীরব হয়ে যান যে এ ব্যাপারে আল্লাহই ভাল জানেন। এরপর তারা জীন (Jean) নামে নিজেদের একজন সহযোগীকে রূপার কয়েকটি মুদ্রা দিয়ে খাবার আনার জন্য শহরে পাঠান। লোকেরা যাতে চিনতে না পারে এজন্য তাকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন। তারা ভয় করছিলেন, লোকেরা আমাদের ঠিকানা জানতে পারলে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে এবং ডায়নার পূজা করার জন্য আমাদের বাধ্য করবে। কিন্তু জীন শহরে পৌঁছে সবকিছু বদলে গেছে দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন সবাই ঈসায়ী হয়ে গেছে এবং ডায়না দেবীর পূজা কেউ করছে না। একটি দোকানে গিয়ে তিনি কিছু রুটি কিনেন এবং দোকানদারকে একটি রূপার মুদ্রা দেন। এ মুদ্রার গায় কাইজার ডিসিয়াসের ছবি ছাপানো ছিল। দোকানদার এ মুদ্রা দেখে অবাক হয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে, এ মুদ্রা কোথায় পেলে? জীন বলে এ আমার নিজের টাকা, অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসিনি। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। লোকদের ভীড় জমে ওঠে। এমন কি শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নগর কোতোয়ালের কাছে পৌঁছে যায়। কোতোয়াল বলেন, এ গুপ্ত ধন যেখান থেকে এনেছো সেই জায়গাটা কোথায় আমাকে বলো। জীন বলেন, কিসের গুপ্ত ধন? এ আমার নিজের টাকা। কোন গুপ্তধনের কথা আমার জানা নেই। কোতোয়াল বলেন, তোমার একথা মেনে নেয়া যায় না। কারণ তুমি যে মুদ্রা এনেছো, এতো কয়েক শো বছরের পুরানো। তুমি তো সবেমাত্র যুবক, আমাদের বুড়োরাও এ মুদ্রা দেখেনি।
নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। জীন যখন শোনেন কাইজার ডিসিয়াস মারা গেছে বহুযুগ আগে তখন তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোন কথাই বলতে পারেন না। তারপর আস্তে আস্তে বলেন, এ তো মাত্র কালই আমি এবং আমার ছয়জন সাথী এ শহর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম এবং ডিসিয়াসের জুলুম থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। জীনের একথা শুনে কোতোয়ালও অবাক হয়ে যান। তিনি তাকে নিয়ে যেখানে তার কথা মতো তারা লুকিয়ে আছেন সেই গুহার দিকে চলেন। বিপুল সংখ্যক জনতাও তাদের সাথী হয়ে যায়। তারা যে যথার্থই কাইজার ডিসিয়াসের আমলের লোক সেখানে পৌঁছে এ ব্যাপারটি পুরোপুরি প্রমাণিত হয়ে যায়। এ ঘটনার খবর কাইজার ডিসিয়াসের কাছেও পাঠানো হয়। তিনি নিজে এসে তাদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের থেকে বরকত গ্রহণ করেন। তারপর হঠাৎ তারা সাতজন গুহার মধ্যে গিয়ে সটান শুয়ে পড়েন এবং তাদের মৃত্যু ঘটে। এ সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখে লোকেরা যথার্থই মৃত্যুর পরে জীবন আছে বলে বিশ্বাস করে। এ ঘটনার পর কাইজারের নির্দেশে গুহায় একটি ইবাদাতখানা নির্মাণ করা হয়।
খৃস্টীয় বর্ণনাসমূহে গুহাবাসীদের সম্পর্কে এই যে কাহিনী বিবৃত হয়েছে কুরআন বর্ণিত কাহিনীর সাথে এর সাদৃশ্য এত বেশী যে, এদেরকেই আসহাবে কাহফ বলা অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে হয়। এ ব্যাপারে কেউ কেউ আপত্তি তোলেন যে, এ ঘটনাটি হচ্ছে এশিয়া মাইনরের আর আরব ভূখণ্ডের বাইরের কোন ঘটনা নিয়ে কুরআন আলোচনা করে না, কাজেই খৃস্টীয় কাহিনীকে আসহাবে কাহফের ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া কুরআনের পথ থেকে বিচ্যুতি হবে। কিন্তু আমার মতে এ আপত্তি ঠিক নয়। কারণ কুরআন মজীদে আসলে আরববাসীদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য এমন সব জাতির ও শক্তির অবস্থা আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছে যাদের সম্পর্কে তারা জানতো। তারা আরবের সীমানার মধ্যে থাকুক বা বাইরে তাতে কিছু আসে যায় না। এ কারণে মিসরের প্রাচীন ইতিহাস কুরআনে আলোচিত হয়েছে। অথচ (প্রাচীন) মিসর আরবের বাইরে অবস্থিত ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, মিসরের ঘটনাবলী কেন হতে পারে না? আরববাসীরা যেভাবে মিসর সম্পর্কে জানতো ঠিক তেমনি রোম সম্পর্কেও তো জানতো। রোমান সাম্রাজ্যের সীমানা হিজাযের একেবারে উত্তর সীমান্তের সাথে লাগোয়া ছিল। আরবদের বাণিজ্য কাফেলা দিনরাত রোমীয় এলাকায় যাওয়া আসা করতো। বহু আরব গোত্র রোমানদের প্রভাবাধীন ছিল। রোম আরবদের জন্য মোটেই অজ্ঞাত দেশ ছিল না। সূরা রূম এর প্রমাণ। এছাড়া একথাও চিন্তা করার মতো যে, এ কাহিনীটি আল্লাহ নিজেই স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে কুরআন মজীদে বর্ণনা করেননি। বরং মক্কার কাফেরদের জিজ্ঞাসার জবাবে বর্ণনা করেছেন। আর আহলি কিতাবরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পরীক্ষা করার জন্য মক্কার কাফেরদেরকে তাঁর কাছ থেকে এমন ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দিয়েছিল যে সম্পর্কে আরববাসীরা মোটেই কিছু জানতো না।
# যখন তারা সাচ্চা দিলে ঈমান আনলো তখন আল্লাহ তাদের সঠিক পথে চলার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিলেন এবং তাদের ন্যায় ও সত্যের ওপর অবিচল থাকার সুযোগ দিলেন। তারা নিজেদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবে কিন্তু বাতিলের কাছে মাথা নত করবে না।
# সে সময় এ আল্লাহ বিশ্বাসী যুবকদের জনবসতি ত্যাগ করে পাহড়ে আশ্রয় নিতে হয় সে সময় এশিয়া মাইনরে এ এফিসুস শহর ছিল মূর্তি পূজা ও যাদু বিদ্যার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। সেখানে ছিল ডায়না দেবীর একটি বিরাট মন্দির। এ খ্যাতি তখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু দূরদেশ থেকে লোকেরা ডায়না দেবীর পূজা করার জন্য সেখানে আসতো। সেখানকার যাদুকর, গণক, জ্যোতিষী ও তাবিজ লেখকরা সারা দুনিয়ায় খ্যতিমান ছিল। সিরিয়া, ফিলিস্তীন ও মিসর পর্যন্ত তাদের জমজমাট কারবার ছিল। এ কারবারে ইহুদীদের বিরাট অংশ ছিল এবং ইহুদীরা তাদের এ কারবারকে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের আমল থেকে চলে আসা ব্যবসায় মনে করতো। (দেখুন ইনসাইক্লোপিডিয়া বিবলিক্যাল লিটারেচার) শিরক ও কুসংস্কারে ভারাক্রান্ত এ পরিবেশে আল্লাহ বিশ্বাসীরা যে অবস্থার সম্মূখীন হচ্ছিলেন পরবর্তী রুকূ’তে আসহাবে কাহফের নিম্নোক্ত উক্তি থেকে তা অনুমান করা যেতে পারেঃ “যদি তাদের হাত আমাদের ওপর পড়ে তাহলে তো তারা আমাদের প্রস্তরাঘাতে হত্যা করবে অথবা জোরপূর্বক নিজেদের ধর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।”
#মাঝখান একথাটি উহ্য রাখা হয়েছে যে, এ পারস্পরিক চুক্তি অনুযায়ী তারা শহর থেকে বের হয়ে পাহাড়গুলোর মধ্যে অবস্থিত একটি গুহায় আত্মগোপন করেন, যাতে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু অথবা জোর করে মুরতাদ বানানোর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
# তাদের গুহার মুখ ছিল উত্তর দিকে। এ কারণে সূর্যের আলো কোন মওসূমেই গুহার মধ্যে পৌঁছতো না এবং বাইরে থেকে কোন পথ অতিক্রমকারী দেখতে পেতো না গুহার মধ্যে কে আছে।
# কেউ বাহির থেকে উঁকি দিয়ে দেখলেও তাদের সাতজনের মাঝে মাঝে পার্শ্বপরিবর্তন করতে থাকার কারণে এ ধারণা করতো যে, এরা এমনিই শুয়ে আছে, ঘুমুচ্ছে না।
# পাহাড়ের মধ্যে একটি গুহার কয়েকজন লোকের এভাবে অবস্থান করা এবং সামনে দিকে কুকুরের বসে থাকা এমন একটি ভয়াবহ দৃশ্য পেশ করে যে, উঁকি দিয়ে যারা দেখতে যেতো তারাই তাদেরকে ডাকাত মনে করে ভয়ে পালিয়ে যেতো। এটি ছিল একটি বড় কারণ, যে জন্য লোকেরা এত দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের সম্পর্কে জানতে পারেনি। কেউ কখনো ভিতরে ঢুকে আসল ব্যাপারের খোঁজ খবর নেবার সাহসই করেনি।
# যে অদ্ভূত পদ্ধতিতে তাদেরকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল এবং দুনিয়াবাসীকে তাদের অবস্থা সম্পর্কে বেখবর রাখা হয়েছিল ঠিক তেমনি সুদীর্ঘকাল পরে তাদের জেগে ওঠাও ছিল আল্লাহর শক্তিমত্তার বিস্ময়কর প্রকাশ।
# গুহাবাসী যুবকদের (আসহাবে কাহ্ফ) একজন যখন শহরে খাবার কিনতে গিয়েছিলেন তখন সেখানকার দুনিয়া বদলে গিয়েছিল। মূর্তি পূজারী রোমানরা দীর্ঘদিন থেকে ঈসায়ী হয়ে গিয়েছিল। ভাষা, তাহযীব, তামাদ্দুন, পোষাক-পরিচ্ছদ সব জিনিসেই সুস্পষ্ট পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। দু’শো বছরের আগের এ লোকটি নিজের সাজ-সজ্জা, পোশাক, ভাষা ইত্যাদি প্রত্যেকটি ব্যাপারে হঠাৎ এক দর্শনীয় বিষয়ে পরিণত হলেন। তারপর যখন খাবার কেনার জন্য কাইজার ডিসিয়াসের যুগের মুদ্রা পেশ করলেন তখন দোকানদার অবাক হয়ে গেলো। সুরিয়ানী বর্ণনা অনুসারে বলা যায়, দোকানদারের সন্দেহ হলো হয়তো পুরাতন যুগের কোন গুপ্ত ধনের ভাণ্ডার থেকে এ মুদ্রা আনা হয়েছে। কাজেই আশেপাশের লোকদেরকে সেদিকে আকৃষ্ট করলো। শেষ পর্যন্ত তাঁকে নগর শাসকের হাতে সোপর্দ করা হলো। সেখানে গিয়ে রহস্যভেদ হলো যে, দু’শো বছর আগে হযরত ঈসার (আ) অনুসারীদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের ঈমান বাঁচাবার জন্য পালিয়েছিলেন এ ব্যক্তি তাদেরই একজন। এ খবর শহরের ঈসায়ী অধিবাসীদের মধ্যে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো। ফলে শাসকের সাথে বিপুল সংখ্যক জনতাও গুহায় পৌঁছে গেলো। এখন আসহাবে কাহ্ফগণ যখন জানতে পারলেন যে, তারা দু’শো বছর ঘুমাবার পর জেগেছেন তখন তারা নিজেদের ঈসায়ী ভাইদেরকে সালাম করে শুয়ে পড়লেন এবং তাদের প্রাণবায়ূ উড়ে গেলো।
টিকা:১৮) সুরিয়ানী বর্ণনা অনুযায়ী সেকালে সেখানে কিয়ামত ও পরকাল সম্পর্কে বিষম বিতর্ক চলছিল। যদিও রোমান শাসনের প্রভাবে সাধারণ লোক ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং পরকাল এ ধর্মের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসের অংগ ছিল তবুও তখনো রোমীয় শিরক ও মূর্তি পূজা এবং গ্রীক দর্শনের প্রভাব ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। এর ফলে বহু লোক আখেরাত অস্বীকার অথবা কমপক্ষে তার অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতো। আবার এ সন্দেহ ও অস্বীকরকে যে জিনিসটি শক্তিশালী করছিল সেটি ছিল এই যে, এফিসুসে বিপুল সংখ্যক ইহুদী বাস করতো এবং তাদের একটি সম্প্রদায় (যাদেরকে সাদুকী বলা হতো) প্রকাশ্যে আখেরাত অস্বীকার করতো। তারা আল্লাহর কিতাব (অর্থাৎ তাওরাত) থেকে আখেরাত অস্বীকৃতির প্রমাণ পেশ করতো। এর মোকাবিলা করার জন্য ঈসায়ী আলেমগণের কাছে শক্তিশালী যুক্তি-প্রমাণ ছিল না। মথি, মার্ক ও লুক লিখিত ইঞ্জিলগুলোতে আমরা সাদুকীদের সাথে ঈসা আলাইহিস সালামের বিতর্কের উল্লেখ পাই। আখেরাত বিষয়ে এ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তিনজন ইঞ্জিল লেখকই ঈসা আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে এমন দুর্বল জবাব সংকলন করেছেন যার দুর্বলতা খোদ খৃস্টান পণ্ডিতগণই স্বীকার করেন। ( দেখুন মথি ২২: ৩২-৩৩, মার্ক ১২: ১৮-২৭, লুক ২০: ২৭-৪০ )। এ কারণে আখেরাত অস্বীকারকারীদের শক্তি বেড়ে যাচ্ছিল এবং আখেরাত বিশ্বাসীরাও সন্দেহ ও দোটানার মধ্যে অবস্থান করতে শুরু করছিল। ঠিক এ সময় আসহাবে কাহফের ঘুম থেকে জেগে ওঠার ঘটনাটি ঘটে এবং এটি মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের স্বপক্ষে এমন চাক্ষুষ প্রমাণ পেশ করে যা অস্বীকার করার কোন উপায় ছিল না।
টিকা:১৯) বক্তব্যের তাৎপর্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি ছিল ঈসায়ী সজ্জনদের উক্তি। তাদের মতে আসহাবে কাহ্ফ গুহার মধ্যে যেভাবে শুয়ে আছেন সেভাবেই তাদের শুয়ে থাকতে দাও এবং গুহার মুখ বন্ধ করে দাও। তাদের রবই ভাল জানেন তারা কারা, তাদের মর্যাদা কি এবং কোন্ ধরনের প্রতিদান তাদের উপযোগী।
টিকা:২০) এখানে রোম সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ এবং খৃস্টীয় গীর্জার ধর্মীয় নেতৃবর্গের কথা বলা হয়েছে, যাদের মোকাবিলায় সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী ঈসায়ীদের কথা মানুষের কাছে ঠাঁই পেতো না। পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে সাধারণ খৃস্টানদের মধ্যে বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক গীর্জাসমূহে শির্ক, আউলিয়া পূজা ও কবর পূজা পুরো জোরেশোরে শুরু হয়ে গিয়েছিল। বুযুর্গদের আস্তানা পূজা করা হচ্ছিল এবং ঈসা, মারয়াম ও হাওয়ারীগণের প্রতিমূর্তি গীর্জাগুলোতে স্থাপন করা হচ্ছিল। আসহাবে কাহফের নিদ্রাভংগের মাত্র কয়েক বছর আগে ৪৩১ খৃস্টাব্দে সমগ্র খৃস্টীয় জগতের ধর্মীয় নেতাদের একটি কাউন্সিল এ এফিসুসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আল্লাহ হওয়া এবং হযরত মারয়ামের (আ) “আল্লাহ-মাতা” হওয়ার আকীদা চার্চের সরকারী আকীদা হিসেবে গণ্য হয়েছিল। এ ইতিহাস সামনে রাখলে পরিষ্কার জানা যায়, (قَالَ الَّذِیۡنَ غَلَبُوۡا عَلٰۤی اَمۡرِہِمۡ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَیۡہِمۡ مَّسۡجِدًا) বাক্যে যাদেরকে প্রাধান্য লাভকারী বলা হয়েছে তারা হচ্ছে এমনসব লোক যারা ঈসার সাচ্চা অনুসারীদের মোকাবিলায় তৎকালীন খৃস্টান জনগণের নেতা এবং তাদের শাসকের মর্যাদার অধিষ্ঠিত ছিল এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিষয়াবলী যাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। মূলত এরাই ছিল শিরকের পতাকাবাহী এবং এরাই আসহাবে কাহফের সমাধি সৌধ নির্মাণ করে সেখানে মসজিদ তথা ইবাদাতখানা নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
টিকা:২১) মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক কুরআন মজীদের এ আয়াতটির সম্পূর্ণ উল্টা অর্থ গ্রহণ করেছে। তারা এ থেকে প্রমাণ করতে চান যে, সাহাবীগণের কবরের ওপর সৌধ ও মসজিদ নির্মাণ জায়েয। অথচ কুরআন এখানে তাদের এ গোমরাহীর প্রতি ইঙ্গিত করছে যে, এ জালেমদের মনে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও পরকাল অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রত্যয় সৃষ্টি করার জন্য তাদের যে নিদর্শন দেখানো হয়েছিল তাকে তারা শিরকের কাজ করার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি সুযোগ মনে করে নেয় এবং ভাবে যে, ভালই হলো পূজা করার জন্য আরো কিছু আল্লাহর অলী পাওয়া গেলো। তাছাড়া এই আয়াত থেকে “সালেহীন” লোকদের কবরের ওপর মসজিদ তৈরী করার প্রমাণ কেমন করে সংগ্রহ করা যেতে পারে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিভিন্ন উক্তির মধ্যে এর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছেঃ
আরবী—————————————- “কবর যিয়ারতকারী নারী ও কবরের ওপর মসজিদ নির্মাণকারীদের এবং কবরে যারা বাতি জ্বালায় তাদের প্রতি আল্লাহ লানত বর্ষণ করেছেন।” (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ) আরবী——————- “সাবধান হয়ে যাও, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবীদের কবরকে ইবাদাতখানা বানিয়ে নিতো। আমি তোমাদের এ ধরনের কাজ থেকে নিষেধ করছি।” (মুসলিম)
আরবী——————- “আল্লাহ ইহুদী ও খৃস্টানদের প্রতি লানত বর্ষণ করেছেন। তারা নিজেদের নবীদের কবরগুলোকে ইবাদাতখানায় পরিণত করেছে।” (আহমদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ।)
আরবী———————— “এদের অবস্থা এ ছিল যে, যদি এদের মধ্যে কোন সৎলোক থাকতো তাহলে তার মৃত্যুর পর এরা তার কবরের ওপর মসজিদ নির্মাণ করতো এবং তার ছবি তৈরী করতো। এরা কিয়ামতের দিন নিকৃষ্ট সৃষ্টি হবে।” (মুসনাদে আহমদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও কোন আল্লাহভীরু ব্যক্তি কুরআন মজীদে ঈসায়ী পাদরী ও রোমীয় শাসকদের যে ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড কাহিনীচ্ছলে বর্ণনা করা হয়েছে তাকেই ঐ নিষিদ্ধ কর্মটি করার জন্য দলীল ও প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করাবার দুঃসাহস কিভাবে করতে পারে?
এ প্রসঙ্গে আরো বলা দরকার যে, ১৮৩৪ খৃস্টাব্দে রেভারেণ্ড আরুনডেল (Arundell) এশিয়া মাইনরের আবিষ্কার (Discoveries in Asia Minor) নামে নিজের যে প্রত্যক্ষ দর্শনের ফলাফল পেশ করেন তাতে তিনি বলেন যে, প্রাচীন শহর এফিসুসের ধ্বংসাবশেষ সংলগ্ন পর্বতের ওপর তিনি হযরত মারয়াম ও “সাত ছেলে”র (অর্থাৎ আসহাবে কাহ্ফ সমাধি সৌধের ধ্বংসাবশেষ পেয়েছেন।
# এ থেকে জানা যায়, এ ঘটনার পৌনে তিনশো বছর পরে কুরআন নাযিলের সময় এ বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে খৃস্টানদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী প্রচলিত ছিল। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি সাধারণ লোকদের জানা ছিল না। আসলে তখন তো ছাপাখানার যুগ ছিল না। কাজেই যেসব বইতে তাদের সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে বেশী সঠিক তথ্যাদি ছিল সেগুলো সাধারণভাবে প্রকাশ করার কোন সুযোগ ছিল না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মৌলিক বর্ণনার সাহায্যে ঘটনাবলী চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো এবং সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তাদের বহু বিররণ গল্পের রূপ নিতো। তবুও যেহেতু তৃতীয় বক্তব্যটির প্রতিবাদ আল্লাহ করেননি তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, সঠিক সংখ্যা সাতই ছিল।
টিকা:২৩) এর অর্থ হচ্ছে, তাদের সংখ্যাটি আসল নয় বরং আসল জিনিস হচ্ছে এ কাহিনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। এ কাহিনী থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, একজন সাচ্চা মু’মিনের কোন অবস্থায়ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং মিথ্যার সামনে মাথা নত করে দেবার জন্য তৈরী থাকা উচিত নয়। এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মু’মিনের ভরসা দুনিয়াবী উপায়-উপকরণের উপর নয় বরং আল্লাহর উপর থাকতে হবে এবং সত্যপথানুসারী হবার জন্য বাহ্যত পরিবেশের মধ্যে কোন অনুকূল্যের চিহ্ন না দেখা গেলেও আল্লাহর উপর ভরসা করে সত্যের পথে এগিয়ে যেতে হবে। এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, যে “প্রচলিত নিয়ম”কে লোকেরা “প্রাকৃতিক আইন” মনে করে এবং এ আইনের বিরুদ্ধে দুনিয়ায় কিছুই হতে পারে না বলে ধারণা করে, আসলে আল্লাহর মোটেই তা মেনে চলার প্রয়োজন নেই। তিনি যখনই এবং যেখানেই চান এ নিয়ম পরিবর্তন করে যে অস্বাভাবিক কাজ করতে চান করতে পারেন। কাউকে দু’শো বছর ঘুম পাড়িয়ে এমনভাবে জাগিয়ে তোলা যে, সে যেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েছে এবং তার বয়স, চেহারা-সুরত, পোশাক, স্বাস্থ্য তথা কোন কিছুর ওপর একালের বিবর্তনের কোন প্রভাব না পড়া, এটা তাঁর জন্য কোন বড় কাজ নয়। এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মানবজাতির অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত বংশধরদেরকে একই সঙ্গে জীবিত করে উঠিয়ে দেয়া, যে ব্যাপারে নবীগণ ও আসমানী কিতাবগুলো আগাম খবর দিয়েছে, আল্লাহর কুদরতের পক্ষে মোটেই কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। এ থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, অজ্ঞ ও মূর্খ মানুষেরা কিভাবে প্রতি যুগে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে নিজেদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও শিক্ষার সম্পদে পরিণত করার পরিবর্তে উল্টা সেগুলোকে নিজেদের বৃহত্তর ভ্রষ্টতার মাধ্যমে পরিণত করতো। আসহাবে কাহফের অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ মানুষকে এজন্য দেখিয়েছিলেন যে, মানুষ তার মাধ্যমে পরকাল বিশ্বাসের উপকরণ লাভ করবে, ঠিক সেই ঘটনাকেই তারা এভাবে গ্রহণ করলো যে, আল্লাহ তাদেরকে পূজা করার জন্য আরো কিছু সংখ্যক অলী ও পূজনীয় ব্যক্তিত্ব দিয়েছেন। —এ কাহিনী থেকে মানুষকে এ আসল শিক্ষাগুলো গ্রহণ করা উচিত এবং এর মধ্যে এগুলোই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত বিষয়। এ বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে এ মর্মে অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু করে দেয়া যে, আসহাবে কাহফ কতজন ছিলেন, তাদের নাম কি ছিল, তাদের কুকুরের গায়ের রং কি ছিল —এসব এমন ধরনের লোকের কাজ যারা ভেতরের শাঁস ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র বাইরের ছাল নিয়ে নাড়াচাড়া করা পছন্দ করে। তাই মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে মু’মিনদেরকে এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, যদি অন্য লোকেরা এ ধরনের অসংলগ্ন বিতর্কের অবতারণা করেও তাহলে তোমরা তাতে নাক গলাবে না এবং এ ধরনের প্রশ্নর জবাব দেবার জন্য অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়ে নিজেদের সময় নষ্ট করবে না। বরং কেবলমাত্র কাজের কথায় নিজেদের সময় ক্ষেপন করবে। এ কারণেই আল্লাহ নিজেও তাদের সঠিক সংখ্যা বর্ণনা করেননি। এর ফলে আজে বাজে বিষয়ের মধ্যে নাক গলিয়ে অযথা সময় নষ্ট করতে যারা অভ্যস্ত তারা নিজেদের এ অভ্যাসকে জিইয়ে রাখার মাল মসলা পাবে না।
# এটি একটি প্রাসঙ্গিক বাক্য। পেছনের আয়াতগুলোর বক্তব্যের সাথে সংযোগ রেখে ধারাবাহিক বক্তব্যের মাঝখানে একথাটি বলা হয়েছে। পেছনের আয়াতগুলোতে বলা হয়েছিলঃ আসহাবে কাহফের সঠিক সংখ্যা একমাত্র আল্লাহই জানেন এবং এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই অনর্থক একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ো না এবং এ ব্যাপারে কারো সাথে বিতর্কও করো না। এ প্রসঙ্গে সামনের দিকে কথা বলার আগে প্রাসাংগিক বাক্য হিসেবে নবী ﷺ ও মু’মিনদেরকে আরো একটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেটি হচ্ছে এই যে, তুমি কখনো দাবী করে একথা বলো না যে, আমি আগামীকাল অমুক কাজটি করবো। তুমি ঐ কাজটি করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে তুমি কীইবা জানো! তোমার অদৃশ্যের জ্ঞান নেই এবং যা ইচ্ছা তা করতে পারবে নিজের কাজের ব্যাপারে এমন স্বাধীন ক্ষমতাও তোমার নেই। তাই কখনো বেখেয়ালে যদি মুখ থেকে এমন কথা বের হয়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই সাবধান হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করো এবং ইন্শাআল্লাহ বলে দাও। তাছাড়া তুমি যে কাজটি করতে বলছো সেটাই অপেক্ষাকৃত কল্যাণকর না অন্য কাজ তার চেয়ে ভাল, একথাও তুমি জানো না। কাজেই আল্লাহর ওপর ভরসা করে এভাবে বলোঃ আশা করা যায় আমার রব এ ব্যাপারে সঠিক কথা অথবা সঠিক কর্মপদ্ধতির দিকে আমাকে চালিত করবেন।
# আমার মতে এ বাক্যটির সংযোগ রয়েছে পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে। অর্থাৎ বাক্যের ধারাবাহিকতা এভাবে সংরক্ষিত হয়েছে যে, “কিছু লোক বলবে তারা তিনজন ছিল এবং চুতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর …………………….. আর কিছু লোক বলে, তারা নিজেদের গুহায় তিনশো বছর ঘুমিয়ে ছিলেন এবং কিছু লোক এ মেয়াদ গণনা করতে গিয়ে আরো নয় বছর বেড়ে গেছে।” এ বাক্যে তিনশো ও নয় বছরের যে সংখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে আমার মতে তা আসলে লোকদের উক্তি যা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে, এটা আল্লাহর উক্তি নয়। এর প্রমাণ হচ্ছে, পরবর্তী বাক্যে আল্লাহ নিজেই বলছেনঃ তুমি বলো, তারা কতদিন ঘুমিয়েছিল তা আল্লাহই ভাল জানেন। যদি ৩০৯ এর সংখ্যা আল্লাহ নিজেই বলে থাকতেন তাহলে তারপর একথা বলার কোন অর্থ ছিল না। এ প্রমাণের ভিত্তিতেই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও এ সদর্থ করেছেনে যে, এটি আল্লাহর উক্তি নয় বরং লোকদের উক্তির উদ্ধৃতি মাত্র।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
# *আসহাবে কাহাফের ঘটনা : এরপর শুরু হয়েছে আসহাবুল কাহফের ঘটনা। নিষ্ঠাবান মােমেনদের অন্তরে ঈমান কতাে দৃঢ় ও মযবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, তার একটা নমুনা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। মােমেনের হৃদয় কিভাবে তার ঈমান নিয়ে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকে, কিভাবে পার্থিব সহায় সম্পদ ও ভােগবিলাসের ওপর ঈমানকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। ঈমান নিয়ে সমাজে টিকতে না পারলে কিভাবে তা নিয়ে প্রয়ােজনে পর্বতগুহায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে, কিভাবে আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে যাবতীয় বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং কিভাবে তাদের ওপর নিজের করুণার ছায়া বিস্তার করেন, তা এ কাহিনী সুস্পষ্ট। এ কাহিনী সম্পর্কে বহু বর্ণনা ও বহু জনশ্রুতি রয়েছে। কতিপয় প্রাচীন পুস্তকে ও উপকথায় বিভিন্নভাবে এ কাহিনীর বিবরণ পাওয়া যায়। তবে আমরা সেসব বিবরণকে হুবহু গ্রহণ করতে পারি না। আমাদেরকে একমাত্র কোরআনের বিবরণেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। কেননা এটাই একমাত্র নির্ভুল উৎস। বিভিন্ন তাফসীরে বিশুদ্ধ সূত্রের বরাত ছাড়া যেসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তা আমরা বর্জন করেছি। কেননা কোরআন নিজেই আমাদেরকে তার বাইরের অপ্রামাণ্য তথ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করেছে এবং অনুমাননির্ভর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করতে বলেছে। এই কিসসা ও জুলকারনাইনের কিসসা সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, ইহুদীরা মক্কাবাসীকে রসূল(স.)-এর কাছে এই দুটো ঘটনা ও আত্মা কী জিনিস, তা জিজ্ঞেস করতে প্ররােচনা দিয়েছিলাে। আবার কিছু কিছু বর্ণনায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, মক্কাবাসীই ইহুদীদের কাছে এমন কিছু প্রশ্নের ফিরিস্তি চেয়েছিলাে, যা দ্বারা তারা রসূল(স.)-এর সত্যবাদিতা পরীক্ষা করবে। এসব বর্ণনা পুরােপুরি বা আংশিক সত্য হতে পারে। যুলকারনাইনের ঘটনার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘তারা তােমাকে জুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে।’… কিন্তু আসহাবুল কাহাফের ঘটনার শুরুতে এ ধরনের প্রশ্নের কোনো উল্লেখ্য নেই । এবার আমরা এই ঘটনা নিয়ে কিছুটা বিস্তৃত আলােচনা করছি। আমরা আগেই বলে এসেছি যে এই সূরার কেন্দ্রীয় বক্তব্যের সাথে এ ঘটনার সুস্পষ্ট সংযােগ রয়েছে। এই ঘটনা উপস্থাপনে শৈল্পিক দিক দিয়ে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তা হলাে প্রথমে সংক্ষিপ্ত সার এবং পরে বিশদ বিবরণ দানের পদ্ধতি। এতে ঘটনার কিছু কিছু দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে এবং কিছু কিছু দৃশ্য শূন্য রাখা হয়েছে, যা আয়াতের ভাষা থেকেই বুঝা যায়। কাহিনীটা শুরু হয়েছে এভাবে, ‘তুমি কি ভেবে দেখেছো যে, গুহা ও ‘রাকিম’ এর অধিবাসীদের কথা? তারা ছিলাে আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর! যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিলো, তখন বললাে, হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি তােমার পক্ষ থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করাে…'(আয়াত ৯-১২) এখানে গােটা কাহিনীর সংক্ষিপ্ত সার দেয়া হয়েছে এবং এর সুদূরপ্রসারী রূপরেখা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ থেকে আমরা যা জানতে পারি তা হলাে, গুহাবাসীরা ছিলাে কতিপয় যুবক। তবে তাদের সংখ্যা অজ্ঞাত। তারা ঈমানদার অবস্থায় গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলাে। গুহার ভেতরে অবস্থানকালে তাদের কানে তালামারা ছিলাে। অর্থাৎ তারা ঘুমন্ত ছিলাে এবং কতাে বছর যাবত ঘুমন্ত ছিলাে তা আমাদের অজানা। পরে এক সময় তারা তাদের দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাে। তাদের দুটো দল ঘুমের সময় নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাে। অতপর তারা গুহায় অবস্থান করার পর আবার জেগে ওঠে, যাতে কোন পক্ষের তথ্য অধিকতর সঠিক তা জানা যায়। তাদের ঘটনাটা বিরল হলেও আল্লাহর নিদর্শন হিসাবে বিস্ময়কর নয়। বিশ্বপ্রকৃতিতে ও তার আশ পাশের সৃষ্টি জগতে গুহা ও রাকীমবাসীর চেয়েও বিস্ময়কর জিনিস অনেক রয়েছে। (‘কাহফ’ হচ্ছে পর্বতের গুহা বা ফাঁকা স্থান। আর ‘রাকীম’ সাধারণত সেই ফলককে বলা হয় যাতে গুহাবাসীর নামের তালিকা রয়েছে। সম্ভবত এই ফলকটা ঐ গুহার দরজায় ঝুলন্ত পাওয়া গিয়েছিলাে) কাহিনীটার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিকারী এই সংক্ষিপ্ত সার তুলে ধরার পর এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া শুরু হয়েছে। এই বিস্তারিত বিবরণের শুরুতেই বলা হয়েছে যে, ‘আল্লাহ তায়ালা এ কাহিনী সম্পর্কে যা বলছেন, সেটাই সকল পরস্পর বিরােধী তথ্যসমূহের মধ্যে সঠিক, চূড়ান্ত ও নিশ্চিত তথ্য।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তােমার কাছে তাদের প্রকৃত তথ্য ব্যক্ত করছি।’…(আয়াত ১৩-১৬) এ চারটা আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে এই কাহিনীর প্রথম দৃশ্য। ‘তারা ছিলাে এমন কতিপয় যুবক, যারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিলো এবং আমি তাদেরকে আরাে বেশী হেদায়াত দিয়েছিলাম।’ অর্থাৎ তাদের কী কর্মপন্থা অবলম্বন করা উচিত, তা আমি তাদের মগযে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। ‘আমি তাদের চিত্ত দৃঢ় করে দিলাম।’ ফলে তাদের মন শান্ত হয়ে গেলাে, যে সত্যের পথে তারা আছে, সে সম্পর্কে সংশয়মুক্ত হয়ে গেলাে এবং ঈমানদার হওয়াকেই তারা গর্ব ও সম্মানের ব্যাপার বলে মনে করলো। ‘যখন তারা দাঁড়ালো’ বস্তুত দাঁড়ানাে হলো দৃঢ় সংকল্প ও স্থিরতার লক্ষণ। তারা বললাে, ‘আমাদের প্রভু তিনিই, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর প্রভু।’ অর্থাৎ তিনি গােটা বিশ্বজগতের প্রভু ও অধিপতি। ‘আমরা তাকে ছাড়া আর কোনাে মাবুদকে ডাকবাে না।’ কেননা তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনাে শরীক নেই। ‘(যদি ডাকি) তবে আমরা হবাে অসত্য ভাষী।’ অর্থাৎ আমরা তাহলে বিপথগামী হয়ে যাবাে ও সঠিক পথ হারিয়ে ফেলবে। অতপর তারা তাদের জাতির অনুসৃত পথের দিকে দৃষ্টি দিলাে এবং তার সমালােচনা করে বললাে, ‘এই হলাে আমাদের জাতি। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে ইলাহ মেনে নিয়েছে। তারা নিজেদের সম্পর্কে কোনাে বলিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট প্রমাণ আনেনা কেন?’ বস্তুত আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক কর্মপন্থা যে, মানুষের হাতে নির্ভরযােগ্য ও অন্যদের মন মগজে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম যুক্তিপ্রমাণ থাকা চাই। নচেত তা হবে নিকৃষ্ট ধরনের মিথ্যাচার। কেননা এটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কেই মিথ্যাচার। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে, তার চেয়ে অত্যাচারী আর কে আছে?’ এ পর্যন্ত এসে যুবকদের নীতিগত অবস্থান সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে জানা যায়। কোনাে সন্দেহ সংশয় ও অস্পষ্টতার অবকাশ থাকে না। তারা ছিলাে যুবক। শারীরিকভাবে শক্ত সমর্থ, ঈমানের দিক দিয়ে অটুট ও অবিচল এবং আপন জাতির অনুসৃত নীতির বিরােধিতায় আপােষহীন। এ দুটো পথ ও মতাদর্শ পরস্পর বিরােধী। কাজেই উভয়ের মধ্যে আপােষ ও সমঝোতার অবকাশ নেই। তাই আপন আদর্শ নিয়ে পালানাে ছাড়া তাদের আর কোনাে উপায় নেই। তারা স্বজাতির কাছে প্রেরিত কোনাে রসূল নয় যে, নিজেদের নির্ভুল আদর্শ দিয়ে তাদের বাতিল আদর্শের মােকাবেলা করবে, তাদেরকে নিজেদের আদর্শের দিকে আহ্বান জানাবে এবং নবী ও রসূলদের ন্যায় ভাগ্য বরণ করবে। একটা যালেম ও কাফের সমাজে তারা এমন ক’জন যুবক, যাদের সামনে নির্ভুল আদর্শ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। কিন্তু সেই আদর্শের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ্যে ঘােষণা করলে সেখানে তাদের জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়, আবার স্বজাতির সাথে আপােষ করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব। তারা যে দেবদেবীর পূজা করে, তারা যেভাবে নেতৃস্থানীয় লােকদের দাসত্ব করে- জীবনের নিরাপত্তার খাতিরে প্রকাশ্যে সেই দেবদেবীর পূজা করবে, তাদের বানানাে আইন কানুন মেনে নেবে এবং গােপনে আল্লাহর ইবাদাত করবে-এ ফর্মূলা তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য ছিলাে না। খুব সম্ভবত তাদের আদর্শিক স্বাতন্ত্র ওই জাতির কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছিলাে। তাই নিজেদের দ্বীন ও ঈমানকে বাঁচাতে তাদের পালিয়ে যাওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েছিলাে। পর্বতের গুহাকে জীবন পথের একটা সােপান হিসাবে গ্রহণ না করে তাদের উপয়ান্তর ছিলে না। তাই পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে তারা পর্বত গুহায় আত্মগােপন করার সিদ্ধান্ত নিলো, ‘তােমরা যখন আপন জাতিকে ও আল্লাহ ছাড়া তারা যার পূজা করে তাকে পরিত্যাগ করেছে, তখন পর্বত গুহায় আশ্রয় নাও…’ এখানে মােমেনদের হৃদয়ের এক বিষ্ময়কর অবস্থা উদঘাটিত হয়েছে। সেটা হলাে, আপন জনগণ, ঘরবাড়ী, আত্মীয় স্বজন এবং পার্থিব ভােগবিলাসের যাবতীয় উপকরণ পরিত্যাগকারী এই যুবকরা সংকীর্ণ, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও কষ্টকর গুহার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে এবং এই অনুগ্রহকে অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী মনে করে। ‘তােমাদের প্রভু তােমাদের ওপর অনুগ্রহ বিস্তার করবেন…’ এই বিস্তার করবেন কথাটার ভেতরে ব্যাপকতা ও প্রশস্ততার ভাব প্রতিফলিত হয়েছে। তাই সংকীর্ণ হওয়া সত্তেও ওই পর্বতগুহা তাদের জন্যে এক সুপরিসর স্থানে পরিণত হয়, যেখানে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ ছড়িয়ে পড়ে, সেই সংকীর্ণ, কষ্টকর ও শ্বাসরুদ্ধকর দেয়াল ঘেরা গুহাটাও তাদের জন্যে সহনীয়, কোমল ও আনন্দময় স্থানে পর্যবসিত হয়। যে উপকরণটি এমন কষ্টকর স্থানকেও সুখময় বানায়, তা হচ্ছে ঈমান। এর মােকাবেলায় পার্থিব উপকরণাদির মূল্য কতােটুকু? পার্থিব জীবনে মানুষের কাছে যে সব উপকরণ, সাজসরঞ্জাম ও মূল্যবােধ পরম আদরের সামগ্রী, তার কী মূল্য আছে এই ঈমানের সামনে? ঈমানের সম্পদে সমৃদ্ধ ও করুণাময় আল্লাহর সাথে পরিচিত হৃদয়ের কাছে স্বতন্ত্র একটা জগত রয়েছে, যা আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ, সন্তোষ ও প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ এবং তা মােমেনের কাছে পার্থিব জগতের চেয়ে ঢের বেশী সুখময়। এই দূশ্যের বিবরণ সংক্ষেপে এই যে, যুবকরা গুহার অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়েছে এবং আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। এরপর দৃশ্যান্তরে যাওয়ার জন্যে এ দৃশ্যের যবনিকাপতন ঘটলাে।
#তুমি দেখতে পেতে, তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থানকালে সূর্য তাদের গুহার দক্ষিণ পাশে হেলে যায় এবং অস্তকালে বাম পাশ দিয়ে অতিক্রম করে…'(আয়াত ১৭-১৮) একটা বিস্ময়ােদ্দীপক বিমূর্ত চিত্র শব্দের তুলিতে এখানে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। গুহাবাসী যুবকদের অবস্থার এ ছবি ঠিক যেন একটা ভিডিও ক্যাসেটে তােলা ছবির মতােই। পর্বত গুহার ওপর সূর্যের আলাে যাতে না পড়ে, সে জন্যে সূর্য যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই একদিকে হেলে গিয়েছে। ‘তাযাওয়ারু’ শব্দটার অর্থ (হেলে যায়) ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ করার অর্থবােধক। অনুরূপভাবে সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় গুহার উত্তর দিক দিয়ে চলে যাওয়াটাও একই ধরনের অর্থবােধক। এই বিস্ময়কর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার আগে কোরআন যুবকদের অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করেছে। এটা কোরআনের একটা সুপরিচিত মন্তব্য যা দ্বারা বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনাকালে মাঝে মাঝে উপযুক্ত স্থানে মনােযােগ আকর্ষণ করা হয়। মন্তব্যটা হলাে, ‘এ হচ্ছে আল্লাহর একটা নিদর্শন।’ অর্থাৎ যুবকদেরকে পর্বতগুহায় এমনভাবে রাখা, যাতে সূর্য তাদের কাছে গিয়ে আলাে দিলেও তার তীব্র কিরণ দ্বারা তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না, অথচ তারা যথাস্থানে নিশ্চল কিন্তু জীবিতাবস্থায় অবস্থান করে এটা নিসন্দেহে আল্লাহর একটা নিদর্শন। ‘যাকে আল্লাহ হেদায়াত করেন, সে হেদায়াত পায়। আর তিনি যাকে বিপথগামী করেন, তার জন্যে তুমি কখনাে কোনাে পথ প্রদর্শক পাবে না।’ হেদায়াত ও গােমরাহীর জন্যে একটা শাশ্বত নিয়ম আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনাবলীর সাহায্যে আল্লাহর পথ চিনে নেয় ও অনুসরণ করে, তাকে আল্লাহ তায়ালা ওই নিয়ম অনুসারে হেদায়াত করেন এবং সে সুনিশ্চিতভাবে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়, আর যে ব্যক্তি হেদায়াতের উপকরণের সদ্ব্যবহার করে না সে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে যায়। তার এই বিভ্রান্তিও আল্লাহর সেই শাশ্বত নিয়ম অনুসারেই সংঘটিত হয়। আল্লাহ তায়ালা তাকে বিপথগামী করে দেন। এরপর তার জন্যে কোনাে পথপ্রদর্শক পাওয়া যাবে না। এরপর এই বিস্ময়কর দৃশ্য পূর্ণতা লাভ করে ১৮ নং আয়াতে। তারা তাদের দীর্ঘস্থায়ী ঘুমে পাশ ফিরে ঘুমাতেও থাকে। যে তাদেরকে দেখে সে ভাবে, ওরা জাগ্রত। অথচ তারা ঘুমন্ত। তাদের কুকুরটা গুহার দরজার পাশেই প্রহরী হিসাবে থাবা মেলে অবস্থান করতে থাকে কুকুরের স্বভাব অনুসারেই। সে তার অজান্তেই এভাবে দর্শকদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে যাতে কেউ তাদেরকে উত্যক্ত করার সাহস না পায়। তাই তাদেরকে জাগ্রত মানুষের মতাে নড়তে চড়তে ও পাশ ফিরতে দেখা গেলেও আসলে তারা জাগ্রত নয়। ‘অকস্মাৎ তাদের মধ্যে স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসে। এভাবে আমি তাদেরকে জাগিয়ে তুললাম…'(আয়াত ১৯-২০) ঘটনা বর্ণনায় আকস্মিকতার বিষয়টি আয়াতে উহ্য রেখেই এই দৃশ্যটা তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানাে হয়েছে যে, যুবকরা একদিন জেগে উঠলাে। কিন্তু যখন ঘুম এসেছিলাে তারপর থেকে তারা ওখানে কতােদিন কাটিয়েছে, তা তারা বুঝতেই পারলাে না। তারা নিজেদের চোখ কচলিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাে, কিহে আমরা কতােক্ষণ ঘুমালাম? দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে ওঠার পর এ ধরনের প্রশ্ন যে কেউ জিজ্ঞেস করে থাকে। তা ছাড়া দীর্ঘ ঘুমের কিছু আলামতও তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবে। তারা বললাে, একদিন কিংবা একদিনের কিছু অংশ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। এরপর তারা ভেবে দেখলে যে, এ প্রশ্নে বেশী মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। তাই এ ব্যাপারটি আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করাই উত্তম। আসলে অজানা বিষয়ে অনর্থক মাথা না ঘামিয়ে আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করা প্রত্যেক ঈমানদারেরই কর্তব্য। তারা মনে করলাে, এ সব বিষয় বাদ দিয়ে আসল প্রয়ােজনীয় বিষয় নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। তারা তখন ক্ষুধার্ত। তাদের কাছে রৌপ্য মুদ্রা ছিলাে। তা নিয়ে তারা বাজারে চলে গেলাে। ‘তারা বললো, এখানে কতােদিন অবস্থান করা হয়েছে, সেটা তােমাদের প্রতিপালকই ভালাে জানেন। অতএব, তােমাদের কোনাে একজনকে এই মুদ্রা দিয়ে শহরে পাঠাও। সে গিয়ে দেখুক শহরে কোন ভালাে খাবার পাওয়া যায়। তার কিছু নিয়ে আসুক।’ অর্থাৎ শহর থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের খাবার বাছাই করে নিয়ে আসুক। এ সময় তারা তাদের গােপনীয়তা যাতে প্রকাশ না পায় এবং তাদের অবস্থান স্থল কেউ জেনে না ফেলে, এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছিলাে। কেননা তাহলে শহরের ক্ষমতাসীন লােকেরা তাদেরকে পাকড়াও করে মেরে ফেলবে। কারণ তারা তাদেরকে ধর্মত্যাগী বলে আখ্যায়িত করবে। পৌত্তলিক দেশে এক খােদার পূজারীদেরকে তারা স্বভাবতই সহ্য করবে না। হয়তাে বা কঠিন শাস্তি দিয়ে তাদেরকে স্বধর্ম পরিত্যাগে বাধ্য করবে। এ কারণেই তারা সতর্কতা অবলম্বন করছিলাে। তাই খাবার কিনতে যাকে পাঠানাে হচ্ছিলাে তাকে সতর্ক থাকতে তাগিদ দেয়া হলাে এভাবে, ‘সে যেন নম্র আচরণ করে এবং কাউকে তােমাদের পরিচয় জানতে না দেয়। তারা জানতে পারলে তােমাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করবে, অথবা জোর করে তাদের ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। এরূপ ঘটলে তােমরা আর কখনাে কল্যাণ পাবে না।’ বস্তুত যে মােমেন মুরতাদ হয়ে মােশরেকে পরিণত হয়, সে কখনাে কল্যাণ লাভ করতে পারে না। এটা বরং সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এভাবে আমরা দেখতে পাই, যুবকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পরস্পরে সলাপরামর্শ করছে। অথবা তারা জানেনা, ইতিমধ্যে বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং সময় পাল্টে গেছে। ইতিমধ্যে বহুপ্রজন্ম একের পর এক অতিবাহিত হয়ে গেছে। তারা যে শাসকগােষ্ঠী সম্পর্কে শংকিত ছিলাে যে, তারা তাদের ধর্মবিশ্বাস পাল্টাতে বাধ্য করতে পারে, তাদের পতন ঘটেছে, যুলুমবাজ রাজার আমলে যে ক’জন মােমেন যুবক নিজেদের ঈমান বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলাে, তাদের কাহিনী দেশের জনগণের মুখে মুখে। বয়ােবৃদ্ধ প্রবীণদের কাছ থেকে শুনে নবীনরা এ কাহিনী পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরম ভক্তি সহকারে প্রচার করে চলেছে। ওই যুবকদের পরিচিতি, আকীদা ও বিশ্বাস এবং তাদের আত্মগােপনের সময়কাল নিয়ে দেশে পরস্পর বিরােধী মতামত প্রচলিত। দেশের এই বিরাট পরিবর্তন সম্পর্কে যুবকদের কিছুই জানা ছিলাে না। এই পর্যায়ে গুহার অভ্যন্তরে তাদের দৃশ্যের যবনিকাপাত ঘটে এবং দৃশ্যান্তরে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আয়াতের বর্ণনায় উভয় দৃশ্যের মাঝে কিছু শুন্যতা রেখে দেয়া হয়েছে। আমরা বুঝতে পারি যে, খাবার কিনতে যাওয়ার সময়কার শহরবাসী সবাই মুসলমান। খাবার কিনতে যাওয়া ব্যক্তি যে বহু বছর আগে ঈমান নিয়ে পালানাে যুবকদেরই একজন, তা টের পাওয়ার পর শহরবাসী তাদের প্রতি ভক্তির আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলাে। আমরা এও কল্পনা করতে পারি যে, গুহাবাসী যুবকরা কী সাংঘাতিক ধরনের আকস্মিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাে যখন তাদের সহকর্মী নিশ্চিত হলাে যে, এই শহর থেকে তাদের পলায়নের পর বহু যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে, যখন সে জানতে পারলো যে, তাদের চার পাশের পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। তাই তাদের জানা বা অজানা কোনাে কিছুরই অস্তিত্ব সে দেখতে পায়নি। সে বুঝতে পেরেছিলাে যে, সে ও তার সাথী গুহাবাসীর বহু শতাব্দী পূর্বের এক প্রাচীন প্রজন্মের লােক। জনগণের দৃষ্টিতে ও অনুভূতিতে তারা এক মহাবিস্ময়। তাই তাদের সাথে সাধারণ মানুষের মতাে আচরণ ও লেন দেন করা তার পক্ষে সম্ভব হলাে না। আপন প্রজন্মের সাথে ওই যুবকদের যে সম্পর্ক ছিলাে, যে রীতি প্রথা, আত্মীয়তা ও আবেগ অনুভূতির যােগসূত্র ছিলাে, তা সবই ছিন্ন হয়ে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের সাথে তাদের মেলামেশা ও লেনদেন করার কোনাে মাধ্যমই আর অবশিষ্ট নেই। তাই এসব কিছু থেকে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে প্রয়ােজন শূন্য করে দেন এবং তাদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেন।
# * ঘটনার শেষ দৃশ্য ও আমাদের শিক্ষা : এ সবই আমরা কল্পনা করতে পারি। কিন্তু কোরআন এ সবের মধ্য থেকে কেবল শেষ দৃশ্যটা উপস্থাপন করে। এই দৃশ্যটা হচ্ছে তাদের মৃত্যুর দৃশ্য। জনগণ এ সময় গুহার বাইরে দাঁড়িয়ে গুহাবাসী যুবকদের নিয়ে মত বিনিময় করতে থাকে যে, যুবকরা কোন ধর্মাবলম্বী ছিলাে, কিভাবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে তাদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা যায়। অতপর এই বিস্ময়কর ঘটনা থেকে অর্জিত শিক্ষা সরাসরি তুলে ধরা হয়। ‘এভাবে আমি জনগণকে তাদের সন্ধান দিয়েছিলাম, যাতে তারা জানতে পারে যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য এবং কেয়ামত নিসন্দেহে অবধারিত'(আয়াত ২১) এই যুবকদের জীবনাবসানের শিক্ষা এই যে, এ দ্বারা কেয়ামতের সত্যতা প্রমাণিত হয় এবং একটা বাস্তব ও অনুভবযােগ্য উদাহরণ দ্বারা তা প্রমাণ করা হয়। পরকালে মানুষের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ব্যাপারটা এ দ্বারা সহজবােধ্য হয়ে ওঠে। মানুষ বুঝতে পারে যে, পরকালের পুনরুজ্জীবনের যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ সত্য এবং কেয়ামত অবধারিত। আল্লাহর এই পরকালীন পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়ার আওতায়ই ঘটেছে যুবকদেরকে ঘুম থেকে জাগানাে ও জনগণকে তাদের সন্ধান দানের ঘটনা। কিছু লােক বললাে, ওদের ধর্মবিশ্বাস যখন জানা যাচ্ছে না, ‘তখন তাদের ওপর একটা সৌধ নির্মাণ করাে। আল্লাহ তায়ালাই তাদের সম্পর্কে অধিক অবগত।’ অর্থাৎ তারা কী আকীদা বিশ্বাস পােষণ করতাে তাও তিনিই ভালাে জানেন। তৎকালীন শাসকরা বললাে, ‘আমরা অবশ্যই তাদের জায়গায় একটা মসজিদ নির্মাণ করবো।’ মাসজিদ দ্বারা আসলে উপাসনালয় বুঝানাে হয়েছে, যা ইহুদী ও খৃষ্টানদের অনুকরণে নির্মাণ করা হতাে। তারা নবী ও মহৎ ব্যক্তিদের কবরে উপাসনালয় বানাতাে। আজকের যুগে বহু মুসলমানও তাদের অনুকরণে রসূল(স.)-এর শিক্ষার বিপরীতে এ কাজ করে থাকে। অথচ রসূল(স.) বলেছেন, ‘ইহুদী ও খৃষ্টানদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ হােক, যারা তাদের নবী ও মহান ব্যক্তিবর্গের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে'(তাফসীরে ইবনে কাসীর)। এই দৃশ্যের সমাপ্তি টানা হয়েছে এখানে। এরপর পরবর্তী আয়াতে পুনরায় এ বিষয়ে আলােচনা করা হয়েছে। আসহাবুল কাহাফ বা গুহাবাসী যুবকদের সম্পর্কে যে বিতর্ক রয়েছে, তার উল্লেখ রয়েছে এ আয়াতে। আসলে বহু শতাব্দী আগের ঘটনা নিয়ে এ ধরনের মতভেদ ঘটা স্বাভাবিক। কারণ এ ধরনের ঘটনার বিবরণ একজনের মুখ থেকে আর একজনের মুখে মুখান্তরিত হতে গিয়ে তথ্যাবলীতে পরিবর্তন ও সংখ্যায় কমবেশী হয়ে থাকে। ২২নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘লােকেরা বলাবলি করবে, গুহাবাসী যুবকরা ছিলাে তিনজন, চতুর্থ ছিলাে তাদের কুকুর। কেউ বলবে, পাঁচজন ছিলাে ৬ষ্ঠ ছিলাে তাদের কুকুর। এ সবই অনুমানভিত্তিক কথা। আবার কেউ বলবে, ওরা ছিলো সাতজন, ৮ম ওদের কুকুর। তুমি বলাে, তাদের সংখ্যা আমার প্রভুই ভালাে জানেন….’ বস্তুত যুবকদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করা অর্থহীন। তারা তিনজনই হােক। পাঁচজনই হােক, সাতজনই হােক বা বেশী হােক সবই সমান। তাদের যাবতীয় বিষয় এবং সঠিক সংখ্যার জ্ঞান কেবল আল্লাহ তায়ালাই রাখেন। সঠিক তথ্য জানা লােকের সংখ্যাও খুবই কম। কাজেই তাদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার প্রয়ােজন নেই। তাদের সংখ্যা কম হােক বা বেশী হােক তাদের ঘটনার শিক্ষা একই। তাই কোরান রসূল(স.)-কে এই বিতর্ক পরিহার করার নির্দেশ দিচ্ছে। আর বিতর্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে এ বিষয় জানারও কোনাে দরকার নেই। নিরর্থক ও অনুপকারী বিষয়ে বুদ্ধি খরচ না করাই ইসলামের বিধান। সুনিশ্চিত তথ্য না জেনে কোনাে ব্যাপারে অনুমান করে কথা বলাও ইসলামে নিষিদ্ধ ও অবাঞ্ছিত। বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা সম্পর্কে সুনিশ্চিত ও বিশুদ্ধ তথ্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তাই এ বিষয়ে আল্লাহর ওপর ন্যস্ত রাখাই সমীচীন। অতীতের অজানা বিষয় নিয়ে তর্ক করতে নিষেধ করার সূত্র ধরে ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে মতামত বা সিদ্ধান্ত ঘােষণা করতেও নিষেধ করা হয়েছে ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে। কেননা ভবিষ্যতে কী ঘটবে মানুষ তা জানে না। তাই সে সম্পর্কে তার কোনাে দৃঢ় মত ব্যক্ত করা সমীচীন নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি কখনাে কোনাে ব্যাপারে বলাে না যে, আমি আগামীকাল এটা করবাে আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে এ কথা যুক্ত করা ছাড়া…’ মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটা তৎপরতা, নড়াচড়া, এমনকি জীবিত প্রাণীর প্রতিটা স্বাস প্রশ্বাস পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণাধীন। মানুষ চলতি মুহূর্তটার ওপাশে কী আছে তা জানে না। পর্দার আড়ালে কী আছে, তা চোখ দিয়ে দেখতে পায় না। তার বিবেক বুদ্ধি যতাে তথ্যই সংগ্রহ করুক, সে আসলেই খুবই সীমিত জ্ঞানের অধিকারী। কাজেই কোনাে মানুষের বলা উচিত নয় যে, আগামীকাল আমি অমুক কাজ করবাে। কেননা আগামীকাল কী হবে না হবে তা শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন। তবে এর অর্থ এটা নয় যে, মানুষ ভবিষ্যত নিয়ে কোনাে চিন্তা ভাবনা ও পরিকল্পনা না করে অলসভাবে বসে থাকবে এবং তার জীবনের অতীতের সাথে বর্তমানের কোনাে সংযােগ থাকবে না। বরং এর অর্থ হলাে, অজানা ও অদৃশ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সেই অনুসারেই চিন্তা ভাবনা করতে হবে, নিজের সংকল্প ও পরিকল্পনায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে যার ইচ্ছার আওতায় সব কিছুই সংঘটিত হয়ে থাকে এবং মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর হাত সব সময় মানুষের হাতের ওপর থাকে। তাই এটা বিচিত্র নয় যে, মানুষ যা পরিকল্পনা করে, আল্লাহ তায়ালা তার বিপরীত পরিকল্পনা করে থাকতে পারেন। যদি আল্লাহ তায়ালা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাহায্য করেন, তাহলে তাে ভালাে কথা। যদি আল্লাহর ইচ্ছা তার পরিকল্পনার বিপরীত হয়, তাহলে দুঃখ ও পরিতাপ করার প্রয়ােজন নেই এবং হতাশ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা যাবতীয় বিষয় আগাগোড়াই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। সুতরাং মানুষকে চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা করতেই হবে। তবে তার একথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা ক্ষমতা দিলেই সে চিন্তা ও পরিকল্পনা করতে পারে। তাই বলে তার উদাসীন ও অলস হয়ে বসে থাকার কোনাে অবকাশ ও যুক্তি নেই। নিজেকে দুর্বল ও অক্ষম মনে করে নিষ্ক্রিয় থাকাও চলবেনা। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমতা, সংকল্প ও আস্থা দিয়েছেন। কিন্তু যখন মানুষ বুঝতে পারবে যে, আল্লাহর পরিকল্পনা তার পরিকল্পনার বিপরীত, তখন আল্লাহর ফয়সালার কাছে সন্তুষ্টচিত্তে ও স্থির মনে আত্মসমর্পণ করতে হবে কেননা এটাই তার ক্ষমতার মূল উৎস, যা এতদিন অজ্ঞাত ছিলাে। এখন যখন তা জানা গেলাে, তখন সেটাই মেনে নেয়া কর্তব্য। বস্তুত ইসলাম প্রত্যেক মুসলমানের মনে এই পদ্ধতিই বদ্ধমূল করে। কাজেই সে চিন্তা ও পরিকল্পনা করার সময় একাকীত্ব ও নিসংগতা বােধ করবে না। সাফল্য লাভ করলে সে অহংকারী ও দাম্ভিক হবে না, আর ব্যর্থ হলে হতাশার শিকার হবে না, সর্বাবস্থায় সে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক বজায় রাখবে, তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে নিজেকে শক্তিশালী মনে করবে, পরিকল্পনায় সফল হলে আল্লাহর শােকর করবে, এবং অহংকার ও হতাশা ছাড়াই আল্লাহর ফয়সালা মেনে নিবে। ‘যখন তােমার ভুল হয়ে যাবে, তখন তােমার প্রতিপালককে স্মরণ করবে।’ অর্থাৎ এই নির্দেশ যখন ভুলে যাবে, তখন দ্রুত আল্লাহকে স্মরণ ও তার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। ‘আর বলো, আশা করি অর্থাৎ প্রতিপালক আমাকে এর চেয়েও নিকটতর সুপথ দেখাবেন।’ অর্থাৎ এই পদ্ধতির চেয়েও যা মনকে সব সময় আল্লাহর সাথে যুক্ত করে। ‘আছা’ (আশা করি) এবং ‘লিআকরাবা’ (নিকটতর)-এই দুটো শব্দ দ্বারা এই পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্ব বুঝানাে হয়েছে এবং সর্বাবস্থায় এই চেতনা জাগ্রত থাকার প্রয়ােজনীয়তা নির্দেশ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি, ওই যুবকরা গুহার মধ্যে কতােদিন থেকেছে। এক্ষণে সেই বিষয়টা সুনিশ্চিতভাবে জানা গেলাে। ‘তারা তাদের গুহায় তিনশাে নয় বছর অবস্থান করেছে। বলাে, আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন, তারা কতােদিন থেকেছে। তিনিই আকাশ ও পৃথিবীর অদৃশ্য জ্ঞান রাখেন। তিনি কতােই না বড় দর্শক ও শ্রোতা?…'(আয়াত ২৫-২৬) এ হচ্ছে তাদের ব্যাপারে শেষ কথা। আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী এই চূড়ান্ত কথা জানালেন। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ দ্রষ্টা ও শ্রোতা। কাজেই এরপর আর বিতর্ক থাকা চাই না। এবার এই কাহিনী নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। এই কাহিনীর উপসংহারে দ্ব্যর্থহীনভাবে আর একবার আল্লাহর একত্বকে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তাদের আর কোনাে অভিভাবক নেই। তার কর্তৃত্বে আর কাউকে শরীক করা উচিত নয়।’ সবার শেষে রসূল(স.)-কে আল্লাহর ওহীকৃত বাণী পড়ে শােনানাের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা এতে রয়েছে চুড়ান্ত নির্ভুল বক্তব্য। এতে রয়েছে নির্ভেজাল অকাট্য সত্য। এতে রয়েছে একমাত্র আল্লাহমুখী হওয়ার নির্দেশ। কেননা তার নিরাপদ আশ্রয় ছাড়া আর কোনাে আশ্রয় নেই। তার আশ্রয়েই আশ্রয় নিয়েছিলাে আসহাবুল কাহাফ গুহাবাসী যুবকেরা। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে অনুগ্রহ ও হেদায়াত দান করেছেন, তােমার কাছে তোমার প্রভুর যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা পড়ে শােনাও…’ (আয়াত ২৭) এ পর্যন্ত এসে কাহিনীর সমাপ্তি টানা হয়েছে। এর ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু নির্দেশও দেয়া হয়েছে, যা কোরআনের কিসসা কাহিনীর মূল লক্ষ্য। সাথে সাথে আয়াতের ধর্মীয় বিধি ও শৈল্পিক উপস্থাপনায় সুন্দর সমন্বয়ও সাধন করা হয়েছে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# ৯-১২ নং আয়াতের তাফসীর:
আসহাবে কাহফের ঘটনা প্রথমে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হচ্ছে, পরে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হবে। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আসহাবে কাহফের এই ঘটনাটি আমার ক্ষমতা প্রকাশের অসংখ্য ঘটনাবলীর মধ্যে একটি সাধারণ ঘটনা মাত্র। এর চেয়ে বড় বড় ঘটনা দৈনন্দিন তোমাদের চোখের সামনে ঘটতে রয়েছে। আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি, দিবস ও রজনীর পরিবর্তন, সূর্য ও চন্দ্রের আনুগত্য ইত্যাদি হচ্ছে মহা ক্ষমতাবানের ক্ষমতার নিদর্শনসমূহ, যেগুলি এটাই প্রকাশ করছে যে, আল্লাহ তাআলা সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সব কিছুর উপরই পূর্ণ ক্ষমতাবান। তার কাছে কোন কিছুই কঠিন নয়। অসহাবে কাহফের চেয়ে তো বড় বড় বিস্ময়কর ঘটনা তোমাদের সামনেই বিদ্যমান রয়েছে। হে নবী (সঃ)! কিতাব ও সুন্নাহর যে জ্ঞান আমি তোমাকে দান করেছি তার গুরুত্ব আসহাবে কাহফের ঘটনা অপেক্ষা অনেক বেশী। অনেক হুজ্জত ও প্রমাণ আমি বান্দাদের উপর খুলে দিয়েছি যা আসহাবে কাহফের ঘটনা অপেক্ষা বেশী প্রকাশমান।
কাহফ বলা হয় পাহাড়ের গর্তকে। সেখানে এই যুবকরা লুকিয়ে গিয়েছিলেন। রাকীম’ হয় ঈলা পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী একটি উপত্যকার নাম, না হয় ঐ জায়গায় একটি অট্টালিকার নাম, কিংবা কোন জনপদের নাম অথবা ঐ পাহাড়ের নাম। ঐ পাহাড়ের নাম নাজলুসও বলা হয়েছে এবং গুহার নাম বলা হয়েছে হায়রূম। ঐ যুবকদের কুকুরটির নাম হামরান বলা হয়েছে।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “সমস্ত কুরআন আমার জানা আছে, কিন্তু ‘হানান’ বা ‘আওয়াহ এবং রাকীম’ শব্দ সম্পর্কে আমার অবগতি নেই। আমার জানা নেই যে, রাকীম’ কিতাবের নাম কি ঐ ভিত্তির নাম। তার থেকে আর একটি রিওয়াইয়াত বর্ণিত আছে যে, রাকীম’ হচ্ছে কিতাব। সাঈদ (রঃ) বলেন যে, ওটা পাথরের একটি ফলক ছিল যার উপর আসহাবে কাফের ঘটনা লিখে ঐ গুহার দরজার উপর লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। আবদুর রহমান (রঃ) বলেন যে, কুরআন কারীমে (আরবী) রয়েছে অর্থাৎ চিহ্নিত লিখিত কিতাব। সুতরাং আয়াতের বাহ্যিক শব্দ দ্বারা এরই পৃষ্ঠ পোষকতা করা হচ্ছে। আর এটাই ইমাম ইবনু জারীরের (রঃ) পছন্দনীয় উক্তি (আরবী) এর ওযনে (আরবী) এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ (আরবী) এবং (আরবী) এর অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই যুবকরা তাদের দ্বীনকে রক্ষা করার জন্যে নিজেদের কওমের নিকট থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের ভয় ছিল যে, না জানি তারা তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। পালিয়ে গিয়ে তারা একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা প্রার্থনা করেছিলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনার পক্ষ থেকে আমাদের উপর রহমত নাযিল করুন। আমাদেরকে আমাদের কওম হতে লুকিয়ে রাখুন এবং আমাদের এই কাজের পরিণতি ভাল করুন।” হাদীসে একটি দুআ’য় রয়েছে “হে আল্লাহ! আমাদের ব্যাপারে আপনি যে ফায়সালা করবেন তার পরিণাম অমাদের জন্যে ভাল করুন।” মুসনাদে আহমাদে রয়েছে। যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর প্রার্থনায় আরজ করতেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সমস্ত কাজের পরিণাম ভাল করুন! আমাদেরকে দুনিয়ার লাঞ্ছনা ও আখেরাতের শাস্তি হতে বাঁচিয়ে নিন।
ঐ গুহায় প্রবেশ করে তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন এবং ঘুমের মধ্যেই বহু বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জাগ্রত করেন। তাদের মধ্যে একজন দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) নিয়ে সওদা খরিদের উদ্দেশ্যে বাজাব্বে দিকে রওয়ানা হন, যেমন সামনে আসছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
“পরে আমি তাদেরকে জাগ্রত করলাম এটা জানবার জন্যে যে, দুই দলের। মধ্যে কোন্টি তাদের অবস্থিতিকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে।
(আরবী) শব্দের অর্থ হচ্ছে, সংখ্যা ব্য গণনা। আবার এই কথাও বলা হয়েছে যে, এই শব্দটি (আরবী) (শেষ সীমা)-এর অর্থেও এসে থাকে। আরব কবিরা তাদের কবিতার মধ্যেও এটাকে’ (আরবী) এর অর্থেই প্রয়োগ করেছেন
১৩-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখান থেকে আল্লাহ তাআলা আসহাবে কাহফের ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা শুরু করেছেন। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা সত্য দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং হিদায়াত লাভ করে। কুরায়েশদের মধ্যেও এটাই ঘটেছিল যে, যবুকরা তো সত্যের আহবানে সাড়া দিয়েছিল, কিন্তু বুড়োদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া সবাই ইসলাম থেকে সরে পড়ে ছিল।
বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল খোদাভীরু, মুমিন এবং সুপথপ্রাপ্ত যুবকদের একটি দল। তারা তাদের প্রতিপালকের একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা তার তাওহীদের উক্তিকারী ছিল। দৈনন্দিন তাদের ঈমান ও হিদায়াত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই ধরণের আরো আয়াত ও হাদীসসমূহ দ্বারা দলীল গ্রহণ করে ইমাম বুখারী (রঃ) প্রভৃতি সম্মানিত মুহাদ্দিসগণ বলেন যে, ঈমান বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এর স্তরে হ্রাস বৃদ্ধি হতে থাকে। এখানে রয়েছেঃ “আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম।” অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হিদায়াত প্রাপ্তদের হিদায়াত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।” (৪৭:১৭) অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা ঈমান এনেছে তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেয়।” (৯:১২৪) অন্য এক স্থানে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেন তারা তাদের ঈমানের সাথে ঈমান আরো বেড়ে নেয়।” (৪৮:৪) কুরআন কারীমের এই বিষয়ের উপর আরো বহু আয়াত রয়েছে। বর্ণিত আছে যে, এই লোকগুলি হযরত ঈসা ইবনু মরিয়মের (আঃ) দ্বীনের উপর ছিলেন। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। তবে বাহ্যতঃ জানা যাচ্ছে যে, এটা হযরত ঈসার (আঃ) পূর্বযুগের ঘটনা। এর একটি দলীল এটাও যে, যদি ঐ লোকগুলি খৃস্টান হতেন, তবে ইয়াহূদীরা এতো মনোযোগ ও গুরুত্বের সাথে তাদের অবস্থাবলী অবহিত হতো না এবং অন্যদেরকে অবহিত করারও চেষ্টা করতো না। অথচ ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, মক্কার কুরায়েশরা তাদের দু’জন প্রতিনিধিকে ইয়াহূদী আলেমদের কাছে পাঠিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ইয়াহুদী আলেমরা যেন তাদেরকে এমন কতকগুলি কথা বলে দেয় যা তারা মুহাম্মদকে (সঃ) জিজ্ঞেস করবে। তখন ইয়াহুদী আলেমরা প্রতিনিধিদ্বয়কে বলেছিলঃ “তোমরা তাঁকে গুহাবাসীদের ঘটনা ও যুলকারনাইনের ঘটনা জিজ্ঞেস করবে এবং রূহ সম্পর্কেও প্রশ্ন করবে। এর দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, ইয়াহুদীদের কিতাবে এর বর্ণনা ছিল এবং এই ঘটনা তারা জানতো। এটা যখন প্রমাণিত হয়ে গেল। তখন এটা স্পষ্টভাবে বলা যেতে পারে যে, ইয়াহূদীদের কিতাব তো খৃস্টানদের কিতাবের পূর্বেকার। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাদেরকে তাদের কওমের বিরোধিতার উপর ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করেছিলাম। তারা তাদের কওমের কোনই পরওয়া করে নাই। বরং তারা নিজেদের দেশ ত্যাগ করে এবং আরাম ও শান্তি সম্পূর্ণরূপে বিসর্জন দেয়।”
পূর্ব যুগীয় কতকগুলি মনীষীর বর্ণনা রয়েছে যে, এই লোকগুলি রোমক ম্রাটের বংশধর এবং রোমের নেতৃস্থানীয় লোক ছিলেন। একবার তাঁরা তাদের কওমের সাথে উৎসব উদ্যাপন করতে গিয়ে ছিলেন। ঐ যুগের বাদশাহর নাম ছিল দাইয়ানুস। সে অত্যন্ত উদ্ধত ও কঠোর প্রকৃতির লোক ছিল। সে সকলকে শিরকের শিক্ষা দিতো এবং মূর্তি পূজা করাতো। এই যুবকগণও তাদের বাপ-দাদাদের সাথে এই উৎসব মেলায় গিয়েছিলেন। তথাকার তামাশা দেখে তাদের মনে ধারণা জন্মে যে, মূর্তি পূজা নিছক বাজে কাজ। ইবাদত-বন্দেগী ও উৎসর্গ এক মাত্র ঐ আল্লাহর জন্যেই হওয়া উচিত যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। সুতরাং এই লোকগুলি এক এক করে সেখান থেকে সরে পড়েন। তাদের একজন গিয়ে এক গাছের নীচে বসে পড়েন। পরে দ্বিতীয় জন, তৃতীয়জন, চতুর্থজন তথায় যান। মোট কথা, এক এক করে সবাই ঐ গাছের নীচে জমা হয়ে যান। অথচ একের অপরের সাথে কোন পরিচয় ছিল না। শুধু ঈমানের জ্যোতি তাদেরকে এক জায়গায় মিলিত করে। হাদীসে রয়েছে যে, রূহসমূহও একটা একত্রিত সেনাবাহিনী। রোযে আযলে যাদের পরস্পরের মধ্যে পরিচয় ঘটেছিল, দুনিয়াতেও তারা মিলে মিশে থাকছে। আর সেই দিন যারা পরস্পর অপরিচিত ছিল, দুনিয়াতে এসেও তাদের মধ্যে মতানৈক্য থেকে যাচ্ছে। (এই হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে) আরববাসীরা বলে যে, এক জাতিত্ব হচ্ছে মিলজুলের কারণ।
গাছের নীচে উপবিষ্ট ঐ যুবকগণ নীরব ছিলেন। তাদের একের অপর হতে ভয় ছিল যে, যদি তিনি মনের কথা বলে দেন তবে তার সঙ্গী তার শক্ত হয়ে যাবেন। কারোই কারো সম্পর্কে কোন খবর ছিল না। তাঁরা জানতেন না যে, তাদের প্রত্যেকেই নিজের কওমের অজ্ঞতাপূর্ণ ও শিরকপূর্ণ কাজে অসন্তুষ্ট। অবশেষে তাদের মধ্যে একজন বুদ্ধিমান ও সাহসী যুবক সকলকে সম্বোধন করে বললেনঃ “ভাইসব! আপনারা সবাই যে, সাধারণ ব্যস্ততপূর্ণ জনসমাবেশ ছেড়ে এখানে এসে বসেছেন। আমি চাই যে, প্রত্যেকেই এর কারণ প্রকাশ করবেন যে কারণে তিনি স্বীয় কওমকে ছেড়ে এসেছেন।” তখন একজন বলে উঠলেনঃ “আমাকে তো আমার কওমের প্রথা, চাল-চলন ও রীতি-নীতি মোটেই ভাল লাগে না। আসমান ও যমীনের এবং আমাদের ও আপনাদের সৃষ্টিকর্তা যখন একমাত্র আল্লাহ তখন আমরা তাকে ছাড়া অন্যের ইবাদত কেন করবো?” তার এই কথা শুনে দ্বিতীয়জন বললেনঃ “আল্লাহর কসম! এই ঘৃণাই আমাকে এখানে এনেছে।” তৃতীয়জনও একথাই বললেন। যখন সবাই এই একই কারণ বর্ণনা করলেন, তখন সবার অন্তরেই প্রেমের এক ঢেউ খেলে গেল। একত্ববাদের আলোকে আলোকিত প্রাণ এই যুবকবৃন্দ পরস্পর সত্য ও খাটি বন্ধুতে পরিণত হয়ে গেলেন এবং তারা সহোদর ভাইদের চেয়েও বেশী একে অপরের শুভাকাংখী হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে ইত্তেহাদ ও ইত্তেফাক হয়ে যায়। তারা তখন একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে নেন এবং সেখানে এক আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন। ক্রমে ক্রমে তাদের কওমের কাছেও তাদের খবর প্রকাশ হয়ে পড়ে। সুতরাং তাদেরকে ধরে ঐ অত্যাচারী বাদশাহর নিকট নিয়ে যায় এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। বাদশাহ্ এ সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে নিজেদের একত্ববাদ ও মাযহাবের বর্ণনা দেন। এমন কি, স্বয়ং বাদশাহ্ তার ভাষদবর্গ এবং সারা দুনিয়াকে এর দাওয়াত দেন। তারা মন শক্ত করে নেন এবং পরিষ্কারভাবে বলে দেনঃ “আমাদের প্রতিপালক তিনিই যিনি আসমান ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা ও মালিক। তাকে ছাড়া অন্য কাউকেও মাবুদ বানিয়ে নেয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভ। আমাদের দ্বারা এটা কখনো হতে পারে না যে, তাকে ছাড়া অন্য কাউকেও আহবান করবো। কেননা, শিরক একেবারেই বাজে কাজ। আমরা এই কাজ কখনো করতে পারবো না। এটা অত্যন্ত বাজে ব্যাপার, অনর্থক কাজ ও বক্র পথ। আমাদের এই কওম মুশরিক। তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে আহবান করছে এবং তাদের ইবাদতে নিমগ্ন রয়েছে। এর কোন দলীল প্রমাণ তারা পেশ করতে পারবে না। সুতরাং তারা মিথ্যাবাদী ও অত্যাচারী।” বর্ণিত আছে যে, তাদের স্পষ্টবাদিতায় বাদশাহ অত্যন্ত রাগান্বিত হয় এবং তাদেরকে শাসান-গর্জন ও ভয় প্রদর্শন করে। সে নির্দেশ দেয়ঃ “তাদের পোষাক খুলে নাও। এরপরেও যদি তারা বিরত না হয়, তবে আমি তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবো।”
বাদশাহর এই কথায় তাদের অন্তর আরো দৃঢ় হয়ে যায়, কিন্তু তারা এটা অবগত হয়ে যান যে, এখানে থেকে তারা দ্বীনদারীর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। তাই, তারা কওম, দেশ এবং আত্মীয়স্বজন সবকে ছেড়ে দেয়ার দৃঢ় সংকল্প করেন। এই হুকুমও রয়েছে যে, মানুষ যেন দ্বীনের ভয়ের সময় হিজরত করে। হাদীসে রয়েছে যে, খুব সন্ত্র মানুষের উত্তম মাল হবে বীর পাল, যেগুলি নিয়ে সে পাহাড়ে-পর্বতে ও মরুপ্রান্তরে বসবাস করবে এবং স্বীয় দ্বীনকে রক্ষার জন্যে পালিয়ে বেড়াবে। সুতরাং এইরূপ পরিস্থিতিতে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা শরীয়ত সম্মত। হাঁ, তবে যদি পরিস্থিতি এরূপ না হয় এবং দ্বীন নষ্ট হওয়ার ভয় না থাকে, তাহলে জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়া শরীয়ত সম্মত নয়। কেননা, এমতাবস্থায় জুমআ ও জামাআতের ফজীলত হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
যখন এই লোকগুলি দ্বীন রক্ষার জন্যে এতো গুরুত্বপূর্ণ উৎসর্গে উদ্যত হন, তখন তাদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ “ঠিক আছে, তোমরা যখন তাদের দ্বীন থেকে পৃথক হয়ে গেছে তখন দেহ হতেও পৃথক হয়ে পড়। যাও তোমরা কোন গুহায় আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের উপর তোমাদের প্রতিপালকের করুণা বর্ষিত হবে। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের শত্রুদের দৃষ্টির অগোচরে রাখবেন। তোমাদের কাজ তিনি সহজ করে দিবেন এবং তোমাদের শান্তির ব্যবস্থা করবেন।”
সুতরাং এই লোকগুলি সুযোগ বুঝে এখান থেকে পালিয়ে যান এবং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেন। দেখতে পাচ্ছিলেনা, অবশেষে তিনি কাফিরদের কালেমা নীচু করে দেন এবং নিজের কালেমা সুউচ্চ করেন। আল্লাহ মর্যাদাবান ও বিজ্ঞানময়।” সত্য তো এটাই যে, এই ঘটনাটি গুহাবাসীদের ঘটনা হতেও বেশী বিস্ময়কর ও অসাধারণ।
একটি উক্তি এও আছে যে, কওম ও বাদশাহ ঐ যুবকদেরকে পেয়ে গিয়েছিল। যখন তারা তাদেরকে গুহায় দেখতে পায়, তখন তারা বলে ওঠেঃ “বাঃ! আমরা তো এটাই চাচ্ছিলাম।” অতঃপর তারা ঐ গুহার মুখটি একটি প্রাচীর দ্বারা বন্ধ করে দেয়, যাতে তারা ওর মধ্যেই মারা যান। কিন্তু এই উক্তির ব্যাপারে চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, কুরআন কারীমে রয়েছে যে, সকাল-সন্ধ্যায় তাদের উপর সূর্যের আলো যাওয়া-আসা করতো ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে মহান আল্লাহই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
# এটা হচ্ছে ঐ বিষয়ের দলীল যে, ঐ গুহাটির মুখ ছিল উত্তর দিকে। সূর্য উদয়ের সময় ওর ডান দিকে রৌদ্রের ছায়া প্রবেশ করতো। সুতরাং দুপুরের সময় সেখানে রৌদ্র মোটেই থাকতো না। সূর্য উপরে উঠার সাথে সাথে এরূপ জায়গা হতে রৌদ্রের আলো কমে যায় এবং সূর্যাস্তের সময় তাদের গুহার দিকে ওর দরজার উত্তর দিক থেকে রৌদ্র প্রবেশ করে থাকে। জ্যোতিষ্ক বিদ্যায় পারদর্শী লোকেরা এটা খুব ভালভাবে বুঝতে পারেন, যাদের সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজির চলন গতি সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে। যদি গুহার দরজাটি পূর্ব মুখী হতো তবে সূর্যাস্তের সময় সেখানে রৌদ্র মোটেই যেতো না আর যদি কিবলামুখী হতো তবে সূর্যোদয়ের সময়ও সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছতো না। এবং সূর্যাস্তের সময়ও না এবং সূর্যের ছায়া ডান বামেও ঝুঁকে পড়তো না আর যদি দরজাপশ্চিমমুখী হতো তবে তখনো সুর্যোদয়ের সময় ভিতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করতো না, বরং সূর্য হেলে পড়ার পরে আলো ভিতরে প্রবেশ করতো। তারপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত বরবারই আলো থাকতো। সুতরাং আমরা যা বর্ণনা করলাম সঠিক কথা ওটাই। অতএব, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) (আরবী) এর অর্থ করেছেন ছেড়ে দেয়া ও পরিত্যাগ করা। মহামহিমান্বিত আল্লাহ আমাদেরকে এটা জানিয়ে দিলেন যাতে আমরা চিন্তা করি ও বুঝি। ঐ গুহাটি কোন শহরের কোন পাহাড়ে রয়েছে, তা তিনি বলে দেন নাই। কারণ, এটা জেনে আমাদের কোনই উপকার নাই। এর দ্বারা শরীয়তের কোন উদ্দেশ্যই লাভ হয় না। তবুও কোন কোন তাফসীরকার এ ব্যাপারে কষ্ট করেছেন। কেউ কেউ বলেন যে, ওটা ঈলার নিকটবর্তী জায়গায় অবস্থিত, কেউ বলেন যে, ওটা নীনওয়ার পাশে রয়েছে। কেউ বলেন যে, রোমের মধ্যে রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, ওটা রয়েছে বালকাতে। ওটা যে কোথায় রয়েছে এর প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তাআলারই আছে। যদি এতে আমাদের কোন দ্বীনী বা মাযহাবী উপকার থাকতো তবে অবশ্যই তিনি তা আমাদেরকে তার নবীর (সঃ) মাধ্যমে জানিয়ে দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে যে কাজ ও জিনিস তোমাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী ও জাহান্নাম হতে দূরে করে থাকে ওগুলির একটিও না ছেড়ে সবই আমি বর্ণনা করে দিয়েছি।” সুতরাং আল্লাহ তাআলা ওর বিশেষ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু ওর জায়গার উল্লেখ করেন নাই। তিনি বলেন যে, সূর্যোদয়ের সময় তাদের গুহা হতে ওটা ডানে-বামে ঝুঁকে পড়ে এবং সূর্যাস্তের সময় তাদেরকে বাম দিকে ছেড়ে দেয়। তারা প্রশস্ততার মধ্যে রয়েছে। সুতরাং তাদের উপর সূর্যের তাপ পোঁছে না। অন্যথায় তাদের দেহ ও কাপড় পুড়ে যেতো। এটা আল্লাহ তাআলার একটা নিদর্শন যে, তিনি তাদেরকে ঐগুহায় পৌঁছিয়েছেন, যেখানে তাদেরকে জীবিত রেখেছেন। সেখানে রৌদ্রও পৌঁছেছে, বাতাসও পৌঁছেছে এবং চন্দ্রালোকও প্রবেশ করেছে; যাতে তাদের নিদ্রার কোন ব্যাঘাত না ঘটে, না কোন ক্ষতি হয়। প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এটাও একটা পূর্ণক্ষমতার নিদর্শন। ঐ একত্ববাদী যুবকদেরকে হিদায়াত স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই দান করেছিলেন। কারো ক্ষমতা ছিল না যে, তাদের পথভ্রষ্ট করে। পক্ষান্তরে তিনি যাদেরকে হিদায়াত দান করেন না, তাদেরকে হিদায়াত করার ক্ষমতা কারো নেই।
# মহান আল্লাহ বলেনঃ “তারা শুয়ে আছে, কিন্তু দর্শকরা তাদেরকে জাগ্রত মনে করে। কেননা তাদের চক্ষু খুলে রয়েছে। বর্ণিত আছে যে, নেকড়ে বাঘ যখন ঘুমায় তখন সে একটি চক্ষু বন্ধ করে ও আর একটি চুক্ষ খুলে রাখে। আবার ওটাকে বন্ধ করে এবং অন্যটিকে খুলে রাখে। যেমন কোন কবি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ সে তার দুই চক্ষুর একটি দ্বারা ঘুমায় এবং অপরটি দ্বারা জেগে থাকে। সে নিজেকে রক্ষা করে। সুতরাং একই সময় সে জাগ্রত ও ঘুমন্ত উভয়ই।”
জীব-জন্তু ও পোকামাকড় ও শত্রু হতে রক্ষা করার জন্যে নিদ্রিত অবস্থায়ও তাদের চুক্ষ খুলে রাখেন এবং মাটিতে যেন খেয়ে না ফেলে এজন্যে তিনি তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করাতে থাকেন। বর্ণিত আছে যে, বছরে দু’বার করে। তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করানো হতো। তাদের কুকুরটিও তাদের পাহারাদার হিসেবে দরজার পার্শ্বে চৌকাঠের নিকটবর্তী জায়গায় মাটিতে তার সামনের পা দুটি প্রসারিত করে বসেছিল। কুকুরটির দরজার বাইরে থাকার কারণ এই যে, যে ঘরে কুকুর, ছবি, অপবিত্র ব্যক্তি এবং কাফের ব্যক্তি থাকে সেই ঘরে ফেরেশতা যান না। যেমন একটি হাসান হাদীসে এসেছে। ঐকুকুরটিও ঐ অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। এটা সত্য কথাই যে, ভাল লোকের সংস্পর্শে আসলে ভাল হওয়া যায়। এরই প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় ঐ কুকুরটি এমন মর্যাদা লাভ করে যার ফলে আল্লাহর কিতাবে ওরও বর্ণনা দেয়া হয়। বর্ণিত আছে যে, ঐ কুকুরটি তাদেরই কোন একজনের পালিত শিকারী কুকুর ছিল। একটা উক্তি এও আছে যে, ওটা ছিল বাদশাহর বাবুর্চীর কুকুর। সেও ছিল ঐ যুবকদেরই মাযহাবপন্থী। সেও তাদের সাথে হিজরত করেছিল। তখন তার কুকুরটিও তাদের পিছনে পিছনে চলে গিয়েছিল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহীমের (আঃ) হাতে হযরত যাবীহুল্লাহর (আঃ) পরিবর্তে যে ভেড়াটি যবাহকৃত হয়েছিল তার নাম ছিল জারীর। হযরত সুলাইমানকে (আঃ) যে হুদহুদ পাখিটি সাবার দেশের রাণী খবর এনে দিয়েছিল তার নাম ছিল আনফায। গুহাবাসীদের ঐ কুকুরটির নাম ছিল ‘কিমীর। বাণী ইসরাঈল যে বাছুরটির পূজা শুরু করেছিল তার নাম ছিল বাহমূত’। হযরত আদম (আঃ) জান্নাত থেকে ভারতে নেমেছিলেন।, হযরত হাওয়া (আঃ) নেমেছিলেন জিদ্দায়, ইবলীস নেমেছিল দাশতে বীসানে এবং সাপ পড়েছিল ইসফাহানে।
একটি উক্তি আছে যে, ঐ কুকুরটির নাম ছিল হামরান। কুকুরটির রঙ সম্পর্কেও অনেকগুলি উক্তি রয়েছে। কিন্তু আমরা বিস্মিত হই যে, এতে লাভ কি? এর প্রয়োজনীয়তাই বা কি? বরং এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই যে, এ সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক নিষিদ্ধ। কেননা এতো হচ্ছে চক্ষু বন্ধ করে প্রস্তর নিক্ষেপ করা এবং বিনা দলীলে কথা বলা!
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাদেরকে এমন প্রভাব দিয়েছিলাম যে, কেউই তাদের দিকে তাকাতে পারতো না। এটা এই কারণে যে, লোকেরা যেন তাদেরকে তামাশার পাত্র বানিয়ে না নেয়, কেউ বীরত্বপনা দেখিয়ে তাদের কাছে চলে না যায়, কেউ তাদের উপর হাত উঠাতে না পারে। যেন তারা ঐ সময় পর্যন্ত আরাম ও শান্তিতে ঘুমাতে পারে যত দিন পর্যন্ত তাদের ঘুমানো আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করেন। যারাই তাদের দিকে তাকায়, তাদের প্রভাবে তারা থর থর কাঁপতে থাকে। তৎক্ষণাৎ তারা উল্টো পায়ে ফিরে যায়। তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করাও প্রত্যেকের জন্যে অসম্ভ।
# ১৯-২০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা বলছেনঃ “যেমনভাবে আমি তাদেরকে আমার পূর্ণ ক্ষমতার মাধ্যমে নিদ্রিত করে ছিলাম, তেমনিভাবেই ঐ ক্ষমতার বলেই তাদেরকে জাগ্রত করলাম। তারা তিনশ’ ন বছর ধরে ঘুমিয়েছিল। কিন্তু যখন জেগে ওঠে, তখন ঠিক ঐরূপই ছিল যেইরূপ ছিল ঘুমাবার সময়। দেহ, চুল, চামড়া সবই ঐ আসল অবস্থাতেই ছিল, যেমন শোবার সময় ছিল। মোট কথা, তাদের মধ্যে কোন প্রকারেরই পার্থক্য সৃষ্টি হয় নাই।” তারা পরস্পর বলাবলি করেঃ “আচ্ছা বলতো, আমরা কতকাল ঘুমিয়ে ছিলাম?” উত্তরে বলা হয়ঃ “একদিন বা একদিনেরও কিছু কম। কেননা, সকালে তাঁরা ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন, আর যখন জেগে ওঠেন তখন ছিল সন্ধ্যাকাল। এজন্যে তাঁদের ধারণা এটাই হয়। তারপর তাদের নিজেদের মনে ধারণা জন্মে যে, এরূপ তো নয়। এজন্যে তারা আর মস্তিষ্ক চালনা না করে মীমাংসিত কথা বলে দেন যে, এর সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তাআলারই আছে। তাদের ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছিল বলে তারা বাজার হতে সওদা আনয়নের পরামর্শ করেন। তাঁদের কাছে টাকা পয়সা ছিল। পথে কিছু খরচ করেছিলেন এবং কিছু তাদের সাথেই ছিল। তারা একে অপরকে বললেনঃ “কাউকে মূল্য দিয়ে এই শহরে পাঠিয়ে দাও। সেখান থেকে সে কিছু উত্তম খাদ্য ক্রয় করে আনুক অর্থাৎ উত্তম ও পবিত্র জিনিস।” যেমন অন্য এক আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হতো তবে তোমাদের কেউই পাক হতো না।” (২৪:২১) আর এক আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সফলকাম হয়েছে ঐ ব্যক্তি, যে পবিত্রতা লাভ করছে।” (৮৭ঃ১৪). যাকাতকে যাকাত এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, ওটা মালকে পাক পবিত্র করে থাকে। দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এর দ্বারা অনেক খাদ্য আনয়ন বুঝানো। হয়েছে। যেমন শস্যক্ষেত্র বেড়ে যাওয়ার সময় আরববাসী বলে থাকে? (আরবী) অর্থাৎ শস্যক্ষেত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। কবির কবিতাতেও রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের গোত্র সাত এবং তোমরা তিন, আর সাত তিন হতে বেশী ও উত্তম।” সুতরাং এখানেও (আরবী) শব্দটি ‘বেশী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই সঠিকতর। কেননা, গুহাবাসীদের এর দ্বারা। উদ্দেশ্য ছিল হালাল ও পবিত্র জিনিস আনয়ন। তা বেশী হোক, আর কমই হোক। তাঁরা বলেনঃ “খাদ্য আনয়নকারীকে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যতদূর সম্ব জনগণের দৃষ্টি এড়িয়ে চলতে হবে, যাতে কেউ আমাদের খবর জানতে না পারে। যদি তারা কোন রকমে জেনে ফেলে, তবে মঙ্গলের কোনই আশা নেই। দাইয়ান্স বাদশাহর লোকেরা যদি আমাদের এই জায়গার খবর পেয়ে যায় তবে তারা আমাদেরকে নানা প্রকারের কঠিন শাস্তি দেবে। অথবা হয়তো আমরা তাদের ভয়ে এই সত্য দ্বীনকে ছেড়ে দিয়ে পুনরায় কাফির হয়ে যাবে। অথবা তারা হয়তো আমাদেরকে একেবারে হত্যা করেই ফেলবে। যদি আমরা তাদের ধর্মে ফিরে যাই, তবে আমাদের মুক্তির কোন আশা নেই। আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের পরিত্রাণ লাভ অসম্ব। হয়ে পড়বে।”
# আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “এভাবেই আমি স্বীয় ক্ষমতা বলে মানুষকে গুহাবাসীদের অবস্থা অবহিত করলাম, যাতে তাঁর ওয়াদা এবং কিয়ামত সংঘটি হওয়ার সত্যতার জ্ঞান লাভ করে।” বর্ণিত আছে যে, ঐ যুগে তথাকার লোকদের কিয়ামত সংঘটিত হওয়া সম্পর্কে কিছু সন্দেহ হয়েছিল। একটি দল তো বলছিল যে, শুধু আত্মার পুনরুত্থান হবে-দেহের নয়। তাই, আল্লাহ তাআলা কয়েক শতাব্দীর পর গুহাবাসীদেরকে জাগিয়ে দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার এবং দেহের পুনরুত্থান হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ কায়েম করলেন।
বর্ণিত আছে যে, গুহাবাসীদের একজন যখন টাকা নিয়ে সওদা ক্রয় করার উদ্দেশ্য গুহা হতে বের হন, তখন লক্ষ্য করেন যে, তাঁর পূর্বের দেখা একটা জিনিসও নেই। সমস্ত চিত্র পরিবর্তিত হয়েছে। ঐ শহরের নাম ছিল আফমূস। যুগের পরিবর্তনে বস্তীগুলোর পরিবর্তন ঘটেছিল। ইতিমধ্যে কয়েক শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ঐ গুহাবাসীর তো ধারণা তা ছিল না। তার ধারণায় সেখানে পৌঁছার পর এক আধ-দিন মাত্র অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু আসলে কয়েক শতাব্দী অতীত হওয়ার কারণে সব কিছু বদলে গিয়েছিল। যেমন কোন কবি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঘরগুলিতো তাদের ঘরগুলির মতই রয়েছে, কিন্তু আমি গোত্রের লোকগুলিকে দেখছি যে, তারা ঐ সব লোক নয়।”
ঐগুহাবাসী লোকটি দেখেন যে, না তো শহরের কোন জিনিস স্বীয় অবস্থায় রয়েছে, না শহরের পরিচিত একটা লোকও আছে। তিনিও কাউকেও চিনছেন ন এবং তাঁকেও কেউ চিনছে না। তিনি মনে মনে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং তার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। কারণ, তিনি মনে মনে বলছিলেনঃ “এইতো কাল সন্ধ্যায় আমি এই শহর ছেড়ে গিয়েছি, তারপর হঠাৎ এ হলো কি! সব সময় তিনি চিন্তা করতে থাকেন। কিন্তু কিছুই বুঝে আসছে না। অবশেষে তিনি ধারণা করলেন যে, তিনি পাগল হয়ে গেছেন বা তার স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পেয়েছে, অথবা তাকে কোন রোগে ধরেছে, কিংবা তিনি স্বপ্ন দেখছেন! তবে বোধগম্য কিছুই হয় না। এইঙ্কারণে তিনি ইচ্ছা করলেন যে, সওদা কিনে নিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁর এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়াই উচিত। অতঃপর তিনি একটি দোকানে গিয়ে দোকানদারকে পয়সা দেন ও আহার্য দ্রব্য চান। দোকানদার ঐ মুদ্রা দেখে কঠিন বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং ওটা তার প্রতিবেশীকে দেখতে দেয়। বলেঃ “ভাই, দেখো তো! এই মুদ্রাটি কেমন? এটা কখনকার ও কোন যুগের মুদ্রা?” সে আবার অন্য দোকানদারকে দেখায়, সে আবার অন্যকে দেয়। এভাবে মুদ্রাটি হাত ফের হতে থাকে। মোট কথা, গুহাবাসী লোকটি একটা তামাশার পাত্র হয়ে যান। সবার মুখ দিয়ে একথা বের হয় যে, সে কোন প্রাচীন যুগের ধনভাণ্ডার লাভ করেছে। তার থেকেই এটা নিয়ে এসেছে। সুতরাং তাকে জিজ্ঞেস করা হোক যে, সে কোথাকার লোক, সে কে এবং এই মুদ্রা সে কোথায় পেলো? অতঃপর তারা তাঁর চুতুর্দিকে জমায়েত হয়ে দাড়িয়ে গেল এবং তাকে বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন করতে শুরু করলো। তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি তো ভাই এই শহরেরই অধিবাসী। গত কাল সন্ধ্যায় আমি এখান থেকে গিয়েছি। এখানকার বাদশাহ হচ্ছে দাকইয়ান্স।” তাঁর একথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে দিলো এবং বললোঃ “এতো কোন্ পাগল লোক! অবশেষে তারা তাকে নিয়ে গিয়ে বাদশাহর সামনে হাজির করে দিলো। বাদশাহ্ তাকে প্রশ্ন করলে তিনি তাকে সমস্ত ঘটনা শুনিয়ে দিলেন। এখন একদিকে বাদশাহ্ ও অপরদিকে জনতা বিস্মিত ও হতভম্ব! আর একদিকে গুহাবাসী লোকটিও হতভম্ব! পরিশেষে সমস্ত লোক তার সঙ্গী হয়ে গিয়ে বললোঃ “আচ্ছ, আমাদেরকে তোমার সঙ্গীদের কাছে নিয়ে চল এবং তোমাদের গুহাটিও দেখিয়ে দাও।” গুহাবাসী লোকটি তখন তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে চললেন।। গুহার কাছে পৌঁছে তাদেরকে বললেনঃ “আপনারা এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি প্রথমে আমার সঙ্গীদেরকে খবর দিয়ে আসি।” এই গুহাবাসী লোকটি জনতা থেকে পৃথক হওয়া মাত্রই আল্লাহ তাআলা তাদের উপর বে-খবরীর পর্দা নিক্ষেপ করলেন। তারা জানতেই পারলো না যে, তিনি কোথায় গেলেন। অতঃপর আল্লাহ তাআলা ঐ রহস্য গোপন করলেন।
আর একটি রিওয়াইয়াতে এও আছে যে, বাদশাহসহ ঐ লোকগুলি তথায় গিয়েছিলেন। গুহাবাসীদের সাথে তাদের সালাম, কালাম ও আলিঙ্গন হয়। এই বাদশাহ স্বয়ং মুসলমান ছিলেন। গুহাবাসীরা তাঁর সাথে মিলিত হয়ে খুবই সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং অত্যন্ত মুহব্বতের সাথে কথা-বার্তা বলেন। তারপর তারা ফিরে গিয়ে নিজনিজ জায়গায় শুয়ে পড়েন। এরপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মৃত্যুদান করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সবারই উপর সদয় হোন! এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সঠিক জ্ঞান রাখেন।
বর্ণিত আছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হযরত মাসলামার (রাঃ) সাথে এক যুদ্ধে ছিলেন। সেখানে তাঁরা রোমের শহরের মধ্যে একটি গুহা দেখতে পান, যার মধ্যে অস্থিসমূহ বিদ্যমান ছিল। জনগণ বললো যে, ঐগুলি আসহাবে কাহফের অস্থি। একথা শুনে হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বললেনঃ “তাদের অস্থিগুলি তো মাটিতে পরিণত হয়ে গেছে। কারণ, তাদের উপর দিয়ে সুদীর্ঘ তিন শ’ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। (এই রিওয়াইয়াতটি ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
তাই, মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “যেমনিভাবে আমি গুহাবাসীদের সুদীর্ঘ তিন শ’ বছর পরে একেবারে অস্বাভাবিক ভাবে পুনর্জাগরিত করেছি, তেমনিভাবে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিকরূপে ঐ শহরবাসীকে তাদের অবস্থা অবহিত করেছি, যেন তাদের এই জ্ঞান লাভ হয় যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারেও যেন তাদের কোন সন্দেহ না থাকে। ঐ সময় ঐ শহরবাসী লোকেরা কিয়ামতের ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করতো। কেউ কেউ কিয়ামতে বিশ্বাসী ছিল এবং কেউ কেউ অস্বীকার করতো। সুতরাং আসহাবে কাহফের প্রকাশ অস্বীকারকারীদের উপর হুজ্জত এবং বিশ্বাসীদের জন্যে দলীল হয়ে গেল।
এখন ঐ এলাকার লোকদের ইচ্ছা হলো যে, গুহাবাসীদের গুহা মুখ বন্ধ করে দেয়া হোক এবং তাদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেয়া হোক। কাজের উপর যাদের প্রাধান্য লাভ ছিল তারা বললোঃ “আমরা তাদের আশে পাশে মসজিদ নির্মাণ করবো।” ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) ঐ লোকদের ব্যাপারে দু’টি উক্তি বর্ণনা করেছেন। একটি এই যে, তাদের মধ্যে মুসলমানরা একথা বলে ছিল, আর দ্বিতীয় উক্তি হচ্ছে এই যে, ঐ উক্তিটি ছিল কাফিরদের। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। কিন্তু বাহ্যতঃ এটাই জানা যাচ্ছে যে, এই উক্তিকারীরা ছিল মুসলমান। তবে তাদের একথা বলা ভাল ছিল, কি মন্দ ছিল সেটা অন্য কথা। এই ব্যাপারে তো পরিষ্কার হাদীস বিদ্যমান রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআ’লা ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের উপর লানত বর্ষণ করুন যে, তারা তাদের নবী ও ওয়ালীদের কবরগুলিকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। তারা যা করতো তা থেকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় উম্মতকে বাঁচাতে চাইতেন। এজন্যেই আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) স্বীয় খিলাফতের যামানায় যখন ইরাকে হযরত দানইয়ালের (রাঃ) কবরের সন্ধান পান, তখন তা গোপন করে দেয়ার নির্দেশ দেন এবং সে লিপি প্রাপ্ত হন, যাতে কোন কোন যুদ্ধ ইত্যাদির বর্ণনা ছিল, তা পুঁতে ফেলার আদেশ করেন।
# জনগণ গুহাবাসীদের সংখ্যার ব্যাপারে কিছু কিছু বলাবলি করতো। তার তিন প্রকারের লোক ছিল। চতুর্থটি গণনা করা হয়নি। প্রথম দুটি উক্তিকে দুর্বল বলা হয়েছে। তারা অনুমানের তীর মেরেছে। তবে আল্লাহ তাআলা তৃতীয় উক্তিটি বর্ণনা করার পর নীরবতা অবলম্বন করেছেন। এটা তিনি খণ্ডন করেন নাই। অর্থাৎ সাতজন এবং অস্টম ছিল তাদের কুকুরটি। এর দ্বারা অনুমিত হচ্ছে যে, এটা সঠিক কথা এবং প্রকৃতপক্ষে এটাই সঠিকও বটে। এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “এই রূপ স্থলে উত্তমপন্থা হচ্ছে এর জ্ঞান। আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়া। এসব ব্যাপারে কোন সঠিক জ্ঞান না থাকা সত্তেও এর পিছনে লেগে থেকে চিন্তা করা ও সন্ধান চালানো বৃথা। সে সম্পর্কে যা জানা থাকবে তা মুখে প্রকাশ করতে হবে। আর যে সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই সেখানে নীরবতা অবলম্বন করাই শ্রেয়। তাদের সংখ্যার সঠিক জ্ঞান খুব কম লোকেরই রয়েছে। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “যাদের এর সঠিক জ্ঞান আছে আমি তাঁদের মধ্যে একজন। আমি জানি যে, তাঁরা। সাতজন ছিলেন। হযরত আতা’ খুরাসানীরও (রঃ) উক্তি এটাই আমরা পূর্বে লিখেছিলাম। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো খুবই অল্প বয়সের ছিলেন, সবে মাত্র যৌবনে পদার্পন করেছিলেন। তারা দিনরাত আল্লাহ তাআলার ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। তারা ক্রন্দন করতেন এবং আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ করতেন।
বর্ণিত আছে যে, তারা ন’জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বড় ছিলেন তাঁর নাম ছিল মিকলমীন। তিনিই বাদশাহর সাথে কথা বলেছিলেন এবং তাকে এক আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দিয়েছিলেন। অবিশষ্টদের নাম হচ্ছে নিম্নরূপঃ ২. ফাহাশালমীন, ৩. তামলীখ, ৪. মারনিস, ৫, কাশতুনিস, ৬. বাইরূনিস, ৭. দানীমুস, ৮. বাতৃনিস, ৯. কাবৃস। তবে হযরত ইবনু আব্বাসের (রঃ) সঠিক রিওয়াইয়াত এটাই যে, তারা ছিলেন সাতজন। আয়াতের বাহ্যিক শব্দ দ্বারা এটাই জানা যাচ্ছে। শুআইব জীবাঈ (রঃ) বলেন যে, তাঁদের কুকুরটির নাম ছিল হামরান। কিন্তু তাঁদের এই নামগুলির সঠিকতার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। এগুলোর অনেকটাই আহলে কিতাবের নিকট হতে নেয়া হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তুমি এই ব্যাপারে বেশী তর্ক-বিতর্ক করবে না। এটা নিতান্ত ছোট কাজ। এতে বড় কোন উপকার নেই। এই সম্পর্কে তুমি কাউকেও জিজ্ঞাসাবাদও করো না। কেননা, সবাই অনুমানে কথা বলবে এবং নিজেদের পক্ষ থেকে বানিয়েসানিয়ে কিছু বলে দেবে। কোন সঠিক ও সত্য দলীল তাদের কাছে নেই।
আর আল্লাহ তাআলা তোমার সামনে যা কিছু বর্ণনা করছেন, তা মিথ্যা হতে পবিত্র, সম্পূর্ণরূপে সন্দেহমুক্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য। এটাই সত্য এবং সর্বাপেক্ষা অগ্রগণ্য।
# ২৩-২৪ নং আয়াতের তাফসীর:
মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে (সঃ) নির্দেশ দিচ্ছেনঃ যে কাজ তুমি কাল করতে চাও ঐ ব্যাপারে তুমি বলো না? আমি কাল এটা করবো। বরং এর সাথে ইনশা আল্লাহ বলো। কেননা, কাল কি হবে, তার জ্ঞান শুধু আল্লাহ তাআলারই রয়েছে। একমাত্র তিনিই ভবিষ্যতের খবর রাখেন এবং সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান একমাত্র তিনিই। সুতরাং তারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।
বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত সুলাইমান ইবনু দাউদের (আঃ) নব্বইটি স্ত্রী ছিল। একটি রিওয়াইয়াতে একশ’ টি এবং অন্য একটি রিওয়াইয়াতে বাহাত্তরটির কথা রয়েছে। তিনি একদা বলেনঃ “আজ রাত্রে আমি আমার সমস্ত স্ত্রীর কাছে যাবো (তাদের সাথে সহবাস করবো) প্রত্যেক স্ত্রীর সন্তান হবে এবং তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে।” ঐ সময় ফেরেশতা তাঁকে বলেছিলেনঃ “ইনশা আল্লাহ বলুন।” কিন্তু তিনি তা না বলে নিজের ইচ্ছানুযায়ী ঐ সব স্ত্রীর নিকট গমন করেন। কিন্তু একটি স্ত্রী ছাড়া আর কারো সন্তান হয় নাই। যার সন্তান হয় সেই সন্তানটিও আবার অর্ধ দেহ বিশিষ্ট ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি হযরত সুলাইমান (আঃ) ঐ সময় “ইনশা আল্লাহ’ বলতেন, তবে তাঁর মনোবাসনাপূর্ণ হতো এবং তার প্রয়োজনও পুরো হয়ে যেতো। তাঁর ঐ সব সন্তান যুবক হয়ে আল্লাহর পথের মুজাহিদ হয়ে যেতো।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে)
এই সূরার তাফসীরের শুরুতেই এই আয়াতের শানে নুযুল বর্ণিত হয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) আসহাবে কাহফের ঘটনা জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি তাদেরকে বলেছিলেনঃ “আগামীকাল আমি তোমাদেরকে এর উত্তর দেবো।” কিন্তু তিনি ইনশা আল্লাহ বলেন নাই। এরপর পনেরো দিন পর্যন্ত তার উপর কোন ওয়াহী অবতীর্ণ হয় নাই। এই হাদীসটিকে আমরা এই সূরার তাফসীরের শুরুতে পূর্ণভাবে বর্ণনা করেছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তির কোন প্রয়োজন নেই।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “যখন তুমি ভুলে যাবে তখন আল্লাহকে স্মরণ করবে। অর্থাৎ যদি যথাস্থানে ইনশা আল্লাহ বলতে ভুলে যাও তবে যখনই স্মরণ হবে তখনই ইনশা আল্লাহ বলবে।”
হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, কেউ যদি কোন বিষয়ে শপথ। করার সময় ইনশা আল্লাহ বলতে ভুলে যায়, তবে পরেও তার ইনশা আল্লাহ বলে নেয়ার অধিকার রয়েছে। যদিও এক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। ভাবার্থ এই যে, কেউ যদি তার কথায় বা কসমে ইনশা আল্লাহ বলতে ভুলে যায়, তবে যখনই স্মরণ হবে তখনই ইনশা আল্লাহ বলে নেবে; যদিও বহু দিন অতীত হয়ে যায় বা এর বিপরীতও ঘটে যায়। এর ভাবার্থ এটা নয় যে, তখন তার কসমের কাফফারা থাকবে না এবং তার ঐ কসম ভেঙ্গে দেয়ার অধিকার থাকবে। ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) এই উক্তির ভাবার্থ এটাই বর্ণনা করেছেন এবং এটা সঠিকও বটে। এরই উপর হযরত ইবনু আব্বাসের (রাঃ) উক্তি স্থাপন করা যেতে পারে। তার থেকে এবং মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এর দ্বারা ইনশা আল্লাহ বলতে ভুলে যাওয়াই বুঝানো হয়েছে। অন্য রিওয়াইয়াতে এরপরে এও রয়েছে যে, এটা রাসুলুল্লাহর (সঃ) সাথেই। খস। অন্য কেউ যদি তার কসমের সাথে ইনশা আল্লাহ বলে তবেই সেটা ধর্তব্য হবে। এর এটাও একটা ভাবার্থঃ যদি কোন কথা ভুলে যাও তবে আল্লাহকে স্মরণ করো। কেননা, ভুলে যাওয়া শয়তানী ক্রিয়া, আর আল্লাহর যির স্মরণে আসার মাধ্যম।
তারপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমাকে যদি এমন কোন প্রশ্ন করা হয়, যা তোমার জানা নেই, তবে তুমি তা আল্লাহকেই জিজ্ঞেস করো এবং তাঁর দিকেই মনোনিবেশ কর, যাতে তিনি তোমাকে সঠিক কথা বলে দেন এবং হিদায়াত লাভের পথ বাতলিয়ে দেন। এ ব্যাপারে আরো বহু উক্তি রয়েছে। এ সব ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
# ২৫-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) ঐ সময়কালের খবর দিচ্ছেন, যে সময়কাল পর্যন্ত গুহাবাসীরা তাদের গুহার মধ্যে নিদ্রিত অবস্থায় অবস্থান করে ছিলেন। ঐ সময়কাল ছিল সূর্যের হিসেবে তিন শ’ বছর এবং চন্দ্রের হিসেবে তিনি শ’ নয় বছর। প্রকৃতপক্ষে শামসী ও কামরী বছরের মধ্যে প্রতি একশ বছরের তিন বছরের পৃথকভাবে বর্ণনা করার পর নয় বছর আলাদাভাবে বর্ণনা করেছেন।
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় নবীকে (সঃ) সম্বোধন করে বলছেনঃ “হে বী (সঃ)! যদি তোমাকে গুহাবাসীদের শয়নকাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় এবং তোমার এর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকে এবং আল্লাহ তাআলাও তোমাকে তা জানিয়ে না থাকেন, তবে তুমি সামনে বেড়ে যেয়ো না এবং এরূপ স্থলে উত্তর দাওঃ এর সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর রয়েছে। আসমান ও যমীনের গায়েবের খবর তিনিই রাখেন। তবে তিনি যাকে জানিয়ে দেন সে জানতে পারে।”
কাতাদা (রঃ) বলেন যে, তারা গুহায় তিন শ’ বছর ছিলেন এটা আহলে কিতাবের উক্তি। আল্লাহ তাআলা এই উক্তিটি খণ্ডন করেছেন এবং বলেছেনঃ এরপূর্ণ ও সঠিক জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ)। হতেও এই অর্থের কিরআত বর্ণিত আছে। কিন্তু কাতাদার (রঃ) উক্তিটি বিবেচনাধীন। কেননা, আহলে কিতাবের মধ্যে শামসী বছরের প্রচলন রয়েছে। এবং তারা গুহাবাসীদের অবস্থানের সময়কাল তিন শ’বছর মেনে থাকে। তিন শ’ নয় বছর তাদের উক্তি নয়। যদি এটা তাদেরই উক্তি হতো, তবে আল্লাহ তাআলা একথা বলতেন না যে, তারা তিনশ’ বছর ঘুমিয়েছিল এবং আরো নয় বছর বেশী করেছিল। বাহ্যতঃ তো এটাই ঠিক মনে হচ্ছে যে, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এটার খবর দিচ্ছেন, কারো উক্তি তিনি বর্ণনা করছেন না। এটাই ইমাম ইবনু জারীর (রাঃ) গ্রহণ করেছেন। কাতাদার (রাঃ) রিওয়াইয়াত এবং হযরত ইবনু মাসউদের (রঃ) কিরআত দু’টোই ছেদ কাটা এবং অতি বিরলও বটে জমহূরের কিরআত ওটাই যা কুরআনে রয়েছে। তিনি বিরল দলীলের পক্ষপাতি নন।
আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদেরকে খুবই দেখতে রয়েছেন এবং তাদের কথাও তিনি বেশ শুনতে রয়েছেন। এই দু’টি শব্দে প্রশংসার আধিক্য রয়েছে। অর্থাৎ “খুব বেশী শ্রোতা ও খুব বেশী দ্রষ্টা। প্রত্যেক বিদ্যমান জিনিস তিনি দেখতে রয়েছেন এবং সমস্ত কথা তিনি শুনতে রয়েছেন। কোন কাজ ও কোন কথা তার কাছে গোপন নেই। তাঁর চেয়ে বেশী কেউ শ্রবণকারীও নেই এবং দর্শনকারীও নেই। প্রত্যেকের আমল তিনি দেখতে রয়েছেন এবং প্রত্যেকের কথা তিনি শুনতে রয়েছেন। সৃষ্টির স্রষ্টা এবং হুকুমের মালিক তিনিই। কেউ তার আদেশকে প্রতিরোধ করতে পারে না। তার কোন উযীর ও সাহায্যকারী নেই। তাঁর কোন অংশীদারও নেই এবং কোন পরামর্শদাতাও নেই। তিনি এই সমূদয় অভাব হতে মুক্ত ও পবিত্র। এই সব ত্রুটি হতে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত।