أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯১৩)
[ مَا مَنَعَکَ اِذۡ رَاَیۡتَہُمۡ ضَلُّوۡۤا ﴿ۙ۹۲﴾
‘ আপনি যখন দেখলেন তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তখন কিসে আপনাকে বাধা দিল—‘]
সূরা:- ত্বাহা।
সুরা:২০
৮৩- ৯৮ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২০:৮৩
وَ مَاۤ اَعْجَلَكَ عَنْ قَوْمِكَ یٰمُوْسٰى
আর কোন জিনিসটি তোমাকে তোমার সম্প্রদায়ের আগে নিয়ে এলো হে মূসা”
২০:৮৪
قَالَ هُمْ اُولَآءِ عَلٰۤى اَثَرِیْ وَ عَجِلْتُ اِلَیْكَ رَبِّ لِتَرْضٰى
সে বললো, “তারা তো ব্যস আমার পেছনে এসেই যাচ্ছে। আমি দ্রুত তোমার সামনে এসে গেছি, হে আমার রব! যাতে তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।”
২০:৮৫
قَالَ فَاِنَّا قَدْ فَتَنَّا قَوْمَكَ مِنْۢ بَعْدِكَ وَ اَضَلَّهُمُ السَّامِرِیُّ
তিনি বললেন, “ভালো কথা, তাহলে শোনো, আমি তোমার পেছনে তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছি এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দিয়েছে।”
২০:৮৬
فَرَجَعَ مُوْسٰۤى اِلٰى قَوْمِهٖ غَضْبَانَ اَسِفًا١ۚ۬ قَالَ یٰقَوْمِ اَلَمْ یَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا١ؕ۬ اَفَطَالَ عَلَیْكُمُ الْعَهْدُ اَمْ اَرَدْتُّمْ اَنْ یَّحِلَّ عَلَیْكُمْ غَضَبٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَاَخْلَفْتُمْ مَّوْعِدِیْ
ভীষণ ক্রোধ ও মর্মজ্বালা নিয়ে মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে এলো। সে বললো, “হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমাদের রব কি তোমাদের সাথে ভালো ভালো ওয়াদা করেননি? তোমাদের কি দিনগুলো দীর্ঘতর মনে হয়েছে? অথবা তোমরা নিজেদের রবের গযবই নিজেদের ওপর আনতে চাচ্ছিলে, যে কারণে তোমরা আমার সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করলে?
২০:৮৭
قَالُوْا مَاۤ اَخْلَفْنَا مَوْعِدَكَ بِمَلْكِنَا وَ لٰكِنَّا حُمِّلْنَاۤ اَوْزَارًا مِّنْ زِیْنَةِ الْقَوْمِ فَقَذَفْنٰهَا فَكَذٰلِكَ اَلْقَى السَّامِرِیُّۙ
তারা জবাব দিল, “আমারা স্বেচ্ছায় আপনার সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করিনি। ব্যাপার হলো, লোকদের অলংকারের বোঝায় আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং আমরা স্রেফ সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।” -তারপর এভাবে সামেরীও কিছু ছুঁড়ে ফেললো।
২০:৮৮
فَاَخْرَجَ لَهُمْ عِجْلًا جَسَدًا لَّهٗ خُوَارٌ فَقَالُوْا هٰذَاۤ اِلٰهُكُمْ وَ اِلٰهُ مُوْسٰى١۬ فَنَسِیَؕ
এবং তাদের জন্য একটি বাছুরের মূর্তি বানিয়ে নিয়ে এলো, যার মধ্য থেকে গরুর মতো আওয়াজ বের হতো। লোকেরা বলে উঠলো, “এ-ই তোমাদের ইলাহ এবং মূসারও ইলাহ, মূসা একে ভুলে গিয়েছে।”
২০:৮৯
اَفَلَا یَرَوْنَ اَلَّا یَرْجِعُ اِلَیْهِمْ قَوْلًا١ۙ۬ وَّ لَا یَمْلِكُ لَهُمْ ضَرًّا وَّ لَا نَفْعًا۠
তারা কি দেখছিল না যে, সে তাদের কথারও জবাব দেয় না এবং তাদের উপকার ও ক্ষতি করার কোন ক্ষমতাও রাখে না?
২০:৯০
وَ لَقَدْ قَالَ لَهُمْ هٰرُوْنُ مِنْ قَبْلُ یٰقَوْمِ اِنَّمَا فُتِنْتُمْ بِهٖ١ۚ وَ اِنَّ رَبَّكُمُ الرَّحْمٰنُ فَاتَّبِعُوْنِیْ وَ اَطِیْعُوْۤا اَمْرِیْ
(মূসার আসার) আগেই হারুন তাদের বলেছিল, “হে লোকেরা! এর কারণে তোমরা পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়েছো। তোমাদের রব তো করুণাময়, কাজেই তোমরা আমার অনুসরণ করো এবং আমার কথা মেনে নাও।”
২০:৯১
قَالُوْا لَنْ نَّبْرَحَ عَلَیْهِ عٰكِفِیْنَ حَتّٰى یَرْجِعَ اِلَیْنَا مُوْسٰى
কিন্তু তারা তাকে বলে দিল, “মূসার না আসা পর্যন্ত আমরা তো এরই পূজা করতে থাকবো।”
২০:৯২
قَالَ یٰهٰرُوْنُ مَا مَنَعَكَ اِذْ رَاَیْتَهُمْ ضَلُّوْۤاۙ
মূসা (তার সম্প্রদায়কে ধমকাবার পর হারুনের দিকে ফিরে) বললো, “হে হারুন! তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন আমার পথে চলা থেকে কিসে তোমাকে বিরত রেখেছিল?
২০:৯৩
اَلَّا تَتَّبِعَنِ١ؕ اَفَعَصَیْتَ اَمْرِیْ
তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করেছো?
২০:৯৪
قَالَ یَبْنَؤُمَّ لَا تَاْخُذْ بِلِحْیَتِیْ وَ لَا بِرَاْسِیْ١ۚ اِنِّیْ خَشِیْتُ اَنْ تَقُوْلَ فَرَّقْتَ بَیْنَ بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ وَ لَمْ تَرْقُبْ قَوْلِیْ
হারুন জবাব দিল, “হে আমার সহোদর ভাই! আমার দাড়ি ও মাথার চুল ধরে টেনো না। আমার আশঙ্কা ছিল, তুমি এসে বলবে যে, তুমি বনী ইসরাঈলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছো এবং আমার কথা রক্ষা করোনি।”
২০:৯৫
قَالَ فَمَا خَطْبُكَ یٰسَامِرِیُّ
মূসা বললো, “আর হে সামেরী তোমার কি ব্যাপার?
২০:৯৬
قَالَ بَصُرْتُ بِمَا لَمْ یَبْصُرُوْا بِهٖ فَقَبَضْتُ قَبْضَةً مِّنْ اَثَرِ الرَّسُوْلِ فَنَبَذْتُهَا وَ كَذٰلِكَ سَوَّلَتْ لِیْ نَفْسِیْ
সে জবাব দিল, “আমি এমন জিনিস দেখেছি যা এরা দেখেনি, কাজেই আমি রসূলের পদাংক থেকে এক মুঠো তুলে নিয়েছি এবং তা নিক্ষেপ করেছি, আমার মন আমাকে এমনি ধারাই কিছু বুঝিয়েছে।
২০:৯৭
قَالَ فَاذْهَبْ فَاِنَّ لَكَ فِی الْحَیٰوةِ اَنْ تَقُوْلَ لَا مِسَاسَ١۪ وَ اِنَّ لَكَ مَوْعِدًا لَّنْ تُخْلَفَهٗ١ۚ وَ انْظُرْ اِلٰۤى اِلٰهِكَ الَّذِیْ ظَلْتَ عَلَیْهِ عَاكِفًا١ؕ لَنُحَرِّقَنَّهٗ ثُمَّ لَنَنْسِفَنَّهٗ فِی الْیَمِّ نَسْفًا
মূসা বললো, “বেশ, তুই দুর হয়ে যা, এখন জীবনভর তুই শুধু একথাই বলতে থাকবি, আমাকে ছুঁয়ো না। আর তোর জন্য জবাবদিহির একটি সময় নির্ধারিত রয়েছে যা কখনোই তোর থেকে দূরে সরে যাবে না। আর দেখ, তোর এই ইলাহর প্রতি, যার পূজায় তুই মত্ত ছিলি, এখন আমরা তাকে জ্বালিয়ে দেবো এবং তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেবো।
২০:৯৮
اِنَّمَاۤ اِلٰهُكُمُ اللّٰهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ١ؕ وَسِعَ كُلَّ شَیْءٍ عِلْمًا
হে লোকেরা! এক আল্লাহই তোমাদের ইলাহ, যিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, প্রত্যেক জিনিসের ওপর তাঁর জ্ঞান পরিব্যাপ্ত।
৮৩-৯৮ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
মূসা (عليه السلام)-কে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, চল্লিশ রাতভর তার ওপর তাওরাত নাযিল করবেন। সেই প্রতিশ্রুতির সময় আসার আগেই মূসা (عليه السلام) বানী-ইসরাঈলদেরকে পেছনে ফেলে তিনি আগেই তুর পাহাড়ে চলে এসেছেন। আল্লাহ তা‘আলা প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বললেন: তারা আমার পেছনে আসছে অচিরেই চলে আসবে, আমি আগে আসার কারণ হল আপনার নৈকট্য হাসিল করা যাতে আপনি আমার প্রতি বেশি খুশি হন। আল্লাহ তা‘আলা বললেন: তুমি তো এখানে চলে এসেছ, আমি তাদেরকে বাছুর পূজা দ্বারা পরীক্ষা করেছি। সামিরী নামক এক ব্যক্তি বাছুর নিয়ে এসে পূজা করতে বললে তারা তাই করল। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ১৪৮ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলার কথা শুনে মূসা (عليه السلام) তেমন কোন গুরুত্ব দেননি, শুধু রাগান্বিত ও অনুতপ্ত অবস্থায় সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলেন। কিন্তু যখন এসে স্বচক্ষে দেখলেন তখন রাগের মাত্রা বেড়ে গেল এমনকি হাতের ফলকগুলো নিক্ষেপ করে দিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:“মূসা যখন ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে স্বীয় সম্প্রদায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করল তখন বলল: ‘আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা আমার কতই নিকৃষ্ট প্রতিনিধিত্ব করেছ! তোমাদের প্রতিপালকের আদেশের পূর্বে তোমরা ত্বরান্বিত করলে?’ এবং সে ফলকগুলো ফেলে দিল আর স্বীয় ভ্রাতাকে চুল ধরে নিজের দিকে টেনে আনল। হারূন বলল: ‘হে আমার সহোদর! লোকেরা তো আমাকে দুর্বল মনে করেছিল এবং আমাকে প্রায় হত্যা করেই ফেলেছিল। তুমি আমার সাথে এমন কর না যাতে শত্র“রা আনন্দিত হয় এবং আমাকে জালিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত কর না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১৫০)
(أَلَمْ يَعِدْكُمْ رَبُّكُمْ وَعْدًا حَسَنًا)
অর্থাৎ তাওরাত নাযিল করে তোমাদেরকে কি উত্তম তথা জান্নাত ও বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দেননি? সে প্রতিশ্রুতির সময় কি দীর্ঘ হয়ে গেছে যে, তোমরা ভুলে গিয়ে বাছুর পূজা শুরু করে দিলে? নাকি আমার অনুপস্থিতি অনেক লম্বা হয়ে গেছে? নাকি তোমরা চাচ্ছ তোমাদের ওপর তোমাদের প্রতিপালকের ক্রোধ নেমে আসুক? জাতির লোকেরা মূসা (عليه السلام)-এর কথা শুনে উত্তর দিল, আমাদের এখতিয়ারে এ কাজ করিনি। কী কারণে করেছে তা পরের অংশে বলা হয়েছে। হারূন (عليه السلام) তাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। সুতরাং তোমরা কেবল এক আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে থাক আর আমার ও আমার কাজের অনুসরণ কর। কিন্তু তারা তার কথা শুনল না বরং বলল যে, আমরা মূসা ফিরে না আসা পর্যন্ত এ পূজা থেকে বিরত হব না।
তখন মূসা (عليه السلام) হারূন (عليه السلام)-কে এ ব্যাপারে তার দাড়ি ও চুল ধরে যখন জিজ্ঞেস করল তখন তিনি তার পূর্ব কথা বললেন এবং বললেন যে, তারা তা শোনেনি।
তখন মূসা (عليه السلام) আবার সামিরীকে জিজ্ঞেস করলেন। হে সামিরী! তোমার ব্যাপার কী? তখন সামিরী তার ঘটনা বৃত্তান্ত খুলে বলল: মূসা (عليه السلام) তার কথা শুনে তাকে শাস্তি দিলেন, তা হল সে কারো সাথে মিশতে পারবে না। সকলে তাকে বর্জন করবে। আর তার গোবৎসকে মূসা (عليه السلام) পুড়িয়ে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন যে, আল্লাহ তা‘আলাই হলেন একমাত্র মা‘বূদ, তিনি ব্যতীত আর কোন সঠিক মা‘বূদ নেই।
(أَنْ تَقُوْلَ فَرَّقْتَ بَيْنَ بَنِيْٓ إِسْرَآئِيْلَ وَلَمْ تَرْقُبْ قَوْلِيْ)
‘তুমি বলবে, ‘তুমি বানী ইসরাঈলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ ও তুমি আমার বাক্য পালনে যতত্নবান হওনি।’ সূরা আ‘রাফের ১৪২ নং আয়াতে বলা হয়েছে হারূন (عليه السلام)-এর উত্তর এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, লোকেরা আামাকে দুর্বল ভেবেছিল এবং আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। যার অর্থ হল হারূন (عليه السلام) নিজের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পালন করেছিলেন এবং তাদেরকে বুঝানো ও বাছুর পূজা হতে বিরত করার ব্যাপারে কোন প্রকার ক্রটি ও শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। কিন্তু ব্যাপারটিকে তিনি এত বাড়তে দেননি যাতে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। কারণ হারূন (عليه السلام)-কে হত্যা মানেই তাঁর সমর্থন ও বিরোধীদের মধ্যে আপোসে রক্তপাত শুরু হয়ে যেত এবং বানী ইসনরাঈলরা দু’ দলে বিভক্ত হয়ে পড়ত, যারা একে অপরের রক্ত পিপাসু হত। যেহেতু মূসা (عليه السلام) সেখানে উপস্থিত ছিলেন না সেহেতু তিনি এ স্পর্শকাতর পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেননি। আর সে কারণেই তিনি হারূন (عليه السلام)-এর প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটি পরিস্কার হওয়ার পর তিনি আসল অপরাধীর দিকে ফিরলেন।
সুতরাং হারূন (عليه السلام)-এর উক্তি ‘আসলে আমি আশংকা করলাম যে, আপনি বলবেন, তুমি বানী-ইসরাইলদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছ এবং তুমি আমার কথার অপেক্ষা করনি’ থেকে এ দলীল নেয়া সঠিক নয় যে, মুসলিমদের মাঝে একতা ও সংহতি বজায় রাখার স্বার্থে শিরকী কর্মকাণ্ড ও অন্যায়কে মেনে নেয়া উচিত।
(أَثَرِ الرَّسُوْلِ)
এখানে রাসূল দ্বারা উদ্দেশ্য হল জিবরীল (عليه السلام)। সামিরীর কথা “আমি দেখলাম যা তারা দেখেনি” এর অর্থ হল সামিরী জিবরীল (عليه السلام)-এর ঘোড়া পার হতে দেখল এবং তার পায়ের নিচের কিছু মাটি নিজের কাছে রেখে দিল। যার মধ্যে কিছু অলৌকিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল। সে মাটিকে গলিত অলংকার বা বাছুর এর ভেতর ভরে দিল যার ফলে ওর ভেতর হতে এক ধরনের আওয়াজ বের হতে শুরু হল। আর তা তাদের ভ্রষ্টতা ও ফিতনার কারণ হয়ে দাঁড়াল।
لَامِسَاسَ অর্থাৎ তুমি সারা জীবন এটি বলতে থাকবে যে, আমার নিকট হতে দূরে থাকো। আমাকে স্পর্শ করো না বা ছুঁয়ো না। কারণ তাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে (সামিরী ও স্পর্শকারী) উভয়েই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ত। সে কারণে যখনই সে কোন মানুষকে দেখত তখনই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠত আমাকে ছুঁয়ো না। সে মানুষের জন্য শিক্ষার এক নমুনা হয়ে যায়। অর্থাৎ মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য যে যত বেশি বাহানা ছল-চাতুরি ও ধোঁকাবাজি করবে দুনিয়া ও আখেরাতে তার শাস্তিও সে হিসেবে তত বেশি কঠিন ও শিক্ষণীয় হবে।
(لَنُحَرِّقَنَّه ثُمَّ لَنَنْسِفَنَّه فِي الْيَمِّ)
‘আমরা তাকে জ্বালিয়ে দেবই, অতঃপর তাকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবই।’ এখান থেকে বুঝা যায় শির্ক নিশ্চিহ্ন করে দেয়া বরং তার নাম নিশানা ও অস্তিত্ব মিটিয়ে ফেলা উচিত, তার সম্পর্ক যত বড়ই ব্যক্তিত্বের সাথেই হোক না কেন। আর এটা তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা ও অপমান নয়; যেমন বিদ‘আতী, তাজিয়া ও কবর পূজারীরা মনে করে থাকে। বরং এটি তাওহীদের উদ্দেশ্য ও ধর্মীয় আত্মচেতনাবোধের দাবী। যেমন এ ঘটনায় দূত (জিবরীল) এর পদচিহ্ন এর মাহাত্ম্য খেয়াল করা হয়নি; যাতে বাহ্যিক দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক বরকত দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। বরং তা সত্ত্বেও তার পরোয়া করা হয়নি। কারণ তা শিরকের মাধ্যম ও অসীলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শিক্ষা:-
# শির্ক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন সকল নিশানা উৎখাত করে দিতে হবে।
# যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, তিনি তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের পথ সহজ করে দেন।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*আল্লাহর মহান সান্নিধ্যে হযরত মুসা : এ পর্যন্ত এসে সাহায্য ও শাস্তির দৃশ্য শেষ হয়ে যাচ্ছে, এ অধ্যায়ের সমাপ্তি হচ্ছে এবং অবশেষে আসছে সে দৃশ্য, যখন দেখা যাচ্ছে মূসা(আ.) তার রবের নৈকট্য হাসিলের জন্যে তুর পর্বতের দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পর্বতের এক নির্দিষ্ট স্থানে মুসা(আ.)-কে সান্নিধ্য দান করার জন্যে ওয়াদা করেছিলেন, বলেছিলেন চল্লিশ দিন পর তাকে সেখানে যেতে, তারপর তাকে বিজয়ী করবেন, যদিও ইতিমধ্যে পরাজয়ের কিছু গ্লানি তাকে স্পর্শ করেছিলাে। সাহায্য পাওয়ার জন্যে অবশ্যই বেশ কিছু কষ্ট করতে হয়। আকীদা আমল ঠিক রাখার জন্যেও অনেক অনেক সবর করতে হয়, অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, মনকে মযবুত বানাতে হয় এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার জন্যে বিরাট এক মানসিক প্রস্তুতির প্রয়ােজন হয়। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর মূসা(আ.) তার সঙ্গীদের পাহাড়ের পাদদেশে রেখে একাই আরােহণ করলেন তূর পর্বতের সর্বোচ্চ শৃংগে । তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে পেছনে ছেড়ে গেলেন তার ভাই হারুনকে। প্রিয়তম প্রভু বিশ্ব সম্রাটের সাথে গােপন আলােচনার জন্যে, একান্ত নির্জনতায় পৌছুনাের আনন্দঘন মুহূর্তটি ছিলাে মূসা(আ.)-এর জন্যে এক বিরল ও অভূতপূর্ব সুযােগ, যার জন্যে তার মনটা পাগলপারা হয়ে ছিলাে এবং তার মন চাইছিলাে আল্লাহর সামনে অবস্থানের সময়টা যেন কখনও শেষ না হয়ে যায় । পরম করুণাময় মালিকের সান্নিধ্যের আনন্দ তিনি ইতিপূর্বে লাভ করেছিলেন, এজন্যে অধীর আগ্রহে কাল-বিলম্ব না করে তার মধুর পরশ পাওয়ার আশায় তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেছিলেন। এরপর তার মালিকের দরবারে যখন তিনি পৌছে গেলেন তখন মাওলা পাকের চেতনা ছাড়া দুনিয়ার আর কোনাে কিছু তার অনুভূতিতে স্থান পায়নি, এমনকি পর্বতের পাদদেশে ছেড়ে আসা তার জাতির অবস্থা কি হল এসব বিষয় চিন্তা করার মতাে কোনো অবসরই আর তিনি পাননি। এমনই এক মুহূর্তে তার রবই তাকে জানাচ্ছে পেছনে ছেড়ে আসা তার জাতির অবস্থা সম্পর্কে। সুতরাং আসুন একবার আমরা তাকাই সে ছেড়ে আসা জনতার অবস্থার দিকে এবং তাঁর একান্ত সংগীদের সম্পর্কে রাব্বুল আলামীনের সাথে তার কথাবার্তা একটু কান পেতে শুনি, ‘কোন জিনিস তােমাকে ব্যস্ত করে ফেললাে তােমার জাতি থেকে এতাে তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্যে হে মূসা? সে বললাে, ওরা তাে আমার পেছনে পেছনেই আসছে, আমি তােমার কাছে আসার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ছিলাম যেন তুমি খুশী হও (হে আমার মালিক)।’ আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘শােনাে তাহলে, আমি মহান আল্লাহ, তােমার আগমনের অব্যবহিত পরেই তােমার জাতিকে একটি পরীক্ষার মধ্যে ফেললাম, আর (এই অবসরে) সামেরী (নামক এক ব্যক্তি) তাদের ভুল পথে চালিত করলাে। আর এভাবেই মুসা এসেছিলেন তাঁর মাওলার দরবারে…’ খুবই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে, অবশ্য আসার এরাদা করার পর তিনি তার রবের সান্নিধ্যে দীর্ঘ চল্লিশটি দিন উপস্থিত থাকার জন্যে মানসিক দিক দিয়ে পুরােপুরি প্রস্তুতি নিয়েই রওয়ানা হয়েছিলেন। শত শত বছর ধরে গােলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ও নবীন জীবন লাভে মুগ্ধ বনী ইসরাঈল জাতির জন্যে জীবনবিধানপ্রাপ্তিই যে ছিলাে মুসা(আ.)-এর রব প্রভু পালনকর্তা মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের কারণ, তা সম্যকভাবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তাদের হীনতা দীনতা ও দীর্ঘ দিনের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছিলেন, যাতে করে আল্লাহর বার্তা মযলুম মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্যে তাদেরকে তিনি যােগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন তাছাড়া তাদেরকে এ গুরুদায়িত্ব বহন করার উপযােগী একদল সুন্দর যােগ্য মানুষ হিসেবে তিনি তাদের গড়ে তুলতে পারেন।
*বনী ইসরাঈলের গোবৎস পূজার গােমরাহী : দীর্ঘ সময় ধরে দাসত্বের শৃঙ্খলে নিষ্পেষিত হওয়ার এবং পৌত্তলিক ফেরাউনের অধীনস্থ থাকার ফলে তাদের প্রকৃতি বিগড়ে গিয়েছিলাে, আল্লাহর দ্বীন প্রচার প্রসার ও প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব বহন করার মনােবল তারা হারিয়ে ফেলেছিলাে। এ মহান দায়িত্ব বহন করার জন্যে যে অবিচলতা ও ধৈর্য প্রয়ােজন তা প্রদর্শন করার যােগ্যতা তাদের নষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে। তাদের মধ্যে ওয়াদা পূরণ করার মতাে চারিত্রিক বল ও দৃঢ়তা ছিলাে না। এর পরিবর্তে তাদের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতার রােগ বাসা বেঁধেছিলাে, তারা নেতৃত্বের গুণাবলী এবং স্বতস্ফূর্ত আনুগত্যবােধ হারিয়ে ফেলেছিলাে। ফলে। যখনই মূসা(আ.) তাঁর ভাই হারুনের পরিচালনায় সাময়িকভাবে তাদের রেখে একটু দূরে চলে গেলেন তখন তাদের মধ্যে নানা প্রকার ফিৎনা জন্ম নিলাে, তাদের আকীদা-বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেলাে এবং প্রথম পরীক্ষাতেই তারা চরম দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে বসলাে। অথচ আল্লাহর খলীফা হিসাবে মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত সঠিকভাবে পৌছে দিতে যে যােগ্যতা প্রয়ােজন তা অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা প্রয়ােজন এবং নানা প্রকার বিপদ মসিবতে নিপতিত করে ধৈর্য অবলম্বন প্রশিক্ষণ ও উদীয়মান এ বনী ইসরাঈল জাতির জন্যে একান্ত দরকার। তাই আল্লাহর পক্ষ থেকে বনী ইসরাঈলের জন্যে প্রথম পরীক্ষা ছিলাে সামেরী কর্তৃক নির্মিত গাে-শাবক। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতপর, আমি, মহান আল্লাহ তােমার জাতিকে (ওদের পেছনে ফেলে) তােমার (বার্তারােহণের) পর পরীক্ষা করলাম, আর সে সময়েই সামেরী তাদের পথভ্রষ্ট করলাে।’ অথচ মুসা(আ.) তাঁর রব এর সাথে সাক্ষাতের পূর্ব পর্যন্ত তার জাতির প্রতি আগত এ পরীক্ষা সম্পর্কে কোনাে খবর রাখছেন না। এ সাক্ষাতকালে তাকে কিছু ফলক দেয়া হয়েছিলাে, যাতে ছিলাে হেদায়াতের বাণী এবং বনী ইসরাঈল জাতিকে সঠিকভাবে গড়ে তােলার জন্যে প্রয়ােজনীয় জীবনবিধান, যাতে তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে। বর্তমান আলােচনার ধারায় বুঝা যাচ্ছে, যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মূসা(আ.)-কে হেদায়াত সম্বলিত সে ফলকগুলাে দিচ্ছিলেন, সে সময়ে পেছনে ছেড়ে আসা তার জাতির যে কঠিন পরীক্ষা মুখােমুখি হয়েছিলাে সে বিষয়ে তাকে কিছুই জানতে দেয়া হয়নি। কারণ তাতে মূসা(আ.)-এর মনে অস্থিরতা আসতাে, তিনি পরিপূর্ণ মনােযােগ সহকারে তার মালিকের সাথে কথা বলতে পারতেন না এবং ক্ষোভে দুঃখে তিনি ফিরে আসার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। কারণ তিনি বড়াে কষ্ট করে তাদের পৌত্তলিকতার পরিবেশ থেকে বের করে এবং মানুষের বন্দেগী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর বান্দায় পরিণত করেছিলেন। তারা যেন পৌত্তলিকতামুক্ত পরিবেশে আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকতে পারে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সহজলভ্য খাদ্য খাবার এবং অন্যান্য সকল প্রকার দ্রব্য তাদের কাছে পৌছে দেয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহ সে ব্যবস্থাও করেছিলেন। এ ছাড়াও মহান আল্লাহ তাঁর নবীর দ্বারা সে ধুধু মরুভূমির মধ্যে তাদের পরিচালনা করেছিলেন। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের সে সমস্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ এবং গােমরাহী ও তার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করাচ্ছেন। তারপর সে জাতিই মানুষের নিজের হাতে তৈরী বাছুরের মধ্য থেকে উত্থিত হাম্বা হাস্বা রব শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাে এবং ঝুঁকে পড়লাে পৌত্তলিকতা ও বাছুর পূজার দিকে! অবশ্য পুতুল পূজার ফিৎনা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা মূসা(আ.)-কে যা কিছু জানিয়েছিলেন এখানে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়নি। এতদসত্তেও এখানে যেভাবে আলােচনা করা হয়েছে তাতে সে জাতির চিত্র সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে। এখানকার বিবরণে দেখা যাচ্ছে, মূসা(আ.) রাগ ও দুঃখ নিয়ে ফিরে আসছেন এবং তাঁর জাতিকে কঠিনভাবে তিরস্কার করছেন- ভীষণভাবে ধমকাচ্ছেন তার ভাইকে। এতে বুঝা যাচ্ছে, মূসা(আ.) তাঁর জাতির এসব কদর্য আচরণ সম্পর্কে পুরােপুরি জানতেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, তারপর মুসা তার জাতির কাছে রাগান্বিত ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ফিরে এলাে, বললাে, হে আমার জাতি… ওরা বললো, মূসা আমাদের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এরই (এই বাছুরটিরই) পূজা করতে থাকবাে।'(আয়াত ৮৬-৯১)। এই হচ্ছে সেই ফিৎনা যার মােকাবেলা মূসা(আ.)-কে তার জাতির সাথে করতে হয়েছিলাে বলে এই প্রসংগে প্রকাশ পাচ্ছে। মূসা(আ.) যখন একাকী তার মালিকের একান্ত সান্নিধ্যে ছিলেন সেই পবিত্র মুহূর্তে এই ফিৎনার কথা প্রকাশ না করে একটু দেরী করা হয়েছিলাে এবং এর বিস্তারিত বিবরণ গােপন রাখা হয়েছিলাে, যাতে করে পরবর্তীকালে এ বিষয়ের জ্ঞান-গবেষণায় মানুষ আত্মনিয়ােগ করতে পারে। ওপরে বর্ণিত বিষয়টি মূসা(আ.) ফিরে না আসা পর্যন্ত তার কাছে গােপন রাখা হয়েছিলাে এই জন্যে যে, তিনি ফিরে এসে যেন নিজ চোখে তাঁর জাতিকে হাম্বারত গাে-শাবকের স্বর্ণ মূর্তিটি পূজা করা অবস্থায় নিজ চোখে দেখতে পারেন । দেখুন, কত বিস্ময়কর এই হতভাগা অকৃতজ্ঞ জাতির ব্যবহার, যাদের মূসা(আ.) কত বিপদের ঝড় মাথায় নিয়ে ফেরাউনের নিগড় থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন এবং যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ক্ষমতার অজস্র নিদর্শন এ পর্যন্ত দেখে এসেছে, তারা কেমন করে একটা বাছুর (তার সামান্য একটা বৈশিষ্ট্যের কারণে) পূজা করতে শুরু করেছে। অথচ তারা ভালো করেই জানে, বাছুরটি তৈরী করেছে তাদেরই সম্প্রদায়ের সামরী নামক একজন সাধারণ মানুষ। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, তারা বলছে, এটাই তােমাদের ও মূসা(আ.)-এর পূজনীয় বস্তু, অথচ তাদের ত্রাণকর্তা মূসা(আ.)-কে তারা বেমালুম ভুলে গেলাে! একথাও ভুলে গেলাে যে, তাদের সে স্থানে অপেক্ষা করতে বলে মূসা(আ.) সেই পর্বত-শিখৱে তার রবের কাছে গেছেন, যেখানে তার পরশ তিনি লাভ করবেন (বলে তারা জেনেছে এবং বিশ্বাস করেছে)! অতপর পড়ন্ত বেলায় ফিরে এসে মূসা(আ.) অতীব দুঃখ ও ক্রোধের সাথে তাঁর জাতির এ কদর্য আচরণের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, হে আমার জাতি, তােমাদের কাছে কি তােমাদের রব আল্লাহ অতি সুন্দর ওয়াদা করেননি? আর এটা অবশ্যই তাদের সবার জানা ছিলাে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন, যে তারা অতি শীঘ্রই একমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মান্যকারী হিসেবে, তারই সাহায্য বলে বায়তুল মাকদাসের পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনে প্রবেশ করবে। এ ওয়াদা দানের পর খুব বেশী দিন তাে অতীত হয়নি যে তারা হয়রান হয়ে যাবে এবং হতাশার কারণে অন্য পথ ধরবে। মাত্র চল্লিশ দিনও পার হয়নি এবং মূসা(আ.) তাদের কাছে তখনও ফিরে আসেননি, এরই মধ্যে তাদের হলাে এই ভীমরতি। তাই তিনি তাঁর হতভাগা জাতিকে অত্যন্ত অসন্তোষ নিয়ে তিরস্কার করছেন; বলছেন, ‘কি ব্যাপার। আল্লাহ তায়ালা তােমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন, তা কি খুব বেশী দিন হয়ে গেছে, না কি তােমরা চাও যে, আল্লাহর গযব তােমাদের ওপর অবধারিত হয়ে যাক এবং অবিলম্বে নেমে আসুক তােমাদের ওপর সেই কঠিন আযাব?’ অর্থাৎ তোমরা যে কাজ ও আচরণ করে চলেছ তাতে তােমাদের ওপর আল্লাহর আযাব আসা অবধারিত হয়ে গেছে। এতে বুঝা যায়, ওরা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে সেসব না-ফরমানী করেছে এবং এর পেছনে রয়েছে কঠিন এক চক্র। এজন্য বলা হচ্ছে; ‘কি ব্যাপার, যে ওয়াদা করেছিলে তা কি অনেক পুরাতন হয়ে গেছে? না কি চাও যে তােমাদের ও আল্লাহর আযাব এসে যাক। অতএব, এই জন্যেই আমার সাথে কৃত চুক্তি তােমরা ভংগ করেছাে- তাই না? অথচ আমরা সবাই পরস্পরের সাথে তাে এই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলাম যে, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কেউ এ চুক্তি ভাংবে না, আমার হুকুম ছাড়া তােমাদের মধ্যে কেউই আকীদার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন আনবেনা বা তােমাদের কর্মকান্ডের মধ্যে কিছু রদবদল করবে না? ওপরের আলােচনায় বুঝা যাচ্ছে যে, সে চুক্তি করার সময়ই তারা নানা প্রকার ওযর আপত্তি করেছিলাে, যা দ্বারা এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ওরা দীর্ঘ দিন ধরে যে মূর্তিপূজার মধ্যে ডুবেছিলাে তার প্রভাব এখনও পুরােপুরি দূর করতে পারেনি। মানসিক দিক দিয়ে তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে এবং তাদের বুদ্ধি এখনও স্থির হতে পারেনি। দেখুন তাদের কথার উদ্ধৃতিতে কি বলা হচ্ছে, ‘ওরা বললাে, আমাদের নিজেদের ইচ্ছা এখতিয়ার অনুযায়ী যে আমরা ওয়াদা ভংগ করেছি তা নয়, অর্থাৎ, এই যে পরিবর্তনের বিষয়টি- এটা আমাদের ইচ্ছা এখতিয়ারের বাইরে ছিলাে, বরং আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলাে গোটা ফেরাউন জাতির অলংকারাদির বােঝা; অতপর সেগুলােই আমরা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম’ অর্থাৎ, মিসর অবস্থিত বনী ইসরাঈল জাতির সকল অলংকার তাদের মহিলাদের কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছিলাে। আমরা সবাই তাদের সাথে নিয়ে সেগুলােকে বহন করে নিয়ে এসেছিলাম, এই বােঝা বলতে ওরা ইংগিত করছিলাে সেই গহনাগাটির দিকে এবং বলছিলাে; আমরা ওইসব অলংকার হারাম মনে করি। ওগুলাে বয়ে বেড়ানাে থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলাম এবং এ জন্যে ওগুলাে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। তখন সামেরী ওগুলাে হাতিয়ে নেয় এবং ওগুলা দিয়ে সে একটি বাছুর তৈরী করে। সামেরী হচ্ছে সামেরা নামক এলাকা থেকে আগত এক ব্যক্তি। সে এলাকার লােকদের সাথে তার ওঠাবসা ছিলাে। অথবা সে তাদেরই একজন যার নামের সাথে সামেরী উপাধি সংযােজিত হয়েছে। এই গো-শাবকের মধ্যে কতকগুলাে ছিদ্র রেখে দেয়া হয়েছিলাে, এগুলাের মধ্যে যখন বাতাস প্রবেশ করতাে তখন হাম্বা হাম্বা রব বেরুত। অথচ এর মধ্যে কোনাে জীবন বা আত্মা কিছুই ছিলাে না। এ ছিলাে নিছক একটি মূর্তি। মূর্তি কথাটি প্রযােজ্য সেই শারীরিক বস্তুর ওপর, যার মধ্যে কোনাে প্রাণ থাকে না, কিন্তু আফসােস, স্বর্ণ নির্মিত এই গাে-শাবক মূর্তির মধ্য থেকে শব্দ নির্গত হতে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে তাদের রবকে ভুলে গেলাে সে জাতি, যাদের তাদের রব চরম অপমানের গ্লানি এবং হীনতা দীনতার কবল থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন। আর তারা এই স্বর্ণ নির্মিত বাছুরের পূজা করতে শুরু করে দিলাে এবং চিন্তার বিভ্রান্তি কবলিত হয়ে বিবেক-বুদ্ধির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে তারা বলে ওঠলাে; ‘এটিই হচ্ছে তােমাদের পূজনীয় সর্বময় ক্ষমতার মালিক প্রভু, আর মূসারও প্রভু এটাই।’ অর্থাৎ সে বিভ্রান্ত নেতৃবৃন্দ তাদের জনগণকে বুঝালাে যে, মূসা এই প্রভুরই সন্ধান করতে গেছে পর্বতের ওপরে। অথচ তিনি তাে এখানে আমাদের সাথে বর্তমান রয়েছেন। হায়, মূসা তার রব এর সান্নিধ্যে পৌছুনাের পথটা ভুল গেলাে এবং তার থেকে দূরে সরে পড়লাে। দেখুন, সে বেওকুফ জাতির কী ভীষণ বেয়াদবী, আল্লাহর নবীকে কিভাবে তারা দোষারােপ করছে এবং কি ভাবে তার মান সন্মানকে পদদলিত করছে, অথচ তিনি শুনছেন ও দেখছেন, তারা বলছে, মূসা(আ.) তাঁর রব এর কাছে পৌছুতে পারেননি, এমনকি, ওরা বলছে যে, তিনি তাঁর রবএর কাছে যাওয়ার পথই ভুলে গেছেন তিনি নিজেও পথ পাননি, তার রবও তাকে সঠিক পথ দেখাননি। অর্থাৎ সে হতভাগা জাতি দোষারােপ করছে একাধারে তাদের নবীকে এবং তাদের রবকেও! সামেরী যে কঠিন ধোকায় ফেলে বনী ইসরাঈল জাতিকে শিরকে লিপ্ত করেছিলাে তা আরাে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে নীচের আয়াতাংশে, ‘ওরা কি দেখছে না যে সে বাছুর দেহী বস্তুটি (হাম্বা হাম্বা শব্দ করলেও) তাদের কথার কোনাে জওয়াব দেয় না বা তাদের কোনাে ক্ষতি অথবা উপকার করতে পারেনা, অর্থাৎ এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে যে আসলে বাছুরটি এমন কোনাে জ্যান্ত প্রাণী ছিলাে না যা শুনতে বা দেখতে পায়, অথবা জীবন্ত গাে-শাবককে ডাকলে যেমন সাড়া দেয় সে রকম সাড়াও সে দিতে পারতাে না, যার দ্বারা প্রাণ স্পন্দনের নিম্নতম লক্ষণ বুঝা যায়, ক্ষতি বা উপকার করা তাে দূরের কথা। তার অবস্থা হচ্ছে না সে গুতা মারতে পারে- না পারতাে লাথি মারতে, না পারতাে মলন মলতে আর না পারতাে কুয়া থেকে পানি তােলার কাজে সাহায্য করতে। আর এ সব কিছুর ওপর যে কথাটি চিন্তা করার তা হচ্ছে, মূসা(আ.) হারুন নবীকে তাদের দেখা শুনার জন্যে তার প্রতিনিধি বানিয়ে পেছনে রেখে গিয়েছিলেন, তার সাবধান করা সত্তেও তাঁর কথা অবজ্ঞা করে তারা এই বাছুরটির সামনে মাথানত করে তার পূজা শুরু করেছিলাে। এটা যে এক কঠিন পরীক্ষা- একথা জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘হে আমার জাতি, অবশ্যই তােমাদের এক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তােমাদের রব-প্রতিপালক তাে তিনি যিনি মহা দয়াময়।’ তার অনুসরণ ও আনুগত্য করার জন্যে তিনি তাদের বারবার উপদেশ দিয়েছেন উপদেশ দিয়েছেন তাদের সেভাবে বুঝাতে যেভাবে মূসা(আ.) তাকে বলে গিয়েছিলেন, আর তিনি একথাও বলে গিয়েছিলেন যে, তার রবের সাথে পবর্তের ওপর নির্দিষ্ট সময় কাটানাের। পর শীঘ্রই তিনি ফিরে আসবেন, কিন্তু হায়, তার কথা মানার পরিবর্তে ঘাড় বাঁকিয়ে তারা সরে গেছে, তার নসীহতের কোনাে পরওয়াই তারা করেনি এবং মুসা(আ.)-এর অবর্তমানে হারুন(আ.)-এর আনুগত্য করবে বলে যে ওয়াদা তারা করেছিলাে তার কোনাে পরওয়াই তারা করলো না; বরং তারা বললাে, “ঠিক আছে, আমরা এই বাছুরটি নিয়েই মেতে থাকবাে যতােক্ষণ না মূসা(আ.) আমাদের কাছে ফিরে আসেন।
*মূসা(আ.)-এর তুর পর্বত থেকে প্রত্যাবর্তন : অতপর প্রচন্ড ক্রোধ ও বেদনাহত হৃদয় নিয়ে মূসা(আ.) তাঁর জাতির কাছে ফিরে এলেন এবং যখন তাদের এই কদর্য কাজের যুক্তি শুনলেন, তখন বুঝলেন তাঁর জাতিকে এক কঠিন চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছে, তাদের চিন্তা ধারা বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। তখন তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তার ভাই হারুনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং চরম উত্তেজিতভাবে তাঁর চুল ও দাড়ি জাপটে ধরে বললেন, ‘হে হারুন, যখন তাদের এভাবে পথভ্রষ্ট হতে দেখলে তখন কোন জিনিস তােমাকে আমার কাছে চলে আসতে বারণ করেছিলাে? তুমি কি আমার নাফরমানী করলে? মূসা(আ.) এই জন্যে তার ওপর বেশী রেগে গিয়েছিলেন যে, যখন তাদের বাছর পূজা থেকে বিরত করতে হারুন ব্যর্থ হলেন তখন সেখানে উপস্থিত থেকে নীরবে সেই অন্যায় সহ্য না করে মুসা(আ.)-এর কাছে পৌছে যাওয়া তার কি উচিত ছিলাে না? তা না করে, সে অন্যায় প্রত্যক্ষ করে তিনি নিজেও কষ্ট পেলেন এবং ওদেরকেও বাছুর পূজা থেকে থামাতে পারলেন না। এতে কি তার জন্যে নির্দেশ অমান্য করা হলাে না? অবশ্য প্রাসংগিক আলােচনায় হারুন(আ.)-এর অবস্থানের যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাকে দাড়ি ও চুল ধরে যখন মূসা(আ.) কথা বলতে উদ্যত হয়েছেন, তখন তিনি কোনাে প্রকার ক্রোধ প্রদর্শন না করে অত্যন্ত অনুতাপ ও বিনয়ের সাথে নিজের ওযর পেশ করছেন এবং হারানাে মহব্বত ফিরে পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বলছেন, ‘হে আমার মায়ের পেটের ভাই, আমার দাড়ি ও চুল ধরে আমাকে ঝাকাবেন না। আমি ভয় করছিলাম যে আপনি বলবেন, বনী ইসরাঈলদের মধ্যে তুমি বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছাে। ওদের সংগঠিত করে রাখার জন্যে তােমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলাম, আমার অবর্তমানে তুমি সে দায়িত্ব পালন করােনি এবং আমার কথা রক্ষা করােনি। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি হারুন ছিলেন যথেষ্ট আত্মসংযমী এবং মূসা(আ.)-এর তুলনায় বেশী ক্রোধ সংবরণকারী। তিনি অবস্থার নাযুকতা গভীরভাবে উপলব্ধি করছিলেন এবং তার স্নেহপূর্ণ সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ভাইয়ের রাগ দমন করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি ভাইকে একথা বুঝাতে চেষ্টা করছিলেন যে, তাঁর সংযম প্রদর্শন ছিলাে প্রকৃতপক্ষে ভাইয়ের আনুগত্যের উদ্দেশ্যেই। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, তার বেশী কড়াকড়িতে হয়তাে বনী ইসরাঈলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হবে এবং তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, একদল বাছুর পূজার দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং নগণ্য আর একটি দল হারুন পন্থী হয়ে থাকবে; অথচ তাঁর মূসা(আ.)-এর নির্দেশ ছিলাে বনী ইরাঈলদের রক্ষণাবেক্ষণ করা ও কোনাে প্রকার দুর্ঘটনা যেন তাদের পেয়ে না বসে সে বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকা, আর তাদের কোনাে বিষয়ে বিশেষভাবে হস্তক্ষেপ না করা মূসা(আ.)। তখন তাে ভাবতে পারেননি যে, এমন কঠিন কাজ তারা করবে। অবশ্য, অন্যদিকে চিন্তা করলে তার এ যুক্তির মধ্যে অনুগত্যের ছোঁয়া বেশ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় । এখানে দেখা যায়, আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে হারুন(আ.)-এর এ বিনম্র ভূমিকায় বেশ ভালাে কাজ হলাে অর্থাৎ, তার ওপর থেকে মূসা(আ.)-এর রাগ নেমে গিয়ে সামেরীর প্রতি তাঁর মনােযােগ আকৃষ্ট হলাে। যেহেতু মূলত সেই ছিলাে এই প্রচন্ড বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের হােতা এ পর্যন্ত মূসা(আ.) তার দিকে খেয়াল দেননি, কারণ হাম্বা-রবকারী যে কোনাে জীব জন্তুর পূজা করার ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে গোটা জাতিই তো দায়ী ছিলাে। অবশ্যই তারা সবাই বুঝত যে, শুধু হাম্বা রবকারী হওয়ার কারণেই কেউ পূজা পাওয়ার যোগ্য হয়ে যায় না। আর প্রকৃতপক্ষে এই বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী গােমরাহ লােকদের ও তাঁর সাথে টিকে থাকা সত্য সঠিক পথে অবস্থানকারীদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্যে হারুনই ছিলেন দায়িত্বশীল। যখন তাদের সংগঠক হিসাবে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তখন মূসা(আ.) তাকেই এ ফিৎনার জন্যে দায়ী মনে করেছিলেন। সামেরীর ব্যাপারটা তাে পরে আসছে। সে প্রথম নবী মূসা(আ.)-এর নাফরমানী করলাে, তারপর দ্বিতীয় নবীর উপদেশের পরওয়াও করলাে না। কাজেই এ কঠিন অবস্থার জন্যে দায়িত্ব বর্তায় প্রথম দায়িত্বশীল মূসা(আ.)-এর ওপর, তারপর আসে দ্বিতীয় দায়িত্বশীল হারুন(আ.)-এর ওপর এবং একেবারে শেষে দায়ী হয় এই ফিৎনা সৃষ্টির হােতা সামেরীর ঊপর। দেখুন, একথা শুনে মূসা(আ.) সামেরীর দিকে মনােযােগী হচ্ছেন! সে বললাে, তােমার কি বলার আছে, বলাে হে সামেরী অর্থাৎ, তােমার অবস্থা ও বক্তব্য কি বলাে দেখি; জিজ্ঞাসা করার এই ভংগিতে বিষয়টি যে কত কঠিন তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। ‘সে বললাে, আমি তাই দেখেছি যা ওরা দেখেনি, তারপর আমি বার্তাবাহক (জিবরাঈল)-এর পদ স্পর্শিত ধূলি থেকে এক মুষ্টি তুলে নিয়েছি এবং নিক্ষেপ করেছি এই ধূলিকণাগুলােকে (সে অলংকারাদির বিগলিত স্তুপের মধ্যে), এভাবেই মন আমাকে যা বলেছে, আমি তাই করে ফেলেছি।’ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য প্রশ্ন আসে, সামেরী কি দেখেছিলাে?- সে বিষয়ে তার বক্তব্য সম্পর্কে বহু রেওয়ায়াত পাওয়া যায়। কে ছিলাে এ ‘রসূল’ যার পদধূলি সে নিক্ষেপ করেছিলো, আর এর সাথে সে স্বর্ণনির্মিত বাছুরেরই বা সম্পর্ক কি ছিলাে, আর এই এক মুষ্টি পদ স্পর্শিত ধূলিরই বা কি কারিশমা (অলৌকিক ক্ষমতা) ছিলাে, এসব বিষয়ে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা এসেছে। আর এসব রেওয়ায়াতের (বর্ণনা পরস্পরের) মধ্যে সব থেকে দ্বিধা-দ্বন্ধের বিষয় হচ্ছে, সে নাকি জিবরাঈল(আ.)-কে দেখেছিলাে, সে নাকি তাকে সেই আসল রূপ চেহারা দেখেছিলাে যা নিয়ে তিনি দুনিয়ায় আগমন করেন, তারপর সে নাকি তার পবিত্র কদমের নীচে থেকে এক মুষ্টি ধুলা তুলে নিয়েছিলো। অথবা তার ঘোড়ার খুরের মাটি থেকে তুলে নিয়েছিলাে, তারপর সে নাকি সেই স্বর্ণ নির্মিত গাে শাবকটির ওপর ছুঁড়ে মেরেছিলাে, যার ফলে সেটি হাম্বা-হাম্বা রব করতে শুরু করে দিলাে, অর্থাৎ সে বিগলিত স্বর্ণ কুন্ডের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলে তা হাম্বা রবকারী বাছুরে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। এখানে আল কোরআন সে ঘটনার রহস্য সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু জানায়নি। একটি কাহিনী হিসাবে শুধুমাত্র সামেরীর ঘটনাটি পেশ করেছে। আর এ কারণেই আমরা কি ঘটেছিলাে, সেটা বড়াে করে না দেখে সামেরীর ওযরটা গুরুত্ব সহকারে পরখ করতে চাই। সেসব স্বর্ণঅলংকার দ্বারা বাছুর বানিয়ে ছিলো যা মিসরবাসীর কাছ থেকে তারা বহন করে নিয়ে এসেছিলাে এবং পরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাে। প্রকৃতপক্ষে সামেরী বাছুরটা এমন এক সুক্ষ প্রযুক্তিতে তৈরী করেছিলো যে, যখনই সেটির মধ্যে বায়ু প্রবেশ করতাে তখনই তা থেকে হাম্বা ডাকের মতাে শব্দ শােনা যেতাে। এ বিষয়টা রহস্যপূর্ণ করে তােলার জন্য এবং তার কেরামতি জাহির করার জন্যে সে বুদ্ধি করে এ কাহিনী বানিয়ে নিয়েছিলাে যে, ‘রসূল’-এর পায়ের ধুলা থেকে এক মুষ্টি সে তুলে নিয়েছিল। অবস্থা যাইই হােক না কেন, তার এই ধোকাবাজি দ্বারা গােটা জাতিকে গােমরাহ করার ক্ষমাহীন অপরাধের শাস্তি স্বরূপ মূসা(আ.) তাকে সারা জীবনের জন্যে বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে বহিষ্কারের ঘােষণা শুনিয়ে তার চূড়ান্ত শাস্তির দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর আনুগত্য থেকে মানুষকে সরিয়ে বাছুর পূজার দিকে এগিয়ে দেয়ার হােতা যে অপরাধ করেছিলাে তাকে তিনি অত্যন্ত কঠোর হাতে দমন করলেন যাতে করে মানুষ প্রামাণ্যভাবে বুঝতে পারে, কোনাে একটি বাছুর কখনও ইলাহ (সর্বশক্তিমান) হতে পারে না, কোনােভাবেই এর নির্মাতার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা যায় না, বা তার কোনাে ওযরই গ্রহণযােগ্য নয়। বিশ্ব সম্রাটের ক্ষমতার বাঁধন থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কিছুর মধ্যে যে লিপ্ত করবে, তাকে সে মহান সম্রাটের প্রতিনিধি কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেন না।
*গাে-শাবক নির্মাতার প্রতি অভিশাপ : এজন্যে আল্লাহর নবী ও রসূল মূসা(আ.) তাকে চূড়ান্ত ও কঠিন অভিশাপ দিলেন আল্লাহর ভাষায় তা হচ্ছে, ‘সে বললাে, দূর হয়ে যা মরদূদ (জাহান্নামের কীট), তাের জন্যে রইলাে এই শাস্তি যে সারা যিন্দেগী ধরে তুমি বলতে থাকবে আমাকে ছুঁয়ােনা আমাকে ছুঁয়াে না। কিছুতেই তুমি এর থেকে মুক্তি পাবে না, আর চেয়ে দেখাে তােমার সে পূজনীয় বস্তুর দিকে যা নিয়ে তুমি মেতেছিলে । ওকে আমরা পুড়িয়ে ছাই করে দেবো এবং সে সব ছাইকে বিশাল সাগরের বুকে ভাসিয়ে দেবাে।’ অর্থাৎ, দূর হয়ে যাও এখান থেকে, ভালো মনে হােক বা মন্দ মনে হােক- কোনাে অবস্থাতেই তােকে কেউ স্পর্শ করবে না- আর তুইও কাউকে স্পর্শ করতে পারবেনা। মূসা (আ.) কর্তৃক যে সব শাস্তির আইন চালু করা হয়েছিলাে, তার মধ্যে এই একঘরে করার দন্ড ছিলাে একটি মােক্ষম শাস্তি। এরপর তাকে চির অচ্ছ্যুৎ ও অস্পৃশ্য হওয়ার ঘােষণা দিয়ে মানুষকে জানিয়ে দেয়া হলাে যে কেউ তার কাছে ঘেঁষবে না এবং সেও কারাে কাছে ঘেঁষতে পারবে না। এরপর তাে রয়েছে পরপারের জন্যে ওয়াদা, সেখানে আল্লাহর কাছে রয়েছে তার জন্যে যথােপযুক্ত শাস্তি ও উচিত প্রতিদান। এরপর দেখা যাচ্ছে, মূসা(আ.) চরম ক্রোধ ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে স্বর্ণের বাছুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং তাতে অগ্নিসংযােগ করে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে সেগুলাে সমুদ্রের বুকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। মূসা(আ.)-এর চারিত্রিক অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলাে পাহাড়সম দৃঢ়তা, সিদ্ধান্তে অবিচলতা, আর এখানে তার ক্রোধ সঞ্চার হওয়া সে তাে আল্লাহরই জন্যে, আল্লাহর দ্বীনের প্রয়ােজনে। এই কারণে তাঁর দৃঢ়তাকে এবং তার কঠোরতাকে ভালাে মনে করা হয়েছে। এভাবে যখন মিথ্যা ইলাহর (পূজনীয় পাত্রের) জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার দৃশ্য সামনে এলাে তখন মূসা(আ.) সঠিক আকীদা বিশ্বাসের আসল রূপ তুলে ধরছেন, অবশ্যই তােমাদের প্রকৃত ইলাহ হচ্ছেন আল্লাহ (যার হাতে রয়েছে সকল ক্ষমতার চাবিকাঠি), তিনি ছাড়া সর্বময় ও চূড়ান্ত ক্ষমতার মালিক আর কেউ নেই। সব কিছুই তার জ্ঞানের পরিধির মধ্যে বর্তমান রয়েছে। আর মূসা(আ.) এর এই ঘােষণার সাথে আলােচ্য সূরার মধ্যে তার কাহিনীর ইতি টানা হয়েছে। তাঁর এ কাহিনীর বর্ণনায় আল্লাহর রহমত ও সুদৃঢ় পরিচালনার ছবি ফুটে ওঠেছে, ফটে ওঠেছে তাঁর দাওয়াতী কাজ ও ব্যক্তিগতভাবে তার পরিপূর্ণ আনুগত্যের জীবন্ত চিত্র। এমনকি যখন ওরা তাঁকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে তখনও তারাই যে ভুল করেছে তা শীঘ্রই ধরা পড়ে গেছে। এরপর এ কাহিনীকে অবলম্বন করে আর অন্য কোনাে তথ্যবিবরণী আসেনি। কারণ এর পরই দেখা যাচ্ছে বনী ইসরাঈল জাতির ওপর আপতিত উপর্যুপরি আযাব নাযিলের ধারা এটাই তাদের নানা প্রকার অপরাধ, অশান্তি বিশৃংখলা ও বিদ্রোহাত্মক কাজের পুরস্কার। পরিশেষে একথা বলতে হয়, সুরাটির মধ্যে আল্লাহর নেককার ও পছন্দনীয় বান্দাদের জন্যে মনােরম দয়ামায়া ও মমতাপূর্ণ এক পরিবেশ ফুটে ওঠেছে। অতএব, এহেন শান্ত সুন্দর পরিবেশের মধ্যে অন্য কোনাে কাহিনীর অবতারণা করে এর সুষমাকে ম্লান করার আর কোনাে প্রয়ােজন নেই।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# এই মাত্র উপরে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে এখান থেকে তার সাথে আলোচনা সম্পৃক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ বনী ইসরাঈলকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে, তোমরা তূর পাহাড়ের ডান দিকে অবস্থান করো এবং চল্লিশ দিনের মেয়াদ শেষ হলে তোমাদের নির্দেশনামা দেয়া হবে।
# এ বাক্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, নিজ সম্প্রদায়কে পেছনে রেখে হযরত মূসা আল্লাহর সাথে মোলাকাতের আগ্রহের আতিশয্যে আগে চলে গিয়েছিলেন। তূরের ডান পাশের যেখানকার ওয়াদা বনী ইসরাঈলদের সাথে করা হয়েছিল সেখানে তখনো কাফেলা পৌঁছুতে পারেনি। ততক্ষণ হযরত মূসা একাই রওয়ানা হয়ে গিয়ে আল্লাহর সামনে হাজিরা দিলেন। এ সময় আল্লাহ ও বান্দার সাথে যা ঘটে তার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে সূরা আরাফের ১৭ রুকূ’তে)। হযরত মূসার আল্লাহর সাক্ষাতের আবেদন জানানো এবং আল্লাহর একথা বলা যে, তুমি আমাকে দেখতে পারবে না তারপর আল্লাহর একটি পাহাড়ের ওপর সামান্য তাজাল্লি নিক্ষেপ করে তাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেয়া এবং হযরত মূসার বেহুশ হয়ে পড়ে যাওয়া, আর তারপর পাথরের তখতিতে লেখা বিধান লাভ করা-এসব সেই সময়েরই ঘটনা। এখানে এ ঘটনার শুধুমাত্র বনী ইসরাঈলের গো-বৎস পূজার সাথে সম্পর্কিত অংশটুকুই বর্ণনা করা হচ্ছে। একটি জাতির মধ্যে মূর্তি পূজার সূচনা কিভাবে হয় এবং আল্লাহর নবী এ ফিতনাটি দেখে কেমন অস্থির হয়ে পড়েন, মক্কার কাফেরদেরকে এ কথা জানানোই এ বর্ণনার উদ্দেশ্য।
# এটা ঐ ব্যক্তির নাম নয়। বরং শব্দের শেষে সম্বন্ধসূচক ইয়া (ى) ব্যবহারের সুস্পষ্ট আলামত থেকে একথা জানা যায় যে, এটা গোত্র, বংশ বা স্থানের সাথে সম্পর্কিত কোন শব্দ। তারপর আবার কুরআন যেভাবে আসসামেরী বলে তার উল্লেখ করছে তা থেকে একথাও অনুমান করা যায় যে, সে সময় সামেরী গোত্র, বংশ বা স্থানের বহু লোক ছিল এবং তাদের এক বিশেষ ব্যক্তি ছিল বনী ইসরাঈলের মধ্যে স্বর্ণ নির্মিত গো-বৎস পূজার প্রচলনকারী এ সামেরী। কুরআনের এ জায়গার ব্যাখ্যার জন্য প্রকৃতপক্ষে এর চাইতে বেশী কিছু বর্ণনার দরকার নেই। কিন্তু এ জায়গায় যা বলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে খৃস্টান মিশনারীরা বিশেষ করে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদরা কুরআনের বিরুদ্ধে ব্যাপক আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তারা বলেন, (নাউযুবিল্লাহ) এটা কুরআন রচয়িতার মারাত্মক অজ্ঞতার প্রমাণ। কারণ এ ঘটনার কয়েকশ’ বছর পর খৃস্টপূর্ব ৯২৫ অব্দের কাছাকাছি সময় ইসরাঈলী সাম্রাজ্যের রাজধানী “সামেরীয়া” নির্মিত হয়। তারপর এরও কয়েকশ’ বছর পর ইসরাঈলী ও অইসরাঈলীদের সমন্বয়ে শংকর প্রজন্মের উদ্ভব হয়, যারা “সামেরী” নামে পরিচিত হয়। তাদের মতে এই সামেরীদের মধ্যে অন্যান্য মুশরিকী বিদআতের সাথে সাথে সোনালী বাছুর পূজার রেওয়াজও ছিল এবং ইহুদীদের মাধ্যমে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের একথা শুনে নিয়ে থাকবেন, তাই তিনি একে নিয়ে হযরত মূসার যুগের সাথে জুড়ে দিয়েছেন এবং এ কাহিনী তৈরী করেছেন যে, সেখানে সোনার বাছুর পূজার প্রচলনকারী সামেরী নামে এক ব্যক্তি ছিল। এ ধরনের কথা এরা হামানের ব্যাপারেও বলেছে। কুরআন এই হামানকে ফেরাউনের মন্ত্রী হিসেবে পেশ করেছে। অন্যদিকে খৃস্টান মিশনারী ও প্রাচ্যবিদরা তাকে ইরানের বাদশাহ আখসোয়ার্সের সভাসদ ও উমরাহ “হামান” এর সাথে মিলিয়ে দিয়ে বলেন, এটা কুরআন রচয়িতার অজ্ঞতার আর একটা প্রমাণ। সম্ভবত এ জ্ঞান ও গবেষণার দাবীদারদের ধারণা প্রাচীন যুগে এক নামের একজন লোক, একটি গোত্র অথবা একটি স্থানই হতো এবং এক নামের দুজন লোক, গোত্র বা দু’টি স্থান হবার আদৌ কোন সম্ভাবনাই ছিল না। অথচ প্রাচীনকালের একটি অতি পরিচিত জাতি ছিল সুমেরী। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যুগে ইরাক ও তার আশপাশের এলাকায় এ জাতিটি বসবাস করতো। আর এ জাতির বা এর কোন শাখার লোকদেরকে মিসরে সামেরী বলা হতে পারে এর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তারপর এই সামেরীয়ার মূলের দিকেও নজর দিন। এরই সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতেই তো পরবর্তীকালে উত্তর ফিলিস্তীনের লোকদেরকে সামেরী বলা হতে থাকে। বাইবেলের বর্ণনা মতে ইসরাঈল রাজ্যের শাসক উমরী “সামেরী” (বা শেমর) নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি পাহাড় কিনেছিলেন যার ওপর পরে তিনি নিজের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। যেহেতু পাহাড়ের সাবেক মালিকের নাম সামর ছিল তাই এ শহরের নাম রাখা হয় সামেরিয়া(বা শামরিয়া) (১-রাজাবলী ১৬-২৪), এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, সামেরিয়ার অস্তিত্ব লাভের পূর্বে “সামর” নামক লোকের অস্তিত্ব ছিল এবং তার সাথে সম্পর্কিত হয়ে তার বংশ বা গোত্রের নাম সামেরী এবং স্থানের নাম সামেরীয়া হওয়া অবশ্যই সম্ভবপর ছিল।
# এর অনুবাদ “ভালো ওয়াদা করেননি” ও হতে পারে। মূল ইবারতের যে অনুবাদ আমি করেছি তার অর্থ হচ্ছে, আজ পর্যন্ত তোমাদের রব তোমাদের সাথে যেসব কল্যাণের ওয়াদা করেছেন তার সবই তোমরা লাভ করতে থেকেছো। তোমাদের নিরাপদে মিসর থেকে বের করেছেন। দাসত্ব মুক্ত করেছেন। তোমাদের শত্রুকে তছনছ করে দিয়েছেন। তোমাদের জন্য তাই মরুময় ও পার্বত্য অঞ্চলে ছায়া ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এ সমস্ত ভালো ওয়াদা কি পূর্ণ হয়নি? দ্বিতীয় অনুবাদের অর্থ হবে, তোমাদেরকে শরীয়াত ও আনুগত্যনামা দেবার যে ওয়াদা করা হয়েছিল তোমাদের মতে তা কি কোন কল্যাণ ও হিতসাধনের ওয়াদা ছিল না?
# দ্বিতীয় অনুবাদ এও হতে পারে,”ওয়াদা পূর্ণ হতে কি অনেক বেশী সময় লাগে যে, তোমরা অধৈর্য হয়ে পড়েছো?
# ” প্রথম অনুবাদের অর্থ হবে, তোমাদের প্রতি আল্লাহ তা’আলা এই মাত্র যে বিরাট অনুগ্রহ করেছেন, এর পর কি অনেক বেশী সময় অতীত হয়ে গেছে যে, তোমরা তাঁকে ভুলে গেলে? তোমাদের বিপদের দিনগুলো কি সুদীর্ঘকাল আগে শেষ হয়ে গেছে যে, তোমরা পাগলের মতো বিপথে ছুটে চলেছো? দ্বিতীয় অনুবাদের পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, পথনির্দেশনা দেবার যে ওয়াদা করা হয়েছিল তা পূর্ণ হতে তো কোন প্রকার বিলম্ব হয়নি, যাকে তোমরা নিজেদের জন্য ওজর বা বাহানা হিসেবে দাঁড় করাতে পারো।
# প্রত্যেক জাতি তার নবীর সাথে যে ওয়াদা করে তার কথাই এখানে বলা হয়েছে। এ ওয়াদা হচ্ছেঃ তাঁর আনুগত্য করা, তাঁর দেওয়া নির্দেশের ওপর অবিচল থাকা এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী না করা।
# এখান থেকে এ প্যারার শেষ ইবারত পর্যন্ত চিন্তা করলে পরিষ্কার অনুভব করা যায় যে, জাতির জবাব “ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম” পর্যন্ত শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী এ বিস্তারিত বিবরণ আল্লাহ নিজেই দিচ্ছেন। এ থেকে যে আসল ঘটনা জানা যায় তা হচ্ছে এই যে, আসন্ন ফিতনা সম্পর্কে বেখবর হয়ে লোকেরা যার যার গহনাপাতি এনে স্তুপীকৃত করে চলেছে এবং সামেরী সাহেবও তাদের মধ্যে শামিল ছিলো। পরবর্তী পর্যায়ে অলংকার গালাবার দায়িত্ব সামেরী সাহেব নিজের কাঁধে নিয়ে নেন এবং এমন কিছু জালিয়াতি করেন যার ফলে ইট বা শলাকা তৈরী করার পরিবর্তে একটি বাছুরের মূর্তি তৈরী হয়ে আসে। তার মুখ থেকে গরুর মতো হাম্বা রব বের হতো। এভাবে সামেরী জাতিকে প্রতারিত করে। তার কথা হচ্ছে, আমি তা শুধু সোনা গালাবার দায়িত্ব নিয়েছিলাম কিন্তু তার মধ্য থেকে তোমাদের এ দেবতা নিজেই স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে।
# যারা সামেরীর ফিতনায় জড়িয়ে পড়েছিল এটি ছিল তাদের ওজর। তাদের বক্তব্য ছিল, আমরা অলংকার ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। বাছুর তৈরী করার নিয়ত আমাদের ছিল না বা তা দিয়ে কি করা হবে তাও আমাদের জানা ছিল না। এরপর যা কিছু ঘটেছে তা আসলে এমন ব্যাপারই ছিল যে, সেগুলো দেখে আমরা স্বতস্ফূর্তভাবে শিরকে লিপ্ত হয়ে গেছি।
“লোকদের অলংকারের বোঝায় আমরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম”-এ বাক্যের সোজা অর্থ হচ্ছে এই যে, আমাদের পুরুষ ও মেয়েরা মিসরের রীতি অনুযায়ী যেসব ভারী গহনা পরেছিল তা এ মরুচারী জীবনে আমাদের জন্য বোঝার পরিণত হয়েছিল। এ বোঝা আর কতদিন বয়ে বেড়াবো এ চিন্তায় আমরা পেরেশান হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী এ গহনাগুলো মিসর ত্যাগ করার সময় প্রত্যেক ইসরাঈলী নারী ও পুরুষ তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে নিয়েছিল। এভাবে তারা প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিবেশীদেরকে লুট করে রাতারাতি হিজরত করার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল। প্রত্যেক ইসরাঈলী নিজেই এ কাজে ব্রতী হয়েছিল, এ নৈতিক কর্মকাণ্ডটি শুধুমাত্র এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এ মহত কর্মটি আল্লাহর নবী হযরত মূসা (আ) তাদেরকে শিখিয়েছিলেন এবং নবীকেও এ নির্দেশ দিয়েছিলেন আল্লাহ নিজেই। দেখুন বাইবেলের যাত্রাপুস্তক এ ব্যাপারে কি বলেঃ
“ঈশ্বর মোশিকে কহিলেন……তুমি যাও ইস্রায়েলের প্রাচীনগণকে একত্র কর, তাহাদিগকে এই কথা বল, ……তোমরা যাত্রাকালে রিক্তহস্তে যাইবে না, কিন্তু প্রত্যেক স্ত্রী আপন আপন প্রতিবাসিনী কিম্বা গৃহে প্রবাসানী স্ত্রীর কাছে রৌপ্যালংকার, স্বর্ণালংকার ও বস্ত্র চাহিবে; এবং তোমরা তাহা আপন আপন পুত্রদের ও কন্যাদের গাত্রে পরাইবে, এই রূপে তোমরা মিস্রীয়দের দ্রব্য হরণ করিবে।” (৩: ১৪-২২)
“আর সদাপ্রভু মোশিকে বলিলেন, ……তুমি লোকদের কর্ণগোচরে বল, আর প্রত্যেক পুরুষ আপন আপন প্রতিবাসী হইতে ও প্রত্যেক স্ত্রী আপন আপন প্রতিবাসিনী হইতে রৌপ্যালংকার ও স্বর্ণালংকার চাহিয়া লউক। আর সদাপ্রভু মিস্রীয়দের দৃষ্টিতে লোকদিগকে অনুগ্রহের পাত্র করিলেন।” (১১: ১-৩)
“আর ইস্রায়েল সন্তানেরা মোশির বাক্যানুসারে কার্য করিল; ফলে তাহারা মিস্রীয়দের কাছে রৌপ্যলংকার, স্বর্ণালংকার ও বস্ত্র চাহিল; আর সদাপ্রভু মিস্রীয়দের দৃষ্টিতে তাহাদিগকে অনুগ্রহ পাত্র করিলেন, তাই তাহারা যাহা চাহিল, মিস্রীয়রা তাহাদিগকে তাহাই দিল। এইরূপে তাহারা মিস্রীয়দের ধন হরণ করিল।” (১২: ৩৫-৩৬)
দুঃখের বিষয় আমাদের মুফাসসিরগণও কুরআনের এ আয়াতের ব্যাখ্যায় এ বর্ণনা চোখ বন্ধ করে উদ্ধৃত করেছেন এবং তাদের এ ভুলের কারণে মুসলমানদের মধ্যে এ চিন্তা ছড়িয়ে পড়েছে যে, অলংকারের এ বোঝা আসলে ছিল লুটের বোঝা।
আয়াতের দ্বিতীয় অংশ “আমরা স্রেফ সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম” এর অর্থ আমি যা বুঝেছি তা হচ্ছে এই যে, যখন নিজেদের গহনাপাতির বোঝা বইতে বইতে লোকেরা ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে গেছে তখন পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত হয়ে থাকবে যে, সবার গহনাপাতি এক জায়গায় জমা করা হোক এবং কার সোনা ও রূপা কি পরিমাণ আছে তা লিখে নেয়া হোক, তারপর এগুলো গলিয়ে ইট ও শলাকায় পরিণত করা হোক। এভাবে জাতির সামগ্রিক মালপত্রের সাথে গাধা ও গরুর পিঠে এগুলো উঠিয়ে দেয়া যাবে। কাজেই এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের যাবতীয় অলংকার এনে অলংকারের স্তুপের ওপর নিক্ষেপ করে গিয়ে থাকবে।
# বাইবেল এর বিপরীত হযরত হারুনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনছে যে, বাছুর বানানো এবং তাকে উপাস্য বানানোর মহা পাপ তিনিই করেছিলেনঃ “পর্বত হইতে নামিতে মোশির বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া লোকেরা হারোণের নিকটে একত্র হইয়া তাহাকে কহিল, উঠুন আমাদের অগ্রগামী হইবার জন্য আমাদের নিমিত্ত দেবতা নির্মাণ করুন, কেননা যে মোশি মিসর দেশ হইতে আমাদিগকে বাহির করিয়া আনিয়াছেন, সেই ব্যক্তির কি হইল, আমরা জানি না। তখন হারোণ তাহাদিগকে কহিলেন, তোমরা আপন আপন স্ত্রী ও পুত্রকন্যাগণের কর্ণের সুবর্ণ কুণ্ডল খুলিয়া আমার কাছে আন। তাহাতে সমস্ত লোক তাহাদের কর্ণ হইতে সুবর্ণ কুণ্ডল খুলিয়া হারোণের নিকটে আনিল। তখন তিনি তাহাদের হস্ত হইতে তাহা গ্রহণ করিয়া শিল্পাস্ত্রে গঠন করিলেন; এবং একটি ঢালা গো-বৎস নির্মাণ করিলেন, তখন লোকেরা বলিতে লাগিল, হে ইস্রায়েল, এ তোমার দেবতা, যিনি মিসর দেশ হইতে তোমাকে বাহির করিয়া আনিয়াছেন। আর হারোণ তাহা দেখিয়া তাহার সম্মুখে এক বেদি নির্মাণ করিলেন এবং হারোণ ঘোষণা করিয়া দিলেন, বলিলে, কল্য সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে উৎসব হইবে।” (যাত্রা পুস্তক ৩২: ১-৬)
বনী ইসরাঈলের সমাজে এ ভুল বর্ণনার খ্যাতি লাভের সম্ভাব্য কারণ এও হতে পারে যে, হয়তো সামেরীর নাম হারুণই ছিল এবং পরবর্তী লোকেরা এই হারুণকে হারুণ নবীর সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আজ খৃস্টান মিশনারী ও পশ্চিমের প্রাচ্যবিদরা জোর দিয়ে একথাই বলতে চায় যে, এখানেও কুরআন নিশ্চয়ই ভুল করেছে। তাদের পাক-পবিত্র নবী-ই বাছুরকে ইলাহ বানিয়েছিলেন এবং তাঁর গাত্রাবরণ থেকে এ দাগটি তুলে দিয়ে কুরআন একটি উপকার করেনি বরং উলটো অপরাধ করেছে। এ হচ্ছে তাদের হঠকারিতার অবস্থা। তবে তারা এটা দেখছেন না যে, এ একই অধ্যায়েই মাত্র কয়েক লাইন পরেই বাইবেল কিভাবে নিজেই নিজের ভুল বর্ণনার রহস্য ভেদ করছে। এ অধ্যায়ের শেষ দশটি শ্লোকে বাইবেল বর্ণনা করছে যে, হযরত মূসা (আ) এরপর লেবীর সন্তানদেরকে একত্র করলেন এবং তাদেরকে আল্লাহর এ হুকুম শুনালেন যে, যারা এ শিরকের মহাপাপে লিপ্ত হয়েছে তাদেরকে হত্যা করতে হবে এবং প্রত্যেক মু’মিন নিজ হাতে নিজের যেসব ভাই, সাথী ও প্রতিবেশী গো-বৎস পূজায় লিপ্ত হয়েছিল তাদেরকে হত্যা করবে। এভাবে সেদিন তিন হাজার লোক নিহত হলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত হারুণকে কেন ছেড়ে দেয়া হলো? যদি তিনিই এ অপরাধের মূল উদগাতা ও স্রষ্টা হয়ে থাকেন তাহলে তাকে এ গণহত্যা থেকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখা হলো? লেবীর সন্তানরা কি তাহলে একথা বলতো না যে, হে মূসা! আমাদের তো হুকুম দিচ্ছো নিজেদের গুনাহগার ভাই, সাথী ও প্রতিবেশীদেরকে নিজেদের হাতে হত্যা করার কিন্তু নিজের ভাইয়ের গায়ে হাত উঠাচ্ছো না কেন, অথচ আসল গোনাহগার তো সে-ই ছিল? সামনের দিকে গিয়ে আরো বলা হয়েছে, মূসা সদাপ্রভুর কাছে গিয়ে আবেদন জানান, এবার বনী ইসরাঈলের গোনাহ মাফ করে দেন, নয়তো তোমার কিতাব থেকে আমার নাম কেটে দাও। এ কথায় আল্লাহ জবাব দেন,”যে ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে গোনাহ করেছে আমি তার নাম আমার কিতাব থেকে মুছে ফেলবো।” কিন্তু আমরা দেখছি, হযরত হারুণের নাম মুছে ফেলা হয়নি। বরং তার পরিবর্তে তাঁকে ও তাঁর সন্তান সন্ততিদেরকে বনী ইসরাঈলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পদ অর্থাৎ নবী লেবীর নেতৃত্বও বায়তুল মাকদিসের সেবায়েতের দায়িত্ব দান করা হয়। (গণনা পুস্তক ১৮: ১-৭) বাইবেলের এ আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য কি তার নিজের পূর্ববর্তী বর্ণনার প্রতিবাদ ও কুরআনের বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করছে না?
# হুকুম বলতে এখানে পাহাড়ে যাবার সময় এবং নিজের জায়গায় হযরত হারুনকে বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব অধিষ্ঠিত করার পূব মুহূর্তে হযরত মূসা তাঁকে যে হুকুম দিয়েছিলে সে কথাই বুঝানো হয়েছে। সূরা আরাফের একে এভাবে বলা হয়েছেঃ
وَقَالَ مُوسَى لِأَخِيهِ هَارُونَ اخْلُفْنِي فِي قَوْمِي وَأَصْلِحْ وَلَا تَتَّبِعْ سَبِيلَ الْمُفْسِدِينَ
“আর মূসা (যাওয়ার সময়) নিজের ভাই হারুনকে বললো, তুমি আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার প্রতিনিধিত্ব করো এবং দেখো, সংশোধন করবে, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পথ অনুসরণ করো না। (১৪২ আয়াত )
# এ আয়াতগুলোর অনুবাদের সময় আমি এ বিষয়টি সামনে রেখেছি যে, হযরত মূসা ছোট ভাই ছিলেন কিন্তু মর্যাদার দিক দিয়ে ছিলেন বড়। অন্যদিকে হযরত হারুন বড় ভাই ছিলেন কিন্তু মর্যাদার দিক দিয়ে ছিলেন ছোট।
# হযরত হারুনের জবাবের অর্থ কখনোই এই নয় যে, জাতির ঐক্যবদ্ধ থাকা তার সঠিক পথে থাকার চাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং শিরকের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা তার এমন অনৈক্যের চেয়ে ভালো যার ভিত্তি গড়ে ওঠে হক ও বাতিলের বিরোধের ওপর। কোন ব্যক্তি যদি এ আয়াতের এ অর্থ করে তাহলে সে কুরআন থেকে গোমরাহী গ্রহণ করবে। হযরত হারুনের পুরো কথাটা বুঝতে হলে এ আয়াতটিকে সূরা আ’রাফের ১৫০ আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়তে হবে। সেখানে বলা হয়েছেঃ
ابْنَ أُمَّ إِنَّ الْقَوْمَ اسْتَضْعَفُونِي وَكَادُوا يَقْتُلُونَنِي فَلَا تُشْمِتْ بِيَ الْأَعْدَاءَ وَلَا تَجْعَلْنِي مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ
“হে আমার সহোদর ভাই! এ লোকেরা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং আমাকে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। কাজেই তুমি দুশমনদেরকে আমার প্রতি হাসবার সুযোগ দিয়ো না এবং ঐ জালেম দলের মধ্যে আমাকে গণ্য করো না।”
এখন এ উভয় আয়াত একত্র করে দেখলে যথার্থ ঘটনার এ ছবি সামনে আসে যে, হযরত হারুন লোকদেরকে এ গোমরাহী থেকে রুখবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন কিন্তু তারা তাঁর বিরুদ্ধে মহা বিপর্যয় সৃষ্টি করে এবং তাঁকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়। বাধ্য হয়ে তিনি এইআশঙ্কায় নীরব হয়ে যান যে, হযরত মূসার ফিরে আমার আগেই গৃহযুদ্ধ শুরু না হয়ে যায় এবং তিনি পরে এসে এ অভিযোগ না করে বসেন যে, তোমার যখন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার ক্ষমতা ছিল না তখন তুমি পরিস্থিতিকে এতদূর গড়াতে দিলে কেন? আমার আসার অপেক্ষা করলে না কেন? সূরা আ’রাফের আয়াতের শেষ বাক্য থেকেও একথাই প্রতিভাত হয় যে, বনী ইসরাঈলের মধ্যে উভয় ভাইয়ের একদল শত্রু ছিল।
# এ আয়াতের ব্যাখ্যায় দু’টি দলের পক্ষ থেকে অদ্ভুত ধরনের টানা হেঁচড়া করা হয়েছে।
একটি দলে আছেন প্রাচীন তাফসীরকারগণ এবং প্রাচীন পদ্ধতিতে তাফসীরকারীদের বৃহত্তম অংশ। তারা এর অর্থ বর্ণনা করেন, “সামেরী রসূল অর্থাৎ জিব্রীলকে যেতে দেখে নিয়েছিল এবং তাঁর পদাংক থেকে এক মুঠো মাটি উঠিয়ে নিয়েছিল। আর এই মাটি যখন বাছুরের মূর্তির মধ্যে রাখা হয়েছিল তখন তার অলৌকিক মহিমায় তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল প্রাণ স্পন্দন এবং একটি জীবন্ত বাছুরের মত হাম্বা রব তার মুখ থেকে বের হতে শুরু হয়েছিল।” অথচ সত্যিই যে এমনটি হয়েছিল তা অবশ্যি কুরআন বলছে না। কুরআন স্রেফ এতটুকু বলছে যে, হযরত মূসার প্রশ্নের জবাবে সামেরী একথা বানিয়ে বলেছিল। এ অবস্থায় আমরা বুঝতে পারছি না, মুফাসিরগণ কেমন করে একে একটি সত্য ঘটনা এবং কুরআন বর্ণিত যথার্থ সত্য মনে করে বসলেন।
দ্বিতীয় দলটি সামেরীর কথার অন্য একটি অর্থ করেন। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সামেরী আসলে বলেছিল, “আমি রসুল অর্থাৎ মূসার দ্বীনের মধ্যে এমন দুর্বলতা দেখেছিলাম যা অন্যেরা দেখতে পায়নি। তাই আমি একদিক থেকে তাঁর পদাংক অনুসরণ করেছিলাম কিন্তু পরে তা ত্যাগ করেছিলাম।” এ ব্যাখ্যাটি সম্ভবত সর্বপ্রথম করেন আবু মুসলিম ইসফাহানী। তারপর ইমাম রাযী একে নিজের তাফসীরে উদ্ধৃত করে এর প্রতি নিজের সমর্থন প্রকাশ করেন। বর্তমানে আধুনিক তাফসীরকারদের অধিকাংশই এ অর্থটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিন্তু তারা এ কথা ভুলে গেছেন যে, কুরআন ধাঁ ধাঁ ও হেঁয়ালির ভাষায় নাযিল হয়নি। বরং পরিষ্কার ও সাধারণের বোধগম্য সহজ-সরল আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। একজন সাধারণ আরববাসী নিজের ভাষায় প্রচলিত স্বাভাবিক বাগধারা অনুযায়ী এর বক্তব্য বুঝতে সক্ষম। আরবী ভাষায় সাধারণ প্রচলিত বাকরীতি ও দৈনন্দিন কথোপকথনের শব্দাবলী সম্পর্কে অবগত কোন ব্যক্তি কখনো একথা মেনে নিতে পারে না যে, সামেরীর এ সামেরীর এ মনোভাব প্রকাশ করার জন্য সহজ-সরল আরবী ভাষায় এমন সব শব্দ ব্যবহার করা হবে যা এ আয়াতের তাফসীরকারগণ বলেছেন। অথবা একজন সাধারণ আরবীয় একথাগুলো শুনে কখনো এমন অর্থ গ্রহণ করতে পারে না যা এ তাফসীরকারগণ বর্ণনা করেছেন। অভিধান গ্রন্থ থেকে কোন একটি শব্দের এমন একাধিক অর্থ গ্রহণ করা যা বিভিন্ন প্রবাদে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং তার মধ্য থেকে কোন একটি অর্থ নিয়ে এমন একটি বাক্যের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া যেখানে একজন সাধারণ আরব কখনোই এ শব্দটিকে এ অর্থে ব্যবহার করে না-এটাতো ভাষাজ্ঞান হতে পারে না, তবে বাগাড়ম্বর হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি নেই। ‘ফরহংগে আসেফীয়া’ নামক উর্দু অভিধান খানি অথবা ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারী’ হাতে নিয়ে যদি কোন ব্যক্তি যথাক্রমে তাদের উর্দু ও ইংরেজী রচনাগুলো মধ্যে এ ধরনের কৃতিত্ব ফলাতে থাকেন, তাহলে সম্ভবত নিজেদের কথার দু-চারটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনেই তাদের লেখকরা চিৎকার করে উঠবেন। সাধারণত কুরআনের এ ধরনের ব্যাখ্যা এমন সময় করা হয় যখন এক ব্যক্তি কোন আয়াতের সহজ-সরল অর্থ দেখে নিজে নিজেই একথা মনে করে থাকে যে, এখানে তো আল্লাহ তা’আলা বড়ই অসাবধান হয়ে গেছেন, এসো আমি তাঁর কথা এমনভাবে পেশ করে দিই যার ফলে তাঁর ভুলের পরদা ঢেকে যাবে এবং তাঁর বক্তব্য নিয়ে লোকদের হাসাহাসি করার সুযোগ থাকবে না।
এ বিবৃত চিন্তা পরিহার করে যে ব্যক্তিই এ বক্তব্য পরম্পরায় এ আয়াতটি পড়বে সে সহজে বুঝতে পারবে যে, সামেরী ছিল একজন ফিতনাবাজ ব্যক্তি। সে ভালোভাবে ভেবেচিন্তে ধোকা ও প্রতারণার একটি বিরাট পরিকল্পনা তৈরী করেছিল। সে কেবল একটি সোনার বাছুর তৈরী করে যে কোন কৌশলে তার মধ্যে গো-বৎসের হামবা রব সৃষ্টি করে দেয়নি এবং সমগ্র জাতি অজ্ঞ ও নির্বোধ লোকদের প্রতারিত করেনি বরং সে আরো দুঃসাহসী হয়ে খোদ হযরত মূসা আলাইহিস সালামকেও এমটি প্রতারণাপূর্ণ গল্প শুনিয়ে দিল। সে দাবী করলো, আমি এমন কিছু দেখেছি যা অন্যেরা দেখেনি। সাথে সাথে এ গল্পও শুনিয়ে দিল যে, রসুলের পদাংকের এক মুঠো মাটিই এ কেরামতি দেখিয়েছে। রসূল বলে সে জিব্রীলকেও নির্দেশ করতে পরে, যেমন প্রাচীন তাফসীরকারগণ মনে করেছেন। কিন্তু যদি একথা মনে করা হয় যে, রসূল শব্দটি বলে সে হযরত মূসাকে নির্দেশ করেছে, তাহলে এটা তার আর একটা প্রতারণা। সে এভাবে হযরত মূসাকে মানসিক উৎকোচ দিতে চাচ্ছিল, যাতে তিনি এটাকে তাঁর নিজের পদাংকের অলৌকিকতা মনে করে গর্বিত হন এবং নিজের অন্যান্য কেরামতির প্রচারণার জন্য সামেরীর প্রতারণা হিসেবেই পেশ করছে, নিজের পক্ষ থেকে প্রকৃত ঘটনা হিসেবে পেশ করছে না। তাই এতে এমন দূষণীয় কিছু ঘটেনি যে, তা প্রক্ষালনের জন্য অভিধান গ্রন্থগুলোর সাহায্যে অযথা বাগাড়ম্বর করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। বরং পরবর্তী বাক্যগুলোতে হযরত মূসা যেভাবে তাকে ধিক্কার ও অভিশাপ দিয়েছেন এবং তার জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেছেন তা থেকে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, তার বানানো এ প্রতারণাপূর্ণ গল্প শোনার সাথে সাথেই তিনি তা তার মুখের উপর ছুঁড়ে মেরেছিলেন।
# শুধু এতটুকুই নয় যে, সারাজীবনের জন্য মানব সমাজের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়েছে এবং তাকে অচ্ছুৎ বানিয়ে রাখা হয়েছে বরং তার ওপর এ দায়িত্বও অর্পিত হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই সে নিজের অচ্ছুৎ হওয়া সম্পর্কে জানিয়ে দেবে এবং দূর থেকেই লোকদেরকে এ মর্মে বলতে থাকবে, “আমি অচ্ছুৎ আমাকে ছুঁয়ো না।” বাইবেলের লেবীয় পুস্তকে কুষ্ঠরোগীর স্পর্শ থেকে লোকদেরকে বাঁচাবার জন্য যে নিয়ম বাতলানো হয়েছে তার মধ্য থেকে একটি নিয়ম হচ্ছে এইঃ “আর যে কুষ্ঠীর ঘা হইয়াছে। তাহার বন্ত্র চেরা যাইবে ও তার মস্তক মুক্ত কেশ থাকিবে ও সে আপনার ওষ্ঠ বস্ত্র দ্বারা ঢাকিয়া ‘অশুচি, অশুচি’ এ শব্দ করিবে। যতদিন তাহার গাত্রে ঘা থাকিবে, ততদিন সে অশুচি থাকিবে; সে অশুচি; সে একাকী বাস করিবে, শিবিরের বাহিরে তাহার বাসস্থান হইবে।” (১৩: ৪৫-৪৬) এ থেকে অনুমতি হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে তাকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করা হয়ে থাকবে অথবা তার জন্য এ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়ে থাকবে যে, শারীরিকভাবে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যেভাবে সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা করে দেয়া হয়ে থাকি ঠিক তেমনিভাবে নৈতিক কুষ্ঠে আক্রান্ত রোগীকেও মানুষদের থেকে আলাদা করে দিতে হবে এবং এ ব্যক্তিও কুষ্ঠরোগীর মতো চিৎকার করে করে তার কাছে আগত প্রত্যেক ব্যক্তিকে বলতে থাকবেঃ আমি অপবিত্র, আমাকে ছুঁয়ো না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৮৩-৮৯ নং আয়াতের তাফসীর:
মূসা (আঃ) যখন বানী ইসরাঈলসহ সমুদ্র অতিক্রম করেন তখন তাদেরকে নিয়ে সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে দেন। তাদেরকে নিয়ে তিনি এমন এক জায়গায় পৌঁছেন যেখানে লোকেরা প্রতিমাসমূহের খাদেম হয়ে বসেছিল। তা দেখে বানী ইসরাঈল হযরত মূসাকে(আঃ) বলেঃ “হে মূসা(আঃ) ! এদের মত আমাদের জন্যেও আপনি কোন মাবুদ নির্ধারণ করে দিন ।!” উত্তরে হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে বলেনঃ “তোমরা তো খুবই অজ্ঞলোক। এরা তো ধ্বংস প্রাপ্ত লোক এবং তাদের ইবাদতও বাতিল।” অতঃপর আল্লাহ তাআলা হযরত মূসাকে (আঃ) ত্রিশ দিন রোযা রাখার নির্দেশ দেন। তারপর তা বাড়িয়ে দিয়ে চল্লিশ দিন করা হয়। তিনি দিন রাত রোযার অবস্থায় থাকতেন। অতঃপর তাড়াতাড়ি তিনি তূর পর্বতের দিকে গমন করেন এবং বানী ইসরাঈলের উপর তার ভাই হারূণকে (আঃ)। প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার সম্প্রদায়কে পশ্চাতে ফেলে তোমাকে ত্বরা করতে বাধ্য করলো কিসে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “এই তো আমার পশ্চাতে তারা রয়েছে এবং হে আমার প্রতিপালক! আমি তাড়াতাড়ি করে আপনার নিকট আসলাম, আপনি সন্তুষ্ট হবেন এই জন্যে।” তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে বললেনঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার চলে আসার পর আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষায় ফেলেছি এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। তারা গো-বংসের পূজা শুরু করে দিয়েছে।
ইসরাঈলী পুস্তক সমূহে আছে যে, সামেরীর নামও হারূণ ছিল। হযরত মূসাকে (আঃ) দান করার জন্যে তাওরাতের ফলক লিখে নেয়া হয়েছিল। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তার জন্যে ফলকে সর্ববিষয়ের বর্ণনা এবং সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ লিখে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলামঃ ওটাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং তোমার কওমকেও বলে দাও যে, তারা যেন উত্তমরূপে ওর উপর আমল করে; আমি তোমাদেরকে সত্বরই ফাসেকদের পরিণাম প্রদর্শন করবো।” (৭:১৪৫)
হযরত মূসা (আঃ) যখন স্বীয় কওমের শিকপূর্ণ কাজের খবর পেলেন তখন তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং ক্রোধ ও ক্ষোভের অবস্থায় সেখান থেকে ফিরে আসলেন। তিনি দেখতে চান যে, তার কওমের লোকেরা আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নিয়ামত রাশি লাভ করার পরেও এরূপ কঠিন অজ্ঞতাপূর্ণ ও শিরকজনিত কাজ করেছে? অতঃপর তিনি অত্যন্ত ক্রুব্ধ ও ক্ষুব্ধ অবস্থায় তাঁর কওমের কাছে এসে বললেনঃ “হে আমার সম্প্রদায় তোমাদের প্রতিপালক কি তোমাদেরকে এক উত্তম প্রতিশ্রুতি দেন নাই। তোমাদেরকে কি তিনি বড় বড় নিয়ামত দান করেন নাই? কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তোমরা তার নিয়ামতসমূহ ভুলে বসলে? তবে কি তোমরা চাচ্ছ যে, তোমাদের প্রতি আপতিত হোক তোমাদের প্রতিপালকের ক্রোধ, যে কারণে তোমরা আমার প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে?” তার কওম তখন তার কাছে ওজর পেশ করে বললোঃ “আমরা এই কাজ নিজেদের ইচ্ছায় করি নাই। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ফিরাউনীদের যে সব অলংকার আমাদের নিকট ছিল সেগুলি নিক্ষেপ করাই আমরা ভাল মনে করলাম। সুতরাং আমরা সবকিছুই আল্লাহর ভয়ে নিক্ষেপ করে দিলাম।”একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, স্বয়ং হযরত হারূণ (আঃ) একটি গর্ত খনন করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেন এবং বানী ইসরাঈলকে নির্দেশ দেন যে, তারা যেন সমস্ত অলংকার ঐ গর্তে নিক্ষেপ করে। হযরত হারূণের (আঃ) ইচ্ছা ছিল যে, সমস্ত অলংকার এক জায়গায় জমা হয়ে যাবে এবং গলে গিয়ে একটা জমাট পাথরের রূপ ধারণ করবে। তারপর যখন হযরত মূসা (আঃ) ফিরে আসবেন তখন তিনি যা বলবেন তাই করা হবে। সামেরী তাতে ঐ মুষ্টিও নিক্ষেপ করেছিল যা সে আল্লাহর দূতের নিদর্শন হতে পূর্ণ করে নিয়েছিল এবং হযরত হারূণকে (আঃ) বলেছিলঃ “আপনি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করুন যেন তিনি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। হযরত হারূণ (আঃ) তো আর তার মনের কথা জানতেন না, তাই তিনি প্রার্থনা করেন। সে ইচ্ছা করে যে, ওর থেকে যেন একটা গো-বৎস নির্মিত হয়ে যায় এবং ওর থেকে যেন বাছুরের মত শব্দও বের হয়। ওটা তাই হয়ে যায় এবং বানী ইসরাঈলের পরীক্ষার কারণ হয়ে দাড়ায়। এ কারণেই মহান আল্লাহ বানী ইসরাঈলের কথা উদ্ধৃত করে বলেনঃ “সেিমরীও তা নিক্ষেপ করে।
একবার হযরত হারূন (আঃ) সামেরীর পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন। ঐ সময় সে ঐ গো-বৎসটি ঠিকঠাক করছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “ওটা কি করছো?” সে উত্তরে বলেঃ “এমন জিনিস তৈরী করছি যা ক্ষতি সাধন করে, কিন্তু উপকার করে না। তিনি দুআ করেনঃ “হে আল্লাহ! তাকে আপনি এরূপই করে দিন।” অতঃপর তিনি সেখান হতে চলে যান। সামেরীর দুআ’য় ওটা গো-বৎস হয়ে যায় এবং ওর থেকে শব্দও বের হতে থাকে। বানী ইসরাঈল বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। এবং ওর পূজা করতে শুরু করে। ওর একটি শব্দের সময় তারা ওর সামনে সিজদায় পড়ে যেতো এবং আর একটি শব্দের সময় সিজদা হতে মাথা উঠাতো। এই দলটি অন্যান্য মুসলমানদেরকেও পথ ভ্রষ্ট করতে থাকে। তারা তাদেরকে বলেঃ “আসল মা’রূদ এটাই। হযরত মূসা (আঃ) ভুল করে তার অনুসন্ধানে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। তিনি এটা বলতে ভুলে গেছেন যে, এটাই তোমাদের মাবূ’দ।”
এ লোকগুলি খাদেমরূপে ওর সামনে বসে পড়ে। তাদের অন্তরে এর মুহব্বত জমে ওঠে। অর্থ এও হতে পারে যে, সামেরী নিজের সত্য ও সঠিক মাবুদকে এবং নিজের পবিত্র দ্বীন ইসলামকে ভুলে বসেছিল। সে এতো নির্বোধ যে, ঐ বাছুর যে একেবারে নির্জীব এটুকুও সে বুঝতে পারে নাই। ওটা তো তাদেরকে কোন কথার জবাব দিতে পারে না এবং কিছু শুনতেও পায় না। দুনিয়া ও আখেরাতের কোন কাজের তার অধিকার নেই এবং লাভ ও ক্ষতি করারও তার কোন ক্ষমতা নেই। তার থেকে যে শব্দ বের হয় ওর একমাত্র কারণ তো এই যে, তার পিছনের ছিদ্র দিয়ে বায়ু প্রবেশ করে এবং সামনের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে যায়। ওটারই শব্দ হয়। তারা ছিল কতো নির্বোধ যে, ছোট পাপ হতে বাচবার জন্যে তারা বড় পাপ করে বসলো। ফিরাউনীদের আমানত হতে মুক্ত হতে গিয়ে তারা শিরক করে বসলো। এর দৃষ্টান্ত তো এটাই হলো যে, কোন এক ইরাকবাসী হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমারকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেঃ “কাপড়ে যদি মশার রক্ত লেগে যায় তবে নামায হবে কি হবে না?” তিনি উত্তরে জনগণকে বলেনঃ “তোমরা ইরাকবাসীদের ব্যবহারের প্রতি লক্ষ্য কর, তারা রাসূলুল্লাহর (সঃ) প্রিয়তমা কন্যা হযরত ফাতেমার (রাঃ) কলেজার টুকরা হযরত হুসাইনকে (রাঃ) হত্যা করেছে, অথচ আজ মশার রক্তের মাসআলা জিজ্ঞেস করছে!”
৯০-৯১ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআ’লা খবর দিচ্ছেন যে, হযরত মূসার (আঃ) ফিরে আসার পূর্বেই হযরত হারূন (আঃ) বানী ইসরাঈলকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে বুঝিয়ে বলেছিলেনঃ “ দেখো তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলে দেয়া হয়েছে। তোমরা দয়াময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে সিজদায় পতিত হয়ো না। তিনি সবকিছুরই খালেক ও মালেক। সবারই ভাগ্য নির্ধারণকারী তিনিই। মর্যাদা সম্পন্ন আরশের তিনিই মালিক। তিনি যা চান তাই করতে পারেন। তোমরা আমার অনুসরণ কর। আমি তোমাদেরকে যা করতে বলি তা কর এবং যা থেকে নিষেধ করি তা হতে বিরত থাকো।” কিন্তু ঐ উদ্ধত ও হঠকারী লোকগুলি উত্তরে বললোঃ “মূসা (আঃ) ফিরে এসে আমাদেরকে নিষেধ করলে আমরা মেনে নিবে। কিন্তু তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এই বাছুর পূজা হতে বিরত হবো না।” সুতরাং তারা হযরত হারূণের কথা প্রত্যাখ্যান করলো, তার সাথে বিবাদ করলো এবং তাঁকে হত্যা করতেও প্রস্তুত হয়ে গেল।
৯২-৯৪ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত মূসা (আঃ) ভীষণ ক্রোধ ও ক্ষোভের অবস্থায় ফিরে এসেছিলেন। তাওরাত লিখিত ফলক তিনি মাটিতে নিক্ষেপ করেন এবং নিজের ভাই হারূণের (আঃ) দিকে কঠিন রাগান্বিত অবস্থায় এগিয়ে যান এবং তার মাথার চুল ধরে নিজের দিকে টানতে থাকেন। এর বিস্তারিত বিবরণ সূরায়ে আ’রাফের তাফসীরে গত হয়েছে। সেখানে এ হাদীসটিও বর্ণিত হয়েছে যে, শোনা খবর দেখার মত নয়। হযরত মূসা (আঃ) তাঁর ভাই ও স্থলাভিষিক্ত হযরত হারূণকে (আঃ) তিরস্কার করতে শুরু করেন যে, ঐ মূর্তি পূজা শুরু হবার সময়ই কেন তিনি তাকে খবর দেন নাই? তবে কি তিনি তাঁর আদেশ অমান্য করেছেন। তিনি তাকে আরো বলেনঃ “আমি তো তোমাকে পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছিলাম যে, তুমি আমার কওমের মধ্যে আমার। স্থলাভিষিক্তরূপে কাজ করবে, তাদেরকে সংশোধিত করবে এবং ফাসাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের কথা মোটেই মানবে না? হযরত হারূণ (আঃ) উত্তরে বলেনঃ “হে আমার মায়ের পুত্র!” একথা তিনি এজন্যেই বলেছিলেন যাতে হযরত মূসার (আঃ) তাঁর উপর দয়া ও মমতা হয়। এটা নয় যে, তাদের পিতা আলাদা ছিলেন। তাদের উভয়েরই পিতাও একই এবং মাতাও একই। তারা ছিলেন একেবারে সহোদর ভাই। হযরত হারূণ (আঃ) ওজর পেশ করে বলেনঃ “আমি এটা মনেও করেছিলাম যে, আপনার কাছে গিয়ে আপনাকে এ সংবাদ অবহিত করি। কিন্তু আবার চিন্তা করলাম যে, এদেরকে এভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত হবে না। কেননা, এতে আপনি হয়তো অসন্তুষ্ট হতেন এবং বলতেনঃ “কেন তুমি এদেরকে ছেড়ে গেলে? হযরত ইয়াকূবের (আঃ) সন্তানদের মধ্যে কেন তুমি বিচ্ছিন্নতা আনয়ন করলে? এবং যা আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম কেন তুমি তা পালন কর নাই।” প্রকৃত ব্যাপার এই যে, হযরত হারূণ (আঃ) ছিলেন হযরত মূসার (আঃ) অত্যন্ত অনুগত। তিনি হযরত মূসাকে (আঃ) অত্যন্ত সম্মান করতেন এবং তার মর্যাদার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন।
৯৫-৯৮ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত মূসা (আঃ) সামেরীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে সামেরী! এটা করতে তোমাকে কিসে উদ্বুদ্ধ করেছে?” হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ লোকটি আহলে বাজিরমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার কওম গরু-পূজারী ছিল। তার অন্তরেও গরুর মুহব্বত ঘর করে নেয়। সে বাহ্যিকভাবে বানী ইসরাঈলের সাথে ঈমান এনেছিল। তার নাম ছিল মূসা ইবনু যু। একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, সে কিরমানের অধিবাসী ছিল। আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, তার গ্রামের নাম ছিল সামেরা। সে হযরত মূসার (আঃ) প্রশ্নের উত্তরে বলেঃ “ফিগ্রাউনকে ধ্বংস করার জন্যে যখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন তখন আমি তার ঘোড়ার খুরের নীচে হতে কিছুটা মাটি উঠিয়ে নিই।”
অধিকাংশ তাফসীরকারদের মতে প্রসিদ্ধ কথা এটাই। হযরত আলী (রাঃ)। হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) এসে যখন হযরত মূসাকে (আঃ) আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হন তখন সামেরী এটা দেখে নেয়। তাড়াতাড়ি সে তার ঘোড়ার খুরের নীচের মাটি উঠিয়ে নেয়। হযরত জিবরাঈল (আঃ) হযরত মূসাকে (আঃ) আকাশ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যান। আল্লাহ তাআলা তাওরাত লিখেন। হযরত মূসা (আঃ) কলমের লিখার শব্দ শুনতে পান। কিন্তু যখন তিনি তার কওমের বিপদের অবস্থা জানতে পারেন তখন তিনি নীচে নেমে এসে ঐ বাছুরটিকে জ্বালিয়ে দেন। (এই হাদীসের সনদ দুর্বল)
ঐ এক মুষ্টি মাটিকে সে বানী ইসরাঈলের জমাকৃত অলংকারের পোড়ার সময় তাতে নিক্ষেপ করে দেয়। ওটা তখন বাছুরের রূপ ধারণ করে। ওর ভিতর ফাকা ছিল বলে ওর মধ্য দিয়ে বাতাস যাওয়া-আসা করতো এবং এর ফলে একটা শব্দ বের হতো। হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) দেখেই সে মনে মনে বলেঃ “আমি তার ঘোড়ার খুরের নীচে হতে মাটি উঠিয়ে নিবো। এই মাটি গর্তে নিক্ষেপ করলে আমি যা চাইবো ওটা তাই হয়ে যাবে।”ঐ সময়েই তার অঙ্গুলীগুলি শুকিয়ে গিয়েছিল। বানী ইসরাঈল যখন দেখলো যে, তাদের কাছে ফিরাউনীদের অলংকারাদি রয়ে গিয়েছে এবং তারা ধ্বংস হয়ে গেছে, সুতরাং এগুলো তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া আর সম্ভম্ব নয়। তখন তারা চিন্তিত হয়ে পড়লো। সামেরী বললোঃ “দেখো, এই কারণেই, তোমাদের উপর বিপদ আপতিত হয়েছে। কাজেই এগুলো জমা করে তাতে আগুন লাগিয়ে দাও।” তারা তাই করলো। যখন ওগুলো আগুনে গলে গেল তখন তার মনে হলো যে, ঐ মাটি ওতে নিক্ষেপ করবে এবং ওর দ্বারা গো বৎসের আকৃতি বানিয়ে নেবে। তাই হয়ে গেল। সে তখন বানী ইসরাঈলকে বললোঃ “এটাই তোমাদের ও মূসার (আঃ) মাবুদ।” আল্লাহ তাআলা তার এই জবাবই এখানে উদ্ধত করেছেনঃ “আমি ওটা নিক্ষেপ করেছিলাম এবং আমার মন আমার জন্যে শোভন করেছিল এইরূপ করা।” তখন হযরত মূসা (আঃ) তাকে বললেনঃ “দূর হও। তোমার জীবদ্দশায় তোমার জন্যে এটাই রইলো যে, তুমি বলবে, আমি অস্পৃশ্য এবং তোমার জন্যে রইলো এক নির্দিষ্ট কাল, তোমার বেলায় যার ব্যতিক্রম হবে না। আর তুমি তোমার যে মা’দের পূজায় রত ছিলে তার প্রতি লক্ষ্য কর যে, আমরা ওকে জ্বালিয়ে দিবই, অতঃপর ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবই।” এইরূপ করার ফলে ঐ স্বর্ণ নির্মিত বাছুরটি ঐভাবেই পুড়ে গেল। যে ভাবে রক্ত মাংসের বাছুর পুড়ে যায়। তারপর ওর ছাইকে প্রখর বাতাসের দিনে সমুদ্রে উড়িয়ে দেয়া হয়।
বর্ণিত আছে যে, সামেরী তার সাধ্যমত বানী ইসরাঈলের মহিলাদের নিকট হতে অলংকারাদি গ্রহণ করেছিল এবং ওগুলি দিয়ে বাছুর তৈরী করেছিল। ওটাকেই হযরত মূসা (আঃ) জ্বালিয়ে দিয়ে ওর ভগ্ন সমুদ্রে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেই ওর পানি পান করেছিল। তারই চেহারা হলুদে বর্ণ ধারণ করেছিল। এর মাধ্যমেই সমস্ত বাছুর পূজারীর পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। তারা তখন তাওবা করে এবং হযরত মূসাকে (আঃ) বলেঃ “আমাদের তাওবা ককূল হওয়ার উপায় কি?” তখন তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তারা যেন একে অপরকে হত্যা করে। এর পূর্ণ বর্ণনা ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে।
অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) তাদেরকে বলেনঃ “তোমাদের মাবুদ এটা নয়। ইবাদতের যোগ্য তো একমাত্র আল্লাহ। বাকী সমস্ত জগত তাঁর মুখাপেক্ষী এবং তার অধীনস্থ। সব কিছুরই তাঁর অবগতি রয়েছে। তাঁর জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টজীবকে ঘিরে রেখেছে। সমস্ত জিনিসের সংখ্যা তার জানা আছে। এক অনুপরিমাণ জিনিসও তার জ্ঞানের বাইরে নেই। প্রত্যেক পাতা ও প্রত্যেক দানার তিনি খবর রাখেন। তাঁর কাছে রক্ষিত কিতাবে সব কিছুই বিদ্যমান রয়েছে। যমীনের সমস্ত জীবকে তিনিই আহার্য দান করে থাকেন। প্রত্যেকের জায়গা তার জানা আছে। প্রকাশ্য কিতাবে সবকিছুই লিপিবদ্ধ আছে। এই ধরনের আরো বহু আয়াত রয়েছে।