أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯০৯)
[ قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِیْ صَدْرِیْۙ
وَ یَسِّرْ لِیْۤ اَمْرِیْۙ
“হে আমার রব! আমার বুক প্রশস্ত করে দাও,এবং আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও
وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِیْۙ
এবং আমার জিভের জড়তা দূর করে দাও,
یَفْقَهُوْا قَوْلِیْ۪
যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে।
وَ اجْعَلْ لِّیْ وَزِیْرًا مِّنْ اَهْلِیْۙ
আর আমার জন্য নিজের পরিবার থেকে সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করে দাও।]
সূরা:- ত্বাহা।
সুরা:২০
০৯-৩৬ নং আয়াত:-
২০:০৯
وَ هَلْ اَتٰىكَ حَدِیْثُ مُوْسٰىۘ
আর তোমার কাছে কি মূসার খবর কিছু পৌঁছেছে?
২০:১০
اِذْ رَاٰ نَارًا فَقَالَ لِاَهْلِهِ امْكُثُوْۤا اِنِّیْۤ اٰنَسْتُ نَارًا لَّعَلِّیْۤ اٰتِیْكُمْ مِّنْهَا بِقَبَسٍ اَوْ اَجِدُ عَلَى النَّارِ هُدًى
যখন সে একটি আগুন দেখলো এবং নিজের পরিবারের লোকদেরকে বললো, “একটু দাঁড়াও, আমি একটি আগুন দেখেছি, হয়তো তোমাদের জন্য এক আধটি অংগার আনতে পারবো অথবা এ আগুনের নিকট আমি কোনো পথের দিশা পাবো।”
২০:১১
فَلَمَّاۤ اَتٰىهَا نُوْدِیَ یٰمُوْسٰىؕ
সেখানে পৌঁছলে তাকে ডেকে বলা হলো, “হে মূসা!
২০:১২
اِنِّیْۤ اَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَیْكَ١ۚ اِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًىؕ
আমিই তোমার রব, জুতো খুলে ফেলো, তুমি পবিত্র ‘তুওয়া’ উপত্যকায় আছো।
২০:১৩
وَ اَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا یُوْحٰى
এবং আমি তোমাকে বাছাই করে নিয়েছি, শোনো যা কিছু অহী করা হয়।
২০:১৪
اِنَّنِیْۤ اَنَا اللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعْبُدْنِیْ١ۙ وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ لِذِكْرِیْ
আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, কাজেই তুমি আমার ইবাদত করো এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য নামায কায়েম করো।
২০:১৫
اِنَّ السَّاعَةَ اٰتِیَةٌ اَكَادُ اُخْفِیْهَا لِتُجْزٰى كُلُّ نَفْسٍۭ بِمَا تَسْعٰى
কিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তার সময়টা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেকটি প্রাণসত্তা তার প্রচেষ্টা অনুযায়ী প্রতিদান লাভ করতে পারে।
২০:১৬
فَلَا یَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَنْ لَّا یُؤْمِنُ بِهَا وَ اتَّبَعَ هَوٰىهُ فَتَرْدٰى
কাজেই যে ব্যক্তি তার প্রতি ঈমান আনে না এবং নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে গেছে সে যেন তোমাকে সে সময়ের চিন্তা থেকে নিবৃত্ত না করে। অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।
২০:১৭
وَ مَا تِلْكَ بِیَمِیْنِكَ یٰمُوْسٰى
– আর হে মূসা! এ তোমার হাতে এটা কি?”
২০:১৮
قَالَ هِیَ عَصَایَ١ۚ اَتَوَكَّؤُا عَلَیْهَا وَ اَهُشُّ بِهَا عَلٰى غَنَمِیْ وَ لِیَ فِیْهَا مَاٰرِبُ اُخْرٰى
মূসা জবাব দিল, “এ আমার লাঠি। এর ওপর ভর দিয়ে আমি চলি, নিজের ছাগলগুলোর জন্য এর সাহায্যে পাতা পাড়ি এবং এর সাহায্যে আরো অনেক কাজ করি।”
২০:১৯
قَالَ اَلْقِهَا یٰمُوْسٰى
বললেন, “একে ছুঁড়ে দাও হে মূসা”!
২০:২০
فَاَلْقٰىهَا فَاِذَا هِیَ حَیَّةٌ تَسْعٰى
সে ছুঁড়ে দিল এবং অকস্মাৎ সেটা হয়ে গেলো একটা সাপ, যা দৌড়াচ্ছিল।
২০:২১
قَالَ خُذْهَا وَ لَا تَخَفْ١ٙ سَنُعِیْدُهَا سِیْرَتَهَا الْاُوْلٰى
বললেন, “ধরে ফেলো ওটা এবং ভয় করো না, আমি ওকে আবার ঠিক তেমনটিই করে দেবো যেমনটি সে আগে ছিল।
২০:২২
وَ اضْمُمْ یَدَكَ اِلٰى جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَیْضَآءَ مِنْ غَیْرِ سُوْٓءٍ اٰیَةً اُخْرٰىۙ
আর তোমার হাতটি একটু বগলের মধ্যে রাখো, তা কোন প্রকার ক্লেশ ছাড়াই উজ্জ্বল হয়ে বের হয়ে আসবে, এটা দ্বিতীয় নিদর্শন।
২০:২৩
لِنُرِیَكَ مِنْ اٰیٰتِنَا الْكُبْرٰىۚ
এজন্য যে, আমি তোমাকে নিজের বৃহৎ নিদর্শনগুলো দেখাবো।
২০:২৪
اِذْهَبْ اِلٰى فِرْعَوْنَ اِنَّهٗ طَغٰى۠
এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।”
২০:২৫
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِیْ صَدْرِیْۙ
মূসা বললো, “হে আমার রব! আমার বুক প্রশস্ত করে দাও।
২০:২৬
وَ یَسِّرۡ لِیۡۤ اَمۡرِیۡ ﴿ۙ۲۶﴾
এবং আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও।
২০:২৭
وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِیْۙ
এবং আমার জিভের জড়তা দূর করে দাও,
২০:২৮
یَفْقَهُوْا قَوْلِیْ۪
যাতে লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে।
২০:২৯
وَ اجْعَلْ لِّیْ وَزِیْرًا مِّنْ اَهْلِیْۙ
আর আমার জন্য নিজের পরিবার থেকে সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করে দাও।
২০:৩০
هٰرُوْنَ اَخِیۙ
আমার ভাই হারুনকে।
২০:৩১
اشْدُدْ بِهٖۤ اَزْرِیْۙ
তার মাধ্যমে আমার হাত মজবুত করো।
২০:৩২
وَ اَشْرِكْهُ فِیْۤ اَمْرِیْۙ
এবং তাকে আমার কাজে শরীক করে দাও,
২০:৩৩
كَیْ نُسَبِّحَكَ كَثِیْرًاۙ
যাতে আমরা খুব বেশী করে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করতে পারি,
২০:৩৪
وَّ نَذْكُرَكَ كَثِیْرًاؕ
এবং খুব বেশী করে তোমার চর্চা করি।
২০:৩৫
اِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِیْرًا
তুমি সব সময় আমাদের অবস্থার পর্যবেক্ষক।”
২০:৩৬
قَالَ قَدْ اُوْتِیْتَ سُؤْلَكَ یٰمُوْسٰى
বললেন, “হে মূসা! তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেয়া হলো।
www.motaher21.net
০৯-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৯-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে মূসা (عليه السلام) মাদইয়ানে দশ বছর অবস্থান করার পর যখন মিসরের উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক ফিরে আসছিলেন তখন পথিমধ্যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে তাঁর কথোপকথন, রিসালাত প্রাপ্তি ও সংশ্লিষ্ট ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যার সারসংক্ষেপ হলো
মূসা (عليه السلام) সস্ত্রীক মাদইয়ান থেকে আসতে পথিমধ্যে রাত হয়ে গেল, রাস্তাও ছিল অজানা, রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, হয়তো কোন দিক নির্দেশনা পেলে রাস্তা পেতেন। কেউ কেউ বলেছেন, স্ত্রীর প্রসবের সময় ছিল আসন্ন, শীতও ছিল কনকনে। সব মিলিয়ে আগুনের প্রয়োজন। যখন তুর পাহাড়ের কাছে আসলেন তখন আগুন দেখতে পেলেন, পরিবারকে বললেন: তোমরা এখানে অবস্থান কর, আমি ঐখানে আগুন দেখতে পাচ্ছি, আগুন নিয়ে আসলে হয়তো শীত কাটানো যাবে অথবা একটা পথ খুঁজে পাব। অতঃপর যখন তিনি ঐ আগুনের নিকট পৌঁছলেন, তখন আওয়াজ এল, হে মূসা! আমিই তোমার পালনকর্তা। অতএব তুমি তোমার জুতো খুলে ফেল। কারণ তুমি পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় রয়েছ। আওয়াজটি এসেছিল গাছের আড়াল থেকে, যেমন সূরা ক্বাসাসের ৩০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। জুতো খোলার নির্দেশ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, এতে বিনয় বেশি প্রকাশ পাবে এবং অধিক সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
আর আমি তোমাকে রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছি। অতএব তোমাকে যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শোন। আমিই আল্লাহ তা‘আলা। আমি ব্যতীত আর কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই। অতএব একমাত্র আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।
(وَأَقِمِ الصَّلٰوةَ لِذِكْرِيْ)
‘আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর’ প্রথমে ব্যাপকভাবে ইবাদতের নির্দেশ দেয়ার পর বিশেষভাবে সালাত আদায় করার নির্দেশ দেয়া হল কেন অথচ ইবাদতের মাঝে সালাত শামিল? কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করার যত ইবাদত রয়েছে বা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল করার যত ইবাদত রয়েছে সকল ইবাদতের মাঝে সালাত সর্বোত্তম পন্থা। তাছাড়া এভাবে ব্যক্ত করে সালাতের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
(لِذِكْرِيْ) এর একটি অর্থ হল- আমার স্মরণার্থে, অর্থাৎ আমার স্মরণার্থে সালাত আদায় কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করার প্রধান মাধ্যম হল সালাত।
দ্বিতীয় অর্থ হল যখনই আমার কথা স্মরণ হবে তখনই সালাত আদায় কর। অর্থাৎ যদি কোন সময় উদাসীনতায় বা ভুলে অথবা ঘুমে আমার স্মরণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও স্মরণ হওয়ার সাথে সাথেই সালাত আদায় কর। যেমন হাদীসে এসেছে: যদি তোমাদের কেউ সালাত আদায় করতে ভুলে যায় অথবা ঘুমিয়ে যায় তাহলে যখনই স্মরণ হবে তখনই সালাত আদায় করে নেবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: ‘আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর’। (সহীহ বুখারী হা: ৫৯৭, সহীহ মুূসলিম হা: ৬৯৭)
তারপর মহান আল্লাহ বলেন: কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, আমি এটা গোপন রাখতে চাই যাতে প্রত্যেকেই নিজ কর্মানুযায়ী ফলাফল লাভ করতে পারে। সুতরাং যে ব্যক্তি কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস করে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে সে যেন তোমাকে (কিয়ামত বিষয়ে সতর্ক থাকা হতে) নিবৃত্ত না করে। তাহলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। মূসা (عليه السلام)-কে ঈমানের মূলনীতির বর্ণনা দেয়ার পর কয়েকটি মু’জিযাহর বর্ণনা দিচ্ছেন যাতে তাঁর অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।
(هِيَ عَصَايَ) মূসা (عليه السلام)-এর হাতে কী ছিল তা আল্লাহ তা‘আলা ভাল করেই জানেন, তারপরেও জিজ্ঞেস আকারে বলার কারণ হল মূসা (عليه السلام) যেন আল্লাহ তা‘আলার কথা মনযোগসহ শুনেন আর তাঁর প্রতি আল্লাহ তা‘আলা যে নেয়ামত দান করেছেন তার গুরুত্ব তুলে ধরা। মূসা (عليه السلام) ছাগল চরাতেন, ফলে এমন একটি মু’জিযাহ দেয়া হল যা তাঁর ব্যক্তিগত কাজেও উপকারে আসে। তিনি এ লাঠির ওপর প্রয়োজনে ভর দিতেন এবং ছাগলের খাবার পাতা পেড়ে দিতেন। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে কেবল জিজ্ঞেস করেছেন তোমার হাতে কী? কিন্তু মূসা (عليه السلام) এত উত্তর দিলেন কেন! কারণ হল তিনি আল্লাহ তা‘আলার সাথে কথা বলার একটি সুযোগ পেলেন, যে কেউ বড়দের সাথে কথা বলতে ভালবাসে। তাই তিনি এ সুযোগে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অনেক কথা বলে নিলেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নির্দেশ প্রদান করে বলেন: তুমি তোমার হাত বগলে রাখ। তারপর দেখবে তা বের হয়ে আসবে উজ্জ্বল ও নির্মল আলো হয়ে, অন্য একটি নিদর্শনরূপে। এটা এজন্য যে, আমি তোমাকে আমার বড় বড় নির্দশনাবলীর কিছু অংশ দেখাতে চাই। এটা ছিল মূসা (عليه السلام)-কে দেয়া দ্বিতীয় মু‘জিযাহ।
মূসা (عليه السلام)-কে নবুওয়াত ও মু‘জিযাহ প্রদান করার পর আল্লাহ তা‘আলা দাওয়াতী কাজের নির্দেশ দিয়ে ফির‘আউনের কাছে প্রেরণ করলেন। طَغٰي অর্থ সীমালঙ্ঘন করা, অর্থাৎ ফির‘আউন বানী-ইসরাঈলদেরকে দাসে পরিণত করত, নানাভাবে নির্যাতন করত, পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করত এবং কন্যাদেরকে জীবিত রাখত। এভাবে সে জমিনে সীমালংঘন করত।
মূসা (عليه السلام)-এর মুখে জড়তা ছিল, ভালভাবে কথা বলতে পারতেন না। তাই আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করলেন: হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ উন্মোচন করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন, আমার মুখের জড়তা দূর করে দিন। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আর আমার পরিবারের মধ্য থেকে আমার ভাই হারূনকে আমার সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন। তার মাধ্যমে আমার শক্তিকে আরো বাড়িয়ে দিন। আর তাকে নবুওয়াত দিয়ে আমার দাওয়াতী কর্মে অংশীদার করুন। যাতে আমরা বেশি বেশি আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারি এবং অধিক পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি। হারূন (عليه السلام) মূসা (عليه السلام) থেকে তিন অথবা চার বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং তিন বছর পূর্বেই মারা যান। মূসা (عليه السلام) যখন হারূন (عليه السلام)-এর জন্য দু‘আ করেন তখন তিনি মিসরে ছিলেন। (কুরতুবী)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে একটি বর্ণনা রয়েছে: যখন মূসা (عليه السلام) ফির‘আউনের বাড়িতে ছিলেন তখন একদা ফির‘আউনের মুখে মূসা (عليه السلام) চড় মারেন এবং তার দাড়ি ধরে টান মারেন। ফলে ফির‘আউন রাগান্বিত হয়ে আসিয়াকে বলে: সে আমার শত্র“, জল্লাদদেরকে ডেকে আন, তাকে মেরে ফেলব। আসিয়া বলল: সে তো একটি ছোট বাচ্চা, এর অপরাধের কারণে পাকড়াও করবেন? সে তো ভাল-মন্দ বুঝে না। তারপর পরীক্ষা করার জন্য একটি পাত্রে জ্বলন্ত অঙ্গার অপর পাত্রে মণিমুক্তা নিয়ে আসা হল। মূসা (عليه السلام) মণিমুক্তায় হাত দিতে গেলে জিবরীল (عليه السلام) হাত ধরে ফেলেন, হাতটি নিয়ে আগুনের অঙ্গারে রাখেন, মূসা (عليه السلام) তা থেকে অঙ্গার তুলে মুখে নিয়ে নেন ফলে হাত ও মুখ পুড়ে যায়। এভাবে তিনি তোতলা হয়ে যান। (কুরতুবী)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মূসা (عليه السلام) ও হারূন (عليه السلام)-এর নবুওয়াতের সত্যতা ও তাঁদেরকে দেয়া কয়েকটি মু’জিযাহর বিবরণ জানতে পারলাম।
২. দাওয়াতী কাজে অন্যের সহযোগিতা নেয়া যাবে।
৩. কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় গোপন রাখার হিকমত জানলাম।
৪. ঘুম বা অজান্তে সালাতের সময়-ক্ষণ চলে গেলে স্মরণ হলেই সালাত আদায় করে নিবে।
৫. মুখে জড়তা বা ভাব প্রকাশে সমস্যা হলে এবং জ্ঞান বৃদ্ধির দু‘আ হল
رَبِّ اشْرَحْ لِیْ صَدْرِیْﭨﺫوَیَسِّرْ لِیْٓ اَمْرِیْﭩﺫوَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِیْﭪﺫیَفْقَھُوْا قَوْلِیْ
এবং এ দু‘আ বেশি বেশি পড়তে হবে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*কোরআন জুড়ে মূসা(আ.) এর কাহিনী : এরপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনী শােনান। তিনি তার দ্বীনের দাওয়াতের জন্যে বাছাই করা লােকদের কিভাবে তদারক ও তত্ত্বাবধান করেন, তার একটা দৃষ্টান্ত এর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনীই কোরআনে সবচেয়ে বেশী আলােচিত। যে যে সূরায় তা আংশিকভাবে আলােচিত হয়েছে, সেই সেই সূরায় তার ঠিক সেই অংশই আলােচিত হয়েছে, যা সে সুরার সামগ্রিক বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এভাবে এ কাহিনী আংশিকভাবে বর্ণিত হয়েছে সুরা বাকারায়, মায়েদায়, আ’রাফে, ইউনুসে, বনী ইসরাইলে, কাহাফে। এ ছাড়া অতি সংক্ষেপে অন্যান্য সুরায় আছে। সূরা মায়েদায় এ কাহিনীর একটা অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। সেটা হলাে বনী ইসরাঈলের পবিত্র ভূমির কাছে অবস্থান এবং সে ভূমিতে একদল দুর্ধর্ষ লােক বাস করে এই অজুহাতে সেখানে প্রবেশ করতে অসম্মতি সংক্রান্ত। সূরা কাহফেও অনুরূপ একটা অংশ বর্ণনা করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে আল্লাহর এক বান্দার সাথে হযরত মূসা(আ.)-এর সাক্ষাত ও তাঁর সাহচর্যে কিছু সময় কাটানাে সংক্রান্ত, কিন্তু সূরা বাকারা, আরাফ, ইউনুস ও এই সূরায় এই কাহিনীর অনেকগুলাে অংশ বর্ণিত হয়েছে। তবে এইসব অংশ এক সূরা থেকে অন্য সূরায় খানিকটা ভিন্নভাবে আলােচিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূরার মূল আলােচ্য বিষয়ের সাথে সমন্বয় রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই কাহিনী অংশে এই বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সূরা বাকারায় হযরত মূসা ও বনী ইসরাঈল সংক্রান্ত কাহিনীর আগে হযরত আদম ও ফেরেশতাদের মধ্যে তার সম্মানজনক অবস্থানের কাহিনী এবং তার ভুল ক্রুটি ক্ষমা করার পর তাকে পৃথিবীর খলিফা পদে অভিষিক্তকরণ ও তাকে বিপুল নেয়ামত প্রদানের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর এসেছে হযরত মূসা ও বনী ইসরাঈলের কাহিনী। এ কাহিনীতে বনী ইসরাঈলকে স্মরণ করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের কত নেয়ামত দান করেছেন, কত অংগীকার তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন, কিভাবে ফেরাউন ও তার দলবলের হাত থেকে তাদের রক্ষা করেছেন, হযরত মূসা(আ.) কিভাবে তাদের জন্যে পানি চেয়েছেন, কিভাবে আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে মরুভূমিতে পানির ঝর্ণা তৈরী করে দিয়েছেন এবং অলৌকিকভাবে মান্না ও সালওয়া নামক খাদ্য পরিবেশন করেছেন। এ সাথে মূসা(আ.)-কে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তুর পর্বতে ডেকে নিলে সেই সুযােগে বনী ইসরাঈলের বাছুর পূজায় লিপ্ত হওয়া ও আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক সেই পাপ ক্ষমা করা, পাহাড়ের নীচে তাদের কাছ থেকে অংগীকার গ্রহণ, শনিবারের আইন লংঘন এবং গাভী সংক্রান্ত ঘটনাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে সূরা বাকারায়। সূরা আরাফ হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনীর আগে সতর্কবাণী উচ্চারণ ও ইতিপূর্বে যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী অস্বীকার করেছে, তাদের ভয়াবহ পরিণতির উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর যখন হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনী শুরু হয়েছে, তখন তা তার নবুওতের প্রাথমিক দায়িত্ব পালনের বিবরণ দিয়ে শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ে তার লাঠি, হাত উজ্জ্বল হওয়া, ঝড় বন্যা, ফসল খেকো কীটপতংগ, উকুন, ব্যাঙ ও রক্তের বিবরণ দেয়া হয়েছে। বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে যাদুকরদের কর্মকান্ডের, ফেরাউনের জীবনাবসানের এবং তার সাংগ-পাংগদের ধ্বংসপ্রাপ্তিরও। এরপর এসেছে হযরত মূসা(আ.)-এর অনুপস্থিতিতে বনী ইসরাঈলের বাছুর পূজার বিবরণ। অতপর এ কিসসার সমাপ্তি টানা হয়েছে এই মর্মে ঘােষণা দানের মাধ্যমে যে, যারা এই নিরক্ষর শেষ নবী মােহাম্মদ(স.)-এর অনুসারী হবে, তারাই হবে আল্লাহর রহমত ও হেদায়াতের উত্তরাধিকারী। সূরা ইউনুসেও এই কাহিনীর আগে নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারী পূর্বতন জাতিগুলাের ধ্বংসের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এরপর এসেছে হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনী। প্রথমে আলােচিত হয়েছে তার রসূলসুলভ কর্মকান্ড, তারপর এসেছে যাদুকরদের দৃশ্য, ফেরাউন ও তার দলবলের ধ্বংসের বিশদ বিবরণ। কিন্তু আলােচ্য সূরা ত্বা-হায় এ কাহিনীর আগেই আলােচিত হয়েছে দ্বীনের দাওয়াতের বাহক হিসাবে আল্লাহর নির্বাচিত নবী রসূলদের ওপর আল্লাহর রহমত ও তদারকীর বিষয়টি। তাই কাহিনীতেও এই বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। কাহিনীর প্রথম দিকেই হযরত মূসা(আ.)-এর সাথে আল্লাহর গােপন আলাপ আলােচনা, তার সমর্থন ও সাহায্যের কিছু দৃষ্টান্ত এবং ইতিপূর্বে তার শৈশবকালেও তাঁকে যেভাবে সংরক্ষণ করেছেন তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তােমার জন্যে আমার পক্ষ থেকে স্নেহ মমতা ঢেলে দিয়েছিলাম যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও।’ *মূসা(আ.)-এর নবুওতপ্রাপ্তি ও আল্লাহর সাথে কথপােকথনের ঘটনা : এবার আমি সুরায় আলোচিত কাহিনীর বিশদ ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হচ্ছি। ‘তোমার কাছে মূসার বৃত্তান্ত পৌঁছেছে কি? সে যখন আগুন দেখতে পেলাে, তখন নিজ পরিবারবর্গকে বললাে, তােমরা এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আগুন দেখতে পেয়েছি…'(আয়াত ৯-১০) ‘তােমার কাছে মূসার বৃত্তান্ত পৌছেছে কি?’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যাকে নবী হিসেবে বরণ করে নেন, তাকে কিভাবে তত্ত্বাবধান ও পথ প্রদর্শন করেন, সেটা কি তুমি সে বৃত্তান্তের মাধ্যমে জানতে পেরেছি? তিনি তুর পর্বতের কাছ দিয়ে মিসর থেকে মাদইয়ানের দিকে যাত্রা করেন। মাদইয়ানে তিনি আল্লাহর নবী হযরত শােয়ায়েবের সাথে এই মর্মে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন যে, কমের পক্ষে আট বছর এবং উপলক্ষে দশ বছর তার গৃহভৃত্য হিসেবে কাজ করলে তার দু’মেয়ের একটাকে তার সাথে বিয়ে দেবেন। এই চুক্তি অনুসারে তিনি তাঁর মেয়েকে বিয়ে করেন এবং অধিকতর নির্ভরযােগ্য মতে পুরাে দশ বছর তার বাড়ীতে কাজ করেন, তারপর তিনি স্ত্রীকে নিয়ে হযরত শােয়াইবের কাছ থেকে আলাদাভাবে জীবন যাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে নিজ জন্মভূমি মিসরে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন, যেখানে তাঁর স্বগােত্র বনী ইসরাঈল ফেরাউনের নির্যাতনে নিষ্পেষিত হচ্ছিলাে। (সূরা ত্বা-হার পূর্বে অবতীর্ণ সূরা কাসাসে হযরত মূসার জীবনের এই প্রাথমিক ঘটনাবলী আলােচিত হয়েছে-গ্রন্থকার) তিনি মিসরে কেন ফিরে গেলেন? অথচ তিনি তার সেখান থেকে বিতাড়িত। জনৈক ইসরাঈলীর সাথে সংঘর্ষের এক কিবতীকে হত্যা করে তিনি মিসর থেকে যখন পলায়ন করেন তখন বনী ইসরাঈল সেখানে ফেরাউনের শাসনাধীনে হরেক রকম নির্যাতন ভােগ করছিলাে। তিনি মাদইয়ানে হযরত শােয়াইবের কাছে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেন এবং তাঁর মেয়েকে বিয়ে করেন। এই ফিরে যাওয়ার মূলে ছিলাে নিজ দেশ ও স্বজনদের আকর্ষণ। মহান আল্লাহ হযরত মূসা(আ.)-কে নানা ধরনের ভূমিকা পালনের জন্যে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন বলেই তার মনে এই আকর্ষণ সৃষ্টি করেন। আমরাও এভাবে পার্থিব জীবনে বিভিন্ন আবেগ ও আকর্ষণ, আশা ও আকাংখা এবং সুখ ও দুঃখের টানাপড়েনে সক্রিয় ও তৎপর হয়ে থাকি। আসলে এগুলাে মহান আল্লাহর সুপ্ত ও অদৃশ্য উদ্দেশ্যকে সফল করার বাহ্যিক উপকরণ ও উপলক্ষ মাত্র। মহা পরাক্রমশালী ও সূক্ষ্মদর্শী আল্লাহর এসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কেউ দেখতে, জানতে ও বুঝতে পারে না। দেখতে পায় শুধু বাহ্যিক উপলক্ষকে। এভাবে হযরত মূসা(আ.) ফিরে চললেন ফিরে যাওয়ার সময় রাতের আধারে মরুভূমির উন্মুক্ত প্রান্তরে পথ হারিয়ে ফেললেন। এ বিষয়টা আমরা জানতে পারি স্বীয় পরিবারবর্গকে সম্বােধন করে উচ্চারিত তাঁর এই উক্তি থেকে, ‘তােমরা একটু দাড়াও, আমি আগুন দেখতে পেয়েছি । হয়তাে আমি তােমাদের জন্যে একটা জ্বলন্ত অংগার নিয়ে আসতে পারবাে, অথবা আগুনের জায়গা থেকে পথের সন্ধান পাবাে।’ এ কথা সুবিদিত যে, মরুবাসীরা সাধারণত একটু উঁচু জায়গায় আগুন জ্বালায়, যাতে মরুচারীরা রাতের অন্ধকারে তা দেখে পথের সন্ধান পায়, অথবা সেখানে রাত্রি যাপন ও খাবার দাবারের সুবিধা পেতে পারে। মূসা(আ.) এই মরুভূমিতে আগুন দেখে খুশী হলেন এবং পরিবার পরিজনের শীত নিবারণের জন্যে সেখান থেকে আগুন নিয়ে আসতে পারবেন ভেবে সেখানে গেলেন । কেননা মরুভূমিতে রাতের বেলা শীত অনুভূত হয়ে থাকে। তিনি এ আশাও পােষণ করছিলেন যে, সে আগুন দ্বারা নিজেই পথ চিনে নিতে পারবেন অথবা ওখানে পথের সন্ধান দিতে পারে এমন কাউকে পাওয়া যাবে।
হযরত মূসা (আ.) একটু আগুনের অংগার অথবা পথের সন্ধানদাতার খোঁজে সেখানে গেলেন বটে, তবে অপ্রত্যাশিতভাবে পেয়ে গেলেন তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ। সেখানে তিনি পেলেন সেই আগুন, যা দিয়ে দেহ নয়, আত্মাকে উদ্দীপিত করা যায়, যা দিয়ে মরুপথের নিশীথ যাত্রা নয় বরং মানব জীবনের কঠিনতম ও বৃহত্তম সফরের পথনির্দেশ লাভ করা যায় । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মূসা যখন আগুনের কাছে গেলাে, তাকে সম্বোধন করা হলাে, ওহে মূসা, আমি তােমার প্রভু! অতএব তােমার জুতা খােলাে, তুমি তা পবিত্র তুয়া ময়দানে উপস্থিত । আমি তােমাকে (নবী হিসাবে) মনােনীত করেছি। সুতরাং তুমি ওহীর মাধ্যমে যা বলা হচ্ছে তা শােনাে। আমিই আল্লাহ। আমি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই। কাজেই আমার এবাদাত করাে এবং আমার স্মরণে নামায কায়েম করাে…'(আয়াত১১-১৬) সেই সময়কার দৃশ্যটা নিছক কল্পনা করতেও মানুষের মন কেঁপে ওঠে এবং শুকিয়ে যায় । মূসা(আ.) একাকী মরুপ্রান্তরে ধাবমান। রাত গভীর। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিস্তব্ধ নিঝুম পরিবেশ। এই পরিবেশে তিনি এগিয়ে চলেছেন আগুন আনতে, যা তিনি তুরের কাছ থেকে দেখতে পেয়েছেন। সহসা তার চার পাশের জগত ঐশীধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। ‘আমি তােমার প্রভু। তুমি জুতা খােলাে। তুমি পবিত্র তুয়া ময়দানে উপস্থিত । আমি তােমাকে মনােনীত করেছি…’ চোখ দিয়ে দেখা যায় না এমন মহা প্রতাপশালী বিশ্ব প্রভু মুখোমুখি হয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, দুর্বল, সীমাবদ্ধ একটা কণা। সেই মহাপ্রতাপশালী প্রভুর প্রতাপের সামনে আকাশ ও পৃথিবী নস্যি মাত্র। তার সেই মহা প্রতাপান্বিত আহ্বানটি পৌছে মানবীয় সত্ত্বার কাছে। মানবীয় সত্ত্বা এ আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিবে যদি আল্লাহর কৃপা তার সহায় না হয়? এটা এমন এক মুহূর্ত, যখন হযরত মূসা(আ.)-এর মাধ্যমে গােটা মানব জাতি এতাে উচ্চস্তরে উপনীত হয়েছিলাে যে, এই আহ্বান সে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলাে। মানুষের পক্ষে এই আহ্বান গ্রহণ করা ও তাতে সাড়া দেয়ার যােগ্যতা ও সামর্থ কম গৌরবের ব্যাপার নয়, চাই যেভাবেই সে সাড়া দিক। কিভাবে সাড়া দিয়েছিলাে তা আমরা জানি না। এ ব্যাপারে রায় দেয়া ও এ বিষয়টা উপলব্ধি করা মানবীয় বিবেক বুদ্ধির সাধ্যাতীত। তবে না বুঝে হলেও এর সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়া ও এর প্রতি ঈমান আনাই তার পক্ষে যথেষ্ট। তাকে সম্বোধন করা হলাে এই কর্মবাচ্য সূচক ক্রিয়া ব্যবহারের কারণ, এই সম্বােধনের উৎস, দিক, পদ্ধতি ও স্বরূপ কী ছিলাে এবং হযরত মূসা(আ.) তা কিভাবে শুনেছেন ও সাড়া দিয়েছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। সুতরাং কথাটা দাঁড়ালাে এ রকম যে, যেভাবেই হােক সম্বােধন করা হয়েছে এবং যেভাবেই হােক তাতে সাড়া দেয়া হয়েছে। এটা আল্লাহর এমন একটা কাজ, যা সংঘটিত হয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি, কিন্তু কিভাবে সংঘটিত হয়েছে তা জানতে চাই না। কেননা কিভাবে হয়েছে সেটা মানুষের বুঝা ও কল্পনা করার ক্ষমতার বাইরে। ‘হে মুসা আমি তােমার প্রভু। কাজেই তােমার জুতা খোলো। তুমি পবিত্র তুয়া ময়দানে উপস্থিত’ (তুয়া কারাে মতে ময়দানের নাম, আবার কারো মতে ময়দানের বিশেষণ) অর্থাৎ তুমি মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত। কাজেই খালি পায়ে এসাে। তুমি সেই ময়দানে উপস্থিত, যেখানে পবিত্র দৃশ্য দেখা যায় । তাই এটাকে জুতাে দ্বারা দলিত করাে না। ‘আমি তােমাকে মনােনীত করেছি।’ বস্তুত এ এক অভাবনীয় গৌরব ও সম্মান যে, আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং লক্ষ কোটি মানুষের মধ্য থেকে একজনকে মনােনীত করেন। আল্লাহর অসংখ্য গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে একটা গ্রহে অবস্থানরত এমন একটা সৃষ্টিকে তিনি বাছাই করেন, যার আকৃতি এই মহাবিশ্বের তুলনায় একটা বিন্দু বা কণার সমান। এতাে বড়াে ও বিশাল সৃষ্টি জগতকে আল্লাহ তায়ালা শুধু একটা শব্দ হও বলে সৃষ্টি করেছেন। এহেন বিশাল সৃষ্টিজগতের একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ মানুষকে তিনি মনােনীত করে যে সম্মান দিয়েছেন, সেটা মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ কৃপাদৃষ্টির ফল ছাড়া আর কিছু নয়। এই সম্মানজনক মনােনয়নের ঘােষণা দান এবং জুতাে খােলার নির্দেশ দিয়ে প্রস্তুতকরণের পর ওহীর বাণী গ্রহণের জন্যে সতর্ক করা হচ্ছে, ‘অতএব ওহীর বাণী শােনাে।’ এই ওহীর বাণীর সার সংক্ষেপ হচ্ছে পরস্পর সুসমন্বিত ও সংযুক্ত তিনটি জিনিস, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস, তার এবাদাত ও আনুগত্য এবং কেয়ামতে বিশ্বাস। এই তিনটিই আল্লাহর রসূলদের রেসালাতের মূল কথা। ‘আমিই আল্লাহ’ আমি ছাড়া কোনাে ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদাত করাে…'(আয়াত ১৪-১৬) আল্লাহর একত্ব হচ্ছে ঈমানের মূল। আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা(আ.)-এর সাথে কথা বলার সময় এ বিষয়টার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রথমে আমিই আল্লাহ এবং তারপর আবার আমি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই বলেছেন। প্রথমটায় আল্লাহকে ‘ইলাহ’ বলা হয়েছে। আর শেষেরটায় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে ইলাহ হওয়া অস্বীকার করা হয়েছে। এই ইলাহত্ব বা প্রভুত্ব থেকেই এবাদাতের উদ্ভব হয়। আর এবাদাত হচ্ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দিকে মনােনিবেশ ও তার হুকুম মানার নাম। তবে এর বিশেষ রূপ হলাে নামায। ‘আমার স্মরণে নামায কায়েম করো।’ কারণ নামায এবাদাতের সবচেয়ে পূর্ণাংগ রূপ ও স্মরণের সবচেয়ে পূর্ণাংগ পদ্ধতি। কেননা এটাই নামাযের একমাত্র উদ্দেশ্য। অন্যসব উদ্দেশ্য থেকে তা মুক্ত। নামাযে মানুষ শুধু আল্লাহর হুকুম পালনের জন্যেই প্রস্তুত হয় এবং তার সাথে মিলিত হবার জন্যেই নিবেদিত হয়। আর কেয়ামত ও পরকাল হলাে পরিপূর্ণ ও ন্যায়সংগত কর্মফল লাভের জন্যে নির্ধারিত সময় । এর প্রতি সবার মন উন্মুখ থাকে এবং এর জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। জীবনপথে চলার সময় প্রতি মুহুর্তে পদস্খলন সম্পর্কে সতর্ক হয়ে চলে। সেই সময়টা যে একদিন আসবেই, তা আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেছেন। সেই সাথে এও বলেছেন যে, ‘আমি তাকে লুকিয়ে রেখেছি।’ বস্তুত কেয়ামত সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান খুবই কম ও সীমিত। তিনি নিজে যতােটুকু ভালাে মনে করেন ততােটুকুই তাদেরকে জানান। অজ্ঞতাই মানব জীবনে ও মানব সত্ত্বার গঠনে মৌলিক উপাদান। মানব জীবনে কিছু জিনিস অজানা থাকা জরুরী, যেন তার জন্যে তারা অনুসন্ধান চালাতে থাকে। মানুষের বর্তমান স্বভাব প্রকৃতি বহাল থাকা অবস্থায়, সব কিছুই যদি তার জানা হয়ে যেতাে, তাহলে তার সমস্ত তৎপরতা বন্ধ হয়ে যেতাে এবং তার জীবন একঘেয়ে হয়ে যেতাে। অজানা জিনিসের পেছনেই সে ঘুরপাক খায়, আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান থাকে, সতর্কতা অবলম্বন করে, অভিজ্ঞতা অর্জন করে, শিক্ষা গ্রহণ করে, নিজের ও আশপাশের সৃষ্টিজগতের অজানা শক্তি ও জানতে চেষ্টা করে, নিজের সত্ত্বায় প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করে এবং আল্লাহ তায়ালা যতােটুকু আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ক্ষমতা ও সুযােগ দেন, পৃথিবীতে ততােটুকু আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করে। যে কেয়ামতের আগমনের সময় কারাে জানা নেই, তার জন্যে মানুষের মন মগয ও চেতনাকে অপেক্ষমাণ ও সচকিত রাখার যে ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা করেছেন, তা তাকে স্বেচ্ছাচারিতা থেকে রক্ষা করে। যেহেতু কেয়ামতের সময় অজ্ঞাত, তাই তার জন্যে সদাসতর্ক ও সদাপ্রস্তুত থাকা প্রত্যেক সুস্থ বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যার বিবেক বিকৃত হয়ে গেছে এবং যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে শিথিল ও উদাসীন থাকে এবং তার পতন ও ধ্বংস অনিবার্য, ‘অতএব যে ব্যক্তি কেয়ামতে বিশ্বাস করে না এবং আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তােমাকেও কেয়ামত সম্পর্কে উদাসীন করে না দেয়। তাহলে তাে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।’ এর কারণ, প্রবৃত্তির অনুসরণই মানুষকে কেয়ামত ও আখেরাত বিশ্বাস করতে প্ররােচিত করে থাকে। সুস্থ প্রকৃতির মানুষ আপনা থেকেই বিশ্বাস করে যে, পার্থিব জীবনে মানুষ কোনাে দিক দিয়েই পূর্ণতা লাভ করে না এবং এখানে পূর্ণ ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। তাই এমন একটা ভিন্নতর জগত থাকতেই হবে, যেখানে মানুষ তার প্রাপ্য পূর্ণতা ও কর্মফলের পূর্ণ ন্যায়বিচার পাবে। এটা ছিলাে হযরত মুসা(আ.)-এর প্রতি উচ্চারিত ঐশী সম্বােধনের প্রথমাংশ। এই সম্বোধনে তার সমগ্র সত্ত্বা সচকিত হয়ে ওঠলাে। আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে তার মনােনীত বান্দাকে তাওহীদের মূলনীতিগুলাে শিখিয়ে দিলেন। মূসা(আ.) যে এতে হতচকিত ও হতবুদ্ধি হয়ে যাবেন এবং তিনি যে আগুন নিতে এসেছিলেন সে কথা ভুলে যাবেন, সেটা ছিলাে অবধারিত।
এই অদৃশ্য আহ্বান কোথা থেকে আসছে, এই ভাবনায় যখন তিনি একান্তভাবেই মশগুল এবং অন্য কোনো দিকে তার ঘূর্ণাক্ষরেও মনােযােগ দেয়ার সুযােগ নেই, তখন সহসা তার কাছে এমন এক প্রশ্ন করা হলাে, প্রশ্নকর্তা যার জবাবের মুখাপেক্ষী নন। প্রশ্নটা হলাে, ‘হে মূসা, তােমার ডান হাতে ওটা কি?’ তাঁর হাতে তার লাঠি ছিলাে, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই, কিন্তু লাঠি দিয়ে তিনি কী করেন? তিনি এর জবাবে লাঠির উপকারিতার উল্লেখ করলেন, ‘মূসা বললাে, ওটা আমার লাঠি। আমি ওর ওপর ভর দেই, ওটা দিয়ে আমার মেষপালকে গাছের পাতা পেড়ে দেই এবং ওতে আমার আরাে অনেক উপকার হয়।’ মূলত তার হাতের লাঠির উপকারিতা কী কী, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়নি। প্রশ্নটা ছিলাে শুধু এই যে, তার হাতের জিনিসটা কী, কিন্তু মূসা(আ.) উপলব্ধি করলেন যে, তাকে বােধ হয় সে জিনিসটার নাম ও পরিচয় জিজ্ঞেস করা হয়নি। কেননা তা তাে সুস্পষ্ট তাকে নিশ্চয়ই সে জিনিসটার উপকারিতা জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তাই তিনি এরূপ জবাব দিলেন। মূসা(আ.) যে জবাব দিলেন তা ছিলাে লাঠি সম্পর্কে তার জানা সর্বশেষ ও সর্বাধিক তথ্য। সে লাঠিতে তিনি ভর দেন, তা দিয়ে তিনি হযরত শােয়াইবের মেষপালের রাখালগিরি করতে গিয়ে গাছের পাতা পেড়ে তাদেরকে খেতে দেন এবং আরাে অনেক প্রয়োজনে লাঠিটা ব্যবহার করেন, যা তিনি সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। তিনি এগুলাের বিশদ বিবরণ দেননি; বরং নমুনাস্বরূপ মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করেছেন। অনেকে বলেন যে, শশুরালয় থেকে স্বদেশে যাওয়ার সময় তিনি মেষপালের একটা অংশ সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যা তার প্রাপ্য ছিলাে। কিন্তু মহাশক্তিধর আল্লাহ তায়ালা তার হাতের লাঠি দিয়ে এমন কাজ সংঘটিত করলেন, যা কেউ ভাবতেও পারেনি। এর উদ্দেশ্য ছিলাে হযরত মূসা(আ.)-কে তার বৃহত্তর দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রস্তুত করা। *মূসা(আ.)-কে আল্লাহ তায়ালার মােজেজা দান : আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে মূসা, লাঠিটা ফেলে দাও। মূসা ফেলে দিলাে। সংগে সংগেই তা এক ধাবমান সাপ হয়ে গেলাে। আল্লাহ তায়ালা বললেন, এবার সাপটাকে ধরাে, ভয় পেয়ো না, আমি ওটাকে আগের আকৃতিতে ফিরিয়ে নেবো।’ এ সময় সেই অলৌকিক মােজেযা সংঘটিত হলাে, যা প্রতি মুহূর্তে সংঘটিত হচ্ছে। অথচ মানুষ সে সম্পর্কে সচেতন নয়। মােজেযা সংঘটিত হলাে এভাবে যে, একটা লাঠি চলন্ত সাপে পরিণত হলাে। অথচ প্রতি মুহূর্তে কত লক্ষ কোটি মৃত বা জড় কোষ যে জীবন্ত কোষে পরিণত হচ্ছে, কে তার ইয়ত্তা রাখে। এটা মানুষকে এতােটা হতচকিত করে না, যতােটা মূসা(আ.)-এর লাঠি সাপে পরিণত হয়ে করেছিলাে। কেননা মানুষ তার ইন্দ্রিয়ের এবং তার সঞ্চিত অভিজ্ঞতার হাতে বন্দী। তাই তার ইন্দ্রিয় যা কিছু অনুভব করে, তার কল্পনা তা থেকে খুব বেশী পৃথক হয় । লাঠির সাপে পরিণত হওয়া একটা ঐন্দ্রিক ঘটনা, যা অনুভূতিকে আঘাত করে। তাই সে তার প্রতি প্রচন্ডভাবে সচকিত ও সচেতন হয়, কিন্তু জীবনের সুপ্ত মােজেযাগুলাে, যা প্রতি মুহূর্তে সংঘটিত হচ্ছে, সেদিকে কেউ ভ্রুক্ষেপ করে না। বিশেষত গতানুগতিকতা তার স্নায়ুকে নতুনত্বের শিহরণ থেকে বঞ্চিত করে। তাই সে উদাসীন ও অবচেতনভাবে তাকে অতিক্রম করে। মােজেযাটি সংঘটিত হলে মুসা(আ.) ঘাবড়ে গেলেন ও ভয় পেলেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘তুমি ওটা ধরাে এবং ভয় পেয়াে না। আমি ওকে আগের আকৃতিতে ফিরিয়ে নেবাে।’ অর্থাৎ লাঠি বানিয়ে দেবাে। এখানকার আয়াতে অন্য সূরার মতাে বলা হয়নি যে, মূসা(আ.) পেছন ফিরে পালালেন এবং ফিরেও তাকালেন না। সংক্ষিপ্তভাবে ইংগিত করা হয়েছে যে, মূসা(আ.) ভয় পেলেন। কারণ এই সূরার সামগ্রিক পটভূমি হচ্ছে প্রশান্তির পটভূমি। তাই এ বিবরণ পেছন ফিরে পালানাে ও আতংকিত হওয়া সম্বলিত বিবরণ থেকে তেমন পৃথক ও ভিন্নতর নয়। এরপর মূসা(আ.) শান্ত হলেন এবং সাপটাকে ধরে ফেললেন। ধরা মাত্রই তা আগের মতাে লঠির আকৃতি লাভ করলাে। সংঘটিত হলাে আরেক ধরনের মোজেজা। একটা জীবত্ত সাপের জীবন ছিনিয়ে নিয়ে তাকে মৃত ও জড় পদার্থে পরিণত করা হলাে, যেমনটি তা প্রথম মােজেযার আগে ছিলাে। পুনরায় আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দা মূসা(আ.)-কে আদেশ দিলেন ‘তােমার হাত তােমার বগলে রাখো, তখন তা সাদা হয়ে বেরিয়ে আসবে, কোনাে অমংগল ব্যতিরেকেই। সেটা হবে আরেকটা নিদর্শন।’ মূসা(আ.) তার হাত তার বগলের নীচে স্থাপন করলেন। আয়াতে বগল ও বাহুকে ডানা বলার কারণ এ অংশটা পাখীর ডানার মতােই হালকা ও মুক্ত। এতে শরীরের বা মাটির ভার পড়ে না। হাত বগলে রাখতে বলা হয়েছে, যাতে তা সাদা হয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু এই সাদা হওয়াটা কোনাে রােগ ব্যাধি বা বিপদের লক্ষণ নয়; বরং লাঠির সাপে পরিণত হওয়ার মতাে এটাও আরেকটা স্বতন্ত্র মােজেযা। যেন তােমাকে আমার বৃহত্তম নিদর্শন গুলো দেখাই। তাহলে তুমি সেই মোজেজা সংঘটিত হওয়া স্বচক্ষে দেখতে পাবে, নিজ ইন্দ্রিয় ও স্নায়ু দ্বারা অনুভব করতে পারবে। তাহলে তুমি এর বৃহত্তম সুফল বহনে নিশ্চিতভাবে সক্ষম হবে।
*দ্বীন প্রতিষ্ঠার মিশনে মূসা(আ.)-কে আল্লাহর সর্বাত্মক সাহায্য : ‘তুমি ফেরাউনের কাছে যাও। সে বিপথগামী হয়ে গেছে।'(আয়াত ২৪) এ সময় পর্যন্তও হযরত মূসা(আ.) জানতেন না যে, তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়ােজিত। অথচ ফেরাউন কেমন মানুষ, তা বিলক্ষণ জানতেন। কেননা তিনি তারই প্রাসাদে লালিত পালিত হয়েছেন, তার স্বৈরাচারী কর্মকান্ড দেখেছেন এবং তার গােত্রের ওপর সে কিরূপ নির্যাতন চালিয়েছে তাও দেখেছেন। এখনাে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে রয়েছেন। তার পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত আদর সম্মান ও সন্তোষ উপভােগ করছেন। তাই এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করে তার কাছ থেকে এমন শক্তি চেয়ে নেয়া খুবই জরুরী মনে করলেন, যাতে করে এই কঠিন দায়িত্ব পালন করা তার জন্যে সহজ হয়ে যাবে এবং রসূলসুলভ দায়িত্ব পালনে দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা প্রদর্শনে তিনি সক্ষম হবেন। ‘তিনি বললেন, হে আমার প্রতিপালক, আমার বুক খুলে দাও, আমার কাজ সহজ করে দাও, আমার জিহ্বার আড়ষ্টতা দূর করে দাও যেন লোকেরা আমার কথা বুঝতে পারে।'(আয়াত ২৫-৩৪) হযরত মূসা(আ.) স্বীয় প্রতিপালকের কাছে দোয়া করলেন যেন তার বুক খুলে দেন। বুক খুলে দেয়ার ফল এই হয় যে, দায়িত্ব পালনের কষ্টটা আনন্দে পর্যবসিত হয় এবং ওটা জীবনকে ভারাক্রান্ত করার পরিবর্তে সামনে এগিয়ে দেয়। তিনি আল্লাহর কাছে নিজের দায়িত্ব পালন সহজ করে দেয়ার দোয়াও করলেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা যদি বান্দার কাজ সহজ করে দেন, তবে তার সাফল্য সুনিশ্চিত। আল্লাহ তায়ালা সহজ করে না দিলে বান্দা বড়ােই অসহায় হয়ে পড়ে। কেননা তার শক্তি ও জ্ঞান সীমিত এবং পথ দীর্ঘ, দুর্গম ও অচেনা। তিনি আল্লাহর কাছে জিহ্বার জড়তা ও আড়ষ্টতা দূর করারও অনুরােধ জানান, যাতে মানুষ তার কথা বুঝতে পারে । বর্ণিত আছে যে, তার জিহ্বায় তােতলামি ছিলাে এবং খুব সম্ভবত এটা থেকেই তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন। সূরা কাসাসে উদ্ধৃত হযরত মূসা(আ.)-এর এই উক্তি থেকেও সেটাই বুঝা যায়, ‘আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে প্রাঞ্জলভাষী।’ হযরত মূসা(আ.) এখানে আল্লাহর কাছে যে দোয়া করেছেন, তাতে প্রথমে বক্ষদেশ প্রশস্ত করে দেয়া ও কাজ সহজ করে দেয়া এই দুটো জিনিসই চেয়েছেন। তারপর সুনির্দিষ্টভাবে যেসব জিনিস তার সহায়ক হতে পারে, সেগুলাে প্রার্থনা করেছেন। তিনি নিজের ভাই হারুনকেও তার কাজের সহযােগী হিসেবে চেয়েছেন। কেননা তিনি তার বাগ্মিতা, বাকপটুতা, মনের দৃঢ়তা ও ঠান্ডা মাথার কথা জানতেন। মূসা(আ.) নিজে ছিলেন কিছুটা রাগী, আবেগ-প্রবণ, ত্বরিত উত্তেজিত ব্যক্তি। তাই তিনি দোয়া করলেন যেন আল্লাহ তায়ালা তার ভাইকে তার সাহায্যকারী হিসেবে মনােনীত করেন। যিনি তাঁর আরাদ্ধ কাজ সম্পন্ন করতে সহযােগীর ভূমিকা পালন করবেন। হযরত মূসা(আ.)-এর আরাদ্ধ কাজ সফল করতে আল্লাহর প্রচুর তাসবীহ, যিকির ও তাঁর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করা আবশ্যক ছিলাে। হযরত মূসা(আ.)-এর বক্ষদেশ প্রশস্ত করে দেয়া, তার কাজ সহজ করে দেয়া ও তার জিহবার আড়ষ্টতা দূর করার জন্যে যে দোয়া করেছেন, তা সরাসরি তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নয় বরং তিনি ও তার ভাই যাতে বেশী করে আল্লাহর তাসবীহ ও যিকির করতে পারেন এবং তার কাছ থেকে আল্লাহর এবাদাতের প্রেরণা লাভ করতে পারেন সে জন্যে। দোয়ার শেষ ভাগে তিনি বলেছেন, ‘তুমি তাে আমাদের সব কিছুই দেখতে পাও।’ অর্থাৎ তুমি আমাদের অবস্থা জানাে, আমাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতা সম্পর্কে তুমি অবহিত এবং আমাদের জন্যে সাহায্যের প্রয়ােজন কতখানি তাও তুমি জানাে। হযরত মূসা(আ.) তার প্রার্থনা অনেক দীর্ঘায়িত করলেন, তার প্রয়ােজন ব্যক্ত করলেন, নিজের দুর্বলতাগুলাে জানালেন এবং আল্লাহর সাহায্য, কাজ সহজ করে দেয়া এবং আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতা ও প্রেরণা প্রার্থনা করলেন। এ প্রার্থনা করার সময় আল্লাহ তায়ালা তার প্রার্থনা শুনছিলেন এবং হযরত মূসা(আ.) তখনকার জন্যে তার দরবারে একজন অতিথি। আল্লাহ তায়ালা তার এ প্রার্থনা কিভাবে অগ্রাহ্য করবেন? তিনি স্বয়ং সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। তিনি তার মেহমানকে লজ্জা দেন না এবং প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেন না। তাই পরিপূর্ণভাবে দোয়া কবুল করতেও তিনি বিলম্ব করলেন না। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘হে মূসা, তুমি যা চেয়েছে তা তােমাকে দেয়া হয়েছে।’ এভাবে একবারে এক বাক্যেই দোয়া মঞ্জুর করা হলাে। এটা সংক্ষিপ্ত বাক্য হলেও এর বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়ােজন নেই। এতে কোন ওয়াদা করা হয়নি; বরং তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করার ঘােষণা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে ‘হে মূসা’ বলে সম্বোধন করে তাকে সম্মানিতও করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তার এক বান্দাকে নাম ধরে ডাকলেন, এর চেয়ে বড়াে সম্মান ওই বান্দার জন্যে আর কিছুই হতে পারে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# এটা সে সময়ের কথা যখন হযরত মূসা মাদয়ানে কয়েক বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করার পর নিজের স্ত্রীকে (যার সাথে মাদয়ানে বিয়ে হয়েছিল) নিয়ে মিসরে ফিরে যাচ্ছিলেন। এর আগর ঘটনা সূরা কাসাসে বর্ণিত হয়েছে। এর সংক্ষিপ্তসার হচ্ছেঃ হযরত মূসার হাতে একজন মিসরীয় মারা পড়ার ফলে তিনি নিজের গ্রেফতার হয়ে যাওয়ারআশঙ্কা করছিলেন। এ সময় তিনি মিসর ত্যাগ করে মাদয়ানে গিয় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
# মনে হচ্ছে তখন সময়টা ছিল শীতকালের একটি রাত। হযরত মূসা সিনাই উপদ্বীপের দক্ষিণ এলাকা অতিক্রম করছিলেন। দূর থেকে একটি আগুন দেখে তিনি মনে করেছিলেন সেখান থেকে কিছু আগুন পাওয়া যাবে যার সাহায্যে শিশু সন্তান ও পরিবারের লোকজনদের সারারাত গরম রাখার ব্যবস্থা হবে অথবা কমপক্ষে সামনের দিকে অগ্রসর হবার পথের সন্ধান পাওয়া যাবে। তিনি দুনিয়ার পথের সন্ধান পাওয়ার কথা চিন্তা করেছিলেন আর পেয়ে গেলেন সেখানে আখেরাতের পথ।
# সম্ভবত এ ঘটনার কারণে ইহুদীরা তাদের শরীযাতের এ বিধান তৈরী করে নিয়েছে যে, জুতা পায়ে দিয়ে নামায পড়া জায়েয নয়।
নবী ﷺ এ বিভ্রান্তিটি দূর করার জন্য বলেনঃ خَالِفُوا الْيَهُودَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُصَلُّونَ فِى نِعَالِهِمْ وَلاَ خِفَافِهِمْ
“ইহুদীদের বিপরীত কাজ করো। কারণ তারা জুতা ও চামড়ার মোজা পরে নামায পড়ে না।” (আবু দাউদ)
এর অর্থ এ নয় যে, জুতা পরেই নামায পড়তে হবে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, এমনটি করা জায়েজ। কাজেই উভয়বিধ কাজ করা। আবু দাউদে আমর ইবনে আসের (রা.) রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে।। তাতে বলা হয়েছে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উভয় অবস্থায় নামায পড়তে দেখেছেন। মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদে আবু সাঈদ খুদরীর (রা.) রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। তাতে নবী (সা.) বলেছেনঃ “যখন তোমাদের কেউ মসজিদে আসে, সে যেন তার জুতা পরীক্ষা করে দেখে নেয়। যদি কোন নাপাকী লেগে থাকে তাহলে মাটিতে ঘসে পরিষ্কার করো এবং সে জুতা পরে নামায পড়ে নাও।” আবু হুরাইরার (রা.) রেওয়ায়াতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথাগুলো আছেঃ “যদি তোমাদের কেউ জুতা দিয়ে নাপাকী মাড়িয়ে থাকে তাহলে মাটি তাকে পাক করে দেবার জন্য যথেষ্ট।” আর হযরত উম্মে সালমাহ (রা.) বর্ণিত রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে يُطَهِّرُهُ مَا بَعْدَهُ অর্থাৎ “এক জায়গায় নাপাকী লেগে থাকলে অন্য জায়গায় যেতে যেতে মাটি নিজে নিজেই তাকে পাক করে দেবে।” এ বিপুল সংখ্যক হাদীসের কারণে ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম আওযায়ী ও ইসহাক ইবনে রাহাওয়াইয়াহ প্রমুখ ফকীহগণ এমত পোষণ করেন যে, জুতা সর্বাবস্থায় যমীনের মাটির সাহায্যে পাক হয়ে যায়। ইমাম আহমদ ও ইমাম শাফেঈর একটি উক্তিও এর সমর্থনে রয়েছে। কিন্তু ইমাম শাফেঈর সর্বজন পরিচিত উক্তি এর বিরোধী। সম্ভবত তিনি জুতা পরে নামায পড়া আদবের বিরোধী মনে করে তা করতে নিষেধ করেন। যদিও একথা মনে করা হয়েছে যে, তাঁর মতে জুতা মাটিতে ঘষলে পাক হয় না। (এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মসজিদে নববীতে চাটাইয়ের বিছানাও ছিল না বরং কাঁকর বিছানো ছিল। কাজেই এসব হাদীসের প্রমাণের ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তি আজ মসজিদের বিছানার ওপর জুতা পায়ে উঠতে চায় তাহলে তা সঠিক হবে না। তবে ঘাসের ওপর বা খোলা ময়দানে জুতা পায়ে নামায পড়তে পারে। তবে যারা মাঠে-ময়দানে জানাযার নামায পড়ার সময়ও পা থেকে জুতা খুলে ফেলার ওপর জোর দিতে থাকে তারা আসলে শরীয়াতের বিধান জানে না।)
# সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, “তুওয়া” ছিল এই উপত্যকাটির নাম। কিন্তু কোন কোন মুফাসসির “পবিত্র তুওয়া উপত্যকা” অর্থ করেছেন, “এমন উপত্যকা যাকে একটি সময়ের জন্য পবিত্র করা হয়েছে”
# এখানে নামাযের মূল উদ্দেশ্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। মানুষ যেন আল্লাহ থেকে গাফেল না হয়ে যায়। দুনিয়ার চোখ ধাঁধানো দৃশ্যাবলী যেন তাকে এ সত্য বিমুখ না করে দেয় যে, সে কারো বান্দা এবং সে স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন নয়। এ চিন্তাকে জীবন্ত ও তরতাজা রাখার এবং আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক জড়িত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে নামায। প্রতিদিন কয়েকবার মানুষকে দুনিয়ার কাজকারবার থেকে সরিয়ে নামায তাকে আল্লাহর দিকে নিয়ে যায়।
কেউ কেউ এর এ অর্থও নিয়েছেন যে, নামায কায়েম করো যাতে আমি তোমাকে স্মরণ করতে পারি, যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ “আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাকে স্মরণে রাখবো।”
আনুসঙ্গিকভাবে এ আয়াত থেকে এ বিধানটিও বের হয় যে, যে ব্যক্তি ভুলে যায় তার যখনই মনে পড়বে তখনই নামায পড়ে নেয়া উচিত। হাদীসে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করা হয়েছেঃ নবী ﷺ বলেছেনঃ
مَنْ نَسِىَ صَلاَةً فَلْيُصَلِّ إِذَا ذَكَرَهَا ، لاَ كَفَّارَةَ لَهَا إِلاَّ ذَلِكَ
“কোন ব্যক্তি কোন সময় নামায পড়তে ভুলে গিয়ে থাকলে যখন তার মনে পড়ে যায় তখনই নামায পড়ে নেয়া উচিত। এছাড়া এর আর কোন কাফফারা নেই।” (বুখারী, মুসলিম, আহমদ)
এ অর্থে হযরত আবু হুরাইরার (রা.) একটি হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এটি তাঁদের হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। আবু কাতাদাহ (রা.) বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি আমরা নামাযের সময় ঘুমিয়ে থাকি তাহলে কি করবো” জবাবে তিনি বলেন, “ঘুমের মধ্যে কোন দোষ নেই। দোষের সম্পর্ক তো জেগে থাকা অবস্থার সাথে। কাজেই যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ভুলে যাবে অথবা ঘুমিয়ে পড়বে তখন জেগে উঠলে বা মনে পড়লে তৎক্ষণাৎ নামায পড়ে নেবে।” (তিরমিযী, নাসাঈ, আবু দাউদ)
# তাওহীদের পরে যে দ্বিতীয় সত্যটি প্রত্যেক যুগে সকল নবীর সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে এবং যার শিক্ষা দেবার জন্য তাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছে সেটি হচ্ছে আখেরাত। এখানে কেবলমাত্র এ সত্যটি বর্ণনা করাই হয়নি বরং এর উদ্দেশ্যের ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে। এ প্রতীক্ষিত সময়টি আসার কারণ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি দুনিয়ায় যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং যে কাজ করেছে তার প্রতিদান পাবে সে আখেরাতে। তবে পরীক্ষার উদ্দেশ্য পূর্ণ করার লক্ষে সে সময়টি গোপন রাখা হয়েছে। যার আখেরাতের সামান্য চিন্তা থাকবে সে সব সময় এ সময়টির কথা ভাববে এবং এ ভাবনা তাকে ভুল পথে চলা থেকে রক্ষা করবে। আর যে ব্যক্তি বৈষয়িক কাজ কর্মের মধ্যে হারিয়ে যেতে চাইবে সে এ চিন্তার মধ্যে ডুবে যাবে যে, কিয়ামত এখনো অনেক দূরে, বহুদূরে ও তার আসার কোন চিহ্ণই দেখা যায় না।
# জ্ঞান লাভ করার বা জানার জন্য এ প্রশ্ন ছিল না। বরং আল্লাহ জানতেন হযরত মূসার হাতে যে লাঠি আছে অন্য কিছু নয় এ ব্যাপারে যেন তিনি নিশ্চিত হয়ে যান এবং এরপর দেখেন আল্লাহর কুদরতের খেলা কিভাবে শুরু হয়।
# যদিও জবাবে শুধুমাত্র এতটুকু বলে দেয়াই যথেষ্ট ছিল যে, জনাব, এটা একটা লাঠি। কিন্তু হযরত মূসা এ প্রশ্নের যে লম্বা জবাব দিলেন তা তাঁর সে সময়কার মানসিক অবস্থার একটা চমৎকার ছবি তুলে ধরেছে। সাধারণত দেখা যায়, মানুষ যখন কোন বড় ব্যক্তির সাথে কথা বলার সুযোগ পায় তখন নিজের কথা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করে, যাতে তার সাথে বেশীক্ষণ কথা বলার সৌভাগ্য লাভ করা যায়।
# সূর্যের আলোর মতো আলো হবে কিন্তু এর ফলে তোমার কোন কষ্ট হবে না। বাইবেলে সাদা হাতের ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং সেখান থেকে আমাদের তাফসীরগুলোতেও এর প্রচলন হয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসা যখন বগলে হাত রেখে বাইরে বের করলেন তখন দেখা গেলো পুরো হাতটাই কুষ্ঠরোগীর হাতের মতো সাদা হয়ে গেছে। তারপর আবার যখন তা বগলে রাখলেন তখন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। এ মুজিযাটির এ ব্যাখ্যাই তালমুদেও বর্ণিত হয়েছে এবং এর গূঢ় তত্ত্ব বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ফেরাউনের কুষ্ঠরোগ ছিল এবং এ রোগ সে লুকিয়ে রেখেছিল। আহ তার সামনে এ মুজিযা পেশ করে তাকে দেখানো হয়েছে যে, দেখো মুহূর্তের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ সৃষ্টি করে মুহূর্তের মধ্যেই তা নিরাময় করা যায়। কিন্তু প্রথমত ভারসাম্যপূর্ণ রুচিশীলতা কোন নবীকে কুষ্ঠরোগের মুজিযা দিয়ে এক বাদশাহর দরবারে পাঠানোর ব্যাপারটিই গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। দ্বিতীয়ত ফেরাউনের যদি অপ্রকাশ্য কুষ্ঠরোগ থেকে থাকে তাহলে কুষ্ঠরোগীর সাদা হাত শুধুমাত্র তার একার জন্য মুজিযা হতে পারে, তার সভাসদদের ওপর এ মুজিযার কী প্রভাব পড়বে” কাজেই সঠিক কথা এটাই, যা আমরা উপরে বর্ণনা করেছি। অর্থাৎ তাঁর হাত সূর্যালোকের মতে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠতো এবং চোখ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো না। প্রথম যুগের মুফাসসিরদের অনেকেই এ অর্থ গ্রহণ করেছেন।
# আমার মনে এ মহান দায়িত্বভার বহন করার মতো হিম্মত সৃষ্টি করে দাও। আমার উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়িয়ে দাও। যেহেতু হযরত মূসাকে (আ) একটি অনেক বড় কাজের দায়িত্ব সোপর্দ করা হচ্ছিল যা করার জন্য দুরন্ত সাহসের প্রয়োজন তাই তিনি দোয়া করেন, আমাকে এমন ধৈর্য, দৃঢ়তা, সংযম, সহনশীলতা, নির্ভীকতা ও দুর্জয় সংকল্প দান করো যা এ কাজের জন্য প্রয়োজন।
# বাইবেলে এর যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসা বললেনঃ “হায় সদাপ্রভু! আমি বাকপটু নহি, ইহার পূর্বও ছিলাম না, বা এই দাসের সহিত তোমার আলাপ করিবার পরেও নহি। কারণ আমি জড় মুখ ও জড় জিহ্বা। (যাত্রাপুস্তক ৪: ১০) কিন্তু তালমূদে এ সম্পর্কিত একটি দীর্ঘ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তাতে একথা বলা হয়েছে যে, শৈশবে হযরত মূসা যখন ফেরাউনের গৃহে লালিত পালিত হচ্ছিলেন তখন একদিন তিনি ফেরাউনের মাথার মুকুট নামিয়ে নিজের মাথায় পরে নেন। এতে প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এ শিশু এ কাজটি ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে, অথবা এটা তার নিছক বালকসুলভ চপলতা। শেষে ঠিক করা হয়, শিশুর সামনে সোনা ও আগুন একসাথে রাখা হবে। সে মোতাবেক দু’টি জিনিস এনে একসাথে সামনে রাখা হলো এবং হযরত মূসা আগুন উঠিয়ে মুখে পুরে দিলেন। এতে তিনি কোন রকমে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার জিহ্বায় চিরদিনের জন্য জড়তা সৃষ্টি হয়।
এ কাহিনী ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আমাদের তাফসীর প্রন্থগুলোতেও লিখিত হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি এ কথা মেনে নিতে অস্বীকার করে। কারণ শিশু যদি আগুনে হাত দিয়েও ফেলে তাহলে এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, সে অঙ্গার উঠিয়ে নিয়ে মুখের মধ্যে পুরে দেবে। শিশু তো আগুনের জ্বালা অনুভব করার সাথে সাথেই হাত গুটিয়ে নেবে। পোড়া হাতে অঙ্গার নিয়ে সে অংগার মুখে দেবার অবকাশ পাবে কেমন করে? কুরআনের শব্দাবলী থেকে আমরা যে কথা বুঝতে পারি তা হচ্ছে এই যে, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম নিজের মধ্যে বাগ্মীতার অভাব দেখছিলেন। ফলে তাঁর মনেআশঙ্কা জেগেছিল যে, নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি তাঁর কখনো বক্তৃতা দেবার প্রয়োজন দেখা দেয় (এ পর্যন্ত যার কোন প্রয়োজন তাঁর দেখা দেয়নি) তাহলে তাঁর স্বভাবসুলভ সংকোচ বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই তিনি দোয়া করেন, হে আল্লাহ। আমার জিভের জড়তা দূর করে দাও যাতে আমি নিজের কথা লোকদেরকে ভালোভাবে বুঝাতে পারি। এ বিষয়েই ফেরাউন একবার তাঁকে খোঁটা দিয়ে বলেছিলঃ “এ ব্যক্তি তো নিজের কথাই সঠিকভাবে বলতে পারে না।” (لَا يَكَادُ يُبِينُ যুখরুফ ৫২ ) এ দুর্বলতা অনুভব করেই হযরত মূসা নিজের ভাই হারুনকে সাহায্যকারী হিসেবে চান। সূরা কাসাসে তার এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে যে,
وَأَخِي هَارُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا
“আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে বাকপটু তাকে সাহায্যকারী হিসেবে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও।” আল কাসাসঃ আয়াত ৩৪ ।)
পরবর্তী আলোচনায় আরো জানা যায় যে, হযরত মূসার এ দুর্বলতা দূর হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি বেশ জোরদার ভাষণ দিতে শুরু করেছিলেন। কুরআনে ও বাইবেলে তাঁর পরবর্তীকালের যেসব ভাষণ উদ্ধৃত হয়েছে তা উন্নত পর্যায়ের শাব্দিক অলংকার ও বাকপটুতার সাক্ষ্য দেয়।
জিভে জড়তা আছে এমন একজন তোতলা ব্যক্তিকে আল্লাহ নিজের রসূল নিযুক্ত করবেন, একথা স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি বিরোধী। রসূলরা সব সময় এমন ধরনের লোক হয়েছেন যারা চেহারা, সুরত ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতার দিক দিয়ে হয়েছেন সর্বোত্তম, যাদের ভেতর বাইরের প্রতিটি দিক অন্তর ও দৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছে। কোন রসূলকে এমন কোন দোষ সহকারে পাঠানো হয়নি এবং পাঠানো যেতে পারতো না যে কারণে তিনি লোকদের মধ্যে হাস্যাস্পদ হন অথবা লোকেরা তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে।
# বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে হযরত হারুন হযরত মূসার চাইতে তিন বছরের বড় ছিলেন। (যাত্রা পুস্তক ৭: ৭) ।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৯-১০ নং আয়াতের তাফসীর:
এখান থেকে হযরত মূসার (আঃ) ঘটনা শুরু হচ্ছে। এটা হলো ঐ সময়ের ঘটনা যখন তিনি সেই সময়কাল পূর্ণ করেছিলেন যা তার মধ্যে তার শ্বশুর (হযরত শুআইব (আঃ) এর মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। তিনি তার পরিবারবর্গকে সঙ্গে নিয়ে দশ বছরেরও বেশী সময়ের পরে নিজের দেশ মিসর অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন। শীতের রাত্রি ছিল এবং তাঁরা পথও ভুলে গিয়েছিলেন। তারা পাহাড়ের ঘাটির মাঝে ছিলেন। অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছিল। আকাশে মেঘও ছিল। তিনি চকমকি পাথরের দ্বারা আগুন বের করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই আগুন বের হলো না। তিনি এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করলেন। ডানদিকের পাহাড়ের উপর তিনি কিছু আগুন দেখতে পেলেন। তখন তিনি তার স্ত্রীকে বললেনঃ “আমি যাচ্ছি এবং আগুনের কিছু অঙ্গার নিয়ে আসছি, যাতে তুমি আগুন পোহাতে পার এবং কিছু আলোরও কাজ দিতে পারে। আর এরও সম্ভাবনা আছে যে, সেখানে কেনি মানুষকে পাওয়া যাবে যে আমাদেরকে পথ বাতলিয়ে দেবে। মোট কথা, পথের ঠিকানা অথবা আগুন পাওয়া যাবেই।”
১১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ হযরত মূসা (আঃ) যখন আগুনের কাছে পৌঁছলেন তখন ঐ বরকতময় মাঠের ডান দিকের গাছগুলির নিকট থেকে শব্দ আসলোঃ হে মূসা (আঃ)! আমি তোমার প্রতিপালক। তুমি তোমার পায়ের জুতা খুলে ফেলো। তাকে জুতা খুলে ফেলার নির্দেশ দেয়ার কারণ হয়তো এই যে, তার ঐ জুতা গাধার চামড়া দ্বারা নির্মিত ছিল, কিংবা হয়তো ঐ স্থানের সম্মানের কারণেই এই নিদের্শ দেয়া হয়েছিল যেমন কাবা গৃহে প্রবেশের সময় লোকেরা জুতা খুলে নেয়। অথবা ঐ বরকতময় জায়গায় পা পড়বে বলেই তাকে এই হুকুম দেয়া হয়। আরো কারণ বর্ণনা করা হয়েছে।
ঐ উপত্যকার নাম ছিল তুওয়া। কিংবা ভাবার্থ হচ্ছেঃ তুমি তোমার পা এই যমীনের সাথে মিলিয়ে নাও। অথবা ভাবার্থ হলোঃ এই যমীনকে কয়েকবার পাক করা হয়েছে এবং তাতে বরকত পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে বারবার করা হয়েছে এর পুনরাবৃতি। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই সঠিকতম। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে পবিত্র তুওয়া উপত্যকায় আহবান করেন। (৭৯:১৬)
মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তোমাকে (রাসূল রূপে) মনোনীত করেছি। এই সময়ের সমস্ত লোকের উপর আমি তোমার মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছি। বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তাআলা হযরত মূসাকে (আঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের উপর মর্যাদা দান করে তোমার সাথে আমি কথা বলেছি এর কারণ তুমি জান কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! এর কারণ তো আমার জানা নেই। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে বলেনঃ “এর কারণ এই যে, তোমার মত কেউ আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে নাই।” এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যা ওয়াহী প্রেরণ করা হচ্ছে তুমি তা মনোযোগের সাথে শ্রবণ কর। আমিই তোমার মা’বূদ, আমি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। এটাই হলো তোমার প্রথম কর্তব্য যে, তুমি শুধু আমারই ইবাদত করবে। আর কারো কোন প্রকারের ইবাদত করবে না। আমাকে স্মরণার্থে নামায কায়েম কর। আমাকে স্মরণ করার সর্বোত্তম পন্থা হলো এটাই। অথবা এটা ভাবার্থ হবেঃ যখন আমাকে স্মরণ হবে তখন নামায কায়েম কর। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের যদি কারো ঘুম এসে যায় বা গাফেল হয়ে পড়ে তবে যখন স্মরণ হয়ে যাবে তখন যেন নামায পড়ে নেয়। কেননা, আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ “আমার স্মরণাথে তোমরা নামায কায়েম কর।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি নামায হতে ঘুমিয়ে পড়ে বা ভুলে যায় সে যেন স্মরণ হওয়া মাত্রই তা আদায় করে নেয়। তার কাফফারা এটা ছাড়া আর কিছুই নয়।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, আমি এটা গোপন রাখতে চাই যাতে প্রত্যেকেই নিজ কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে। এক কিরআতে (আরবী) এর পরে (আরবী) শব্দও রয়েছে। কেননা আল্লাহ তাআলার সত্ত্বা হতে কোন কিছু গোপন নেই। সুতরাং অর্থ হবেঃ এর জ্ঞান আমি আমা ছাড়া আর কাউকেও প্রদান করবো না। কাজেই সারা ভূ-পৃষ্ঠে এমন কেউ নেই যার কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার নির্ধারিত সময় জানা আছে। এটা এমন একটা বিষয় যে, সম্ভব হলে আমি নিজ হতেও ওটাকে গোপন রাখতাম। কিন্তু আমার কাছে কোন কিছু গোপন থাকা সম্ভব নয়। এটা ফেরেশতাদের হতেও গোপন আছে এবং নবীরাও এটা জানেন না। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ (হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাওঃ আল্লাহ ছাড়া আসমান ও যমীনবাসীদের কেউই গায়েবের খবর জানে না।” (২৭:৬৫) অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ কিয়ামত) আসমানে ও যমীনে ভারী হয়ে গেছে, ওটা তোমাদের উপর হঠাৎ এসে যাবে।” (৭:১৮৭) অর্থাৎ এর অবগতি কারো নেই। এক কিরআতে (আরবী) রয়েছে। অরফা (রঃ) বলেনঃ “আমাকে হযরত সাঈদ ইবনু জুবাইর (রঃ) এভাবেই পড়িয়েছেন। এর অর্থ হলো (আরবী) অর্থাৎ আমি “ওটাকে প্রকাশ করবো।” সেইদিন প্রত্যেক আমলকারীকে তার আমলের প্রতিদান দেয়া হবে। তা অনুপরিমাণ পুণ্যই হোক অথবা পাপই হোক। ঐদিন প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে।
সুতরাং যে ব্যক্তি কিয়ামতে বিশ্বাস করে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে কিয়ামতে বিশ্বাস স্থাপন হতে নিবৃত্ত না করে। যদি সে তোমাকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হয়ে যায় তবে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।
১৭-২১ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে হযরত মূসার (আঃ) একটি খুবই বড় ওস্পষ্ট মু’জিযার বর্ণনা। দেয়া হচ্ছে, যা আল্লাহর ক্ষমতা ছাড়া অসম্ভম্ব এবং যা নবী ছাড়া অন্যের হাতেও সন্ত্র নয়। তূর পাহাড়ের উপর তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছেঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার ডান হাতে ওটা কি? হযরত মূসার (আঃ) ভয়-ভীতি দূর করার জন্যেই তাঁকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। একথাও বলা হয়েছে যে, এটা ছিল আলোচনা মূলক প্রশ্ন। অর্থাৎ তোমার হাতে লাঠিই আছে। এটা যে কি তা তুমি ভালরূপেই জান। এখন এটা যা হতে যাচ্ছে তা তুমি দেখে নাও।
এই প্রশ্নের জবাবে হযরত মূসা কালীমুল্লাহ (আঃ) বলেনঃ ‘এটা আমার লাঠি। এর উপর আমি ভর দিয়ে দাড়াই। অর্থাৎ চলার সময় এটা আমার একটা আশ্রয় স্থলরূপে কাজে লাগে। এর দ্বারা আমি আমার বকরীর জন্যে গাছ হতে পাতা ঝরিয়ে থাকি।’ এরূপ লাঠিতে কিছু লোহা লাগানো হয়ে থাকে। এর ফলে গাছের পাতা ও ফল সহজে ঝরানো যায় এবং লাঠি ভেঙ্গেও যায় না। তিনি বললেন যে, এই লাঠি দ্বারা তিনি আরো অনেক উপকার লাভ করে থাকেন। এই উপকার সমূহের বর্ণনায় কতকগুলি লোক একথাও বলেছেন যে, ঐ লাঠিটিই রাত্রি কালে উজ্জল প্রদীপরূপে কাজ করতো। দিনের বেলায় যখন হযরত মূসা (আঃ) ঘুমিয়ে পড়তেন তখন ঐ লাঠিটিই তার বকরীগুলির রাখালী করতো। কোন জায়গায় ছায়া না থাকলে তিনি লাঠি মাটিতে গেড়ে দিতেন, তখন ওটা তাঁবুর মত তাঁকে ছায়া করতো, ইত্যাদি বহু উপকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এগুলো বানী ইসরাঈলের বানানো কাহিনী। তা না হলে ঐ লাঠিকে সাপ হতে দেখে। হযরত মূসা (আঃ) এতো ভয় পাবেন কেন? উনি তো লাঠিটির বিস্ময়কর কাজ পূর্ব হতেই দেখে আসছিলেন। কারো কারো উক্তি এই যে, প্রকৃতপক্ষে ওটা ছিল হযরত আদমের (আঃ) লাঠি। কেউ কেউ বলেন যে, লাঠিটি কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দাব্বাতুল আরদ রূপে প্রকাশিত হবে। বলা হয়েছে যে, ওটার নাম ছিল মাশা। এ সব উক্তির সত্যতা কতটুকু তা আল্লাহ তাআলাই জানেন। হযরত মূসাকে (আঃ) তাঁর লাঠিটির লাঠি হওয়ার কথা জানিয়ে দিয়ে তাকে সতর্ক করতঃ বলেনঃ “ওটাকে যমীনের উপর নিক্ষেপ কর।” যমীনে নিক্ষিপ্ত হওয়া মাত্র লাঠিটি বিরাট অজগর সাপে পরিণত হয় এবং এদিক ওদিক চলতে শুরু করে দেয়। ইতিপূর্বে এতো ভয়াবহ অজগর সাপ কেউ কখনোদেখে নাই। সাপটির অবস্থা তো এই ছিল যে, সামনে একটি গাছ পড়লেই তা সে খেয়ে ফেলে। পথে বড় পাথর পড়লে তা গ্রাস করে নেয়। এ অবস্থা দেখা মাত্রই হযরত মূসা (আঃ) পিছন ফিরে পালাতে শুরু করেন। শব্দ আসেঃ “হে মূসা (আঃ) ! ওটা ধরে নাও।” কিন্তু তার সাহস। হয় না। আবার আওয়াজ আসেঃ “হে মূসা (আঃ)! ভয় করো না, ধরে ফেলো।” তখন তাঁর সংশয় থেকে যায়। তৃতীয়বার বলা হয়ঃ “তুমি আমার নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে। এবার তিনি হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে নেন।
বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তাআলার নির্দেশের সাথে সাথেই হযরত মূসা (আঃ) লাঠিটি মাটিতে ফেলে দেন। তারপর তার দৃষ্টি এদিক ওদিক চলে যায়। অতঃপর দেখেন যে, লাঠির পরিবর্তে একটি ভয়াবহ অজগর সাপ রয়ে গেছে এবং তা এমনভাবে চলা ফেরা করছে যে, যেন কাউকে খুঁজছে। বড় বড় পাথরকে সে খেয়ে ফেলছে এবং আকাশচুম্বী বড় বড় গাছকেও গ্রাস করে নিচ্ছে। ওর চক্ষু দুটি আগুনের অঙ্গারের মত জ্বল জ্বল করছে। ওটা এতো ভয়াবহ অজগর যে, হযরত মূসা (আঃ) ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পিছন ফিরে পালিয়ে যেতে শুরু করেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলার সাথে কথা বলার বিষয়টি স্মরণ হয়ে তিনি থমকে দাড়ান। ওখানেই শব্দ আছেঃ “হে মূসা (আঃ)! ফিরে গিয়ে যেখানে ছিলে সেখানেই এসে যাও।” তিনি ফিরে আসেন, কিন্তু অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা নিদের্শ দেনঃ “তুমি ওটা তোমার ডান হাত দ্বারা ধরে নাও এবং ভয় করো না। আমি ওকে ওর আসল অবস্থায় ফিরিয়ে দেবো।” ঐ সময় হযরত মূসা (আঃ) পশমের কম্বল গায়ে জড়িয়ে ছিলেন। ওটাকে তিনি ঐ কম্বলখানা হাতে জড়িয়ে ঐ ভয়াবহ সাপটিকে ধরার ইচ্ছা করেন। তখন ফেরেশতা তাঁকে বলেনঃ “হে মূসা (আঃ)! যদি আল্লাহ তাআলা সাপটিকে দংশন করার হুকুম দেন তবে কি এই কম্বল আপনাকে রক্ষা করতে পারবে?” তিনি জবাবে বলেনঃ “কখনো নয়। কিন্তু আমার দুর্বলতার কারণেই এ কাজ আমার দ্বারা হতে যাচ্ছিল। আমাকে খুবই দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে।” অতঃপর তিনি কম্বল সরিয়ে দিয়ে সাহসিকতার সাথে সাপটির মাথা ধরে নেন। তৎক্ষণাৎ সাপটি আবার লাঠিতে পরিণত হয়ে যায়, যেমন পূর্বে ছিল। যখন তিনি পাহাড়ের মাটির উপর উঠছিলেন এবং তাঁর হাতে লাঠিটি ছিল,যার উপর তিনি ভর করে দাঁড়িয়েছিলেন ঐ অবস্থাতেই তিনি লাঠিটিকে পূর্বে দেখেছিলেন। ঐ অবস্থাতেই ওটা তার হাতে লাঠির আকারে বিদ্যমান ছিল।
২২-৩৫ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত মূসাকে (আঃ) দ্বিতীয় মুজিযা দেয়া হচ্ছে। তাঁকে বলা হচ্ছেঃ ‘তোমার হাতখানা বগলে ফেলে আবার তা বের করে নাও। তুমি দেখবে যে, ওটা চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল ও জ্যোতির্ময় হয়ে বেরিয়ে আসবে। এটা নয় যে, ওটা শ্বেত কুষ্ঠের শুভ্রতা হবে, বা অন্য কোন রোগ অথবা দোষের কারণে সাদা হবে।’ অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) যখন বগলে হাত রেখে তা বের করে নেন তখন দেখা যায় যে, প্রদীপের ন্যায় উজ্জ্বল ও ঝকমকে হয়ে গেছে। এর ফলে তিনি যে আল্লাহ তাআলার সাথে কথা বলছেন এই বিশ্বাস তার আরো বৃদ্ধি পেলো। এ দুটো মু’জিযা তঁাকে এখানে প্রদানের কারণ এই যে, যেন তিনি আল্লাহর যবরদস্ত নিদর্শনগুলি দেখে তার অসীম ক্ষমতার প্রতি পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা হযরত মূসাকে (আঃ) নির্দেশ দিলেনঃ ফিরাউন আমার চরম বিদ্রোহী হয়ে গেছে। তুমি তার কাছে গিয়ে তাকে বুঝাতে থাকো।
হযরত অহাব (রঃ) বলেন যে, হযরত মূসাকে (আঃ) আল্লাহ তাআলা। খুবই নিকটবর্তী হওয়ার নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ঐ গাছের গুঁড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে যান। তাঁর হৃদয় প্রশান্ত হয়ে যায়। ভয়-ভীতি দূরীভূত হয়। হাত দুটি স্বীয় লাঠির উপর রেখে, মাথা ঝুঁকিয়ে এবং গ্রীবা নীচু করে অত্যন্ত আদবের সাথে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা তিনি শুনতে লাগলেন। মহান আল্লাহ তাকে বললেনঃ মিসরের বাদশাহ ফিরাউনের কাছে তুমি আমার পয়গাম নিয়ে যাও। সেখান থেকে তুমি পালিয়ে এসেছিলে। তাকে তুমি বল যে, সে যেন, আমারই ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকেও শরীক না। করে। বানী ইসরাঈলের সাথে যেন সৎ ব্যবহার করে এবং তাদের প্রতি অনুগ্রহ করে। তাদেরকে যেন কষ্ট না দেয়। ফিরআউন চরম বিদ্রোহী হয়ে গেছে। সে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আখেরাতকে সে সম্পূর্ণরূপে ভুলে বসেছে। হে মূসা (আঃ)! তুমি আমার রিসালাত নিয়ে তার কাছে গমন কর। আমার চক্ষু ও কর্ণ তোমার সাথেই রইলো। আমি তোমাকে সদা দেখতে শুনতে থাকবো। সব সময় আমার সাহায্য তোমার সাথে থাকবে। আমার পক্ষ হতে আমি দলীল প্রমাণাদি প্রদান করেছি এবং তোমাকে দৃঢ় ও মজবুত করেছি। তুমি একাই আমার বিরাট সেনাবাহিনী। আমার এক দুর্বল বান্দার কাছে আমি তোমাকে প্রেরণ করছি। সে আমার নিয়ামত রাশি পেয়ে সবই ভুলে বসেছে। সে আমার পাকড়াওকেও বিস্মরণ হয়েছে। দুনিয়ার মোহে পড়ে সে চরম অহংকারী হয়ে বসেছে। সে আমাকে পালনকর্তা, সৃষ্টিকর্তা এবং উপাস্য বলে স্বীকার করছে না। সে আমার দিক থেকে চক্ষু ফিরিয়ে নিয়েছে। সে আমা থেকে বিমুখ হয়েছে এবং আমার পাকড়াওকে ভুলে গেছে। আমার শাস্তি হতে সে নির্ভয় হয়েছে। আমার মর্যাদার শপথ! আমি যদি তাকে অবকাশ দিতে না চাইতাম তবে তার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়তে এবং যমীন তাকে গ্রাস করে নিতো। সমুদ্রও তাকে নিজের মধ্যে নিমজ্জিত করতো। কিন্তু আমার সাথে মুকাবিলা করার শক্তি তার নেই এবং সব সময় সে আমার ক্ষমতাধীন রয়েছে বলেই আমি তাকে ঢিল দিয়ে রেখেছি। আমি তো তাকে কোন পরওয়াই করি না। আমি সমস্ত মাখলুক হতে তো সম্পূর্ণ রূপে অমুখাপেক্ষী ও অভাবমুক্ত। সত্য এটাই যে, একমাত্র আমিই সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী ও অভাবমুক্ত। শুধুমাত্র আমিই এইগুণের অধিকারী। হে মূসা (আঃ)! তুমি রিসালাতের দায়িত্ব পালন কর। তুমি ফিরাউনকে আমার ইবাদতের হিদায়াত কর, তাওহীদ ও ইখলাসের দাওয়াত দাও, আমার নিয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দাও, আমার শাস্তি হতে ভয় প্রদর্শন কর এবং আমার গযব হতে সতর্ক করে দাও। আমি রাগান্বিত হলে আর পরিত্রাণ নেই। তুমি তাকে নম্রতার সাথে বুঝাতে থাকো। তাকে আমার দান এবং দয়া দাক্ষিণ্যের খবর দিয়ে দাও। তাকে জানিয়ে দাও যে, এখানে যদি সে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে আমি তার সমস্ত দুষ্কর্মের পাপ মার্জনা করবো। আমার গারের উপর আমার রহমত বিজয়ী। সাবধান! তুমি তার জাকজমক ও শান শওকতের প্রভাবে পড়ে যেয়ো না। তার চুলের খোপা আমার হাতেই রয়েছে। তার মুখ চলতে পারে না, তার হাত উঠতে পারে না, তার চোখের পাতা নড়তে পারে না এবং সে শ্বাস গ্রহণ করতে পারে না যে পর্যন্ত না আমি অনুমতি দিই। তাকে বুঝিয়ে বল যে, যদি সে আমাকে মেনে নেয় তবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। চারশ’ বছর ধরে সে আমার বিরুদ্ধাচরণ করতে রয়েছে। আমার বান্দাদের উপর জুলুম ও নির্যাতন চালাচ্ছে এবং জনগণকে আমার ইবাদত থেকে ফিরিয়ে রাখছে, তথাপি আমি তার উপর বৃষ্টি বন্ধ করি নাই, ফসল উৎপাদন বন্ধ রাখি নাই, তাকে রোগাক্রান্ত করি নাই, বৃদ্ধ করি নাই এবং পরাভূত করি নাই। ইচ্ছা করলে আমি তাকে জুলুমের সাথে পাকড়াও করতাম। কিন্তু আমার সহনশীলতা খুব বেশী। হে মূসা (আঃ)! তুমি তোমার ভাই (হারূণ (আঃ) কে সঙ্গে নিয়ে তার কাছে। যাও এবং পূর্ণভাবে জিহাদ কর। তোমরা আমার সাহায্যের উপর ভরসা কর। আমি ইচ্ছা করলে আমার সৈন্য সামন্ত পাঠিয়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু আমি তাকে দেখাতে চাই যে, আমার জামাআতের একজনও সারা ভূ পৃষ্ঠের শক্তিশালীদের উপর বিজয় লাভ করতে সক্ষম। সাহায্য আমার অধিকারভূক্ত। তোমরা পার্থিব শান শওকতের। কি ওর প্রতি চোখ তুলে তাকাবেও না। আমি ইচ্ছা করলে তোমাকে এতো বেশী ধন সম্পদ দিতে পারি যে, ফিরাউনের ধন সম্পদ ওর ধারে পাশেও যাবে না। কিন্তু আমি আমার বান্দাদেরকে সাধারণতঃ গরীবই রাখি যাতে তাদের পরকাল সুন্দর ও কল্যাণকর হয়। তারা গরীব বলেই যে আমার কাছে। সম্মানের পাত্র নয় এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং আমি এটা এজন্যেই করি যে, যেন তাদের দুই জাহানের নিয়ামত রাশি পরজগতে একত্রিত হয়। আমার কাছে আমার বান্দার কোন আমল এতো বেশী ওজনসই হয় না যতো ওজনসই দুনিয়ার প্রতি উদাসীনতা। আমি আমার বিশিষ্ট বান্দাদেরকে প্রশান্তি এবং বিনয় নম্রতার পোশাক পরিয়ে থাকি। তাদের মুখমণ্ডল সিজদার ঔজ্জ্বল্যের উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এরাই হয় আল্লাহর সত্যিকারের বন্ধু। তাদের সামনে সবারই আদবের সাথে অবস্থান করা উচিত। নিজের জিহ্বা ও অন্তরকে তাদের অনুগত করা দরকার। জেনে রেখো যে, যারা আমার বন্ধুদের সাথে শত্রুতা রাখে তারা যেন আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। তা হলে তাদের এটা অনুধাবন করা উচিত যে, যারা আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করতে চায় তারা কি কখনো সফলকাম হতে পারে? কখনই না। আমি তাকে ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখে থাকি এবং তাকে ধ্বংস ও তছনছ করে দেই। আমার শত্রু কখনো আমার উপর বিজয় লাভ করতে পারে না। আমার বিরুদ্ধবাদীরা আমার কোনই ক্ষতি সাধন করতে পারে না। আমার বন্ধুদেরকে আমি নিজেই সাহায্য করে থাকি। তাদেরকে আমি শত্রুদের শিকার হতে দেই না। তাদেরকে আমি দুনিয়া ও আখেরাতে বিজয় দান করে থাকি এবং সব সময় তাদের উপর আমার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই।
হযরত মূসা (আঃ) তার শৈশবকাল ফিরাউনের বাড়ীতেই কাটিয়েছিলেন, এমনকি তার ক্রোড়েই শৈশবাবস্থা অতিবাহিত করেছিলেন। যৌবন পর্যন্ত মিসর রাজ্যে তার প্রাসাদেই অবস্থান করেছিলেন। অতঃপর তার অনিচ্ছাতেই একজন কিবতী তাঁর হাতে মৃত্যু বরণ করে। ফলে তিনি সেখান থেকে পলায়ন করেন। তখন থেকে তার ভূর পাহাড়ে সময়ে আগমন পর্যন্ত তিনি আর মিসরের মুখ দেখেন নাই। ফিরাউন একজন দুশ্চরিত্র ও কঠোর হৃদয়ের লোক ছিল। গর্ব ও অহংকার তার এতো বেড়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহকে তা সে বুঝতোই না। নিজের প্রজাদেরকে সে বলে দিয়েছিলঃ “তোমাদের খোদা আমিই। ধন সম্পদে, সৈন্য সামন্তে এবং অড়িম্বর ও জাকজমকে সারা দুনিয়ায় তার সমতুল্য আর কেউই ছিল না। তাকে হিদায়াত করার জনে আল্লাহ তাআলা যখন হযরত মূসাকে (আঃ) নির্দেশ দিলেন তখন তিনি তাঁর নিকট প্রার্থনা জানালেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমার বক্ষ খুলে দিন এবং আমার কাজকে সহজ করুন। আপনি আমাকে সাহায্য না করলে এতো বড় শক্ত কাজের দায়িত্ব বহন করা আমার পক্ষে সদ্য নয়। আমার জিহ্বার আড়ষ্টতা দূর করে দিন।”শৈশবাবস্থায় তাঁর সামনেখেজুর ও আগুনের অঙ্গার রাখা হয়েছিল। তিনি অঙ্গার উঠিয়ে নিয়ে মুখে পুরে দিয়েছিলেন বলে তাঁর জিহবায় আড়ষ্টতা এসে গিয়েছিল। তাই, তিনি প্রার্থনা করেছিলেনঃ “হে আল্লাহ! আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন।” এটা হযরত মূসার (আঃ) ভদ্রতার পরিচয় যে, তিনি জিহ্বা সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার জন্যে আবেদন জানাচ্ছেন না। বরং এই আবেদন করেছেন যে, যেন জিহ্বার জড়তা দূর হয়, যাতে লোকেরা তার কথা বুঝতে পারে। নবীগণ (আঃ) শুধুমাত্র প্রয়োজন পুরো করার জন্যেই প্রার্থনা করে থাকেন। এর বেশীর জন্যে তারা আবেদন জানান না। তাই হযরত মূসার (আঃ) জিহ্বায় কিছুটা জড়তা। থেকে গিয়েছিল। যেমন ফিরাউন বলেছিলঃ “আমি উত্তম, না এই ব্যক্তি? এতো গরীব ও তুচ্ছ এবং এতো পরিষ্কারভাবে কথাও বলতে পারে না।”
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, হযরত মূসা (আঃ) জিহ্বার একটি গিরা খুলে দেয়ার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। এবং তা পূর্ণ হয়েছিল। যদি তিনি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করে দেয়ার আবেদন জানাতেন তবে সেটাও পূর্ণ হতো। তিনি শুধু তার জিহ্বার ততটুকু জড়তা দূর করার প্রার্থনা করেছিলেন যাতে মানুষ তার কথা বুঝতে পারে।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ হযরত মূসার (আঃ) এই ভয় ছিল যে, না জানি হয়তো ফিরআউন তার উপর হত্যার অভিযোগ এনে তাকে হত্যা করে ফেলবে। তাই, তিনি নিরাপত্তার জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন এবং তা কবুলও হয়েছিল। তার জিহবায় জড়তা ছিল তা তিনি এই পরিমাণ পরিষ্কার করে দেয়ার জন্যে প্রার্থনা করেন যাতে লোকেরা তার কথা বুঝতে পারে। তার এ দুআও কবুল হয়। তারপর তিনি দুআ করেন যে, হারূণকে যেন (আঃ) নবী করে দেয়া হয়। তাঁর এ দুআও মঞ্জুর হয়।
বর্ণিত আছে যে, হযরত কাবের (রঃ) নিকট তার এক আত্মীয় এসে তাঁকে বলেঃ “এটা বড়ই লজ্জার কথা যে, আপনার মুখের কথা ত্রুটিপূর্ণ।” তখন হযরত কা’ব (রঃ) তাকে বলেনঃ “হে আমার ভ্রাতুস্পুত্র! আমার কথা কি তুমি বুঝতে পার না?” উত্তরে সে বলেঃ “হাঁ, বুঝতে পারি বটে।” হযরত কা’ব (রঃ) তখন বলেনঃ “তা হলে এই যথেষ্ট। হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে এটুকুর জন্যেই প্রার্থনা করেছিলেন।
এরপর হযরত মূসা (আঃ) প্রার্থনা করেনঃ “আমার প্রকাশ্য সাহায্যকারী হিসেবে আমার স্বজনবর্গের মধ্য হতে একজনকে নির্বাচিত করুন, অর্থাৎ আমার ভাই হারূণকে (আঃ) আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দিন এবং তাঁকে নুবওয়াত দান করুন।”
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, তখনই হযরত হারূণকে (আঃ) হযরত মূসার (আঃ) সাথে সাথেই নুবওয়াত দান করা হয়।
হযরত উরওয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একবার হযরত আয়েশা (রাঃ) উমরা করার উদ্দেশ্যে গমন করেন। তিনি একজন বেদুঈনের বাড়ীতে অবস্থান করেছিলেন এমন সময় তিনি শুনতে পান যে, একজন লোক প্রশ্ন করলোঃ “দুনিয়ায় কোন ভাই তার নিজের ভাইকে সবচেয়ে বেশী উপকৃত করেছিলেন?”তার এই প্রশ্ন শুনে সবাই নীরব হয়ে যায় এবং বলেঃ “আমাদের এটা জানা নেই।” ঐ লোকটি তখন বলেঃ “আল্লাহর শপথ! আমি ওটা জানি।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আমি মনে মনে বললামঃ এ লোকটি তো বৃথা সাহসীকতা প্রদর্শন করছে, ইনশা আল্লাহ না বলেই শপথ করে বসেছে!” জনগণ তখন তাকে বলেঃ “অচ্ছাি, তুমি বল দেখি?” সে উত্তরে বলেঃ “তিনি হলেন হযরত মূসা (আঃ) তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করে তার ভাই হারূণের (আঃ) নুবওয়াতের মঞ্জুরী নিয়ে নেন।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আমি নিজেও তার এই জবাব শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাই এবং মনে মনে বলি যে, লোকটি তো সত্য কথাই বলেছে। বাস্তবিকই হযরত মূসা (আঃ) অপেক্ষা কোন ভাই তার ভাইকে বেশী উপকৃত করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা সত্যই বলেছেন যে, মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে বড়ই মর্যাদাবান ছিলেন। (এটা মুসনাদে ইবন আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে)
এই প্রার্থনার কারণ বলতে গিয়ে হযরত মূসা (আঃ) বলেনঃ “এর দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় হবে। তিনি আমরা কাজে সহায়ক ও অংশীদার হিসেবে থাকবেন। যাতে আমার আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে পারি প্রচুর এবং আপনাকে স্মরণ করতে পারি অধিক।”
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, বান্দা আল্লাহ তাআলার অধিক যিকরকারী তখনই হয় যখন সে উঠতে, বসতে এবং শুইতে সর্বাবস্থাতেই আল্লাহর যিকরে নিমগ্ন থাকে।
হযরত মূসা (আঃ) বলেনঃ হে আল্লাহ! আপনি তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা এটা আপনার আমাদের প্রতি করুণা যে, আমাদেরকে আপনি নবীরূপে মনোনীত করেছেন এবং আপনার শত্রু ফিরাউনকে হিদায়াত করার জন্যে আমাদেরকে তার নিকট পাঠিয়েছেন। আমরা আপনারই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি এবং সমস্ত প্রশংসা আপনার জন্যেই বটে। আমাদের উপর আপনার যে নিয়ামতরাজি রয়েছে এ জন্যে আমরা আপনার নিকট বড়ই কৃতজ্ঞ।