أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৯৭)[ وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مَرْيَمَ
তুমি এই কিতাবে মারয়্যামের কথা বর্ণনা কর; ]
সূরা:- মরিয়ম।
সুরা:১৯
১৬-৪০ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
১৯:১৬
وَ اذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ مَرۡیَمَ ۘ اِذِ انۡتَبَذَتۡ مِنۡ اَہۡلِہَا مَکَانًا شَرۡقِیًّا ﴿ۙ۱۶﴾
তুমি এই কিতাবে মারয়্যামের কথা বর্ণনা কর; যখন সে তার পরিবারবর্গ হতে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্ব দিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল।
১৯:১৭
فَاتَّخَذَتۡ مِنۡ دُوۡنِہِمۡ حِجَابًا ۪۟ فَاَرۡسَلۡنَاۤ اِلَیۡہَا رُوۡحَنَا فَتَمَثَّلَ لَہَا بَشَرًا سَوِیًّا ﴿۱۷﴾
অতঃপর তাদের হতে সে নিজেকে পর্দা করল;[১] অতঃপর আমি তার নিকট আমার রূহ (জিবরীল)কে পাঠালাম, সে তার নিকট পূর্ণ মানুষ আকারে আত্মপ্রকাশ করল।
১৯:১৮
قَالَتۡ اِنِّیۡۤ اَعُوۡذُ بِالرَّحۡمٰنِ مِنۡکَ اِنۡ کُنۡتَ تَقِیًّا ﴿۱۸﴾
মারয়্যাম বলল, ‘আমি তোমা হতে পরম করুণাময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করছি; তুমি যদি সংযমশীল হও (তাহলে আমার নিকট থেকে সরে যাও)।’
১৯:১৯
قَالَ اِنَّمَاۤ اَنَا رَسُوۡلُ رَبِّکِ ٭ۖ لِاَہَبَ لَکِ غُلٰمًا زَکِیًّا ﴿۱۹﴾
সে বলল, আমি তো তোমার রব-এর দূত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য।
১৯:২০
قَالَتۡ اَنّٰی یَکُوۡنُ لِیۡ غُلٰمٌ وَّ لَمۡ یَمۡسَسۡنِیۡ بَشَرٌ وَّ لَمۡ اَکُ بَغِیًّا ﴿۲۰﴾
মারয়্যাম বলল, ‘কেমন করে আমার পুত্র হবে! যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করেনি; আর আমি ব্যভিচারিণীও নই।’
১৯:২১
قَالَ کَذٰلِکِ ۚ قَالَ رَبُّکِ ہُوَ عَلَیَّ ہَیِّنٌ ۚ وَ لِنَجۡعَلَہٗۤ اٰیَۃً لِّلنَّاسِ وَ رَحۡمَۃً مِّنَّا ۚ وَ کَانَ اَمۡرًا مَّقۡضِیًّا ﴿۲۱﴾
সে বলল, ‘এই ভাবেই হবে; তোমার প্রতিপালক বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং তাকে আমি এই জন্য সৃষ্টি করব, যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট হতে এক অনুগ্রহ; এটা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।’
১৯:২২
فَحَمَلَتۡہُ فَانۡتَبَذَتۡ بِہٖ مَکَانًا قَصِیًّا ﴿۲۲﴾
অতঃপর সে গর্ভে সন্তান ধারণ করল ও তাকে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল।
১৯:২৩
فَاَجَآءَہَا الۡمَخَاضُ اِلٰی جِذۡعِ النَّخۡلَۃِ ۚ قَالَتۡ یٰلَیۡتَنِیۡ مِتُّ قَبۡلَ ہٰذَا وَ کُنۡتُ نَسۡیًا مَّنۡسِیًّا ﴿۲۳﴾
অতঃপর প্রসব-বেদনা তাকে এক খেজুর-গাছের নীচে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বলল, ; ‘হায়। এর আগে যদি আমি মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতাম।
১৯:২৪
فَنَادٰىہَا مِنۡ تَحۡتِہَاۤ اَلَّا تَحۡزَنِیۡ قَدۡ جَعَلَ رَبُّکِ تَحۡتَکِ سَرِیًّا ﴿۲۴﴾
(জিবরীল) তার নিম্নপাশ হতে আহবান করে তাকে বলল, ‘তুমি দুঃখ করো না, তোমার নিম্নদেশে তোমার প্রতিপালক এক নদী সৃষ্টি করেছেন।
১৯:২৫
وَ ہُزِّیۡۤ اِلَیۡکِ بِجِذۡعِ النَّخۡلَۃِ تُسٰقِطۡ عَلَیۡکِ رُطَبًا جَنِیًّا ﴿۫۲۵﴾
‘আর তুমি তোমার দিকে খেজুর-গাছের কাণ্ডে নাড়া দাও, সেটা তোমার উপর তাজা-পাকা খেজুর ফেলবে।
১৯:২৬
فَکُلِیۡ وَ اشۡرَبِیۡ وَ قَرِّیۡ عَیۡنًا ۚ فَاِمَّا تَرَیِنَّ مِنَ الۡبَشَرِ اَحَدًا ۙ فَقُوۡلِیۡۤ اِنِّیۡ نَذَرۡتُ لِلرَّحۡمٰنِ صَوۡمًا فَلَنۡ اُکَلِّمَ الۡیَوۡمَ اِنۡسِیًّا ﴿ۚ۲۶﴾
সুতরাং আহার কর, পান কর ও চোখ জুড়াও; মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি তুমি দেখ, তাহলে বল, আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে চুপ থাকার মানত করেছি; সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে কথা বলব না।’
১৯:২৭
فَاَتَتۡ بِہٖ قَوۡمَہَا تَحۡمِلُہٗ ؕ قَالُوۡا یٰمَرۡیَمُ لَقَدۡ جِئۡتِ شَیۡئًا فَرِیًّا ﴿۲۷﴾
তারপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হল; তারা বলল, ‘হে মারইয়াম! তুমি তো এক অঘটন করে বসেছ ।
১৯:২৮
یٰۤاُخۡتَ ہٰرُوۡنَ مَا کَانَ اَبُوۡکِ امۡرَ اَ سَوۡءٍ وَّ مَا کَانَتۡ اُمُّکِ بَغِیًّا ﴿ۖۚ۲۸﴾
হে হারূন ভগ্নী!তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিল না এবং তোমার মাতাও ছিল না ব্যভিচারিণী।
১৯:২৯
فَاَشَارَتۡ اِلَیۡہِ ؕ قَالُوۡا کَیۡفَ نُکَلِّمُ مَنۡ کَانَ فِی الۡمَہۡدِ صَبِیًّا ﴿۲۹﴾
তখন মারইয়াম সন্তানের প্রতি ইংগিত করল। তারা বলল, ‘যে কালের শিশু তার সাথে আমারা কেমন করে কথা বলব?
১৯:৩০
قَالَ اِنِّیۡ عَبۡدُ اللّٰہِ ۟ؕ اٰتٰنِیَ الۡکِتٰبَ وَ جَعَلَنِیۡ نَبِیًّا ﴿ۙ۳۰﴾
(শিশুটি) বলল, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর দাস; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন।
১৯:৩১
وَّ جَعَلَنِیۡ مُبٰرَکًا اَیۡنَ مَا کُنۡتُ ۪ وَ اَوۡصٰنِیۡ بِالصَّلٰوۃِ وَ الزَّکٰوۃِ مَا دُمۡتُ حَیًّا ﴿۪ۖ۳۱﴾
‘যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে
১৯:৩২
وَّ بَرًّۢا بِوَالِدَتِیۡ ۫ وَ لَمۡ یَجۡعَلۡنِیۡ جَبَّارًا شَقِیًّا ﴿۳۲﴾
এবং আমার মাতার প্রতি অনুগত থাকতে। আর তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত, হতভাগ্য।
১৯:৩৩
وَ السَّلٰمُ عَلَیَّ یَوۡمَ وُلِدۡتُّ وَ یَوۡمَ اَمُوۡتُ وَ یَوۡمَ اُبۡعَثُ حَیًّا ﴿۳۳﴾
‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি , যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব।
১৯:৩৪
ذٰلِکَ عِیۡسَی ابۡنُ مَرۡیَمَ ۚ قَوۡلَ الۡحَقِّ الَّذِیۡ فِیۡہِ یَمۡتَرُوۡنَ ﴿۳۴﴾
এ-ই মারইয়াম-এর পুত্র ঈসা। আমি বললাম সত্য কথা, যে বিষয়ে তারা সন্দেহ পোষণ করছে।
১৯:৩৫
مَا کَانَ لِلّٰہِ اَنۡ یَّتَّخِذَ مِنۡ وَّلَدٍ ۙ سُبۡحٰنَہٗ ؕ اِذَا قَضٰۤی اَمۡرًا فَاِنَّمَا یَقُوۡلُ لَہٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ ﴿ؕ۳۵﴾
আল্লাহ্ এমন নন যে, কোন সন্তান গ্রহণ করবেন, তিনি পবিত্র মহিমাময়। তিনি যখন কিছু স্থির করেন, তখন সেটার জন্য বলেন, ‘হও’ তাতেই তা হয়ে যায়।
১৯:৩৬
وَ اِنَّ اللّٰہَ رَبِّیۡ وَ رَبُّکُمۡ فَاعۡبُدُوۡہُ ؕ ہٰذَا صِرَاطٌ مُّسۡتَقِیۡمٌ ﴿۳۶﴾
আর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার রব ও তোমাদের রব ; কাজেই তোমরা তাঁর ইবাদাত কর, এটাই সরল পথ ।
১৯:৩৭
فَاخۡتَلَفَ الۡاَحۡزَابُ مِنۡۢ بَیۡنِہِمۡ ۚ فَوَیۡلٌ لِّلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ مَّشۡہَدِ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۳۷﴾
অতঃপর দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করল , কাজেই দুর্ভোগ কাফেরদের জন্য মহাদিবস প্রত্যক্ষকালে।
১৯:৩৮
اَسۡمِعۡ بِہِمۡ وَ اَبۡصِرۡ ۙ یَوۡمَ یَاۡتُوۡنَنَا لٰکِنِ الظّٰلِمُوۡنَ الۡیَوۡمَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۳۸﴾
তারা যেদিন আমাদের কাছে আসবে সেদিন তারা কত চমৎকার শুনবে ও দেখবে ! কিন্তু যালেমরা আজ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে।’
১৯:৩৯
وَ اَنۡذِرۡہُمۡ یَوۡمَ الۡحَسۡرَۃِ اِذۡ قُضِیَ الۡاَمۡرُ ۘ وَ ہُمۡ فِیۡ غَفۡلَۃٍ وَّ ہُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۳۹﴾
আর তাদেরকে সতর্ক করে দিন পরিতাপের দিন সম্বন্ধে, যখন সব সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। অথচ তারা রয়েছে গাফলতিতে নিমজ্জিত এবং তারা ঈমান আনছে না।
১৯:৪০
اِنَّا نَحۡنُ نَرِثُ الۡاَرۡضَ وَ مَنۡ عَلَیۡہَا وَ اِلَیۡنَا یُرۡجَعُوۡنَ ﴿٪۴۰﴾
নিশ্চয় পৃথিবী ও তাতে যা কিছু আছে তার চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী আমিই এবং তারা আমারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।
১৬-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১৬-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ঈসা (عليه السلام)-এর মা মারইয়াম (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এ কুরআনে মারইয়ামের কথা বর্ণনা করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
انْتَبَذَتْ এর আসল অর্থ: দূরে নিক্ষেপ করা। انتباذ এর অর্থ লোকালয় থেকে নিরালায় চলে আসা। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে পরিবার ও লোকালয় থেকে আলাদা হয়ে বায়তুল মুকাদদাসের পূর্ব দিকে পর্দা টাঙ্গিয়ে নিরালায় অবস্থান নিলেন।
এমন সময় আল্লাহ জিবরীল (عليه السلام)-কে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে প্রেরণ করলেন। سَوِيًّا অর্থ পূর্ণাঙ্গ একজন পুরুষ, যিনি সুন্দর ও উত্তম অবয়বের অধিকারী। মারইয়াম (عليه السلام) তাকে মানুষ মনে করে ভয় পেয়ে গেলেন, হয়তো কোন অসৎ উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেছে, তাই তিনি বললেন: তুমি যদি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর তাহলে আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। জিবরীল (عليه السلام) বললেন: আপনি যা মনে করেছেন তা নয়, আমি আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত একজন দূত। আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে আপনাকে একটি পূতপবিত্র পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান করার জন্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ اللّٰهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِّنْهُ ق لا اسْمُهُ الْمَسِيْحُ عِيْسَي ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيْهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِيْنَ )
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তার পক্ষ থেকে এক কালিমার সুসংবাদ দিচ্ছেন, তার নাম হল মাসীহ, ঈসা ইবনু মারইয়াম। তিনি দুনিয়া এবং আখিরাতে সম্মানিত এবং নৈকট্যপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আলি-ইমরান ৩:৪৫)
মারইয়াম বললেন, কিভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ (বৈধ উপায়ে সহবাস) করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই। জিবরীল (عليه السلام) বললেন: এভাবেই হবে। অর্থাৎ যদিও গর্ভ ধারণের জন্য পুরুষের সাথে মিলন হওয়া আবশ্যক, তবুও এভাবে হবে। আপনার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার।
পৃথিবীর মানুষকে চার পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে: ১. পিতা-মাতা ছাড়া, যেমন আদম (عليه السلام), ২. শুধু পুরুষ হতে যেমন হাওয়া (عليه السلام)-কে আদম থেকে, ৩. ঈসা (عليه السلام)-কে মা থেকে পিতা ছাড়া এবং ৪. পিতা-মাতার মাধ্যমে বাকী আদম সন্তান।
(اٰيَةً لِّلنَّاسِ)
অর্থাৎ ঈসা (عليه السلام)-কে মানুষের একটি নিদর্শন বানাবেন যা আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের ওপর প্রমাণ বহন করে। যেমন সূরা আম্বিয়ার ৯১ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
অতঃপর মারইয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটি দূরবর্তী স্থানে চলে গেল। এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খেজুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন তিনি বললেন: হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম। কেননা মানুষ সন্তান সম্পর্কে প্রশ্ন করলে কী জবাব দেব? সবাই জানে আমি বিবাহিতা নই, আমি একজন ইবাদতকারিণী, তাহলে সন্তান জন্ম নিল কিভাবে?
(نَسْيًا مَّنْسِيًّا)
অর্থ মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়া, অর্থাৎ আমি মারইয়াম নামে দুনিয়াতে কোন নারী ছিলাম তা যদি মানুষের স্মৃতিপট থেকে মুছে যেতাম। এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে আওয়াজ দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ কর না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন।
سَرِيًّا অর্থ ছোট নদী বা ঝরনা। رُطَبًا جَنِيًّا অর্থ সিক্ত পরিপক্ক খেজুর। অর্থাৎ পায়ের নিচে ঝরনা দিলেন, খেজুর গাছে নাড়া দিলে সিক্ত পরিপক্ক খেজুর পড়ে যাবে, এসব কিছু মু’জিযাহ বা কারামতস্বরূপ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বললেন: খাও, পান কর আর সন্তান দেখে চোখ জুড়াও।
আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার জন্য সিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারো সাথে কোন কথাই বলব না।
অতঃপর মারইয়াম (عليه السلام) সন্তান প্রসবের পর শারীরিক সুস্থতা ফিরে আসলে সন্তানকে নিয়ে সম্প্রদায়ের কাছে আসলেন। তারা বলল: হে মারইয়াম! তুমি তো এক অদ্ভূত কাণ্ড করে বসেছ। হে হারূনের বোন! তোমার পিতা কোন অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না কিংবা তোমার মাতাও কোন ব্যভিচারিণী মহিলা ছিলেন না। সম্প্রদায়ের এ ধরণের কথা শুনে মারইয়াম তার সন্তানের দিকে ইঙ্গিত করল যে, এসব কথার জবাব সে দেবে। তারা বলল: এ কোলের শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলব?
(أُخْتَ هٰرُوْنَ)
এখানে হারূন বলতে মূসা (عليه السلام) এর ভাই হারূন নয়, বরং হারুন বলতে বানী ইসরাঈলের কোন একজন সৎ ব্যক্তি, মারইয়াম তার সহোদর বোন ছিলেন। (আযওয়ারুল বায়ান)
ঈসা (عليه السلام) তখন বলে উঠল, আমি আল্লাহ তা‘আলার দাস। তিনি আমাকে কিতাব প্রদান করেছেন এবং আমাকে নাবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ প্রদান করেছেন যতদিন আমি জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করার জন্য এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি। আমার প্রতি শান্তি ও শয়তানের সকল অনিষ্ট থেকে মুক্ত যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি আর যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন আমাকে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত করা হবে। এটাই হল মারইয়াম পুত্র ঈসা (عليه السلام), আর এটাই হল সত্য কথা (যা উপরে বর্ণনা করা হয়েছে) যে বিষয়ে লোকেরা বিতর্ক করে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা এমন নন যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন (যেমন খ্রিস্টানরা বলে থাকে ঈসা আল্লাহ তা‘আলার পুত্র) তিনি এ ব্যাপারে মহান, পবিত্র।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(یٰٓاَھْلَ الْکِتٰبِ لَا تَغْلُوْا فِیْ دِیْنِکُمْ وَلَا تَقُوْلُوْا عَلَی اللہِ اِلَّا الْحَقَّﺚ اِنَّمَا الْمَسِیْحُ عِیْسَی ابْنُ مَرْیَمَ رَسُوْلُ اللہِ وَکَلِمَتُھ۫ﺆ اَلْقٰٿھَآ اِلٰی مَرْیَمَ وَرُوْحٌ مِّنْھُﺑ فَاٰمِنُوْا بِاللہِ وَرُسُلِھ۪ﺤ وَلَا تَقُوْلُوْا ثَلٰثَةٌﺚ اِنْتَھُوْا خَیْرًا لَّکُمْﺚ اِنَّمَا اللہُ اِلٰھٌ وَّاحِدٌﺚ سُبْحٰنَھ۫ٓ اَنْ یَّکُوْنَ لَھ۫ وَلَدٌ)
“মারইয়ামের ছেলে ‘ঈসা মসীহ তো আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মারইয়ামের নিকট প্রেরণ করেছিলেন ও তাঁর আদেশ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণে ঈমান আন এবং বল না, ‘তিন!’ (তিনজন ইলাহ) নিবৃত্ত হও, এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর হবে। আল্লাহ তো একমাত্র ইলাহ; তাঁর সন্তান হবে তিনি এটা হতে পবিত্র।” (সূরা নিসা ৪:১৭১)
আর তিনি যে সকল কার্যকলাপ করেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তিনি এমন উপাস্য যখন তিনি কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন বলেন, হও! এবং তা হয়ে যায়। যেমন পিতা ছাড়া ঈসা (عليه السلام)-এর জন্ম, সুতরাং সন্দেহ পোষণ করার কোন কিছুই নেই।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কোন সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রী-পরিজন গ্রহণ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। ঈসা (عليه السلام) আরো বললেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আমার পালনকর্তা ও তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। আর এটাই হল সরল-সঠিক পথ। ঈসা (عليه السلام)-এর এ সকল কথা শুনেও একশ্রেণির লোকের বিশ্বাস হল না।
(فَاخْتَلَفَ الْأَحْزَابُ)
অর্থাৎ ইয়াহূদীরা ঈসা (عليه السلام)-এর ব্যাপারে বিভিন্ন দলে ও মতে বিভক্ত হয়ে গেল; কেউ বাড়াবাড়ি করে বলল: তিনিই আল্লাহ, কেউ বলল: তিনি আল্লাহ তা‘আলার সন্তান, কেউ বলল: তিনি তিনজনের একজন (আল্লাহ, মারইয়াম ও ঈসা)। কেউ নাবী বলে আখ্যায়িত করে না, বরং বলে থাকে: তিনি জারজ সন্তান যেমন ইয়াহূদীরা। সব কথাই বাতিল, যারাই এসব কথা বলে তারাই কুফরী করেছে। এভাবে তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত হয়ে গেল। সুতরাং কিয়ামত দিবসে তাদের জন্য থাকবে ধ্বংস ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। যেমন সূরা যুখরুফের ৬৩-৬৫ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
তাদের দলে দলে বিভক্ত হওয়ার ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তিরস্কার করণার্থে বলেন দুনিয়াতে তারা সত্য কথা না শুনলেও, না দেখলেও কিয়ামতের দিন তারা চমৎকারভাবে শুনবে ও দেখবে, যেদিন তারা সবাই আমার নিকট আগমন করবে। আর তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কিয়ামত দিবসে মৃত্যুকে একটি ধূসর রঙের মেষের আকারে আনা হবে। তখন একজন সম্বোধনকারী ডাক দিয়ে বলবেন: হে জান্নাতবাসী! তখন তারা ঘাড়-মাথা উঁচু করে দেখতে থাকবে। আহ্বানকারী বলবেন: তোমরা কি একে চিন? তারা বলবে: হ্যাঁ, এ হল মৃত্যু। কেননা সকলেই তাকে দেখেছে। তারপর সম্বোধনকারী আবার ডাক দিয়ে বলবেন: হে জাহান্নামবাসী! জাহান্নামীরা মাথা উঁচু করে দেখতে থাকবে, তখন আহ্বানকারী বলবেন: তোমরা কি একে চিন? তারা বলবে: হ্যাঁ, এ তো মৃত্যু। কেননা তারা সকলেই তাকে দেখেছে। তারপর (সেটিকে) জবেহ করা হবে। আর ঘোষক বলবেন: হে জান্নাতবাসী! স্থায়ীভাবে এখানে থাক। তোমাদের মৃত্যু নেই। আর হে জাহান্নামবাসী চিরদিন এখানে থাক। তোমাদেরও মৃত্যু নেই। এরপর রাসূলুল্লাহ পাঠ করলেন: “তাদেরকে সতর্ক করে দাও পরিতাপের দিবস সম্বন্ধে, যখন সকল সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। এখন তারা গাফিল এবং তারা বিশ্বাস করে না।”
সুতরাং আমাদের উচিত সত্যকে সত্য বলে মেনে নেয়া আর মিথ্যাকে বর্জন করা। কারণ আমাদের সকলকেই একদিন আল্লাহ তা‘আলার নিকট ফিরে যেতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই হাতে।
২. আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে পিতা ছাড়াও সন্তান দান করতে পারেন।
৩. আল্লাহ তা‘আলা কোন স্ত্রী-পুত্র, পরিজন গ্রহণ করা থেকে পূতপবিত্র।
৪. আল্লাহ তা‘আলা চাইলে কোলের শিশুকেও কথা বলাতে পারেন। যেমন ঈসা (عليه السلام)।
৫. ঈসা (عليه السلام) ছিলেন বরকতস্বরূপ।
৬. সকলকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট ফিরে যেতে হবে।
৭. ফেরেশতা মানবাকৃতি ধারণ করতে পারেন।
৮. মানুষের রিযিক নির্ধারণ করা থাকলেও তা অন্বেষণ করে নিতে হবে, যেমন মারইয়াম (عليه السلام)-কে নির্দেশ দেয়া হলো।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*ঈসা(আ.)-এর জন্মবৃত্তান্ত : এখন অন্য একটি ঘটনার বর্ণনা আসছে যা ইয়াহইয়া(আ.)-এর ঘটনার চেয়েও অনেক বেশী চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর। ঘটনাটি হচ্ছে ঈসা(আ.)-এর জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কিত। এখানে ঘটনা দুটোর বর্ণনায় একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে একজন বন্ধ্যা নারী ও একজন অশীতিপর বৃদ্ধের সন্তান লাভের ঘটনা। এটা একটা অসাধারণ ও বিস্ময়কর ঘটনা। এরপর বর্ণনা করা হয়েছে এমন আর একটি ঘটনা যা পূর্বের ঘটনার চেয়েও অধিক বিস্ময়কর এবং তা হচ্ছে কোনাে পুরুষের সংস্পর্শে না এসেই একজন কুমারী নারীর সন্তান প্রসব করা। এটা নিসন্দেহে একটা নযির বিহীন ঘটনা। গােটা মানব ইতিহাসে এ জাতীয় কোনাে ঘটনার অস্তিত্বের কথা আমাদের জানা নেই। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমরা নিজেরাও মানব সৃষ্টির মূল ঘটনার সাথে অপরিচিত। আমরা একটা ধরা বাঁধা নিয়মের অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। খােদ মানব সৃষ্টির ঘটনাটা তাে গােটা ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ও অভাবনীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই ঘটনার সাথে আমরা কতােটুকু পরিচিত। আদি মানবের সৃষ্টি হয়েছিলাে পিতা ও মাতাবিহীন অবস্থায়। এই ঘটনার পর শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেছে। কিন্তু অনুরূপ দ্বিতীয় কোনাে ঘটনা পৃথিবীর বুকে আর ঘটেনি। তাই আল্লাহ তায়ালা দ্বিতীয় একটি ঘটনা ঘটিয়ে দেখালেন এই পিতাবিহীন একটি মানব সৃষ্টির মাধ্যমে। স্বাভাবিক নিয়মের সম্পূর্ণ বিপরীত নিয়মে ঈসা(আ.)-এর জন্মের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটান, যেন গােটা মানব জাতি তার কুদরতের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে এবং আদি মানবের সৃষ্টির বিষয়টি যদি বােধগম্য না হয় তাহলে এই দ্বিতীয় বিস্ময়কর বিষয়টির প্রতিই যেন তারা দৃষ্টিপাত করে। বংশবৃদ্ধি ও সন্তান উৎপাদনের স্বাভাবিক নিয়ম যা আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তা হলাে, নর ও নারীর মিলন। এই প্রাকৃতিক নিয়ম প্রতিটি জীব-জন্তু ও প্রজাতির ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযােজ্য। এমন কি যে সব জীব ও প্রাণীর মাঝে স্ত্রী ও পুরুষ জাতি হিসেবে ভিন্ন কোনাে জাতের অস্তিত্ব নেই, সে সবের মাঝেও আল্লাহ তায়ালা স্ত্রী-কোষ ও পুরুষ কোষ নামে দুটো ভিন্ন ভিন্ন কোষ সৃষ্টি করে রেখেছেন। যুগ যুগ ধরে এই একই নিয়ম ও পদ্ধতি চলে আসার কারণে মানুষ মনে করে নিয়েছে যে, এটাই বুঝি একমাত্র নিয়ম। এর বাইরে আর কোনাে নিয়ম নেই। অথচ তাদের সম্মুখে আদি মানবের সৃষ্টির ইতিহাস রয়েছে। সেই সৃষ্টিও ছিলাে সাধারণ নিয়ম বহির্ভূত। কিন্তু, মানুষ সেই ইতিহাস ভুলে গেছে, তাই, আল্লাহ তায়ালা ঈসা(আ.)-এর সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তার কুদরত কোনাে নিয়ম নীতির অধীন নয়, কোনাে নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বিধানের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়। বরং এই কুদরত, এই ইচ্ছা হচ্ছে স্বাধীন ও মুক্ত। তবে ঈসা(আ.)-এর জন্মের অনুরূপ ঘটনা আর কখনও ঘটবে না। বরং জন্ম ও বংশ বৃদ্ধির সাধারণ নিয়মই বলবৎ থাকবে। কারণ, এই নিয়ম তারই পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজেই সেটাই বলবৎ থাকবে। ঈসা(আ.)-এর ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনাটি ঘটানাে হয়েছে তাঁর স্বাধীন ও মুক্ত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশের উদ্দেশ্যে। এটা আল্লাহর কুদরতের একটা জ্বলন্ত নমুনা হিসেবে থেকে যাবে। ‘যেন আমি তাকে মানবজাতির জন্যে একটা নিদর্শন বানাতে পারি।’ এই বিস্ময়কর ঘটনার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য অনুধাবন করা এক শ্রেণীর মানুষের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। তাই তারা ঈসা(আ.)-এর প্রতি দেবত্ব আরােপ করে তার সম্পর্কে নানা ধরনের আজগুবী ও কাল্পনিক কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। অথচ এসব কাহিনী দ্বারা ঈসা(আ.)-এর সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করা হয়েছে। আর সে উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর অপার কুদরতকে প্রমাণ করা, যে কুদরত কোনাে বাঁধা ধরা নিয়মের অধীন নয়। এটা তাওহীদেরই একটা অংগ। অথচ সে সব আজগুবী ও কাল্পনিক ঘটনাবলীর দ্বারা এই তাওহীদের মূলেই কুঠারাঘাত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এই বিস্ময়কর ঘটনা উল্লেখ করে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে। সাথে সাথে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সব উদ্ভট ও অতিপ্রাকৃতিক কিসসা-কাহিনীর জন্ম দেয়া হয়েছে সেগুলােকেও বাতিল ও ভ্রান্ত বলে ঘােষণা করা হয়েছে। ঘটনার নিরেট বর্ণনাকে অতিক্রম করে এমন কিছু দূশ্যের অবতারণা করা হয়েছে যা মানবীয় আবেগ অনুভূতি দ্বারা পরিপূর্ণ, যা পাঠকের হৃদয়কে এমনভাবে নাড়া দেয় যেন সে স্বচক্ষে দৃশ্যগুলাে অবলােকন করছে। এই কিতাবে মারইয়ামের কথাও… এক স্থিরকৃত ব্যাপার।(আয়াত ১৬-২১) ঘটনার প্রথম দৃশ্যে আমরা এমন একজন যুবতীর সাক্ষাত পাই যে কুমারী ও ধর্মযাজিকা। সে যখন মাতৃগর্ভে ছিলাে তখনই তার মা এবাদাত খানার সেবার জন্যে তাকে উৎসর্গ করেন। তার সম্পর্ক ছিলো বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় নেতা হারুন(আ.)-এর বংশের সাথে । সে ছিলাে সতীত্ব ও চারিত্রিক নির্মলতার মূর্তপ্রতীক। তার মাঝে এই সৎ গুণ ছাড়া অন্য কোনাে অসৎ গুণের অস্তিত্বই ছিলাে না। এই সৎ ও পূত পবিত্র যুবতী একদিন নিতান্ত ব্যক্তিগত কোনাে প্রয়ােজনের তাগিদে পরিবারের অন্যান্য লােকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নির্জন স্থানে চলে যায়। প্রয়ােজনটা কি ছিলাে, তার কোনাে বিবরণ কোরআনে দেয়া হয়নি। খুব সম্ভবত মেয়েলী কোনাে প্রয়ােজন হতে পারে। যা হােক এই নির্জন স্থানে পৌছে সে নিশ্চিত মনে ভাবতে লাগলাে যে, সে এখন সম্পূর্ণ রূপে একা। কিন্তু হঠাৎ করে এই নির্জন স্থানে তার সামনে একজন বলিষ্ঠ ও পরিপূর্ণ পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। ফলে সে একজন কুমারী যুবতীর মতােই ভয়ে ও বিস্ময়ে কাঠ হয়ে যায়। সে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করে, সাহায্য কামনা করে এবং লােকটির মাঝে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার জন্যে চেষ্টা করে। এই নির্জন স্থানে তাকে আল্লাহ তায়ালা দেখছেন সে কথাও তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে তাকে বলে, ‘সে বললাে… কাছে পানাহ চাই'(আয়াত ১৮) আল্লাহভীরু লােকদের মন আল্লাহর কথা শুনলেই কেঁপে উঠে এবং কামভাব ও শয়তানী প্ররােচনা থেকে দূরে সরে দাড়ায়। এই পূণ্যাত্মা, সচ্চরিত্রা ও কুমারী যুবতীর কথা চিন্তা করলেই মনের মাঝে একটা কম্পনের সৃষ্টি হয়। কারণ তিনি কোনাে সাধারণ যুবতী ছিলেন না। বরং তিনি এমন এক অসাধাণ যুবতী ছিলেন যাকে তার মা ভ্রুণ অবস্থায়ই আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেছিলেন এবং জন্মের পর তার লালন-পালন হয়েছে একজন নবীর হাতে, এক পবিত্র পরিবেশে। যুবতীর কথার উত্তরে লােকটি বলে, ‘সে বললাে আমি… দিয়ে যেতে পারি'(আয়াত-১৯) এই উত্তর শুনে যুবতীর মাঝে কি পরিমাণ ভয়-ভীতি ও লজ্জার সৃষ্টি হতে পারে তা চিন্তা করলে আর একবার হৃদয় প্রকম্পিত হয়। কারণ এই নীরব ও নির্জন স্থানে একজন সুপুরুষ একজন যুবতীকে বলছে, ‘আমি তােমাকে সন্তান দান করতে চাই।’ আল্লাহর প্রেরিত প্রতিনিধি বলে সে যে দাবী করছে সেটা হয়তাে প্রতারণার উদ্দেশ্যে করছে। এর মাধ্যমে সে একজন সরলা ও অবলা যুবতীকে প্রতারণার ফাঁদে আটকাতে চায়। লােকটির প্রস্তাব শুনে এবং নিজের ইযযত আবরু হুমকির সম্মুখীন দেখে যুবতীর মাঝে সাহস জন্ম নেয়। ফলে সে স্পষ্ট ভাষায় তাকে জিজ্ঞেস করে। ‘সে বললাে… না আমি কখনাে ব্যাভিচারিণী ছিলাম!'(আয়াত ২০) এভাবেই অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও খােলামেলা ভাষায় সে লােকটির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। পরিস্থিতিই তাকে এমনটি করতে বাধ্য করেছে। এখন লজ্জা-শরমের স্থান নেই। এখানে ইযযত আবরু রক্ষার প্রশ্ন। কাজেই তাকে জানতে হবে, লোকটি কিভাবে তাকে সন্তান দান করবে। সে নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি বলে দাবী করেছে বলেই ক্ষান্ত দিতে হবে, শান্ত থাকতে হবে, তা হতে পারে না। কারণ, তাকে তাে ইতিপূর্বে কোনাে মানুষ স্পর্শ করেনি। এমন কি সে তাে কোনাে পতিতা ও নয় যে, সন্তান জন্ম নেয়ার মতাে কাজ করতে সম্মত হবে। তার এই প্রশ্ন দেখে মনে হয়, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে কল্পনাই করতে পারেনি যে, নর-নারীর মিলনের সাধারণ নিয়মের বাইরেও সন্তান জন্ম দেয়ার অন্য কোনাে উপায় থাকতে পারে। মানব স্বভাবের ধর্ম এটাই অর্থাৎ সে সাধারণ নিয়ম নীতি দ্বারা অভ্যস্ত। ‘সে বললাে (হাঁ,) এ রূপই… এক স্থিরীকৃত ব্যাপার, যা অবশ্যই পুরাে হতে হবে'(আয়াত ২১) এই অসাধারণ ঘটনা সেটা ঘটতে পারে বলে কল্পনা করাও মারইয়ামের পক্ষে অসম্ভব, তা আল্লাহর বেলায় খুবই সহজ ও সাধারণ। যে মহা শক্তিধর আল্লাহ ‘হও’ নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথেই সব কিছু হয়ে যায়, তার বেলায় এ কাজটি সহজ হবে না কেন? তার ইচ্ছা তাে কোনাে নিয়ম-নীতির অধীন নয়। সাধারণ নিয়ম নীতি অনুযায়ী হােক বা না হােক তাতে কিছু আসে যায় না। তিনি যখন যা চাইবেন তাই হবে। এ কথাই জিবরাঈল(আ.) মারইয়ামকে জানিয়ে দিচ্ছেন। সাথে সাথে তাকে আশস্ত করছেন এই বলে যে, এই বিস্ময়কর ঘটনাটিকে আল্লাহ তায়ালা গােটা মানব জাতির জন্যে এবং বনি ইসরাঈল সম্প্রদায়ের লােকদের জন্যে রহমত হিসেবে রেখে দিতে যান। এর মাধ্যমে তারা যেন আল্লাহর অপার কুদরতের পরিচয় লাভ করতে পারে এবং তাঁর এবাদত বন্দেগী ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে আত্মনিয়ােগ করতে পারে। জিবরাঈল এবং মারিয়াম(আ.)-এর মধ্যকার কথাবার্তা এখানেই শেষ । এই কথাবার্তার পরে কি ঘটেছিলাে, সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনায় একটা কৌশলগত ছেদ এখানে লক্ষ্য করা যায়। এটাই হচ্ছে কোরআনের এক প্রকার বর্ণনাভংগি, তবে উভয়ের মধ্যকার কথাবার্তায় জানা যায় যে, কুমারী হওয়া সত্তেও এবং কোনাে পুরুষের সংস্পর্শে না এসেও মারইয়ামের একটি সন্তান হবে। এই সন্তান খােদায়ী কুদরত ও রহমতের জীবন্ত নিদর্শন হিসেবে পৃথিবীর বুকে আগমন করবে। এ রকম একটি ঘটনা যে ঘটবে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব থেকেই চুড়ান্ত ও নির্ধারিত হয়েছিলাে । কিন্তু কি ভাবে তা ঘটবে সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি।[সূরায়ে আত তাহরীম এর ১২ নং আয়াতে রুহ শব্দটি এসেছে এবং আলােচ্য সূরাতেও একই ভাবে ‘রুহ শব্দাটি উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুটো আয়াতে ‘রুহ’ বলতে কি একই অর্থ বুঝানাে হয়েছে, না ভিন্ন কোনাে অর্থ বুঝানাে হয়েছে। আমাদের কাছে শব্দটি দু’জায়গায় দুটো অর্থ প্রকাশ করছে। আলােচ্য সুরায় ‘রুহ’ বলতে জিবরাঈল(আ.) কে এবং সূরায়ে তাহরিমে ‘রুহ’ বলতে আত্মা বা প্রাণ বুঝানাে হয়েছে। এই আত্মা আদম(আ.)-এর মাঝে স্থাপন বা ফুৎকার করা হয়েছিলাে এবং মাইরয়াম(আ.)-এর মাঝেও স্থাপন বা ফুৎকার করা হয়েছিল। আত্মা স্থাপনের পর আদম(আ.) জীবন্ত হন, আর মারইয়াম(আ.)-এর দেহে এই আত্মা ফুৎকারের পর তার ডিম্বকোষ জীবন্ত হয়ে তা সন্তান উৎপাদনের উপযুক্ত হয়ে উঠে। অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে ফুৎকারের মানুষের মাঝে জীবনের সৃষ্টি হয় এবং এই জীবন সৃষ্টির জন্য প্রয়ােজনীয় গুণাবলীও সৃষ্টি হয়। সূরায়ে মারইয়ামে বর্ণিত রুহ জিবরাইল(আ.) রূহ অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে আত্মার শুণাবলী নিয়ে এসেছিলেন মারইয়ামের জন্য। প্রকৃত কুহ বলতে কী বুঝায় তা অবশ্য আমাদের জানা নেই। কিন্তু উভয় স্থানে রুহ’ বলতে যে কারও প্রতি ইংগিত করা হয়েছে সেটা অবশ্যই জানা আছে -সম্পাদক]
#এরপর ঘটনার অপর একটি নতুন চিত্র আমাদের সামনে চলে আসছে। এই চিত্রে আমরা একজন ভীত-সন্ত্রস্ত ও দিশাহারা কুমারী যুবতীকে দেখতে পাই। সে তার প্রচন্ড অসহায়ত্বের কথা এভাবে তুলে ধরছে। ‘অতপর সে গর্ভে সন্তান… বিস্মৃত হয়ে যেতাম'(আয়াত ২২-২৩) তৃতীয় বার অবাক হওয়ার পালা। কারণ, পুর্বাপর কোনাে আয়াতে বলা হয়নি সে কি ভাবে অন্তসত্বা হলাে এবং কতােদিন ধরে সে অন্তসত্বা থাকলাে। সে কি অন্যান্য নারীদের মতো সাধারণ নিয়মেই অন্তসত্বা হয়েছিলাে? অর্থাৎ আত্মা ফুৎকার এর মাধ্যমে তার ডিম্বকোষকে জীবন্ত ও গতিশীল করে তােলা হয়েছে। ফলে সেটি পর্যায়ক্রমে মাংসপিন্ড, তারপর অস্থি, তারপর অস্থির উপর মাংসের আবরণ সৃষ্টি হয়ে একটি পরিপূর্ণ ভ্রুণে পরিণত হয়ে নির্ধারিত সময় কি অতিবাহিত করেছে? এ হলে হতেও পারে। কারণ গর্ভাশয়ে শুক্রাণু প্রবিষ্ট হওয়ার পরই ডিম্বকোষ জীবন্ত ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর তা পূর্ণতা লাভ করতে চান্দ্র মাসের হিসেবে নয় মাস সময় লাগে। এখানে শুক্র বিন্দু সংস্থাপন এর পরিবর্তে ‘আত্মা’ ফুৎকার করা হয়েছে। এর ফলেই ডিম্বকোষ সক্রিয় হয়ে গর্ভ সঞ্চার ঘটিয়েছে এবং তা স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারেই করা হয়েছে। অথবা তা সাধারণ নিয়মের বাইরেই ঘটেছে। অর্থাৎ ডিম্বকোষ অত্যন্ত দ্রুত ও অস্বাভাবিক ভাবে তার নির্ধারিত পর্যায়গুলাে অতিক্রম করে ভ্রুণে রূপান্তরিত হয়েছে। যা হােক, কোরআনের বক্তব্যে এ দুটোর কোনাে একটিরও উল্লেখ নেই। কাজেই গ্রহণযােগ্য ও যুক্তিসংগত কোনাে প্রমাণ ব্যতীত এ প্রসংগ নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা না করাই আমি সীমচীন করি। তাই মারইয়ামের পরবর্তী অবস্থা কী দাড়িয়েছিলাে আমরা আবার সে প্রসংগে ফিরে যাচ্ছি। পূর্বের আলােচনায় আমরা মারইয়ামের মাঝে সতিত্ব, সচ্চরিত্রতা ও পবিত্রতার গুণ দেখেছি। এখন দেখছি সে কলঙ্কের বােঝা মাথায় নিয়ে সমাজের মুখােমুখি হতে যাচ্ছে। একদিকে শারীরিক বেদনা, অপরদিকে মানসিক যাতনা। এর চেয়েও মারাত্মক ও কষ্টদায়ক হচ্ছে প্রসব বেদনা। এই প্রসব বেদনাই তকে এক নির্জন স্থানে নিয়ে এসেছে এবং সেখানে একটি খেজুর গাছের গােড়ায় হেলান দিয়ে বসতে বাধ্য করেছে। এখানে সে সম্পূর্ণ একা ও নিসংগ। প্রসব কোনাে অভিজ্ঞতা তার নেই। কারণ, সে তাে একজন কুমারী ও সতী যুবতী । এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সে কী করবে এবং কার সাহায্য নেবে কিছুই যেন স্থির করতে পারছিলাে না। একান্ত অসহায় ও নিরুপায় হয়ে বলতে বাধ্য হয়, ‘হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুছে যেতাম’ এ কথা যখন সে বলছে তখন তার মনের অবস্থা কি ছিলাে, তিনি কতোটুকু মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন তা আমরা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারি। তার শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সর্বশেষ পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলাে বলেই সে ঋতুস্রাবে ব্যবহৃত কাপড়ের টুকরাে (নাসিয়া) হতে চেয়েছিলাে। কারণ এ জাতীয় কাপড়ের টুকরাে ব্যবহার করার পর তা ছুড়ে ফেলা হয় এবং ভুলে যাওয়া হয়। এই প্রচন্ড প্রসব যন্ত্রণা ও মানসিক যাতনার কঠিন মুহূর্তে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যায়। গায়েবী কন্ঠ ডাক দিয়ে বলছে, তখন একজন (ফেরেশতা কিংবা শিশু ঈসা) তাকে তার… সাথেই কথাবার্তা বলবাে না। (আয়াত ২৪-২৬) আল্লাহ তায়ালার কী কুদরত! সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরক্ষণেই নিচে থেকে তাকে ডাকছে, সান্তনা দিচ্ছে, আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলছে। সাথে সাথে তার খাবারের কথাও বলে দিচ্ছে, পানির কথাও বলে দিচ্ছে। তুমি চিন্তা করাে না। আল্লাহ তায়ালা তােমাকে ভুলে যাননি, তােমাকে ত্যাগ করে যাননি। চেয়ে দেখাে, তােমার পায়ের নিচে পানির ধারা ছুটে চলেছে। নির্ভরযােগ্য মত অনুযায়ী এই পানির ধারা হয়তাে তাৎক্ষণিক ভাবে কোনাে ঝর্ণা থেকে প্রবাহিত হয়েছিলাে, অথবা পাহাড়ী ঢল থেকে নেমে এসেছিলাে। এই যে খেজুরের গাছ যেটার গােড়ায় তুমি হেলান দিয়ে বসে আছো সেটাকে ঝাঁকুনি দাও। তাতে করে ওপর থেকে পাকা ও তরতাজা খেজুর পড়বে। এই হচ্ছে তােমার খাবার ও পানীয়। মিষ্টি খাবার প্রসূতিদের জন্যে উপযােগী। এই হিসেবে মিষ্টি ও তরতাজা খেজুর প্রসূতীদের জন্যে। একটা উত্তম খাবার। তাই প্রাণ ভরে এই খাবার খাও এবং তৃপ্তি সহকারে এই পানি পান করাে। কোনােরূপ চিন্তা করাে না। মনটাকে শান্ত রাখাে। যদি কারাে সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে কথা বলে ইংপিতে জানিয়ে দিয়াে যে, তুমি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীর উদ্দেশ্যে কারাে সাথে কথা না বলার প্রতিজ্ঞা করেছো। কারাে কোনাে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার তােমার প্রয়ােজন নাই। আমাদের ধারণা, এসব কথা শুনে মারইয়াম হয়তাে দীর্ঘক্ষণ বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলেন। খেজুর গাছে ঝাকুনী দিতেও ভুলে গিয়েছিলেন। বিস্ময় ঘাের কেটে যাওয়ার পর তার মনে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, না, আল্লাহ তায়ালা তাকে ছেড়ে যাননি এবং এই শিশুও কোনাে সাধারণ শিশু নয়। বরং অসাধারণ ও অলৌকিক এক শিশু। তার মাধ্যমে অজানা ও অসাধারণ অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে। এরপর তিনি শিশুটিকে কোলে করে নিজের গােত্রের লােকদের কাছে চলে আসলেন। তখন কি অবস্থা দাঁড়িয়েছিলাে তা চিন্তা করলেও মন কেঁপে উঠে। গােত্রের লােকেরা হতবাক হয়ে দেখতে লাগলাে, তাদেরই বংশের মেয়ে অজানা ও অপরিচিতি এক শিশুকে নিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই মেয়েটিতো সতী, সাধ্বী, সচ্চরিত্র ও পূত-পবিত্র একজন কুমারী মেয়ে ছিলাে। তার কোলে আবার সন্তান আসলাে কোথা থেকে? তাই তারা বলে উঠলাে, অতপর সে তাকে নিজের… ছিলাে না! (আয়াত ২৭ ও ২৮) মারইয়ামকে লক্ষ্য করে যখন তারা উপরের কথাগুলাে বলছিলাে তখন বােধ হয় দাঁত কটমট করে এবং চিবিয়ে চিবিয়ে বলছিলাে। এরপর অত্যন্ত রাগের সুরে তাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলাে, ‘হারুনের বােন’ অর্থাৎ একজন নবীর বােন হয়ে এবং তারই রেখে যাওয়া এবাদাত খানায় লালিত পালিত হয়ে, সেই এবাদাত খানার সেবায় নিয়ােজিত থেকেও তােমার দ্বারা এই জঘন্য ও ঘৃণ্য কাজ করা কিভাবে সম্ভব হলাে? তােমার মা বাপ তাে কোনাে খারাপ লােক ছিলাে না, তাহলে তুমি এমন খারাপ কাজ কিভাবে করতে গেলে? এখন মারিয়াম তার শিশুর উপদেশ পালন করে সে শিশুর দিকেই ইংগিত করলাে । এই ইংগিত দেখে সমাজের লােকজনের মাঝে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলাে তা ব্যক্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলাে। কারণ, একদিকে তাে মেয়েটি অজানা ও অপরিচিত একটি শিশুকে কোলে নিয়ে হাযির হয়েছে। অপরদিকে আবার তাচ্ছিল্যভরে ও মশকরা করে সে শিশুকে প্রশ্ন করে আসল ঘটনা জানতে বলছে। তাই তারা বলতে বাধ্য হয়, যে কোলের শিশু তার সাথে আমরা কেমন করে কথা বলবাে? কিন্তু তাদের জন্যে আর একটি বিস্ময়কর অলৌকিক কান্ড-কারখানা তখন অপেক্ষা করছে। সেই কোলের শিশুটিই এবার বলে উঠলাে, আমার ওপর ছিলাে… অবস্থায় পুনরুথিত হবাে। (আয়াত ৩৩) ঈসা(আ.) এভাবেই আল্লাহর প্রতি তার আনুগত্য ও দাসত্বের কথা ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দিলেন। এর অর্থ, তিনি আল্লাহর পুত্রও নন এবং স্বয়ং, কোনাে দেবতাও নন, যেমনটি কোনাে কোনাে দল ও গােষ্ঠী মনে করে থাকে। বরং তিনি হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত নবী। তাঁর শরীকও নন এবং সন্তানও নন। আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন এবং আজীবন নামায ও যাকাত আদায়ে যত্নশীল হতে বলেছেন। সাথে নিজের মা ও বংশের লােকদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে বলেছেন, তাদের প্রতি বিনয়ী আচরণ করতে বলেছেন। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, ঈসা(আ.) সীমিত জীবনের অধিকারী। তার মৃত্যু ও আছে এবং পুনরুজ্জীবনও আছে। তার জন্ম, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের দিনে তাকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ করুণা, দয়া শান্তি ও নিরাপত্তা দান করেছেন ও করবেন। ঈসা(আ.)-এর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ব্যাপারে কোরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য আসার পর কোনাে রূপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তর্ক বিতর্কের কোনা অবকাশ নেই। ঈসা(আ.) মায়ের কোলে কথা বলার পর ব্যাপারটিকে তার সম্প্রদায়ের লােকেরা কিভাবে গ্রহণ করেছিলাে, এই ঘটনার পর মারইয়াম ও তার এই অসাধারণ পুত্রের ভাগ্যে ঘটেছিলাে এবং কখন তিনি নবুওত প্রাপ্ত হয়েছিলেন এসব ব্যাপারে কোরআনে আর কিছুই বলা হয়নি। কারণ এখানে প্রধান বিষয়বস্তু ছিলাে ঈসা(আ.)-এর জন্মের ঘটনা। কাজেই সেই অভাবনীয় ও অলৌকিক ঘটনার বিবরণ এসে যাওয়ায় পর অন্যান্য খুটিনাটি বিষয়ের অবতারণা না করে আসল ও প্রকৃত উদ্দেশ্য এভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এই হচ্ছে মারিয়াম পুত্র ঈসা… সরল পথ। (আয়াত ৩৪-৩৬) অর্থাৎ ঈসা হচ্ছে মারইয়ামের পুত্র। সে কোনাে দেবতাও নয় এবং কুমারী মায়ের পাপাচারের ফলও নয়। তার গোটা জন্মবৃত্তান্ত তুলে ধরা হলো। এই জন্ম বৃত্তান্তই সঠিক। সে ব্যাপারে যারা সন্দেহ করছে তারা ভুলের মাঝে রয়েছে। তিনি আল্লাহর পুত্র নন। কারণ আল্লাহ তায়ালা কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি, আর এমনটি করা তার জন্যে শােভা পায় না। সন্তান তাে তারা গ্রহণ করে যারা নশ্বর। তারা সন্তান গ্রহণ নিজের বংশ পরিচিতি টিকিয়ে রাখার জন্যে অথবা প্রয়ােজনের সময় সাহায্য লাভের জন্যে। আল্লাহ তায়ালা তো অবিনশ্বর, তার কোনাে লয় নেই। তিনি নিজেই স্বয়ং সম্পূর্ণ ও শক্তিধর। তার কারাে সাহায্যের প্রয়ােজন নেই। বরং গােটা সৃষ্টি জগত তার নির্দেশেই অস্তিত্ব লাভ করেছে। তিনি কোনাে কিছু করতে চাইলে, কোনাে কিছু সৃষ্টি করতে চাইলে কেবল বলেন, ‘হও’। আর তখনই তা হয়ে যায়। এখানে কারাে সাহায্যের প্রয়ােজন হয় না, কোনাে সন্তানের সহায়তারও প্রয়ােজন হয় না। এরপর ঈসা(আ.)-এর বক্তব্য আসছে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মানব জাতিকে একমাত্র ও লা শরীক আল্লাহর এবাদাতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আমার… সরল পথ। (আয়াত ৩৬) এই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্যের পর আর কোনাে কুসংস্কার ও পৌরানিক কিসসা কাহিনীর অবকাশ থাকে না।
# ঘটনার শেষে যে বিবৃতিমূলক মন্তব্য এসেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই সত্যটিকেই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করা। এই চূড়ান্ত ও সুস্পষ্ট মন্তব্যের পর ঈসা (আ.)-কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল ও গােষ্ঠীর মাঝে যে সব মতপার্থক্য ও বিরােধের সৃষ্টি হয়েছে এখন সে সম্পর্কে আলােচনা করা হচ্ছে। এই জাজ্জল্যমান সত্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও বিষয়টিকে নিয়ে কোনাে রূপ মতপার্থকা ও বিতর্কের সৃষ্টি হওয়া অবান্তর ও অনাকাংখীতই বটে। সেই অবাঞ্চিত মতবিরােধের প্রতি ইংগিত করেই বলা হচ্ছে, পরিস্কার ঘােষণা থাকা… আগমনকালের কঠিন এক দুর্ভোগ। (আয়াত ৩৭) একবার রােমান সম্রাট কনষ্টানটিন পাদ্রীদের এক সম্মেলনের ব্যবস্থা করলেন। এটা ছিলাে তাদের তিনটি প্রসিদ্ধ সম্মেলনের অন্যতম। এই সম্মেলনে দুই হাজার একশত সত্তর জন পাদ্রী অংশগ্রহণ করেছিলাে। এরা সকলেই ঈসা(আ.)-এর ব্যাপারে প্রচন্ড মতবিরােধে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলাে। প্রত্যেক দলই তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করছিলো। কেউ বলছিলাে, ঈসা(আ.) হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, যিনি পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন। এরপর যাকে ইচ্ছা তাকে জীবিত রেখে এবং যাকে ইচ্ছা তাকে মৃত্যু দিয়ে তিনি পুনরায় উর্ধলােকে ফিরে গিয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলছিলাে, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর পুত্র। অন্যদল বলছিলাে, তিনি হচ্ছেন তিনের মাঝে এক। অর্থাৎ, উপাস্য আল্লাহ তায়ালা, উপাস্য তিনি ও উপাস্য তার মাতা। অপরদিকে আর এক দল বলছিলাে, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা, তার রসূল, তার আত্মা ও তাঁর বাণী । এভাবে বিভিন্ন দল বিভিন্ন মত ও বক্তব্য দিয়ে চলছিলাে। কোনােক্রমেই তারা সর্বসম্মতিক্রমে কোনাে ঐকমত্যে থাকতে পারছিলাে না। তবে তাদের মধ্য থেকে তিন শত আট জনের বেশী পাদ্রী একটি রায়ের ব্যাপারে অভিন্নমত পােষণ করে। ফলে সম্রাট তাদের রায়কেই মেনে নেন এবং বাকী সবাইকে বিশেষ করে তাওহীদ পন্থীদেরকে সম্মেলন থেকে তাড়িয়ে দেন। এর ফলে সে তিনশত আট জন পাদ্রীরই বিজয় সূচিত হয়। সম্মেলন করে ভ্রান্ত মত ও আকীদা বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা হলেও তা আল্লাহর কাছে ভ্রান্ত বলেই বিবেচিত হবে। কাজেই আল্লাহর একত্ববাদকে অস্বীকার করে যারা এ জাতীয় ভ্রান্ত আকীদা বিশ্বাসকে মেনে নেবে পরকালে তারা কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে বলে পরবর্তী আয়াতে হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে, পরিস্কার ঘােষণা থাকা ওপর… আমলও করছে না। (আয়াত ৩৭, ৩৮, ৩৯) কি ভয়ংকর ও মারাত্মক হবে পরকালের সেই দৃশ্য। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবে মানুষ ও জ্বীন উভয় জাতি। যে মহান ও পরাক্রমশালী আল্লাহর সাথে ওরা কুফুরী করেছে সেই আল্লাহর সামনে এই ভয়ংকর দৃশ্য অবলােকন করবে স্বয়ং ফেরেশতারাও। দুনিয়ার বুকে এরা দেখেও দেখতাে না, শুনেও শুনতাে না। সত্য পথের সন্ধান পেয়েও তারা সে পথে চলতাে না। আর এখন, এই চরম মুহূর্তে, এই কঠিন দিনটিতে যেন তাদের শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি যেন প্রখর হয়ে উঠেছে। এখন তারা ভালাে করে দেখতেও পাচ্ছে এবং সুস্পষ্ট ভাবে শুনতেও পাচ্ছে। তাদের এই নতুন পরিবর্তনকে উপহাস করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, যেদিন এরা আমার সামনে এসে… নিমজ্জিত হয়ে আছে। (আয়াত ৩৮)। কি অদ্ভুত তাদের অবস্থা! যখন দেখা ও শুনা হেদায়াত ও মুক্তির উপায় ছিলাে তখন তারা শুনতো না ও দেখতাে না। আর যেদিন এই দেখা ও শুনা তাদের জন্যে লাঞ্ছনা ও অপমানের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেদিন তারা খুব ভালােভাবেই দেখছে ও শুনছে! তাই আজ এই মহান দিনটিতে তাদেরকে সেই সব জিনিসই শুনানাে হচ্ছে ও দেখানাে হচ্ছে যা তারা ঘৃণা করে ও পরিহার করে চলে। ‘পরিতাপের দিনটি সম্পর্কে তাদেরকে হুশিয়ার করে দিন।’ কারণ, এই দিনটিতে সবাই হায়-হুতাশ ও আক্ষেপ করতে থাকবে। পরিতাপ ও বিষাদের ছায়া এই দিনটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। তাই এই দিনটিকে পরিতাপের দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই দিনটি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করতে বলা হয়েছে। কারণ, এই দিনে আক্ষেপ করে, হা-হুতাশ করে কোনােই লাভ হবে না। কারণ, আয়াত ৩৯নং এর অনুবাদ এই দিনটির আগমন যেন ওদের অবিশ্বাস ও গাফলতিরই পরিণতি স্বরূপ ঘটবে। এই সন্দেহাতীত দিনটি সম্পর্কে ওদেরকে হুশিয়ার করে দিন। চিরকাল কেউ পৃথিবীতে থাকবে না, বরং সবাইকে একদিন ওই মহান আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে। মিরাসী সম্পত্তি ওয়ারিসদের কাছে যেমন ফিরে যায় সেভাবেই ফিরে যাবে সবাই। সে কথাই নিচের আয়াতে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী তাে… ফিরে আসতে হবে। (আয়াত ৪০)
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# তুলনামুলক অধ্যয়নের জন্য তাফহীমুল কুরআন সূরা আলে ইমরান ৪২ ও ৫৫ টীকা এবং সূরা নিসা ১৯০ – ১৯১ টীকা দেখুন।
# সূরা আলে ইমরানে এ কথা বলা হয়েছে যে, হযরত মারয়ামের মা তাঁর মানত অনুযায়ী তাঁকে বাইতুল মাকদিসে ইবাদতের জন্য বসিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত যাকারিয়া তাঁর হেফাজত ও রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সেখানে একথাও বলা হয়েছে যে, হযরত মারয়াম বাইতুল মাকদিসের একটি মিহরাবে ইতিকাফ করেছিলেন। এখন এখানে বলা হচ্ছে, যে মিহরাবটিতে হযরত মারয়ামের ই’তিকাফরত ছিলেন সেটি বাইতুল মাকদিসের পূর্বাংশে অবস্থিত ছিল। সেখানে তিনি ইতিকাফকারীদের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী একটি চাদর টাঙ্গিয়ে দিয়ে নিজেকে অন্যদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে নিয়েছিলেন। যারা বাইবেলের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য পূর্বাংশ অর্থে “নাসেরাহ” নিয়েছেন তারা ভুল করেছেন কারণ নাসেরাহ জেরুশালেমের উত্তর দিকে অবস্থিত, পূর্বদিকে নয়।
# ইতিপূর্বে ৬ টীকায় আমরা ইঙ্গিত করেছি, হযরত মারয়ামের বিস্ময়ের জবাবে ফেরেশতার “এমনটিই হবে” একথা বলার কোনক্রমেই এ অর্থ হতে পারে না যে, মানুষ তোমাকে স্পর্শ করবে এবং তোমার ছেলে হবে। বরং এর পরিষ্কার অর্থ হচ্ছে, এই যে, কোন মানুষ তোমাকে স্পর্শ না করা সত্ত্বেও তোমার ছেলে হবে। উপরে এ একই শব্দাবলীর মাধ্যমে হযরত যাকারিয়ার বিস্ময়ও উদ্ধৃত হয়েছে এবং সেখানেও ফেরেশতা সেই একই জবাব দিয়েছে। একথা পরিষ্কার, সেখানে এ জবাবটির যে অর্থ এখানেও তাই। অনুরূপভাবে সূরা যারিয়াতের ২৮-৩০ আয়াতে যখন ফেরেশতা হযরত ইবরাহীমকে (আ) পুত্রের সুসংবাদ দেন এবং হযরত সারাহ বলেন, আমার মতো বুড়ী বন্ধ্যা মেয়েলোকের আবার ছেলে হবে কেমন করে? তখন ফেরেশতা তাঁকে জবাব দেন, كَذَلِكَ “এমনটিই হবে।” একথা সুস্পষ্ট যে, এর অর্থ হচ্ছে, বার্ধক্য ও বন্ধ্যাত্ব সত্ত্বেও তাদের ছেলে হবেই। তাছাড়া যদি كَذَلِكَ অর্থ এই নেয়া হয় যে, মানুষ তোমাকে স্পর্শ করবে এবং তোমার ছেলে হবে ঠিক তেমনি ভাবে যেমন সারা দুনিয়ার মেয়েদের ছেলে হয়, তাহলে তো পরবর্তী বাক্য দু’টি একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় একথা বলার কি প্রয়োজন থাকে যে, তোমার রব বলেছেন, এমনটি করা আমার জন্য অতি সহজ এবং আমি ছেলেটিকে একটি নিদর্শন করতে চাই? নিদর্শন শব্দটি এখানে সুস্পষ্টভাবে মু’জিযা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বাক্যটি একথাই প্রকাশ করে যে, “এমনটি করা আমার জন্য বড়ই সহজ।” কাজেই এ উক্তির অর্থ এছাড়া আর কিছুই নয় যে, আমি এ ছেলেটির সত্তাকে বনী ইসরাঈলের সামনে একটি মু’জিযা হিসেবে পেশ করতে চাই। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সত্তাকে কিভাবে বনী ইসরাঈলের সামনে মুজিযা হিসেবে পেশ করা হয় পরবর্তী বিবরণ নিজেই তা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে।
# দূরবর্তী স্থান মানে বাইতুল লাহ্ম। ই’তিকাফ থেকে উঠে সেখানে যাওয়া হযরত মারয়ামের জন্য একটি স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। বনী ইসরাঈলের পবিত্রতম ঘরানা হারুন গোত্রের মেয়ে, যিনি আবার বাইতুল মাকদিসে আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য উৎসর্গিত হয়েছিলেন, তিনি হঠাৎ গর্ভধারণ করলেন। এ অবস্থায় যদি তিনি নিজের ই’তিকাফের জায়গায় বসে থাকতেন এবং লোকেরা তাঁর গর্ভধারণের কথা জানতে পারতো, তাহলে শুধুমাত্র পরিবারের লোকেরাই নয়, সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোকেরাও তাঁর জীবন ধারণ কঠিন করে দিতো। তাই তিনি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবার পর নীরবে নিজের ইতিকাফ কক্ষত্যাগ করে বাইরে বের হয়ে পড়লেন। যাতে আল্লাহর ইচ্ছা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত নিজ সম্প্রদায়ের তিরস্কার, নিন্দাবাদ ও ব্যাপক দুর্নাম থেকে রক্ষা পান। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম যে, পিতা ছাড়াই হয়েছিল এ ঘটনাটি নিজেই তার একটি বিরাট প্রমাণ। যদি তিনি বিবাহিতা হতেন এবং স্বামীর ঔরসে তাঁর সন্তান জন্মলাভের ব্যাপার হতো তাহলে তো সন্তান প্রসবের জন্য তাঁর শ্বশুরালয়ে বা পিতৃগৃহে না গিয়ে একাকী একটি দূরবর্তী স্থানে চলে যাওয়ার কোন কারণই ছিল না।
# এ শব্দগুলো থেকে হযরত মারয়ামের সে সময়কার পেরেশানীও অনুমান করা যেতে পারে। পরিস্থিতির নাজুকতা সামনে রেখে প্রত্যেক ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারেন যে, প্রসব বেদনার কষ্টজনিত কারণে তাঁর মুখ থেকে একথাগুলো বের হয়নি বরং আল্লাহ তাঁকে যে ভয়াবহ পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন তাতে কিভাবে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হবেন এই চিন্তায় তিনি পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। গর্ভাবস্থাকে এ পর্যন্ত যে কোনভাবে গোপন করতে সক্ষম হয়েছেন কিন্তু এখন শিশুটিকে কোথায় নিয়ে যাবেন? এ পরবর্তী বাক্যাংশ অর্থাৎ ফেরেশতা বললেন, “দুঃখ করো না।” মারয়ামের বক্তব্য সুস্পষ্ট করে তুলেছে যে তিনি কেন একথা বলেছিলেন। বিবাহিতা মেয়ের প্রথম সন্তান জন্মের সময় সে যতই কষ্ট পাক না কেন তার মনে কখনো দুখ ও বেদনাবোধ জাগে না।
# শিশুর ব্যাপারে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তার জন্মের ব্যাপারে যে কেউ আপত্তি তুলবে তার জবাব দেবার দায়িত্ব এখন আমার। (উল্লেখ বনী ইসরাঈলের মধ্যে মৌনতা অবলম্বনের রোযা রাখার রীতি ছিল) হযরত মারয়ামের আসল পেরেশানী কি ছিল এ শব্দাবলীও তা পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া এখানে এ বিষয়টিও প্রণিধানযোগ্য যে, বিবাহিতা মেয়ের প্রথম সন্তান যদি দুনিয়ার প্রচলিত নিয়মেই জন্মলাভ করে তাহলে তার মৌন ব্রত অবলম্বন প্রয়োজন দেখা দেবে কেন?
# এ শব্দগুলোর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে, এখানে এগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা যায় এবং এ কথা মনে করা যায় যে, হযরত মারয়ামের হারুন নামে কোন ভাই ছিল। দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, আরবী বাগধারা অনুযায়ী اُخْتُ هَارُوْنَ মানে হচ্ছে হারুন পরিবারের মেয়ে। কারণ আরবীতে এটি একটি প্রচলিত বর্ণনা পদ্ধতি। যেমন মুদার গোত্রের লোককে يَا اَخَا مُضَرَ হে মুদারের ভাই এবং হামাদান গোত্রের লোককে يَا اَخَا هَمَدَانَ হে হামাদানের ভাই বলে ডাকা হয়। প্রথম অর্থটিকে প্রাধান্য দেবার পক্ষে যুক্তি হচ্ছে এই যে, কোন কোন হাদীসে নবী ﷺ থেকেই এ অর্থটি উদ্ধৃত হয়েছে। আর দ্বিতীয় অর্থটির সমর্থনে যুক্তি হচ্ছে এই যে, পরিবেশও পরিস্থিতি এই অর্থটিই দাবী করে। কারণ এ ঘটনার কারণে জাতির মধ্যে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে বাহ্যত জানা যায় না যে, হারুন নামের এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কুমারী বোন শিশু সন্তান কোলে নিয়ে চলে এসেছিল। বরং যে জিনিসটি বিপুল সংখ্যক লোকদেরকে হযরত মারয়ামের চারদিকে সমবেত করে দিয়েছিল সেটি এ হতে পারতো যে বনী ইসরাঈলের পবিত্রতম ঘরানা হারুন বংশের একটি মেয়েকে এ অবস্থায় পাওয়া গেছে। যদিও একটি মারফূ হাদীসের উপস্থিতিতে অন্য কোন ব্যাখ্যা ও অর্থ গ্রহণ করা নীতিগতভাবে সঠিক হতে পারে না তা থেকে এ অর্থ বের হয় না যে, এ শব্দগুলোর অর্থ অবশ্যই “হারুনের বোন”ই হবে। মুগীরা ইবনে শু’বা (রা.) বর্ণিত হাদীসে যা কিছু বলা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, নাজরানের খৃস্টানরা হযরত মুগীরার সামনে আপত্তি উত্থাপন করে বলে, কুরআনে হযরত মারয়ামের হারুণের বোন বলা হয়েছে, অথচ হযরত হারুন তাঁর শত শত বছর আগে দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নিয়েছেন। হযরত মুগীরা তাদের এ আপত্তির জবাব দিতে পারেননি এবং তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এ ঘটনাটি বলেন। তাঁর কথা শুনার পর নবী ﷺ বলেন “তুমি এ জবাব দাও নি কেন যে বনী ইসরাঈলরা নবী ও সৎ লোকদের সাথে যুক্ত করে নিজেদের নাম রাখতো? ” নবীর ﷺ এ উক্তি থেকে শুধুমাত্র এতটুকুই বক্তব্য পাওয় যায় যে, লা-জওয়াবটি দিয়ে আপত্তি দূর করা যেতে পারতো।
(ক)) যারা হযরত ঈসার (আ) অলৌকিক জন্ম অস্বীকার করে তারা এ কথার কি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারে যে, হযরত মারয়ামকে শিশু সন্তান কোলে করে নিয়ে আসতে দেখে তার জাতির লোকেরা তাঁকে এক নাগাড়ে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করতে লাগলো কেন?
# কুরআনের অর্থ বিকৃতকারীরা এ আয়াতের এ অর্থ নিয়েছে, “কালকের শিশুর সাথে আমরা কি কথা বলবো? ” অর্থাৎ তাদের মতে এ কথাবার্তা হয়েছিল হযরত ঈসার যৌবন কালে। তখন বনী ইসরাঈলের নেতৃ পর্যায়ের বড় বড় লোকেরা বলেছিল, আমরা এ ছেলেটির সাথে কি কথা বলবো যে কালই আমাদের সামনে দোলনায় শুয়েছিল? কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি ও পূর্বাপর আলোচনার প্রতি লক্ষ রেখে সামান্য চিন্তা ভাবনা করলে যে কোন ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারবে যে, এটি নিছক একটি বাজে ও অযৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধুমাত্র অলৌকিকতাকে এড়িয়ে চলার জন্য এ পথ অবলম্বন করা হয়েছে। অন্য কিছু না হলেও এই জালেমরা অন্তত এতটুকু চিন্তা করতো যে, তারা যে বিষয়টির ওপর আপত্তি জানাতে এসেছিল তাতো শিশুর জন্মের সময়কার ব্যাপার, তার কৈশোর বা যৌবনকালের ব্যাপার নয়। তাছাড়া সূরা আলে ইমরানের ৪৬ এবং সূরা মায়েদার ১১০ আয়াত দু’টি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করছে যে, হযরত ঈসা তাঁর যৌবনে নয় বরং মায়ের কোলে সদ্যজাত শিশু থাকা অবস্থায় এ কথা বলেছিলেন। প্রথম আয়াতে ফেরেশতা হযরত মারয়ামকে শিশু জন্মের সুসংবাদ দান করে বলেছেন সে দোলনায় শায়িত অবস্থায় লোকদের সাথে কথা বলবে এবং যৌবনে পদার্পণ করেও। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ নিজেই হযরত ঈসাকে বলছেন, তুমি দোলনায় থাকা অবস্থায় লোকদের সাথে কথা বলতে এবং যৌবনকালেও।
# কুরআনের অর্থ বিকৃতকারীরা এ আয়াতের এ অর্থ নিয়েছে, “কালকের শিশুর সাথে আমরা কি কথা বলবো? ” অর্থাৎ তাদের মতে এ কথাবার্তা হয়েছিল হযরত ঈসার যৌবন কালে। তখন বনী ইসরাঈলের নেতৃ পর্যায়ের বড় বড় লোকেরা বলেছিল, আমরা এ ছেলেটির সাথে কি কথা বলবো যে কালই আমাদের সামনে দোলনায় শুয়েছিল? কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি ও পূর্বাপর আলোচনার প্রতি লক্ষ রেখে সামান্য চিন্তা ভাবনা করলে যে কোন ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারবে যে, এটি নিছক একটি বাজে ও অযৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধুমাত্র অলৌকিকতাকে এড়িয়ে চলার জন্য এ পথ অবলম্বন করা হয়েছে। অন্য কিছু না হলেও এই জালেমরা অন্তত এতটুকু চিন্তা করতো যে, তারা যে বিষয়টির ওপর আপত্তি জানাতে এসেছিল তাতো শিশুর জন্মের সময়কার ব্যাপার, তার কৈশোর বা যৌবনকালের ব্যাপার নয়। তাছাড়া সূরা আলে ইমরানের ৪৬ এবং সূরা মায়েদার ১১০ আয়াত দু’টি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করছে যে, হযরত ঈসা তাঁর যৌবনে নয় বরং মায়ের কোলে সদ্যজাত শিশু থাকা অবস্থায় এ কথা বলেছিলেন। প্রথম আয়াতে ফেরেশতা হযরত মারয়ামকে শিশু জন্মের সুসংবাদ দান করে বলেছেন সে দোলনায় শায়িত অবস্থায় লোকদের সাথে কথা বলবে এবং যৌবনে পদার্পণ করেও। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ নিজেই হযরত ঈসাকে বলছেন, তুমি দোলনায় থাকা অবস্থায় লোকদের সাথে কথা বলতে এবং যৌবনকালেও।
#.ক)) পিতামাতার হক আদায়কারী বলেননি, শুধুমাত্র মাতার হক আদায়কারী বলেছেন। একথাটিও হযরত ঈসার কোন পিতা ছিল না একথাই প্রমাণ করে। আর কুরআনের সর্বত্র তাঁকে মারয়াম পুত্র ঈসা বলা হয়েছে, এও এরই একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ।
# এটিই সেই নিদর্শন হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সত্তার মাধ্যমে যা বনী ইসরাঈলদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। বনী ইসরাঈলের অব্যাহত দুষ্কৃতির কারণে আল্লাহ তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেবার আগে তাদের সামনে সত্যকে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে পেশ করতে চাচ্ছিলেন। এ জন্য তিনি যে কৌশল অবলম্বন করেন তা হচ্ছে এই যে, হারুন গোত্রের এমন এক মুত্তাকী, ধর্মনিষ্ঠ ও ইবাদাত গুজার মেয়েকে, যিনি বাইতুল মাকদিসে ই’তিকাফরত এবং হযরত যাকারিয়ার প্রশিক্ষণাধীন ছিলেন, তাঁর কুমারী অবস্থায় গর্ভবতী করে দিলেন। এটা এ জন্য করলেন যে, যখন সে শিশু সন্তান কোলে করে নিয়ে আসবে তখন সমগ্র জাতির মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যাবে এবং আকস্মিকভাবে সবার দৃষ্টি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হবে। তারপর এ কৌশল অবলম্বন করার ফলে বিপুল সংখ্যক লোক যখন হযরত মারয়ামের চারদিকে ঘিরে দাঁড়ালো তখন আল্লাহ এই নবজাত শিশুর মুখ দিয়ে কথা বলালেন, যাতে শিশু বড় হয়ে যখন নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করবে তখন জাতির হাজার হাজার লোক এ মর্মে সাক্ষ্য দেবার জন্য উপস্থিত থাকে যে, এর ব্যক্তিত্বের মধ্যে তারা আল্লাহর একটি বিস্ময়কর অলৌকিকত্ব দেখেছিল। এরপরও এ জাতি যখন তার নবুওয়াত অস্বীকার করবে এবং তার আনুগত্য করার পরিবর্তে তাকে অপরাধী সাজিয়ে শুলবিদ্ধ করার চেষ্টা করবে তখন তাদেরকে এমন কঠোর শাস্তি দেয়া হবে যা দুনিয়ায় কোন জাতিকে দেয়া হয়নি। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আলে ইমরান ৪৪ টীকা ও ৫৩ টীকা , আন নিসা ২১২ টীকা ও ২১৩ টীকা, আল আম্বিয়া ৮৮ টীকা , ৮৯ টীকা ও ৯০ টীকা এবং আল মু’মিনুন ৪৩ টীকা )।
# এ পর্যন্ত খৃস্টানদের সামনে যে কথাটি সুস্পষ্ট করা হয়েছে সেটি হচ্ছে এই যে, ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র মনে করার যে আকীদা তারা অবলম্বন করেছে তা মিথ্যা। যেভাবে একটি মু’জিযার মাধ্যমে হযরত ইয়াহিয়ার জন্মের কারণে তা তাঁকে আল্লাহর পুত্রে পরিণত করেনি ঠিক তেমনিভাবে অন্য একটি মু’জিযার মাধ্যমে হযরত ঈসার জন্মও এমন কোন জিনিস নয় যে, তাকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করতে হবে। খৃস্টানদের নিজেদের বর্ণনাসমূহেও একথা রয়েছে যে, হযরত ইয়াহইয়া ও হযরত ঈসা উভয়েই এক এক ধরনের মু’জিযার মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল। লুক লিখিত সুসমাচারে কুরআনের মতো এ উভয়বিধ মু’জিযার উল্লেখ একই বর্ণনা পরম্পরায় করা হয়েছে। কিন্তু এটি খৃস্টানদের বাড়াবাড়ি যে, তারা একটি মু’জিযার মাধ্যমে সৃষ্ট ব্যক্তিকে আল্লাহর বান্দা বলে এবং অন্য একটি মু’জিযার মাধ্যমে সৃষ্ট ব্যক্তিকে বলে আল্লাহর পুত্র।
# এখানে খৃস্টানদেরকে জানানো হয়েছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দাওয়াতও তাই ছিল যা অন্য নবীগণ এনেছিলেন। তিনি এছাড়া আর কিছুই শিখাননি যে কেবলমাত্র এক আল্লাহর বন্দেগী করতে হবে। এখন তোমরা যে তাঁকে বান্দার পরিবর্তে আল্লাহ বানিয়ে নিয়েছো এবং আল্লাহর সাথে ইবাদতের শরীক করছো এসব তোমাদের নিজেদের উদ্ভট আবিষ্কার। তোমাদের নেতা কখনোই তোমাদের একথা শেখাননি। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আলে ইমরান ৬৮ টীকা , মায়েদাহ ১০০ টীকা , ১০১ টীকা ও ১৩০ টীকা এবং আয যুখরূফ ৫৭ টীকা ও ৫৮ টীকা )।
# খৃস্টানদের শুনবার জন্য যে ভাষণ অবতীর্ণ হয়েছিল তা এখানে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই ভাষণের মাহাত্ম্য একমাত্র তখনই অনুধাবন করা যেতে পারে যখন এ সূরার ভূমিকায় আমি যে ঐতিহাসিক পটভূমির অবতারণা করেছি তা পাঠকের দৃষ্টি সম্মুখে থাকবে। এ ভাষণ এমন এক সময় অবতীর্ণ হয়েছিল যখন মক্কার মজলুম মুসলমানরা একটি ঈসায়ী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিল। তখন এটি নাযিল করার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, সেখানে যখন ঈসা সম্পর্কে ইসলামী আকীদার প্রশ্ন উত্থাপিত হবে তখন এই “সরকারী বিজ্ঞপ্তি ঈসায়ীদেরকে শুনিয়ে দেয়া হবে। ইসলাম যে সত্য ও ন্যায়ের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে কোন অবস্থায়ও তোষামোদী নীতি অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করেনি, এর সপক্ষে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে? তারপর যেসব সাচ্চা মুসলমান হাবশায় হিজরত করে গিয়েছিলেন তাদের ঈমানী শক্তিও ছিল বিস্ময়কর। তারা রাজদরবারে এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এ বক্তৃতা শুনিয়ে দিয়েছিলেন, যখন নাজ্জাশীর দরবারের সভাসদরা উৎকোচ গ্রহণ করে তাদেরকে তাদের শত্রুর হাতে তুলে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। তখন পূর্ণআশঙ্কা ছিল, খৃস্টবাদের বুনিয়াদী আকীদার ওপর ইসলামের মুসলমানদেরকে কুরাইশ কসাইদের হাতে সোপর্দ করে দেবেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা সত্য কথা বলতে একটুও ইতস্তত করেননি।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১৬-২১ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বে হযরত যাকারিয়ার (আঃ) ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছিল এবং এই বর্ণনা দেয়া হয়েছিল যে, হযরত যাকারিয়া (আঃ) পূর্ণ বার্ধক্যে উপনীত হওয়া পর্যন্ত সন্তানহীন ছিলেন। তার স্ত্রীর মধ্যে সন্তান লাভের কোন সম্ভাবনাই ছিল না। এই অবস্থায় আল্লাহ তাআলা নিজের ক্ষমতাবলে তাদেরকে সন্তান দান করেন। হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও খোদাভীরু। এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাঁর এর চেয়েও বড় ক্ষমতার নিদর্শন পেশ করছেন। এখানে তিনি হযরত মারইয়ামের (আঃ) ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি ছিলেন চির কুমারী। কোন পুরুষ তাকে কখনো স্পর্শ করে নাই। এভাবে বিনা পুরুষেই আল্লাহ তাআলা স্বীয় পূর্ণ ক্ষমতাবলে তাঁকে সন্তান দান করেন। তার গর্ভে হযরত ঈসার (আঃ) জন্ম হয়, যিনি আল্লাহর মনোনীত নবী এবং তার রূহ ও কালেমা ছিলেন।
এই দু’টি ঘটনায় পূর্ণভাবে পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে বলে এখানে এবং সূরায়ে আল ইমরান ও সূরায়ে আম্বিয়াতেও এ দুটি ঘটনাকে মিলিতভাবে বর্ণনা করেছেন, যাতে বান্দা আল্লাহ তাআলার অতুলনীয় ক্ষমতা এবং ব্যাপক প্রতিপত্তি পর্যবেক্ষণ করে।
হযরত মারইয়াম (আঃ) হযরত ইমরানের কন্যা ছিলেন। তিনি ছিলেন হযরত দাউদের (আঃ) বংশধর। এই পরিবারটি বানী ইসরাঈলের মধ্যে পবিত্র পরিবার হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। সুরায়ে আল-ইমরানে তার জন্মের বিস্তারিত বিবরণ গত হয়েছে। ঐ যুগের প্রথা অনুযায়ী হযরত মারইয়ামের (আঃ) মাতা তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদে কুদৃসের খিদমতের জন্যে পার্থিব কাজ কর্ম হতে আযাদ করে দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর এই নর কবুল করেছিলেন। ‘উত্তমরূপে তিনিহযরত মারইয়ামকে (আঃ) বড় করে তুলেছিলেন। তিনি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী, দুনিয়ার প্রতি ঔদাসীন্য এবং সংযমী শীলতায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। তার ইবাদত, আধ্যাত্মিক সাধনা ও তাকওয়ার কথা সর্বসাধারণের মুখে আলোচিত হতে থাকে। তাঁর লালন পালনের দায়িত্বভার তাঁর খালু হযরত যাকারিয়া (আঃ) গ্রহণ করেছিলেন। ঐ সময় তিনি ছিলেন বাণী ইসরাঈলের নবী। সমস্ত বাণী ইসরাঈল তাদের ধর্মীয় কাজে তাঁরই অনুসারী ছিল। হযরত যাকারিয়ার (আঃ) কাছে হযরত মারইয়ামের (আঃ) বহু অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়ে ছিল। বিশেষ করে যখনই তিনি হযরত মারইয়ামের (আঃ) ইবাদত খানায় প্রবেশ করতেন, তখন তিনি তার কাছে নতুন ধরণের অমওসূমী ফল দেখতে পেতেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করতেনঃ “হে মারইয়াম! এই ফল কোথা হতে আসলো?” উত্তরে তিনি বলতেনঃ “এগুলি আল্লাহ তাআলার নিকট হতে এসেছে। তিনি এমন ক্ষমতাবান যে, যাকে ইচ্ছা করেন বে হিসেবে রিক দান করে থাকেন।
অতঃপর আল্লাহ তাআ’লা হযরত মারইয়ামের (আঃ) গর্ভে হযরত ঈসাকে (আঃ) সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন, যিনি পঁচিজন স্থির প্রতিজ্ঞ নবীদের একজন ছিলেন।
হযরত মারইয়াম (আঃ) মসজিদে কুদসের পূর্ব দিকে গমন করেন। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, হায়েয বা মাসিক ঋতুর কারণেই তিনি ঐ দিকে গিয়েছিলেন। অন্যদের মতে তিনি অন্য কোন কারণে গিয়েছিলেন। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আহলে কিতাবের উপর বায়তুল্লাহ মুখী হওয়া ও হজ্ব করা ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু হযরত মারইয়াম (আঃ) বায়তুল মুকাদ্দাস হতে পুর্ব দিকে গমন করেছিলেন বলে তারা পূর্ব মুখী হয়েই নামায পড়তে শুরু করে দেয়। হযরত ঈসার (আঃ) জন্মস্থানকে তারা নিজেরাই কিবলা বানিয়ে নেয়। বর্ণিত আছে যে, হযরত মারইয়াম (আঃ) যে জায়গায় গিয়েছিলেন সেটা ছিল ঐ জনদপ হতে দূরে এক নির্জন স্থান। কথিত আছে যে, সেখানে তার শস্যক্ষেত্র ছিল এবং তাতে তিনি পানি দিতে গিয়েছিলেন। একথাও বলা হয়েছে যে, সেখানে তিনি একটি কক্ষ বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জনগণ হতে পৃথক হয়ে নির্জনে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
যখন হযরত মারইয়াম (আঃ) জনগণ হতে পৃথক হয়ে দূরে চলে যান এবং তাদের মধ্যে ও তার মধ্যে আড়াল হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে ফেরেশতা হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) প্রেরণ করেন। তিনি পূর্ণ মানবাকৃতিতে তার সামনে প্রকাশিত হন। এখানে ‘রূহ দ্বারা এই মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতাকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন কুরআন কারীমের (আরবী) এই আয়াতে রয়েছে।
হযরত উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) বলেন যে, রোযে আযলে যখন হযরত আদমের (আঃ) সমস্ত সন্তানের রূহসমূহের নিকট হতে তার প্রতিপালক হওয়ার স্বীকারোক্তি নিয়েছিলেন ঐ রূহগুলির মধ্যে হযরত ঈসার (আঃ) রহও ছিল। ঐ রূহকেই মানবাকৃতিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মারইয়ামের (আঃ) নিকট পাঠানো হয়। ঐ রূহই তার সাথে কথা বলেন এবং তার দেহের মধ্যে প্রবেশ করেন। (কিন্তু এই উক্তিটি অস্বাভাবিক হওয়া ছাড়াও সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার্য। খুব সম্ভব এটা বাণী ইসরাঈলেরই উক্তি হবে)
হযরত মারইয়াম (আঃ) ঐ জনশূন্য স্থানে একজন অপরিচিত লোক দেখে মনে করেন যে, হয়তো কোন দুষ্ট প্রকৃতির লোক হবে। তাকে তিনি আল্লাহর ভয় দেখিয়ে বলেনঃ “আপনি খোদাভীরু লোক হলে তাকে ভয় করুন। আমি তারই কাছে আশ্রয় চাচ্ছি।” তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য দেখেই হযরত মারইয়াম (আঃ) বুঝে ফেলেছিলেন যে, তিনি ভাল লোকই হবেন এবং তিনি জানতেন যে, ভাল লোকের জন্যে আল্লাহর ভয়ই যথেষ্ট। ফেরেশতা হযরত মারইয়ামের (আঃ) ভয় ভীতি দূর করে দেয়ার জন্যে পরিষ্কার ভাবে বলেনঃ “আপনি অন্য কোন ধারণা করবেন না, আমি আল্লাহ তাআলার প্রেরিত ফেরেশতা।” বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তাআলার নাম শুনেই হযরত জিবরাঈল (আঃ) কেঁপে উঠেন এবং নিজের প্রকৃতরূপ ধারণ করেন। আর বলে দেনঃ “ আমি আল্লাহর একজন দূত রূপে প্রেরিত হয়েছি। তিনি আমাকে এজন্যেই প্রেরণ করেছেন যে, তিনি আপনাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করবেন।”
(আরবী) এর দ্বিতীয় পঠন (আরবী) রয়েছে। প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত কারী আবু উমার ইবনু আলার কিরআত এটাই। দুটো কিরআতেরই মতলব পরিষ্কার।
হযরত জিবরাঈলের (আঃ) এ কথা শুনে হযরত মারইয়াম (আঃ) আরো বেশী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেনঃ “সুবহানাল্লাহ! আমরি সন্তান হওয়া কি করে সম্ব? আমার তো বিয়েই হয় নাই এবং কখনো কোন খারাপ খেয়াল আমার মনে জাগে নাই। আমার দেহ কখনো কোন পুরুষ লোক স্পর্শ করে নাই এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই। সুতরাং আমার সন্তান হওয়া কেমন কথা।”
(আরবী) শব্দ দ্বারা ব্যভিচারিণীকে বুঝানো হয়েছে। হাদীসেও এই শব্দটি এই অর্থেই এসেছে। যেমন বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ ব্যভিচারিণীর খরচা হারাম।
হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর এই বিস্ময় দূর করার জন্যে বলেনঃ “এটা সত্য বটে, তবে স্বামী ছাড়া বা অন্য কোন উপকরণ ও উপাদান ছাড়াও আল্লাহ তাআলা সন্তান দানে সক্ষম। তিনি যা চান তাই হয়। তিনি এই সন্তান ও এই ঘটনাকে মানুষের জন্যে একটা নিদর্শন বানাতে চান। এটা আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন হবে যে, তিনি সর্ব প্রকারের সষ্টির উপরই সক্ষম। হযরত আদমকে (আঃ) তিনি পুরুষ ও নারীর মাধ্যম ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন। হাওয়াকে (আঃ) তিনি সৃষ্টি করেছেন নারী ছাড়াই-শুধু পুরুষের মাধ্যমে। বাকী সমস্ত মানুষকে তিনি পুরুষ ও নারীর মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন। শুধু হযরত ঈসা (আঃ) এই নিয়মের ব্যতিক্রম। তিনি পুরুষ ছাড়াই শুধু নারীর মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছেন। সুতরাং মানব সৃষ্টির এই চারটি নিয়ম হতে পারে এবং সবটাই মহান আল্লাহ পুরো করে দেখিয়েছেন। এভাবে তিনি নিজের ব্যাপক ও পূর্ণক্ষমতা ও বিরাটত্বের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। এটা বাস্তব কথা যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই এবং কোন প্রতিপালকও নেই। এই শিশু আল্লাহর রহমতরূপে পরিগণিত হবেন। তিনি তাঁর নবী হবেন। তিনি মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান করবেন।” অন্য জায়গায় রয়েছেঃ “যখন ফেরেশতাগণ বললোঃ হে মারইয়াম (আঃ)! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন একটি কালেমার যা আল্লাহর পক্ষ হতে হবে; তার নাম হবে মাসীহ্ ঈসা ইবনু মারইয়াম; সম্মানিত হবে ইহলোকে এবং পরলোকে, আর সান্নিধ্য প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। মানুষের সাথে কথা বলবে দোলনার মধ্যে এবং প্রাপ্ত বয়সে এবং সসভ্য লোকদের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ তিনি বাল্যাবস্থায় ও বৃদ্ধ বয়সে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আহবান করবেন।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত মারইয়াম (আঃ) বলেনঃ “ঈসা (আঃ) আমার পেটে থাকা অবস্থায় যখন আমি নির্জনে থাকতাম তখন সে আমার সাথে কথা বলতো। আর যখন আমি লোকদের সাথে থাকতাম তখন সে তাসবীহ ও তাকবীর পাঠ করতো।” (এটা ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ঘোষিত হচ্ছেঃ এটাতো এক স্থিরকৃত ব্যাপার। খুব সম্ভব যে, এটাও হযরত জিবরাঈলেরই (আঃ) উক্তি। আবার এও হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলার এই ফরমান রাসূলুল্লাহর (সঃ) মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছে। আর এর দ্বারা রূহ ফুকে দেয়াই উদ্দেশ্য। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ “ইমরানের কন্যা মারইয়াম (আঃ), যে তার গুপ্তাঙ্গকে পবিত্র রেখেছিল এবং আমি তার মধ্যে আমার রূহ ফুকে ছিলাম।” সুতরাং এই বাক্যের ভাবার্থ হচ্ছেঃ এটা তো হয়েই যাবে। আল্লাহ তাআলা এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
২২-২৩ নং আয়াতের তাফসীর:
বর্ণিত আছে যে, যখন হযরত মারইয়াম (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ শুনে নেন এবং তাঁর সামনে নত হয়ে পড়েন তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) তার জামার কলারের মধ্যে দিয়ে ফুৎকার দেন, যার ফলে আল্লাহর হুকুমে তিনি গর্ভবতী হয়ে যান। এরপর তিনি কঠিনভাবে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন এবং জনগণকে তিনি কি জবাব দিবেন একথা ভেবে তিনি কেঁপে ওঠেন। তার ধারণা হলো যে, তিনি নিজেকে লক্ষবার দোষমুক্ত বললেও তাঁর ঐ অস্বাভাবিক কথা বিশ্বাস করবে কে? এভাবে ভয়ে ভয়েই তিনি কালাতিপাত করতে থাকেন। কারো কাছেই তিনি ঐ ঘটনা প্রকাশ করেন নাই। হাঁ, তবে একদা তিনি তার খালা হযরত যাকারিয়ার (আঃ) স্ত্রীর নিকট আগমন করেন।
তাঁর খালা তখন তাঁর কাঁধে কাঁধ মিলানোর পর বলেন, “হে আমার বোনের মেয়ে আল্লাহর অসীম ক্ষমতাবলে ও তোমার খালুর প্রার্থনার বরকতে এই বৃদ্ধ বয়সেও আমি গর্ভবতী হয়ে গেছি।” তখন হযরত মারইয়াম (আঃ) তাকে বললেনঃ “খালাজান! আমার সাথে এরূপ এরূপ ঘটনা ঘটেছে এবং আমিও নিজেকে গর্ভবতী দেখছি।” তিনি ছিলেন নবী পরিবারের মহিলা, কাজেই তিনি আল্লাহর ক্ষমতার উপর এবং মারইয়ামের (আঃ) সত্যবাদিতার উপর ঈমান আনয়ন করেন। এখন থেকে অবস্থা এই দাড়ালো যে, যখনই তাঁরা দু’জন একত্রে মিলিত হতেন তখন খালা অনুভব করতেন যে, তার পেটের সন্তান যেন তার ভাগিনেয়ীর পেটের সন্তানের সামনে ঝুঁকে পড়ছে ও তাকে সম্মান করছে। তাদের মাযহাবে এটা জায়েযও ছিল। এ কারণেই হযরত ইউসুফের (আঃ) ভ্রাতাগণ ও তাঁর পিতা মাতা তাকে সিজদা করেছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদেরকে হযরত আদমের (আঃ) সামনে সিজদাবনত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের শরীয়তে এইরূপ সম্মান প্রদর্শন আল্লাহ তাআলার জন্যেই বিশিষ্ট হয়ে গেছে। অন্যকারো সামনে সিজদাবনত হওয়া আমাদের শরীয়তে হারাম। কেননা, এইরূপ সম্মান প্রদর্শন আল্লাহর মাহাত্ম্যের বিপরীত। এটা একমাত্র তার জন্যেই শোভা পায়।
ইমাম মালিক (রঃ) বলেন যে, হযরত ঈসা (আঃ) ও হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) পরস্পর খালাতো ভাই ছিলেন। তাঁরা দুজন একই সময়ে নিজ নিজ মায়ের গর্ভে ছিলেন। হযরত ইয়াহ্ইয়ার (আঃ) মাতা প্রায়ই হযরত মারইয়ামকে (আঃ) বলতেনঃ “আমার এরূপ মনে হচ্ছে যে, আমার পেটের সন্তান যেন তোমার পেটের সন্তানের সামনে সিজদা করছে। এর দ্বারা হযরত ঈসার (আঃ) উচ্চ মর্যাদার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কেননা, আল্লাহ তাআলার হুকুমে তিনি মৃতকে জীবিত করতেন এবং জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে ভাল করতেন। জমহুরের উক্তি তো এটাই যে, তিনি নয় মাস পর্যন্ত মাতার গর্ভে ছিলেন। ইকরামা (রঃ) বলেন, আট মাস পর্যন্ত ছিলেন। তিনি বলেন যে, এজন্যেই আট মাস পর্যন্ত থাকা সন্তান প্রায়ই বাঁচে না। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, হযরত মারইয়াম (আঃ) গর্ভবতী হওয়ার সাথে সাথেই হযরত ঈসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এটা গারীব উক্তি। সম্ভৱতঃ আয়াতের বাহ্যিক শব্দ দেখেই তিনি এটা ধারণা করেছেন। কেননা, গর্ভ পৃথক হওয়া এবং প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার বর্ণনা (আরবী) অক্ষরের সাথে রয়েছে। আর (আরবী) অক্ষরটি (আরবী) (পিছনে পিছনে আসা বা পরপরই আসা) এর জন্যে এসে থাকে। কিন্তু এই যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) বিষয় অনুপাতে হয়ে থাকে। অর্থাৎ “আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার উপাদান হতে। অতঃপর আমি ওকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আধারে। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি জমাট রক্তে; অতঃপর জমাট রক্তকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে।” এখানেও দুই জায়গায় রয়েছে এবং এটাও এর জন্যেই বটে। কিন্তু হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, এই দুই অবস্থায় চল্লিশ দিনের ব্যবধান থাকে। কুরআন কারীমের এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি কি দেখ নাই যে, আল্লাহ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, অতঃপর যমীন সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে?” (২২:৬৩) এটা স্পষ্টভাবে প্রকাশমান যে, বৃষ্টি বর্ষণের বহু দিন পরে মাঠ সবুজ শ্যামল হয়ে থাকে। অথচ (আরবী) এখানেও রয়েছে। সুতরাং বুঝা গেল যে, (আরবী) প্রত্যেক জিনিসের জন্যে ওর অনুপাতেই হয়ে থাকে।
সোজা কথা এটাই যে, হযরত মারইয়াম (আঃ) অন্যান্য স্ত্রী লোকদের মতই গর্ভধারণের পূর্ণ সময় অতিবাহিত করেন এবং ঐ সময় তিনি মসজিদেই কাটিয়ে দেন। মসজিদে আরো একজন খাদেম ছিলেন। তাঁর নাম ছিল ইউসুফ নাজ্জার। তিনি হযরত মারইয়ামকে (আঃ) ঐ অবস্থায় দেখে তার প্রতি কিছুটা সন্ধিহান হয়ে পড়েন। কিন্তু তার সংসার বিমুখতা খোদাভীরুতা, ইবাদত বন্দেগী এবং সত্যবাদিতার প্রতি খেয়াল করে তার ঐ সন্দেহ দূরীভূত হয়। কিন্তু যত যত দিন অতিবাহিত হয়, তার গর্ভ প্রকাশিত হতে থাকে। কাজেই আর তিনি নীরব থাকতে পারলেন না। একদিন আদবের সাথে তাঁকে বললেনঃ “হে মারইয়াম (আঃ)! আপনাকে আমি একটি কথা জিজ্ঞেস করছি অসন্তুষ্ট হবেন না। আচ্ছা বলুন তো, বিনা বীজে গাছ হয়? বিনা দানায় কি ফসল হয়? বিনা বাপে কি সন্তান হয়? হযরত মারইয়াম (আঃ) তাঁর উদ্দেশ্য বুঝে ফেললেন। তাই, তিনি উত্তরে বললেনঃ “এই সবকিছুই সম্ভ। সর্বপ্রথম যে গাছটি আল্লাহ সৃষ্টি করেন তা বিনা বীজেই ছিল। সর্বপ্রথম যে ফসল আল্লাহ উৎপন্ন করেন তা বিনা দানাতেই ছিল। আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম হযরত আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করেন এবং তাঁর বাপ ছিল না। এমনকি মাও ছিল না। তার এ জবাবে ঐ লোকটি সব কিছু বুঝে নিলেন এবং আল্লাহর শক্তিকে অস্বীকার করতে পারলো না।
হযরত মারইয়াম (আঃ) যখন দেখলেন যে, তাঁর কওমের লোকেরা তাঁর উপর অপবাদ দিতে শুরু করেছে, তখন তাদেরকে ছেড়ে তিনি বহু দূরে চলে। যান। ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (রঃ) বলেন যে, যখন গর্ভের অবস্থা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন তার কওম তাকে নানা কথা বলে। তারা হযরত ইউসুফ নাজ্জারের (রঃ) মত সৎলোকের উপর এই অপবাদ দেয়। তখন তিনি তাদের নিকট থেকে সরে পড়েন। না কেউ তাঁকে দেখতে পায় এবং না তিনি কাউকেও দেখতে পান। প্রসব বেদনা উঠে গেলে হযরত মারইয়াম (আঃ) একটি খেজুর গাছের নীচে বসে পড়েন। কথিত আছে যে, এই নির্জন স্থানটি ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্ব দিকের কক্ষটি। এটাও একটি উক্তি আছে যে, যখন তিনি সিরিয়া ও মিসরের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছেন, তখন তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। আর একটি উক্তি আছে যে, তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস হতে। আট মাইল দূরে গিয়েছিলেন। ঐ বস্তীটির নাম ছিল বাইতে লাহাম। পর্বে মিরাজের ঘটনায় একটি হাদীস গত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, হযরত ঈসার (আঃ) জন্ম গ্রহণের স্থানও ছিল বাইতে লাহাম। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
প্রসিদ্ধ উক্তিও এটাই এবং খৃস্টানরা তো এর উপর একমত। আর উপরোক্ত হাদীস দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হয় যদি ও হাদীসটি বিশুদ্ধ হয়।
ঐ সময় হযরত মারইয়াম (আঃ) মৃত্যু কামনা করতে লাগলেন। কেননা, দ্বীনের ফিৎনার সময় এ কামনাও জায়েয। তিনি জানতেন যে, কেউই তাকে সত্যবাদিনী বলবে না এবং তাঁর বর্ণিত ঘটনাকে সবাই মনগড়া মনে করবে। দুনিয়া তঁাকে হতবুদ্ধি করে ফেলবে। ইবাদত ও স্থিরতায় বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। সবাই তার দুর্নাম করবে। জনগণের মধ্যে খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে। তাই, তিনি বলতে লাগলেনঃ “হায়! এর পূর্বে যদি আমি মরে যেতাম। এবং যদি আমাকে সৃষ্টি করাই না হতো! হায়! যদি আমি লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম!” লজ্জা শরম তাকে এমনভাবে পরিবেষ্টন করে ফেললো। যে, তিনি ঐ কষ্টের উপর মৃত্যুকেই প্রাধান্য দিলেন এবং কামনা করলেন যে, যদি তিনি জনগণের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে পড়তেন। তবে কতই না ভাল হতো! না কেউ তাকে স্মরণ করতো, না কেউ খোজ খবর নিতো, না তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতো। হাদীস সমূহে মৃত্যু কামনা।
করতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা ঐ রিওয়াইয়াতগুলিকে (আরবী) এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করে দিয়েছি।
২৪-২৬ নং আয়াতের তাফসীর:
(আরবী) এর দ্বিতীয় কিরআত (আরবী) ও রয়েছে। এই সম্বোধনকারী ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আঃ)। হযরত ঈসার (আঃ) প্রথম কাজ তো ওটাই ছিল, যা তিনি তার মাতাকে দোষমুক্ত করা ও পবিত্রতা প্রকাশের ব্যাপারে জনগণের সামনে করেছিলেন। ঐ উপত্যকার নীচের পার্শ্বদেশ হতে হযরত মারইয়াম (আঃ) ঐ চিন্তা ও উদ্বেগের অবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাকে এইভাবে সান্ত্বনা দান করেছিলেন। এই উক্তিও রয়েছে যে, এই সান্ত্বনামূলক কথা হযরত ঈসাই (আঃ) বলেছিলেন। শব্দ আসেঃ দুঃখ করো না ও চিন্তিত হয়ো না। দেখো, তোমার পায়ের নীচে নির্মল, স্বচ্ছ মিষ্টপানির ঝরণা তোমার প্রতিপালক প্রবাহিত করে দিয়েছেন। তুমি এই পানি পান করে নাও। একটি উক্তি এটাও আছে যে, ঐ ঝর্ণনা বা প্রস্রবণ দ্বারা স্বয়ং হযরত ঈসাকেই (আঃ) বুঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই বেশী প্রকাশমান। যেহেতু এই পানির বর্ণনার পরেই খাবারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছেঃ যাও, খেজুরের এই গাছটিকে নাড়া দাও। এর থেকে টাটকা ও পুষ্ট খেজুর ঝরে পড়বে। কথিত আছে যে, ঐ খেজুরের গাছটি শুকিয়ে গিয়েছিল। আবার এ উক্তিও আছে যে, ওটা ফল দানকারীই ছিল। বাহ্যতঃ জানা যাচ্ছে যে, ঐ সময় ঐ গাছটি খেজুর শূন্য ছিল। কিন্তু হযরত মারইয়াম (আঃ) ওটা নাড়া দেয়া মাত্রই মহান আল্লাহর কুদরতে তার থেকে খেজুর ঝরে পড়তে থাকে। তার কাছে খাদ্য ও পানীয় সবকিছুই মওজুদ হয়ে গেল। আর তাকে পানাহারের অনুমতি দেয়া হলো। বলা হলোঃ ‘খাও, পান কর ও চক্ষু জুড়িয়ে নাও।
হযরত আমরা ইবনু মায়মূন (রাঃ) বলেছেন যে, নিফাস বিশিষ্টা (নতুন সন্তান প্রসবকারিণী) মহিলাদের জন্যে টাটকা খেজুর ও শুষ্ক খেজুর অপেক্ষা উত্তম খাদ্য আর কিছুই নেই।
হযরত আলী ইবনু আবি তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা খেজুর বৃক্ষের সম্মান করো। কেননা, এটাকে ঐ মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে যা দ্বারা হযরত আদম (আঃ) সৃষ্টি হয়েছিলেন। এটা ছাড়া অন্য কোন গাছ নর ও মাদী মিলিত হয়ে ফলে না। স্ত্রী লোকদেরকে তাদের সন্তান প্রসবের সময় টাটকা খেজুর খেতে দেবে। না পেলে শুষ্ক খেজুরই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলার নিকট অন্য কোন গাছ এর চেয়ে বেশী মর্যাদা সম্পন্ন নয়। এ কারণেই এর নীচে হযরত মারইয়াম (আঃ) অবতারিতা হন।” (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা সম্পূর্ণরূপে মুনকার বা অস্বীকার্য)
(আরবী) এর অন্য কিরআত (আরবী) ও (আরবী) রয়েছে। সব কিরআতের ভাবার্থ একই।
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ তুমি কারো সাথে কথা বলো না, শুধু ইশারা ইঙ্গিতে তাদেরকে বুঝিয়ে দাও যে, তুমি রোযা রেখেছে। কিংবা উদ্দেশ্য এই যে, তাদের রোযায় কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল অথবা ভাবার্থ হচ্ছেঃ আমি কথা বলা থেকেই রোযা রেখেছি। অর্থাৎ আমাকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
হারেসা (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি হযরত ইবনু মাসউদের (রাঃ) নিকট অবস্থান করছিলাম। এমন সময় দু’জন লোক তার নিকট আগমন করে। তাদের একজন সালাম করলো কিন্তু অন্যজন সালাম করলো না। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার সালাম না করার কারণ কি?” তার সঙ্গীরা উত্তরে বললোঃ “আজ কারো সাথে কথা না বলার সে কসম খেয়েছে। তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) তাকে বললেনঃ “তুমি লোকদের সাথে কথা বলো ও তাদেরকে সালাম দাও। এটা তো ছিল। শুধু হযরত মারইয়ামের (আঃ) জন্য। কেননা, আল্লাহ তাআলা তাঁর সত্যবাদিতা ও মাহাত্ম প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। এজন্যে তার পক্ষে ওটা ওযর ছিল।” (এটা ইসহাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবদুর রহমান ইবনু যায়েদ (রঃ) বলেন যে, যখন হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর মাতাকে বলেনঃ “আপনি বিচলিত হবেন না।” তখন তার মাতা হযরত মারইয়াম (আঃ) বলেনঃ কিরূপে আমি বিচলিত না হই? আমার স্বামী নেই এবং আমি কারো অধিকারীভুক্ত বাদী বা দাসীও নই। দুনিয়াবাসী বলবে যে, এ সন্তান কিরূপে হলো? আমি তাদের সামনে কি জবাব দেবো? তাদের সামনে আমি কি ওর পেশ করবো? হায়! যদি আমি ইতিপূর্বেই মরে যেতাম! যদি আমি লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম!” ঐ সময় হযরত ঈসা (আঃ) বলেছিলেনঃ “আম্মাজান! কারো সামনে কিছু বলার আপনার কোন প্রয়োজন নেই। যা কিছু বলার আমিই বলবো। আমিই আপনার জন্যে যথেষ্ট। মানুষের মধ্যে কাউকেও যদি আপনি দেখেন, তবে বলবেনঃ ‘আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতাবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোন মানুষের সাথে বাক্যালাপ করবো না।” তিনি বলেন যে, এগুলি সবই হযরত ঈসার (আঃ) তাঁর মাতার উদ্দেশ্যে উক্তি। অহাবও (রঃ) এরূপই বলেছেন। (এটা ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
২৭-৩৩ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত মারইয়াম (আঃ) আল্লাহ তাআলার এই হুকুমও মেনে নেন এবং নিজের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে জনগণের নিকট হাজির হন। তাঁকে ঐ অবস্থায় দেখা মাত্রই প্রত্যেকে সঁতে আঙ্গুল কাটে এবং সবারই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েঃ “মারইয়াম (আঃ)! তুমি তো বড়ই মন্দ কাজ করেছো!” নাউফ বাকারী (রঃ) বলেন যে, লোকেরা হযরত মারইয়ামকে (আঃ) খোজে বের হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তাআলার কি মাহাত্ম যে, তারা কোথাও তাকে খুঁজে পায় নাই। পথে একজন রাখালের সাথে তাদের সাক্ষাৎ হলে তারা তাকে জিজ্ঞেস করেঃ “এরূপ এরূপ ধরণের কোন স্ত্রী লোককে এই জঙ্গলের কোন জায়গায় দেখেছো কি?” উত্তরে সে বলেঃ “না তো। তবে রাত্রে আমি এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখেছি। আমার এই সব গরু এই উপত্যকার দিকে সিজদায় পড়ে গিয়েছিল। ইতিপূর্বে আমি কখনো এরূপ দেখি নাই। আমি স্বচক্ষে ঐদিকে এক নূর (জ্যোতি) দেখেছি।” লোকগুলি ঐ নিশানা ধরে চলতে শুরু করে। এমতাবস্থায় তারা হযরত মারইয়ামকে (আঃ) দেখতে পায় যে, তিনি সন্তানকে কোলে করে এগিয়ে আসছেন। লোকগুলিকে দেখে সেখানেই তিনি সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে পড়েন। তারা সবাই তাকে ঘিরে ফেলে এবং বলতে থাকেঃ “হে মারইয়াম (আঃ)! তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেছে। তারা তাকে হারূণের ভগ্নী বলে সম্বোধন করার কারণ এই যে, তিনি হযরত হারূণের (আঃ) বংশেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অথবা হয়তো তাঁর পরিবারের মধ্যে হারূণ নামক একজন সৎ লোক ছিলেন এবং তিনি ইবাদত বন্দেগী ও আধ্যাত্মিক সাধনায় তাকেই অনুসরণ করছিলেন। এজন্যেই তাকে হারূণের ভগ্নী বলা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন যে, হারূণ নামক একজন দুষ্ট লোক ছিল। এজন্যে লোকেরা উপহাস করে তাকে হারূণের বোন বলেছিল। এসব উক্তি হতে সবচেয়ে বেশী গারীব উক্তি হলো এই যে, তিনি হযরত হারূণের (আঃ) ও হযরত মূসার (আঃ) সহদরা ভগ্নী ছিলেন, যাকে হযরত মূসার (আঃ) মাতা হযরত মূসাকে বাক্সে ভরে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সময় বলেছিলেনঃ “তুমি এই বাক্সের পিছনে পিছনে সমুদ্রের ধার দিয়ে এমনভাবে চলবে যে, কেউ যেন বুঝতেই না পারে। কিন্তু এই উক্তিটি একেবারে ভুল ও ভিত্তিহীন। কেননা, কুরআন কারীম দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, হযরত ঈসা (আঃ) বাণী ইসরাঈলের শেষ নবী ছিলেন। তার পরে শুধু খাতামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) নবী হন। আর হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “আমিই হযরত ঈসা ইবনু মারইয়ামের (আঃ) সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী কেননা, আমার ও তার মাঝে অন্য কোন নবীর আবির্ভাব হয় নাই।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)
সুতরাং যদি মুহাম্মদ ইবনু কা’ব কারাযীর (রঃ) উক্তি সঠিক হয় যে, হযরত ঈসার (আঃ) মাতা হযরত মারইয়াম (আঃ) হারূণের (আঃ) ভগ্নী ছিলেন, তবে এটা মানতে হবে যে, তিনি হযরত দাউদ (আঃ) ও হযরত সুলাইমানের (আঃ) পূর্বে বিদ্যমান ছিলেন। কেননা, কুরআন কারীমে বিদ্যমান রয়েছে যে, হযরত দাউদ (আঃ) হযরত মূসার (আঃ) পরে এসেছেন। আয়াত গুলি হলোঃ (আরবী) (২:২৪৬)।
এই আয়াতগুলিতে হযরত দাউদের (আঃ) ঘটনা এবং তাঁর জাতকে হত্যা করার বর্ণনা রয়েছে। আর এতে এই শব্দ বিদ্যমান রয়েছে যে, এটা হযরত মূসার (আঃ) পরের ঘটনা। তিনি যে ভুল বুঝেছেন তার কারণ এই যে, তাওরাতে আছেঃ যখন হযরত মূসা (আঃ) বাণী ইসরাঈলসহ সমুদ্র অতিক্রম করেন এবং ফিরাউন তার কওমসহ পানিতে নিমজ্জিত হয়, তখন মারইয়াম বিনতে ইমরান, যিনি হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূণের (আঃ) ভগ্নী ছিলেন, অন্যান্য স্ত্রীলোকসহ দ (এক প্রকার বাদ্য যন্ত্র) বাজিয়ে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করতঃ তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তাওরাতের এই ইবারত থেকেই কারাযী (রঃ) মনে করে নিয়েছেন যে, ঐ মারইয়ামই হযরত ঈসার (আঃ) মাতা ছিলেন। অথচ এটা সম্পূর্ণ ভুল। হতে পারে যে, হযরত মূসার (আঃ) বোনের নামও মারইয়াম ছিল কিন্তু ঐ মারইয়াম যে ঈসার (আঃ) মাতা ছিলেন এর কোন প্রমাণ নেই, বরং এটা অস। হতে পারে যে, দুজনের একই নাম। একজনের নামে অন্যের নাম রাখা হয়ে থাকে। বাণী ইসরাঈলের তো এটা অভ্যাসই ছিল যে, তারা তাদের নবী ও ওয়ালীদের নামে নিজেদের নাম রাখতো।
হযরত মুগীরা ইবনু শু’বা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে নাজরানে প্রেরণ করেন। সেখানে আমাকে খৃস্টানরা জিজ্ঞেস করেঃ “তোমরা (আরবী) পড়ে থাকো। অথচ হযরত মূসা (আঃ) তে। হযরত ঈসার (আঃ) বহু পূর্বে অতীত হয়েছেন?” ঐ সময় আমি তাদের এই প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলাম না। মদীনায় ফিরে এসে আমি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সামনে ওটা বর্ণনা করলাম। তিনি বলেনঃ “তুমি তো তাদেরকে ঐ সময়েই এ উত্তর দিতে পারতে যে, ঐ লোকেরা তাদের পূর্ববর্তী নবী ও সৎ লোকদের নামে তাদের সন্তানদের নাম বরাবরই রেখে আসতো।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে। সহীহ মুসলিমেও এটা রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন।)
বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত কা’ব (রাঃ) বলেছিলেনঃ “এই হারূণ হযরত মূসার (আঃ) ভাই হারূণ (আঃ) নন।” উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত কাবের (রাঃ) একথা অস্বীকার করেন। তখন হযরত কা’ব (রাঃ) তাকে বলেনঃ “যদি আপনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হতে কিছু শুনে থাকেন, তবে আমি তা মানতে সম্মত আছি। অন্যথায় ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে তো তাদের মাঝে ছয় শ বছরের ব্যবধান রয়েছে। তাঁর একথা শুনে হযরত আয়েশা (রাঃ) নীরব হয়ে যান। (এই ইতিহাসের ব্যাপারে কিছু চিন্তা বিবেচনার অবকাশ রয়েছে)
হযতর কাতাদা (রঃ) বলেন যে, হযরত মারইয়ামের (আঃ) পরিবার ও বংশের লোক উপরের স্তর হতেই সৎ ও দ্বীনদার ছিলেন এবং এই দ্বীনদারী যেন বরাবরই উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছিল। কতকগুলি লোক এরূপই। হয়ে থাকেন। আবার কতক পরিবার ও বংশ এর বিপরীতও হয় যে, উপরের স্তর থেকে নীচের স্তর পর্যন্ত সবাই খারাপ হয়। এই হারূণ বড়ই বুযুর্গ লোক ছিলেন। এই কারণেই বাণী ইসরাঈলের মধ্যে হারূণ নাম রাখার সাধারণভাবে প্রচলন হয়ে যায়। এমন কি বর্ণিত আছে যে, যেই দিন এই হারূণের জানাযা বের হয় সেই দিন তার জানাযায় ঐ হারূণ নামেরই চল্লিশ হাজার লোক শরীক হয়েছিল।
হযরত মারইয়ামের (আঃ) কওম তাকে তিরস্কারের সুরে বলেঃ “কি করে তুমি এরূপ অসৎ কাজ করলে? তুমি তো ভাল ঘরের মেয়ে! তোমার পিতামাতা উভয়েই ভাল ছিলেন। তোমার পরিবারের সমস্ত লোকই পবিত্র। এতদসত্ত্বেও কি করে তুমি একাজ করতে পারলে?” কওমের এই ভৎসনা মূলক কথা শুনে হযরত মারইয়াম (আঃ) নির্দেশ অনুযায়ী তার শিশু সন্তানের দিকে ইশারা করেন। তারা তার মর্যাদা স্বীকার করে নাই বলে তাকে অন্যায়ভাবে অনেক কিছু বললো। তারা বললোঃ “তুমি কি আমাদেরকে পাগল পেয়েছে। যে, আমরা তোমার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবো? সে আমাদেরকে কি বলবে?” ইতিমধ্যেই হযরত ঈসা (আঃ) মায়ের কোল থেকেই বলে উঠলেনঃ “হে লোক সকল! আমি আল্লাহর একজন দাস।”
হযরত ঈসার (আঃ) প্রথম উক্তি ছিল এটাই। তিনি মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করলেন এবং নিজের দাসত্বের কথা ঘোষণা করলেন। তিনি আল্লাহ তাআলার ‘যাত বা সত্তাকে সন্তান জন্মদান হতে পবিত্র বলে ঘোষণা দিলেন, এমনকি তা সাব্যস্ত করে দিলেন। কেননা, সন্তান দাস হয় না। অতঃপর তিনি বললেনঃ “আল্লাহ আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। এতে তিনি তাঁর মাতার দোষমুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন এবং দলীলও বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “আমাকে আল্লাহ তাআলা নবী করেছেন এবং কিতাব দান করেছেন।”
বর্ণিত আছে যে, যখন ঐ লোকগুলি হযরত মারইয়াম (আঃ) কে তিরস্কার করছিল ঐ সময় হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর দুধ পান করছিলেন। তাদের ঐ তিরস্কার বাণী শুনে তিনি স্তন থেকে মুখ টেনে নেন এবং বাম পার্শ্বে ফিরে তাদের দিকে মুখ করে এই উত্তর দেন। কথিত আছে যে, এই উক্তির সময় তার অঙ্গলী উখিত ছিল এবং হাত কাধ পর্যন্ত উঁচু ছিল। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, আমাকে কিতাব দিয়েছেন তার এই উক্তির ভাবার্থ হচ্ছেঃ আমাকে কিতাব দেয়ার ইচ্ছা করেছেন। এটা পূর্ণ হবেই। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, জন্ম গ্রহণের সময়েই হযরত ঈসার (আঃ) সব কিছু মুখস্থ ছিল এবং তাকে সব কিছু শিখিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছিল। (কিন্তু এই উক্তিটির সনদ ঠিক নয়) হযরত ঈসা (আঃ) আরো বলেনঃ “যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি (আল্লাহ) আমাকে আশিস ভজিন করেছেন। আমি মানুষকে কল্যাণের কথা শিক্ষা দেবে এবং তারা আমার দ্বারা উপকৃত হবে।”
বানূ মাখযুম গোত্রের গোলাম অহাব ইবনু অরূদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একজন আলেম তার চেয়ে বড় একজন আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আল্লাহ আপনার উপর দয়া করুন! বলুন তো, আমার কোন আমল আমি ঘোষণা বা প্রচার করতে পারি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ। কেননা, এটাই হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন যা সহ তিনি তাঁর নবীদেরকে তার বান্দাদের নিকট পাঠিয়েছিলেন। সমস্ত ধর্মশাস্ত্রবিদ এ বিষয়ে একমত যে, হযরত ঈসার (আঃ) এই সাধারণ বরকত দ্বারা ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে নিষেধকেই বুঝানো হয়েছে। তিনি যেখানেই আসতেন, যেতেন, উঠতেন ও বসতেন সেখানেই তার একাজ তিনি চালু রাখতেন। আল্লাহর কথা মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে তিনি কখনো কার্পণ্য করতেন না।
হযরত ঈসা (আঃ) আরো বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যতদিন আমি জীবিত থাকবে, ততদিন যেন নামায পড়ি ও যাকাত প্রদান করি। আমাদের নবীকেও (সঃ) এই নির্দেশই দেয়া হয়েছিল। তার ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “মৃত্যু পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদতে লেগে থাকো।” (১৫:৯৯) সুতরাং হযরত ঈসাও (আঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা আমার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ দুটি কাজ আমার উপর ফরয করে দিয়েছেন। এর দ্বারা তকদীর সাব্যস্ত হয় এবং যারা তকদীরকে অস্বীকার করে তাদের দাবী খণ্ডন করা হয়ে যায়।
অতঃপর তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের সাথে সাথে আমাকে এ হুকুমও দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন আমার মাতার প্রতি অনুগত থাকি। কুরআন কারীমে এ দুটি বর্ণনা প্রায়ই একই সাথে দেয়া হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।” (১৭:২৩) অন্য এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো আমার ও তোমার পিতা-মাতার।” (৩১:১৪)
তিনি বলেনঃ তিনি (আল্লাহ) আমাকে উদ্ধত ও হতভাগ্য করেন নাই। আল্লাহ তাআলা আমাকে এমন উদ্ধত করেন নাই যে, আমি তার ইবাদত এবং আমার মাতার আনুগত্যের ব্যাপারে অহংকার করি এবং হতভাগ্য হয়ে যাই। সুফিয়ান সাওরী (রঃ) বলেন যে, (আরবী) ও (আরবী) হলো ঐ ব্যক্তি যে ক্রোধের সময় কাউকেও হত্যা করে ফেলে। পূর্ব যুগীয় কোন কোন মনীষী বলেছেন যে, পিতা-মাতার অবাধ্য সেই হয়, যে উদ্ধত ও হতভাগ্য হয়। দুশ্চরিত্র সেই হয়, যে গর্ব ও অহংকার করে।
বর্ণিত আছে যে, একটি স্ত্রী লোক হযরত ঈসার (আঃ) মু’জিযাগুলি দেখে তাঁকে বলেঃ “ঐ পেট কতই না বরকতময়, যে পেট আপনাকে বহন করেছে এবং ঐ সন্তান কতইনা কল্যাণময়, যে আপনাকে দুধ পান করিয়েছে। তার একথার জবাবে হযরত ঈসা (আঃ) বলেনঃ “ঐ ব্যক্তির জন্যে সুসংবাদ, যে আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, অতঃপর ওর অনুসরণ করে এবং উদ্ধত ও হতভাগ্য হয় না।”
এরপর হযরত ঈসা (আঃ) বলেন, আমার প্রতি ছিল শান্তি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি ও শান্তি থাকবে যে দিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি পুনরুত্থিত হবে। এর দ্বারাও হযরত ঈসার (আঃ) দাসত্ব এবং সমস্ত মাখলুকের মত তিনিও যে আল্লাহর এক মাখলুক, এটা প্রমাণিত হচ্ছে। সমস্ত মানুষ যেমন অস্তিত্বহীনতা হতে অস্তিত্বে এসেছে, অনুরূপ ভাবে তিনিও অস্তুিতহীনতা হতে অস্তিত্বে এসেছেন। অতঃপর তিনি মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন জীবিত অবস্থায় পুনরুতিও হবেন। তবে এই তিনটি অবস্থা অত্যন্ত কঠিন হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জন্যে এটা সহজ হয়ে যাবে। তার মধ্যে কোন উদ্বেগ ও ভয়-ভীতি থাকবে না; বরং তিনি পূর্ণভাবে শান্তি লাভ করবেন। তার উপর আল্লাহর দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।
৩৪-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফাকে (সঃ) বলছেনঃ হযরত ঈসার (আঃ) ঘটনার ব্যাপারে যে লোকদের মতানৈক্য ছিল, ওর মধ্যে যা সঠিক, তা আমি বর্ণনা করলাম। (আরবী) এর দ্বিতীয় পঠন (আরবী) ও রয়েছে। হযরত ইবনু মাসউদের (রাঃ) কিরআতে (আরবী) রয়েছে। (আরবী) শব্দের (আরবী) ‘কে (আরবী) বা পেশ দিয়ে পড়াই বেশী প্রকাশমান। আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তিটিই এর প্রমাণ। তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এটা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে সত্য, সুতরাং তুমি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।” (৩:৬০) হযরত ঈসা (আঃ) যে আল্লাহর নবী ও বান্দা ছিলেন এ কথা বলার পর আল্লাহ তাআলা নিজের সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করছেন। তার মাহাত্মের এটা সম্পূর্ণ বিপরীত যে, তার সন্তান হবে। অজ্ঞ ও যালিম লোকেরা যে এই গুজব রটিয়ে ফিরছে তার থেকে মহান আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে পবিত্র এবং তিনি এর থেকে দূরে রয়েছেন। তিনি যে কাজের ইচ্ছা করেন, সে জন্যে তার কোন উপকরণের প্রয়োজন হয় না। তিনি শুধু মাত্র বলেনঃ ‘হও’ আর তেমনই তা হয়ে যায়। একদিকে হুকুম এবং অন্যদিকে জিনিস মওজুদ। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই ঈসার (আঃ) আশ্চর্য অবস্থা আল্লাহর নিকট আদমের (আঃ) আশ্চর্য অবস্থার ন্যায়, তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করলেন, তৎপর তা (রকালবীকে বললেনঃ (সজীব) হয়ে যাও, তখনই তা (সজীব) হয়ে গেলো এই বাস্তব ঘটনা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে; সুতরাং তুমি সংশয়ীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।”
হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর কওমকে বললেনঃ আল্লাহই আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক। সুতরাং তোমরা তারই ইবাদত করো, এটাই সরল পথ! এটাই আমি আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে নিয়ে এসেছি। যারা এর অনুসরণ করবে তারা সুপথ প্রাপ্ত হবে এবং যারা এর বিপরীত করবে তারা পথভ্রষ্ট হবে।
হযরত ঈসা (আঃ) নিজের সম্পর্কে এইরূপ বর্ণনার পরেও আহলে কিতাবের দলগুলি নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি করলো। ইয়াহূদীরা বললো যে, (নাউযুবিল্লাহ) তিনি জারজ সন্তান। তাদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক যে, তারা তার একজন উত্তম রাসূলের উপর জঘন্য অপবাদ দিয়েছে। তারা বলেছে যে, তার এই কথা বলা ইত্যাদি সবই জাদু। অনুরূপভাবে খৃস্টানরাও বিভ্রান্ত হয়ে বলতে শুরু করেছে যে, তিনি তো স্বয়ং আল্লাহ এবং এই কথা আল্লাহরই কথা। অন্যেরা বলেছে যে, তিনি আল্লাহর পুত্র। আরো অন্যেরা বলেছে যে, তিনি তিন মা’বুদের মধ্যে এক মাবদ। তবে একটি দল প্রকৃত ঘটনা মুতাবেক বলেছে যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল। এটাই হচ্ছে সঠিক উক্তি। হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে মুসলমানদের আকীদা এটাই। আর মু’মিনদেরকে আল্লাহ তাআলা এই শিক্ষাই দিয়েছেন।
বর্ণিত আছে যে, বাণী ইসরাঈলের এক সম্মেলন হয়। তারা চারটি দল। ছাঁটাই করে এবং প্রত্যেক কওম নিজ নিজ আলেমকে পেশ করে। এটা হযরত ঈসার (আঃ) আকাশে উঠে যাওয়ার পরের ঘটনা। এখন চারটি দলের চারজন আলেমের মধ্যে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে মতানৈক্য হয়। একজন বলে যে, তিনি নিজেই আল্লাহ ছিলেন। তিনি যত দিন ইচ্ছা দুনিয়ায় অবস্থান করেছেন। যাকে ইচ্ছা জীবিত রেখেছেন এবং যাকে ইচ্ছা মেরে ফেলেছেন।
তার পর তিনি আকাশে উঠে গেছেন। এই দলটিকে ইয়াকুবিয়্যাত বলা হয়। বাকী তিনটি দলের তিনজন আলেম ঐ আলেমকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করে। তখন ঐ তিন জনের দুজন তৃতীয়জনকে বলেঃ “তোমার ধারণা ও মতামত কি?” সে বললোঃ “তিনি আল্লাহর পুত্র ছিলেন। এই দলটির নাম নাসতুরিয়্যাহ। অবশিষ্ট দুজন ঐ তৃতীয় জনকে বললোঃ “তুমিও ভুল বললে।” অবশিষ্ট দু’জনের একজন অপরজনকে বললোঃ “তুমি তোমার মতামত পেশ কর।” সে বললোঃ “আমার তো আকীদা এই যে, তিনি তিন মাবুদের এক মাবুদ। এক মা’দ আল্লাহ, দ্বিতীয় মাবুদ এই ঈসা (আঃ) এবং তৃতীয় মা’বুদ তাঁর মাতা মারইয়াম (আঃ)।” এই দলটির নাম ইসরাঈলিয়্যাহ। আর দলটিই ছিল খৃস্টানদের বাদশাহ। তাদের সবার উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। চুতর্থ জন বললোঃ “তোমরা সবাই মিথ্যাবাদী। হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল। তিনি ছিলেন আল্লাহর কালেমা এবং তারই নিকট হতে প্রেরিত আল্লাহর রূহ।” এই দলটি মুসলমান। আর এরাই ছিল সঠিক পথের অনুসারী। তাদের মধ্যে যার অনুসারী যে দল ছিল সেই দল তার উক্তির উপরই চলে গেলো এবং তারা পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু করে। দিলো। সর্বযুগে মুসলমানদের সংখ্যা কম থাকে বলে ঐ সব দল মুসলমানদের উপর বিজয় লাভ করলো। আল্লাহ তাআলার উক্তির তাৎপর্য এটাই যে, তারা এমন লোকদেরকে হত্যা করতো মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়ের আদেশ করতো।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা এই যে, বাদশাহ কুতুনতীন তিনবার খৃস্টানদের একত্রিত করে। শেষ বারের সম্মেলনে তাদের দু’ হাজার এক শ’ সর জন আলেম একত্রিত ছিল। কিন্তু তারা সবাই হযরত ঈসার (আঃ) ব্যাপারে বিভিন্ন মতাবলম্বী ছিল। এক শ’ জন এক কথা বললে সত্তর জন অন্য কথা বলে। পঞ্চাশ জন আরো অন্য কিছু বলে। ষাট জনের আকীদা অন্য। প্রত্যেকের মত একে অপরের বিপরীত ছিল। সবচেয়ে বড় দলটির লোক সংখ্যা ছিল তিনশ ষাট। বাদশাহ এই দলের লোক সংখ্যা বেশী দেখে এই দলভুক্ত হয়ে যায়। রাজ্যের মঙ্গল এতেই ছিল। সুতরাং তার রাজনীতি তাকে এই দলের প্রতিই মনোযোগী করলো। সে অন্যান্য সমস্ত দলকে বের করে দিলো। আর এদের জন্যে সে ‘আমানাতে কুবরা এর প্রথা আবিষ্কার করলো। প্রকৃত পক্ষে এটাই হচ্ছে জঘন্যতম খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা। এখন ঐ আলেমদের দ্বারা সে শরীয়তের মাসআলার কিতাবগুলি লিখিয়ে নিলো। আর রাজ্যের বহু রীতি-নীতি এবং শহরের জরুরী বিষয়গুলি শরীয়তরূপে তার মধ্যে দাখিল করে দিলো। সে অনেক কিছু নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করলো। এভাবে প্রকৃত দ্বীনে মাসীহর রূপ পরিবর্তন করে একটা সংমিশ্রিত দ্বীন তৈরী করলো। আর জনগণের মধ্যে ওটা আইন রূপে চালু করে দিলো। তখন থেকে দ্বীনে মাসীহ বলতে এটাকেই বুঝায়। ওটার উপর যখন সে সকলকে সম্মত করে ফেললো, তখন চতুর্দিকে গীর্জা ও ইবাদতখানা নির্মাণ করা এবং ওগুলিতে আ’লেমদেরকে বসিয়ে দিয়ে তাদের মাধ্যমে ঐ নব সৃষ্ট মাসীহিয়্যাতকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগে গেল। সিরিয়ায়, জাযীরায় এবং রোমে প্রায় বারো হাজার এইরূপ ঘর তার যুগে নির্মিত হয়। যে জায়গায় শূল তৈরী করা হয়েছিল সেখানে তারা মাতা হায়লানা একটা গম্বুজ তৈরী করিয়ে নিয়েছিল। নিয়মিতভাবে ওর পূজা শুরু হয়ে যায় এবং সবাই বিশ্বাস করে নেয় যে, হযরত ঈসাকে (আঃ) শূলে চড়ানো হয়েছে। অথচ তাদের এ উক্তিটি সম্পূর্ণ ভুল। আল্লাহ তাআলা তাকে নিজের পক্ষ থেকে আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। এটাই হলো খৃস্ট ধর্মের সংক্ষিপ্ত নমুনা।
যারা আল্লাহ তাআলার উপর মিথ্যা আরোপ করে এবং সন্তান ও শরীক স্থাপন করে তারা দুনিয়ায় হয়তো অবকাশ লাভ করবে, কিন্তু ঐ ভীষণ ভয়াবহ দিনে চতুর্দিক থেকে তাদের উপর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়ে যাবে এবং তারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা স্বীয় অবাধ্য বান্দাদেরকে তাড়াতাড়ি শাস্তি দেন না বটে, কিন্তু তাদেরকে একেবারে ছেড়েও দেন না।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা যালিমকে অবকাশ দেন, কিন্তু যখন তাকে পাকড়াও করেন, তখন তার কোন আশ্রয় স্থল বাকী থাকে না।” একথা বলার পর তিনি কুরআন কারীমের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন।
(আরবী) অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালকের পাকড়াও করার পন্থা এরূপই যে, যখন কোন অত্যাচারী গ্রামবাসীকে পাকড়াও করেন ,তখন নিশ্চিত জানবে যে, তার পাকড়াও কঠিন যন্ত্রণাদায়ক।” (১১:১০২)
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্য একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অপছন্দনীয় কথা শুনে আল্লাহ অপেক্ষা অধিক ধৈর্যশীল আর কেউই নেই। মানুষ তার সন্তান স্থাপন করে, তথাপি তিনি তাদেরকে রিযক দিতেই রয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে রেখেছেন। আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অনেক গ্রামবাসীকে, তারা অত্যাচারী হওয়া সত্ত্বেও আমি অবকাশ দিয়েছি, তারপরে তাদেরকে পাকড়াও করেছি, শেষে তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই কাছে।” (২২:৪৮) অন্য জায়গায় তিনি বলেছেনঃ “অত্যাচারী লোকেরা যেন তাদের আমলের ব্যাপারে আল্লাহকে উদাসীন ও অমনোযোগী মনে না করে। তাদেরকে তিনি অবকাশ দিচ্ছেন ঐ দিনের জন্যে, যেই দিন চক্ষু উপরের দিকে উঠে যাবে।” ঐ কথা তিনি এখানেও বলছেনঃ এই কাফিরদের এক মহা দিবসের আগমনে ভীষণ দুর্দশা রয়েছে।
হযরত উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ এক, তার কোন অংশীদার নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল, আর ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও তার রাসূল এবং তাঁর কালেমা যা তিনি মারইয়ামের (আঃ) প্রতি নিক্ষেপ করেছিলেন এবং তিনি তাঁর রূহ; আরো সাক্ষ্য দেয় যে, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, তার আমল যা-ই হোক না কেন আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবিষ্ট করবেন। (এ হাদীসটি বিশুদ্ধ। এর বিশুদ্ধ তার ব্যাপারে সবাই একমত)
৩৮-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
কিয়ামতের দিন কাফিরদের অবস্থা কিরূপ হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, আজ দুনিয়ায় কাফিররা তাদের চক্ষু বন্ধ করে রেখেছে এবং কানে সোলা দিয়েছে, (চোখেও দেখে না এবং শুনেও শুনে না), কিন্তু কিয়ামতের দিন তাদের চক্ষুগুলি খুবই উজ্জ্বল হয়ে যাবে এবং কানও উত্তমরূপে খুলে যাবে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
অর্থাৎ “যদি তুমি দেখো, তবে এক বিস্ময়কর অবস্থা দেখবে যখন এই অপরাধীরা স্বীয় প্রতিপালকের সামনে মস্তক অবনত করে থাকবে (এবং বলবে) হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শুনলাম।” (৩২:১২) সুতরাং সেই দিন দেখা ও শোনা কোনই কাজে আসবে না এবং দুঃখ ও আফসোস করেও কোন লাভ হবে না। যদি তারা দুনিয়ায় চক্ষু ও কর্ণ দ্বারা কাজ নিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে মেনে নিতো আজ আর দুঃখ ও আফসোস করতে হতো না। সেই দিন চক্ষু ও কর্ণ খুলে যাবে, অথচ আজ তারা অন্ধ ও বধির সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলছেনঃ তুমি মানুষকে ঐ দুঃখ ও আফসোস করার দিন থেকে সাবধান করে দাও। যখন সমস্ত কাজের ফায়সালা হয়ে যাবে, জান্নাতীদেরকে জান্নাত এবং জা হান্নামীদেরকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়া হবে, সেই দুঃখ ও আফসোস করার দিন হতে তারা আজি উদাসীন রয়েছে, এমনকি এটাকে তারা বিশ্বাসই করছে না। তুমি তাদেরকে সেই দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও।
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতীরা জান্নাতে এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে চলে যাওয়ার পর মৃত্যুকে একটি ভেড়ার আকারে আনয়ন করা হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে খাড়া করে দেয়া হবে। অতঃপর জান্নাতীদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে “একে চেনো কি?” উত্তরে তারা বলবেঃ “হাঁ, এটা মৃত্যু।” তারপর জাহান্নামীদেরকেও এই একই প্রশ্ন করা হবে। তারাও ঐ একই উত্তর দেবে। তারপর আল্লাহর নির্দেশক্রমে মৃত্যুকে যবাহ করে দেয়া হবে। এরপর ঘোষণা করা হবেঃ “হে জান্নাতবাসী! তোমাদের জন্যে চিরস্থায়ী জীবন হয়ে গেলো, মৃত্যু আর হবে না। আর হে জাহান্নামবাসী! তোমাদের জন্যেও চিরস্থায়ী জীবন হয়ে গেলো, মরণ আর হবে না।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবী) এই আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন। অতঃপর তিনি ইশারা করে বলেনঃ “দুনিয়াবাসী গাফলাতে দুনিয়ায় রয়েছে (দুনিয়ায় বাস করে পরকালকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে রয়েছে)।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) একটি ঘটনা দীর্ঘভাবে বর্ণনা করার পর বলেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তি তার জাহান্নাম ও জান্নাতের ঘর দেখতে থাকবে। ঐদিন হবে দুঃখ ও আফসোস করার দিন। জাহান্নামী তার জান্নাতী ঘরটি দেখতে থাকবে এবং তাকে বলা হবেঃ “যদি তুমি ভাল আমল করতে তবে এই ঘরটি লাভ করতে।” তখন সে দুঃখ ও আফসোস করবে। পক্ষান্তরে জান্নাতীদেরকে তাদের জাহান্নামের ঘরটি দেখানো হবে এবং বলা হবেঃ “যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ না হতো তবে তোমরা এই ঘরে যেতে।” অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, মৃত্যুকে যবাহ করার পর যখন চিরস্থায়ী বাসের ঘোষণা দেয়া হবে তখন তারা এতো বেশী খুশী হবে যে, আল্লাহ না বাচালে খুশীর আধিক্য হেতু তারা মরেই যেতো। আর জাহান্নামবাসীরা ভীষণ দুঃখিত হয়ে যেতো। সুতরাং এ আয়াতের ভাবার্থ এটাই। এটা হবে আফসোসের সময় এবং কাজের পরিসমাপ্তিরও সময়। তাই কিয়ামতের সময় এবং কাজের পরিসমাপ্তিরও সময়। তাই, কিয়ামতের নাম সমূহের মধ্যে একটি নাম হচ্ছে (আরবী) বা আফসোসের দিন। যেমন অন্য এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী আমি। সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও ব্যবস্থাপক আমি ছাড়া আর কেউই নয়। আমি ছাড়া কোন কিছুর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার দাবীদার কেউই হতে পারে না। আমার সত্ত্বা যুলুম থেকে পবিত্র।
ইসলামের বাদশাহ আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমার ইবনু আবদিল আযীয (রাঃ) কূফায় আবদুল হামীদ ইবনু আবদির রহমানকে পত্র লিখেন। তাতে তিনি লিখেনঃ “হামদ ও সানার পর, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টজীবকে সৃষ্টি করার সময়েই তাদের উপর মৃত্যু লিখে দিয়েছেন। সবকেই তার কাছেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তিনি তার এই নাযিলকৃত সত্য কিতাবের মধ্যে লিখে দিয়েছেন। যে, কিতাবকে নিজের ইলম দ্বারা মাহফুয বা রক্ষিত রেখেছেন এবং ফেরেশতাদের দ্বারা যে কিতাবকে তিনি রক্ষণাবেক্ষণ করছেন (তাতে লিখে দিয়েছেন যে, পৃথিবী ও ওর উপর যারা আছে তাদের চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী তিনিই এবং তারা তারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।”