(বই#৮৯৬)[“আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো।”] সূরা:- মরিয়ম সুরা:১৯ ০৭- ১৫ নং আয়াত:- [ خُذِ الۡکِتٰبَ بِقُوَّۃٍ ؕ “আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো।”] www.motaher21.net

 

 أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৯৬)[“আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো।”]
সূরা:- মরিয়ম
সুরা:১৯
০৭- ১৫ নং আয়াত:-
[ خُذِ الۡکِتٰبَ بِقُوَّۃٍ ؕ
“আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো।”]
www.motaher21.net

০৭- ১৫ নং আয়াতের তাফসীর:

 

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-৭

یٰزَكَرِیَّاۤ اِنَّا نُبَشِّرُكَ بِغُلٰمِ اِ۟سْمُهٗ یَحْیٰى١ۙ لَمْ نَجْعَلْ لَّهٗ مِنْ قَبْلُ سَمِیًّا

(জবাব দেয়া হলো) “হে যাকারিয়া‍‌! আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি, যার নাম হবে ইয়াহইয়া, এ নামে কোন লোক আমি এর আগে সৃষ্টি করিনি।

এক্ষেত্রে লুকের সুসমাচারে যে শব্দাবলী ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছেঃ “আপনার গোষ্ঠীতে তো এ নামের কোন লোক নেই।” (১: ৬১)

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-৮

قَالَ رَبِّ اَنّٰى یَكُوْنُ لِیْ غُلٰمٌ وَّ كَانَتِ امْرَاَتِیْ عَاقِرًا وَّ قَدْ بَلَغْتُ مِنَ الْكِبَرِ عِتِیًّا

সে বললো, “হে আমার রব‍‌! আমার ছেলে হবে কেমন করে যখন আমার স্ত্রী বন্ধ্যা এবং আমি বুড়ো হয়ে শুকিয়ে গেছি?”

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-৯

قَالَ كَذٰلِكَ١ۚ قَالَ رَبُّكَ هُوَ عَلَیَّ هَیِّنٌ وَّ قَدْ خَلَقْتُكَ مِنْ قَبْلُ وَ لَمْ تَكُ شَیْئًا

জবাব এলো, “এমনটিই হবে” তোমার রব বলেন, এ তো আমার জন্য সামান্য ব্যাপার মাত্র, এর আগে আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি যখন তুমি কিছুই ছিলে না!

হযরত যাকারিয়ার এই প্রশ্ন এবং ফেরেশতাদের জবাব সামনে রাখুন। কারণ সামনের দিকে হযরত মারয়ামের কাহিনীতে এ বিষয়বস্তু আবার আসছে এবং এখানে এর যে অর্থ সেখানেও সেই একই অর্থ হওয়া উচিত। হযরত যাকারিয়া বলেন, আমি একজন বৃদ্ধ এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা, আমার ছেলে হতে পারে কেমন করে! ফেরেশতারা জবাব দেন, “এমনিই হবে।” অর্থাৎ তোমার বার্ধক্য ও তোমার স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব সত্ত্বেও তোমার ছেলে হবে। তারপর ফেরেশতা আল্লাহর কুদরাতের বরাত দিয়ে বলেন, যে আল্লাহ‌ তোমাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন, তোমার মত খুনখুনে বুড়োর ঔরসে আজীবন বন্ধ্যা এক বৃদ্ধার গর্ভে জন্ম দেয়া তার কুদরাতের অসাধ্য নয়।

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-10

قَالَ رَبِّ اجْعَلْ لِّیْۤ اٰیَةً١ؕ قَالَ اٰیَتُكَ اَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلٰثَ لَیَالٍ سَوِیًّا

যাকারিয়া বললেন, “হে আমার রব! আমার জন্য নিদর্শন স্থির করে দাও।” বললেন, “তোমার জন্য নিদর্শন হচ্ছে তুমি পরপর তিনদিন লোকদের সাথে কথা বলতে পারবে না।”

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-11

فَخَرَجَ عَلٰى قَوْمِهٖ مِنَ الْمِحْرَابِ فَاَوْحٰۤى اِلَیْهِمْ اَنْ سَبِّحُوْا بُكْرَةً وَّ عَشِیًّا

কাজেই সে মিহরাব৭ থেকে বের হয়ে নিজের সম্প্রদায়ের সামনে এলো এবং ইশারায় তাদেরকে সকাল-সাঁঝে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করার নির্দেশ দিল

মিহরাবের ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আলে ইমরান, ৩৬ টীকা।

লুক লিখিত সুসমাচারে এই ঘটনার যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তা আমরা এখানে উদ্ধৃত করেছি। এভাবে পাঠকের সামনে কুরআনের পাশাপাশি খৃষ্টীয় বর্ণনাও রাখা যাবে এবং মাঝে মাঝে বন্ধনীর মধ্যে থাকছে আমাদের বক্তব্যঃ “যিহূদিয়ার রাজা হেরোদের সময়ে (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, বনী ইসরাঈল, ৯ টীকা ) অবিয়ের পালার মধ্যে সখরীয় (যাকারিয়া) নামক একজন যাজক ছিলেন, তাঁহার স্ত্রী হারোণ বংশীয়া, তাঁহার নাম ইলীশাবেৎ (Elizabeth) তাঁহারা দুইজন ঈশ্বরের সাক্ষাতে ধার্মিক ছিলেন, প্রভুর সমস্ত আজ্ঞা ও বিধি অনুসারে নির্দ্দোষরূপে চলিতেন। তাঁহাদের সন্তান ছিল না, কেননা, ইলীশাবেত বন্ধ্যা ছিলেন এবং দুই জনেরই অধিক বয়স হয়েছিল। একদা যখন সখরীয় (যাকারিয়া) নিজ পালার অনুক্রমে ঈশ্বরের সাক্ষাতের যাজকীয় কার্য করিতেছিলেন, তখন যাজকীয় কার্যের প্রথানুসারে গুলিবাঁট ক্রমে তাঁহাকে প্রভুর মন্দিরে প্রবেশ করিয়া ধূপ জ্বালাইতে হইল। সেই ধূপদাহের সময়ে সমস্ত লোক বাহিরে থাকিয়া প্রার্থনা করতেছিল। তখন প্রভুর এক দূত ধূপবেদির দক্ষিণ পার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে দর্শন দিলেন। দেখিয়া সখরিয়(যাকারিয়া) ত্রাসযুক্ত হইলেন, ভয় তাঁহাকে আক্রমণ করিল। কিন্তু দূত তাঁহাকে বলিলেন, সখরিয়, ভয় করিওনা কেননা, তোমার বিনীত গ্রাহ্য হইয়াছে, (বাইবেলের কোথাও হযরত সখরিয়ার (যাকারিয়ার) দোয়ার উল্লেখ নেই।) তোমার স্ত্রী ইলীশাবেৎ তোমার জন্য পুত্র প্রসব করিবেন ও তুমি তাহার নাম যোহন (অর্থাৎ ইয়াহইয়া) রাখিবে। আর তোমার আনন্দ ও উল্লাস হইবে এবং তাহার জন্মে অনেকে আনন্দিত হইবে। কারণ সে প্রভুর সম্মুখে মহান হইবে, (এ বিষয়টি ব্যক্ত করার জন্য সূরা আলে ইমরানে سَيِدًا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে) এবং দ্রাক্ষারস কি সূরা কিছুই পান করিবে না। تَقِيًّا আর সে মাতার গর্ভে হইতেই পবিত্র আত্মায় পরিপূর্ণ হইবে;وَآتَيْنَاهُ الْحُكْمَ صَبِيًّا এবং ইস্রায়েল সন্তানদের মধ্যে অনেককেই তাহাদের ঈশ্বর প্রভুর প্রতি ফিরাইবে। সে তাহার সম্মুখে এলিয়ের (ইলিয়াস আলাইহিস সালাম) আত্মায় ও পরাক্রমে গমন করিবে, যেন পিতৃগণের হৃদয় সন্তানদের প্রতি ও অনাজ্ঞাবহদিগকে ধার্মিকদের বিজ্ঞতায় চলিবার জন্য ফিরাইতে পারে, প্রভুর নিমিত্ত সুসজ্জিত এক প্রজামণ্ডলী প্রস্তুত করিতে পারে।”

“তখন সখরিয়া (যাকারিয়া) দূতকে কহিলেন, কিসে ইহা জানিব? কেননা আমি বৃদ্ধা এবং আমার স্ত্রীরও অধিক বয়স হইয়াছে। দূত উত্তর করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, আমি গাব্রিয়েল (জিব্রীল), ঈশ্বরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকি, তোমার সহিত কথা কহিবার ও তোমাকে এ সকল বিষয়ের সুসমাচার দিবার জন্য প্রেরিত হইয়াছি। আর দেখ, এই সকল যেদিন ঘটিবে, সেই দিন পর্যন্ত নীরব থাকিবে, কথা কহিতে পারিবে না; যেহেতু আমার এই যে সকল বাক্য যথাসময়ে সফল হইবে, ইহাতে তুমি বিশ্বাস করিলে না। (এ বর্ণনাটি কুরআন থেকে ভিন্নতর। কুরআন একে নিদর্শন গণ্য করে এবং লুকের বর্ণনা একে বলে শাস্তি। তাছাড়া কুরআন কেবলমাত্র তিন দিন কথা না বলার কথা বলে এবং লুক বলেন, সেই থেকে হযরত ইয়াহিয়ার জন্ম হওয়া পর্যন্ত হযরত যাকারিয়া নীরব থাকেন।) আর লোক সকল সখরিয়ের অপেক্ষা করিতেছিল;এবং মন্দিরের মধ্যে তাহার বিলম্ব হওয়াতে তাহারা আশ্চর্য জ্ঞান করিতে লাগিল। পরে তিনি বাহিরে আসিয়া তাহাদের কাছে কথা কহিতে পারিলেন না; তখন তাহারা বুঝিল যে, মন্দিরের মধ্যে তিনি কোন দর্শন পাইয়াছেন; আর তিনি তাহাদের নিকটে নানা সংকেত করিতে থাকিলেন এবং বোবা হইয়া রহিলেন।” (লুক১: ৫-২২)

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-12

یٰیَحْیٰى خُذِ الْكِتٰبَ بِقُوَّةٍ١ؕ وَ اٰتَیْنٰهُ الْحُكْمَ صَبِیًّاۙ

“হে ইয়াহইয়া! আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো।” আমি তাকে শৈশবেই “হুকুম” দান করেছি

মাঝখানে এই বিস্তারিত তথ্য পরিবেশিত হয়নি যে, আল্লাহর ফরমান অনুযায়ী হযরত ইয়াহিয়ার (আ) জন্ম হয় এবং শৈশব থেকে তিনি যৌবনে পদার্পণ করেন, এখন বলা হচ্ছে, যখন তিনি জ্ঞানলাভের নির্দিষ্ট বয়ঃসীমায় পৌঁছেন তখন তাঁর ওপর কি দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এখানে মাত্র একটি বাক্যে নবুওয়াতের মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সময় তার ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয় তার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি তাওরাতকে সদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবেন এবং বনী ইসরাঈলকে এ পথে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবেন।

#“হুকুম” অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি, ইজতিহাদ করার শক্তি, দ্বীনের গভীর তত্বজ্ঞান, জীবন সমস্যার ক্ষেত্রে সঠিক মত প্রকাশের যোগ্যতা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে ফয়সালা দান করার ক্ষমতা।

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-13

وَّ حَنَانًا مِّنْ لَّدُنَّا وَ زَكٰوةً١ؕ وَ كَانَ تَقِیًّاۙ

এবং নিজের পক্ষ থেকে হৃদয়ের কোমলতা ও পবিত্রতা দান করেছি, আর সে ছিল খুবই আল্লাহভীরু

আসলে حَنَان শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি মমতার প্রায় সমার্থক শব্দ। অর্থাৎ একজন মায়ের মনে নিজের সন্তানের জন্য যে চূড়ান্ত পর্যায়ের স্নেহশীলতা থাকে, যার ভিত্তিক সে শিশুর কষ্টে অস্থির হয়ে পড়ে, আল্লাহর বান্দাদের জন্য হযরত ইয়াহিয়ার মনে এই ধরনের স্নেহ-মমতা সৃষ্টি হয়েছিল।

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-14

وَّ بَرًّۢا بِوَالِدَیْهِ وَ لَمْ یَكُنْ جَبَّارًا عَصِیًّا

এবং নিজের পিতামাতার অধিকার সচেতন, সে উদ্ধত ও নাফরমান ছিল না।

সুরা: মারইয়াম
আয়াত নং :-15

وَ سَلٰمٌ عَلَیْهِ یَوْمَ وُلِدَ وَ یَوْمَ یَمُوْتُ وَ یَوْمَ یُبْعَثُ حَیًّا۠

শান্তি তার প্রতি যেদিন সে জন্ম লাভ করে এবং যেদিন সে মৃত্যুবরণ করে আর যেদিন তাকে জীবিত করে উঠানো হবে।

বাইবেলের বিভিন্ন পুস্তকে হযরত ইয়াহিয়ার জীবনের যে ঘটনাবলী ছড়িয়ে আছে সেগুলো একত্র করে আমি এখানে তাঁর পূতপবিত্র জীবনের একটি চিত্র তুলে ধরছি। এর সাহায্যে সূরা আলে ইমরান এবং এ সূরাটির সংক্ষিপ্ত ইশারা ইঙ্গিতগুলোর ব্যাখ্যা হয়ে যাবে।

লুকের বর্ণনা অনুসারে হযরত ইয়াহইয়া (আ) ছিলেন, হযরত ঈসা (আ) চেয়ে ৬ মাসের বড়। তাঁর মাতা হযরত ঈসার (আ) মাতার নিকটাত্মীয়া ছিলেন। প্রায় ৩০ বছর বয়সে তিনি কার্যকরভাবে নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ করেন। যোহনের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ট্রান্স জর্ডন এলাকায় আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেবার কাজ শুরু করেন। তিনি বলতেনঃ “আমি প্রান্তরে এক জনের রব যে ঘোষণা করিতেছে তোমরা প্রভুর সরল পথ ধর।” (যোহন১: ২৩)

মার্কের বর্ণনা মতে তিনি লোকদের পাপের জন্য তাদের তাওবা করাতেন এবং তাওবাকারীদেরকে বাপ্তাইজ করতেন। অর্থাৎ তাওবা করার পর তাদেরকে গোসল করাতেন, যাতে আত্মা ও শরীর উভয়ই পবিত্র হয়ে যায়। ইয়াহুদিয়া (যিহূদা) ও জেরুসালেমের অধিকাংশ লোক তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁর দ্বারা বাপ্তাইজিত হচ্ছিল। (মার্ক ১: ৪-৫) এ জন্য তিনি বাপ্তাইজক ইয়াহইয়া (Jhon The Baptist) নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণভাবে বনী ইসরাঈল তাঁর নবুওয়াত স্বীকার করে নিয়েছিল। (মথি২১: ২৬) , ঈসা আলাইহিস সালামের উক্তি ছিল, “স্ত্রী লোকের গর্ভজাত সকলের মধ্যে যোহন বাপ্তাইজক হইতে মহান কেহই উৎপন্ন হয় নাই।” (মথি ১১: ১১)।

তিনি উটের লোমের কাপড় পরতেন, চর্মপটুকা কোমরে বাঁধতেন এবং তার খাদ্য ছিল পঙ্গপাল ও বনমধু। (মথি৩: ৪) এই ফকিরী জীবন যাপনের সাথে সাথে তিনি প্রচার করে বেড়াতেনঃ “মন ফিরাও (অর্থাৎ তাওবা কর) কেননা স্বর্গ রাজ্য সন্নিকট হইল।” (মথি৩: ২) অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতের দাওয়াতের সূচনা হতে যাচ্ছে। এ কারণে তাঁকে সাধারণ হযরত ঈসার (আ) ‘আরহাস’ বলা হতো। কুরআন মজীদেও তাঁর সম্পর্কে একথাই এভাবে বলা হয়েছেঃ مُصَدِّقًا بِكَلِمَةٍ مِنَ اللَّهِ অর্থাৎ “সে আল্লাহর বাণী সত্যতার সাক্ষ্যদানকারী”( আলে ইমরান ৩৯ ) তিনি লোকদের নামায পড়ার ও রোযা রাখার উপদেশ দিতেন (মথি ৯: ১৪, লুক, ৫: ৩৩, লুক১১: ১)

তিনি লোকদের বলতেন, “যাহার দুইটি আঙ্রাখা আছে, সে, যাহার নাই, তাহাকে একটি দিউক; আর যাহার কাছে খাদ্যদ্রব্য আছে সেও তদ্রূপ করুক।” কর গ্রাহীরাও তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, গুরু আমরা কি করবো? তাতে তিনি জবাব দেন, “তোমাদের জন্য যাহা নিরূপিত তাহার অধিক আদায় করিও না।” সৈনিকরা জিজ্ঞেস করলো, আমাদের প্রতি কি নির্দেশ? জবাব দেন, “কাহারও প্রতি দৌরাত্ম্য করিও না, অন্যায় পূর্বক কিছু আদায়ও করিও না এবং তোমাদের বেতনে সন্তুষ্ট থাকিও।” (লুক ৩: ১০-১৪) বনী ইসরাঈলদের বিপথগামী উলামা, ফরীশী ও সদ্দুকীরা তাঁর কাছে বাপ্তাইজ হবার জন্য এলে তিনি তাদেরকে ধমক দিয়ে বলেন, “হে সর্পের বংশেরা আগামী কোপ হইতে পলায়ন করিতে তোমাদিগকে কে চেতনা দিল? . . . . . . . . . . . . . . . আর ভাবিও না যে, তোমরা মনে মনে বলিতে পার আব্রাহাম আমাদের পিতা, ……………… আর এখন গাছগুলোর মুলে কুড়াল লাগান আছে, অতএব যে কোন গাছে উত্তম ফল ধরে না তাহা কাটিয়া আগুনে ফেলিয়া দেওয়া যায়।” (মথি ৩: ৭-১০) ( উপরের সবগলো লিংক একসাথে দেখুন)

তাঁর যুগের ইহুদী শাসনকর্তা হীরোদ এন্টিপাসের রাজ্যে তিনি সত্যের দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই শাসনকর্তা ছিল আপাদমস্তক রোমীয় সভ্যতার প্রতিভূ। তারই কারণে সারাদেশে দুষ্কৃতি, নৈতিকতা বিরোধী ও আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতামূলক কার্যকলাপ প্রসার লাভ করছিল। সে নিজের ভাই ফিলিপের স্ত্রী হিরোদিয়াসকে নিজের গৃহে রক্ষিতা রেখেছিল। হযরত ইয়াহইয়াএ জন্য হিরোদকে ভর্ৎসনা করেন এবং তার পাপাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এ অপরাধে হিরোদ তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। তবুও সে তাঁকে একজন পবিত্রাত্মা ও সৎকর্মশীল মনে করে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতো এবং জনগণের মধ্যে তাঁর প্রভাবের কারণে তাঁকে ভয়ও করতো। কিন্তু হিরোদিয়াস মনে করতো, ইয়াহইয়া, আলাইহিস সালাম জনগণের মধ্যে যে নৈতিক চেতনা সঞ্চার করেছেন তার ফলে জনগণের দৃষ্টিতে তার মতো মেয়েরা ঘৃণিত হয়ে যাচ্ছে। তাই তাঁর প্রাণ সংহারের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত হিরোদের জন্ম বার্ষিকী উৎসবে সে তার কাংখিত সুযোগ পেয়ে যান। উৎসবে তার মেয়ে মনোমুগ্ধকর নৃত্য প্রদর্শন করে হিরোদের চিত্ত জয় করে। হিরোদ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বলে, কি পুরস্কার চাও বলো। মেয়ে তার ব্যভিচারী মাকে জিজ্ঞেস করে, কি চাইবো? মা বলে, ইয়াহিয়ার মস্তক চাও। তাই সে হিরোদের সামনে হাত জোড় করে বলে, জাহাঁপনা! আমাকে এখনি ইয়াহইয়া বাপ্তাইজকের মাথা একটি থালায় করে আনিয়ে দিন। হিরোদ একথা শুনে বড়ই বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রিয়ার মেয়ের দাবী না মেনে উপায় ছিল না। সে তৎক্ষণাত কারাগার থেকে ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের মাথা কেটে আনলো এবং তা একটি থালায় রেখে নর্তকীকে নজরানা দিল। (মথি ১৪: ৩-১২, মার্ক ৬: ১৭-১৯ ও লুক ৩: ১৯-২০)

ফী জিলালিল কুরআন:

এরপর আসছে দোয়া কবুলের দৃশ্য। এই দূশ্যে আমরা মহান আল্লাহকে অত্যন্ত দয়ালু, করুণাময় ও সহানুভূতিশীল পাচ্ছি। তিনি প্রকাশ্যে তার বান্দার নাম নিয়ে ডাকছেন, ‘হে যাকারিয়া বলো’ এরপর বিলম্ব না করে বলছেন, ‘তােমাকে আমি এক জন পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি’, এই সুসংবাদ শুনানাের সাথে সাথে পুত্রটির নামও ঘােষণা দিয়ে জানানাে হচ্ছে। আর সে নাম হচ্ছে ইয়াহইয়া’, এক অভিনব ও অভূতপূর্ব নাম। ইতিপূর্বে কাউকেই এই নামে ডাকা হয়নি। আল্লাহর করুণা অঝোর ধারায় বয়ে যাচ্ছে এক বান্দার ওপর, যিনি নিজ প্রভুর সামনে কাতর স্বরে দোয়া করে চলেছেন, নীরবে ডেকে চলেছেন, নিজের মনের আশা আকাংখার কথা তাকে জানাচ্ছেন। এই দোয়া ও কাকুতি মিনতির পেছনে এক মাত্র কারণ হচ্ছে যে, তিনি নিজ আদর্শ, নিজ আকীদা বিশ্বাস, নিজ ধন সম্পদ এবং দায় দায়িত্ব অর্পণ করার মতাে উপযুক্ত কোনাে পাত্র খুঁজে পাচ্ছেন না। এরূপ একজন সুপাত্রের জন্যেই তিনি তার প্রভুর কাছে আরযি পেশ করেন। দয়াময় প্রভু তার ডাকে সাড়া দেন এবং তার মনের ইচ্ছা পূর্ণ করেন। দোয়া কবুল হওয়ার সুসংবাদ লাভের পরপরই যাকারিয়া(আ.) এক কঠিন সত্যের মুখােমুখি হন। আর তা হলাে, তিনি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন, শারীরিক দুর্বলতা তাকে আছন্ন করে ফেলেছে। তাছাড়া তার স্ত্রীও একজন বন্ধ্যা নারী। সন্তান প্রসব করার মতাে স্বাভাবিক ক্ষমতা তার নেই। এমতাবস্থায় তার ঘরে কিভাবে সন্তান আসবে। এটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে। তাই সে ব্যাপারে তিনি আশ্বস্ত হতে চান। কিভাবে এবং কোন উপায়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে সন্তান দান করবেন তা তিনি জানতে চান, বুঝতে চান। তাই তিনি বলে উঠলেন, ‘সে বললাে, হে আমার… সীমানায় এসে উপনীত হয়েছি।'(আয়াত ৮) তিনি একদিকে এই কঠিন বাস্তবতায় মুখোমুখি, অপর দিকে আল্লাহর ওয়াদা তার সামনে। তিনি এই ওয়াদার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। কিন্তু তিনি জানতে চান ও আশ্বস্ত হতে চান, এই কঠিন বাস্তবতার অস্তিত্ব সত্তেও ওয়াদার বাস্তবায়ন কিভাবে হবে, এটা সাধারণ মানবীয় স্বভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। যাকারিয়া(আ.) একজন আল্লাহভীরু ও সৎ নবী ছিলেন। কিন্তু তিনি তাে ছিলেন একজন মানুষ। কাজেই বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার মতাে ক্ষমতা তার ছিলাে না এটাই স্বাভাবিক। তাই তিনি আগ্রহ ভরে দেখতে চান ও জানতে চান যে, এই কঠিন বাস্তবকে আল্লাহ তায়ালা কিভাবে পরিবর্তন করবেন। আল্লাহ তায়ালা এখানে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, ‘এরূপ করাটা তার কাছে ব্যাপারই নয়। বরং খুবই সহজ ও সাধারণ ব্যাপার। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তিনি বলছেন, আল্লাহ তায়ালা… তুমি কিছুই ছিলে না!'(আয়াত ৯) সৃষ্টি জগতের কোনাে কিছুই আল্লাহর কাছে কঠিন নয়। ছােট-বড়, এবং তুচ্ছ-অতুচ্ছ সব কিছুরই সৃষ্টির পদ্ধতি আল্লাহর কাছে কেবল একটাই। আর তা হলাে, তিনি নির্দেশ দেন হও, এবং সাথে সাথেই তা হয়ে যায়।’ বন্ধ্যা নারীর গর্ভে এবং অশীতিপর বৃদ্ধের ঔরসে সন্তান জন্ম না নেয়ার সাধারণ নিয়ম আল্লাহ তায়ালা নিজেই সৃষ্টি করেছেন। কাজেই এই নিয়মের পরিবর্তন করার ক্ষমতাও তার রয়েছে। ফলে একজন বন্ধ্যা নারীর বন্ধ্যাত্ব দূর করে এবং বৃদ্ধ পুরুষের মাঝে যৌবন ফিরিয়ে দিয়ে তিনি উভয়কে সন্তান উৎপাদনক্ষম করে তুলতে পারেন। এটা কোনাে উপাদান ছাড়াই মানুষ সৃষ্টি করার চেয়ে অনেক বেশী সহজ। যদিও আল্লাহর কুদরতের সামনে সব কিছুই সহজ নতুন করে কিছু সৃষ্টি করা বা পুনরায় কিছু সৃষ্টি করা সবই আল্লাহর কাছে সমান। তা সত্তেও আশ্বস্ত হওয়ার আগ্রহে যাকারিয়া(আ.) সে শুভ সংবাদ বাস্তবায়নের একটা নিদর্শন বা আলামত দেখতে চান। আল্লাহ তায়ালা যাকারিয়া(আ.) এর মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল একটি নিদর্শন দান করেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেন তিনি বার্ধক্যে পুত্র লাভ করার মতাে এক বিরল নেয়ামতের শােকর আদায় করতে পারেন। আর সেই নিদর্শন হচ্ছে এই যে, তিনি একাকী ও নির্জনে একাধারে তিন রাত আল্লাহর এবাদাত বন্দেগী ও যিকির আযকারে কাটাবেন এবং এই সময়ে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা সত্তেও মানুষের সাথে কথা বলতে পারবে না। বরং ইশারা ইংগিতে তাদের সাথে কথা বলবেন। নিচের আয়াতে সে বিষয়টি সম্পর্কেই বলা হয়েছে, সে বললাে, ‘হে আমার… পবিত্রতা ও মহিমা ঘােষণা করে'(আয়াত ১০-১১) তিনি উপস্থিত জনতাকে ইংগিতে দিন রাত আল্লাহর যিকিরে মশগুল থাকতে বললেন, যেন তারাও সেই একই আধ্যাত্মিক পরিবেশে বিচরণ করতে পারে যে পরিবেশে তিনি তিন দিন যাবত বিচরণ করছেন এবং তারাও যেন তার সাথে এই বিরল ও অভাবনীয় নেয়ামত লাভের কৃতজ্ঞতা প্রকাশে একত্ব হয়ে যেতে পারে।

*নবুওতের উত্তরাধীকারী হিসেবে হযরত ইয়াহইয়া(আ.) : ধ্যান ও তাসবীহমগ্ন যাকারিয়া(আ.)-এর প্রসংগ আপাতত স্থগিত রেখে আল্লাহ তায়ালা এখন নতুন এক প্রসংগের অবতারণা করছেন। এই প্রসংগটি হচ্ছে ইয়াহইয়া(আ.)-কে কেন্দ্র করে। এখানে আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ্যে তার নাম ধরে ডাক দিয়ে বলছেন, ইয়াহিয়ার জন্ম হলাে, এক পর্যায়ে সে যখন বড়াে… বুদ্ধি দান করেছিলাম।'(আয়াত ১২) যাকারিয়া(আ.)-এর প্রসংগ এবং ইয়াহইয়া(আ.)-এর প্রসংগের মাঝে সময়ের যে বিরাট ব্যবধান ছিলাে তারই মাঝে ইয়াহইয়া (আ.) জন্ম লাভ করেন, লালিত-পালিত হন এবং শৈশবে পদার্পন করেন। এই ব্যবধান ঘুচিয়ে পবিত্র কোরআন তার নিজস্ব রচনা শৈলীর মাধ্যমে নতুন প্রসংগের অবতারনা করেছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা। আলােচ্য আয়াতে ইয়াহইয়া(আ.) সম্পর্কে একটি কথাও না বলে সরাসরি তার নাম ধরে ঢাকার মাধ্যমে তার উচ্চ মর্যাদার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা যাকারিয়া(আ.)-এর দোয়া কবুল করেছেন এবং তাকে এমন একজন উপযুক্ত উত্তরসূরী দান করেছেন যিনি তার মৃত্যুর পরে তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, তার আদর্শের ধারক ও বাহক হবেন। এ কারণেই ইয়াহইয়া(আ.) সম্পর্কিত প্রথম বক্তব্যেই তাকে এক মহান দায়িত্বের জন্যে নির্বাচিত করা হয় এবং বলা হয়, ‘ইয়াহিয়ার জন্ম হলাে, এক পর্যায়ে… বুদ্ধি দান করেছিলাম'(আয়াত ১২) আলােচ্য আয়াতে গ্রন্থ বা কিতাব বলতে ‘তাওরাতকে বুঝানাে হয়েছে যা মুসা(আ.)-কে দান করা হয়েছিলাে। এই কিতাবেরই অনুসরণ করতাে বনী ইসরাঈলের সকল গােষ্ঠী এবং এই কিতাবেরই তালিম ও প্রচার প্রসারের কাজে নিয়ােজিত ছিলেন বনী ইসরাঈল বংশের সকল নবী রসূলরা। এখন ইয়াহইয়া(আ.) উত্তরাধিকার সূত্রে এই গ্রন্থই তার পিতা যাকারিয়া(আ.)-এর কাছ থেকে লাভ করতে যাচ্ছেন। তাই তাকে ডেকে বলা হচ্ছে, তিনি যেন এই গুরু দায়িত্ব দৃঢ়তা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেন এবং এ ব্যাপারে যেন কোনাে রূপ দূর্বলতা, অবহেলা বা দায়িত্বহীনতার পরিচয় না দেন। সাথে সাথে উত্তরাধিকারের এই কঠিন দায়িত্ব থেকে যেন কখনও পিছপা না হন। সম্বোধনের পালা শেষ হওয়ায় এখন ইয়াহইয়া(আ.) কে স্বীয় গুরু দায়িত্ব পালন করার মতাে উপযােগী কি কি গুণাবলী দান করা হয়েছে সে প্রসংগে বলা হচ্ছে, ‘ইয়াহিয়ার জন্ম হলো, এক পর্যায়ে… পরহেযগার ব্যক্তি'(আয়াত ১২-১৩) অর্থাৎ তাকে শৈশবেই জ্ঞান ও বুদ্ধি দান করা হয়েছে। এটা নিসন্দেহে একটা বিরল ঘটনা ঠিক ইয়াহইয়া(আ.)-এর নামের মতােই। কারণ, সাধারণ নিয়ম অনুসারে মানুষের মাঝে জ্ঞান-বুদ্ধির উন্মেষ ঘটে তখনই যখন তার বয়স বৃদ্ধি পায় এবং তার মাঝে পরিপক্কতা আসে। কিন্তু ইয়াহইয়া(আ.)-এর বেলায় এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। তাই শৈশবেই তাকে জ্ঞান বুদ্ধি দান করা হয়েছে। তাকে আর একটি গুণ দান করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে দয়া মায়ার গুণ। এই গুণ তাকে জন্মগতভাবেই দান করা হয়েছিলাে। এটার জন্যে তাকে পৃথক কোনাে চেষ্টা সাধনা করতে হয়নি। এই দয়া মায়ার গুণ নবীদের জন্যে খুবই জরুরী। কারণ তাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সত্যের পথে ডাকা, কল্যাণের পথে ডাকা এবং নরম ও কোমল ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় মনকে আকৃষ্ট করা, তাদের অন্তরকে জয় করা। তাকে আরাে একটি গুণ দান করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে মনের পবিত্রতা, চরিত্রের নির্মলতা। উদ্দেশ্য হলাে এগুলাের সাহায্যে যেন তিনি অন্যদের হৃদয়ের ও চরিত্রের কলুষতা ও আবিলতা দূর করতে পারেন। আল্লাহ ভীতি বা তাকওয়া পরহেযগারীর গুণও তাকে দান করা হয়েছে। এই তাকওয়া পরহেযগারীর ফলে তিনি সর্বক্ষণ আল্লাহর অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারবেন। সর্বক্ষণ নিজেকে আল্লাহর দৃষ্টির সামনে দেখতে পাবেন। কাজেই প্রকাশ্যে ও নির্জনে সর্ব অবস্থায় তিনি আল্লাহকে ভয় করে চলবেন। আল্লাহ তায়ালা ইয়াহইয়া(আ.)-কে শৈশবে এই পাথেয় দান করেই তাকে নিজ পিতার যােগ্য উত্তরসূরী রূপে গড়ে তুলেছেন। কারণ, তার বৃদ্ধ পিতা নিজ প্রভু ও মালিকের কাছে অত্যন্ত কাতর স্বরে এই দোয়া জানিয়েছিলেন। দয়ালু প্রভু সেই দোয়া কবুল করেছেন এবং তাকে একজন সৎ পুত্র সন্তান দান করেছেন। ইয়াহইয়া(আ.)-এর প্রসংগটি এখানেই শেষ হচ্ছে। তার জীবন সম্পর্কে, আদর্শ সম্পর্কে এবং কর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে একটা মােটা রেখা এখানে টানা হয়েছে। ফলে একজন নবীর গুণাবলী, দায় দায়িত্ব ও চরিত্র মাধুর্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা আমরা লাভ করতে পারি। সাথে সাথে একথাও আমাদের জানতে হবে যে, যাকারিয়া(আ.)-এর দোয়া এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই দোয়া কবুল হওয়া ইত্যাদি বিষয় থেকেও উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করার মতাে অনেক কিছুই রয়েছে। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দ্বারা এই উপদেশ ও মূল বক্তব্যের মাঝে নতুন কিছু জুড়ে দেখার প্রয়ােজন নেই । উপরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাই যথেষ্ট।

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৭-১৫ নং আয়াতের তাফসীর:

পূর্বের আয়াতগুলোতে যাকারিয়া (عليه السلام) এর সন্তান লাভের দু‘আর কথা তুলে ধরা হয়েছে। অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া (عليه السلام)-এর দু‘আ কবূল করে সন্তান দিলেন এমনকি সন্তানের নামও রেখে দিলেন যে, তার নাম হবে ইয়াহইয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَنَادَتْهُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ وَهُوَ قَآئِمٌ يُّصَلِّيْ فِي الْمِحْرَابِ لا أَنَّ اللّٰهَ يُبَشِّرُكَ بِيَحْيٰي مُصَدِّقًاۭ بِكَلِمَةٍ مِّنَ اللّٰهِ وَسَيِّدًا وَّحَصُوْرًا وَّنَبِيًّا مِّنَ الصّٰلِحِيْن) ‏

“অতঃপর ফেরেশতারা তাকে ডেকে বললেন: তখন তিনি মেহরাবে সালাতরত অবস্থায় ছিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে ইয়াহইয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। তিনি হবেন আল্লাহর বাণীর সত্যায়নকারী, নেতা, প্রবৃত্তি দমনকারী এবং পুণ্যবান নাবীদের একজন।” (সূরা আলি-ইমরান ৩:৩৮-৩৯)

سَمِيًّا অর্থাৎ এ নামে পূর্বে আমি আর কারো নামকরণ করিনি। যাকারিয়া (عليه السلام) সুসংবাদ পেয়ে বললেন: হে আমার পালনকর্তা! কেমন করে আমার পুত্র হবে, অথচ আমার স্ত্রী বন্ধ্যা এবং আমি বার্ধক্যে উপনীত হয়ে গেছি। সূরা আলি ইমরানের ৪০ নং আয়াতও এ কথা বলা হয়েছে।

عَاقِرًا বলা হয় যে নারী বার্ধক্যের কারণে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম, আবার ঐ মহিলাকেও বলা হয়, যে প্রথম থেকেই বন্ধ্যা। এখানে বার্ধক্যের কারণে যে বন্ধ্যা তা-ই উদ্দেশ্য।

যাকারিয়া (عليه السلام) এর প্রশ্নের জবাবে ফেরেশতা বললেন, এভাবেই হবে। তোমার প্রভু বলে দিয়েছেন যে, এটা আমার জন্য খুবই সহজ। আমি তো ইতোপূর্বে তোমাকে সৃষ্টি করেছি, যখন তুমি কিছুই ছিলে না। সুতরাং যে আল্লাহ তা‘আলা কিছু ছাড়াই মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন তিনি বৃদ্ধ বয়সেও সন্তান দিতে পারবেন।

যাকারিয়া (عليه السلام) বললেন: হে আমার পালনকর্তা! আমাকে একটি নিদর্শন প্রদান করুন। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তোমার নিদর্শন হচ্ছে, তুমি সুস্থাবস্থায় একটানা তিনদিন কারো সাথে কথা বলতে পারবে না। সূরা আলি ইমরানে বলা হয়েছে, ইশারা করা ছাড়া কথা বলতে পারবে না। অতঃপর তিনি কক্ষ থেকে বের হয়ে সম্প্রদায়ের নিকট আসলেন এবং তাদেরকে ইঙ্গিতে বললেন, সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করার জন্য। سَوِيًّا অর্থ: পূর্ণ সুস্থ, অর্থাৎ কথা বলতে সক্ষম এমন সুস্থাবস্থায় কথা বলতে পারবে না।

যাকারিয়া (عليه السلام) এর দু‘আ অনুযায়ী যখন ছেলে ইয়াহইয়া (عليه السلام)-কে পেলেন আর ইয়াহইয়া (عليه السلام)-বুঝেন-শুনেন এমন বয়সে উপনীত হলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি ওয়াহী নাযিল করে বললেন, হে ইয়াহইয়া! দৃঢ়তার সাথে এ কিতাব ধারণ কর। (خُذِ الْكِتٰبَ بِقُوَّةٍ) অর্থাৎ তার ওপর আমল কর। কিতাব বলতে তাওরাতকে বা তাঁকে যে বিশেষ কিতাব দান করা হয়েছে তা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য দান করেছেন। তখন তিনি ছোট বয়সের ছিলেন।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহইয়া (عليه السلام) এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন;

(১) শৈশবেই প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে (২) তাঁকে নরম প্রকৃতি ও কোমলতা দান করেছেন, (৩) তিনি পূত-পবিত্র ছিলেন, (৪) তিনি অতীব তাক্বওয়াশীল, (৫) পিতা-মাতার প্রতি অনুগত এবং (৬) তিনি উদ্ধত ও অবাধ্য নন।

এছাড়াও সূরা আলি ইমরানে তাঁর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, (৭) তিনি সাক্ষ্য দিবেন আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের সত্যতা সম্পর্কে, (৮) তিনি হবেন নেতা, (৯) তিনি নারীসঙ্গ মুক্ত হবেন, (১০) তিনি একজন সৎ কর্মশীল নাবী হবেন।

তাঁর উপরে শান্তি যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন আর যেদিন তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং যেদিন তাঁকে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত করা হবে।

মানুষের তিনটি সময় কঠিন ও ভয়াবহ (১) যখন সে মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে, (২) যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, (৩) যখন কবর থেকে জীবিত করা হবে এবং নিজেকে কিয়ামতের দিন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি দেখবে। এ তিন সময়ই তাঁর জন্য থাকবে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে শান্তি।

অনেকে এ আয়াত থেকে দলীল গ্রহণ করে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্মোৎসব বা ঈদে মীলাদুন্নাবী উদ্যাপন করে থাকে। তারা বলে: আল্লাহ তা‘আলা জন্মদিনের জন্য সালাম শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তাই আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্মদিনে সালাম দেয়ার জন্য ঈদে মীলাদুন্নাবী পালন করে থাকি। তাদের এ দাবী ভিত্তিহীন। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় এরূপ কোনকিছুর প্রমাণ পাওয়া যায় না; এমনকি সাহাবী, তাবিঈদের যুগেও নয় যার অনুসরণ করা যায়। অতএব এগুলো স্পষ্ট বিদআত যা সর্বাবস্থায় বর্জনীয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে যাবতীয় বিদআতী কর্মকাণ্ড পরিহার করে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ মোতাবেক আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মানুষের সকল অভাব পূরণ করে থাকেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে অস্তিত্বহীনতা থেকে সৃষ্টি করেছেন।
৩. সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করতে হবে।
৪. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি দৃঢ় আস্থা ও সৎ আমল করে আহ্বান করলে তিনি আহ্বানে সাড়া দেন।
৫. ঈদে মীলাদুন্নাবী পালন করা কোন নেকীর কাজ নয়, যদি তা হত তাহলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণ তা পালন করতেন। সুতরাং তা বর্জণীয় এবং পালন করা বিদ‘আত।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:- হযরত যাকারিয়ার (আঃ) প্রার্থনা কবুল হয় এবং তাকে বলা হয়ঃ তুমি একটি সন্তানের সুসংবাদ শুনে নাও, যার নাম হবে ইয়াহইয়া (আঃ)। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তখন যাকারিয়া (আঃ) প্রার্থনা করলো স্বীয় প্রভূর নিকট, বললোঃ হে আমার প্রতিপালক! দান করুন আমাকে আপনার নিকট হতে কোন উত্তম সন্তান; নিশ্চয় আপনি খুব প্রার্থনা শ্রবণকারী। অতঃপর তাকে ফেরেশতারা ডেকে বললোঃ যখন সে মেহরাবে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছিলঃ আল্লাহ আপনাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন ইয়াহইয়ার (আঃ)। তার অবস্থা এই হবে যে, তিনি সমর্থনকারী হবেন কালেমাতুল্লাহর (নবুওয়াতে ঈসা (আঃ) এবং সরদার হবেন ও স্বীয় প্রবৃত্তিকে খুব দমনকারী হবেন, আর নবীও হবেন এবং উচ্চ স্তরের সুসভ্যও হবেন।” (৩:৩৮-৩৯)

এখানে মহান আল্লাহ বলেন যে, তার পূর্বে এই নামের কোন মানুষ ছিল। এটাও বলা হয়েছে যে, তার সাথে সাদৃশ্যযুক্ত কেউ হবে না।’ (আরবী) শব্দের এই অর্থই এই আয়াতেও রয়েছে। এ অর্থও বর্ণনা করা হয়েছে যে, এর পূর্বে কোন বন্ধ্যা স্ত্রী লোকের এইরূপ সন্তান হয় নাই। হযরত যাকারিয়ার কোন সন্তান জন্ম গ্রহণ করে নাই এবং তার স্ত্রীও পূর্ব হতেই সন্তানহীনা ছিলেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত সারা (আঃ) এই দু’জনও সন্তানের সুসংবাদ পেয়ে অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তারা সন্তানহীনা ও বন্ধ্যা ছিলেন বলেই যে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন তা নয়। বরং তাদের বিস্ময় প্রকাশের কারণ ছিল তাদের ঐ চরম বার্ধক্যের অবস্থায় সন্তান লাভ। হযরত যাকারিয়ার (আঃ) ঐ পূর্ণ বার্ধক্য অবস্থা পর্যন্ত কোন সন্তানই জন্মগ্রহণ করে নাই এবং তাঁর স্ত্রী তো প্রথম থেকেই বন্ধ্যা ছিলেন। কিন্তু হযরত ইবরাহীম খলীলের (আঃ) অবস্থা তো ছিল এর বিপরীত। কারণ, তখন থেকে তেরো বছর পূর্বে তো তাঁর পুত্র। হযরত ইসমাঈল (আঃ) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাজেই বন্ধ্যা হওয়ার কারণে তিনি বিস্মিত হন নাই। বরং অত্যন্ত বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের (ইসহাকের (আঃ) সুসংবাদ শুনেই তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী সারাও (রাঃ) ঐ সুসংবাদ শুনে আশ্চর্যান্বিতা হয়েছিলেন এবং বলেছিলেনঃ “এই চরম বার্ধক্যের অবস্থায় আমার সন্তান হবে এটা কেমন কথা? আর আমার স্বামীও তো সীমাহীন বুদ্ধ! এটাতো চরম বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে। তাঁর এ কথা শুনে ফেরেশতারা বলেছিলেনঃ “আপনি কি আল্লাহর কাজে বিস্ময় প্রকাশ করছেন? (হে) এই পরিবারের লোকেরা! আপনাদের প্রতি তো আল্লাহর বিশেষ রহমত ও তাঁর বিবিধ বরকতসমূহ (নাযিল হয়ে আসছে) নিশ্চয় তিনি প্রশংসার যোগ্য, মহামহিমান্বিত।”
৮-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত যাকারিয়া (আঃ) তাঁর প্রার্থনা কবুল হওয়ার ও নিজের সন্তান হওয়ার সুসংবাদ শুনে আনন্দ ও বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করেন যে, বাহ্যতঃ তো এটা অসম্ব বলেই মনে হচ্ছে। কেননা স্বামী স্ত্রী উভয়ের দিক থেকেই শুধু নৈরাশ্যই বিরাজ করছে। স্ত্রী বন্ধ্যা, এই পর্যন্ত তার ছেলে মেয়েই হয়নি। আর তিনি শেষ পর্যায়ের বৃদ্ধ। তার অস্থি গুলিও তো মজ্জাহীন হয়ে গেছে। তিনি একেবারে শুষ্ক ডালের মত হয়ে গেছেন এবং তাঁর স্ত্রীও তো থুড়থুড়ে বুড়ী। কাজেই এমতাবস্থায় তাদের সন্তান হওয়া কি করে সম্ব? তাই, তিনি আনন্দিত ও বিস্মিত হয়েই বিশ্ব প্রতিপালকের কাছে এর অবস্থা জানতে চান। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “সমস্ত সুন্নাত আমার জানা আছে। কিন্তু আমি জানি না যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যুহরে ও আসরে পড়তেন কিনা এবং এটাও জানি না যে, তিনি (আরবী) বলার পর (আরবী) বলতেন কি (আরবী) বলতেন। (এটা ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ফেরেশতারা উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ তাআলা তো এটা ওয়াদাই করেছেন যে, এই অবস্থাতেই এই স্ত্রী হতেই তিনি আপনাকে ছেলে দান করবেন। তার কাছে এ কাজ মোটেই কঠিন নয়। এর চেয়ে বেশী বিস্ময়কর এবং এর চেয়ে বড় শক্তির কাজ তো তোমরা স্বয়ং দেখেছে এবং সেটা হচ্ছে। তোমাদের নিজেদেরই অস্তিত্ব, যা কিছুই ছিল না, আল্লাহ তাআলাই বানিয়েছেন। সুতরাং যিনি তোমাদের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি কি তোমাদেরকে সন্তান দানে সক্ষম নন? যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিঃসন্দেহে মানুষের উপর কালের মধ্যে এমন একটি সময় অতীত হয়েছে, যখন সে কোন উল্লেখযোগ্য বস্তুই ছিল না।” (৭৬:১)
১০-১১ নং আয়াতের তাফসীর:

আরো বেশী মনের প্রশান্তি ও অন্তরের সান্ত্বনার জন্যে হযরত যাকারিয়া (আঃ) আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেনঃ “হে আল্লাহ! এর কোন একটি নিদর্শন প্রকাশ করুন। যেমন হযরত ইবরাহীম (আঃ) মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করণ দর্শনের আকাংখা এ জন্যেই প্রকাশ করেছিলেন। হযরত যাকারিয়ার (আঃ) প্রার্থনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা তাকে বলেনঃ “তুমি মূক বা বোবা হবে না এবং রোগাক্রান্ত হবে না, কিন্তু তুমি লোকদের সাথে কথা বলতে পারবে না এবং ঐ সময় তোমার মুখ দিয়ে কথা সরবে না। তিন দিন ও তিন রাত এ অবস্থাই থাকবে। এটাই হলো নিদর্শন। হলোও তাই। তিনি মুখে তাসবীহ পাঠ, ক্ষমতা প্রার্থনা ও প্রশংসা কীর্তন সবই করতে পারতেন। কিন্তু লোকদের সাথে কথা বলতে পারতেন না। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে যে, (আরবী) এর অর্থ হলো ক্রমাগত। অর্থাৎ ক্রমাগত তিন দিন ও তিন রাত যুবান পার্থিব কথা হতে বিরত থাকবে। প্রথম উক্তিটিও তার থেকেই বর্ণিত আছে এবং জমহূরের তাফসীরও এটাই। আর এটাই সঠিকও বটে। যেমন সূরায়ে আলে ইমরানে এর বর্ণনা গত হয়েছে যে, নিদর্শন চাওয়ায় আল্লাহ তাআলা বলেছিলেনঃ “তোমার লক্ষ্যণ এটাই যে, তুমি মানুষের সাথে কথা বলতে সমর্থ হবে না তিন দিন পর্যন্ত ইশারা ছাড়া; আর তুমি প্রচুর পরিমাণে যিকর করবে, আর তাসবীহ পাঠ করবে অপরাহেও।” সুতরাং ঐ তিন দিন ও তিন রাত তিনি লোকদের সাথে কথা বলতে পারতেন না। ইশারা ইঙ্গিতে শুধু নিজেরা মনের কথা বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু এটা নয় যে, তিনি মূক হয়ে গিয়েছিলেন। এখন তিনি তাঁর যে কক্ষে গিয়ে নির্জনে সন্তানের জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন, সেখান থেকে বের হয়ে আসেন এবং আল্লাহ তাআলা তাকে যে নিয়ামত দান করেছিলেন এবং যে যিকর ও তাসবীহ্ পাঠের তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ঐ হুকুম তার কওমের উপরও হয়। কিন্তু তিনি কথা বলতে পারতেন না বলে ইশারায় তাদেরকে বুঝিয়ে দেন অথবা মাটিতে লিখে বুঝিয়ে দেন।
১২-১৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলার শুভ সংবাদ অনুযায়ী হযরত যাকারিয়ার (আঃ) ঔরষে হযরত ইয়াহইয়া জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাওরাত শিক্ষা দেন যা তার উপর পাঠ করা হতো এবং যার হুকুম সমূহ সৎলোকেরা ও নবীগণ অন্যদের নিকট প্রচার করতেন। ঐ সময় তিনি ছোট বালক ছিলেন। এ জন্যেই মহান আল্লাহ তাঁর ঐ অসাধারণ নিয়ামতেরও বর্ণনা দিয়েছেন যে, তিনি হযরত যাকারিয়াকে (আঃ) সন্তানও দান করেন এবং তাঁকে বাল্যাব স্থাতেই আসমানী কিতাবের আলেমও বানিয়ে দেন। আর তাকে নির্দেশ দেনঃ “কিতাবকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ করো ও তা শিখে নাও।” আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ “সাথে সাথে আমি তাকে ঐ অল্প বয়সেই বোধসম্পন্ন জ্ঞান, শক্তি, দৃঢ়তা, বুদ্ধিমত্তা এবং সহনশীলতা দান করেছিলাম।” শৈশবেই তিনি সৎ কাজের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং চেষ্টা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর ইবাদত ও জনসেবার কাজে লেগে পড়েন। শিশুরা তাকে তাদের সাথে খেলতে ডাকতো। কিন্তু তিনি উত্তরে বলতেনঃ “আমাদেরকে খেলা করার জন্যে সৃষ্টি করা হয় নাই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “হযরত যাকারিয়ার (আঃ) জন্যে হযরত ইয়াহইয়ার (আঃ) অস্তিত্ব ছিল আমার করুণার প্রতীক, যার উপর আমি ছাড়া আর কেউই সক্ষম নয়। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে এটাও বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “আল্লাহর কসম! (আরবী) এর ভাবার্থ কি তা আমার জানা নেই। অভিধানে এটা প্রেম,প্রীতি, করুণা ইত্যাদি অর্থে এসে থাকে। বাহ্যতঃ ভাবার্থ এটাই জানা যাচ্ছে তাকে প্রেম, প্রীতি, স্নেহ এবং পবিত্রতা দান করেছিলাম।”

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জাহান্নামে একটি লোক এক হাজার বছর পর্যন্ত (আরবী) ও (আরবী) বলে ডাকতে থাকবে। (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে) হযরত ইয়াহ্ইয়া (আঃ) সর্বপ্রকারের ময়লা হতে, পাপ। হতে এবং নাফরমানী হতে তিনি মুক্ত ছিলেন। তাঁর জীবনের একমাত্র কাজ ছিল সৎ কার্যাবলী সম্পাদন। তিনি পাপকার্য ও আল্লাহর অবাধ্যাচরণ হতে বহু দূরে ছিলেন। সাথে সাথে তিনি পিতা-মাতার অনুগত ছিলেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতেন। কখনো কোন কাজে তিনি পিতা-মাতার অবাধ্য হন নাই। কখনো তিনি তাঁদের কোন কথার বিরোধিতা করেন নাই। তারা যে কাজ করতে নিষেধ করতেন তা তিনি কখনো করতেন না। তাঁর মধ্যে কোন ঔদ্ধত্যপনা ও হঠকারিতা ছিল না। এই উত্তম গুণাবলী ও প্রশংসনীয় স্বভাবের কারণে তিনটি অবস্থায় আল্লাহ তাআলা তাঁকে শান্তি ও নিরাপত্তা দান করেছিলেন। অর্থাৎ জন্মের দিন, মৃত্যুর দিন এবং হাশরের দিন। এই তিনটি জায়গাই অতি ভয়াবহ ও অজানা। মায়ের পেট থেকে বের হওয়া মাত্রই একটি নতুন দুনিয়া দেখা যায় যা আজকের দুনিয়া হতে বিরাট ও সম্পূর্ণ পৃথকরূপে পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুর দিন ঐ মাখলুকের সাথে সম্বন্ধ হয়ে যায়। যাদের সাথে পার্থিব জীবনে কোনই সম্বন্ধ ছিল না। তাদেরকে কখনো দেখেও নাই। এইভাবে হাশরের দিন নিজেকে একটা বিরাট জন সমাবেশে দেখে মানুষ অত্যন্ত হতভম্ব ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে। কেননা, ওটাও একটা নতুন পরিবেশ। এই তিন ভয়াবহ সময়ে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবেন।

একটি মুরসাল হাদীসে রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন সমস্ত লোক কিছু না কিছু গুনাহ নিয়ে যাবে, একমাত্র হযরত ইয়াহইয়া ছাড়া। হযরত কাতাদা’ (রাঃ) বলেন যে, হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) গুনাহ্ করা তো দূরের কথা, গুনা হর কখনো কোন ইচ্ছাও করেন নি। (এটা মারফু’রূপে এবং দুই সনদেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু দুটো সনদই দুর্বল। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)

হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) ও হযরত ঈসার (আঃ) পরস্পর সাক্ষাৎ হলে হযরত ঈসা (আঃ) হযরত ইয়াহইয়াকে (আঃ) বলেনঃ “আপনি আমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থণা করুন! আপনি আমার চেয়ে উত্তম।” উত্তরে হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) বলেনঃ “আপনিই আমার চেয়ে উত্তম।” তখন হযরত ঈসা (আঃ) বলেনঃ “আমি তো নিজেই নিজের উপর সালাম বলেছি, আর আপনার উপর স্বয়ং আল্লাহ সালাম বলেছেন।” এখন এই দুই নবীর (আঃ) ফযীলত প্রকাশ হয়ে পড়লো।

Leave a Reply