أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৩০)
[২১: ৬৯
قُلۡنَا یٰنَارُ کُوۡنِیۡ بَرۡدًا وَّ سَلٰمًا عَلٰۤی اِبۡرٰہِیۡمَ ﴿ۙ۶۹﴾
আমি বললাম, ‘হে আগুন! তুমি ইব্রাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’]
সূরা:- আল্ আম্বিয়া।
সুরা:২১
৫১-৭০ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২১:৫১
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَاۤ اِبۡرٰہِیۡمَ رُشۡدَہٗ مِنۡ قَبۡلُ وَ کُنَّا بِہٖ عٰلِمِیۡنَ ﴿ۚ۵۱﴾
নিশ্চয় আমি এর পূর্বে ইব্রাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং আমি তার সম্বন্ধে ছিলাম অবগত।
২১:৫২
اِذۡ قَالَ لِاَبِیۡہِ وَ قَوۡمِہٖ مَا ہٰذِہِ التَّمَاثِیۡلُ الَّتِیۡۤ اَنۡتُمۡ لَہَا عٰکِفُوۡنَ ﴿۵۲﴾
যখন সে তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলল, ‘এই মূর্তিগুলি কি, যাদের পূজায় তোমরা রত রয়েছ?’
২১:৫৩
قَالُوۡا وَجَدۡنَاۤ اٰبَآءَنَا لَہَا عٰبِدِیۡنَ ﴿۵۳﴾
তারা বলল, ‘আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদেরকে এদের পূজা করতে দেখেছি।’
২১:৫৪
قَالَ لَقَدۡ کُنۡتُمۡ اَنۡتُمۡ وَ اٰبَآؤُکُمۡ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۵۴﴾
সে বলল, ‘তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃ-পুরুষরাও রয়েছ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে।’
২১:৫৫
قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا بِالۡحَقِّ اَمۡ اَنۡتَ مِنَ اللّٰعِبِیۡنَ ﴿۵۵﴾
তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদের নিকট সত্য এনেছ, না তুমি কৌতুক করছ?’
২১:৫৬
قَالَ بَلۡ رَّبُّکُمۡ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ الَّذِیۡ فَطَرَہُنَّ ۫ۖ وَ اَنَا عَلٰی ذٰلِکُمۡ مِّنَ الشّٰہِدِیۡنَ ﴿۵۶﴾
তিনি বললেন, ‘বরং তোমাদের রব তো আসমানসমূহ ও যমীনের রব, যিনি সেগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং এ বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী।’
২১:৫৭
وَ تَاللّٰہِ لَاَکِیۡدَنَّ اَصۡنَامَکُمۡ بَعۡدَ اَنۡ تُوَلُّوۡا مُدۡبِرِیۡنَ ﴿۵۷﴾
শপথ আল্লাহর! তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করব।’
২১:৫৮
فَجَعَلَہُمۡ جُذٰذًا اِلَّا کَبِیۡرًا لَّہُمۡ لَعَلَّہُمۡ اِلَیۡہِ یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۵۸﴾
অতঃপর তিনি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন মূর্তিগুলোকে, তাদের প্রধানটি ছাড়া ; যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে।
২১:৫৯
قَالُوۡا مَنۡ فَعَلَ ہٰذَا بِاٰلِہَتِنَاۤ اِنَّہٗ لَمِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۵۹﴾
তারা বলল, ‘আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এরূপ আচরণ কে করল? সে নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী।’
২১:৬০
قَالُوۡا سَمِعۡنَا فَتًی یَّذۡکُرُہُمۡ یُقَالُ لَہٗۤ اِبۡرٰہِیۡمُ ﴿ؕ۶۰﴾
কেউ কেউ বলল, ‘আমরা এক যুবককে ওদের সমালোচনা করতে শুনেছি, তার নাম ইব্রাহীম।’
২১:৬১
قَالُوۡا فَاۡتُوۡا بِہٖ عَلٰۤی اَعۡیُنِ النَّاسِ لَعَلَّہُمۡ یَشۡہَدُوۡنَ ﴿۶۱﴾
তারা বলল, ‘তাকে লোক সম্মুখে উপস্থিত কর, যাতে তারা সাক্ষ্য দিতে পারে।’
২১:৬২
قَالُوۡۤا ءَاَنۡتَ فَعَلۡتَ ہٰذَا بِاٰلِہَتِنَا یٰۤـاِبۡرٰہِیۡمُ ﴿ؕ۶۲﴾
তারা বলল, ‘হে ইব্রাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এরূপ আচরণ করেছ?’
২১:৬৩
قَالَ بَلۡ فَعَلَہٗ ٭ۖ کَبِیۡرُہُمۡ ہٰذَا فَسۡـَٔلُوۡہُمۡ اِنۡ کَانُوۡا یَنۡطِقُوۡنَ ﴿۶۳﴾
তিনি বললেন, ‘বরং এদের এ প্রধান-ই তো এটা করেছে , সুতরাং এদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি এরা কথা বলতে পারে।’
২১:৬৪
فَرَجَعُوۡۤا اِلٰۤی اَنۡفُسِہِمۡ فَقَالُوۡۤا اِنَّکُمۡ اَنۡتُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿ۙ۶۴﴾
তখন তারা মনে মনে চিন্তা করে দেখল এবং একে অপরকে বলতে লাগল, ‘তোমরাই তো সীমালংঘনকারী।’
২১:৬৫
ثُمَّ نُکِسُوۡا عَلٰی رُءُوۡسِہِمۡ ۚ لَقَدۡ عَلِمۡتَ مَا ہٰۤؤُلَآءِ یَنۡطِقُوۡنَ ﴿۶۵﴾
অতঃপর তাদের মস্তক অবনত হয়ে গেল (এবং তারা বলল), ‘তুমি তো জানই যে, ওরা কথা বলতে পারে না।’
২১:৬৬
قَالَ اَفَتَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مَا لَا یَنۡفَعُکُمۡ شَیۡئًا وَّ لَا یَضُرُّکُمۡ ﴿ؕ۶۶﴾
ইবরাহীম বললেন, ‘তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ‘ইবাদত কর যা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে না এবং অপকারও করতে পারে না?
২১:৬৭
اُفٍّ لَّکُمۡ وَ لِمَا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۶۷﴾
‘ধিক তোমাদের জন্য এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদাত কর তাদের জন্য! তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?’
২১:৬৮
قَالُوۡا حَرِّقُوۡہُ وَ انۡصُرُوۡۤا اٰلِہَتَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ فٰعِلِیۡنَ ﴿۶۸﴾
তারা বলল, ‘তাকে পুড়িয়ে দাও এবং সাহায্য কর তোমাদের উপাস্যগুলিকে; যদি তোমরা কিছু করতে চাও।’
২১: ৬৯
قُلۡنَا یٰنَارُ کُوۡنِیۡ بَرۡدًا وَّ سَلٰمًا عَلٰۤی اِبۡرٰہِیۡمَ ﴿ۙ۶۹﴾
আমি বললাম, ‘হে আগুন! তুমি ইব্রাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’
২১:৭০
وَ اَرَادُوۡا بِہٖ کَیۡدًا فَجَعَلۡنٰہُمُ الۡاَخۡسَرِیۡنَ ﴿ۚ۷۰﴾
তারা তার সাথে চক্রান্ত করার ইচ্ছা করেছিল; কিন্ত আমি তাদেরকে করে দিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।
৫১-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ইবরাহীম(আ.)-এর সংগ্রাম : হযরত মূসা ও হারুনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়ার পর শুরু হয়েছে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর জীবনের একটা পূর্ণাংগ ঘটনা। হযরত ইবরাহীম(আ.) ছিলেন সমগ্র আরব জাতির শ্রেষ্ঠতম পূর্ব পুরুষ। তিনিই ছিলেন পবিত্র কা’বার নির্মাতা। যার ভিতরে কাফেররা বহুসংখ্যক মূর্তি স্থাপন করেছিলাে এবং সেই মূর্তির পূজা করতাে। হযরত ইবরাহীম(আ.) মূর্তি ভেংগেছেন। আলােচ্য আয়াতগুলােতেও তাকে এভাবেই পেশ করা হয়েছে যে, তিনি মূর্তিপূজা অপছন্দ করেন এবং মূর্তিকে ভাংতেও দ্বিধা করেন না। এখানে কাহিনীটা যে নবুওত ও রেসালাত সংক্রান্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাহিনী কয়েকটা ধারাবাহিক দৃশ্যপটে বিভক্ত, যার মাঝে মাঝে সামান্য কিছু ঘটনা উহ্য রয়েছে। এই কাহিনীর সূচনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম(আ.)-কে আগেই সত্যের অর্থাৎ তাওহীদের সন্ধান দেয়া হয়েছিলাে। বস্তুত এটাই সবচেয়ে বড়াে সত্য, যাকে এখানে রুশদ শব্দটা দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। ‘আমি ইতিপূর্বে ইবরাহীমকে সত্যের সন্ধান দিয়েছিলাম এবং তার সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম।’ অর্থাৎ তার অবস্থা জানতাম এবং নবী ও রসূলদের যে দায়িত্ব বহন করতে হয়, সেই দায়িত্ব বহনে তার যােগ্যতা সম্পর্কে অবহিত ছিলাম। ‘যখন সে তার পিতাকে ও জনগণকে বললো, এই মূর্তিগুলাে কী যে তােমরা এগুলাের বন্দনায় পড়ে রয়েছে?’ ইবরাহীম(আ.)-এর এই উক্তিটাই প্রমাণ করেছিলাে যে, তিনি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। পাথর ও কাঠের তৈরী মুর্তিগুলােকে তিনি দেবতা নামে আখ্যায়িত না করে মূর্তি বলে অভিহিত করেছেন এবং তার বন্দনার প্রতি কটাক্ষ করছেন। আকিফুন শব্দটা দ্বারা অব্যাহত ও সার্বক্ষণিক বন্দনা বুঝায়। যদিও মােশরেকরা সর্বক্ষণ মূর্তিপূজা করে না, কিন্তু সে মূর্তির প্রতি তারা সর্বক্ষণ ভক্তি ও অনুরাগ পােষণ করে। তাই এটাকে কার্যত সার্বক্ষণিক পূজা বন্দনা হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। এই ভক্তি ও অনুরাগের প্রতি তিনি কটাক্ষ করেছেন এবং সর্বক্ষণ মূর্তিগুলাের পূজা নিয়ে পড়ে থাকে এরূপ মন্তব্য করে তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। তাদের একমাত্র জবাব ও যুক্তি ছিলো এই- ‘তারা বললাে, আমরা তো আমাদের পূর্ব পুরুষদের এগুলাের পুজো করতে দেখেছি।’ এ জবাব থেকে বুঝা যায় যে, তাদের মূর্তি পূজার পেছনে কোনাে যুক্তি ছিলাে না। ছিলাে শুধু প্রাণহীন ঐতিহ্যের ছকে আবদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্বিক গােয়ার্তুমী। ছিলাে না ঈমানের স্বাধীনতা, ছিলাে না দৃষ্টি ও চিন্তার স্বাধীনতা, ছিলাে না প্রচলিত ধ্যান ধারণা ও মূল্যবােধের পরিবর্তে প্রকৃত মূল্যবােধের আলোকে পরিস্থিতি ও জিনিসপত্রের মূল্যায়ন। বস্তুত আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ হলাে পুরুষানুক্রমিক ও কল্পনাসর্বস্ব ধর্মীয় চিন্তাধারা এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অযৌক্তিক একগুয়েমি থেকে মুক্তি লাভ। ইব্রাহিম বললো, ‘তোমরা ও তােমাদের পূর্বপুরুষরা সুস্পষ্ট গােমরাহীতে লিপ্ত।’ বস্তুত পূর্ব পুরুষদের পূজা উপাসনার দরুণ এসব মুর্তি এমন কোনাে মর্যাদা ও ধর্মীয় গুরুত্ব অর্জনে সক্ষম হয় না, যার অধিকারী তারা আসলেই নয়। পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ থেকে কোনাে কিছুর মর্যাদার সৃষ্টি হয় না। একমাত্র মুক্ত ও স্বাধীন বিচার বিবেচনা ও মূল্যায়ন দ্বারাই কোনাে জিনিসের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। হযরত ইবরাহীম(আ.) যখন তাদের কাছে এই মুক্ত ও স্বাধীন বিচার বিবেচনার আবশ্যকতা তুলে ধরলেন এবং ফয়সালার এই স্বচ্ছতা কামনা করলেন, তখন তারা প্রশ্ন তুললাে, ‘তারা বললাে, তুমি কি আমাদের কাছে সত্য নিয়ে এসেছে, নাকি (আমাদের সাথে) তামাশা করছো?’ এটা এমন অস্থিরমতি লােকদের জিজ্ঞাসা, যারা নিজেদের ধারণা বিশ্বাস নিয়ে সংশয়াপন্ন থাকে। কেননা তা নিয়ে তারা চিন্তাগবেষণা করেনি এবং কোন ধারণা সঠিক, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়নি। তবে ভিত্তিহীন অলীক ধ্যান ধারণা ও পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্যের প্রভাবে তার বিবেকবুদ্ধি ও চিন্তা চেতনাও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কেননা কোন কথা সঠিক তা সে জানে না। আর এবাদত উপাসনা শুধুমাত্র নিশ্চিত বিশ্বাসের ভিত্তিতেই করা সম্ভব, যুক্তি প্রমাণহীন নড়বড়ে ধ্যান ধারণার ভিত্তিতে নয়। এ কারণেই যারা আপন বিবেক বুদ্ধির কাছে সন্দেহাতীতভাবে সঠিক ও স্বচ্ছ তাওহীদ বিশ্বাসের অনুসারী নয়, তারা এক কুলকিনারাহীন মরীচীকার মধ্যে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। হযরত ইবরাহীম(আ.) ছিলেন এর বিপরীত। তিনি আল্লাহকে চিনতেন এবং তার প্রতি তার বিশ্বাস ছিলাে অবিচল ও সন্দেহাতীত। সে বিশ্বাস প্রতিফলিত হয় তার চিন্তায় চেতনায় ও বক্তব্যে। তাই তার মতাে নিশ্চিত ঈমানধারী মােমনদের পক্ষে না বলা স্বাভাবিক, তিনিও তাই বলেছিলেন। ‘ইবরাহীম বললাে, আসলে তােমাদের প্রভুতাে তিনিই যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু। এ ব্যাপারে আমি একজন সাক্ষী।’ অর্থাৎ আকাশ, পৃথিবী ও মানুষের প্রভু ভিন্ন ভিন্নজন নয় বরং একই জন। তার প্রভুত্বের কারণ শুধু এই যে, তিনি এ সবের সৃষ্টিকর্তা। বস্তুত আকাশ, পৃথিবী ও মানুষের প্রভু ও সৃষ্টিকর্তা-এই দুটো বৈশিষ্ট্য অবিচ্ছেদ্য। এ সংক্রান্ত বিশ্বাসটাও ধ্রুব সত্য ও বিশুদ্ধ। অথচ মােশরেকরা বিশ্বাস করে যে, তাদের সেসব দেবতারা ও মূর্তিগুলােই তাদের প্রভু ও বিধাতা। অথচ তারা এটাও জানে ও বিশ্বাস করে যে, দেবতারা বা মূর্তিগুলাে কিছুই সৃষ্টি করে না এবং করতেও পারে না, বরং সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। এটা জানা সত্তেও তারা সেসব অক্ষম দেব-দেবী ও বিগ্রহের পূজা করে। এই সত্যের ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর প্রত্যয় ছিলাে একটা সন্দেহাতীত বাস্তব ঘটনার চাক্ষুস দর্শকের মতাে। তাই তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমি একজন সাক্ষী।’ এ কথা সত্য যে, ইবরাহীম(আ.) আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তার নিজের ও তার জাতির সৃষ্টির ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখেননি। কিন্তু ঘটনাটা এতাে স্পষ্ট ও এমন ধ্রুবসত্য যে, এর প্রতি বিশ্বাসীরা বলিষ্ঠভাবে সাক্ষ্য দিতে পারে। বিশ্ব চরাচরের যেখানে যা কিছু আছে, তা সমগ্র বিশ্ব জগতের স্রষ্টা ও পরিচালকের একত্বের সাক্ষ্য দেয়। অনুরূপভাবে, মানব সত্ত্বার অভ্যন্তরে যেখানে যা কিছুই আছে তাও তাকে বিশ্বের স্রষ্টা ও বিধাতার একত্ব মেনে নিতে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি যে প্রাকৃতিক নিয়ম বিশ্ব জগতকে পরিচালনা করে তাকেও এক ও অভিন্ন বলে স্বীকৃতি দিতে প্রেরণা যােগায়। এরপর ইবরাহীম(আ.) তার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত স্বজাতীয়দেরকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি তাদের মূর্তিগুলাের ব্যাপারে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, যা আর কখনাে প্রত্যাহার করা হবে না, ‘আল্লাহর কসম, তােমরা এখান থেকে সরে গেলে আমি তােমাদের মুর্তিগুলের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবোই।’ এ সময় হযরত ইবরাহীম(আ.) মূর্তিগুলাের বিরুদ্ধে কী চক্রান্ত করবেন তা স্পষ্টভাবে জানাননি। আর এই হুমকির কী জবাব তার জাতি দিয়েছিলাে, কোরআন তারও উল্লেখ করেনি। সম্ভবত তারা ইবরাহীম(আ.)-কে কিছুই বলেনি। কারণ তারা নিশ্চিত ছিলাে যে, তিনি তাদের মূর্তিগুলাের কোনােই ক্ষতি সাধন করতে পারবেন না। ‘অতপর সে মূর্তিগুলােকে চুরমার করে দিলাে তাদের বড়ােটা ছাড়া, যাতে তারা তার কাছে (জিজ্ঞাসার জন্যে) ফিরে আসে।'(আয়াত ৫৮) যেসব মূর্তি এতাে দিন দেবতা হিসেবে পূজো উপাসনা পেয়ে আসছিলাে, তারা কতকগুলাে ছিন্নভিন্ন পাথর ও কাঠের টুকরােয় পরিণত হলাে। কেবল বড়ো মূর্তিটাকে হযরত ইবরাহীম(আ.) অক্ষত রেখে দিলেন। ‘যাতে জনগণ তার কাছে ফিরে আসে’ অতপর তাকে জিজ্ঞেস করে যে, এমন একটা দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটলাে এবং সে উপস্থিত থেকেও কেন ছােটো খাটো মূর্তিগুলােকে রক্ষা করলাে না? তিনি ভেবেছিলেন যে, ওকে যখন ওরা জিজ্ঞেস করবে, তখনই পুরাে ব্যাপারটা নিয়ে তারা ভাববার অবকাশ পাবে, প্রকৃত সত্যের সন্ধান পাবে এবং বুঝবে যে, এই সব মূর্তির পূজা করাটা নিতান্তই বােকামি ও ফালতু কাজ। যথাসময়ে তারা ফিরে এসে দেখতে পেলাে তাদের বড়াে মূর্তি ছাড়া আর সবগুলাে টুকরাে টুকরাে হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু তারা বড়াে মূর্তিটার কাছেও জিজ্ঞেস করলাে না। নিজেরাও ভেবে দেখলাে না যে, এরা যদি দেবতা হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ওপর এমন সর্বনাশা আঘাত নেমে এলাে কি করে এবং তারা সে আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পারলাে না কেন? বড়াে দেবতাটাই বা কি করে নিজেকে ও অন্যদেরকে রক্ষা না করে বসে থাকলাে? এ প্রশ্নটা তাদের মাথায় আসেনি। কেননা কুসংস্কার তাদের বিবেক বুদ্ধির চিন্তা করার শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিলাে। পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ তাদের মনমগজ থেকে চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলাে। তবুও প্রশ্নটা স্বভাবতই না উঠে পারেনি। যে ব্যক্তি তাদের দেবতাদেরকে ধ্বংস করেছে তার কাছ থেকে প্রতিশােধ গ্রহণের মনােভাব নিয়েই তারা প্রশ্ন তুললাে, ‘তারা বললাে, আমাদের দেবতাদের সাথে এমন আচরণ কে করলাে? সে নিশ্চয়ই একজন যুলুমবাজ।’ অনেকে ইতিপূর্বে শুনেছিলাে যে, ইবরাহীম(আ.) তার বাবা ও তার বাবার ঘনিষ্ঠজনদের মূর্তিপূজোয় আপত্তি তুলেছে এবং হুমকিও দিয়েছে যে, তারা যখন মূর্তিগুলাের কাছ থেকে অন্য কোথাও চলে যাবে, তখন সে মূর্তিগুলাের ক্ষতি সাধন করবে। যারা এ খবর শুনেছিলাে তাদের এবার মনে পড়ে গেলাে। ‘তারা বললাে, আমরা ইবরাহীম নামক এক যুবকের কথা শুনেছি। সে নাকি এদের সম্পর্কে নানা কথা বলে।’ এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইবরাহীম(আ.) এ সময় একজন তরুণ ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে সত্যের জ্ঞান দান করেছিলেন। তাই তিনি মূর্তিপূজা অপছন্দ করতো এবং মূর্তিগুলােকে এভাবে ধ্বংস করেন। এখন প্রশ্ন এই যে, তিনি কি ওই সময়ে ওহী ও নবুওত লাভ করেছিলেন? নাকি নবুওতের পূর্বেই তিনি এই আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এই সত্যজ্ঞান লাভ করেন, সেই দিকেই তিনি তার পিতাকে দাওয়াত দেন এবং এরই ভিত্তিতে তিনি তার জাতির অনুসৃত পৌত্তলিকতার সমালােচনা করেন? শেষােক্ত ধারণাটা অগ্রগণ্য। এমনও হতে পারে যে, ‘আমরা ইবরাহীম নামক এক যুবকের নাম শুনেছি’- এই কথাটা দ্বারা হযরত ইবরাহীম(আ.)-কে গুরুত্বহীন ও অবিপজ্জনক বলে বুঝানাে হয়েছে। এটা অসম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারণাটাই অগ্রগণ্য মনে হয় যে, তিনি ওই সময় একজন অল্পবয়সী তরুণ ছিলেন। ‘তারা বললাে, তাহলে তাকে জনগণের সামনে হাযির করাে। হয়তাে বা তারা সাক্ষ্য দেবে।’ (আয়াত ৬১) এ বক্তব্য দ্বারা আসলে ইবরাহীম ও তার কাজটা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করার ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়েছিলো। ‘তারা বললাে, হে ইবরাহীম, আমাদের দেবতাদের সাথে এই কান্ডটা কি তুমি করেছে?’ মূর্তিগুলাে টুকরাে টুকরাে হয়ে পড়ে থাকা সত্তেও তারা ওগুলােকে দেব-দেবী হিসেবে মানা অব্যাহত রাখলাে। অথচ ইবরাহীম(আ.) তাদের প্রতি কটাক্ষ করতে ও উপহাস করতে লাগলেন। তিনি একা আর ওরা সংখ্যায় বহু জন। তবু তিনি কিছুমাত্র দমলেন না। কারণ তিনি মুক্ত বুদ্ধি ও অকুণ্ঠ বিবেক দ্বারাই ব্যাপারটা দেখছিলেন। তাই তিনি তাদের প্রতি বিদ্রুপ ও উপহাস করে থাকতেই পারছিলেন না। আর তাদের এই নিম্নমানের বুদ্ধির সাথে সংগতি রেখেই তাদের প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘ইবরাহীম বললো, বরঞ্চ ওদের মধ্যকার সে বড়ােটাই এ কান্ড ঘটিয়েছে। কাজেই ওদেরকেই জিজ্ঞেস করাে যদি তারা কথা বলতে পারে।’ এই বিদ্রুপাত্মক জবাবে সুস্পষ্ট কটাক্ষপাত ছিলাে। কাজেই এ উক্তিটাকে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর মিথ্যা উক্তিরূপে চিহ্নিত করা ও নানারকমের যুক্তি দিয়ে তার কারণ দর্শানাের কোনাে প্রয়ােজন নেই। ব্যাপারটা এর চেয়ে অনেক সহজ। তিনি তাদেরকে যা বলতে চেয়েছেন তা হলাে, এই মূর্তিগুলাে জানেই না ওদেরকে কে ধ্বংস করেছে, আমি না সে বড়ো মূর্তিটা, যে কিনা নড়তে চড়তেই পারে না। ওগুলাে তাে একেবারেই জড় পদার্থ, যার আদৌ কোনাে অনুভূতি ও বােধশক্তি নেই। তােমরাও তাে ওই জড় মূর্তিগুলাের মতাে বােধশক্তি হারিয়ে বসেছে। ফলে ন্যায় অন্যায় অবৈধ ও বৈধের বাছ-বিচার করাে না। ফলে মূর্তিগুলাে আমি ধ্বংস করেছি, না এই বৃহৎ মূর্তিটা ধ্বংস করেছে তা তােমরা জানােই না। ‘কাজেই ওরা যদি কথা বলতে সক্ষম হয়ে থাকে, তবে ওদেরকেই জিজ্ঞেস করাে।’ মনে হয়, হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর এই বিদ্রুপাত্মক কটাক্ষ তাদের মধ্যে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিলাে। পরের আয়াত থেকেই এটা মনে হয়। ‘অগত্যা তারা চিন্তা-ভাবনা করে বললাে, তােমরাই যুলুমবাজ।’ তাদের এই উক্তিটা ছিলাে একটা শুভলক্ষণ। এ দ্বারা ধারণা হচ্ছিলাে যে, তারা তাদের কার্যকলাপের ভ্রান্তি বুঝতে পারবে এবং মূর্তিপূজো যে কতাে বড়াে অন্যায় ও যুলুম, তা উপলব্ধি করতে পারবে। কিন্তু না, ওটা ছিলাে এক মুহূর্তের একটা আলাের ঝলকানি। এরপরই তাদেরকে আবার অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেললাে এবং এক মুহুর্তের জাগরণের পর তাদের বিবেক আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাে। অতপর তারা মাথা নুইয়ে ফেললাে এবং বললাে, ‘হে ইবরাহীম, তুমি তাে জানাে যে, এসব মূর্তি কথা বলতে অক্ষম।’ সত্যিই তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিলাে জাগরণ সূচক এবং দ্বিতীয়টা ছিলাে সাবেক মতে প্রত্যাবর্তন সূচক । কোরআনের অপরূপ বাচনভংগী এর খুবই চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছে। প্রথমটা ছিলাে মনােজগতে চিন্তাভাবনার উদ্রেককারী একটা আলােড়ন । আর দ্বিতীয়টা ছিলাে মস্তিষ্কের একটা পাল্টা বিপ্লব, যা সমস্ত চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধি চর্চার পথ রুদ্ধ করে দেয়। নচেৎ তাদের এই সর্বশেষ উক্তিটা তাদেরই বিপক্ষের যুক্তি। মূর্তিগুলাে কথা বলতে না পারার চেয়ে বলিষ্ঠ প্রমাণ হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর বক্তব্যের পক্ষে আর কী হতে পারে। এ কারণেই অতীব সহনশীল ও বিনম্র স্বভাবের মানুষ হয়েও হযরত ইবরাহীম(আ.) এরূপ বিরক্তিসূচক ও কঠোর মন্তব্য করলেন। কেননা এখানে যে হীনতা ও গােয়ার্তুমি প্রকাশ করা হয়েছে, তা ধৈর্যশীল ব্যক্তির ধৈর্য ও সহনশীলতাকেও হার মানিয়েছে। ‘ইবরাহীম বললাে, তবে কি যা তােমাদের কোনােই লাভ বা ক্ষতি করতে পারে না। তার উপাসনা তােমরা করবেই আল্লাহকে বাদ দিয়ে? তােমাদের প্রতি এবং আল্লাহকে ছেড়ে তােমরা যেগুলাের উপাসনা করছে। তার প্রতি ধিক্কার। তবুও কি তােমরা বুঝবে না?’ এ কথাটার ভেতর দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত হীনতা ও গােয়াতুর্মির প্রতি বিরক্তি, ঘৃণা এবং বিস্ময় ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
*অগ্নিকুণ্ড যখন শান্তির নিবাসে পরিণত হয় : হঠকারী স্বভাবের স্বেচ্ছাচারী একনায়ক যেমন যুক্তি প্রমাণ হাতছাড়া হয়ে গেলে দিশেহারা ও বেশামাল হয়ে পড়ে এবং তার আত্মাভিমান তাকে পাপ কাজে প্ররােচিত করে, ঠিক তেমনি তারাও আত্মাভিমানী হয়ে উঠলাে। ফলে তারা আগ্রাসী ক্ষমতার দাপট দেখাতে ও নিপীড়ণমূলক কর্মকান্ড করতে উদ্যত হলাে, ‘তারা বললাে, ওকে জ্বালিয়ে দাও এবং তােমাদের দেবতাকে সাহায্য করাে, যদি যথার্থই কিছু করতে চাও।’ কী বিস্ময়কর এই মােশরেকদের মাবুদ যে, তারা তাদের বান্দাদেরই সাহায্য করতে যাবে না। নিজেদের ও তাদের উপাসকদের সাহায্য করা দূরে থাক, নিজেদের সামান্যতম লাভক্ষতিও তারা করতে পারে না। তারা আদেশ দিলাে বটে, ‘ওকে জ্বালিয়ে দাও।’ কিন্তু অপরদিক থেকে আরেকটা আদেশ দেয়া হলো, যা অন্য সকল আদেশ ও সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। কেননা সেটাই সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে বলিষ্ঠ আদেশ যাকে অকার্যকর বা বাতিল করার ক্ষমতা কারাে নেই। সেই আদেশটা হলাে, আমি আদেশ দিলাম, ‘হে আগুন, ইবরাহীমের প্রতি তুমি শীতল ও শান্তিময় হয়ে যাও।’ যথার্থই তা ইবরাহীম (আ.)-এর প্রতি শীতল ও শান্তিময় হয়ে গেলাে। কিভাবে আগুন শীতল হলাে? শুধু আগুন নিয়েই এ প্রশ্ন কেন? আসলে ‘হয়ে যাও’ এই শব্দটাই এমন যে, আল্লাহ তায়ালা এটা উচ্চারণ করা মাত্রই বিশাল বিশাল জগত সৃষ্টি হয়ে যায়। কাজেই আমাদের এ প্রশ্ন করা চাই না যে, আগুন কেন ইবরাহীম(আ.)-কে পােড়ালাে না, অথচ এটা চাক্ষুস সত্য ও সর্বজনবিদিত সত্য যে, আগুন জীব দেহকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়, বস্তুত যিনি আগুনকে পােড়াতে আদেশ দিয়েছিলেন, তিনিই আগুনকে শীতল ও শান্তিময় হতে আদেশ দিয়েছেন। একই কথা, যা বলার পর কোথাও মানুষ যা দেখতে অভ্যস্ত তাই হয়, আবার কোথাও যেটা দেখতে তারা অভ্যস্ত নয় সেটাও হয়। যারা আল্লাহর কাজকে মানুষের কাজের সমতুল্য ভাবে, তারা জিজ্ঞেস করে এটা কেমন করে হলাে? ওটা কিভাবে সম্ভব হলাে? যারা এই দুই কাজের প্রকৃতি এবং দুই কাজের উপকরণ সম্পর্কে অবগত আছেন, তারা এ প্রশ্ন একেবারেই করেন না। তারা বৈজ্ঞানিক কিংবা অবৈজ্ঞানিক কোনাে ধরনেরই কারণ দর্শান না। কারণ বিষয়টা মানবীয় মাপকাঠিতে মাপার মতাে বিষয়ই নয়। এ ধরনের মােজেযাগুলােকে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা না করা মৌলিকভাবে একটা ভ্রান্ত নীতি। কেননা আল্লাহর কাজকে মানবীয় মাপকাঠিতে মাপা এবং তাদের সীমিত জ্ঞান ও বিদ্যার আলােকে যাচাই করা অসম্ভব। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু এতােটুকু বিশ্বাস করা যে, ব্যাপারটা সংঘটিত হয়েছে। কেননা সে ব্যাপারটার স্রষ্টা ওটাকে সংঘটিত করতে সক্ষম। তবে আল্লাহ তায়ালা আগুনকে কিভাবে তৈরী করলেন যে, তা ইবরাহীম(আ.)-এর জন্যে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীকে পরিণত হয়ে গেলাে? তিনি কিভাবে ইবরাহীম(আ.)-কে তৈরী করেছিলেন, যে আগুন তাকে পোড়াতে পারলাে না? এ প্রশ্নে কোরআন নীরব। কেননা মানুষের সীমিত বুদ্ধি দ্বারা সেটা বুঝা সম্ভব নয়। অপরদিকে কোরআনের উক্তি ছাড়া আমাদের হাতে এর কোনাে প্রমাণও নেই। আগুনকে ইবরাহীম(আ.)-এর জন্যে ঠান্ডা করে দেয়া ও আগুনকে নিরাপদ করে দেয়ার ঘটনাটা ছিলো এমন একটা দৃষ্টান্ত, যার নযীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু সেসব ঘটনা এ ঘটনার মতাে আলােড়ন সৃষ্টি করে না। বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের ওপর অনেক সময় এমন বিপর্যয় নেমে আসে, যা সে ব্যক্তি বা দলকে একেবারেই ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতো, কিন্তু কার্যত তা একটা ক্ষুদ্র আলােড়ন সৃষ্টি করে মাত্র। এমনকি তা সে ব্যক্তি বা দলকে ধ্বংস করার পরিবর্তে ক্ষেত্র বিশেষে আরাে জীবন্ত ও উদ্দীপিত করে দিয়ে যায়। ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা হওয়া সত্তেও তা তার প্রভূত কল্যাণ সাধন করে। বস্তুত ‘হে আগুন ইবরাহীমের জন্যে শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও’ কথাটা বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের জীবনে এবং আকীদা বিশ্বাস, মতবাদ ও দাওয়াতের জীবনে বারবার এসে থাকে। সে ক্ষেত্রে এ কথাটা আসলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সেই চূড়ান্ত দিক নির্দেশক বাণীরই প্রতীক হয়ে থাকে, যে বাণী অন্য সকল বাণীকে এবং সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়। কেননা সে বাণীই সর্বোচ্চ। তাকে কেউ অকার্যকর বা বাতিল করতে পারে না। পরবর্তী আয়াতের বক্তব্য, ‘আর তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকালাে, ফলে আমি তাদেরকে সর্বাধিক ব্যর্থ ও বিফল করে দিলাম।’ বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সম-সাময়িক সম্রাট নমরূদ উপাধিতে ভূষিত ছিলাে। ছিলাে ইরাকের আরামীয় জাতির রাজা। আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া আযাবে সে তার দলবলসহ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাে। এই আযাবের বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে মতভেদ রয়েছে, যার কোনােটা সম্পর্কেই কোনাে নির্ভরযােগ্য প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। কেবল এতােটুকু জেনে রাখাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট যে, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম(আ.)-কে ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা এবং ষড়যন্ত্রকারীদেরকে এমন বিপর্যয়ের কবলে ফেলেছিলেন, যার চেয়ে বড়াে কোনাে বিপর্যয় থাকতে পারে না। সেই বিপর্যয়টা কি ধরনের ছিলাে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি, অনির্দিষ্টভাবে রেখে দেয়া হয়েছে, এরপরের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি তাকে ও লুতকে রক্ষা করলাম এবং সেই দেশে পাঠালাম যার ওপর আমি জগতবাসীর জন্যে কল্যাণ অবতীর্ণ করেছি।’ এটা হচ্ছে সিরিয়া। এখানে হযরত ইবরাহীম(আ.) ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত লূত হিজরত করে চলে গেলেন। ওই দেশটা দীর্ঘকাল ওহী অবতরণের স্থান হিসেবে বহাল ছিলাে এবং হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর বংশােদ্ভূত নবী ও রসূলদের আবাসভূমি ছিলাে। ওখানেই পবিত্র ভূমি ও দ্বিতীয় কেবলা অবস্থিত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ওহী ও নবুওতের বরকত ছাড়াও জীবিকার প্রাচুর্য ও ভূমির উর্বরতার দিক দিয়েও দেশটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রেখেছিলাে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# আমি এখানে رشد শব্দের অনুবাদ করেছি “শুভবুদ্ধি ও সত্যের জ্ঞান” রুশদ এর অর্থ হচ্ছে সঠিক ও বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য করে সঠিক কথা বা পথ অবলম্বন করা এবং বেঠিক কথা ও পথ থেকে দূরে সরে যাওয়া। এ অর্থের প্রেক্ষিতে “রুশদ” এর অনুবাদ “সত্যনিষ্ঠা”ও হতে পারে। কিন্তু যেহেতু রুশদ শব্দটি কেবলমাত্র সত্যনিষ্ঠ নয় বরং এমন সত্যজ্ঞানের ভাব প্রকাশ করে যা হয় সঠিক চিন্তা ও ভারসাম্যপূর্ণ সুষ্ঠ বুদ্ধি ব্যবহারের ফলশ্রুতি তাই আমি “শুভবুদ্ধি ও সত্যের জ্ঞান” এই দু’টি শব্দকে একত্রে এর অর্থের কাছাকাছি পেয়েছি। “ইবরাহীমকে তার সত্যজ্ঞান ও শুভবুদ্ধি দান করেছিলাম।” অর্থাৎ সে যে সত্যের জ্ঞান ও শুভবুদ্ধির অধিকারী ছিল তা আমিই তাঁকে দান করেছিলাম। “আমি তাঁকে খুব ভালোভাবে জানতাম।” অর্থাৎ আমি চোখ বন্ধ করে তাকে এ দান করিনি। আমি জানতাম সে কেমন লোক। সব জেনেশুনেই তাঁকে দান করেছিলাম। اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ “আল্লাহ ভালো জানেন নিজের রিসালাত কাকে সোপর্দ করবেন।” (আন’আমঃ ১২৪) এর মধ্যে কুরাইশ সরদাররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে যে আপত্তি করতো তার প্রতি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে। তারা বলতো, এ ব্যক্তির মধ্যে এমন কি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে যে, আল্লাহ আমাদের বাদ দিয়ে তাঁকেই রিসালাতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছেন? এর জবাব কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেয়া হয়েছে। এখানে কেবলমাত্র এতটুকু সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে যে, এ প্রশ্ন ইবরাহীম সম্পর্কেও হতে পারতো। বলা যেতে পারতো যে, সারা ইরাক দেশে একমাত্র ইবরাহীমকেই কেন এ অনুগ্রহে অভিসিক্ত করা হলো? কিন্তু আমি জানতাম ইবরাহীমের মধ্যে কি যোগ্যতা আছে। তাই তাঁর সমগ্র জাতির মধ্য থেকে একমাত্র তাঁকেই এ অনুগ্রহ দান করার জন্য বাছাই করা হয়।
ইতিপূর্বে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পবিত্র সীরাতের বিভিন্ন দিক সূরা বাকারার ১২৪ থেকে ১৪১ ও ২৫৮ থেকে ২৬০ , আন’আমের ৭৪ থেকে ৮১ , তাওবার ১১৪ , হূদের ৬৯ থেকে ৭৪ , ইবরাহীমের ৩৫ থেকে ৪১ , আল হিজরের ৫১ থেকে ৬০ এবং আন নাহলের ১২০ থেকে ১২৩ আয়াতে আলোচিত হয়েছে। এর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলে ভালো হবে।
# সামনের দিকে যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, তা পড়ার আগে একথাগুলো মনের মধ্যে তাজা করে নিতে হবে যে, কুরাইশরা হযরত ইবরাহীমের সন্তান ছিল। কাবাঘর তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। আর ইবরাহীমের আওলাদও ইবরাহীমী কাবার খাদেম হবার কারণেই কুরাইশরা যাবতীয় সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছিল। আজ এ যুগে এবং আরবের বহু দুরবর্তী এলাকার পরিবেশে হযরত ইবরাহীমের এ কাহিনী শুধুমাত্র একটি শিক্ষণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবেই দেখা যায় কিন্তু যে যুগে ও পরিবেশে প্রথম প্রথম একথা বলা হয়েছিল, তা দৃষ্টি সম্মুখে রাখলে অনুভূত হবে যে, কুরাইশদের ধর্ম ও তাদের পৌরহিত্যের ওপর এটা এমন একটা তীক্ষ্ণ কশাঘাত ছিল, যা একেবারে তার মর্মমূলে আঘাত হানতো।
# এ বাক্যটির শাব্দিক অনুবাদ হবে, “তুমি কি আমাদের সামনে সত্য পেশ করছো, না খেলা করছো?” কিন্তু এর আসল অর্থ ওটাই যা উপরে অনুবাদে বলা হয়েছে। নিজেদের ধর্মের সত্যতার প্রতি তাদের বিশ্বাস এত বেশী ছিল যে, তারা গুরুত্ব সহকারে কেউ এ কথা বলতে পারে বলে কল্পনাও করতে প্রস্তুত ছিল না। তাই তারা বললো, তুমি নিছক ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও খেলা-তামাশা করছো, না কি প্রকৃতপক্ষে এটাই তোমার চিন্তাধারা?
# যদি তোমরা যুক্তির সাহায্যে কথা বুঝতে অপারগ হয়ে থাকো তাহলে আমি তোমাদেরকে কার্যত দেখিয়ে দেবো যে, এরা অসহায়, সামান্যতম ক্ষমতাও এদের নেই এবং এদেরকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা ঠিক নয়। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ দর্শনের মধ্যে একথা তাদের সামনে কেমন করে প্রমাণ করবেন, এর কোন বিস্তারিত বিবরণ হযরত ইবরাহীম (আ) এ সময় দেননি।
# যে সময় পূজারী ও রক্ষণাবেক্ষণকারীরা উপস্থিত ছিল না সে সময় সুযোগ পেয়েই হযরত ইবরাহীম (আ) তাদের কেন্দ্রীয় ঠাকুরঘরে প্রবেশ করলেন এবং মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেললেন।
# “তার দিকে” কথাটির মধ্যে যে ইঙ্গিত রয়েছ তা বড় মূর্তিটির দিকেও হতে পারে আবার হযরত ইবরাহীমের দিকেও। যদি প্রথমটি হয় তাহলে এটি হবে হযরত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে তাদের আকীদা বিশ্বাসের প্রতি একটি বিদ্রূপাত্মক কটাক্ষের সমার্থক। অর্থাৎ যদি তারা মনে করে থাকে সত্যিই এরা ইলাহ, তাহলে তাদের এ বড় ইলাহটির ব্যাপারে সন্দেহ হওয়া উচিত যে, সম্ভবত বড় ইলাহ কোন কারণে ছোট ইলাহদের প্রতি বিরূপ হয়ে গিয়ে তাদের সবাইকে কচুকাটা করে ফেলেছেন। অথবা বড় ইলাহটিকে জিজ্ঞেস করো যে, হুযুর! আপনার উপস্থিতিতে একি ঘটে গেলো? কে এ কাজ করলো? আপনি তাকে বাধা দিলেন না কে? আর যদি দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করা হয় তাহলে বুঝা যাবে যে, এ কাজের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীমের উদ্দেশ্য এই ছিল যে, নিজেদের মূর্তিগুলোর এ দুরবস্থা দেখে হয়তো তাদের দৃষ্টি আমার দিকে ফিরে আসবে এবং তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তখন তাদের সাথে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলার সুযোগ আমি পেয়ে যাবো।
# এভাবে হযরত ইবরাহীমের মনের আশাই যেন পূরণ হলো। কারণ তিনি এটিই চাচ্ছিলেন। ব্যাপরটিকে তিনি শুধু পুরোহিত ও পূজারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছিলেন না। বরং তিনি চাচ্ছিলেন, ব্যাপারটা সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ুক। তারাও আসুক, দেখে নিক এই যে মূর্তিগুলোকে তাদের অভাব পূরণকারী হিসেবে রাখা হয়েছে এরা কতটা অসহায় এবং স্বয়ং পুরোহিতরাই এদের সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করে। এভাবে এ পুরোহিতরাও ফেরাউনের মতো একই ভুল করলো। ফেরাউন যাদুকরদের সাথে হযরত মূসাকে (আ) প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করার জন্য সারা দেশের মানুষকে একত্র করেছিলো, এরাও হযরত ইবরাহীমের মামলা শোনার জন্য সারা দেশের মানুষকে একত্র করলো। সেখানে হযরত মূসা সবার সামনে একথা প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি যা কিছু এনেছেন তা যাদু নয় বরং মু’জিযা। এখানে হযরত ইবরাহীমকেও তাঁর শত্রুরাই সুযোগ দিয়ে দিল যেন জনগণের সামনে তাদের ধোঁকাবাজির তেলেসমাতি ছিন্নভিন্ন করতে পারেন।
# এ শেষ বাক্যটি স্বতই একথা প্রকাশ করছে যে, প্রথম বাক্যে হযরত ইবরাহীম মূর্তি ভাঙ্গার দায় যে বড় মূর্তিটির ঘাড়ে চাপিয়েছেন, তার দ্বারা মিথ্যা বলা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং তিনি নিজের বিরোধীদেরকে প্রমাণ দর্শাতে চাচ্ছিলেন। তারা যাতে জবাবে নিজেরাই একথা স্বীকার করে নেয় যে, এ উপাস্যরা একেবারেই অসহায় এবং এদের দ্বারা কোন উপকারের আশাই করা যায় না, তাই তিনি একথা বলেছিলেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোন ব্যক্তি প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য যে বাস্তব ঘটনা বিরোধী কথা বলে তাকে মিথ্যা গণ্য করা যেতে পারে না। বক্তা প্রমাণ নির্দেশ করার জন্য একথা বলে এবং শ্রোতাও একে সেই অর্থেই গ্রহণ করে।
দুর্ভাগ্যক্রমে হাদীসের এক বর্ণনায় একথা এসেছে যে, হযরত ইরাহীম (আ) তাঁর জীবনে তিনবার মিথ্যা কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে এটি একটি “মিথ্যা।” দ্বিতীয় “মিথ্যা” হচ্ছে সূরা সাফফাতে হযরত ইবরাহীমের إِنِّي سَقِيمٌ কথাটি। আর তৃতীয় “মিথ্যাটি” হচ্ছে তাঁর নিজের স্ত্রীকে বোন বলে পরিচিত করানো। একথাটি কুরআনে নয় বরং বাইবেলের আদি পুস্তকে বলা হয়েছে। এক শ্রেণীর বিদ্বানদের “রেওয়াত” প্রীতির ব্যাপারে সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, তাদের কাছে বুখারী ও মুসলিমের কতিপয় বর্ণনাকারীর সত্যবাদিতাই বেশী প্রিয় এবং এর ফলে যে একজন নবীর ওপর মিথ্যা বলা অভিযোগ আরোপিত হচ্ছে, তার কোন পরোয়াই তাদের নেই। অপর একটি শ্রেনী এই একটিমাত্র হাদীসকে ভিত্তি করে সমগ্র হাদীস শাস্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে দেয় এবং বলতে থাকে, সমস্ত হাদীসের স্তুপ উঠিয়ে দূরে ছুঁড়ে দাও। কারণ এর মধ্যে যতো আজেবাজে ধরনের রেওয়ায়াত পাওয়া যায়। অথচ কোন একটি বা কতিপয় হাদীসের মধ্যে কোন ত্রুটি পাওয়া যাবার কারণে সমস্ত হাদীস অনির্ভরযোগ্য হয়ে যাবে— এমন কোন কথা হতে পারে না। আর হাদীস শাস্ত্রের দৃষ্টিতে কোন হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা মজবুত হওয়ার ফলে এটা অপরিহার্য হয়ে ওঠে না যে, তার “মতন” (মুল হাদীস) যতই আপত্তিকর হোক না কেন তাকে চোখ বন্ধ করে “সহী” বলে মেনে নিতে হবে। বর্ণনা পরম্পরা সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হবার পরও এমন অনেক কারণ থাকতে পারে, যার ফলে এমন “মতন” ত্রুটিপূর্ণ আকারে উদ্ধৃত হয়ে যায় এবং এমন সব বিষয়বস্তু সম্বলিত হয় যে, তা থেকে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, একথাগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ নিসৃত হতে পারে না। তাই সনদ তথা বর্ণনা পরম্পরার সাথে সাথে “মতন”ও দেখা অপরিহার্য। যদি মতনের মধ্যে সত্যিই কোন দোষ থেকে থাকে তাহলে এরপরও অযথা তার নির্ভুলতার ওপর জোর দেয়া মোটেই ঠিক নয়।
যে হাদীসটিতে হযরত ইবরাহীমের তিনটি “মিথ্যা কথা” বর্ণনা করা হয়েছে সেটি কেবলমাত্র এ কারণে আপত্তিকর নয় যে, এটি একজন নবীকে মিথ্যাবাদী গণ্য করেছে বরং এ কারণেও এটি ত্রুটিপূর্ণ যে, এখানে যে তিনটি ঘটনার কথার বলা হয়েছে সেগুলো সবই বিতর্কিত। এর মধ্যে “মিথ্যা”র অবস্থা তো পাঠক এইমাত্র দেখলেন। সামান্য বুদ্ধি-জ্ঞানও যার আছে তিনি কখনো এই প্রেক্ষাপটে হযরত ইবরাহীমের এই বক্তব্যকে “মিথ্যা” বলে আখ্যায়িত করতে পারেন না। এক্ষেত্রে নবী ﷺ সম্পর্কে নাউযুবিল্লাহ আমরা এমন ধারণা তো করতেই পারি না যে, তিনি এই বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝাবেন না এবং খামাখাই একে মিথ্যা ভাষণ বলে আখ্যায়িত করবেন। আর إِنِّي سَقِيمٌ সংক্রান্ত ঘটনাটির ব্যাপারে বলা যায়, এটিকে মিথ্যা প্রমাণ করা যেতে পারে না যতক্ষণ না একথা প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইবরাহীম সে সময় সম্পূর্ণ সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত ছিলেন এবং তিনি সামান্যতম অসুস্থতায়ও ভুগছিলেন না। একথা কুরআনে কোথাও বলা হয়নি এবং আলোচ্য হাদীসটি ছাড়া আর কোন নির্ভরযোগ্য হাদীসেও এ আলোচনা আসেনি। এখন বাকী থাকে স্ত্রীকে বোন বলার ঘটনাটি। এ ব্যাপারটি এত বেশী উদ্ভট যে, কাহিনীটি শোনার পর কোন ব্যক্তি প্রথমেই বলে বসবে এটা কোন ঘটনাই হতে পারে না। এটি বলা হচ্ছে তখনকার কাহিনী যখন হযরত ইবরাহীম নিজের স্ত্রী সারাকে নিয়ে মিসরে যান। বাইবেলের বর্ণনামতে তখন হযরত ইবরাহীমের বয়স ৭৫ বছর ও হযরত সারার বয়স ৬৫ বছরের কিছু বেশী ছিল। এ বয়সে হযরত ইবরাহীম ভীত হলেন মিসরের বাদশাহ এ সুন্দরীকে লাভ করার জন্য তাঁকে হত্যা করবেন। কাজেই তিনি স্ত্রীকে বললেন, যখন মিসরীয়রা তোমাকে ধরে বাদশাহর কাছে নিয়ে যেতে থাকবে তখন তুমি আমাকে নিজের ভাই বলবে এবং আমিও তোমাকে বোন বলবো, এর ফলে আমি প্রাণে বেঁচে যাবো। (আদি পুস্তকঃ১২ অধ্যায়) হাদীসে বর্ণিত তৃতীয় মিথ্যাটির ভিত্তি এই সুস্পষ্ট বাজে ও উদ্ভট ইসরাঈলী বর্ণনার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যে হাদীসের ‘মতন’ এ ধরনের উদ্ভট বক্তব্য সম্বলিত তাকেও আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি বলে মেনে নেবো কেমন করে— তা তার ‘সনদ’ যতই ত্রুটিমুক্ত হোক না কেন? এ ধরনের একপেশে চিন্তা বিষয়টিকে বিকৃত করে অন্য এক বিভ্রান্তির উদ্ভব ঘটায় যার প্রকাশ ঘটাচ্ছে হাদীস অস্বীকারকারী গোষ্ঠী। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন আমার লিখিত বই রাসায়েল ও মাসায়েল ২ খণ্ড , কতিপয় হাদীসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তার জবাব নিবন্ধের ১২নং জবাব)
# মূলে نُكِسُوا عَلَى رُءُوسِهِمْ (মাথা নিচের দিকে উলটিয়ে দেয়া হলো) বলা হয়েছে। কেউ কেউ এর অর্থ করেছেন, তারা লজ্জায় মাথা নত করলো। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি ও বর্ণনা ভংগী এ অর্থ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। বক্তব্য পরম্পরা ও বক্তব্যের ধরনের প্রতি নজর দিলে যে সঠিক অর্থটি পরিষ্কার বুঝা যায় সেটি হচ্ছে এই যে, হযরত ইবরাহীমের জবাব শুনে প্রথমেই তারা মনে মনে ভাবলো, প্রকৃতপক্ষে তোমরা নিজেরাই তো জালেম। কেমন অসহায় ও অক্ষম দেবতাদেরকে তোমরা ইলাহ বানিয়ে নিয়েছো, যারা নিজমুখে তাদের ওপর কি ঘটে গেছে এবং কে তাদেরকে ভেঙ্গে চুরে রেখে দিয়েছে একথা বলতে পারে না। যারা নিজেরা নিজেদেরকে বাঁচাতে পারে না তারা তোমাদেরকে কিভাবে বাঁচাবে। কিন্তু এর পরপরই আবার তাদের ওপর জিদ ও মূর্খতা চড়াও হয়ে গেলো এবং জিদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তা চড়াও হবার সাথে সাথেই তাদের বুদ্ধি উল্টোমুখী হয়ে গেলো। মস্তিষ্ক সোজা ও সঠিক চিন্তা করতে করতে হঠাৎ উল্টো চিন্তা করতে আরম্ভ করলো।
# শব্দাবলী পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে এবং পূর্বাপর বক্তব্যও এ অর্থ সমর্থন করছে যে, তারা সত্যিই তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। অন্যদিকে আগুনের কুণ্ড তৈরী হয়ে যাবার পর তারা যখন হযরত ইবরাহীমকে তার মধ্যে ফেলে দেয় তখন মহান আল্লাহ আগুনকে হুকুম দেন সে যেন ইবরাহীমের জন্য ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং তাঁর কোন ক্ষতি না করে। বস্তুত কুরআনের সুস্পষ্টভাবে যেসব মু’জিযার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এটিও তার অন্তর্ভুক্ত। এখন কোন ব্যক্তি যদি এ মু’জিযাগুলোকে সাধারণ ঘটনা প্রমাণ করার জন্য জোড়াতালি দিয়ে কৃত্রিম ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়, তবে বুঝতে হবে যে, তার মধ্যে আল্লাহর জন্যও বিশ্ব-জাহানের প্রচলিত নিয়মের বাইরে অস্বাভাবিক কোন কিছু করা সম্ভবপর নয়। যে ব্যক্তি এরূপ মনে করে, আমি জানতে চাই যে, সে আল্লাহকে মেনে নেয়ার কষ্টই বা করতে যাচ্ছে কেন? আর যদি সে এ ধরনের জোড়াতালির ব্যাখ্যা এজন্য করে থাকে যে, আধুনিক যুগের তথাকথিত যুক্তিবাদীরা এ ধরনের কথা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়, তাহলে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি, জনাব! তথাকথিত সেসব চুক্তিবাদীকে যে কোনভাবেই হোক স্বীকার করাতেই হবে, এ দায়িত্ব আপনার ঘাড়ে কে চাপিয়ে দিয়েছিল? কুরআন যেমনটি আছে ঠিক তেমনিভাবে যে তাকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়, তাকে তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দিন। তার স্বীকৃতি আদায় করার জন্য কুরআনকে তার চিন্তাধারা অনুযায়ী ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করা, যখন কুরআনের মূল বক্তব্যে প্রতিটি শব্দ এ ঢালাইয়ের বিরোধিতা করছে, তখন এটা কোন্ ধরনের প্রচার এবং কোন্ বিবেকবান ব্যক্তি একে বৈধ মনে করতে পারে? (বেশী বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সূরা আনকাবুত ৩৯ টীকা)
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৫১-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:
মূসা (عليه السلام) ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে আলোচনা করার পর অত্র আয়াতগুলোতে মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (عليه السلام) স¤পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সৎ পথের জ্ঞান দান করেছিলেন। مِنْ قَبْلُ অর্থাৎ মূসা (عليه السلام) ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করা ও তাঁদেরকে কিতাব দেয়ার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে হিদায়াতের জ্ঞান দান করেছিলেন, ফলে তিনি মানুষকে এদিকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। (وَكُنَّا بِه۪ عٰلِمِيْنَ) অর্থাৎ ইবরাহীম (عليه السلام)-কে সঠিক পথের জ্ঞান দান করা, তাঁকে নাবী হিসেবে চয়ন করা, তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা এবং দুনিয়া ও পরকালে শ্রেষ্ঠত্ব দান করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান ছিল যে, ইবরাহীম (عليه السلام)-এর অধিকারী ও যোগ্য।
ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতা ও সম্প্রদায়কে বললেন: এ মূর্তিগুলো কী? تماثيل শব্দটি تمثال এর বহুবচন। অর্থ কোন জিনিসের হুবহু প্রতিকৃতি। عاكف অর্থ অবস্থান করা, ধরে রাখা। অর্থাৎ এ মূর্তিগুলো কী, যাদের কাছে নিরবে অবস্থান কর? তারা বলল: আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এরূপ পূজা করতে দেখেছি। তখন ইবরাহীম (عليه السلام) বললেন: তোমরা ও তোমাদের বাপ দাদারা প্রকাশ্য গুমরাহীতে লিপ্ত রয়েছ। তখন তারা বলল: তুমি কি আমাদের নিকট সত্য জিনিস নিয়ে এসেছ, না তুমি কৌতুক করছ। তখন তিনি বললেন: না, তোমাদের প্রতিপালক তো তিনি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আর আমি এ বিষয়ে অন্যতম সাক্ষী। প্রাথমিক দাওয়াতের কাজ এখানে সমাপ্ত, এরপরও যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল তখন ইবরাহীম (عليه السلام) তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: আল্লাহ তা‘আলার শপথ! তোমরা অনুষ্ঠানে বা ঈদে চলে যাওয়ার পর আমি এ মূর্তিগুলোর ব্যাপারে কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যখন তারা চলে গেল তখন তিনি এ মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। শুধুমাত্র তাদের বড় মূর্তিটি ব্যতীত। অতঃপর যখন তারা ফিরে এসে এরূপ অবস্থা দেখতে পেল তখন তারা বলল: কে আমাদের উপাস্যগুলোর সাথে এরূপ আচরণ করেছে? নিশ্চয়ই সে একজন সীমালঙ্ঘনকারী। তখন তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলল: আমরা এক যুবককে এদের ব্যাপারে সমালোচনা করতে শুনেছি যার নাম ইবরাহীম। তখন তাঁকে নিয়ে আসার জন্য বলা হল। অতঃপর যখন তাঁকে নিয়ে আসা হল তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ? তাদের প্রশ্নের জবাবে ইবরাহীম (عليه السلام) বললেন: তাদের মধ্যে যে বড় সেই তো এ কাজ করেছে, তাকেই জিজ্ঞেস কর যদি তারা কথা বলতে পারে। একথা শুনে তারা লজ্জায় মাথা অবনত করল এবং বলল: তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলতে পারে না।
তখন ইবরাহীম (عليه السلام) তাদেরকে বললেন: তোমরা এমন জিনিসের পূজা করছ যারা তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না? সুতরাং তোমাদের জন্য এবং তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদের জন্য ভর্ৎসনা।
তখন তাঁর সম্প্রদায় আর কোন জবাব দিতে পারলনা। শুধুমাত্র বলল যে, তাঁকে আগুনে পুড়ে ফেল, তোমাদের মা‘বূদদেরকে রক্ষা কর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেনঃ
(فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا اقْتُلُوهُ أَوْ حَرِّقُوهُ)
“অতঃপর তার সম্প্রদায়ের এ কথা বলা ছাড়া কোন উত্তর ছিল না যে, ‘একে হত্যা কর অথবা অগ্নিদগ্ধ কর।” (আনকাবুত ২৯:২৪)
তখন তারা তাকে আগুনে নিক্ষেপ করল জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য। ইবরাহীম (عليه السلام)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হল তখন তিনি বলেছিলেন: حسبي الله ونعم الوكيل আমার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মকর্তা। তখন আল্লাহ তা‘আলা আগুনকে নির্দেশ দিয়ে বললেন: আগুন! তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। অবশেষে তারা ক্ষতি করতে গিয়ে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। আর ইবরাহীম (عليه السلام) অক্ষত অবস্থায় সে আগুন থেকে পরিত্রাণ পেলেন। ইবরাহীম (عليه السلام) সম্পর্কে আরো আলোচনা সূরা আন‘আমে ও সূরা মারইয়ামে উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইবরাহীম (عليه السلام)-এর মত হিকমত নিয়ে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে।
২. মূর্তি ভাঙ্গা নাবীদের বৈশিষ্ট্য, মুসলিমদের উচিত নাবীদের এ বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা।
৩. ইবরাহীম (عليه السلام) জানতেন মূর্র্তি ভাঙ্গলে তাকে পাকড়াও করবে, তারপরেও তিনি ভেঙ্গেছেন।
৪. সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করতে হবে।
৫. যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে অবিচল থাকে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সহযোগিতা করেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫১-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তাঁর বন্ধু হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) বাল্যকাল হতেই হিদায়াত দান করেছিলেন। তাঁকে তিনি তাঁর দলীল প্রমাণাদি প্রদান করেছিলেন ও কল্যাণের জ্ঞান দিয়েছিলেন। যেমন অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এই হচ্ছে আমার দলীল যা আমি ইবরাহীমকে (আঃ) তার কওমের উপর প্রদান করেছিলাম।” (৬:৮৩) এই কাহিনীটি যে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) তাঁর মাতা তার দুধ পানের যুগেই একটি গুহায় রেখে এসেছিলেন। যেখান থেকে তিনি বহুদিন পর বেরিয়ে আসেন এবং আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুর উপর, বিশেষ করে চন্দ্র, তারকা ইত্যাদির উপর দৃষ্টিপাত করে আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছিলেন এসব বানী ইসরাঈলের বানানো কাহিনী। নিয়ম এই যে, আমাদের কাছে মহান আল্লাহর যে সত্য গ্রন্থ আল কুরআন এবং সুন্নাতে রাসূল (সঃ) বিদ্যমান রয়েছে, বনী ইসরাঈলের কোন ঘটনা যদি এগুলির সাথে মিলে যায় তবে তা সত্য ও গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি এগুলির বিপরীত হয় তবে তা হবে সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। যদি তাদের কোন ঘটনার ব্যাপারে আমাদের শরীয়ত নীরব থাকে, ওর অনুকুলও না। হয় এবং প্রতিকলও না হয় তবে যদিও অধিকাংশ তাফসীরকারদের মতে ওর রিওয়াইয়াত করা জায়েয, তথাপি আমরা ওটাকে সত্যও বলতে পারি না এবং মিথ্যাও না। আর এটা তো প্রকাশমান যে, তাদের ঘটনাবলী আমাদের জন্যে সনদও নয় এবং তাতে আমাদের কোন দ্বীনী উপকারও নেই। এরূপ হলে আমাদের ব্যাপক ও পরিপূর্ণ শরীয়ত ওগুলি বর্ণনা করতে মোটেই কার্পণ্য করতো না। আমাদের এই তাফসীরে আমাদের নীতি তো এই রয়েছে যে, আমরা এর মধ্যে বানী ইসরাঈলের এরূপ রিওয়াইয়াত অনিয়ন করি না। কেননা, এতে সময় নষ্ট ছাড়া কোনই উপকার নেই, বরং ক্ষতিই আছে। কেননা, আমাদের বিশ্বাস আছে যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে রিওয়াইয়াতে সত্য-মিথ্যা যাচাই করার কোন যোগ্যতাই ছিল না। তাদের মধ্যে মিথ্যা অনুপ্রবেশ করেছিল, যেমন আমাদের হাফিয ইমমিগণ ব্যাখ্যা করেছেন।
মোট কথা, এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলেনঃ ইতিপূর্বে আমি ইবরাহীমকে (আঃ) সৎ পথের জ্ঞান দান করেছিলাম এবং তার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত।
হযরত ইবরাহীম (আঃ) বাল্যকালেই তাঁর কওমের গায়রুল্লাহর পূজাপার্বন অপছন্দ করেন। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে কঠোর ভাবে তিনি ওটা অস্বীকার করেন। তাঁর কওমকে তিনি প্রকাশ্যভাবে বলেনঃ “এই মুর্তিগুলি কি, যাদের পূজায় তোমরা, রত রয়েছো?’
বর্ণিত আছে যে, হযরত ইসবাগ ইবনু নাবাতা’ (রঃ) একদা পথ চলছিলেন। পথে এক জায়গায় তিনি দেখতে পান যে, কতকগুলি লোক দাবা খেলায় রত রয়েছে। তখন তিনি তাদের সামনে (আরবী) আয়াতটি পাঠ করেন এবং বলেনঃ “তোমাদের কারো দাবার মোহর স্পর্শ করার চেয়ে হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার রেখে দেয়াই উত্তম।” (এটা ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবরাহীমের (আঃ) ঐ স্পষ্ট দলীলের কোন জবাব তার কওমের কাছে ছিল না। তাই, তারা তাঁকে বললোঃ “আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এগুলির পূজা করতে দেখেছি।” তিনি তখন তাদেরকে বললেনঃ “এটা কোন দলীল হলো কি? তোমাদের উপর আমি যে প্রতিবাদ করছি ঐ প্রতিবাদ তোমাদের পিতৃ পুরুষদের উপরও বটে। তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষরাও স্পষ্ট বিভ্রান্তির উপর রয়েছে। তার একথা শুনে তাদের কান খাড়া হয়ে যায়। কেননা, তারা দেখলো যে, তিনি তাদের জ্ঞানী লোকদেরকে অবজ্ঞা করছেন। তাদের পিতৃ পুরুষদের সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য। করলেন তা তাদের শোনার মত নয়। আর তিনি তাদের উপর উপাস্য দেবদেবীদেরকেও অবজ্ঞা করলেন। তাই, তারা হতবুদ্ধি হয়ে তাঁকে বললোঃ “হে ইব্রাহীম (আঃ)! তুমি কি আমাদের নিকট কোন সত্য এনেছে, না তুমি আমাদের সাথে কৌতুক করছো?” এবার তিনি (হযরত ইবরাহীম আঃ) তাদের কাছে সত্য প্রচার করার সুযোগ পেলেন এবং পরিস্কারভাবে ঘোষণা করলেনঃ “তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি ওগুলিকে সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি তিনিই। তোমাদের এই উপাস্য দেব-দেবীগুলি কোন ক্ষুদ্র ও নগণ্য জিনিসেরও সৃষ্টি কর্তা ও মালিক নয়। সুতরাং তারা উপাস্য ও ইবাদতের যোগ্য কিরূপে হতে পারে? আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সৃষ্টিকর্তা ও মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনিই ইবাদতের যোগ্য। তিনি ছাড়া অন্য কেউই উপাস্য হতে পারে না।”
৫৭-৬৩ নং আয়াতের তাফসীর:
উপরে উল্লিখিত হয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় কওমকে মূর্তিপূজা হতে বিরত থাকতে বলেন এবং তাওহীদের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে শপথ করে বলেনঃ “তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করবো।” তার একথা তার কওমের কতকগুলি লোক শুনে নেয়। তাদের যে ঈদের দিনটি নির্ধারিত ছিল, ঐ দিনটিকে লক্ষ্য করে হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাদেরকে বলেনঃ “যখন তোমরা তোমাদের ঈদের নীতিমালা আদায় করার উদ্দেশ্যে বের হবে তখন আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই একটা ব্যবস্থা অবলম্বন করবো।” ঈদের দু’একদিন পূর্বে তার পিতা তাঁকে বলেঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি আমাদের সাথে আমাদের ঈদ পর্বে যোগদান কর, যাতে তুমি আমাদের ধর্মের গুণাবলী সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে পারো।” সুতরাং তার পিতা তাঁকে নিয়ে ঈদ পর্ব উদযাপনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি তাঁর পিতাকে বললেনঃ “আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি, সুতরাং আমি আপনাদের সাথে যেতে পারবো না।” তার পিতা তখন তাকে ছেড়েই চলে গেল। তাঁর পার্শ্ব দিয়ে গমনকারী লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করতে থাকেঃ “কি ব্যাপার? তুমি রাস্তায় বসে আছ। কেন?” তিনি তাদেরকে উত্তর দেনঃ “আমি রুগ্ন হয়ে পড়েছি।” অতঃপর যখন সাধারণ লোকেরা সব চলে গেল এবং বুড়োরা রয়ে গেল। তখন তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা সবাই চলে যাবার পর আমি তোমাদের মূর্তিগুলির অবশ্যই সংস্কার সাধন করবো।” তিনি যে তাদেরকে বললেনঃ ‘আমি রুগ্ন হয়ে পড়েছি’ আগের দিন সত্যিই তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। যখন তারা সবাই চলে গেল, তখন ময়দান খালি পেয়ে তিনি স্বীয় উদ্দেশ্য পুরো করার কাজে লেগে পড়েন এবং বড় মূর্তিটিকে রেখে সমস্ত মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। যেমন অন্যান্য আয়াতে এর বিস্তারিত বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে যে, নিজের হাতে তিনি ঐ মূর্তিগুলিকে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে ফেলেন। ঐ বড় মূর্তিটিকে বাকী রাখার মধ্যে যৌক্তিকতা ও নিপুণতা ছিল এই যে, যেন ঐ লোকগুলির মস্তিষ্কে এই খেয়াল জাগে যে, সতঃ তাদের ঐ বড় দেবতাটি ঐ ছোট দেবতাগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কেননা, হয়তো এই বড় দেবতার মনে মর্যাদাবোধ হয়েছে যে, তার মত বড় দেবতা থাকতে এই ছোট দেবতাগুলি কিরূপে পূজনীয় হতে পারে? এই খেয়াল তাদের মস্তিষ্কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই তিনি ঐ বড় দেবতার কাধে কুঠারঠিও লটকিয়ে দিয়ে ছিলেন, যেমন এটা বর্ণিত আছে।
যখন ঐ মুশরিকরা মেলা থেকে ফিরে আসে তখন তারা দেখতে পায় যে, তাদের সমস্ত দেবতা মুখের ভরে পড়ে রয়েছে এবং নিজেদের অবস্থার মাধ্যমে বলতে রয়েছে যে, তারা শুধু প্রাণহীন তুচ্ছ ও ঘৃণ্য বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। লাভ বা ক্ষতি করার ক্ষমতা তাদের মোটেই নেই। তারা যেন তাদের ঐ অবস্থা দ্বারা তাদের পূজারী ও উপাসকদের নির্বুদ্ধিতা ও বোকামী প্রকাশ করতে রয়েছে। কিন্তু এতে ঐ নির্বোধদের উপর উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো। তারা বলতে শুরু করলোঃ কোন্ যালিম ব্যক্তি আমাদের উপাস্যদের এই অবস্থা ঘটিয়েছে?”
ঐ সময় যে লোকগুলি হযরত ইবরাহীমের (আঃ) ঐ কথা শুনেছিল তাদের তা স্মরণ হয়ে গেল। তারা বললোঃ ইবরাহীম (আঃ) নামক যুবকটিকে আমরা আমাদের দেবতাদের সমালোচনা করতে শুনেছি।” হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতটি পাঠ করতেন ও বলতেনঃ “আল্লাহ যে নবীকেই পাঠিয়েছেন। যুবকরূপেই পাঠিয়েছেন এবং যে আলেমকেই ইলম দান করা হয়েছে তিনি যুবকই রয়েছেন। (অর্থাৎ যুবক অবস্থাতেই ইল্ম লাভ করেছেন।
তারা বললোঃ “তাকে লোক সম্মুখে হাজির কর যাতে তারা সাক্ষ্য দিতে পারে।” হযরত ইবরাহীমের (আঃ) কওমের লোকেরা পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, লোকজনকে জমা করা হোক এবং ইবরাহীমকে (আঃ) তাদের সামনে হাজির করে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। হযরত ইবরাহীমও (আঃ) এটাই চাচ্ছিলেন যে, এরূপ একটা সমাবেশের ব্যবস্থা করাহলেই তিনি তাদের সামনে হাজির হয়ে তাদের ভুলটা তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবেন। এভাবে তিনি তাদের মধ্যে একত্ববাদ প্রচার করবেন এবং তাদেরকে বলবেনঃ “তোমরা কত বড় যালিম ও অজ্ঞ যে, যারা কারো কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে না, এমন কি নিজেদের জীবনেরও যারা কোন অধিকার রাখে না, তাদের ইবাদত কর তোমরা কোন যুক্তিতে?”
সুতরাং জনসমাবেশ হলো। ছোট বড় সবাই এসে গেল। হযরত ইবরাহীমও (আঃ) অভিযুক্ত হিসেবে হাজির হলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “হে ইবরাহীম (আঃ)! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করেছো?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “এই বড় মূর্তিটিই এ কাজ করেছে।” একথা বলার সময় তিনি ঐ মূর্তিটির প্রতি ইশারা করেন যেটাকে তিনি ভেঙ্গে ফেলেন নাই। তারপর তাদেরকে বলেনঃ “তোমরা বরং এই দেবতাগুলিকেই প্রশ্ন কর যদি এরা কথা বলতে পারে। এর দ্বারা হযরত ইবরাহীমের (আঃ) উদ্দেশ্য ছিল, ঐলোকগুলি যেন নিজেরাই বুঝতে পারে যে, ঐ পাথরগুলি কি কথা বলবে? আর তারা যখন এতই অপারগ তখন তারা মা’বুদ হতে পারে কি করে? সুতরাং আল্লাহপাকের ফযল ও করমে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) এই উদ্দেশ্যও পূর্ণ হয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত ইবরাহীম (আঃ) মাত্র তিনটি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। একটি তো হলো তাঁর একথা বলা যে, এই মূর্তিগুলিকে বড় মুর্তিটিই ভেঙ্গেছে। দ্বিতীয় হলো তার একথা বলাঃ “আমি রুগ্ন বা অসুস্থ। তৃতীয় হলো এই যে, একবার তিনি তাঁর স্ত্রী হযরত ‘সারা’সহ সফরে ছিলেন। ঘটনাক্রমে তিনি এক অত্যাচারী রাজার রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করছিলেন। সেখানে তিনি মঞ্জিল করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঐ সময় কে একজন বাদশাহকে খবর দেয়ঃ :“একজন মুসাফিরের সাথে একটি সুন্দরী মহিলা রয়েছে এবং তারা এখন আমাদের রাজ্যের সীমানার মধ্যেই রয়েছে। তৎক্ষণাৎ বাদশাহ হযরত সারাকে ধরে আনার জন্যে একজন সিপাহীকে পাঠিয়ে দেন। সে হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) জিজ্ঞেস করেঃ “এটা আপনার। কে?” হযরত ইবরাহীম (আঃ) উত্তরে বলেনঃ “এটা আমার বোন। সে বলেঃ “একে বাদশাহর দরবারে পাঠিয়ে দিন।” তিনি হযরত সারার কাছে গিয়ে বলেনঃ “এই যালিম বাদশাহ তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে এবং আমি তোমাকে আমার বোন বলেছি। তোমাকে জিজ্ঞেস করা হলে তুমিও একথাই বলবে। আর দ্বীনের দিক দিয়ে তুমি আমার বোনও বটে। জেনে রেখো যে, ভূ-পৃষ্ঠে আমি ও তুমি ছাড়া কোন মুসলমান নেই।” একথা বলে তিনি চলে আসেন। হযরত সারা বাদশাহর দরবারে চলে যান। আর হযরত ইবরাহীম (আঃ) নামাযে দাড়িয়ে যান। ঐ যালিম বাদশাহ হযরত সারাকে দেখা মাত্রই তার দিকে ধাবিত হয়। সাথে সাথে আল্লাহর আযাব তাকে পাকড়াও করে। তার হাত পা অবশ হয়ে যায়। সুতরাং সে হতবুদ্ধি হয়ে তাকে বলেঃ “তুমি আমার জন্যে আল্লাহর নিকট দুআ কর আমি ওয়াদা করছি যে, তোমার কোন ক্ষতি করবো না। তিনি দুআ করলেন এবং সে ভাল হয়ে গেল। কিন্তু ভাল হওয়া মাত্রই সে আবার কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার ইচ্ছা করলো। সুতরাং পুনরায় সে আল্লাহর শাস্তির কবলে পতিত হলো। আর এই শাস্তি পূর্বাপেক্ষা কঠিনতর। ফলে আবার সে তার কাছে অনুনয় বিনয় করলো। তৃতীয়বার মুক্তি পাওয়া মাত্রই সে তার নিকট অবস্থানরত পরিচারককে বললো? তুমি আমার কাছে কোন মানুষ মহিলাকে আনয়ন কর নাই, বরং শয়তান মহিলাকে এনেছো। একে তুমি বের করে দাও এবং হাজেরাকে তার সাথে পাঠিয়ে দাও।” তৎক্ষণাৎ তাঁকে সেখান হতে বের করে দেয়া হয় এবং হাজেরাকে (দাসী হিসেবে) তাঁর কাছে সমর্পণ করা হয়। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁদের পদধ্বনি শুনেই নামায শেষ করেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “বল, খবর কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “মহান আল্লাহ ঐ কাফিরের চক্রান্ত বানচাল করে দিয়েছেন এবং হাজেরাকে আমার খিদমতের জন্যে আমাকে প্রদান করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এই হাদীসটি বর্ণনা করে বলেনঃ “হে আকাশের পানির সন্তানরা! ইনি হলেন তোমাদের মাত্য।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
৬৪-৬৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীমের (আঃ) কওম সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন, যখন তিনি তাদেরকে যা বলার তা বললেন। তার কওম তার কথা শুনে নিজেদের বোকামীর কারণে নিজেদেরকেও ভৎসনা করতে লাগলো এবং অত্যন্ত লজ্জিত হলো। তারা পরস্পর বলাবলি করলোঃ “আমরা তো আমাদের দেবতাদের হিফাজতের জন্যে কাউকেও রেখে না গিয়ে চরম ভুল করেছি!” অতঃপর তারা চিন্তা ভাবনা করার পর হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) বললোঃ “আমাদের দেবতাদেরকে কে ভেঙ্গেছে এ সম্পর্কে তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে বলছো এটা কেমন কথা? তুমি তো জানই যে, আমাদের দেবতাগুলি কথা বলতে পারে না?” অপারগতা, বিস্ময় ও অত্যন্ত নিরুত্তরতার অবস্থায় তাদেরকে এ কথা স্বীকার করতেই হলো যে, তাদের দেবতাদের কথা বলারও শক্তি নেই। কাজেই তিনি তাদেরকে জন্ধ করার বিশেষ সুযোগ। পেয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তাদেরকে বললেনঃ “যারা কথা বলতেও পারে না এবং লাভ ও ক্ষতি করারও যাদের কোন ক্ষমতা নেই তাদের পুজা করা কেমন? তোমরা এতো নির্বোধ হচ্ছো কেন? তোমাদেরকে ও তোমাদের বাতিল মাবুদদেরকে ধিক! বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, তোমরা এক আল্লাহকে ছেড়ে এসব বাজে জিনিসের ইবাদত করতে রয়েছে। এগুলোই ছিল ঐ দলীল যার বর্ণনা ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিলঃ “আমি ইবরাহীমকে (আঃ) তাঁর কওমের উপর আমার হুজ্জত বা দলীল প্রদান করেছিলাম। (যাতে তার কওম সত্য উপলব্ধি করতে পারে)।”
৬৮-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:
এটা নিয়ম যে, মানুষ যখন দলীল প্রমাণ পেশ করতে অপারগ হয়ে যায় তখন হয় পুণ্য তাকে আকর্ষণ করে, না হয় পাপ তার উপর জয়যুক্ত হয়। এখানে এই লোকগুলিকে তাদের মন্দভাগ্য ঘিরে ফেলে এবং তারা দলীল প্রমাণ পেশ করতে অপারগ হয়ে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) উপর শক্তি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। পরস্পর পরামর্শক্রমে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) আগুনে নিক্ষেপ করা হোক, যাতে তাদের দেবতাদের মর্যাদা রক্ষা পায়। এর উপর তাদের সবাই একমত হয়ে গেল এবং খড়ি জমা করার কাজে লেগে পড়লো। এমন কি তাদের রুগ্না নারীরাও মানত করলো যে, যদি তারা রোগ হতে আরোগ্য লাভ করে তবে তারাও হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) পোড়াবার জন্যে খড়ি আনয়ন করবে। যমীনে একটা বড় ও গভীর গর্ত তারা খনন করলো এবং খড়ি দ্বারা তা পূর্ণ করে দিলো। খড়ির স্তুপ খাড়া করে তারা তাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। ভূ-পৃষ্ঠে কখনো এমন ভয়াবহ আগুন দেখা যায় নাই। অগ্নি শিখা যখন আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো এবং ওর পার্শ্বে গমন অসম্ব হয়ে পড়লো তখন তারা হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়লো যে, কেমন করে তারা হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) আগুনে নিক্ষেপ করবে? (শেষ পর্যন্ত পারস্যের কুর্দিস্তানের একজন। বেদুইনের পরামর্শক্রমে একটি লোহার দোলনা তৈরী করা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, তাঁকে ওটায় বসিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হবে এবং এই ভাবে তাকে অগ্নি কুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। ঐ বেদুঈন লোকটির নাম ছিল হায়ন। বর্ণিত আছে যে, ঐলোকটিকে তৎক্ষণাৎ আল্লাহ যমীনে ধ্বসিয়ে দেন। যখন তাঁকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয় তখন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মকর্তা।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও তাঁর সাহাবীদের (রাঃ) কাছে যখন এ খবর পৌঁছে যে, সমস্ত আরব বীর সৈনিকদেরকে নিয়ে তার মুকাবিলার জন্যে আসছে তখন তিনিও উপরোক্ত দুআটি পাঠ করেন।
এটাও বর্ণিত আছে যে, যখন মুশরিকরা হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে থাকে তখন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আকাশে আপনি (মাবুদ) একাই এবং যমীনে আমি একাই আপনার ইবাদত করি। (এটা মুসনাদে আবি ইয়ালায় হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে) বর্ণিত আছে যে, যখন কাফিররা হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) বাধতে থাকে তখন তিনি পাঠ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আপনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, আপনি পবিত্র, প্রশংসা আপনারই জন্যে, রাজত্ব আপনারই, আপনার কোন অংশীদার নেই।” হযরত শুআইব জুবাঈ (রঃ) বলেন যে, ঐ সময় হযরত ইবরাহীমের (আঃ) বয়স ছিল মাত্র ষোল বছর। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
পূর্ব যুগীয় কোন কোন মনীষী হতে বর্ণিত আছে যে, ঐ সময়েই হযরত জিবরাঈল (আঃ) তার সামনে আসমান ও যমীনের মাঝে আবির্ভূত হন এবং তাঁকে বলেনঃ “আপনার কোন প্রয়েজিন আছে কি? উত্তরে তিনি বলেনঃ “আপনার কাছে আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজন আছে আল্লার কাছে।”
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, বৃষ্টির দারোগা ফেরেশতা সব সময় কান খাড়া করে প্রস্তুত ছিলেন যে, কখন আল্লাহর হুকুম হবে এবং তিনি ঐ আগুনে বৃষ্টি বর্ষণ করে তা ঠাণ্ডা করে দিবেন। কিন্তু মহান আল্লাহ সরাসরি আগুনকেই হুকুম করলেনঃ “হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের (আঃ) জন্যে ঠাণ্ডা ও নিরাপদ হয়ে যাও।” বর্ণিত আছে যে, এই হুকুমের সাথে সাথেই সারা পৃথিবীর আগুন ঠাণ্ডা হয়ে যায়। হযরত কা’ব আহবার (রাঃ) বলেন যে, ঐ দিন সারা দুনিয়ায় কেউই আগুন দ্বারা কোন উপকার লাভ করতে পারে নাই। হযরত ইবরাহীমের (আঃ) বন্ধনের রশিগুলি আগুনে পুড়ে যায় বটে, কিন্তু তাঁর নিজের শরীরের একটি লোমও পুড়ে নাই। হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ আগুনকে নিদের্শ দেয়া হয় যে, যেন হযরত ইবরাহীম খলীলের (আঃ) কোনই ক্ষতি না করে। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যদি আগুনকে শুধু ঠাণ্ডা হওয়ার নির্দেশ দেয়া হতো তবে ঠাণ্ডাই তার ক্ষতি করতো। এজন্যেই সাথে সাথেই ওকে নিদের্শ দেনঃ “নিরাপদ হয়ে যাও।’
যহহাক (রাঃ) বলেন যে, মুশরিকরা খুব বড় ও গভীর গর্ত খনন করেছিল। এবং ওটাকে আগুন দ্বারা পূর্ণ করেছিল। চতুর্দিকে আগুনের শিখা বের হচ্ছিল। তারা ওর মধ্যে হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু অগ্নি তাকে স্পর্শও করেনি। শেষ পর্যন্ত মহামহিমান্বিত আল্লাহ ওকে ঠাণ্ডা করে দেন। উল্লিখিত আছে যে, ঐ সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর সাথে ছিলেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ) মুখ হতে ঘর্ম মুছতে ছিলেন। সুতরাং এইটুকু ছাড়া আগুন তার আর কোন কষ্ট দেয় নাই।
সুদ্দী (রাঃ) বলেন যে, ছায়াকারী ফেরেশতা ঐ সময় তার সাথে ছিলেন। বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) ঐ অগ্নিকুণ্ডে চল্লিশ দিন অথবা পঞ্চাশ দিন ছিলেন। তিনি বলতেনঃ “এই দিনগুলিতে আমি যতটা আরাম ও আনন্দবোধ করেছিলাম, ওর থেকে বের হওয়ার পর ততটা আরাম ও শান্তি লাভ করি নাই। যদি আমার সারা জীবনটাই ওর মধ্যে অতিবাহিত হয়ে যেতো তবে কতই না ভাল হতো!”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, হযরত ইবরাহীমের পিতা সবচেয়ে উত্তম যে কথাটি বলে ছিলেন তা এই যে, যখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) আগুন হতে সম্পূর্ণ সুস্থ ও নিরপিদ অবস্থায় বের হয়ে আসেন, ঐ সময় তাকে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আসতে দেখে সে তাকে বলেছিলঃ “হে ইবরাহীম (আঃ)! তোমার প্রতিপালক বড়ই বুযর্গ ও মহান এবং বড়ই শক্তিশালী।”
হযরত কাতাদা (রাঃ) বলেন যে, ঐদিন যতগুলি জীবজন্তু বের হয় সবাই ঐ আগুন নিবিয়ে দিবার চেষ্টা করতে থাকে, একমাত্র গিরগিট (টিকটিকির চেয়ে বড় এক প্রকার বিষাক্ত প্রাণী) এর ব্যতিক্রম। হযরত যুহরী (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গিগিটকে মেরে ফেলার হুকুম দিয়েছেন এবং ওকে ফাসেক বলেছেন। হযরত আয়েশার (রাঃ) ঘরে একটি বর্শা দেখে একটি স্ত্রী লোক তাকে জিজ্ঞেস করেঃ “ঘরে এটা কেন রেখেছেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “গিরগিটকে মারবার জন্যে এটা রেখেছি। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “যে সময় হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয় সেই সময় গিরগিট ছাড়া সমস্ত জীবজন্তু ঐ আগুন নিবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু গিরগিট ঐ আগুনে ফু দিচ্ছিল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) গিরগিটকে মেরে ফেলার নিদের্শ দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা তার ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু আমি করে দিলাম তাদের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত।
হযরত আতিয়্যাহ আওফী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ইব্রাহীমকে (আঃ) আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখবার জন্যে ঐ কাফিরদের বাদশাহ এসেছিল। একদিকে হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হলো, আর অপরদিকে ঐ আগুনেরই একটি স্ফুলিঙ্গ উড়ে এসে ঐ বাদশাহ বৃদ্ধাঙ্গুলীর উপর পড়ে যায় এবং সেখানেই সবারই সামনে তাকে এমনভাবে জ্বালিয়ে দেয় যেমন ভাবে তূলা জ্বলে থাকে।