أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৩৩)
[ رَبى أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
আমার রব, ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’]
সূরা:- আল্ আম্বিয়া।
সুরা:২১
৮৩-৮৬ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২১:৮৩
وَ اَیُّوۡبَ اِذۡ نَادٰی رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَسَّنِیَ الضُّرُّ وَ اَنۡتَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ ﴿ۚۖ۸۳﴾
আর (স্মরণ কর) আইয়ুবের কথা; যখন সে তার প্রতিপালককে আহবান করে বলল, ‘আমি দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’
২১: ৮৪
فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ فَکَشَفۡنَا مَا بِہٖ مِنۡ ضُرٍّ وَّ اٰتَیۡنٰہُ اَہۡلَہٗ وَ مِثۡلَہُمۡ مَّعَہُمۡ رَحۡمَۃً مِّنۡ عِنۡدِنَا وَ ذِکۡرٰی لِلۡعٰبِدِیۡنَ ﴿۸۴﴾
তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম; তার দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে দিলাম, তাকে তার পরিবার পরিজনকে ফিরিয়ে দিলাম, তাদের সাথে তাদের মত আরো দিলাম আমার বিশেষ করুণা স্বরূপ এবং উপাসনাকারীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ।
২১:৮৫
وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِدۡرِیۡسَ وَ ذَاالۡکِفۡلِ ؕ کُلٌّ مِّنَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿ۚۖ۸۵﴾
আর (স্মরণ কর) ইসমাঈল, ইদরীস ও যুলকিফল[১] এর কথা; তাদের প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল।
২১:৮৬
وَ اَدۡخَلۡنٰہُمۡ فِیۡ رَحۡمَتِنَا ؕ اِنَّہُمۡ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۸۶﴾
তাদেরকে আমি আমার অনুগ্রহভাজন করেছিলাম, নিশ্চয় তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ।
৮৩-৮৬ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে হযরত আইয়ুব(আ.) : এবার আমরা হযরত আইয়ুবের বিপদ মুসিবতের পরীক্ষার কাহিনী প্রসংগে আসছি । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আইয়ুব যখন তার প্রতিপালককে বললাে, আমাকে কষ্টকর একটা মুসিবতে ধরেছে। তুমি তো শ্রেষ্ঠতম দয়ালু। তখন আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম, তার মুসিবত দূর করে দিলাম।’ হযরত আইয়ুবের পরীক্ষার কাহিনী একটা অনন্য আলােড়ন সৃষ্টিকারী পরীক্ষার কাহিনী, কোরআনে এর বিশদ বিবরণ না দিয়ে সংক্ষেপে আলােচনা করেছে। এখানে হযরত আইয়ুবের দোয়া ও তা আল্লাহর পক্ষ থেকে কবুল হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। কেননা এখানে যে ধারাবাহিক আলােচনা চলে আসছে তা নবীদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাদের পরীক্ষায় আল্লাহর সাহায্য সংক্রান্ত। এসব পরীক্ষা কখনাে স্বজাতির প্রত্যাখ্যান ও কষ্টদায়ক আচরণের আকারে হয়েছে, যেমন হযরত ইবরাহীম, লূত ও নূহের ক্ষেত্রে। কখনাে হয়েছে সুখ ও প্রাচূর্যের আকারে, যেমন হযরত দাউদ ও সোলায়মান ক্ষেত্রে। আবার কখনাে হয়েছে প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতির আকারে, যেমন হযরত আইয়ুবের ক্ষেত্রে। এখানে আইয়ুব(আ.) তার দোয়ায় নিজের দুর্দশার বিবরণ শুধু এতটুকুই দিয়েছেন যে, আমাকে বিপদ-মুসিবতে আক্রান্ত করেছে আর আল্লাহর গুণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন এই বলে যে, ‘তুমি তাে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ তিনি মুসিবত থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে দোয়া করেননি। তিনি ধৈর্যধারণ করতে চান। তিনি আল্লাহর কাছে কোনাে অনুরােধও করেননি। কেননা তিনি সেটাকে আল্লাহর সাথে বেয়াদবি ও অবমাননা বলে গণ্য করেন। এভাবে তিনি ধৈর্যশীল বান্দার নমুনা ও আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হন। কঠিন বিপদেও তিনি দিশেহারা হননি এবং ক্ষয়ক্ষতিতে তার মনােবল ক্ষুন্ন হয়নি। অথচ তার এই মুসিবত ও ক্ষয়ক্ষতি এতাে মারাত্মক ছিলাে যে, তা সকল যুগের মানব সমাজে একটা কিংবদন্তীর রূপ ধারণ করেছে। {হযরত আইয়ুব(আ.) কে আক্রান্তকারী মুসিবত কী ছিল তা নিয়ে অনেক মতভেদ ঘটেছে এবং অনেকে অতিরঞ্জিত কাহিনীও ফেঁদেছে। যেমন কেউ কেউ বলেছে যে, তিনি এমন ঘৃণ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন যে লােকেরা তার কাছ থেকে দূরে সরে যেত এবং তাকে শহরের বাইরে ফেলে রেখেছিল। অথচ এই উক্তির সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। একজন রসূল এমন ঘৃণ্য রােগে আক্রান্ত হতেই পারেন না। কোরআন থেকে শুধু এতটুকুই জানা যায় যে, তিনি নিজের ও নিজের পরিবারকে নিয়ে বিরাট মুসিবত ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। পরীক্ষা হিসেবে এতটুকু বলাই যথেষ্ট। ইসরাইলী রেওয়াতের ওপর ভিত্তি করে খামাখা এসব গল্প কাহিনীর পেছনে পড়া উচিৎ না।- সম্পাদক} বরং মুসবিত থেকে তাকে উদ্ধার করা হােক আল্লাহর কাছে এই দোয়া করতেও তিনি সংকোচ বােধ করেন। তিনি বিষয়টা আল্লাহর বিবেচনার ওপরই ছেড়ে দেন। কেননা তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, তার অবস্থা আল্লাহর জানাই আছে এবং তার কোনাে কিছু চাওয়ার দরকার নেই। আর যে মুহূর্তে হযরত আইয়ুব তার প্রতিপালকের কাছে এমন নিশ্চিত বিশ্বাস ও আদব সহকারে উপস্থিত হলেন, সেই মুহূর্তেই আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি সাড়া দিলেন, সদয় হলেন এবং তার মুসিবতের অবসান ঘটলাে। ‘আমি তার আহ্বানে সাড়া দিলাম…’ তার দেহের কষ্ট দূর করা হলাে। ফলে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন, তার পরিবার সংক্রান্ত মুসিবতও দূর করা হলাে। ফলে তিনি পরিবারের হারানাে সদস্যদের বিনিময়ে নতুন কিছু লােক পেয়ে গেলেন এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের মতােই আরাে কিছু লােক তাদেরকে দিলেন। কারাে কারাে মতে এর অর্থ এই যে, আল্লাহ তায়ালা তার পুত্রদেরকে যেমন ফেরত দিলেন, তেমনি তাকে আরাে সমসংখ্যক পুত্র সন্তান দিলেন, অথবা তাকে পুত্র ও পৌত্র দান করলেন। ‘আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ স্বরূপ।’ বস্তুত প্রত্যেক দানই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ও রহমত। ‘এবাদাতকারীদের জন্যে স্মরণীকা’ কেননা তা আল্লাহর কথা, তার পরীক্ষা বা বিপদ-মুসিবতের কথা, বিপদ মুসিবতে ও বিপদ মুসিবতের পরে তার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বস্তুত আইয়ুব(আ.)-এর মুসিবতে সমগ্র মানব জাতির জন্যে শিক্ষণীয় রয়েছে, আইয়ুব(আ.) ধৈর্য ও সমগ্র মানব জাতির জন্যে আদর্শস্বরূপ। ধৈর্য, আদব ও উত্তম পরিণতির দিক দিয়ে তিনি উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত যে, সকলের দৃষ্টি তার দিকে উত্থিত না হয়ে পারে না। পরীক্ষা ও মুসিবতের প্রসংগে ‘এবাদাতকারীদের’ শব্দটার উল্লেখ তাৎপর্যবহ এবাদাতকারীরা বিপদ মুসিবত ও পরীক্ষার সম্মুখীন হতে বাধ্য এটাই এর তাৎপর্য। এবাদাত, ঈমান ও প্রত্যয়ের দৃঢ়তার এ পরীক্ষা অনিবার্য। কেননা ঈমান কোনাে খেলার বিষয় নয়, বরং একটা গুরুতর দায়িত্ব। ঈমান একটা আমানত, যা একমাত্র সেইসব বিশ্বস্ত লােককেই দেয়া হয়, যারা এটা সংরক্ষণের ক্ষমতা রাখে এবং প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতিও নেয়। শুধু মুখের কথা ধর্তব্য নয়। এবাদতকারীদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে ধৈর্য অপরিহার্য। এরপর হযরত ইসমাঈল, ইদ্রিস ও যুলকিফল(আ.) এর বিষয় সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘ইসমাঈল, ইদ্রীস, যুলকিফল এরা সবাই ধৈর্যশীল। আমি এদের সবাইকে আমার রহমতে প্রবেশ করিয়েছি। তারা সবাই সৎকর্মশীল।’ এই নবীদেরও প্রধান বৈশিষ্ট্য ধৈর্য, যা তাদের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম কে আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষা করেন আপন ছেলেকে যবাই করার নির্দেশ দিয়ে। তিনি এ পরীক্ষায় ধৈর্যের সাহায্যে উত্তীর্ণ হন এবং তার ছেলে নবী ইসমাইল(আ.)ও এই বলে আত্মসমর্পণ করেন যে, ‘হে পিতা, আপনাকে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা করুন। আপনি আমাকে ধৈর্যশীল দেখতে পাবেন।’ হযরত ইদ্রীস (আ.) সম্পর্কে আগেই বলেছি যে, তার স্থান ও কাল অজ্ঞাত। কারাে কারাে মতে তিনি হচ্ছেন ওযােরিস, যাকে মিশরীয়রা তার মৃত্যুর পর পূজা করতাে এবং তাকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী রচনা করেছিলো, কেউ কেউ তাকে মানব জাতির প্রথম শিক্ষক বলে আখ্যায়িত করেছে, যিনি তাদেরকে কৃষ্টি ও শিল্পের শিক্ষা দেন। তবে এ সম্পর্কে আমরা কোনাে প্রমাণ পাইনি। সুতরাং আমাদের এতটুকু জেনে নিতে হবে যে, তিনি এমন এক পর্যায়ের ধৈর্যশীল ছিলেন, যা আল্লাহর চিরস্থায়ী গ্রন্থে নিবন্ধিত হবার যােগ্যতা রাখে। হযরত যুলকিফলেরও আবির্ভাবের স্থান ও কাল অজ্ঞাত। তবে খুব সম্ভবত তিনি ছিলেন বনী ইসরাঈলের একজন নবী। আবার কারাে কারাে মতে তিনি বনী ইসরাঈলের একজন পুণ্যবান লােক। বনী ইসরাঈলের জনৈক নবীর ইন্তেকালের সময় সমাগত হলে তিনি তাদের জন্যে এমন এক ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে চান, যার মধ্যে তিনটি গুণ থাকবে, সে সারা রাত জেগে নামায পড়ে, প্রতি দিন রােযা রাখে ও মানুষের বিবাদ মীমাংসা করার সময় রাগান্বিত হয় না। হযরত যুলকিফল এই তিনটি গুণের অধিকারী প্রমাণিত হন এবং এজন্যেই তাকে যুলকিফল বলে। তবে এটাও একটা প্রমাণহীন বক্তব্য। এখানে কোরআনের এ সার্টিফিকেটই যথেষ্ট যে, যুলফিকল ধৈর্যশীল ছিলেন। তাদের সবাইকে আমার রহমতের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছিলােম। প্রকৃতপক্ষে এখানে তাদের উল্লেখের এটাই প্রধান উদ্দেশ্য।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# হযরত আইয়ুবের (আ) ব্যক্তিত্ব, সময়, জাতীয়তা সব বিষয়েই মতবিরোধ আছে। আধুনিক যুগের মুফাসসিরগণের মধ্য থেকে কেউ তাঁকে ইসরাঈলী গণ্য করেন। কেউ বলেন, তিনি মিসরীয় আবার কেউ বলেন আরব ছিলেন। কারো মতে, তিনি ছিলেন হযরত মূসার পূর্ববর্তীকালের লোক। কেউ বলেন, তিনি হযরত দাউদ (আ) ও সুলায়মানের (আ) আমলের লোক। আবার কেউ তাঁকে তাঁদেরও পরবর্তীকালের পুরাতন নিয়মে সংযোজিত ইয়োব তথা আইইয়ূবের সিফর বা আইয়ূবের সহীফা । তার ভাষা, বর্ণনা ভংগী ও বক্তব্য দেখে এসব বিভিন্ন মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে অন্য কোন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণ নেই। এ ইয়োব বা আইইয়ূবের সহীফার অবস্থা হচ্ছে এই যে, এর বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে বৈপরীত্য এবং এর বর্ণনা কুরআন মজীদের বর্ণনা থেকে এত বেশী ভিন্নতর যে, উভয়কে একসাথে মেনে নেয়া যেতে পারে না। কাজেই আমরা এর ওপর একটুও নির্ভর করতে পারি না। বড় জোর নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য যদি কিছু হয় তাহলে তা হচ্ছে এই যে, ইয়াসইয়াহ (যিসাই) নবী ও হিযকিইল (যিহিস্কেল) নবীর সহীফায় তার উল্লেখ করা হয়েছে এবং সহীফা দু’টি ঐতিহাসিক দিক দিয়ে বেশী নির্ভরযোগ্য। ইয়াসইয়াহ নবী খৃস্টপূর্ব অষ্টম এবং হিযকিইল নবী খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অতিক্রান্ত হয়েছেন। তাই নিশ্চয়তা সহকারে বলা যেতে পারে যে, হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম খৃস্টপূর্ব নবম শতক বা এরও পূর্বের নবী ছিলেন। তাঁর জাতীয়তা সম্পর্কে বলা যেতে পারে, সূরা নিসার ১৩৬ ও সূরা আন’আমের ৮৪ আয়াতে যেভাবে তাঁর আলোচনা এসেছে তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, তিনি বনী ইসরাঈলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু ওহাব ইবনে মুনাববিহের এ বর্ণনাও একেবারে অযৌক্তিক নয় যে, তিনি হযরত ইসহাকের (আ) পুত্র ঈসূর বংশধর ছিলেন।
# দোয়ার ধরন অত্যন্ত পবিত্র, সূক্ষ্ম ও নমনীয়! সংক্ষিপ্ত বাক্যের সাধ্যমে নিজের কষ্টের কথা বলে যাচ্ছেন এবং এরপর একথা বলেই থেমে যাচ্ছেন— “তুমি করুণাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।” পরে কোন অভিযোগ ও নালিশ নেই, কোন জিনিসের দাবী নেই। দোয়ার এই ভংগীমা যে উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন চিত্রটি তুলে ধরে তা হচ্ছে এই যে, কোন পরম ধৈর্যশীল, অল্পে তুষ্ট, ভদ্র ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি দিনের পর দিন অনাহার ক্লিষ্টতার দুঃসহ জ্বালায় ব্যাকুল হয়ে কোন পরমদাতা ও দয়ালু ব্যক্তির সামনে কেবলমাত্র এতটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়ে যায়, “আমি অনাহারে আছি এবং আপনি বড়ই দানশীল।” এরপর সে আর মুখে কিছুই উচ্চারণ করতে পারে না।
# সূরা সাদের চতুর্থ রুকূ’তে এর যে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাঁকে বলেনঃ
ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ
“নিজের পা দিয়ে আঘাত করো, এ ঠাণ্ডা পানি মজুদ আছে গোসল ও পান করার জন্য।”
এ থেকে জানা যায়, মাটিতে পা ঠুকবার সাথে সাথেই আল্লাহ তাঁর জন্য একটি প্রাকৃতিক ঝরণা-ধারা প্রবাহিত করেন। এ ঝরণার পানির বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এ পানি পান ও এতে গোসল করার সাথে সাথেই তিনি রোগমুক্ত হয়ে যান। এ রোগ নিরাময়ে এদিকে ইঙ্গিত করে যে, তাঁর কোন মারাত্মক চর্মরোগ হয়েছিল। বাইবেলের বর্ণনাও এর সমর্থক। বাইবেল বলছে, তাঁর সমস্ত শরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ফোঁড়ায় ভরে গিয়েছিল। (ইয়োব ২: ৭)
# এ কাহিনীর মধ্য দিয়ে কোরআন মজীদ হযরত আইয়ুবকে এমনভাবে পেশ করেছে যার ফলে তাঁকে সবরের প্রতিমূর্তি মনে হয়। এরপর কুরআন বলছে, তাঁর জীবন ইবাদাতকারীদের জন্য একটি আদর্শ। অন্যদিকে বাইবেলের আইয়ুবের সহীফা (ইয়োব) পড়লে সেখানে এমন এক ব্যক্তির ছবি ফুটে উঠবে যিনি আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগে সোচ্চার এবং নিজের বিপদের জন্য আপাদমস্তক ফরিয়াদী হয়ে আছেন। বারবার তাঁর মুখ থেকে এ বাক্যটি নিঃসৃত হচ্ছেঃ “বিলুপ্ত হোক সেদিন যেদিন আমার জন্ম হয়েছিল।” “আমি কেন গর্ভে মরে যাইনি?” “মায়ের পেট থেকে বের হওয়া মাত্র আমি কেন প্রাণত্যাগ করিনি?” বারবার তিনি আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেনঃ “সর্বশক্তিমানের বান আমার ভিতরে প্রবিষ্ট, আমার আত্মা তাঁরই বিষপান করছে, ঈশ্বরীয় ত্রাসদল আমার বিরুদ্ধে শ্রেণীবদ্ধ।” “হে মানুষ্য দর্শক, আমি যদি পাপ করে থাকি, তবে আমার কর্মে তোমার কি হয়? তুমি কেন আমাকে তোমার শর লক্ষ্য করেছো? আমিতো আপনার ভার আপনি হয়েছি। তুমি আমার অধর্ম ক্ষমা কর না কেন? আমার অপরাধ দূর কর না কেন?” “আমি ঈশ্বরকে বলবো আমাকে দোষী করো না; আমাকে বল আমার সাথে কি কারণে বিবাদ করছো। এটা কি ভাল যে, তুমি উপদ্রব করবে? তোমার হস্তনির্মিত বস্তু তুমি তুচ্ছ করবে? দুষ্টগণের মন্ত্রণায় প্রসন্ন হবে?” তাঁর তিন বন্ধু এসে তাঁকে সান্ত্বনা দেন এবং ধৈর্য, আত্মসমর্পণ ও সন্তুষ্টি লাভ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি কোন কথা শুনেন না। তিনি তাদের পরামর্শের জবাবে আল্লাহর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আনতে থাকেন এবং তাদের শত বুঝাবার পরও জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে, আল্লাহর এ কাজের মধ্যে কোন প্রজ্ঞা ও কল্যাণ নেই, আছে শুধু একটা জুলুম, যা আমার মতো মুত্তাকী ও ইবাদাতকারী ব্যক্তির প্রতি করা হচ্ছে। তিনি আল্লাহর ব্যবস্থাপনার কঠোর সমালোচনা করেন এই বলে যে, একদিকে দুষ্কৃতকারীদেরকে অনুগৃতীত করা হয় এবং অন্যদিকে সুকৃতিকারীদেরকে জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ করা হয়। নিজের সৎকর্মগুলোকে তিনি এক এক করে গণনা করেন তারপর এর প্রতিদানে আল্লাহ তাঁকে যেসব কষ্ট দিয়েছেন সেগুলো বর্ণনা করতে থাকেন এবং এরপর বলেন, আল্লাহর কাছে যদি কোন জবাব থাকে তাহলে তিনি বলুন কোন অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমার সাথে এর ব্যবহার করা হয়েছে? নিজের স্রষ্টা ও প্রভুর বিরুদ্ধে তাঁর এ অভিযোগ ধীরে ধীরে এত বেশী বেড়ে যেতে থাকে যে, শেষে তাঁর বন্ধুরা তাঁর কথার জবাব দেয়া বন্ধ করে দেন। তারা চুপ করে যান। তখন চতুর্থ এক ব্যক্তি, যিনি তাঁদের কথা নিরবে শুনছিলেন, মাঝখান থেকে হস্তক্ষেপ করেন এবং আইয়ুবকে এ ব্যাপারে ভীষণভাবে তিরস্কার করতে থাকেন যে, “তিনি তো আল্লাহকে নয় বরং নিজেকে সঠিক গণ্য করছেন।” এ ভাষণ শেষ হবার আগেই মাঝখান থেকে আল্লাহ নিজেই বলে ওঠেন এবং তারপর তাঁর ও আইয়ুবের মধ্যে খুব মুখোমুখি বিতর্ক হতে থাকে। এ পুরো কাহিনীটি পড়তে পড়তে আমরা একবারও অনুভব করি না যে, আমরা এমন এক অতুলনীয় ধৈর্যশীল নবীর অবস্থা ও কথা পড়ছি যার চিত্র কুরআন ইবাদাতকারীদের জন্য শিক্ষণীয় ও আদর্শ হিসেবে পেশ করেছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এ পুস্তকের প্রথম অংশ এক ধরনের কথা বলে, মাঝখানের অংশ বলে ভিন্ন কথা এবং শেষে ফলাফল দেখা যায় সম্পূর্ণ অন্য কিছু। এ তিন অংশের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্য নেই। প্রথম অংশ বলে, আইয়ুব একজন বড়ই সত্যনিষ্ঠ, খোদাভীরু ও কুকর্ম ত্যাগকারী সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। এই সঙ্গে তিনি এতই ধনাঢ্য ছিলেন যে, “পূর্ব দেশের লোকদের মধ্যে তিনি-ই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বড়লোক।” একদিন আল্লাহর কাছে তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর নিজের পুত্রগণ হাজির হন। তাদের সাথে শয়তানও আসে। আল্লাহ সেই মজলিসে তাঁর বান্দা আইয়ুবের জন্য গর্ব করেন। শয়তান বলে, আপনি তাঁকে যা কিছু দিয়ে রেখেছেন তারপর সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে আর কি করবে? তার প্রতি যেসব অনুগ্রহ করেছেন সেগুলো একবার ছিনিয়ে নেন তারপর দেখুন সে যদি আপনার মুখের ওপর আপনাকে অস্বীকার না করে থাকে তাহলে আমার নাম শয়তান নয়। আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে তাঁর সব কিছু তোমার হস্তগত করে দেয়া হচ্ছে, শুধুমাত্র তাঁর শারীরিক কোন ক্ষতি করো না। শয়তান গিয়ে আইয়ুবের সমস্ত ধন-দৌলত ও পরিবার-পরিজন ধ্বংস করে দেয়। আইয়ুব সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধুমাত্র একাই থেকে যান। কিন্তু এতে আইয়ুবের মনে কোন দুঃখ ও ক্ষোভ জাগেনি। তিনি আল্লাহকে সিজদা করেন এবং বলেন, “আমি মায়ের গর্ভ থেকে উলংগ এসেছি এবং উলংগই ফিরে যাবো; খোদাই দিয়েছেন আবার খোদাই নিয়েছেন, খোদার নাম ধন্য হোক।” (দেখুন: ইয়োব ১)
আবার এক দিন আল্লাহর দরবারে একই ধরনের একটি মজলিস বসে। তাঁর ছেলেরা আসে, শয়তানও আসে। আল্লাহ শয়তানকে বলেন, আইয়ুব কেমন সত্যনিষ্ঠ প্রমাণিত হয়েছে দেখে নাও। শয়তান বলে, আচ্ছা জনাব, তার শরীরকে একবার বিপদগ্রস্ত করে দেখুন সে আপনার মুখের ওপর আপনার কুফরী করবে। আল্লাহ বলেন, ঠিক আছে যাও, তাঁকে তোমার হাতে দেয়া হচ্ছে, তবে তাঁর প্রাণটি যেন সংরক্ষিত থাকে। অতঃপর শয়তান ফিরে যায়। সে “আইয়ুবকে মাথার চাঁদি থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়ায় ভরে দেয়।” তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলে, “এখনো কি তুমি তোমার সত্যনিষ্ঠার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে? আল্লাহকে অমান্য করো এবং প্রাণত্যাগ করো।” তিনি জবাব দেন, “তুমি মুঢ়া স্ত্রীর মতো কথা বলছো। আমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে শুধু সুখ পাবো, দুঃখ পাবো না।” (দেখুন: ইয়োব ২)
এ হচ্ছে আইয়ুবের সহীফার (ইয়োব পুস্তক) প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত সার। কিন্তু এরপর তৃতীয় অধ্যায়ে একটি ভিন্নতর বিষয়বস্তু শুরু হয়েছে। এটি বিয়াল্লিশতম অধ্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। এসব অধ্যায়ে হযরত আইয়ুবের ধৈর্যহীনতা এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ ও দোষারোপের একটি ধারাবাহিক কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তা থেকে একথা পুরোপুরি প্রমাণিত হয়ে যায় যে, হযরত আইয়ুবের সম্পর্কে আল্লাহর অনুমান ভুল ও শয়তানের অনুমান সঠিক ছিল। তারপর আল্লাহর সাথে একচোট তর্ক বিতর্ক করার পর বিয়াল্লিশতম অধ্যায়ের শেষের দিকে ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও তাওয়াক্কুলের ভিত্তিতে নয় বরং আল্লাহর তিরস্কার ও ধমক খেয়ে আইয়ুব তাঁর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং তিনি তা গ্রহণ করে তার সমস্ত কষ্ট দূর করে দেন। এরপর তাঁকে পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী সম্পদ দান করেন। এ শেষ অংশটি পড়তে গিয়ে মনে হবে আইয়ুব ও আল্লাহ উভয়েই শয়তানের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছেন। তারপর নেহাত নিজের কথা রাখার জন্যই আল্লাহ ধমক দিয়ে তাঁকে মাফ চাইতে বাধ্য করেন এবং মাফ চাওয়ার সাথে সাথেই তা গ্রহণ করে নেন, যাতে শয়তানের সামনে তাঁকে লজ্জিত হতে না হয়।
এ পুস্তকটি নিজ মুখেই একথা ঘোষণা করছে যে, এটি আল্লাহর বা হযরত আইয়ুবের বাণী নয়। বরং হযরত আইয়ুবের জামানার বইও নয় এটি। তাঁর ইন্তেকালের শত শত বছর পরে কোন এক ব্যক্তি আইয়ুবের ঘটনাকে ভিত্তি করে “ইউসুফ যোলায়কা” ধরনের একটি চমকপ্রদ কাহিনী কাব্য রচনা করেন। তাতে আইয়ুব (ইয়োব), তৈমনীয় ইলীফস, শূহীয় বিলদদ, নামাথীয় সোফর, বুষীয় বারখেলের পুত্র ইলীহূ প্রমুখ কয়েকটি চরিত্র উপস্থাপন করে তাদের মুখ দিয়ে বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আসলে তিনি নিজের মনগড়া দর্শন বর্ণনা করেছেন। তার কাব্য প্রতিভা ও চমৎকার বর্ণনা ভংগীর যতই প্রশংসা করতে পারেন করুন কিন্তু তাকে পবিত্র কিতাব ও আসমানী সহীফার অন্তর্ভুক্ত করার কোন অর্থ নেই। আইয়ুব আলাইহিস সালামের জীবনী ও সীরাতের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক ততটুকু যতটুকু সম্পর্ক আছে “ইউসুফ যোলায়খা”র সাথে ইউসুফ আলাইহিস সালামের। বরং সম্ভবত অতটুকুও নেই। বড়জোর আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, এ পুস্তকের প্রথম ও শেষ অংশে যেসব ঘটনা বলা হয়েছে তার মধ্যে সঠিক ইতিহাসের একটি উপাদান পাওয়া যায়। কবি তা শ্রুতি থেকে গ্রহণ করে থাকবেন, যা তাঁর যুগে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল অথবা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য এমন কোন সহীফাহ থেকে নিয়ে থাকবেন।
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা রূমের ৩৩ টীকা।
# “যুলকিফ্ল”-এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে “ভাগ্যবান” এবং অর্থ হচ্ছে নৈতিক মাহাত্ম ও পরকালীন সওয়াবের দৃষ্টিতে ভাগ্যবান, পার্থিব স্বার্থ ও লাভের দৃষ্টিতে নয়। এটি সংশ্লিষ্ট মনীষীর নাম নয় বরং তাঁর উপাধি। কুরআন মজীদে দু’জায়গায় তাঁর কথা বলা হয়েছে। দু’জায়গায়ই তাঁকে এ উপাধির মাধ্যমে স্মরণ করা হয়েছে, নামের সাহায্যে নয়।
কে এই যুলকিফ্ল? কি তাঁর পরিচয়? কেন দেশ ও জাতির সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল? তিনি কোন যুগের লোক ছিলেন? এ সম্পর্কে মুফাসসিরগণের উক্তিগুলো বড় বেশী বিক্ষিপ্ত। কেউ বলেন, এটি হযরত যাকারিয়ার (আ) দ্বিতীয় নাম (অথচ এটি একটি সুস্পষ্ট ভুল কথা। কারণ, তাঁর আলোচনা এর পরই সামনের দিকে আসছে)। কেউ বলেন, তিনি হচ্ছেন হযরত ইলিয়াস (আ)। কেউ ইউশা’ ইবনে নূনের নাম নেন। কেউ বলেন, তিনি আল ইয়াসা’ (অথচ এটিও ভুল। কারণ, সূরা সা’দ-এ তাঁর কথা ও “যুলকিফল”-এর কথা আলাদা আলাদা করে বলা হয়েছে।) কেউ তাঁকে হযরত আল ইয়াসার (আ) খলীফা বলেন। আবার কারো বক্তব্য হচ্ছে, তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুবের ছেলে। হযরত আইয়ুবের (আ) পরে তিনি নবী হন এবং তাঁর আসল নাম ছিল বিশর। আল্লাম আলূসী তাঁর রূহুল মা’আনী গ্রন্থে লিখেছেনঃ “ইহুদীদের দাবী হচ্ছে, তিনি হিযকিইল (যিহিস্কেল) নবী। বনী ইসরাঈলদের পরাধীনতার (৫৯৭ খৃঃ পূঃ) যুগে তিনি নবুওয়াতের মর্যাদায় অভিসিক্ত হন এবং খাবুর (কবার) নদীর তীরে একটি জনপদে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।”
এ বিভিন্ন উক্তি ও মতামতের ভিত্তিতে তিনি যথার্থই কোন নবী ছিলেন নিশ্চিত নির্ভরতার সাথে বলা যেতে পারে না। বর্তমান যুগের মুফাসসিরগণ হিযকিইল নবীর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কিন্তু এ মত গ্রহণের পক্ষে আমি কোন ন্যায় সঙ্গত যুক্তি-প্রমাণ পেলাম না। তবুও এর সপক্ষে কোন যথাযথ প্রমাণ পেলে এ মতটিকে অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। কারণ, বাইবেলের হিযকিইল সহীফাটি দেখলে মনে হয় যথার্থই এ আয়াতে তাঁর যে প্রশংসা করা হয়েছে তিনি তার হকদার অর্থাৎ ধৈর্যশীল ও সৎকর্মপরায়ণ। জেরুসালেম শেষ বার ধ্বংস হবার আগে বখতে নসরের হাতে যারা গ্রেফতার হয়েছিল তিনি ছিলেন তাদের একজন। বখতে নসর ইরাকে ইসরাঈলী কয়েদীদের একটি উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল খাবুর (কবার) নদীর তীরে। এর নাম ছিল তেলআবীব। এ স্থানেই ৫৯৪ খৃস্টপূর্বাব্দে হযরত হিযকিইল নবুওয়াতের মর্যাদায় অভিসিক্ত হন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩০ বছর। অবিশ্রান্তভাবে ২২ বছর ধরে তিনি একদিকে বিপদগ্রস্ত ইসরাঈলীদেরকে এবং অন্যদিকে জেরুসালেমের গাফেল ও অস্থির-বিহবল অধিবাসী ও শাসকদেরকে সজাগ করার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এ মহান দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁর নিষ্ঠা ও আত্মনিমগ্নতা অবশ্যি প্রণিধানযোগ্য। একটি ঘটনা থেকে এ বিষয়টি অনুমান করা যেতে পারে। নবুওয়াতের নবম বছরে তাঁর স্ত্রী, যাতে তিনি নিজেই বলেন, “নয়নের প্রীতি পাত্র” ইন্তিকাল করেন। লোকেরা শোক প্রকাশের জন্য তাঁর বাড়িতে জমায়েত হয়। এদিকে তিনি নিজের মানসিক যন্ত্রণা ও শোকের কথা বাদ দিয়ে নিজের সম্প্রদায়কে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখাতে থাকেন। এ আযাব সে সময় তাদের মাথার ওপর ঝুলছিল। (২৪: ১৫-২৭) বাইবেলের যিহিস্কেল পুস্তক এমন একটি পুস্তক যা পড়ে মনে হয় সত্যি এটি আল্লাহর কালাম।
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৮৩-৮৪ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা আইয়ূব (عليه السلام)-এর স¤পর্কে আলোচনা করেছেন। আইয়ূব (عليه السلام) ধৈর্যশীল নাবীগণের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এবং অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন। বিপদে ধৈর্য ধারণ করায় এবং আল্লাহ তা‘আলার পরীক্ষাকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়ায় আল্লাহ তা‘আলা আইয়ূব (عليه السلام)-কে ‘ধৈর্যশীল’ ও ‘সুন্দর বান্দা’ হিসেবে প্রশংসা করেছেন। কুরআনে ৪টি সূরার ৮টি আয়াতে তাঁর কথা উল্লেখ রয়েছে। সূরা নিসার ১৬৩ ও আন‘আমের ৮৪ নং আয়াতে কেবল তাঁর নাম, আর সূরা স্ব-দ-এর ৪১-৪৪ নং আয়াতে কিছু আলোচনা উল্লেখ রয়েছে। তাফসসীরবিদ ও ঐতিহাসিকগণ আইয়ূবের জনপদের নাম বলেছেন ‘হূরান’ অঞ্চলের ‘বাছানিয়াহ’ এলাকা। যা ফিলিস্তিনের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর দামেস্ক ও আযরূ‘আত-এর মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত।
প্রত্যেক নাবীকেই কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তারা সকলেই সে সব পরীক্ষায় ধৈর্যধারণ করেছেন ও উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু আইয়ূব (عليه السلام)-এর আলোচনায় বিশেষভাবে
(اِنَّا وَجَدْنٰھُ صَابِرًا)
“আমি তাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল পেয়েছি।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৪৪) বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে কঠিনতম কোন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। তবে সে পরীক্ষা কী তা কুরআনে উল্লেখ নেই। হাদীসে শুধু এতটুকু এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আইয়ূব (عليه السلام) একদিন নগ্নাবস্থায় গোসল করছিলেন। এমন সময় তাঁর ওপর সোনার টিড্ডি পাখিসমূহ এসে পড়ে। তখন তিনি সেগুলিকে ধরে কাপড়ে ভরতে থাকেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে বলেন: হে আইয়ূব
أَلَمْ أَكُنْ أَغْنَيْتُكَ عَمَّا تَريَ
আমি কি তোমাকে এসব থেকে অমুখাপেক্ষী করিনি? আইয়ূব (عليه السلام) জবাবে বললেন:
بَلَي وَعِزَّتِكَ وَلَكِنْ لَا غِنَي بِي عَنْ بَرَكَتِكَ
তোমার ইযযতের কসম! অবশ্যই তুমি আমাকে তা দিয়েছ। কিন্তু তোমার বরকত থেকে আমি অমুখাপেক্ষী নই। (সহীহ বুখারী হা: ২৭৯) সুতরাং নাবীর মর্যাদার খেলাফ ও যা ফাসেকদের হাসি-ঠাট্টার খোরাক হয় এমন কথা ও মন্তব্য না করাই শ্রেয়। যেমন বলা হয় তাঁর শরীরের মাংস খসে পড়ে গিয়েছিল, শরীরে পোকা হয়েছিল, পচে-গলে দুর্গন্ধময় হয়ে যাওয়ায় ঘর থেকে বের করে জঙ্গলে ফেলে আসা হয়েছিল, ১৮ বা ৩০ বছর ধরে রোগাগ্রস্ত ছিলেন ইত্যাদি নাবীবিদ্বেষী ও ইসলামের শত্র“দের বানোয়াট গল্পগুজব বৈ কিছুই নয়।
অত্র সূরা ও সূরা স্ব-দ-এর আইয়ূব (عليه السلام)-এর আলোচনার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলার নিকট আইয়ূব (عليه السلام)-এর আহবানের (اِذْ نَادٰی) কথা বলা হয়েছে। এতে বুঝা যায়, আইয়ূব (عليه السلام) নিঃসন্দেহে কঠিন বিপদে পড়েছিলেন। সেজন্য তিনি আকুতিভরে আল্লাহ তা‘আলাকে ডেকেছিলেন। আর বিপদে পড়ে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকা ও তাঁর নিকট বিপদ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা নবুওয়াতের শানের বিপরীত নয় বরং তা অনুগত বান্দার পরিচয়। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاذْكُرْ عَبْدَنَا أَيُّوْبَ إِذْ نَادَي رَبَّه۫ أَنِّيْ مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَّعَذَابٍ)
“স্মরণ কর! আমার বান্দা আইয়ূবের কথা, যখন সে তার প্রতিপালককে আহ্বান করে বলেছিল: শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৪১) যে বিপদ দিয়ে কঠিন পরীক্ষা করেছিলেন তা ছিল দু’ ধরণের ১. بِنُصْبٍ তথা শারীরিক কষ্ট, ২. عَذَابٍ ধন-সম্পদের কষ্ট। এক্ষণে শয়তান তাঁকে কী ধরণের বিপদে ফেলেছিল কেমন রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, দেহের সর্বত্র কেমন পোকা ধরেছিল, জিহ্বা ও কলিজা ব্যতীত দেহের সব মাংস খসে পড়েছিল ইত্যাদি কাহিনী ইমাম কুরতুবী স্বীয় তাফসীরে অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন যার কোন ভিত্তি নেই বরং তা ইসরাঈলী উপকথা মাত্র।
(فَاسْتَجَبْنَا لَھ۫ فَکَشَفْنَا مَا بِھ۪ مِنْ ضُرٍّ)
‘তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, তার দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে দিলাম’ কীভাবে দূর করা হয়েছিল তার চিকিৎসা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তুমি তোমার পা দ্বারা মাটিতে আঘাত কর, ফলে তা থেকে ঠাণ্ডা পানি বের হবে , তুমি তা থেকে পান কর এবং তা দ্বারা গোসল কর এতে তোমার ভেতর ও দেহের কষ্ট দূর হয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ)
“(আদেশ করলাম) তোমার পা দিয়ে মাটিতে আঘাত কর। (আঘাত করতেই একটি ঝরণা উৎপন্ন হল) এ হল সুশীতল গোসলের পানি এবং পানাীয়।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৪২)
(وَّاٰتَیْنٰھُ اَھْلَھ۫ وَمِثْلَھُمْ)
‘তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের সমপরিমাণ আরো দিলাম’ এখানে পরিস্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তাঁর বিপদে ধৈর্য ধারণের পুরস্কার দ্বিগুণভাবে পেয়েছিলেন দুনিয়াতে এবং আখেরাতে। বিপদে পড়ে যা কিছু তিনি হারিয়েছিলেন, সবকিছুই তিনি বিপুলভাবে ফেরত পেয়েছিলেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَکَذٰلِکَ نَجْزِی الْمُحْسِنِیْنَ)
“আর আমি এভাবেই সৎ কর্মপরায়ণদেরকে পুরষ্কৃত করি।” (সূরা আন‘আম ৬:৮৪)
(رَحْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا)
‘আমার বিশেষ রহমতরূপে’ অর্থাৎ আইয়ূব (عليه السلام)-কে বিপদ থেকে মুক্তি ও পরিবারবর্গকে ফেরত দেয়া ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত। তিনি অনুগ্রহ করে দান করেছেন। আয়াতের এ শব্দটিকে ‘রহীমা’ করে এটিকে আইয়ূব (عليه السلام)-এর স্ত্রীর নাম হিসেবে একদল লোক সমাজে চালু করে দিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যেন বলছেন যে, আইয়ূবের স্ত্রী রহীমা তার স্বামীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরে আমি তাকে আইয়ূবের কাছে ফিরিয়ে দিলাম। বস্তুত এটি একটি উদ্ভট ব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই নয়। মূলত আইয়ূব (عليه السلام)-এর স্ত্রীর নাম কী ছিল, সে বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই।
আইয়ূব (عليه السلام)-এর অত্র ঘটনা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَذِکْرٰی لِلْعٰبِدِیْنَ)
‘আর এটা ‘ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ’, সূরা স্ব-দ-এ বলা হয়েছে
(وَذِکْرٰی لِاُولِی الْاَلْبَابِ)
‘এবং জ্ঞানীদের জন্য উপদেশস্বরূপ’ অর্থাৎ এতে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলার দাসত্বকারী ব্যক্তিই প্রকৃত জ্ঞানী এবং প্রকৃত জ্ঞানী তিনিই যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার দাসত্বকারী।
বিশিষ্ট তাবেয়ী মুজাহিদ (রহঃ) হতে বর্ণিত যে, (১) কিয়ামতের দিন ধনীদের সম্মুখে প্রমাণস্বরূপ পেশ করা হবে সুলাইমান (عليه السلام)-কে, (২) ক্রীতদাসের সামনে পেশ করা হবে ইউসুফ (عليه السلام)-কে এবং (৩) বিপদগ্রস্তদের সামনে পেশ করা হবে আইয়ূব (عليه السلام)-কে । (আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/২০৭, ২১০)
সুতরাং বিপদে, দুঃখে-কষ্টে, রোগে সবার্বস্থায় আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইতে হবে। কোন মাযার বা কবরে শায়িত ব্যক্তিদের নিকট চাওয়া যাবে না। তাহলে শিরক হয়ে যাবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করতে হবে। অধৈর্য হয়ে নিরাশ হওয়া যাবে না।
২. ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাঁর পক্ষ থেকে রহমত দান করেন।
৩. আইয়ূব (عليه السلام) সম্পর্কে যে সকল বানোয়াট কথা বলা হয় তা থেকে সাবধান থাকা উচিত।
৪. প্রকৃত স্ত্রী তিনিই যিনি সর্বাবস্থায় নেককার স্বামীর সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। আইয়ূব (عليه السلام)-এর স্ত্রী ছিলেন বিশ্বের পুণ্যবতী মহিলাদের শীর্ষস্থানীয় দৃষ্টান্ত।
৫. প্রয়োজনে স্ত্রীকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার জন্য মৃদু প্রহার করা যাবে, তবে সীমালংঘন করা যাবে না।
৮৫-৮৬ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতদ্বয়ে তিনজন নাবীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাঁরা সকলেই ধৈর্যশীল ও সৎ কর্মপরায়ণ ছিলেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে স্বীয় রহমতে আচ্ছন্ন করে নিয়েছিলেন।
প্রথমত:
ইসমাঈল (عليه السلام)-এর কথা বলা হয়েছে, তাঁর সম্পর্কে কিছু ঘটনা সূরা মারইয়ামের ৫৪-৫৫ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রথম সন্তান, যাঁকে যাবীহুল্লাহ বলা হয়। আর তিনি তাঁর পিতার সাথে কাবাগৃহ নির্মাণ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيْمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيْلُ)
“আর যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কা‘বার ভিত্তি উঁচু করছিলেন।” (সূরা বাক্বারা ২:১২৭)
তিনি একজন ধৈর্যশীল বান্দাও ছিলেন। তাঁর পিতা যখন স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি তাকে যবাই করছেন তখন এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনাকে আপনার প্রতিপালক যে নির্দেশ দিয়েছেন তা বাস্তবায়ণ করুন আর এবিষয়ে আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্তই পাবেন। তার উক্তি:
(قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِيْ إِنْ شَا۬ءَ اللّٰهُ مِنَ الصَّابِرِيْنَ)
“সে বলল: হে আমার বাবা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা পূর্ণ করুন। ইন্শাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা সফফাত: ৩৭:১০২)
দ্বিতীয়ত:
ইদরীস (عليه السلام), তাঁর সম্পর্কে সূরা মারইয়ামের ৫৬-৫৭ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। তিনিও একজন ধৈর্যশীল বান্দা ছিলেন।
তৃতীয়ত:
যুল-কিফল (عليه السلام), অত্র সূরাসহ সূরা স্ব-দ-এর ৪৮ নং আয়াতে তাঁর নাম এসেছে। তিনি আল-ইয়াসা‘ (عليه السلام)-এর পরে নাবী হন এবং ফিলিস্তিনে বানী ইসরাঈলের মাঝে দাওয়াতী কাজ করেন। তিনি নাবী হওয়া সম্পর্কে কেউ কেউ ভিন্ন মত পোষণ করেন। এ ব্যাপারে সঠিক কথা হল; যেহেতু তাঁর নাম ইসমাঈল, ইদরীস, আল ইয়াসা‘ প্রমুখ নাবীদের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে সেহেতু তিনি যে নাবী ছিলেন তা অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে। নাবী না হওয়ার ব্যাপারে বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ নেই। তাঁকে ধরেই বলা হয়, কুরআনে পঁচিশ জন নাবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে রহমতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত ও শ্রেষ্ঠ বান্দাদের একজন বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(وَاذْكُرْ إِسْمَاعِيْلَ وَالْيَسَعَ وَذَا الْكِفْلِ وَكُلٌّ مِّنَ الْأَخْيَارِ)
“স্মরণ কর! ইসমাঈল, আল-ইয়াসা‘আ ও যুল-কিফলের কথা, তারাও প্রত্যেকেই শ্রেষ্ঠ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৪৮)
সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের উচিত নাবীদের দৃঢ় ঈমান দেখে শিক্ষা নিয়ে সর্বদা সৎ আমল করা, মানুষদেরকে সত্যের দিকে দাওয়াত দেয়া এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইসমাঈল (عليه السلام) ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রথম সন্তান, তাঁকেই যবাহ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
২. যুল-কিফল (عليه السلام) একজন নাবী, আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নবুওয়াত দিয়েছেন।
৩. সৎ বান্দাদেরকে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলা রহম করে থাকেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৮৩-৮৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআ’লা হযরত আইয়ুবের (আঃ) কষ্ট ও বিপদাপদের বর্ণনা দিচ্ছেন। আর তা ছিল আর্থিক, দৈহিক এবং সন্তানগত। তার বহু প্রকারের জীবজন্তু, ক্ষেত খামার বাগ-বাগিচা ইত্যাদি ছিল। তার আল্লাহ প্রদত্ত সন্তান সন্ততিসমূহ দাস-দাসী, ধন সম্পদ ইত্যাদি সবকিছুই বিদ্যমান ছিল। অতঃপর তার উপর আল্লাহ তাআলার পরীক্ষা আসে এবং সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি তাঁর দেহেও কুষ্ঠরোগ প্রকাশ পায়। শুধুমাত্র অন্তর ও যুবান ছাড়া তার দেহের কোন অংশই এই রোগ হতে রক্ষা পায় নাই। শেষ পর্যন্ত আশে পাশের লোকদের কাছে তিনি ঘৃণার পাত্র হয়ে যান। বাধ্য হয়ে তাঁকে শহরের এক জনমানবহীন প্রান্তে অবস্থান করতে হয়। তার একটি মাত্র স্ত্রী ছাড়া সবাই তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই বিপদের সময় তার থেকে সবাই সরে পড়ে। এই একটি মাত্র স্ত্রী সদা তাঁর সেবার কাজে লেগে থাকতেন। সাথে সাথে মজুরী খেটে খেটে তার পানাহারেরও ব্যবস্থা করতেন। নবী (সাঃ) বলেছেনঃ “ সবচয়ে কঠিন পরীক্ষা হয় নবীদের উপর। তারপর সৎলোকদের উপর এরপর তাদের চেয়ে কম মর্যাদা সম্পন্ন লোকদের উপর এবং এরপরে আরো নিম্নমানের লোকদের উপর আল্লাহর পরীক্ষা এসে থাকে। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, প্রত্যেকের পরীক্ষা তার দ্বীনের পরিমাণ হিসেবে হয়ে থাকে। যদি কেউ দ্বীনের ব্যাপারে দৃঢ় হয় তবে তার পরীক্ষাও কঠিন হয়। হযরত আইয়ুব (আঃ) বড়ই ধৈর্যশীল ছিলেন এমনকি তার ধৈর্যশীলতার কথা সর্বসাধারণের মুখে মুখে রয়েছে।
হযরত ইয়াযীদ ইবনু মাইসারা (রাঃ) বলেন যে, যখন হযরত আইয়ুবের (আঃ) পরীক্ষা শুরু হয় তখন তাঁর সন্তান সন্ততি মারা যায়, ধন- সম্পদ ধ্বংস হয় এবং তিনি সম্পূর্ণরূপে রিক্ত হস্ত হয়ে পড়েন। এতে তিনি আরো বেশী আল্লাহর যিকরে লিপ্ত থাকেন। তিনি বলতে থাকেনঃ “হে সকল পলিনকারীদের পালনকর্তা! আমাকে আপনি বহু ধন মাল ও সন্তান সন্ততি দান করেছিলেন। ঐ সময় আমি ঐগুলিতে সদা লিপ্ত থাকতাম। অতঃপর আপনি ঐগুলি আমার থেকে নিয়ে নেয়ার ফলে আমার অন্তর ঐ সবের চিন্তা থেকে মুক্ত হয়েছে। এখন আমার অন্তরের মধ্যে ও আপনার মধ্যে কোনই প্রতিবন্ধকতা নেই। যদি আমার শত্রু ইবলীস আমার প্রতি আপনার এই মেহেরবানীর কথা জানতে পারতো তবে সে আমার প্রতি হিংসায় ফেটে পড়তো।” ইবলীস তার এই কথায় এবং তাঁর ঐ সময়ের ঐ প্রশংসায় জ্বলে পুড়ে মরে। তিনি নিম্নরূপ প্রার্থনাও করেনঃ “হে আমর প্রতিপালক! আপনি আমাকে ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি এবং পরিবার পরিজনের অধিকারী করেছিলেন। আপনি খুব ভাল জানেন যে, ঐ সময় আমি কখনো অহংকার করি নাই এবং কারো প্রতি জুলুম ও অবিচারও করি নাই। হে আল্লাহ! এটা আপনার অজানা নেই যে, আমার। জন্যে নরম বিছানা প্রস্তুত থাকতো। কিন্তু আমি তা পরিত্যাগ করে আপনার ইবাদতে রাত্রি কাটিয়ে দিতাম এবং আমার নসকে ধমকের সুরে বলতামঃ তুমি নরম বিছানাতে আরাম করার জন্যে সৃষ্ট হও নাই। হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমি সুখ শান্তি ও আরাম আয়েশ বিসর্জন দিতাম।” (এটা মুসনাদে ইবনু আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে) এই আয়াতের তাফসীরে ইবনু জারীর (রাঃ) ও ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) একটি খুব দীর্ঘ কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যা পর যুগীয় বহু মুফাসৃসিরও রিওয়াইয়াত করেছেন। কিন্তু তাতে অস্বাভাবিকতা রয়েছে এবং ওটা খুবই দীর্ঘ হওয়ার কারণে আমরা ছেড়ে দিয়েছি।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই বিপদে জড়িত ছিলেন। হযরত হাসান (রাঃ) ও হযরত কাতাদা (রাঃ) বলেন যে, তিনি সাত বছর ও কয়েক মাস এই কষ্ট ভোগ করেছিলেন। বানী ইসরাঈলের আবর্জনা ফেলার জায়গায় তাঁকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তার দেহ পোকা হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর মহান আল্লাহ তার প্রতি দয়াপরবশ হন এবং তাঁকে সমস্ত বিপদ ও কষ্ট হতে মুক্তি দান করেন। আর তাকে তিনি পুরস্কৃত করেন ও তার উত্তম প্রশংসা করেন। অহবি ইবনু মুনাব্বাহ্ (রাঃ) বলেন যে, তিনি পুর্ণ তিন বছর এই কষ্টের মধ্যে পতিত ছিলেন। তাঁর দেহের সমস্ত মাংস খসে পড়েছিল। শুধু অস্থি ও চর্ম অবশিষ্ট ছিল। তিনি ছাই এর উপর পড়ে থাকতেন। তাঁর কাছে শুধু তার একজন স্ত্রী ছিলেন। দীর্ঘযুগ এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর একদা তিনি তাঁর স্বামীকে বলেনঃ “হে আল্লাহর নবী (আঃ)! আপনি মহান আল্লাহর নিকট কেন প্রার্থনা করেন না যাতে তিনি আমাদেরকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “দেখো, আল্লাহ তাআলা আমাকে সত্তর বছর সুস্থ শরীরে রেখেছিলেন। সুতরাং তিনি যদি আমাকে সত্তর বছর এই অবস্থায় রাখেন এবং আমি ধৈর্য ধারণ করি আল্লাহর জন্যে তবে এটা তো আল্লাহর জন্যে খুবই অল্প (সময়)।” একথা শুনে তাঁর স্ত্রী কেঁপে ওঠেন। তিনি তাঁর স্বামীর জন্যে শহরে বেরিয়ে যেতেন এবং এর ওর বাড়ীতে কাজকাম করে যা পেতেন তাই এনে স্বামীকে খাওয়াতেন। ফিলিস্তিনবাসী দু’জন লোক হযরত আইয়ুবের (আঃ) ভাই ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। তাদের কাছে শয়তান গিয়ে বলেঃ “তোমাদের ভাই আইয়ূব (আঃ) ভীষণ বিপদ গ্রস্ত ও কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তোমরা গিয়ে তার খবরা খবর নাও এবং তোমাদের এখান থেকে কিছু মদ সঙ্গে নিয়ে যাও। ওটা তাঁকে পান করালেই তিনি আরোগ্য লাভ করবেন। তার কথা মত তারা দু’জন হযরত আইয়ুবের (আঃ) নিকট আগমন করে এবং তার অবস্থা দেখা মাত্রই তঁাদের চক্ষু অশ্রু সিক্ত হয়ে ওঠে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমরা কে?” তারা নিজেদের পরিচয় দান করে। তিনি খুবই খুশী হন এবং তাদেরকে মুবারকবাদ জানান। তারা বলেঃ “হে আইয়ূব (আঃ)! সম্বতঃ আপনি ভিতরে কিছু গোপন রাখতেন এবং বাইরেও বিপরীত প্রকাশ করতেন। এজন্যেই আল্লাহ আপনাকে পরীক্ষায় ফেলেছেন।”তাদের কথা শুনে হযরত আইয়ূব (আঃ) দৃষ্টি আকাশের দিকে উঠিয়ে বলেনঃ “আমি কি গোপন রাখতাম ওর বিপরীত কি প্রকাশ করতাম তা তিনি (আল্লাহ) জানেন। তিনি বরং আমাকে এই বিপদে জড়িয়ে ফেলেছেন এই উদ্দেশ্যে যে, আমি ধৈর্য ধারণ করি কি অধৈর্য হয়ে পড়ি তা তিনি দেখতে চান।অতঃপর তারা দু’জন বলেঃ “আমরা আপনার জন্যে ওষুধ এনেছি, আপনি তা পান করে নিন। এতে আপনি আরোগ্য লাভ করবেন। ওটা হলো মদ, যা অমিরা আমাদের ওখান থেকে আনয়ন করেছি।” তাদের একথা শোনা মাত্রই তিনি কঠিন রাগান্বিত হন এবং বলেনঃ “কলুষিত শয়তান তোমাদেরকে আমার নিকট আনয়ন করেছে। তোমাদের সাথে কথা বলা এবং তোমাদের খাদ্য ও পানীয় আমার জন্যে হারাম।” তখন তারা দু’জন তার নিকট থেকে চলে যায়।
একদিনের ঘটনা, তাঁর স্ত্রী এক বাড়ীতে রুটি পাকিয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের একটি শিশু ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন বাড়ীর মালিক ঐ শিশুর অংশের ছোট রুটি তাকে দিয়ে দেয়। তিনি রুটিটি নিয়ে হযরত আইয়ুবের (আঃ) কিট আসেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এরুটি তুমি কোথা হতে আনলেঃ উত্তরে তিনি ঘটনাটি বর্ণনা করেন। এ ঘটনা শুনে তিনি তার স্ত্রীকে বলেনঃ “তুমি এখনই রুটি নিয়ে ফিরে যাও। খুব সম্ভ শিশুটি এখন জেগে উঠেছে এবং এই ছোট রুটিটির জন্যে জি ধরেছে এবং কেঁদে কেঁদে সারা বাড়ীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। বাধ্য হয়ে তার স্ত্রী রুটি ফিরিয়ে নিয়ে চললেন। ঐ বাড়ীর বারান্দায় একটি ছাগল বাধা ছিল। ছাগলটি তাকে জোরে এক টক্কর মারে। ফলে তাঁর মখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায়ঃ “দেখো, হযরত আইয়র (আঃ) কত বড় ভুল ধারণা করে বসেছেন?” অতঃপর তিনি উপরে উঠে গিয়ে দেখেন যে, সত্যি সত্যিই শিশুটি রুটির জন্য কান্না জুড়ে দিয়েছে এবং বাড়ীর লোকদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলেছে। এদেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলঃ “আল্লাহ তাআলা হযরত আইয়ুবের (আঃ) উপর দয়া করুন!” অতঃপর তিনি রুটিটি তাদেরকে দিয়ে দেন এবং ফিরে আসেন। পথে শয়তান ডাক্তারের রূপ ধরে তার সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বলেঃ “তোমার স্বামী অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছেন। দীর্ঘ দিন ধরে কঠিন রোগে ভুগছেন। তুমি তাকে বুঝিয়ে বল যে, তিনি যেন অমুক গোত্রের প্রতিমার নামে একটি মাছি মারেন। এটা করলেই তিনি আরোগ্য লাভ করবেন।” হযরত আইয়ুবের (আঃ) নিকট পৌঁছে তিনি তাঁকে এই কথা বলেন। তিনি তখন তাকে বলেনঃ “তোমার উপর কলুষিত শয়তানের যাদু লেগে গেছে। সুস্থ হলে আমি তোমাকে একশ চাবুক মারবো।” একদা তাঁর স্ত্রী অভ্যাসমত জীবিকার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। বাড়ী বাড়ী যান কিন্তু কাজ কাম পেলেন না। কাজেই তিনি নিরাশ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসলে হযরত আইয়ুবের (আঃ) ক্ষুধার চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন। সুতরাং তিনি নিরুপায় হয়ে তার চুলের এক খোপা কেটে নিয়ে এক সম্ভ্রান্ত লোকের কন্যার নিকট বিক্রী করেন। মেয়েটি পানাহারের অনেক কিছু জিনিস তাকে প্রদান করে। তা নিয়ে তিনি হযরত আইয়ুবের (আঃ) নিকট পৌঁছেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি এতগুলো ভাল ভাল খাদ্য পেলে কোথায়?” তাঁর স্ত্রী উত্তরে বলেঃ “এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়ীতে কাজ করে দিয়ে ওর বিনিময়ে এগুলো পেয়েছি।” হযরত আইয়ুব (আঃ) তখন তা খেয়ে নেন। ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় দিনও এরূপই ঘটে। সেদিনও তিনি তাঁর চুলের অপর খোপাটি কেটে নিয়ে বিক্রী করে দেন এবং ওর বিনিময়ে প্রাপ্ত খাদ্য নিয়ে স্বামীর নিকট হাযির হন। আজকেও ঐ খাদ্যই দেখে হযরত আইয়ূব (আঃ) তার স্ত্রীকে বলেনঃ “আল্লার কসম! আজকে আমি কিছুতেই এ খাদ্য খাবো না যে পর্যন্ত না তুমি আমাকে খবর দেবে যে, তুমি এ খাদ্য কিরূপে পেলে?” তখন তিনি তাঁর মাথা হতে ওড়না সরিয়ে দেন। ফলে হযরত আইয়ুব (আঃ) দেখতে পান যে, তাঁর মাথার চুল সবই কর্তিত হয়েছে। এ দেখে তিনি অত্যন্ত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। ঐ সময় তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আমার প্রতিপালক! আমি দুঃখ কষ্টে পড়েছি, আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!” (২১৪ ৮৩) হযরত নাওফ (রাঃ) বলেন যে, যে শয়তান হযরত আইয়ুবের (আঃ) পিছনে লেগেছিল তার নাম ছিল মাবসূত।
হযরত আইয়ুবকে (আঃ) তার স্ত্রী প্রায়ই বলতেনঃ “আপনি রোগ মুক্তির জন্যে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করুন।” কিন্তু তিনি প্রার্থনা করতেন না। একদা বানী ইসরাঈলের কতকগুলি লোক তার পার্শ্ব দিয়ে গমন করে। তাকে দেখে তারা মন্তব্য করেঃ “এ লোকটি অবশ্যই কোন পাপের কারণে এই কষ্টে পতিত হয়েছেন। ঐ সময় হঠাৎ তার মুখ দিয়ে এই প্রার্থনা বেরিয়ে পড়ে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উবায়েদ ইবনু উমাইর (রাঃ) বলেন যে, হযরত আইয়ুবের (আঃ) দুটি ভাই ছিল। একদিন তারা তাকে দেখতে আসে। কিন্তু তার শরীরের দুর্গন্ধের কারণে তারা তাঁর নিকটে যেতে পারে নাই। দূরে দাড়িয়ে বলাবলি করেঃ “যদি এর মধ্যে সততা থাকতো তবে সে এই কঠিন বিপদে পতিত হতো না।” তাদের একথায় হযরত আইয়ুবের (আঃ) এতো দুঃখ হয় যে, এরপূর্বে কোন কিছুতেই তিনি এতো দুঃখ পান নাই। ঐসময় তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! যদি আপনার জানা থাকে যে, এমন কোন রাত্রি অতিবাহিত হয় নাই যে রাত্রিতে আমার জানা মতে কেউ ক্ষুর্ধাত অবস্থায় থেকেছে এবং আমি পেট পুরে খাদ্য খেয়েছি। হে আল্লাহ! যদি আমি আমার একথায় আপনার নিকট সত্যবাদী হই তবে আপনি আমাকে সত্যায়িত করুন। তৎক্ষণাৎ আকাশ হতে তাকে সত্যায়িত করা হয় এবং ঐ দুজন তা শুনতে পায়। আবার তিনি বলেন, “হে আল্লাহ! কখনও এমন ঘটে নাই যে, আমার কাছে অতিরিক্ত কাপড় থেকেছে এবং কোন উলঙ্গ ব্যক্তিকে আমি তা প্রদান করি নাই। যদি আমি এতে সত্যবাদী হই তবে আপনি আমাকে আকাশ হতে সত্যায়িত করুন।এবারেও তাদেরকে শুনিয়েই তাঁকে সত্যায়িত করা হয়। পুনরায় তিনি নিম্নরূপ প্রার্থনা করতে করতে সিজদায় পড়ে যানঃ “হে আল্লাহ! আমি ঐ পর্যন্ত সিজদা হতে মাথা উঠাবো না যে পর্যন্ত না আপনি আমার উপর আপতিত সমস্ত বিপদ দূর করবেন।” তঁর এই প্রার্থনা কবুল হয়ে যায় এবং তিনি সিজদা হতে মাথা উঠানোর পূর্বেই তার সমস্ত বিপদ ও রোগ দূর হয়ে যায়।
হযরত আনাস ইবনু মালিকা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “হযরত আইয়ূব (আঃ) আঠারো বছর পর্যন্ত ঐ রোগে পরিবেষ্টিত থাকেন। তাঁর নিকটের ও দূরের সব আত্মীয় স্বজন তাঁর থেকে সরে পড়ে। শুধুমাত্র তার দুই বিশিষ্ট ভাই তার কাছে সকাল সন্ধ্যায় আসতো। তাদের একজন অপরজনকে বলেঃ “জেনে রেখো যে, অবশ্যই আইয়ূব (আঃ) এমন পাপ করেছেন, যে পাপ সারা বিশ্বে কেউ করে নাই। তার একথা শুনে তার সঙ্গী তাকে বলে, তুমি এটা কি করে বললে?” সে উত্তরে বলেঃ “তাই যদি না হবে তবে সুদীর্ঘ আঠারো বছর গত হয়ে গেল তুবও আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর রোগ হতে তাকে আরোগ্য দান করছেন না কেন?” অতঃপর সন্ধ্যায় যখন তারা দু’জন তার কাছে আসলো তখন ঐ লোকটি আর ধৈর্য ধরতে পারলো না। বরং তাঁর কাছে ঐ লোকটির কথা বর্ণনা করে দিলো। তখন হযরত আইয়ূব (আঃ) তাকে বললেনঃ “তুমি যা বলছে তা আমি জানি না। তবে মহামহিমান্বিত আল্লাহ জানেন যে, রাস্তায় চলার সময় যখন আমি দু’জন লোককে ঝগড়া করতে দেখতাম এবং তাদের কাউকেও আল্লাহর নামে শপথ করতে শুনতাম তখন আমি এই কাজটি অবশ্যই করতাম যে, বাড়ী গিয়ে তার কসমের কাফফারা আমি নিজের পক্ষ থেকে আদায় করে দিতাম। তা আমি এই আশংকায় করতাম যে, সে হয় তো অন্যায়ভাবে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে থাকবে। (এ হাদীসটি ইবনু হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আইয়ুব (আঃ) এই রোগে এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীর হাত ধরে প্রস্রাব ও পায়খানার জন্যে যেতেন। একদা তাঁর (প্রস্রাব বা পায়খানার) প্রয়োজন হয়। তিনি স্বীয় স্ত্রীকে ডাক দেন। কিন্তু তার আসতে বিলম্ব হয়। ফলে তাঁর অত্যন্ত কষ্ট হয়। তৎক্ষণাৎ আকাশ থেকে শব্দ আসেঃ “তুমি তোমার পা দ্বারা ভূমিতে আঘাত কর, এই তো গোসলের সুশীতল পানি আর পানীয়। তুমি এই পানি পান কর এবং তাতে গোসলও কর। (এ হাদীসটি মার’ হওয়া খুবই গরীব)
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, তখনই আল্লাহ তাআলা জান্নাত হতে তাঁর জন্যে হুল্লা (পোষাক বিশেষ) পাঠিয়ে দেন। ওটা পরিধান করে তিনি এক প্রান্তে একাকী বসে পড়েন। যখন তার স্ত্রী আগমন করেন তখন তিনি তাকে চিনতে না পেরে তাকেই জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর বান্দা! এখানে একজন রুগ্ন, দুর্বল ও শক্তিহীন ব্যক্তি ছিলেন। তার কি হলো তা আপনি বলতে পারেন কি? তাঁকে বাঘে খেয়ে ফেলে নাইতো? অথবা কুকুরে নিয়ে যায় নাই তো?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “না, না। ঐ রুগ্ন ব্যক্তি আইয়ুব (আঃ) আমিই তো।” আপনি আমার সাথে রসিকতা করছেন কেন?” তিনি বলেনঃ “না, না। আমিই আইয়ূব (আঃ)। আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। তিনি আমাকে আমার প্রকৃত রূপ ও ঔজ্জ্বল্যও ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মাল ধনও তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তাঁর সন্তানদেরকে এবং তাদের সাথে অপরাপর সম্পদগুলিও তিনি ফিরিয়ে পান। ওয়াহীর মাধ্যমে তাকে এ সুসংবাদও দেয়া হয়েছিল ও বলা হয়েছিলঃ “তুমি তোমার সহচর ও পরিবার পরিজনদের পক্ষ হতে কুরবানী এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা, তারা তোমার ব্যাপারে আমার নাফরমানী করেছিল।”
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা যখন হযরত আইয়ূবকে (আঃ) আরোগ্য দান করেন তখন তিনি তার উপর সোনার ফড়িং সমূহ বর্ষণ করেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) তখনও গুলি হাতে ধরে ধরে কাপড়ে জমা করতে শুরু করেন। ঐ সময় তাকে বলা হয়ঃ “হে আইয়ুব (আঃ)! এখনও তুমি পরিতৃপ্ত হওনি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আপনার রহমত হতে কে পরিতৃপ্ত হতে পারে। (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) কান করেছেন। এর মৃণা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে)
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তাকে তার পরিবার পরিজন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) তে বলেন যে, ঐ লোকদেরকেই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কারো কারো ধারণামতে তার স্ত্রীর নাম ছিল রহমত। এই উক্তি যদি এই আয়াত দ্বারা বুঝা হয়ে থাকে তবে তো এটা বহু দূরের বিষয়। আর যদি আহলে কিতাব হতে নেয়া হয়ে থাকে তবে এটা সত্য বা মিথ্যা কোনটাই বলা যাবে না। ইবনু আসাকির (রাঃ) তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে হযরত আইয়ুবের (আঃ) স্ত্রীর নাম বলেছেনঃ লাইয়া। তিনি হলেন লাইয়া বিতে মীশা’ ইবনু ইউসুফ ইবনু ইয়াকূব ইবনু ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (আঃ)। একথাও বলা হয়েছে যে, হযরত লাইয়া ছিলেন হযরত ইয়াকুবের (আঃ) কন্যা এবং হযরত আইয়ুবের (আঃ) স্ত্রী। তিনি হযরত আইয়ুবের (আঃ) সাথে সানিয়া নামক স্থানে ছিলেন।
হযরত মুজাহিদ (রাঃ) বলেন যে, তাকে বলা হয়ঃ “হে আইয়ূব (আঃ)! তোমার আহ্ল (পরিবার পরিজন) সব জান্নাতী। তুমি যদি চাও তবে তাদের সবাইকে দুনিয়ায় এনে দিই, আর যদি চাও তবে তাদেরকে তোমার জন্যে জান্নাতেই রেখে দিই এবং প্রতিদান হিসেবে দুনিয়ায় তোমার তাদের অনুরূপ প্রদান করি।” তিনি বললেনঃ ‘না, বরং তাদেরকে জান্নাতেই রেখে দিন। তখন তাদেরকে জান্নাতেই রেখে দেয়া হয় এবং দুনিয়ায় তাঁকে তাদের অনুরূপ প্রতিদান দেয়া হয়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা ছিল আমার বিশেষ রহমত এবং ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ। এসব কিছু এজন্যেই হলো যে, বিপদে পতিত ব্যক্তিরা যেন হযরত আইয়ুবের (আঃ) নিকট হতে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং ধৈর্য হারা হয়ে যেন অকৃতজ্ঞ না হয়ে যায়। আর লোকেরা তাদেরকে খারাপ বান্দা বলে ধারনা না করে। হযরত আইয়ূব (আঃ) ছিলেন ধৈর্যের পর্বত স্বরূপ এবং স্থিরতার নুমনা ছিলেন। আল্লাহর তাকদীরের লিখন ও তাঁর পরীক্ষার উপর মানুষের ধৈর্য ধারণ করা উচিত। এতে যে তাঁর কি হিকমত বা রহস্য নিহিত রয়েছে তা মানুষের জানা নেই।
৮৫-৮৬ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত ইসমাঈল (আঃ) ছিলেন হযরত ইবরাহীম খলীলের (আঃ) পুত্র। সূরায়ে মারইয়ামে তাঁর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইদরীসের (আঃ) বর্ণনা গত হয়েছে। যুল কিফলকে বাহ্যতঃ নবীরূপেই জানা যাচ্ছে। কেন না, নবীদের বর্ণনায় তার নাম এসেছে। কিন্তু লোকেরা বলেছেন যে, তিনি নবী ছিলেন না, বরং একজন সৎ লোক ছিলেন। তিনি তাঁর যুগের বাদশাহ ও ন্যায় বিচারক। ইমাম ইবনু জারীর (রাঃ) এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেন। নাই। সুতরাং এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
মুজাহিদ (রাঃ) বলেন যে, তিনি একজন সৎ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার যুগের নবীদের চুক্তি ও অঙ্গীকার করেছিলেন এবং ওর উপর প্রতিষ্ঠি ত ছিলেন। কওমের মধ্যে তিনি ন্যায় বিচার করতেন। বর্ণিত আছে যে, যখন হযরত ইয়াসাআ’ (আঃ) খুবই বৃদ্ধ হয়ে যান তখন তিনি নিজের জীবদ্দশাতেই তার একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করার ইচ্ছা করেন। তিনি তার আমল দেখতে চান। সূতরাং তিনি জনগণকে একত্রিত করেন এবং বলেনঃ “তিনটি প্রস্তাব যে ব্যক্তি সমর্থণ করবে তাকে আমি খিলাফত বা প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবো। প্রস্তাব তিনটি এই যে, সে সারাদিন রোযা রাখবে, সারা রাত দাড়িয়ে ইবাদত করবে এবং কখনো রাগান্বিত হবে না।’ তার একথা শুনে একটি লোক ছাড়া আর কেউই পঁড়ালো না। যে লোকটি দাঁড়ালো তাঁকে মানুষ হাল্কা মর্যাদার লোক মনে করতো। তিনি দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ “অর্থাৎ তুমি দিনে রোযা রাখবে, রাত্রে তাহাদের নামায পড়বে এবং কারো উপর রাগ করবে নাঃ” লোকটি উত্তর করলেনঃ “হ” হযরত ইয়াসা’আ বললেনঃ “আচ্ছা, আজকে তোমরা চলে যাও, কালকে আবার একত্রিত। হও।” পরদিনও তিনি মজলিসে সাধারণভাবে প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ঐ লোকটি ছাড়া আর কেউই দাঁড়ালো না। সুতরাং তিনি তাকেই খলীফা বা প্রতিনিধি নির্বাচন করলেন। এখন শয়তান ছোট ছোট শয়তানদেরকে এই সম্রান্ত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে পাঠাতে শুরু করলো। কিন্তু তারা তাকে কোন ক্রমেই বিভ্রান্ত করতে পারলো না। তখন ইবলীস নিজেই চললো। ঐ বুযুর্গ লোকটি দুপুরে বিশ্রামের জন্যে সবে মাত্র শুয়েছেন এমন সময় ইবলীস শয়তান তার দরজার কড়া নাড়তে শুরু করে। লোকটি জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কে?” ইবলীস বলতে শুরু করলোঃ “আমি একজন অত্যাচারিত ব্যক্তি। আমার কওমের একটি লোক আমার উপর জুলুম করেছে। সে আমার সাথে এটা করেছে, ওটা করেছে। এভাবে সে দীর্ঘ বর্ণনা দিতে থাকে। সে তার বর্ণনা শেষ করতেই চায় না। তাঁর ঘুমাবার সময়টুকু তার সাথেই কেটে যায়। হযরত যুলকিফল (অর্থাৎ ঐ সম্রান্ত লোকটি) দিন রাত্রির মধ্যে শুধু এই সময়টুকুতে সামান্য কিছুক্ষণের জন্য ঘুমাতেন। তিনি তাকে বললেনঃ “তুমি সন্ধ্যায় এসো, তোমার প্রতি ন্যায় বিচার করা হবে। অতঃপর সন্ধ্যায় তিনি বিচার করতে বসলেন তখন চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে ইবলীসকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোন দিকেই তাকে দেখা গেল না। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই বাইরে গিয়ে তাকে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথায়ও তাকে পেলেন না। পর দিন সকালেও সে এলো না। আবার যেমনই তিনি দুপুরে সামান্য বিশ্রামের জন্যে শুয়েছেন তখনই সে দরজায় করাঘাত করতে শুরু করেছে। তিনি দরজা খুলে দেন এবং তাকে বলেনঃ “আমি তো তোমাকে সন্ধ্যায় ডেকে ছিলাম এবং তোমার জন্য অপেক্ষমান ছিলাম, তখন তুমি আস নাই কেন?” সে উত্তরে বলেঃ “ জনাব! কি আর বলবো? আমি আপনার কাছে আসার ইচ্ছা করেছি এমন সময় আমার হক নষ্টকারী লোকটি আমাকে অনুরোধ করে বলেঃ “তুমি যেয়ো না, আমি তোমার প্রাপ্য তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।”কাজেই আমি এলাম না। কিন্তু এখন আবার সে অস্বীকার করেছে।” এভাবে আজকেও বহু লম্বা চওড়া বর্ণনা শুরু করে দেয়। সুতরাং আজও তার ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। এবারও তিনি তাকে সন্ধ্যায় আসতে বলেন। সন্ধ্যায় আবার তিনি তার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু সে আসলো না তৃতীয় দিন তিনি একজন দ্বাররক্ষী নিযুক্ত করে তাকে বলে দিলেনঃ “দেখো, আজ যেন কেউই আমার দরজায় করাঘাত না করে। উপুর্যপরি কয়েকদিন কাহিল হয়ে পড়েছি। একথা বলে তিনি সবে মাত্র শুয়েছেন এমন সময় আবার ঐ বিতাড়িত শয়তান এসে পড়ে। দ্বাররক্ষী তাকে বাধা দেয়। কিন্তু সে এক তাকের মধ্য দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে এবং ভিতর থেকে দরজায় করাঘাত করতে শুরু করে দেয়। তিনি তখন উঠে দ্বার রক্ষীকে বলেনঃ “আমি তোমাকে বলে দেয়ার পরেও কেন তুমি একে দরজায় আসতে দিলে?” দ্বার রক্ষী উত্তরে বললোঃ কেউ তো যায় নাই?” এবার তিনি ভালরূপে দেখে শুনে। বুঝতে পারলেন যে, দরজা তো বন্ধই রয়েছে, আবার ভিতরে লোক প্রবেশ করলো কিরূপে? কাজেই এটা শয়তান ছাড়া কেউই নয়। ঐ সময় শয়তান তাকে সম্বোধন করে বললোঃ “হে আল্লাহর ওয়ালী! আমি আপনার নিকট পরাজিত হয়েছি। না আপনি রাত্রির ইবাদত পরিত্যাগ করেছেন, না এরূপ পরিস্থিতিতে আপনার দ্বার রক্ষী ভৃত্যের উপর রাগান্বিত হয়েছেন।” তখন আল্লাহ তাআলা তার নাম রাখলেন যুলকিফল। কেননা, যে বিষয়ের তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন। (এটা ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতেও কিছু তাফসীরের পর এই ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, বানী ইসরাঈলের মধ্যে একজন কাযী (বিচারক) ছিলেন। যিনি তাঁর মৃত্যুর সময় বলেছিলেনঃ “আমার পরে আমার এ পদের দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে?” উত্তরে এই লোকটি (যুলকি) বলেছিলেনঃ “আমি গ্রহণ করবো।” তখন তার নাম যুলকিফল হয়ে যায়। এতে আছে যে, তাঁর ঘুমাবার সময় হলে প্রহরীরা শয়তানকে আসতে বাধা দেয় সে এতো গোলমান শুরু করে দেয় যে, তিনি জেগে ওঠেন। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিনও এরূপই করে। তখন তিনি তার সাথে যেতে উদ্যত হয়ে বলেনঃ “আমি তোমার সাথে গিয়ে তোমার হক আদায় করে দিচ্ছি।” কিন্তু রাস্তায় গিয়ে সে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।
হযরত আশআরী (রাঃ) মিম্বরের উপর ভাষণ দেয়া অবস্থায় বলেনঃ “যুকিফুল নবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বানী ইসরাঈলের মধ্যে একজন সৎ লোক, যিনি প্রত্যহ একশ (রাকাত নামায পড়তেন। তিনি এই ইবাদতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে তাঁকে যুলকিফল বলা হয়েছে। একটি মুনকাতা (যে হাদীসের সনদের মধ্য হতে মাঝে মাঝে রাবী বা বর্ণনাকারী ছুটে গেছেন। ঐ হাদীসকে মুনকাতা হাদীস বলে) হাদীসে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। মুসনাদে আহমাদে একটি গারীব বা দুর্বল হাদীস বর্ণিত আছে। যাতে কিল এর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাকে যুলকিফুল বলা হয়। নাই। সম্ভবতঃ তিনি এই ফুলকিফুল নন। বরং অন্য কোন লোক হবেন।
হাদীসের ঘটনাটি এই যে, কিক্ল নামক একজন লোক ছিল, যে কোন পাপকার্য হতেই বিরত থাকতো না। একদা সে একটি স্ত্রীলোককে ষাটটি দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) দিয়ে ব্যভিচারের জন্যে উৎসাহিত করে। যখন সে নিজের কামনা চরিতার্থ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায় তখন ঐ স্ত্রীলোকটি ক্রন্দন করতে ও কাপতে শুরু করে দেয়। সে তখন তাকে বলেঃ “আমি তোমার প্রতি কোন বল প্রয়োগ তো করি নাই তথাপি তোমার ক্রন্দনের ও কম্পনের কারণ কি? স্ত্রীলোকটি উত্তরে বলেঃ “আজ পর্যন্ত আমি আল্লাহ তাআলার কোন নাফরমানী করি নাই। কিন্তু আজ আমার অভাব ও দারিদ্র আমাকে এ কুকাজে বাধ্য করছে। (তাই, আমি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করছি ও কম্পিত হচ্ছি)!” তার একথা শুনে কি তাকে বলেঃ “তুমি মাত্র একটি পাপ কার্যের কারণে এতো উদ্বেগ প্রকাশ করছো! অথচ এর পূর্বে তো তুমি এরূপ কোন কাজ কর নাই। তৎক্ষণাৎ সে তাকে ছেড়ে দেয় এবং তার থেকে পৃথক হয়ে যায়। অতঃপর তাকে বলেঃ “যাও, এই দীনারগুলি আমি তোমাকে দান করে দিলাম। আল্লাহর শপথ! আজ হতে আর কোন দিন আমি আল্লাহ তাআলার কোন নাফরমানী করবে না। আল্লাহর কি মহিমা যে, ঐ রাত্রেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। মানুষ সকালে এসে দেখে যে, তার দরজার উপর কুদরতী হরূফে লিখিত রয়েছেঃ “আল্লাহ কিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।”
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#933)
[ رَبى أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
My Lord:”Verily, distress has seized me, and You are the Most Merciful of all those who show mercy.”]
Sura:21
Sura: Al-Anbiyaa
Ayat: 83-86
www.motaher21.net
21:83
وَ اَیُّوۡبَ اِذۡ نَادٰی رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَسَّنِیَ الضُّرُّ وَ اَنۡتَ اَرۡحَمُ الرّٰحِمِیۡنَ ﴿ۚۖ۸۳﴾
And [mention] Job, when he called to his Lord, “Indeed, adversity has touched me, and you are the Most Merciful of the merciful.”
The Prophet Ayub
Allah tells:
وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِن ضُرٍّ
And (remember) Ayub, when he cried to his Lord:”Verily, distress has seized me, and You are the Most Merciful of all those who show mercy.”
21:84
فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ فَکَشَفۡنَا مَا بِہٖ مِنۡ ضُرٍّ وَّ اٰتَیۡنٰہُ اَہۡلَہٗ وَ مِثۡلَہُمۡ مَّعَہُمۡ رَحۡمَۃً مِّنۡ عِنۡدِنَا وَ ذِکۡرٰی لِلۡعٰبِدِیۡنَ ﴿۸۴﴾
So We responded to him and removed what afflicted him of adversity. And We gave him [back] his family and the like thereof with them as mercy from Us and a reminder for the worshippers [of Allah ].
So We answered his call, and We removed the distress that was on him,
Allah tells us about Ayub (Job), and the trials that struck him, affecting his wealth, children and physical health.
He had plenty of livestock, cattle and crops, many children and beautiful houses, and he was tested in these things, losing every thing he had. Then he was tested with regard to his body, and he was left alone on the edge of the city and there was no one who treated him with compassion apart from his wife, who took care of him. It was said that it reached the stage where she was in need, so she started to serve people (to earn money) for his sake. The Prophet said:
أَشَدُّ النَّاسِ بَلَءً الاَْنْبِيَاءُ ثُمَّ الصَّالِحُونَ ثُمَّ الاَْمْثَلُ فَالاَْمْثَل
The people who are tested the most severely are the Prophets, then the righteous, then the next best and the next best.
According to another Hadith:
يُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى قَدْرِ دِينِهِ فَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ صَلَبَةٌ زِيدَ فِي بَلَيِه
A man will be tested according to his level of religious commitment; the stronger his religious commitment, the more severe will be his test.
The Prophet of Allah, Ayub, upon him be peace, had the utmost patience, and he is the best example of that.
Yazid bin Maysarah said:
“When Allah tested Ayub, upon him be peace, with the loss of his family, wealth and children, and he had nothing left, he started to focus upon the remembrance of Allah, and he said:
`I praise You, the Lord of lords, Who bestowed His kindness upon me and gave me wealth and children, and there was no corner of my heart that was not filled with attachment to these worldly things, then You took all of that away from me and You emptied my heart, and there is nothing to stand between me and You. If my enemy Iblis knew of this, he would be jealous of me.’
When Iblis heard of this, he became upset. And Ayub, upon him be peace, said:
`O Lord, You gave me wealth and children, and there was no one standing at my door complaining of some wrong I had done to him. You know that. I used to have a bed prepared for me, but I forsook it and said to myself:You were not created to lie on a comfortable bed. I only forsook that for Your sake.”‘
This was recorded by Ibn Abi Hatim.
Ibn Abi Hatim recorded from Abu Hurayrah that the Prophet said:
لَمَّا عَافَى اللهُ أَيُّوبَ أَمْطَرَ عَلَيْهِ جَرَادًا مِنْ ذَهَبٍ فَجَعَلَ يَأْخُذُ مِنْهُ بِيَدِهِ وَيَجْعَلُهُ فِي ثَوْبِهِ قَالَ فَقِيلَ لَهُ يَا أَيُّوبُ أَمَا تَشْبَعُ قَالَ يَا رَبِّ وَمَنْنَيشْبَعُ مِنْ رَحْمَتِك
When Allah healed Ayub, He sent upon him a shower of golden locusts, and he started to pick them up and gather them in his garment. It was said to him, “O Ayub, have you not had enough!”
He said, “O Lord, who can ever have enough of Your mercy!
The basis of this Hadith is recorded in the Two Sahihs, as we shall see below.
…
وَاتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُم مَّعَهُمْ
and We restored his family to him (that he had lost) and the like thereof along with them.
It was reported that Ibn Abbas said:
“They themselves were restored to him.”
This was also narrated by Al-`Awfi from Ibn Abbas.
Something similar was also narrated from Ibn Mas`ud and Mujahid, and this was the view of Al-Hasan and Qatadah.
Mujahid said:
“It was said to him, `O Ayub, your family will be with you in Paradise; if you want, We will bring them back to you, or if you want, We will leave them for you in Paradise and will compensate you with others like them.’
He said, `No, leave them for me in Paradise.’ So they were left for him in Paradise, and he was compensated with others like them in this world.”
…
رَحْمَةً مِّنْ عِندِنَا
as a mercy from Ourselves,
means, `We did that to him as a mercy from Allah towards him.’
…
وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ
and a Reminder for all those who worship Us.
means, `We made him an example lest those who are beset by trials think that We do that to them because We do not care for them, so that they may take him as an example of patience in accepting the decrees of Allah and bearing the trials with which He tests His servants as He wills.’
And Allah has the utmost wisdom with regard to that.
21:85
وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ اِدۡرِیۡسَ وَ ذَاالۡکِفۡلِ ؕ کُلٌّ مِّنَ الصّٰبِرِیۡنَ ﴿ۚۖ۸۵﴾
And [mention] Ishmael and Idrees and Dhul-Kifl; all were of the patient.
Ismail, Idris and Dhul-Kifl
Allah tells:
وَإِسْمَاعِيلَ وَإِدْرِيسَ وَذَا الْكِفْلِ كُلٌّ مِّنَ الصَّابِرِينَ
وَأَدْخَلْنَاهُمْ فِي رَحْمَتِنَا إِنَّهُم مِّنَ الصَّالِحِينَ
21:86
وَ اَدۡخَلۡنٰہُمۡ فِیۡ رَحۡمَتِنَا ؕ اِنَّہُمۡ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۸۶﴾
And We admitted them into Our mercy. Indeed, they were of the righteous.
And (remember) Ismail, Idris and Dhul-Kifl:All were from among the patient. And We admitted them to Our mercy. Verily, they were of the righteous.
Ismail was the son of Ibrahim Al-Khalil, peace be upon them both. He has already been mentioned in Surah Maryam, where mention was also made of Idris.
From the context and the fact that Dhul-Kifl is mentioned alongside Prophets, it appears that he was also a Prophet. Others say that he was a righteous man, a just king and a fair judge.
Ibn Jarir refrained from making any decisive comment.
And Allah knows best
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran