أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৫৫)
[ الۡفُلۡکِ تُحۡمَلُوۡنَ
নৌযানে আরোহণও করে থাকো।]
সূরা:- আল্-মুমিনূন।
সুরা:২৩
১২-২২ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৩:১২
وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ سُلٰلَۃٍ مِّنۡ طِیۡنٍ ﴿ۚ۱۲﴾
নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির উপাদান হতে।
২৩:১৩
ثُمَّ جَعَلۡنٰہُ نُطۡفَۃً فِیۡ قَرَارٍ مَّکِیۡنٍ ﴿۪۱۳﴾
তারপর তাকে একটি সংরক্ষিত স্থানে টপ্কে পড়া ফোঁটায় পরিবর্তিত করেছি,
২৩:১৪
ثُمَّ خَلَقۡنَا النُّطۡفَۃَ عَلَقَۃً فَخَلَقۡنَا الۡعَلَقَۃَ مُضۡغَۃً فَخَلَقۡنَا الۡمُضۡغَۃَ عِظٰمًا فَکَسَوۡنَا الۡعِظٰمَ لَحۡمًا ٭ ثُمَّ اَنۡشَاۡنٰہُ خَلۡقًا اٰخَرَ ؕ فَتَبٰرَکَ اللّٰہُ اَحۡسَنُ الۡخٰلِقِیۡنَ ﴿ؕ۱۴﴾
এরপর সেই ফোঁটাকে জমাট রক্তপিন্ডে পরিণত করেছি, তারপর সেই রক্তপিন্ডকে মাংসপিন্ডে পরিণত করেছি, এরপর মাংসপিন্ডে অস্থি-পঞ্জর স্থাপন করেছি, তারপর অস্থি-পঞ্জরকে ঢেকে দিয়েছি গোশত দিয়ে, তারপর তাকে দাঁড় করেছি স্বতন্ত্র একটি সৃষ্টি রূপে। কাজেই আল্লাহ বড়ই বরকত সম্পন্ন, সকল কারিগরের চাইতে উত্তম কারিগর তিনি।
২৩:১৫
ثُمَّ اِنَّکُمۡ بَعۡدَ ذٰلِکَ لَمَیِّتُوۡنَ ﴿ؕ۱۵﴾
এরপর তোমাদের অবশ্যই মরতে হবে,
২৩:১৬
ثُمَّ اِنَّکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تُبۡعَثُوۡنَ ﴿۱۶﴾
তারপর কিয়ামতের দিন নিশ্চিতভাবেই তোমাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে।
২৩:১৭
وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا فَوۡقَکُمۡ سَبۡعَ طَرَآئِقَ ٭ۖ وَ مَا کُنَّا عَنِ الۡخَلۡقِ غٰفِلِیۡنَ ﴿۱۷﴾
নিশ্চয় আমি তোমাদের ঊর্ধ্বে সৃষ্টি করেছি সপ্ত স্তর এবং আমি সৃষ্টি বিষয়ে অসতর্ক নই।
২৩:১৮
وَ اَنۡزَلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءًۢ بِقَدَرٍ فَاَسۡکَنّٰہُ فِی الۡاَرۡضِ ٭ۖ وَ اِنَّا عَلٰی ذَہَابٍۭ بِہٖ لَقٰدِرُوۡنَ ﴿ۚ۱۸﴾
আমি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করি পরিমিতভাবে, অতঃপর আমি তা মাটিতে সংরক্ষিত করি। আর আমি ওকে অপসারিত করতেও নিশ্চিতভাবে সক্ষম।
২৩:১৯
فَاَنۡشَاۡنَا لَکُمۡ بِہٖ جَنّٰتٍ مِّنۡ نَّخِیۡلٍ وَّ اَعۡنَابٍ ۘ لَکُمۡ فِیۡہَا فَوَاکِہُ کَثِیۡرَۃٌ وَّ مِنۡہَا تَاۡکُلُوۡنَ ﴿ۙ۱۹﴾
অতঃপর আমি ওটা দ্বারা তোমাদের জন্য খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করি; এতে তোমাদের জন্য আছে প্রচুর ফল; আর তা হতে তোমরা আহার করে থাক।
২৩:২০
وَ شَجَرَۃً تَخۡرُجُ مِنۡ طُوۡرِ سَیۡنَآءَ تَنۡۢبُتُ بِالدُّہۡنِ وَ صِبۡغٍ لِّلۡاٰکِلِیۡنَ ﴿۲۰﴾
আর সিনাই পাহাড়ে যে গাছ জন্মায় তাও আমি সৃষ্টি করেছি তা তেল উৎপাদন করে এবং আহারকারীদের জন্য তরকারীও।
২৩:২১
وَ اِنَّ لَکُمۡ فِی الۡاَنۡعَامِ لَعِبۡرَۃً ؕ نُسۡقِیۡکُمۡ مِّمَّا فِیۡ بُطُوۡنِہَا وَ لَکُمۡ فِیۡہَا مَنَافِعُ کَثِیۡرَۃٌ وَّ مِنۡہَا تَاۡکُلُوۡنَ ﴿ۙ۲۱﴾
আর প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্য গবাদী পশুদের মধ্যেও একটি শিক্ষা রয়েছে। তাদের পেটের মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকে একটি জিনিস আমি তোমাদের পান করাই এবং তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে আরো অনেক উপকারিতাও আছে, তাদেরকে তোমরা খেয়ে থাকো।
২৩:২২
وَ عَلَیۡہَا وَ عَلَی الۡفُلۡکِ تُحۡمَلُوۡنَ ﴿٪۲۲﴾
এবং তাদের ওপর ও নৌযানে আরোহণও করে থাকো।
১২-২২ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মানবসৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক অবস্থাসমূহ : মােমেনদের গুণাবলী বর্ণনা শেষে আলােচনার গতিধারা ফিরে যাচ্ছে মানব জীবনের মধ্যে ঈমানের বিভিন্ন প্রমাণাদি বর্ণনার দিকে, তার অস্তিত্ব ও উন্নতির উপায় নিরূপণের দিকে। অবশেষে আলােচনা এসেছে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হয়ে যিন্দেগীতে পদার্পণ করতে হবে সে সম্পর্কে এবং এ উভয় জীবনের মধ্যে যে কি সম্পর্ক রয়েছে এবং কি ভাবে এ সম্পর্ককে নিবিড় করা যায় সে সম্পর্কে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আমি মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর তাকে শুক্রবিন্দুতে পরিণত করে স্থাপন করেছি এক সংরক্ষিত আঁধারে… অতপর কেয়ামতের দিন তােমাদেরকে আবার জীবিত হয়ে উঠতে হবে।'(আয়াত ১২-১৬) প্রথমত, এভাবে সৃষ্টির সূত্রপাত হওয়ায় এবং পরবর্তীতে ওপরে বর্ণিত নিয়মে অবিরতভাবে সৃষ্টির কাজ চলতে থাকায়, সৃষ্টিকর্তা যে আছেন এবং তাঁরই ইচ্ছায় যে এ সৃষ্টি কাজ বিরতিহীনভাবে চলছে তা পরিষ্কার বুঝা যায় এবং পরবর্তীতে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে মানুষের চেষ্টা তদ্বীরের দ্বারা এ ধরনের কোনাে কাজ সাধিত হয় না। সুতরাং, একথা চিন্তা করার কোনাে সুযােগ নেই যে, এসব কিছু হঠাৎ করে পয়দা হয়ে গেছে অথবা খামখেয়ালী প্রকৃতির ইচ্ছায় এবং বিনা পরিকল্পনায় এলােমেলােভাবে ও কোনাে নিয়ম শৃংখলা ছাড়াই এ সৃষ্টির কাজ চলছে। এর পেছনে কোনাে উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা নেই। অথচ আমরা সৃষ্টি রাজ্যের মধ্যে তাকালে দেখতে পাই সেখানে কোনাে ত্রুটি নেই কোনাে অনিয়ম নেই, আপনা থেকেই এমন ত্রুটিহীনভাবে সব কিছু চলছে এটা কোনাে সুস্থ ও বিবেকবান ব্যক্তি কিভাবে মেনে নিতে পারে। সুতরাং, এ সত্য মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনাে উপায় থাকে না যে এ মহা সৃষ্টির পেছনে রয়েছে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহর ইচ্ছা ও সুপরিকল্পিত এক ব্যবস্থাপনা, যার অধীনে পরিপূর্ণ এক শৃংখলার মধ্যে এসব কিছু চলছে। সার্বক্ষণিকভাবে সব কিছু এই একইভাবে চলতে থাকা যে কোনাে সূক্ষদর্শী মানুষের দৃষ্টিতে এ সত্য তুলে ধরবে যে এসব কিছুর স্রষ্টা একজনই এবং তাদেরকে আহ্বান জানাবে যেন সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র তার দিকেই রুজু করা হয় এবং তাকেই সব কিছুর বিধানদাতা মেনে নিয়ে তাঁর হুকুম মত চলার জন্যে সবাই প্রস্তুত হয়ে যায়। পূর্ব অধ্যায়ে বর্ণিত মােমেনদের এসব গুণাবলী ও তৎপরতাই বিশ্ব মানবতাকে পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাকে দুনিয়া আখেরাতে উভয় স্থানে সাফল্যমন্ডিত করে, আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমূহই হচ্ছে সেই মূল বিষয় যা নিয়ে এই সূরায়ে মােমেনুনের দুটি অধ্যায়ে আলােচনা করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আমি তাকে মাটির নির্যাস দ্বারা সৃষ্টি করেছি’ অর্থাৎ, আলােচ্য এ আয়াতটি মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির বিভিন্নমুখী সম্ভাবনা সম্পর্কে আভাস দিচ্ছে বিশেষ কোনাে একটি গন্ডীর মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়নি এজন্যে মানুষের মধ্যে এসব সম্ভাবনা কত বেশী তা কেউই নিরূপণ করতে পারে না, তার সাধ্যানুযায়ী সে চেষ্টা জারি রাখবে এবং যত প্রকার পদ্ধতি সে প্রয়োগ করতে পারে সেই সকল পদ্ধতিতেই সে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এর ফলে সে অবশ্যই তেমনি উপকৃত হবে যেমন করে কাদামাটি থেকে সে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিলাে। মানুষ জন্মের প্রথম উৎসই হচ্ছে এই কাদা মাটি, এটাই হচ্ছে মানব সৃষ্টির প্রথম অবস্থা, তারপর পূর্ণাংগ মানুষে পরিণত হওয়া এটাই তার ক্রমােন্নতির শেষ অবস্থা… এই তথ্যটিই আমরা মহান আল্লাহর সন্দেহমুক্ত গ্রন্থ আল কোরআন থেকে জানতে পারি। মানব সৃষ্টির রহস্য জানার জন্যে মানুষের তৈরী কোনাে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান গবেষণায় আমরা বিশ্বাসী নই, আমরা এ বিষয়ে কারাে কাছে বাড়তি কিছু জানতেও চাই না। জীব জন্তু পয়দা হলাে কিভাবে সে বিষয়েও মানুষের জ্ঞান-গবেষণা আমরা মানি না, আল্লাহর প্রেরিত রসূলদেরকে আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতিনিধি বলে বুঝেছি এবং মেনেও নিয়েছি। অবশ্যই আল কোরআন উপরোক্ত বিষয়টিকে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে, যাতে করে আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞান গবেষণা করার জন্যে আমাদের সামনে সুনির্দিষ্ট পথ উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং সে কাদা মাটি থেকে মানব সৃষ্টির এই জটিল ধারা কিভাবে এগিয়ে গেলাে তার পর্যায়ক্রমিক রহস্য উদ্ঘাটনে আমরা সক্ষম হই এবং এর বাইরে আরো বিস্তারিতভাবে জানার জন্যে অন্য কোনাে পদ্ধতি নিয়ে আমরা যেন মাথা না ঘামাই, কেননা তাতে সৃষ্টির আরাে বড় সত্যসমূহকে জানার পথে আমরা কোনাে সহযােগিতা পাবাে না। এখন দেখুন, এই উর্বর মস্তিষ্ক মানুষ প্রদত্ত বৈজ্ঞানিক মতবাদ মানব সৃষ্টি ও তার অগ্রগতি সম্পর্কে আল্লাহর দেয়া তথ্য মানার পথে এক বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ সে মতবাদ একথাকে নাকচ করছে যে মানুষকে কাদা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ সত্যকে অস্বীকার করার কারণে মানুষ নানা প্রকার ভুলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে। আল কোরআন সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে এর থেকে আর বেশী কিছু জানায়নি, সুতরাং আল কোরআনের বর্ণনার ওপর অন্য কারাে মত শুনতে ও মানতে গিয়ে আমরা আল্লাহর কেতাব প্রদত্ত চেতনা বিপর্যস্ত করতে চাইনে… কাদা মাটি থেকে মানুষের কায়ায় আসা, তার মধ্যে রূহকে প্রবিষ্ট করানাে, তার মধ্যে রক্ত মাংস ও বীর্য সৃষ্টি এবং এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাতৃ জরায়ুতে সে বীর্যের দ্বারা নতুন প্রজন্মের উৎপত্তি- এসব কার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় সম্ভব হয়েছে। এসব বৈজ্ঞানিক জ্ঞান-গবেষণা সব ব্যর্থ হয়ে যেতাে যদি না আল্লাহর কেতাব থেকে গৃহীত তথ্যের সাহায্য না নেয়া হতাে! এটা নিশ্চিত বিদগ্ধ চিত্তের অধিকারী মানুষের কাছে আল্লাহর কেতাব প্রদত্ত তথ্য বহির্ভূত আজকের মানুষের জ্ঞান গবেষণার দাবী সব হেঁয়ালী বলে মনে হবে। তথ্যানুসন্ধানের মাল মশলা ও পদ্ধতিসমূহ মানুষের হাতে যা আছে তা এতােই সীমাবদ্ধ যে তার অনুসরণে যখন মানুষ পথ চলতে চায় তখন সে এমন এক প্রহেলিকার জালে আবদ্ধ হয়ে যায় যা ছিন্ন করে সত্য পথ প্রাপ্তি তার জন্যে সুকঠিন হয়ে পড়ে। আল কোরআন এসব সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে বিভিন্ন স্থানে সংক্ষেপে এভাবে বলেছে,… তিনি মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন কাদামাটি দ্বারা… এরপর যে পর্যায়ক্রমিক ধারায় এ সৃষ্টি পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা তাে দূরের কথা, কোনাে ইংগিতও দেয়া হয়নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোরআনে বর্ণিত সকল কথার সার সংক্ষেপ যা জানা গেছে তা হচ্ছে মানব সৃষ্টি বাস্তবে এসেছে কাদা মাটির সারাংশ বা নির্যাস থেকে। অতপর দেখা যাচ্ছে আয়াতের শেষাংশটি, মানব সৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক অবস্থাসমূহকে এক বিশেষ কারণে এখানে অতি সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছে। মাটি থেকে পর্যায়ক্রমে পূর্ণাংগ মানুষ কেমন করে অস্তিত্বে এলাে, সে বিষয়ে আল কোরআন একেবারেই নিশ্চুপ, যা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর কারণ হচ্ছে এ বিষয়ের জ্ঞান দান করা আল কোরআনের কোনাে মূল লক্ষ্য নয়। এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবক্তারা পরস্পর বিরােধী অনেক কথা বলেছে। এক একজন এক এক কথা বলেছে, যেহেতু বাস্তব জীবনে এর কোনাে প্রয়ােজন নেই, নেই এর সত্যিকারের কোনাে প্রয়ােগ- এজন্যে পর্যায়ক্রমে যে যতাে কথাই বলেছে তা প্রায় সবই মানুষের স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে, এভাবে কতাে কথাই মানুষ ভেবেছে বলেছে সে সবই এক এক করে মানুষ ভুলেও গেছে। পরবর্তীকালে কেউ ওগুলাে জানতেও পারেনি। আরাে হয়তাে অন্যান্য আরাে বহু কারণ আছে, যার জন্যে ওসব নিয়ে আর কেউ কোনাে ঘাটাঘাটিও করেনি, কিন্তু এ বিষয়ে আল কোরআনের অনুসৃত পদ্ধতি ও মানব বুদ্ধি সঞ্চিত মতবাদের মধ্যে যে বিশেষ পার্থক্যটি পরিলক্ষিত হয় তা হচ্ছে আল কোরআন মানুষকে সম্মান দিয়েছে, দিয়েছে পরস্পরের মধ্যে মর্যাদাবােধ, আর জানিয়েছে যে, এই মানুষের কায়ার মধ্যে আল্লাহর সৃষ্ট রূহ (আত্মা বা প্রাণ শক্তি) থেকে কিঞ্চিৎ ফুকে দিয়ে প্রবিষ্ট করানাে হয়েছে, যা মাটির নির্যাস থেকে তৈরী সে দেহটিকে বানিয়েছে জীবন্ত ও গতিশীল মানুষ এবং তাকে সেই সব বৈশিষ্ট্য দান করেছে যার কারণে সে হয়েছে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত একটি মানুষ। পশু থেকে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্ণীত হয়েছে আর এই পর্যায়ে এসে দেখা যায় ইসলামী চিন্তাধারা থেকে বস্তুবাদী মানুষের মতবাদ সম্পূর্ণ পৃথক। যে যাই বলুক না কেন, আল্লাহর কথাই হচ্ছে সঠিক ও সত্য। (মােহাম্মদ কুতুব রচিত ‘আল ইনসানু বায়নাল মাদিয়াতে ওয়াল ইসলাম’ দ্রষ্টবা) এইই হচ্ছে মানব জাতির সৃষ্টির মূল উপাদান… কাদা মাটির নির্যাস… এরপর এই মানব সন্তানদের সৃষ্টি ও বৃদ্ধি শুরু হলাে অন্য আর এক পদ্ধতিতে যা আজ সর্বজন বিদিত, যা প্রকাশ করতে গিয়ে আল কোরআন বলছে, ‘তারপর আমি (শুক্রবিন্দুর আকারে) তাকে এক সুরক্ষিত স্থানে স্থাপন করেছি’… অর্থাৎ অবশ্য সে পয়দা হয়েছে কাদা-মাটির নির্যাস থেকে। এরপর মানব সন্তানদের আগমন ধারা শুরু হলাে ও তাদের বংশ বৃদ্ধির কাজ চলতে থাকলাে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক অমােঘ নিয়মে, আর তা হচ্ছে, নরদেহের পিঠ থেকে নির্গত এক জাতীয় পদার্থ কোনাে নারীর বাচ্চাদানীর মধ্যে স্থান লাভ করে… এখনে উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে… একটিমাত্র পানি জাতীয় পদার্থের ফোটা, না বহু ফোটা প্রকৃত সত্য কথা হচ্ছে, বাচ্চাদানিতে শেষ পর্যন্ত শুক্রবিন্দুর মধ্যে অবস্থিত অদৃশ্য হাজার হাজার শুক্রকীট- এর মধ্য থেকে একটি মাত্র কীট। সেই স্থানের বর্ণনায় এরশাদ হয়েছে, একটি সুরক্ষিত স্থান, অর্থাৎ জরায়ুর দুই পাশের অস্থি দুটির মধ্যবর্তী কোটরগত স্থানের গভীরে, যে স্থানটি শরীরের ঝাকির ক্ষতি থেকে রেহাই পায়, রেহাই পায় সকল প্রকার আঘাত ও ক্ষত থেকে এবং সকল প্রকার কম্পন ও ধাক্কা থেকে! আল কোরআনের ব্যাখ্যায় জানা যায় যে এই বিন্দুটি মানব সৃষ্টির স্তরসমূহের মধ্যে একটি স্তর, যা মানুষের অস্তিত্বের মধ্য থেকে আর একটি অস্তিত্বের আগমনের জন্যে বানানাে হয়েছে, এটাই এক বাস্তব সত্য, কিন্তু এ সত্যকে বুঝতে হলে বেশ কিছু চিন্তা ভাবনার প্রয়ােজন রয়েছে। পূর্ণাংগ এই মানুষটির মধ্যে যতাে প্রকার গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তা সবই বিদ্যমান থাকে সে ক্ষুদ্র শুক্রবিন্দুর মধ্যে। এভাবেই যখন শুক্রবিন্দু ভ্রুণে পরিণত হয় তখন তার মধ্যে সেসব বৈশিষ্ট্যকে আবারও নতুন করে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আবার এই বৈশিষ্ট্যগুলােকেই অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে ফিরিয়ে দেয়া হবে যখন এই মানুষটি পুর্ণাংগ বয়সপ্রাপ্ত হবে। এই শুক্রবিন্দু মাতৃ ডিম্ব কোষের সাথে মিলিত হয়ে রক্ত পিন্ডতে পরিণত হয়ে প্রথম দিকে বাচ্চাদানীর গায়ের সাথে একটি ক্ষুদ্র বিন্দু আকারে লেগে থাকে এবং মাতৃ শরীর থেকে রক্ত আকারে তার খাদ্য পেতে থাকে। আবার এই ক্ষুদ্র বিন্দু একটু বড় হয়ে রক্ত পিন্ডের রূপ নেয়, এরপর এটি পরিণত হয় একটি মাংস পিন্ডে, তারপর এটা মিশ্রিত ঘন রক্ত পিন্ডে রূপান্তরিত হয়। এভাবে ওপরে বর্ণিত শুক্র কীটটি একটি মানব শিশু আকারে পরিণত হয়ে মাতৃ গর্ভে নীরবে বড় হতে থাকে এবং প্রথম প্রথম এর রূপান্তর গ্রহণ করার অবস্থায় সে ভ্রুণটির কোনাে নড়া-চড়া অনুভূত হয় না, এবং নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যখন এই ভ্রুণের নড়াচড়ার সময় এসে যায় তখন তা একটা নির্দিষ্ট গতিতে নড়াচড়া করতে কিন্তু একটুও কসুর করে না। এসময় এ শুক্রকীটের মধ্যে নিহিত শক্তি ধীরে ধীরে তকদীর ও তদ্বীর এর ভাগ্য লিখন নিয়ে বর্ধিত হতে হতে হাড় পরার স্তরে এসে পৌছে যায়। সে অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল কোরআন জানাচ্ছে, ‘তারপর আমি এই পিন্ডকে অস্থিপাজরে পরিণত করি’ অর্থাৎ এইটিই হচ্ছে হাড়কে গােশত দ্বারা পরিধান করানাের স্তর। এজন্যে বলা হচ্ছে, আমি হাড্ডিকে গোশতের পােষাক পরাই এখানে এসে মানুষের বুদ্ধি আর কাজ করতে চায় না, সে রহস্যের কথা চিন্তা করে যে কেমন করে সে প্রলম্বিত ভ্রুণ এক অজানা পদ্ধতিতে এগিয়ে যায় এবং এক অভিনব উপায়ে মানব শিশুতে পরিণত হয়। এ অবস্থায় পৌছুতে কতাে যে সংকটপূর্ণ স্তর পার হতে হয় তা মানুষ বাচ্চা পয়দা না হওয়া পর্যন্ত বুঝতে পারে না, বুঝতে পারে না যে গােশতের কোষের মধ্যে হাড় কিভাবে সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে একথা তো জানা গেছে যে, ভ্রুণের মধ্যে হাড্ডির কোষগুলাে আগে সৃষ্টি হয়, আর হাড্ডির কোষগুলাে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত একটি গােশত কোষও পরিলক্ষিত হয় না। তারপর ভ্রুণের এই পূর্ণাংগ অবস্থা প্রাপ্তির জন্যে হাড্ডির কাঠামাে পূর্ণতা প্রাপ্ত হতে হবে, এইটিই সেই গূঢ় রহস্য- আল কোরআন যার দ্বার উদঘাটন করেছে। জানানাে হচ্ছে, অতপর, ‘আমি গােশত পিন্ডকে অস্থিপাজরে পরিণত করলাম তারপর হাড্ডিকে গােশতের পােষাক পরালাম… তারপর তাকে আমি আর একটি সৃষ্টিতে পরিণত করলাম।’ অর্থাৎ অবশেষে এসব বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মানুষ হয়ে সময়ান্তরে সে গড়ে উঠলাে। মাতৃগর্ভে যখন বাচ্চা ভ্রুণ আকারে থাকে তখন তার শারীরিক কাঠামাে জীব জানােয়ারের ভ্রুণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ থাকে, কিন্তু যখন সে ভূমিষ্ট হয় তখন সে নতুন এক সৃষ্টিতে পরিণত হয়। তারপর যখন ক্রমান্বয়ে এ বাচ্চা বেড়ে ওঠে তখন ধীরে ধীরে তার বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশ পেতে থাকে, পশুর ভ্রুণটি আত্মপ্রকাশ করে পশু হিসাবে, তার মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে না, যা একটি মানব শিশুর মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। মানব শিশুর ভ্রুণ বিশেষ বিশেষ কিছু গুণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে থাকে এবং যখন সে যৌবনে পদার্পণ করে তখন তার গুণাবলী পূর্ণতা লাভ করে এবং তখনই দেখা যায় আল্লাহর কথার বাস্তবতা। এরশাদ হচ্ছে, অতপর আমি তাকে আর এক সৃষ্টিতে পরিণত করি। অর্থাৎ, ভ্রুণ থাকা অবস্থায় তার যে আকার আকৃতি ছিলাে তার থেকে সে ভিন্ন আকৃতি গ্রহণ করে। অপরদিকে পশুর ভ্রুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে পশুই থেকে যায়, তার মধ্যে মানব শিশুর মতাে বৈশিষ্ট্যসমূহ সৃষ্টি হয় না। একারণে পশু পশুই থেকে যায় এবং পশুর আকৃতি প্রকৃতির উর্ধে সে উঠতে পারে না, কিন্তু হাসির ব্যাপার হচ্ছে আত্মগর্বী, উগ্রমস্তিষ্ক, বস্তুবাদী ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সমৃদ্ধ (?) কিছু মানুষ মনে করে যে পশু (বানর) ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে মানুষে পরিণত হয়েছে। বসতে বসতে তার লেজ খসে পড়েছে, অথচ এসব পাগলরা একটুও হিসাব করে না যে বানর শিশু যখন ভূমিষ্ট হয় তখন দুনিয়ার সকল বানর লেজ বিশিষ্ট হয়, কিন্তু কোনােকালে কোনাে মানব শিশুই লেজ বিশিষ্ট হয়নি। তারপর রয়েছে স্বভাব প্রকৃতি, মানব শিশুর ও বানরের স্বভাব প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য চিরদিন একই প্রকার থেকেছে। এভাবে ভ্রুণ থাকাকালে পশু ও মানব ভ্রুণগুলাে আকৃতিতে একই প্রকার হলেও ভূমিষ্ট হওয়ার সময় মানব শিশু ‘ভিন্ন আর এক সৃষ্টিতে পরিণত হয় এবং এরপর যতােই বাড়তে থাকে ততােই তার মধ্যে মানব শিশুর সকল গুণ বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠতে থাকে এবং তার মধ্যে নানা প্রকার যােগ্যতার বিকাশ হয়। তখন সে পরিণত হয় নতুন আর এক সৃষ্টিতে। অবশ্য এটা ঠিক যে, প্রাণী হওয়ার কারণে মানুষ ও পশুর মধ্যে অনেক দিক দিয়েই সাদৃশ্য রয়েছে; এতদসত্তেও এ দুই শ্রেণীর জীবের মধ্যে পার্থক্যসমূহও খুবই স্পষ্ট, যার কারণে মানুষ মানুষই হয় এবং পশু পশুর স্তর থেকে উন্নীত হয়ে কখনাে মানুষের স্তরে পৌছুতে পারে না। এসব মানব সুলভ গুণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে মানবতা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। এসব গুণ বৈশিষ্ট্য আল্লাহরই । এখানে আমাদের ভালো করে বুঝে নিতে হবে, যান্ত্রিক সভ্যতা গড়ে তােলার ক্ষমতা শুধু মানবজাতি পেলেও আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে যন্ত্র দানব বানাননি এবং যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতি সাধনই তার জীবনের মূখ্য বিষয় নয়, বরং নৈতিকতা ও সেসব নৈতিক দায়িত্ববােধ সৃষ্টি করাই এর আসল কথা, যার দ্বারা পশু ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।[মানুষের সৃষ্টি ও অগ্রগতির বর্তমান মতবাদটি গড়ে উঠেছে পরস্পর বিরােধী মূলনীতির ভিত্তিতে, কারণ এই মতবাদের প্রবক্তারা বলতে চায় যে, অন্য জীব জন্তুর উন্নতির মতােই মানুষের অগ্রগতি হয় এবং তারা ধারণা করে যে পশু উন্নতি করতে করতে মানুষে পরিণত হয়েছে, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষ ও পশুর সম্পর্ককে অবাস্তব ও অসম্ভব বলে প্রমাণ করেছে এবং এ কারণেই এটা একটা প্রাচীন ও পরিত্যক্ত মতবাদে পরিণত হয়েছে। আজ সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে অন্য কোনাে পশুই মানব জাতির বৈশিষ্টসমূহের অধিকারী হয়নি। তারা সর্বদাই পশুত্বের স্বভাব প্রকৃতি নিয়েই এখানে বর্তমান রয়েছে। ভারউইন ও অন্য আরাে অনেকে যে মত প্রকাশ করেছে তা আজ সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ তার সুনির্দিষ্ট গুণ বৈশিষ্টসমূহ নিয়ে মানবতা বিকাশ ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং নিজস্ব বৈশিষ্টের কারণে সে মানুষ বলে সর্বকালে পরিচিত হয়ে এসেছে এবং এখনও সে মানুষ বলেই পরিচিত হচ্ছে। এটা যান্ত্রিক উন্নতির ফসল নয়, বরং মানুষের নৈতিক ও অন্যান্য উন্নতির পেছনে বাইরের কোনাে শক্তির অবদান সুস্পষ্ট।-সম্পাদক] এরশাদ হচ্ছে, মহা পবিত্র ও কল্যাণময় আল্লাহ যিনি সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টিকর্তা। একথা সর্ববাদী স্বীকৃত সত্য যে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত সৃষ্টিকর্তা আর কেউ নেই। এমতাবস্থায় সর্বোৎকৃষ্ট বলতে বুঝায় সকল কিছুকে সুন্দরভাবে সৃষ্টিকারী, এখানে অন্যদের তুলনায় তিনি ভালো সৃষ্টিকারী একথা বুঝানা হয়নি। আবারও খেয়াল করুন, ‘আল্লাহ তায়ালা কতাে উত্তম সৃষ্টিকর্তা!’ অর্থাৎ যিনি মানব প্রকৃতির মধ্যে সেসব ক্ষমতা ও যােগ্যতা দিয়েছেন যা ব্যবহার করে সে উন্নতির এই পর্যায়ে পৌছেছে এবং তার এসব যোগ্যতা গড়ে উঠেছে। এমন এক অমােঘ নিয়ম অনুসারে এসব যােগ্যতা গড়ে উঠেছে যার কোনাে দিন কোনাে পরিবর্তন হয় না, যা মুছে যায় না এবং যে নিয়মের বিপরীতও কোনাে নিয়ম কোনাে দিন আসে না। তাতেই তাে মানুষ তার উন্নতি ও অগ্রগতির এই পরিপূর্ণ স্তরে পৌছুতে পেরেছে এবং মানব জীবনের জন্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা সে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে! মানুষ যখন বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও আশ্চর্যজনক আবিষ্কারগুলাের দিকে তাকায় তখন সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, অর্থাৎ যখন মানুষ দেখে যে সে নিজ হাতে সরাসরি কাজ না করে মেশিনের সাহায্যে দ্রুতগতিতে এবং বিস্ময়কর ও নিপুণতার সাথে বহু কঠিন কাজ করতে থাকে তখন আসলেই তার বিষ্ময়ের সীমা থাকে না। এখন চিন্তা করার বিষয় হচ্ছে ভ্রুণের মধ্যে এই পরিবর্তন ও বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করার এই শক্তি ও যােগ্যতা কোত্থেকে এলাে? এক অবস্থা থেকে যখন আর এক অবস্থা আসে তখন যে বিরাট পরিবর্তন দেখা যায়, তার দিকে খেয়াল করলে পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে তার বিরাট পার্থক্য মানুষকে দারুণভাবে বিস্মিত করে, প্রশ্ন জাগে, কোত্থেকে এলাে এসব পরিবর্তন? কার ইচ্ছায় এ রূপান্তর ঘটলাে এবং কেনই বা পর্যায়ক্রমে এসব অবস্থার সৃষ্টি হলো। কিন্তু অত্যাশ্চার্য এসব দৃশ্যের পাশ দিয়ে মানুষ এমনভাবে চোখ বন্ধ করে চলে যায় এবং এগুলাে বুঝা থেকে তারা তাদের অন্তরের দরজাগুলােকে এমনভাবে বন্ধ করে নেয় যে এসব রহস্য তাদের কাছে তিমিরেই থেকে যায়। এর কারণ চিন্তা করতে গেলে বুঝা যায় যে, পৃথিবীর সুখ সম্পদ বেশী বেশী ভােগের আশা তাদেরকে এসব অদ্ভূত ও বিস্ময়কর রহস্য উদঘাটন করার কথা ভুলিয়ে দেয়… এখানে একটি কথা বুঝতে হবে যে এই রূপান্তর, ভাবান্তর এবং প্রকৃতির পরিবর্তন সব কিছুর পেছনে রয়েছে এক এমন মানুষ গড়ার উদ্দেশ্য যা সৃষ্টির বুকে তার অনন্য ভূমিকা রাখবে। সে মানুষ এক জটিল ও অত্যাশ্চর্য সৃষ্টি যার প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যাবে তার জীবনের প্রতিটি স্তর বিস্ময়ে ভরা তার এ ছােট্ট দেহের মধ্যে অফুরন্ত ও অকল্পনীয় এক বিরাট সম্ভাবনার বীজ লুকিয়ে রয়েছে যা উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিচর্যা পেলে এমন বিস্ময়কর অবদান রাখতে পারে, যা পূর্ব থেকে ধারণাও করা যায় না। তার সম্ভাবনাসমূহের সঠিক বিকাশের জন্যে প্রয়ােজন সে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শুক্রকীটের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন। এতােই ক্ষুদ্র সে শুক্রকীট যা খালি চোখে দৃষ্টিগােচর হয় না, তার মধ্যেই পর্যায়ক্রমিক সেসব সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। এভাবে ধাপে ধাপে তার অগ্রগতি ও তার প্রকৃতির রূপান্তর হয়। এভাবেই সে এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায় পৌছে গিয়ে সে পরিণত হয় অভিনব আর এক সৃষ্টিতে। জড় পদার্থ বলে যাকে আমরা বুঝতাম, পর্যায়ক্রমে তা কথা বলতে শুরু করে। এরপর দেখা যায় সব শিশুও এক প্রকার হয় না। এক এক শিশু নিজ নিজ স্বতন্ত্র কিছু গুণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে এগুতে থাকে এবং এদের মধ্যে থেকে অনেক মনীষী বেরিয়ে আসে যারা মানুষকে অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যাদের জ্ঞান গবেষণায়, যাদের উৎকর্ষ সাধনে এবং যাদের সফলতা ও সত্য পথ পরিক্রমায় মানব জীবনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে।
* *মানব জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় : এরপর মানব জীবন পথপরিক্রমা নানা প্রকার অবস্থার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। যে জীবনের সূত্রপাত মাটি থেকে হয়েছিলাে তা মাটির বুকে বিলীন হয়ে একেবারে শেষ হয়ে যায় না, কারণ তার শরীরের মধ্যে মাটি ছাড়া আর একটি উপাদান আছে যা মাটিতে মিশতে পারে না, আর তা হচ্ছে সেই রূহ যা মহান আল্লাহর কাছে থেকে এসেছে, এজন্যে সে রূহ আল্লাহর কাছেই ফিরে যায়। এ রহকে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে পয়দা করা হয়েছে যা দৈহিক কাঠামাে থেকে ভিন্নতর, আর এজন্যে গােশত ও রক্তের পরিণতি থেকে তার পরিণতি আলাদা হয়ে থাকে। আল্লাহর কাছ থেকে আগত রূহ আল্লাহর কাছেই ফিরে যায় এবং সেখানেই শুরু হয় তার দ্বিতীয় জীবন। এরশাদ হচ্ছে, এরপর তােমরা হয়ে যাবে মৃত এবং অবশেষে কেয়ামতের দিনে তােমাদেরকে পুনরায় তােলা হবে। অর্থাৎ, পৃথিবীর জীবন শেষে (দ্বিতীয় জীবনের শুরুতে) এই মৃত্যু আসবে। আর এই দুই জীবন দুনিয়া এবং আখেরাতের মাঝখানের এই সময়টির নাম হচ্ছে বরযখ, মানুষের জীবন পরিসমাপ্তকারী স্তর নয়, বরং এটা হচ্ছে তার জীবনের স্তরসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ স্তর। তারপর আসবে শেষ স্তর এবং এটা শুরু হবে সেই দিন থেকে যেদিন তাকে পুনরায় এ ধরার বুক থেকে উঠানাে হবে। প্রকৃতপক্ষে এসময় থেকেই শুরু হবে তার পূর্ণাংগ জীবনের আসল অধ্যায়, যা পাপ পংকিলময় পার্থিব জীবনের আবিলতা থেকে ভিন্ন হবে অথবা গােশত ও রক্তের চাহিদাসমূহ থেকে পবিত্র হবে, ভয় ও পেরেশানী থেকে, যে কোনাে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন থেকে মুক্ত হবে, কারণ এ অধ্যায়টি হচ্ছে মানব জীবনের জন্যে পূর্ব নির্ধারিত চূড়ান্ত অধ্যায়। তার যে পথ চলার বর্ণনা সূরাটির প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছিলাে এখানে এসে তার জীবন সফরের পরিসমাপ্তি ঘটে। এটাই হচ্ছে মােমেনদের পথ, কিন্তু পার্থিব জীবনে যে ব্যক্তি নিজেকে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে দিয়ে এ পথকে কন্টকাকীর্ণ করে এবং প্রথম জীবনের পরিসমাপ্তিতে আখেরাতের জীবনকে চরম বিপর্যস্ত করে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে সে অবস্থায় সে মানবতার প্রাসাদকে ভেংগে চুরমার করে দেয় এবং নিজের জন্যে জাহান্নামের আগুনকে হালাল করে নিয়ে আগুনের ইন্ধনে পরিণত হয়। সেদিনে জাহান্নামের জ্বালানী হবে পাথর ও মানুষ। একারণেই পাথর ও পাপাচারী মানুষ উভয়ে সে দিনই একই সমান হয়ে যাবে।
*প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান আল্লাহর কিছু অকাট্য নিদর্শন : আবার দেখুন, ঈমানের প্রমাণাদি মানুষের নিজেদের মধ্যে যেমন বিরাজ করছে, তেমনি দিগন্ত ব্যাপী প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা সকল বস্তু ও বিষয়াদির মধ্যেও তা পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, যা মানুষ প্রতিদিন দেখছে ও বুঝছে, কিন্তু তারা এসবের পাশ দিয়ে অবহেলা করে চলে যাচ্ছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, অবশ্যই আমি, তােমাদের ওপর সাতটি পথকে সৃষ্টি করেছি… এর ওপর তােমরা (চলা-ফেরা কর) আর নৌযানগুলােতেও তােমরা আরােহণ করাে।'(আয়াত ১৭-২২)। আলােচ্য প্রসংগে ঈমান আনার জন্যে প্রয়ােজনীয় প্রমাণাদি হাযির করা হয়েছে এবং সমগ্র আলােচনার মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বের লক্ষণসমূহ, তাঁর রহমতের চিহ্নসমূহ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার শক্তি ক্ষমতার নিদর্শনের বর্ণনা সূরাটিকে মহীয়ান করেছে। এখানে আরাে উল্লেখিত হয়েছে মানুষের চেষ্টা তদ্বীরের তাৎপর্য এবং চেষ্টা তদ্বীর ও তাকদ্বীরকে সমন্বিত করা হয়েছে, তাকদ্বীরের কার্যক্রম ও লক্ষ্যকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে যে সকল কিছু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দেয়া একই নিয়মে বাঁধা এবং সৃষ্টির সব কিছু তাদের গতি প্রকৃতি ও কার্য নির্বাহ কালে একটি আর একটির সহযােগিতায় নিয়ােজিত একথা জানানাে হয়েছে, সব কিছু দিবা-নিশি সৃষ্টির সেরা এই মানুষেরই জন্যেই কাজ করে চলেছে যাকে স্বয়ং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা মর্যাদাবান বানিয়েছেন। এখানে এ সূরাটির বর্ণনার মধ্যে আরেকটি কথা খেয়াল করুন, দেখবেন প্রাকৃতিক এসব দৃশ্যাবলী ও মানব জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির মধ্যে চমৎকার সমন্বয় ও পারস্পরিক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, তােমাদের ওপর আমি সাতটি পথ সৃষ্টি করেছি এবং মােটেই আমি (সৃষ্টির) কোনাে কিছু থেকে গাফেল নই।’ ওপরের আয়াতটিতে উল্লেখিত পথসমূহ বলতে বিভিন্ন স্তর বুঝায় যা একটি আর একটির ওপর অবস্থিত অথবা একটি আর একটির উর্ধে একটি আর একটি থেকে অনেক অনেক দূরে একথা দ্বারা উর্ধাকাশে অবস্থিত সাতটি ছায়াপথ বা কক্ষপথও বুঝানাে হতে পারে, অথবা হতে পারে সাত তারকারাজির সমষ্টি, যেমন রয়েছে সাতটি সৌরমন্ডল, অথবা সাতটি ছায়াপথের সমাহার, এই ধরনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জ্যোতির্বিদরা বলেন, এসব হচ্ছে তারকারাজির সমষ্টি। যে যাই বলুক না কেন, সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, মানবমন্ডলী যে পৃথিবীতে বাস করে তার ওপরে সৃষ্ট সাতটি আকাশ, অর্থাৎ উর্ধাকাশে রয়েছে সাতটি স্তর, যার রহস্য ভেদ করা কোনাে মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ এ পর্যন্ত জ্ঞান গবেষণা করে যা জানতে পেরেছে তা নিশ্চিত কিছু নয়, অনেকটা আব্দায অনুমান করেই এসব হিসাব নিকাশ করা হয়েছে। তবে যে জিনিসটি আমরা আমাদের চর্ম | চোখে দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে, এসব কিছু মহা শক্তিশালী এক নিয়ামকের হাতে সুরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত রয়েছে। একথাটাই বর্ণিত হয়েছে কোরআনের আয়াতে, আমি এ বিশাল সৃষ্টির কোনাে কিছু থেকেই বে-খবর নই’ এর কোনােটি সম্পর্কে এবং কোনাে অবস্থার ব্যাপারে আমার অজানা কোনাে কিছুই নেই আরাে এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি আকাশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাপ মতাে পানি পাঠিয়েছি অতপর তার দ্বারা আমি পৃথিবীকে সিঞ্চিত করেছি আর এই পানিকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারেও আমি সম্পূর্ণ সক্ষম।’… দেখা যায়, এভাবে পৃথিবীকে সে সাতটি (ছায়া) পথের সাথে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। অতপর আরাে খেয়াল করুন, এই বৃষ্টিধারার সাথে মহাকাশ ও তার স্তরগুলাে যুক্ত রয়েছে, কারণ সে বৃষ্টিধারা ছাড়া পৃথিবীতে জীবন একেবারেই অসম্ভব। এতে বুঝা যায় যে, সৃষ্টির সব কিছুকে পরস্পর এক অদেখা ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, একটি আর একটির ওপর নির্ভরশীল। আকাশের যােগ ছাড়া এ ধরণীর জীবন কল্পনা করা যায় না এবং এ পৃথিবীবাসী। বাঁচতেও পারে না। এ ব্যাপারে সাধারণভাবে যে মতবাদ চালু রয়েছে তা হচ্ছে, এই যে পৃথিবীর পেটের মধ্যে যে পানি মজুদ রয়েছে তা ওপরের সেই পানির সাথে সংযুক্ত রয়েছে- যা আবার পরে আকাশ থেকে বর্ষিত হয় । এই উভয়ের পানির সম্মেলনে পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীর প্রয়ােজন পূরণ হয়। এটা যতােটুকু সত্য তা নীচের আলােচনা থেকে বুঝা যাবে। বলা হয়েছে, ‘আমি, আকাশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি বর্ষণ করিয়েছি’ এ বর্ষণ সম্পূর্ণ পরিসীমিত ও হিসাব করা। এই নির্ধারিত পরিমাপের মধ্যে যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও নিখুঁত ব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে তাতে বুঝা যায় এর পেছনে এমন এক মহা-শক্তিমান হাত রয়েছে, যার মধ্যে কোনাে দুর্বলতা নেই, নেই অজানার কোনাে সংশয়। সে মহাশক্তিমান তার অফুরন্ত ও অসীম ক্ষমতা বলে সুনির্দিষ্ট পন্থায় সব কিছুকে ত্রুটিহীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। মানুষ এ পর্যন্ত জেনে এসেছে যে পথিবীর মধ্যে সঞ্চিত যে পানি তা আকাশ থেকে বর্ষিত পানি থেকেই জমা হয়েছে এবং আকাশ থেকে বর্ষিত পানি মানুষ জীব জন্তু ও গাছ-পালা তরুলতা সব কিছুর প্রয়ােজন মেটানাের পরই গিয়ে পৃথিবীর পেটের মধ্যে জমা হয়। এ পর্যন্তকার মানুষের জানাকে নাকচ করে দিয়ে সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে যে, না পৃথিবীর পেটের মধ্যে যে পানি আছে তার সাথে পৃথিবীর উপরিভাগে থাকা অর্থাৎ আকাশ থেকে বর্ষিত পানির কোনাে সম্পর্ক নেই। অথচ এই সত্যটিকেই আল কোরআন চৌদ্দশত বছর পূর্বে জানিয়েছে। দেখুন আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি পাঠিয়েছি আকাশ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি।’ পুরােপুরি বুদ্ধিমত্তা সহকারে এবং সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাঠিয়েছি। প্রয়ােজনের থেকে এমন বেশী নয় যে সবকিছু ডুবিয়ে দেবে, আবার এতাে কমও নয় যে পানির অভাবে ফসল হবে না ও চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে, আবার বে-মওসুম পানিও বর্ষিত হয় না। কারণ তাতে পানির কোনাে সদ্যবহার হয় না এবং বেকার পানিটা নষ্ট হয়ে যায়। কারাে কোনাে কাজেই লাগে না। তাই আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘আমি আকাশ থেকে পানি এক নির্দিষ্ট পরিমাণে বর্ষণ করেছি, অতপর এ পানিকে আমি (মজুদ করে রেখেছি) পৃথিবীর বুকে ধরে রেখেছি এভাবে পানিকে ধরে রাখার সাথে সে শুক্রবিন্দুর পানির সাথেও তুলনা করা যায়, যা মাতৃগর্ভের মধ্যে ধরে রাখা হয়। এক সুরক্ষিত স্থানে’… উভয় পানিই আল্লাহর মেহেরবানী ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুরক্ষিত হয় যাতে তার দ্বারা জীবন প্রতিপালিত হয়… কোরআনের এক বিশেষ বর্ণনা ভংগীর মাধ্যমে সত্যকে ছবির মতাে চোখের সামনে তুলে ধরে এ কথাগুলােকে তুলে ধরা হয়েছে। আমি এ পানিকে ফিরিয়ে নিতেও পুরােপুরিই সক্ষম অর্থাৎ যদি এভাবে পানিকে ফেরত নিয়ে যাই তাহলে এ পানি চলে যাবে পৃথিবীর গভীরে দূরবর্তী স্তরসমূহের মধ্যে, কঠিন শিলাসমূহ ভেদ করে এ পানি চলে যেতে পারে নীচে বহু দূরে; কিন্তু সেভাবে পানিকে নীচে নেমে যাওয়া থেকে আমিই হেফাযত করেছি অথবা এসব উপায় ছাড়াই আমি প্রয়ােজনীয় পানিকে হেফাযত করেছি। অতএব, যিনি তার ক্ষমতা বলে এ পানিকে ধরে রাখেন তিনি একে অপচয় ও নিঃশেষ হয়ে যাওয়া থেকেও রক্ষা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। অবশ্যই এই সব কিছুই মানুষের জন্যে আল্লাহর মেহেরবানীর দান। পানি থেকেই সকল জীবনের জন্ম হয়: এরশাদ হচ্ছে, অতপর আমি তােমাদের জন্যে খেজুর ও আঙ্গুরের বাগিচা সমূহ পয়দা করেছি। এগুলাের মধ্যে তােমাদের প্রয়ােজন মেটাতে সক্ষম বহু ফলমূল রয়েছে, এগুলাে খাদ্য হিসাবে তােমরা ব্যবহার করে। খেজুর ও আংগুর দুটি অতি উৎকৃষ্ট ফল। উদ্ভিদ জগতে পানি দ্বারা উদ্গত বৃক্ষসমূহের মধ্যে এ দুটি চমৎকার উদাহরণ, যেমন মানব জগতে শুক্র বিন্দুর মাধ্যমে মনুষ্য সৃষ্টি অস্তিত্বে এসেছে। এ হচ্ছে আল কোরআনে বর্ণিত উদাহরণ পদ্ধতি যাতে করে মানুষ অতি সহজেই কথাগুলাে বুঝতে পারে। এ দুটি উদাহরণ সেসব দৃষ্টান্তের দিকেও ইংগিত করছে, যা পানি দ্বারা জীবন লাভ করেছে। এরপর বিশেষভাবে যায়তুন নামক বৃক্ষের কথা উল্লেখিত হয়েছে, এরশাদ হচ্ছে, একটি বৃক্ষ যা তুরপর্বত ও তার পাশের উপত্যকা ভূমিতে উৎপন্ন হয়, যা তেল সমৃদ্ধ এবং খানেওয়ালাদের জন্যে তরকারির কাজও করে। এই উপত্যকায় উৎপন্ন অধিকাংশ যায়তুন বৃক্ষ থেকে তেল, খাদ্য ও কাঠ পাওয়া যায়, আর আরব দেশের বেশী পাশের দেশ হচ্ছে এই সিনাই উপত্যকা এই এলাকা সে পবিত্র ভূমিরও কাছে যার উল্লেখ আল কোরআনে এসেছে। এক বিশেষ কারণেই আল কোরআনে এই এলাকার কথা উল্লেখিত হয়েছে, আর তা হচ্ছে, সে এলাকার এই যায়তুন বৃক্ষও সেই পানির সিঞ্চনে উৎপন্ন হয় যা সেখানে সর্বক্ষণ মজুদ থাকে এবং সেখানে এই পানির কারণে বিশাল জনবসতিও গড়ে উঠেছে। সেখানকার মাটি বৃষ্টি থেকে সঞ্চিত এ পানি শুষে নেয় না। সে এলাকার ভূমির এই বৈশিষ্ট্য থাকায় সেখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যায়তূন বনাঞ্চল এবং তৈলসমৃদ্ধ এই গাছের বাগান গড়ে উঠেছে। এর থেকে যেমন ফলের প্রয়ােজন মেটে, তেমনি এর প্রক্রিয়াজাত যে তেল পাওয়া যায় তা ঘি-এর মতােই খাবারের তরকারির মতাে ব্যবহার করা হয়। এ তেল যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর, আর এই কারণে এই এলাকার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ঘিরে বিশাল জনবসতি গড়ে উঠেছে।
* আল কোরআন জানাচ্ছে, অবশ্যই তােমাদের জন্যে গৃহপালিত এসব পশুর মধ্যে বহু শিক্ষার বিষয় রয়েছে, এগুলাের পেটের মধ্যে যা আছে তা থেকে আমি তােমাদের দুধ পান করাই। এর মধ্যে তােমাদের আরাে বহু উপকারীতা রয়েছে, সেগুলাে থেকে তােমরা (তাদের গােশত) ভক্ষণ করে আবার তাদের পিঠে তােমরা আরােহণও করাে এবং আরোহণ করাে বিভিন্ন নৌযানেও। সৃষ্টির মধ্যে এসব জীব-জানােয়ারকে আল্লাহর ক্ষমতা ও তারই ব্যবস্থাপনায় মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীনে এনে দেয়া হয়েছে। কর্মসমূহকে বিভক্ত করে এদের দ্বারা এদের উপযােগী কাজ নেয়া। | হয়। আল্লাহ তায়ালা, তার নিজ ক্ষমতা বলে ও তার ব্যস্থাপনার অধীনে এগুলােকে মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন বানিয়েছেন, যার কারণে মানুষ তাদের দ্বারা বিভিন্ন প্রকার কাজ নিয়ে থাকে এজন্যেই এগুলো থেকে মানুষের বহু কিছু শিক্ষা নেয়ার বিষয় রয়েছে, বিশেষ করে যারা খােলা মন ও উন্মুক্ত চোখে এগুলাের দিকে তাকায়, এ সবের দিকে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখে, এর চতুর্দিকের পরিবেশ থেকে আল্লাহর বিস্তর হেকমত ও তার ক্ষমতার বহু নিদর্শন তারা দেখতে পায়। এগুলাের পেট থেকে যে দুধ পাওয়া যায় তার থেকে তারা সুপেয় পানীয় সংগ্রহ করে, অতি উত্তম পানীয় হিসাবে এ দুধ তারা পান করে, যা সহজে হজম হয় এবং পুষ্টির প্রয়ােজনও মেটায়। এরশাদ হচ্ছে, ‘এদের মধ্যে তােমাদের জন্যে রয়েছে আরাে বহু উপকার…’ অর্থাৎ, প্রথমত সংক্ষেপে এদের সাধারণ উপকারের কথা বলা হয়েছে। তারপর খাস করে এদের আরো দুটি উপকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলাে থেকে তােমরা খাও এবং এদের ওপর আরােহণও করাে এবং আরাে আরােহণ করাে নৌযান সমূহে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষের জন্যে যেসব পশুর গােশত হালাল করেছেন তার মধ্যে রয়েছে উট, গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি; কিন্তু তাদেরকে কষ্ট দিয়ে যবাই করাকে বা তাদের শরীরের অংশ বিশেষকে কেটে নেয়াকে হালাল বানাননি, কারণ জীবনের জন্যেই খাদ্যের প্রয়ােজন। কষ্ট দিয়ে হত্যা করা বা তাদের শরীরের অংশ বিশেষ কেটে নেয়ায় যেমন নিষ্ঠুরতা করা হয়, তেমনি খাদ্য হিসাবে সেটা উপকারীও হয় না, এতে বরং মানুষের অপকারই হয়। এখানে নৌযান ও স্থল যান হিসাবে যে দুটি বস্তুর উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাধারণত যে সুবিধা পাওয়া যায় তা হচ্ছে যে, এ উভয় প্রকার বাহন দ্বারা দেশ-বিদেশে সফর করা যায় এবং বিপুল মালের বহর দেশ থেকে দেশ-দেশান্তরে নিয়ে যাওয়া যায়। এদের একটি হচ্ছে স্থলযান আর একটি নৌযান। এ দুটি যানই প্রাচীন কাল থেকে মানুষের সমাজে যানবাহন হিসাবে পরিচিত হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এ দুই শ্রেণীর বাহনই প্রধানত ব্যবহৃত হতে থাকবে। পানির ওপরের বাহনের বিকল্প আরাে অনেক কিছু আবিষ্কৃত হলেও মরু অঞ্চলে উট বহরের বৈশিষ্ট্যসমূহ আজও পরিলক্ষিত হয়। মরু যাত্রীরা তাদের দুরন্ত সফরে অন্তরের গভীরে এমনটিই আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং নিজেদের অজান্তেই তারা নিজেদেরকে তার কাছে সােপর্দ করে দেয়। অপরদিকে নূহ(আ.)-এর আমল থেকে, অথবা আরাে পূর্ব থেকে মানব সমাজে নৌযান এর ব্যবহার চালু রয়েছে, বিপুল পরিমাণ মাল বহন করে যাত্রীরা যখন বিশাল সমুদ্রে পাড়ি জমায়, অকল্পনীয় ঝড় ঝার সম্মুখীন হয় তখন কায়মনােবাক্যে তারা সর্বশক্তিমান আল্লাহকে স্মরণ করে- তখন তারা গভীরভাবে অনুভব করে, সে অকূল সাগর বক্ষে তাদের সাহায্য করার মতাে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ নেই। যখন উত্তাল তরংগাভিঘাতে জাহাজ শােলার মত প্রচন্ড বেগে দুলতে থাকে। আকাশচুম্বী ও পাহাড় সম ঢেউ যখন জাহাজটিকে ওপরের দিকে নিয়ে যায় আবার পরক্ষণে যখন অকুল পাথারে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তখন আরোহীদের ধড়ে যেন আর প্রাণ থাকে না। সেই মুহূর্তে এমন কোনাে নাস্তিক নেই যে, সব ক্ষমতার মালিক ত্রাণকর্তা আল্লাহকে স্মরণ না করে, কায়মনােবাক্যে রব্বুল আলামীনকে ডাকে না। সুতরাং, উভয় প্রকার যান বাহনের যাত্রীদের অন্তরে ঈমানের অনুভূতি ও আল্লাহর ক্ষমতার চেতনা জাগানাের জন্যে এবং যারা এসব দুরন্ত সফরের অভিজ্ঞতা লাভ করেনি, তাদের কল্পনা চোখে তা তুলে ধরার জন্যে এই দুই বা ততােধিক প্রকারের যান বাহনের ছবি উল্লেখিত হয়েছে, যেন তারা বিশ্ব সম্রাটের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সময় থাকতেই তার হুকুম মেনে নিজেদের জীবনকে ধন্য করে। প্রকৃতপক্ষে এখানে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে এই দুই প্রকার যানবাহনের কথা উল্লেখিত হয়েছে এবং এই লক্ষ্যে উত্থাপিত প্রমাণাদি দ্বারা সূরাটি তার শুরু ও শেষকে পরস্পর সংগবদ্ধ করেছে। কেন আল্লাহকে সকল ক্ষমতার মালিক বলে মানতে হবে, তার অস্তিত্বে কেন বিশ্বাস করতে হবে এবং কেনই বা তার হুকুম মতাে চলতে হবে তার জওয়াব স্বরূপ আল্লাহ রব্বুল আলামীন নূহ(আ.)-এর কাহিনীটি এ প্রসংগে তুলে ধরেছেন। দেখুন এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আমি নূহকে তার জাতির কাছে পাঠিয়েছি… হে রসূলরা, তােমরা পবিত্র (খাদ্য) বস্তুসমূহ থেকে খাও এবং তােমরা নেক কাজ করতে থাকো, অবশ্যই সে সব বিষয়ে আমি জ্ঞাত। আছি যা তােমরা করে চলেছে।… অতএব তােমরা ভয় করাে বাছ বিচার করে চলাে।’
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
#.কোন মুক্তমনের অধিকারী ব্যক্তি শিশুকে মাতৃগর্ভে লালিত পালিত হতে দেখে একথা ধারণাও করতে পারে না যে, এখানে এমন একটি মানুষ তৈরি হচ্ছে, যে বাইরে এসে জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিল্পকর্মের এসব নৈপুণ্য দেখাবে এবং তার থেকে এ ধরনের বিস্ময়কর শক্তি ও যোগ্যতার প্রকাশ ঘটবে। সেখানে সে হয় হাড় ও রক্ত মাংসের একটি দলা পাকানো পিণ্ডের মতো। তার মধ্যে ভূমিষ্ঠ হবার আগে পর্যন্ত জীবনের প্রারম্ভিক বৈশিষ্টসমূহ ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তার মধ্যে থাকে না শ্রবণ শক্তি, থাকেন না দৃষ্টি শক্তি, বাকশক্তি, বুদ্ধি-বিবেচনা ও অন্য কোন গুণ। কিন্তু বাইরে এসেই সে অন্য কিছু হয়ে যায়। পেটে অবস্থানকারী ভ্রূণের সাথে এগুলোর কোন সম্পর্কই থাকে না। অথচ এখন সে শ্রবণকারী, দর্শনকারী ও বাকশক্তির অধিকারী একটি সত্তা। এখন সে অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ দর্শনের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করে। এখন তার মধ্যে এমন একটি ব্যক্তিসত্তার উন্মেষ ঘটার সূচনা হয় যে জাগ্রত হবার পরপরই প্রথম মুহূর্ত থেকেই নিজের আওতাধীন প্রত্যেকটা জিনিসের ওপর নিজের কর্তৃত্ব ও শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা চালায়। তারপর সে যতই এগিয়ে যেতে থাকে তার সত্তা থেকে এ “অন্য জিনিস” হবার অবস্থা আরও সুস্পষ্ট ও আরো বিকশিত হতে থাকে। যৌবনে পদার্পণ করে শৈশব থেকে ভিন্ন কিছু হয়ে যায়। পৌঢ়ত্বে পৌঁছে যৌবনের তুলনায় অন্য কিছু প্রমাণিত হয়। বার্ধক্যে উপনীত হবার পর নতুন প্রজন্মের জন্য একথা অনুমান করাই কঠিন হয়ে পড়ে যে, তার শিশুকাল কেমন ছিল এবং যৌবনকালে কি অবস্থা ছিল। এত বড় পরিবর্তন অন্তত এ দুনিয়ার অন্য কোন সৃষ্টির মধ্যে ঘটে না। কোন ব্যক্তি যদি একদিকে কোন বর্ষীয়ান পুরুষের শক্তি, যোগ্যতা ও কাজ দেখে এবং অন্য দিকে একথা কল্পনা করতে থাকে যে, পঞ্চাশ ষাট বছর আগে একদা যে একটি ফোঁটা মায়ের গর্ভকোষে টপকে পড়েছিল তার মধ্যে এত সবকিছু নিহিত ছিল, তাহলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে একই কথা বের হয়ে আসবে যা সামনের দিকের বাক্যের মধ্যে আসছে।
# মূলে تَبَارَكَ اللَّهُ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অনুবাদের মাধ্যমে এর সমগ্র গভীর অর্থ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আভিধানিক ও ব্যবহারিক দিক দিয়ে এর মধ্যে দু’টি অর্থ পাওয়া যায়। এক, তিনি অত্যন্ত পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। দুই, তিনি এমনই কল্যাণ ও সদগুণের অধিকারী যে, তাঁর সম্পর্কে তোমরা যতটুকু অনুমান করবে তার চেয়ে অনেক বেশী তাঁকে পাবে। এমনকি তাঁর কল্যাণকর ধারা কোথাও গিয়ে শেষ হয় না। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল ফুরকান, ১ টীকা ও ১৯ টীকা ) এ দু’টি অর্থ সম্পর্কে চিন্তা করলে একথা বুঝা যাবে যে, মানুষ সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায় বর্ণনা করার পর فَتَبَارَكَ اللَّهُ বাক্যাংশটি নিছক একটি প্রশংসামূলক বাক্যাংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়নি বরং এটি হচ্ছে যুক্তির পরে যুক্তির উপসংহারও। এর মধ্যে যেন একথাই বলা হচ্ছে যে, যে আল্লাহ একটি মাটির ঢিলাকে ক্রমোন্নত করে একটি পূর্ণ মানবিক মর্যাদা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন তিনি প্রভুত্বের ব্যাপারে তার সাথে কেউ শরীক হবে এ থেকে অনেক বেশী পাক-পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। তিনি এ একই মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করতে পারেন, কি পারেন না এরূপ সন্দেহ-সংশয় থেকে অনেক বেশী পাক-পবিত্র। আর তিনি একবারই মানুষ সৃষ্টি করে দেবার পর তাঁর সব নৈপুণ্য খতম হয়ে যায় এবং এরপর তিনি আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারেন না, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণ ক্ষমতা সম্পর্কে এটা বড়ই নিকৃষ্ট ধারণা।
# মূলে طَرَائِقَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে পথও হয় আবার স্তরও হয়। যদি প্রথম অর্থটি গ্রহণ করা হয় তাহলে সম্ভবত এর অর্থ হবে সাতটি গ্রহের আবর্তন পথ। আর যেহেতু সে যুগে মানুষ সাতটি গ্রহ সম্পর্কেই জানতো তাই সাতটি পথের কথা বলা হয়েছে। এর মানে অবশ্যই এ নয় যে এগুলো ছাড়া আর কোন পথ নেই। আর যদি দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করা হয় তাহলে سَبْعَ طَرَائِقَ এর অর্থ তাই হবে যা سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا (সাতটি আকাশ স্তরে স্তরে) এর অর্থ হয়। আর এই সঙ্গে যে বলা হয়েছে “তোমাদের ওপর” আমি সাতটি পথ নির্মাণ করেছি, এর একটি সহজ-সরল অর্থ হবে তাই যা এর বাহ্যিক শব্দগুলো থেকে বুঝা যায়। আর দ্বিতীয় অর্থটি হবে, তোমাদের চাইতে বড় জিনিস আমি নির্মাণ করেছি এ আকাশ। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
لَخَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَكْبَرُ مِنْ خَلْقِ النَّاسِ
“আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করা মানুষ সৃষ্টি করার চাইতে অনেক বড় কাজ।” (আল মু’মিন, ৫৭ আয়াত )
# অন্য একটি অনুবাদ এভাবে করা যেতে পারে, “আর সৃষ্টিকূলের পক্ষ থেকে আমি গাফিল ছিলাম না অথবা নই।” মূল বাক্যে যে গ্রহণ করা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে আয়াতের অর্থ হয়ঃ এসব কিছু যা আমি বানিয়েছি এগুলো এমনি হঠাৎ কোন আনাড়ির হাত দিয়ে আন্দাজে তৈরী হয়ে যায়নি। বরং একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ণ জ্ঞান সহকারে প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আইন সক্রিয় রয়েছে। সমগ্র বিশ্বজাহানের ছোট থেকে নিয়ে বড় পর্যন্ত সবকিছুর মধ্যে একটি পূর্ণ সামঞ্জস্য রয়েছে। এ বিশাল কর্ম জগতে ও বিশ্ব-জগতের এ সুবিশাল কারখানায় সব দিকেই একটি উদ্দেশ্যমুখিতা দেখা যাচ্ছে। এসব স্রষ্টার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রমাণ পেশ করছে। দ্বিতীয় অনুবাদটি গ্রহণ করলে এর অর্থ হবেঃ এ বিশ্ব-জাহানে আমি যা কিছুই সৃষ্টি করেছি তাদের কারোর কোন প্রয়োজন থেকে আমি কখনো গাফিল এবং কোন অবস্থা থেকে কখনো বেখবর থাকিনি। কোন জিনিসকে আমি নিজের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তৈরী হতে ও চলতে দেইনি। কোন জিনিসের প্রাকৃতিক প্রয়োজন সরবরাহ করতে আমি কখনো কুন্ঠিত হইনি। প্রত্যেকটি বিন্দু, বালুকণা ও পত্র-পল্লবের অবস্থা আমি অবগত থেকেছি।
# যদিও এর অর্থ হতে পারে মওসুমী বৃষ্টিপাত কিন্তু আয়াতের শব্দ বিন্যাস সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে অন্য একটি অর্থও এখান থেকে বুঝা যায়। সেটি হচ্ছে, সৃষ্টির সূচনাতেই আল্লাহ একই সঙ্গে এমন পরিমিত পরিমাণ পানি পৃথিবীতে নাযিল করেছিলেন যা তাঁর জ্ঞান অনুযায়ী কিয়ামত পর্যন্ত এ গ্রহটির প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট ছিল। এ পানি পৃথিবীর নিম্ন ভূমিতে রক্ষিত হয়েছে। এর সাহায্যে সাগর ও মহাসাগরের জন্ম হয়েছে এবং ভূগর্ভেও পানি (Sub-soil water) সৃষ্টি হয়েছে। এখন এ পানিই ঘুরে ফিরে উষ্ণতা, শৈত্য ও বাতাসের মাধ্যমে বর্ষিত হতে থাকে। মেঘমালা, বরফাচ্ছাদিত পাহাড়, সাগর, নদী-নালা ঝরণা ও কুয়া এ পানিই পৃথিবীর বিভিন্নঅংশে ছাড়িয়ে দিয়ে থাকে। অসংখ্য জিনিসের সৃষ্টি ও উৎপাদনে এরই বিশিষ্ট ভূমিকা দেখা যায়। তারপর এ পানি বায়ুর সাথে মিশে গিয়ে আবার তার মূল ভাণ্ডারের দিকে ফিরে যায়। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পানির এ ভাণ্ডার এক বিন্দুও কমেনি এবং এক বিন্দু বাড়াবারও দরকার হয়নি। এর চাইতেও বেশী আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালেয়র প্রত্যেকটি ছাত্রই একথা জানে যে, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এ দু’টি গ্যাসের সংমিশ্রণে পানির উৎপত্তি হয়েছে। একবার এত বিপুল পরিমাণ পানি তৈরী হয়ে গেছে যে, এর সাহায্যে সমুদ্র ভরে গেছে এবং এখন এর ভাণ্ডারে এক বিন্দুও বাড়ছে না। কে তিনি যিনি এক সময় এ বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিলিয়ে এ অথৈ পানির ভান্ডার সৃষ্টি করে দিয়েছেন? আবার কে তিনি যিনি এখন আর এ দু’টি গ্যাসকে সে বিশেষ অনুপাতে মিশতে দেন না যার ফলে পানি উৎপন্ন হয়, অথচ এ দু’টি গ্যাস এখনো দুনিয়ার বুকেমওজুদ রয়েছে? আর পানি যখন বাষ্প হয়ে বাতাসে উড়ে যায় তখন কে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনকে আলাদা হয়ে যাওয়া থেকে বাধা দেয়? নাস্তিক্যবাদীদের কাছে কি এর কোন জবাব আছে? আর যারা পানি ও বাতাস এবং উষ্ণতা ও শৈত্যের পৃথক পৃথক সৃষ্টিকর্তার স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের কাছে কি এর কোন জবাব আছে?
# তাকে অদৃশ্য করার কোন একটাই পদ্ধতি নেই। অসংখ্য পদ্ধতিতে তাকে অদৃশ্য করা সম্ভব। এ মধ্য থেকে যে কোনটিকে আমরা যখনই চাই ব্যবহার করে তোমাদেরকে জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি থেকে বঞ্চিত করতে পারি। এভাবে এ আয়াতটি সূরা মুলকের আয়াতটি থেকে ব্যাপকতর অর্থ বহন করে যেখানে বলা হয়েছেঃ
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَصْبَحَ مَاؤُكُمْ غَوْرًا فَمَنْ يَأْتِيكُمْ بِمَاءٍ مَعِينٍ
‘তাদেরকে বলো, তোমরা কি কখণো ভেবে দেখেছো, যমীন যদি তোমাদের এ পানিকে নিজের ভেতরে শুষে নেয়, তাহলে কে তোমাদেরকে বহমান ঝরণাধারা এনে দেবে।”
# খেজুর ও আংগুর ছাড়াও আরো নানান ধরণের ফল-ফলাদি।
# এসব বাগানের উৎপন্ন দ্রব্যাদি, ফল, শস্য, কাঠ এবং অন্যান্য যেসব দ্রব্য তোমরা বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করো, এসব থেকে তোমরা নিজেদের জন্য জীবিকা আহরণ করো। وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ تَأْكُلُونَ (যেগুলো থেকে তোমরা খাও) এর মধ্যে যে “যেগুলো” শব্দটি রয়েছে এটির মাধ্যমে বাগানগুলো বুঝানো হয়েছে, ফল-ফলাদি নয়। আর فلان يأكل من حرفته মানে শুধু এই নয় যে, এ বাগানগুলোর ফল তোমরা খাও বরং এ শব্দটি সামগ্রিকভাবে জীবিকা অর্জন করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন আমরা বলি, অমুক ব্যক্তি নিজের অমুক (অমুক ব্যক্তি তার শিল্পকর্ম থেকে খাচ্ছে অর্থাৎ তার শিল্পকর্ম থেকে জীবিকা অর্জন করছে)।
#এখানে জয়তুনের কথা বলা হয়েছে। ভুমধ্যসাগরের আশপাশের এলাকার উৎপন্ন দ্রব্যাদির মধ্যে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী। এ গাছগুলো দেড় হাজার দু’হাজার বছর বাঁচে। এমনকি ফিলিস্তিনের কোন কোন গাছের দৈঘ্য, স্থুলতা ও বিস্তার দেখে অনুমান করা হয় যে, সেগুলো হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যুগ থেকে এখনো চলে আসছে। সিনাই পাহাড়ের সাথে একে সম্পর্কিত করার কারন সম্ভবত এই যে, সিনাই পাহাড় এলাকার সবচেয়ে পরিচিত ও উল্লেখযোগ্য স্থানই এর আসল স্বদেশ ভূমি।
# দুধ। এ সম্পর্কে কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, রক্ত ও গোবরের মাঝখানে এটি আর একটি তৃতীয় জিনিস। পশুর খাদ্য থেকে এটি সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।
# গবাদি পশু ও নৌযানকে একত্রে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে এই যে, আরববাসীরা আরোহণ ও বোঝা বহন উভয় কাজের জন্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উট ব্যবহার করতো এবং উটের জন্য “স্থল পথের জাহাজ” উপমাটি অনেক পুরানো। জাহেলী কবির যুররুম্মাহ বলেনঃ
سفينة بر تحت خدى زمامها
“স্থলপথের জাহাজ চলে আমার গণ্ডদেশের নিচে তার লাগমটি।”
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১২-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে মূলত আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ ক্ষমতার কথা বর্ণনা করা হচ্ছে আর তা হল মানব জাতির সৃষ্টি প্রক্রিয়া। মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা কত সূক্ষ্মভাবে নগণ্য বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন যা মানুষের তুচ্ছতা ও দুর্বলতা প্রকাশ করে আর আল্লাহ তা‘আলার মহত্ব, বড়ত্ব ও ক্ষমতা প্রকাশ করে। মানুষের সৃষ্টি তথ্য প্রদান করতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে উদ্দেশ্য হল আদম (عليه السلام)। কারণ একমাত্র তাকেই মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর যদি সকল মানুষকে উদ্দেশ্য করি তাহলে বলা যায়ন সকল মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে পিতার মেরুদন্ড ও মায়ের পাঁজরের মধ্য হতে নির্গত মিশ্রিত তরল পদার্থের নির্যাস থেকে। তবে আদম (عليه السلام), হাওয়া আলাইহাস সালাম ও ঈসা (عليه السلام) ব্যতীত। কারণ আদম সৃষ্টি হয়েছেন মাটি থেকে, হাওয়া আদমের বাম পাঁজর থেকে আর ঈসা (عليه السلام) বিনা পিতায় আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে। তাই বলা যায়, মানব সৃষ্টির মূল উপাদান হল মাটি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِيْنٍ)
“মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি দিয়ে।” (সূরা সিজদাহ ৩২:৭)
এরূপ সূরা রূমের ২০ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
পিতার মেরুদন্ড থেকে নির্গত তরল পদার্থের নির্যাস শুক্রাণু আর মায়ের পাঁজর থেকে নির্গত তরল পদার্থের ডিম্বাণুর মিশ্রণ ঘটে উভয়ের মিলনের মাধ্যমে। এ মিশ্র তরল পদার্থ নিরাপদ স্থান মায়ের জরায়ুতে রেখে দেন, সেখানে প্রবেশ করা হাজারো ডিম্বানু ও শুক্রাণু থেকে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী শুক্রাণু হতে সন্তান পয়দা করা হয়। দলীলসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَمْ نَخْلُقْكُّمْ مِّنْ مَّا۬ءٍ مَّهِيْنٍ لا فَجَعَلْنٰهُ فِيْ قَرَارٍ مَّكِيْنٍ)
“আমি কি তোমাদেরকে নগণ্য পানি হতে সৃষ্টি করিনি? অতঃপর আমি তাকে স্থাপন করেছি এক নিরাপদ স্থানে।” (সূরা মুরসালাত ৭৭:২০-২১)
আর এ শুক্রবিন্দুর উৎস স্থল হল পিতার পিঠ ও মায়ের বুক, যে শুক্রবিন্দুর উৎস স্থল সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَلْیَنْظُرِ الْاِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَﭔﺚ خُلِقَ مِنْ مَّا۬ئٍ دَافِقٍﭕﺫ یَّخْرُجُ مِنْۭ بَیْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَا۬ئِبِ)
“সুতরাং মানুষের লক্ষ্য করা উচিত যে, তাকে কিসের দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে । তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রবল বেগে নির্গত পানি হতে, যা বের হয় পিঠ ও বুকের হাড়ের মধ্য হতে।” (সূরা তারিক ৮৬:৫-৭)
এরপর এ শুক্রবিন্দুকে পরিণত করা হয় রক্তপিণ্ডে অতঃপর সেটাকে পরিণত করা হয় মাংসপিণ্ডে অতঃপর অস্থি এবং অস্থিকে ঢেকে দেয়া হয় গোশত দ্বারা। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ يُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوْآ أَشُدَّكُمْ ثُمَّ لِتَكُوْنُوْا شُيُوْخًا)
“তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে, পরে শুক্রবিন্দু হতে, তারপর বের করেন শিশুরূপে, অতঃপর যেন তোমরা উপনীত হও যৌবনে, তারপর হও বৃদ্ধ।” (সূরা মু’মিন ৪০:৬৭)
অবশেষে এগুলো থেকে পূর্ণাকৃতির মানুষ সৃষ্টি করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে? সে কি নিক্ষিপ্ত শুক্রবিন্দু ছিল না? অতঃপর সে রক্তপিন্ডে পরিণত হয়। তারপর তাকে আকৃতি দান করেন এবং সুঠাম করেন। তারপর তিনি তা হতে সৃষ্টি করেন জোড়া জোড়া পুরুষ ও নারী। তবুও কি তিনি মৃতকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম নন?” (সূরা কিয়ামাহ ৭৫:৩৬-৪০) এ সম্পর্কে সূরা হজ্জ-এর ৫ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এ সৃষ্টির পর অর্থাৎ তোমাদের আয়ুষ্কাল শেষ হবার পর তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(كُلُّ نَفْسٍ ذَا۬ئِقَةُ الْمَوْتِ قف ثُمَّ إِلَيْنَا تُرْجَعُوْنَ)
“প্রতিটি প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; অতঃপর তোমরা আমারই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা আনকাবুত ২৯:৫৭)
এবং সর্বশেষে কিয়ামত দিবসে তোমাদেরকে পুনরায় জীবিত করা হবে যেমনভাবে তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করা হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(كَيْفَ تَكْفُرُوْنَ بِاللّٰهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ج ثُمَّ يُمِيْتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيْكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ)
“কিভাবে তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন, এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পরে আবার জীবিত করবেন, অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।” (সূরা বাকারাহ ২:২৮)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَعُرِضُوْا عَلٰي رَبِّكَ صَفًّا ط لَقَدْ جِئْتُمُوْنَا كَمَا خَلَقْنٰكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍۭ ز بَلْ زَعَمْتُمْ أَلَّنْ نَّجْعَلَ لَكُمْ مَّوْعِدًا)
“এবং তাদেরকে তোমার প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত করা হবে সারিবদ্ধভাবে এবং বলা হবে, ‘তোমাদেরকে প্রথমবার যেভাবে সৃষ্টি করেছিলাম সেভাবেই তোমরা আমার নিকট উপস্থিত হয়েছ, অথচ তোমরা মনে করতে যে, তোমাদের জন্য প্রতিশ্র“ত কাল আমি কখনও উপস্থিত করব না।’’ (সূরা কাহফ ১৮:৪৮) সুতরাং যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে তাদের এ সৃষ্টি তথ্য নিয়ে গবেষণা করলেই সঠিক হুশ ফিরে আসবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষকে বিভিন্ন ধাপে সৃষ্টি করা হয়েছে।
২. মানুষ আয়ুষ্কাল শেষে অবশ্যই মৃত্যু বরণ করবে।
৩. পুনরুত্থান দিবসে মানুষ সৃষ্টির শুরুর মত বিনা খাতনায় খালি পায়ে উঠবে।।
১৭ নং আয়াতের তাফসীর:
মানব জাতির সৃষ্টির কথা আলোচনা করার পর আল্লাহ তা‘আলা আকাশসমূহ সৃষ্টির বর্ণনা দিচ্ছেন। মানব সৃষ্টির তুলনায় আকাশসমূহের সৃষ্টি আরো অধিক কঠিন কাজ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, আমি তোমাদের ঊর্ধ্বে সৃষ্টি করেছি সপ্তস্তর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন:
সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৪৪)
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(أَلَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللّٰهُ سَبْعَ سَمٰوٰتٍ طِبَاقًا)
“তোমরা লক্ষ্য করনি আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে সাত আসমানকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন?” (সূরা নুহ ৭১:১৫)
এ সকল সৃষ্টির কথাই প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত দ্বিতীয় আর কেউ নেই। এবং আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির বিষয়ে অসতর্কও নন। বরং তিনি প্রত্যেক বিষয়ের যথাযথ খবর রাখেন। কোথায় কী হয় না হয় সব কিছ্ইু তিনি জানেন। (আল্লাহ তা‘আলা অধিক জ্ঞাত)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. আকাশ ও জমিন সাতটি।
১৮-২২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা আকাশ থেকে পরিমিত বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এতে বেশিও থাকে না, আবার কমও থাকে না। বেশি হলে বন্যা বয়ে যাবে আর কম হলে প্রয়োজন পূরণ হবে না। পানি বর্ষণ করে জমিনে সংরক্ষণ করে রাখেন, যেমন খাল-বিল, নদী-নালা ইত্যাদি পানি দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেন। যাতে সে সময় কাজে লাগাতে পারে যখন বৃষ্টি হয় না বা যে এলাকায় বৃষ্টি কম হয়েছে। সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করে দিচ্ছেন, তিনি চাইলে এ পানি অপসারিত করতে সক্ষম। বৃষ্টির পর পানি জমিনে তলিয়ে যাবে, খুঁজেও পাওয়া যাবে না। সুতরাং নেয়ামত পেয়ে নেয়ামতের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে এবং আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
(فَأَنْشَأْنَا لَكُمْ بِه)
অর্থাৎ বৃষ্টির পানি দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা খেজুর-আঙ্গুরসহ অনেক ফল-ফলাদির বাগান তৈরি করেন। এসব ফল-ফলাদি তোমরা খেয়ে থাক। যে সম্পর্কে পূর্বে সূরা নাহলে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَشَجَرَةً تَخْرُجُ)
অর্থাৎ এ বৃষ্টির পানি দ্বারা একটি গাছও উৎপন্ন হয় যা যায়তুন গাছ নামে পরিচিত। যার ফল পিষে তেল বের হয় এবং তা খাওয়া ও জ্বালানো হয়। যয়তুন ফলও তরকারী বা আচাররূপে ব্যবহার হয়। তরকারী বলা হয়েছে যেহেতু রুটিকে তার তরকারীতে ডুবিয়ে রঙানো হয় তাই। সিনাই পর্বত ও তার আশপাশের এলাকা বিশেষ করে উক্ত গাছের জন্য বড়ই উৎকৃষ্ট ভূমি।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমরা যায়তূনের তেল খাও ও লাগাও, কেননা এটা কল্যাণময় গাছ হতে বের হয়ে থাকে। (মুসতাদারাক হাকিম ২/৩৯৮)
(وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً)
“এবং তোমাদের জন্য অবশ্যই শিক্ষণীয় বিষয় আছে চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে’’ অতঃপর এর কিছু বিবরণ এভাবে দেয়া হয়েছেন
(نُسْقِيْكُمْ مِّمَّا فِيْ بُطُوْنِهَا)
অর্থাৎ এসব জন্তুর পেটে আমি তোমাদের জন্য পাক-সাফ দুধ তৈরি করেছি, যা মানুষের উৎকৃষ্ট খাদ্য। এরপর বলা হয়েছে: শুধু দুধই নয়,
(وَلَكُمْ فِيْهَا مَنَافِعُ كَثِيْرَةٌ)
এসব জন্তুর মধ্যে তোমাদের জন্য অনেক উপকারিতা রয়েছে। এদের দেহের প্রতিটি অংশ প্রতিটি লোম মানুষের কাজে আসে এবং জন্তুদের পশম, অস্থি, অন্ত্র এবং সমস্ত অংশ দ্বারা মানুষ প্রয়োজনীয় কত যে সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র তৈরি করে, তা গণনা করা কঠিন। এসব উপকার ছাড়া আরো একটি বড় উপকার এই যে, হালাল জন্তুদের মাংসও মানুষের এক প্রকার উৎকৃষ্ট খাদ্য
(وَّمِنْهَا تَأْكُلُوْنَ)
পরিশেষে জন্তু-জানোয়ারের আরো একটি মহা উপকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, তোমরা তাদের পিঠে আরোহণও কর এবং মাল পরিবহনের কাজেও নিযুক্ত কর। এ জন্তুদের সাথে নদীতে চলাচলকারী নৌকাও শরীক আছে। মানুষ নৌকায় আরোহণ করে এবং মালপত্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। তাই এর সাথে নৌকার কথাও আলোচনা করে বলা হয়েছেন
(وَعَلَيْهَا وَعَلَي الْفُلْكِ تُحْمَلُوْنَ)
চাকার মাধ্যমে চলে এমন সব যানবাহনও এগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. বৃষ্টি বর্ষণ করা এবং তা দ্বারা জমিন থেকে ফসল উৎপন্ন করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলা ফল-ফলাদি সৃষ্টি করেছেন মানুষের রিযিকের জন্য।
৩. চতুষ্পদ জন্তুর উপকারিতা সম্পর্কে জানা গেল।
৪. যায়তূন বৃক্ষের মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল।