أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৪৭)
[ اُذِنَ لِلَّذِیۡنَ یُقٰتَلُوۡنَ بِاَنَّہُمۡ ظُلِمُوۡا ؕ
যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তারা অত্যাচারিত।]
সূরা:- আল্ – হাজ্জ।
সুরা:২২
৩৮-৪০ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২২:৩৮
اِنَّ اللّٰہَ یُدٰفِعُ عَنِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یُحِبُّ کُلَّ خَوَّانٍ کَفُوۡرٍ ﴿٪۳۸﴾
নিশ্চয়ই আল্লাহ ঈমানদারদের সংরক্ষণ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বিশ্বাসঘাতক কৃতঘ্নকে পছন্দ করেন না।
২২:৩৯
اُذِنَ لِلَّذِیۡنَ یُقٰتَلُوۡنَ بِاَنَّہُمۡ ظُلِمُوۡا ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ عَلٰی نَصۡرِہِمۡ لَقَدِیۡرُۨ ﴿ۙ۳۹﴾
যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তারা অত্যাচারিত। আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সম্যক সক্ষম।
২২:৪০
الَّذِیۡنَ اُخۡرِجُوۡا مِنۡ دِیَارِہِمۡ بِغَیۡرِ حَقٍّ اِلَّاۤ اَنۡ یَّقُوۡلُوۡا رَبُّنَا اللّٰہُ ؕ وَ لَوۡ لَا دَفۡعُ اللّٰہِ النَّاسَ بَعۡضَہُمۡ بِبَعۡضٍ لَّہُدِّمَتۡ صَوَامِعُ وَ بِیَعٌ وَّ صَلَوٰتٌ وَّ مَسٰجِدُ یُذۡکَرُ فِیۡہَا اسۡمُ اللّٰہِ کَثِیۡرًا ؕ وَ لَیَنۡصُرَنَّ اللّٰہُ مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَقَوِیٌّ عَزِیۡزٌ ﴿۴۰﴾
তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ী হতে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ।’ আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিষ্টান সংসার-বিরাগীদের উপাসনা স্থান, গীর্জা, ইয়াহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ; যাতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম। আর আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে (তাঁর ধর্মকে) সাহায্য করে। আল্লাহ নিশ্চয়ই মহাশক্তিমান, চরম পরাক্রমশালী।
৩৮-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*যুদ্ধের অনুমতি দান ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি : একজন মুসলমানের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য পয়দা করার জন্যে এবং তার প্রতিটি কাজে, কথায়, চিন্তায় ও ব্যবহারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্যে চাই অনুকূল পরিবেশ, যা তাকে বিরােধীদের মােকাবেলায় সাহস যােগাতে পারে, সহযােগিতা করতে পারে এবং তার সব প্রতিকুলতাকে প্রতিরােধ করতে পারে, যাতে করে তার আকীদা বিশ্বাসের অনির্বাণ প্রদীপ অন্যভাবে জ্বলতে থাকে এবং অবিরামভাবে সে তার রবের বন্দেগী করে যেতে পারে। এমনই পরিবেশ পেলে সত্য সচেতন একজন মোমেন এবাদাতের স্থান সমূহের পবিত্রতা ও ইসলামের প্রতীকী কাজগুলাের মর্যাদা রাখতে পারবে এমনই অনুকূল পরিবেশে আল্লাহর হুকুম পালনে তৎপর ও বাস্তব কাজে নিয়ােজিত মােমেনদের পক্ষে তাদের ঈমান আকীদার ওপর ভিত্তি করে নিখুঁত এক জীবনপদ্ধতি গড়ে তােলা সম্ভব হবে, তাদের জীবন হবে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত এবং তখনই তারা গােটা-বিশ্ববাসীর ইহকাল ও পরকালের কল্যাণে আত্মনিয়ােগ করতে পারবে। মদীনার জীবনে যখন এমন পরিবেশ সৃষ্টি হলাে তখনই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, হিজরতের পর মােশরেকদের সাথে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন যাতে করে তারা অহংকারী ও বলদর্পী দুশমনদের আক্রমণ থেকে তাদের ঈমান আকীদা এবং জান মাল ও ইযযত আবরু রক্ষা করতে পারে। আর এটাও লক্ষ্যযােগ্য যে আল্লাহ তায়ালা যুদ্ধের অনুমতি তখনই দিলেন যখন কাফেরদের দৌরাত্ব সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে এবং মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে তারা সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছিলো। এজন্যে আল্লাহ তায়ালা চাইলেন যে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে তার দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরী হয়ে যাক, যার ছায়াতলে সত্যপন্থী ও সত্যাশ্রয়ী মুসলমানরা নিরাপদ হয়ে যাবে মানুষের গােলামী থেকে মুক্তিকামী অপর সকল মানুষের জীবন এই জন্যেই আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা এই প্রতিরােধকামী মুসলমানদের সাথে ওয়াদা করলেন যে অবশ্যই তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন ও পৃথিবীর বুকে তিনি ক্ষমতাসীন বানাবেন। অবশ্য এর জন্যে তিনি শর্ত দিলেন যে মুসলমানদের আত্মসচেতন হতে হবে, সকল জড়তা ও দুর্বলতার জালকে ছিন্ন করে তাদের জেগে উঠতে হবে এবং তাদের মালিক মনিব সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করে তাদের আকীদাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এগিয়ে যেতে হবে, এর পূর্ণ বিবরণ নীচের আয়াতগুলােতে দেয়া হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের ওপর থেকে শত্রুদের আক্রমণকে প্রতিহত করবেন… আর আল্লাহরই হাতে রয়েছে সকল কাজের পরিণতি'(আয়াত ৩৮-৪১) এটা অবশ্যই সত্য কথা, চিরদিনই দুনিয়ায় অন্যায় ও অসত্যের প্রসার বেশী দেখা যায় এবং এটাও সত্য যে ভালাে ও মন্দ এবং ন্যায় ও অন্যায় পথ বা কাজের মধ্যে নিরন্তুর এক সংঘাত লেগে রয়েছে, একইভাবে ঈমানী শক্তি ও আল্লাহদ্রোহী শক্তির মাঝেও সেই দিন থেকে সংঘর্ষ লেগে রয়েছে যেদিন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পয়দা করেছেন। এটাও দেখা যায় যে, যে কোনাে মন্দ জিনিসই অ-গােছালাে ও অশান্তিকর হয় এবং মিথ্যা সদা-সর্বদাই অস্ত্র সজ্জিত থাকে। মিথ্যা শক্তি বে-পরওয়াভাবে মানুষকে পাকড়াও করে এবং কাউকে আঘাত করার সময় ডানে বায়ে তাকায় না, আর ন্যায় পথের পথিকদেরকে সত্যভ্রষ্ট করার জন্যে তাদেরকে নানা প্রকার ফিৎনার মধ্যে ফেলে দেয় এবং সত্য পথ জানা ও দেখার পরও তার থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখে, এজন্যে এসব জবরদস্তি থেকে বাঁচানাের জন্যে সত্যের সমর্থনে কাউকে না কাউকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। যেন সত্যকে সমর্থন দেয়া যায় এবং অসত্যের উপদ্রব ও অনিষ্টকারিতা থেকে সত্যকে পাহারা দিয়ে এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা কখনও চাননি ঈমানী শক্তি, কল্যাণ তৎপরতার উদ্যোগ ও সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একাকী ও অসহায় অবস্থায় পতিত হােক এবং তারা একঘরে হয়ে থেকে সকল বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে একাকী সংগ্রাম করুক। আল্লাহ তায়ালা এটাও চাননি যে আল্লাহর ভক্ত অনুগত বান্দাহরা শুধুমাত্র ঈমানী মনােবলকে সম্বল করে পৃথিবীর বস্তু শক্তির বিরুদ্ধে নিরন্তরভাবে রুখে দাঁড়াক, মােকাবেলা করুক আত্মম্ভরী ও অহংকারী ক্ষমতাধরদের সাথে একেবারে খালি হাতে অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে বিশ্ব মানবের কল্যাণ সাধন করার জন্যে শুধু তত্বকেই যথেষ্ট মনে করা হয়নি- মােটেই আল্লাহর সুন্নত এটা নয় যে তার সৈনিকরা ঢাল নেই, তলােয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার হয়ে যে কোনাে মারনাস্ত্রের সামনে খালি হাতে এগিয়ে যাক, বরং অন্তরের গভীরে বিশ্বাসের সুবিশাল দৃঢ়তার সাথে তাদেরকে অবশ্যই সেইসব সর্বাধুনিক সমর সজ্জায় সজ্জিত হতে হবে যা নিয়ে বড়াই করছে শক্তিধরেরা এবং হা হা করে এগিয়ে আসছে আত্মগর্বী অহংকারী বলদর্পীরা- মােমেনদের হাতেও প্রকৃতপক্ষে অনুরূপ অস্ত্র হওয়া শর্ত, কিন্তু অস্ত্রের পরিমাণে বা জন সংখ্যায় এক হতে হবে এটা মােটেই জরুরী নয়- শত্রুর চোখে এক-কে দশ করে দেখানাে এটা আল্লাহর দায়িত্ব, আর এই সাহায্য লাভের জন্যে মােমেনীন সালেহীনের কাছে আল্লাহ তায়ালা দাবী করেন পর্বতসম দৃঢ়তা, অবিচলতা-নিষ্ঠা ও আল্লাহর মহব্বতে সব কিছুকে বিলিয়ে দিয়ে, উদ্দেশ্য সাধনে নিঃশেষে নিজেদের জীবনটুকু পর্যন্ত কোরবানী করার মনােবাঞ্ছার প্রমাণ। মােমেনরা তো মানুষই- মানুষের মধ্যে সম্ভাব্য দুর্বলতার উর্ধে তারা নয়। কাজেই যা মানুষের চোখে ধাধা লাগায়, তাদের চোখেও তা চমক সৃষ্টি করে- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল মানুষের স্বাভাবিক এসব দুর্বলতা জানেন, এজন্যে তিনি তাদেরকে এমন কঠিন পরীক্ষায় ফেলতে চাননি যা তাদের প্রকৃতির খেলাফ। তবে, আল্লাহর ওয়াদা হচ্ছে, যখনই তারা শত্রুর মােকাবেলা করার জন্যে মনে প্রাণে প্রস্তুত হয়ে যাবে এবং যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে যে কোনাে শক্তিকে প্রতিরােধের জন্যে, মনের মধ্যে থাকবে ‘বিনা রনে ছাড়ি নাহি দিবাে এক ইঞ্চি ভূমি’ তখনই আল্লাহর গায়েবী মদদ নেমে আসবে। তাই দেখা যায়, তৎকালীন নিবেদিত প্রাণ মােমেনদেরকে আল্লাহ তায়ালা তখনই যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছেন যখন তারা মানসিক প্রকৃতির সাথে সাথে যথাসম্ভব বস্তুগত প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছে এবং তখনই তাদেরকে তিনি আক্রমণকারীকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার জন্যে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে আল্লাহ তায়ালা নিজেই যুদ্ধের খবরদারী করবেন এবং অবশ্যই তারা আল্লাহর সাহায্যের ছায়াতলে থাকবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের পক্ষ থেকে প্রতিরােধ করবেন।’ বিশ্ব সম্রাট আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের দুশমনদেরকে তাদের কুফরীর কারণে চরমভাবে ঘৃণা করেন এবং অবশ্য অবশ্যই তিনি তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন যেহেতু তারা সকল প্রকার আমানতের খেয়ানত করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা কোনাে খেয়ানতকারী কাফেরকে পছন্দ করেন না।’ তিনিই সকল শক্তির আধার- তার এই শক্তি বলেই তিনি মােমেনদের ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত করে ফেলেছেন যে তাদের শত্রুকে তিনি প্রতিহত করবেনই এবং মােমেনদের দলের মধ্যে শৃংখলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখবেন যেহেতু তারা মযলুম- অন্যায়ভাবে তারা আক্রান্ত, মােটেই তারা অহংকারী নয়, মোটেই তারা নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের আকাংখী নয়, একথাটিই ফুটে উঠেছে নীচের আয়াতাংশে, ‘তাদেরকে যুদ্ধ করার জন্যে অনুমতি দেয়া হলাে যেহেতু তাদের প্রতি যুলুম করা হয়েছে।’ আর তাদেরকে জানানাে হচ্ছে, তারা যেন নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত থাকে যে অবশ্যই আল্লাহর সমর্থন ও সাহায্য আসবেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর নিশ্চিত একথা সত্য যে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে অবশ্যই সম্পূর্ণ সক্ষম।’ চিন্তাগত দিক দিয়ে মােমেনরা যুদ্ধ করার কাজটিকে যে ভালাে কাজ বলে বুঝলেন তার কারণ হচ্ছে যালেমদের যুলুমকে উৎখাত করে যে সঠিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে তাতে বান্দাহদের বন্দেগী থেকে মানুষকে মুক্ত করে আল্লাহর প্রভুত্ব কায়েম করা ও বান্দাহদেরকে তার বন্দেগী করার সুযােগ করে দেয়ায় সামগ্রিকভাবে সমগ্র মানবতার উপকার হবে- শুধুমাত্র মুসলমানদের নয়। আর এ কল্যাণ সাধনে সকল মােমেনকে সামগ্রিকভাবে সংগ্রাম করতে হবে। এই যুদ্ধ-সংগ্রামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সকল প্রকার জড়তা ও অস্পষ্টতার মধ্য থেকে আকীদা ও এবাদাতের মুক্তি, আর এ মুক্তির পথ রচিত হয়েছে মক্কার মযলুম মুসলমানদের স্বদেশ থেকে না হক ভাবে বহিষ্কৃত হওয়ার বদৌলতে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘(সে মযলুম জনতা তারাই) যাদেরকে কোনাে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজেদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে; তাদেরকে শুধু মাত্র একথার কারণে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ।’ মুসলমানদের যুদ্ধ করা সম্পর্কে আধুনিক দুনিয়ার মানুষ যতাে কথা বলুক না কেন তার মধ্যে একথাটাই সব থেকে সত্য এবং সব থেকে সঠিক অথচ হায়! এই সর্বাধিক সত্য সঠিক কারণেই তাদেরকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছে। নিসন্দেহে ক্ষমতাগর্বী নেতৃবর্গের পক্ষ থেকে এ আচরণ ছিলো সর্বদিক দিয়েই জঘন্য- এতে ব্যক্তিগত সাময়িক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী কোনাে লক্ষ্য এই নিষ্ঠুর আচরণের পেছনে নেই। মক্কী যিন্দেগীতে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তারা তাে সমাজ জীবনের বাস্তব কোনাে ব্যাপারে হাত দিচ্ছিলেন না, নিছক বিশ্বাসগত এক পরিবর্তন এসেছিলো তাদের জীবনে, কিন্তু যালেমরা এতােটুকু অপরাধ (?) ও সহ্য করতে রাযি ছিলাে না, এর জন্যেই তাদেরকে অসহায় অবস্থায় নিজেদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। তারা কারাে কোনাে স্বার্থে হস্তক্ষেপ করছিলেন না, এমনও কিছু করছিলেন না যাতে তাদের লােভ-লালসা চরিতার্থ হওয়ার পথে তাৎক্ষণিকভাবে কোনাে আঘাত লাগছিলাে। কোনাে স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছিল, তাদের জীবন ধারণ পদ্ধতি বদলে যাচ্ছিলাে বা তাদের কোনাে উপকারের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাে। এতদসত্তেও এসব কিছুর পেছনে যে সরল সত্য কথাটা বিরাজ করছে, অর্থাৎ আল্লাহকেই একমাত্র রব মানার ব্যাপার- এই আকীদাকেই তারা বরদাশত করতে পারছিলাে না এবং ভাবছিলাে নির্যাতনের ষ্টীম রােলার চালালেই সবাই ও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, সব কিছু পরিত্যাগ করে, আবার সবাই তারা ফিরে আসবে বাপ-দাদার ধর্মে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘যদি আল্লাহ তায়ালা এক দলকে অপর আর এক দল দ্বারা দমন না করতেন তাহলে ধ্বংস হয়ে যেতাে দরবেশদের নির্জন ইবাদতখানা খৃষ্টানদের গীর্জাসমূহ, ইহুদীদের উপাসনালয়গুলাে এবং মুসলমানদের মাসজিদসমূহ- যেখানে বেশী বেশী আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়।’ এখানে ব্যবহৃত শব্দগুলােতে ‘সাওয়ামি’ বলতে বোঝানো হয়েছে দরবেশদের নির্জন এবাদাতখানাসমূহ, ‘বিয়ায়ুন’ বলতে বুঝানাে হয়েছে সওয়ামি থেকে প্রশস্ত খৃষ্টানদের গীর্জাসমূহ, ‘সালাওয়াতুন’ বলতে বুঝানাে হয়েছে ইহুদীদের এবাদতখানাসমূহ এবং ‘মাসাজিদ’ বলতে বুঝানাে হয়েছে মুসলমানদের এবাদাতের ঘরসমূহকে অর্থাৎ মাসজিদসমূহকে। উল্লেখিত এ সকল ঘর বরাবরই প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে খাস করে একমাত্র আল্লাহর এবাদাতের জন্যে- অর্থাৎ এ স্থানগুলাে নির্মিত ও সংরক্ষিত হয়েছে, এ স্থানগুলােতে সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করা ও তার শ্রেষ্ঠত্ব-জ্ঞাপক প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করার জন্যে; কাজেই এসব স্থানগুলােকে ধ্বংস করার জন্যে মােশরেকরা টার্গেট বানিয়ে রেখেছিলাে এসব স্থানে একমাত্র আল্লাহরই স্মরণ হবে এবং তাদের দেব-দেবীদের কোনাে স্থান এসব জায়গায় থাকবে না- এটা ছিলাে তাদের সহ্যের বাইরে। এজন্যে এগুলােকে ভেংগে দিতে তারা ছিলো বদ্ধপরিকর। তাদের আক্রোশ থেকে এগুলোর রেহাই পাওয়ার কোনাে উপায় ছিলাে না যদি না তাদের মধ্যে দলাদলি হতাে এবং এক দল আর এক দলকে দমন না করতাে প্রকৃতপক্ষে এগুলাে হচ্ছে মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত এক প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা। তারা বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে নিজ নিজ দেব-দেবীদের প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব কায়েমের জন্যে চেষ্টা করছে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা এমনই ব্যস্ত হয়ে থাকতাে যে তারা অপরের কথা ভুলে যেতো অথবা শক্তিহীন হয়ে পড়তাে সে সব এবাদতখানা ভাংগার ব্যাপারে। বাতিল শক্তি সর্বদাই অহংকারে পরিপূর্ণ হয়, তার এ দম্ভ কখনও থামেনা বা শেষ হয় না, আর একারণেই সে অবিরতভাবে অন্যায় কাজ করতেই থাকে; এজন্যে এ অসুর শক্তিকে দমন করার জন্যে দরকার এমন কোনাে শক্তি যা তার পাশাপাশি থেকে তার গতির সাথে তাল রেখে চলতে পারে, প্রতিবাদী ও প্রতিরােধকারী সে বাতিল শক্তিই সে অশুভ শক্তির সাথে থেকে তালে তাল মিলাতে পারে, মিথ্যা বলাতে ও মিথ্যা বলতে পারে। নিষ্ঠুরতার জওয়াব দিতে পারে নিষ্ঠুরতা দিয়ে, প্রয়ােজনে ধোকা দিতে পারে। কেননা অনেক সময় সত্য সঠিক ব্যবস্থা দ্বারা ওদের জওয়াব ঠিক মতাে হয় না। এ স্বতসিদ্ধ আইনের নিয়ম বরাবর একইভাবে চালু রয়েছে জীব জগতে ও জড় জগতে কার্যকর রয়েছে। *আল্লাহর সাহায্য কখন আসে : নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালাই যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছেন সেসব মােশরেকদের বিরুদ্ধে যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে এগিয়ে আসছিলাে এবং তাদের বিরুদ্ধে বাতিল শক্তি সীমালংঘন করছিলাে- এজন্যে আল্লাহ তায়ালা নিজেই মােমেনদের পক্ষে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্যে নিজেই উদ্যোগ নিলেন আর অবশ্যই কাফের খেয়ানতকারী, অহংকারে পরিপূর্ণ তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা ঘৃণা করেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের পক্ষ থেকে (তাদের শত্রুর আক্রমণ) প্রতিহত করবেন নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা খেয়ানতকারী কাফেরদেরকে পছন্দ করেন না।’ অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে তিনি নিজেই তাদের পক্ষ থেকে কাফেরদের যে কোনাে আক্রমণকে প্রতিহত করবেন। আর এটা কি বুঝতে কষ্ট হয় যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা যার পক্ষ নেন তার কোনাে চিন্তা বা ভয় থাকার প্রশ্নই আসে না? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন মােমেনদেরকে বিজয় দান করার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন তখন আবার নিজের ভয় বা চিন্তা… এখন প্রশ্ন আসে কিসের কারণে এ যুদ্ধ এবং কিসের কারণেই বা জিহাদের ডাক, কিসের কারণেই বা লড়াই করে প্রাণ হারানাে বা জখম হওয়া? কিসের কারণেই বা এতাে সংগ্রাম, এতাে কষ্ট, এতাে ত্যাগ স্বীকার, এতাে রক্তক্ষয়, এতাে ব্যথা-বেদনা… যুদ্ধের পরিণামে যখন বিজয় সুনিশ্চিত-একথা তাে আল্লাহর জানাই আছে এবং মােমেনদের যখন জানাই আছে পরিণতিতে বিজয় আসবেই তখন এই যুদ্ধ বিগ্রহের প্রয়ােজনটা কি? এসবের জওয়াব হচ্ছে, প্রথম কথা আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারের মধ্যে রয়েছে এসবের রহস্যরাজি এবং সব কিছুর পেছনে রয়েছে চূড়ান্ত যুক্তি যা হয়তাে আমাদের সীমিত বুদ্ধির কারণে সঠিকভাবে সবকিছু নাও বুঝতে পারি। তবে চিন্তা করলে আমরা আল্লাহর হেকমতকে কিছু না কিছু অবশ্যই বুঝতে পারি। এ বুঝবার ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান-গবেষণা ও অভিজ্ঞতা কম বেশী হওয়ার কারণে হয়তাে কিছু তারতম্য হতে পারে। তবে, আমাদের সবাই সাধারণভাবে যে জিনিসটা বুঝতে পারি। তা হচ্ছে যে আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালা কিছুতেই চান না যে ইসলামের মৌখিক দাওয়াত তীর ধনুক প্রয়ােগের মাধ্যমে যুদ্ধের দ্বারা মানুষকে প্রভাবিত করার দ্বারা দ্বীনের দাওয়াত বিফল হয়ে যাক। অবশ্যই মােমেনদের মধ্যে একদল লােক সকল সময়েই আছে যারা যুদ্ধের কোনাে ঝুঁকি না নিয়ে এবং ময়দানে না গিয়ে ঘরে বসে থাকতে চায়, চায় সহজেই আল্লাহর সাহায্যে বিনা কষ্টে বিজয় এসে যাক। যখনই কোনাে কষ্ট হয় ও কোনাে আক্রমণ আসে তখন তারা শুধু নামায কায়েম, কোরআন তেলাওয়াত এবং কায়মনােবাক্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করাকেই যথেষ্ট মনে করে। হাঁ, অবশ্যই নামায কায়েম করতে হবে এবং সুখে ও দুঃখে দোয়া করার মাধ্যমে অবশ্যই আল্লাহমুখী হতে হবে, কিন্তু এতােটুকু কাজ করাকে এবাদাত বা বন্দেগী (মনিবের আনুগত্য) মনে করা এবং এর দ্বারা দাওয়াত দান করার দায়িত্ব পালন করা হয়েছে এবং দ্বীনের সাহায্যকারীর ভূমিকায় সঠিক অবদান রাখা হয়েছে বলে মনে করা কিছুতেই সঠিক হবেনা? বরং আসল ব্যাপার হলাে যে উপরােল্লেখিত আনুষ্ঠানিক এবাদাতসমূহ মােমেনকে জীবনের বাস্তব সমরক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়? অবশই আমরা সবাই এ বিষয়ে একমত হবাে যে বিশ্ব জোড়া আল্লাহর এই বিশাল সাম্রাজ্য তার প্রজাদের সুখে-শান্তিতে ও নিরাপদে রাখার লক্ষ্যে, তাঁরই আইন কানুন চালু করার মাধ্যমে তার প্রভূত্ব কায়েম করার জন্যে যে সুশিক্ষিত সুবিন্যস্ত সৈন্যবাহিনীর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়ােজন- ওপরে বর্ণিত গুণাবলীর মাধ্যমে সেই যােগ্যতাই অর্জিত হয় এবং সে গুণাবলীর মাধ্যমে। মানুষ আল্লাহর সাথে নিজেকে সম্পর্কিত মনে করতে পারে। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা মােমেনদের পক্ষে থেকে তাদের শত্রুদের আক্রমণকে প্রতিহত করতে চেয়েছেন এবং তাদের সাথে এ ব্যাপারে ওয়াদা করেছেন, অবশ্যই তিনি তাদের পদ্ধতিতে এবং তাদেরই হাত দিয়ে এ ওয়াদা পূরণ করবেন, যাতে করে যুদ্ধকালে তাদের অনুসৃত পদ্ধতি ফলপ্রসু বলে প্রমাণিত হয়। অতপর অবশ্যই এটা স্থির সত্য যে, যে কোনাে মানবগােষ্ঠি যখনই তাদের সঞ্চিত শক্তিকে জাগ্রত করতে চায় তখনই তারা অবশ্যই কোনাে বিপদের ঝুঁকি নেয় আর তখনই তারা অন্যায়কারীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং তখনই অশুভ শক্তিকে তারা দমন করতে সক্ষম হয়। এ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে তাদেরকে সংগ্রহ করতে হয় শক্তি সামর্থ এবং একত্রিত করতে হয় তাদের সম্মিলিত জনশক্তিকে, তাদেরকে সংগঠিত করতে হয় ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হয়, তাদের মধ্যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি দরদ মহব্বত ও ত্যাগ-তিতিক্ষার অনুপ্রেরণা জাগাতে হয়, তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতার মনােভাব গড়ে তুলতে হয়, তাদের সম্ভাব্য সকল যুদ্ধাস্ত্র ও সাজ সরঞ্জাম নিয়ােজিত করতে হয় এবং সর্বান্তকরণে ও সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিয়ে বাস্তব রণক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হয়। আল্লাহর খলীফা হিসেবে তার দ্বীন কায়েমের যে বিরাট আমানত তারা কাঁধে তুলেছিলাে সে বােঝা বহন করার জন্যে এবং তার হক আদায় করার জন্যে সর্বপ্রকার প্রস্তুতি তারা নিয়েছিলাে। এসব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে আশু সাহায্য আসা আল্লাহর জন্যে কোনাে ব্যাপারই নয়। আর ঘরে বসে থাকা ও নির্বিকার চিত্তে গৃহের পরিবেশে নির্ঝঞ্জাট বসে থাকলে মােমেনদের মধ্যে যেসব সম্ভাবনার বীজ রেখে দেয়া হয়েছে তার আত্মপ্রকাশ বন্ধ হয়ে থাকবে, কেননা এ শক্তি নড়া-চড়ার অভাবে নির্জীব হয়ে যেতে বাধ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন, তার সৈনিকদেরকে সময় মতাে এবং দ্রুত গতিতে সাহায্য করার জন্যে সর্বদা প্রস্তুত, কিন্তু তার জন্যে তার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে যে তৎপরতা প্রয়ােজন, তা যদি যথাসময়ে ও যথাযথভাবে গ্রহণ করা না হয় তাহলে সে সাহায্য আসা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, অল্প মূল্যে সুন্দর ও ভালাে সওদা পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যদি এমন মূল্যবান কোনাে বস্তু অল্প মূল্যে পাওয়াও যায়, সেগুলাের মূল্যায়ন হয় না এবং দেখা যায় সঠিকভাবে কাজে না লাগানাের কারণে ও অব্যবহৃত অবস্থায় তা নষ্ট হয়ে যায়। একইভাবে অল্পমূল্যে সংগৃহীত অস্ত্র সমরক্ষেত্রে নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায় না, আর যদি ভালাে অস্ত্র অল্পমূল্যে পাওয়া যায় তাহলে তার কদর হয় না এবং অযত্ন-অবহেলায় ফেলে রাখায় তা নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহর সাহায্য লাভের জন্যে একাধারে হৃদয়ের আবেগ ও বাস্তব প্রশিক্ষণ প্রয়ােজন এবং আল্লাহর সাহায্য বিজয় ও পরাজয়, আক্রমণ ও পলায়ন, শক্তি ও দুর্বলতা এবং ময়দানে অগ্রগতি ও ময়দান থেকে পলায়ন এসব অবস্থা মানুষ দেখে দেখেই বিভিন্নমুখী অভিজ্ঞতা লাভ করে। এসব অবস্থার পর্যায়ক্রমে আগমনে মানুষের মধ্যে যেসব চেতনা জাগে, তার মধ্যে রয়েছে আশা আকাংখা, ব্যথা-বেদনা, খুশী আনন্দ ও দুঃখ-দৈন্য, রয়েছে প্রশান্তি ও পেরেশানী। এসব চেতনার মধ্যে রয়েছে দুর্বলতা ও মুক্তির অনুভূতি… আর এগুলাের সাথে রয়েছে আকীদা বিশ্বাস, দলীয় জীবন এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রের মধ্যে ও যুদ্ধ ক্ষেত্রের বাইরের জীবনের প্রশস্ত ক্ষেত্রসমূহে নিয়ম শৃংখলা ও নিয়মানুবর্তিতা। এ সকল অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত মানুষের মধ্যে নিহিত শক্তি ও দুর্বলতার বিভিন্ন দিক বিকশিত হয়। এসব অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েই জীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর রণক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্যে ও মানুষের বিভিন্নমুখী প্রবণতার সাথে সংঘাতকালে তাদের কাছে সঠিক দাওয়াত পেশ করা ও বিজয়ী হওয়ার জন্যে ওপরে বর্ণিত সকল প্রকার পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা প্রয়ােজন, যেহেতু মানুষকে দুনিয়ায় এসব অবস্থা নিয়েই চলতে হয়। এসব কিছুর কারণে এবং এগুলাের বাইরে আল্লাহ তায়ালা আরাে যা কিছু শিখিয়েছেন তা নিয়েই আমাদেরকে ময়দানে কাজ করতে হবে… এভাবেই মােমেনদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তায়ালা যে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন তা তাদের হাত দিয়েই বাস্তবায়িত করবেন আর এজন্যে তাদেরকে সাধ্যমত প্রস্তুতি নিয়ে ময়দানে নামতে হবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আকাশ থেকে ফেলে দেয়া এমন কোনাে নেয়ামতের পুটলি নয় যা বিনা কষ্টে নেমে আসবে।[{এতদসত্বেও এটা সবৈব সত্য কথা যে ইসলাম যুদ্ধকে তার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেনি। অর্থাৎ যুদ্ধ করার জন্যই ইসলাম এসেছে এবং যুদ্ধ ছাড়া ইসলাম অন্য কিছু মানতে রাজি নয়-এমনটি মোেটই নয়; বরং ইতিহাস সাক্ষী যে, যে কোন যুদ্ধের পূর্বে আলাপ-আলােচনা ও শান্তি-চুক্তি করাকে বরাবরই অগ্রাধিকার দিয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠাই ইসলামের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য প্রতিষ্ঠা কল্পে এই মহান আন্দোলনের সফল তৎপরতা পরিচালিত হয়েছে। আল কোরআনের বহু আয়াত আবারা একখা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে; কিন্তু এ শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে ইসলাম অবশ্যই একথা নিশ্চিত করতে চায় যে এ কাজে কেউ বাধা দেবে না, কেউ কারাে ওপর অত্যাচার করবে না, কারাে স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। এ সমস্ত বিদ্রোহাত্বক ও যুক্তিহীন কাজ যেখানেই হােক এবং যার দ্বারাতেই হােক না কেন, এসব কাজ ও আচরণ যদি মানবতা বিরােধী হয়, অর্থাৎ কোন ব্যক্তি, শক্তি বা গােষ্ঠী যদি কোন জনপদের চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, আল্লাহর বান্দাহ হিসাবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র তাঁরই বন্দেগী করার কাজে যদি কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ইনসাফপুর্ণ বিচার-ফায়সালায় যদি কেউ বাধা দেয়, মানুষের পাওনা পরিশােধ করতে গিয়ে কেউ যদি ইনসাফ না করে গনিমতের মাল ও অন্যানা বস্তু বন্টনে কেউ যদি সঠিক ফায়সালা না করে, যার যার পাওনা তা যদি সঠিকভাবে বুঝে না দেয়া হয়, আল্লাহর দেয়া সীমার মধ্য থেকে মানুষ যদি ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে অবশাই তার বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। মূল্যায়ন করার এসব বস্তুর মধ্যে যে কোন একটার যেভাবেই মূল্যায়ন করা হােক না কেন, ব্যক্তির কাছে ব্যক্তির দাবী হােক বা সমাজের কাছে ব্যক্তির দাবীজনিত বিষয় হােক অথবা ব্যক্তির কাছে সমাজের ও সমাজের কাছে সমাজের দাবীর ব্যাপার হােক অথবা কোন রাষ্ট্রের অন্য কোন রাষ্ট্রের পাওনা হােক না কেন এগুলো কোন একটিও যদি পূরণ না করা হয় তাহলেও সেসব আচরণ বিদ্রোহাত্মক বা অন্যায় কাজ বলে গণ্য করা হবে। এ ধরনের কোন অন্যায় কাজ করে ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করেছে বলে নিশ্চিন্ত হতে পারে না। আবার কেউ যদি মনে করে ইসলাম অর্থ ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক থেকে নিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতিতে জাতিতে আদান-প্রদান ও চুক্তি বিনিময়ের মধ্যে সীমাবন্ধ সে কথাও ঠিক নয়, বরং আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত বিধান মতে সমাজের সকল তর ও পর্যায়ে হক ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার নামই ইসলাম (আরও বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ‘আস-সালামুল আলামী আল ইসলাম’ গ্ৰন্থটি)}] যারা যুলুম করেছে, অন্যায়-অত্যাচার করেছে এবং মানুষকে তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে, তাদের ওপর, সেই সকল হক পন্থী, যারা ঘােষণা দিয়েছে যে, আমাদের রব আল্লাহ তাদের বিজয় দান করতে কিছু বিলম্ব করা হয়েছে, আর এই বিলম্বের পেছনে অবশ্যই কিছু যুক্তিসংগত কারণ আছে, যা আল্লাহ তায়ালাই ভালাে করে জানেন। অবশ্যই কিছু হেকমত আছে যে এ জন্যে তিনি বিজয় দিতে কিছু দেরী করেছেন। এই বিজয় দান করার কাজ পরিচালনা ও সূচনা ততােক্ষণ পর্যন্ত করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মােমেন সমাজের বুনিয়াদ মযবুত না হয় এবং তাদের সব কিছুর মধ্যে পরিপক্কতা না আসে, কারণ কোনাে কিছু পরিপক্ক হয়ে গেলে তাকে পরিপক্কতা দান করতে আর কেউ এগিয়ে আসতে সাহস করবে না, একবার পরিপূর্ণতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারলে তার ওপর নতুন আর কোনাে মত প্রকাশের সুযােগ কেউ পাবে না এবং একবার ইসলামী শক্তি আত্মপ্রকাশ করার পর ইসলামের দুশমনরা তার বিরুদ্ধে তৎপরতা চালানাের সাহস হারিয়ে ফেলবে। সকল প্রকার কাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যােগ্যতা লাভ করার পূর্বেই যদি আল্লাহ তায়ালা সাহায্য ও বিজয় এসে যায় তাহলে মুসলমানেরা এ বিজয়কে বেশীদিন ধরে রাখতে পারবে না, বরং যােগ্যতার অভাবে শীঘ্রই তারা এই সহজ বিজয়কে হারিয়ে ফেলবে! এই কারণেই দেখা গেছে, বিজয় দান করা হয়েছে তখন যখন মুসলমানরা সাধ্যমত যােগ্যতা অর্জন করেছে, তাদের একতা সুসংবদ্ধ হয়েছে, তাদের নিজ মিশনের প্রতি মহব্বত আশানুরূপ প্রগাঢ় হয়েছে, কিছু জনশক্তি সৃষ্টি হয়েছে, মনােবল গড়ে উঠেছে এবং যথাসাধ্য হাতিয়ার ও রসদও যােগাড় হয়ে গেছে; যখন আল্লাহর পথে সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার জন্যে সর্বোতভাবে তারা প্রস্তুত হয়ে গেছে ঠিক তখনই এসেছে আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য ও বিজয়। রসূলুল্লাহ(স.) পরিচালিত এই ক্ষুদ্র উম্মতের জন্যে তখনই সাহায্য এসেছে যখন তারা তাদের শক্তি-সামর্থ ও যােগ্যতা সবটুকু ব্যবহার করেছে এবং পরিশেষে আল্লাহর ওপর এই অনুভূতি নিয়ে পূর্ণ তাওয়াক্কুল করেছে যে, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সকল যােগাড় যন্ত্র বিফল। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর সাহায্য তখনই নাযিল হবে যখন তারা সাধ্যমত সব কিছু করবে এবং এরপর আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। কখনও এ কারণেও সাহায্য বিলম্বিত করা হয় যে আল্লাহ তায়ালা চান মানুষ আরাে বেশী আল্লাহর মুখাপেক্ষী হােক, তার কাছে আরাে কাতর হােক এবং কায়মনােবাক্যে তার কাছে প্রার্থনা করুক, এর ফলে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হওয়ার সুযােগ হবে। এদেরকে সাহায্য চাইতে হবে, ব্যথা-বেদনা ভােগ করতে হবে এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং মনের মধ্যে সর্বদা একথা রাখতে হবে যে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তাদের সাহায্যকারী আর কেউ নেই এবং দুঃখের দিনে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এমন কেউ নেই যার আশ্রয় কামনা করা যেতে পারে। আর যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিজয় লাভ করার পর আল্লাহর পথে মযবুতীর সাথে টিকে থাকার জন্যে আল্লাহর সাথে এই সম্পর্কই মানুষকে সাহায্য করে, যেহেতু তার অনুমতিক্রমে তারা যুদ্ধ করে। কাজেই, তারা মনে করে এ বিজয়ের যাবতীয় কৃতিত্ব আল্লাহর, এতে তাদের ফুর্তি করার কিছু নেই, গর্ব করার তাে প্রশ্নই ওঠেনা। আর এজনাে তারা কোনাে অহংকারও করে না এবং সত্য সঠিক কাজ ও ইনসাফ করা থেকেও সেইসব কল্যাণকর কাজ থেকে তারা পিছিয়ে যায় না, যার কারণে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেছেন। আবার, কখনও সাহায্য আসতে এজন্যেও বিলম্ব হয় যে, আল্লাহ তায়ালা দেখে নিতে চান কে সংগ্রাম করা থেকে থেমে যায়, পরখ করে নিতে চান কে আল্লাহর পথে কতটুকু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত, আর কে নিজ স্বার্থের জন্যে যুদ্ধ করে এবং কে যুদ্ধ করে শত্রুর মােকাবেলায় নিজের বাহাদুরী প্রদর্শনের জন্যে। আল্লাহ তায়ালা চান জিহাদ একমাত্র তার জন্যেই করা হােক এবং তার পথেই করা হােক, এতে অন্য কোনাে চিন্তা-চেতনা বা উদ্দেশ্য না থাকুক। একবার রসূলুল্লাহ(স.) কে জিজ্ঞাসা করা হলাে, এক ব্যক্তি যুদ্ধ করে আত্ম মর্যাদা, বংশ বা জাতির স্বার্থে, এক ব্যক্তি যুদ্ধ করে নিজ বাহাদুরি প্রদর্শনের জন্যে, আর এক ব্যক্তি লােককে দেখানাের জন্যে যুদ্ধ করে এদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে বলে মনে করা যায়। তখন রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, যে আল্লাহর কথা (ও কাজকে) এবং আল্লাহর প্রাধান্যকে সমুন্নত করার জন্যে যুদ্ধ করে সেই প্রকৃত পক্ষে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে।(বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন) আবার কখনও সাহায্য আসতে একারণেও বিলম্ব হয় যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে তার অকল্যাণের মধ্যে কিছু কল্যাণকারিতা থাকতে পারে, যা পরখ করার জন্যে অথবা যাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে অবস্থিত কিছু ভালাে লােককে বের হয়ে পৃথক সুযােগ দেয়ার অপেক্ষায় বিলম্ব করা হয়, যাতে করে নিশ্চিন্তে যুদ্ধ করা যেতে পারে এবং যেন মন্দকে দূর করতে গিয়ে ভালাের এতোটুকু ক্ষতি না হয় বা কোনাে কল্যাণকারিতা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে না যায়। কখনও আবার এজন্যেও বিলম্বে সাহায্য আসে যে, যাদের সাথে মােমেনরা যুদ্ধরত তাদের মিথ্যাচার সাধারণ মানুষের কাছে এখনও পুরােপুরি পরিষ্কার নয়। এমতাবস্থায় মােমেনরা বিজয়ী হয়ে গেলে তাদের আশেপাশে যাদেরকে তারা সাহায্যকারী হিসাবে দেখতে পাবে তারা আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে পারবে না এবং গােপনে গােপনে তারা বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমানদের অর্জিত বিজয়কে নস্যাৎ করতে চাইবে, এর ফলে, যেসব সরল মানুষের কাছে সকল ঘটনা স্পষ্ট নয় তারা সঠিক অবস্থা বুঝতে না পারায় দারুণ সংকট অনুভব করবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এজন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন চান, বাতিল ব্যবস্থার অসারতা সাধারণ জনগণের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তা টিকে থাকুক। আর সত্য ব্যবস্থার অনুসারীরা যেন এই বিলম্বিত সাহায্যের কারণে আফসােস না করে। আবার কখনও এজন্যেও সাহায্য আসতে বিলম্ব হয় যে, মােমেনরা যে সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা কবুল করেছে, তা রাষ্ট্রিয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মতাে পরিবেশ হয়তাে এখনও গড়ে ওঠেনি, ইসলাম যে ন্যায়-নীতি ও সুবিচার কায়েম করতে চায় তার সঠিক মূল্যায়ন করার যােগ্যতা এখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে পয়দা হয়নি। এমতাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় যদি এসে যায় তাহলে গােটা পরিবেশ আরও বেশী বিরােধী হয়ে উঠবে এবং সর্বদাই এ বিজয়কে তারা বাঁকা চোখে দেখবে এবং এ বিজয়কে বিফল করার জন্যে নানা প্রকার চক্রান্ত করতে থাকবে। এর ফলে সমাজের মধ্যে সর্বদা একটা ঠান্ডা যুদ্ধের পরিবেশ বিরাজ করতে থাকবে এবং মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যে তাদের স্বভাব-প্রকৃতির উপযােগী করে যে ব্যবস্থা পাঠানাে হয়েছে তার কার্যকারিতা ব্যাহত হবে! ওপরে বর্ণিত কারণসমূহ ছাড়াও হয়তাে আরাে কিছু কারণ আছে যেগুলাে বিবেচনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুসলমানদের সাহায্য করতে বিলম্ব করেছেন। এজন্য অনেক কোরবানী দিতে হয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এবং বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদেরকে বহু কষ্ট করতে হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য নেমে এসেছে এবং আল্লাহ তায়ালা দুশমনদের মােকাবেলায় সরাসরি বরাবরই সত্যপন্থীদেরকে সাহায্য করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, সাহায্য লাভের জন্যে মানুষকে বহু বহু তাকলীফ করতে হয়। কষ্ট ছাড়া, ত্যাগ ছাড়া এবং ধৈর্য ছাড়া কোনাে বড় নেয়ামত আশা করা যায় না। একথা সর্ববাদি সত্য এবং চিরদিন মানুষ এসত্য উপলব্ধি করে এসেছে যে মূল্যবান জিনিস মূল্য দিয়েই খরিদ করতে হবে। সুতরাং, মুসলমানদেরকেও অবশ্যই অনেক অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে সত্যের বাতি জ্বালতে হবে, যেমন করে অতীতে তারা বহু দুঃসহ জ্বালা সহ্য করার মধ্য দিয়ে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছিলেন। এরশাদ হচ্ছে, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করবেন তাদেরকে যারা আল্লাহকে সাহায্য করে। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা, অবশ্যই মহা শক্তিমান। সকল ক্ষমতার অধিকারী, আর আল্লাহর হাতেই রয়েছে সকল কাজের শেষ পরিণতি'(আয়াত ৪০-৪১) অর্থাৎ, আল্লাহ সােবহানাহ তায়ালা পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে আশ্বাস দিচ্ছেন যে যারা তাকে সাহায্য করবে তিনি অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করবেন, এটা তার ওয়াদা এবং কিছুতেই তিনি এ ওয়াদা খেলাফ করবেন না। সুতরাং যে কোনাে ব্যক্তি বা দল আল্লাহর সাহায্যে এগিয়ে আসবে তারা আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার হকদার হয়ে যাবে। তার পক্ষ থেকে প্রদত্ত ওয়াদা খেলাফের প্রশ্নই আসে না, যেহেতু তিনিই সর্বশক্তিমান- তিনিই সকল ক্ষমতার মালিক। তিনি সাহায্য করতে চাইলে যে কোনাে অবস্থায় এবং যে কোনাে সময়ে যে কোনাে প্রকার সাহায্য করতে সক্ষম। কেউ নেই এমন যে তার ইচ্ছা বা ক্ষমতায় বাধ সাধতে পারে। অতএব, যে তার ওপর ভরসা করে একমাত্র তার জন্যেই লড়বে, কে আছে এমন যে তাদেরকে হারাতে পারে?
# তারা আল্লাহ্র ইচ্ছায় তাদের পর্যুদস্ত করে দিলো ।’ ‘ইযন’ অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছার ওপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। যাতে করে মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি নিয়ন্ত্রণ যে একমাত্র মহাশক্তিমান আল্লাহর কূদরতি হাতেই নিবদ্ধ তা মোমেনরা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে। বাস্তব সত্যটা হলো মোমেনরা আল্লাহর হাতিয়ার, আল্লাহ তায়ালা তাদের দ্বারা যা খুশি তাই করান। তাদের মাধ্যমে মূলত তিনি তার ইচ্ছাই বাস্তবায়ন করেন এবং এর ভেতরে অন্য কারো ইচ্ছার কোনো প্রভাব নেই। এমনকি যাদের মাধ্যমে তিনি তার ইচ্ছা বাস্তবায়িত করেন তাদেরও কোনো ক্ষমতা নেই। আল্লাহ তায়ালাই নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্যে তাদের মনোনীত করেছেন, তার অনুমতিক্রমেই তাদের মাধ্যমে তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয় । এ এমনই এক শক্তি যা মোমেনের হৃদয় শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তায় কানায় কানায় ভরে দেয়। তারা হলো আল্লাহর বান্দা আর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাদের বাছাই করেছেন, এটা আল্লাহর এক অসীম দয়া ও মেহেরবানী । এদের জন্যে রয়েছে সম্মান আর সম্মান । প্রথমত আল্লাহ তায়ালা এক মহান দায়িত্ব পালনের জন্যে তাদেরকে বাছাই করে সম্মানিত করেছেন। দ্বিতীয়ত এই দায়িত্ব পালনের পর তাদেরকে প্রতিদানস্বরূপ সাফল্যের তাজ পরিয়ে দিয়েছেন । এটাও আল্লাহর এক সীমাহীন করুনা। তিনি যদি দয়া করে তাদেরকে সাহায্য না করতেন তাহলে তারা এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হতো না এবং সাফল্যও তারা পেতো না। এমনিভাবে যখন লক্ষ্য উদ্দেশ্যের মহত্ব, পথ ও পদ্ধতির পরিচ্ছন্নতা একজন মোমেনের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় তখন আল্লাহ তায়ালা তার নিয়তের মধ্যে খুলুসিয়াত ও কাজে কর্মে একনিষ্ঠতা দান করেন৷ তখন তার মধ্যে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ বা রিপু কাজ করে না। অপরদিকে নিয়তের বিশুদ্ধতা, পবিত্রতা, আনুগত্যের দৃঢ় সংকল্প আর একান্ত নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করলে, সকল রিপুকে দমন করে একমাত্র আল্লাহর সম্তষ্টির উদ্দেশ্যে। কাজ করলেই আল্লাহ্ তায়ালা একজন মানুষকে এ সবকিছুর অধিকারী করেন। অতপর কোরআন হযরত দাউদ (আ.)-এর ঘটনা আমাদের সামনে এভাবে তুলে ধরে, “আর দাউদ জালুতকে হত্যা করলো” । বনী ইসরাইলের মধ্যে হযরত দাউদ (আ.) তখন নিতান্ত যুবক মাত্র। আর জালুত হচ্ছে শক্তিধর বাদশাহ, প্রবল প্রতাপশালী এক দুর্ধর্ষ নেতা ৷ কিছু আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলেন যে, গোটা জাতি এটা দেখুক যে, নিছক বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ীই সবকিছু হয় না, বরং ঘটনা ঘটে বাস্তবতার নিরীখে, যে বাস্তবতার জ্ঞান রয়েছে কেবল আল্লাহর, আর সে বাস্তবতার পরিমাণ আর তার মানদন্ডও কেবল তারই হাতে । মানুষের কর্তব্য হচ্ছে কেবল দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসা । আল্লাহর সংগে সম্পাদিত অংগীকার পূরণ করা । অতপর তাই হবে তাই ঘটবে, যা আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করেন, যেভাবে এবং যে উপায়ে তিনি তা ঘটাতে চান সেভাবেই হবে। তিনি ইচ্ছা করলেন যে এক অল্প বয়স্ক যৃবকের হাতে এ প্রবল প্রভাবশালী দুর্দমনীয় স্বেচ্ছাচারীর পতন হোক। যাতে লোকেরা এটা বুঝতে পারে যে, দুর্বলরা যে দোর্দণ্ড প্রতাপশালীকে এতো ভয় পায় একজন অল্প বয়স্ক যুবকও তাকে পরাভূত করতে পারে৷ এটা তখনই সম্ভব যখন আল্লাহ তায়ালা কাউকে হত্যা করার ইচ্ছা করেন । এখানে আরো একটি গোপন রহস্য ছিলো, আর তা ছিলো এই, তিনি ফয়সালা করে রেখেছিলেন যে, তালুতের পর দাউদের হাতে নেতৃত্ব দান করা হবে। তার পুত্র সোলায়মান হবে তার উত্তরাধিকারী, বনী ইসরাইলের সুদীর্ঘ ইতিহাসে তার যুগটাই হবে সোনালী যুগ । আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাদের মনে যে বিভ্রান্তি আর গোমরাহী বাসা বেঁধেছিলো তা দুর হয়ে তারা বিশুদ্ধ দ্বীনী আকীদায় বিশ্বাসী হয়ে উঠবে। “আল্লাহ তায়ালা তাকে দান করলেন রাজত্ব ও প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দিলেন এমন কিছু- যা তিনি শিক্ষা দিতে চান ।” হযরত দাউদ (আ.) ছিলেন যুগপৎ বাদশাহ এবং নবী । আল্লাহ্ তায়ালা তাকে যুদ্ধান্ত্র এবং লৌহবর্ম নির্মাণের কৌশল শিখিয়েছিলেন । কোরআন মজীদের অনেক স্থানে এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। এখানে বর্ণনাধারায় গোটা কাহিনীর পেছনে ভিন্ন লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। এখানে কেবল কাহিনীর পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যে কথাটি এখানে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে তা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত দৃঢ় ঈমানী শক্তিরই জয় হয়, বস্তুবাদী শক্তির নয়। জয় হয় ঈমানের, সংখ্যা সেখানে প্রধান বিষয় নয়। এখানে একটি বিরাট লক্ষ্যের কথা স্পষ্ট ব্যক্ত করা হয়েছে। সে মহান লক্ষ্য কোনো সম্পদ হস্তগত করা নয়, ছিনতাই করাও নয়। মর্যাদা আর প্রভুত্ব কর্তৃত্বও তার উদ্দেশ্য নয়। তা হচ্ছে কেবল পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। অন্যায়ের সংগে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করাই হচ্ছে সে মহান লক্ষ্য। এক জালেমকে দিয়ে আরেক জালেমকে দমন : ‘আর আল্লাহ তায়ালা যদি কতক লোককে দিয়ে কতক লোককে প্রতিহত না করতেন, তবে পৃথিবী নিশ্চিত বিপর্যস্ত হতো, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো জগৎবাসীর প্রতি দয়াশীল ।” এ ক্ষুদ্র বাক্যে পৃথিবী পরিচালনার ব্যাপারে আল্লাহর একটা রহস্য বর্ণনা করা হয়েছে। এসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে শক্তির সংঘাত, ক্ষমতার দ্বন্দ এবং দুনিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে । এখানে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সংঘাতময় জীবনের নানা দিক, যা সমুদ্র উত্তাল তরংগের মতো মানুষের জীবনকে তরংগায়িত করে তোলে ৷ একে অপরকে প্রতিহত করে নিজ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এসবের পেছনে আল্লাহর ক্রিয়াশীল প্রজ্ঞাময় শক্তিই মূল নিয়ন্ত্রণভার ধারণ করে। অবশেষে আল্লাহর সেই প্রজ্ঞাময় শক্তির নেতৃত্ব এ সংঘাতময় শক্তিকে নেতৃত্ব দিয়ে কল্যাণ আর উন্নতির দিকে নিয়ে যায়৷ যদি কতক লোককে দিয়ে কতক লোককে প্রতিহত না করতেন, তাহলে মানুষের গোটা জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠতো। এ জীবন হয়ে পড়তো পূতিগন্ধময়, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তাতেই বাহ্যিক স্বার্থের সংঘাত নিহিত রয়েছে। একারণেই একে অপরের ওপর বিজয়ী হওয়ার জন্যে অন্যকে প্রতিহত করার জন্যে এমনিতেই মানুষ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ্ তায়ালা মানুষের প্রবৃত্তিতে এই প্রতিযোগিতাব ভাবধাবা নিহিত না রাখালে মানুষকে অলসতা আর দুর্বলতা গ্রাস করতো । তার প্রকৃতির মধ্যে এই প্রবৃত্তি থাকার কারণেই মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে । মানুষ হয়ে পড়ে সদা জাগ্রত, কর্মতৎপর। মাটির নীচে রক্ষিত সম্পদের সন্ধানে সে অনেক নিচে নেমে পড়ে। সুপ্ত শক্তির গোপন রহস্যকে সে কাজে নিয়োজিত করে। এভাবে সে শান্তি, সুস্থিতি, মংগল কল্যাণ আর প্রবৃদ্ধি খুঁজে পায়। যদি এই উন্নতি অগ্রগতি এমন একটা কল্যাণকামী, হেদায়াতপ্রাপ্ত একটি দলের হাতে হতো, যারা সত্যকে স্পষ্ট করে তুলে ধরে, সত্যকে ভালোভাবে চিনতে পারে এবং আল্লাহর পথ কোনটা তাও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। যারা অনুধাবন করে যে, পৃথিবীতে বাতিলকে প্রতিহত করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই তারা আদিষ্ট হয়েছে। এটাই হচ্ছে তাদের একমাত্র কর্তব্য । যারা বুঝতে পারে যে, এ মহান ভূমিকা পালন করা ছাড়া আল্লাহর আযাব থেকে নাজাতের অন্য কোনো পথ নেই । এ ছাড়া দুনিয়ায় আল্লাহর পথে আনুগত্য প্রকাশ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার অন্য কোনো উপায় নেই। এখানে এসেই আল্লাহ তায়ালা তার নির্দেশ জারী করেন। তার নির্ধারিত ভাগ্যলিপি কার্যকর করেন। সত্য, মংগল কল্যাণ ও সুস্থিতির বাণীকে তিনি উর্ধ্বে তুলে ধরেন । সংঘাত-সংঘর্ষ আর প্রতিরোধের পরিণাম তিনি দান করেন গঠনমূলক আর কল্যাণকর শক্তির হাতে । জীবনের যে চরম ও চূড়ান্ত পর্যায়ে তাকে নিয়ে যাওয়া তিনি নির্ধারন করে রেখেছেন, সেখানে তিনি তাকে নিয়ে যান। এখানে এসেই আল্লাহর ওপর আস্থাবান ক্ষুদ্র মোমেনের দল শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয় এবং তারা আল্লাহ্র সাহায্য লাভ করে। এর কারণ হচ্ছে, পৃথিবীর বুক থেকে বিপর্যয় রোধ করে জীবনে মংগল ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় বাস্তবায়নে তারা আল্লাহর প্রতিকী শক্তিতে পরিণত হয় । উন্নত লক্ষ্যের প্রতিভূ হওয়ার ফলেই তারা এ সাহায্য লাভের যোগ্য হয়।
# ‘আর আমি তোমাদের সামনে বিদ্যমান তাওরাতকে সত্যায়িত করতে এসেছি, তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ করা কতক জিনিসকে বৈধ করতে এসেছি এবং তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন নিয়ে এসেছি। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমাকে অনুসরণ করো । এটাই সঠিক পথ ।’ (আয়াত ৫০-৫১) বনী ইসরাঈলের প্রতি ঈসা (আ.)-এর দাওয়াতের এই উপসংহার আল্লাহ দ্বীনের প্রকৃতি সংক্রান্ত কয়েকটি মৌলিক তত্ত্বের সন্ধান দেয় এবং সকল নবীর দাওয়াতের আলোকে এই দ্বীনের তাৎপর্য কী, সে সম্পর্কে কতিপয় মূল্যবান সত্য উদঘাটন করে। বিশেষভাবে হযরত ঈসা(আ.)-এর মুখ দিয়ে যখন এগুলো উচ্চারিত হয়, তখন এই তত্ত্বগুলোকে অধিকতর মূল্যবান বলে মনে হয়। কেননা হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও তার পরিচয় নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। অথচ কেবল আল্লাহর দ্বীনের মৌল আদর্শ থেকে বিচ্যুতির কারণেই এ বিভ্রান্তি ছড়ানো সম্ভব হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনের এই প্রকৃতি কোনো রসূলের আমলেই পরিবর্তিত হয় না। ‘আমি তোমাদের সামনে বিদ্যমান তাওরাতকে সত্যায়িত করতে এবং তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ করা কিছু জিনিসকে বৈধ করতে এসেছি ।’ এ উক্তি থেকে হযরত ঈসা(আ.)-এর শরীয়তের প্রকৃত রূপটি উদঘাটিত হয়। যে তাওরাত গ্রন্থ হযরত মুসা (আ.)-এর ওপর নাযিল হয়েছে, যা সেই সময়কার প্রয়োজন অনুযায়ী সমাজ জীবনকে সংঘটিত করার জন্যে আইন দিয়েছিলো এবং যাতে বনী ইসরাঈলের জীবনের সমস্যা ও ঘটনাবলী আলোচিত হয়েছে, (যেহেতু একটি নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীর জন্যে এতে একটি বিশেষ ধর্মীয় বিধান দেয়া হয়েছিলো) ৷ সেই তাওরাত হযরত ঈসা (আ.)-এর রেসালাতের জন্যেও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। তার রিসালাত এই তাওরাতকে সত্যায়িত করতে এসেছিলো ৷ তবে কিছু কিছু হারামকে হালাল করার সংশোধনীও এর অন্তর্ভুক্ত। এ সব জিনিস হারাম ঘোষিত হয়েছিলো তাদের কিছু কিছু গুনাহের শাস্তিদানের জন্যে । পরে আল্লাহ তায়ালা ঈসা (আ.)-এর মাধ্যমে নিজ দয়ায় তার কিছু কিছু জিনিসকে পুনরায় হালাল করে দেন। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহর দ্বীন চাই তা কোনো নবীর আমলের দ্বীন হোক না কেন তার প্রকৃতি এই যে, তাতে মানুষের সামষ্টিক জীবনকে সুষ্ঠভাবে সংঘবদ্ধ করার জন্যে আইনগত বিধান থাকবেই । তাতে শুধু মানুষের আধ্যাত্মিক ভাবাবেগকে প্রশমিত করার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই থাকবে না। জীবনের সকল সমস্যার সমাধান না থাকলে তা আল্লাহর দ্বীন হতে পারে না। আল্লাহর দ্বীন হলো মানুষের যে অংশ রয়েছে, তা আনুষ্ঠানিক এবাদাত নৈতিক মূল্যবোধ ও জীবনের অন্যান্য অংশ ও বিভাগের বিধান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। কিন্তু খৃষ্টবাদে এই কান্ডটি ঘটেছে। হযরত ঈসা (আ.)-এর আনীত দ্বীন প্রকৃতপক্ষে শেষ নবীর দ্বীন আসার আগ পর্যন্ত সময়ের জন্যে প্রবর্তিত হয়েছিলো বিধায় তার আইনগত বিধানের অংশটি তার নৈতিক আধ্যাত্মিক ও এবাদাত সম্বলিত অংশটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইহুদীদের সাথে হযরত ঈসা (আ.)-এর, তার সহচরদের ও পরবর্তীকালে তার আনীত দ্বীনের অনুসারীদের মধ্যে স্থানীয় শত্রুতার সৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় আইন-কানুন সম্বলিত তাওরাত এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেরণাদায়ফ উপদেশাবলী সম্বলিত ইনজীলের মাঝে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়ে গেছে। আর তাওরাতের সেই আইন কানুন এবং শরীয়ত একটি নির্দিষ্ট যুগের ও নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীর জন্যে নির্ধারিত ছিলো । পক্ষাস্তরে সমগ্র মানবজাতির জন্যে চিরস্থায়ী শরীয়ত ও আইন-কানুন নির্ধারিত সময়ে নাযিল করা হবে বলে আল্লাহ তায়ালা স্থির করে রেখেছিলেন । মোদ্দা কথা, এভাবে খৃষ্টবাদ আল্লাহর শরীয়ত ও আইনবিহীন একটি সমাজে পরিণত হয়। আর এই পর্যায়ে এসে তা তৎকালীন বিশ্বের জাতিসমূহের নেতৃত্ব দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে । কেননা মানবজাতির সামাজিক জীবনের নেতৃত্ব দিতে হলে একদিকে যেমন বিশ্বজগত ও মানবজীবনের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাখ্যাসম্বলিত একটি আদর্শের প্রয়োজন, তেমনি আনুষ্ঠানিক এবাদাত ও নৈতিক মূল্যবোধসম্বলিত একটি বিধানেরও প্রয়োজন । আবার একইভাবে এমন একটি অপরিহার্য আইনগত বিধি ব্যবস্থারও প্রয়োজন, যা গোটা সমাজজীবনকে সুশৃংখল করে গড়ে তুলবে এবং যা উল্লেখিত আকীদা ও নৈতিক মূল্যবোধ থেকেই উৎসারিত ৷ এই সার্বিক বিধি-ব্যবস্থাসম্বলিত দ্বীনই একটা সুষ্ঠ সামাজিকব্যবস্থা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ সভ্যতার অবকাঠামো গড়ে তোলার নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম। খৃষ্টীয় ধর্মে যখন উক্ত বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তখন তা মানবজীবনের মূল্যবোধ ও বাস্তব কর্ম-প্রেরণা পরস্পর থেকে পৃথক হতে বাধ্য হয়। এই বিচ্ছেদটা সামাজিক জীবনসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা দেয়। ফলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার স্বাভাবিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়ে কার্যত ভিত্তিহীন বা পংগু হয়ে পড়ে। এ ঘটনাটা মানব ইতিহাসের কোনো নগণ্য ঘটনা ছিলো না। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিলো মানবজাতির জন্যে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় । এ বিপর্যয়ের ফলেই আধুনিক বস্তুবাদী সভ্যতার ওপর রকমারী দুর্যোগ ও দুর্ভোগ নেমে আসে। এ অবস্থা এখনো খৃষ্টবাদকে আকড়ে ধরে থাকা দেশগুলোতে বিরাজমান, যদিও সেখানে খৃষ্টবাদ আইনকানুন ও সামাজিক বিধানবিহীন নিরেট নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যবস্থার সমর্থক তেমনি খৃষ্টবাদ থেকে বিচ্যুত অথচ খৃষ্টান নামধারী দেশগুলোতেও তা পুরোপুরি বিরাজমান ৷ আসলে হযরত ঈসা যে ঐশী বিধান নিয়ে আসেন, তা হচ্ছে গোটা মানবজীবনকে সংগঠিত করার এমন এক ব্যবস্থা, যা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সেই বিশ্বাসেরই ভিত্তিতে প্রাপ্ত নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা গঠিত । বলা বাহুল্য, শুধু হযরত ঈসা (আ.)-এর আনীত দ্বীন নয়, আল্লাহর দ্বীন বলতে যা বুঝায় তা সর্বকালেই এ ধরনের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে থাকে। এ ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধান না হলে তাকে খৃষ্টবাদ বলেও অভিহিত করা চলে না। তাকে দ্বীন বা ধর্ম বলাও সংগত নয়। এরূপ সর্বাত্মক বিধি-ব্যবস্থা ছাড়া মানবজীবনের জন্যে এমন কোনো সামাজিক বিধান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিক জীবনের চাহিদা পূরণে এবং আল্লাহর সারিধ্যে পৌছে দিতে সক্ষম ৷ এ বিষয়টিই হযরত ঈসা(আ.) এর নিম্নোক্ত উক্তির অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘আর আমি আমার সামনে বিরাজমান তাওরাতের সত্যায়ন এবং তোমাদের ওপর নিধিদ্ধ কতিপয় জিনিসকে বৈধ করে দেয়ার জন্যে এসেছি ।’ আর এ সত্য জনগণের কাছে পৌছানোর ব্যাপারে তিনি আরো বৃহৎ ও অকাট্য সত্য তাওহীদের ওপর নির্ভর করছেন, ‘আমি তোমাদের প্রতিপালকের একটি নিদর্শন নিয়ে এসেছি। কাজেই তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ও আমার প্রতিপালক ।’ সুতরাং একমাত্র তারই দাসত্ব করো। এটাই সঠিক পথ । এখানে হযরত ঈসা সেই মহাসত্যের ঘোষণা দিচ্ছেন, যার ওপর আল্লাহর গোটা দ্বীনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ৷ সেটি হচ্ছে এই যে, তিনি যে মোজেযা নিয়ে এসেছেন, তা তার নিজের কৃতিত্ব নয়। একজন মানুষ হিসাবে এ সব অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর কোনো ক্ষমতা তার নেই। এগুলো তিনি আল্লাহর কাছ থেকে এনেছেন। তার মূল দাওয়াত হলো, আল্লাহকে ভয় করা ও তার রসূলের অনুসরণ করা । তারপর তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তারও প্রভু তার জাতিরও প্রভু । তিনি নিজে প্রভু নন তিনি বান্দা মাত্র। তাই তিনি তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর এবাদাতে মশগুল হতে বলেছেন। সবশেষে বলেছেন যে, আল্লাহর একত্ব, এককভাবে শুধু তারই দাসত্ব এবং তার আনা জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ করাই হলো সীরাতুল মোস্তাকীম বা সঠিক ও নির্ভুল পথ । এছাড়া আর সব পথই হচ্ছে বিপথগামিতা ৷
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# এখান থেকে অন্য একটি বিষয়বস্তুর দিকে ভাষণটির মোড় ফিরে গেছে। প্রাসঙ্গিক বক্তব্য অনুধাবন করার জন্য একথা স্মরণ করা দরকার যে, এটি এমন এক সময়ের ভাষণ যখন হিজরাতের পর প্রথমবার হজ্জের মওসুম এসেছিল। সে সময় একদিকে মুহাজির ও মদীনার আনসারদের কাছে এ বিষয়টি বড়ই কঠিন মনে হচ্ছিল যে, তাদেরকে হজ্জের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং হারাম শরীফের যিয়ারতের পথ জোরপূর্বক তাদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মক্কায় মুসলমানদের ওপর যেসব জুলুম করা হয়েছিল শুধুমাত্র সেগুলোর আঘাতই তাদের মনে দগদগ করছিল তাই নয় বরং এ ব্যাপারেও তারা অত্যন্ত শোকাহত ছিল যে, ঘরবাড়ী ছেড়ে তারা মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছে এরপর এখন মদীনাতেও তাদেরকে নিশ্চিন্তে বাস করতে দেয়া হচ্ছে না। এ সময় যে ভাষণ দেয়া হয় তার প্রথম অংশে কাবাগৃহ নির্মাণ, হজ্জ পালন ও কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে একথা বলা হয় যে, এসব বিষয়ের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল এবং জাহেলীয়াত এগুলোকে বিকৃত করে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেছে। এভাবে মুসলমানদের মধ্যে প্রতিশোধ নেবার সংকল্প নিয়ে নয় বরং সংস্কারের সংকল্প নিয়ে এ অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য এগিয়ে আসার প্রেরণা সৃষ্টি করা হয়। তাছাড়া এ সঙ্গে মদীনায় কুরবানীর পদ্ধতি জারি করে মুসলমানদেরকে এ সুযোগ দেয়া হয় যে, হজ্জের সময় নিজ নিজ গৃহেই কুরবানী করে শত্রুরা তাদেরকে যে সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে তাতে তারা অংশ গ্রহণ করতে পারবে। আবার হজ্জ থেকে আলাদাভাবে কুরবানীকে একটি স্বতন্ত্র সুন্নাত হিসেবে জারী করে। এর ফলে যারা হজ্জ করার সুযোগ পাবে না তারাও আল্লাহর এ নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তাঁর শেষ্ঠত্ব ঘোষণার হক আদায় করতে পারবে। এরপর এখন দ্বিতীয় অংশে মুসলমানদেরকে তাদের ওপর যে জুলুম করা হয়েছিল এবং যে জুলুমের ধারা অব্যাহত ছিল তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
# মূলে مدَافِعَت শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর উৎপত্তি হয়েছে دفع থেকে। এ শব্দটির আসল মানে হচ্ছে, কোন জিনিসকে হটিয়ে দেয়া ও সরিয়ে দেয়া। কিন্তু যখন “দফা” করার পরিবর্তে “মুদাফা’আত” করার কথা বলা হবে তখন এর মধ্যে আরো দু’টি অর্থ শামিল হয়ে যাবে। এক কোন শত্রুশক্তি আক্রমণ চালাচ্ছে এবং প্রতিরক্ষাকারী তার মোকাবিলা করছে। দুই, এ মোকাবিলা শুধুমাত্র একবারেই শেষ হয়ে যায়নি বরং যখনই আক্রমণকারী আক্রমণ করে তখনই এ প্রতিরক্ষাকারী তার মোকাবিলা করে। এ দু’টি অর্থ সামনে রেখে বিচার করলে মু’মিনদের পক্ষ থেকে আল্লাহর ‘মুদাফা’আত’ করার অর্থ এই বুঝা যায় যে, কুফর ও ঈমানের সংঘাতে মু’মিনরা একা ও নিসঙ্গ হয় না বরং আল্লাহ নিজেই তাদের সাথে এক পক্ষ হয়ে দাঁড়ান। তিনি তাদেরকে সমর্থন দান করেন। তাদের বিরুদ্ধে শত্রুদের কৌশল ব্যর্থ করে দেন। অনিষ্টকারকদের অনিষ্টকে তাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে থাকেন। কাজেই এ আয়াতটি আসলে হক পন্থীদের জন্য একটি বড় রকমের সুসংবাদ। তাদের মনকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য এর চেয়ে বড় আর কোন জিনিস হতে পারে না।
# এ সংঘাতে আল্লাহ কেন হকপন্থীদের সাথে একটি পক্ষ হন এটি হচ্ছে তার কারণ। এর কারণ হচ্ছে, হকের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত দ্বিতীয় পক্ষটি বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ এবং নিয়ামত অস্বীকারকারী। আল্লাহ তার কাছে যেসব আমানত সোপর্দ করেছেন তার প্রত্যেকটিতে সে খেয়ানত করেছে এবং তাকে যেসব নিয়ামত দান করেছেন অকৃতজ্ঞতা, অস্বীকৃতি ও নেমকহারামির মাধ্যমে তার প্রত্যেকটির জবাব দিয়ে চলছে। কাজেই আল্লাহ তাকে অপছন্দ করেন এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত হকপন্থীদেরকে সাহায্য-সহায়তা দান করেন।
# যেমন ইতিপূর্বে ভূমিকায় বলা হয়েছে, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা সম্পর্কে অবতীর্ণ এটিই প্রথম আয়াত। এ আয়াতে কেবলমাত্র অনুমতি দেয়া হয়েছিল। পরে সূরা বাকারায় যুদ্ধের আদেশ প্রদান সম্পর্কিত আয়াতটি নাযিল হয়।
# এরা মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক, এ সত্ত্বেও আল্লাহ এদেরকে আরবের সমগ্র মুশরিক সমাজের ওপর বিজয়ী করতে পারেন। একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যখন এ অস্ত্রধারণ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছিল তখন মুসলমানদের সমস্ত শক্তি কেবলমাত্র মদীনার একটি মামূলী ছোট শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় মুহাজির ও আনসারদের মিলিত শক্তি সর্বসাকুল্যে এক হাজারও ছিল না। এ অবস্থায় কুরাইশদেরকে চ্যালেঞ্জ দেয়া হচ্ছিল। আর কুরাইশরা একা ছিল না বরং আরবের অন্যান্য মুশরিক গোত্রগুলোও তাদের পেছনে ছিল। পরে ইহুদীরাও তাদের সাথে যোগ দেয়। এ সময় “আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে” একথা বলা অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল। এর ফলে এমনসব মুসলমানদের মনেও সাহসের সঞ্চার হয়েছে যাদেরকে সমগ্র আরব শক্তির বিরুদ্ধে তলোয়ার হাতে মোকাবিলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং কাফেরদেরকেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই মর্মে যে, তোমাদের মোকবিলা আসলে আল্লাহর সাথে, ঐ মুষ্টিমেয় মুসলমানদের সাথে নয়। কাজেই যদি আল্লাহর মোকাবিলা করার সাহস থাকে তাহলে সামনে এসো।
# এ আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, সূরা হজ্জের এ অংশটি অবশ্যই হিজরতের পরে নাযিল হয়েছে।
# এদের ওপর যে ধরনের অত্যাচার করে বের করে দেয়া হয় তা অনুমান করার জন্য নিম্নোক্ত কয়েকটি ঘটনা সামনে রাখতে হবেঃ
হযরত সোহাইব রুমী (রা.) যখন হিজরত করতে থাকেন তখন কুরাইশ বংশীয় কাফেররা তাঁকে বলে, তুমি এখানে এসেছিলে খালি হাতে। এখন অনেক ধনী হয়ে গেছো। যেতে চাইলে তুমি খালি হাতে যেতে পারো। নিজের ধন-সম্পদ নিয়ে যেতে পারবে না। অথচ তিনি নিজে পরিশ্রম করেই এ ধন-সম্পদ উপার্জন করেছিলেন। কারো দান তিনি খেতেন না। ফলে বেচারা হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং সবকিছু ঐ জালেমদের হাওয়ালা করে দিয়ে এমন অবস্থায় মদীনায় পৌঁছেন যে, নিজের পরনের কাপড়গুলো ছাড়া তাঁর কাছে আর কিছুই ছিল না।
হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) ও তাঁর স্বামী আবু সালামাহ (রা.) নিজেদের দুধের বাচ্চাটিকে নিয়ে হিজরত করার জন্য বের হয়ে পড়েন। বনী মুগীরাহ (উম্মে সালামাহর পরিবারের লোকেরা) তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। তারা আবু সালামাহকে বলে, তোমার যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো কিন্তু আমাদের মেয়েকে নিয়ে যেতে পারো না। বাধ্য হয়ে তিনি স্ত্রীকে রেখে দিয়ে চলে যান। এরপর বনী আবদুল আসাদ (আবু সালামাহর বংশের লোকেরা) এগিয়ে আসে এবং তারা বলে, শিশুটি আমাদের গোত্রের। তাকে আমাদের কাছে দিয়ে দাও। এভাবে মা ও বাপ উভয়ের কাছ থেকে শিশু সন্তানকেও ছিনিয়ে নেয়া হয়। প্রায় এক বছর পর্যন্ত হযরত উম্মে সালামাহ (রা.) স্বামী ও সন্তানদের শোকে ছটফট করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত বড়ই কঠিন বিপদের মধ্যদিয়ে নিজের শিশু সন্তানটি পুনরুদ্ধার করে মক্কা থেকে এমন অবস্থায় বের হয়ে পড়েন যে, একজন নিসঙ্গ স্ত্রীলোক কোলে একটি ছোট বাচ্চা নিয়ে উটের পিঠে বসে আছেন। এমন পথ দিয়ে তিনি চলছেন যেখান দিয়ে সশস্ত্র কাফেলা যেতে ভয় পেতো।
আইয়াশ ইবনে রাবীআহ আবু জেহেলের বৈপিত্রেয় ভাই ছিলেন। হযরত উমরের (রা.) সাথে হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে যান। পিছে পিছে আবু জেহেল নিজের এক ভাইকে সাথে নিয়ে সেখানে পৌঁছে যায়। সে মায়ের নামে মিথ্যা বানিয়ে বলে, আম্মাজান কসম খেয়েছেন আইয়াশের চেহারা না দেখা পর্যন্ত রোদ থেকে ছায়ায় যাবেন না এবং মাথায় চিরুনীও লাগাবেন না। কাজেই তুমি গিয়ে একবার শুধু তাঁকে চেহারা দেখিয়ে দাও তারপর চলে এসো। তিনি মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও মাতৃভক্তির আতিশয্যে তাদের সঙ্গ নেন। পথে দুই ভাই মিলে তাকে বন্দী করে এবং তাকে নিয়ে মক্কায় এমন অবস্থায় প্রবেশ করে যখন তার আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং দুই ভাই চিৎকার করে যাচ্ছিল, “হে মক্কাবাসীরা! নিজেদের নালায়েক ছেলেদেরকে এমনিভাবে শায়েস্তা করো যেমন আমরা করেছি।” দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি বন্দী থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত একজন দুঃসাহসী মুসলমান তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মক্কা থেকে মদীনায় যারাই হিজরত করেন তাদের প্রায় সবাইকেই এ ধরনের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়ও জালেমরা তাদেরকে নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে বের হয়ে আসতে দেয়নি।
# মূলে صَوَامِعُ ও بِيَعٌ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। صَلَوَاتٌ এমন জায়গাকে বলা হয় যেখানে খৃস্টান রাহেব যোগী, সন্ন্যাসী, সংসার বিরাগী সাধুরা থাকেন। صومعة শব্দটি আরবী ভাষায় খৃস্টানদের ইবাদাতগাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। بيعة শব্দের অর্থ হচ্ছে ইহুদীদের নামায পড়ার জায়গা। ইহুদীরা নিজেদের ভাষায় একে বলে صلوات “সালওয়াতা।” এটি আরামীয় ভাষার শব্দ। বিচিত্র নয় যে, ইংরেজী ভাষার (Salute ও Salutation) শব্দ এর থেকে বের হয়ে প্রথম ল্যাটিন ও পরে ইংরেজী ভাষায় পৌঁছে গেছে।
# আল্লাহ কোন একটি গোত্র বা জাতিকে স্থায়ী কর্তৃত্ব দান করেননি, এটি তাঁর বিরাট অনুগ্রহ। বরং বিভিন্ন সময় দুনিয়ায় একটি দলকে দিয়ে তিনি অন্য একটি দলকে প্রতিহত করতে থেকেছেন। নয়তো কোন এটি নির্দিষ্ট দল যদি কোথাও স্থায়ী কর্তৃত্ব লাভ করতো তাহলে শুধু দূর্গ, প্রাসাদ এবং রাজনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস করে দেয়া হতো না বরং ইবাদাতগাহগুলোও বিধ্বস্ত হওয়ার হাত থেকে রেহাই পেতো না। সূরা বাকারায় এ বিষয়বস্তুকে এভাবে বলা হয়েছেঃ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ
“যদি আল্লাহ লোকদেরকে একজনের সাহায্যে অন্যজনকে প্রতিহত না করতে থাকতেন তাহলে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি বড়ই করুণাময়।” ( ২৫১ আয়াত )
# সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-২৫১
فَهَزَمُوْهُمْ بِاِذْنِ اللّٰهِ١ۙ۫ وَ قَتَلَ دَاوٗدُ جَالُوْتَ وَ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الْمُلْكَ وَ الْحِكْمَةَ وَ عَلَّمَهٗ مِمَّا یَشَآءُ١ؕ وَ لَوْ لَا دَفْعُ اللّٰهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ١ۙ لَّفَسَدَتِ الْاَرْضُ وَ لٰكِنَّ اللّٰهَ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْعٰلَمِیْنَ
অবশেষে আল্লাহর হুকুমে তারা কাফেরদের পরাজিত করলো। আর দাউদ জালুতকে হত্যা করলো এবং আল্লাহ তাকে রাজ্য ও প্রজ্ঞা দান করলেন আর সেই সাথে যা যা তিনি চাইলেন তাকে শিখিয়ে দিলেন। এভাবে আল্লাহ যদি মানুষদের একটি দলের সাহায্যে আর একটি দলকে দমন না করতে থাকতেন, তাহলে পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হতো। কিন্তু দুনিয়াবাসীদের ওপর আল্লাহর অপার করুণা (যে, তিনি এভাবে বিপর্যয় রোধের ব্যবস্থা করতেন) ।
দাউদ আলাইহিস সালাম এ সময় ছিলেন একজন কম বয়েসী যুবক। ঘটনাক্রমে তালুতের সেনাবাহিনীতে তিনি এমন এক সময় পৌঁছে ছিলেন যখন ফিলিস্তিনী সেনাদলের জবরদস্ত পাহলোয়ান জালুত (জুলিয়েট) বনী ইসরাঈলী সেনাদলকে প্রত্যক্ষ মুকাবিলায় আসার জন্য আহবান জানাচ্ছিল এবং ইসরাঈলীদের মধ্য থেকে একজনও তার সাথে মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল না। এ অবস্থা দেখে দাউদ (আ) নির্ভয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং জালুতকে হত্যা করলেন। এ ঘটনায় তিনি হয়ে উঠলেন ইসরাঈলীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তালুত নিজের মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দিলেন। অবশেষে তিনিই হলেন ইসরাঈলীদের শাসক। (বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন ১ম সামুয়েল ১৭ ও ১৮ অধ্যায়)।
পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা অক্ষুন্ন রাখার জন্য মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ যে পদ্ধতি নির্ধারণ করেছেন তা হচ্ছে এই যে, তিনি বিভিন্ন মানব গোষ্ঠী ও দলকে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দুনিয়ায় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের সুযোগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখনই কোন দল সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে তখনই তিনি অন্য একটি দলের সাহায্যে তার শক্তির দর্প চূর্ণ করে দেন। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা চিরন্তনভাবে একটি জাতি ও একটি দলের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে রাখা হতো এবং তার ক্ষমতার দাপট ও জুলুম-নির্যাতন হতো সীমাহীন ও অশেষ, তাহলে নিঃসন্দেহে আল্লাহর এই রাজ্যে মহা বিপর্যয় নেমে আসতো।
# এ বক্তব্যটি কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় উপস্থাপিত হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাওহীদের দিকে আহ্বান করে এবং সত্য দ্বীন কায়েম ও মন্দের জায়গায় ভালোকে বিকশিত করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালায় তারা আসলে আল্লাহর সাহায্যকারী। কারণ এটি আল্লাহর কাজ। এ কাজটি করার জন্য তারা আল্লাহর সাথে সহযোগিতা করে।
# সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-৫২
فَلَمَّاۤ اَحَسَّ عِیْسٰى مِنْهُمُ الْكُفْرَ قَالَ مَنْ اَنْصَارِیْۤ اِلَى اللّٰهِ١ؕ قَالَ الْحَوَارِیُّوْنَ نَحْنُ اَنْصَارُ اللّٰهِ١ۚ اٰمَنَّا بِاللّٰهِ١ۚ وَ اشْهَدْ بِاَنَّا مُسْلِمُوْنَ
যখন ঈসা অনুভব করলো, ইসরাঈল কুফরী ও অস্বীকার করতে উদ্যোগী হয়েছে, সে বললোঃ “কে হবে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ বললোঃ আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম (আল্লাহ্র সামনে আনুগত্যের শির নতকারী) ।
# ‘হাওয়ারী’ শব্দটি আমাদের এখানে ‘আনসার’ শব্দের কাছাকাছি অর্থ বহন করে। বাইবেলে সাধারণভাবে হাওয়ারীর পরিবর্তে ‘শিষ্যবৃন্দ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন স্থানে তাদের ‘রসূল’ও বলা হয়েছে। কিন্তু রসূল এই অর্থে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে দ্বীন প্রচারের জন্য পাঠাতেন। আল্লাহ তাদেরকে রসূল হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, এই অর্থে রসূল বলা হয়নি।
# ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে অংশ গ্রহণকে কুরআন মজীদের অধিকাংশ স্থানে “আল্লাহ্কে সাহায্য করা” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি অবশ্যি একটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ বিষয়। জীবনের যে পরিসরে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা ও সংকল্পের স্বাধীনতা দান করেছেন সেখানেই তিনি নিজের খোদায়ী শক্তি ব্যবহার করে কুফর বা ঈমান, বিদ্রোহ বা আনুগত্যের মধ্য থেকে কোন একটির পথ অবলম্বন করার জন্য মানুষকে বাধ্য করেননি। এর পরিবর্তে তিনি যুক্তি ও উপদেশের সাহায্য নিয়েছেন। এভাবে তিনি মানুষের কাছ থেকে এই স্বতষ্ফুর্ত স্বীকৃতি আদায় রতে চেয়েছেন যে, অস্বীকৃতি, নাফরমানী ও বিদ্রোহ করার স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তার জন্য নিজের স্রষ্টার দাসত্ব, আনুগত্য ও বন্দেগীর পথ অবলম্বন করাই প্রকৃত সত্য এবং এটিই তার সাফল্য ও নাজাতের পথ। এভাবে প্রচার, উপদেশ ও নসীহতের সাহায্যে মানুষকে সত্য সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করাই আল্লাহর কাজ। আর যেসব লোক এই কাজে আল্লাহকে সাহায্য করে তাদেরকেই আল্লাহর সাহায্যকারী গণ্য করা হয়। আল্লাহর কাছে মানুষের এটিই সর্বোচ্চ মর্যাদা। নামায, রোযা এবং অন্যান্য যাবতীয় ইবাদাত বন্দেগীতে মানুষ নিছক বান্দা ও গোলামদের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-সাধনার মাধ্যমে সে আল্লাহর সাহায্যকারী ও সহযোগীর মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। এই দুনিয়ার রূহানী ও আধ্যাত্মিক উন্নতির শিখরে অভিষিক্ত হবার এটিই উচ্চতম মর্যাদা ও মকাম।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, তিনি তাঁর মু’মিন বান্দা হতে দুঃখ-কষ্ট, শত্র“র আক্রমণ, অনিষ্টতা ইত্যাদি প্রতিহত করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِيْنَ)
“আর মু’মিনদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য।” (সূরা রূম ৩০:৪৭) বর্ণিত আছে, এ আয়াতটি নাযিল হয় মক্কার মু’মিনদেরকে কেন্দ্র করে। যখন তাদের ওপর কাফিররা অধিকহারে অত্যাচার চালাতে লাগল তখন কিছু মু’মিন হাবশায় হিজরত করল। আর যারা মক্কায় ছিল তারা পরিকল্পনা করল যে, আমরা যে সকল কাফিরদেরকে করায়ত্ত করতে পারব তাদেরকে হত্যা করব, তাদেরকে ধোঁকা ও প্রতারণা দিব। তখন এ আয়াত নাযিল হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা দেন যে, তিনি তাদের পক্ষ থেকে সকল নির্যাতন প্রতিহত করবেন। মু’মিনদেরকে খিয়ানত ও প্রতারণা করা থেকে বারণ করলেন।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
إِنَّ الغَادِرَ يُرْفَعُ لَهُ لِوَاءٌ يَوْمَ القِيَامَةِ، يُقَالُ: هَذِهِ غَدْرَةُ فُلاَنِ بْنِ فُلاَنٍ
কিয়ামতের দিন খিয়ানতকারীর কোমরে একটি ঝাণ্ডা লাগিয়ে দেয়া হবে। এটা হবে, তার খিয়ানতের পরিচয়। বলা হবেন এ ব্যক্তি অমুকের সাথে খিয়ানত করেছে। (সহীহ বুখারী হা: ১)
সুতরাং মু’মিনরা যদি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সঠিকভাবে ঈমান আনে, সৎ আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সকল বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন, কাফিরদের ওপর বিজয় দান করবেন। “خوان” শব্দের অর্থ বিশ্বাসঘাতকতা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকলে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের শত্র“কে প্রতিহত করবেন।
৩৯-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
(أُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقٰتَلُوْنَ….) শানে নযূল:
সাহাবী ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশ্যে বের হলেন তখন আবূ বকর (رضي الله عنه) বললেন: এ কাফিররা তাদের নাবীকে তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এরা ধ্বংস হবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতটি নাযিল করেন। তখন আবূ বকর (رضي الله عنه) বলেন: আমি অবগত হলাম যে, অচিরেই তাদের সঙ্গে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। (ইবনে হিব্বান ১১:৮, তিরমিযী হা: ৩১৭১, সহীহ)
ইসলামের প্রথম দিকে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষেধ ছিল। বরং তাদের নির্যাতনে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এর পিছনে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ছিল। যখন মুসলিমরা মদীনায় হিজরত করে চলে আসলেন, তাদের শক্তি অর্জিত হল। তারপরেও তাদের ওপর নির্যাতন করা হলে জিহাদের অনুমতি দেয়া হল। তাই বলা হয়, এটাই জিহাদের অনুমতিমূলক প্রথম আয়াত। যুদ্ধের অনুমতি দেয়ার দুটি কারণন ১. মুসলিমদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে, তারা নির্যাতিত। অন্যায়ভাবে তাদেরকে এলাকা থেকে করে দেয়া হয়েছে, তাদের ভূ-খণ্ড দখল করা হয়েছে। সুতরাং এর যথার্থ প্রতিশোধ না নিলে অত্যাচারীরা অত্যাচার চালিয়েই যাবে। কাফিরদের বাহাদুরি ও সাহস আরো বেড়ে যাবে। ২. আল্লাহ তা‘আলার কালেমাকে জমিনে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সুতরাং কোন এলাকার বা দেশের মু’মিনরা যদি কাফিরদের দ্বারা নির্যাতিত হয় এবং তাদেরকে স্বদেশ থেকে বের করে দেয়া হয় তাহলে তারা যুদ্ধ করতে পারবে এবং এক্ষেত্রে অন্যান্য মুসলিমদের সাহায্য করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে বিনা যুদ্ধেই তাদেরকে নির্যাতন থেকে মুক্ত করতে পারতেন এবং কাফিরদের ওপর জয়যুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি পরীক্ষা করতে চান, কে দীন কায়েমে তাঁর পথে জিহাদ করে আর কে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَوْ يَشَا۬ءُ اللّٰهُ لَانْتَصَرَ مِنْهُمْ لا وَلٰكِنْ لِّيَبْلُوَاْ بَعْضَكُمْ بِبَعْضٍ ط وَالَّذِيْنَ قُتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللّٰهِ فَلَنْ يُّضِلَّ أَعْمَالَهُمْ - سَيَهْدِيْهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ)
“আল্লাহ ইচ্ছা করলে নিজেই তাদেরকে দমন করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তোমাদের একের দ্বারা অপরকে পরীক্ষা করতে চান। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হবে আল্লাহ তাদের আমলকে কখনো বিফল করবেন না। তিনি তাদেরকে সঠিক পথে চালাবেন এবং তাদের অবস্থা ভালো করে দেবেন।” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৪-৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتّٰي نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِيْنَ مِنْكُمْ وَالصّٰبِرِيْنَ لا وَنَبْلُوَاْ أَخْبَارَكُمْ)
“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব, যাতে তোমাদের অবস্থা যাচাই করে নিতে পারি এবং দেখে নিতে পারি যে, তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ ও ধৈর্যশীল।” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩১)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি একদল দ্বারা অন্যদলকে প্রতিহত করেন। অর্থাৎ একদলকে অন্য দলের ওপর শক্তিশালী করে দেন যার ফলে একদল বিজয়ী হয় আর অন্যদল পরাজিত হয়।
যদি এমনটি না হত উভয় দলের শক্তি-সামর্থ্য সমান পরিমাণ থাকত তাহলে পৃথিবী ফেতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয়ে ভরে যেত। তবে যারা আল্লাহ তা‘আলাকে সাহায্য করে অর্থাৎ যারা তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে, তিনি তাদেরকে বিজয় দান করেন; ফলে তারাই হয় বিজয়ী। আর বাতিল হয় পরাভূত।
لَّهُدِّمَتْ – শব্দের অর্থ হল- বিধ্বস্ত হওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
صَوَامِعُ শব্দটি صومعة এর বহুবচন, খ্রিস্টান পাদ্রীদের ছোট উপাসনালয়কে বলা হয়। আবার কেউ বলেন, ‘সাবী’ মাযহাবের লোকদের ইবাদতখানাকে صَوَامِعُ বলা হয়।
আবার কারো মতে ‘মাজুসী’ অর্থাৎ অগ্নিপূজকদের ইবাদতখানাকে বলা হয়।
بِيَعٌ শব্দটি بيعة এর বহুবচন, এটা صَوَامِعُ অপেক্ষা বড় ঘর। এটাও খ্রিস্টানদের ইবাদতখানা।
صَلَوٰتٌ – এটি হল ইয়াহূদীদের ইবাদতখানা। অর্থাৎ তাদের ইবাদতখানাকে صَلَوٰتٌ বলা হয়।
مَسٰجِدُ – এটা হল মুসলিমদের ইবাদতখানা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করা শরীয়তসম্মত।
২. কাফিররা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন করার কারণ একটাই তাহল তারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাসী।
৩. আল্লাহ তা‘আলা জিহাদ ফরয করেছেন মু’মিনদের উত্তম প্রতিদান দেয়া এবং দুনিয়ায় আল্লাহ তা‘আলার কালেমাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# আল্লাহ তাআলা নিজের পক্ষ হতে খবর দিচ্ছেন যে, তাঁর যে বান্দা তার উপর নির্ভরশীল হয়, তার দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে তিনি নিরাপত্তা দান করেন। দুষ্টদের দুষ্টামি ও দুশমনদের অনিষ্ট হতে তাকে রক্ষা করেন। তার উপর তিনি নিজের সাহায্য অবতীর্ণ করেন। তাকে সব সময় তিনি নিজের হিফাযতে রাখেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্যে কি যথেষ্ট নন? (৩৯:৩৬) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি তার জন্যে যথেষ্ট।” (৬৫:৩) প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক এবং অকৃতজ্ঞ লোকেরা মহান আল্লাহর র হমত হতে বঞ্চিত। যারা নিজেদের কৃত ওয়াদা অঙ্গীকার পূর্ণ করে না এবং আল্লাহর নিয়ামতরাজিকে অস্বীকার করে তারা তাঁর দয়া, অনুকম্পা এবং ভালবাসা হতে বহু দূরে রয়েছে।
৩৯-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সা হাবীবর্গকে মদীনা হতেও বের করে দেয়ার উপক্রম হয় এবং মক্কাবাসী কাফিররা মদীনা আক্রমণ করতে উদ্যত হয় তখন জিহাদের অনুমতির এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। বহু পূর্ব যুগীয় গুরুজন হতে বর্ণিত আছে যে, জিহাদের প্রথম আয়াত এটাই যা কুরআন কারীমে অবতীর্ণ হয়। এর দ্বারা কোন কোন গুরুজন এই দলীল গ্রহণ করেছেন যে, এটা মাদানী সূরা।
যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন তখন হযরত আবূ বকর (রাঃ) বলে ফেলেনঃ “বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এই কাফিররা আল্লাহর রাসূলকে (সঃ) তাঁর জন্মভূমি হতে বের করে দিলো! নিঃসন্দেহে এরা ধ্বংস হয়ে যাবে।” অতঃপর এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) জেনে নেন যে, এদের সাথে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।
আল্লাহ তাআলা স্বীয় মুমিন বান্দাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম। ইচ্ছা করলে বিনা যুদ্ধেই তিনি তাদেরকে জয়যুক্ত করতে পারেন। কিন্তু তিনি পরীক্ষা করতে চান। যেমন মহামহিমান্বিত ও প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ “যখন তোমরা কাফিরদের সাথে যুদ্ধে মুকাবিলা কর তখন তাদের গর্দানে আঘাত কর, পরিশেষে যখন তোমরা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পারাভূত করবে তখন তাদেরকে কষে বাধবে, অতঃপর হয় অনুকম্পা, নয় মুক্তিপণ। তোমরা জিহাদ চালাবে যতক্ষণ না যুদ্ধ ওর অস্ত্র নামিয়ে ফেলে। এটাই বিধান। এটা এই জন্যে যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি চান তোমাদের একজনকে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তিনি কখনো তাদের কর্ম বিনষ্ট হতে দেন না। তিনি তাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করে দেন।
তিনি তাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার কথা তিনি তাদেরকে জানিয়ে ছিলেন। আল্লাহ তাআলা আর এক জায়গায় বলেনঃ “তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর, আল্লাহ তোমাদের হাতে তাদেরকে শাস্তি দান করবেন এবং তাদেরকে অপদস্থ করবেন, আর তোমাদেরকে তাদের উপর বিজয়ী করবেন, তিনি মুমিনদের বক্ষ খুলে দিবেন এবং তাদের সাথে যাকে ইচ্ছা তিনি তাওবা করার তাওফীক দান করবেন, আল্লাহ মহাজ্ঞানী, বিজ্ঞানময়।”
অন্য অন্য আয়াতে রয়েছেঃ “তোমরা কি মনে করেছে যে, তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ আল্লাহ জানেন নাই তোমাদের মধ্যে যারা মুজাহিদ তাদেরকে এবং যারা আল্লাহ, তদীয় রাসূল (সঃ) এবং মুমিনদেরকে ছেড়ে অন্য কাউকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নাই? তোমরা জেনে রেখো যে, তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তা সবই খবর রাখেন।” মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে এবং কে ধৈর্যশীল তা এখনো জানেন না?” (৩:১৪২) আর এক জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, যতক্ষণ না আমি জেনে নিই তোমাদের মধ্যে জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদেরকে এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে পরীক্ষা করি।” (৪৭:৩১) এই ব্যাপারে আরো বহু আয়াত রয়েছে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সম্যক সক্ষম। আর এটাই হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা স্বীয় সেনাবাহিনীকে দুনিয়ার উপর বিজয় দান করেন।
জিহাদ যে সময় শরীয়ত সম্মত হয় ঐ সময়টাও ছিল ওর জন্যে সম্পূর্ণরূপে উপযোগী ও সঠিক। যতদিন পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সঃ) মক্কায় ছিলেন ততদিন পর্যন্ত মুসলমানরা ছিলেন খুবই দুর্বল। সংখ্যায়ও ছিলেন তারা খুবই কম। মুশরিকদের দশজনের স্থলে মুসলমানরা মাত্র একজন। আকাবার রাত্রে যখন আনসারগণ রাসূলুল্লাহর (সঃ) হাতে বায়আত গ্রহণ করেন তখন তারা বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি হুকুম করলে এখন মিনাতে যত মুশরিক একত্রিত হয়ে রয়েছে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে আমরা তাদেরকে হত্যা করে ফেলবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “না, আমাকে এখনো এই হুকুম দেয়া হয় নাই।” এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, ঐ সময় মহান ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল মাত্র আশির কিছু বেশী।
শেষ পর্যন্ত মুশরিকদের উপদ্রব চরম সীমায় পৌঁছে গেল। রাসূলুল্লাহকে (সঃ) তারা নানা ভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। এমনকি তাঁকে হত্যা করারও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়লো। অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরামের উপরও বিপদের পাহাড় চেপে বসলো এবং তাঁরা মাল-ধন, আত্মীয়-স্বজন সবকিছু ছেড়ে যে যেখানে পারলেন পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কেউ গেলেন আবিসিনিয়ায় এবং কেউ গেলেন মদীনায়। এমন কি স্বয়ং রিসালাতের সূর্যের (সঃ) উদয়ও মদীনাতেই হলো। মদীনাবাসী মুহাম্মদী পতাকাতলে (সঃ) সমবেত হয়ে গেলেন। ফলে, ওটা একটা সেনাবাহিনীর রূপ নিয়ে ফেললো। কিছু মুসলমানকে এক ঝাণ্ডার নীচে দেখা যেতে লাগলো। তাঁদের পা রাখার জায়গা হয়ে গেল। এখন ইসলামের দুশমনদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ার হুকুম নাযিল হয়ে গেল। যুদ্ধের এটাই হলো প্রথম আয়াত। এতে বলা হলো যে, এই মুসলমানরা অত্যাচারিত। তাদের ঘরবাড়ী তাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। বিনা কারণে তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। মক্কা থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিঃস্ব ও অসহায় অবস্থায় তারা মদীনায় পৌঁছেছে। তাদের কোনই অপরাধ ছিল না। একমাত্র অপরাধ এই যে, তারা এক আল্লাহর উপাসনা করেছে। তাঁকে এক বলে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা তাদের প্রতিপালক হিসেবে একমাত্র আল্লাহকেই মেনেছে। এটা হলো ইসৃতিসনা মুনকাতা। আসলে এটা ছিল মুশরিকদের কাছে অমার্জনীয় অপরাধ। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা রাসূলুল্লাহকে (সঃ) এবং তোমাদেরকে এ কারণেই বের করে দিয়েছে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপর ঈমান এনেছো।” (৬০:১) যেমন আসহাবুল উখদুদের ঘটনায় বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু এই কারণে যে, তারা বিশ্বাস করতো পরাক্রমশালী ও প্রশংসনীয় আল্লাহে।” (৮৫:৮)।
মুসলমান সাহাবীগণ খন্দক খননের সময় নিম্নলিখিত ছন্দ পাঠ করতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ আপনি না থাকলে (আপনার দয়া না হলে) আমরা সুপথ প্রাপ্ত হতাম না এবং আমরা দান-খয়রাতও করতাম না, নামাযও পড়তাম না। সুতরাং আমাদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ করুন এবং আমরা যুদ্ধের সম্মুখীন হলে আমাদের পা গুলি অটুট ও স্থির রাখুন! নিশ্চয় প্রথমে তারা আমাদের উপর চালিয়েছে, যদি তারা বিশৃংখলা সৃষ্টির ইচ্ছা করে তবে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করবো। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের আনুকূল্য করেছিলেন এবং ছন্দের শেষ অংশটি তিনিও তাদের সাথে পাঠ করছিলেন। (আরবী) বলার সময় স্বর খুব উঁচু করেছিলেন।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তবে বিধ্বস্ত হয়ে যেতো খৃস্টান সংসার বিরাগীদের উপাসনা স্থান। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠে, বিশৃংখলা ও অশান্তি সৃষ্টি হয়ে যেতো। শক্তিশালীরা দুর্বলদেরকে খেয়ে ফেলতো। খৃস্টান পাদরীদের ছোট উপাসনালয়কে (আরবী) বলা হয়। একটা উক্তি এটাও আছে যে, সাবী মাযহাবের লোকদের উপাসনালয়কে (আরবী) বলা হয়। কেউ কেউ আবার বলেন যে, অগ্নি উপাসকদের উপাসনালয়কে (আরবী) বলে। মুকাতিল (রঃ) বলেন যে, (আরবী) হলো ঐ ঘর যা পথের উপর থাকে (আরবী) হলো (আরবী) অপেক্ষা বড় ঘর। এটাও খৃস্টান পাদরীদের ইবাদতের ঘর। কেউ কেউ বলেন যে, এটা হলো ইয়াহূদীদের উপাসনালয়। (আরবী) এরও একটি অর্থ এটাই করা হয়েছে। কেউ কেউ আবার বলেন যে, এর দ্বারা গীর্জাকে বুঝানো হয়েছে। কারো কারো উক্তি এই যে, এটা হলো সা’ৰী লোকদের ইবাদতখানা। রাস্তার উপর আহলে কিতাবের যে ইবাদতখানা থাকে তাকে (আরবী) বলে। আর মুসলমানদের ইবাদতখানা হলো মাসজিদ। (আরবী) এর সর্বনামটি (আরবী) এর দিকে ফিরেছে। কেননা এটাই এর সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী। এটাও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা এইসব জায়গাকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সংসারত্যাগীদের উপাসনালয় (আরবী) খৃস্টানদের (আরবী) ইয়াহুদীদের (আরবী) এবং মুসলমানদের (আরবী) যে গুলিতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম। কোন কোন আলেমের উক্তি এই যে, এখানে কম হতে ক্রমান্বয়ে বেশীর দিকে যাওয়া হয়েছে। তুলনামূলকভাবে দুনিয়ায় মসজিদের সংখ্যা বেশী এবং এতে ইবাদতকারীদের সংখ্যাও অধিকতম।
আল্লাহ তাআলার উক্তিঃ আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। যেমন অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পাগুলি স্থির রাখবেন। আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্যে রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিবেন।” (৪৭:৭-৮)
এরপর আল্লাহ তাআলা নিজের দুটি বিশেষণের বর্ণনা দিচ্ছেন। তার একটি হলো তার শক্তিশালী হওয়া এই কারণে যে, তিনি সমস্ত সৃষ্ট জীব ও সৃষ্ট বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর দ্বিতীয় বিশেষণ এই যে, তিনি হলেন মহা মর্যাদাবান ও মহাপরাক্রমশালী। কেননা, সমস্ত কিছুই তার অধীন। সবই তাঁর সামনে হেয় ও তুচ্ছ। সবাই তার সাহায্যের মুখাপেক্ষী। তিনি সব কিছু হতে, অমুখাপেক্ষী ও অভাবমুক্ত। যাকে তিনি সাহায্য করেন সে জয়যুক্ত হয়। আর যার উপর থেকে তিনি সাহায্যের হাত টেনে নেন সে হয় পরাজিত। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এই বাক্য পূর্বেই স্থির হয়েছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্য প্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনীই হবে বিজয়ী।” (৩৭:১৭১-১৭৩) তিনি আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ লিপিবদ্ধ করেই রেখেছেনঃ আমি ও আমার রাসূলরা জয়যুক্ত থাকবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী।” (৫৮:২১)