(বই#৯৪৯) [ فَإِنَّهَا لَاإ تَعْمَى الاْإَبْصَارُ وَلَكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ আসল ব্যাপার হচ্ছে, চোখ অন্ধ হয় না বরং হৃদয় অন্ধ হয়ে যায়, যা বুকের মধ্যে আছে।] সূরা:- আল্ – হাজ্জ। সুরা:২২ ৪২-৫১ নং আয়াত:- www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৪৯)
[ فَإِنَّهَا لَاإ تَعْمَى الاْإَبْصَارُ وَلَكِن تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ
আসল ব্যাপার হচ্ছে, চোখ অন্ধ হয় না বরং হৃদয় অন্ধ হয়ে যায়, যা বুকের মধ্যে আছে।]
সূরা:- আল্ – হাজ্জ।
সুরা:২২
৪২-৫১ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২২-৪২
وَ اِنۡ یُّکَذِّبُوۡکَ فَقَدۡ کَذَّبَتۡ قَبۡلَہُمۡ قَوۡمُ نُوۡحٍ وَّ عَادٌ وَّ ثَمُوۡدُ ﴿ۙ۴۲﴾
আর যদি লোকেরা আপনার প্রতি মিথ্যারোপ করে, তবে তাদের আগে নূহ, ‘আদ ও সামূদের সম্প্রদায়ও তো মিথ্যারোপ করেছিল।
২২:৪৩
وَ قَوۡمُ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ قَوۡمُ لُوۡطٍ ﴿ۙ۴۳﴾
এবং ইবরাহীম ও লূতের সম্প্রদায়,
২২:৪৪
وَّ اَصۡحٰبُ مَدۡیَنَ ۚ وَ کُذِّبَ مُوۡسٰی فَاَمۡلَیۡتُ لِلۡکٰفِرِیۡنَ ثُمَّ اَخَذۡتُہُمۡ ۚ فَکَیۡفَ کَانَ نَکِیۡرِ ﴿۴۴﴾
এবং মাদয়ানবাসীরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল, এবং মূসার প্রতিও মিথ্যা আরোপ করা হয়েছিল। এসব সত্য অস্বীকারকারীকে আমি প্রথমে অবকাশ দিয়েছি তারপর পাকড়াও করেছি। এখন দেখে নাও আমার শাস্তি কেমন ছিল।
২২:৪৫
فَکَاَیِّنۡ مِّنۡ قَرۡیَۃٍ اَہۡلَکۡنٰہَا وَ ہِیَ ظَالِمَۃٌ فَہِیَ خَاوِیَۃٌ عَلٰی عُرُوۡشِہَا وَ بِئۡرٍ مُّعَطَّلَۃٍ وَّ قَصۡرٍ مَّشِیۡدٍ ﴿۴۵﴾
কত দুষ্কৃতকারী জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি এবং আজ তারা নিজেদের ছাদের ওপর উলটে পড়ে আছে, কত কূয়া অচল এবং কত প্রাসাদ ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে।
২২:৪৬
اَفَلَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَتَکُوۡنَ لَہُمۡ قُلُوۡبٌ یَّعۡقِلُوۡنَ بِہَاۤ اَوۡ اٰذَانٌ یَّسۡمَعُوۡنَ بِہَا ۚ فَاِنَّہَا لَا تَعۡمَی الۡاَبۡصَارُ وَ لٰکِنۡ تَعۡمَی الۡقُلُوۡبُ الَّتِیۡ فِی الصُّدُوۡرِ ﴿۴۶﴾
তারা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করেনি, যার ফলে তারা উপলব্ধিকারী হৃদয় ও শ্রবণকারী কানের অধিকারী হতো? আসল ব্যাপার হচ্ছে, চোখ অন্ধ হয় না বরং হৃদয় অন্ধ হয়ে যায়, যা বুকের মধ্যে আছে।
২২:৪৭
وَ یَسۡتَعۡجِلُوۡنَکَ بِالۡعَذَابِ وَ لَنۡ یُّخۡلِفَ اللّٰہُ وَعۡدَہٗ ؕ وَ اِنَّ یَوۡمًا عِنۡدَ رَبِّکَ کَاَلۡفِ سَنَۃٍ مِّمَّا تَعُدُّوۡنَ ﴿۴۷﴾
তারা আযাবের জন্য তাড়াহুড়ো করছে আল্লাহ কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন না। কিন্তু তোমার রবের কাছের একটি দিন তোমাদের গণনার হাজার বছরের সমান হয়।
২২:৪৮
وَ کَاَیِّنۡ مِّنۡ قَرۡیَۃٍ اَمۡلَیۡتُ لَہَا وَ ہِیَ ظَالِمَۃٌ ثُمَّ اَخَذۡتُہَا ۚ وَ اِلَیَّ الۡمَصِیۡرُ ﴿٪۴۸﴾
কতই জনপদ ছিল দুরাচার, আমি প্রথমে তাদেরকে অবকাশ দিয়েছি তারপর পাকড়াও করেছি। আর সবাইকে তো ফিরে আমারই কাছে আসতে হবে।
২২:৪৯
قُلۡ یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ اِنَّمَاۤ اَنَا لَکُمۡ نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿ۚ۴۹﴾
বল, ‘হে মানুষ! আমি তো তোমাদের জন্য এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।’
২২:৫০
فَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ ﴿۵۰﴾
কাজেই যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা।
২২:৫১
وَ الَّذِیۡنَ سَعَوۡا فِیۡۤ اٰیٰتِنَا مُعٰجِزِیۡنَ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ الۡجَحِیۡمِ ﴿۵۱﴾
আর যারা আমার আয়াতকে ব্যর্থ করার অপচেষ্টা করে তারাই হবে জাহান্নামের অধিবাসী।
৪২-৫১ নং আয়াতের তাফসীর:

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

এখানে পূর্ববর্তী দারসটি শেষ হচ্ছে। এ দারসের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসসমূহ ও ইসলামের প্রতীকী চিহ্ন ও বৈশিষ্ট্যগুলাে রক্ষা করার জন্যে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছে; আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সে সকল লােককে সাহায্য করবেন বলে ওয়াদা করেছেন যারা তাদের ঈমান আকীদা ঠিক রাখার জন্যে এবং মানুষের জীবনে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার কষ্ট করেছে এমনকি জীবনেরও ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েছে। তারপর দ্বীনের খাতিরে মােমেনদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট ও ঝুঁকি নেয়ার কথা বর্ণনা শেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রসূলুল্লাহ(স.)-কে সান্তনা দান করতে গিয়ে বলছেন যে তাঁর সাহায্যের জন্যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা তার হাতকে প্রসারিত করে রেখেছেন এবং কাফেরদেরকে পর্যদুস্ত করার জন্যে তার গযবের হাতও কার্যরত রয়েছে, যেমন করে তার পূর্ববর্তী রসূলগণকে সাহায্যের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতের হাতকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন। সত্যকে মিথ্যা বানানাের প্রচেষ্টারত ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন যামানায় তিনি কঠিনভাবে পাকড়াও করেছেন। আলোচ্য অধ্যায়ে তিনি কুরআন নাযিল কালের মুশরিকদের সহ সকল যামানার অন্যায়-অত্যাচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তাদেরকে সময় থাকতেই সাবধান হতে বলেছেন, আহবান জানিয়েছেন যেন তারা অতীতের জাতিসমূহের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা নেয় এবং যে কারণে তাদের ওপর গযব নাযিল হয়েছিলাে, সময় থাকতেই সে কারণগুলাে বর্জন করে, যদি প্রকৃতপক্ষেই তারা শিক্ষা গ্রহণকারী ও চিন্তাশীল অন্তরের অধিকারী হয়ে থাকে। আসলে তাদের চোখগুলাে এমন অন্ধ হচ্ছে নয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথ তারা দেখতে পাচ্ছে না; বরং অন্ধ তাদের বক্ষস্থিত কালব (অন্তর) সমূহ। এরপর মেহেরবান আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে সান্তুনা দিতে গিয়ে বলছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তার রসূলদেরকে বরাবর শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করেছেন এবং হেফাযত করেছেন সত্যকে প্রত্যাখ্যানকারীদের ষড়যন্ত্র থেকেও, আর শয়তানের সকল প্রকার প্রচেষ্টাকে পর্যুদস্ত করে দিয়ে তিনি তার নিদর্শনাবলীকে মযবুত বানিয়ে সেগুলােকে যে কোনাে নিশ্চিন্ত পরিতৃপ্ত অন্তরসমূহের কাছে উজ্জ্বল করে তুলেছেন। কিন্তু রােগগ্রস্ত সত্য বিরােধী ও সত্যকে অস্বীকারকারীদের হৃদয়ের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় থাকবেই। অতঃপর খেয়াল করুন আলোচ্য অধ্যায়ের সবটুকুই সর্বশক্তিমান আল্লাহর কুদরতের নমুনাসমূহের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিয়ােজিত হয়েছে যা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে এবং এসব বর্ণনা দাওয়াতী কাজের জন্যে রচিত কিতাবসমূহের মধ্যেও লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেখানে এটাও দেখানাে হয়েছে যে, ইসলামের দাওয়াত দানকারীরা তাদের মৌলিক ও প্রাথমিক কর্তব্যসমূহ পালন করার সাথে সাথে সারা বিশ্বের বুকে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন এমনকি তারা নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করেও এ দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়ােগ করেছেন, যার বিবরণ ইতিপূর্বেকার পর্বে আমরা দেখতে পেয়েছি।  *যুগে যুগে দ্বীনের দাওয়াত অস্বীকারকারীদের পরিণতি : এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি ওরা তােমাকে প্রত্যাখ্যান করে ও তােমাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চেষ্টা করে তাহলে জেনে রাখাে, এটা নতুন কোনাে কথা নয়, বরং… সুতরাং দেখাে না, কেমন হলাে (তাদের অস্বীকৃতির) পরিণতি'(আয়াত ৪২-৪৪) আসলে রসূলদের সকলের জীবনেই এই অস্বীকৃতিজনিত কষ্ট দান সাধারণভাবে দেখা যায় । শেষ রাসূল(স.)-এর পূর্বে যে রাসূল এসেছেন তাদের সবার জীবনেই দেখা যায়, তাদের দেশবাসীরা তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে, শুধু আখেরী রসূলকেই যে অস্বীকার করা হয়েছে তা নয়, অবশ্য অবশ্যই তাদেরকে যে পরিণতি ভােগ করতে হয়েছে তাও মােটামুটি সবার জানা আছে, এই সাধারণ নিয়মের কথা আল কোরআনের ভাষায় এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘অবশ্যই ওদের পূর্বে নূহের কওম, আদ, সামুদ ও ইবরাহীমের কওম এবং লূত-এর কওম (তাদের রসূলদেরকে) প্রত্যাখ্যান করেছে'(আয়াত ৪৩) এখানে দেখা যায়, এই সাধারণ বর্ণনার ধারার মধ্য থেকে মূসা(আ.)-এর কথা একটু পৃথকভাবে বলা হয়েছে, খাস এক একটি বাক্যে তার কথাটি পেশ করা হয়েছে, এরশাদ হচ্ছে, ‘আর মুসাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলাে।’ তাঁর কথা খাসভাবে বলার অনেকগুলাে কারণ দেখা যায়; যেমন, এক. অন্যান্য জাতিরা যেমন তাদের রসূলদেরকে অস্বীকার করেছিলাে, সেইভাবে মূসা(আ.)-এর কওম তাকে অস্বীকার করেনি, বরং তাকে অস্বীকার করেছিলাে ফেরাউন ও তার কওমের নেতৃবৃন্দ। দুই. মূসা(আ.)-কে তার রিসালাতের প্রমাণস্বরূপ অনেকগুলাে সুস্পষ্ট প্রমাণ বা মােজিযা দেয়া হয়েছিলাে, এতাে বেশী দৃশ্যমান মােজিযা আর কাউকেই দেয়া হয়নি এবং প্রত্যেকটি মােজিযা দেখানাের পর কাফেরদেরকে চিন্তা-ভাবনা করার জন্যে এবং বুঝার জন্যে বেশ কিছু সময় দেয়া হয়েছিলাে, যেমন করে সময় দেয়া হয়েছিলাে কোরায়শদেরকেও- তারপর তাদেরকে কঠিন আযাব দ্বারা পাকড়াও করা হয়েছিলাে। আর এখানে অত্যন্ত ভীতিপ্রদভাবেও বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন রাখা হয়েছে, ‘অতপর কেমন হলাে তাদের শাস্তি (শেষ পরিণাম)…’ আসলে নাকীর শব্দটির অর্থ হচ্ছে কঠিন অস্বীকৃতি, যার মধ্যে (শিক্ষা ও কথাকে) পরিবর্তনের অর্থও নিহিত রয়েছে। এর জবাবও সর্বজন বিদিত অর্থাৎ, এটা ছিলাে বড়ো ভয়ংকর শাস্তি! আর তা হচ্ছে, তুফানের শাস্তি, পৃথিবীর মধ্যে ধ্বসে যাওয়ার শাস্তি, প্রলয়কান্ড ও জনপদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শাস্তি, ভূমিকম্পের শাস্তি- ঘূর্ণিঝড় ও সর্বগ্রাসী আতংকের শাস্তি…। আর একের পর এক এসব কথা পেশ করার পর সাধারণভাবে প্রাচীনকালে সত্য বিরােধীদের প্রতি অবশ্যম্ভাবী আযাব নাযিল হওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর কতাে যালেম জাতিকে আমি মহান আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছি, তারা নিঃশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে (নাস্তানা-বুদ হয়ে গেছে ধরনীর বুক থেকে), পরিত্যক্ত ও বিরাণ হয়ে রয়েছে তাদের ইদারাগুলো এবং ধ্বংসন্তূপে পরিণত হয়ে রয়েছে তাদের ইমারতগুলাে। তাদের যুলুমের কারণে এধরনের বহু এলাকা ও শহর নগরের ধ্বংসাবিশেষের চিহ্ন আজও পৃথিবীর বুকে যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে, এসব ঘটনার বিবরণ এমনভাবে পেশ করা হয়েছে যেন মনে হয় সে ধ্বংসলীলার দৃশ্যগুলাে আমাদের চোখের সামনে আজও ভাসছে এবং আমাদের অন্তর্চক্ষুর সে দেখা আমাদের মধ্যে প্রবল এক কম্পনের সৃষ্টি করছে, ‘সেগুলো পরিপূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে আছে…’ উ’রূশ’ বলতে ছাদসমূহকে বুঝায় এগুলাে তাে ভিত্তি নির্মাণের পর নির্মিত ইমারতের প্রাচীরের ওপর স্থাপিত হয়… যখন এ বুনিয়াদগুলাে ভেংগে যায় তখন তার ওপর ধ্বসে পড়ে ছাদগুলাে আর তার পর গােটা প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কল্পনানেত্রে এ দৃশ্যটি ভেসে উঠলে ভয়ানক এক দুঃখজনক অবস্থা হৃদয়মনকে ছেয়ে ফেলে এবং এ কাল্পনিক দৃশ্য চিন্তা জাগায়। মক্কানগরীর নিকটে বহু ধ্বংসস্তুপ দেখা যায়, দেখা যায় বহু শূন্য কূপ ও ইদারার চিহ্ন, বহু পর্যটক এখানে এসে এসব দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে গেছে, তারা এসব ধ্বংসস্তুপ দেখে এখানকার অহংকারী অধিবাসীদের কথা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছে। আরাে দেখা যায় মক্কানগরীর চতুর্দিকের পবর্তাঞ্চলে জনশূন্য বহু মযবুত ইমারতের ধ্বংসাবিশেষ। বহু পর্যটক এখানে এসে আর অনুভব করে যে আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাতিসমূহের প্রেতাত্মাগুলাে যেন এখনও এসব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

*অবিশ্বাসীদের বিবেকের দরজায় আঘাত হানা : এ প্রসংগের আলােচনা যখন সামনে আসে তখন পাঠকের হৃদয় পটে ভেসে ওঠে এসব ধ্বংস্তুপের ছবি, আর তখনই মােশরেক কাফেরদের সামনে ক্রোধ ও ঘৃণার সাথে এ প্রশ্নটি তুলে ধরা হয়, ‘ওরা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করে না… কিন্তু তাদের বক্ষ মধ্যস্থিত হৃদয়গুলাে অন্ধ (ভোঁতা) হয়ে গেছে'(আয়াত ৪৬) অতীতের অহংকারী জাতিসমূহের নাফরমানীর দরুণ নেমে আসা এসব গযবের দৃশ্য দেখে যে কোনাে ব্যক্তির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়, নিষ্পলক নেত্রে সে এগুলাের দিকে তাকিয়ে তার অন্তরপটে জেগে ওঠে সেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির অহংকারপূর্ণ আচরণ ও তার ফলে নেমে আসা এসব গযব। তাই, এসব দর্শকদের শিক্ষার জন্যে, তাদের সামনে এ প্রশ্নটি রাখা হচ্ছে, ‘তারা কি ভ্রমণ করে না পৃথিবীর বুকে এবং দেখে না কি… এগুলাে সামনে রেখে ওরা কি চিন্তা করে না?’ চিন্তা করলে অবশ্য তারা বুঝবে নাফরমানীর পরিণাম কতাে কঠিন এবং হয়তাে এর থেকে তারা শিক্ষা নিতে পারবে, কারণ এসব দৃশ্য অবলােকনকালে এগুলাে যেন তাদের সাথে কথা বলতে থাকে। ‘তখন তাদের অন্তরগুলাে কি এসব দৃশ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে না।’ অবশই অন্তর্চক্ষু ও দিলওয়ালা লোকেরা ধ্বংসস্তুপের এসব দৃশ্য থেকে শিক্ষা নিতে পারবে এ- ধ্বংসাবশেষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিকলভাবে পড়ে রয়েছে। এ ছবিগুলাে বদলে যাচ্ছে না, শেষও হয়ে যাচ্ছে না মানুষকে দেখানাের জন্যে আল্লাহ তায়ালা এসব ধ্বংসাবশেষকে অবিকল অবস্থায় রেখে দিয়েছেন। ‘তাদের কি কান নেই, তার দ্বারা (এসব অতীত কাহিনী) কি তারা শােনে না?’ তারা যদি অতীতের এসব ধ্বংসাবশেষের কাহিনী পর্যটকদের মুখে শুনতাে তাহলেও তারা অনেক শিক্ষা নিতে পারতাে। তাদের কি অন্তর নেই। তারা দেখছে এসব জীবন্ত দৃশ্য তবুও তারা এ থেকে কি শিক্ষা নিচ্ছে না? এসব ঘটনার বিবরণ তারা শুনছে, তবুও তাদের টনক নড়ছে না, কোনাে প্রকার দাগই কাটছে না তাদের হৃদয় কন্দরে! এজন্যেই বলা হয়েছে, ‘আসলে তাদের চোখগুলাে অন্ধ নয়, বরং তাদের বুকের মধ্যে অবস্থিত অন্তরগুলােই অন্ধ হয়ে গেছে।’ বিশেষভাবে অন্তর মধ্যস্থিত স্থানের কথা উল্লেখ করে পাঠকের মনােযােগ আকর্ষণ করা হচ্ছে, যা রয়েছে বক্ষসমূহের মধ্যে অর্থাৎ, পাঠকের হৃদয়ে বিশেষভাবে চিন্তার উদ্রেক করানাের উদ্দেশ্যে এই বুকের মধ্যে অবস্থিত স্থানের কথা খাস করে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই যদি তাদের বুকের মধ্যে অবস্থিত অন্তরগুলাে বাস্তব চোখের অধিকারী হতো তাহলে অবশ্যই তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতাে এবং পরকালের ঈমানের চিন্তার দিকে তাদের গতি ফিরে যেতাে। তারা বুঝতাে যে অতীত জাতিসমূহের নাফরমানী ও অহংকারের কারণে যে দুর্গতি হয়েছে তাদের জন্যেও সেই একই পরিণতি অপেক্ষা করছে এবং তাদের আশ-পাশেই তাে প্রাচীন জাতিসমূহের বিস্তর ভগ্নাবশেষ ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু ধ্বংসাবশেষ দেখে চিন্তা না করা ও শিক্ষা নেয়া ঈমান না আনার দিকে ঝুঁকে পড়া ও আল্লাহর আযাবকে ভয় না করে ‘আসুক না দেখি আযাব, দেখি কেমন করে আসে’ অর্থাৎ শাস্তি লাভ করার জন্যে তারা বড়ােই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ভাবখানা এই যে আযাব বড়াে মজার জিনিস তাই না? আর এটা এই জন্যে সম্ভব হচ্ছে, যে আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে তাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে একটা নির্দিষ্ট মুহূর্ত পর্যন্ত সময় দিয়ে রেখেছেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা বড়ােই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আযাবের জন্যে… আর সেদিনকার একটি দিন, তােমরা যেসব দিন গুনে থাক তার হাজার বছরের সমান।’ সকল কালের ও সকল সময়ের যালেমদের এইটিই তো রীতি। তারা যালেমদের তৎপরতা ও পরিণাম দেখে তাদের সম্পর্কে বহু সংবাদও পাঠ করে এবং তাদের পরিণাম কি হচ্ছে এরপরও জানতে পারে, পথের শেষের দিকে না তাকিয়ে এবং পরিণাম কি হবে সে চিন্তা না করে তারা সেই চিহ্নিত ধ্বংসের পথে মহা উল্লাসে চলতে থাকে, যে পথে অতীত জাতিসমূহ চলেছে। এরপর যদি তাদেরকে তাদের অতীত জাতির নির্মম পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলা হয় এবং তাদের পূর্বসুরীদের পথ পরিহার করার জন্যে উপদেশ দেয়া হয় তাদের ওপর যেসব মুসীবত নেমে এসেছে, সেসব মুসীবতের ভয় দেখানাে হয়, খবর পৌছানাের উদ্দেশ্যে যদি অহংকারী জাতিসমূহের ইতিহাসও তাদের সামনে তুলে ধরা হয়, তখন যারা তাদেরকে শেষ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করছে তাদেরকে তারা উপহাস বিদ্রুপ করতে শুরু করে দেয়। আর এই উপহাস বিদ্রুপেরই একটি অংশ হচ্ছে, সে আযাবের জন্যে ব্যস্ততা দেখানাে, যার ভয় তাদেরকে দেখানাে হচ্ছে। এজন্যে এরশাদ হচ্ছে, ‘কিছুতেই আল্লাহ তায়ালা তার সেই ওয়াদা খেলাফ করবেন না যা তাদেরকে তিনি দিয়ে রেখেছেন।’ অবশ্যই তা আসবে সেই সুনির্দিষ্ট সময়ে যা তিনি নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং বিশেষ কোনাে কারণে পূর্ব-পরিকল্পিত সময় পর্যন্ত সে আযাব আসাকে তিনি বিলম্বিত করেছেন। মানুষ জলদি করলে তিনিও যে তাদের সাথেই ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং তাঁর পূর্ব-পরিকল্পনাকে ভেংগে দিয়ে তাড়াতাড়ি তিনি আযাব নাযিল করে ফেলবেন এমন কখনও হবে না। আসলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সময়ের হিসাব নিকাশ ও তার ব্যবহার মানুষের হিসাব নিকাশ থেকে ভিন্নতর। তাই এরশাদ হচ্ছে, কতাে কতো এলাকাবাসীকে জুলুম করা সত্তেও আমি ঢিল দিয়েছি, তারপর তাদেরকে পাকড়াও করেছি, আর আমার কাছেই তাে তাদেরকে ফিরে আসতে হবে।’ সুতরাং, একবার ভেবে দেখুন, আযাব পাওয়ার ব্যাপারে যারা ব্যস্ততা দেখাচ্ছে সেসব মােশরেকদের ব্যাপারটা আসলে কি? কী আশ্চর্য, শাস্তির ধমকি যখন তাদেরকে শােনানাে হচ্ছে তখন তারা আযাবের জন্যে ব্যস্ততা দেখিয়ে দাওয়াত দানকারীদের সাথে ঠাট্টা-মস্কারি করছে। আচ্ছা, তাদেরকে নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত ঢিল দিয়ে রাখা হয়েছে- এই জন্যেই এতো ব্যস্ততা? ঠিক আছে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও (ওহে রসূল) ‘হে মানবমন্ডলী, অবশ্যই আমি তােমাদের কাছে সুস্পষ্ট একজন সতর্ককারী হিসেবে আগমন করেছি… ওরাই হচ্ছে দেযখবাসী'(আয়াত ৪৯-৫১) উপরের আয়াতগুলােতে সতর্ককারী হিসাবে রসূলুল্লাহ(স.)-এর দায়িত্বের কথাটাই শুধু  স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, আমি তােমাদের জন্যে সুস্পষ্ট সতর্ককারী। একথার কারণেই তাে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে, বিদ্রুপ করা হচ্ছে এবং প্রকাশ্যভাবে আযাব সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করায় জলদি আযাব নামিয়ে আনতে বলা হচ্ছে… এরপর প্রত্যাবর্তন স্থলের বিস্তারিত বিবরণ দান শুরু করা হচ্ছে, অতপর, যারা ঈমান এনেছে এবং ঈমানের বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে যে কাজ প্রয়ােজন সে সব দায়িত্ব পালন করেছে, ভালাে কাজসমূহ করেছে তাদের প্রতিদান হচ্ছে, ‘তাদের রবের পক্ষ থেকে দেয়া মাগফেরাত’ ওইসব গুনাহের জন্যে যা তারা পূর্বে করেছে অথবা যেসব ত্রুটি ইতিপূর্বে তাদের দ্বারা হয়ে গেছে সে সবের জন্যে ‘আরও রয়েছে (তাদের জন্যে) সম্মানজনক রিযিক (সর্বপ্রকার জীবন সামগ্রী)। অর্থাৎ, এরপর তাদেরকে আর কোনােপ্রকার দোষারােপ করা হবে না এবং তাদেরকে কোনাে দিক দিয়ে ছােটো করা হবে না, আসবে না তাদের জন্যে কোনাে অপমানজনক অবস্থা! আর যারা, আল্লাহর আয়াতসমূহকে মানুষ পর্যন্ত পৌছুতে বাধা দান করবে এবং মানুষকে এই আয়াতগুলাে অনুসারে চলতে দেবে না- অথচ আল্লাহর এসব আয়াত তাে সত্য কথা ও সত্য ব্যবস্থা প্রকাশকারী ও মানবমন্ডলীর জন্যে আল্লাহর বিধান বর্ণনাকারী- এমতাবস্থায় এ আয়াতগুলাের সাথে সেসব দুর্ব্যবহারকারী নিজেদেরকে জাহান্নামের অধিকারী বানিয়ে নিলাে। আর, হায়, ওই সম্মানজনক রিযিকের পরিবর্তে তারা কি কঠিন ও নিকৃষ্ট পরিণতি নিজেদের জন্যে খরীদ করে নিলাে।

 

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

# তাদের মধ্যে কোন জাতিকেও নবীকে অস্বীকার করার সাথে সাথেই পাকড়াও করা হয়নি। বরং প্রত্যেককে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়। তাদেরকে তখনই পাকড়াও করা হয় যখন ইনসাফের দাবী পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় কাফেররা যেন তাদের দুর্ভাগ্য আসতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে নবীর সতর্কবাণীগুলোকে নিছক অন্তসারশূন্য হুমকি মনে না করে। মূলত এভাবে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য আল্লাহ তাঁর রীতি অনুযায়ী তাদেরকে অবকাশ দিচ্ছেন। এ অবকাশের সুযোগ যদি তারা যথাযথভাবে ব্যবহার না করে তাহলে তাদের পরিণামও তাই হবে যা তাদের পূর্ববর্তীদের হয়েছে।

# মূলে نَكِيرِ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শাস্তি বা অন্য কোন শব্দের মাধ্যমে এর পুরোপুরি অর্থ প্রকাশ পায় না। এ শব্দের দু’টি অর্থ হয়। এক, কোন ব্যক্তির খারাপ মনোভাব ও মন্দ নীতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করা। দুই, তাকে এমন শাস্তি দেয়া যার ফলে তার অবস্থা ওলট-পালট হয়ে যায়, চেহারা এমনভাবে বিকৃত হয়ে যায় যেন কেউ দেখে তাকে চিনতে না পারে। এ দু’টি অর্থের দৃষ্টিতে এ বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায়, “এখন দেখে নাও, তাদের এ নীতির কারণে যখন আমার ক্রোধ উদ্দীপিত হলো তখন আমি তাদের অবস্থা পরিবর্তিত করে দিলাম।”

# আরবে কূয়া ও জনবসতি প্রায় সমার্থক শব্দ। কোন গোত্রর জনবসতির নাম নিতে হলে বলা হয় ماء بنى فلان অর্থাৎ অমুক গোত্রের কূয়া। একজন আরবের সামনে যখন বলা হবে কূয়াগুলো অকেজো পড়ে আছে তখন সে এর অর্থ এ বুঝবে যে জনবসতিগুলো জনশূন্য ও পরিত্যক্ত।

# মনে রাখতে হবে, কুরআন বিজ্ঞানের বই নয় বরং সাহিত্যের ভাষায় কথা বলে। এখানে অযথা এ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই যে, বক্ষস্থিত হৃদয় আবার চিন্তা করে কবে থেকে? সাহিত্যের ভাষায় আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা-ভাবনা বরং প্রায় সব রকমের কাজকেই মস্তিষ্ক, বক্ষদেশ ও হৃদয়ের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। এমনকি কোন কথা মনে থাকার ব্যাপারটিও এভাবে বলা হয়, “সেটা তো আমার বুকে সংরক্ষিত আছে।”

# বারবার চ্যালেঞ্জ করছে। তারা বলছে যদি তুমি সাচ্চা নবী হয়ে থাকো, তাহলে আল্লারহ সত্য নবীকে অস্বীকার করার ফলে যে আযাব আসা উচিত এবং যার ব্যাপারে তুমি বারবার হুমকি দিয়েছো তা আসছে না কেন?

# মানুষের ইতিহাসে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের সময় নির্ধারক ও পঞ্জিকার হিসেব অনুযায়ী হয় না। যেমন আজকে একটি ভুল বা সঠিক নীতি অবলম্বন করা হলো এবং কালই তার মন্দ বা ভালো ফলাফল প্রকাশ হয়ে গেলো, এমন নয়। কোন জাতিকে বলা হয়, অমুক কর্মপদ্ধতি অবলম্বনের ফল দাঁড়াবে তোমাদের ধ্বংস। এর জবাবে তারা যদি এ যুক্তি পেশ করে যে, এ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করার পর আমাদের দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, এখনো তো আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি, তাহলে তারা হবে বড়ই নির্বোধ। ঐতিহাসিক ফলাফলের জন্য দিন, মাস ও বছর তো সামান্য ব্যাপার শতাব্দীও কোন বিরাট ব্যাপার নয়।

# আমি তোমাদের ভাগ্য নির্ণায়ক নই বরং একজন সতর্ককারী মাত্র। সর্বনাশ ঘটার আগে তোমাদের সতর্ক করে দেয়াই আমার কাজ, এর বেশী কোন দায়িত্ব আমার ওপর নেই। পরবর্তী ফায়সালা করা আল্লাহর কাজ। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে কতদিন পর্যন্ত অবকাশ দেবেন এবং কবে কোন্ অবস্থায় শাস্তি দেবেন।

# “মাগফেরাত” বলতে বুঝানো হয়েছে অপরাধ, পাপ, ভুল-ভ্রান্তি ও দুর্বলতা উপেক্ষা করা ও এড়িয়ে চলা। আর “সম্মানজনক জীবিকা”র দু’টি অর্থ হয়। প্রথমত, উত্তম জীবিকা দেয়া এবং দ্বিতীয়ত, মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে জীবিকা দেয়া।

তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৪২-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর:

উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলছেন, হে নাবী! কাফিররা তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে এ জন্য মনঃক্ষুণœ হয়ো না। এরা শুধু তোমাকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে না, বরং তোমার পূর্বে যত নাবী-রাসূল আগমন করেছে যেমন নূহ, সালেহ, হূদ, ইবরাহীমসহ সকলকেই তারা অস্বীকার করেছে এবং মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছে। সুতরাং তাদের কাজই হল মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, সত্য থেকে বিমুখ থাকা। তাদেরকে যেমন অবকাশ দেয়ার পর শাস্তি দিয়েছিলাম তেমনি তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারীদেরকে অবকাশ দিলেও শাস্তি দিব। যেমন বদরসহ অন্যান্য যুদ্ধে নির্মমভাবে নিহত হওয়া কাফিররা।

এরপর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী সকল যুগের কাফিরদের পরিণতি উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তোমার পূর্বে কত জনপদবাসীকে ধ্বংস করেছি, তারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী ও রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। তাদের বাড়ি-ঘর উল্টিয়ে দিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিলাম, পানি পান করা কূপ ও বিশাল প্রাসাদ সব পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য জমিনে সফর কর। যদি তোমাদের বুঝার মত কোন হৃদয় থাকে, শোনার মত কোন কান থাকে, আর দেখার মত কোন চোখ থাকে তাহলে অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। তোমাদের তো বুঝার মত কোন অন্তর নেই, তোমাদের যে হৃদয় রয়েছে তা তো অন্ধ হয়ে গেছে, শিক্ষা নিবে কোথা থেকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন

(وَكَذٰلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَآ أَخَذَ الْقُرٰي وَهِيَ ظٰلِمَةٌ ط إِنَّ أَخْذَه۫ٓ أَلِيْمٌ شَدِيْدٌ)‏

“এরূপই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি‎! তিনি শাস্তি‎ দান করেন জনপদসমূহকে যখন তারা জুলুম করে থাকে। নিশ্চয়ই তাঁর শাস্তি‎ যন্ত্রণাদায়ক কঠিন।” (সূরা হূদ ১১:১০২)

অর্থাৎ তাদের চোখ সত্য জিনিস দেখে বটে কিন্তু তাদের হৃদয় সত্য গ্রহণ করতে সাড়া দেয় না। যার ফলে তারা কুফরীর মধ্যেই থেকে যায়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. দুনিয়াতে যারাই আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
২. পূর্ববর্তীদের ধ্বংসাবশেষ রেখে দিয়েছেন যাতে তাদের দেখে পরবর্তীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
৩. দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা প্রদান করা উত্তম কাজ।
৪৭-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিদের ধ্বংসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরেও কাফিরদের অবাধ্যতা ও সীমালংঘন এত দূর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে যে, এরা মনে করে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে শাস্তির যে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন তা অলীক এবং তা কখনো ঘটা সম্ভব নয়। তাই বলছে, তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে শাস্তি নিয়ে এসো। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথা তুলে ধরে বলেন:

(وَإِذْ قَالُوا اللّٰهُمَّ إِنْ كَانَ هٰذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِّنَ السَّمَا۬ءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ)‏

“স্মরণ কর! যখন তারা বলছিল, ‘হে আল্লাহ! এটা যদি তোমার পক্ষ হতে সত্য হয়, তবে আমাদের ওপর আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষণ কর কিংবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দাও।” (সূরা আনফাল: ৮:৩২)

وَعْدَه۫ এখানে ওয়াদা ভঙ্গ করেন না বলতে কাফিররা যে দ্রুত শাস্তি কামনা করছে সে প্রতিশ্র“ত শাস্তি তাদেরকে অবশ্যই দেবেন, কিন্তু তা দেবেন যথাসময়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَیَسْتَعْجِلُوْنَکَ بِالْعَذَابِﺚ وَلَوْلَآ اَجَلٌ مُّسَمًّی لَّجَا۬ءَھُمُ الْعَذَابُﺚ وَلَیَاْتِیَنَّھُمْ بَغْتَةً وَّھُمْ لَا یَشْعُرُوْنَﮄ)

“তারা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে। যদি নির্ধারিত কাল না থাকত তবে শাস্তি তাদের ওপর অবশ্যই আসত। নিশ্চয়ই তাদের ওপর শাস্তি আসবে আকস্মিকভাবে, তারা টেরও পাবে না।” (সূরা আনকাবুত ২৯: ৫৩) অথচ তারা এটা জানে না যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। তাই তিনি তাঁর ওয়াদা অনুসারে যখন তাদের শাস্তির সময় আসল তখন তিনি তাদেরকে শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করে দিলেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা যা ওয়াদা করেন তা যথাসময়ে সত্যে পরিণত হবেই।
২. আখিরাতের একদিন সমান দুনিয়ার হাজারন বছর এ কথা জানতে পারলাম।
৪৯-৫১ নং আয়াতের তাফসীর:

উক্ত আয়াতগুলোতে কাফির-মুশরিকদের পূর্বোক্ত দাবীর জবাব প্রদান করা হচ্ছে, যে দাবী তারা করত। তারা তাদেরকে শাস্তি তাড়াতাড়ি দেয়ার জন্য বলত, তাই তাদের এ কথার জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে নাবী! তুমি বল, আমার কাজতো কেবল সতর্ক করা ও সুসংবাদ দেয়া। আযাব ও শাস্তি প্রেরণ করা আল্লাহ তা‘আলার কাজ। এটা আমার ক্ষমতার বাইরে। কাউকে দ্রুত পাকড়াও করা অথবা দেরীতে পাকড়াও করার কাজ তাঁর হিকমত ও ইচ্ছাধীন। তার জ্ঞানও আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কারো নেই। এ কথা যদিও মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেহেতু সারা বিশ্ববাসীর জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন তাই ‘হে মানুষ’ দিয়ে সম্বোধন করা হয়েছে। এ আয়াতে কিয়ামত পর্যন্ত আগত ঐ সমস্ত কাফির-মুশরিকদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে যারা মক্কার লোকদের মত আচরণ করবে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: যারা সতর্কবাণী শোনার পর ঈমান আনবে ও সৎ আমল করবে তারাই হবে ক্ষমাপ্রাপ্ত দল এবং তারাই হবে জান্নাতের অধিবাসী। পক্ষান্তরে যারাই স্বৈরাচারিতা করবে, আয়াতকে মিথ্যা বলবে তারাই হবে জাহান্নামী।

আয়াত হতে শি¬ক্ষণীয় বিষয়:

১. আকাশ থেকে শাস্তি প্রেরণ করা কেবল আল্লাহ তা‘আলারই কাজ।
২. কোন্ কাজ করলে জান্নাতী এবং কোন্ কাজ করলে মানুষ জাহান্নামী হবে তা জানতে পারলাম।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

৪২-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) সান্ত্বনা দিচ্ছেনঃ হে নবী (সঃ)! তোমার কওম যে তোমাকে মিথ্যা প্রতিপাদন ও অস্বীকার করছে এটা কোন নতুন কথা নয়। নূহ (আঃ) থেকে নিয়ে মূসা (আঃ) পর্যন্ত কাফিররা সমস্ত নবীকেই অস্বীকার করে আসছে। দলীল প্রমাণাদি তাদের সামনে বিদ্যমান। ছিল, সত্য উদঘাটিত হয়েছিল, তথাপি তারা কিছুই স্বীকার করে নাই। আমি ঐ সব কাফিরকে অবকাশ দিয়েছিলাম যে, চিন্তা ভাবনা করে হয়তো তারা নিজেদের পরিণামকে ভাল করে নেবে। কিন্তু যখন তারা নিমক হারামী থেকে ফিরে আসলো না তখন শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে শাস্তি দ্বারা। পাকড়াও করি। আমার শাস্তি কতই না কঠোর ছিল!

পূর্ব যুগীয় গুরুজন হতে বর্ণিত আছে যে, ফিরাউনের খোদায়ী দাবী করা এবং আল্লাহ তাআলার তাকে আযাবে পাকড়াও করার মাঝে চল্লিশ বছরের ব্যবধান ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক অত্যাচারীকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু যখন তিনি পাকড়াও করেন তখন। আর কোন রক্ষা থাকে না। যেমন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালক যখন কোন অত্যাচারী গ্রামবাসীকে পাকড়াও করেন তখন তাঁর পাকড়াও এরূপই, নিশ্চয়ই তাঁর পাকড়াও খুবই যন্ত্রণাদায়ক ও কঠোর।” (১১:১০২)।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি যে গুলির বাসিন্দা ছিল অত্যাচারী। এই সব জনপদ তাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংস স্কুপে পরিণত হয়েছিল। ঐ গুলির ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান আছে।

তাদের সুউচ্চ ও সুদৃঢ় প্রাসাদসমূহ আজ বিলীন হয়ে গেছে। পানির কূপগুলি পরিত্যক্ত হয়েছে। যেগুলি কলি ছিল বাস যোগ্য ও ব্যবহার যোগ্য, আজ ঐ সব গুলিই হয়ে গেছে বাসের অযোগ্য ও অকেজো। তাদের সবকিছু আজ শ্মশানে পরিণত হয়েছে। সবই খাঁ খাঁ করছে। যেমন অল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) “তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু তোমাদেরকে পেয়ে বসবেই যদিও তোমরা সুউচ্চ ও সুদৃঢ় দূর্গেও অবস্থান কর না কেন।” (৪:৭৮)

মহামহিম আল্লাহ বলেনঃ তারা কি দেশ ভ্রমণ করে নাই? তারা কি কখনো এ বিষয়ে চিন্তা গবেষণা করে নাই? এরূপ করলে তো তারা কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো?

ইমাম ইবনু আবি দুনিয়া কিতাবুত তাফাকুর ওয়াল ই’তেবার’ নামক গ্রন্থে একটি রিওয়াইয়াত এনেছেন যে, আল্লাহ তাআলা হযরত মূসার (আঃ)। নিকট ওয়াহী প্রেরণ করেনঃ “হে মূসা (আঃ)! তুমি লোহার জুতো পরে এখনো লোহার লাঠি নিয়ে ভূ পৃষ্ঠে ভ্রমণ কর এবং নিদর্শনাবলী ও শিক্ষণীয় জিনিস গুলির প্রতি লক্ষ্য করতে থাকো। তুমি দেখবে যে, তোমার জুতো টুকরো টুকরো হয়ে গেছে এবং লাঠিও ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে, কিন্তু ওগুলি শেষ হয় নাই।”

ইবনু আবিদ দুনিয়া (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, কোন বিজ্ঞ লোক বলেছেনঃ “ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমে তোমরা অন্তরকে জীবিত কর, চিন্তা ফিরের মাধ্যমে ওকে জ্যোতির্ময় করে দাও, সংসারের প্রতি উদাসীনতার দ্বারা ওকে মেরে দাও, বিশ্বাসের দ্বারা ওকে দৃঢ় কর, মৃত্যুর স্মরণ দ্বারা ওকে লাঞ্ছিত কর, ধ্বংসের বিশ্বাস দ্বারা ওকে ধৈর্যশীল কর, দুনিয়ার বিপদ আপদগুলি ওর সামনে রেখে দাও, ওর চক্ষু গুলি খুলে দাও, যুগের সংকীর্ণতা দেখিয়ে ওকে ভীত সন্ত্রস্ত কর, অতীতের ঘটনাবলী দ্বারা ওকে শিক্ষা গ্রহণ করাও, পূর্ববর্তী লোকদের কাহিনী শুনিয়ে ওকে সতর্ক করে দাও, তাদের পরিণামের কথা চিন্তা করতে ওকে অভ্যস্ত কর যে, ঐ পাপীদের সাথে আল্লাহ তাআলা কি ব্যবহার করেছেন! কিভাবে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।”

এখানেও আল্লাহ তাআলা ঐ কথাই বলেনঃ পূর্ববর্তীদের ঘটনাবলী তোমাদের চোখের সামনে তুলে ধর, অন্তরকে বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন কর, তাদের ধ্বংসলীলার সত্য কাহিনী শুনে উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ কর। বস্তুতঃ তোমাদের চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়। তোমাদের হৃদয় অন্ধ হওয়ার কারণেই তোমরা পূর্বের ঘটনাবলী হতে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি তোমরা হারিয়ে ফেলেছে। আবূ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ ইবনু মুহাম্মদ ইবনু হাইয়ান উনদুলুসী শানতারীনী, যিনি ৫১৭ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেছেন, এ বিষয়টিকে তাঁর নিম্ন লিখিত কবিতায় সুন্দররূপে ফুটিয়ে তুলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে ঐ ব্যক্তি! যে, পাপরাশির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে আনন্দ উপভোগ করছো, তুমি তোমার বার্ধক্য ও অচলাবস্থা হতে কি বে-খবর রয়েছো? তোমার জন্যে উপদেশ যদি ক্রিয়াশীল না হয় তবে তুমি দেখে, শুনেও কি শিক্ষা গ্রহণ করতে পার না? জেনে রেখো যে, চক্ষু ও কর্ণ কাজ না করলে এটা ততো দোষনীয় নয় যতো দোষনীয় হলো ঘটনাবলীর মাধ্যমে উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ না করা। স্মরণ রেখো যে, যামানা, দুনিয়া, আসমান, সূর্য ও চন্দ্র কিছুই বাকী থাকবে না। মন না চাইলেও তোমাকে একদিন দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করতেই হবে, তুমি আমীরই হও বা ফকীরই হও এবং শহরবাসীই হও বা পল্লীবাসীই হও।”

৪৭-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলছেনঃ এই বিপথগামী কাফিররা, আল্লাহকে, তাঁর রাসূলকে (সঃ) এবং কিয়ামতের দিনকে মিথ্যা প্রতিপাদনকারীরা তোমাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলছে। তারা বলছে যে, তাদের উপর শান্তি আসতে বিলম্ব হচ্ছে কেন? যে শাস্তি হতে তাদেরকে ভয় দেখানো হচ্ছে তা তাদের উপর কেন তাড়াতাড়ি আসে না? তারা তো স্বয়ং আল্লাহকেও বলতোঃ “হে আল্লাহ! যদি এটা আপনার পক্ষ হতে সত্য হয় তবে আমাদের উপর আকাশ হতে প্রস্তর বর্ষণ করুন অথবা আমাদের কাছে বেদনাদায়ক শাস্তি আনয়ন করুন!” আল্লাহ তাআলা বলেনঃ দেখো, আল্লাহর ওয়াদা সত্য। কিয়ামত ও শাস্তি অবশ্যই আসবে। আল্লাহর বন্ধুদের মর্যাদা লাভ এবং তার শত্রুদের লাঞ্ছনা ও অপমান অবশ্যম্ভাবী।

হযরত আসমাঈ (রঃ) বলেনঃ “আমি একদা আবু আমর ইবনু আ’লার কাছে ছিলাম। এমন সময় আমর ইবনু উবায়েদ আসলো এবং বললোঃ “হে আবু আমর! আল্লাহ তাআলা নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করেন কি? উত্তরে তিনি বললেনঃ “না।” তৎক্ষণাৎ সে উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করলো। তখন তিনি বললেনঃ “তুমি কি আজমী? (আরব ছাড়া অন্যান্য সমস্ত দেশের লোককে আজমী বলে) শুনে রেখো যে, আরবে (আরবী) অর্থাৎ ভাল জিনিসের ওয়াদার খেলাপ করা মন্দ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু (আরবী) অর্থাৎ শাস্তির হুকুমের রদবদল করা বা ক্ষমা করে দেয়াকে মন্দ মনে করা হয় না; বরং ওটাকে করুণা ও অনুকম্পা মনে করা হয়। দেখো, কবি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি যদি কাউকেও শাস্তি দেয়ার কথা বলি অথবা কাউকেও পুরস্কার দেয়ার ওয়াদা করি তবে এটা হতে পারে যে, শাস্তি দেয়ার কথা উলটিয়ে দিতে পারি এবং সম্পূর্ণ মাফ করে দিতে পারি। কিন্তু আমার পুরস্কার দানের ওয়াদা আমি অবশ্যই পূর্ণ করি। মোট কথা, শাস্তি দেয়ার ওয়াদা করে শাস্তি না দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ নয়। কিন্তু ইনআমের ওয়াদা করে ইনআ’ম না দেয়া খারাপ বিশেষণ যা থেকে আল্লাহর সত্তা অতি পবিত্র।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহর নিকট এক একটি দিন তোমাদের হাজার দিনের সমান। তিনি যে শাস্তি দিতে বিলম্ব করেন এটা তাঁর সহনশীলতা। কেননা, তিনি জানেন যে, যে কোন সময় তিনি তাদেরকে পাকড়াও করতে সক্ষম। কাজেই তাড়াহুড়ার প্রয়োজন কি? তাদের রশি যতই ঢিল দেয়া হোক না কেন, যখন তিনি তাদেরকে পাকড়াও করার ইচ্ছা করবেন, তখন তাদের শ্বাস গ্রহণেরও সময় থাকবে না।

ঘোষিত হচ্ছেঃ বহু জনপদবাসী অত্যাচার করার কাজে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিলে। আমি ওটা দেখেও দেখি না। যখন তারা তাতে সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন হয়ে গেল তখন আমি অকস্মাৎ তাদেরকে পাকড়াও করে ফেলি। তারা সবাই আমার কাছে প্রত্যাবর্তন করবে। এছাড়া তাদের কোন উপায় নেই। আমার সামনে তাদেরকে হাজির হতেই হবে।

হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দরিদ্র মুসলমানরা ধনী মুসলমানদের অর্ধদিন পুর্বে (অর্থাৎ পাঁচশ বছর পূর্বে) জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। জামে তিরমিযী ও সুনানে নাসায়ীতেও এটা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “দরিদ্র মুসলমানরা ধনী মুসলমানদের অর্ধদিন পরিমাণ পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “অর্ধদিনের পরিমাণ কত?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “তুমি কি কুরআন পড় ?” জবাবে বলা হয়ঃ “হাঁ, পড়ি। তিনি তখন (আরবী) এ আয়াতটি পড়ে শুনিয়ে দেন। অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালকের একদিন তোমাদের গণনায় সহস্র বছরের সমান।” (২২:৪৭) (এটা ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সা’দ ইবনু আবি অক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর কাছে আমি আশা রাখি যে, তিনি আমার উম্মতকে অর্ধ দিন পিছিয়ে রাখবেন।” হযরত সা’দকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “অর্ধদিনের পরিমাণ কত?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “পাঁচ শ’ বছর।” (এটা আবু দাউদ (রঃ) কিতাবুল মালাহিম-এর শেষে বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “এই দিন ঐ দিনগুলির অন্তর্ভূক্ত যে গুলিতে আল্লাহ তাআলা আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। (এটা ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রঃ) কিতাবুর রদ আ’লাল জামিয়্যাহ্ গ্রন্থে এটাকে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এই আয়াতটি নিম্নের আয়াতটির মতইঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি আকাশ হতে পৃথিবী পর্যন্ত সমুদয় বিষয় পরিচালনা করেন, অতঃপর একদিন সমস্ত কিছুই তাঁর সমীপে সমুখিত হবে যে দিনের পরিমাণ হবে তোমাদের হিসেবে হাজার বছরের সমান।” (৩২:৫)

ইমাম মুহাম্মদ ইবনু সীরীন (রঃ) আহলে কিতাবের একজন নও মুসলিম হতে বর্ণনা করেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন এবং একদিন তোমার প্রতিপালকের নিকট এক হাজার দিনের সমান যা তোমরা গণনা করে থাকে। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আয়ুষ্কাল রেখেছেন ছয় দিন। সপ্তম দিনে কিয়ামত হবে। আর একদিন হাজার দিনের সমান। সুতরাং ছয়দিন তো কেটেই গেছে। এখন তোমরা সপ্তম দিনে রয়েছে। এখন তো অবস্থা ঠিক গর্ভবতী নারীর মত যার গর্ভ পূর্ণ দশ মাসের হয়ে গেছে। জানা যায় না কোন ক্ষণে সে সন্তান প্রসব করে!

৪৯-৫১ নং আয়াতের তাফসীর:

কাফিররা যখন তাড়াতাড়ি শাস্তি চাইলো তখন আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূলকে (সঃ) বলছেনঃ হে রাসূল (সঃ)! তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ হে লোক সকল! আমি তো আল্লাহ তাআলার একজন প্রেরিত বান্দা। আমি তোমাদেরকে ঐ শাস্তি হতে সতর্ক করতে এসেছি যা তোমাদের সামনে রয়েছে। তোমাদের হিসাব গ্রহণের দায়িত্ব আমার নয়। শাস্তি আল্লাহ তাআলার অধিকারে রয়েছে। ইচ্ছা করলে তিনি এখনই তা নাজিল করবেন, ইচ্ছা করলে বিলম্বে করবেন। কার ভাগে হিদায়াত রয়েছে এবং কে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত তা আমার জানা নেই। হুকুমত তারই হাতে। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারে না। তিনি খুব তাড়াতাড়ি হিসাব গ্রহণকারী। আমার অধিকার শুধু এটুকুই যে, আমি একজন সতর্ককারী ও ভয় প্রদর্শক। যাদের অন্তরে ইয়াকীন ও ঈমান রয়েছে এবং তাদের আমল দ্বারা তা প্রমাণিত হয়, তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার যোগ্য। তাঁর পূণ্যগুলিও প্রশংসা লাভের যোগ্যতা রাখে।

(আরবী) দ্বারা জান্নাতকে বুঝানো হয়েছে। যারা অন্যদেরকে আল্লাহর পথ ও রাসূলের (সঃ) আনুগত্য হতে বিরত রাখে তারা জাহান্নামী। তারা হবে কঠিন শাস্তি ও প্রজ্জলিত অগ্নির খড়ি। আল্লাহ আমাদেরকে ওটা হতে রক্ষা করুন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা কুফরী করেছে এবং আল্লাহর পথ হতে (মানুষকে) বিরত রেখেছে, তাদের ফাসাদ সৃষ্টির কারণে আমি তাদের শাস্তির উপর শাস্তি বৃদ্ধি করবো।” (১৬:৮৮)

Leave a Reply