(বই#৯৫০)[মুনাফিক কি? বই নং ২৩] [ الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِّلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ শয়তানের নিক্ষিপ্ত অনিষ্টকে পরীক্ষায় পরিণত করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে মুনাফিকীর রোগ রয়েছে।] সূরা:- আল্ – হাজ্জ। সুরা:২২ ৫২-৫৭ নং আয়াত:- www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৫০)[মুনাফিক কি? বই নং ২৩]
[ الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِّلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ
শয়তানের নিক্ষিপ্ত অনিষ্টকে পরীক্ষায় পরিণত করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে মুনাফিকীর রোগ রয়েছে।]
সূরা:- আল্ – হাজ্জ।
সুরা:২২
৫২-৫৭ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২২:৫২
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ وَّ لَا نَبِیٍّ اِلَّاۤ اِذَا تَمَنّٰۤی اَلۡقَی الشَّیۡطٰنُ فِیۡۤ اُمۡنِیَّتِہٖ ۚ فَیَنۡسَخُ اللّٰہُ مَا یُلۡقِی الشَّیۡطٰنُ ثُمَّ یُحۡکِمُ اللّٰہُ اٰیٰتِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿ۙ۵۲﴾
আমি তোমার পূর্বে যে সব রসূল কিংবা নবী প্রেরণ করেছি তাদের কেউ যখনই আকাঙ্ক্ষা করেছে, তখনই শয়তান তার আকাঙ্ক্ষায় কিছু প্রক্ষিপ্ত করেছে। কিন্তু শয়তান যা প্রক্ষিপ্ত করে, আল্লাহ তা বিদূরিত করেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহকে সুদৃঢ় করেন।আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
২২:৫৩
لِّیَجۡعَلَ مَا یُلۡقِی الشَّیۡطٰنُ فِتۡنَۃً لِّلَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ وَّ الۡقَاسِیَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ ؕ وَ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ لَفِیۡ شِقَاقٍۭ بَعِیۡدٍ ﴿ۙ۵۳﴾
(তিনি এজন্য এমনটি হতে দেন) যাতে শয়তানের নিক্ষিপ্ত অনিষ্টকে পরীক্ষায় পরিণত করেন তাদের জন্য যাদের অন্তরে মুনাফিকীর রোগ রয়েছে এবং যাদের হৃদয়বৃত্তি মিথ্যা-কলূষিত— আসলে এ জালেমরা শত্রুতায় অনেক দূরে পৌঁছে গেছে—
২২:৫৪
وَّ لِیَعۡلَمَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ اَنَّہُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکَ فَیُؤۡمِنُوۡا بِہٖ فَتُخۡبِتَ لَہٗ قُلُوۡبُہُمۡ ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَہَادِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۵۴﴾
আর এ জন্যেও যে, যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা যেন জানতে পারে যে, এটা তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে প্রেরিত সত্য; অতঃপর তারা যেন তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর যেন তার প্রতি অনুগত হয়। যারা বিশ্বাস করেছে তাদেরকে আল্লাহ অবশ্যই সরল পথে পরিচালিত করেন।
২২:৫৫
وَ لَا یَزَالُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فِیۡ مِرۡیَۃٍ مِّنۡہُ حَتّٰی تَاۡتِیَہُمُ السَّاعَۃُ بَغۡتَۃً اَوۡ یَاۡتِیَہُمۡ عَذَابُ یَوۡمٍ عَقِیۡمٍ ﴿۵۵﴾
যারা অবিশ্বাস করেছে তারা ওতে সন্দেহ পোষণ করা হতে বিরত হবে না; যতক্ষণ না তাদের নিকট কিয়ামত এসে পড়বে আকস্মিকভাবে অথবা এসে পড়বে এক বন্ধ্যা (অশুভ) দিনের শাস্তি।
২২:৫৬
اَلۡمُلۡکُ یَوۡمَئِذٍ لِّلّٰہِ ؕ یَحۡکُمُ بَیۡنَہُمۡ ؕ فَالَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فِیۡ جَنّٰتِ النَّعِیۡمِ ﴿۵۶﴾
সেদিন বাদশাহী হবে আল্লাহর এবং তিনি তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন। যারা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হবে তারা যাবে নিয়ামত পরিপূর্ণ জান্নাতে।
২২:৫৭
وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا وَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا فَاُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ ﴿٪۵۷﴾
আর যারা কুফরী করেছে ও আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করছে, তাদেরই জন্য রয়ছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।
৫২-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে ওহী ও রসূলদের হেফাযত করা : আল্লাহ তায়ালা মহান সেই সত্ত্বা যিনি অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানকারীদের থেকে তার দ্বীনের দাওয়াত হেফাযত করেন, হেফাযত করেন দাওয়াতী কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া ও বাধা দানকারীদের দৌরাত্ম থেকে, হেফাযত করেন অক্ষমকারীদের অক্ষম করার অপ-প্রচেষ্টা থেকে এবং এভাবেই তিনি দাওয়াতদানকারীদেরকে শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাযত করেন, আরাে তিনি হেফাযত করেন তার দ্বীনের দাওয়াতকেও। রসূলদের অন্তরে মানবীয় দুর্বলতার কারণে যে সব কথা জাগে সেসব কথা চালু হওয়া থেকে আল্লাহ তায়ালা তাদের মাসুম বানিয়েছেন, এজন্যে তারা সবাই শয়তানের শয়তানী থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। এতদসত্তেও তারা তাে ছিলেন মানবীয় সকল দুর্বলতাসহ সবাই এক একজন মানুষ। এজন্যে তাদের মনেও জাগত সেসব আশা-আকাংখা যা অন্যান্য মানুষের মধ্যে জাগে, রেসালাতের দায়িত্ব পালন করা থেকে তাদেরকে বিচ্যুত করতে চায়, পরকালীন জীবনে আল্লাহর কাছে জবাবদিহির চিন্তা ভুলিয়ে দিতে চায়, তাও তাদের মনে জাগাটা ছিলাে স্বাভাবিক। এদিকে শয়তানও বসে থাকে না, সে তাদের আকাঙ্খার মধ্যে এমন কিছু বিষয় ঢুকিয়ে দিতে চায় যেন দাওয়াতী কাজ মূলােৎপাটিত হয়ে যায় এবং তার সঠিক মূল্য থেকে মানুষ দূরে সরে চলে যায়… এজন্যে দেখা যায়, সকল যামানায় রসূলদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা শয়তানের যাবতীয় ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন এবং তাদের দাওয়াতকে বানিয়ে দিয়েছেন ক্ষুরধার। তিনি রসূলদেরকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন দ্বীনের মূলনীতি ও মূল্যবােধ সম্পর্কে এভাবে তিনি তাঁর আয়াতগুলােকে মযবুত ও সংরক্ষিত বানিয়েছেন এবং সকল প্রকার সন্দেহ সংশয় সৃষ্টির সম্ভাবনাকে দূর করে দিয়েছেন, দাওয়াতের মূল্যবােধ ও এর উপায়-উপাদানকে রক্ষা করেছেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যখনই তােমার পূর্বে, আমি কোনাে রসূল পাঠিয়েছি… নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই ঈমানদারদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালনাকারী।'(আয়াত ৫২-৫৪) ওপরের এ আয়াতগুলাের শানে নযুল সম্পর্কে অনেকগুলাে রেওয়ায়েত এসেছে যা বহু মুফাসসিররা তাদের তাফসীরসমূহে উল্লেখ করেছেন। ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীরে বলেছেন, এসব রেওয়ায়াত মুরসাল (সাহাবা পর্যন্ত যার বর্ণনাক্রম শেষ- রসূলুল্লাহ(স.) পর্যন্ত পৌঁছায়নি) এগুলাের কোনাে একটিকেও সঠিকভাবে রসূলুল্লাহ(স.) পর্যন্ত পৌছুতে আমি দেখিনি। আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন।’ আরাে যে বিষয়টি উল্লেখযােগ্য তা হচ্ছে, এ বিষয়ক বিস্তারিত বিবরণ একমাত্র ইবনে আবি হাতিমের বর্ণনা থেকে জানা যায়। তিনি বলেন, ইবনে শিহাব বলেছেন (এ ব্যক্তি সাহাবী কিনা তারও কোনাে হদীস নেই), সূরায়ে নাজম নাযিল হলে মক্কার মােশরেকরা বলতে থাকে, এ লােকটা যদি আমাদের মাবুদ’ (মূর্তি সর্বস্ব) দেবতাদের সম্পর্কে কিছু ভালাে কথা বলতাে তাহলে তার কথা ও তার সংগীদের কথাকে আমরা মেনে নিতাম এবং তাদেরকে কোনাে কাজে আমরা বাধা দিতাম না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমাদের পরম পূজনীয় এসব (মূর্তি-সর্বস্ব) মাবুদদেরকে সে এমনভাবে নিন্দা করে এবং তাদেরকে অকল্যাণকারী বলে গালি দেয় যে, তাদের দ্বীন থেকে ইহুদী নাসারাদের দ্বীন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে এমনভাবে নিন্দা করে না। আর এসময়টি ছিলাে এমন সংগীন যে এসময় মুহাম্মদ(সা.) ও তাঁর সাহাবাদের বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতা সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাে এবং তাদের ওপর চরম যুলুম নির্যাতন ও পূর্ব থেকে অনেক বেড়ে গিয়েছিলাে, রাসূল(স.)-এর কাছে তাদের এসব গােমরাহী কাজ ছিলাে বড়ােই হৃদয়বিদারক যেহেতু তার সকল ঐকান্তিকতা নিয়ে তাদেরকে হেদায়াতপ্রাপ্ত দেখতে চাইতেন কিন্তু যখন সূরায়ে নাজম নাযিল হলাে যে, তােমরা কি লাত’ ও ‘উযযার কথা চিন্তা করে দেখেছ আর তৃতীয় আর এক ব্যক্তি মানাত’-এর কথাও কি কখনও ভেবে দেখেছাে? তােমাদের জন্যে তােমরা পুত্র সন্তান (ছেলে) পছন্দ করলে আর তার জন্যে বরাদ্দ করলে মেয়ে-ছেলে (কন্যা সন্তান)?’ এ সময় যখন আল্লাহ তায়ালা তাগুতী শক্তিসমূহের কথা উল্লেখ করছিলেন, তখন শয়তান তার নিজের তরফ থেকে কিছু কথা ওই কথাগুলাের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাে, যার কারণে তিনি বলে উঠলেন, আর ওরা হচ্ছে এমন সুন্দরী যাদের কপালের চুলগুলাে কী সুন্দর লম্বা। আর তাদের সুপারিশই আশা করা হয়ে থাকে। আসলে এটা ছিলাে শয়তানের একটি ছন্দময় কথা এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার এক ফাদ। ব্যস, একথাটা মক্কার মোশরেকদের অন্তরে বড়াে মজাদার মনে হলো, শুরু হয়ে গেলাে এর চর্চা এবং তারা এটাকে দারুণ এক সুখবর হিসাবে প্রচার করতে লেগে গেলাে, তারা বলতে থাকলাে, হা, কী মজা, এবারে মােহাম্মদ তার বাপ-দাদার ধর্মে ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে তার জাতির ধর্ম মতে। রসূলুল্লাহ(স.) কথাটা জানতে পেরে সূরায়ে নাজম পড়া শেষ করে সিজদা করলেন এবং সেখানে উপস্থিত মুসলিম ও মুশরিক যারা ছিলাে তারা সবাই সিজদা করলাে। একমাত্র এক বর্ষিয়ান ব্যক্তি ওলীদ ইবনে মুগীরা সিজদা করলাে না, সে এক মুষ্টি মাটি হাতে তুলে নিয়ে তার ওপর সিজদা করলাে। এমতাবস্থায় উপস্থিত মুসলমান অমুসলমান সকল জনতা রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে সিজদা করলাে সবার এই একসাথে সিজদা করার কারণে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ছিলাে। মুসলমানরা বিস্মিত হলাে এ কথা মনে করে যে তাদের সাথে মােশরেকরা কেমন করে সিজদা করলাে। অথচ তাদের না আছে ঈমান, আর না আছে কোনাে একীন, আসলে এসময় মােমেনরা ওই কথাটি শুনেছেন যা শয়তান কাফেরদের কানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলে। এজন্যে তাদের মন নিশ্চিন্ত ছিলাে, অর্থাৎ রসূলুল্লাহ যখন কথা বলতে শুরু করেছিলেন তখন শয়তান একটি কথা উপস্থিত মোশরেকদের মনে জাগিয়ে দিয়েছিলেন যে, রাসুলুল্লাহ(স.) সুরার মধ্যে (শয়তান কর্তৃক সংজোযিত) সে কথাটি পড়েছেন এজন্যে তাদের মাবুদদের সম্মানার্থে তারা সিজদা করেছে। অতপর শয়তানও একাজে যােগ দিয়ে কথাটা খুব করে প্রচার করে দিলাে, যার কারণে অচিরেই হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়ায়) অবস্থিত হিজরতকারী সকল মুসলমান এবং স্থানীয় অমুসলমানদের কাছে খুব জলদিই কথাটা এভাবে পৌছে গেলাে যে, রসূলুল্লাহ(স.) সূরার মধ্যে সে কথাটা পড়েছেন এবং সবাই এক সাথে সিজদা করেছেন। এসব মুসলমানদের মধ্যে ওসমান ইবনে মাযউন ও তার সংগীরা ছিলেন। তারা পরস্পর বলাবলি করতে থাকলাে যে মক্কাবাসীরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে তারা নামায পড়েছে, তারা আরাে জানতে পারলাে যে ওলীদ ইবনে মুগীরাই শুধু তার হাতের মধ্যে তুলে নেয়া মাটির ওপর সিজদা করেছে তারা আরাে শুনলাে যে মক্কার মােমেনরা সবাই এখন নিরাপদ হয়ে গেছে। সুতরাং শীঘ্রই তারা মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে পড়লাে। ইতিমধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরার অংশ হিসাবে শয়তান কর্তৃক কথাগুলােকে নাকচ করে ঘােষণা করলেন এবং তার আয়াতগুলােকে মিথ্যা মুক্ত করে হেফাযত করলেন ও মযবুত বানালেন, আর তারপর নাযিল করলেন, ‘আমি, তােমার পূর্বে যখনই কোনাে রসূল বা নবী পাঠিয়েছি, তারা কথা বলার এরাদা করতোই, কোনাে কোনাে সময়ে শয়তান তার নিজের কথা, সে আয়াতগুলাের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে…. আর অবশ্যই যালেমরা এতাে বেশী বিরােধিতা করেছে যে তারা হেদায়াত থেকে বহু বহু দূরে সরে গেছে।'(আয়াত ৫২-৫৩) তারপর যখন আল্লাহ তায়ালা তার ফয়সালার কথা জানিয়ে দিলেন এবং রসূলুল্লাহ(স.)-এর কথাকে শয়তানের সে ছন্দময় কথা থেকে মুক্ত করলেন তখন মােশরেকরা আবার তাদের ভুল পথে এবং মুসলমানদের বিরােধিতায় ফিরে গেলাে, বরং পূর্ব থেকে আরাে বেশী কঠিন হয়ে গেলাে তাদের বিরােধী ভূমিকা। ইবনে কাসীর বলেন, বাগবী তার তাফসীরে ইবনে আব্বাসের কিছু রেওয়ায়াত উদ্ধৃত করেছেন এবং তিনি সেখানে এই একই ধরনের আরাে কয়েকটি রেওয়ায়াত এনেছেন মােহাম্মদ ইবনে কা’ব আলকুরাযী এবং আরাে কয়েকজন থেকে, তারপর একটা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। রসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি অবতীর্ণ আল্লাহর যামানতপ্রাপ্ত সুরক্ষিত একটি সূরার মধ্যে শয়তানের কথার অনুপ্রবেশ কি করে সম্ভব হলাে? তারপর এ বিষয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও কিছু কথা লিখেছেন। আর সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে শয়তান নাকি মােশরেকদের কর্ণ কুহরে কিছু কথা ঢুকিয়ে দিয়েছিলাে যার কারণে তারা ভাবতে শুরু করেছিলাে যে, কথাগুলাে রসূলুল্লাহ(স)-নিজেই বলেছেন। আসলে ব্যাপারটা মােটেই তেমন নয়। প্রকৃতপক্ষে, এটা ছিলাে শয়তানের এক কীর্তি, আল্লাহর রসূলের কোনাে ভূমিকা এর মধ্যে নেই। ঘটনাটি আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। বােখারী বলেন, ইবনে আব্বাস ‘ফী উমনিয়্যাতিহী’ (তার আকাংখার মধ্যে) শব্দগুলাের অর্থ করতে গিয়ে বলেন, রসূলুল্লাহ যখন একথাটি বলেছেন, তখন শয়তান তার কথার সাথে যােগ দিয়ে মােশরেকদের কানে অতিরিক্ত কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শয়তানের সে কথাকে বাতিল বলে ঘােষণা করে দিয়েছেন, তারপর তিনি তার আয়াতগুলােকে মযবুত করে দিয়েছেন। মােজাহেদ ইযা তামান্না’ শব্দ দুটির অর্থ করতে গিয়ে বলেন, এর অর্থ হচ্ছে যখন তিনি বললেন। আর উমনিয়্যাতিহী’ অর্থ তার কেরআত-এর (পাঠের) মধ্যে বাগবী বলেন, অধিকাংশ তাফসীরকারকদের মতে ‘তামান্না’ শব্দটির অর্থ তিনি তেলাওয়াত করেছেন বা আল্লাহর কিতাব পড়েছেন, ‘শয়তান তাঁর উমনিয়্যা’র মধ্য, অর্থাৎ তেলাওয়াতের মধ্যে কিছু কথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তামান্না’ শব্দটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইবনে জারীর বলেন, ‘তালা’ অর্থ তিনি তেলাওয়াত করেছেন এই কথাটাই উক্ত কথার ব্যাখ্যা হিসাবে বেশী উপযােগী। গারানীক’ এর হাদীস বলে যে হাদীসটি পরিচিত সে সম্পর্কে এইই হচ্ছে সার কথা। এ ছাড়া অন্য যে কথা বর্ণিত হয়েছে সেগুলাে ভিত্তিহীন। হাদীসবেত্তারা সম্মিলিতভাবে বলেছেন, সেহাহ সেত্তা প্রণেতাদের কেউই এই হাদীসটি রেওয়ায়াত করেননি, আর যারা এটা রেওয়ায়াত করেছেন, তারাও রসূলুল্লাহ পর্যন্ত বর্ণনা ধারা পৌঁছেছে বলে দাবী করেননি, অর্থাৎ তারা এটাকে মুত্তাসিল হাদীস বলেননি (যা বিশ্বাসযােগ্যতার এক বিশেষ মাপকাঠি বলে সবাই জানে)। আবু বকর আল বাযযার বলেন, একথাটিকে হাদীস বলা হলেও নবী(স.) থেকে একথাটা এসেছে বলে আমরা জানিনা । যাকে মুত্তাসিল বলা হয় এবং হাদীস বলে যার উল্লেখ জায়েয মনে করা যায় এটা মােটেই সে রকম কোনাে কথা নয়। আর একথার মধ্যে যে সুরটা প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাতে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কথার ওপর নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত- এটা আমাদের যে মূল আকীদা যে ‘রসূলুল্লাহ(স.)-এর কথার মধ্যে শয়তান কর্তৃক কোনাে সংমিশ্রন তার যামানায় সম্ভব ছিলাে না’-এর সাথে সংঘর্ষশীল। এ কাল্পনিক হাদীসটিকে কেন্দ্র করে প্রাচ্যের কিছু উর্বর মস্তিষ্ক ব্যক্তি এবং এ দ্বীনকে দোষারােপকারী কিছু ব্যক্তি অনেক কিছু কল্পনার জাল বুনেছে এবং মনে করেছে যে এভাবে ইসলামের এই শাশ্বত জীবন ব্যবস্থাকে সংশয়পূর্ণ করে তােলা যাবে। কিন্তু তাদের এ দিবা স্বপ্ন কোনাে দিন সফল হয়নি আর কোনাে দিন হবেও না। ব্যাধিগ্রস্ত কিছু অন্তর ছাড়া এসব বাজে কথায় কেউ কোনাে দিন কান দেয়নি, আর এটাকে কোনাে দিন আলােচনার কোনাে বিষয়বস্তু হিসাবেও মনে করা হয়নি। আল কোরআন থেকে যা জানা যায় তাতে একথা বেশ বুঝা যায় যে রসূল(স.)-এর যিন্দেগীতে এধরনের ঘটনা কোনাে দিন ঘটেনি এবং এ ঘটনাটি আলােচ্য আয়াতের কোনাে শানে নযুলও নয়। আল কোরআন রিসালাত ও রসূলদের ব্যাপারে সাধারণভাবে এই মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, তোমার পূর্বে যে নবী রসূলকেই আমি পাঠিয়েছি, তারা যখনই কোনাে কথা বলতে চেয়েছে তাদের ইচ্ছার মধ্যে শয়তান কিছু কথা এনে দিয়েছে; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সেগুলাে নাকচ করে দিয়েছেন এবং তারপর তার আয়াতগুলােকে তিনি মযবুত বানিয়েছেন।’ সুতরাং সাধারণভাবে একথা বলতে চাওয়া হয়েছে যে মানুষ হিসাবে সকল রসূলদের মধ্যেই শয়তান কিছু কথা ঢুকিয়েছে, কিন্তু আল্লাহর সাহায্যে সেগুলাে টিকে থাকতে পারেনি। ওয়াসওয়াসা দেয়ার এই সম্ভাবনা থাকা তার বে-গুনাহ (মাসূম বা নিরপরাধ) হওয়ার পরিপন্থী মােটেই নয়, যেহেতু রসূলদের মাসূম রাখার স্থির সিন্ধান্ত পূর্ব থেকেই হয়ে রয়েছে। এই কথাটাই আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আল্লাহর সাহায্যেই রসূলরা মাসূম ছিলেন আর আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছা সম্পর্কে ভালােভাবেই জানেন। আমরা আমাদের মানবীয় বুঝ মতােই তাঁর কালামের তাফসীর করছি মাত্র। রসূলদের যখন মানুষের কাছে রিসালাতের বার্তা বহন করে নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তখন তাদের কাছে সর্বাধিক প্রিয় বন্ধু হচ্ছে মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে একত্রিত করা এবং আল্লাহর কাছ থেকে তারা যে কল্যাণকর জীবন ব্যবস্থা পেয়েছেন তাদের নিজেদের জীবনে তা প্রতিষ্ঠিত করা, যাতে করে সাধারণ মানুষ এ কল্যাণ ব্যবস্থার কার্যকারিতা দেখতে পায় এবং হৃদয় মন দিয়ে তারা তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এটাও ঠিক দ্বীন-এর দাওয়াতে বিস্তর বাধা বিঘ্ন আসবে, এপথ কাটায় ভরা। রসূলরাও মানুষ হিসাবে বিশেষ এক সীমার মধ্যে থাকতে বাধ্য, তাদের বয়স ও সাধ্যের নির্দিষ্ট সীমা আছে। তারা এটা জানেন ও অনুভব করেন, এজন্যে তারা কামনা করেন যে তারা সব থেকে দ্রুত উপায়ে মানুষকে তাদের দাওয়াতের দিকে আকৃষ্ট করবেন একইভাবে তারা এটাও চান যে যদি মানুষ তাদেরকে কোনাে কথা দেয়, তা যেন রক্ষা করে। তারা সমগ্র হৃদয় মন দিয়ে চান যে মানুষ জাহেলী যুগের মধ্যে লালিত সকল বদভ্যাসকে পরিহার করুক, বাপ-দাদার আমল থেকে প্রাপ্ত সকল রীতি নীতিগুলােকে ত্যাগ করুক, ধীরে ধীরে মিথ্যা ও অসার জিনিসের অনুসরণ করা পরিত্যাগ করুক এবং এভাবে মানুষ যেন হেদায়াতের দিকে পরিপূর্ণভাবে এগিয়ে আসে। তারপর, এভাবে যখন ইসলামের ছায়াতলে তারা মনে প্রাণে প্রবেশ করবে তখনই বাপ-দাদার আমল থেকে প্রাপ্ত বাতিল রীতিনীতিকে তারা পুরােপুরি পরিত্যাগ করতে পারবে, যেগুলােকে তারা এতাে দিন থেকে বড় মহব্বতের সাথে লালন করে আসছিলাে! অবশ্য, এমনও হতে পারে যে, পূর্ব জীবনের কোনাে কিছুর জন্যে তাদের মনের মধ্যে কোনাে আকর্ষণ যদি থেকেও থাকে তাহলে সেটা ছাড়তে হয়তো একটু বিলম্ব হতে পারে। আল্লাহর মহব্বত বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্য সকল বিষয়বস্তুর আকর্ষণ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে, কিন্তু তার জন্যে সঠিক পরিচর্যা ও পরিচালনা প্রয়ােজন যা অন্য সব কিছু থেকে তাদের মনকে সরিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে। সকল নবীর মানবীয় অন্যান্য চাহিদামতাে বা তার থেকেও বেশী সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চান যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানাের যে দায়িত্ব তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তার আশু প্রসার ঘটুক এবং অচিরেই তা বিজয়ী হােক। এজন্যেই তারা এ মিশন সফল করতে সর্বাধিক তৎপর ছিলেন যেহেতু আল্লাহ তায়ালা চান, তার দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়ার কাজটা পূর্ণাংগ মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হােক, যেহেতু আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থা মানব জীবনের সার্বিক কল্যাণে নিয়ােজিত এজন্যে অবশ্যই এ ব্যবস্থা সব দিক দিয়ে পুরােপুরি ভারসাম্যপূর্ণ। আর আল্লাহ তায়ালা চান, নবীদের মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত এ জীবন ব্যবস্থাকে মানুষ পড়াশুনার মাধ্যমে জানুক, নবীদের জীবনকে সামনে রেখে এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করুক এবং পরিতৃপ্ত মন নিয়ে এ মহান ব্যবস্থা গ্রহণ করুক অথবা পছন্দ না হলে অস্বীকার করুক। মানবীয় সকল দুর্বলতা ও সন্দেহ সংশয়কে ঝেড়ে মুছে ফেলে পূর্ণাংগভাবে এ দাওয়াতকে গ্রহণ করেছে তা সন্দেহাতীতভাবে জানেন একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহ। তিনি চান যে মানুষ ভারসাম্যপূর্ণ ঐসব মূলনীতি মেনে চলুক, যদিও এ পথের প্রথম দিকে কিছু লােক ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু দাওয়াতী কাজের মূলনীতির ওপর যারা সুদৃঢ় অবস্থান করবে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে যারা সুসামঞ্জস্যভাবে সকল কাজ আঞ্জাম দেয়ার চেষ্টা করবে তারাই জীবনের সফলতার দেখা পাবে তারাই দাওয়াতী কাজের কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে পারবে, তাই চলতে পারবে সেই সরল-সােজা পথে যেখানে নেই। কোনাে বিভ্রান্তি, নেই তাদেরকে থামিয়ে দেয়ার মতাে কোনাে শক্তি। প্রকৃতিগতভাবে মানুষের মধ্যে যেসব আবেগ উচ্ছাস আছে, যেসব ঝোক প্রবণতা মাঝে মাঝে তাদের কথা বা কাজে প্রকাশ পায়, এসব কিছুর মধ্যে শয়তান সংগােপনে প্রবেশ করে, নানা প্রকার বিভ্রান্তি আনার চেষ্টা করে, যাতে দাওয়াতী কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়, তারা এর মূলনীতি থেকে দূরে সরে যায়, তাদের মনের মধ্যে নানাপ্রকার ওয়াসওয়াসা আসায় মন দুর্বল হয়ে যায়, কিন্তু এতদসত্তেও বিশ্বে দাওয়াতী কাজ চলছে, চলবে এ কাজ কোনােদিন থেমে যাবে না। আল্লাহ তায়ালা সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী এবং তিনি তার সিদ্ধান্ত নির্দেশগুলাে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। মানুষ তার নির্দেশাবলী যতােটুকু বুঝেছে এবং দাওয়াতী কাজের কৌশল সম্পর্কে যে জ্ঞান-গবেষণা চালিয়েছে, তাতে কখনও কখনও ক্রুটি বিচ্যুতি বা ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে, যেমন যদি কখনও রাসূল(স.)-এর কোনাে কথাকে কেন্দ্র করে কোনাে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, সেগুলোর সমাধান আল কোরআন দিয়েছে। এইভাবে আল্লাহ তায়ালা শয়তানের জারিজুরিকে বাতিল করে দেন এবং তাঁর আয়াতগুলােকে মযবুত বানান, যাতে তা পালন করার ব্যাপারে কারাে মনে কোনাে সন্দেহ সংশয় না থাকে। আল্লাহ তায়ালা জাননেওয়ালা, বিজ্ঞানময়’… এখন যাদের অন্তরে রয়েছে কপটতা অথবা দ্বীন থেকে সরে যাওয়ার মনােভাব তাদের কথা স্বতন্ত্র। অন্যদিকে রয়েছে কাফের ও কঠিন হৃদয় বিরােধী শ্রেণী, তারা ঝগড়া করার জন্যে সব কিছুর মধ্য থেকে কিছু না কিছু ক্রুটি-বিচ্যুতি বের করে, তাদের জেদ ও বিরােধী মনােভাব ইসলামের সৌন্দর্য উপলব্দি থেকে তাদের বঞ্চিত রেখেছে, বরং বলা যায়, তারা মাছির মতাে সব কিছুর মধ্যে পচা জিনিসই খোজ করে । তাই বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই যালেমরা দূরে সরিয়ে দেয়ার মতাে বিরােধিতায় মগ্ন।’ আর অনেক মানুষকেই সত্য-সঠিক জ্ঞান ও সত্যকে চেনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তারা আল্লাহর কোনাে কথা এবং কোনাে বিষয়ে তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা জানতে পারার সাথে সাথে নিশ্চিন্ত পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদেরকে সঠিক পথের দিকে পরিচালনাকারী।  *সার্বজনীন ইসলামী দাওয়াত : নবী(স.)-এর যিন্দেগীতে এবং ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাস থেকে আমরা যেসব তথ্য জানতে পাই তাতে সকল বিষয়ের ব্যাখ্যা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় । এই কথাটার দিকেই ইবনে জারীর ইংগিত করেছেন। এ বিষয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম(রা.)-এর একটি ঘটনা আমাদের কাছে একটি উঞ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে রয়ে গেছে। অন্ধ অভাবী এই পাগলপারা সাহাবী একদিন রসূল(স.)-এর দরবারে এসে বললেন, ইয়া রসূলুল্লাহ, আমাকে একটু পড়িয়ে দিন এবং আল্লাহ তায়ালা আপনাকে যেসব শিক্ষা দিয়েছেন তার থেকে আমাকে কিছু শিখিয়ে দিন- কথাটা তিনি বারবার বলতে থাকলেন, অপরদিকে রসূলাল্লাহ(স.) ওলীদ ইবনে মুগীরার সাথে কথায় ব্যস্ত থাকায় ইবনে মাকতুমের দিকে মনােযােগ দিতে পারছিলেন না, তিনি চাইছিলেন যদি ওই লােকটিকে তিনি ইসলামের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। তার সাথে আরাে কয়েকজন কোরায়শ নেতৃবৃন্দ ছিলাে, কিন্তু অন্ধ হওয়ার কারণে ইবনে উম্মে মাকতুম তাদেরকে দেখতে পারছিলেন না আর তিনি জানতেনও না যে রসূলুল্লাহ(স.) এভাবে ব্যস্ত আছেন; ফলে ইবনে উম্মে মাকতুমের এক কথা বারবার বলাতে তার একটু খারাপ লাগলাে, এজন্যে রসূলুল্লাহ(স.) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, অতপর এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে কঠিনভাবে ধমক দিয়ে আয়াত নাযিল করলেন, ‘সে বেজার হলাে ও মুখ ফিরিয়ে নিলাে তার কাছে একজন অন্ধ ব্যক্তি এসেছে বলে… না, সে যা চাইছে তা কিছুতেই হবার নয়। অবশ্যই এটা একটা উপদেশমালা, অতপর যে এর থেকে শিক্ষা নিতে চায়, নেবে…'(আবাসা ১-১২) এভাবে আল্লাহ তায়ালা দাওয়াতের মূল্য এবং দাওয়াত দানের পাত্রের ব্যাপারে অত্যন্ত সূক্ষ ও নিরপেক্ষ এবং সঠিক মূল্যের কথা ঘােষণা করলেন, দাওয়াতী প্রচেষ্টা চালানাের ক্ষেত্র সম্পর্কে রসূলুল্লাহ(স.)-এর খেয়ালকে তিনি শুধরে দিলেন, কারণ অবশ্যই একান্ত একাগ্রতা নিয়ে তিনি কোরায়শ নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলছেন- সর্বান্তকরণে তিনি চাইছিলেন ওরা যদি ইসলাম গ্রহণ করতাে! ওরা তাে বহু লােকের নেতা, ওরা মুসলমান হলে ওদের দেখা-দেখি হয়তাে আরাে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করবে; এজন্যে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করে তাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন যে, যে সূক্ষ্ম ভিত্তির ওপর ইসলামের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত তা গ্রহণ করার জন্যে আগ্রহী হৃদয়, পরম আগ্রহ ও গভীর হৃদয়াবেগ নিয়ে যারা এ দাওয়াত গ্রহণ করার জন্যে এগিয়ে আসবে তাদের সামনে সেসব হঠকারী, অহংকারী ও আত্মকেন্দ্রিক নেতৃবৃন্দের কোনাে মূল্য নেই। এই বুঝের মধ্যে যে শূন্যতা বিরাজ করছিলাে তা পূরণ করার জন্যে শয়তানের অপচেষ্টাকে আল্লাহ তায়ালা বাতিল করে দিলেন, তিনি তার নিদর্শনগুলােকে মযবুত করে দিলেন এবং এ বিষয়ে সঠিক চেতনা দিয়ে তাঁর প্রিয় নবীসহ সকল মােমেনদের হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করে দিলেন। এরপর থেকে রসূলুল্লাহ(স.) বরাবর ইবনে উম্মে মাকতুমকে বিশেষভাবে সম্মান দিতেন, আর যখনই তাঁকে দেখতেন বলতেন, স্বাগত (হে বন্ধু) তুমিই তাে সেই ব্যক্তি যার জন্যে আমার রব আমাকে তিরস্কার করেছেন, আর তাকে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তােমার কি কিছু প্রয়ােজন আছে? রসূলুল্লাহ(স.) তাকে কতােবেশী মর্যাদা দিতেন তা এতে বুঝা যায় যে, দু’দুবার তাকে মদীনাতে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। এভাবে, মুসলিম শরীফের রেওয়ায়েতে জানা যায়, আবু বকর ইবনে আবী শায়বা হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস(রা.)-এর বরাত দিয়ে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে আমরা ছ’জন ব্যক্তি একদিন এক জায়গায় উপস্থিত ছিলাম, এমন সময় কয়েকজন মােশরেক ব্যক্তি নবী(স.) কে বললাে, এ লােকদেরকে সরিয়ে দিন, এরা আমাদের উপস্থিতিতে এখানে থাকার যোগ্য নয়। রেওয়ায়েতকারী ইবনে আবী ওয়াক্কাস বলছেন, ওখানে উপস্থিত ছিলাম আমি, ইবনে মাসউদ, হায়েল গােত্রের একজন, বেলাল এবং আরাে দু’জন যাদের নাম আমি ভুলে গেছি। অতপর রসূলুল্লাহ(স.) মনে মনে কিছু বললেন, তারপর আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলেন, ‘তাড়িয়ে দিয়ে না তাদেরকে যারা সকাল সন্ধা সন্তুষ্টি প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তাদের রবকে ডাকছে।’ এভাবে ইসলামের দিকে দাওয়াতের কাজকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ বানিয়েছেন, এর সূক্ষ্ম মূল্য সম্পর্কে, আর এ মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিদের কাজে নাক গলানাের চেষ্টায় শয়তানের হস্তক্ষেপকে তিনিই প্রতিহত করেছেন। এ মর্যাদায় যারা অভিষিক্ত হয়েছেন তাদের গন্ডীর মধ্যে নেতা-অথবা বিত্তশালী হওয়ার দোহাই দিয়ে কারাে অনুপ্রবেশ চিরদিনের জন্যে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছেন, রদ করে দিয়েছেন তাদের একথাকে যে, সে গরীব দুঃখী ও মর্যাদাহীন লােকদের যদি তাদের উপস্থিতির সময় সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দৃষ্টিতে ইসলাম গ্রহণের আগ্রহের মূল্যই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, এজন্যে তার দৃষ্টিতে ওইসব অহংকারী নেতৃবৃন্দ ও তাদের অনুসারীদের থেকে সে গরীব আগ্রহী ব্যক্তিদের মর্যাদা অনেক বেশী। কারণ ওদের থেকে আগ্রহী লােকদের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের মহব্বত বহু বহুগুণে অধিক। সে নেতৃবৃন্দের তুলনায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার এই সাধারণ লােকদের দ্বারাই বেশী আশা করা যায়, যদিও সাধারণ মানুষ এতাে হিসাব করে পারে না, যেমন রসূলুল্লাহও (সঠিকভাবে না বুঝতে পেরে) সে নেতৃবৃন্দের ইসলাম গ্রহণ আশা করেছিলেন বেশী এবং তাদেরকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন, শক্তির উৎস কোথায়। আর তা হচ্ছে মহব্বতপূর্ণ ইচ্ছা ও দৃঢ়তা যা সঠিকভাবে মানুষকে পরিচালনা করে এটা বিশেষ বিশেষ কোনাে ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল নয়। সম্ভবত আরাে দুটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে, যেমন রসূলুল্লাহ(স.)-এর ফুপাতাে বােন যায়নাব বিনতে জাহশ-এর ঘটনায় জানা যায়। তাকে রসূলুল্লাহ(স.) যায়েদ ইবনে হারেসা(রা.)-এর সাথে বিয়ে দেন। এরা সংসার জীবন শুরু করেন নবুওত আসার পূর্বে। এসময় যায়েদকে যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলা হতো; কিন্তু এভাবে ধর্মবাপ বলার প্রথাকে, আল্লাহ তায়ালা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছিলেন- এজন্যে আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী এ সম্পর্ক ভাংগার ব্যবস্থা করা হয়েছিলাে যেন এই ধর্মবাপ হওয়ার কারণে যে কৃত্রিম হালাল-হারাম মানার চিন্তা করা হতাে সে প্রথাটা বন্ধ হয়ে যায়। তাই আল্লাহ তায়ালা হকুম দিলেন, ‘ওদেরকে তাদের নিজেদের বাপের নামে ডাকো, এটাই আল্লাহর কাছে বেশী সুবিচার ও যুক্তিপূর্ণ।’ আরো বলেছেন, ‘আর তিনি তােমাদের পালক ছেলেদেরকে তােমাদের সন্তান বানাননি।’ যায়েদ(রা.), রসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে অন্য সবার থেকে বেশী প্রিয় ছিলেন, এজন্যেই তিনি নিজের ফুপাতাে বােনের সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের এ বিবাহিত জীবন টিকলাে না। আরব দেশে পালক ছেলের পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিয়ে করাকে চরম ঘৃণার বিষয় মনে করা হতাে, আল্লাহ তায়ালা এ কৃত্রিম ও ভুল প্রথা ভেংগে দিতে চাইলেন, যেমন বাপ ছাড়া অন্য কারাে নামে কোনাে ব্যক্তিকে ডাকার প্রথাকে তিনি ইতিপূর্বে ভেংগে দেয়ার ঘােষণা দিয়েছিলেন। এজন্যে তিনি তাঁর রসূল নির্দেশ দিলেন যে, যায়েদ তদীয় স্ত্রী যায়নাবকে তালাক দিয়ে দিলে তিনি নিজেই যেন যয়নবকে বিয়ে করেন। যাতে পালক ছেলের তালাক দেয়া স্ত্রী বিয়ে করাকে ঘৃণিত মনে করার যুক্তিহীন প্রথা চিরতরে তিরোহিত হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ নির্দেশের কথাটি মনের মধ্যে গােপন রেখেছিলেন এবং যতােবারই যায়েদ, তার স্ত্রী সম্পর্কে কোনাে নালিশ নিয়ে আসতেন ততােবারই রসূলুল্লাহ(স.) তাকে ধৈর্য ধরার উপদেশ দিতেন এবং বলতেন, ‘স্ত্রীকে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাও’ তার মনে হতাে যায়েদ তালাক দিয়ে দিলে যায়নাবের সম্ভ্রমের জন্যে এটা বড়ােই কঠিন হবে, আর অবশেষে যায়েদ যে তালাক দিয়ে দেবে আল্লাহর এ সিদ্ধান্তকেও তিনি প্রকাশ করছিলেন না, অবশেষে যায়েদ তালাক দিয়ে দিলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে তাঁর ছাফ ছাফ ফয়সালা আল কোরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, যাতে করে রসূল(স.)-এর জন্যে আল্লাহ তায়ালা যা চেয়েছিলেন তা সফল হয় এবং জাহেলী যামানার কুপ্রথাটারও ইতি ঘােষিত হয়ে যায়। পরিষ্কারভাবে শরীয়াতের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করে দেখাে, সেই সময়ের কথা যখন তুমি বলছিলে… এবং আল্লাহ নির্দেশ কার্যকরী হবেই হবে'(আহযাব ৩৭) আর আয়শা(রা.) সত্য বলেছেন, যখন তিনি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যে কথাটা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন রসূলুল্লাহ(স.) তা প্রকাশ না করে থাকলে অবশ্যই তা গােপন করেছেন (এবং অবশ্যই কোনাে কারণবশত তা করেছেন) যেহেতু আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আর তুমি মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখছিলে তাই যা আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ করতে চান, ‘আর তুমি মানুষকে ভয় করছো, কিন্তু আল্লাহকেই বেশী ভয় করা দরকার।’ এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তার বিধান ও তার হুকুম আহকামকে মযবুত বানিয়েছেন। আর, রসূলুল্লাহ(স.) এর অন্তরে যে খটকাটা ছিলাে তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, অর্থাৎ এ বিয়ে করলে সমাজের লােকেরা নানাভাবে তাকে দোষারােপ করতে থাকবে যে, ‘দেখ মোহাম্মদ এখন পালক ছেলের স্ত্রীকে পর্যন্ত বিয়ে করা শুরু করে দিয়েছে।’ আল্লাহ তায়ালা নিজে বিষয়টা পরিষ্কার করে দেয়াতে শয়তানের জন্যে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করার আর কোনাে উপায় থাকলাে না। আর যে সব ব্যাধিগ্রস্ত মুনাফিক রাসূল(স.) কে বদনাম করার জন্যে ওৎ পেতে ছিলাে তাদের জন্যেও ফিৎনা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করারও আর কোনাে সুযােগ রইলাে না।  *আন্দোলন কৌশলের নামে সুন্নাত পরিহার করার অবকাশ নেই : আলােচ্য আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে এভাবেই আমরা সংশয়মুক্ত ও তৃপ্ত হয়েছি। এভাবে রসূলদের যামানা শেষ হওয়ার পর পরবর্তী মােবাল্লেগদের জন্যে সুস্পষ্ট নিকনির্দেশনা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলাে যে, সর্বকালে দাওয়াত গ্রহণ করার জন্যে সেসব মানুষকেই উপযােগী মনে করতে হবে এবং তাদের কাছেই আগ্রহভরে দাওয়াত পৌছাতে হবে যারা আগ্রহভরে তা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসবে এবং আল্লাহ তায়ালা ও তার দ্বীনের জন্যে অন্তরের মহব্বত নিয়ে অগ্রসর হবে। যেহেতু যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চায় তাদের মূল্যই তার কাছে বেশী, এতে তাদের শক্তি সামর্থ অর্থ সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদা যতাে তুচ্ছই হােক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। তাদের দ্বারাই আল্লাহ তায়ালাই তাঁর দ্বীনের খেদমত নেবেন। অপরদিকে সামাজিক মর্যাদায় যারা অধিষ্ঠিত এবং অর্থ সম্পদ ও বিভিন্নমুখী মর্যাদাবােধকে সামনে রেখে যে সব ব্যক্তি ও নেতৃবৃন্দ নিজেরাই নিজেদের মূল্যায়ন করে এবং অপরকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আল্লাহর নযরে তারা মূল্যহীন। অতএব, ইসলামী দাওয়াতকে যারা অগ্রসর করতে চায়, তারা যেন সে ভুলটি আর না করে যে ভুলটি রসূলুল্লাহ(স.)-এর দ্বারা সংঘটিত হয়েছিলাে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা চেয়েছিলেন তাঁর রসূলের এ ভুল সংঘটিত হােক, তাহলে সে ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে স্থায়ী একটা শিক্ষা রেখে দেয়া যাবে। এভাবে চিরদিনের জন্যে দাওয়াতী কাজ পরিচালনার পদ্ধতি নির্ণয় করে দেয়া হয়েছে, কিসের মূল্য দিতে হবে, কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হবে তা সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। ওপরের ঘটনা থেকে এ শিক্ষাটিও পাওয়া যায়, মানুষ দাওয়াতী কাজ বৃদ্ধির জন্যে অনেক সময় নিজেদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেয়, সে অবস্থায় অনেক কাজ নেক নিয়তে করতে গেলেও ভুল হয়ে যায়, যেহেতু শয়তান সদা-সর্বদা ওঁৎ পেতে বসে থাকে যেন মানুষের ভালাে ইচ্ছার সাথে সে কিছু নিজের চিন্তা চেতনার গুরুত্ব দিতে গিয়ে এধরনের ভুল করে, যেন তাকে আত্মম্ভরিতায় পেয়ে বসে এবং সে নিজের চিন্তার প্রাধান্য দিয়ে বসে, আর সেই সুযােগে শয়তান তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে। এজন্যে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ও অতীতের ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে যে দিক-নির্দেশনা নাযিল হয়েছে, সেগুলােকে সামনে রেখে পরবর্তী দায়িত্বশীলেরা নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করে নেয়। আল্লাহর হাতেই সকল কাজের পরিণতি নিবদ্ধ, গায়েবের খবর একমাত্র তারই হাতে, কাজেই তার দেয়া পদ্ধতিতে কাজ করেই আমাদের সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকতে হবে। এভাবেই মহাগ্রন্থ আল কোরআন আমাদেরকে শয়তানের সুক্ষ্ম চালবাজি থেকে সাবধান করছে। সে আমাদের মনে নানা প্রকার আশা আকাংখা জাগিয়ে দেয় এবং সেগুলাে কোনাে ভালাে কাজের জন্য পরিচালিত হচ্ছে বলে আমাদেরকে বুঝায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবী রসূলদেরকে তাে নিজেই শয়তানের এসব সূক্ষ্ম চাল থেকে রক্ষা করেছেন, শয়তান হাজারাে চেষ্টা করা সত্তেও তাদের দ্বারা কোনাে অন্যায় কাজ করাতে পারেনি। কিন্তু আমরা তাে মাসুম (নিরপরাধ) নই, এজন্যে আমাদেরকে আরাে বেশী সাবধান হতে হবে, আর তার উপায় হচ্ছে আল্লাহর কাছে পুরােপুরি আত্মসমপর্ণ করা এবং সকল কাজে রসূল(স.)-এর তরফ থেকে কি দিক নিদের্শনা পাওয়া গেছে তা সঠিকভাবে জেনে নিয়ে সেগুলাে সযত্নে অনুসরণ করা। দাওয়াতী কাজ করার ব্যাপারে শয়তান যেন আমাদেরকে ভুল পথে পরিচালনা করতে না পারে তার জন্যে আলােচ্য আয়াতগুলাে ভালােভাবে বুঝতে চেষ্টা করা একান্ত প্রয়ােজন। শয়তানের ওয়াসওয়াসা অনেক সময় এমন হয় যে নিজের মনে অনেক পরিকল্পনা ও পদ্ধতি জাগে যেগুলাে আমাদেরকে বুঝানাে হয় যে পরিস্থিতির আলােকে এগুলােই মসলিহাত (অপরিহার্য) ও হেকমত (কৌশল)। পরামর্শ, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা ও কোরআন হাদীসের কথাকে প্রাধান্য দান না করার কারণে নিজের বুদ্ধি অনেক সময় বড় হয়ে দেখা দেয় এবং তখনই শয়তান সুযােগ করে নেয়। এজন্যে শয়তান যুক্তি দেখায়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত নীতিমালার মধ্যে নিহিত হেরফের করাতে তেমন কোনাে অসুবিধা নেই। এটাই হচ্ছে একমাত্র বড়াে শয়তানী হাতিয়ার, যার দ্বারা সে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে, আর তা হচ্ছে আল্লাহর বিধান ও রসূল(স.)-এর প্রদর্শিত পন্থাকে বড়াে করে না দেখে নিজের বুদ্ধিকে প্রাধান্য দান, আসলে এটাই সঠিক পথ পরিহার করার নামান্তর। এই পরিহার অল্প হােক আর বেশী এটাই আসল ফিৎনা- অবস্থার চাহিদা বা মাসলেহাতের নামে এগুলাে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করে। অবস্থা কি আছে এগুলাে খেয়াল না করলে আমাদেরকে পাকড়াও করা হবে না, পাকড়াও করা হবে আমরা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের কথা পুরােপুরি মানছি কিনা সে ব্যাপারে। এ প্রসংগের সর্বশেষ কথা হচ্ছে যে দাওয়াতী কাজের জন্যে আলােচ্য আয়াতগুলাে আমাদেরকে পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছে যে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা বাদ দিয়ে কৌশলের নামে নিজেদের বুদ্ধির কোনাে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। এ স্থায়ী নীতি থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে নেবে তারা আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত হয়ে যাবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘সদা-সর্বদা কাফেররা কোরআনের মধ্যে তাদের তরফ থেকে সন্দেহ জাগাতে থাকবে… তারাই হচ্ছে সেসব মানুষ যাদের জন্যে অপেক্ষা করছে অপমানজনক আযাব।’ এটাই হচ্ছে সমগ্র কোরআনের সাথে কাফেরদের ব্যবহার। বর্তমান আয়াতগুলােও আলােচ্য প্রসংগ, তাদের অবস্থান ও দৃষ্টিভংগী সম্পর্কে জানাচ্ছে। নবী রসূলদের অন্তরে জাগ্রত নানা আশা আকাংখার কথা তুলে ধরে মানুষকে তারা বিভ্রান্ত করতে চায়। এজন্য তারা নানা প্রকার উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরে, বিশেষ করে ওপরে বর্ণিত ঘটনাদ্বয়কে তারা মােক্ষম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। এভাবে তারা কোরআনের মধ্যে সন্দেহ পূর্ণ কথা রয়েছে বলে প্রচার করতে থাকে, উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ যেন খুশী মনে ও তৃপ্তি সহকারে আল কোরআনের কথাগুলাে গ্রহণ করতে এবং এভাবে আল কোরআনের তাৎপর্যও মাধুর্য পাওয়া থেকে যেন তারা বঞ্চিত হয়। তাদের এই অপচেষ্টা চলতে থাকবে। অবশেষে, হঠাৎ করে তাদের ওপর কেয়ামত এসে যাবে অথবা এমন সময় এসে যাবে যা তাদের সকল তৎপরতাকে ব্যর্থ করে দেবে। কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পর আর কি থাকবে তাদের জন্যে (সে চিন্তা এখনই করা দরকার)। ব্যর্থতার দিন আসবে বলা হয়েছে, অর্থাৎ সে দিনের পর আর কিছুই চাওয়া পাওয়ার থাকবে না। সেদিনটিই শেষ দিন । এই দিনটিতে রাজ্য ও ক্ষমতা হবে একমাত্র আল্লাহর, অন্য কারাে হাতে থাকবে না কোনাে ক্ষমতা ও এখতিয়ার, এমনকি দুনিয়ায় যাদেরকে বাদশাহ মনে করা হয়, তারাও হারিয়ে ফেলবে তাদের সকল ক্ষমতা। সে দিন একমাত্র আল্লাহর ফয়সালাই কার্যকর হবে। সেদিন তিনি সকল দলের জন্যে, তাদের জন্যে নির্ধারিত ফয়সালা শােনাবেন এবং সেই অনুযায়ী তারা তাদের পাওনা পাবে। ‘অতপর ঈমান যারা এনেছে এবং ভালাে কাজসমূহ যারা করেছে তারাই নেয়ামত ভরা জান্নাতে থাকবে… আর কুফরী যারা করেছে এবং আমার আয়াতগুলােকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক আযাব।’ এটাই হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনের সাথে ষড়যন্ত্রের বদলা, আর তার আয়াতগুলােকে প্রত্যাখ্যান করার প্রতিদানও নির্ধারিত রয়েছে, নির্ধারিত রয়েছে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য করা থেকে অহংকারপূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়ার শাস্তি।

 

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

# রসূল ও নবীর মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারটির ব্যাখ্যা সূরা মারয়ামের আলোচিত হয়েছে।

# “রাসূল” মানে প্রেরিত। এই মানের দিক দিয়ে আরবী ভাষায় দূত, পয়গম্বর, বার্তাবাহক ও রাজদূতের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আর কুরআনের এ শব্দটি এমন সব ফেরেশতার জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে যাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ কাজে নিযুক্ত করা হয় অথবা এমন সব মানুষকে এ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে যাদেরকে আল্লাহ‌ সৃষ্টির কাছে নিজের বাণী পৌঁছাবার জন্য নিযুক্ত করেন।

“নবী” শব্দটির অর্থের ব্যাপারে অভিধানবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ একে نَبَا শব্দ থেকে গঠিত বলেন। এক্ষেত্রে এর অর্থ হয় খবর। এই মূল অর্থের দিক দিয়ে নবী মানে হয় “খবর প্রদানকারী।” আবার কেউ কেউ বলেন, نَبُو ধাতু থেকে নবী শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ উন্নতি ও উচ্চতা। এ অর্থের দিক দিয়ে এর মানে হয় “উন্নত মর্যাদা” ও “সুউচ্চ অবস্থান।” আযহারী কিসায়ী থেকে তৃতীয় একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। সেটি হচ্ছে এই যে, এ শব্দটি মূলত نَبِى থেকে এসেছে। এর মানে হচ্ছে পথ। আর নবীদেরকে নবী এজন্য বলা হয়েছে যে, তাঁরা হচ্ছেন আল্লাহর দিকে যাবার পথ।

কাজেই কোন ব্যক্তিকে “রাসূল নবী” বলার অর্থ হবে “উন্নত মর্যাদাশালী পয়গম্বর অথবা”আল্লাহর পক্ষ থেকে খবর দানকারী পয়গম্বর” কিংবা “এমন পয়গম্বর যিনি আল্লাহর পথ বাতলে দেন।”

কুরআন মজীদে এ দু’টি শব্দ সাধারণত একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই আমরা দেখি একই ব্যক্তিকে কোথাও শুধু নবী বলা হয়েছে এবং কোথাও শুধু রাসূল বলা হয়েছে আবার কোথাও রসূল ও নবী এক সাথে বলা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন জায়গায় রসূল ও নবী শব্দ দু’টি এমনভাবেও ব্যবহৃত হয়েছে যা থেকে প্রকাশ হয় যে, এ উভয়ের মধ্যে মর্যাদা বা কাজের ধরনের দিক দিয়ে কোন পারিভাষিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন সূরা হজ্জের ৭ রুকূ’তে) বলা হয়েছেঃ وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا……………………….. ()

“আমি তোমার আগে এমন কোন রসূলও পাঠাইনি এবং এমন কোন নবী পাঠাইনি, যে………….”

একথাগুলো পরিষ্কার প্রকাশ করছে যে, রসূল ও নবী দু‍‍’টি আলাদা পরিভাষা এবং এদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন আভ্যন্তরীণ পার্থক্য আছে। এরই ভিত্তিতে এ পার্থক্যের ধরনটা কি এ নিয়ে তাফসীরকারদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু আসলে চূড়ান্ত ও অভ্রান্ত দলীল প্রমাণের সাহায্যে কেউই রসূল ও নবীর পৃথক মর্যাদা চিন্তিত করতে পারেননি। বড়জোর এখানে এতটুকু কথা নিশ্চয়তা সহকারে বলা যেতে পারে যে, রসূল শব্দটি নবীর তুলনায় বিশিষ্টতা সম্পন্ন। অর্থাৎ প্রত্যেক রসূল নবী হন কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল হন না। অন্যকথায়, নবীদের মধ্যে রসূল শব্দটি এমন সব নবীর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। একটি হাদীসও এ বক্তব্য সমর্থন করে। হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন ইমাম আহমদ হযরত আবু উমামাহ থেকে এবং হাকেম হযরত আবু যার (রা.) থেকে। এতে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসূলদের সংখ্যার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, ৩১৩ বা ৩১৫ এবং নবীদের সংখ্যা জিজ্ঞেস করা হলে বলেন, এক লাখ চব্বিশ হাজার। যদিও হাদিসটির সনদ দুর্বল কিন্তু কয়েকটি সনদের মাধ্যমে একই কথার বর্ণনা কথাটির দুর্বলতা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।

# মূল শব্দটি হচ্ছে, تَمَنَّى (তামান্না)। আরবী ভাষায় এ শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হচ্ছে কোন জিনিসের আশা-আকাংখা করা। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে তেলাওয়াত অর্থাৎ কিছু পাঠ করা।

# “তামান্না” শব্দটি যদি প্রথম অর্থ গ্রহণ করা হয় তাহলে এর অর্থ হবে, শয়তানও তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবার পথে বাধার সৃষ্টি করে। আর দ্বিতীয় অর্থে গ্রহণ করলে এর অর্থ হবে, যখনই তিনি লোকদেরকে আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন তখনই শয়তান সে সম্পর্কে লোকদের মনে নানা সন্দেহ-সংশয় ও আপত্তি সৃষ্টি করে দিয়েছে, সেগুলোর অদ্ভূত অদ্ভূত অর্থ তাদের সামনে তুলে ধরেছে এবং একমাত্র সঠিক অর্থটি ছাড়া বাকি সব ধরনের উল্টা-পাল্টা অর্থ লোকদেরকে বুঝিয়েছে।

# প্রথম অর্থটির দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হবে এই যে, আল্লাহ শয়তানের বিঘ্ন সৃষ্টি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নবীর তামান্না তথা আশা-আকাঙ্ক্ষা (আর নবীর আশা-আকাংখা এছাড়া আর কি হতে পারে যে, তাঁর প্রচেষ্টা ফলবতী এবং মিশন বাস্তবায়িত হবে) পূর্ণ করেন এবং নিজের আয়াতকে (অর্থাৎ নবীর সাথে অঙ্গীকার করেছিলেন) পাকাপোক্ত ও মজবুত অঙ্গীকারে পরিণত করেন। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর তৎপর্য হবে, শয়তানের ঢুকানো সন্দেহ-সংশয় ও আপত্তি আল্লাহ দূর করে দেন এবং এক একটি আয়াত সম্পর্কে সে লোকদের মনে যেসব জটিলতা সৃষ্টি করে পরবর্তী কোন অধিকতর সুস্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে সেগুলো পরিষ্কার করে দেয়া হয়।

# তিনি জানেন শয়তান কোথায় কি বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে এবং তার কি প্রভাব পড়েছে। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শয়তানী ফিতনার প্রতিবিধান করে।
# শয়তানের ফিতনাবাজীকে আল্লাহ লোকদের জন্য পরীক্ষা এবং নকল থেকে আসলকে আলাদ করার একটা মাধ্যমে পরিণত করেছেন। বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরা এসব জিনিস থেকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এগুলো তাদের জন্য ভ্রষ্টতর উপকরণে পরিণত হয়। অন্যদিকে স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী লোকেরা এসব কথা থেকে নবী ও আল্লাহর কিতাবের সত্য হবার দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করে এবং তারা অনুভব করতে থাকে যে, এগুলো শয়তানের অনিষ্টকর কার্যকলাপ। এ জিনিসটি তাদেরকে একদম নিশ্চিন্ত করে দেয় যে, এটি নির্ঘাত কল্যাণ ও সত্যের দাওয়াত, নয়তো শয়তান এতে এতো বেশী অস্থির হয়ে পড়তো না।

বক্তব্য পরম্পরা সামনে রাখলে এ আয়াতগুলোর অর্থ পরিষ্কার বুঝা যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত এ সময় যে পর্যায়ে ছিল তা দেখে বাহ্যজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা মনে করছিল তিনি নিজের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছেন। সাধারণ দর্শকরা এটাই দেখছিল যে, এক ব্যক্তির বিপুল আকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি আশা করছিলেন তাঁর জাতি তাঁর প্রতি ঈমান আনবে। তের বছর ধরে নাউযুবিল্লাহ অনেক মাথা খোড়ার পর তিনি শেষমেশ নিজের মুষ্টিমেয় কয়েকজন সঙ্গী সাথী নিয়ে প্রিয় স্বদেশভূমি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হলেন। এ অবস্থায় লোকেরা যখন তাঁর এ বক্তব্য দেখতো যেখানে তিনি বলছেন, আমি আল্লাহর নবী এবং তিনি আমাকে সাহায্য-সহায়তা দান করছেন আর এ সঙ্গে কুরআনের এ ঘোষণাবলীও দেখতো, যাতে বলা হয়েছে, নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী জাতি আল্লাহর আযাবের সুম্মখীন হয় তখন তাদের কাছে তাঁর ও কুরআনের সত্যতা সংশয়িত হয়ে যেতো। তাঁর বিরোধীরা এর ফলে গায়ে পড়ে নানা কথা বলতো। তারা বলতো, কোথায় গেলো সে আল্লাহর সাহায্য-সহায়তা? কি হলো সে শাস্তির ভয় দেখাবার? আমাদের যে আযাবের ভয় দেখানো হতো তা এখন আসে না কেন? এর আগের আয়াতগুলোতে এসব কথার জবাব দেয়া হয়েছিল। এবং এরই জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। আগের আয়াতগুলোতে জবাবের লক্ষ্য ছিল কাফেররা এবং এ আয়াতগুলোতে এর লক্ষ্য হচ্ছে এমন সব লোক যারা কফেরদের প্রচারণায় প্রভাবিত হচ্ছিল। সমগ্র জবাবের সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ

“কোন জাতি কর্তৃক তার নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করার ব্যাপারটি ইতিহাসে কোন নতুন ঘটনা নয়। ইতিপূর্বেও এমনটিই হয়েছে। তারপর এ মিথ্যা আরোপের পরিণাম ও ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের আকারে তোমাদের সামনে রয়েছে। শিক্ষা নিতে চাইলে এ থেকে নিতে পারো। তবে মিথ্যা আরোপ এবং নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার সাথে সাথেই কুরআনের অসংখ্য আয়াতে যে আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে তা শুরু হয়ে যায়নি কেন, এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, প্রত্যেকটি প্রত্যাখ্যান সঙ্গে সঙ্গেই আযাব নিয়ে আসে একথা কবে বলা হয়েছিল? আর আযাব নিয়ে আসা নবীর নিজের কাজ একথাই বা তিনি কবে বলেছিলেন? এর ফায়সালা তো আল্লাহ নিজেই করেন এবং তিনি তাড়াহুড়া করে কাজ করেন না। ইতিপূর্বেও তিনি আযাব নাযিল করার আগে জাতিগুলোকে অবকাশ দিয়ে এসেছেন এবং এখনো দিচ্ছেন। এ অবকাশকাল যদি শত শত বছর পর্যন্তও দীর্ঘ হয় তাহলে এ থেকে নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি আযাব নাযিলের হুমকি দেয়া হয়েছিল তা অন্তঃসারশূন্য প্রমাণিত হয় না।

তারপর নবীর আশা-আকাংখা পূর্ণ হবার পথে বাধার সৃষ্টি হওয়া বা তাঁর দাওয়াতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ এবং বিভিন্ন প্রকার সন্দেহ-সংশয়-আপত্তির প্রবল ঝড় সৃষ্টি হওয়াও কোন নতুন কথা নয়। পূর্বে সকল নবীর দাওয়াতের মোকাবিলায় এসব কিছুই হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ এসব শয়তানী ফিতনার মুলোচ্ছেদ করেছেন। বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও সত্যের দাওয়াত সম্প্রসারিত হয়েছে। সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত আয়াতের মাধ্যমে সন্দেহ-সংশয়ের বিঘ্ন দূরীভূত হয়েছে। শয়তান ও তার সাংগ পাংগরা এসব কৌশল অবলম্বন করে আল্লাহর আয়াতকে মর্যাদাহীন করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ সেগুলোকেই মানুষের মধ্যে আসল ও নকলের পার্থক্য করার মাধ্যমে পরিণত করেছেন। এ পথেই আসল ও নির্ভেজাল মানুষেরা সত্যের দাওয়াতের দিকে এগিয়ে আসে এবং ভেজাল ও মেকী লোকেরা ছাঁটাই হয়ে আলাদা হয়ে যায়।”

পূর্বাপর বক্তব্যের আলোকে এ হচ্ছে এ আয়াতগুলোর পরিষ্কার ও সহজ-সরল অর্থ। কিন্তু দুঃখের বিষয় একটি রেওয়ায়াত এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যার মধ্যে এমন জটিলতা সৃষ্টি করে দিয়েছে যার ফলে কেবল এদের অর্থেরই আমূল পরিবর্তন ঘটেনি বরং সমগ্র দ্বীনের বুনিয়াদই বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এখানে আমি এর আলোচনা এজন্য করছি যে, কুরআনের জ্ঞানানুশীলনকারীকে অবশ্যই কুরআনের অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে রেওয়ায়াতের সাহায্য গ্রহণ করার সঠিক ও বেঠিক পদ্ধতিগুলোর পার্থক্য ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে এবং তাদের জানতে হবে রেওয়ায়াতের প্রতি মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে অবৈধ বাড়াবাড়ির ফল কি হয় এবং কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদানকারী রেওয়ায়াত যাচাই করার সঠিক পদ্ধতি কি। ঘটনা এভাবে বর্ণনা করা হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনে আকাঙ্ক্ষা জাগে, আহা, যদি কুরআনে এমন কোন আয়াত নাযিল হতো যার ফলে ইসলামের বিরুদ্ধে কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের ঘৃণা দূর হয়ে যেতো এবং তারা কিছুটা কাছাকাছি এসে যেতো! অথবা কমপক্ষে তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে এমন কড়া সমালোচনা না হতো যা তাদেরকে উত্তেজিত করে। এ আকাঙ্ক্ষা তাঁর মনের মধ্যেই ছিল এমন সময় একদিন কুরাইশদের একটি বড় মজলিসে বসে থাকা অবস্থায় তাঁর ওপর সূরা নজম নাযিল হয় এবং তিনি তা পড়তে শুরু করেন। যখন তিনি أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّى – وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى আয়াতে পৌঁছেন তখন হঠাৎ তাঁর মুখ থেকে নাকি বের হয়ে যায়ঃ تلك الغرائقة العلى وان شفاعتهن لترجى (এরা মহিয়সী দেবী, এদের সুপারিশ অবশ্যই কাংখিত) এরপর তিনি সামনের দিকে সূরা নজমের আয়াতগুলো পড়ে যেতে থাকেন। এমনকি সূরা শেষে যখন তিনি সিজদা করেন তখন মুশরিক মুসলিম নির্বিশেষে সবাই সিজদা করে। কুরাইশ বংশীয় কাফেররা বলতে থাকে, এখন আর মুহাম্মাদের সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরাও তো এ কথাই বলতাম, আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা আর আমাদের এ দেবদেবীরা তাঁর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশকারী। সন্ধ্যায় জিব্রীল আসেন। তিনি বলেন, এ আপনি কি করলেন? এ দু’টি বাক্য তো আমি নিয়ে আসিনি। এতে তিনি বড়ই দুঃখ ভারাক্রান্ত হন। তখন মহান আল্লাহ সূরা বনী ইসরাঈলের ৮ রুকূ’র নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেনঃ

وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ …………… ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا

এ বিষয়টি সব সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে রাখে। শেষে সূরা হজ্জের এ আয়াতটি নাযিল হয় এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ মর্মে সান্ত্বনা দেয়া হয় যে, তোমার পূর্বেও নবীদের সাথে এমনিতর ঘটনা ঘটতে থেকেছে। ওদিকে কুরআন শুনে কুরাইশের লোকেরাও নবীর ﷺ সাথে সিজদা করেছে এ ঘটনাটি হাবশার মুহাজিরদের কাছেও এভাবে পৌঁছে যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে সাথে মক্কার কাফেরদের সমঝোতা হয়ে গেছে তাই বহু মুহাজির মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু এখানে এসে তারা জানতে পারেন সমঝোতা ও সন্ধির খবরটি ভুল ছিল, ইসলাম ও কুফরের শত্রুতা আগের মতই অপরিবর্তিত আছে।

এ ঘটনাটি ইবনে জারীর ও অন্যান্য বহু তাফসীরকার নিজেদের তাফসীর গন্থে, ইবনে সা’দ তাবকাতে আল ওয়াহেদী, আসবাবুন নুযুলে, মূসা ইবনে উকবাহ মাগাযীতে, ইবনে ইসহাক সীরাতে এবং ইবনে আবূ হাতেম, ইবনুল মুনযির, বাযযার, ইবনে মারদুইয়া ও তাবারানী নিজেদের হাদীস সংকলনে উদ্ধৃত করেছেন। যেসব বর্ণনা পরম্পরায় এ ঘটনাটি উদ্ধৃত হয়েছে সেগুলো মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস, মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরযী, উরওয়াহ ইবনে যুবাইর, আবু সালেহ, আবুল আলীয়াহ, সা’ঈদ ইবনে জুবাইর, দ্বাহহাক, আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হারেস, কাতাদাহ, মুজাহিদ, সুদ্দী, ইবনে শিহাব, যুহরী ও ইবনে আব্বাস পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। (উল্লেখ্য, ইবনে আব্বাস ছাড়া এঁদের মধ্যে আর একজনও সাহাবী নেই।) ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা ক্ষেত্রে সামান্য ছোট-খাটো বিরোধ ও অসামঞ্জস্য বাদ দিলেও দু’টি বড় বড় বিরোধ দেখা যায়। একটি হচ্ছে, মূর্তির প্রশংসায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে যেসব শব্দ বেরিয়েছে বলে বর্ণনা করা হয়েছে তা প্রায় প্রত্যেক বর্ণনায় অন্য বর্ণনা থেকে আলাদা। আমি এগুলো একত্র করার চেষ্টা করেছি। ফলে পনেরটি ইবারতে আলাদা শব্দ পেয়েছি। দ্বিতীয় বড় বিরোধটি হচ্ছে, কোন্ বর্ণনার প্রেক্ষিতে এ শব্দগুলো অহীর মাঝখানে শয়তান তাঁর মনে ঢুকিয়ে দেয় এবং তিনি মনে করেন এও বুঝি জিব্রীল এনেছেন। কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ শব্দগুলো নিজের পূর্বের বাসনার প্রভাবে ভুলক্রমে তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে গেছে। কোনটায় বলা হয়েছে, সে সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং এ অবস্থায় এ শব্দগুলো তাঁর কন্ঠ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। করোর বর্ণনা হচ্ছে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে একথা বলেন কিন্তু অস্বীকারমূলক জিজ্ঞাসা হিসেবেই বলেন। কারো বক্তব্য হচ্ছে, শয়তান তাঁর আওয়াজের সাথে আওয়াজ মিলিয়ে এ শব্দগুলো বলে দেয় এবং মনে করা হয় তিনি এগুলো বলেছেন। আবার কারো মতে মুশরিকদের মধ্য থেকে কেউ একথা বলে।

ইবনে কাসীর, বাইহাকী, কাযী আইয়ায, ইবনে খুযাইমা, কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী, ইমাম রাযী, কুরতুবী, বদরুদ্দীন আইনী, শাওকানী, আলূসী প্রমুখ মহোদয়গণ এ ঘটনাটিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা গণ্য করেন। ইবনে কাসীর বলেন, “যতগুলো সনদের মাধ্যমে এ হাদীসটি বর্ণনা করা হয়েছে সবগুলোই মুরসাল১ ও মুনকাতে২। কোন সহীহ মুত্তাসিল৩ সনদের মাধ্যমে এ হাদীসটি আমি পাইনি।” বাইহাকী বলেন, “হাদীস বিচারের যথার্থ পদ্ধতিতে এ ঘটনাটি প্রমাণিত নয়।” ইবনে খুযাইমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়, তাতে তিনি বলেন, “এটি যিনদিকদের (যরোথুষ্ট্রীয়পন্থী নাস্তিক্যবাদী গোষ্ঠী) তৈরি করা।” কাযী আইয়ায বলেন, “এর দুর্বলতা এখান থেকেই সুস্পষ্ট যে, সিহাহে সিত্তার৪ লেখকদের একজনও নিজের গন্থে একে স্থান দেননি এবং কোন সহীহ্ মুত্তাসিল ত্রুটিমুক্ত সনদ সহকারে নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমেও এটি উদ্ধৃত হয়নি।” ইমাম রাযী, কাযী আবু বকর ও আলূসী এর ওপর বিস্তারিত আলোচনা করে শক্তিশলী যুক্তির ভিত্তিতে একে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু অন্যদিকে হাফেয ইবনে হাজার আসকালানীর মতো উচ্চস্তরের মুহাদ্দিস, আবু বকর জাসসাসের ন্যায় খ্যাতিমান ফকীহ, যামাখশারীর মতো যুক্তিবাদী মুফাসসির এবং ইবনে জারীরের ন্যায় তাফসীর, ইতিহাস ও ফিকাহর ইমাম একে সহীহ বলে স্বীকার করেন এবং একেই আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা গণ্য করেন। ইবনে হাজারের মুহাদ্দিস সুলভ যুক্তি হচ্ছেঃ “সাঈদ ইবনে জুবাইরের মাধ্যম ছাড়া বাকি অন্যান্য যেসব মাধ্যমে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে, তা হয় যঈফ৫ আর নয়তো মুনকাতে’। কিন্তু মাধ্যমের সংখ্যাধিক্য একথা প্রকাশ করে যে, এর নিশ্চয়ই কোন মূল আছে। এছাড়াও এটি একটি মাধ্যমে মুত্তাসিল পদ্ধতিতে সহীহ সনদ সহকারেও বর্ণিত হয়েছে। বযযার এটি উদ্ধৃত করেছেন। (এখানে ইউসুফ ইবনে হাম্মাদ-উমাইয়াহ ইবনে খালেদ থেকে, তিনি শু’বা থেকে, তিনি আবু বিশর থেকে, তিনি সাঈদ ইবনে জুবাইর থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হাদীসটির কথা বলা হয়েছে) অন্য দু’টি মাধ্যমে যদিও মুরসাল বর্ণিত হয়েছে কিন্তু এর রাবীগণ ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী পূর্ণ গুণ সম্পন্ন। তাবারী এ দু’টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। একটি উদ্ধৃত হয়েছে ইউনুস ইবনে ইয়াযীদ কর্তৃক ইবনে শিহাব থেকে এবং অন্যটি মুতামির ইবনে সুলাইমান ও হাম্মাদ ইবনে সালামাহ কর্তৃক দাউদ ইবনে আবী হিন্দ থেকে এবং তিনি আবীল আলীয়াহ থেকে।”

সমর্থকদের ব্যাপারে বলা যায়, তারা তো এ হাদীসটিকে সহীহ বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বিরোধীরাও সাধারণভাবে এর বিরুদ্ধে সমালোচনার হক আদায় করেননি। একটি দল একে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তাদের দৃষ্টিতে এর সনদ শক্তিশালী নয়। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, যদি সনদ শক্তিশালী হতো তাহলে তারা এ কাহিনীটি মেনে নিতেন। দ্বিতীয় দলটি একে এজন্য প্রত্যাখ্যান করেন যে, এর ফলে সমগ্র দ্বীনই সন্দেহযুক্ত হয়ে যায় এবং দ্বীনের প্রত্যেকটি বিষয়ের ব্যাপারে সন্দেহ দেখা দেয় যে, না জানি আরো কোথায় কোথায় শয়তানী কুমন্ত্রণা ও মিশ্রণের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অথচ এ ধরনের যুক্তি তো কেবল এমনসব লোককে নিশ্চিত করতে পারে যারা আগে থেকে দৃঢ় ও পরিপক্ক ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। কিন্তু যারা প্রথম থেকেই সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যে অবস্থান করছেন অথবা যারা এখন গবেষণা-অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঈমান আনা বা না আনার ফায়সালা করতে চান তাদের মনে তো যেসব জিনিসের কারণে এ দ্বীন সন্দেহযুক্ত হয়ে যায় সেগুলো প্রত্যাখ্যান করার অনুভূতি জাগতে পারে না। বরং তারা বলবেন, যখন কমপক্ষে একজন প্রখ্যাত সাহাবী এবং বহু তাবেঈ, তাবে’তাবেঈ ও অসংখ্য নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারীদের বর্ণনার মাধ্যমে একটি ঘটনা প্রমাণ হচ্ছে তখন তাকে শুধুমাত্র এজন্যই বা কেন প্রত্যাখ্যান করা হবে যে, এর ফলে আপনার দ্বীন সংশয়পূর্ণ হয়ে যায়? এর পরিবর্তে আপনার দ্বীনকেই বা সংশয়পূর্ণ মনে করা হবে না কেন যখন এ ঘটনাটি তাকে সংশয়পূর্ণ বলে প্রমাণ করছে?

এখন সমালোচনা ও যাচাই ও বাছাইয়ের সঠিক পদ্ধতি চিহ্নিত করা দরকার, যার কষ্ঠি পাথরে যাচাই করে এর সনদ যতই শক্তিশালী বা দুর্বল হোক না কেন একে অগ্রহণযোগ্য গণ্য করা যেতে পারে।

প্রথম জিনিসটি হচ্ছে তার আভ্যন্তরীন সাক্ষ্য। এটি তাকে ভুল প্রমাণ করে কাহিনীটিতে বর্ণনা করা হয়েছে, হাবশায় হিজরত সম্পন্ন হয়ে যাবার পর ঘটনাটি ঘটে এবং এই ঘটনার খবর শুনে হাবশায় হিজরাতকারীদের একটি দল মক্কায় ফিরে আসে। এবার একটু তারিখের পার্থক্য বিবেচনা করুন।

নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে জানার যায় হাবশায় হিজরত অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম নববী সালের রজব মাসে। আর হাবশার মুহাজিরদের একটি দল সমঝোতার ভুল খবর শুনে তিন মাস পরে (অর্থাৎ একই বছর প্রায় শাওয়াল মাসে) মক্কায় ফিরে আসে। এ থেকে জানা যায়, এটি নির্ঘাত পঞ্চম নববী সনের ঘটনা। সূরা বনী ইসরাঈলের একটি আয়াতের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, সেটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশের উদ্দেশে নাযিল হয়েছিল। সূরা বনী ইসরাঈল মি’রাজের পরে নাযিল হয়। আর নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসমূহের ভিত্তিতে বলা যায়, ১১ বা ১২ নববী সালে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কাজের পাঁচ ছয় বছর পর আল্লাহ তাঁর অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আর পূর্বাপর বক্তব্যের ভিত্তিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আলোচ্য আয়াতটি ১ হিজরী সনে নাযিল হয়। অর্থাৎ ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশের পরও যখন আরো দুই আড়াই বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে তখন ঘোষণা করা হয়, এ মিশ্রণ তো শয়তানী কুমন্ত্রণার মাধ্যমে ঘটে গিয়েছিল। আল্লাহ একে রহিত করে দিয়েছেন। কোন বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি কি একথা মেনে নিতে পারে যে, মিশ্রণের কাজটি হলো আজ, তার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করা হলো ৬ বছর পর এবং মিশ্রণটি রহিত করার ঘোষণা হলো ৯ বছর পর? তারপর এ ঘটনায় বলা হয়েছে, এ মিশ্রণটি হয়েছিল সূরা নজমে এবং এভাবে হয়েছিল যে, শুরু থেকে নবী (সা.) আসল সূরার শব্দাবলী পাঠ করে আসছিলেন। হঠাৎ وَمَنَاةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى বাক্যাংশে পৌঁছে তিনি নিজেই বা শয়তানী প্ররোচনায় এ বাক্য মিশিয়ে দিলেন এবং তারপর সামনের দিকে আবার সূরা নজমের আসল আয়াত পড়তে থাকলেন। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, মক্কার কাফেররা এটা শুনে খুশী হয়ে গিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, এখন আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে বিরোধ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সূরা নজমের বক্তব্য পরম্পরায় এ প্রক্ষিপ্ত বাক্যটি সংযুক্ত করে দেখুন তো কি দাঁড়ায়ঃ

“তারপর তোমরা কি একটু চিন্তা করে দেখেছো এই লাত, উযযা ও তৃতীয় একটি (দেবী) মানাত সম্পর্কে? এরা হচ্ছে উচ্চ মর্যাদাশালিনী দেবী। এদের সুপারিশ অবশ্যি কাংখিত। তোমাদের জন্য হবে পুত্রগণ এবং তার (অর্থাৎ আল্লাহর) জন্য হবে কন্যাগণ? এতো বড় অন্যায় ভাগ-ভাটোয়ারা। আসলে এগুলো কিছুই নয় তবে কতিপয় নাম, যা তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা রেখে দিয়েছে। আল্লাহ এগুলোর জন্য কোন প্রমাণপত্র অবর্তীণ করেননি। লোকেরা নিছক অনুমান ও মনগড়া চিন্তার অনুসরণ করে চলছে। অথচ তাদের রবের পক্ষ থেকে সঠিক পথ-নির্দেশনা এসে গেছে।”

দেখুন এ প্যারাগ্রাফটির মধ্যে রেখাচিহ্নিত বাক্যটির বক্তব্য কেমন পরিষ্কার বৈপরীত্য সৃষ্টি করে দিয়েছে। এক কথায় বলে দেয়া হচ্ছে, যথার্থই তোমাদের এ দেবীগুলো উচ্চমর্যাদার অধিকারী, এদের সুপারিশ অবশ্যই আকাংখার বস্তু। অন্য কথায় উল্টা দিকে মুখ করে আবার তাদেরই ওপর আঘাত হানা হচ্ছে এই বলে যে, নির্বোধের দল! তোমরা আল্লাহর জন্য এ মেয়েদেরকে কেমন করে ঠিক করে রাখলে? ধাপ্পা তো মন্দ নয়, তোমরা নিজেরা তো পেলে পুত্র আর আল্লাহর হিসসায় কন্যা। এসব তোমাদের মনগড়া। এগুলোর সপক্ষে আল্লাহর কোন প্রমাণপত্র তোমাদের কাছে নেই। এটি একটি স্রেফ পরস্পর বিরোধী ভাষণ— যা কোন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানবান মানুষের মুখ থেকে বের হতে পারে না। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য এ প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। মেনে নিন, শয়তান প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়ে একথা মুখ দিয়ে বের করিয়েছে। কিন্তু কুরাইশদের সে সমগ্র জনমণ্ডলী যারা একথা শুনছিল তারা কি একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল যে, পরবর্তী বাক্যগুলোয় এই প্রশংসাপূর্ণ শব্দগুলোর সুস্পষ্ট প্রত্যাখ্যানের বার্তা শুনেও তারা একথাই মনে করতে থাকলো যে, তাদের দেবীদেরকে যথার্থই প্রশংসা করা হয়েছে। সূরা নজমের শেষ পর্যন্ত যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে সে সমগ্র বক্তব্যই এ একটি মাত্র প্রশংসামূলক বাক্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। কেমন করে একথা মেনে নেয়া যেতে পারে যে, কুরাইশের লোকেরা এগুলো শেষ পর্যন্ত শোনার পর সবাই মিলে একযোগে এ বলে চিৎকার করে বলে থাকবে যে, চলো আজ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যকার বিরোধ খতম হয়ে গেছে?

এতো হচ্ছে এ ঘটনার আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য! এর মাধ্যমে ঘটনাটি যে একবারেই অর্থহীন ও বাজে একথাই প্রমাণিত হচ্ছে। এরপর দ্বিতীয় যে জিনিসটি দেখার তা হচ্ছে এই যে, এর মধ্যে তিনটি আয়াতের নাযিল হওয়ার যে কার্যকারণ বর্ণনা করা হচ্ছে কুরআনের বিন্যাসও তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত কি না? ঘটনায় বলা হচ্ছে, সূরা নজমে মিশ্রণ করা হয়েছিল। আর সূরা নজম ৫ নববী সনে নাযিল হয়। এ মিশ্রণের বিরুদ্ধে সূরা বনী ইসরাঈলের আয়াতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। আবার একে রহিত ও ঘটনার ব্যাখ্যা করা হয় সূরা হজ্জের আলোচ্য আয়াতে। এখন অবশ্য দু’টি অবস্থার মধ্যে যে কোন একটিই হয়ে থাকবে। মিশ্রণের ঘটনা যখন ঘটেছে তখনই ক্রোধ প্রকাশ ও রহিত করার আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে অথবা ক্রোধ সংক্রান্ত আয়াত সূরা বনী ইসরাঈলের সাথে এবং রহিত করা সংক্রান্ত আয়াত সূরা হজ্জের সাথে নাযিল হয়েছে। যদি প্রথম অবস্থাটি হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার! এ আয়াত দু’টি সূরা নজমে সংযুক্ত করা হলো না বরং ক্রোধ সংক্রান্ত আয়াতকে ছ’বছর পর্যন্ত এমনিভাবেই রেখে দেয়া হলো এবং সূরা বনী ইসরাঈল যখন নাযিল হলো তখনই তাকে এনে তার সাথে জুড়ে দেয়া হলো। তারপর আবার রহিত করা সংক্রান্ত আয়াত আরো দু’-আড়াই বছর পর্যন্ত পড়ে রইলো এবং সূরা হজ্জ নাযিল না হওয়া পর্যন্ত তাকে কোথাও সংযুক্ত করা হলো না। কুরআনের বিন্যাস কি এভাবেই হয়েছে, এক সময় যে আয়াতগুলো নাযিল হয় সেগুলো বিক্ষিপ্ত আকারে চারদিকে পড়ে থাকে এবং বছরের পর বছর পর হয়ে যাবার পর তাদের কোনটিকে কোন সূরার সাথে এবং কোনটিকে অন্য সূরার সাথে জুড়ে দেয়া হয়? কিন্তু যদি দ্বিতীয় অবস্থাটি হয়ে থাকে অর্থাৎ ক্রোধ সংক্রান্ত আয়াত ঘটনার ৬ বছর পর এবং রহিত করা সংক্রান্ত আয়াত আট নয় বছর পর নাযিল হয় তাহলে ইতিপূর্বে আমি যে অসামঞ্জস্যের কথা বলে এসেছি তা ছাড়াও এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, সূরা বনী ইসরাঈল ও সূরা হজ্জের মধ্যে এ আয়াতগুলোর নাযিল হওয়ার সুযোগ কোথায়?

এখানে এসে যথার্থ সমালোচনার তৃতীয় ধারাটি আমাদের সামনে আসে। অর্থাৎ কোন আয়াতের যে ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে কুরআনের পূর্বাপর বক্তব্যও তা গ্রহণ করে কি না তা দেখতে হবে। সূরা বনী ইসরাঈলের ৮ রুকূ’ পড়ে দেখুন। তার পূর্বের ও পরের বক্তব্যের ওপর ও চোখ বুলিয়ে নিন। এ বক্তব্য পরম্পরায় নবীকে ছ’বছর আগের একটি ঘটনার জন্য শাসিয়ে দেবার সুযোগ কোথায় পাওয়া যায়?

إِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ আয়াতে নবীকে কোন প্রকার শাসানো হচ্ছে কিনা এবং আয়াতের শব্দাবলী কাফেরদের ফিতনায় নবীর জড়িয়ে পড়ার কথা বলছে, না তার প্রতিবাদ করছে— এ প্রশ্ন বাদ দিলে এভাবে সূরা হজ্জও আপনার সামনে আছে। আলোচ্য আয়াতের পূর্বের বক্তব্যও পড়ুন এবং পরের বক্তব্যও। এ প্রেক্ষাপটে “হে নবী! ৯ বছর পূর্বে কুরআনে মিশ্রণ ঘটাবার যে কাজ তুমি করেছিলে, সে ব্যাপারে ভয় পেয়ো না, ইতিপূর্বেকার নবীদের সাথেও শয়তান এ ব্যবহার করে এসেছে এবং যখনই নবীরা এ ধরনের কাজ করে তখনই আল্লাহ তাকে রহিত করে নিজের আয়াতকে আবার শক্তিশালী ও তরতাজা করে দেন।” —এ ধরনের বক্তব্য কেমন করে এসে গেলো, এর কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ কি আপনি বুঝতে পেরেছেন?

আমি এর আগেও বার বার বলেছি এবং এখানে আবার তার পুনরাবৃত্তি করছি যে, কোন রেওয়ায়াত তার বর্ণনা পরম্পরা যতই সূর্যের চাইতেও উজ্জল হোক না কেন তার ‘মতন’১ যখন তার ভুলের দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ পেশ করতে থাকে এবং কুরআনের শব্দাবলী, পূর্বাপর বক্তব্য, বিন্যাস, সবকিছুই তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করতে থাকে তখন তা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ যুক্তিগুলো একজন সন্দেহবাদী ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধানীকে অবশ্য নিশ্চিত করে দেবে। তিনি এ কাহিনীটি পুরোপুরি মিথ্যা বলে মেনে নেবেন। আর কোন মু’মিন তো একে কখনো সত্য বলে মেনে নিতে পারেন না। কারণ তিনি প্রকাশ্য দেখছেন এ রেওয়ায়াতটি কুরআনের একটি নয় বহু আয়াতের সাথে সংঘর্ষশীল। একজন মুসলমানের পক্ষে একথা মেনে নেয়া বড়ই সহজ যে, এ হাদীসটির বর্ণনাকারীদেরকে শয়তান বিভ্রান্ত করেছে। এর তুলনায় তারা কখনো একথা মেনে নিতে পারে না যে, রসূলুল্লাহ ﷺ কখনো নিজেই নিজেই মানসিক আকংখার তাড়নায় কুরআনে একটি শব্দও মেশাতে পারতেন অথবা তাঁর মনে কখনো মুহূর্তকালের জন্যও এ চিন্তা আসতে পারতো যে, তাওহীদের সাথে শিরকের কিছুটা মিশ্রণ ঘটিয়ে কাফেরদেরকে সন্তুষ্ট করা হোক কিংবা আল্লাহর ফরমানসমূহের ব্যাপারে তিনি কখনো এ আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে পারতেন যে, আল্লাহ যেন এমন কোন কথা বলে না বসেন যার ফলে কাফেররা নারাজ হয়ে যায় অথবা তাঁর কাছে এমন কোন অসংরক্ষিত ও সংশয়পূর্ণ পদ্ধতিতে অহী আসতো যার ফলে জিব্রীলের সাথে সাথে শয়তানও তাঁর কাছে নিজের কোন শব্দ প্রক্ষেপ করতো এবং তিনি তাকেও জিব্রীলের নিয়ে আসা শব্দ মনে করার ভুল ধারণায় নিমজ্জিত থাকতেন। এর মধ্যে প্রত্যেকটি কথাই কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য বিরোধী। আমাদের মনে কুরআন ও মুহাম্মাদ ﷺ সম্পর্কে যে সব আকীদা-বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত আছে এগুলো তারও বিরোধী। এমন ধরনের রেওয়ায়াতের পেছনে দৌঁড়ানো থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই,নিছক সনদের সংযোগ রাবীরে নির্ভরযোগ্যতা কিংবা বর্ণনাসূত্রের আধিক্য দেখে কোন মুসলমানকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের ব্যাপারে এমন কঠিন কথাও স্বীকার করে নিতে উদ্বুদ্ধ করে।

এত বিপুল সংখ্যক, হাদীস বর্ণনাকারীকে এ ঘটনাটি বর্ণনা করার সাথে জড়িত থাকতে দেখে মনে যে সন্দেহ জাগে এ প্রসঙ্গে তা দূর করে দেয়া সঙ্গত মনে করি। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করতে পারে, যদি এ ঘটনাটির মূলে কোন সত্য না-ই থাকে তাহলে নবী ও কুরআনের বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ হাদীসের এত বিপুল সংখ্যক রাবীদের মাধ্যমে যাদের মধ্যে বড় বড় খ্যাতিমান নির্ভরযোগ্য বুযর্গও রয়েছেন, কেমন করে বিস্তার লাভ করলো? এর জবাব হচ্ছে, হাদীসের বিপুল সম্পদের মধ্যেই আমরা এর কারণ খুঁজে পাই। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমদে আসল ঘটনাটি এভাবে এসেছেঃ নবী ﷺ সূরা নজম তেলাওয়াত করেন। সূরা শেষে যখন তিনি সিজদা করেন তখন মুসলিম-মুশরিক নির্বিশেষে সকল উপস্থিতি ব্যক্তিবর্গ সিজদা করে। আসল ঘটনা শুধু এতটুকুই ছিল। আর কোন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল না। প্রথমত, কুরআনের শক্তিশালী বক্তব্য এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী বর্ণনা ভংগী, এর ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কণ্ঠে এর যাদুকরী প্রকাশের পর যদি তা শুনে উপস্থিত সমগ্র জনমণ্ডলী বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে তাঁর সাথে সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে তাহলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। এ জিনিসটির জন্যই তো কুরাইশরা বলতো, এ ব্যক্তি যাদুকর। তবে মনে হয়, পরে কুরাইশরা নিজেদের এ সাময়িক ভাবাবেগের জন্য কিছুটা লজ্জিত হয়ে থাকবে এবং তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি অথবা কিছু লোক নিজেদের এ কাজের এ ব্যাখ্যা দিয়ে থাকবে যে, জনাব আমরা তো মুহাম্মাদের মুখ থেকে নিজেদের মাবুদদের প্রশংসায় কিছু কথা শুনেছিলাম, যে কারণে আমরা তাঁর সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলাম। অন্যদিকে এ ঘটনাটি হাবশার মুহাজিরদের কাছে এভাবে পৌঁছে যে, নবী ﷺ ও কুরাইশদের মধ্যে সন্ধি হয়ে গেছে। কারণ লোকেরা তাঁকে এবং মুশরিক ও মু’মিনদেরকে এক সাথে সিজদা করতে দেখেছিল। এ গুজব এতো বেশী ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রায় ৩৩ জন মুহাজির মক্কায় ফিরে আসেন। এক শতাব্দীর মধ্যে এ তিনটি কথা অর্থাৎ কুরাইশদের সিজদা, এ সিজদার এ ব্যাখ্যা এবং হাবশার মুহাজিরদের ফিরে আসা একসাথে মিশে একটি কাহিনীর আকার ধারণ করে এবং অনেক মুত্তাকী, বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য লোকও এ ঘটনা বর্ণনা করতে থাকেন। মানুষ যাই হোক না কেন মূলত মানুষই। বড় বড় সৎকর্মপরায়ণ ও জ্ঞানবান লোকেরাও অনেক সময় ভুল-ভ্রান্তি করে বসেন এবং তাদের এ ভুল সাধারণ লোকের ভুলের তুলনায় অনেক বেশী ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। এদের প্রতি সীমাতিরিক্ত ভক্তি শ্রদ্ধা পোষণকারীরা এদের সঠিক কথার সাথে সাথে ভুল কথাগুলোও চোখ বন্ধ করে গ্রহণ করে নেয়। আর মন্দ চরিত্রের লোকেরা এদের ভুলগুলো বাছাই করে করে একত্র করে এবং এগুলোকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে বলতে থাকে, এদের মাধ্যমে আমাদের কাছে যা কিছু পৌঁছেছে সবই আগুনে পুড়িয়ে ফেলার যোগ্য।

-( ১। মুরসালঃ যে হাদীসের সনদের শেষের দিকে তাবেঈর পরে কোন রাবী নেই এবং তাবেঈ নিজেই বলেছেন, “রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন।” ২। মুনকাতেঃ যে হাদীসের কোন স্তরে এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়ে যায়। ৩। মুত্তাসিলঃ যে হাদীসের সনদের কোন স্তরে কোন রাবী বাদ পড়েনি এবং সকল রাবীর নাম যথাস্থানে উল্লেখিত হয়েছে। ৪। সিহাহে সিত্তাঃ ছয়টি সহীহ তথা নির্ভুল হাদীস গন্থ যেমন বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ। ৫। যঈফঃ যে হাদীসের রাবীর মধ্যে ‘আদালত’ ও ‘যবত’ গুণ যে কোন পর্যায়েই থাকে না। আদালত মানে হচ্ছে (১) তাকওয়া ও পবিত্রতা গুণ থাকা, (২) মিথ্যা না বলা, (৩) কবীরা গুনাহ না করা, (৪) অজ্ঞাতনামা না হওয়া অর্থাৎ দোষগুণ বিচারের জন্য যার জীবনী জানা সম্ভব হয় না এবং (৫) শরীয়াত বিরোধী আকীদা-বিশ্বাসের অধিকারী এবং বিদআতীও নয়। অন্যদিকে “যবত” হচ্ছে এমনশক্তি যার সাহায্যে মানুষ শোনা বা লিখিত বিষয়কে ভুলে যাওয়া বা বিনষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে এবং ইচ্ছা মতো তাকে সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে।-অনুবাদক)

# মূলে আছে عَقِيمٍ শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে “বন্ধ্যা” দিনকে বন্ধ্যা বলার দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, এমন ভাগ্য বিড়ম্বিত দিন যার মধ্যে কোন রকম কলাকৌশল কার্যকর হয় না। প্রত্যেকটা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় প্রত্যেকটা আশা নিরাশায় পরিণত হয়। দুই, এমন দিন যার পরে রাত দেখা আর ভাগ্যে জোটে না। উভয় অবস্থায়ই এর অর্থ হচ্ছে, এমন দিন যেদিন কোন জাতির ধ্বংসের ফায়সালা হয়ে যায়। যেমন, যেদিন নূহের জাতির ওপর তুফান এলো সেদিনটি তাদের জন্য ছিল ‘বন্ধ্যা’ দিন। এমনিভাবে আদ, সামূদ, লূতের জাতি, মাদয়ানবাসী ও অন্যান্য সকল ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির জন্য আল্লাহর আযাব নাযিলের দিনটি বন্ধ্যা দিনই প্রামাণিত হয়েছে। কারণ “সেদিনের” পরে আর তার “পরের দিন” দেখা যায়নি এবং নিজেদের বিপর্যস্ত ভাগ্যকে সৌভাগ্যে রূপান্তরিত করার কোন পথই খুঁজে পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৫২-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:

অত্র আয়াতে

تَمَنّٰي ও أُمْنِيَّتِه۪

এ শব্দদ্বয়ের দুটি অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। একটি হলন আকাক্সক্ষা করা বা অন্তরে কল্পনা করা। অন্যটি হল- পড়া বা তেলাওয়াত করা। এ ভিত্তিতে أُمْنِيَّتِه۪ এর অর্থ হবে রাসূলের আকাক্সক্ষা করা বা তেলাওয়াত করা। যেমন উসমান (রাঃ)-কে যখন হত্যা করা হয় তখন কবি হাসসান বিন সাবেত বলেছিলেন:

تمني كتاب الله أول ليلة … وآخرها لاقي حِمام المقادر

প্রথম অর্থ অনুযায়ী এর তাৎপর্য হলন যখনই আল্লাহ তা‘আলার রাসূল বা নাবীগণ কোন আকাক্সক্ষা করেন শয়তান তাতে বাধা সৃষ্টি করে, যাতে তা পূর্ণ না হয়। আর রাসূলদের আকাক্সক্ষা এটা হয় যে, সবাই ঈমান আনুক, ইসলাম গ্রহণ করুক। কিন্তু শয়তান বাধা সৃষ্টি করে বেশি সংখ্যক মানুষকে ঈমান আনা হতে দূরে রাখতে চায়।

দ্বিতীয় অর্থ অনুযায়ী এর তাৎপর্য দাঁড়াবে যে, যখনই আল্লাহ তা‘আলার রাসূল ও নাবীগণ ওয়াহী তেলাওয়াত করে শোনান, তখনই শয়তান উক্ত ওয়াহীর কথার সাথে নিজের কিছু কথা মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা শয়তানের এ চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন। এ তাফসীর অধিকাংশ মুফাসসিরগণ করেছেন। (ইমাম বুখারী সূরা হজ্জের অত্র আয়াতের তাফসীরে নিয়ে এসেছেন, ইগাসাতুল লাহফান ১:৯৩)

আর আল্লাহ তা‘আলা এ কথার দ্বারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দিলেন যে, শয়তান এরূপ কার্যকলাপ শুধু তোমার সাথেই করেনি বরং তোমার পূর্ববর্তী সকল নাবীদের সাথেই করেছে। সুতরাং তুমি একটুও বিচলিত হবে না। শয়তানের ঐ সমস্ত চক্রান্ত ও দুরভিসন্ধি হতে যেমন আমি পূর্বের নাবীদেরকে রক্ষা করেছি, তেমনি তুমিও সুরক্ষিত থাকবে এবং শয়তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলা নিজের বাণীকে পাকাপোক্ত ও সুদৃঢ় করবেন।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: শয়তানের এ সকল চক্রান্ত করার উদ্দেশ্য হলন যে সকল মানুষের অন্তরে কুফরী ও মুনাফিকীর রোগ রয়েছে এবং যাদের অন্তর অধিক পাপ করতে করতে পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গেছে এদেরকে তার জালে আটকে ফেলে অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করা। কারণ শয়তান কয়েকটি কথা নাবীদের কথার সাথে মিশ্রণ করতে পারলে সে সব কথাকে দলীল বানিয়ে বাতিলকে শক্তিশালী করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আর এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে একটা পরীক্ষাও বটে। ফলে যারা কাফির ও মুনাফিক তারা এ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় এবং শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে মন্দ কর্মে লিপ্ত হয়। পক্ষান্তরে যারা মু’মিন, জ্ঞানী তারা এ পরীক্ষায় কৃতকার্য হয় এবং সাথে সাথে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়।

অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ আয়াতের তাফসীরে কিসসাতুল গারানীক

قصة الغرانيق

উল্লেখ করেছেন। আর তা হলো এই যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কার জীবনে একদা

والنجم إذا থেকে

الثالثة الأخري

(সূরা নাজমের ১-২০ নং আয়াত) পর্যন্ত পাঠ করেন তখন শয়তান তাঁর কথার সাথে এ কথা মিলিয়ে দিয়ে রাসূলের মুখে প্রকাশ করায় যে,

تلك الغرانيق العلي – وإن شفاعتهن لترجي

অর্থাৎ এগুলো হল মহান গারানীক এবং তাদের সুপারিশের আশা করা যায়। যখন সূরার শেষ প্রান্তে চলে গেলেন তখন তিনি সিজদা করলেন, সাথে সাথে মুসলিম ও মুশরিক সবাই সিজদা করল।

মুশরিকরা বলল: আজ তিনি আমাদের দেবতাদের এমন প্রশংসা করেছেন যা তিনি ইতোপূর্বে করেননি। মক্কায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে, মক্কার মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সিজদা করার মধ্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমনকি এ কথা শুনে হাবশায় যে সকল মুসলিমরা হিজরত করেছিল তারা ফিরে এসেছিল এ ধারণা নিয়ে যে, তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরাও হয়তো ইসলাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসে দেখে তারা কাফির রয়ে গেছে। এ ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বাতিল। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন কথা বলবেন না যে, এরা (লাত, উযযা, মানাত ইত্যাদি দেবতা) মহান গারানীক আর এদের সুপারিশ কবুল করার আশা করা যায়, এটা সম্পূর্ণ শিরকী ও কুফরী কথা। তাঁর মুখ দিয়ে এরূপ কথা কোন দিন বের হতে পারে না। এটা যে মিথ্যা তার প্রমাণ পরের আয়াত থেকেই বুঝা যাচ্ছে। কারণ পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

(إِنْ هِيَ إِلَّآ أَسْمَا۬ءٌ سَمَّيْتُمُوْهَآ أَنْتُمْ وَاٰبَآؤُكُمْ مَّآ أَنْزَلَ اللّٰهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ ط إِنْ يَّتَّبِعُوْنَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَي الْأَنْفُسُ)

“এগুলো কতক নাম মাত্র, যা তোমাদের পূর্বপুরুষরা ও তোমরা রেখেছ, এর সমর্থনে আল্লাহ কোন দলীল প্রেরণ করেননি। তারা শুধু অনুমান এবং তাদের প্রবৃত্তি যা চায় তারই অনুসরণ করে।” (সূরা নাজম ৫৩:২৩)

পূর্বের আয়াতগুলোতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের মা‘বূদের প্রশংসা করার পর অত্র আয়াতে নিন্দা করবেন এটা বোধগম্য নয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুশরিকরদের মা‘বূদের প্রথমে প্রশংসা করবেন তারপর নিন্দা করা হবে, আর তারা ছেড়ে দিবে? আবার তারা সিজদাও করবে? কখনো হতে পারে না। এছাড়া কুরআনের অনেক আয়াত রয়েছে যা প্রমাণ করে যে, এ ঘটনা মিথ্যা। তা হলন আল্লাহ তা‘আলা কোন নাবী বা রাসূলগণের ওপর শয়তানের কর্তৃত্ব দেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(إِنَّه۫ لَيْسَ لَه۫ سُلْطٰنٌ عَلَي الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَلٰي رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ – إِنَّمَا سُلْطٰنُه۫ عَلَي الَّذِيْنَ يَتَوَلَّوْنَه۫ وَالَّذِيْنَ هُمْ بِه۪ مُشْرِكُوْنَ)

“নিশ্চয়ই তার কোন আধিপত্য নেই তাদের ওপর যারা ঈমান আনে ও তাদের প্রতিপালকেরই ওপর নির্ভর করে। তার আধিপত্য কেবল তাদেরই ওপর যারা তাকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে এবং যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে।” (সূরা নাহাল ১৬:৯৯-১০০) আল্লাহ বলেন:

(وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰي) ‏

“এবং সে প্রবৃত্তি হতেও কোন কথা বলে না।” (সূরা নাজম ৫৩:৩)

শাইখ আলবানী

(رحمه الله) نصب المجانيق لنسف قصة الغرانيق

গ্রন্থে এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট দশটি বর্ণনা নিয়ে এসেছেন এবং সে সকল বর্ণনার ত্র“টি উল্লেখপূর্বক বাতিল বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ বিষয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. অজ্ঞ লোকেরাই কেবল শয়তানের ধোঁকায় পড়ে, জ্ঞানীরা নয়।
২. নাবীদের আকাক্সক্ষা হল বেশি বেশি মানুষ ঈমান নিয়ে আসুক তা জানলাম।
৩. শয়তানের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানলাম।
৪. কিসসাতুল গারানীক একটি ভ্রান্ত ও সাজানো মিথ্যা ঘটনা।
৫৫-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:

يوم عقيم

এর মূল অর্থ হল- বন্ধ্যা দিন। আর তা হল কিয়ামতের দিন। এ দিনকে বন্ধ্যা এ কারণে বলা হয়েছে যে, তারপর আর কোন দিন হবে না। যেমন কারো সন্তান না হলে তাকে বন্ধ্যা বলা হয়। অথবা এ কারণে যে, সেদিন কাফিরদের জন্য কোন দয়া থাকবে না। অর্থাৎ সেদিন তাদের জন্য কল্যাণশূন্য হবে। যেমন আযাবস্বরূপ আগত ঝড়কে ريح عقيم বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(وَفِيْ عَادٍ إِذْ أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الرِّيْحَ الْعَقِيْمَ) ‏

“এবং (নিদর্শন রয়েছে) ‘আদের ঘটনায়, যখন আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলাম অকল্যাণকর বাতাস।” (সূরা যারিআত ৫১:৪১) অর্থাৎ এমন বায়ু যার মধ্যে কোন কল্যাণ ও বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল না।

مِرْيَةٍ مِّنْهُ

অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আসার পূর্ব পর্যন্ত কাফিররা কুরআনের ব্যাপারে সংশয়ে থাকবে। কেউ বলেছেন, শয়তান রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথার সাথে বা আকাক্সক্ষার সাথে যা মিশ্রিত করে দেন সে ব্যাপারে সন্দেহে থাকবে।

(اَلْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ لِّلّٰهِ)

অর্থাৎ কিয়ামতের দিনের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার থাকবে। দুনিয়ার রাজত্ব কি আল্লাহ তা‘আলার নয়? অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলার, কিন্তু দুনিয়াতে অনেকে নিজেকে রাজা বলতে পারে, কিয়ামতের দিন এ রাজা নামটি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কারো থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لِمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ ط لِلّٰهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ)

(আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন) আজ কর্তৃত্ব কার? এক পরাক্রমশালী আল্লাহরই। (সূরা মু’মিন ৪০:১৬)

হাদীসে এসেছে: কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিন ডান হাতে গুটিয়ে নেবেন, অতঃপর বলবেন:

يَقْبِضُ اللّٰهُ الأَرْضَ، وَيَطْوِي السَّمَوَاتِ بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يَقُولُ: أَنَا المَلِكُ، أَيْنَ مُلُوكُ الأَرْضِ

আমিই রাজা। দুনিয়ার রাজা-বাদশাহরা কোথায়? (সহীহ বুখারী হা: ৪৮১২, সহীহ মুসলিম হা: ২৭৮৭)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সত্যের ব্যাপারে কাফিররা কিয়ামত পর্যন্ত সন্দেহে থাকবে। কিয়ামত হঠাৎ করে চলে আসবে।
২. কিয়ামতকে يوم عقيم বা অশুভ দিন বলা হয়, কারণ কিয়ামত কাফিরদের জন্য শুভ হবে না।
৩. কিয়ামতের দিন রাজত্ব হবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার।
৪. যারা সৎ কাজ করে তারা জান্নাতী আর যারা অসৎ কাজ করে তারা জাহান্নামী।

Leave a Reply