أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৮৪) الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ]
তিনি ফুরকান নাযিল করেছেন।]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৮
০১- ৩ নং আয়াত:-
২৫:১
تَبٰرَکَ الَّذِیۡ نَزَّلَ الۡفُرۡقَانَ عَلٰی عَبۡدِہٖ لِیَکُوۡنَ لِلۡعٰلَمِیۡنَ نَذِیۡرَا ۙ﴿۱﴾
বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি যিনি এ ফুরকান তাঁর বান্দার ওপর নাযিল করেছেন যাতে সে সারা বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হয়।
২৫:২
ۣالَّذِیۡ لَہٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لَمۡ یَتَّخِذۡ وَلَدًا وَّ لَمۡ یَکُنۡ لَّہٗ شَرِیۡکٌ فِی الۡمُلۡکِ وَ خَلَقَ کُلَّ شَیۡءٍ فَقَدَّرَہٗ تَقۡدِیۡرًا ﴿۲﴾
যিনি আসমানসমূহ যমীনের সার্বভৌমত্বের অধিকারী; তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি; সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন অতঃপর তা নির্ধারণ করেছেন যথাযথ অনুপাতে।
২৫:৩
وَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اٰلِہَۃً لَّا یَخۡلُقُوۡنَ شَیۡئًا وَّ ہُمۡ یُخۡلَقُوۡنَ وَ لَا یَمۡلِکُوۡنَ لِاَنۡفُسِہِمۡ ضَرًّا وَّ لَا نَفۡعًا وَّ لَا یَمۡلِکُوۡنَ مَوۡتًا وَّ لَا حَیٰوۃً وَّ لَا نُشُوۡرًا ﴿۳﴾
লোকেরা তাঁকে বাদ দিয়ে এমন সব উপাস্য তৈরি করে নিয়েছে যারা কোন জিনিস সৃষ্টি করে না বরং নিজেরাই সৃষ্ট, যারা নিজেদের জন্যও কোন উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখে না, যারা না জীবন-মৃত্যু দান করতে পারে আর না মৃতদেরকে আবার জীবিত করতে পারে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ:
(الْفُرْقَانَ) ফুরকান শব্দের অর্থ সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। ফুরকান শব্দটি অত্র সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখ রয়েছে বিধায় এ সূরাটি উক্ত নামে নামকরণ করা হয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে সম্পূর্ণ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) ও কাতাদাহ (رضي الله عنه) বলেন: ৬৮-৭০ এ তিনটি আয়াত মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে (কুরতুবী)। সূরায় কুরআনের মাহাত্ম্য, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাতের সত্যতা এবং শত্র“দের পক্ষ থেকে উত্থাপিত আপত্তিসমূহের জবাব দেয়া হয়েছে।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:
تَبٰرَكَ শব্দটি بركة থেকে উদ্ভূত। বরকতের অর্থন প্রভূত কল্যাণ। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: প্রত্যেক কল্যাণ ও বরকত আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আসে, তাই তাঁর কাছেই বরকত কামনা করা উচিত। الْفُرْقَانَ শব্দের অর্থ সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, হিদায়াত-গুমরাহী, সৌভাগ্যশীল-দুর্ভাগার পার্থক্য নিরূপণকারী। এর দ্বারা “আল-কুরআন”-কে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু কুরআন হক ও বাতিল, তাওহীদ ও শির্ক, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য স্থাপন করেছে তাই আল-কুরআনকে ফুরকান নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
(عَلٰی عَبْدِھ۪) ‘তাঁর বান্দার প্রতি’ অর্থাৎ এ কুরআন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে যাতে তিনি বিশ্ববাসীকে সতর্ক করতে পারেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা পৃথিবীবাসীর জন্য প্রেরিত রাসূল। তাঁকে এ কুরআন দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে যাতে তিনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ প্রদান করেন আর অসৎকর্মশীলদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেন। তাঁর পর আর কোন নাবী ও রাসূল আগমন করবেন না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ يٰٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّيْ رَسُوْلُ اللّٰهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعَا)
“বল ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৫৮)
হাদীসে এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমাকে পাঁচটি জিনিস দেয়া হয়েছে যা আমার পূর্বে আর কাউকে দেয়া হয়নি। অতঃপর তার মধ্যে থেকে একটি উল্লেখ করেন যে, প্রত্যেক নাবী-রাসূলকে তার নিজ সম্প্রদায়ের নিকট পাঠানো হয়েছে। আর আমাকে পাঠানো হয়েছে সকল মানুষের জন্য। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩৫, সহীহ মুসলিম হা: ৫২১)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর চারটি ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হল:
প্রথম বৈশিষ্ট্য:
তিনি আকাশ ও জমিনের একমাত্র মালিক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللّٰهَ لَه۫ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ)
“তুমি কি জান না যে, আসমান ও জমিনের আধিপত্য আল্লাহরই।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৪০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
( قُلِ اللّٰهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ)
“বলুন, হে আল্লাহ তা‘আলা! তুমিই রাজত্বের মালিক।” (সূরা আল ইমরান ৩:২৬)
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:
যারা আল্লাহ তা‘আলার অংশী সাব্যস্ত করেন যেমন ইয়াহূদীরা বলে, উযাইর আল্লাহ তা‘আলার ছেলে; খ্রিস্টানরা বলে, ঈসা আল্লাহ তা‘আলার ছেলে; মারইয়াম আল্লাহ তা‘আলার স্ত্রী; তাছাড়া আরবের মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা মনে করে। তাদের বিশ্বাসকে খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি; সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন শরীক নেই।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ ھُوَ اللہُ اَحَدٌﭐﺆ اَللہُ الصَّمَدُﭑﺆ لَمْ یَلِدْﺃ وَلَمْ یُوْلَدْﭒﺫ وَلَمْ یَکُنْ لَّھ۫ کُفُوًا اَحَدٌﭓﺟ)
“বল: তিনিই আল্লাহ, একক। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি। আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।” (সূরা ইখলাস ১১২:১-৪)
অন্যত্রে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّأَنَّه۫ تَعَالٰي جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَّلَا وَلَدًا)
“এবং নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা সমুচ্চ; তিনি কোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং কোন সন্তানও।” (সূরা জিন ৭২:৩)
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য:
তিনি প্রত্যেকের তাকদীর বা ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন, যার জন্য যা উপযোগী ও যা প্রয়োজন তিনি তা-ই দিয়ে দিয়েছেন। তাতে কোন প্রকার ঘাটতি রাখেননি।
আল্লাহর বাণী:
(الَّذِيْ خَلَقَ فَسَوّٰي وَالَّذِيْ قَدَّرَ فَهَدٰي)
“যিনি সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর পরিপূর্ণভাবে সুবিন্যস্ত করেছেন, এবং যিনি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন, তারপর হিদায়াত দিয়েছেন।” (সূরা আলা ৮৭:২-৩)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنٰهُ بِقَدَرٍ)
“নিশ্চয়ই আমি সকল কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।” (সূরা কামার ৪:৫৯)
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য:
প্রত্যেক বস্তুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِکُمُ اللہُ رَبُّکُمْ خَالِقُ کُلِّ شَیْءٍﺭ لَآ اِلٰھَ اِلَّا ھُوَﺇ فَاَنّٰی تُؤْفَکُوْنَﮍ کَذٰلِکَ یُؤْفَکُ الَّذِیْنَ کَانُوْا بِاٰیٰتِ اللہِ یَجْحَدُوْنَﮎ)
“তিনি আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক, সব কিছুর স্রষ্টা; তিনি ব্যতীত (সত্য) কোন মা‘বূদ নেই, সুতরাং তোমরা কোথায় পথভ্রষ্ট হয়ে ঘুরছ? এভাবেই পথভ্রষ্ট হয়ে তারা ঘুরে, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে।” (সূরা মু’মিন ৪০:৬২-৬৩)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নিজের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার পর বাতিল ও ভ্রান্ত মা‘বূদের কিছু দুর্বলতার দিক তুলে ধরেছেন। আর তা হল:
১. তারা কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ لَنْ يَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّلَوِ اجْتَمَعُوْا لَه۫)
“তোমরা আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশ্যে তারা সকলে একত্রিত হলেও।” (সূরা হজ্জ ২২:৭৩)
২. তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থাৎ তারা অপরের সৃষ্ট বস্তু। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ لَا يَخْلُقُوْنَ شَيْئًا وَّهُمْ يُخْلَقُوْنَ)
“তারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অপর যাদেরকে আহ্বান করে তারা কিছুই সৃষ্টি করে না, তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়।’’ (সূরা নাহল ১৬:২০)
৩. তারা নিজেদের কোন উপকার ও ক্ষতি করতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ مَنْ رَّبُّ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ ط قُلِ اللّٰهُ ط قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِّنْ دُوْنِه۪ٓ أَوْلِيَا۬ءَ لَا يَمْلِكُوْنَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا)
“বল: ‘কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক?’ বল: ‘আল্লাহ তা‘আলা।’ বল: ‘তবে কি তোমরা অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছ আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে অপরকে যারা নিজেদের লাভ বা ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়?’ (সূরা রাদ ১৩:১৬)
৪. তারা কাউকে মৃত্যু দান করতে পারে না আর না পারে জীবিত করতে এবং তারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান করতেও সক্ষম নয়। এ সকল বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ক্ষমতাবান, অন্য কেউ নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(كَيْفَ تَكْفُرُوْنَ بِاللّٰهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ج ثُمَّ يُمِيْتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيْكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ)
“কিভাবে তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন, এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পরে আবার জীবিত করবেন, অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।” (সূরা বাকারাহ ২:২৮)
অতএব ইবাদতের একমাত্র যোগ্য আল্লাহ তা‘আলা অন্য কেউ নয়। কারণ তাদের হাতে কোনই ক্ষমতা নেই। আর যাদের কোন ক্ষমতা নেই তারা ইবাদতের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। সুতরাং আমাদের উচিত যারা কোন কিছু করার ক্ষমতা রাখে না তাদেরকে বর্জন করে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে নাযিলকৃত কিতাব।
২. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন।
৩. কুরআন মানুষের জন্য সতর্কবাণীস্বরূপ।
৪. সমস্ত কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
৫. আল্লাহ তা‘আলা কোন সন্তান-সন্ততি গ্রহণ করেন না। তাঁর কোন শরীক নেই।
৬. পুনরুত্থানের মালিকও একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
৭. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যান্য বাতিল মা‘বূদ কোন ক্ষমতা রাখে না, এমনকি নিজেদের কোন উপকার ও ক্ষতি করতেও পারে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(২৫-ফুরকান) : নামকরণ:
প্রথম আয়াত تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ থেকে সূরার নাম গৃহীত হয়েছে। কুরআনের অধিকাংশ সূরার মতো এ নামটিও বিষয়বস্তু ভিত্তিক শিরোনাম নয় বরং আলামত হিসেবে সন্নিবেশিত হয়েছে। তবুও সূরার বিষয়বস্তুর সাথে নামটির একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সামনের দিকের আলোচনা থেকে একথা জানা যাবে।
(২৫-ফুরকান) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
বর্ণনাভঙ্গী ও বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার মনে হয়, এ সূরাটিও সূরা মু’মিনূন ইত্যাদিটি সূরাগুলোর সমসময়ে নাযিল হয়। অর্থাৎ সময়টি হচ্ছে, রসূলের (সা.) মক্কায় অবস্থানকালের মাঝামাঝি সময়। ইবনে জারীর ও ইমাম রাযী যাহ্হাক ইবনে মুযাহিম ও মুকাতিল ইবনে সুলাইমানের একটি রেওয়ায়ত উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, এ সূরাটি সূরা নিসার ৮ বছর আগে নাযিল হয়। এ হিসেবেও এর নাযিল হবার সময়টি হয় মক্কী যুগের মাঝামাঝি সময়। (ইবনে জারীর, ১৯ খণ্ড, ২৮-৩০ পৃষ্ঠা ও তাফসীরে কবীর, ৬ খণ্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠা)
(২৫-ফুরকান) :কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় :
কুরআন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত এবং তাঁর পেশ-কৃত শিক্ষার বিরুদ্ধে মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে যেসব সন্দেহ ও আপত্তি উত্থাপন করা হতো সেগুলো সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। এর প্রত্যেকটি যথাযথ জবাব দেয়া হয়েছে এবং সাথে সাথে সত্যের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার খারাপ পরিণামও পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শেষে সূরা মু’মিনূনের মতো মু’মিনদের নৈতিক গুণাবলীর একটি নকশা তৈরি করে সেই মানদণ্ডে যাচাই করে খাঁটি ও ভেজাল নির্ণয় করার জন্য সাধারণ মানুষের সামনে রেখে দেয়া হয়েছে। একদিকে রয়েছে এমন চরিত্র সম্পন্ন লোকেরা যারা এ পর্যন্ত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এবং আগামীতে যাদেরকে তৈরি করার প্রচেষ্টা চলছে। অন্যদিকে রয়েছে এমন নৈতিক আদর্শ যা সাধারণ আরববাসীদের মধ্যে পাওয়া যায় এবং যাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য জাহেলিয়াতের পতাকাবাহীরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন আরববাসীরা এ দু’টি আদর্শের মধ্যে কোনটি পছন্দ করবে তার ফায়সালা তাদের নিজেদেরকেই করতে হবে। এটি ছিল একটি নীরব প্রশ্ন। আরবের প্রত্যেকটি অধিবাসীর সামনে এ প্রশ্ন রেখে দেয়া হয়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একটি ক্ষুদ্রতম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ছাড়া বাকি সমগ্র জাতি এর যে জবাব দেয় ইতিহাসের পাতায় তা অম্লান হয়ে আছে।
# মূলে تَبَارَكَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর পূর্ণ অর্থ এক শব্দে তো দূরের কথা এক বাক্যে বর্ণনা করাও কঠিন। এর শব্দমূলে রয়েছে ب – ر – ك অক্ষরত্রয়। এ থেকে بَرَكَة ও بُرُوك দু’টি ধাতু নিষ্পন্ন হয়। بَرَكَة এর মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, বিপুলতা, প্রাচুর্যের ধারণা। আর بُرُوك এর মধ্যে স্থায়িত্ব, দৃঢ়তা, অটলতা ও অনিবার্যতার ধারণা রয়েছে। তারপর এ ধাতু থেকে যখন تَبَارَكَ এর ক্রিয়াপদ তৈরী করা হয় তখন تفاعل এর বৈশিষ্ট্য হিসেবে এর মধ্যে বাড়াবাড়ি, অতিরঞ্জন ও পূর্ণতার প্রকাশের অর্থ শামিল হয়ে যায়। এ অবস্থায় এর অর্থ দাঁড়ায় চরম প্রাচুর্য, বর্ধমান প্রাচুর্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ের স্থায়িত্ব। এ শব্দটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে কোন জিনিসের প্রাচুর্য বা তার দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের অবস্থা বর্ণনা করার জন্য বলা হয়ে থাকে। যেমন কখনো এর অর্থ হয় উচ্চতায় অনেক বেশী এগিয়ে যাওয়া। বলা হয়, تباركت النخلة অর্থাৎ অমুক খেজুর গাছটি অনেক উঁচু হয়ে গেছে। আসমায়ী বলেন, এক বন্ধু একটি উঁচু টিলায় উঠে পড়ে এবং নিজের সাথীদেরকে বলতে থাকে تَبَارَكْتُ عَلَيْكُمْ “আমি তোমাদের চাইতে উঁচু হয়ে গেছি।” কখনো মর্যাদায় ও শ্রেষ্ঠত্বে বেশী অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে এ শব্দটি বলা হয়। কখনো একে ব্যবহার করা হয় দয়া ও সমৃদ্ধি পৌঁছানো এবং শুভ ও কল্যাণের ক্ষেত্রে অগ্রসরতার জন্য। কখনো এ থেকে পবিত্রতার পূর্ণতা ও চূড়ান্ত বিশুদ্ধতার অর্থ গ্রহণ করা হয়। এর স্থায়িত্ব ও অনিবার্যতার অর্থের অবস্থাও একই। পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং পূর্বাপর বক্তব্যই বলে দেয় কোথায় একে কোন্ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে সামনের দিকে যে বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হয়েছে তাকে দৃষ্টি সমক্ষে রাখলে বুঝা যায়, এক্ষেত্রে আল্লাহর জন্য تَبَارَكَ শব্দটি এক অর্থে নয় বরং বহু অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমনঃ
একঃ মহা অনুগ্রহকারী ও সর্বজ্ঞ। কারণ, তিনি নিজের বান্দাকে ফুরকানের মহান নিয়ামত দান করে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছেন।
দুইঃ বড়ই মর্যাদাশালী ও সম্মানীয়। কারণ, পৃথিবী ও আকাশে তাঁরই রাজত্ব চলছে।
তিনঃ বড়ই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। কারণ, তাঁর সত্তা সকল প্রকার শিরকের গন্ধমুক্ত। তাঁর সমজাতীয় কেউ নেই। ফলে আল্লাহর সত্তার সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন নজির ও সমকক্ষ নেই। তাঁর কোন ধ্বংস ও পরিবর্তন নেই। কাজেই তাঁর স্থলাভিষিক্তের জন্য কোন পুত্রের প্রয়োজন নেই।
চারঃ বড়ই উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। কারণ, সমগ্র রাজত্ব তাঁরই কতৃর্ত্বাধীন। তাঁর ক্ষমতায় অংশীদার হবার যোগ্যতা ও মর্যাদা কারো নেই।
পাঁচঃ শক্তির পূর্ণতার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ, তিনি বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টিকারী ও তার ক্ষমতা নির্ধারণকারী। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল মুমিনূন ১৪ ও আল ফুরকান ১৯ নং টীকা। )
# কুরআন মজীদ। فُرْقَان শব্দটি ধাতুগত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এর শব্দমূল হচ্ছে ف – ر – ق অক্ষরত্রয়। এর অর্থ হচ্ছে দু’টি জিনিসকে আলাদা করা। অথবা একই জিনিসের অংশ আলাদা আলাদা হওয়া। কুরআন মজীদের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে পার্থক্যকারী হিসেবে অথবা যার মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে অর্থে। অথবা এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অতিরঞ্জন। অর্থাৎ পৃথক করার ব্যাপারে এর পারদর্শিতা এতই বেশী যেন সে নিজেই পৃথক। যদি একে প্রথম ও তৃতীয় অর্থে নেয়া হয় তাহলে এর সঠিক অনুবাদ হবে মানদণ্ড, সিদ্ধান্তকর জিনিস ও নির্ণায়ক (CRITERION)। আর যদি দ্বিতীয় অর্থে নেয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে পৃথক পৃথক অংশ সম্বলিত এবং পৃথক পৃথক সময়ে আগমনকারী অংশ সম্বলিত জিনিস। কুরআন মজীদকে এ দু’টি দিক দিয়েই আল ফুরকান বলা হয়েছে।
# মূলে نَزَّلَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হয় ক্রমান্বয়ে ও সামান্য সামান্য করে নাযিল করা। এ মুখবন্ধসূচক বিষয়বস্তুর সম্পর্ক সামনের দিকে ৩২ আয়াত অধ্যয়নকালে জানা যাবে। সেখানে “এ কুরআন সম্পূর্ণটা একই সময় নাযিল করা হয়নি কেন” মক্কার কাফেরদের এ আপত্তি আলোচনা করা হয়েছে।
# সাবধান বাণী উচ্চারণকারী এবং গাফিলতি ও ভ্রষ্টতার অশুভ ফলাফলের ভীতি প্রদর্শনকারী। এ ভীতি প্রদর্শনকারী ফুরকানও হতে পারে আবার যে বান্দার উপর ফুরকান নাযিল করা হয়েছে তিনিও হতে পারেন। শব্দটি এমন ব্যাপক অর্থবোধক যে, উভয় অর্থই এখানে প্রযোজ্য হতে পারে। আর প্রকৃত অর্থে যেহেতু উভয়ই এক এবং উভয়কে একই কাজে পাঠানো হয়েছে তাই বলা যায়, উভয় অর্থই এখানে লক্ষ্য। তারপর সারা বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হবার যে কথা এখানে বলা হয়েছে এ থেকে জানা যায় যে, কুরআনের দাওয়াত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত কোন একটি দেশের জন্য নয় বরং সারা দুনিয়ার জন্য এবং কেবলমাত্র নিজেরই যুগের জন্য নয় বরং ভবিষ্যতের সকল যুগের জন্য। এ বিষয়বস্তুটি কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিবৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا
“হে মানুষেরা! আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত।” (সূরা আল আরাফ, ১৫৮ আয়াত)
وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآنُ لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ
“আমার কাছে এ কুরআন পাঠানো হয়েছে যাতে এর মাধ্যমে আমি তোমাদের এবং যাদের কাছে এটা পৌঁছে যায় তাদের সতর্ক করে দেই।” (সূরা আল আনআম, ১৯ আয়াত)
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا
“আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে পাঠিয়েছি।” (সূরা সাবা, ২৮ আয়াত)
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
“আর আমি তোমাকে সারা দুনিয়াবাসীর জন্য রহমত বানিয়ে পাঠিয়েছি।” (আল আম্বিয়া, ১০৭ আয়াত)
এ বিষয়বস্তুটিকে আরো সুস্পষ্টভাবে নবী ﷺ হাদীসে বার বার বর্ণনা করেছেনঃ بعثت الى الاحمر والاسود “আমাকে সাদা-কালো সবার কাছে পাঠানো হয়েছে।” كَانَ النَّبِىُّ يُبْعَثُ إِلَى قَوْمِهِ خَاصَّةً ، وَبُعِثْتُ إِلَى النَّاسِ عَامَّةً “প্রথমে একজন নবীকে বিশেষ করে তাঁর নিজেরই জাতির কাছে পাঠানো হতো এবং আমাকে সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতির কাছে পাঠানো হয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম) وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّونَ “আমাকে সমস্ত সৃষ্টির কাছে পাঠানো হয়েছে এবং আমার আগমনে নবীদের ধারাবাহিক আগমন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।” (মুসলিম)
# অন্য অনুবাদ এও হতে পারে, “আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব তাঁরই জন্য।” অর্থাৎ এটা তাঁরই অধিকার এবং তাঁরই জন্য এটা নির্দিষ্ট। অন্য কারো এ অধিকার নেই এবং এর মধ্যে কারো কোন অংশও নেই।
# কারো সাথে তাঁর কোন বংশীয় সম্পর্ক নেই এবং কাউকে তিনি দত্তকও নেননি। বিশ্ব-জাহানের এমন কোন সত্তা নেই, আল্লাহর সাথে যার বংশগত সম্পর্ক বা দত্তক সম্পর্কের কারণে সে মাবুদ হবার অধিকার লাভ করতে পারে। তাঁর সত্তা একান্ত একক। কেউ নেই তাঁর সমজাতীয়। আল্লাহর কোন বংশধর নেই যে, নাউযুবিল্লাহ এক আল্লাহর ঔরস থেকে কোন প্রজন্ম চালু হবে এবং একের পর এক বহু আল্লাহর জন্ম নিতে থাকবে। কাজেই যে মুশরিক সমাজ ফেরেশতা, জিন বা কোন কোন মানুষকে আল্লাহর সন্তান মনে করে তাদেরকে দেবতা ও উপাস্য গণ্য করেছে তারা পুরোপুরি মূর্খ, অজ্ঞ ও পথভ্রষ্ট। এভাবে যারা বংশীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে না হলেও কোন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একথা মনে করে নিয়েছে যে, বিশ্ব-জাহানের প্রভু আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে নিজের পুত্র বানিয়ে নিয়েছেন তারাও নিরেট মূর্খতা ও ভ্রষ্টতার মধ্যে অবস্থান করছে। “পুত্র করে নেবার” এ ধারণাটিকে যেদিক থেকেই বিশ্লেষণ করা যাবে অত্যন্ত অযৌক্তিক মনে হবে। এর কোন বাস্তব ও ন্যায়সঙ্গত বিষয় হবার প্রশ্নই উঠে না। যারা এ ধারণাটি উদ্ভাবন বা অবলম্বন করে তাদের নিকৃষ্ট মানসিকতা ইলাহী সত্তার শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনায় অক্ষম ছিল। তারা এ অমুখাপেক্ষী ও অসমকক্ষ সত্তাকে মানুষের মতো মনে করে, যে একাকীত্ব ও নির্জনতার ভয়ে ভীত হয়ে অন্য কারো শিশুকে কোলে নিয়ে নেয় অথবা স্নেহ-ভালবাসার আবেগে উদ্বেল হয়ে কাউকে নিজের ছেলে করে নেয় কিংবা সবার পরে কেউ তার উত্তরাধিকারী হবে এবং তার নাম ও কাজকে জীবিত রাখবে তাই দত্তক নেবার প্রয়োজন অনুভব করে। এ তিনটি কারণেই মানুষের মনে দত্তক নেবার চিন্তা জাগে। এর মধ্য থেকে যে কারণটিকেই আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে তা অবশ্যই মহামূর্খতা বেআদবী ও স্বল্পবুদ্ধিতাই প্রমাণ করবে। (আরো বেশি ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কোরআন, সুরা ইউনুস ৬৬ — ৬৭ — ৬৮ টীকা)
# মূলে ملك শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি বাদশাহী, রাজত্ব, সর্বময় কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের (Sovereignty) অর্থে বলা হয়ে থাকে। এর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহই এ বিশ্ব-জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এবং তাঁর শাসন ক্ষমতায় কারো সামান্যতমও অংশ নেই। একথার স্বতঃস্ফূর্ত ও অনিবার্য ফল এই যে, তাহলে তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। কারণ, মানুষ যাকেই মাবুদে পরিণত করে একথা মনে করেই করে যে, তার কাছে কোন শক্তি আছে যে সে আমাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে এবং আমাদের ভাগ্যের উপর ভালো-মন্দ প্রভাব ফেলতে পারে। শক্তিহীন ও প্রভাবহীন সত্ত্বাদেরকে আশ্রয়স্থল করতে কোন একান্ত নির্বোধ ব্যক্তিও রাজি হতে পারে না। এখন যদি একথা জানা যায় যে, মহান আল্লাহ ছাড়া এ বিশ্ব-জাহানে আর কারো কোন শক্তি নেই তাহলে বিনয়-নম্রতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করার জন্য কোন মাথা তাঁর ছাড়া আর কারো সামনে ঝুঁকবে না, কোন হাতও তাঁর ছাড়া আর কারো সামনে নজরানা পেশ করার জন্য এগিয়ে যাবে না, কোন কণ্ঠও তাঁর ছাড়া আর কারো প্রশংসা গীতি গাইবে না বা কারো কাছে প্রার্থনা করবে না ও ভিক্ষা চাইবে না এবং দুনিয়ার কোন নিরেট মূর্খ ও অজ্ঞ ব্যক্তিও কখনো নিজের প্রকৃত ইলাহ ছাড়া আর কারো আনুগত্য ও বন্দেগী করার মতো বোকামী করবে না অথবা কারো স্বয়ংসম্পূর্ণ শাসনাধিকার মেনে নেবে না। “আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব তাঁরই এবং তাঁরই জন্য” ওপরের এ বাক্যাংশটি থেকে এ বিষয়বস্তুটি আরো বেশী শক্তি অর্জন করে।
# অন্য অনুবাদ এও হতে পারে যে, “প্রত্যেকটি জিনিসকে একটি বিশেষ পরিমাণ অনুযায়ী রেখেছেন।” অথবা প্রত্যেক জিনিসের জন্য যথাযথ পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু যে কোন অনুবাদই করা হোক না কেন তা থেকে পূর্ণ অর্থ প্রকাশ হয় না। এর পূর্ণ অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিসের কেবল অস্তিত্বই দান করেননি বরং তিনিই প্রত্যেকটি জিনিসকে তার সত্তার সাথে সম্পর্কিত আকার-আকৃতি, দেহ সৌষ্ঠব, শক্তি, যোগ্যতা, গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য, কাজ ও কাজের পদ্ধতি, স্থায়িত্বের সময়-কাল, উত্থান ও ক্রমবিকাশের সীমা এবং অন্যান্য যাবতীয় বিস্তারিত বিষয় নির্ধারণ করেছেন। তারপর যেসব কার্য-কারণ, উপায়-উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধার বদৌলতে প্রত্যেকটি জিনিস এখানে নিজ পরিসরে নিজের উপর আরোপিত কাজ করে যাচ্ছে তা বিশ্ব-জগতে তিনিই সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
তাওহীদের সমগ্র শিক্ষা এ একটি আয়াতের মধ্যেই ভরে দেয়া হয়েছে। এটি কুরআন মজীদের সর্বাত্মক তাৎপর্যবহ আয়াতগুলোর মধ্যে একটি মহান মর্যাদাপূর্ণ আয়াত। এর মাত্র কয়েকটি শব্দের মধ্যে এত বিশাল বিষয়বস্তু ভরে দেয়া হয়েছে যে, এর ব্যাপ্তি পরিবেষ্টন করার জন্য পুরোপুরি একটি কিতাব যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে না। হাদীসে বলা হয়েছেঃ كان النبى صلى الله عليه وسلم اذا افصح الغلام من بنى عبد المطلب علمه هذه الاية –
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়ম ছিল, তাঁর বংশের কোন শিশু যখন কথা বলা শুরু করতো তখন তিনি তাকে এ আয়াতটি শিখিয়ে দিতেন।” (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক ও মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ। আমর ইবনে শুআইব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
এ থেকে জানা যায় মানুষের মনে তাওহীদের পুরোপুরি ধারণা বসিয়ে দেবার জন্য এ আয়াতটি একটি উত্তম মাধ্যম। প্রত্যেক মুসলমানের সন্তানের শৈশবে যখন বুদ্ধির প্রাথমিক উন্মেষ ঘটে তখনই তার মন-মগজে শুরুতেই এ নকশাটি বসিয়ে দেয়া উচিত।
# এ শব্দগুলো ব্যাপক ও পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে এবং এ থেকে সব ধরনের মনগড়া মাবুদ ও উপাস্য বুঝায়। আল্লাহর অনেক সৃষ্টিকে মানুষ মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে, যেমন ফেরেশতা, জিন, নবী, আউলিয়া, সূর্য, চাঁদ, গ্রহ-নক্ষত্র, নদ-নদী, গাছ-পালা, পশু ইত্যাদি। আবার মানুষ নিজেই কিছু জিনিস থেকে তৈরী করে তাদেরকে মাবুদ ও উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে, যেমন পাথর, কাঠ ও মাটির তৈরী মূর্তি।
# বক্তব্যের সার নির্যাস হচ্ছে মহান আল্লাহ তাঁর এক বান্দার কাছে প্রকৃত সত্য কি তা দেখিয়ে দেবার জন্য এ ফুরকান নাযিল করেন কিন্তু লোকেরা তা থেকে গাফেল হয়ে এ গোমরাহিতে লিপ্ত হয়েছে। কাজেই সতর্ককারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী করে এক বান্দাকে পাঠানো হয়েছে। তিনি লোকদেরকে এ বোকামির অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করবেন। তাঁর প্রতি পর্যায়ক্রমে এ ফুরকান নাযিল করা শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি হককে বাতিল থেকে এবং আসলকে নকল থেকে আলাদা করে দেখিয়ে দেবেন।
ফি জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সুরা: আল-ফুরকান
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
ফী জিলালিল কুরআন:
সংক্ষিপ্ত আলোচনা : পরম বরকতময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাদের কাছে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী আল কোরআন নাযিল করেছেন… আর তােমার রব তাে সব কিছুই দেখছেন। আলোচ্য সূরাটি সম্পূর্ণভাবে মক্কী। এ সূরাটি রসূল(স.)-এর ওপর নাযিল হয়েছে এক আনন্দ, খুশী ও প্রশান্তির প্রতীক হিসাবে। এমন সময় এ সূরাটি রসূল(স.)-কে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে যখন তিনি কোরায়শ জাতির মধ্যে মােশরেক গােষ্ঠীর মােকাবেলা করছিলেন, মােকাবেলা করছিলেন তার প্রতি তাদের দীর্ঘদিনের হিংসা ও ঘৃণা-বিদ্বেষের। নবুওতপ্রাপ্তির পর থেকেই অবিরতভাবে ওরা রসূলুল্লাহ(স.)-কে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে আসছিলাে, নানা প্রকার তর্ক-বিতর্ক করছিলাে এবং সত্যের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখার জন্যে সর্বোতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাে। এমনই এক কঠিন সময়ে এ সূরাটি তার কাছে এক অনাগত দিনের সুসংবাদ বয়ে আনলাে, তাঁর ব্যথিত হৃদয়ে মধুর পরশ বুলিয়ে দিলাে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তরফ থেকে তাঁর প্রিয়তম বান্দার জন্যে সুসংবাদের এমন ফল্গুধারা নেমে এলাে, যা তার সেই ব্যথা বেদনা ও ক্লান্তির ওপর প্রলেপ হিসাবে কাজ করলো। যখন সত্যবিরােধীদের ঘৃণা-বিদ্বেষ ভেংগে দিচ্ছিলাে তার অন্তরকে, সেই কঠিন সময়ে সূরাটি তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস, নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি করলাে, আর তার মনে এ নিশ্চয়তা জাগালাে যে পর্দার অন্তরাল থেকে আল্লাহ তায়ালা তাকে পরিচালনা করছেন। আবার পরক্ষণেই দেখা যায়, সূরাটি সত্যকে অস্বীকারকারী, সত্য বিরােধী ও অবাধ্য জনগণের সাথে অবশ্যম্ভাবী এক চূড়ান্ত সংগ্রামের পূর্বাভাসও দান করেছে। এরা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের বিরােধিতায় দৃঢ় সংকল্প ছিলাে এবং অত্যন্ত কঠিনভাবে সত্যের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করে চলছিলাে। তারা যুক্তিহীনভাবে সত্য থেকে দূরে সরে থাকছিলাে, তাদের শত্রুতা দীর্ঘায়িত হচ্ছিলাে। আসলে এই বিদ্বেষ পােষণ করে তারা নিজেরাই কষ্ট পাচ্ছিলাে, কারণ যে সত্য তাদেরকে চোখে আংগুল দিয়ে সাফল্যের পথ দেখাচ্ছিলাে তার থেকেই তারা দূরে সরে যাওয়ার জন্যে বদ্ধপরিকর ছিলাে। মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিরােধিতা করতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে সে পাষাণ হৃদয় জনগণ মহাগ্রন্থ আল কোরআন থেকেই ফিরে যাচ্ছিলাে, এরশাদ হচ্ছে, (ওরা বলছিলাে), ‘এটা মনগড়া এক মিথ্যা বৈ আর কিছু নয়, আর তাকে একাজে অন্যরাও সাহায্য করে থাকে… অথবা ওরা বলে প্রাচীন লােকদের কাহিনী লিখে নেয়া হয়েছে, যা সকাল সন্ধ্যা তাকে পড়ে শােনানাে হয়।’ কোরায়শদের কাফেররা সম্মানিত রসূল(স.) সম্পর্কে এ কথাগুলােই বলে থাকে। আরও বলে, ‘তােমরা যাদুর স্পর্শে জ্ঞানহারা এক ব্যক্তির অনুসরণই তাে করছো’… অথবা ওরা মস্করা করে বলে, ‘হায়, এই নাকি সেই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তায়ালা রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন?’… এমনই এক হতভাগা জাতি ওরা যে, এতাে সব বাজে কথা বলেও ওরা ক্ষান্ত হয়নি, ‘বরং আরাে অগ্রসর হয়ে স্বয়ং মহান আল্লাহর দোষ ধরতেও দ্বিধাবােধ করেনি, আর যখন তাদেরকে বলা হয়, সেজদা করাে মহা দয়াময় আল্লাহকে, তখন ওরা বলে, দয়াময় (রহমান) আবার কে? আমরা কি সেজদা করবাে তাকে যাকে তুমি সেজদা করতে বলবে? এভাবে, তারা আরও দূরে সরে যাবে, তাদের থেকে বেশী কিছু ফায়দা হবে না।'(আয়াত ৬০) আর আল্লাহর আয়াত নাযিল হতে দেখে অনেক সময়ে ওরা কষ্ট পায় এবং বলে, আমাদের ওপর কেন ফেরেশতা দল নাযিল হয় না অথবা কেন আমরা আমাদের রবকে দেখতে পাই না?’ আর এটাই হচ্ছে সত্য বিরােধীদের চিরাচরিত নিয়ম। প্রাচীন কাল থেকে পথভ্রষ্ট লােকেরা এইভাবেই বলে এসেছে। নূহ(আ.)-এর সময় থেকে নিয়ে শেষ রসূল পর্যন্ত বরাবর একই নিয়ম দেখা যাচ্ছে। এখানে দেখা যাচ্ছে সে যালেম জাতির আপত্তি হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা একজন মানুষকে কেন রসূল বানাবেন, অর্থাৎ রসূলের দায়িত্ব পালন ও মর্যাদা লাভের জন্যে মানুষ হওয়াটাই তাদের কাছে আপত্তিকর । এজন্যে তারা বলতাে, ‘এ আবার কেমন রসূল, যে খায়-দায় এবং বাজার ঘাটে হেঁটে বেড়ায়? তার কাছে একজন ফেরেশতা কেন নাযিল হয় না যে তার সাথে সতর্ককারী হিসেবে কাজ করতে পারে।’ এরপর তারা মুহাম্মদ(স.)-এর অর্থনৈতিক যােগ্যতা বা সম্পদশালী হওয়া না হওয়ার ব্যাপার নিয়ে প্রশ্ন তুললাে। ওরা বললাে, ‘অথবা তার ওপর যদি প্রচুর ধন সম্পদ বর্ষিত হতাে অথবা যদি তার মালিকানায় এক সুবিশাল বাগিচা থাকতাে, যার থেকে সে (ফলমূল) ভক্ষণ করতো।’ আবার আল কোরআনের অবতীর্ণ হওয়ার পদ্ধতি নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলতাে, বলতাে, ‘কেন (এক কোরআন) একবারেই সবটুকু নাযিল হয় না?’ এসব প্রশ্নের মধ্যে যেসব বে-আদবী নিহিত ছিলাে তা হচ্ছে রসূলুল্লাহ(স.)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা, উপহাস বিদ্রুপ করা। আর এটা তার প্রতি মিথ্যারােপ করা থেকেও ছিলাে গুরুতর। এর অর্থ দাঁড়ায় স্বয়ং আল্লাহর প্রতি দোষারােপ করা । তার ক্ষমতার প্রতি এটা এক চ্যলেঞ্জও বটে! রসূল(স.) ধীরস্থিরভাবে ও পরম দৃঢ়তার সাথে, এসব দুঃসহ পরিস্থিতির মােকাবেলা করে চলেছিলেন যদিও তিনি একা, সহায়-সম্পদহীন, একমাত্র তার রবের ওপরই তিনি নির্ভরশীল, যার কারণে শক্র কর্তৃক নিক্ষিপ্ত এসব হৃদয়বিদারক শেল তাকে আহত করলেও তাকে কখনাে ধরাশায়ী করতে পারেনি, পারেনি তাকে তার রবের প্রিয় কাজ পরিত্যাগ করাতে, বা ভিন্ন কোনাে পথেও তাকে চালিত করতে পারেনি। দেখুন, সে অবস্থায় তিনি তার রবের করুণা প্রার্থী হয়ে তার কাছে কাতর কণ্ঠে দোয়া করছেন, হে আমার রব, তােমার গযব থেকে যদি আমি বেঁচে যেতে পারি, তাই আমার জন্যে যথেষ্ট, এতে যতাে কিছু দুঃখ কষ্ট সইতে হয়- সবই সইবাে। এতে আমার যতাে কষ্টই হােক না কেন, তাতে আমার কোনাে পরওয়া নেই, একমাত্র তােমার করুণা আমি ভিক্ষা চাই, চাই শুধু তােমার সন্তুষ্টি। অতপর, দেখা যাচ্ছে এই সূরাটির মধ্যে তাঁর রব তাকে নিজের কাছে আশ্রয় দিচ্ছেন, তাকে নিজরহমতের ছায়াতলে টেনে নিচ্ছেন আর তার ক্লান্তি ও ব্যথা বেদনাকে মুছে দিচ্ছেন, তিনি তাকে এই চরম দুঃখের মধ্যে সান্তনা দিচ্ছন এবং শত্রুদের সে ঘৃণ্য আচরণ থেকে তার নরকে সরিয়ে নিচ্ছেন। তার জাতি যে বাড়াবাড়ি করে চলেছিলাে এই যে চরম বে-আদবী করে চলছিলাে। তাঁর ও তাঁর সংগী সাথীদের ওপর দিনের পর দিন ও রাতের পর রাত ধরে সেগুলােকে সহজভাবে গ্রহণ করার জন্যে তার মনকে তিনি প্রস্তুত করে দিচ্ছেন। অতি সহজভাবে তিনি এই কথাটাই গ্রহণ করছেন যে, যে হতভাগারা আপন সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতাকেই মানে না, যাকে তারা সৃষ্টিকর্তা বলে জানে, জানে তিনিই সৃষ্টির সব কিছুর নিয়ামক ও পরিচালক, তার ওপরেই যখন তারা বাড়াবাড়ি করে তখন তারা এসব দুর্ব্যবহার করবে- এটা তাে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার! এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা অন্যদের দাসত্ব আনুগত্য করে এবাদাত করে যারা তাদের কোনাে উপকার করতে পারে না এবং কোনাে ক্ষতিও করতে পারে না, আর এমন কাফের ব্যক্তি নিজেকে মনে করে, সেই তার রবের একজন সাহায্যকারী।’… আর ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আরাে এমন অনেককে তাদের এবাদাত পাওয়ার যােগ্য হিসাবে গ্রহণ করে যারা ওদেরকে মৃত্যু দেয়ার মালিক নয় বাঁচিয়ে রাখার মালিকও নয় এবং পুনরায় কবর থেকে তুলতেও তারা পারবে না।… ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, সেজদা কর রহমানকে ওরা বলে, রহমান আবার কে?’ মােহাম্মাদুর রসূল(স.) কোনাে নবাগত বা অপরিচিত ব্যক্তি নন, তিনি তাে তাদেরই মধ্যে লালিত পালিত । তার স্বভাব চরিত্র ও মান সম্মান সবার জানা। এমন মহান ব্যক্তিকে তারা এমন হৃদয়হীনভাবে লাঞ্ছিত করছে, উপহাস-বিদ্রুপ করছে এবং তার সাথে এতাে হিংস্র ব্যবহার করছে, যার প্রতিক্রিয়া তাদের নিজেদের মধ্যেও মাঝে মাঝে দেখা দেয়। সে কঠিন অবস্থার চিত্র যখন সামনে আসে তখন বুঝা যায় যে কী ধংসাত্মক অবস্থার মধ্যে তারা হাবুডুবু খাচ্ছিলাে-গড়াগড়ি দিচ্ছিলাে তারা কী ঘৃণা পংকিলতার মধ্যে! এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি কি চিন্তা করে দেখেছে, যে ব্যক্তি তার কূ-প্রবৃত্তিকে তার মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে, তুমি কি তার অভিভাবক হয়ে যাবে? অথবা তুমি কি মনে করাে যে ওদের মধ্যে অধিকাংশ লােক (সত্যিকারে) শােনে ও তাদের জ্ঞানকে কাজে লাগায়? ওরা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে পশুর মতাে বরং তাদের থেকেও ওরা অধিক নিকৃষ্ট ও সত্য সঠিক পথ পরিহারকারী।’ (আয়াত ৪৩-৪৪) এ হঠকারী ও তাঁকে নিয়ােজিত কাফেরদের যুক্তিহীন ব্যবহারের এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবেন বলে ওয়াদা করছেন, তিনি তাকে জানাচ্ছেন, ‘ওরা তােমার সাথে তর্ক করতে গিয়ে যতাে উদাহরণই পেশ করুক না কেন আমি সত্য বিষয়টি অতি সুন্দর ব্যাখ্যাসহ অবশ্যই তুলে ধরবো'(আয়াত ৩৩) এসব ঝগড়া ও তর্কের কথাগুলাে জানানাের পর অতীতের হঠকারী ও মিথ্যা আরােপকারী অনুরূপ-যুক্তিহীন বচসাকে পেশ করা হচ্ছে, এরা বিভিন্ন যুগে একইভাবে যুক্তিহীনতার সাথে নবীদের সাথে ঝগড়া করেছে। এরা বাস করত মূসা, নূহ, আদ, সামুদ ও কূপবাসী এবং ওদের মধ্যবর্তী সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে। এরপর একের পর এক, তাদের সামনে কেয়ামতের দৃশ্যাবলী তুলে ধরে তাদের ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ(স)-কে অবহিত করা হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘(ওরা হচ্ছে সেসব মানুষ) যাদেরকে মুখের ওপর টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে। এদের সেই বাসস্থানটা হবে বড়ােই নিকৃষ্ট আর প্রকৃতপক্ষে তারাই নিকৃষ্ট পথের পথিক… বরং তারা কেয়ামত সম্পর্কে (রসূলের কথাকে) মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে; ‘আর আমি কেয়ামতকে অস্বীকারকারী ব্যক্তির জন্য (জাহান্নামের) আগুন ঠিক করে রেখে দিয়েছি। এই আগুন যখন দূর থেকে নযরে পড়বে তখন তারা এর তর্জন-গর্জন ও হুংকার শুনতে পারে। আর যখন তাদেরকে সেখানে এক সংকীর্ণ স্থানের মধ্যে হাত পা বাঁধা অবস্থায় নিক্ষেপ করা হবে, তখন তারা সেই ধ্বংসকারী মৃত্যুকে ডাকতে থাকবে। (কিন্তু বলা হবে) এক ধ্বংস (মৃত্যু) কে ডেকো না আজ, (অর্থাৎ আজ এক মৃত্যুজ্বালাকে ডেকো না) অনেক অনেক মৃত্যু জ্বালাকে ডাকো।’ সেদিন (প্রত্যেক) যালেম ব্যক্তি নিজের হাত কামড়াতে কামড়াতে বলবে, হায় আফসােস, আমি যদি রসুলের পথ ধরতাম! হায়রে দুর্ভাগ্য আমার! যদি গ্রহণ না করতাম অমুক ব্যক্তিকে আমার বন্ধুরূপে তাহলে কতই না ভালাে হতাে…'(আয়াত ২৭-২৮) এ পর্যায়ে এসে আল্লাহ রব্বুল আলামীন রসূলে করীম(স.)-কে সান্তনা দিতে গিয়ে বলছেন, আর তােমার পূর্বে আমি যে রাসূল পাঠিয়েছি তারা (সবাই) খাদ্য খাবার খেতো এবং বাজার-ঘাটে চলাফেরা করতাে’…(আয়াত ২০) আর এমনি করেই আমি অপরাধী লােকদের মধ্য থেকে প্রত্যেক নবীর জন্যে কোনাে না কোনাে শত্রু বানিয়ে দিয়েছি, তােমার জন্যে তােমার রবই পথ প্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে যথেষ্ট। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর রসূলকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তিনি দৃঢ়তার সাথে সবর করেন এবং অপরকেও সবর করার জন্যে উৎসাহিত করেন এবং তার কাছে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের যে জ্ঞান-ভান্ডার রয়েছে তা দিয়েই যেন তিনি কাফেরদের মােকাবেলা করেন, কেননা এ পাক কালাম যথেষ্ট পরিমাণ মযবুত যুক্তি-প্রমাণ সহ সত্যের পক্ষে কথা বলেছে, যা হৃদয়ের অভ্যন্তরে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব, কাফেরদের অনুসরণ করাে না এবং তাদের সাথে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হও।’ এখানে বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে যে, ৬৮-৭০নং আয়াত ছাড়া সূরাটির বাকী অংশ অবতীর্ণ হয়েছে যখন মুসলমানদের হাতে কোনাে বস্তুগত শক্তি ক্ষমতা ছিলাে না। তাদের ওপর আক্রমণকে প্রতিহত করার কোনাে উপায়ও ছিলাে না। এতদসত্তেও আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন, তিনি যেন তাঁর মালিক পরওয়ারদেগারের ওপর ভরসা করে সত্যের ওপর টিকে থাকার জন্যে এবং অপরকেও সত্যের দিকে আহ্বান জানানাের জন্যে চরম প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। বিরােধিতা, কষ্ট, অপমান অবমাননা উপহাস বিদ্রুপ যাই আসুক না কেন তাতে যেন তিনি দমে না যান এবং তার দায়িত্ব পালনে কোনাে সময়ে যেন তিনি বিরত না হন, বরং অবিরাম গতিতে তার মিশনকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা জারি রাখেন। এর প্রতিক্রিয়ার কোনাে পরওয়া না করে, একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করেই যেন তিনি তার দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হতে থাকেন। একবার যে কদম সামনে বেড়েছে তা যেন আর কখনাে পিছিয়ে না যায়। দেখুন, কী বলিষ্ঠ আল্লাহর নির্দেশ, ভরসা করাে সেই চিরঞ্জীব সত্ত্বার ওপর, যিনি কখনাে মৃত্যুবরণ করবেন না এবং তার প্রশংসা ও কৃতিত্ব বর্ণনার সাথে সাথে ঘোষণা করে যে তিনি সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতার উর্ধে, তিনি অবশ্যই তার বান্দাদের সম্পর্কে খবর রাখার জন্যে যথেষ্ট। এভাবে সূরাটির বর্ণনা এগিয়ে চলেছে। এ বর্ণনা ধারাতে কোনাে সময়ে দেখা যাচ্ছে রসূল(স.)-এর প্রতি তাঁর মহব্বত ও স্নেহের ঝর্ণাধারা বিগলিত ধারায় ঝরছে, কখনাে তাকে আনন্দ দান করা হচ্ছে, কখনাে তার প্রতি দয়া সহানুভূতি প্রদর্শন করা হচ্ছে, আবার কখনাে বা দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার শক্তি-ক্ষমতা প্রদর্শন করে তাঁর রসূলের অন্তরে শক্তির সঞ্চার করছেন। আবার কোনাে কোনাে আয়াতে দেখা যাচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে নিজ শক্তি ক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার মিশনকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে উৎসাহিত করছেন। বাঞ্ছিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে কাফের-মােশরেকদের পক্ষ থেকে আসা সর্বপ্রকার দুঃখ-কষ্ট আরাে কিছু দিন সয়ে যাওয়ার জন্যে তাঁকে উজ্জীবিত করছেন। সাথে সাথে সুস্পষ্টভাবে তাকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে সত্য বিরােধী চক্রের ধ্বংস অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী, যেহেতু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের হাতেই নিবদ্ধ রয়েছে সকল শক্তি ক্ষমতার লাগাম। এ লাগামাকে তিনি এজন্যেই একটু ঢিল দিয়ে রেখেছেন যাতে শত্রুপক্ষ দৌরাত্মের চরম সীমায় পৌছে যায়, তারপরই যখন তাদের তিনি পাকড়াও করবেন তখন সেই পাকড়াও থেকে বাঁচার আর কোনাে উপায়ই আর তাদের থাকবে না, পাশাপাশি মেহেরবান মালিক তাদের অন্তরে তাঁর আদব মহব্বতের মধুর পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন যারা তাঁর দয়ার ভিখারী হয়ে তারই হুকুম মেনে চলেছে। সর্বপ্রকার প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যারা আল্লাহ তায়ালার প্রেমের সুরভিত বায়ুর খুশবুতে মাতােয়ারা হয়ে গেছে, যারা চিরন্তন সুন্দর জীবনের সুসংবাদে সকল দুঃখ জ্বালা ভুলে গেছে, যাদের অন্তর জান্নাতের সুনিশ্চিত আশ্বাসে নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে, যারা দুঃসহ নির্যাতনের মাঝেও সত্য পথকে আঁকড়ে ধরে থাকার পরম প্রশান্তি লাভ করেছে। এই কথাটাই অনুরণিত হচ্ছে আল্লাহর উচ্চারিত আদরের ভাষায়, ‘এবাদুর রহমান মহা দয়াময়, যার রহমতের বারি ধারা সকল মানবকুলের ওপর ঝরে পড়ে- সেই প্রেমময়ের একান্ত ভক্ত অনুগত তারা’- তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা পৃথিবীর বুকে বিনয়াবনতভাবে চলাফেরা করে। আর যখন তাদেরকে হঠকারী জাহেল ব্যক্তিরা যুক্তিহীন কথা বলে সম্বােধন করে তখন তারা (রুষ্টভাব না দেখিয়ে এবং কর্কশ জওয়াব না দিয়ে বলে ‘সালাম’ (অর্থাৎ শান্তিতে থাকুন, কল্যাণ হােক আপনাদের)…’ একথা দ্বারা সে সব পাষাণ হৃদয় মূৰ্খ নাদানের দলের সাথে সংষর্ষ বাধানােকে এড়িয়ে চলা বুঝানাে হয়েছে, যারা জেনে-বুঝেই ভুল পথ গ্রহণ করে নিজেদের জীবনকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অপরদিকে এই সত্যপন্থী দল যেন মানব কুলের কাঁটাভরা গাছে ফুটে ওঠা সেই সুন্দর সমধুর ফল যার মধ্যে জীবনের সুরভিত সুমিষ্ট স্বাদ নিহিত রয়েছে, যার রূপ-রস-গন্ধ অত্যাচারিত অবহেলিত মানবতাকে শান্তি ও কল্যাণের ইংগিত দিচ্ছে। সূরাটি শেষ হচ্ছে সে সুন্দর মনােরম মানব গােষ্ঠীর ছবি তুলে ধরে, যারা আল্লাহর সামনে বিনম্র-ভদ্র, বিনয়াবনত সর্বপ্রকার অহংকার বর্জিত। কেন মােমেনদের হৃদয়গুলাে তার কাছে কাতর প্রার্থনা করবে না, কেন ডাকবে না তারা তাকে বিনয়ের সাথে! তারা যে আল্লাহর মহব্বতের পরশ পেয়ে গেছে। এদের বাইরে যারা অহংকারী হঠকারী গােষ্ঠী রয়েছে তাদের জন্যে উচ্চারিত হচ্ছে, বলে দাও (তাদেরকে হে রাসূল) আমার রব এতােটুকু পরওয়া করবেন না তােমাদের, যদি তােমরা তাকে না ডাকো। তােমরা সত্যকে অস্বীকার করেছ এবং মিথ্যাবাদী সাজিয়েছ (মহান নবীকে) সুতরাং তােমাদের জন্যে আশু আযাব অনিবার্য হয়ে গেছে।’ ওপরে আলােচিত কথাগুলােই হচ্ছে এ সূরাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সূরাটির বাকি কথাগুলাে ও অন্যান্য কিছু বিষয় আবর্তিত হয়েছে। আলােচিত বিষয়গুলাে একটি আর একটির সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত, যেগুলাের একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা বেশ কঠিন, তবে বিষয়গুলােকে মােট চারটি অধ্যায় ভাগ করা যায়। প্রথম অধ্যায়টি শুরু হচ্ছে একথার সাথে যে, আল্লাহ তায়ালা তার পরম প্রিয় বান্দার কাছে এই পাক কালাম আল কোরআনকে নাযিল করেছেন যাতে করে এই গ্রন্থ নিয়ে তিনি সারাবিশ্বের জন্যে সতর্ককারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, আর এই নেয়ামত লাভের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি যেন আল্লাহর পবিত্রতা ঘােষণা করেন ও আজীবন তার কৃতিত্ব বর্ণনা করতে থাকেন। তাঁকে আরাে জানানাে হচ্ছে যে, তার মূল দায়িত্ব হচ্ছে, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মালিক, একমাত্র তারই প্রভুত্ব কর্তৃত্ব সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা, সবাইকে এ বিষয়ে অবহিত করা যে তিনিই সব কিছুর মালিক, তার নিজস্ব প্রজ্ঞা ও শক্তি ক্ষমতা বলে তিনি সব কিছু পরিচালনা করছেন ও সব কিছুর ব্যবস্থাপনা আনজাম দিচ্ছেন। এসব কাজ করতে গিয়ে তাকে কারাে ওপর নির্ভর করতে হয় না বা কারাে সাহায্যও নিতে হয় না, আর এজন্যেই তাঁর কোনাে সন্তানাদি বা কোনাে অংশীদারের প্রয়ােজন নেই। তারপর উল্লেখ করা হচ্ছে যে এতদসত্তেও মােশরেকরা এমন আরাে অনেককে মাবুদ বানায়, যারা কোনাে কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট জীব। রসূল(স.) আল্লাহর কাছ থেকে যে বাণী বহন করে এনেছেন সে কথা তাে ওরা অস্বীকার করেই, উপরন্তু ওরা আরাে দাবী করে বলে যে, তিনি নিজে এসব মনগড়া কথা নিজ থেকে তৈরী করে বলেন, আরা বলে যে এগুলাে হচ্ছে সব প্রাচীনকালের কাহিনী, যা তিনি নিজে লিখিয়ে নিয়েছেন। তারা এসব কথাও দাবী করে বলে যে তিনি সাধারণ একজন মানুষ হয়ে রসূল হন কেমন করে? তিনি তাে সাধারণ মানুষেরই মতাে খানা পিনা করেন, বাজার ঘাটে চলাফেরা করেন। তারা আল্লাহর সমালােচনা করে একথাও বলে যে, আল্লাহ তায়ালা রাসূল যদি পাঠান, তাহলে কোনাে ফেরেশতাকে কেন রসূল বানিয়ে পাঠালেন না? আর মানুষকে যদি রসূল বানানাে প্রয়ােজন হয়েছিলাে তাহলে তাকে প্রচুর ধন সম্পদ দিয়ে সবার ওপর তাকে প্রভাবশালী কেন বানালেন না অথবা তাকে অসহায় দরিদ্র না বানিয়ে এমন কোনাে ভালাে বাগিচার মালিক কেন বানালেন না যার ফলমূল সে তৃপ্তির সাথে খেতে পারতাে। এরপর দেখুন, তার কুসুম কোমল নির্মল চরিত্রের পর দোষারােপ করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, তিনি যাদুগ্রস্থ এক ব্যক্তি… আসলে এ কথার দ্বারা আল্লাহর ক্ষমতাকেই অস্বীকার করা হচ্ছে, আর এই কারণে রসূল(স.)-কেও অপমান করা হচ্ছে… এভাবে তারা সঠিক পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে এবং অন্যদিকে আখেরাতকেও অস্বীকার করা হচ্ছে, অতপর এসব কিছুর পরিণতিতে আল্লাহ তায়ালা তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন বলে ওয়াদা করছেন- সে স্থানটা হবে অত্যন্ত সংকীর্ণ যেখানে তাদেরকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় নিক্ষেপ করা হবে। এর পাশাপাশি চিত্র আঁকা হচ্ছে জান্নাতবাসী মােমেনদের ‘সেখানে তাদের জন্যে রয়েছে তাই যা তাদের অন্তর চাইবে, চিরন্তন হবে সে জীবন। হাশরের দিনের সেই দৃশ্য সদা-সর্বদা মােমেনদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে এবং অতীতে আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য যাদের বন্দেগী তারা করতে তাদের করুণ অবস্থাও যেন তাদের চোখের সামনে তারা দেখতে থাকে। অন্যদিকে আল্লাহর সাথে অন্য কারাে কাছে সাহায্য চাওয়ার মাধ্যমে মােশরেকরা যে শিরক করে আর এ কারণে তারা রসূল(স.)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে… এ পর্যায়ে রসূল(স.)-কে সান্তনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন যে, সকল রাসূলের অবস্থা একই ছিলাে, তারাও খাওয়া দাওয়া করতো ও বাজারে চলাফেরা করতাে, তাদের সাথেও এই একই প্রকার দুর্ব্যবহার করা হতাে। অতপর রসূল(স.)-কে এসব কথা বলে সান্ত্বনা দান শেষে এ অধ্যায়টি শেষ করা হচ্ছে। এরপর শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় অধ্যায়, যার মধ্যে বর্ণনা এসেছে সে সব ব্যক্তির, যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের প্রশ্নে রাসূল(স.)-এর কথাকে প্রত্যাখ্যান করতাে। তাদের কথাকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলা হচ্ছে তারা বলতাে, ‘কেন নাযিল করা হয় না আমাদের ওপর ফেরেশতা অথবা কেন আমরা আমাদের রবকে দেখি না?’ অর্থাৎ, যেদিন তারা ফেরেশতাদেরকে দেখতে থাকবে সেই দিনের দৃশ্য তাদের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে… আর সে দিনটা কাফেরদের জন্যে বড়ই কঠিন হবে… সেদিন প্রত্যেক যালেম ব্যক্তি (দুঃখের চোটে) নিজ নিজ হাত কামড়াতে থাকবে, বলবে, হায় আফসােস, যদি আমি রসূলের সাথে পথ ধরতাম তাহলে কতােই না ভালাে হতাে। সেদিন রাসূল(স.)-এর পথে না আসার কারণে তাদের বড়ােই আফসােস হতে থাকবে, যেহেতু কোরআনকে তারা পরিত্যাগ করেছিলাে, আর সেদিন, তাদের এই সত্য বিরােধিতা ও কোরআন পরিত্যাগ করার কারণে রসূল(স.) তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে নালিশ দায়ের করবেন। দেখুন, তাদের ধৃষ্ঠতা কত দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিলাে যে, তারা কোরআন নাযিলের পদ্ধতি সম্পর্কেও আল্লাহর ওপর প্রশ্ন তুলছিলাে এবং বলছিলাে, কেন তার ওপর সমগ্র কোরআন একযােগে নাযিল হয়নি তাদের এই বেয়াদবীপূর্ণ প্রশ্ন তােলার কারণে কেয়ামতের দিন তাদেরকে এই শাস্তি দেয়া হবে যে, তাদেরকে মুখের ওপর টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে, অথচ আজকে তারা সেই রােয কেয়ামতকেই অস্বীকার করছে। উপরন্তু, তাদের সামনে তাদের পূর্বেকার জাতি নূহ, আদ, সামুদ কূপবাসী এবং আরাে বহু জাতির ভীষণ শাস্তির দৃশ্য ছবির মতাে তুলে ধরা হচ্ছে। একথাও কি সত্য নয় যে তারা গযবপ্রাপ্ত লূত জাতির ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে যখন অতিক্রম করে তখন তারা নিজেরাই বিস্ময় প্রকাশ করে, কিন্তু তবুও তারা শিক্ষা নেয় না। কিন্তু রসূল(স.)-এর ওপর তারা যে বাড়াবাড়ি করছিলাে তার জন্যে তারা নিজেদের অজান্তেই নিজেদের কাছে ছােট হয়ে যাচ্ছিলাে। আবারও দেখুন, আল্লাহর কাজের ওপর তারা বিস্ময় প্রকাশ করছে বলছে, এই ব্যক্তিটাকেই কি আল্লাহ তায়ালা রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন? তারপর তাদের এই বিদ্রুপাত্মক ব্যবহারের কারণে তারা কতাে হীন অবস্থাপ্রাপ্ত হয় তা জানাতে গিয়ে বলা হচ্ছে, তারা নিকৃষ্ট পশুর মতাে, বরং তাদের থেকেও আরাে বেশী নিকৃষ্ট প্রাণী। আল কোরআন এর ভাষায় তাদের চিত্র আকতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ’ওরা অবিকল পশুরই মতাে, বরং ভুল পথে চলার দিক দিয়ে তারা পশু থেকেও খারাপ।’ এরপর আসছে তৃতীয় অধ্যায়ের আলােচনা, গােটা বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে পরিব্যাপ্ত আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ক্ষমতার বিবরণ দিতে গিয়ে এ আলােচনা এগিয়ে চলেছে। তারপরই পাঠকের দৃষ্টি ফেরানাে হলে পর্যায়ক্রমে রাত দিনের আনাগােনার দিকে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে প্রাণ সঞ্চারকারী পানিবাহী সুশীতল নির্মল বায়ুর সুসংবাদের দিকে, চিন্তা করতে বলা হচ্ছে যে এই তুচ্ছ পানি থেকেই তাে মানুষের সৃষ্টি… আর এতদসত্তেও তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব কিছু বন্দেগী করছে, যা তাদের কোনাে উপকার করতে পারে না- বা তাদের কোনা ক্ষতিও করতে পারে না। আর এরপর তারা তাদের রব ও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ওপর তাদের প্রাধান্য বিস্তারের প্রগলভতাও দেখাচ্ছে, আর যখন তাদেরকে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর এবাদাত করার জন্যে আহ্বান জানানাে হচ্ছে, তখন তারা নানা প্রকার ওযর আপত্তি দেখাচ্ছে… এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, সেজদা করাে রহমানকে, তখন তারা বলে, রহমান আবার কে?…’ ‘আর তিনিই তাে সেই সত্ত্বা, যিনি আকাশের মধ্যে নিরাপত্তাপূর্ণ স্তরসমূহ বানিয়েছেন এবং তার মধ্যে বাতি ও উজ্জ্বল চাঁদ বানিয়েছেন। তিনিই তাে রাত ও দিনকে বানিয়েছেন- একের পেছনে অপরকে আগমনরত অবস্থায়। যে কোনো ব্যক্তি এর থেকে শিক্ষা নিতে চাইবে এবং যে চাইবে শােকগােযারি করতে অবশ্যই সে এর থেকে সর্ব প্রকার শিক্ষা পাবে।’ কিন্তু হায়, দুঃখ তাদের জন্যে তারা এর থেকে কোনো প্রকার শিক্ষা না নেয়, না তারা কোনাে শােকরগগাযারি করে। এরপর আসছে তৃতীয় অধ্যায়টি, যার মধ্য ‘দয়াময় আল্লাহর বান্দাদের চিত্র আঁকা হয়েছে, যারা তাকে সেজদা করে এবং একমাত্র তারই দাসত্ব করে এবং তারা তাদের সেই অবস্থানগুলাে নির্ণয় করে যা তারা তাদের মহৎ গুণাবলী দ্বারা অর্জন করেছে, তিনি সেসব লােকের জন্যে তাওবার দরজা খুলে দিয়েছেন যারা প্রকৃতপক্ষে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং পরম করুণাময়। আল্লাহর পথে চলতে শুরু করে, আর পাশাপাশি সেই নেককার ব্যক্তিদের পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করেছেন যারা ঈমান আকীদার ওপর মযবুতভাবে টিকে থাকার জন্যে সংকল্প গ্রহণ করে এবং সর্বাবস্থায় চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখায়। এদের সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে, এরাই হচ্ছে সেসব ব্যক্তি, যাদের সবর এখতিয়ার করার কারণে তাদেরকে জান্নাতের সুসজ্জিত ও সুরভিত কক্ষ দান করা হবে এবং সেখানে তাদের সাথে অভিভাদন ও সালাম সহকারে সাক্ষাত করা হবে। এই কথা দ্বারা সূরাটির সমাপ্তি টানা হচ্ছে যে, যে যাই হােক না কেন, আল্লাহর সামনে মানুষ অতি তুচ্ছ ও অতি ছােট, অতএব তার সামনে সদা-সর্বদা মানুষের বিনয়াবনত থাকা উচিত। মানুষের অন্তর যদি অনুগত না হয়, আল্লাহর ডাকে সাড়া না দেয় এবং আল্লাহকে যদি সে না চেনে তাহলে এসব অস্বীকারকারী মানুষ জীব জানােয়ারের মতােই জীবনের কঠিন পথে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াবে এবং নিজেকে সে চরম অধপতনের দিকে নামিয়ে দেবে। আল্লাহর পথ থেকে সরে যাওয়ার কারণে মানুষ কতাে নীচে নামতে পারে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় রসূল(স.)-এর সাথে তাদের ব্যবহারে। এতাে নিষ্ঠুর ব্যবহার তারা কিভাবে করতে পারে তার কিছু কারণ এ সূরাটির মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, সূরাটির মূল আলােচ্য বিষয় কি লক্ষ্যই বা কি তা জানানাে হয়েছে এবং এ আলােচনার ধারা এমনই মনােজ্ঞ ও চমকপ্রদ যা আমাদেরকে আল কোরআনের এক অনবদ্য বর্ণনা ভংগি সম্পর্কে অবহিত করবে। এবারে আমরা প্রথম অধ্যায়টির বিস্তারিত আলােচনা শুরু করছি।
ফী জিলালিল কুরআন:
‘পরম বরকতময় তিনি, যিনি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী এক গ্রন্থ তাঁর বান্দার কাছে নাযিল করেছেন, যাতে করে সে সারা বিশ্বের জন্যে সতর্ককারী হিসাবে কাজ করতে পারে… ওরা মালিক নয় মৃত্যু দান করার, জীবন দানের ক্ষমতাও তাদের নেই, না তারা তাদেরকে আবার জীবিত করে তুলতে পারবে।’ দেখুন, কী চমৎকার প্রাণবন্ত সেই সূরাটির এই শুরুর কথাগুলাে, যা আল কোরআনের মৌলিক সূরাগুলাের অন্যতম। এর আগমন তাে আল্লাহরই পক্ষ থেকে। এখানে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, রেসালাতে মােহাম্মদী সমগ্র মানবমন্ডলীর জন্যে এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের একত্ব ও একচ্ছত্র আধিপত্য নিরংকুশ তা প্রশ্নাতীত, অনবদ্য ও সকল সীমাবদ্ধতার উর্ধে, যেসব কারণে সেরা সৃষ্টজীব মানুষের সম্মান প্রয়ােজন, প্রয়ােজন কোনাে শরীকের- সে সব প্রয়ােজন থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। তার মালিকানা সারা বিশ্বব্যাপী পরিব্যপ্ত, তার যুক্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা সবখানে বিরাজিত এবং সব কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত ও পূর্ব নির্ধারিত। হায়, এসব কিছু (বুঝা সত্তেও) মােশরেকরা শিরক করে, মিথ্যা নির্মাণকারীরা অলীক কল্পনার জাল বুনে কুট তর্কে লিপ্ত হয়, আত্মগর্বী তার্কিকরা এবং অপরিণামদর্শী বলদর্পী অহংকারীরা মনে করে তারা আছে চিরদিন, আর থাকবেও বুঝি চিরদিন। একথাগুলাে জানাতে গিয়েই আল্লাহ তায়ালা এ বাণী উচ্চারণ করছেন। *সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী আল কোরআন : মহা কল্যাণময় সত্ত্বা তিনি যিনি নাযিল করেছেন হক ও বাতইলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। (এ কিতাব) তার এক বান্দার ওপর যেন (এ গ্রন্থ) মানুষের সামনে অবতীর্ণ হয় এক সতর্ককারীর ভূমিকায়। ‘তাবারাকা’ শব্দটি ‘তাফায়ালার’ ধাতুগত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ পারস্পরিকভাবে বরকত (বা অযাচিত ও অচিন্তনীয় কল্যাণ) বিনিময় করা। এ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর মেহেরবানী, তাঁর করুণা, তার দান ও তার পক্ষ থেকে সম্মান বৃদ্ধি এসব কিছু সম্পর্কেই জানাচ্ছেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের বড়ত্ব-মহত্ব ও মর্যাদার কথা উল্লেখ করেননি, বরং তার উপরােল্লিখিত গুণটির দিকে ইংগিত দিতে গিয়ে বলছেন, ‘যিনি নাযিল করেছেন ফোরকান (সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী) যাতে করে পৃথিবীর এ স্থানের সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় এবং সুস্পষ্টভাবে তার গুণাবলী প্রকাশিত হয়, কারণ সূরার আলােচ্য বিষয়টি হচ্ছে রেসালাতের সত্যতা ও আল কোরআনের বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তায়ালা সূরাটির নাম দিয়েছেন ‘আল ফোরকান’ কেননা এর মধ্যে হক ও বাতিল এর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী যুক্তিসমূহ রয়েছে, জীবন ধারণের সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে এবং ভুল ও অকল্যাণকর সব কিছুকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে, বরং আরাে স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে এ পাক কালাম আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান ও অন্যান্য সকল বিধানের মাঝে পার্থক্য দেখিয়েছে এবং মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্যে করা চুক্তি ও অন্যান্য চুক্তির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছে। অতপর আল কোরআন গোটা জীবনের সব কিছুর জন্যে স্থায়ী এক বিধান ও কর্মসূচী পেশ করেছে এবং এমন যুক্তিপূর্ণ ভাষায় এর বর্ণনা এসেছে যা হৃদয় মনকে বিগলিত করে এবং মানুষের সাধারণ বিবেক বুদ্ধিকে আকর্ষণ করে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী উল্লেখ করে ইসলামী ব্যবস্থার বাস্তবতা এমন জীবন্ত করে তােলা হয়েছে যে সত্যকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করার পর মানব মন পরম পুলকে ভরে ওঠে, তখন কোনাে জাতির সামনে এক নবযুগের সূচনা হয় যে জাতি নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ত ক্ষেত্রে এর যৌক্তিকতা ও সৌন্দর্যের, স্বাদ পায়নি সে জাতি অনুভব করে, যে এ অপূর্ব জীবন বিধান হচ্ছে তুলনাহীন, যার অভিজ্ঞতা অনেক দিন ধরে মানবকুল লাভ করেনি। অতএব, এ পবিত্র কিতাব সর্বব্যাপক ও বিরাট অর্থেই ফোরকান। যে ব্যক্তি সবেমাত্র শিশুকাল পার হয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছে এবং এ পাক কালামের সংস্পর্শে এসেছে, সে যেমন এ কিতাবকে ‘ফোরকান’ রূপে দেখেছে, একইভাবে সেই ব্যক্তির সামনেও কোরআন নামক মহাগ্রন্থ ফোরকান হয়ে হাযির হয়েছে যে, এ কিতাবের অত্যাশ্চর্য ও অলৌকিক বস্তুশক্তির কারিশমা দেখে এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন করতে করতে মনন্তাত্তিক দিক দিয়েও সে এতােটা বেশী উন্নতি লাভ করেছে সে যেন রিসালাতের স্তরের কাছাকাছি পৌছে গেছে, আর এ সময়ই আগমন ঘটেছে শেষ নবী মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর ! যাকে অনাগত সকল মানব জাতির জন্যেই রসূল বানিয়ে পাঠানাে হয়েছে। তার সম্পর্কেই বলা হয়েছে, ‘যেন সে বিশ্বজগতের সবার জন্যে সতর্ককারী হয়।’ অর্থাৎ সতর্ককারীর দায়িত্ব পালন করে। *মানুষের মাঝ থেকে নবী রাসুল নির্বাচন : এরপর রসূলুল্লাহ(স.)-এর মান মর্যাদা ও মানবমন্ডলীর মধ্যে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলা হচ্ছে যে, তিনি আল্লাহর বান্দা (অনুগত দাস), এজন্যে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আলা আবদেহী’ অর্থাৎ তার বান্দার প্রতি… একইভাবে তার সম্পর্কে মেরাজ উপলক্ষেও (এই শব্দটি) ‘আবদেহী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা আমরা সূরায়ে ‘আল ইসরাতে’ দেখতে পাই। সূরায়ে জ্বিনের মধ্যে এভাবে তার দোয়ার মধ্য ব্যবহৃত হয়েছে অ আন্নাহু লাম্মা কামা আবদুল্লাহ (আর যখন তাঁর বান্দা তার কাছে দোয়া করার জন্যে উঠে দাঁড়ালাে)- মূলত যে পরিবেশ পরিস্থিতিতে সূরায়ে কাহাফ এর প্রথম অধ্যায়টি নাযিল হয়েছে, সেই একই পরিবেশে সুরায়ে আল ফোরকান নাযিল হয়েছে। সূরায়ে কাহাফ এর শুরুতে নাযিল হয়েছে, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তার বান্দার কাছে কিতাব নাযিল করেছেন এবং এর মধ্যে কোনাে বক্রতা বানাননি।’ আর রসূলুল্লাহ(স.)-এর ‘উবুদিয়াৎ’ বা দাসত্বের যে গুণটি বিভিন্ন সূরার মধ্যে উল্লিখিত হয়েছেই সেই গুণটিই তাকে মহীয়ান করেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যতাে গুণের অধিকারীই হােক না কেন এবং মানুষকে মর্যাদার যতাে শিখরেই তোলা হােকনা কেন এই গুণটিই তার জন্যে সব থেকে গৌরবের, কারণ এর মধ্যে প্রত্যেকের জন্যে এক গােপন স্মরণিকা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা অতি সংগােপনে উক্ত কথার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, হে আমার প্রিয় বান্দা, সাধারণ মানুষের স্তর থেকে তুলে এনে আমি তােমাকে আমার বৈশিষ্ট্য পূর্ণ বান্দাদের সারিতে স্থান দিলাম। এভাবে এরা বিশ্বসমূহের অধিপতি, সকল শক্তিক্ষমতার মালিকের খাস লােক তার সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেলাে। এদের ওপর মর্যাদাবান শুধু আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ নয়, তিনি একচ্ছত্র অধিপতি এবং তাঁর রসূলরা তার সর্বপ্রধান কর্মকর্তা। তাঁর সমকক্ষ বা তার সাহায্যকারী কেউ নেই। তিনি ছাড়া আর কেউই নেই, তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ারও কারাে কোনাে প্রয়ােজন নেই। যা কিছু করার তিনি একাই করেন, তার হয়ে অন্য কারাে কিছু করার নেই, কোনাে অধিকার কারােই নেই, এজন্যে সার্বভৌমত্ব বলতে যা কিছু বুঝায় সবই তাঁর। এ কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা কারাে নেই। এই উদাহরণটাই পেশ করা হয়েছে ইসরা কিংবা মে’রাজের ঘটনার মধ্যে, অথবা দোয়া-মােনাজাত বা ওহী এলহাম এর ঘটনার মধ্যে। এসব প্রসংগে সূরা ইসরায় কী চমৎকারভাবে বলা হয়েছে, মহা মহাপবিত্র সেই সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে নিয়ে গেলেন। এসব কথা ভালােভাবে না বুঝায় বা রসূল(স.)-এর শিক্ষার দিকে যথাযথভাবে মনোযােগ না দেয়ার কারণে ইতিপূর্বে অনেক রসূলের মর্যাদা হানি হয়েছে, তারা নিজ নিজ যামানার রসূলদেরকে বান্দার স্তর থেকে ওপরে তুলতে গিয়ে আল্লাহর ছেলেই মনে করে নিয়েছে অথবা সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বা সর্বশক্তিমান সত্ত্বা যিনি, তাঁর সাথে অন্য সৃষ্টজীবের মৌলিক পার্থক্যটার দিকে তারা নযর দিতে পারেনি। এজন্যেই আল কোরআন এখানে আল্লাহর রসুলদের উবুদিয়্যাত বা দাসত্ব নামক এই গুণটির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে এবং জানিয়েছে যে, এই গুণের কারণেই রাসূল আল্লাহর সাম্রাজ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। এরপর ফোরকান নামক এই সূরাটি নাযিল হওয়ার লক্ষ্য নির্মিত হচ্ছে, যেন এ সূরা গােটা বিশ্বের জন্যে সতর্ককারী হয়…’ লক্ষ্য করুন, এ সূরাটি হচ্ছে মক্কী। মক্কায় দাওয়াত পেশ করার একেবারে প্রথম দিককার দিনগুলাে থেকে নিয়েই আল্লাহর এ কালামটির লক্ষ্য স্থির করে দেয়া হয়েছে, আর তা হচ্ছে রসূলুল্লাহ(স)-এর আনীত বিশ্বজনীন দাওয়াতকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া। কোনাে কোনাে অমুসলিম ঐতিহাসিকের মতে এ দাওয়াত বিশেষ এক দেশের জন্যে এসেছে; কিন্তু উপর্যুপরি বিজয়ের কারণে এ দাওয়াত ক্রমান্বয়ে বিশ্বজনীন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের দাবী করা মােটেই ঠিক নয়, বরং সারাবিশ্বের সকল মানুষের জন্যেই এসেছে এ দাওয়াত, সবাইকে লক্ষ্য করেই আল কোরআন কথা বলেছে এবং সবাইকে ডেকেছে হেদায়াতের এই সার্বজনীন কল্যাণের পথে। এই কারণেই দেখা যায়, ইসলামী কাফেলা যুগে যুগে ও দেশে দেশে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানিয়েছে। এই ফোরকানের আলােকেই তারা পৃথিবীর সকল বিদগ্ধ জনতার কাছে সত্য মিথ্যার এ পার্থক্য তুলে ধরেছে, যাতে করে সময় থাকতেই তারা সাবধান হতে পারে এবং মিথ্যার আঁধার চিরে প্রকৃত সত্যকে খুঁজে নিতে সক্ষম হয়, এ পবিত্র কালাম যেন তাদের জন্যে সতর্ককারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। হায়, যে দাওয়াত বিশ্বের সব মানুষের জন্যে, আর যে মহা-মানব উদাত্ত কণ্ঠে সারা বিশ্বকে শান্তি সমৃদ্ধির পথে, কল্যাণের পথে আহ্বান জানাচ্ছেন, দেখুন তাকে কি নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে, কতাে হৃদয়হীনভাবে প্রতিহত করা হচ্ছে, চরম হঠকারিতার সাথে তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
ফী জিলালিল কুরআন:
*আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের ভাগ্য লিখন : তাই বিশ্ব সম্রাজ্যের খােদ মালিক অধিপতি সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তাকে বলছেন, ‘বড়ােই বরকতপূর্ণ সেই সত্ত্বা যিনি তাঁর বান্দার কাছে পাঠালেন… আর সৃষ্টি তিনি সব কিছুকে, তারপর সব কিছুর ভাগ্যও তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন।’ আরাে দেখুন, আল্লাহ তায়ালা তার নিজের মর্যাদা ব্যঞ্জক কথাবলীর পরিবর্তে এই পর্যায়ে সকল বস্তুর ওপর তার কর্তৃত্ব ও মালিকানা প্রকাশ করার জন্যে যে গুণটি উল্লেখ করা একান্ত প্রয়ােজন সে মহত গুণটিই এখানে উল্লেখ করছেন, যাতে করে পাঠক পাঠিকা যথাযথ শুরুত্ব সহকারে এ বিষয়ে-চিন্তা করতে পারে । এরশাদ হচ্ছে, “তিনি সেই সত্ত্বা যার বাদশাহী ছড়িয়ে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ব্যাপী…’ অর্থাৎ, আসমান যমীনের সবখানেই রয়েছে তার নিরংকুশ ক্ষমতা, রয়েছে মালিকানার ক্ষমতা, কর্তৃত্ব করার শক্তি সাহস, ব্যয় ও ব্যবস্থা নির্মাণের অধিকার এবং যে কোনাে বিষয়কে পরিবর্তন করার সার্বিক এখতিয়ার একমাত্র তারই রয়েছে। আর তিনি কোনাে সন্তান গ্রহণ করেননি একথা দ্বারা বুঝতে হবে যে, এই যে বিশেষ এক প্রক্রিয়ায় সন্তানাদি হওয়ার ব্যবস্থা এটা তাে শুধু সৃষ্টিটাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়ােজনেই রাখা হয়েছে। আল্লাহর এক নিয়মের সাথে সম্পর্ক কি? যিনি নিজে সকল নিয়মের নিয়ামক তাকে কোনাে নিয়মের গন্ডীর মধ্যে আনতে পারে কে? নিয়ম বানানাে, পরিবর্তন করা না করা, ভাংগা গড়া সবই তাে তার নিজস্ব ব্যাপার, এখানে নাক গলানাের ক্ষমতা আর কারাে থাকতে পারে কি? তিনিই একমাত্র স্থায়ী, আর সবই তাে অস্থায়ী। একমাত্র তিনিই সব কিছু করতে সক্ষম, আর কেউই কিছু করতে পারে না, তিনি কারাে মুখাপেক্ষী নন তাঁর মুখাপেক্ষী সবাই- অন্য সবাই। নিজেদের মধ্যে কারাে না কারাে মুখাপেক্ষী হতেই হয়। তাই বলা হচ্ছে, বাদশাহী বা নিরংকুশ মালিকানা ও কর্তৃত্বে তার কোনাে শরীক নেই, আসমান যমীনের যেখানে যা কিছু আছে, তা সবই একথার সাক্ষী যে তিনি একাই সেই সত্ত্বা, যার সিদ্ধান্তে কোনাে পরিবর্তন নেই, সকল ক্ষমতার মালিক এককভাবে তিনিই এবং সব কিছু ব্যবহারের ব্যাপারেও তার একক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এরশাদ হচ্ছ, তিনি সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন তারপর সব কিছুর তাকদীর (ভবিষ্যত কি হবে তাও) তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন। তিনিই সব কিছুর আকৃতি-প্রকৃতিকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তাদের পেশা ও কাজকে স্থির করে দিয়েছেন তাদের সময় ও স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং এই মহা সৃষ্টির বুকে কার সাথে কি সম্পর্ক প্রয়ােজন তাও তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই মহা বিশ্বের গঠন প্রণালী এবং এর মধ্যস্থিত সব কিছুর আকৃতি প্রকৃতির দিকে তাকালে একেবারেই দিশেহারা হয়ে যেতে হয়, সকল প্রতিরােধ ক্ষমতা বিলুপ্ত হয় এবং কোনাে বুদ্ধিই আর তখন কাজ করতে চায় না। এ সময় মানুষের কাছে ভাগ্য লিখন যে কতাে সত্য এবং কোনাে অবস্থাতেই তাকদীরের সিদ্ধান্ত এড়ানাে যায় না, একথাটি স্পষ্ট হয়ে যায়। মানুষ চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু কিছুতেই সে জোর করে বলতে পারে না যে অমুক সময়ের মধ্যে অবশ্যই সে অমুক কাজটি করবে। সৃষ্টির রহস্য রাজির মধ্যে অবশ্যই এটা একটা বড়াে রহস্য। যতােবেশী মানুষ তার জ্ঞান বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে থাকে ততাে বেশী তার সামনে সৃষ্টি রহস্যের জট একে একে খুলতে থাকে এবং ততাে বেশী সে বুঝতে থাকে যে, সারাবিশ্বের রহস্য রাজির সবগুলাে পরস্পরের সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত যে একটা ছাড়া আর একটার অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না এবং পরিশেষে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, তা হচ্ছে সব কিছু মিলে গােটা সৃষ্টি একই সুরে গাথা এবং সব কিছুর এই একাত্মতা এই কথাই বলে দেয় যে সবার সৃষ্টিকর্তা এক, আর এ সব কিছু আরাে জানায় যে সেই মহান স্রষ্টার বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুসারে সবাইই একই নিয়মে চলতে বাধ্য। *সবকিছুই এখানে পরিমাপ মতাে সৃষ্টি করা হয়েছে : এরপর পাঠকের সামনে একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ কথা আসছে, ‘আর তিনি সব কিছুকে সৃষ্টি করেছেন এক পূর্ব পরিকল্পিত নিয়মে এবং তাদের নিয়তিকেও তিনি স্থির করে দিয়েছেন।’ নিউ ইয়র্কের সায়েন্স একাডেমীর প্রেসিডেন্ট মি. ক্রেসি মরিসন তাঁর ‘ম্যান ডাজ নট লিভ এ্যালােন’ নামক পুস্তকটিতে এমনই মন্তব্য করেন।(পুস্তকটির আরবীতে অনুবাদ করেন মাহমুদ সালেহ আলফালকী এবং নাম করণ করেন, ‘আল এলমু ইয়্যাদউ ইলাল ঈমান’ অর্থাৎ বিজ্ঞান যা ঈমানের দিকে আহবান জানায়) বিশ্ব প্রকৃতির যে বিষয়টি আমাদের বুদ্ধিকে অকেজো করে দেয় তা হচ্ছে, বিশ্বের এই যে বিশাল আকৃতি এর মধ্যে এতাে বেশী রহস্য রয়েছে যার দিকে তাকালে মানুষকে বুদ্ধিহারা হয়ে যেতে হয়, কোনাে কিছুই বুঝা যায় না কারণ পৃথিবীর উপরিভাগের স্তর বা শিলাগুলাে যদি আরাে ৮/৯ ভাগ বেশী পুরু হয়ে যেতাে তাহলে অক্সিজেনের মধ্যে যে কার্বন ডাই অক্সাইড আছে তা পৃথিবীর আর্দ্রতাকে একেবারে শুষে নিতাে। এর ফলে গাছ পালা শাক সজি কোনাে কিছুই এখানে বেঁচে থাকতে পারতাে না। আবার বর্তমানে বাতাস যে অবস্থায় আছে, তার থেকে যদি আরাে বেশী নির্মল হয়ে যেত এবং আজকে যেসব কোটি কোটি অগ্নিশিখা বাতাসের মধ্যেই জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার কোন একটি যদি ভূ-পৃষ্ঠে আঘাত হানতাে তাহলে পৃথিবীর অণু-পরমাণু সব কিছুই জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। সবাই জানে, বিজ্ঞানীদের জ্ঞান গবেষণায় ধরা পড়েছে যে, আলাে প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিতে ছুটে চলে। তার মধ্যে অগ্নিশিখাসমূহের মধ্যে দাহ্য সকল বস্তুকে জ্বালিয়ে দেয়ার মতাে শক্তি নিহিত রয়েছে। এত তীব্র গতিতে আঘাত হানা তাে দূরের কথা, যদি বন্দুকের গুলির তীব্রতা নিয়েও কোনাে কিছু পৃথিবীর বুকে আঘাত হানতাে তাহলেও পৃথিবীর সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেতাে এবং মানব জাতির পরিণতি এতাে ভয়াবহ হতাে যা কেউ কোনােদিন কল্পনাও করতে পারে না। সব থেকে দুর্বল ও কম গতিসম্পন্ন উল্কা পিন্ডটিও যদি মানুষকে আঘাত হানে তাহলে তার গতিও বন্দুকের গুলির গতি থেকে নব্বই গুণ বেশী হবে এবং এই উল্কা পিন্ড বায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার কারণে যে তাপ উৎপন্ন হবে, শুধু সেই তাপেই সব কিছু ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে! কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলেও একথা সত্য যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সৃষ্টি জগতকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সৃষ্টির সকল কিছুর মধ্যে এক অদেখা সম্পর্ক স্থাপন করেছেন যেন তারা সবাই মিলে পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে গােটা সৃষ্টিকে অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। ‘আলােক রশ্মিগুলাে যখন বায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তখন তরল বায়ুকে বা বায়বীয় পদার্থ সমূহকে এক নির্দিষ্ট পরিমাণে ঘনীভূত করতে করতে এগিয়ে যায়। এই ঘর্ষণজনিত ক্রিয়াকে বলা যায় রাসায়নিক ক্রিয়া। চাষ বাস করে গাছ গাছালি উৎপাদন করার জন্যে এই রাসায়নিক প্রভাব বা রাসায়নিক সারের বড়াে প্রয়ােজন। এই রসায়নক্রিয়াই পােকা মাকড় ও বিভিন্ন রােগব্যাধির জীবানু ধ্বংস করতে সহায়তা করে এবং একে মানুষের জন্যে ধ্বংসাত্মক বানানাের পরিবর্তে বৃক্ষ গুল্ম লতাসমূহকে ভিটামিনসমৃদ্ধ ও শক্তিশালী বানায়। তবে এগুলােকে যদি কেউ প্রয়ােজন থেকে বেশী সময় ধরে ব্যবহার করে, তা স্বতন্ত্র কথা, তখন অবশ্যই সেখানে কিছু ক্ষতি হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সারা বছর ধরে পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে গ্যাস বেরিয়ে চলেছে, যার বেশীর ভাগই বিষাক্ত, তা সত্তেও জীব জন্তু মানুষের সেবন ও জীবন ধারণের জন্যে প্রয়ােজনীয় নির্মল বায়ু বর্তমান রয়েছে এবং বাতাস ও বিষাক্ত গ্যাসের সহ অবস্থানের মধ্যে যে ভারসাম্য রয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না। এ বিষয়ে এ পর্যন্ত মানুষের জ্ঞান গবেষণায় যে সত্যটা ধরা পড়েছে, তা হচ্ছে প্রাণী জগতের অস্তিত্বকে টিকেয়ে রাখার জন্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ ব্যাপী জুড়ে থাকা পানির বিশাল মজুদ অর্থাৎ সাগর মহাসাগর, নদী নালা খাল বিল পুকুর ইত্যাদির অস্তিত্ব। এই পানির সরবরাহ থেকেই আসে জীবন ও জীবনের প্রয়ােজনে খাদ্যসম্ভার। ভারসাম্যপূর্ণ আবহাওয়া, গাছ পালা ফসল ও ফল ফলাদিও এ থেকে আসে। সর্বশেষে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে স্বয়ং মানুষ নিজে। পৃথিবীর বুকে এতাে প্রতিকূলতার মধ্যেও এসব কিছু আছে এবং তার ক্রমােন্নতি চলছেই। অন্য এক অধ্যায়ে একই লেখক বলেন, ‘বাতাসের মধ্যে অক্সিজেনের পরিমাণ সাধারণভাবে শতকরা একুশভাগ। এ অনুপাতের পরিবর্তন হয়ে যদি বাতাসে শতকরা পঞ্চাশ বা তার থেকে আরাে কিছু বেশী অক্সিজেন এসে যায় তাহলে পৃথিবীতে দাহ্য যতাে বস্তু আছে তা সবই আগুনের অংগারে পরিণত হয়ে যাবে এবং এতাে প্রচন্ড বেগে তা জ্বলে উঠবে যে, তার একটি স্ফূলিংগের ঝলকানো আলাে কোনাে গাছে পড়লে যে অংগার সৃষ্টি হবে তা সন্নিহিত গােটা বনভূমিকে বিস্ফোরিত করে দেবে। আর বাতাসে অক্সিজেনের অনুপাত যদি শতকরা দশ ভাগে নেমে আসে বা তার থেকেও যদি কমে যায় তাহলে তা এতাে বেশী শীতল হয়ে যাবে যে সৃষ্টিকুলের সবাই প্রকৃতির মধ্যেই নিশেষে বিলীন হয়ে যাবে। উক্ত লেখক তার বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে লিখছেন, কী চমৎকার এই বিশ্ব ব্যবস্থা, যার অধীনে সকল জীবজন্তু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এরা যতােই বড়াে হােক, যতােই ছােট হােক, যতোই হিংস্র যতােই অপ্রিয় হােক- সব কিছু সেই মহা শক্তিধর কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে, যার অধীনে সেই প্রস্তরযুগ থেকে নিয়ে সারাবিশ্বজগত চলছে, কিন্তু আফসােস যে মানুষকে বানানাে হলাে সৃষ্টির সেরা, যাকে ভূষিত করা হলাে জ্ঞান-গরিমা ও স্বাধীনতা-রূপ নেয়ামত দ্বারা, যাকে খেলাফতের মহান মর্যাদা দান করা হলাে, একমাত্র সেই মানুষ বৃক্ষ লতা-পাতা ও জীব জন্তুকে তাদের নিজ নিজ স্থান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যায়, এর মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য তারা নষ্ট করে ফেলে আর এর ফলে তারা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আজ তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছে, জীব জন্তু, কীট পতংগ ও গাছ পালার ওপর নানা প্রকার বিপদ-আপদ নেমে আসছে।’ প্রকৃতির ভারসাম্য এভাবে নষ্ট করে দেয়াতে বাস্তবে মানুষ এর প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে চলেছে। এ সব কিছুর সাথে মানুষের অস্তিত্ব অংগাংগিভাবে জড়িত। বেশ কয়েক বছর থেকে অষ্ট্রেলিয়াতে ভারতীয় ডুমুর জাতীয় এক প্রকার গাছের চাষ করা হচ্ছে। এগুলাে দ্বারা বেশ শক্ত বেড়া বানানাে যায়, কিন্তু এগুলাে আপনা থেকে এতাে বেশী উৎপন্ন হতে শুরু করেছে যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ইংল্যান্ডের মতাে বিশাল এক প্রান্তর ব্যাপী এ গাছ ছেয়ে গেছে এবং এবং গােটা দেশের আবাদী জমির সমান জায়গা এরা দখল করে ফেলেছে, এর ফলে তাদের ফসলের প্রচুর ক্ষতি হতে শুরু করেছে, কিন্তু এ গাছের বৃদ্ধি অযত্ন অবহেলাতে এতাে বেশী এগিয়ে চলেছে যে স্থানীয় অন্য কোনাে গাছ এর সাথে কিছুতেই প্রতিযােগিতা করে পারছে না বা স্থানীয় জনগণ এর প্রসার থামাতেও সক্ষম হচ্ছে না। এর ফলে এর দ্রুত প্রসার গােটা দেশের ফসল উৎপাদনের বিরুদ্ধে এক কঠিন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা অপ্রতিরােধ্য গতিতে এর প্রসার এগিয়ে চলেছে। আবার দেখুন, কীটপতংগ-বিজ্ঞানীরা প্রচন্ড অনুসন্ধিৎসা নিয়ে দেশ বিদেশে ভ্রমণ করতে করতে এমন এক কীটের সন্ধান পেয়েছেন যারা উক্ত ভারতীয় ডুমুর বৃক্ষ বিশেষের ওপরে ছাড়া অন্য কোথাও বেঁচে থাকতে পারে না এবং সে গাছের পাতা ও ফল ছাড়া আর কিছুই তারা খায় না। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ পােকার প্রসার ঘটে এবং আজ সমগ্র অস্ট্রেলিয়ায় এর বৃদ্ধি রোধ করার মতাে শক্তি কারাে নেই। এ পােকা সমগ্র গাছের ওপর ছড়িয়ে পড়ে, আবার তারা গুটিয়ে এসে এক স্থানে একত্রিত হয়ে যায় এবং অল্প কিছু সংখ্যক ছাড়া বাকি সবাই অল্প ক্ষণেই মরে যায়। আসলে একটি প্রজন্মের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যই আল্লাহ তায়ালা কিছু সংখ্যক পােকাকে বাঁচিয়ে রাখেন। আর তারই অদৃশ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে সে ডুমুর জাতীয় গাছকে সীমাহীনভাবে বাড়তে থাকা থেকে রােধ করার জন্যে এ পােকা মাকড়ের প্রসার ব্যবস্থাকে চালু রাখা হয়েছে। এভাবে প্রকৃতির সব কিছুর মধ্যে এমনভাবে ভারসাম্য রেখে দেয়া হয়েছে যার ফলে আল্লাহর দেয়া সব কিছু মানুষের জন্যে সদা-সর্বদা উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে।’ আবার চিন্তা করে দেখুন, অতীতে আমাদের বাপ-দাদারা ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবে কি করুণভাবে মৃত্যুবরণ করতাে, কিন্তু আজকে সেইভাবে ম্যালেরিয়া কেন ছড়াচ্ছে না? অথবা কেনই বা মানুষ প্রতিশেধক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে আরাে বলা যায় যে মশা থেকে জন্ডিস (পান্ডুরােগ) বিস্তার লাভ করে যা অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে ইউরােপের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি আমেরিকার নিউইয়র্ক পর্যন্ত এ মারাত্মক ব্যাধি পৌছে যায়। এমনি করে হিমাচলে অবস্থিত দেশগুলােতেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে মশার উপদ্রব পরিলক্ষিত হয়। আজকে এমনও অনেক শীত প্রধান দেশ দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে মাছি টিকতে পারে না, কিন্তু সে সব জায়গায় অজস্র মশার উপদ্রব জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। বলা যায় এসবের অকল্পনীয় প্রাদুর্ভাব জীবনের অস্তিত্বকে যেন বিলীন করে দিতে চাইছে। এই কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও মশা-মাছির দ্বারা কলেরা, বসন্ত, প্লেগ ইত্যাদি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধিসমূহ যখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলাে তখন এ সবের কোনাে চিকিৎসা না থাকায় জনপদের পর জনপদ ধংস হয়ে যেতে লাগলাে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কিভাবে এবং কার ইচ্ছায় পৃথিবীতে মানব জাতি টিকে আছে তা চিন্তা করতে গেলেও দিশেহারা হয়ে যেতে হয়, মানুষের বুদ্ধি সেখানে খেই হারিয়ে ফেলে। যে পৃথিবীতে অগনিত কীট পতংগ আমরা দেখতে পাই, পরীক্ষা করে দেখা গেছে মানুষের মতাে সেগুলাের কিন্তু দুটো ফুসফুসে নেই। এগুলো শ্বাসনালীর মাধ্যমে নিশ্বাস প্রশ্বাস ছাড়ে এবং এভাবেই এসব কীট পতংগ ছাড়ায় ও বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এসব শ্বাসনালীর সম্প্রসারণ ও সংকোচন ক্রিয়া এতাে দ্রুত বেগে চলতে থাকে যে, এর সাথে তাল মিলিয়ে এদের নিশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করা সম্ভব হয় না, আর সম্ভবত এজন্যেই কোনাে কীট পতংগ কয়েক ইঞ্চির বেশী দীর্ঘ হতে পারে না এবং কোনাে কীট বা পতংগের বাহু বা পাখনাগুলােও বেশী লম্বা হয় না। এটা আল্লাহ পাকেই এক সুক্ষ্ম ব্যবস্থা, কীট পতংগের প্রজাতিকে তিনি এমনই এক গঠন প্রণালী দিয়েছেন যে তার নির্দিষ্ট এক পরিমাণের বাইরে আর বড়াে হয় না। এটা শুধু কীট-পতংগের ব্যাপারই নয়, সকল প্রাণীর জন্যেই তিনি এক বিশেষ গঠন প্রণালী দিয়েছেন এবং সবার জন্যেই দিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের পৃথক পৃথক নিয়ম, যার বাইরে কোনাে গঠন গ্রহণ করার ক্ষমতা তাদের নেই এবং তাদের বৃদ্ধির যে সীমা তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন তার থেকে বড়াে হওয়ার কোনাে সাধ্য কারাে নেই। এ সীমাবদ্ধতা ও প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ যদি না থাকতাে তাহলে পৃথিবীর বুকে আজ সৃষ্টির কোনাে অস্তিত্বই থাকতাে না। মানুষ বােলতার ছবিটি কল্পনা নেত্রে একবার দেখুক ও চিন্তা করুক, যদি এটা আরাে বড় হতে থাকতাে তাহলে এক সময় এটা সিংহের আকৃতিতে পর্যন্ত পৌছে যেতাে। এমন করে মাকড়সা বাড়তে বাড়তে সে রকম অন্য কোনাে প্রাণীর সমপর্যায়ে যেতে পারে- যেমন করে বিড়াল বাড়তে বাড়তে বাঘের আকৃতি ধারণ করে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা নিজেই এদেরকে বিশেষ এক সীমার মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা চান চিন্তাশীল বাক্তিরা তার ক্ষমতা ও শক্তি বুঝতে সক্ষম হােক, তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সীমাহীন ক্ষমতা বুঝার জন্যে এসব জিনিসের প্রতি খেয়াল করুক। জীব জস্তুর বাইরে প্রাকৃতিক জিনিসের এসব গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে দৃশ্যত যেসব পার্থক্য দেখা যায় এবং এসবের বাইরে সকল কিছুর মধ্যে আভ্যন্তরীণ মেজাজ ও রুচিগত যেসব বিস্ময়কর পার্থক্য রয়েছে সে বিষয়ে খুব কম জীব বিজ্ঞানীই এ পর্যন্ত মাথা ঘামাতে সক্ষম হয়েছেন। তারা প্রধানত জীব জগতের বাইরে উদ্ভিদ জগতের মধ্যেই তাদের পদচারণা সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তাদের জ্ঞান গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে উদ্ভিদ জগত কিভাবে অস্তিত্বে এলাে এবং কিভাবে এর অস্তিত্ব টিকে থাকতে পারে সে বিষয়ে জ্ঞান গবেষণা জারি রাখা। মানব বিজ্ঞানীদের কাছে এমনি করে দিনে দিনে সৃষ্টি রহস্যের অত্যাশ্চর্য অনেক জট খুলতে শুরু করেছে। আজ তারা অনেকেই বুঝতে পারছে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত সকল সৃষ্টির পেছনে নিশিদিন কাজ করে যাচ্ছে; তারা বুঝতে পারছে বিশ্ব-প্রকৃতির সব কিছুর মাঝে বয়ে যাচ্ছে, প্রচন্ড ও অপ্রতিরােধ্য এক মহাশক্তি, তিনিই সব কিছুর ব্যবস্থাপক ও পরিচালক, যার মহাশক্তিমান হাত অদৃশ্যভাবে সকল কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রভাব বলয় থেকে দূরে সরে যাওয়া কারাে পক্ষেই সম্ভব নয়। এসব রহস্য নিয়ে যখন চিন্তা করা হয় তখনই সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী ফোরকান নামটির তাৎপর্য বুঝতে সহজ হয়, যা তিনি তার বান্দার ওপর নাযিল করেছেন, তিনি সৃষ্টি করেছেন সব কিছুকে, তারপর সব কিছুর তাকদীর বা পরিসমাপ্তির অবস্থাও বাতলে দিয়েছেন। এর সাথে আরাে যে কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হচ্ছে যে সে মােশরেকরা সৃষ্টি রহস্যের এসব সূক্ষ্ম কথা বুঝতে মােটেই সক্ষম নয়, যার জন্যে তারা রহস্য সাগরে হাবুড়ুবু খেয়ে বেড়াচ্ছে।
*আল্লাহর নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব : এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা তাকে বাদ দিয়ে বহু সত্ত্বাকে পূজনীয় বা আনুগত্য দানের যােগ্য এবং ক্ষমতাধর বলে গ্রহণ করেছে। তারা কোনাে কিছু সৃষ্টি করে না, বরং তারাই সৃষ্ট হয়েছে, তারা নিজেদেরও কোনাে ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না, আর মৃত্যু, জীবন দান এবং পুনরায় জীবিত করে তােলার ব্যাপারেও তাদের কোনাে হাত নেই।’ এভাবে উলুহিয়্যাৎ বা পূজা উপাসনা এবং নিরংকুশ আনুগত্যের দাবীদার হওয়ার জন্যে যেসব যােগ্যতা ও গুণ বৈশিষ্ট্যের প্রয়ােজন তার কোনােটাই তাদের মধ্যে নেই। এজন্যে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, তারা কোনাে কিছু সৃষ্টি করতে পরে না। আল্লাহ তায়ালাই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। বরং তারাই সৃষ্ট জীব’… তাদের এই কাল্পনিক মাবুদদের অন্ধ অনুসারী (গােলাম) যারা, তারাই ওদেরকে সৃষ্টি(৫) করেছে, না, বরং ওরা খড়-কুটো বা ইট পাথর দিয়ে তাদেরকে বানিয়েছে পুতুল বা মূর্তি বানালে ইট পাথর বা খড় কুটো দিয়ে বানিয়েছে, কিন্তু তাদেরকে তাে আল্লাহ তায়ালা ‘না থেকে হা’-তে এনেছেন, মাটির দেহে রূহ প্রবেশ করে দিয়ে অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। মানুষ, জ্বিন, গাছপালা, পাথর বা ফেরেশতাদেরকে যখন তারা পূজা অর্চনা করতে শুরু করেছে, যখন মানবরচিত আইনের আনুগত্য মেনে নিয়েছে তখন তাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে এই দেবদেবী কিংবা আইন প্রণেতারা যখন নিজেদের ওপরেই কোনাে কর্তৃত্বের অধিকারী নয়, তারা যখন নিজেদের কোনাে ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না, তখন স্বেচ্ছায় যারা নিজেদেরকে ওদের গােলাম বানিয়ে নিয়েছে তারা তাদের অপকার বা উপকার করবে কেমন করে? আর যে ব্যক্তি নিজেই উপকার করার ক্ষমতা রাখে না, তার ক্ষতি করা অতি সহজ কাজ, যেহেতু তারা অপরের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম নয়- বাঁচাতে পারলে তাে সে নিজের উপকার করতেই পারতাে! এজন্যে ব্যাখ্যাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সব থেকে সহজ কাজ হচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থন করা বা নিজের উপকার করা। এ কাজটাই যে করতে পারে না, সে অপরের উপকার করবে কি ভাবে? এরপর সেই সব গুণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হচ্ছে যেগুলাে আল্লাহ ছাড়া কোনাে সৃষ্ট জীবের মধ্যে থাকতে পারে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারা মৃত্যু, জীবন বা রাে হাশরের দিন জীবিত করে তােলার ব্যাপারেও কোনাে কর্তৃত্ব রাখে না।’ এর অর্থ হচ্ছে, কোনাে জীবিতকে মারার ক্ষমতা তাদের নেই, নেই তাদের কোনােই ক্ষমতা কোনাে মরাকে বাঁচানাের। জীবিতদেরকে প্রতিপালনের ক্ষমতা তাদের নেই, এর পর উলুহিয়্যাত বা পূজা আনুগত্য পাওয়ার কোনাে যােগ্যতা তাদের থাকবে কিভাবে নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলারই বা থাকলে কোনাে যুক্তি। সুতরাং আইন রচনা করার অধিকার কিংবা আল্লাহর অন্য যে কোনাে ক্ষমতা কোনাে ব্যক্তি, বস্তু বা গােষ্ঠীর হাতে তুলে দিলে এটা যে প্রচ্ছন্ন শিরক এবং এটা কেউ করলে সে সাথে সাথে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। এটা সন্দেহাতিতভাবে সত্য। এতে সন্দেহের কি আছে? আসলে এটা হচ্ছে নিছক হিংসার কারণেই মুখ ফিরিয়ে নেয়া। এসব কিছুর পেছনে কারণ এটা নয়, যে তারা বুঝে না, তারা সব কিছুই বুঝে তবুও নিজেদের প্রাধান্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবেই আল্লাহর হুকুম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এরপর রসূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং রসূলের ওপর নানাপ্রকার দোষারােপ করা কি অধিক বিচিত্র কিছু হতে পারে। ওরা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যেসব কঠিন কথা বলে তা আরাে মারাত্মক, আরাে কঠিন। রসূলের ওপর দোষারােপ করা থেকেও আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে অসম্মানজনক উক্তি আরাে বহু বহু গুণে কঠিন অপরাধ। ছিঃ, আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে নানা প্রকার ভুল কথা বলার দরুণ কী জঘন্য অপরাধে লিপ্ত রয়েছে ওরা অথচ একবারও তারা ভাবে না যে তিনিই তাে তাদের এবং অন্যান্য সবারও সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, তিনিই সব কিছুর পরিচালক ও সবার পরিণতি নির্ধারণকারী । এর থেকে মানুষের নিকৃষ্ট কাজ আর কি হতে পারে যে তারা আল্লাহর ক্ষমতাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে চায়, অধিকার অন্যকে দিয়ে দেয়, আল্লাহর সাথে শিরক করে। রসূলুল্লাহ(স.)-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলাে, কোন গুনাহ সব থেকে বড়াে? তিনি বলেছিলেন, তার সাথে অন্য কাউকে শরীক মনে করা, অথচ তিনিই তােমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।(এ হাদীসটি বুখারী থেকে সংগৃহীত)