أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৮৫)
[আল কোরআন ও মুহাম্মদ সম্পর্কে কাফেরদের মিথ্যাচার :]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৮
০৪-৬ নং আয়াত:-
২৫:৪
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّاۤ اِفۡکُۨ افۡتَرٰىہُ وَ اَعَانَہٗ عَلَیۡہِ قَوۡمٌ اٰخَرُوۡنَ ۚۛ فَقَدۡ جَآءُوۡ ظُلۡمًا وَّ زُوۡرًا ۚ﴿ۛ۴﴾
আর কাফেররা বলে, ‘এটা মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়, সে এটা রটনা করেছে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে।’ সুতরাং অবশ্যই কাফেররা যুলুম ও মিথ্যা নিয়ে এসেছে।
২৫:৫
وَ قَالُوۡۤا اَسَاطِیۡرُ الۡاَوَّلِیۡنَ اکۡتَتَبَہَا فَہِیَ تُمۡلٰی عَلَیۡہِ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا ﴿۵﴾
ওরা বলে, ‘এগুলি তো সে কালের উপকথা; যা সে লিখিয়ে নিয়েছে। অতঃপর এগুলি সকাল-সন্ধ্যা তার নিকট পাঠ করা হয়।’
২৫:৬
قُلۡ اَنۡزَلَہُ الَّذِیۡ یَعۡلَمُ السِّرَّ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّہٗ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا ﴿۶﴾
বলুন, ‘এটা তিনিই নাযিল করেছেন যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সমুদয় রহস্য জানেন; নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*আল কোরআন ও মুহাম্মদ সম্পর্কে কাফেরদের মিথ্যাচার : সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্দুল আলামীনের মহান মর্যাদা সম্পর্কে এই দীর্ঘ আলােচনা পর আমাদের প্রাণ প্রিয় নবী মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর স্থান সারা বিশ্বের মধ্যে কত মহীয়ান সে বিষয়ে আমরা কিছু আলােচনা করতে চাই, বলিষ্ঠ কণ্ঠে আমরা পৃথিবীবাসীকে জানিয়ে দিতে চাই যে, যেসব নির্বোধ বেওকুফ তার সততা সত্যবাদিতা, জ্ঞান প্রজ্ঞা ও অন্যান্য সকল গুণাবলীর ওপর কটাক্ষপাত করার দুঃসাহস করেছে তারা সবাই কালের গহীন গহবরে চিরদিনের মতাে ডুবে গেছে এবং ভবিষ্যতেও যারা তাঁর প্রতি কোনাে তির্যক ইংগিত করবে তারাও একইভাবে মহাকালের অতলান্ত সাগরে ডুবে যাবে। তাই সে নির্বোধদের কথার উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে এরশাদ হচ্ছ, ‘কাফেররা বললাে, নিশ্চয়ই এটা এক মনগড়া মিথ্যা কথা… বলাে, এ পাক কালাম পাঠিয়েছেন সেই মহান সত্ত্বা যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল গোপন তথ্য জানেন। নিশ্চয়ই তিনি মাফ করনেওয়ালা মেহেরবান।’ (আয়াত ৪-৬) কোরায়শদের মধ্যে যারা কাফের ছিলাে তাদের বক্তব্যের মধ্যে সব থেকে কঠিন যে মিথ্যাটা তা ছিলাে ওপরে বর্ণিত তাদের এই কথাটি, অথচ তারা গভীরভাবে এটা বিশ্বাস করতাে যে তাদের একথাটা এক নির্জলা মিথ্যা, যার কোনােই ভিত্তি নেই, এতদসতেও কেমন করে তাদের সেসব মুরুব্বীদের সামনে সে বেওকুফদের কথার অসারতা বুঝে আসলাে না, যারা নিজেরাই স্বীকারােক্তি দিয়েছে যে, মােহাম্মদ(স.)-এর ওপর যে বাণী নাযিল হয়েছে তা অবশ্যই কোনাে মানুষের পক্ষে বানিয়ে আনা সম্ভব নয়- একথাটা তারা, এ মহাবানীর শব্দ শৈলী থেকে গভীরভাবে অনুভব করতাে এবং তারা আল কোরআনের প্রবল আকর্ষণ থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছিলাে না। তাছাড়া নবুওত লাভ করার পূর্বে মুহাম্মদ(সা.) যে কতাে বড়াে সত্যবাদী ছিলেন তা তারা জানতাে এমনকি এভাবে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাে যে তিনি কখনাে মিথ্যা কথা বলেন না এবং কখনাে কোন আমানতের খেয়ানত করেন না। সুতরাং এমন সত্যবাদী মানুষ আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কেমন করে মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে বলবেন এবং আল্লাহর দিকে তিনি কেমন করে এমন কথার বরাত দেবেন যা বাস্তবে তিনি বললেননি। কিন্তু কাফের মােশরেকদের ধর্মীয় মহলে রসূলুল্লাহ সম্পর্কে যে ঘৃণা বিদ্বেষ বিরাজ করছিলাে এবং তার আনীত ব্যবস্থার মূলােৎপাটনের জন্যে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যেসব পরিকল্পনা তাদের মধ্যে পৃহীত হয়েছিলাে তার পেছনে এই ভয় কাজ করছিলাে যে, তাদের অলীক ও মিথ্যা ধোঁকাবাজির ব্যবস্থা হয়তাে আর বেশীদিন টিকবে না। শনৈ শনৈ মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং ইসলামের যুক্তিপূর্ণ আবেদন তাদেরকে অস্থির করে ফেলছিলাে, তারা তাদের মিথ্যাচারের ও স্বার্থান্ধতার মৃত্যু ঘন্টা যেন প্রতি মুহুর্তেই শুনতে পাচ্ছিলাে- ইসলাম সম্পর্কে এক ভয়-ভীতি সারা আরবের বুকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিলাে, সাধারণ লােকের অবস্থা ছিলাে এই যে, তারা আল্লাহর কালাম ও মানুষের কথার মধ্যে পার্থক্য করতে পারতাে না বা আল্লাহর কালামের মর্যাদাও তারা বুঝতাে না। এজন্যে তাদের কথা উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘এতাে হচ্ছে এক ডাহা মিথ্যা, যা সে বানিয়ে বলছে এবং তাকে অন্য কোনাে এক দল, (লােক কাজে) সাহায্য করছে।’ কথিত আছে, তারা বলতাে তিন জন বা ততােধিক আজমী (অনারব) ব্যক্তি এসব কথা তৈরী করার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে, অথচ এ ছিলাে এমন এক বাজে কথা যা কোনাে যুক্তির ধোপে টেকে না, কেননা প্রথম কথা হচ্ছে তারা আজমী ব্যক্তিদেরকে সাহায্যকারী বানাচ্ছে, অথচ আরবী সাহিত্য ভান্ডারে তারা নিজেরা এতাে বড়াে বড়াে পারদর্শী কবি বর্তমান থাকা সত্তেও আল কোরআনের মতাে এমন একটি লাইনও তৈরী করতে পারেনি। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আল কোরআনের এসব জ্ঞান গর্ভ কথা রচনায় সে আজমী ব্যক্তি যদি সাহায্য করবে, তাহলে তারা নিজেরাই কেন এর রচয়িতা হিসাবে দাবী করে না? কেনই বা তাদেরকে যখন চ্যালেঞ্জ হলাে তখন তারা একটি লাইনও তৈরী করে আনতে পারলাে না? এই কারণেই আল কোরআন তাদের সে সব বাজে কথার কোনাে জওয়াব দিচ্ছে না, বরং তাদের মধ্যে যে অসততা ও অন্যায় পথে যুক্তিহীনভাবে জিদ বিরাজ করছে। সেই কথাগুলােকে তুলে ধরতে গিয়ে আল কোরআন বলছে, ‘অবশ্যই তারা চরম যুক্তিহীন ও মিথ্যা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।…’ তাদের যুলম ও যুক্তিহীন ব্যবহার ছিলাে সত্যের বিরুদ্ধে, মুহাম্মদ(স.)-এর বিরুদ্ধে এবং স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে। তাদের মিথ্যাচার ছিলাে সুস্পষ্ট, প্রকাশ্যভাবে তারা অসত্য ও অন্যায়ের ওপর তাদের তৎপরতা চালাচ্ছিলাে। এরপর তারা রসূলুল্লাহ(স.) ও আল কোরআন সম্পর্কে নানা প্রকার মিথ্যা ও অসদুদ্দেশ্য প্রণােদিত কথার জাল বুনেছিলাে। দেখুন তাদের কথার উদ্ধৃতাংশ। ওরা বললাে, এতাে পূরাকালের অলীক কাহিনী, যা সে (কারাে দ্বারা) লিখিয়ে নিয়েছে, আর সেই কথাগুলো কে তার সামনে সকাল সন্ধা পড়ে পড়ে শােনানাে হয়। এসব কথা তখনই তারা বলতাে যখন তাদের উপদেশের জন্যে তাদের সামনে অতীতের বহু ঘটনাবলীকে, উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরা হতাে। মক্কাবাসী হঠকারী সে জনতার জন্যে উপদেশ ও তাদের প্রশিক্ষণের জন্যে অতীত ইতিহাসের এই সব ঘটনাবলী তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে, যাতে তারা এগুলাের দিকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকায় এবং চিন্তা করতে পারে। এসব কোনাে অলীক কাহিনী নয়, বরং এগুলাে ছিলাে সব সত্য ঘটনা, পূর্ববর্তীদের (ঐতিহাসিক) কাহিনী। তারা ধারণা করতো ও প্রচার করতাে যে রসূলুল্লাহ(স.) কাউকে এগুলাে লিখে দেয়ার জন্যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাতে সকাল সন্ধা তার সামনে এগুলাে পড়ে শােনানাে হয়। যেহেতু তিনি ছিলেন নিরক্ষর, পড়তে লিখতে জানতেন না-এজন্যে ওরা বলে ‘তার কাছে পড়ে শােনানাে হয় আর সে কিনা বলে, একথাগুলাে আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে।’ তাই আলােচ্য আয়াতে তাদের কথাগুলােকে রদ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, তাদের এসব দাবীর পেছনে কোনাে যুক্তিই নেই। আলােচনা করলে তাদের কোনাে কথাই প্রমাণিত হবে না। আল কোরআন এ প্রসংগের আলােচনায় এমন শব্দাবলী ব্যবহার করেছে এবং এ হঠকারী জাতির যুক্তিহীন কথাকে রদ করার জন্যে অতীতের ঘটনাবলীকে এমনভাবে তুলে ধরেছে যে, যে কোনাে পাঠক এসব বর্ণনা থেকে সে পাপাচারী জাতির সত্যবিরােধিতা আঁচ করতে পারে, বুঝতে পারে যে ঐতিহাসিক সেসব কাহিনীর মধ্যে বর্ণিত শাস্তি যে সব অপরাধের কারণে এসেছিলাে- এ জাতিও সেই একই অপরাধে অপরাধী হওয়ায় যে কোনাে মুহূর্তে তাদের ওপর সে একই শাস্তি নেমে আসতে পারতাে, যেহেতু শাস্তি নাযিলের জন্যে যেসব কারণ প্রয়ােজন তা অতীতের জাতিদের মধ্যে এবং এই কোরায়শ জাতির মধ্যে একইভাবে বিরাজ করছিলাে। অতীতের ঘটনাবলী যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পেশ করা হচ্ছে তা হলাে এই যে, মানুষ যেন সকল ঘটনাবলীকে সামনে নিয়ে চিন্তা করে এবং সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে, কিন্তু হঠকারী ও সত্য বিরােধীরা মনে করে আল কোরআনে উল্লেখিত কথাগুলাে কল্প-কাহিনী মাত্র, এগুলাে সুখ পাঠ্য হিসাবে পড়ার জন্যে অথবা এসব কাহিনী পড়ে সময় কাটানাের জন্যে এসেছে। সে যালেম জাতির কথাগুলাে ছিলাে চরম নির্বুদ্ধিতা পূর্ণ ও যুক্তিহীন। এগুলাে সব অতীতের অলীক কাহিনী। তাদের একথাগুলাে বলার মূল উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা যে, মােহাম্মদ একজন মিথ্যাবাদী। সে নিজে রচনা করে কথা বলছে, অথবা কিছু লােক যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা এসব ঐতিহাসিক কাহিনী বলে তাকে এসব কথা রচনা করতে সাহায্য করে, আর সকাল সন্ধা বারবার তাকে কথাগুলাে এতাে বেশী পড়ে পড়ে শােনায় যে সে সুমধুরভাবে সে কথাগুলাে উচ্চারণ করতে পারে- ইসলামের দুশমন সে চরম মূর্খরা আল্লাহর রসূল(স.) কে দোষ দিতে গিয়ে এটা হিসাব করলাে না যে, যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ মােহাম্মদ(স.)-কে শিখাবে তাকে অবশ্যই জ্ঞান-বুদ্ধি প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার দিকে দিয়ে তার মােহাম্মাদ(স) এর থেকে বেশী হতে হবে, তাকে অবশ্যই হতে হবে গােপন রহস্যরাজি সম্পর্কে অধিক ওয়াকেফহাল, কিন্তু কে আছে এমন যে মােহাম্মদ(স.)-এর থেকে বেশী জ্ঞানী গুণী ও প্রজ্ঞাবান? তাদের বুঝা উচিত যে, এ পাক কালাম শিখিয়েছেন তিনি যিনি সকলের থেকে বেশী জ্ঞানী, সকল রহস্য সম্পর্কে ওয়াকেফহাল, যার কাছে অতীত ও ভবিষ্যতের কোনাে কিছুই গােপন নেই। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, তাঁর কাছে (এ বাণী) পাঠিয়েছেন তিনি, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল রহস্য জানেন।’ এবারে, ওহে হঠকারী মূর্খের দল বলাে, কোথায় এবং কে আছে এমন যে প্রাচীনকালের কাহিনীসমূহ জানে এবং এভাবে বর্ণনা করতে পারে? কোথায় আছে লিপিবদ্ধ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর গােপন রহস্য? আর কোথায় আছে সেই সূক্ষ্ম বিন্দুটি মহা বিশ্বের বুকে কুল কিনারাহীন ও অবিরত ঘূর্ণায়মান, যাকে আমরা পৃথিবী বলে জানি? শােনাে, রসূলুল্লাহ(স.) সম্পর্কে এসব বাজে কথা বলে ওরা খুবই বড়াে শুণাহ করছে। এসব কথা বলার সময় আর যে মহা অপরাধটি তারা করছে তা হচ্ছে তারা আল্লাহর সাথে শেরকের কাজ করার ব্যাপারে অনড় হয়ে রয়েছে, এতদসত্তেও তাওবার দরজা এখনও তাদের জন্যে খােলা এবং এসব বড়াে বড়াে গুনাহ থেকে এখনও তাদের ফিরে আসা সম্ভব। আর মহান আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সেই সত্ত্বা যিনি জানেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর রহস্য রাজিকে, আর তিনিই জানেন সে মিথ্যা সম্পর্কে যা ওরা নিজেদের মন থেকে তৈরী করে বলছে এবং জানেন তাদের সকল চক্রান্ত সম্পর্কে। তিনি মাফ করনেওয়ালা-তিনিই মেহেরবাণ। তাই এরশাদ হচ্ছে, তিনিই মাফ করনেওয়ালা মেহেরবান।’
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
যে সকল কাফির-মুশরিকরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতকে মিথ্যা বলে অস্বীকার করে তারা বলে: এ কুরআন এটা মিথ্যা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সে নিজে এটা রচনা করে আল্লাহ তা‘আলার নামে অপবাদ দিচ্ছে এবং এ ব্যাপারে তাকে অন্যান্য লোকেরা সাহায্য করছে। যেমন তাদের কথা:
(وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّهُمْ يَقُوْلُوْنَ إِنَّمَا يُعَلِّمُه۫ بَشَرٌ)
“অবশ্যই আমি জানি, তারা বলে: ‘তাকে শিক্ষা দেয় এক মানুষ।” (সূরা নাহল ১৬:১০৩) তারা আরো বলে:
( فَقَالَ إِنْ هٰذَآ إِلَّا سِحْرٌ يُّؤْثَرُ إِنْ هٰذَآ إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ)
“এবং বলল: এটা চিরাচরিত জাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এটা তো মানুষেরই কথা।” (সূরা মুদ্দাসির ৭৪:২৪-২৫)
এবং তারা আরো বলত যে, এ কুরআন হল
(أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ)
বা পূর্ব যুগের কাহিনী ও উপকথা, যা তার নিকট সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করা হয়েছে আর সে তা অন্যের মাধ্যমে লিখিয়ে নিয়েছে। যেমন তারা বলত:
(وَإِذَا تُتْلٰي عَلَيْهِمْ اٰيٰتُنَا قَالُوْا قَدْ سَمِعْنَا لَوْ نَشَا۬ءُ لَقُلْنَا مِثْلَ هٰذَآ لا إِنْ هٰذَآ إِلَّآ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ)
“যখন তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তারা তখন বলে, ‘আমরা তো শ্রবণ করলাম, ইচ্ছা করলে আমরাও এর অনুরূপ বলতে পারি, এগুলো সেকালের লোকদের উপকথা ছাড়া কিছুই নয়।’’ (সূরা আনফাল ৮:৩১)
আর এসমস্ত তর্ক-বিতর্কের কারণেই তারা সঠিক পথের সন্ধান পায়নি বরং গোমরাহ থেকে গেছে। তাদের এসব কথার জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, হে নাবী! তুমি বলে দাওন এ কুরআন কোন মিথ্যা কথা নয় এবং পূর্ববর্তীদের উপকথাও নয়। বরং এ কুরআন ঐ প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত যিনি আকাশ ও জমিনের সমুদয় রহস্য সম্পর্কে অবগত আছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُلْ نَزَّلَه۫ رُوْحُ الْقُدُسِ مِنْ رَّبِّكَ بِالْحَقِّ)
“বল: ‘তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে রূহুল-কুদুস জিব্রাঈল সত্যসহ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন’।” (সূরা নাহল ১৬:১০২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاِنَّھ۫ لَتَنْزِیْلُ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَﰏ نَزَلَ بِھِ الرُّوْحُ الْاَمِیْنُﰐعَلٰی قَلْبِکَ لِتَکُوْنَ مِنَ الْمُنْذِرِیْنَﰑ بِلِسَانٍ عَرَبِیٍّ مُّبِیْنٍﰒ)
“নিশ্চয়ই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক হতে অবতীর্ণ। জিব্রাঈল এটা নিয়ে অবতরণ করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারী হতে পার। (অবতীর্ণ করা হয়েছে) সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।” (সূরা শুয়ারা ২৬:১৯২-১৯৫)
অতএব কুরআন ও রাসূলকে যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এবং অপবাদ দিবে তাদের ওপর অচিরেই নেমে আসবে আল্লাহ তা‘আলার আযাব।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন কোন মিথ্যা কথা নয় এবং পূর্ববর্তীদের উপকথাও নয়। বরং এটা সত্যসহ বিশ্ব প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# বর্তমান যুগে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদরা কুরআন মজীদের বিরুদ্ধে এ আপত্তিটিই উত্থাপন করে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সমকালীন বৈরী সমাজের একজনও একথা বলেনি যে, শিশুকালে খৃস্টীয় যাজক বুহাইরার সাথে যখন তোমার দেখা হয়েছিল তখন তার কাছ থেকে এ সমস্ত বিষয় তুমি শিখে নিয়েছিলে। তাদের কেউ একথাও বলেনি যে, যৌবনকালে বাণিজ্যিক সফরে তুমি যখন বাইরে যেতে সে সময় খৃস্টীয় পাদ্রী ও ইহুদী রাব্বীদের কাছ থেকে তুমি এসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলে। কারণ এসব সফরের অবস্থা তাদের জানা ছিল। তিনি একাকী এসব সফর করেননি। বরং তাদের নিজস্ব কাফেলার সাথে সফর করেছিলেন। তারা জানতো, এগুলোর সাথে জড়িত করে বাইরে থেকে কিছু শিখে আসার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপন করলে তাদের নিজেদের শহরের হাজার হাজার লোক তাদের মিথ্যুক বলবে। তাছাড়া মক্কার প্রত্যেক সাধারণ লোক জিজ্ঞেস করবে, যদি এসব তথ্য এ ব্যক্তি বারো তেরো বছর বয়সেই বুহাইরা থেকে লাভ করে থাকে অথবা ২৫ বছর বয়সে যখন থেকে তার বাণিজ্যিক সফর শুরু হয় তখন থেকেই লাভ করতে থাকে, তাহলে এ ব্যক্তি তো বাইরে কোথাও থাকতো না, আমাদের এ শহরে আমাদের মধ্যেই বাস করতো, এ অবস্থায় চল্লিশ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত তার এসব জ্ঞান অপ্রকাশ থাকলো কেমন করে? কখনো তার মুখ থেকে এমন একটি শব্দও বের হলো না কেমন করে যার মাধ্যমে তার এ জ্ঞানের প্রকাশ ঘটতো? এ কারণেই মক্কার কাফেররা এ ধরনের ডাহা মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি। এটা তারা ছেড়ে দিয়েছিল পরবর্তীকালের আরো বেশী নির্লজ্জ লোকদের জন্য। নবুওয়াত পূর্বকাল সম্পর্কে কোন কথা তারা বলতো না। তাদের কথা ছিল নবুওয়াত দাবীর সময়ের সাথে সম্পর্কিত। তারা বলতো, এ ব্যক্তি তো নিরক্ষর, নিজে পড়াশুনা করে নতুন জ্ঞান আহরণ করতে পারে না। ইতিপূর্বে কিছু শেখেনি। আজ এর মুখ থেকে যেসব কথা বের হচ্ছে চল্লিশ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত এগুলোর কোন কথাই সে জানতো না। তাহলে এখন হঠাৎ এসব জ্ঞান আসছে কোথা থেকে? এগুলোর উৎস নিশ্চয়ই আগের যুগের লোকদের কিছু কিতাব। রাতের বেলা চুপিসারে সেগুলো থেকে কিছু কিছু অংশ অনুবাদ করিয়ে লেখানো হয়। কাউকে দিয়ে তার অংশ বিশেষ পড়িয়ে এ ব্যক্তি শুনতে থাকে তারপর সেগুলো মুখস্থ করে নিয়ে দিনের বেলা আমাদের শুনিয়ে দেয়। হাদীস থেকে জানা যায়, এ প্রসঙ্গে তারা বেশ কিছু লোকের নামও নিতো। তারা ছিল আহলি কিতাব। তারা লেখাপড়া জানতো এবং মক্কায় বাস করতো। অর্থাৎ আদ্দাস (হুওয়াইতিব ইবনে আবদুল উয্যার আজাদকৃত গোলাম), ইয়াসার (আলা আল-হাদারামির আজাদ করা গোলাম) এবং জাবর (আমের ইবনে রাবীআর আজাদকৃত গোলাম)।
আপাতদৃষ্টিতে এটা বড়ই শক্তিশালী অভিযোগ মনে হয়। অহীর দাবী নাকচ করার জন্য নবী কোথা থেকে জ্ঞান অর্জন করেন তা চিহ্নিত করার চাইতে বড় ওজনদার আপত্তি আর কি হতে পারে। কিন্তু প্রথম দৃষ্টিতে মানুষ এ ব্যাপারটি দেখে অবাক হয়ে যায় যে, এর জবাবে আদৌ কোন যুক্তিই পেশ করা হয়নি বরং কেবলমাত্র একথা বলেই শেষ করে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা সত্যের প্রতি জুলুম করছো, পরিষ্কার বে-ইনসাফীর কথা বলছো, ডাহা মিথ্যার বেসাতি করছো। এতো এমন আল্লাহর কালাম যিনি আকাশ ও পৃথিবীর গোপন রহস্য জানেন। এ ধরনের কঠোর বিরোধিতার পরিবেশে এমনইতর কঠিন অভিযোগ পেশ করা হয় এবং তাকে এভাবে তাচ্ছিল্য ভরে রদ করে দেয়া হয়, এটা কি বিস্ময়কর নয়? সত্যিই কি এটা এমনি ধরনের তুচ্ছ ও নগণ্য অভিযোগ ছিল? এ জবাবে কি শুধু মাত্র “মিথ্যা ও জুলুম” বলে দেয়াই যথেষ্ট ছিল? এ সংক্ষিপ্ত জবাবের পর সাধারণ মানুষ আর কোন বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট জবাবের দাবী করেনি, নতুন মু’মিনদের মনেও কোন সন্দেহ দেখা দেয় নি এবং বিরোধীদের কেউও একথা বলার হিম্মত করেনি যে, দেখো, আমাদের এ শক্তিশালী অভিযোগের জবাব দিতে পারছে না, নিছক “মিথ্যা ও জুলুম” বলে একে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, এর কারণ কি?
ইসলাম বিরোধীরা যে পরিবেশে এ অভিযোগ করেছিল সেখানেই আমরা এ সমস্যার সমাধান পেয়ে যাবোঃ
প্রথম কথা ছিল, মক্কার যেসব জালেম সরদার মুসলমানদের মারপিট করছিল ও কষ্ট দিচ্ছিল তারা যেসব লোক সম্পর্কে বলতো যে, তারা পুরাতন কিতাব থেকে অনুবাদ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মুখস্থ করাচ্ছে তাদের গৃহ এবং নবীর ﷺ গৃহ অবরোধ করে তাদের নিজেদের কথামত এ কাজের জন্য যেসব বই ও কাগজপত্র জমা করা হয়েছিল সেসব আটক করা তাদের পক্ষে মোটেই কঠিন ব্যাপার ছিল না। ঠিক যে সময় এ কাজ করা হচ্ছিল তখনই তারা সেখানে অতর্কিত হামলা চালিয়ে মূল প্রমাণপত্র লোকদের দেখাতে পারতো এবং বলতে পারতো, দেখো, এ তোমাদের নবুওয়াতের প্রস্তুতি চলছে। বেলালকে যারা মরুভূমির তপ্ত বালুর বুকে পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে ফিরছিল তাদের পক্ষে এ কাজ করার পথে কোন নিয়ম ও আইন-কানুন বাধ্য ছিল না। এ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারা চিরকালের জন্য মুহাম্মাদী নবুওয়াতের বিপদ দূর করতে পারতো। কিন্তু তারা কেবল মুখেই অভিযোগ করে থাকে। কোনদিনও এ ধরনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসেনি।
দ্বিতীয় কথা ছিল, এ প্রসঙ্গে তারা যেসব লোকের নাম নিতো তারা কেউ বাইরের লোক ছিল না। সবাই ছিল এ মক্কা শহরেরই বাসিন্দা। তাদের যোগ্যতা গোপন ছিল না। সামান্য বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিও দেখতে পারতো যে, মুহাম্মাদ ﷺ যা পেশ করছেন তা কোন্ পর্যায়ের, তার ভাষা কত উচ্চ পর্যায়ের, সাহিত্য মর্যাদা কত উন্নত, শব্দ ও বাক্য কেমন শিল্পসমৃদ্ধ এবং সেখানে কত উন্নত পর্যায়ের চিন্তা ও বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। অন্যদিকে মুহাম্মাদ ﷺ যাদের থেকে এসব কিছু হাসিল করছেন বলে তারা দাবী করছে তারা কোন পর্যায়ের লোক। এ কারণে এ অভিযোগকে কেউই এক কানাকড়ি গুরুত্ব দেয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তি মনে করতো, এসব কথায় মনের জ্বালা মেটানো হচ্ছে, নয়তো এ কথার মধ্যে সন্দেহ করার মতো একটুও প্রাণশক্তি নেই। যারা এসব লোককে জানত না তারাও শেষমেষ এতটুকুন কথাও চিন্তা করতে পারতো যে, যদি তারা এতই যোগ্যতা সম্পন্ন হয়ে থাকতো, তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের পাণ্ডিতের প্রদীপ জ্বালালো না কেন? অন্য এক জনের প্রদীপে তেল যোগান দেবার কি প্রয়োজন তাদের পড়েছিল? তাও আবার চুপিসারে, যাতে এ কাজের খ্যাতির সামান্যতম অংশও তাদের ভাগে না পড়ে?
তৃতীয় কথা ছিল, এ প্রসঙ্গে যেসব লোকের নাম নেয়া হচ্ছিল তারা সবাই ছিল বিদেশাগত গোলাম। তাদের মালিকরা তাদেরকে স্বাধীন করে দিয়েছিল। সেকালের আরবের গোত্রীয় জীবনে কোন ব্যক্তিও কোন শক্তিশালী গোত্রের সাহায্য-সমর্থন ছাড়া বাঁচতে পারতো না। কোন সচেতন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কি একথা চিন্তা করতো পারতো যে, এরা নিজেদের পৃষ্ঠপোষকদেরকে নারাজ করে দিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এ ষড়যন্ত্রে শরীক হয়ে গিয়ে থাকবে? কি এমন লোভ হতে পারতো যেজন্য তারা সমগ্র জাতির ক্রোধ ও তিরস্কারের লক্ষ্যবস্তু এবং সমগ্র জাতি যাকে শত্রু বলে চিহ্নিত করেছে তার সাথে সহযোগিতা করতো এবং এ ধরনের বিপদগ্রস্ত লোকের কাছ থেকে কোন্ লাভের আশায় নিজের পৃষ্ঠপোষকদের থেকে বিছিন্ন হয়ে যাওয়ার ক্ষতি বরদাশত করতো? তারপর তাদের মারধর করে ঐ ব্যক্তির সাথে তাদের ষড়যন্ত্রের স্বীকারোক্তি আদায় করার সুযোগ তাদের পৃষ্ঠপোষকদের তো ছিলই, এটাও চিন্তা করার ব্যাপার ছিল। তারা এ সুযোগ ব্যবহার করেনি কেন? কেনই বা তারা সমগ্র জাতির সামনে তাদের নিজেদের মুখে এ স্বীকৃতি প্রকাশ করেনি যে, তাদের কাছ থেকে শিখে ও জ্ঞান নিয়ে নবুওয়াতের এ দোকান জমজমাট করা হচ্ছে?
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল এই যে, তারা সবাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনে এবং সাহাবায়ে কেরাম রসূলের পবিত্র সত্তার প্রতি যে নজিরবিহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করতেন তারাও তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক নবুওয়াত তৈরীর পেছনে যারা নিজেরাই মাল-মশলা যুগিয়েছে তারাই আবার তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং প্রাণঢালা শ্রদ্ধা সহকারে ঈমান আনবে এটা কি সম্ভব? আর ধরে নেয়া যাক যদি এটা সম্ভব হয়ে থেকেও থাকে, তাহলে মুমিনদের জামায়াতে তাদের তো কোন উল্লেখযোগ্য মর্যাদা লাভ করা উচিত ছিল? আদ্দাস, ইয়াসার ও জাবরের শক্তির উপর নির্ভর করে নবুওয়াতের কাজ-কারবার চলবে আর নবীর দক্ষিণ হস্ত হবেন আবু বকর, উমর ও আবু উবাইদাহ, এটা কেমন করে সম্ভব হলো?
অনুরূপভাবে এ ব্যাপারটিও ছিল বড়ই অবাক করার মতো, যদি কয়েকজন লোকের সহায়তায় রাতের বেলা বসে নবুওয়াতের এ ব্যবসায়ের কাগজ-পত্র তৈরী করা সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে যায়েদ ইবনে হারেসা, আলী ইবনে আবু তালেব, আবু বকর সিদ্দীক ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিবারাত্রের সহযোগী অন্যান্য লোকদের থেকে তা কিভাবে গোপন থাকতে পারতো? এ অভিযোগের মধ্যে যদি সত্যের সামান্যতম গন্ধও থাকতো, তাহলে এ লোকগুলো কেমন করে এ ধরনের আন্তরিকতা সহকারে নবীর প্রতি ঈমান আনলো এবং তাঁর সমর্থনে সব ধরনের বিপদ-আপদ ও ক্ষতি কিভাবে বরদাশত করলো? এটা কি কোনক্রমেই সম্ভব ছিল? এসব কারণে প্রত্যেক শ্রোতার কাছে এ অভিযোগ এমনিতেই ছিল অর্থহীন ও অযৌক্তিক। তাই কোন গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের জবাব দেবার জন্য কুরআনে একে উদ্ধৃত করা হয়নি বরং একথা বলার জন্য উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, দেখো সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করার ক্ষেত্রে এরা কেমন অন্ধ হয়ে গেছে এবং কেমন ডাহা মিথ্যা, অন্যায় ও বে-ইনসাফির আশ্রয় নিয়েছে।
# এখানে এ বাক্যাংশটি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে হচ্ছে আল্লাহ কি অপরূপ দয়া ও ক্ষমার আধার! যারা সত্যকে অপদস্ত করার জন্য এমন সব মিথ্যার পাহাড় সৃষ্টি করে তাদেরকেও তিনি অবকাশ দেন এবং তাদের অপরাধের কথা শুনার সাথে সাথেই তাদের উপর আযাব নাযিল করা আরম্ভ করেন না। এ সাবধান বাণীর সাথে সাথে এর মধ্যে উপদেশেরও একটি দিক আছে। সেটি যেন ঠিক এমনি ধরনের যেমন, “হে জালেমরা! এখনো যদি নিজেদের হিংসা-দ্বেষ থেকে বিরত হও এবং সত্য কথাকে সোজাভাবে মেনে নাও তাহলে আজ পর্যন্ত যা কিছু করতে থেকেছো সবই ক্ষমা করা যেতে পারে।”
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে মুশরিকদের একটি অজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন যা তার সত্তা সম্পর্কে ছিল। এখানে তিনি তাদের অন্য একটি অজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছেন যা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সত্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। তারা নবী (সঃ)-কে বলে- তুমি এই কুরআনকে অন্যদের সাহায্যবলে নিজেই বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, এটা তাদের অত্যাচার ও মিথ্যামূলক কথা যা তারা নিজেরাও জানে। কিন্তু তাদের জানা কথারও বিপরীত কথা তারা বলছে।
কখনো কখনো তারা গলা উঁচু করে বলে যে, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের কাহিনীগুলো তিনি লিখিয়ে নিয়েছেন এবং ঐগুলোই সকাল সন্ধ্যায় তাঁর মজলিসে পঠিত হয়। তাদের এটাও এমন একটা মিথ্যা কথা যে, এটা মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। কেননা, শুধু মক্কাবাসী নয়, বরং দুনিয়া জানে যে, আমাদের নবী (সঃ) নিরক্ষর ছিলেন। না তিনি লিখতে জানতেন পড়তে জানতেন। নবুওয়াতের পূর্বের চল্লিশ বছরের জীবন তিনি মক্কাবাসীদের মধ্যেই কাটিয়েছেন। তাঁর এ জীবন তাদের মধ্যে এমনভাবে কেটেছে যে, তার এ দীর্ঘ জীবনের মধ্যে এমন একটি ঘটনা ঘটেনি যার ফলে তাঁর প্রতি কোন প্রকার দোষারোপ করা যেতে পারে। মক্কাবাসী তাঁর এক একটি গুণের উপর পাগল ছিল। তাঁর মধুর চরিত্র এবং উত্তম ব্যবহারে তারা এমনভাবে মুগ্ধ ছিল যে, তাকে তারা মুহাম্মদ আমীন (সঃ) বলে অত্যন্ত স্নেহের সুরে আহ্বান করতো। কোন এমন অন্তর ছিল যাতে তিনি বাসা বাঁধেননি? কোন এমন চক্ষু ছিল যাতে তার মর্যাদা প্রকাশিত হয়নি? কোন এমন সমাবেশ ছিল যেখানে তাঁর সম্পর্কে উত্তম আলোচনা হয়নি? কোন এমন লোক ছিল যে তাঁর বুযর্গী, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্থতা ও সততার উক্তিকারী ছিল না? অতঃপর তাকেই যখন মহান আল্লাহ উচ্চতম সম্মানে সম্মানিত করলেন, আসমানী অহীর তাঁকে আমীন বানানো হলো, তখন শুধু বাপ-দাদার রীতি-নীতি ও কু-প্রথা উঠে যেতে দেখে ঐ নির্বোধের দল তাঁর শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করে দেয় এবং তার প্রতি নানারূপ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। তাঁর সম্পর্কে তারা নানারূপ মন্তব্য করে। কেউ তাকে কবি বলে, কেউ বলে যাদুকর এবং কেউ বলে পাগল। কি করে তারা তাদের বাপ-দাদাদের অজ্ঞতাপূর্ণ রীতি-নীতি ও কু-প্রথা ঠিক রাখতে পারে এই চিন্তাতেই তারা সদা নিমগ্ন থাকে। তারা এ চিন্তাও করতে থাকে যে, কোনক্রমেই যেন তাদের মিথ্যা ও বাজে উপাস্যদের পতাকা উল্টোমুখে পতিত হয় এবং অজ্ঞতার অন্ধকারে পরিপূর্ণ দুনিয়া আল্লাহর জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়। এখন তাদেরকে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে জবাব দেয়া হচ্ছেঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও- এই কুরআন তো তিনিই অবতীর্ণ করেছেন যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমুদয় রহস্য অবগত আছেন। যার থেকে এক অণু-পরিমাণ জিনিসও লুক্কায়িত নয়। এতে অতীতের যেসব ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। তার সবই সত্য। ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবার বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেগুলোও সত্য। যা কিছু হবে সবই আল্লাহর কাছে সমান। তিনি অদৃশ্যকে ঐ ভাবেই জানেন যেমন তিনি জানেন দৃশ্যকে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেন যে, তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তাঁর এ কথা বলার কারণ হলো যাতে মানুষ তার থেকে নিরাশ না হয়ে যায়। তারা যেন এ আশা করতে পারে যে, তারা যত কিছু অন্যায় ও দুস্কার্য করুক না কেন, পরে যদি তারা শুদ্ধ অন্তঃকরণে সমস্ত পাপ হতে তাওবা করতঃ তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তিনি তাদের পূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিবেন। এরূপ আশা পেয়ে হয়তো তারা তাদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হবে এবং মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টির সন্ধানী হবে।
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা কতই না মহান ও দয়ালু যে, যারা তার চরম অবাধ্য ও শত্রু, যারা তার প্রিয় রাসূল (সঃ)-কে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কষ্ট দিচ্ছে, তাদেরকেও তিনি নিজের সাধারণ করুণার দিকে আহ্বান করছেন! যারা তাকে মন্দ বলছে, তাঁর রাসূল (সঃ)-কে খারাপ বলছে তাদেরকেও তিনি ক্ষমা করে দেয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন এবং তাদের সামনে ইসলাম ও হিদায়াত পেশ করছেন! নিজের উত্তম কথাগুলো তাদেরকে বুঝাতে রয়েছেন! যেমন অন্য আয়াতে তিনি ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদিতার বর্ণনা দেয়ার পর তাদের শাস্তির কথা উল্লেখ করতঃ বলেন (আরবি)
অর্থাৎ “তারা কি আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতঃ তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আল্লাহ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৫: ৭৪) তিনি আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী নর-নারীদের বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তাওবা করেনি তাদের জন্যে আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রণা।” (৮৫: ১০)।
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ “আল্লাহর এই দয়া ও দানের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, যারা তাঁর বন্ধুদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তাদেরকে তিনি তাওবা ও রহমতের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। (এটা কত বড় দয়া ও সহনশীলতার পরিচায়ক)!”