أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯০)
[সেদিন আকাশ মেঘমালাসহ বিদীর্ণ হবে।]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৯
২৫-২৯ নং আয়াত:-
২৫:২৫
وَ یَوۡمَ تَشَقَّقُ السَّمَآءُ بِالۡغَمَامِ وَ نُزِّلَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ تَنۡزِیۡلًا ﴿۲۵﴾
সেদিন আকাশ মেঘমালাসহ বিদীর্ণ হবে এবং ফিরিশতাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হবে–
২৫:২৬
اَلۡمُلۡکُ یَوۡمَئِذِۣ الۡحَقُّ لِلرَّحۡمٰنِ ؕ وَ کَانَ یَوۡمًا عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ عَسِیۡرًا ﴿۲۶﴾
সেদিন প্রকৃত কর্তৃত্ব হবে পরম দয়াময়ের এবং অবিশ্বাসীদের জন্য সেদিন হবে বড় কঠিন।
২৫:২৭
وَ یَوۡمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی یَدَیۡہِ یَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِی اتَّخَذۡتُ مَعَ الرَّسُوۡلِ سَبِیۡلًا ﴿۲۷﴾
জালেমরা সেদিন নিজেদের হাত কামড়াতে থাকবে এবং বলতে থাকবে, “হায়! যদি আমি রসুলের সহযোগী হতাম।
২৫:২৮
یٰوَیۡلَتٰی لَیۡتَنِیۡ لَمۡ اَتَّخِذۡ فُلَانًا خَلِیۡلًا ﴿۲۸﴾
হায়! আমার দুর্ভাগ্য, হায়! যদি আমি অমুক লোককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম।
২৫:২৯
لَقَدۡ اَضَلَّنِیۡ عَنِ الذِّکۡرِ بَعۡدَ اِذۡ جَآءَنِیۡ ؕ وَ کَانَ الشَّیۡطٰنُ لِلۡاِنۡسَانِ خَذُوۡلًا ﴿۲۹﴾
আমাকে অবশ্যই সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট কুরআন পৌঁছনোর পর। আর শয়তান তো মানুষকে বিপদকালে পরিত্যাগই করে।’
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২৫-২৯ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন। কিয়ামতের দিন অবস্থা এতই ভয়াবহ হবে যে, আকাশ মেঘমালার ভারত্বে বিদীর্ণ হয়ে যাবে, এ মেঘমালাতে আল্লাহ তা‘আলা ও ফেরেশতারা বিচার-ফায়সালা করার জন্য আগমন করবেন। ফেরেশতারা এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَإِذَا انْشَقَّتِ السَّمَا۬ءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالدِّهَانِ)
“যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে সেদিন ওটা লাল চামড়ার মত রক্তবর্ণ ধারণ করবে; (সূরা রহমান ৫৫:৩৭)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّجَا۬ءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا)
“এবং তোমার পালনকর্তা আগমন করবেন ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে উপস্থিত হবে। ” (সূরা ফাজর ৮৯:২২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(هَلْ يَنْظُرُوْنَ إِلَّآ أَنْ يَّأْتِيَهُمُ اللّٰهُ فِيْ ظُلَلٍ مِّنَ الْغَمَامِ وَالْمَلَا۬ئِكَةُ وَقُضِيَ الْأَمْرُ ط وَإِلَي اللّٰهِ تُرْجَعُ الْأُمُوْرُ)
“তারা কি শুধু এ অপেক্ষাই করছে যে, আল্লাহ তা‘আলা মেঘমালার ছায়া তলে তাদের নিকট আগমন করবেন, আর ফেরেশতারাও (আসবেন) এবং সকল বিষয়ের মীমাংসা করা হবে। আর প্রতিটি বিষয় (শেষ পর্যন্ত) আল্লাহ তা‘আলার দিকেই প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা বাকারাহ ২:২১০)
সেদিন কর্তৃত্ব হবে কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জন্য। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কারো কোন ক্ষমতা থাকবে না। তিনি যা করবেন ও বলবেন তা-ই হবে, ব্যতিক্রম কিছুই হবে না। দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ, ফকীর, স্বাধীন-দাস সবাই সমান হয়ে যাবে। কোন পার্থক্য থাকবে না।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, কিয়ামতের দিন যারা কুফরী ও শির্ক করে নিজেদের ওপর জুলুম করেছে তারা কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে ও নিজেদের অপরাধের কথা স্মরণ করে হাত কামড়াতে থাকবে; যেমন দুনিয়াতে আমরা দেখি মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলে হাতের আঙ্গুল কামড়ায় তেমনি কাফিররা কিয়ামতের দিন কামড়াতে থাকবে আর বলবে: যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। (তারা হল মানুষ ও জিন শয়তান) হায়! আমি যদি রাসূলের অনুসারী হতাম। এরকমভাবে তারা আফসোস করতে থাকবে। কিন্তু তথায় আফসোস করে আর কোন লাভ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(رُبَمَا يَوَدُّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَوْ كَانُوْا مُسْلِمِيْنَ)
“কখনও কখনও কাফিরগণ আকাক্সক্ষা করবে যে, তারা যদি মুসলিম হত!” (সূরা হিজর ১৫:২)
সুতরাং কথায় আছেন সৎ সঙ্গে সর্গে বাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তাই আমাদের উচিত অসৎ মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে ভাল মানুষের সঙ্গ গ্রহণ করা এবং সৎ আমল করা, অন্যথায় মুক্তি পাওয়া যাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা ও ফেরেশতাগণ নেমে আসবেন বিচার-ফায়সালা করার জন্য।
৩. যারা খারাপ ও অসৎ ব্যক্তিদেরকে সঙ্গীরূপে গ্রহণ করেছিল তারা কিয়ামতের দিন আফসোস করবে।
৪. যারা রাসূলের পথে চলবে তারাই সেদিন নাযাত পাবে।
৩০-৩১ নং আয়াতের তাফসীর:
কুরআনকে যেভাবে চর্চা করা, মেনে চলা ও মর্যাদা দেয়া এবং বিশ্বাস করা উচিত উম্মাতের যারা তা করে না তাদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার কাছে বলবেন: হে আল্লাহ তা‘আলা! আমার এ জাতি কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে। তারা কুরআনকে বর্জন করেছে, কুরআনকে মেনে নেয়নি এবং তার যথার্থ মর্যাদা দেয়নি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ অভিযোগ দুনিয়াতেই করেছেন, না আখিরাতে করবেন তা নিয়ে মতামত পাওয়া যায়, তবে পরবর্তী আয়াত দ্বারা বুঝা যায়ন এ অভিযোগ দুনিয়াতেই করেছেন। তাই তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَكَذٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا مِّنَ الْمُجْرِمِيْنَ)
অর্থাৎ আপনার শত্র“রা কুরআন অমান্য করলে সে জন্য আপনার সবর করা উচিত।
আর এভাবেই আখিরাতে অপরাধীরা তাদের রাসূলদের শত্র“ হয়ে যাবে। কেননা তারা মানুষকে অন্যায় কাজের দিকে আহ্বান করত আর আল্লাহ তা‘আলার পথে বাধা দিত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَكَذٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيٰطِيْنَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوْحِيْ بَعْضُهُمْ إِلٰي بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا ط وَلَوْ شَا۬ءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوْهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُوْنَ – وَلِتَصْغٰٓي إِلَيْهِ أَفْئِدَةُ الَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ بِالْاٰخِرَةِ وَلِيَرْضَوْهُ وَلِيَقْتَرِفُوْا مَا هُمْ مُّقْتَرِفُوْنَ)
“অনুরূপভাবে আমি মানব ও জিনের মধ্যে যারা শয়তান তাদেরকে প্রত্যেক নাবীর শত্র“ করেছি, প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ কথা অতি গোপনীয়ভাবে জানিয়ে দেয়। যদি তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন তবে তারা এটা করত না; সুতরাং তুমি তাদেরকে ও তারা যা মিথ্যা রচনা করে তাকে বর্জন কর। আর তারা এ উদ্দেশ্যে প্ররোচিত করে যে, যারা আাখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের মন যেন তার প্রতি অনুরাগী হয় এবং তাতে যেন তারা পরিতুষ্ট হয় আর তারা যে অপকর্ম করে তারাও যেন সেসব অপকর্ম করতে থাকে। (সূরা আন‘আম ৬:১১২-১১৩)
সুতরাং যারা অপরাধী তারা রাসূলের শত্র“ হয়ে যাবে। আর এ কারণে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তাই আমাদের উচিত রাসূলের নির্দেশিত পথে চলা। কেননা রাসূলের দেখানো পথে না চললে রাসূলের শত্র“তে পরিণত হতে হবে। আর রাসূলের শত্র“ মানে আল্লাহ তা‘আলার শত্র“। যারা আল্লাহ তা‘আলার শত্র“ তারা কখনো জান্নাতে যেতে পারবে না। আর কুরআনকে বেশি বেশি চর্চা, পালন ও মেনে চলা উচিত। কারণ যারা কুরআন বর্জন করবে তাদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অভিযোগ করেছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন বর্জন করার পরিণতি খুবই খারাপ, তাই বেশি বেশি তার চর্চা ও বিধি-বিধান মেনে চলা উচিত।
২. যারা অন্যায় কাজ করে তারা রাসূলদের ও আল্লাহ তা‘আলার শত্র“।
৩. আল্লাহ তা‘আলা যাকে পথ দেখান তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে পথ দেখানোর কেউ নেই।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৫-২৯ নং আয়াতের তাফসীর
কিয়ামতের দিন যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং যেসব বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হবে, আল্লাহ তাআলা এখানে তারই সংবাদ দিচ্ছেন। এগুলোর মধ্য হতে কয়েকটি যেমনঃ আকাশ মেঘপুঞ্জসহ বিদীর্ণ হওয়া এবং ফেরেশতাদেরকে নামিয়ে দেয়া। সেই দিন ফেরেশতারা একত্রিত হওয়ার স্থানে সমস্ত সৃষ্টজীবকে পরিবেষ্টন করে ফেলবেন। অতঃপর মহা কল্যাণময় প্রতিপালক বিচার-ফায়সালার জন্যে আগমন করবেন। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এটা আল্লাহ তাআলার নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ তাদের নিকট মেঘের ছায়ার মধ্যে আগমন করবেন তারা শুধু এরই অপেক্ষা করছে।” (২:২১০)
আল্লাহ পাকের(আরবি)-এই উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তা’আলা দানব, মানব, পশু-পাখী এবং সমস্ত সৃষ্টজীবকে একই মাটিতে একত্রিত করবেন। অতঃপর দুনিয়ার আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে এবং এই আকাশের অধিবাসীরা নীচে নেমে আসবে যাদের সংখ্যা দানব, মানব ও সমুদয় সৃষ্টজীব অপেক্ষা বেশী হবে। সুতরাং তারা দানব, মানব এবং সমুদয় মাখলুককে পরিবেষ্টন করে ফেলবে। এরপর দ্বিতীয় আকাশ বিদীর্ণ হবে এবং ওর অধিবাসীরা নীচে নেমে আসবে। তারা তাদের পূর্বে অবতণকারী ফেরেশতাদেরকে ও জ্বিন, মানুষ এবং সমস্ত মাখলুককে পরিবেষ্টন করবে। আর এই দ্বিতীয় আকাশের অধিবাসীদের সংখ্যা হবে দুনিয়ার আকাশের অধিবাসী এবং সমস্ত সৃষ্টজীব অপেক্ষা বেশী। তারপর তৃতীয় আকাশ ফেটে যাবে এবং ওর অধিবাসীরা নীচে অবতরণ করবে। তারা সংখ্যায় দ্বিতীয় আকাশের অধিবাসী, দুনিয়ার আকাশের অধিবাসী এবং সমস্ত সৃষ্টজীব অপেক্ষা অধিক হবে। তারা তাদের পূর্বে অবতারিত ফেরেশতাসমূহ, দানব, মানব এবং সমুদয় মাখলুককে পরিবেষ্টন করবে। অতঃপর অনুরূপভাবে প্রত্যেক আকাশই ফেটে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত সপ্তম আকাশ বিদীর্ণ হবে এবং ওর অধিবাসীরা নীচে নেমে আসবে যাদের সংখ্যা ছয় আকাশের অধিবাসী, দানব, মানব এবং সমস্ত সৃষ্টজীব অপেক্ষা বেশী হবে। তারা তাদের পূর্বে অবতারিত আকাশসমূহের অধিবাসী, জ্বিন, মানুষ এবং সমস্ত মাখলুককে পরিবেষ্টন করবে। আর আমাদের মহামহিমান্বিত প্রতিপালক মেঘমালার ছায়ায় অবতরণ করবেন। এবং তাঁর চতুর্দিকে তাঁর নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাগণ থাকবেন যাদের সংখ্যা সপ্ত আকাশের অধিবাসী দানব, মানব ও সমস্ত সৃষ্টজীব অপেক্ষা বেশী হবে। বর্শার ফলকের গিঁটের মত তাঁদের শিং থাকবে। তারা আরশের নীচে অবস্থান করবেন। তারা মহামহিমান্বিত আল্লাহর তাসবীহ-তাহলীল পাঠে এবং তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণায় লিপ্ত থাকবেন। তাদের পায়ের পাতা ও পায়ের গিটের মধ্যকার দূরত্ব হবে পাঁচশ’ বছরের পথ। পায়ের গিট ও হাঁটুর মধ্যকার দূরত্ব হবে পাঁচশ’ বছরের পথ। হাঁটু হতে কোমর পর্যন্ত জায়গার দূরত্ব হবে পাচশ’ বছরের পথ। কোমর থেকে নিয়ে বুকের উপরের অস্থি পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব হবে পাঁচশ’ বছরের পথ। বক্ষের উপরোস্থিত অস্থি হতে কানের লতি পর্যন্ত জায়গার দূরত্ব হবে পাঁচশ বছরের পথ। আর সেখান থেকে উপরের শেষাংশ পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব হবে পাঁচশ’ বছরের পথ। জাহান্নাম এর অনুভূতি স্থল।” (এভাবে এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
ইউসুফ ইবনে মাহরান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ এই আকাশ যখন বিদীর্ণ হয়ে যাবে তখন এটা হতে ফেরেশতারা অবতরণ করবেন যাদের সংখ্যা মানব ও দানব হতে বেশী হবে। ওটা হলো কিয়ামতের দিন, যেই দিন আসমানের অধিবাসী ও যমীনের অধিবাসীরা মিলিত হবে। তখন যমীনবাসীরা জিজ্ঞেস করবেঃ “আমাদের প্রতিপালক এসেছেন কি?” তারা উত্তরে বলবেনঃ “তিনি এখনো আসেননি, তবে আসবেন।” অতঃপর দ্বিতীয় আকাশ ফেটে যাবে। তারপর পর্যায়ক্রমে আকাশগুলো ফাটতে থাকবে। অবশেষে সপ্তম আকাশ ফেটে পড়বে। তখন ওর থেকে ফেরেশতারা নীচে অবতরণ করবেন যাদের সংখ্যা পূর্বে আকাশসমূহ হতে অবতারিত সমুদয় ফেরেশতা হতে এবং সমস্ত দানব ও মানব হতে বেশী হবে। তারপর নেতৃস্থানীয় ফেরেশতাগণ অবতরণ করবেন। অতঃপর আমাদের প্রতিপালক আটজন ফেরেশতা দ্বারা বহনকৃত আরশে চড়ে আসবেন। ঐ আটজন ফেরেশতার প্রত্যেকের পায়ের গিঁট হতে কাঁধ পর্যন্ত জায়গার দূরত্ব হবে পাঁচশ বছরের রাস্তা। ঐ ফেরেশতারা একে অপরের মুখের দিকে তাকাবেন না। বরং তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মাথা নিজ নিজ হস্তদ্বয়ের মাঝে রেখে বলতে থাকবেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “মহান ও পবিত্র বাদশাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি। তাদের মাথার উপর তীরের ন্যায় কিছু থাকবে এবং ওর উপর আরশ থাকবে। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ বর্ণনাটি খুবই দুর্বল এবং এতে কঠিন অস্বীকৃতি রয়েছে। প্রসিদ্ধ সূরের (শিঙ্গার) হাদীসে প্রায় এরূপই বর্ণনা রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী)
মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “সেদিন সংঘটিত হবে মহাপ্রলয়, এবং আকাশ বিদীর্ণ হয়ে বিশ্লিষ্ট হয়ে পড়বে। ফেরেশতারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে এবং সেই দিন আটজন ফেরেশতা তাদের প্রতিপালকের আরশকে ধারণ করবে তাদের ঊর্ধ্বে।” (৬৯:১৫-১৭)
শাহর ইবনে হাউশিব (রঃ) বলেন যে, আটজন ফেরেশতা আরশ বহন করবেন। তাদের মধ্যে চারজন বলতে থাকবেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং আপনার প্রশংসা করছি। আপনার জানার পরেও আপনার সহনশীলতার জন্যে প্রশংসা আপনার।” আর তাদের অবশিষ্ট চারজন বলবেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমরা আপনার মহিমা ঘোষণা করছি। আপনার ক্ষমতার পরেও আপনার ক্ষমার কারণে প্রশংসা আপনারই জন্যে।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আবু বকর ইবনে আবদিল্লাহ (রঃ) বলেন যে, যমীনবাসী যখন আরশের দিকে তাকাবে তখন তাদের চক্ষু স্থির ও বিস্ফারিত হয়ে যাবে এবং প্রাণ হয়ে যাবে কণ্ঠাগত।
আল্লাহ পাকের উক্তিঃ ‘সেই দিন প্রকৃত কর্তৃত্ব হবে দয়াময়ের। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আজ কর্তৃত্ব কার? আল্লাহর জন্যে, যিনি এক, প্রবল পরাক্রান্ত।” (৪০: ১৬)
সহীহ হাদীসে আছে যে, আল্লাহ তা’আলা আসমানসমূহকে ডান হাতে এবং যমীনসমূহকে বাম হাতে ধারণ পূর্বক বললেনঃ “আমি বাদশাহ এবং আমি মহাবিচারক। যমীনের বাদশাহরা কোথায়? কোথায় শক্তিশালীরা? অহংকারীরা কোথায়?” আর এক জায়গায় তার উক্তি রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “ঐ দিন কাফিরদের উপর কঠিন হবে।” (২৫: ২৬) কেননা, ওটা হবে ন্যায়বিচার ও ফায়সালার দিন। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “ওটা সেই দিন হবে কঠিন দিন। কাফিরদের উপর তা সহজ নয়।” (৭৪: ৯-১০) সুতরাং এই দিন এটা হবে কাফিরদের অবস্থা। পক্ষান্তরে মুমিনদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “বড় ভয়-বিহ্বলতা তাদেরকে চিন্তান্বিত করবে না।” (২১:১০৩)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ওটা এমন একদিন যা পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান’ এই দিন কতই না দীর্ঘ হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার শপথ! অবশ্যই ওটা মুমিনের উপর হালকা করা হবে। এমনকি ওটা তার উপর দুনিয়ার ফরয নামাযের চেয়েও হালকা হবে।”
মহান আল্লাহর উক্তিঃ যালিম ব্যক্তি সেই দিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করবে। এই উক্তি দ্বারা আল্লাহ তা’আলা ঐ যালিমের অনুতাপের সংবাদ দিচ্ছেন যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং তিনি যে সুস্পষ্ট সত্য জিনিস আল্লাহ তা’আলার নিকট হতে নিয় এসেছেন তা থেকে সরে পড়েছে, আর রাসূল (সঃ)-এর বাতলানো পথের বিপরীত পথে চলেছে। সুতরাং যেই দিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেই দিন সে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হবে এবং শোকে ও দুঃখে স্বীয় হস্ত কামড়াতে থাকবে। কিন্তু ঐ সময় এতে কোনই উপকার সে লাভ করতে পারবে না। এ আয়াতটি উকবা ইবনে আবি মুঈত এবং অন্যান্য দুষ্ট শ্রেণীর লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হলেও প্রত্যেক যালিমের ব্যাপারে এটা সাধারণ এবং সমানভাবে প্রযোজ্য। অতএব কিয়ামতের দিন প্রত্যেক যালিমই অত্যন্ত লজ্জিত হবে এবং স্বীয় হস্তদ্বয় কামড়াতে কামড়াতে বলবেঃ “হায়! আমি যদি রাসূল (সঃ)-এর সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায় দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম!” অর্থাৎ যে তাকে হিদায়াতের পথ হতে সরিয়ে দিয়ে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে গিয়েছিল তার কথা মান্য করার কারণে সে এরূপ আক্ষেপ করবে। এটা উমাইয়া ইবনে খালফ অথবা তার ভাই উবাই ইবনে খালফ বা অন্যান্য সমস্ত যালিমের ব্যাপারেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ‘আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ অর্থাৎ কুরআন পৌঁছার পর। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ‘শয়তান তো মানুষের জন্যে মহাপ্রতারক।’ অর্থাৎ সে প্রতারণা করে মানুষকে সত্য পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে বিভ্রান্তি ও বাতিলের পথে নিয়ে যায়। আর সে তাকে ঐ দিকে আহ্বান করে।
৩০-৩১ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল ও নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেন যে, নবী (সঃ) বললেনঃ হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায়তো এই কুরঅনকে পরিত্যাজ্য মনে করে। এটা এভাবে যে, মুশরিকরা কুরআন কারীম শ্রবণ করতো না এবং তাতে কর্ণপাত করতো না। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কাফিররা বলে-তোমরা এই কুরআন শ্রবণ করো না এবং ওটা আবৃত্তিকালে শোরগোল সৃষ্টি করো যাতে তোমরা জয়ী হতে পার।” (৪১:২৬) কাফিরদের সামনে যখন কুরআন কারীম পাঠ করা হতো তখন তারা হট্টগোল ও গোলমাল করতো এবং আজে বাজে কথা বলতে যাতে তারা কুরআন শুনতে না পায়। এটাই হলো তাদের কুরআন পরিত্যাগ করা ও ওর প্রতি ঈমান না আনা।
কুরআনের সত্যতা স্বীকার না করার অর্থও হলো ওটা পরিত্যাগ করা। কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করা পরিত্যাগ করা হলো কুরআনকে পরিত্যাগ করা। কুরআন অনুযায়ী আমল, ওর নির্দেশাবলী প্রতিপালন এবং ওর নিষেধাবলী থেকে পরহেযগারী অবলম্বন পরিত্যাগ করাও হলো কুরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করা। কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কবিতা, গান এবং খেল-তামাশার প্রতি আকৃষ্ট হওয়াও হলো ওকে পরিত্যাজ্য মনে করা। সুতরাং অনুগ্রহশীল ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর নিকট আমরা প্রার্থনা করছি যে, তিনি যেন আমাদেরকে এমন জিনিস হতে পরিত্রাণ দান করেন যার উপর তাঁর ক্রোধ পতিত হয় এবং যেন তিনি আমাদেরকে এমন জিনিসের আমলকারী বানিয়ে দেন যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন। যেমন তাঁর কিতাব হিফয করা, ওটা অনুধাবন করা এবং দিন রাত ওর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। নিশ্চয়ই তিনি পরম দয়ালু ও দাতা।
মহান আল্লাহ বলেনঃ এই ভাবেই প্রত্যেক নবীর শক্ত করেছিলাম আমি অপরাধীদেরকে। অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তোমার কওম যেমন কুরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করছে, পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতেরাও তেমনই ছিল। কেননা, আল্লাহ তা’আলা প্রত্যক নবীরই শক্ত করেছেন অপরাধীদেরকে। তারা মানুষকে তাদের বিভ্রান্তির দিকে ও তাদের কুফরীর দিকে আহ্বান করতো। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর শক্র করেছিলাম মানব ও দানব শয়তানদেরকে।” (৬:১১২) এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেনঃ তোমার জন্যে তোমার প্রতিপালকই পথ-প্রদর্শক ও সাহায্যকারীরূপে যথেষ্ট। অর্থাৎ যে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য স্বীকার করবে, তাঁর কিতাবের উপর ঈমান আনবে এবং ওর সত্যতা স্বীকার করতঃ ওর অনুসরণ করবে, দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ হবেন তার পথ-প্রদর্শক ও সাহায্যকারী। পথ-প্রদর্শক ও সাহায্যকারী বলার কারণ এই যে, মুশরিকরা লোকদেরকে কুরআনের অনুসরণ হতে বাধা প্রদান করতো, যাতে কেউই এর দ্বারা হিদায়াত প্রাপ্ত হতে না পারে এবং তাদের পন্থা যেন কুরআনের পন্থার উপর জয়যুক্ত হয়। এজন্যেই মহান আল্লাহ বলেনঃ এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর শক্র করেছি অপরাধীদেরকে (শেষ পর্যন্ত)।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*কেয়ামতের ধ্বংসলীলা ও কাফেরদের পরিণতি : কাফেররা দাবী জানাতাে যে, আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের সাথে নিয়ে সদল বলে মেঘমালার ভেতরে দৃশ্যমান হােক। ইসরাঈলী কেচ্ছা কাহিনীতে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এরূপ ধারণা দেয়া হতাে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মেঘমালার ভেতরে বা আগুনের শিখার ভেতরে দর্শন দিতেন। এসব কিসসা কাহিনী দ্বারা প্ররােচিত হয়েই তারা এরূপ দাবী করতাে। এই পটভূমিতেই ২৫ ও ২৬ নং আয়াতে আরেকটা দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। তাদের কাছে ফেরেশতা আসুক এই মর্মে তারা যে দাবী তুলতাে, সেটা এই দৃশ্যে পূর্ণ হয়েছে। যেদিন আকাশ মেঘমালাসহ ফেটে পড়বে এবং ফেরেশতাদেরকে নামানাে হবে। সেদিন প্রকৃত রাজত্ব হবে করুণাময় আল্লাহর এবং কাফেরদের জন্যে সে দিনটা হবে খুবই কষ্টকর।’ এ আয়াত এবং অন্য বহুসংখ্যক আয়াত প্রমাণ করে যে, কেয়ামতের দিন মহাবিশ্বে বিরাট বিরাট ঘটনা ঘটবে। সে সব ঘটনার সার কথা এই যে, দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন জগত, আকাশ, কক্ষপথ, গ্রহ-নক্ষত্র সব কিছুই একেবারে এলােমেলাে ও ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। এগুলাের নিয়ম শৃংখলা, সংযােগ, সম্বন্ধ ও আকৃতি প্রকৃতি ওলট পালট হয়ে আজকের দৃশ্যমান এই সৃষ্টি জগতের সমস্ত নিয়মতান্ত্রিকতার অবসান ঘটবে। এই ওলট পালট ও বিপ্লব শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং গ্রহ নক্ষত্র ও মহাকাশেও বিস্তৃত হবে। এই বিপ্লব সম্পর্কে বিভিন্ন সূরায় যে বিবরণ এসেছে, সেগুলাে এ প্রসংগে তুলে ধরা যেতে পারে। যেমন, সূর্য যখন আলােহীন হয়ে পড়বে, নক্ষত্রসমূহ যখন খসে পড়বে, পবর্তমাকে যখন উৎপাটিত করা হবে… সমুদ্রগুলােকে যখন উদ্বেলিত করা হবে… আকাশ যেদিন ফেটে যাবে, নক্ষত্রগুলাে যেদিন বিক্ষিপ্ত হবে, সাগরগুলােকে যখন উত্তাল করা হবে এবং কবরগুলােকে যখন খােলা হবে… ‘আকাশ যেদিন ফেটে যাবে। এবং নিজ প্রভুর আদেশ পালন করবে…(সূরা তাকওয়ীর, ইনফিতার, ইনশিকাক, রহমান, ওয়াকেয়া, হাক্কাহ, মায়ারেজ, যিলযাল, কারিয়া, দুখান, মুযাম্মিল, ফজর, কিয়ামাহ, মুরসালাত, তােয়াহা, নামল, কাহফ, ইবরাহীম ও আম্বিয়া কেয়ামত সংক্রান্ত আয়াত গুলো দেখুন) এসব আয়াত থেকে জানা যায় যে, আমাদের এই বিশ্বজগতের ধ্বংসের ঘটনাটা হবে লােমহর্ষক। পৃথিবীতে ভূমিকম্প হবে এবং তাকে ভেংগে চূর্ণ-বিচুর্ণ করা হবে। পাহাড় পর্বত ধূলিসাৎ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সমুদ্রগুলাে উদ্বেলিত হবে। এটা সমগ্র পৃথিবী আলােড়িত হওয়ার কারণে হতে পারে, বা তার সমস্ত অণু পরমাণু বিস্ফোরিত হয়ে আগুনে পরিণত হবার কারণেই হতে পারে। নক্ষত্র মন্ডলি আলােহীন হয়ে খসে খসে পড়বে। আকাশ ফেটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। গ্রহ উপগ্রহ ধ্বংস হয়ে ছুটে পড়বে। পারস্পরিক দূরত্ব বিঘ্নিত হওয়ার ফলে সূর্য ও চন্দ্র একত্রিত হবে। আকাশ কখনাে ধুমায়িত এবং কখনাে আগুনে জ্বলতে জ্বলতে লাল হয়ে যাবে। এভাবে আরাে বহু গা শিউরে ওঠা বিবরণ রয়েছে। চলতি সূরা ফোরকানে আল্লাহ তায়ালা মােশরেকদেরকে হুমকি দিচ্ছেন যে, আকাশ ও মেঘমালা ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে। এই মেঘমালা সেই ভয়ংকর বিস্ফোরণগুলাের গ্যাস থেকে সৃষ্ট পুঞ্জীভূত মেঘমালাও হতে পারে। সেদিন ফেরেশতারাও কাফেরদের কাছে আসবে, যেমনটি তারা দাবী করতাে। কিন্তু এই আসা রসূলের দাওয়াতের সত্যতা প্রমাণের জন্যে নয়, বরং আল্লাহর হুকুম অনুসারে তাদেরকে আযাব দেয়ার জন্যে। এ জন্যেই বলা হয়েছে যে, সে দিনটা হবে কাফেরদের জন্যে কঠিন দিন। কারণ ওই দিনে আযাব ও অনেক ভীতিপ্রদ ঘটনাবলী ঘটবে। যদিও তারা ফেরেশতা পাঠানাের দাবী জানাচ্ছিলাে। কিছু ফেরেশতারা সেই কঠিন দিনে ছাড়া আসবে না। এরপর সে দিনের একটা দৃশ্যও দেখানাে হচ্ছে, যাতে অত্যাচারী অবাধ্য বান্দাদেরকে অনুতাপ ও অনুশােচনা করতে দেখা যাচ্ছে। এ দৃশ্য বেশ দীর্ঘ হয়েছে। এমনকি পাঠকের কাছে মনে হতে থাকে যেন এর কোনাে শেষ নেই। দৃশ্যটা হলাে, অপরাধীদের অনুশােচনায় হাত কামড়ানাে। যেদিন অবাধ্য অত্যাচারী নিজের উভয় হাত কামড়াবে আর বলতে থাকবে যে, ‘হায়, আমি যদি রসূলের অনুসারী হতাম, হায় আমি যদি অমুককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম, আমার কাছে কোরআন রূপী স্মারক আসার পরও তা থেকে সে আমাকে বিপথগামি করেছে। বস্তুত শয়তান মানুষের নিদারুণ অপমানকারী।'(আয়াত ২৭-২৯) এ সময় তার চার পাশের সকল বস্তু থাকবে নীরব ও নিস্তব্ধ। এই পরিবেশে সে তার অনুশােচনাপূর্ণ গভীর প্রভাব বিস্তারকারী সুদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করে। ফলে শ্রোতা ও পাঠক উভয়েই এই অনুশােচনায় শরীক বলে মনে হচ্ছে। অত্যাচারী যেদিন তার উভয় হাত কামড়াবে? অর্থাৎ একখানা হাত কামড়ানােকে সে যথেষ্ট মনে করবে না, বরং হয় এক হাতের পর আর এক হাত কামড়াবে, নতুবা উভয় হাত এক সাথেই কামড়াবে। কেননা তীব্র অনুশােচনা তার বিবেককে দংশন করে তাকে অস্থির করে তুলবে। হাত কামড়ানাে এমন একটা কাজ, যা একটা বিশেষ মানসিক অবস্থার ইংগিত দেয়া এবং তাকে শারীরিক অবস্থার আকৃতিতে তুলে ধরে। সে বলবে, হায়! আমি যদি রসূলের অনুসারী হতাম। অর্থাৎ যে রসূলের রেসালাতকে সে অস্বীকার করতাে এবং আল্লাহ তায়ালা তাকে রসূল করে পাঠাতে পারেন বলেই মনে করতাে না, সেই রসূলেরই অনুসারী না হওয়ার জন্যে আক্ষেপ করবে। হায় আক্ষেপ, আমি যদি অমুককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম। নাম উল্লেখ না করে অমুক’ শব্দ প্রয়াগ করা হয়েছে যাতে এমন প্রত্যেক অসৎ সংগী এর আওতায় এসে যায়, যে মানুষকে রসূলের পথ থেকে দূরে সরায় এবং আল্লাহর স্মরণ থেকে বিপথগামী করে। (এ আয়াতের নাযিল হওয়ার পটভূমি সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, কোরায়শ নেতা ওকবা ইবনে আবি মুইত বসূল(স.)-এর সাথে বেশ ঘন ঘন দেখা করতাে। সে একবার রসূল(স.)-কে খাবার দাওয়াত দিলাে। রসূল(স.) বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ না করলে আমি তোমার খাবার গ্রহণ করবাে না। ওকবা তৎক্ষণাত কলেমায়ে শাহাদাত পড়লে। এতে তার বন্ধু উবাই বিন খালফ তাকে তিরস্কার করলাে এবং বললাে, তুমি সাবী (নক্ষত্র পূজারী) হয়ে গেলে? ওকবা বললাে, আল্লাহর কসম, আমি নক্ষত্র পুজারী হইনি, তবে মােহাম্মদ আমার বাড়িতে বসেই আমার খাদ্য খেতে অস্বীকার করায় কলেমা পড়েছি। উবাই বললাে, তােমার কোনাে অজুহাতে আমি সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ মোহাম্মাদ মাথায় পা না রাখা এবং তার মাথায় থুথু না দাও। এরপর ওকবা রসূল(স.)-কে কাবার চত্বরে সেজদারত পেয়ে তার মাথায় পা রাখলাে ও থুথু দিলাে। রসূল(স.) বললেন, আমি তােমাকে যখনই মক্কার বাইরে পাবাে তখনই তরবারি দিয়ে তােমার মাথা কেটে শুন্যে উঁচু করবো। পরে বদরের যুদ্ধে সে বন্দী হয় এবং রসূল(স.) হযরত আলীকে আদেশ দিয়ে তাকে হত্যা করান) ‘সে তাে আমাকে (কোরআনের) উপদেশ আসার পর তা থেকে বিপথগামী করেছে।’ অর্থাৎ সে বিভ্রান্তকারী শয়তান অথবা তার চেলা ছিলাে। শয়তান মানুষের জন্যে নিদারুণ অপমানকারী। অর্থাৎ অপমানিত হতে হয় এমন পথে টেনে নিয়ে যায় এবং অপমানিত করে। আর আতংকজনক ও কষ্টদায়ক পথে টেনে নিয়ে যায়। এভাবেই কোরআন এসব ভয়ংকর দৃশ্য তুলে ধরে মানুষের মনকে সচকিত করে এবং তাদের শােচনীয় পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে। এসব দৃশ্য কাফেরদের লােমহর্ষক পরিণতি তুলে ধরে এবং তাদেরকে একটা বাস্তব ঘটনা প্রদর্শন করায়। অথচ এর পরও তারা আল্লাহর সামনে উপস্থিতির সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে, সর্বত্র সর্বক্ষণ আল্লাহর বিদ্যমানতাকে কিছুমাত্র সমীহ না করে চ্যালেঞ্জ করে এবং এমন সব ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবী জানায়, যা অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ নিয়ে সময়ােত্তীর্ণ অনুতাপ ও অনুশােচনা সহকারে তাদের জন্যে পরকালে অপেক্ষমান থাকবে।
কেয়ামতের সেই কঠিন দিন সংক্রান্ত এই বিবরণ দেয়ার পর রসূল(স.)-এর সাথে তাদের নীতি ও আচরণ এবং কোরআন অবতরণের পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের আপত্তিগুলাে নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। অতপর হাশরের ময়দানে তারা কিভাবে উপস্থিত হবে, সে দৃশ্যটাও এখানে দেখানাে হচ্ছে। ‘আর রাসূল বলবে হে আমার প্রতিপালক, আমার জাতি এই কোরআনকে পরিত্যক্ত করে রেখেছিলাে।'(আয়াত ৩০-৩৪) বস্তুত যে কোরআনকে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দার ওপর নাযিল করেছিলেন এই উদ্দেশ্যে, যেন তা দিয়ে তিনি মানুষকে সতর্ক করেন ও সচেতন করেন, সেই কোরআনকে তারা পরিত্যক্ত করে রেখেছিলাে। অর্থাৎ তা তারা শুনতাে না। কেননা তারা জানতাে যে, শুনলে হয়তাে তাদের মন তার দিকে এমনভাবে আকৃষ্ট হবে যে, তা আর ফেরাতেই পারবে না কোরআনের মর্মার্থ হৃদয়ংগম করার জন্যে এবং সত্যকে উপলব্ধি করার জন্যে তারা কোরআনকে মনােযােগ দিয়ে শুনতাে না এবং তা নিয়ে গবেষণাও করতাে না। যে কোরআন এসেছিলাে মানুষের জীবন। ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে, সেই কোরআনকে তারা জীবন ব্যবস্থা বানানাের পরিবর্তে পরিত্যক্ত করে রেখে দিয়েছে। ৩০ নং আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই এটা জানতেন। তথাপি আল্লাহর কাছে নিজের অন্তরের একাগ্রতা ও নিষ্ঠা প্রমাণ করার জনেই এ কথা বলবেন, যাতে আল্লাহ তায়ালা নিজেই সাক্ষ্য দেন যে, রসূল চেষ্টার কোনাে ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু তার জাতি এ কোরআনকে মনােযােগ দিয়ে শােনেইনি এবং তা দিয়ে কোনাে চিন্তা-ভাবনাও করেনি।
*বাধা বিপত্তি ইসলামী আন্দোলন গতিশীল করে : পরবর্তী আয়াতে (৩১ নং) আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে সান্তনা দিচ্ছেন ও সমবেদনা জানাচ্ছেন এই বলে যে, প্রত্যেক নবীরই কিছু শত্রু থাকতাে, যারা তার কাছে আগত হেদায়াতের বাণীকে পরিত্যাগ করতাে এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে দিতাে। তবে আল্লাহ তায়ালা তার নবী ও রসূলদেরকে কিভাবে তার শত্রুদের ওপর বিজয়ী হওয়া যায়, তা শিক্ষা দিয়েছেন তিনি বলেছেন, এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে অপরাধীদের মধ্য থেকে একজন শত্রু তৈরী করে রেখেছি । তবে তােমার প্রভুই তােমার সুপথ প্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে যথেষ্ট। সুক্ষ্ম ও অব্যর্থ কৌশল একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই প্রয়ােগ করে থাকেন। ইসলামের দাওয়াতের বিরুদ্ধে শত্রু সৃষ্টিও তার এক সুনিপুণ কৌশল। এসব শক্রর আবির্ভাব দাওয়াত কে শক্তিশালী করে এবং তাকে সংকল্পের দৃঢ়তা দান করে। দাওয়াতে নিয়ােজিত লােকেরা যখন এসব শক্রর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তখন এতে তাদের যতাে কষ্টই হােক এবং দাওয়াত যতােই বাধাগ্রস্ত হােক, তখন এই সংগ্রামই সত্য দাওয়াতকে মিথ্যা ও মেকি দাওয়াত থেকে পৃথক করে । এই সংগ্রামই একনিষ্ঠ দাওয়াতদাতাদেরকে ভন্ড ও প্রতারকদের থেকে বাছাই করে আলাদা করে। ফলে সংগ্রামের পর মুসলমানদের মধ্যে কোনাে লােভী ও ভন্ড থাকতে পারে না, সবাই একনিষ্ঠ ও খাটি মােমেন, হয়ে যায়, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছু চায় না। দাওয়াত যদি সহজ কাজ হতাে, তার পথ যদি কুসুমাস্তীর্ণ হতাে, তার পথে যদি শত্রু ও বিরােধী না থাকতাে, তাকে প্রত্যাখ্যান ও তার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ রচনা করার মতাে লােক না থাকতাে, তাহলে প্রত্যেক মানুষের পক্ষে দাওয়াতদাতা হয়ে যাওয়া সহজ হতাে, হক ও বাতিলের মিশ্রিত হয়ে দাওয়াত একাকার হয়ে যেতাে এবং সন্দেহ সংশয় ও ফেতনা বেড়ে যেতাে। দাওয়াতের সামনে শত্রু ও বিরােধীর আবির্ভাব তার বিজয়ের সংগ্রামকে অনিবার্য করে তােলে এবং তার জন্যে দুঃখ কষ্ট ও ত্যাগ তিতিক্ষাকে তার বিজয়ের সহায়কে পরিণত করে। এ জন্যেই একনিষ্ঠ, দৃঢ় সংকল্প ও আপােষহীন মােমেন ছাড়া সংগ্রাম করতে পারে না এবং দুঃখ কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে পারে না। কারণ তারা তাদের দাওয়াতকে আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। এমনকি দাওয়াতের জন্যে যখন শাহাদাত লাভ অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তখন তারা নিজেদের জীবনের ওপরও দাওয়াতকে অগ্রাধিকার দেয়। তিক্ত ও কষ্টকর সংগ্রামে টিকে থাকতে পারে শুধু তারাই, যারা সবচেয়ে দৃঢ় ও মযবুত ঈমানের অধিকারী, যারা সবচেয়ে কঠিন, অনমনীয় ও অবিচল মনােবলের অধিকারী, যারা আল্লাহর পুরস্কার লাভে অধিকতর আগ্রহী এবং মানুষের কাছ থেকে স্বার্থোদ্ধারে যাদের সর্বাধিক অনীহা। এভাবেই সত্যের দাওয়াত বাতিলের দাওয়াত থেকে পৃথক হয়ে যায়। এভাবেই দৃঢ় ঈমানধারী লােকেরা দুর্বল ঈমানধারী লােকদের থেকে পৃথক হয়ে যায়। এভাবেই ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনে দুঃখ কষ্ট, বাধাবিপত্তি ও ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দৃঢ়চেতা লােকদের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলন সামনে এগুতে থাকে । এসব লােকই ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের বিশ্বস্ত পতাকাবাহী। ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনকে বিজয়ী করতে যা কিছু করা দরকার, তা তারাই করে থাকে এবং এর সুফলও তারাই ভোগ করে থাকে। অতীতে এ ধরনের অমিততেজা লোকেরা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে অনেক মূল্য দিয়ে বিজয় অর্জন করেছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অগ্নি পরীক্ষা তাদেরকে শিখিয়েছে পর্বত প্রমাণ বাধা ডিংগিয়ে কিভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হয়। ভয়ভীতি ও বাধা-বিপত্তি তাদের শক্তি ও মনােবলকেই শুধু নয়, তাদের জ্ঞানকেও বহুগুণ বৃদ্ধি করে। সঞ্চিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শক্তি ও জ্ঞানের এই পুঁজিই তাদের দাওয়াত ও আন্দোলনের প্রেরণার উৎস এবং এই প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েই তারা সুখে দুঃখে সর্বাবস্থায় দাওয়াত ও আন্দোলনের পতাকা সমুন্নত রাখে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যা ঘটে থাকে তা এই যে, অপরাধীদের সাথে ইসলামী আন্দোলনের সাথীদের সংঘর্ষে অধিকাংশ মানুষ প্রথমে নীরব দর্শক হয়ে উপভােগ করে। পরবর্তী পর্যায়ে যখন ইসলামী শিবিরে ক্ষয়-ক্ষতি, কোরবানী ও দুঃখ কষ্টের মাত্রা বেড়ে যায় এবং তখনাে তারা দাওয়াতের কাজে অবিচল থেকে সামনে এগুতে থাকে, তখন নীরব দর্শক জনতা বলে বা ধারণা করে যে, এতাে ক্ষয়ক্ষতি ও দুঃখকষ্টের পর এরা আর দাওয়াতের ওপর টিকে থাকতে পারবে না। তবে এই পর্যায়ে তাদের এ বিশ্বাসও জন্মে যে, এই দাওয়াত ও আন্দোলনে লিপ্ত লােকেরা যা কিছু হারাচ্ছে, তার চেয়েও মূল্যবান একটা কিছু নিশ্চয়ই অর্জন করছে। যা তাদের কাছে যাবতীয় সহায় সম্পত্তি এমনকি তাদের জীবনের চেয়েও অগ্রগণ্য। অবশেষে তারা সেই আকীদা ও আদর্শের সন্ধান পেয়ে যায় যা জীবন ও সহায় সম্পদের চেয়ে মূল্যবান এবং দীর্ঘকাল নীরব দর্শক হয়ে লড়াই দেখার পর দলে দলে ইসলামী আকীদা ও আদর্শকে গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীর জন্যে অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু সৃষ্টি করেছেন। এই উদ্দেশ্যেই অপরাধীদেরকে ইসলামী আন্দোলনের পথে প্রতিবন্ধক শক্তিতে পরিণত করেছেন, আর আন্দোলনকারীদেরকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে করেছেন সংগ্রামমুখর। এতে তাদের ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ যতােই হােক দাওয়াতকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে। ফলাফল আগে থেকেই নির্ধারিত ও পরিচিত। আল্লাহর ওপর যাদের অটুট আস্থা রয়েছে, তারা নির্ভুলভাবে জানে যে, এর ফলে তাদের আর যাই হােক, সত্যের পথের সন্ধান লাভ এবং বিজয় অর্জন তাদের জন্যে সুনিশ্চিত। আল্লাহ তায়ালা তাই বলেছেন, ‘হেদায়েতকারী ও বিজয়দানকারী হিসেবে তােমার প্রভুই যথেষ্ট।’ নবীদের পথে অপরাধী গােষ্ঠীর বাধা হয়ে দাঁড়ানাে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কেননা ইসলামের দাওয়াত ঠিক এমন সময়ই আবির্ভূত হয়, যখন সমাজে বা সমগ্র মানব জাতির ভেতরে পুঞ্জীভূত বিকৃতি শােধরানাের জন্যে তার আগমন অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই বিকৃতি তাদের মনমগয, চরিত্র ও গােটা সমাজ ব্যবস্থায় সংক্রমিত হয়। অপরাধীরাই এই বিকৃতির মূল সংগঠক। তারাই সমাজে বিকৃতি ও দুষ্কৃতির জন্ম দেয় এবং তাকে কাজেও লাগায়। সমস্ত বিকৃতি ও দুষ্কৃতির ধারক বাহকরা ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ থাকে এবং দুষ্কৃতিতে ভরা নােংরা ও অসুস্থ সামাজিক পরিবেশেই জীবন ধারণ করে। কেননা এই সামাজিক পরিবেশেই তাদের বিকৃত মূল্যবােধ টিকে থাকে। আর সে বিকৃত মূল্যবােধ ও বাতিল ধারণা বিশ্বাসই তাদের অস্তিত্ব রক্ষার নিশ্চয়তা দেয় । কাজেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই তাদের নবীদের বিরুদ্ধে ও নবীদের দাওয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ স্বাভাবিক । যে ধরনের সামাজিক পরিবেশ ছাড়া তারা জীবন ধারণ করতে অপারগ, সে পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে তারা যে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে, তা মােটেই অপ্রত্যাশিত নয়। এটা সুবিদিত যে, কোনাে কোনাে পােকা-মাকড় ফুলের সুগন্ধে দম আটকে মরে যায় এবং ময়লা আবর্জনায় ছাড়া তারা জীবন ধারণই করতে পারে না। কোনাে কোনাে কীটপতংগ বহমান পবিত্র পানিতে মারা যায় এবং নােংরা নর্দমা বা আঁস্তাকুড়ে ছাড়া বাঁচে না। মানব সমাজে যারা পাপী ও অপরাধী, তারাও তদ্রুপ। তাই তারা যে ইসলামের দাওয়াতের শত্রু হবে এবং তার মরণপণ প্রতিরােধে লিপ্ত হবে,সেটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আর শেষ পরিণতিতে ইসলামের দাওয়াতই যে বিজয়ী হবে, তাও স্বাভাবিক। কেননা তা জীবনের স্বাভাবিক নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহর সাথে তার মিলিত হওয়া এবং আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তার সর্বোচ্চ উৎকর্ষ ও পূর্ণতা লাভ করা তার জন্যে অবধারিত। ‘তােমার প্রভু হেদায়াতকারী ও সাহায্যকারী হিসাবে যথেষ্ট। এ কথার মর্মার্থ এটাই।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# যে সমস্ত নকল রাজত্ব ও রাজ্যশাসন দুনিয়ায় মানুষকে প্রতারিত করে তা সবই খতম হয়ে যাবে। সেখানে কেবলমাত্র একটি রাজত্বই বাকি থাকবে এবং তা হবে এ বিশ্ব-জাহানের যথার্থ শাসনকর্তা আল্লাহর রাজত্ব। সূরা মু’মিনে বলা হয়েছেঃ يَوْمَ هُمْ بَارِزُونَ لَا يَخْفَى عَلَى اللَّهِ مِنْهُمْ شَيْءٌ لِمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ “সেদিন যখন এরা সবাই প্রকাশ হয়ে যাবে, আল্লাহর কাছে এদের কোন জিনিস গোপন থাকবে না, জিজ্ঞেস করা হবে আজ রাজত্ব কার? সবদিক থেকে জবাব আসবে, একমাত্র আল্লাহর যিনি সবার উপর বিজয়ী।” (১৬ আয়াত) হাদীসে এ বিষয়বস্তুকে আরো বেশী স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আল্লাহ এক হাতে পৃথিবী ও অন্য হাতে আকাশ নিয়ে বলবেনঃ أَنَا الْمَلِكُ أَنَا الدَّيَّانُ أَيْنَ مُلُوكُ الأَرْضِ؟ أَيْنَ الْجَبَّارُونَ؟ أَيْنَ الْمُتَكَبِّرُونَ؟ “আমিই বাদশাহ, আমিই শাসনকর্তা। এখন সেই পৃথিবীর বাদশাহরা কোথায়? কোথায় স্বৈরাচারী একনায়কের দল? অহংকারী ক্ষমতাদর্পীরা কোথায়?” (মুসনাদে আহমদ, বুখারী, মুসলিম ও আবু দাউদে সামান্য শাব্দিক হেরফের সহকারে এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে)।
# এটিও কাফেরদের উক্তির একটি অংশ হতে পারে। আবার এও হতে পারে যে, তাদের উক্তির উপর এটি আল্লাহর নিজের উক্তি। দ্বিতীয় অবস্থায় এর যথার্থ উপযোগী অনুবাদ হবে, “আর ঠিক সময়ে মানুষকে প্রতারণা করার জন্য শয়তান তো আছেই।”
# মূল শব্দ مَهْجُورًا —এর কয়েকটি অর্থ হয়। যদি একে هجر থেকে গঠিত ধরা হয় তাহলে অর্থ হবে পরিত্যক্ত। অর্থাৎ তারা কুরআনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে বলে মনেই করেনি, তাকে গ্রহণ করেনি এবং তার থেকে কোনভাবে প্রভাবিতও হয়নি। আর যদি একে هجر থেকে গঠিত ধরা হয় তাহলে এর দু’টি অর্থ হতে পারেঃ এক, তারা একে প্রলাপ ও অর্থহীন বাক্য মনে করেছে। দুই, তারা একে নিজেদের প্রলাপ ও অর্থহীন বাক্য প্রয়োগের লক্ষ্যস্থলে পরিণত করেছে এবং একে নানান ধরনের বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে থেকেছে।
# আজ তোমার সাথে যে শত্রুতা করা হচ্ছে এটা কোন নতুন ব্যাপার নয়। আগেও এমনটি হয়ে এসেছে। যখনই কোন নবী সত্য ও সততার দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তখনই অপরাধজীবী লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে আদাপানি খেয়ে লেগেছে। এ বিষয়বস্তুটি সূরা আন’আমের ১১২-১১৩ আয়াতে আলোচিত হয়েছে। আর “আমি তাদের শত্রুতে পরিণত করে দিয়েছি।” মর্মে এ কথাটি বলা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে এই যে, আমার প্রাকৃতিক আইন এ রকমই। কাজেই আমার এ ইচ্ছার ওপর সবর করো এবং প্রাকৃতিক আইনের আওতায় যেসব অবস্থার সম্মুখীন হওয়া অপরিহার্য ঠাণ্ডা মাথায় দৃঢ় সংকল্প সহকারে সেগুলোর মোকাবিলা করতে থাকো। একদিকে তুমি সত্যের দাওয়াত দেবার সাথে সাথেই দুনিয়ার বিরাট অংশ তা গ্রহণ করার জন্য দৌঁড়ে আসবে এবং সকল দুস্কৃতিকারী নিজের যাবতীয় দুষ্কৃতি যোগ করে সত্যের দাওয়াতকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরবে এমনটি আশা করো না।
# পথ দেখানো অর্থ কেবলমাত্র সত্যজ্ঞান দান করাই নয় বরং ইসলামী আন্দোলনকে সাফল্যের সাথে চালানো এবং শত্রুদের কৌশল ব্যর্থ করার জন্য যথাসময়ে সঠিক ব্যবস্থা অবলম্বন করার পথও দেখিয়ে দেয়া বুঝায়। আর সাহায্য মানে হচ্ছে সব ধরনের সাহায্য। যতগুলো ময়দানে হক ও বাতিলের সংঘাত হয় তার প্রত্যেকটিতে হকের সমর্থনে সাহায্য পৌঁছানো আল্লাহর কাজ। যুক্তির লড়াই হলে তিনিই সত্যপন্থীদেরকে সঠিক ও পূর্ণশক্তিশালী যুক্তি সরবরাহ করেন। নৈতিকতার লড়াই হলে তিনিই সবদিক থেকে সত্যপন্থীদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। সংগঠন-শৃংখলার মোকাবিলা হলে তিনিই বাতিলপন্থীদের হৃদয় ছিন্নভিন্ন এবং হকপন্থীদের হৃদয় সংযুক্ত করেন। মানবিক শক্তির মোকাবেলা হলে তিনিই প্রতিটি পর্যায়ে যোগ্য ও উপযোগী ব্যক্তিবর্গ ও গ্রুপসমূহ সরবরাহ করে হকপন্থীদের দলের শক্তি বৃদ্ধি করেন। বস্তুগত উপকরণের প্রয়োজন হলে তিনিই সত্যপন্থীদের উপকরণের প্রাচুর্য তার মোকাবিলায় নিছক একটি প্রতারণাই প্রমাণিত হয়। মোটকথা সাহায্য দেয়া ও পথ দেখানোর এমন কোন দিক নেই যেখানে সত্যপন্থীদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট নন এবং তাদের অন্য কারো সাহায্য-সহায়তা নেবার প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, আল্লাহর তাদের জন্য যথেষ্ট হওয়ার ওপর তাদের বিশ্বাস ও আস্থা থাকতে হবে এবং তারা কোন প্রকার প্রচেষ্টা না চালিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকতে পারবে না। বরং তৎপরতা সহকারে বাতিলের মোকাবিলায় হকের মাথা উঁচু রাখার জন্য লড়ে যেতে হবে।
একথা মনে রাখতে হবে, আয়াতের এ দ্বিতীয় অংশটি না হলে প্রথম অংশ হতো বড়ই হতাশাব্যঞ্জক। এক ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে, আমি জেনে বুঝে তোমাকে এমন একটি কাজের দায়িত্ব দিয়েছি যা শুরু করার সাথে সাথেই দুনিয়ার যত কুকুর ও নেকড়ে তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে—এর চেয়ে বড় উৎসাহ ভঙ্গকারী জিনিস তার জন্য আর কী হতে পারে! কিন্তু এ ঘোষণার সমস্ত ভীতি এ সান্ত্বনাবাণী শুনে দূর হয়ে যায় যে, এ প্রাণান্তকর সংঘাতের ময়দানে নামিয়ে দিয়ে তোমাকে আমি একাকী ছেড়ে দেইনি বরং তোমার সাহায্যার্থে আমি নিজেই রয়েছি। অন্তরে ঈমান থাকলে এর চেয়ে বেশী সাহস সঞ্চারী কথা আর কি হতে পারে যে, সারা বিশ্ব-জাহানের মালিক আল্লাহ নিজেই আমাদের সাহায্যদান ও পথ দেখাবার দায়িত্ব নিচ্ছেন। এরপর তো শুধুমাত্র একজন হতোদ্যম কাপুরুষই ময়দানে এগিয়ে যেতে ইতস্তত করতে পারে।