أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯১)
[ *পর্যায়ক্রমে কোরআন নাজিলের তাৎপর্য :-]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৯
৩২-৩৪ নং আয়াত:-
২৫:৩২
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لَوۡ لَا نُزِّلَ عَلَیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ جُمۡلَۃً وَّاحِدَۃً ۚۛ کَذٰلِکَ ۚۛ لِنُثَبِّتَ بِہٖ فُؤَادَکَ وَ رَتَّلۡنٰہُ تَرۡتِیۡلًا ﴿۳۲﴾
আর কাফেররা বলে, ‘সমগ্র কুরআন তার কাছে একবারে নাযিল হলো না কেন?’ এভাবেই আমরা নাযিল করেছি আপনার হৃদয়কে তা দ্বারা মযবুত করার জন্য এবং তা ক্রমে ক্ৰমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি।
২৫:৩৩
وَ لَا یَاۡتُوۡنَکَ بِمَثَلٍ اِلَّا جِئۡنٰکَ بِالۡحَقِّ وَ اَحۡسَنَ تَفۡسِیۡرًا ﴿ؕ۳۳﴾
ওরা তোমার নিকট কোন সমস্যা উপস্থিত করলেই আমি তোমাকে ওর সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা দান করি।
২৫:৩৪
اَلَّذِیۡنَ یُحۡشَرُوۡنَ عَلٰی وُجُوۡہِہِمۡ اِلٰی جَہَنَّمَ ۙ اُولٰٓئِکَ شَرٌّ مَّکَانًا وَّ اَضَلُّ سَبِیۡلًا ﴿٪۳۴﴾
–যাদেরকে উপুড় করে জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেয়া হবে তাদের অবস্থান বড়ই খারাপ এবং তাদের পথ সীমাহীন ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এই আপত্তিটাই ছিল মক্কার কাফেরদের খুবই প্রিয় ও যুৎসই। তাদের মতে এ আপত্তিটি খুবই শক্তিশালী। এজন্য বারবার তারা এর পুনরাবৃত্তি করতো। কুরআনেও বিভিন্ন স্থানে এটি উদ্ধৃত করে এর জবাব দেয়া হয়েছে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নমল ১০১-১০৬ ও বনী ইসরাঈল ১১৯ টীকা ) তাদের প্রশ্নের অর্থ ছিল, যদি ব্যক্তি নিজে চিন্তা-ভাবনা করে অথবা কারো কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে এবং বিভিন্ন কিতাব থেকে নকল করে এসব বিষয়বস্তু না এনে থাকে বরং যদি সত্যি সত্যিই এটি আল্লাহর কিতাব হয়, তাহলে সমগ্র কিতাবটি একই সময়ে একই সঙ্গে নাযিল হচ্ছে না কেন? আল্লাহ যা বলতে চান তা তো তিনি ভালো করেই জানেন। যদি তিনি এগুলোর নাযিলকারী হতেন তাহলে সব কথা এক সাথেই বলে দিতেন। এই যে চিন্তা-ভাবনা করে বিভিন্ন সময় কিছু কিছু বিষয় আনা হচ্ছে এগুলো একথার সুস্পষ্ট আলামত যে, অহী উপর থেকে নয় বরং এখানেই কোথাও থেকে আহরণ করা হচ্ছে অথবা নিজেই তৈরী করে সরবরাহ করার কাজ চলছে।
# অন্য অনুবাদ এও হতে পারেঃ “এর মাধ্যমে আমি তোমার অন্তরকে শক্তিশালী করি” অথবা “তোমার বুকে হিম্মত সঞ্চার করি।” শব্দগুলোর মধ্যে উভয় অর্থই রয়েছে এবং উভয় অর্থই এখানে প্রযোজ্য। এভাবে একই বাক্যে কুরআন পর্যায়ক্রমে নাযিল করার বহুতর কারণ বর্ণনা করা হয়েছেঃ
একঃ স্মৃতির ভাণ্ডারে একে হুবহু ও অক্ষরে অক্ষরে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। লেখার আকারে নয় বরং একজন নিরক্ষর নবীর মাধ্যমে নিরক্ষর মানব গোষ্ঠীর মধ্যে মৌখিক ভাষণের আকারে এর প্রচার ও প্রসার হচ্ছে।
দুইঃ এর শিক্ষাগুলো ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যেতে পারে। এজন্য থেমে থেমে সামান্য সামান্য কথা বলা এবং একই কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণনা করাই বেশী উপযোগী হয়।
তিনঃ এ কিতাব যে জীবন পদ্ধতির কথা বলেছে তার উপর মন স্থির হয়ে যেতে থাকে। এজন্য নির্দেশ ও বিধানসমূহ পর্যায়ক্রমে নাযিল হওয়াটাই বেশী যুক্তিসঙ্গত। অন্যথায় যদি সমস্ত আইন-কানুন এবং সমগ্র জীবন ব্যবস্থা একই সঙ্গে বর্ণনা করে তা প্রতিষ্ঠিত করার হুকুম দেয়া হতো তা হলে চেতনা বিশৃংখল হয়ে যেতো। তাছাড়া এটাও বাস্তব সত্য যে, প্রত্যেকটি হুকুম যদি যথাযথ ও উপযুক্ত সময়ে দেয়া হয় তাহলে তার জ্ঞানবত্তা ও প্রাণসত্তা বেশী ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। অন্যদিকে সমস্ত বিধান, ধারা ও উপধারা অনুসারে সাজিয়ে একই সঙ্গে দিয়ে দিলে এ ফল পাওয়া যেতে পারে না।
চারঃ ইসলামী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে যখন হক ও বাতিলের লাগাতার সংঘাত চলে সে সময় নবী ও তাঁর অনুসারীদের মনে সাহস সঞ্চার করে যেতে হবে। এজন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একবার একটি লম্বা-চওড়া নির্দেশনামা পাঠিয়ে দিয়ে সারা জীবন সমগ্র দুনিয়ার যাবতীয় বাঁধা-বিপত্তির মোকাবিলা করার জন্য তাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেবার তুলনায় বার বার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের কাছে পয়গাম আসা বেশী কার্যকর হয়ে থাকে। প্রথম অবস্থায় মানুষ মনে করে সে প্রবল বাত্যা বিক্ষুব্ধ তরংগের মুখে পড়ে গেছে। আর দ্বিতীয় অবস্থায় মানুষ অনুভব করে, যে আল্লাহ তাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছেন তিনি তার প্রতি দৃষ্টি রেখেছেন। তার কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তার অবস্থা দেখছেন, তার সমস্যা ও সংকটে তাকে পথ দেখাচ্ছেন এবং প্রত্যেকটি প্রয়োজনের সময় তাকে তাঁর সামনে হাজির হবার ও সম্বোধন করার সৌভাগ্য দান করে তার সাথে নিজের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে থেকেছেন। এ জিনিসটি তার উৎসাহ বৃদ্ধি এবং সংকল্প সুদৃঢ় করে।
# এটি হচ্ছে পর্যায়ক্রমে কুরআন নাযিল করার পদ্ধতি অবলম্বনের আর একটি কারণ। কুরআন মজীদ নাযিল করার কারণ এ নয় যে, আল্লাহ “বিধানাবলী” সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করতে চান এবং এর প্রচারের জন্য নবীকে তাঁর এজেন্ট নিয়োগ করেছেন। আসল ব্যাপার যদি এটাই হতো, তাহলে পুরো বইটি লেখা শেষ করে একই সময় এজেন্টের হাতে সম্পূর্ণ বইটি তুলে দেবার দাবী যথার্থ হতো। কিন্তু আসলে এর নাযিলের কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ কুফরী, জাহিলীয়াত ও ফাসেকীর মোকাবিলায় ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও আল্লাহভীতির একটি আন্দোলন পরিচালনা করতে চান এবং এ উদ্দেশ্যে তিনি একজন নবীকে আহবায়ক ও নেতা হিসেবে সামনে এনেছেন। এ আন্দোলন চলাকালে একদিকে যদি তিনি আহবায়ক ও তার অনুসারীদের প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা ও নির্দেশনা দেয়া নিজের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে থাকেন তাহলে অন্যদিকে এটাও নিজ দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছেন যে, বিরোধীরা যখনই কোন আপত্তি বা সন্দেহ অথবা জটিলতা পেশ করবে তখনই তিনি তার সঠিক ব্যাখ্যা করে দেবেন এবং যখনই তারা কোন কথার ভুল অর্থ করবে তখনই তিনি তার সঠিক ব্যাখ্যা করে দেবেন। এরূপ রকমারি প্রয়োজনের জন্য যেসব ভাষণ আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হচ্ছে সেগুলোর সমষ্টির নাম কুরআন। এটি কোন আইন, নৈতিকতা বা দর্শনের কিতাব নয় বরং একটি আন্দোলনের কিতাব। আর এর প্রতিষ্ঠার সঠিক প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে তা শুরু হবে এবং শেষ পর্ব পর্যন্ত যেভাবে আন্দোলন চলতে থাকবে এও সাথে সাথে সুযোগ ও প্রয়োজন অনুযায়ী নাযিল হতে থাকবে। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, ১ম খন্ড, ভূমিকা, ৯-২০ পৃষ্ঠা)
# যারা সোজা কথাকে উল্টোভাবে চিন্তা করে এবং উল্টো ফলাফল বের করে তাদের বুদ্ধি উল্টোমুখো হয়েছে। এ কারণেই তারা কুরআনের সত্যতা প্রমাণ পেশকারী প্রকৃত সত্যগুলোকে তাদের মিথ্যা হবার প্রমাণ গণ্য করছে। আর এজন্যই তাদেরকে নিম্নমুখী করে মুখের উপর জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*পর্যায়ক্রমে কোরআন নাজিলের তাৎপর্য : এরপর আবার কোরআনের দাওয়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী অপরাধী গােষ্ঠীর বিভিন্ন কথার পর্যালােচনা করা ও জবাব দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে একটা হলাে, কাফেররা বলে মােহাম্মদের ওপর সমস্ত কোরআন একসাথে নাযিল হয় না কেন। ‘এভাবেই নাযিল হবে যাতে আমি তােমার মনকে স্থির ও মযবুত করে দেই, আর (এ কারণেই) আমি কোরআনকে থেমে থেমে নাযিল করি।’ এই কোরআন এসেছে একটা জাতি, একটা সমাজ ও একটা রাষ্ট্র গঠন করার উদ্দেশ্যে। আর এই গঠন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় প্রয়ােজন, গােটা সমাজ তার বাণী দ্বারা প্রভাবিত হওয়া প্রয়ােজন এবং এই প্রভাবকে বাস্তবে রূপদান করত পারে এমন একটা জোরদার আন্দোলনের প্রয়ােজন। নতুন বিধানের ধারক একখানা পূর্ণাংগ পুস্তক পড়ে রাতারাতি নিজেকে পুরােপুরিভাবে বদলে ফেলা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সে একটু একটু করে নতুন বিধানের এক এক অংশ প্রয়ােগ করে পর্যায়ক্রমে নিজেকে তা দ্বারা প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করতে পারে। এর দায়িত্ব বহনে সে ক্রমে ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে থাকে। একটা বিশাল ও কঠিন কাজ সে সহসাই সম্পন্ন করতে পারে না। তাকে যদি প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট ও সহনীয় পরিমাণে ডােজ দেয়া হয়, তবে সে পরের দিন পরবর্তী ডোজ গ্রহণের যােগ্যতা অর্জন করে এবং পরবর্তী ডােজ তার কাছে অধিকতর সুস্বাদু লাগে। পবিত্র কোরআন সমগ্র মানব জীবনের জন্যে একটা পূর্ণংগ বিধান নিয়ে এসেছে। সেই সাথে সে এমন একটা প্রশিক্ষণ পদ্ধতিও নিয়ে এসেছে যা মানুষের জন্মগত স্বভাব প্রকৃতির সাথে সংগতিশীল এবং স্রষ্টার কাছ থেকে সে মানুষকে যথাযথ জ্ঞান অর্জনও করে। এ জন্যে সে-মুসলিম সমাজের নৈমিত্তিক প্রয়োজন পূরণের উপযােগী জ্ঞানের ভান্ডার হয়ে এসেছে। আল্লাহর প্রশিক্ষণ পদ্ধতির অধীনে ক্রমবর্ধমান আকারে মুসলমানদের যােগ্যতা অনুসারে নিয়মিত উন্নতি ও অগ্রগতির পথে ধাবিত হওয়ার জন্যে এ কেতাব পথ প্রদর্শক হয়ে এসেছে। এ কেতাব মানুষের জীবন যাপনের ও প্রশিক্ষণের পদ্ধতি নিয়ে এসেছে যে, শুধু জ্ঞান ও আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে পড়ার জন্যেই আসেনি যে, কোরআন এসেছে তাকে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত করার জন্যে। কোরআন এ জন্যে এসেছে এর আয়াতগুলাে মুসলমানদের জন্য দৈনন্দিন নির্দেশরূপে পরিগণিত হবে এবং তারা তা তাৎক্ষণিকভাবে পালন করবে যেমন সৈনিক রণাংগনে বা সেনা শিবিরে করে থাকে। শুধু আদেশ পালনে নিজেকে বাধ্য মনে করে পালন করবে না যথাযথভাবে বুঝে সুঝে, পূর্ণ আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে করবে। এ উদ্দেশ্যেই কোরআন থেমে থেমে ক্রমান্বয়ে নাযিল হয়েছে। সর্বপ্রথম সে রসূল(স.)-এর অন্তরে এর শিক্ষা বদ্ধমূল করে এবং পর্যায়ক্রমে এক অংশের পর আর এক অংশ প্রয়ােজন অনুসারে শিক্ষা দেয়। এভাবেই নাযিল করা হয়েছে, যাতে এটা আমি তােমার অন্তরে বদ্ধমূল করি আর একে পর্যায়ক্রমে পড়ে নাই। এখানে ‘তারতীল’ শব্দটা দ্বারা পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া বুঝানাে হয়েছে, যা আল্লাহর সুক্ষ্ম জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মুমিনের হৃদয়ের গ্রহণক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুসারে কার্যকর করা হয়। কোরআন তার এই পর্যায়ক্রমিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি প্রয়ােগ করে অলৌকিক সাফল্যের সাক্ষর রেখেছে। মুসলমানরা এই পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে কুরআন শেখার কারণে নিজেদের জীবন কোরআনের সাথে এতাে সংগতিশীল করতে পেরেছে যে, তাকে অলৌকিক সাফল্য বলা যায় । পরবর্তীকালে মুসলমানরা যখন এই পদ্ধতির কথা ভুলে গেছে এবং কোরআনকে নিছক সাংস্কৃতিক বিনােদন ও নিছক তেলাওয়াত কেন্দ্রিক এবাদাতের পুস্তক হিসেবে গ্রহণ করেছে, প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও জীবন পদ্ধতির পুস্তক হিসেবে গ্রহণ করেনি, তখন তা দ্বারা তাদের উপকৃত হওয়ার সুযােগ তিরােহিত হয়ে গেছে। কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা এ দ্বারা উপকৃত হওয়ার যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন, তাকে তারা উপেক্ষা করেছে। পরবর্তী আয়াতে রসূল(স.)-কে আরাে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, মােশরেকরা যখনই নতুন করে কোনাে বিতর্ক বা আপত্তি তুলবে, অমনি রাসূল(স.)-কে অকাট্য প্রমাণাদি সরবরাহ করা হবে। তারা যখনই তােমার কাছে নতুন কোনাে উদাহরণ নিয়ে আসবে, অমনি আমি তােমার কাছে অকাট্য সত্য ও উৎকৃষ্টতর ব্যাখ্যা পাঠান। এ কথা সুবিদিত যে, মােশরেকরা বাতিল ও অসত্য যুক্তি দিয়ে লড়াই করে থাকে। আর আল্লাহ তায়ালা সত্য দিয়ে তাদের সেই বাতিলকে খন্ডন করেন। কোরআন শুধু যে তর্কে রসূলের বিজয় লাভ নিশ্চিত করতে চায় তা নয়, বরং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে কোরআনের আসল লক্ষ্য। আর সত্য সত্যিই শক্তিশালী ও সুস্পষ্ট, বাতিলের সাথে তার কখনাে মিশ্রণ বা ভেজাল হয় না। রসূল(স.)-এর সাথে তার জাতির সকল তর্কযুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা তাকে সাহায্য করবেন বলে যে ওয়াদা করেছেন, তার কারণ এই যে, তিনি নির্ভেজাল সত্যের ওপর বহাল রয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে সত্য দিয়ে সাহায্য করেন, যা বাতিলের ওপর বিজয়ী হয়ে থাকে। সুতরাং তাদের বিতর্ক আল্লাহর অকাট্য যুক্তির কাছে টিকতেই পারে না। আল্লাহর কাছ থেকে আগত সত্য তাদের বাতিলের সাথে সহাবস্থান করতেই পারে না, বরং তাকে খন্ডন করার জন্যেই সে এসে থাকে। অতপর এ অধ্যায়টা শেষ হচ্ছে কেয়ামতের দিন কাফেরদেরকে উপুড় করে জাহান্নামের দিকে পাঠানাের দশ্য বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এটা হবে তাদের পক্ষ থেকে সত্যকে প্রত্যাখ্যান ও তাদের নিল বিতর্কে উল্টো যুক্তি পেশ করার শাস্তি, তাদের উপুড় করে জাহান্নামের দিকে পাঠানাে হইবে, তারা হলাে নিকৃষ্টতম স্থানের অধিবাসী এবং সবচেয়ে বিপথগামী। উপুড় করে জাহান্নামে পাঠানােটা আসলে তাদের সত্যকে উপেক্ষা করা ও অহংকার করার ঠিক বিপরীত অপমান ও তাচ্ছিল্যজনক শাস্তি। এ দৃশ্যটা রসূল(স.)-এর সামনে তুলে ধরার উদ্দেশ্য তার সাথে তাদের অসদাচরণের জন্যে তাকে সান্তনা দান। একই সাথে এ দৃশ্য কাফেরদেরকেও দেখিয়ে তাদেরকে হুঁশিয়ার করা হচ্ছে যে, তাদের জন্যে ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষমান। এ দৃশ্যটা তুলে ধরাই তাদের গর্ব ও অহংকারকে ধুলােয় মিশিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। হুঁশিয়ারী কাফেরদেরকে প্রচন্ডভাবে আতংকিত করতাে। কিন্তু তারা তৎক্ষণাত নিজেদেরকে সামনে নিতো এবং তাদের জিদ ও হঠকারিতা অব্যাহত রাখতাে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩২-৩৪ নং আয়াতের তাফসীর:
(وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا….) শানে নুযূল:
ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনন মুশরিকরা বলত, যদি মুহাম্মাদ তাঁর কথা অনুযায়ী নাবীই হয় তাহলে তার প্রতিপালক তাকে শাস্তি দেবেন না। যদি এমনটিই হয় তাহলে তার ওপর কুরআন একত্রে নাযিল হয় না কেন, তাঁর ওপর এক আয়াত, দুই আয়াত এভাবে নাযিল হয় কেন। তখন এ আয়াতটি নাযিল হয়। (হাকিম এটা সহীহ বলেছেন, লুবানুল নুকূল পৃঃ ২০৩)
পূর্বের আয়াতগুলো থেকেই কাফেরদের আলোচনা চলে আসছে। এখানেও কাফিরদের সম্পকে আলোচনা করা হয়েছে যারা কুরআনকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের অভিযোগ, কুরআন কেন পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব তাওরাত ইঞ্জিলের মত একত্রে নাযিল হল না? কেউ বলেছেন: এ কথা মক্কার কুরাইশরা বলেছিল। ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: যখন কুরআন খণ্ড খণ্ড আকারে নাযিল হতে লাগল তখন ইয়াহূদীরা বলতে লাগল, কেন কুরআন একত্রে নাযিল হয় না; যেমন তাওরাত, ইঞ্জিল একত্রে নাযিল হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে খণ্ড খণ্ড আকারে নাযিল করার হেকমত বর্ণনা করছেন যে, যাতে কুরআনের মাধ্যমে তোমার অন্তর দীনের ওপর অটল রাখতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাওয়াতী কাজে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতেন, মানুষ দাওয়াত বর্জন করত, বিভিন্নভাবে কষ্ট দিত। এসব কষ্ট সহ্য করেও তিনি দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যেতেন, তিনি চাইতেন তারপরেও মানুষ ঈমান আনুক। ফলে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সময় সান্ত্বনা, পূর্ববর্তী নাবীগণের কষ্টময় জীবন ইত্যাদি মাঝে মাঝে তুলে ধরতেন যাতে এসব কষ্ট তিনি সহজে সহ্য করে নেন এবং তাতে অটল থাকতে পারেন। এছাড়াও আরো অনেক হেকমত রয়েছে।
(وَرَتَّلْنٰهُ تَرْتِيْلًا)
অর্থাৎ থেমে থেমে অবকাশ দিয়ে নাযিল করেছেন যাতে কোন সমস্যা উপস্থিত হলে সমাধান দিতে পারা যায়। সুতরাং কোরআন ক্রমে ক্রমে নাযিল করা; একত্রে নাযিল না করা ঈমান না আনার কোন কারণ হতে পারে না।
(وَلَا يَأْتُوْنَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئْنٰكَ بِالْحَقِّ)
অর্থাৎ সত্যকে প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ করার জন্য তারা যে কোন প্রকার উপমা নিয়ে আসুক, আমি তোমার ওপর নাযিল করব যা সত্য ও পরিপূর্ণ বর্ণনা সম্বলিত থাকবে। এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: যে সকল কাফির-মুশরিকদেরকে কিয়ামতের দিন মুখের ওপর ভর দিয়ে জাহান্নামে উপস্থিত করা হবে অবস্থানের দিক দিয়ে তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও পথভ্রষ্ট।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কুরআন খণ্ড খণ্ড আকারে নাযিল করার হেকমত জানতে পারলাম।
২. কিয়ামতের দিন কাফিরদেরকে মুখের ওপর ভর করে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩২-৩৪ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা কাফিরদের অত্যধিক প্রতিবাদ, হঠকারিতা এবং নিরর্থক কথার খবর দিতে গিয়ে বলেনঃ “সমগ্র কুরআন তার উপর (মুহাম্মাদ সঃ-এর উপর) একবারে অবতীর্ণ হলো না কেন?’ এ কথা তারা বলেছিল। অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর যে কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ করা হয়েছে তা একযোগেই কেন অবতীর্ণ হয়নি যেমন তার পূর্বে আসমানী কিতাবসমূহ একযোগে অবতীর্ণ হয়েছিল, যেমন তাওরাত, ইঞ্জীল, যনূর ইত্যাদি? তাদের এ প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, তিনি কুরআনকে ক্রমান্বয়ে তেইশ বছরে ঘটনাবলী ও প্রয়োজনীয় বিধান অনুপাতে অবতীর্ণ করেছেন যাতে এর দ্বারা মুমিনদের হৃদয় মজবুত হয়। এজন্যেই তিনি বলেনঃ এভাবেই আমি অবতীর্ণ করেছি তোমার হৃদয়কে ওটা দ্বারা মজবুত করবার জন্যে এবং আমি ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করেনি যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করিনি। অর্থাৎ হে নবী (সঃ)! তারা তোমার কাছে যে কোন সমস্যা উপস্থিত করেছে তারই সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করেছি। কুরআন ও রাসূল (সঃ)-এর দোষ-ত্রুটি বের করার উদ্দেশ্যে কাফির ও মুশরিকরা যখনই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে সাথে সাথে আল্লাহর পক্ষ হতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাদের ঐ প্রশ্নের উত্তর সম্বলিত আয়াত নিয়ে হাযির হয়েছেন। এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বড় মর্যাদা যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট হতে সকাল-সন্ধ্যায়, দিনে-রাত্রে, সফরে ও বাড়ীতে তাঁর অহী আসতে থেকেছে। প্রত্যেকবারই ফেরেশতা তাঁর কাছে কুরআন নিয়ে এসেছেন। কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার এই পদ্ধতি পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ অবতীর্ণ হওয়ার পদ্ধতির বিপরীত ছিল। এর দ্বারা সমস্ত নবীর উপর এ নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রমাণিত হচ্ছে। সুতরাং কুরআন হলো আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব এবং হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী।
আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমের মধ্যে একই সাথে দু’টি বিশেষণ একত্রিত করেছেন। ঊর্ধ্ব জগতের লাওহে মাহফুয হতে দুনিয়ার আকাশের বায়তুল ইযযায় একযোগে এটা অবতীর্ণ হয়েছে। অতঃপর ঘটনার অনুপাতে ক্রমান্বয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হতে থেকেছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেনঃ “কদরের রাত্রে কুরআন কারীম দুনিয়ার আকাশে একযোগে অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর বিশ বছরে অল্প অল্প করে দুনিয়ায় অবতীর্ণ হতে থেকেছে। (এটা ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এখানে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করেনি যার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে দান করিনি।” অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি খণ্ড খণ্ডভাবে যাতে তুমি মানুষের নিকট পাঠ করতে পার ক্রমে ক্রমে এবং আমি ওটা ক্রমশঃ অবতীর্ণ করেছি।” (১৭: ১০৬)
এরপর আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের দুরবস্থা, কিয়ামতের দিন তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল এবং অত্যন্ত জঘন্য অবস্থায় ও নিকৃষ্ট বিশেষণে তাদের জাহান্নামে একত্রিত হওয়ার সংবাদ দিতে গিয়ে বলেনঃ যাদেরকে মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় জাহান্নামের দিকে একত্রিত করা হবে, তাদেরই স্থান হবে অতি নিকৃষ্ট এবং তারাই পথভ্রষ্ট।
সহীহ হাদীসে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক জিজ্ঞেস করেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কিয়ামতের দিন কাফিরকে কিভাবে মুখের ভরে চলা অবস্থায় একত্রিত করা হবে?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “নিশ্চয়ই যিনি তাকে পায়ের ভরে চালিয়ে থাকেন তিনিই তাকে মুখের ভরে চালাতেও সক্ষম।” মুজাহিদ (রঃ), হাসান (রাঃ), কাতাদা (রঃ) এবং আরো বহু মুফাসসির এরূপই বর্ণনা করেছেন।