(বই#৯৯২) *[ প্রবৃত্তির দাসত্ব মানুষকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট করে দেয় :-] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯২)
*[ প্রবৃত্তির দাসত্ব মানুষকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট করে দেয় :-]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৯
৩৫-৪৪ নং আয়াত:-
২৫:৩৫
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡکِتٰبَ وَ جَعَلۡنَا مَعَہٗۤ اَخَاہُ ہٰرُوۡنَ وَزِیۡرًا ﴿ۚۖ۳۵﴾
আমি অবশ্যই মূসাকে গ্রন্থ দিয়েছিলাম এবং তার ভাই হারূনকে করেছিলাম তার সহযোগী।
২৫:৩৬
فَقُلۡنَا اذۡہَبَاۤ اِلَی الۡقَوۡمِ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا ؕ فَدَمَّرۡنٰہُمۡ تَدۡمِیۡرًا ﴿ؕ۳۶﴾
এবং বলেছিলাম, ‘তোমরা সে সম্প্রদায়ের নিকট যাও, যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যাজ্ঞান করেছে।’ অতঃপর আমি সে সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করেছিলাম।
২৫:৩৭
وَ قَوۡمَ نُوۡحٍ لَّمَّا کَذَّبُوا الرُّسُلَ اَغۡرَقۡنٰہُمۡ وَ جَعَلۡنٰہُمۡ لِلنَّاسِ اٰیَۃً ؕ وَ اَعۡتَدۡنَا لِلظّٰلِمِیۡنَ عَذَابًا اَلِیۡمًا ﴿ۚۖ۳۷﴾
নূহের সম্প্রদায় যখন রসূলগণকে মিথ্যা মনে করল, তখন আমি ওদেরকে নিমজ্জিত করলাম এবং ওদেরকে মানবজাতির জন্য নিদর্শনস্বরূপ করে রাখলাম। আর সীমালংঘনকারীদের জন্য আমি মর্মন্তুদ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।
২৫:৩৮
وَّ عَادًا وَّ ثَمُوۡدَا۠ وَ اَصۡحٰبَ الرَّسِّ وَ قُرُوۡنًۢا بَیۡنَ ذٰلِکَ کَثِیۡرًا ﴿۳۸﴾
আর আমরা ধ্বংস করেছিলাম ‘আদ, সামূদ, ‘রাস্‌’ -এর অধিবাসীকে এবং তাদের অন্তর্বর্তীকালের বহু প্ৰজন্মকেও৷
২৫:৩৯
وَ کُلًّا ضَرَبۡنَا لَہُ الۡاَمۡثَالَ ۫ وَ کُلًّا تَبَّرۡنَا تَتۡبِیۡرًا ﴿۳۹﴾
তাদের প্রত্যেককে আমি (পূর্বে ধ্বংস প্রাপ্তদের) দৃষ্টান্ত দিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছি এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেককে ধ্বংস করে দিয়েছি।
২৫:৪০
আর তারা তো সে জনপদ দিয়েই যাতায়াত করে যার উপর বর্ষিত হয়েছিল অকল্যাণের বৃষ্টি, তবে কি তারা এসব দেখতে পায় না ? বস্তুত তারা পুনরুত্থানের আশাই করে না।
২৫:৪১
وَ اِذَا رَاَوۡکَ اِنۡ یَّتَّخِذُوۡنَکَ اِلَّا ہُزُوًا ؕ اَہٰذَا الَّذِیۡ بَعَثَ اللّٰہُ رَسُوۡلًا ﴿۴۱﴾
ওরা যখন তোমাকে দেখে, তখন ওরা তোমাকে কেবল উপহাসের পাত্ররূপে গণ্য করে এবং বলে, ‘এই কি সেই; যাকে আল্লাহ রসূল করে পাঠিয়েছেন?
২৫:৪২
اِنۡ کَادَ لَیُضِلُّنَا عَنۡ اٰلِہَتِنَا لَوۡ لَاۤ اَنۡ صَبَرۡنَا عَلَیۡہَا ؕ وَ سَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ حِیۡنَ یَرَوۡنَ الۡعَذَابَ مَنۡ اَضَلُّ سَبِیۡلًا ﴿۴۲﴾
‘সে তো আমাদেরকে আমাদের উপাস্যগণ হতে দূরে সরিয়েই দিত, যদি না আমরা তাদের আনুগত্যের উপর অবিচল থাকতাম।’ আর যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন জানতে পারবে কে অধিক পথভ্ৰষ্ট।
২৫:৪৩
اَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰـہَہٗ ہَوٰىہُ ؕ اَفَاَنۡتَ تَکُوۡنُ عَلَیۡہِ وَکِیۡلًا ﴿ۙ۴۳﴾
তুমি কি দেখ না তাকে, যে তার কামনা-বাসনাকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার কর্মবিধায়ক হবে।
২৫:৪৪
اَمۡ تَحۡسَبُ اَنَّ اَکۡثَرَہُمۡ یَسۡمَعُوۡنَ اَوۡ یَعۡقِلُوۡنَ ؕ اِنۡ ہُمۡ اِلَّا کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ ہُمۡ اَضَلُّ سَبِیۡلًا ﴿٪۴۴﴾
তুমি কি মনে করো তাদের অধিকাংশ লোক শোনে ও বোঝে? তারা পশুর মতো বরং তারও অধম।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি : এরপর তাদেরকে অতীতের সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী শুনানাে হচ্ছে, ‘আমি মূসা (আ.)-কে কেতাৰ দিয়েছিলাম…'(আয়াত ৩৫-৪০) এখানে সংক্ষেপে অতীতের কাফেরদের শােচনীয় পরিণতির কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হচ্ছে। যেমন একদিকে মূসা(আ.)-কে কেতাব দান এবং তার ভাই হারুনকে তাঁর সহযােগী ও উপদেষ্টা নিয়ােগ, অতপর উভয়কে আল্লাহর নিদর্শনাবলী প্রত্যাখ্যানকারী একটা জাতিকে প্রতিহত করার আদেশ প্রদানের দৃষ্টান্ত। কারণ ফেরাউন ও তার অনুসারীরা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিলাে। তারা মূসা ও হারুনকে তাদের কাছে প্রেরণের আগে থেকেই এটা করে আসছিলাে। আল্লাহর নিদর্শনাবলী সদাসর্বদা বিদ্যমান। যারা এই সব নিদর্শন সম্পর্কে উদাসীন থাকে, তাদেরকে স্মরণ ও সচেতন করার জন্যেই নবী ও রসূলরা আবির্ভূত হন। আয়াতের শেষাংশে তাদের শােচনীয় পরিণাম অত্যন্ত সংক্ষেপে ও জোরদার ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে। ফলে তাদেরকে সর্বতোভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। অপরদিকে উল্লেখ করা হয়েছে নূহের জাতির দৃষ্টান্ত। ‘তারা যখন নবীদেরকে প্রত্যাখ্যান করলাে, তখন আমি তাদেরকে ডুবিয়ে দিলাম।’ তারা শুধু নূহকেই প্রত্যাখ্যান করেছিলাে। কিন্তু নুহ(আ.) যেহেতু সেই একই আকীদা বিশ্বাস নিয়ে এসেছিলেন, যা অন্যান্য নবীরা এনেছেন তাই তাকে প্রত্যাখ্যান সকল নবী ও রসূলকে প্রত্যাখ্যানের শামিল বলে গণ্য করা হয়েছে। ‘আর তাদেরকে সমগ্র মানব জাতির জন্য নিদর্শন বানিয়েছি।’ বস্তুত সেই ভয়াবহ বন্যার কথা মানব জাতি চিরকাল মনে রাখবে। আর প্রত্যেক সচেতন ও চিন্তাশীল মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। ‘আর আমি অত্যাচারীদের জন্যে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।’ আসলে এ শাস্তি উপস্থিতই ছিলাে, প্রস্তুত করার মুখাপেক্ষী ছিলাে না। ‘অত্যাচারীদের জন্যে শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।’ এই অত্যাচারীদের শব্দটা স্পষ্টতই জানিয়ে দিচ্ছে তাদের শাস্তির কারণ কি। এরপর আসছে আদ, সামুদ, রসবাসী(অর্থাৎ একটা অদৃশ্য প্রাচীর বিশিষ্ট পুঙ্করিনীর অধিবাসীরা। কেউ কেউ বলেন, এই পুস্করিনী অধিবাসীরা ইয়ামামার একটা গ্রামে বাস করতাে। তারা তাদের নবীকে হত্যা করেছিলাে। ইবনে জারীরের মতে, এরা হচ্ছে উখদুদবাসী, যাদের কথা সূরা বুরুজে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা একদল মােমেনকে পুড়িয়ে মেরেছিলাে) ও এদের মধ্যবর্তী অন্যান্য জাতির প্রসংগ। সবার একই পরিণতি হয়েছে। কেননা তাদের সবাইকে সদুপদেশ দেয়া হয়েছিলাে। কিন্তু কেউ তা শােনেনি এবং নিজেদের অনিবার্য ধ্বংস থেকে তারা আত্মরক্ষা করেনি। এই দৃষ্টান্তগুলাে হচ্ছে হযরত মূসা ও নূহের জাতি, আদ, সামুদ, রস’বাসী। মধ্যবর্তী অন্যান্য জাতি এবং হযরত লূতের জাতি সংক্রান্ত। সবারই ছিলাে একই চরিত্র এবং সবারই একই পরিণতি হয়েছিলাে। ‘শিক্ষা ও উপদেশ লাভের জন্যে সকলকেই আমি উদাহরণ হিসেবে পেশ করেছি। আর সবাইকে আমি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছি।’ অর্থাৎ নবীদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানের পরিণামেই তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিলাে। এই দৃষ্টান্তমূলক ধ্বংসের ঘটনাগুলােকে অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। সবার শেষে এসেছে লূতের জাতির ঘটনা। এটা সদোম নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছিলাে। আরবের লােকেরা গ্রীষ্মকালে সিরিয়া সফরে যাওয়ার সময় এই এলাকার পাশ দিয়ে চলাচল করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা সদোমকে আগ্নেয়গিরির গ্যাস ও পাথর বৃষ্টি দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। উপসংহারে মন্তব্য করা হয়েছে যে, যেহেতু তারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তাই তাদের মন এ সব ঘটনা থেকে কোনােই শিক্ষা গ্রহণ করে না। কোনাে শিক্ষামূলক ঘটনাতেই যে তাদের মন গলে না, তার কারণ এটাই। কোরআন ও রসূল সম্পর্কে তাদের সমস্ত আপত্তি, উপহাস ও খারাপ ধারণার উৎসও এখানেই নিহিত।
*স্বার্থরক্ষার জন্যেই সমাজপতিরা বিরােধীতা করে : এই সংক্ষিপ্ত বিবরণগুলাের পর রাসুল(স.)-এর প্রতি তাদের করা ব্যংগ বিদ্রুপের বর্ণনাও দেয়া হচ্ছে। ইতিপূর্বে তাদের দম্ভ, অহংকার ও কুরআন এক সাথে নাযিল না করে টুকরাে টুকরাে আকারে নাযিল করায় তাদের আপত্তি তুলে ধরা হয়েছে। কেয়ামতের ময়দানে তাদের কেমন শােচনীয় দশা হবে এবং তাদের মতাে অন্যান্য কাফেরদের পরিণামই বা কেমন হবে, তাও বর্ণনা করা হয়েছে। এসব বর্ণনার উদ্দেশ্য শুধু রসূল(স.)-এর মনকে তার সাথে কৃত ব্যংগ বিদ্রুপের উল্লেখের আগেই প্রবােধ দান করা। অতপর তাদেরকে কঠোর হুঁশিয়ারী জ্ঞাপনের পাশাপাশি তাদেরকে পশুর চেয়েও নিম্নস্তরের প্রাণীর সাথে ব্যংগ বিদ্রুপ করে। ওরা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওরা যখনই তােমাকে দেখতে পায় তখন… বরং পর তার চেয়েও বিপথগামী'(আয়াত ৪১-৪৪) এ কথা সুবিদিত যে, মােহাম্মদ(স.) নবুওত লাভের পূর্বে তার জাতির কাছে অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন। বংশগতভাবে তিনি তাদের কাছে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বনু হাশেমের শ্রেষ্ঠ সন্তান, আর তারা ছিলাে কোরায়শী শ্রেষ্ঠ সন্তান নিষ্কলুষ চরিত্র। সততার জন্যেও তিনি ছিলেন বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ও ‘আল আমীন’ খেতাবে ভূষিত । নবুওত লাভের অনেক আগে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের ব্যাপারে তার মধ্যস্থতা ও মীমাংসায়ও তারা খুবই খুশী ছিলাে। একদিন তিনি তাদেরকে সাফা পর্বতের ওপর ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, এই পাহাড়ের অপর পাশে একটা বাহিনী ওৎ পেতে আছে এ কথা যদি তিনি বলেন, তবে তারা বিশ্বাস করবে কিনা। তারা বললাে, হাঁ তুমি আমাদের কাছে কখনাে অভিযুক্ত ছিলে না। কিন্তু সেই কোরায়শই তার নবুওত লাভের পর এবং তিনি কোরআন নিয়ে আসার পর তাকে উপহাস করে বলতে লাগলাে, ‘তিনিই কি সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তায়ালা রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন।’ এটা আসলে প্রচন্ড বিদ্রুপাত্মক ও নিন্দাসূচক কথা ছিলাে। কিন্তু এ ধরনের বিদ্রুপাত্মক কথা বলার কারণ কি এই ছিলাে যে, তারা তার মতাে মহৎ ব্যক্তিকে এ ধরনের ব্যংগ বিদ্রুপের উপযুক্ত বলে যথার্থই মনে করতাে? অথবা তার দাওয়াতকে যথার্থই বিদ্রুপের যােগ্য বলে তারা মনে করতাে? না, কখনাে নয়। এটা ছিলাে আসলে জনসাধারণের ওপর রাসূল(স.)-এর বিরাট ও বিশাল ব্যক্তিত্বের ও কোরআনের অপ্রতিরােধ্য প্রভাবকে কিছুটা কমানাের লক্ষ্যে শীর্ষস্থানীয় কোরায়শ নেতাদের তৈরী করা একটা পরিকল্পনা। যেহেতু রাসূল(স.) পরিচালিত এই নতুন দাওয়াত ও আন্দোলন তাদের প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করেছিলাে এবং যে সব ভ্রান্ত ধ্যান ধারণা ও আকীদা বিশ্বাসের ওপর তাদের সমগ্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি দাঁড়িয়েছিলাে, সেগুলােকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাই এই দাওয়াতকে প্রতিহত করার একটা উপায় ও মাধ্যম মনে করে তারা এর বিরুদ্ধে ব্যংগ বিদ্রুপ ও ঠান্ডা উপহাস চালাতাে। রকমারি ফন্দি ফিকির ও ষড়যন্ত্র উদ্ভাবনের জন্যে তারা নিয়মিত সলাপরামর্শও করতাে এবং এ ধরনের কোনাে না কোনাে ফন্দি ফিকির তারা তৈরীও করতাে। অথচ তারা সুনিশ্চিতভাবেই জানতাে যে, তাদের এসব ফন্দি ফিকির সঠিক নয়। ইবনে ইসহাক এমনি এক ফন্দি ফিকিরের বর্ণনা করেছেন। একবার হজ্জের মওসুম সমাগত হলে প্রবীণ কোরায়শ নেতা ওলীদ ইবনুল মুগীরার কাছে কিছু লােক সমবেত হলো। ওলীদ তাদেরকে সম্বােধন করে বললাে, হে কোরায়শ জনমন্ডলী, এবার হজ্জের মওসুম তাে এসে পড়লাে। এ সময় তােমাদের কাছে আরবের দূর দূরান্ত থেকে বহু হজ্জ প্রতিনিধি দল আসবে। ইতিমধ্যে তােমাদের স্বগােত্রীয় মােহাম্মদের কথা তারা শুনেছে। এ ব্যাপারে তােমরা একটা ঐক্যমতে উপনীত হও এবং মতভেদ সৃষ্টি করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে না যে, তােমাদের এক একজন এক এক রকম কথা বলবে এবং একজন যা বলবে, অন্যজন তা খন্ডন করবে। সমবেত বললাে, ওহে আব্দুশ শামসের পিতা, আপনিই বলুন, আপনিই আমাদের জন্যে একটা মত ঠিক করে দিন, যা আমরা সবাই ধারণ ও প্রচার করবাে। ওলীদ বললাে, বরঞ্চ তােমরাই বলাে, আমি শুনি। কয়েকজন বললাে, ‘আমরা তাে মনে করি, সে একজন জ্যোতিষী।’ ওলীদ বললাে, না, আল্লাহর কসম, সে জ্যোতিষী নয়। আমরা বহু জ্যোতিষী দেখেছি। জ্যোতিষীরা যে ধরনের ছকবাধা ও সুরেলা কন্ঠে কথা বলে থাকে, তা মােহাম্মদের মধ্যে নেই। এবার সবাই বললাে, তাহলে আমাদের ধারণা, সে পাগল। ওলীদ বললাে, কত পাগলই তো দেখেছি এবং পাগলামী কী জিনিস, তা আমাদের কাছে সুপরিচিত। কিন্তু তার কোনাে লক্ষণ মােহাম্মদের মধ্যে নেই। সবাই বললাে, ‘তাহলে আমরা বলবাে, সে কবি।’ ওলীদ বললাে, না, সে কবিও নয়। আমরা সব রকমের কবিতা ও তার রকমারি ছন্দ চিনি। মােহাম্মদ(স.) যা বলে তা কবিতা নয়। তারা বললাে, তাহলে আমরা বলবাে, সে যাদুকর।’ ওলীদ বললাে, না সে যাদুকরও নয়। যাদুকর ও যাদু অনেক দেখেছি। যার কোনাে লক্ষণ এতে নেই।’ সকলে বললাে, ওহে আব্দুশ শামসের পিতা, তাহলে আপনি কী বলতে চান? ওলীদ বললাে, মােহাম্মদ(স.)-এর কথা বড়ই মনােহর, তার মূল খেজুর গাছের মতাে শক্ত এবং তার শাখা প্রশাখা ফলে ভর্তি। তােমরা যেটাই বলবে, তা বাতিল বলে গণ্য হবে। তবে তােমরা তাকে যাদু বলতে পারাে। এটাই প্রকৃত সত্যের কাছাকাছি হবে। কেননা সে এমন বাণী নিয়ে এসেছে, যা একজন মানুষকে তার পিতা, ভাই, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন ও পর করে দেয়। এরপর সবাই ওলীদের কাছ থেকে চলে গেলাে। তারা হজ্জে আগত জনসাধারণের চলাচলের পথের পাশে বসে থাকতে লাগলাে। তাদের কাছ থেকে যে ব্যক্তিই যাচ্ছিলাে, তাকে মােহাম্মদ(স.) সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে থাকলাে এবং তার কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত করতে লাগলো। রসূল(স.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাতে তার স্বজাতি কিভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাে, এটা তার একটা দৃষ্টান্ত মাত্র। এ থেকে এ কথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তারা মােহাম্মদ(স.) কে সঠিকভাবেই চিনতে পেরেছিলাে। তার প্রতি বিদ্রুপ করে এ কথা বলা যে, এই কি সেই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তায়ালা রাসূল করে পাঠিয়েছেন?’ সেই সব ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এ ষড়যন্ত্র তাদের অন্তরের কোনাে সচেতন উপলব্ধির ফসল ছিলাে না, বরং এর মাধ্যমে তারা স্রেফ জনগণের সামনে রসূল(স.)-কে হেয় করতে চেয়েছিলাে। শীর্ষস্থানীয় কোরায়শ নেতারা ভেবেছিলাে, এভাবে তাদের ধর্মীয় অভিভাবকত্ব চিরস্থায়ী হবে এবং এভাবে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলােও চিরস্থায়ী হবে। এতে কোরায়শের ভূমিকা সর্বকালের ও সকল জায়গার ইসলামী আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের শত্রুর ভূমিকার অনুরূপ। ব্যংগ বিদ্রুপ করার সময়েও তারা যে কথা বলতে, তা থেকেই বুঝা যেতাে মােহাম্মদ(স.) তার দাওয়াত ও কোরআনের বিরুদ্ধে তাদের মনে কী সাংঘাতিক বিদ্বেষপূর্ণ মনােভাব বিরাজ করতো। আমরা ধৈর্যধারণ না করলে সে তাে আমাদেরকে আমাদের দেব-দেবী থেকে বিপথগামী করেই ফেলতো। বস্তুত তাদের স্বীকারােক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, রাসূল(স.)-এর বিপ্লবী দাওয়াত ও কোরআনের হৃদয়গ্রাহী আবেদন তাদের অন্তরাত্মাকে ঝাঁকুনির পর ঝাঁকুনি দিয়ে এতােটা নড়বড়ে করে দিয়েছিলাে যে, তারা তাদের দেব-দেবী ও তাদের পূজা অর্চনা প্রায় ছেড়ে দেয়ারই উপক্রম করেছিলাে- যদি তাদের ভেতরে তাদের ধর্ম ও তার তীর্থস্থানগুলােকে সংরক্ষণ করার প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে তাদের দেব-দেবীর ওপর ধৈর্যধারণ করা ও অবিচল থাকার মনােভাব না জেগে উঠতাে এবং ইসলামী দাওয়াতের প্রভাব প্রতিরােধ করার ইচ্ছা সৃষ্টি না হতাে তাহলে হয়তােবা তারা ছেড়েই দিতাে। কোনাে দিক দিয়ে প্রবল আকর্ষণের সৃষ্টি হলে সেই আকর্ষণের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্যই ধৈর্যের প্রয়ােজন হয়। মােশরেকরা চিরন্তন সত্যের ও শাশ্বত মূল্যবােধের অবমূল্যায়ন করে বলেই হেদায়াতকে বিপথগামিতা বলে আখ্যায়িত করেছিলাে। কিন্তু তাদের হৃদয় জগতে রাসূল(স.)-এর দাওয়াত, তার ব্যক্তিত্ব ও তার আনীত কোরআনের প্রভাবে যে কম্পন, অস্থিরতা ও আলােড়ন শুরু হয়ে গিয়েছিলাে, সেটা তারা লুকাতে পারেনি। এমনকি নিছক হঠকারিতা ও জিদের বশে তারা যখন তার ব্যক্তিত্বের প্রতি তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করছিলো, তখনাে এটা লুকাতে সক্ষম হয়নি। এ জন্যেই আয়াতটার শেষাংশে তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে ধমক দিয়ে শাসিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ওরা যখন আযাব দেখবে, তখনই বুঝতে পারবে, কারা বেশী বিভ্রান্ত। অর্থাৎ তখন তারা জানতে পারবে যে, রসূল(স.) তাদের কাছে যে জিনিস নিয়ে এসেছেন তাই হচ্ছে হেদায়াত- গােমরাহী নয় । তবে আযাব দেখার পর তা জেনে তাদের আর কোনাে লাভ হবে না। এই আযাব দুনিয়াতেই দেখুক, যেমন বদরের যুদ্ধের সময় দেখেছে, অথবা আখেরাতে দেখুক যেমন কেয়ামতের দিন দেখবে।

*প্রবৃত্তির দাসত্ব মানুষকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট করে দেয় : এরপর রাসূল(স.) কে সম্বােধন করে তাদের হঠকারিতা, গােয়ার্তুমি ও ঠাট্টা-বিদ্রুপের ব্যাপারে তাঁকে সান্তনা ও সমবেদনা জানানাে হয়েছে। কেননা তিনি তাে তার দাওয়াত ও প্রচারের কাজে কোনাে ত্রুটি রাখেননি। যুক্তি প্রমাণ পেশ করতে কোনাে কসুর করেননি। তিনি এমন কিছু করেননি, যার জন্যে তাদের দুর্ব্যবহার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কোনাে যৌক্তিকতা থাকতে পারে। এই ঔদ্ধত্যের কারণ একান্তভাবে তাদের নিজস্ব। তারা তাদের খেয়ালখুশী ও ভাবাবেগকেই দেবতার আসনে বসিয়ে রেখেছে। কোনাে যুক্তি প্রমাণের ধার ধারেনি। আর যারা নিজের ভাবাবেগের গােলাম হয়ে যায়, তাদের ব্যাপারে নবী রসূলের কিছুই করার থাকে না। ‘তুমি কি সেই ব্যক্তির ব্যাপারটা ভেবে দেখেছে, যে নিজের ভাবাবেগকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। তুমি কি তার কোনাে দায় দায়িত্ব নিতে পারবে?’ এটা একটা চমকপ্রদ জিজ্ঞাসা। এ জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে একটা বিশেষ মানসিক অবস্থার সুগভীর অভিব্যক্তি ঘটেছে। কোনাে মানুষ যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা যাবতীয় রীতিনীতি, আইন কানুন ও যাবতীয় যুক্তি প্রমাণকে অগ্রাহ্য করে নিরেট নিজের ভাবাবেগ ও কামনা বাসনার দাসত্ব করতে থাকে এবং নিজেকে ও নিজের খেয়াল খুশীকে মাবুদের আসনে বসায়। তখনকার অবস্থাই এখানে ফুটে উঠেছে। এ অবস্থায়ও মহান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে পরম স্নেহ, মমতা ও সহানুভূতির সাথে এই শ্রেণীর মানুষের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তুমি কি ভেবে দেখেছাে?’ অতপর এর পরবর্তী অংশে সে শ্রেণীর মানুষের একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ শ্রেণীটির সামনে কোনাে যুক্তি প্রমাণ পেশ করা একেবারেই নির্থক ও বৃথা। তার কাছে কোনাে যুক্তি, তত্ত্ব বা তথ্যের কোনাে গুরুত্ব বা মূল্য নেই এবং এসব তাকে হেদায়াতের পথে আনতে সাহায্য করে না। এ শ্রেণীটি হেদায়াতের অযােগ্য। আর এ কারণে রসূল(স.)-এর পক্ষে তার দায় দায়িত্ব গ্রহণও অসম্ভব । বলা হয়েছে, ‘তুমি কি তার দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে?’ অতপর এসব প্রবৃত্তির গােলামদের নিন্দায় আরাে একধাপ এগিয়ে গিয়ে তাদেরকে বিবেক বিবেচনা বর্জিত পশুর সমান বলা হয়েছে। তারপর আরো একধাপ এগিয়ে তাদেরকে পশুর চেয়েও অধম ও বিপথগামী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, ‘তুমি কি মনে করো যে, তাদের অধিকাংশই বিবেকবান ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন? তারা তাে পশুর সমান। বরঞ্চ তারা পশুর চেয়েও বিপথগামী।'(আয়াত ৪৪) আয়াতের ভাষায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা ও সুবিচার করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘তাদের অধিকাংশ’ সবাইকে পাইকারি দোষারােপ করা হয়নি। কেননা তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ হেদায়াতের পথে চালিত হয়েছিলাে, অথবা সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করেছিলাে। পক্ষান্তরে তাদের অধিকাংশ ছিলাে প্রবৃত্তির দাস তারা যুক্তি প্রমাণের ধার ধারতাে না। সুতরাং তারা পশুর সমান। কেননা বিচার বিবেচনা ও সত্যোপলব্ধি, সেই সত্যোপলব্ধির ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং যুক্তি প্রমাণের আলােকে যাবতীয় কাজ করা এগুলােই মানুষকে পশু থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র প্রাণী রূপে চিহ্নিত করে। শুধু তাই নয়, এসব গুণাবলী থেকে বঞ্চিত মানুষ পশুর চেয়েও অধম। কেননা পশু আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে জীবনের সঠিক পথের সন্ধান পায় এবং নিজের যা যা করণীয়, তা যথাযথভাবে সম্পাদন করে। অথচ মানুষ আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা ও যােগ্যতাকে কাজে না লাগিয়ে নিস্ক্রিয় করে রাখে এবং পশু যেমন তা দ্বারা উপকৃত হয়, সেভাবে সে উপকৃত হয় না। তাই তাদের ‘পশুর চেয়েও অধম’ বলা হয়েছে। এভাবে রসূল(স.)-কে যারা উপহাস ও ব্যংগ বিদ্রুপ করে, তাদেরকে এতাে ঘৃণ্য ও তুচ্ছ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যে, তারা মানুষই নয়, পশুর সমান, এমনকি পশুর চেয়েও অধম। এভাবে সূরার দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ হলাে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এখানে কিতাব বলে সম্ভবত তাওরাত নামে পরিচিতি গ্রন্থটিকে বুঝানো হচ্ছে না, যা মিসর থেকে বনী ইসরাঈলদের নিয়ে বের হবার সময় হযরত মূসাকে দেয়া হয়েছিল। বরং এখানে এমন সব নির্দেশের কথা বলা হচ্ছে, যেগুলো নবুওয়াতের দায়িত্বে নিয়োজিত হবার সময় থেকে নিয়ে মিসর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত হযরত মূসাকে দেয়া হয়েছিল। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ফেরাউনের দরবারে হযরত মূসা যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি এবং ফেরাউনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাবার সময় যে সব নির্দেশ তাঁকে দেয়া হয়েছিল সেগুলোও। কুরআন মজীদের বিভিন্নস্থানে এগুলোর উল্লেখ আছে। কিন্তু যতদূর মনে হয় তাওরাতে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। দশটি বিধানের মাধ্যমে তাওরাতের সূচনা হয়েছে। বনী ইসলাঈলকে নিয়ে মিসর ত্যাগ করার সময় সিনাই এলাকার তূর পাহাড়ে প্রস্তর ফলকে লিখিত আকারে তাঁকে এগুলো দেয়া হয়েছিল।
# হযরত ইয়াকুব (আ) ও হযরত ইউসূফের (আ) মাধ্যমে যেসব আয়াত তাদের কাছে পৌঁছেছিল এবং পরবর্তীকালে বনী ইসরাঈলের সংকর্মশীলরা তাদের কাছে যেগুলো প্রচার করেছিলেন।
# যেহেতু মানুষ কখনো নবী হতে পারে একথা মেনে নিতে তারা অস্বীকার করেছিল, তাই তাদের এ মিথ্যাচার কেবলমাত্র নূহের বিরুদ্ধেই ছিল না বরং মূলত নবুওয়াতের পদকেই তারা অস্বীকার করেছিল।
# আখেরাতের শাস্তি।
# আসহাবুর রস্ কারা ছিল, এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি। তাফসীরকারগণ এ সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাদের কোন বর্ণনাই সন্তোষজনক নয়। বড় জোর এতটুকু বলা যেতে পারে, তারা এমন এক সম্প্রদায় ছিল যারা তাদের নবীকে কূয়ার মধ্যে ফেলে দিয়ে বা ঝুলিয়ে রেখে হত্যা করেছিল। আরবী ভাষায় “রাসস” বলা হয় পুরাতন বা অন্ধ কূপকে।
# লূত জাতির জনপদ। নিকৃষ্টতম বৃষ্টি মানে পাথর বৃষ্টি। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় একথা বলা হয়েছে। হিজায বাসীদের বাণিজ্য কাফেলা ফিলিস্তিন ও সিরিয়া যাবার পথে এ এলাকা অতিক্রম করতো। সেখানে তারা কেবল ধ্বংসাবশেষ দেখতো না বরং আশপাশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মুখে লূত জাতির শিক্ষণীয় ধ্বংস কাহিনীও শুনতো।
# যেহেতু তারা পরকাল বিশ্বাস করে না তাই নিছক একজন দর্শক হিসেবে এ ধ্বংসাবশেষ প্রত্যক্ষ করেছে। এ থেকে কোন শিক্ষা নেয়নি। এ থেকে জানা যায়, পরকাল বিশ্বাসী ও পরকাল অবিশ্বাসীর দৃষ্টির মধ্যে রয়েছে কত বড় ফারাক। একজন নিছক ঘটনা বা কীর্তিকলাপ দেখে অথবা বড়জোড় ইতিহাস রচনা করে। কিন্তু অন্যজন ঐসব জিনিস থেকেই নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে এবং জীবনের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন প্রকৃত সত্যের নাগাল পায়।
# কাফেরদের এ দু’টি কথা পরস্পর বিরোধী। প্রথম কথাটি থেকে জানা যায়, তারা নবীকে ﷺ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে এবং তাঁকে বিদ্রূপ করে তাঁর মর্যাদা হ্রাস করতে চাচ্ছে। তারা যেন বলতে চাচ্ছে, নবী (সা.) তাঁর মর্যাদার চাইতে অনেক বেশী বড় দাবী করেছেন। দ্বিতীয় কথা জানা যায়, তারা তাঁর যুক্তির শক্তি ও ব্যক্তিত্বের ক্ষমতা মেনে নিচ্ছে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে স্বীকার করে নিচ্ছে যে, তারা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে নিজেদের আরাধ্য দেবতাদের বন্দনায় অবিচল না থাকলে এ ব্যক্তি তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নিতেন। ইসলামী আন্দোলন তাদেরকে কি পরিমাণ আতংকিত করে তুলছিল এই পরস্পর বিরোধী কথা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেহায়ার মতো যখন তামাশা-বিদ্রূপ করতো তখন হীনমন্যতা বোধের পীড়নে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদের মুখ থেকে এমন সব কথা বের হয়ে যেতো যা থেকে এ শক্তিটি তাদের মনে কি পরিমাণ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে তা স্পষ্ট বুঝা যেতো।
# প্রবৃত্তির কামনাকে মাবুদে পরিণত করার মানে হচ্ছে, তার পূজা করা। আসলে এটাও ঠিক মূর্তি পূজা করা বা কোন সৃষ্টিকে উপাস্যে পরিণত করার মতই শিরক। আবু উমামাহ রেওয়ায়াত করেছেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ ما تحت ظل السماء من اله يعبد من دون الله تعالى اعظم عند الله عزوجل من هوى يتبع – “এ আকাশের নীচে যতগুলো উপাস্যের উপাসনা করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপাস্য হচ্ছে এমন প্রবৃত্তির কামনা যার অনুসরণ করা হয়।” (তাবরানী) আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আল কাহাফ ৫০ টীকা । যে ব্যক্তি নিজের কামনাকে বুদ্ধির অধীনে রাখে এবং বুদ্ধি ব্যবহার করে নিজের জন্য ন্যায় ও অন্যায়ের পথের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, সে যদি কোন ধরনের শিরকী বা কুফরী কর্মে লিপ্ত হয়েও পড়ে তাহলে তাকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনা যেতে পারে এবং সে সঠিক পথ অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর তার উপর অবিচল থাকবে এ আস্থাও পোষণ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রবৃত্তির দাস হচ্ছে একটি লাগামহীম উট। তার কামনা তাকে যেদিকে নিয়ে যাবে সে পথহারা হয়ে সেদিকেই দৌড়াতে থাকবে। তার মনে ন্যায় ও অন্যায় এবং হক ও বাতিলের মধ্যে ফারাক করার এবং একটিকে ত্যাগ করে অন্যটিকে গ্রহণ করার কোন চিন্তা আদৌ সক্রিয় থাকে না। তাহলে কে তাকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনতে পারে? আর ধরে নেয়া যাক, যদি সে মেনেও নেয় তাহলে তাকে কোন নৈতিক বিধানের অধীন করে দেয়া কোন মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়।
# গরু-ছাগলের দল যেমন জানে না তাদের যারা হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা তাদের চারণক্ষেত্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, না কসাইখানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তারা কেবল চোখ বন্ধ করে যারা হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ইশারায় চলতেই থাকে, ঠিক তেমনি এ জনসাধারণও তাদের নিজেদের শয়তানী প্রবৃত্তি ও পথভ্রষ্টকারী নেতাদের ইশারায় চোখ বন্ধ করে চলতেই থাকছে। তারা জানে না তাদের হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কল্যাণের দিকে, না ধ্বংসের দিকে। এ পর্যন্ত তাদের অবস্থা গরু-ছাগলের সাথে তুলনীয়। কিন্তু গরু-ছাগলকে আল্লাহ‌ বুদ্ধিজ্ঞান ও চেতনা শক্তি দান করেননি। তারা যদি চারণক্ষেত্র ও কসাইখানার মধ্যে কোন পার্থক্য না করে থাকে তাহলে এতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় একদল মানুষ যাদের আল্লাহ‌ বুদ্ধি-জ্ঞান ও চেতনা শক্তি দান করেছেন এবং তারপরও তারা গরু-ছাগলের মতো অসচেতনতা ও গাফলতির মধ্যে ডুবে রয়েছে। কেউ যেন প্রচার-প্রচারণাকে অর্থহীন গণ্য করা এ ভাষণের উদ্দেশ্য বলে মনে না করেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে এ কথাগুলো এজন্য বলা হচ্ছে না যে, তিনি যেন লোকদেরকে অনর্থক বুঝাবার চেষ্টা ত্যাগ করেন। আসলে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যেই এ বক্তব্য রাখা হয়েছে, যদিও বাহ্যত সম্বোধন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আসলে তাদের এ কথা শুনানো উদ্দেশ্য যে, ওহে গাফেলরা! তোমাদের এ অবস্থা কেন? আল্লাহ কি তোমাদের বুদ্ধি-বিবেক এজন্য দিয়েছেন যে, তোমরা দুনিয়ায় পশুদের মতো জীবন যাপন করবে?

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩৫-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা মূসা, নূহ, হূদ, সালেহ (عليهم السلام)-এর সম্প্রদায়ের পাপাচারের কথা ও তাদের কী শাস্তি দেয়া হয়েছিল সে কথা বর্ণনা করেছেন। যাদের সম্পর্কে সূরা আ‘রাফ, হূদসহ পূর্বে একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে এবং সূরা নামলের ৪৫-৫৩ নং আয়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের এ সকল শাস্তিমূলক কাহিনী বর্ণনা করার পেছনে উদ্দেশ্য একটাই যাতে এ উম্মাতের লোকেরা ঐ সকল ঘটনা ও শাস্তির কথা শুনে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে, তাক্বওয়া অবলম্বন করে চলে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলার বিধান অমান্য করলে অবশ্যই শাস্তির সম্মুখিন হতে হবে।
২. পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিদের থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত।

৪১-৪৪ নং আয়াতের তাফসীর:

কাফির-মুশরিকরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করত। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِذَا رَاٰكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْآ إِنْ يَّتَّخِذُوْنَكَ إِلَّا هُزُوًا ط أَهٰذَا الَّذِيْ يَذْكُرُ اٰلِهَتَكُمْ ج وَهُمْ بِذِكْرِ الرَّحْمٰنِ هُمْ كٰفِرُوْنَ)

“কাফিররা যখন তোমাকে দেখে তখন তারা তোমাকে কেবল বিদ্রুপের পাত্ররূপেই গ্রহণ করে। তারা বলে, ‘এ-ই কি সে, যে তোমাদের দেব-দেবীগুলোর সমালোচনা করে?’ অথচ তারাই তো ‘রাহ্মান’-এর উল্লেখের বিরোধিতা করে।” (সূরা আম্বিয়া ২১:৩৬) আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, তোমরা রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করবে এজন্য তো রাসূল প্রেরণ করিনি। বরং তোমাদের কর্তব্য তাঁর অনুসরণ করবে, তাঁকে মেনে চলবে। কিন্তু তা না করে তোমরা তার বিপরীত করছ।

আর তারা তাদের শির্কী কার্যকলাপের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেমন তাদের কথা:

(وَانْطَلَقَ الْمَلَأُ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوْا وَاصْبِرُوْا عَلٰٓي اٰلِهَتِكُمْ)

“আর তাদের নেতারা এ কথা বলে চলে যায় যে, তোমরা চলে যাও এবং অবিচল চিত্তে তোমাদের মা‘দূদের পূজায় লেগে থাক এবং নিজেদের উপাস্যদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ কর।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৬)

অর্থাৎ শরীয়ত বিরোধী কাজে প্রবৃত্তির অনুসরণ এক প্রকার র্শিক। ইবনু আববাস (رضي الله عنه) বলেন: শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ করা, নিজের মনমত চলা একপ্রকার মূর্তিপূজা। তারপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(أَفَمَنْ زُيِّنَ لَه۫ سُوْٓءُ عَمَلِه۪ فَرَاٰهُ حَسَنًا ط فَإِنَّ اللّٰهَ يُضِلُّ مَنْ يَّشَا۬ءُ وَيَهْدِيْ مَنْ يَّشَا۬ءُ ﱸﺘ فَلَا تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرٰتٍ ط إِنَّ اللّٰهَ عَلِيْمٌۭ بِمَا يَصْنَعُوْنَ)

“যাকে তার খারাপ কাজ সুন্দর করে দেখানো হয় এবং সে তাকে উত্তম মনে করে (সে কি তার সমান যে মন্দকে মন্দ মনে করে)? নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন। অতএব তুমি তাদের জন্য অনুতাপ করে নিজেকে ধ্বংস করবে না। তারা যা করে আল্লাহ তা‘আলা তা অবশ্যই জানেন।” (সূরা ফাতির ৩৫:৮)

এদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, এরা হচ্ছে চতুস্পদ জন্তুর চেয়েও অধম। কারণ চতুষ্পদ জন্তুকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে তা তারা শুনে ও মেনে চলে। কিন্তু এ সকল মানুষ তাদেরকে যে উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে তা ভুলে গিয়ে শির্কী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে। তাই ওরা সবচেয়ে নিকৃষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন:

(وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيْرًا مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ ﺘ لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا يَفْقَهُوْنَ بِهَا ز وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَّا يُبْصِرُوْنَ بِهَا ز وَلَهُمْ اٰذَانٌ لَّا يَسْمَعُوْنَ بِهَا ط أُولٰ۬ئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ط أُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْغٰفِلُوْنَ)‏

“আমি তো বহু জিন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তারা তা দ্বারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে কিন্তু তারা তা দ্বারা দেখে না, এবং তাদের কর্ণ আছে কিন্তু তারা তা দ্বারা শ্রবণ করে না, তারাই পশুর ন্যায়, বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত। তারাই গাফিল।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৭৯)

তাই প্রতিটি মানুষের উচিত আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কার্য সম্পাদন করা ও যথাযথভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলের কোন বিষয়ে হাসি-তামাশা করা যাবে না, তা করলে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।
২. শির্কী কার্যকলাপ পরিহার করতে হবে।
৩. প্রবৃত্তির অনুসরণ করার অর্থ হলো তাকে একপ্রকার মা‘বূদ বানিয়ে নেয়া।
৪. একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

৩৫-৪০ নং আয়াতের তাফসীর

হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে তাঁর কওমের মুশরিক ও বিরোধী লোকেরা যে অবিশ্বাস ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তাদেরকে তিনি তার যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ভয় প্রদর্শন করছেন এবং অতীতের উম্মতদের যারা তাদের রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করেছিল তাদেরকে যেমন তিনি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, তেমনিভাবে মক্কার এই মুশরিকদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। হযরত মূসা (আঃ) থেকেই তিনি শুরু করছেন। তাকে তিনি কিতাব দিয়েছিলেন এবং তাঁর ভ্রাতা হারূন (আঃ)-কে তাঁর সাহায্যকারী করেছিলেন। অতঃপর তাঁদের দুজনকে তিনি ফিরাউন ও তার অধীনস্থ লোকদের নিকট পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাদেরকে অবিশ্বাস ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। তখন তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এবং কাফিরদের জন্যে রয়েছে অনুরূপ পরিণাম। আল্লাহ তা’আলা অনুরূপ ব্যবহার হযরত নূহ (আঃ)-এর কওমের সাথেও করেছিলেন যখন তারা হযরত নূহ (আঃ)-কে অবিশ্বাস করেছিল। যারা একজন রাসূলকে অবিশ্বাস করে তাদের সমস্ত রাসূলকেই অবিশ্বাস করা হয়। কারণ রাসূলদের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। যদি আল্লাহ তা’আলা তাদের কাছে সমস্ত রাসূলকেও প্রেরণ করতেন তবে তারা সকলকেই অবিশ্বাস করতো। এ জন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায় যখন রাসূলদের প্রতি মিথ্যা আরোপ করলো (শেষ পর্যন্ত)। অথচ আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট শুধুমাত্র হযরত নূহ (আঃ)-কেই নবীরূপে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাদের মধ্যে সাড়ে নয়শ বছর অবস্থান করেছিলেন। তাদেরকে তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছিলেন এবং তাদেরকে তার শাস্তির ভয় দেখিয়েছিলেন। কিন্তু অল্প সংখ্যক লোক ছাড়া তার উপর কেউ ঈমান আনেনি। এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা তাদের সকলকেই নিমজ্জিত করেছিলেন এবং তাদের কাউকেও বাকী রাখেননি। হযরত নূহ (আঃ)-এর নৌকার আরোহীগণ ছাড়া ভূ-পৃষ্ঠে তিনি কোন আদম সন্তানকে জীবিত ছাড়েননি। মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদেরকে আমি মানব জাতির জন্যে নিদর্শন স্বরূপ করে রাখলাম। অর্থাৎ তাদের জন্যে শিক্ষণীয় বিষয় করলাম যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “যখন জলোচ্ছাস হয়েছিল তখন আমি তোমাদেরকে আরোহণ করিয়েছিলাম নৌযানে। আমি এটা করেছিলাম তোমাদের শিক্ষার জন্যে এবং এই জন্যে যে, শ্রুতিধর কর্ণ এটা সংরক্ষণ করে।” (৬৯: ১১-১২) অর্থাৎ তরঙ্গপূর্ণ সমুদ্রে নৌকায় আরোহণ করিয়ে আমি তোমাদেরকে রক্ষা করলাম যাতে তোমরা আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর যে, তিনি তোমাদেরকে সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করলেন এবং তোমাদের ভাবী বংশধরদের এটা শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে গেল যে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং তাঁর হুকুমকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে তারা এভাবে মুক্তি পাবে।

আল্লাহ পাকের উক্তিঃ (আরবি) আদ ও সামূদের ঘটনা অন্য সূরায়, যেমন সূরায়ে আরাফে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এখানে তাদের ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। এখানে রাস্সবাসী সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, তারা সামূদ সম্প্রদায়ের গ্রামসমূহের একটি গ্রামের অধিবাসী। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, আসহাবুস রাস্স হলো ফালজের অধিবাসী এবং তারা হলো আসহাবে ইয়াস।

কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ফালজ হচ্ছে ইয়ামামার গ্রামসমূহের একটি গ্রাম। মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাস্স হচ্ছে আযারবাইজানের একটি কূপ। সাওরী (রঃ) আবূ বকর (রঃ) হতে এবং তিনি ইকরামা (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাস হলো একটি কূপ যাতে ওর মালিকরা তাদের নবী (আঃ)-কে দাফন করেছিল। ইবনে ইসহাক (রঃ) মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন লোকদের মধ্যে যে লোকটি সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে সে হলো কালো দাস। ঘটনা এই যে, আল্লাহ তা’আলা এক গ্রামবাসীর নিকট একজন নবী প্রেরণ করেন। ঐ কালো দাসটি ছাড়া ঐ গ্রামের আর কেউই তার উপর ঈমান আনেনি। গ্রামবাসী নবীর সাথে শত্রুতা করতে শুরু করলো। তারা তার জন্যে একটা কূপ খনন করলো। অতঃপর তারা তাঁকে ঐ কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে কঠিন ভারী পাথর দ্বারা ওর মুখ বন্ধ করে দিলো। ঐ দাসটি বনে গিয়ে কাঠ কাটততা এবং কাঠ পিঠে বহন করে এনে বাজারে বিক্রী করতো। ঐ মূল্য দ্বারা সে খাদ্য ও পানীয় ক্রয় করতো। তারপর ঐগুলো সে ঐ কূপটির নিকট নিয়ে আসতো। অতঃপর সে কূপের মুখ হতে ঐ শক্ত পাথরটি উঠিয়ে নিতে এবং ওটা ওঠাতে আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করতেন। তারপর তার খাদ্য ও পানীয় সে ঐ কূপের মধ্যে নামিয়ে দিতে এবং পরে ওর মুখ পূর্বের ন্যায় বন্ধ করে দিতো। আল্লাহ যতদিন চাইলেন ঐরূপ হতে থাকলো।

এরপর একদিন সে অভ্যাসমত কাঠ কাটতে গেল এবং কাঠ কেটে বোঝা বাঁধলো। অতঃপর বোঝাটি বহন করার ইচ্ছা করলো। কিন্তু তন্দ্রা এসে যাওয়ায় সে শুয়ে পড়লো এবং অবশেষে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো। আল্লাহ তাআলা তাকে দীর্ঘ সাত বছর রাখলেন। অতঃপর সে জেগে উঠলো এবং গা মোচড় দিয়ে পার্শ্ব পরিবর্তন করলো। আবার আল্লাহ তাকে সাত বছর ঘুমিয়ে রাখলেন। অতঃপর সে জেগে উঠলো এবং কাঠের বোঝাটি বহন করে নিয়ে চললো। সে ধারণা করলো যে, সে দিনের এক ঘন্টাকাল ঘুমিয়েছে। সে গ্রামে আসলো এবং তার কাঠের বোঝাটি বিক্রী করলো। তা দিয়ে সে খাদ্য ও পানীয় কিনলো যেমন সে ইতিপূর্বে করতো। তারপর যে জায়গায় কূপটি ছিল তা সে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু জায়গাটি সে পেলো না। তার ঘুমের অবস্থায় তাদের কওমের শুভজ্ঞান ফিরে এসেছিল। তাই কূপের মধ্য হতে তারা তাদের নবীকে বের করেছিল এবং তার উপর ঈমান এনে তার সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। তাদের নবী তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ “ঐ কালো দাসটির কি হয়েছে বা সে কোথায় গেছে তারা উত্তরে বলেছিলঃ “আমরা তার সম্পর্কে কিছুই জানি না বা বলতে পারবো না।” অবশেষে আল্লাহ তা’আলা ঐ নবীর রূহ কবয করে নেন। এরপর ঐ কালো দাসটি ঘুম থেকে জাগ্রত হয়। অতঃপর রাসূলুল্লহ (সঃ) বলেনঃ “নিশ্চয়ই ঐ কালো দাসটি সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটা এভাবে মুরসালরূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এতে বড়ই অস্বাভাবিকতা ও অস্বীকৃতি রয়েছে এবং সম্ভবতঃ এ ব্যাপারে একটির মধ্যে অপরটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)

ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ এ লোকগুলোকে ঐ আসহাবুর রাস্স-এর উপর স্থাপন করা বৈধ নয় যাদের বর্ণনা কুরআন কারীমে দেয়া হয়েছে। কেননা, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা খবর দিয়েছেন যে, তাদেরকে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন। বরং এরা হলো ওরাই যারা তাদের পূর্বপুরুষদের ধ্বংসের পর তাদের নবীর উপর ঈমান এনেছিল। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ মতটি পছন্দনীয় মনে করেছেন যে, আসহাবুর রাস দ্বারা ঐ আসহাবুল উখদূদ (কুণ্ডের অধিপতিদের) -কে বুঝানো হয়েছে যাদের ঘটনা কুরআন কারীমের সূরায়ে বুরূজে বর্ণিত হয়েছে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ (আমি ধ্বংস করেছিলাম) তাদের অন্তর্বর্তীকালের বহু সম্প্রদায়কেও। -এর অর্থ হলো সম্প্রদায় বা জাতি। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ তাদের পরে আমি সৃষ্টি করেছি অন্যান্য জাতি বা সম্প্রদায়সমূহকে।” (২৩:৪২) কারো কারো মতে (আরবি)-এর সীমা হলো একশ বিশ বছর। কেউ কেউ একশ বছরও বলেছেন। কারো মতে আশি বছর। আবার কারো কারো উক্তি চল্লিশ বছরও রয়েছে। কারো কারো এগুলো ছাড়া অন্য উক্তিও আছে। প্রকাশমান উক্তি এই যে, (আরবি) বলা হয় পরস্পর একই যুগে বসবাসকারী জাতি বা সম্প্রদায়সমূহকে। অতঃপর যখন তারা বিদায় গ্রহণ করে এবং ছেড়ে যায় তাদের পিছনে তাদের বংশধরকে, তখন সেটা হয় অপর যুগ। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছেঃ “আমার যুগ সর্বোত্তম যুগ। তারপর উত্তম হলো ওর নিকটবর্তী যুগ এবং তারপর ওর নিকটবর্তী যুগ।”

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা তো সেই জনপদ দিয়েই যাতায়াত করে যার উপর বর্ষিত হয়েছিল অকল্যাণের বৃষ্টি। অর্থাৎ হযরত লূত (আঃ)-এর কওমের গ্রাম, যেটাকে সুদূম বলা হয়, যাকে আল্লাহ উল্টিয়ে দেয়া এবং প্রস্তর-কংকর বৃষ্টির মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম, সুতরাং যাদেরকে ভয় প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের উপর বর্ষিত বৃষ্টি ছিল অকল্যাণকর।” (২৭: ৫৮) আর এক জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমরা তো তাদের ধ্বংসাবশেষগুলো অতিক্রম করে থাকো সকালে ও সন্ধ্যায়, তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?” (৩৭:১৩৭-১৩৮) এজন্যেই আল্লাহ তাআলা এখানে বলেনঃ তবে কি তারা এটা প্রত্যক্ষ করে না? অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করলে ঐ লোকদের তাদের রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তাদের উপর যে শাস্তি অবতীর্ণ হয়েছিল তার দ্বারা এই লোকগুলো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ বস্তুতঃ তারা পুনরুত্থানের আশংকা করে না। অর্থাৎ এই কাফিরদের যারা ঐ জনপদ দিয়ে গমনাগমন করে তারা ঐ লোকদের ধ্বংসাবশেষ দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ করে না। কেননা, তারা কিয়ামতের দিনে আল্লাহর সামনে হাযির হওয়াকে বিশ্বাসই করে না।

৪১-৪৪ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, মুশরিকরা যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে দেখে তখন তাঁকে উপহাস ও বিদ্রুপ করে। যেমন তিনি বলেনঃ “যখন কাফিররা তোমাকে দেখে তখন তারা তোমাকে শুধু ঠাট্টা-বিদ্রুপের পাত্র রূপে গণ্য করে।” অর্থাৎ তারা তাকে দোষ-ত্রুটির সাথে বিশেষিত করে। এখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা যখন তোমাকে দেখে তখন তারা তোমাকে শুধু ঠাট্টা-বিদ্রুপের পাত্র রূপে গণ্য করে এবং বলে- এই কি সে, যাকে আল্লাহ রাসূল করে পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ তারা তাঁকে খাটো করার জন্যে একথা বলে। তাই আল্লাহ তাদের দুষ্কৃতি ও বদভ্যাসের বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমার পূর্বেও রাসূলদেরকে বিদ্রুপ করা হয়েছিল।” (৬: ১০) মহান আল্লাহর উক্তিঃ সে তো আমাদেরকে আমাদের দেবতাগণ হতে দূরে সরিয়ে দিতো। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা ঐ মুশরিকদের উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তারা বলে- আমরা আমাদের দেবতাদের আনুগত্যে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত না থাকলে সে তো আমাদেরকে তাদের ইবাদত হতে সরিয়ে দিতো। আল্লাহ তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন ও হুমকির সুরে বলেনঃ যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে তখন জানবে কে সর্বাধিক পথভ্রষ্ট।

এরপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে জানিয়ে দেন যে, যার তকদীরে আল্লাহ দুর্ভোগ ও পথভ্রষ্টতা লিখে দিয়েছেন তাকে মহামহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া আর কেউই সুপথ প্রদর্শন করতে পারে না। তাই তিনি বলেনঃ তুমি কি দেখো না তাকে, যে তার কামনা বাসনাকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে? অর্থাৎ যে প্রবৃত্তির দাস এবং প্রবৃত্তি যা চায় তাই যে ভাল মনে করে, সেটাই তার দ্বীন ও মাযহাব। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তবে কি যে ব্যক্তির খারাপ কাজ তার জন্যে শোভনীয় করা হয়েছে, অতঃপর সে ওটাকে উত্তম দেখে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন।” (৩৫: ৮) এ জন্যেই তিনি এখানে বলেনঃ তবুও কি তুমি তার কর্মবিধায়ক হবে?

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, অজ্ঞতার যুগে একজন লোক কিছুকাল যাবত সাদা পাথরের ইবাদত করতো। অতঃপর যখন দেখতো যে, ওটার চেয়ে অন্যটি উৎকৃষ্টতর, তখন পূর্বটির পূজা ছেড়ে দিয়ে ঐ দ্বিতীয়টির পূজা শুরু করে দিতো।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তুমি কি দেখো না যে, তাদের অধিকাংশ শুনে ও বুঝে? তারা তো পশুরই মত; তারা আরো অধম। অর্থাৎ তাদের অবস্থা বিচরণকারী পশুর চেয়েও খারাপ। কারণ পশুরা ঐ কাজই করে যে কাজের জন্যে ওগুলোকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক শরীক বিহীন আল্লাহর ইবাদতের জন্যে। কিন্তু তারা তা পালন করেনি। বরং তারা তাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করে এবং তাদের কাছে দলীল প্রমাণাদি কায়েম হওয়া এবং তাদের নিকট রাসূলদেরকে প্রেরণ করা সত্ত্বেও তারা তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করে।

Leave a Reply