أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৯৩)
[*প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে আল্লাহকে খুঁজে পাওয়া :-]
www.motaher21.net
সূরা:- আল্ ফুরকান।
সুরা:২৫
পারা:১৯
৪৫-৫০ নং আয়াত:-
২৫:৪৫-
اَلَمۡ تَرَ اِلٰی رَبِّکَ کَیۡفَ مَدَّ الظِّلَّ ۚ وَ لَوۡ شَآءَ لَجَعَلَہٗ سَاکِنًا ۚ ثُمَّ جَعَلۡنَا الشَّمۡسَ عَلَیۡہِ دَلِیۡلًا ﴿ۙ۴۵﴾
তুমি কি দেখ না, কিভাবে তোমার প্রতিপালক ছায়া বিস্তার করেন? তিনি তো ইচ্ছা করলে একে স্থির রাখতে পারতেন; অতঃপর আমি সূর্যকে এর নির্দেশক করেছি।
২৫:৪৬
ثُمَّ قَبَضۡنٰہُ اِلَیۡنَا قَبۡضًا یَّسِیۡرًا ﴿۴۶﴾
অতঃপর আমি একে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনি।
২৫:৪৭
وَ ہُوَ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الَّیۡلَ لِبَاسًا وَّ النَّوۡمَ سُبَاتًا وَّ جَعَلَ النَّہَارَ نُشُوۡرًا ﴿۴۷﴾
আর তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণস্বরূপ, বিশ্রামের জন্য তোমাদের দিয়েছেন নিদ্ৰা এবং ছড়িয়ে পড়ার জন্য করেছেন দিন ।
২৫:৪৮
وَ ہُوَ الَّذِیۡۤ اَرۡسَلَ الرِّیٰحَ بُشۡرًۢا بَیۡنَ یَدَیۡ رَحۡمَتِہٖ ۚ وَ اَنۡزَلۡنَا مِنَ السَّمَآءِ مَآءً طَہُوۡرًا ﴿ۙ۴۸﴾
তিনিই স্বীয় করুণার প্রাক্কালে সুসংবাদবাহীরূপে বায়ু প্রেরণ করেন এবং আকাশ হতে পবিত্র পানি বর্ষণ করেন-
২৫:৪৯
لِّنُحۡیِۦَ بِہٖ بَلۡدَۃً مَّیۡتًا وَّ نُسۡقِیَہٗ مِمَّا خَلَقۡنَاۤ اَنۡعَامًا وَّ اَنَاسِیَّ کَثِیۡرًا ﴿۴۹﴾
যাতে তা দ্বারা আমরা মৃত ভূ-খণ্ডকে সঞ্জীবিত করি এবং আমরা যা সৃষ্টি করেছি তার মধ্য হতে বহু জীবজন্তু ও মানুষকে তা পান করাই।
২৫:৫০
وَ لَقَدۡ صَرَّفۡنٰہُ بَیۡنَہُمۡ لِیَذَّکَّرُوۡا ۫ۖ فَاَبٰۤی اَکۡثَرُ النَّاسِ اِلَّا کُفُوۡرًا ﴿۵۰﴾
এ বিস্ময়কর কার্যকলাপ আমি বার বার তাদের সামনে আনি যাতে তারা কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে কিন্তু অধিকাংশ লোক কুফরী ও অকৃতজ্ঞতা ছাড়া অন্য কোন মনোভাব পোষণ করতে অস্বীকার করে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
এ অধ্যায়টাতে মােশরেকদের কথাবার্তা ও রসুল(স.)-এর সাথে তাদের তর্ক-বিতর্কের প্রসংগ বাদ দিয়ে প্রকৃতির দৃশ্যাবলীর দিকে রাসূল(স.)-এর মনােযােগ আকর্ষণ করা হয়েছে। প্রকৃতির সাথে তার এই যােগাযােগ স্থাপিত হওয়া মােশরেকদের বিব্রতকর আচরণ ভুলিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। এটা তার মনকে এতাে উদার ও উঁচু করে যে, সেখান থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র ও অপরাধীদের শত্রুতা নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়। প্রত্যেক মানুষের মন ও বিবেককে আল্লাহর বিশাল সৃষ্টি জগতের দিকে আকৃষ্ট ও যুক্ত করা এবং তাকে নবতর আবেগ ও অনুভূতি সহকারে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে অনুপ্রাণিত করা কোরআনের চিরন্তন রীতি। এভাবে সৃষ্টির প্রতি মনােযােগ আকৃষ্ট করার পর তার মন ও বিবেক প্রকৃতির প্রতিটি বিষয় পর্যবেক্ষণ ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। বিশ্বের সর্বত্র আল্লাহর যে অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেগুলােকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে সে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে। সে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর সৃজনশীল হাত সক্রিয় দেখতে পায়। আর এভাবে সৃষ্টির সাথে যােগাযােগের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে তার চিন্তা-গবেষণা ও তার সাথে যোগাযােগ গড়ে ওঠে। আর মানুষ যখন মুক্ত চোখ ও মুক্ত মন নিয়ে জাগ্রত বিবেক ও সতেজ চেতনা নিয়ে এবং সুসংহত চিন্তা ও সক্রিয় অনুভূতি নিয়ে বাস করতে শুরু করে, তখন তার জীবন পৃথিবীর ছােটো খাটো সমস্যাবলীর উর্ধে উঠে যায় এবং জীবন সম্পর্কে তার অনুভূতি অত্যন্ত উন্নত হয় ও বহুগুণ বেড়ে যায়। সে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে যে মহাবিশ্বের মুক্ত দিগন্ত এই পৃথিবীর সীমিত গন্ডির চেয়ে বহুগুণ বেশী প্রশস্ত। সে এও অনুভব করে যে, মহাবিশ্বে সে যা কিছুই দেখতে পায়, সব একই ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত দ্বারা সৃজিত হয়েছে। সব একই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। একই স্রষ্টার ইচ্ছাধীন। সে স্বয়ং মহান আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্য থেকেই একটা সৃষ্টি। তার চার পাশে যা কিছু বিরাজ করে, যা কিছুর নজরে পড়ে এবং যা কিছু সে হাত দিয়ে স্পর্শ করে, সব কিছুর ওপরই আল্লাহর হাত তথা নিরংকুশ কর্তৃত্ব বিদ্যমান। মানুষ যখন এভাবে আল্লাহর সৃষ্টি করা এই বিশ্বে জীবন যাপন করে, তখন এক ধরনের আল্লাহভীতি, সম্প্রীতি ও আত্মবিশ্বাসের মিশ্র মনোভাব তার সমগ্র চেতনায়, অন্তরাত্মায় ও সমগ্র সত্ত্বায় ছড়িয়ে পড়ে। আর এর ফলে সে যতােদিন এই গ্রহে বেঁচে থাকে, এক বিশেষ ধরনের স্বচ্ছতা, ভালােবাসা ও স্বস্তি তার ব্যক্তিত্বকে অনন্য রূপ দান করে এবং সে সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত হয়। *প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে আল্লাহকে খুঁজে পাওয়া : এই অধ্যায়ে প্রথমে পৃথিবীতে শান্ত সুশীতল ছায়ার বিস্তৃতি ও আল্লাহর হাত দিয়ে তাকে সহজে ও শান্তভাবে ছােট ও বড় করার বিষয়টা আলােচিত হয়েছে। অতপর রাত ও রাতের বেলার ঘুম, দিনের বেলার কর্মব্যস্ততা, দয়া ও অনুগ্রহের শুভ আভাস দানকারী বাতাস এবং মৃত ভূমিকে পুনরুজ্জীবনকারী পানি সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। তারপর আলােচনা করা হয়েছে মিঠা পানি ও লােনা পানির দুই সমুদ্র সম্পর্কে। এই দুটো সমুদ্র পাশাপাশি অবস্থান করলেও একটার সাথে অপরটার কোনােই মিশ্রণ ঘটে না। তারপর আকাশের পানি থেকে শুরু করে বীর্য সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। এই বীর্য থেকে বিশ্ব পরিচালনাকারী মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। তারপর ছয় দিনে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ ও পৃথিবী। তারপর আকাশের বুরুজ তথা রাশি চক্র, দীপ্তিমান সূর্য ও চন্দ্র এবং রাত ও দিনের আবর্তন সম্পর্কে আলেচনা করা হয়েছে। এসব বিষয় আলােচনার মাঝে মাঝে আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার জন্যে মন ও বিবেককে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, তার শক্তি ও পরিকল্পনার প্রশংসা করা হয়েছে, তার সাথে অন্যান্য বস্তুকে শরীক করার যে রীতি মােশরেকরা অনুসরণ করে চলেছে, যে বস্তু তাদের লাভ ক্ষতি কিছুই করতে পারে না। তার দাসত্ব ও পূজা এবং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা, ঔদ্ধত্য ও অস্বীকৃতির কঠোর নিন্দা ও সমালােচনা করা হয়েছে। এ সমালােচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর এতাে সব নিদর্শন ও তার এতাে সব বিচিত্র সৃষ্টি দেখার পরও তাদের এসব আচরণ অত্যন্ত বিস্ময়কর। এবার আল্লাহ তায়ালা তার যে বিচিত্র সৃষ্টিজগত নিয়ে সারা জীবন চিন্তা গবেষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন, আসুন, অন্তত কিছুক্ষণ তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি কি দেখনি, তােমার প্রভু কিভাবে ছায়াকে প্রলম্বিত করেছেন।…'(আয়াত ৪৫-৪৬) শীতল ছায়া একজন শ্রান্ত ক্লান্ত মানুষের মনে যে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তি এনে দেয়, তা সত্যিই অবর্ণনীয়। কিন্তু কাফেরদের বিদ্রুপ ও উপহাসে জর্জরিত হওয়ার পর বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা যে ছায়ার কথা স্মরণ করিয়েছেন, তার মর্ম কি এটাই? আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রাণান্তকর সংগ্রামে শ্রান্ত-ক্লান্ত বান্দার মনকে তিনি যে সান্তনা দিচ্ছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মােশরেক ও সংখ্যালঘু মােমেনদের অধ্যুষিত মক্কায় মােশরেকদের কুফরী, অহংকার, ঔদ্ধত্য ধোকা ও হঠকারিতায় বিব্ৰত বান্দাকে তিনি যে প্রবােধ দিচ্ছেন, তার অর্থ কি শুধু এতােটুকুই? যে বান্দাকে তখনাে পর্যন্ত মােশরেকদের আক্রমণাত্মক আচরণ, বিদ্রুপ ও উপহাসের জবাবে একই ধরনের আচরণের অনুমতি দেয়া হয়নি। তাকে এই ছায়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আসলে তিনি কী বুঝাতে চাইছেন। আসলে রসূল(স.)-এর কাছে নাযিল হওয়া এই কোরআনই হচ্ছে সেই শান্তিদায়ক, সুশীতল ছায়া। এই কোরআনই কুফরী ও নাফরমানীর উষর মরুতে প্রাণ সঞ্চারক পানি। তাই সমগ্র সূরার বক্তব্য ও মর্মবাণীর সাথে এই ছায়ার অপূর্ব সামঞ্জস্য রয়েছে-বিশেষত আরবের মরু প্রধান দেশে। আয়াতের ভাষায় ছায়ার পাশাপাশি আল্লাহর কুশলী হাতের ছবিও এঁকে দেয়া হয়েছে, যা অতি সংগােপনে ছায়াকে ছােট ও বড় করে থাকে। দিনের বেলায় সূর্যের কিরণ বিভিন্ন বস্তুর আড়ালে গেলে যে হালকা অন্ধকারের সৃষ্টি হয়, তাকেই ছায়া বলে। সূর্যের সামনে থেকে পৃথিবী যতোখানি দূরে সরে, ছায়াও ততােখানি সরে ও লম্বা হয়। সূর্য নিজের আলাে ও উত্তাপ দিয়ে তাকে পথ প্রদর্শন করে এবং তার আকৃতি, প্রসার ও প্রত্যাবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর ছায়ার ক্রম-বৃদ্ধি ও ক্রমহ্রাস মানুষের মনে যেমন এক ধরনের স্বস্তি ও স্নিগ্ধতার বিস্তার ঘটায়, তেমনি এক ধরনের সুক্ষ্ম ও স্বচ্ছ চেতনাও উজ্জীবিত করে। এর মধ্য দিয়ে মানুষের মন মহাশক্তিশালী ও অতীব সুক্ষ্মদর্শী স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুণ্য প্রত্যক্ষ করে। ছায়া ও সূর্য কিরণ কখনাে একই অবস্থায় থাকে না বরং ক্রমেই অদৃশ্য হতে থাকে। ছায়া ক্রমেই লম্বা হতে থাকে। অবশেষে এক সময়ে তাকালে তা আর মােটেই দেখা যায় না। এক সময় সূর্য ও ছায়া দুটোই অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথায় যায়? সেই গােপন হাতই তাকে মুঠোর মধ্যে গুটিয়ে নেয়, যা এক সময় তাকে প্রসারিত করেছিলাে । রাতের গভীর ছায়ায় ও ঘন তমসায় এক সময় তা হারিয়ে যায়। এ হচ্ছে অসীম শক্তিধর স্রষ্টার সুনিপুণ হাত। মানুষের চারপাশে বিরাজমান সৃষ্টিজগতে এই হাতের যে তৎপরতা আবহমান কাল ধরে চলছে, কখনাে তাতে স্থবিরতা আসে না। ‘তিনি যদি চাইতেন তবে এই ছায়াকে স্থির করে দিতে পারতেন।’ অর্থাৎ গােটা বিশ্ব নিখিলের বর্তমান অবস্থা প্রক্রিয়াই ছায়াকে এরূপ মৃদুভাবে সচল রেখেছে। এই সময় প্রক্রিয়ায় যদি সামান্যতম বৈকল্য বা ব্যত্যয় ঘটতাে, তাহলে দৃশ্যমান ছায়ায় তার প্রভাব পড়তে। পৃথিবী যদি স্থির থাকতাে, তাহলে তার ওপরের সকল ছায়াও স্থির থাকতাে এবং ছােট বড় হতাে না। আর যদি পৃথিবীর গতি আরাে ধীর বা দ্রুত হতাে, তাহলে ছায়াও বর্তমানের চেয়েও ধীর কিংবা দ্রুতগতিতে কমতাে ও বাড়তাে। মােট কথা, বর্তমান প্রাকৃতিক নিয়মে বিশ্ব ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার কারণেই ছায়ার আকৃতিতে সেসব তারতম্য ঘটে, যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। আমাদের প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া এই প্রাকৃতিক দৃশ্য, যা আমরা দেখেও না দেখার ভান করে উদাসীনভাবে চলে যাই। এটাকে আমাদের বিবেকে জাগরূক করাই কোরআনের অন্যতম লক্ষ্য। এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে পারিপার্শ্বিক জগত সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন ও সচকিত করে, আমাদের সেই সুপ্ত ও অচেতন অনুভূতি জাগিয়ে তােলে। কেননা দীর্ঘদিন ক্রমাগতভাবে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে তার বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যগুলাে আমাদেরকে আর বিমােহিত করে না এবং এ সবের মধ্যে কোনাে চিন্তা-ভাবনার ও শিক্ষার বিষয় আছে বলে আমাদের মনে হয় না। তাই এভাবেই কোরআন এই বিস্ময়কর প্রকৃতির সাথে আমাদের বিবেক ও মনের যােগাযােগ পুনস্থাপন করে। ছায়া সংক্রান্ত আলােচনার পর আচ্ছাদনকারী রাত, স্বস্তিদায়ক ঘুম এবং কর্মব্যস্ত দিন সম্পর্কে আলােচনা আসছে, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাতকে পােশাক, ঘুমের বিশ্রাম ও দিনকে প্রাণ চাঞ্চল্যের আধার বানিয়েছেন।’ রাত পৃথিবীর যাবতীয় বন্ধু ও প্রাণীকে এমনভাবে ঢেকে দেয় যে, তখন মনে হয়, গােটা পৃথিবীই যেন রাতকে পোশাক হিসেবে গ্রহণ করে পরিধান করেছে এবং তার অন্ধকারে নিজেকে আবৃত করেছে। এভাবে রাত একটা পােশাকে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আর সাধারণত রাতে সমস্ত কর্মব্যস্ততা ও চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ ও পশু পাখী ঘুমায়। ঘুম প্রকৃতপক্ষে চলাচল, কর্মকান্ড ও অনুভূতি উপলব্ধির বিরতি। তাই এটা বিশ্রামের নামান্তর। তারপর সকাল হওয়ার সাথে সাথেই আবার শুরু হয় কর্মচাঞ্চল্য ও চলাচল। তাই দিন যেন রাতের ক্ষুদ্র ও সাময়িক মৃত্যুর পর নব জীবনের সূচনা স্বরূপ এই সাময়িক মৃত্যু এবং তারপর পুনরুজ্জীবন পৃথিবীতে জীবনের পর্যায়ক্রমিক স্থিতি নিয়ে আসে এবং এখনাে তাতে স্থবিরতা আসে না। অথচ এ জিনিসটা যে আল্লাহর অতুলনীয় পরিচালনা নৈপুণ্য ও ব্যবস্থাপনা-দক্ষতার প্রমাণ বহণ করে। মানুষ তা অবজ্ঞার সাথে এড়িয়ে যায়। মহান আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে শুধু নিজের নৈপুণ্যেরই স্বাক্ষর রাখেননি, বরং তিনি যে এক মুহূর্তের জন্যেও ঘুমান না বা নিজ সৃষ্টির তত্ত্বাবধান থেকে উদাসীন হন না, তারও প্রমাণ দিয়েছেন। এরপরে বৃষ্টির আভাস বহনকারী বাতাস এবং তা থেকে জীবনের ব্যাপক বিস্তার সম্পর্কে বলা হয়েছে। ‘তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা যিনি তার রহমতের সুসংবাদবাহী হিসেবে বাতাসকে পাঠিয়েছেন, আর আমি আকাশ থেকে পবিত্র পানি বর্ষণ করি, যাতে তা দ্বারা মৃত দেশকে পুনরুজ্জীবিত করি এবং তা আমার সৃষ্টি করা বহু প্রাণী ও মানুষকে পান করাই।’ এই পৃথিবীর সকল প্রাণীরই জীবন বৃষ্টির পানির সাথে ওৎপ্রােতভাবে জড়িত, চাই প্রত্যক্ষভাবে হােক কিংবা পৃথিবীর বিভিন্ন জলাশয়, নদ নদী, কিংবা ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের মাধ্যমেই হােক। তবে যারা সরাসরি বৃষ্টির পানির ওপর জীবন ধারণ করে, তারাই পানির আকারে আল্লাহর রহমতকে সঠিকভাবে ও পূর্ণাংগভাবে লাভ করে। যেহেতু তাদের জীবন পুরােপুরিভাবে বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল, তাই তারা সব সময় বৃষ্টির জন্য উন্মুখ ও উদগ্রীব হয়ে থাকে। আর একই কারণে তারা মেঘ পরিচালনাকারী বাতাসের অপেক্ষায় থাকে, বাতাস দেখলে বৃষ্টি হবে বলে আশান্বিত হয় এবং তাতেই আল্লাহর রহমত অনুভব করে- যদি তারা পরিপক্ক ঈমানের অধিকারী হয়ে থাকে। আয়াতের বক্তব্য থেকে পবিত্রতা ও পবিত্রকরণের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝা যায়। বলা হয়েছে, আকাশ থেকে আমি পবিত্র পানি বর্ষণ করেছি।’ অতপর পানিতে নিহিত জীবনের কথা বলা হয়েছে। ‘যাতে আমি মৃত দেশকে পুনরুজ্জীবিত করি এবং তা আমার সৃষ্টি করা বহু মানুষ ও পশুকে পান করাই।’ এ উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, পবিত্রতাকে জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীতে যে জীবনের উদ্ভব ঘটিয়েছেন, মূলত পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করেই তার উত্তর ঘটাতে চেয়েছেন এবং কার্যত তদ্রূপ ঘটিয়েছেন। তিনি পৃথিবীকে বিধৌতও করেছেন আকাশ থেকে বর্ষিত পবিত্র পানি দিয়ে, মৃত মাটিতে প্রাণের উদ্ভবও ঘটিয়েছেন সেই পবিত্র পানি দিয়ে, আর এই পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ ও প্রাণীকূলকে পানও করান সেই পবিত্র পানি। সুতরাং পবিত্রতাই জীবনের ভিত্তি ও উৎস। প্রাকৃতিক উপকরণসমূহের পর্যালোচনা এই পর্যায়ে অবতারণা করা হয়েছে কোরআনের প্রসংগ। কেননা আকাশ থেকে বর্ষিত পবিত্র পানির মতােই মানুষের অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও বিশুদ্ধ করার মহৎ উদ্দেশ্যে এই কোরআন ও আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি তা[{কোনাে কোনাে মােফাসসেরের মতে এই তা’ সর্বনাম দ্বারা পানিকে বুঝানাে হয়েছে। কারণ পানিই নিকটতম উল্লেখিত জিনিস এবং এ জায়গায় কোরআনের কোনাে উল্লেখ নেই। তবে আমার মতে, এ দ্বারা পানি নয়, কোরআনকেই বুঝানাে হয়েছে। কেননা পরবর্তী আয়াতে যেখানে বলা হয়েছে, তা দ্বারা অবাধ্যদের বিরুদ্ধে জোরদার সংগ্রাম কর’ সেখানে তা সর্বনাম দ্বারা কোরআনকেই বুঝানাে হয়েছে। কেননা পানি কোনাে সংগ্রামের উপকরণ হয় না। দ্বিতীয় সর্বনাম দিয়ে যদি কোরআনকে বুঝানাে হয়ে থাকে, তবে প্রথম সর্বনাম দ্বারাও কোরআনকে বুঝানাে হবে। এতে কোনাে সন্দেহ নেই। এটা আসলে কোরআনের একটা বহুল প্রচলিত বাকরীতি। যাতে এটা প্রাসংগিক বিষয় এর সাথে সংযােগ থাকার কারণে সর্বনামের লক্ষ্যবন্তু উহ্য রাখা হয়। এই প্রাসংগিক বিষয়টা হলো জীবনদায়ীনী পবিত্র পানি বর্ষণ, যা মনকে জীবনদায়ীনী ও বিশুদ্ধকারী কোরআনের দিকে আকৃষ্ট করে। আর এই সুরাটা সামগ্রিকভাবে কোরআনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত}] তাদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছি, যাতে তারা স্মরণ করে। আর যদি আমি চাইতাম তবে প্রত্যেক গ্রামে এক একজন সতর্ককারী পাঠাতাম। সুতরাং তুমি আল্লাহর অবাধ্য লােকদের আনুগত্য করাে না এবং তা দ্বারা তাদের সাথে জোরদার সংগ্রাম চালিয়ে যাও।’ আমি তা (অর্থাৎ কোরআনকে) তাদের মধ্যে বন্টন করেছি। ‘ অর্থাৎ নানাভাবে ও নানা পন্থায় তাদের কাছে কোরআনকে উপস্থাপন করেছি। নানারকম আকর্ষণীয় পন্থায় কোরআনের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। নানা রকম ভংগিতে তাদের বিবেক, মন ও অনুভূতিকে সম্বােধন করেছি, সকল সম্ভাব্য পন্থায় তাদের হৃদয়কে জয় করার পদক্ষেপ নিয়েছি এবং তাদের বিবেককে জাগানাের সকল পন্থাই প্রয়ােগ করেছি। ‘যাতে তারা স্মরণ করে।’ কেননা স্মরণ করার চেয়ে বেশী কিছুর প্রয়ােজন নেই। যে সত্য হৃদয়ে বদ্ধমূল করতে। কোরআন সচেষ্ট, তা তাদের অন্তরাত্মার গভীরে জন্মসূত্রেই প্রােথিত রয়েছে। কেবল তাদের প্রবৃত্তিই তাদেরকে সে সত্য ভুলিয়ে রেখেছে। কেননা এই প্রবৃত্তিকে তারা মাবুদের আসনে বসিয়ে রেখেছে। কেননা এই প্রবৃত্তিকে তারা থােদার আসনে বসিয়ে রেখেছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কেবল কুফরী করতেই সম্মত হয়েছে। এমতাবস্থায় রসূল(স.)-এর দায়িত্ব খুবই বড় ও কঠিন হয়ে দাড়ায়। কেননা তিনি সমগ্র মানব জাতিকে সুপথ প্রদর্শনের দায়িত্বে নিযুক্ত। অথচ অধিকাংশ মানুষই নিজ প্রবৃত্তি দ্বারা বিভ্রান্ত। তাই ঈমানের অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত থাকা সত্তেও তারা ঈমান আনতে নয়, বরং কুফরী করতেই সম্মত।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪৫-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাঁর অস্তিত্ব, ক্ষমতা ও বান্দার প্রতি তাঁর নেয়ামতের বর্ণনা দিচ্ছেন যা তাঁর একত্বের প্রমাণ বহন করে। الظِّلَّ দ্বারা উদ্দেশ্যন সুবহে সাদিক থেকে সূর্য উঠা পর্যন্ত নাতিশীতোষ্ণ সময়টুকু। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে সকল মানুষকে বলছেন: তুমি কি তোমার দৃষ্টি দ্বারা প্রত্যক্ষ এবং চিন্তা করে দেখছ না? আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে ছায়া বিস্তৃত করে দিয়েছেন। রৌদ্র ও ছায়া দু’টি এমন নেয়ামত যা ছাড়া মানুষের জীবন ও কাজ কারবার চলতে পারে না। সর্বদা ও সর্বত্র রৌদ্র থাকলে মানুষ ও জীব গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যেত যা গ্রীষ্মকালে মানুষসহ পশু-পাখি, জীব-জন্তু অনুধাবন করে থাকে। পক্ষান্তরে সর্বদা ও সর্বত্র ছায়া থাকলে, রোদ না আসলে মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে না এবং হাজারো কাজে বিঘœ সৃষ্টি হবে, কোন ফসল ও উদ্ভিদ উদ্গত হবে না যা শীতকালে অনুধাবন করা যায়। সুতরাং রৌদ্র ও ছায়া আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ নেয়ামত।
(وَلَوْ شَا۬ءَ لَجَعَلَه۫ سَاكِنًا)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করলে ছায়া স্থির করে দিতে পারতেন, কখনো রৌদ্র আসতো না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তা না করে সূর্যের কিরণ দ্বারা ছায়া দূরীভূত করে দিয়েছেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ جَعَلَ اللّٰهُ عَلَيْكُمُ اللَّيْلَ سَرْمَدًا إِلٰي يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ إلٰهٌ غَيْرُ اللّٰهِ يَأْتِيْكُمْ بِضِيَا۬ءٍ)
“বল: ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ তা‘আলা যদি রাতকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত এমন কোন মা‘বূদ আছে যে তোমাদেরকে আলো এনে দিতে পারে?” (সূরা কাসাস ২৮:৭১-৭২)
دَلِيْلًا অর্থাৎ আমি সূর্যকে করেছি ছায়ার ওপর দলীলস্বরূপ। সূর্যের আলোর মাধ্যমে ছায়া চিনতে পারা যায়। যদি আলো না থাকত তাহলে ছায়া বুঝা যেত না। এরপর আল্লাহ তা‘আলা ছায়াকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অন্য আরেকটি ক্ষমতার কথা বর্ণনা করেছেন। তা হল আল্লাহ তা‘আলা রাত্রিকে মানুষের জন্য করেছেন লেবাস। অর্থাৎ পোশাক যেমন মানুষকে ঢেকে রাখে অনুরূপভাবে রাত্রি তার অন্ধকার দ্বারা সব কিছু আচ্ছাদিত করে নেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشٰي)
“শপথ রাত্রির, যখন সে আচ্ছন্ন করে।” (সূরা লাইল ৯২:১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشٰهَا)
“শপথ রাত্রির যখন সে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে” (সূরা শামস ৯১:৪)
سُبَاتًا শব্দটি سبت থেকে উদ্ভুত, এর প্রকৃত অর্থ হল ছিন্ন করা। سبات এমন বস্তু যা দ্বারা অন্য বস্তুকে ছিন্ন করা হয়। নিদ্রাকে আল্লাহ তা‘আলা এমন করেছেন যে, এর ফলে সারাদিনের ক্লান্তি ও কষ্ট ছিন্ন তথা দূর হয়ে যায়। ফলে রাতে ঘুম আবৃত করে নেয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا)
“আমিই তোমাদের নিদ্রাকে করেছি আরামদায়ক।” (সূরা নাবা ৭৮:৯)
সুতরাং আমরা স্বভাবগতভাবেই অনুধাবন করতে পারি রাত ঘুমের জন্য কত উপযোগী। দিনের বেলা মানুষের কোলাহল, সূর্যের আলো, সব মিলিয়ে ঘুম আসে না, আসলেও তৃপ্তিদায়ক হয় না।
পক্ষান্তরে দিনকে করেছেন বিচরণ করার জন্য। মানুষ দিনের বেলা জীবিকা উপার্জন ও কাজ-কর্ম করার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিচরণ করে থাকে। نُشُوْرً শব্দের প্রকৃত অর্থ উত্থিত হওয়া, জাগা। ঘুম এক প্রকার মৃত্যু, সকাল বেলা মানুষ যখন ঘুম থেকে উঠে তখন সে জীবন ফিরে পায়, তাই তাকে نُشُوْرً বলা হয়েছে। তাই আমরা ঘুম থেকে জাগার দু‘আয় বলি:
الحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
প্রশংসা সে সত্তার যিনি আমাদেরকে মৃত্যুর পর জীবিত করেছেন এবং তাঁর দিকেই উত্থিত হব। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَّجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا)
“আর দিবসকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম করে দিয়েছি; (সূরা নাবা ৭৮:১১)
এরপর আল্লাহ তাঁর অন্যান্য করুণা বা ক্ষমতার কথা বর্ণনা করেছেন যে, তিনিই তাঁর করুণার প্রাক্কালে সুসংবাদবাহীরূপে বাতাস প্রেরণ করেন। আল্লাহ বলেন:
(وَهُوَ الَّذِيْ يُرْسِلُ الرِّيٰحَ بُشْرًام بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِه۪)
“তিনিই স্বীয় অনুগ্রহের প্রাক্কালে বায়ুকে সুসংবাদবাহীরূপে প্রেরণ করেন।” (সূরা আ‘রাফ ৭:৫৭)
উবাই বিন কাব (রাঃ) বলেন: কুরআন প্রত্যেক যে সকল স্থানে رياح বা বহুবচন হিসেবে ব্যবহার হয়েছে তা রহমতের বাতাস বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়েছে। আর যেসকল স্থানে ريحবা একবচন হিসেবে ব্যবহার হয়েছে তা আযাবের বাতাস বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আরেকটি নিদর্শনের কথা বর্ণনা করছেন যে, আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন, যা দ্বারা তিনি মৃত জমিনকে জীবিত করেন। أَنَاسِيَّ শব্দটি انسي এর বহুবচন অর্থ মানুষ। অর্থাৎ মাটি মরে ধু-ধু হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টির পানি যেমন তাকে জীবিত করে, তেমনি বৃষ্টির পানি দ্বারা জীব-জন্তু ও মানুষ পিপাসা নিবারণ করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَانْظُرْ إِلٰٓي اٰثٰرِ رَحْمَتِ اللّٰهِ كَيْفَ يُحْيِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ط إِنَّ ذٰلِكَ لَمُحْيِ الْمَوْتٰي ج وَهُوَ عَلٰي كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ )
“অতএব আল্লাহ তা‘আলার রহমাতের ফল সম্পর্কে চিন্তা কর; কিভাবে তিনি জমিনকে জীবিত করেন তার মৃত্যুর পর।” (সূরা রূম ৩০:৫০)
সুতরাং এসব নেয়ামত যে সত্তা দান করেছেন সে সত্তার প্রশংসা করা উচিত, একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. এতে প্রমাণিত হয় যে, সকল কিছুর ওপর কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার, সুতরাং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে। অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না।
২. সকল বস্তুর রিযিকের মালিক কেবল আল্লাহ তা‘আলা।
৩. মানুষের যখন যা প্রয়োজন তখন আল্লাহ তা‘আলা তা প্রদান করেন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মূলে “দলীল” (دليل) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ঠিক এমন একটি অর্থে যে অর্থে ইংরেজী ভাষায় Pilot শব্দটির ব্যবহার হয়। মাঝি-মাল্লাদের পরিভাষায় “দলীল” এমন এক ব্যক্তিকে বলা হয় যে নৌকাকে পথ-নির্দেশনা দিয়ে চালাতে থাকে। ছায়ার উপর সূর্যকে দলীল করা অর্থ হচ্ছে এই যে, ছায়ার ছড়িয়ে পড়া ও সংকুচিত হওয়া সূর্যের উপরে ওঠা ও নেমে যাওয়া এবং তার উদয় হওয়া ও অস্তে যাওয়ার উপর নির্ভরশীল এবং তার আলামত। ছায়া অর্থ আলোক ও অন্ধকারের মাঝামাঝি এমন অবস্থা যা সকাল বেলা সূর্য ওঠার আগে হয় এবং সারাদিন ঘরের মধ্যে, দেয়ালের পেছনে ও গাছের নিচে থাকে।
# নিজের দিকে গুটিয়ে নেয়া মানে হচ্ছে, অদৃশ্য ও বিলীন করে দেয়া। কারণ যে কোন জিনিস ধ্বংস হয় তা আল্লাহরই দিকে ফিরে যায়। প্রত্যেকটি জিনিস তাঁর দিক থেকেই আসে এবং তাঁরই দিকে ফিরে যায়। এ আয়াতের দু’টি দিক। বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিক। বাহ্যিক দিক থেকে আয়াতটি মুশরিকদের বলছে, যদি তোমরা পৃথিবীতে পশুর মতো জীবন ধারণ না করতে এবং কিছুটা বুদ্ধি-বিবেচনা ও সচেতনতার সাথে এগিয়ে চলতে, তাহলে প্রতিনিয়ত তোমরা এই যে ছায়া দেখতে পাচ্ছো এটিই তোমাদের এ শিক্ষা দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল যে, নবী তোমাদের যে তাওহীদের শিক্ষা দিচ্ছেন তা যথার্থই সত্য ও সঠিক। তোমাদের সারা জীবন এ ছায়ার জোয়ার-ভাটার সাথে বিজড়িত। যদি চিরন্তন ছায়া হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীতে কোন প্রাণী এমন কি উদ্ভিদও জীবিত থাকতে পারে না। কারণ সূর্যের আলো ও উত্তাপের উপর তাদের সবার জীবন নির্ভর করে। ছায়া যদি একেবারেই না থাকে তাহলেও জীবন অসাধ্য। কারণ সর্বক্ষণ সূর্যের মুখোমুখি থাকার এবং তার রশ্মি থেকে কোন আড়াল না পাওয়ার ফলে কোন প্রাণী এবং কোন উদ্ভিদও বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। বরং পানিও উধাও হয়ে যাবে। রোদ ও ছায়ার মধ্যে যদি হঠাৎ করে পরিবর্তন হতে থাকে তাহলে পৃথিবীর সৃষ্টিকূল পরিবেশের এসব আকস্মিক পরিবর্তন বেশীক্ষণ বরদাশত করতে পারবে না। কিন্তু একজন মহাজ্ঞানী স্রষ্টা ও সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তা পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে এমন একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন যার ফলে স্থায়ীভাবে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে ধীরে ধীরে ছায়া পড়ে ও হ্রাস-বৃদ্ধি হয় এবং রোদ ক্রমান্বয়ে বের হয়ে আসে এবং বাড়তে ও কমতে থাকে। এ ধরনের বিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা কোন অন্ধ প্রকৃতির হাতে আপনা আপনি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অথবা বহুসংখ্যক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রভুও একে প্রতিষ্ঠিত করে এভাবে একটি ধারাবাহিক নিয়ম-শৃংখলা সহকারে চালিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু এসব বাহ্যিক শব্দের অভ্যন্তর থেকে আর একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে, বর্তমানে এই যে কুফরী ও শিরকের অজ্ঞতার ছায়া চতুর্দিকে ছেয়ে আছে এটা কোন স্থায়ী জিনিস নয়। কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আকারে হেদায়াতের সূর্য উদিত হয়েছে। বাহ্যত ছায়া বিস্তার লাভ করেছে দূর দূরান্তে। কিন্তু এ সূর্য যতই উপরে উঠতে থাকবে ততই ছায়া সংকুচিত হতে থাকবে। তবে একটু সবরের প্রয়োজন। আল্লাহর আইন কখনো আকস্মিক পরিবর্তন আনে না। বস্তুজগতে যেমন সূর্য ধীরে ধীরে উপরে উঠে এবং ছায়া ধীরে ধীরে সংকুচিত হয় ঠিক তেমনি চিন্তা ও নৈতিকতার জগতেও হেদায়াতের সূর্যের উত্থান ও ভ্রষ্টতার ছায়ার পতন ধীরে ধীরেই হবে।
# ঢাকবার ও লুকাবার জিনিস।
# এ আয়াতের তিনটি দিক রয়েছে। একদিক থেকে এখানে তাওহীদের যুক্তি পেশ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দিক থেকে নিত্যদিনকার মানবিক অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের সাহায্যে মৃত্যুর পরের জীবনের সম্ভাবনার যুক্তি পেশ করা হচ্ছে। তৃতীয় দিক থেকে যেভাবে সুসংবাদ দেয়া হচ্ছে যে, জাহেলীয়াতের রাত শেষ হয়ে গেছে, এখন জ্ঞান, চেতনা ও হেদায়াতের উজ্জ্বল দিবালোকের স্ফূরণ ঘটেছে এবং শিগগির বা দেরীতে যেমনি করেই হোক নিদ্রিতরা জেগে উঠবেই। তবে যাদের জন্য রাতের ঘুম ছিল মৃত্যু ঘুম তারা আর জাগবে না এবং তাদের না জেগে ওঠা হবে তাদের নিজেদের জন্যই জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া, দিনের কাজ কারবার তাদের কারণে বন্ধ হয়ে যাবে না।
# এমন পানি যা সব ধরনের পংকিলতা থেকেও মুক্ত হয় আবার কোন প্রকার বিষাক্ত পদার্থ ও জীবানুও তার মধ্যে থাকে না। যার সাহায্যে নাপাকি ধুয়ে সাফ করা যায় এবং মানুষ, পশু, পাখি, উদ্ভিদ সবাই জীবনী শক্তি লাভ করে।
# উপরের আয়াতটির মতো এ আয়াতটিরও তিনটি দিক রয়েছে। এর মধ্যে তাওহীদের যুক্তি রয়েছে, পরকালের যুক্তিও রয়েছে এবং এ সঙ্গে এ সূক্ষ বিষয়বস্তুটিও এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে যে, জাহেলীয়াতের যুগ ছিল মূলত খরা ও দূর্ভিক্ষের যুগ। সে যুগে মানবিকতার ভূমি অনুর্বর ও অনাবাদী থেকে গিয়েছিল। এখন আল্লাহ অনুগ্রহ করে নবুওয়াতের রহমতের মেঘমালা পাঠিয়েছেন। তা থেকে অহী জ্ঞানের নির্ভেজাল জীবনবারি বর্ষিত হচ্ছে। সবাই না হলেও আল্লাহর বহু বান্দা তার স্বচ্ছ ধারায় অবগাহন করতে পারবেই।
# মূল শব্দগুলো হচ্ছে لَقَدْ صَرَّفْنَاهُ —এর তিনটি অর্থ হতে পারে। এক, বারিধারা বর্ষণের এ বিষয়বস্তুটি আমি কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বারবার বর্ণনা করে প্রকৃত সত্য বুঝাবার চেষ্টা করেছি। দুই, আমি বারবার গ্রীষ্ম ও খরা, মওসূমী বায়ু, মেঘ, বৃষ্টি এবং তা থেকে সৃষ্ট বিচিত্র জিবন-উপকরণসমূহ তাদের দেখাতে থেকেছি। তিন, আমি বৃষ্টিকে আবর্তিত করতে থাকি। অর্থাৎ সব সময় সব জায়গায় সমান বৃষ্টিপাত হয় না। বরং কখনো কোথাও চলে একদম খরা, কোথাও কম বৃষ্টিপাত হয়, কোথাও চাহিদা অনুযায়ী বৃষ্টিপাত হয়, কোথাও ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার আবির্ভাব হয় এবং এসব অবস্থায় বিভিন্ন বিচিত্র ফলাফল সামনে আসতে থাকে।
# যদি প্রথম দিক থেকে (অর্থাৎ তাওহীদের যুক্তির দৃষ্টিতে) দেখা যায়, তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়ঃ লোকেরা যদি চোখ মেলে তাকায় তাহলে নিছক বৃষ্টির ব্যবস্থপনারই মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবলী এবং তাঁর একক রব্বুল আলামীন হবার প্রমাণ স্বরূপ এত বিপুল সংখ্যক নিদর্শন দেখতে পাবে যে, একমাত্র সেটিই নবীর তাওহীদের শিক্ষা সত্য হবার পক্ষে তাদের নিশ্চিন্ত করতে পারে। কিন্তু আমি বারবার এ বিষয়বস্তুর প্রতি তাদের দৃষ্টি আর্কষণ করা সত্ত্বেও এবং দুনিয়ায় পানি বণ্টনের এ কার্যকলাপ নিত্য-নতুনভাবে একের পর এক তাদের সামনে আসতে থাকলেও এ জালেমরা কোন শিক্ষা গ্রহণ করে না। তারা সত্য ও ন্যায়নীতিকে মেনে নেয় না। তাদের আমি বুদ্ধি ও চিন্তার যে নিয়ামত দান করেছি তার জন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করে না। এমন কি তারা নিজেরা যা কিছু বুঝতো না তা তাদের বুঝাবার জন্য কুরআনে বার বার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে–এ অনুগ্রহের জন্য শোকর গুজারীও করে না।
দ্বিতীয় দিক থেকে (অর্থাৎ আখেরাতের যুক্তির দৃষ্টিতে) দেখলে এর অর্থ দাঁড়ায়ঃ প্রতি বছর তাদের সামনে গ্রীষ্ম ও খরায় অসংখ্য সৃষ্টির মৃত্যুমুখে পতিত হবার এবং তারপর বর্ষার বদৌলতে মৃত উদ্ভিদ ও কীটপতঙ্গের জীবিত হয়ে উঠার নাটক অভিনীত হতে থাকে। কিন্তু সবকিছু দেখেও এ নির্বোধের দল মৃত্যুর পরের জীবনকে অসম্ভব বলে চলছে। বারবার সত্যের এ দ্ব্যর্থহীন নিদর্শনের প্রতি তাদের দৃষ্টি আর্কষণ করা হয় কিন্তু কুফরী ও অস্বীকৃতির অচলায়তন কোনক্রমেই টলে না। তাদের বুদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তির যে অতুলনীয় নিয়ামত দান করা হয়েছে তার অস্বীকৃতির ধারা কোনক্রমে খতমই হয় না। শিক্ষা ও উপদেশ দানের যে অনুগ্রহ তাদের প্রতি করা হয়েছে তার প্রতি অকৃতজ্ঞ মনোভাব তাদের চিরকাল অব্যাহত রয়েছে।
যদি তৃতীয় দিকটি (অর্থাৎ খরার সাথে জাহেলীয়াতের এবং রহমতের বারিধারার সাথে অহী ও নবুওয়াতের তুলনাকে) সামনে রেখে দেখা হয় তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়ঃ মানবজাতির ইতিহাসে এ দৃশ্য বার বার সামনে এসেছে যে যখনই এ দুনিয়া নবী ও আল্লাহর কিতাবের কল্যাণসুধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে তখনই মানবতা বন্ধ্যা হয়ে গেছে এবং চিন্তা ও নৈতিকতার ভূমিতে কাঁটাগুল্ম ছাড়া আর কিছুই উৎপন্ন হয়নি। আর যখনই অহী ও রিসালাতের জীবন বারি এ পৃথিবীতে পৌঁছে গেছে তখনই মানবতার উদ্যান ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান মূর্খতা ও জাহেলীয়াতের স্থান দখল করেছে। জুলুম-নিপীড়নের জায়গায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফাসেকী ও অশ্লীলতার জায়গায় নৈতিক ও চারিত্রিক মাহাত্মের ফুল ফুটেছে। যেদিকে তার দান যতটুকু পৌঁছেছে সেদিকেই অসদাচার কমে গেছে এবং সদাচার বেড়ে গেছে। নবীদের আগমন সবসময় একটি শুভ ও কল্যাণকর চিন্তা ও নৈতিক বিপ্লবের সূচনা করেছে। কখনো এর ফল খারাপ হয়নি। আর নবীদের বিধান ও নির্দেশাবলী প্রত্যাখ্যান করে বা তা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবজাতি সব সময় ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে। কখনো এর ফল ভালো হয়নি। ইতিহাস এ দৃশ্য বারবার দেখিয়েছে এবং কুরআনও বার বার এদিকে ইশারা করেছে। কিন্তু এরপরও লোকেরা শিক্ষা নেয় না। এটি একটি অমোঘ সত্য। হাজার বছরের মানবিক অভিজ্ঞতার ছাপ এর গায়ে লেগে আছে। কিন্তু একে অস্বীকার করা হচ্ছে। আর আজ নবী ও কিতাবের নিয়ামত দান করে আল্লাহর যে জনপদকে ধন্য করেছেন সে এর শোকর গুজারী করার পরিবর্তে উল্টো অকৃতজ্ঞ মনোভাব প্রকাশের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪৫-৪৭ নং আয়াতের তাফসীর
মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে স্বীয় অস্তিত্ব ও বিভিন্ন প্রকার জিনিস সৃষ্টি করার উপর পূর্ণ ও ব্যাপক ক্ষমতার দলীল প্রমাণাদি বর্ণনা শুরু করেছেন। তিনি বলেনঃ তমি কি তোমার প্রতিপালকের প্রতি লক্ষ্য কর না কিভাবে তিনি ছায়া সম্প্রসারিত করেন?’ ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে উমার (রাঃ), আবুল আলিয়া (রঃ), আবূ মালিক (রঃ), মাসরূক (রঃ), মুজাহিদ (রঃ), সাঈদ ইবনে জুবাইর (রঃ), নাখঈ (রঃ), যহহাক (রঃ), হাসান (রঃ) এবং কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এটা হচ্ছে ফজর প্রকাশিত হওয়া থেকে নিয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত এ দুয়ের মধ্যবর্তী সময়। আল্লাহ পাকের উক্তিঃ তিনি ইচ্ছা করলে এটাকে স্থির অর্থাৎ স্থায়ী ও সদা বিরাজমান রাখতে পারতেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তুমি বলে দাও-তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, যদি আল্লাহ তোমাদের উপর রাত্রিকে স্থির ও চিরস্থায়ী করতেন।” (২৮:৭১)
মহান আল্লাহর উক্তিঃ অনন্তর আমি সূর্যকে করেছি এর নির্দেশক। অর্থাৎ যদি সূর্য উদিত না হতো তবে দিবস ও রজনীর পরিচয় পাওয়া যেতো না। কেননা, বিপরীতকে বিপরীতের মাধ্যমেই চেনা যায়।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ অতঃপর আমি এটাকে আমার দিকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনি। অর্থাৎ সহজে গুটিয়ে আনি। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি) অর্থ করেছেন (আরবি) অর্থাৎ তাড়াতাড়ি। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলো গোপন করা। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, (আরবি) -এর অর্থ হলো গোপনীয়ভাবে গুটিয়ে নেয়া। শেষ পর্যন্ত ছাদের নীচে ও গাছের নীচে ছাড়া ভূ-পৃষ্ঠের অন্য কোন জায়গায় ছায়া থাকবে না। সূর্য ছায়া দেবে যা ওর উপরে রয়েছে। আইয়ুব ইবনে মূসা (রঃ) বলেন যে, (আরবি)-এর অর্থ হলো অল্প অল্প করে গুটিয়ে নেয়া।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তিনিই তোমাদের জন্যে রাত্রিকে করেছেন আবরণ স্বরূপ। অর্থাৎ রাত্রি আবরণ দ্বারা সব কিছুকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ অর্থাৎ “শপথ রজনীর, যখন সে আচ্ছন্ন করে।” (৯২: ১)
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ বিশ্রামের জন্যে তোমাদের দিয়েছেন নিদ্রা। অর্থাৎ দেহের বিশ্রামের জন্যে গতিশীলতা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেননা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো দিনের বেলায় জীবিকা উপার্জনের জন্যে গতিশীল থাকে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর যখন রাত্রি আসে তখন গতিশীলতা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেহ আরাম পায়। আর এর ফলে ঘুম এসে যায় এবং এতে একই সাথে দেহ ও আত্মা শান্তি ও বিশ্রাম লাভ করে।
মহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আর তিনি সমুথানের জন্যে দিয়েছেন দিবস। অর্থাৎ দিনের বেলায় মানুষ জীবিকা ও জীবনের বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহের নিমিত্তে ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “এটাও আল্লাহর একটা অনুগ্রহ ও করুণা যে, তিনি তোমাদের জন্যে রাত্রি ও দিবস বানিয়েছেন, যেন তোমরা তাতে শান্তি পাও এবং তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান কর।” (২৮:৭৩) ৪৮। তিনিই স্বীয় রহমতের প্রাক্কালে সুসংবাদবাহী রূপে। বায়ু প্রেরণ করেন এবং আমি আকাশ হতে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করি।
৪৮-৫০ নং আয়াতের তাফসীর
এটাও আল্লাহ তা’আলার পূর্ণ ও ব্যাপক ক্ষমতার পরিচায়ক যে, তিনি মেঘের আগমনের সুসংবাদবাহী রূপে বায়ু প্রেরণ করেন।
(আরবি) এরপরে ঘোষিত হচ্ছেঃ আর আমি আকাশ হতে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করি। (আরবি)-এর অর্থ হলো অতি পবিত্র এবং যা অন্য কিছুকেও পবিত্র করে থাকে।
সাবিত আল বানানী (রঃ) বলেনঃ “আমি একদা বর্ষার দিনে আবুল আলিয়া (রঃ)-এর সাথে চলতে থাকি। ঐ সময় বসরার পথগুলো ময়লাযুক্ত থাকতো। তিনি নামায পড়লেন। তখন আমি তাঁকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ আমি আকাশ হতে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করি।’ সুতরাং আকাশ হতে বর্ষিত পানি এগুলোকে পবিত্র করেছে (কাজেই এখানে নামায পড়াতে কোন দোষ নেই)।” এটা মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে।
সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রঃ) এই আয়াত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেনঃ “আল্লাহ এই পানিকে পবিত্ররূপে বর্ষণ করেছেন। এটাকে কোন কিছুই অপবিত্র করতে পারে না।”
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা বুযাআর কূপের পানিতে অযু করতে পারি কি? এটা এমন একটি কূপ, যার মধ্যে পচা-সড়া জিনিস এবং কুকুরের মাংস নিক্ষেপ করা হয়। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “নিশ্চয়ই পানি পবিত্র, ওকে কোন কিছুই অপবিত্র করতে পারে না। (এ হাদীসটি ইমাম শাফেয়ী (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমাদ (রঃ) এটাকে সহীহ বলেছেন। ইমাম আবূ দাঊদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযীও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান বলেছেন। ইমাম নাসাঈও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)
হযরত খালিদ ইবনে ইয়াযীদ (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমরা একদা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের নিকট উপস্থিত ছিলাম এমন সময় জনগণ পানি সম্পর্কে আলোচনা শুরু করে। তখন আমি বলি, এক প্রকার পানি হলো ঐ পানি যা আকাশ হতে বর্ষিত হয়। আর এক প্রকার পানি হলো ঐ পানি যা সমুদ্র হতে উথিত মেঘমালা পান করিয়ে থাকে। সমুদ্রের পানি উদ্ভিদ জন্মায় না, বরং আকাশ হতে বর্ষিত পানি উদ্ভিদের জন্ম দেয়।” (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, যখনই আল্লাহ তা’আলা আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা বর্ষণ করেন তখনই যমীনে উদ্ভিদের জন্ম হয় অথবা সমুদ্রে মণিমুক্তা জন্ম হয়। অন্য কেউ বলেন যে, স্থলে গম ও সমুদ্রে মুক্তার সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ ওর দ্বারা আমি মৃত ভূ-খণ্ডকে সঞ্জীবিত করি। অর্থাৎ যে ভূমি দীর্ঘাদন যাবত পানির জন্যে অপেক্ষমান ছিল এবং পানি না হওয়ার কারণে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল, তাতে না ছিল কোন গাছ-পালা, না ছিল কোন তরু-লতা, অতঃপর যখন আল্লাহ তা’আলা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন তখন সেই মৃত প্রায় ভূমি নব-জীবন লাভ করলো এবং তাতে বৃক্ষ ও তরু-লতার জন্ম হলো ও সেগুলো ফলে-ফুলে ভরে উঠলো। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যখন আমি তাতে বারি বর্ষণ করি তখন তা শস্য-শ্যামল হয়ে আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সর্বপ্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ।” (৪১:৩৯)
আল্লাহ পাক বলেনঃ আমার সৃষ্টির মধ্যে বহু জীব-জন্তু ও মানুষকে ঐ পানি আমি পান করাই। অর্থাৎ সেই পানি বিভিন্ন জীব-জন্তু ও মানুষ পান করে থাকে যারা ঐ পানির বড়ই মুখাপেক্ষী। মানুষ সেই পানি নিজেরা পান করে এবং তাদের ফসলের জমিতে তা সেচন করে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তারা নিরাশ হয়ে যাওয়ার পর তিনিই (আল্লাহই ) তাদের উপর বারি বর্ষণ করে থাকেন।” (৪২: ২৮) আর এক স্থানে বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তুমি আল্লাহর করুণার লক্ষণের প্রতি লক্ষ্য কর যে, কিভাবে তিনি যমীনকে ওর মরে যাওয়ার পরসঞ্জীবিত করেন।” (৩০: ৫০)।
ঘঘাষিত হচ্ছেঃ আমি এটা (এই পানি) তাদের মধ্যে বিতরণ করি যাতে তারা স্মরণ করে। অর্থাৎ আমি এই ভূমিতে পানি বর্ষণ করি এবং ঐ ভূমিতে বর্ষণ করি না। মেঘমালা এক ভূমি অতিক্রম করে অন্য ভূমির উপর বৃষ্টি বর্ষণ করে এবং যে ভূমিকে অতিক্রম করে যায় ওর উপর এক ফোঁটাও বৃষ্টি বর্ষণ করে। এর মধ্যে পূর্ণ কৌশল ও নিপুণতা রয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, এক বছরে অন্য বছর অপেক্ষা বেশী বৃষ্টি বর্ষিত হয় না, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তা যেভাবে চান বিতরণ করে থাকেন। অতঃপর তারা (আরবি)
অর্থাৎ “আমি ওটা (ঐ পানি) তাদের মধ্যে বিতরণ করে থাকি যাতে তারা স্মরণ করে। কিন্তু অধিকাংশ লোক শুধু অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে।” অর্থাৎ তারা যেন স্মরণ করে যে, যে আল্লাহ মৃত ভূমিকে সঞ্জীবিত করতে সক্ষম, সে আল্লাহ মৃতকে ও গলিত অস্থিকে পুনর্জীবন দান করতেও নিঃসন্দেহে সক্ষম। অথবা সে যেন স্মরণ করে যে, তার পাপের কারণে যদি আল্লাহ তার উপর বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেন তবে সে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এটা স্মরণ করে যেন সে পাপকার্য হতে বিরত থাকে।
উকবা (রাঃ)-এর আযাদকৃত গোলাম উমার (রাঃ) বলেন যে, একদা হযরত জিবরাঈল (আঃ) জানাযার জায়গায় উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় নবী (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে জিবরাঈল (আঃ)! আমি মেঘের বিষয়টি অবগত হতে পছন্দ করি।” তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাকে বললেনঃ “আপনি মেঘের উপর নিযুক্ত এই ফেরেশতাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন।” এ কথা শুনে মেঘের উপর নিযুক্ত ফেরেশতা বললেন, আমাদের কাছে মোহরকৃত একটা নির্দেশনামা আসে। তাতে নির্দেশ দেয়া থাকে- “অমুক অমুক শহরে পানি পান করাও। অমুক অমুক জায়গায় পানির ফোঁটা পৌছিয়ে দাও।” (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটি মুরসাল)
আল্লাহ পাক বলেনঃ কিন্তু অধিকাংশ লোক শুধু অকৃজ্ঞতাই প্রকাশ করে থাকে। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা বলে- “অমুক অমুক নক্ষত্রের আকর্ষণে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্মিত হয়েছে।” যেমন একদা রাত্রিকালে বৃষ্টিপাত হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে (রাঃ) সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমাদের প্রতিপালক যা বলেছেন তা তোমরা জান কি?” সাহাবীগণ (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি ঈমান আনয়নকারীরূপে সকাল করে এবং কেউ সকাল করে আমাকে অস্বীকারকারীরূপে। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বলে‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণার ফলে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে সে আমার উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী এবং তারকাকে অস্বীকারকারী। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বলে- ‘অমুক অমুক তারকার আকর্ষণে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে সে আমাকে অস্বীকারকারী এবং নক্ষত্রের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারী।”