(বই#১০১০) [জ্ঞান ও শক্তি; আল্লাহ রহমানুর রহীমের নামে শুরু করা:- ] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১০)
[জ্ঞান ও শক্তি; আল্লাহ রহমানুর রহীমের নামে শুরু করা:- ]
www.motaher21.net
সূরা:- আন-নমল।
পারা:১৯
১৫-৪৪ নং আয়াত:-
২৭:১৫
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا دَاوٗدَ وَ سُلَیۡمٰنَ عِلۡمًا ۚ وَ قَالَا الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡ فَضَّلَنَا عَلٰی کَثِیۡرٍ مِّنۡ عِبَادِہِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۵﴾
আমি দাউদ ও সুলাইমানকে জ্ঞান দান করলাম এবং তারা বললো, সেই আল্লাহর শোকর যিনি তাঁর বহু মু’মিন বান্দার ওপর আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
২৭:১৬
وَ وَرِثَ سُلَیۡمٰنُ دَاوٗدَ وَ قَالَ یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ عُلِّمۡنَا مَنۡطِقَ الطَّیۡرِ وَ اُوۡتِیۡنَا مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ ؕ اِنَّ ہٰذَا لَہُوَ الۡفَضۡلُ الۡمُبِیۡنُ ﴿۱۶﴾
আর সুলাইমান হয়েছিলেন দাউদের উত্তরাধিকারী এবং তিনি বলেছিলেন, ‘হে মানুষ! আমাদেরকে পাখিদের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেয়া হয়েছে , এটা অবশ্যই সুস্পষ্ট অনুগ্রহ।’
২৭:১৭
وَ حُشِرَ لِسُلَیۡمٰنَ جُنُوۡدُہٗ مِنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ وَ الطَّیۡرِ فَہُمۡ یُوۡزَعُوۡنَ ﴿۱۷﴾
সুলাইমানের সম্মুখে তার সমস্ত বাহিনী; জীন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে সমবেত করা হল; তাদেরকে (এক এক) দলে বিন্যস্ত করা হল।
২৭:১৮
حَتّٰۤی اِذَاۤ اَتَوۡا عَلٰی وَادِ النَّمۡلِ ۙ قَالَتۡ نَمۡلَۃٌ یّٰۤاَیُّہَا النَّمۡلُ ادۡخُلُوۡا مَسٰکِنَکُمۡ ۚ لَا یَحۡطِمَنَّکُمۡ سُلَیۡمٰنُ وَ جُنُوۡدُہٗ ۙ وَ ہُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۱۸﴾
যখন ওরা পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল, তখন এক পিপীলিকা বলল, ‘হে পিপীলিকাদল! তোমরা তোমাদের বাসায় প্রবেশ কর, নচেৎ সুলাইমান এবং তার বাহিনী তাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পদতলে পিষে ফেলবে।’
২৭:১৯
فَتَبَسَّمَ ضَاحِکًا مِّنۡ قَوۡلِہَا وَ قَالَ رَبِّ اَوۡزِعۡنِیۡۤ اَنۡ اَشۡکُرَ نِعۡمَتَکَ الَّتِیۡۤ اَنۡعَمۡتَ عَلَیَّ وَ عَلٰی وَالِدَیَّ وَ اَنۡ اَعۡمَلَ صَالِحًا تَرۡضٰىہُ وَ اَدۡخِلۡنِیۡ بِرَحۡمَتِکَ فِیۡ عِبَادِکَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۹﴾
অতঃপর সুলাইমান তার এ কথাতে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, ‘হে আমার রব! আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন যাতে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার পিতামাতার প্রতি আপনি যে অনুগ্রহ করেছেন তার জন্য এবং যাতে আমি এমন সৎকাজ করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন । আর আপনার অনুগ্রহে আমাকে আপনার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের শামিল করুন।
২৭:২০
وَ تَفَقَّدَ الطَّیۡرَ فَقَالَ مَا لِیَ لَاۤ اَرَی الۡہُدۡہُدَ ۫ۖ اَمۡ کَانَ مِنَ الۡغَآئِبِیۡنَ ﴿۲۰﴾
পক্ষীকুলকে পর্যবেক্ষণ করল এবং বলল, ‘কি ব্যাপার! আমি হুদহুদকে দেখছি না কেন? সে অনুপস্থিত নাকি?
২৭:২১
لَاُعَذِّبَنَّہٗ عَذَابًا شَدِیۡدًا اَوۡ لَاَاذۡبَحَنَّہٗۤ اَوۡ لَیَاۡتِیَنِّیۡ بِسُلۡطٰنٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۲۱﴾
সে উপযুক্ত কারণ না দর্শালে আমি অবশ্যই ওকে কঠিন শাস্তি দেব অথবা জবাই করব।’
২৭:২২
فَمَکَثَ غَیۡرَ بَعِیۡدٍ فَقَالَ اَحَطۡتُّ بِمَا لَمۡ تُحِطۡ بِہٖ وَ جِئۡتُکَ مِنۡ سَبَاٍۭ بِنَبَاٍ یَّقِیۡنٍ ﴿۲۲﴾
কিছুক্ষণ অতিবাহিত না হতেই সে এসে বললো, “আমি এমন সব তথ্য লাভ করেছি যা আপনি জানেন না। আমি সাবা সম্পর্কে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি।
২৭:২৩
اِنِّیۡ وَجَدۡتُّ امۡرَاَۃً تَمۡلِکُہُمۡ وَ اُوۡتِیَتۡ مِنۡ کُلِّ شَیۡءٍ وَّ لَہَا عَرۡشٌ عَظِیۡمٌ ﴿۲۳﴾
اِنِّیْ وَجَدْتُّ امْرَاَةً تَمْلِكُهُمْ وَ اُوْتِیَتْ مِنْ كُلِّ شَیْءٍ وَّ لَهَا عَرْشٌ عَظِیْمٌ

আমি সেখানে এক মহিলাকে সে জাতির শাসকরূপে দেখেছি। তাকে সব রকম সাজ সরঞ্জাম দান করা হয়েছে এবং তার সিংহাসন খুবই জমকালো।
২৭:২৪
وَجَدۡتُّہَا وَ قَوۡمَہَا یَسۡجُدُوۡنَ لِلشَّمۡسِ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ وَ زَیَّنَ لَہُمُ الشَّیۡطٰنُ اَعۡمَالَہُمۡ فَصَدَّہُمۡ عَنِ السَّبِیۡلِ فَہُمۡ لَا یَہۡتَدُوۡنَ ﴿ۙ۲۴﴾
আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম, তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদাহ করছে। শয়তান ওদের নিকট ওদের কার্যাবলীকে সুশোভন করেছে এবং ওদেরকে সৎপথ হতে বিরত রেখেছে, ফলে ওরা সৎপথ পায় না।’
২৭:২৫
اَلَّا یَسۡجُدُوۡا لِلّٰہِ الَّذِیۡ یُخۡرِجُ الۡخَبۡءَ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ یَعۡلَمُ مَا تُخۡفُوۡنَ وَ مَا تُعۡلِنُوۡنَ ﴿۲۵﴾
‘নিবৃত্ত করেছে এ জন্যে যে, তারা যেন সিজদা না করে আল্লাহ্‌কে, যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের লুক্কায়িত বস্তুকে বের করেন । আর যিনি জানেন, যা তোমরা গোপন কর এবং যা তোমরা ব্যক্ত কর।
২৭:২৬
اَللّٰہُ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ رَبُّ الۡعَرۡشِ الۡعَظِیۡمِ ﴿ٛ۲۶﴾
আল্লাহ, ছাড়া আর কেউ ইবাদাতের হকদার নয় তিনি মহান আরশের মালিক।(এখানে সিজদা করা ওয়াজিব।)
২৭:২৭
قَالَ سَنَنۡظُرُ اَصَدَقۡتَ اَمۡ کُنۡتَ مِنَ الۡکٰذِبِیۡنَ ﴿۲۷﴾
সুলাইমান বললেন, ‘আমরা দেখব তুমি কি সত্য বলেছ, নাকি তুমি মিথ্যুকদের অন্তর্ভুক্ত?
২৭:২৮
اِذۡہَبۡ بِّکِتٰبِیۡ ہٰذَا فَاَلۡقِہۡ اِلَیۡہِمۡ ثُمَّ تَوَلَّ عَنۡہُمۡ فَانۡظُرۡ مَا ذَا یَرۡجِعُوۡنَ ﴿۲۸﴾
তুমি আমার এ পত্র নিয়ে যাও এবং তাদের নিকট অর্পণ কর; অতঃপর তাদের নিকট হতে সরে পড় এবং দেখ, তারা কি উত্তর দেয়।’
২৭:২৯
قَالَتۡ یٰۤاَیُّہَا الۡمَلَؤُا اِنِّیۡۤ اُلۡقِیَ اِلَیَّ کِتٰبٌ کَرِیۡمٌ ﴿۲۹﴾
বলল, ‘হে পারিষদবর্গ! আমাকে এক সম্মানিত পত্র দেওয়া হয়েছে;
২৭:৩০
اِنَّہٗ مِنۡ سُلَیۡمٰنَ وَ اِنَّہٗ بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ ﴿ۙ۳۰﴾
তা সুলাইমানের পক্ষ থেকে এবং আল্লাহ রহমানুর রহীমের নামে শুরু করা হয়েছে।”
২৭:৩১
اَلَّا تَعۡلُوۡا عَلَیَّ وَ اۡتُوۡنِیۡ مُسۡلِمِیۡنَ ﴿٪۳۱﴾
বিষয়বস্তু হচ্ছেঃ “আমার অবাধ্য হয়ো না এবং মুসলিম হয়ে আমার কাছে হাজির হয়ে যাও।”
২৭:৩২
قَالَتۡ یٰۤاَیُّہَا الۡمَلَؤُا اَفۡتُوۡنِیۡ فِیۡۤ اَمۡرِیۡ ۚ مَا کُنۡتُ قَاطِعَۃً اَمۡرًا حَتّٰی تَشۡہَدُوۡنِ ﴿۳۲﴾
রাণী বললো, “হে জাতীয় নেতৃবৃন্দ! আমার উদ্ভূত সমস্যায় তোমরা পরামর্শ দাও। তোমাদের বাদ দিয়ে তো আমি কোন বিষয়ের ফায়সালা করি না।”
২৭:৩৩
قَالُوۡا نَحۡنُ اُولُوۡا قُوَّۃٍ وَّ اُولُوۡا بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ ۬ۙ وَّ الۡاَمۡرُ اِلَیۡکِ فَانۡظُرِیۡ مَاذَا تَاۡمُرِیۡنَ ﴿۳۳﴾
তারা জবাব দিল, “আমরা শক্তিশালী ও যোদ্ধা জাতি, তবে সিদ্ধান্ত আপনার হাতে, আপনি নিজেই ভেবে দেখুন আপনার কি আদেশ দেয়া উচিত।
২৭:৩৪
قَالَتۡ اِنَّ الۡمُلُوۡکَ اِذَا دَخَلُوۡا قَرۡیَۃً اَفۡسَدُوۡہَا وَ جَعَلُوۡۤا اَعِزَّۃَ اَہۡلِہَاۤ اَذِلَّۃً ۚ وَ کَذٰلِکَ یَفۡعَلُوۡنَ ﴿۳۴﴾
রাণী বললো, কোন বাদশাহ যখন কোন দেশে ঢুকে পড়ে তখন তাকে বিপর্যস্ত করে এবং সেখানকার মর্যাদাশালীদের লাঞ্ছিত করে এ রকম কাজ করাই তাদের রীতি।
২৭:৩৫
وَ اِنِّیۡ مُرۡسِلَۃٌ اِلَیۡہِمۡ بِہَدِیَّۃٍ فَنٰظِرَۃٌۢ بِمَ یَرۡجِعُ الۡمُرۡسَلُوۡنَ ﴿۳۵﴾
আমি তাদের কাছে একটি উপঢৌকন পাঠাচ্ছি তারপর দেখছি আমার দূত কি জবাব নিয়ে ফেরে।”
২৭:৩৬
فَلَمَّا جَآءَ سُلَیۡمٰنَ قَالَ اَتُمِدُّوۡنَنِ بِمَالٍ ۫ فَمَاۤ اٰتٰىنِۦَ اللّٰہُ خَیۡرٌ مِّمَّاۤ اٰتٰىکُمۡ ۚ بَلۡ اَنۡتُمۡ بِہَدِیَّتِکُمۡ تَفۡرَحُوۡنَ ﴿۳۶﴾
যখন সে (রাণীর দূত) সুলইমানের কাছে পৌঁছলো, সে বললো, তোমরা কি অর্থ দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ‌ আমাকে যা কিছু দিয়েছেন তা তোমাদের যা কিছু দিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশী। তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে তোমরাই খুশি থাকো।
২৭:৩৭
اِرۡجِعۡ اِلَیۡہِمۡ فَلَنَاۡتِیَنَّہُمۡ بِجُنُوۡدٍ لَّا قِبَلَ لَہُمۡ بِہَا وَ لَنُخۡرِجَنَّہُمۡ مِّنۡہَاۤ اَذِلَّۃً وَّ ہُمۡ صٰغِرُوۡنَ ﴿۳۷﴾
(হে দূত!) ফিরে যাও নিজের প্রেরণকারীদের কাছে, আমি তাদের বিরুদ্ধে এমন সেনাদল নিয়ে আসবো যাদের তারা মোকাবিলা করতে পারবে না এবং আমি তাদেরকে এমন লাঞ্ছিত করে সেখান থেকে বিতাড়িত করবো যে, তারা ধিকৃত ও অপমানিত হবে।”
২৭:৩৮
قَالَ یٰۤاَیُّہَا الۡمَلَؤُا اَیُّکُمۡ یَاۡتِیۡنِیۡ بِعَرۡشِہَا قَبۡلَ اَنۡ یَّاۡتُوۡنِیۡ مُسۡلِمِیۡنَ ﴿۳۸﴾
সুলাইমান বললো, “হে সভাসদগণ! তারা অনুগত হয়ে আমার কাছে আসার আগে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমার কাছে নিয়ে আসতে পারে?”
২৭:৩৯
قَالَ عِفۡرِیۡتٌ مِّنَ الۡجِنِّ اَنَا اٰتِیۡکَ بِہٖ قَبۡلَ اَنۡ تَقُوۡمَ مِنۡ مَّقَامِکَ ۚ وَ اِنِّیۡ عَلَیۡہِ لَقَوِیٌّ اَمِیۡنٌ ﴿۳۹﴾
এক শক্তিশালী জীন বলল, ‘আপনি আপনার বৈঠক হতে উঠবার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই ক্ষমতাবান, বিশ্বস্ত।’
২৭:৪০
قَالَ الَّذِیۡ عِنۡدَہٗ عِلۡمٌ مِّنَ الۡکِتٰبِ اَنَا اٰتِیۡکَ بِہٖ قَبۡلَ اَنۡ یَّرۡتَدَّ اِلَیۡکَ طَرۡفُکَ ؕ فَلَمَّا رَاٰہُ مُسۡتَقِرًّا عِنۡدَہٗ قَالَ ہٰذَا مِنۡ فَضۡلِ رَبِّیۡ ۟ۖ لِیَبۡلُوَنِیۡۤ ءَاَشۡکُرُ اَمۡ اَکۡفُرُ ؕ وَ مَنۡ شَکَرَ فَاِنَّمَا یَشۡکُرُ لِنَفۡسِہٖ ۚ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ رَبِّیۡ غَنِیٌّ کَرِیۡمٌ ﴿۴۰﴾
গ্রন্থের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, ‘আপনি চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা এনে দেব।’ সুতরাং সুলাইমান যখন তা সম্মুখে উপস্থিত দেখল, তখন সে বলল, ‘এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ; যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ, না অকৃতজ্ঞ। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তা নিজের কল্যাণের জন্য করে এবং যে অকৃতজ্ঞ, সে জেনে রাখুক যে, নিশ্চয় আমার প্রতিপালক অভাবমুক্ত, মহানুভব।’
২৭:৪১
قَالَ نَکِّرُوۡا لَہَا عَرۡشَہَا نَنۡظُرۡ اَتَہۡتَدِیۡۤ اَمۡ تَکُوۡنُ مِنَ الَّذِیۡنَ لَا یَہۡتَدُوۡنَ ﴿۴۱﴾
সুলাইমান বললো, “সে চিনতে না পারে এমনভাবে সিংহাসনটি তার সামনে রেখে দাও, দেখি সে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় কিনা অথবা যারা সঠিক পথ পায় না তাদের অর্ন্তভুক্ত হয়।”
২৭:৪২
فَلَمَّا جَآءَتۡ قِیۡلَ اَہٰکَذَا عَرۡشُکِ ؕ قَالَتۡ کَاَنَّہٗ ہُوَ ۚ وَ اُوۡتِیۡنَا الۡعِلۡمَ مِنۡ قَبۡلِہَا وَ کُنَّا مُسۡلِمِیۡنَ ﴿۴۲﴾
(বিলকীস) যখন পৌঁছল, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তোমার সিংহাসন কি এরূপই?’ সে বলল, ‘এটা যেন সেটাই! আমরা ইতিপূর্বেই সমস্ত কিছুই অবগত হয়েছি এবং আত্মসমর্পণকারী (মুসলমান) হয়েছি।’
২৭:৪৩
وَ صَدَّہَا مَا کَانَتۡ تَّعۡبُدُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ؕ اِنَّہَا کَانَتۡ مِنۡ قَوۡمٍ کٰفِرِیۡنَ ﴿۴۳﴾
আল্লাহর পরিবর্তে যেসব উপাস্যের সে পূজা করতো তাদের পূজাই তাকে ঈমান আনা থেকে ঠেকিয়ে রেখেছিল। কারণ সে ছিল একটি কাফের জাতির অন্তর্ভুক্ত।
২৭:৪৪
قِیۡلَ لَہَا ادۡخُلِی الصَّرۡحَ ۚ فَلَمَّا رَاَتۡہُ حَسِبَتۡہُ لُجَّۃً وَّ کَشَفَتۡ عَنۡ سَاقَیۡہَا ؕ قَالَ اِنَّہٗ صَرۡحٌ مُّمَرَّدٌ مِّنۡ قَوَارِیۡرَ ۬ؕ قَالَتۡ رَبِّ اِنِّیۡ ظَلَمۡتُ نَفۡسِیۡ وَ اَسۡلَمۡتُ مَعَ سُلَیۡمٰنَ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿٪۴۴﴾
তাকে বলা হল, ‘প্রাসাদটিতে প্রবেশ কর।’ অতঃপর যখন সে সেটা দেখল তখন সে সেটাকে এক গভীর জলাশয় মনে করল এবং সে তার পায়ের গোছা দুটো অনাবৃত করল। সুলাইমান বললেন, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক মণ্ডিত প্রাসাদ। সেই নারী বলল, ‘হে আমার রব ! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছিলাম , আর আমি সুলাইমানের সাথে সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পণ করছি।’

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলোচনা (১৫-৪৪) : হযরত মুসা(আ.)-এর কাহিনীর উল্লিখিত অংশটার পর হযরত দাউদ সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত ও হযরত সোলায়মান সম্পর্কে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা হচ্ছে। এরা তিন জনই ছিলেন বনী ইসরাঈলের নবী। এ সূরার সূচনা হয়েছে কোরআন সংক্রান্ত বক্তব্য দিয়ে। আর পরবর্তীতে একটা আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যেসব বিষয়ে তারা মতভেদে লিপ্ত এই কোরআন বনী ইসরাঈলের কাছে তার অধিকাংশ বর্ণনা করে।’ হযরত সুলায়মানের কাহিনী এই সূরায় যতােটা বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ততোটা আর কোনাে সূরায় হয়নি। অবশ্য এ সূরায় তার জীবনের কেবল একটা অংশই বর্ণনা করা হয়েছে। এ অংশটা হুদহুদ পাখি ও সাবার রাণীর সাথে সংশ্লিষ্ট। ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত সোলায়মান জনসমক্ষে ঘােষণা করেছেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে পাখির ভাষা শিখিয়েছেন, সকল জিনিসের অংশ বিশেষ দান করেছেন এবং আল্লাহর এই অনুগ্রহের জন্য তিনি তার শােকর আদায় করছেন। এরপর উল্লেখ করা হয়েছে জ্বিন, মানুষ ও পাখির সমবায়ে গঠিত তার বাহিনীর কথা, এক পিপড়ে কর্তৃক স্বজাতিকে এই বাহিনী সম্পর্কে সতর্ক করার কথ। হযরত সােলায়মান কর্তৃক পিপড়ের এই বক্তব্য অনুধাবন, আল্লাহর এই অনুগ্রহের জন্যে তার শােকর আদায়, আল্লাহর দেয়া যে কোনাে সম্পদই যে পরীক্ষাম্বরূপ, তা হযরত সােলায়মান কর্তৃক উপলব্ধি করণ। অতপর হযরত সুলায়মানের এই মর্মে দোয়া যে, আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে শাোকর করার ও এই পরীক্ষায় পাস করার ক্ষমতা দান করেন। সূরার শুরুতে কোরআনের যে প্রসংগ আলােচিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে এক আয়াতে যে বলা হয়েছে, এই কোরআন বনী ঈসরাঈলের পারস্পরিক বিরােধ ও মতভেদের অধিকাংশই তাদের অবহিত করে-সেই প্রেক্ষাপটেই এই সূরায় এসব কাহিনী সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। আর হযরত মূসা, দাউদ ও সােলায়মানের কাহিনী যে বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সে কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বনী ইসরাইলের ইতিহাসের এই পর্যায় ও তার পটভুমির সাথে এই সূরার আলােচ্য বিষয়ের সম্পর্ক কী তা এই কাহিনী ও এই সূরার বিভিন্ন স্থানে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। যেমন, সূরার ভূমিকায় আমি উল্লেখ করেছি যে, এ সূরার একটা কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে জ্ঞান, আর হযরত দাউদ ও সোলায়মান কাহিনীতেও সর্বাগ্রে উল্লেখ করা হয়েছে জ্ঞানের কথা, ‘আমি দাউদ ও সােলায়মানকে জ্ঞান দান করেছি।’ এ ছাড়া হযরত সােলায়মান তাকে দেয়া আল্লাহর যেসব নেয়ামতের বিবরণ দিয়েছেন তার মধ্যেও সর্বপ্রথম উল্লেখ করেছেন পাখির ভাষা সংক্রান্ত জ্ঞানের কথা। তিনি বলেছেন! হে জনমন্ডলী, আমাকে পাখির ভাষা শেখানাে হয়েছে। আর হুদহুদ পাখি নিজের অনুপস্থিতির বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে তারও সূচনা হয়েছে এভাবে, আপনি যা জানেন না, আমি তা জেনেছি এবং সাবা জাতির কাছ থেকে সুনিশ্চিত তথ্য নিয়ে আপনার কাছে হাযির হয়েছি। আর চোখের পলকে সাবার রাণীর সিংহাসন হাযির করতে চেয়েছিলাে যে জ্বিন, তারও বৈশিষ্ট্য এই যে, সে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান রাখতো। সূরার শুরুতে মােশরেকদের কাছে আল্লাহর সুস্পষ্ট কিতাব কুরআন নাযিল করার বিষয় আলােচিত হয়েছে। অথচ এই কিতাবকে তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করে, এই কাহিনীতে হযরত সোলায়মানের চিঠি সাবার রাণী কর্তৃক গ্রহণের এবং অনতিবিলম্বেই তার ও তার জনগণের আত্মসমর্পণ করে উপস্থিত হওয়ার বিবরণ রয়েছে। কেননা জ্বিন, মানুষ ও পাখির সমন্বয়ে গঠিত যে বিশাল বাহিনীকে তারা হ্যরত সােলায়মানের সাথে দেখেছে, তাতে তাদের আত্মসমর্পণ না করে গত্যন্তর ছিলাে না। হযরত সােলায়মানের এতাে শক্তি ও এতে সৈন্য-সামন্ত কেবল আল্লাহই তাকে দিয়েছেন। তিনিই তাঁর বান্দাদের ওপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই মহান আরশের অধিপতি। এই সূরায় আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের কী কী নেয়ামত দিয়েছেন, প্রকৃতির জগতে আল্লাহর কী কী নিদর্শন বিদ্যমান, মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পৃথিবীর খলিফা নিয়ােগ, আর এসব সত্তেও আল্লাহর নিদর্শনাবলী অস্বীকার করা ও তার শােকর না করার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এ কাহিনীতে একজন কৃতজ্ঞ বান্দার নমুনা তুলে ধরা হয়েছে, যে আল্লাহর কাছে তার নেয়ামতের শােকর আদায়ের ক্ষমতা ও প্রেরণা চায়, আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার তাওফীক চায়। এ ব্যাপারে উদাসীনতা থেকে রেহাই চায় এবং প্রার্থনা করে যেন ধন সম্পদের প্রাচুর্য ও ক্ষমতার দাপট তাকে অহংকারী না বানায়। এভাবে সূরার আলােচ্য বিষয় ও কাহিনীর প্রতিপাদ্য বিষয়ের মধ্যে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সাবার রাণীর সাথে হযরত সােলায়মানের যে কাহিনী এ সূরায় আলােচিত হয়েছে, তা কোরআনের কাহিনী হিসাবেও যেমন একটা পূর্ণাংগ নমুনা, শৈল্পিক বর্ণনাভংগির বিচারেও তেমনি। সামগ্রিকভাবে এ কাহিনীর ঘটনাবলী, দৃশ্যাবলী ও আবেগ অনুভূতি চমকপ্রদ, রোমাঞ্চকর। আর এসব দৃশ্যের মাঝে মাঝে ছেদ টেনে শৈল্পিক শূন্যতার সৃষ্টি করে তাকে অধিকতর উপভােগ্য করা হয়েছে। এবার বিস্তৃত তাফসীরে মনােনিবেশ করছি।  *তাফসীর :  *জ্ঞানের উৎস ও তার সঠিক প্রয়ােগ : আমি দাউদ ও সােলায়মানকে জ্ঞান দান করেছি। তারা উডয়ে বলেছেন, ‘যে আল্লাহ তায়ালা আমাদের তার বহুসংখ্যক মােমেন বান্দার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তার জন্যে সকল প্রশংসা'(আয়াত-১৫), এ হচ্ছে কাহিনীর সূচনা ও উদ্বোধনী ঘােষণা। হযরত দাউদ ও সােলায়মানকে আল্লাহ তায়ালা যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তন্মধ্যে জ্ঞানকেই এখানে শ্রেষ্ঠতম আখ্যায়িত করা হয়েছে। হযরত দাউদকে আল্লাহ যেসব জ্ঞান ও বিদ্যা শিখিয়েছেন তার বিবরণ অন্যান্য সূরায় দেয়া হয়েছে। যেমন, তিনি ‘যাবুর’ এমন সুললিত কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন যে, তা শুনে তার চারপাশের সমগ্র প্রকৃতিতে সাড়া পড়ে যেতাে। পাহাড় পর্বত ও পাখিকুল তার সুমিষ্ট তান ও আবেগময় সুরের ঝংকারে মূর্ছিত ও তন্ময় হয়ে যেতাে। আল্লাহর সাথে তিনি গভীর একান্ত সংলাপে নিমগ্ন হতেন। বিশ্ব প্রকৃতির যাবতীয় বস্তুরাজির মধ্যে ও তার মধ্যে কোনাে বাধা থাকতাে না। তিনি লৌহ বর্ম, শিরস্ত্রাণ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরী করতে পারতেন, লােহা দিয়ে যাই চাইতেন- বানাতে পারতেন এবং মানুষের বিবাদ বিসম্বাদ মেটানাের কৌশল জানতেন, আর এই কৌশলে হযরত সোলায়মান তার অংশীদার ছিলেন। এই সূরায় হযরত সোলায়মান আল্লাহ তায়ালা তায়ালা যে পাখির ভাষা শিখিয়েছিলেন সে কথার এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিদ্যার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। তা ছাড়া অন্যান্য সূরায় হযরত সুলায়মানের বিচার সংক্রান্ত দক্ষতা ও আল্লাহর হুকুমে বাতাসকে তার অনুগত বানানাের বিষয়ও আলােচিত হয়েছে। কাহিনীর শুরুতেই এই সংক্ষিপ্ত বক্তবাটা এসেছে যে, ‘আমি দাউদ ও সােলায়মানকে জ্ঞান দান করেছি।’ আয়াত শেষ হবার আগেই এই নেয়ামত লাভের জন্য হযরত দাউদ ও সােলায়মানের কৃতজ্ঞতার উল্লেখ করা হয়েছে, এর অসাধারণত্ব ও বিরাটত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং এই জ্ঞান দ্বারা তাদের দুজনকে আল্লাহর অন্যান্য মােমেন বান্দার ওপর যে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, তার জন্যে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে। এ বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেছে, জ্ঞান বা বিদ্যার কতাে মূল্য, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে তা দান করেন, সে কতাে মর্যাদাবান এবং এই দান কতাে বড় দান। এখানে বিদ্যার কোনাে শ্রেণী বা বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। কেননা সামগ্রিকভাবে জ্ঞান বিদ্যাকে তুলে ধরাই উদ্দেশ্য। জ্ঞান বা বিদ্যা মাত্রেই আল্লাহর মহাদান, প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিরই বুঝা উচিত জ্ঞান বা বিদ্যা কোথা থেকে আসে বা কে দেয়। অতপর এর জন্যে আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর করা উচিত এবং সেই জ্ঞান বা বিদ্যাকে এমন পথেই ব্যয় করা উচিত যে পথে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। এরূপ করলে কোনাে জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরায় না এবং আল্লাহকে ভুলিয়ে দেয় না। জ্ঞান যখন আল্লাহর নেয়ামত ও অবদানরূপে বিবেচিত হয়, তখন তা কিভাবে মানুষকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরাবে বা আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেবে? যে জ্ঞান বা যে বিদ্যা মানুষকে আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে সরায় তা ভ্রান্ত ও বিকৃত জ্ঞান। সে জ্ঞান তার মূল উৎস ও লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট। সে জ্ঞান মানুষের জন্যে কোনাে সুখ বয়ে আনে না। তা বয়ে আনে অশান্তি, ভীতি ও ধ্বংস। কেননা তা লক্ষ্যভ্রষ্ট ও উৎসভ্রষ্ট। সে জ্ঞান আল্লাহর পথ হারিয়ে ফেলেছে। মানব জাতি আজ বিজ্ঞানের এক নতুন স্তরে উপনীত। অণুকে চূর্ণ করে ও কাজে লাগিয়ে সে এই পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের বিজ্ঞান, যার অধিকারী আল্লাহকে মনে রাখে না- এ দ্বারা মানুষ কী অর্জন করতে পেরেছে, যে জ্ঞান বিজ্ঞান অর্জন করে মানুষ আল্লাহকে ভয় পায় না, আল্লাহ শােকর করে না এবং আল্লাহর দিকে মনােনিবেশ করে না। তা দ্বারা মানুষ পাশবিক গণহত্যা ছাড়া আর কী ঘটাতে পেরেছে, যেমনটি ঘটিয়েছে হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে দুটো আণবিক বােমা? এ দ্বারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষকে ভয়ে আতংকে দিশেহারা করে দেয়া এবং ধ্বংসের হুমকি দিয়ে তাদের চোখের ঘুম কেড়ে নেয়া ছাড়া আর কী লাভ হয়েছে। [ বার্হিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আনবিক বােমা নির্মাণকারী শিল্প সংস্থার সদস্য এম, ই উলিভেনেট হিরােশিমা ও নাগাসাকির মর্মান্তিক ঘটনার পর বলেছিলেন, আমি নিশ্চিত যে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বিশ্ব নাট্যমঞ্চে প্রাথমিক বোমাগুলোর চেয়ে দশহাজার টন বেশী বিস্ফোরণ ক্ষমতাসম্পন্ন বােমার আবির্ভাব ঘটবে। ওগুলাের পর দশ লক্ষ টন ক্ষমতাসম্পন্ন বােমাও আবিস্কৃত হবে, যা থেকে আত্মরক্ষার কোনাে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা সতর্কতা কাজে লাগবে না। এ ধরনের ৬টা বোমা গােটা ইংল্যান্ডকে ধংস কর়ে ফেলার জন্যে যথেষ্ট। তার এ ভবিষ্যদ্বাণী নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে। পরবর্তীকালে যে হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কৃত হয়েছে, তার সামনে হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত আনবিক বোমা দুটো নিছক শীতের খেলনা বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, হিরােশিমার মােটা তাৎক্ষণিকভাবেই মৃত্যু ঘটায় ২ লক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষের। যারা আহত হয়ে ও দগ্ধ হয়ে পরে মারা গিয়েছিলাে, তাদের সংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ ]

*জ্বীন ও প্রাণীজগত নিয়ে সােলায়মান(আ.)-এর সাম্রাজ্য :  হযরত দাউদ ও সােলায়মান(আ.)-কে জ্ঞান নামক নেয়ামত দান এবং এই নেয়ামত দিয়ে অনুগৃহীত করার জন্যে হযরত দাউদ ও সোলায়মান কর্তৃক শােকর আদায়ের কথা উল্লেখ করার পর এবার শুধু হযরত সোলায়মান সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘সুলায়মান দাউদের উত্তরাধিকারী হলো…'(আয়াত ১৬) হযরত দাউদকে তার রাজত্ব ও নবুওত দুটোই দেয়া হয়েছিলাে, কিন্তু তাঁর ও হযরত সােলায়মানকে প্রদত্ত নেয়ামতের বিবরণ দেয়ার সময় রাজত্বের উল্লেখ করা হয়নি, উল্লেখ করা হয়েছে শুধু ইলম বা জ্ঞানের। কেননা রাজত্ব এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতাে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। ‘সােলায়মান দাউদের উত্তরাধিকারী হলাে’, কথাটা দ্বারা ইলম বা জ্ঞানের উত্তরাধিকারী বুঝানাে হয়েছে। কেননা এটাই সর্বোচ্চ গুরুত্ববহ উল্লেখযােগ্য বিষয়। এখানে যে জ্ঞানের কথা বুঝানাে হয়েছে, সেটা হযরত সুলায়মানের জনসমক্ষে দেয়া ঘোষণা থেকেও স্পষ্ট, ‘সােলায়মান বললাে, হে জনমন্ডলী, আমাকে পাখির ভাষা শেখানাে হয়েছে এবং সব কিছুরই অংশ আমি পেয়েছি।’ পাখির ভাষা সংক্রান্ত জ্ঞানকে তিনি স্পষ্ট ভাষায়ই উল্লেখ করেছেন, কিন্তু অন্যান্য নেয়ামতের কথা নামােল্লেখ না করেই ব্যক্ত করেছেন। সাথে সাথে এর উৎসেরও উল্লেখ করে বলেছেন, যিনি পাখির ভাষা শিখিয়েছেন, সেই আল্লাহই অন্যান্য নেয়ামতেরও দাতা। এ নেয়ামতের দাতা হযরত দাউদ নন। কেননা তিনি এটা নিজের পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে পাননি। অনুরূপভাবে অন্যান্য যেসব নেয়ামত পেয়েছেন, তাও সেই উৎস থেকেই এসেছে, যেখান থেকে পাখির ভাষার জ্ঞান এসেছে। ‘আমাকে পাখির ভাষা শেখানাে হয়েছে…’ হযরত সােলায়মান(আ.) এ কথা জনসমক্ষে ঘােষণা করছেন নিছক আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্তির কথা প্রচার করার জন্যে এবং তার অনুগ্রহের বিবরণ দেয়ার জন্যে, দম্ভ ও অহংকার প্রকাশ করার জন্যে নয়। এ সম্পর্কে হযরত সােলায়মান মন্তব্য করেছেন, ‘নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট অনুগ্রহ।’ অর্থাৎ আল্লাহর অনুগ্রহ, যা অনুগ্রহ দাতা ও অনুগৃহীত উভয়কেই উন্মোচিত করে। কেননা কোনাে মানুষকে পাখির ভাষা শেখানাে এবং সকল জিনিস থেকে কিছু না কিছু দেয়া একমাত্র আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব। পশু, পাথী ও সরীসৃপের জন্যে পারস্পরিক যােগাযােগ ও সমঝােতার উপকরণ হিসেবে তাদের নিজস্ব ভাষা চালু রয়েছে। বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা সূরা আনয়ামে বলেছেন, পৃথিবীতে যতাে প্রাণী এবং যতাে পাখি আছে, সবই তােমাদেরই মতাে বিভিন্ন শ্রেণী মাত্র। জীবন ধারণের জন্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার সুনির্দিষ্ট মাধ্যম এবং সমঝােতার উপকরণ না থাকলে তা কোনাে জীব- শ্রেণী হতেই পারে না। বহুসংখ্যক পশু পাখী ও জীব সম্পর্কের মধ্যে এটা পরিলক্ষিত হয়। এ সকল সৃষ্টি সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা যে এদের ভাষা ও সমঝোতার উপকরণ সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য অনুসন্ধানে ব্যাপৃত, সে শুধুই অনুমানভিত্তিক সুনিশ্চিত জ্ঞানভিত্তিক নয়, কিন্তু হযরত সােলায়মানকে আল্লাহ তায়ালা যে জ্ঞান দিয়েছিলেন, তা ছিলাে অসাধারণ ও অলৌকিকভাবে প্রাপ্ত। এটা তিনি এ যুগের বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞদের মতো অনুমানসর্বস্ব পন্থায় খুঁজে বের করেননি। এ বিষয়টা আরাে একটু স্পষ্ট করে দেয়ার প্রয়ােজন অনুভব করছি। কেননা আধুনিক কালের কোনাে কোনাে মুফাসসির হযরত সুলায়মানের এতদসংক্রান্ত সাফল্যকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পদ্ধতিতে অর্জিত পশু পাখি ও সরীসৃপের ভাষার জ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন। আসলে তারা আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সামনে নিজেদের পরাজিত ভাবেন ও হীনমন্যতায় ভােগেন। এ ধরনের তাফসীর প্রকৃতপক্ষে অলৌকিক ব্যাপারকে স্বাভাবিকের পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং মানুষের সামান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের কাছে পরাভব স্বীকার করার শামিল। অথচ এটা আল্লাহর কাছে অতি সহজ ও অতি নগণ্য ব্যাপার যে, তিনি তার কোনাে এক বান্দাকে কোনাে কষ্ট সাধনা ছাড়াই নিজের পক্ষ থেকে পশু পাখী ও সরীসৃপের জ্ঞান দান করবেন। এটা আর কিছু নয়- বিভিন্ন জাতের সৃষ্ট জীবের মাঝে আল্লাহ তায়ালা যে সীমারেখা বেঁধে দিয়েছেন সেটা তুলে নেয়া মাত্র। যিনি সকল জীবের স্রষ্টা, তার পক্ষে এটা অসম্ভব বা কঠিন হতে যাবে কেন? হযরত সােলায়মানকে আল্লাহ তায়ালা যেসব অলৌকিক সুযােগ-সুবিধা দিয়েছিলেন, এ তাে তার একটা অংশমাত্র। এর অপর অংশ হলাে, এক শ্রেণীর জ্বিন ও পাখীকে তার এমন বশীভূত ও আজ্ঞাবহ করে দেয়া হয়েছিলাে যে, তার মনুষ্য বংশােদ্ভূত বাহিনীর সদস্যদের সাথে তাদের কোনােই পার্থক্য ছিলাে না। পাখীর যে শ্রেণীকে আল্লাহ তায়ালা তার অনুগত বানিয়েছিলেন, তাকে তিনি একই জাতের পাখীর অনুরূপ অনান্য শ্রেণীর চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান বানিয়েছিলেন। এর প্রমাণ হুদহুদ। সাবার রাণী ও তার জাতির অবস্থা এবং তৎপরতা সম্পর্কে তার এমন তীক্ষ্ণ ও সৃক্ষ উপলব্ধি হয়েছিলাে, যা সর্বোচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিমান, মেধাবী ও আল্লাহভীরু মানুষেরই হওয়া সম্ভব। এটাও একটা অলৌকিক ব্যাপার ও মােজেযা ছিলাে । এ কথা সত্য যে, সৃষ্টিজগতে আল্লাহর যে বিধান চালু রয়েছে, সে অনুসারে পাখীর একটা বিশেষ বােধশক্তি থাকে। বিভিন্ন পাখীর মধ্যে এই বােধশক্তির পরিমাণে ও মানে তারতম্যও থাকতে পারে, কিন্তু তা কখনাে মানুষের বোধশক্তির পর্যায়ে উন্নীত হয় না। পাখীর সৃষ্টির এই কৌশল প্রকৃতিতে সমন্বয় সাধনের এক সর্বব্যাপী প্রক্রিয়ারই অংশ এবং এককভাবে এটা সর্বব্যাপী প্রাকৃতিক বিধানেরই আওতাধীন। এই প্রাকৃতিক বিধান পাখীর অস্তিত্ব যেভাবে হবার দাবী জানায়, পাখী ঠিক সেভাবেই জন্ম লাভ করে। আবার এ কথাও সত্য, যে হুদহুদ পাখী আজকাল জন্মে, তা হাজার হাজার বছর আগে যে হুদহুদ পাখী জন্ম নিত, তারই বংশধর। উত্তরাধিকারের এমন বহু উপকরণ রয়েছে, যা আজকের একটা হুদহুদকে প্রথম হুদহুদের প্রায় সমমানেরও বানাতে পারে, কিন্তু প্রজন্মান্তরে এই পাখীর মান ও প্রকৃতিতে যতাে তারতম্যই ঘটুক না কেন, তা কখনাে হুদহুদ শ্রেণীর বাইরে অন্য শ্রেণীর পাখীতে রূপান্তরিত হয় না। হুদহুদ (মাথায় ঝুঁটিওয়ালা এক ধরনের সুন্দর পাখি) কখনাে বাদুড় বা শালিক ইত্যাদি হয় না। এটাও আল্লাহর প্রচলিত প্রাকৃতিক বিধানের অন্যতম, যা মহাবিশ্বের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির সাথে সুসমন্বিত। কিন্তু এই চিরাচরিত দুটো প্রাকৃতিক সত্য বা সত্য প্রাকৃতিক বিধানের ব্যতিক্রমও অসম্ভব নয়। আল্লাহ তায়ালা যখনই ইচ্ছা করেন, এই বিধানের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে অলৌকিক কান্ডও ঘটাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। এমনকি এই অলৌকিক ঘটনাও সাধারণ প্রাকৃতিক বিধানের অংশ হতে পারে, যার ব্যাপক রূপ ও বিচিত্র দিকগুলাে হয়তাে আমরা জানি । এই ঘটনা হয়তাে একটা নির্দিষ্ট সময়েই সংঘটিত হয়, যা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। এ জাতীয় ঘটনায় মানুষের চির পরিচিত রীতিনীতি লংঘিত হয় বটে। তবে তা আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান এবং সর্বব্যাপী ভারসাম্য ও সমন্বয়কে পূর্ণতা দান করে। হযরত সােলায়মানের হুদহুদ এ ধরনেরই একটা অলৌকিক সৃষ্টি ছিলাে, যা তার সময়কালে তার অনুগত পাখীকুলের মধ্যে ছিলাে সর্বশ্রেষ্ঠ।

# এই আনুষংগিক আলােচনার পর আমি হযরত সুলায়মানের সেই কাহিনীর বিশদ বিবরণে ফিরে আসছি, যা তিনি হযরত দাউদের উত্তরাধিকারী হবার পর এবং আল্লাহ তায়ালা তাকে জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করে সম্মানিত করেছেন বলে ঘােষণা করার পর সংঘটিত হয়েছিলো।’জ্বিন, মানুষ ও পাখির সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী সমূহ সুলায়মানের জন্যে সুশৃংখলভাবে সমবেত হলাে'(আয়াত ১৭) জ্বিন, মানুষ ও পাখীর সমন্বয়ে গঠিত এই বিশাল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন হযরত সোলায়মান স্বয়ং নিজে। মানুষ তো আমাদের কাছে পরিচিত। তবে জ্বিন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে যতােটুকু আমাদের জানিয়েছেন, আমরা ততােটুকুই জানি। আমরা কেবল এতােটুকু জানি যে, আল্লাহ আগুন দিয়ে জিন সৃষ্টি করেছেন। তারা মানুষকে দেখতে পায়, কিন্তু মানুষ তাদের দেখতে পায় না। ‘ইবলীস ও তার সংগী তােমাদের এমনভাবে দেখতে পায় যে, তােমরা তাদের দেখতে পাও না।’ (সূরা আরাফের এ আয়াত ইবলীস বা শয়তান সংক্রান্ত। আর ইবলীস তাে জ্বিন জাতিরই অন্তর্ভুক্ত।) জিনদের এ ক্ষমতাও রয়েছে যে, তারা সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে খারাপ কাজের প্ররােচনা দিতে ও গুনাহের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। তবে কিভাবে সেটা পারে তা আমাদের জানা নেই। আবার এ কথাও সত্য যে, জ্বিনদের একটা গােষ্ঠী রসূল(স.)-এর ওপর ঈমান এনেছিলাে। তিনি নিজে এটা জানতে পারেননি; বরং আল্লাহ তায়ালা তাকে জানিয়েছেন। যেমন সূরা জিনের ১ ও ২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, বলাে, আমার কাছে এই মর্মে ওহী এসেছে যে, জিনদের একটা গােষ্ঠী শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরা বিস্ময়কর কোরআন শুনেছি, যা সততার পথ দেখায়। আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি এবং আমরা কখনাে আমাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করবাে না। আমরা আরাে জানি, আল্লাহ তায়ালা জ্বিনদের একটা গােষ্ঠীকে হযরত সােলায়মানের অনুগত করে দিয়েছিলেন, যারা তার জন্যে বড় বড় দুর্গ, মূর্তি, খাবারের জন্যে বড় বড় পাত্র তৈরী করতাে। তার জন্যে সমূদ্রে ডুবুরী হিসেবে কাজ করতাে এবং আল্লাহর হুকুমে তার সকল নির্দেশ মেনে চলতাে। এই জ্বিনদেরই একাংশকে এখানেও দেখা যাচ্ছে, তাদের ভাই মানুষ ও পাখীর সাথে হযরত সুলায়মানের বাহিনীতে কাজ করতাে। আমার মতে, আল্লাহ তায়ালা যেমন হযরত সুলায়মানের জন্যে একদল মানুষকে তার অনুগত করেছিলেন, তেমনি অনুগত করেছিলেন একদল জ্বিন এবং পাখিকে। পৃথিবীর সকল মানুষ হযরত সুলায়মানের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলাে না। কেননা তার সাম্রাজ্যের সীমানা বর্তমান ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের ফোরাতের উপকূল পর্যন্তই বিস্তৃত ছিলাে, তার বাইরে নয়। তেমনি সমুদয় জ্বিন জাতি ও পাখিকুল তার অনুগত ছিলাে না। প্রত্যেক শ্রেণীর একটা গােষ্ঠীই শুধু তার সেনাদলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জ্বিনদের সকলে যে হযরত সুলায়মানের অনুগত ছিলাে না। তার প্রমাণ এই যে, ইবলীসও তার বংশধর জিনদের অন্তর্ভুক্ত। কেননা কোরআনে আছে, ইবলিস জ্বিনদের অন্তর্ভুক্ত ছিলোে। (সূরা কাহফ) আল্লাহ তায়ালা আরাে বলেছেন, ‘যে মানুষের অন্তরে কুপ্ররোচনা দেয়, জ্বিন ও মানুষের মধ্য থেকে।’ এই জাতীয় জ্বিনেরা হযরত সােলায়মানের আমলেও মানুষকে কু-প্ররােচনা দিতাে। সমুদয় জ্বিন জাতি যদি হযরত সুলায়মানের অনুগত থাকতাে, তাহলে তারা কু-প্ররােচণা দিতাে না। কেননা তিনি ছিলেন সৎপথ প্রদর্শক একজন নবী। সুতরাং এটা সুনিশ্চিত যে, জ্বিন জাতির সকলে নয় বরং একটা গােষ্ঠীই তার অনুগত ছিলাে। পাখীদেরও সবাই নয় বরং একটা অংশই হযরত সােলায়মানের অনুগত ছিলাে। এর প্রমাণ এই যে, হযরত সোলায়মান যখন পাখিকে খুঁজতে লাগলেন, তখন জানতে পারলেন যে, হুদহুদ পাখীটা নিখোঁজ রয়েছে। সকল পাখী যদি তার অনুগত এবং তার সেনাদলের অন্তর্ভুক্ত থাকতাে, তাহলে হুদহুদ পাখিরাও থাকতো। আর সে ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ পাখির মধ্য থেকে একটা হুদহুদের অনুপস্থিতি তিনি টের পেতেন না এবং বলতেন না যে, হুদহুদকে দেখছি না কেন? সুতরাং ওটা যে একটা বিশেষ ও নির্দিষ্ট হুদহুদ, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। এটা সম্ভবত হুদহুদ শ্রেণীর সেই নির্দিষ্ট পাখী, যাকে হযরত সােলায়মানের অনুগত করা হয়েছিলাে, অথবা সে বাহিনীতে যে কটা নির্দিষ্ট পাখীর কর্মরত থাকার পালা ছিলাে, এই হুদহুদটা ছিলাে তাদেরই একটা এবং ঠিক এ সময় তার পালা ছিলাে। যে তথ্য দ্বারা এ বিষয়টা আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলাে, সে হুদহুদটা এক বিশেষ ধরনের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলাে, যা অন্যান্য হুদহুদ বা অন্যান্য পাখীর মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। এ ধরনের বিশেষ মেধা ও প্রতিভা হুদহুদের একমাত্র সেই নির্দিষ্ট গােষ্ঠীটার মধ্যেই থাকতে পারে, যাদের হযরত সুলায়মানের অনুগত করা হয়েছিলাে, সকল হুদহদ বা সকল পাখীর মধ্যে নয়। কেননা এই বিশেষ হুদহুদটা যে উঁচু মানের প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলাে, তা প্রাজ্ঞ, বুদ্ধিমান, মেধাবী ও আল্লাহভীরু মানুষেরই সমপর্যায়ের। ‘সুলাইমানের জন্যে জ্বিন, মানুষ ও পাখির মধ্য থেকে বাহিনীসমূহ সংগঠিত করা হয়েছিলাে। ওটা ছিলাে এক বিশাল বাহিনী। তাদের সংঘবদ্ধ করা হয়েছিলাে।’ অর্থাৎ সুশৃংখল করা হয়েছিলাে। ফলে তাদের ছিন্নভিন্ন হওয়া এবং তাদের ভেতরে উচ্ছৃংখলতা ও অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ার কোনাে সুযােগ ছিলাে না। সে বাহিনীটা একটা সুশৃংখল ও সুগঠিত সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছিলাে, যার ফলে তার ওপর সামরিক পরিভাষা প্রয়ােগ করা যায়। তাদের সংঘবদ্ধ করা হয়েছিলাে’- এ কথাটা আসলে শৃংখলা ও সংঘবদ্ধতার প্রতি ইংগিত দেয়। পরবর্তী আয়াতে ‘সেনাবাহিনী’ ও ‘প্রস্তুত করাে’ শব্দ দুটো লক্ষণীয়, অবশেষে যখন তারা পিপড়ের উপত্যকায় এলাে, তখন একটা মহিলা পিপড়ে বললাে, হে পিপড়ের দল। তােমাদের বাসগৃহে ঢুকে পড়ো, যেন সােলায়মান ও তার সেনা বাহিনী তােমাদের ধ্বংস করে না ফেলে। এ কথা শুনে সােলায়মান মুচকি হাসলাে এবং বললো, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে এমনভাবে প্রস্তুত করাে যেন আমি তােমার সেই নেয়ামতের শােকর আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দিয়েছে, আর আমি যেন এমন সৎ কাজ করি, যাতে তুমি খুশী হও এবং তােমার অনুগ্রহে আমাকে তােমার সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করাে। হযরত সােলায়মানের সেনাবাহিনী সদলবলে রওনা হলাে। এ বাহিনী জ্বিন, মানুষ ও পাখীর সমন্বয়ে গঠিত। সুশৃংখল, কাতারবদ্ধ এ বাহিনী তালে তালে কদম ফেলে এগিয়ে চললো। চলতে চলতে তারা বিরাট এক ময়দানের কাছে এসে পড়লাে। সে ময়দানে বিপুল সংখ্যক পিপড়ে বাস করতাে। পিপড়ের আধিক্যের কারণে ওটাকে পাহাড়ের ময়দান বলা হয়েছে। বাহিনী সে ময়দানের কাছে এলে একটা মহিলা পিপড়ে- যে সে ময়দানে বসবাসকারী পিপড়গুলাে সংগঠক ও শাসকের দায়িত্বে ছিলাে- পিপড়ে বললাে, ‘তােমরা নিজ নিজ বাসগৃহে ঢুকে পড়াে, যেন সােলায়মান ও তার বাহিনী তােমাদের নিজেদের অজাতসারেই মেরে না ফেলে।’ মহিলা পিপড়েটা এ আদেশ কিভাবে প্রচার করেছিলাে তা আমরা জানি না। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সাধারণ পিপড়েদের মধ্যে যে ভাষা ও যে পদ্ধতি প্রচলিত এবং সুবিদিত ছিলো, সেই ভাষায় ও সেই পদ্ধতিতেই প্রচার করেছিলাে। উল্লেখ্য যে, পিঁপড়ার রাজ্য মৌমাছির রাজ্যের মতাে অত্যন্ত দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাথে সংগঠিত ও পরিচালিত। এখানে বিভিন্ন পদ ও দায়িত্ব বন্টন করা রয়েছে এবং তা বিস্ময়কর শৃংখলার সাথে পালিত হয়ে থাকে। মানুষ এতাে উন্নত মানের বুদ্ধিমত্তা ও মেধার অধিকারী হয়েও পিপড়ে এবং মৌমাছির এমন চমৎকার শৃংখলা ও সংঘবদ্ধতার অনুকরণ করতে পারে না। মহিলা পিপড়াটা যে আদেশ প্রচার করলো তা হযরত সােলায়মান শুনলেন, বুঝলেন ও কৌতুহল বােধ করলেন। কোনাে শিশু যদি কোনাে বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষ থেকে নির্যাতিত হবার আশংকায় আত্মরক্ষার চেষ্টা করে, অথচ তাকে নির্যাতন করার কোনাে চিন্তা সে বয়স্ক ব্যক্তির মাথায় নেই। তাহলে এ বয়স্ক ব্যক্তি যেমন কৌতুহল বােধ করে, হযরত সােলায়মানও তেমনি কৌতুহল বােধ করলেন। এ ঘটনায় হযরত সােলায়মান কিছুটা আত্মতৃপ্তিও বােধ করলেন। কেননা এটা ছিলাে তার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, যার সাহায্যে মানব জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন ও অজ্ঞাত এসব সৃষ্টির সাথে তার যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছে। মহিলা পিপড়েটার এমন বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তা এবং সাধারণ পিপড়েগুলাের আনুগত্য দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। হযরত সােলায়মান এই ব্যাপারটা হৃদয়ংগম করলেন এবং তার কথায় মুচকি হাসলেন। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য তাকে আলােড়িত ও হতচকিত করলাে, এই অলৌকিক জ্ঞানদানকারী মহান আল্লাহর প্রতি তার মন বিগলিত হলাে। আল্লাহর এসব অজানা সৃষ্টির রহস্য তার কাছে উদঘাটিত হলাে এবং তিনি কাতর কণ্ঠে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে প্রেরণা দান করো যেন আমি তােমার সেই নেয়ামতের শােকর আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দিয়েছো।’ রাব্বী’ শব্দটির অর্থ যদিও ‘হে আমার মালিক প্রতিপালক’; কিন্তু এ শব্দটা অত্যন্ত কাছ থেকে উচ্চারিত সম্বােধন বুঝায়। ‘আও যি’নী’ শব্দের অর্থ গােটা সত্ত্বাকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করাে বা তাওফীক দাও, আমার অংগ প্রত্যংগকে, আবেগ অনুভূতিকে, জিহ্বাকে, মনকে, চেতনাকে, ভাষাকে, কাজকে, ধ্যান-ধারণা ও ঝোককে, আমার সমস্ত শক্তি, যােগ্যতা ও প্রতিভাকে শক্তি যােগাও, প্রেরণা দাও, ক্ষমতা দাও, এই সবগুলাে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ করাে (এটাই ‘আও যি’নী’ শব্দের আভিধানিক অর্থ), যাতে এই সবগুলাে আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দেয়া নেয়ামতের শােকর আদায়ে নিয়োজিত হয়। এ উক্তি থেকে জানা যায়, সে মুহূর্তে হযরত সােলায়মান এই বিশেষ অনুগ্রহ দ্বারা কতাে বেশী অভিভূত হয়েছিলেন, তার চেতনা ও প্রেরণা কতাে শাণিত ও তীক্ষ্ণ হয়েছিলাে, আল্লাহর দিকে তার মনােযােগ কতাে প্রবল ও তীব্র হয়েছিলাে, তার বিবেক ও মন কতাে অনুপ্রাণিত ও আলােড়িত হয়েছিলাে, আল্লাহর অনুগ্রহকে তিনি কতাে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তার ওপর ও তার পিতামাতার ওপর আল্লাহর সাহায্যের হাত কতােখানি সম্প্রসারিত হয়েছিলাে এবং আল্লাহর নেয়ামত ও রহমতে সিক্ত হয়ে তিনি কতাে বিনীত ও কৃতার্থ হয়েছিলেন তাও জানা যায়। এবং আমি যেন এমন সৎ কাজ করি, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও। এ উক্তি থেকে জানা যায়, সৎ কাজ করতে পারাটাও আল্লাহর অনুগ্রহ। যে ব্যক্তি আল্লাহর নেয়ামতের শােকর আদায় করে, তাকে আল্লাহ তায়ালা সৎ কাজের তাওফীক তথা প্রেরণা ও ক্ষমতা দান করেন। আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হযরত সােলায়মান একদিকে যেমন আল্লাহর নেয়ামতের শােকর আদায় করার ক্ষমতা ও প্রেরণা আল্লাহর কাছ থেকে চেয়েছেন, অপরদিকে তেমনি আল্লাহর কাছে যে সৎ কাজ সন্তোষজনক, তা করার তাওফীকও তিনি আল্লাহর কাছে চেয়েছেন। কেননা তিনি বুঝতেন যে, সৎ কাজ করতে পারা আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত আরাে একটা নেয়ামত ও আরো একটা প্রেরণা। আর আমাকে অনুগ্রহপুর্বক তােমার সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করো। এ কথা বারা বুঝা যায়, আল্লাহর সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়াটাও যে আল্লাহর এক রহমত, তা হযরত সােলায়মান জানতেন। আল্লাহর রহমতই বান্দাকে সৎ কাজে অনুপ্রাণিত করে থাকে এবং এভাবেই সে সৎ বান্দাদের দলভুক্ত হয়। এ কথা জানতেন বলেই তিনি আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করে আবেদন জানাচ্ছেন তাকে সৎকর্মশীল, রহমতপ্রাপ্ত ও তাওফীকপ্রাপ্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করা হােক। জ্বিন, মানুষ ও পাখিকুলকে আল্লাহ তায়ালা তার অনুগত করে দিয়েছেন এবং তাকে বিপুল নেয়ামতে সমৃদ্ধ করেছেন। এতদসত্তেও তিনি এভাবে কাকুতি মিনতি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে নবী হিসেবে মনােনীত করেছেন, তা সত্তেও তিনি আল্লাহর শাস্তি সম্বন্ধে বেপরােয়া হলো, তিনি তখনাে শংকিত ছিলেন, তার সৎ কাজ ও শােকর আল্লাহর নেয়ামতের তুলনায় কম থেকে যায় কিনা। অনুরূপভাবে আল্লাহর ভয় এবং তার সন্তোষ ও দয়ার প্রতি প্রবল আকর্ষণ আগ্রহ তাকে প্রচন্ডভাবে সংবেদনশীল এবং স্পর্শকাতর করে তুলেছিলাে। অথচ এ মুহূর্তে তিনি আল্লাহর নেয়ামতে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ। সে সময় একটা মহিলা পিপড়ে যে কথা বলছিলাে, তা আল্লাহর দয়া ও শিক্ষাদানের বদৌলতে তিনি বুঝতে পারছিলেন। এখানে আমরা একটা নয়, দুটো অলৌকিক ঘটনা দেখতে পাই। একটা হলো, মহিলা পিপড়ে তার স্বজাতীয় পিঁপড়েদের সতর্ক করে যে বক্তব্য রেখেছিলাে তা হযরত সােলায়মান কর্তৃক উপলব্ধি করা, অপরটি হলাে, সে মহিলা পিপড়ের এটা উপলব্ধি করা যে, এই বাহিনী হযরত সােলায়মানের বাহিনী। প্রথমটা অর্থাৎ হযরত সোলায়মান কর্তৃক পিপড়ের ভাষা বুঝা স্বয়ং আল্লাহর শিখানাে বিদ্যা। হযরত সোলায়মান তো একজন মানুষ ও নবী। সুতরাং ব্যাপারটা হযরত সােলায়মানের দিক দিয়ে দ্বিতীয় মােজেযার চেয়েও সহজতর। দ্বিতীয় মােজেযাটা মহিলা পিপড়ের কথার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সে হয়তাে বুঝতে পেরেছে যে, এই বাহিনী একটা বৃহত্তর সৃষ্টি। যার পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে পিপড়েরা মরে যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা পিপড়ের মধ্যে যে জীবন রক্ষাকারী বুদ্ধিমত্তা দিয়ে রেখেছিলেন, সেটা প্রয়ােগ করে তারা বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে। তবে মহিলা পিপড়ে কর্তৃক এই বাহিনীকে হযরত সোলায়মান ও তার বাহিনী বলে চিনতে পারাটাই বিশেষ মােযেজা ও অসাধারণ ঘটনা। এরূপ পরিস্থিতিতে এটাই একটা অলৌকিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এবার আমি হুদহুদ পাখী ও সাবার রাণীর সাথে হযরত সুলায়মানের কাহিনী আলােচনা করবো। এ কাহিনীর তিনটি দৃশ্য রয়েছে, যেগুলাের মাঝে নানা রকমের শৈল্পিক শূন্যতা বিরাজ করছে। উপস্থাপিত দৃশ্যগুলাে দ্বারাই এ সব শূন্যতা পূরণ হয় এবং কাহিনীর শৈল্পিক উপস্থাপনার সৌন্দর্যও পূর্ণতা লাভ করে। এ সব দৃশ্যের মাঝে কোনাে কোনাে দৃশ্য সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, যা সূরার মূল আলােচ্য বিষয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ আবেগজড়িত নির্দেশ প্রদান করে। সেই সাথে সেই শিক্ষাও বাস্তবায়িত করে, যা কোরআনের কিসসা কাহিনীর মূল উদ্দেশ্য। মাঝে মাঝে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে, তা এর দৃশ্যাবলী ও শূন্যতাগুলোর সাথে চমৎকারভাবে সমন্বিত এবং সে সমন্বয় শৈল্পিক সৌন্দর্য ও ধর্মীয় আবেগ এই দুদিক থেকেই। হযরত সোলায়মান সংক্রান্ত আলােচনাটা যেহেতু একই সাথে জ্বিন, মানুষ, পাখী ও জ্ঞানরূপী নেয়ামতের উল্লেখ দিয়ে শুরু করা হয়েছে, সেহেতু এই গল্পে জ্বিন, মানুষ, পাখি ও জ্ঞান সবারই অবদান আলােচিত হয়েছে। হয়তাে বা এ প্রাথমিক আলােচনাটাই কাহিনীর প্রধান নায়কদের ভূমিকা সম্বলিত। বস্তুত এটাই কোরআনের কিসসা কাহিনীর একটা সূক্ষ্ম শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য। কাহিনীর কিছু কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, মানসিক উত্তেজনা এবং ভাবাবেগও এখানে পরিলক্ষিত হয়। তন্মধ্যে হযরত সােলায়মান, সাবার রাণী বিলকিস, হুদহুদ পাখি এবং রাণীর সভাসদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অন্যতম। পয়লা দৃশ্যটা শুরু হয়েছে হযরত সােলায়মান ও তার বাহিনীর পাহাড়ের উপত্যকায় উপস্থিত হওয়া দিয়ে, মহিলা পিপড়ের হুশিয়ারী জ্ঞাপক বক্তব্য প্রদান এবং হযরত সােলায়মান কর্তৃক আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা, আনুগত্য ও দোয়ার পর তার বাহিনীর সমাবেশের সময়, ‘সােলায়মান পাখীকে অনুপস্থিত দেখে বললাে, ব্যাপার কী? হুদহুদকে দেখছি না কেন? তবে কি সে অনুপস্থিত। সে যদি অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত করতে না পারে। তবে আমি তাকে হয় কঠিন শাস্তি দেবে, অথবা যবাই করে ফেলবাে।’ এই হচ্ছেন সেই জাকজমকপূর্ণ বিশাল সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সম্রাট নবী সােলায়মান। তিনি পাখি বাহিনী পরিদর্শনে গিয়ে হুদুদকে অনুপস্থিত দেখতে পেলেন। আমরা এ থেকে বুঝতে পারি যে, ওটা একটা নির্দিষ্ট হুদহদ, যে স্বীয় পালা অনুসারে এ সময় এ বাহিনীতে বিশেষ কোনাে দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলাে, এটি সে সময়কার পৃথিবীতে বিদ্যমান লক্ষ লক্ষ হুদহুদ জাতীয় পাখির মধ্য থেকে যে কোন একটা হুদহুদ। এই হুদহুদটাকে হযরত সােলায়মান কর্তৃক অনুপস্থিত চিহ্নিত করতে পারা দ্বারা আমরা একথাও বুঝতে পারি যে, হযরত সােলায়মান কতাে সচেতন, দৃঢ়চেতা ও সূক্ষ্মদর্শী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। জিন, মানুষ ও পাখীর সমন্বয়ে গঠিত এই বিশাল সেনাবাহিনীর একজন মাত্র সৈন্যের অনুপস্থিতি তিনি টের পেয়ে গেলেন। অথচ এ বাহিনী এত সুগঠিত ছিলাে যে, তার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা সদস্যকে সে সংঘবদ্ধ ও অটুট সংকল্পের অধিকারী বানিয়ে রেখেছে। ব্যাপার কী, হুদহুদকে দেখি না কেন? হযরত সােলায়মানের এই জিজ্ঞাসাটা ছিলাে পরিচায়ক। অত্যন্ত গুরুগম্ভীর। ব্যাপক অর্থবােধক ও উদার মনােভাবের এ উক্তি থেকে বুঝা যায়, পাখিটা সত্যিই অনুপস্থিত ছিলাে এবং তাও বিনা অনুমতিতে। তাই এরূপ কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলাে। অন্যথায় বিশৃংখলা দেখা দিতে পারতাে। সুতরাং সম্রাট কর্তৃক এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পর ব্যাপারটা আর গােপন থাকেনি। দৃঢ়তা ও কড়াকড়ির সাথে এটা জিজ্ঞেস না করলে সেনাবাহিনীর বাদবাকী সদস্যদের জন্যে একটা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতাে। তাই আমরা দেখি, দৃঢ়চেতা সম্রাট সােলায়মান অনুপস্থিত সৈন্য হুদহুদের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। ‘সে যদি অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত না করে, তাহলে তাকে আমি অবশ্যই কঠোর শাস্তি দেবাে, অথবা যবাই করে ফেলবো।’ কিন্তু হযরত সােলায়মান পৃথিবীর অন্যান্য রাজাদের মতাে স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী রাজা ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন নবী। তিনি তখনাে হুদহুদের অনুপস্থিতির কারণ শােনেননি। কাজেই তার কাছ থেকে না শুনে তার সম্পর্কে কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা শােভনীয় নয়। ন্যায়বিচারক নবীর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তার এই উক্তি দ্বারা। সে যদি কোনাে অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত করতে না পারে। অর্থাৎ এমন কোনাে শক্তিশালী প্রমাণ, যা তার অনুপস্থিতির যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে বা সে শাস্তির যােগ্য নয়, এ কথা সাব্যস্ত করে। এরপর হুদহুদ উপস্থিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কাহিনীর এই দৃশ্যের যবনিকাপাত ঘটে (অথবা দৃশ্যটা তখনাে বহাল ছিলাে)।

#   *সাবার রাণীর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা : হুদহুদ এক চাঞ্চল্যকর খবর নিয়ে হাযির হলাে। হযরত সোলায়মান এবং আমরা যারা এই কাহিনী এখন শুনছি, সবার জন্যেই খবরটা ছিলাে বিন্ময়ােদীপক। অল্পক্ষণ পরেই হুদহদ বলে উঠলাে, ‘আপনি যা জানেন না, তাই আমি জেনে এসেছি।'(আয়াত ২২-২৬) হুদহুদ জানতাে সম্রাট কতাে কঠোর স্বভাবের মানুষ। তাই সে তার কথাটা এমন আকস্মিকভাবে তুলে ধরলাে যে, তার অনুপস্থিতির বিষয়টা চাপা পড়ে গেলাে এবং সম্রাট মনােযােগের সাথে তা শুনতে লাগলেন। বস্তুত এমন রাজা কোথায় পাওয়া যাবে, যার প্রজাদের একজন রাজাকে বলে, আপনি যা জানেন না, আমি তা জেনে এসেছি।’ এরপরও রাজা তার কথা শোনেন? এরূপ আকস্মিক বিবরণের প্রতি রাজার যখন মনােযােগ আকৃষ্ট হলো, তখন হুদহুদ সাবা জাতি ও তার রাণীর কাছ থেকে নিয়ে আসা খবর বিশদভাবে বর্ণনা করা শুরু করলাে। আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে ইয়ামানে অবস্থিত এই সাবা রাজ্য সম্পর্কে সে জানালাে যে, ‘এই সারা রাজ্যের শাসক এক মহিলা। তাকে সব কিছুই দেয়া হয়েছে।’ এ কথাটা দ্বারা এই মর্মে ইংগিত করা হয়েছে যে, তার রাজত্ব বিশাল, তার সহায় সম্পদ বিপুল এবং তার সুসভ্য দেশ বিরাট শক্তি ও সম্পদের অধিকারী। ‘আর তার রয়েছে এক বিরাট সিংহাসন।’ অর্থাৎ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বিশালকায় রাজকীয় সিংহাসন যা সেই দেশের প্রাচুর্য, সমৃদ্ধি ও শিল্পে অগ্রসরতার প্রতীক। সে আরাে জানালাে যে, সে সেই রাজ্যের জনগণ ও রাণীকে সূর্যের পূজা করতে দেখেছে। এখানে সে এই জাতির এই বিভ্রান্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে যে, শয়তানই তাদের কাছে তাদের কর্মকান্ড সুসজ্জিত করে দেখিয়েছে, সুসজ্জিত করে দেখিয়ে তাদের বিপথগামী করেছে এবং এর ফলে তারা আল্লাহর এবাদাতের পথের সন্ধান পায় না- ‘যিনি আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় গুপ্ত বস্তু বের করে আনেন।’ ‘আল-খাবউ’ শব্দটার অর্থ হলাে গুপ্ত বন্ধু চাই তা আকাশের বৃষ্টি ও পৃথিবীর উদ্ভিদ হােক, অথবা আকাশ ও পৃথিবীর অন্য কোনাে গুপ্ত রহস্য হােক। এ দ্বারা প্রকৃত পক্ষে বিশাল এই প্রকৃতিতে যেসব অজানা অদেখা জিনিস রয়েছে, তার দিকেই ইংগিত করা হয়েছে। ‘আর যা তােমরা প্রকাশ ও গোপন করো, তা তিনি জানেন।’ অর্থাৎ আকাশ ও পৃথিবীতে বিরাজমান যাবতীয় গুপ্ত জিনিস যেমন জানেন, তেমনি মানুষের অন্তরাত্মার গভীরে বিদ্যমান বিষয়গুলােও তিনি জানেন, চাই তা প্রকাশ্যভাবেই বিরাজ করুক বা গােপনভাবে। হুদহুদ এ পর্যন্ত অপরাধীর ভূমিকাই অবলম্বন করেছিলাে। রাজা (হযরত সােলায়মান) তখনাে তার সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত নেননি। এরপর সে তার কথিত কাহিনীর শেষ পর্যায়ে এসে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর বর্ণনা দিচ্ছে, যিনি সকলের প্রতিপালক, যিনি মহান আরশের মালিক। এই আরশের সাথে মানুষের সিংহাসনের কোনাে তুলনাই হয় না। এ কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, রাজা যেন আল্লাহর এই শ্রেষ্ঠত্বের বিবরণ শুনে তার মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব ও জাঁকজমকে অহংকারী না হয়। আল্লাহ ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই, তিনিই মহান আরশের অধিপতি।’ রাণী ও তার জাতির কর্মকান্ডের খবর শােনার পর এই সুক্ষ ইংগিতের তাৎপর্য হযরত সােলায়মান উপলব্ধি করেন। আমরা এক বিস্ময়কর পাখী হুদহুদকে দেখতে পাই এখানে। সে শুধু প্রখর বুদ্ধি, মেধা, দৃঢ় ঈমান, তথ্য প্রকাশের অসাধারণ দক্ষতা, নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা এবং সূক্ষ্ম ও মননশীল ইংগিতদানের যােগ্যতাই শুধু রাখে না, বরং সেই সাথে রাজা ও প্রজার পার্থক্যও বােঝে, তারা সূর্যকে সেজদা কিভাবে করে তাও অনুধাবন করে, আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় গুপ্ত রহস্যের উদঘাটক এবং মহান আরশের অধিপতি আল্লাহ ছাড়া আর কারাে উদ্দেশ্যে সেজদা করা উচিত নয়, এটাও সে উপলব্ধি করে। সাধারণ হুদহুদ পাখীরা তাে এতােসব বােঝে না। সুতরাং এটা যে একটা অসাধারণ বােধশক্তিসম্পন্ন বিশেষ হুদহুদ ছিলাে এবং সে অলৌকিকভাবে এ সব ক্ষমতা লাভ করেছিলাে, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। হযরত সােলায়মান তার দেয়া তথ্য বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনােটাই করতে তাড়াহুড়া করেন । তিনি তার দেয়া গুরুতর সংবাদকে হালকাভাবেও দেখেন না; বরং একজন ন্যায়বিচারক নবী ও দৃঢ়চেতা সম্রাট হিসেবে তিনি এ সব তথ্য নিজের অভিজ্ঞতার ভান্ডারে সঞ্চিত রাখেন এবং পরবর্তী সময়ে তার সত্যতা যাচাই করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সোলায়মান বললো, তুমি সত্য বলেছাে না মিথ্যা বলেছো, সেটা পরে দেখবাে। এখন তুমি আমার এই চিঠিটা নিয়ে যাও এবং তা ওদের কাছে ফেলে দিয়ে চলে এসাে, দেখাে তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ সময়ে হযরত সােলায়মান তার চিঠির মর্ম প্রকাশ করেননি, যাতে তা যথাস্থানে প্রকাশিত ও ঘােষিত হয় এবং যথাসময়ে শৈল্পিক আকস্মিকতা নিয়ে তা প্রকাশ পায়। এ দূশ্যের এখানেই যবনিকাপাত ঘটে। এরপর আমরা দেখতে পাই, রাণীর কাছে চিঠি পৌছে গেছে এবং তিনি তার সভাসদদের সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলােচনা চালাচ্ছেন, রাণী বললাে, ওহে সভাসদবৃন্দ, আমার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পৌছানাে হয়েছে, চিঠিটা সােলায়মানের কাছ থেকে পরম দাতা ও দয়ালু আল্লাহর নামে লিখিত। এতে বলা হয়েছে, তােমরা আমার ওপর দম্ভ দেখাও না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে চলে এসাে।’ অর্থাৎ রাণী সভাসদদের জানাচ্ছেন যে, তার কাছে একটা চিঠি পৌছানাে হয়েছে, তার এই উক্তি থেকে আমার মনে হয়, খুব সম্ভবত সে জানতে পারেনি চিঠিটা কে দিয়ে গেলাে এবং কিভাবে দিলাে। সে যদি জানতাে, হুদহুদ দিয়ে গেছে, তাহলে এই অসাধারণ ঘটনা সে প্রকাশ করতাে। কেননা এমন কান্ড সচরাচর ঘটে না। সে বলেছে, পৌছানাে হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, চিঠিটা কে পৌছালাে এবং কিভাবে পৌছালাে, তা সে বুঝতে পারেনি। রাণী চিঠিটাকে ‘কারীম’ অর্থাৎ সম্মানজনক বা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশেষিত করেছে। সম্ভবত সিল বা আকৃতি দেখে সে চিঠির এই বিশেষত্ব উপলব্ধি করেছে। চিঠির বিষয়বস্তু থেকেও সে তার এরূপ মূল্যায়ন করে থাকতে পারে, যা সে সভাসদদের কাছে প্রকাশ করেছে। সে আল্লাহর এবাদাত করেন না, কিন্তু হযরত সােলায়মানের খ্যাতি এই চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছিলাে। আর চিঠির যে ভাষা কোরআনে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাতে দৃঢ়তা, অনমনীয় মনােভাব ও উষ্ণ মর্যাদা প্রতিফলিত হয়েছে। এ ভাষার আলােকেও সে চিঠির এরূপ মূল্যায়ন করে থাকতে পারে। চিঠির বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং তেজস্বী। শুরু হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ দিয়ে। এতে একটিমাত্র আদেশ দেয়া হয়েছে যে, চিঠির প্রেরকের প্রতি কোনাে রকম অহংকার প্রকাশ না করে ও কোনাে রকম অবাধ্যতা না দেখিয়ে সেই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করো সবাই যেন তার কাছে চলে আসে, যে আল্লাহর নামে চিঠি লেখা হয়েছে। রাণী প্রথমে সভাসদদের কাছে চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করলাে। তারপর তাদের পরামর্শ চেয়ে আলােচনার সূত্রপাত ঘটালাে। অতপর তাদের জানালাে যে, সে তাদের সাথে পরামর্শ না করে তাদের সম্মতি ও অনুমােদন ছাড়া এ ব্যাপারে কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে না। সে বললাে, সভাসদবৃন্দ, আমার উপস্থাপিত বিষয়ে তােমাদের মতামত দাও। তোমরা আমার সাথে শরীক না হওয়া পর্যন্ত আমি কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবাে না। এ কথার মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞাময়ী রাণীর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম মুহূর্ত থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে যে, সে অজ্ঞাত বাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এই চিঠিটাকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে এবং এই চিঠিতে যে বড়ত্ব ও দৃঢ়তা প্রতিফলিত হয়েছে, সেটা সে লক্ষ্য করেছে। সে তার এই মূল্যায়ন ও মনােভাব তার জাতির নেতৃস্থানীয় লােকদের মনেও সঞ্চারিত করেছে চিঠিটাকে কারীম বা সম্মানের যােগ্য বলার মাধ্যমে। সে যে হযরত সােলায়মানের সাথে সংঘাত ও শত্রুতা চায় না, তাও সুস্পষ্ট। তবে রাণী সে কথাটা খােলাখুলিভাবে বলতে চায় না। কথাটা সে এই বিশেষণ প্রয়ােগের মাধ্যমে বলতে চায়। তারপর সে তাদের মতামত ও পরামর্শ তলব করে। সভাসদদের চিরাচরিত রীতি অনুসারে তারা রাণীর কাংখিত কাজে সক্রিয় হবার প্রস্তুতি ব্যক্ত করলাে। তবে তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাণীর কাছেই সােপর্দ করলাে। তারা বললাে, আমরা শক্তিশালী এবং প্রবল ক্ষমতাধর। সিদ্ধান্ত আপনারই হাতে। আপনি কী নির্দেশ দেবেন ভেবে দেখুন। এখানে রাণীর ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে ‘নারী’র ব্যক্তিত্ব প্রতিফলিত হচ্ছে। যে নারী স্বভাবসুলভ নিয়মেই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ধ্বংস অপছন্দ করে, শক্তি প্রয়ােগ ও সংঘাতে যাওয়ার আগে কৌশল প্রয়ােগ এবং আপােষকামিতার অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করার পক্ষপাতী, সেই নারীর ব্যক্তিত্ব এখানে ফুটে ওঠেছে। রাণী বললাে, ‘রাজারা যখন কোনাে জনপদে প্রবেশ করে, তখন তা তছনছ করে দেয় এবং সেখানকার সম্মানী লোকের অপদস্থ করে।’ অর্থাৎ রাণী জানতাে, রাজাদের স্বভাবই এ রকম যে, কোনাে জনপদে ঢুকলেই তারা জানমাল ও সম্ভ্রমের ক্ষতি সাধন করে। তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে, যার শীর্ষে অবস্থান করে সেখানকার নেতৃবৃন্দ। এই নেতৃবৃন্দকে তারা অপদস্থ করে। কেননা তারাই প্রতিরােধ সৃষ্টি করে, আর এটাই যে রাজাদের চিরাচরিত অভ্যাস তাও রাণীর জানা ছিলাে। উপহার-উপঢৌকন মনকে নরম করে, প্রীতির মনােভাব প্রকাশ করে এবং কখনাে কখনো তা যুদ্ধ প্রতিহত করতেও সফল হয়। এটা একটা অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচিত হবে। হযরত সােলায়মান(আ.) যদি উপঢৌকন গ্রহণ করেন তাহলে বুঝতে হবে, তার লক্ষ্য পার্থিব বিজয় এবং সে ক্ষেত্রে পার্থিব উপায়-উপকরণ কাজে লাগতে পারে, আর যদি গ্রহণ না করেন তাহলে তার অর্থ হবে, তিনি আদর্শগত বিজয় ছাড়া আর কিছু চান না এবং পার্থিব ধন সম্পদ দিয়ে তাকে সে কাজ থেকে নিবৃত্ত করা সম্ভব নয়। এখানে এসে এ দৃশ্যের যবনিকাপাত ঘটে এবং নতুন দৃশ্যের অবতারণা হয়। রাণীর প্রেরিত দূতরা রাণীর উপঢৌকন নিয়ে হযরত সােলায়মানের দরবারে উপনীত হয়। হযরত সােলায়মান এটা অপছন্দ করেন। তাকে অর্থ দিয়ে কেনা বা ইসলামের দাওয়াত থেকে ফেরানাের মনােভাবের তিনি নিন্দা করেন। অতপর তিনি তার চূড়ান্ত হুমকি প্রদান করেন এই বলে, ‘দূত যখন সােলায়মানের কাছে এলাে, তখন সে বললাে, তােমরা কি আমাকে সম্পদ দিয়ে সাহায্য করছ? আল্লাহ তায়ালা আমাকে যা দিয়েছেন তা তােমাদের সম্পদের চেয়ে ঢের ভালাে। তােমরা বরং তােমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাকো। তুমি তাদের কাছে ফিরে যাও। আমরা অবশ্যই তাদের কাছে এমন বাহিনী নিয়ে আসবে, যার প্রতিরােধ করার ক্ষমতা তাদের নেই।’ হযরত সুলায়মানের জবাবে সম্পদের প্রতি উপহাস করা হয়েছে এবং আদর্শ ও দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধন সম্পদ প্রয়ােগের মানসিকতার নিন্দা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন ‘তােমরা কি আমাকে সম্পদ দিয়ে সাহায্য করছো?’ অর্থাৎ এই নগণ্য ও সন্তা পার্থিব বস্তু আমাকে দিতে চাইছাে? ‘আল্লাহ তায়ালা আমাকে যা দিয়েছেন তা তােমাদের সম্পদের চেয়ে ভালাে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাকে পার্থিব সম্পদও দিয়েছেন তােমাদের চেয়ে বেশী, আর ইসলামের জ্ঞান ও নবুওতের আকারে যে মহামূল্যবান সম্পদ দিয়েছেন, তাও যে কোনাে পার্থিব সম্পদের চেয়ে ভালাে। তা ছাড়া জ্বিন ও পাখীকে পর্যন্ত আমার অনুগত করে দেয়া হয়েছে। আমার সুখের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কিছুর প্রয়ােজন নেই। ‘বরং তােমরা তােমাদের উপঢৌকনাদি নিয়ে সুখে থাকো।’ অর্থাৎ আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি এবং তার উপঢৌকন ও পুরস্কার লাভের পরিবর্তে এসব তুচ্ছ পার্থিব সম্পদ লাভে যদি তােমাদের সুখ বােধ হয়, তবে সেই সুখ তােমরাই ভোগ করাে। তারপর এই নিন্দা ও ভৎর্সনার পর হযরত সােলায়মান হুমকি দিলেন, ‘তুমি তাদের কাছে ফিরে যাও।’ অর্থাৎ এসব উপঢৌকন ফেরত নিয়ে চলে যাও এবং ভয়াবহ পরিণতির প্রতীক্ষায় থাকো। তিনি বললেন, আমরা অবশ্যই এমন এক বাহিনী নিয়ে তাদের কাছে আসবাে, যাকে প্রতিহত করার সাধ্য কারো নেই।’ অর্থাৎ সে বাহিনীকে পৃথিবীর কোথাও কেউ বশীভূত করতে যেমন পারে না, তেমনি সাবার রাণীরও ক্ষমতা নেই তার সাথে লড়বার। তিনি আরাে বললেন, আর আমরা তাদের সেখান থেকে পরাজিত ও লাঞ্ছিত করে বিতাড়িত করবাে। এই পর্যন্ত এসে এই আতংকজনক দৃশ্যের সমাপ্তি ঘটে এবং দূতেরা চলে যায়। এরপর আয়াতে এ সম্পর্কে নীরবতা পালন করা হয়, যেন ঘটনার এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে।

# এ পর্যায়ে হযরত সােলায়মান বুঝতে পারেন যে, দূতদের কাছে পাঠানাে এই জবাবই বিষয়টার পরিসমাপ্তি ঘটাবে। কেননা রাণী তার সাথে যুদ্ধ বিগ্রহ চান না। আর এ বিষয়টা তার উপঢৌকনাদি সহকারে দূত পাঠানাে দ্বারাই পরিষ্কার বুঝা গিয়েছিলাে। হযরত সােলায়মান এটাও প্রত্যাশা করছিলেন বরং নিশ্চিতই ছিলেন যে, রাণী তার দাওয়াত গ্রহণ করবেন। বস্তুত রাণী তা যথার্থই গ্রহণ করেছিলেন। তবে আয়াতে এ কথা জানানাে হয়নি যে, রাণীর দূতেরা তার কাছে কিভাবে ফিরে গিয়েছিলাে, তাকে কী বলেছিলাে কিংবা রাণী তারপর কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আয়াতে এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করা হয়েছে। আমরা শুধু পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে বুঝতে পারি যে, রাণী হযরত সুলায়মানের কাছে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন এবং হযরত সোলায়মান তা জেনেও ফেলেছিলেন। তাই তিনি তার বাহিনীর সাথে আলােচনাও শুরু করে দিয়েছিলেন যে, রাণী তার দেশে যে সিংহাসন নিজ সেনাবাহিনীর প্রহরাধীন সুরক্ষিত করে রেখে সফরে বেরিয়ে পড়েছেন, সেই সিংহাসন রাণী পৌছার আগেই নিয়ে আসা যায় কিনা। ‘সােলায়মান বলা রাণী আমার বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে চলে আসার আগে কে তার সিংহাসন আমার কাছে নিয়ে আসতে পারে?…'(আয়াত ৩৮, ৩৯ ও ৪০) রাণী তার কাছে আত্মসমর্পণ করে সদলবলে চলে আসার আগেই তার সিংহাসন নিয়ে আসার পেছনে হযরত সােলায়মানের উদ্দেশ্যটা কী তা কি পাঠক বুঝতে পারছেন? আমার ধারণা, খুব সম্ভবত এটা ছিলাে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে ও ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করতে রাণীকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে হযরত সুলায়মানের অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করার কৌশল। জ্বিনদের ভেতর থেকে এক দানব তার এ কথা শুনে বললাে, সে তার সিংহাসনটা হযরত সােলায়মানের চলতি এজলাস শেষ হবার আগেই হাযির করে দিতে পারে। কথিত আছে, তার এই এজলাস সকাল থেকে যোহর পর্যন্ত চলে, কিন্তু ঐ সময়টাও হযরত সােলায়মানের কাছে বেশী মনে হলাে। তখন ‘তার কাছে আসমানী কিতাবের জ্ঞান ছিলাে’ সে বললাে, হযরত সােলায়মান চোখের পলক ফেলার আগেই সে তা এনে দিতে পারে। এই ব্যক্তির নাম এবং কোন আসমানী কিতাবের জ্ঞান তার কাছে ছিলাে, তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আমরা শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি যে, সে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত একজন মােমেন বান্দা ছিলাে। আল্লাহর সেই সর্বোচ্চ ও অজেয় শক্তির একটা অংশ তাকে গােপনে দেয়া হয়েছিলাে, যার সামনে কোনাে বাধাই টিকতে পারে না এবং যে কোনাে দূরত্বই তার সামনে নস্যি। আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কারাে কারাে মধ্যে যে জিনিসটা কখনাে কখনাে দেখা যায়, কিন্তু এর রহস্য বা ব্যাখ্যা কখনাে উদঘাটিত হয়নি। কেননা তা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রণালীর আওতা বহির্ভূত। অলীক ও উদ্ভট কল্পকাহিনীর সাথে এগুলাের আদৌ কোনাে সম্পর্ক নেই। আসমানী কিতাবের জ্ঞান এই উক্তিটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাফসীরকাররা নানা রকমের মতামত দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাওরাতের জ্ঞান। কেউ কেউ বলেছেন, সে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নাম ‘এসমে আযম’ জানতাে। কেউ কেউ অন্যান্য ব্যখ্যাও দিয়েছেন। তবে কেউই নিজ নিজ মতামতের পক্ষে কোনাে নিশ্চিত কারণ বা প্রমাণ দর্শাতে পারেননি। তবে বিষয়টার প্রতি বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টি দিলে ব্যাপারটা এসব কিছুর চেয়েও সহজ মনে হবে। এই মহাবিশ্বে এমন বহু রহস্য রয়েছে, যা আমরা জানি না এবং এমন বহু শক্তি রয়েছে, যা আমরা ব্যবহার করি । মানুষের সত্ত্বায়ও এমন বহু রহস্য ও শক্তি রয়েছে, যার কোনাে তথ্য আমাদের জানা নেই। এসব শক্তি ও রহস্যের কোনাে একটারও সন্ধান যখন আল্লাহ তায়ালা কাউকে দিতে ইচ্ছা করেন, তখনই ঘটে যায় সেই অলৌকিক ঘটনা, যা মানব জীবনে সচরাচর ঘটে না। এ ঘটনা নিছক আল্লাহর ইচ্ছায়, আদেশে ও ব্যবস্থায়ই ঘটে। যার হাতে আল্লাহ তায়ালা ঘটনাটা ঘটাতে চান না, সে তা ঘটাতে পারে না। হযরত সােলায়মানের সভাসদদের মধ্যে যে ব্যক্তির কাছে আসমানী কিতাবের জ্ঞান ছিলাে, সে তার জ্ঞানের কারণেই এ ব্যাপারে অগ্রণী হয়েছিলো। তার হাতে যে অলৌকিক ঘটনাটা ঘটেছিলাে, সেটা ঘটানাের ক্ষমতা যেসব মহাজাগতিক শক্তির ছিলাে, তার সাথে তার সংযােগ ঘটেছিলাে সে জ্ঞানেরই কারণে ও প্রেরণায়। কেননা এ কিতাবের জ্ঞান তার মনকে আল্লাহর সাথে এমনভাবে যুক্ত করে দিয়েছিলাে, যাতে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত শক্তি ও রহস্য গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। কোনাে কোনাে তাফসীরকার বলেছেন, এই ব্যক্তি আর কেউ নয়, স্বয়ং হযরত সােলায়মান। আমার ধারণা, তিনি নন। তিনি হলে আয়াতে তার নামই বলা হতাে। কেননা ঘটনাটা তার সম্পর্কেই। কাজেই তার নাম গােপন করার কোনাে আবশ্যকতা নেই। কেউ বলেছেন, এই ব্যক্তির নাম আসিফ বিন বরখিয়া। তবে এই বক্তব্যের সপক্ষে কোনাে প্রমাণ নেই। ‘যখন সােলায়মান দেখলাে, সিংহাসনটা তার কাছেই রয়েছে, তখন বললেন, এটা আমার মালিকের অনুগ্রহেরই ফল; যাতে করে তিনি আমাকে যাচাই করেন যে, আমি তার শােকর করি, না না-শােকরী করি…'(আয়াত ৪০) এই চাঞ্চল্যকর আকস্মিক ঘটনা হযরত সােলায়মানের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিলাে। আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছা এমন অলৌকিকভাবে পূরণ করলেন দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, এমন অসাধারণ উপায়ে প্রাপ্ত এ অনুগ্রহও একটা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা এ পরীক্ষায় পাস করতে হলে তার ভেতরে বিশেষ সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া প্রয়ােজন। আল্লাহর বিশেষ সাহায্য পাওয়া প্রয়ােজন এবং আল্লাহর এই নেয়ামত ও অনুগ্রহের মর্যাদা উপলব্ধি করা আবশ্যক। তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার সচেতনতার মর্যাদা দেবেন ও তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবেন। আসলে আল্লাহ তায়ালা তাে শােকর আদায়কারীদের শােকরের মুখাপেক্ষী নন। যে ব্যক্তি শােকর করে সে নিজেরই উপকার সাধন করে, আল্লাহর কাছ থেকে আরাে বেশী নেয়ামত লাভ করে এবং পরীক্ষায় পাস করার জন্যে উত্তম সাহায্য লাভ করে। ‘আর যে ব্যক্তি নাশােকরী করে, আল্লাহ তায়ালা তার মুখাপেক্ষী নন’, অর্থাৎ তার শােকরের মুখাপেক্ষী নন এবং আল্লাহ মহানুভব। অর্থাৎ তিনি শোককের প্রত্যাশায় দান করেন না, বরং নিজের মহানুভবতার জন্যেই দান করেন। আল্লাহর নেয়ামতের সামনে এরূপ অভিভূত হওয়া এবং এই নেয়ামতের আড়ালে যে পরীক্ষা রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর হযরত সােলায়মান প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন সাবার রাণী- যিনি একটু পরেই আসছেন, তার জন্যে বিবিধ রকমের বিস্ময়ােদ্দীপক দৃশ্যপট সৃষ্টি করতে। ‘সােলায়মান বললাে, রাণীর সিংহাসনটাকে অচেনা বানিয়ে দাও, দেখবাে সে চিনতে পারে কিনা।'(আয়াত ৪১) অর্থাৎ সিংহাসনের চিহ্নগুলাে পাল্টে দাও, যাতে আমরা বুঝতে পারি যে, সে সিংহাসনের চিহ্নগুলাে এভাবে পাল্টে দেয়ার পরও তা চিনতে পারার মতাে বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞার অধিকারী, না কি চিহ্ন পাল্টানাের কারণে ওটা তার কাছে অচেনাই থেকে যায়। সম্ভবত এ মহিলার মেধা ও বুদ্ধিমত্তা কেমন এবং সিংহাসনের ব্যাপারে গােলক ধাঁধায় পড়ে গিয়ে সে কী করে, তা দেখা ও পরীক্ষা করার জন্যেই হযরত সােলায়মান এ ব্যবস্থা করেন। সহসা রাণী উপস্থিত হয়ে গেলেন। উপস্থিত হওয়া মাত্র বলা হলাে, ‘তােমার সিংহাসনটা কি এ রকম? সে বললাে, মনে হচ্ছে এটা। আসলে এটা এতাে বড় গোলক ধাধা ছিলো যে, রাণী তা কল্পনাও করতে পারেননি। কোথায় সিংহাসন তালাবদ্ধ করে পাহারাদার নিযুক্ত করে রেখে এসেছেন, আর কোথায় তা হযরত সােলায়মানের রাজধানী বায়তুল মাকদাসে? কিভাবে তা আনা হলাে? কে আনলাে। কিন্তু গােলক ধাধা সৃষ্টি করে ও চিহ্ন পাল্টে যতাে অচেনাই করা হােক, সিংহাসনটা ছিলাে রাণী ক্ষণেক ভেবে নিলেন যে, তিনি কি অস্বীকার করবেন, ওটা তার সিংহাসন নয়, না কি স্বীকার করে নিবেন? কেননা কিছু কিছু চিহ্ন তাে তখনো রয়েছে। অবশেষে তিনি খুবই বুদ্ধিমতিসুলভ জবাব দিলেন যে, মনে হচ্ছে ওটাই। অস্বীকারও করলেন না, স্বীকারও করলেন না। আকস্মিক গোলক ধাঁধায় পড়ে কেমন প্রজ্ঞা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিতে হয়, সেটাই তিনি দেখালেন। এখানে আয়াতে ঘটনার কিছু অংশ উহ্য রাখা হয়েছে। যেন রাণী আকস্মিক গােলক ধাধার রহস্য ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, উপঢৌকন ফেরত দেয়ার পর থেকেই তিনি আত্মসমর্পণ ও ইসলাম গ্রহণপূর্বক হযরত সুলায়মানের কাছে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা আগেই জ্ঞান লাভ করেছি এবং ইসলাম গ্রহণ করেছি। এ পর্যায়ে কোরআন হযরত সােলায়মানের চিঠি পাওয়ার পর রাণীর ইসলাম গ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করছে। কারণটা এই যে, রাণী একটা অমুসলিম জাতির সন্তান এবং আল্লাহর সৃষ্টি সূর্যের পূজা করার কারণেই তিনি আল্লাহর উপাসনা করেননি। সে আল্লাহ ছাড়া অন্য যে জিনিসের পূজা করতাে, সেটাই তাকে আল্লাহর এবাদাত থেকে দূরে রেখেছে। ‘আসলে সে ছিলাে একটা কাফের জাতির সন্তান।'(আয়াত ৪৩) হযরত সোলায়মান রাণীর জন্যে আরাে একটা গোলক ধাঁধা প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। সেটা হলাে, ‘তাকে বলা হলো, এই প্রাসাদে প্রবেশ করো'(আয়াত ৪৪) এই গোলক ধাধাটা ছিলাে স্বচ্ছ কাঠের একটা প্রাসাদ, যার ভিত গড়া হয়েছিলাে পানির ওপর। ওর ফলে পুরাে প্রাসাদটাকেই একটা জলাশয় মনে হচ্ছিলাে। তাই রাণীকে যখন বলা হলাে, এই প্রাসাদে প্রবেশ করো, তখন তিনি ভাবলেন, তিনি জলাশয়ে নামতে যাচ্ছেন, এ জন্যে পায়ের গােছার ওপর কাপড় তুলে নিলেন। রাণী যখন সত্যই গােলক ধাঁধায় মতিভ্রান্ত হলেন তখন হযরত সােলায়মান তাকে তার রহস্য জানিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ওটা তাে একটা কাঠের প্রাসাদ। রাণী এসব গােলক ধাধায় দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কেননা এগুলাে সবই ছিলাে অসাধারণ ও অলৌকিক। এগুলাে থেকে স্পষ্ট বুঝা গেল, হযরত সুলায়মানের অধীনে মানুষের চেয়েও অনেক বড় বড় শক্তি কর্মরত রয়েছে। তাই রাণী আল্লাহর দিকে মনােনিবিষ্ট হলেন। তাকে বাদ দিয়ে অন্যান্য উপাস্যের পূজা করে এ যাবত যে গুনাহ করেছে, তার জন্যে তিনি ক্ষমা চাইলেন এবং তার ইসলাম গ্রহণের ঘােষণা করলেন। এখানে লক্ষণীয় যে, তার ইসলাম গ্রহণ হযরত সােলায়মানের জন্যে নয় বরং ইসলাম গ্রহণটা ছিলাে শুধু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্যে। রাণীর হৃদয়ের বন্ধ দরজা যখন খুলে গেলাে, তখন তিনি বুঝলেন, ইসলাম গ্রহণ আল্লাহর কোনাে সৃষ্টির কাছে আত্মসমর্পণের নাম নয়। এমনকি এতাে সব অলৌকিক কান্ড যিনি ঘটালেন, সেই নবী হযরত সােলায়মানের কাছেও নয়, বরং একমাত্র বিশ্ব জাহানের প্রভু আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের নাম। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও ঈমানের দিকে আহ্বানকারী মােমেনদের সমপর্যায়ের সাথী হওয়ার নাম। কোরআনের এ আয়াতের শেষাংশে এ বিষয়টা খুবই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও আত্মসমর্পণের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য। এ দ্বারাই সেই প্রতাপ ও পরাক্রমের অধিকারী হওয়া যায়, যা পরাজিতদের বিজয়ীতে পরিণত করে। অন্য কথায় বলা যায়, এভাবেই বিজয়ী ও বিজিত উভয়ে আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যায়। কেউ কারাে ওপর বিজয়ী নয় এবং কেউ কারাে পদানত নয়। সবাই রব্বুল আলামীনের সমান বান্দা, পরস্পরে ভাই ভাই। কোরায়েশ নেতারা রসূলের ইসলামের দাওয়াতে বিরক্ত হতাে। কারণ তারা অহংকারী ছিলাে। আবদুল্লাহর ছেলে মােহাম্মাদের অনুগত হতে তারা প্রস্তুত ছিলাে না, কিন্তু এ সূরায় এক নারীর ইতিহাস বর্ণনা করা হলাে। যে নারী তাদের শিক্ষা দিচ্ছে যে, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ নেতা ও অনুসারীদের মধ্যে এবং আহ্বানকারী ও আহতদের মধ্যে যথার্থ সাম্য গড়ে তােলে। কেননা তারা সর্বজগতের প্রতিপালক ও প্রভু বিধাতার কাছে তার রসূলের সাথেই আত্মসমর্পণ করে।

Leave a Reply