أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১২)
[ *বিবেকের দরজায় কোরআনের কষাঘাত :-]
www.motaher21.net
সূরা:- আন-নমল।
পারা:২০
৫৯-৯৩ নং আয়াত:-
২৭:৫৯
قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ وَ سَلٰمٌ عَلٰی عِبَادِہِ الَّذِیۡنَ اصۡطَفٰی ؕ آٰللّٰہُ خَیۡرٌ اَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿ؕ۵۹﴾
বলুন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ্রই এবং শান্তি তাঁর মনোনীত বান্দাদের প্রতি !’ শ্রেষ্ঠ কি আল্লাহ্, নাকি তারা যাদেরকে শরীক করে তারা?
২৭:৬০
اَمَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ وَ اَنۡزَلَ لَکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً ۚ فَاَنۡۢبَتۡنَا بِہٖ حَدَآئِقَ ذَاتَ بَہۡجَۃٍ ۚ مَا کَانَ لَکُمۡ اَنۡ تُنۡۢبِتُوۡا شَجَرَہَا ؕ ءَ اِلٰہٌ مَّعَ اللّٰہِ ؕ بَلۡ ہُمۡ قَوۡمٌ یَّعۡدِلُوۡنَ ﴿ؕ۶۰﴾
অথবা তিনি, যিনি সৃষ্টি করেছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং আকাশ হতে তোমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করেন; অতঃপর তা দিয়ে মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করেন। ওর বৃক্ষাদি উদগত করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তবুও ওরা এমন এক সম্প্রদায় যারা সত্য বিচ্যুত হয়।
২৭:৬১
اَمَّنۡ جَعَلَ الۡاَرۡضَ قَرَارًا وَّ جَعَلَ خِلٰلَہَاۤ اَنۡہٰرًا وَّ جَعَلَ لَہَا رَوَاسِیَ وَ جَعَلَ بَیۡنَ الۡبَحۡرَیۡنِ حَاجِزًا ؕ ءَ اِلٰہٌ مَّعَ اللّٰہِ ؕ بَلۡ اَکۡثَرُہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿ؕ۶۱﴾
কিংবা তিনি, যিনি পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং ওর মাঝে মাঝে প্রবাহিত করেছেন নদীমালা এবং ওতে সুদৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং দুই সাগরের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অন্তরায়। আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং ওদের অনেকেই তা জানে না।
২৭:৬২
اَمَّنۡ یُّجِیۡبُ الۡمُضۡطَرَّ اِذَا دَعَاہُ وَ یَکۡشِفُ السُّوۡٓءَ وَ یَجۡعَلُکُمۡ خُلَفَآءَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَ اِلٰہٌ مَّعَ اللّٰہِ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَذَکَّرُوۡنَ ﴿ؕ۶۲﴾
নাকি তিনি, যিনি আর্তের ডাকে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং বিপদ দূরীভূত করেন , আর তোমাদেরকে যমীনের প্রতিনিধি বানান । আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন ইলাহ আছে কি? তোমরা খুব অল্পই শিক্ষা গ্রহণ করে থাক।
২৭:৬৩
اَمَّنۡ یَّہۡدِیۡکُمۡ فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ وَ مَنۡ یُّرۡسِلُ الرِّیٰحَ بُشۡرًۢا بَیۡنَ یَدَیۡ رَحۡمَتِہٖ ؕ ءَ اِلٰہٌ مَّعَ اللّٰہِ ؕ تَعٰلَی اللّٰہُ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿ؕ۶۳﴾
নাকি তিনি, যিনি তোমাদেরকে স্থলভূমি ও সমূদ্রের অন্ধকারে পথ দেখান এবং যিনি তাঁর অনুগ্রহের প্রাক্কালে সুসংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন। আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন ইলাহ আছে কি? তারা যাকে শরীক করে আল্লাহ্ তা থেকে বহু ঊর্ধ্বে।
২৭:৬৪
اَمَّنۡ یَّبۡدَؤُا الۡخَلۡقَ ثُمَّ یُعِیۡدُہٗ وَ مَنۡ یَّرۡزُقُکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ ءَ اِلٰہٌ مَّعَ اللّٰہِ ؕ قُلۡ ہَاتُوۡا بُرۡہَانَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۶۴﴾
নাকি তিনি, যিনি প্রথম সৃষ্টি করেন, তারপর সেটার পুনরাবৃত্তি করবেন এবং যিনি তোমাদেরকে আসমান ও যমীন হতে জীবনোপকরণ দান করেন । আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন ইলাহ আছে কি? বলুন, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ পেশ কর।
২৭:৬৫
قُلۡ لَّا یَعۡلَمُ مَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ الۡغَیۡبَ اِلَّا اللّٰہُ ؕ وَ مَا یَشۡعُرُوۡنَ اَیَّانَ یُبۡعَثُوۡنَ ﴿۶۵﴾
বল, ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না এবং ওরা কখন পুনরুত্থিত হবে (তাও) ওরা জানে না।’
২৭:৬৬
بَلِ ادّٰرَکَ عِلۡمُہُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ ۟ بَلۡ ہُمۡ فِیۡ شَکٍّ مِّنۡہَا ۫۟ بَلۡ ہُمۡ مِّنۡہَا عَمُوۡنَ ﴿٪۶۶﴾
বরং আখেরাত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান তো নিঃশেষ হয়েছে ; তারা তো এ বিষয়ে সন্দেহে রয়েছে, বরং এ বিষয়ে তারা অন্ধ।
২৭:৬৭
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا ءَ اِذَا کُنَّا تُرٰبًا وَّ اٰبَآؤُنَاۤ اَئِنَّا لَمُخۡرَجُوۡنَ ﴿۶۷﴾
কাফেররা বলে, ‘আমরা ও আমাদের পিতৃপুরুষেরা মাটিতে পরিণত হয়ে গেলেও কি আমাদেরকে বের করা হবে?
২৭:৬৮
لَقَدۡ وُعِدۡنَا ہٰذَا نَحۡنُ وَ اٰبَآؤُنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ اِنۡ ہٰذَاۤ اِلَّاۤ اَسَاطِیۡرُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۶۸﴾
আমাদেরকে এবং পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকেও অবশ্যই এ বিষয়ে ভীতি-প্রদর্শন করা হয়েছে। এ তো সে কালের উপকথা ব্যতীত আর কিছু নয়।’
২৭:৬৯
قُلۡ سِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَانۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُجۡرِمِیۡنَ ﴿۶۹﴾
বল, ‘পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর এবং দেখ অপরাধীদের পরিণাম কি হয়েছে?’
২৭:৭০
وَ لَا تَحۡزَنۡ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا تَکُنۡ فِیۡ ضَیۡقٍ مِّمَّا یَمۡکُرُوۡنَ ﴿۷۰﴾
ওদের আচরণে তুমি দুঃখ করো না এবং ওদের ষড়যন্ত্রে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ো না ।
২৭:৭১
وَ یَقُوۡلُوۡنَ مَتٰی ہٰذَا الۡوَعۡدُ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۷۱﴾
ওরা বলে, ‘তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে বল, এ প্রতিশ্রুতি কখন পূর্ণ হবে?’
২৭:৭২
قُلۡ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنَ رَدِفَ لَکُمۡ بَعۡضُ الَّذِیۡ تَسۡتَعۡجِلُوۡنَ ﴿۷۲﴾
বল, ‘তোমরা যে বিষয়ে ত্বরান্বিত করতে চাচ্ছ, সম্ভবতঃ তার কিছু শীঘ্রই তোমাদের উপর এসে পড়বে।’
২৭:৭৩
وَ اِنَّ رَبَّکَ لَذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی النَّاسِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَشۡکُرُوۡنَ ﴿۷۳﴾
আর নিশ্চয় আপনার রব মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ।
২৭:৭৪
وَ اِنَّ رَبَّکَ لَیَعۡلَمُ مَا تُکِنُّ صُدُوۡرُہُمۡ وَ مَا یُعۡلِنُوۡنَ ﴿۷۴﴾
আর নিশ্চয় আপনার রব, তিনি অবশ্যই জানেন তাদের অন্তর যা গোপন করে এবং তারা যা প্রকাশ করে।
২৭:৭৫
وَ مَا مِنۡ غَآئِبَۃٍ فِی السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ اِلَّا فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۷۵﴾
আর আসমান ও যমীনে এমন কোন গোপন রহস্য নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।
২৭:৭৬
اِنَّ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنَ یَقُصُّ عَلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ اَکۡثَرَ الَّذِیۡ ہُمۡ فِیۡہِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ﴿۷۶﴾
বনী ইসরাঈল যে সব বিষয়ে মতভেদ করে, নিশ্চয় এ কুরআন তার অধিকাংশ তাদের কাছে বিবৃত করে।
২৭:৭৭
وَ اِنَّہٗ لَہُدًی وَّ رَحۡمَۃٌ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۷۷﴾
আর নিশ্চয় এটি মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত।
২৭:৭৮
اِنَّ رَبَّکَ یَقۡضِیۡ بَیۡنَہُمۡ بِحُکۡمِہٖ ۚ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡعَلِیۡمُ ﴿ۙۚ۷۸﴾
আপনার রব তো তাঁর বিধান অনুযায়ী তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। আর তিনি পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ।
২৭:৭৯
فَتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّکَ عَلَی الۡحَقِّ الۡمُبِیۡنِ ﴿۷۹﴾
অতএব আল্লাহর উপর নির্ভর কর; নিঃসন্দেহে তুমি স্পষ্ট সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
২৭:৮০
اِنَّکَ لَا تُسۡمِعُ الۡمَوۡتٰی وَ لَا تُسۡمِعُ الصُّمَّ الدُّعَآءَ اِذَا وَلَّوۡا مُدۡبِرِیۡنَ ﴿۸۰﴾
মৃতকে তো আপনি শোনাতে পারবেন না , বধিরকেও পারবেন না ডাক শুনাতে, যখন তারা পিঠ ফিরিয়ে চলে যায়।
২৭:৮১
وَ مَاۤ اَنۡتَ بِہٰدِی الۡعُمۡیِ عَنۡ ضَلٰلَتِہِمۡ ؕ اِنۡ تُسۡمِعُ اِلَّا مَنۡ یُّؤۡمِنُ بِاٰیٰتِنَا فَہُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ﴿۸۱﴾
আপনি অন্ধদেরকেও তাদের পথ ভ্রষ্টতা থেকে পথে আনতে পারবেন না। আপনি তো কেবল তাদেরকে শোনাতে পারবেন, যারা আমাদের নিদর্শনাবলীতে ঈমান আনে। অতঃপর তারাই আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)।
২৭:৮২
وَ اِذَا وَقَعَ الۡقَوۡلُ عَلَیۡہِمۡ اَخۡرَجۡنَا لَہُمۡ دَآبَّۃً مِّنَ الۡاَرۡضِ تُکَلِّمُہُمۡ ۙ اَنَّ النَّاسَ کَانُوۡا بِاٰیٰتِنَا لَا یُوۡقِنُوۡنَ ﴿٪۸۲﴾
আর যখন আমার কথা সত্য হবার সময় তাদের কাছে এসে যাবে তখন আমি তাদের জন্য মৃত্তিকা গর্ভ থেকে একটি জীব বের করবো। সে তাদের সাথে কথা বলবে যে, লোকেরা আমাদের আয়াত বিশ্বাস করতো না।
২৭:৮৩
وَ یَوۡمَ نَحۡشُرُ مِنۡ کُلِّ اُمَّۃٍ فَوۡجًا مِّمَّنۡ یُّکَذِّبُ بِاٰیٰتِنَا فَہُمۡ یُوۡزَعُوۡنَ ﴿۸۳﴾
আর স্মরণ করুন সে দিনের কথা, যেদিন আমরা সমবেত করব প্রত্যেক সম্প্রদায় থেকে একেকটি দলকে, যারা আমার নিদর্শনাবলী প্রত্যাখ্যান করত অতঃপর তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে একত্রিত করা হবে
২৭:৮৪
حَتّٰۤی اِذَا جَآءُوۡ قَالَ اَکَذَّبۡتُمۡ بِاٰیٰتِیۡ وَ لَمۡ تُحِیۡطُوۡا بِہَا عِلۡمًا اَمَّا ذَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۸۴﴾
পরিশেষে যখন ওরা সমাগত হবে, তখন আল্লাহ ওদেরকে বলবেন, ‘তোমরা কি আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিলে; অথচ তা তোমরা জ্ঞানায়ত্ত করতে পারনি? অথবা তোমরা কি করছিলে?’
২৭:৮৫
وَ وَقَعَ الۡقَوۡلُ عَلَیۡہِمۡ بِمَا ظَلَمُوۡا فَہُمۡ لَا یَنۡطِقُوۡنَ ﴿۸۵﴾
আর যুলুমের কারণে তাদের উপর ঘোষিত শাস্তি এসে পড়বে; ফলে তারা কিছুই বলতে পারবে না।
২৭:৮৬
اَلَمۡ یَرَوۡا اَنَّا جَعَلۡنَا الَّیۡلَ لِیَسۡکُنُوۡا فِیۡہِ وَ النَّہَارَ مُبۡصِرًا ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ ﴿۸۶﴾
তারা কি দেখে না যে, আমরা রাত সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি দৃশ্যমান? এতে তো অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা ঈমান আনে।
২৭:৮৭
وَ یَوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ فَفَزِعَ مَنۡ فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَنۡ فِی الۡاَرۡضِ اِلَّا مَنۡ شَآءَ اللّٰہُ ؕ وَ کُلٌّ اَتَوۡہُ دٰخِرِیۡنَ ﴿۸۷﴾
আর যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, সেদিন আসমানসমূহ ও যমীনের সকলেই ভীত-বিহ্বল হয়ে পড়বে , তবে আল্লাহ্ যাদেরকে চাইবেন তারা ব্যতীত এবং সকলই তাঁর কাছে আসবে হীন অবস্থায়।
২৭:৮৮
وَ تَرَی الۡجِبَالَ تَحۡسَبُہَا جَامِدَۃً وَّ ہِیَ تَمُرُّ مَرَّ السَّحَابِ ؕ صُنۡعَ اللّٰہِ الَّذِیۡۤ اَتۡقَنَ کُلَّ شَیۡءٍ ؕ اِنَّہٗ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَفۡعَلُوۡنَ ﴿۸۸﴾
তুমি পর্বতমালা দেখে অচল মনে করছ; কিন্তু (সেদিন) ওরা হবে মেঘপুঞ্জের মত চলমান। এ আল্লাহরই সৃষ্টি-নিপুণতা যিনি সমস্ত কিছুকে করেছেন সুষম। তোমরা যা কর, সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহে তিনি সম্যক অবগত।
২৭:৮৯
مَنۡ جَآءَ بِالۡحَسَنَۃِ فَلَہٗ خَیۡرٌ مِّنۡہَا ۚ وَ ہُمۡ مِّنۡ فَزَعٍ یَّوۡمَئِذٍ اٰمِنُوۡنَ ﴿۸۹﴾
যে কেউ সৎকাজ নিয়ে আসবে, সে তা থেকে উৎকৃষ্ট প্রতিফল পাবে এবং সেদিন তারা শংকা থেকে নিরাপদ থাকবে।
২৭:৯০
وَ مَنۡ جَآءَ بِالسَّیِّئَۃِ فَکُبَّتۡ وُجُوۡہُہُمۡ فِی النَّارِ ؕ ہَلۡ تُجۡزَوۡنَ اِلَّا مَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۹۰﴾
আর যে কেউ অসৎকাজ নিয়ে আসবে, তাকে অধোমুখে নিক্ষেপ করা হবে আগুনে ‘তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল তোমাদেরকে দেয়া হচ্ছে।’
২৭:৯১
اِنَّمَاۤ اُمِرۡتُ اَنۡ اَعۡبُدَ رَبَّ ہٰذِہِ الۡبَلۡدَۃِ الَّذِیۡ حَرَّمَہَا وَ لَہٗ کُلُّ شَیۡءٍ ۫ وَّ اُمِرۡتُ اَنۡ اَکُوۡنَ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ﴿ۙ۹۱﴾
আমি তো এ নগরীর প্রতিপালকের উপাসনা করতে আদিষ্ট হয়েছি, যিনি একে সম্মানিত করেছেন।[১] সমস্ত কিছু তাঁরই। আমি আরও আদিষ্ট হয়েছি, যেন আমি আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)দের একজন হই।
২৭:৯২
وَ اَنۡ اَتۡلُوَا الۡقُرۡاٰنَ ۚ فَمَنِ اہۡتَدٰی فَاِنَّمَا یَہۡتَدِیۡ لِنَفۡسِہٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَقُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُنۡذِرِیۡنَ ﴿۹۲﴾
আমি আরো আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি, কুরাআন তিলাওয়াত করতে ; অতঃপর যে ব্যাক্তি সৎপথ অনুসরণ করে, সে সৎপথ অনুসরণ করে নিজেরই কল্যাণের জন্য। আর কেউ ভুল পথ অনুসরণ করলে, আপনি বলুন, ‘আমি তো শুধু সতর্ককারীদের একজন।’
২৭:৯৩
وَ قُلِ الۡحَمۡدُ لِلّٰہِ سَیُرِیۡکُمۡ اٰیٰتِہٖ فَتَعۡرِفُوۡنَہَا ؕ وَ مَا رَبُّکَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿٪۹۳﴾
তাদেরকে বলো, প্রসংশা আল্লাহরই জন্য, শিগগির তিনি তোমাদেরকে তাঁর নির্দশনাবলী দেখিয়ে দেবেন এবং তোমরা তা চিনে নেবে। আর তোমরা যেসব কাজ করো তা থেকে তোমার রব বেখবর নন।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলোচনা (৫৯-৯৩) : এ পর্বটা সূরা নামল এর সর্বশেষ অংশ। হযরত মূসা, দাউদ, সোলায়মান, সালেহ ও লুত(আ.)-এর কাহিনীর অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরার পর এই শেষ পর্বটার সূত্রপাত হয়েছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এই শেষাংশ সূরার প্রথমাংশের সাথেই যুক্ত। আর উভয় অংশের মাঝখানে যে কিসসা কাহিনী রয়েছে, তার সাথে প্রথমাংশ ও শেষাংশের সমন্বয় এবং সাযুজ্য রয়েছে। প্রত্যেক কাহিনীতে সূরার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের অংশবিশেষ প্রতিফলিত হয়েছে। এ অংশের শুরুতে রয়েছে আল্লাহর প্রশংসা এবং তার মনােনীত রসূলদের প্রতি সালাম। ইতিপূর্বে তাদের কাহিনী আলােচিত হয়েছে। এই প্রশংসা ও সালামের মাধ্যমে ইসলামী আকীদা এবং আদর্শের একটা বিবরণ শুরু করা হয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্য, মানব সত্ত্বার অভ্যন্তরের বিভিন্ন দিক এবং অদৃশ্য জগত, কেয়ামত ও আখেরাতের কিছু লােমহর্ষক দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই পর্বটাতে মানব জাতিকে বিশ্ব প্রকৃতির বিভিন্ন দৃশ্য ও মানব সত্তার অভ্যন্তরের বিভিন্ন দিক দেখানাে হয়েছে, যার অস্তিত্ব তারা অস্বীকার করতে পারে না এবং একমাত্র সর্বশক্তিমান, সর্বস্রষ্টা, নিখুঁত ব্যবস্থাপক ও একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া এর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় এসব দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। শ্রোতাদের সামনে বহু অকাট্য যুক্তি পেশ করা হয়েছে এবং বহু প্রশ্ন রাখা হয়েছে। যেমন, আকাশ ও পৃথিবীকে কে সৃষ্টি করেছে। কে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তা দিয়ে চমৎকার বাগান সৃষ্টি করেছে। কে পৃথিবীকে স্থির ও ভারসাম্যপূর্ণ করেছে, তার ভেতরে নদনদী ও খালবিল বানিয়েছে, তার ওপর পাহাড় পর্বত তৈরী করেছে এবং দুই সমুদ্রের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। আর্ত মানুষ যখন প্রার্থনা করে তখন কে তা গ্রহণ করে এবং তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে? কে তােমাদের পৃথিবীর খলীফা বানায়? কে তােমাদের অন্ধকারে জলে ও স্থলে সুপথ প্রদর্শন করে? কে স্বীয় দয়ার প্রতীক স্বরূপ সুসংবাদবাহী মেঘকুল পাঠায়? কে প্রথম সৃষ্টি ও পুন সৃষ্টি করে? কে তােমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে জীবিকা দেয়? আর প্রত্যেক প্রশ্নের পর তাদের বিবেককে এই বলে কষাঘাত করে যে, আল্লাহর সাথে কি অন্য কোনাে ইলাহ আছে? তারা তো দাবী করতে পারে না যে, আল্লাহর সাথে আর কোনাে ইলাহ আছে। অথচ তারপরও আল্লাহ ছাড়া অন্যদের এবাদাত করে। মানুষের মনের ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তারকারী এই বিবরণটার পর তাদের আখেরাতের অস্বীকৃতি ও তা নিয়ে তাদের গােয়ার্তুমির পর্যালােচনা করা হয়েছে এবং অতীতে যারা তাদের মত আখেরাতকে অস্বীকার করেছে ও ধ্বংস হয়েছে, তাদের কথা স্মরণ করতে বলা হয়েছে। এরপর কেয়ামতের ময়দানের লােমহর্ষক দৃশ্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অতপর মানুষকে আকস্মিকভাবে তার পার্থিব জীবনে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে, তারপর পুনরায় কেয়ামতের ময়দানে। এভাবে মানুষের মনে প্রবল আলােড়ন ও কম্পন সৃষ্টি করা হয়েছে। সবার শেষে এক ভয়ংকর বর্ণনার মাধ্যমে সূরার সমাপ্তি ঘটেছে। রসূল(স.) মােশরেকদের ব্যাপারে নিজের দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেন। কেননা তিনি প্রাকৃতিক দৃশ্যসমূহ ও কেয়ামতের ভয়ংকর পরিণতির দিকে বার বার তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্তেও তারা তার সাথে ব্যংগ বিদ্রুপ অব্যাহত রেখেছে। তাই তিনি তাদের তাদের মনােনীত পরিণতির হাতেই সােপর্দ করেন। ‘আমাকে তাে কেবল আদেশ দেয়া হয়েছে এই শহরের প্রভুর এবাদাত করতে…'(আয়াত ৯১-৯২) তারপর এ পর্বের সূচনা যেমন আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে হয়েছে, তেমনি সূরার সমাপ্তিও আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যাতে তাদের নিদর্শনাবলী পর্যবেক্ষণ করান, সে জন্য তাদের আল্লাহর হাতে সােপর্দ করা হয়েছে। আর বলাে, আল্লাহর জন্যেই সকল প্রশংসা। শিগগিরই তিনি তােমাদের তার নিদর্শনাবলী দেখাবেন। তখন তােমরা তা জানবে। আর তােমার মালিক তােমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে উদাসীন নন। (আয়াত ৯৩) এখানে এসে এই মনােজ্ঞ বক্তব্যের মাধ্যমে সূরা সমান্ত হয়। *তাফসীর : ‘বলাে, আল্লাহর জন্যে সকল প্রশংসা এবং আল্লাহর মনােনীত বান্দাদের ওপর সালাম। আল্লাহ তায়ালা ভালো, না যাদের তারা শরীক মানে তারা?'(আয়াত-৫৯) এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে আদেশ দিচ্ছেন যেন তিনি তার কথাবার্তা, যুক্তিতর্ক ও দাওয়াত- সব কিছুই আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু করেন এবং শেষও করেন। কেননা এটাই ঈমানদারের উপযুক্ত কাজ। ‘বলাে, আল্লাহর জন্যে সকল প্রশংসা।’ কেননা তিনি তার বান্দাদের যেসব নেয়ামত দিয়েছেন, তার জন্যে প্রশংসার যােগ্য। সর্বপ্রথম যে নেয়ামত দিয়েছেন তা হলাে, বান্দাদের আল্লাহর মনােনীত জীবন বিধানের শিক্ষা দান করেছেন। ‘আর আল্লাহর মনােনীত বান্দাদের ওপর সালাম।’ কেননা তারা তাঁর বাণী ও বিধান বহন করে এনেছেন এবং তার দাওয়াত প্রচার করেছেন।
*বিবেকের দরজায় কোরআনের কষাঘাত : এই প্রাথমিক বক্তব্যের পর আল্লাহর নিদর্শনাবলী প্রত্যাখ্যানকারীদের চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটানাের উদ্দেশ্যে তাদের কাছে একটা প্রশ্ন রাখা হচ্ছে। প্রশ্নটা এমন যে, তার জবাবে তথাকথিত এসব দেব দেবী ও মূর্তিকে আল্লাহর সাথে শরীক কার বিপক্ষে মত দেয়া ছাড়া আর কোনাে উপায় থাকে না। প্রশ্নটা হলো, ‘আল্লাহ উত্তম- না যাদেরকে তারা শরীক করে তারা উত্তম?’ তারা যাদের শরীক করে তারা অবশ্যই দেব দেবী বা মূর্তি, ফেরেশতা কিংবা জ্বিন অথবা আল্লাহর কোনাে না কোনাে সৃষ্টি, আর এ কথা কোনাে বিবেকবান মানুষের কল্পনায়ও আসতে পারে না যে, আল্লাহর কোনাে সৃষ্টি আল্লাহর সদৃশ সমকক্ষ বা সমতুল্য হতে পারে, আল্লাহর চেয়ে উত্তম হওয়ার তাে প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্নের আকারে করা হলেও আসলে এটা প্রশ্ন নয়, নিছক ধমক ও শাসানি মাত্র। কেননা প্রকৃত অর্থে আল্লাহ তায়ালা উত্তম না অন্য কেউ উত্তম এ বিষয়টা নিয়ে কারাে কাছে প্রশ্ন করাই চলে না এবং এর কোনাে জবাবের আশাও করা যায় না। এ কারণেই এ প্রশ্নের পর পুনরায় এমন একটা প্রশ্ন করা হয়েছে, যা মানুষের আশেপাশে বিদ্যমান এবং সদা দৃশ্যমান বাস্তব প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর ভিত্তিতে করা হয়েছে। প্রশ্নটা হলো, ‘তিনিই কি উত্তম নন, যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন…'(আয়াত ৬০) আকাশ ও পৃথিবী এমন এক প্রতিষ্ঠিত সত্য, যার অস্তিত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে না, কিংবা কেউ এ দাবীও করতে পারে না যে, কথিত দেব-দেবী, মূর্তি, ফেরেশতা, শয়তান এদের কেউ, সূর্য চন্দ্র কিংবা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্ট করেছে। জাজ্জল্যমান বাস্তবতাই এ দাবী সজোরে প্রত্যাখ্যান করছে। মােশরেকদের কেউ দাবী করতে না যে, এই বিশ্বজগত আপনা থেকেই সৃজিত হয়েছে, যেমনটি সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলােতে কিছুলােক দাবী করেছে। তাই সে সময়ে শুধুমাত্র আকাশ ও পৃথিবীর অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়া এবং এ দুটো কে সৃষ্টি করলাে, সেটা ভেবে দেখার প্রতি মনােযােগ আকর্ষণ করাই শিরেকের ধারণা বাতিল সাব্যস্ত করার ও মােশরেকদের লা-জবাব করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিলাে। এ প্রশ্ন আজও বহাল রয়েছে। কেননা আকাশ ও পৃথিবীর দিকে তাকালেই বুঝা যায়, এ দুটো বস্তু সুপরিকল্পিতভাবে এবং পরিপূর্ণ সমন্বয় ও ভারসাম্য সহকারে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ধরনের সৃষ্টি কখনাে কাকতালীয় ও আকস্মিক হতে পারে । তাই এ কথা স্বীকার না করেই পারা যায় না যে, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা এক অদ্বিতীয়। তার একত্ব তার এ সব সৃষ্টি দ্বারাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। এটাও প্রমাণিত যে, গোটা সৃষ্টি জগতের জন্যে একটাই সুসমন্বিত রূপরেখা ছিলাে। সে রূপরেখার প্রকৃতিও ছিলাে এক এবং উদ্দেশ্য লক্ষ্যও অভিন্ন। তাই অনিবার্যভাবেই এই রূপরেখা ও সৃষ্টি একই ইচ্ছে, একই সিদ্ধান্ত ও একই পরিকল্পনার ফল না হয়ে পারে না। ছােট কিংবা বড় সকল সৃষ্টিতেই সেই একই সত্ত্বার সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছা সক্রিয়। আয়াতে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রসংগের পরেই এসেছে আকাশ থেকে পানি বর্ষণের বিষয়টি। এটাও এক চাক্ষুষ সত্য। কোনােভাবেই এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে, একজন অতীব সুদক্ষ সুনিপুণ স্রষ্টা রয়েছেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে তার নিজের তৈরী এমন এক প্রাকৃতিক নিয়ম ও বিধি মােতাবেক সৃষ্টি করেছেন, যে নিয়ম ও বিধি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণকেও অনুমােদন করে, শুধু বৃষ্টি বর্ষণকেই অনুমােদন করে না, বরং যেভাবে ও যে পরিমাণ বৃষ্টি বর্ষিত হলে এখানে বর্তমানের মতাে জীবনের সমারােহ ঘটতে পারে, সেভাবে ও সে পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষণ অনুমােদন করে। কাজেই এসব কিছু অপরিকল্পিতভাবে ও আকস্মিকভাবে হওয়া সম্ভব নয়। আকস্মিক ঘটনাবলী কখনাে এতাে সুশৃংখল, সুপরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে হয় না, যা যাবতীয় প্রাণীর বিশেষত মানুষের প্রয়ােজন ও চাহিদা পূরণ করে। এ বিষয়টাই কোরআনে ‘তােমাদের জন্যে পানি বর্ষণ করেছেন’ এই কথাটা দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। জাতির জীবন ধারণে ও তাদের জীবনের চাহিদা পূরণে এই বৃষ্টির কি কি অবদান ও উপকারিতা রয়েছে তার উল্লেখ করে বলা হয়েছে। যদিও তারা সেসব উপকারিতা সম্পর্কে চিন্তা করে না। আয়াতের পরবর্তী অংশে বৃষ্টির উপকারিতার উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, ‘অতঃপর তা দ্বারা আমি নয়নাভিরাম বাগানসমূহ উদ্গত করেছি…’ অর্থাৎ সুন্দর, আনন্দোদ্দীপক, তরতাজা বাগানসমূহ। বাগানের দৃশ্য দেখলেই মনে আনন্দ, সজীবতা ও উল্লাস সঞ্চারিত হয়। এই তরতাজা ও নয়নাভিরাম বাগানের সৌন্দর্যের কথা চিন্তা করাই মনকে উজ্জীবিত করার জন্যে যথেষ্ট। বাগানে যে অভিনব সৃষ্টির নিদর্শন বিরাজ করে, তা দেখলে এই বিস্ময়কর সৌন্দর্যের মহান স্রষ্টার প্রশংসা না করে পারা যায় না। বাগানে যে লক্ষ লক্ষ ফুল ফোটে, সমগ্র মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম কারিগর তার যে কোনাে একটা ফুল তৈরী করতে সক্ষম হবে কি? একটা ফুলের ভেতরে যে রকমারি রংয়ের ব্যঞ্জনা, রেখার বৈচিত্র্য ও ছােট বড় পাপড়ির সমন্বয় দেখা যায়, তা এতাে বড় অলৌকিক ব্যাপার যে, প্রাচীন ও আধুনিক শিল্পের সর্বোচ্চ দক্ষতা নৈপুণ্য প্রয়ােগ করেও তা করা সম্ভব নয়। আর উদ্ভিদের প্রাণের ক্রমবিকাশ তাে সবচেয়ে বড় রহস্য। এ রহস্য উদঘাটন করা আজও মানুষের সাধ্যাতীতই রয়ে গেছে। এ কথাই আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, ‘বাগানের গাছপালা উৎপাদন তােমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’ বস্তুত মানুষ, জীবজন্তু কিংবা উদ্ভিদ কোনটারই জীবন রহস্যের কূল কিনারা মানুষ এখনাে করতে পারেনি। এখনাে পর্যন্ত কেউ বলতে পারে না যে, এই জীবনের আবির্ভাব কিভাবে ঘটেছে এবং কিভাবেই বা তা উদ্ভিদ, জীবজন্তু বা মানুষের দেহের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য জানতে হলে দৃশ্যমান এই জগতের বাইরের কোনো উৎসের কাছেই ধর্ণা দিতে হবে। নয়নাভিরাম সুন্দর এসব বাগানে বিকাশমান জীবনের সামনে থমকে দাঁড়ানাে মানুষের মনে যখন চিন্তার উদ্রেক হয়, তখনই তার কাছে প্রশ্ন তােলা হয়, আল্লাহর সাথে আর কি কোনাে মাবুদ আছে যেহেতু মাবুদ আছে বলে দাবী করার কোনাে অবকাশ নেই, তাই আর কোনাে মাবুদ নেই, এই মর্মে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় থাকে না। আর এই পর্যায়ে মােশরেকরা পড়ে যায় দোটানা অবস্থায়। একদিকে যুক্তিতে হেরে গিয়ে স্বীকার করতে হয় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই। অপরদিকে অন্যান্য দেব দেবী ও উপাস্যদের আল্লাহর সমকক্ষ মেনে নিয়ে তাদের আল্লাহর মতােই পূজা উপাসনা করতে থাকে। বরঞ্চ তারা এমন এক মানব গোষ্ঠী, যারা অন্যদের আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে। ‘ইয়াদিলুন’ শব্দের দুটো অর্থ হতে পারে। প্রথমত. তারা দেব-দেবীকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে। দ্বিতীয়ত. তারা সরে দাঁড়ায়। অর্থাৎ সৃষ্টির কৃতিত্বে আল্লাহর সাথে অন্য কেউ অংশীদার ছিলাে না এ কথা জেনে বুঝেও উপাসনা আনুগত্যে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করার মাধ্যমে তারা সুস্পষ্ট সত্য থেকে দূরে সরে যায়। উভয়টাই অন্যায় ও ভুল কাজ। এরপর আরাে একটা জাগতিক সত্যের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে, ‘অথবা তিনিই কি উত্তম নন, যিনি পৃথিবীকে স্থিতিশীল করেছেন, তার ভেতরে নদ নদী সৃষ্টি করেছেন’ প্রথম জাগতিক সত্যটা ছিলাে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি। আর এ আয়াতে যে সত্যটা তুলে ধরা হয়েছে তা হলাে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পরবর্তী অবস্থা। এটাকে আল্লাহ তায়ালা জীবন যাপনের, জীবন ধারণের, জীবন বিকশিত হওয়ার ও জীবের বংশ বৃদ্ধির উপযােগী করে সৃষ্টি করেছেন। সূর্য ও চন্দ্র থেকে পৃথিবীর দূরত্ব এখন যতােটুকু আছে, তার চেয়ে যদি বেশী বা কম হতাে, পৃথিবীর আয়তন বা আকৃতি যদি ভিন্ন রকমের হতাে, এর উপাদান ও পরিবেশ যদি পাল্টে যেতাে, এর আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতি যদি অন্য রকমের হতাে, অথবা এর চারপাশে চন্দ্রের আবর্তনের গতি যদি অন্য রকমের হতাে, বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলাে যদি বিন্দুমাত্রও পাল্টে যেতাে, তাহলে পৃথিবী জীবন ধারণের যােগ্য থাকতাে না। ‘অথবা তিনিই কি উত্তম নন যিনি পৃথিবীকে স্থিতিশীল বানিয়েছেন’ আল্লাহর এই উক্তি থেকে এতােসব বিস্ময়কর তত্ত্ব তথ্য হয়তাে বা সেকালের শ্রোতারা বুঝতে পারতাে না, তবে তারা মােটামুটিভাবে দেখতো যে, পৃথিবী প্রাণীদের জীবন ধারণের যােগ্য। আর তারা এমন দাবীও কখনাে করতে পারতাে না যে, তাদের কোনাে দেব-দেবী বা মূর্তি পৃথিবীকে এমন সুন্দরভাবে সৃষ্টি করার কাজে অংশগ্রহণ করেছে। এটুকুই তাদের জন্যে যথেষ্ট ছিলাে। এরপর আয়াতের মর্ম বিশ্লেষণের দরজা পরবর্তী প্রজন্মগুলাের জন্যে উন্মুক্ত রয়েছে। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যতাে প্রসার ঘটবে, মানুষ এর নিত্য-নতুন তাৎপর্য উপলব্ধি করতে থাকবে যুগ যুগ ধরে। এটাই কোরআনের অলৌকিকত্ব যে, সে সকল যুগের সকল পর্যায়ের বিবেকবুদ্ধিকে সম্বােধন করে কথা বলে। পৃথিবীতে নদ নদী হচ্ছে জীবদেহে ধমনী সদৃশ। পূর্ব দিকে, পশ্চিম দিকে, উত্তর দিকে ও দক্ষিণ দিকে উর্বরা শক্তি, জীবনী শক্তি ও উন্নয়নের প্রাণপ্রবাহ নিয়ে ক্রমাগত বয়ে চলেছে এই সব নদ নদী। ভূ-প্রকৃতি অনুসারে বৃষ্টির সঞ্চিত পানি যেদিকে স্বাভাবিকভাবে গড়ায়, সেদিকেই নদীর সৃষ্টি হয়। বিশ্ব স্ৰষ্টা আল্লাহ তায়ালা নিজেই মেঘমালা সৃষ্টি, বৃষ্টি বর্ষণ ও নদ নদী প্রবাহের পরিকল্পনা তৈরী করেন। কেউ বলতে পারে না যে, দক্ষ স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ এই জগত সৃষ্টিতে কোনােভাবে অংশগ্রহণ করেছে। নদ নদীর প্রবাহ এমন এক দেদীপ্যমান বাস্তবতা, যা মােশরেকরাও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে থাকে। এই বাস্তবতা কে সৃষ্টি করলাে? আল্লাহর সাথে আর কোনাে উপাস্য আছে কি? ‘রাওয়াসী’ অর্থ পাহাড় পর্বত, যা পৃথিবীর ওপর স্থির ও স্থিতিশীল হয়ে বিদ্যমান। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই পাহাড় পর্বতই নদ নদীর উৎস। বৃষ্টির পানি এখান থেকেই সমতল ভূমিতে গড়িয়ে যায়। এই পানি পর্বতের চূড়া থেকে প্রবল শক্তি নিয়ে নেমে আসার মাধ্যমে মাটিতে খাদ কেটে এগিয়ে যায়। এখানে কোরআন যে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট তুলে ধরেছে, সে দৃশ্যপটে প্রবহমান নদ নদীর বিপরীতে রয়েছে পাহাড় পর্বত। এরূপ দৃশ্যপটগত বৈপরীত্য উপস্থাপনই কোরআনের স্থায়ী রীতি। এখানেও সেই রীতিই প্রতিফলিত হয়েছে। এ জন্যেই নদ নদীর পর পাহাড় পর্বতের। উল্লেখ করা হয়েছে। আর দুই সাগরের মাঝে তিনি অন্তরায় বানিয়েছেন। একটা লবণাক্ত সাগর এবং একটা মিষ্টি পানির নদী। দুটোই জলাশয় বিধায় দুটোর মধ্যে যেটি বৃহত্তর, সেটিকে প্রাধান্য দিয়ে উভয়কে একত্রে দুই সাগর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্তরায়’ দ্বারা প্রধানত প্রাকৃতিক অন্তরায় বুঝানাে হয়েছে, যার কারণে সমুদ্রের পানি নদীতে প্রবাহিত হয় না। কেননা নদী-পৃষ্ঠ সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতর । এটাই উভয়ের পানিকে আলাদা করে রেখেছে। অথচ সাধারণ নিয়মে নদীর পানি সমুদ্রেই গড়ায়। সমুদ্রের পানি কখনাে নদীতে গড়ায় না, এমনকি নদী-পৃষ্ঠ সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে নীচু হলেও নয়। যে কারণেই হােক না কেন, নদী ও সমুদ্রের পানির ঘনত্বের প্রকৃতি থেকেই এই অন্তরায় সৃষ্টি হয় ও বহাল থাকে। কেননা নদীর পানি। হালকা ও সমুদ্রের পানি ভারী হওয়ায় উভয়ের স্রোতধারা পৃথক থাকে, পরস্পর মিশ্রিত হয় না এবং একটা অন্যটার ওপর চড়াও হয় না। এটা পৃথিবীতে চালু আল্লাহর প্রাকৃতিক নিয়ম ও তার সূক্ষ্ম পরিকল্পনারই অংশবিশেষ। কিন্তু কে করে এ সব? আল্লাহর সাথে আর কেউ কি আছে এ সব কৃতিত্বের অংশীদার। এসব কৃতিত্বের দাবী আর কেউ করতে পারে না। কেননা সমগ্র সৃষ্টি জগতের পরিকল্পনা ও নকশার যে ঐক্য অডিন্নতা আমাদের সামনে বিদ্যমান, তা আমাদের স্রষ্টার একত্ব মেনে নিতে বাধ্য করে, বরং তাদের অধিকাংশেরই জ্ঞান নেই। এখানে জ্ঞানের উল্লেখের কারণ এই যে, এই প্রকৃতির তথ্য সম্পর্কে জ্ঞান অত্যাবশ্যক, যাতে সৃষ্টির সমন্বয়, নৈপুণ্য ও প্রাকৃতিক নিয়ম বিধি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা যায়। তা ছাড়া আমি আগেই বলেছি যে, সূরা নমলের কেন্দ্রীয় বিষয়ই হলাে এলেম বা জ্ঞান। এরপর আলােচনার ধারা প্রাকৃতিক দৃশ্যসমূহ থেকে মানুষের স্বভাব প্রকৃতির দিকে স্থানান্তরিত হচ্ছে, বিপন্ন মানুষ যখন ফরিয়াদ করে, তখন যিনি ফরিয়াদ শোনেন, বিপদ দূর করেন এবং তােমাদের পৃথিবীর প্রতিনিধি বানান, তিনিই কি ভালাে নন? আল্লাহর সাথে কি আর কোনো মাবুদ আছে? তােমরা খুব কমই স্মরণ করে থাকো। (আয়াত ৬২) এখানে মানুষের আবেগকে স্পর্শ করা হয়েছে এবং মানুষের মনের বিচিত্র ধ্যান ধারণা ও তার বাস্তব অবস্থা স্মরণ করানাে হয়েছে। যে ব্যক্তি কঠিন সমস্যা সংকটে পতিত হয়, সে তার অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠার মুহূর্তে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে সহায় হিসেবে পায় না। তাই দুর্যোগ থেকে উদ্ধারের জন্যে সে আল্লাহকে ডাকে। মানুষ কঠিন বিপদে পড়ে যখন চারদিকে তাকায়, তখন তার নিজের হাতেও কোনাে ক্ষমতা দেখতে পায় না আর উদ্ধার পাওয়ার কোনাে উপায় উপকরণ বা সাহায্য সহযােগিতারও সাক্ষাত পায় না। বিপদের সময় যে যে স্থান থেকে সাহায্য পাবে বলে ধারণা করেছিলাে তার সবই উধাও হয়ে যায়। এরূপ পরিস্থিতিতেই তার বিবেক জেগে ওঠে। সাহায্য করা ও উদ্ধার করার ক্ষমতাসম্পন্ন একমাত্র সত্তা মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে, যদিও ইতিপূর্বে সুখের সময় তাঁকে ভুলে থাকে। তার মনে পড়ে যায় যে, তিনিই তাে আর্তের ফরিয়াদ শ্রবণকারী, তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারকারী ও তার সুখ শান্তি পুনর্বহালকারী একমাত্র সত্ত্বা। সুখের সময় মানুষ এ সত্য ভুলে থাকে। তাই দুর্বল ও অক্ষম পার্থিব শক্তিগুলাের কাছে সে শক্তি, সাহায্য ও নিরাপত্তা চাইতে থাকে, কিন্তু যখন কঠিন মসিবতে পড়ে দিশেহারা হয়ে যায়, তখন তার বিবেক থেকে উদাসীনতা ও শৈথিল্যের পর্দা ওঠে যায় এবং মহান আল্লাহর শরণাপন্ন হয়। পূর্বে যত শৈথিল্য ও উদাসীনতাই থাক, তা সে ঝেড়ে ফেলে। কোরআন দাম্ভিক অবিশ্বাসীদের বিবেককে এই সত্য সম্পর্কে সজাগ করে তােলে। এ সত্য তাদের অন্তরে সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে। সে তার সামনে প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক ও জাগতিক দৃশ্যগুলাে তুলে ধরে, যথা, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি, আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ, চোখ জুড়ানাে ও মন মাতানাে বাগ বাগিচা জন্মানাে, পৃথিবীকে পাহাড় পর্বত দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিশীল করা, নদ নদী ও সমুদ্র প্রবাহিত করা এবং দুই সাগরের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করা। এ সব দৃশ্যের সাথে আল্লাহর কাছে বিপন্ন মানুষের ফরিয়াদ জানানাে ও একমাত্র আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তার ফরিয়াদ শ্রবণের সাদৃশ্য রয়েছে। প্রথমােক্ত বিষয়গুলাে জাগতিক আর শেষােক্তগুলাে মানসিক, এই যা পার্থক্য। এরপরে জীবনের অন্যান্য বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের আবেগকে উদ্দীপিত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘আর তিনি তােমাদের পৃথিবীর প্রতিনিধি বানান।’ কে তাদের পৃথিবীর প্রতিনিধি বানায়, তিনি কি একমাত্র আল্লাহ তায়ালা নন, যিনি তাদের পূর্ববর্তীদের প্রথমে প্রতিনিধি বানিয়েছিলেন। তারপর এক প্রজন্মের পর আর এক প্রজন্মকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। পৃথিবীর রাজত্ব পরিচালনায় তাদের এক দল আরেক দলের স্থলাভিষিক্ত হয়। এ ব্যবস্থা কি আল্লাহ করেন না? তিনি কি একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই নন, যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তারই রচিত সেসব প্রাকৃতিক নিয়ম বিধি অনুসারে সৃষ্টি করেছেন, যার ভিত্তিতে পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা ও বসবাসের অবকাশ জন্মে? তিনিই তাদের সেসব শক্তি, ক্ষমতা ও যােগ্যতা দিয়েছেন, যা তাদের পৃথিবীতে খলিফা বা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তােলে। যে সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম পৃথিবীকে মানুষের জন্যে বসবাসযােগ্য বানায়, গােটা বিশ্বজগতকে সুসমন্বিত করে এবং এতে জীবন যাপনের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তােলে, সেগুলােই মানুষকে তার এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনেরও ক্ষমতা যােগায়। এই বিশ্বজগতকে সুসম করার জন্যে প্রয়ােজনীয় বহুসংখ্যক শর্তের মধ্য থেকে কোনাে একটা শর্তও যদি উধাও হয়ে যেতাে, তাহলে এ পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে পড়তাে।(সূরা ফোরকানের ২ নং আয়াতের শেষাংশের তাফসীর দেখুন) সর্বশেষ বিবেচ্য বিষয় এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই কি জীবন ও মৃত্যুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না এবং এক প্রঞ্জনাকে আরেক প্রজন্মের উত্তরাধিকারী করেন না? পূর্ববর্তী প্রজন্মের লােকেরা যদি সবাই বেঁচে থাকতাে, তাহলে পরবর্তী ও পূর্ববর্তীদের একত্রে বসবাস করার জন্যে পৃথিবীতে স্থান সংকুলান হওয়া কঠিন হতাে এবং জীবন, সভ্যতা ও চিন্তার গতি শ্লথ হয়ে যেতাে। কেননা নতুন নতুন প্রজন্মের আনাগােনাই চিন্তা, অভিজ্ঞতা, চেষ্টা সাধনা ও জীবন যাপন পদ্ধতিতে গতি সঞ্চার করে, নতুনত্ব আনে। এক প্রজন্মের তিরােধানে আরেক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটার কারণেই প্রাচীন ও নবাগতদের মধ্যে কোনাে বাস্তব সংঘাত ছাড়াই চিন্তা, কর্ম ও জীবন পদ্ধতিতে দ্রুততা এবং নতুনত্ব আসে। যা কিছু সংঘাত ঘটে তা কেবল চিন্তা ও অনুভূতির জগতেই ঘটে প্রাচীন মানুষেরা যদি বেঁচে থাকতাে,তাহলে প্রকাশ্যে ও বড় আকারে সংঘাত ঘটতো এবং জীবনের অগ্রযাত্রা থেমে যেতাে [{ মানুষের বয়স বাড়ানাের জন্যে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কিন্তু চেষ্টার কোনো শেষ নেই। এক শ্রেণীর বিজ্ঞানী মনে করেন, মানুষের ডিএনএ’ থেকে বয়স বাড়া সংক্রান্ত ‘জিন’কে যদি মডিফাই করা যায়, তাহলে অনায়াসেই একজন মানুষের গড়পড়তা বয়স ৭৫ থেকে (ইউরােপের হিসাব অনুযায়ী) বাড়িয়ে তা ১২৫ কিংবা ১৫০ করা সম্ভব, কিন্তু সমস্যা দাঁড়িয়েছে সমাজবিজ্ঞানীদের একটি মারাত্মক আশঙ্কা নিয়ে। সমাজ বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানুষের বয়স বাড়ানাে হলে মানব জাতির গােটা অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে যাবে। কেননা, একজন মানুষের স্বাভাবিক কর্ম ক্ষমতা (ইউরােপে সে সীমা ৬৫-৭৫) বাড়ানাের কিন্তু কোনাে উপায় নেই। হিউম্যান ডিএনএ-তে মানবীয় কর্মক্ষতা সংক্রান্ত জিনস’গুলাে এ সীমা পর্যন্তই বাঁচে। তাই তারা মনে কৱেন, বয়েস বাড়ানাের পর (অবশ্য যদিও এটা অবাস্তব বিলাস স্বপ্ন) কি হবে, তার জীবনের বাকী ৭৫ বছর অকর্মণ্য জীবনকে সমাজের বাকী অংশ কি এমনি এমনি লালন পালন করবে? বুড়ােদের নিয়ে ইউরোপ আমেরিকার মানুষগুলাে এমনিই ভীষণ সমস্যায় আছে। একমাত্র গ্রেট বৃটেনেই প্রতি ৩ জন মানুষের একজন হচ্ছে পেনশনভােগী বুড়ো। আগামী শতকে এই হার ৫০: ৫০ হয়ে যাবে বলে অনেকেই আশংকা প্রকাশ করছেন। বয়স বাড়ানাের এই অসাধ্য কাজটি কোনাে দিন যদি সফল হয়ও, এর ফলে নিসন্দেহে আমাদের গােটা সমাজ ব্যবস্থা ভেংগে খান খান হয়ে যাবে, সমাজে কর্মক্ষম মানুষ যখন আর পাওয়া যাবে না, যখন গােটা জনশক্তি, অর্ধেক অংশ শুধু একটি পেটসর্বস্ব জীবে পরিণত হবে, তখন পুনরায় এতে ‘ব্যালেন্স’ আনার জন্যে সেই রোমান শাসক নিরাে-র মতাে বিপুল পরিমাণ ‘মৃত্যুশালা’ বানাতে হবে, এক পর্যায়ে পৃথিবীর সব বুড়ােগুলােকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে এই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা স্বীকার করুন আর নাই করুন। আল্লাহ তায়ালার স্বাভাবিক এই জীবন মৃত্যুর পদ্ধতিই হচ্ছে সমাজের একমাত্র জীয়ন-কাঠি। আল্লাহ তায়ালা যিনি মানুষদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি ভালাে করেই জানেন, একজন মানুষের কতােদিন পর্যন্ত কর্মক্ষমতা অবশিষ্ট থাকবে এবং কতােদিন তার এই দুনিয়ার কর্মশালায় বেঁচে থাকা দরকার।-সম্পাদক}] এ সত্যগুলাে মানসিক এবং সে সত্যগুলাে জাগতিক। কে এই সত্যগুলাের আবির্ভাব ঘটালাে? আল্লাহ ছাড়া কি আর কেউ? মানুষ ভুলে যায়। অথচ এ সত্যগুলাে তাদের মনে সুপ্ত এবং বাস্তব জীবনে দৃশ্যমান থাকে। তোমরা খুব কমই স্মরণ করে থাকো। মানুষ যদি এ সব সত্য মনে রাখতাে এবং চিন্তা গবেষণা করতাে, তাহলে আল্লাহর সাথে তার স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠতাে, তার সম্পর্কে সে উদাসীন হতাে না এবং তার সাথে কাউকে শরীক করতাে না। এরপর আরাে কয়েকটা অনস্বীকার্য সত্য নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে, ‘তিনিই কি উত্তম নন, যিনি জল ও স্থলের অন্ধকারে তােমাদের পথ দেখান?…'(আয়াত ৬৩) কোরআন নাযিল হবার সমকালীন লােকেরা সহ সাধারণ মানুষ পর্যটনকালে জল ও স্থল দিয়ে চলাচলের নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করতাে। কে তাদের পথ প্রদর্শন করতাে? তাদের কে বােধশক্তি দান করেছে? কে তাদের নক্ষত্র, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য নিদর্শনাবলী দ্বারা গন্তব্য পথের সন্ধান লাভের যােগ্যতা দিয়েছে। তাদের স্বভাব প্রকৃতিকে সৃষ্টি জগতের স্বভাব প্রকৃতির সাথে সংগতিশীল করেছে কে? কে তাদের প্রকৃতির রহস্য অনুধাবনের যােগ্যতা দান করেছে? কানকে শোনার, চোখকে দেখার এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে অনুভব করার শক্তি কে দিয়েছে। অতপর এসব অংগ প্রত্যংগ দ্বারা উপকৃত হওয়া ও এগুলাের অর্জিত অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যে বুদ্ধি বা বিবেক নামক বস্তুটি কে সৃষ্টি করেছে। তিনি কি আল্লাহর সহযােগী কেউ? না স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা? ‘আর যিনি বাতাসকে তার করুণার বার্তাবহ হিসেবে পাঠান’ বাতাসের কারণ ও উপাদান সম্পর্কে যা কিছুই বলা হােক না কেন, তা আসলে আদি মহাজাগতিক পরিকল্পনারই আওতাধীন। সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই তা চলাচল করে, মেঘমালাকে বহন করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যায় আল্লাহর করুণাবাহী বৃষ্টির সুসংবাদ দেয়। বস্তুত এই বৃষ্টিই জীবনের উপাদান। কে এ বিশ্বজগত ও এই বাতাস এভাবে সৃষ্টি করেছেন? তিনি কি আল্লাহর কোনাে সহযােগী, না স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা?
*পুনরুত্থান প্রথম সৃষ্টিরই অনিবার্য দাবী : সর্বশেষে যে প্রশ্ন রাখা হয়েছে তা মানুষের সৃষ্টি, আখেরাতে তার পুনরুথান এবং আকাশ ও পৃথিবী থেকে তার জীবিকার সংস্থান সংক্রান্ত। শুধু প্রশ্ন নয়, এই সাথে চ্যালেঞ্জও দেয়া হয়েছে, ‘তিনি কি উত্তম নন, যিনি সৃষ্টির সূচনা ও পুন সৃষ্টি করেন।'(আয়াত ৬৪) প্রথম সৃষ্টি একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না এবং আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ব মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনােভাবে এর ব্যাখ্যা দেয়াও সম্ভব নয়। আল্লাহর অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। কারণ এ বিশ্বজগতের অস্তিত্বই আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করে। এ বিশ্ব জগত যে একটা সুপরিকল্পিত সৃষ্টি, তা এর দিকে তাকালেই স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। আর এ ধরনের একটা সুপরিকল্পিত সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের উৎস বা কারণ দর্শানাের জন্যে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে অন্য কোনাে ব্যাখ্যা দেয়ার যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। আল্লাহর একত্বও অনস্বীকার্য। কেননা এ বিশ্বজগতে আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্যের যে নিদর্শনগুলাে বিদ্যমান, সেগুলােই আল্লাহর একত্ব মেনে নিতে বাধ্য করে। এ বিশ্বজগতের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা- দুটোই যে একই প্রকৃতির, আর এর পরিপূর্ণ ও সর্বাত্মক সময় যে একই প্রাকৃতিক নিয়ম এবং একই সিদ্ধান্তের প্রতীক, তা থেকেই অকাটাভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টাও একক সত্ত্বা। এরপর আসে আখেরাতের পুনরুত্থানের প্রসংগ। এ বিষয়টা নিয়ে মােশরেকরা তর্কে লিপ্ত হতাে, কিন্তু প্রথম সৃষ্টিকে সত্য মেনে নিলে পুন সৃষ্টির সত্যতা স্বীকার করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। কেননা এভাবেই মানুষ ক্ষণস্থায়ী জগতে কত যাবতীয় কর্মের সঠিক প্রতিফল লাভ করতে পারে। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে পরিপূর্ণ কর্মফল পাওয়া সম্ভব নয়, হয়তাে বা আংশিক ফল কখনাে কখনাে পাওয়া যেতে পারে। এই বিশ্বজগতে যে সর্বাত্মক সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়, এখানে কৃতকর্ম ও কর্মফলের মধ্যেও সেই সর্বাত্মক সমন্বয় থাকা অপরিহার্য। অথচ এটা দুনিয়ার জীবনে সংঘটিত হয় না। তাই অন্য একটা জীবনকে সত্য মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেখানে পরিপূর্ণ সমন্বয় বিরাজ করবে। এই পৃথিবীতে কর্ম ও কর্মফলের মাঝে সেই পরিপূর্ণ সমন্বয় কেন সংঘটিত হয় না সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এর জবাব এই যে, এর প্রকৃত রহস্য মহান সৃষ্টিকর্তাই ভালাে জানেন। এটা এমন এক অজানা রহস্য, যা তিনি কাউকে জানাননি। প্রথম সৃষ্টি স্বীকার করলে দ্বিতীয় বা পুনসৃষ্টি মেনে নেয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় বলেই ৬৪ নং আয়াতে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, এই সৃষ্টি ও পুন সৃষ্টি কি আল্লাহর কোনাে সহযােগীর কৃতিত্ব, না স্বয়ং আল্লাহর? আকাশ ও পৃথিবী থেকে মানুষের পূরণ করার যা কিছু আসে সেগুলাে যেমনি আসে তেমনি আবার ফিরেও যায়। মানুষ তার প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী পৃথিবীর জীবজন্তু, গাছ পালা, পানি ও বাতাস থেকে সংগ্রহ করে এবং এগুলােকে সে নানাভাবে ব্যবহার করে; খাদ্য, পানীয়, শ্বাস প্রশ্বাস ইত্যাদির কাজে সে এগুলাে লাগায়। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর পেটের মধ্য থেকে সংগৃহীত সম্পদ, খনিজ দ্রব্য, ধাতব পদার্থ, সামুদ্রিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে খাদ্য-সামগ্রী এবং নানা প্রকার সৌন্দর্যের বস্তু; রয়েছে বিস্ময়কর চুম্বক শক্তিসম্পন্ন বস্তু ও বৈদুত্যিক সরঞ্জামাদি। এমনিভাবে মানুষের জন্যে আল্লাহর দেয়া আরও অনেক প্রকার দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে, যা এখনও মানুষের জ্ঞানের পরিধির মধ্যে ধরা পড়েনি- আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ সেগুলাে সম্পর্কে কিছু জানেও না। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে নতুন নতুন বন্ধু যখন মানুষের জ্ঞান-গবেষণায় ধরা পড়ে এবং সেগুলাে ব্যবহার করে যখন মানুষ অপূর্ব আনন্দ পায়, তখন তার বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না। আর পার্থিব জীবনে ব্যবহার্য মানুষের প্রয়ােজনীয় নানা উপকরণ, যেগুলাে আকাশ থেকে আসে, সেগুলাের মধ্যে রয়েছে আলাে-তাপ, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ ও মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা বহু প্রকার শক্তি। আখেরাতের যিন্দেগীর জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ব্যবস্থা করে রেখেছেন তাঁর মহাদান যা তাদের চেষ্টা সাধনা ও সৎ কর্মের পুরস্কার আকারে আসবে। যে বিষয়ে কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং এগুলােই আকাশ থেকে আসবে বলে বুঝানাে হয়েছে। এটা হচ্ছে কোনাে কিছুকে উর্ধ্বে তোলা ও মহান বানানাের একটা প্রক্রিয়া। শুরু করা ও ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলার পর উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাদের রিযিক আসে আসমান ও যমীন থেকে, কারণ আকাশ ও পৃথিবী থেকে আগত দ্রব্য সম্ভারের সাথে শুরু হওয়া ও ফিরে যাওয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পৃথিবীর রিযিক (দ্রব্য সামগ্রী)-এর শুরুর সাথে সম্পর্ক কিভাবে রয়েছে তা মানুষের জানা আছে, কারণ এই জীবন ধারণ সামগ্রী নিয়েই তাে মানুষ জীবন যাপন করে। আখেরাতের সাথে তার (জীবন ধারণের যাবতীয় সামগ্রীর) সম্পর্ক এভাবে যে, পার্থিব জীবনে এসব সামগ্রী লাভ করার পর মানুষ যেভাবে এগুলাে ব্যবহার করবে, সেভাবে সে আখেরাতের জীবনে তার বিনিময় পাবে। আকাশ থেকে প্রাপ্ত্য দ্রব্য সামগ্ৰীর সম্পর্ক সৃষ্টির শুরুর সাথে কিভাবে রয়েছে তা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। কারণ সেগুলােও দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়ােজন এবং তার সঠিক ব্যবহারের ফল মানুষ (দুনিয়াতে পাওয়ার সাথে সাথে) আখেরাতেও পাবে। আল কোরআনে এসব প্রসংগে অত্যন্ত চমৎকার ভাবে আলােচনা এসেছে। যে কোনাে জিনিসের প্রারম্ভ ও পরিশেষে তার প্রত্যাবর্তন একটা বাস্তব সত্য, একইভাবে আকাশ ও পৃথিবী থেকে আগত জীবন সামগ্রীও এক বাস্তব সত্য; কিন্তু এ সত্য সাধারণভাবে মানুষ বুঝতে চায় না, যার কারণে আল কোরআন তীব্র ভাষায় তাদের এই উদাসীনতার সমালােচনা করেছে এবং তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে বলছে, আছে কি আল্লাহর সাথে অন্য কোনাে সর্বশক্তিমান? তাদের বলাে (হে রসূল), এ বিষয়ে তােমরা কোনাে দলীল প্রমাণ নিয়ে এসাে যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকে। কিন্তু ওরা অবশ্যই তাদের দাবীর সপক্ষে কোনাে প্রমাণ পেশ করতে পারবে না, এ পর্যন্তও পারেনি। আকীদা সম্পর্কে যুক্তি পেশ করার এই হচ্ছে আল কোরআনের পদ্ধতি। এই পদ্ধতিই হচ্ছে সৃষ্টির দৃশ্যসমূহ এবং খোদ মানুষের অস্তিত্বের মধ্যে যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সেগুলাে মানুষের সামনে তুলে ধরা, যাতে হৃদয়ের গভীরে মানুষ এসব রহস্য সম্পর্কে অনুভব করতে পারে, মানুষের বিবেককে জাগাতে পারে এবং সুস্পষ্ট যুক্তি সহকারে সে এই সুবিশাল সৃষ্টিলােকের বিস্ময়কর রহস্য অনুধাবন করতে পারে। সর্বোপরি তার চেতনা জাগিয়ে তাকে তার সঠিক কেন্দ্রের দিকে পরিচালিত করতে পারে। আসলে এসব এমনই রহস্য যার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালে মানুষ বহু অজানা বিষয়ের সন্ধান পেতে পারে, কিন্তু মানুষের দুর্বলতা হচ্ছে, সে বিলাসব্যসনে এমনভাবে মজে থাকে যে, গভীরভাবে কোনাে কিছু দেখা বা গভীরভাবে কোনাে কিছু চিন্তা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। যার কারণে তার নযরের ওপর পর্দা পড়ে যায়, সে দেখেও বহু সত্য দেখতে পায় না, এর ফলে সে এসব অস্বীকার করে বসে। এ জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন গােটা বিশ্বকে তার সামনে এক বিশাল পুস্তক হিসেবে হাযির করে দিয়েছেন যা তার অন্তরের নিকট গ্রহণযােগ্য সর্বপ্রকার যুক্তি প্রমাণ পেশ করে, এগুলাে দেখে তার হৃদয়ের গ্রন্থিগুলাে খুলে যায়, বিবেক জেগে ওঠে এবং এগুলাের দিকে একটু খেয়াল করে যখন সে তাকায় তখন তার গােটা সত্ত্বা সচল হয়ে ওঠে, তার মধ্যে পূর্ণ এক আবেগের সৃষ্টি হয়। এমনই এক বিশেষ মুহূর্তে তার সামনে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের রহস্য ভান্ডারের বহু দরজা খুলে যায়, গাফলতির ঘুম তার ভেংগে যায়, তখন আল্লাহর নেয়ামতগুলাে সে আর অস্বীকার করতে পারে না। সত্যের বাতি তার হৃদয়ে জ্বলে ওঠে এবং সে কর্তব্য সচেতন হয়ে ওঠে, এই রহস্যময় মহাবিশ্ব সকল কিছুর ওপর তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাকে আত্মসম্ভ্রমবােধসম্পন্ন আল্লাহর মহান খলীফা হিসাবে গড়ে তােলে। সে তখন তাওহীদের মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি করে।
*গায়বে বিশ্বাস গায়বের ইলম এক নয় : মহান আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠা ও শিরকের কদর্য থেকে বাঁচার লক্ষ্যে, আদিগন্ত পরিব্যাপ্ত রহস্যসমূহের পরিক্রমা এবং অনুসন্ধান কাজ সমাপ্ত করার পর আল্লাহর অনুগত বান্দা পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা অজানা অচেনা আরও অনেক রহস্য জানতে চায়- জানতে চায় সে আখেরাত ও আখিরাতের জীবন সম্পর্কেও। এ জন্যে সে তার সামনে অনুপস্থিত সৃষ্টির সাহায্য নিয়ে মূল ব্যাপারটা বুঝতে চায়, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সীমার উর্ধ্বে সে আর কিছুই বুঝতে পারে না, যেহেতু সেগুলো একমাত্র আল্লাহ আলেমূল গায়েবের জানার বন্ধু, তিনি ছাড়া আর কোনাে সৃষ্টি সে রহস্য ভেদ করতে পারে না, তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে (হে রসূল), আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর বাসিন্দাদের মধ্যে কেউই গায়েবের খবর রাখে। এবং আল্লাহ ছাড়া সেসব রহস্য সম্পর্কে আর কেউই কিছু জানে না। তারা কেউই জানে না তাদের কখন আবার যিন্দা করে তোলা হবে… আর অবশ্যই তােমার রব জানেন যা বক্ষসমূহের মধ্য গােপন রয়েছে এবং যা তারা প্রকাশ করে। আকাশমন্ডলী ও গায়েবের যাবতীয় খবর একটি সুস্পষ্ট কিতাবের মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে।'(আয়াত ৬৫-৭৫) বিশ্বাস সম্পর্কিত যতাে জিনিস আছে তার মধ্যে প্রধান প্রধান বিষয় হচ্ছে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়া, হাশরের ময়দানে সবার হাযির হওয়া এবং হিসাব নিকাশ বাদ শাস্তি বা পুরস্কার পাওয়া। এসব বিষয়ের ওপর বিশ্বাস না থাকলে মানুষ দুনিয়ার সঠিক পথে টিকে থাকতে পারে না এবং লােভ-লালসা দমন করে সত্যনিষ্ঠ জীবন যাপন করতে পারে না। অতএব, যে কোনাে জ্ঞানী ব্যক্তি যে আখেরাতে আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়ার আশা করে, সেখানে সঠিক প্রতিদান পেতে চায়, নিজের কাজের সঠিক মর্যাদা পাওয়ার আশা করে, সর্বোপরি পেতে চায় অন্তরের মধ্যে অনাবিল শান্তি, সে যেন তার কাজ ও কথায় মিল রেখে চলে, নিজের হিসাব নিজে নেয় এবং পরকালে যে প্রতিদানের আশা সে করে সে অনুযায়ী তার যাবতীয় কাজ ও ব্যবহার পরিচালনা করে এবং সময় থাকতেই তার সকল যােগ্যতা কাজে লাগায়। অবশ্যই এ জীবন শেষে আর এক জীবন আসবে এবং আখেরাতের সে যিন্দেগীতে আল্লাহর কাছে তাকে হাযির হতে হবে, এসব বিষয়ে বিভিন্ন যুগে মানুষ নানা দৃষ্টিভংগি পােষণ করে এসেছে, এর ব্যাপকতা ও প্রয়ােজন সম্পর্কে চিন্তা করেছে, কিন্তু যখন রসূলুল্লাহ(স.) তাদের কাছে মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়ে ওঠতে হবে বলে সংবাদ দিলেন- জানালেন যে, বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যাওয়ার পর পুনরায় সবাই অনন্ত আর এক জীবনে ফিরে আসবে, তখন তারা চরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে, অথচ তারা কখনও চিন্তা করতে চায় না, অথবা এ বিষয়টিও তাদের কাছে আশ্চর্য লাগে না যে, তাদের জীবনের প্রথম সূচনাটা হলাে কি করে তারা একটুও বুঝতে চায় না যে, একেবারে না থেকে অস্তিত্বে আনার তুলনায় অস্তিত্ব থেকে তার পুন আগমন কি অনেক সহজ নয়! এই বুঝতে না চাওয়ার কারণেই তারা আখেরাত সম্পর্কে সন্দিহান। এক পরীক্ষিত চরিত্রের মানুষ, তাদের সবার জানা শােনা মানুষ, সবার একান্ত ভাল মানুষটি যখন এ খবর দিচ্ছেন তখন তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না; বরং তারা চরম হঠকারিতার সাথে তাকে ও তাঁর কথাকে অস্বীকার করে চলেছে এবং শুধু অস্বীকার করেই তৃপ্তি পাচ্ছে না; বরং চির সত্যবাদী, তাদেরই দেয়া খেতাবে ভূষিত আল আমীন(স.)-কে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণ করার জন্যে আদা পানি খেয়ে লেগে গেছে। হাঁ, আখেরাত, পরকালীন জীবন, অবশ্যই তা এক অদেখা সত্য। মানুষের চোখের অন্তরালে অদেখা এ সত্য সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান তাে একমাত্র আল্লাহর কাছেই রয়েছে। অন্য কেউই এ বিষয়ে কিছু জানে না। তাদের দাবী হচ্ছে, ঠিক আছে, আখেরাত সম্পর্কিত কথা আমরা বিশ্বাস করতে পারি, সত্য বলে মেনে নিতে পারি যদি আপনি আমাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিতে পারেন যে, অমুক সময়ে বা এতােদিন পরে তা সংঘটিত হবে, তাহলে বুঝবাে আপনি একটা পূত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী মানুষ। এসব কথা বলে প্রকারান্তরে তারা নবীকে অস্বীকার করেছে, উপেক্ষা করেছে এবং মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করেছে। বলেছে, এসব প্রাচীনকালের লােকদের মনগড়া কল্পকাহিনী মাত্র অথচ এসব কথার বিবরণ ইতিপূর্বে আরও অনেক এসেছে, কিন্তু কিছুতেই সে হঠকারীরা নবীদের এসব কথা মানেনি। এজন্যে এখানে পুনরায় জোর দিয়ে বলা হচ্ছে যে, গায়েবের খবর আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ভান্ডারের গােপন রহস্যসমূহের অন্যতম। আসলেই ওদের আখেরাত সম্পর্কে জ্ঞান অত্যন্ত অল্প ও সীমাবদ্ধ। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, কেউ জানে না গায়েবের খবর, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অধিবাসী অন্য কেউ, একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া, তারা কেউ জানে না তাদের কখন পুনরায় তােলা হবে।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীতে তাঁর হুকুম আহকাম চালু করার দায়িত্ব দিয়েছেন মানুষকে। মানুষ তার প্রতিনিধি হিসেবে সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার কাছ থেকে সকল প্রকার যােগ্যতা, শক্তি সামর্থ ও প্রয়ােজনীয় ক্ষমতা পেয়েছে। এ গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্যে তার স্থান নিরূপিত হয়েছে স্বয়ং আল্লাহর পরেই, এ দায়িত্ব কোনাে ছোটো খাটো দায়িত্ব নয় । এর জন্যে প্রয়ােজন বিশ্বের সব কিছুর সহযােগিতা। তাই সকল জীব-জানােয়ার, কীট পতংগ ও সকল জড় পদার্থকে তার খেদমতে নিয়ােজিত করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য এটা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বুঝতে হবে যে, সে আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি, কোনাে কিছুর মালিক সে নয়, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সকলের এবং সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক। তার কর্তব্য মালিকের অনুগত থাকা এবং সকল কিছু মালিকের হুকুম অনুযায়ী ব্যবহার করা। সে যদি নিজে মালিক হতে চায় এবং মালিকের অধিকার আত্মসাৎ করতে গিয়ে নিজের ইচ্ছা কাজে লাগাতে চায়, অর্থাৎ মালিককে তার অধিকার না দিয়ে সে অধিকার নিজের কাজে লাগায়, তাহলে মালিকের কোপ দৃষ্টিতে সে পড়তে বাধ্য। আল্লাহর খলীফা হিসেবে নিয়ােজিত থাকার কারণেই তাকে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দেয়া হয়েছে, যা আর কাউকে দেয়া হয়নি এবং দেয়া হয়েছে ততােটুকু, যতােটুকু তার দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রয়ােজন, তার বেশী নয়। তাই আল্লাহ তায়ালা যতােটুকু জ্ঞান তাকে দিয়েছেন এবং সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে তাকে যতােটুকু জানিয়েছেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার মধ্যেই তার কল্যাণ । এই নির্দিষ্ট সীমার বাইরের রহস্যরাজি তাকে জানানাে তার জন্য কল্যাণকর হবে বলে যদি আল্লাহ তায়ালা বুঝতেন, তাহলে তার সামনে তিনি তার রহস্য ভান্ডারের দ্বার আরও বেশী প্রশস্ত করে দিতেন। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা খেলাফত বা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠানাের সময় থেকে নিয়েই মানুষের মধ্যে, এ দায়িত্ব পালন করার জন্যে প্রয়ােজনীয় সকল প্রকার যোগ্যতা, শক্তি ও ক্ষমতা দান করেছেন। এর বেশী সে ইচ্ছা করলেও পেতে পারে না। তাকে প্রদত্ত এই দায়িত্ব পালন করার জন্যে সৃষ্টির সকল রহস্য জানা তার জন্যে জরুরীও নয়। তবে অবশ্যই এটা সত্য, যদি কোনাে ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করার জন্যে গভীরভাবে নিবেদিত (প্রাণ) হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন কিছু বিশেষ জ্ঞান ও যােগ্যতা দান করেন এবং তার সামনে তার রহস্য ভান্ডারের এমন কিছু দিক খুলে দেন, যা সাধারণভাবে মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। এহেন সত্য-সঠিক ও সত্য পথে আত্মউৎসর্গীকৃত প্রাণ বান্দাকে মহান আল্লাহ পৃথিবীর গভীরে লুকায়িত বহু অজানা বস্তুর সন্ধান দিয়ে থাকেন, তাকে জানার ব্যবস্থা করে দেন অতলান্ত সাগরের গভীরে লুকিয়ে থাকা অনেক তথ্য। তাকে মহাশুন্যালােকের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বহু বিষয় জানান। সৃষ্টির বহু নিয়ম কানুন এবং গােপন শক্তি সম্পর্কে তাকে জানিয়ে দেন। এমন সব গােপন রহস্যও তাকে জানান যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর, যা পৃথিবী সৃষ্টির মূল উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে, যা সকল কিছুকে অস্তিত্বে এনেছে এবং এদের নানা আকৃতি ও বর্ণ দিয়েছে; আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সৃষ্টি করার পর সকল কিছুকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বানিয়েছেন এবং মানুষকে আবিষ্কার করার বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। তাকে এমন সব বিষয় জানিয়েছেন যা ইতিপূর্বে আর কারও জানা ছিলাে না। এভাবে এ পৃথিবীতে মানুষ তার ভূমিকাকে পূর্ণতা দান করেছে এবং তাকে পৃথিবীতে খলীফা বানানাের জন্যে মহান আল্লাহ যে ওয়াদা করেছিলেন তিনি তা পূর্ণ করেছেন। শুধু মানুষের কাছেই যে সৃষ্টি রহস্য গােপন রাখা হয়েছে তা নয় বরং ফেরেশতা, জ্বিন এবং অন্য যেসব সৃষ্টিকে আল্লাহ রুব্বল আলামীন তার নিজের পক্ষ থেকে জ্ঞান দিয়েছেন, তাদের থেকেও তিনি সৃষ্টির রহস্য গােপন রেখেছেন, তারা ততােটুকুই জানে যতােটুকু মহান-আল্লাহ তাদের জানাতে চেয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তার বেশী জানার ক্ষমতা কারও নেই। এভাবে তাদের প্রত্যেককেই তিনি বিশেষ বিশেষ এক দায়িত্বে নিয়ােজিত করেছেন। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব জানে এবং আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে তারা সবাই সচেতন। একমাত্র মানুষ ও জিন ছাড়া, কিন্তু কেউই তার নিজ দায়িত্ব ছাড়া অপরের দায়িত্ব সম্পর্কে কিছুই জানে না। পরিশেষে সবার রহস্য জানেন একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীন! এই কথাটিই মহান আল্লাহর কালামে ঝংকৃত হয়েছে, ‘বলাে, কেউ জানে না আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যারা আছে, তাদের গায়েব সম্পর্কে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া’। যাবতীয় সন্দেহের উর্ধে যে মহান কিতাব চূড়ান্ত দিশারী হিসেবে মানব সমাজে বর্তমান রয়েছে, সেই মহাগ্রস্থ আল কোরআন আজও সম্পূর্ণ নির্ভুল, অকাট্য তার দলীল-প্রমাণ। এ পাক কালাম ছাড়া সারা বিশ্বের বুকে অন্য কোনাে এমন গ্রন্থ নেই যা এই ভাবে নির্ভুল হওয়ার দাবী করতে পারে, এর মধ্যে ধারণা বা আন্দাজ অনুমান বলতে কিছু নেই। কোনাে সাময়িক সমাধান দানকারী কিতাবও এটা নয়। বিশ্ব মানবতাকে সাফল্যের দুয়ারে পৌছে দেয়ার জন্য এ কিতাবই চূড়ান্ত ও শেষ সমাধান হিসেবে এসেছে।
*পুনরুত্থান নিয়ে সন্দেহবাদীদের বিতর্কের অপনােদন : এভাবে, ‘গায়েবের খবর কেউ রাখে না আল্লাহ ছাড়া’ এ কথাটা সাধারণভাবে সবার জন্যে একইভাবে সত্য। একথা জানিয়ে দেয়ার পর আবার খাস করে বলা হয়েছে আখেরাতের কথা, কারণ এটাই হচ্ছে সে বিষয় যা নিয়ে তাওহীদের পরই মানুষের মধ্যে প্রচন্ড মতভেদ গড়ে ওঠেছে। মােশরেকদের সাথে মােমেনদের মতপার্থক্য বিরাজ করেছে। আল্লাহর বাণীতে কথাটা কী চমৎকারভাবে উল্লেখিত হয়েছে, ‘আর ওরা কেউ জানে না, কখন ওদের (পুনরায় জীবিত করে) তােলা হবে।’ এ কথা দ্বারা পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না বলে সুস্পষ্টভাবে জানানাে হয়েছে এবং চূড়ান্তভাবে ঘােষণা দিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কেয়ামত ও “বা’স ওয়া বা’দাল মওত” (মৃত্যুর পর আবার আসা যিন্দেগী) কখন এটা সংঘটিত হবে, এ বিষয়ে কাউকে কিছু জানানাে হয়নি। মানুষ যতােই জ্ঞান-সাধনা করুক না কেন এবং এ বিষয়ে যতােভাবেই জানার চেষ্টা করুক কেন, এটিই একমাত্র বিষয় যার সম্পর্কে কারও কিছুই জানার উপায় নেই এ বিষয়ে মানুষ সম্পূর্ণ মজবুর। কথাটিকে আরও বেশী জোরদার করার জন্যে বলা হয়েছে যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে কোথাও কেউ নেই যে, এ বিষয়ে সামান্যতম জ্ঞান রাখতে পারে। তারপর উদাহরণ দিয়ে কথাটি বুঝানাের চেষ্টা হয়েছে, যেন মানুষ আখেরাত সম্পর্কে আলােচনা করে এবং আখেরাত সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস কি সে বিষয়ে মত বিনিময় করে। তাই বলা হচ্ছে, ‘বরং আখেরাত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নিঃশেষ হয়ে গেছে।’ অর্থাৎ, যতােই তারা আখেরাত সম্পর্কে চিন্তা করুক না কেন এবং যতাে বেশীই তারা এ বিষয়ে বুঝার চেষ্টা করুক না কেন, আখেরাত সম্পর্কে জানার জন্যে তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। অনুমান করতে করতে তারা মনে করেছে, এই বুঝি আমরা জেনে ফেলবাে; কিন্তু অবশেষে তারা বুঝেছে, হায়, একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আমরা ব্যর্থই হয়ে গেলাম! অন্ধরা যেমন চোখে না দেখে অনুমান করে, আলাে বুঝি এই রকম। এভাবে তাদের সকল অনুমানই যেমন নিস্ফল হয়ে যায়; তেমনই আখেরাতের চিন্তা মানুষের কাছে সে অন্ধের মতােই এক নিস্ফল চিন্তা। এ ভয়ংকর অবস্থার চিত্র তাদের মনের পর্দায় আঁকা এ রকমই এক ব্যর্থ চেষ্টা। সে দিনে কি কঠিন অবস্থা হবে, তার প্রকৃতিই বা হবে কি রকম, তা অনুমান করা মানুষের জন্যে একেবারেই অসম্ভব। ‘বরং সে বিষয়ে (তাদের ধারণা কল্পনার মধ্যে আনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে) তারা সন্দেহের মধ্যে পড়ে যায়।’ অর্থাৎ তাদের মনের মধ্যে এমন সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যায় যে, আখেরাত সংঘটিত হবে বলে তারা আর একীন করতে পারে না। কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে নিছক একটি ধারণার মধ্যেই তারা থেকে যায় এবং এ ঘটনা ঘটবে বলে তারা শুধু এন্তেযারই করতে থাকে। বরং এ বিষয়ে তারা একেবারেই অন্ধ বনে যায়। অর্থাৎ, এ বিষয়টি বুঝার ব্যাপারে তাদের অবস্থা হয় একেবারেই একজন অন্ধের মতাে, সে বিষয়ে সে কিছুই দেখতে পায় না এবং তার অবস্থা কি হবে কিছুতেই তা বুঝতে পারে না, এটা হচ্ছে আব্দায-অনুমান- এই দুই অবস্থা থেকে বহু দূরের এক অবস্থা।
‘ আর কাফেররা বলে, আমরা ও আমাদের বাপ-দাদারা পচে গলে মাটিতে পরিণত হয়ে যাবাে, সে অবস্থা থেকে কি আমাদের পুনরায় বের করা হবে?'(আয়াত ৬৭)। অর্থাৎ এই সন্দেহের মধ্যে হাবুডুবু খাওয়াই কাফেরদের আসল অবস্থা। সদা সর্বদা তারা এই বিশ্বাসের গােলমালের মধ্যে পড়ে আছে যে, আমাদের দেহ থেকে যখন প্রাণ আলাদা হয়ে যাবে, আমাদের দেহ পচে গলে যখন কবরে মধ্যে মিশে যাবে এবং একেবারে মাটিতে পরিণত হয়ে যাবে, তখন আসবে সে কেয়ামত? তখন আবার দেহ তৈরী হবে এবং আবার যিন্দা হতে হবে? এ যে এক অদ্ভুত কথা! আরও যেসব কথা বলা হচ্ছে যে, মৃত্যুর পরে কবরস্থ করে দেয়ার পর বহু বহু বছর অতীত হয়ে যাবে, তারপর সংঘটিত হবে কেয়ামত। আমরা, আমাদের বাপ-দাদারা, যারা কতকাল পূর্বে গুযরে গেছে, তাদের সবাইকে আবার যিন্দা করে তোলা হবে। মরে পচে গেলে সম্পূর্ণভাবে মাটিতে পরিণত হওয়ার পর আবার জীবিত করে তোলা হবে? (একি অদ্ভুত কথা শোনানো হচ্ছে। এসব কথাও বিশ্বাস করতে হবে) তারা এ কথা বলে এবং তাদের ও আখেরাতের যিন্দেগীর ধারণার মাঝে এই বস্তুগত জীবনের অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। এ সময় তারা ভুলে যায় যে, তাদের এমন অবস্থা থেকেই তাে পয়দা করা হয়েছে যখন তাদের কোনাে অস্তিত্বই ছিলাে না। কেউ জানত না যে এসব জীবকোষ ও এসব উপাদান, যা দ্বারা তাদের আকৃতি ও প্রকৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে, তা শুরুতে কোথায় ছিলাে। প্রকৃতপক্ষে সব উপাদান তাে পৃথিবীর মাটির স্তরসমূহের মধ্যে, সাগরের পানিতে ও শুন্যলােকের মধ্যে বিরাজমান অণু পরমাণুর মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। তারপর মাটি, পানি, বাতাস ও সুদূর মহাশূন্যে অবস্থিত সূর্যের কিরণ থেকে তার সৃষ্টির উপাদানগুলাে জড়ো করা হল এবং এভাবে সৃষ্টি হল মানুষ, বৃক্ষ, লতা-পাতা, পশু-পাখী ও কীট-পতংগ। সেসব কিছু থেকে তাদের সৃষ্টির মূল উপাদানগুলো সবাই পেলে, তাদের বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন উপাদান পেলাে, যেমন পানি, যা থেকে তৃপ্তির সাথে পান করে; স্বচ্ছ বায়ু, যার দ্বারা তারা শ্বাস গ্রহণ করে এবং সূর্যের কিরণ, যার থেকে তারা পায় আলাে ও তাপ। তারপর যখন মৃত্যু আসে তখন এই মানব দেহের টুকরাগুলাে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, কত অসংখ্য টুকরায় এগুলাে ছড়িয়ে পড়ে তা কেউ জানে না একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এবং কোত্থেকেই বা উদ্গত হয়েছে এই দেহ প্রাণ, তার খবরও তা কেউ জানে না একমাত্র তিনি ছাড়া মানব দেহের এই বিক্ষিপ্ত অণু-পরমাণুগুলাে একদিন আবার একত্রিত হয়ে পরিপূর্ণ মানবে পরিণত হবে। অথচ প্রথম পয়দা হওয়ার সময় মাতৃগর্ভে একটি শুক্রকীট থেকে এই মানুষ বৃদ্ধি পেতে পেতে একটি পূর্ণাংগ মানুষে পরিণত হয়েছে, একটি ঝুলন্ত গোশতের টুকরা, যা পরে পরিপূর্ণ মানব আকারে আত্মপ্রকাশ করে পুনরায় কাফনের মধ্যে জড়ানাে অবস্থায় মাটির মধ্যেই ফিরে গেছে। এই যদি হয় তার প্রথম সৃষ্টির ইতিবৃত্ত, তাহলে আবারও তার মানব আকার ধারণ করা অথবা অন্য কোনাে অবস্থায় আবার জীবিত হওয়ার মধ্যে বিস্ময় কি আছে! কিন্তু তবুও তারা বিস্মিত হতাে এবং সংশয় প্রকাশ করে এ রকম কথাই বলতাে। ওদের কেউ কেউ আজও সামান্য কিছু শাব্দিক হেরফেরসহ এ একই কথা বলে! বরাবর এভাবেই তারা কথাটি বলত। তারপর সেই পরিত্যক্ত জাহেলী কথাটা ঘৃণার সাথে তারা আবারও বলে এবং একান্ত খারাপ লাগা সত্তেও তারা অনুসরণ করছে।
এরশাদ হচ্ছে, ‘এর পূর্বে আমাদের ও আমাদের বাপ-দাদাদের সাথে এভাবেই ওয়াদা করা হয়েছে। নিশ্চয়ই এটা প্রাচীন কালের কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। এর দ্বারা বুঝা গেলাে যে, এর আগে ওদের বাপ-দাদাদের কাছে রসূলরা এসেছেন এবং পুনরুত্থান দিবস ও আল্লাহর দরবারে একত্রিত হতে হবে বলে তাদের সতর্কও করেছেন। তাদের কথায় এটাও প্রমাণিত হয় যে, আরবদের মন মগয ঈমানের মূল আকীদা বিশ্বাস থেকে একেবারেই মুক্ত ছিলাে তা নয় এবং এ বিশ্বাসের প্রকৃত মর্ম কি তা যে তারা জানতাে না তাও নয়। তারা শুধু এটাই হিসাব করছিলাে যে, শিরক ও অন্যায় কাজের কারণে যেসব আযাবের কথা বলা। হয়েছে, তা বহু বহু কাল আগের কথা, এগুলাে এখন আর দেখা যায় না। এ কারণেই তাদের কাছে আযাবের ভয় দেখানােটা ছিলাে অতীতের মতােই এক ঠাট্টা মঙ্কারি, যা আবার নতুন করে তাদের সামনে আসছে! এই জন্যেই তারা বলতাে, এটা প্রাচীন কালের কাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়, যা মােহাম্মদ(স.) আবার নতুন করে জানাচ্ছে। এসব কথা বলে তারা কেয়ামতকে ভুলে থাকতে চাইতাে, যা অবশ্য নির্দিষ্ট সময়েই আসবে। তাদের নাফরমানীর কারণে নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই যে কেয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে তা নয়, মনে মনে তারা যদি চায় যে কেয়ামত আরও একটু দেরীতে আসুক- তাও হবার নয়। অবশ্যই কেয়ামত সংঘটিত হবে ঠিক সেই নির্ধারিত সময়েই, যার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছেই আছে। এ সম্পর্কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে অবস্থিত আল্লাহর সকল বান্দা সমানভাবে অজ্ঞ। তাই রসূল(স.) জিবরাঈল(আ.) কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর বলেছিলেন, ‘যাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, সে জিজ্ঞাসাকারী থেকে বেশী জানে না'(ঈমান ও ইসলামের ভাৎপর্য সম্পর্কে এ আলােচনা আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণিত হাদীস থেকে নেয়া হয়েছে) এখানে এসব মিথ্যারােপকারীদের মােকাবেলা করার জন্যে মােমেনদের প্রস্তুত করা হচ্ছে। যারা রসূল(স.)-কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করছে এবং অতীতের আম্বিয়ায়ে কেরামকেও মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চেয়েছে, এখানে তাদের প্রতি আল্লাহর আযাবের ভয় প্রদর্শন করা হচ্ছে, এ উদ্দেশ্যে তাদের চিন্তার ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত করতে বলা হচ্ছে। অতপর আরো জানানাে হচ্ছে যে, কোনাে এক যুগের মানুষও গােটা পৃথিবীর মানবমন্ডলী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনাে মানব গােষ্ঠী নয়। তারা সবাই সে সকল নিয়মে বাধা যা সকল মানুষের জন্যে একই নিয়মে একইভাবে প্রযোজ্য এবং সবার জন্যে তা তাদের সৃষ্টিকর্তা সমভাবে দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা অপরাধীদের জন্যে ইতিপূর্বে যেসব শাস্তির ঘােষণা দিয়েছেন, পরবর্তীদের জন্যেও দিয়েছেন সেই একই ঘােষণা। এই নিয়মের মধ্যে কোনা পরিবর্তন নেই- না এ নিয়ম কারও সাথে কোনো প্রকার আপােষ করে চলে। পৃথিবীর বুকে যারা ভ্রমণ করে এবং গভীর দৃষ্টিতে সব কিছুর দিকে তাকায়, তারা দেখতে পায়, এ কথার পরিপূর্ণ বাস্তবতা সর্বত্র বিরাজমান রয়েছে। তারা এ সব কিছু থেকে বিশ্ব প্রভু, দোজাহানের একমাত্র মালিক মহান আল্লাহর কথার সত্যতা জানতে পায়। এ শিক্ষা লাভ করে তাদের গােটা দেহ মন রব্বুল আলামীনের দরবারে কৃতজ্ঞতাভরে নুয়ে পড়ে। তাদের চিন্তা চেতনা আল্লাহর রহমতের ঝলমলে আলােকে রংগিন হয়ে যায় এর ফলে দুনিয়ার সকল আকর্ষণ, সকল লােভ লালসা, হীনমন্যতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। এবং তারা নিজেদের আল্লাহর অত্যন্ত কাছাকাছি অনুভব করে, তাদের কাছে মনে হয় দিক চক্রবালে ছড়িয়ে থাকা সৃষ্টিলােকের মধ্যে বিরাজমান সব কিছু নিশিদিন বুঝি রহমানুর রহীমের জয়গান গেয়ে চলেছে। সেখানে কোনাে জড়তা নেই, কোনো স্থবিরতা নেই, কোনাে সংকীর্ণতা নেই, নেই পারস্পরিক কোনাে বিচ্ছিন্নতা। এইভাবে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় সৃষ্টি এই সুন্দর মানুষের মনকে তার দিকে আকৃষ্ট করার পর তাঁর রসূল(স.)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন, সত্যবিমুখ ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারী লােকদের সকল আচার আচরণ থেকে তাঁর হাত দুটি গুটিয়ে নিতে এবং তাদেরকে তাদের নিয়তির হাতে ছেড়ে দিতে তাদের সেই ভয়ানক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে, যার দৃশ্যসমূহের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করার জন্যে সকল প্রকার প্রচেষ্টা চালানাে হয়েছে। তাকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, সত্যকে নস্যাৎ করার জন্যে তাদের সকল অপপ্রয়াসে তার হৃদয় যেন সংকীর্ণ না হয়ে যায়, কারণ কোনাে কিছুই তার কোনাে ক্ষতি করতে পারবে না, আর তিনিও যেন তাদের ভীষণ পরিণতির কথা চিন্তা করে দুঃখিত না হন, কেননা তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্যে তিনি সম্ভাব্য সকল প্রকার চেষ্টা করেছেন, যথাযথভাবে তিনি তাদের কাছে আল্লাহর অমীয় বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং তাদের সত্যের শুভ্র সমুজ্জ্বল পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। এবার এরশাদ হচ্ছে, ‘না, তুমি দুঃখিত হয়াে না তাদের জন্যে। (সত্যের বাতি নিভিয়ে দেয়ার জন্যে) যেসব চক্রান্ত তারা চালাচ্ছে, তার জন্যে তােমার হৃদয় যেন সংকীর্ণ না হয়ে যায়।’ এ আয়াতাংশটি রাসূলের হৃদয়ানুভূতির কী চমৎকার ছবি এঁকে দিয়েছে তা লক্ষণীয়। এ আয়াত এ কথার সুস্পষ্ট ইংগিত দিচ্ছে যে, মহানবী(স.) দিব্য-দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন তার জাতি কঠিন পরিণামের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে, তাদের পূর্বে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী জাতিসমূহের ব্যাপারে আয়াত সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র কতাে কঠিন, কতাে তীব্র ছিলাে, আরও জানিয়ে দিচ্ছে যে, কতাে গভীর হৃদয়াবেগ নিয়ে মহানবী(স.) তাদের নিকট দাওয়াত পেশ করেছেন এবং তাদের সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার জন্যে মুসলমানরা কি কি কোরবানী দিয়ে চলেছে, এমনকি শেষ পর্যন্ত প্রিয় নবী রহমাতুল্লিল আলামীন(স.)-এর সুপ্রশস্ত হৃদয়ও এর ফলে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে।
*পুনরুত্থান নিয়ে ঠাট্টা মশকারার পরিণতি : পুনরুথান বিষয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে আলােচনা এগিয়ে চলেছে, তাই তাদের নাফরমানীর পরিণতিতে দুনিয়া আখেরাতে যে কঠিন আযাব ভােগ করতে হবে, এ ধমকিকে তারা তুচ্ছ মনে করে চলেছে। নীচের আয়াতাংশে সেই কথাটির বর্ণনা পাওয়া যায়, আর ওরা বলে, পুনরুত্থান ও কেয়ামত দিবস সম্পর্কে তােমরা যে ভয় দেখাচ্ছো, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বলাে না, তা কখন সংঘটিত হবে?’ যখনই তাদের সামনে তাদের পূর্বেকার অপরাধীদের কঠিন পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়, তখনই তারা এসব কথা বলে, অথচ সাধারণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বহু জাতির ঘটনাই তাদের জানা রয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত সেসব এলাকাবাসীর ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে তারা মাঝে মাঝে যাতায়াতও করে থাকে। যেমন, লুত(আ.)-এর এলাকা সিরিয়া অভিমুখে প্রায় একশত পঞ্চাশ মাইল উত্তরে অবস্থিত। সামুদ জাতির এলাকা এবং মহাপ্রলয় তাড়িত বালুর পাহাড় সমূহে ঘেরা আদ জাতির এলাকার ধ্বংসাবশেষ এবং প্রলয়ংকরী পানির স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সাবা জাতির জনমানবশূন্য পরিত্যক্ত এলাকার দৃশ্যসমূহ, এসব দেখা সত্তেও তারা ঠাট্টা মস্করাচ্ছলে বলতাে, ‘কবে আসবে তােমার সেই ওয়াদার (গযব নাযিলের) দিন, বলাে না যদি তােমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো!’ অর্থাৎ যে আযাবের ভয় তােমরা আমাদের দেখাচ্ছো, তা কবে সংঘটিত হবে? তােমরা তােমাদের কথায় সত্যবাদী হয়ে থাকলে এখনই নিয়ে এসাে না। অথবা, কবে আসবে সে আযাব- তা নির্দিষ্ট করে বলাে না! এই পর্যায়ে এসে এমন এক ভাষায় তাদের জওয়াব দেয়া হচ্ছে যা তাদের অন্তরাত্মার মধ্যে প্রচন্ড এক ভয় সৃষ্টি করছে এবং অত্যন্ত অল্প কথায় তাদের মনের এই ভীতিজনক অবস্থার দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘বলাে, হয়তাে শীঘ্রই তােমাদের পেছনে সেই আযাবের কিছু অংশ ছুটে আসছে যার জন্যে তােমরা বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছো।’ এখানে মনে রাখতে হবে, যারা ঠাট্টা-মঙ্কারি করছিলাে, তারা নবী মােহাম্মদ(স.)-কে ছােটবেলা থেকে চিনতাে, তার সততা ও সত্যবাদিতার কথা জানতাে। গরীবের প্রতি তাঁর মমত্ববােধ সম্পর্কে জানতাে, পরের হিতে তার নিজের অসাধারণ আত্মত্যাগের অভূতপূর্ব ইতিহাসও জানতাে। এজন্যে যখন তার মুখ দিয়ে আযাবের সংবাদ তারা শুনেছে, তখন তাদের অন্তরাত্মা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে ওঠেছে, যেমন বেলালের সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ, আবদুর রহমান ইবনে আওফের মুখে যখন শুনেছিলাে, অচিরেই তারা মুসলমানদের হাতে নিহত হবে, তখন তার বুক থরথর করে কেঁপে ওঠেছিলাে এবং জিজ্ঞেস করে যখন সে জেনে নিয়েছিলাে যে, তাদের মৃত্যু হবে মক্কার বাইরে। তখন সে কসম খেয়েছিলাে যে আর কখনও মক্কার বাইরে যাবে না। ‘তাই হয়তাে শীঘ্রই আসবে সেই আযাব যার জন্যে তারা এত ব্যস্ততা দেখাচ্ছিলাে।’- একথা শােনার সাথে সাথে তাদের মন দারুণভাবে আতংকিত হয়ে পড়লো, পেরেশানী এতােদূর তাদের ঘিরে ফেললাে যেন তারা ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখেছে যে, প্রবল বেগে তাদের দিকে সর্বগ্রাসী এক আযাব ছুটে আসছে, ছুটে আসছে এমনভাবে যেমন করে কোনাে পশুর ওপর আরােহী যাত্রীকে তার অজান্তে কোনাে ঘােড়সওয়ার ধাওয়া করে। তাই, ‘আযাব নাযিল হােক,’ বলে যারা জলদি করে তারা হয়তাে ভুলে রয়েছে যে, তাদের পেছনে ধেয়ে আসছে সেই কাংখিত আযাব। সুতরাং হায় আফসােস, হঠাৎ করে যখন তাদের ঘিরে ফেলবে সেই কঠিন আযাব তখন তাদের হাড়ির জোড়াগুলাে ভীষনভাবে কাপতে থাকবে, যেমন করে কাপতে শুরু করেছে সেই মুহূর্তে- যখন তারা শুনেছে শীঘ্রই আযাব নাযিল হবে।
মানবজাতির ক্ষমাহীন উদাসীনতা : কেই বা জানে গায়বের রহস্য। গায়ব বলতে বুঝা- চোখের অন্তরালে যা কিছু আছে, তা তাে আসলে পর্দার আড়ালেই রয়েছে, তা কেমন কে তার খবর রাখে! সে পর্দা তাে ঝুলে রয়েছে পায়ের তলদেশ পর্যন্ত, এর অপর পাশে কি আছে তা কেউ জানে না, জানতে পারে না- তারা তাে গাফলতির নিদ্রায় নিদ্রিত! প্রকৃত বুদ্ধিমান তাে সে ব্যক্তি যে সতর্ক হয়ে চলে, সে পােখতা এরাদা করে এবং প্রতি মুহূর্তেই পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রহস্যসমূহ জানার ও বুঝার জন্যে সদা-সর্বদা সচেষ্ট থাকে। এরশাদ হচ্ছে, তােমার রব সমগ্র মানবমন্ডলীর জন্যে অবশ্যই মেহেরবান, কিন্তু তাদের অধিকাংশই শোকরগুজারী করে না। অর্থাৎ অপরাধী হওয়া সত্তেও অথবা ওরা কর্তব্য পালনে বিরত থাকা সত্তেও ওদের ওপর আযাব নাযিল করতে যে বিলম্ব করা হচ্ছে, তাদের (সংশােধনের জন্যে) সুযােগ দেয়া হচ্ছে, এটা তার অসীম মেহেরবানীরই অংশ। আহ, ওরা যদি এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করতাে, সঠিকভাবে এর মর্যাদা বুঝতাে, এ সুযােগ কাজে লাগাতাে, তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতাে এবং সময় থাকতেই যদি ওরা সত্য সুন্দর ও মযবৃত পথটি বুঝতাে (তাহলে তা ওদের জন্যে কতােই না ভালাে হতাে!) কিন্তু ওদের অধিকাংশই শোকরগুজারী করে না। এ মহান সুযােগের সদ্ব্যবহার করে না, এই রহমতের হক ওরা আদায় করে না, বরং তারা ঠাট্টা-মস্কারি করে এবং আল্লাহর আযাব দেখার জন্যে ব্যস্ততা দেখায়। আসলে ব্যস্ততা দেখানাের মাধ্যমে তারা এটাই বুঝাতে চায় যে, আযাব নাযিল হওয়ার যে ধমকি তাদেরকে দেয়া হচ্ছে, তা মােটেই কোনাে বিশ্বাসযােগ্য ব্যাপার নয়, কোনােদিনই এটা আসবে না। একটা ভুয়া কথা বলে মােহাম্মদ তাদের ওপর প্রভুত্ব কর্তৃত্ব বিস্তার করতে চায় মাত্র, অথবা বলা যায়, তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে, কি করবে না করবে কিছুই তারা বুঝে ওঠতে পারছে না। একদিকে তাদের মনের মধ্যে মােহাম্মদ(স.)-এর বর্তমান ও অতীতের পবিত্র সত্যনিষ্ঠ জীবন, তাঁর সত্যসন্ধ তৎপরতা ও পরােপকারী কার্যাবলী ধাক্কা দিচ্ছে। অপরদিকে বাপ-দাদার ধর্ম, রীতি-নীতি সব পরিত্যাগ করার কষ্ট এবং সর্বোপরি রয়েছে নেতা কর্তাদের পক্ষ থেকে জাগিয়ে দেয়া আত্মমর্যাদাবােধের নিদারুণ নেশা, কিন্তু একবারও তারা ভাবছে না এ সবের শেষ কোথায়। তাই তাদের মধ্যে সঠিক চেতনা জাগানাের উদ্দেশ্যে মহান করুণাময় রব্বুল আলামীন বলছেন, ‘তােমার রব, তিনি অবশ্যই জানেন যা কিছু ওদের বক্ষসমূহ গােপন করে রেখেছে এবং যা কিছু ওরা প্রকাশ করছে।’ অর্থাৎ মহান পরওয়ারদেগার সংশােধনের জন্যে তাদের সর্বপ্রকার সুযােগ দিচ্ছেন এবং আযাব নাযিল করায় যথেষ্ট বিলম্ব করছেন। যদিও তাদের বুকের মধ্যে যা কিছু গােপন রয়েছে এবং যা কিছু ওরা ওদের কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করছে তা সবই তিনি জানেন। জেনে বুঝেই তিনি সুযােগ দিচ্ছেন এবং এই সুযােগ দান করা তার মহা মেহেরবানীর বহিপ্রকাশ মাত্র। তবে পরিশেষে বলা হচ্ছে, অবশ্যই তাদের এসব কাজ, কথা ও চিন্তার হিসাব নেয়া হবে যা তাদের বুকের মধ্যে বিরাজ করছে এবং যা তারা প্রকাশ করছে। আলােচ্য এ প্রসংগের বিরতি টানা হচ্ছে এ কথার ওপর যে, মহান আল্লাহর ইলম (জ্ঞান) পরিব্যাপ্ত রয়েছে সকল কিছুর ওপর এবং আসমান যমীনের কোনাে কিছুই তার কাছে গােপন নেই। নীচের আয়াতে সুস্পষ্টভাবে এ কথা বলে দেয়া হয়েছে, আসমান যমীনের যেখানে যা কিছু গােপন রয়েছে তা সবই সুস্পষ্ট কিতাবের মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে।’ ওপরের কথা দ্বারা মানুষের চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা সুউচ্চ আকাশ ও বিশাল এ পৃথিবীর দিকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে, চোখের অন্তরালে যা কিছু বস্তু বা বিষয় নিহিত রয়েছে তা জানানাে হচ্ছে। যা কিছু শক্তি ও তথ্য তা সবই সর্বশক্তিমান আল্লাহর মহান জ্ঞানভান্ডারের মধ্যে মজুদ রয়েছে। এ ভান্ডার থেকে কোনাে কিছু হারিয়ে যাওয়া বা তাঁর নযর এড়িয়ে কোনাে কিছু বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যা কিছু এ সূরার মধ্যে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে, তার মূল কথাই হচ্ছে, আল্লাহর সর্বব্যাপী ও অসীম জ্ঞানের মধ্যে সব কিছুই বর্তমান রয়েছে। এখানে কোনাে জিনিস তাঁর জানা-শােনার বাইরে নেই। এটাই এ সূরার শেষ ও চূড়ান্ত কথা।
*ইহুদীদের বিকৃতি ও মতভেদে লিপ্ত হওয়া : এ প্রসংগে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের চূড়ান্ত ও নিরংকুশ জ্ঞান সম্পর্কে কথা এসেছে। যার বর্ণনা আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে এসেছে। তাই দেখা যায়, বনী ইসরাঈল জাতি যেসব বিষয়ে মতভেদ করেছে সেগুলাের ব্যাপারে তিনি পৃথক পৃথকভাবে ওদের সম্বোধন করেছেন। তার নিশ্চিত ও অবাধ জ্ঞান দ্বারা ওদের মতভেদের বিষয়গুলাে জেনে তিনি তার সঠিক ফয়সালা দান করেছেন। এ জ্ঞান তাঁর মেহেরবানীর নমুনা এ জ্ঞান দ্বারা তিনি বিভিন্ন মতাবলম্বীর মধ্যে ফয়সালা করেছেন। তিনি বিবদমান প্রত্যেক গ্রুপকে সম্বােধন করেছেন যাতে করে তার চূড়ান্ত জ্ঞান দ্বারা রসূল(স.)-কে সম্মানিত করা যায় এবং আল্লাহর দুশমনদের তার হাতে ছেড়ে দেয়া যায়, যেন তিনি তার অদৃশ্য জ্ঞান অনুযায়ী উভয় শ্রেণীর মধ্যে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দিতে পারেন। এরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চয়ই এ কোরআনে বনী ইসরাঈলদের মতভেদ দূর করার জন্যে এতাে বেশী কথা বলেছেন যা ওদের বিবদমান বিষয়গুলাে থেকেও বেশী (যেন সহজেই এরা মতভেদ করা থেকে বিরত হতে পারে)।’ তুমি অন্ধ কোনাে ব্যক্তিকে, তাদের ভুল পথ থেকে সঠিক পথে জোর করে টেনে আনতে পারবে না। শুধু তাকেই তুমি শােনাতে পারবে যে আমার আয়াতগুলাের ওপর ঈমান রাখে, অতপর তারাই হবে মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী)'(আয়াত ৭৬-৮১)। নাসারারা ঈসা মাসীহ(আ.) ও তার মা মারইয়ামের ব্যাপারে নানাপ্রকার মতভেদ করেছে। একদল বলেছে, ঈসা মসীহ শুধু একজন মানুষ এবং আর একদল বলেছে, বাপ, ছেলে এবং পবিত্র আত্মা- এই তিনটি একই অস্তিত্বের বিভিন্ন রূপ, যাদের সম্পর্কে মানুষকে বুঝানাের জন্যে আল্লাহ তায়ালা নিজে এইভাবে ঘােষণা দিয়েছেন। ওদের ধারণায়, আল্লাহ তায়ালা এই তিনে মিশে এ মহাশক্তির সমাহার, পিতা-পুত্র ও পবিত্র আত্মা। অতপর রুহুল কুদুস (পবিত্র আত্মা) আকারে আল্লাহ তায়ালা নিজে নেমে এসেছেন এবং মারইয়ামের মধ্যে দেহ ধারণ করেছেন, যার কারণে তার থেকে ‘ইয়াসূ’ আকারে এক বাচ্চার জন্ম হয়েছে। আর একদল বলেছে, পিতার মতাে পুত্র কোনাে চিরন্তন সত্ত্বা নয়, সে বিশ্বজগতের পক্ষ থেকে আগত এক সৃষ্টি। সুতরাং সে পিতা থেকে আলাদা এক সত্ত্বা এবং তার কাছে অবনত। আর এক দল আছে, যারা সর্বশক্তিমান হিসেবে রুহুল কুদুসের অস্তিত্বই অস্বীকার করে। আর ৩২৫ খৃষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় সমাবেশে এ ‘তিনে মিলে এক মহাসুর’ এ কথার ঘােষণা দেয়া হয়েছিল এবং ৩৮১ খৃষ্টাব্দে কনষ্টানটিনােপলের মহাসমাবেশে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, সর্বশক্তিমান পিতার (সাহায্যের জন্যে) রুহুল কুদুস এবং পুত্র- দুই ব্যক্তিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনাদিকাল থেকে পিতার মধ্য থেকে পুত্রের জন্ম হয়েছে। আর রুহুল কুদুসের আবির্ভাব হয়েছে পিতা থেকে। এরপর ৫৮৯ খৃষ্টাব্দে কর্ডোভার টলেডােতে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় কনফারেন্সে ঘােষণা দেয়া হলাে যে, রুহুল কুদুস পুত্রের মধ্য থেকে আবির্ভূত হতে পারে। এরপর এই বিশেষ দিককে কেন্দ্র করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গির্জাগুলাে বিভক্ত হয়ে যায় তারপর মহাগ্রন্থ আল কোরআন এই মতপার্থক্যের চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেয়। আল কোরআন এ বিষয়ের চূড়ান্ত সমাধান দিতে গিয়ে ঈসা মসীহ(আ.) সম্পর্কে জানায় যে, তিনি হচ্ছেন আল্লাহর এক বিশেষ ক্ষমতা, হাঁ, অবশ্যই তিনি আল্লাহর ক্ষমতার এক নিদর্শন। তার এই নিদর্শন তিনি দান করেছেন মারইয়ামের কাছে এবং তার কাছ থেকে আগত এটা একটা আত্মা এবং অবশ্যই সে একজন মানুষ……….. সে একজন বান্দা মাত্র, যার ওপর আমি মহান আল্লাহ আমার নেয়ামত বর্ষণ করেছি এবং বনী ইসরাঈলের জন্যে তাকে আমার ক্ষমতার এক দৃষ্টান্ত বানিয়েছি। যে বিষয়ে ওরা মতভেদে লিপ্ত ছিল, সে বিষয়টি চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করে দেয়ার জন্যে এ ছিলাে এক চূড়ান্ত ব্যবস্থা। এভাবে তারা মতভেদ করলাে তাকে শূলিতে চড়ানাের বিষয়েও। ওদের মধ্যে কেউ কেউ বললাে, তাকে শূলিতে চড়ানাের পর তিনি মারা গেছেন এবং দাফন করার তিন দিন পর তিনি যিন্দা হয়ে ওঠেন, এরপর তাকে তুলে নেয়া হয় উর্ধ্বাকাশে। ওদের মধ্যে আর এক দল বলেছে, তার বিশিষ্ট সাহাবাদের মধ্যে ইয়াহুদা নামক এক ব্যক্তি ছিলাে। সে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলাে, যার ফলে (আল্লাহর ইচ্ছায়) তার চেহারা ঈসা(আঃ)-এর মত হয়ে গেলাে এবং তাকেই ধরে শূলিতে চড়ানাে হলো। ওদের আর এক দল বলেছে, সাইমুন নামক এক ব্যক্তির চেহারাকে তার মতাে করে দেয়া হলাে এবং তাকে ধরে শূলিতে চড়ানাে হল… তাই কোরআনুল করীম এ বিষয়ে সঠিক ও সুনিশ্চিত কাহিনীর বর্ণনা পেশ করেছে, ‘ওরা তাকে হত্যা করেনি বা শূলিতেও চড়ায়নি, বরং তাদের কাছে সে (ধৃত) ব্যক্তিকে তার মতােই মনে হয়েছিল। এরপর আলকোরআন বলছে, ‘হে ঈসা, অবশ্যই আমি তােমাকে ওফাত দান করব এবং তােমাকে আমার কাছে তুলে নিয়ে আসবে এবং তােমাকে পবিত্র করবাে। এভাবেই, আল কোরআন এ চূড়ান্ত কথা দ্বারা সকল মতভেদের অবসান ঘটিয়েছে। এর আগেই ইহুদীরা তাওরাত পরিবর্তন করে ফেলেছিলাে এবং আল্লাহ তায়ালার আইন-কানুন থেকে তারা সরে গিয়েছিলাে। অতপর আল কোরআন এসে সেই আসল আইনটা চালু করেছে যা আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেছেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, আমি মহান আল্লাহ, তাদের জন্যে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করার জন্যে (বিধান) প্রেরণ করলাম, যাতে বলা হলাে, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং প্রত্যেক যখমের জন্যে রয়েছে অনুরূপ শাস্তি।’ কোরআন তাদের ইতিহাস ও তাদের নবীদের ইতিহাস থেকে সত্য কথাগুলােই তুলে ধরেছে। এ সব কথা সে সকল কাল্পনিক কাহিনী থেকে মুক্ত, যেগুলাে সম্পর্কে তাদের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা এসেছে। নবীদের জন্যে মানহানিকর যেসব বাজে কথা তারা বর্ণনা করেছে, আল কোরআন সেগুলাে থেকে নবীদের পবিত্রতা ঘোষণা করেছে। বনী ইসরাঈলের নেতারা নবীদের সম্পর্কে ভিত্তিহীন যেসব বর্ণনা পেশ করেছে সেগুলাে এতাে অবমাননাকর যে, সেগুলাের দিকে খেয়াল করে দেখলে বিষয়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় এবং প্রশ্ন জাগে, এ জাতি এমন করে আল্লাহর নবীদের সম্পর্কে এসব জঘন্য কথা আরােপ করতে পারলাে? তারা কোনাে একজন নবীকেও সেসব কদর্য অপবাদ থেকে রেহাই দেয়নি। এসব রেওয়ায়াত এক সময় এই ধারণারই জন্ম দেয় যে, শয়তানের তাবেদারি করতে গিয়ে তারা ব্যক্তি বা শ্রেণী স্বার্থকে সর্বদা অগ্রাধিকার দিয়েছে, এ কারণে তাদের নীতি নৈতিকতার মান এতােদূর নেমে গিয়েছিলাে যে, নবীদেরও তারা নিজেদের মতাে আত্ম-পূজারী হিসাবে গণ্য করেছে এবং তাদের ঘিরে বহু অলীক কাহিনীর জন্ম দিয়েছে।
দেখুন, নবী ইবরাহীম(আ.) সম্পর্কে তারা কী জঘন্য কাহিনী বানিয়েছে। তারা দাবী করেছে যে, ফিলিস্তিনের বাদশাহ আবু মালেকের কাছে ইবরাহীম(আ.) তার স্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন। আর এক সময় মিসরের বাদশাহ ফেরাউনের কাছে(তার স্ত্রীকে) তিনি তার বােন পরিচয় দিয়ে পাঠিয়েছেন। যেন তাদের কাছ থেকে সাহায্য সহযােগিতা ও আর্থিক আনুকুল্য লাভ করা যায়। আবার দেখুন ইয়াকুব(আ.) সম্পর্কে তাদের ব্যবহার! ইয়াকুব(আ.)-ই পরে ইসরাঈল বলে পরিচিত হয়েছেন, যার নামে এই জাতির নাম হয়েছে বনী ইসরাঈল। তার পিতা হচ্ছেন ইসহাক(আ.) এবং দাদা ইবরাহীম(আ.) এই ইয়াকুব(আ.) তাঁর পিতা ইসহাক(আ.)-এর মাধ্যমে, দাদা ইবরাহীম(আ.) থেকে চুরি হিলা-বাহানা এবং মিথ্যা কথা বলে বরকত লাভ করেছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এ বরকতের স্বত্ত্বাধিকারী বা ন্যায্য পাওনাদার ছিলাে ইয়াকুব(আ.)-এর বড় ভাই ঈসূ! লূত(আ.) সম্পর্কে তাদের বর্ণনা আরাে জঘন্য, তারা দাবী করে, তার দুই নকন্যা তাকে শারীরিকভাবে উত্তেজিত করে এবং তারা উভয়ই অন্তত এক রাত্রির জন্যে তাকে তাদের শয্যাসঙ্গী বানাতে চেয়েছে, ফলে তাদের গর্বে তার ঔরসজাত সন্তানের জন্ম হবে এবং সেই সন্তান বা সন্তানেরা তার ওয়ারিস হবে এবং তাদের বাপের সম্পদ আর বাইরে যাবে না। আর লৃত (আ.)-এর কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় এ প্রক্রিয়া গ্রহণযােগ্য মনে করা হয়েছে। এর ফলে সে দুই কন্যা যা চেয়েছিলাে তাই পূরণ হয়েছে। নবী দাউদের ব্যাপারে তাদের ঔদ্ধত্য দেখুন। দাউদ(আ.) তার বাড়ীর ছাদ থেকে একজন সুন্দরী স্ত্রীলােককে দেখতে পেয়ে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। তিনি জানতে পারলেন, সে মহিলার স্বামী তারই সেনাবাহিনীর একজন সদস্য; অতপর সে মহিলাকে পাওয়ার জন্যে সে সৈনিককে তিনি এক কঠিন সমরে পাঠিয়ে দেন, যাতে করে সে মারা যায় এবং তাকে পাওয়ার পথ তার জন্যে সুগম হয়ে যায়। আর নবী সােলায়মান(আ.) ওদের কথা অনুযায়ী একবার এক খচ্চরের পূজা করার দিকে (নাউযু বিল্লাহ) ঝুঁকে পড়েন, উদ্দেশ্য প্রচুর যৌনশক্তির অধিকারী হওয়া। কেননা তার এক স্ত্রীকে তিনি অত্যধিক ভালােবাসতেন, কিন্তু তিনি তার যৌনক্ষুধা মেটাতে পারতেন না, এ জন্যে তাকে তিনি ভাড়া দিতে বাধ্য হতেন। [{(বনী ইসলাঈলের এই নর্দমার কীটগুলাে অতীত যমানায় যে এসব করেছে তাই নয় নিজেদের কুলাংগার চরিত্রের মতাে নবীদেরও এ চরিত্র হনন প্রক্রিয়া তারা ইতিহাসের সর্বগ্রেই চালু রেখেছে। তাদের এ আচরণ ইদানীং ধর্মগ্রন্থের পাশাপাশি ইলেকট্রোনিক মিডিয়া তথা চলচ্চিত্র, কম্পিউটার সিডি ও ইন্টারনেটের ওপর গিয়ে ভর করেছে। ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু বলে কথিত হলিউড থেকে যেসব চলচ্চিত্র ইদানীং তৈরী হচ্ছে তার প্রতিটি স্তরে তাদের এ ষড়যন্ত্রের স্বাক্ষর আপনার নধরে পড়বে। ‘কিং সলােমান ও কুইন অব শিবা’ ছবিতে হযরত সােলায়মানকে যৌন বিকৃত একজন প্রেমিক বাদশাহ হিসেবে শিবার রানীর নগ্ন প্রায় দেহের সাথে ঢলাঢলি খেতে দেখানাে হয়েছে। ধর্মভিত্তিক বিখ্যাত ছবি টেন কমান্ডমেন্টস ফেরাউনের মহলে মুসার চরিত্রেও চার্লটন হেস্টনের নৈতিক বেলেল্লাপনা দেখুন। বাছুর পুজার প্রতি হারুনের তীব্র আশক্তির কলংকিত কাহিনীও দেখুন। বৃটিশ টিভির পপুলার কমেডি সিরিজ ‘ও ব্রাইন’-এ হযরত ঈসাকে নির্লজ্জভাবে অপমান করা হয়েছে। ৮০-র দশকের মাঝামাঝি হলিউডের জনৈক ইহুদী পরিচালকের ছবি ‘লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট’ ছবিটি সম্ভবত নোংরামি ও কদর্যে সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এই ছবিতে হযরত ঈসাকে একজন সমকামে আসক্ত ও পতিতা দেখানাে হয়েছে। খৃষ্টানদের ধর্মীয় গুরু পােপ জন পল সহ অনেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু বিশ্বব্যাপী ইহুদী চক্রান্তের পাতানাে জালে সে কন্ঠগুলােও একসময় আটকা পড়ে কোথায় হারিয়ে গেছে, কেউই টের করতে পারেনি। যারা নবী রসূলদের নিয়ে এই নির্মম তামাশা করে তাদের ওপর আল্লাহর গযব শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।-সম্পাদক)}] এমনই এক যুগসন্ধিক্ষণে আল কোরআন নাযিল হলাে এবং নবীদের চরিত্রের ওপর ইসরাঈলীদের আরােপিত কলংক কালিমাগুলাে নিশেষে মুছে দিলাে, যেগুলাে (তাদের দাবী মতে) আসমান থেকে অবতীর্ণ তাওরাতের মধ্যে লিখিত রয়েছে। এভাবে মারইয়াম পুত্র ঈসা(আ.) সম্পর্কে ওদের রটানাে বদনামগুলােও আল কোরআন এভাবে সংশােধন করেছে।
*কোরআন হলো মােমেনদের পথ প্রদর্শক : মহাগ্রন্থ আল কোরআন তার পূর্বে অবতীর্ণ সকল কিতাবের পরিদর্শক, পর্যালােচনাকারী ও অভিভাবক হিসেবে কাজ করেছে এবং সেসব মতভেদের ফায়সালা করে দিয়েছে যার মধ্যে, অন্যান্য কিতাবের অনুসারীরা লিপ্ত হওয়ার ফলে নানা মত ও পথে তারা বিভক্ত হয়ে গেছে এবং কলহ-বিবাদ ও মারামারি-কাটাকাটি করে ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে গেছে। এ হিসেবে আল কোরআন বিবদমান সম্প্রদায় গুলোর মধ্যে অনেকটা বিচারকের ভূমিকা পালন করেছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই এ কিতাব হেদায়াত (পথ প্রদর্শক) ও মােমেনদের জন্যে রহমত।’ হেদায়াত’ এ অর্থে যে, ওদের মতভেদ ও ভুল পথে চালিত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, তাদের জন্যে একটি মাত্র জীবন পথ নিরূপণ করে দিয়েছে এবং সুনির্দিষ্টভাবে তাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে, শান্তি ও কল্যাণের পথ মাত্র একটি। এরপর তাদের জানিয়েছে যে, মহা সৃষ্টির সকল নিয়ম কানুনের সাথে তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে যা কোনাে সময় বদলায় না এবং যে নিয়ম কখনও থেমেও যায় না। এভাবে আল কোরআন তাদের মধ্যে বিরাজমান সকল মতভেদ দূর করেছে, বিভিন্ন মত ও পথের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে তারা যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, সেই কঠিন অবস্থা থেকে তাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। অতপর তাদের পরম করুণাময় আল্লাহর সাথে জুড়ে দিয়েছে, যার সান্নিধ্য লাভ করে তারা ধন্য হওয়ার সুযােগ পেয়েছে, পরম পরিতৃপ্তিতে এবার তাদের মন ভরে ওঠে। শান্তির সাথে নিজেদের পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী ও সকল শ্রেণীর জনগণকে নিয়ে বাস করতে শুরু করে। এভাবে তারা আল্লাহর সম্ভুষ্টিলাভে ধন্য হয় এবং পরকালের সঠিক সাফল্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যায়। মানুষকে নতুন জীবন দান করার জন্যে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের পদ্ধতিই হচ্ছে একমাত্র ও অনবদ্য পদ্ধতি। এই পদ্ধতি অবলম্বনেই তাদের ঘাঁটি প্রকৃতির ধর্মে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কেননা এর মধ্যে সে তার প্রয়ােজনীয় সব কিছু পায়, যা একজন সামাজিক জীব হিসেবে তার পাওয়া প্রয়োজন। এই জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করার মাধ্যমেই সৃষ্টির সব কিছুর সাথে সে সহজেই এবং বিনা কষ্টে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। এই পদ্ধতি অবলম্বনে সে তার জীবনের মূল্যবােধও খুজে পাবে। মানুষ এমন এক বিশ্বে বাস করছে যার মধ্যে বিরাজমান প্রত্যেকটি জিনিস একটি অপরটির সাথে নিশিদিন সহযােগিতা করে চলছে, কোনাে জিনিস একটি আর একটির সাথে মােটেই সাংঘর্ষিক নয়, সাংঘর্ষিক হতেই পারে না। যেহেতু এসব কিছুর মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালাই এগুলােকে তার নিজস্ব পরিকল্পনামাফিক চালাচ্ছেন। তার এই ইচ্ছা ও পরিকল্পনা সঠিকভাবে মােমেন ব্যক্তিই বুঝতে পারে। যখন সে আল্লাহর বিধানমতে এগুলাে ব্যবহার করে তখনই এগুলাে থেকে সে আশানুরূপ ফায়দা পেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এভাবেই মানুষ মহাবিশ্বের সব কিছুকে নিজেদের সর্বাধিক কল্যাণে নিয়াজিত করতে পারে। তাই দেখা যায়, পৃথিবীর যেখানে যখন মানুষ আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে এবং তার বিধান অনুযায়ী সব কিছু ভােগ ব্যবহার করতে চেয়েছে, তখন সেখানে সব কিছুই তার সাথে সহযােগিতা করে তাকে অভাবনীয় কল্যাণ দিয়েছে, মানুষে মানুষে ভালোবাসা বাসি পয়দা হয়েছে, আর তখনই প্রকৃতপক্ষে সকল রূপ ও অর্থে আল্লাহর রহমত অযুত ধারায় দুনিয়ার বুকে নেমে এসেছে।
*দ্বীন বিমুখ অন্ধদের মােকাবেলায় দায়ীদের অবস্থান : এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির আলােচনা শেষে আসুন, আমরা একবার আল্লাহর সেই অপার রহমতের বারিধারার দিকে নযর বুলাই, যা এই কোরআনের ধারক বাহকদের ওপর সিঞ্চিত করা হয়েছে, এটা বনী ইসরাঈলদের বিবদমান বিষয়াদির ফয়সালা করে দিয়েছে, মুমিনদের হেদায়াতের পথে পরিচালনা করেছে এবং তাদের জন্যে তার রহমতের ভান্ডারও অবারিত করে দিয়েছে। সুস্পষ্টভাবে রসূলকে জানিয়ে দিয়েছে যে, তাঁর রব শীঘ্রই তার ও তার জাতির মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন এবং তিনি তার সেই চূড়ান্ত ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা করে দেবেন যা কেউই থামাতে পারবে না। তাঁর এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি রচিত হয়েছে সুনিশ্চিত জ্ঞান ও অবিচল বিশ্বাসের ওপর। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘অতএব (হে নবী), ভরসা করে আল্লাহর ওপর, অবশ্যই তুমি সুস্পষ্ট সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছো। অবশ্যই আল্লাহ রব্বুল আলামীন চিরন্তন। চূড়ান্ত সত্য হিসেবে তিনি সত্যের প্রতি সাহায্য ও সমর্থন দান ঠিক তেমনি অবধারিত ও সুনিশ্চিত করে দিয়েছেন যেমন করে আসমান যমীনের অস্তিত্ব সন্দেহাতীত একটি সত্য, যেমন সত্য রাত ও দিনের আনাগােনাও। এ এমন এক নিয়ম যার মধ্যে কোনাে পরিবর্তন নেই। এ সব কিছু চলছে, ধীর ও মন্থর গতিতে আবর্তিত হচ্ছে, এমন ধীর গতিতে যেন এর বাসিন্দারা ছিটকে না পড়ে যায়, এ হচ্ছে আল্লাহর এক অমোঘ এবং অনির্বচনীয় ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা যে উদ্দেশ্যে তিনি দান করেছেন তা একমাত্র তিনিই জানেন এবং তার সে উদ্দেশ্য সফল করার জন্যেই মূলত এ সব আয়ােজন। এ ব্যবস্থা বিরতিহীনভাবে চলতে থাকবে- এটা আল্লাহর ওয়াদা এবং তিনি তার ওয়াদা কখনও খেলাফ করেন না। এটা অবশ্যই সত্য কথা যে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য- এ কথার ওপর আস্থা রাখা ঈমানের একটি অপরিহার্য অংগ। অতএব এ ওয়াদা পূরণের জন্যে অবশ্যই আমাদের কিছুটা সময় এন্তেযার করতে হবে, তার ওয়াদা পূরণ হবেই এবং সময়মতােই তা পূরণ হবে, তার আগেও নয় পরেও নয়। এরপর কাফেরদের বিরূপ আচরণের মধ্যে রসূলুল্লাহ(স.)-কে সান্তনা দেয়া হচ্ছে। জাহেলিয়াতের মধ্যে অবিচল ও অনড়ভাবে টিকে থাকার জন্যে তাদের জিদ এবং সত্য সঠিক ব্যবস্থা এসে যাওয়ার পরও তার প্রতি অবজ্ঞার কারণে যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছিলাে তা ঝেড়ে মুছে ফেলে আল্লাহর রহমত ও কুদরতের ওপর ভরসা রাখার জন্যে তাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে রসূলুল্লাহ(স.) হঠকারীদের সর্বপ্রকার বাধা-বিপত্তি, বিরােধিতা, ঘৃণা, কটাক্ষপাত, অপমান ও বিদ্রুপবাণ সহ্য করে তার সর্বোত্তম চরিত্র ও মধুর ব্যবহারের মাধ্যমে সত্যের যে বাতি জ্বালানাের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এবং তার দেশবাসীকে অবিশ্রান্তভাবে যে নসীহত করে চলেছিলেন, তার প্রতি আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় তার মনের ওপর যে কঠিন চাপ পড়ছিলাে তা লাঘব করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাকে জানাচ্ছেন, না- ওদের এসব কদর্য ব্যবহার তার দাওয়াতকে কখনই হেয় করতে পারবে না।’ অবশ্যই ওদের মধ্য থেকে কিছু যিন্দা দিল লােক এগিয়ে আসবে, সংখ্যায় কম হলেও তাদের গানগুলো তার কথাকে হেফাযত করবে, তাদের অন্তরগুলোকে তাঁর কথা যথাযথভাবে দোলা লাগবে এবং তারা সর্বান্তকরণে ও পরম বিশ্বস্ততার সাথে তার দাওয়াত কবুল করবে। যাদের দিল মরে গেছে, হেদায়াত ও ঈমানের প্রদীপ্ত প্রদীপ দেখা থেকে যাদের চোখ অন্ধ হয়ে গেছে, কোনােভাবেই তারা সঠিক পথ দেখতে পাবে না, তাদের অন্তরের ঘনান্ধকারের মধ্যে সত্যের জ্যোতি কোনােভাবেই প্রবেশের পথ খুঁজে পাবে না এবং তাদের এই গােমরাহীর মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকা ও সত্য থেকে পালিয়ে বহু দূরে চলে যাওয়া তার কোনােই ক্ষতি করতে পারবে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘(মনে রেখাে,) তুমি মৃত লোকদের কখনাে (তােমার কথা শুনাতে পারবে না, বধিরকেও তােমার আওয়ায শােনাতে পারবে না, (বিশেষ করে) যখন তারা (তােমাকে দেখে) মুখ ফিরিয়ে নেয় (তখন তাে শােনানাের প্রশ্নই আসে না। একইভাবে) তুমি (সত্যের ব্যাপারে) অন্ধদেরও (তাদের) গােমরাহী থেকে (বের করে) সঠিক পথের ওপর আসতে পারবে না, তুমি তাে শুধু তাদেরই (তােমার কথা) শােনাতে পারবে, যারা আমার আয়াতসমূহের ওপর ঈমান আনে এবং সে অনুযায়ী (আল্লাহর কাছে) আত্মসমর্পণ করে।’ আল কোরআনের কী চমৎকার ব্যাখ্যা। এর মধুর ভাষা ও বর্ণনাশৈলী সত্যকে চিত্রিত করেছে এক জীবন্ত সত্ত্বা হিসাবে, যা এমন সব আত্মাকে গতি দান করেছে যার মধ্যে কোনাে চেতনাই ছিলাে না। এরা ছিলাে জড় পদার্থের মত এদের অন্ত ছিলাে পাথরের মতাে চেতনাহীন, এদের রুহগুলো ছিলাে স্থবির, ওদের অনুভূতির মধ্যে বােকামি সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিলাে এবং বোধশক্তি ছিলো নির্বাপিত, অতপর রসূলুল্লাহ(স.) যখন ওদেরে আহবান জানান তখন মৃতের মতাে এরা কোনাে সাড়া দেয় না, এমনকি ওরা ডাক শােনে বলেও মনে হয় না, কারণ মৃতদের যেমন বুঝ থাকে না এদেরও বুঝ শক্তি বলতে কোনাে জিনিস নেই! এদের কোনাে সময় বের করে নেয়া হবে বধির হিসেবে, যেহেতু এদের ডাকলে এরা সাড়া না দিয়ে পিঠ ফিরিয়ে চলে যায়, মনে হয় এরা শােনেই না। ওরা পরস্পরের সামনে এভাবে হাযির হয় যেন তারা নড়ানড়ি করা এক দেহমাত্র যদিও তারা নিজেদের খুবই জ্ঞানী ও অনুভূতিশীল মনে করে! আল্লাহর দৃষ্টিতে মৃত, অন্ধ ও বধিরদের মােকাবেলায় দাড়িয়ে রয়েছে মােমেনরা- এরাই তার দৃষ্টিতে যিন্দা, এরাই সব শুনে, এরাই সব দেখে। এ জন্যেই তিনি বলছেন, ‘তুমি তাদেরই শােনাতে পারবে যারা আমার আয়াতগুলােকে বিশ্বাস করে এবং তারাই মুসলমান।’ অর্থাৎ, তুমি শুধু সেসব ব্যক্তিদের শােনাতে পারবে যাদের অন্তর শােনার জন্যে প্রস্তুত রয়েছে এবং যারা জীবনের সকল সজীবতা দিয়ে, শােনার শক্তি ও দৃষ্টিশক্তি দিয়ে তা গ্রহণ করতে সচেষ্ট হয়ে আছে। জীবনের লক্ষণ হচ্ছে চেতনা থাকা এবং শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির লক্ষণ হচ্ছে তার কাছ থেকে কান ও চোখের খেদমত নেয়া। প্রকৃতপক্ষে মােমেনরাই তাদের জীবদ্দশায় কান ও চোখের সদ্ব্যবহার করে এবং রসূলুল্লাহ(স.)-এর রেসালাতের যিন্দেগীর মধ্য থেকে গৃহীত শিক্ষাসমূহ যথাযথভাবে কাজে লাগায়। রসূলুল্লাহ(স.) তাদের আল্লাহর বাণী শােনান এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তাদের পরিচালনা করেন, যার কারণে মুসলমানরা প্রতি মুহূর্তে ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং নিজেদের অন্তরের আবেগসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্যই ইসলাম একমাত্র ব্যাপক ও সুপ্রশস্ত জীবন ব্যবস্থা, মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান এর মধ্যেই রয়েছে। এ ব্যবস্থা মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সকল দাবী পূরণ করে। এ ব্যবস্থার মধ্যে এমন কোনাে নির্দেশ নেই যা তার জন্যে অকল্যাণকর বা তার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ইসলামের সকল ব্যবস্থা জেনে বুঝে, মন প্রাণ দিয়ে মেনে না নেয়া পর্যন্ত এ ব্যবস্থার সৌন্দর্য, উপযােগিতা ও উপকারিতা বুঝা সম্ভব নয়। কেউ আল্লাহর বিধানের কাছে পুরােপুরি আত্মসমর্পণ করলেই সে দেখতে পাবে যে, এর মধ্যে কোনাে জটিলতা নেই। আর এভাবে আল কোরআন সেসব অন্তরেরই ছবি এঁকেছে, যারা হেদায়াতের দিকে এগিয়ে আছে, সত্য কথা শুনতে সদা সর্বদা প্রস্তুত হয়ে আছে, যারা বাজে তর্ক করে না এবং রসূলুল্লাহ(স.) যে বিষয়ে তাদের আহ্বান জানাচ্ছেন সে বিষয়ে পুনরায় চিন্তা করার কোনাে দরকার মনে করে না, তারাই হচ্ছে মােমেন।
*কেয়ামতের কিছু আলামত : এরপর সূরাটির মধ্যে বর্ণিত শেষ ঘটনা বলার পূর্বে আর একটি পরিভ্রমণের কথা আসছে। তা হচ্ছে, আখেরাতের পূর্ব শর্তসমূহ ও তার কিছু দৃশ্য সম্পর্কে ……. এ পরিক্রমায় উল্লেখিত হয়েছে অদ্ভুত এক জন্তুর আগমনের কথা, যা মানুষের সাথে কথা বলতে শুরু করবে, কথা বলতে থাকবে তাদের সাথে যারা ঈমান আনবে না। এ হবে এমন এক ঘটনা, যা সৃষ্টির বুকে বিরাজমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ক্ষমতার নিদর্শনাবলীর অন্যতম। এ নিদর্শন রােয হাশরের দৃশ্যের এক চমৎকার ছবি অংকন করবে, যে আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শনাবলী প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্যে এক প্রচন্ড ধমক হিসেবে কাজ করবে। এসব অবস্থা দেখে সে হঠকারী কাফেরদের দল বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাবে, তাদের মুখ দিয়ে কোনাে কথা সরবে না। অতপর এ দৃশ্য থেকে তাদের নযর আবার ফিরিয়ে দেয়া হবে রাত ও দিনের মধ্যে বর্তমান আরাে নিদর্শনসমূহের দিকে, যা দিবানিশি তাদের চোখের সামনে ভাসছে, তবু তারা দেখছে না। দ্বিতীয় বারের মত পুনরায় তাদের সেই দিনের সেই ভয়ানক দৃশ্যের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে যে দিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, শিংগায় ফুঁক দেয়ামাত্রই দেখা যাবে পাহাড় পর্বতগুলাে স্থানচ্যুত হয়ে চলতে শুরু করেছে এবং সবকিছু মেঘমালার মতাে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমনই কঠিন সময়ে তাদের নিরাপদে অবস্থানকারী ও এহসানকারী আর একটি দলকে সামনে আনা হবে, আর এদের পাশাপাশি থাকবে অন্যায়কারীদের আর একটি দল, যাদের চেহারাগুলাে আগুনের মধ্যে ঝলসে দেয়া হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের ওপর কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় এসে যাবে, আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাদের জন্যে পৃথিবী থেকে এমন একটি জন্তু বের করবাে যে ওদের সাথে কথা বলবে, বলবে, হে মানুষ, আমরা (আল্লাহর ক্ষমতার) নিদর্শনগুলাে বিশ্বাস করতাম না।'(আয়াত ৮২) যেদিন আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ সেসব লােকের প্রত্যেক দল থেকে কিছু কিছু জনসমষ্টিকে আলাদা আলাদা আলাদা করে একত্রিত করবে, যারা আমার আয়াতগুলাে প্রত্যাখ্যান করতাে। সেসব জনগােষ্ঠীকে আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘তােমরা যা কিছু করছিলে তা কোনো (নিশ্চিত) জ্ঞানের ভিত্তিতে তাে করনি।'(আয়াত ৮৩-৮৫) ‘ওরা কি দেখেনি যে আমি মহান আল্লাহ, বানিয়েছি রাত্রিকে যেন… তারই প্রতিদান দেয়া হবে যা তােমরা করেছ।'(আয়াত ৮৬-৯৩) ওপরে বর্ণিত সে বিশেষ জন্তুটি সম্পর্কে বহু হাদীস এসেছে, সেগুলাের মধ্যে কিছু কিছু বিশুদ্ধ হাদীস আছে, কিন্তু সে সহীহ হাদীসগুলাের মধ্যে উপরােল্লিখিত জন্তুর চেহারা ছবি কেমন হবে সে বিষয়ের কোনাে বর্ণনা নেই। যেসব রেওয়ায়াত গ্রহণযােগ্য নয় সেগুলােতে সে জন্তুর গুণাগুণ বর্ণিত হয়েছে। এ জন্য আমরা এ গুণাগুণ সম্পর্কে আলােচনা থেকে বিরত রইলাম। তবে সেসব বর্ণনার মধ্যে যে কথাগুলাে পাওয়া যায় তা হচ্ছে, এ জন্তুটির দৈর্ঘ হবে ষাট হাত, তার শরীর থাকবে ঘন মোলায়েম পশমে ঢাকা, তার পাখনা ও ক্ষুর থাকবে, তার দাড়ি থাকবে, মাথা হবে ষাঁড়ের মাথার মতো, তার চোখ হবে শুয়ােরের চোখের মতাে, কান হবে হাতির কানের মতাে, নর হরিণের শিংয়ের মতাে হবে তার শিং। ঘাড় হবে উট পাখির ঘাড়ের মতাে, বুক হবে সিংহের বুকের মতে, রং হবে চিতা বাঘের রংয়ের মতাে, পাছা হবে বিড়ালের পাছার মতাে, লেজ হবে পুরুষ ভেড়ার লেজের মতাে এবং ঠ্যাংগুলাে হবে উটের ঠ্যাংয়ের মতাে…. এভাবে শেষ পর্যন্ত আরও যেসব বর্ণনা পাওয়া যায়, তার বর্ণনা করতে গিয়ে তাফসীরকাররা বেশ মুশকিলে পড়ে গেছেন। তবে কোরআন ও সহীহ হাদীসে প্রাপ্ত বর্ণনার ওপর তৃপ্ত থাকাই আমরা যথেষ্ট মনে করি, যা সুনিশ্চিতভাবে আমাদের এতােটুকু জানায় যে, অকল্পনীয় এই জন্তুটি হবে কেয়ামতের লক্ষণাবলীর অন্যতম। যখন এ জন্তুর আবির্ভাব হবে তখন তাওবার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে, তখন তাওবা করলে কোনাে ফায়দা হবে না। তখন যারা দুনিয়ায় থাকবে তাদের ওপর আযাব নাযিল হওয়াটা অবধারিত হয়ে যাবে, যেহেতু তখন কারও তাওবাই কবুল করা হবে না। তখন যারা যে যে আমল আখলাকের ওপর অবস্থান করবে সে অনুযায়ীই তাদের সাথে ব্যবহার করা হবে।… এমনই কঠিন সময়ে আল্লাহ তায়ালা তাদের তার ক্ষমতা দেখিয়ে দেয়ার জন্যে এ অভূতপূর্ব জানােয়ারটি বের করবেন, যা তাদের সাথে কথা বলবে। বাস্তবে আমরা জানি, কোনাে জন্তু জানােয়ারই কথা বলে না, বা মানুষ তাদের কথা বুঝে না, কিন্তু সেদিন মানুষ এ জানােয়ারটির কথা বুঝবে এবং জানতে পারবে যে, এটা এক অলৌকিক জীব, যা কেয়ামতের আলামত হিসেবেই পাঠানাে হয়েছে। সুস্পষ্টভাবে তখন মানুষ বুঝে যাবে যে, কেয়ামত অত্যন্ত কাছে এসে গেছে। বিশেষভাবে সেসব সীমালংঘনকারী হঠকারী-নাফরমানদের জন্যেই এ চূড়ান্ত আলামত পাঠানাে হবে যারা আল্লাহর আয়াতগুলাে বিশ্বাস করে না এবং ওয়াদা করা কেয়ামতের আগমন সংবাদ প্রত্যাখ্যান করে। সূরা নামলের মধ্যে যেসব বর্ণনা এসেছে তাতে আমরা অনেকগুলাে দৃশ্য এক সাথে দেখতে পাই। সেখানকার বর্ণনায় অতি সংক্ষেপে উল্লেখিত হয়েছে সােলায়মান(আ.), কীট-পতংগ, পাখী ও জ্বিন জাতির কথা। অতপর এসেছে সে বিশেষ জন্তুর, বর্ণনা যার সাথে মানুষ কথা বলবে। এই অভিনব জীবের আগমন সংবাদ সূরার মধ্যে উল্লেখিত আরও বহু অলৌকিক ঘটনা বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যশীল। এ বর্ণনা আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত আরাে বহু বর্ণনার সাথে সংগতিপূর্ণ। কেয়ামতের দিন সাধারণ যে দৃশ্যটি সামনে আসবে এবং তার মধ্যে যতাে কিছু সংঘটিত হবে, সে সবের একটি সমন্বিত চিত্র এ সূরার মধ্যে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে।(দেখুন, ‘আত্তাসওয়ীরুল ফাননি ফিল কোরআন’ নামক গ্রন্থটির মধ্যে ‘ফাসলুত্তানাসুকুল ফান্নি’ নামক অধ্যায় (পৃঃ ৮৬-১০৭) ৩য় সংস্করণ) এ প্রসংগের ব্যাখ্যায় জানা যায় যে, কেয়ামতের যেসব আলামত এ সূরাটির মধ্যে বর্ণিত হয়েছে তা কেয়ামতের নিকটবর্তী হওয়া সম্পর্কে বুঝানাের জন্যে যথেষ্ট। *দ্বীনের প্রত্যাখ্যানকারীদের করুণ পরিণতি : ‘সেদিন, যেসব জনগােষ্ঠী আমার আয়াতগুলাে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের মধ্য থেকে একটি দলকে আমি আলাদা করে নেবাে। অতপর পৃথকভাবে তাদের সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে।’ সকল মানুষকেই সেদিন হাশরের ময়দানে একত্রিত করা হবে, তাদের মধ্য থেকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে তাদের কথা, যারা নবী ও নবীর আনীত কেতাবকে মিথ্যা সাব্যন্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তাদের আলাদাভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে’, অর্থাৎ প্রথম সারিতে যারা থাকবে তাদের থেকে আলাদা করে তাদের টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে এমন সব লােকদের সামনে, যারা কোনাে অন্যায় কাজে কখনাে অগ্রণী ভূমিকা নেয়নি। এই দাঁড়ানাের ব্যাপারে তাদের ইচ্ছা, আকাংখা এখতিয়ার কোনাে কিছুই খাটানাের কোনাে উপায় থাকবে না। এমনকি যখন ওরা আসবে, বলবে, ‘তােমরা কি আমার আয়াতগুলােকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছিলে। অথচ তােমাদের তাে সে বিষয়ে কোনাে জ্ঞান ছিলাে না। আর যদি এটা নাই করে থাকো, তাহলে বলাে না, কি করছিলে তােমরা?…’ আসলে এটা এমনই একটা প্রশ্ন হবে যে, সেদিন চুপ থাকা ও পেরেশান হওয়া ছাড়া যার কোনাে জওয়াব সেদিন তাদের কাছে থাকবে না; যার কাছে প্রশ্ন করা হবে তার অবস্থাটা সেদিন এমনই দাঁড়াবে যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং এ কষ্টের কথা অন্তরের মধ্যে চেপে রাখা ছাড়া তাদের কোনাে উপায়ই থাকবে না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের যুলুমের কারণে তাদের ওপর আযাবের ওয়াদা সেদিন পূর্ণ হয়ে যাবে, কিন্তু তখন তারা কোনাে কথাই বলতে পারবে না।’ অর্থাৎ দুনিয়ায় তারা যেসব যুলুমে লিপ্ত ছিলাে তারই কারণে তাদের ওপর আমার ফয়সালা কার্যকর হয়ে যাবে। তারা চরম অস্থিরতা অনুভব করতে থাকবে এবং তারা সবাই নির্বাক অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকবে। ইতিমধ্যেই সে অভিনব জন্তুটার আবির্ভাব হয়ে যাবে এবং মানুষের সাথে সে জন্তুটি কথা বলতে শুরু করবে। এ সময়ে আল্লাহর অসীম ক্ষমতা তারা চোখে দেখতে পাবে। এ জন্যে তারা আর কোনাে কথাই বলতে পারবে না। এই হচ্ছে আল কোরআনের চমৎকার ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন পদ্ধতি এবং আল্লাহর নিদর্শনসমূহ, যার বর্ণনা আল কোরআন আমাদের সামনে পেশ করেছে। এ প্রসংগে যে পরিভ্রমণের কথা বলা হয়েছে তার সাথে সাথে পরবর্তীতে আর একটি বিশেষ অবস্থা আসবে বলে জানানাে হয়েছে, আর তা হচ্ছে দুনিয়ার দৃশ্য ও আখেরাতের দৃশ্যের এক সন্ধিক্ষণ। এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থার দিকে গমনের দৃশ্য। রসূলুল্লাহ(স.)-এর মুখ দিয়ে যখন একথাগুলাে বেরােচ্ছিলাে, তখন চরম হঠকারীও স্থির থাকতে পারছিলাে না, তারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলাে।
*আল্লাহর নিদর্শন ও কেয়ামতের মহাপ্রলয় : হাশরের ময়দানে, আল্লাহর আয়াতগুলাে প্রত্যাখ্যানকারীরা কী ভীষণ দুরবস্থার মধ্যে পড়ে যাবে, এখানে তার দৃশ্য তুলে ধরার পর দৃষ্টি পুনরায় দুনিয়ার দৃশ্যাবলীর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব দৃশ্য মানুষের মধ্যে গভীর আবেগ সৃষ্টি করার জন্যে যথেষ্ট, যে আবেগ তাদের প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান নিয়ম শৃংখলা সম্পর্কে চিন্তা করতে আহ্বান জানায়, আহ্বান জানায় তাদের সেসব জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করতে, যা সাধারণভাবে তাদের নযরের সামনে ভাসছে এবং বিশ্বের সবকিছু তাদের অন্তরে এ কথা জাগায় যে, এ সবের মূলে অবশ্যই আছেন এমন এক ক্ষমতাধর সত্ত্বা, যাকে নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। তিনিই সবার এবং সব কিছুর নিয়ন্ত্রণকারী এবং একমাত্র তিনিই সবাইকে পরিচালনা করছেন, তাদের সবার জন্য জীবন ধারণের যাবতীয় সামগ্রী তিনিই যােগাড় করে দিচ্ছেন, তাদের জন্যে সর্বপ্রকার আরাম-আয়েশের উপাদান সরবরাহ করা এসব একমাত্র তারই দান। তিনিই সৃষ্টির সব কিছু তাদের জীবনের জন্যে উপযােগী বানিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ সবের কোনােটাই তাদের ক্ষতির জন্যে নয়, নয় তাদের জীবন বিপন্ন করার জন্যে বা তাদের জীবনের সাথে সংঘর্ষশীল বানিয়ে এগুলাে তাদের জীবনকে ব্যাহত করার জন্যে নয়, বা তাদের জীবন চিরস্থায়ী বানানাের জন্যেও নয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা কি দেখছে না যে, আমি রাত্রিকে এমনভাবে বানিয়েছি যে, তার মধ্যে তারা শান্তি পায়, আর বানিয়েছি দিনকে দেখার জন্যে, অবশ্যই এসব কিছুর মধ্যে রয়েছে (রব্বুল আলামীনকে চেনার জন্যে) বহু নিদর্শন- সেই জাতির জন্যে যারা ঈমান রাখে।’ রাত্রির দৃশ্য হচ্ছে, তা আরাম ও শান্তি আনয়নকারী ক্লান্তিহারক, দিনের অবস্থা হচ্ছে, তা প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান দৃশ্যসমূহ থেকে দেখার কাজে মানুষকে সাহায্য করে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সৃষ্ট এই দুটি প্রাকৃতিক অবস্থা মানুষের মধ্যে আপনা থেকেই এক আনুগত্যবােধ জাগায় এবং আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সাথে তার গভীর একটা সম্পর্ক সৃষ্টি করে। তাকে জানায় যে, তিনিই রাত ও দিনের আনাগােনা নিয়ন্ত্রণ করেন। রাত ও দিন, এ দুটি অবস্থার দিকে তাকিয়ে মানুষ যদি একটু চিন্তা করে তাহলে অবশ্যই এ অবস্থা তার অন্তরের মধ্যে ঈমানী যােগ্যতা পয়দা করবে, কিন্তু আফসােস, গভীর দৃষ্টিতে মানুষ এগুলাের দিকে তাকায় না বলেই তারা ঈমান আনে না, ঈমান আনতে সক্ষম হয় না। রাত বলতে কোনাে অবস্থা যদি না হতাে তাহলে সারাক্ষণ দিনই থাকত এবং পৃথিবীর বুকে জীবনের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেতাে। এমনি করে যদি সারাক্ষণ ব্রত হতাে তাহলে জীবন অসম্ভব হয়ে যেতাে, শুধু তাই নয়, যদি বর্তমানের তুলনায় রাত বা দিন, যে কোনােটাই দশ গুণ বেশী বা কম হতাে তাহলে পৃথিবীর সব কিছু জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যেতাে, অথবা সব গাছপালা জমে বরফ হয়ে যেতাে এবং পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে যেতাে। এজন্যে এক বিশেষ উদ্দেশ্যেই এবং এক বিশেষ পরিমাপমতাে রাত ও দিনের আনােগােনা চালু রাখা হয়েছে, যাতে করে জীবনের প্রয়ােজনে এসব অবস্থা মানুষের খেদমত করতে পারে, এই জন্যেই বলা হয়েছে, রাত্র-দিনের আনাগােনার মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তবু ওরা ঈমান আনে না।’ পৃথিবীতে রাত ও দিন- এ দুটি নিদর্শন থেকে এবং সৃষ্টির বুকে বিরাজমান এই সূক্ষ্ম নিয়ম শৃংখলার মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত চিন্তাশীল লােকরা আল্লাহর অস্তিত্ব ও ক্ষমতার নিদর্শন দেখতে থাকবে, তারা এসব থেকে শিক্ষা নেবে যারা অন্তরের চোখ দিয়ে সেই দৃশ্যের দিকে তাকাবে, শিংগায় ফুঁক দেয়ার দিনে সেই ভয়ানক অবস্থার দিকে দেখবে, যা সারা আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং সকল সৃষ্টির ওপর নেমে আসবে, তবে এই কঠিন অবস্থা থেকে তারাই রেহাই পাবে যাদের আল্লাহতায়ালা বাঁচাতে চাইবেন। যে পর্বতমালা সারা পৃথিবীকে মযবুত করে রেখেছে, যাদের তিন ভাগের এক ভাগ উপরে এবং বাকি তিন ভাগের দুই ভাগ মাটির নীচে থাকার কারণে সেগুলাে খুঁটা বা আওতাদ’ হিসেবে কাজ করছে। যেগুলাে দৃঢ়তা দান করার প্রতীক হিসাবে কাজ করে চলছে সেসবই সমূলে উপড়ে গিয়ে সঞ্চালিত হতে থাকবে এবং শেষে সেই ভয়াবহ দিন আসবে যেদিন সত্য ও সৎ পথ অবলম্বীদের পুরস্কার হিসেবে নিরাপত্তা ও কল্যাণ এবং হঠকারী ও অন্যায়কারীদের জন্যে চরম আতংক নেমে আসবে, পরিশেষে আসবে দোযখের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার চরম শাস্তি। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যে দিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে… তােমাদের তারই প্রতিদান দেয়া হবে যা তােমরা (পৃথিবীর জীবনে) করে এসেছে।'(আয়াত ৮৭-৯৩) উল্লেখিত এই শিংগা হচ্ছে এক ভয়ংকর বাঁশি, যার প্রলয়ংকর আওয়ায হবে এমন ভয়ানক যা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল অধিবাসীদের গ্রাস করে ফেলবে। এ কঠিন অবস্থা থেকে তারাই শুধু বাঁচতে পারবে এবং তারাই নিরাপদ থাকবে যাদের প্রতি মহান আল্লাহর মেহেরবানীর দৃষ্টি থাকবে। বলা হয়েছে, যারা নিজেদের আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে বিলিয়ে দিয়েছেন এবং তার উদ্দেশ্যেই শাহাদাত বরণ করেছেন, সেই শহীদরা সে ভয়ানক অবস্থা থেকে নাজাত লাভ করবেন। সে অবস্থায় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল অধিবাসী বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে, একমাত্র তারা ছাড়া যাদের স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বাঁচিয়ে নেবেন। এরপর আসবে পুনরুত্থান দিবসের শিংগার ফুৎকার। তারপর আসবে আর একটি শিংগা ফুৎকার। এর ফলে সবাই এক বিশাল প্রান্তরে সমবেত হবে। এরশাদ হয়েছে, ‘সমবেতভাবে ওরা এগিয়ে আসবে তার কাছে অবনত মস্তকে ও হীনতার সাথে, সেদিন তারা আত্মসমর্পণকারী হয়ে যাবে।’ এই ভয়-ভীতির সাথেই সেই প্রলয়ংকরী মহা উলট পালট সংঘটিত হবে, যা গােটা বিশ্বকে ধংস করে দেবে। বিশ্বের চারদিকে আবর্তনরত সকল ব্যবস্থা লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। এই বিপ্লব শুরু হলে আকাশচুম্বী পর্বতগুলাে চলতে শুরু করবে এবং এতাে হালকা ও দ্রুততা থাকবে এর মধ্যে, যেন এগুলাে সব ভাসমান মেঘমালা। আর পর্বতসমূহের এই চলতে থাকার দৃশ্য হবে এক প্রচন্ড ভীতিজনক দৃশ্য। যা দেখা তাে দূরে থাক, এর বিবরণ শুনলেও মানুষের অন্তর কাঁপতে থাকে। তখন মনে হয়, যত প্রকার ভয়ের জিনিস থাকতে পারে এ ভয়ংকর দৃশ্য সব কিছুর উর্ধ্বে। এ ভয় যখন মনের ওপর চেপে বসে তখন মানুষ সকল শক্তি হারিয়ে ফেলে, পেরেশানীতে হুঁশ হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়, এমনভাবে এ ভয় গােটা দেহ মনের ওপর জেঁকে বসে যে, তা আর নামতে চায় না, এমন এক অস্থিরতা এসে যায় যে, মানুষ সকল স্বস্তি হারিয়ে ফেলে। এরশাদ হচ্ছে, ‘এসব আল্লাহর কীর্তি, তিনি সব কিছুকে মযবুত বানিয়েছেন।’ মহান আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে পবিত্র। এই অস্তিত্বের সব কিছুর মধ্যে তার নিপুণ কর্ম-কুশলতা প্রকাশ পায়। তিনি যা কিছু করতে চান তা যে কোনাে সময়ে করতে পারেন। তার কোনাে ব্যর্থতা নেই বা তাঁর কাজ বাধাগ্রস্ত করারও কেউ নেই। তার কীর্তিসমূহের মধ্যে কোনাে কমতি কিংবা কোনাে ত্রুটি নেই, কোনাে গরমিল বা কোনাে ভ্রান্তি নেই। তাঁর বিস্ময়কর সকল কীর্তির মধ্যে সুচিন্তিত এক পরিকল্পনা দেখা যায়। এমন নয় যে, যে কোনাে একটি উপাদান দ্বারা তিনি এ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, যার সাথে অন্য কোনাে জিনিসের কোনাে সম্পর্ক নেই; বরং ছােট-বড়, গুরুত্বপূর্ণ, কম গুরুত্বপূর্ণ সব কিছুই তিনি পয়দা করেছেন এবং পরিকল্পনার অধীন এক নির্দিষ্ট হিসাব অনুযায়ী। প্রতিটি জিনিসই এক বিশেষ উদ্দেশ্যে, সুনির্দিষ্ট এক বিধানমতে সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের সংযােগ রয়েছে। একটি আর একটির সম্পূরক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে ।(সূরায়ে ফোরকান এর আয়াত ‘ওয়া খালাকা কুল্লা শাইইন ফাক্কদ্দারাহু তাক্বদীরা’-র তাফসীরে দেখুন) অবশ্যই তিনি প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে খবর রাখেন। রব্বুল আলামীনের কাছে যখন মানুষ সেই হিসাব দিবসে পৌছবে, সেদিন তিনি তাদের সকল কাজের হিসাব গ্রহণ করবেন। প্রত্যেকটি জিনিসকে তিনি যে পূর্ণতা দান করেছেন, অবশ্য তা এক বিশেষ পরিমাপমতােই দিয়েছেন। সবাই সেই ওয়াদা করা নির্দিষ্ট দিনে হাযির হবে- এক মুহূর্ত আগেও নয় এক মুহূর্ত পরেও নয়। সেদিন তারা সবাই নিজ নিজ কর্মফল ভােগ করবে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির জন্যে যে চিরস্থায়ী বিধান পাঠিয়েছেন। সেই অনুসারে প্রত্যেকেই নিজ নিজ পাওনা বুঝে পাবে। এভাবে উভয় জীবন ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের মধ্যে একটি যােগসূত্র স্থাপিত হবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর সৃষ্টি, যার দ্বারা সকল জিনিসকে তিনি পূর্ণত্ব দান করেছেন… অবশ্যই খবর রাখেন যা কিছু তােমরা করছো। এই কঠিন ও ভয়াবহ দিনে (কাফেরদের জন্যে যেমন নানাপ্রকার শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে, তেমনি) মােমেনদের জন্যেও নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা থাকবে। তারা সর্বপ্রকার ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত থাকবে। তারা দুনিয়ার জীবনে যেসব ভালাে কাজ করেছে এবং মানুষের সাথে যে সদ্ব্যবহার করেছে, তারই প্রতিদানস্বরূপ তারা এই বাড়তি পুরস্কার পাবে। অর্থাৎ প্রতিদান ও পুরস্কার হিসেবে যা পাওয়ার তা তাে পাবেই, মান সম্ভ্রম, নিরাপত্তাবােধ ও নিশ্চিন্ত হবে তাদের অতিরিক্ত পুরস্কার এবং এটা এতােবেশী তারা পাবে, যা হবে তাদের পাওনার চাইতেও অনেক বেশী। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে কোনাে নেক কাজ নিয়ে আসবে, তাকে তার উচিত প্রতিদান থেকেও উত্তম প্রতিদান দেয়া হবে, তারা সেদিনকার কঠিন ভয় থেকে নিরাপদ থাকবে।’ প্রকৃতপক্ষে সে দিনের প্রচণ্ড ভয় থেকে নিরাপদ থাকাটাই হবে বড় প্রতিদান, এরপর অন্য যা কিছু দেয়া হবে তা হবে আল্লাহর অতিরিক্ত মেহেরবানী এবং এহসান। তারা দুনিয়াতে আল্লাহকে সর্বদা ভয় করে চলেছে; সুতরাং দুনিয়ার ভয় এবং আখেরাতের আতংক আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে একত্রিত করবেন না; বরং তিনি আসমান যমীনের যাবতীয় আতংক থেকে ওদের নিরাপদ রাখবেন। পরবর্তীতে এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা সেদিন আসবে মন্দ কাজ নিয়ে, তাদেরকে তাদের মুখের ওপর উপুড় করে দোযখের মধ্যে ফেলে দেয়া হবে।’ এ হবে এক ভয়ানক দৃশ্য, তাদের মুখের ওপর তাদেরকে (ধাক্কা মেরে) জাহান্নামের আগুনের মধ্যে ফেলে দেয়া হবে। এরপর তাদের ওপর ধ্বংসকর আযাব এবং তিরস্কার বাড়তেই থাকবে। বলা হবে, ‘তােমাদের সেই কাজেরই প্রতিদান দেয়া হচ্ছে, যা কিছু তােমরা দুনিয়ায় করে এসেছো।’ দুনিয়ার জীবনে সঠিক পথকে তারা লাঞ্ছিত করেছিলাে, এজন্যেই আগুনের মধ্যে ফেলে তাদের ঝলসে দেয়া হবে এবং দোযখের সেই কঠিন আগুনে মুখের ওপর উপুড় করে ফেলে দেয়া হবে। দুনিয়াতে ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট সত্য থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাে, অথচ এ মহা সত্য তাদের কাছে দিন ও রাতের মতােই পরিস্কার ছিলাে।
*আল্লাহর সার্বভৌমত্বই ইসলামের মূল চেতনা : পরিশেষে আসছে আখেরাতে যা ঘটবে সে অবস্থাসমূহের বিবরণ। যেসব দৃশ্যের বর্ণনা দান করে রসূলুল্লাহ(স.) তাঁর দাওয়াত এবং তার মিশনের নির্যাস তুলে ধরছেন, তাদের সেই গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন যার বর্ণনা দ্বারা তাদের মন-মগয ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা বহুলাংশে সম্ভব হয়েছে। তারপর আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতিত্বের কথা ঘােষণা দ্বারা এ অধ্যায়টির সমাপ্তি টানা হচ্ছে। এই অধ্যায় শুরু করা হয়েছিলাে তার প্রশংসা দ্বারা, পুনরায় তাদের সামনে তার নিদর্শনসমূহ তুলে ধরে তাদের চূড়ান্তভাবে সেসব কাজের হিসবে নেয়ার জন্যে আহ্বান জানানাে হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন আমি এবাদাত করি এই শহরের রবের, যিনি একে সম্মানিত করেছেন, তিনিই সব কিছুর মালিক… তোমার রব গাফেল নন সেসব জিনিস থেকে, যা তােমরা করে চলেছে'(আয়াত ৯১-৯৩) মক্কাবাসীরা এই সম্মানিত শহর ও মর্যাদাপূর্ণ ঘরের দোহাই দিয়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতাে। এ ঘরের সম্মানের সাথে তারা জড়িত, একথা বলে তারা গােটা আরবের বুকে নিজেদের প্রাধান্য কায়েম করে রেখেছিলাে। এই ঘরের কারণেই তাদের ধারণা ছিলাে যে, তারা সমগ্র আরবের নেতা। এর পরেও তারা মহান আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানা কায়েম করতে প্রস্তুত ছিলাে না। যিনি এই পবিত্র ঘরকে মর্যাদাবান বানিয়েছেন এবং তাদের জীবনের জন্যে যা কিছু প্রয়ােজন, সবই এই ঘরের ওসীলাতেই পূরণ করার ব্যবস্থা করেছেন। রসূলুল্লাহ(স.) যথাযথভাবেই আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব চালু করার কাজ করে চলেছেন। এ জন্যে তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা দিচ্ছেন, তাকে এই ঘরের রবেরই বন্দেগী (পূর্ণাংগ ও নিরংকুশ আনুগত্য) করতে হুকুম দেয়া হয়েছে, যাকে তিনি মর্যাদাপূর্ণ বানিয়েছেন তার কোনাে শরীক নেই। পূর্ণাংগ ইসলামী চিন্তা চেতনা এই কথাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে যে, সমগ্র বিশ্বের সর্বময় কর্তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা, আর এই শহরের যিনি রব, তিনি প্রতিপালক ও মালিক, সৃষ্টিজগতের সকল কিছুর মালিকানা একমাত্র তার।’ এরপর রসূলুল্লাহ (স.) ঘােষণা করছেন যে, তাকে হুকুম দেয়া হয়েছে, যেন তিনি পরিপূর্ণভাবে যারা আত্মসমর্পণকারী হয়ে গেছে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। মুসলমানদের যা কিছু আছে সেসব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা একথা তারা যেন সর্বান্তকরণে স্বীকার করে। এই মালিকানায় অন্য কেউ সামান্যতম অংশীদার, এ কথা কোনােভাবেই যেন তারা না মানে বা চিন্তা না করে। তারা সেসব জনপদের মানুষ বলে বিবেচিত যারা সর্বযুগে একমাত্র আল্লাহর কাছে পুরােপুরিভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। এটাই হচ্ছে তার দাওয়াতের মূল কথা, এটাই মুসলমানদের পরিচালিকা শক্তি। আর এই দাওয়াতের ওসীলাই হচ্ছে আল কোরআনের তেলাওয়াত, এটাই হচ্ছে তার মূল প্রাণশক্তি। তাই রসূলুল্লাহ(স.)-কে বলতে বলা হচ্ছে, (আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে) আমি যেন আল কোরআন তেলাওয়াত করি। সুতরাং এটা পরিষ্কারভাবে বুঝা গেলাে যে, কোরআন এই দাওয়াতের কিতাব, দাওয়াতের বিধান, তাকে এ কোরআন দিয়েই কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে বলা হয়েছে। একমাত্র এরই মধ্যে রয়েছে অন্তরাত্মা ও বুদ্ধি-বিবেকের সাথে জেহাদের সকল মাল মসলা, এরই মধ্যে রয়েছে মানুষকে সকল দিক দিয়ে গড়ে তােলার জন্যে সকল প্রকার প্রয়ােজনীয় শিক্ষা। জ্ঞানভান্ডার ও চেতনাসমূহের গতিপথও রয়েছে এখানে। এ পাক কালামের মধ্যে এমন কিছু আছে যা অনুসন্ধানী অন্তরসমূহকে প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত করে এবং এমন চিন্তার সৃষ্টি করে যে, তারা স্থির থাকতে পারে না। এরপর যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কে যে বিধান দেয়া হয়েছে তা শুধুমাত্র এই জন্যে যে, তারা যেন সকল প্রকার বিপদ-আপদে আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ও সত্য বিরােধীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারে, এ মহান কোরআনের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার আযাদী লাভ করতে পারে এবং তারা যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সরকারী ক্ষমতা লাভ করে আল্লাহর যমীনে তার আইন-কানুন চালু করতে পারে। আসলে ইসলামের দাওয়াত দান করার জন্যে দাওয়াতের এ মহান কিতাব যথেষ্ট। ‘আর আমি যেন কোরআন তেলাওয়াত করতে পারি।’ ‘অতএব, যে হেদায়াত কবুল করবে সে তার নিজের স্বার্থেই হেদায়াত কবুল করবে, যে ব্যক্তি ভুল পথ ধরবে তুমি তাকে বলে দাও, অবশ্যই আমি একজন সতর্ককারী মাত্র।’ ওপরের আয়াতটিতে বুঝা যাচ্ছে, আল্লাহর বিচারে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বক্তিগতভাবে তার পরিণতি ভােগ করতে হবে। সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে হােক বা ভুল পথের পথিক হওয়ার কারণে হােক। ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে ব্যক্তি নিজ নিজ কর্মের জন্যে দায়ী হবে বলার কারণে, প্রকৃতপক্ষে মানুষের সম্মানই বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা কারও জন্য অন্য কাউকে পুরােপুরিভাবে দায়ী করা হবে না- এটাই ইসলামের বিধান। এ জন্য বিরাট বিরাট দলকে কখনও এক সাথে হুকুম দিয়ে ঈমানের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা হয়নি। এ দাওয়াতদান শুরু হয়েছিলাে কোরআনের তেলাওয়াত দ্বারা, যারা ঈমান আনতে থাকলাে তাদের স্বেচ্ছায় ঈমানের দাবী অনুসারে কাজ করার জন্যে ছেড়ে দেয়া হলাে। এটা ছিলাে ইসলামের বৈশিষ্ট্য, তার আবেদনের সূক্ষ্ম ও গভীর গ্রহণযােগ্যতা, তার মায়াভরা আকর্ষণ, যা মানব প্রকৃতি মহব্বতের সাথে কাছে টেনে নেয়। তার সম্মােহনী শক্তি মানুষের অন্তরের মধ্যে যে আবেদন সৃষ্টি করে, তা হচ্ছে, ‘এ ব্যবস্থা তাে আমাদের জন্যে সার্বিক কল্যাণের সুধা বয়ে এনেছে, আমরা কেন এর থেকে দূরে থাকবে। আর মহাগ্রন্থ আল কোরআন এ অমীয় সুধার বার্তা বয়ে এনেছে। তাই আল কোরআনের শিক্ষা হচ্ছে, ‘আর বলাে, আলহামদু লিল্লাহ (যাবতীয় কৃতিত্ব ও প্রশংসা আল্লাহর)।’ বিশ্ব প্রভুর কাছে আবেদন পেশ করার শুরুতে ভূমিকাস্বরূপ তার প্রশংসা জ্ঞাপন করার এ শিক্ষা আল কোরআনের এক অনবদ্য পদ্ধতি। এরপর বলা হচ্ছে, ‘শীঘ্রই তিনি তার নিদর্শনসমূহ দেখাবেন, তখন তােমরা বুঝতে পারবে (কি মহা নেয়ামত) তোমাদের জন্যে এ কিতাব বয়ে এনেছে।’ অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা সত্য বলেছেন, অতপর মানুষ যখন সত্যসন্ধিৎসু মন নিয়ে এবং অন্তরের চোখ দিয়ে তাকায়, তখন সে নিজের মধ্যে এবং তার সামনে মুক্ত বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে প্রতিদিনই আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার কোনাে না কোনাে নিদর্শন দেখতে পায়। তখনই তার সামনে রহস্যভরা এ মহা সৃষ্টির তথ্যসমূহ ভেসে ওঠে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘যা তােমরা করে চলেছাে তােমার রব সে ব্যাপারে গাফেল নন। পরিশেষে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই শেষ ও চূড়ান্ত কথাটা তার মনের মধ্যে জাগিয়ে দিচ্ছেন, সেই সূক্ষ্ম কথাটি জাগিয়ে দিচ্ছেন এই চমৎকার ব্যাখ্যার মাধ্যমে, যা প্রথমেই মানুষের মনে ভয়ের অনুভূতি পয়দা করে, তারপর যে কাজ করা প্রয়ােজন সে তা করতে শুরু করে দেয়। তখন তার অন্তরের এ কথাটা সদা জাগরূক হয়ে যায় এবং গভীরভাবে একথাটা রেখাপাত করতে থাকে যে, ‘তােমার রব মােটেই গাফেল নন সেসব বিষয়ে যা তােমরা করছাে।’