أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১৩)
[*আল্লাহর কুদরতে দুশমনের হাতেই মূসা(আ.)-এর লালন পালন :
মিথ্যার পরাজয় অবশ্যই হবে, তা রক্ষা করার যতই কৌশল করা হোক না কেন।:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৮:ক্বাসাস
পারা:২০
১-৪৩ নং আয়াত:-
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : আলােচ্য সূরাটি মক্কা মােয়াযযামায় অবতীর্ণ। এ সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে মক্কায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিলাে অত্যন্ত নগণ্য এবং নানা প্রকার দুর্বলতাও তাদের ঘিরে রেখেছিলাে। অপরদিকে মােশরেকদের অবস্থা ছিলাে এই যে, তারা যেমন ছিলাে শক্তিশালী, তেমনি আর্থিক দিক দিয়েও ছিলাে খুবই সচ্ছল, মান-সম্মানও তাদের যথেষ্ট ছিলাে এবং তারা ছিলাে বহু ক্ষমতার অধিকারী। ঠিক এই সময়ে সূরাটি নাযিল হয় এবং এর মাধ্যমে তাদের শক্তি ও মূল্যবােধকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তােলার জন্যে আহ্বান জানানাে হয়। আল্লাহর এ আয়াতগুলাে এই কথাটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছিলাে যে, এই সৃষ্টিজগতের সবখানে একটি শক্তিই কাজ করে যাচ্ছে, আর তা হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শক্ত। সমগ্র বিশ্বের একটি জিনিসেরই স্থায়ী মূল্য আছে, আর তা হচ্ছে ঈমান। সুতরাং এটা মানতেই হবে, যাদের সাথে আল্লাহর শক্তি রয়েছে তাদের কোনাে ভয় নেই, যদিও শক্তি প্রকাশের যতাে প্রকার মাধ্যম আছে বাস্তবে তখনাে তার কোনােটাই তাদের হাতে আছে বলে দেখা যায় না; যাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর শক্তি মারমুখী হয়ে দাড়িয়ে থাকে তাদের না আছে নিরাপত্তা, না আছে শান্তি, এমনকি তাদের অবস্থানকে সমর্থন দেয়ার মতাে নানা প্রকার যুক্তি প্রমাণ হাযির করা সত্তেও তাদের মনের মধ্যে সদা সর্বদা প্রচন্ড এক দুর্বলতা বিরাজ করতে থাকে। যার কাছে ঈমানের সঠিক মূল্য আছে সে সবচেয়ে বেশী কল্যাণের অধিকারী, আর এই মূল্যবােধটা যে হারিয়ে ফেলে সে মূলত কোনাে জায়গা থেকেই কোনাে কল্যাণ পেতে পারে না। সূরাটির শুরুতে মূসা(আ.) ও ফেরাউনের কাহিনী পেশ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সূরাটির মূল বক্তব্য ফুটে ওঠেছে, ফুঠে ওঠেছে কারুন তার জাতির সাথে যে ব্যবহার করেছিলাে তার মধ্য দিয়েও। অবশেষে মূসা(আ.)-এর জাতি সম্পর্কে বহু শিক্ষামূলক কথাও এখানে এসেছে। এসব কাহিনীর মধ্যে সূরাটি সর্বপ্রথম যে কাহিনী পেশ করেছে তা হচ্ছে মিসরের তৎকালীন শাসন কর্তৃপক্ষের শক্তি প্রদর্শনের কথা । এ প্রসংগে অহংকারী, বিদ্রোহী ও অত্যাচারী ফেরাউনের শক্তি প্রদর্শন ও মানুষের মধ্যে তার পক্ষ থেকে প্রচন্ড আতংক সৃষ্টি করে রাখার কথা বলা হয়েছে, এর মােকাবেলায় বর্ণিত হয়েছে মূসা(আ.)-এর কথা, যিনি ছিলেন তারই ঘরে লালিত পালিত এক দুগ্ধপোষ্য শিশু(সম), তার না ছিলাে কোনাে শক্তি, না ছিলাে কোনাে আশ্রয়, আর না ছিলাে তার জন্যে কোনাে নিরাপত্তার ব্যবস্থা। অথচ ফেরাউন ছিলাে তৎকালীন পৃথিবীতে সর্বাধিক ক্ষমতাধর বাদশাহ। সে তার প্রজাদের তার জন্যে নিবেদিতপ্রাণ ভক্ত বানিয়ে রেখেছিলাে এবং বনী ইসরাঈল জাতিকে সকল দিক থেকে দুর্বলতার মধ্যে ঘেরাও অবস্থায় ফেলে রেখেছিলাে, তাদের ছেলেদের সে হত্যা করছিলাে এবং মেয়েদের এই নিষ্ঠুর হত্যা থেকে রেহাই দিচ্ছিলো। এই ভাবে সে গােটা বনী ইসরাঈল জাতিকে তার কব্জার মধ্যে রেখে আতংকগ্রস্ত করে রেখেছিলাে, কিন্তু যখন নবুওতের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মূসা(আ.) নির্ভীক চিত্তে এই অগ্নিগর্বী-বলদর্পী যালেম শাসকের দরবারে হাযির হলেন, তখন ফেরাউনের দর্প, শক্তি-সাহস, ঔদ্ধত্য ও আত্মসম্মানবোধ সবই এমনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলাে যে, বাস্তবে তার মনােবল, জনবল, শক্তি সরঞ্জাম সবই যেন ভোতা হয়ে গেলাে। কি মহা আশ্চর্যের ব্যাপার, নিজেকে যে ব্যক্তি সর্বশক্তিমান বলে দাবী করে এসেছে, যে নিজের শক্তি ক্ষমতা নিষ্কন্টক রাখার জন্যে এতাে লােককে হত্যা করে এসেছে, আজ সে তারই ঘরে লালিত পালিত সে দিনকার এক শিশুর সামনে দাড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে থতমত খেয়ে যাচ্ছে, কেমন যেন এক অজানা অদেখা ভয় তার হৃদয়কে গ্রাস করে ফেলেছে। এমন এক আতংক তাকে পেয়ে বসেছে যে, মূসা(আ.)-এর ওপর কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা তার বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেয়া তাে দূরের কথা, তার সামনে থেকে যেন সরতে পারলেই সে বেঁচে যায়। কেন এমন হচ্ছে? কার ইচ্ছা এখানে কাজ করছে, মূসা(আ.)-এর ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে কার শক্তি-ক্ষমতার বহিপ্রকাশ ঘটে। আসলে বাহ্যিক দিক দিয়ে মূসা(আ.) শক্তিহীন, সাথীহীন ও নিঃস্ব হলেও তিনি যে অদেখা সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রয়েছেন, যার শক্তির বেষ্টনী এমনভাবে তাকে ঘিরে রেখেছে যে তার দিকে রক্ত চক্ষু তুলে তাকায় এমন সাহস কারও নেই। বরং মূসা(আ.)-এর এক একটি কথা তার বুকের মধ্যে শেলের মতাে বিধছে, প্রবল এক ভয় তার কলিজার মধ্যে এমনভাবে জেকে বসেছে যে, সে কি করবে আর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে সে বলছে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও তাে! আমি মূসাকে কতল করে ফেলি, সে তার রবকে ডাকুক। আমার ভয় হচ্ছে যে, সে তােমাদের ধর্ম-কর্ম সব বদলে ফেলবে, অথবা সারা রাজ্যে সে এক প্রচন্ড বিশংখলা ছড়িয়ে দেবে।'(আয়াত ৪০, ২৬) এই আয়াতটিতে ফেরাউনের কি অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। তাকে কে ধরে রেখেছিলাে যে, ছাড়তে হবে? সে না সর্বশক্তিমান? তাহলে কেন সে এমন ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারছে না যে তার গােটা রাজ্যে বিশৃংখলা ছড়িয়ে দেবে বলে সে আশংকা করছে? আসলে, এ কথা বলে সে পিঠটান দিতে চায়। সে দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে যে, সে দিনের সে শিশু মূসা(আ.)-কে অলংঘনীয় এক গায়বী মদদ ঘিরে রেখেছে। তার গায়ে হাত দেয়া থেকে তার হাত পা যেন কে বেঁধে ফেলেছে। মহাশক্তিমান সিংহ সে, কিন্তু এখন ভয়ে লেজ গুটিয়ে নিজ গর্তে ফিরে যেতে পথ পাচ্ছে না, পেছন থেকে তার হাত যেন কে বেঁধে ফেলেছে। কাপুরুষের মতােই তার অন্তর কাঁপতে শুরু করেছে। তাই মূসা(আ.)-এর কোনাে ক্ষতি করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে। তার অন্তরের মধ্যে সে ভয়ে কিভাবে চুপসে গেছে তা একমাত্র সে-ই বুঝতে পারছে। দ্বিতীয় যে শিক্ষাটি এ সূরার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করা। বিশেষ করে, যার সাথে জ্ঞানের যােগ রয়েছে। এ মহামূল্য সম্পদ যেমন মানুষের উপকার করে, তেমনি মানুষকে হিংস্র পশুর স্তরেও নামিয়ে দেয়। এই সম্পদই মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণার জন্ম দেয়। তাই দেখা যায়, কারুন তার জাতির মধ্যে এই সম্পদ নিয়ে চরম জাঁকজমকপূর্ণভাবে আবির্ভূত হয়েছে। এমনভাবে সে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছিলাে যে মানুষের মধ্যে এ কথাটা সাধারণভাবে জানাজানি হয়ে গিয়েছিলাে, তার অর্থভাণ্ডার চাবিগুলাে বহন করতে গিয়ে শক্তিশালী একদল[দল বলতে বুঝায় দশ বা দশের ওপরের কোনাে সংখ্যা। যেমন সূরা ইউসুফে ইউসুফ(আ.)-এর ভাইয়েরা বলেছিল, আমরা তাে একটি দল। তারা সংখ্যায় ছিলাে এগার জন। আর একটি পরিভাষা বিদউন-অর্থাৎ তিন থেকে নয়, সুতরাং দল (উসবাতুন) বলতে বিদউনের ওপরের যে কোনাে সংখ্যাই হবে] লােক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এখন দল বলতে যদি দশ জনও হয় তাহলে দশ জন শক্তিশালী লোক কমপক্ষে দশ মণ বােঝা বইতে পারে। কমপক্ষে দশ মণ যদি চাবির বােঝা হয়, আর সে চাবিগুলাে যদি কামরার বা বাক্স সিন্দুকের হয়, তাহলে কতগুলাে বাক্স ভর্তি স্বর্ণ-রৌপ্য হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আবার জ্ঞানের কারণেও কারুন অহংকার করতে এবং সে মনে করতাে, এই যে বিপুল পরিমাণে অর্থ-সম্পদের মালিক সে হয়েছে- এটা তার জ্ঞান ও জ্ঞানগত যােগ্যতারই ফল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার কওমের মধ্যে যারা সঠিক জ্ঞানের অধিকারী, তারা সম্পদ কম হলেও কারুনের তুলনায় নিজেদের কখনাে ছােট মনে করতাে না, বা কারূনের জাকজমক ও জৌলুস দেখে হীনমন্যতায় ভুগতাে না; বরং সাধনা করা ও সঠিক পথে থেকে জীবন যাপন করা এবং অপরকে সাহায্য করার বিনিময়ে তারা আল্লাহর কাছেই প্রতিদান আশা করতাে। তারা জানতাে যে আল্লাহ তায়ালাই উত্তম এবং তিনিই চিরস্থায়ী। তারপর যখন কারুনের অহংকার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলাে, তখন মহান আল্লাহ তায়ালা তার হস্তক্ষেপ করলেন এবং তাকে তার সহায় সম্পদসহ মাটির মধ্যে ধসিয়ে দিলেন। সে সময়ে তার ধন সম্পদ ও জ্ঞান তাকে কিছুমাত্র সাহায্য করতে পারলাে না। তখন তাকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সরাসরি ও প্রকাশ্যভাবে হস্তক্ষেপ করলেন, যেমন সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিলেন ফেরাউনের ব্যাপারে। সবার নযরের সামনে তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তাকে ও তার বাহিনীকে সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে ফেলে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। নিসন্দেহে ফেরাউন ডুবে মরেছিলে । অবশ্যই বনি ইসরাঈল জাতির ওপর সে যবরদন্তি করেছিলাে। একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে এবং স্বেচ্ছাচারী শাসন ক্ষমতা চালিয়ে গােটা দেশে এক চরম নৈরাজ্য ও চরম অশান্তি সৃষ্টি করে রেখেছিলাে। একভাবে কারুনও তার অর্থ সম্পদ ও জ্ঞানের দাপট দেখিয়ে মানুষকে বশীভূত করে রেখেছিলাে। ফলে তার সেই একই পরিণতি হয়েছিলাে, যা হয়েছিলাে ফেরাউনের। তাকে তার ধনদৌলত ও বাড়ীঘর দুয়ারসহ পৃথিবীর বুকে ধসিয়ে দেয়া হয়েছিলো। অপরদিকে সীমা-লংঘনকারী, বলদর্পী আল্লাহর সে দুশমন ফেরাউন ও তার দোসরদের দিকে লক্ষ্য করুন। কেমন করে গভীর সাগরের উত্তাল তরংগাভিঘাতে হাবুডুবু খেয়ে তারা মরছে, কতাে অসহায়ভাবে তারা বাঁচার জন্যে হাত পাছুঁড়ছে, কিন্তু হায়, এ যে আল্লাহর শাস্তি নেমে এসেছে। ভূধরে, সাগরে, অন্তরীক্ষে এমন কেউ নেই যে তার হুকুম রদ করতে পারে। আল্লাহর যমীনে বাস করে যারা তার নাফরমানী করবে, তার ক্ষমতাকে উপেক্ষা করার দৌরাত্ম্য দেখাবে, তার নিজের শক্তি ক্ষমতা কায়েম করতে চাইবে তাদের অবস্থাও হবে এমনি। বিদ্রোহী, ও অশান্তি সৃষ্টিকারীদের ওপর যখন আল্লাহর গযব নেমে আসবে তখন কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না। আলােচ্য সূরার এ বর্ণনাটি আমাদের এ শিক্ষাই দিচ্ছে। সুস্পষ্টভাবে এ সূরা জানাচ্ছে যে, মানুষের জীবন যখন এ ধরনের অহংকারী বিদ্রোহী শাসকের নিষ্পেষণে দুর্বিষহ হয়ে পড়ে, তখনই সত্যাশ্রয়ীদের জন্যে গায়বী মদদ এবং বিদ্রোহীদের জন্যে চূড়ান্ত ও অলংঘনীয় শাস্তি নেমে আসে। এ কাহিনী থেকে এ কথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যখন কোনাে এলাকায় অবিচার, দুর্নীতি ও পাপাচার সাধারণভাবে ছড়িয়ে পড়ে, ন্যায়নীতি কোণঠাসা হয়ে যায়, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার মতো কেউ থাকে না এবং হকপন্থীরা সম্পূর্ণভাবে অসহায় হয়ে পড়ে, তাদের সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, সমাজের বুকে সর্বদিক থেকে অশান্তি বিশৃংখলা নেমে আসে এবং গােটা জাতির ওপর অর্থ সংকট ও দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যায়, তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালার কুদরতী হাত প্রকাশ্যভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সকল উদ্ধত শক্তিকে নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসে। তখন কোনাে সৃষ্টি জীবের সাহায্য সহযােগিতা ছাড়াই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রকাশ্য সাহায্য মানুষের সামনে ভেসে ওঠে। অসত্যকে দমন করার জন্যে এবং সত্য প্রতিষ্ঠাকল্পে আল্লাহর গায়বী মদদ এ জন্যে নেমে আসে যে, তিনি সকল অন্যায় অবিচার নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সকল প্রকার যুলুম নির্যাতন ও অশান্তি সীমালংঘন করা থামিয়ে দেন [ সূরা ‘ত্ব-হা’র মধ্যে সম্পর্কে দীর্ঘ আলােচনা এসেছে। এমন এক সময় ছিলাে যখন গােটা বনী ইসরাঈল জাতিকে যালেম ফেরাউনের হাতে তাদের হীনতা-দীনতার চরম মূল্য দিতে হয়েছে। সে বনী ইসরাঈল কওমের ছেলেদের এই অপরাধের কারণে হত্যা করছিলো যে, কোনাে এক জ্যোতির্বিদ বলেছিলো, বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে এক ছেলে ভুমিষ্ঠ হবে যে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ফেরাউন তাদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করা থেকে বিরত থাকছিলাে এ জন্য যে, তাদের কেউ ক্ষমতার অন্তরায় হবে না, কিন্তু কুদরতের হাত কে রুখতে পারে। যার মাধ্যমে তিনি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন এবং শাস্তি দেবেন, তাকে তিনি ঠিকই বাঁচিয়ে রাখলেন। বনী ইসরাঈল জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করার অপরাধে তাদের এই জরিমানা দিতে হচ্ছিলাে। তাদের হীনতা-দীনতা ও চরম অপমানের যিন্দেগী কাটাতে হচ্ছিলাে, সদা-সর্বদা এই ভয়-ভীতি তাদের লেগে থাকতাে যে, আবার কোনাে নতুন শাস্তি তাদের জন্য বরাদ্দ হয়ে যায় কিনা! এই দুঃসময়ে যারা মূসা(আ.)-এর সাথে থেকে আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছিলাে এবং তাদের অন্তর ঈমানের আলােতে আলােকিত হয়ে গিয়েছিলাে- (এই অপরাধের কারণে)। যারা শাস্তি ভােগ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাে, তারা সে অবস্থায়ও দমে যায়নি; বরং মাথা উচু করে তারা ফেরাউনের মুখের ওপর ঈমানের কথা উচ্চারণ করেছিলাে। তখন তারা একটুও থতমত খায়নি, প্রকম্পিত হয়নি, কোনাে দুশ্চিন্তাও করেনি, শান্তি থেকে বাঁচার জনা কোনাে নমনীয় ভাবও প্রদর্শন করেনি। আসলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা এ সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার জন্যে তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন এবং তাদের অন্তরপ্রাণের মধ্যে তিনি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাণী প্রবিষ্ট করে দিয়েছিলেন। সে অবস্থাটাই এখানে পাওয়া যাচ্ছে এবং সেটাই যথার্থ। এ সূরার প্রাসংগিক আলােচনাও কথার সাক্ষ্য বহন করে। সূরা ত্বা-হা-তেও কিছু শাব্দিক পার্থক্যসহ এই একই কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহর ক্ষমতা ও শক্তির হাত যে কোনাে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার জন্যে তাদের সাহস যােগাচ্ছিলাে, কিন্তু এ চরম অত্যাচারী অহংকারী যালেম বাদশাহর মুখের ওপর ঈমানের প্রকাশ্য ঘােষণা এবং হক কথা উচ্চারণ করার পরই আল্লাহর সর্বশেষ সাহায্য নেমে এলাে ] ফেরাউন ও কারণ এই দুই ব্যক্তির কাহিনীর মধ্যে মােশরেকদের সাথে যে আলাপ-আলােচনা হয়েছিলাে তাতে সত্যের পক্ষে যথেষ্ট দলীল-প্রমাণ হাযির করা হয়েছে। এ প্রমাণপত্র এতােই উজ্জ্বল যে, কোনাে ব্যক্তি বুঝতে চাইলে তারা যদি প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন দৃশ্যের দিকে একবার তাকায় তাহলে অবশ্যই সত্যকে তারা বুঝতে পারবে। যদি একবার অতীতের জাতিসমূহের কর্মকান্ড ও তাদের পরিণতির দিকে তাকায়, আর একবার যদি কেয়ামত সম্পর্কে চিন্তা করে এবং নিজেদের মানস চোখে কেয়ামতের দৃশ্য ফুটিয়ে তােলে, তাহলে তারা দেখতে পাবে কাহিনী দুটোর মধ্যে বর্ণিত ঘটনাবলী তাদের সঠিক দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে এবং প্রত্যেক ঘটনাই তাদের জন্যে উপকারী বলে প্রমাণিত হচ্ছে। সে দুই ব্যক্তির সাথে সংঘটিত ঘটনা তাদের আস্তে আস্তে সত্য পথের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, তাদের সামনে আল্লাহর অমােঘ নিয়মসমূহ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে। কি যুক্তিহীনভাবে মােশরেকরা রসূলুল্লাহ(স.)-কে বলছে, (আপনার আনীত) হেদায়াতের পথ গ্রহণ করলে আমাদেরকে আমাদের যমীন থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া হবে।’ এসব কথা বলে আসলে তারা সত্য থেকে দূরে থাকতে চাইতাে। সত্য গ্রহণ না করার জন্যে তারা নানা প্রকার খোড়া ওযর পেশ করতাে। বলতাে যে, দেশ থেকে উৎখাৎ হয়ে যাওয়ার ভয়েই তারা সত্য গ্রহণ করছে না। কারণ বাপ-দাদার আমল থেকে তারা যেসব পূজা পার্বণ করে আসছিলাে, এখন সমাজপতি সমাজ নেতাদের কথা অমান্য করে সেগুলাে বাদ দিলে এসৰ সমাজপতি ও নেতৃবৃন্দ। তাদের দেশ থেকে বের করে দেবে, অথচ তারা মর্যাদাপূর্ণ কাবা ঘরকে সম্মান করতাে এবং যারা এ ঘরের সাথে সম্পর্কিত থাকতাে তাদের ধন্যবাদ দিতাে। এ জন্যে এ সূরার মধ্যে আল্লাহ তায়ালা মূসা(আ.) ও ফেরাউনের ঘটনাটি পেশ করেছেন, তাদের দেখিয়েছেন, নিরাপত্তা এবং ভয় কোত্থেকে আসে। তিনি উক্ত ঘটনার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে মানুষকে এ কথা জানাচ্ছেন যে, যে কোনাে প্রতিকূল অবস্থায় একমাত্র আল্লাহর কাছে থেকেই নিরাপত্তা লাভ করা যেতে পারে। যখন মানুষ দেখে কোনােভাবেই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনাে উপায় দেখা যাচ্ছে না এবং নিরাপত্তা লাভ করার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, তখনই আল্লাহনির্ভর ব্যক্তিদের জন্যে অভাবনীয়ভাবে তার পক্ষ থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেমে আসে। নিরাপত্তা বলতে যা কিছু মানুষ বুঝে তা যখন এসে যায় তখন ভয়ভীতি অনেকাংশে কমে যায় এবং তখন মানুষ মনের মধ্যে এক বেহেশতী নিশ্চিন্ততা অনুভব করে।একথা বুঝানোর জন্যেই রব্বুল আলামীন কারুনের ঘটনাটা তুলে ধরেছেন। তাদের সম্পর্কে এসব তথ্য পরিবেশন করার পর বলা হচ্ছে, আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ কি তাদের জন্যে এই নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ শহরটি প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল সর্বদিক থেকে সংগৃহীত হয়ে আসবে এবং আমার পক্ষ থেকে যাবতীয় জীবন ধারণ সামগ্রীর সমাবেশ ঘটানাে হবে, কিন্তু (তবুও তাদের অধিকাংশ মানুষ জানে না। এখানে তাদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, যে মহান সত্তা তাদের যাবতীয় ভয় ভীতি থেকে নিরাপদ রেখেছেন, তিনিই এই শহরটিকে মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ বানিয়েছেন, তিনিই তাদের জন্যে এই নিরাপত্তাকে চিরস্থায়ী করবেন, অথবা (তাদের নাফরমানীর কারণে) তিনি নিজেই তাদের এই নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করবেন। এভাবে আল্লাহ তায়ালা অহংকার ও নাশােকরীর পরিণতি সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আরাে কতাে কতাে এলাকাবাসী তাদের জীবন ধারণ সামগ্রীর ব্যাপারে অহংকার করেছে, কিন্তু সে সকল এলাকায় পরে আর কেউই বসবাস করেনি- অতি নগণ্য কিছুসংখ্যক মানুষ ছাড়া। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা, আমিই সবকিছুর উত্তরাধিকারী। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল আচরণের পরিণতি সম্পর্কে তাদের ভয় দেখাচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে একজন রসূল পাঠিয়ে তাদের সতর্ক করছেন। ইতিপূর্বে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিয়ম অতীত হয়ে গেছে, সতর্ককারী কোনাে নবী আসার পর যখন তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে তখন সেসব প্রত্যাখ্যানকারীদের ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, তোমার রব কোনাে এলাকাকে ধ্বংস করেন না যতক্ষণ না তার অধিবাসীদের কাছে কোনাে রাসূল পাঠানো হয়, যে তাদের কাছে আমার আয়াতগুলাে তেলাওয়াত করে শােনায়। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ কোনাে এলাকাকে ধ্বংস করি না যতােক্ষণ পর্যন্ত তার অধিবাসীরা যালেম না হয়ে যায়। এরপর তাদের কাছে কেয়ামতের দিনের দৃশ্য তুলে ধরা হচ্ছে, স্মরণ করানাে হচ্ছে, যখন সবার সামনে একেবারে প্রকাশ্যভাবে তাদের সে শরীর সব দূরে সরে যাবে এবং সেসব শিরকের সাথে তাদের কোনাে সম্পর্ক না থাকার কথা ঘােষণা করবে। অতপর দুনিয়ার আযাব সম্পর্কে সতর্ক করার পর তাদের আখেরাতের আযাবের দৃশ্য দেখানাে হচ্ছে, এর আগে তাদের জানানাে হয়েছে, কখন কোন কারণে ভয়ভীতি আসবে, আর কখনই বা তাদের নিরাপত্তা দান করা হবে। এরপর সূরাটির সমাপ্তি টানা হচ্ছে রসূলে করীম(স)-এর সাথে আল্লাহর ওয়াদার কথা উল্লেখ করে। যখন মক্কাবাসী কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে রসূল(স.) দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, তখন আল্লাহ তায়ালা তার সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, তিনি আবার তাকে তার দেশে ফিরিয়ে আনবেন, তখন তিনি তাকে শিরকের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্যে এবং তাঁর দেশবাসীর ওপর বিজয় লাভ করার ব্যাপারে অবশ্যই সাহায্য করবেন। অবশ্যই আল্লাহ রক্দুল আলামীন তাকে রেসালাতের এ মহান দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছেন, যদিও ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে তিনি কোনাে অনুমানই করতে পারেননি। মক্কাবাসীরা তার দেশত্যাগ সম্পর্কে আঁচ করতে পেরে যখন তার ও তার সাথীদের ওপর অত্যাচার চরমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সে সময়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন নিজেই তাকে সাহায্য করবেন বলে আশ্বস্ত করছেন এবং তাকে ওয়াদা দিচ্ছেন, শীঘ্রই তাকে তার জন্মভূমিতে আবার ফিরিয়ে আনা হবে, যেখান থেকে তিনি বিতাড়িত হচ্ছেন, শীঘ্রই সেখানে তিনি পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে এবং সফলতা ও সাহায্যপ্রাপ্ত অবস্থায় আবার ফিরে আসবেন। আলােচ্য সূরার মধ্যে বর্ণিত কেসসাগুলােতে এ কথাগুলাের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে এবং অত্যন্ত জোরালােভাবে এর আভাস দেয়া হয়েছে। যেহেতু মূসা(আ.)ও এভাবে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় বিতাড়িত হয়ে দেশ ত্যাগ করার পর সেই দেশে আবার এক নির্দিষ্ট সময়ের পর ফিরে এসেছিলেন। তিনি ফিরে এসে বনী ইসরাঈল জাতিকে দেশ থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাদের যুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছিলেন, ফেরাউন ও তার লােকলস্কর মূসা এবং তার নাজাতপ্রাপ্ত জাতির সামনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাে। জানানাে হচ্ছে যে, এ ওয়াদা পূর্ণ হতে চলেছে, এবার শেষ ঘটনাটির কথা উল্লেখ করে সূরাটি সমাপ্ত করা হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে (সর্বময় ক্ষমতার মালিক) হিসেবে তােমরা ডেকো না। নেই কোনাে ইলাহ তিনি ছাড়া। সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে একমাত্র তার অস্তিত্ব ছাড়া। হুকুম দেয়ার মালিক একমাত্র তিনি তার কাছেই তােমাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। সূরাটির বাহ্যিক চেহারার দিকে তাকালে এবং এর আলোচ্য বিষয়গুলাে সামনে রাখলে বুঝা যাবে, ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলােই হচ্ছে সূরাটির মূল আলােচ্য বিষয়। সুতরাং এ সূরটির ওপর বিস্তারিতভাবে আলােচনা রাখতে গিয়ে আমরা চারটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবাে। মূসা(আ.)-এর কিসসা, পরবর্তীতে কি হলাে সে বিষয়ে অনুসন্ধান, কারুনের কিসসা এবং মূল জায়গায় ফিরিয়ে নেয়ার এই শেষ প্রতিশ্রুতি।
* সূরাটি শুরু হচ্ছে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন হরফ (অক্ষর) দ্বারা। ‘ত্ব-সীন-মীম’ এগুলাে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী কিতাবের আয়াত। এই বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলাে দিয়ে সূরাটি শুরু হচ্ছে এ কথা জানানাের জন্যে, যে এগুলাের মতােই কিছু জিনিস এমন আছে যা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী এ কিতাবের আয়াতগুলাের সাথে সংযুক্ত। এগুলাে বেশ কিছু জটিল অর্থ ও বহু দূরের তথ্য সরবরাহকারী, এগুলাে মানুষের ধারণা শক্তিকে বহু দূরের বস্তু বা বিষয়ের দিকে এগিয়ে দেয়, বিচ্ছিন্ন এ অক্ষরগুলাে থেকে যেসব চিন্তা শক্তির উদ্রেক করে, মানুষের অস্থায়ী ভাষার গন্ডীর মধ্যে তার স্থান সংকুলান হয় না। এই কথাটির দিকেই ইংগিত দিয়েছে নীচের আয়াতটি, ‘এগুলাে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী আয়াত।’ এ কথা দ্বারা জানানাে হচ্ছে যে, সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী এ কিতাব কোনাে মানুষের তৈরী বস্তু নয়। আর এটা এমনই এক কিতাব যে, তারা কেউ এমন একখানা গ্রন্থ তৈরী করতে পারবে না; অবশ্যই এটা হচ্ছে সেই ওহী যা আল্লাহ তায়ালা বা ফেরেশতা জিবরাঈল(আ.)-এর মাধ্যমে তার বান্দার কাছে নিজে পড়ে শােনান। ফেরেশতা জিবরাঈল যেহেতু অবিকল তাই পৌছিয়েছেন রসূল(স.)-এর কাছে, যা তিনি আল্লাহর কাছ থেকে শুনেছেন। তাতে কোনাে দিক দিয়ে কোনাে প্রকার পরিবর্তন করার ক্ষমতা তার নেই। এ বিষয়টি বুঝার জন্যে যদি আমরা টেপ রেকর্ডারের মাধ্যমে ব্যবহার যােগ্য ক্যাসেটের দিকে তাকাই তাহলে কিছুটা বুঝতে সুবিধা হবে। এই ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কীর্তির চমৎকারিত্ব প্রকাশিত হয়েছে, যেমন করে এই মহা সৃষ্টির বড় ছােট সকল প্রকার জিনিস থেকে আল্লাহর নির্মিত এমন সব বিষয় প্রকাশ পায় যা তৈরী করা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি মহান আল্লাহ, তােমার কাছে ফেরাউন ও মূসার সংবাদ যথাযথভাবে তেলাওয়াত করছি সেই জাতির জন্যে, যারা ঈমান রাখে।’ এ আয়াতে বুঝা গেলাে, এ কিতাব মােমিন জাতির উদ্দেশ্যে ও তাদেরকে গড়ে তােলার জন্যে নাযিল হয়েছে। এ কিতাব দ্বারা তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, তাদের সঠিক মানে উন্নীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং তাদের কাছে পার্থিব যিন্দেগীর জন্যে বিস্তারিত কর্মসূচী পেশ করা হচ্ছে। এই পদ্ধতি অবলম্বনেই জীবন সমস্যার সকল সমাধান বের হয়ে আসে। আলােচ্য সূরাটির মধ্যে এই যে কিসসাগুলাে বর্ণনা করা হচ্ছে তার লক্ষ্য, মােমেনরা যেন এ মহাগ্রন্থ থেকে যথার্থভাবে ফায়দা হাসিল করতে পারে। আল কোরআনের এই যে তেলাওয়াত আমরা করি, এটা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকেই প্রাপ্ত। তারই অনুগ্রহে এবং তাঁরই সরাসরি তত্ত্বাবধানে অত্যন্ত যত্ন সহকারে মােমেনদের এই তেলাওয়াত শেখানাে হয়েছে এবং তাদের মধ্যে এ পবিত্র কালামের মর্যাদার চেতনা দান করা হয়েছে, যারা গভীরভাবে এর মূল্য বুঝে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, কেমন করে তারা এই গভীর উপলব্ধি পেতে পারে? জওয়াব হচ্ছে, মহান আল্লাহ মােমেনদের জন্যে তাদেরই প্রয়ােজনে এ কিতাব তার রসূলের কাছে পাঠিয়েছেন এবং তাকে যথাযথভাবে শিখিয়েছেন, তাদের যাবতীয় কল্যাণ সাধনার্থে আল্লাহ রকুল আলামীন তাদের এই মেহেরবানী দান করেছেন। ‘সেই জাতির জন্যে যারা ঈমান রাখে।’ এতােটুকু ভূমিকা পেশ করার পর আল্লাহ অতীতের কাহিনী পেশ করার মাধ্যমে বক্তব্য বর্ণনা শুরু করছেন।
*হযরত মুসা(আ.)-এর বিচিত্র শৈশব : সর্বপ্রথমে মূসা ও ফেরাউনের কাহিনী। সে মহান নবীর ঘটনা বলতে গিয়ে একেবারে তার জীবনের প্রারম্ভ থেকেই শুরু করা হয়েছে। অর্থাৎ একেবারে তার জন্মলগ্ন থেকেই তার জীবনের কাহিনীর কথা এসেছে এবং এ সূরাটিতে তার জীবনের ঘটনাগুলাে এমন চমৎকার ও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, যা অন্য কোনাে সূরাতে আসেনি। মূসা(আ.)-এর জীবনের প্রথম অধ্যায়টি কিভাবে শুরু হচ্ছে, কি কঠিন পরিবেশ পরিস্থিতিতে তিনি জন্মগ্রহণ করছেন এবং কিভাবে শুরু হচ্ছে তার জীবনের চমকপ্রদ অধ্যায়গুলাে, কত অসহায় অবস্থায় তার শিশু জীবনের সূচনা হচ্ছে- সবই এখানে লক্ষণীয়। এক দুর্বল ও শক্তিহীন কওমের মাঝে এক দীনহীন ঘরে তার জন্ম। আলােচ্য সূরার মধ্যে এ কঠিন ও প্রতিকূল অবস্থাকে এক মৌলিক বিষয় হিসেবে তুলে ধরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর শক্তি ক্ষমতা দেখানাে হয়েছে। মানুষকে এ কথা বুঝার সুযােগ দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়াবী দৃষ্টিতে যেসব জিনিস শক্তি সামর্থ ও সাহায্য বলে বিবেচিত হয়, সেসব কিছু থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত থাকাবস্থায় কিভাবে তার কোনাে বান্দাকে তিনি মর্যাদাবান বানিয়েছেন এবং কিভাবে তিনি তাকে নিজের প্রতিনিধি বানিয়েছেন। তৎকালীন পৃথিবীতে যে অহংকারী শাসক নিজেকে সর্বশক্তিমান বানিয়ে রেখেছিলাে, সেই নরপতিকে তারই ঘরে লালিত পালিত ছেলের দ্বারা কিভাবে পর্যুদন্ত করেছেন, কিভাবে, মানুষের সকল প্রকার সাহায্য বিবর্জিত অবস্থায় তার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা খেদমত নিয়েছেন এমন এক জাতি গড়ার, যারা গােটা পৃথিবীতে দীর্ঘ চার হাজার বছর ধরে শাসন কার্য পরিচালনা করেছে, তাদেরই নেতৃত্বে তিনি তৎকালীন পৃথিবী থেকে যুলুম অত্যাচারের অবসান ঘটিয়েছেন। দুর্বল, অসহায় ও নির্দয়-নিষ্ঠুর যালেম ফেরাউনের হাতে দীর্ঘকাল ধরে নিষ্পেষিত সে জাতিকে কিভাবে তিনি রেহাই দিয়েছেন; যাদের পেছনে কোনাে সহায় সম্বল, শক্তি-সামর্থ কিছুই ছিলাে না, যারা সকল দিক থেকেই অসহায় অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছিলাে। কে তাদের পরিণত করলাে শাসকের জাতিতে, শাসকের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে শােষিতদের ক্ষমতার মসনদে বসালাে কে? এই ঘটনাটাই মােমেনদের সামনে তুলে ধরে তাদের সান্তনা দেয়া হচ্ছে এবং তাদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন মক্কা থেকে বিতাড়িত, নিগৃহীত ও অসহায় মােমেনদের সর্ব শক্তিমান আল্লাহ রব্বুল আলামীন আপন কুদরত বলে পৃথিবীর ক্ষমতার মসনদে বসাবেন, তাদের দ্বারা দুনিয়ার নেতৃত্বের এবং বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার খেদমত নেবেন। অসহায়ত্ব ও প্রতিপক্ষ বিবেচনায় বনী ইসরাঈল জাতি ও মক্কী যিন্দেগীতে অবস্থানরত মক্কার মুসলমানদের মধ্যে তেমন কোনাে পার্থক্যই ছিলাে না। এ জন্যেই মূসা(আ.)-এর ঘটনা মুসলমানদের জন্যে ছিলাে যেমন শিক্ষাপ্রদ, তেমনি তাদের হতাশ প্রাণে এ সূরাটির বর্ণনা আশার জোয়ার প্রবাহিত করেছিলাে। অন্যান্য সূরার মধ্যে মূসা(আ.)-এর যে তথ্য বিবরণী এসেছে তাতে দেখা যায়, সেসব স্থলে প্রধানত তার রেসালাতের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে বেশী, তাঁর জন্ম ও তৎসংলগ্ন ঘটনা সেখানে তেমন বেশী প্রাধান্য পায়নি। আসলে জন্মলগ্নের ঘটনা ও তৎসংশ্লিষ্ট তথ্যসমূহের মাধ্যমে বিদ্রোহী, অহংকারী, শক্তিদর্পী বাদশাহর ওপর ঈমানী শক্তির বিজয় চমৎকারভবে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। তারপর দেখানাে হয়েছে ঈমানী শক্তির অধিকারীদের জন্যে গায়বী মদদের দৃশ্য। অবশেষে যালেম ও বিদ্রোহীদের জন্যে তাদের করুণ পরিণতির শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে নিছক একটি কাহিনী বর্ণনা করাই আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। মূলত এ কথাটাই বলতে চাওয়া হয়েছে যে, যখন কোনাে দেশে অন্যায় অবিচার, যুলুম-নির্যাতন ও মন্দের প্রসার ঘটে, তখন সে সমাজের ধ্বংস হওয়াটা অবধারিত হয়ে যায়। যখন আল্লাহর রাজ্যে তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন তা দমন করার জন্যে মানুষের কোনাে শক্তি প্রয়ােজন হয় না বরং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার কুদরতী হাত বাড়িয়ে দেন, যারা হীনতা দীনতার অক্টোপাসে আবদ্ধ হয়ে দুর্বল হয়ে রয়েছে, তারাই তখন সে হাত ধারণ করে, তারা আল্লাহর শক্তি দিয়েই যালেমদের শায়েস্তা করে, ওদের অত্যাচার থেকে মানুষকে রেহাই দেয়। কল্যাণের পথ ও তার উপাদানসমূহ সে জাতিকে তারা ঢেলে সাজায়। তাদের জনপদের নেতা এবং পূর্ববর্তী যালেমদের সহায় সম্পদের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেয়। এ সূরাটির আলােচনা ধারা থেকে এই উদ্দেশ্যই ফুটে ওঠেছে, আর এই জন্যেই দেখা যাচ্ছে, আলােচ্য ভাষণে এই উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। আল কোরআনে যতাে কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে, সবগুলােই এই ধরনের কোনাে না কোনাে উদ্দেশ্য সামনে রেখেই বর্ণিত হয়েছে। আসলে কোনাে জাতিকে গড়ে তােলার জন্যে এবং তাদের মানসিক অবস্থা কোন উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালিত করার জন্যে এই ধরনের উপাদানের সাহায্য নিতে হয়, তাহলে যে কোনো বক্তব্যকে ফলপ্রসূ বানানাে যায়, কোনাে বিষয় প্রস্ফূটিত করে তােলা যায় এবং এইভাবে অন্তরসমূহকে সত্য সচেতন করে তােলা সম্ভব হয়। এখানে কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে যেসব ভাষণ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে মূসা(আ.)-এর জন্ম বৃত্তান্ত ও সে জন্মলগ্নকে ঘিরে যেসব কঠিন অবস্থা সামনে এসেছে তা অবশ্যই দেখার বিষয়। এ কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে মূসা(আ.)-এর নবুওত লাভ পর্যন্ত পৌছানাের ঘটনাবলী সামনে রাখলে সহজেই বুঝা যায় যে, স্বয়ং আল্লাহর পরিচালনা এবং মেহেরবানীতেই এ ঘটনাগুলাে সংঘটিত হয়েছে। এরপর আসছে পর্যায়ক্রমে তার কৈশোর, যৌবন ও নবুওতকালীন অবস্থা। বর্ণনায় এক কিবতির নিহত হওয়ার ঘটনাও আসছে এবং তাকে ধরার জন্যে ফেরাউন ও তার আমীর ওমরাদের ষড়যন্ত্র এবং তার মিসর থেকে পালিয়ে মাদইয়ানের দিকে চলে যাওয়া, সেখানে তার বিয়ে, বেশ কয়েক বছর চাকরি করা, তাকে আল্লাহর ডাক দেয়া এবং রেসালাতের দায়িত্ব প্রদান, তারপর ফেরাউন ও তার সভাসদদের সাথে মােকাবেলা এবং মূসা(আ.) ও হারুন(আ.)-কে তাদের প্রত্যাখ্যান করা, পরিশেষে ওদের সবার ডুবে মরা- এসব ঘটনা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘটে গেছে। আলােচ্য বিষয়ের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ঘটনা দুটির আলােচনা বেশ দীর্ঘ বিস্তারিত আকারে এসেছে। এ দুটি ঘটনা যেহেতু এ সূরার মধ্যে নতুন এক আংগিকে পেশ করা হয়েছে, তাই এ দুটি ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতার বাস্তব প্রকাশ ঘটেছে এবং ফেরাউনের অহংকার ও বড়ত্বের মিথ্যা দাবী ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, তার অক্ষমতা এবং সে যে আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী ফয়সালার অধীন, তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ, ফেরাউন, হামান ও তাদের লােকলস্করদের এ দুটি ঘটনা থেকে সেই সত্য দেখিয়ে দিতে চাই, যার আশংকা তারা করছিল। এরপর আল কোরআনের বর্ণনা পদ্ধতি অনুযায়ী পুরাে ঘটনা কয়েকটি দৃশ্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে এবং একটি দৃশ্য থেকে অপর দৃশ্যের মধ্যে যে ব্যবধান দেখা যায়, তা একজন সহজেই পূরণ করে নিতে পারে, ফলে পাঠকের মন একটি ঘটনা থেকে অপর ঘটনার মধ্যে কোনাে ব্যবধান রয়েছে বলে অনুভব করে না। এভাবে যে কোনাে জাগ্রত চেতনাশক্তিই আল কোরআনের বর্ণনাভংণির লালিত্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। প্রথম ঘটনাটি পাঁচটি দৃশ্য বর্ণনার মাধ্যমে পেশ করা হয়েছে, দ্বিতীয় ঘটনার বর্ণনা এসেছে নয়টি দূশ্যের মাধ্যমে এবং তৃতীয় ঘটনাটি চারটি দূশ্যে বিবৃত হয়েছে। এক ঘটনা থেকে অপর ঘটনার দূরত্ব কখনাে বেশী এবং কখনাে কম। পড়ার সময় তা এমনি টের পাওয়া যায়।
*কিবতীদের ওপর ফেরাউনের নির্মম অত্যাচার : কাহিনীটির পূর্ণাংগ বর্ণনা শুরু করার পূর্বে সেই পরিবেশের একটা ছবিও তুলে ধরা হয়েছে যার মধ্যে এ ঘটনাগুলাে সংঘটিত হয়েছিলো। এক্ষেত্রে সে সময়টার কথাও বলা প্রয়োজন যখন সেসব ঘটনাগুলাে ঘটেছিলাে এবং বর্ণনার পূর্বে ঘটনাগুলাে কেন ঘটানাে হয়েছিলাে তাও পেশ করা হয়েছে। এইভাবে প্রতিটি বিষয়ের পুংখানুপুংখ বর্ণনাদান আল কোরআনের কাহিনী বর্ণনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা এর বিষয় ও লক্ষ্যকে সুস্পষ্ট প্রস্ফূটিত করে তােলে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ফেরাউন পৃথিবীর বুকে তার বড়ত্ব প্রদর্শন করলাে, সে উদ্ধত হয়ে তার দেশবাসীকে ভাগ ভাগ করে রাখলাে… তাদের সৈন্য সামন্তকে সেই জিনিস দেখাতে চেয়েছিলাম যার আশংকা তারা করেছিল'(আয়াত ৫-৬) এভাবে সেই দৃশ্যটি ছবির মতাে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে যাতে তাদের সামনে আল্লাহ রব্বুল ইযযতের অপ্রতিরােধ্য শক্তি খুলে গিয়েছিলাে এবং সেই উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিলাে, যা তিনি পূরণ করতে চেয়েছিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতার এই প্রকাশ এবং পর্দার অন্তরাল থেকে তাঁর অকল্পনীয় ক্ষমতার নযির তুলে ধরাই আলােচ্য সূরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়, যার বর্ণনা সূরাটির শুরু থেকে নিয়ে ছত্রে ছত্রে এবং সকল বর্ণনাধারার মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠেছে। এভাবে সুরাটির মধ্যে বর্ণিত কাহিনীটি শুরু হচ্ছে, এ মহা আশ্চর্য কিতাবের এ বর্ণনাধারা এতােই চমৎকার এবং এতে বেশী চিত্তাকর্ষক যে, এর সাথে মানুষের তৈরী কোনাে পুস্তকের কোনাে তুলনাই হয় না। এই বিস্তারিত আলােচনার মধ্যে যে ফেরাউনের কথা বলা হয়েছে, সে যে কোন ফেরাউন তা মােটই সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি, অর্থাৎ রসূলুল্লাহ(স.)-এর যমানা থেকে সে কতাে দিন পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিলাে, কতদিন রাজত্ব করেছিলাে, তার আগে কে ছিলাে, কি ভাবে সে ক্ষমতায় এলাে এবং কেমন করেই বা সে এতাে ক্ষমতার মালিক হয়ে বসলাে, কেনই বা তার আধিপত্যের বিরুদ্ধে কোনাে আপত্তি বা অভ্যুত্থান হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি ঐতিহাসিক তথ্য কিছুই আল কোরআন তুলে ধরেনি। কারণ এসব কিসসা কাহিনী বা অতীত ঘটনাবলী রসিয়ে-কষিয়ে বলা এবং তার দ্বারা কোনাে মজা হাসিল করা এ পাক কিতাবের উদ্দেশ্য নয়। উল্লেখিত ঘটনাপঞ্জীর মধ্যে এতােটুকু তথ্য দিয়েই আল কোরআন ক্ষান্ত হয়েছে যে, ইউসুফ(আ.)-এর যমানার পর এ শাসকের আবির্ভাব হয়েছিলাে। ইউসুফ(আ.)-এর ভায়েরা মিসরে আসার পর সেখানেই থেকে যায়। তাঁর পিতা ছিলেন ইয়াকুব(আ.), যিনি পরবর্তীতে ইসরাঈল নামে পরিচিত হন এবং তার সন্তানেরা বনি ইসরাঈল নামে খ্যাত। মিসরেই তাদের বংশ বিস্তার হয় এবং সেখানে তারা এক বিরাট বংশ হিসেবে বসবাস করতে থাকে। যখন এ অহংকারী স্বৈরাচারী ফেরাউন (মিসরের বাদশাহদের সে যমানায় ফেরাউন বলা হতাে) ক্ষমতাসীন হলাে, তখন সে তার কূটনৈতিক বুদ্ধি দ্বারা গােটা জনপদকে এমনভাবে দুর্বল করে রাখলাে যে, কেউ তার বিরুদ্ধে কোনাে কিছু বলার সাহস পেতাে না। যদিও মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছিলাে, তার অত্যাচারে জনসাধারণের জীবন অতিষ্ঠ ছিলাে, এমনকি তার বংশের লােকেরা যে সবাই তার ওপর খুশী ছিলাে তাও নয়, তবুও তারা তার অত্যাচার থেকে বাঁচার কোনাে উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাে না। তার কূটনীতির প্রধান কাজ ছিলাে গােটা মিসরবাসীকে অতি কৌশলে নানা দলে বিভক্ত করে রাখা। তার পলিসি ছিলাে, ‘ডিভাইড এন্ড রুল, জাতিকে বিভিন্ন দলে ভাগ করাে এবং তাদের শাসন করাে’, যা তার উত্তরসূরীরাও গ্রহণ করেছে। আজও মিসর সহ অন্যান্য দেশের কর্ণধাররা এই একই পলিসি অবলম্বন করে নিজ নিজ দেশে অত্যাচারের ষ্টীম রােলার চালিয়ে যাচ্ছে। ফেরাউনের বংশীয় লােক ও তার সৈন্য সামন্তরা সংখ্যায় যাই থাকুক না কেন, তারা ছিলাে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির কৃপাধন্য। তাদেরও বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে রেখে তাদের দলীয় নেতাদের পদ, পদবী ও অর্থ দিয়ে এমনভাবে বশীভূত করে রাখা হয়েছিলাে যে, সামন্ত কায়দায় তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ দলকে ঠিক রাখতাে বনী ইসরাঈল জাতি তার কূট-কৌশলের কারণে ঐক্যবদ্ধ কোনাে জাতিতে পরিণত হতে পারেনি। যদিও এ জাতির সবাই জানতাে যে, তারা আল্লাহর নবী ইবরাহীম(আ.)-এর বংশধর, তারা জানতাে ইবরাহীম(আ.) তৎকালীন স্বেচ্ছাচারী শাসক নমরুদের ক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে মানুষের মুক্তি এনেছিলেন। তারা এও জানতাে যে, তাদের মত ও পথ একটিই এবং তাদের জীবন যাপন পদ্ধতিও সুনির্দিষ্ট রয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন প্রকার সুবিধা দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও উচ্চাভিলাষী লােকদের ফেরাউন এমনভাবে হাত করে রেখেছিলাে যে, তাদের ব্যক্তিত্ব ও বাগ্মীতার হাতিয়ার ফেরাউনের জন্যে হয়েছিলাে প্রধান সহায়ক শক্তি। ছলে-বলে কলে-কৌশলে ফেরাউন নিজের বড়ত্ব কায়েম রেখেছিলাে, সে জনগণকে মজবুর করে রেখেছিলাে। নানা কুট কৌশলের মাধ্যমে মিসরবাসীকে নানা বিবদমান দলে বিভক্ত করে রেখেছিলাে, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ কোনাে শক্তিতে পরিণত হতে না পারে এবং একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে। তার অহংকার, যুলুম ও দমন নীতির প্রধান শিকার ছিলাে বনী ইসরাঈল। কারণ তাদের আকীদা বিশ্বাস ও জীবন যাপনের নিয়ম নীতি ছিলাে তার ও তার কওমের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। তারা তাদের দাদা ইবরাহীম(আ.) ও পিতা ইয়াকুব(আ.)-এর প্রবর্তিত নিয়ম বিধান মেনে চলতাে। দিনে দিনে তাদেরও জীবন যাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে থাকলাে। এতদসত্তেও বিশ্বজগতের মালিক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তায়ালা এই মূল বিশ্বাসটা তখনও তাদের মধ্যে জীবন্ত ছিলাে। শত নিষ্পেষণেও তারা ফেরাউনের সর্বময় ক্ষমতার মালিক হওয়ার দাবী স্বীকার করতাে না, তারা সবাই তার শিরক ও পৌত্তলিকতার মনােভাবকে অস্বীকার করতাে। এভাবে চরম অহংকারী শাসক ফেরাউন অনুভব করতে লাগলাে যে, এই ভিন্ন মতাবলম্বী জাতির আকীদা বিশ্বাস ও মিসরে তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব তার ক্ষমতা ও তার রাজত্বের জন্যে এক মারাত্মক হুমকি হয়ে রয়েছে, কিন্তু সংখ্যায় তারা এতাে বেশী যে, সামগ্রিকভাবে তাদের মিসর থেকে বহিষ্কার করাও কঠিন। আদম শুমারিতে দেখা গেছে তাদের সংখ্যা বেশ কয়েক লক্ষ এবং এটাও তার সন্দেহ ছিলাে যে, তারা বিরুদ্ধবাদী শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশগুলাের সহযােগিতা নিয়ে তাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এ জন্য সে এই অনমনীয় ও অবাধ্য জাতিকে দমন করার উদ্দেশ্যে নানাপ্রকার জঘন্য ও নিপীড়নমূলক উপায় উদ্ভাবন করতে লেগে গেলাে। বিভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা আবিষ্কার করলাে, তাদের দেশের কর্মসংস্থান প্রকল্পগুলাে থেকে দূরে সরিয়ে রাখলাে, তাদের জীবনকে সকল দিক দিয়ে দুর্বিষহ করে তুললাে, তাদের জীবনে নানা প্রকার জ্বালা যন্ত্রণা ও অশান্তি এনে দিল এবং সর্বশেষে তাদের সংখ্যা কমানাের হীন উদ্দেশ্যে তাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করতে শুরু করলাে। প্রশাসনের প্রতি হুকুম জারি করে দিলাে যখনই বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে কোনাে পুত্র সন্তানের জন্ম হবে তখনই যেন তাকে হত্যা করা হয়, তবে কন্যা সন্তান হলে যেন তাকে জীবিত ছেড়ে দেয়া হয়। সে ভাবলাে, নানা প্রকার শান্তি ও যুলুমের সাথে এই পুত্র নিধনযজ্ঞ চালাতে থাকলে ক্রমান্বয়ে তাদের বংশহ্রাস হতে থাকবে এবং ধীরে ধীরে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। এই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে যখন এ যালেম শাসক দমন নিপীড়ন চালাতে শুরু করলাে, তখন সে একটুও হিসাব করতে পারলাে না যে, সে নিজে কতাে দিন বাঁচতে পারবে। তার মতাে আরও তাে কতাে মানুষ দুনিয়ায় এসেছে, কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর তাদের এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। এ বর্ণনাও এসেছে যে, যালেম ফেরাউন দেশব্যাপী বনী ইসরাঈলদের গর্ভবতী মহিলাদের খোঁজ খবর রাখার জন্যে ধাত্রীদের নিয়ােজিত করে রেখেছিলাে। যাতে করে ওদের প্রতিটি পুত্র সন্তান পয়দা হওয়ার সাথে সাথে হত্যা করা হয় এবং সেসব নিরপরাধ শিশুদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে কোনাে দয়া-সহানুভূতি বা অনুকম্পা প্রদর্শন করা না হয় । এই ছিলাে সেই মারাত্মক পরিবেশ পরিস্থিতি, যার মধ্যে মূসা(আ.)-এর জন্ম হয়েছিলাে। তাঁর জন্মলগ্ন থেকে ফেরাউন ও তার জাতির সলিল সমাধির কাহিনীর বিবরণ পেশ করে আল্লাহ তায়ালা অপরিণামদর্শী ও অহংকারীদের তার শক্তি ক্ষমতা দেখাতে চেয়েছেন। কোনাে ব্যক্তি বা জাতিকে তিনি বাঁচাতে চাইলে সারা দুনিয়ার সকল মানুষ ও শক্তি মিলে চেষ্টা করলেও তাকে মারা যায় না, আর কাউকে তিনি ধ্বংস করতে চাইলে কেউ তাকে বাঁচাতে পারে না, একথাটাই তিনি তাদের জানাতে চেয়েছেন। মূর্খ নাদানের দল একটুও চিন্তা করে না যে, বস্তুশক্তিগুলাের মালিক কে? তাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো কি তাদের কথামতাে চলে? কার বিধান মতাে সব কিছু আবর্তিত হচ্ছে। বিশেষ করে কোরায়শ জাতি তাদেরই আল-আমীনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে যখন লিপ্ত হয়েছে, তখন একটুও ডেবে দেখলাে না যে, ইবরাহীম(আ.)-কে সে প্রলয়ংকরী অগ্নিকুন্ড থেকে কে বাঁচাল এবং তার দাওয়াতটাই কি ছিলাে। আর মােহাম্মদ(স.)-এর দাওয়াতই বা কি। সারা জগতের মালিক আল্লাহর হুকুম পালন করার এবং তার প্রভুত্ব কায়েম করার আহ্বান জানানােই যদি মুহাম্মদ(স.)-এর অপরাধ হবে, তাহলে ইবরাহীম(আ.)ও তাে এই একই অপরাধ(?) করেছিলেন। তাকে যদি অভাবনীয়ভাবে আল্লাহ তায়ালা বাঁচাতে পারেন তাহলে আজ মােহাম্মদ(স.)-কে আল্লাহ তায়ালা বাঁচাতে পারবেন না কেন? তাছাড়া যেসব হাতিয়ারের জোরে এই বিদ্রোহীরা বড়াই করে, তার মূল উপাদান তাে আগুন। সেই আগুনের মালিক যদি আল্লাহ তায়ালা হন, তিনি যদি চান যে সে আগুন তার অনুগতদের স্পর্শ করবে না, তাহলে অন্য কার কথামত সে আগুন কাজ করবে? তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর ফেরাউন পৃথিবীতে নিজের বড়ত্ব প্রদর্শন করলাে এবং দেশের অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে ফেললাে… অবশ্যই সে ছিলাে ভয়ানক অশান্তি সৃষ্টিকারী।’ অতপর আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার ইচ্ছা নস্যাৎ করে অন্য কিছু করতে চাইলেন, তিনি তার তাগুতী শক্তির সকল ইচ্ছা ও চক্রান্ত নাকচ করে দিয়ে নিজের ইচ্ছা কার্যকর করতে সম্পূর্ণ সক্ষম, কিন্তু আফসােস, বিদ্রোহী অহংকারী শক্তিদর্পীদের সাময়িকভাবে আল্লাহ তায়ালা কিছু শক্তি ক্ষমতা দিলে তারা ধোকায় পড়ে যায়। তারা ভাবতে শুরু করে যে, শক্তি বা ক্ষমতার বুঝি কোনাে শেষ নেই, নেই কোনাে লয়। উপায়-উপকরণ ও অর্থ সম্পদ তাদের এতােদূর মুগ্ধ করে ফেলে যে, তারা ভুলে যায়, এগুলাের আসল মালিক কিন্তু তারা কেউ নয়। আসল মালিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এগুলাে ব্যবহার করতে চাইলে মূল মালিকের হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তারা মনে করতে শুরু করে যে, যেভাবে তারা এগুলাে ব্যবহার করতে চাইবে, ব্যবহার করতে পারবে এবং তাদের শত্ৰুর বিরুদ্ধে ইচ্ছা করলেই তা প্রয়ােগ করতে পারবে, কিন্তু বিধি যদি বাম হয় তাহলে তাদের এসব শক্তি সরঞ্জাম যে তাদের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াতে পারে এসব কথা তারা মনে করতে পারে না। তাই আল্লাহ তায়ালা এখানে তার ইচ্ছার কথা ঘােষণা করছেন এবং তার শক্তি ক্ষমতার কথা জানাতে গিয়ে ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্য-সামন্তদের কথা উল্লেখ করছেন যে, তাদের সকল প্রকার যোগাড়যন্ত্র, সাবধানতা ও সতর্কতা তাদের কোনােই কাজে লাগলাে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘যাদের দেশের মধ্যে সকল দিক দিয়ে দুর্বল করে রাখা হয়েছে তাদের প্রতি আমি এহসান করতে চাই… যার আশংকা ওদের কাছ থেকে তারা করতাে।’ অতপর সে যালেম বাদশাহ দুর্বল করে রাখা যেসব মানুষকে নিজের অত্যাচারের লক্ষ্য বানিয়ে রেখেছিলো, তাদের সাথে যেভাবে খুশী নৃশংস আচরণ করে চলেছিলাে, তাদের ছেলেদের হত্যা করছিলাে এবং তাদের কন্যা সন্তানদের যিন্দা ছেড়ে দিচ্ছিলাে এবং নিকৃষ্টভাবে সে তাদের কষ্ট দিচ্ছিলাে এবং সম্ভাব্য সকল প্রকার দমন নীতি তাদের ওপর চালিয়ে যাচ্ছিলাে এতদসত্তেও তাদের ফেরাউন ভয় করছিলাে এবং তার নিজের ও দেশের জন্যে এক প্রচন্ড হুমকি হিসেবে তাদের সে গণ্য করছিলাে। এ জন্যে সব সময়েই তাদের প্রতি সে নযর রাখছিলাে এবং তাদের বিরুদ্ধে গােয়েন্দা বিভাগকে সদা সর্বদা সতর্ক করে রেখেছিলাে। পুত্র সন্তানের জন্ম হয়ে যাতে তাদের বংশ বৃদ্ধি হতে না পারে তার জন্যে প্রয়ােজনীয় সকল ব্যবস্থাই সে করে রেখেছিলাে। সে এমনভাবে গােয়েন্দাদের জাল বিস্তার করে রেখেছিলাে যে, বনী ইসরাঈল কওমের মধ্যে কোনাে পুত্র সন্তান জন্ম হওয়ার সাথে সাথে তাকে জল্লাদের হাতে সােপর্দ করে দিতে হতাে এবং সংগে সংগে সে কসাই এসে তাকে যবাই করে ফেলতাে। কল্পনার চোখে সে পরিবেশ পরিস্থিতির দিকে একবার লক্ষ্য করুন। কতাে অসহায় হয়ে পড়েছিলাে তখনকার মানুষ। সেই কঠিন অবস্থা থেকে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন অধােপাতিত ও নিগৃহীত সে জাতিকে টেনে তুলতে চাইলেন, চাইলেন তাদের দুনিয়ার নেতৃত্ব দান করতে ও তাদের দুঃসহ দুঃখ জ্বালা নিবারণ করতে । অতপর চাইলেন যেন তারা এতদিনকার দাসত্বের দুঃখ-গ্লানি ঝেড়ে মুছে ফেলে এক স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে এবং দুনিয়ার নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়। সর্বশেষে তিনি এও চাইলেন, সারা দুনিয়া তাদের কতৃত্বাধীনে এসে যাক। হাঁ, তাদের অবশ্যই এ মর্যাদা দেয়া হয়েছিলাে এবং দেয়া হয়েছিলাে তখন, যখন তারা ঈমান ও নেক আমলের মাধ্যমে তাদের যােগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলো। তাই দেখা যায়, পরবর্তীতে তাদের তিনি দুনিয়ার শাসন ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন এবং তারা নিশ্চিন্ত ও পরিতৃপ্ত হৃদয়ে মান মর্যাদা ও ক্ষমতার মসনদে প্রতিষ্ঠিত হলাে তাদের সম্মানজনক অবস্থা বাস্তবায়িত হলাে। ফেরাউন, হামান ও তাদের বেগবান সৈন্য সামন্তের দল যার ভয় করছিলাে, তাদের অজান্তেই তাদের সকল সতর্কতা ব্যর্থ হয়ে গেলাে। এভাবে এ কাহিনীর বিস্তারিত আলােচনা পেশ করার আগেই প্রসংগক্রমে বনী ইসরাঈল জাতির কাছে সেই খবরের ঘােষণা দিয়ে দেয়া হলাে যা অনাগত ভবিষ্যতে ঘটবে। উদ্দেশ্য, এর ফলে এই শক্তিময়ী পরস্পর মুখােমুখী দাঁড় করানাে যাবে। একদিকে ফুলে ফেঁপে ওঠা বলদর্পী ফেরাউনের বিশাল বাহিনী সর্বপ্রকার সমরসজ্জায় সজ্জিত হয়ে প্রবল প্রতাপ নিয়ে অগ্রসরমান, দেখে মনে হচ্ছিলাে তাদের রুখবার মতাে কেউই নেই এবং প্রতিপক্ষের সকল শক্তিকে তারা চুরমার করে দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম। অপরদিকে আল্লাহর শক্তি সমৃদ্ধ কতিপয় মানুষ, যারা মানুষের চোখ ধাঁধানাে সকল শক্তি ক্ষমতা ধুলিসাৎ করে দিতে পারে, এ কথা তাদের ভাবনা চিন্তায়ও উদিত হয়নি। এভাবে ঘটনাটির পূর্ণ বৃত্তান্ত পেশ করার পূর্বেই সে বিস্ময়কর কাহিনীর একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র আঁকা হচ্ছে, যাতে করে ঘটনাটি পরিপূর্ণভাবে জানার জন্যে মন উন্মুখ হয়ে যায়। কিভাবে সংঘটিত হলাে এই মহাবিস্ময়কর ঘটনাটি। এতাে বড় ক্ষমতাধর ও অনমনীয় বলদর্পী বাদশাহর সকল দর্প কিভাবে চুর্ণ হয়ে গেলাে এবং কিভাবে তাদের সমূলে নিধনযজ্ঞ সম্পন্ন হলাে, তা বুঝার জন্যে যে ব্যক্তির মন যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তার জন্যে এখানে পূর্বেই একটু আভাস দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপর সেই ঘটনার ছবি আঁকা হচ্ছে। এ ছবির দৃশ্য মানস-পটে এমনভাবে আঁকা হচ্ছে, যা দেখে মনে হচ্ছে এই প্রথম বুঝি তারা ঘটনাটি জানলাে, অথচ ইতিপূর্বে আল কোরআনের পৃথক পৃথক স্থানে ঘটনাটির অনেক বিবরণ এসেছে, মানবেতিহাসে অন্য কোথাও এতাে পুরাতন ঘটনার কোনাে বিবরণ পাওয়া যায় না। এভাবে মানুষের কাছে বর্ণনাকে আকর্ষণীয় ও গ্রহণযােগ্য করার জন্যে আল কোরআনের এ এক বিশেষ বর্ণনাভংগি, যার সাথে অন্য কোনাে গ্রন্থের বর্ণনাভংগির তুলনা করা যায় না।
*আল্লাহর কুদরতে দুশমনের হাতেই মূসা(আ.)-এর লালন পালন : এবার পর্যালােচনা করে দেখা যাক কাহিনীটির পূর্ণাংগ বর্ণনা কিভাবে শুরু করা হচ্ছে, কিভাবে ফেরাউনের বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে এবং এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে কিভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কুদরতের কারিশমা ফুটে ওঠছে এবং পর্দার অন্তরাল থেকে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতার চাবুক কিভাবে বেরিয়ে আসছে। মুসা(আ.)-এর জন্ম হয়েছে যে কঠিন পরিস্থিতিতে তা সূরার শুরুতে বর্ণিত হয়েছে। চতুর্দিকে যখন শুধু বিপদ আর বিপদের ঘনঘটা, মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি যখন বাজছে দিকে দিকে, দুহাত বাড়িয়ে যখন বিভীষিকাময় মৃত্যুর ভয়াল হাত এগিয়ে আসছে, সেই কঠিন মুহূর্তে ভূমিষ্ঠ হচ্ছেন ভবিষ্যতের নবী মূসা(আ.)। হাঁ, হয়রান পেরেশান মায়ের মন, প্রচন্ড আতংকে দারুণ দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত তার হৃদয় দুরু দুরু করছে, ভীষণ ভয়ের দোলায় দুলছে সদ্য ভূমিষ্ঠ বাচ্চার আশু অকল্যাণ চিন্তায়, প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি জল্লাদ খবর পেয়ে গেলাে। এই বুঝি তার মায়ের বুক থেকে তার কলিজার টুকরাকে ছিনিয়ে নিয়ে টুকরা টুকরা করে কেটে ফেলবে। প্রত্যেক মা যেন দেখতে পাচ্ছেন তার আদরের দুলালের কণ্ঠে শন শন করে জল্লাদের ক্ষুরধার ছুরি চলছে। কচি শিশুর মায়ের এই প্রচন্ড ভয়, যে মা বাচ্চার নিরাপত্তা বিধানের কোনাে ক্ষমতা রাখেন না, বাচ্চাকে কোনাে স্থানে লুকিয়ে রাখারও তার কোনাে উপায় নেই। সদ্যপ্রসূত বাচ্চার জীবনের লক্ষণ তার কান্নার আওয়ায বেড়েই চলেছে এবং যে আওয়াজ কোনোভাবেই গােপন করা যাচ্ছে না, কোনােভাবেই বাচ্চার কান্না প্রশমিত করা যাচ্ছে না। হায়, দুর্বল ক্ষীণদেহী অভাবী মা কিভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তার নয়নমণিকে বাঁচাবেন। এ সব নানাবিধ দুশ্চিন্তায় মায়ের মন যখন থর থর করে কাঁপছে, তার বাকশক্তি যখন রহিতপ্রায়, সে সময়েই কুদরতের হাত হস্তক্ষেপ করছে। এই সুশীতল শান্তি ও সান্তনাদায়ক হাতটি চিন্তাক্লিষ্ট, ভীত-সন্ত্রস্ত, পেরেশান মায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতটি কী মধুর পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে বেদনা-ক্লিষ্ট এই মায়ের দেহে, কী মায়াময় বাণী তার কাছে পৌছে দিচ্ছে। যার বিবরণ আসছে নীচের আয়াতে, ‘আমি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ, মূসার মাকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম, নিশ্চিন্তে তােমার বাচ্চাকে তুমি দুধ পান করাও। যখন খুব বেশী ভয় লাগবে তখন বাচ্চাকে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দাও। খবরদার তুমি ভয় পেয়াে না এবং দুঃখ নিয়ে না।’ ইয়া আল্লাহ, হে সকল ক্ষমতার মালিক! কি মধুময় তােমার বাণী। হে মূসার মা, তােমার বাচ্চাকে দুধ পান করাও। বাচ্চাকে তােমার দু’বাহু দ্বারা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখাে, তুমি অস্থির হয়ে যাচ্ছে কেন? তিনি নিজেই তাে তােমার সহায় হয়ে রয়েছেন। দেখাে, তােমার বাচ্চা কতাে নিশ্চিন্তে এবং কেমন করে শান্তভাবে তােমার বুকের দুধ খাচ্ছে, তবুও তুমি ভয় পাচ্ছাে? তুমি তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে, কিসের বিপদ তােমার। তাকে ধরার মতাে কেউ নেই, তবুও তুমি ভয় পাচ্ছাে? আচ্ছা ঠিক আছে, তােমার ভয় যদি কিছুতেই দমন করতে না পারাে তাহলে ‘খোলা সাগরের বুকে তাকে ভাসিয়ে দাও।’ ‘আর মােটেই তুমি ভয় পেয়াে না, ভেংগে পড়াে না দুঃখে।’ সে তাে এখানেই আছে, সাগরের বুকেই আছে, আছে সেই মহান পরওয়ারদেগারের তত্ত্বাবধানে, যার নিরাপত্তা ছাড়া সত্যিকারের নিরাপত্তা অন্য কারও কাছে নেই, নেই অন্য কোথাও। এমন শক্তিশালী মালিকের হাত যার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে, তার কোনাে ভয় নেই। এমন মযবুত সে হাত, যার ধারে কাছেও কোনাে ভয়-ভীতি আসে না। সে হাতের স্পর্শে কঠিন থেকে কঠিন আগুন ঠান্ডা হয়ে যায় এবং সেখানে পরিপূর্ণ শান্তি নেমে আসে। সে হাতের ছোঁয়ায় উন্মত্ত সাগর বক্ষ আশ্রয়স্থলে রূপান্তরিত হয়। সে হাত যাকে নিরাপত্তা দেয় তার একটি চুলও কেউ স্পর্শ করতে পারে না করার সাহস রাখে না মহাবিদ্রোহী ফেরাউন বা পৃথিবীর কোনাে অহংকারী বলদর্পী শাসক, তারা সবাই মিলেও যদি চায় সেই নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে কারও ক্ষতি করতে, তাও পারবে না। তার ঘােষণা, ‘অবশ্যই আমি, মহান আল্লাহ, তােমার কাছে তাকে ফেরত এনে দেবো…’ সুতরাং তার জীবন সম্পর্কে তােমার ভয় করার প্রয়ােজন নেই বা সে চোখের আড়াল হয়ে গেছে বলে তােমার কোনাে চিন্তা করা লাগবে না… (তুমি জেনে নাও,) আমি তাকে রসূল বানাবাে। এটাই ছিলাে সে নিরাপত্তাদানের আশ্বাসের সাথে অতিরিক্ত সুসংবাদ। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ওয়াদা অবশ্যই অন্য সবার কথা থেকে বেশী সত্য। উক্ত কাহিনীর এই হচ্ছে প্রথম দৃশ্য, পেরেশান ও ভীত-সন্ত্রস্ত মায়ের সে ছবি, মৃত্যুর ভয়ে যে মুখচ্ছবি থেকে জীবনের সকল লক্ষণ বিলীন হয়ে গেছে, তার অন্তরের মধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন এ মহান আশ্বাস বাণী এসে যাচ্ছ, তখন সেখানে নব জীবনের স্পন্দন ভেসে ওঠছে, সব কিছু তার কাছে সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, তার কম্পিত হৃদয় তৃপ্তিতে ভরে ওঠছে। এ তৃপ্তির রেখা তার প্রশান্ত বদনে ফুটে ওঠছে। এরপর সেই বেদনাহত মা কতাে শান্ত মনে এবং কতাে নিশ্চিন্ততার সাথে, ধীরস্থিরভাবে বাচ্চাটাকে নিশ্ছিদ্র একটি বাক্সে করে সাগর বক্ষে ভাসিয়ে দিচ্ছে, এর পূর্ণ বিবরণ আর দান করা হয়নি। এ দৃশ্যের ওপর পর্দা ফেলে দেয়া হয়েছে, যাতে করে পাঠক এ পর্দা নিজেরাই সরাতে পারে। তারপর আমরা মুখােমুখি হচ্ছি দ্বিতীয় দৃশ্যের, ‘তারপর এ বাক্স ফেরাউনের পরিবার তুলে নিলাে।’ এটাই কি সেই নিরাপত্তা? এটাই কি সেই ওয়াদার সত্যতা? এটাই কি সেই সুসংবাদ, ইতিপূর্বে যার উল্লেখ করা হয়েছে? কার আশ্বাসবাণী দ্বারা মূসা(আ.)-এর মায়ের হৃদয়কে আশ্বস্ত করা হয়েছে। ফেরাউনের পরিবার ছাড়া অন্য কাউকে কি এই সর্বহারা অসহায় মা ভয় করছিলাে? ফেরাউনের পরিবার ছাড়া এ গােপনীয়তা অন্য কারাে কাছে প্রকাশ হওয়ার ভয় করছিলাে কি এই দিশেহারা মা? ফেরাউনের পরিবার ছাড়া অন্য কারও হাতে পড়ে যাবে তার আদরের দুলাল এই ভয়ই কি এ স্নেহময়ী মায়ের উত্তপ্ত হৃদয়ে জেগে ওঠেছিলাে? হাঁ, অবশ্যই মূসা(আ.)-এর মায়ের হৃদয়ে যে কথাগুলাে ইতিপূর্বেই জাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো, তাতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে তাদের কি করতে হবে, কোথায় সে যাবে, কার হাতে পড়বে, কোথায় সে লালিত পালিত হবে এবং অবশেষে মহান বিশ্বপালক তার দ্বারা কি খেদমত নেবেন, সব কিছুই বিস্তারিত তার মাকে জানিয়ে দিয়ে তার হৃদয়কে নিরুদ্বিগ্ন করে দেয়া হয়েছিলাে। সকল ক্ষমতার মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন যে, ফেরাউন, হামান ও তাদের লােকলস্কর বনী ইসরাঈলদের ছেলেদের এই আশংকায় হত্যা করছিলাে যে, ওরা তাদের এক সময়ে দেশ থেকে বের করে দেবে, শাসন ক্ষমতা দখল করে নেবে এবং তাদের খতম করে দেবে। এ কারণেই তারা সদা সর্বদা তাক লাগিয়ে ছিলাে যেন হত্যা করা থেকে বনী ইসরাঈলের একজন শিশুও বাদ না পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা চাইলেন, যে বাচ্চার নেতৃত্বে তাদের ধ্বংসের আশংকা তাদের মনে পয়দা হয়েছিলো, তার লালন পালন ওদের মধ্যেই সম্পন্ন হবে এবং এমন ব্যবস্থা তিনি করবেন যে, সে বাচ্চাটাকে কেউ আর খুজে বের করার চেষ্টা করবে। কে এই বাচ্চা হাঁ, এই বাচ্চার হাতেই তাদের সবার মৃত্যু আসবে! হাঁ, এই সে ভাগ্যবান শিশু, যে চরম অসহায় অবস্থায় তাদের হাতে পড়েছে এবং এমন অসহায় অবস্থায় তাদের দ্বারাই লালিত পালিত হচ্ছে, যার নিজেকে বাঁচানাের মতাে কোনাে শক্তি সামর্থ নেই, নেই তার কোনাে আশ্রয়স্থল, নিজের শক্তি ফিরে পাওয়ারও যার কোনাে উপায় নেই। হাঁ, এই বিপজ্জনক বাচ্চাই সকল বন্ধুর পথ অতিক্রম করে ফেরাউনের কেল্লা পর্যন্ত পৌছে যাবে, পৌছে যাবে সে বলদর্পী অত্যাচারী রক্তপিপাসু শাসকের দরবারে, অথচ কিছুতেই ফেরাউনের লােক লােকলস্কর এই বাচ্চার সন্ধান পাবে না। বনী ইসরাঈল জাতির কোন ঘরে, কোন মায়ের কোলে দুধ খাওয়া অবস্থায় এই শিশু বড় হচ্ছিলাে তারা কেউই তার খোঁজ পাবে না। এই বাচ্চাই একদিন খােলা ময়দানে সবার সামনে সুস্পষ্টভাবে তাদের তার উদ্দেশ্যের কথা জানাবে, ‘যাতে করে তাদের জন্যে সে শত্রুরূপে বিবেচিত হয় এবং তাদের সীমাহীন দুশ্চিন্তারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’ অর্থাৎ, সে সমান সমান শক্তির দাবীদার হওয়ার মাধ্যমে বা ফেরাউনের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার দাবী করে তার মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অথচ অহংকারী যালেম বাদশাহ তার কোনােই ক্ষতি করতে পারবে না।
*কিবতী হত্যার ঘটনা : মূসা(আ.) ছিলেন একজন সাহসী ও স্বাধীনচেতা মানুষ। নিজ জাতির ওপর এই যুলুম নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করা ছিলাে তার পক্ষে অসম্ভব। তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে অনুধাবন করছিলেন যে, দীর্ঘদিন থেকে এই অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে করতে তার জাতির আত্মসম্মান, অনুভূতি ও বােধশক্তি পর্যন্ত লােপ পেয়ে গিয়েছে। এ কারণেই তিনি এক বনী ইসরাঈলীর ওপর যুলুম করতে দেখে এক কিবতীকে কষে এক চড় বসিয়ে দেন এবং চড় খেয়ে লােকটি অনাকাংখিতভাবে মরে গেলে তিনি লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর পরদিন আবারও যখন তিনি এক ইসরাঈলীকে মারতে দেখেন, তখন তিনি তাকে বাচানাের জন্যে এগিয়ে আসেন। তিনি কিবতীকে হত্যা করতে নয় বরং ইসরাঈলীকে তার যুলুম থেকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন, তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেন, তার ডাকে সাড়া দেন। কারণ মানুষের অন্তরে কী আছে তা তাে আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন। তিনিই ভালাে জানেন মানুষের ধৈর্য সহ্যের সীমা কতােটুকু। এদিকে ইসরাঈলীদের প্রতি ফেরাউনের যুলুম এমন চরম পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলাে, আপােষ মিমাংসার মাধ্যমে জাতিকে মুক্ত করার সম্ভাবনার সকল দ্বার রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাে। দীর্ঘদিন থেকে যুলুম করতে করতে তারা এমন বেপরােয়া হয়ে উঠেছিলাে যে, সামষ্টিক একটি গণজাগরণ বা বিপ্লব না হলে মূসা(আ.) ব্যক্তিগতভাবে যা করেছেন এমন বিক্ষিপ্তভাবে কিছু করে সত্যিকার অর্থে কোনাে কাজ হবে না। পরে তিনি সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যা করেছেন তাতে পরিস্থিতি আরাে ঘােলাটে হতে পারে। দুরদর্শী দৃষ্টি দিয়ে যখন তিনি ভাবলেন, তখন বুঝলেন, যা তিনি করেছেন তা নিজের কর্মপন্থা তথা নিজের উপরই অবিচার। সামান্য দেরীতে হলেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই গােলামীর শিকল থেকে, এই যুলুম অত্যাচার থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হলে প্রয়ােজন সুপরিকল্পিত ও দুরদর্শি বাস্তবমুখী পরিকল্পনা। এর পরবর্তী বিস্তৃত ঘটনায় আমরা দেখতে পাই স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই তার নবী মূসা(আ.)-এর মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। কেননা তিনি ছিলেন সেই জাতির জন্যে আল্লাহর তরফ থেকে নির্বাচিত নবী। আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি তার কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন করেছেন। মক্কাতেও প্রথম দিকে মুসলমানদের একই অবস্থা ছিলাে, তাই প্রথমদিকে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে ধৈর্য ধরতে, কাউকে পাল্টা জবাব না দিয়ে হাত সংযত রাখতে। যাই হােক আমরা আবার মূল ঘটনায় ফিরে যাই। দ্বিতীয় দিন যখন মূসা(আ.) অন্য এক কিবতীকে দেখলেন, সেই ইসরাঈলীর ওপর যুলুম করতে তখন তিনি তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন, কিবতি মূসা(আ.)-কে এগিয়ে আসতে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেলাে। সে জানতাে যে গতকাল মূসা(আ.) এক চড়ে এক লােককে মেরে ফেলেছে। তাই সে বললাে, ‘তুমি গতকাল যেমন একজনকে হত্যা করেছে তেমনি কি আমাকেও আজ হত্যা করতে চাও।’ সে আরাে বললাে, ‘তুমি তো দেখছি সেচ্ছাচারী হতে চলেছে, তুমি তো শান্তি স্থাপনকারী হতে চাও না।’ কিবতী লােকটি মূসা(আ.) সম্পর্কে এমন একটি কথা বললাে যা তার চরিত্রের সাথে মােটেই সামঞ্জস্য নয়। জীবনভর তিনি মানুষের উপকার করেছেন, মানুষের কল্যাণ চেয়েছেন, অনেকের মাঝে বিদ্যমান ঝগড়া বিবাদ মীমাংসা করেছেন। তিনি কখনােই সেচ্ছাচারীতা কিংবা অন্যায়ভাবে কারাে সাথে কখনাে বাড়াবাড়ি করেননি। অথচ কিবতী লােকটি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিলাে যে, সে নাকি সেচ্ছাচারীতা করে, ফাসাদ সৃষ্টি করে, মানুষের মাঝে মীমাংসা না করে সে মানুষ হত্যা করে ইত্যাদি। কোনাে কোনাে মােফাসসেররা অবশ্য বলেছেন যে, এই কথাগুলাে কিবতীর নয়; বরং ইসরাঈলীই মূসা(আ.)-কে বলেছিলাে। কেননা যখন মূসা(আ.) তাকে বললেন, ‘তুমি তাে দেখছি ভারি গোমরাহ ব্যক্তি’ এবং রাগান্বিত হয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন, তখন ইসরাঈলী মনে করেছিলাে মূসা(আ.) তার উপরেই ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তাই পরিস্থিতি তার অনুকুলে আনার জন্যে হঠাৎ সে ভােল পাল্টে উল্টা মূসা(আ.)-কে কথা দিয়ে একহাত নিয়ে নিলাে এবং গতকাল ঘটে যাওয়া সেই অনাকাংখিত ঘটনাটি সে জনসমক্ষে ফাস করে দিলাে। যে সব মােফাসসের এই মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন তারা মনে করেন, পূর্বের দিনের ঘটনাটি শুধু এই ইসরাঈলীই জানতাে, অন্য কেউ জানতাে না। আমি আমার বই ‘আত তাসবীরুল ফান্নী ফিল কোরআন’ নামক বইয়ে ইতিপূর্বে এই মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে কথাটি ইসরাঈলী নয়, বরং বলেছিলাে এবং মূসা(আ.) কর্তৃক কিবতীকে হত্যা করার ঘটনা আগেই ফাঁস হয়ে গিয়েছিলাে। এর পরবর্তী ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, কিবতী গতকালের ঘটনার উল্লেখ করার পর মূসা(আ.) আর আগে বাড়েননি। তাদের সাথে এ নিয়ে আর কোনাে বাদানুবাদ করেননি।
*ফেরাউনের হুলিয়া জারি ও মূসা(আ.)-এর দেশত্যাগ : এরপর এখান থেকে শুরু হয়েছে ঘটনার নতুন অধ্যায়। এখানে আমরা দেখতে পাই মূসা(আ.)-এর কল্যাণকামী এক ব্যক্তি শহরের অপর প্রান্ত থেকে ছুটে এসে তাকে ভয়াবহ এক দুঃসংবাদ দিলাে। সে জানালাে যে, ফেরাউনের লোকেরা মূসা(আ.)-কে গ্রেফতার করার জন্যে ছুটে আসছে। সে এসে বললাে, ‘ফেরাউনের দরবারীরা আপনাকে হত্যা করার পরামর্শ করছে, আপনি এই মুহূর্তে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যান (সংবাদটি আপনাকে এজন্যেই দিলাম যে,) আমি সত্যিই আপনার একজন শুভাকাংখী। এটাই হলো আল্লাহর মদদ। বান্দার জন্যে তার সাহায্য সময়মতাে ঠিকই এসে উপস্থিত হয়ে যায়। বান্দা যদি সব ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করে, সবর করে তাহলে তার জন্যে আল্লাহর সাহায্য অবধারিত। যে যেমন ষড়যন্ত্রই করুক না কেন আল্লাহ তায়ালা তার নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করবেনই তাতে শত্রুসেনার দল, ষড়যন্ত্রকারীরা বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতাে ক্ষমতাশালী হােক না কেন। এদিকে ফেরাউন, তার সভাসদ, প্রশাসন, কর্মচারী ও ছােটখাটো নেতারা পর্যন্ত বুঝে ফেললাে যে, এই হত্যাকান্ড মূসা(আ.)-এর কাজ, শুধু তা-ই নয়, তারা আরাে বুঝতে পারলাে যে, এই ঘটনা তাে বিদ্রোহের পূর্বাভাস। যদি তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, যদি ঘটনার হােতাদের এক্ষণই দমন না করা হয়, তাহলে বড় ধরনের কোনাে বিদ্রোহের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তারা এটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বিবেচনা করলো, এটাকে ফেরাউন তার স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে হুমকি মনে করলাে, এ কারণে তারা বিষয়টি নিয়ে জরুরী মিটিংয়ে মিলিত হয়েছে। তারা যদি এটাকে সাধারণ হত্যাকান্ডের মতে বিক্ষিপ্ত কোনাে ঘটনা মনে করতাে তাহলে তারা প্রশাসনিকভাবে এমন জরুরী মিটিং ডাকতাে না। ফেরাউন তার লােকজন নিয়ে মিটিং করে আর আল্লাহ তায়ালা কি তার প্রিয় বান্দাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন? কিছুতেই না। প্রশাসনিকভাবে ফেরাউনের গৃহিত সিদ্ধান্ত বানচাল করে দেয়ার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্য থেকেই একজন লােককে বাছাই করে নিলেন। সে গিয়ে ফেরাউনের বাহিনী পৌছানাের আগেই মূসা(আ.)-কে সবকিছু জানিয়ে দিলাে। এই হলেন সেই ব্যক্তি যার কথা সূরা মােমেনের ২৮ নং আয়াতে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘ফেরাউনের দলেরই একজন ঈমানদার ব্যক্তি… যে তার ঈমান গ্রহণের কথা গােপন করে রেখেছিলাে। অতপর সে ভীত ও আতংকিত অবস্থায় শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাে…'(আয়াত ২১) আয়াতে মূসা(আ.)-এর মিশর থেকে বের হওয়ার যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে মানুষ হিসেবে কোনাে ঘটনা থেকে প্রভাবিত হওয়ার মানবীয় চরিত্র, ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকানাে, তাড়াহুড়া করা এবং সম্ভাব্য দুর্ঘটনার কারণে শংকিত হওয়ার মানবীয় প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সাথে সাথে বিপদে আপদে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দিকে ঝুকে পড়া, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, তার আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং সবকিছুই আল্লাহ তায়ালা দেখছেন- এটা মনে করে তার কাছেই বিপদ থেকে মুক্তি দানের জন্যে দোয়া করার মতাে ঈমানী বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলনও আমরা তার মাঝে স্পষ্ট দেখতে পাই। একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে, কোনাে রকম সহায় সম্বল ছাড়া সৈরাচারী শাসকের দেয়া হুলিয়া মাথায় নিয়ে সম্পূর্ণ আল্লাহর সাহায্যের ওপর নির্ভর করে তিনি শহর ছেড়ে মাদইয়ানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। যখন সে (মিশর ছেড়ে) মাদইয়ান অভিমুখে যাত্রা করলাে…'(আয়াত ২২) মূসা(আ.) এগিয়ে চলছেন মাদইয়ান অভিমুখে। সংগী সাথীহীন একাকী মরুভূমীর পথ ধরে তিনি চলছেন। ফেরাউনী ষড়যন্ত্রের স্বীকার মূসা(আ.) ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় মিশর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। অচেনা অজানা পথ, কোনাে পথ প্রদর্শক নেই। কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই, দুনিয়াবী কোনাে সহায় নেই, সম্বল নেই। একমাত্র আল্লাহর রহমতের ছায়ায়, তাকে সহায় করে, তার ওপরই ভরসা করে তিনি এগিয়ে চলছেন একমাত্র আল্লাহর দিকেই তিনি চেয়ে আছেন যে, তিনিই তাকে হেফাযত করবেন, পথ দেখাবেন।
*মাদইয়ান এসে আশ্রয় পেলেন মূসা(আ.) : ‘যখন সে মাদইয়ান অডিমুখে… তখন সে বললাে, আশাকরি আমার মালিক আমাকে শীগ্রই সঠিক পথ দেখাবেন।'(আয়াত ২৩) এখানে আমরা মূসা(আ.)-এর মাঝে দৃঢ়চেতা, অনড় অবিচল এক প্রত্যয়ী চরিত্র খুঁজে পাই। ফেরাউনের জাতি, তার আর্মি-পুলিশ, রাজ কর্মচারীরা ওঁৎ পেতে আছে তাকে শায়েস্তা করার জন্যে। ব্যক্তিগত শত্রুতা, বিদ্বেষ সব ভুলে মূসাকে দমন করার ব্যাপারে আপ জাতা সবাই একযােগে মাঠে নেমেছে। কারণ শৈশব থেকে মূসা(আ.)-এর অনেক ব্যাপারেই তাদের আপত্তি ছিলাে। তবে উপযুক্ত সুযােগ না পাওয়ায় তারা কিছু করতে পারেনি। আজ তারা সূবর্ণ সুযােগ হাতে পেয়েছে, তারা এতােদিনের শােধ আদায়ের সুযােগ পেয়েছে। অপরাধী ও হত্যাকারী হিসেবে তার কাছ থেকে প্রতিশােধ নেয়ার এই সুযােগে তাদের মনের সকল ক্ষোভ আজ মেটাতে চায়। কিন্তু সারা পৃথিবীর ষড়যন্ত্রকারীরা একত্রিত হয়ে ষড়যন্ত্র পাকালেই বা কি হবে। তার ওপর তাে রয়েছে আল্লাহর কুদরতী হাত। আর এই কুদরতী হাত কিছুতেই তাকে শত্রুদের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত নয়। এই কুদরতী হাত তাকে সকল যড়যন্ত্র, সকল অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে নিরাপদে মাদইয়ান উপকুলে এনে হাজির করে। ‘অবশেষে যখন সে মাদইয়ান (উপকুলে) একটি পানির কুপের কাছে পৌছলাে তখন সেখানে সে অনেক মানুষ দেখতে পেলাে, যারা তাদের পশুদের পানি পান করাচ্ছে… তাদের অদূরে সে দু’জন রমণীকে দেখতে পেলাে… সে তাদের পশুদের পানি পান করিয়ে দিলাে হে আমার মালিক! যে নেয়ামত…'(আয়াত ২৩-২৪) এক সুদীর্ঘ সফর শেষে মূসা(আ.) মাদইয়ান এসে পৌছেছেন। তিনি এখন ক্লান্ত শ্রান্ত, তার একটু বিশ্রাম প্রয়ােজন, একটু আরামের দরকার। কিন্তু তিনি এখানে এসে এমন এক অনাকাংখিত দৃশ্য দেখলেন, যা দেখে কোনাে ডদ্র সভ্য বিবেকবান মানুষ চুপ থাকতে পারে না। বিশেষ করে লােকটি যদি হন মূসা(আ.)-এর মতাে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, আল্লাহর নবী- তাহলে সেই দৃশ্য দেখে তিনি কিভাবে চুপ করে থাকবেন। তিনি দেখলেন রাখালেরা তাদের পশুদের পানি পান করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের ভীড়ে কারণে পশুদের পানি পান করতে না পেরে দু’জন রমনী অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে, অথচ সেদিকে তাদের কোনাে ভ্রুক্ষেপই নেই। ভদ্র, সভ্য, শালীন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ হলে তাে উচিৎ ছিলাে প্রথমে নারীদেরকে তাদের কাজ সেরে চলে যাওয়ার সুযােগ দেয়া। কিন্তু সুবিধাবাদী চিন্তাধারা থাকলে মানুষের মধ্য থেকে এরকমই মনুষ্যত্ববােধ এমনিতেই নিঃশেষ হয়ে যায় । দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে মূসা(আ.) চাচ্ছিলেন গাছের ছায়ায় একটু বিশ্রাম নিতে। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে তিনি বরদাশত করতে পারলেন না। এই ধরনের অসভ্য, অমানবিক দৃশ্য তার জাগ্রত বিবেক কিছুতেই মেনে নিলাে না। ‘তিনি এগিয়ে গিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?’ অর্থাৎ, তােমরা তােমাদের পশুদেরকে পানি পান না করিয়ে দাড়িয়ে আছো কেন? ‘তারা বললাে, যতােক্ষণ এই রাখালরা এদের পশুদের সরিয়ে না নেবে, ততােক্ষণ আমরা আমাদের পশুদের পানি পান করাতে পারবাে না, আমাদের পিতা তাে বৃদ্ধ মানুষ, তাই (তিনি আসতে পারেন না বলে) আমরাই এসেছি।’ এখন মূসা(আ.) ঘটনার আসল রহস্য বুঝতে পারলেন, তিনি বুঝতে পারলেন শালীনতা, লজ্জাশীলতা ও রমণীসুলভ দুর্বলতাই এদের দূরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ। তাদের আসতে হয়েছে এ কারণেই যে, তাদের বাবা খুবই বৃদ্ধ মানুষ, যার পক্ষে রাখাল বা সবল পুরুষদের মতাে খাটাখাটনি করা সম্ভব নয়। তাই মূসা (আ.) এগিয়ে এলেন, মানবিকতা ও সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে দৃশ্যটি যেমন হওয়া উচিৎ ছিলাে, তিনি দৃশ্যটিকে সেই রূপে রূপান্তরিত করতে এগিয়ে এলেন। মূসা(আ.)-এর অবস্থাটা একটু চিন্তা করে দেখুন। এই এলাকায় তিনি সম্পূর্ণ নতুন, পরিচিতজন বলতে এখানে তার কেউই নেই, সুবিধা অসুবিধায় একটু সাহায্য সহযােগিতা করার মতােও তার কোনাে বন্ধু নেই, কোনাে ধরনের সফর সামগ্রী ছাড়া সম্পূর্ণ পায়ে হেটে তিনি এসেছেন, শত্রুরা তাকে পেছন থেকে ধাওয়া করছিলাে, এমনকি তাকে তারা ধরতে পারলে হত্যা করে ফেলতাে… এতাে কঠিন পরিস্থিতি, প্রতিকুল অবস্থাও তাকে তার মানবতাবােধ ও দায়িত্ববােধ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি নারীত্বের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তিনি এগিয়ে গিয়ে তাদের পশুদের পানি পান করিয়ে দিলেন। ঘটনাটি মূসা(আ.)-এর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি সত্ত্বেও তার অভিব্যক্তিতে, তার চলনে বলনে, আচার আচরণে এমন এক ধারালাে ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিলাে যে, তিনি যখন ভীড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন, তখন তাকে বাধা দেয়া মতাে, তার সামনে দাড়ানাের মতাে দুঃসাহস কারাে হয়নি। শারিরীক, চারিত্রিক এবং আত্মিক শক্তির সমন্বয়ে এমন এক অভিব্যক্তি তার মাঝে ফুটে উঠেছে যে, রাখালরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাে। তবে শারীরিক দিকটির চেয়ে চারিত্রিক ও আত্মিক পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে অর্জিত আধ্যাত্মিক বা রূহানী শক্তির দিকটিই এখানে প্রধান, কারণ মানুষ এটিকেই বেশী ভয় পায়, এতেই বেশী প্রভাবিত হয়, এই ধরনের ব্যক্তিত্বকেই বেশী সমীহ করে। তারপর সরে গিয়ে একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলো। এতে বােঝা যায় তখন গ্রীষ্মকাল ছিলো। কিন্তু প্রচন্ড রােদ, মরুভূমি অঞ্চলের বালুকাময় পথে এতাে দীর্ঘ সফরেও যে মূসা(আ.) এতােটুকু ক্লান্ত হননি- এটা তার পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু চরিত্রও তুলে ধরে। তিনি গাছের ছায়ায় বসে দোয়া করলেন, ‘হে আমার মালিক, (মানুষের কল্যাণকামি চরিত্ররূপী) যে নেয়ামত তুমি আমাকে দিয়েছে, আমি নিজেই এখন সেই ধরনের কল্যাণ (কামী একজন মানুষ)-এর প্রয়ােজন বােধ করছি।’ গাছের ছায়ায় বসে তিনি আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় চাচ্ছিলেন। এ দোয়া ছিলাে তার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দোয়া, হে আমার মালিক! তুমি তাে দেখছাে আমি মােহাজের অবস্থায় আছি, আমি একা, আমি দুর্বল, আমি তোমার দয়া, রহমত করুনার খুবই মুখাপেক্ষী। মূসা(আ.)-এর দোয়া আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল হয়ে গেলাে। তিনি তাকে একটি আশ্রয়… একটি ঠিকানা দান করলেন, ‘সেই দু’জন রমণীর একজন লজ্জাবনত অবস্থায় তার কাছে এসে বললাে, আপনি যে আমাদের পশুদের পানি পান করিয়ে দিয়েছেন আমার পিতা আপনাকে তার পারিশ্রমিক দিতে ডাকছেন।’ ইয়া আল্লাহ! কী শান তােমার! তুমি তোমার বান্দাকে কতাে মমতাময় রহমতের কোলে লালন করাে। বৃদ্ধার ডাকের মধ্য দিয়ে আরশে আযীমের মালিকের দরবারে দোয়া কবুল হওয়ার বাস্তব প্রমাণ এসে হাযির হলাে। যথেষ্ঠ ইযযত সম্মানের সাথে মূসা(আ.) একটি ঠিকানা পেলেন। শুধু তা-ই নয়, সাথে আরাে পেলেন বিবাহের পয়গাম, যালেমদের হাত থেকে নিষ্কৃতি। কেননা এই অঞ্চল ফেরাউনের সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। যে রমণী তার বাবার প্রস্তাব নিয়ে মূসা(আ.)-এর কাছে এসেছিলেন, এখানে তার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চাল চলনও একটু আলােচনার দাবী রাখে। তিনি তার চাল চলনে, কথাবার্তায় এবং বাবার প্রস্তাব পেশ করার সময় একজন সম্ভ্রান্ত মুসলিম নারীর মতােই যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখেছেন। তার আচরণে ছিলাে রমণী সুলভ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার বহিঃপ্রকাশ। তার মধ্যে কোনাে রকম কপটতা কিংবা অশালীনতার ছোঁয়াও ছিলাে না। যথেষ্ট ভদ্রতার সাথে স্পষ্ট ভাষায় তিনি শুধু তার বাবার দেয়া প্রস্তাবটা মূসা(আ.)-এর কাছে পৌছে দিলেন। প্রয়ােজনে নারী পুরুষের কথা বলার ক্ষেত্রে শরীয়া নির্ধারিত পন্থায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বাক্যে তিনি শুধু তার বাবার প্রস্তাবটুকু পেশ করেই ক্ষান্ত থাকলেন। তার সেই সংক্ষিপ্ত বাক্যটি উপস্থাপন করতে গিয়ে কোরআন বলছে, ‘আমার বাবা আপনাকে ডাকছেন…’ আমরা তার উচ্চারিত সংক্ষিপ্ত কথাগুলাের মধ্যেই লজ্জাশীলতা, বিনয় ও কপটতাই নয় স্পষ্টভাষীতার প্রমাণ পাই। তার কথার মাঝে কোনাে রকম অতিরঞ্জন নেই, অপ্রয়ােজনীয় শব্দ নেই। এটিই একজন শালীন, সভ্য রুচিশীলা ও বুদ্ধিমতি নারীর পরিচয় বহন করে। তার কথায় যেমন অতিরঞ্জন বা অপ্রয়ােজনীয় কথা নেই তেমনি জড়তা বা অস্পষ্টতাও নেই। তিনি সবচেয়ে কম কথা বলে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তার বাবার প্রস্তাব পেশ করেছেন। ঘটনার এই অংশটি কোরআন এখানেই সমাপ্তি করেছে। মূসা(আ.) এই প্রস্তাব পেয়েই বুঝে ফেলেছেন যে, এটা আসমান থেকে তার দোয়া কবুলের বাস্তব প্রমাণ। এরপর কোরআন আমাদেরকে নিয়ে যায় মূসা(আ.) ও সেই রমণীর বৃদ্ধ বাবার কথপােকথনের দৃশ্যে, তবে এখানে সেই বৃদ্ধার নাম উল্লেখ করা হয়নি। ‘মূসা যখন তার কাছে এলাে ও তাকে সমস্ত ঘটনা জানালাে, তখন বৃদ্ধ তাকে বললাে, তােমার ভয় নেই, তুমি অত্যাচারী জাতির কবল থেকে মুক্তি পেয়েছো।’ কারাে কারাে মতে, তিনি ছিলেন সুপরিচিত নবী হযরত শােয়াইবের ভ্রাতুস্পুত্র ইয়াছরুন। [ ইতিপূর্বে এই তাফসীরের এক জায়গায় আমি বলেছি যে, এই ব্যক্তি হযরত শােয়াইব আলাইহিস সালাম আবার অন্যত্র বলেছি যে, তিনি নবী শােয়ায়ব হতে পারেন, কিংবা অন্য কেউও হতে পারেন, কিন্তু এখন আমার মনে হয়, খুব সম্ভব তিনি হযরত শােয়ায়ব নন; বরং মাদইয়ানের অন্য কোনাে প্রধান ব্যক্তি। আমার এ অভিমত পােষণের কারণ এই যে, হযরত শােয়ায়বের জাতি তাে তার চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে গেছে তাকে অস্বীকার করার কারণে। এই ধ্বংসজজ্ঞের পর তার জাতির মধ্য থেকে যারা তার প্রতি ঈমান এনেছিলো ও আযাব থেকে বেঁচে গিয়েছিলো, তারা ছাড়া আর কেউ তার সাথে থাকার কথা নয়। এখন এই প্রবীণ ব্যক্তি যদি নবী শােয়ায়ব হয়ে থাকেন এবং তার জাতির মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে ও আযাব থেকে রেহাই পেয়েছে তাদের মধ্যে বসবাস করেন, তাহলে এই মােমেনদের চরিত্র কখনাে এমন হতে পারে না যে, তাদের নবীর মেয়েদের আগে তারা নিজেদের পশুকে পানি খাওয়াবে। তাছাড়া এই প্রবীণ ব্যক্তি তার জামাতা হযরত মুসাকে কোনাে সদুপদেশ দিয়েছেন বলে কোরআনে উল্লেখ নেই। অথচ তিনি তার কাছে দশ বছর অবস্থান করেছেন। নবী সােয়য়ব হয়ে থাকলে আমরা দীর্ঘ সময়ে তার কাছ থেকে নবীসুলভ অনেক কথাবার্তাই শুনতে পেতাম ] হযরত মূসা(আ.)-এর এ সময় খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়ােজন যেমন ছিলাে, তেমনি নিরাপদ আশ্রয়েরও প্রয়ােজন ছিলাে। তবে দেহের জন্যে খাদ্যের প্রয়ােজন যতােটা ছিলাে, তার মনের জন্যে নিরাপত্তার আশ্বাসের প্রয়ােজন ছিলাে তার চেয়েও অনেক বেশী। এজন্যেই আয়াতে সাক্ষাতের দৃশ্যে শ্রদ্ধাভাজন বৃদ্ধের এই উক্তিটাই সবার আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘তােমার ভয় নেই।’ হযরত মূসা(আ.)-এর বৃত্তান্ত শােনার পর বৃদ্ধ যে মন্তব্য করেছেন, এটা তার প্রথম বাক্য। তিনি সবার আগে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে হযরত মূসাকে সান্তনা দিতে চেয়েছেন। এরপর এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন যে, তুমি অত্যাচারী জাতির কবল থেকে রেহাই পেয়েছো। কেননা মাদইয়ানের ওপর তাদের কোনাে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নেই এবং মাদইয়ানে অবস্থানকারীদের কোনাে ক্ষতি সাধন বা কষ্ট দেয়ার সাধ্য তাদের নেই।
*বিয়ে করলেন হযরত মূসা(আ.) : এরপর আমরা এক সরলমতি ও সদাচারী নারীকণ্ঠ শুনতে পাই ‘সে দুই মহিলার একজন বললাে, হে পিতা, ওকে তুমি মজুর হিসাবে নিয়ােগ করাে। এরূপ বিশ্বাসী ও শক্তিমান ব্যক্তিকে নিয়ােগ করা তােমার জন্যে উত্তম।’ এ মহিলা ও তার বােন অনেক কষ্ট করে মেষ পালন করতাে। এ জন্যে তাদের উভয়কে পুরুষদের ভীড় ঠেলে পুকুরে মেষকে পানি খাওয়াতে যেতে হতাে। যেসব মহিলা পুরুষদের কাজ করে, তাদের এ ধরনের কষ্টকর পরিশ্রম করতেই হয়। সে ও তার বােন এসব কাজের জন্যে খুবই ব্রিতবােধ করতাে এবং পর্দানশীন সতী সাধ্বী নারী হিসেবে গৃহের অভ্যন্তরে অবস্থান করার ব্যবস্থা হােক- এটা মনে প্রাণে কামনা করতাে। যাতে মেষ পালকে পুকুরে পানি খাওয়াতে ও মাঠে ঘাস খাওয়াতে গিয়ে বেগানা পুরুষদের মুখােমুখি হতে না হয়। সতী সাধ্বী, সরলমতি ও পরিচ্ছন্নমনা মহিলারা পুরুষদের ভীড়ের ভেতরে চলাফেলা করায় কখনাে স্বস্তি অনুভব করে না এবং এই চলাফেরার ফলে ঘটিত মর্যাদাহানির জন্যে অস্থিরতা বোধ করে। একদিন মাদইয়ানে এক নবাগত বিতাড়িত প্রবাসী যুবককে দেখা গেলাে। যুবকটি সুঠামদেহী, শক্তিমান ও বিশ্বাসী। সে এতােটা শক্তিমান যে, অন্যান্য রাখালরা তাকে দেখে ভয় পাচ্ছিলাে, তাকে পথ ছেড়ে দিচ্ছিলাে ও তাদের দু’বােনের মেষদের পানি খেতে দিচ্ছিলাে। যুবক বহিরাগত হলেও তাকে বেশ শক্তিশালী দেখাচ্ছিলাে। অথচ বহিরাগত মানুষ শক্তিশালী হলেও দুর্বল ও প্রভাবহীন হয়ে থাকে। মহিলার দৃষ্টিতে সে অত্যন্ত বিশ্বাসী মনে হয়েছিলাে। কারণ সে যখন তার কাছে তার পিতার দাওয়াত পৌছাতে গিয়েছিলাে, তখন তার আনত দৃষ্টি ও সংযত ভাষা সে লক্ষ্য করেছিলাে। তাই সে তার পিতাকে পরামর্শ দিলাে যুবককে বেতনভুক্ত মজুর হিসেবে নিয়ােগ করতে। যাতে তার ও তার বোনের বাইরে গিয়ে পুরুষদের ভীড়ে ঠেলাঠেলি করে অসর্তকজনকভাবে কাজকর্ম করতে না হয়। কেননা যুবকটি কাজকর্মের ক্ষেত্রে যেমন সুস্থ সবল ও সুযােগ্য, পণ্যসামগ্রীর ব্যাপারে তেমনি সৎ ও বিশ্বাসী প্রতীয়মান হয়েছিলাে। কারণ বেগানা মহিলাদের সম্ভ্রমের প্রতি যে ব্যক্তি এতাে শ্রদ্ধাশীল, সে অন্যান্য সামগ্রীর ব্যাপারেও সৎ ও বিশ্বাসী না হয়ে পারে না। পিতাকে এই পরামর্শ দেয়ার সময় এই মহিলা কোনাে রকম দ্বিধা সংকোচও বোধ করেনি, কোনাে খারাপ ধারণা বা কোনো অপবাদের শিকার হবার আশংকাও করেনি। তার মন ছিলাে কলুষমুক্ত এবং অনুভূতি ছিলাে পরিচ্ছন্ন। তাই পিতাকে পরামর্শ দেয়ার সময় তার কোনাে ভয় বা দ্বিধাসংকোচ ছিলাে না, সে কোনাে রকম জড়তা বা ইতস্তত বোধ করেনি। এ প্রসংগে হযরত মূসা(আ.)-এর শক্তির প্রমাণ হিসাবে তফসীরকাররা যেসব বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন তার কোনাে প্রয়ােজন নেই। যেমন কেউ কেউ বলেছেন কয়াটা যে পাথর দিয়ে ঢাকা থাকতাে, তা বিশ চল্লিশ বা আরাে বেশী সংখ্যক লােক মিলিত হয়েও তুলতে পারতাে না। সেই পাথর হযরত মূসা(আ.) একাই তুলে ফেলেছিলেন। আসলে কুয়া মােটেই ঢাকা ছিলাে না, কেবল রাখালরা পশুদেরকে পানি খাওয়াচ্ছিলাে। হযরত মূসা(আ.) তাদের সরিয়ে দিয়ে মহিলাদ্বয়ের পশুদের পানি খাইয়েছিলেন, কিংবা রাখালদের সাথে থেকেই নিজে পানি খাইয়েছিলেন। অনুরূপ হযরত মূসা(আ.)-এর সততার প্রমাণ হিসেবে যেসব বর্ণনা তাফসীরকাররা উদ্ধৃত করেছেন, তাও নিষ্প্রয়ােজন। উদাহরণ স্বরূপ, কেউ কেউ বলেছেন যে, মহিলাটার ওপর হযরত মূসার চোখ পড়ে যায় কিনা, এই আশংকায় তিনি তাকে তার পেছনে পেছনে চলতে ও পথ দেখাতে অনুরােধ করেন। কারাে কারাে মতে, প্রথমে মহিলা হযরত মুসা(আ.)-এর আগে আগে চলতে থাকে, বাতাসের ঝাপটায় মহিলার হয়তাে পায়ের গােছার ওপর থেকে কাপড় সরে যায়। তখন হযরত মূসা তাকে তার পিছু পিছু হাঁটতে বলেন। এ সবই নিস্প্রয়ােজন কৃত্রিমতা এবং আদৌ অস্তিত্ব নেই এমন কাল্পনিক খটকা নিরসনের বৃথা চেষ্টা। হযরত মূসা(আ.) যেমন সংযত দৃষ্টি ও পরিচ্ছন্ন মানসিকতার অধিকারী ছিলেন, মহিলাও ছিলাে তেমনি। এ ধরনের একজন পুরুষ ও মহিলার সাক্ষাতের সময় সততা ও সতীত্ব প্রমাণ করার জন্যে এতাে সব কৃত্রিমতার কোনােই প্রয়ােজন হয় না। সততা ও সতীত্ব কোনাে রকম কৃত্রিমতা ছাড়াই সাধারণ কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে আপনা আপনিই প্রকাশ পায়। বৃদ্ধ তার মেয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। সম্ভবত তিনি টের পেয়েছিলেন যে, তার কথা ও হযরত মুসা(আ.)-এর মনে পারস্পরিক আস্থা এবং পবিত্র ও স্বাভাবিক আকর্ষণের সৃষ্টি হয়েছে, যা একটা পরিবার গড়ার জন্যে উপযুক্ত। কোনাে পুরুষের ভেতরে যখন শক্তি সামর্থ ও সততা এই দুটো গুণেরই সমাবেশ ঘটে, তখন তার প্রতি একজন সতী সাধ্বী ও সচ্চরিত্রা যুবতীর আকৃষ্ট হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক। তাই এই বৃদ্ধ যখন হযরত মূসা(আ.)-এর সাথে তার দুই কন্যার একজনকে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন এবং এর বিনিময়ে তার ওপর তার সে ও তার গৃহপালিত পশুগুলােকে আট বছর যাবত লালন পালনের দায়িত্ব আরােপ করলেন, তখন তিনি আসলে দুটো উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সমন্বয় ঘটালেন। এই সাথে বৃদ্ধ এ কথাও বললেন যে, মূসা ইচ্ছা করলে আরাে দুবছর এ কাজ অব্যাহত রাখতে পারেন, কিন্তু এটা বাধ্যতামূলক নয়। এটা তার ইচ্ছাধীন।
*বিয়ের ব্যাপারে ইসলামী সমাজের দৃষ্টিভংগি : ‘বৃদ্ধ বললাে, আমি তােমার সাথে আমার এই দুই কন্যার একজনকে বিয়ে দিতে চাই।'(আয়াত-২৭) এভাবে সেই প্রবীণ ব্যক্তি তার দুই কন্যার একজনকে হযরত মূসা(আ.)-এর সাথে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কোন কন্যাকে, সেটা অনির্দিষ্ট থাকলেও তিনি সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে, কন্যা নির্দিষ্টই আছে। যুবকের মনের সাথে যে কন্যার মনের মিল ও আস্থা জন্মে গিয়েছিলাে সেই কন্যাই ছিলাে পাত্রী। তিনি নির্দ্ধিধায় ও নিসংকোচেই প্রস্তাবটা দিলেন। কেননা বিয়ের প্রস্তাব দেয়াতে লজ্জা-সংকোচের কিছু নেই। বিয়ে হচ্ছে একটা পরিবার গড়ার ব্যবস্থা । তাতে লজ্জা-শরম, দ্বিধা-সংকোচ, দূর থেকে ইশারা ইংগিত ও কৃত্রিমতার আশ্রয় নেয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই। যে সমাজে এগুলাে পরিলক্ষিত হয় তা সরল স্বাভাবিক রীতিনীতি থেকে বিচ্যুত ও বিকৃত সমাজ। সে সমাজে এমন সব কৃত্রিম, অন্যায় ও অশােভন রীতিপ্রথা মেনে চলা হয়, যা পিতা বা অভিভাবককে উদ্যোগী হয়ে নিজের বােন, মেয়ে বা আত্মীয়ার জন্য নিজের পছন্দসই ধার্মিক চরিত্রবান পাত্রের কাছে প্রস্তাব দিতে দেয় না। শুধু পাত্র, তার অভিভাবক বা প্রতিনিধিকেই প্রস্তাব দিতে হয় এবং পাত্রীর পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়ার কোনাে সুযােগ থাকে না। এহেন বিকৃত সমাজ ব্যবস্থারই কুফল এই যে, কোনাে বিয়ের প্রস্তাব বা উদ্দেশ্য ছাড়াই যুবক যুবতীরা স্বাধীনভাবে একে অপরের সাথে সাক্ষাত করে, কথাবার্তা বলে, মেলামেশা করে এবং পরস্পরের প্রতি ঘনিষ্ঠ হয়। অথচ যে-ই বিয়ের প্রস্তাব আসে বা বিয়ের কথা উল্লেখ করা হয়, অমনি কৃত্রিম লজ্জার ঢল নামে এবং কৃত্রিম বাধা এসে স্বচ্ছতা, সরলতা ও স্পষ্টতার পথ রুদ্ধ করে দেয়। রসূল(স.)-এর আমলে পিতার কন্যাদের পছন্দসই পাত্রদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন। এমনকি মহিলারাও স্বয়ং রাসূল(স.)-এর কাছে বা তাদের আগ্রহী পাত্রের কাছে নিজেদের বিয়ের প্রস্তাব দিতেন। এ কাজটা সম্পন্ন হতাে স্পষ্টবাদিতা ও ভদ্রতার সাথে এবং পরিচ্ছন্ন ও রুচিসম্মতভাবে। এতে কোনাে পক্ষের সম্মানও ক্ষুণ্ন হতাে না। কেউ লজ্জা বােধ করতাে না। হযরত ওমর (রা.) স্বীয় কন্যা হাফসাকে প্রথমে হযরত আবু বকরের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে তিনি নীরবতা অবলম্বন করেন এবং পরে হযরত ওসমানকে প্রস্তাব দিলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে যখন রসূল(স.)-কে ব্যাপারটা জানালেন, তখন তিনি তাকে এই বলে উল্লসিত করলেন যে, হয়তাে আল্লাহ তায়ালা হাফসার ভাগ্যে সে দু’জনের চেয়েও উত্তম মানুষ জোটাবেন। অতপর রসূল(স.) নিজেই হাফসাকে বিয়ে করলেন। অপর এক মহিলা নিজেকে রসূল(স.)-এর কাছে সােপর্দ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তখন সেই মহিলা রসূল(স.)-কে নিজের অভিভাবক নিয়ােগ করলেন এবং তিনি যাকে পছন্দ করেন তার সাথেই তাকে বিয়ে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করলেন। রসূল(স.) তাকে এমন এক ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিলেন যে কোরআনের মাত্র দুটো সূরা শিখেছিলাে। সে এ দুটো সূরা মহিলাকে শেখালাে। এটাই ছিলাে তার বিয়ের দেনমােহর। এহেন সরল, দিল খােলা স্বচ্ছ পরিবেশেই ইসলামী সমাজের যাত্রা শুরু হয় এবং তার পরিবার গঠন ও সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কোনাে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা কৃত্রিমতার স্থান সেখানে ছিলাে না। মাদইয়ানের প্রবীণ ব্যক্তি এভাবেই হযরত মূসা(আ.)-এর সাথে আচরণ করলেন। মূসার নিকট নিজ কন্যাকে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন এই শর্তে যে, তিনি আট বছর তার গৃহভৃত্য হিসেবে কাজ করবেন। তবে তাকে এই প্রতিশ্রুতিও দিলেন যে, তাকে বেশী কঠিন কাজের দায়িত্ব দেবেন না এবং তার কষ্ট বাড়াবেন না। তিনি আশান্বিত ছিলেন যে, তিনি আল্লাহর ইচ্ছায় মূসা (আ.)-এর সাথে ব্যবহারে ও প্রতিশ্রুতি পালনে অত্যন্ত আন্তরিক ও সৎ প্রমাণিত হবেন। নিজের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি চমৎকার বিনয় এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতার পরিচয় দিলেন। তিনি নিজেকে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে গণ্য করেননি এবং নিজের সততা নিয়ে গালভরা বুলি আওড়াননি। তবে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর ভরসা করে আশা প্রকাশ করেন যে, তিনি সৎ প্রমাণিত হবেন। মূসা তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন, সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিয়ের আকদ সম্পাদন করলেন এবং এ ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী মানলেন, ‘মূসা বললাে, ঠিক আছে, এটা আপনার ও আমার মাঝে স্থির থাকলাে। দুই মেয়াদের যেটাই আমি সমাপ্ত করি, আমার ওপর কোনাে বাড়াবাড়ি হবে না। আর আমরা যা বলছি সে সম্পর্কে আল্লাহ সাক্ষী আছেন।’ মনে রাখা দরকার যে, চুক্তি ও চুক্তির শর্তাবলীর ক্ষেত্রে কোনাে অস্পষ্টতা, জড়তা বা লাজলজ্জার অবকাশ নেই। এ জন্যেই হযরত মূসা(আ.) প্রবীণ ব্যক্তির উল্লিখিত শর্তাবলী সাপেক্ষে তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন ও চুক্তি সম্পাদন করলেন। তারপর এর ব্যাখ্যা দেন এভাবে, ‘দুই মেয়াদের যেটাই আমি সমাপ্ত করি, আমার ওপর কোনাে বাড়াবাড়ি হবে না।’ অর্থাৎ আমি আট বছরের মেয়াদ সমাপ্ত করি অথবা দশ বছর পূর্ণ করি, আমার ওপর দায়িত্ব চাপানাের ব্যাপারে কোনাে বাড়াবাড়িও হবে না এবং দশ বছর পূর্ণ করতেও বাধ্য করা হবে না। কেননা আট বছরের চেয়ে বেশী কাজ করা আমার ইচ্ছাধীন। ‘আর আমরা যা-ই বলি, আল্লাহ সে সম্পর্কে সাক্ষী আছেন।’ অর্থাৎ আল্লাহর নামে চুক্তিতে আবদ্ধ দুই পক্ষের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থায় আল্লাহ তায়ালাই চূড়ান্ত কর্তৃত্বশীল ও সাক্ষী। হযরত মূসা(আ.) নিজের স্বভাবসুলভ সরলতা ন্যায়নিষ্ঠা এবং চুক্তিবদ্ধ পক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে এ কথা বলেন। মূলত তার নিয়ত ছিলাে, দুই মেয়াদের মধ্যে যেটা ভালাে সেটা পূর্ণ করবেন। বােখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রসূল(স.) বলেছেন যে, হযরত মূসা(আ.) বৃহত্তর মেয়াদই পূর্ণ করেছিলেন। এভাবে হযরত মূসা(আ.) স্বীয় স্বশুরালয়ে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করলেন। ইতিপূর্বে ফেরাউনের ষড়যন্ত্র থেকেও তিনি রক্ষা পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন, কোন মহৎ উদ্দেশ্য এসবের পেছনে নিহিত ছিলাে। কাহিনীর এই অংশ আমরা এখানেই শেষ করছি। কারণ এর পরবর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে। কোরআন নীরবতা পালন করেছে।
*মূসা(আ.)-এর প্রত্যাবর্তন : এরপর হযরত মুসা(আ.) দশ বছর মেয়াদ পূর্ণ করলেন। এই দশ বছরের কোনাে বিবরণ কোরআনে নেই। এরপর কাহিনীর তৃতীয় পর্ব শুরু হয়। হযরত মূসা(আ.) মেয়াদ পূর্ণ করার পর নিজ পরিবার-পরিজন নিয়ে মাদইয়ান থেকে মিসরে প্রত্যাবর্তন করার জন্যে যাত্রা শুরু করলেন। বিগত দশ বছর ধরে যে পথে তিনি একা একাই চলাফেরা করেছেন, সেই পথে আজ তিনি সপরিবারে রওনা হয়েছেন। তবে এই প্রত্যাবর্তন সফরের পরিবেশ প্রথম সফরের পরিবেশ থেকে ভিন্নতর। ফেরার পথে তিনি এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হলেন, যা কল্পনাও করতে পারেননি। এই ঘটনার ফলস্বরূপ স্বয়ং মহান আল্লাহ তার সাথে কথা বললেন, তাকে সম্বােধন করলেন এবং তাকে সেই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলেন, যার জন্যে তিনি তাকে এতােদিন সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এটা ছিলাে হযরত মূসা(আ.)-কে ফেরাউনের কাছে প্রেরণের ঘটনা। তাকে এই বার্তা সহকারে পাঠানাে হয় যে, সে যেন তার সাথে বনী ইসরাইল গােত্রকে পাঠিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য ছিলাে এই যে, তারা আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক না করে এক আল্লাহর এবাদাতের সুযােগ পাবে, দেশের শাসন ক্ষমতা তাদের হস্তগত হবে। হযরত মূসা(আ.) ফেরাউন, হামান ও তাদের দলবলের শত্রুতে পরিণত হবেন, ও দুশ্চিন্তার কারণ হবেন, শেষ পর্যন্ত তার হাতে তাদের ধ্বংস সংঘটিত হবে। ‘অতঃপর যখন মূসা মেয়াদ পূর্ণ করেন এবং স্বীয় পরিবারসহ যাত্রা করলাে…'(আয়াত-২৯-৩৫)। আলােচ্য পর্বের এই দুটো দৃশ্য পর্যালােচনার আগে আমাদের একটু ভেবে দেখা প্রয়ােজন, এই দশ বছরে আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা(আ.)-এর জন্যে কিভাবে তার দায়িত্ব পালনের পথ সুগম করলেন এবং এই সফরেই বা কিভাবে তার যাত্রা সহজ করলেন। মহান আল্লাহ হযরত মূসা(আ.)-এর শিশুকাল থেকে আলােচ্য ঘটনা পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়কালে তার প্রতিটা পদক্ষেপ স্বহস্তে বিন্যস্ত করেছেন, এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। প্রথমে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করালেন যাতে ফেরাউনের পরিবারই তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। খােদ ফেরাউনের স্ত্রীর মনে তার প্রতি স্নেহ মমতার সৃষ্টি করে দেন যাতে তিনি তারই শত্রুর কোলে লালিত পালিত হন। শহরে এমন সময় তাকে প্রবেশ করান, যখন সবাই অসতর্ক ছিলাে, যাতে তিনি সেই শহরের অধিবাসীদের একজনকে হত্যা করে বসেন। আর তার কাছে ফেরাউন পরিবারের সেই লােকটিকে পাঠান তাকে সতর্ক করা ও শহর থেকে অবিলম্বে বেরিয়ে যাওয়ার উপদেশ দেয়ার জন্যে। তারপর মিসর থেকে মাদইয়ান পর্যন্ত দীর্ঘ মরু পথ ধরে সম্পূর্ণ একাকী ও বিনা সম্বলে যাত্রা করার সময় মূসার সহযাত্রী হন মাদইয়ানে তাকে সেই প্রবীণ ব্যক্তির সাথে মিলিত করেন, যাতে এই দশটা বছর তার কাছে কাটাতে পারেন এবং সর্বশেষে সেখান থেকে মিসরে প্রত্যাবর্তন করান, যাতে এই সুমহান দায়িত্বভার লাভ করেন। মহান আল্লাহর সম্বােধন ও তার পক্ষ থেকে দায়িত্ব লাভের আগে প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ, তদারকী ও অভিজ্ঞতা অর্জনের এ এক সুদীর্ঘ সময়। এ সময়ে তিনি একদিকে যেমন মহান আল্লাহর অলক্ষ্য তদারকী, স্নেহ ভালােবাসা ও পথনির্দেশনার অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, তেমনি চাপা ক্ষোভ ও আবেগের প্রভাবে আত্মসংবরণ করতে না পারা এবং সেজন্যে অনুতাপ, অনুশােচনা ও ক্ষমা প্রার্থনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, অর্জন করেছেন ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় পলায়ন, একাকিত্ব, প্রবাস, ক্ষুধা এবং রাজপ্রাসাদে রাজপুত্রসুলভ জীবন যাপনের পর মাদইয়ানের মেষ রাখালগিরি ও গৃহভৃত্যগিরির অভিজ্ঞতাও। তা ছাড়া এসব বড় বড় অভিজ্ঞতার মাঝখানে বহু ছােটখাট অভিজ্ঞতা, পরস্পর বিরােধী আবেগ, অনুভূতি, মনের আকস্মিক ঝোক ও তাড়না, জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করেন। এ সবই ছিলাে পরিণত বয়সে পৌছার পর আল্লাহ তায়ালা তাকে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেন তার অতিরিক্ত। রেসালাত একটা বিরাট কষ্টকর, বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী দায়িত্ব। যিনি এ দায়িত্ব লাভ করেন তার প্রয়ােজন হয় বিপুল পরিমাণ অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, বাস্তব জীবন যাপননাপযােগী রুচিবােধ এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান বিবেক ও মনের পথ-নির্দেশিকা। বিশেষত হযরত মূসা(আ.)-এর রিসালাত সম্ভবত হযরত মুহাম্মদ(স.)-এর রেসালাতের পর কোনাে মানুষের ওপর অর্জিত সবচেয়ে গুরুতর দায়িত্ব। কেননা সেকালের সমগ্র পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সিংহাসন ও সবচেয়ে স্থিতিশীল সাম্রাজ্য, সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী, বিশ্ববাসীর ওপর জেঁকে বসা সবচেয়ে অহংকারী, সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও সবচেয়ে দোর্দন্ড প্রতাপশালী সম্রাটের কাছে তাকে পাঠানাে হয়েছিলাে। তার আবির্ভাব ঘটেছিলাে চরম লাঞ্ছনাময় ও অবমাননাকর গােলামীর শৃংখলে আবদ্ধ একটা জাতিকে উদ্ধার করার জন্যে। গােলামী মানুষের স্বভাব প্রকৃতি তথা তার জন্মগত সৎ গুণাবলী, উচ্চাকাংখা ও মহত্ত্ব ধ্বংস করে দেয়, নষ্ট করে দেয় অন্যায় এবং পাপাচারের প্রতি তার জন্মগত ঘৃণা ও অরুচিকে। বস্তুত এ ধরনের কোনাে জাতিকে উদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন ও দুরূহ কাজ। যে জাতির কাছে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন, তাদের একটা প্রাচীন আদর্শ ছিলাে, কিন্তু তা থেকে তারা বিচ্যুত ও ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিলাে এবং সেই আদর্শ সম্পর্কে তাদের ধারণা খারাপ হয়ে গিয়েছিলাে। তাই তাদের মন এতােটা সরল, সহজ, নিঙ্কলংক ও সুস্থ ছিলাে না যে, নতুন আদর্শ সহজেই গ্রহণ করে নেবে। আবার তারা তাদের পুরনাে আদর্শেও বহাল ছিলাে না। এ ধরনের লােকদের চিকিৎসা করা খুবই কঠিন। আর চিকিৎসার কাজে যদি কোনাে ব্যর্থতা, বক্রতা ও ভ্রষ্টতা আসে তবে তাতে তা আরাে কঠিন হয়ে পড়ে । প্রকৃতপক্ষে একটা জাতিকে সম্পূর্ণ গােড়া থেকে গড়ে তােলার জন্যেই হযরত মূসাকে পাঠানাে হয়েছিলাে। তার নেতৃত্বে বনী ইসরাঈল সর্বপ্রথম একটা স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়। যার স্বতন্ত্র জীবন পদ্ধতি ছিলাে এবং যা নবীদের দ্বারা শাসিত হতাে। এভাবে কোনাে জাতিকে ভিত্তিমূল থেকে নতুন করে গড়া খুবই কঠিন ও দুরূহ কাজ। সম্ভবত এই দৃষ্টিকোণ থেকেই কোরআন এই কাহিনীটাকে এত গুরুত্ব দিয়েছে। একটা আদর্শের ভিত্তিতে একটা জাতিকে কিভাবে গঠন করতে হয়, এই গঠন করার কাজে কী কী আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সমস্যাবলীর সম্মুখীন হতে হয়, কী কী ধরনের বিচ্যুতি, বাধাবিপত্তি ও অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়, এ কাহিনী তার পরিপূর্ণ নমুনা বহন করে। ওদিকে মাদইয়ানের দশ বছরের অভিজ্ঞতা হযরত মূসাকে তার রাজপ্রাসাদে লালিত জীবন এবং ইসলাম প্রচার ও তার কঠিন দায়িত্ববহ জীবনের পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। প্রাসাদ জীবনের একটা বিশেষ পরিবেশ ও বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। মানুষের মনের ওপর তার একটা বিশেষ প্রভাব ও ছাপ পড়ে- চাই সে যতােই জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞাবান হােক না কেন। পক্ষান্তরে নবী রসূল হিসাবে দায়িত্ব পালনের অর্থই হলাে সর্বশ্রেণীর জনগণের সাথে মেলামেশা করা ও তাদের আচরণ বরদাশত করা। জনগণের মধ্যে হরেক রকমের মানুষ রয়েছে, যথা ধনী-দরিদ্র, ভাগ্যবান-ভাগ্যাহত, পরিচ্ছন্ন-অপরিচ্ছন্ন, ভদ্র-অভদ্র, সৎ-অসৎ, ভালাে-মন্দ, সবল-দুর্বল, ধৈর্যশীল ধৈর্যহারা ইত্যাদি। পানাহারের বেশভূষায় ও চলাফেরায় দরিদ্র লােকদের বিশেষ আদত অভ্যাস ও রীতিপ্রথা থাকে। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাদের বিচার বিবেচনা ও উপলব্ধি, জীবন সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনা করার পদ্ধতি, তাদের কথা বলা ও কাজ করার ধরন। এবং তাদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশের ভংগি- এসবই স্বতন্ত্র। এসব আদত অভ্যাস- রীতিনীতি বিত্তশালী ও প্রাসাদে লালিত লােকদের কাছে খুবই অসহনীয়। দরিদ্র লােকদের এসব চালচলন ও রীতিনীতির সাথে খাপ খাওয়ানাে তাে দূরের কথা, চোখ দিয়ে দেখাও তাদের পক্ষে দুসাধ্য। দরিদ্র লােকদের মন যতই সরল ও সত্যনিষ্ঠ হােক না কেন, সেটা প্রাসাদবাসীর বিবেচনায় আসে না। কেননা দরিদ্রদের বাহ্যিক বেশভূষা ও চালচলনই প্রাসাদবাসীর কাছে গ্রহণযােগ্য হয় না । নবুওত ও রেসালাতের দায়িত্ব পালন করতে অনেক কষ্ট করতে হয় এবং কখনাে অনেক ত্যাগ ও বঞ্চনা স্বীকার করতে হয়। প্রাসাদবাসীরা যতােই তাদের বিলাসিতা ও আরাম আয়েশের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাক না কেন, বাস্তব জীবনে যখন প্রকৃত কষ্ট, শ্রম ও বঞ্চনা সহ্য করার প্রশ্ন আসে, তখন তারা সেটা দীর্ঘ সময় সহ্য করতে পারে না। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মূসা যে মানের জীবন যাপনে অভ্যস্ত, তা থেকে তাকে নীচে নামিয়ে আনতে হবে, তাকে মেষ পালকদের কাতারে শামিল করতে হবে এবং তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে হবে, যাতে সে প্রচন্ড ভয়ভীতি, দুঃখ কষ্ট ও ক্ষুধার যাতনা ভােগ করার পর মেষপালক হয়েও খাদ্য এবং আশ্রয় পাওয়াকে সৌভাগ্য মনে করে। আল্লাহ তায়ালা তার অনুভূতি থেকে রীতিনীতি, চাল-চলন, দারিদ্র ও দারিদ্রক্লিষ্ট লোকদের প্রতি উন্নাসিকতাবােধ, তাদের সরলতা ও কষ্টসহিষ্ণুতার প্রতি বিরক্তিবােধ, তাদের দারিদ্র, মূর্খতা, জরাজীর্ণ দশা, তাদের সমগ্র আচরণ ঐতিহ্য ও রীতিপ্রথার প্রতি আদর্শবােধ দূর করবেন বলে স্থির করলেন। শিশুকালে যেমন তাকে আল্লাহ তায়ালা সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছিলেন, তেমনি পরিণত বয়সে তাকে জীবনের কর্মময় সাগরে নিক্ষেপ করতে ইচ্ছা করলেন, যাতে তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব লাভের আগেই এই দায়িত্ব পালনের প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এভাবে যখন হযরত মূসা স্বীয় প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পালা বিদেশের মাটিতে বসে সমাপ্ত করলেন, তখন মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে আবার ফিরিয়ে আনলেন তার স্বদেশের মাটিতে। যেখানে তাকে কাজ করতে হবে এবং রেসালাতের দায়িত্ব পালন করতে হবে। যে পথ ধরে তিনি ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় পালিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, সেই পথ ধরেই তিনি ফিরে এলেন। একই পথ ধরে এই আশা ও যাওয়ার উদ্দেশ্য কী? এর প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন। এমনকি পথের চড়াই উত্রাই সম্পর্কেও তার অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ লাভ করা প্রয়ােজন ছিলাে। কেননা আল্লাহর নির্দেশে এক সময় তাকে এই পথ ধরেই নিজের জাতিকে নিয়ে যেতে হবে। তাই পথপ্রদর্শকসুলভ গুণাবলী ও অভিজ্ঞতা অর্জন করাও তার জন্যে জরুরী ছিলাে। যাতে অন্য কোনাে পথপ্রদর্শকের ওপর নির্ভর করতে না হয়। কেননা তার জাতি বনী ইসরাঈলের এমন একজন নেতার প্রয়ােজন ছিলাে যিনি ফেরাউনের দাসত্বের কারণে চিন্তাশক্তি ও প্রজ্ঞা হারিয়ে ফেলা জাতিকে ছােট বড় সকল সমস্যার সমাধানে পথ প্রদর্শন করতে পারবেন। এভাবে আমরা বুঝতে পারি, কিভাবে আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসাকে নিজ চোখের সামনে গড়ে তুলেছিলেন এবং কিভাবে তাকে তার দায়িত্ব গ্রহণের যােগ্য বানিয়েছিলেন। তাই আসুন, এবার আমরা দেখি কিভাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার এই দায়িত্ব পালনে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়েছেন। ‘মূসা যখন তার মেয়াদ পূর্ণ করলাে এবং সপরিবারে রওনা করলাে তখন তূরের দিক থেকে আগুন দেখতে পেলে…'(আয়াত-২৯) এখানে লক্ষ্য করেছেন কি, কোন চালিকা শক্তি মূসাকে মেয়াদ শেষে মিসরে ফিরিয়ে আনলাে? অথচ সেখান থেকেই তিনি প্রাণ ভয়ে পালিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একজন মানুষকে হত্যাও করেছিলেন। এ জন্যে তার সেখানে ঝুঁকি রয়েছে এবং ফেরাউন যে তাকে হত্যা করার প্রস্তুতি নিয়ে সদলবলে অপেক্ষমাণ রয়েছে, তা কোন কারণে তিনি ভুলে গেলেন? যিনি এ যাবত তাকে প্রতিটা ধাপ অতিক্রম করে এগিয়ে এনেছেন, একমাত্র সেই মহামহিম আল্লাহ তায়ালাই তাকে ফিরিয়ে এনেছেন। হয়তাে এবার তিনি হযরত মূসাকে পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও জন্মভূমির প্রতি সহজাত আকর্ষণের জন্যেই স্বদেশ ভূমিতে ফিরিয়ে এনেছেন এবং যে ভয়ে তিনি পালিয়েছিলেন, সে ভয়ের কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন, যাতে তিনি নিজের সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন, যার জন্যে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যার জন্যে তাকে প্রথম থেকেই রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে।
*আল্লাহর সাথে কথপােকথন ও মুসার ওহী প্রাপ্তি : যে কারণেই হােক, তিনি সপরিবারে স্বদেশের পথে ফিরে যাচ্ছেন। গভীর রাত, ঘাের অন্ধকার। তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। আর রাতটা যে শীতের রাত, তা আগুনের প্রতি তার আগ্রহ দেখে বুঝা যায়, যাতে ওখান থেকে কিছু আগুন এনে তপ্ত হতে পারেন। এটা হচ্ছে এ পর্বের প্রথম দৃশ্য। দ্বিতীয় দৃশ্যটা হলাে বৃহত্তম অপ্রত্যাশিত ঘটনা, মূসা আগুনের কাছে আসামাত্রই তাকে সম্বােধন করা হলাে, ‘হে মূসা, আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা…'(আয়াত-৩০)। আসলে তিনি যে আগুন দেখেছিলেন, সেটা এই উদ্দেশ্যেই দেখানাে হয়েছিলাে। এটাই সেই আহ্বান যা তূর পর্বতের ডান দিকের উপত্যকার পার্শ্ব থেকে ভেসে এসেছিলাে। পবিত্র স্থানটি এই মুহূর্ত থেকেই পবিত্র ও কল্যাণময়। এরপর সমগ্র বিশ্বজগত মূসার কাছে আগত আহ্বানের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে। বৃক্ষ থেকে সম্ভবত এই স্থানে এটাই ছিলাে একমাত্র বৃক্ষ। ‘হে মূসা, আমিই বিশ্বপ্রভু আল্লাহ তায়ালা।’ সেই নিঝুম উপত্যকায়, নিস্তব্ধ রাতে হযরত মূসা প্রত্যক্ষ সম্বােধন শুনতে পেলেন। তার পার্শ্বে অবস্থিত গােটা প্রকৃতি তা দ্বারা প্রতিধ্বনিত হলাে। গােটা আকাশ ও পৃথিবী মুখরিত হলাে। আমরা জানি না, তিনি কিভাবে, কোন অংগ দিয়ে এবং কোনাে দিক থেকে তা শুনতে পেলেন। তবে এ ধ্বনিতে যে গােটা প্রকৃতির রাজ্য প্রতিধ্বনিত হয়েছিলাে তা জানি। এও জানি যে, তাকে এ আওয়ায শ্রবণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলাে। কেননা তাকে আল্লাহর চোখের সামনেই এমনভাবে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করা হয়েছিলাে যে, তিনি এই মুহূর্তটার জন্যে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলেন। বিশ্বজগতের অভ্যন্তরে এ আওয়ায সংরক্ষিত করা হলাে। মহান আল্লাহর জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় স্থানটি পবিত্র ও কল্যাণময় হয়ে রইলাে। এই জ্যোতি দ্বারা সম্মানিত উপত্যকা চিরদিনের জন্যে বৈশিষ্ট্যময় হয়ে রইলাে। আর হযরত মূসা সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত হলেন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে পরবর্তী যে নির্দেশ দিলেন তা হলাে, ‘তােমার লাঠিটা নিক্ষেপ করাে।’ মূসা আপন প্রভুর এই নির্দেশ মান্য করে লাঠিটা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু কী ঘটলাে? নিক্ষেপ করার পর তা আর তার সেই লাঠি বলে মনে হলাে না, যা তার সাথে দীর্ঘদিন যাবত রয়েছে এবং যাকে তিনি নিশ্চিতভাবেই চিনেন। বরং দেখলেন, তা দ্রুতগামী এক সাপে পরিণত হয়েছে, যা আকারে বড় হওয়া সত্তেও ছােট সাপের মতাে দ্রুত গতিশীল, যখন তাকে সাপের মত ছুটাছুটি করতে দেখলাে, অমনি ছুটে পালালাে এবং পেছনে ফিরেও তাকালাে না। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্যে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। স্বভাবগত আবেগ প্রবণতার কারণে ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি ছুটে পালালেন এবং পেছনে ফিরে তাকালেন না। অর্থাৎ তিনি ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্যে এবং এই বিরাট বিস্ময়ের মর্ম উদ্ধারের জন্যে ওদিকে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেও দেখলেন না। আবেগপ্রবণ লােকদের এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। নাযুক মুহূর্তেই এটা প্রকাশ পেয়ে থাকে। এর পর তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশ শুনলেন, ‘হে মূসা, সামনে এগিয়ে যাও, ভয় পেয়াে না, তুমি নিরাপদ।’ মানুষের মনে ভয় ও নিরাপত্তাবােধ একটার পর একটা পালাক্রমে আসতে থাকে এবং জীবনের প্রত্যেকটা স্তর এই দুটো জিনিস দ্বারা সর্বক্ষণ ঘেরাও হয়ে থাকে। পার্থিব জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বত্র এই পরিস্থিতি বিরাজ করে। মানুষের মনে এরূপ সার্বক্ষণিক উদ্বেগ লেগে থাকুক এটাই মহান স্রষ্টার ইচ্ছা। দুনিয়ার জীবনে এটা তারই নির্ধারিত ভাগ্যলিপি। কেননা বনী ইসরাঈলের সুদীর্ঘ দুর্বিষহ জীবনের অবসান ঘটিয়ে উন্নতি ও সমৃদ্ধির উদ্বোধন ঘটানাের জন্যে ভীতির পর নির্ভীকতা ও নিরাপত্তার আশ্বাস পাওয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছিলাে। এটা ছিলাে মহান স্রষ্টারই কৌশল এবং তাঁরই নির্ধারিত ব্যবস্থা। এজন্যেই বনী ইসরাঈলের এই ত্রাণকর্তা রসূলকে আল্লাহ তায়ালা এই বলে আশ্বস্ত করলেন, এগিয়ে যাও, ভয় পেয়াে না, তুমি নিরাপদ। বস্তুত যে ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ স্বয়ং নিরাপদ বলে পরিগণিত করছেন এবং স্বয়ং যাকে তত্ত্বাবধান করছেন, তার আবার কিসের ভয়? ‘তুমি তােমার জামার ভেতরে হাত ঢুকাও, (দেখবে) সেই হাত সাদা হয়ে বের হবে। অথচ তাতে কোনাে ক্ষতির আশংকা থাকবে না।’ হযরত মূসা আদেশ পালন করলেন। নিজের হাত তার বুকের কাছে পােশাকের ভেতরে ঢুকালেন, তারপর তা বের করলেন। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেলাে আবেগ হতবুদ্ধিকর ঘটনা। হাতটা উজ্জ্বল হয়ে ঝিকমিক করতে লাগলাে। অথচ ইতিপূর্বে তার রং ছিলাে স্বাভাবিক, কিছুটা শ্যামলা ধাচের। আসলে ইংগিত করা হয়েছে যে, হযরত মূসার কাছে এ রকমই উজ্জ্বল সত্য, স্পষ্ট নিদর্শন ও অকাট্য প্রমাণ এসেছে। হযরত মূসা(আ.) নিজের স্বভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। ক্রমাগত অলৌকিক ঘটনাবলী ঘটতে থাকায় যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে, তাতে তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। তাই পুনরায় মহান আল্লাহর স্বীয় স্নেহময় তদারকী দ্বারা তাকে শান্ত করার লক্ষ্যে নির্দেশ দিলেন, তােমার হাতটা তােমার হৃৎপিন্ডের ওপর চেপে ধর, তাহলে তােমার মনের অশান্ত অবস্থা প্রশমিত হবে। ‘তােমার ডানা তােমার ওপর চেপে ধরাে ভীতির কারণে..’ এখানে ডানা দ্বারা হাত বুঝানাে হয়েছে। পাখি যেমন শান্ত হয়ে বসলে ডানা গুটিয়ে নেয়, তেমনি ডানা গুটিয়ে অর্থাৎ বুকের সাথে হাত চেপে ধরে রাখতে বলা হয়েছে। ডানা নাড়াতে থাকার দৃশ্য হৃৎপিন্ডের কম্পন ও অস্থিরতা…। আর ডানা চেপে রাখা শান্ত থাকার সাথে তুলনীয় এই বর্ণনাভংগি দ্বারা এই দৃশ্য ব্যক্ত করা কোরআনের একটা স্বতন্ত্র পদ্ধতি বিশেষ। এবার মূসার যা নির্দেশ পাওয়া দরকার ছিলাে তা পেয়ে গেলেন। যা দেখার দরকার ছিলাে তা দেখে নিলেন। দুটো অলৌকিক নিদর্শন দেখানাে এবং দেখে যে আতংকে ভুগছিলেন তাও প্রশমিত হলাে। এখন তিনি এই ঘটনার আড়ালের রহস্য উপলব্ধি করলেন এবং যে দায়িত্ব পালনের জন্যে তাকে শিশুকাল থেকে তৈরী করা হচ্ছিলাে, সেই দায়িত্ব লাভ করলেন। এ দুটো তােমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ফেরাউন ও তার দলবলের কাছে আগত প্রমাণ। তারা একটা পাপিষ্ঠ জনগােষ্ঠী। এ থেকে বুঝা গেলাে, হযরত মূসা(আ.)-কে অগ্নিকুন্ডের পাশ থেকে আল্লাহ তায়ালা যে কথাবার্তা বলছেন এবং যে দুটো অলৌকিক ঘটনা ঘটলাে, এসব তাকে ফেরাউনের কাছে নবী হিসাবে পাঠানাের প্রতীক ও নিদর্শন। আর মূসা দুগ্ধপােষ্য শিশু থাকাকালে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপের সময় আল্লাহ তায়ালা তার মাকে যে ওয়াদা করেছিলেন, এটা সেই ওয়াদারই বাস্তব রূপ। আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছিলেন, ‘আমি এই শিশুকে তােমার কাছেই ফিরিয়ে আনবে এবং রসূল বানাবাে।’ এটা ছিলাে অকাট্য ওয়াদা এবং বহু বছর কেটে যাওয়ার পর তা এখন বাস্তব রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা তার ওয়াদা কখনাে খেলাপ করেন না। তিনি সবচেয়ে বড় সত্যভাষী। এ সময়ে হযরত মূসা(আ.)-এর মনে পড়ে গেলাে, তিনি ফেরাউনের দলের একজনকে হত্যা করেছেন এবং তারা তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে জানতে পেরে তিনি মিসর থেকে পালিয়েছেন। যেহেতু হযরত মূসা মহান আল্লাহর চোখে চোখেই রয়েছেন, তিনি তাকে সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণ করছেন, তাকে প্রত্যক্ষ কথােপকথন ও অলৌকিক নিদর্শনবলী দ্বারা সম্মানিত করেছেন, তাই তিনি ভাবলেন, তাকে ফেরাউন হত্যা করে ফেললে তাে তার নবী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অবসান ঘটবে। কাজেই প্রচারের কাজে সতর্কতা অবলম্বন করলে ক্ষতি কী? ‘মূসা বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তাদের একজনকে হত্যা করেছি। তাই আমার ভয় হয় যে, তারা আমাকে হত্যা করবে।’ হযরত মূসা(আ.) এ কথা দ্বারা তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইছেন না, বরং সতর্কতা অবলম্বন করতে চাইছেন এবং তিনি নিজের ব্যাপারে যে আশংকা করছিলেন তা ঘটলেও যাতে দাওয়াত ও প্রচারের কাজ বন্ধ না হয়ে অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাইছেন। একনিষ্ঠ দৃঢ় ঈমানের অধিকারী হযরত মূসার এরূপ মনােভাব নিতান্তই স্বাভাবিক, ‘আমার ভাই হারুন আমার চেয়েও ভালােভাবে কথা বলতে পারে, কাজেই তাকে আমার সাথে পাঠাও…'(আয়াত-৩৪) অর্থাৎ হারুন যখন উৎকৃষ্টতর ভাষায় কথা বলতে সক্ষম, তখন দাওয়াতের কাজে তিনি অধিকতর পারঙ্গম। তিনি তার সহযােগী হতে পারেন, অধিকতর শক্তি যােগাতে পারেন এবং মূসা(আ.)-কে হত্যা করা হলে তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন। এ পর্যায়ে মূসা(আ.) মহান আল্লাহর সম্মতি ও আশ্বাস লাভ করেন। ‘তিনি (আল্লাহ তায়ালা) বলেন, আমি তােমার ভাইকে দিয়ে তােমার শক্তি বৃদ্ধি করবাে এবং তােমাদের উভয়কে এতটা ক্ষমতাশালী করবাে যে, তারা তােমাদের দুজনের নাগালই পাবে না । তােমরা উভয়ে এবং তােমাদের অনুসারীরা আমার নিদর্শনাবলীর জোরেই বিজয়ী হবে'(আয়াত ৩৫) হযরত মূসা(আ.)-এর আবেদন তার প্রতিপালক গ্রহণ করলেন, তার ভাইকে সাথে পাঠিয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করলেন, উপরন্তু এই আশ্বাস ও সুসংবাদ দিলেন, তােমাদের এতােটা ক্ষমতাশালী করবাে যে, ওরা তােমাদের নাগালই পাবে না। অর্থাৎ মূসা ও হারুন(আ.)-কে স্বৈরাচারী ফেরাউনের কাছে অসহায় অবস্থায় যেতে হবে না বরঞ্চ এমন দোর্দন্ড শক্তি তাদের সাথে যাবে, যার সামনে পৃথিবীর কোনাে শক্তি টিকতে পারে না এবং যা সাথে থাকলে পৃথিবীর কোনাে স্বৈরাচারী যুলুমবাজ তাদের স্পর্শও করতে পারে না। কেননা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার অজেয় শক্তি তাদের চারপার্শ্বে প্রহরারত এবং তারা উভয়ে আল্লাহর সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রিত। হযরত মূসা ও হারুনকে শুধু এতােটুকুই সুসংবাদ দেয়া হয়নি; বরং তারা বিজয়ী হবেন বলেও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তবে এই বিজয় তাদের দু’জনার নয়; বরং যে সত্যের তারা পতাকাবাহী সেই সত্যের এবং আল্লাহর যে নিদর্শনাবলীর সাহায্যে তারা স্বৈরাচারীদের মােকাবেলা করে চলেছেন সেই নিদর্শনাবলীর বিজয়। কেননা এই নিদর্শনাবলীই একমাত্র অস্ত্র, একমাত্র শক্তি এবং বিজয়ের একমাত্র সাজসরঞ্জাম ও উপায় উপকরণ। ‘আমার নিদর্শনাবলীর জোরেই তােমরা উভয়ে ও তােমাদের অনুসারীরা বিজয়ী হবে।’ এই পর্যায়ে মহান আল্লাহর অজেয় শক্তি ঘটনাবলীর নাট্যমঞ্চে প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে এবং কোনাে রাখঢাক না করে খােলাখুলিভাবেই নিজের ভূমিকা পালন করে, যাতে মানব সমাজ বিজয় অর্জনের যেসব উপায় উপকরণের সাথে পরিচিত, সেগুলাে ছাড়াই বিজয় অর্জিত হয় এবং যাতে জনগণের মনে শক্তি ও মূল্যবােধের নতুন মানদন্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই মানদন্ড হলাে ঈমান ও আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীলতা। এরপর সব কিছু আল্লাহর হাতে সমর্পণ।
*মূসা (আ.)-এর দাওয়াতের প্রতি ফেরাউন ও তার জাতির অস্বীকৃতি : এরপর এই দৃশ্যের যবনিকাপাত ঘটে। স্থান ও কালের আবর্তন উহ্য রাখা হয় এবং মূসা ও হারুন(আ.)-কে মহান আল্লাহর সুষ্ঠু নিদর্শনাবলীর সাহায্যে ফেরাউনের সাথে মােকাবেলারত দেখানাে হয়, হেদায়াত ও গােমরাহীর মাঝে বিতর্ক চলে এবং সংক্ষেপে ও দ্রুতগতিতে দুনিয়ার জীবনে সাগরে ডুবিয়ে মারা ও আখেরাতে অভিশাপের বর্ণনা দেয়া হয়। (আয়াত নং ৩৬ থেকে ৪২ পর্যন্ত দেখুন) ফেরাউনের ধ্বংস হওয়া, যাদুকরদের ঈমান আনয়নের ঘটনা অন্যান্য সূরায় বিস্তারিতভাবে পেশ করা হলেও আলােচ্য আয়াতগুলােতে দ্রুত ও সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করা হয়েছে, যাতে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান থেকে সরাসরি ধ্বংসের আলােচনায় পৌছা যায়। এরপর পার্থিব শাস্তির বর্ণনায় কোনাে বিরতি না দিয়ে আখেরাতের অভিযাত্রা বর্ণনা করা হয়। এই পর্বে দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত বিবরণই কাম্য এবং কাহিনীর উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ। মহান আল্লাহ যে সময়ে সময়ে কোনাে রাখাঢাক না রেখেই সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন, সে কথা বলাই এ কাহিনীর উদ্দেশ্য। এখানে দেখানাে হয়েছে যে, হযরত মূসা যেই ফেরাউনের সাথে মােকাবেলায় লিপ্ত হলেন, অমনি আল্লাহ তায়ালা তাৎক্ষণিকভাবে তাকে শাস্তি দিলেন এবং চূড়ান্ত আঘাত হানলেন। এ ক্ষেত্রে আর কোনাে বিশদ বিবরণ দেয়া হলাে না। ‘অতঃপর যখন মূসা(আ.) আমার সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এলাে, তখন তারা বললাে, এটা তাে অলীক যাদু ছাড়া আর কিছু না। আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে কখনাে এরূপ হয়েছে বলে শুনিনি।'(আয়াত-৩৬) মক্কার মােশরেকরাও হযরত মুহাম্মদ(স.)-কে অবিকল এ রকম কথাই বলতাে। ‘এটা তাে অলীক যাদু ছাড়া আর কিছু নয়…’ এ কথা দ্বারা আসলে সত্যকে প্রতিহত করা যায় না, তা নিয়ে বিতর্ক তােলার অপপ্রয়াস মাত্র। যেখানেই হক বাতিলের মুখােমুখি হয়েছে এবং বাতিল জবাব দিতে অক্ষম হয়েছে, সেখানেই এ ধরনের বিতর্ক তােলার অপপ্রয়াস চলেছে এবং বার বার চলেছে। বাতিলপন্থীরা সত্যকে যাদু বলে দাবী করে, কিন্তু এ দাবীর সপক্ষে কোনাে প্রমাণ দিতে পারে না। তবে এতােটা খোঁড়া যুক্তি এই দিয়ে থাকে যে, এটা তাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। পূর্বপুরুষদের থেকে কখনাে তারা এ কথা শােনেনি। বাতিলপন্থীরা যুক্তি প্রমাণ দিয়ে কথা বলে না। তারা এমন অস্পষ্ট কথা বলে, যা কোনাে সত্য প্রতিষ্ঠিত করে না, বাতিলকে বাতিল প্রমাণ করে না এবং কোনাে দাবী প্রতিহত করে না। পক্ষান্তরে মূসা(আ.) তার ও ফেরাউনের মধ্যকার বিরােধটাকে আল্লাহর হাতে সােপর্দ করেন, কেননা তারা কোনাে যুক্তি দেয়নি যে, তিনি তা খন্ডন করবেন এবং তারা কোনাে প্রমাণ চায়নি যে, তিনি তা তাদের দেবেন। সকল জায়গায় ও সকল স্থানে বাতিলপন্থীরা যেমন ঝগড়া বাধায়, তেমনি তারাও ঝগড়া বাধায় ও বিতর্ক তােলে। তাই তাদের এড়িয়ে চলাই সম্মানজনক, সংক্ষেপে কথা বলাই উত্তম এবং তার ও মােশরেকদের মধ্যকার বিরােধ আল্লাহর হাতে সােপর্দ করাই তিনি শ্রেয় মনে করেছেন, ‘মূসা বললাে, কে হেদায়াতের বাণী নিয়ে এসেছে এবং কে আখেরাতে চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করবে সেটা আমার প্রভুই ভালাে জানেন। নিশ্চয়ই অত্যাচারীরা সাফল্য লাভ করে না'(আয়াত-৩৭) এটা একটা মার্জিত ও সৌজন্যপূর্ণ জবাব। এতে খােলাখুলি কিছু বলা হয়নি। যা বলা হয়েছে আভাস ইংগিতে। তবে কথাটা স্পষ্ট বটে। এ জবাব হক ও বাতিলের মােকাবেলার শেষ পরিণতির কী, সে সম্পর্কে নিশ্চিত আত্মবিশ্বাস ও আত্মতৃপ্তিতে ভারপুর। যে আল্লাহর হাতে তিনি বিরোধের মীমাংসার ভার অর্পন করছেন, সেই আল্লাহ তায়ালাই তার সত্যতা ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে অন্য সবার চেয়ে বেশী জানেন। আখেরাতের সুফল হেদায়াতপ্রাপ্তদের জন্যেই নির্ধারিত। আর অপরাধীরা পরিণামে সফলকাম হয় না। এটাই আল্লাহর অমােঘ ও অলংঘনীয় নীতি, যদিও বাহ্যত কোনাে কোনাে ব্যাপার এর বিপরীত বলে প্রতীয়মান হয়। এই অলংঘনীয় নীতির ভিত্তিতেই হযরত মূসা তার স্বজাতির মােকাবেলা করেন এবং অন্যান্য নবীরাও নিজ নিজ জাতির মােকাবেলা করেন। হযরত মূসা(আ.)-এর এই মার্জিত ও ভদ্রজনােচিত বক্তব্যের জবাবে ফেরাউন যে জবাব দেয় তা ছিলাে একাধারে ধৃষ্টতাপূর্ণ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও বিদ্রূপাত্মক, ‘ফেরাউন বললাে, হে সভাসদবৃন্দ, আমি ছাড়া তােমাদের আর কোনাে মাবুদ আছে বলে তাে আমার জানা নেই'(আয়াত-৩৮) সভাসদদের সম্বােধন করে ফেরাউন যে কথাটা বললাে, তা একটা কাফেরসুলভ ও পাপীসুলভ কথা। অথচ সভাসদরা তা নির্বিবাদে মেনে নেয়। এ কথাটা বলার সময় ফেরাউন নির্ভর করেছে তৎকালে মিসরে প্রচলিত এই কীংবদন্তীর ওপর যে, সম্রাটরা দেবতাদের বংশধর। তাছাড়া সে তার একনায়কসুলভ শক্তি এবং প্রতাপের ওপরও নির্ভর করেছে, যা মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে মানুষ স্বচক্ষে দেখেছে, সম্রাটরা সাধারণ মানুষের মতােই জন্ম গ্রহণ করে ও মৃত্যুবরণ করে। তথাপি তাদের সামনে ফেরাউন নিজেকে দেবতাদের বংশধর বলে দাবী করে, কিন্তু এ দাবী তারা কোনাে প্রতিবাদ ও মন্তব্য ছাড়াই শােনে। ফেরাউন শুধু এই দাবী করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এরপর সে আন্তরিকতা সহকারে সত্য জানা এবং মূসার মাবুদকে অনুসন্ধান করার চেষ্টার ভান করেছে। এই ভানটাও ছিলাে তার বিদ্রুপ ও উপহাসমাত্র। হামানকে সে বলেছে, আমার জন্যে ইট তৈরী করাে, অতপর আমার জন্যে একটা উঁচু প্রাসাদ বানাও, হয়তাে আমি মূসা(আ.)-এর মাবুদকে দেখতে পাবাে। অর্থাৎ তার ধারণা যে, সে আকাশে আল্লাহকে দেখতে পাবে। সত্যবাদিতায় সে সন্দিগ্ধ, তথাপি অনুসন্ধান চালাতে চায়, যাতে প্রকৃত সত্য জানতে পারে। ‘আমি তাকে মিথ্যুক মনে করি।’ এখানে যাদুকরদের সাথে প্রতিযোগিতার ঘটনাটা ঘটে, কিন্তু কাহিনীর শেষ পর্যায়টা দ্রুত এগিয়ে আনার লক্ষ্যে এই ঘটনা উহ্য রাখা হয়। ‘ফেরাউন ও তার দলবল দেশে বিনা অধিকারে অহংকার করেছিলাে এবং ভেবেছিলাে যে, তাদের আমার কাছে আর ফিরে আসতে হবে না'(আয়াত-৩৯) তারা যখন ভাবলাে, আল্লাহর কাছে আর ফিরে যেতে হবে না, তখনই অংহকারে লিপ্ত হলাে। অথচ অহংকারের কোনাে অধিকার তাদের ছিলাে না। অহংকারবশেই তারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও সতর্কবাণীগুলােকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলাে (এ পর্বের শুরুতে সংক্ষেপে ও অন্যান্য সূরায় সবিস্তারে এসব নিদর্শনের বিবরণ এসেছে)। ‘তাই আমি তাকে ও তার দলবলকে পাকড়াও করলাম এবং সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম'(আয়াত-৪০) এভাবে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে পাকড়াও করা ও সমুদ্রে নিক্ষেপের ঘটনা। পাথর ও পাথরের টুকরাে যেভাবে নিক্ষেপ করা হয় ঠিক সেভাবে তাদের নিক্ষেপ করা হয়েছিলাে। যে সমুদ্রে দুধের শিশু মূসা(আ.)-কে নিক্ষেপ করা হলে তা নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হলাে, সেই সমুদ্রেই ফেরাউন ও তার দলবলের কবর রচিত হলাে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শান্তি ও নিরাপত্তা একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য লাভের ওপরই নির্ভরশীল। আর অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা আল্লাহ তায়ালা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই ঘটে থাকে। সুতরাং যালেমদের পরিণতি কেমন হয় দেখে নাও। যে পরিণতি ফেরাউনের হয়েছিলাে তা সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে পরিষ্কার। এতে শিক্ষা গ্রহণকারীদের জন্যে শিক্ষা এবং অস্বীকারকারীদের জন্যে সতর্ক বাণী রয়েছে। মহান আল্লাহর শক্তি কিভাবে স্বৈরাচারীদের এক নিমীষে ধ্বংস করে দিতে পারে, আধা লাইনেরও কম জায়গায় তার বিবরণ দেয়া হয়েছে। এরপর আবার এক মুহূর্তে দুনিয়ার জীবন অতিক্রম করে ফেরাউন ও তার দলবলকে এক অদ্ভুত ভংগিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘আমি তাদের জাহান্নামের দিকে আহবানকারী নেতা বানিয়েছি।’ কী ভয়ংকর নেতৃত্ব ও এবং কী জঘন্য তার আহ্বান! আর কেয়ামতের দিন তাদের কোনাে সাহায্য করা হবে না। অর্থাৎ তাদের পরাজয় দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গায়। এটা তাদের দাম্ভিকতা ও বিদ্রোহের শাস্তি। শুধু পরাজয় নয়; বরং পৃথিবীতে অভিশাপ এবং আখেরাতে লাঞ্ছনাও। ‘তাদের এই পৃথিবীতে অভিশাপ দিয়েছি। আর আখেরাতে তারা লাঞ্ছিত হবে।’ ‘মাকবুহীন’ শব্দটা মূলত অপমান, অবমাননা ও লাঞ্ছনার দৃশ্য চিহ্নিত করে। আর এটা পার্থিব জীবনে তারা যে অহংকার করতাে এবং আল্লাহর বান্দাদের ওপর যে দম্ভ প্রকাশ করতাে, তার উপযুক্ত শাস্তি। পরবর্তী আয়াতগুলােতে মিসর থেকে বনী ইসরাঈলের হিজরত এবং এই হিজরতকালে সংঘটিত ঘটনাবলীর পর্যালােচনা করা হয়েছে, যাতে ফেরাউনের ভয়াবহ পরিণাম দেখানাের পর হযরত মূসা(আ.)-এর সাফল্য দেখানাে হয়। পূর্ববর্তী জাতিগুলােকে ধ্বংস করার পর আমি মূসা(আ.)-কে কিতাব দিয়েছিলাম মানব জাতির জন্যে শিক্ষা, হেদায়াত ও রহমত হিসাবে, যাতে তারা স্মরণ করে।’ এই হলাে হযরত মূসার ভাগ্য। এটা নিসন্দেহে বিরাট সৌভাগ্য। এটা মূসা(আ.)-এর সম্মানজনক পরিণতি। তিনি আল্লাহর কিতাব পেলেন, যা মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। ‘যাতে স্মরণ করে’ অর্থাৎ কিভাবে মহান আল্লাহ স্বৈরাচারী ও দুর্বল মানুষদের মধ্যে মীমাংসার জন্যে হস্তক্ষেপ করেন, স্বৈরাচারীদের ধ্বংস করেন এবং মযলুমদের কল্যাণ ও ক্ষমতা দান করেন, সেটা যাতে তারা স্মরণ করে। এভাবেই এ সূরায় ফেরাউন ও হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনী সমাপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে এই সত্য দীপ্ত হয়ে ফুটে ওঠেছে যে, মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনই নিরাপত্তা লাভের একমাত্র উপায় এবং আল্লাহর কাছ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়াই নিরাপত্তাহীনতার একমাত্র কারণ। এ সত্যটাও জানা গেছে যে, স্বৈরাচারী শক্তিগুলাে যখন এতাে প্রতাপশালী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়ে ওঠে যে, সত্যের পথপ্রদর্শকরা তাদের প্রতিহত করতে অক্ষম হয়ে যায়, তখন মহান আল্লাহ সেখানে হস্তক্ষেপ করেন এবং তাদের পর্যুদস্ত করেন। মক্কার ক্ষুদ্র ও দুর্বল মুসলিম দলটির জন্যে এই আশ্বাসবাণীর প্রয়ােজন ছিলাে। আর স্পর্ধিত মােশরেক শক্তিরও এ সত্যটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার প্রয়ােজন ছিলাে। ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলন যেখানেই চালু হবে এবং যেখানেই স্বৈরাচারী খোদা দ্রোহী শক্তি সেই দাওয়াতের গতিরোধ করে দাঁড়াবে, সেখানেই এ সত্যটা বাস্তব হয়ে দেখা দেবে। সত্যের বিরুদ্ধে বাতিল শক্তির আগ্রাসন ও অবরােধ যতােদিন চলতে থাকবে, মহান আল্লাহর অজেয় শক্তির হস্তক্ষেপ ততােদিনই চলতে থাকবে। এভাবে কোরআনের কিসসা কাহিনীগুলাে মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়, বিশ্ব প্রকৃতিতে বিরাজিত শাশ্বত সত্য ও নীতিমালা মানুষের মনমগযে বদ্ধমূল করে। ‘আশা করা যায়, তারা স্মরণ করবে’ কথাটার মর্মার্থ এটাই।