أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১৬)
[ *সমাজের ভয়ে হেদায়াতের পথ পরিত্যাগ করা !? :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৮:ক্বাসাস
পারা:২০
৫৬-৬১ নং আয়াত:-
২৮:৫৬
اِنَّکَ لَا تَہۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَہۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ ہُوَ اَعۡلَمُ بِالۡمُہۡتَدِیۡنَ ﴿۵۶﴾
আপনি যাকে ভালবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না। বরং আল্লাহ্ই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভাল জানেন।
২৮:৫৭
وَ قَالُوۡۤا اِنۡ نَّتَّبِعِ الۡہُدٰی مَعَکَ نُتَخَطَّفۡ مِنۡ اَرۡضِنَا ؕ اَوَ لَمۡ نُمَکِّنۡ لَّہُمۡ حَرَمًا اٰمِنًا یُّجۡبٰۤی اِلَیۡہِ ثَمَرٰتُ کُلِّ شَیۡءٍ رِّزۡقًا مِّنۡ لَّدُنَّا وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۵۷﴾
তারা বলে, “যদি আমরা তোমার সাথে এ হেদায়াতের অনুসরণ করি তাহলে নিজেদের দেশ থেকে আমাদেরকে উৎখাত করে দেয়া হবে।” এটা কি সত্য নয়, একটি নিরাপদ হারমকে আমি তাদের জন্য অবস্থানস্থলে পরিণত করেছি, যেদিকে সব ধরনের ফলমূল চলে আসে আমার পক্ষ থেকে রিযিক হিসেবে? কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।
২৮:৫৮
وَ کَمۡ اَہۡلَکۡنَا مِنۡ قَرۡیَۃٍۭ بَطِرَتۡ مَعِیۡشَتَہَا ۚ فَتِلۡکَ مَسٰکِنُہُمۡ لَمۡ تُسۡکَنۡ مِّنۡۢ بَعۡدِہِمۡ اِلَّا قَلِیۡلًا ؕ وَ کُنَّا نَحۡنُ الۡوٰرِثِیۡنَ ﴿۵۸﴾
কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি যার অধিবাসীরা নিজেদের ভোগ-সম্পদের জন্য গর্বিত ছিল। এগুলিই তো ওদের ঘরবাড়ী; ওদের পর এগুলিতে লোকজন সামান্যই বসবাস করেছে। আর আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী!
২৮:৫৯
وَ مَا کَانَ رَبُّکَ مُہۡلِکَ الۡقُرٰی حَتّٰی یَبۡعَثَ فِیۡۤ اُمِّہَا رَسُوۡلًا یَّتۡلُوۡا عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِنَا ۚ وَ مَا کُنَّا مُہۡلِکِی الۡقُرٰۤی اِلَّا وَ اَہۡلُہَا ظٰلِمُوۡنَ ﴿۵۹﴾
তোমার প্রতিপালক তাঁর বাক্য আবৃত্তি করার জন্য প্রধান জনপদে রসূল প্রেরণ না করে জনপদসমূহকে ধ্বংস করেন না এবং তিনি জনপদসমূহকে তখনই ধ্বংস করেন যখন এর অধিবাসীরা সীমালংঘন করে।
২৮:৬০
وَ مَاۤ اُوۡتِیۡتُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ فَمَتَاعُ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ زِیۡنَتُہَا ۚ وَ مَا عِنۡدَ اللّٰہِ خَیۡرٌ وَّ اَبۡقٰی ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ ﴿٪۶۰﴾
তোমাদের যা কিছুই দেয়া হয়েছে তা নিছক দুনিয়ার জীবনের সাজ-সরঞ্জাম এবং তার সৌন্দর্য-শোভা আর যা কিছু আল্লাহর কাছে আছে তা হচ্ছে তার চেয়ে ভালো এবং অধিকতর স্থায়ী। তোমার কি বিবেচনা করবে না?
২৮:৬১
اَفَمَنۡ وَّعَدۡنٰہُ وَعۡدًا حَسَنًا فَہُوَ لَاقِیۡہِ کَمَنۡ مَّتَّعۡنٰہُ مَتَاعَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ثُمَّ ہُوَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ مِنَ الۡمُحۡضَرِیۡنَ ﴿۶۱﴾
আচ্ছা, যাকে আমি উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং সে তা পেতে যাচ্ছে, সে ব্যক্তি কি কখনো এমন ব্যক্তির মতো হতে পারে, যাকে আমি কেবলমাত্র দুনিয়ার জীবনের সাজ-সরঞ্জাম দিয়েছি এবং তারপর কিয়ামতের দিনের শাস্তির জন্য তাকে হাজির করা হবে?
৫৬-৬১ নং আয়াতের তাফসীর:
(إِنَّكَ لَا تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ…..) শানে নুযূল:
সাঈদ বিন মুসাইয়্যাব তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর চাচা আবূ তালেবের মুমূর্ষু অবস্থায় তার কাছে আগমন করেন। তিনি দেখলেনন আবূ জাহল, আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া পাশে বসা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: হে চাচা! আপনি বলুন:
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ
“আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোন সত্য মা‘বূদ নেই। আমি আপনার জন্য কিয়ামতের দিন এর দ্বারাই সাক্ষ্য দিব। আবূ জাহল, আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া বলল: হে আবূ তালেব! তুমি কি আবদুল মুত্তালিবের ধর্মকে পরিত্যাগ করবে। তারা বার বার এ কথা বলতে লাগল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও বার বার বলতে থাকলেন। পরিশেষে আবূ তালেব বলল: মুত্তালিবের ধর্মের ওপরেই রইলাম। আর সে
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ
বলতে অস্বীকার করল। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: আমাকে নিষেধ না করা পর্যন্তঅবশ্যই আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তখন আল্লাহ তা‘আলা
(مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ….)
এ আয়াতটি নাযিল করেন। আর আবূ তালিবের উদ্দেশ্যে
(إِنَّكَ لَا تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ….)
এ আয়াতটি নাযিল হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৩৮৮৪, সহীহ মুসলিম হা: ২৪)
সূরা ফাতিহাতে উল্লেখ করা হয়েছেন হিদায়াত দু’ প্রকার। একপ্রকার হলন মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়া, অপর প্রকার হলন সঠিক পথে চলার তাওফীক দেয়া। এখানে দ্বিতীয় প্রকার উদ্দেশ্য। সঠিক পথে চলার তাওফীক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা দিতে পারেন, অন্য কেউ পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنْ تَحْرِصْ عَلٰي هُدٰهُمْ فَإِنَّ اللّٰهَ لَا يَهْدِيْ مَنْ يُّضِلُّ وَمَا لَهُمْ مِّنْ نّٰصِرِيْنَ)
“যদি তুমি তাদের পথ প্রদর্শন করতে আগ্রহী হও তবুও আল্লাহ তা‘আলা যাকে বিভ্রান্ত করেছেন, তাকে তিনি সৎ পথে পরিচালিত করবেন না এবং তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই।”(সূরা নাহল ১৬:৩৭) এ সম্পর্কে সূরা নাহলের ৩৭ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
এটা মক্কার কুরাইশদের কথা। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: কুরাইশদের মধ্য থেকে হারেস বিন উসমান নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলল: আপনি যা বলেন তা যে সত্য সেটা আমরা জানি, কিন্তু আপনার প্রতি ঈমান আনতে ও হিদায়াতের অনুসরণ করতে পারছি না, কারণ যদি আমরা আপনার অনুসরণ করি তাহলে ভয় রয়েছে যে, আরবের লোকেরা আমাদেরকে মক্কা থেকে বের করে দিবে। আর তারা সবাই আমাদের বিরুদ্ধে ঐকমত্য হয়ে যাবে, তাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কুরআনে তাদের এ খোঁড়া অজুহাতের তিনটি জবাব দেয়া হয়েছে:
১. (أَوَلَمْ نُمَكِّنْ لَّهُمْ حَرَمًا اٰمِنًا يُّجْبٰٓي إِلَيْهِ ثَمَرٰتُ كُلِّ شَيْءٍ)
‘আমি কি তাদের জন্য এক নিরাপদ হারাম প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানী হয়’ অর্থাৎ তাদের অজুহাত বাতিল। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে মক্কাবাসীর হেফাযতের জন্য একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই করে রেখেছেন। তা এই যে, তিনি মক্কার ভূখণ্ডকে নিরাপদ হারাম করে দিয়েছেন। সমগ্র আরবের গ্রোত্রসমূহ কুফর, শির্ক পারস্পারিক শত্র“তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে একমত ছিল যে, হারামের ভেতরে হত্যা ও যুদ্ধবিগ্রহ ঘোরতর অপরাধ। হারামের ভেতরে পিতার হত্যাকারীকে পেলেও সন্তান চরম প্রতিশোধস্পৃহা থাকা সত্ত্বেও তাকে হত্যা করতে পারবে না। অতএব যে প্রভু নিজ কৃপায় কুফর ও শির্ক সত্ত্বেও তাদেরকে এ ভূখণ্ডে নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছেন, ঈমান কবূল করলে তিনি তাদেরকে ধ্বংস হতে দেবেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এছাড়াও আয়াতে হারামের দুটি গুণ বর্ণিত হয়েছেন ১. এটা শান্তির আবাসস্থল। ২. এখানে বিশ্বের প্রতিটি কোণ থেকে সর্ব প্রকার ফল-মূল আমদানী হয়, যাতে মক্কার বাসিন্দারা তাদের প্রয়োজন সহজে মেটাতে পারে। মক্কায় প্রত্যেক প্রকার ফল-মূল আমদানী হওয়া আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ নিদর্শন। সারাবিশ্বে যখন কোন ফল-মূল থাকেনা তখন মক্কায় ফল-মূল থাকে। যখন যে ফলের মওসুম নয় তখনও মক্কায় সে ফল পাওয়া যায়। সুবহানাল্লাহ!
২. এরপর তাদের অজুহাতের দ্বিতীয় জবাব হলন
(وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَرْيَةٍۭ بَطِرَتْ مَعِيْشَتَهَا)
‘কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি যার বাসিন্দারা নিজেদের ভোগ-সম্পদের অহঙ্কার করত!’ এতে বলা হয়েছে যে, জগতের অন্যান্য কাফির সম্প্রদায়ের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত কর। কুফর ও শির্কের কারণে তারা কিভাবে নিপাত হয়েছে। তাদের বসত-বাড়ি, সুদৃঢ় দুর্গ ও প্রতিরক্ষামূলক সাজ-সরঞ্জামাদি মাটিতে মিশে গেছে। অতএব কুফর শির্ক হচ্ছে প্রকৃত আশঙ্কার বিষয়। দুটিই ধ্বংসের কারণ হয়ে থাকে। তোমরা এমনই বোকা ও নির্বোধ যে, কুফর ও শির্কের কারণে বিপদাশঙ্কা বোধ কর না। ঈমানের কারণে বিপদাশঙ্কা বোধ কর।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন, তিনি কোন জনপদকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত ধ্বংস করেন না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করার জন্য সতর্ককারী প্রেরণ করেন যদি তারা সতর্ক না হয় তখন তাদের ওপর শাস্তি অবতীর্ণ করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِيْنَ حَتّٰي نَبْعَثَ رَسُوْلًا)
“আমি রাসূল না পাঠান পর্যন্ত কাউকেও শাস্তি দেই না।” (সূরা ইসরা ১৭:১৫)
৩. তৃতীয় জবাব হলন
(وَمَآ أُوْتِيْتُمْ مِّنْ شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا)
‘তোমাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তা তো পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা’ এতে বলা হয়েছে; যদি ধরে নেয়া হয় ঈমান আনার ফলে তোমাদের কোন ক্ষতি হয়েই যায় তবে মনে রেখ, তা ক্ষণস্থায়ী।
এ জগতের ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ও ধন-দৌলত যেমন ক্ষণস্থায়ী, কারও কাছে চিরকাল থাকে না তেমনি এখানকার কষ্টও ক্ষণস্থায়ী ও দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই বুদ্ধিমানের উচিত, সেই কষ্ট ও সুখের চিন্তা করা যা চিরস্থায়ী ও অক্ষয়। দুনিয়ার চাকচিক্য, সৌন্দর্য সকল কিছু ক্ষণস্থায়ী। আর আল্লাহ তা‘আলার নিকট যা কিছু আছে তা উত্তম ও চিরস্থায়ী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا عِنْدَ اللّٰهِ خَيْرٌ لِّلْأَبْرَارِ)
“আল্লাহর নিকট যা রয়েছে তা পুণ্যবানদের জন্য বহুগুণে উত্তম।” (সূরা আলি ইমরান ৩:১৯৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْـحَيٰوةَ الدُّنْيَا – وَالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ وَّأَبْقٰي)
“কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক। অথচ আখিরাত (জীবন) উত্তম ও চিরস্থায়ী।” (সূরা আলা ৮৭:১৬-১৭)
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার মূল্য এমন যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রে একটি আঙ্গুল ডুবিয়ে বের করে নিয়ে দেখুক সমুদ্রের তুলনায় তার আঙ্গুলে কতটা পানি লেগেছে। (সহীহ মুসলিম হা: ২৮৫৮)
অতঃপর যারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতিশ্র“তি অনুযায়ী ভাল আমল করে আর যারা আখিরাতকে অস্বীকার করে তাদের মধ্যে তুলনা দিচ্ছেন যে, তারা কখনো সমান হতে পারে না। বরং যারা অস্বীকার করবে তারা অপরাধী হয়ে আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে উপস্থিত হবে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِیْنَ کَالْمُجْرِمِیْنَﭲﺚمَا لَکُمْ کَیْفَ تَحْکُمُوْنَ)
“আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের মত করব? কি হয়েছে তোমাদের? তোমরা কেমন ফয়সালা কর?” (সূরা কালাম ৬৮:৩৫-৩৬)
অতএব যারা আখিরাতে বিশ্বাস রেখে সৎ আমল করে আর যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং তার কোন তোয়াক্কা না করে অসৎ আমল করেই যায় তারা কোন দিক দিয়েই সমান হতে পারে না। যারা সৎ তারা জান্নাতী আর যারা অসৎ তারা জাহান্নামী। সুতরাং আমাদের উচিত সর্বদা সৎ আমল করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২. কাফির-মুশরিকদের জন্য দু‘আ করা কোন মু’মিন ব্যক্তির জন্য বৈধ নয়; সে যতই নিকটাত্মীয় হোক না কেন।
৩. মক্কা নগরী পবিত্র, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ।
৫. ঈমান আনার পিছনে ওযর পেশ করা যাবে না।
৬. গর্ব অহঙ্কার করা যাবে না।
৭. আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতসমূহের শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
৮. দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী।
৯. মু’মিন ও কাফির ব্যক্তি কক্ষনো সমান নয়।
১০. আখিরাতে মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট হাজির করা হবে তা নিশ্চিত।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*হেদায়াত একমাত্র আল্লাহর হাতে : আহলে কিতাব গােষ্ঠীর মধ্য থেকে ঈমান আনয়নকারী এই দলটাকে ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে রসূল(স.) তাদের কোরআন পড়িয়ে শােনানাের চেয়ে বেশী কিছু করেননি। অথচ তার নিজ জাতির অভ্যন্তরে এমন অনেক লােক ছিলাে, যাদের ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করুক- এটা সর্বান্তকরণে কামনা করতেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কারাে কারাে ভাগ্যে ইসলাম রাখেননি। কেন রাখেননি, সেটা তিনিই জানেন। রসূল(স.) যার ইসলাম গ্রহণ পছন্দ করেন তাকে ইসলামে দীক্ষিত করতে পারবেন, এমন নিশ্চয়তা আল্লাহ তায়ালা দেননি; বরং প্রকৃত ব্যাপার এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালা যাকে ইসলাম গ্রহণের যোগ্য মনে করেন এবং ইসলামের জন্যে প্রস্তুত বলে জানেন, তাকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এই কথাটাই বলা হয়েছে ৫৬ নং আয়াতে। ‘তুমি যাকে ভালােবাসাে, তুমি চাইলে তাকে হেদায়াত করতে পারবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন হেদায়াত করেন এবং তিনিই হেদায়াতপ্রাপ্তদের ভাল জানেন। সহীহ বােখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, এ আয়াত রসূল(স.)-এর চাচা আবু তালেব সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। আবু তালেব রসূল(স.)-কে সর্বক্ষণ ঘিরে রাখতেন ও সাহায্য করতেন। তিনি যাতে তার দাওয়াত সবার কাছে পৌছাতে পারেন, সে জন্যে তাকে কোরায়শদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেন এবং এটা করতে গিয়ে তিনি কোরায়শদের পক্ষ থেকে বনু হাশেম গােত্রকে যে বয়কট করা হয়েছিলাে, তাও বরদাশত করেছিলেন, কিন্তু তিনি এসব কিছুই করেছিলেন নিছক আপন ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি স্নেহের বশে এবং গােত্রীয় গর্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। যেদিন তাঁর মৃত্যু আসন্ন হয়ে পড়লাে, রসূল(স.) তাকে ঈমান আনা ও ইসলাম গ্রহণ করার আহ্বান জানালেন, কিন্তু আল্লাহ এটা তার ভাগ্যে লিখেননি এবং এর প্রকৃত কারণ একমাত্র তারই জানা আছে। যুহরী বলেন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়ার স্বীয় পিতা মুসাইয়াব বিন হুযন আল-মাখযুমীর বরাত দিয়ে আমাকে জানিয়েছেন যে, আবু তালেবের যখন মুমূর্ষ অবস্থা, তখন রসূল(স.) তার কাছে এসে আবু জাহল ইবনে হিশাম ও আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া কে দেখতে পেলেন। রসূলুল্লাহ(স.) বললেন, চাচা, আপনি বলুন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, এই একটা কথা বললেই আমি এর ওসিলায় আল্লাহর কাছে আপনার জন্যে সুপারিশ করতে পারবাে। আবু জাহল ও আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া বললাে, হে আবু তালেব, আপনি কি আবদুল মােত্তালেবের ধর্ম ত্যাগ করবেন? রসূল(স.) বার বার তার অনুরােধের পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন, আর ওরা দুজনও বার বার তাদের কথা বলতে লাগলাে। অবশেষে আবু তালেব যে শেষ কথাটা বললেন, তা ছিলাে, আবদুল মােত্তালেবের ধর্মের ওপর।’ তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে অস্বীকৃতি জানালেন। রসূল(স.) বললেন, আল্লাহর কসম, আপনার যে জিনিস আমি ঠেকাতে পারিনি, তার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবাে। এই সময় আল্লাহ তায়ালা নাযিল করলেন, ‘নবী ও মােমেনদের পক্ষে মােশরেকদের জন্যে ক্ষমা চাওয়া শােভনীয় নয়। এমনকি তারা যদি আত্মীয়স্বজনও হয়।’ (সূরা তাওবা) আর আবু তালেব সম্পর্কে নাযিল করলেন, ‘তুমি যাকে ভালােবাসাে তাকেই হেদায়াত করতে পারাে না; বরং আল্লাহই যাকে চান হেদায়াত করেন।'(বােখারী ও মুসলিম) মুসলিম ও তিরমিযী হযরত আবু হুরায়রা(রা.) থেকে আরাে বর্ণনা করেন, আবু তালেবের মৃত্যু নিকটবর্তী হলে তার কাছে এসে রসূল(স.) বললেন, ওহে চাচা, আপনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন। আমি আপনার পক্ষে কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য দেবাে। আবু তালেব বললেন, ‘কোরায়শ যদি এই কথা বলে আমার দুর্নাম না রটাতাে যে, আবু তালেব কেবল মৃত্যুকষ্টের ভয়ে এই কালেমা পড়েছে, তাহলে আমি এই কালেমা পড়ে তােমাকে খুশী করতাম এবং কেবল তােমাকে খুশী করার জন্যেই ওটা পড়তাম। অতপর আল্লাহর এই উক্তিটা নাযিল হলাে, ‘তুমি যাকেই হেদায়াত করতে চাও হযরত ইবনে আব্বাস, ইবনে ওমর, মােজাহেদ, শা’বী এবং কাতাদাহও বলেন, এ আয়াত আবু তালেব সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। তার শেষ কথাটা ছিলাে, আবদুল মােত্তালেবের ধর্মের ওপর।’ এই হাদীসটা পড়ে যে কোন মানুষ বুঝতে পারে আল্লাহর দ্বীন কতাে আপােষহীন এবং কতাে পক্ষপাতহীন। রসূলুল্লাহর এই চাচা, যিনি রসূলের অভিভাবক ও রক্ষক ছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে ঈমান বরাদ্দ করলেন না। অথচ তিনি রসূল(স.)-কে এবং রসূল(স.) তাকে অত্যধিক ভালবাসতেন। কারণ রসূলের প্রতি আবু তালেবের যে স্নেহ মমতা ও ভালােবাসা, তা ছিলাে আত্মীয়তাজনিত ও পিতৃসুলভ। আকীদা ও আদর্শজনিত নয়। আল্লাহ তায়ালা এটা জানতেন। তাই রসূল(স.) যে কারণে তাকে ভালবাসতেন ও যে জিনিস আশা করতেন, সেটা আবু তালেবের ভাগ্যে রাখেননি। এ কারণে হেদায়াতের ব্যাপারটাকে তিনি রাসূল(স.)-এর ক্ষমতার আওতার বাইরে এবং নিজের ইচ্ছাধীন রেখেছেন। নবীর ক্ষমতার আওতায় রেখেছেন শুধু প্রচার ও দাওয়াত। দাওয়াতকারীদের জন্যে তিনি শুধু শুভ কামনা ও হিতােপদেশ বরাদ্দ করেছেন। আর মানুষের হৃদয় রয়েছে দয়াময় আল্লাহর হাতের মুঠোর মধ্যে। বান্দাদের মধ্য থেকে যার ভেতরে হেদায়াতের যােগ্যতা রয়েছে বলে তিনি জানেন তাকে হেদায়াত দান করেন। আর যার ভেতরে গােমরাহীর যােগ্যতা রয়েছে বলে জানেন তাকে গােমরাহীতে লিপ্ত করেন।
*সমাজের ভয়ে হেদায়াতের পথ পরিত্যাগ করা : এবার মােশরেকদের সেই উক্তিটার উল্লেখ করা হচ্ছে, যা দ্বারা তারা রসূল(স.)-এর অনুসরণে তাদের ওযর বা অসুবিধা ব্যাখ্যা করেছিলাে। অসুবিধা হলাে, তারা ভয় পেতাে যে, রসূল(স.)-এর অনুসরণ করলে প্রতিবেশী আরব গােত্রগুলাের ওপর তাদের যে আধিপত্য ও প্রভাব প্রতিপত্তি বর্তমান, তা আর থাকবে না। সে গােত্রগুলাে পবিত্র কাবাকে ভক্তি করে, কা’বার সেবক ও রক্ষকদের তাবেদারী করে এবং কাবায় রক্ষিত মূর্তিগুলােকে সম্মান করে। কোরায়শরা যদি মােহাম্মদ(স.)-এর ওপর ঈমান আনে ও তার অনুসারী হয়ে যায়, তাহলে সে গােত্রগুলাে তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে, অথবা অন্য শত্রুরা তাড়িয়ে দেবে, কিন্তু এই গােত্রগুলাে কোরায়শদের সাহায্য করবে না। এর জবাবে তাদেরকে তাদের অতীত ও বর্তমানের নিরিখে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাদের ভয়ভীতি কোন দিক থেকে আসে আর নিরাপত্তাই বা কোন্ দিক থেকে আসতে পারে। ইতিপূর্বে এ বিষয়টা ফেরাউন ও হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনীতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেই সাথে অতীত জাতিগুলাের ধ্বংস বৃত্তান্তও বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে তাদের ধ্বংসের প্রকৃত কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এই কারণটা হলাে অহংকার, হঠকারিতা, কৃতজ্ঞতার কমতি, রসূলদের অবিশ্বাস এবং আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অবজ্ঞা করা। এরপর আর কিছু আয়াতে মূল্যবােধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কাছে যেসব নেয়ামত রয়েছে, তার তুলনায় দুনিয়ার জীবন ও তার সহায় সম্পদ নিতান্তই মূল্যহীন তুচ্ছ, এ কথাই এ আয়াতগুলােতে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। তারা বলেছে, ‘আমরা যদি তােমাদের সাথে সৎপথের অনুসারী হই, তাহলে আমরা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হবো…'(আয়াত ৫৭-৬১) বস্তুত নিতান্ত স্থুল ভাসাভাসা, সীমিত ও জড়বাদী দৃষ্টিভংগিই কোরায়শদের প্ররােচনা দিতো এবং সকল মানুষকে প্ররােচনা দেয় যে, আল্লাহর নির্দেশিত সততা ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করা তাদের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ) ক্ষতির আশংকাবহ। এটা তাদের শত্রুদের উস্কে দেবে, সকল সাহায্য সহযােগিতা থেকে তাদের বঞ্চিত করবে এবং তাদের দরিদ্র ও সর্বহারা বানিয়ে ছাড়বে। তারা বলেছে, ‘আমরা যদি তােমার সাথে সৎ পথের অনুসারী হই, তাহলে আমরা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হবো…’ এ উক্তি থেকে এটা স্পষ্ট যে, রাসূল(স.)-এর দেখানাে পথই যে সৎপথ, সে কথা তারা অস্বীকার করে না। তবে তারা ভয় পায় যে, তাহলে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। এই ভয় পাওয়ার কারণ, তারা আল্লাহকে ভুলে যায়, তারা এও ভুলে যায় যে, আল্লাহই একমাত্র রক্ষক এবং আল্লাহ তায়ালা যাকে রক্ষা করেন, পৃথিবীর সকল শক্তি একত্রিত হয়েও তাকে বিতাড়িত বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না, আর আল্লাহ তায়ালা যাকে লাঞ্ছিত করেন, পৃথিবীর সকল শক্তি মিলিত হয়েও তাকে সাহায্য করতে পারে না। যেহেতু ঈমান তাদের হৃদয় স্পর্শ করেনি, সেহেতু তারা এরূপ চিন্তা করে। ঈমান যদি তাদের হৃদয় স্পর্শ করতাে, তা হলে পৃথিবীর সকল শক্তি ও ক্ষমতা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যেতাে। পৃথিবীর যাবতীয় ব্যাপারে তাদের মূল্যায়ন ও বিবেচনার ধারা বদলে যেতাে। তারা বিশ্বাস করতাে, শান্তি নিরাপত্তা আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি ছাড়া পাওয়া সব নয় এবং আল্লাহর দেখানাে সততা ও হেদায়াতের পথ থেকে থাকা ছাড়া ভীতি ও আশংকার আর কোনাে কারণ নেই। এই সৎপথ অবলম্বনই প্রকৃত শক্তি ও সম্মান লাভের সুনিশ্চিত পথ পন্থা। এ কথা শুধু কল্পনা নয় এবং মনকে প্রবােধ দেয়ার জন্যেও তা বলা হয়নি; বরং এ হচ্ছে একটা অকাট্য সত্য। কেননা আল্লাহর দেখানাে সৎপথ অনুসরণের অর্থই হলাে মহাবিশ্ব ও তার শক্তিগুলাের নিয়ম কানুনের সাথে একাত্ম হওয়া এবং তার সাহায্য ও আনুগত্য লাভ করা। আল্লাহ এই মহাবিশ্বকে এমন এক নীতিমালার অধীন সৃষ্টি করেছেন এবং পরিচালিত করছেন, যা তিনি স্বেচ্ছায় ও সানন্দে গ্রহণ করেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেখানাে সৎ পথ অনুসরণ করে, সে এই মহাবিশ্বে বিরাজমান সকল অসীম শক্তির সাহায্য লাভ করে, পার্থিব জীবনে এক দুর্জয় শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে। আল্লাহর দেখানো ও শেখানাে সৎপথ বিশুদ্ধ ও নিখুত নিরাপদ পার্থিব জীবন যাপনের একমাত্র পথ ও পদ্ধতি এবং একমাত্র গ্যরান্টি। এই জীবন পদ্ধতি যখন বাস্তবায়িত হয় তখন তা আখেরাতের সাফল্য ও সৌভাগ্যের পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনেও সুখ শান্তি এবং কর্তৃত্বের নিশ্চয়তা দেয়। আল্লাহর শেখানাে এই জীবন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এই যে, এর দৃষ্টিতে দুনিয়া ও আখেরাত পরস্পর থেকে বিছিন্ন নয় এবং আখেরাতের সুখ ও সাফল্য লাভের জন্যে দুনিয়ার জীবন অচল করে দিতে হয় না। বরং দুনিয়া ও আখেরাত উভয়কে সে একই রজ্জু দিয়ে বেঁধে ফেলে। সেই রজ্জু হলাে, পৃথিবীতে মনের বিশুদ্ধতা, সমাজের বিশুদ্ধতা ও জীবনের বিশুদ্ধতা। এভাবে দুনিয়ার জীবন আখেরাতের পথ হিসেবে গণ্য হয়। এ জন্যেই বলা হয়েছে, দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। পৃথিবীকে বেহেশতরূপে গড়ে তােলা ও তার কর্তৃত্ব লাভ করা আসলে আখেরাতের বেহেশত লাভ এবং সেখানে চিরস্থায়ী হওয়ার উপায় ও পন্থা মাত্র। এ জন্যে শর্ত কেবল এই যে, পার্থিব জীবনে আল্লাহর হেদায়াত তথা সৎপথ অনুসরণ করতে হবে এবং সৎ কাজের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে মনােনিবেশ করতে ও তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। মানবেতিহাসে যখনই কোনাে মানবগােষ্ঠী আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানের আলােকে নিজেদের জীবন সঠিকভাবে গড়ে তুলেছে, তখনই চূড়ান্ত পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার ক্ষমতা, ও কর্তৃত্বের চাবিকাঠি তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তবে তার আগে তাদের এই ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের গুরুদায়িত্ব অর্থাৎ পৃথিবীর খেলাফত ও পৃথিবীর সামষ্টিক জীবন পরিচালনার গুরুদায়িত্ব বহনের জন্যে প্রস্তুত করেছেন। আল্লাহর শরীয়ত ও জীবন বিধান অনুসারে চলতে অনেকেই ভয় পায়। আল্লাহর দুশমনদের দুশমনী, ষড়যন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যাবলীর ভারে জর্জরিত হবার আশংকা বােধ করে। অথচ এগুলাে নিছক ভিত্তিহীন কল্পনামাত্র। কোরায়েশরা যখন বলেছিলাে, ‘তােমার সাথে আমরাও যদি আল্লাহর হেদায়াতের অনুসারী হই, তাহলে আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। তখন তারা যেমন কল্পিত শংকায় বিভাের ছিলাে, ঠিক তেমনি। অথচ কোরায়শ ও অন্যান্য আরবরা যখন আল্লাহর বিধান মেনে নিলাে, মাত্র ২৫ বছরে বা তার চেয়েও কম সময়ে তারা পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে নিজেদের কর্তৃত্ব এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলাে। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা তাদের এই কল্পিত শংকা, খোড়া অজুহাত তাৎক্ষণিকভাবে খন্ডনও করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন যে, কে তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছে। কে তাদের জন্যে কা’বা শরীফের ন্যায় নিরাপদ জায়গা তৈরী করে দিয়েছে? কেইবা সারা দুনিয়ার মানুষের মনকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করেছে এবং সারা পৃথিবীর ফল, ফসল ও পণ্য তাদের কাছে পৌছানাের ব্যবস্থা করেছে। পৃথিবীর সকল এলাকা থেকে যাবতীয় ফলফলারি আরবে পৌছে যায়। অথচ এসব ফল-ফলারি উৎপাদনের এলাকা এবং মৌসুমে কত ব্যবধান বিভিন্নতা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি কি তাদের একটা নিরাপদ হারাম শরীফের অধিবাসী বানাইনি, যেখানে আমার পথ থেকে জীবিকা হিসেবে সকল ফলাফল পৌছে যায়?’ তাহলে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করলেই তাদের বিতাড়িত করা হবে, এমন আশংকা তারা কেন বােধ করে? অথচ আল্লাহ তায়ালাই তাে তাদের তাদের পিতা হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর আমল থেকেই সে নিরাপদ হারাম শরীফের অধিবাসী বানিয়েছেন! যে আল্লাহ তায়ালা তাদের তার ঘাের অবাধ্য থাকাকালেও নিরাপত্তা দান করেছেন, সেই আল্লাহ তায়ালা কিনা তাদেরকে তার ফরর্মাবরদার হওয়ার পর স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হতে দেবেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। অর্থাৎ কোথায় ভয় এবং কোথায় নিরাপত্তা, তা মানুষ জানে না। সব কিছুর চুড়ান্ত ক্ষমতা যে আল্লাহর হাতে, তাও জানে না। তারা যদি সত্যিই বিতাড়ন, ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসের কবল থেকে রেহাই পেতে চায়, তাহলে ধ্বংসের কারণগুলাে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেগুলাে থেকে তারা যেন দূরে থাকে। ‘আমি এমন বহু লােকালয়কে ধ্বংস করে দিয়েছি। যার অধিবাসীরা তাদের সম্পদের গর্ব'(আয়াত ৫৮) অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও সম্পদের গর্ব করা এবং তার শােকর না করাই জনপদগুলাের ধ্বংসের কারণ । তাদের যে নিরাপদ হারাম শরীফ দেয়া হয়েছে, সেটাও আল্লাহর অন্যতম নেয়ামত। তাই এই নেয়ামত নিয়েও গর্ব ও না-শােকরী থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত। নচেত যে সমস্ত বিধ্বস্ত জনপদকে তারা চেনে এবং প্রতিনিয়ত দেখে থাকে, সেগুলাের মতােই তাদের ওপরও নেমে আসবে ধ্বংসের করালগ্রাস। ‘সেগুলােতে খুব সামান্যই বসবাস করা হয়েছে।’ অর্থাৎ সেসব বিধ্বস্ত জনপদ ভয়ংকর ও আতংকজনক রূপ নিয়ে কেবল তাদের পূর্ববর্তী অধিবাসীদের ধ্বংসের বৃত্তান্ত এবং তাদের অহংকার ও গর্বের কাহিনী বলার জন্যে কোনােমতে জনশূন্য অবস্থায় টিকে আছে। সেসব জনপদের সকল অধিবাসী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কাউকেই জীবিত রাখা হয়নি। কেউ তাদের উত্তরাধিকারী হয়ে বেঁচে থাকেনি; ‘বরং আমি তাদের পরে তাদের উত্তরাধিকারী হয়েছি।’ তবে আল্লাহ তায়ালা সে সকল দাম্ভিক জনপদবাসীকে ধ্বংস করার আগে তাদের প্রধান শহরে কোনাে না কোনাে রসূল অবশ্যই পাঠাতেন। এটা আল্লাহর নীতি। তাঁর বান্দাদের ওপর দয়া পরবশ হয়ে তিনি নিজের ওপর এই নীতি অপরিহার্য হিসেবে ধার্য করেছেন। ‘তোমার মালিক সেসব জনপদবাসীকে ততােক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংস করেননি, যতােক্ষণ ওই জনপদগুলাের কেন্দ্রস্থলে একজন রসূল না পাঠিয়েছেন…'(আয়াত ৫৯) কেন্দ্রস্থলে, বৃহত্তম জনপদে বা রাজধানীতে রাসূল পাঠানাের যৌক্তিকতা এই যে, এতে ইসলামের দাওয়াত প্রচারের কেন্দ্রস্থল এমন সুবিধাজনক জায়গায় হয়, যেখান থেকে ইসলামের দাওয়াত সকল দিকে ও সকল জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে এ ব্যাপারে কারাে কোনাে ওযর বাহানা করার অবকাশ থাকে না। শেষ নবী মুহাম্মদ(স.) প্রেরিত হয়েছিলেন পবিত্র মক্কা নগরীতে, যা ছিলাে আরব জনপদের কেন্দ্রস্থল । তিনি তাদের পূর্ববর্তী সেসব জনগােষ্ঠীর ভয়াবহ পরিণাম থেকে সতর্ক করেন, যারা তাদের কাছে সতর্ককারী (রসূল) আগমনের পর তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছিলাে। ‘জনপদবাসী অত্যাচারী হলে আমি তাদের ধ্বংস করতাম না’ অর্থাৎ জেনে শুনে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে বিশ্বাস না করলে আমি তাদের ধ্বংস করতাম না। এ প্রসংগে বলা হচ্ছে, ইহকালীন জীবনের সমুদয় ধন সম্পদ, সমুদয় উপায়-উপকরণকে আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত সম্পদের সাথে তুলনা করলে তা একেবারেই তুচ্ছ ও নগণ্য মনে হয়। এ কথাটাই বলা হয়েছে ৬০ নং আয়াতে, ‘তােমাদের যা কিছুই দেয়া হয়েছে তা হলাে ইহকালীন জীবনের সহায় সম্পদ ও সাজ সজ্জা। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তাই উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী। তােমরা কি বুঝবে না?’ পৃথিবীতে মানুষ যে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, সুখ সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ভােগ করে, শুধু সেগুলাে সম্পর্কেই এই চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা হয়নি, মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যে স্বাধীনতা, ক্ষমতা, অধিকার, ফল ও ফসল দান করেছেন, শুধু সে সম্পর্কেও এই মূল্যায়ন করা হয়নি, এমনকি অতীতের জাতিগুলােকে আল্লাহ যে ঈর্ষণীয় সম্পদ দান করেছিলেন এবং যার জন্যে তারা অহংকারে মেতে ওঠায় আল্লাহ তায়ালা তাদের ধ্বংস করেছিলেন, শুধু সে সম্পর্কেও এ মূল্যায়ন নয়। বরঞ্চ পৃথিবীতে মানুষ যা কিছুই অর্জন করে, তা যদি নিরাপদে নির্বিঘ্নে ভােগও করতে পারে, তা যদি পূর্ণাংগও হয়, তা যদি টেকসই এবং স্থিতিশীলও হয়, ধ্বংসশীল না হয়, তবুও সেসব পার্থিব সহায় সম্পদ সম্পর্কেই এটা আল্লাহর চুড়ান্ত মূল্যায়ন। এ সবই নগণ্যতম ইহকালীন জীবনের সহায় সম্পদ ও সাজসজ্জা। পক্ষান্তরে যা কিছু আল্লাহর কাছে রয়েছে সেগুলােই উত্তম ও চিরস্থায়ী। সেগুলাে মানের দিক দিয়েও সর্বোত্তম এবং সময়ের বিচার চিরস্থায়ী। তবুও কি তােমরা বুঝবে না? এ কথাটা বলার উদ্দেশ্য এই যে, পার্থিব সহায় সম্পদ ও আল্লাহর কাছে যে সহায় সম্পদ রয়েছে। এই দুই প্রকারের সম্পদের তুলনা করা ও বাছ-বিচার করার জন্যে সূক্ষ্ম বিবেক এবং বিচার বুদ্ধির প্রয়ােজন, যা উভয়ের কোনটার মান কেমন, তা বুঝতে সাহায্য করে। তাই এই বাছ-বিচারের মাধ্যমে যাতে উত্তম জিনিসটা নির্ধারণ করা যায়, সে জন্যে এখানে বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগাতে তাগিদ দেয়া হয়েছে। অতঃপর এই পর্বের শেষে ভালো ও মন্দের বাছাইয়ের কাজে সহায়তা করার জন্যে আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আচ্ছা, আমি যাকে উত্তম প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এবং সে ওই প্রতিশ্রুত জিনিস পাবেও, সে কি সে ব্যক্তির মতাে, যাকে আমি পার্থিব জীবনের সহায় সম্পদ দিয়েছি অতপর তাকে কেয়ামতের দিন উপস্থিত করা হবে'(আয়াত ৬১) এ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা যার সাথে ভালাে ভালাে পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন এবং যে আখেরাতে সেসব ভালাে পুরস্কার সুনিশ্চিতভাবেই পাবে তার চিত্র। এর পাশাপাশি এখানে সেই ব্যক্তির চিত্রও রয়েছে, যে সীমিত ও নগণ্য পার্থিব জীবনের সম্পদ লাভ করেছে, তারপর তাকে আখেরাতে হিসাবের জন্য উপস্থিত করা হবে। এই উপস্থিত করা হবে’ কথাটা দ্বারা স্পষ্টতই বুঝানাে হয়েছে যে, তাকে উপস্থিত হতে বাধ্য করা হবে এবং সে মনে মনে আক্ষেপ করবে, দুনিয়ার নগণ্য সীমিত সম্পদের হিসাব দেয়ার জন্যে আজ যদি তার উপস্থিত হতে না হতাে, তাহলে কতই না ভালাে হতাে। তারা যে বলতাে, রসূলের আনীত হেদায়াতের অনুসরণ করলে আমাদেরকে আমাদের ঘরবাড়ী থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়ন করা হবে, তার জবাবেরই শেষ পর্যায়ে এ কথাটা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ তারা সেদিন বুঝবে, এমনকি দুনিয়ার জীবনে যদি নিজ ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িতও হতে হতাে, তবুও সেটা ঢের ভালাে হতাে আখেরাতে হাযির হয়ে হিসাব দিতে বাধ্য হওয়ার চেয়ে। আর আল্লাহর হেদায়াতের বাণীর অনুসরণে তাে পৃথিবীতে নিরাপদ ও স্বাধীন জীবন যাপন এবং আখেরাতে মুক্তি সফলতা লাভের নিশ্চয়তা রয়েছেই। এমতাবস্থায় একমাত্র অজ্ঞ ও নির্বোধ লােকেরাই আল্লাহর বিধান মেনে চলে না। তারা মহাবিশ্বে বিরাজমান শক্তিসমূহের প্রকৃত পরিচয় জানে না। তাই কিসে শান্তি এবং কিসে অশান্তি তাও জানে না। একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত লােকেরাই আল্লাহর হেদায়াত গ্রহণ করে না, তারা সঠিক জিনিস বাছাই করতে জানে না এবং সে কারণে ধ্বংস ও বিনাশ থেকে আত্মরক্ষাও করতে পারে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# আলোচনার প্রেক্ষাপট থেকে একথা প্রকাশিত হয় যে, হাব্শার খৃস্টানদের ঈমান ও ইসলামের কথা উল্লেখ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল আসলে মক্কার কাফেরদেরকে লজ্জা দেয়া। বক্তব্য ছিলঃ অভাগার দল! তোমরা নিজেদের কপাল কিভাবে পুড়াচ্ছো তা ভেবে দেখো। অন্যেরা কোথায় কোন্ দূরদেশ থেকে এসে এ নিয়ামতের কল্যাণ লাভে ধন্য হচ্ছে আর তোমরা তোমাদের নিজেদের গৃহ অভ্যন্তরে এই যে কল্যাণের স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে এ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছো। কিন্তু কথাটা এভাবে বলা হয়েছেঃ হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তুমি চাচ্ছো তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা, তোমার ভাই-বন্ধু-বান্ধবরা, তোমার আত্নীয়-স্বজনরা এই আবেহায়াতের সঞ্জীবনী ধারায় লাভবান হোক কিন্তু তুমি চাইলে কি হবে, হিদায়াত তো আল্লাহর হাতে, যেসব লোকের মধ্যে তিনি এ হিদায়াত গ্রহণ করার আগ্রহ দেখতে পান তাদেরকেই এ কল্যাণ ধারায় অবগাহন করান। তোমার আত্নীয় পরিজনদের মধ্যে যদি এই আগ্রহ না দেখা যায় তাহলে এ কল্যাণ তাদের ভাগ্যে কেমন করে জুটতে পারে।
বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে এ আয়াতটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আবু তালেবের প্রসঙ্গে নাযিল হয়। তাঁর শেষ সময় উপস্থিত হলে নবী ﷺ নিজের সামর্থ্য মোতাবেক কালেমা লা-ইলাহা ইল্লালাহু-এর প্রতি তাঁর ঈমান আনবার জন্য চূড়ান্ত চেষ্টা চালান। তিনি চাচ্ছিলেন তাঁর চাচা ঈমানের মধ্য দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন। কিন্তু চাচা তা গ্রহণ না করে আব্দুল মুত্তালিবের অনুসৃত ধর্মের মধ্যে অবস্থান করে জীবন দেয়াকে অগ্রাধিকার দেন। এ ঘটনায় আল্লাহ বলেন إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ “তুমি যাকে ভালবাসো তাকে হিদায়াত করতে পারো না” কিন্তু মুহাদ্দিস ও মুফাসসিরগণের পরিচিত পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, একটি আয়াত নবীর জামানায় যে বিশেষ ঘটনা বা ব্যাপারের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয় তাকে তাঁরা আয়াতটির শানে নুযুল বা নাযিল হওয়ার উপলক্ষ্য ও কার্যকারণ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাই এ হাদীসটি এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত তিরমিযী ও মুসনাদে আহমদ ইত্যাদিতে আবু হুরাইরা (রাঃ) ইবনে আব্বাস (রা.) ইবনে উমর (রা.) প্রমূখ সাহাবীগণ বর্ণিত অন্যান্য হাদীসগুলো থেকে অনিবার্যভাবে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না যে, সূরা আল কাসাসের এ আয়াতটি আবু তালেবের ইন্তেকালের সময় নাযিল হয়েছিল। বরং এ থেকে শুধুমাত্র এতটুকু জানা যায় যে, এ আয়াতের বিষয়বস্তুর সত্যতা ও বাস্তবতা এ ঘটনার সময়ই সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়। যদিও আল্লাহর প্রত্যেকটি বান্দাকে সঠিক পথে নিয়ে আসা ছিল নবী করীমের ﷺ আন্তরিক ইচ্ছা, তথাপি কোন ব্যক্তির কুফরীর ওপর মৃত্যুবরণ করা যদি তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি কষ্টকর হতো এবং ব্যক্তিগত ভালবাসা ও সম্পর্কের ভিত্তিতে যদি কোন ব্যক্তির হিদায়াত লাভ করার তিনি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন তাহলে তিনি ছিলেন আবু তালেব। কিন্তু তাঁকেই হিদায়াত দান করার শক্তি যখন তিনি লাভ করলেন না তখন একথা একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, কাউকে হিদায়াত দান করা বা কাউকে হিদায়াত বঞ্চিত করা নবীর কাজ নয়। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে। আর আল্লাহর কাছ থেকে এ সম্পদটি কোন আত্নীয়তা ও পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নয় বরং মানুষের সত্যানুরাগ, সত্যপ্রীতি ও সত্যাগ্রহী মানসিকতার ভিত্তিতেই দান করা হয়।
# কুরাইশ বংশীয় কাফেররা ইসলাম গ্রহণ না করার অজুহাত হিসাবে একথাটি বলতো। গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে জানা যাবে, এটিই ছিল তাদের কুফরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কারণ। একথাটি যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে আমাদের দেখতে হবে ঐতিহাসিকভাবে সে সময় কুরাইশদের কি মর্যাদা ছিল, যার ওপর আঘাত আসার আশংকা ছিল। শুরুতে আরবে যে জিনিসটির জন্য কুরাইশ গোষ্ঠী গুরুত্ব লাভ করে, সেটি হচ্ছে তাদের হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের বংশধর হওয়ার বিষয়টি আরবীয় বংশধারার দিক দিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত ছিল। এ কারণে তাদের বংশটি ছিল আরবদের দৃষ্টিতে পীরজাদার বংশ। তারপর যখন কুশাই ইবনে কিলাবের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার কারণে তারা কাবা গৃহের মুতাওয়াল্লী ও পরিচালকে পরিণত হলো এবং মক্কায় তাদের আবাস গড়ে উঠলো তখন তাদের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশী বেড়ে গেল। কারণ এখন তারা ছিল আরবের সবচেয়ে বড় তীর্থ স্থানের পরিচালক। আরবের সকল গোত্রের মধ্যে তারা ধর্মীয় পুরোহিতের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর হজ্জের কারণে আরবের এমন কোন গোত্র ছিল না যারা তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতো না। এ কেন্দ্রীয় মর্যাদাকে পুঁজি করে কুরাইশরা ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়িক উন্নতি লাভ করতে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে রোম ও ইরানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তাদেরকে আর্ন্তজাতিক বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দান করে। সে সময় রোম, গ্রীস, মিশর ও সিরিয়ার যত প্রকার বাণিজ্য চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার সাথে চলতো তার সমস্ত পথই ইরান বন্ধ করে দিয়েছিল। লোহিত সাগরের পথটিই ছিল সর্বশেষ পথ। একমাত্র এ পথটিই খোলা ছিল। পরে ইরান যখন ইয়ামেন দখল করে নিল, তখন সে এ পথটিও বন্ধ করে দিল। এখন আরব বণিকরা একদিকে রোম অধিকৃত এলাকার পণ্য সম্ভার আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের বন্দরসমূহে পৌঁছিয়ে দিতে লাগলো এবং অন্যদিকে একই বন্দরসমূহ থেকে পূর্বদেশীয় বাণিজ্যপণ্য নিয়ে রোম সাম্রাজের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছাতে থাকলো। এ ছাড়া এ বাণিজ্যটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হলো। এ সময় কুরাইশরাই বলতে গেলে এ ব্যবসায়ের ইজারাদারী লাভ করে বসেছিল। কিন্তু যেসব উপজাতীয় এলাকার মধ্য দিয়ে এ বাণিয়জ্য পথগুলো গিয়েছিল তাদের সাথে তাদের সাথে আরবদের গভীর বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছাড়া আরবের রাজনৈতিক অরাজকতার পরিবেশে এ ব্যবসায়িক আদান প্রদান সম্ভবপর ছিল না। এ উদ্দেশ্যে কুরাইশ সরদাররা শুধুমাত্র নিজেদের ধর্মীয় প্রভাবের ওপর নির্ভর করতে পারতো না। এ জন্য তারা সকল উপজাতির সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করে রেখেছিল। ব্যবসায়িক মুনাফায়ও তাদেরকে অংশীদার করতো। উপজাতীয় শেখ ও প্রভাবশালী সরদারদেরকে মূল্যবান তোহ্ফা দিয়ে তুষ্ট করতো। এই সঙ্গে পাতা ছিল সূদী ব্যবসায়ের জাল। এতে জড়িয়ে পড়েছিল প্রায় সকল প্রতিবেশী উপজাতীয় ব্যবসায়ী ও সরদারবৃন্দ।
এ অবস্থায় যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাওহীদের দাওয়াত সম্প্রসারিত হতে লাগলো তখন বাপ-দাদার ধর্মের প্রতি অন্ধপ্রীতির চাইতে বড় হয়ে যে জিনিসটি কুরাইশদেরকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠার কারণ হয়ে দেখা দিল সেটি ছিল এই যে, এ দাওয়াতের ফলে তারা নিজেদের স্বার্থহানির আশংকা করছিল। তারা মনে করছিল, যুক্তিপূর্ণ দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে শিরক ও মূর্তিপূজা মিথ্যা এবং তাওহীদ সঠিক প্রমাণিত হয়ে গেলেও তো তাকে পরিত্যাগ করে একে গ্রহণ করে নেয়া আমাদের জন্য ধ্বংসকর হবে। এমনটি করার সাথে সাথেই সমগ্র আরবের অধিবাসীরা আমাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। কাবাগৃহের পরিচালনায় দায়িত্ব থেকে আমাদের সরিয়ে দেবে। সন্ধি চুক্তির ফলে মূর্তিপূজক উপজাতিগুলোর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যার ভিত্তিতে আমাদের বাণিজ্য কাফেলা দিন-রাত আরবের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা সবই ছিন্ন হয়ে যাবে। এভাবে এ দ্বীনটি আমাদের ধর্মীয় প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং এই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও অবসান ঘটাবে। বরং বিচিত্র নয় যে, আরবের সমস্ত উপজতি মিলে আমাদের মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য করবে।
এখানে এসে দুনিয়া পূজারীদের প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির অভাবের এক বিষ্ময়কর চিত্র মানুষের সামনে ফুটে ওঠে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারবার তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দান করেছিলেন যে, তোমাদের সমানে আমি যে কালেমা পেশ করছি তা মেনে নাও, আরব ও আজম তোমাদের পদাবনত হয়ে যাবে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা সা’দ, ভূমিকা : ঐতিহাসিক পটভূমি) কিন্তু তারা এর মধ্যে নিজেদের মৃত্যু দেখছিল। তারা মনে করছিল, আমরা আজ যে সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভ করেছি এও খতম হয়ে যাবে। তারা আশংকা করছিল, এ কালেমা গ্রহণ করার সাথে সাথেই আমরা সরেজমিনে এমনই বন্ধু-বান্ধব ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়বো যে, চিল-কাকেরা আমাদের গায়ের গোশত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। নিজেদের সংকীর্ণ দৃষ্টির কারণে তারা এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিল না যে, মাত্র কয়েক বছর পরেই সমগ্র আরব ভূ-খন্ড মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাভূক্ত হতে যাচ্ছিল। তারপর এ একই প্রজন্মের জীবনকালেই ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিশর সব দেশই এক এক করে এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতাধীন হতে চলছিল। আর এ উক্তির পরে এক শতক অতিক্রান্ত হবার আগেই কুরাইশ বংশীয় খলিফাগণই সিন্ধু থেকে স্পেন এবং কাফ্ফাজ থেকে ইয়ামেনের উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত দুনিয়ার একটি বৃহত্তম অংশের শাসন পরিচালনা করতে যাচ্ছিল।
# এটি হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের আপত্তির প্রথম জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, যে হারমের শান্তি ও নিরাপত্তা এবং কেন্দ্রীয় গুরুত্বের বদৌলতে আজ তোমরা এমন যোগ্যতার অধিকারী হয়েছো, যার ফলে সারা দুনিয়ার বাণিজ্যপণ্যের স্রোত এহেন অনুর্বর ধূলিবিবর্ণ উপত্যকায় চলে আসছে, তার এই নিরাপদ ও কেন্দ্রীয় মর্যাদা কি তোমাদের কোন কৌশল অবলম্বনের ফলে অর্জিত হয়েছে? আড়াই হাজার বছর আগে আল্লাহর এক বান্দা জনশূন্য পাহাড়ের মাঝখানে এ পানি ও বৃক্ষলতাহীন উপত্যকায় তাঁর স্ত্রী ও দুধের বাচ্চাকে নিয়ে এখানে আসেন। তিনি এখানে পাথর ও কাদা দিয়ে একটি কক্ষ নির্মাণ করেন এবং ডাক দিয়ে বলেন, আল্লাহ একে হারমে পরিণত করেছেন, এসো এ ঘরের দিকে এবং একে প্রদক্ষিণ করো। এখন ২৫ শতক বছর থেকে এ জায়গাটি আরবের কেন্দ্র হয়ে রয়েছে, মারাত্মক ধরণের নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশে দেশের এ একটিমাত্র স্থানে নিরাপত্তা লাভ করা যায়, আরবের আবালবৃদ্ধবণিতা একে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে এবং প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ একে প্রদক্ষিণ করার জন্য চলে আসে। এসব আল্লাহ প্রদত্ত বরকত ও সমৃদ্ধি নয়তো আর কি হতে পারে? এ নিয়ামত লাভের ফলেই তো তোমরা আরবের সরদার হয়ে গেছো এবং বিশ্ব বাণিজ্যের একটি বড় অংশ তোমাদের করতলগত হয়েছে। এখন কি তোমরা মনে করো, যে আল্লাহ তোমাদেরকে এ নিয়ামত দান করেছেন তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তোমরা সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠবে আর তাঁর দ্বীনের অনুগত হয়ে চললেই ধ্বংস হয়ে যাবে?
# এটি তাদের আপত্তির দ্বিতীয় জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, যে ধনদৌলত ও সমৃদ্ধির জন্য তোমরা অহংকারী হয়ে উঠেছো এবং যার বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কায় বাতিলের উপরে টিকে থাকতে ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছো সেই জিনিসই এক সময় আদ, সামূদ, সাবা, মাদয়ান ও লূতের জাতির লোকদের দেয়া হয়েছিল। এ জিনিস কি তাদেরকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল? মোট কথা জীবন যাপনের উন্নত মানই তো একমাত্র কাম্য বস্তু নয়, যে মানুষ সত্য-মিথ্যার পরোয়া না করে শুধুমাত্র তারই পেছনে পড়ে থাকবে এবং সঠিক পথ অবলম্বন করলে এ ইপ্সিত মুক্তখণ্ডটি হস্তচ্যুত হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে বলেই তা অবলম্বন করতে অস্বীকার করবে। যেসব অসৎ ও ভ্রষ্টতামূলক কাজ অতীতের সমৃদ্ধিশালী জাতিগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে তার ওপর টিকে থাকার প্রচেষ্টা চালিয়ে তোমরা রক্ষা পেয়ে যাবে এবং তাদের মতো তোমাদের ওপর কখনো ধ্বংস নেমে আসবে না এর কোন গ্যারান্টি কি তোমাদের কাছে আছে?
# এটি হচ্ছে তাদের আপত্তির তৃতীয় জবাব। পূর্বে যেসব জাতি ধ্বংস হয়েছিল তাদের লোকেরা জালেম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করার পূর্বে নিজের রসূল পাঠিয়ে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। রসূলদের সতর্ক করে দেবার পরও যখন তারা বাঁকা পথে চলা থেকে বিরত হয়নি তখন তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তোমরা এখন এ একই অবস্থায় পতিত হয়েছো। তোমরাও জালেম হয়ে গেছো। একজন রসূল তোমাদেরকেও সতর্ক করার জন্য এসেছেন। এখন তোমরা কুফরী ও অস্বীকারের নীতি অবলম্বন করে নিজেদের আয়েশ-আরাম ও সমৃদ্ধিকে রক্ষা করতে পারবে না বরং উল্টা বিপদের মুখে ঠেলে দেবে। যে ধ্বংসের আশঙ্কা তোমরা করছো তা ঈমান আনার জন্য নয় বরং অস্বীকার করার কারণে তোমাদের ওপর আপতিত হবে।
# এটা হচ্ছে তাদের আপত্তির চতুর্থ জবাব। এ জবাবটি বুঝতে হলে প্রথমে দু’টি কথা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবেঃ
একঃ দুনিয়ার বর্তমান জীবন। এর সময়কাল কারো জন্যই কতকগুলো বছরের বেশী হয় না। এটি নিছক একটি সফরের সাময়িক পর্যায় মাত্র। আসল জীবনটি হবে চিরস্থায়ী। সেটি সামনের দিকে আসছে। বর্তমান সাময়িক জীবনে মানুষ যতই সহায়-সম্পদ জমা করুক না কেন এবং কয়েক বছরের এ জীবনে যতই আয়েশ-আরাম করুক, এ জীবন একদিন শেষ হয়ে যাবেই এবং এখানকার সমস্ত বিত্ত-বৈভব সবকিছুই এখানে রেখেই তাকে চলে যেতে হবে। এ সংক্ষিপ্ত জীবনকালের আয়েশ-আরামের বিনিময়ে যদি মানুষকে আগামীর অন্তহীন জীবনে চিরকালীন দুরবস্থা ও বিপদের মধ্যে কাটাতে হয়, তাহলে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ ক্ষতির সওদা করতে পারে না। এর মোকাবিলায় একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এখানে কয়েক বছর বিপদ আপদের মধ্যে জীবন কাটিয়ে দেয়াকে প্রাধান্য দেবে। সে এর মাধ্যমে এমন সব কল্যাণ ও নেকী উপার্জন করতে চাইল, যা পরবর্তী অন্তহীন জীবনে তার চিরকালীন আয়েশ-আরামের কারণ হবে।
দুইঃ আল্লাহর দ্বীন মানুষের কাছে দাবী করে না যে, সে এ দুনিয়ার জীবনোপকরণ থেকে লাভবান হতে পারবে না এবং এখানকার রূপ সৌন্দর্য অযথা পদদলিত করে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তার দাবী শুধু এতটুকু যে, দুনিয়ার জীবনের ওপর তাকে আখেরাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ দুনিয়া ধ্বংসশীল এবং আখেরাত চিরস্থায়ী। দুনিয়ার ভোগ-তৃপ্তি নিম্ন পর্যায়ের। পক্ষান্তরে আখেরাতের ভোগ-তৃপ্তি উচ্চ ও উন্নত পর্যায়ের। তাই মানুষকে দুনিয়ার এমন সম্পদ ও সৌন্দর্য করায়ত্ত করতে হবে যা আখেরাতের চিরন্তন জীবনে তাকে সফলকাম করবে অথবা কমপক্ষে সেখানকার চিরন্তন ক্ষতির সাগরে তাকে ভাসিয়ে দেবে না। কিন্তু যেখানে মোকাবিলার ব্যাপার এসে যায় অর্থাৎ দুনিয়ার সাফল্য ও আখেরাতের সাফল্য পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়ায় সেখানে মানুষের কাছে সত্য দ্বীনের দাবী এবং ভারসাম্যপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির দাবীও এটিই যে, মানুষ দুনিয়াকে আখেরাতের জন্য উৎসর্গ করে দিক এবং এ দুনিয়ার সাময়িক সম্পদ সৌন্দর্যের জন্য সে কখনো এমন পথ অবলম্বন না করুক যার ফলে তার পরকাল চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যায়।
এ দু’টি কথা সামনে রেখে দেখুন উপরের বাক্যগুলোতে আল্লাহ মক্কার কাফেরদেরকে কি বলছেন। তিনি একথা বলছেন না যে, তোমরা নিজেদের ব্যবসায় গুটিয়ে নাও, কারবার খতম করে দাও এবং আমার নবীকে মেনে নিয়ে ফকির দরবেশ হয়ে যাও। বরং তিনি বলছেন, দুনিয়ার যে ধন সম্পদের জন্য তোমরা পাগলপারা তা অতি সামান্য সম্পদ এবং দুনিয়ার জীবনে মাত্র সামান্য ক’দিনের জন্য তোমরা তা থেকে লাভবান হতে পারো। অন্য দিকে আল্লাহর কাছে যা কিছু আছে তা এর তুলনায় গুণগত ও পরিমাণগত (Quality an Quantity) দিক দিয়েও ভালো এবং চিরন্তন স্থায়িত্বের অধিকারী। তাই যদি তোমরা এ সাময়িক জীবনের সীমাবদ্ধ নিয়ামত দ্বারা লাভবান হবার উদ্দেশ্যে এমন নীতি অবলম্বন করো যার ফল আখেরাতে চিরন্তন ক্ষতির আকারে ভোগ করতে হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় বোকামি আর কী হতে পারে? এক ব্যক্তি কঠোর পরিশ্রম করে নিজের রবের খিদমত করে এবং তারপর চিরকালের জন্য তাঁর পুরস্কার লাভ করে ধন্য হয়। আর এক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়ে আল্লাহর আদালতে অপরাধী হিসেবে আনীত হয় এবং গ্রেফতারীর পূর্বে সে নিছক কয়েকদিন হারাম সম্পদের মজা লুটবার সুযোগ পায়। এ দু’জনের মধ্যে কে সফলকাম হলো? তোমরা নিজেরাই তুলনা করে দেখে নাও।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫৬-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে বলেনঃ “হে মুহাম্মাদ (সঃ)! কাউকে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত করা তোমার শক্তির বাইরে। তোমার দায়িত্ব শুধু আমার বাণী জনগণের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া। হিদায়াতের মালিক আমি। আমি যাকে ইচ্ছা হিদায়াত কবূল করার তাওফীক দান করে থাকি। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ তাদেরকে হিদায়াত করার দায়িত্ব তোমার নয়, বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করে থাকেন।” (২:২৭২) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমার লিলা থাকলেও অধিকাংশ লোক মুমিন নয়।” (১২:১০৩) হিদায়াত লাভের হকদার কে এবং কে পথভ্রষ্ট হবার হকদার এর জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে রয়েছে যে, এ আয়াতটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চাচা আবু তালিবের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যিনি তাঁকে খুবই সাহায্য সহানুভূতি করেছিলেন। সর্বক্ষেত্রেই তিনি তার সহযোগিতা করে এসেছিলেন এবং আন্তরিকভাবে তাকে ভালবাসতেন। কিন্তু তার এ ভালবাসা ছিল আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে প্রকৃতিগত। এ ভালবাসা শরীয়তগত ছিল না। যখন তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তিনি তাকে ঈমান আনয়নের ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। কিন্তু তাঁর তকদীরের লিখন এবং আল্লাহ পাকের ইচ্ছা জয়যুক্ত হয়। তিনি ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং কুফরীর উপরই অটল থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তার মৃত্যুর সময় তাঁর নিকট আগমন করেন। আবু জেহেল ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও তাঁর পাশে উপবিষ্ট ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় চাচা! আপনি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু পাঠ করুন। এই কারণে আমি আল্লাহর নিকট আপনার জন্যে সুপারিশ করবো।” তখন আবু জেহেল ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁকে বলেঃ “হে আবু তালিব! তুমি কি তোমার পিতা আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম হতে ফিরে যাবে?” এভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বুঝাতে থাকেন এবং তারা দু’জন তাকে ফিরাতে থাকে। অবশেষে তার মুখ দিয়ে শেষ কথা বের হয়ঃ “আমি এ কালেমা পাঠ করবো না, আমি আবদুল মুত্তালিবের ধর্মের উপরই থাকলাম।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, আমি আপনার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা। করতে থাকবো। তবে যদি আল্লাহ আমাকে এর থেকে বিরত রাখেন এবং নিষেধ। করে দেন তাহলে অন্য কথা।” তৎক্ষণাৎ এ আয়াত অবতীর্ণ হয়ঃ (আরবি)
অর্থাৎ “নবী (সঃ) ও মুমিনদের জন্যে মোটেই উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে যদিও তারা তাদের নিকটতম আত্মীয় হয়।” (৯:১১৩) আর আবূ তালিবের ব্যাপারে (আরবি) এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। (এটা ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু তালিবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে চাচা! লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করুন, আমি কিয়ামতের দিন এর সাক্ষ্য দান করবো।” উত্তরে আবূ তালিব বলেনঃ “হে আমার ভ্রাতুস্পুত্র! আমার যদি আমার বংশ কুরায়েশদের বিদ্রুপ বলে ভয় না থাকতো যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে এ কালেমা পাঠ করছি তবে অবশ্যই আমি এটা পাঠ করতাম। আর এভাবে তোমার চক্ষু ঠাণ্ডা করতাম।” ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা .. (আরবি)-এ আয়াত অবতীর্ণ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেন)
অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, শেষ পর্যন্ত তিনি কালেমা পড়তে অস্বীকার করেন এবং পরিষ্কারভাবে বলে দেন- “হে আমার ভ্রাতুস্পুত্র! আমি তো আমার বড়দের ধর্মের উপর রয়েছি।” তাঁর মৃত্যু একথারই উপর হয় যে, তিনি আবদুল মুত্তালিবের মাযহাবের উপর রয়েছেন।
হযরত সাঈদ ইবনে আবি রাশেদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রোমক সম্রাট কায়সারের দূত যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয় এবং কায়সারের পত্রখানা নবী (সঃ)-এর সামনে পেশ করে তখন নবী (সঃ) তা নিজের ক্রোড়ে রেখে দেন। অতঃপর দূতকে বলেনঃ “তুমি কোন গোত্রের লোক?” সে উত্তরে বলেঃ “আমি তানূখ গোত্রের লোক।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি কি চাও যে, তুমি তোমার পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের উপর এসে যাবে?” জবাবে সে বলেঃ “আমি যে কওমের দূত, যে পর্যন্ত না আমি তাদের পয়গামের জবাব তাদের কাছে পৌছাতে পারবো, তাদের মাযহাব পরিত্যাগ করতে পারবো না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুচকি হেসে তার সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে (আরবি) এই আয়াতটিই পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
মুশরিকরা তাদের ঈমান আনয়ন না করার একটি কারণ এও বর্ণনা করতো যে, তারা যদি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক আনীত হিদায়াত মেনে নেয় তবে তাদের ভয় হচ্ছে যে, এই ধর্মের বিরোধী লোকেরা যে তাদের চতুর্দিকে রয়েছে তারা তাদের শত্রু হয়ে যাবে, তাদেরকে কষ্ট দেবে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, এটাও তাদের ভুল কৌশল। আল্লাহ পাক তো তাদেরকে এক নিরাপদ হারামে অর্থাৎ মক্কা শরীফে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেখানে দুনিয়ার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নিরাপত্তা বিরাজ করছে। তাহলে কুফরীর অবস্থায় যখন তারা সেখানে নিরাপত্তা লাভ করছে, তখন আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করলে কি করে ঐ নিরাপত্তা উঠে যেতে পারে? এটাতো ঐ শহর যেখানে তায়েফ ইত্যাদি বিভিন্ন শহর হতে ফলমূল, ব্যবসার মাল ইত্যাদি বহুল পরিমাণে আমদানী হয়ে থাকে। সমস্ত জিনিস এখানে অতি সহজে চলে আসে এবং এভাবে মহান আল্লাহ তাদেরকে রিযক পৌঁছিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এটা জানে না। এজন্যেই তারা এরূপ বাজে ওর পেশ করে থাকে। বর্ণিত আছে যে, এ কথা যে বলেছিল তার নাম ছিল হারিস ইবনে আমির ইবনে নাওফিল।
৫৮-৫৯ নং আয়াতের তাফসীর
মক্কাবাসীকে সতর্ক করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহ তা’আলার বহু নিয়ামত লাভ করে ভোগ সম্পদের দম্ভ করতো এবং হঠকারিতা ও ঔদ্ধত্যপনা প্রকাশ করতো, আল্লাহ ও তাঁর নবীদেরকে (আঃ) অমান্য ও অস্বীকার করতো এবং আল্লাহর রিযক ভক্ষণ করে নিমকহারামী করতো, তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন যে, আজ তাদের নাম নেয়ারও কেউ নেই। যেমন অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি) হতে (আরবি) পর্যন্ত। অর্থাৎ “আল্লাহ একটি গ্রামের (লোকদের) উপমা বর্ণনা করেছেন যারা (পার্থিব বিপদ-আপদ হতে) নিরাপদে ছিল এবং তাদের মধ্যে শান্তি বিরাজ করছিল, সব জায়গা থেকে তাদের নিকট পর্যাপ্ত পরিমাণে রিক আসততা ……… অতঃপর তাদের যুলুম করা অবস্থায় শাস্তি তাদেরকে পেয়ে বসে।” (১৬:১১২-১১৩) এখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি যার বাসিন্দারা নিজেদের ভোগ সম্পদের গর্ব করতো! এইতো তাদের ঘরবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে; তাদের পর এগুলোতে লোকজন খুব কমই বসবাস করেছে। আমিই তো চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী।
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত কা’ব (রাঃ) হযরত উমার (রাঃ)-কে হযরত সুলাইমান (আঃ) পেঁচাকে বলেনঃ “তুমি ক্ষেতের ফসল খাও না কেন? সে উত্তরে বলেঃ “এই কারণেই তো হযরত আদম (আঃ)-কে জান্নাত হতে বের করে দেয়া হয়েছিল। এজন্যেই আমি তা খাই না।” আবার তিনি প্রশ্ন করেনঃ “তুমি পানি পান কর না কেন?” জবাবে সে বলেঃ “কারণ এই যে, হযরত নূহ (আঃ)-এর কওমকে এই পানিতেই ডুবিয়ে দেয়া হয়।” পুনরায় তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি তাঁবুতে বাস কর কেন?” সে উত্তর দেয়ঃ “কেননা, ওটা আল্লাহর মীরাস।” অতঃপর হযরত কা’ব (রাঃ) (আরবি) আয়াতটি পাঠ করেন।
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় আদল ও ইনসাফের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি কাউকেও যুলুম করে ধ্বংস করেন না। প্রথমে তিনি তাদের সামনে তার হুজ্জত ও দলীল প্রমাণ পেশ করেন এবং তাদের ওযর উঠিয়ে দেন। রাসূলদেরকে প্রেরণ করে তিনি তাদের কাছে নিজের বাণী পৌঁছিয়ে দেন।
এই আয়াত দ্বারা এটাও জানা যাচ্ছে যে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নবুওয়াত ছিল সাধারণ। তিনি উম্মুল কুরা বা জনপদের কেন্দ্রে প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁকে সারা আরব-আজমের নিকট রাসূলরূপে প্রেরণ করা হয়েছিল। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যেন তুমি মক্কাবাসীকে এবং ওর চতুষ্পর্শ্বের লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন। কর।” (৪২ ৪৭) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সবারই নিকট রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি।” (৭:১৫৮) অন্য একটি আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যাতে আমি এই কুরআন দ্বারা তোমাদেরকে ভয়-প্রদর্শন করি এবং তাদেরকেও যাদের কাছে এটা পৌঁছে যাবে।” (৬:১৯) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “দুনিয়াবাসীদের মধ্যে যে কেউ এই কুরআনকে অস্বীকার করবে তার ওয়াদার স্থান হচ্ছে জাহান্নাম।” (১১:১৭) অন্য এক আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সমস্ত জনপদকে আমি কিয়ামতের পূর্বে ধ্বংসকারী অথবা কঠিন শাস্তি প্রদানকারী।” (১৭:৫৮) সুতরাং আল্লাহ তা’আলা খবর দিলেন যে, কিয়ামতের পূর্বে তিনি সত্বরই প্রত্যেক জনপদকে ধ্বংস করবেন। আর এক জায়গায় মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি শাস্তি প্রদানকারী নই যে পর্যন্ত না আমি রাসূল প্রেরণ করি।” (১৭:১৫) সুতরাং আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর রিসালাত বা প্রেরিতত্বকে সাধারণ করেছেন এবং সারা দুনিয়ার কেন্দ্রস্থল মক্কাভূমিতে তাঁকে প্রেরণ করে বিশ্বজাহানের উপর স্বীয় হুজ্জত খতম করে দেন।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি প্রত্যেক লাল-কালোর নিকট রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি। এ জন্যেই তাঁর উপরই নবুওয়াতকে শেষ করে দেয়া হয়েছে। তার পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। বলা হয়েছে যে, (আরবি) দ্বারা আসল এবং বড় গ্রাম বা শহর উদ্দেশ্য।
৬০-৬১ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার তুচ্ছতা, ওর জাকজমকের নগণ্যতা এবং অস্থায়িত্ব ও নশ্বরতার বর্ণনা দিচ্ছেন এবং অপরপক্ষে আখিরাতের নিয়ামতরাজির স্থায়িত্ব ও উৎকৃষ্টতার বর্ণনা দিচ্ছেন। যেমন তিনি বলেনঃ অর্থাৎ “তোমাদের কাছে যা আছে তা শেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা তা বাকী থাকবে।” (১৬:৯৬) আরো বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহর নিকট যা রয়েছে সৎলোকদের জন্যে তা অতি উত্তম।” (৩:১৯৮) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “পার্থিব জীবন (অস্থায়ী) ভোগ-বিলাস ছাড়া কিছুই নয়।” (৫৭:২০) অন্যত্র বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ, অথচ আখিরাতই উৎকৃষ্টতর ও স্থায়ী।” (৮৭:১৬-১৭)।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর শপথ! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এমনই যেমন কেউ সমুদ্রের পানিতে তার অঙ্গুলী ডুবিয়ে দেয়, অতঃপর তা উঠিয়ে নিলে দেখতে পায় যে, তার অঙ্গুলীর অগ্রভাগে যতটুকু পানি উঠেছে তা সমুদ্রের পানির তুলনায় কতটুকু। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ যারা আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে তারা কি মোটেই জ্ঞান রাখে না?
মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাই বলেনঃ যাকে আমি উত্তম পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যা সে পাবে সে কি কখনো ঐ ব্যক্তির মত হতে পারে যাকে আমি পার্থিব জীবনের ভোগ-সম্ভার দিয়েছি, অতঃপর যাকে কিয়ামতের দিন হাযির করা হবে (ও খুঁটিনাটিভাবে হিসাব নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে)?
বর্ণিত আছে যে, এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং অভিশপ্ত আবু জেহেলের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। একটি উক্তি এও আছে যে, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় হযরত হামযা (রাঃ) ও আবু জেহেলের ব্যাপারে। এটা প্রকাশমান যে, আয়াতটি সাধারণভাবেই অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন যে, জান্নাতী মুমিন জান্নাত হতে ঝুঁকে দেখবে এবং জাহান্নামীকে জাহান্নামের মধ্যস্থলে দেখতে পেয়ে বলবেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ না থাকলে আমিও তো আটক ব্যক্তিদের মধ্যে শামিল হতাম।” (৩৭:৫৭) অন্য এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “জ্বিনেরা জানে যে, তাদেরকে অবশ্যই হাযির করা হবে।” (৩৭:১৫৮) ৬২। আর সেই দিন তিনি তাদেরকে আহ্বান করে বলবেনঃ তোমরা যাদেরকে আমার শরীক গণ্য করতে তারা কোথায়?