أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০১৯)[মুনাফিক কি:- বই নং ২৯]
[ *ঈমানের পরীক্ষায় মােনাফেকদের অবস্থা :- ]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৯:আল-আনকাবুত
পারা:২০
১-১৩ নং আয়াত:-
২৯:১
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾
আলিফ-লাম-মীম;
২৯:২
اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَکُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ ہُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۲﴾
মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে?
২৯:৩
وَ لَقَدۡ فَتَنَّا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ فَلَیَعۡلَمَنَّ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ الۡکٰذِبِیۡنَ ﴿۳﴾
অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি, আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন৩ কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক।
২৯:৪
اَمۡ حَسِبَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ السَّیِّاٰتِ اَنۡ یَّسۡبِقُوۡنَا ؕ سَآءَ مَا یَحۡکُمُوۡنَ ﴿۴﴾
তবে কি যারা মন্দকাজ করে তারা মনে করে যে, তারা আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে ? তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ!
২৯:৫
مَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ اللّٰہِ فَاِنَّ اَجَلَ اللّٰہِ لَاٰتٍ ؕ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۵﴾
যে কেউ আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করার আশা করে (তার জানা উচিত) , আল্লাহর নির্ধারিত সময় আসবেই। আর আল্লাহ সবকিছু শুনেন ও জানেন।
২৯:৬
وَ مَنۡ جَاہَدَ فَاِنَّمَا یُجَاہِدُ لِنَفۡسِہٖ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَغَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۶﴾
যে ব্যক্তিই প্রচেষ্টা- সংগ্রাম করবে সে নিজের ভালোর জন্যই করবে। আল্লাহ অবশ্যই বিশ্ববাসীদের প্রতি মুখাপেক্ষিতাহীন।
২৯:৭
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَنُکَفِّرَنَّ عَنۡہُمۡ سَیِّاٰتِہِمۡ وَ لَنَجۡزِیَنَّہُمۡ اَحۡسَنَ الَّذِیۡ کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۷﴾
আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে আমরা অবশ্যই তাদের মন্দকাজগুলো মিটিয়ে দেব এবং আমরা অবশ্যই তাদেরকে তারা যে উত্তম কাজ করত, তার প্রতিদান দেব।
২৯:৮
وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡہِ حُسۡنًا ؕ وَ اِنۡ جَاہَدٰکَ لِتُشۡرِکَ بِیۡ مَا لَیۡسَ لَکَ بِہٖ عِلۡمٌ فَلَا تُطِعۡہُمَا ؕ اِلَیَّ مَرۡجِعُکُمۡ فَاُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۸﴾
আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছি, তবে ওরা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন কিছুকে অংশী করতে বাধ্য করে, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মান্য করো না। আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন; অতঃপর তোমরা যা কিছু করেছ, আমি তা তোমাদেরকে জানিয়ে দেব।
২৯:৯
وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَنُدۡخِلَنَّہُمۡ فِی الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۹﴾
আর যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করে থাকবে তাদেরকে আমি নিশ্চয়ই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবো।
২৯:১০
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ فَاِذَاۤ اُوۡذِیَ فِی اللّٰہِ جَعَلَ فِتۡنَۃَ النَّاسِ کَعَذَابِ اللّٰہِ ؕ وَ لَئِنۡ جَآءَ نَصۡرٌ مِّنۡ رَّبِّکَ لَیَقُوۡلُنَّ اِنَّا کُنَّا مَعَکُمۡ ؕ اَوَ لَیۡسَ اللّٰہُ بِاَعۡلَمَ بِمَا فِیۡ صُدُوۡرِ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۰﴾
লোকদের মধ্যে এমন কেউ আছে যে বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি কিন্তু যখন সে আল্লাহর ব্যাপারে নিগৃহীত হয়েছে তখন লোকদের চাপিয়ে দেয়া পরীক্ষাকে আল্লাহর আযাবের মতো মনে করে নিয়েছে। এখন যদি তোমার রবের পক্ষ থেকে বিজয় ও সাহায্য এসে যায়, তাহলে এ ব্যক্তিই বলবে, “আমরা তো তোমাদের সাথে ছিলাম।” বিশ্ববাসীদের মনের অবস্থা কি আল্লাহ ভালোভাবে জানেন না?
২৯:১১
وَ لَیَعۡلَمَنَّ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ ﴿۱۱﴾
আর আল্লাহ্ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা ঈমান এনেছে এবং অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা মুনাফিক।
২৯:১২
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّبِعُوۡا سَبِیۡلَنَا وَ لۡنَحۡمِلۡ خَطٰیٰکُمۡ ؕ وَ مَا ہُمۡ بِحٰمِلِیۡنَ مِنۡ خَطٰیٰہُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ ؕ اِنَّہُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۲﴾
আর কাফিররা মুমিনদেরকে বলে, ‘তোমরা আমাদের পথ অনুসরণ কর তাহলে আমরা তোমাদের পাপভার বহন করব ।’ কিন্তু ওরা তো তাদের পাপভারের কিছুই বহন করবে না। নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।
২৯:১৩
وَ لَیَحۡمِلُنَّ اَثۡقَالَہُمۡ وَ اَثۡقَالًا مَّعَ اَثۡقَالِہِمۡ ۫ وَ لَیُسۡـَٔلُنَّ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ عَمَّا کَانُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ ﴿٪۱۳﴾
ওরা অবশ্যই নিজেদের পাপভার বহন করবে এবং তার সঙ্গে আরও কিছু পাপের বোঝা এবং ওরা যে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, সে সম্পর্কে কিয়ামতের দিন অবশ্যই ওদেরকে প্রশ্ন করা হবে।
সুরা: আল-আনকাবুত
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : সূরা আনকাবুত মক্কী সূরা। কোনাে কোন বর্ণনায় প্রথম এগারাে আয়াতকে মাদানী বলা হয়েছে। এর কারণ এই যে, এই এগারাে আয়াতে জিহাদ ও মুনাফিকীন শব্দের উল্লেখ রয়েছে। তবে এতদসত্তেও আমাদের মতে, সূরার মক্কী হওয়াই অগ্রগণ্য। ৮ম আয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ওটা হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসের ইসলাম গ্রহণ উপলক্ষে নাযিল হয়েছে। পরবর্তীতে এ ঘটনার বিবরণ আসছে। সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসের ইসলাম গ্রহণ যে মক্কাতেই সংঘটিত হয়েছিলাে, সে ব্যাপারে কোনাে দ্বিমত নেই। আর এ আয়াতটা মতান্তরে মাদানী বলে কথিত এগারাে আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে পুরাে সূরাটাই মক্কী মনে করা আমার কাছে অগ্রগণ্য। তবে এই আয়াতগুলােতে জিহাদের উল্লেখের কারণ সহজেই বুঝা যায়। কেননা জেহাদের উল্লেখ করা হয়েছে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ প্রসংগে । অর্থাৎ মন দিয়ে জেহাদ করতে বলা হয়েছে, যাতে মােমেনরা ধৈর্য ধারণ করে এবং নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ঈমান ত্যাগ না করে বসে। পূর্বাপর আয়াতগুলাের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার। নেফাকের উল্লেখের ব্যাখ্যাও এভাবেই করা যায়। ঈমানের দাবীদারদের একটা শ্রেণীর অবস্থা তুলে ধরাই এর উদ্দেশ্য। সূরার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ধরনের বর্ণনাভংগি পরিলক্ষিত হয়। প্রারম্ভিক বর্ণমালা আলিফ-লা-ম-মীম।’ এরপর ঈমান ও পরীক্ষা সংক্রান্ত বক্তব্য দিয়েই সূরার শুরু। অন্তরের অন্তস্তলে বদ্ধমূল যথার্থ ঈমানের পরিচয় ও দায়দায়িত্ব কী, সেটা দিয়েই সূরার সূচনা হয়েছে। বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ঈমান শুধু মুখ দিয়ে দাবী করার জিনিস নয়। ঈমান হচ্ছে কষ্টকর ও অপ্রীতিকর অবস্থার সামনে ধৈর্যের সাথে টিকে থাকার এবং এর দায়দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করার নাম। কেননা ঈমানের পথ দায়দায়িত্বপূর্ণ ও কাঁটা বিছানাে। দুঃখ কষ্ট ও যুলুম নির্যাতন সহ্য করে ঈমানের পরীক্ষা দেয়া যে প্রত্যেক মােমেনের জন্যে অবধারিত, এ বিষয়টাই সম্ভবত এ সূরার কেন্দ্রীয় আলােচ্য বিষয়। কেননা সূচনায় এ বিষয়ে বক্তব্য রাখার পর সমগ্র সূরা জুড়েই হযরত নূহ, ইবরাহীম, লূত, শোয়াইব, আদ, সামূদ, কারূন, ফেরাউন ও হামানের কাহিনী সংক্ষেপে আলােচনা করা হয়েছে। এসব আলােচনার কেন্দ্রীয় বিষয় এটাই যে, ঈমানের দিকে দাওয়াত দেয়ার পরিণামে বিভিন্ন রকমের বাধাবিঘ্ন ও যুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়া সকল যুগে সকল প্রজন্মেই অনিবার্য। এরপর এসব কাহিনীর ওপর পর্যালােচনা চালানাে হয়েছে। বলা হয়েছে যে, সত্য প্রকাশ ও হেদায়াতের বাণী প্রচারের পথে কিছু লােক ও কিছু শক্তি বাধার সৃষ্টি করে থাকে। এ সব শক্তির দাপট দেখে ঘাবড়ানাে উচিত নয়। কেননা এদের প্রত্যেককেই শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা পাকড়াও করেছেন ও ধ্বংস করেছেন। বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেককেই আমি তার করা অপরাধের দায়ে পাকড়াও করেছি…'(আয়াত ৪০) আর এসব শক্তির উদাহরণ এমনভাবে দেয়া হয়েছে যে, এতে তাদের দুর্বলতা ও নগণ্যতা স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন – ‘যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের উদাহরণ মাকড়সার মতাে…'(আয়াত ৪১) এরপর যে সত্যের দিকে আল্লাহর নবীরা দাওয়াত দিয়েছেন আর আল্লাহর সৃষ্টিজগতে যে সত্য নিহিত রয়েছে, সেই উভয় সত্যের মধ্যে সংযােগ স্থাপন করা হয়েছে, আর সকল নবীর দাওয়াত ও মােহাম্মদ(স.)-এর দাওয়াতকে এক অভিন্ন দাওয়াত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা সবই আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। সবই আল্লাহর অনুগত হবার দাওয়াত। এ জন্যে সর্বশেষ কিতাব কুরআন সম্পর্কেও বক্তব্য এসেছে। মােশরেকরা এই বক্তব্য কিভাবে গ্রহণ করেছে তাও জানানাে হয়েছে। মােশরেকরা শুধু এই কেতাবে সন্তুষ্ট হয়নি, এই কেতাবে বিশ্বাসীদের জন্যে যে উপদেশ, শিক্ষা ও অনুগ্রহের বিবরণ রয়েছে, তা তাদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি; বরং তারা অলৌকিক ঘটনাবলী দেখতে চেয়েছে এবং আল্লাহর আযাব তাড়াতাড়ি আসুক বলে দাবী জানিয়েছে, অথচ জাহান্নাম তাে কাফেরদের ঘেরাও করেই রেখেছে। তারা তাদের যুক্তিতে সব সময় স্ববিরােধী। একদিকে আকাশ ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিয়ে মৃত পৃথিবীকে কে পুনরুজ্জীবিত করেছে, জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব দেয় যে, আল্লাহ তায়ালা করেছেন, আর জাহাজে চড়লে তারা কায়মনে আল্লাহকে ডাকে। অথচ এ সব সত্ত্বেও তারা আল্লাহর সাথে অন্যদের শরীক মানে এবং মােমেনদের নির্যাতন করে। মােশরেক ও মােমেনদের মধ্যে সংঘটিত এই তর্ক-বিতর্ক প্রসংগে আল্লাহ মােমেনদের তাদের জীবনাদর্শের নিরাপত্তার খাতিরে বিদেশে হিজরত করার আহ্বান জানিয়েছেন (আয়াত ৫৬) এবং এ ব্যাপারে মৃত্যু ও ক্ষুধার ভয় সম্পর্কে নিউকি থাকতে বলেছেন। কেননা, ‘প্রত্যেক প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করা অনিবার্য'(আয়াত ৫৭) ‘এবং আল্লাহ তােমাদের ও সকল প্রাণীর জীবিকা দিয়ে থাকেন'(আয়াত ৬০) সূরার শেষ আয়াতে আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের প্রশংসা এবং তাদের সৎপথে অবিচল থাকতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ‘যারা আমার পথে জেহাদ করে, তাদের আমি অবশ্য অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করবাে। আল্লাহ এসব সৎকর্মশীলদের সাথে রয়েছেন'(আয়াত ৬৯) এভাবে সূরার সূচনায় ও সমাপ্তিতে অপূর্ব মিল দেখতে পাওয়া যায়, সূরার পূর্বাপর আলােচ্য বিষয়ের যৌক্তিকতা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর সূরার সূচনা ও সমাপ্তির মাঝে যে বিভিন্ন পর্ব রয়েছে, এর মধ্যে চমৎকার এককেন্দ্রিকতা এবং বিষয়গত সমন্বয় ও একাত্মতা পরিলক্ষিত হয়। সমগ্র সূরায় আলােচ্য বিষয় কেন্দ্রীভূত হলেও সূরাটা তিন পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে আলােচিত হয়েছে ঈমানের প্রকৃত তাৎপর্য ও পরিচয়। নামা রকমের বিপদ মুসিবতের আকারে ঈমানের পরীক্ষা আল্লাহর নীতি। মােমেন, কাফের ও মােনাফেকদের পরিণাম এবং অন্যদের বিপথগামী করার দরুন পাপের বােঝা বৃদ্ধি পাওয়া সত্তেও কেয়ামতের দিন প্রত্যেকের নিজ নিজ পাপের জন্যে নিজেকেই জবাবদিহি করার অপরিহার্যতা। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে ওপরে যেসব কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলাে। এসব কাহিনী থেকে ইসলামের দাওয়াতের পথে বিপদ ও বাধা-বিঘ্নের অনিবার্যতা সম্পর্কে প্রাপ্ত শিক্ষা এবং আল্লাহর শক্তির সামনে সেসব বাধা-বিঘ্ন আরােপকারীদের শক্তির নগণ্যতা সংক্রান্ত বক্তব্য। এই সাথে নবীদের দাওয়াত ও মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে যে একই মহাসত্য নিহিত রয়েছে, তাও তুলে ধরা হয়েছে। কেননা উভয়টাই আল্লাহর কাছ থেকে আগত। তৃতীয় পর্বে কিতাবধারীদের মধ্যে যারা যালেম, তারা ছাড়া অন্য সবার সাথে কেবলমাত্র ডদ্রজনােচিত ও মার্জিত ভাষায় বিতর্ক করতে আদেশ দেয়া হয়েছে, তাদের ধর্ম ও মােহাম্মদ(স.) আনীত ধর্ম যে এক ও অভিন্ন, সে সম্পর্কে বক্তব্য রাখা হয়েছে এবং সর্বশেষে আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জানানাে হয়েছে নানা ধরনের পুরস্কার বিনিময়ের কথা। সূরার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহু স্থানে ঈমানের হাকীকত ও তাৎপর্য সম্পর্কে অত্যন্ত জোরদার গভীর আলােচনা করা হয়েছে। এ আলােচনা পাঠকের চেতনা ও অনুভূতিতে শিহরণ জাগায়, বিবেককে ঝাঁকুনি দেয় এবং তাকে ঈমানের দাবী অনুযায়ী কাজ করার অদম্য প্রেরণা যােগায়। ফলে সে হয় ঈমানের দাবী পূরণে সক্রিয় হয়ে ওঠে, নতুবা তা থেকে পিছু হটে যায় অন্যথায় মােনাফেকীর নীতি অবলম্বন করে, যা আল্লাহ তায়ালা শেষ পর্যন্ত ফাস করে দেন এবং তাকে অপমানিত করেন। এ আলােচনায় যে আলােড়ন সৃষ্টি করা হয়েছে তা এ সংক্রান্ত আয়াতগুলাে ছাড়া আর কোনাে কিছু দ্বারা ফুটিয়ে তােলা যেতাে না। তাই এখানে সে সম্পর্কে শুধু কিছু আভাস দেয়াই যথেষ্ট মনে করছি। বিস্তারিত আলােচনা যথাস্থানে সংশ্লিষ্ট আয়াতের সাথেই করা যাবে।
আলিফ, লা-ম, মী-ম এই বিচ্ছিন্ন অক্ষর গুলোর ব্যাখ্যা প্রসংগে আমি আগেই আমার দৃষ্টিভংগি তুলে ধরেছি। আমি বলেছি, এগুলাে দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার ওপর যে কিতাব নাযিল করেছেন, তার উপাদান হিসেবে এই অক্ষর বা বর্ণমালাই ব্যবহৃত হয়েছে। এ বর্ণমালা আরবদের কাছে সুপরিচিত এবং এগুলাে দ্বারা তারা নিজেদের ইচ্ছামতাে যে কোনাে কথা সহজেই রচনা করতে পারে। অথচ তারা এ দ্বারা এ ধরনের একটা কিতাব রচনা করতে পারেনি এবং কখনাে পারবেও না। কেননা এ কিতাব আল্লাহর রচিত- মানুষের রচিত নয়। আমি ইতিপূর্বে আরাে বলেছি, যে কটা সূরা এরূপ বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা দিয়ে শুরু হয়েছে, সেগুলােতে কোরআন সম্পর্কে কিছু না কিছু বক্তব্য থাকেই। সে বক্তব্য এই অক্ষরগুলাের অব্যবহিত পরও থাকতে পারে আবার সূরার ভেতরেও থাকতে পারে। এ সূরায় রয়েছে ভেতরের দিকে। যেমন, ‘যে কিতাব তােমার কাছে ওহীযােগে পাঠানাে হয়েছে তা পড়ে শােনাও'(আয়াত ৪৫) ‘এভাবেই আমি তােমার কাছে কেতাব নাযিল করেছি'(আয়াত ৪৭) ‘ইতিপূর্বে তুমি কোনাে কিতাব পড়তে সক্ষম ছিলে না'(আয়াত ৪৮) ‘আমি যে তোমার কাছে কিতাব নাযিল করেছি তা কি তাদের জন্যে যথেষ্ট নয়?'(আয়াত ৫১) সূরার শুরুতে এসব বর্ণমালার ব্যাখ্যা দিতে আমি যে মূলনীতি গ্রহণ করেছি, তার সাথে এই আয়াতগুলাে সংগতিপূর্ণ।
*ঈমানের পথে পরীক্ষা অনিবার্য : সূচনার পর শুরু হয়েছে ঈমান সংক্রান্ত আলােচনা। ঈমান বাস্তবায়িত করার জন্যে এবং বিপদ-আপদ দিয়ে কে ঈমানের সত্য দাবীদার ও কে মিথ্যা দাবীদার, তা নির্ণয় করার জন্যে মােমেনদের যে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়, সেই পরীক্ষা সম্পর্কেও এ সূরার প্রথম কটা আয়াতে আলােচনা করা হয়েছে। যেমন, ‘মানুষ কি ভেবেছে যে, তারা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদের পরীক্ষা না নিয়েই ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের কাছ থেকেও পরীক্ষা নিয়েছি…'(আয়াত ২) সূরার এই জোরদার অধ্যায়টা হচ্ছে এর প্রথম বক্তব্য, যা প্রশ্নের আকারে রাখা হয়েছে। এ প্রশ্নে যে ঈমানে’-র উল্লেখ করা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের ধারণাজাত ঈমান। তাদের ধারণা, ঈমান হলাে এমন একটা জিনিস, যার কথা মুখ দিয়ে দাবী করাই যথেষ্ট। অথচ ঈমান কেবল মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার নাম নয়, বরং ঈমান হলাে একটা গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ কাজ, একটা ঝুঁকিপূর্ণ আমানত, এমন এক জিহাদ যা জয় করতে ধৈর্যের প্রয়ােজন এবং এমন এক সাধনা, যার সাফল্যের জন্যে সহিষ্ণুতা অপরিহার্য। সুতরাং এটা যথেষ্ট নয় যে, মানুষ ঈমান এনেছি এই দাবী করেই পার পেয়ে যাবে। এই দাবী করার পর যখন পরীক্ষা আসবে তখন তাকে সেই পরীক্ষায় এমনভাবে উত্তীর্ণ হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে যে, তার ঈমানে কিছুমাত্র ভেজাল মিশবে না এবং কিছুমাত্র দুর্বলতা আসবে না। যেমন আগুন স্বর্ণকে পরীক্ষা করে এবং স্বর্ণ ও তার সাথে যুক্ত খাদ পৃথক করে দেয়। এটাই ফিৎনা’ (পরীক্ষা) শব্দটার ধাতুগত অর্থ, আবার এটাই এর ভাবার্থ । স্বর্ণের মতাে এই ফিতনা মনকেও খালেস তথা ভেজালমুক্ত করে দেয়, অর্থাৎ বিপদ মসিবতের আকারে আগত পরীক্ষা এটাকে খাঁটি করে তােলে। ঈমানের এই পরীক্ষা আল্লাহর মানদন্ডে একটা চিরস্থায়ী মূলনীতি ও একটা শাশ্বত রীতি। আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছি। এভাবে আল্লাহ সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীদের পরখ করে নেবেনই। এ কথা সত্য যে, আল্লাহ তায়ালা পরীক্ষার আগেও কার মন কেমন তা জানেন। তবে আল্লাহর কাছে যা জ্ঞাত ও উন্মুক্ত, পরীক্ষার মাধ্যমে তা বাস্তব জগতেও জ্ঞাত ও উন্মুক্ত হয়ে যায়। মানুষ যা জানতাে না, পরীক্ষার পর তা জানতে পারে। ফলে আল্লাহ তায়ালা যে হিসাব নেবেন ও কর্মফল দেবেন, তা শুধু তার নিজের জানার ভিত্তিতেই নয়, বরং মানুষের বাস্তব কাজের ভিত্তিতেও দেবেন। এটা একদিক থেকে আল্লাহর অনুগ্রহ আর একদিক থেকে তার সূক্ষ্ম সুবিচার । আর এক দিক থেকে মানুষের প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিংয়ের শামিল। মানুষেরাও নিজেদের কাউকে তার প্রকাশ্য কাজের মাধ্যমে যা প্রকাশিত ও প্রমাণিত হয়, কেবল তারই প্রতিফল দেবে। কেননা মানুষের মন সম্পর্কে অন্য মানুষ আল্লাহর চেয়ে বেশী জানতে পারে না। এটা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পরীক্ষার মাধ্যমে খাটি মােমেন ও ভন্ড মােমেনকে বাছাই করার তাঁর একই চিরন্তন রীতি। কারণ ইসলাম পৃথিবীতে আল্লাহর আমানত। এ আমানত কেবল তারাই গ্রহণ করে, যাদের তা গ্রহণ করার যােগ্যতা ও ক্ষমতা রয়েছে, যাদের অন্তরে এর প্রতি পরিপূর্ণ নিষ্ঠা আন্তরিকতা রয়েছে এবং যারা একে নিজেদের সুখ শান্তি, ভােগবিলাস ও সহায় সম্পদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়। ঈমান হচ্ছে পৃথিবীর খেলাফতের দায়িত্ব, মানুষকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার দায়িত্বের সমার্থক। সুতরাং এটা এক মহা মূল্যবান ও অত্যন্ত গুরুতর দায়িত্ব। ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিষ্ঠা আসলে আল্লাহর কাজ- যা সম্পাদনের দায়িত্ব মানুষ গ্রহণ করে, তাই এর জন্যে বিপদাপদে ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় এক বিশেষ ধরনের ধৈর্য আবশ্যক। মােমেনের ওপর পরীক্ষা এভাবেও আসতে পারে যে, তাকে বাতিলপন্থীদের পক্ষ থেকে যুলম নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। অথচ তাকে সাহায্য করা ও উদ্ধার করার মতাে কোনাে লােকও পাওয়া যাচ্ছে না, নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে এবং রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে না, আগ্রাসনের মুখে টিকে থাকার জন্যে যে শক্তি দরকার তাও অর্জন করতে পারছে না। এটা ফিতনা বা পরীক্ষার একটা উল্লেখযােগ্য রূপ। ফিতনা শব্দটা উল্লেখ করলেই এই অবস্থাটা মানসপটে ভেসে ওঠে। তবে এটাই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা নয়। বিভিন্ন রূপ ধারণ করে এমন বহু ফিতনা বা পরীক্ষা আসতে পারে, যা এর চেয়েও ভয়ংকর কষ্টকর। কখনাে কখনাে আপনজন ও বন্ধু বান্ধব ফিতনা হয়ে দেখা দিতে পারে। ইসলামী দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিয়ােজিত ব্যক্তির কারণে তাদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসতে পারে এবং সে হয়তাে তা রােধ করতে সক্ষম হবে না। ওসব আপনজন অতিষ্ঠ হয়ে তাকে আপােষ বা আত্মসমর্পণ করার জন্যে চাপ দিতে পারে। তারা আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে এবং ক্ষয় ক্ষতি, যুলুম বা ধ্বংসের মুখােমুখি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের রক্ষা বা সাহায্য করতে এগিয়ে আসার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখালে আল্লাহর শাস্তির ভয় পর্যন্ত দেখায়। এই সূরায় আরাে এক ধরনের ফিতনার উল্লেখ রয়েছে, যা খুবই কঠিন ও জটিল। এই ফিতনা পিতামাতা সংক্রান্ত। আরাে একটা ফিতনা হলাে, বাতিলপন্থীদের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ও সুখ সমৃদ্ধি। মানুষ তাদের সফলকাম ও ভাগ্যবান দেখতে পায়। মানুষ দেখে যে, বাতিলপন্থীদের সর্বত্র সম্বর্ধনা জানানাে হচ্ছে, জনগণ তাদের স্বাগত জানাচ্ছে, তাদের পথের সমস্ত বাধা এক নিমেষে দূর হয়ে যাচ্ছে। এক কথায়, তাদের জীবন সুখ শান্তি ও সম্মানে পরিপূর্ণ। অথচ ইসলামের খেদমতে নিয়ােজিত ব্যক্তিরা যেন সবার কাছে অবহেলিত ও অপরিচিত। কেউ তাদের পক্ষ নিতে চায় না। তারা যে সত্যের পতাকাবাহী, একমাত্র তাদেরই মতাে মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক ক্ষমতাহীন লােক ছাড়া সে সত্য কেউ বিবেচনায় আনতে চায় না। আবার কখনাে কখনাে এমন হয় যে, মােমেন তাকিয়ে দেখতে পায় তার চারপাশের সবাই গােমরাহীতে মগ্ন এবং ইসলাম বিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত। ওই সমাজে সে নিজেকে সম্পূর্ণ একা, অচেনা ও কোণঠাসা অনুভব করে। সেখানকার পরিবেশ তার ও তার আদর্শের সম্পূর্ণ বৈরী । এটাও মুমিনের জন্যে একটা ফিতনা বা পরীক্ষার রূপ ধারণ করে থাকে। আরাে এক ধরনের ফিতনা রয়েছে, যাকে ইদানীং আমরা অত্যন্ত গুরুতর মনে করছি। সেটা হচ্ছে এই যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতি জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত থাকা সত্তেও তাদের সমাজ ব্যবস্থা ও জীবন যাপনের মান অত্যন্ত উন্নত । সেখানে ব্যক্তির অধিকার, সুযােগ সুবিধা ও জানমালের নিরাপত্তার এমন চমৎকার ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়, যা মানুষের মূল্য ও মর্যাদার সাথে পুরােপুরি সংগতিপূর্ণ। সেসব দেশ ও জাতি শক্তিশালী সম্পদশালী। অথচ তারা কট্টর আল্লাহদ্রোহী! এসব কিছুর পাশাপাশি আরেকটি বড় ও মারাত্মক ফিতনা হলাে প্রবৃত্তি ও প্রবৃত্তির কামনা বাসনা, পার্থিব লালসা ও মােহ, রক্ত-মাংসের চাহিদা তথা জৈবিক ক্ষুধা, সম্পদ ও ক্ষমতার লিন্সা, শান্তি ও নিরাপত্তার আকাংখা, ঈমানের পথে টিকে থাকা ও অগ্রগতি অর্জনের বাধা বিপত্তি এবং অন্তরের গভীরে, জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগে, পরিবেশ সংক্রান্ত যুক্তিতর্কে ও সমকালীন সমাজের ধ্যান ধারণায় ইসলাম বিরােধী উপাদানসমূহ বদ্ধমূল হয়ে আছে। এসব ফিতনা বা পরীক্ষার কোনাে একটাও যখন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আল্লাহর সাহায্যের আগমন বিলম্বিত হয়, তখন ফিতনা আরাে কঠিন ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এহেন ফিতনা ধৈর্য ধারণ করাও গণ্য হয় নিদারুণ যাতনাময় পরীক্ষারূপে। এরূপ পরিস্থিতিতে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা যাকে রক্ষা করেন সে-ই ধৈর্য ধারণ করতে ও টিকে থাকতে পারে। আর যারা ধৈর্য ধারণ করে, তারাই নিজেদের সত্ত্বায় ঈমানের মর্মার্থ বাস্তবায়িত করতে পারে এবং তাদের ওপরই অর্পিত হয়। আল্লাহর সর্ববৃহৎ আমানত বা দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা কখনােই এ সব ফিতনা দ্বারা মােমেনদের শাস্তি ও কষ্ট দিতে চান না। পরীক্ষা আর শাস্তি এক কথা নয়। আসলে এসব পরীক্ষা ও ফিতনার উদ্দেশ্য হলাে মােমেনকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করা- যাতে সে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব পালন করতে পারে। মােমেনের এ ধরনের প্রস্তুতির প্রয়ােজন রয়েছে এবং সেটা বাস্তব ময়দানে কষ্টকর অবস্থা উত্তরণের মাধ্যমে ছাড়া সম্ভব নয়। ফিতনা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া ও পরীক্ষা যাতনাময় হওয়া সত্তেও দুঃখ কষ্টে সত্যিকারভাবে ধৈর্য ধারণ করা, আল্লাহর সাহায্য বা প্রতিদানের ব্যাপারে সত্যিকার নির্ভরশীলতা ও অটুট আস্থা স্থাপন করা এবং প্রবৃত্তির কামনা বাসনা থেকে নিজেকে সংযত রাখার মাধ্যমে এ দায়িত্ব গ্রহণের যােগ্যতা অর্জন করা যায়। আগুন যেমন স্বর্ণকে গলিয়ে তা থেকে বাদ বের করে দেয়, তেমনি কঠিন পরীক্ষা মনকে গলিয়ে তা থেকে ভেজাল দূর করে দেয়। ভেজাল দূর করার পর তার সুপ্ত শক্তিগুলাে জাগিয়ে তােলে ও সংঘবদ্ধ করে। শক্তি প্রয়ােগ করে তাকে সােজা করে এবং ধুয়ে ও ঘষে মেজে পরিষ্কার করে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন, সমষ্টির ক্ষেত্রেও তেমনি। সামষ্টিকভাবে বিপদ-মসিবত ও দুঃখ-কষ্ট দ্বারা পরীক্ষা করে একটা দল বা জাতিকেও পরিশুদ্ধ করা হয়। ফলে দৃঢ়চেতা, পরিপক্ক ঈমানদার ও আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কের অধিকারী ছাড়া আর কেউ টিকে থাকতে পারে না। যারা টিকে থাকে তারা অটুট বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহর কাছ থেকে তারা দুটো উত্তম পুরস্কারের মধ্য থেকে যে কোনাে একটা অবশ্যই পাবে। দুনিয়ার বিজয় অথবা আখেরাতের সওয়াব। অবশেষে এই মযবুত ঈমানদারদের হাতেই পতাকা অর্পিত হয়। কেননা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তারা এর যােগ্যতার প্রমাণ দিয়ে থাকে। যে দায়িত্ব তারা গ্রহণ করে তা তাদের কাছে অত্যধিক মূল্যবান। কেননা এর জন্যে তারা অত্যধিক মূল্য দিয়েছে, এর জন্যে তারা অনেক ধৈর্য ধারণ করেছে, এর জন্যে তারা বহু কষ্ট সহ্য করেছে এবং অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। যে ব্যক্তি এর জন্যে নিজের রক্ত বা শরীরের কোনাে অংগ প্রত্যংগ বিসর্জন দেয় এবং নিজের সুখ-শান্তি ও প্রিয় জিনিস থেকে বঞ্চিত হয়, আর এই বঞ্চনা ও কষ্ট সহ্য করে, সে এতাে ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত এই দায়িত্বের মূল্য ও কদর বােঝে । তাই সে এই দায়িত্ব ও এই পতাকা সহজে পর্যুদস্ত হতে দেবে না। এখন প্রশ্ন এই যে, এতাে দুঃখ কষ্ট সহ্য করে, এতাে ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে সত্য ও ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখার জন্যে মােমেনরা যে সংগ্রাম সাধনা করে, তা কি শেষ পর্যন্ত বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত হবে। এর জবাব এই যে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার দ্বীনই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট। কোনাে মােমেন আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে সন্দেহ পােষণ করে না। তবে সে বিজয় এবং সাফল্য বিলম্বিতও হতে পারে। যদি বিলম্বিত হয়, তবে তার পেছনেও সুনির্দিষ্ট যুক্তি, প্রজ্ঞা ও বৃহত্তর কল্যাণের উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। সে বিলম্ব অবশ্যই মােমেনদের ও তাদের ঈমানের জন্যে কল্যাণকর। আল্লাহর সত্য দ্বীন বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত তার সম্মান ও মর্যাদা যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না, সে কথা স্বয়ং আল্লাহর চেয়ে বেশী আর কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। সুতরাং দ্বীনের বিজয়ে বিলম্বের জন্যে মােমেনদের উদ্বিগ্ন হবার কোনাে কারণ নেই। শত বিপদ মসিবত এবং যুলুম নির্যাতন ভােগ করার পরও তাদের জন্যে এই গৌরবই যথেষ্ট যে, তাদের আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের আন্দোলন করার জন্যে মনােনীত করা হয়েছে। তাদের পরীক্ষার জন্যে মনােনীত করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তাদের দ্বীনদারী অনমনীয় ও আপােষহীন। সহীহ বােখারীতে বর্ণিত হয়েছে, ‘সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হন নবীরা, তারপর তাদের উম্মতের সৎ ও নেককার ব্যক্তিরা, অতপর পর্যায়ক্রমে যারা তাদের নিকটতর তারা। মানুষকে তার দ্বীনদারী ও সততার দৃঢ়তা অনুযায়ী পরীক্ষা নেয়া হয়। তার দ্বীনদারী যদি দৃঢ় ও মযবুত হয়, তাহলে তার পরীক্ষা বেড়ে যায়।’ পক্ষান্তরে যারা মােমেনদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালায় এবং অন্যায় ও অসৎ কাজে নিয়ােজিত থাকে, তারা কখনাে আল্লাহর আযাব থেকে নিস্তার পাবে না। চাই তাদের বাতিল শক্তির দৌরাত্ম্য, প্রতাপ ও জাঁকজমক যতােই বেড়ে যাক না কেন এবং যতােই তা সফল ও বিজয়ী বলে মনে হােক না কেন। চুড়ান্ত পর্যায়ে এটাই আল্লাহর অংগীকার এবং এটাই আল্লাহর চিরাচরিত রীতি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত তারা কি আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করে? তাদের এ অভিমত খুবই নিকৃষ্ট'(আয়াত ৪) অর্থাৎ কোনাে দুরাচারীর এ কথা ভাবা উচিত নয় যে, সে আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে, আমার পাকড়াও থেকে নিস্তার পেয়ে গেছে। এ ধরনের ধ্যান-ধারণা ও মত যে ব্যক্তি পােষণ করে, সে অত্যন্ত ভ্রান্ত মূল্যায়ন করে ও খারাপ ধারণা পােষণ করে। কেননা যে আল্লাহ মােমেনদের ঈমানের দৃঢ়তা যাচাই এবং ভন্ড ও নিষ্ঠাবান মােমেনকে চিহ্নিত করার জন্যে পরীক্ষা করা চিরস্থায়ী রীতি হিসেবে চালু করেছেন, সেই আল্লাহ তায়ালাই অত্যাচারীদের শাস্তি দেয়ার চিরস্থায়ী নীতিও চালু করেছেন। এই নীতিতে কোনাে রদবদল, হেরফের ও সংশােধনের অবকাশ নেই। এটা এই সূরার প্রথমাংশের দ্বিতীয় প্রধান বক্তব্য, যা প্রথম বক্তব্যটার সমমানের। বিপদাপদ দিয়ে ঈমানের দৃঢ়তা যাচাই করা যখন চিরন্তন রীতি, তখন অত্যাচারী ও পাপাচারীদের ব্যর্থ হওয়া এবং পাকড়াও হওয়াও একটা চিরস্থায়ী বিধি, যা কার্যকর হতে বাধ্য। তৃতীয় প্রধান বক্তব্যটা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী ও তার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠকারীদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের যে আশা পােষণ করে, তা অবশ্যই সফল হবে। তাই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূরণে তাদের দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে প্রতীক্ষ্যমাণ থাকা উচিত।(আয়াত ৫) আয়াতের বর্ণনাভংগি থেকে আল্লাহর সাক্ষাত প্রত্যাশী মােমেনদের ব্যাকুলতার চিত্র ফুটে ওঠে। এই প্রত্যাশা পূরণের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে আয়াতের শেষাংশে এই বলে যে, আল্লাহ তায়ালা শ্রবণকারী ও বিজ্ঞ। তিনি মােমেনদের প্রত্যাশা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল।
চতুর্থ প্রধান বক্তব্যটা রাখা হয়েছে ঈমানের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ও সংগ্রামমুখর মােমেনদের লক্ষ্য করে। এতে বলা হয়েছে যে, মােমেনদের এই জেহাদ সংগ্রাম এবং এই ত্যাগ ও কোরবানি, সবই তাদের নিজেদেরই কল্যাণ, নিজেদেরই মর্যাদা বৃদ্ধি ও আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে পরিচালিত। নচেত আল্লাহর এ সবের কোনাে প্রয়ােজন নেই। কেননা তিনি মহাবিশ্বের যাবতীয় বস্তুর চাহিদা থেকে মুক্ত। তিনি সর্বতােভাবে অভাবশূন্য ও অমুখাপেক্ষী। (আয়াত ৬) সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যখন মােমেনদের ওপর কোনাে ফিতনা তথা পরীক্ষা ও বিপদ মসিবত চাপিয়ে দেন এবং তারা যাতে বিপদ মসিবতে ধৈর্যধারণে অভ্যস্ত হয় সে জন্যে নিজেদের প্রস্তুত ও প্রশিক্ষিত করার জন্যে সংগ্রাম সাধনা করার আদেশ দেন, তখন সেটা তাদের সংশোধন, উন্নয়ন ও পূর্ণতা সাধনের উদ্দেশ্যেই দেন। এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ নিশ্চিত করেন। জেহাদ বা সগ্রাম মােমেনের মন ও প্রবৃত্তিকে পরিশুদ্ধ করে। তার চিন্তাধারা উন্নত ও মার্জিত করে। তাকে কৃপণতা, অলসতা ও কর্মবিমুখতা থেকে মুক্ত করে, তার ভেতরে যে উৎকৃষ্টতম যােগ্যতা ও প্রতিভা রয়েছে তাকে জাগ্রত, জোরালাে ও শাণিত করে। এটা শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্য, যা মােমেনদের কোনাে দলে অন্তর্ভুক্ত হবার আগেই সে অর্জন করে। মােমনদের দলে এ অন্তর্ভুক্ত হবার পর সে সমগ্র দলের সততা ও কল্যাণমুখিতা, তার ভেতরে বিদ্যমান ন্যায় ও সত্যের স্থীতিশীলতা এবং মন্দের ওপর ভালাের প্রাধান্য দ্বারা অধিকতর প্রভাবিত, উপকৃত ও উদ্বুদ্ধ হয়। যে ব্যক্তি জেহাদ করে সে নিজের কল্যাণের জন্যেই জেহাদ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত কল্যাণের জন্যে জেহাদের একটা স্তর অতিক্রম করে, তার সেখানে মাঝপথে ক্ষান্ত হয়ে যাওয়া উচিত নয়। আংশিক জেহাদ করেই তার সুফল চাওয়া, আল্লাহর ও তাঁর দ্বীনের প্রচারে যথেষ্ট অবদান রেখেছি বলে বড়াই করা এবং আল্লাহর কাছ থেকে তার ক্ষতিপূরণ চাওয়া কোনােক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা তার জেহাদ, সংগ্রাম ও সাধনা দ্বারা আল্লাহর কোনােই লাভ হয় না। তিনি একজন দুর্বল ও অক্ষম মানুষের চেষ্টা সাধনার মুখাপেক্ষী নন। তিনি সারা বিশ্ব থেকেই চাহিদামুক্ত ও অমুখাপেক্ষী। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা যে তাকে জেহাদে নিযুক্ত করেছেন, তার ওপর যে পৃথিবীর খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন এবং আখেরাতে যে তার পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর বিশেষ অনুগ্রহ। এ কথাই বলা হয়েছে ৭ নং আয়াতে। ‘যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের সমস্ত গুনাহ আমি ক্ষমা করে দেবাে…’ সুতরাং সৎকর্মশীল মুমিনের নিশ্চিন্ত থাকা উচিত। তাদের জিহাদের সুফল, গুনাহর মার্জনা ও সৎকর্মের প্রতিদানপ্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থাকা উচিত, জেহাদের কষ্ট সহ্য করা উচিত এবং সবরকমের বিপদ-মসিবতে ধৈর্য ধারণ করা উচিত। কেননা তাদের জন্যে এক অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যত ও চমৎকার প্রতিদান নির্ধারিত রয়েছে। মােমেন যদি সারা জীবন ইনসাফ থেকে বঞ্চিতও থাকে, তথাপি তার জন্যে এই সুফলগুলাে যথেষ্ট। এরপর একটা বিশেষ ধরনের ফিতনা বা পরীক্ষার বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে, যার সম্পর্কে আমি সূরার শুরুতে আভাস দিয়ে এসেছি। এটা হলাে আত্মীয়স্বজন, পরিবার পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবজনিত পরীক্ষা। এ সংক্রান্ত সঠিক বিধি-ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ মধ্যম ও দৃঢ় ভাষায় দেয়া হয়েছে, যাতে মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতাও নেই, আবার মাত্রাতিরিক্ত নমনীয়তাও নেই।
বলা হয়েছে, ‘আমি তার পিতা মাতার প্রতি সদাচরণ করার আদেশ দিয়েছি…'(আয়াত ৮) এ কথা নিসন্দেহে সত্য যে, পিতা-মাতাই মানুষের নিকটতম ও ঘনিষ্ঠতম প্রিয়জন। তাদের জন্যে বিশেষ মর্যাদা, বিশেষ অনুগ্রহ এবং তাদের প্রতি বিশেষ কর্তব্য নির্ধারিত রয়েছে। তাদের ভালােবাসতে হবে, ভক্তি ও সম্মান করতে হবে এবং তাদের যাবতীয় মৌলিক প্রয়ােজন পূরণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটা পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, কিন্তু আল্লাহর হুকুম অমান্য করে পিতা-মাতার আনুগত্য করার অবকাশ নেই। এটাই ইসলামের অকাট্য বিধান। আল্লাহ এ কথাই আয়াতে বলেছেন, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার আদেশ দিয়েছি, কিন্তু যদি পিতা-মাতা আমার সাথে শরীক করার জন্যে তােমাকে চাপ দেয়, তাহলে তাদের আনুগত্য করাে না।’ বস্তুত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক হচ্ছে সর্বপ্রথম, সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে মযবুত সম্পর্ক। তাই পিতা-মাতা যদি মােশরেক হয়, তাহলে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে, তাদের যাবতীয় প্রয়ােজন পূরণ করতে হবে, কিন্তু তাদের আনুগত্য ও অনুকরণ করা চলবে না। এই ব্যবস্থা কেবল পার্থিব জীবনের জন্যে। এরপর সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। আয়াতের শেষাংশে এ কথা বলা হয়েছে।
এরপর ৯ নং আয়াতে মােমেনদের ও মােশরেকদের পার্থক্য বর্ণনা করা হচ্ছে, আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তাদের আমি অবশ্যই সৎলােকদের অন্তর্ভুক্ত করবাে। এভাবেই আল্লাহর প্রিয় ও অনুগত বান্দারা আখেরাতে একই দলে সংঘবদ্ধ হবে, যেমন দুনিয়ার জীবনে তারা একই দল। রক্ত, আত্মীয়তা, বংশ ও বর্ণের বন্ধন দুনিয়ার জীবনের অবসানের সাথে সাথেই ছিন্ন হয়ে যাবে। কেননা এগুলাে চূড়ান্ত বন্ধন নয়, কৃত্রিম ও ক্ষণস্থায়ী বন্ধন। আসল অটুট বন্ধনের সাথে এর কোনাে সম্পর্ক ও যােগসূত্র নেই। এ আয়াতের তাফসীর প্রসংগে তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে, এ আয়াত হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস(রা.) ও তার মাতা হামনা বিনতে আবু সুফিয়ান সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। হযরত সাদ খুবই মাতৃভক্ত ছিলেন। একদিন তার মাতা বলে বসলেন, তুমি এই যে নতুন ধর্ম বানিয়েছো, এর রহস্যটা কী? আল্লাহর কসম, তুমি তােমার সাবেক ধর্মে ফিরে না এলে আমি কিছুই খাবাে না। আমি এভাবে না খেয়ে মরে গেলে লােকে তােমাকে সারা জীবন ‘মাতৃহন্তা’ বলে ডাকতে থাকবে। সাদের মা এরপর পুরাে একদিন একরাত উপােস করে কাটালেন। তারপর সাদ তার কাছে এলেন এবং বললেন, ‘আম্মা, আপনার যদি একশােটা প্রাণ থাকতাে এবং প্রত্যেকটা প্রাণ এক এক করে বেরিয়ে যেতাে, তাহলেও আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করতাম না। এখন ইচ্ছা হলে আপনি খেতেও পারেন ইচ্ছা হলে উপােসও করতে পারেন। এরপর যখন তার মা দেখলেন ছেলের ভেতরে পরিবর্তনের আর কোনাে আশা নেই, তখন আবার খাওয়া দাওয়া শুরু করলেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন। এতে তিনি একদিকে পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার আদেশ দিলেন। অপরদিকে তারা মােশরেক হলে তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করলেন। এভাবে ঈমান বিজয়ী হলাে আত্মীয়তা ও রক্তের বন্ধনের ওপর এবং শুধু সদ্ব্যবহারই অবশিষ্ট রইলাে। মােমেন মাত্রই সব সময় এ ধরনের ফিতনার সম্মুখীন। সুতরাং আল্লাহর বিধান ও সাদের বাস্তব দৃষ্টান্ত যেন সকলের জন্যে মুক্তি ও নিরাপত্তার পথনির্দেশক হয়।
*ঈমানের পরীক্ষায় মােনাফেকদের অবস্থা : এরপর ১০ নং আয়াতে একশ্রেণীর মানুষের পরিপূর্ণ নমুনা পেশ করা হয়েছে, যারা নির্যাতন নিপীড়নের আকারে পরীক্ষার সম্মুখীন হলেই দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে আবার শান্তির সময়ে বড় বড় বুলি আওড়ায়। মাত্র কয়েকটা বাক্যে এই শ্রেণীটার সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এমন মানুষ আছে যারা মুখে বলে যে, ঈমান এনেছি… এ হচ্ছে সেই নমুনার মানুষ, যে শাস্তির সময়ে ঈমান আনার কথা ঘােষণা করে। কেননা সে মনে করে, ঈমান আনার কারণে কোনাে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা নেই। অতপর যখন আল্লাহর ওপর ঈমান আনার কারণে তাকে নির্যাতন করা হয় তখন সে মানুষের নির্যাতনকে আল্লাহর আযাবের মতাে মনে করে। তাই সে পরীক্ষার মুখােমুখি হলেই ভয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। ফলে তার কাছে নৈতিক মূল্যবােধের কোনাে গুরুত্ব থাকে না এবং তার বিবেকের কাছে আকীদা ও আদর্শের কোনাে মূল্য থাকে না। সে মনে করে যে, দুনিয়ার জীবনে আজ সে যে নির্যাতন ভােগ করছে, তার চেয়ে বড় আর কোনাে আযাব থাকতে পারে না, এমনকি আল্লাহর আযাবও নয়। সে মনে মনে বলে, ‘এ হচ্ছে এমন কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক আযাব, যার চেয়ে বড় আর কোনাে আযাব নেই। তাহলে ঈমানের খাতিরে আর কোন জিনিসটায় আমাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে? আজকে আমি যে যন্ত্রণায় ভুগছি, আল্লাহর আযাব এর চেয়ে বেশী কিছু নয়। সে মানুষের আযাব ও আল্লাহর আযাবকে একাকার করে ফেলে। অথচ মানুষ চেষ্টা করলে মানুষের তৈরী আযাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর আল্লাহর আযাবের তাে সীমা সরহদই কারাে জানা নেই। এই হলাে কঠিন পরীক্ষার মুখে দিশেহারা একশ্রেণীর মানুষের অবস্থা। ‘তােমার প্রভুর পক্ষ থেকে সাহায্য এলে তারা নিশ্চয়ই বলবে, আমরা তাে তােমাদের সাথেই ছিলাম।’ ‘আমরা তােমাদের সাথে ছিলাম’ অর্থাৎ সে দিশেহারা ও মােনাফেকী লাঞ্ছনা গঞ্জনার কঠিন মুহূর্তে এবং ভুল মূল্যায়নের সময় আমরা ছিলাম, কিন্তু যখনই সুখের দিন এলাে, অমনি লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানাে শুরু হয়ে গেলাে এবং দুর্বল পরাজিত লােকেরাও সিংহের রূপ ধারণ করে বলতে লাগলাে, আমরা তাে তােমাদের সাথেই ছিলাম। জগদ্বাসীর মনের অবস্থা সম্পর্কে কি আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে বেশী অবহিত নন।’ অর্থাৎ কাদের মনে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা আছে, আর কাদের মনে হতাশা ও কাপুরুষতা, কাদের মনে ঈমান এবং কাদের মনে মােনাফেকী, তা কি আল্লাহ তায়ালাই বেশী জ্ঞাত নন? তাহলে তারা কাকে ধোকা দিতে চাচ্ছে? ‘কারা মােমেন এবং কারা মােনাফেক তা আল্লাহ অবশ্যই জ্ঞাত হবেন।’ অর্থাৎ তিনি উভয় শ্রেণীর পরিচয় উন্মুক্ত করে দেবেন, ফলে সকলেই জানতে পারবে কারা মােমেন এবং কারা মােনাফেক। বস্তুত ফিতনা বা পরীক্ষা তথা বিপদ-মসিবত ও যুলুম-নিপীড়নের উদ্দেশ্যই হলাে মােমেন ও মােনাফেকদের ছাঁটাই-বাছাই করা। কিছুক্ষণের জন্যে আমাদের কোরআনের নিম্নোক্ত উক্তির সূক্ষ্ম ইংগিত নিয়ে ভাবা উচিত। এতে এই বিশেষ ধরনের মানব শ্রেণী কোন বিষয়টাতে ভুল করে, তা দেখিয়ে দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘মানুষের নির্যাতনকে সে আল্লাহর আযাবের মতাে মনে করে।’ অর্থাৎ তাদের ভ্রান্তি এটা নয় যে, আযাব সহ্য করার ব্যাপারে তাদের ধৈর্যশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ধরনের সাময়িক দুর্বলতা কখনাে কখনাে খাঁটি মােমেনদের মধ্যেও দেখা দিয়ে থাকে। কেননা মানুষের শক্তি সামর্থ সীমিত। আসলে তারা এ কথাটার মধ্য দিয়ে তাদের কল্পনা ও উপলব্ধির পার্থক্য স্পষ্ট করে দিচ্ছে। মানুষ মানুষের ওপর যুলুম নির্যাতন চালানাের যতােটা ক্ষমতা রাখে, তার সাথে আল্লাহর ভয়াবহ আযাবের পার্থক্য কতােখানি, সেটাই এখানে দেখানাে হচ্ছে। দুনিয়ার ক্ষুদ্র ও ক্ষণস্থায়ী জগত এবং আখেরাতের সীমাহীন ও অন্তহীন জগত তাদের অনুভূতিতে কখনাে একাকার হয়ে যায় না। এমনকি যখন মানুষের নির্যাতন তাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখনাে নয়। যুলুম নির্যাতন যতােই সহ্যের বাইরে যাক, আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই মােমেনের অনুভূতিতে বহাল থাকেন, কোনাে কিছুই তাতে বাদ সাধতে পারে না। অন্তরে ঈমান অথবা মােনাফেকীর অবস্থানে যে পার্থক্য ঘটে, তা এটুকুই। সবার শেষে তুলে ধরা হচ্ছে এক ধরনের প্রতারণা ও প্রলােভনের ফিতনাকে। আর সেই সাথে কর্মফল সম্পর্কে কাফেরদের বিকৃত ধ্যান-ধারণাও উন্মােচন করা হচ্ছে। এটা হলাে ইসলামের সেই মহান মতবাদ, যাতে ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম প্রতিফলন ঘটেছে।(আয়াত ১২-১৩) কাফেররা তাদের গােত্রীয় জীবনে গােষ্ঠীগতভাবে খুনের জরিমানা বা দিয়াত দিতে অভ্যস্ত থাকায় তাদের মধ্যে এরূপ ধারণা প্রচলিত হয়ে গিয়েছিলাে যে, আল্লাহর সাথে শিরক করলে যদি কোনাে শাস্তি ভােগ করা একান্তই অনিবার্য হয়ে পড়ে, তবে তারা সেটাও অনুরূপ গােষ্ঠীগতভাবে আর্থিক জরিমানা দিয়ে প্রতিহত করতে সক্ষম। আর এই ধারণাটাকে তারা আখেরাতের কর্মফল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করারও ধৃষ্টতা দেখায়, ‘কাফেররা মােমেনদের বলে, তােমরা আমাদের পথ অনুসরণ করাে, আমরা তোমাদের পাপের ভার বহন করবো।’ তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার কঠোর জবাব দিয়ে বলা হচ্ছে যে, সেটা তারা কখনাে পারবে না। কেননা আল্লাহর কাছে সমষ্টিগতভাবে নয় বরং প্রতিটা মানুষ ব্যক্তিগতভাবে দাঁড়াবে। তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির কাজের হিসাব নেবেন, অন্য কেউ তার হিসাব দেবে না। ‘তারা তাদের পাপের কোনাে অংশই বহন করবে না।’ তাদের এই উক্তি যে মিথ্যা ও ছলনায় পরিপূর্ণ, সে কথা জানিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা দেয়া হয়েছে, ‘তারা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।’ পরের আয়াতে বলা হচ্ছে যে, তারা অন্যের পাপের ভার বহন করা এবং অন্য কাউকে পাপ থেকে উদ্ধার করা তাে দূরের কথা, তারা স্বয়ং নিজেদের পাপের বােঝা এবং যাদের তারা বিপথগামী করে তাদেরও পাপের বােঝা বহন করবে, তারা নিজেদের পাপের বােঝা বহন করবে এবং সেই সাথে আরাে বহু পাপের বােঝা বহন করবে। অতপর কেয়ামতের দিন তাদের ছলনা প্রতারণা সম্পর্কে তাদের অবশ্যই জিজ্ঞেস করা হবে। এভাবে এই ফিতনার পথও রুদ্ধ করা হলাে। মানুষ জানতে পারলাে যে, আল্লাহ তায়ালা দলগতভাবে নয় বরং ব্যক্তিগতভাবে হিসাব নিবেন ও বিচার করবেন। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কর্মফলের কাছেই জিম্মী হয়ে থাকবে। ঈমান আনয়নকারীদের মধ্যে কারা সত্যিকার মােমেন এবং কারা কপট ও ভন্ড মােমেন, সেটা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নেয়া যে আল্লাহর চিরস্থায়ী রীতি, সে সম্পর্কে আলােচনার প্রথম পর্ব এখানে শেষ হয়েছে। বৈরী পরিবেশ, যুলুম ও নির্যাতন, প্রলােভন ও প্রতারণা- পরীক্ষার এই কটা পন্থা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(২৯-আনকাবুত) : নামকরণ:
একচল্লিশের আয়াতের অংশবিশেষ مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوتِ থেকে সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ যে সূরার মধ্যে আনকাবুত শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, এটি সে সূরা।
(২৯-আনকাবুত) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
৫৬ থেকে ৬০ আয়াতের মধ্যে যে বক্তব্য এসেছে তা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, এ সূরাটি হাবশায় হিজরতের কিছু আগে নাযিল হয়েছিল। অধিকন্তু বিষয়বস্তু গুলোর অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যও একথাই সমর্থন করে। কারণ, পশ্চাতপটে সে যুগের অবস্থার চিত্র ঝলকে উঠতে দেখা যায়। যেহেতু এর মধ্যে মুনাফিকদের আলোচনা এসেছে এবং মুনাফিকীর প্রথম দশটি আয়াত হচ্ছে মাদানী এবং বাকি সমস্ত সূরাটি মক্কী। অথচ এখানে যেসব লোকের মুনাফিকীর কথা বলা হয়েছে তারা কেবল কাফেরদের জুলুম, নির্যাতন ও কঠোর শারীরিক নিপীড়নের ভয়ে মুনাফিকী অবলম্বন করছিল। আর একথা সুস্পষ্ট, এ ধরনের মুনাফিকীর ঘটনা মক্কায় ঘটতে পারে, মদীনায় নয়। এভাবে এ সূরায় মুসলমানদেরকে হিজরত করার উপদেশ দেয়া হয়েছে, এ বিষয়টি দেখেও কোন কোন মুফাসসির একে মক্কায় নাযিলকৃত শেষ সূরা গণ্য করেছেন।। অথচ মদীনায় হিজরতের আগে মুসলমানগণ হাবশায়ও হিজরত করেছিলেন। এ ধারণাগুলো আসলে কোন হাদীসের ভিত্তিতে নয়। বরং শুধুমাত্র বিষয়বস্তুর অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। আর সমগ্র সূরার বিষয়বস্তুর ওপর সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে এ অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য মক্কার শেষ যুগের নয় বরং এমন এক যুগের অবস্থার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে যে যুগে মুসলমানদের হাবশায় হিজরত সংঘটিত হয়েছিল।
(২৯-আনকাবুত) : বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় বক্তব্যঃ
সূরাটি পড়লে মনে হবে এটি যখন নাযিল হচ্ছিল তখন মক্কায় মুসলমানরা মহা বিপদ-মুসিবতের মধ্যে অবস্থান করছিল। কাফেরদের পক্ষ থেকে পূর্ণ শক্তিতে চলছিল ইসলামের বিরোধিতা এবং মু’মিনদের ওপর চালানো হচ্ছিল কঠোর জুলুম-নিপীড়ন। এহেন অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিকে সাচ্চা ঈমানদারদের লজ্জা দেবার জন্য এ সূরাটি নাযিল করেন। এই সাথে এর মধ্যে মক্কায় কাফেরদেরকেও এ মর্মে কঠোর ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, নিজেদের জন্য এমন পরিণতি ডেকে এনো না সত্যের সাথে শত্রুতা পোষণকারীরা প্রতি যুগে যার সম্মুখীন হয়ে এসেছে।
। সে সময় কিছু কিছু যুবক যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন এ প্রসঙ্গে তারও জবাব দেয়া হয়েছে। যেমন তাদের পিতা-মাতারা তাদের ওপর মুহাম্মদ (সা.) এর দ্বীন ত্যাগ করে তাদের দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করতো। তাদের পিতা-মাতারা বলতো, যে কুরআনের প্রতি তোমরা ঈমান এনেছো তাতেও তো লেখা আছে যে, মা-বাপের হক সবচেয়ে বেশি। কাজেই আমরা যা কিছু বলছি তাই তোমরা মেনে নাও। নয়তো তোমরা নিজেদের ঈমান বিরোধী কাজে লিপ্ত হবে। ৮ আয়াতে এর জবাব দেয়া হয়েছে।
। অনুরূপভাবে কোন কোন নওমুসলিমকে তাদের গোত্রের লোকেরা বলতো, তোমরা আমাদের কথা মেনে নাও এবং ঐ ব্যক্তি থেকে আলাদা হয়ে যাও, এ জন্য আযাব-সওয়াব যাই হোক, তার দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করছি। যদি এ জন্য আল্লাহ তোমাদের পাকড়াও করেন তাহলে আমরা অগ্রবর্তী হয়ে বলে দেবোঃ জনাব, এ বেচারাদের কোন দোষ নেই। আমরাই এদেরকে ঈমান ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলাম। কাজেই আমাদের পাকড়াও করুন। এর জবাব দেয়া হয়েছে ১২-১৩ আয়াতে।
। এ সূরায় যে কাহিনীগুলো বর্ণনা করা হয়েছে সেখানেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ দিকটিই সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী নবীদেরকে দেখো, তারা কেমন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। কত দীর্ঘকাল ধরে তারা নির্যাতিত হয়েছেন। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের সাহায্য করা হয়েছে। কাজেই ভয় পেয়ো না। আল্লাহর সাহায্য নিশ্চয়ই আসবে কিন্তু পরীক্ষার একটি সময়কাল অতিবাহিত হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। মুসলমানদেরকে এ শিক্ষা দেবার সাথে সাথে মক্কার কাফেরদেরকেও এ কাহিনীগুলোতে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাকড়াও হতে দেরি হয়, তাহলে তাতে আর কোনদিন পাকড়াও হবেই না বলে মনে করে নিয়ো না। অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর চিহ্ন ও ধ্বংসাবশেষ তোমাদের সামনে রয়েছে। দেখে নাও, শেষ পর্যন্ত তাদের সর্বনাশ হয়েই গেছে এবং আল্লাহ তার নবীদেরকে সাহায্য করেছেন।
। তারপর মুসলমানদেরকে এভাবে পথনির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, জুলুম নির্যাতন যদি তোমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাহলে ঈমান পরিত্যাগ করার পরিবর্তে তোমরা ঘরবাড়ি ত্যাগ করে বের হয়ে যাও। আল্লাহর যমীন অনেক প্রশস্ত। যেখানে আল্লাহর বন্দেগী করার সুযোগ আছে সেখানে চলে যাও।
। এসব কথার সাথে সাথে কাফেরদেরকে বুঝাবার দিকটিও বাদ দেয়া হয়নি। তাওহীদ ও আখেরাত উভয় সত্যকে যুক্তিসহকারে তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। শির্ককে খণ্ডন করা হয়েছে। বিশ্ব-জাহানের নির্দশনাবলীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদেরকে জানানো হয়েছে যে, আমার নবী তোমাদের সামনে যে শিক্ষা পেশ করছেন এ নির্দশনাবলী তার সত্যতা প্রমাণ করছে।
যে অবস্থায় একথা বলা হয় তা ছিল এই যে, মক্কা মু’আযযমায় কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেই তার ওপর বিপদ আপদ ও জুলুম-নিপীড়নের পাহাড় ভেঙ্গে পড়তো। কোন গোলাম বা গরীব মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ভীষণভাবে মারপিট এবং কঠোর নির্যাতন-নিপীড়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত করা হতো। সে যদি কোন দোকানদার বা কারিগর হতো তাহলে তার রুজি-রোজগারের পথ বন্ধ করে দেয়া হতো। সে যদি কোন প্রভাবশালী পরিবারের কোন ব্যক্তি হতো, তাহলে তার নিজের পরিবারের লোকেরা তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো ও কষ্ট দিতো এবং এভাবে তার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতো। এ অবস্থা মক্কায় একটি মারাত্মক ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এ কারণে লোকেরা নবী (সা.) এর সত্যতার স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও ঈমান আনতে ভয় করতো এবং কিছু লোক ঈমান আনার ভয়াবহ শাস্তিরও সম্মুখীন হলে সাহস ও হিম্মতহারা হয়ে কাফেরদের সামনে নতজানু হয়ে যেতো। এ পরিস্থিতি যদিও দৃঢ় ঈমানের অধিকারী সাহাবীগণের অবিচল নিষ্ঠার মধ্যে কোনো প্রকার দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করেনি তবুও মানবিক প্রকৃতির তাগিদে অধিকাংশ সময় তাদের মধ্যেও একটা মারাত্মক ধরনের চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে যেতো। এ ধরনের অবস্থার একটা চিত্র পেশ করে হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত বর্ণিত একটি হাদীস। হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন বুখারী, আবু দাউদ ও নাসাঈ তাদের গ্রন্থে। তিনি বলেন, যে সময় মুশরিকদের কঠোর নির্যাতনে আমরা ভীষণ দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিলাম সে সময় একদিন আমি দেখলাম নবী (সা.) কা’বাঘরের দেয়ালের ছায়ায় বসে রয়েছেন। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করেন না? একথা শুনে তার চেহারা আবেগে-উত্তেজনায় রক্তিমবর্ণ ধারণ করলো এবং তিনি বললেন, “তোমাদের পূর্বে যেসব মু’মিন দল অতিক্রান্ত হয়েছে তারা এর চাইতেও বেশি নিগৃহীত হয়েছে। তাদের কাউকে মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে বসিয়ে দেয়া হতো এবং তারপর তার মাথার ওপর করাত চালিয়ে দু’টুকরা করে দেয়া হতো। কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সন্ধিস্থলে লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ানো হতো, যাতে তারা ঈমান প্রত্যাহার করে। আল্লাহর কসম, এ কাজ সম্পন্ন হবেই, এমনকি এক ব্যক্তি সান’আ থেকে হাদ্বারামাউত পর্যন্ত নিশঙ্ক চিত্তে সফর করবে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় তার মনে থাকবে না।”
এ চিত্তচাঞ্চল্যকে অবিচল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় রূপান্তরিত করার জন্য মহান আল্লাহ মু’মিনদেরকে বুঝান, ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য অর্জনের জন্য আমার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি রয়েছে কোন ব্যক্তি নিছক মৌখিক ঈমানের দাবীর মাধ্যমে তার অধিকারী হতে পারে না। বরং প্রত্যেক দাবীদারকে অনিবার্যভাবে পরীক্ষার চুল্লী অতিক্রম করতে হবেই। তাকে এভাবে নিজের দাবির সত্যতা পেশ করতে হবে। আমার জান্নাত এত সস্তা নয় এবং দুনিয়াতেও আমার বিশেষ অনুগ্রহ এত আয়াসলব্ধ নয় যে, তোমরা কেবলি মুখে আমার প্রতি ঈমান আনার কথা উচ্চারণ করবে আর অমনিই আমি তোমাদেরকে সেসব কিছুই দান করে দেবো। এসবের জন্য তো পরীক্ষার শর্ত রয়েছে। আমার জন্য কষ্ট বরদাশত করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হবে, বিপদ-মুসিবত ও সংকটের মুকাবিলা করতে হবে। ভীতি ও আশঙ্কা দিয়ে পরীক্ষা করা হবে এবং লোভ-লালসা দিয়েও। এমন প্রত্যেকটি জিনিস যা ভালোবাসো ও পছন্দ করো, আমার সন্তুষ্টির জন্য তাকে উৎসর্গ করতে হবে। আর এমন প্রত্যেকটি কষ্ট যা তোমাদের অনভিপ্রেত এবং তোমরা অপছন্দ করে থাকো, আমার জন্য তা অবশ্যই বরদাশত করতে হবে। তারপরেই তোমরা আমাকে মানার যে দাবী করেছিলে তার সত্য-মিথ্যা যাচাই হবে। কুরআন মজীদের এমন প্রত্যেকটি জায়গায় যেখানে বিপদ-মুসিবত ও নিগ্রহ-নিপীড়নের সর্বব্যাপী আক্রমণে মুসলমানদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের অবস্থা হয়ে গেছে সেখানেই একথা বলা হয়েছে। হিজরাতের পরে মদিনায় মুসলমানদের জীবনের প্রথমাবস্থায় যখন অর্থনৈতিক সংকট, বাইরের বিপদ এবং ইহুদী ও মুনাফিকদের ভিতরের দুষ্কৃতি মু’মিনদেরকে ভীষণভাবে পেরেশান করে রেখেছিল তখন আল্লাহ বলেনঃ
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ
“তোমরা কি মনে করেছো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনো তোমরা সে অবস্থার সম্মুখীন হওনি, যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী (ঈমানদার) গণ? তারা সম্মুখীন হয়েছিল নির্মমতা ও দুঃখ-ক্লেশের এবং তাদেরকে অস্থির করে তোলা হয়েছিল। এমনকি রসূল ও তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? (তখনই তাদেরকে সুখবর দেয়া হয়েছিল (এই মর্মে যে) জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (আল বাকারাহঃ ২১৪)
অনুরূপভাবে ওহোদ যুদ্ধের পর যখন মুসলমানদের ওপর আবার বিপদ-মুসিবতের একটি দুর্যোগপূর্ণ যুগের অবতারণা হয় তখন বলা হয়ঃ
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ
“তোমরা কি মনে করে নিয়েছো, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি যে, তোমাদের মধ্য থেকে কে জিহাদে প্রাণ উৎসর্গকারী এবং কে সবরকারী? ” (আল ইমরানঃ ১৪২)
প্রায় একই বক্তব্য সূরা আলে ইমরানের ১৭৯ , সূরা তাওবার ১৬ এবং সূরা মুহাম্মাদের ৩১ আয়াতে বলা হয়েছে। এসব বক্তব্যের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুসলমানদের মনে এ সত্যটি গেঁথে দিয়েছেন যে, পরীক্ষাই হচ্ছে এমন একটি মানদণ্ড যার মাধ্যমে ভেজাল ও নির্ভেজাল যাচাই করা যায়। ভেজাল নিজে নিজেই আল্লাহর পথ থেকে সরে যায় এবং নির্ভেজালকে বাছাই করে নিয়ে নেয়া হয়। এভাবে সে আল্লাহর এমনসব পুরস্কার লাভের যোগ্য হয়, যেগুলো কেবলমাত্র সাচ্চা ঈমানদারদের জন্য নির্ধারিত।
# তোমাদের সাথে যা কিছু হচ্ছে, তা কোন নতুন ব্যাপার নয়। ইতিহাসে হরহামেশা এমনটিই হয়ে এসেছে। যে ব্যক্তিই ঈমানের দাবী করেছে তাকে অবশ্যই পরীক্ষার অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে দগ্ধ করা হয়েছে। আর অন্যদেরকেও যখন পরীক্ষা না করে কিছু দেয়া হয়নি তখন তোমাদের এমন কি বিশেষত্ব আছে যে, কেবলমাত্র মৌখিক দাবীর ভিত্তিতেই তোমাদেরকে দেয়া হবে?
# মূল শব্দ হচ্ছে فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ এর শাব্দিক অনুবাদ হবে, “আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন” একথায় কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আল্লাহ তো সত্যবাদীর সত্যবাদিতা এবং মিথ্যুকের মিথ্যাচার ভালোই জানেন, পরীক্ষা করে আবার তা জানার প্রয়োজন কেন? এর জবাব হচ্ছে, যতক্ষণ এক ব্যক্তির মধ্যে কোন জিনিসের কেবলমাত্র যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাই থাকে, কার্যত তার প্রকাশ হয় না ততক্ষণ ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দৃষ্টিতে সে কোন পুরস্কার বা শাস্তির অধিকারী হতে পারে না। যেমন এক ব্যক্তির মধ্যে আমানতদার হবার যোগ্যতা আছে এবং অন্যজনের মধ্যে যোগ্যতা আছে আত্মসাৎ করার। এরা দু’জন যতক্ষণ না পরীক্ষার সম্মুখীন হয় এবং একজনের থেকে আমানতদারী এবং অন্যজনের থেকে আত্মসাতের কার্যত প্রকাশ না ঘটে ততক্ষণ নিছক নিজের অদৃশ্য জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ একজনকে আমানতদারীর পুরস্কার দিয়ে দেবেন এবং অন্যজনকে আত্মসাতের শাস্তি দিয়ে দেবেন, এটা তার ইনসাফের বিরোধী। তাই মানুষের ভালো কাজ ও মন্দ কাজ করার আগে তাদের কর্মযোগ্যতা ও ভবিষ্যত কর্মনীতি সম্পর্কে আল্লাহর যে পূর্ব জ্ঞান আছে তা ইনসাফের দাবী পূরণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। অমুক ব্যক্তির মধ্যে চুরির প্রবণতা আছে, সে চুরি করবে অথবা করতে যাচ্ছে, এ ধরনের জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ বিচার করেন না। বরং সে চুরি করেছে-এ জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি বিচার করেন। এভাবে অমুক ব্যক্তি উন্নত পর্যায়ের মু’মিন ও মুজাহিদ হতে পারে অথবা হবে এ জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ তার ওপর অনুগ্রহ ও নিয়ামত বর্ষণ করেন না বরং অমুক ব্যক্তির নিজের কাজের মাধ্যমে তার সাচ্চা ঈমানদার হবার কথা প্রমাণ করে দিয়েছে এবং আল্লাহর পথে জীবন সংগ্রাম করে দেখিয়ে দিয়েছে-এরি ভিত্তিতে বর্ষণ করেন। তাই আমি এ আয়াতের অনুবাদ করেছি “আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন।”
# যদিও আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত সকলের উদ্দেশ্যে এখানে বলা হতে পারে তবুও বিশেষভাবে এখানে বক্তব্যেও লক্ষ হচ্ছে, কুরাইশদের সেই জালেম নেতৃবর্গ যারা ইসলামের বিরোধিতায় নেমে ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর নিগ্রহ চালাবার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ছিল, যেমন ওলীদ ইবনে মুগীরাহ, আবু জেহেল, উতবাহ, শাইবাহ, উকবাহ ইবনে আবু মু’আইত, হানযালা ইবনে ওয়াইল এবং আরো অনেকে। এখানে পূর্বাপর বক্তব্যেও স্বতস্ফূর্ত দাবী এই যে, পরীক্ষা তথা বিপদ-মুসিবত ও জুলুম-নিপীড়নের মুকাবিলায় মুসলমানদেরকে সবর ও দৃঢ়তা অবলম্বন করার নির্দেশ দেবার পর এ সত্যপন্থীদের ওপর যারা জুলুম-নিপীড়ন চালাচ্ছিল তাদেরকে সম্বোধন করে ভীতি ও হুমকিমূলক কিছু কথাও বলা হোক।
# এ অর্থও হতে পারে, “আমার পাকড়াও এড়িয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে পারবে।” মূল শব্দ হচ্ছে يَسْبِقُونَا অর্থাৎ আমার থেকে এগিয়ে যাবে। এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, যা কিছু আমি করতে চাই (অর্থাৎ আমার রসূলদের মিশনের সাফল্য) তা করতে আমার সফল না হওয়া এবং যা কিছু তারা করতে চায় (অর্থাৎ আমার রসূলকে হেয় প্রতিপন্ন করা) তা করতে সফল হওয়া। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তাদের বাড়াবাড়ির জন্য আমি তাদেরকে পাকড়াও করতে চাই এবং তারা পালিয়ে আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
# যে ব্যক্তি পরকালীন জীবনে বিশ্বাসই করে না এবং মনে করে, কারো সামনে নিজের কাজের জবাবদিতি করতে হবে না এবং এমন কোন সময় আসবে না যখন নিজের জীবনের যাবতীয় কাজের কোন হিসেব-নিকেশ দিতে হবে, তার কথা আলাদা। সে নিজের গাফলতির মধ্যে পড়ে থাকুক এবং নিশ্চিন্তে যা করতে চায় করে যাক। নিজের আন্দাজ-অনুমানের বিপরীত নিজের পরিণাম সে নিজেই দেখে নেবে। কিন্তু যারা আশা রাখে, এক সময় তাদেরকে তাদের মা’বুদের সামনে হাজির হতে হবে এবং নিজের কর্ম অনুযায়ী পুরস্কারও শাস্তি পেতে হবে, তাদের তো মনে করা উচিত, সে সময় অতি নিকটেই এসে গেছে এবং কাজের অবকাশ খতম হবারই পথে। তাই নিজের শুভ পরিণামের জন্য তারা যা কিছু করতে চায় করে ফেলুক। দীর্ঘ জীবন-কালের ভিত্তিহীন নির্ভরতার ওপর ভরসা করে নিজের সংশোধনে বিলম্ব করা উচিত নয়।
# তাদের এ ভুল ধারণাও পোষণ করা উচিত নয় যে, এমন কোন বাদশাহর সাথে তাদের ব্যাপার জড়িত, যিনি বিভিন্ন ব্যাপারের কোন খোঁজ খবর রাখেন না। যে আল্লাহর সামনে তাদের জবাবদিহি করার জন্য হাজির হতে হবে তিনি বেখবর নন বরং সবকিছু শোনেন ও জানেন। তার কাছে তাদের কোন কথা গোপন নেই।
# “মুজাহাদা” শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে, কোন বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, প্রচেষ্টা ও সাধনা করা। আর যখন কোন বিশেষ বিরোধী শক্তি চিহ্নিত করা হয় না বরং সাধারণভাবে “মুজাহাদা” শব্দ ব্যবহার করা হয়, তখন এর অর্থ হয় একটি সর্বাত্মক ও সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব-সংঘাত। মু’মিনকে এ দুনিয়ায় যে দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম করতে হয় তা হচ্ছে এ ধরনের। তাকে শয়তানের সাথেও লড়াই করতে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ সৎকাজের ক্ষতির ভয় দেখায় এবং অসৎকাজের লাভ ও স্বাদ উপভোগের লোভ দেখিয়ে বেড়ায়। তাকে নিজের নফসের বা কুপ্রবৃত্তির সাথেও লড়তে হয়, যে তাকে সর্বক্ষণ নিজের খারাপ ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার দাসে পরিণত করে রাখার জন্য জোর দিতে থাকে। নিজের গৃহ থেকে নিয়ে বিশ্ব-সংসারের এমন সকল মানুষের সাথে তাকে লড়তে হয় যাদের আদর্শ, মতবাদ, মানসিক প্রবণতা, চারিত্রিক নীতি, রসম-রেওয়াজ, সাংস্কৃতিক ধারা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিধান সত্য দ্বীনের সাথে সংঘর্ষশীল। তাকে এমন রাষ্ট্রের সাথেও লড়তে হয় যে আল্লাহর আনুগত্যমুক্ত থেকে নিজের ফরমান জারী করে এবং সততার পরিবর্তে অসততাকে বিকশিত করার জন্য শক্তি নিয়োগ করে। এ প্রচেষ্টা-সংগ্রাম এক-দু’দিনের নয়, সারাজীবনের। দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি মুহূর্তের। কোন একটি ময়দানে নয় বরং জীবনের প্রত্যেকটি ময়দানের ও প্রতিটি দিকে। এ সম্পর্কেই হযরত হাসান বাসরী (র) বলেনঃ
ان الرجل ليجاهدو ماضرب يوما من الدهر بسيف
“মানুষ যুদ্ধ করে চলে, যদিও কখনো একবারও তাকে তলোয়ার চালাতে হয় না।”
# আল্লাহ এ জন্য তোমাদের কাছে এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের দাবী করছেন না যে, নিজের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার ও প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন এবং তোমাদের এ যুদ্ধ ছাড়া তার ইলাহী শাসন চলবে না, বরং এটিই তোমাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথ, তাই তিনি তোমাদের এ দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে লিপ্ত হবার নির্দেশ দিচ্ছেন। এ পথেই তোমরা দুষ্কৃতি ও ভ্রষ্টতার ঘূর্ণাবর্ত থেকে বের হয়ে সৎকর্মশীলতা ও সত্যতার পথে চলতে পারবে। এ পথে অগ্রসর হয়ে তোমরা এমন শক্তির অধিকারী হতে পারো যার ফলে দুনিয়ায় তোমরা কল্যাণ ও সুকৃতির ধারক এবং পরকালে আল্লাহর জান্নাতের অধিকারী হবে। এ সংগ্রাম ও যুদ্ধ চালিয়ে তোমরা আল্লাহর কোন উপকার করবে না বরং তোমরা নিজেরাই উপকৃত হবে।
# ঈমান অর্থ এমন সব জিনিসকে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া, যেগুলো মেনে নেবার জন্য আল্লাহ, তার রসূল ও তার কিতাব দাওয়াত দিয়েছে। আর সৎকাজ হচ্ছে, আল্লাহ ও তার রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা। মানুষের চিন্তাধারা, ধারণা-কল্পনা ও ইচ্ছার পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতাই হচ্ছে মন ও মস্তিষ্কেও সৎকাজ। খারাপ কথা না বলা এবং হক-ইনসাফ ও সত্য-সততা অনুযায়ী সব কথা বলাই হচ্ছে কণ্ঠের সৎকাজ। আর মানুষের সমগ্র জীবন আল্লাহর আনুগত্য ও বন্দেগীর মধ্যে এবং তার বিধানসমূহ মেনে চলে অতিবাহিত করাই হচ্ছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ইন্দ্রিয়ের সৎকাজ। এ ঈমান ও সৎকাজের দু’টি ফল বর্ণনা করা হয়েছে।
একঃ মানুষের দুষ্কৃতি ও পাপগুলো তার থেকে দূর করে দেয়া হবে।
দুইঃ তার সর্বোত্তম কাজসমূহের সর্বোত্তম পুরস্কার তাকে দেয়া হবে। পাপ ও দুষ্কৃতির কয়েকটি অর্থ হয়। একটি অর্থ হচ্ছে ঈমান আনার আগে মানুষ যতই পাপ করে থাকুক না কেন ঈমান আনার সাথে সাথেই তা সব মাফ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, ঈমান আনার পর মানুষ বিদ্রোহ প্রবণতা সহকারে নয় বরং মানবিক দুর্বলতা বশত যেসব ভুল-ত্রুটি করে থাকে, তার সৎকাজের প্রতি নজর রেখে সেগুলো উপেক্ষা করা হবে। তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, ঈমান ও সৎকর্মশীলতার জীবন অবলম্বন করার কারণে আপনা-আপনিই মানুষের নফসের সংশোধন হয়ে যাবে এবং তার অনেকগুলো দুর্বলতা দূর হয়ে যাবে। ঈমান ও সৎকাজের প্রতিদান সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছেঃ
لَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ
এর দু’টি অর্থ হয়। একটি হচ্ছেঃ মানুষের সৎকাজগুলোর মধ্যে যেটি হবে সবচেয়ে ভালো সৎকাজ, তাকে সামনে রেখে তার জন্য প্রতিদান ও পুরস্কার নির্ধারণ করা হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মানুষ তার কার্যাবলীর দৃষ্টিতে যতটা পুরস্কারের অধিকারী হবে তার চেয়ে বেশি ভালো পুরস্কার তাকে দেয়া হবে। একথাটি কুরআনের অন্যান্য স্থানেও বলা হয়েছেঃ
مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا
“যে ব্যক্তি সৎকাজ নিয়ে আসবে তাকে তার থেকে দশগুণ বেশি দেয়া হবে।” (আনআমঃ১৬০ আয়াত)
সূরা আল কাসাসে বলা হয়েছেঃ
مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِنْهَا
“যে ব্যক্তি সৎকাজ নিয়ে আসবে তাকে তার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দেয়া হবে।”
সূরা নিসায় বলা হয়েছেঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِنْ تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا
আল্লাহ তো কণামাত্র ও জুলুম করেন না এবং সৎকাজ হলে তাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন।”
# এ আয়াতটি সম্পর্কে মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ, আবু দাউদ ও নাসাঈর বর্ণনা হচ্ছে, এটি হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াককাস এর ব্যাপারে নাযিল হয়। তার বয়স যখন আঠারো উনিশ বছর তখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তার মা হামনা বিনতে সুফিয়ান (আবু সুফিয়ানের ভাইঝি) যখন জানতে পারে যে. তার ছেলে মুসলমান হয়ে গেছে তখন সে বলে, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদকে অস্বীকার করবে ততক্ষণ আমি কিছুই পানাহার করবো না এবং ছায়াতেও বসবো না। মায়ের হক আদায় করা তো আল্লাহর হুকুম। কাজেই তুমি আমার কথা না মানলে আল্লাহরও নাফরমানী করবে। একথায় হযরত সা’দ অত্যন্ত পেরেশান হয়ে পড়েন। তিনি রসূলুল্লাহ ﷺ এর দরবারে হাজির হয়ে নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন। এ ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয়। মক্কা মুআযযামার প্রথম যুগে যেসব যুবক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন হতে পারে তারাও একই ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাই সূরা লুকমানেও পূর্ণ শক্তিতে এ বক্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
আলোচ্য সূরার ১৫ আয়াতের বলা হয়েছে, সৃষ্ট জীবের মধ্যে মানুষের মধ্যে মানুষের ওপর মা-বাপের হক হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই মা-বাপই যদি মানুষকে শিরক করতে বাধ্য করে তাহলে তাদের কথা মেনে নেয়া উচিত নয়। কাজেই এক্ষেত্রে অন্য কারো কথায় মানুষের এ ধরনের শিরক করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তারপর শব্দগুলি হচ্ছেঃ وَإِنْ جَاهَدَاكَ অর্থাৎ যদি তারা দু’জন তোমাকে বাধ্য করার জন্য তাদের পূর্ণশক্তি নিয়োগ করে। এ থেকে জানা গেল, কম পর্যায়ের চাপ প্রয়োগ বা বাপ-মায়ের মধ্য থেকে কোন একজনের চাপ প্রয়োগ আরো সহজে প্রত্যাখ্যান করার যোগ্য। এই সঙ্গে مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ “যাকে তুমি আমার শরীক হিসেবে জানো না” বাক্যাংশটিও অনুধাবনযোগ্য। এর মধ্যে তাদের কথা না মানার সপক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি প্রদান করা হয়েছে। অবশ্যই এটা পিতা-মাতার অধিকার যে, ছেলেমেয়েরা তাদের সেবা করবে, তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে এবং বৈধ বিষয়ে তাদের কথা মেনে চলবে। কিন্তু তাদেরকে এ অধিকার দেয়া হয়নি যে, মানুষ নিজের জ্ঞানের বিরুদ্ধে তাদের অন্ধ অনুসরণ করবে। শুধমাত্র বাপ-মায়ের ধর্ম বলেই তাদের ছেলে বা মেয়ের সেই ধর্ম মেনে চলার কোন কারণ নেই। সন্তান যদি এ জ্ঞান লাভ করে যে, তার বাপ-মায়ের ধর্ম ভুল ও মিথ্যা তাহলে তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করে তার সঠিক ধর্ম গ্রহণ করা উচিত এবং তাদের চাপ প্রয়োগের পরও যে পথের ভ্রান্তি তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে সে পথ অবলম্বন করা তার উচিত নয়। বাপ-মায়ের সাথে যখন এ ধরনের ব্যবহার করতে হবে তখন দুনিয়ার প্রত্যেক ব্যক্তির সাথেও এ ব্যবহার করা উচিত। যতক্ষণ নাকোন ব্যক্তির সত্য পথে থাকা সম্পর্কে জানা যাবে ততক্ষণ তার অনুসরণ করা বৈধ নয়।
# এ দুনিয়ার আত্মীয়তা এবং আত্মীয়দের অধিকার কেবলমাত্র এ দুনিয়ার সীমা-ত্রিসীমা পর্যন্তই বিস্তৃত। সবশেষে পিতা-মাতা ও সন্তান সবাইকে তাদের স্রষ্টার কাছে ফিরে যেতে হবে। সেখানে তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহি হবে তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বেও ভিত্তিতে। যদি পিতা-মাতা সন্তানকে পথভ্রষ্ট করে থাকে তাহলে তারা পাকড়াও হবে। যদি সন্তান পিতা-মাতার জন্য পথ ভ্রষ্টতা গ্রহণ করে থাকে তাহলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। আর সন্তান যদি সঠিক পথ অবলম্বন করে থাকে এবং পিতা-মাতার বৈধ অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রেও কোনো প্রকার ত্রুটি না করে থাকে কিন্তু পিতা-মাতা কেবলমাত্র পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী না হবার কারণে তাকে নির্যাতন করে থাকে, তাহলে তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে না।
# যদিও বক্তা এক ব্যক্তি মাত্র কিন্তু সে “আমি ঈমান এনেছি” বলার পরিবর্তে বলছে, “আমরা ঈমান এনেছি।” ইমাম রাযী এর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম অর্থেও প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেন, মুনাফিক সবসময় নিজেকে মু’মিনদের মধ্যে শামিল করার চেষ্টা করে থাকে এবং নিজের ঈমানের উল্লেখ এমনভাবে করে থাকে যাতে মনে হয় সেও ঠিক অন্যদের মতই মু’মিন। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেমন কোন কাপুরুষ যদি কোন সেনাদলের সাথে গিয়ে থাকে এবং সেনাদলের অসম সাহসী সৈনিকেরা লড়াই করে শত্রুদলকে বিতাড়িত করে দিয়ে থাকে তাহলে কাপুরুষটি নিজে কোনো কাজে অংশ গ্রহণ না করে থাকলেও সে এসে লোকদেরকে বলবে, আমরা গিয়েছি, আমরা ভীষণ যুদ্ধ করেছি এবং শত্রুকে পরাস্ত করেছি। অর্থাৎ সেও যেন সেই অমিত সাহসী যোদ্ধাদের সাথে মিলে যুদ্ধ করেছিল।
# আল্লাহর আযাবের ভয়ে যেমন কুফরী ও গোনাহ থেকে বিরত থাকা উচিত এ ব্যক্তি ঠিক তেমনি বান্দা প্রদত্ত নির্যাতন-নিগ্রহের ভয়ে ঈমান ও সৎকাজ থেকে বিরত হয়েছে। ঈমান আনার পর যখন সে কাফেরদের হুমকি, মারধর ও কারা নির্যাতনের সম্মুখীন হয় তখন সে মনে করে মরে যাবার পর কুফরীর অপরাধে যে জাহান্নামের আযাব ভোগ করতে হবে আল্লাহর সেই জাহান্নামের আযাব কিছুটা এ ধরনেরই হবে। তাই সে সিদ্ধান্ত করে, সে আযাব তো পরে ভোগ করবো কিন্তু এখন নগদ আযাব যা পাচ্ছি তার হাত থেকে নিস্তার লাভ করার জন্য আমাকে ঈমান ত্যাগ করে কুফরীর মধ্যে চলে যাওয়া উচিত। এভাবে দুনিয়ার জীবনটাতো নিশ্চিন্তে আরামের মধ্য দিয়ে কেটে যাবে।
# আজ সে নিজেকে বাঁচাবার জন্য কাফেরদের সাথে যোগ দিয়েছে এবং মু’মিনদের পক্ষ ত্যাগ করেছে। কারণ সত্য দ্বীনের সম্প্রসারণের জন্য নিজের গায়ে আঁচড়টি লাগাতেও প্রস্তুত নয় কিন্তু যখন এ দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদেরকে আল্লাহ সাফল্য ও বিজয়-দান করবেন তখন এ ব্যক্তি বিজয়ের ফল ভাগ করে নেবার জন্য এসে যাবে এবং মুসলমানদের বলবে, আমি তো মনে প্রাণে তোমাদেরই সাথে ছিলাম, তোমাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করেছিলাম এবং তোমাদের প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও কুরবানীকে আমি বিরাট মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেছি। এ প্রসঙ্গে আরো এতটুকু কথা জেনে রাখতে হবে যে, অসহনীয় নিপীড়ন, ক্ষতি বা মারাত্মক ভীতিজনক অবস্থায়কোন ব্যক্তির কুফরী কথা বলে নিজেকে রক্ষা করা শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েয। তবে এ জন্য শর্ত হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আন্তরিকতা সহকারে ঈমানের ওপর অবিচল থাকতে হবে। কিন্তু যে আন্তরিকতা সম্পন্ন মুসলমানটি অক্ষম অবস্থায় প্রাণ বাঁচাবার জন্য কুফরীর প্রকাশ করে এবং যে সুবিধাবাদী লোকটি আদর্শ ও মতবাদ হিসেবে ইসলামকে সত্য জানে এবং সে হিসেবে তাকে মানে কিন্তু ঈমানী জীবনধারার বিপদ ও বিঘ্ন-বিপত্তি দেখে কাফেরদের সাথে হাত মিলায় তাদের দু’জনের মধ্যে ফারাকটি অনেক বড়। আপাত দৃষ্টিতে তাদের দু’জনের অবস্থা পরস্পর থেকে কিছু বেশি ভিন্ন মনে হবে না কিন্তু আসলে যে জিনিসটি তাদের মধ্যে আকাশ পাতালের ব্যবধান সৃষ্টি করে সেটি হচ্ছে এই যে, বাধ্য হয়ে কুফরীর প্রকাশকারী আন্তরিকতা সম্পন্ন মুসলমানটি কেবলমাত্র আকীদার দিক দিয়ে ইসলামের ভক্ত থাকে না বরং কার্যতও তার আন্তরিক সহানুভূতি ইসলাম ও মুসলমানদের সাথেই থাকে। তাদের সাফল্যে সে খুশিহয় এবং তাদের ব্যর্থতা তাকে অস্থির করে তোলে। অক্ষম অবস্থায়ও সে মুসলমানদের সাহায্য করার কয়েকটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তার ওপর ইসলামের শত্রুদের বাঁধন যখনই ঢিলে হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গেই সে মুসলমানদের সাথে যোগ দেয়, এ সুযোগের অপেক্ষাই সে থাকে। পক্ষান্তরে সুযোগ সন্ধানী লোক যখনই দেখে ইসলামের পথ কঠিন হয়ে গেছে এবং খুব ভালভাবে মাপজোক করে দেখে নেয়, ইসলামের সহযোগী হবার ক্ষতি কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করার লাভের চেয়ে বেশি তখনই সে নিছক নিরাপত্তা ও লাভের খাতিরে ইসলাম ও মুসলমানদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষে তাদের জন্য এমন কোনো কাজ করতে সে পিছপা ও হয় না যা ইসলামের মারাত্মক বিরোধী এবং মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু এই সাথে হয়তো কোন সময় ইসলামের বিজয় সাধিত হতে পারে, এ সম্ভাবনার দিক থেকেও সে একেবারে চোখ বন্ধ করে রাখে না। তাই যখনই মুসলমানদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় তখনই সে তাদের আদর্শকে সত্য বলে মেনে নেবার, তাদের সামনে নিজের ঈমানের অঙ্গীকার করে এবং সত্যেও পথে ত্যাগ ও কুরবানীর জন্য তাদেরকে বাহবা দেবার ব্যাপারে একটুও কার্পণ্য করেন না। এ মৌখিক স্বীকৃতিকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে প্রয়োজনের সময় সে তাকে কাজে লাগাতে চায়। কুরআন মাজীদে অন্য এক জায়গায় মুনাফিকদের এ বেনিয়া মানসিকতাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
الَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِنْ كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِنَ اللَّهِ قَالُوا أَلَمْ نَكُنْ مَعَكُمْ وَإِنْ كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُوا أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُمْ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
“এরা হচ্ছে এমন সব লোক যারা তোমাদের ব্যাপারে অপেক্ষা করছে (অর্থাৎ দেখছে, অবস্থা কোনদিকে মোড় নেয়)। যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের বিজয় হয়, তাহলে এসে বলবে, আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? আর যদি কাফেরদের পাল্লা ভারী থাকে, তাহলে তাদেরকে বলবে, আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলাম না এবং এরপরও তোমাদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে বাঁচাইনি? (আন নিসাঃ১৪১)
# মু’মিনদের ঈমান ও মুনাফিকদের মুনাফিকির অবস্থা যাতে উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং যার মধ্যে যা কিছু লুকিয়ে আছে সব সামনে এসে যায় সেজন্য আল্লাহ বারবার পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। একথাটিই সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছেঃ
مَا كَانَ اللَّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ حَتَّى يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ
“আল্লাহ মু’মিনদেরকে কখনো এমন অবস্থায় থাকতে দেবেন না, যে অবস্থায় এখন তোমরা আছো (অর্থাৎ সাচ্চা ঈমানদার ও মুনাফিক সবাই মিশ্রিত হয়ে আছো।) তিনি পবিত্র লোকদেরকে অপবিত্র লোকদের থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করে দেবেন।”(আয়াতঃ১৭৯)
# তাদের এ উক্তির অর্থ ছিল, প্রথমত মৃত্যু পরবর্তী জীবন, হাশর-নশর, হিসেব ও শাস্তি-পুরস্কারের এসব কথা একদম বাজে ও উদ্ভট। কিন্তু ধরে নেয়া যাক যদি পরকালের কোন জীবন এবং সেখানে জবাবদিহির কোন বিষয় থেকেই থাকে, তাহলে তার তার দায়ভার আমরা গ্রহণ করছি। আল্লাহর সামনে সমস্ত শাস্তি ও পুরস্কারের বোঝা আমরা মাথা পেতে নেবো। আমাদের কথায় তোমরা এ নতুন ধর্ম পরিত্যাগ করো এবং নিজেদের পিতৃ পুরুষের ধর্মের দিকে ফিরে এসো। হাদীসে বিভিন্ন কুরাইশ সরদার সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রথমদিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের সাক্ষাত করে এ সরদাররা এমনি ধরনের কথা বলতো। তাই হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন তিনি ঈমান আনেন, আবু সুফিয়ান ও হারব ইবনে উমাইয়াহ ইবনে খালফও তার সাথে সাক্ষাত করে একথাই বলেছিল।
# প্রথমত এটা সম্ভব নয়।কোন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে অন্যের দায়-দায়িত্ব নিজের ওপর নিতে পারে না এবং কারো বলার কারণে গোনাহকারী নিজের গোনাহের শাস্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। কারণ সেখানে তো প্রত্যেক তার নিজের কৃতকর্মের জন্য দায়ী।لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى (কোন বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না)। কিন্তু ধরে নেয়া যাক যদি এমনটি হয়ও, তাহলে যে সময় কুফরী ও শিরকের পরিণতি একটি প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামের আকারে সামনে এসে যাবে তখন কার এত বড় বুকের পাটা হবে যে, সে দুনিয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসে বলবে, জনাব! আমার কথায় যে ব্যক্তি ঈমান ত্যাগ করে মুরতাদ হয়েছিল আপনি তাকে মাফ করে জান্নাতে পাঠিয়ে দিন এবং আমি জাহান্নামের নিজের কুফরীর সাথে সাথে তার কুফরীর শাস্তিও ভোগ করতে প্রস্তুত আছি।
# আল্লাহর সামনে যদিও তারা নিজেদের বোঝার সাথে অন্যের বোঝা বইবে না কিন্তু দ্বিগুণ বোঝা উঠানোর হাত থেকে নিষ্কৃতিও পাবে না। তাদের ওপর চাপবে তাদের নিজেদের গোমরাহ হবার একটি বোঝা। আর দ্বিতীয় একটি বোঝাও তাদের ওপর চাপানো হবে অন্যদের গোমরাহ করার। একথাটিকে এভাবে বলা যায়, এক ব্যক্তি নিজেও চুরি করে এবং অন্য ব্যক্তিকেও তার সাথে এ কাজে অংশ নিতে বলে। এখন যদি এ দ্বিতীয় ব্যক্তি তার কথায় চুরি করায় অংশ নেয়, তাহলে অন্যের কথায় অপরাধ করেছে বলে কোন আদালত তাকে ক্ষমা করে দেবে না। চুরির শাস্তি অবশ্যই সে পাবে। ন্যায় বিচারের কোন নীতি অনুযায়ী তাকে রেহাই দিয়ে তার পরিবর্তে এ শাস্তি সেই প্রথম চোরটি যে তাকে ধোঁকা দিয়ে চৌর্যবৃত্তিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তাকে দেয়া কোনক্রমেই ঠিক হবে না। কিন্তু সেই প্রথম চোরটি তার নিজের অপরাধের সাথে সাথে অন্যজনকে চোরে পরিণত করার অপরাধের শাস্তিও পাবে। কুরআন মাজীদের অন্য এক জায়গায় এ নিয়মটিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
لِيَحْمِلُوا أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِينَ يُضِلُّونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ
“যাতে কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের বোঝাও পুরোপুরি বহন করে এবং এমনসব লোকদের বোঝার একটি অংশও বহন করে যাদেরকে তারা জ্ঞান ছাড়াই গোমরাহ করে।” (আন নাহলঃ ২৫)
আর এ নিয়মটি নবী (সা.) নিম্নোক্ত হাদীসটিতে বর্ণনা করেছেনঃ
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا
“যে ব্যক্তি সঠিক পথের দিকে আহ্বান জানায় সে তাদের সমান প্রতিদান পাবে যারা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করে, এ জন্য তাদের প্রাপ্য কোন কমতি করা হবে না। আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর দিকে আহ্বান জানায় সে তাদের সবার সমান গোনাহের ভাগী হবে যারা তার অনুসরণ করে এবং এ জন্য তাদের গোনাহের মধ্যে কোন কমতি করা হবে না।” (মুসলিম)
# মিথ্যাচার মানে এমনসব মিথ্যা কথা যা কাফেরদের নিম্নোক্ত উক্তির মধ্যে লুকিয়ে ছিলঃ “তোমরা আমাদের অনুসরণ করো এবং তোমাদের গোনাহখাতাগুলো আমরা নিজেদের ওপর চাপিয়ে নেবো।” আসলে দু’টি বানোয়াট চিন্তার ভিত্তিতে তারা একথা বলতো। একটি হচ্ছে, তারা যে শিরকীয় ধর্মের অনুসরণ করে চলছে তা সত্য এবং মুহাম্মাদ(সা.) এর তাওহীদি ধর্ম মিথ্যা। আর দ্বিতীয় বানোয়াট চিন্তা হচ্ছে, কোন কিয়ামত টিয়ামত হবে না এবং পরকালের জীবনের এ ধ্যান-ধারণা যার কারণে একজন মুসলমান কুফরী করতে ভয় পায়, এটা একেবারেই অর্থহীন ও ভিত্তিহীন। এ বানোয়াট চিন্তা নিজেদের মনে পোষণ করার পর তারা একজন মুসলমানকে বলতো, ঠিক আছে, তোমাদের মতে কুফরী করা যদি গোনাহই হয় এবং কোন কিয়ামতও যদি অনুষ্ঠিত হবার থাকে যেখানে এ গোনাহের কারণে তোমাদের জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে, তাহলে আমরা তোমাদের এ গোনাহ নিজেদের মাথায় নিয়ে নিচ্ছি, আমাদের দায়িত্বে তোমরা মুহাম্মাদের ধর্ম ত্যাগ করে তোমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে এসো। এ ব্যাপারের সাথে আরো দু’টি মিথ্যা কথাও জড়িত ছিল। তার একটি হচ্ছে, যে ব্যক্তি অন্যের কথায় কোন অপরাধ করে সে নিজের অপরাধের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে এবং যার কথায় সে এ অপরাধ করে সে এর পূর্ণ দায়ভার উঠাতে পারে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তারা যথার্থই তাদের দায়ভার মাথায় তুলে নেবে, যারা তাদের কথায় ঈমান পরিত্যাগ করে কুফরীর দিকে ফিরে গিয়েছিল। কারণ, যখন কিয়ামত সত্যি সত্যি কায়েম হয়ে যাবে এবং তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে জাহান্নাম তাদের চোখের সামনে বিরাজ করবে। তখন তারা কখনোই নিজেদের কুফরীর শাস্তি পাওয়ার সাথে সাথে যাদেরকে তারা দুনিয়ায় ধোঁকা দিয়ে গোমরাহ করতো তাদের গোনাহের সমস্ত বোঝাও নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিতে রাজি হবে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
সূরার নামকরণ:
الْعَنْكَبُوْتِ (আনকাবূত) শব্দের অর্থ মাকড়সা। উক্ত সূরাতে ‘মাকড়সা’ সংক্রান্ত একটি ঘটনা বিবৃত হয়েছে বিধায় এ সূরাকে আনকাবূত নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরাতে বিভিন্ন নাবী ও তাঁদের সম্প্রদায়ের বর্ণনা, মুশরিকদের উপমা, আহলে কিতাবসহ সকল অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দেয়ার পথ, পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সবশেষে আল্লাহ তা‘আলার ওপর প্রকৃত ভরসাকারী এবং তাঁর পথে জিহাদকারীদের মর্যাদা ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর:
ال۬مّ۬ – (আলিফ-লাম-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরসমূহ সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য ও অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
(أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُّتْرَكُوْآ….) শানে নুযূল:
ইবনু মাসউদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: প্রথম যাদের ইসলাম গ্রহণ প্রকাশ পেয়েছিল তারা ছিলেন সাতজন। তারা হলেনন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবূ বাকর, সুমাইয়া, আম্মার, সুহাইব, বেলাল এবং মিকদাদ (رضي الله عنهم)। যখন তাদের ইসলাম গ্রহণ প্রকাশ হয়ে পড়ল তখন সকলকে মুশরিকরা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে শাস্তি প্রদান করে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবূ বকর (رضي الله عنه) ব্যতীত। তাদের এ শাস্তির ব্যাপারে এ আয়াতটি নাযিল হয়। (মুসানাদ আহমাদ ১/৪০৪, ইবনু মাজাহ হা: ১৫০, হাসান)
সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা মানুষের একটি ভুল ধারণা দূর করছেন। অনেকে মনে করতে পারে ঈমান এনেছি, ফলে জান্নাতে যেতে বাধা কোথায়? হ্যাঁ, জান্নাতে যেতে ঈমানের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন কে সত্যিকার ঈমানদার আর কে ঈমানদার নামে মুনাফিক। কখনো শারীরিক কষ্ট ও আর্থিক অভাব, কখনো আসমানী বালা, কখনো কাফিরদের দ্বারা কষ্ট আবার কখনো কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করা ও নিজের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন। সুতরাং যারা এসব বিপদাপদে ঈমানের ওপর অটল থাকবে, দীন ইসলামকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে তারাই জান্নাতে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তোমরা কি ধারণা করেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত সঙ্কটময় অবস্থা এখনো তোমাদের ওপর আসেনি। তাদেরকে বিপদ ও দুঃখ স্পর্শ করেছিল এবং তাদেরকে কাঁপিয়ে তোলা হয়েছিল। এমনকি রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সাথে ঈমান আনয়নকারীরা শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন, কখন আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।” (সূরা বাকারাহ ২:২১৪)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتّٰي نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِيْنَ مِنْكُمْ وَالصّٰبِرِيْنَ لا وَنَبْلُوَاْ أَخْبَارَكُمْ)
“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব, যাতে তোমাদের অবস্থা যাচাই করে নিতে পারি এবং দেখে নিতে পারি যে, তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ ও ধৈর্যশীল।” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৩১)
যার ঈমান যত বেশি, তাকে তত বেশি কষ্ট ও বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। হাদীসে এসেছে:
মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হন নাবী-রাসূলগণ অতঃপর সৎ ব্যক্তিগণ। এরপর তাদের মত যারা ঈমানদার তারা। এভাবে মানুষকে তাদের দীনের অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। যদি সে তার দীনের ওপর দৃঢ় হয় তবে তার পরীক্ষাও কঠিন হয় এবং বিপদ-আপদ তার ওপর নাযিল হয়ে থাকে। (তিরমিযী হা: ২৩৯৮, ইবনু মাযাহ হা: ৪০২৩, সহীহ) যে ব্যক্তি যত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে তার প্রতিদান তত বেশি হবে। আল্লাহ তা‘আলা যে জাতিকে ভালবাসেন তাদেরকে পরীক্ষা করেন, যে ব্যক্তি সে পরীক্ষায় ধৈর্যশীল ও সন্তুষ্ট থাকবে আল্লাহ তা‘আলাও তার ওপর সন্তুষ্ট থাকবেন আর অসন্তুষ্ট হলে আল্লাহ তা‘আলাও অসন্তুষ্ট হবেন। (তিরমিযী, ইবনু মাযাহ হা: ৪০৩১, হাসান)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে জেনে নেনন কে প্রকৃত ঈমানদার, আর কে মিথ্যা ঈমানের দাবীদার। পূর্ববর্তী জাতির ঈমানদারদেরকে আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা করেছিলেন। যারা প্রকৃত ঈমানদার ছিল তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে আর যারা শুধু মুখে ঈমানের কথা বলত অন্তরে ঈমান ছিল না তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। খাব্বাব বিন আরাত্ত (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাদর মুড়ি দিয়ে কাবার ছায়াতলে বসে ছিলেন। এমন সময় আমরা অভিযোগ করলাম, আপনি যদি আমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য চাইতেন, দু‘আ করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমাদের পূর্ববর্তী যারা ঈমানদার ছিল তাদের কাউকে নিয়ে এসে কাফিররা মাথার ওপর করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলত, লোহার চিরুনী নিয়ে আসা হতো এবং তা দিয়ে শরীরের গোসত হাড় থেকে আলাদা করে ফেলা হত। এর পরেও তাদেরকে দীন থেকে সরাতে পারত না। (সহীহ বুখারী হা: ৩৮৫২)
(أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ يَعْمَلُوْنَ السَّيِّئٰتِ)
অর্থাৎ যারা ঈমান ও আমলের পরওয়া করে না, অসৎ আমল করেই যাচ্ছে তারা কি ধারণা করে যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পাকড়াও করতে পারবেন না! না, এরূপ ধারণা কতই না খারাপ, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যথোপযুক্ত শাস্তি দেবেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষকে তার ঈমান অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়। যার ঈমান যত মজবুত তার পরীক্ষা তত কঠিন।
২. সকল বস্তুই আল্লাহ তা‘আলার আয়ত্তাধীন, কেউ তার আয়ত্তের বাইরে নয়।
৩. কাফিররাও পরীক্ষার সম্মুখীন হবে।
৫-৭ নং আয়াতের তাফসীর:
(لِقَا۬ءَ اللّٰهِ) ‘আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাত’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ভালবাসা, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও সৎ বান্দা হয়ে যে আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাত কামনা করে সে জেনে রাখুক, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাতের নির্দিষ্ট সময় অবশ্যই আসবে এবং তা খুবই নিকটে। কেননা
كُلُّ مَا آتٍ فَهُوَ قَرِيْبٌ
যা অবশ্যই হবে তা খুবই নিকটে। তাই আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য যথাসম্ভব সকল অসৎ আমল থেকে বিরত থেকে সৎ আমল ও নেকীর কাজ চালিয়ে যেতে থাক।
جَاهَدَ শব্দের অর্থন প্রচেষ্টা করা, এখানে ঈমান আনা থেকে শুরু করে যাবতীয় সৎ আমল করা ও অসৎ আমল থেকে বিরত থাকা এমনকি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা পর্যন্ত সবই শামিল। ঈমান আনতেও প্রচেষ্টা করতে হয়, কেননা শয়তান তাতে কঠিনভাবে বাধা দেয়। কারণ একজন ব্যক্তি ঈমান আনলে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ط وَإِنَّ اللّٰهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ)
“যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আল্লাহ অবশ্যই সৎ কর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।” (সূরা আনকাবুত ২৯:৬৯)
যে ব্যক্তি ঈমান ও সৎ আমলের পথে প্রচেষ্টা করল সে তার নিজের কল্যাণের জন্যই করল। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বজগত হতে অমুখাপেক্ষী।’ কে সৎ আমল করল আর কে অসৎ আমল করল সে জন্য তাঁর কিছু আসে যায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِه۪ ج وَمَنْ أَسَا۬ءَ فَعَلَيْهَا ز ثُمَّ إِلٰي رَبِّكُمْ تُرْجَعُوْنَ)
“যে সৎ আমল করে সে তার নিজের (কল্যাণের) জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কর্ম করলে তার প্রতিফল তার ওপরই বর্তাবে, অতঃপর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।” (সূরা জাসিয়া ৪৫:১৫) যেহেতু আল্লাহ সৎ আমল ও সৎ আমলকারীদেরকে ভালবাসেন সেহেতু তিনি তাদের দ্বারা যে সকল পাপ কাজ হয়ে গেছে তা মিটিয়ে দেবেন এবং তাদের কর্মের উত্তম প্রতিদান দেবেন।
অতএব প্রত্যেক ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে যা আমল করবে তার প্রতিদান সে পাবে ভাল বা মন্দ হোক। তবে যারা সর্বদা ভাল আমল করে তাদের দ্বারা যদি কোন অন্যায় কাজ হয়ে যায় আর তৎক্ষণাৎ যদি তারা তাদের ভুলের কথা স্বীকার করে তাওবা করে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের মন্দ আমলগুলোকে নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। মূলত তাদের কর্মফল কখনো নষ্ট করা হবে না। বরং তারা আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহে আরো দ্বিগুণ পাবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষ যা আমল করে তা আমলকারীর ওপর বর্তাবে, ভাল করলে ভাল আর মন্দ করলে মন্দ।
২. ঈমানদার সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা কোন পাপ কাজ হয়ে গেলে তা থেকে তাওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দেন এমনকি আরো উত্তম প্রতিদান দেন।
৮-৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা সৎ আমলের উত্তম প্রতিদান বর্ণনা করার পরপরই এখানে আল্লাহ তা‘আলার পরেই বান্দাদের মধ্য হতে সবচেয়ে বেশি ভাল ব্যবহার ও খেদমত পাওয়ার হকদার পিতা-মাতার বিষয়টি আলোকপাত করেছেন। তাই কুরআনের যেখানে আল্লাহ তা‘আলা নিজের হকের কথা তথা একমাত্র তাঁর ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে পিতা-মাতার হকের কথা সংযুক্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের গুরুত্ব অপরিসীম। সূরা বানী ইসরাঈলের ২৩-২৪ নং আয়াতে পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের গুরুত্ব আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের গুরুত্ব এত বেশি থাকা সত্ত্বেও তাদের নির্দেশ পালনে একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে আর তা হলোন তারা যদি আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করার নির্দেশ দেয় তাহলে তাদের কথা মানা যাবে না। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর যদি তোমার মাতা-পিতা তোমার ওপর চাপ দেয় যে, তুমি আমার সাথে এমন কিছু শরীক সাব্যস্ত কর, যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর।” (সূরা লুকমান ৩১:১৫)
হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করা হল: হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার নিকট সবচেয়ে উত্তম ব্যবহার পাবার হকদার কে? তিনি বললেন: তোমার মা। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল তার পর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। পুনরায় লোকটি জিজ্ঞেস করল। অতঃপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। চতুর্থবার জিজ্ঞেস করা হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমার পিতা। (সহীহ বুখারী হা: ৫৯৭১, সহীহ মুসলিম হা: ২৫৪৮)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা সৎ আমল করবে ও ঈমান নিয়ে আসবে তিনি তাদেরকে সৎ কর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করবেন। অর্থাৎ তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। আর তারা তাদের এ সকল সৎ আমলের কারণে জান্নাতে অনাবিল আনন্দে বসবাস করবে। যেখানে তারা শুধু সুখই ভোগ করবে, কোন দুঃখ তাদেরকে স্পর্শ করবে না। এটা মূলত তাদের সৎ আমলের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির কারণেই। তাই আমাদের উচিত সর্বদা ভাল আমল করা এবং মন্দ আমল করা থেকে বিরত থাকা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সর্বদা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। তারা খারাপ ব্যবহার করলেও তাদের সাথে অসদ্ব্যবহার করা যাবে না।
২. পিতা-মাতা যদি আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করার নির্দেশ দেয় শুধু সেক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করা যাবে না।
৩. মানুষকে সর্বশেষে আল্লাহ তা‘আলার দিকেই ফিরে যেতে হবে।
৪. সৎ কর্ম করলে সৎ কর্মশীলদের মধ্যে শামিল হওয়া যায়।
১০-১১ নং আয়াতের তাফসীর:
সূরার শুরু থেকে এ যাবৎ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেনন তিনি পরীক্ষা করবেন কে প্রকৃত মু’মিন আর কে মুনাফিক। অত্র আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছেন, মানুষের মাঝে একশ্রেণি রয়েছে যারা মুখে ঈমানদার বলে দাবী করে কিন্তু মূলত তারা মুনাফিক, তাদের অন্তরে ঈমান নেই।
(فِتْنَةَ النَّاسِ) দ্বারা উদ্দেশ্য হল: মু’মিনরা কাফির শক্রদের থেকে যে কষ্ট, হত্যা, বন্দী ও নির্যাতনের শিকার হত তা। এরূপ কষ্টকে মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির সাথে তুলনা করত। অর্থাৎ যখন আল্লাহ তা‘আলার পথে জিহাদ করতে গিয়ে নিহত হত, মার খেত ও বন্দী হত তখন তা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির মত গণ্য করত।
আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি মানুষকে যেমন কুফর ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, কাফিরদের দ্বারা মুনাফিকরা শাস্তি প্রাপ্ত হলে দীন থেকে ফিরে যেত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ یَّعْبُدُ اللہَ عَلٰی حَرْفٍﺆ فَاِنْ اَصَابَھ۫ خَیْرُ اۨطْمَاَنَّ بِھ۪ﺆ وَاِنْ اَصَابَتْھُ فِتْنَةُ اۨنْقَلَبَ عَلٰی وَجْھِھ۪ﺥ خَسِرَ الدُّنْیَا وَالْاٰخِرَةَﺚ ذٰلِکَ ھُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِیْنُﭚ)
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে দ্বিধার সাথে; তার মঙ্গল হলে তাতে প্রশান্তি লাভ করে আর কোন বিপর্যয় ঘটলে সে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুনিয়াতে ও আখিরাতে; এটা তো সুস্পষ্ট ক্ষতি।” (সূরা হাজ্জ ২২:১১)
পক্ষান্তরে যদি কোন সাহায্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আসে তখন তারা বলে যে, আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(الَّذِيْنَ يَتَرَبَّصُوْنَ بِكُمْ ج فَإِنْ كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِّنَ اللّٰهِ قَالُوْآ أَلَمْ نَكُنْ مَّعَكُمْ ﺘوَإِنْ كَانَ لِلْكٰفِرِيْنَ نَصِيْبٌ لا قَالُوْآ أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُمْ مِّنَ الْمُؤْمِنِيْنَ)
“যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে তারা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তোমাদের জয় হলে বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’ আর যদি কাফিরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে ‘আমরা কি তোমাদের পরিবেষ্টন করে রেখেছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদেরকে মু’মিনদের হাত হতে রক্ষা করিনি?’’ (সূরা নিসা ৪:১৪১)
আল্লাহ তা‘আলা যুদ্ধের ময়দানে মুসলিম দলের জয়-পরাজয় দিয়ে থাকেন পরীক্ষা করার জন্য এবং জেনে নেয়ার জন্য, আসলে কে প্রকৃত ঈমানদার আর কে প্রকৃত ঈমানদার নয়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যুদ্ধের ময়দানে পরীক্ষা হয় কে প্রকৃত মু’মিন আর কে মুনাফিক।
২. সুখের সময় মুনাফিকরা ঈমানের কথা খুব প্রকাশ করে কিন্তু দুঃখের সময় পেছনে থাকে।
৩. মুনাফিকরা মুসলিমদের জন্য কাফিরদের থেকে অধিক ক্ষতিকর।
১২-১৩ নং আয়াতের তাফসীর:
মুসলিমদেরকে কাফিররা ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করে থাকে। কখনো শক্তি দিয়ে, কখনো অর্থ দিয়ে আবার কখনো সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করে। আলোচ্য আয়াতে তাদের এমনই একটি অপকৌশল উল্লেখ করা হয়েছে। কাফিররা মুসলিমদেরকে বলে: তোমরা অহেতুক আখিরাতের শাস্তির ভয়ে আমাদের পথে চলছ না, আমাদের পথে চলে আসো, আমাদের ধর্ম মেনে নাও, তোমাদের ইসলাম ধর্ম বর্জন কর। সকল সুবিধা দেব, অর্থ ও শক্তি দিয়ে সাহায্য করব, তোমাদের সাথে বাণিজ্য করব। তোমাদেরকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাব। তাতেও যদি রাজি না হও-তাহলে তোমরা যে আখিরাতের ভয় কর তার শাস্তির দায়িত্ব আমাদের কাঁধে তুলে নিলাম। আখিরাতে তোমাদের কোন সমস্যা হবে না। তারপরেও আমাদের পথে চলে আসো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “কিন্তু তারা তো তাদের পাপভারের কিছুই বহন করবে না। তারা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।”
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا يَسْأَلُ حَمِيْمٌ حَمِيْمًا)
“আর কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুর খোঁজ নিবে না।” (সূরা মা‘আরিজ ৭০:১০)
সুতরাং যে যতই এ ব্যাপারে আশা দিয়ে থাকুক না কেন অর্থাৎ যদি কেউ বলেন তুমি এ অন্যায় কাজটি কর এর ফলে যা গুনাহ হবে তা আমি বহন করব। এমন কথায় বিশ্বাসী হয়ে অন্যায় করা যাবে না। কেননা এ কথা শুধ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বলতে পারবে, মুমূর্ষুকালে একথা বলবে না, কারণ তখন সত্য উপলদ্ধি করতে পারবে। আর আখিরাতে তো পিতা-মাতাও সন্তানকে অস্বীকার করবে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল লোকদের সম্পর্কে বলেন, যারা নিজেরা খারাপ কাজ করে অন্যদেরকেও খারাপ কাজের দিকে আহ্বান করে। মানুষকে খারাপ কাজের দিকে আহ্বান করার কারণে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে ও খারাপ আমলে জড়িত হয়েছে তাদের পাপের বোঝা আহ্বানকারীরা নিজেদের বোঝার সাথে বহন করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لِيَحْمِلُوْآ أَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً يَّوْمَ الْقِيٰمَةِ لا وَمِنْ أَوْزَارِ الَّذِيْنَ يُضِلُّوْنَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ ط أَلَا سَا۬ءَ مَا يَزِرُوْنَ)
“ফলে কিয়ামত দিবসে তারা বহন করবে তাদের পাপভার পূর্ণ মাত্রায় এবং পাপভার তাদেরও যাদেরকে তারা অজ্ঞতাহেতু পথভ্রষ্ট করেছে। দেখ, তারা যা বহন করবে তা কত নিকৃষ্ট!” (সূরা নাহল ১৬:২৫)
সহীহ হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে সৎ পথের দিকে আহ্বান করে তার আমলনামায় কিয়ামত পর্যন্ত ঐ পরিমাণ সওয়াব লেখা হবে, অনুসৃত ব্যক্তির আমলনামায় যে পরিমাণ সওয়াব লেখা হয়। তবে অনুসরণকারী ব্যক্তির আমলনামা থেকে কোন কিছুই কমানো হবে না। আর যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তিকে ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করবে তার আমলনামায় কিয়ামত পর্যন্ত ঐ পরিমাণ গুনাহ লেখা হবে যে পরিমাণ গুনাহ অনুসারণকারী ব্যক্তির আমলনামায় লেখা হবে। তবে অনুসরণকারী ব্যক্তির গুনাহ থেকে কোন কিছুই কমানো হবে না। (সহীহ মুসলিম হা: ১৬)
অতএব প্রত্যেককেই তার নির্ধারিত পাপের বোঝা বহন করতে হবে। তার নির্ধারিত পাপ থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না। তাই আমাদের উচিত হবে আমরা মানুষকে মন্দ কর্মের দিকে আহ্বান করবো না এবং আহ্বানের উপকরণ তৈরি করবো না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. প্রত্যেককে তার পাপের বোঝা বহন করতে হবে।
২. অসৎ কাজ করা ও অসৎ কাজের পথ দেখানো সমান অপরাধ।
৩. কাফিররা বিভিন্ন কৌশল ও লোভ দেখিয়ে মুসলিমকে পথভ্রষ্ট করতে চাইবে, সুতরাং সর্বদা সাবধান থাকতে হবে, কখনো তাদের প্ররোচনায় প্ররোচিত হওয়া যাবে না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ মুমিনদেরকেও পরীক্ষা না করেই ছেড়ে দেয়া হবে- এটা অসম্ভব।
সহীহ হাদীসে এসেছেঃ “সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয় মুমিনদের উপর, তারপর সৎ লোকদের উপর, এরপর তাদের চেয়ে নিম্ন মর্যাদার লোকদের উপর, এরপর তাদের চেয়েও নিম্ন মর্যাদার লোকদের উপর। পরীক্ষা তাদের দ্বীনের অনুপাতে হয়ে থাকে। যদি সে তার দ্বীনের উপর দৃঢ় হয় তবে তার পরীক্ষাও কঠিন হয় এবং বিপদ-আপদ তার উপর অবতীর্ণ হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে দাখিল হয়ে যাবে, যখন আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে এবং কে ধৈর্যশীল তা এখনও জানেন (৩:১৪২) অনুরূপ আয়াত সূরায়ে বারাআতেও রয়েছে। মহামহিমান্বিত আল্লাহ সূরায়ে বাকারায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, যদিও এখনও তোমাদের নিকট তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত ও কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথে ঈমান আনয়নকারীরা বলে উঠেছিল- আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? হ্যা, হ্যাঁ, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (২:২১৪) এই জন্যেই এখানেও বলেনঃ আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরকেও পরীক্ষা করেছিলাম, আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন কারা সত্যবাদী ও কারা মিথ্যাবাদী। এর দ্বারা এটা মনে করা চলবে না যে, আল্লাহ এটা জানতেন না। বরং যা হয়ে গেছে। এবং যা হবে সবই তিনি জানেন। এর উপর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সমস্ত ইমাম একমত। এখানে (আরবি) অর্থ (আরবি) বা দেখার অর্থে ব্যবহৃত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) (আরবি)-এর অর্থ (আরবি) করেছেন। কেননা, দেখার সম্পর্ক বিদ্যমান জিনিসের সাথে হয়ে থাকে এবং (আরবি) এর (আরবি) থেকে বা সাধারণ।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যারা মন্দ কর্ম করে তারা কি মনে করে যে, তারা আমার আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে? তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ! অর্থাৎ যারা ঈমান আনয়ন করেনি তারাও যেন এ ধারণা না করে যে, তারা পরীক্ষা হতে বেঁচে যাবে। তাদের জন্যে বড় বড় শাস্তি অপেক্ষা করছে। তারা আল্লাহর আয়ত্তের বাইরে যেতে পারবে না। তাদের ধারণা খুবই মন্দ, যার ফল তারা সত্বরই জানতে পারবেন।
৫-৭ নং আয়াতের তাফসীর
যাদের আখিরাতে বিনিময় লাভের আশা রয়েছে এবং ওটাকে সামনে রেখে তারা পুণ্যের কাজ করে থাকে তাদের আশা পূর্ণ হবে। তারা এমন পুরস্কার লাভ করবে যা কখনো শেষ হবার নয়। আল্লাহ তা’আলা প্রার্থনা শ্রবণকারী। তিনি জগতসমূহের সব খবরই রাখেন। তার নির্ধারিত সময় টলবার নয়।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যে কেউ ভাল আমল করে সে নিজের লাভের জন্যেই তা করে। আল্লাহ তাআলা মানুষের আমলের মুখাপেক্ষী নন। যদি সমস্ত মানুষ আল্লাহভীরু হয়ে যায় তবুও তাঁর সাম্রাজ্য সামান্য পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে ।
হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, শুধু তরবারী চালনা করার নামই জিহাদ নয়। মানুষ পুণ্যময় কাজের চেষ্টায় লেগে থাকবে এটাও এক প্রকারের জিহাদ। মানুষ ভাল কাজ করলে তা আল্লাহ তাআলার কোন উপকারে আসবে না, তবুও এটা তার বড় মেহেরবানী যে, তিনি মানুষকে তার ভাল কাজের পুরস্কার প্রদান করে থাকেন। এই কারণে তিনি তার গুনাহ মাফ করে দেন। ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম পুণ্যেরও তিনি মর্যাদা দিয়ে থাকেন এবং এর জন্যে বড় রকমের পুরস্কার প্রদান করেন। একটি পুণ্যের বিনিময়ে তিনি সাতশগুণ পর্যন্ত প্রতিদান দিয়ে থাকেন।
আর পাপকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দেন। অথবা ওর সমপরিমাণ শাস্তি প্রদান করেন। তিনি যুলুম হতে সম্পূর্ণ পবিত্র। তিনি পুণ্যকে বাড়িয়ে দেন এবং নিজের নিকট হতে বিরাট প্রতিদান প্রদান করেন। তাই মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যারা ঈমান আনে ও সত্যার্যাবলী সম্পাদন করে, আমি নিশ্চয়ই তাদের মন্দ কর্মগুলো মিটিয়ে দিবো এবং তাদের কর্মের উত্তম ফল দান করবো।
৮-৯ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম তার তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার নির্দেশ দেয়ার পর এখন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন। কেননা, পিতা-মাতার মাধ্যমেই মানুষ অস্তিত্বে এসে থাকে। পিতা সন্তানের জন্যে খরচ করে এবং তাকে লালন-পালন করে। আর মা তাকে স্নেহ দান করে, ভালবাসে এবং লালন-পালন করে থাকে। এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না; তাদের সাথে বলো সম্মান সূচক নম্র কথা। মমতাবশে তাদের প্রতি নম্রতার পক্ষপুট অবনমিত করো এবং বলল- হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।” (১৭:২৩-২৪) তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, যদি তারা শিরকের দিকে আহ্বান করে তবে তাদের কথা মানতে হবে না। মানুষের জেনে রাখা উচিত যে, তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর তারা যা করতো তা তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। যদি মানুষ আল্লাহর সাথে শিরক করার ক্ষেত্রে তাদের পিতা-মাতার আদেশ না মানে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তবে অবশ্যই তিনি তাদেরকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবেন।
হযরত সা’দ (রাঃ) বলেন, আমার ব্যাপারে চারটি আয়াত অবতীর্ণ হয়। এগুলোর মধ্যে একটি (আরবি) আয়াতটিও। এটা এজন্যে অবতীর্ণ হয় যে, আমার মা আমাকে বলেঃ “(হে সা’দ রাঃ)! আল্লাহ কি তোমাকে মায়ের সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দেননি? আল্লাহর শপথ! তুমি যদি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নবুওয়াতকে অস্বীকার না কর তবে আমি পানাহার ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুবরণ করবো।” সে তাই করে। শেষ পর্যন্ত লোকেরা জোরপূর্বক তার মুখ ফেড়ে তার মুখে খাদ্য ও পানীয় প্রবেশ করিয়ে দিতো। ঐ সময় উপরোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১০-১১ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে ঐ মুনাফিকদের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যারা মুখে ঈমানের দাবী করে, কিন্তু যখন বিরোধীদের পক্ষ হতে কোন দুঃখ কষ্ট তাদের উপর আপতিত হয় তখন তারা মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী হয়ে যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন এ অর্থই করেছেন। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে এক ধারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে, যদি তাকে শান্তি ও সুখ পৌঁছে তবে সে সন্তুষ্ট থাকে, আর যদি কষ্ট ও বিপদ আপদ পোঁছে তবে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (২২:১১) এজন্যেই আল্লাহ পাক এখানে বলেনঃ মানুষের মধ্যে কতক লোক বলে- আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি, কিন্তু আল্লাহর পথে যখন তাদেরকে কোন দুঃখ-কষ্ট পৌঁছে, তখন তারা মানুষের পীড়নকে আল্লাহর শাস্তির মত গণ্য করে। আর যখন তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে কোন সাহায্য (গনীমত) আসে তখন বলে- আমরা। তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। যেমন অন্য আয়াতে আছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ যারা তোমাদের সাথে অপেক্ষমান থাকে, অতঃপর যদি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তোমাদের বিজয় লাভ হয় তবে তারা বলে আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? আর যদি কাফিরদের (বিজয়ের) অংশ হয় তখন তারা (কাফিরদেরকে) বলে- আমরা কি তোমাদেরকে সহায়তা করিনি এবং তোমাদের পক্ষে কি মুমিনদের প্রতিরোধ ও প্রতিহত করিনি?” (৪:১৪১) আর এক জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “খুব সম্ভব যে, আল্লাহ বিজয় আনয়ন করবেন অথবা নিজের পক্ষ হতে কোন বিষয় আনয়ন করবেন, তখন তারা তাদের অন্তরে যা গোপন রেখেছে সে জন্যে লজ্জিত হয়ে যাবে।” (৫:৫২)
আল্লাহ তা’আলা এখানে বলেনঃ তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে কোন সাহায্য আসলে তারা বলতে থাকে। আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম।
অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ বিশ্ববাসীর অন্তঃকরণে যা আছে, আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন? অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের অন্তরে যা কিছু গোপন রেখেছে, আল্লাহ সবই অবগত আছেন।
আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দিবেন ঈমানদারদেরকে এবং অবশ্যই তিনি প্রকাশ করবেন মুনাফিকদেরকে। অর্থাৎ সুখ-দুঃখ ও বিপদ-আপদের মাধ্যমে তিনি মুমিন ও মুনাফিকদেরকে পৃথক করে দিবেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, যতক্ষণ না আমি জেনে নিই তোমাদের মধ্যে জিহাদকারী ও ধৈর্যশীলদেরকে এবং আমি তোমাদের ব্যাপারে পরীক্ষা করি।” (৪৭:৩১) যেমন আল্লাহ তা’আলা উহুদের ঘটনার পরে বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ অসৎকে সৎ হতে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছে। আল্লাহ সেই অবস্থায় মুমিনদেরকে ছেড়ে দিতে পারেন না।” (৩:১৭৯)
১২-১৩ নং আয়াতের তাফসীর
কুরায়েশ কাফিররা মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যে তাদেরকে একথাও বলতোঃ “তোমরা আমাদের মাযহাবের উপর আমল কর, এতে যদি কোন পাপ হয় তবে তা আমরাই বহন করবো। অথচ এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে এটা প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। কেউ তার নিকটতম আত্মীয়েরও পাপের বোঝা বহন করবে না এবং করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “বন্ধু বন্ধুর তত্ত্ব নিবে না, তাদেরকে করা হবে একে অপরের দৃষ্টিগোচর ।” (৭০:১০-১১) হ্যাঁ, তবে এ লোকগুলো নিজেদের পাপের বোঝা বহন করবে এবং যাদেরকে তারা পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরও পাপের বোঝা এদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু ঐ পথভ্রষ্ট লোকেরাও বোঝামুক্ত হবে না। তাদের পাপের বোঝা তাদের উপরই থাকবে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যেন তারা তাদের বোঝা পূর্ণভাবে বহন করে কিয়ামতের দিন এবং অজ্ঞতা বশতঃ যাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরও বোঝা বহন করে।” (১৬:২৫)
সহীহ হাদীসে রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি লোকদেরকে হিদায়াতের দাওয়াত দিবে, কিয়ামত পর্যন্ত যেসব লোক ঐ হিদায়াতের উপর চলবে তাদের সবারই পুণ্য ঐ একটি লোক লাভ করবে, অথচ তাদের পুণ্য হতে কিছুই কম করা হবে না। অনুরূপভাবে যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেবে, যারা ওর উপর আমল করবে সবারই গুনাহ তার উপর পড়বে এবং তাদের গুনাহ হতে কিছুই কম করা হবে না।”
আর একটি হাদীসে আছেঃ “ভূ-পৃষ্ঠে যত খুনাখুনি হবে, সবগুলোর পাপ হযরত আদম (আঃ)-এর ঐ পুত্রের উপর পতিত হবে, যে অন্যায়ভাবে তার ভাইকে হত্যা করেছিল। কেননা, হত্যার সূচনা তার থেকেই হয়।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা যে মিথ্যা উদ্ভাবন করে সে সম্পর্কে কিয়ামত দিবসে তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।
হযরত আবু উমামা (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সমস্ত রিসালাত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি একথাও বলেছেনঃ তোমরা যুলুম হতে দূরে থাকো। কেননা, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলবেন- “আমার ইজ্জত ও মর্যাদার শপথ! আজ একটি যুলুমও ছেড়ে দিবো না।” অতঃপর একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবেনঃ “অমুকের পুত্র অমুক কোথায়?” সে তখন আসবে এবং পর্বত বরাবর পুণ্য তার সাথে থাকবে। এমনকি হাশরের মাঠে উপস্থিত লোকদের দৃষ্টি তার দিকে উঠবে। সে আল্লাহর সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। অতঃপর ঘোষণাকারী ঘোষণা করবেনঃ “এ ব্যক্তি কারো উপর যুলুম করে থাকলে সে যেন আজ প্রতিশোধ নিয়ে নিজের হক আদায় করে নেয়।” একথা শুনে এদিক-ওদিক হতে লোকেরা এসে তাকে ঘিরে নিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ “আমার এই বান্দাদেরকে তাদের হক আদায় করিয়ে দাও।” ফেরেশতারা বলবেনঃ “কিভাবে আমরা তাদের হক আদায় করিয়ে দিবো?” আল্লাহ তা’আলা উত্তরে বলবেনঃ “তার পুণ্যগুলো নিয়ে এদেরকে দিয়ে দাও।” এরূপই করা হবে। শেষ পর্যন্ত তার আর কোন পুণ্য অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু অত্যাচারিত ও হকদার আরও বাকী থেকে যাবে। আল্লাহ তা’আলা তখন বলবেনঃ “এদেরকেও এদের হক আদায় করিয়ে দাও।” ফেরেশতারা বলবেনঃ “এখন তো তার কাছে আর কোন পণ্য বাকী নেই!” আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “তাদের পাপগুলো তার উপর চাপিয়ে দাও।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতবুদ্ধি হয়ে।
(আরবি)-এ আয়াতটি পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে মুআয (রাঃ)! নিশ্চয়ই মুমিনকে তার সমস্ত চেষ্টা-শ্রম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, এমনকি তার চক্ষুদ্বয়ের সুরমা ও তার অঙ্গুলি দ্বারা ঠাসা মাটি সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হবে। দেখো, যেন এরূপ না হয় যে, কিয়ামতের দিন কেউ তোমার পুণ্য নিয়ে নেয়।” (এ হাদীসটিও ইবনে আবি হাতিমই (রঃ) বর্ণনা করেছেন)