أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০২৭)
[ *দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে ইসলামী দর্শন :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ২৯:আল-আনকাবুত
পারা:২১
৬৪-৬৯ নং আয়াত:-
২৯:৬৪
وَ مَا ہٰذِہِ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا لَہۡوٌ وَّ لَعِبٌ ؕ وَ اِنَّ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ لَہِیَ الۡحَیَوَانُ ۘ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶۴﴾
আর এ দুনিয়ার জীবন একটি খেলা ও মন ভুলানোর সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল জীবনের গৃহতো হচ্ছে পরকালীন গৃহ, হায়! যদি তারা জানতো।
২৯:৬৫
فَاِذَا رَکِبُوۡا فِی الۡفُلۡکِ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ فَلَمَّا نَجّٰہُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اِذَا ہُمۡ یُشۡرِکُوۡنَ ﴿ۙ۶۵﴾
যখন তারা নৌযানে আরোহণ করে তখন নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নিয়ে তার কাছে প্রার্থনা করে। তারপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে ভিড়িয়ে দেন তখন সহসা তারা শিরক করতে থাকে,
২৯:৬৬
لِیَکۡفُرُوۡا بِمَاۤ اٰتَیۡنٰہُمۡ ۚۙ وَ لِیَتَمَتَّعُوۡا ٝ فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶۶﴾
ফলে ওরা ওদের প্রতি আমার দান অস্বীকার করে এবং ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে। সুতরাং অচিরেই ওরা জানতে পারবে।
২৯:৬৭
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّا جَعَلۡنَا حَرَمًا اٰمِنًا وَّ یُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنۡ حَوۡلِہِمۡ ؕ اَفَبِالۡبَاطِلِ یُؤۡمِنُوۡنَ وَ بِنِعۡمَۃِ اللّٰہِ یَکۡفُرُوۡنَ ﴿۶۷﴾
তারা কি দেখে না আমরা ‘হারাম’কে নিরাপদ স্থান করেছি, অথচ এর চারপাশে যেসব মানুষ আছে, তাদের উপর হামলা করা হয়। তবে কি তারা বাতিলকে স্বীকার করবে, আর আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করবে।
২৯:৬৮
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِالۡحَقِّ لَمَّا جَآءَہٗ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَہَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۶۸﴾
আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর মিথ্যা রটনা করে অথবা তাঁর কাছ থেকে সত্য আসার পর তাতে মিথ্যারোপ করে, তার চেয়ে বেশি যালিম আর কে ? জাহান্নামের মধ্যেই কি কাফিরদের আবাস নয়?
২৯:৬৯
وَ الَّذِیۡنَ جَاہَدُوۡا فِیۡنَا لَنَہۡدِیَنَّہُمۡ سُبُلَنَا ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَمَعَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿٪۶۹﴾
যারা আমার জন্য সংগ্রাম- সাধনা করবে তাদেরকে আমি আমার পথ দেখাবো। আর অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশালীদেরই সাথে আছেন।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে ইসলামী দর্শন : এখানে প্রধানত চারটি বিষয়ের ওপর আলােচনা এসেছে। ১. পৃথিবীর বুকে জীবনের অস্তিত্ব, ২. তাদের জীবন ধারণ সামগ্রী, ৩. তাদের বিস্তার এবং ৪. জীবন শেষে পৃথিবী থেকে বিদায়ের পরে যেদিন রােজহাশরের ময়দানে বিচারের সূক্ষ্ম মানদন্ড তাদের সামনে রেখে দেয়া হবে সেদিন সে মানদন্ডে ধরা পড়বে, ভালাে বা মন্দ যে যা করেছে সব কিছু সঠিকভাবে। সুতরাং আখেরাতের সেই জীবন সম্পর্কে যখন চিন্তা করা হয় তখন দুনিয়ার জীবনের প্রয়ােজনীয় সামগ্রী, বিলাসব্যসন এবং খেলাধূলা সব কিছু অসার মনে হয়। এ বিষয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘দুনিয়ার এ জীবন এক (সাময়িক) খেল তামাশা বৈ আর কিছুই নয়, প্রকৃতপক্ষে আখেরাতের বাসস্থানই আসল যিন্দেগী, হায় যদি ওরা বুঝতাে!’ আসলে আখেরাতের জীবন সম্পর্কে যদি চিন্তা না করা হয় এবং এ জীবনের সব কিছুর জন্যে রােজ হাশরে আল্লাহর দরবারে হাযির হয়ে হিসাব দিতে হবে এ কথা যদি চিন্তা না করে জীবন যাপন করা হয় তাহলে অবশ্যই এ জীবনের সব কিছুই খেল-তামাশা ও অসার বস্তুতে পরিণত হবে। আর যদি আখেরাতের জীবনের চেতনা থাকে এবং প্রতিটি কাজ, কথা ও চিন্তা সম্পর্কে আদালতে আখেরাতে হিসাব দেয়ার কথা মনে রেখে জীবন যাপন করা হয় তাহলে সকল কাজই দায়িত্বপূর্ণ হবে, অবহেলায় জীবনের অমূল্য সময় ব্যয়িত হবে না। সে মহান দিবসের কথা চিন্তা করেই মানুষ তার জীবনের কর্মকান্ডের পরিকল্পনা তৈরী করবে, তখন সে খুঁজে পাবে তার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। প্রকৃতপক্ষে আখেরাতের জীবনই হচ্ছে আসল জীবন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে সেটাই আসল জীবন।’ অর্থাৎ আখেরাতের কথা স্মরণ করে যে জীবন পরিচালিত হবে তার মধ্যে থাকবে না কোনাে দায়িত্বহীন কাজ ও ব্যবহার, থাকবে না সময় ও সম্পদের অপচয়, হেলায় খেলায় কাটবে না সে জীবন; বরং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব করে তার জীবন, কাজ ও ব্যবহার পরিচালিত হবে; আর এরই ফলে তার জীবন সার্থকতা ও সফলতায় কানায় কানায় ভরে ওঠবে। এ কথার অর্থ অবশ্যই এটা নয় যে, আল কোরআন মানুষকে দরবেশী জীবন যাপন করতে শিখাচ্ছে, শিখাচ্ছে দুনিয়ার কোন নেয়ামত ভােগ না করে সেসব কিছু থেকে দূরে থাকতে; বরং এটা ইসলামের শিক্ষা ও মূল সুরের খেলাফ। জীবনকে নীরস নিরানন্দ করে তােলা কখনাে ইসলামের লক্ষ্য হতে পারে না। ইসলাম চায়, মানুষ আখেরাতকে সামনে রেখেই জীবনের সব কিছু ভােগ ব্যবহার করুক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দেয়া সীমার মধ্যে থেকে জীবনকে আনন্দময় করায় অবশ্যই কোনাে বাধা নেই। এমন রস ও রসিকতা বারণ করা হয়নি যার দ্বারা নিজে বা অন্য কারাে কোনাে প্রকার ক্ষতি না হয় এবং আল্লাহর কোনাে বিধান সরাসরি লংঘিত না হয়। এভাবে একজন মােমেন দুনিয়া ও আখেরাতকে পাশাপাশি রেখে চিন্তা করে, এমন কিছু করতে সে কখনাে প্রস্তুত হয় না যাতে তার আখেরাতের জীবনে কোনাে কষ্ট নেমে আসার সম্ভাবনা থাকে। এভাবে আখেরাতের জীবন ঠিক রেখে একজন মােমেন পার্থিব জীবন সুন্দর, সুখময় ও আনন্দমুখর করতে দ্বিধা করে না এবং এতে আল্লাহ রসূলের পক্ষ থেকেও কোনাে বাধা নেই তাই, মুমিনের যিন্দেগী হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ ও হিসাব-নিকাশ করা এক যিন্দেগী। সে কখনাে নিজেকে পুরােপুরি স্বাধীন মনে করে না ও লাগামছাড়া ভাবেও চলে না। আখেরাতের চিন্তা থেকে মুক্ত জীবন খেল তামাশা এবং আখেরাতমুখী জীবনই নিষ্কলুষ ও সুন্দর জীবন।
*শুধু বিপদের সময়েই আল্লাহকে স্মরণ করা : এভাবে মাপঝােক করে চলার জন্য থমকে যাওয়া, খেয়াল করা- এ মনােভাবই একজন মােমেনকে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ ও ব্যবহার থেকে থামিয়ে দেয়, সে মােশরেকদের মতাে অকৃতজ্ঞ হয় না। যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর যখন তারা নৌ-জাহাজে আরােহণ করে তখন নিষ্ঠার সাথে আল্লাহকে ডাকে। তার পর যখন তিনি (আল্লাহ তায়ালা তাদের বিপদ থেকে মুক্ত করে স্থলভাগে পৌছে দেন তখন তারা শিরক করতে শুরু করে।’ এই হচ্ছে তাদের কাজ ও ব্যবহারের অসংলগ্নতা এবং কথা ও কাজের বৈপরীত্য। যখন তারা জাহাজে আরােহণ করে এবং উত্তাল তরংগের মধ্যে জাহাজটি প্রচন্ডভাবে দুলতে থাকে, ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে জাহাজটাকে খেলনার মতাে নাচাতে থাকে, তখন আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে কথা তাদের মনে থাকে না। তারা তখন কায়মনােবাক্যে বিশ্ব পালকের কাছেই কান্নাকাটি করতে থাকে এবং একমনে শুধু তাকেই স্মরণ করতে থাকে। তখন একমাত্র একটি শক্তিই তাদের মন ও গােটা অস্তিত্ব দখল করে রাখে এবং সেটাই আল্লাহর শক্তি। তখন তাদের চেতনায়, মনে মুখে একই শব্দ গুঞ্জরিত হয়, আল্লাহ। আল্লাহ। এই সময়ে তারা সবাই নিজেদের আসল প্রকৃতির দিকে ফিরে যায় এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর অস্তিত্ব হৃদয় মন দিয়ে অনুভব করে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর যখন তিনি তাদের সে মহাবিপদ নাজাত দেন এবং ডাংগার দিকে নিয়ে যান তখন তারা (এ উদ্ধার কাজে আরও কারও বাহাদুরী আছে বলে) তার শক্তি-ক্ষমতায় অন্যকে অংশীদার বানায়।’ অর্থাৎ উদ্ধার হয়ে যাওয়ার পর তারা ভুলে যায় তাদের সঠিক ও সুদৃঢ় প্রকৃতির বার্তাকে, ভুলে যায় সে কথা যে, একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করবে বলে তারা একদিন ওয়াদা করেছিলাে এবং একাগ্রচিত্তে একমাত্র তাকেই তারা বিপদ মুক্তির জন্যে ডেকে ছিলাে। এভাবে শুভদিন ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে পেছনের সব কথা ভুলে গিয়ে ওয়াদা ও আত্মসমর্পণের কথা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর এই সত্য-বিমুখতার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করা। অস্বীকার করা তার দেয়া সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণাদিকে। হায়রে হতভাগা মানুষ। সত্য থেকে এভাবে দূরে সরে যাওয়ার পেছনে তার উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হচ্ছে স্বার্থপরতার সাথে এবং লাগামহীনভাবে দুনিয়াটাকে ভােগ করার প্রবণতা। এর ফল যা হওয়া দরকার তাই হয়। অর্থাৎ, তাদের ওপর মহাবিপর্যয়, অশান্তি ও অবক্ষয় নেমে আসে। তাদের এ মহাঅন্যায় আচরণ তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘(তাদের সে আচরণ দ্বারা) তারা অস্বীকার করতে চায় এ নেয়ামতকে যা আমি মহান আল্লাহ তাদের দিয়েছি এবং এভাবে জীবনটাকে কানায় কানায় ভােগ করতে চায়। অতপর শীঘ্রই তারা জানতে পারবে।’ এ কথা দ্বারা ইংগিতে তাদের জানিয়ে দেয়া হলো যে, অচিরেই তাদের ওপর কঠিন আযাব নেমে আসবে। এরপর তাদের জানানাে হচ্ছে যে, হারাম শরীফকে তাদের জন্যে পরম নিরাপদ এলাকা বানিয়ে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তাদের মহাসম্মান রূপ নেয়ামত দ্বারা ভূষিত করছেন, কিন্তু তারা আল্লাহর নেয়ামতের শোকর গুজারী করতে রাযি নয়, প্রস্তুত নয় একমাত্র তারই কাছে নতিস্বীকার করতে এবং ইবাদত করতে, বরং তারা মােমেনদেরও সে শিরকের মধ্যে লিপ্ত করে ফেলতে চায়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ওরা কি দেখছে না যে, আমি মহান আল্লাহ হারাম শরীফকে নিরাপদ স্থান বানিয়েছি, অথচ তার আশপাশ থেকে মানুষকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওরা কি মিথ্যার ওপর ঈমান আনবে এবং আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করবে?’ অবশ্যই এটা বাস্তব সত্য কথা যে, মক্কা নগরীতে অবস্থিত হারাম শরীফের অধিবাসীরা পরম নিরাপত্তার মধ্যে বাস করতাে। তাদের আল্লাহ রব্বুল আলামীন বায়তুল্লাহর কারণেই সম্মানিত করেছিলেন। অথচ এই মর্যাদাপূর্ণ এলাকার চতুস্পার্শ্বস্থ এলাকার লােকেরা সদা-সর্বদা লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত থাকতাে এবং তারা একে অপরকে নিরন্তর ভয়ভীতির মধ্যে নিপতিত রাখতাে। এর ফলে সেই পবিত্র ঘরের ছায়াতলে আসা ছাড়া তারা কোনােই নিরাপত্তা বােধ করতে না, যাকে আল্লাহ তায়ালা নিজে নিরাপদ রেখেছিলেন। এতদসত্তেও বড়ই আজব ব্যাপার যে, আল্লাহ রব্বুল ইযযতের সেই ঘরের মধ্যেই তারা বানিয়ে রেখেছিলাে প্রতিমার মঞ্চ। আর এর থেকে বিচিত্র ব্যাপার আর কি হতে পারে। যে সেই ঘরকেই অন্যের পূজার জন্যে বেদী বানালাে অবশ্যই সে মহাপাপাচারী ও বড় যালেম, তা সে যে-ইই হােক না কেন! ‘তাহলে তারা কি বাতিল বা মিথ্যার ওপর ঈমান আনবে এবং আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করবে?’ আরও এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তার থেকে বড় যালেম আর কে হবে যে আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরােপ করবে এবং সত্য এসে যাওয়ার পর তা প্রত্যাখ্যান করবে? (তাহলে) জাহান্নামের মধ্যেই কি কাফেরদের বাসস্থান নয়?’ এসব মােশরেকরা আল্লাহর সাথে জেনে বুঝে অন্যকে শরীক করে মিথ্যা ও অন্যায় কাজ করেছে। তারা সত্য সমাগত হওয়ার পর তা অস্বীকার করেছে এবং বেয়াদবী করেছে সত্যের সাথে। তাহলে জাহান্নামের মধ্যেই কি কাফেরদের বাসস্থান নির্ধারিত হবে না? অবশ্যই এবং সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবেই তাদের স্থান হবে জাহান্নামের মধ্যে।
# অন্য আর একটি দলের উল্লেখ করে সূরাটি সমাপ্ত করা হচ্ছে। যারা আল্লাহর পথে টিকে থাকতে গিয়ে এবং তার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জেহাদ করে, জেহাদ করে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্দেশ্যে, যারা তাঁর পথে চলতে গিয়ে মাল-সামান সংগ্রহ ও বহন করে, এরপর আর পেছনের দিকে তাকায় না বা হতাশও হয় না, যারা অন্তরের মধ্য থেকে আগত বাধা-বিপত্তির মধ্যে এবং বাইরে থেকে আসা বিপদের মধ্যে অবস্থান করার সময়ে সবর করে, যারা চাদর গায়ে দিয়ে রওয়ানা হয় সে অজানা, কষ্টকর, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর পথে… তারাই হচ্ছে সেসব মানুষ যাদের আল্লাহ রব্বুল আলামীন পরিত্যাগ করবেন না, এই বিপদসংকুল রাস্তায় অসহায় ও একাকী অবস্থায় ছেড়ে দেবেন না, তাদের ঈমান এবং তাদের জেহাদ তিনি ভুলে যাবেন না। তিনি তাঁর মহাসম্মানজনক অবস্থান থেকে তাদের কাজগুলাে পর্যবেক্ষণ করছেন, দেখছেন ও মূল্যায়ন করছেন তাদের জেহাদ এবং তিনিই দেখাবেন তাদের প্রকৃত সঠিক পথ। সত্যের পথে নিবেদিত লােকদের তিনি অবশ্যই দেখছেন এবং দেখছেন তাদের কঠোর সগ্রামী জীবন। তিনি আরও দেখছেন, এ পথে কাজ করতে গিয়ে তারা আলিংগন করে নিয়েছে এবং সকল দুঃখ জ্বালা ও দুঃসহ কষ্টের মধ্যে সবর করে চলেছেন। তিনি আরও দেখে যাচ্ছেন তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং সত্যের খাতিরে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সৌহার্দ বিনিময়কে, এ জন্যে অবশ্যই তিনি তাদের উপযুক্ত পুরস্কার ও মর্যাদা দান করবেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যারা আমার পথে টিকে থাকতে গিয়ে চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে, অবশ্যই আমি মহান আল্লাহ তাদের বহু পথ দেখাব। আর অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এহসানকারীদের সাথে রয়েছেন।’
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এর বাস্তবতা শুধুমাত্র এতটুকুই যেমন ছোট ছেলেরা কিছুক্ষণের জন্য নেচে গেয়ে আমোদ করে এবং তারপর যার যার ঘরে চলে যায়। এখানে যে রাজা হয়ে গেছে সে আসলে রাজা হয়ে যায়নি বরং শুধুমাত্র রাজার অভিনয় করছে। এক সময় তার এ খেলা শেষ হয়ে যায়। তখন সে ঠিক তেমনি দ্বীনহীন অবস্থায় রাজ সিংহাসন থেকে বিদায় নেয় যেভাবে এ দুনিয়ার বুকে এসেছিল। অনুরূপভাবে জীবনের কোন একটি আকৃতিও এখানে স্থায়ী ও চিরন্তন নয়। যে যে অবস্থায়ই আছে সাময়িকভাবে একটি সীমিত সময়কালের জন্যই আছে। মাত্র কয়েকদিনের জীবনের সাফল্যের জন্য যারা প্রাণপাত করে এবং এরই জন্য বিবেক ও ঈমান বিকিয়ে দিয়ে সামান্য কিছু আয়েশ আরামের উপকরণ ও শক্তি-প্রতিপত্তির জৌলুস করায়ত্ত করে নেয়, তাদের এ সমস্ত কাজ মন ভুলানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব খেলনার সাহায্যে তারা যদি দশ, বিশ বা ষাট সত্তর বছর মন ভুলানোর কাজ করে থাকে এবং তারপর শূন্য হাতে মৃত্যুর দরোজা অতিক্রম করে ভ্রমণ জগতে পৌঁছে যায় সেখানকার স্থায়ী ও চিরন্তন জীবনে তাদের এ খেলা এক প্রতিপত্তিহীন রোগে পরিণত হয়, তাহলে এ ছেলে ভুলানোর লাভ কি?
# যদি তারা একথা জানতো, এ দুনিয়ার জীবন একটি পরীক্ষার অবকাশ মাত্র এবং মানুষের জন্য আসল জীবন, যা চিরকাল স্থায়ী হবে, তা হচ্ছে আখেরাতের জীবন, তাহলে তারা এখানে পরীক্ষার সময় কালকে খেলা তামাশায় নষ্ট না করে এর প্রতিটি মুহূর্ত এমনসব কাজে ব্যবহার করতো যা সেই চিরন্তন জীবনের জন্য উৎকৃষ্ট ফলদায়ক হতো।
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আন’আম ২৯ ও ৪১ ; সূরা ইউসুফ ২৯ ও ৩১ এবং সূরা বনী ইসরাঈল ৮৪ টীকা।
# তারা যে মক্কা শহরে বাস করে, যে শহরে তারা পূর্ণ নিরাপদ জীবন যাপন করছে, কোন লাত বা হুবল কি একে হারম তথা নিরাপদ স্থানে পরিণত করেছে? আরবের আড়াই হাজার বছরের চরম অশান্তি ও নৈরাজ্যের পরিবেশ এ স্থানটিকে সকল প্রকার বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় মুক্ত রাখার কি কোন দেবতা বা দেবীর সাধ্যায়াত্ত ছিল? আমি ছাড়া আর কে এর মর্যাদা রক্ষাকারী ছিল?
# নবী রিসালাতের দাবী করেছেন এবং তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করেছো। এখন বিষয়টি দু’টি অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। নবী যদি আল্লাহর নাম নিয়ে মিথ্যা দাবী করে থাকেন, তাহলে তার চেয়ে বড় জালেম আর কেউ নেই। আর যদি তোমরা সত্য নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে থাকো, তাহলে তোমাদের চেয়ে বড় জালেম আর কেউ নেই।
# “সংগ্রাম-সাধনার” ব্যাখ্যা এ সূরা আনকাবুতের ৮ টীকায় করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি সংগ্রাম-সাধনা করবে সে নিজের ভালোর জন্য করবে (৬ আয়াত)। এখানে এ নিশ্চিন্ততা দান করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর পথে আন্তরিকতা সহকারে সারা দুনিয়ার সাথে সংঘর্ষের বিপদ মাথা পেতে নেয় তাদেরকে পথ দেখান এবং তার দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন। তারা তার সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন। পথের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাদেরকে আলো দেখান। যার ফলে কোনটা সঠিক পথ ও কোনটা ভুল পথ তা তারা দেখতে চায়। তাদের নিয়ত যতই সৎ ও সদিচ্ছা প্রসূত হয় ততই আল্লাহর সাহায্য, সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও হিদায়াতও তাদের সহযোগি হয়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
# (وَمَا هٰذِهِ الْحَيٰوةُ الدُّنْيَآ…. وَلِیَتَمَتَّعُوْا فَسَوْفَ یَعْلَمُوْنَ)
এখানে দুনিয়ার জীবনকে ক্রীড়াকৌতুক বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলন ক্রীড়াকৌতুকের যেমন কোন স্থিতিশীলতা নেই, তেমন পৃথিবীর কোন স্থিতিশীলতা নেই। কখন তা ধ্বংস করে দেয়া হবে তা কেউ জানেনা। তাই হাদীসে এসেছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস কর যেন তুমি একজন অপরিচিত লোক, অথবা একজন পথিক। অর্থাৎ পথিক যেমন বেশিক্ষণ পথে অবস্থান করেনা তেমনিভাবে দুনিয়াতে বসবাস কর। ইবনু উমার (রাঃ) বলতেন: যখন তুমি বিকাল করবে তখন সকালের অপেক্ষা করো না আর যখন সকাল করবে তখন বিকালের অপেক্ষা করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪১৬) ইবনু মাযায় এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াটা তেমন যেমন তোমাদের কেউ সাগরে আঙ্গুল দিয়ে পানি তুললে যতটুকু পরিমাণ আসে। সে যেন লক্ষ্য করে দেখে কতটুকু পরিমাণ পানি আনতে পেরেছে। (ইবনু মাযাহ হা: ৪১০৮, সহীহ)
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, প্রকৃত জীবন তো আখিরাতের জীবন। যে জীবনের কোন শেষ নেই, যারা জান্নাতে যাবে তাদের সেখানে কোন কষ্ট, বেদনা কিছুই থাকবে না। থাকবে শুধু সুখ আর সুখ।
সুতরাং মানুষ যদি জানত আখিরাত কী তাহলে দুনিয়াতে অন্যায় কাজ করতো না, আখিরাতের ওপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিত না।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মানুষের একটি মন্দ অভ্যাসের বর্ণনা দিচ্ছেন, যখন তারা বিপদগ্রস্ত হয়, যেমন সমুদ্রে চলাচল করছে এমন সময় বিশাল ঢেউ এসে ডুবিয়ে দেবে এমন অবস্থায় উপনীত হয় তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকে, আবার যখন এ বিপদ থেকে তাদেরকে উদ্ধার করা হয় তখনই আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করে। অর্থাৎ বলে যদি মাঝি ভাল না হত তাহলে যে ঢেউ এসেছিল তাতে বাঁচার কোন উপায় ছিল না, ড্রাইভার ভাল না হলে দুর্ঘটনা ঘটেই যেত ইত্যাদি। অথচ আল্লাহ তা‘আলা যে রক্ষা করলেন সে কথা মনে রাখে না এবং একবার শুকরিয়াও আদায় করে না। এ সম্পর্কে সূরা বানী ইসরাঈলের ১৭ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَمَا ھٰذِھِ الْحَیٰوةُ الدُّنْیَآ اِلَّا لَھْوٌ وَّلَعِبٌ… وَاِنَّ اللہَ لَمَعَ الْمُحْسِنِیْنَ)
ওপরের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে মক্কার মুশরিকরা বিশ্বাস করত সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। এমনকি বিপদ থেকে মুক্তিদাতাও আল্লাহ তা‘আলা বলে বিশ্বাস করত। কিন্তু বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করেই আবার শিরকে লিপ্ত হত। এখানে আল্লাহ তা‘আলা মক্কার কুরাইশদের ওপর যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি তাদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা হারাম শরীফে স্থান দিয়েছেন। মু’মিন কাফির নির্বিশেষে যে কেউ এখানে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। কোন প্রকার হত্যা, লুন্ঠন, শিকার, বৃক্ষ কর্তন ইত্যাদি করা যাবে না। অথচ পাশেই যারা বসবাস করে তারা এরূপ নিরাপত্তা পায় না। সুতরাং তাদের এ নেয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা উচিত। يُتَخَطَّفُ শব্দের অর্থ ছোঁ মেরে নেয়া। অর্থাৎ হারামের পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকেরা হামলা ও লুণ্ঠনের নির্যাতন থেকে নিরাপদ নয়। তাদেরকে যে কোন সময় হামলা করে উধাও করে দেয়া হতে পারে, কিন্তু তোমরা এরূপ আতঙ্ক থেকে নিরাপদ। এতসব নেয়ামত পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতের কুফরী কর এবং তাঁর সাথে শির্ক কর।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَلَمْ تَرَ إِلَي الَّذِيْنَ بَدَّلُوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ كُفْرًا وَّأَحَلُّوْا قَوْمَهُمْ دَارَ الْبَوَارِ)
“তুমি কি তাদেরকে লক্ষ্য কর না যারা আল্লাহর অনুগ্রহের বদলে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং তারা তাদের সম্প্রদায়কে নামিয়ে আনে ধ্বংসের দ্বারে।” (সূরা ইবরাহীম ১৪:২৮)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা আল্লাহ তা‘আলার নামে মিথ্যা কথা বলে, অথবা তাঁর নিকট হতে আগত সত্যকে অস্বীকার করে সে হচ্ছে সবচেয়ে বড় জালিম। আর তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম।
(وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا….) جهاد
শব্দের অর্থন প্রচেষ্টা করা, ঈমান আনা থেকে শুরু করে যাবতীয় সৎ আমল করা ও অসৎ আমল থেকে বিরত থাকা এমনকি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা পর্যন্ত এখানে সব শামিল। ঈমান আনতেও প্রচেষ্টা করতে হয়, কেননা শয়তান এতে কঠোরভাবে বাধা দেয়। কারণ একজন ব্যক্তি ঈমান আনলে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি সত্য পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সঠিক পথ দেখাবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় শত্র“র বিরুদ্ধে জিহাদ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জান্নাতের পথ দেখাবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাহায্য, সহযোগিতা দিয়ে সৎ কর্মশীলদের সাথে রয়েছেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
* সকল বিপদাপদ থেকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই রক্ষা করেন আর মানুষ উসিলা মাত্র। তাই কেবল আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
* বায়তুল্লাহর মর্যাদা অবগত হলাম।
*আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যারোপ করা সবচেয়ে বড় জুলুম।
*সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলে জানতে হবে। সত্যকে মিথ্যা বলা যাবে না। আবার মিথ্যাকে সত্য বলা যাবে না।
*আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় সংগ্রাম করার ফযীলত অনেক।
*আল্লাহ তা‘আলা সৎ কর্মপরায়ণ লোকদেরকে সর্বদা সাহায্য করেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৬৪-৬৬ নং আয়াতের তাফসীর
দুনিয়ার তুচ্ছতা, ঘৃণ্যতা, নশ্বরতা এবং ধ্বংসশীলতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, এর কোন স্থায়িত্ব নেই। এ দুনিয়া তো খেল-তামাশার জায়গা ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষান্তরে আখিরাতের জীবন হচ্ছে স্থায়ী ও অবিনশ্বর। এটা ধ্বংস, নষ্ট,হ্রাস ও তুচ্ছতা হতে মুক্ত। যদি তাদের জ্ঞান বুদ্ধি থাকতো তবে কখনো এই স্থায়ী জিনিসের উপর অস্থায়ী জিনিসকে প্রাধান্য দিতো না।
এরপর মহান আল্লাহ বলেন যে, এই মুশরিকরা অসহায় ও নিরুপায় অবস্থায় এক ও অংশী বিহীন আল্লাহকে ডাকতে শুরু করে। অতঃপর যখন বিপদ কেটে যায় এবং কষ্ট দূর হয়ে যায় তখন অন্যদেরকে ডাকতে শুরু করে দেয়। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবি)
অর্থাৎ “সমুদ্রে যখন তোমাদেরকে কষ্ট ও বিপদ আপদ স্পর্শ করে তখন যাদেরকে ডাকতে তাদের সবকে ভুলে গিয়ে একমাত্র তাঁকেই ডেকে থাকো, অতঃপর যখন তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়ে স্থলভাগে নিয়ে আসেন তখন তোমরা তার থেকে বিমুখ হয়ে যাও।” (১৭:৬৭) আর এখানে মহান আল্লাহ বলেনঃ অতঃপর তিনি যখন স্থলে ভিড়িয়ে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখন তারা শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন মক্কা জয় করেন তখন ইকরামা (রাঃ) ইবনে আবি জেহেল সেখান হতে পালিয়ে যান এবং হাবশায় গমনের ইচ্ছা করে নৌকায় আরোহণ করেন। ঘটনাক্রমে ভীষণ ঝড়-তুফান শুরু হয়ে যায় এবং নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। নৌকায় যত মুশরিক ছিল সবাই বলে ওঠেঃ “এটা হলো এক আল্লাহকে ডাকার সময়। ওঠো এবং এসো, আমরা মুক্তির জন্যে তাঁরই নিকট বিশুদ্ধচিত্তে প্রার্থনা করি। এখন মুক্তি দেয়ার ও উদ্ধার করার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই আছে।” একথা শোনা মাত্রই ইকরামা (রাঃ) বলে উঠেনঃ “দেখো, আল্লাহর কসম! সমুদ্রের বিপদে যদি উদ্ধার করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই থাকে তবে স্থল ভাগের বিপদ হতেও উদ্ধার করার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই রয়েছে। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট অঙ্গীকার করছি যে, যদি আমি এই বিপদ হতে রক্ষা পাই তবে সরাসরি গিয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর হাতে হাত রেখে তার কালেমা পাঠ করবো। আমার বিশ্বাস আছে যে, আল্লাহর রাসূল (সঃ) আমার অপরাধ মার্জনা করবেন এবং আমার প্রতি দয়া করবেন। তিনি তাই করেন।
(আরবি) এবং (আরবি) শব্দদ্বয়ের শুরুতে যে (আরবি) অক্ষরটি রয়েছে একে (আরবি) (পরিণাম সম্বন্ধীয় (আরবি) বলা হয়েছে। কেননা, তারা ওটা ইচ্ছা করে না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যখন তাদের দিকে সম্বন্ধ লাগানো হবে তখন এটা হবে(আরবি) বা পরিণাম সম্বন্ধীয় লাম। তবে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত হলে ওটা হবে (আরবি) বা কারণ সম্বন্ধীয় লাম।।(আরবি) (২৮:৮) এই আয়াতের তাফসীরে আমরা এটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি।
৬৭-৬৯ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা কুরায়েশদের উপর নিজের একটি অনুগ্রহের কথা বলছেন যে, তিনি তাদেরকে নিজের হারম শরীফে স্থান দিয়েছেন। এটা এমন এক জায়গা যে, এখানে কেউ প্রবেশ করলে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। এর আশেপাশে যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং লুটপাট হতে থাকে। কিন্তু এখানকার অধিবাসীরা সুখে-শান্তিতে ও নিরাপদে জীবন যাপন করে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “যেহেতু কুরায়েশের আসক্তি আছে, আসক্তি আছে তাদের শীত ও গ্রীষ্মে সফরের। তারা ইবাদত করুক এই গৃহের রক্ষকের যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি হতে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।” (১০৬:১) তাহলে এতো বড় নিয়ামতের শুকরিয়া কি এটাই যে, তারা আল্লাহর সাথে অন্যদেরও ইবাদত করবে? ঈমান আনয়নের পরিবর্তে কুফরী করবে? এবং নিজেরা ধ্বংস হয়ে অন্যদেরকেও ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে? তাদের তো উচিত ছিল যে, তারা এক আল্লাহর ইবাদত করার ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী। থাকবে এবং শেষ নবী (সঃ)-এর পুরোপুরি অনুসারী হবে। কিন্তু এর বিপরীত তারা আল্লাহর সাথে শিরক করতে, কুফরী করতে এবং নবী (সঃ)-কে অবিশ্বাস করতে ও তাকে কষ্ট দিতে শুরু করে দিয়েছে। তাদের ঔদ্ধত্য এমন চরমে পৌঁছেছে যে, তারা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে মক্কা থেকে বের করে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। অবশেষে আল্লাহর নিয়ামত তাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। বদরের যুদ্ধে তাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা নিহত হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-এর হাতে মক্কা জয় করিয়েছেন এবং তাদেরকে করেছেন লাঞ্ছিত ও অপমানিত।
তার চেয়ে বড় যালিম আর কেউ হতে পারে না, যে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে। অহী না আসলেও বলে যে, তার উপর আল্লাহর অহী এসেছে। তার চেয়েও বড় যালিম কেউ নেই যে আল্লাহর সত্য অহীকে এবং সত্যকে অবিশ্বাস করে এবং হক এসে যাওয়ার পরেও ওকে অবিশ্বাস করার কাজে উঠে পড়ে লেগে যায়। এইরূপ মিথ্যা আরোপকারী ও অবিশ্বাসকারী লোকেরা কাফির। আর তাদের বাসস্থান জাহান্নাম।
আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সঃ), তাঁর সাহাবীবর্গ এবং তাঁর অনুসারীদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রামকারীদেরকে অবশ্যই আমি আমার পথে পরিচালিত করবো।’ হযরত আবূ আহমাদ আব্বাস হামাদানী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ যারা নিজেদের ইলম অনুযায়ী আমল করে, আল্লাহ তাদেরকে ঐ সব বিষয়েও সুপথ প্রদর্শন করবেন যা তাদের ইলমের মধ্যে নেই।
আবু সালমান দারানী (রঃ)-এর সামনে এটা বর্ণনা করা হলে তিনি বলেনঃ যার অন্তরে কোন কথা জেগে ওঠে, যদিও তা ভাল কথাও হয়, তবুও ওর উপর আমল করা ঠিক হবে না যে পর্যন্ত না কুরআন ও হাদীস দ্বারা ওটা প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয়ে গেলে ওর উপর আমল করতে হবে এবং আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে যে, তিনি তার অন্তরে এমন কথা জাগিয়ে দিয়েছেন যা কুরআন ও হাদীস দ্বারাও সাব্যস্ত হয়ে গেছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে রয়েছেন।
হযরত ঈসা (আঃ) বলেনঃ “ইহসান হচ্ছে ওরই নাম যে, যে তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করে তুমি তার সাথে সদ্ব্যবহার কর। যে সদ্ব্যবহার করে তার সাথে সদ্ব্যবহার করার নাম ইহসান নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#1027)
[The world life vision:-]
www.motaher21.net
Sura:29
Para:21
Sura: Al-Ankabut
Ayat: – 64-69
29:64
وَ مَا ہٰذِہِ الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا لَہۡوٌ وَّ لَعِبٌ ؕ وَ اِنَّ الدَّارَ الۡاٰخِرَۃَ لَہِیَ الۡحَیَوَانُ ۘ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶۴﴾
And this worldly life is not but diversion and amusement. And indeed, the home of the Hereafter – that is the [eternal] life, if only they knew.
Allah says:
وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلاَّ لَهْوٌ وَلَعِبٌ
And this life of the world is only an amusement and a play!
Allah tells us how insignificant and transient this world is, and how it will soon end. All that it is, is amusement and play:
وَإِنَّ الدَّارَ الاْإخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ
Verily, the home of the Hereafter — that is the life indeed,
means, the true everlasting life that will never end, but will continue forever and ever.
لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
if they but knew.
means, they would prefer that which will last over that which will pass away.
Then Allah says that at times of calamity, the idolators call upon Him alone, with no partner or associate, so why do they not do that all the time!
29:65
فَاِذَا رَکِبُوۡا فِی الۡفُلۡکِ دَعَوُا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۚ فَلَمَّا نَجّٰہُمۡ اِلَی الۡبَرِّ اِذَا ہُمۡ یُشۡرِکُوۡنَ ﴿ۙ۶۵﴾
And when they board a ship, they supplicate Allah, sincere to Him in religion. But when He delivers them to the land, at once they associate others with Him
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ
And when they embark on a ship, they invoke Allah, making their faith pure for Him only,
This is like the Ayah,
وَإِذَا مَسَّكُمُ الْضُّرُّ فِى الْبَحْرِ ضَلَّ مَن تَدْعُونَ إِلَا إِيَّاهُ فَلَمَّا نَجَّـكُمْ إِلَى الْبَرِّ أَعْرَضْتُمْ
And when harm touches you upon the sea, those that you call upon vanish from you except Him (Allah Alone). But when He brings you safely to land, you turn away. (17:67)
Allah says here:
فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
but when He brings them safely to land, behold, they give a share of their worship to others.
Muhammad bin Ishaq reported from Ikrimah bin Abi Jahl that when the Messenger of Allah conquered Makkah, he (Ikrimah) ran away, fleeing from him. When he was on the sea, headed for Ethiopia, the ship started to rock and the crew said:
“O people, pray sincerely to your Lord alone, for no one can save us from this except Him.”
Ikrimah said:
“By Allah, if there is none who can save us on the sea except Him, then there is none who can save us on land except Him either, O Allah, I vow to You that if I come out of this, I will go and put my hand in the hand of Muhammad and I will find him kind and merciful.”
And this is what indeed did happen.
Allah says:
لِيَكْفُرُوا بِمَا اتَيْنَاهُمْ وَلِيَتَمَتَّعُوا فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ
29:66
لِیَکۡفُرُوۡا بِمَاۤ اٰتَیۡنٰہُمۡ ۚۙ وَ لِیَتَمَتَّعُوۡا ٝ فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶۶﴾
So that they will deny what We have granted them, and they will enjoy themselves. But they are going to know.
So that they become ingrate for that which We have given them, and that they take their enjoyment, but they will come to know
29:67
اَوَ لَمۡ یَرَوۡا اَنَّا جَعَلۡنَا حَرَمًا اٰمِنًا وَّ یُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنۡ حَوۡلِہِمۡ ؕ اَفَبِالۡبَاطِلِ یُؤۡمِنُوۡنَ وَ بِنِعۡمَۃِ اللّٰہِ یَکۡفُرُوۡنَ ﴿۶۷﴾
Have they not seen that We made [Makkah] a safe sanctuary, while people are being taken away all around them? Then in falsehood do they believe, and in the favor of Allah they disbelieve?
The Blessing of the Sanctuary Here
Allah says:
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَمًا امِنًا وَيُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنْ حَوْلِهِمْ
Have they not seen that We have made a secure sanctuary, while men are being snatched away from all around them! Then do they believe in falsehood, and deny the graces of Allah
Allah reminds Quraysh how He blessed them by granting them access to His sanctuary which He has made (open) to (all) men, the dweller in it and the visitor from the country are equal there, and whoever enters it is safe, because he is in a place of great security, although the Arabs of the desert round about used to ambush and raid one another and kill one another.
As Allah says:
لاإِيلَـفِ قُرَيْشٍ
إِيلَـفِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَأءِ وَالصَّيْفِ
فَلْيَعْبُدُواْ رَبَّ هَـذَا الْبَيْتِ
الَّذِى أَطْعَمَهُم مِّن جُوعٍ وَءَامَنَهُم مِّنْ خوْفٍ
For the protection of the Quraysh. The caravans to set forth safe in winter and in summer. So let them worship the Lord of this House. Who has fed them against hunger, and has made them safe from fear. (106:1-4)
أَفَبِالْبَاطِلِ يُوْمِنُونَ وَبِنِعْمَةِ اللَّهِ يَكْفُرُونَ
Then do they believe in falsehood, and deny the graces of Allah.
means, is the thanks that they give for this immense blessing to associate others with Him and worship others besides Him, idols and rivals
بَدَّلُواْ نِعْمَتَ اللَّهِ كُفْرًا وَأَحَلُّواْ قَوْمَهُمْ دَارَ الْبَوَارِ
Have you not seen those who have changed the blessings of Allah into disbelief, and caused their people to dwell in the house of destruction! (14:28)
They disbelieved in the Prophet, servant and Messenger of Allah , when what they should have done was to worship Allah Alone and not associate anything with Him, and to believe in, honor and respect the Messenger, but they rejected him and fought him, and expelled him from their midst. So, Allah took His blessing away from them, and killed those of them whom He killed at Badr, then His Messenger and the believers gained the upper hand, and Allah enabled His Messenger to conquer Makkah, and He disgraced them and humiliated them (the disbelievers).
Then Allah says
29:68
وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰہِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِالۡحَقِّ لَمَّا جَآءَہٗ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَہَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۶۸﴾
And who is more unjust than one who invents a lie about Allah or denies the truth when it has come to him? Is there not in Hell a [sufficient] residence for the disbelievers?
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءهُ
And who does more wrong than he who invents a lie against Allah or denies the truth, when it comes to him!
There is no one who will be more severely punished than one who tells lies about Allah and says that Allah revealed something to him at the time when Allah did not reveal anything to him, or says, `I shall reveal something like that which Allah revealed.’
And there is no one who will be more severely punished than one who denies the truth when it comes to him, for the former is a fabricator and the latter is a disbeliever.
Allah says:
أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْكَافِرِينَ
Is there not a dwelling in Hell for the disbelievers!
Then Allah says
29:69
وَ الَّذِیۡنَ جَاہَدُوۡا فِیۡنَا لَنَہۡدِیَنَّہُمۡ سُبُلَنَا ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَمَعَ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿٪۶۹﴾
And those who strive for Us – We will surely guide them to Our ways. And indeed, Allah is with the doers of good.
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا
As for those who strive hard for Us,
meaning the Messenger and his Companions and those who follow him, until the Day of Resurrection,
لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
We will surely guide them to Our paths.
means, `We will help them to follow Our path in this world and the Hereafter.’
Ibn Abi Hatim narrated that Abbas Al-Hamdani Abu Ahmad — one of the people of Akka (Palestine) — said, concerning the Ayah:
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
As for those who strive hard for Us (in Our cause), We will surely guide them to Our paths. And verily, Allah is with the doers of good.
“Those who act upon what they know, Allah will guide them to that which they do not know.”
Ahmad bin Abu Al-Hawari said,
“I told this to Abu Sulayman Ad-Darani, and he liked it and said:`No one who is inspired to do something good should do it until he hears a report concerning that; if he hears a report then he should go ahead and do it, and praise Allah because it was in accordance with what he himself felt.”‘
وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
And verily, Allah is with the doers of good.
Ibn Abi Hatim recorded that Ash-Sha`bi said;
“Isa bin Maryam, peace be upon him, said:
`Righteousness means doing good to those who ill-treat you, it does not mean doing good to those who do good to you.”‘
And Allah knows best.
This is the end of the Tafsir of Surah Al-`Ankabut. All praise and thanks are due to Allah
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran