أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০২৮)
[ অকাট্য সত্য ভবিষ্যদ্বাণী:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩০:আর্-রূম
পারা:২১
১-৭ নং আয়াত:-
৩০:১
الٓـمّٓ ۚ﴿۱﴾
আলিফ-লাম-মীম
৩০:২
غُلِبَتِ الرُّوۡمُ ۙ﴿۲﴾
রোমকগণ পরাজিত হয়েছে–
৩০:৩
فِیۡۤ اَدۡنَی الۡاَرۡضِ وَ ہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ غَلَبِہِمۡ سَیَغۡلِبُوۡنَ ۙ﴿۳﴾
নিকটবর্তী অঞ্চলে। কিন্তু ওরা ওদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয় লাভ করবে–
৩০:৪
فِیۡ بِضۡعِ سِنِیۡنَ ۬ؕ لِلّٰہِ الۡاَمۡرُ مِنۡ قَبۡلُ وَ مِنۡۢ بَعۡدُ ؕ وَ یَوۡمَئِذٍ یَّفۡرَحُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ﴿۴﴾
কয়েক বছরের মধ্যে । ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আগেও আল্লাহরই ছিল। পরেও তাঁরই থাকবে। আর সেদিনটি হবে এমন দিন যেদিন মুসলমানরা আনন্দে উৎফুল্ল হবে।
৩০:৫
بِنَصۡرِ اللّٰہِ ؕ یَنۡصُرُ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ۙ﴿۵﴾
আল্লাহ প্রদত্ত বিজয়ে । আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী ও মেহেরবান।
৩০:৬
وَعۡدَ اللّٰہِ ؕ لَا یُخۡلِفُ اللّٰہُ وَعۡدَہٗ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶﴾
এটা আল্লাহরই প্রতিশ্রুতি ; আল্লাহ্ তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।
৩০:৭
یَعۡلَمُوۡنَ ظَاہِرًا مِّنَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚۖ وَ ہُمۡ عَنِ الۡاٰخِرَۃِ ہُمۡ غٰفِلُوۡنَ ﴿۷﴾
ওরা পার্থিব জীবনের বাহ্য দিক সম্বন্ধে অবগত, অথচ পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধে ওরা উদাসীন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৩০-রূম) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতের غُلِبَتِ الرُّومُ থেকে সূরার নাম গৃহীত হয়েছে।
(৩০-রূম) : নাযিলের সময়কাল:
শুরুতেই যে ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা থেকে নাযিলের সময়-কাল চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। এখানে বলা হয়েছে যে, “নিকটবর্তী দেশে রোমীয়রা পরাজিত হয়েছে।” সে সময় আরবের সন্নিহিত রোম অধিকৃত এলাকা ছিল জর্দান, সিরিয়া ও ফিলিস্তীন। এসব এলাকায় রোমানদের ওপর ইরানীদের বিজয় ৬১৫ খৃষ্টাব্দে পূর্ণতা লাভ করেছিল। এ থেকে পূর্ণ নিশ্চয়তা সহকারে বলা যেতে পারে যে, এ সূরাটি সে বছরই নাযিল হয় এবং হাবশায় হিজরতও এ বছরই অনুষ্ঠিত হয়।
(৩০-রূম) : প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক পটভূমি:
এ সূরার প্রথম দিকের আয়াতগুলোতে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা কুরআন মজীদের আল্লাহর কালাম এবং মুহাম্মদ (সা.) এর সত্য রসূল হবার সুস্পষ্ট প্রমাণগুলোর অন্যতম। এটি অনুধাবন করার জন্য এ আয়াতগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
। নবী (সা.) এর নবুয়াত লাভের ৮ বছর আগের একটি ঘটনা। রোমের কায়সার মরিসের (Mauric) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়। ফোকাস (Phocas) নামক এক ব্যক্তি রাজ সিংহাসন দখল করে। সে প্রথমে কায়সারের চোখের সামনে তার পাঁচ পুত্রকে হত্যা করায় তারপর নিজে কায়সারকে হত্যা করে পিতা ও পুত্রদের কর্তিত মস্তকগুলো কনস্ট্যান্টিনোপলে প্রকাশ্য রাজপথে টাঙিয়ে দেয়। এর কয়েকদিন পর সে কায়সারের স্ত্রী ও তাঁর তিন কন্যাকেও হত্যা করে। এ ঘটনার ফলে ইরানের বাদশাহ খসরু পারভেজ রোম আক্রমণ করার চমৎকার নৈতিক অযুহাত খুঁজে পান। কায়সার মরিস ছিলেন তার অনুগ্রাহক। তার সহায়তায় পারভেজ ইরানের সিংহাসন দখল করেন। তাই তিনি তাকে নিজের পিতা বলতেন। এ কারণে তিনি ঘোষণা করেন, বিশ্বাসঘাতক ফোকাস আমার পিতৃতুল্য ব্যক্তি ও তার সন্তানদের প্রতি যে জুলুম করেছে আমি তার প্রতিশোধ নেবো। ৬০৩ খৃষ্টাব্দে তিনি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে ফোকাসের সেনাবাহিনীকে একের পর এক পরাজিত করে একদিকে এশিয়া মাইনরের এডেসার (বর্তমান উরফা) এবং অন্যদিকে সিরিয়ার হালব ও আন্তাকিয়ায় পৌঁছে যান। রোমের রাজ পরিষদ যখন দেখলো ফোকাস দেশ রক্ষা করতে পারছে না তখন তারা আফ্রিকার গভর্ণরের সাহায্য চাইলো। গভর্ণর তার পুত্র হিরাক্লিয়াসকে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী সহকারে কনস্ট্যান্টিনোপলে পাঠান। তারা সেখানে পৌঁছে যাবার সাথে সাথেই ফোকাসকে পদচ্যুত করা হয়। তার পরিবর্তে হিরাক্লিয়াসকে কায়সার পদে অভিষিক্ত করা হয়। তিনি ক্ষমতাসীন হয়েই ফোকাসের সাথে একই ব্যবহার করেন যা সে ইতিপূর্বে মরিসের সাথে করেছিল। এটি ছিল ৬১০ খৃষ্টাব্দের ঘটনা এবং এ বছর নবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়াত লাভ করেন।
। খসরু পারভেজ যে নৈতিক বাহানাবাজির ভিত্তিতে যুদ্ধ করেছিলেন। ফোকাসের পদচ্যুতি ও তার হত্যার পর তা খতম হয়ে গিয়েছিল। যদি সত্যিই বিশ্বাসঘাত ফোকাসের থেকে তার জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করাই তার উদ্দেশ্যে থাকতো তাহলে তার নিহত হবার পর নতুন কায়সারের সাথে পারভেজের সন্ধি করে নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি এরপরও যুদ্ধ জারি রাখেন। বরং এরপর তিনি এ যুদ্ধকে অগ্নি উপাসক ও খৃষ্টবাদের মধ্যে ধর্মীয় যুদ্ধের রূপ দেন। খৃষ্টানদের যেসব সম্প্রদায়কে ধর্মচ্যুত ও নাস্তিক গণ্য করে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় গীর্জা বছরের পর বছর ধরে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল (অর্থাৎ নাস্তুরী, ইয়াকূবী ইত্যাদি) তারাও আক্রমণকারী অগ্নি উপাসকদের প্রতি সর্বাত্মক সহানুভূতি দেখাতে থাকে। এদিকে ইহুদীরাও অগ্নি উপাসকদেরকে সমর্থন দেয়। এমন কি খসরু পারভেজের সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণকারী ইহুদী সৈন্যদের সংখ্যা ২৬ হাজারে পৌঁছে যায়।
। হিরাক্লিয়াস এসে এ বাঁধা ভাঙ্গা স্রোত রোধ করতে পারেন নি। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই পূর্বদেশ থেকে প্রথম যে খবরটি তার কাছে পৌঁছে সেটি ছিল ইরানীদের হাতে আন্তাকিয়ার পতন। তারপর ৬১৩ খৃষ্টাব্দে তারা দামেশক দখল করে। ৬১৪ খৃষ্টাব্দে বায়তুল মাকদিস দখল করে ইরানীরা সমগ্র খৃষ্টান জগতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ৯০ হাজার খৃষ্টানকে এই শহরে হত্যা করা হয়। তাদের সবচেয়ে পবিত্র আল কিয়ামাহ গীর্জা (Holy Scpulchre) ধ্বংস করে দেয়া হয়। আসল ক্রুশ দণ্ডটি, যে সম্পর্কে খৃষ্টানদের বিশ্বাস হযরত মসীহকে তাতেই শূলীবিদ্ধ করা হয়েছিল, ইরানীরা ছিনিয়ে নিয়ে মাদায়েন পৌঁছিয়ে দেয়। আর্চবিশপ যাকারিয়াকেও পাকড়াও করা হয় এবং শহরের সমস্ত বড় বড় গীর্জা তারা ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। খসরু পারভেজ বিজয়ের নেশায় যেভাবে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তা বায়তুল মাকদিস থেকে হিরাক্লিয়াসকে তিনি যে পত্রটি লিখেছিলেন তা থেকে আন্দাজ করা যায়। তাতে তিনি বলেন: “সকল খোদার বড় খোদা, সমগ্র পৃথিবীর অধিকারী খসরুর পক্ষ থেকে তার নীচ ও মূর্খ অজ্ঞ বান্দা হিরাক্লিয়াসের নামে- “তুমি বলে থাকো, তোমার খোদার প্রতি তোমার আস্থা আছে। তোমার খোদা আমার হাত থেকে জেরুশালেম রক্ষা করলেন না কেন ?”
। এ বিজয়ের পর এক বছরের মধ্যে ইরানী সেনাদল জর্দান, ফিলিস্তীন ও সমগ্র সিনাই উপদ্বীপ দখল করে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা মিসর পর্যন্ত বিস্তৃত করে। এটা এমন এক সময় ছিল যখন মক্কা মু’আযযামায় এর চাইতে আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ চলছিল। এখানে মুহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্বাধীনে তাওহীদের পতাকাবাহীরা কুরাইশ সরদারদের নেতৃত্বে শির্কের পতাকাবাহীদের সাথে যুদ্ধরত ছিল। এ অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, ৬১৫ খৃষ্টাব্দে বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে স্বদেশ ত্যাগ করে হাবশার খৃষ্টান রাজ্যে (রোম সাম্রাজ্যের মিত্র দেশ) আশ্রয় নিতে হয়। এ সময় রোম সাম্রাজ্যে ইরানের বিজয় অভিযানের কথা ছিল সবার মুখে মুখে, মক্কার মুশরিকরা এসব কথায় আহলাদে আটখানা হয়ে উঠেছিল। তারা মুসলমানদের বলতো, দেখো, ইরানের অগ্নি উপাসকরা বিজয় লাভ করেছে এবং অহী ও নবুয়াত অনুসারী খৃষ্টানরা একের পর এক পরাজিত হয়ে চলছে। অনুরূপভাবে আমরা আরবের মূর্তিপূজারীরাও তোমাদেরকে এবং তোমাদের দ্বীনকে ধ্বংস করে ছাড়বো।
। এ অবস্থায় কুরআন মাজীদের এ সূরাটি নাযিল হয় এবং এখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়: “নিকটবর্তী দেশে রোমানরা পরাজিত হয়েছে কিন্তু এ পরাজয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যেই আবার তারা বিজয়ী হবে।” এর মধ্যে একটির পরিবর্তে দুটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, রোমানরা জয়লাভ করবে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মুসলমানরাও একই সময় বিজয় লাভ করবে। আপাত:দৃষ্টিতে এ দুটি ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো একটিরও কয়েক বছরের মধ্যে সত্যে পরিণত হবার দূরতম সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছিল না। একদিকে ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুসলমান। তারা মক্কায় নির্যাতিত হয়ে চলছিল। এ ভবিষদ্বাণীর পরও আট বছর পর্যন্ত কোনো দিক থেকে তাদের বিজয় লাভের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। অন্যদিকে রোমের পরাজয়ের বহর দিনের পর দিন বেড়েই চলছিল। ৬১৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র মিশর পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে চলে এসেছিল। অগ্নি উপাসক সেনাদল ত্রিপোলির সন্নিকটে পৌঁছে তাদের পতাকা গেঁড়ে দিয়েছিল। এশিয়া মাইনরে ইরানী সেনাদল রোমানদের বিতাড়িত ও বিধ্বস্ত করতে করতে বসফোরাস প্রণালীতে পৌঁছে গিয়েছিল। ৬১৭ সালে তারা কনস্ট্যান্টিনোপলের সামনে খিলকদুন (Chalccdon: বর্তমান কাযীকোই) দখল করে নিয়েছিল। কায়সার খসরুর কাছে দূত পাঠিয়ে অত্যন্ত বিনয় ও দ্বীনতা সহকারে আবেদন করলেন, আমি যে কোনো মূল্যে সন্ধি করতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি জবাব দিলেন: “এখন আমি কায়সারকে ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তা দেবো না যতক্ষণ না তিনি শৃঙ্খলিত অবস্থায় আমার সামনে হাজির হন এবং তার শূলীবিদ্ধ ঈশ্বরকে ত্যাগ করে অগ্নি খোদার উপাসনা করেন।” অবশেষে কায়সার এমনই পরাজিত মনোভাব সম্পন্ন হয়ে পড়লেন যে, তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল ত্যাগ করে কার্থেজে (Carthage: বর্তমান টিউনিস) চলে যাবার পরিকল্পনা করলেন। মোটকথা ইংরেজ ঐতিহাসিক গীবনের বক্তব্য অনুযায়ী কুরআন মাজীদের এ ভবিষ্যদ্বাণীর পরও সাত আট বছর পর্যন্ত এমন অবস্থা ছিল যার ফলে রোমানরা ইরানীদের ওপর বিজয় লাভ করবে এ ধরনের কোনো কথা কোনো ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারতো না। বরং বিজয় তো দূরের কথা তখন সামনের দিকে এ সাম্রাজ্য আর টিকে থাকবে এ আশাও কারো ছিল না।
। কুরআন মাজীদের এ আয়াত নাযিল হলে মক্কার কাফেররা এ নিয়ে খুবই ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে থাকে। উবাই ইবনে খালফ হযরত আবু বকরের (রা.) সাথে বাজী রাখে। সে বলে, যদি তিন বছরের মধ্যে রোমানরা জয়লাভ করে তাহলে আমি তোমাকে দশটা উট দেবো অন্যথায় তুমি আমাকে দশটা উট দেবে। নবী (সা.) এর বাজীর কথা জানতে পেরে বলেন, কুরআনে বলা হয়েছে فِي بِضْعِ سِنِينَ আর আরবী ভাষায় بضع শব্দ বললে দশের কম বুঝায়। কাজেই দশ বছরের শর্ত রাখো এবং উটের সংখ্যা দশ থেকে বাড়িয়ে একশো করে দাও। তাই হযরত আবু বকর (রা.) উবাইর সাথে আবার কথা বলেন এবং নতুনভাবে শর্ত লাগানো হয় যে, দশ বছরের মধ্যে উভয় পক্ষের যার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে সে অন্যপক্ষকে একশোটি উট দেবে।
। ৬২২ সালে একদিকে নবী (সা.) হিজরত করে মদীনা তাইয়েবায় চলে যান। অন্যদিকে কায়সার হিরাক্লিয়াস নীরবে কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে বের হয়ে কৃষ্ণসাগরের পথে ত্রাবিজুনের দিকে রওয়ানা দেন। সেখানে গিয়ে তিনি পেছন দিক থেকে ইরানের ওপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই প্রতি আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য কায়সার গীর্জার কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন জানান। ফলে খৃষ্টীয় গীর্জার প্রধান বিশপ সারজিয়াস (Sergius) খৃষ্টবাদকে মাজুসীবাদের (অগ্নিপূজা) হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গীর্জাসমূহে ভক্তদের নজরানা বাবদ প্রদত্ত অর্থ সম্পদ সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেন। হিরাক্লিয়াস ৬২৩ খৃষ্টাব্দে আর্মেনিয়া থেকে নিজের আক্রমণ শুরু করেন। দ্বিতীয় বছর ৬২৪ সালে তিনি আজারবাইজানে প্রবেশ করে জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান আরমিয়াহ (Clorumia) ধ্বংস করেন এবং ইরানীদের সর্ববৃহৎ অগ্নিকুণ্ড বিধ্বস্ত করেন। আল্লাহর মহিমা দেখুন, এই বছরেই মুসলমানরা বদর নামক স্থানে মুশরিকদের মোকাবিলায় প্রথম চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। এভাবে সূরা রূমে উল্লেখিত দু’টি ভবিষ্যদ্বাণীর দশ বছরের সময়সীমা শেষ হবার আগেই একই সঙ্গে সত্য প্রমাণিত হয়।
। এরপর রোমান সৈন্যরা অনবরত ইরানীদেরকে পর্যুদস্ত করে যেতেই থাকে। ৬২৭ খৃষ্টাব্দে নিনেভার যুদ্ধে তারা পারস্য সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়। এরপর পারস্য সম্রাটদের আবাসস্থল বিধ্বস্ত করে। হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং তারা তদানীন্তন ইরানের রাজধানী তায়াসফুনের (Ctesiphon) দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। ৬২৮ সালে খসরু পারভেজের পরিবার তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাকে বন্ধী করা হয়। তার চোখের সামনে তার ১৮ জন পুত্র সন্তানকে হত্যা করা হয়। কয়েকদিন পরে কারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তিনি নিজেও মৃত্যুবরণ করেন। এ বছরই হুদাইবিয়ার চুক্তি সম্পাদিত হয়, যাকে কুরআন মহা বিজয় নামে আখ্যায়িত করেছে এবং এ বছরই খসরুর পুত্র দ্বিতীয় কুবাদ সমস্ত রোম অধিকৃত এলাকার ওপর থেকে অধিকার ত্যাগ করে এবং আসল ক্রুশ ফিরিয়ে দিয়ে রোমের সাথে সন্ধি করে। ৬২৯ সালে “পবিত্র ক্রুশ” কে স্বস্থানে স্থাপন করার জন্য কায়সার নিজে “বায়তুল মাকদিস” যান এবং এ বছরই নবী (সা.) কাযা উমরাহ আদায় করার জন্য হিজরতের পর প্রথম বার মক্কা মু’আযযমায় প্রবেশ করেন।
। এরপর কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী যে, পুরোপুরি সত্য ছিল এ ব্যাপারে কারো সামান্যতম সন্দেহের অবকাশই ছিল না। আরবের বিপুল সংখ্যক মুশরিক এর প্রতি ঈমান আনে। উবাই ইবনে খাল্ফের উত্তরাধিকারীদের পরাজয় মেনে নিয়ে হযরত আবু বকরকে (রা.) বাজীর একশো উট দিয়ে দিতে হয়। তিনি সেগুলো নিয়ে নবী (সা.) এর খেদমতে হাজির হন। নবী (সা.) হুকুম দেন, এগুলো সাদকা করে দাও। কারণ বাজী যখন ধরা হয় তখন শরীয়াতে জুয়া হারাম হবার হুকুম নাযিল হয়নি। কিন্তু এখন তা হারাম হবার হুকুম এসে গিয়েছিল। তাই যুদ্ধের মাধ্যমে বশ্যতা স্বীকারকারী কাফেরদের থেকে বাজীর অর্থ নিয়ে নেয়ার অনুমতি তো দিয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু এই সঙ্গে হুকুম দেয়া হয়, তা নিজে ভোগ না করে সাদকা করে দিতে হবে।
(৩০-রূম) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:
এ সূরায় বক্তব্য এভাবে শুরু করা হয়েছে, আজ রোমানরা পরাজিত হয়েছে এবং সমগ্র বিশ্ববাসী মনে করছে এ সাম্রাজ্যের পতন আসন্ন। কিন্তু কয়েক বছর অতিবাহিত হতে না হতেই সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং আজ যে পরাজিত সেদিন সে বিজয়ী হয়ে যাবে।
। এ ভূমিকা থেকে একথা প্রকাশিত হয়েছে যে, মানুষ নিজের বাহ্য দৃষ্টির কারণে শুধুমাত্র তাই দেখে যা তার চোখের সামনে থাকে। কিন্তু এ বাহ্যিক পর্দার পেছনে যা কিছু আছে সে সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। এ বাহ্যদৃষ্টি যখন দুনিয়ার সামান্য সামান্য ব্যাপারে বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত অনুমানের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যখন শুধুমাত্র “আগামীকাল কি হবে” এতটুকু কথা না জানার কারণে মানুষ ভুল হিসেব করে বসে তখন সামগ্রিকভাবে সমগ্র জীবনের ব্যাপারে ইহকালীন বাহ্যিক জীবনের ওপর নির্ভরশীল এবং এরই ভিত্তিতে নিজের সমগ্র জীবন পুঁজিকে বাজী রাখা মস্ত বড় ভুল, তাতে সন্দেহ নেই।
। এভাবে রোম ইরানের বিষয় থেকে ভাষণ আখেরাতের বিষয়ের দিকে মোড় নিয়েছে এবং ক্রমাগত তিন রুকু পর্যন্ত বিভিন্নভাবে একথা বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে, আখেরাতের জীবন সম্ভব, যুক্তিসঙ্গত এবং এর প্রয়োজনও আছে। মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে সুস্থ ও সুন্দর করে রাখার স্বার্থেও তার জন্য আখেরাতে বিশ্বাস করে বর্তমান জীবনের কর্মসূচী নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় বাহ্যদৃষ্টির ওপর নির্ভর করে কর্মসূচী গ্রহণ করার যে পরিণাম হয়ে থাকে তাই হতে বাধ্য।
। এ প্রসঙ্গে আখেরাতের পক্ষে যুক্তি পেশ করতে গিয়ে বিশ্ব- জগতের যেসব নিদর্শনকে সাক্ষ্য- প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে সেগুলো তাওহীদেরও প্রমাণ পেশ করে। তাই চতুর্থ রুকুর শুরু থেকে তাওহীদকে সত্য ও শির্ককে মিথ্যা প্রমাণ করাই ভাষণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং বলা হয়, মানুষের জন্য পুরোপুরি এক নিষ্ঠ হয়ে এক আল্লাহর বন্দেগী করা ছাড়া আর কোন প্রাকৃতিক ধর্ম নেই। শির্ক বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতির বিরোধী। তাই যেখানেই মানুষ এ ভ্রষ্টতার পথ অবলম্বন করেছে সেখানেই বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগে আবার সেই মহা বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যা সে সময় দুনিয়ার দুটি সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। বলা হয়েছে, এ বিপর্যয়ও শির্কের অন্যতম ফল এবং মানব জাতির অতীত ইতিহাসে যতগুলো জাতি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে তারা সবাই ছিল মুশরিক।
। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে উপমার মাধ্যমে লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে, যেমন মৃত পতিত যমীন আল্লাহ প্রেরিত বৃষ্টির স্পর্শে সহসা জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং জীবন ও ফসলের ভাণ্ডার উদগীরণ করতে থাকে, ঠিক তেমনি আল্লাহ প্রেরিত অহী ও নবুয়াতও মৃত পতিত মানব ও তার পক্ষে রহমতের বারিধারা স্বরূপ এবং নাযিল হওয়া তার জন্য জীবন, বৃদ্ধি, বিকাশ এবং কল্যাণের উৎসের কারণ হয়। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে আরবের এ অনুর্বর ভূমি আল্লাহর রহমতে শস্য শ্যামল হয়ে উঠবে এবং সমস্ত কল্যাণ হবে তোমাদের নিজেদেরই জন্য। আর এর সদ্ব্যবহার না করলে নিজেদেরই ক্ষতি করবে। তারপর অনুশোচনা করেও কোনো লাভ হবে না এবং ক্ষতিপূরণ করার কোন সুযোগই পাবে না।
# ইবনে আব্বাস (রা.) এবং অন্যান্য সাহাবী ও তাবেঈগণের বর্ণনা থেকে জানা যায়, রোম ও ইরানের এ যুদ্ধে মুসলমানদের সহানুভূতি ছিল রোমের পক্ষে এবং মক্কার কাফেরদের সহানুভূতি ছিল ইরানের পক্ষে। এর কয়েকটি কারণ ছিল। এক, ইরানীরা এ যুদ্ধকেখ ৃস্টবাদ ও অগ্নি পূজার মতবাদের যুদ্ধের রূপ দিয়েছিল। তারা দেশ জয়ের উদ্দেশ্য অতিক্রম করে একে অগ্নি পূজার মতবাদ বিস্তারের মাধ্যমে পরিণত করছিল। বায়তুল মাকদিস জয়ের পর খসরু পারভেজ রোমের কায়সারের কাছে যে পত্র লিখেছিলেন তাতে পরিষ্কারভাবে নিজের বিজয়কে তিনি অগ্নি উপাসনাবাদের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। নীতিগতভাবে অগ্নি উপাসনাবাদের সাথে মক্কার মুশরিকদের ধর্মের মিল ছিল। কারণ, তারাও ছিল তাওহীদ অস্বীকারকারী। তারা দুই খোদাকে মানতো এবং আগুনের পূজা করতো। তাই মুশরিকরা ছিল তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের মোকাবিলায় খৃস্টানরা যতই শিরকে লিপ্ত হয়ে যাক না কেন তবুও তারা তাওহীদকে ধর্মের মূল ভিত্তি বলে স্বীকার করতো। তারা আখেরাতে বিশ্বাস করতো এবং অহী ও রিসালাতকে হিদায়েতের উৎস বলে মানতে। তাই তাদের ধর্ম তার আসল প্রকৃতির দিক থেকে মুসলমানদের ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল। এ জন্য মুসলমানরা স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং তাদের ওপর মুশরিক জাতির বিজয়কে তারা অপছন্দ করতো। দ্বিতীয় কারণটি ছিল, এক নবীর আগমনের পূর্বে পূর্ববর্তী নবীকে যারা মানতো নীতিগতভাবে তারা মুসলমানের সংজ্ঞারই আওতাভুক্ত হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত পরবর্তী আগমনকারী নবীর দাওয়াত তাদের কাছে না পৌঁছে এবং তারা তা অস্বীকার না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা মুসলমানদের মধ্যেই গণ্য হতে থাকে। (দেখুন, সূরা কাসাস ৭৩ টীকা) সে সময় নবী ﷺ এর নবুওয়াত লাভের পর মাত্র পাঁচ-ছয় বছর অতিবাহিত হয়েছিল। তাঁর দাওয়াত তখনো বাইরে পৌঁছে নি। তাই মুসলমানরা খৃস্টানদেরকে কাফেরদের মধ্যে গণ্য করতো না। তবে ইহুদীরা তাদের দৃষ্টিতে ছিল কাফের। কারণ তারা ঈসা (আঃ) এর নবুওয়াত অস্বীকার করতো। তৃতীয় কারণ ছিল, ইসলামের সূচনায় খৃস্টানদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের সাথে সহানুভূতিশীল ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমন সূরা কাসাসের ৫২ থেকে ৫৫ এবং সূরা মায়েদার ৮২ থেকে ৮৫ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। বরং তাদের মধ্য থেকে বহু লোক খোলা মন নিয়ে সত্যের দাওয়াত গ্রহণ করছিল। তারপর হাবশায় হিজরাতের সময় খৃস্টান বাদশাহ মুসলমানদেরকে আশ্রয় দেন এবং তাদের ফেরত পাঠাবার জন্য মক্কায় কাফেরদের দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। এরও দাবী ছিল মুসলমানরা অগ্নি পূজারীদের মোকাবিলায় খৃস্টানদের কল্যাণকামী হোক।
# পূর্বে যখন ইরানীরা জয়লাভ করে তখন নাউযুবিল্লাহ তার অর্থ এটা ছিল না যে, বিশ্ব-জাহানের প্রভু আল্লাহ তাদের মোকাবিলায় পরাজিত হয়ে গেছেন এবং পরে যখন রোমীয় জয়লাভ করবে তখন এর অর্থ এ হবে না যে, আল্লাহ তাঁর হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পাবেন। সর্ব অবস্থায় শাসন কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। পূর্বে যে বিজয় লাভ করে তাকে আল্লাহই বিজয় দান করেন এবং পরে যে জয়লাভ করবে সেও আল্লাহরই হুকুমে জয়লাভ করবে। তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বে কেউ নিজের শক্তির জোরে প্রাধান্য লাভ করতে পারে না। তিনি যাকে উঠান সে-ই ওঠে এবং যাকে নামিয়ে দেন সে-ই নেমে যায়।
# ইবনে আব্বাস (রা.) আবু সাঈদ খুদরী (রা.), সুফিয়ান সওরী (রা.), সুদ্দী প্রমুখ মনীষীগণ বর্ণনা করেন, ইরানীদের ওপর রোমীয়রা এবং বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের ওপর মুসলমানরা একই সময় বিজয় লাভ করেন। এ জন্য মুসলমানরা দ্বিগুণ আনন্দিত হয়। ইরান ও রোমের ইতিহাস থেকেও একথাই প্রমাণিত হয়। ৬২৪ সালে বদরের যুদ্ধ হয়। এ বছরই রোমের কায়সার অগ্নি উপাসনাবাদের প্রবর্তক জরথুষ্ট্রের জন্মস্থান ধ্বংস করেন এবং ইরানের সবচেয়ে বড় অগ্নিকুণ্ড বিধ্বস্ত করেন।
# যদিও আখেরাতের প্রমাণ পেশ করার মত বহু সাক্ষ্য ও নিদর্শন রয়েছে এবং সেগুলো থেকে গাফিল হবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবুও এরা নিজেরাই গাফিল থেকেছে। অন্য কথায় এটা তাদের নিজেদের ত্রুটি। দুনিয়ার জীবনের এই বাহ্যিক পর্দার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তারা বসে রয়েছে। এর পিছনে যা কিছু আসছে সে সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। নয় তো আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানাবার ব্যাপারে কোনো প্রকার ত্রুটি করা হয়নি।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এ সূরার প্রথম আয়াতগুলাে একটা বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে নাযিল হয়েছে। ঘটনাটা ছিলাে এই যে, আরব উপদ্বীপে রােম সাম্রাজ্যের যে অংশটুকু ছিলাে, সেই অংশটি রােম সাম্রাজের হাত ছাড়া হয়ে যায় এবং তার ওপর পারস্য সাম্রাজ্য বিজয়ী হয়। এ ঘটনাটা ঘটে তখন, যখন হিজরতের পূর্বে মক্কার মুসলমান ও মোশরেকদের মধ্যে ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে বিতর্ক তুংগে উঠেছিলাে। রােম সাম্রাজ্য ছিলাে খুষ্টানদের দ্বারা পরিচালিত। খৃষ্টান সম্প্রদায় যে আল্লাহর কিতাব ইনজীল ও আল্লাহর নবী হযরত ঈসার অনুসারী, সে কথা সুবিদিত। পক্ষান্তরে পারসিকরা মােশরেক এবং অগ্নি উপাসক। তাই এই ঘটনায় মক্কার মােশরেকরা খুব খুশী হয়। তারা পারস্যের অগ্নি উপাসকদের বিজয়কে তওহীদের ওপর পৌত্তলিকতার বিজয়ের সমার্থক এবং মােমেনদের ওপর কাফেরদের বিজয়ের সংকেত হিসেবে গ্রহণ করে। এ কারণে এই সূরার প্রথম আয়াত কটাতে ভবিষদ্বাণী করা হয়েছে যে, কয়েক বছরের মধ্যেই রােমকরা পুনরায় বিজয় ছিনিয়ে আনবে এবং তখন মুসলমানরা আনন্দিত হবে। কেননা মুসলমানরা মােশরেকদের ওপর আহলে কিতাবের বিজয় হােক এটাই পছন্দ করে। কিন্তু কোরআন শুধু এই ওয়াদা ও এই ঘটনাতেই নিজের আলােচনা সীমিত রাখেনি। বরং সে নির্দিষ্ট ঘটনা থেকে শুরু করে ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী বক্তব্য পেশ করেছে। এ ক্ষেত্রে এটা ছিলাে একটা উপলক্ষ মাত্র। এই উপলক্ষকে সামনে রেখে কোরআন মানব জাতিকে সমগ্র সৃষ্টির সাথে একীভূত করে, আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে বিজয়ী করার ব্যাপারে আল্লাহর যে চিরন্তন ঐতিহ্য ও নীতি রয়েছে, তার সাথে সেই মহা সত্যের সংযােগ সাধন করে যার ওপর আকাশ ও পৃথিবীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, আর সংযােগ সাধন করে মানব জাতির অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝেও। তারপর ইহকালীন জীবনের পর পরকালীন জীবনের বিষয়েও আলােচনা করে। তাদেরকে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী পর্যবেক্ষণ করায়। আরাে পর্যবেক্ষণ করায় মানব সত্তার আভ্যন্তরীণ ও সামগ্রিক অবস্থা এবং সৃষ্ট জগতের বিস্ময়কর নিদর্শনাবলী । এই পর্যবেক্ষণের ফলে তারা এমন সব তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে, যা তাদের জীবনকে উন্নত করে, মুক্ত করে, উদার ও প্রশস্ত করে, তাদেরকে স্থান কাল ও পরিস্থিতির সংকীর্ণতা থেকে উদ্ধার করে। অতপর তাকে টেনে নিয়ে যায় সৃষ্টি জগতের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সুপ্রশস্ত বিশালতার দিকে এবং প্রকৃতির নিয়মনীতি ও যােগসূত্রসমূহের দিকে। এ জন্যে এই মহাবিশ্বে যাবতীয় সংযােগ ও সম্পর্কের প্রকৃত তাৎপর্য নির্ণয়ে তাদের ক্ষমতার মান উন্নত হয়। তারা বুঝতে পারে যে, মহাবিশ্বকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণকারী এবং মানব স্বভাব নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী বিধানসমূহ কত বড়। তারা আরাে বুঝতে পারে মানব জীবন ও তার ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী এবং জয় পরাজয়ের স্থান নির্ণয়কারী, আল্লাহর বিধিসমূহ কত সূক্ষ্ম ও নিখুঁত। তারা আরাে উপলব্ধি করতে পারে বিশ্ববাসীর কর্মকান্ডের ফলাফল ও মান নির্ণয়কারী, তাদের পার্থিব তৎপরতার মূল্যায়নকারী ও তার ভিত্তিতে দুনিয়া ও আখেরাতের কর্মফল নির্ধারণকারী দাঁড়িপাল্লা কেমন সূক্ষ্ম ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে। এই উন্নততর, ব্যাপকতর ও প্রশস্ততর চিন্তা ও উপলব্ধির আলােকে এটা স্পট হয়ে ওঠে যে, ইসলামের এ দাওয়াত আসলে একটা বিশ্বজনীন দাওয়াত এবং তা সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে অংগাংগিভাবে জড়িত, যদিও এ দাওয়াত এক সময় মক্কায় আবির্ভূত হয়েছিলাে এবং তার পাহাড় পর্বত ও উপত্যকাসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাে। এ দাওয়াতের ক্ষেত্র এতাে ব্যাপক বিস্তৃত যে, তা শুধু এই পৃথিবীর সাথেই যুক্ত নয়, বরং তা সমগ্র সৃষ্টি জগত ও তার প্রধান নিয়মাবলীর সাথে, মানুষের স্বভাব প্রকৃতির সাথে এবং মানব জাতির অতীত ও ভবিষ্যতের সাথেও যুক্ত। এটা শুধু দৃশ্যমান এই পৃথিবী জুড়েই বিস্তৃত নয়, বরং আখেরাত পর্যন্তও বিস্তৃত। অনুরূপভাবে এর সাথে প্রত্যেক মুসলমানের মনও জড়িত। এর ভিত্তিতে জীবন ও মূল্যবােধ সম্পর্কে তার অনুভূতি ও ধ্যান ধারণাও গঠিত। এরই আলােকে তার দৃষ্টি পরিচালিত হয় আকাশ ও আখেরাতের দিকে, তার চার পাশের বিস্ময়কর ও রহস্যময় জগতের দিকে এবং তার সামনে ও পেছনে সংঘটিত ঘটনাবলী ও তার ফলাফলের দিকে। এরই আলােকে সে তার ও তার জাতির অবস্থা উপলব্ধি করে এবং মানুষের বিবেচনায় ও আল্লাহর বিবেচনায় নিজের ও নিজের আকীদা বিশ্বাসের মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করে। অতপর সে সচেতনভাবে নিজের ভূমিকা পালন করে এবং পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়ােগ করে। সূরাটা সে সব সম্পর্ক ও সম্বন্ধের ওপর আলােকপাত করে এবং বিশ্ব প্রকৃতিতে ও মানব মনে তার নিদর্শনাবলীকে চিহ্নিত করে। সূরাটা দুটো পর্বে বিভক্ত, প্রথম পর্বে মুসলমানদের বিজয় এবং আকাশ, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যবর্তী যাবতীয় সৃষ্টি যে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর যে সত্যের সাথে ইহকাল ও পরকালের সমগ্র ব্যবস্থা জড়িত। সেই সত্যের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়েছে। আর মানুষের মনকে পূর্ববর্তী মানুষদের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পরকালীন জীবনটাও যে অবিকল ড্রপ, সে কথাও জানানাে হয়েছে। এ কারণে তাদের সামনে কেয়ামতের একটা দৃশ্য এবং কাফের ও মােমেনরা সেখানে কেমন কর্মফল পাবে তা দেখানাে হয়েছে। অতপর পুনরায় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, নিদর্শনাবলী ও তার শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। অতপর মানুষের নিজের ও তার দাসদাসীর উদাহরণ দিয়ে দেখানাে হয়েছে যে, শিরক কত নিকৃষ্ট ধরনের মতবাদ এবং কোনাে সত্যের ওপর বা নির্ভুল জ্ঞানের ওপর তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত নয়। এই পর্বের সমাপ্তি টানা হয়েহে রসূল(স.)-কে সত্যের তথা আল্লাহ তায়ালা যে স্বাভাবিক অবস্থার ওপর (ফিতরাত) মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সেই পথ ও সেই অবস্থার অনুসরণের নির্দেশ দানের মাধ্যমে। এই পথ কখনাে পরিবর্তিত হয় না এবং তা কখনাে কারাে খেয়ালখুশীর অনুসারী হয় না। তাই এই পথের অনুসারীরা কখনাে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না এখানে তেমন কিছু ঘটেনা প্রবৃত্তির অনুসারীরা। দ্বিতীয় পর্বে দেখানাে হয়েছে যে, পরিবর্তন ও স্থীতিহীনতা মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। কাজেই মানুষ যতােক্ষণ কোনাে অটল ও অপরিবর্তনীয় বিধানের অনুসারী না হবে, ততক্ষণ তার ওপর ভিত্তি করে কোনাে জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না। এই পর্বে সুখে দুঃখে, অভাবে ও প্রাচুর্যে মানুষের কী অবস্থা হয়, তাও দেখানাে হয়েছে। এই প্রসংগে সম্পদের ব্যয় বন্টন ও উন্নয়নের বিষয়ও আলােচিত হয়েছে। অতপর পুনরায় শিরক ও যাদেরকে শরীক মানা হয় তারা কোন সম্পদ সৃষ্টি করতে বা দিতেও পারে না, কাউকে বাঁচাতেও পারে না, মারতেও পারে না। জলে ও স্থলে দুর্যোগ ও বিপর্যয় সংঘটিত হওয়ার জন্যে মানুষের অপকর্মকে দায়ী করা হয়েছে এবং মানুষকে পৃথিবীতে ভ্রমণ করে মােশরেকদের কী পরিণতি হয়েছে তা দেখতে বলা হয়েছে। এ জন্যে রসূল(স.)-কে কেয়ামত আসার আগেই স্বভাব ধর্ম ইসলামকে অবিচলভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতপর বিশ্ব প্রকৃতিতে বিরাজমান আল্লাহর নিদর্শনালী পর্যবেক্ষণ করানাে হয়েছে প্রথম পর্বের মতােই। আর এরপর এই বলে মন্তব্য করা হয়েছে যে, আল্লাহ যে পথ নির্দেশিকা দেন, সেটাই প্রকৃত পথ নির্দেশিকা। আর রসূল(স.)-এর কাজ প্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। যারা আল্লাহর নিদর্শন চোখ দিয়ে দেখতে ও আল্লাহর বিধান কান দিয়ে শুনতে চায় না, সেই সব সেচ্ছাকৃত অন্ধ ও বধিরদেরকে আল্লাহ তায়ালা হেদায়াত করেন না। এরপর মানুষের নিজের জন্ম বৃত্তান্ত আলােচনা করে দেখানাে হয়েছে কিভাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে শৈশবের দুর্বলতম মুহূর্ত থেকে মৃত্যু, পুনরুজ্জীবন ও কেয়ামত পর্যন্ত ধাপে ধাপে অগ্রসর করেন। অতপর কেয়ামতের একটা দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে। এই সাথেই এই পর্ব শেষ ও সূরার সমাপ্তি হয়েছে। সমাপ্তির সময় রসূল(স.)-কে নিজের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে ধৈর্য অবলম্বন করা, মানুষের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার সহ্য করা। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই কার্যকর হবে-একথা বিশ্বাস করা এবং কোনােভাবেই যেন তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হন ও অবিশ্বাসীরা যেন তাকে হীনমন্যতায় আক্রান্ত করতে না পারে-সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুরার সার্বিক পটভূমি ও ভাষা একত্রে মিলিত হয়ে এর প্রধান আলােচ্য বিষয়কে চিহ্নিত ও চিত্রিত করতে সহায়তা করেছে। সেই কেন্দ্রীয় আলােচ্য বিষয় হলাে মানুষের বিভিন্ন অবস্থা, জীবনের বিভিন্ন ঘটনা মানব জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এবং প্রাকৃতিক জগতের উদ্ভব, বিকাশ ও বিবর্তন সংক্রান্ত আল্লাহর বিধানের মাঝে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক উদঘাটন। এই সম্পর্ক উদঘাটন করতে গিয়ে প্রকাশ পেয়েছে যে, এ বিশ্ব জগতের প্রতিটি স্পন্দন ও প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ঘটনা ও প্রতিটি অবস্থা, প্রতিটি সূচনা ও প্রতিটি সমাপ্তি, প্রতিটি জয় ও প্রতিটি পরাজয়- পরস্পর একটা অবিচ্ছেদ্য যােগসূত্রে ও অটুট বন্ধনে আবদ্ধ এবং প্রত্যেকটা একটা সূক্ষ্ণ ও নিখুঁত আইন দ্বারা শাসিত ও পরিচালিত। এর সব কিছুরই আদি অন্ত আল্লাহর হাতে। প্রথমে ও শেষে সব কিছুই আল্লাহর হাতে। এই বিষয়টার ওপরই সমগ্র কোরআনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং একেই ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের মূল তত্ত্ব রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা এই মূলতত্ত্ব থেকেই যাবতীয় ইসলামের চিন্তাধারা, মূল্যবোেধ, মূল্যায়ন ও মতাদর্শ আহরিত হয়েছে। এবং এই মূলতত্ত্ব ছাড়া কোন চিন্তাধারা ও কোনাে মতাদর্শই নির্ভুল হতে পারে না। আসুন, এবার আমরা বিশদভাবে সূরার তাফসীর আলােচনা করি।
‘আলিফ-লাম-মীম, নিকটতম ভূমিতেই রােমকরা পরাজিত হলো। কয়েক বছরের মধ্যেই তারা পুনরায় বিজয়ী হবে…'(আয়াত ১-৬) সূরাটা ‘হুরুফে মােকাত্তায়াত অর্থাৎ কয়েকটা বিচ্ছিন্ন আরবী বর্ণমালা দিয়ে শুরু হয়েছে। এর তাফসীরের আমরা এই মতটাই গ্রহণ করেছি যে, এই কোরআন এই ধরনের কিছু সংখ্যক আরবী বর্ণমালা দিয়েই শুরু হয়েছে, যা আরবদের কাছে সুবিদিত। তথাপি তারা এ ধরনের কোনাে পুস্তক রচনা করতে সক্ষম হয়নি। এই বর্ণমালা দিয়েই তাদের ভাষা তৈরী হয়েছে। কিন্তু এই ভাষায় এ ধরনের গ্রন্থ রচনা করা তাদের সাধ্যে কুলায়নি।
বিচ্ছিন্ন বর্ণমালার পরই এসেছে এই অকাট্য সত্য ভবিষ্যদ্বাণী যে, রােমকরা কয়েক বছরের মধ্যেই বিজয়ী হবে। ইমাম ইবনে জারীর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, পারস্য সাম্রাজ্য রােম সাম্রাজ্যের ওপর বিজয়ী হয়েছিলাে। পারসিকরা রোমকদের ওপর বিজয়ী হােক-এটা আরবের মােশরেকদেরও কাংখিত ছিলাে। পক্ষান্তরে মুসলমানরা পছন্দ করতাে রােমকরা পারসিকদের ওপর বিজয়ী হােক। কেননা তারা আহলে কিতাব এবং তারা মুসলমানদের ধর্মের নিকটতম। যখন এই ভবিষ্যদ্বাণী নাযিল হলাে, তখন তারা হযরত আবু বকরকে বললাে, ওহে আবু বকর, তােমার সাথী তাে বলছে যে, কয়েক বছরের মধ্যেই নাকি রােম পারস্যের ওপর বিজয়ী হবে। হযরত আবু বকর(রা.) বললেন, তিনি সত্যই বলেছেন। তারা বললাে, এ ব্যাপারে আমরা তােমার সাথে বাজি ধরতে চাই। তুমি রাজী আছ? হযরত আবু বকর(রা.) সম্মতি দিলেন এবং তারা বাজি ধরলাে যে, সাত বছরের মধ্যে রােমকরা বিজয়ী না হলে হযরত আবু বকর মােশরেকদেরকে ৪টা উট এবং বিজয়ী হলে মােশরেকরা ৪টা উট দেবে। এরপর সাত বছর কেটে গেলাে। কিন্তু কিছুই ঘটলাে না। এতে মােশরেকরা আনন্দিত হলাে। আর মুসলমানরা বিব্রত বােধ করতে লাগলাে। কেউ কেউ গিয়ে ব্যাপারটা রসূল(স.)-এর কাছে উল্লেখ করলাে। রসূল(স.) বললেন, তােমরা ‘বিদয়ী সিনীন (কয়েক বছর) বলতে কী বােঝ? তারা বললাে, দশের কম। রাসূল(স.) বললেন, তাহলে যাও, উটের সংখ্যা আরাে বাড়িয়ে দাও।’ এরপর দু’বছর অতিবাহিত না হতেই ঘােড় সওয়ার সৈনিকরা এসে পারস্যের ওপর রােমের বিজয়ের খবর জানালাে। এতে মুসলমানরা খুশী হলাে। এই ঘটনা সম্পর্কে অনেকগুলাে বর্ণনা রয়েছে আমি তন্মধ্যে থেকে ইমাম ইবনে জরীরের বর্ণনাটা গ্রহণ করেছি। এই ঘটনার পর যে সব উপদেশ এই সূরায় বিবৃত হয়েছে, সেগুলাে নিয়ে আলােচনা করার আগে এই ঘটনার কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তুলে ধরতে চাই। প্রথম শিক্ষা এই যে, তাওহীদ ও ঈমানের দাওয়াতের বিপরীতে শিরক ও কুফরের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা ও সহমর্মিতা সকল যুগে ও সকল স্থানেই সক্রিয় থাকে। যদিও তৎকালে দেশে দেশে ও জাতিতে জাতিতে সম্পর্ক বর্তমান কালের মত ঘনিষ্ঠ ও জোরদার ছিলাে না, তথাপি মক্কার মােশরেকরা অনুভব করতাে যে, পৃথিবীর যে কোন জায়গায় আসমানী কিতাবধারীদের ওপর পৌত্তিলিকদের বিজয় তাদেরই বিজয়। পক্ষান্তরে মুসলমানদের অনুভব করতাে যে, আসমানী কিতাবধারী ইহুদী ও খৃষ্টানদের সাথে তাদের একটা সম্পর্ক রয়েছে। পৌত্তলিকরা পৃথিবীর কোথাও জয়লাভ করুক-এটা তারা পছন্দ করতাে না। তারা উপলব্ধি করতো, তাদের চারপাশে পৃথিবীর যেখানে যা কিছুই ঘটছে, তা থেকে তারা ও তাদের আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং তা ঈমান ও কুফরের বিরােধকে কোনাে না কোনাে ভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু আমাদের যুগের অনেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা সম্পর্কে উদাসীন। রসূল(স.)-এর যুগের মুসলমান ও পৌত্তলিকদের মত তাদের অনুভূতি এ বিষয়ে তেমন তীব্র নয়। বিগত চৌদ্দ শতাব্দী ধরেই এই পরিস্থিতি চলে আসছে। তাই তারা ভৌগােলিক ও বংশগত গন্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তারা বুঝতে পারে না যে, বিরোধটা মূলত ঈমান ও কুফরের বিরােধ এবং সংঘাত-সংঘর্ষ যা কিছুই ঘটে, তা প্রকৃতপক্ষে ‘হিযবুল্লাহ’ (আল্লাহর দল) এবং ‘হিযবুশ শাইত্বন’ (শয়তানের দল) এর সংঘাত-সংঘর্ষ। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের আজ এই সংঘাতের প্রকৃতি ও এই বিরােধের স্বরূপ উপলব্ধি করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় এসেছে। কাফের ও পৌত্তলিক শক্তিগুলাে ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়ে এসব বিরােধ লড়াই এর যতরকম নামই দিক, তাতে মুসলমানদের বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয় । কেননা বিরােধের যতাে কারণ বা উপলক্ষ থাক না কেন, অমুসলিমরা মুসলমানদের সাথে একমাত্র আকীদা বিশ্বাস নিয়েই লড়াই করে থাকে। দ্বিতীয় শিক্ষা হলাে, আল্লাহর ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতিতে পরিপূর্ণ আস্থা ও অবিচল বিশ্বাস থাকতে হবে। হযরত আবু বকরের দ্বিধাহীন উক্তিতে এই অবিচল বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়। মােশরেকরা যখন রাসূল(স.)-এর কথা শুনে তার কাছে বিস্ময় প্রকাশ করলাে, তখন তিনি নিসংকোচে বললেন, তিনি সত্য বলেছেন। তারা বাজি ধরলে তিনিও বাজি ধরলেন পূর্ণ আস্থার সাথে । এরপর আল্লাহর প্রতিশ্রুতি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূর্ণ হলো। মুসলমানদের সামনে যতাে বিপদ মুসিবতই আসুক না কেন এমন চমকপ্রদ পন্থায় এরূপ পরিপূর্ণ ও সর্বাত্মক আস্থা প্রকাশের কারণেই তাদের আস্থা, মনােবল ও শক্তি সব সময় অটুট থেকেছে। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের সাফল্য এসেছে এবং আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হয়েছে। মুসলমানরা যখনই এবং যে দেশেই যতাে দীর্ঘ ও কষ্টকর জিহাদ-সংগ্রামে লিপ্ত হােক না কেন, আল্লাহর এই ওয়াদা তাদের বেলায়ও কার্যকর থাকবে। তৃতীয় শিক্ষাটা হলাে, সকল ঘটনা-দুর্ঘটনায় শেষ ফল আল্লাহর হাতে সােপর্দ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জয়-পরাজয়, কোনাে দেশের স্বাধীনতা লাভ বা স্বাধীনতা হারানাে,শক্তিশালী হওয়া বা দুর্বল হওয়া-সবই এ বিশ্বজগতের অন্য সকল ঘটনা ও অবস্থার মতই সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তিনি যা ইচ্ছা, তাই করেন এবং নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুসারেই করেন। সমস্ত ঘটনা ও পরিস্থিতি আল্লাহর স্বাধীন ইচ্ছার প্রতীক। তার এই স্বাধীন ইচ্ছার ওপর কারাে কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন ঘটনার পশ্চাতে কোনাে মঙ্গল-চিন্তা এবং কোনাে মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। এবং কোনাে ঘটনার কারণ ও উৎস কি, তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ জানে না। সুতরাং সকল অবস্থায় ও সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর ফয়সালার সামনে সর্বাত্মক নতি স্বীকার ও আত্মসমর্পণই মানুষের একমাত্র ও সর্বশেষ করণীয় কাজ। *ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের মৌলিক দৃষ্টিভংগি : আলিফ-লাম-…'(আয়াত ১-৫) প্রথমে ও পরে সব কিছুর ফয়সালা মূলত আল্লাহর হাতেই নিবদ্ধ। তিনি যাকে চান বিজয়ী করেন। তার ইচ্ছাকে শৃংখলিত করার ক্ষমতা কারাে নেই। আল্লাহর যে ইচ্ছা কোনাে ঘটনার নির্দিষ্ট ফলাফল আকাংখা করে, সে ইচ্ছাই ঘটনার কারণ সংঘটিত করে। কাজেই বিজয়কে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল করা ও তার বাস্তব কারণ পাওয়ার ভেতরে কোনাে বিরােধ নেই, যেসব প্রাকৃতিক নিয়ম নীতি অনুসারে এই বিশ্বজগত পরিচালিত হয়, তা আল্লাহর সর্বময় স্বাধীন ইচ্ছা থেকেই উদ্ভূত। আল্লাহর এই সর্বময় স্বাধীন ইচ্ছার কাজ ছিলাে বিশ্ব প্রকৃতির জন্যে কতকগুলাে অমােঘ ও অপরিবর্তনীয় নীতি এবং স্থিতিশীল ব্যবস্থা প্রচলিত থাকা, আর জয় পরাজয় এমনি দুটো অবস্থা। যা আল্লাহর স্বাধীন ইচ্ছা কর্তৃক মনােনীত প্রাকৃতিক নীতিমালা অনুসারেই আবির্ভূত হয়। এ ব্যাপারে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস সুস্পষ্ট ও সম্পূর্ণরূপে যুক্তিসংগত। এই আকীদা বিশ্বাসের মূল কথা এই যে, সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে ঘটে থাকে। তবে তার অর্থ এটা নয় যে, মানুষকে সেসব স্বাভাবিক উপায় উপকরণ অবলম্বনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, যা তার চেষ্টা সাধনার ফলাফল বাস্তব জগতে প্রকাশ করে দিয়ে থাকে। অবশ্য সেসব ফলাফল কার্যত প্রকাশ পাওয়া বা না পাওয়া মানুষের দায় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা চূড়ান্ত পর্যায়ে এর পরিণতি আল্লাহর হাতে সােপর্দ রয়েছে। জনৈক বেদুঈন মসজিদে নববীর দরজার কাছে তার উষ্ট্ৰীটা ছেড়ে রেখে রসূল(স.)-এর সাথে দেখা করতে গেলাে এবং বললাে, ‘উষ্ট্ৰীর ব্যাপারে আল্লাহর ওপর নির্ভর করলাম।’ রসূল(স.) বললেন, ‘আগে ওটাকে বাঁধাে, তারপর আল্লাহর ওপর নির্ভর করাে।'(তিরমিযী) সুতরাং ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের আলােকে তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতার আগে স্বাভাবিক উপায় উপকরণ অবলম্বন করা অপরিহার্য। এ কাজটা করার পরই সব কিছু আল্লাহর হাতে সােপর্দ করতে হয়। ‘তিনি যাকে চান বিজয়ী করেন, তিনিই মহাশক্তিশালী ও দয়ালু।’ অর্থাৎ এই বিজয় মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও তার দয়ার ফলেই মানুষের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে বাস্তব রূপ লাভ করে থাকে। আর এভাবে তা বিজয়ী ও পরাজিত উভয় দলের জন্যে রহমতে পরিণত হয়। আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারায় বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যদি এক দল মানুষকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তা হলে পৃথিবী অশান্তিময় হয়ে যেতাে। বস্তুত চূড়ান্ত পর্যায়ে পৃথিবীর শান্তি ও কল্যাণ, বিজয়ী ও পরাজিত উভয়ের জন্যে কল্যাণকর। এ হচ্ছে আল্লাহর ওয়াদা। ‘আল্লাহ তায়ালা তার ওয়াদার খেলাপ করেন না।’ অর্থাৎ মুসলমানদের বিজয় সূচিত হবে- এটা আল্লাহর ওয়াদা, যা বাস্তবায়িত না হয়ে পারে না। ‘তিনি নিজের ওয়াদার খেলাপ করেন না।’ অর্থাৎ তার ওয়াদা যেহেতু তার স্বাধীন ইচ্ছা অনুসারে এবং তার সুগভীর প্রজ্ঞার আলােকেই হয়েছে, তাই তিনি তার বাস্তবায়নে সক্ষম, কেউ তাতে তাকে বাধা দিতে পারে না এবং মহাবিশ্বে তিনি যা চান তা ছাড়া আর কিছুই সংঘটিত হয় না। ‘এই ওয়াদা পালিত হওয়া আল্লাহর অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়মেরই একটা অংশ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ অর্থাৎ যদিও মনে হয় তারা খুবই জ্ঞানী এবং অনেক কিছুই জানে, কিন্তু তারা আসলে অত্যন্ত স্থূল ও ভাসা ভাসা জ্ঞানের অধিকারী। পার্থিব জীবনের বাহ্যিক অংশটাই শুধু জানে, কিন্তু পৃথিবীর চিরস্থায়ী ও প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক বিধান জানে না, আর বাহ্যিক অংশের অন্তরালে কী আছে, তাও তারা জানে না। পার্থিব জীবনের বাহ্যিক অংশটা আসলে খুবই ক্ষুদ্র ও সীমিত, যদিও তা সাধারণ মানুষের চোখে বিরাট ও বিশাল মনে হয়। মানুষ স্বীয় চেষ্টা-সাধনা দ্বারা পার্থিব জীবনের একটা অংশমাত্র জয় করতে পারে, সম্পূর্ণটা পারে না। কেননা তার জীবনই সীমিত, আর সমগ্র জীবজগতই গােটা সৃষ্টি জগতের তুলনায় নিতান্ত ক্ষুদ্র। এই সৃষ্টিজগতে আল্লাহর যে প্রাকৃতিক নীতিমালা ও বিধান কার্যকর রয়েছে সেগুলােই এই জীব জগতকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছে। যে ব্যক্তি এই সৃষ্টি জগতের রীতি-নীতি ও প্রাকৃতিক বিধান মন দিয়ে উপলব্ধি করে না এবং চেতনা দিয়ে অনুভব করে না, সে প্রকৃতির দিকে এমনভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে যেন দেখতেই পায় না। সে শুধু সৃষ্টির বাহ্যিক আকৃতি ও গতিবিধিই দেখে, এর নিগূঢ় রহস্য ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে না। অধিকাংশ মানুষই এ রকম। কেননা একমাত্র খাঁটি ও বিশুদ্ধ ঈমানই বাহ্যিক জীবনকে সৃষ্টি রহস্যের সাথে একাত্ম ও একীভূত করে। আর এই ঈমানই মানবীয় জ্ঞানকে সৃষ্টি রহস্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা দান করে। অথচ এ ধরনের বিশুদ্ধ ঈমানের অধিকারী মােমনদের সংখ্যা খুবই অল্প। তাই অধিকাংশ মােমেন প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। আর তারা আখেরাত সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন। কেননা আখেরাতও সৃষ্টিরই একটা ধারাবাহিকতা এবং এর অসংখ্য স্তরের মধ্য থেকে একটা অন্যতম স্তর। যারা সৃষ্টির রহস্য ও প্রাকৃতিক নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ, তারা আখেরাত সম্পর্কেও অজ্ঞ উদাসীন। আখেরাতের প্রকৃত গুরুত্ব তারা অনুধাবন করে না। তারা বােঝে না যে, আখেরাত জীবনেরই একটা অংশ এবং তার আগমন অবধারিত। আখেরাত সম্পর্কে অজ্ঞতা মানুষের যাবতীয় মানদন্ড ও মূল্যবােধই এলােমেলাে করে দেয়। জীবন, জীবনের ঘটনাবলী ও মূল্যবােধগুলাের সঠিক মূল্যায়ন এবং এগুলাে সম্পর্কে সঠিক ধারণা পােষণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। জীবন সম্পর্কে তাদের জ্ঞানও হয়ে থাকে স্থূল অসম্পূর্ণ। কেননা মানুষের বিবেক বুদ্ধি আখেরাত সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনাবলী সম্পর্কে তার ধারণা বদলে দেয়। পৃথিবীতে সে যে জীবন যাপন করে, তা মহাবিশ্বে তার দীর্ঘ সফরের একটা সংক্ষিপ্ত অধ্যায় মাত্র। এই পৃথিবীতে জীবনের যে অংশটুকু সে কাটায়, তা তার বিশাল জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশ। আর এই পৃথিবীতে যে ঘটনাবলী ঘটে এবং যেসব অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা বিশাল গ্রন্থের একটা ক্ষুদ্র পরিচ্ছেদ মাত্র, বড় ও দীর্ঘ সফরের একটা সংক্ষিপ্ত স্তর। এতাে বড় জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশ এবং এতাে বড় গ্রন্থের একটা ক্ষুদ্র পরিচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে কোনাে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মানুষের উচিত নয়। এ কারণেই যে ব্যক্তি আখেরাতে বিশ্বাস করে ও সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাজ করে, সে এমন কোনাে ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রাখতে সক্ষম হয় পরকালের কোনাে কিছুতে আস্থা রাখে না। পার্থিব জীবনের কোনাে ব্যাপারেই এই দু’ব্যক্তির বিচার-বিবেচনা, ধ্যান ধারণা, মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত এক রকম হয় না। উভয়ের আলাদা আলাদা দৃষ্টিভংগি, পৃথক পৃথক মানদন্ড ও ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবােধ হয়ে থাকে এবং তার আলােকে উভয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তু, ঘটনা ও পরিস্থিতির ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়ন করে থাকে। একজন শুধু পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিকটাই দেখে আর অপরজন বাহ্যিক আকৃতির আড়ালে যে যােগসূত্র, যে রীতিনীতি, গােপন ও প্রকাশ্য, দৃশ্য ও অদৃশ্য, দুনিয়া ও আখেরাত, জীবন ও মৃত্যু, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত, মানবজগত এবং জীব-জড় নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বজগত সম্পর্ক যে নিয়ম ও বিধান রয়েছে তা জানে ও বােঝে। এই সর্বব্যাপী, সর্বোচ্চ ও বিশালতম জগতের দিকেই ইসলাম মানুষকে নিয়ে যায় এবং এখানে তাকে তার উপযুক্ত সম্মানের আসনে বসায়। তার আসন পৃথিবীতে খলীফা বা প্রতিনিধির আসন। তার সত্ত্বায় আল্লাহর রূহের যে প্রভাব ও প্রেরণা সক্রিয় রয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই সে খলীফার আসনে সমাসীন।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ:
الروم ‘রূম’ তৎকালীন পরাশক্তিসম্পন্ন একটি দেশ, যা বর্তমানে মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত ইতালি হিসেবে পরিচিত। যার প্রেসিডেন্ট ছিল হিরাকল। সেই রূম সম্পর্কে এ সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া সূরার দ্বিতীয় আয়াতে রূম শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, সেখান থেকেই এ নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
ফযীলত:
আবূ রূহ জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেনন একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করছিলেন। উক্ত সালাতে সূরা রূম তেলাওয়াত করছিলেন। তেলাওয়াতকালে হঠাৎ তিনি ভ্রান্তিতে পড়ে গেলেন। সালাত শেষে বললেন: আমাদের কাছে কুরআন (তেলাওয়াত করা) সংমিশ্রণ হয়ে গেছে। তোমাদের মধ্যে কিছু লোক আমাদের সাথে সালাত আদায় করে কিন্তু ভাল করে ওযূ করে না। আমাদের সাথে যে ব্যক্তি সালাতে শরীক হবে সে যেন ভাল করে ওযূ করে। (আহমাদ ৩/৪৭১, ৪৭২ সনদ সহীহ)
অত্র সূরাতে অনেক বিষয়ের আলোচনা স্থান পেয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হচ্ছে: পরাশক্তিসম্পন্ন দেশ রোমের পরাজয়ের সুসংবাদ, সকল কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলার হাতে, তিনি প্রতিশ্র“তির ব্যতিক্রম করেন না, জমিনে ভ্রমণ করে পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হওয়া, কিয়ামতের দিন বাতিল মা‘বূদেরা তাদের ইবাদতকারীদেরকে অস্বীকার করবে, মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি এবং প্রশান্তি ও ভালাবাসার জন্য তাদের যুগল সৃষ্টিসহ আল্লাহ তা‘আলার কয়েকটি নির্দশনের বর্ণনা, সকল প্রকার শির্ক ও তাগুত বর্জন করে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা, বাতিল মা‘বূদের অক্ষমতার বিবরণ, হিদায়াতের একমাত্র মালিক আল্লাহ তা‘আলা, কিয়ামতের দিন প্রতিদানের দিন; কোন ওজর-আপত্তি ও আবেদনের দিন নয় ইত্যাদি।
১-৭ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় যখন পারস্যের বাদশা সাবুর রূম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা বিজয় লাভ করে। এমনকি রূমের বাদশা হিরাকল পলায়ন করে কুসতুনতিনিয়ায় (বর্তমান ইস্তাম্বুল) আশ্রয় নেয়। সেখানে তাকে দীর্ঘ সময় আটক করে রাখা হয়। পরবর্তীতে হিরাকল রাজত্ব ফিরে পায়। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
রোম ও পারস্য তৎকালীন পৃথিবীর পরাশক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কায় অবস্থানকালে পারসিকরা রোমানদের ওপর হামলা চালায়। পারসিকরা ছিল অগ্নিপূজক মুশরিক। আর রোমানরা ছিল আহলে কিতাব, নিজেদেরকে তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাবধারী মনে করত। এ যুদ্ধ চলাকালে মক্কার মুশরিকরা চাচ্ছিল পারসিকদের বিজয় হোক। কারণ পারসিকরাও মুশরিক আর মক্কার কুরাইশরাও মুশরিক, সেদিক থেকে তাদের সাথে একটি মিল ছিল। আর মুসলিমরা চাচ্ছিল রোমানদের বিজয় হয়। কারণ তারা আহলে কিতাব। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মুসলিমদের অনেক মিল ছিল। কিন্তু ঘটনাক্রমে রোমানদের ওপর পারসিকদের জয় হয়। ফলে মক্কার মুশরিকরা খুব আনন্দিত হয় এবং মুসলিমরা একপ্রকার লজ্জা পায়। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতগুলো নাযিল করে জানিয়ে দেন রোমানদের ওপর পারসিকদের জয় হলেও অচিরেই পারসিকরা রোমানদের কাছে পরাজয় বরণ করবে। এটা আল্লাহ তা‘আলার একটি ওয়াদা, আর আল্লাহ তা‘আলা কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
ال۬مّ۬ (আলিফ-লাম-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
(فِيْٓ أَدْنَي الْأَرْضِ)
‘এক নিকটবর্তী স্থানে’ পারসিকরা তাদের নিকটবর্তী এলাকার ওপর জয় লাভ করেছে। রোমানদের সম্পূর্ণ রাজ্য দখল করতে পারেনি। এ এলাকাটুকু ছিল শাম থেকে পারস্য পর্যন্ত। (তাফসীর মুয়াসসার)
(فِيْ بِضْعِ سِنِيْنَ)
‘তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে।’ بِضْعٌ শব্দটি তিন থেকে নয় পর্যন্ত বুঝানো জন্য ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ তিন থেকে নয় বছরের মাঝেই রোমানরা পারসিকদের ওপর জয় লাভ করবে।
ইবনু আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মুশরিকরা পছন্দ করতো যে, পারস্যবাসী রোমদের ওপর বিজয়ী হোক, কেননা পারস্যবাসী মূর্তিপূজক ছিল। আর মুসলিমরা কামনা করত যে, রোমানরা পারস্যদের ওপর বিজয়ী হোক। কেননা তারা ছিল আহলে কিতাব। (কুরতুবী)
এ বিষয়টি আবূ বকর (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আলোচনা করলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন: অচিরেই রোমানরা বিজয় লাভ করবে। এ কথাটি আবূ বাকর কুরাইশদের বললে তারা বলল: আমাদের মধ্যে এবং তোমার মধ্যে একটি সময় নির্ধারণ করে দিন। তখন আবূ বকর পাঁচ বছর সময় নির্ধারণ করলেন এবং উভয়ের মাঝে একটি চুক্তি হয়। পাঁচ বছর অতিক্রম হয়ে গেল কিন্তু রোমানগণ বিজয় লাভ করল না। আবূ বাকর (رضي الله عنه) এ খবর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: কেন তুমি দশ বছর নির্ধারণ করনি। সাঈদ বিন যোবায়ের বলেন। بضع হল দশ থেকে কম একটি সংখ্যা। অতঃপর এ দশ বছরের ভিতরেই রোমানরা বিজয় লাভ করে। (তিরমিযী হা: ৩১৯৩, হাসান সহীহ)
জয়-পরাজয়, ক্ষমতা আদান-প্রদান আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ক্ষমতাধীন। তিনি ইচ্ছা করলে কাউকে বিজয় ও ক্ষমতা দান করেন আবার ইচ্ছা করলে পরাজিত করেন ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لِلّٰهِ الْأَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَمِنْۭ بَعْدُ)
‘পূর্বের ও পরের সিদ্ধান্ত আল্লাহরই’ অর্থাৎ শুধু উপকরণ থাকলেই বিজয় অর্জন হয় না, যদি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ফয়সালা না থাকে। যেদিন রোমানরা পারসিকদের ওপর জয় লাভ করবে সেদিন মুসলিমরা আনন্দিত হবে। যদিও উভয় দল কাফির, তবে পারসিকরা মুসিলমদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। আর রোমানরা ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূলনীতিতে মুসলিমদের অনেক কাছাকাছি। সে জন্যই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন রোমের রাষ্ট্র প্রধানের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেছিলেন তখন তাতে লিখে ছিলেন:
(قُلْ يٰٓأَهْلَ الْكِتٰبِ تَعَالَوْا إِلٰي كَلِمَةٍ سَوَا۬ءٍۭ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللّٰهَ وَلَا نُشْرِكَ بِه۪ شَيْئًا وَّلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ ط فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُوْلُوا اشْهَدُوْا بِأَنَّا مُسْلِمُوْنَ)
“বলুন, হে আহলে কিতাবরা! তোমরা আস এমন একটি কালেমার দিকে যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে সমান; তা হল, আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করব না এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করব না এবং আমাদের কেউ অপর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করবে না। এরপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম।” (সূরা আলি ইমরান ৩:৬৪)
(يَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَيٰوةِ الدُّنْيَا)
অর্থাৎ মক্কার মুশরিকরা শুধু দুনিয়ার বাহ্যিক ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নতি, ভোগ-বিলাস ও চাকচিক্য সম্পর্কেই জানে। পরকালের বিষয়াদি থেকে সম্পর্ণ অজ্ঞ। দুনিয়া থেকে একদিন চলে যেতে হবে, দুনিয়ার জয়-পরাজয় প্রকৃত জয়-পরাজয় নয় ইত্যাদি বিষয়ে তারা গাফেল।
সুতরাং পরকাল থেকে গাফেল হয়ে দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নতি ও চাকচিক্য নিয়ে ব্যস্ত থাকা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। বরং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হল পরকালকে প্রাধান্য দিয়ে দুনিয়ার অংশকে ভুলে না যাওয়া।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. খুশির সংবাদ শুনে আনন্দ উল্লাস করা বৈধ, তবে তা শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় হতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা কখনো তাঁর দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
৩. কোনো বিষয়ে মানুষ শুধু বাহ্যিক জানতে সক্ষম হয়, এর ভেতরটা জানতে পারে না যতক্ষণ না আল্লাহ তা‘আলা ওটা মানুষকে জানান।
৪. জয়-পরাজয় মানুষের হাতে নয়, আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা জয় দিয়ে থাকেন।
৫. পরকালকে ভুলে দুনিয়া নিয়ে মত্ত থাকা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। যারা পরকালকে প্রাধান্য দিয়ে দুনিয়ার অংশকে ধরে রাখে তারা প্রকৃত জ্ঞানী।